বাঁশফুল – শিবতোষ ঘোষ
এ অঞ্চলে প্রথম বাঁশফুল ফুটল অতুলদের ভালকি-বাঁশে।
অতুলের বাবা ছানিকাটা চশমা পরে সে-ই বাঁশতলায় বসে ছেঁড়া জাল সারাই করছিল আর ধানখেতে টিয়ে তাড়াচ্ছিল। আড়াই বিঘের পুরো বন্ধ পাকা সোনার রং ধারণ করেছে, বোরোধানের খেত, আই আর ছত্রিশ, পন্থনগরের বীজ, দারুণ ফলেছে। শুধু তারাই নয় পথ-চলতি যে-ই খেতের পাশ দিয়ে যায় সে মনে-মনে হিসেব করে, একেবারে স্বল্প পরিচিত পথিক, সেও কাছে এসে বলছে বাবু গো, খেতিটা তোমাদের বুঝি? এবার শুধু টিয়াগুলোকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করো গো বাবু, বলে রাখলাম একশো পঁচিশ-তিরিশ মন ধান তোমার বেটা কাটবেই।
টিয়ে তাড়াতে হয় সকাল ছ’টা থেকে সকাল ন’টা, আর বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে পাঁচটা, এখন সাড়ে ছ’টায় সূর্য ডোবে, যতক্ষণ না মুখ-আঁধারি হয়।
বুড়ো জাল সেলাই করছিল, মাছ ধরার মতো অত নেশা আর কোনও-কিছুতে নেই, পাখি ধরা, বাড়গোল-ধরা…সে যে ধরা হোক মাছ ধরার কাছে কেউ না, মাছ ধরায় বা ধরার সরঞ্জাম নির্মাণে কখনও ক্লান্তি আসে না। অতুলের বউকে দুটি দূর্বা তুলতে বললে বলে—উঃ কী রোদ! ন্যাড়াদার রাজকুলের মেয়ে, তাদের ভেতর বাইরেই কখনও রোদ পড়েনি, দাসীগণ মাথায় বাতাস করে করে তাদের চুল শুকোত, রাজবাড়ির মেয়েদের, সেই চন্দ্রা, ডাকল—লক্ষ্মী, একমুঠা দূর্বা তুলে এনে দিবি গো? কিন্তু এই রাজকুলের মেয়েও ভাত খেয়ে-না-খেয়ে খিড়কি পুকুরে ছিপ হাতে বসে যায়, পুঁটির খুটান নয়, বড় খুটান, নিশ্চয় বড় ট্যাংরা, ট্যাংরা মাছের বীজের টক দারুণ প্রিয় অতুলের বউয়ের। চন্দ্রার মাথার ওপর দিয়ে দুর্বা তোলার চেয়েও কত যে কঠিন রোদ বয়ে যায়, চন্দ্রা চোল-চোল করে জল নেয় মাথায়।
কৃপণ ছাড়া দুটো জিনিস কিছুতেই হয় না বাঁশ আর মাছ। জিনিসদুটোর ধর্মই হল কমালে দারুণ দ্রুত কমে, বাড়ালে দারুণ দ্রুত বাড়ে। অতুলের বাবা একটু কৃপণ, একটু নয়, অতুলও কৃপণ, কৃপণের বাড়িতে যেই জন্মাক সে যে কী করে কৃপণ হয়ে যায়, তাদের বাড়িটারই কৃপণ নামে একটু, একটু নয়…
কিন্তু এর ফলে তাদের বাঁশবাগান হতিহষ্কা অঞ্চলে একটি দেখবার জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের একটা গোটা বাঁশ নিয়ে যেতে ছ-সাতজনের দরকার হয়। সাত ঝাড় বাঁশ অতুলদের, এর যে-কোনওটার তলায় এসে দাঁড়াল গর্বে বুক ফুলে সাত হাত হয়ে যেত তাদের সকলের।
কিন্তু মুশকিল হল অতুল বউয়ের কাছে যেদিনই তাদের এই বাঁশ নিয়ে গর্ব করেছে সেদিনই চন্দ্রা তাকে একেবারে পথে বসিয়ে ছেড়েছে, ছড়া কাটে চা—ধনের ভেতর ধন, আড়াই মুঠি শন, সেই নিয়ে ঘুরে মরে এ-কোণ সে-কোণ। সে ন্যাড়াদার রাজকন্যা, যদিও তার বাবা পরেশ কোঙারকে তিরিশ হাজার টাকায় আমবাগান বন্ধক দিয়ে তার বিবাহ দিতে হয়েছিল, তবু সে রাজকন্যা, সে অমন বাঁশের মতো তুচ্ছ। দেমাক সহ্য করতে পারে না।
অতুলের হয়েছে মহাবিপদ। বাঁশঝাড় ছাড়া গর্ব করার মতো তাদের যে আর কিছু নেই। এরই জন্য তাদের এত কৃপণ হতে হয়েছে। কৃপণের জন্য বাঁশ না বাঁশের জন্য কৃপণ…সে যাই হোক, তাদের বাঁশ আর কৃপণ-স্বভাব একসঙ্গে এমন মিশে গেছে যে একটাকে দেখলে আর-একটা দেখা হয়ে যায়। তাদের চন্দ্রাদের মতো ভাঙা হাতিশালও নেই, ভাঙা ঘোড়াশালও নেই, রাজা শচীনন্দনের সাত ভাই, সানো ভাইয়ের শাখার নৌকো হচ্ছে এই চন্দ্রার। যদিও সাত ভাই, যদিও সব ভাঙা, সব জরাজীর্ণ, ন্তু অহঙ্কারটা ঠিক বয়ে যাচ্ছে স্রেতের নৌকোর মতো। কত লোকের কত কী-বেচনবাবুর সাতশো গাছের বিশাল আমবাগান, শ্রীহরি ঘোষের যোলো সের দুধ দেওয়া জার্সি গাই, কার্তিক জানার বৈঠকখানাতেই পাঁচ হাজার টাকার বাঁধানো ফোটো দেওয়ালে পেরেক মেরে মেরে টাঙানো, কাউকে পেলে তাকে একটা-একটা করে দেখায়—এ হল গোপা বুদ্ধদেবরাহুল, এ হল—নিমাই-শচীমাতা-বিষ্ণুপ্রিয়া, এ হল রামকৃষ্ণ পরমহংস-সারদা-বিবেকনানন্দ… সত্যি ওই বাঁশ ছাড়া তাদের দেখানো মতো আর কিছু ছিল না। অথচ একটা-কিছু অহঙ্কার না নিয়ে জীবনযাপনটাও কীরকম মুহ্য-মুহ্য লাগে।
অতুলের বাবা ভেবে রেখেছে বাঁশ বেচে মেয়ের বিয়ে দেবে, ওইটাই বাড়ির শেষ কাজ, জাঁকজমক করে করবে। কিন্তু অতুলের ঠাকুমা চাপ দেয় হরিমন্দিরের জন্য। টাকা কোথা? কেন রে, বাঁশ বেচে দে, বাঁশ তো তোরা কেউ লাগাসনি, তোর বাপ লাগিয়ে রেখে গেছে। অতুলের জ্যাঠা আবার গোটা বারান্দায় টিন দিতে চায়, একবার করে ফেলতে পারলে পঞ্চাশ বছর আর দেখতে হবে না। টিনের ওপর একটা নারকেল পড়লে বেড়ে যায়, এগুলো টিন! কিন্তু কে শোনে কার কথা, জ্যাঠা স্বপ্ন দেখে যায়।
অতুলও বাঁশ বেচার স্বপ্ন দেখে, শ্বশুর সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়েছে, বাকি সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে…শ্বশুরের পুরোটাই দেওয়ার কথা ছিল, দিল না তো আর কী করবে, বাঁশ আছে বাঁশ বেচে দেবে, তার স্পষ্ট ছবি আয়না-টায়না দিয়ে সুসজ্জিত মোটর সাইকেলের পেছনে বসে আছে চন্দ্রা, সিনেমার মতো চন্দ্রা তার কোমর জড়িয়ে, তারা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে।
আস্তে-আস্তে করে পরিবারের যার যা যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার মূল উৎস বা ভিত্তিভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঁশ, বাঁশ থেকে তার বাঁশরি বানাচ্ছিল।