• বইয়ের নামঃ জোনাকিদের বাড়ি
  • লেখকের নামঃ স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
  • প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃ উপন্যাস

০১. পেখম

আকাশজুড়ে জোনাকিদের বাড়ি
বুকের নীচে পাগলা রাজার ঘোড়া
তখন থেকে সবার সঙ্গে আড়ি
তখন থেকে আমার শহর পোড়া!
ধ্বংস ঘেঁটে তোমায় পেলাম মোহর
তোমার আলোয় বাঁচল আমার প্রাণী
কক্ষ থেকে ছিটকে যেত গ্রহ…
উল্কা তোমার কাচের ফুলদানি!
কেমন ছিল সেসব ধুলোখেলা!
কেমন ছিল সাগরপারের রানি!
এই জীবনের নরম বিকেলবেলায়…
আমরা দু’জন, কেবল দু’জন জানি
আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন জানি।

আজ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কাঁঠালচাঁপার গন্ধ চৌধুরীদের ওই লম্বা পাঁচিল টপকে, ঝুমাদিদের কলতলা ঘুরে, হেমন্তকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে আসছে এই এত দূরে, দীপমালা মানে পেখমের কাছে। আজ হাওয়াও দিচ্ছে খুব। ওই দূরে চ্যাটার্জিপাড়ার দিকের জলট্যাঙ্কের পিছন থেকে হাওয়া ভেসে আসছে। হাওয়া উড়ে আসছে। আর ডুবিয়ে দিচ্ছে পেখমকে। ডুবিয়ে দিচ্ছে সোনাঝুরি নামে এই ছোট্ট মফস্‌সলটিকে।

পেখম সামনের দিকে তাকাল। জ্যোৎস্নার হলুদ লেগে রয়েছে কাজুর মুখে। কাজুর চোখ দুটো বন্ধ। এতক্ষণ নরম গলায় কবিতাটা বলে এখন চুপ করে আছে। যেন হাওয়ায় তুলোর বীজ উড়িয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ! যেন দূরে, আরও দূরে সেইসব বীজ উড়িয়ে, ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এই জ্যোৎস্নার নীচে ভাসিয়ে দিতে চাইছে অক্ষর!

পেখম কিছু বলল না। তাকিয়েই রইল। এই বাসন্তী লুকোচুরি আলোয় ও তাকিয়ে দেখল কাজুকে। একমাথা কোঁকড়া চুল। নরম ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ। টানা ভুরুর তলায় বড়-বড় চোখ। বন্ধ। পেখমের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় পৃথিবীর আর সব কিছু ভুল। আর সব কিছু বাড়তি! শুধু কাজু সঙ্গে থাকলেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে ও।

পেখম তাকিয়ে রইল চোখ বন্ধ করে বসা কাজুর দিকে। আজ ইলেকট্রিক চলে গিয়েছে। ওদের এই ছোট্ট একতলা পাড়াটা কেমন যেন নিঝুম! কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। কিন্তু ঘরে আলো না থাকায় ওরা উঠে এসেছে ছাদে।

পেখম জানে, মা থাকলে ওকে এমন করে কাজুর সঙ্গে ছাদে আসতে দিত না। কিন্তু মা আজ নেই। শুক্রবার বলে পাঠ শুনতে গিয়েছে। কাছেই শানিপাড়ায় গীতাপাঠ হয় শুক্রবার করে। ‘দ্য লাইফ’-এর কাকিমার সঙ্গে মা যায় সেই পাঠ শুনতে।

‘দ্য লাইফ’ এই সোনাঝুরির সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকান। খুব চলে। সারাক্ষণ লোকজন ভরতি থাকে। কাকিমার আসল নাম মিতু।

মিতুকাকিমাদের বাড়িটা পেখমদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট মতো লাগে। খুব বড় বাড়ি কাকিমাদের। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঢালাই লোহার নকশা করা দরজা। মাথার উপর কাগজফুলের কেয়ারি করা।

পেখমের কী ভাল লাগে! মনে হয়, এমন একটা বাড়ি যদি ওদের থাকত!

কিন্তু ওদের এমন বাড়ি হবে কোথা থেকে? ওদের বাড়িটা তো ছোট্ট। একতলা। মাথায় ছাদ থাকলেও গায়ে প্লাস্টার নেই। ঠাকুরদা ভাড়া নিয়েছিল পনেরো বছর আগে। সেই পঞ্চাশ সালে, যখন ওরা সকলে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এসেছিল, তখনই ভাড়া নেওয়া হয়েছিল এই বাড়িটা।

পেখমের আবছা মনে পড়ে। তখন তো ওর মোটে পাঁচ বছর বয়স। তাই প্রতিটি স্মৃতিই কেমন যেন আবছা, ঘষা কাচের ওপারে রাখা কোনও ছবি! ভাল মনে পড়ে না। এই বাড়িতেই ওর জ্ঞান হওয়া, বড় হওয়া। তাই এই বাড়ি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না পেখম। কিন্তু তাও ওই মিতুকাকিমাদের বাড়িটা দেখলে মনে হয়, ইস, এমন যদি একটা বাড়িতে থাকতে পারত!

পেখমের ঠাকুরদা বগলাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই অঞ্চলে একটা টেলারিং শপ চালান। ওই দেশ থেকে আসার পর ঠাকুরদা কী করবেন বুঝতে না পেরে শেষে এই দোকানটি নেন। ঠাকুরদার যৌবন কেটেছিল কুমিল্লায়। সেখানেই ঠাকুরদাদের মামার বড় কাপড়ের দোকান আর টেলারিং শপ ছিল। এই দর্জির কাজ সেই মামাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন ঠাকুরদা।

দোকানটার নাম মুখার্জি ব্রাদার্স। তবে শুধু টেলারিং নয়, সঙ্গে চা, চানাচুর, বাদাম, বিস্কিটও রাখা হয়। সোনাঝুরি জায়গাটা বড় নয় খুব। কিন্তু যেহেতু একটা বড় জুটমিল আছে, তাই লোকজনের আনাগোনা খুব। ঠাকুরদার দোকানটা খারাপ চলে না।

পেখমের বাবা চাকরি করে পুলিশে। লোকাল থানার মেজবাবু। লোকজন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বেশ। তবে পেখম বোঝে আসলে এটা ভয়। কেন কে জানে সাধারণ লোকজন পুলিশকে বেশ ভয় খায়। কিন্তু ওই ভয়টুকুই যা আছে। তাতে তো আর পেট ভরে না! পেখম প্রায়ই মাকে গজগজ করতে শোনে। মাইনে তো আর বেশি নয়। তবে পেখম শুনেছে বাবাদের চাকরিতে উপরির বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু বাবা ওসব দিকে যায় না। লোকে বলে “সবুজবাবু খুব সৎ।” কথাটা শুনলে বাবা রাগই করে। বাবার কথা হল, “আমি যা কাজ করি, তার জন্য সরকার আমায় টাকা দেয়। আমি কেন উপরি রোজগার করতে যাব? আর এই মাইনে যে পাব, সেটা জেনেই তো কাজে ঢুকেছিলাম!”

পেখম জানে সকলে বাবার মতো ভাবে না। কেন ভাববে? মায়ের ভাষায় সবাই তো আর ‘বোকা’ নয়!

তবে ভাল বাড়িতে থাকতে না পারলেও ওদের অভাব নেই। পেখমের কলেজের মাইনে। টিউশনির খরচ। গানের স্যারের খরচ। এসব চালাতে বাবার অসুবিধে হয় না।

ওদের ছোট্ট বাড়িটায় পেখমদের সঙ্গে ওর ছোটকাকুরাও থাকে। ছোটকাকু মানে তপন মুখার্জি। সবাই কাকুকে রেফারি হিসেবে চেনে। কলকাতার মাঠে ফুটবল খেলায় রেফারি হয় ছোটকাকু, মানে ছোটকা। তবে সেটা করলে তো আর সংসার চলে না। কাছের সোনাঝুরি জুটমিলের ফোরম্যান হিসেবে চাকরি করে ছোটকা।

ছোটকাকিমা জামসেদপুরের মেয়ে। একটু চুপচাপ ধরনের। আর ওদের একমাত্র ছেলে, প্লাবন। প্লাবনকে টেটু বলে ডাকে সবাই। টেটু এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। লেখাপড়ায় ভাল ছেলেটা। আর পেখমের খুব ন্যাওটা।

পেখম নিজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বি এ। মায়ের ইচ্ছে ছিল না পেখম পড়ুক। কিন্তু পেখম জেদ ধরেছিল। আর তাতে ঠাকুরদাও সায় দিয়েছিলেন।

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “জীবনে লেখাপড়াই আসল। তুই যতদিন পারবি পড়বি।”

মা যতই রাগী হোক, ঠাকুরদার মুখের উপর কথা বলে না। কেউই বলে না। ঠাকুরমা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেও অল্প দিনেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন ঠাকুরদা।

পেখম অবাক হয়েছিল, “তুমি তো খুব শক্ত মনের!”

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “মৃত্যু তো কম দেখলাম না! দেশভাগের সময় কত জনকে মারা যেতে দেখলাম চোখের সামনে। তবে হ্যাঁ, রাণু আমার সবটা ছিল। ও ছিল বলেই এমন বয়সে দেশ, মাটি ছেড়ে এমন বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে বাস করতে পারলাম। এত মনের জোর আর তো কারও দেখলাম না! তাই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? এক শহরের সামনে দিয়ে নদী কি অন্য শহরের দিকে বয়ে যায় না?”

পেখমের খুব ভাল লাগে ঠাকুরদার সঙ্গে গল্প করতে। রাত ন’টায় ঠাকুরদার দোকান বন্ধ হয়। ইন্দবাবু বলে একজন কারিগর আছেন ঠাকুরদার দোকানে। ন’টার সময় ইন্দবাবুই দোকান বন্ধ করেন। তারপর ঠাকুরদাকে চাবি দিয়ে চলে যান।

ঠাকুরদার দোকানটাও কাছে। হেঁটে দশ মিনিটের মতো লাগে। সোয়া ন’টার মধ্যে ঠাকুরদা বাড়ি চলে আসেন। তখন পেখম কিছুক্ষণ এসে বসে ঠাকুরদার কাছে। গল্প করে। ঠাকুরদাও সারা দিনের রোজগার থেকে বাঁচিয়ে এক টাকা করে দেন পেখমকে।

একটা ঘট আছে পেখমের। তামাটে রঙের। মাটির। গতবছর পুজোয় কিনে দিয়েছিল ঠাকুরদা। সেটাতেই ওই বড় কয়েনটা ফেলে দেয়। টাকা জমায় পেখম। কেন জমায় জানে না। কিন্তু ভাল লাগে। আসলে ওর তো তেমন খরচ কিছু নেই। কলেজের মাইনে, ট্রেনের মান্থলি সবটাই বাবা কেটে দেয়। মা বাড়ি থেকে টিফিন করে দেয়। তবে পথে কিছু সমস্যা হলে যাতে অসুবিধে না হয় তাই পাঁচ টাকা করে দেওয়া হয় পেখমকে।

তবে অসুবিধে আর কী হবে? ট্রেনে করে বালিগঞ্জ যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগে। সোনাঝুরি স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে ওরা। চার বোগির ট্রেন। স্টিম ইঞ্জিনে টানে। খুব বেশি ভিড় হয় না। ওর সঙ্গে নয়না বলে আর-একটা মেয়েও যায়। কয়েকটা ছেলেও যায় ট্রেনে। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলে না। নয়না বলে মনোজ কুমারের মতো দেখতে একটা ছেলে নাকি তাকায় খুব ওর দিকে। কিন্তু পেখম পাত্তা দেয় না। আসলে কাজু ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকেই তাকানোর মতো ছেলে বলে মনে হয় না ওর।

কাজুর পুরো নাম বেঞ্জামিন কূজন সরকার। ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ওরা। গঙ্গার কাছে সাহেবপাড়ায় থাকে। তবে সাহেবপাড়া মানে বিরাট কোনও ব্যাপার নয়। আগে, যখন ভারত স্বাধীন হয়নি, তখন সোনাঝুরি জুটমিলে বেশ কয়েকজন সাহেব কাজ করত। তারা এখানে থাকত। সেই থেকে জায়গাটার নাম সাহেবপাড়া।

এখন অবশ্য সাহেবরা নেই। তাদের ফেলে যাওয়া অনেকটা জায়গা আর জঙ্গল নিয়ে চারটে বিশাল বড় বড় বাসি দুধ-চা রঙের বাড়ি পড়ে আছে। লোকে বলে জোনাক-বাড়ি! তবে বাড়িগুলো ময়লা, রং না-করা, ইটের পাঁজর বের করা। সেখানে গাদাগাদি করে বেশ কিছু পরিবার থাকে। কাজুও সেখানেই থাকে। দুটো ঘরের সংসার কাজুদের। বাবা, মা, এক ছোট ভাই, এক বোন, মায়ের এক আন্টি আর ঠাকুরমা। পেখম একবার গিয়েছিল কাজুর সঙ্গে ওদের বাড়ি। তবে লুকিয়ে। বাড়িতে জানে না। জানলে মা আর আস্ত রাখবে না।

ক্লাস নাইনে কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। এই সোনাঝুরিতে কাজুর খুব নাম। লেখাপড়ায় খুব ভাল। স্কুল ফাইনালে ফিফ্‌থ হয়েছিল। খবরের কাগজেও নাম বেরিয়েছিল। সেই থেকে সবাই সমীহ করে চলে কাজুকে।

কাজুর এক বন্ধু আছে, সতু। ভাল ফুটবল খেলে। তার সূত্রেই কাজুর আলাপ হয়েছিল ছোটকার সঙ্গে। বাবা তখন পেখমকে বাড়িতে পড়াবে এমন কাউকে খুঁজছিল। ছোটকার কথায় কাজু রাজি হয়েছিল পেখমকে পড়াতে।

যেদিন প্রথম কাজু এসেছিল পেখমদের বাড়ি, সেই দিনটা ওর আজও মনে আছে!

জানুয়ারি মাস ছিল সেটা। সকালের আলোর ভিতর কেমন যেন একটা পাতলা দুধের সরের মতো কুয়াশা পড়েছিল। পেখমদের ছোট্ট বাড়িটার পাশের পুকুরের জলে তখনও ভাল করে সূর্য এসে দাঁড়ায়নি। পেখম একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে গরম দুধের গেলাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।

কাজু এসেছিল একটা লাল হলুদ ডোরাকাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে।

ওদের বাড়িতে ঢুকেই একদম পেখমের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল কাজু। আর কেন কে জানে, থমকে দাঁড়িয়েছিল। পেখমও গেলাস হাতে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। অমন হালকা দাড়ি। টানা চোখ। অমন শীতের রোদ্দুরের মতো দৃষ্টি! পেখমের বুকের ভেতরে যে কী হয়ে গিয়েছিল, সেও নিজেও বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল, আজ থেকে ওর জীবনটা আর শুধু ওর রইল না।

প্রেম ব্যাপারটাকে পেখম ছোট থেকেই খুব ভয় পায়। ওদের অঞ্চলের ঝিকুদা তো কোন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগলই হয়ে গেল। এখন ঝিকুদাকে দেখা যায় কখনও চক্রবর্তীর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, কখনও মামুর ইলেকট্রিকের দোকানের টুলে বা ঘোষ বাইন্ডিং-এর সামনের বারান্দায় একা-একা বসে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কারও দিকে তাকায় না। পেখমের মনে হয় সোনাঝুরির সবাই বোধহয় ঝিকুদার কাছে স্বচ্ছ কাচের তৈরি।

নয়না খুব ডানপিটে ধরনের মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে। সাইকেল চালায়। এমনকী, লুকিয়ে সিগারেটও খায়। একদিন তো নয়না গিয়ে ধরেছিল ঝিকুদাকে। বলেছিল, “তুমি এমন ক্যালানের মতো বসে থাকো কেন গো? একটা মেয়ে ছেড়ে গেল বলে? ন্যাকামিটা কি প্র্যাকটিস করে আয়ত্ত করেছ না জন্মগত?”

পেখম পাশেই ছিল নয়নার। ওর তো ভয়ে ঢিপঢিপ করছিল বুক। কী কেলেঙ্কারি করছে মেয়েটা? ও শুনেছে ঝিকুদা নাকি মাঝে মাঝেই মারমুখী হয়ে ওঠে। তাকে এসব কী বলছে নয়না? ঝিকুদা রেগে গিয়ে এবারও যদি কিছু করে?

কিন্তু ঝিকুদা কিছুই করেনি। শুধু পেখমদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল একটু। তারপর ফুড়ুৎ গলায় বলেছিল, “বিলকিস।”

মা নয়নাকে পছন্দ করে না। মা কাকিমাকে পছন্দ করে না। মা কাজুকেও পছন্দ করে না। মা আসলে সেই মানুষদের মধ্যে পড়ে যার মাথা আর চোখ আতসকাচ দিয়ে তৈরি। সব কিছুকে খুঁটিয়ে না দেখলে মায়ের মন ভরে না। আবার দেখার পর তো আরওই ভরে না! পেখম মাকে ভয় পায় বেশ।

কাজু সেই যে এসেছিল সকালবেলা আর পেখমকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সেটা ঠিক লক্ষ করেছিল মা। তাই বাবা কাজুকে পড়ানোর জন্য ঠিক করলেও মায়ের মনঃপূত হয়নি ব্যাপারটা।

বাবাকে বলেছিল, “এটা কি ঠিক হল? এমন উঠতি বয়সের একটা ছেলে! পেখমকে দেখেই তো ওর জিভ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল! নিজের মেয়ের রূপ দেখে বোঝো না যে, ওকে সাবধানে রাখতে হবে? আমি কত শাসনে রাখি। আর তুমি সেখানে খাল কেটে কুমির ঢোকালে!”

বাবা বলেছিল, “তুমি পাগল হয়ে গেলে? ও তো বাড়িতেই পড়াতে আসছে। আর কত ভাল ছেলে লেখাপড়ায়! সক্কলে ওর নাম জানে। তুমি সব কিছুতেই এমন কোরো না তো!”

মা বলেছিল, “ভাল হলেই ভাল। না হলে…”

বাবা শুধু বলেছিল, “না হলে আমি তো আছি।”

সেই কাজুর পড়াতে আসার শুরু। সপ্তাহে তিনদিন করে সন্ধের দিকে আসত ও। ছোট্ট ঘরটার বিছানায় বসত পেখম আর লাগোয়া টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসত কাজু। একমনে পড়াত। মা চা দিয়ে যেত। মুড়ি মেখে দিয়ে যেত। কিন্তু খেয়ালই থাকত না ওর। ও শুধু পড়িয়ে যেত। আর পড়াতে-পড়াতে দেশ-বিদেশের কথা বলত। নানা মানুষের গল্প বলত। বলত যুদ্ধের ইতিহাস। বলত দক্ষিণ মেরুর গল্প। অঙ্ক করাতে গেলে ইউক্লিডের সময়কার গল্পও বলত অনায়াসে। আর পেখম রোজ একটু-একটু করে ডুবে যেত। চারিদিকে গোলাপি তুলোর ভিতর কে যেন ওকে ডুবিয়ে দিত আস্তে আস্তে। এক-একটা পড়ানোর দিন শেষ হলে মনের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট হত। মনে হত আবার কবে আসবে কাজু! কেন সপ্তাহে মাত্র তিনদিন আসবে? রোজ এলে ক্ষতি কী? তারপর পড়ানোর সময় হলে তো পেখমের বুকের ভিতরটায় কী যেন একটা হত। একই সঙ্গে ভাল লাগা আর ভয়, কষ্ট আর আনন্দ, বন্ধন আর মুক্তির স্বাদ পেত পেখম।

বাল্‌বের আলোয় চকচক করত কাজুর মুখ। হাত নেড়ে, চুলে হাত ডুবিয়ে ঠিক করতে-করতে কাজু কত কী যে বলত! পেখম বুঝত দু’ঘণ্টার শেষে কাজুর মুখটুকু ছাড়া আর কিছুই মাথায় ঢোকেনি! এমন করতে-করতে ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোল। আর সবাই অবাক হয়ে দেখল পেখম ফেল করতে করতে কোনওমতে পাশ করল!

প্রথম ঝড়টা তুলেছিল মা! এত ভাল ছাত্রী, তার এ কী দশা! এ কেমন করে হল? এই মাস্টার ভাল ছাত্র হতে পারে, কিন্তু পড়াতে পারে না একদম।

রাতে খেতে বসে মা তো চিৎকার করে বলেছিল, “কোথা থেকে ঠাকুরপো একে জোগাড় করে এনেছে! বড় বড় বুলি শুধু! এই পড়ায়? একে তুমি টাকা দিয়ে রেখেছ? কেন রেখেছ? কীসের জন্য? কাল এলে ওকে বিদায় করবে। একদম ধুলোপায়ে বিদেয় করবে। ঠাকুরপো অনেক উপকার করেছে। আর আমার মেয়ের ভবিষ্যতের বারোটা বাজাতে হবে না।”

বাবা রুটির টুকরো ছিঁড়ে চুপ করে বসেছিল। পাশের ঘর থেকে সব শোনা যায়। পেখমের ভয় লাগছিল খুব। ছোটকার নামে মা এসব বলছে! ছোটকা না-হয় নাইট ডিউটিতে গিয়েছে, কিন্তু কাকিমা তো সব শুনতে পাবে!

পেখম একবার বলেছিল, “মা, কাজুদার দোষ নেই। আমিই ফাঁকি দিয়েছি।”

“তুই চুপ কর!” মা ধমক দিয়েছিল খুব, “তোকে বড়দের মধ্যে কথা বলতে বারণ করেছি না?”

বাবা তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি চুপ করো একটু। আর কথা বাড়িয়ো না। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আজকে। ও নিজেই বলেছে আর পড়াবে না।”

আর পড়াবে না! নিজে বলেছে! পেখমের মনে হয়েছিল, কেউ বুঝি ওর বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে! কী বলছে এসব! এমন হয় নাকি? পড়াবে না বললেই হল! হাত কাঁপছিল পেখমের। ঝাপসা লাগছিল সবকিছু। তবু তার মধ্যেও শুনেছিল, মা অনবরত বলে চলেছে, “আমি সব বুঝি। পড়াবে না! সাধু সাজা! আর তুমি সব শুনলে? কিছু বলতে পারলে না? হুঃ, পুলিশ না ছাই! বললে না কেন যে, শুধু কি চা-মুড়ি ধ্বংস করতে আসত!”

পেখমের চোখে জল এসে গিয়েছিল এবার। এসব কী বলছে মা? কাজু তো কিছুই খায় না! পেখম কতবার বলে বলে খাওয়ায়। আর খাওয়া দেখেই বোঝে এসব কিছুতেই কোনও আগ্রহ নেই ওর। শুধু বই-খাতায় ডুবে থাকে ছেলেটা! কতই-বা বয়স! ইসকুল যেতে-আসতে তো কাজুর বয়সি ছেলেদের দেখে পেখম। সব এক-একটা বখাটে। শুধু সাইকেল নিয়ে চক্কর মারবে। চিঠি ছুড়বে। দেব আনন্দের গান গাইবে! এত বিরক্ত লাগে পেখমের! এরা কী ভাবে? জীবনটা হিন্দি সিনেমা? এরা বোঝে না কোনও মেয়ে এসব অসভ্যতা পছন্দ করে না? কাজুর ওই আনমনা ভাবটাই পেখমকে টানে। ওই যে কোনও কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিছু না হলেও চলে যায়, এমন ভাবটাই পেখমকে দুর্বল করে দেয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে! কাজুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।

সেই কাজুকে আসতে বারণ করে দেবে বাবা! তবে ওর কী হবে? নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছিল পেখমের। এসব কী করল ও? এমন বোকার মতো জিনিসটা বুঝতে পারল না? কাজু যখন পড়াতে আসত, মা তো সারাক্ষণ নানা অছিলায় ঘরে ঢুকত। আড়চোখে দেখত কাজুকে। পেখম বুঝত, মা বিরক্ত হচ্ছে! কেন হচ্ছে সেটাই শুধু বুঝত না। আর তাই তো পেখমের উচিত ছিল আরও ভাল করে পড়া। ওর তো বোঝা উচিত ছিল যে, রেজ়াল্ট খারাপ হলে মা প্রথমেই কাজুর আসা বন্ধ করে দেবে।

সেদিন রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি পেখম। ওর ছোট্ট ঘরটার জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মশারির ভেতর শুয়ে পেখম এপাশ-ওপাশ করেছিল বহুক্ষণ। তারপর একসময় আর থাকতে না পেরে উঠে বসে খুলে দিয়েছিল জানলা। তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। আকাশের দিকে। আর তখনই দেখেছিল জোনাকিদের! বাড়ির পাশের বড় ঝোপের মধ্য থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল জোনাকির দল। সবুজাভ আলোয় আশপাশের সব কিছু কেমন যেন মায়াবী হয়ে উঠেছিল। পেখম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই দিকে। আকাশের দিকে কেন উড়ে যাচ্ছে জোনাকিরা? কী চায় ওরা? কাদের কাছে পৌঁছতে চায়? আকাশের সব তারাই কি একসময় মাটির এই জোনাকি ছিল?

কতক্ষণ বসেছিল মনে নেই পেখমের। শুধু যখন পুব আকাশে লাল রং লেগেছিল, যখন মাধব বৈরাগী খোল-করতাল নিয়ে বেরিয়েছিল নামগান করতে আর ঠাকুরদার গলায় কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শুনেছিল, তখন সংবিৎ ফিরেছিল পেখমের। আর তখনই বুঝতে পেরেছিল ওর কী করা উচিত। ঠাকুরদা! এমন বিপদে ঠাকুরদাই ভরসা। বাড়িতে কেউ ঠাকুরদার ওপর কথা বলে না। ঠাকুরদা আছেন বলেই এখনও বিরাট বড় কোনও ঝগড়া হয় না এই বাড়িতে। ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তুলে কথা বলে না।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরদা ভগবানের নাম করেন। তারপর নিজেই ছোট্ট একটা হিটার জ্বালিয়ে চা বানিয়ে নেন। সঙ্গে দুটো পটল বিস্কুট বের করেন ডালডার টিন থেকে। তারপর বারান্দায় বসে খান সময় নিয়ে। খাওয়া শেষ হলে ঠাকুরদা মাফলার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন হাঁটতে। পাশের বাড়ির ফুলুদাদুও হাঁটেন ঠাকুরদার সঙ্গে। দু’জনেই একসঙ্গে এই দেশে এসেছিলেন। ফুলুদাদু ঠাকুরদার ছোটবেলার বন্ধু। খুব মজার মানুষ ফুলুদাদু। পেখমের সঙ্গে একদম বন্ধুর মতো মেশেন!

ঠাকুরদা হাঁটতে যাওয়ার সময় মা ওঠে। দরজা জানলা খোলে। তারপর ধীরে ধীরে দিনের কাজ শুরু করে।

পেখম বুঝেছিল ঠাকুরদাকে ধরতে হলে এখনই ধরতে হবে। মা উঠে পড়লে আর হবে না।

নিজের ছোট ঘরের দরজাটা খুলে পা টিপে-টিপে বেরিয়েছিল পেখম। শীতকাল। মেঝে যেন বরফ দিয়ে তৈরি! গায়ে চাদরটাকে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠাকুরদার কাছে।

ঠাকুরদা সবে চা বানিয়ে বড় একটা কাপে ঢালছিলেন। এমন সময় পেখমকে দেখে কেমন যেন অবাকই হয়েছিলেন।

পেখম চুপ করে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে।

“কিছু বলবি?” ঠাকুরদা তাকিয়েছিলেন।

“ঠাকুরদা, তুমি বাবাকে একটু বলবে?”

“আমি?” ঠাকুরদা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “কী হয়েছে তোর? এমন মুখ-চোখ কেন? রেজ়াল্ট খারাপ হয়েছে বলে তোর মনখারাপ? অমন হতেই পারে।”

“কাজুদা আমায় আর পড়াবে না বলেছে!”

“কে?” ঠাকুরদার বুঝতে যেন একটু সময় লেগেছিল।

“আমায় যে পড়ায়। ওই যে ছেলেটা। খুব ভাল স্টুডেন্ট। বলেছে, এমন রেজ়াল্ট করেছি তো, তাই পড়াবে না। তুমি বাবাকে বলবে একটু যে, ও-ই যেন আমায় পড়ায়!”

“কেন?” ঠাকুরদা চায়ে চুমুক দিয়ে সামান্য নাক কুঁচকেছিলেন। তারপর রান্নাঘরের তাক থেকে চিনির কৌটো পেড়ে নিয়ে এসে বলেছিলেন, “কী হয়েছে কী?”

“আমায় অপমান করেছে কাজুদা, মানে ওই ছেলেটা,” পেখম ঠোঁট কামড়ে তাকিয়েছিল ঠাকুরদার দিকে।

ঠাকুরদা কি ওর মিথ্যেটা ধরতে পারলেন?

ঠাকুরদা একচামচ চিনি নিয়ে কাপে গুলতে গুলতে বলেছিলেন, “ছেলেটা নিজেই পড়াবে না বলেছে?”

“হ্যাঁ,” পেখম অভিনয়টা যথাসাধ্য বজায় রেখে বলেছিল, “আমি নাকি বাজে লেখাপড়ায় বলে পড়াবে না! আমি দেখিয়ে দিতে চাই ওকে ঠাকুরদা। তুমি বাবাকে বলো।”

ঠাকুরদা সময় নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, “তাই?”

বাইরে থেকে হাওয়া আসছিল। বারান্দার পাশেই বড় পুকুর। শীতের এত ভোরে ঠান্ডা হাওয়ায় শিরশির করছিল পেখমের শরীর। ঘুমও আসছিল। সারারাত জেগে থাকার শোধ তুলছিল শরীর। তাও চোখ টান করে তাকিয়েছিল পেখম। মুখটাকে অপমানের ওজনে ভার করে রেখেছিল!

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “অন্য মাস্টার পড়ালে হবে না?”

“না,” জেদি গলায় বলেছিল পেখম, “ওকেই আমি মজা দেখাব।”

ঠাকুরদা হেসেছিলেন শুধু। আর কিছু বলেননি।

রেজ়াল্ট বেরোনোর পরের ছুটি চলছিল স্কুলে। অন্যদিন হলে বান্ধবীদের বাড়িতে যেত পেখম। কিন্তু সেদিন কোথাও যায়নি। বুকের মধ্যে কেবল ছটফট করছিল একটা কাঠবেড়ালি! কেবলই মনে হচ্ছিল, কী হবে? কাজুকে কি বলবে বাবা? মা কী বলবে? ঠাকুরদা কি বলে দেবে বাবাকে যে, পেখম ওসব বলেছে?

সারা দিন কেমন একটা ম্যাজম্যাজে শরীর নিয়ে কেটেছিল। বুকের ভিতর একটা কষ্ট। মনখারাপ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। টেটু এসেছিল গল্প করতে, পেখম ওকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কথা বলেনি। দুপুরে খায়নি ভাল করে। মা এসে কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল জ্বর এসেছে কি না। পেখম ওসব খেয়াল করেনি।

তারপর সারা বিকেল চুপ করে ও পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। ওই পাড়ে ঘোষদের বাড়ি। অন্য পাশে সর্দারদের বাঁশবাগান। পেখম দেখছিল কীভাবে আকাশের র‌ং পালটে, গাছের পাতাদের রং পালটে, পুকুরের জলের রং পালটে সূর্য ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পশ্চিমের আকাশে। হাওয়া দিচ্ছিল চ্যাটার্জিপাড়ার দিক থেকে। ঝিরিঝিরি নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল ডিসেম্বরের আলো। শীতের বিকেলগুলোয় যে এত মনখারাপ জমা হয়ে থাকে, সেদিনই যেন জানতে পেরেছিল ও! আর এর মধ্যে পেখমের কেবলই মনে পড়ছিল ওই কোঁকড়া চুল, পাতলা খাড়া নাক। মনে পড়ছিল নরম ঘাসের মতো দাড়ি! এত কষ্ট হচ্ছিল যে, নিজের মনটাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবা কি শুনবে ঠাকুরদার কথা?

ছোটকার সেদিন ডে শিফট ছিল। রাতে সকলে একসঙ্গেই খেতে বসেছিল ওরা। বাবার মুখ দেখে পেখম বুঝতে পারছিল, কিছু একটা হয়েছে। ও রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ছিল, ডালে ডোবাচ্ছিল, কিন্তু খেতে পারছিল না। মা অবাক হয়েছিল খুব। তাকাচ্ছিল বারবার। এমন তো করে না পেখম। আজ তবে কী হল?

কথাটা শুরু করেছিলেন ঠাকুরদাই। বলেছিলেন, “সাবু, তুই কি ওই মাস্টারের সঙ্গে কথা বলেছিলি?”

বাবা চট করে একবার তাকিয়ে নিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর আলতো গলায় বলেছিল, “হ্যাঁ বাবা, ওই কাজুকে বলেছি পড়াতে আসতে!”

“কী?” মায়ের গলায় যে-চকোলেট বোমাটা ফেটেছিল সেটার ওপর শেষ মুহূর্তে মা নিজেই বালি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আসলে ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তোলে না! তাও শব্দের গুণ বালিতে ঢাকা পড়েনি খুব একটা! পেখম সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

বাবা বলেছিল, “বাবা বললেন, তাই… মানে…”

বাবার ফেলে রাখা অসমাপ্ত বাক্য শেষ করেছিলেন ঠাকুরদা। বলেছিলেন, “সাবুকে আমি বলেছি ওই মাস্টারকে বলতে। দোকানে শুনি আমার নাতনি নাকি খারাপ লেখাপড়ায়। তাই নাকি ওই চ্যাংড়াটা বলে বেড়াচ্ছে ওর দ্বারা কিছু হবে না! আমাদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া হবে না? বললেই হল? আমি তাই সাবুকে বলেছি ওকেই পড়াতে বলতে। পেখম ওকে এবার দেখিয়ে দেবে, কার কী হবে আর কী হবে না!”

মায়ের মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল একদম। ঠাকুরদার সামনে কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু আবার সহ্যও করতে পারছিল না। শুধু থালা-বাসনের ঝংকার বেড়ে গিয়েছিল এর পর।

রাতে চাপা গলায় মা বলেছিল, “তোমার আমায় বিয়ে করা উচিত হয়নি। কোনও ক্রীতদাসীকে নিয়ে আসা উচিত ছিল!”

বাবা বলেছিল, “নমি, এমন বোলো না। জানোই তো, বাবার মুখের উপর কিছু বলা যায় না। তা ছাড়া রাস্তায় এসব শুনে বাবার রাগ হয়েছে। সোনাঝুরির মতো ছোট জায়গায় সব কথাই তো ওড়ে! তাই…”

“তুমি দেখো, একদিন কী হয়! সেদিন, সেদিন কিন্তু…” মায়ের কথাগুলো ডুবে গিয়েছিল কান্নায়। পাশের ঘর থেকে পেখম শুনেছিল বাবা বলছে, “আমি তো আছি নমি। তোমার মেয়ের কিছু হতে দেব না। দেখো।”

পরের দিন সকালে দোকানে যাওয়ার আগে পেখমের ঘরে এসেছিলেন ঠাকুরদা। তারপর নিচু স্বরে বলেছিলেন, “দেখিস, আবার কেলেঙ্কারি কিছু বাঁধাস না। মনে রাখিস, আমাদের সমাজ কিন্তু কাজুদের সমাজ নয়।”

“তুমি কী ভাল কবিতা বলো!” পেখম আলতো গলায় বলল।

এবার চোখ খুলল কাজু। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, “আমি আস্তে আস্তে জমাচ্ছি, জানো! কবিতা জমাচ্ছি।”

“বই করবে?” পেখম আগ্রহভরে তাকাল কাজুর দিকে।

কাজু দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “তার জন্য টাকা দরকার। আমার নিজের টাকায় বই করা হবে না। তবে কেউ যদি করে… কলকাতায় কেউ যদি…”

পেখম আলতো করে হাতটা ধরল কাজুর। বলল, “ঠিক হবে, দেখো।”

হাতটা সরিয়ে নিল কাজু, “এমন কোরো না পেখম। জানোই তো সব। তোমার কাকিমা নীচে আছেন। বললেন, একটু পরেই চা নিয়ে আসবেন। তা ছাড়া তোমার মা যদি এসে যান…”

পেখম বলল, “ওসব বাদ দাও। আমায় কবিতার বইটার কথা বলো। কতগুলো হয়েছে?”

কাজু বলল, “হয়েছে কিছু। একটা ডায়েরিতে ফ্রেশ করে রাখছি। তোমায় দেখাব একদিন।”

“সত্যি?” পেখম বড়-বড় চোখ করল। দেখল, কাজু আবার তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ ভরা পূর্ণিমা। নিকানো আকাশে টলটল করছে আলোভরতি একটা বেলুন! পেখমের কষ্ট হচ্ছে শরীরে। মনে হচ্ছে আর দূরে থাকতে পারছে না কাজুর কাছ থেকে। সেই নাইন থেকে এই সেকেন্ড ইয়ার। কম দিন তো হল না!

পেখমের বলতে ইচ্ছে করেনি, কিন্তু তবু নিজের অজান্তেই যেন বলে ফেলল, “তুমি চাকরির কিছু করলে? আর কতদিন ওইসব পার্টি-টার্টি করবে?”

এবার তাকাল কাজু। যেন কিছুটা সময় নিল শব্দগুলোকে নিজের মনের মধ্যে বসে যেতে দিতে। তারপর বলল, “তুমি যা চাও, তা কি হবে কোনওদিন?”

“কেন হবে না?” পেখমের গলা শক্ত হল এবার, “এমন খারাপ কিছু ভেবো না।”

কাজু বলল, “না হলেও আমার কবিতা থাকবে। তোমায় নিয়ে লেখা সব কবিতা।”

“আমার ওসব চাই না!” পেখম দ্রুত চুপ করিয়ে দিতে চাইল কাজুকে। বলতে চাইল কাজুকেই শুধু চায় ও। আর কিছু নয়। কিন্তু বলতে পারল না। বরং কেমন এক অভিমান এসে বুজিয়ে দিল ওর গলা! কাজু সব সময় কেন এমন মনখারাপের কথা বলে! কেন কাছে এসেও আবার এমন সরে-সরে যায়!

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “যদি আমরা এক হতে নাও পারি, তাও এই সময়গুলো তো আর মিথ্যে নয় পেখম। এই রাত। এই জ্যোৎস্না। এই সব কবিতা তো আর মিথ্যে নয়! যে যার মতো যা খুশি ভাবুক, আমি আমার লেখা তোমার জন্য রেখে যাব। আমার বাদামি ডায়েরির সব লেখা শুধুমাত্র তোমার জন্য রেখে যাব। আমি যদি তোমায় খুঁজে নাও পাই, সেই ডায়েরি তোমায় খুঁজে পাবে পেখম। সেইসব কবিতা তোমায় খুঁজে পাবে। আর এই শব্দগুলোর অর্থ কেবল আমরাই জানব। মাত্র আমরা দু’জন জানব!”

.

০২. মাহির

বুটটা খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখল মাহির। পায়ে কী যেন একটা খোঁচা দিচ্ছিল। কাঁকর নয়। থাকলে ঝাড়লেই বেরিয়ে যেত। কিন্তু বেরোয়নি। ও হাত ঢুকিয়ে দেখল। আঃ। কী এটা? আঙুলটা বের করল মাহির। ছোট্ট এক বিন্দু রক্ত ফুটে উঠেছে আঙুলের ডগায়। ভেতরে কি পেরেকটা জেগে উঠল!

বিরক্তিতে মাহিরের মুখটা বেঁকে গেল। আচ্ছা জ্বালাতন তো! এই তো সেদিন বুটটা ঠিক করাল, এর মধ্যেই আবার পেরেক বেরিয়ে এসেছে!

শালা, বুটটাকে বিরক্তিতে পাশে ছুড়ে মারল মাহির। পরশুদিন খেলা আর আজই বুটটা বেগড়বাই করছে! কপাল তো নয়, যেন টালি নালা!

সামনের দিকে তাকিয়ে মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল মাহিরের। সকলে প্র্যাকটিস করছে আর ও বসে বসে ছিঁড়ছে! এখনই পতাদা খিস্তি করবে ওকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখলে। বলবে, টিম থেকে লাথি মেরে বের করে দেবে, যদি না পরিশ্রম করে! পরিশ্রম! নিজে বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বাঁশি মুখে পিঁ পিঁ করে হুমদো হয়ে ঘুরবে, আর দূর থেকে চেঁচাবে, সে বেলায় কিছু নয়! ভাটের যত কথা! পরিশ্রম!

পতাদা মানে পতঞ্জলি লাহিড়ি, লেক অ্যাভিনিউ ক্লাবের সেক্রেটারি কাম কোচ। নিজে দীর্ঘদিন কলকাতার মাঠে খেলেছে। তারপর লেক অ্যাভিনিউতে এসেছে। মাহিরকে পতাদাই এই সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবটায় নিয়ে এসেছে বছরদুয়েক হল। কিন্তু তা বলে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?

জার্সি, মোজা, প্যান্ট আর রুটি-কলা, ঘুঘনি-পাঁউরুটি ছাড়া ওদের কিছু দেয় ক্লাব? কিচ্ছু না। তবে অত “পরিশ্রম, পরিশ্রম” করে চেঁচায় কোন মুখে? এই টিম কি আর সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হবে কোনওদিন? কোনওদিন হবে না। তাই বেকার খেটে লাভ কী? তার চেয়ে রিতুদার কথাটা মেনে নিলেই ভাল হবে বোধহয়!

মাহির আবার বুটটা তুলে ভেতরে সাবধানে হাত ঢোকাল। এই তো পেরেকটা। বেশ কিছুটা বেরিয়ে আছে পাশ থেকে। তাই ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে লাগছিল। শালা গিয়ে ছোটনের মুখে ছুড়ে মারবে। এই সারিয়েছে? নিজেকে মুচি বলে কোন মুখে?

টিটি ঠিক বলেছিল। ছোটনকে দেওয়াই ঠিক হয়নি। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ পালটে পালটে মালটার অভ্যেসটাই বিগড়ে গিয়েছে! বাঁদরের হাতে বন্দুক পড়লে যা হয়, তাই হয়েছে!

মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুতোটা সরিয়ে রাখল। এক-একটা ভাল বুটের কী দাম! শুনলে মাথায় জাঙিয়া পরতে ইচ্ছে করে। ওসব কেনার সাধ্য নেই মাহিরের। এই ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর, তাও কিছু কাজ তো জোটাতে পারল না। মায়ের আয়ার চাকরির উপর ভরসা। তার উপর ভাই আছে। ভাইয়ের পিছনেই তো দেদার টাকা যায়! সেখানে কোন মুখে মাকে বলবে, বুটটা আর চলছে না! পরশু ম্যাচে কী পরবে!

মাহির ব্যাগের ভিতর বুটটা ঢুকিয়ে নিল। তারপর প্লাস্টিকে জড়ানো হাওয়াই চটিটা বের করে পায়ে পরে নিল। জার্সি আর প্যান্টটা বাড়ি গিয়ে ছাড়বে।

“কী রে, গুটিয়ে ফেললি?”

মাহির পেছন ফিরে তাকাল। সুমিত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সুমিত সামান্য হাঁপাচ্ছে। হাতের গ্লাভসটা খুলে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর আবার বলল, “পতাদা মাইরি লাল সুতো, নীল সুতো বের করে দিচ্ছে! আমি মাইরি গোলকিপার, আমায় ছ’বার মাঠ চক্কর মারাচ্ছে কেন? আমি অলিম্পিকে দশ হাজার মিটার দৌড়োব নাকি?”

মাহির দেখল, পতাদা বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কুল ডাউন এক্সারসাইজ় শুরু করে দিয়েছে। মানে আজকের মতো প্র্যাকটিস শেষ!

ও বলল, “প্র্যাকটিস তো শেষ।”

“তুই তো আগে থেকেই বসে গেলি। পতাদা দেখেছে কিন্তু। খিস্তি করবে।”

“আমার এইটা,” মাহির রেগে গিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল, “করুক খিস্তি। আমার বুটের হাল খারাপ খুব। কবে থেকে পতাদাকে বলছি, তুমি বুটটা দাও। শোনে কথা?”

সুমিত হাসল, “আরে, দেবে কোথা থেকে? ক্লাবের হাল জানিস না?”

“কেন, স্পনসর?” মাহির তাকাল সুমিতের দিকে।

সুমিত নিজের ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে মাথাটা মুছল। তারপর হাসল।

শীত শেষ হয়ে গিয়েছে কলকাতায়। তবে এখনও সেই গরমটা পড়েনি। ফেব্রুয়ারির এই তৃতীয় সপ্তাহে আকাশটা কেমন যেন ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে আছে।

মাহির বলল, “হাসছিস কেন? স্পনসরের কথা যে বলল সেদিন। বলল কুড়ি লাখ টাকা দেবে নাকি তারা?”

“টাকা গাছে ফলে?” সুমিত এবার জল খেল একটু। তারপর বোতলের মুখটা বন্ধ করে বলল, “শোন, ওসব ছেঁদো কথা। গত্তি নেই। আমাদের টিম কি বার্সেলোনা নাকি? সেকেন্ড ডিভিশনের মাঝামাঝি একটা টিম। চ্যাম্পিয়ন হব, সেই দম নেই আমাদের। কে টাকা দেবে? কেনই-বা দেবে?”

মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না। গত সপ্তাহে ফ্রেন্ডস ইউনিয়নের সঙ্গে খেলায় জিতেছে ওরা। পরিষ্কার টু-নিল। তারপর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে পতাদাই স্পনসরের কথাটা বলেছিল।

বলেছিল, “আজকের মতো যদি খেলতে পারিস তবে আর চিন্তা নেই। পরের চারটে ম্যাচ জিতলেই আমরা কিন্তু টপ থ্রি-তে পৌঁছে যাব। একটা সিমেন্টের কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা বলেছে কুড়ি লাখ টাকা দেবে। ভাবতে পারছিস ব্যাপারটা? তোদেরও কিছুটা দেখতে পারব। সুতরাং, ঢিলে দিবি না। জান লড়িয়ে দে। ফার্স্ট ডিভিশনে উঠতে পারলে ভাবতে পারিস কী হবে?”

সেদিন থেকে কুড়ি লাখ টাকা মাথায় ঘুরছে মাহিরের। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকাও যদি ক্লাব দেয়, তবেই তো অনেক। ও তো মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল সহজে কাউকে ডিফেন্স দিয়ে বল নিয়ে গলতে দেবে না।

“কী রে, কী ভাবছিস?” সুমিত ঠেলল মাহিরকে।

মাহির মাথা নাড়ল, “কিছু না। পতাদা হেবি ঢপবাজ। ধুর, আমি আর খেলব না।”

“কেন?” সুমিত চোখ গোলগোল করল।

মাহির উত্তর দিতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। প্র্যাকটিস শেষ করে পতাদা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। বাকিরাও যে যার মতো মাঠে ছড়িয়ে বসে আছে।

লেকের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে এখন। আপ বজবজ লোকাল লেক গার্ডেন্স ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বালিগঞ্জের দিকে। আর পাখি উড়ছে। আকাশে ভুরু এঁকে পাখির ঝাঁক হাওড়ার দিকে থেকে উড়ে যাচ্ছে বারুইপুরের দিকে। কেমন একটা মনখারাপ করা আলো যেন ভাসছে। সূর্য নেই, তবু তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে যাওয়া আলোয় দিনটা কেমন যেন নিচু হয়ে এসে মাথায় লাগছে মাহিরের।

ক’টা বাজে? আলো দেখে সময় বলে দিতে পারে মা। ও পারে না। কিন্তু ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেও লজ্জা করছে। গতকাল হাত থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইলটার পেছনের দিকের ঢাকনাটা খুলে গিয়েছে। কিছুতেই আর আটকাতে পারেনি। পরানদার দোকানেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরানদা বলেছে, এমন করে ভেঙেছে আর জোড়া লাগানো যাবে না। গোটা ফেসিয়া পালটাতে হবে। কিন্তু এত পুরনো মডেল, ফেসিয়া পাওয়াও নাকি কঠিন।

পরানদা বলেছিল, “আরে, নতুন ফোন নিয়ে নে। এসমার্ট ফোন। বড় স্কিরিন! ভাল করে ছবি আর ভিডিয়ো দেখতে পাবি।”

শেষের কথাটা বলার সময় চোখ টিপেছিল পরানদা। কিন্তু মাহির ওসব পাত্তা দেয়নি। বড় স্ক্রিন! স্মার্ট ফোন! কে দেবে টাকা? পরানদা? না পরানদার বাপ?

গতকাল থেকে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে ফোনটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে ও, না হলে ব্যাটারিটা পড়ে যেতে পারে। খুব বদখত লাগছে দেখতে। তাই সবার সামনে সেটা বের করতে ইচ্ছে করছে না। লজ্জা করছে।

“কী রে, তুই কুল ডাউনের আগেই বসে পড়লি কেন?” পতাদা এসে কোমরে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়াল।

মাহির মাথা তুলে তাকাল। বিরাট বড় ভুঁড়িটার জন্য কেমন একটা লাগছে। গায়ের টি-শার্টটা কোমরের দিকে উঁচু হয়ে আছে। পইতেটা সামান্য বেরিয়ে ঝুলছে। পতাদার মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথার চুলের আসল রং কলপের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় মাথাটা কেমন যেন দোয়েল পাখির মতো লাগছে।

মাহির এসব দেখতে-দেখতে তাকিয়ে থাকল।

“কী রে শালা?” পতাদা খিঁচিয়ে উঠল, “বয়রা হয়ে গেছিস? উত্তর দে! ডিসিপ্লিন নেই কিছু? শো-কজ় করব?”

মাহিরের মনে হল বাছা-বাছা কিছু গালাগালি দেয়! শো-কজ়! পাজামার বুক পকেট!

কিন্তু নিজেকে সামলাল ও। তারপর বলল, “বুটটা গিয়েছে পতাদা। ছোটনকে দিয়েছিলাম সারাতে। কিন্তু পারেনি ভাল। পেরেক বেরিয়ে গিয়েছে।”

“তো?” পতাদা বলল, “জানিস, আমরা কেমন খেলেছি? পেরেক-ফেরেক কিচ্ছু মানিনি। একবার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা ছিল। কৃশানু, বিকাশ, চিমা। কে নেই ওদের টিমে! কিন্তু আমরা যা ফাইট দিয়েছিলাম না! আমারও সেদিন বুটে প্রবলেম ছিল। কিন্তু আমি কি পিছিয়ে এসেছি? আজও সবাই বলে সেই ম্যাচটার কথা।”

মাহিরের মুখটা আপনা থেকেই বেঁকে গেল! পতাদা এত বাতেলা করে না! সবাই জানে, পতাদার মতো ভুলভাল ঢপ কেউ মারে না!

ও বলল, “কিন্তু পতাদা, পা কেটে যাবে। ওই বুটে খেলা যাবে না।”

“তবে?” পতাদা তাকাল, “পরশু ম্যাচ আছে। তুই আমার রাইট ব্যাক। তোকে ভেবেই টিম করেছি। এখন বলছিস বুট খারাপ? আর বুট নেই?”

মাহির মাথা নাড়ল, “পরার মতো নেই। পুরনোটা আছে, কিন্তু স্টাডস গিয়েছে।”

পতাদা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ঠিক আছে, কাল আয়, দেখব। কী যে করিস! কত নম্বর পা তোর? দশ?”

মাহির আবার মাথা নাড়ল, “এগারো।”

“এগারো?” পতাদা অবাক হল, “মাইরি! রাবণ নাকি তুই?”

শরীরটা ওর বড়সড়। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা। চওড়া কাঁধ আর বুক। ভুঁড়ি নেই একটুও। ঢালাই লোহার শরীর। বাদামি চামড়ায় মাছি পিছলে যায়। রেশমি বলত, “তোর সঙ্গে কে প্রেম করবে? চেপে ধরলে আমি মরেই যাব।”

মরে যাবে? রেশমিকে এমনভাবে কেন চেপে ধরবে যে, ও মরে যাবে? রেশমি মরে গেলে ওর কী হবে?

ফরসা, রোগা মেয়ে ছিল রেশমি। একমাথা বাদামি চুল। গালে একটা তিল। ওকে দেখলেই দম বন্ধ হয়ে আসত মাহিরের। রেশমিকে বলতও সেই কথা। শুনে রেশমি হাসত, বলত, “ছেলেগুলোকে চিনি না? বদের বাসা! হিট উঠে গেলে যা খুশি তাই বলে! শুধু শোওয়ার ধান্দা!”

কিন্তু মাহিরের সেসব উদ্দেশ্যই ছিল না। সেই ক্লাস ইলেভেন বয়সটায় রেশমি বললে ও গলফ গ্রিনের টিভি টাওয়ার থেকে ঝাঁপও দিতে পারত।

কিন্তু রেশমি সেসব বুঝল না। ফাগুন মাহাতোর সঙ্গে এক সপ্তমী পুজোর দিন পালিয়ে গেল।

ন’বছর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজও মাহিরের ভিতরের জ্বালাটা মরেনি। ও চলে যাওয়ার পর তো পড়াটাও ছেড়ে দিয়েছিল মাহির। সারাক্ষণ ঘর অন্ধকার করে বসে থাকত। খেতে চাইত না। খালি মনে হত বজবজ লোকালে গলা দেয়! মনে মনে দেখত ফাগুন আদর করছে রেশমিকে। সম্ভাব্য সমস্ত রকম আদর যেন মনে মনে দেখতে পেত ও। আর বুকের পাঁজরে আগুন লেগে যেত! সারা শরীর পুড়তে শুরু করত ওর! পাগলের মতো লাগত মাহিরের। মনে হত সাপে কেটেছে ওকে। বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। বুঝত, এই বিষ বাকি জীবন বয়ে যাবে ওর শিরায় শিরায়।

সারা জীবন? সত্যি? না, সারা জীবন আর নয়। সত্যি করে বলতে গেলে সেভাবে হয়তো প্রেম আর নেই, কিন্তু কোথায় যেন একটা হেরে যাওয়া আছে। জ্বালাটা যে হারের সেটা বুঝতে পারে এখন। বুকের ভিতরের রাবার গাছ থেকে সারাক্ষণ টপ-টপ করে রস চুঁইয়ে পড়ে! খালি মনে হয় আধবুড়ো ফাগুনের কী ছিল, যা ওর ছিল না? উত্তরটা অবশ্য খুঁজতে হয় না। উত্তরটা ও জানে। টাকা। জমি-ব্যাবসার দালালির টাকা।

টাকাটাই মেরে দিল মাহিরকে। সব কিছুতেই পিছন থেকে টেনে ধরল। সেই রেশমি থেকে এই বুট অবধি। টাকা কিছুতেই এগোতে দেয় না ওকে।

পতাদা চলে যাওয়ার আগে বলল, “কী করিস, একটা বুটও কিনতে পারিস না!”

মাহির উত্তর দিতেও পারত, কিন্তু দিল না। কী হবে মুখ নাড়িয়ে। পতাদা বলবেই। তার চেয়ে একটা নতুন বুট পেলে ভাল হবে।

সুমিত উঠল, “কী রে, তোকে ছেড়ে দেব?”

মাহির মাথা নাড়ল, “না, আমি হেঁটেই চলে যাব। টিটি আসবে জাহাজবাড়ির সামনে।”

সুমিত কাঁধ ঝাঁকাল, “কী যে করিস মাহির! এখনও বলছি এইচএস-টা দিয়ে দে প্রাইভেটে। খেলার পাশে অন্তত এইচএস-টা হয়ে থাকলে সুবিধে পাবি।”

মাহির হাসল। বিষণ্ণ হাসি। সুমিত বুঝবে না। ওকে তাই বলে লাভ নেই। লেখাপড়ায় তো খারাপ ছিল না মাহির। মাধ্যমিকে লেটার ছিল চারটে। স্টার পেয়েছিল। ওদের ওই স্কুল থেকে মাত্র দুটো ছেলে পেয়েছিল স্টার। তার মধ্যে এই মাহির বসু একজন। ইংরেজিতে খুব ভাল ছিল ও। স্যার বলতেন, “মন দিয়ে পড়িস মাহির। জীবনে সব কিছু আমাদের ছেড়ে যায়, কিন্তু অর্জন করা বিদ্যে কখনও ছেড়ে যায় না। এর চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ নেই।”

স্যারের কথা আজও খুব মনে পড়ে মাহিরের। ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় ইংরেজিতে একশোয় বিরাশি পেয়েছিল মাহির। স্যার নিজে ওকে একটা বই দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা আইনস্টাইনের জীবনী। বইটা আজও আছে মাহিরের কাছে। শুধু বইটাই আছে। আর সব যেন হারিয়ে ফেলেছে ও! রেশমি চলে গিয়েছে, সঙ্গে করে বাকি জীবনটাও নিয়ে গিয়েছে।

সুমিত বলল, “হাসছিস? কিন্তু একদিন এর ফলটা ভুগবি। আমি ঠেকে শিখেছি। আটাশ হল আমারও। যদি বিএসসি-তে ব্যাকটা ক্লিয়ার করে রাখতাম, আজ শালা দাদার লেদের কারখানায় ঘানি ঘোরাতে হত না!”

ওরা মাঠের বাইরের দিকে হাঁটতে লাগল।

বড় রেলিং দিয়ে মাঠটা ঘেরা আছে। সন্ধের ঘোলাটে আলো বিশাল প্লাস্টিকের মতো এসে নামছে শহরের মাথায়। আস্তে-আস্তে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের আলো জ্বলছে। চিড়িক চিড়িক করে জেগে উঠছে বড়-বড় বিলবোর্ড। গাড়ির ছবি। বড় হাউজ়িং-এর ছবি। বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্যাকেজের ছবি। প্রতিদিন মাঠ থেকে বেরোনোর আগে এই বিলবোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে মাহির। এত টাকা মানুষ পায় কোথা থেকে? কে দেয় এত টাকা তাদের? ওর মা মাসে আট হাজার মতো পায়। তাতে ওদের তিনজনের চলতে দম ফুরিয়ে যায়! সেখানে এসব কেনে কারা?

মাঠের বাইরে এসে ফুটপাথের উপর স্ট্যান্ড করা মোটরবাইকটার সামনে দাঁড়াল সুমিত। পিছনের ক্যারিয়ারে ব্যাগটা আটকে রেখে বলল, “কী রে, আজ এত ডাউন কেন? বাড়িতে প্রবলেম?”

মাহির উত্তর দিল না। দেখল, মাঠ থেকে বিশু, সঞ্জয়, মইদুল, মনা, সুব্রত, বাবু এক-এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ ওকে দেখে হাসছে। কেউ পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। সবার মুখই কেমন যেন ম্লান! কেমন যেন ইস্ত্রি-বিহীন সব হাসি। এখানে কেউ আলো টাঙিয়ে দিয়ে যায়নি!

সুমিত বলল, “এই মাহির, কী হয়েছে তোর? তেমন হলে বলিস আমি তোকে জুতো কেনার টাকা ধার দেব। ভাবছিস কেন?”

মাহির হাসল এবার। সুমিত সেটা দিতেই পারে। যতই বলুক ওর দাদার লেদের কারখানায় ও ঘানি ঠেলছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেছে মাহির। যথেষ্ট ভাল অবস্থা। না হলে কেউ এমন আশি হাজার টাকার বাইক কিনতে পারে? মাহির জানে কারও-কারও দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করার একটা অভ্যেস থাকে। সুমিতেরও তেমন আছে। পড়ত ওর মতো ঘরে! থাকত অমন বস্তিতে! সবার সঙ্গে লড়াই করে জল নিতে হত। মাতালদের চিৎকারের মাঝখানে ঘুমোতে হত। আচমকা মারামারির মধ্যে, বোমাবাজির মধ্যে বাড়ি ফিরতে হত, তখন এসব বাতেলা বেরিয়ে যেত।

মাহির দেখে, সবাই যেন দিলীপ কুমার! ট্র্যাজিক হিরো! সবারই এত্ত বড়-বড় কষ্ট। আর সেই সব সহ্য করে বেঁচে থেকে যেন গোটা পৃথিবীকে উদ্ধার করে দিচ্ছে। মরে যেতে পারলে যেন সবাই বেঁচে যেত। এদিকে পেছনে লঙ্কাপটকা ফাটলে খাটের তলায় গিয়ে লুকোবে সব।

হুঃ! হতে পারে ছাব্বিশ বছর বয়স, কিন্তু জীবন কম দেখল না মাহির। যার বাপ নিজের মাসির সঙ্গে পালায় ছোটবেলায়! যাকে আধখ্যাপা, অসুস্থ একটা ভাই আর ক্লান্ত বিষণ্ণ মাকে টেনে বেড়াতে হয়, সে জানে জীবনের কোন ধানে কী ধরনের চাল হয়।

সুমিত ওকে ভালবাসে। বন্ধু হিসেবেই দেখে। কিন্তু ওর এই টাকা ধার দেওয়ার ভঙ্গিটা ভাল লাগল না মাহিরের। তবে কিছু বলল না ও। আসলে ও কিছুই বলে না। বোঝে, এই পৃথিবীতে কাউকে কিছু বলে কিছু হয় না। যে যা করার সেটাই করে।

সুমিত বাইকে উঠে বলল, “তুই এমন মুখ করে থাকিস না। চিয়ারফুল থাক। পরশু কিন্তু ভাইটাল ম্যাচ। জিততে হবে। জিতলে…”

“জিতলে?” মাহির তাকাল সুমিতের দিকে।

সুমিত বলল, “সুপার ডিভিশনের টিম থেকে স্পটাররা আসবে। অল্প টাকায় ভাল ছেলে খুঁজছে ওরা।”

মাহিরের হাসি পেল। এ আর-এক মিথ্যে কথা। ম্যাচের আগে পতাদা এমন একটা কথা ছড়ায়। আগেও হয়েছে। আসলে কেউই আসে না। কারও খেয়েদেয়ে কাজ নেই ওদের স্পট করতে আসবে। যেন ফুটবলারের অভাব পড়েছে!

ও বলল, “স্পনসরের কথাটা ধরতে পারলি আর এটা পারলি না?”

সুমিত বাইকে বসে স্টার্ট দিয়ে বলল, “এবার আর বুলু দিচ্ছে না। আজ বিকেলে শুনেছি ফোনে কথা বলতে। ওরা আসবে। তুই দেখিস।”

মাহির আর কিছু বলল না। এটাও পতাদার চাল। একে ওকে শুনিয়ে কথা বলার ভান করে। জানে, তা হলে খবর ছড়াবেই। ওসবে আর ভুলছে না মাহির।

সুমিত বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, “শোন, যদি কাল বুটের ব্যবস্থা না হয় আমি করে দেব। তুই ভাবিস না। শুধু পরশু ইউনিয়নের লেফট আউটটাকে দেখে নিস। মালটার ব্যাপক স্পিড! আর আউট স্টেপে একটা অদ্ভুত ফল্‌স আছে। কেটে যাস না ভাই।”

সুমিতের বাইক গাড়ির তোড়ে নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দূরে ওদের ক্লাবঘরের আলো জলছে। মাহির জানে পতাদার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে ভিতরে। ওরা অনেক রাত অবধি থাকে।

আশপাশে কেউ নেই। এবার ব্যাগের ভিতর থেকে ওর রাবার-ব্যান্ড লাগানো মোবাইলটা বের করল মাহির। বোতাম টিপল। আর সঙ্গে-সঙ্গে জোনাকি রঙের আলো জ্বলে উঠল স্ক্রিনে। প্রায় ছ’টা বাজে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। টিটিও বোধহয় এসে পড়েছে জাহাজবাড়ির সামনে। তবে বাড়িটা এখান থেকে কাছেই। পা চালিয়ে হাঁটলে বড়জোর মিনিটচারেক লাগবে।

মোবাইলটাকে এবার পকেটে ঢোকাল মাহির। তারপর ব্যাগটা কাঁধে ফেলে হাঁটতে লাগল।

এদিকটায় আলো থাকলেও সামান্য আবছায়াও আছে। আসলে চারিদিকে অনেক গাছ। মা বলে এই রাস্তাটায় আগে নাকি আরও অনেক গাছ ছিল। কিন্তু এখন কিছুটা কমেছে। কে জানে! এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না মাহির। এতে তো আর ভাত জুটবে না! শহরটা সুন্দর থাকুক বা কুৎসিত তাতে ওর কী? মানুষরাই যদি ভাল না থাকে তা হলে এসব ওপরের চটকবাজি দিয়ে কী হবে?

পাশ দিয়ে হুসহাস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আলতো হাওয়া দিচ্ছে গোলপার্কের দিক থেকে। আচমকা আকাশে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই রে, বৃষ্টি হবে নাকি?

আকাশের দিকে তাকাল মাহির। বিকেলে তো মেঘ ছিল না! তবে? এবার পা চালাল ও। ভিজলে চলবে না।

সিগনাল টপকে ওই দিকে ফুটপাথে উঠে বাঁ দিকে কিছুটা হাঁটলেই জাহাজবাড়ি। সামনেই টিটি দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে ‘গুরু’ বলে এগিয়ে এল।

টিটির চেহারাটা স্কেল দিয়ে টানা লাইনের মতো। রোগা। বেঁটে। কালো। শুধু মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কেমন যেন ছোট ঝুলঝাড়ুর মতো দেখতে! আর সব সময় মাথায় একটা হেয়ার ব্যান্ড পরে থাকে। আজও পরে আছে।

টিটি নেশা করে খুব। মানে গাঁজা, চরস, হেরোইন থেকে আঠা, সব ধরনের নেশায় টিটি ক্যাপ্টেন!

মাহির সামান্য হাসল। ভোল্টেজ কমে যাওয়া বাল্‌বের মতো হাসি। মাথার ভিতরটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। মনখারাপের ছোট্ট ধূপ কে যেন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে মনের কোণে!

“কী কাকা, এমন ড্যামেজ চোপা নিয়ে ঘুরছ কেন?” টিটি খ্যালখ্যাল করে হাসল।

মাহির দেখল লিলিপুটের মতো টিটিকে। অনেকটা যেমন মানুষ দোতলার বারান্দা থেকে একতলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দেখে, সেভাবে।

টিটি থমকে গেল। বুঝল হাওয়া খারাপ। মাথার ব্যান্ডটাকে ঠিক করে নিয়ে টিটি এবার সংযত গলায় বলল, “কী রে, এমন ডাউন মেরে আছিস কেন?”

মাহির সময় নিল একটু। একটা দীর্ঘশ্বাস আসছিল, সেটাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল, “না রে, কিছু না। বল, কী জন্য এখানে ডেকেছিস?”

টিটি ছাড়ল না। কাছে ঘেঁষে এসে বলল, “কী হয়েছে তোর? শালা আজও কি রেশমি এসে ঘাড়ে চেপেছে! শালা, এই জন্য প্রেম মারাতে নেই! আমার কাকা সোজা হিসেব। লাগাও আর ছাড়ো! তলপেটই ঠিক আছে। কেস বুক অবধি গড়িয়েছে কী তোমার মারা গেল।”

মাহির অন্যদিন হলে হাসত। কিন্তু আজ হাসল না। আসলে কোথায় যেন টিটি ঠিক। সব কষ্ট-দুঃখগুলোই যেন একটাই নদীর সঙ্গে বাঁধা। সব জল শেষমেশ সেই নদীতে গিয়েই যেন পড়ে! নিজেকে মনে মনে একটা তাগড়া গালি দিল মাহির। এসব বিলাসিতা ওকে মানায় না। কোথাকার কে একটা মেয়ে, ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে আধবুড়োর সঙ্গে পালাল, সেটা নিয়ে ছিরকুটে মেরে পড়ে থাকবে কেন ও? জীবনে কাজ নেই? ওর পাড়ার প্রায় সবাই কিছু না-কিছু করে এখন। কেউ ওর মতো এমন মায়ের ঘাড়ে বসে খায় না! এখন জীবনে সেই দিকেই লক্ষ দিতে হবে ওকে। এই ফুটবল-টল খেলে কিছু যে হবে না সেটা বুঝতে পারছে। বড় চেহারাটাই আছে ওর, স্কিল তেমন নেই। নিজেই বোঝে। কিন্তু কীভাবে যে রোজগার করা যায়! ওই যে বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জীবন, তেমন জীবন কিন্তু ও কল্পনা করে না। ওর একটা সাধারণ জীবন হলেই হয়। প্রতি মাসের শেষের ওই অন্ধকার সপ্তাহটা আর নিতে পারে না ও। খুব কষ্ট হয় ওরকম আধপেটা খেয়ে থাকতে। মায়ের গালাগাল খেতে।

মাহির টিটির দিকে তাকাল। রোগা বেঁটে একটা ছেলে। ওরও তো জীবনটা কষ্টের। কিন্তু কী করে এমন সব সময় টগবগে থাকে কে জানে! কালীঘাটের ওই বড় গলিতে ওর বাড়ি। ইটের গাঁথনি দেওয়া ছোট্ট টালির ঘর। দুটো কামরা। একটায় ও থাকে। অন্যটাতে ওর মা। মায়ের কাছে যখন ক্লায়েন্ট আসে টিটি বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে। কী যে জীবন ছেলেটার! তাও কখনও টিটিকে ও গোমড়ামুখে থাকতে দেখে না! সারাক্ষণ হাসে, নেশা করে। ইকিরমিকির কথা বলে।

টিটিদের বাড়িতে বহুবার গিয়েছে মাহির। আসলে ওইখানেই একটা স্কুলে পড়ত তো। যদিও ইলেভেন পাশ করে আর পড়েনি। তবু ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন অবধি ওই পাড়াতেই তো গিয়েছে। জানে তো কী পরিবেশে সেখানে মানুষজন থাকে!

টিটিও ওদের সঙ্গে পড়ত। তবে ক্লাস নাইনের পর আর পড়েনি। কিন্তু বন্ধুত্বটা ঠিক টিকে গিয়েছে। টিটির জীবন ওদের বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোনওদিন অসুবিধে করেনি। বরং স্কুলে পড়ার সময় তো মাঝে মাঝেই ওদের ওখানে যেত মাহির। আড্ডা মারত। খেলত। ওদের ওখানকার অনেকের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে মাহিরের। এখনও কখনও-সখনও মাহির ওখানে যায়, আড্ডা মারে। তবু টিটির মতো কিছুতেই হতে পারে না ও। চেষ্টা করে কষ্ট নামক অতিরিক্ত বোঝাটা নামিয়ে রাখতে। কিন্তু কে যেন সেটাকে ওর শরীরের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছে।

টিটি বলল, “কী রে? শালা, আজকাল তোদের পতাদা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ধ্যান করা শেখাচ্ছে নাকি! মাইরি তোকে বুঝতে পারি না আমি। এক-একদিন এক-এক কিসিমের ক্যালানে হয়ে যাস। এসব আর কতদিন চলবে?”

“কী জন্য এখানে দেখা করতে বলেছিস বল,” মাহির ব্যাগটা কাঁধ বদল করে বলল।

টিটি হাসল। হলুদ কালোর ছোপ-ধরা উঁচু দাঁত। হাসলে বড় মাড়ি দেখা যায়। ও বলল, “রিতুদা ডেকেছে তোকে। আর্জেন্ট কাজ।”

“আমায়?” মাহির অবাক হল সামান্য!

“কেন? তোকে তো আগেও ডেকেছে অনেকবার! তুই তো ঢ্যামনামো মেরে যাসনি। আমি গতসপ্তাহে বলেছিলাম তোর কথা। আসলে কাকিমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কাকিমাকে দেখে কষ্ট হল আমার। আর কত লোকের গু-মুত ঘাঁটবে বল তো! এবার একটু মাকে রেহাই দে। আমি তো আমার মাকে বলেছি। আর বছরখানেক, তারপর ঘরে বাবু বসানো বন্ধ। অনেক হয়েছে শালা। আর না। ছোটবেলা থেকে শালা লাগানোর আওয়াজ আর স্টিম ইঞ্জিনের হেঁচকি শুনে বড় হলাম। আর পোষায় না।”

মাহির বলল, “ঠিক আছে। চুপ কর। কী কাজ বল।”

“আরে শালা, চল না,” এবার টিটি হাত ধরে টানল ওকে, “আগে থাকতেই হাজার প্রশ্ন! রিতুদা এখানকার নেতা। পার্টিতে ঘ্যামা হোল্ড। শালা যত ফ্ল্যাট হয় তার থেকে টাকা আসে। আমাদের পাড়া থেকে টাকা আসে। আরও হাজারটা গলতা আছে টাকা রোজগারের। প্লাস ইট-বালি-পাথর-সিমেন্টের সাপ্লাই থেকে টাকা আসে। এত সোর্স! সব তো আর নিজে দেখাশোনা করতে পারে না। দেখিস না নেতাদের পাশে ক্যালানের মতো মুখ করে বেশ কিছু মানুষ ঝুলে থাকে সবসময়? তুইও থাকবি। আমেরিকায় তো জন্মাসনি যে, কর্পোরেশনের মইয়ের মতো চেহারা বলে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে নেবে! এখানে শালা গতরটার ডিসপ্লে দে। রিতুদার সঙ্গে থাক। পার্টি অফিসে এসে বোস। প্লাস রিতুদা পার্টিতে আরও ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজছে। এমনভাবে কিছু উন্নয়ন না ভাটের কী করে পার্টির উপরমহলের চোখে পড়তে চায়। শুধু এমপি-তে পোষাচ্ছে না। মন্ত্রী হতে চায়। কিন্তু সেসব ঘুঁটি সাজাতে গেলে একটা টিম তো চাই। তোকে চায় টিমে। কোনও বেআইনি কাজ নয়। সোজা কাজ। চল।”

মাহির তাকাল টিটির দিকে। এসব ব্যাপারগুলো খুব ভাল বোঝে ও। রিতুদাকেও সামান্য চেনে। বছর পঞ্চাশের মতো বয়স। মোটা। বেঁটে। মাথায় টাক। সারাক্ষণ লজেন্স খায়। কাঁধে সব সময় একটা তোয়ালে থাকে। মাহির দেখেছে, লোকটা শীতকালেও কুলকুল করে ঘামে! ও ভাবে কর্পোরেশনের কল যদি এই লোকটার মতো হত!

এর আগেও রিতুদা ওকে লোক মারফত ডেকে পাঠিয়েছে। কাজ দেবে বলেছে। কিন্তু মা করতে দেয়নি। আর সত্যি বলতে কী, মাহিরেরও ইচ্ছে ছিল না। তাই মা যখন বলেছে, “ওই মোটার কাছে যেতে হবে না। হেন খারাপ কাজ নেই ও করে না! পুলিশের ঘানি ঘোরাতে চাস? না গুলি খেয়ে মরতে চাস? জানিস না ওদের পার্টির ভিতরেই দশখানা পার্টি আছে? ভাগ আছে? জানিস না, রিতুর সবচেয়ে বড় শত্রু মনা পান্ডে? দু’জন দু’জনকে পারলেই দেখে নেয়! আর এসব বলছিস কেন? আমার রোজগারে তোর চলছে না? আর আমি তো কয়েকজনকে বলেছি। হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় বা হোটেলে বেয়ারার কাজ ঠিক হয়ে যাবে। তবে খেলে যদি কিছু পাস, তবে তো কথাই নেই! কিন্তু ওর কাছে যাবি না।”

মায়ের কথা থেকে সব বাদ দিয়ে শুধু অসমর্থনটুকু নিজের মনে তুলে নিয়েছিল মাহির। ভেবেছিল মা যখন বারণ করছে, তখন যাবে না। মনা পান্ডের সঙ্গে রিতুদার আকচাআকচি সবাই জানে। ঝিলের মাঠে মাঝে মাঝে বোমাবাজি হয়। পেপারে বেরোয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু রিতুদা বলে অপজ়িশন হামলা করেছিল! সবাই সব জানে, তাও সব অন্ধ হয়ে বসে আছে! মাহির একটা জিনিস খুব বোঝে, টাকার চেয়ে বড় শাসক আর কেউ নেই। এর চেয়ে বড় চাবুক আর কিছু নেই।

মাহির বলল, “তুই এমন করতে গেছিস কেন? মা পছন্দ করে না!”

“ওরে আমার ন্যাকাখোকা! মায়ের কথা শুনে কত চলিস! মনে নেই, একদিন মাল খেয়ে আমাদের পাড়ার প্রতিমাদির ঘরে গিয়েছিলি? ওকে নাকি রেশমির মতো দেখতে! মাকে জিজ্ঞেস করেছিলি? শোন, হাওয়াটা বোঝ মাহির। এমন স্টাইলের নাম নিয়ে ঘুরলেই হবে! ঘটে কিছু থাকবে না? বড়-বড় শিল্পী সাহিত্যিকরা সুযোগ বুঝে পাল তুলে দিয়ে নৌকো বাইছে! আর সেখানে তুই আতাক্যালানে! রিতুদার এই কাজটা ভাল। এক নম্বরি। চল। ভাল দেবে। দু’মাসের মধ্যে বাইক নিয়ে ঘুরবি!” কথাটা বলে পকেট থেকে বিড়ি বের করল টিটি।

মাহির বিরক্ত হয়ে দেখল সেটা। ও কালে-ভদ্রে মদ খায়, কিন্তু কখনওই বিড়ি বা সিগারেট খায় না। গন্ধেই কেমন একটা গা গুলোয় ওর। বিশেষ করে এই বিড়ি জিনিসটা।

ও বিরক্ত হয়ে তাকাল টিটির দিকে। টিটি পাত্তা দিল না। নেশা নিয়ে টিটি কারও কথা শোনে না। বরং বলল, “শোন, আগেও বলেছে রিতুদা। কিন্তু এবারেরটা ভাইটাল। নতুন কাজ। খুব জটিল কাজ। ভাল টিম না হলে চলে না।”

“কী জটিল কাজ?” মাহির ভুরু কোঁচকাল।

“সে আমি কী জানি! কিন্তু রিতুদা যখন বলেছে, তখন জটিল! ব্যস! বেকার জেরা করবি না তো! রিতুদার অনেকদিন তোর উপরে চোখ আছে। জানে তো তুই একসময় ক্যারাটে করতিস।”

“সে তো আগে। লাস্ট দু’বছর তো করি না। আর আমি কি রিতুদার হয়ে মারামারি করব নাকি?” মাহির চোয়াল শক্ত করল।

টিটি সময় নিল একটু। বিড়িতে বড় করে একটা টান দিয়ে গাল ফুলিয়ে ধোঁয়াটাকে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর রাস্তার হলুদ আলোর মুখে ছুড়ে দিল নীলচে মিহি রুমাল! মাহির দেখল ধোঁয়ার ছোট্ট মেঘটাকে। দেখল, পুঁচকি মেঘটা ধীরে-ধীরে ছিঁড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল সন্ধের বাতাসে। নাকটা কুঁচকে গেল মাহিরের। গন্ধটা বড্ড বাজে! যারা রাস্তাঘাটে এসব খায় বা খেতে খেতে হাঁটে, তারা বোঝে না ব্যাপারটা কতটা বিরক্তিকর অন্যদের পক্ষে। অনেক বাতেলা বক্তৃতা করা লোককে দেখেছে মাহির, যারা এইসব সাধারণ অসভ্যতা নিয়ে ভাবে না। আসলে সেই বোধটাই নেই!

“শোন বোকা, যা বলছি কর। আমার আর কী! আমি তো ঢুকে গেছি। তোকে ভালবাসি। তাই বলছি। আর কথাটা শুনতে কী আছে বে? কান দিয়েছে ভগবান, সেটা শালা কাজে লাগাবি না? শোন, রিতুদা বাণী দেবে আর তুই শুনবি। আমাদের কাছে রিতুদার বাণী হল দৈববাণী! আর অত ভাটের নখরামোর কী আছে! রিতুদা বাইক পাঠিয়েছে তোর জন্য। বোঝ রে গান্ডু! চল।”

মাহির অবাক হয়ে গেল! বাইক পাঠিয়েছে রিতুদা! ওর জন্য! সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টিটির দিকে তাকাল। বলে কী ছেলেটা! ও এত গুরুত্বপূর্ণ হল কবে থেকে!

মাহির এদিক-ওদিক তাকাল। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে একের পর এক। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের দিকের ফুটপাথে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনেই মেনকা সিনেমা। সন্ধের শো কি শুরু হল?

এই রাস্তাটায় বড়-বড় গুলমোহর, কিছু রেনট্রি আর অশ্বত্থগাছ রয়েছে। রাস্তার হলুদ আলো এই গাছগুলোয় ধাক্কা খেয়ে ছোট-ছোট ছায়ায় ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। কিন্তু তার ভিতর তো কোনও বাইক নেই! টিটি কী সব হাবিজাবি বলছে!

টিটি বুঝল ব্যাপারটা। পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে কানে লাগাল। বলল, “কী বে? কোথায় গেলি? তোর গাঁজা কেনা হয়নি? শালা, গাছ লাগাচ্ছিস নাকি বে!”

মাহিরের মুখটা বিরক্তিতে বেঁকে গেল। বুঝল, বাইক নিয়ে কেউ একটা গাঁজা কিনতে গিয়েছে। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা গাঁজার ঠেক আছে। টিটির দৌলতে মাহিরও সেসব চিনে গিয়েছে। ও তাকাল টিটির দিকে।

টিটি ওকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “ও, এসে গেছিস? তাই বল। দেরি করিস না।”

মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিতুদার সামনে ওকে যেতেই হবে! কী আপদ! এমন একটা মানুষ। কিছু বললে, কী করে মুখের ওপর না করবে! আর মা? মাকে কী বলবে? মাহির নিজের মনটাকে শক্ত করল। এটাই ওর সমস্যা, বড্ড বেশি আগাম ভেবে নেয় ও। আগে কী বলে দেখা যাক। তারপর না হয় চিন্তা করবে। আর সৎ কাজ হলে করবে না কেন? মা-ও নিশ্চয় বুঝবে ব্যাপারটা। সারা জীবন আর কত অনিশ্চয়তার ভিতর থাকবে!

“ওই এসে গিয়েছে।”

টিটির গলা শুনে তাকাল মাহির। একটা হলুদ কালো বাইক এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশে। যে ছেলেটা চালাচ্ছে, তার মুখটা চেনা। আন্ডারকাট চুল। সামনেটা ব্রোঞ্জের মতো রং। বাইকটা দাঁড় করিয়ে মাটিতে পা রেখে ছেলেটা লুকিং গ্লাসে নিজের চুল ঠিক করছে।

টিটি মাহিরকে ইঙ্গিত করে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।

ছেলেটা সোজা হয়ে বসে এবার তাকাল মাহিরের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখটা হাসিতে ভরে গেল, “আরে! মাহিরদা!”

মাহির অবাক হল। ও ছেলেটার মুখ চেনে। নাম জানে না। কিন্তু ছেলেটা ওকে চেনে!

ছেলেটা বলল, “আমি নকু। মানে নকুলেশ্বর। আমি তোমায় চিনি। তুমি তো হেবি খেলো! গতমাসে ওই কবরডাঙায় খেলতে গিয়েছিলে না? হায়ার করে নিয়ে গেছিল তোমায়! আমার মামার বাড়ি তো ওখানে। আমি দেখেছিলাম। আমার খুব ফুটবল খেলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু…”

মাহির হাসল।

টিটি নকুকে কথা শেষ করতে দিল না। মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর ফ্যাচকাস না! ফুটবল খেলবে! গাঁজার ছিলিম চুষে ফুসফুস কয়লার বস্তা করে ফেলেছে! শালা! শোন, তুই সোজা রিতুদার অফিসে নিয়ে যাবি। এখন দাদা চেম্বারে আছে। আমি পরে যাব।”

মাহির অবাক হল, “তুই যাবি না?”

টিটি আবার সেই শ্যাওলা-ধরা দাঁত দেখিয়ে বলল, “যাব, আগে আমার কাজটা শেষ করি।”

কথাটা শেষ করে নকুর দিকে হাত বাড়াল টিটি। বলল, “দে। রিফার করে রেখেছিস তো?”

নকু হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট দিল টিটিকে। মাহির মাথা নাড়ল শুধু। গাঁজা ভরা সিগারেট। আর সিগারেটের মাথাটা পাকানো। টিটি নেশা করেই একদিন শেষ হবে!

নকু বাইকটা স্টার্ট করে তাকাল মাহিরের দিকে। বলল, “বোসো দাদা।”

মাহির বলল, “হেলমেট?”

“আরে দূর! ওসবের দরকার নেই। বোসো,” নকু বাইকের হাতল ঘুরিয়ে ভ্রুম ভ্রুম শব্দ তুলে রেস দিল।

মাহির ব্যাগটা সামলে বসল।

টিটি বলল, “মুখটা অমন ক্যালানের মতো করে রাখিস না। হাস। শালা, তোকে কেউ ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছে না! কত ছেলে রিতুদার সঙ্গে চিপকাবার জন্য লাইন দিয়ে পড়ে আছে। সেখানে রিতুদা নিজে তোকে ডাকছে, আর তুই পোঁদ দোলাচ্ছিস! তোর হেবি তেল! যা। ভাল করে কথা বল। কাজ শুরু করে দে। বুঝলি?”

পার্টি অফিসের সামনে বাইকটা থামিয়ে পেছন ফিরে নকু বলল, “মাহিরদা, এই যে। তুমি সোজা ভেতরে চলে যাও। কোনও চাপ নেই!”

মাহির বাইক থেকে নেমে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। প্রতাপাদিত্য রোডের উপর একটা নতুন তৈরি মাল্টিস্টোরেডের নীচের তলায় পার্টি-অফিস।

সামনে চওড়া ফুটপাথ। সেখানে প্লাস্টিকের চেয়ারে বেশ কিছু লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে। তাদের মুখে একটা ‘মার দিয়া’ টাইপের ভাব। এদের মুখ চেনে মাহির। সবক’টাই রিতুদার ল্যাংবোট। সকাল-সন্ধে এখানে বসে থাকে। চা খায়। হ্যা হ্যা করে। রিতুদার সঙ্গে এদিক-ওদিক যায়। আর পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে শেষ মন্তব্যটা করে! দেখলেই জুতো খুলে পেটাতে ইচ্ছে করে মাহিরের। তেল দেওয়াটাও এখন একটা কাজ হিসেবে নিয়ে নিয়েছে বাঙালি! বুদ্ধিজীবী থেকে দুর্বুদ্ধিজীবী সবাই ব্যাপক হারে এটা দিয়ে চলেছে! স্যার বলতেন, “এরা ঘুণপোকা! দেশটাকে এরাই ভেতর থেকে শেষ করছে।” স্যারের কথাগুলো আজও মনে আছে মাহিরের।

মাহির এগিয়ে গেল অফিসের দরজার সামনে। দুটো ছেলে বসে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিল। ওর দিকে তাকাল। তারপর চিনতে পেরে হাসল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও এসে গেছ! যাও ভেতরে। দাদা বলেছেন তুমি আসবে।”

অফিসের দরজাটা আসলে একটা রোলিং শাটার। ফলে সামনেটা গোটাটাই খোলা! কিন্তু ভিতরে একটা পার্টিশান দিয়ে তৈরি করা ঘর রয়েছে। রিতুদার চেম্বার!

অফিসের ভিতরে পা দিয়েই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহির! আচমকা সামনের ওই চেম্বারটার দরজা খুলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। একটা স্লিভলেস কুর্তি, সঙ্গে জিন্‌স পরা। গলায় একটা স্কার্ফ। মেয়েটার ফরসা মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে মেয়েটা।

উত্তেজনার বশে মেয়েটা দেখতে পায়নি, চেম্বারের বাইরে একটা পাপোশ রয়েছে। তাতে নিমেষে পা জড়িয়ে গেল মেয়েটার। সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একটা টেবিল ধরে টাল সামলাল। তবে হাতের ফাইলগুলো ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। মেয়েটা থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

মাহির এগিয়ে গেল। তারপর ধীরে-ধীরে ফাইলগুলো গুছিয়ে তুলে দিল মেয়েটার হাতে। মেয়েটা এখনও ফুঁসছে! কিন্তু ফাইলগুলো পেয়ে সামান্য থমকাল। তারপর চোয়াল শক্ত করে দেখল মাহিরকে।

“থ্যাঙ্কস,” মেয়েটা ছোট্ট করে বলল।

“ইটস অলরাইট!” মাহির মাথা নাড়ল।

মেয়েটা থমকে গেল যেন। চোখে কি সামান্য বিস্ময়! ওকে দেখে কি মনে হয়নি যে, এটুকু ইংরেজি ও জানবে! মনের ভিতরের আত্মসম্মানের ঘরটা ক্রমশ ছোট হয়ে গিয়েছে মাহিরের। জীবনের চাপে পড়েই যেন কীরকম হাওয়া-কমা বেলুনের মতো দিনদিন চুপসে যাচ্ছে সেটা। কিন্তু সেটাতেও একটা ছোট্ট লাল পিঁপড়ে কামড়াল। মেয়েটার চোখ থেকে ছিটকে আসা বিস্ময়ের ভিতরের একটা হুল এসে বিঁধে রইল ওই ঘরে। মাহির মনে মনে ভাবল, মেয়েটা তো জানে না, ইলেভেন থেকে টুয়েল‌্‌ভে ওঠার পরীক্ষায় একশোয় ও বিরাশি পেয়েছিল ইংরেজিতে। স্যার বলেছিলেন, “মন দিয়ে পড়! তোর হবে!”

কিছু হয়নি মাহিরের। কিচ্ছু হয়নি! রেশমি আচমকা চলে গিয়ে ওকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। আর সেই নিকষ কালোয় হারিয়ে গিয়েছিল ওর সবটুকু! কিন্তু সেই অন্ধকারের ভিতর নিভে আসা, ছোট হয়ে আসা একটা ঘর এখনও যে রয়ে গিয়েছে, সেটা এই হুলটা না বিঁধলে জানতেই পারত না মাহির!

ও পিছন ফিরে দেখল। মেয়েটা বেরিয়ে যাচ্ছে অফিস থেকে। বাইরে আলতো একটা ধোঁয়াশা! স্ট্রিট লাইটের আলোর ভিতর ভেসে আছে দুধের সরের মতো ধূলিকণা। মেয়েটার ফরসা পিঠের পাশ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে ব্রেসিয়ারের কালো স্ট্র্যাপ। যেন একটা দাগ! একটা রেখা! যার ওই দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটা এখনও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মাহিরের দিকে। সেই মাহির! যে একদিন একশোতে বিরাশি পেয়েছিল ইংরেজিতে!

.

০৩. আইকা

এই শহরটাকে পিঁপড়ের বাসার মতো মনে হয় আইকার। এই দশতলার উপর থেকে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয়, সার বেঁধে পিঁপড়েরা বেরিয়েছে খাবার খুঁজতে। কোনওদিকে যেন নজর নেই! আগ্রহ নেই! শুধু পেটের চুম্বক যেন তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক বিন্দু থেকে আর-এক বিন্দুতে।

আইকা তাকিয়েই থাকে। সামনে খোলা কম্পিউটার, ডায়েরি, পেন, পাশে রাখা চায়ের কাপ— সব কিছু থেকে কীভাবে যেন আলাদা হয়ে যায় ও। একা হয়ে যায়। মনে হয় ও নিজেও তো তাই। পিঁপড়ে! পেটের ভিতর ওরও তো একটা চুম্বক রয়ে গিয়েছে! আর তার প্রবল টানে ও নিজেও তো ঘুরে মরছে!

টুংটুং করে বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে আইকার সংবিৎ ফিরল এবার। স্ক্রিনটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ও ফোনটা হাতে তুলে দেখল। মেসেজ। সার্ভিস প্রোভাইডারের! মেসেজটা ডিলিট করে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখল আইকা। ফেব্রুয়ারির শেষ এখন। তাতেই কী গরম! নেহাত এসি রয়েছে তাই বাঁচোয়া। ইয়ার এন্ড হতে আর মাসখানেক মতো বাকি। এখনই খুব একটা চাপ নেই কাজের। তাও আইকা কাজ ফেলে রাখে না। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে এই ‘হোমওয়ার্ড বাউন্ড রিয়েলটরস’-এর সিনিয়র ম্যানেজার স্টোরস-এর পদটা তো আর কোম্পানি ওর মুখ দেখে দেয়নি! কাজ করে বলেই সব হয়েছে।

জীবনে কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝেনি আইকা। এর জন্য সব ছেড়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর ও তো দেখেছে কী হয়েছিল ওদের সঙ্গে! জেঠুরা তো প্রায় কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। ওদের পাওনা দেয়নি। মাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। বাবার সামান্য পেনশন আর মায়ের প্রাইমারি স্কুলের চাকরি ভরসা করে যাদবপুরে খুব ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল ওরা! ক্লাস সেভেনে পড়ত তখন। ছোট্ট দুটো ঘর। একটুখানি একটা বেসিন। আবছা অন্ধকার একটা বাথরুম। দু’মিনিট টানা কল খুলে রাখলে বাড়িওয়ালি জেঠিমা দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে গালাগাল করত। কাপড় কাচলে বলত, “এটা বস্তি নয় যে, এমন আওয়াজ করছ!” কথায়-কথায় জেঠিমা জিরাফের মতো গলা বাড়াত। চিৎকার করত। উঠে যাওয়ার হুমকি দিত। এমনকী, একদিন তো মাকে বেশ্যা পর্যন্ত বলেছিল, ঠিকমতো মেন গেট আটকায়নি বলে। তবে এই শেষ কথাটা মেনে নিতে পারেনি আইকা। তখন ও ক্লাস নাইনে পড়ে। যা ঝগড়া সেদিন ও করেছিল! জেঠিমা তো শেষপর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিল! কোনওদিনই অন্যায় মেনে নিতে পারে না ও। সেদিনও পারেনি। আজও পারে না! সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে কোথায় যেন একটা ভাললাগা এখনও মনে আসে! জেঠিমার ওই ভয় পেয়ে যাওয়া মুখটা এখনও চোরা একটা তৃপ্তি দেয় ওকে। তবে সত্যি বলতে কী, সেসব দিনগুলো আর ভাবতে চায় না আইকা।

কম্পিউটারের দিকে মনোযোগ দিল এবার আইকা। ইনভেন্ট্রির লিস্ট পাঠানো হয়েছে ওকে। এসব ওর আর নিজে না দেখলেও চলে। কিন্তু তাও দেখে ও। স্টোরের লোকজন চুরি করে। সাইটে মাল পাঠানোর সময় দরকারের চেয়ে বেশি মাল নিয়ে যায়, কিন্তু চালান-এ সেটা দেখায় না। তাই আপ টু ডেট ইনভেন্ট্রি লিস্ট মিলিয়ে নিতে হয়। কতটা মাল গেল আর কতটা থাকল দেখে নিতে হয়।

স্টোরের বড়বাবু রমেন মণ্ডল লোকটা ঘোড়েল। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, তেল দিয়ে পালিশ করা চুল, লাল বেদানার মতো দাঁত নিয়ে দরকারের চেয়ে বেশি হেঁ হেঁ করে! এমন হেঁ হেঁ করা মানুষ দেখলে বড্ড রাগ হয় আইকার। উপরের প্লাস্টিকের হাসির তলায় লুকোনো দাঁত-নখগুলো ভালই চিনতে পারে ও। জীবন ওকে এইসব জিনিস চিনিয়ে দিয়েছে।

আগে লোকটার উপর ভরসা করত আইকা। কিন্তু এখন আর করে না। লোকটা যে জিনিস সরায়, সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারেনি। কিছু বললেই বলে, ওয়েস্টেজ বেশি। লেবাররা শয়তানি করে। কনস্ট্রাকশানে নানা ঝামেলা। তাই এমন বাড়তি ব্যয় হচ্ছে! আরে বাবা, দিব্যি ভাল ওয়্যার হাউস। লেবারদের খবরও অন্যদের থেকে পায়! সেখান থেকে ওয়েস্টেজ কী করে বেশি হবে?

কিন্তু এসব তো আর মুখের কথায় হয় না। প্রমাণ চাই। তাই আজকাল নিজেই আচমকা মাঝে মাঝে ওয়্যার হাউসে যায় আইকা। মাঝে মাঝে সাইটেও যায়! আর ওকে সামনে দেখলে রমেন এখনও হেঁ হেঁ করে। কিন্তু আজকাল ওই হাসির আড়ালে বসে থাকা শয়তানটাকে চিনতে পারে ও।

আইকার সাড্‌ন ভিজ়িটের জন্য চুরি কিছুটা কমেছে। ও নিজে গিয়ে সব মালপত্তর মিলিয়ে রমেনবাবুকে দিয়ে ইনভেন্ট্রি লেজারে সই করিয়ে নেয়। লোকটা পাঁকাল মাছের মতো, ঢিলে দিলেই কিছু একটা করে বসবে।

আইকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা আজ কেন কে জানে ছিটকে যাচ্ছে বারবার। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে! একটা ফড়িং ঢুকে গিয়েছে যেন মাথার ভিতর। যতই টেনেটুনে মনটাকে বসানোর চেষ্টা করছে, ততই মনটা কীরকম যেন পিছলে যাচ্ছে! কাজ করতেই ইচ্ছে করছে না। এখানে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। কিছুই ইচ্ছে করছে না। আজ দিনের সব কিছুই ‘না’ দিয়ে তৈরি! কারণ, শুধু মনে পড়ছে আজকের তারিখটার কথা! আজই ওর বিয়ে হয়েছিল না! বিয়ের তারিখটা আজই তো!

“কী রে আইকা? বাড়ি যাবি না?”

মুখ তুলে দূর্বাকে দেখল আইকা। মেয়েটা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কিন্তু সেটাও বুঝতে আজ সামান্য সময় লাগল ওর। তারপর বলল, “বাড়ি?”

দূর্বা হেসে বলল, “ক্যালানে হয়ে গেলি? ক’টা বাজে দেখেছিস? সওয়া পাঁচটা। আজ তোর নোঈ-এর ওই ব্যাপারটা আছে না? বলেছিলি তো আমায় নিজেই। তোকে তো যেতে হবে।”

আরে, তাই তো! আইকা চমকে উঠল। সব ভুলে যাচ্ছে! কী কাণ্ড! ও চট করে ঘড়ি দেখল। ছ’টায় ছেলের বাড়ির লোকরা আসবে। এখন সওয়া পাঁচটা বাজে। ওর তো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা। তিনরকম মিষ্টি আর দু’রকম নোনতা। কী কাণ্ড!

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল আইকার। মেয়ে দেখতে এসে এসব গান্ডেপিন্ডে গেলাটা জাস্ট সহ্য করা যায় না। কিন্তু কী করবে! পুটুমাসি পইপই করে বলে দিয়েছে, আইকা যেন মনে করে কিনে নিয়ে যায় এসব। বাড়িতে তেমন কিছু ঝামেলা করছে না!

পুটুমাসি মায়ের বান্ধবী। ওদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। পুটুমাসিরা আগে শ্যামবাজারে থাকত। কিন্তু বছরছয়েক হল ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে এই ভবানীপুরে। আইকারাও তখনই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল! মা আর পুটুমাসি বলতে গেলে একসঙ্গে যুক্তি করে কিনেছে ফ্ল্যাট দুটো!

আইকার মনে পড়ে গেল আবার। ফ্ল্যাটটা তো কেনাই হত না যদি না ওর জীবনে আজকের দিনটা থাকত!

“মাইরি! কী রে?” দূর্বা এবার এগিয়ে এসে ঠেলল আইকাকে, “এমন স্পেসড আউট হয়ে আছিস কেন?”

“না তো, কই!” আইকা হাসার চেষ্টা করল।

দূর্বা বলল, “আমিও আজ তাড়াতাড়ি কাটব। মায়ের শরীরটা ভাল নয়। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। ব্রতীন তো নেই কলকাতায়।”

আইকা দূর্বার দিকে তাকিয়ে হাসল। আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দূর্বা ওর খুব বন্ধু, তাই কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু এক-একদিন থাকে যখন কিছুই ভাল লাগে না। রোদের রং, হাওয়ার ওড়না, আকাশ থেকে নেমে আসা আলো, সবেতেই কেমন একটা মনখারাপ লেগে থাকে যেন। যেন মনে হয় সবই অনর্থক! সবই শূন্য! সব কিছুই কেবল থাকার জন্যই রয়েছে!

আইকা আবার একবার জানালার দিকে তাকাল। আলো নরম হয়ে এসেছে অনেক! শহরের শিরা-ধমনির মতো রাস্তাগুলো অনেকটাই ম্রিয়মাণ। কিন্তু পিঁপড়েরা চলেছে! মনখারাপ আর অন্ধকার ভেঙে তাদের সারি এগিয়ে চলেছে। একসঙ্গে। একাকী।

“কী হয়েছে তোর?” দূর্বা পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল এবার, “এমন মুখ করে আছিস কেন? সত্যি মাইরি! তোকে নিয়ে আর পারি না! আর কত বোঝাব বল তো? ছত্রিশ বছর বয়সটা কি তোর হাওয়ায় হল? আরে বাবা, বর কি কারও মারা যায় না? তবে? এবার একটা বিয়ে কর। কত ছেলে তো লাইন দিয়ে রেখেছে! একজনকে বেছে তারপর বিয়ে করে নে।”

আইকা হাসল। কী বলে মেয়েটা! আসলে সবটা তো আর জানে না। কাউকে বলেও না। কী হবে বলে? পুরনো কথা মাটি খুঁড়ে বের করে আনলে দুর্গন্ধই বেরোবে! এখনকার আপাতশান্ত জীবনটা বিঘ্নিত হবে। তার চেয়ে যা অলক্ষ্যে ও অতীতে রয়েছে, তা অলক্ষ্যেই থাকুক।

দূর্বা বলল, “দেখ আইকা, এভাবে মুখ বুজে থাকলে হবে না। আমার তো চল্লিশ হল। আমি কম ঘাটের জল খাইনি! তোর মতো আমারও ছোট থেকে বাবা নেই। সবটা আমাকে আর মাকে করতে হয়েছে। ব্রতীন আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। ওকেও কিন্তু দেখতে হয় আমাকেই। হতে পারে মাল্টিন্যাশনালের ভিপি, কিন্তু জানিস তো ডান দিকে ফিরলে বাঁ দিকটা ভুলে যায়! আগেই জানতাম ও এমনটাই। মা বলেওছিল, অফিস করে এমন ছেলেকে সামলাতে পারবি তো! কিন্তু আমি দূরের সময়টা দেখেছিলাম। ফিউচার ইজ় মাই কনসার্ন। তাই ওকে বিয়ে করব ঠিক করছি। এখনও বয়স আমাদের দিকে। শরীরে, মনে জোর আছে। কিন্তু সারা জীবনটা তো এমন যাবে না! আঠাশে তোর হাজ়ব্যান্ড চলে গেল। তারপর আট বছর কেটে গিয়েছে বস! এবার কিছু কর। বেকার কষ্ট পেয়ে কী লাভ?”

আইকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাউসটা ধরে নাড়াল সামান্য। তারপর বলল, “তুই এত কথা বলিস কেন?”

“যাঃ শালা!” দূর্বা ওর খোলা চুলটাকে আঙুল দিয়ে কানের পিছনে নিয়ে গিয়ে বলল, “বলছি তোর ভালর জন্য রে!”

আইকা হেসে একবার দ্রুত ইনভেন্ট্রি লিস্টটায় চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বন্ধ করে বলল, “আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু যাকে-তাকে বিয়ে করে নেব? এতটা ডেসপারেট হইনি এখনও।”

দূর্বা হাসল, “যাকে-তাকে কী বলছিস! তোর জন্য যা লাইন, তা পেট্রোলের দাম বাড়ার আগের রাতের পেট্রোল পাম্পকেও হার মানাবে।”

আইকা জানে দূর্বা ইয়ারকি করছে! ও ওরকমটা করে। মেয়েটা খুবই ভাল। পরিশ্রমী। তাই কোম্পানিতে ভাল পোস্টে আছে। আর আইকাকে ভালওবাসে খুব। কিন্তু তা হলেও আইকা ওকেও সবটা বলতে পারেনি! কাউকেই পারেনি কোনওদিন। পারে না। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়া আর তার পরবর্তী জীবনের কষ্ট আর সংগ্রামটাই কোথায় যেন পালটে দিয়েছে ওকে। রাগী, অভিমানী আর জেদি করে দিয়েছে। আর তাই তো আজ ওর জীবনটা এরকম হয়ে গেল! জীবনে টাকা আর স্থিতিশীলতার জন্য একের পর এক যা করেছে, তা ওকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই স্কুলজীবন থেকেই ও টিউশনি করত। তারপর কলেজে উঠে পার্টটাইম কাজ করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে। এমনকী মায়ের যখন শরীর খারাপ হল, জীবনবিমার এজেন্ট হিসেবেও কয়েকমাস কাজ করেছিল বাড়তি রোজগারের জন্য। আর অল্পবয়সি, সুন্দরী মেয়ে বলে কম নোংরামো তো ওকে সামলাতে হয়নি! কাজ যেমন হত, তেমন মানুষজন নানা খারাপ কথা, ইঙ্গিত আর প্রস্তাবও দিত। জীবন দোধারী তরোয়ালের মতো। একদিকে ওর বাঁধনগুলো যেমন কেটেছে, তেমন ওকেও কেটেছে অন্য দিকে!

কম্পিউটারটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল আইকা। এবার যেতেই হবে, না হলে পুটুমাসি রাগ করবে। আর সত্যি তো, ছেলের বাড়ির লোকজন এসে যাওয়ার আগেই ওর যাওয়া উচিত। রাঙামেসো আর পুটুমাসি ঠিক সামলাতে পারে না কিছু। তাই আইকাকে থাকতেই হয়।

পুটুমাসি মায়ের ছোটবেলার বন্ধু। তবে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। মায়ের বিয়ের চার বছরের মধ্যে দু’বছরের জন্য বাবার বদলি হয়ে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশ। তখন থেকেই আর যোগাযোগ ছিল না। ফলে ওদের ওই ভয়ংকর সময়টার কথা পুটুমাসিরা জানত না। তবে মায়ের ওই সময় পুটুমাসির কথা মনে থাকলেও মা সেখানে যায়নি। সাহায্য চায়নি। কারও কাছেই যায়নি। দু’জনেই যতটা পেরেছে সব সামলেছিল!

শুভ মারা যাওয়ার পর আবার যোগাযোগ হয়েছিল পুটুমাসির সঙ্গে। এখনও মনে আছে আইকার। শুভর শ্রাদ্ধের চারদিন পর মাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল আইকা। পুটুমাসিরাও এসেছিল ব্যাঙ্কে। অ্যাকাউন্ট খুলতে। মা আর পুটুমাসি তো দু’জন দু’জনকে দেখে কিছুক্ষণ নড়তেই পারেনি! কেমন যেন থমকে গিয়েছিল! থমকে গিয়েছিল সময়! তারপর দু’জনে জড়িয়ে ধরেছিল একে অপরকে। আর কী কান্না কী কান্না! মা একদম ছেলেমানুষের মতো আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল পুটুমাসিকে। পুটুমাসিও কাঁদছিল। ব্যাঙ্কে লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল গোটা ব্যাপারটা! কেউ কেউ হাসছিলও। সকলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আইকার খুব এমব্যারাসড লাগছিল। মনে হচ্ছিল মা এমন বাড়াবাড়িটা না করলেই পারত। কিন্তু কিছু বলতেও পারেনি। কী বলবে! আসলে এই বহুবছর পরের দেখা হওয়াটার ভিতর যে অনেক অনেক মেঘ জমে ছিল! মানুষকে মাঝে মাঝে কাঁদতেও দিতে হয়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তখন। তাকে সান্ত্বনা দিতে নেই। তাকে প্রবোধ দিতে নেই। কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে নেই। তাকে শুধু কাঁদতে দিতে হয়। আইকা জানে, কান্না আসলে খুব ব্যক্তিগত একটা অভিব্যক্তি। খুব সৎ একটা প্রকাশ। সান্ত্বনার মতো বাহ্যিক আড়ম্বর দিয়ে তাকে সব সময় লঘু করার মানে হয় না।

সেই মায়ের সঙ্গে আবার পুটুমাসির যোগাযোগের শুরু। সেই যোগাযোগ থেকেই একসঙ্গে ফ্ল্যাট কেনাও হয়েছে। আসলে শুভর সঙ্গে বিয়ের পর টাকাপয়সার সব অভাব মিটে গিয়েছিল আইকার। তাই শুভ মারা যাওয়ার পরে পঞ্চান্ন লক্ষ টাকা দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনতে ওদের কোনও অসুবিধে হয়নি।

শুভর সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। ইংলিশে এম এ করছিল আইকা। শুভদের ছিল সোনার ব্যাবসা। গোটা কলকাতায় ছ’টা সোনার দোকান ছিল ওদের। শুভ নিজে দেখত দুটো দোকান। তার একটা ছিল কলেজ স্ট্রিটে। সেখানেই একদিন আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে শুভর। রথের দিন ছিল সেটা। আজও মনে আছে আইকার।

শুভ লম্বা ছিল খুব। গায়ের রং মিশকালো। মোটা গোঁফ, দাড়ি। গম্ভীর মুখ। আইকার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় ছিল শুভ।

একটা ছোট বই কিনতে গিয়েছিল আইকা। আটত্রিশ টাকা দাম ছিল সেটার। সঙ্গে খুচরো ছিল না ওর। আইকা পাঁচশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানদার লোকটি বিরক্ত হয়েছিল খুব। আইকাও বুঝতে পারছিল যে, বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। এতটা খুচরো সব সময় যে থাকবে তা তো নয়। সেটা ও ভাল করে বলতেও গিয়েছিল। কিন্তু লোকটা শুনছিল না কিছুতেই।

পাশেই একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছিল শুভ। হাতে মাটির খুরিতে চা নিয়ে ও যে গোটা ব্যাপারটাই দেখছিল, সেটা বুঝতে পারেনি আইকা!

দোকানদার লোকটাকে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে আইকা যখন বইটা না কিনেই চলে আসছিল, ঠিক তখনই এগিয়ে এসেছিল শুভ।

আইকার লজ্জা লাগছিল খুব! এমনিতেই দোকানদারটি ওকে সামান্য হলেও অপমান করেছিল, তারপর একদম অচেনা একজন এমন করে গায়ে পড়ে উপকার করছে দেখে লজ্জাটা যেন বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। কিন্তু বইটাও দরকার ছিল খুব। তাই শুভ টাকাটা খুচরো করে দিতে চাইলে আর আপত্তি করেনি। শুভ বিশেষ কথা বলেনি। শুধু জানতে চেয়েছিল, কী পড়ে আইকা।

আইকা বলেছিল। শান্ত নরম গলায় ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এসেছিল দোকান থেকে। কিন্তু পরের দিন ইউনিভার্সিটি ছুটির পরে দেখেছিল বিদেশি দামি বাইকে হেলান দিয়ে ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুভ! প্রচণ্ড অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল আইকা। কী করছে লোকটা এখানে? টাইট জিন্‌স, বুকের একটা বোতাম খোলা সাদা জামা আর বিশাল বড় একটা বিদেশি বাইক! লোকজন রীতিমতো দেখছিল বাইকটা। আইকা কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু শুভ একদম সামনে চলে আসায় এড়াতে পারেনি। সৌজন্যবশত সামান্য হেসেছিল! শুভ ভাবলেশহীন মুখে বলেছিল, “আজও যদি খুচরো লাগে, তাই চলে এলাম!”

ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল আইকা। সামনের কাচে নিজেকে দেখে ছোট করে কাটা চুলগুলো ঠিক করে নিল। তারপর টেবলে রাখা বোতলটা থেকে জল খেল একটু।

“শোন, স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে যাস,” দূর্বা নিজের কিউবের দিকে যেতে-যেতে বলল, “তোকে একবার খুঁজছিলেন।”

“তো এতক্ষণে বলছিস!” আইকার বিরক্ত লাগল, “আমায় বেরোতে হবে! আসল কথা না বলে এসব জ্ঞান তোকে কে দিতে বলেছে! আর উনি বেয়ারা দিয়ে কল করাননি কেন?”

দূর্বা বলল, “আরে, আমি ঘরে গিয়েছিলাম তাই আমাকেই বললেন! জাস্ট দু’মিনিট লাগবে। মনে হয় ঝাড়খণ্ডের ওই প্রজেক্টটা নিয়ে কিছু বলবেন।”

আইকা মাথা নাড়ল বিরক্তিতে। তারপর ঘড়ি দেখল। সেই লেট হবেই! ভাগ্যিস ওর নিজের গাড়ি। সত্যি দূর্বাকে নিয়ে আর পারা যায় না। ও আর অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেল স্যারের চেম্বারের দিকে। স্যার মানে ওদের কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার রুপিন মেহতা। দেখা যাক, স্যার কতক্ষণ আটকান।

ওর কিউবিকল থেকে বেরিয়ে একটা টানা লম্বা করিডর। আশপাশের কিউবিকলে এখনও লোকজন কাজ করছে। আইকা সেইদিকে তাকাল না। শুধু ঘড়ি দেখল। দূর্বাটা যেন কী একটা! কাজের কথা না বলে এটা-সেটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত! মেয়েটা খুব ভাল। কিন্তু দরকারের চেয়ে বেশি সেন্টিমেন্টাল। এত বেশি সেন্টিমেন্টাল, যে মাঝে মাঝে অফিসেই কেঁদে ফেলে! বিরক্ত লাগে আইকার। নিজের মনের গোপন ভাঁজগুলো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি ভাল লাগে না ওর। জীবনে যখনই সেন্টিমেন্ট আর কার্যকারিতার মধ্যে বাছবিচার করতে হয়েছে, কার্যকর হবে যেটা ওর পক্ষে, সেটাই সব সময় বেছে নিয়েছে আইকা।

“তুই এমনটা করতে পারলি!”

আচমকা কথাটা মনে পড়ায় থমকে গেল আইকা! ভুরু কুঁচকে গেল ওর। কী হল ব্যাপারটা! হঠাৎ এটা মনে পড়ল কেন! আইকা চোখ বন্ধ করল একটু সময়ের জন্য। হঠাৎ এতদিন পরে এটা মনে পড়ল কেন? সেন্টিমেন্ট-কার্যকারিতা এসব নিয়ে ভাবছে বলেই কি এটা মাথায় এল? কিন্তু সে তো প্রায় উনিশ বছর হয়ে গিয়েছে! সেই স্কুললাইফের ব্যাপার। তবে? বয়স বাড়ছে বলেই কি আচমকা মনে পড়ে গেল ওর কথা?

করিডরের শেষ প্রান্তে রুপিনস্যারের কেবিন। তার আগের এই জায়গাটা স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে মোড়া। সামান্য বাঁকাচোরা হলেও প্রতিফলন দেখা যায়।

আইকা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে নিল আর-একবার! ছোট করে কাটা চুল। বেবি পিঙ্ক রঙের শার্টের সঙ্গে কালো ট্রাউজ়ার। সারা দিনের ক্লান্তির পরেও দেখতে খারাপ লাগছে না! ভালই তো আছে আইকা! নিজের ফ্ল্যাট। মা। বন্ধুবান্ধব। ঋষি। সব নিয়ে খারাপ নেই তো! তবে?

ঋষির কথা মনে পড়তেই হাসি পেল আইকার। ঋষি আগরওয়াল। আলিপুরে থাকে ছেলেটা। বিশাল বড়লোকের ছেলে। চাল, পেঁয়াজ, ডাল আরও কীসবের ব্যাবসা আছে। মদেরও একটা ব্রুয়ারি আছে। কিন্তু সেসব দিকে ঋষির মন নেই।

ঋষি বিবাহিত। কিন্তু বউয়ের দিকেও মন নেই। আইকা বউয়ের কথা তুললে ঋষি বলে, “আরে, ওটা সমঝোতা। বাবার বিজ়নেস বাড়বে ওতে! পলকের বাবুজির বিশাল কারোবার। তুমি তো বোঝো আইকা। শি ডাজ়নট নো হাউ টু লাভ! হাউ টু ফ্‌… ইউ নো!”

আইকা হাসে। ঋষি ওর চেয়ে আট বছরের ছোট। অফিসের একটা পার্টিতেই আলাপ হয়েছিল বছরদুয়েক আগে। তারপর থেকেই আঠার মতো লেগে থাকে ওর সঙ্গে!

ঋষির একটা ফ্ল্যাট আছে রাজারহাটে। বেশ বড়। প্রায় তিন হাজার স্কোয়ার ফিট। সেখানে মাঝে মাঝে যায় ওরা। ঋষি পাগলামো করে! শরীর নিয়ে মেতে ওঠে! তারপর বিছানাতেই বসে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করে ওরা। বড় টিভিতে ফিল্ম দেখে। আড্ডা মারে। কিন্তু ওইটুকুই। আর কিছু নয়। শুধু টাইম পাস। কোনও মন নেই। গভীরতা নেই। ফিরে আসার সময় পিছুটান নেই। কিচ্ছু নেই। কেবলমাত্র ফান-টাইম। ব্যস। এটা কতদিন থাকবে, সেটাও ও জানে না।

রুপিন মেহতার কেবিনটা বেশ বড়। চারিদিকে বাদামের খোসার রঙের ফার্নিচার। এককোণে বড় লাউঞ্জার। প্রায় নিঃশব্দে এসি চলছে। বড় একটা টেবলের উলটো দিকে বসে রয়েছেন রুপিন। ছোটখাটো মানুষ। গোলাপি ফরসা গায়ের রং। মাথায় পাট করে আঁচড়ানো চুল। দাড়িগোঁফ কামানো। চোখে রিমলেস চশমা। ঘন ভুরুর আড়ালে আঁশফলের বীজের মতো চোখ! দেখলে বোঝা যায় না লোকটার পঞ্চাশ বছর বয়স!

আইকা ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই রুপিন চোখ তুলে তাকালেন। তারপর হাত দিয়ে বসতে বললেন সামনের চেয়ারে। আইকার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এই রে! বসতে বলছেন! তার মানে দেরি হবে। রুপিন ওর বস। তাঁর সামনে তো আর বিরক্তি দেখাতে পারে না আইকা! তাই যথাসম্ভব ক্যাজ়ুয়াল থেকে আড়চোখে ঘড়িটা আবার দেখল আইকা। আজ নির্ঘাত মা আর পুটুমাসির কাছে ঝাড় খাবে! পাত্রপক্ষ চলে এলে মুশকিল হবে। নোঈও রাগ করবে।

নোঈ পুটুমাসির ছোট মেয়ে। বড় মেয়ে এখানে থাকে না। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নিউ জার্সিতে থাকে। প্রায় ওর মতোই বয়স। আর সেখানে নোঈ মাত্র ছাব্বিশ! এই বয়সে আজকাল কেউ কারও বিয়ে দেয়! হয়তো দেয়! আইকার মনে হয় এখনও নোঈ বিয়ে করার মতো হয়নি।

আইকার বিরক্ত লাগে। মানুষ যে কী করে না! পুটুমাসিদের কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় মনে আলো হাওয়া লেগেছে! কিন্তু তারাও এটা কী করে করছে কে জানে! রাঙামেসোর সঙ্গে আইকার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তাই নোঈ-র এখন বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নিয়ে রাঙামেসোকে চেপে ধরেছিল আইকা।

রাঙামেসো মানুষটা ভাল। চুপচাপ ধরনের। ঝগড়াঝাঁটি বা তর্ক পছন্দ করে না। সব প্রায় মেনেই নেয়।

আইকার ভাল লাগে রাঙামেসোকে। সারাদিন হয় বই, নয়তো ল্যাপটপে মুভি নিয়ে বসে থাকে। কাউকে জ্বালায় না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘চা দাও’ বলে চিৎকার করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে রাঙামেসোর এই নন-এনগেজিং ধরনটা ভাল লাগে না আইকার। মনে হয়, এভাবে জীবন-বিমুখ হয়ে কী করে থাকে কেউ! পুটুমাসিই যা করার করে, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেয়। রাঙামেসো যেন বাড়ির একটা ফুলদানি!

গত সপ্তাহে নোঈ-র এই বিয়ের সম্বন্ধের কথাটা ওদের বলেছিল পুটুমাসি। সন্ধেবেলাটায় মা পুটুমাসিদের বাড়িতেই থাকে। অফিস থেকে ফিরে আইকাও যায়। কখনও ও খাবার কিনে নিয়ে যায় আবার কখনও পুটুমাসি কিছু খাবার বানায়। সেদিন ও নিজে পিৎজ়া নিয়ে এসেছিল। খাবারটা ভাগ করে দিতে দিতে পুটুমাসিই তুলেছিল কথাটা!

পুটুমাসি বলেছিল, “তোদের একটা খবর দেওয়ার ছিল রেখা।”

আইকা তাকিয়ে দেখেছিল মাকে। মা চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছিল সবে। পুটুমাসির কথা শুনে থমকে গিয়েছিল।

পুটুমাসি বলেছিল, “পরের সপ্তাহে নোঈকে দেখতে আসবে।”

“দেখতে আসবে মানে?” মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পুটুমাসির দিকে।

“মানে বিয়ের জন্য,” হেসেছিল পুটুমাসি, “গত জানুয়ারিতে আমরা একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। ওই মুকুন্দপুরের ওইদিকে। সেখানে ওঁরা দেখেছিলেন নোঈকে। খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই খবর দিয়েছে।”

“নোঈ-র জন্য!” মা বলেছিল, “এখনই বিয়ে দিয়ে দিবি?”

পুটুমাসি সামনের চেয়ারটায় বসে হেসেছিল। তারপর গদগদ মুখে বলেছিল, “হ্যাঁ। ছেলেদের অবস্থা ভাল। ডাক্তার। বাপ-ঠাকুরদাও ডাক্তার। ওদের আগ্রহ খুব। তা ছাড়া নোঈ তো আর কচি খুকি নয়!”

নোঈকে দেখতে ভাল। ফরসা। টিকালো নাক। বড়-বড় চোখ। চশমা পরে। থুতনিতে একটা হালকা টোল আছে। হাসিটাও সুন্দর। ঝকঝকে। পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে।

মা বলেছিল, “তাও ওর বয়সটা দেখ!”

পুটুমাসি বলেছিল, “ওর মতো বয়সে আমার বড় মেয়ে টটি হয়ে গিয়েছে! ছাব্বিশটা খুব একটা কম বয়সও নয়। ছেলের তেত্রিশ। একদম ঠিক আছে।”

আইকা আর কথা না বলে থাকতে পারেনি। ও পাশে বসে মোবাইল নিয়ে খুটখুট করতে থাকা নোঈকে বলেছিল, “কী রে, তুই কিছু বলছিস না কেন?”

“আমি আর কী বলব!” নোঈ মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই বলেছিল, “বললে কি মা শুনবে? শুনবে না।”

কথাটা সত্যি। পুটুমাসি কারও কথাই শোনে না। আর রাঙামেসো যেহেতু নির্বাক চলচিত্রের পার্শ্বচরিত্র, তাই পুটুমাসিই সমস্ত ডায়ালগের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।

আইকা ছাড়েনি। বলেছিল, “তুই কারও সঙ্গে প্রেম করিস না?”

নোঈ এবার তাকিয়েছিল আইকার দিকে। বলেছিল, “তোকে কতবার বলব দি? না, করি না।”

“আহা, সত্যিটা বল না।” আইকা চাপ দিয়েছিল।

“ও ওসব করে না। ছোট মেয়ে, কী প্রেম করবে? আর করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব না?”

“ছোট মেয়ে?” আইকা চোখ গোল করেছিল, “তা হলে বিয়ে দিচ্ছ কেন?”

“ও তুই বুঝবি না। আমরা বয়সে তোদের চেয়ে বড়। আমরা জানি কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।”

পুটুমাসির গলায় অধৈর্য লক্ষ করেছিল আইকা। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গিয়েছিল ওর।

এই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না আইকা। বড় বলেই সব জানে? তাই যদি হত, তা হলে ইতিহাসে এত যুদ্ধবিগ্রহ কেন? এত কোটি-কোটি লোকের এত দুঃখ-দুর্দশা কেন? যা খুশি তাই বললেই হল?

আইকা চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু মা পাশ থেকে চেপে ধরেছিল হাতটা। মা আইকাকে ভালই চেনে। তাই জানে কখন কোথায় ওকে আটকাতে হয়। না আটকালে আইকার মুখে কিছু আটকায় না।

আইকা শুধু তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। নোঈ একমনে মোবাইলে কাউকে একটা মেসেজ করে যাচ্ছিল। যেন এই ঘরে ও নেই। এই ঘরের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কই নেই।

আইকা টেবিল থেকে খাবারের একটা প্লেট তুলে ভেতরের ঘরের দিকে গিয়েছিল। রাঙামেসো ভেতরের ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল একা।

আইকা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মেসোকে দেখছিল। ঠিক নোঈর ফোটোকপি! বাপ আর মেয়ের এই চুপ করে, একা হয়ে থাকায় কী মিল! ওই ঘরে মেয়ে বসে মোবাইলের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছে। আর এই ঘরে বাবা ল্যাপটপে।

খাবারের প্লেটটা নিয়ে গিয়ে ঠকাস করে টেবিলে রেখেছিল আইকা। মেসো তাকিয়েছিল ওর দিকে। মুখে সামান্য হাসি।

রাগটা মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল আইকার, হাসিটা যেন সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল একদম।

ও দাঁত চেপে বলেছিল, “হাসো যত পারো! মেয়েটা তোমার তো? ঠিক জানো?”

রাঙামেসোর সঙ্গে এভাবেই কথা বলে আইকা। একদম যা মনে হয় বলে। মেসো কিছু মনে করে না। বরং কেন কে জানে প্রশ্রয় দেয়।

মেসো ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “কী হয়েছে তোর? এত খেপে আছিস কেন?”

আইকা বলেছিল, “নোঈর এই বয়সে বিয়ে দিয়ে দেবে পুটুমাসি! আর তুমি এখানে ল্যাপটপে বিদেশি মিনি সিরিজ় দেখছ!”

“আজ কি বিয়ে হচ্ছে?” মেসো হাসিমুখে তাকিয়েছিল আইকার দিকে।

“মানে?”

“মানে, আজই কি বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে?”

আইকা থমকে গিয়েছিল।

মেসো বলেছিল, “শোন, সারাক্ষণ এত উত্তেজিত থাকিস কেন? এত অস্থির হলে হয়! একটা বাড়ি থেকে নোঈকে পছন্দ করেছে। করুক। দেখতে আসবে। আসুক। বিয়ে তো হচ্ছে না।”

আইকা বলেছিল, “তোমায় দেখে অবাক হয়ে যাই! এত ঠান্ডা থাকো কী করে? পুটুমাসি যেভাবে ছেলের গুণগান করছে, সময় থাকলে নিজেই হয়তো বিয়ে করে নিত!”

মেসো হেসেছিল খুব। তারপর বলেছিল, “শোন, নোঈ যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করবে। সে পুটু যাই বলুক।”

আইকা মুখ বেঁকিয়েছিল ইচ্ছে করে। তারপর বলেছিল, “তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি জানি তোমায়। তুমি ভিতু।”

মেসো ল্যাপটপের স্ক্রিনটা নামিয়ে দিয়ে রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। তারপর বলেছিল, “জানিস, পুটুকে ওদের বাড়ির লোকজন আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়নি। হাইলি পলিটিক্যালি কানেক্টেড ছিল ওদের বাড়ি। সব রকম চেষ্টা করেছিল আমাকে আটকাতে। মারতেও চেষ্টা করেছিল।”

“তারপর?” অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আইকা।

মেসো হেসেছিল শান্তভাবে। তারপর বলেছিল, “নোঈ না চাইলে ওর বিয়ে কেউ দিতে পারবে না।”

“আর ইউ ইন আ হারি?” রুপিন ফাইল থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন।

আইকা বাঁ হাতের ঘড়িটা ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, “একটু স্যার। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে।”

“ও, ইজ় দ্যাট সো!” রুপিন ফাইলটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে নিয়ে বললেন, “আমি তা হলে ব্যাপারটা ছোট করে বলি। কাল ডিটেলে ডিসকাস করব। কেমন?”

আইকা মাথা নাড়ল। আসলে ক্লান্ত লাগছে ওর। রুপিনের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আবার অন্যদিকে বাড়িতে গিয়ে ওইসব পাত্রী দেখার মধ্যেও পড়তে ইচ্ছে করছে না। একবার খ্যাপাটে চিন্তা এল মাথায়। ভাবল সব উচ্ছন্নে যাক! একবার কি ঋষিকে ডেকে নেবে? কিন্তু সেটাও ভাল লাগছে না। ছেলেটা শরীর নিয়ে বড্ড হামলে পড়ে! বিরক্ত লাগে।

“শোনো,” রুপিন বললেন, “এবার আমরা ডিপার্টমেন্টাল কিছু রদবদল করব। ম্যানেজমেন্ট চাইছে যাতে লোকজন স্ট্যাগন্যান্ট না হয়ে পড়ে! সেই জন্য তোমায় আমরা স্টোর থেকে সরিয়ে নিয়ে ফিল্ডে প্লেস করব! আমাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য যে জমি বা বাড়ি অ্যাকোয়্যার করতে হয়, সেটার চার্জে তোমায় রাখা হবে।”

“আমায়?” একটু অবাক হল আইকা।

“হ্যাঁ, ইটস আ প্রোমোশন আইকা। ইনক্রিমেন্ট, ফেসিলিটিস, সব পাবে। প্লাস লাস্ট দু’বছর আগে তুমি তো বলেইছিলে তোমায় ফিল্ডে দিতে। এবার সেটা হয়েছে। দিনকে দিন কমপিটিশন বাড়ছে। ফলে টাফ হচ্ছে ল্যান্ড পাওয়া। কোম্পানি তোমার পারফরম্যান্সে খুশি। তাই তুমি এটা দেখো। কেমন? আমি আনঅফিশিয়ালি জানালাম। দু’দিনে ইট উইল বি অফিশিয়াল। তুমি এই দু’দিনে তোমার নেক্সট ম্যান চঞ্চলকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ো।”

আইকা হাসল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আই উইল।”

“ইউ মে টেক ইয়োর লিভ। আজ এটুকুই।”

রুপিন বাড়তি কথা খুব একটা বলেন না। আজও বললেন না। পেনটা খুলে আবার ডুবে গেলেন ফাইলে। খুব মৃদু স্বরে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এসি-র গুঞ্জন। স্তব্ধতা।

আইকা ঘরের বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল। আজ ওর প্রোমোশন হল। খুব ভাল খবর। কিন্তু ওর তেমন একটা ভাল লাগছে না কেন? ওর মনটা কেমন যেন সেই নেতিয়েই আছে। মনে হচ্ছে কী হবে এসব নিয়ে? কাজে ডুবে থেকে সব কিছু ভুলে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু সেটা তো হল না। কেন হল না? কাজ কি তা হলে কিছুই ভরাট করতে পারে না?

ফ্ল্যাটের নীচে পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে আকাশটা দেখল আইকা। সন্ধে নেমে গিয়েছে। সাড়ে ছ’টা বাজে। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে আজ। যা ট্র্যাফিক! শহরটা আস্তে-আস্তে মজে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন থেমে আছে। সঙ্গে কেমন একটা বিজবিজে গরম পড়তে শুরু করেছে! শীতের শেষের এই সময়টা কেমন যেন শুকনো লাগে। আইকার ঠোঁটটা টানছে বেশ।

তবে ভরসা একটাই যে, নোঈকে দেখতে লোকজন এই সবে এসেছে। পুটুমাসি ফোন করেছিল আসার পথে।

গাড়িটার পেছনের সিট থেকে খাবারের বড় প্লাস্টিকগুলো নামিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল আইকা। তারপর রিমোট টিপে লক করে দিল গাড়ি।

“দিদি।”

আইকা ঘুরে দেখল, সুশান্ত। ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার। আইকা তাকাল।

“দিদি, একটু দরকার ছিল।”

“কী?”

“শ’তিনেক টাকা লাগবে। মানে, মেয়েটাকে একটু ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব।”

“কী হয়েছে?” আইকা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।

সুশান্ত ছেলেটা এই ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার। গ্যারেজ-স্পেসের পাশের একটা ঘরে থাকে। সঙ্গে ওর বউ আর বাচ্চা মেয়েও থাকে। মেয়েটা সত্যি খুব ছোট। বছরদেড়েক বয়স। ফরসা। গোলগাল। একমাথা কোঁকড়া চুল। আইকাকে খুব চেনে। দেখলেই হাত বাড়ায়। আইকার কী যে ভাল লাগে! মেয়েটাকে ‘মাগো’ নামে ডাকে আইকা। ছুটির দিনে বেশির ভাগ সময় নিজের কাছেই রাখে মাগোকে।

“জ্বর হয়েছে দিদি।”

“সে কী?” আইকা চোয়াল শক্ত করল, “তুই এখন বলছিস? কখন হয়েছে এটা?”

“বিকেলে দিদি,” সুশান্ত ঢোঁক গিলল।

“আর এখন বলছিস? মাকে বলিসনি কেন? আমায় ফোন করিসনি কেন? তোকে জুতোপেটা করতে হয় জানোয়ার!” আইকা চিৎকার করল। তারপর নিজেই দ্রুত হেঁটে গেল ওর ঘরের দিকে।

দরজাটা আলতো করে টানা ছিল। আইকা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। মাগো শুয়ে রয়েছে বিছানায়। চোখ বন্ধ। চড়াই পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দের মতো আলতো শ্বাস পড়ছে।

“মাগো!” হাতের প্যাকেট বিছানায় রেখে আইকা ঝুঁকে পড়ল।

মাগো ঘুমের মধ্যে চোখ খুলল আলতো। হাসল কি? তারপর নরম পালকের মতো হাতটা তুলে আইকার গালে রাখল।

আইকার জল এসে গেল চোখে। আচমকা, কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই জল এসে গেল। গলার কাছটা কেমন যেন দলা পাকিয়ে উঠল। ভীষণ টনসিলের ব্যথা গলা থেকে বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ল।

মাগো চোখ বন্ধ করে ফেলল আবার। আইকা সামলাল নিজেকে। কোন বন্ধন এটা? ওর কে হয় এই একরত্তি মেয়ে? কেন এমন বুকের ভেতর গোটা সমুদ্র নড়ে ওঠে এমন আলতো হাতের ছোঁয়ায়? নিভৃতে বসে আসলে কে ছোঁয় আইকাকে?

আইকা ব্যাগটা খুলে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে তাকাল সুশান্তর দিকে। তারপর চাপা গলায় বলল, “যা এখুনি। আর ফিরে এসে জানাবি আমায় কী হল।”

লিফ্‌টে উঠে চোখ বন্ধ করল আইকা। গালটা এখনও শিরশির করছে! মাগোর হাতের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। পালকের মতো হালকা, ঠান্ডা একটা স্পর্শ! গলার কাছটা ব্যথা করছে আইকার। কষ্ট হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আর কতদিন এই পিঁপড়ের মতো জীবন? আর কতদিন এভাবে এক গর্ত থেকে আর-এক গর্তে দৌড়ে বেড়াবে ও? কোথায় এর শেষ! প্রতিটা দিনের শেষে কি ওর জন্য কোনওদিন এমন স্পর্শ অপেক্ষা করবে না!

শুভর মুখটা মনে পড়ল ওর। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। শুভকে কি ও সত্যি কোনওদিন ভালবেসেছিল?

ছ’তলার করিডরে বেরিয়ে নিজেকে ঠিক করল আইকা। পুটুমাসি আর ওদের ফ্ল্যাট দুটো পাশাপাশি। কিন্তু আইকা জানে মা পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটেই আছে।

পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটের দরজাটা বেশ সুন্দর। কাঠের ওপর কাস্ট আয়রনের ছোট ছোট মূর্তি বসানো। দরজার ওপরে একটা ছোট্ট উইন্ড-চাইম ঝুলছে। পুটুমাসির ফেং-শুইয়ে খুব ভরসা। আসলে রাঙামেসোর ওপরে ছাড়া পুটুমাসির সব কিছুতেই ভরসা। জ্যোতিষ থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক— শুনলেই হল, পুটুমাসি ছুটবে! মাকেও ট্যাঁকে করে নিয়ে যায়। রাগ হয় আইকার। মাকে বারণ করে, কিন্তু মা শোনে না। বলে, “পুটু জোর করে, কী করব!” কিন্তু আসল ব্যাপারটা অন্য বলে মনে হয়। আইকার মনে হয়, মা নিজেও ক্রমে-ক্রমে এসবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। শুধু ওর ভয়ে কিছু বলে না।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে নিল আইকা। ঘরে বাইরের লোকজন রয়েছে। অফিস থেকে তো বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছে! তাও হাত দিয়ে যেটুকু সামাল দেওয়া যায় আর কী।

ডোরবেলটা বাজিয়ে একটু সরে দাঁড়াল আইকা। হাতের প্যাকেটে খাবার আছে। এগুলোকে সাজিয়ে দেওয়াটা ওকেই মনে হয় করতে হবে। এত খাবারের কী দরকার, আইকা বোঝে না! পুটুমাসি এত বাড়াবাড়ি করে না!

সকালে শুনেছিল পুটুমাসি মাকে বলছে, “এমন পাত্র হাতছাড়া করলে হবে না বুঝলি। যেভাবেই হোক একে জামাই করতে হবে! মেয়েসন্তান। কখন যে কী হয়!”

কথাটার মধ্যে এমন একটা দৈন্য ছিল যে, আইকার কেমন যেন গা ঘিনঘিন করছিল! নোঈ খুব ভাল মেয়ে। লেখাপড়াতেও খুব ভাল। এম কম করেছে। চাকরি করছে একটা ফার্মে। ঠিক সময়ে নিজে যখন বুঝবে পছন্দ করে বিয়ে করবে। কিন্তু এই যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া! এই যে মেয়ে বলে, তার শরীরে আর মনে একটা রেগুলেটর বসিয়ে দেওয়া, এটা ভাবলেই মাথায় আগুন জ্বলে আইকার! বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে আর ওকে তো কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি! আর সেটা হয়েছে ওরা দু’জন মেয়ে বলেই।

দিনকে দিন পুটুমাসি কেমন যেন হয়ে উঠছে। এত ডেসপারেশন কীসের? বিয়ে করে কী মোক্ষ লাভ হবে? আর ‘মেয়েসন্তান! কখন কী হয়!’ এসবের মানে কী? যত্তসব রিগ্রেসিভ ধারণা!

আইকার মনে হচ্ছিল, একবার গিয়ে চেপে ধরে পুটুমাসিকে। কিন্তু শেষে মত বদলেছে। মা বলে, “পুটু ওরকম। পাগলি। ছোট থেকেই পাগলি। ওর কথা ধরবি না! ওর মনটা খুব ভাল!”

মনটা খুব ভাল হওয়া যেমন জরুরি, তেমন কথাবার্তাগুলো ঠিক হওয়াও জরুরি। আমাদের দেশে, ‘ওর মন ভাল’ এই দোহাই দিয়ে অনেক লোকের খারাপ ব্যবহারকে পাশ নম্বর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে!

মা এসে দরজাটা খুলে দিল। আইকা ঘরে ঢুকে একটু দাঁড়াল। মা আইকার হাত থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে বলল, “তুই আজকে না এলেও পারতিস!”

আইকার ভুরু কুঁচকে গেল। মা এমনভাবেই কথা বলে রেগে গেলে।

মা বলল, “যা গিয়ে বোস ওখানে। তিনজন এসেছে। পাত্র আর সঙ্গে দু’জন। ওখানে রাঙাদা আছে। পুটুও আছে। তবে নোঈ এখনও ওদের সামনে যায়নি! তুই গিয়ে বোস। কেমন ছেলে ভগবান জানে! তিন বামুনে কখনও মেয়ে দেখতে আসে!”

আইকা ভাবল একবার বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেবে। কিন্তু তারপরেই মত বদলাল। কী হবে? ওর তো বিয়ে নয়!

ও জুতোটা খুলে বসার ঘরের দিকে এগোল।

ঘর থেকে পুটুমাসির গলা পাওয়া যাচ্ছে! ও দেখল সোফায় বসে রয়েছে তিনজন। দু’জনকে পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে আর একজনের মাথার পেছনটা দেখা যাচ্ছে।

আইকা গিয়ে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। পুটুমাসি কিছু বলছিল। কিন্তু এবার থমকাল। তাকাল ওর দিকে। সেই সঙ্গে বাকিরাও তাকাল। আইকা দেখল ওর দিকে পেছন করে বসে ছিল যে-মানুষটি, সেও মাথা ঘোরাল!

আর সঙ্গে-সঙ্গে দূরে, বহুদূরে কোথায় যেন একটা বরফের পাহাড় ভেঙে পড়ল। আর তার শব্দে শরীরের ভেতরটা নড়ে উঠল আইকার!

ও দেখল মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে উনিশ বছর আগে ফেলে আসা একটা সময়! অতীতে ফেলে আসা এক জীবাশ্ম! ওর মনে হল, ওই বিকেলেই ওর কথা মনে হয়েছিল না!

.

০৪. নিশান

“তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম। তোমার শব্দের মধ্যে আমার মাতৃভাষা। তোমার বুকের নীচে বয়ে চলা জলধারা থেকে জল পান করে আমার মৃতপ্রায় সব হরিণেরা। তুমি ছিলে তাই আমিও আজ দাঁড়িয়ে রয়েছি এই বকুলবীথিতে। তুমি শ্বাস নাও তাই গাছ হাওয়া পায়। মেঘ বয়ে যায় নদী থেকে আকাশের দিকে। তুমি স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাও তাই গাছেরা ফুল ফোটায়। মৌমাছি জমিয়ে তোলে বিন্দু বিন্দু মধু। তুমি চোখ মেলে আকাশ দেখো, তাই গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষায় পৌঁছতে পারে প্রকৃতি। তুমি গান গাও তাই পাখি ডাকে, মাঝি নৌকো বায়, শিশুরা মায়ের স্তন্য খুঁজে নেয় আলগোছে। তুমি হাসো, তাই হারানো বন্ধু ফিরে পায় মানুষ। পাথর হয়ে যাওয়া বুক ফাটিয়ে আলোর দিকে হাত বাড়ায় ফুলগাছ। নতুন ভাতের গন্ধে দৃষ্টি ফিরে পায় অন্ধ ভিক্ষুক। তুমি ছিলে তাই সুর পাঠালেন ঈশ্বর। তুমি ছিলে তাই স্তব গেঁথে রাখলেন বৈদিক ঋষি। তুমি ছিলে তাই অন্ধকার আকাশ ভেঙে প্রতিদিন তোমায় দেখবে বলে উঠে আসেন অর্কদেব। আজ তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম। আজ তোমার আনন্দের মধ্যে আমার জীবন্ত হয়ে ওঠা।”

ঘরটা ছোট। আবছায়া। একটুকরো জানলা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে অর্ধেক মুখে। গালের ওপর পড়ে রয়েছে দু’-চারটে অন্যমনস্ক চুলের রেশম। নরম আলোয় দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো। বাইরের দিকে, আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা পাথর রঙের চোখ দুটো।

মেঘলা প্রায়ই বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে এভাবে। গঙ্গার পাশেই ওদের এই ছোট বাড়ি। ইটের দেওয়াল। মাথার ওপর টালি দেওয়া। মেঘলার বাবা মানিক ভটচাজ পুজোআচ্চা করতেন। এখন আর নেই। মারা গিয়েছেন। মেঘলার এক বড় দাদা রয়েছে। নাম বাদল। কিন্তু বর্তমানে ও জেলে। ওয়াগন ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। দু’বছরের জেল হয়েছে ওর। সারা দিন বাড়িতে মা আর মেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে নিশান যায় ওদের বাড়িতে। এমনিই যায়। কারণ নেই।

ওদের ঘরে গিয়ে চৌকিতে একটু বসে। তেল-মুড়ি মাখা খায়। দু’-চারটে কথা বলে। তারপর উঠে আসে।

বাদল আর নিশান একসঙ্গে পড়ত। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির পরে বাদল আর পড়েনি। নিশান যখন কলেজে ভরতি হয়েছিল, তখন বাদল বালুরঘাটে তেলের ডিপোয় কাজ নিয়ে ঢুকে পড়ে!

মেঘলাকে ছোট থেকে চেনে নিশান। মেয়েটা চোখে দেখতে পায় না। মাথাটাও মাঝে মাঝে ভারসাম্য হারায়। তখন মেঘলা খুব চিৎকার করে। হাত-পা ছোড়ে। আঁচড়ে-কামড়ে দেয়। কিন্তু তারপর আবার যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন দেখলে বোঝাই যায় না মেঘলার কোনওদিন কোনও অসুখ ছিল।

নিশান আজ দুটো নারকেল নিয়ে এসেছে। ওদের বাড়িতে চারটে নারকেল গাছ এখনও অবশিষ্ট আছে। বাবা সেখান থেকে নারকেল পাড়িয়েছে আজ দুপুরবেলা। তখনই মা বলেছিল মেঘলাদের বাড়িতে যেন দুটো নারকেল নিয়ে যায়!

সাইকেলের ক্যারিয়ারে দড়ি দিয়ে বেঁধে এনেছে নিশান। কাকিমা অর্থাৎ মেঘলার মা খুশি হয়েছে খুব। বলেছে, নারকেলের যা দাম, কিনে খাওয়ার কথা আর ভাবে না।

সোনাঝুরির একপাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। মোহনার কাছাকাছি বলে নদী এখানে বেশ চওড়া, কিন্তু তার গতি বেশ মন্থর।

মেঘলাদের বাড়িটা নদীর একদম পাড়েই। খুব বৃষ্টি হলে, নদীর জল এসে ওদের উঠোন ডুবিয়ে দেয়।

এখানে আসতে খুব ভাল লাগে নিশানের। সবসময় সুন্দর একটা হাওয়া দেয়। ঘর থেকে বসে জাহাজ দেখা যায়। তার সঙ্গে চারপাশ কী নির্জন। কানে বাতাসের শব্দ এসে লাগে।

মেঘলা সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। নিশানের এনে দেওয়া ব্রেইলের কিছু বই পড়ে। নিশান চেষ্টা করছে ওকে কিছু একটা কাজ জোগাড় করে দিতে। মাঝেরহাটের কাছে একটা দৃষ্টিহীন বাচ্চাদের স্কুল আছে। সেখানে মেঘলার একটা চাকরি করে দেওয়ার চেষ্টা করছে নিশান। জানে না পারবে কি না!

আসলে নিশান সকলের জন্য চেষ্টা করে। বাবা বলে, “শুধু নিজের জন্য কিছু করলি না। অপোগণ্ড একটা!”

নিশান হাসে মনে মনে। নিজের জন্য বলতে কী বোঝায়? টাকা রোজগার? তা টাকা ওদের কম কিছু নেই। সোনাঝুরিতে ওদের বড় তেলকল আছে। জমি আছে। দশ ঘর ভাড়াটে আছে। টাকার অভাব তো হওয়ার নয়। তা হলে কেন বলে বাবা? তেলকলে বসে না বলে? মাস গেলে ঘুরে-ঘুরে ভাড়া তোলে না বলে? হবে হয়তো। এই পৃথিবীতে কেউ টাকা রোজগার না করতে পারলে তাকে সকলে অপোগণ্ড বলে দাগিয়ে দেয়!

নিশান ভাবে এমন অপোগণ্ডই ভাল। কবিতা লেখা, কবিতা-পত্রিকা করা, রাজনীতি করা আর দায়ে-দরকারে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে ও খারাপ তো নেই।

দরজায় শব্দ হল এবার। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল নিশান। মেঘলা জানলা থেকে মুখ না সরিয়ে বলল, “মা, এসেছে।”

নিশান হাসল নিজের মনে। মেঘলা এমন হঠাৎ হঠাৎ কিছু না দেখেও সঠিক বলে দিতে পারে!

কাকিমা ঘরে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে বলল, “তোকে বাবু একটু মুড়ি মেখে দিই? টকঝাল চানাচুর আছে আজ। দেব?”

নিশান বলল, “না কাকিমা, আজ খাব না। দেরি করে খেয়েছি দুপুরে। তারপর কেমন যেন অম্বল হয়ে গিয়েছে।”

“জোয়ান দেব একটু?” কাকিমা উদ্বিগ্ন হল।

নিশান জানে এই উদ্বেগটা লোক দেখানো নয়। কাকিমা সকলের জন্য ভাবে। করেও। পাড়ায় যার যা দরকার তাতেই ছুটে যায়। সাধারণত কোনও বাড়ির ছেলে জেলে গেলে তাদের একঘরে করে রাখা হয় এলাকায়। কিন্তু কাকিমার এই পরোপকার করার স্বভাবের জন্য কেউ ওদের খারাপ চোখে দেখে না। বরং প্রতিবেশীরাও নানাভাবে কাকিমাদের পাশে দাঁড়ায়।

মেঘলা যখন মাঝে মাঝে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে, পাড়ার লোকজনই তো আসে সামলাতে। না হলে কাকিমার একার সাধ্য কী মেঘলাকে সামলায়!

“কী রে বাবু, দেব একটু জোয়ান?”

নিশান বলল, “দাও। আর-একটা কথা, তুমি কি গিয়েছিলে বাদলের কাছে?”

কাকিমা সামনের একটা ছোট্ট তাক থেকে জোয়ানের শিশিটা পাড়ল। তারপর সেটা এনে এগিয়ে দিল নিশানের দিকে। বলল, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম গতকাল।”

নিশান শিশির মুখটা খুলে অল্প একটু জোয়ান ঢেলে নিল হাতে।

“দাও,” নিশান দেখল, বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই ওর দিকে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে মেঘলা।

“আবার বাঁ হাত?” কাকিমা সামান্য বকুনি দেওয়ার গলায় বলল, “কতবার বলেছি এমন করে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিবি না! বাঁ হাতে কেউ কিছু নেয়! ডান হাতে নিবি।”

মেঘলা শুনল না। বরং বাঁ হাতটা অধৈর্যের সঙ্গে নাড়িয়ে বলল, “দাও, দাও, দাও।”

নিশান আলতো করে হাত ধরল মেঘলার। তারপর জোয়ান ঢেলে দিল হাতের পাতায়।

মেঘলা হাতটা টেনে নিল এবার। তারপর বলল, “খাবারের নাম জোয়ান! আচ্ছা বৃদ্ধ বলেও কি কোনও খাবার হয়?”

কাকিমা এর উত্তর দিল না। বরং আগের কথার খেই ধরে বলল, “আর বলিস না বাবু, ছেলেটা রোগা হয়ে গিয়েছে!”

নিশান কী আর বলবে! ও চুপ করেই থাকল। ও নিজেও কয়েকবার গিয়েছে বাদলকে দেখতে। আলিপুর জেলে আছে। খুবই খারাপ অবস্থা! প্রথমত, দেখা করাটাই ঝক্কির। তারপর ভেতরে ঢুকলেও হাজারটা ঝামেলা। ছোট জালের ওপার থেকে সকলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলাও দুষ্কর।

কাকিমা বলল, “জানিসই তো টাকাপয়সা দিতে হয়। আমাদের তো এই অবস্থা! কোথা থেকে মাসে মাসে ওকে এত টাকা দিই বল তো!”

নিশান দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাথা নামাল। ও নিজে যে ক’বার গিয়েছে বাদলের সঙ্গে দেখা করতে, বেরিয়ে আসার পর ওর নিজেরই কেমন যেন অসুস্থ লেগেছে। আর ভেবেছে ওসব জায়গায় মানুষ থাকে কী করে! আমাদের দেশের এই জেলগুলোকে সংশোধনাগার বলা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, মানুষের কতটা সংশোধন হয় এখানে কে জানে।

কাকিমা এবার এসে বসল ওর পাশে, “বাবু, তুই বলেছিলি না, কিছু সেলাইয়ের কাজ জোগাড় করে দিবি? মনে আছে তোর?”

নিশানের মনে পড়ল। সত্যি কয়েকমাস আগে কাকিমাকে এটা বলেছিল বটে। বলেছিল, কাকিমাকে কিছু সেলাইয়ের কাজ জোগাড় করে দেবে।

সোনাঝুরির কাছেই হাকিমপাড়া। বহু পুরনো অঞ্চল ওই হাকিমপাড়া। ওস্তাগরদের পাড়া ওটা। সেখান থেকে সেলাইয়ের কাজ পাওয়া যায়।

নিশানের বন্ধু রহিমদের নিজেদেরই বড় দরজির ব্যাবসা আছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জামাকাপড় সাপ্লাই করে ওরা। কাপড় আর ডিজ়াইন পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওদের। রহিমরা সেলাই করে ফিনিশড গুডস পাঠিয়ে দেয়।

তাতে বাচ্চাদের জামা থেকে শুরু করে জিন্‌সের প্যান্ট সব থাকে।

রহিমরা নিজেরা জামাকাপড় সেলাই করলেও জামাকাপড়ের লেবেলগুলো আশপাশ থেকে পার পিস হিসেবে সেলাই করিয়ে নেয়।

ঠিকমতো করতে পারলে মাসে হাজারদুয়েক টাকা রোজগার করাই যায়। নিশান জানে কাকিমাদের কাছে সেটাই বড় ব্যাপার।

কাকিমা বলল, “বুঝিসই তো দিনকাল। তোর কাকুর আর ক’টা টাকা জমানো আছে বল! যদি পাওয়া যেত!”

নিশান হাসল সামান্য। জোয়ানটা চিবিয়ে সামান্য রস গিলে নিয়ে বলল, “তুমি মনে করিয়ে দেবে তো! রহিমকে বললেই হবে। আমি ঠিক ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু চোখের খুব স্ট্রেন হয়। ওটা দেখো। বুঝেশুনে কাজে নেমো!”

কাকিমা হাসল, “আর ওসব ভাবার সময় নেই বাবু। টাকার দরকার রে। বাদলটা যে কী করল! জানি না কী হবে! তুই একটু দেখিস।”

“কী দেখবে?” আচমকা জানলার দিক থেকে মুখ ঘোরাল মেঘলা, “খুব মাগুনে বুড়ি হয়েছ তো! অতই যদি তোমার টানাটানি থাকে রোজ মাছ করো কেন? কেন গন্ধসাবান কেনো? কেন পোস্ত খাও? আর নিজের অপদার্থ ভাইদের হাতে টাকা গোঁজো কেন তুমি? তারা তো সব জুটমিলে কাজ করে। তাও তোমার কাছে এসে নাকে কাঁদে কেন? আর তুমিই-বা তাদের হাতে টাকা দাও কেন? জানো না, তোমার দুই ভাই-ই লম্পট! মাতাল! যার নিজের পায়ের তলায় মাটি নেই, সে কী করে অন্যকে টেনে শক্ত মাটিতে দাঁড় করাতে চায়! নিশানদা এলেই তুমি বারবার বলো এটা চাই, ওটা চাই। আর নাকে কাঁদো। এসব অসহ্য লাগে আমার। বিরক্তিকর লাগে। একদম এসব করবে না।”

কাকিমা চুপ করে গেল আচমকা। নিশানও থমকে গেল। এই মেঘলার বিপদ! কখন যে কী বলে বসবে! কী করবে তার ঠিক নেই। একটু আগে কী বলছিল, আর এখন কী বলছে! ওর লজ্জা লাগল খুব। কাকিমার মুখটা অপমানে কালো হয়ে গিয়েছে। নিশানের মনে হল একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এইসব অবস্থায় বসে থাকাও বিড়ম্বনার।

কাকিমা কোনওমতে বলল, “তুই চুপ করবি!”

“কেন চুপ করব?” এবার ঘুরে বসল মেঘলা, “আমায় চুপ করাতে চাও কেন সবাই মিলে? কী হবে চুপ করিয়ে? আমি চুপ করে থাকলে সত্যিটা কি মিথ্যে হয়ে যাবে? বাবাও তোমায় এই নিয়ে বলত। এগুলো শোনো না কেন? আর নিশানদা কত করবে? তোমার অপদার্থ ছেলেকে সারাজীবন লাই দিয়ে গেলে। লেখাপড়া করল না। বাবা যখন বকত, তুমি বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে। বাবার কাছ থেকে দাদার অন্যায়গুলো লুকিয়ে রাখতে। যখন লেখাপড়া ছেড়ে দিল, তখন কিছু বললে না। তারপর যখন চুরির টাকা এনে তোমার হাতে দিত, তখন বাবাকে বলতে বাবার মুরোদ নেই এত টাকা আনার। আর এখন এসব নাকে কাঁদছ। বাবা মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে।”

“তুই চুপ করবি!” এবার কাকিমাও তেড়ে উঠল, “খুব চোপা হয়েছে না তোর? দিনকে দিন বাড়িতে বসে গিলে-গিলে খুব চোপা হয়েছে? একপয়সা রোজগারের মুরোদ নেই আবার কথা!”

মেঘলা হাসল সামান্য। তারপর বলল, “সেই তো, অন্ধ মেয়ের রোজগারের দিকে তাকিয়ে আছ এখন! কিন্তু কী করব বলো তো? আমায় তো এভাবেই পয়দা করেছ।”

কাকিমা এবার চাপা গলায় চিৎকার করল, “চুপ করবি তুই! এসব কী বলছিস? জানোয়ার হয়ে গিয়েছিস পুরো! তুই চাস আমি মরে যাই?”

মেঘলা, নদীর পাথরের মতো চোখগুলো তুলে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, “তুমি মরে গেলে তো তোমার ভাইদের অসুবিধে হবে। নিজের সোনার চুড়িও তো গতমাসে তোমার নবাবপুত্তুর ছোটভাইকে দিয়েছ। আমি জানি না? আমার চোখ নেই, কিন্তু কান তো আছে! নাকি সেটাও নেই ভাবো?”

“মুখপুড়ি, তোর এতবড় জিভ হয়েছে! আমার জিনিস যাকে খুশি দেব। তোর কী?”

“দাও, সব দিয়ে দাও! আর লোকের কাছে নাকে কাঁদো। ভিক্ষে করো। এরপর আর কাকে-কাকে বলবে আমি দেখব,” মেঘলা আচমকা গলা চড়াল এবার।

“আঃ, মেঘলা!” নিশান আর পারল না। চিৎকার করে উঠল, “চুপ করবি তুই? এসব বলছিস কেন? কাকিমা আমায় আগেই বলেছিলেন তো! আর আমাকেই তো বলছেন! তুই এমন করে অসভ্যতা করছিস কেন রে?”

মেঘলা আবার জানলার দিকে মুখ ফেরাল। নিশান জানে জানলার বাইরে শুধু অন্ধকার এখন। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গঙ্গায় শুধু দু’-চারটে নৌকো ভাসছে। আর আলো বলতে তাদের গলুইয়ের নীচে জ্বলা আগুন। মাঝিরা রান্না করছে। বাকিটা অন্ধকার। তবু ওই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কী দেখতে চায় একটা মেয়ে? কাকে দেখতে চায় নিজের অমন দৃষ্টি দিয়ে?

নিশানের বকুনি খেয়ে মেঘলা চুপ হয়ে যাওয়ায় ঘরের ভেতরটা আচমকা নিঝুম হয়ে গিয়েছে। নদী থেকে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে শুধু। মাথার ওপর পুরনো দিনের ডিসি পাখা শব্দ করে ঘুরে চলেছে। দাঁত-নখ বের করা স্বরযুদ্ধের পরের নিস্তব্ধতা তুচ্ছ শব্দদেরও প্রকট করে দিচ্ছে এখন।

নিশানের খুব অস্বস্তি হল। মনে হল উঠে চলে যায়। মেঘলাটা কীসব বলে না মাঝে মাঝে! হ্যাঁ, সবাই জানে যে, ওর মানসিক অবস্থা আর-পাঁচজনের মতো নয়। কিন্তু সারাক্ষণ তো আর সেসব মনে রাখা যায় না। অভাবের সংসার শুধু তো ভাতের হাঁড়িতে টান দেয় না, মনের ভেতরেও একটা ক্লান্তি আর অসহিষ্ণুতা তৈরি করে! কাকিমার রেগে যাওয়াটা তাই বুঝতে পারে নিশান।

কাকিমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। জলাফটক এই সোনাঝুরি থেকে সাইকেলে মিনিট চল্লিশেক দূরে। কাকিমার ভাইরা সেখানেই থাকে। বাদলের সঙ্গে ওই বাড়িতে কয়েকবার গিয়েওছে নিশান। মাটির বাড়ি। তাও ভাঙাচোরা। কাকিমার দুই ভাই জুটমিলে কাজ করলেও তিন-চারটে করে ছেলেপুলে দু’জনের। তাই ওদের সংসার সারাক্ষণ ঘাটতিতে চলে। ফলে দায়ে-দফায় দিদির কাছে এসে হাত পাতে দু’জনে। কাকিমার মনটা নরম। ফেরাতে পারে না কাউকে।

নিশান বোঝে সমস্যাটা। কিন্তু এটাও ভাবে যে, সারা জীবন যদি কেউ সেভাবে পরিশ্রম না করে কেবল নাকে কেঁদে কিছু পেয়ে যায়, তা হলে একটা সময় পর সেটাই তার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়।

নিশান ঘড়ি দেখল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। এবার উঠতে হবে। পার্টি-অফিসে একবার যেতে বলেছে বিজনদা। কীসব দরকার আছে! বিজনদার কথা খুব মানে নিশান।

বিজন সরখেল অকৃতদার মানুষ। ভাঙা রেললাইনের পাশে একাই থাকেই পার্টি-অফিসের পাশের একটা ছোট বাড়িতে। ইট বের করা, মাথার ওপর টালি দেওয়া বাড়িটায় গিয়েছে নিশান। বড় রাস্তা থেকে ভাঙা রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে হয় কিছুটা!

চ্যাটার্জিপাড়ায় বিজনদাদের বড় বাড়ি থাকলেও লোকটা কেমন একা সন্ন্যাসীর জীবন কাটায়! খুব অবাক লাগে নিশানের! এমনও কেউ পারে! এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন কেউ আছে, যার কিছু দরকার নেই! বিজনদা নিজেই রান্না করে। সাতষট্টি বছর বয়সেও লোকটা এখনও মজবুত খুব। চোদ্দো বছর বয়স থেকে পার্টির হয়ে কাজ করছে এই অঞ্চলে। সকলে এক ডাকে বিজনদাকে চেনে।

নিশান জানে ওকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসে বিজনদা। জুটমিলটায় প্রায়ই নানা ঝামেলা লেগে থাকে। এখনও চলছে। ইউনিয়নটা নিশানদের পার্টির দখলে। তাই দায়িত্ব ওদের বেশি। বিরোধীরা তো একটা করে নতুন ইসু তৈরি করতেই থাকে। নিশানদের নেতা তারক চক্রবর্তী। বাবার পরিচিত এই লোকটা। তবে সুবিধের লোক নয়। বিজনদার চেয়ে জুনিয়র হয়েও পার্টিকে ধরে এখানে মগডালে উঠেছে! তবে ও দেখেছে, এই নিয়ে বিজনদার কোনও ক্ষোভ নেই! আর এ-ও দেখেছে, তারকদাও বিজনদার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে যায় না!

“কাকিমা, আমি হাকিমপাড়ার ওদের সঙ্গে কথা বলব। তুমি ভেবো না,” নিশান উঠে দাঁড়াল।

কাকিমা মুখ তুলে তাকাল নিশানের দিকে। চোখে জল টলটল করছে। খারাপ লাগল নিশানের। মেঘলা কী যে করে না!

কাকিমা বলল, “আমি আর কী বলি তোকে? দেখলি তো সব! শুনলি তো! নিজের মেয়ের কাছ থেকে এসব শুনতে হয়। মায়ের পেটের ভাই আমার। এসে এমন করে কথা বলে! ওদের বাচ্চাগুলো খেতে পায় না। সব শুনে কী করে চুপ করে থাকি বল?”

নিশান জোর করে হাসার চেষ্টা করল। পরিস্থিতিটা দমচাপা হয়ে আছে। ও বলল, “আরে, ছাড়ো না। আমি জানি তো। প্লাস মেঘলাকেও তো চিনি। তুমি এসব ভেবো না।”

নিশান এবার মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই, আমি আসি। মাথা ঠান্ডা রাখ। বুঝলি?”

মেঘলা ওর দিকে তাকাল না। কিন্তু তাও ওকেই জিজ্ঞেস করল, “‘তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম’— এমন লেখা আর লেখো না কেন নিশানদা? কবে পড়ে শুনিয়েছিলে, আমার আজও মনে আছে। তেমন কিছু লেখো না কেন?”

নিশান থমকে গেল। সেই তেইশ-চবিবশ বছর বয়সের লেখা। তখন এসে মাঝে মাঝে মেঘলাকে পড়ে শোনাত ও। এই অংশটা বারবার শুনতে চাইত মেয়েটা। সেটা এখনও মনে আছে দেখে আজ অবাকই হয়েছিল ও।

নিশান হাসল। বলল, “বয়সের সঙ্গে তো চিন্তাও পালটায়, তাই না?”

মেঘলা বলল, “তাও ওরকম লিখো আবার। ওরকমটাই শুনতে ভাল লাগে।”

নিশান “আসি,” বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

জীবনে অনেক কিছু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কী করে যেন আবছা হয়ে মিলিয়ে যায়। হারিয়ে যায় অজানা বাঁকে। আজকাল নিশানের যেন মনেও পড়ে না ও এমন লিখত। সেই নিশানটা যেন এই নিশান নয়!

সাইকেলটা রাখা ছিল উঠোনের পাশে। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। তবে রাস্তায় আলো আছে। তার সামান্য ভাঙাচোরা টুকরো এসে পড়েছে এই জায়গাটায়।

সোনাঝুরির মূল টাউনশিপটায় এখন আলোর বন্যা। কিন্তু এমন গলিঘুঁজি বা ব্যাক পকেটের মতো জায়গাগুলোয় এখনও চল্লিশ পাওয়ারের স্ট্রিট বাল্‌ব ঠিলঠিল করে জ্বলছে!

গেট পেরিয়ে সাইকেলে উঠল নিশান। রাস্তাটা কংক্রিট করা। কিন্তু জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। আবছা আলোয় সবটা স্পষ্ট নয়। রাস্তার দু’পাশে ঝোপ। ঝিঁঝি ডেকে চলেছে টানা। মাঝে মাঝে দু’-একটা ছোট বাড়ি আর তার জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলোয় পুরো জায়গাটাকেই ভুতুড়ে লাগছে নিশানের। ও সাবধানে প্যাডেল করতে লাগল।

রাস্তাটা সোজা গিয়ে বাঁধের ওপর উঠেছে। তারপর বাঁধটা টপকে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে মূল শহরের ভেতর।

বাঁধ টপকালেই ঘন জনবসতি। বহুব্রীহি ক্লাব। পুরনো গলি। মরচে পড়া বাড়িঘর। আধা ঝিম-ধরা দোকানপাট। আর তারপরেই সোনাঝুরির বড় রাস্তা। ওদের পার্টি অফিস ওই রাস্তা দিয়ে সোজা অনেকটা গিয়ে ভাঙা রেললাইনের পাশে।

বাঁধের ওপর সাইকেল নিয়ে উঠে একটু থমকাল নিশান। আরে, মণীশ আসছে না!

মণীশ ছেলেটা ভাল ফুটবল খেলে। বয়স কম। আঠারো-উনিশ মতো। কলকাতার একটা সেকেন্ড ডিভিশনে খেলছে এখন। তবে নিশান নিশ্চিত, বড় ক্লাবেও ও খেলবে। ছেলেটা একটু রগচটা ধরনের আছে। কিন্তু মনটা ভাল। বিজনদা বেশ কয়েকবার নিশানকে বলেছে, মণীশকে পার্টি অফিসে নিয়ে আসতে। নতুন রক্ত না আনলে তো আর দল বাঁচবে না!

সবাইকে ডেকে-ডেকে পার্টিতে ঢোকানোয় বিশ্বাস করে না নিশান। ভাল লাগে না ওর। ইচ্ছের বিরুদ্ধে, অবলিগেশনে ফেলে কাউকে কিছু করানোর মানে হয় না। কারণ, তাতে আসল কাজটা হয় না। যেখানে মন, হৃদয় অনুপস্থিত সেখানে সবটাই ফাঁকি।

তাও বিজনদার কথা মেনে চলে বলে, মণীশকে পার্টির কথা বলে নিশান। অফিসে আসতে বলে। কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন পাশ কাটিয়ে যায়।

হ্যাঁ, ছেলেটা মণীশই তো! এই আলোছায়ার চেককাটা দৃশ্যের মধ্যেও ছেলেটার হেঁটে আসা দেখে ঠিক চিনতে পেরেছে নিশান!

সাইকেলে বসেই মাটিতে পা দিয়ে সাইকেলটাকে দাঁড় করাল ও। মণীশ কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে। বাঁ হাতে ফোনটা কানের সঙ্গে চেপে ধরে মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটছে ছেলেটা।

“এই মণীশ!” গলা তুলে এবার ডাকল নিশান। বাঁধ থেকে নেমে যাওয়ার রাস্তাটা সামনেই। মণীশ ওই দিকে বাঁক নিয়ে নিয়েছিল প্রায়।

আচমকা ডাকে থমকে দাঁড়াল মণীশ। কান থেকে বাঁ হাতটা সামান্য সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর আবছায়ার ভেতরে নিশানকে দেখতে পেয়ে থমকাল একটু। হাসল। ডান হাত তুলে এগিয়ে এল।

নিশানের সামনে এসে দাঁড়াল মণীশ। ফোনে বলল, “আরে, খেপ খেলবে না কেন? বলছি না একটা ম্যাচের জন্য দেড় হাজার টাকা দেবে। ধান্যকুড়িয়ায় যেতে হবে খেলতে। আমি তোমার কথা বলেছি মাহিরদা। বেকার ভয় পেয়ো না তো। পতাদা জানবে কেমন করে? আগেও দুটো চান্স ছেড়েছ। আর বলব না বলে দিচ্ছি।”

ওদিক থেকে কী উত্তর এল, বুঝতে পারল না নিশান। শুনল, মণীশ বলছে, “দূর বাবা, বলছি কালকের মধ্যে জানাতে হবে! বেকার নকশা মারাচ্ছ কেন? তবে এটাই লাস্ট চান্স। পতাদাকে অতই ভয় পেলে যাও পতাদার পা ধরে বসে থাকো। রাখছি।”

ফোনটা কেটে চার অক্ষরের একটা গালি দিয়ে নিশানের দিকে তাকাল মণীশ। বলল, “এই জন্য শালা লোকের উপকার করতে নেই! বারবার বলি খেপ খ্যালো, টাকা পাবে। টাকার দরকার, কিন্তু পেছনে যত রাজ্যের ভয়! কী না পতাদা নাকি বকবে। বেকার ভুঁড়িওয়ালা একটা পিস! এর আগেও দু’বার কথা দিয়ে আসেনি। আমার শালা ভাল লাগে না। যেচে কিছু করতে গেলে লোকে বিশাল ভাও খায়।”

নিশান হাসল। মণীশের মাথাটা গরম। মুখটাও খুব কিছু ভাল নয়। ছোট-বড় জ্ঞান নেই ওর। গালি দিতে পারলেই যেন বাঁচে। কিন্তু এই এবড়োখেবড়ো ছেলেটার ভেতরে অন্যের জন্য ভাল কিছু করার তাগিদ আছে। বিজনদার চোখ আছে। রগচটা ছেলেটার ভেতরে ভাল মানুষটাকে ঠিক চিনতে পেরেছে।

আসলে চারিদিকে তো কেবল মুখোশ পরা মানুষের ভিড় দ্যাখে নিশান। পাউডার-মাখা হাসি। টিপ-কাজল সাজানো ভালবাসা। ভুরু প্লাক করা বন্ধুত্ব। সকলেই সকলের প্রশংসা করছে। বাঁ হাতে ছোরা লুকিয়ে ডান হাতে পিঠ চাপড়াচ্ছে! কেউ আসলে আর সত্যিকারের ভালবাসছে না কাউকে। শুধু শপিং মলের মতো হাসিখুশি আর আলোময় মুখ নিয়ে একে-অপরের সামনে দাঁড়াচ্ছে। এর ভেতরে এই ধরনের মণীশরা ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছে, ঢেকে যাচ্ছে।

নিশান বলল, “এত ভাবিস কেন! কে কী করল, না করল, সেই নিয়ে উত্তেজিত হোস কেন তুই?”

“হব না?” মণীশ চোখ বড় করল, “জানো, মাহিরদা আমাদের টিমে খেলে। ডিফেন্স। বিশাল চেহারা। টেকনিক ভাল নয়, কিন্তু ডিফেন্ডার তো, তাই চেহারা দিয়ে পুষিয়ে দেয়। হয় বল যায়, নয়তো ম্যান যায়। দুটো একসঙ্গে যেতে দেয় না। স্টেশন মোড়ের বেণুবীণা ক্লাব আছে না, ওরা ধান্যকুড়িয়ায় খেলতে যাবে। জিতলে এক লাখ টাকা দেবে। বড় রুপোর কাপ দেবে। আরও নানা পুরস্কার আছে। ওরা আমায় কলকাতা থেকে তিনজন এনে দিতে বলেছে। একটা ডিফেন্ডার, একটা হাফ আর একটা স্ট্রাইকার। দেড় হাজার টাকা করে দেবে ম্যাচ পিছু। তাও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে খেলতে হবে। কিন্তু শালা ঢ্যামনামো করছে!”

নিশান হাসল, “তোর কী দরকার পড়েছে? আর প্লেয়ার নেই?”

“আরে বাবা, মাহিরদার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। একটা অসুস্থ ভাই আছে। মা আয়ার কাজ করে। মাহিরদা বেকার। বাবা তো নেই। নিজেই বলেছিল এসব। শুনলে কষ্ট লাগে না, বলো? পার ম্যাচ দেড় হাজার। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ফ্রি। আর ফাইনালে জিতলে বোনাস হিসেবে পাঁচ হাজার! লোকের শালা ভাল করতে নেই! এখন বলেছি, বলে পতাদা, মানে আমাদের কোচ, সে নাকি বকবে! ন্যাংটো খোকা আমার!”

“অত রাগ করতে নেই,” নিশান হাসল শব্দ করে, “সবাই একরকম হয় না। কিন্তু এভাবে একজন একজন করে আর কতজনকে হেল্‌প করবি! নিজে তো আর বাড়ি-বাড়ি এসব করতে পারবি না। মানুষের জন্য কাজ করতে হলে চাই ওয়ার্কফোর্স। চাই সংগঠন। সেটা পেলে তোর মতো ছেলেরা দেশে সোনা ফলাবে!”

মণীশ ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, “বিজনবুড়ো তোমায় ছেলেধরা বানিয়েছে, না?”

নিশান হাসল, “শোন, বিজনদা তো ফুটবল-পাগল, তোর খেলা পছন্দ করে। তোকেও খুব পছন্দ করে।”

মণীশ বলল, “পছন্দ করে মানে?”

“ওঃ, তোর খেলা পছন্দ করে। তোর অরগানাইজ়িং যে ক্যাপাসিটি, সেটা পছন্দ করে। গত ডিসেম্বরে রক্তদান শিবির করলি, সরস্বতী পুজোর সময় দুঃস্থ বাচ্চাদের বইখাতা দিলি। বিজনদা সব খেয়াল করেছে।”

“মহা কেলো তো!” মণীশ বলল, “আমি একা করেছি নাকি? আমাদের ক্লাব থেকে করেছে। আমিও ছিলাম। এই মাত্র।”

“যাই হোক, বয়স্ক মানুষ এত করে বলছেন। একদিন আয় না পার্টি অফিসে। কাছেই হুলোর চপের দোকান আছে। ব্যাপক ভেজিটেবল চপ বানায়। খেয়ে যাবি,” নিশান হাসল সামান্য।

মণীশ মোবাইলটা টিপে সময় দেখল, “ওরে বাবা, লেট হয়ে গিয়েছে। সামনে ইলেভেনের পরীক্ষা। দু’-দু’বার গাড্ডা মেরেছি। এবারও যদি মারি, বাপ লাথ মেরে গঙ্গায় ফেলে দেবে। আমি চলি নিশানদা।”

“আমি তোকে ছেড়ে দেব? কেরিয়ারে উঠে বোস।”

“দূর, ওই কেরিয়ারে কে বসবে!” মণীশ বিরক্ত হল, “শোনো, এখন সকলেই বাইক চালায়। পার্টি করে কী ছিঁড়লে? দ্যাখো না, পার্টিতে ঢুকেই গলায় সোনার চেন আর বাইক নিয়ে নেয় সবাই। সে শালা টিপছাপ থেকে এম এ পাশ সবার এক কেস। বাঙালির পাছা এখন সেনসিটিভ হয়ে গিয়েছে! তোমার সাইকেলের কেরিয়ার তার ভাল লাগবে না। আমরা বাইকের নরম গদিতে বসতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বুঝেছ?”

নিশান বলল, “তা হলে তুইও আয়। বাইক হয়ে যাবে তোরও।”

মণীশ আচমকা চোয়াল শক্ত করল। তারপর বলল, “শোনো নিশানদা, কারা তেল দেয় জানো? যাদের ট্যালেন্ট নেই। যাদের নিজেদের ওইখানে জোর নেই। আমার আছে। আমি নিজের রোজগারে বাইক কিনব। গাড়ি কিনব। অপদার্থ তেলখোর, চোর-চোট্টাগুলোকে তেল দিতে যাব না। বাই।”

নিশান জানে মণীশের কথাটা ঠিক। এই তেল দেওয়ার ব্যাপারটা এখন এমন একটা পর্যায় পৌঁছে গিয়েছে যে, ওর মনে হয় অধিকাংশ লোকের বোধহয় তেলের খনি আছে!

মণীশ যেতে গিয়েও থমকে গেল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা নিশানদা, জোনাক-বাড়ির কেসটা কী বলো তো!”

“জোনাক-বাড়ির আবার কী কেস?” নিশান অবাক হল।

“যা! তুমি জানো না? গতকাল বাবা জেঠুকে বলছিল। জোনাক-বাড়ি নাকি বিক্রি হয়ে যাবে! সত্যি?”

“দূর! অত পুরনো একটা ব্যারাক-বাড়ি, অত বড় জায়গা নিয়ে তৈরি! বিক্রি হয়ে যাবে বললেই হল? ওর ভেতরের বাগানে কত গাছ আছে দেখেছিস? প্লাস ওটা আমাদের সোনাঝুরির একটা আইডেন্টিটি!” নিশান পাত্তাই দিল না মণীশের কথার।

“তাই?” মণীশ কাঁধ ঝাঁকাল, “কে জানে! শুনলাম বলে বললাম। তোমরা পার্টির লোক। তোমরা তো জানবে। তবে ওই তারক চক্কোত্তি পারে না এমন কোনও কাজ নেই! পারলে গঙ্গাটাকে বিক্রি করে দেয়! শুনছি সোনাঝুরি জুট মিলটাকেও নাকি হুজ্জতি করে বন্ধ করে দিতে চাইছে। তারপর প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেবে। সত্যি?”

চোয়াল শক্ত করল নিশান। কথাটা ও নিজেও শুনেছে। পার্টির ভেতর এটা ওদের বলা হয়েছে যে, জুট মিল তুলে সেখানে নাকি আবাসন হবে। গঙ্গার ধারে বড়-বড় ফ্ল্যাট আর বাংলো হবে। কে জানে! তবে জুট মিল তোলা অত সহজ নয়। ব্রিটিশ আমলের মিল। মালিক গ্রুপ বহু দশক ধরে চালাচ্ছে। এখনও সাড়ে ছ’হাজার শ্রমিক আছে। এ তো আর ফুটে প্লাস্টিক পেতে বসা দোকান নয় যে, হল্লাগাড়ি এসে ইচ্ছেমতো তুলে দেবে!

নিশান বলল, “ওসব কিছু নয়। বেকার কথা। হলে আমরা জানব না? জোনাক-বাড়িতে অত অত বড় বাগান। প্লাস বাড়িটার একটা হেরিটেজ ভ্যালু আছে। বিক্রি করব বললেই হল?”

মণীশ হাসল, “বাগান কই আর! এখন তো জঙ্গল! তবে বিক্রি হয়ে গেলে বেকার হবে কিন্তু। জায়গাটা সুন্দর। যাকগে, কাটি গো। পরে কথা হবে।”

নিশান বাঁধের ধার বেয়ে নামতে থাকা মণীশের উদ্দেশে সামান্য চেঁচিয়ে বলল, “অফিসে কাল-পরশু করে আসিস একবার। ভুলিস না কিন্তু।”

বড়রাস্তায় উঠে ডান দিকে বাঁক নিল নিশান। সন্ধের সময় জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে। দোকানপাটে ভিড় থাকে বেশ। তাই লোকজনের মধ্যে দিয়ে জোরে সাইকেল চালানো মুশকিল।

ওর সামনেই এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে হা-হা হি-হি করতে করতে হাঁটছে। নিশান বুঝল টিউশন থেকে ফিরছে সব। কিন্তু এরা এমন করে হাঁটছে যে, সাইকেল নিয়ে গলে যাওয়ার জায়গা নেই!

টিংটিং করে বেল বাজাল নিশান। কিন্তু কেউ সরার নাম করল না। বিরক্ত লাগল ওর। আচ্ছা মুশকিল! ও ভাবল একবার জায়গা পেলেই সুট করে সাইকেলটা গলিয়ে দেবে।

তার আগেই “নিশান,” বলে একটা মেয়েলি গলার ডাক শুনতে পেল ও। সাইকেলটাকে ব্রেক করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশান। কেয়াদির গলা! চোয়াল শক্ত করল ও। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়।

কেয়াদি মানে কেয়া বটব্যাল। সোনাঝুরির সবচেয়ে বড় নাচের স্কুলটা কেয়াদিই চালায়। সঙ্গে একটা প্রাইমারি স্কুলও আছে। আর এই অঞ্চল থেকে বেরোনো লিটল ম্যাগ ‘সন্দর্ভ’-ও কেয়াদিই সম্পাদনা করে।

ওই ম্যাগে প্রতি সংখ্যায় লিখতে হয় নিশানকে। তবে এখন মূলত রাজনৈতিক লেখা লেখে ও। কেয়াদি নিশানকে খুব স্নেহ করে। আর তাতেই সমস্যাটা হয়েছে। কারণ, নিশানকে দেখলেই কেয়াদির নানা কাজ করার কথা মনে পড়ে যায়।

চোয়ালটা শক্ত করে নিশান ভাবল, এখন আবার কী করে দিতে হবে ভগবান জানে!

কেয়াদি হন্তদন্ত হয়ে কাছে এল। হাঁটা দেখে হাসি পেল নিশানের। কেয়াদি কেমন একটা আলখাল্লা ধরনের জামার সঙ্গে বড় ঢোলা প্যান্ট পরে। কাঁধে সারাক্ষণ একটা রংবেরঙের ঝোলা থাকে। মাথার কাঁচা-পাকা চুলগুলো একদম কদম ফুলের মতো করে ছাঁটা। কানে ঢাউস দুল। কপালে কালো রম্বস আকৃতির টিপ! ওদের মফস্‌সলে কেয়াদিকে কেমন মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা প্রাণীর মতো লাগে নিশানের।

কেয়াদির বিয়ে হয়েছিল দু’বার। কিন্তু দু’বারই বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। এক মেয়ে আছে। ফলসা। সে বেঙ্গালুরুতে চাকরি করে।

কেয়াদি বলে, “আমার বাষট্টি বছর বয়স হতে পারে, কিন্তু মনটা এখনও কুড়ি, বুঝলি?”

নিশানের হাসি পায়। মানুষের তো বয়স হবেই! সমস্ত পৃথিবীতে সব মানুষের বয়স বাড়েই। কিন্তু দেখেছে সেটা নিয়ে কত মানুষের মনে কতরকমের জটিলতা। বয়স নিয়ে কিছু মানুষ অযথা ডিফেনসিভ হয়ে পড়ে!

কেয়াদি যখন কথায়-কথায় কুড়ি বছর বয়সের কথা বলে, নিশানের মনে হয়, ও এমন কিছু কুড়ি বছরের ছেলেপুলেকে চেনে, যারা গাম্ভীর্যে দুশো কুড়ি বছর ছুঁয়ে ফেলেছে! বয়স দিয়ে কে কতটা মানসিকভাবে নবীন আর তাজা, সেটা বোঝানোর খুব কিছু দরকার আছে বলে মনে হয় না নিশানের।

কেয়াদি একটু নাচতে-নাচতে হাঁটে। এখনও একরাস্তা লোকের মধ্যে দিয়ে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল, “কী রে, তুই কোথায় যাচ্ছিস? ওই বুড়োটার কাছে?”

নিশান হাসি চাপল কোনওমতে। বিজনদাকে কেয়াদি কেন কে জানে, সহ্য করতে পারে না! কথা উঠলেই বলে, “শালা মেনিমুখো! পার্টি করে! লেনিনকে কী উচ্চারণ করত জানিস? লেলিন! আমার বাবার পায়ের কাছে বসে থাকত। আর কাজুদার চামচা হয়ে ঘুরত। সে কিনা এখন সং সেজে ঢং করছে! তুই যাস কেন দেড়েলটার কাছে? যাবি না একদম!”

কেয়াদিরা এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। অনেক কিছু চেনে। আসলে নিশানরা আগে এখানে থাকত না। মুর্শিদাবাদে বাবার ব্যাবসা ছিল। পরে ওরা সোনাঝুরিতে চলে আসে জমিজায়গা কিনে। নিশানের তখন পাঁচ বছর বয়স। দেখতে-দেখতে তারপর চব্বিশ বছর কোথা দিয়ে যে কেটে গেল!

কেয়াদির কাছে সোনাঝুরির কথা শোনে নিশান। পুরনো সোনাঝুরির কথা। শোনে সেই সময়কার স্কুল, গঙ্গার পাড়, জোনাক-বাড়ির কথা। আর শোনে একটা ছেলের কথা। অল্পবয়সি, ফরসা, একমাথা কোঁকড়া চুল আর গালে হালকা দাড়িওয়ালা একটা ছেলের কথা। কেয়াদি তার কথা বলতে গেলেই কেমন আবছাভাবে তাকায় দূরের দিকে। তারপর অস্ফুটে বলে, “সত্যি, অদ্ভুত মানুষ ছিল কাজুদা!”

“কাজুদা? মানে?” প্রথমবার শুনে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল নিশান।

কেয়াদি বলেছিল, “সে ছিল একজন। পুরো নাম বেঞ্জামিন কূজন সরকার।”

“কথা কানে যায় না?” কেয়াদি ঝংকার দিয়ে উঠল, “আমায় কেয়াদি বলিস ঠিক আছে, কিন্তু জানবি আমি তোর মায়ের বয়সি। কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবি।”

নিশান হাসল, “এই বলো বয়স কুড়ি। আবার এই বলছ মায়ের বয়সি! এত কনফিউজ়ড কেন তুমি?”

“আমি কনফিউজ়ড?” কেয়াদি চোখ বড়-বড় করল।

“বিজনদা ঠিকই বলে…” কথাটা অসমাপ্ত রেখে চুপ করে গেল নিশান। বিজনদার নাম শুনলে চিড়বিড় করে ওঠে কেয়াদি। এই চিড়বিড়ানিটা দেখতে খুব মজা পায় ও।

“কী বলে দেড়েলটা? আমায় নিয়ে কথা বলে ও? ওর দাড়ি যদি না ছিঁড়েছি আমি! আমার নাম পালটে দিস!” রাস্তার মধ্যে প্রায় লাফাতে লাগল কেয়াদি।

নিশানের আবার হাসি পেল খুব। অবশ্য তার সঙ্গে হঠাৎ ভালও লাগল। আসলে কুড়ি নয়, কেয়াদির বয়স বড়জোর তেরো। নেহাত কপাল খারাপ, তাই ওই মনটা একটা বাষট্টি বছরের শরীরে আটকে আছে!

“বলো ডাকলে কেন? আমি বিজনদার কাছে যাব। আলুর চপ নিয়ে যাব। বিজনদা রোজ সন্ধেবেলা মুড়ি দিয়ে খায়।”

“রোজ?” কেয়াদি চোখ বড়-বড় করে তাকাল, “বুড়োর রস কম নয়তো! রোজ ওই মোবিলে ভাজা চপগুলো গেলে? মরার ইচ্ছে হয়েছে? হলে বলিস আমি গিয়ে গলা টিপে দিয়ে আসব।”

“আহা, তুমি বলো না, কী কেস? ডাকলে কেন?” নিশান এবার সত্যি অধৈর্য হল। কেয়াদি এত কথা বলে যে, একবার ধরলে ছাড়া পাওয়া মুশকিল।

কেয়াদির যেন মনে পড়ে গেল কথাটা। চট করে একবার হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, “আরে, তুই আমার সব গুলিয়ে দিস! শোন, এখনই একবার সোনাঝুরি স্টেশনে চলে যা।”

“কী? কেন?” অবাক হল নিশান।

“আরে, ফলসা এসেছে আজ। কাল ওর জন্মদিন না?” কেয়াদি এমন করে বলল, যেন ফলসার জন্মদিনটা পাবলিক হলিডে।

“তোমার মেয়ে এসেছে?” অবাক হল নিশান।

“আসবে না? সেই গতবছর পুজোর পর এই এল। তা, ওর কয়েকজন বান্ধবী এসেছে আমাদের বাড়িতে। থাকবে।”

“ভাল কথা,” নিশান বলল, “তাতে আমি স্টেশনে যাব কেন? ট্রেনের গার্ড আর ড্রাইভাররাও আসবে নাকি?”

“আরে, কথাটা শোন! খালি বাজে বকবক! দেড়েলটার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুইও ক্যালানে হয়ে গেছিস।”

“কেয়াদি,” নিশান বলল, “কী সব ভাষা ব্যবহার করো!”

“ওরে আমার নাড়ু!” কেয়াদি চটাস করে একটা চাঁটি মারল নিশানের হাতে, “ছেলেরা বলতে পারে আর আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? শভিনিস্ট পিগ!”

নিশান হেসে বলল, “তা পিগ স্টেশনে গিয়ে কী করবে?”

“ওর একটা বান্ধবীকে নিয়ে আসবি। বেচারি আগে কোনওদিন ট্রেনে করে আসেনি। খুব বড়লোক বাড়ির মেয়ে। এই সোনাঝুরি জুট মিলটার মালিকের মেয়ে! ট্রেনে-ফেনে চড়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু গাড়িতেও আসবে না। ওর ইচ্ছে লোকাল ট্রেনে একবার উঠবে। তুই স্টেশনে গিয়ে ওকে রিসিভ করে রিকশা করে আমাদের বাড়িতে এখনই নিয়ে আয়। ওর ট্রেন আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে ঢুকবে।”

নিশান কিছু বলার আগে কুঁইকুঁই করে ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ও দেখল নোঈ কল করেছে!

নোঈ ওর মাসতুতো বোন। ভবানীপুরে থাকে ওরা। পুটুমাসি আর রাঙামেসো খুব ভালমানুষ! নোঈও খুব ভাল মেয়ে। তবে আজকাল আর সেই ছোটবেলার মতো যোগাযোগটা নেই!

ফোনটা দেখলেও ধরল না নিশান। পরে কলব্যাক করে নেবে।

“আমায় মেয়েটি চিনবে কী করে?”

“আরে, আমি ওকে তোর ছবি মেসেজ করে দিয়েছি। তুই টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি, ও চিনে নেবে,” কেয়াদি ঝরঝর করে একনিশ্বাসে বলে গেল কথাগুলো।

ওকে না জিজ্ঞেস করেই করে দিয়েছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশান। এই ভয়টাই করেছিল ও। কেয়াদি মানেই একটা না-একটা কাজের ফরমায়েশ!

ও বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি।”

“শোন, তোর ওই পার্টির লেকচার দিবি না মেয়েটাকে। ও ভাল মেয়ে। কত বড়লোক বুঝতে পারছিস?” কেয়াদি সাবধান করে দেওয়ার মতো গলায় বলল।

“ভাল মেয়ে মানে? আমরা কি খারাপ ছেলে?” নিশান ভুরু কোঁচকাল, “এমন মেয়ে, যার কাছে লোকাল ট্রেন চড়াটা অ্যাডভেঞ্চার, তাকে পার্টির কথা বলে আমি কেন বেকার আমার ব্যাটারি খরচ করব!”

“এইসব কথা বলবি না ওকে একদম। বুঝলি?” কেয়াদি সাবধান করে দিল, “ওর নাম রাধিয়া। রাধিয়া মালিক! মনে রাখবি নামটা। এখন যা।”

নিশান সাইকেলটা ঘুরিয়ে উঠে বসল তার ওপর।

কিন্তু প্যাডেল করার আগেই কেয়াদি সাইকেলের হ্যান্ডেলটা চেপে ধরে বলল, “‘লেলিন’ রোজ ওই তেলেভাজা-মুড়ি খায় নাকি? হুলোটা যা তেলে ভাজে, ওতে তো হাতিও মারা যাবে রোজ খেলে!”

নিশান থমকে গেল একটু। কেয়াদি তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। বড়-বড় চোখ স্থির।

নিশান বলল, “ম্যাক্সিমাম দিন। কেন?”

কেয়াদি আলতো করে ছেড়ে দিল সাইকেলের হ্যান্ডেলটা। তারপর বলল, “আত্মহত্যা করবে বলেছিল চল্লিশ বছর আগে। কিন্তু সেটা যে এভাবে রোজ চপ-মুড়ি খেয়ে করবে তা বুঝতে পারিনি তখন।”

০৫. নোঈ

খুব নিচু দিয়ে একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল আর নোঈ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তার কী বিশাল ছায়া পড়ল বাড়িটার গায়ে! ভাস্কর চক্রবর্তীর একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল ওর!

নোঈ চশমাটা খুলে আলতো করে কপালের ঘাম মুছল। মার্চের শেষ এখন, কিন্তু মনে হচ্ছে ভরা বৈশাখ চলছে। কালবৈশাখী বলে একটা ব্যাপার ছিল ছোটবেলায়, কিন্তু আজকাল সেসব আর হয় না। কে জানে হয়তো অ্যানালগ সময়ের জিনিস বলে এই ডিজিটাল যুগে আর তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না!

ঘড়িটা দেখল একবার। সওয়া পাঁচটা বাজে। শ্বেতা বলেছিল পাঁচটায় চলে আসবে। কী যে করে না মেয়েটা! এমনিতেই আজ মেজাজটা গরম হয়ে আছে। তার ওপর যদি ও দেরি করে, তা হলে আর কত মাথা ঠিক রাখা যায়!

নন্দনের সামনের রেলিং-এ হেলান দিয়ে মাথাটা নিচু করে দাঁড়াল নোঈ। ক্লান্ত লাগছে। কারও সঙ্গে রুড ব্যবহার করতে খারাপ লাগে ওর। কাউকে অসম্মান করলে মনে হয় সেটা ওর নিজের অসম্মান। কিন্তু ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল যে, আর সহ্য করা যাচ্ছিল না।

প্লেনটা চলে গেলেও তার শব্দটা এখনও যেন চারিদিকে রয়ে গিয়েছে। এত নিচু দিয়ে প্লেন যেতে কোনওদিন দেখেনি নোঈ। ও মাঝে মাঝে ভাবে কোনওদিন যদি কোনও প্লেন ভেঙে পড়ে এই শহরটায়! কী সাংঘাতিক ব্যাপারটাই না হবে!

সাইড-ব্যাগটার ভেতর থেকে একটা জলের বোতল বের করল নোঈ। অর্ধেক জল আছে। কিছুটা খেয়ে আবার ব্যাগে ভরে রাখল বোতলটা। তারপর চারপাশে তাকাল। বিকেলের এই সময়টায় বেশ ভিড় থাকে। আজ আবার কী সব অনুষ্ঠান আছে জীবনানন্দ সভাঘরে। ওই দিকে যাওয়ার যে-গেটটা রয়েছে তার সামনে বড়-বড় পোস্টার পড়েছে! গল্পপাঠ না কী যেন হবে। অন্য দিন হলে হয়তো নোঈ যেত, কিন্তু আজ মেজাজটা ভাল নেই। ব্যাগটাও বড্ড ভারী লাগছে। গীতবিতানটা এত মোটা! এটা নিয়ে সারা দিন ঘুরছে ও। অফিসও করেছে। কী, না শ্বেতা ওটা নেবে। শ্বেতার বইটা কোন এক বান্ধবী নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কাল শ্বেতার গানের প্রোগ্রাম আছে।

আসলে নোঈর আজ একটুও দাঁড়াতে ভাল লাগছে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে বাড়ি গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে এসিটা চালিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিতে। পরপর যা ঘটছে জীবনে, আর নিতে পারছে না! প্রথমে মা, তারপর জয়, তারপর এই চাকরি। কী যে ঝামেলা! চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করল নোঈ। মায়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। মায়ের রাগী, গোমড়ামুখ! কী অদ্ভুত! মা কেন এমন করে কে জানে! সবাই বলে ছেলেমানুষি। কিন্তু নোঈ জানে আসলে এটা ইগো, জেদ। মায়ের কথা সবাইকে শুনতে হবে। কেন শুনতে হবে? ভুল বললেও শুনতে হবে! এমন আবদার করার মানে কী? রাগ হয়ে যায় নোঈর। আরে বাবা, তোমার যদি পাত্র অতই পছন্দ হয় তবে তুমি যাও না, বিয়ে করো না! ডাক্তার হলেই তাকে পছন্দ করতে হবে? বিলেতে থাকলেই তার ওপর হামলে পড়তে হবে? আশ্চর্য সাইকোলজি মানুষের! মনের ওপর কি জোর চলে! হয়নি সেই ছেলেটিকে পছন্দ নোঈর। কী করবে? আর ছেলে তো নয়, বড় বড় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন যেন! আর সারাক্ষণ কত রোজগার করে, কত দামি গাড়ি চড়ে, এসব বলে গেল। এত বাজে লাগছিল নোঈর! নিজের নামটা পর্যন্ত চিবিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “ডিনো।”

বাবা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল নাম শুনে। অবাক হয়ে বলেছিল, “ডিনো মানে?”

“আসলে পুরো নামটা নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির। ম্যারিকায় লোকের ডাকতে সমস্যা হয়! তাই ডিনো করে নিয়েছি আমি।”

পাশ থেকে চশমা পরা শান্ত চোখের মানুষটা এবার প্রথম কথা বলেছিল। আলতো গলায় বলেছিল, “ওর ভাল নাম দীনবন্ধু।”

খুব হাসি পেয়ে গিয়েছিল নোঈর। তবে খুব জোর নিজেকে সামলে নিয়েছিল ও। নোঈর হাসি একবার শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না।

বাবা বলেছিল, “কিন্তু এটা তো ভাল নাম। দীনবন্ধু মিত্রের লেখা ‘নীল দর্পণ’ পড়েছ?”

ডিনো আবার কায়দা করে বলেছিল, “ডাক্তারি করতে গেলে বাইরের বই খুব-একটা পড়া হয় না! প্লাস ঠাকুরদা নামটা রেখেছিল। খুব ওল্ড ফ্যাশন। আই ডোন্ট লাইক।”

বাবা সামান্য হেসে নরম গলায় বলেছিল, “বিদেশে থাকো। কিন্তু সেখানকার একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? নাম নিয়ে ওদের অত নতুন-পুরনো বাতিক নেই। যেমন ধরো রিচার্ড নামটা। সেই পুরনো দিনের রাজার নাম। আবার এখনকার হলিউডের অভিনেতার নাম। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, গৌরনাথ, ঢোলগোবিন্দ, কমলাকান্ত এমন ধারার নামগুলো সব উঠেই গিয়েছে প্রায়!”

ডিনো এর উত্তরে আবার কীসব হাবিজাবি বলছিল। আর নোঈ দেখছিল ওই চশমা পরা শান্ত চোখের মানুষটাকে। ভারী অদ্ভুত নাম মানুষটার। এই ডিনোর জেঠতুতো দাদা এমন, ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল ওর।

মা তারপর খোঁচা দিয়েছিল নোঈকে। চাপা গলায় বলেছিল, “তুই কিছু জিজ্ঞেস করবি না?”

চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলেছিল নোঈ। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার ডেভিড ফিঞ্চার ভাল লাগে? বা তোরনাতোরে?”

“সে কে?” ডিনো ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে।

আবার পাশ থেকে উত্তর এসেছিল, “ভাই খুব-একটা ফিল্ম দেখে না।”

“আরে নোঈ, তুই এখানে?” আচমকা ডাকে চোখ খুলল নোঈ। সামান্য অবাক হল। সামনে নিশান দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফরসা রংটা যেন একটু পুড়ে গিয়েছে এই ক’দিনে। গালে দাড়িও রাখছে।

“তুই-ই বা এখানে কী করছিস নিশানদা?” নোঈ অবাক হল।

“আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে জীবনানন্দ সভাঘরে একটা গল্পপাঠের আয়োজন করা হয়েছে আজ। সাড়ে ছ’টায় শুরু হবে। তাই এসেছি আমরা। ওই দেখতে পাচ্ছিস, প্ল্যাকার্ড আর হোর্ডিং পড়েছে,” নিশান বলল।

নোঈ বিরক্ত হয়ে বলল, “এই সবই কর। তোকে একদিন ফোন করেছিলাম। ধরলি না। তারপর একবার কল ব্যাকও করলি না! তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস!”

“আরে, সরি সরি!” নিশান হেসে কান ধরল, “খুব ভুল হয়ে গিয়েছে রে! আসলে সেদিন কেয়াদির পাল্লায় পড়ে সব গুলিয়ে গিয়েছিল।”

কেয়াদি কে, সেটা জানে নোঈ। দেখেছে সোনাঝুরিতে। তবে খুব আলাপ নেই। ওই মুখ-চেনা টাইপ আর কী।

নোঈ আবার ঘড়ি দেখল। শ্বেতার মোবাইলটা কাল বাস থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে যে ফোন করে তাড়া দেবে, তারও উপায় নেই। খুব বিরক্ত লাগছে নোঈর, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ বাড়িতে গিয়ে মা যে কী বলবে, সেটাই দেখার। একে তো বিয়ে করবে না বলে গত পরশু ঘোষণা করার পর থেকে মা রেগে আগুন হয়ে আছে! তার ওপর আজ অফিসের ব্যাপারটা শুনলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, স্বয়ং ভগবানও জানেন না!

“তোর নাকি বিয়ে?” আচমকা প্রশ্নটা করল নিশান।

“কী?” সামান্য থতমত খেয়ে গেল নোঈ।

“আরে বিয়ে, বিয়ে। তোর। তাই?” নিশান হাসল, “ভাল ডাক্তার নাকি! বিয়ের পর আমেরিকায় চলে যাবি শুনলাম! সত্যি?”

নোঈর মুখটা নিমেষে লাল হয়ে গেল। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন পাল্লা দিয়ে দৌড়ে মাথায় গিয়ে জমা হল। ও চোয়াল শক্ত করে তাকাল।

“যাঃ বাবা, খচে যাচ্ছিস কেন? মাসিমণি তো মাকে বলেছে। ছেলে নাকি বলেছে বছর পাঁচেকের মধ্যে প্লেন কিনবে? তাই?”

“সব তো জানিস, তাও আমার মাথা খাচ্ছিস কেন?” নোঈ এবার চিড়বিড় করে উঠল!

“বাপ রে! প্লেন কেন কিনবে বল তো? রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভয় লাগে? আকাশ দিয়ে ফাঁকায় ফাঁকায় যাবে বলে?” নিশান খিকখিক করে হাসল।

“আমি বিয়েটা করছি না,” নোঈ কোনওমতে রাগটাকে গিলে বলল।

“সে কী? কেন?” নিশান চুপ করে গেল এবার।

নোঈ ঠোঁট টিপে মাথা নিচু করল।

“বাদ দে,” নিশান হেসে বলল, “এই বয়সে বিয়ে করবি কী! মাস্টার্স করেছিস। চাকরি করছিস। গ্রেট গোয়িং। আগে নিজের কেরিয়ার সেট কর।”

“কে কাকে বলে দ্যাখো!”

নোঈ দেখল নিশানের পেছনে কেয়াদি উঁকি দিচ্ছে!

কেয়াদি সামনে এসে বিরক্ত মুখে বললেন, “এই নিশান, তোকে তখন থেকে ফোন করছি, কী করছিস তুই?”

“আমায়? ফোন?” পকেট থেকে ফোনটা বের করে জিভ কাটল নিশান, “ওহো, সরি। সাইলেন্ট করা ছিল। কী হয়েছে?”

কেয়াদি বলল, “অনুষ্ঠান শুরু করার আগে কাজ থাকে না? এখানে গপালে হবে? চল।”

নিশান হাসল, “আসলে বোনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তো!”

কেয়াদি নোঈকে দেখল। হাসল সামান্য। কিন্তু নোঈ বুঝল সেটা নিছক ভদ্রতা।

কেয়াদি বলল, “চল নিশান। কোথা থেকে একটা গোঁয়ার-গোবিন্দকে ধরে এনেছিস! প্রতি পদে সবার সঙ্গে ঝগড়া করছে।”

“আরে মণীশ, একটু মাথাগরম ছেলে। ঠিক আছে চলো আসছি।”

“আয় তাড়াতাড়ি,” কেয়াদি দাঁড়াল না আর। আবার চলে গেল সভাঘরের দিকে।

নিশান হাসল নোঈর দিকে তাকিয়ে। তারপর বলল, “মাসিমণি ঝামেলা করছে? শোন, নিজের যা ভাল মনে হবে করবি! মাসিমণিরা অন্য জেনারেশন। আমাদের বুঝবে না। সিকিয়রিটির কনসেপ্টটা আমাদের কাছে যা, ওদের কাছে তা নয়। প্লাস ইগো তো আছেই!”

নোঈ কিছু বলল না। আসলে নোঈ চট করে নিজের কথা কাউকে বলতে পারে না। শ্বেতা ওর খুব ভাল বান্ধবী বলে তাও কিছুটা বলে। যদিও নিশান ওর মাসতুতো দাদা। ভাল ছেলে। কিন্তু সেই কানেকশনটা তো নেই। তাই ওকে আর কী বলবে! মা এমন করে যে, অপমান লাগে নোঈর। মেয়ের কষ্ট হতে পারে, খারাপ লাগতে পারে, সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই! লোকে কী ভাববে! কে কী বলবে! কীসে আরও প্রেস্টিজ বাড়বে এই নিয়ে ভেবে সব সময় মাথা খারাপ করে!

নিশান মাথা নেড়ে এবার বলল, “আমি আসি। এলে পারতিস। ভাল লাগত তোর!”

নিশান চলে যাওয়ার পর ঘড়িটা আবার দেখল নোঈ। আধঘণ্টা হয়ে গেল। শ্বেতা কি আসবে না? তবে কি বাড়ি চলে যাবে? বাড়ি গিয়ে কী বলবে? কাল থেকে আর অফিস নেই! মা তো আরও চেপে ধরবে। বিয়ের জন্য পাগল করে দেবে। ও যে ডিনোকে বিয়ে করতে পারবে না, সেটা মা এখনও ছেলের বাড়িতে জানায়নি! মা আইকাদিদের বলেছে যে, সব মেয়েরাই নাকি ওরকম বলে। কিন্তু মা ঠিক নোঈকে কনভিন্স করে ছাড়বে!

কনভিন্স! কীসের কনভিন্স! এটা কি কেউ ধূপকাঠি বিক্রি করতে এসেছে নাকি? ছেলে জ্বলে অনেকক্ষণ বেশি! ছেলের গন্ধ ভাল! ধোঁয়া ডাইরেক্ট ভগবানের নাকে হিট করে! কনভিন্স! বোকার মতো কথা! নোঈর মাথাগরম কি সাধে হয়!

নোঈ কাজ করতে চায়। আজ কাজটা ছেড়ে এসেছে বটে, কিন্তু তার মানে তো আর ঘরে বসে থাকবে না। আবার কাজ খুঁজবে। সঙ্গে ব্যাঙ্কিং-এর পরীক্ষাও দেবে। কিছু একটা তো ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু কাজ ওকে করতেই হবে।

মনটা খারাপ হয়ে আছে। মাস চারেক হল চাকরিটা করছিল নোঈ। ভালই ছিল প্রথম মাস আড়াই। তারপর শেফালি বলে অ্যাকাউন্টসের হেড এমন পেছনে লাগতে শুরু করল! নোঈর তৈরি করা স্প্রেড শিটে নিজে ইচ্ছে করে ভুল ডেটা বসিয়ে বসের কাছে ঝাড় খাওয়াচ্ছিল। সেই সঙ্গে খারাপ ব্যবহার তো ছিলই! আর নিতে পারছিল না নোঈ। অফিস যাওয়ার নামে আতঙ্ক হয়ে যাচ্ছিল। রাতে ঘুমোতে পারছিল না। শুনছিল, শেফালিদির নিজের কোন এক ক্যান্ডিডেট রয়েছে, তাকে পুশ করার জন্য নোঈকে এমনভাবে হ্যারাস করছে মহিলাটি।

আর, আজ তো চরম জায়গায় পৌঁছেছিল ব্যাপারটা! সকলের সামনে এমন করে বলল শেফালিদি যে, আর নিতে পারেনি নোঈ। ও নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছে! ওর নাকি অন্য মতলব আছে! কীভাবে কেউ এসব বলতে পারে! মানুষ এত নীচে নামতে পারে! কী মিন করেছে শেফালিদি?

“সরি, সরি নোঈ। অনেক লেট হয়ে গিয়েছে,” শ্বেতা হাঁপাতে-হাঁপাতে ওর পেছনের দিক থেকে এসে দাঁড়াল সামনে।

নোঈ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল শ্বেতার দিকে।

শ্বেতা বলল, “আরে, আমার দোষ নেই। মেট্রোয় আসছিলাম। রবীন্দ্র সরোবরে একজন সুইসাইড করেছে। তাই ট্রেন বন্ধ ছিল। এটা কি সত্যি রে যে, ওই স্টেশনে ভূত আছে?”

নোঈ বিরক্ত হয়ে বলল, “ববির সঙ্গে প্রেম করছিলি, না? তোকে কতবার বলেছি, ছেলেটা সুবিধের নয়! শুনবি না তো সেই কথা!”

“মাইরি বলছি,” শ্বেতা হাসল, “ওই জন্য লেট হয়নি। আমি সত্যি মেট্রোয় ছিলাম। তুই বিশ্বাস কর। আচ্ছা যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করিস সুইসাইড হয়েছে কি না। তবে হ্যাঁ, ববি সঙ্গে ছিল।”

নোঈ চোয়াল শক্ত করল। এই ছেলেটাকে ভাল লাগে না নোঈর। চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায়, সোজা পথের নয়। তা ছাড়া হোয়াটস অ্যাপে একদিন নোঈকে প্রোপোজ়ও করেছে। বলেছে, নোঈকে নাকি সারাক্ষণ চোখে হারায়! নোঈ সেদিন ভাল করে ঝেড়েছিল ওকে। শ্বেতা কত ভালবাসে ছেলেটাকে, আর সে কিনা ওকে প্রোপোজ় করছে!

পরে অবশ্য ববি বলেছিল, নেশা করেছিল বলে ভুলভাল বলেছে। আসলে ও কিছুই মিন করেনি। বেশি মদ খেয়ে ফেললে নাকি ও এমন ভুলভাল করে ফেলে।

তারপর থেকে দেখেছে, ওকে দেখলে ববি অদ্ভুতভাবে তাকায়। কিছু একটা বক্তব্য দৃষ্টি দিয়ে পাঠাতে চায়। গোটা ব্যাপারটায় মাথা খুব গরম হয়ে যায় নোঈর। মানুষ মানুষকে কী করে এমন ঠকাতে পারে! শ্বেতাকে যদি ববির পছন্দ না হয়, তবে কেন শুধু শুধু মেয়েটার সঙ্গে ঘোরে? এমনকী, ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। শ্বেতা ববি ছাড়া আর কিছু বোঝে না। কিন্তু ববি শ্বেতা ছাড়া আর সব কিছু বুঝতে চায়।

ববির ওকে প্রোপোজ় করার ব্যাপারটা শ্বেতাকে বলেনি নোঈ। বললে শ্বেতার সঙ্গে ওর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। কারণ, নোঈ নিশ্চিত ববি এর পরিবর্তে এমন কিছু শ্বেতাকে বলবে যে, পুরো ব্যাপারটাই পালটে যাবে। আর সত্যি বলতে কী, শ্বেতা ওর প্রিয়তম বন্ধু হলেও একটা সীমার পর ওর জীবনে আর ঢোকে না নোঈ। আসলে ছোট থেকেই নোঈ এটা বাবার কাছ থেকে শিখেছে। বাবার মতো এমন চুপচাপ মানুষ ও কোনওদিন দেখেনি! নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কখনও নোঈ দেখেনি মানুষটা অন্যের ব্যাপারে যেচে নাক গলিয়েছে বা কিছু বলেছে। বাবাকে দেখে নির্জন পাহাড়ি নদীর পাড়ের কাঠের বাড়ি মনে হয়! খুব ভাল লাগে ওর। মা তো সারা জীবন বুঝলই না বাবাকে। শুধু রাগ আর অভিমান করে গেল।

“কী রে, কী ভাবছিস?” শ্বেতা সামান্য ঠেলা দিল নোঈকে।

নোঈ বলল, “কিছু না।” তারপর ব্যাগ থেকে গীতবিতানটা বের করে দিয়ে বলল, “এই নে। এটা ধর।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, জানু!” শ্বেতা নোঈকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল একটা।

নোঈ বলল, “থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না। এতক্ষণ ওয়েট করালি বেকার! আমার এমনিতেই আজ মনটা ভাল নেই।”

“কী হয়েছে?” শ্বেতা এবার সিরিয়াস মুখ করে তাকাল।

নোঈ চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল একটু। তারপর সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে বলল, “চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি।”

“সে কী রে? পাগল নাকি? এই তো কয়েক মাস হল জয়েন করলি!” শ্বেতা চোখ গোলগোল করে তাকাল ওর দিকে।

“পাগল কেন হব? আর সহ্য করা যাচ্ছিল না,” নোঈ চশমাটা পরে নিল আবার। বলল, “ওই অ্যাটমসফিয়ারে কাজ করা যায় না।”

“কী হয়েছে রে? একদম ছেড়েই দিলি? সত্যি?” শ্বেতা মাথা নাড়ল।

“আরে, আমার স্প্রেড শিটগুলো শেফালিদি ট্যাম্পার করে বসের কাছে সাবমিট করছিল। বারবার করছিল। আজ আমি আর শেফালিদিকে কিছু না বলে সোজা বসকে গিয়ে সাবমিট করেছি আমার কাজগুলো। ব্যস, শেফালিদি কী রেগে গেল! যা খুশি বলতে শুরু করল। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছি নাকি আমি! আমি নাকি অন্য কিছু চাই! আরও কীসব ইঙ্গিত করল। আই জাস্ট ফ্লিপড। ছেড়ে দিয়েছি। দু’মাসের নোটিশ দিতে হয়। দিয়ে এসেছি। বলেছি টাকাপয়সা যেন আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। আমি আর যাচ্ছি না ওই নরকে!”

শ্বেতা মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আর মাথাগরম করিস না। তুই এত ভাল লেখাপড়ায়। ঠিক অন্য চাকরি পেয়ে যাবি আবার।”

নোঈ মাথা নাড়ল, “অপমানটা ভুলতে পারছি না। অসভ্যতা আমি পছন্দ করি না জানিস তো! শেফালিদির নাকি নিজের কোন এক ক্যান্ডিডেট আছে। ঠিক আছে, এখন তাকে ঢোকাক আমার জায়গায়। আমার অত টাকার দরকার নেই। সব সহ্য করে পড়ে থাকা আমার দ্বারা হবে না।”

শ্বেতা ঘড়ি দেখল। মুখে-চোখে স্পষ্ট যে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

নোঈ বলল, “তোর রিহার্সাল আছে না? তুই তা হলে আয়।”

“কিন্তু তুই এমন করে একা… মানে তোকে এভাবে আমি একা ছেড়ে যাই কী করে?”

“তো কী হয়েছে? আমি এখন বাড়ি যাব। নিড আ শাওয়ার,” নোঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

শ্বেতা চট করে ঘড়ি দেখল আবার। তারপর বলল, “ঠিক বলছিস তো? কোনও প্রবলেম নেই তো?”

নোঈ হাসল। অনেকক্ষণ পর হাসল। নিজেরই অবাক লাগল নোঈর। তারপর বলল, “কোনও প্রবলেম নেই। তুই আয়। আমিও যাব।”

শ্বেতা বলল, “কাল তোদের বাড়ি যাব। আর-একটা কথা তোকে বলা হয়নি। আমি কয়েকমাসের জন্য একটা স্কলারশিপ পেয়ে চণ্ডীগড় চলে যাচ্ছি!”

“তাই?” নোঈ অবাক হল।

“হ্যাঁ। আজ এসেছে চিঠিটা। তবে এখন আর এই নিয়ে কিছু বলছি না। পরে ফোনে বলব। আমার দিনটা ভাল আজ। মনটা কী ভাল ছিল! কিন্তু এখন আমার কী খারাপ লাগছে! তোর দিনটা আজ এমন গেল!”

নোঈ জানে শ্বেতার সত্যি খারাপ লাগছে। খুব ভাল মেয়েটা। সত্যি ওর জন্য চিন্তা করে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, ওর মেজাজ খারাপ আছে বলে এখন শ্বেতাকে ওর জন্য বেবি সিটিং করতে হবে।

শ্বেতার সঙ্গে নোঈ নিজেও বেরোল নন্দন চত্বর থেকে। শ্বেতা কবে চণ্ডীগড় যাবে, কোথায় থাকবে, এই নিয়ে টুকটাক কথা হল কিছু। কিন্তু নোঈ বুঝল, ও এসব কথা বললেও মনের ভিতরটা ওর এমন হয়ে আছে যে, কিছুই আসলে ভাল লাগছে না। কোনও কথা ঠিক গাঁথছে না মনে। এই যে শ্বেতা ওর এত বান্ধবী, সে চলে যাবে শুনেও তেমন হেলদোল হচ্ছে না। কেন কে জানে! আচ্ছা, নোঈ কি বড্ড স্বার্থপর!

বড়রাস্তায় গিয়েই বাস পেয়ে গেল শ্বেতা। বাসে উঠে পিছনে ফিরে একবার হাত নাড়ল মেয়েটা। নোঈ হাসল একটু। তারপর বাসটা বেরিয়ে গেলে ও রাস্তা পার হয়ে নিল।

গলাটা আবার শুকিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে জলের বোতল আছে নোঈর, কিন্তু কোল্ড ড্রিঙ্ক খেতে ইচ্ছে করছে ওর। মোড়ের কাছে ডান দিকে একটা দোকান আছে। শ্বেতার সঙ্গে মাঝে মাঝে ওখান থেকে কোল্ড ড্রিঙ্ক খায় নোঈ।

সামনে সামান্য ভিড়। তাদের কাটিয়ে বড় ক্লাবটার সামনে দিয়ে এগোল মোড়ের দিকে। কোল্ড ড্রিঙ্কটা খেয়ে রবীন্দ্রসদন থেকে মেট্রো ধরে নেবে। মার্চের শেষ এখন। গরম পড়েছে বেশ। কুর্তির ভেতর দিয়ে সরু ঘামের রেখা শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে। এক-এক ফোঁটা জল। নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। ওর মতো!

দীর্ঘশ্বাস পড়ল নোঈর। আজ হঠাৎ নিজেকে খুব একা লাগছে ওর। মনে হচ্ছে আসলে ওর কেউ নেই। কেউ কোনওদিন ছিল না। এখন বাড়িতে ঢুকতেও ইচ্ছে করছে না। আবার রাস্তাতেও থাকতে ভাল লাগছে না। কী যে করে নোঈ! ও আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য ডুবে গেলেও তার মনখারাপ করা একটা আলো লেগে রয়েছে মেঘে। যেন আলতা মোছা তুলো ছড়িয়ে আছে আকাশময়! কলকাতার আকাশটা এমন ধূসর কেন কে জানে! নীল রঙের আকাশ শেষ কবে কলকাতায় দেখেছে মনে করতে পারে না নোঈ!

মোড়ের কাছটায় ভিড় হয়ে আছে। লোকজন রাস্তা পার হবে বলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটো উসকোখুসকো পাগল বসে রয়েছে দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে। তার পাশে ভাজাভুজির দোকান আর একটা পান-কোল্ড ড্রিঙ্কসের দোকান। ফুটপাথটার যেন দমবন্ধ অবস্থা।

নোঈ মাঝে মাঝে ভাবে এই শহরে যে ওদের নানারকম ট্যাক্স দিতে হয় সেটার কতটা লাভ পায় ওরা! অর্ধেকের বেশি ফুটপাথে হয় হকার বসে রয়েছে নয়তো মানুষজন বসবাস করছে! গত পাঁচ-ছ’বছরে ফুটপাথে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা যেন তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে! স্টোভে, উনুনে বা ইট দিয়ে তৈরি উনুনে রান্না, রেলিং-এ মেলে রাখা জামাকাপড়, চাটাই পেতে শুয়ে পড়া, প্লাস্টিকের পুঁটলিতে জড়ো করে রাখা জামাকাপড়, ছড়িয়ে রাখা তরকারির খোসা, ভাতের ফ্যান, টলমল করে হাঁটা ছোট ছোট বাচ্চা, মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা মানুষ! এরা কারা? কোথা থেকে আসে? আগেই-বা ছিল কোথায়? এই নিয়ে আর বেশি ভাবতে চায় না নোঈ। মাথার ভিতরটা কেমন করে!

নোঈ সাইড-ব্যাগটাকে সামনে করে নিয়ে এসে দাঁড়াল দোকানটার সামনে। একজন বয়স্ক বিহারি মানুষ দোকানটা চালান। নোঈর মুখ চেনা। তার পাশে আজ একটা অল্পবয়সি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক মানুষটাকে হাতে-হাতে সাহায্য করছে।

নোঈ কোন কোল্ডড্রিঙ্কটা চায়, সেটা বলল।

দোকানে আরও দু’-তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ঘুরে তাকাল নোঈর দিকে। নোঈ পাত্তা দিল না। ও জানে রাস্তায় বেরোলে লোকজন দ্যাখে ওকে। কেন দ্যাখে সেটাও জানে। শ্বেতা বলে, “তোকে যা দেখতে ইজ়ি সিনেমায় চান্স পেতে পারিস। এমন মাখনের মতো গায়ের রং ভগবান যদি আমায় দিত! কী চাকরি-বাকরি করে জীবনটা নষ্ট করছিস! ববিকে বলব? ওর ফিল্ম লাইনে যোগাযোগ আছে।”

কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলটা নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল নোঈ! দুশো এমএল-এর ছোট্ট বোতল। তবে খুব ঠান্ডা। দু’হাত দিয়ে বোতলটা প্রাণপণে চেপে তার সমস্ত শীতলতা নিজের শরীর আর মনের মধ্যে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করল নোঈ!

খালি বোতলটা নিয়ে এগিয়ে গেল নোঈ। নতুন মেয়েটা হাত বাড়িয়ে নিল বোতলটা। বলল, “দশ রুপায়া।”

নোঈ ব্যাগটা খুলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল।

“ছুট্টা নেহি হ্যায়,” মেয়েটা বিরক্ত হল একটু।

“আমার কাছেও নেই,” নোঈ সহজ গলায় বলল।

“আরে, দশ টাকার জিনিস নিয়ে কেউ পঞ্চাশ টাকা দেয়!” মেয়েটার ভাঙা বাংলায় এবার আরও বেশি ঝাঁজ!

“আরে, নেই আমার কাছে!” নোঈও বিরক্ত হল সামান্য।

“ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি,” মেয়েটা গলা বাড়িয়ে হাত দিয়ে নোঈর ব্যাগটা দেখাল, “ওই তো দশটাকার একটা নোট! ঝুট কাহে বোল রহি হো?”

“মানে?” নোঈর মাথাটা আচমকা গরম হয়ে গেল, “লাগবে না ব্যালেন্স।”

নোঈ আর কথা না বলে হাঁটা দিল। আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে। সবাই অবাক। পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বাকি টাকা ফেরত নিচ্ছে না!

নোঈর মাথা ঝাঁঝাঁ করছে! মেয়েটা বলে, ও মিথ্যেবাদী! এত লোকের সামনে!

“দিদিজি, দিদিজি, সুনিয়ে পিলিজ, দিদিজি…” বয়স্ক মানুষটি কোনওমতে এসে নোঈর পাশে দাঁড়ালেন। নোঈ তাকাল ওঁর দিকে।

“পিলিজ দিদিজি, গুসসা না হোইয়ে। ছোটি লড়কি। বুঝতে পারেনি! আমি দিচ্ছি আপনাকে চেঞ্জ। পিলিজ মাফ কর দিজিয়ে!” বয়স্ক মানুষটি আন্তরিকভাবে বললেন কথাগুলো।

নোঈ দাঁড়িয়ে পড়ল। মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল একটু। মাথা নাড়ল অল্প। তারপর বলল, “সরি।”

“নেহি দিদিজি। আপ সরি না বোলিয়ে,” বয়স্ক মানুষটি এবার হাফশার্টের বুকপকেট থেকে দুটো কুড়ি টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলেন নোঈর দিকে। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেহাতি ভাষায় কিছু একটা বললেন।

নোঈ দেখল মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে ওই ভাষাতেই কী একটা উত্তর দিল।

আশপাশের লোকজন আরও একটু ঘিরে এসেছে যেন। যথেষ্ট হয়েছে। নোঈ ভাবল এবার ওর এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। আর সত্যি বলতে কী মেয়েটা তো ভুল কিছু বলেনি! সত্যি তো ওর ব্যাগে একটা দশ টাকার নোট আছে। কিন্তু সেটা তো খরচ করা যায় না! হতে পারে নোটটা দশ টাকার। কিন্তু এর মূল্য তো আর দশ টাকা নয়! এই নোটটা অমূল্য। কারণ জয় ওকে দিয়েছিল এটা। জয় মানে জয়ব্রত ঘোষাল। সেই থার্ড ইয়ারে, হাজরা মোড়ে। সেই পান-কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকানের সামনে। শীতের এক সন্ধেবেলা। নোঈ বলেছিল, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে। শীতে কোল্ড ড্রিঙ্ক! জয় বিরক্ত হয়েছিল বেশ! তারপর পকেট থেকে এই দশ টাকার নোটটা বের করে দিয়ে বলেছিল, “এটা দিয়ে কিনে নে। আমার টাইম নেই। আমি আসি।”

জয়ের চলে যাওয়া চুপচাপ ছলছলে চোখে দেখেছিল নোঈ। ও কোল্ড ড্রিঙ্ক খায়নি সেদিন। শুধু নোটটা মুঠো করে ধরে ভিড় ফুটপাথে একা দাঁড়িয়ে ছিল! সেই থেকে এটা ওর কাছে থাকে সারাক্ষণ। আর আজ কী করে এই নোটটা দিয়ে দেবে নোঈ! জয়ের এটুকুই যে শুধু রয়ে গিয়েছে ওর কাছে!

নোঈ বলল, “দেখুন, আমায় যেতে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ।”

বয়স্ক লোকটি বললেন, “ওকে ক্ষমা করে দেবেন, দিদিজি!”

নোঈ মাথা নেড়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। মেয়েটার জন্য এবার একটু খারাপ লাগছে ওর। আসলে এটাই হয় নোঈর। রাগের পর কেমন একটা খারাপ লাগা আসে। আসলে মেয়েটার তো দোষ নেই! ও তো ঠিকই দেখেছে নোটটা! কিন্তু এটা তো কোনওদিন দিতে পারবে না ও। কাউকেই দিতে পারবে না।

আচমকা জয়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। রোগা, ফরসা, চাপদাড়ি আর চশমা। চশমার আড়ালে একজোড়া বাদামি রঙের চোখ। নোঈর দেখলে মনে হত, ওই চোখের ভেতরে কিছু একটা আছে, না হলে কেন এমন ওলট-পালট হয়ে যেত ওর মনটা! শুধুই ওলট-পালট হয়ে যেত! সবটাই কি অতীত এখন? ওই চোখটা মনে পড়লে কি এখনও কিছু হয় না? ভরা কলকাতাটা কি এখনও আচমকা শূন্য হয়ে যায় না?

নোঈ দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবল, না আর অতটা শূন্য হয়ে যায় না। জয়ের ওই শেষ কথাগুলো শোনার পর আর কিছু হয়ে যায় না। আসলে একটা-একটা করে ইট গেঁথে তুলে জয়ের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে নোঈ। যে-কষ্ট আর মানসিক অত্যাচার জয় ওকে করেছে, সেটাতে আর ফিরে যেতে পারবে না ও। তার চেয়ে এমন হয়ে থাকাই ভাল।

রবীন্দ্রসদন মেট্রোয় ঢোকার মুখটায় খুব ভিড়। বিকেল শেষ হচ্ছে, কিন্তু নোঈ লক্ষ করেছে, বিকেল শেষ হওয়ার পর থেকেই কলকাতা যেন নতুন করে জেগে ওঠে। অফিস বা কলেজ ফেরতা মানুষের মধ্যে সুন্দর করে সাজগোজ করে ঘুরতে বেরোনো মানুষও মিশে থাকে। এই শহরে আবহাওয়া আজকাল আর বোঝা যায় না। শুধু যুবক-যুবতীদের পোশাকটাই বলে দেয়, কী ঋতু ফিসফিস করছে বাতাসে!

রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে মেট্রোর সিঁড়িতে পা দিল নোঈ। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারল না।

“নোঈ,” পেছন থেকে আসা ডাকটা থমকে দিল ওকে। ও পেছনে ঘুরল। দি!

নোঈ দাঁড়িয়ে পড়ে এক ধাপ নেমে এল সিঁড়ি থেকে। তারপর পথ না আটকে রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে বলল, “দি তুই? এখানে?”

আইকা কপালে এসে পড়া চুলটা ঠিক করে নিয়ে বলল, “বাড়ি যাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ,” নোঈ মাথা নাড়ল।

“চল আমার সঙ্গে,” আইকা নোঈর হাত ধরে টান মেরে ওকে রাস্তায় নামিয়ে আনল।

“আরে, আমি বাড়ি যাব। অফিস থেকে আসছি। নিড আ শাওয়ার দি। তুই কি গাড়ি এনেছিস?”

“না, গাড়ি আনিনি আজ। আর আমিও বাড়ি যাব। চল না!” আইকা হাত ধরে টানল, “এই ক্লাবে এসেছিলাম দু’মিনিটের জন্য। একজনকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল। ওই পারে গাড়িতে আমার বন্ধু বসে আছে। ও পৌঁছে দেবে। চল।”

নোঈ ভুরু কোঁচকাল। আইকার বন্ধু তো ও যাবে কেন তার গাড়িতে? চেনে না জানে না! কেন যাবে? বোকা বোকা ব্যাপার!

ও বলল, “না, আমি মেট্রোতেই যাব।”

“আচ্ছা ঢ্যাঁটা মেয়ে!” আইকা কপট রাগে চোখ পাকাল, “হাত ধরে টানছি, এবার না গেলে কান ধরে টানব তোকে। চল। পাকামো সব সময়!”

“তুই যে কী করিস না!” নোঈ হাসল, “ঠিক আছে চল। এইটুকু পথ তাও আবার গাড়িতে!”

আইকা কথার উত্তর না দিয়ে রাস্তার গাড়ির জটের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে নোঈকে নিয়ে পথ পার হয়ে গেল।

রাস্তার এই পারটায় যেন আরও ভিড়। মেট্রো স্টেশনের আড়ালে খাবারের দোকান আছে এদিকে। মানুষ তার উপর যেভাবে ভেঙে পড়েছে, নোঈ ভাবল কলকাতায় কি এতদিন দুর্ভিক্ষ চলছিল?

এই পাশের ফুটপাথ আর রাস্তাটা মোড়ের কাছে বেশ অপরিষ্কার! খাবারের অবশিষ্ট, রোলের ছেঁড়া কাগজ, পচা ফল, পানের পিক! নোংরা দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে নোঈর। ও দেখল আইকা অম্লানবদনে সেই সব টপকে মানুষের ভিড়ের ভিতর দিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেল।

এই পারে এসেই নোঈর হাত ছেড়ে দিয়েছিল আইকা। তাই নোঈ পিছিয়ে পড়ল একটু। তারপর সময় নিয়ে নোংরা বাঁচিয়ে এগিয়ে গেল গাঢ় নীল রঙের একটা গাড়ির সামনে দাঁড়ানো আইকার দিকে।

“এত পুতুপুতু কেন তোর?” আইকা ভুরু কোঁচকাল, “এই শহরে বড় হয়েছিস না?”

নোঈ কিছু না বলে হাসল। আসলে সব কিছুর তো উত্তর হয় না! তবে অবাক লাগল দেখে যে, আইকা এমন উচ্ছ্বসিত! সাধারণত আইকা একটু গম্ভীর ধরনের মেয়ে। সে এমন স্কুলের মেয়েদের মতো তড়বড় করছে দেখে, কেমন একটা লাগল নোঈর! কিন্তু কিছু বলল না। আইকাকে ভাল লাগে ওর। খুব ভাল লাগে এমনটা নয়, কিন্তু ভালই লাগে। আসলে আইকার জীবনটা খুব-একটা আনন্দের নয়। তাই ভাল লাগার চেয়ে একটা চাপা সহানুভুতি কাজ করে নোঈর। মনে হয়, মেয়েটা দুঃখী! আর দুঃখী মানুষদের জন্য কোথায় যেন একটা খারাপ-লাগা কাজ করে ওর।

“কী রে! কী ভাবছিস? আজকাল কী হয়েছে তোর? এখন তুই শিয়োর প্রেমে পড়েছিস কারও, না?” আইকা হাসল।

“ধুৎ!” খানিকটা জোর করেই পালটা হেসে উত্তর দিল নোঈ।

মানুষজনের এই ধরনের ইয়ারকিগুলো খুব বোকা বোকা লাগে নোঈর। সামান্য অন্যমনস্ক লাগলেই হয় বলে, কী রে কবিতা লিখবি! নয়তো এই, প্রেমে পড়েছিস! এত স্টিরিয়টাইপ! মানুষ যেন এমনি অন্যমনস্ক হতে পারে না! যেন তার আনমনা হতে এমনি এমনি ইচ্ছে করতে নেই!

“শোন না,” আইকা হাত ধরল ওর, “একটা সারপ্রাইজ় দেব তোকে।”

“আমায়!” নোঈ অবাক হল। তবে সত্যি বলতে কী একটুও আগ্রহ বোধ করল না। আজ চাকরি ছেড়ে এসেছে। অশান্তি হয়েছে অফিসে। ওদিকে বাড়িতেও মায়ের সঙ্গে ঝামেলা চলছে! এখন কি আর ওর এই সব সারপ্রাইজ় দেখে আনন্দে ডগমগ হওয়ার সময় আছে!

“আয়।”

আইকা হাত ধরে ওকে আবার টেনে এনে দাঁড় করাল ওই গাড়িটার পাশে। নোঈ দেখল নীল গাড়িটার কাচটা টিন্টেড। আইকা হাত ঘুরিয়ে গাড়িটার কাচটা নামানোর ইঙ্গিত করল।

সামান্য সময় নিল গাড়ির ভিতরে বসা মানুষটা। তারপর মসৃণভাবে নেমে এল গাড়ির কাচ। শহরের মাথা থেকে প্রায় বিদায় নেওয়া শেষবেলার আলো তার আবছা রং নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল গাড়ির গায়ে, তার ভিতরে। নোঈ দেখল মানুষটাকে। আর খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনে হল, ওর পায়ের তলার মাটি একটু কাঁপল!

আবার কি ভূমিকম্প হল? না মনের ভুল! নোঈ একবার তাকিয়েই কেন জানে না চোখটা সরিয়ে নিল মানুষটার দিক থেকে। বুকের ভিতর কেমন একটা অস্বস্তি হল ওর। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এই আইকার সারপ্রাইজ়? ও যত এইসব এড়াতে চাইছে, তত কেন জীবন এমন সব ঘটনা ও মানুষ এনে সামনে রাখছে ওর! মায়ের সঙ্গে যে জন্য বিবাদ হচ্ছে সেই কারণটাই ওর সামনে! কেন বারবার ঈশ্বর ওকে এমন বিপদে ফেলেন? এমন সংকটের সামনে এনে দাঁড় করান?

“কী রে, খুব চমকে গিয়েছিস, না?” আইকা হাসল, “তোর উড বি হাজ়ব্যান্ডের দাদা। চিনতে পারছিস?”

উড বি হাজ়ব্যান্ড! কথাটা কট করে কানে লাগল নোঈর। এসব কী বলছে আইকা! উড বি হাজ়ব্যান্ড মানে? ও তো সেই ডাক্তার ছেলেটিকে বিয়েই করবে না। তবে! এসব কী বলছে আইকা!

“আঃ দি! কী সব বলছিস তুই!” নোঈ দাঁত চেপে বলল কথাগুলো, “কার বিয়ে? কে উড বি হাজ়ব্যান্ড?”

“তোর রে। ন্যাকা খুকি আমার!” আইকা হইহই করে হেসে গাড়ির ভিতরে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখলি, কেমন লজ্জা পাচ্ছে! এখনও বিয়ে হয়নি, তাতেই এত লজ্জা! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!”

মানুষটা এবার গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। নোঈ আজ যেন ভাল করে দেখল মানুষটাকে। গম-রঙা মানুষটার দোহারা চেহারা। পাঁচ ফুট দশ-এগারো ইঞ্চির মতো উচ্চতা। সামান্য ঢেউ খেলানো চুল, গোঁফ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। মুখে হাসি থাকলেও কোথাও যেন একটা বিষণ্ণতাও আছে। ওই ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে ওকে দেখতে এসেছিল এই মানুষটা। কিন্তু সেদিন ভাল করে তাকায়নি নোঈ। বিরক্তিতে সেদিন ভাল করে মুখই তোলেনি ও। সেদিন সবকিছু আর সকলকে অসহ্য লাগছিল। নিজেকে পথের উপর উপুড় করে বিক্রি করা সবজির মতো মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সকলে চোখ দিয়ে টিপে-টুপে ওজন করে দেখছে ও কতটা চলতে পারে। ওকে নিজেদের সংসারে নিলে লাভ হবে না ক্ষতি। কী ভীষণ অপমানজনক আর বর্বর এই প্রথা! আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে এত ছুঁতমার্গ, কিন্তু আসলে গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের নানা রিচুয়াল আর সামাজিক আচার আসলে কোথায় যেন একটা জাতির অবদমিত যৌনতাকেই বড্ড বেশি করে ফুটিয়ে তোলে।

আজ কিন্তু মানুষটাকে দেখে নোঈর অস্বস্তি হলেও তার তলায় কোথায় একটা ভালও লাগছে। কেউ-কেউ থাকে যাদের দেখলে পাহাড়ের কথা মনে পড়ে। সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ের নীল রঙের মধ্যে জেগে থাকা নির্জনতার কথা মনে পড়ে। এই মানুষটাকে দেখেও সেটাই মনে হচ্ছে নোঈর। মনে হচ্ছে, এই ভিড়ে হিজিবিজি হওয়া এক্সাইড মোড়েও মানুষটা কেমন যেন একলা, কেমন যেন নির্জন! নোঈর খারাপ লাগল এই ভেবে যে, এই মানুষটার সঙ্গে ওর এমন একটা পরিস্থিতিতে দেখা হল!

“এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে?” আইকা হি হি করে হাসল এবার।

“কী করছিস! উনি হয়তো এমব্যারাসড হচ্ছেন!”

মানুষটার গলাটা হালকা, নরম। নোঈ মুখ তুলে তাকাল। আর আবার কয়েক লক্ষ মাইল দূরের কিছুর টানে পৃথিবী নড়ে উঠল যেন। কী হচ্ছে এসব! নোঈ ধমক দিল নিজেকে।

আইকা বলল, “কেন, তোর ভাইয়ের সঙ্গেই তো বিয়ে হবে ওর, বললে লজ্জা কী!”

মানুষটা হাসল সামান্য। তারপর আইকাকে বলল, “আচ্ছা, তুই থাম,” তারপর নোঈর দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় বলল, “সেদিন ভাল করে আলাপ হয়নি। তাই হয়তো আপনি আমার নামটা মিস করে গিয়েছেন। আমার নাম…”

নোঈ মুখ তুলল। দূরের মহাজাগতিক বস্তুটি নড়ছে। তরঙ্গ ভেসে আসছে শূন্যতা ভেদ করে। এ হতে পারে না। এমন অবিবেচক হতে পারে না নোঈ। প্রত্যেকটা শুরুর আগে একটা শুরু থাকে। যেমন থাকে, প্রত্যেকটা শেষের পরে আর-একটা শেষ। তাই সেই শুরুর আগের শুরুটা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। নোঈ এতটা বোকা, সেন্টিমেন্টাল হতে পারে না। হতে পারে না আর সেইসব কিছু, যেগুলোকে ও নিজেই সারা জীবন হেয় করে এসেছে, ছোট করে এসেছে! ওই কম্পনকে ও সামলে দেবে রূঢ়তা দিয়ে। ভরিয়ে দেবে নিষ্ক্রিয় কিছু শব্দ দিয়ে।

মানুষটার কথা শেষ হওয়ার আগেই নোঈ তাই ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি জানি। মনে আছে। আর আমি নোঈ, অ্যাজ় ইউ নো। আর শুনুন, দি জানে না। শি ইজ় মিসইন্টারপ্রেটিং মাই সাইলেন্স। অ্যাকচুয়ালি অল অফ দেম আর! কিন্তু আপনি ভুল কিছু ভেবে নেবেন না। আমি আপনার ভাইকে বিয়ে করছি না। বুঝলেন মিস্টার পুশকিন চক্রবর্তী?”

.

০৬.কাজু

গাছ থেকে পাতাটা ঘুরে-ঘুরে পড়ছে! নদীর দিক থেকে আসা হাওয়া পাতাটাকে আলতো করে ধরে নামিয়ে আনছে মাটির দিকে। বিকেলের রোদ নরম হয়ে আসছে এবার। শীতের ছোট বেলা গুটিয়ে নিচ্ছে পৃথিবী। মনখারাপ রঙের একটা আলো ধীরে-ধীরে নেমে আসছে সোনাঝুরির বুকে! আর কিছু পরেই চটকলে ভোঁ পড়বে। গঙ্গার পাড়ে নৌকোর আনাগোনা বেড়ে যাবে। জলে মেটে সিঁদুর গুলে দিয়ে সূর্য ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাবে পাতালে!

এমন সময়টা বুকের ভেতর কেমন যেন করে কাজুর। মনে হয়, কত কিছু যে করার ছিল, কিন্তু কিছুই করা হল না। মনে হয়, হাজার বছর কেটে গিয়েছে, ও এখানেই এমন পাথরের মতো বসে রয়েছে। কত কবিতা লেখা বাকি রইল। কত দেশ দেখা বাকি রইল। কত মানুষের পাশে দাঁড়ানো বাকি রইল। কত কী বাকি রয়ে গেল। ওর বয়স ছাব্বিশ। বন্ধুরা বলে সারা জীবনটা পড়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু কাজু জানে পড়ে নেই, সময় নেই ওর হাতে। কেন কে জানে ছোট থেকেই ওর কেবলই মনে হয় ওর সময় কম! যা করতে হবে, তাড়াতাড়ি করতে হবে। যা লিখতে হবে, তাড়াতাড়ি লিখতে হবে। যেখানে-যেখানে যেতে হবে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মনে হয় ওর জীবনও ওই শীতের ঝরে পড়া পাতার মতো। হাওয়ায় ভেসে ধীরে-ধীরে মাটির বুকে নেমে আসছে। একবার ভূমি স্পর্শ করলেই সব স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই এই ভেসে থাকার সময়টুকুই হাতে রয়েছে ওর। যা কিছু করার করে নিতে হবে এই সময়টার মধ্যেই।

ভাল করে গায়ের চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে বসল কাজু। গত রাত থেকে জ্বর এসেছে। ভেবেছিল ওষুধ না খেলেও কমে যাবে। কিন্তু কমছে না। বাবা বলেছে স্বপনডাক্তারকে যেন সন্ধেবেলা গিয়ে দেখিয়ে নেয়।

ডাক্তার দেখাতে বিরক্ত লাগে কাজুর। ওই স্বপন ডাক্তারকে দেখালেই একটা কাচের কর্ক আঁটা বোতলে লাল মিক্সচার দেয়। বোতলের গায়ে আবার কাগজের খাঁজকাঁটা দাগ দেওয়া। এক চামচ পেটে পড়লে মনে হয় ঊর্ধ্বতন দশ পুরুষের মুখ তেতো হয়ে গেল! কাজুর বিরক্ত লাগে।

তার চেয়ে মজুমদার-ডাক্তার ভাল। রোগা-পাতলা। প্রায় বুকের কাছে প্যান্ট পরে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। একটা নড়বড়ে টেবিলে রাখা হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স, নরম আলোর হারিকেন আর মান্ধাতার আমলের চেয়ারে নিজে বসেন মানুষটা। পাশেই একটা লম্বা বেঞ্চ। রোগী এসে বসে সেখানে।

খুব একটা ভিড় হয় না মজুমদার-ডাক্তারের কাছে। কাজু যাতায়াতের পথে দেখে, মানুষটা একমনে বই পড়ছেন। কবিতার বই!

নয়না এই মজুমদার-ডাক্তারের মেয়ে। বাবার মতো মোটেই শান্তশিষ্ট নয়। বরং খুব দস্যি। নয়নাকে ভয় লাগে কাজুর। পেখমের প্রাণের বন্ধু নয়না। তাই পেখমকে বলতে পারে না যে, নয়না ওর দিকে অন্যভাবে তাকায়। একা দেখা হলেই অদ্ভুত সব কথা বলে। কথা বলতে-বলতে হাত ছোঁয়! হাসে। কাছে এগিয়ে আসে। ভয় লাগে কাজুর। খুব ভয় লাগে। পেখম যদি জানতে পারে! যদি ভুল বোঝে! পেখম ওর কাছ থেকে সরে গেলে ওর যে কী হবে!

নদী থেকে আসা হাওয়ায় শিরশির করে উঠল কাজুর শরীর। আস্তে আস্তে জুটমিল থেকে লোকজন বেরোচ্ছে। সাইকেল বাড়ছে সোনাঝুরির রাস্তায়। এই বড় বাড়িটার সামনের গেট ছুঁয়ে চটকলে যাওয়ার রাস্তা।

কাজু মাঝে মাঝে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি। চারটে বড়-বড় ব্লক। আসলে বাড়িটা বহু পুরনো। তখন মাত্র একটা ব্লক ছিল। সে সময় এখানে পর্তুগিজ সারেংরা থাকত। তাদের কাছ থেকেই পরে ব্রিটিশরা এই জায়গা কেনে। জুটমিল বানায়। বাড়িটার একটা ব্লক থেকে চারটে ব্লক করে। তারপর থাকতে শুরু করে। পরে বিশের দশকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই মিল, এই বাড়ি আর আশপাশের জায়গা কিনে নেয় মালিক গ্রুপ। তারপর থেকে তারাই এর অধিকর্তা।

প্রায় দেড়শো বছর বয়স বাড়িটার। এখন গাদাগাদি করে অনেকে থাকে। জুটমিলের বহু হিন্দিভাষী মানুষ থাকে এই বাড়িতে। আরও নানা মানুষজন থাকে। কাজুরাও অনেকে থাকে দুটো ঘর নিয়ে। সবাই মিলে হাঁসফাঁস করে দুটো কামরায়! তাই ছাদের ওপর প্রায় ভেঙে যাওয়া একটা ঘরে কাজু বেশির ভাগ সময় কাটায়। এমনকী, গরমকালে তো সেখানে ঘুমিয়েও পড়ে রাতে।

চারটে বাড়িই তিনতলা। কিন্তু পুরনো দিনের বাড়ি বলে সেটাকে ছ’তলা মনে হয়। ছাদটাও গড়ের মাঠের মতো। তবে সন্ধের পর বিশেষ কেউ যায় না। আর ওই চিলেকোঠায় তো কেউ যায়ই না।

কিন্তু আজ শরীর ভাল নেই, তাই ছাদে আর ওঠেনি কাজু। বরং এই বড় উঠোনটায় এসে বসেছে। আর দেখছে বিকেল কেমন শামুকের মতো এগিয়ে চলেছে আরও গাঢ় বিকেল ছুঁয়ে সন্ধের গুহায়!

কাজু দেখল, ওদের ওই বড় গেট পেরিয়েই মানুষজন আসছে ভেতরে।

“কা বাবুয়া, বুখার আভি উতরা নহি?” যাদবকাকা সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়াল।

সত্যনারায়ণ যাদব ছাপরার মানুষ। চটকলে ফোরম্যানের কাজ করে। ইউনিয়নের নেতাও। ওদের পার্টিরই লোক। প্রৌঢ় মানুষটি বড় ভালবাসে কাজুকে।

কাজু বলল, “না, কমেনি। যাব সন্ধেবেলা মজুমদার-ডাক্তারের কাছে!”

“ও দ্যাট ওল্ড হ্যাগ!” পাশের ইজ়িচেয়ার থেকে সিগারেটে বড় টান দিয়ে কথাগুলো বলল আন্টি বাডু।

যাদবকাকা ঠোঁট টিপে হেসে কাজুর দিকে চোখের ইশারা করল। কাজুও হাসল মুখ টিপে।

কাজুরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। তবে বাবার দিকে থেকে ওরা বাঙালি হলেও ওর মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মায়ের দিকে আর কেউ বেঁচে নেই শুধু এই আন্টি ছাড়া। কাজুর মাকে ছোট থেকে এই আন্টিই মানুষ করেছিল নিজের কাছে রেখে। তাই এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আন্টি থাকে ওদের কাছে। আসলে কোথাও যাওয়ার নেই মহিলার!

আন্টির মনটা ভাল হলেও মুখ খুব খড়খড়ে। কাজু এই নিয়ে কিছু বললেই বলে, “হবই তো রাফ! কোন সময় পার করে এসেছি জানিস? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোরা পল্টনদের ক্লাবে ওয়েট্রেস ছিলাম। যদি না মুখ চালাতাম তবে আমায় এখানে দেখতে পেতিস না! কোনও অন্ধকার গলিতে পচে-গলে মরতে হত! মুখের জোর ছিল বলে ওই ছ’বছর বয়সের বনি, মানে তোর মাকে নিয়ে বাঁচতে পেরেছি! অন্ধকার আর তোরা কী দেখলি!”

আন্টির বয়স এখন প্রায় পঁয়ষট্টি। সারাদিন খুটখুট করে সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করে আর মাঝে মাঝে বিকেলে এই ইজ়ি চেয়ারটায় বসে সিগারেট খায়! ওদের মফস্‌সলে মেয়েরা সিগারেট খায় না। তাই নতুন মানুষজন এখনও আন্টিকে ওইভাবে আধশোয়া হয়ে সিগারেট খেতে দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিসফাস করে। হাওয়ায় ওড়া কথা কানে আসে কাজুর। শোনে, আন্টি নাকি অন্য ধরনের মহিলা!

গোটা ব্যাপারটায় হাসি পেলেও সমাজের মানুষজনের মানসিক অন্ধকারটা বোঝে কাজু! ওদের এই বাড়িতেই কয়েকটা ঘরে রাতের বেলায় অশান্তি হয়। রেল লাইনের পাশের ঝুপড়ি থেকে বাংলা মদ খেয়ে এসে হল্লা করে কেউ! কেউ আবার নিজের স্ত্রীকে পেটায়, অকথ্য গালিগালাজ করে! সেসব নিয়ে কিন্তু কারও মাথাব্যথা নেই! সবাই যে যার ঘরের খিল আটকে থাকে। কাজু কয়েকবার বলতে গিয়েছে বটে এই নিয়ে, কিন্তু বাবা-মা এখন কাজুকে যেতেও দেয় না! বাবা বলে, “তোর ওপর জগতের ভার নেই। সব সমস্যা মেটাতে তুই আসিসনি। তুই মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার নোস যে, ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ বলে বেরিয়ে পড়বি। চেপে বসে থাক।”

নিজের ঘরে বসে কাজুর একটা অসহায় রাগ হয়। মনে হয় কিছুই কি করার নেই ওর? কিছুই কি করতে পারে না?

আন্টি হাতের সিগারেটটা মাটিতে নিবিয়ে টোকা মেরে পাশের একটা জঞ্জাল রাখার জায়গায় ছুড়ে দিয়ে বলল, “তুই কেন যাবি ওই জোচ্চোরটার কাছে! ও ডাক্তার?”

কাজু হাসল, “আন্টি, তুমি এমন বলো কেন? কত ভাল লোক জানো? কবিতা পড়ে!”

“মাই ফুট, কবিতা পড়ে! তা হলে তোদের কফি হাউসে গিয়ে বনের মোষ তাড়াক! এখানে ওরকম ম্যাদামারা চেম্বার খোলার কী আছে!” আন্টি তার বড় শরীরটা নিয়ে কোনওক্রমে সোজা হল। ইজ়ি চেয়ারটাও প্রাণপণে ক্যাঁচকোচ শব্দ করে প্রতিবাদ জানাতে চাইল। কিন্তু আন্টি পাত্তা দিল না একটুও। বরং বলল, “দ্যাট ম্যান ইজ় নাথিং। বলে আমায় সিগারেট ছেড়ে দিতে। না হলে শ্বাসের কষ্ট কমবে না। তবে তোর ওষুধ খাব কেন রে মর্কট! সিগারেট ছাড়লে তো এমনিই ভাল থাকব। তোর ওষুধে জোর নেই তাই ছাড়তে বলিস। ওটার কাছে যাবি না কাজু!”

কাজু বলল, “কিন্তু আমার তো কমে!”

“মোটেই কমে না!” আন্টি এবার কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল, “ওটা প্লাসিবো এফেক্ট। মিছরির দানায় অ্যালকোহল ঢেলে রোগ কমাচ্ছে! তুই স্বপনডাক্তারের কাছে যা।’

আন্টি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলমল পায়ে কিছুটা বেসামাল হল। কাজু উঠে গিয়ে ধরল চট করে। আন্টি নিজেকে সামলাল। তারপর কাজুর হাতটা ধরে তাপ মাপল। কপালেও হাত চেপে দেখল কতটা গরম। তারপর বলল, “এ কী রে! জ্বর তো আছে! এই ঠান্ডা হাওয়ায় বসে কী করছিস? যা ঘরে যা।”

“আমি ঠিক আছি,” কাজু হাসল, “তুমি আস্তে আস্তে যাও। দোতলায় উঠতে পারবে, না আমি ধরব?”

আন্টি পাত্তা না দিয়ে তাকাল যাদবকাকার দিকে। তারপর বলল, “আর তুমি আবার পার্টি-পলিটিক্স খুলে বোসো না। ওকে রেস্ট নিতে দাও।”

যাদবকাকা হাসল। আন্টি বিরক্ত হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল মূল বাড়ির দিকে।

কাজু আবার বসল বাঁধানো রকটায়। আজ কিচ্ছু ভাল লাগছে না। পেখমকে পড়াতে যাওয়াও নেই। ওরা থাকবে না। কলকাতায় যাবে সবাই মিলে। প্রথম-প্রথম ও গুটিয়ে থাকত, কিন্তু এখন পেখমকে না দেখলে মনখারাপ করে ওর। কেমন সব আবছা লাগে! বুকের ভেতরে যে কষ্টের একটা ছোট্ট চোরাকুঠুরি থাকে, প্রেমে না পড়লে বোধহয় মানুষ জানতে পারে না! কাজু ভাবে কুঠুরিটা থাকলেও কষ্ট, আবার না থাকলেও শূন্যতা। ভাবে, মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী। যা মনে করলে কষ্ট হয়, তাই সে বারবার মনে করে। গলায় কাঁটা ফুটলে যেমন বারবার ঢোঁক গিলতে চায়, ঠিক তেমন। কষ্টের তলায় কি সত্যি পূর্ণতার ফল্গুনদী বয়? কষ্ট পাওয়াটাকে কি আমরা সত্যি মহান কিছু হিসেবে দেখি? আমরা কি কষ্টের আগুনে পুড়ে নিজের ভিতরের খাদগুলো গলিয়ে ফেলতে চাই? বিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার প্রচেষ্টা কি সকলের মনের অবচেতনে কাজ করে?

পেখমকে না দেখলে আজকাল কেমন একটা ভয়ও যেন গ্রাস করে ওকে। কাকিমা, মানে পেখমের মা ওকে পছন্দ করে না। প্রথম দিন থেকেই সেটা ও বোঝে। যদিও কাকু খুব ভাল মানুষ। পুলিশে চাকরি করেন বলে বাড়িতে বিশেষ থাকেন না। আর পেখমের ঠাকুরদা তো খুবই ভাল! এই মানুষটার জন্যই যে ও পেখমের কাছে যেতে পারছে, সেটা পেখমের থেকেই জেনেছে কাজু! কিন্তু ওই বাড়িতে ঢুকলেই ও বোঝে কোথায় যেন দুটো চোখ ওকে সারাক্ষণ লক্ষ রাখছে! খুব অস্বস্তি লাগে! তাই যতক্ষণ থাকে মাথা নিচু করে থাকে। নিজের মতো পড়িয়ে চলে আসে।

তবে পেখমের সঙ্গে ওর দেখা হয় সোনাঝুরির কোনও না-কোনও লুকোনো ভাঁজে। তাও সামান্য সময়ের জন্য। আর প্রতিদিন দেখা করে ফেরার পরে মনের ভিতর তৈরি হওয়া কুয়োটা যেন আরও গভীর হয়ে পড়ে! যেন কুয়োর ভিতর থেকে অতৃপ্ত আত্মারা সব দু’হাত তুলে জল প্রার্থনা করে! প্রতিদিন পেখমের কাছ থেকে সরে আসার সময় শরীরের আর মনের ভিতর কী যেন ছিঁড়ে পড়ে যায়! যন্ত্রণায় ছটফট করে কাজু! ভাবে, কবে পেখমকে সারা জীবনের মতো করে পাবে ও!

“সচমে বুখার ইতনা হ্যায়?” যাদবকাকা সামনে এসে কপালে হাত দিল এবার। তারপর বসে পড়ল পাশে, “আসলে তোর সঙ্গে কিছু কথা ছিল কাজু।”

কাজু সরে বসল একটু। যাদবকাকা সোজা মিল থেকে আসছে। শরীর থেকে ঝাঁজালো ঘামের নোনতা গন্ধের সঙ্গে খইনির গন্ধও আসছে। খারাপ গন্ধ সহ্য করতে পারে না কাজু। আর এখন তো শরীর খারাপ, তাই আরও গা গুলোচ্ছে!

যাদবকাকা এসব ভ্রূক্ষেপ করল না। বরং আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুই খবর জানিস?”

“কী?” কাজু যতটা সম্ভব কম শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল।

যাদবকাকা বলল, “রাশিয়া থেকে বিরাট অর্ডার পেয়েছি আমরা। প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকার অর্ডার। বুঝলি? কিন্তু সেখানে ইন্সপেকশন ক্লজ় আছে। লেট সাপ্লাইয়ের জন্য পেনাল্টি ক্লজ় আছে। অর্ডার পাওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। বলেছিল ঠিক সময়ের মধ্যে আমরা যদি মাল ডেলিভারি করে দিতে পারি ফাইভ পারসেন্ট করে ইনটেনসিভ দেবে।”

কাজু বলল, “ইনসেনটিভ!”

“ও একহি বাত হ্যায়,” কথাটাকে মাছির মতো হাত নেড়ে সরাল যাদবকাকা, “কিন্তু প্রোডাকশন ঝাড় খেয়েছে। মালিকের ছেলে দু’নম্বরি পাট দিয়ে বেশ কিছু মাল তৈরি করতে বলেছিল। সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফেঁসে! এখন মালিক বলছে আমাদের নাকি দোষ! বলছে পার্টি যদি টাকা কাটে, তবে আমাদের থেকে মালিকও কেটে নেবে। তার যুক্তি হল, লাভ হলে যদি ফাইভ পারসেন্ট বেশি টাকা আমরা নেব বলে মেনে নিই, তবে লোকসান হলেও তার দায়ের একটা অংশ আমাদের বইতে হবে। ব্যাটা মানছেই না যে, যা হয়েছে ওর লালচি ছেলের জন্য হয়েছে!”

কাজু শুনল চুপ করে। তারপর বলল, “গোপেনদা জানে?”

গোপেন শাসমল এই অঞ্চলের এমএলএ। তা ছাড়া এই জুটমিলটার ব্যাপার-স্যাপারগুলো গোপেনদাই দেখে। যদিও কাজুদের বিরোধী পার্টির লোক গোপেন, কিন্তু কাজুকে বিশেষ স্নেহ করে। মতবিরোধ থাকলেও কাজুর কথার গুরুত্ব দেয়!

“সেই জন্যই তো তোকে বলছি কাজু!” যাদবকাকা দু’হাত দিয়ে ধরল কাজুর হাত। বলল, “তুই একবার বল দাদাকে। আমরা ওর দুশমন তো! আমাদের মিলের ইউনিয়ন ওরা এখনও দখল করতে পারেনি। তাই খুন্নস আছে লোকটার। তুই একবার ওকে বল। তোকে তো অন্যভাবে দেখে। জানিস তো মালিকদের সঙ্গে ওর দহরম-মহরম খুব। ওরা ইউনিয়নে ক্ষমতায় না থাকলেও মালিক ওর কথা ফেলবে না।”

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিল। যাদবকাকার হাতটা খরখরে বালি-কাগজের মতো। মুখটা তেতো লাগছে। মাথাটাও ব্যথা করছে বেশ। নদীর দিক থেকে আসা হাওয়ায় শীতটা যেন শিরদাঁড়াতেও অনুভব করতে পারছে। শরীরখারাপের মধ্যে আর এইসব ভাল লাগছে না। কিন্তু ও জানে ভাল না লাগলেও এটা ওকে করতে হবে। যেভাবেই হোক করতে হবে। অনেক মানুষের ন্যায্য পাওনা জড়িয়ে আছে এতে! মরালিটির প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আসলে টাকা এসে গেলেই ও দেখেছে মরালিটিগুলো কেমন যেন পেছনের দিকে চলে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। মানুষ মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে এই রুপোর ঝনৎকারের সামনে! তাই ভাল না লাগলেও এই নিয়ে গোপেনের সঙ্গে কথা বলতে হবে ওকে। আজ না হলেও দু’-এক দিনের মধ্যেই বলতে হবে। কাজু জানে এতে হয়তো সোনাঝুরিতে ওদের পার্টির মাথা বিমলদা রাগ করবে, কিন্তু বিমলদা এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না। মালিকপক্ষের সঙ্গে বিমলদার সম্পর্কটা আদায়-কাঁচকলায়। যাদবকাকা ঠিকই বলেছে, গোপেনদার দল এখনও ইউনিয়নের দখল নিতে না পারলেও গোপেনদার সঙ্গে মালিকের খাতির খুব! তাই ও জানে, কিছু করতে পারলে গোপেনই পারবে। কাজু বোঝে সব বিষয়ে মাথা গরম করলে হয় না। কিছু জিনিস বুদ্ধি করেও বের করতে হয়।

“আরে, তুই শুনছিস কি?” যাদবকাকা বলল, “জানি, তোর কষ্ট হচ্ছে শরীর খারাপ নিয়ে এসব শুনতে। কিন্তু আজই এই নিয়ে একদফা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। তু জরা দেখ কাজু। ঝামেলা হতে পারে বড়। যদি মাল ইন্সপেকশনে আটকে যায়, বা সেখানে বেরিয়ে গেলেও ডেলিভারির পরে যদি বেশির ভাগ মাল ফেঁসে যায়, তা হলে পার্টি শেষ টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকা আটকে দেবে! মালিকরা তো লাভ বের করে নিয়েছে! কিন্তু ওই আটকে যাওয়া টাকার ছুতোয় আমাদের মাইনে আটকে যাবে। বিশাল অসুবিধে হয়ে যাবে। বাবু তু জরা দেখ।”

কাজু তাকাল সামনের দিকে। আলো নরম হয়ে এসেছে। হাওয়ার ভেতরের শীতটাও বাড়ল যেন। ও যাদবকাকার মুখের দিকে তাকাল। লোকটাকে কেমন ভাঙাচোরা লাগছে আজকে। সারাদিন কাজের পর এখন এইসব নিয়ে ভাবছে। না নিজের জন্য শুধু নয়, সকলের জন্য। মালিকের ছেলেটি গন্ডগোলের। সবাই জানে। মালিক নিজেও জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না!

গায়ের চাদরটা ভাল করে আবার জড়িয়ে নিল কাজু। তারপর ধীর গলায় বলল, “আমি দেখব যাদবকাকা। তুমি চিন্তা কোরো না। লক আউট করব বললেই তো করা যায় না। আমি কথা বলব গোপেনকাকার সঙ্গে। আজ সন্ধেবেলা যাব মজুমদার-ডাক্তারের কাছে। ফেরার পথে গোপেনকাকার বাড়ি হয়ে আসব। দেখি, কী বলেন কাকা। কেমন?”

যাদবকাকা উঠল। পকেট থেকে খয়েরি রঙের একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছল। তারপর হাসল, “আরে, সুস্থ হয়ে যা আগে। পহলে বুখার তো উতর যায়ে! তারপর দেখিস। আজ যেতে হবে না।”

কাজু নিজেও উঠল। ঘরে যাবে। আর বসবে না। সন্ধে হয়ে যাবে একটু পরে। মশা আসতে শুরু করেছে। এখনই কয়েকটা কানের কাছে পিনপিন করছে। যাদবকাকার মাথার উপর মুকুটের মতো ঘন হয়ে এসেছে কয়েকটা। ও দেখল যাদবকাকা বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে।

বাড়ির চারটে ব্লকের সাউথ ব্লকে থাকে যাদবকাকা। তিন তলায়। আর নর্থ ব্লকের দোতলায় থাকে কাজুরা। তবে এটাকে যদি থাকা বলে!

আগেকার দিনের বাড়ি। কড়িবরগা দেওয়া সিলিং উঁচু হলেও ঘরগুলো খুব একটা বড় নয়। ইয়া মোটা মোটা দেওয়াল। তবে ড্যাম্প ধরা। ঘরে ঢোকার দরজাগুলো বেশ ছোট। ঘরে কুলুঙ্গি আছে দুটো। ইলেকট্রিকের কানেকশান আছে। তবে মরা মানুষের চোখের মতো টিমটিম করে বাল্‌ব। একটা ডিসি পাখা ওই সিলিং থেকে লম্বা রড দিয়ে ঝুলে থাকে। চৌকো বাক্সের মতো রেগুলেটরের খটখটে সুইচ দিয়ে তাকে যতই তাড়া লাগাও না কেন, সে কিছুতেই তার গদাইলশকরি চাল ছেড়ে এগোয় না। এখন শীত তাই রক্ষে। গরমকালে, রাতে এত জনের সঙ্গে এই ঘরটায় শোওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়। কাচের ভাঙা স্কাইলাইটটাও সব গরম হাওয়া বের করতে পারে না। বইয়ে পড়া গ্যাস চেম্বারের কথা মনে পড়ে কাজুর। তাই সেই গরমের রাতগুলোর বেশির ভাগ সময়টা ও চিলেকোঠার ওই আধাখেঁচড়া ঘরটায় ঘুমোয়।

জ্বরটা আছে। গায়ে-হাত-পায়ে বেশ ব্যথাও রয়েছে। বিশেষ করে ঘাড়টা বেশ ব্যথা। সাড়ে ছ’টার আগে মজুমদার-ডাক্তার বসে না। কাজু ভাবল, সতু থাকলে সাইকেল করে নিয়ে যেত। কিন্তু ব্যাটা সেই যে নর্থ বেঙ্গল গিয়েছে তো গিয়েছেই! পার্টির কাজেই গিয়েছে। কবে আসবে কে জানে!

দু’বার চিঠি লিখেছিল কাজু। উত্তর পায়নি। বিমলদা বলেছে, ওখানে লোকজনকে একত্রিত করতে উদয়াস্ত খাটতে হচ্ছে সতুকে। তাই সময় পাচ্ছে না।

সতু ডাকাবুকো ছেলে। ভয়ডর বলে কিছু নেই। ওই চা-বাগানের মতো জায়গায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে সংগঠন তৈরি করার কাজ রীতিমতো কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ! তাও সতু নিজেই আগ বাড়িয়ে নিয়েছে কাজটা। কেন কে জানে সতুর মধ্যে একটা মারদাঙ্গা মনোভাব আছে। ও কথায়-কথায় বলে এভাবে ন্যাকা-ন্যাকা ভাবে কিছু হবে না। বাস্তিলের পতনও ন্যাকা ন্যাকা কথায় হয়নি, জারদের উৎখাত করাও ন্যাকা ন্যাকা কথায় হয়নি। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া নাকি এই পচে যাওয়া, নর্দমার মতো পৃথিবীটার মুক্তির উপায় নেই। চারিদিকে পাঁক জমে সবটাই নাকি স্তব্ধ আর নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছে। একে খুঁচিয়ে দূর না করতে পারলে হবে না!

হিংসার পথ ভাল লাগে না কাজুর। মানুষ মারতে হবে সমাজ বাঁচাতে গেলে! মানুষ ছাড়া সমাজ হয় নাকি? খারাপ লোকদের প্রান্তিক মানুষে পরিণত করতে হবে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে। মানুষের মনে সুচিন্তার বীজ বুনতে হবে শিক্ষার মাধ্যমে। তা হলে মানুষ নিজেই আবর্জনাদের সরিয়ে দেবে, গুরুত্বহীন করে দেবে। তার জন্য রক্তারক্তি করার কোনও দরকার পড়বে না।

সতু প্রাণের বন্ধু কাজুর। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে দু’জনের মতের মিল হয় না। তবে সতু সেটা নিয়ে কখনও মাথাগরম করে না। বরং বলে, “তুই বুঝবি একদিন। আমার কথার গুরুত্ব বুঝবি। তুই যা বলছিস সেটা থিয়োরি! আসল ক্ষেত্রে কিন্তু এমন সহজ নয় ব্যাপারটা। মানুষকে নিয়ে কাজ। তাদের ইচ্ছে, লোভ, সেয়ানাগিরি, ধান্দাবাজি, ভয়, ইনসিকিয়রিটি, কপটতা, বোকামো এগুলোকে কনসিডার করতে হবে না? এই ফ্যাক্টরগুলোই থিয়রি আর প্র্যাকটিক্যাল পৃথিবীর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়! তবে এটা জানবি, মানুষ কিন্তু তৈরি হচ্ছে তলায়-তলায়। বিপ্লবের দিন ঘনিয়ে আসছে ভাই!”

“কাজুদা,” পিছন থেকে পরিচিত গলার ডাক পেয়ে থমকে গেল কাজু। গলাটা বিজনের। চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে। কিন্তু এখনই পার্টির কাজে ঢুকে পড়েছে! এটা ভাল লাগে না কাজুর। আগে একটু লেখাপড়া করুক, তারপর না হয় ঢুকবে! কিন্তু বিমলদা সেটা মানে না। বলে, “আরে, নতুন অবস্থাতেই ধরতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে আসল ব্যাপারটা কী! এই বয়সে ডেডিকেশান, মরালিটি, ফোর্সফুলনেস বেশি থাকে। করাপ্ট হওয়ার আগেই ওদের বোঝাতে হবে জীবনটা আসলে কী! দেশ ও দশের উন্নতি কীসে হবে!”

ফোর্সফুলনেস জিনিসটা কী, কাজু জানে না। বিমলদার কথার পিঠে কী বলবে বুঝতেও পারে না। বিমলদা কারও কথা শোনার মানুষই নয়! তবে ব্যক্তিগতভাবে বিজনকে সময় পেলেই বোঝায় কাজু। বলে লেখাপড়াটা মন দিয়ে করতে। এসবের জন্য তো সারা জীবন পড়ে রয়েছে! কাজু বোঝে বিজন খুব ভালবাসে ওকে। লোকজন আড়ালে বিজনকে ওর চামচা বলেও ডাকে। কিন্তু সেসব ও পাত্তা দেয় না! বড় বাড়ির ছেলে বিজন। টাকাপয়সার অভাব নেই। কিন্তু এই উঠতি বয়সেও কত সাধারণভাবে থাকে। এসব ছেলে নিজের জন্য আসেনি পৃথিবীতে, কাজু বোঝে। তাই ও চায় আরও পড়ুক ছেলেটা। আরও জানুক। বাকিদের শক্ত মাটিতে তুলতে হলে আগে নিজেকে শক্ত মাটিতে দাঁড় করাক।

কাজু পেছন ফিরল। আর সঙ্গে-সঙ্গে থমকে গেল একটু। বিজনের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে নয়না। চোয়াল শক্ত করল কাজু। মেয়েটা আজও এসেছে! আজকাল ওর আসা যেন বেড়ে গিয়েছে খুব! কথাটা ঘুরিয়ে ও একবার বলেছিল পেখমকে। পেখম পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, “ও পাগলি। তা ছাড়া আমায় তো মা যেতে দেয় না তোমার কাছে। লুকিয়ে দেখা করি কী কষ্ট করে জানোই তো! ওই তো তোমার খবর এনে দেয় আমায়। ও আমার সবচেয়ে ভাল বান্ধবী। আসলে বোনই বলতে পারো।”

পেখমের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কাজু! এত বিশ্বাস আর ভালবাসা অন্যের জন্য যার থাকে সে মানুষটা যে কতটা ভাল, কতটা এই পৃথিবীর জন্য প্রয়োজনীয়, সেটা পেখম নিজেই জানে না। নয়না যে সহজ মন নিয়ে আসে না কাজুর কাছে সেটা কিছুতেই স্পষ্টভাবে পেখমকে বলতে পারে না কাজু। ও জানে কিছুতেই কাজুর এই কথাটা বিশ্বাস করবে না পেখম।

কাজু থমকাল একটু। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। শাড়ির ওপর একটা পঞ্চো পরে রয়েছে নয়না। টানটান করে বাঁধা চুল। কপালের একপাশে চাঁদের আকারের ছোট্ট একটা কাটা দাগ। ধারালো ছুরির মতো মুখ নয়নার। চিনেমাটির প্লেটের মতো চকচকে মুখের চামড়া। খাঁজ কাটা ওপরের ঠোঁটে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস!

কাজু সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, নয়নার হাতে একটা কাচের বয়াম।

“তোমার জ্বর কি বাড়ল কাজুদা?” বিজন ছটফটে গলায় জিজ্ঞেস করল।

কাজু বলল, “ওই আর কী। তা তোরা?”

বিজন কিছু বলার আগেই নয়না বলল, “তোমার জ্বর হয়েছে আমায় বিজন বলল। আমায় তো খবর পাঠাতে পারতে একটা!”

কাজু বলল, “এটা কোনও বলার মতো খবর! সোনাঝুরিতে কত লোকের জ্বর হয়, তোকে সবটা সবাই জানাবে?”

নয়নার চোখের দৃষ্টি কড়া হল। ও রাগের গলায় বলল, “সবাই আর তুমি এক? এই বোঝো? আর বাবার কাছে যাওনি কেন?”

কাজু ঢোঁক গিলল সামান্য। নয়নাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। ও বলল, “তোর হাতে কী?”

নয়নার মুখটা সামান্য নরম হল যেন। ও গম্ভীর গলায় বলল, “আমার আজ জন্মদিন। তাই এতে বাড়িতে তৈরি পিঠে আছে। তোমার জন্য মা পাঠাল।”

কাজু হেসে ফেলল, “গত দু’সপ্তাহ আগেও তো তোর জন্মদিন ছিল! আজ আবার জন্মদিন! ভাল তো বেশ!”

নয়না ভুরু কুঁচকে বলল, “তাতে তোমার কী?” তারপর বিজনের দিকে কাচের বয়ামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কাকিমার হাতে দিয়ে আয় একছুটে। যা।”

বিজন বয়ামটা নিয়ে দৌড়ে গেল।

নয়না তাকাল কাজুর দিকে। কাজুর শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন যেন এক ফোঁটা বিদ্যুৎ গড়িয়ে গেল। কাছে না এসেও একটা মেয়ে এমন করে শুধুমাত্র তাকিয়ে কাছে চলে আসতে পারে!

নয়না বলল, “তোমার জন্য আমার রোজ-রোজ জন্মদিন হতে পারে কাজুদা।”

“এসব কী বলছিস?” কাজু চোয়াল শক্ত করল। আজ মেয়েটা এমন খোলাখুলি বলছে কেন? এমন করে পুরো ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলছে কেন?

নয়না বলল, “কেন, কানে শুনতে পাচ্ছ না কী বলছি? এতদিন যা চুপচাপ বোঝাতে চেয়েছি, সেটা তো আর বোঝোনি! এবার তাই স্পষ্ট করে বলছি।”

“এমন বলিস না নয়না। তুই তো জানিস সবটা।”

“কী জানি আমি?” নয়না ফোঁস করে উঠল, “পেখম সুন্দরী, কিন্তু আমিও কি সুন্দরী নই! ও তোমার জন্য সব ছাড়তে পারবে ভেবেছ? ওর মাকে দেখেছ? লেডি হিটলার। তোমায় ঘেন্না করে। মায়ের বিরুদ্ধে যাবে ভেবেছ ও? কোনওদিন না। আর সেখানে আমি সব পারি তোমার জন্য। সব।”

কাজুর বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছে। এসব কেন বলছে নয়না? সুন্দর ব্যাপারটাকে কেন এমন নষ্ট করে দিচ্ছে? ও কি জানে না যে, পেখম ছাড়া আর কেউ কাজুর মনে থাকতে পারে না! পেখম ছাড়া ওর জীবন শূন্য! তা হলে এসব কেন বলছে?

কাজু অসহায়ভাবে তাকাল নয়নার দিকে। কী করে বোঝায় ও মেয়েটাকে!

নয়না বড়-বড় চোখগুলো স্থিরভাবে জ্বেলে রেখেছে কাজুর চোখের সামনে।

কাজু বলল, “প্লিজ় নয়না। এমন করিস না।”

“আমায় ‘তুমি’ করে বলো না কেন কাজুদা?” নয়না চোয়াল শক্ত করল, “আমি কি মেয়ে নই?”

“নয়না, নয়না… তোকে আমি কী করে বোঝাই…” কাজু মাথা নাড়ল।

নয়না বলল, “আমার দিদির সঙ্গে তো তোমার আলাপ আছে কাজুদা। আমার চেয়ে কত বছরের বড় জানো তো! পাঁচ বছরের। আমি যখন সাত বছরের ছিলাম, ওর একটা সুন্দর পুতুল ছিল। আমারও ওটা ভাল লাগত। কিন্তু ওটা আমায় ধরতে দিত না ও। জানো, আমি কী করেছিলাম? আমি…”

“শোন,” কাজু মাঝপথে থামিয়ে দিল নয়নাকে, বলল, “আমি কিন্তু পুতুল নই। মানুষ কিন্তু পুতুল নয়।”

হাসল নয়না। অবজ্ঞার হাসি। তারপর বলল, “এত পড়ে এই জানলে! কাজুদা, আমরা সবাই পুতুল। শুধু নিজেরা বুঝি না। একদিন তুমিও বুঝতে পারবে। একদিন ওই গল্পের শেষটা তোমায় শোনাব। কেমন?”

.

০৭. রাধিয়া

কেরদানি দেখানোটা যে বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে, সেটা এখন খুব বুঝতে পারছে রাধিয়া। মধুদাকে গাড়ি দিয়ে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়াটা যে কী ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছে! এখন কী করবে? চারিদিকে এখন চৈত্র-সেলের ভিড়। মানুষের মাথা মানুষে খাচ্ছে! তার মধ্যে কী করে খুঁজে পাবে ও কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িটা? বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে ফুল স্টপের মতো ছড়ানো মানুষের মাথাগুলোর দিকে টেন্‌সড হয়ে তাকিয়ে রইল রাধিয়া।

মোবাইলটার কি এখনই বন্ধ হওয়ার ছিল! আর কপাল এমন যে, পাওয়ার ব্যাঙ্কটাও আনেনি সঙ্গে করে। কী করবে এখন ও! পলি, জয়তী, বুদা আর রাখি তো বলেইছিল ওদের সঙ্গে যেতে, কিন্তু কী যে মাথায় ভুত চাপল রাধিয়ার? নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছে ওর! শুনেছে ফার্ন রোড দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে যেন কাঁকুলিয়া রোড যাওয়া যায়। কিন্তু কোথা দিয়ে যাওয়া যায় সেটা ঠিক জানে না।

সুম্পার জন্মদিন আজ। ইউনিভার্সিটির বন্ধু সুম্পা। খুব ঘনিষ্ঠ কিছু নয়। তবে বন্ধু। তাই নেমন্তন্ন করছে। আগে তো আসেনি। তাই কীভাবে যাবে জানতে চাইলে সুম্পা বলেছিল, “তোকে বলে লাভ আছে? গড়িয়াহাট ক্রস করে বিজন সেতুর দিকে এগোলে দেখবি ফার্ন রোডের সিগনাল পড়বে। ওখানে এসে ফোন করবি আমায়। আমি তোদের মধুদাকে বলে দেব! নানা রাস্তায় ওয়ান ওয়ে থাকে। মধুদা বুঝতে পারবে।”

সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আজ দিনটাই এমন যে, কী আর বলবে!

ইউনিভার্সিটি বন্ধ আজ। তাই কোথাও যাওয়ার ছিল না সকালে। মা তো বলেছিল এখানেও আসতে হবে না। কিন্তু মায়ের কথা শোনেনি রাধিয়া। মায়ের তো সবকিছুতেই আপত্তি। ওর ইউনিভার্সিটিতে আপত্তি। বন্ধুদের নিয়ে আপত্তি। ওর নিজেকে সাধারণভাবে রাখা নিয়ে আপত্তি। আর কত কিছু শুনবে!

তা ছাড়া আলিপুর থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছের কাঁকুলিয়া রোড কী আর এমন দূর!

মা তবু জেদ করেছিল। বলেছিল, “বাবা জানলে কিন্তু রাগ করবে! এমন করিস না রাধি।”

“কেন রাগ করবে?” রাধিয়া তর্ক ছাড়েনি, “সেই যে আমি লোকাল ট্রেনে করে সোনাঝুরি গেলাম, তাতে বাবা রাগ করল? তুমিই তো রাগ করছিলে! বাবা মোটেও রাগ করে না। তুমিই শুধু বাবার নামে মিথ্যে মিথ্যে রাগ করার কথা বলো!”

“আমি মিথ্যে বলি?” মা খুব রেগে গিয়েছিল, “আসুক তোর বাবা। আমি বলব তার মেয়ের গুণপনা! ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এই শিখছে! তখনই বলেছিলাম ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে। এখানে জংলিদের সঙ্গে থেকে থেকে সব ম্যানার্স নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্টেটাসের একটা ফ্যামিলিকে দেখা, যে এভাবে তোর মতো থাকে! তোর বাবা কী নিয়ে এত ব্যস্ত কে জানে যে, এইদিকে নজর দেয় না! মেয়েটা কি আমার একার!”

মা এই বলে, বাবাকে ওর নামে বলবে। এই বলে, বাবা সময় দেয় না। মা যে কী চায়! ওদের বিশাল বড় ব্যাবসা। সেদিকে বাবার সময় না দিলে চলবে? বাবা অনেক সময় নানা টুরে যায়। সেটা তো ব্যাবসার জন্যই না কি? শুধু তো আর সোনাঝুরির জুটমিল নয়, ওদের কাপড়ের ব্যাবসা আছে। রাইস মিল আছে। ফুড প্রোডাক্টের ব্যাবসা আছে। এখন বাবা একটা অন্য ব্যাবসা শুরু করবে। এত কিছু যে-মানুষটা করে, তার কি অন্যদিকে মন দেওয়ার সময় আছে? মা এত তলিয়ে ভাবে না।

রাধিয়া ঘড়ি দেখে বলেছিল, “তুমি আমার ওপর রাগ করে টাইম নষ্ট করছ কেন? তোমায় না পার্লারে যেতে হবে!”

“অ্যাঁ!” মা এবার চমকে উঠে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে, “তাই তো! বুজু তো গাড়িটা এখনও বের করল না! কী যে করে না!”

হাসি পেয়ে গিয়েছিল রাধিয়ার। বুজু হল মায়ের রাইটহ্যান্ড। মায়ের সব কাজ বুজু করে দেয়। এমনকী, মায়ের গাড়িটাও বুজুই চালায়। সবাই একটু থমকে যায় বটে মহিলা গাড়িচালক দেখে। কিন্তু বুজুর মজা লাগে! বলে, “জানো রাধি, আমার যা মজা লাগে না! সব বাড়ির ড্রাইভাররা তো পুরুষ। তাই আমায় দেখে সবাই চমকে যায়!”

তবে রাধিয়ার মনে হয় ঠিকই আছে। বুজুর গাড়ি চালানোর হাত খুব ভাল। ওদের চারটে গাড়ি। একটা বাবা চড়ে অফিস যায়। একটা ও ব্যবহার করে। এই এসইউভিটা মা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে আর একটা ছোট হ্যাচব্যাক আছে সেটা বাড়ির জন্য!

রাধিয়া মায়ের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে বলেছিল, “যাও দ্যাখো, কী হল।”

মা নিজেকে সামলে নিয়েছিল দ্রুত। বাদামি চুলগুলো সামলাতে-সামলাতে বলেছিল, “কথা ঘোরাচ্ছিস! আজকাল কী হচ্ছে তোর! যত্তসব আজেবাজে জায়গায় যাওয়া! আমাদের সঙ্গে ক্লাবে যাওয়ার বেলায় তো আগ্রহ দেখি না! কার মতো হয়েছিস তুই?”

রাধিয়া প্রায় বলে ফেলছিল কার মতো। কিন্তু তারপর সামলে নিয়েছিল নিজেকে। বলেছিল, “বাবা, ঠাকুমা আমায় কিছু বলে না। কিন্তু তুমি এমন করো কেন?”

মা তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর বলেছিল, “কারণ, আমি তোর মা বলে। তোর জন্য চিন্তা হয় না আমার!”

“কীসের চিন্তা মা!” রাধিয়া অবাক হয়েছিল।

“কীসের চিন্তা বুঝিস না! আগে মা হ, তারপর বুঝবি!” মায়ের চোখে জল এসে গিয়েছিল আচমকা।

“মা,” রাধিয়া এসে মায়ের হাতটা ধরেছিল, “কী যে করো না তুমি! এই রাগছ! এই কাঁদছ! কীভাবে এত মুড শিফট হয় তোমার? কোনও মানে আছে এর?”

“ছাড়!” মা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সাবধানে চোখের জলটা চেপে-চেপে মুছেছিল। রাধিয়া দেখেছিল মায়ের বড়, সুন্দর চোখদুটো ছলছল করছে। তবে যত্ন করে করা মেকআপ একটুও নষ্ট হয়নি।

মায়ের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও দশ বছর কম মনে হয়। রাধিয়ার বান্ধবীরা বলে, “তোর মা বলে কিন্তু বিশ্বাসই হয় না!”

কথাটা ঠিক। কিন্তু বাবাকে সেই তুলনায় বুড়ো লাগে বেশ। যদিও বাবা-মায়ের বয়সের তেমন খুব একটা তফাত নেই।

মা বলে, “প্রথম থেকেই তোর বাবা অমন বুড়োটে। সারাক্ষণ খালি ব্যাবসা আর ব্যাবসা! বাড়ির বাইরে থাকতে পারলেই যেন বেঁচে যায়!”

রাধিয়ার হাসি পায়। মা এমন করে বলে যেন কত অনিচ্ছের সঙ্গে মা বিয়ে করেছিল বাবাকে!

“মা, কী কথা হচ্ছিল আর তুমি কোনদিকে নিয়ে গেলে কথাটা! এর কোনও মানে আছে? আমি যাবই সুম্পার জন্মদিনে… যাবই, ব্যস!” রাধিয়া রাগের গলায় বলেছিল এবার।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়েছিল রাধিয়ার দিকে। তারপর বলেছিল, “ঠিক আছে মধুদাকে নিয়ে যাবি। আর বেশি দেরি করবি না। আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরবি। কেমন?”

মধুদা বাড়ির সবচেয়ে পুরনো ড্রাইভার। বাবার কথায় সবচেয়ে বিশ্বস্ত। তাই বাবা মধুদার ওপর ভার দিয়েছে রাধিয়াকে সব জায়গায় নিয়ে আসা, নিয়ে যাওয়া করার জন্য।

এই বাড়িতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল মধুদার। একরকম এই বাড়ির লোকের মতোই হয়ে গিয়েছে। গাড়ি চালানো ছাড়াও নানারকম কাজকর্ম করে দেয়। বিশেষ করে ঠাকুরমার সমস্ত কেনাকাটা মধুদাই করে।

বুজু এসে পড়েছিল এরপর। মা বলেছিল, “মধুদাকে ডেকে দে তো। আমি যাওয়ার আগে বলে যাব, রাধিয়াকে যেন ঠিক সময়ে ফিরিয়ে আনে। ওর কোনও কথা যেন না শোনে।”

“মধুদা?” বুজু সামান্য থমকেছিল। ঠোঁট চেটে কী যেন একটা বলবে বলে ইতস্তত করছিল।

“হ্যাঁ। নামটা প্রথম শুনলি?” মা বিরক্ত হয়েছিল এবার।

মায়ের মাথা একটু গরম। চট করে রেগে ওঠে। বুজু খুব ভাল করে জানে সেটা। তাই মায়ের রেগে ওঠায় বুজু আর-একটু থমকে গিয়েছিল।

“কী হল, বল।”

বুজু বলেছিল, “আসলে শুনলাম মধুদার বউয়ের শরীরটা ভাল নেই। আজ বিকেলে ডাক্তার দেখানোর কথা। আজ রাধির কলেজ নেই তো, তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। তাই… মানে…”

“তোকে আমায় মানে বোঝাতে বলেছি!” মা আচমকা চেঁচিয়ে উঠেছিল, “সবাই এখানে কাজ করতে এসেছে না অজুহাত দিতে এসেছে! ডাক মধুদাকে। আমি কথা বলছি।”

বুজু মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল।

“মা, আরে আমি বাচ্চা নাকি! ওলা ধরে চলে যাব। নো প্রবলেম। কেন মধুদাকে ডাকছ!”

মা তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, “ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি। বাড়িটা আমায় চালাতে হয়। এদের আমায় সামলাতে হয়। মধুদা পুরনো লোক হতে পারে। কিন্তু চাকরি করে। একটা মাইনে পায়। তার এই সময়টা আমরা কিনেছি। বউকে নিয়ে ডাক্তার কবে দেখাবে সেটা ওর বলা উচিত ছিল। নিজের খুশিমতো এমনটা ও করতে পারে না। সেটা ওকে বলে দেওয়া দরকার।”

ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে আবার মাথার ওপরের সুইচটা টিপল রাধিয়া। নাঃ। সেই কালো স্ক্রিন! চোয়াল শক্ত করল রাধিয়া। আজ দিনটাই কেমন যেন। তার ওপর রাসবিহারীর দিকটায় আকাশটা কালো হয়ে এসেছে। প্রথম এপ্রিলের সাংঘাতিক গরম ভেদ করে তবে কি এবার বৃষ্টি আসবে? শহর কি শেষ চৈত্রে এসে প্রথম মাথা পেতে নেবে কালবৈশাখীকে!

রাধিয়া অসহায়ের মতো একবার আকাশ আর একবার সামনে ছড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়টাকে দেখল। এই কি ব্যূহ! এটা ভেদ করে ও যাবে কী করে?

বিকেল সাড়ে পাঁচটার গড়িয়াহাটা মানে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটা। তার মধ্যে সব দোকানদার ‘সেল’ ঝুলিয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে কার জিনিসপত্র কত সস্তা। কে কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। এর মধ্যে কীভাবে সুম্পার বাড়ি পৌঁছবে ও! এর চেয়ে মাঝসমুদ্রে রবারের ডিঙিতে ভাসাও বোধহয় ভাল ছিল।

রাধিয়া ভাবল মধুদার কথা শুনলেই ভাল হত। মধুদা তো বলেছিল ওর অসুবিধে হবে না। মধুদার বউ না হয় ডাক্তারের চেম্বারে একটু অপেক্ষা করবে।

কিন্তু রাধিয়ার একটুও ভাল লাগছিল না। আসলে মা এমন বিচ্ছিরিভাবে মধুদাকে বকাবকি করেছিল যে, রাধিয়ার কেমন যেন অপরাধবোধ হচ্ছিল একটা।

এটা হয় রাধিয়ার। কেউ কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে, ওর নিজের কেমন একটা অপরাধবোধহয়। রাধিয়া কিছু বলেইনি। ও কোনওভাবে হয়তো সেই ঘটনাতে যুক্তও নয়। তবু ওর মনের ভেতরটা কেমন করে! কেমন যে করে সেটা ঠিক নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে করে কিছু একটা। বকুনি খাওয়া, মনখারাপ করে, ম্লান মুখে চলে যাওয়া মানুষগুলোর মন, কিছু একটা করে ভাল করার চেষ্টা করে রাধিয়া। পলি বলে, “বড্ড বাড়াবাড়ি করিস তুই রাধি।”

তা হবেও-বা বাড়াবাড়ি। কিন্তু রাধিয়া কী করবে! ওর তো এমনটাই মনে হয়। জোর করে কিছু করবে কী করে ও!

গাড়িতে উঠে সামনের আয়নায় মধুদার মুখটা অর্ধেক দেখতে পাচ্ছিল রাধিয়া। কেমন একটা ঘষা কাচের মতো চোখ। লম্বাটে ঝুলে পড়া মুখ। কাঁচা-পাকা ভুরুগুলো কেমন যেন কষ্টে কুঁকড়ে গিয়েছে।

আলিপুর জেলের সামনেটা পেরোনোর সময় রাধিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, “ক’টায় শিখামাসির ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট মধুদা?”

“শিখার?” মধুদা মুখ না ফিরিয়েই ক্লান্ত গলায় বলেছিল, “সোয়া ছ’টা।”

“কোথায়?”

“ওই প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ওখানে একটা পলিক্লিনিকে। কেন গো রাধিদিদি?”

রাধিয়া গাড়ির ড্যাশবোর্ডে লাগানো ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলেছিল, “তুমি আমায় রাসবিহারীতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যাও। তারপর সব কাজ মিটিয়ে আমায় আবার পিক আপ করে নেবে কাঁকুলিয়া থেকে।”

“সে কী!” এবার মধুদা একটু সময়ের জন্য পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল। তারপর আবার সামনে তাকিয়ে বলেছিল, “এ হয় না রাধিদিদি। ম্যাডাম জানলে রাগ করবে।”

“আরে দূর, জানলে তো করবে!” রাধিয়া এগিয়ে বসে বলেছিল, “মধুদা, আমি যা বলছি শোনো। আমায় নামাও। আমি ঠিক চলে যাব। তুমি কাজ সেরে আবার এসো। কেউ জানতে পারবে না।”

মধুদা বলেছিল, “তুমি চেপে বোসো দেখি। আমি পরে শিখাকে নিয়ে যাব।”

“আঃ,” রাধিয়া বলেছিল, “তোমরা কেউ আমার কথা শোনো না কেন? আমি কি বাচ্চা আছি নাকি এখনও? আমি মোটেও খুকি নই। রাস্তাঘাটে ভিড় বাস বা অটো দেখে মোটেও ভয় পাই না আমি।”

মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় উপচে পড়া বাস আর হেলে পড়া গাড়ির মধ্যে দিয়ে মাথা নিচু করে ছোটা অটোগুলোকে দেখল রাধিয়া! এগুলোয় উঠবে কী করে ও! ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে রাধিয়ার। ও বুঝল যে, আসলে আমরা অনেক কথাই তাৎক্ষণিকভাবে বলে ফেলি। অনেক কথাই বলি নিজেদের মাপ আর ধারণক্ষমতা না বুঝে। কিছুটা আবেগ আর কিছুটা নিজের মনের মধ্যে অবচেতনায় বহন করা নায়ক বা নায়িকার প্রোজেকশনের পাল্লায় পড়ে আমরা এমন কাজ করে ফেলি। যাতে, পরে নিজেরই মনে হয় এমনটা না করলেই ভাল হত!

মধুদা রাসবিহারীতে ছাড়েনি ওকে। কিন্তু রাধিয়ার দেওয়া চাপে বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে ওকে ছেড়ে মধুদা গাড়িটা ডান দিকে টার্ন করে বেরিয়ে গিয়েছে সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের দিকে। বলে গিয়েছে, আটটার মধ্যে ঠিক পৌঁছে যাবে কাঁকুলিয়া রোডে।

কলেজটার সামনের দেওয়াল ঘেঁষে শাড়ির দোকান। উলটোদিকে সার দিয়ে বসে রয়েছে মেহেন্দি এঁকে দেওয়ার ছেলেরা। তবে শুধু ছেলে নয়, কিছু মেয়েকেও দেখল রাধিয়া। তারা কাস্টমারদের হাতে মেহেন্দি পরাচ্ছে।

ভিড়ের চাপে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না ও। কলেজের পাশেই ছোটখাটো একটা মল। সেখান থেকেও গলগল করে মানুষ বেরোচ্ছে!

এ কী বেকায়দায় পড়ল রাধিয়া! এখন ও কী করবে! মোবাইলটা বন্ধ। আর সত্যি বলতে কী সুম্পার নম্বরটাও মুখস্থ নেই। এই হয়েছে এক বিপদ। এখন মোবাইলে সব নাম লেখা থাকে বলে কারও নম্বর মুখস্থ থাকে না। দরকার পড়ে না তো!

“দিদি, পরবেন নাকি? ও দিদি?”

একটা তীক্ষ্ণ মেয়েলি গলার ডাকে সামনে তাকাল রাধিয়া। লাল কুর্তি আর জিন্‌স পরে একটা মেয়ে বসে রয়েছে সামনের মেহেন্দি স্টলটায়। মেয়েটার বয়স ওরই মতো। চোয়াল নড়ছে মেয়েটার। বোঝা যাচ্ছে পানমশলা খাচ্ছে। খয়েরি রঙের চুলগুলো গোছা করে বাঁধা। ওর স্টলের সামনে চারটে সিট। চারটেই ভরতি।

রাধিয়া বলল, “কী বলছেন?”

মেয়েটা খরখরে গলায় বলল, “মেহেন্দি পরবেন?”

“আমি? না তো!” রাধিয়া মাথা নাড়ল।

“তো, বেকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বিজ়নেসের সময়! সরে যান! তখন থেকে জ্যাম করে রেখেছেন সামনেটা!” মেয়েটা ঝাঁজিয়ে উঠল।

রাধিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। ভালমানুষি দেখিয়ে মধুদাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই তো নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। সেই সোনাঝুরিতে একা লোকাল ট্রেনে করে যাওয়ার যে-অ্যাডভেঞ্চার ছিল, সেটার তুলনায় এই ভিড় ও মানুষের স্রোত ভেঙে কাঁকুলিয়া রোড পৌঁছনো অনেক কঠিন।

“কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না!” মেয়েটা এবার বেশ রেগে উঠল, “দোকানের সামনে থেকে সরুন। এভাবে দাঁড়ালে আমাদের অসুবিধে হচ্ছে!”

রাধিয়া ঘাবড়ে গেল এবার। মেয়েটার গলার তীক্ষ্ণতা বড্ড বেশি। আশপাশের সবাই মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে। সকলের চোখেই বিরক্তি। আসলে সকলেই আজকাল সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকে। সকলেই খুব ব্যস্ত। সকলের কার সঙ্গে যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কারা যেন সকলের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সকলেই যেন এক মঞ্চ থেকে নেমে আর-এক মঞ্চে উঠবে। সকলেই সেলেব্রিটি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সকলের পাঁচশো বন্ধু। সকলের ছবিতে শ’য়ে-শ’য়ে লাইক। সকলেই অটোগ্রাফ দেবে বলে উদ্‌গ্রীব, কিন্তু অটোগ্রাফ নেওয়ার লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সকলেই বিরক্ত। যেমন এই মেয়েটি।

রাধিয়া দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমি কাঁকুলিয়া রোড যাব কী করে বলতে পারেন?”

মেয়েটা হয়তো আরও খারাপ কিছু বলত এবার, কিন্তু রাধিয়ার কথার ভঙ্গি আর গলার স্বর দেখে থমকে গেল। বুঝল কিছু একটা। তারপর বলল, “এ তো কাছেই। আপনাকে সামনে যেতে হবে। রাস্তায় নেমে দাঁড়ান। একটা অটো ধরুন। গড়িয়াহাটার অটো নয়, বালিগঞ্জের অটো ধরবেন। তারপর ফার্ন রোডের মোড়ে নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। ভেতর দিয়ে হেঁটে কাছেই। বুঝলেন?”

“থ্যাঙ্ক ইউ,” রাধিয়া নরম করে বলল।

তারপর ব্যাগটাকে সামলে মেহেন্দি পরানোর দুটো স্টলের মাঝখানের জায়গা দিয়ে রাস্তায় নামল। যেতে যখন হবেই তখন সত্যি এরকম ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তো আর লাভ নেই।

রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে। পুজোর আগেও এমন অবস্থা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, রাধিয়া এভাবে ফুটপাথে ঘুরে-ঘুরে বাজার করে না। তাই এই ভিড়টা ওকে ঠেলতে হয় না!

রাধিয়া ডান দিকে তাকাল। বাস, ট্রাম, গাড়ি সব ধেয়ে আসছে। কিন্তু সব ক’টাই তো ভরতি। তবে? রাধিয়া কিছু ভাবার আগেই আচমকা চিৎকার শুনল একটা। খোনা গলা। পুরুষের। সকলের মতো রাধিয়াও চমকে পেছনে তাকাল।

একটা লোক। বেঁটে। কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল। ছাই রঙের হাফহাতা শার্ট আর গোড়ালির ওপর অবধি গোটানো একটা আধময়লা প্যান্ট। কাঁধে পেটমোটা একটা ঝোলা। লোকটার গায়ের রং পুড়ে ইটের মতো হয়ে গিয়েছে। গাল দুটো তোবড়ানো। থুতনিতে সাত দিনের না-কাটা কাঁচাপাকা দাড়ি। শুধু লোকটার বড় কালো চোখ দুটো উজ্জ্বল! লোকটা একটু লেংচে হাঁটছে। তার মধ্যেও মুখে হাসি আর হাতে-ধরা গোছা পাতলা চটি বই। লোকটা বইগুলো হাতপাখার মতো করে নাড়াচ্ছে!

রাধিয়া দেখল লোকটাকে। তারপর শুনল, লোকটা চেঁচিয়ে বলছে, “মানুষ ফুরিয়ে যায় আর থেকে যায় তার কথা। তার নিজের কথা, তার মনের ভেতর জমা হওয়া কথা। ইতিহাস সাক্ষী আছে, মানুষ লিখতে পছন্দ করে। স্টোন ট্যাবলেট, মাটির ট্যাবলেট, মোমের ট্যাবলেট থেকে শুরু করে নীল নদের পাশে পাওয়া প্যাপিরাস ছুঁয়ে, পার্চমেন্ট স্পর্শ করে আধুনিক কাগজ হয়ে এখন ইলেকট্রনিক ট্যাবলেটে মানুষ লিখে যাচ্ছে ক্রমাগত! সারা জীবন ধরে লিখেই যাচ্ছে সে! সেই আদিম ট্যাবলেটকে জড়ো করে রাখা থেকে প্যাপিরাসকে গুটিয়ে স্ক্রোল বানানো থেকে মানুষ চিরকাল চেয়েছে তার নিজের কথাকে যত্ন করে ধরে রাখতে! হেরোডোটাস বলেছেন, ফোনেশিয়ানরা এই প্যাপিরাস আর লেখার প্রক্রিয়া নিয়ে এসেছিল প্রাচীন গ্রিসে। সেই তার জয়যাত্রার সূচনা। প্যাপিরাস হয়ে কাঠের পাতলা ‘ব্যাম্বু বুক’ হয়ে আমাদের তালপাতার পুঁথি ছুঁয়ে, গুটেনবার্গের ছাপাখানা অবধি পৌঁছে এ জিনিস মানুষের সভ্যতা ও তার উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। এ সেই জিনিস, যা মানুষকে বাড়তে দিয়েছে, জানতে দিয়েছে, ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে! সেই জিনিস, যে মানুষের একলা সময়ের বন্ধু। দূর সফরের সঙ্গী। পালা-পার্বণে উপহার। প্রেমপত্র বহন করার মাধ্যম। সাজিয়ে রাখার অহংকার। সেই জিনিস, যা প্রাচীনকাল থেকে প্রতিটি বিজ্ঞানী আর দার্শনিকের মনের আলো। সেই জিনিস, যা এখনকার পৃথিবীতে আমাদের রোজকার সঙ্গী। আমি আজ এই সেলের বাজারে মানুষের উপকারের জন্য আবার একবার নিয়ে এসেছি তাকে। কমপিউটারের যুগে যা আজও অপরিহার্য। আমাদের সংস্কৃতির যা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি নিয়ে এসেছি সেই জিনিস যা ওল্ড ইংলিশে ‘বক’, স্লাভিক ভাষায় ‘বাকভা’, চিনেভাষায় ‘শু’, আরবিতে ‘কিতাব’, আরমেনিয়ানে ‘গির্ক’, ফরাসিতে ‘লিভ্রা’, স্পেনীয় ভাষায় ‘লিব্রো’ আর আমাদের মাতৃভাষায় বই। সুধীজন, বেজুবান, কদরদান ও ফ্যান অফ শাহরুখ খান। নিয়ে যান, নিয়ে যান, নিয়ে যান। বাচ্চাদের গ্রামার শেখানোর, ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলার জন্য এই সেলের বাজারে আমার বই। শুধু গায়ের পোশাক নয়, নিয়ে যান মনের আশ্রয়। আমার এই চারটে বই একসঙ্গে মাত্র কুড়ি টাকায়। স্পেশ্যাল অফার। কুড়িয়ে নিন কুড়িকে। আর নিজেকে অংশ করে তুলুন মহান হেরোডোটাস থেকে কোপারনিকাস হয়ে ইবনবতুতা, শেক্সপিয়র, মিলটন, কিটস, নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, জয়েস, মিলার হয়ে এখনকার হকিং, কামু আর পামুকের। গর্ববোধ করুন তাদের সঙ্গে আপনার মিল থাকার বিন্দুর। গর্ববোধ করুন যে, আপনিও এই সব মহান মানুষের মতোই বই হাতে তুলে নিয়েছেন। আর তাই সেই সু্যোগ হাতছাড়া না করে, নিয়ে নিন আমার আনা স্পেশ্যাল শিক্ষার মাধ্যম। চারটে বই। একসঙ্গে মাত্র কুড়ি! কুড়ি টাকা! খরচা কম, চর্চা বেশি। কাকা কথা হবে না!”

রাধিয়া হাঁ হয়ে গেল। একটানা কথাগুলো বলে লোকটা থমকাল একটু। হাঁপাচ্ছে! রাধিয়া দেখল আশপাশের ভিড়টা কেমন যেন থমকে গিয়েছিল এই সময়টায়। তারপর লোকটা থামতেই কেমন চটরপটর হাততালি আর হাসির ছররা উঠল চারিদিকে। লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করল। তারপর উপস্থিত সকলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল বই বিক্রি করার জন্য।

রাধিয়া এরকম কাউকে কখনও দেখেনি। এভাবে যে কেউ বই বিক্রি করতে পারে ভাবতেও পারেনি। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। বেঁটে, সামান্য-খুঁড়িয়ে-হাঁটা একটা মানুষ। গায়ে ময়লা জামাকাপড়। কাঁধে ঝোলা। হাতে একগোছা বই। বোঝা যাচ্ছে যে, ঝোলাটা বইতে কষ্ট হচ্ছে। তবু হাসিমুখে লোকটা যাচ্ছে সকলের কাছে। অধিকাংশই কিনছে না। কিন্তু লোকটার মুখের হাসিটা অমলিন। এমন করেও বেঁচে থাকে লোকে! এই মিনিটদশেক এখানে দাঁড়িয়েই কত কিছু যেন শিখে গেল রাধিয়া! ‘হ্যাপি প্রিন্স’-এর মতো বাবার ছোটবেলার পরি যেন আজ এই সময়টুকুতেই কিছুটা স্বাদ পেল আসল পৃথিবীর। এই মানুষটারও তো বাড়িতে বউ আছে নিশ্চয়। ছেলেমেয়ে? তাও আছে। তাদের ইচ্ছে, আহ্লাদ আর আনন্দগুলো লোকটা এই সামান্য বই বিক্রি করে মেটাতে পারে। এই চারদিকে উপচে পড়া পণ্যের ভেতরে এইসব মানুষগুলো কীভাবে এমন শান্ত মুখে থাকে! এদের লোভ নেই? ইচ্ছে নেই? এদের বাচ্চাদের জীবনে সেল বা পুজোয় নতুন জামা নেই?

“দাদা,” রাধিয়া লোকটাকে ডাকল।

লোকটা সামান্য খুঁড়িয়ে এগিয়ে এল ওর দিকে।

“আমায় একটা সেট দিন!”

লোকটা ভুরু তুলল। তারপর হেসে বলল, “শিয়োর ম্যাডাম।”

কাঁধে ঝোলানো নীল তাপ্পিমারা ঝোলার ভেতর থেকে বের করে আনল একটা প্লাস্টিক। তারপর তাতে ভরে দিল বইগুলো, “এই যে ম্যাডাম।”

রাধিয়া একটা একশো টাকার নোট দিল লোকটাকে।

লোকটা বলল, “এই রে! খুচরো নেই?”

রাধিয়া বলল, “না তো!”

“আচ্ছা, দাঁড়ান, দেখি ওরা দিতে পারে কি না!” লোকটা ফুটপাথের ধারে এগিয়ে গেল মেহেন্দির দোকানের দিকে।

রাধিয়া পিছিয়ে এল দু’পা। তারপর রাস্তার দিকে তাকাল। একটা অটো এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। পেছনের সিট থেকে নামল দু’জন। কালো, রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুলোগুলো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। অটোচালকটি চিৎকার করছে, “বালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ।”

রাধিয়া দ্রুত এগোল। একজন মোটামতো ভদ্রমহিলাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল অটোর ভেতরে। ভদ্রমহিলা রাগতস্বরে কিছু একটা বললেন। কিন্তু রাধিয়া পাত্তা দিল না। ও বসামাত্রই ওর পাশে এসে বসে পড়ল একজন বয়স্ক লোক। গাড়ি ভরতি। অটোচালকটি আর দেরি না করে ছেড়ে দিল গাড়ি।

“ম্যাডাম…”

চারদিকের চিৎকার, গাড়ির হর্ন আর অটোর আওয়াজের মধ্যে আবছাভাবে “দিদি!” ডাকটা শুনতে পেল রাধিয়া। ও হাসল শুধু। তারপর সামনের অটোচালকটিকে বলল, “ভাই ফার্ন রোডে নামব। ভাড়া কত?”

ভাড়া বলে অটোচালকটি বলল, “ভাড়া হাতে রাখুন, দিদি…” তারপর সামনের সিটে ওর পাশে বসে থাকা লম্বাচওড়া ছেলেটাকে বলল, “তুই মাইরি নকশা করেই গেলি! দ্যাখ, রিতুদা আমায় অটো কিনে দিল। পারমিট নেই, তাও দাবড়ে বিজ়নেস করছি। কারও বাপ শালা কিছু করতে পারবে না। জানিস তো আমি এটা ভাড়ায় দিই, আবার কখনও-কখনও নিজেও চালাই! মাল্লু আসে কাকা! সেখানে তোকে এত করে বলল, তুই দু’-একদিন গিয়ে আবার বসে গেলি। মাইরি, রিতুদা খচে গেলে কিন্তু বিলা কেস হয়ে যাবে। একটু বোঝ মাহির!”

রাধিয়া দেখল বড়সড় চেহারার ছেলেটা কিছু বলল না। বরং চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

গাড়িটা এসে গড়িয়াহাটার সিগনালে দাঁড়িয়েছে। চালকটি পেছনে ফিরে সকলের কাছ থেকে ভাড়া নিল। তারপর যাকে যার মতো খুচরো ফেরত দিয়ে আবার বড় চেহারার ছেলেটার দিকে তাকাল, “তুই মাইরি ক্যালানে না শয়তান, কে জানে! রিতুদা কালকেও বলল আমায়। বলল, ওকে নিয়ে আয়, কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে চান্স করিয়ে দেব। আর তুই…”

“ফার্স্ট ডিভিশনে!” এবার ছেলেটা ঘুরে তাকাল।

সামনে সিগনাল খুলে গিয়েছে! গাড়িটা স্টার্ট করে চালকটি বলল, “তবে তোকে কী বলছি! চল ভাই। আর কতদিন তোদের পতাদার ভুঁড়ি দেখে দিন কাটাবি! চল।”

“ফার্স্ট ডিভিশনে! সত্যি!”

“শালা, আমি কি ঢপ দিচ্ছি? আর রিতুদা কি ঢপ দেয়? চল আজকেই। দাদা হেব্বি খুশি হবে।”

রাধিয়ার ইচ্ছে করছে না এসব শুনতে। বরং ফার্ন রোডে নেমে কীভাবে কাঁকুলিয়া রোডে যাবে সেই নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছে!

অটোটাও বাস আর গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথের লোক উপচে এসে পড়েছে রাস্তায়। মানুষজন প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা পার হচ্ছে! রাধিয়ার বাঁ দিকের লোকটি বড্ড ঘেঁষে বসেছে রাধিয়ার দিকে। লোকটার শরীর থেকে নোনতা একটা গন্ধ হাওয়ার সঙ্গে এসে ঢুকছে। ওঃ, গা গুলোচ্ছে রাধিয়ার।

“দিদি, ফার্ন রোড,” লাল সিগন্যালের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে অটোটা দাঁড় করাল চালকটি।

রাধিয়া পাশের লোকটিকে বলল, “এক্সকিউজ় মি।”

লোকটা তাকাল রাধিয়ার দিকে। তারপর নেমে দাঁড়াল রাস্তায়। রাধিয়া নিজেকে যতটা পারল সংকুচিত করে নেমে পড়ল। কিন্তু তাও লোকটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নোনতা গন্ধটা আবার নাকে এল। ইস! রাধিয়া বাজে গন্ধ একদম নিতে পারে না। ও কোনওমতে নিজেকে সামলে দাঁড়াল ফুটপাথ ঘেঁষে।

“রাধি!” আচমকা চিৎকারে রাধিয়া চমকে পেছনে তাকাল। আরে, এই তো বুদা আর পলি! ওঃ! প্রচণ্ড ভিড়, গরম আর ঘিঞ্জি কলকাতা ভিজিয়ে যেন বৃষ্টি নামাল রাধিয়ার মনে!

পলি আর বুদা এসে দাঁড়াল ওর সামনে।

“তুই, অটোয়! কোক কি পেপসির ক্যানে বিক্রি হচ্ছে নাকি রে?”

রাধিয়া কিছু না বলে হাসল।

পলি হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু রাধিয়ার পেছনে কাউকে দেখে যেন থমকে গেল। রাধিয়া পেছনে ফিরল। অটোটা সিগনালে দাঁড়িয়ে। পলি তাকিয়ে রয়েছে অটোর সামনের সিটে বসা ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও তাকিয়ে দেখছে পলিকে। ছেলেটার মুখে একটা হাসি আসবে কি আসবে না ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে লুকোচুরি খেলছে।

পলি কিন্তু হাসছে না। রাধিয়া অবাক হল। ছেলেটা এবার হাসল, কিন্তু হাসিটা সম্পূর্ণ হল না। কারণ, সিগনাল পেয়ে অটোটা দ্রুত ছিটকে বেরিয়ে গেল সামনে!

রাধিয়া তাকাল পলির দিকে, “তুই ছেলেটাকে চিনিস?”

পলি নাক টানল। তারপর বলল, “চিনি মানে দু’বার কথা হয়েছে। প্রতাপাদিত্য রোডে রিতুদা বলে এক পার্টি নেতার কাছে গেছি তো কয়েকবার। ওই আমাদের ‘ব্রোঞ্জ ইয়ারস’-এর জন্য একটা বাড়ির তদবির করতে। সেখানে দু’-তিনবার দেখা হয়েছে। তবে বেশি না। জাস্ট কয়েকটা সেনটেন্স। তাও লাস্ট কয়েকবার দেখিনি।”

বুদা বলল, “দেখে তো ভাল বাড়ির মনে হয় না!”

রাধিয়া বলল, “আবার শুরু করলি! মানুষকে ওভাবে চেনা যায়? কী মেয়ে রে তুই! আবার রাজনীতি করিস!”

বুদা হাসল, “তুই শালা এত ফেদার-টাচ টাইপ কেন বল তো? দেখে যা মনে হল বললাম। কী বল পলি?”

পলি রুমাল দিয়ে চেপে ঠোঁটটা মুছল। তারপর কী মনে পড়ায় ডানদিকে হাত দিয়ে ব্লাউজ়ের পাশ দিয়ে হালকা উঁকি দেওয়া ব্রেসিয়ারের স্ট্র্যাপটা ব্লাউজ়ের ভেতরে গুঁজে দিয়ে নিজের মনে সামান্য হাসল। তারপর বলল, “চল তাড়াতাড়ি। সুম্পা রাগ করবে! বাকিরা বোধহয় এসে গেল।”

রাধিয়া বলল, “অনেকটা নাকি রে? মানে অনেকটা হাঁটতে হবে?”

বুদা বলল, “তা তো একটু হবে রূপাঞ্জেল! টাওয়ারে থাকতে-থাকতে তোমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে সোনা। তবে তুই পারবি। এই সেলের ভিড়ের গড়িয়াহাট ঠেলে যখন অটোয় চড়ে এসেছিস, তখন এটুকু হাঁটা তো নস্যি জানেমন!”

রাস্তাটা পার হয়ে ফার্ন রোডে ঢুকল ওরা। রাস্তার ওপর সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোলপার্কের দিক থেকে আসছে অধিকাংশ গাড়ি। ফুটপাথের ওপরে হকার বসে আর লোকজন থাকতে শুরু করায় এমনিতেই তো হাঁটার জায়গা আর নেই কলকাতায়। তারপর রাস্তাজোড়া গাড়ি! রাধিয়া বারবার পিছিয়ে পড়ছে। ডান দিকে বাঁ দিকে জামা-কাপড়ের দোকানের সঙ্গে রংচটা সোনার দোকান, পুরনো বইয়ের দোকান, স্টেশনারি দোকান। পলি আর বুদা কিছুটা এগিয়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ছে আর এগিয়ে আসতে বলছে রাধিয়াকে।

রাধিয়ার অসহায় লাগছে খুব। এত দোকানপাটের মধ্যে ফুটপাথে হাঁটার সরু জায়গা। তার মধ্যে কলকাতার লোকজনের তো বেশ একটা গদাইলশকরি চাল আছেই! তাই তাদের রাস্তা জুড়ে ‘একদিন ঠিক পৌঁছব’ ধরনের হাঁটা ঠেলে এগোতে পারছে না ও।

ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার দেখে বুদা পিছিয়ে এসে হাত ধরল রাধিয়ার। বলল, “শালা, এমন করে হাঁটলে সুম্পার নেক্সট ইয়ার বার্থডে-তে পৌঁছব। ধাক্কা মেরে, খিস্তি করে পথ বের করতে হয় এখানে। এরা সব দুর্যোধন। বিনা রণে সূচ্যগ্র মেদিনীও দেবে না, বুঝলি?”

বলেই রাধিয়ার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নিয়ে আশপাশের লোকজনকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে, গুঁতিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর গলির আরও ভেতরে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় গিয়ে শ্বাস নিল ওরা।

বুদা হাতটা ছেড়ে বলল, “রাধিয়া, তুই বিদেশে বিয়ে করে চলে যাস। এখানে থাকিস না। নির্ঘাত মারা পড়বি!”

পলি বলল, “দেশটার কী অবস্থা বল তো! কেউ কোনও নিয়ম মানে না। পুলিশ প্রশাসনের লোকজনের কি চোখ নেই?”

বুদা হাসল, “খোঁকি শ্বশুরবাড়ি যাবিস-এর সময় নেই খেন্তিপিসি! সকলের চোখ আছে। তার চেয়েও বেশি আছে মাথা। তুই ভোট দিস? এরা দেয়। এরাই রিয়েল পাওয়ার। এদের চটালে চট নিয়ে বসতে হবে রাস্তায়, সেটা নেতারা জানে। তাই ‘লুটেপুটে যা খুশি করো’-র লাইসেন্স এদের দেওয়া হয়েছে। তুই নালিশ করতে গেলে বলবে, একটু অ্যাডজাস্ট করে নিন না! নিজের জীবনে বেহায়াপনাটা জাস্ট অ্যাড করে নিতে পারলে আর এখন বাঁচতে অসুবিধে হবে না। ফলে কানে তুলো, পিঠে কুলো। বুঝলে খুকুমণি!”

রাধিয়া দেখল, কথাগুলো হাসতে-হাসতে বললেও বুদার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বুদা ইউনিভার্সিটিতে প্রথমদিকে পলিটিক্স করত। এখন আর করে না। কিন্তু একটু র‍্যাডিকাল পলিটিক্সে ওর আগ্রহ আছে। সেটা মাঝে মাঝে কথায় ফুটে বেরোয়।

পলি বলল, “এটা একটা দিক। কিন্তু গরিব মানুষগুলোর কথা ভাববি না? এরা যাবে কোথায়?”

“স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন গেল, কলকাতা কতটুকু বাড়ল রে! আর-একটা সিটি তৈরি হল না কেন, যে কিছুটা এই শহরের ভার নিতে পারবে! রাজারহাটের কথা বলবি না, ওটা এখনও কিছুই করতে পারেনি। শালা হেরিটেজ নষ্ট করে, সারা শহরটায় গিজগিজে লোক বসিয়ে, মোচ্ছব আর পুজো করে গোটা সমাজটা ভোগে গেল! আর সব সেই ভোগ খাবে বলে পাতা হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব সমান! শালা…” দু’ অক্ষরেই থেমে গেল বুদা।

রাধিয়া বুঝল কারণটা। সুম্পাদের বাড়ি এসে গিয়েছে!

বাড়িটা দেখেই ভাল লেগে গেল রাধিয়ার। বেশ পুরনো। আগেকার সেই লাল ইটের তৈরি। আর্চ বসানো, রংবেরঙের কাচের জানলা-দরজা। সামনে একটু বাগান। ছাদে ছোট-ছোট কয়েকটা মূর্তিও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বাড়ি মাথায় লেখা আছে ‘বসু ভিলা’।

রাধিয়া দেখল লোহার গেটের ওপরটা একটা তারজালির আর্চ করা আছে। আর তাতে লতিয়ে উঠে একটা ফ্রেমের মতো করে আছে বোগেনভেলিয়া গাছ। তাতে গোলাপি কাগজফুল হাওয়ায় নড়ছে। আকাশের দিকে তাকাল রাধিয়া। রাসবিহারীর দিকের মেঘটা কাঁকুলিয়া অবধি ঢেকে ফেলেছে! হাওয়া দিচ্ছে বেশ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠান্ডা শিরশিরে ভাব একটা। বোঝা যাচ্ছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নিশ্চিত। গরমে ক্লান্ত আর বিরক্ত শহরকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আসছে কালবৈশাখী।

বেল বাজাতে হল না। দরজাটা খোলাই ছিল। দরজার গোড়ায় জুতোর সাম্রাজ্য দেখে রাধিয়া বুঝল বেশ কিছু মানুষজন ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে। ওর একটু অস্বস্তি হল। সুম্পার সঙ্গেই ওর যা জানাশোনা। ওদের বাড়ির আর কাউকেই তো ও চেনে না!

দরজা দিয়ে ঢুকেই লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে জুতো খুলতে-খুলতেই সুম্পা বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ঝিলমিল করে বলে উঠল, “কী রে! তোদের কাণ্ডজ্ঞান নেই? এখন ক’টা বাজে! আসতে বলেছিলাম সেই চারটের সময়! দেখ তো, কত লোকে এসে গিয়েছে! জয়তী আর রাখি তো এখনও এল না। কী যে করিস না তোরা! দেখ, কত গান আর কবিতা হয়ে গেল এর মধ্যে! রাধিয়া, তুই গান গাইবি বলেছিলি। চল।”

রাধিয়া জুতো খুলে ঠিকমতো দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই সুম্পা ওকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল।

ঘরটা বড়। না রাধিয়ার বাড়ির তুলনায় নয়, কিন্তু বড়ই। উঁচু সিলিং। বড় তিনটে সোফা ঘরটার কিছুটা ভরে রেখেছে। রাধিয়া দেখল, অন্যান্য আসবাব পেছনে সরিয়ে মেঝেতেই বেশ সাদা ফরাস পেতে দেওয়া হয়েছে। রাধিয়া সকলের দিকে তাকাল। সকলের বয়সই ওর মতো। কিন্তু তার মধ্যেই চোখ আটকে গেল একজনের ওপর। আরে নিশান!

ডিমের কুসুম রঙের পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছে নিশান। রাধিয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মুখে মিটিমিটি হাসি।

রাধিয়া অপ্রস্তুত হল একটু। কেন হল সেটা নিজেই বুঝতে পারল না। সেদিন সোনাঝুরি স্টেশনে এই ছেলেটা নিতে এসেছিল ওকে। তারপর স্টেশন থেকে একটা রিকশায় উঠিয়ে রিকশার পেছন-পেছন ফলসাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল! না, তেমন কথা বলেনি ওর সঙ্গে। শুধু ফলসাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় হেসেছিল একটু। সামান্য হাওয়ায় নিশানের গা থেকে গন্ধ ভেসে এসেছিল খানিক। কী সুন্দর মিষ্টি কর্পূরের গন্ধ! কী পারফিউম ওটা! না, রাধিয়া জিজ্ঞেস করতে পারেনি। ও শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছিল, ফলসাদের বাড়ির সামনের আধো-আলো আধো-অন্ধকার রাস্তা ধরে একটা সাইকেল মিলিয়ে যাচ্ছে আবছা ঝিমঝিম অন্ধকারে।

তারপর কয়েকদিন কখনও সন্ধেবেলা, আবার কখনও রাত্রিবেলা, আচমকাই হাওয়ার সঙ্গে মিশে, হাওয়ায় ভেসে-ভেসে ওর কাছে ফিরে আসছিল গন্ধটা। আর রাধিয়া যেন দেখতে পাচ্ছিল, একটা সাইকেল আধো অন্ধকারে ডুবে, ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায়! শুধু ছোট্ট প্রজাপতির মতো হাওয়ায় উড়ছে আলতো হলুদ একটা পাঞ্জাবি!

সেদিনের পরে নিশানকে আজ এই দেখল ও। কী বলবে এখন রাধিয়া! প্রায় জনাপঁচিশেক ছেলেমেয়ের মধ্যে পেছনের দিকে বসে রয়েছে নিশান। সোজা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। ও কেন তাকাচ্ছে অমন করে! আর রাধিয়ারই-বা ওর দিকে কেন বারবার চোখ পড়ে যাচ্ছে!

সুম্পা রাধিয়ার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফরাসের একদিকে রেখে, সামনে তাকিয়ে বলল, “দিস ইজ় রাধিয়া, পলি অ্যান্ড বুদা…” তারপর হেসে ভিড়ের দিকে হাত দেখিয়ে রাধিয়াদের বলল, “আর শোন, দিস ইজ় এভরিবডি।”

পলি রাধিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “সুম্পার দাদা বিখ্যাত আঁতেল, জানিস তো! এরা বোধহয় ওর সেই কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা।”

“কী রে ফিসফিস করছিস?” সুম্পা পলিকে সামান্য ধাক্কা দিল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাধিয়া খুব ভাল গান গায়। এখন ও গান গেয়ে শোনাবে। আমায় বলেছিল, আজ ও গান গাইবে।”

“গান?” রাধিয়া একটু চমকে গেল, “আমি কবে বললাম রে?”

সামনের সারি থেকে রোগা, বেঁটে, চশমাপরা একজন বলে উঠল, “কেন, না বললে কি শোনানো যায় না? আমার প্যাঁও তো কিছু না বললেও শোনায়!”

“আবার শুরু করেছিস, স্মরণ!” পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠল, “সবসময় প্যাঁও! শালা প্যাঁওটা কে রে? একদিনও তো দেখলাম না!”

সুম্পা দ্বিতীয় ছেলেটাকে বলল, “শোন জিৎ, স্মরণের কোনও প্যাঁও নেই। ও ঢপ মারে!”

“প্যাঁও নেই?” স্মরণ সোজা হয়ে বসে একটু উত্তেজিত হল, “আরে, প্যাঁও আমার প্রেমিকা। কতবার বলেছি তোদের! তবে সবার সঙ্গে মেশে না। তোদের সঙ্গে মিশবে না। আর তোর সঙ্গে তো মিশবেই না। যারা বিদেশে থাকে তাদের সঙ্গে মেশে না, তাই আসে না।”

জিৎ বলল, “তোর সঙ্গেও তো মেশে না! তাই ঢপ মারিস!”

ঝগড়াটা বাড়ত। কিন্তু সুম্পা হাত তুলে বলল, “কেক কাটার আগে রাধিয়া গান গাইবে। কেউ ঝগড়া করবে না কেমন!”

“ওরে, তুই এই বুড়ো বয়সে কেকও কাটবি!” স্মরণ মোটা চশমার পেছনে চোখগুলো গোল করল, “তবে আমায় এক পিস এক্সট্রা দিয়ে দিস তো। প্যাঁওকে দেব।”

“আবার শালা…” জিৎ লাফিয়ে উঠতে গিয়েছিল। কিন্তু সুম্পা সামনে এগিয়ে জিৎকে চেপে বসিয়ে বলল, “চুপ সবাই। রাধিয়া গান গাইবে। কেমন?”

রাধিয়া দেখল, ঘরের সবাই তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে! আজ শাড়ি পরে এসেছে রাধিয়া। ও আঁচল দিয়ে ঠোঁটের ওপরের ঘামের ফুলস্টপগুলো মুছল চেপে-চেপে। তারপর তাকাল সবার দিকে। আসলে ঠিক সবাই নয়, একজনের দিকে। নিশানের দিকে। কেন তাকাল! রাধিয়া জানে না। শুধু মনে হল, আবার সেই মিষ্টি কর্পূরের গন্ধটা ফিরে এল।

রাধিয়া চোখ বন্ধ করে সময় নিল একটু। ভিড় থেকে, কোলাহল আর হুল্লোড় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল। দ্রুত শ্বাসকে সংযত করল। শরীরকে নমনীয় করে নিল। তারপর তাকাল। বলল, “গান নয়। আমি একটা কবিতা বলব। আমার ঠাকুরমা মাঝে মাঝে বলে এই কবিতাটা। না, আমায় বলে না। নিজের মনে, একা বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কখনও কখনও বলে, আমি আড়াল থেকে শুনেছি। আমি সেটা বলব।”

পলি আর বুদা বসে পড়েছে ফরাসে। সুম্পা বসেছে একটা সোফার চওড়া হাতলের ওপর। স্মরণ মোটা চশমার ওপার থেকে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। জিৎ পাশের একটা ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে দেখছে ওকে। পেছন থেকে নিশানও অপলকভাবে দেখছে। ঘরের সবাই তাকিয়ে রয়েছে রাধিয়ার দিকে।

রাধিয়া আর-একটু সময় নিল। ঘরের ভেতর ফ্যানের গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু নেই!

রাধিয়া এবার সেই গুঞ্জন ভেঙে তুলো-খসে-পড়া আওয়াজে বলল:

“আকাশ জুড়ে জোনাকিদের বাড়ি
বুকের নীচে পাগলা রাজার ঘোড়া
তখন থেকে সবার সঙ্গে আড়ি
তখন থেকে আমার শহর পোড়া!
ধ্বংস ঘেঁটে তোমায় পেলাম মোহর
তোমার আলোয় বাঁচল আমার প্রাণী
কক্ষ থেকে ছিটকে যেত গ্রহ…
উল্কা তোমার কাচের ফুলদানি!
কেমন ছিল সেসব ধুলোখেলা!
কেমন ছিল সাগরপারের রানি!
এই জীবনের নরম বিকেলবেলায়…
আমরা দু’জন, কেবল দু’জন জানি
আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন জানি।”

.

০৮.  পুশকিন

কলকাতায় বরফ পড়ে না কেন? সাদা তুলোর মতো, নরম, হালকা বরফ কেন নেমে আসে না কলকাতায়? ভিক্টোরিয়ার পরির পাখনায় বেশ বরফ জমে থাকবে! শহিদ মিনারের মাথায় জমে থাকবে সাদা ফেনার মতো বরফ! মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই মানুষজনের পা ডুবে যাবে ফুটপাথের পাশে জমে থাকা বরফে! ট্র্যাফিক পুলিশের হেলমেটের মাথায়, স্কুলফেরতা বাচ্চাদের পিঠের ব্যাগের ওপর, সবুজ-হলুদ অটোর ছাদে বা সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের গাছপালার গায়ে চুড়ো করে জমে থাকবে বরফ! লাল নীল ক্রেয়নের মতো উলের জামাকাপড় পরে মানুষজন জমা হবে রাস্তায়! আর আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করবে ছোট্ট বাচ্চার গালের মতো তুলতুলে বরফকুচি! ইস, কলকাতায় বরফ পড়লে কী ভালই যে হত! কেন যে বরফ পড়ে না! যা-যা হলে ভাল হয়, ভাল হত, কেন যে সেসব কিছু হয় না!

জানলায় দাঁড়িয়ে দূরে আকাশের গায়ে জমতে থাকা পেশিবহুল বাইসনের মতো মেঘগুলো দেখে ছোটবেলার মতো আবার এইসব মনে পড়ল পুশকিনের।

এপ্রিলের শেষ হতে চলল, কলকাতা আলকাতরার মতো ফুটছে। সবাই চাইছে একটা অন্তত কালবৈশাখী আসুক। মাসের প্রথমদিকে একদিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর আবার সেই এক আগুন! এক যন্ত্রণা!

এত লোকের ডাকেই কিনা কে জানে, আজ পশ্চিম দিকটায় বেশ মেঘ করেছে! জঙ্গল থেকে ছাড়া পেয়ে একপাল বাইসন যেন ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে শহরের দিকে! শেষমেশ কি আসবে তারা? মানুষ কি আজ বৃষ্টি পাবে?

পুশকিন জানলার কাচে নাক ঠেকিয়ে সামনের দিকে তাকাল। এত ওপর থেকে কলকাতার আকাশটাকে অদ্ভুত লাগে। রাজারহাট এমনিতেই বেশ ফাঁকা। আকাশের বিস্তার এখানে বেশি। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতেও আকাশ চোখে পড়ে। তাই এখানে অফিস হওয়ায় মনে মনে বেশ খুশিই পুশকিন। এই ক’মাসে রাজারহাটকে ভালবেসে ফেলেছে ও। কিন্তু আজ যেন একটু বেশি ভালবাসা পাচ্ছে ওর! এমন বাইসন যে এখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে, আগে বুঝতে পারেনি।

“শালা, কাচের গন্ধ শুঁকছিস নাকি?”

আপনের গলা পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাল পুশকিন। দরজাটা অর্ধেক খুলে মাথা বের করে আছে আপন। মুখে একটা সিগারেট। এই ছেলেটা কথা শোনে না। অফিসের মধ্যে স্মোক করা বারণ। কিন্তু ও কিছুতেই শুনবে না। আজ আবার বস আসছে। আপন একটা কেলেঙ্কারি না করে থামবে না!

“কী রে, এমন মুখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?” আপন হাসল।

পুশকিন বলল, “তোকে বলেছি না নক না করে ঘরে ঢুকবি না? আর মুখে সিগারেট কেন? তোকে কতবার বলব?”

আপন দাঁত বের করে হাসল। তারপর সিগারেটটা ঠোঁট থেকে হাতে নিয়ে বলল, “টেনশনে সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারছি না। বস আসছে। শালা কোন-কোন অ্যাঙ্গেল থেকে বাঁশ দেবে কে জানে!”

“ভয়ের কী আছে? বস ওরকম নাকি?” পুশকিন জানলার কাছ থেকে সরে এসে চেয়ারে বসে বলল, “প্লাস, কাজ তো ভালই হচ্ছে, অ্যাটলান্টিস সি ফুডের টেক ওভারটা তো মসৃণভাবেই হল। তুই বেকার এত টেনশন করছিস কেন কে জানে!”

“আরে, তুই তো ভালই কাজ করেছিস। কিন্তু আমি সোনাঝুরি নিয়ে কী ঝুলে আছি জানিস না। শালা তারক চক্কোত্তি মাইরি হারামি দ্য গ্রেট! যা ঝোলাচ্ছে না!” আপন হাতের সিগারেটটা একবার টেনে মুখটা বিকৃত করল। তারপর কোথায় ফেলবে বুঝতে না পেরে সটান এসে পুশকিনের চেয়ারের পেছনের জানলাটা এক হ্যাঁচকায় খুলে নীচের দিকে ছুড়ে দিল!

“আরে! কী করলি কী এটা?” পুশকিন চেয়ারে ঘুরে অবাক হয়ে তাকাল।

“বেশ করলাম,” আপন নাক টেনে পুশকিনের উলটো দিকে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় বসে বলল, “শালা, আমার নাড়িভুঁড়ি সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে টেনশনে, আর ও আমায় ম্যানার্স শেখাচ্ছে!”

পুশকিন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। লাভ নেই। সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে তো দেখছে ও আপনকে। নিজে যা ভাল বোঝে করে। কারও কথা শোনে না। এমনকী, পুশকিনকেও পাত্তা দেয় না। কিন্তু বিপদে পড়লেই পুশকিনের কাছে আসে। আগেও এমনটাই হত। আসলে কিছু জিনিস সারা জীবনেও পালটায় না।

আপন বলল, “আমায় তাড়িয়ে দেবে না তো! মানে তোর ওই সি ফুড কোম্পানি টেকওভারের পাশে আমার শালা এমন ল্যাজেগোবরে দশাটা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। প্লাস, বস তোকে তো পছন্দও করে।”

“ব্যাপারটা ওভাবে দেখছিস কেন?” পুশকিন বলল, “এসব ব্যাপারে কি তুলনা চলে? আর পছন্দ করে মানে! তুই সেই সবসময় এমন করে ভাবিস কেন?”

আপন উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা পেছন দিকে ঠেলে বলল, “তোমার আর কী গুরু! ঝাড়া হাত-পা। আমার মতো এক পিস বউ গলায় ঝুললে বুঝতে। সারাক্ষণ তার সারা পৃথিবীর জিনিসপত্তর চাই! আমার তো পেছনে ইংরেজি বাজনা বাজার উপক্রম! শালা, ভালই ছিলাম নয়ডায়। বেশি মাইনে, কলকাতায় থাকব, এসবের লোভে এখানে এসেই ডুবেছি! আমি তো রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি, ভগবান আমার বউ যেন অন্যের প্রেমে পড়ে! শালা বউটাও এক পিস! আমায় ছেড়ে নড়বে না! ভাগ্যবানের বউ পালায় জানিস তো?”

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পুশকিন তাকিয়ে রইল আপনের চলে যাওয়ার দিকে। ওর ফেলে রাখা শূন্য চেয়ারটার দিকে। স্মিতা মারা গিয়েছে প্রায় চার বছর! কিন্তু তাও আজও ওর বুকের মাঝখানে, প্রকাণ্ড হলঘরের ভেতর এমন একটা ভাঙা পুতুল কেন বসে থাকে? উসকোখুসকো, জামা ছেঁড়া, রং লেপটে যাওয়া একটা পুতুল আজও কেন বসে থাকে এমন আনমনে? কেন ও পুতুলটাকে মন থেকে বের করে দিতে পারে না? কেন সব কিছু করার পরও ওর মনে হয় হেরে গিয়েছে ও? কেন নিজেকে এমন প্রকাণ্ড ব্যর্থ এক কচ্ছপের মতো লাগে পুশকিনের? কেন পারে না পুরনো পুশকিনটাকে বের করে আনতে? কেন মনে হয়, স্মিতাকে আসলে বুঝতে ভুল হয়েছিল! কেন মনে হয় ওর দোষে আজ স্মিতা নেই! সেই রাতে ও যদি অমন অবস্থায় না থাকত তা হলে… তা হলে যে কী, সেটা আজও বুঝতে পারে না পুশকিন। ওদের সম্পর্কটা কেমন একটা অন্ধ গলিতে ঢুকে গিয়েছিল যেন! থাকার উপায় নেই, পালানোর পথ নেই! যেন ডেড লক! আর সেটা ভেঙে দিতেই যেন এসেছিল মৃত্যু!

স্মিতা যা করেছিল তার পিছনে কি কোনও যুক্তি আছে? জানে না পুশকিন। কী এমন হয়েছিল যে, স্মিতা অমন করল? কাজ না করলে জীবন চলবে কী করে! আর স্মিতাই-বা ওকে নিজের কাছে তা হলে ডেকেছিল কেন?

স্মিতার হয়তো চার মাসের প্রেম ছিল, কিন্তু পুশকিনের তো আর তা নয়। সাড়ে তিন বছর ধরে স্মিতাকে ভালবেসেছিল ও!

এমবিএ করে তখন সবে একটা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। জীবনের প্রথম চাকরি। মনে মনে খুব সিরিয়াস ছিল পুশকিন। চার মাসের ট্রেনিং-এ ভেবেছিল কোনওদিকে তাকাবে না। জীবনে ভালভাবে দাঁড়াতেই হবে। কাজ শিখতে হবে। ওদের কোম্পানির সল্ট লেক অফিসে ট্রেনিং হত। ক্যান্টিনটা ছিল এক তলায়। লাঞ্চের সময় ওখানেই খেতে যেতে হবে জানত।

কিন্তু সেদিনই ক্যান্টিনে কী একটা ঝামেলা ছিল। তাই অফিস থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী খাবে সেটাই ভাবছিল পুশকিন।

অফিসের সামনে বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। কিন্তু তাদের দেখে খুব একটা ভক্তি আসছিল না। খাবার নিয়ে একটা সময় বেশ পিটপিট করত পুশকিন। তাই কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু খিদে বড় বালাই। তাই এদিক-ওদিক দেখে, অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

স্যান্ডউইচ! নিজের মনকে মেরে, এক প্লেট স্যান্ডউইচ নিয়ে সকলের কাছ থেকে দূরে একটা বড় গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পুশকিন।

সেদিন মেঘ ছিল আকাশে। গাছের ছায়া আরও একটু বেশি ছায়াময় ছিল যেন। উলটো ফুটের বিশাল বড় বিল্ডিংটা দেখে সেটাকে রাক্ষস মনে হচ্ছিল পুশকিনের। মনে হচ্ছিল একটু পরেই এটা সামনে ছড়ানো মানুষগুলোকে আবার গিলে নেবে! হাতে ধরা স্যান্ডউইচের প্লেটের দিকে তাকিয়ে পুশকিনের নিজেকেও তেমনই একটা খাবার মনে হয়েছিল।

আর ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা ভেসে এসেছিল গাছের অন্যদিক থেকে।

ক্লিংক্লিং করে সামনে রাখা ইন্টারকমটা বেজে উঠল এবার। পুশকিন তাকাল। এখন আবার কার ফোন এল! চশমাটা চোখ থেকে খুলে রেখে রিসিভারটা তুলল পুশকিন, “হ্যালো।”

“স্যার, আপনার সঙ্গে আইকা নামে একজন দেখা করতে এসেছেন। মিসেস আইকা বাসু।”

“আইকা!” অবাক হল পুশকিন। ওর আবার কী দরকার পড়ল!

“হ্যাঁ স্যার। শুড আই সেন্ড হার আপ?”

“না,” পুশকিন বলল, “আমি আসছি। ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন।”

ফোনটা রেখে উঠল পুশকিন। আজ বস আসবেন, আর আজকেই মেয়েটা এল! আর আসবি তো আয় এমন সময়! প্লাস, একটা ফোন তো করবে! এমন হুট করে কেউ কাজের জায়গায় আসে!

পুশকিন নিজের ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। করিডর নির্জন। আসলে এই রাজ্যে ওদের এই অফিসটা নতুন। মাসপাঁচেক হয়েছে। এখনও রিক্রুট চলছে। তাই জনাদশেক কর্মী আর দু’জন রিসেপশনিস্ট আছে। আরও কিছু ছেলেমেয়ে দরকার। সি-ফুড কোম্পানিটার মেরামত আর সঙ্গে সেটাকে আবার সচল করতে হলে, বিদেশে মার্কেট ধরতে হলে আরও লোক লাগবে। আর পাশাপাশি তো আরও নানা সেক্টরে কাজ চলছে! তাই লোকজন নিতেই হবে। সেই কাজ নিয়ে আলোচনা করতেই দিল্লি থেকে বস আসছেন।

আপনের ঘরের ঘষা কাচের দরজা বন্ধ। ভালই হয়েছে। ওকে দেখলেই আবার এসে হাবিজাবি কথা শুরু করবে। আপনের সব কথাতেই একটা সূক্ষ্ম হুল টের পায় পুশকিন! কেন কে জানে! পুশকিন ভদ্রতাবশত কিছু বলতে পারে না, কিন্তু মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে! ওর কোথায় যেন পুশকিনকে নিয়ে সমস্যা আছে!

লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কল-বাটনটা টিপে ঘড়ি দেখল পুশকিন। সাড়ে চারটে বাজে। বস আসবেন পাঁচটা নাগাদ। কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন উনি, নিজের কী একটা কাজ সেরে তারপর আসবেন।

টুং শব্দে লিফটের দরজাটা খুলে গেল। বারো তলার ওপরে অফিস ওদের। তবে নীচে একটা রিসেপশন-স্পেস নেওয়া আছে।। সামনের দু’বছরের ভেতরে অফিস স্পেস আরও বাড়াতে হবে।

একতলার বোতামটা টিপে লিফটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল পুশকিন। লিফটটা ফাঁকা। নরম হলুদ আলোয় ভরতি। এই আলোটাকে কেমন একটা জ্যোৎস্নার মতো লাগে পুশকিনের। মনে হয় এই বুঝি মেঘ এসে মুছে দেবে আলোটুকু!

ছ’তলায় এসে লিফটটা থামল। দরজা খুলতেই স্মরণকে দেখতে পেল পুশকিন। বেঁটে রোগা। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ মতো। ছেলেটা মাসখানেক হল ওদের কোম্পানিতে জয়েন করেছে। অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। তবে বললে নানা চিঠি-চাপাটিও করে দেয়। কোনও কাজে ‘না’ বলে না। আসলে ওর এখনও কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই।

তবে ছেলেটা যেন কেমন। কখনও মাথার চুল আঁচড়াতে দেখল না ছেলেটাকে! জামাটাও কেমন যেন এলোমেলো। হাজারবার বলেও শু পরাতে পারেনি কেউ। সারাক্ষণ একটা সবুজ রঙের স্নিকার পরে থাকে।

লিফটের ভেতরে পুশকিনকে দেখে একটু থমকাল স্মরণ। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে একপাশে দাঁড়াল।

“তুমি ফিফথ ফ্লোরে কী করছ নিজের টেব্‌ল ছেড়ে?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকাল।

“স্যার ওই মানে…” স্মরণ মাথা চুলকোল।

“ওই মানে?” পুশকিনের হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করল ও। মাথার চুল এবার পুরো ঘেঁটে গিয়েছে ছেলেটার।

স্মরণ বলল, “স্যার, মানে পারসোনাল একটু।”

পুশকিন কড়া চোখে তাকাল স্মরণের দিকে, “অফিস টাইমে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছ নিজের সিট ছেড়ে! আবার জিজ্ঞেস করলে বলছ পারসোনাল?”

স্মরণ জিভ কেটে বলল, “সরি স্যার। মা কালী বলছি, অন্যায় কিছু করিনি!”

“হোয়াট!” পুশকিন কী বলবে ভেবে পেল না! প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে ওর। কিন্তু কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হয়ে তো আর এভাবে হাসা যায় না!

লিফটটা এসে থামল গ্রাউন্ড ফ্লোরে। পুশকিন বাইরে বেরোল। স্মরণও বেরিয়েছে ওর সঙ্গে।

পুশকিন আবার বলল, “এসব কী বলছ! নিজের সিট ছেড়ে কী করছ তুমি? ফিফথ ফ্লোরে তো অন্য একটা কোম্পানির অফিস। সেখানে কী করছিলে?”

“বললে রাগ করবেন না তো স্যার?” স্মরণের মুখটা কেমন যেন ভয়ে শুকিয়ে গেল।

“আশ্চর্য তো!” পুশকিন ঠোঁট কামড়ে কড়া চোখে তাকাল, “ডু ইউ থিঙ্ক দিস ইজ় ফানি? আজ বস আসছেন, জানো তো! আর সেখানে উনি হিসেব দেখতে চাইলে দেখাতে পারবে? সব আপ টু ডেট আছে তো? না হলে কিন্তু তোমার বিপদ আছে। এখনও পারমানেন্ট হওনি!”

“প্যাঁও, স্যার।”

“হোয়াট?” পুশকিন থমকে গেল, “প্যাঁও মানে?”

“একটা মেয়ে, স্যার। আমার ইয়ে স্যার। ওই ছ’তলার অফিসটায় এসেছিল স্যার।”

পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না।

স্মরণ বলল, “স্যার, আসলে আমি কাজ করছিলাম। প্যাঁও এল। তাই আমায় ডাকল আর কী! আর আমি…”

“ওকে, ওকে…” পুশকিন হাত তুলে থামাল স্মরণকে, “আই ডোন্ট ওয়ন্ট এনি ডিটেল অফ ইয়োর পারসোনাল লাইফ! নীচে এসেছ কেন? সিটে যাও।”

“স্যার, একটা কথা স্যার!” স্মরণ এখনও আমতা-আমতা করে যাচ্ছে!

“কী?” পুশকিন জিজ্ঞেস করল।

“সোনাঝুরিতে যে-প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে, সেই টিমে আমায় নেবেন স্যার? আমার তো তেমন কাজ নেই। আমি স্যার তার ফাঁকে এখন যেটা করছি সেটাও করে দেব। কাইন্ডলি যদি আমায়…”

“সোনাঝুরির কাজটা তো এখন আপন দেখছে। আমি তো দেখছি না! ওকে বলো।”

“উনি স্যার খ্যাঁকখ্যাঁক করেন!” স্মরণ ব্যাজার মুখে বলল, “কিছু বলতে গেলেই এমন করেন যেন, আমি ওঁর টিফিন চুরি করে খেয়েছি!”

“কী সব বলছ!” পুশকিন হাসল এবার। আস্ত পাগল একটা ছেলে!

“সত্যি স্যার। অন গড!”

“ঠিক আছে। আমি মনে রাখব। এখন নিজের জায়গায় যাও। নীচে এলে কেন?” পুশকিন কথা শেষ করতে চাইল!

“স্যার, একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়েই চলে যাচ্ছি!” স্মরণ আর না দাঁড়িয়ে হনহন করে বিল্ডিং-এর বাইরে হাঁটা লাগাল।

পুশকিনের হাসি পেল। প্যাঁও! এটা কোনও নাম! ছেলেটা ইয়ারকি মারল না তো!

পাশে বড়-বড় কাচের জানলার দিকে তাকাল পুশকিন। আকাশের রং পালটে গিয়েছে আরও! বাইসনরা আরও কাছে চলে এসেছে শহরের! তবে কি আজ সত্যি বৃষ্টি আসবে?

লিফট থেকে নেমে ওদের রিসেপশন স্পেসটা কয়েক পা দূরে। কাছাকাছি পৌঁছতেই পুশকিন দেখল সামনে রাখা চেয়ারে আইকা বসে আছে। দিন এতটা গড়িয়ে গিয়েছে, তাও সাজগোজ এখনও নিখুঁত। ছোট করে কাটা চুল এখনও পাট করে আঁচড়ানো!

মার্বেলের মেঝেতে পুশকিনের জুতোর শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকাল আইকা। তারপর হেসে উঠে দাঁড়াল।

“তুই!” চশমাটা খুলে পকেটে রেখে বলল পুশকিন।

“কেন আসতে নেই?” আইকা হেসে চুলটা অকারণে হাত দিয়ে ঠিক করল।

“হ্যাঁ, মানে…” পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না, “আসলে আজ একটু ব্যস্ত আছি। দিল্লি থেকে বস আসছে। তাই সবাই একটু বেশি অ্যালার্ট আর কী!”

“ওহো! তবে তো অসুবিধে করে ফেললাম!” আইকার মুখে কেমন একটা অপরাধীর ছাপ।

খারাপ লাগল পুশকিনের। ও কোনও বিষয়ে কাউকে খুব একটা বারণ করতে পারে না। খবর না দিয়ে চলে আসাতে ওর অসুবিধে হল জেনে আইকা যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, সেটায় কেন যেন খারাপ লাগল ওর।

ও বলল, “আরে, আধঘণ্টা তো কথা বলাই যেতে পারে!”

আইকা সামান্য হাসল। কিন্তু তাও দ্বিধার ভাবটা কাটছে না ওর।

“চল, ক্যাফেতে যাই। ডোন্ট লুক সো গ্লুমি। ইট ডাজ়ন্ট সুট ইউ!” পুশকিন আলতো করে হাসল।

এই বিল্ডিংটা বেশ বড়। পেছনের দিকে একটা ক্যাফে আছে। চা, কফি ছাড়াও টুকটাক খাবার পাওয়া যায়। পুশকিন নিজে চা বা কফি কিছু খায় না। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে আসে এই ক্যাফেতে। এরা একটা দারুণ আঙুরের শরবত বানায়।

ক্যাফেতে ছোট-ছোট কয়েকটা চেয়ার-টেবিল আছে। তবে এখন তার একটায় মাত্র দু’জন মেয়ে বসে রয়েছে। বাকি চেয়ার-টেবিলগুলো ফাঁকা।

জানলার কাছে একটা চেয়ার দেখে বসে পড়ল পুশকিন। হাতের ব্যাগটা টেবিলের একপাশে রেখে সামনের চেয়ারটা টেনে বসল আইকাও।

“কফি?” পুশকিন জিজ্ঞেস করল।

“তুই তো খাস না। তুই কী খাবি?” আইকা ভুরু তুলে তাকাল পুশকিনের দিকে।

“গ্রেপ জুস। আর তোর কফি বলি?”

আইকা মাথা নাড়ল।

পুশকিন “চাচা” বলে কাউন্টারের লোকটিকে ডেকে একটা গ্রেপ জুস আর কফি দিতে বলে গুছিয়ে বসল এবার।

“বল।”

আইকা নাক টানল, “এই এসেছিলাম কাছের একটা কোম্পানিতে, ‘কোডি স্টিল’। আমরা একটা বড় সেমিনার করছি। তাই এসেছিলাম ওদের জেনারেল ম্যানেজারকে নেমন্তন্ন করতে। মানে, ওঁকে তো আর যাকে-তাকে দিয়ে নেমন্তন্নের কার্ড পাঠানো যায় না! কাজটা শেষ করে ভাবলাম, তুই সেদিন বলেছিলি এখানে আছিস। তাই টুক মাই চান্স। বুঝতে পারিনি তুই বিজ়ি! সরি।”

“আরে, তা নয়,” পুশকিন হাসল, “এই অফিসটা গোটাটাই আমায় আর আপনকে দেখতে হয়। আমরা এই রিজিয়নে নতুন। উই হ্যাভ টু হ্যাভ আ গুড হোল্ড অন দ্য রিজিয়ন। তাই একটা কাজের চাপ আছে। দিল্লির হেড কোয়ার্টার থেকে চাপ দেয়। বাদ দে। তারপর? কী খবর বল।”

আইকা কিছু বলতে গিয়েও থমকাল। কাউন্টারের বয়স্ক মানুষটি এসে ওদের সামনে কফি আর একটা শরবতের গেলাস রেখে গেল।

আইকা ব্যাগ থেকে একটা ওয়াইপ বের করে হাত মুছল। তারপর কাপটা টেনে নিয়ে বলল, “আসলে তোকে এত বছর পরে আচমকা দেখে এত ভাল লাগছে! মাঝে তো পুরো হারিয়ে গিয়েছিলি! তোর সঙ্গে সেই বিকেলের পরে এই দেখা হচ্ছে। মেসেজ করলে রিপ্লাই দিস না কেন রে?”

পুশকিন গেলাসে সামান্য চুমুক দিয়ে শুনল কথাগুলো। আইকা এমন এলোমেলো কথা বলছে কেন! আসলে কী বলতে চাইছে, সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না! ও তাকিয়ে রইল।

“আমার এত খারাপ লাগছে! কী বলব তোকে!” আইকা কাপের মুখটায় আঙুল বোলাতে লাগল এবার।

“খারাপ? কেন?” পুশকিনের এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল আইকা কি স্কুলের সেই কথাটা তুলছে নাকি!

“খারাপ লাগবে না? কী বলছিস?” আইকা ঠোঁট কামড়ে তাকাল।

পুশকিন ক্যাফের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা দেখল একবার। আইকা কী শুরু করল এসব!

“কী ব্যাপার বল তো!” পুশকিন গেলাসে লম্বা চুমুক দিয়ে তাকাল আইকার দিকে।

আইকা কিছু বলতে গিয়েও কেমন যেন থমকে গেল। তারপর আচমকা হাত বাড়িয়ে পুশকিনের ঠোঁটের ওপর লেগে থাকা আঙুরের পাল্প মুছে নিল আঙুল দিয়ে। তারপর সেটা মুখে ঢুকিয়ে খেয়ে নিল। বলল, “ইয়াম!”

পুশকিনের ধক করে উঠল বুকটা। এটা কী করল আইকা! এর মানে কী! ও চট করে দেখে নিল আশপাশটা। দূরের টেবলে বসা দুটো মেয়ে কি দেখল এটা!

আইকা হাসল, “কফি না বলে আমিও শরবতটা খেতে পারতাম মনে হচ্ছে।”

পুশকিনের এবার বিরক্তি লাগছে। কী চায় আইকা? ও এল কেন? পাঁচটা বাজে প্রায়। এই আইকার মধ্যে যেন স্কুলের রাগী, অহংকারী সেই মেয়েটা আর নেই।

“তুই কিছু বলবি?” পুশকিন আর থাকতে না পেরে বলল এবার।

“ও হ্যাঁ, মানে… আসলে তোকে দেখতে ইচ্ছে করল!” আইকা তাকাল পুশকিনের দিকে।

পুশকিন হাসল সামান্য। অস্বস্তি হচ্ছে ওর। কিন্তু কী বলবে! আইকা দেখতে খুবই সুন্দরী। রূপচর্চার ফলে সেটা আরও খুলেছে। এমন একটা মেয়ে এসব বললে যে-কোনও ছেলেরই মনে নানা রঙের এলইডি জ্বলতে পারে। কিন্তু পুশকিনের জ্বলল না। এই আইকাকে ও চেনে। স্কুলে এমন কাজ করেছিল যে, এখনও ওর মন তেতো হয়ে আছে। নেহাত অভদ্রতা করতে পারে না তাই কিছু বলছে না!

পুশকিন উঠে দাঁড়াল, “তোর কীসে খারাপ লাগল যখন বললি না, তখন আমি আজ আসি রে। বস যে-কোনও সময় ঢুকবেন।”

হা-হা করে এবার হেসে উঠল আইকা, “ভয় পেয়ে গেলি! এখনও ভিতুই আছিস! কিচ্ছু পালটাসনি তুই পুশকিন।”

পুশকিন হাসল। যদিও এতে হাসির কী আছে বুঝল না। ও হাত তুলে চাচার দিকে ইঙ্গিত করল।

আইকা বলল, “দামটা?”

“আমার খাতা চলে এখানে। ডোন্ট ওয়ারি।”

ক্যাফের বাইরে এসে আইকা ঘড়ি দেখল। বলল, “যা বলছিলাম। আসলে নোঈ যে এমন করে তোর ওই খুড়তুতো ভাইকে বাতিল করে দেবে, আমরা বুঝতে পারিনি। তাই খারাপ লাগছে আমার।”

“এতে খারাপ লাগার কী আছে?” পুশকিন বলল, “ওর জীবন, ও যেটা ভাল বুঝবে সেটাই করবে। প্লাস ডিনো বিদেশে ফিরে গিয়েছে। এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়।”

“আসলে মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তায় আছি আমরা। একটা চাকরি করত। সেটা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ খুঁজছে। পাচ্ছে না। ওর মা বিয়ে দেবে বলে উঠে-পড়ে লেগেছে, কিন্তু সেটাও করবে না। কাকু আমায় বলছিল যদি…”

“নোঈ কী পাশ করেছে? মানে কোয়ালিফিকেশন কী! আমাদের এখানে রিক্রুটমেন্ট চলছে। ইফ শি ইজ় ইন্টারেস্টেড, তা হলে…”

পুশকিনকে কথা শেষ করতে দিল না আইকা। প্রায় ছোঁ মেরে ওর মুখ থেকে কথাটা তুলে নিয়ে বলল, “আরে, নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টেড হবে।”

“দেখ, ওকে আগে বল,” পুশকিন সাবধানি গলায় বলল, “নোঈকে আগে বলে দ্যাখ। ইউ ডোন্ট কমিট। প্লাস ভবানীপুর থেকে রাজারহাট আসবে কি না, সেটাও একটা ব্যাপার। আমায় দু’দিনের মধ্যে জানা, তা হলেই হবে,” পুশকিন ঘড়ি দেখল আর দেরি করা যাবে না।

আইকা হাসল, “আমি জানাচ্ছি। খুব ভাল হবে এটা। তোদের বাড়িতে আপত্তি হবে না তো?”

“মানে?” পুশকিন ভুরু তুলল, “বাড়িতে আপত্তি কেন? অফিস আর বাড়ি তো আলাদা। আর বিয়ের কথা মানেই তো বিয়ে নয়। এসব ভাবিস না। যদি ইন্টারেস্টেড হয় আসতে বলিস। কেমন?”

“যদি বলছিস কেন?” আইকা তাও যেন ছাড়ছে না!

“সেদিন গাড়িতে উঠতে বলেছিলি, ও কি উঠল!” হাসল পুশকিন, “দ্যাখ, যদি আসে।”

আইকা বলল, “আজ তবে আসি। আমি আবার আসতে পারি তো?”

“তুই?” পুশকিন সামান্য থমকাল। এর আগের দিন রাস্তায় আচমকা দেখা হয়ে গিয়েছিল বলে লিফট দিয়েছিল গাড়িতে। কিন্তু আবার আসবে? পুশকিন সামান্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। দ্বিধা নিয়ে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। তারপর কোনওমতে মাথা নেড়ে বলেছিল, “শিয়োর।”

আইকা সামান্য এগিয়ে এল কাছে। তারপর আলতো করে হাতটা ধরল ওর। বলল, “স্কুল অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গিয়েছে পুশকিন। সেই আইকাটা আর নেই কিন্তু।”

এই বিল্ডিংটার নীচের তলাটা বেশ ফাঁকা থাকে। বড়-বড় থাম। উঁচু সিলিং! থমথমে লম্বা সাদা দেওয়াল— গোটা জায়গাটাকে যেন আরও নির্জন করে দেয়!

আইকা পায়ের জুতোর আওয়াজ তুলে চলে গেল। আর সেই খটখট আওয়াজ যেন ছোট ছোট ফুটো করে দিল নিস্তব্ধতার আলখাল্লায়!

পুশকিন চুলের ভেতর হাত ডোবাল। বাইরে ছিল ভাল ছিল। কলকাতায় এসেই আবার চুঁইয়ে-চুঁইয়ে অতীত এসে ঢুকছে ওর জীবনে! বাবা ঠিকই বলেছে, “পালিয়ে বাঁচতে পারবি না বাবু।”

বাবার কথা মনে পড়তেই ঘড়ি দেখল পুশকিন। আজ বাবার ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার কথা, গিয়েছে কি!

বাবা রাসবিহারী মোড়ের কাছে ওদের বড় বাড়িতে থাকে ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ওপর রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের কাছে ওর ফ্ল্যাটে থাকে না।

এটা পুশকিনের একটা কষ্টের জায়গা। বাড়ির অমতে স্মিতাকে বিয়ে করেছিল পুশকিন। সবাই বাধা দিয়েছিল। মা তো সাংঘাতিক অসুস্থ হয়েও পড়েছিল। কিন্তু তাও পুশকিন কারও কথা শোনেনি! স্মিতা এমন করে টেনেছিল ওকে! আর সে সময় পুশকিনের মনে হয়েছিল, স্মিতাকে ও কথা দিয়েছে বিয়ে করবে! প্রেমের চেয়েও কথা রাখাটা জরুরি!

কিন্তু বুঝতে পারেনি একটা কথা রাখতে গিয়ে জীবনের অন্যদিকটা নষ্ট হয়ে যাবে! ওর বিয়ের চার মাসের মধ্যে মা মারা গিয়েছিল!

এখনও বিকেলটার কথা মনে আছে পুশকিনের। তখনও প্যারিসে পোস্টিং হয়নি ওর। কলকাতাতেই ছিল। অফিসে বসের ঘরে মিটিং হচ্ছিল সেদিন। নতুন চাকরি। পুশকিন সারাক্ষণ তটস্থ থাকত সেই সময়।

মার্কেটিং চিফ একটা গ্রাফ নিয়ে কথা বলছিলেন, এমন সময় পুশকিনের পকেটের মোবাইলটা তারস্বরে বেজে উঠেছিল। ঘরের সবাই খুব বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে। পুশকিনের মনে হচ্ছিল ন’তলার ওপর থেকে ঝাঁপ মারে রাস্তায়। ফোনটা বের করে সুইচ অফ করতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল একদম! স্ক্রিনে দেখেছিল বাবার মোবাইল থেকে কলটা এসেছে!

নিস্তব্ধ ঘরের মাঝখানে বিরক্ত মুখের বেশ কয়েকজন মানুষকে তোয়াক্কা না করেই খ্যানখ্যান করে বাজছিল ফোনটা! কিন্তু বাবা ফোন করল কেন? পুশকিন ফোনের ‘রিজেক্ট’ বোতামটা টিপতে পারছিল না।

বিয়ের আগে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারপর একবারই বাড়িতে গিয়েছিল পুশকিন। কিন্তু কিছুতেই ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি ওর ভাই আর কাকারা। বাবা দোতলার বারান্দা থেকে সেদিন দাঁড়িয়ে দেখেছিল সবাই মিলে পুশকিনকে কীভাবে বাড়ির দরজা থেকে দূর করে দিয়েছিল! ভাই যখন ওর কলার ধরে ওকে ধাক্কা মেরে বাড়ির দরজা থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলছিল, বাবা কী অদ্ভুত নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখছিল ওকে! ভাইয়ের সেই ধাক্কা, কাকাদের গালাগালি ওকে কষ্ট দেয়নি! কিন্তু বাবার ওই ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকাটা ভেতরে-ভেতরে একদম মেরে ফেলেছিল ওকে।

সেই বাবা নিজে ফোন করেছে! কেন? হঠাৎ কী হল? ফোনটা হাত-পা ছুড়ে একগুঁয়ে বাচ্চার মতো চিৎকার করে চলছিল!

আচমকা বস শান্ত গলায় বলেছিল, “টেক ইট আউটসাইড। ইট মাস্ট বি ইমপর্ট্যান্ট!”

ঘরের কাচের দরজাটা ঠেলে বাইরে এসে ফোনটা ধরেছিল পুশকিন।

বাবা শান্ত গলায় বলেছিল, “তোমার মা আর নেই। আজ একটু আগে দেহ রেখেছেন। উনি শেষ মুহূর্তেও চাননি তোমায় খবর দিতে। কিন্তু আমি মনে করি, কোনও কিছুই মৃত্যুর চেয়ে বেশি নয়, বড় নয়। যা কিছু মনোমালিন্য তার থেকে মৃত্যুকে দূরে রাখাই ভাল। পারলে কেওড়াতলায় এসো।”

সেদিন অনেক রাতে শ্মশানে একটা সিঁড়িতে একা বসেছিল পুশকিন! ওদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিল। কিন্তু কেউই কথা বলছিল না ওর সঙ্গে। বরং এমন একটা ভাব নিয়ে ঘুরছিল যাতে পুশকিনের মনে হচ্ছিল, মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই দায়ী!

মায়ের মুখাগ্নিটা পর্যন্ত করেছিল ভাই। দূরে অপরিচিতের মতো দাঁড়িয়ে পুশকিন দেখেছিল মা চলে যাচ্ছে সারা জীবনের মতো! সেই ছোটবেলায় মুখ ধুইয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেওয়া মা। সেই পক্সের সময় সারা রাত জেগে বসে থাকা মা। এক মনখারাপের দুপুরে পাশে এসে মাথায় হাত রাখা মা। চলে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছিল, বাবা, ভাই আর এত আত্মীয়স্বজন কী করে জানবে মা ওর কতটা ছিল! একটা মেয়েকে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছে বলে ওকে এমন করে সবাই দাগ কেটে বাইরের লোক করে দিল। মা-ও বুঝল না পুশকিনকে।

সেদিন শেষরাতে বাড়ি ফিরেছিল পুশকিন। স্মিতা জেগে বসেছিল বসার ঘরে। এতক্ষণের কান্নাটা স্মিতাকে দেখে কেমন যেন বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। মাটিতে বসে স্মিতার কোলে মুখ গুঁজে দিয়েছিল পুশকিন। বন্ধ চোখের অন্ধকারে দেখেছিল মা ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছে আগুনের সঙ্গে!

স্মিতা মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে বলেছিল, “কাঁদে না সোনা। আমি তো আছি।”

কেউ থাকে না। ভাই থাকে না। বন্ধু থাকে না। বাবা থাকে না। মা থাকে না। স্ত্রী থাকে না। প্রেমও থাকে না। নিস্তব্ধতা আর একাকিত্ব তার কালো আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে দেয় মাথা-নিচু মানুষের জীবন।

লিফট থেকে বেরিয়ে অফিসে পা রাখল পুশকিন।

“কোথায় ছিলে গুরু? বস এসে গিয়েছে!” আপন হাতে একটা ফাইল নিয়ে এগিয়ে এল সামনের একটা কিউবিকলের ভেতর থেকে।

এই কিউবগুলোর সবটায় লোকজন নেই। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিতে লোকজন বাড়লে এই মৌমাছির খোপগুলো ভরে উঠবে।

পুশকিন কিছু না বলে বসের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভারী কাচের দরজার বেশির ভাগটাই ফ্রস্টেড। তার ফাঁক দিয়েও বসের ভ্যানিটি ব্যাগটা দেখা যাচ্ছে।

“স্যার,” আচমকা কানের কাছে ফিসফিস করে একটা গলা পেল পুশকিন। সামান্য চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল ও। স্মরণ এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। বেঁটে, রোগা পাতলা ছেলেটার চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে এখনও। সঙ্গে জামাটাও অর্ধেক গোঁজা আর বাকি অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে প্যান্টের বাইরে।

পুশকিনের আবার হাসি পেল। এমন কাকতাড়ুয়া হয়ে আছে কেন ছেলেটা! আর ফিসফিস করেই-বা কথা বলছে কেন?

হাসি চেপে পুশকিন গম্ভীরভাবেই বলল, “কী হয়েছে?”

“স্যার বস, মেয়ে?” স্মরণের চোখগুলো গোলগোল হয়ে আছে।

“হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?”

স্মরণ বলল, “না মানে, হিন্দি সিনেমায়, বাংলা সিনেমায় যে দেখায় বস মানে ছেলে?”

“বস মানে ছেলে? তাই নাকি?” পুশকিন আর না হেসে পারল না!

আপন একটু পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এবার ও বলল, “শালা, এই জ্ঞান বসের সামনে ফলাস না স্মরণ। আর এখন কাট এখান থেকে। ডাকলে আসবি, না হলে আসবি না। বস কিন্তু খুব রাগী।”

স্মরণ কী বুঝল কে জানে! নিজের খোপের দিকে যেতে-যেতে মাথা নেড়ে বলল, “বস শব্দের জেন্ডারটা না জানা গেলেও এটা জানা গেল যে, বস খুব ডেঞ্জার!”

আপন পাশে এসে দাঁড়াল পুশকিনের। বলল, “যা রিক্রুট করেছ না গুরু, জানলে ইন্ডিয়ান ফুটবল টিমের সিলেক্টার বানিয়ে দেবে।”

পুশকিন বলল, “ছেলেটা কাজ করে মন দিয়ে। সিনসিয়ার। অনেস্ট। একটু খ্যাপাটে। কিন্তু তাতে কাজের ক্ষতি তো হচ্ছে না।”

আপন বলল, “শালা, বরাবর দেখছি তোর ট্যান টাইপের জিনিসই বেশি ভাল লাগে। নিজেও তো শালা তার-কাটা!”

পুশকিন হাসল। আপনের কথায় ও কিছু মনে করে না। আপন ওর পুরনো বন্ধু বটে, কিন্তু ও বোঝে আপন সারা জীবন ওর মধ্যে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকেই দেখে এসেছে!

পুশকিনের কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। ওর কেবল এক ক্লান্তি আছে। মনের মধ্যে সহস্র বছরের জমে থাকা এক ঘুম আছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় একদিন সব ছেড়ে ও দূরে কোনও ঠান্ডা পাহাড়ি শহরে চলে যাবে। সেখানে নির্জন একটি ঘরে বসে দেখবে আকাশ থেকে নেমে আসা ক্যান্ডিফ্লসের মতো তুষারের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে এক ছোট্ট নিশ্চুপ জনপদ।

আচমকা আকাশ ফাটিয়ে কড়কড় করে মেঘ ডেকে উঠল। কাচের বড় জানলাগুলোর দিকে তাকাল পুশকিন। বাইসনের দল এসে গিয়েছে। তাদের খুরের ধুলোয় চারদিক অন্ধকার! কতদিন বৃষ্টি হয় না! আজ কি হবে?

“স্যার, আপনাদের ম্যাডাম ডাকছেন।”

কাচের দরজা ঠেলে হাবু বেরিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।

আপন হাত দিয়ে সামনে ঠেলে দিল পুশকিনকে, “এগো, চল। শালা আজ আমার বাম্বু ডট কম হবে শিয়োর।”

কাচের দরজা ঠেলে দু’জনেই অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকল।

বস বড় কাচের টেবিলের অন্য পারে বসে মন দিয়ে সামনে খুলে রাখা কিছু কাগজ দেখছেন। ওদের দিকে না তাকিয়েই হাত নেড়ে বসতে বললেন।

এই ঘরটা বন্ধই থাকে, বস এলেই শুধু ঝাড়পোঁছ করে খোলা হয়। মিসেস মালভিকা আইয়ার কড়া হলেও মানুষ ভাল। সিনসিয়ারিটি না দেখলে যেমন রেগে যান খুব, তেমনই ভাল কাজের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করেন না কখনও।

গত আড়াই বছর হল এই কোম্পানিতে জয়েন করেছে পুশকিন। সেখানেই কাজের সূত্রে দেখেছে, ঢিলেমি একদম পছন্দ করেন না বস।

এই যে কলকাতায় ওকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, সেখানেও ওকে বলা হয়েছে যে কোম্পানির কাজ এই অঞ্চলে পুশকিন আর আপনের পারফরম্যান্সের ওপরেই নির্ভর করবে। সেখানে যেন কেউ গাফিলতি না দেখায়!

বসের বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন। মাথার চুল বড়। কিন্তু কাঁচায় পাকায় মেশানো। পরনের শাড়িটা যে খুব দামি, সেটা আর বলে দিতে হবে না।

“সো জেন্টলমেন, তোমাদের খবর কী?” বস সামনের কাগজটা সরিয়ে ওদের দিকে তাকালেন।

পুশকিন জানে এর উত্তর দিতে নেই। বসের কোনও ইন্টারেস্ট নেই ওদের ব্যাপারে। উনি কেরলের মানুষ হলেও দীর্ঘদিন কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন বলে বাংলাটা ভালই বলেন।

আপন হাতে ধরা ফাইলটা টেবিলে রেখে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “ম্যাম, উই হ্যাভ সাম গ্লিচেস ইন দ্যাট সোনাঝুরি প্রজেক্ট। আ পারসন… তারক চক্রবর্তী ইজ ক্রিয়েটিং হ্যাভক ট্রাবল। সো…”

“তুমি এসব তো ই মেলেও জানিয়েছ লাস্ট উইকে। তার পর দশ দিন কেটে গিয়েছে, এখনও একই গল্প দিয়ে যাচ্ছ! নতুন কী প্রগ্রেস হল?”

“ম্যাম, আসলে তারক লোকটি খুব ঝামেলা করছে। কিছুতেই নিজের জায়গা থেকে সরছে না! জুট মিলটা কিছুতেই রিভাইভ করতে দিতে চাইছে না! আর দিলেও ওর ডিম্যান্ড আছে কিছু! আমি মানে…”

বস হাত তুলে আপনকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, “একটা লোকের জন্য তবে কি সবটা আটকে যাবে? জুট মিল টেক ওভার করে সেটাকে চালানো, ওই বড় বাড়িটা নিয়ে সেটাকে রিসর্ট করে তোলা। পাশের নদীতে লাক্সারি ফেরি টুরিজ়ম! সব কি তবে আমরা ডিসকার্ড করে দেব? আপন আই মাস্ট সে ইউ আর নট গুড এনাফ।”

“না ম্যাম, আপনি বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা তা নয়। যে কেউ ওখানে গেলে এমন ফেঁসে যাবে! আমি দেখি তারককে যদি অন্যভাবে কিছু করে বাগে আনা যায়,” আপন হাত মুঠো করে চোখ সরু করে একটা গভীর কিছু করতে চলেছে এমন ভাব দেখাল।

“ডোন্ট মেক ফেসেস। সেভেন্টিজ়ের হিন্দি মুভিজ়ের ভিলেনরা এমন মুখ করত। ওসব ড্রামা বাদ দাও আপন,” বস বিরক্ত হয়ে তাকালেন আপনের দিকে। তারপর পুশকিনকে লক্ষ করে বললেন, “তোমার সি-ফুডের ব্যাপারটা তো ভালই এগিয়েছে। এক কাজ করো, গিভ দ্যাট টু আওয়ার ড্রামাকুইন আপন। তুমি সোনাঝুরির প্রজেক্টটা হাতে নাও। আজ থেকে ওটা তোমার আন্ডারে। ভাল কয়েকজন ছেলেমেয়ে রিক্রুট করো। দেন গো ফর ইট। তারক না কে, তাকে বাইপাস করে টক টু মালিকস। ওদের তো সম্পত্তি! দ্যাখো, ওরা কী বলে। টেল দেম আওয়ার প্ল্যান্‌স। আমরা শুধু বিজ়নেস করি তা নয়, ডেভেলপমেন্টও আমাদের মাধ্যমে হয়। সেটা ওদের বলো। সোনাঝুরি উইল ব্লুম লাইক এনিথিং!”

“আমি পারব ম্যাম!” ঘ্যানঘ্যানে বাচ্চার মতো আপন মাঝখানে লাফিয়ে পড়ে বলল।

“অনেক পেরেছ। আর নয়। পেপার্স পুশকিনকে হ্যান্ডওভার করে দাও। সি ফুডের প্রোডাকশন, সেল্‌স, প্রোমোশনটা তুমি দ্যাখো,” বস কথাটা শেষ করে পুশকিনকে বললেন, “গেট ইট ডান। আমার ওপরও চাপ আছে। ডোন্ট ডিস্যাপয়েন্ট মি। সোনাঝুরির কাজটা ইমপর্ট্যান্ট। রাশিয়া, ইউএস, ব্রিটেন প্লাস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ এনভায়রনমেন্ট-এর ব্যাপারে খুব কশাস! ওখানে জুট আর জুটের প্রোডাক্ট ইজ় ইন হাই ডিম্যান্ড। প্লাস ওই হেরিটেজ বিল্ডিংটাও আমাদের দরকার। ফ্যান্টাস্টিক রিসর্ট হবে। বিদেশ থেকে কত ডেলিগেটস আসবে জানো? পুশকিন, তুমি শুরু করে দাও।”

পুশকিন কিছু বলার আগে আপন আবার কথার মাঝে ঢুকে পড়ল, “ম্যাম, ওই রাক্ষসের মতো বাড়িটা আমি দেখেছি। ওটাকে সারাতে গেলে অনেক খরচ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ওটাকে ভেঙে যদি…”

“শাট আপ!” বস চুপ করিয়ে দিলেন আপনকে। তারপর বললেন, “রাক্ষস-বাড়ি কী কথা! জানো না এভাবে কথা আমি পছন্দ করি না! পুশকিন, তুমি জানো বাড়িটা সম্বন্ধে?”

“জানি ম্যাম। আমি কাল থেকেই পারস্যু করছি ব্যাপারটা!”

“জানিস?” আপন ব্যঙ্গের গলায় বলল, “কী করে জানলি?”

পুশকিন তাকাল আপনের দিকে। তারপর বসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ছোটবেলায় আমার বাবা-ঠাকুরদারা সোনাঝুরিতে থাকত। আমিও খুব ছোট বয়সে থাকতাম। গঙ্গার পাশে আমাদের স্কুল ছিল ম্যাম। সোনাঝুরি নার্সারি অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল। যাতায়াতের পথে ওই বিশাল বাড়িটার গেটটা আমরা দেখতাম। বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা বিশাল চারটে বাড়ি! ওখানের লোকজন বলে জোনাক-বাড়ি!”

বস তাকালেন পুশকিনের দিকে। তারপর কেটে-কেটে বললেন, “হ্যাঁ, ওই বাড়িটাই, আমাদের ওই বাড়িটাও চাই। টেক নেসেসারি মেজ়ারস্‌।”

.

০৯. আইকা

বড় আয়নাটায় নিজেকে দেখল আইকা। সামান্য মোটা হয়ে গিয়েছে কি? কোমরের দু’পাশে কি লাভ হ্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে? পেটেও কি চর্বি জমছে? বুকদুটো কি নেমে আসছে নীচে?

হাফ-টার্নে ঘুরে কাঁধের পেছনের দিকটা দেখল আইকা। স্ট্রেচ মার্কস দেখা যাচ্ছে কি? শরীরে সময় তার থাবা বসাবেই। কিন্তু সেটা এতদিন আটকে রাখতে পেরেছিল আইকা। এবার কি তা হলে সেই প্রতিরোধ ভাঙার সময় হল?

গত সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছে আইকা। এমনি সব ঠিক থাকলেও সুগার লেভেল সামান্য বাড়তির দিকে। ডাক্তার বলেছেন, যেন সতর্ক থাকে আইকা। তা থাকে ও। নিজেকে যতটা সম্ভব যত্ন করে। কিন্তু তাও আজ কেন মনে হচ্ছে যে, শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে? কেন মনে হচ্ছে জীবন পালটে যাচ্ছে ওর?

কোমরে আর বুকের ওপরে দাঁতের দাগ হয়ে গিয়েছে। ঋষি এমন করে কামড়ে দিয়েছে! ব্যথা করছে বেশ! আইকার এসব মারামারি, আঁচড়ানো, কামড়ানো ভাল লাগে না একটুও! আর ঋষি ঠিক উলটো! মারবে, কামড়াবে, হাত-পা বেঁধে রাখবে!

আইকা রাগ করে, বলে, “এত পর্নো দেখো না। ওসব ওদের শুটিং-এ ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে ওসব নোংরামো ভাল লাগে না!”

ঋষি হাসে, বলে, “ডার্টি সেক্স ইজ় দ্য রাইট কাইন্ড অফ সেক্স ডিয়ার!”

বিরক্ত লাগছে আইকার। আজকাল ঋষির ওপর খুব বিরক্ত লাগে। আগে যাও-বা আড্ডা হত, ইদানীং সেটাও হয় না। শুধু কোন কোম্পানির শেয়ার উঠল, কোন কোম্পানির শেয়ার পড়ল! অসহ্য বোরিং সব তথ্য! আর সেটা শেষ হলেই মারামারি করে সেক্স! আইকার মনে হচ্ছে একটা সীমারেখা টানতে হবে এবার। ঋষিকে ঝেড়ে ফেলার সময় এসে গিয়েছে! কিন্তু এখনই এসব মনে হচ্ছে কেন? ঋষি কি সত্যি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে, নাকি ওর মনটা অন্যদিকে টাল খেয়ে যাচ্ছে!

আজ সেক্স করার সময় আবছায়া ঘরে যখনই চোখ বন্ধ করছিল, বারবার ওই মুখটা ভেসে উঠছিল কেন? কেন ওই মুখটাকে মনে করে বারবার ও ঋষিকে আঁকড়ে ধরছিল? কীসের জন্য ওই রাজারহাটের অফিস-ফেরতা বৃষ্টির গন্ধটা স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল?

ঋষির কাছে আসার আগে একটা মজা ছিল, কিন্তু এখন কেমন যেন একটা ঋষির মনরক্ষার দায় হয়ে পড়েছে। তারপর এমন করে আঁচড়ে, কামড়ে ওকে যন্ত্রণা দেওয়াটা আর নিতে পারছে না।

রাজারহাটের এই ফ্ল্যাটের বাথরুমটা বেশ বড়। ফ্রস্টেড কাচের বাক্সের মধ্যে দারুণ সুন্দর শাওয়ার লাগানো আছে। শুধু মাথার ওপর থেকেই নয়, নানা জায়গা থেকে জল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরে।

সাদা বড় শ্বেতপাথরের বাথটাবও রয়েছে এক পাশে। পাথুরে বেসিনের পাশের কাবার্ডে নানারকম বাথসল্ট আর কোলন। ঋষি খুব যত্ন করে সাজিয়েছে বাথরুমটা।

এই বাথরুমে এলেই আইকার মনে পড়ে যায় ওদের সেই যাদবপুরের ভাড়াবাড়ির বাথরুমের কথা! অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘর। দুর্বল চল্লিশ পাওয়ারের হলদেটে বাল্‌ব। শ্যাওলা-পড়া মেঝে। এক কোণে রাখা ভাঙা টিনের বালতি। প্লাস্টিকের, তলা সাদা হয়ে যাওয়া মগ। একপাশে টাঙানো একটা নাইলনের দড়ি। বড়জোর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে স্নান করতে পারে। আইকার যে কী কষ্ট হত! দেওয়ালের ঝুল, আরশোলার ওড়াউড়ি আর জাল পেতে বসে থাকা ডোরাকাটা মাকড়সা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত আইকা! শুধু ভাবত জীবনে যদি কোনওদিন ভাল করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তা হলে যে-বাড়িটা করবে সেখানে সুন্দর একটা বাথরুম তৈরি করবে ও।

ভবানীপুরে ওদের বাথরুমটা সুন্দর করে সাজিয়েছে আইকা। কিন্তু ঋষির এই বাথরুমের মতো নয় সেটা।

কাচের ঘরে ঢুকে শাওয়ারটা খুলে দিয়ে আইকা ভাবল, ঋষির সঙ্গে দেখা না হলে ওর কোনও আফশোস থাকবে না, শুধু এই বাথরুমটার জন্য ওর মনখারাপ করবে মাঝে মাঝে!

গায়ে জল পড়ামাত্র কেমন পিঠের চিড়চিড়ে জ্বলুনিটাও আরও বেড়ে গেল যেন! আইকার মাথাটা গরম হয়ে গেল আরও! ঋষিটা একটা জানোয়ার! আইকার অবাক লাগছে, কী করে ও এই দেড়বছর ঋষিকে সহ্য করল!

শাওয়ারের তলায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল আইকা। সারা দিনের কাজের পর এখানে এসে ঋষিকে সহ্য করে এখন শরীরটা কেমন যেন ছেড়ে দিচ্ছে। ঘুম এসে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখে। মনে হচ্ছে জলের তলায় দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ে!

মে মাসের কলকাতা বাইরে জ্বলছে! সন্ধেবেলাতেও কেমন একটা গরম ভাপ যেন! এ বছর একটা মাত্র কালবৈশাখী হয়েছে। তারপরে আর মেঘের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না আকাশে! ধুলোমাখা একটা শহর ক্রমশ আরও ধুলোটে আর আবছায়া হয়ে যাচ্ছে যেন!

সেই সব থেকে দূরে এই জলের তলায় শরীর আস্তে-আস্তে কেমন যেন নিভে আসছে আইকার।

“উই হ্যাভ টু বি ভিজিলেন্ট আইকা,” আজ রুপিন বলছিলেন ওকে, “যেভাবে কমপিটিশন বাড়ছে, উই হ্যাভ টু বি ভিজিলেন্ট। রিয়েল এস্টেট একটা অদ্ভুত ব্যাবসা! মানুষ তার অনেক সাধ আর পরিশ্রম এখানে ইনভেস্ট করে। ইটস নট ওনলি অ্যাবাউট মানি। প্লাস এত রাজনৈতিক ইন্টারফেয়ারেন্স! এভ‌রিবডি ওয়ান্টস হিজ় পিস অফ কেক উইদাউট এনি এফর্ট! লাস্ট ইয়ার আমাদের বিজ়নেস ডিপ করেছে খানিকটা। এমনিতেই রিসেশন আর ডিমনিটাইজ়েশন আমাদের থমকে দিয়েছিল কিছুটা। তাই সামনে উই হ্যাভ আ স্টিপ ক্লাইম্ব! ব্যাবসা বাড়াতেই হবে। নো আদার ওয়ে। ম্যানেজমেন্ট তোমার ওপর ভরসা করছে। এই কাজে নানা ফাইনান্সারও ইন্টারেস্টেড। সোনাঝুরির প্রজেক্টটা কিন্তু হট প্রপার্টি। অনেকের নজর আছে ওতে। ইউ মাস্ট স্টেপ অন দ্য গ্যাস! গঙ্গার পাশে অত সুন্দর জায়গা! ওই বড় বাড়ি প্লাস আশপাশের জমিগুলো নিয়ে নিতে পারলে আমাদের বিজনেস বুস্ট হবে। বুঝলে?”

আইকা এর সবটাই জানে। রুপিন তাও কেন যে এসব বারবার বলেন কে জানে! সোনাঝুরি জায়গাটা গঙ্গার বাঁকের পাশে। সুন্দর ছিমছাম একটা মফস্‌সল। এখানে হাউজ়িং হলে খুব ভাল হবে, সেটা জানে আইকা। কলকাতা থেকে মাত্র চোদ্দো-পনেরো কিলোমিটার দূরত্ব। তার সঙ্গে নদীটাকেও ব্যবহার করার একটা ভাবনা আছে ওদের মাথায়। আমাদের এখানে এত রাস্তা কম। গাড়ি, ট্রেন আর মেট্রোর ওপর এমন বিশাল চাপ! কিন্তু একটা এত বড় নদী পড়ে আছে সেটাকে আমরা কাজে লাগাই না সেভাবে! কেন কে জানে! হ্যাঁ, স্থানীয়ভাবে কিছু লঞ্চ, স্টিমার আর ভটভটি চলে বটে, কিন্তু সেটা দরকারের তুলনায় খুব কম। জলপথে কি অনেকটা জুড়ে ফেরি চালানো যায় না?

রুপিন মানুষটা ভাল। ঠিক টিপিকাল বস নন। বরং অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য কখনও বকাবকি করেন না।

আইকা জানে এই প্রজেক্টটা ওর ওপরে ওঠার সিঁড়িও। এটাকে যদি ক্র্যাক করতে পারে, তা হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রজেক্ট-এর জন্য হয়তো ওর নামটা উঠবে।

স্নান সেরে বেরিয়ে আইকা দেখল ঋষি জামাকাপড় পরে নিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল সেট করছে। চুল ঋষির একটা অবসেশন। কতরকমের স্প্রে আর জেল যে লাগায়!

ওকে আয়না দিয়ে দেখে ঋষি ঘুরে দাঁড়াল, “লুকিং হট ইন টাওয়েল!”

আইকা বিরক্ত গলায় বলল, “সারাক্ষণ এসব ভাল লাগে না আমার। তুমি কি ম্যানিয়াক?”

ঋষি থমকে গেল, “তাওয়া গরম হ্যায় কেয়া?”

আইকা নিজের ব্যাগ আর জামাটা তুলে পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “শাট আপ।”

পাশের ঘরটাও বড়। কিন্তু ফ্ল্যাট বেশির ভাগ সময় খালি থাকে বলে এই ঘরে তেমন কিছু আসবাব নেই। শুধু একটা দেওয়ালজোড়া আলমারি আর তাতে লাগানো আয়না রয়েছে।

দ্রুত জামাকাপড় পরে নিল আইকা। তারপর ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুলটা আঁচড়ে নিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। একটা লিপস্টিক বের করে হালকা করে বুলিয়ে নিল ঠোঁটের ওপর। নিজেকে সামান্য দেখে নিল, তারপর ঋষির ঘরের দিকে এগোল।

ঋষি বিছানায় বসে গাড়ির চাবিটা ঘোরাচ্ছিল হাতে। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল, “তুমি এতক্ষণ ধরে স্নান করো কেন?”

“আমার ইচ্ছে!” আইকার যেন সহ্য হচ্ছে না ঋষিকে। ওর নিজের এমন রূঢ় ব্যবহার নিজের কাছেই কেমন যেন আশ্চর্য লাগছে।

ঋষি ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হয়েছে? আরে, তোমার এই স্নানের জন্য পাপার কাছে আমায় ঝাড় খেতে হল। বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল আগেই। পলকের বাবা-মা আজ আসবে ডিনারে। তারা শালা, এক ঘণ্টা আগেই এসে গিয়েছে। এখন পাপা আমার জান খাচ্ছে! সল্ট লেক থেকে বুয়াদের তুলে নিয়ে যেতে হবে আমায়। আই অ্যাম অলরেডি সো লেট!”

আইকা বলল, “তাতে আমি কী করব! তোমায় আমি বলেছিলাম, আজ এখানে আসব? অফিসের পরে তুমিই তো আমায় জোর করে নিয়ে এলে। আমার গাড়িটা পর্যন্ত আনতে দিলে না! ইফ ইউ কান্ট কন্ট্রোল দ্যাট টাইনি থিং অফ ইয়োর্স, হোয়াট দ্য ফাক ক্যান আই ডু?”

“টাইনি?” ঋষি অবাক হয়ে নিজের প্যান্টের দিকে তাকাল।

“নয়তো কী! আর মুখ খুলিয়ো না,” আইকা বিরক্ত হল, “পলক কি এমনি তোমার সঙ্গে বেড শেয়ার করে না!”

ঋষি থতমত খেয়ে কী বলবে বুঝতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আরে, এসব কথা বলছ কেন? বুঝতে পারছ না, আমার দেরি হয়ে গিয়েছে?”

“ডোন্ট ইয়েল!” আইকার মনে হল হাতের ব্যাগটা ছুড়ে মারে ঋষির মুখে। ও বলল, “চলো এখন।”

ঋষি ঘড়ি দেখল একবার। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগাতে-লাগাতে বলল, “শিট, আই অ্যাম সো লেট। আইকা, আমি তোমায় কিন্তু ভবানীপুরে ড্রপ করতে পারব না। তুমি একটা অ্যাপ-ক্যাব ধরে নাও।”

“মানে?” আইকা ভুরু কুঁচকে তাকাল, “এখন সাড়ে আটটা বাজে। এই সময়ে রাজারহাট থেকে আমি ট্যাক্সি করে বাড়ি যাব?”

“হ্যাঁ, যাবে,” ঋষি বিরক্ত হল, “আরে, আমার বাম্বু হয়ে গিয়েছে পুরো। আমাদের নতুন পেপার মিলে পলকের বাবাও ইনভেস্ট করবে। পাপা চায় আজকেই কথা ফাইনাল করে নিতে। আমায় প্রেজ়েন্ট থাকতে হবে। পলক যদি কিছু ট্রাবল ক্রিয়েট করে, অল উইল বি লস্ট! আমি পারব না তোমায় পৌঁছে দিতে।”

আইকা আর কথা বাড়াল না। লিফটে করে নেমে সোজা বড়রাস্তার দিকে হাঁটা দিল। ঋষি দেখেও কিছু বলল না। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার জন্য উলটো পথে চলে গেল ও।

আইকা বড়রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল একটু। রাগে গা-হাত-পা জ্বলছে! আর কোনওদিন একবার ঋষি আসতে বলুক! বাপের সঙ্গে ওর শ্বশুরেরও বিয়ে দেখিয়ে ছাড়বে!

রাজারহাট এখন অনেক জমজমাট। মোবাইল দিয়ে গাড়ি বুক করতে অসুবিধে হল না ওর। কাছেই ছিল গাড়িটা। এসে পড়ল মিনিটপাঁচেকের মধ্যে। শেয়ারের গাড়ি। পেছনের সিটে দু’জন বসে রয়েছে। গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে স্পষ্ট করে মুখ দেখতে পেল না আইকা। কিন্তু বুঝল, খুব কিছু ভাল ঘরের নয়। জানলার দিকে বসে থাকা ছেলেটার মাথায় আবার একটা ব্যান্ড! রোগা-পাতলা চেহারায় ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে ব্যান্ডটা দেখতে কেমন যেন লাগছে! আইকা গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর পাশে বসা ছেলেটার চেহারাটা বেশ বড়সড়। ও বসতেই ছেলেটা যথাসম্ভব সংকুচিত হয়ে বসল।

গাড়ি চলতে শুরু করলে আইকা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এই দিকটা এখনও মূল শহরের তুলনায় ফাঁকা। তবে বছরপাঁচেকের মধ্যে একদম পালটে যাবে সবকিছু।

গাড়ির এসি চলছে। আইকার কেমন যেন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে! সারাদিন অফিসের পরে ওর ঋষির সঙ্গে এখানে আসা ঠিক হয়নি।

আইকা ঘুম কাটাতে মোবাইলটা বের করে দেখল। নোঈকে একটা মেসেজ করেছিল, এখনও ‘সিন’ হয়নি। মেয়েটা গিয়েছিল কি? আজ তো যাওয়ার কথা ছিল। নোঈকে বিশ্বাস নেই। যা জেদি মেয়ে! সামান্য কিছু হলেই গোঁজ হয়ে থাকে মাঝে মাঝে! কী যে করবে বোঝা যায় না।

পুশকিনের কাজ়িনের সঙ্গে বিয়েটা ভেস্তে দিল! কেন দিল কে জানে! প্রেম-টেম যে নোঈর নেই, সেটা জানে আইকা। আগে একটা ছেলে ছিল। কিন্তু ছেলেটা নিজে ওকে ছেড়ে গিয়েছে। নোঈ দীর্ঘদিন এই নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল। এখন তাও কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। আসলে এই ব্যাপারগুলো ঠিক ভাল করে বোঝে না আইকা।

শুভর সঙ্গে ওর বিয়েটা শুভর দিক থেকে প্রেমে পড়ে হলেও, ওর কাছে সেটা ছিল একটা সুরক্ষিত জীবনের হাতছানি। থাকতে-থাকতে একটা মায়া আর ভাললাগা জন্মালেও সেই যে সর্বগ্রাসী প্রেম, সেটা কিন্তু হয়নি। আর আইকা যেমন, ওর প্রেমে গন্ডগোল হলে, তার জন্য মনখারাপ করে না থেকে সেটা কী করে সমাধান করা যায় সেটার দিকেই ওর বেশি ঝোঁক থাকত। এসব লবঙ্গলতিকা হয়ে ফুল স্পিডে ডিপ্রেশন চালিয়ে যাওয়ার মেয়ে ও নয়।

নোঈকে ও পছন্দ করলেও নোঈর এই জিনিসটা ওর ভাল লাগে না! কিছু-কিছু মানুষ আছে প্রেমের জন্য বড্ড হেদায়! জীবনে যেন আর কিছু নেই!

পুশকিনের সঙ্গে কথা বলে আসার সেই দিনেই রাতে নোঈদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল আইকা।

পুটুমাসি টিভি দেখছিল। রাঙামেসো যথারীতি নিজের ঘরে ল্যাপটপে বিদেশি ফিল্ম নিয়ে বসেছিল।

আইকা ঘরে ঢুকেই পুটুমাসিকে বলেছিল, “নোঈ কোথায় গো? ওর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

পুটুমাসি টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে বলেছিল, “ওর ঘরে আছে, যা না।”

“না, ওকে ডাকো,” আইকা ইচ্ছে করে টিভিটা আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।

“আরে,” পুটুমাসি ছটফট করে উঠে বলেছিল, “আরে, ঝগড়াটা দেখতে দে ভাল করে, সর!”

“ডাকো নোঈকে,” আইকা বলেছিল, “আর অত ঝগড়া দেখার ইচ্ছে হলে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

নোঈকে ডাকতে হয়নি।

“কী রে দি? কিছু বলবি?” নোঈ হাতে মোবাইলটা নিয়ে নিজেই বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে।

নোঈর চোখে বেশ হাই পাওয়ারের চশমা। আইকা কতবার বলেছে সেটা পালটে কন্ট্যাক্ট করে নিতে, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই নেবে না। এত সুন্দর দেখতে নোঈকে, কিন্তু একটুও সাজে না। শুধু মাঝে মাঝে টিপ পরে। তাও সামান্য ওপরে। এখন আবার এই ফ্যাশনটা ফিরে এসেছে!

শাড়ি পরেছিল নোঈ। আর কপালে একটা অনুস্বরের মতো দেখতে আঁকা টিপ!

“এই ফিরলি নাকি?” জিজ্ঞেস করেছিল আইকা।

নোঈ বলেছিল, “হ্যাঁ, শ্বেতার বাড়িতে একটা নেমন্তন্ন ছিল। ও চণ্ডীগড় থেকে এসেছে সাতদিনের জন্য। কিছু বলবি দি?”

আইকা কিছু বলার আগেই পুটুমাসি বলেছিল, “তোরা আমায় দেখতেই দিলি না সিরিয়ালটা! শাশুড়িটা বউয়ের রান্না করা খাবারে সব লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে দিল লুকিয়ে। এবার কী যে হবে!”

“ধ্যাত্তেরি!” আইকা রিমোট তুলে টিপে বন্ধ করে দিয়েছিল টিভিটা! বলেছিল, “অফিস থেকে এসেছি দরকারি কথা বলতে! সেখানে এসব চালিয়ে রেখেছে!”

নোঈ সোফায় বসে তাকিয়েছিল আইকার দিকে, “কী হয়েছে দি?”

“তোর চাকরির কথা বলতে এসেছি আমি,” আইকা সময় নিয়ে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। মেয়েটা কারও থেকে কিছু নেয় না। এই কথাটায় কী প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে পারছিল না।

নোঈ কিছু বলেনি। বড়-বড় চোখ করে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। পুটুমাসির মুখে বরং আগ্রহ ছিল বেশি।

আইকা বলেছিল, “আমি আজ গিয়েছিলাম পুশকিনদের অফিসে। ওরা বিশাল বড় কোম্পানি! মাল্টিন্যাশনাল জায়ান্ট! রিকো গ্রুপ! কলকাতায় সদ্য অফিস খুলেছে। প্রজেক্টের কাজ করে। রিক্রুট করছে। আমি তোর কথা বলেছি। পুশকিন বলল তোর সিভিটা পাঠাতে।”

“পুশকিন কে?” পুটুমাসি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।

আইকা বলেছিল, “তুমি কিছু মনে রাখতে পারো না কেন গো? সেই যে ডিনো না কে এসেছিল না নোঈকে দেখতে, ওর সেই দাদা!”

পুটুমাসি থমকে গিয়েছিল একটু। তারপর ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠেছিল, “না না, একদম নয়। নোঈ ওদের সঙ্গে যা করেছে তাতে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে ওদের সামনে? সম্ভব নয়!”

“আরে,” আইকা বিরক্ত মুখে বলেছিল, “কেন সম্ভব নয়? চাকরি করতে অসুবিধে কোথায়? আর বিয়ের সম্বন্ধ না-ই হতে পারে! তাতে কি জীবন আটকে থাকবে?”

পুটুমাসি বলেছিল, “আমাদের একটা মানসম্মান নেই নাকি? চাকরি দেবে বললেই যেতে হবে?”

“চাকরি দেবে বলেনি। বলেছে যোগাযোগ করতে!” আইকার মাথা গরম হচ্ছিল, “তুমি এসব কেন কমপ্লিকেটেড করছ? কাজ তো রে বাবা!”

“না, ও যাবে না,” পুটুমাসি গোমড়ামুখে বলেছিল, “সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না? আমাদের এতে অসম্মান হবে। নোঈ যাবে না।”

“আরে, যুক্তিটা কী?” আইকা কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

পৃথিবীতে গোঁয়ারতুমির মতো অসুখ কমই আছে! ইগো আর গোঁয়ারতুমির জন্য সারা পৃথিবীর আজ এই অবস্থা!

“আমি বলেছি যাবে না, সেটাই শেষ কথা,” পুটুমাসি বুকের কাছে হাতদুটো আড়াআড়িভাবে জড়ো করে এমন একটা ভঙ্গি করেছিল, যার অর্থ হল এর পর আর কথা চলে না!

“দি আমায় ই-মেল আইডিটা দিস, আমি সিভি পাঠিয়ে দেব,” নোঈ শান্ত গলায় বলেছিল।

“কী?” পুটুমাসি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, “তুই… তুই ওখানে চাকরি করবি? মানে ওদের ওখানে…”

“ওদের ওখানে মানে?” নোঈ ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল পুটুমাসির দিকে, “অফিসটা কি ওই ডিনোদের নাকি? পুশকিন নিজেও চাকরি করে। আমার করতে অসুবিধে কোথায়!”

পুটুমাসি কিছুক্ষণ নোঈর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের মনে বলেছিল, “ঠিকই তো। আমি আর কে হই? যেমন বাপ তেমন মেয়ে! আমি তো দাসীবাঁদি হয়ে থাকার জন্যই এসেছি এই বাড়িতে! যা পারিস কর, কিন্তু পরে কিছু হলে আমার কাছে কাঁদতে আসবি না!”

আইকা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল পুটুমাসিকে। আর ভাবছিল পরে কী হতে পারে? পুটুমাসি কী হবে বলে ভয় পাচ্ছে?

আইকা ই-মেল আইডি দিয়েছিল নোঈকে। তারপর পুশকিনের মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে বলেছিল, “সিভিটা পাঠিয়ে একটা মেসেজ করে দিবি। ও ইন্টারভিউয়ে ডেকে নেবে।”

পুটুমাসি শেষ চেষ্টা করার মতো করে বলেছিল, “আবার একবার ভেবে দেখ, আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে কিন্তু।”

নোঈ শুধু ছোট্ট করে বলেছিল, “এত দুর্বল ঘাড় হলে তো মুশকিল!”

আচমকা মুঠোর মধ্যে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠল। আইকা চমকে উঠল। ও কি ঘুমিয়ে পড়েছিল! কতটা এল গাড়ি? সামান্য সোজা হয়ে বসল আইকা। আবছায়া গাড়ির ভেতরে সামান্য একটু সময় আইকার কেমন যেন লাগল। মাথাটা যেন পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে!

ও আলগোছে পাশে তাকাল একবার। ছেলেদুটো নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছে। এবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে সায়েন্স সিটি চিনতে পারল আইকা। মানে সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল ও!

ফোনটা এখনও মুঠোর ভেতর কাঁপছে! আইকা দেখল স্ক্রিনটা। অচেনা নাম্বার! এখন কে ফোন করল?

ও ফোনটা ধরে কানের কাছে নিল। আলতো গলায় বলল, “কে বলছেন?”

“আমি তারকবাবুর কাছ থেকে বলছিলাম,” ও পাশের গলাটা খরখরে। সামান্য রূঢ়।

“পার্ডন,” নিজের অজান্তেই আইকার ভুরু কুঁচকে গেল। আজকাল কী যে হয়েছে! বেশির ভাগ মানুষ কেমন একটা বিরক্তি আর রাগ মেশানো গলায় কথা বলে! সবার যেন প্রচুর তাড়া! সবার প্রচুর কাজ! সবাই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে, এমন একটা ভাব। আইকার মনে হয়, আসলে কি সবাই একটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে? তাই কি বাইরে এমন একটা বর্ম পরে থাকে?

“কী?” লোকটা থমকে গেল এক মুহূর্ত।

আইকা বুঝল ইংরেজিটা বুঝতে পারেনি।

তারপর আবার বলল, “আরে, আমি সোনাঝুরির তারক চক্রবর্তীর অফিস থেকে বলছি। স্যারকে আপনি ফোন করেছিলেন না কাজের ব্যাপারে, তাই স্যার বললেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন,” আইকা এবার নড়েচড়ে বসল। আরে, লোকটা সোনাঝুরি থেকে ফোন করেছে! ওই প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলতে সত্যিই তারক চক্রবর্তীকে কয়েকদিন আগে ফোন করেছিল আইকা। কিন্তু ভদ্রলোক কথা বলতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, ঠিক সময়ে ডেকে নেওয়া হবে। আইকা বুঝতে পারেনি কতদিনে ঠিক সময় হবে!

এখন ভাবল লোকটা ভুলে যায়নি।

লোকটা বলল, “স্যার বললেন, আপনি পরশুদিন একবার আসবেন। এই সকাল দশটার দিকে।”

“ঠিকানাটা একটু বলবেন?”

“ঠিকানা?” লোকটা হাসল, “আরে, স্টেশনে নেমে যে-কোনও রিকশাওয়ালাকে বলবেন তারক চক্রবর্তীর অফিসে যাব, নিয়ে যাবে। আর গাড়িতে এলে সোনাঝুরি ব্রিজের কাছে এসে একই কথা যে-কাউকে জিজ্ঞেস করবেন। সোনাঝুরিতে থাকতে হলে তারক চক্রবর্তীর অফিসটা চিনতে হয়। বুঝলেন? দেরি করবেন না। স্যারের হেভি কাজ থাকে। নমস্কার।”

ফোনটা কেটে চুপ করে বসে রইল আইকা। গাড়ি জ্যামে থামতে-থামতে এখন বালিগঞ্জ স্টেশন পেরিয়ে গড়ি়য়াহাট মোড়ের দিকে দৌড়োচ্ছে।

রুপিনকে কি একবার ফোন করে জানাবে? রাত হয়ে গিয়েছে। যদিও রুপিন একাই থাকেন। আলিপুরে কোথাও একটা ফ্ল্যাট আছে। কিন্তু তাও এমন সময় কি ফোন করে জানানোটা ঠিক হবে?

নাঃ, কাল অফিসেই জানাবে। মত বদলে বাইরের দিকে তাকাল আইকা। গড়িয়াহাটের সিগন্যালটা আজ খোলা আছে। তাই জ্যাম পেরিয়ে গাড়ি রাসবিহারীর দিকে যাচ্ছে। তবে দ্রুত যেতে পারছে না। সিগনালটা পেরিয়েই অটোস্ট্যান্ড। সেখানে এমন করে গাড়িগুলো জটলা পাকাচ্ছে, বিরক্ত লাগছে আইকার! নিজের গাড়িটা আনলে কত সুবিধে হত! ঋষিটাকে আর জাস্ট নিতে পারছে না ও! আইকা ভবানীপুর যাবে। ছেলেগুলোও নিশ্চয় সামনে কোথাও নামবে।

বাইরের দিকে চোখ থাকলেও এবার ছেলেগুলোর কথা কানে আসতে লাগল ওর।

জানলার দিকে বসা মাথায় ব্যান্ড পরা ছেলেটা চাপা গলা বলল, “তুই শালা গান্ডুই রয়ে গেলি। তোকে রিতুদা বলল একটা মেশিন রাখতে, তুই সতীপনা করতে শুরু করে দিলি। আরে, দাদার কথা শোন, পেলেয়ার কোটায় ভাল জাগায় ঢুকিয়ে দেবে। রিতুদা তোর ওপর ভরসা করে মাহির। এমন উদো হয়ে থাকিস না।”

মাহির বলে ছেলেটা যে আড়চোখে আইকাকে দেখল একবার, সেটা খুব ভাল বুঝতে পারল ও।

মাহির এবার চাপা গলায় বলল, “তোকে বলেছি না, এমন জায়গায় মুখ সামলে কথা বলবি! এত গালাগালি দিস কেন? তোর লজ্জা নেই, আমার আছে। এদিকে আমার মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে! জানিস তো ভাইটার কী হাল! ডাক্তার বলেছে ডায়ালিসিস করতে হবে। এক-একদিন কত করে টাকা লাগবে বুঝতে পারছিস? আমরা কোথায় যাব বল তো?”

“আঃ,” অন্য ছেলেটা বলল, “সামনে টাকার আলমারি নাচছে, সেখানে ঢ্যামনামো করছিস কেন? তোর ভাই পটল তুললে সতীপনা করিস একা-একা।”

মাহির বলল, “পতাদা বলল, আর-একটা ট্রায়াল আসছে। সেটায় নামকরা সব কোম্পানি আসবে। চাকরি হতেও পারে রে, টিটি।”

“তোর ওই বা…” টিটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “পতাদার পাছায় তিনটে লাথ মারা উচিত। ঢপবাজ বুড়ো। শালা। রিতুদাকে বল মাহির। হাতের লক্ষ্মী বুঝলি! এই যে কাজটায় এলাম। পেমেন্ট নিলাম। এই যে এসি গাড়িতে ফিরছি, সেটা কি রিতুদা না থাকলে হত! শালা বাসে ধাক্কা খেয়ে ঘামের গন্ধ শুঁকে ঢিকিরঢিকির করে ফিরতে হত! বোঝ রে গা…” টিটি আবার নিজেকে সামলে নিল।

“স্যার, আপনারা কোথায় নামবেন?” সামনের দিক থেকে ড্রাইভারটি মুখ না ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“রাসবিহারীর সিগন্যাল তো খোলা আছে, ওই রাইট টার্ন নিয়ে হাজরার দিকে ঘুরিয়ে বাঁ দিক করে নামিয়ে দিন,” টিটি বলল।

ড্রাইভার সিগন্যাল পার করে ওদের নামিয়ে দিল। ওরা নামবে বলে আইকাকেও নেমে দাঁড়াতে হল। আইকা শুনল ওই টিটি বলে ছেলেটা চাপা গলায় বলছে, “কী বলল শুনলি? স্যার! শালা খিস্তি দিয়ে ছাড়া আর কেউ কোনওদিন কিছু বলে ডেকেছে আমাদের? এটাও রিতুদার জন্য।”

ফ্ল্যাটের সামনে যখন পৌঁছল আইকা, সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছে। গেটের কাছে সুশান্ত মাগোকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাগো আইকাকে দেখামাত্র হাত বাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল! আইকা হেসে কোলে তুলে নিল ওকে।

সুশান্ত বলল, “দিদি, আপনি এই এলেন। ফ্রেশ হয়ে নিন, তারপর ওকে আমি দিয়ে আসব আপনার কাছে!”

আইকা মাগোকে কোলে করে লিফটের দিকে এগোতে-এগোতে বলল, “চড় খাবি বুড়োবয়সে?”

লিফটের মধ্যে আইকা মাগোর সঙ্গে একটু খেলে নিল। মেয়েটা খিলখিল করে খুব হাসে। আইকার কাঁধের ব্যাগের মধ্যে ঝুঁকে পড়ে খোঁজে আজ আইকা কী নিয়ে এসেছে ওর জন্য।

আইকা রোজ মাগোর জন্য কিছু না-কিছু নিয়ে আসে। আজও ট্যাক্সি থেকে নেমে মিল্ক চকোলেট নিয়ে এসেছে। মাগো ব্যাগের চেন খুলতে চেষ্টা করছে দেখে আইকা নিজেই সেটা বের করে দিল। মেয়েটা সেটা নিয়েই হেসে উঠল আবার!

আইকা জানে মাগো এটা একা খাবে না। প্যাকেট খুলে নিজের হাতে আইকাকে খাইয়ে দেবে কিছুটা। ওইটুকু সময়ের জন্য সারাদিন আইকা অপেক্ষা করে। খুব খারাপ কাটা দিনও ওইটুকু সময়ের ছোঁয়ায় কতবার যে ভাল হয়ে উঠেছে!

আইকা নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যাওয়ার সময় আচমকা থমকে দাঁড়াল। আরে, পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটের দরজা সামান্য খোলা কেন?

পাশের ফ্ল্যাট, সামনে দিয়েই যেতে হয়। আইকা একবার বেলটা বাজিয়ে দরজাটা সম্পূর্ণ ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। দেখল, আজ বসার ঘরে রাঙামেসোও বসে আছে। টিভি বন্ধ। কেমন একটা খুশি-খুশি হাওয়া খেলছে ঘরে।

ওকে দেখেই মেসো হাসল। বলল, “তুই আবার কবে থেকে বেল বাজিয়ে ভেতরে আসতে শিখলি!”

আইকা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও অবাক হয়ে দেখল পুটুমাসি আর নোঈর মাঝখানে সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে পুশকিন।

১০. কাজু

ঘোষ বাইন্ডিং-এর সামনের কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চটায় বসে রয়েছে ঝিকু। একমাথা কাঁচা-পাকা চুল। কালো-সাদায় জড়িয়ে যাওয়া গোঁফদাড়ি। চোখ দুটো হলদেটে। বেঞ্চটায় উবু হয়ে বসে এদিক-ওদিক দেখছে। রাস্তার উলটো দিক থেকে মানুষটাকে দেখল কাজু। সতু পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি কিনছে দোয়ারিদের দোকান থেকে। বিড়ি আর মৌরি লজেন্স। কাজু নেশা করে না কোনও। সতুকেও বকে এইসব বিড়ি-সিগারেট খায় বলে। কিন্তু সতু তো আর শোনার ছেলে নয়, বরং বিড়ি খেলে সমাজের কী উপকার হতে পারে, সেটা ওকে সবিস্তারে বলে দেয়। এও যে একটা কুটির শিল্প এবং এটাকেও যে বাঁচিয়ে রাখা মানুষের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটা নানাভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

কাজু মানতে চায় না। কিন্তু মনে মনে এটাও বোঝে, ও যেমন মানতে চাইছে না তেমন সতুও মানতে চাইছে না ওর কথা। আসলে জীবনে একটা সময়ের পরে কেউ কারও কথাই মানতে চায় না। ইগো, লজিকের চেয়ে বড় হয়ে যায়। আজকাল তাই আর কিছু বলে না সতুকে। কিন্তু সতু বোঝে। তাই বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার সময় কাজুর সঙ্গে নরম করে কথা বলে।

কাজু তাকাল ঝিকুর দিকে। মানুষটা কেমন হয়ে গিয়েছে! ছোটবেলায় দেখত এই লোকটাই কী ফিটফাট হয়ে মিল-এ যাচ্ছে চাকরি করতে। কিন্তু তারপর যে কী হল!

কেউ বলে প্রেমে পড়ে ঝিকুর এমন অবস্থা হয়েছে। কেউ বলে ওর ভাইরা ওকে খাবারে ওষুধ মিশিয়ে পাগল করে দিয়েছে। কেউ আবার বলে, ও নাকি পরি দেখেছিল জোনাক-বাড়ির পেছনের গঙ্গায়!

যাই হোক না কেন, মানুষটা এমন একটা বাতিল অঙ্ক-খাতার মতো পড়ে আছে, দেখতে খুব খারাপ লাগে ওর। কষ্ট হয়। মনে হয় কিছু করে। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারে না।

গতকাল পেখমকে দেখে হঠাৎ ঝিকুর কথা মনে পড়েছিল কাজুর।

পেখম এসেছিল হস্টেলের মাঠে। সোনাঝুরির এই দিকটা খুব সুন্দর। মিলের লোকজনের জন্য যেমন কিছু কোয়ার্টার্স আছে, তেমনই হস্টেলও রয়েছে। হস্টেলের পেছনেই খাবারের মেস। হৃষীকেশদা রান্না করে মেসে। দুপুরে আর রাতে বেশ ভিড় থাকে। কিন্তু বিকেলের দিকটায় হস্টেলের পেছনের মাঠটা খুব নির্জন আর শুনশান হয়ে থাকে।

ওদিকটায় বেশ কিছু সার দেওয়া পামগাছ আছে। আর আছে বট-অশ্বত্থের ভিড়। এদের ছায়ায় জায়গাটায় কেমন একটা একা-একা ভাব তৈরি হয়।

পেখমকে ও বলেছিল ওইখানে আসতে। পেখম খুব একটা বাড়ি থেকে বেরোয় না এখন। ওর মা সারাক্ষণ ওকে চোখে-চোখে রাখে। এমনকী পারলে, ওর সঙ্গে কলেজেও যায়!

সতু বলে, “তুই শালা সোনাঝুরিতে দেখা করিস কেন ওর সঙ্গে? কলকাতায় দেখা করতে পারিস না?”

কলকাতায় পেখমের সঙ্গে দেখা করে কাজু, কিন্তু সেটা খুব অল্প কয়েকবারই হয়েছে। আসলে নয়না থাকে পেখমের সঙ্গে। নয়না কলেজ না গেলে ওদের দেখা হয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, নয়না কেমন যেন পেখমের সঙ্গে সেঁটে থাকে, একটুও জায়গা দেয় না ওদের।

নয়নারা এখন নেই এখানে। পুরী বেড়াতে গিয়েছে। নয়নার জ্যাঠার একটা ফোটো স্টুডিয়ো আছে স্টেশনের কাছে। ওর জেঠতুতো দাদা সেটা চালায়। তার কাছ থেকেই জেনেছে যে, সাত দিনের জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছে নয়না।

পেখম এসেছিল বিকেলের দিকে। একটা পামগাছের নীচে অপেক্ষা করছিল কাজু। নরম ঘাসের ওপর শুয়ে একটা বইয়ের পাতা উলটোচ্ছিল। তখনই শাড়ির খসখস শুনতে পেয়েছিল ও।

পেখম কোনও সেন্ট ব্যবহার করে না, কিন্তু তাও ও কাছে এলেই কাজু কী অদ্ভুত একটা নরম চন্দন মেশানো কর্পূরের গন্ধ পায়! কেন পায়? কোথা থেকে এই গন্ধ ভেসে আসে কে জানে!

আর শুধু কাছে এলেই নয়, ঘুম ভেঙে উঠে বসা মাঝরাতে, একাকী দুপুরের মনখারাপে বা ভোররাতের স্বপ্নের মধ্যেও এই অদ্ভুত নরম একটা গন্ধ জোনাকির মতো একা পিটপিট করে বুকের মাঝে! ওর অন্ধকার জীবনে কেমন অদ্ভুত সবুজ-হলুদ এক আলো জ্বালিয়ে দেয়! সেই আলোটুকুতেই যেন কাজু দেখতে পায় নিজেকে। ওর মনে হয় জোনাকির আলোর গন্ধ কি এমন চন্দন মেশানো কর্পূরের মতো হয়?

গতকাল ঘাসে শুয়ে বইয়ের দিকে চোখ থাকলেও সেই গন্ধটা আচমকা ভেসে এসেছিল বিকেলের রোদে। আর কাজু না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল কে এসে দাঁড়িয়েছে মাথার কাছে।

লেবু-হলুদ শাড়ি আর ঘন সবুজ ব্লাউজ় পরেছিল পেখম। গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়ানো।

উঠে বসেছিল কাজু। বইটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রেখেছিল পাশের ঝোলায়। বুকের ভেতরে তিতির পাখি কাঁপছিল কাজুর! পেখমকে দেখলেই এমন একটা কাঁপন টের পায় ও।

পেখম বসেছিল ঘাসে। শীতের মফস্‌সলে বিকেল নামছিল ধীরে। আকাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া সূর্য দিগন্তের দিকে যেতে-যেতে আরও কমলা হয়ে উঠছিল যেন। আর হাওয়া আসছিল। শেষ শীতের দিক থেকে বসন্তের দিকে যেতে-যেতে হাওয়া সোনাঝুরি ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটু-একটু করে। কাজুর মনে হচ্ছিল এই বিকেলটা যেন সারা জীবন ধরে চলে।

“বলো!” পেখমের স্বরে অজস্র প্রজাপতি ছড়িয়ে গিয়েছিল সোনাঝুরির হাওয়ায়।

কাজু তাকিয়ে ছিল সেই সব প্রজাপতির দিকে। কথা বলতে পারছিল না একটুও। মনে হচ্ছিল ওর গলার আওয়াজ পেলেই সব প্রজাপতি মিলিয়ে যাবে নিমেষে।

“আরে! খালি তাকিয়ে থাকে!” পেখম সামান্য লজ্জা পেয়ে আলতো করে চিমটি কেটেছিল কাজুর হাতে।

কাজু হেসেছিল। কথা, শব্দ, বাক্য মাঝে মাঝে অর্থহীন হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাতের চেয়ে সহজ কথোপকথন আর কিছু হয় না।

“আচ্ছা, আমি তবে আসি,” সামান্য বিরক্ত হয়ে পেখম উঠে যাচ্ছিল।

এবার ওর হাতটা ধরেছিল কাজু। বলেছিল, “ছটফট করছ কেন?”

পেখম বলেছিল, “মা রাগ করছিল খুব। বলছিল, কোথায় যাচ্ছি? কলেজ নেই কিছু নেই, তাও কেন বেরোচ্ছি। জানোই তো! আর তুমি তো কাল আসতেই বাড়িতে। কেন আজ ডাকলে?”

কাজু হেসেছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, “আচ্ছা, এমনি ডাকা যায় না?”

পেখম মাথা নিচু করে নিয়েছিল। বলেছিল, “যায় তো। কিন্তু মা… মা খুব রাগ করে… আমার ভয় করে, যদি তোমায় আর আমাদের বাড়ি যেতে না দেয়! তাই আমি সাবধানে থাকি। আমার ইচ্ছে-টিচ্ছেয় তো মা তেমন আমল দেয় না কখনও!”

কাজু মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। ওই মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলে যাওয়া পেখমের কথাগুলো আসলে কথা নয়! এসব ধ্বনি আসলে প্রজাপতিদের জন্ম দেয়!

কাজুর এমনি পেখমকে দেখতে ইচ্ছে করছিল বলে ও বিজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল। ও জানে পেখমের বাড়িতে এসব অসুবিধে আছে। কিন্তু তাও আজ এমন একটা কষ্ট হচ্ছিল যে, ইচ্ছে করছিল এই নির্জনে দেখা করতে।

পেখম আবার বলেছিল, “ঠিক আছে দেখা তো হল, এবার আমি আসি?”

কাজু হেসেছিল, “কেন? আর-একটু বোসো। আশপাশে কে আছে যে, দেখে ফেলবে?”

“মিল ছুটি হলেই কাতারে-কাতারে লোক বেরিয়ে আসবে। তখন? মিল ছুটির সময় হয়ে গেল তো!”

কাজু হেসে বলেছিল, “দেখলে কী হবে? বাড়িতে বলে দেবে?”

পেখম নামিয়ে নিয়েছিল মাথা। বলেছিল, “গতকালও মা খুব অশান্তি করেছে। ছোটকাকিমার বাপের বাড়ি জামশেদপুর। সেখান থেকে কে যেন একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। ছেলে ডাক্তার। আমি ‘না’ বলেছি বলে মা গতকাল খুব রাগ করছিল। আমার আজ বাইরে থাকাটা মা ভাল মনে নেবে না। তাই বলছি দেখা তো হল… আর কী-ই বা এত দেখো! এলাম তো! কী হল এতে!”

কাজু তাকিয়েছিল পেখমের দিকে। বুকের ভেতর অসংখ্য তিতির এসে ডানা ঝাপটাচ্ছিল! ওই মুখ নিচু করে বসে থাকা পেখম। ওই ছোট্ট গোলাপি পাপড়ির মতো ঠোঁট! কমলা আলো লেগে সামান্য রাঙা হয়ে ওঠা গাল কোথায় যেন মেরে ফেলছিল ওকে! প্রেম এমন নিঃশব্দে এসে মেরে ফেলে যে, মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না কখন সে আর নেই!

“কী দেখি? কেন পাগল হই? কী হল এতে?” কাজু হাসল। চোখ বন্ধ করল খানিক তারপর বলল:

“Come to the orchard in Spring.

There is light and wine, and sweethearts

in the pomegranate flowers.

If you do not come, these do not matter.

If you do come, these do not matter.”

পেখম কিছু না বলে শুধু ছলছলে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আর দূরে বসেও সেই কর্পূর-চন্দনের গন্ধটা আবার পেয়েছিল কাজু!

পেখম আর-একটু সময় বসেছিল। তবে কথা বলেনি একবারও। শুধু কমলা বিকেল গাঢ় হয়ে উঠছিল পেখমকে নিজের কাছে পেয়ে।

একসময় পেখম উঠে চলে গিয়েছিল নিঃশব্দে। কিন্তু আসলে নিঃশব্দে নয়। যাওয়ার আগে পেখম একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। আর কাজু আবার স্পর্শ পেয়েছিল। শব্দের অতীত এক স্পর্শ! হাজার-হাজার বছর ধরে যা গ্রন্থিবিহীনভাবে বেঁধে রেখেছে প্রেম-বদ্ধ নারী-পুরুষকে!

কাজু ঘাসে মোড়া মাটিতে বসে দেখছিল পেখম চলে যাচ্ছে। লাল-সাদা কোয়ার্টার্সের ফাঁক দিয়ে মাথা নিচু করে ওই চলে যাচ্ছে পেখম। বিকেলের আলো আকাশ থেকে চুঁইয়ে নেমে আসছে আর যেন ক্রমশ সেই আলোর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ও!

আর তিতির উড়ছিল! বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে সারা মফস্‌সল জুড়ে তিতির উড়ছিল যেন! কাজু বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটি ছাড়া ওর জীবনের আর কোনও অর্থ নেই। ভাবছিল পেখম যদি চলে যায়, তা হলে কি ওকেও ওরকম ঝিকুদার মতো রাস্তার পাশে বসে সব কিছুর এককথায় উত্তর দিতে হবে? বলতে হবে, “বিলকিস!”

“কী রে কী দেখছিস? ঝিকুদা বৈজয়ন্তীমালা নাকি?”

সতুর কথায় মুখ ফিরিয়ে তাকাল কাজু। বিড়িটা দু’আঙুলে ধরে মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়ল ও। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “এই নে তোর মৌরি লজেন।”

মৌরি লজেন্স হাতে নিয়ে হাসল কাজু। বলল, “মানুষটাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় জানিস সতু। ভেবে দেখ, লোকটার কেউ নেই! কোথাও যাওয়ার নেই, ওর কোথাও থেকে ফেরার নেই। কেউ আসবে না ওর কাছে। ও যে কারও কাছে যাবে, তেমন কেউ নেই! সারা জীবন এই স্টেশন রোড, সোনাঝুরির বড় রাস্তা, গঙ্গার পাশের চৌধুরীদের পোড়োবাড়ির মধ্যে বসে থেকে থেকে সব শেষ হয়ে যাবে ওর!”

“শালা,” সতু ছিক করে থুতু ফেলল। তারপর বলল, “আলট্রা-ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিস দিন-কে-দিন! শালা, তোদের এই যে লাউগাছের মতো ন্যাতপেতে মন, এটা এই যুদ্ধের বাজারে মেনটেন করিস কী করে?”

“বা রে, লোকটাকে দেখে কষ্ট হবে না?” অবাক হল কাজু।

“ওর তো বোধ নেই! খিদে পেলে খায়, হাগু পেলে হাগে, ঘুম পেলে ঘুমোয়। যে-কোনও প্রাণীর মতো হয়ে গিয়েছে! কিন্তু যেসব মানুষ সব বোধ নিয়েও দিনের পর দিন কষ্ট করছে, নিজের বাচ্চাদের মুখে ভাত তুলে দিতে পারছে না, তাদের কথা ভাব। জোতদার, দালাল, পুঁজির পুঁজ জমে যাওয়া, হাতে গোনা কিছু মানুষ, যাদের জন্য সৎ, গরিব মানুষগুলো সারা জীবন সার্ফদের মতো অত্যাচারিত হয়ে গেল, তাদের কথা ভেবে তোর মনখারাপ হয় না?” সতু স্ট্রিট কর্নার করার ঢঙে বলল, “আমি তো গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গে। দেখে এলাম! ওদিকে ভিয়েতনামে যে-রেজ়িস্ট্যান্স চলছে, তেমন একটা যদি এখানে আমরা গড়ে তুলতে পারি, শালাদের মুতিয়ে ছেড়ে দেব! তোর ওই ন্যাকা প্রেম আর পাগলদের দেখে আহা-উহু-ই শালা বাঙালিদের শেষ করে দিল!”

কাজু কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু পারল না। বিজন আর পরিতোষ সাইকেল করে এসে থামল ওদের সামনে।

বিজন বলল, “আরে, তোমরা এখানে কী করছ? বিমলদা তোমাদের জন্য ওয়েট করছে তো!”

কাজু, বিজনের সাইকেলের সামনে বসা ছেলেটাকে দেখল। পরিতোষ। প্রায় বিজনের মতোই বয়স। ভাল ছেলে! ক্লাসে ফার্স্ট হয়। সোনাঝুরিতে ওর নাম আছে। কিন্তু বিজনের সঙ্গে ছেলেটা ঘুরছে কেন? বিজনটা নিজে লেখাপড়া করে না। এই বয়স থেকেই খালি পার্টি আর পার্টি! সেখানে পরিতোষের মতো ছেলেরা কেন ঘুরবে ওদের সঙ্গে?

কাজু এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু আজ এত বিরক্ত লাগল যে বলল, “পরিতোষ, তুই কী করছিস বিজনের সঙ্গে?”

পরিতোষ ছেলেটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! আসলে সোনাঝুরিতে কাজুর খুব নামডাক। সেখানে সেই মানুষটা এমন করে ওর সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলছে বলেই বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গেল।

পরিতোষ বলল, “না, মানে… ইয়ে…”

“আরে, আমি বলছি,” বিজন বলল, “আমি ওকে বলেছি আমার সঙ্গে বিমলদার কাছে যেতে। সারাক্ষণ বই মুখে বসে থাকে! আরে বাবা দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কি কম আছে? যা কম আছে, তা হল প্রকৃত মানুষ। সেটা হতে হবে না? আমি ওকে বলেছি ট্রটস্কি পড়তে! গোর্কি পড়তে! তুমি বলো কাজুদা, গোর্কি গ্রেটেস্ট রাশিয়ান নভেলিস্ট না? ওর সমান আর কেউ আছে?”

কাজুর মনে হল, বিজনের কানটা পেঁচিয়ে ধরে। এত বাড়তি কথা বলে ছেলেটা! আর পরিতোষের সামনে জ্ঞান ফলাচ্ছে!

কাজু বলল, “আলেকজান্দার পুশকিন কি বানের জলে ভেসে এসেছে?”

“পুশ…” ঘাবড়ে গেল বিজন। পরিতোষের সামনে বিদ্যে জাহির করছিল ভালই, কিন্তু এই নামটা আর কমন পড়েনি!

কাজু বলেছিল, “ওকে মডার্ন রাশিয়ান লিটারেচারের জনক বলা হয়। কেন বলা হয় বড় হয়ে পড়বি। বুঝলি?”

পরিতোষ বলল, “পুশকিন! অদ্ভুত নাম তো!”

বিজন চোখ ঘুরিয়ে বলল, “নে পরিতোষ, তোর নামের খাতায় লিখে রাখ নামটা। পরে বাচ্চা হলে নাম রাখিস! হুঁ! পুশকিন! বিমলদা বলেছে, গোর্কি বেস্ট!”

সতু বলল, “শালা, মারব কানের গোড়ায়। ডেঁপোমি সব সময়।”

বিজন বলল, “সে মেরো পরে। আগে চলো চক্রবর্তীর চায়ের দোকানে। বিমলদা অপেক্ষা করছে।”

রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটা বেশ বড়। চক্রবর্তীকাকু আর কাকুর দুই ছেলে সারাদিন চা, ডিম টোস্ট, ভেজিটেবল চপ, ঘুঘনি, এসব বানিয়ে যায়। সোনাঝুরির কফি হাউস এই দোকানটা।

বিমলদাকে যদি কেউ পার্টি অফিসে না পায়, তা হলে এই দোকানটাতে পাবেই। বিমলদা মানুষটা বিয়ে করেনি। সারাক্ষণ পার্টির কাজে ঘোরে। একটা কাপড়ের ঝোলা সারাক্ষণ কাঁধে থাকে। তাতে রেড বুক থেকে সহজ হোমিওপ্যাথি শিক্ষা, সব থাকে! ঝোলাটা সব সময় হরিণ গিলে ফেলা অজগরের মতো ফুলে থাকে! সোনাঝুরির সবাই জানে বিমলদার মতো সন্ন্যাসী হয় না। কিন্তু কাছের লোকজন জানে বিমলদা কতটা বদমেজাজি মানুষ। কখন যে রেগে যাবে, কেউ জানে না।

এখন তেমনই কাজুদের দেখেই মানুষটা রেগে গেল। হাতের আধখাওয়া চায়ের গেলাসটা এমন ঠক করে টেবিলে রাখল যে, বাকি চা-টা চলকে পড়ে গেল টেবিলে!

কাজু একটু ঘাবড়ে গেল।

বিমল স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠল, “শুয়ার, তুই হিরো হয়েছিস? তোকে বলেছি না, যে যাবি না গোপেনের কাছে। সেখানে গিয়েছিলি কেন তুই?”

কাজু থমকে গেল! দেখল সতুও ওর দিকে কেমন একটা চোখে তাকিয়ে রয়েছে!

কাজু সময় নিল একটু। এখানে মাথাগরম করলে বা ঘাবড়ে গেলে হবে না।

ও বলল, “আমি তো এমনি-এমনি যাইনি বিমলদা। আপনি বলেছেন যে, আপনি জুটমিলের ওই কাজের ঝামেলার ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না। মালিক যদি মিল লকআউট করে দেয়, তারপর আপনি আন্দোলনে যাবেন। কিন্তু লক আউট করে দেওয়ার পর আর কতদিন খালি পেটে ওয়ার্কাররা আন্দোলন করবে? কতবার আর ওদের ওপর দিয়ে আমরা আমাদের পার্টির মাহাত্ম্য বোঝাব? আমি চাই শ্রমিকদের যাতে সুরাহা হয়। গোপেনদা যদি মালিককে বুঝিয়ে শ্রমিকদের ইনসেনটিভটা দেখে বা অন্তত কাজের কোথায় প্রবলেম হচ্ছে, কোথায় প্রোডাকশন মার খাচ্ছে, সেটা নিয়ে যদি শ্রমিকদের সঙ্গে বসে একবার! তাই… এ ছাড়া গোপেনদার সঙ্গে তো দেখা হয়নি আমার। তা হলে? এত রাগ করার কী আছে! পার্টি করছি তো মানুষের হকটা তাদের দেওয়ার জন্য। সেটা যদি দেওয়া যায় সেটাই তো আসল!”

“গান্ডু তুই? নাকি গোপেনের এজেন্ট?” বিমলদা দাঁতে দাঁত ঘষল, “এটা বুঝিস না যে, প্রবলেমটা যদি গোপেন সলভ করে দেয়, তা হলে আমাদের পার্টির কী হাল হবে? মাসকয়েক বাদে মজদুর ইউনিয়নের ভোট। আর কেউ আমাদের ভোট দেবে? আর গোপেনের সঙ্গে মালিকের ভালই আঁতাত আছে। ওরা যদি ইউনিয়নের দখল নেয়, তা হলে কী ভেবেছিস, শ্রমিকদের খুব সুরাহা হবে? ছাগল তুই? এমন দাড়ি রেখে কলির কেষ্ট সেজে ঘুরে কচি মেয়েদের মাথা আর বুক খেয়ে বেড়াচ্ছিস বেড়া, আমাদের পার্টির পেছনে কাঠি করতে এলে কিন্তু মেরে রেখে দেব একদম!”

“মানে?” কাজুর মাথায় আচমকা রক্ত চলকে উঠল, “কী বলছেন এসব? এমন নোংরা কথা বলছেন কেন?”

কাজু দেখল বিমলদার চিৎকারে আশপাশের টেবল থেকে সবাই ঘুরে তাকাচ্ছে! কী লজ্জার ব্যাপার!

“বেশ করেছি, বলেছি!” বিমলদা চেঁচাল, “খুব র‍্যালা নিয়ে ঘোরা হচ্ছে, না? রক্ত দিয়ে এই পার্টিকে সোনাঝুরিতে এই জায়গায় নিয়ে এসেছি আমি। তুমি হিরো সাজবে বলে সেটাকে আমি নষ্ট করব ভেবেছ? নাকি আমায় ল্যাং মেরে নিজে আমার জায়গাটা নিবি? কী ভেবেছিস, এই সব কেতাবি ঢ্যামনামি করে লোকের সামনে ভাল হবি? নেতা হবি? শালা, পাছায় লাথ মেরে তোকে বের করে দেব পার্টি থেকে!”

কাজু চোয়াল শক্ত করে বলল, “ইতরের মতো কথা বলবেন না। পার্টি কারও সম্পত্তি নয়। মানুষের যাতে ভাল হয় আমি সেটাই করব। তাতে পার্টির হাইকম্যান্ড আমায় কিছু বললে তাদের উত্তর আমি দেব। আপনার খেউড়কে আমি পাত্তা দিচ্ছি না।”

বিমলদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “শালা, খুব তেল হয়েছে, না? বিপ্লবী হবে? যদি আর-একবার তুই গোপেনের কাছে গিয়েছিস তো পার্টি থেকে তোকে লাথ মেরে বের করে দেব হারামজাদা!”

কাজু চোয়াল শক্ত করে একবার বিমলদাকে দেখল, আর-একবার তাকাল সতুর দিকে। দেখল, সতু মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কাজু আর না-দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। দোকানের বাইরে সাইকেল নিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজন। পরিতোষ নেই। নিশ্চয় চলে গিয়েছে।

কাজুর মাথা দিয়ে মনে হল আগুন বেরোচ্ছে! আরে, ও কি আর সাধ করে গিয়েছিল নাকি গোপেনদার কাছে?

এই বিমলদাই তো বলেছিল, “এখন এসব করা যাবে না। আমরা আবেদন-নিবেদন করতে যাব কেন? আমরা আন্দোলন করব। কেন শুধু-শুধু মালিকের জুতো চাটতে যাব? দিক না বন্ধ করে মিল! আন্দোলনের জোর আমরা দেখিয়ে দেব। মালিকের কাছে গিয়ে মাথা নত আমি করতে পারব না।”

‘আমি’! এই আমিটাতেই আপত্তি কাজুর। যেখানে মানুষের হয়ে কাজ করার কথা সেখানে ‘আমি’ আসবে কেন? এত ইগো কীসের? কীসের এত অহং?

কাজু চোয়াল শক্ত করল। গোপেনদা কিছুদিনের জন্য দিল্লি গিয়েছে। সেখান থেকে ফিরলে ও আবার যাবে। এতজন শ্রমিকের রুজির ব্যাপার! সেখানে সামনের ইউনিয়নের ভোটে কে কী সুবিধে নেবে, সেটা পরে দেখা যাবে। আর বিমলদা যদি ওকে পার্টি থেকে বের করার ষড়যন্ত্র করে, তবে ও নিজেই পার্টি থেকে বেরিয়ে যাবে। মানুষের হয়ে কাজ করতে কোনও পার্টি না হলেও ওর চলবে!

“কাজু, কাজু! এই কাজু…” আচমকা একটা ডাকে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মুখ তুলে দেখল কাকিমা! মানে পেখমের মা! কেন কে জানে কাজুর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল! কাকিমা তো এভাবে ওকে কখনও রাস্তায় ডাকে না! তা হলে!

কাকিমা কাছে এসে বলল, “কী হল? এতবার ডাকছি, শুনছ না যে বড়!”

“ডাকছেন?” কাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। আসলে মাথা এমন গুলিয়ে আছে যে… ও খুব অন্যমনস্ক ছিল। তাই শুনতে পায়নি।

“হ্যাঁ,” কাকিমার গলাটা বেশ গম্ভীর!

কাজু এবার ভাল করে দেখল। কাকিমার হাতে একটা ঠোঙা। কাকিমা তো সচরাচর বাজারে বেরোন না!

“কিছু বলবেন?” কাজু নিজের গলাটা যথাসাধ্য নরম করার চেষ্টা করল।

কাকিমা কোনওরকম ভণিতা না করে বলল, “তুমি হস্টেলের পেছনের মাঠে পেখমকে ডেকে পাঠিয়েছিলে?”

কাজু ঘাবড়ে গেল। এটা কী হল? কাকিমা এটা জানল কী করে?

কাকিমা বলল, “তুমি এটা ঘোরতর অন্যায় করেছ। কিছুদিন আগে আমি বাড়ি ছিলাম না, তুমি পেখমের সঙ্গে লোডশেডিং-এ আমাদের ছাদে গিয়ে বসেছিলে। এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই কি নয়? আমাদের সমাজ আর তোমাদের সমাজ এক নয়। এটা বোঝো না?”

কাজু কী বলবে ভেবে পেল না। ও তাকিয়ে রইল শুধু।

কাকিমা বলল, “আমার মেয়ে, তাই আমাকেই তার ভালমন্দ দেখতে হবে। ভাল বিয়ের সম্বন্ধ আসছে ওর। আমি চাই না ওর বদনাম হোক। তুমি আর আমাদের বাড়িতে এসো না। পেখমের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব রেখো না। বুঝলে? এই আমি বলে দিলাম। আশা করি ভদ্রলোকের ছেলে তুমি, আমার কথা রাখবে!”

বন্দুকের গুলির মতো কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে কাকিমা চলে গেলেও কাজু নড়তে পারল না। দুপুরের মফস্‌সল ওর সামনে টলমল করতে লাগল। মাথার ওপরের আকাশটা যেন একবাটি গরম ডালের মতো ফুটছে! শীতের শহরতলি থেকে শিরশিরে হাওয়া যেন তার চাদর গুটিয়ে নিয়েছে ক্রমশ! যেন আর কিছু নেই চারপাশে! শুধু একখণ্ড নির্জন মৃত নগরের পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাজু! পেখমের সামনে ও আর যাবে না? পেখমের বিয়ে হয়ে যাবে? ও অন্য কারও হয়ে যাবে? এও সম্ভব! পেখম আছে বলেই তো ওর এই চারপাশের দম বন্ধ করা পৃথিবীটা তুচ্ছ! আর পেখম না থাকলে তো সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে যাবে!

কাজু এদিক-ওদিক তাকাল। কাউকেই যেন ঠিক চিনতে পারছে না ও। শুধু লোকজনের ভেতর থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসা ঝিকুদাকে চিনতে পারল।

ঝিকুদা মাথা নাড়তে-নাড়তে কাজুর পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওর দিকে তাকাল একবার। তারপর ফিক করে একটু হেসে দিয়ে বলল, “বিলকিস! সব শালা বিলকিস!”

.

১১. নোঈ

বেসিনের কলটা খুলে চোখেমুখে ভাল করে জল দিল নোঈ। মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করছে! এভাবে যে জয়ের সামনে পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি ও। জীবনে যা চায় না সেটাই কেন এসে পড়ে ওর সামনে? মনেপ্রাণে তো চেয়েছিল যে, জয়ের সামনে যেন ওকে পড়তে না হয় আর কোনওদিন! কিন্তু ঠিক সেটাই হল! জয় যে এই অফিসেই চাকরি করছে, সেটা তো আর জানত না ও। জয় বলেনি। কিন্তু সেভাবে দেখতে হলে জয় কিছুই বলেনি ওকে। কোনওদিনই কিছু বলেনি। নোঈই যা খবর নেওয়ার নিয়েছে। যা উতলা হওয়ার হয়েছে। কষ্ট পাওয়ার পেয়েছে। জয় সেসব খুব একটা পাত্তা দেয়নি। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই এমন। জয় যে কী চায়, কাকে চায়, সেটা জয় নিজেই জানে না। কলেজে পড়ার সময়ে ওর চেয়ে চার বছরের বড় এক মহিলার সঙ্গে জয়ের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেটাও সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে জয় আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেনি। বা করলেও সেটা জানতে পারেনি নোঈ।

কলেজের প্রথম দিন থেকে নোঈর ভাল লাগত জয়কে। মানে কিছু-কিছু জিনিস হয় না, মানুষ বোঝে যে এতে বিপদ বাড়বে কিন্তু তাও এড়াতে পারে না? এটাও সেরকমই ছিল। অনেকটা মাধ্যাকর্ষণ বলের মতো। কিন্তু দীর্ঘদিন সেটা জয়কে জানতে দেয়নি ও। শুধু সংগ্রহ করে গিয়েছে। জয়ের দেওয়া লজেন্সের র‍্যাপার, জ়েরক্সের বিল, ফেরত নিতে ভুলে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া উড পেন্সিল, রাবার ব্যান্ড, বাসের টিকিট, খাতার লেখার লুজ় পৃষ্ঠা, আরও কত কী! ওই যে দশ টাকার নোট! ওটাও তো জয়েরই দেওয়া।

কিন্তু সেসব পেছনে ফেলে এবার এগিয়ে যেতে চায় নোঈ। নতুন করে দাঁড়াতে চায় জীবনে! কিন্তু পারছে কই? এখানে জয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল?

আয়নায় নিজের দিকে তাকাল নোঈ। ফরসা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে! কপালে অনুস্বর-এর মতো করে আঁকা টিপটা জলের ঝাপটায় মুছে গিয়েছে কিছুটা। চোখদুটোও লাল হয়েছে বেশ! নোঈ বুঝতে পারছে শরীর বেয়ে একটা কান্না উঠে আসার চেষ্টা করছে!

নোঈর মনে হয় কান্না যেন কোনও পর্বতারোহী। শরীরের অদৃশ্য কোটর থেকে তুষার-কুড়ুল, কাঁটাওয়ালা জুতো শরীরে গেঁথে উঠে আসে চোখের কাছে। এই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়েও নোঈ বুঝতে পারল অদৃশ্য কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে সেই মানুষটি। নিজের শরীরে তার কাঁটাওয়ালা জুতো, বরফের কুড়ুলের আঘাত বুঝতে পারল।

নোঈ চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সংযত করল। না, এখানে আর কান্নাকাটি করা যাবে না। খুব বাজে একটা ব্যাপার হয়ে যাবে।

ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নিজের মুখটা ভাল করে মুছল নোঈ। পাশে রাখা চশমাটা পরল। তারপর পেছন ফিরে বেরিয়ে এল লু থেকে।

পার্ক স্ট্রিটের এই অফিসটা বিজ্ঞাপনের। ওদের কোম্পানির কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ এই প্রোমোট নামে কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে! সোদপুরের কাছে একটি আর বারাসতের কাছে দুটি, মোট তিনটে হাউজ়িং প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু শুধু বাড়িঘর তৈরি করলেই তো হবে না, তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ!

অফিসে আপন এই কাজটা দেখছে। নোঈকে আপনই পাঠিয়েছে এখানে। আসলে প্রোমোট-এর লোকজন বলেছিল, ওরাই গিয়ে দিয়ে আসবে কিছু পেপার। কিন্তু আপন বারণ করেছে। বলেছে ওদের অফিস থেকেই লোক যাবে।

নোঈকে আপন বলেছিল, “তুমি পেপারগুলো নিয়ে আসবে। সঙ্গে ওদের মার্কেটিং-এ যে-ছেলেটা আছে, তাকে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওটা কিন্তু ইমপর্ট্যান্ট। কাজ নেওয়ার সময় এসে ‘স্যার’, ‘স্যার’ করছিল, এখন একে-ওকে পাঠিয়ে পাশ কাটানোর ধান্দা। বলবে আপ্রুভালটা আমি দেব। ওই ছেলেটি যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।”

তখন তো আর নোঈ বুঝতে পারেনি এই মার্কেটিং-এর ছেলেটি আর কেউ নয়, জয়! নোঈ দেখেছে ও যা এড়িয়ে যেতে চায়, তাই এসে আছড়ে পড়ে ওর জীবনে। এই যে চাকরিটা, সেটাও কি আর ও চেয়েছিল! বরং ডিনোদের সঙ্গে আর যাতে দেখা না হয় সেটাই চেয়েছিল। বা আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল, পুশকিনের সঙ্গে যাতে দেখা না হয় সেটাই চেয়েছিল। কেন কে জানে, পুশকিনকে দেখলেই কেমন একটা নাগরদোলা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো ফিলিং হয় নোঈর! কেন এমন হয়, কে জানে! আর সত্যি বলতে কী, কারণটা নিয়ে নিজেকে বেশি খোঁচাখুচি করতে চায় না নোঈ। মোদ্দা কথা পুশকিনের মুখোমুখি আর যেন না হতে হয়, সেটাই মনেপ্রাণে চেয়ে এসেছিল। তাই সেদিন আইকা কথাটা বলার পরে নোঈ থমকে গিয়েছিল একদম। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারেনি। শুধু অবাক হয়ে ভাবছিল, আবার সেই কাণ্ডটাই ঘটল!

মা আপত্তি জানিয়েছিল এই কাজের ব্যাপারে। সব ব্যাপারেই মায়ের নিজস্ব লজিক থাকে। এই ব্যাপারেও আছে। আইকা বোঝানোর চেষ্টা করছিল মাকে যে, জীবনে এসব ভাবলে বা দেখলে চলে না। কিন্তু মা কিছুতেই মানছিল না। আর নোঈ সেই তর্কের ফাঁকে নিজে সময় নিচ্ছিল। নিজেকে প্রস্তুত করছিল। নিজেকে বোঝাচ্ছিল যে, সব কিছু থেকে জীবনে পালানো যায় না। ও যত পালাতে চাইবে তত সমস্ত অপ্রিয়, অস্বস্তিকর জিনিস আরও বেশি করে ছুটে আসবে ওর কাছে।

তাই শেষে নিজেই বলেছিল, সিভিটা দেবে।

পরের দিন সকালে ই মেলে সিভি পাঠিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল ওর। কেবলই মনে হচ্ছিল কাজটা হয়ে যাবে। পুশকিনের মুখটা মনে পড়ছিল। ওই এলোমেলো করে তাকিয়ে থাকা। চশমার ওপারের চোখ। ওই মাথা নামিয়ে সামান্য হাসি। তা ছাড়া ওর দিকে পুশকিনের তাকানোর মধ্যে একটা কেমন যেন ব্যাপার আছে। না, কোনও খারাপ কিছু নয়, কিন্তু কিছু আছে একটা। তাই তো ওই চোখের দিকে তাকালে নোঈর মনে হয় প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা নাগরদোলা থেকে ছিটকে পড়ছে ও!

ডাকটা এসেছিল তার চারদিনের মাথায়। ছোট্ট এক লাইনের একটা ই মেল। ওর ইন্টারভিউয়ের তারিখ আর সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ই মেল-এ।

মা তো প্রথম থেকেই গজগজ করছিল, কিন্তু তাও মনে একটু আশা ছিল যে, নোঈকে হয়তো ইন্টারভিউয়ে ডাকবে না। কিন্তু ওই ই মেলটা আসার পরে মা যেন খেপে উঠেছিল একদম।

সারাদিন নোঈকে বুঝিয়ে সফল না হয়ে রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবাকে নিয়ে পড়েছিল।

বাবা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “ইন্টারভিউয়ে গাড়ি নিয়ে যাবি কি? না ক্যাব ডেকে নিবি? অত দূর!”

মা ভাত দিচ্ছিল। বাবার এই একটা কথাতেই মা হাত থেকে ভাতের হাতাটা শব্দ করে টেবলে রেখে বলেছিল, “নাও, আরও মাথা খাও মেয়ের! এত আহ্লাদ করার কী আছে মেয়েকে? আদর দিয়ে তো মাথায় তুলে ফেলেছ! দেশে কি আর কোম্পানি নেই? সেখানে কি আর কেউ চাকরি পায় না? ওই কোম্পানিতেই ওকে কাজ করতে হবে?”

বাবা শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি ওকে কেন ওর মতো করে ডিসিশন নিতে বাধা দিচ্ছ? ও যদি নিজের মতো করে ঠিক-ভুল না শেখে, সারা জীবন তো কষ্ট পাবে! আমরা তো আর সারা জীবন ওকে গার্ড করে ঘুরে বেড়াব না!”

মা রাগে ফুঁসছিল, “সারাক্ষণ তোমার শুধু তত্ত্বকথা। আমেরিকার ছেলেটিকে না করার সময় মনে ছিল না যে, এটা একটা ভুল ডিসিশন নেওয়া হচ্ছে! আর এখন ওর দাদার কোম্পানিতে চাকরি করবে!”

বাবা আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবার। চিৎকার করে বলেছিল, “এনাফ! আমি সেদিন থেকে শুনছি এসব নিয়ে তুমি অশান্তি করছ! কেন করছ এমন? ওই ছেলেটাকে বিয়ে করেনি তো কী হয়েছে? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে তাতে? সব কিছুর একটা লিমিট আছে! তোমার আমেরিকায় থাকা জামাই হলে কি সমাজে মান বাড়বে? মেয়ের পছন্দ নয় যাকে, তার সঙ্গে সে থাকবে কেমন করে? ওর ইচ্ছে হয়েছে এখানে কাজ করার ও করবে! আমি কিছু বলি না মানে এই নয় যে, অন্যায় দেখেও কিছু বলব না! এই নিয়ে আর যদি কোনও কথা হয়, তবে আমি কিন্তু আর চুপ করে থাকব না।”

বাবা আর ভাত না খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল শব্দ করে। নোঈর খারাপ লাগছিল খুব। ওর খিদে পেয়েছিল, কিন্তু এসব দেখে ওরও আর খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করছিল না। আস্তে করে প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে ও নিজেও উঠে গিয়েছিল।

মা বসেছিল একা। পাথরের মতো। নোঈর কষ্ট হচ্ছিল মায়ের জন্য। কিন্তু ও জানত মাকে এই সময়ে কিছু বললে আর রক্ষে থাকবে না!

আসলে বাবা সংসারের কোনও কিছুতে থাকে না। নিজের কাজ আর হবি নিয়েই থাকে। সেই মানুষটা যে এমন করে রেগে যেতে পারে সেটা নোঈ বুঝতে পারেনি। কোনওদিন বাবাকে রাগতে দেখেনি নোঈ। তাই ওর নিজেরও খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল ওর জন্য বাড়িতে একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হল!

তবে পরের দিন ঘুম থেকে উঠে নোঈ অবাক হয়ে দেখেছিল যে বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বাবা আবার নিজের কাজে। মা আবার রোজকার মতো এই রাগছে, এই হাসছে!

ও অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে!

বাবা মুচকি হেসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, “কাল রাতে আমার জামা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে রাগের চোটে। আমায় বালিশ দিয়ে খুব মেরেছে! তারপর কেঁদে শান্ত হয়েছে! জানিস তো তোর মাকে। পাগলি! আমি কোনওদিন তো বকিনি তাই খুব অভিমান হয়েছিল। তবে তোকে আর কিছু বলবে না। তোর যেটা ঠিক মনে হয় সেটাই কর।”

নিজেদের গাড়ি নেয়নি নোঈ। মোবাইল থেকে গাড়ি বুক করে নিয়েছিল। ভেবেছিল চাকরি পেলে তখন ভেবে দেখবে রোজ কী করে যাবে!

অফিসটা দেখে বেশ ভাল লেগেছিল নোঈর। বেশ বড়। অনেক উঁচুতে! আর, একদিকের কাচের দেওয়াল দিয়ে বহুদূর দিগন্ত দেখা যায়। বিকেল বলে ওই দৃশ্যটা যেন আরও সুন্দর লাগছিল। গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা রিসেপশন পেরিয়ে ওকে ওপরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেও আর-একটা রিসেপশন। গদি-আঁটা চেয়ার। কয়েকটা গাছ। সামনে টেবিলে জলের গেলাস। আর, একটা যেন চুপচাপ শীত-শীত ভাব! কেউ শ্বাস নিলেও শব্দ শোনা যায় এমন নিস্তব্ধতা! রিসেপশনে বসে সামান্য টেনশন হচ্ছিল ওর। কেন হচ্ছিল কে জানে! ইন্টারভিউ বলে, নাকি পুশকিনের সামনে যেতে হচ্ছে বলে!

প্রায় দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পরে ওকে ডাকা হয়েছিল একটা ঘরে। উঠে দাঁড়িয়ে পাশের কাচে একবার নিজেকে দেখে নিয়েছিল নোঈ। তারপর এগিয়ে গিয়েছিল।

“আরে, কোথায় তুমি?” লু থেকে বেরিয়েই সামনে স্মরণকে দেখল নোঈ। সেই সামান্য এলোমেলো চুল, জামাটা ঠিকমতো গোঁজা নয়, পায়ে স্নিকার! নোঈ মাথা নাড়ল। এই ছেলেটাকে বলে লাভ নেই! সেই একইরকম ভাবে থাকবে।

অফিসে গিয়ে প্রথম দিনেই স্মরণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নোঈর। এমন একটা ছেলে কী করে এই সংস্থায় কাজ করে! এমন ছন্নছাড়া, উসকোখুসকো একটা ছেলেকে কেউ কিছু বলে না!

বলে, আপন বলে। ও সুযোগ পেলেই ঝাড়ে স্মরণকে। কিন্তু ছেলেটা কী দিয়ে তৈরি কে জানে! গায়ে যেন কিছুই লাগে না! আপন যখন খারাপভাবে ওকে বলে, স্মরণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বকাঝকা শেষ হয়ে গেলে নিজেই বলে, “আমি তবে যাই স্যার?”

আপন লোকটাকে প্রথম দিন দেখেই ভাল লাগেনি নোঈর। ইন্টারভিউ দিতে ঢুকেই আপনের মুখে এমন কিছু একটা দেখেছিল নোঈ যেটা ওর ভাল লাগেনি একদম! আর পাশে বসা পুশকিন ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসেছিল মাত্র!

আপন সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেছিল, “সিট।”

নোঈ বসার পরে মাথা ঝুঁকিয়ে “গুড আফটারনুন” বললেও আপন উত্তর দেয়নি।

পুশকিন পালটা উইশ করে বলেছিল, “আমরা তোমার সিভি দেখেছি। সাপোর্টিং ডকুমেন্টসও দেখেছি। তুমি আগে যে-কোম্পানিতে কাজ করতে সেটার রেফারেন্সও দেখলাম। তবে একটা কথা, আমাদের এখানে কিন্তু অ্যাকাউন্টসে তেমন করে ভেকেন্সি নেই! তোমার তো মার্কেটিং-এ একটা ডিপ্লোমা আছে। প্রজেক্ট ওরিয়েন্টেড কাজ করতে অসুবিধে নেই তো?”

নোঈ কিছু বলার আগেই, আপন বলেছিল, “আরে, আপত্তি থাকলে এখানে কাজ করা যাবে না। সিম্পল। তা পুশকিন, তুই তো মোটামুটি ঠিক করেই রেখেছিস যে ওকে নিবি, তা এটা বসকে বলেছিস তো?”

আপনের কথার মধ্যে কেমন একটা খোঁচা ছিল। কিন্তু পুশকিন উত্তেজিত না হয়ে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, “না বলে, ওঁর সঙ্গে কনসাল্ট না করে কি আমি কাজ করছি নাকি?”

আপন কেমন একটা চোখে তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। তারপর বলেছিল, “প্রজেক্টের কাজ কিন্তু কঠিন। এমনও হতে পারে অন সাইট গেলে সেখানে রাতে থাকতে হতে পারে। লেবারদের মধ্যে থাকা… হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য সিচুয়েশন। তখন কিন্তু ট্যানট্রাম সহ্য করা হবে না। আর-একটা কথা, এখন প্রবেশনারি পিরিয়ড থাকবে ছ’মাস, এরপর তোমার জব ইভ্যালুয়েশন হবে, তারপর পারমানেন্ট। এটা যেন মনে থাকে।”

আপনের কথার ধরন মোটেও ভাল লাগছিল না নোঈর। কিন্তু পুশকিনের মুখে একটা সহজ হাসি ছিল। কোথায় যেন নিরুচ্চারে ভরসা দিচ্ছিল ওকে।

“ওকে স্যার,” নোঈ মাথা নেড়েছিল।

“ক্যান ইউ জয়েন টুমরো?” জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিন।

“শিয়োর স্যার,” নোঈ উঠে দাঁড়িয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় যেন আবছাভাবে আপনের মৃদু গলা শুনতে পেয়েছিল নোঈ। শুনেছিল আপন বলছে, “কেমন ননির পুতুলের মতো চেহারা! দেখ, কতদিন টেকে!”

সেদিন ইন্টারভিউ সেরে কয়েকটা পেপারে সই করতে-করতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। পুশকিন নিজেই বলেছিল যে, ও গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবে ওকে। নোঈ আপত্তি করেছিল, কিন্তু পুশকিন খুব একটা পাত্তা দেয়নি।

ফেরার পথে গাড়িতে পুশকিন প্রায় কথাই বলেনি। সামান্য একটু “হুঁ, হাঁ” করেছে। সামনের সিটে পুশকিনের পাশে বসে নোঈর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এই গাড়িটায় একদিন উঠতে চায়নি ও। আর আজ এই গাড়িতেই ওকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। সত্যি, জীবন অদ্ভুত! কোন বাঁক থেকে সে যে মানুষকে কোন বাঁকে এনে ফেলে!

শুধু পাড়ার মুখে যখন নোঈ নেমে যেতে চেয়েছিল, তখন পুশকিন বলেছিল, “কেন? আমি ফ্ল্যাটের নীচ অবধি ছেড়ে দিচ্ছি। প্রবলেম আছে?”

নোঈ কী বলবে বুঝতে না পেরে ফস করে বলে ফেলেছিল, “মানে… মা একটু… আসলে…”

হেসেছিল পুশকিন, “উনি চান না তুমি আমাদের কোম্পানিতে জব করো, তাই না? ডিনোর সঙ্গের ব্যাপারটা ওঁর খুব একটা ভাল লাগেনি বোধহয়। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে, চলো। লেটস সর্ট ইট আউট। প্লাস, তোমার বাবাকে আমার চমৎকার লেগেছে।”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কেউ নিজে থেকে ওদের বাড়ি যেতে চাইছে! তাকে তো আর না বলা যায় না! আর অবাক হয়ে যাচ্ছিল দেখে যে, মনের মধ্যে অস্বস্তির সঙ্গে কেমন একটা ভাল লাগাও আসছিল নোঈর। পুশকিন বেশ সহজ-সরল মানুষ! জটিলতা যেন ঠিক পছন্দ নয় ওর!

বাড়িতে দরজা খুলেই মা পুশকিনকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল বেশ। নোঈর মাকে নিয়ে ভয় ছিল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছিল মা হেসে, নরম ভাবেই কথা বলছে পুশকিনের সঙ্গে।

তবে পুশকিন বসেনি বেশিক্ষণ। আইকা মাগোকে কোলে করে ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। নোঈর কেমন যেন একটা লেগেছিল। আইকা ঘরে ঢুকতেই কি পুশকিন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল? কেন?

পুশকিন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “আমি তা হলে আসি।”

মা এবার সামান্য হেসে বলেছিল, “আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব! আপনাদের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তা হতে পারত কিন্তু নোঈটা এমন…”

“ও ঠিক করেছে!” পুশকিন হেসে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে, “ডিনো ইজ় নো ম্যাচ ফর হার। বিদেশে থাকে মানেই যে, সে সাংঘাতিক, সেটা কিন্তু ভাববেন না।”

“কিন্তু তাও…”

মাকে কথাটা শেষ না করতে দিয়ে পুশকিন বলেছিল, “আর নোঈ নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছে! আমার কথায় নয় কিন্তু! আমাদের বস, তিনি নিজেও সব রিক্রুটের ব্যাপারে সিভি স্ক্রুটিনি করেন! আপনি মনে কোনও দ্বিধা রাখবেন না।”

“তুমি এতক্ষণ বাথরুমে কী করছিলে?” স্মরণ গোলগোল চোখ করে তাকাল ওর দিকে। এমনিতেই ছেলেটার চোখগুলো গোল্লা ধরনের। তার ওপর আবার ওরকম করে তাকিয়ে আছে! ছেলেটা সত্যি অদ্ভুত, একটা মেয়েকে যে এমন প্রশ্ন করতে নেই, সেটাও জানে না।

নোঈ কিছু না বলে হাসল।

স্মরণ বলল, “সে কী! হাসি প্র্যাকটিস করছিলে নাকি? আরে, ওই জয় রয় ডাকছে আমাদের। চলো।”

আবার জয়ের কথা ওঠায় নোঈর বুকের ভেতর যেন দশ কেজির বাটখারা আছড়ে পড়ল। আসলে ও রিসেপশনে বসে দূর থেকে জয়কে দেখেছিল। এবার যে একদম সামনে থেকে ফেস করতে হবে, সেটা ভাবলেই পেটের ভেতরে কেমন যেন পাক দিচ্ছে! তবু মনে মনে নিজেকে শক্ত করল নোঈ।

স্মরণ বলল, “তুমি মাঝে মাঝে পজ় মোডে চলে যাচ্ছ কেন আজ? আসার সময় তো ভালই ছিলে! তেমন হলে তুমি বোসো, আমি গিয়ে ওই কথাটা বলে আসছি। জাস্ট তো একটা লাইন। আপনস্যারের সঙ্গে দেখা করতে বলতে হবে। আমি বলে আসছি।”

স্মরণ নোঈর উত্তরের অপেক্ষা না করে এগোতে গেল। কিন্তু নোঈ স্মরণকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল, “না। আমিই যাব। এটা কাজ। আমায় ঠিক থাকতে হবেই।”

“মানে?” স্মরণ চোখ গোলগোল করে তাকাল আবার, “কোনও কেস আছে নাকি? এমন করে বলছ কেন?”

নোঈ নিজেকে ঠিক করল। তারপর জোর করে হাসল। আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

জয়ের কিউবটা রিসেপশন থেকে সামান্য দূরে। পেছন থেকে জয়কে দেখে নোঈর বুকটা কেঁপে গেল আবার। জয় বড় চুল রেখেছে। পাশ থেকে দাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চোখে চশমা। মাথা নিচু করে জয় কিছু একটা করছে।

নোঈ একবার আড়চোখে স্মরণকে দেখে নিল। ছেলেটা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কী খুঁজছে কে জানে!

“এক্সকিউজ় মি!” নোঈ সাবধানে ডাকল।

জয় না তাকিয়েই প্রথমে “ইয়া,” বলে তারপর মুখ তুলে নোঈকে দেখে চমকে গেল!

“তু…” জয় কেমন যেন ঘাবড়ে গেল!

নোঈ দ্রুত স্মরণকে হাত দিয়ে টেনে সামনে এনে বলল, “আমরা এসেছিলাম আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে। আপন বাসু আমাদের পাঠিয়েছেন। আর্টওয়ার্কের হার্ড কপিটা নেব। আর উনি আপনাকে একটা কথা বলতে বলেছেন।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে নোঈ চোয়াল শক্ত করল। ও যতই চাইছে না, কিন্তু তবু ওর চোখ বারবার খুঁটিয়ে দেখছে জয়কে। চশমার ফ্রেমটা নতুন। শার্টের মাঝের বোতামটা অর্ধেক লাগানো। দাড়িটা ট্রিম করা। লম্বা চুলে বার্গেন্ডি কালার। নাকের ব্রিজের পাশে সেই তিল। কানের লতির নীচে একটা ছোট্ট জড়ুল। আঃ! কী করছে কী ও! আচ্ছা জয় কি বুঝতে পারছে এটা? ওকে কি হ্যাংলা ভাবছে?

জয়ও নিজেকে সামলাল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন করে বলল, “বাবা, তুই এভাবে আমায় আপনি-আজ্ঞে করছিস কেন? আমি তোর ভাশুর নাকি?”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না।

স্মরণ বলল, “আপনারা একে অপরকে চেনেন?”

“চিনি মানে?” জয় হাসল, “চিনি, গুড়, সুগার, সুগার ফ্রি সব।”

নোঈ বলল, “এটা অফিস ম্যাটার। আমাদের কিছু প্রোটোকল মেনটেন করা উচিত।”

জয় হাসল, “দূর, কী যে বলিস! আমরা এখানে অত আপটাইট নই। তা তোদের আপন কী বলেছেন?”

নোঈ বলল, “স্যার বলেছেন আপনাকে একবার দেখা করতে। মানে ইন পার্সন।”

“অ,” মাথা নাড়ল জয়, “এই কেস। বুঝেছি। তা আর্টওয়ার্ক পেয়েছিস তো?”

স্মরণ বলল, “হ্যাঁ, ওই রিসেপশনে রাখা আছে, বেরোনোর সময় নিয়ে যাব। আপনি কিন্তু একবার গিয়ে দেখাটা করবেন। স্যার বলেছেন এটা আর্জেন্ট।”

“কফি খাবি?” জয় মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে হাসল।

নোঈর মনে হল বুকের কোনও এক সূদর খাতে ঝুপঝুপ করে নদীর পাড় ভেঙে পড়ল। নোঈ জানে হাসির সঙ্গে টোল জেগে উঠেছে। কিন্তু দাড়ি বলে বোঝা যাচ্ছে না।

“না, আমাদের যেতে হবে,” নোঈ মাথা নামিয়ে নিল, “আপনি শুধু একবার দেখা করে নেবেন, থ্যাঙ্কস।”

“আরে, তুই এমন করছিস কেন বল তো?” জয় এবার যেন সামান্য বিরক্ত হল, “আপনি-আপনি করছিস কেন? তোর এসব ওভার রি-অ্যাকশন আমার ভাল লাগে না!”

নোঈ আর পারল না। শুধু চাপা গলায় বলল, “ভাল যে লাগে না সেটা জানি। বাই।”

মে মাসের আঠারো তারিখ আজ। আকাশ থেকে কেউ যেন গলন্ত লাভা ঢেলে দিচ্ছে কলকাতার মাথায়। নোঈ আকাশের দিকে তাকাল। এই রংচটা নীল বেডকভারটা কবে থেকে যে টাঙানো আছে মাথার ওপর! ওর মনে হল পাখিরা যে রোস্ট হয়ে মাটিতে টুপটুপ করে খসে পড়ছে না, সেটাই অনেক ভাগ্যের।

পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় বেশ ভিড়। স্মরণ হাতে আর্টওয়ার্কের বড় ফোল্ডারটা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আজ আর রাজারহাটের অফিসে যেতে হবে না। এই বিকেল সোয়া চারটের সময় অতদূরে গেলে পৌঁছতেই ছ’টা বেজে যাবে।

স্মরণ বলল, “আইসক্রিম তেষ্টা পেয়েছে, খাবে?”

“কী?” হাসল নোঈ।

স্মরণ বলল, “বলছি, আইসক্রিম খাবে? সামনেই হবি সেন্টার। খাবে?”

নোঈ বলল, “না, আমি ঠিক মানে…”

স্মরণ বলল, “আরে বাবা, আমি তোমায় এমনি খেতে বললাম। আমার অন্য উদ্দেশ্য নেই! তুমি যা ভালনারেবল স্টেটে আছ, তাই… প্যাঁও রেগে গেলে বা মনখারাপ করলেই আমি ওকে আইসক্রিম খাইয়ে দিই।”

“কে?” নোঈ বুঝতে পারল না ঠিক!

“আরে প্যাঁও! আমার প্রেমিকা!” স্মরণ বলল, “দারুণ সুন্দর দেখতে প্যাঁওকে। ছোট্ট মুকুট কপাল। এইটুকু ঠোঁট। জাপানি পার্লের মতো দাঁত। থুতনিতে একটা আলতো ডিপ্রেশন আছে। নাকের দু’পাশে ছোট্ট ফুলস্টপের মতো দুটো তিল। থুতনিতেও আর-একটা। আর হাতের আঙুলগুলো যা দারুণ না! ওঃ!”

স্মরণ বর্ণনা দিতে-দিতে নিজেই খুশি হয়ে উঠল। বলল, “তবে একটা ব্যাপার, প্যাঁও খুব রাগী কিন্তু। সিংহ লগ্ন তো! মানে আমার সিংহী আর কী। আমায় খুব বকে। মাঝে মাঝে তাড়িয়েও দেয়। পরে আবার কাছে ডাকে। মেয়ে নয়, পুরো মুডের স্পেকট্রাম। কতরকমের মেজাজ চাই? সব রকম দেখিয়ে দেবে। আসলে ও গান গায় তো খুব সুন্দর, তাই রাগটা একটু বেশি!”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। ওর মনটা মোটেই ভাল লাগছে না। বরং সেই নাম-না-জানা কোটর থেকে আবার পর্বতারোহীটি বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার মধ্যে স্মরণের এই সব কথা ভাল লাগছে না মোটেই।

স্মরণ বলল, “জয়ের জন্য তুমি বাথরুমে ঢুকে কান্নাকাটি করছিলে?”

“কী?” আচমকা এমন একটা কথায় নোঈ বেশ হকচকিয়ে গেল।

স্মরণ বলল, “ও তোমায় ‘তুই’ করে কথা বলছিল। এমন ভাব করছিল, যেন সব কিছু ঠিক আছে, আর তুমি ঠিক উলটোভাবে ওর সঙ্গে একটা আরোপিত দূরত্ব দেখাচ্ছিলে। স্ট্রেস দিচ্ছিলে ‘আপনি’ শব্দটার ওপর। ওর ওই ক্যাজ়ুয়াল বিহেভিয়ার আর তোমার অতিরিক্ত চোয়াল শক্ত করে ওর সঙ্গে দূরত্ব রাখার চেষ্টা তো একটা জিনিসই স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়।”

“কী বুঝিয়ে দেয়?” নোঈ ভুরু কুঁচকে তাকাল।

স্মরণ হেসে বলল, “এটাই বোঝায় যে, ও মোটেই ক্যাজ়ুয়াল নয়। অকোয়ার্ড সিচুয়েশানে পড়ে সেখান থেকে নিজের মুখ রক্ষা করছে। আর তুমি কিছুতেই ওকে সেই সিচুয়েশন থেকে বেরোতে দিতে চাও না। ওকে একটা গিল্ট দিয়ে কোণঠাসা করতে চাও।”

নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। এভাবে যে কেউ কলিগের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে পারে, ও ভাবতেই পারে না! কিন্তু স্মরণের এসব বোধ আছে বলে মনে হয় না!

স্মরণ আবার বলল, “ওই অনুস্বরের মতো টিপ মুছে ফেলে যখন বাথরুম থেকে বেরোলে, বুঝলাম কিছু কেস হয়েছে। তারপর জয়বাবুকে দেখে তো নিশ্চিত হলাম কী কেস।”

নোঈ আর নিতে পারল না। সামান্য গম্ভীর গলায় বলল, “প্লিজ়। তোমার মনে হচ্ছে না যে, তুমি বড্ড বেশি জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছ?”

স্মরণ বলল, “দূর! এগুলো তো মনে এল বলে বললাম। সারাক্ষণ তোমরা ফেসবুকে সেলফি দেবে, কী করছ তার স্টেটাস দেবে। কেমন ফিল করছ তা বলবে। আর কেউ একটু কিছু বললেই এমন ভাব দেখাবে, যেন সবার মনের ভেতর একটা করে নিউক্লিয়ার বোমার লঞ্চ কোড লুকোনো আছে! সেটা জানার চেষ্টা চলছে। তোমার যা হয়েছে সেটা কমন ব্যাপার। এটাকে এত গুরুত্ব দিয়ো না। যাই হোক, তুমি যখন বাথরুমে ছিলে আমায় ফোন করেছিলেন পুশকিনস্যার। বলছিলেন, কাজ শেষ হলে একবার রাসেল স্ট্রিটের ওখানে যেতে। উনি আসবেন। আমি বলেছি আমায় ডালহৌসি যেতে হবে। তুমি চলে যাবে। এখান থেকে একটু হেঁটে গেলেই পেয়ে যাবে অফিসটা। দেখবে, একটা পুরনো চাইনিজ় লন্ড্রি আছে। তার পাশেই।”

নোঈ বলল, “ঠিক আছে। তুমি তা হলে কাল ওই আর্টওয়ার্কটা নিয়ে যেয়ো মনে করে। আমি আসছি।”

স্মরণ হেসে বুড়ো আঙুল তুলে ওকে দেখিয়ে পা চালিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল।

নোঈ দাঁড়াল একটু। এই পার্ক স্ট্রিটে আসতে নোঈর ভাল লাগে খুব। কেমন একটা পুরনো অভিজাত কলকাতা যেন আজও বেঁচে আছে এই পার্ক স্ট্রিটে। এই চওড়া রাস্তা। পুরনো ধাঁচের বাড়িঘর। কাঠের প্যানেলওয়ালা রেস্তরাঁ। সব মিলিয়ে সময়টা কেমন যেন কলোনিয়ান ক্যালকাটায় ফিরে যায়!

“দিদি, একটা চুইং গাম কিনবেন?” আচমকা সামনে একটা খয়াটে চেহারার লোক এসে দাঁড়াল।

লোকটাকে ভাল করে দেখল নোঈ। কালো, রোগা। কানে একটা ছোট্ট পাথরের দুল। গায়ের ডোরাকাটা গেঞ্জিটা কতদিন যে কাচে না কে জানে! লোকটার গা থেকে সস্তা মদের গন্ধ আসছে।

“দিদি, পিলিজ। খিদে পেয়েছে। দুটো পড়ে আছে চুইংগাম। পিলিজ!” লোকটা কেমন যেন এগিয়ে আসছে নোঈর দিকে। নোঈ ভয় পেয়ে গেল।

“এই ভাগ, ভাগ এখান থেকে!”

নোঈ সামান্য ঘাবড়ে গেল। দেখল পেছন থেকে এসে লোকটাকে কড়া ধমক দিল জয়।

লোকটা গুটিয়ে গেল কিছুটা।

জয় আবার বলল, “ভাগ বলছি না! পাতা খাবি এখন বসে আর বলছিস খিদে পেয়েছে! ভাগ!”

লোকটা চোয়াল শক্ত করে একবার দেখল জয়কে, তারপর মাথা নামিয়ে চলে গেল।

নোঈ তাকাল জয়ের দিকে। ও কী করছে এখানে?

জয় বলল, “আমি সিগারেট খেতে নীচে নেমেছি। তোর জন্য নয়।”

নোঈ মাথা নিচু করে নিল। চলে যেতে হবে ওকে এখান থেকে। পুশকিন ডেকেছে। কিন্তু যেতে পারছে না। জয় এত কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর গায়ের সেই ‘হট ওয়াটার’ পারফিউমের সঙ্গে তামাক মেশানো গন্ধ! সেই বিকেলবেলা! নোঈর গায়ে নিজের অজান্তেই কাঁটা দিয়ে উঠল। জীবন খুব নিষ্ঠুর। সব কিছু সাজিয়ে সামনে মেলে ধরেও এমন একটা ফাঁক রেখে দেয় যে, জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে!

নোঈ চোয়াল শক্ত করে বলল, “এভাবে গায়ে পড়ে অপমান করছিস কেন? আমি কি বলেছি, তুই আমার জন্য নীচে নেমে এসেছিস?”

জয় হাসল। বলল, “দেখ, এভাবে যে দেখা হবে, সেটা তো আমরা জানতাম না। কিন্তু কোয়াইট ফ্র্যাঙ্কলি, আর দেখা না হলেই বোধহয় ভাল হবে। নেক্সট টাইম তুই আসিস না।”

“মানে?” নোঈর বিরক্ত লাগল, “আমি চাকরি করি। সেই কাজে দরকার পড়লে আবার আসব।”

জয় মাথা নাড়ল। হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে বলল, “চাকরি? হাঃ হাঃ! তোদের আবার চাকরি! টাইম পাস বল? শখ। আর আসবি মানে? মানে আবার সেই… ওঃ… অনেক তো হল নোঈ, এবার ছাড়। আর কতদিন? এটা প্রেম না, ইগো আর অবসেশন! প্লাস আমি চেষ্টা করছি, বিদেশে চাকরির কথা হচ্ছে। বাই বাই ক্যালকাটা। বুঝলি?”

জয় হেসে ওদের যা কিছু সম্পর্ক আর বিচ্ছেদ ছিল সব আকাশে ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। ঢুকে গেল বড় বাড়িটার মধ্যে। আর নোঈর মনে হল গোটা পার্ক স্ট্রিটটা যেন জয়ের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল ওর সামনে থেকে! ওর মনে হল সামনের রাস্তাটা কেমন যেন টলছে! মনে হল, আসলে পাখি নয়, ওর নিজের ঝলসানো মাংস টুপটুপ করে খসে পড়ছে আকাশ থেকে! মনে হল এই গ্রীষ্মের যেন কোনও শেষ নেই। এক অক্লান্ত আগুন, যুগের পর যুগ ধরে, ঝলসে, পুড়িয়ে দিয়ে যাবে সবকিছু। আর সব শেষে মাটিতে পড়ে থাকবে ওই পিষে ফেলা সিগারেটের মতো কিছু আধপোড়া মানুষ আর তাদের নরম, একাকী ইচ্ছেগুলো।

নোঈ দেখল ওই চুইংগাম বিক্রেতা ছেলেটা আবার ফিরে আসছে। ও ব্যাগ খুলল এবার। কিছু কার্ড, কাগজ আর কয়েকটা একশো টাকার নোটের পাশে চারটে দশ টাকার নোট দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা সেই পুরনো পাঁজর ওর।

নোঈ চোখ বন্ধ করে হাত বাড়াল। দেখা যাক কোন নোটটা হাতে ওঠে। যদি সেই নোটটা ওঠে, তবে সেটাই দিয়ে দেবে। আজ আর কোনও পিছুটান রাখবে না।

হাতে পাতলা কাগজগুলো ঠেকল নোঈর। ও চিন্তা না করে তুলে নিল একটা। কী উঠল হাতে? ও কী চায়? কোন নোটটা উঠুক? এখনও, আজকের পরেও কি ওর মনে হবে ‘রেখে দিই’ ওই কাগজের টুকরোটা?

আবার মদের গন্ধ নাকে আসছে। ঘ্যানঘ্যানে গলাটা শোনা যাচ্ছে। নোঈ নিজেকে প্রস্তুত করল। তারপর চোখ খুলে তাকাল হাতের নোটটার দিকে!

.

১২. রাধিয়া

উত্তর কলকাতাটাকে কেমন একটা বাতিল চিলেকোঠার মতো লাগে রাধিয়ার। ঘিঞ্জি রাস্তা, রংচটা বৃদ্ধ বাড়িঘর, ধুলোমাখা রুগ্ণ গাছ, ছেঁড়া পোস্টার, বেখেয়ালি হকার। সব নিয়ে মনে হয় বাতিল আর অতিরিক্ত জিনিসপত্র কে যেন দলামোচড়া করে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা ঘরের ভেতরে! কেন এমন করে রাখা হয়েছে শহরটাকে? কেন এমন একটা শহর চলে যায় দখলদারদের হাতে?

রাধিয়ার মনে সারাক্ষণ এমন নানা প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কাকে কী বলবে?

আজ ইউনিভার্সিটিতে পলি আর বুদা এসেছে, বাকিরা কেউ আসেনি। ক্লাসও তেমন ছিল না। তাই ভেবেছিল বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু পলি তো ছাড়ার পাত্রী নয়।

বলেছে, “এত তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কী করবি? আমার সঙ্গে চল। ‘ব্রোঞ্জ ইয়ার্স’-এ নিয়ে যাব চল তোকে। কতদিন যেতে বলেছি, তুই তো শুনবি না!”

কলেজ স্ট্রিটটা আজ যেন উপচে পড়ছে! সামনে জামাইষষ্ঠী, কিন্তু তাতে কী? আজকাল তো আর মানুষজন কেউ কাউকে খুব একটা বই-টই উপহার দেয় না! বই পড়াকে লোকে হয় অবজ্ঞার চোখে দেখে, নয়তো ভাবে শো অফ করছে! তাই পালাপার্বণে বইয়ের বাজারে ভিড় দেখলে খুব আশ্চর্য হয় রাধিয়া!

মধুদা গাড়িটা পার্ক করেছে সেই সূর্য সেন স্ট্রিটে বিখ্যাত শরবতের দোকানটার কাছে। এখানে থেকে ওই অবধি হেঁটে যেতে বেশ কসরত করতে হবে।

তবে তার আগে একটা কাজ আছে। ঠাকুরমা বলেছে কয়েকটা বইয়ের অর্ডার দিয়ে আসতে। কোন এক স্কুলে দিতে হবে। এসবের জন্য মধুদা আছে। বাবার অফিসের লোকজন আছে। কিন্তু ঠাকুরমা রাধিয়ার ওপরই জোর দেয় এসব করার জন্য। বলে, “তোর আপত্তি কোথায়? অত পুতুপুতু করে থাকতে হবে না। তুই কানাইয়ের দোকানে গিয়ে আমার নাম করে অর্ডার দিয়ে আসবি। অন্য লোক গিয়ে ডেলিভারি নিয়ে আসবে। বুঝলি?”

ঠাকুরমা অদ্ভুত মানুষ। ওদের বাড়িতে থাকলেও কেমন একা-একাই থাকে। বড় বাড়ি বলে অসুবিধেও হয় না। আসলে এইসব বাড়িঘর, নানারকমের ব্যাবসাপত্র, এই সবকিছু ঠাকুরমার নামেই। তবে বাবাও মালিক গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। আর রোজকার ব্যাবসা বাবাই দেখে!

ঠাকুরমা বলে, “এত নানা ধরনের ব্যাবসা, আমার আর ভাল লাগে না। সত্যি, বিষয় বিষ! জানিস রাধি, আমি শ্বশুরঠাকুরকে বলেছিলাম যে, আমার নামে এসব দিয়ে যাবেন না। কিন্তু উনি শোনেননি। নিজের ছেলের চেয়ে আমাকে বেশি বিশ্বাস করতেন। লোকটা শেষজীবনে কেমন পালটে গিয়েছিলেন। সেই রাগ বা তেজ, কিছুই ছিল না।”

রাধিয়ার এসব শুনতে ভাল লাগে না। ওদের যে অনেক টাকা সেটা ও জানে। কিন্তু কী-কী ব্যাবসা আছে, কোথায়-কোথায় কী আছে সেসব নিয়ে ওর আগ্রহ নেই।

ঠাকুরমা যদিও বলে এসব একটু জেনে নিতে, কিন্তু রাধিয়া কিছুতেই কিছু শুনতে চায় না। কিছুদিন আগে ওই যে রাধিয়া সোনাঝুরিতে গেল, সেখানেও ওদের একটা জুটমিল আছে। ঠাকুরমা সোনাঝুরির কথা শুনে শুধু বলেছিল, “তুই যাচ্ছিস? যা। আমি যে কত বছর যাইনি!”

রাধিয়ার অবাক লেগেছিল, “কেন যাওনি ঠাকুমা? খুব তো কিছু দূর নয়। আর আমাদের তো একটা মিল আছে। তা হলে?”

ঠাকুরমা বলেছিল, “ওদিকে আর যাব না আমি। যে-জীবন ওখানে ফেলে এসেছি, সেই জীবন কষ্ট ছাড়া আর কিছু দেয়নি আমায়।”

“কিন্তু ওখানে অনেক সম্পত্তি আছে না তোমার নামে?”

“শ্বশুরমশাই খুব ভালবাসতেন আমায়। তাই কিছু জিনিস আমার নামে করে গিয়েছেন। কিন্তু নামে করা মানেই তো সেটা আমার নয়! আমার আর কিছুই নয়। শুধু প্রশ্ন ছাড়া আমার আর কিছু নেই,” ঠাকুরমা আর কিছু না বলে চুপ করে গিয়েছিল।

“সোনাঝুরির কথা তুমি কিছু বলতে চাও না কেন ঠাকুমা?”

“কিছু বলার নেই রে রাধি। সেই জীবনটাই নেই তো আর কী বলব!”

রাধিয়া বোঝে না ব্যাপারটা কী। সোনাঝুরির প্রসঙ্গ উঠলেই এমন ম্রিয়মাণভাবে কেন কথা বলে ঠাকুরমা! তবে এই নিয়ে বেশি প্রশ্ন করে না ও। কাউকে কোনও ব্যাপারে জোর করা ওর পছন্দ নয়।

ঠাকুরমার দানধ্যানের হাত খুব। নিজের শ্বশুরমশাইয়ের নামে একটা বৃত্তি চালু করছে। বিভিন্ন অনাথাশ্রমে বার্ষিক একটা টাকা দেয়। আরও নানা কিছু করে। পলিদের এই ওল্ড এজ হোমটাতেও প্রতিমাসে একটা করে টাকা পাঠায় ঠাকুরমা।

ঠাকুরমা বলে, “ভগবান অনেক দিয়েছেন। আমি না হয় তার থেকে একটু দিলাম। তাতে আমার তো কমছে না!”

আজ যে এই বইয়ের অর্ডার দেওয়ার ব্যাপার আছে, সেটাও এমন একটা কাজের অঙ্গ।

রাধিয়া আপত্তি করেনি। ওর এসব ছোটখাটো কাজ ভালই লাগে। মা সারাক্ষণ ওকে আগলে রাখে। তুলোয় মুড়ে রাখে। কিন্তু রাধিয়ার সেটা ভাল লাগে না। ওরও ইচ্ছে করে আর-পাঁচজনের মতো ঘুরতে। কিন্তু পারে না। সারাক্ষণ গাড়ি করে ঘোরা! এসিতে বসে থাকতে-থাকতে মাঝে মাঝে ভুলে যায় কলকাতায় কোন ঋতু চলছে!

মায়ের কথা হল বাইরে এত পলিউশন, তোর স্কিন আর চুল খারাপ হয়ে যাবে। আরে বাবা, মানুষ কি শুধু রূপটুকু নাকি? ওর অন্য বান্ধবীরা কেমন প্রজাপতির মতো স্বাধীনভাবে উড়ে-ঘুরে বেড়ায়!

মায়ের তো কলকাতাতেও ওকে পড়তে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ওর দুই মামা ইংল্যান্ডে থাকে। মা খুব জেদ ধরেছিল রাধিয়াকে ওখানে পড়তে পাঠাবে। কিন্তু রাধিয়াও জেদ করে যায়নি। আর শুধু রাধিয়াই নয়। ঠাকুরমাও রাধিয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আসলে ঠাকুরমাকে টপকে ওদের বাড়িতে কিছু হয় না। মা এই নিয়ে বাবার কাছে অনুযোগ করে। বলে, “আমরা এত বড় হলাম, তাও ওঁর কথামতো কেন আমায় চলতে হবে? আমার মেয়ে, তাকে আমি আমার ইচ্ছেমতো পড়াতেও পারব না! ওই দেশে গিয়ে পড়লে ওর কেরিয়ার কত ভাল হত!”

বাবা বেশি কথার মানুষ নয়। সঙ্গে কিছুটা রাগীও আছে। মায়ের এক কথা বারবার বলায় বলেছিল, “ওর যেখানে ভাল লাগবে পড়বে। তুমি এই নিয়ে আর অশান্তি কোরো না। আর রাধি তো নিজেই এখানে থাকতে চায়!”

রাধিয়া বোঝে কেন এমন বলে মা। আসলে মায়ের নিজের ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেটা আর হয়নি। তবে ঠাকুরমা বা বাবা নিষেধ করেনি লেখাপড়া করতে। কিন্তু মায়ের খুব অভিমান হয়েছিল নিজের বাবা-মায়ের ওপর। তাই নিজেই আর পড়েনি।

মা ওকে বলে, “তোকে তো আমি বিয়ে করতে বলব না। তুই ইচ্ছে হলে বিয়ে করবি, না হলে করবি না। কিন্তু লেখাপড়া থামাবি না।”

মায়ের মধ্যে ওর মনে হয়, দুটো মানুষ আছে। একটা মানুষ কেমন যেন স্নব, অহংকারী। আর আর-একজন বুকের ভেতরে চাপা পড়ে যাওয়া মনখারাপ করা এক মানুষ। মাঝে মাঝে মাকে ঠিক বুঝতে পারে না ও।

“তুই কি রাস্তা ক্রস করবি? নাকি মোটামুটি রাত অবধি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান আছে তোর?”

পলির কথায় পাশে তাকাল রাধিয়া।

“হ্যাঁ, এই তো!” রাধিয়া হাসল।

পলি বলল, “তাড়াতাড়ি চল। আমায় হোমে ছ’টার মধ্যে পৌঁছতে হবে। তারপর স্যারের বাড়ি যাব!”

“যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি। অমন তাড়া দিচ্ছিস কেন?” রাধিয়া হাসল, “আর রোজ স্যারের বাড়ি যাস কেন? রোজ পড়া থাকে?”

“কাজ থাকে, পড়া, নোটস… সে অনেক ব্যাপার, আমার কথা ছাড়, তুই চল,” পলি ওকে তাড়া দিল।

“তুই আজকাল মাঝে মাঝে কী চিন্তা করিস রে? অন্যমনস্ক হয়ে যাস হঠাৎ-হঠাৎ! কী হয়েছে তোর? জিতেনের ভাগ্য খুলল নাকি?” বুদা পাশ থেকে ফুট কাটল।

“খালি বাজে কথা,” রাধিয়া বিরক্ত হল, “কী সব বলিস না!”

জিতেন ওদের সঙ্গেই ইংরেজিতে এমএ করছে। আর সেই প্রথম থেকেই রাধিয়ার পেছনে পড়ে আছে। ইউনিভার্সিটির আর কারও জানতে বাকি নেই যে, জিতেন রাধিয়ার জন্য পাগল!

রাধিয়ার বিরক্ত লাগে এসব। এমন গায়ে-পড়া মানুষ দেখলে মনে হয় পালিয়ে যায়। জিতেন আবার বিশ্ব-আঁতেল! কীসব ম্যাগাজ়িন বের করে! ঘাড় অবধি লম্বা চুল রাখে ছেলেটা। মাঝে মাঝে আবার খোঁপাও করে। সারাক্ষণ রংবেরঙের পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে থাকে। কাঁধে একটা তাপ্পিমারা ঝোলা। স্নান করে কি না কে জানে! সারাক্ষণ সিগারেট জ্বলছে মুখে। দেখলেই ঘেন্না লাগে রাধিয়ার। আর মুখে সব সময় বড়-বড় কথা। জয়েস, কাফকা, বোর্হেস, লোরকা, কাম্যু, ইয়োসা… আরও কত কী নাম! এদিকে নিজেরা যা লেখে, সেসব ওদের ওই ধরাচুড়ো পরা গ্রুপটা ছাড়া আর কেউ বোঝে কি না কেউ জানে না। ভান দেখলেই গা-পিত্তি জ্বলে রাধিয়ার। ওর মনে হয় যারা অযোগ্য কিন্তু লোভী, তারাই ঘ্যাম আর ভান নিয়ে ঘোরে।

কফি হাউসটা বাঁ দিকে রেখে প্রথম বাঁ হাতের রাস্তাটা শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট। সেই রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই কানাইদার দোকান।

গল্পের বইটই এই মানুষটার কাছ থেকেই কেনে রাধিয়া। কানাইদা খুব ভাল মানুষ। সারাক্ষণ পান মুখে থাকে। রাজ্যের বাংলা বইয়ের নাম আর পাবলিশার্সের নাম মুখস্থ!

কানাইদা একটা প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসে হাতপাখার হাওয়া খাচ্ছিল। কানাইদার দুই ছেলেই মূলত দোকান দেখে এখন।

রাস্তার ওপরেই দোকান। বেশ ভিড়। দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তাও রাধিয়া দু’জন মানুষকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল কানাইদার সামনে।

কানাইদার হাতপাখা থেমে গেল। এক গাল হেসে বলল, “আরে, কেমন আছ? অনেকদিন আসোনি!”

রাধিয়া হাসল। তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে চার ভাঁজ করা কাগজ বের করে সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখানে দুশোটা বই আছে। ঠাকুমা যেমন পাঠায় আর কী। কালকে এলে কি পাওয়া যাবে?”

কানাইদা কাগজটা হাতে নিয়ে মাথা উঁচিয়ে বাইফোকাল চশমার তলা দিয়ে দেখল। তারপর বলল, “আচ্ছা, হয়ে যাবে। তোমাদের যে লোক আসবে তাকে বোলো আসার আগে একবার যেন আমায় ফোন করে নেয়। আসলে রাস্তার ওপরে তো এভাবে এত বই রাখা যায় না! তাই অন্য জায়গায় রেখে দেব। উনি এলে তখন দিয়ে দেব।”

“কিছু টাকা দিয়ে যাব?”

কানাইদা হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “না গো দিদিমণি, যখন নেবে তখন দিয়ো।”

রাধিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পলি পাশ থেকে খোঁচা মারল। মেয়েটা খুব তাড়া দিচ্ছে আজ!

রাধিয়া হাসল কানাইদার দিকে তাকিয়ে তারপর বলল, “আমি তা হলে আসি?”

“গাড়ি কোথায় রেখেছ?” কানাইদা জিজ্ঞেস করলেন।

“ওই সামনেই… আসছি…” রাধিয়া হেসে পেছন ফিরল।

এই রাস্তাটা আরওই ঘিঞ্জি! তার মধ্যে একটা ঠেলাওয়ালা তার বিরাট বড় ঠেলা ঢুকিয়ে দিয়ে রাস্তার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়।

বুদা বিরক্ত হয়ে বলল, “নাও ঠেলার জন্য এখন ঠেলা বোঝো!”

রাধিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ও দেখতে পেল ছেলেটাকে। রোগা-পাতলা, বেঁটে, এক মাথা উসকোখুসকো চুল। চোখে চশমা। শার্টটা অর্ধেক গোঁজা আর অর্ধেক বের করা।

আরে, এই ছেলেটাকে দেখেছিল না সুম্পার জন্মদিনে! কী যেন নাম! হ্যাঁ মনে পড়েছে। স্মরণ।

কিন্তু ছেলেটা করছে কী? রাধিয়া দেখল, বড় ঠেলাটার পেছনের দিকটা ধরে টানছে স্মরণ। ওর মনে হল, এই ভিড়টা থেকে ঠেলাটাকে বের করার জন্য এমন করছে ছেলেটা। এবার একটা মেয়েকে দেখল ও। ফরসা। কাটা-কাটা মুখ চোখ। চশমা পরা। একটা জিন্‌স আর সাদা কালো ডোরাকাটা একটা গোল গলা টি-শার্ট পরে রয়েছে মেয়েটা। আর স্মরণকে দু’হাত দিয়ে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে ও।

পলি বলল, “ওই দেখ কোন মক্কেল! কী করছে মালটা?”

রাধিয়া দেখল বুদা হাসছে। আর সত্যি বলতে কী, আরও নানা লোকজন হাসছে।

রাধিয়ার খারাপ লাগল। সবাই ঠেলাওয়ালাটাকে গালাগালি করছে। কিন্তু সে বেচারা রুজির জন্য বেরিয়েছে। আর শুধু ঠেলাওয়ালার দোষ নয় মোটেই। রাস্তাটাকেই সবাই মিলে এমন করে রেখেছে যে, জট পাকিয়ে গিয়েছে। আর বেচারা স্মরণ সেই জট খোলার চেষ্টা করছে বলে সবাই ওকে দেখে হাসছে।

মাঝে মাঝে এইসব দেখে মনখারাপ হয়ে যায় রাধিয়ার। যে কোনও কিছু করার চেষ্টা করে তাকে নিয়েই পৃথিবীতে হাসাহাসি হয়। এখন যেমন হল।

ও দ্রুত এগোল। মানুষের ফাঁকফোকর দিয়ে গলে, দোকানের সিঁড়িতে উঠে, কাঠের টুল টপকে ও গিয়ে পৌঁছল ওদের সামনে।

“স্মরণ, কী করছ?”

স্মরণ ফিরে তাকাল। নাক থেকে পিছলে চশমাটা নেমে এসেছে নীচে। ও চশমাটা তুলে নাক কুঁচকে সেটাকে সেট করে বলল, “আরে রাধিয়া! দেখছ না কী কেস! এভাবে কেউ এখানে ঠেলা ঢোকায়! এটাকে বের না করে দিলে গোটা রাস্তাটা দাঁড়িয়ে যাবে!”

“ছাড়ো, ছাড়ো বলছি! ছাড়ো তুমি…” পাশ থেকে মেয়েটা আলতো করে এবার থাপ্পড় মারল স্মরণের কাঁধে।

স্মরণ তাও ছাড়ল না। তবে রাধিয়াকে এগিয়ে যেতে দেখেই বোধহয় এবার আরও কিছু মানুষজন মজা দেখা বাদ দিয়ে এসে হাত লাগাল। তার ফলে ঠেলাটা সোজা হয়ে এগিয়ে যেতে পারল। আর জট খুলে রাস্তাও স্বাভাবিক হয়ে গেল।

পলি আর বুদা এসে দাঁড়াল রাধিয়ার পেছনে। ওদের দেখে স্মরণ হাসল, “আরে, তোমরা সবাই এসেছ! দারুণ তো!”

জয়তী আর রাখি আসেনি। কিন্তু সেটা আর বলল না রাধিয়া।

ও শুধু বলল, “আমাদের তো ইউনিভার্সিটি এখানে। তোমরা? বই কিনতে?”

“আরে না, না,” স্মরণ হাসল, “কিছু স্টেশনারি কিনতে এসেছি। আমাদের আপনস্যার পাঠালেন। আর স্যারের কিছু বইও কিনতে হবে। যাই হোক, আলাপ করিয়ে দিই। ও আমাদের অফিসেই আছে। নাম নোঈ।”

নোঈ হেসে ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝোঁকাল। এবার মেয়েটাকে আরও ভাল করে দেখল রাধিয়া। খুব সুন্দর দেখতে। ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন করতে পারে এমন স্কিন! এই বিকেলের ধুলোটে আলোতেও মুখটা ঝলমল করছে।

“আমি রাধিয়া।”

আশপাশ থেকে ভ্যান, গাড়ি, লোকজন ক্রমাগত ওদের ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

স্মরণ বিরক্ত হয়ে বলল, “এটা এমন একটা জায়গা যে, শান্তিতে হাঁটতেও পারবে না কেউ! তা সেদিনের পরে তো আর দেখাও হল না তোমাদের সঙ্গে!”

রাধিয়া বুঝল স্মরণের তেমন কোনও কথা নেই বলার। ও পলির দিকে তাকাল।

এসব অবস্থায় পলি সোজাসাপটা কথা বলতে পারে ভাল।

পলি বুঝল ইঙ্গিতটা। ও বলল, “ঠিক আছে স্মরণ, আমরা তা হলে আসি। আসলে উই আর ইন আ হারি।”

“তাই?” স্মরণ হাসল। যেন পলি খুব হাসির কথা বলেছে, “আমার কোনও তাড়া নেই। বসের পারসোনাল কাজে এসেছি। তোমরা মুড়ি খাবে? কলেজ স্কোয়ারে মাখে একজন। ওই দিকটায় বসে। খাবে?”

“আঃ,” নোঈ বলল, “ওদের তাড়া আছে স্মরণ!”

“ও আচ্ছা,” স্মরণ মাথা নাড়ল, “কিন্তু মুড়ি খেতে আর কতক্ষণ টাইম লাগবে?”

বুদা জিজ্ঞেস করল, “তোমার প্যাঁও কেমন আছে?”

“প্যাঁও দারুণ আছে,” স্মরণ আবার নতুন উদ্যমে শুরু করল, “আজ সন্ধেবেলাতেই দেখা হবে আমাদের। ও আসলে গান শেখে তো! ওই বেহালা চৌরাস্তার কাছে গান শিখতে আসে। আমি না গেলে খুব রাগ করে। মানে, ওখান থেকে ওকে পিক আপ করে বাড়িতে দিয়ে আসতে হয় আমায়! আসলে…”

“বাই স্মরণ,” পলি হাত নেড়ে বুদা আর রাধিয়াকে টেনে নিয়ে এগিয়ে গেল।

স্মরণ থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। রাধিয়া যেতে-যেতে শুনল নোঈ চাপা গলায় স্মরণকে বলছে, “তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? সব জায়গায় প্যাঁও প্যাঁও! যেন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে! তুমি কি পাগল?”

ওদের গাড়িটা বেশ বড়। সরু রাস্তা ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিটে বেরোনো অবধি গাড়িটা শামুকের মতো চলল। আশপাশের লোকজন যে বিরক্ত হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল রাধিয়া। বড় আর সুন্দর গাড়ি দেখলেই রাস্তার লোকজন খেপে যায়। এটা দেখেছে রাধিয়া। আমাদের আশপাশটা হিংসুটেদের নিয়ে তৈরি।

বুদা গাড়ির সামনে বসেছে। ও মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা, সুম্পাদের বাড়িতে সেই ছেলেটা ছিল না? সেই যে রে তোর সঙ্গে আলাদা হয়ে কথা বলছিল খাবারের সময়। কী যেন নাম!”

“নিশান!” রাধিয়া ছোট্ট করে বলল।

বুদা বলল, “রাইট। গতকাল ওকে দেখলাম নন্দনে। একটা ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ওকে। সঙ্গে একজন বেশ বয়স্ক মহিলা ছিলেন। ছোট করে কাটা চুল। সামান্য উইয়ার্ড ড্রেস করেছিলেন। সো আই সেড, হাই!”

পলি বলল, “ছেলেটা বেশ। দেখতে অনেকটা ক্রিকেটার মণীশ পাণ্ডের মতো, না?”

বুদা বলল, “কী একটা লিটল ম্যাগের জন্য এসেছিল বলল। আরে, আমি তো নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না! ও এদিকে আমায় ডেকে কথা বলছে! আই ফেল্ট সো অকোয়ার্ড!”

রাধিয়া চুপ করে রইল। ছেলেটা বুদার সঙ্গে কথা বলেছে! ওর কথা জিজ্ঞেস করেনি? কথাটা মনে হতেই নিজেকে ধমক দিল রাধিয়া। এসব কী ভাবছে ও! কেন জিজ্ঞেস করবে ওর কথা! একদিন স্টেশন থেকে নিয়ে একটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল আর একদিন একটা নেমন্তন্নে দেখা হয়ে টুকটাক একটু কথা বলেছিল। তাতে তেমন তো আর পরিচয় হয়নি যে, ওর কথা জিজ্ঞেস করবে! তবে একটা দীর্ঘশ্বাস মনে মনে চাপল রাধিয়া, ছেলেটার পারফিউমটা খুব সুন্দর! কথাটা মনে পড়তেই চোখ বুজে এল। আর ওর সামনে ভেসে উঠল সেই আধো অন্ধকারে জড়িয়ে থাকা একটা গলি। তার ভেতর দিয়ে ডুবে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছে একটা সাইকেল। আর সেই হলুদ পাঞ্জাবিটা হালকা হাওয়ায় উড়ছে প্রজাপতির মতো।

“তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল জানিস?” বুদা এবার পিছন ফিরে তাকাল রাধিয়ার দিকে।

রাধিয়া সামান্য হাসল। ওর জানতে ইচ্ছে করছে কী জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু ও জানে বেশি কৌতূহল দেখালে পলি আর বুদা ওকে খুব জ্বালাবে!

বুদা বলল, “নিশান বলল, ‘আপনার সেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বান্ধবী কেমন আছেন?’ তোকে এমন করে বলল কেন রে?”

রাধিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল! এ আবার কেমন কথা! ও এর উত্তরে কিছু না বলে সামনে বসা মধুদাকে বলল, “ওই কালীঘাট ট্রাম ডিপো হয়ে যেয়ো তো মধুদা। পলি আর বুদা নামবে।”

“কেন, তুই নামবি না?” পলি পাশ থেকে অবাক হল।

“না রে,” ছোট করে বলল রাধিয়া, “আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে। আসলে ঠাকুমাকে নিয়ে একটু বেরোব। ঠাকুমা বলেছিল, আমি ভুলে গেছি একদম।”

“যা,” পলি মাথা নাড়ল, “আমি জানি তুই মিথ্যে বলছিস। এত ঘরকুনো কেন রে তুই?”

“না রে, সত্যি বলছি,” রাধিয়া বলল, “ঠাকুমা একবার দোকানে যাবে জুতো কিনতে। আমাকেও যেতে হবে!”

“ও,” পলি চুপ করে গেল।

আচমকা গাড়িটা কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে গেল। গাড়ির কাচ তোলা। গুনগুন করে এসি চলছে। গাড়িটা টিপু সুলতান মসজিদের সামনের সিগনালে এসে দাঁড়িয়েছে!

বিকেল এবার ক্রমশ নরম হয়ে আসছে। সামনে গাড়ি আর বাস এমন করে গিঁট পাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে আর জীবনেও এই গিঁট খুলবে না!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল রাধিয়া। আর তখনই চমকে উঠল! আরে ওটা কে? বাবা না!

রাধিয়া ভাল করে ঘুরে বসল এবার। সত্যি দেখছে তো? বাবা-ই তো? হ্যাঁ, ঠিক। বাবা-ই! একটা সাদা সেডানের পেছনে বসে রয়েছে বাবা। কালো টি-শার্ট পরে আছে। আর পাশে ওটা কে? একজন মহিলা! ছোট করে, প্রায় ন্যাড়ার মতো করে কাটা চুল। শার্প ফিচার! বাবা মহিলার দিকে ফিরে কথা বলছে। কিন্তু বাবা এই শেষ বিকেলে কী করে কলকাতায় থাকতে পারে? বাবা তো বলেছে যে, ব্যাবসার কাজে নাগপুর গেছে। গত কালকেই তো বেরোল। তা হলে?

রাধিয়া কী বলবে বুঝতে পারল না। ও সিগনালের দিকে তাকাল। এখনও লাল। ওঃ, কিছুতেই সিগনালটা খুলছে না! মনখারাপের সঙ্গে কেমন একটা টেনশনও হচ্ছে ওর। মধুদা যদি দেখে ফেলে! কী হবে তা হলে! কী লজ্জা, কী লজ্জা!

এসির মধ্যে বসেও নিমেষে ঘেমে গেল রাধিয়া! মুখ-চোখ ভয় আর কষ্টে লাল হয়ে গেল! বাবা মিথ্যে বলে এমন করে বাড়ির বাইরে আছে কেন? ওই মহিলাই-বা কে? বাবাকে সারাক্ষণ গম্ভীর দেখে! কিন্তু ওই গাড়িতে বসে বাবা তো রীতিমতো হাসছে! আশপাশে কিছু খেয়ালই করছে না। দু’জন মানুষকে দেখলে বোঝা যায় তাদের সম্পর্কের ধাঁচটা কী। এখানে বাবাকে ‘মোর ইগার’ লাগছে! মহিলাটি তো শান্ত মুখে বসে আছে। চোয়াল শক্ত করে রইল রাধিয়া। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে থাকল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস ধড়াস করছে! এসব কতদিন ধরে চলছে? বাবা যে কাজে নেই সেটা তো স্পষ্টই। কাজে থাকলে আউট স্টেশন যাওয়ার নাম করে কলকাতায় থাকত না। এসব তো মা, ঠাকুমা জানে না। জানলে কী হবে! বাবা কি ওদের ছেড়ে চলে যাবে! আর মা? মা কী করবে?

“কী হয়েছে রে রাধি?” পলি পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল।

রাধিয়া উত্তর দেওয়ার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল। ও ঘাড় না ঘুরিয়েও চোখের আড় দিয়ে দেখার চেষ্টা করল গাড়িটা কোথায়। নাঃ, গাড়িটা পিছিয়ে আছে। সামনের বড় দুটো বাস গড়িমসি করছে স্টার্ট নিতে। ও মনে মনে বলল, গাড়িটা আরও পিছিয়ে যাক।

ও মধুদাকে বলল, “জোরে চালাও মধুদা। আমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।”

“হোয়াটস রং?” পলি এবার রাধিয়ার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল।

সামান্য হেসে মাথা নাড়াল রাধিয়া। ওর এত কষ্ট হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে বুকের পাঁজরগুলো ইমপ্লোড করবে এখনই! মনে হচ্ছে কেউ ওকে জলে ডুবিয়ে দিয়েছে! এটা কী দেখল ও? এত বছর তা হলে যে বাবা ওদের সঙ্গে আছে, সেটা অভিনয়? নাকি… নাকি অন্য কোনও গল্প আছে? মানে ও যা ভাবছে, সেটা ঠিক নয়। মানে… কী মানে? রাধিয়ার হাত-পা ঘেমে উঠেছে। এটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। তাই কাউকেই বলা যাবে না। কিন্তু ওকে তো জানতে হবে ব্যাপারটা কী! না জানলে ও নিজে শান্তি পাবে না। বাবাকে যে মুখোমুখি জিজ্ঞেস করবে, সেটাও ওর দ্বারা হবে না। বাবা এমন রাগী আর এমন করে নিজের রাগটা প্রকাশ করে যে, সেটার সামনে দাঁড়ানো ওর পক্ষে কঠিন।

এমন সুন্দর একটা বিকেল এক নিমেষে কী করে নষ্ট হয়ে গেল! সত্যি কোনও দিক দিয়েই জীবনে নিশ্চয়তা নেই। গাড়িটা যখন গিয়ে সিগনালে দাঁড়াল, তখনও কি ও বুঝতে পেরেছিল সামনে, এক মুহূর্ত পরে কী আসতে চলেছে ওর জীবনে?

পলি আরও কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। বুদাও সামনের সিট থেকে পেছন ফিরে কিছু বলছিল। কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকছে না রাধিয়ার। সারা শরীরে যেন লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝি পোকা ডাকছে ওর! ব্যাপারটা কী! ওকে জানতেই হবে। কিন্তু কীভাবে জানবে?

কালীঘাট ট্রাম ডিপোর কাছে গাড়ি থেকে বুদা আর পলি নেমে গেল। অন্য সময় হলে পলি হয়তো জোর করেই রাধিয়াকে টেনে নামাত। কিন্তু আচমকা রাধিয়ার পরিবর্তন দেখে আজ আর কিছু বলল না। শুধু বুদা একবার বলল, “আমি তোকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসব?”

“আয়াম ওকে,” রাধিয়া ছোট্ট করে বলে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিল।

রাধিয়া খুবই শান্ত ধরনের। কখনও কারও সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে না। কিন্তু আজ কিছুতেই রাধিয়া নিজেকে সামলাতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে এটা কী দেখল ও!

কালীঘাট ট্রাম ডিপো থেকে আলিপুর খুব কিছু দূর নয়। কিন্তু যেহেতু অফিস ছুটি হয়েছে এখন, লোকজন গিজগিজ করছে কলকাতায়, তাই গাড়িটা গোঁত্তা খেতে-খেতে চলছে। কিন্তু রাধিয়ার কিছুই যেন মনে আসছে না।

আকাশে আলো কমে এসেছে বেশ। বাড়ি ফেরার তাড়ার মাঝে শহরের চোখে-মুখে কেমন যেন একটা মনমরা ভাব। ভিড়ে নুইয়ে যাওয়া বাস, বদমেজাজি অটোর যেখানে-সেখানে নাক গলানো আর মোটরবাইকের ছোঁকছোঁক। অন্যদিন এসব দেখে রাধিয়া, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর সামনের শহরটাকে কে যেন একটা ধূসর জলরং করে দিয়েছে!

জাজেস কোর্টের সামনে দিয়ে গাড়িটা ডান দিকে বাঁক নিল। হর্টিকালচার ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ওদের বাড়ি।

মধুদা গাড়িটাকে গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে হর্ন দিল। আর তার শব্দে কেঁপে উঠল রাধিয়া। বাড়ি চলে এসেছে। আরে গালে কী? হাত দিয়ে দেখল রাধিয়া। জল। ও কাঁদছে। কিন্তু মাথা তো পুরো খালি হয়ে ছিল। তা হলে চোখে জল এল কেন? চিরদিন মনে মনে বাবাকে একটু বেশি ভালবেসেছে বলেই কি আজ এমন একটা শূন্যতা এসে ঢুকে পড়েছে ওর মধ্যে!

গেটটা খুলে দেওয়ায় গাড়িটা ঢুকে গেল ভেতরে।

পাথর বিছানো রাস্তায় ধীরে-ধীরে গাড়িটা থামল পোর্টিকোর তলায়। মধুদা নেমে দরজা খুলে দেওয়ার আগেই ও নিজে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। অন্যদিন বাড়িতে ঢোকার আগে মধুদাকে ‘আসছি’ বলে। কিন্তু আজ সেটাও বেরিয়ে গিয়েছে মাথা থেকে।

চারটে শ্বেতপাথরের ধাপ পেরিয়ে বড় হলঘরটায় ঢুকল রাধিয়া। ওর মন খুব অস্থির হয়ে আছে। সোজা স্নান করবে ও। অন্য কোনওদিকে তাকাবে না।

বড় হলঘরের একপাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলার দিকে। রাধিয়া প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল।

“রাধিদি,” পেছন থেকে বুজু ডাকল ওকে।

রাধিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথা রীতিমতো টলছে ওর। সব কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। গাড়ির ভেতর বসে থাকা খুব ছোট করে কাটা চুলের মহিলার মুখটা বারবার মনে পড়ছে ওর। কেন মনে পড়ছে? কেন আমরা যা ভুলতে চাই তাই বারবার মনে পড়ে? কেন খারাপ লাগাগুলো বস্তায় ভরে পার করে দেওয়া বিড়ালের মতো আবার ঠিক পথ চিনে ফিরে আসে আমাদের কাছে? কেন বারবার খারাপ দৃশ্য বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনের মতো মনের মধ্যে ভেসে ওঠে? আমাদের মন, কিন্তু আমাদেরই পোষ মানতে চায় না। কেন? কষ্টের মধ্যে জীবনের কোন মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে? কী শেখাতে চায় সে আমাদের?

রাধিয়ার মনে হচ্ছে ও যেন এক অদৃশ্য জালে পেঁচিয়ে গিয়েছে। এই বাড়ি, এই বাবা-মা, এই সম্পর্ক। সব কিছুই যেন হাওয়ার তৈরি মনে হচ্ছে ওর।

“রাধিদি,” বুজু আবার ডাকল।

“ক-কী?” রাধিয়া কোনওরকমে পেছনে ঘুরল।

বুজু বলল, “দু’জন এসেছেন ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করতে। এই এলেন। ঠাকুমা তো পুজোয় বসেছে, আমি গেলে বকবে এখন। তুমি যদি একবার বলে…”

রাধিয়া সিঁড়ির ওপর থেকে বসার ঘরে দূরে বসে থাকা দু’জনের দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর।

বুজু বলল, “একজন বললেন তোমায় চেনেন। ওই দূরে বসে আছেন। নাম বললেন…”

“আমি পারব না,” রাধিয়া কথাটা ছুড়ে দিয়ে কোনওরকমে দোতলায় নিজের ঘরের কাছে গেল। পেছন থেকে বুজু কিছু বলছিল, কিন্তু সেসব কথা কেমন যেন হাওয়ায় ভেসে গেল এদিক-ওদিক।

ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে কাঠের পাল্লায় মাথা দিয়ে দাঁড়াল রাধিয়া। এবার কী করবে ও? মায়ের সামনে যাবে কেমন করে? কার কাছে গিয়ে বলবে এসব কথা! এমন অবস্থায় কি অন্য কিছু মাথায় ঢোকে! বুজুদি কি ওকে দেখে বুঝতে পারেনি ওর মনের মধ্যে কী চলছে! সেখানে কারা এসেছে সেই নিয়ে… আচমকা থমকে গেল রাধিয়া। বুজু কী বলল? দু’জন এসেছে নীচে আর তার মধ্যে একজন ওকে চেনে? আর নামটা? নামটা যেন কী বলল? রাধিয়া দুদ্দাড় করে চলে এলেও বুজুর কথার একটা খণ্ড কী করে যেন কানে ঢুকে পড়েছে ওর।

হতভম্বের মতো ঘরের অন্যদিকে রাখা বিশাল বড় আয়নায় নিজেকে দেখল রাধিয়া! এমন একটা দিনে কে এল ওদের বাড়িতে! বুজু যে নামটা বলল, সেই কি এসেছে? নিশান কি এসেছে আজ ওদের বাড়ি?

.

১৩. মাহির

কোথাও একটা ট্রান্সফরমার বার্স্ট করেছে! সারা পাড়া ডুবে আছে রোঁয়াওঠা ফুটো কম্বলের মতো অন্ধকারের তলায়।

বোচনদার দোকানে একটা ব্যাটারির লাইট জ্বলছে। সামনের ধোপা বাড়িতেও হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে! পরানদার দোকানে জ্বলছে ইমার্জেন্সি ছোট টিউব। এ ছাড়া আশপাশের বাড়ি থেকে ছিটকে আসা মোমবাতির আলোর কুচি ভেসে আছে দূরে।

আকাশে মেঘ করে আছে বেশ। জুনের আট তারিখ আজ। বর্ষা আসার কথা। কিন্তু আকাশে মেঘটুকুই করে আছে শুধু, বৃষ্টির দেখা নেই।

ক’দিন খুব ভ্যাপসা গরম পড়েছে। ওদের নিচু সিলিং-এর টালির বাড়িটা পুরো ফার্নেস হয়ে আছে যেন। ভাইয়ের এত কষ্ট হচ্ছে!

ওদের পাড়ায় বেশির ভাগই টালির বাড়ি। কিন্তু আজকাল দেখছে অনেকেই এসি লাগিয়ে নিচ্ছে। কোথা থেকে টাকা পায় এরা? এসি লাগায় কী করে? ওর তো নিজের হাতখরচ তুলতে কালঘাম ছুটে যায়!

কিটব্যাগটা এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধে নিল। আজ ম্যাচ ছিল। ড্র হয়েছে। সেকেন্ড ডিভিশনে এখন ওরা চতুর্থ হয়ে আছে। আজ ভালই খেলেছে মাহির। শুধু ম্যাচ শেষের একটু আগে ওদের ন’নম্বরটা এমন করে পা চালাল! শিন বোনের কাছে বেশ লেগেছে। কালশিটে পড়ে গিয়েছে।

মাহির শেষমুহূর্তে পা-টা সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তাতে খুব লাভ হয়নি কিছু।

ম্যাচের পরে মাঠের ধারে বসে কালশিটে পড়া জায়গাটা দেখছিল মাহির। বুট খুলে রেখেছিল পাশে। সুমিত টাকা না ধার দিলে এটা কিনতেই পারত না। দেখেছিল, পতাদা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।

মাহিরের মাথাটাই গরম হয়ে গিয়েছিল। এই এসে গিয়েছে ঢপবাজ! সারাক্ষণ বাতেলা! স্পনসর! রিক্রুট! শালা যেন নির্বাচনের আগের প্রতিশ্রুতি! আর এমন মাথার ওপর এসে দাঁড়ানোর কী হয়েছে? বুকে উঠে পড়বে নাকি?

পতাদা বলেছিল, “কী করিস? পা-টা সরাতে পারলি না? চোট খেয়ে গেলি? পরের ম্যাচে নামতে পারবি তো?”

“পরের ম্যাচ তো সামনের সপ্তাহে,” বিরক্তিটাকে লুকিয়ে কোনওমতে বলেছিল মাহির।

পতাদা মাথা নেড়ে বলেছিল, “তোদের ফিটনেস এত কম! আমাদের সময়ে আমরা যা ফিট ছিলাম না! দুটো-তিনটে ভল্ট মারা কোনও ব্যাপারই ছিল না! একবার সেই মজিদ বাসকারের পা থেকে এমন করে বল কেড়ে নিয়েছিলাম যে, মজিদ পরে বলেছিল আমায়, এমন স্ট্যান্ডার্ডের প্লেয়ার ও খুব বেশি দেখেনি!”

মাহির কী বলবে বুঝতে না পেরে পতাদার পেছনে বসা সুমিতকে দেখছিল। সুমিত মাটিতে শুয়ে পেটে হাত চেপে হাসছিল! পতাদা যে মারাদোনার নাম করেনি, এটা ওদের চোদ্দো পুরুষের ভাগ্য!

মাহিরের হাসি পাচ্ছিল না। পায়ের ব্যথা, বাড়িতে টেনশন, এসবের মাঝে এইসব আলুছালু কথা ভাল লাগছিল না ওর!

ও বলেছিল, “তোমার ক্লাবের স্পনসরের কী হল? সেই সিমেন্ট কোম্পানি আসবে না? আমরা তো জান-প্রাণ দিয়ে খেলছি। সেই বারো নম্বর থেকে চারে উঠে এলাম। প্লাস যারা ট্রায়াল দেখতে এসেছিল, তারা কই? এভাবে আর কতদিন যাবে পতাদা?”

পতাদা ভুঁড়িটাকে জামা দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলেছিল, “আরে, আসবে, হবে। এখনই অস্থির হলে চলবে? ফুটবল হল তপস্যা। সেখানে ফলের আশা করতে নেই। ধর্মকথায় পড়িসনি?”

মাহির মাথা নেড়ে উঠে পড়েছিল। একে বলে লাভ নেই। শালা, গোটা জীবনটা বেকার হয়ে গেল! এই ছাব্বিশেই মনে হয় ছেচল্লিশ হয়ে গিয়েছে ওর! সকালে ঘুম ভাঙলে মনে হয় আজ কেন ঘুম ভাঙল? মনে হয়, আজকের দিনটা ও বাঁচবে কেন?

ওদের পাড়ায় ওর বয়সি ছেলেদের দেখে মাহির! সারাক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। নানারকম স্টাইলে মাথার চুল কাটা। হাতে-পায়ে ট্যাটু। চোখে সন্ধেবেলাতেও সানগ্লাস! সারাক্ষণ হ্যা-হ্যা করে চলেছে।

ওর মাঝে মাঝে রাগ হয়। কেন ও এমন হতে পারে না? এমন হতে পারলে কী যে ভাল হত! স্যার বলতেন, “অগভীর মানুষ অমানুষের মতো!”

এটা সত্যি না মিথ্যে জানে না মাহির, শুধু এটুকু মনে হয়, সেটা হতে পারলে ও হয়তো বেঁচে যেত। নিজের গভীরতায় মানুষ অধিকাংশ সময় নিজেই ডুবে মরে!

পতাদা আরও কিছু বলেছিল। কিন্তু সেসব আর ভাল করে শোনেনি! কী হবে শুনে? পেট ভরবে?

আজ সুমিত ওকে বাইকের পেছনে বসিয়ে লিফট দিয়েছিল। ময়দান থেকে বেরিয়ে হরিশ মুখার্জি দিয়ে ফিরছিল ওরা।

নিজের কথা অন্যকে বলতে খারাপ লাগে মাহিরের। কিন্তু একটা-একটা করে দিন চলে যাচ্ছে, এদিকে কিছুই হচ্ছে না! প্রতিটা দিন যেন ইটের মতো ওকে গেঁথে ফেলছে দেওয়ালের সঙ্গে!

বাইকের পেছনে বসে ও সুমিতকে বলেছিল, “আমার কোনও কাজকর্ম হতে পারে রে?”

মাথা না ঘুরিয়েই সুমিত বলেছিল, “কী কাজ করতে চাস?”

“যা বলবি,” মাহির বলেছিল, “আমার যা হোক একটা কাজ পেলেই হবে। তোর দাদার ফ্যাক্টরিতে কিছু একটা করে দে ভাই। ঝাঁট-টাট দিতে হলেও আমার আপত্তি নেই!”

“কী সব বলছিস তুই?” সুমিত অবাক হওয়ার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়েছিল যেন!

“বাড়িতে খুব ঝামেলা রে। মানে টাকাপয়সার এমন অবস্থা! ভাইটা… ভাইটার কিডনির অসুখ ধরা পড়েছে। খালি ঘুরে-ঘুরে জ্বর আসছিল। ডাক্তার পরীক্ষা করতে দিয়েছিল নানারকম। সেখানেই ধরা পড়েছে। কিডনি কাজ করছে না। ডায়ালিসিস করাতে হবে। তারপর সম্ভব হলে কিডনি বদলাতে হবে।”

“সে কী রে!” সুমিতের গলা শুনে মাহির বুঝতে পেরেছিল যে ও সত্যি চমকে গিয়েছে!

সুমিত বলেছিল, “এসব কবে হল? বলিসনি তো!”

মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “সারাক্ষণ আর কত খারাপ কথা বলি বল তো!”

সুমিত বলেছিল, “আমি দাদাকে বলছি। আমার এত খারাপ লাগছে শুনে! অন্য কোনও কাজ পাচ্ছিস না?”

সামনে বাঁকটা ঘুরলেই বাঁ হাতে মাহিরের বাড়ি। আজকাল বাড়িতে ফিরতে কষ্ট হয় ওর। ভাইটাও এমনিতেই স্বাভাবিক নয়। তারপর এমন অসুস্থ! পা ফুলে যাচ্ছে! চোখ-মুখ ফুলে যাচ্ছে! চোখে দেখা যায় না!

মায়ের আয়ার কাজ থাকে। সংসারের মূল রোজগার সেটাই। তাই মাকে তো বেরোতেই হয়। পাশের বাড়ির তুয়াদি ভাইয়ের কাছে থাকে।

তুয়াদি সেলাইয়ের কাজ করে। বিয়ে করেনি। প্রায় পঁয়ত্রিশ হল। আর বিয়ে করবে বলে মনেও হয় না। তুয়াদির একটা পা আর-একটা পায়ের চেয়ে সামান্য ছোট। দেখতে সুন্দর হলেও ওই কারণে তুয়াদির বিয়ে হয়নি।

তুয়াদি মুখরা খুব। কিন্তু ভাইকে ভালবাসে। তাই ভাইয়ের শরীর খারাপের কথা শুনে নিজেই বলেছিল যে, মা যতক্ষণ থাকবে না, ও ভাইয়ের কাছে থাকবে!

তুয়াদির ব্যপারাটা ঠিক বোঝে না মাহির। একদিকে মাহিরকে বকাঝকা করে। এই যে ফুটবল খেলে! এই যে এখনও ভাল করে কাজকর্ম পায়নি, এটা নিয়ে তুয়াদি খুব কথা শোনায়। আবার অন্যদিকে কেমন করে যেন তাকায়। গায়ে হাত দেয়। বুকে হাত বোলায়! আচমকা নিজের ভরাট বুকটা চেপে ধরে মাহিরের শরীরের সঙ্গে!

মাহিরের রাগ হয়। কিন্তু কিছু বলে না! এসব নিয়ে বলা যায় না কিছু। আর সত্যি বলতে কী, আজকাল কাউকেই কিছু বলতেও আর ইচ্ছে করে না ওর। কারও সঙ্গে দরকারের চেয়ে একটা বেশি শব্দও খরচ করতে ইচ্ছে করে না। যে যা বলে মেনে নেয়।

এখনও তুয়াদি ভাইয়ের কাছে আছে। আজ মায়ের দুটো দশটার কাজ। আসতে দেরি হবে। তুয়াদি আবার ওকে একা পেয়ে গালাগাল দেবে সেভাবে কাজের চেষ্টা করছে না বলে। নাকি অন্য কিছু করবে, জানে না!

মাহিরের আবার সুমিতের কথাটা মনে পড়ল। কাজ কি একদম পাচ্ছে না? পাচ্ছে, কিন্তু সেটা কেমন কাজ মাহির ভাল করে জানে!

রিতুদা ওকে আজকাল প্রায়ই ডেকে পাঠায়। সব সময় না গেলেও মাঝে মাঝে তো যেতেই হয়। তখন খুচখাচ কাজ করে দিতে বলে ওকে।

এই তো কিছুদিন আগে টিটির সঙ্গে ওকে রাজারহাটের ওদিকে যেতে হয়েছিল। একটা পেমেন্ট আনার ব্যাপার ছিল।

রিতুদা নিজেই ডেকে বলেছিল টিটির সঙ্গে যেতে।

মাহিরের ভাল লাগছিল না। কিন্তু ও বোঝে, রিতুদার মতো মানুষেরা ‘না’ শব্দটা শুনতে পছন্দ করে না।

তাও মাহির অনিচ্ছার গলায় বলেছিল, “দাদা, আমার তো আজ বিকেলে প্র্যাকটিস আছে… তাই…”

“তাতে কী?” রিতুদা হেসেছিল খুব। পান-খাওয়া দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। কাঁধ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছে বলেছিল, “ওই তো বালের খেলা তোদের! তার আবার প্র্যাকটিস! এতদিন খেলে কী করলি মাহির? আমাদের দেশে ইনডিভিজুয়াল স্পোর্টস ছাড়া কেউ কোনও কিছুতে সাকসেস পাবে না। ক্রিকেট টিম গেম হলেও দ্যাখ, ইন্ডিভিজুয়াল কিন্তু আসলে। এত চুকলিবাজি! এত পলিটিক্স! সেখানে ফুটবল! নিম্নমধ্যবিত্তদের খেলা! ছাড়, আজ যাবি টিটির সঙ্গে। আমার বাকি ছেলেপুলেরা আজ নেই। তুই যাবি, টাকাটা নিবি, তারপর মোবাইলে গাড়ি বুক করে চলে আসবি। ক্লিন কাজ। লাফড়া নেই। বুঝলি?”

টিটি বসেছিল ঘরের এক কোণে। ও বলেছিল, “হ্যাঁ রিতুদা, কোনও চাপ নেই। ও যাবে। আমরা ঠিক নিয়ে আসব!”

মাহির অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হয়েছিল।

রিতুদা একটা পাঁচশো টাকার নোট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “ধর এটা। আর-একটা জিনিস।”

কথাটা শেষ না করে রিতুদা পাশের ড্রয়ার টেনে তাতে হাত ঢুকিয়েছিল। তারপর হাতটা বের করে এনে টেবিলে রেখেছিল একটা খাপ। তার থেকে পিস্তলের বাঁটটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল মাহির! ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে গিয়েছিল! এসব কী!

“অনেক টাকা… এটা রাখ, চালিয়েছিস কোনওদিন?” রিতুদা এমন করে জিজ্ঞেস করছিল যেন স্কুলপাঠ্যে এসব শেখানো হয়।

“না, না,” মাহির আঁতকে উঠেছিল, “এসব… প্লিজ় না…”

“যাঃ শালা! সতীপনা করছিস কেন? প্যান্টে মুতে দিলি নাকি যন্ত্র দেখে?”

“এর দরকার নেই রিতুদা, আমি এমনি নিয়ে আসব,” মাহির নিজেকে শান্ত করে কেটে-কেটে বলেছিল কথাগুলো।

রিতুদা তাকিয়েছিল মাহিরের দিকে। তারপর বলেছিল, “ডাইনোসর থেকে ম্যামথ থেকে সেবর টুথড টাইগার, সবাই এত শক্তিশালী হয়েও কেন বল তো পৃথিবী থেকে হাপিশ হয়ে গেল? কারণ, কেউ ওরা সময়ের সঙ্গে নিজেদের পালটাতে পারেনি। কেউ পারেনি। মানুষ এই একমাত্র একটা কারণে নিজেকে এত ভয়ংকর জন্তু আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে সারা পৃথিবীকে কবজা করেছে। নিজেকে পালটাতে শেখ মাহির। না হলে জাস্ট হাওয়া হয়ে যাবি। বুঝলি!”

কাজটাতে গিয়েছিল মাহির। কোনও অসুবিধে হয়নি। ক্যাশ গুনে হিসেব মিলিয়ে টাকা নিয়ে ফেরার গাড়ি ধরেছিল।

টিটি ওর নতুন কেনা ফোন থেকে বুক করেছিল একটা গাড়ি। শেয়ারের গাড়ি। তারপর সারাটা পথ পুটুরপুটুর করে রিতুদার গুণকীর্তন করতে-করতে এসেছে! ওঃ, এত বিরক্ত লাগছিল মাহিরের!

মাঝপথে একজন খুব সুন্দরী স্টাইলিশ দেখতে ভদ্রমহিলা উঠেছিল গাড়িতে। মাহির সংকুচিত হয়ে বসেছিল। মেয়েদের দেখলেই কেমন যেন নার্ভাস হয়ে যায় ও। আসলে রেশমি চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়েদের ব্যাপারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে মাহির!

টিটিকে চাপা গলায় সাবধান করেছিল, টিটি যাতে গালাগালি না দেয়! কিন্তু টিটি কি আর ওর কথা শোনার ছেলে! এমন সব কথা বলছিল যে, কান লাল হয়ে গিয়েছিল মাহিরের। তবে কাজ সেরে ফেরার পর রিতুদা আরও পাঁচশো হাতে দিয়েছিল ওর। এবার আর আপত্তি করেনি মাহির। বুঝতে পারছিল, আপত্তি করে লাভ নেই।

দরজায় টোকা দেওয়ার একটু পরে তুয়াদি এসে খুলে দিল দরজাটা। লোডশেডিং-এর জন্য ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছে। ভাই পাশের খাটে চুপ করে শুয়ে আছে। দেওয়ালের দিকে মুখ। ঘুমোচ্ছে বোধহয়। পাশে রাখা হাতপাখা দেখে মাহির বুঝল তুয়াদি ভাইকে হাওয়া করছিল।

ওদের দুটো ঘর। এই ঘরটা বড়। পাশের ছোট ঘরে মাহির থাকে। সেখানে একটা চৌকি আছে। আর একটা আলনা। চৌকিটা একটু উঁচু। তার তলায় লোহার ট্রাঙ্কে মাহিরের জিনিসপত্র থাকে। বারবার ট্রাঙ্ক খুলে জিনিস বের করতে হয়। খুব অসুবিধে হয় মাহিরের। কিন্তু উপায় নেই।

বড় ঘরে ঢুকে একপাশে চটিটা খুলে রাখল। তারপর কিটব্যাগটা টিনের ভাঁজ করা চেয়ারের মাথায় ব্যালেন্স করে বসিয়ে তুয়াদিকে জিজ্ঞেস করল, “কারেন্ট কখন গেল তুয়াদি?”

তুয়াদি সেটার উত্তর না দিয়ে বলল, “তোর মোবাইল খারাপ?”

“কেন?” অবাক হল মাহির।

“আরে, ওই টিটিটা এসেছিল। তোকে নাকি মোবাইলে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না!” তুয়াদির গলায় হালকা বিরক্তি।

আসলে তুয়াদি টিটিকে পছন্দ করে না। কারণ, টিটি একবার মদ খেয়ে এসে তুয়াদিকে প্রপোজ় করে বসেছিল!

তুয়াদি এত রেগে গিয়েছিল যে, পায়ের চটি খুলে ছুড়ে মেরেছিল টিটিকে।

টিটির তাতে অবশ্য হেলদোল খুব কিছু হয়নি! টিটির নেশা কেটে যাওয়ার পরে মাহির খুব বকেছিল টিটিকে। বলেছিল, “এটা কী করেছিস তুই? এমন অসভ্যতা কেউ করে? কত বড় বল তো তোর চেয়ে?”

টিটি হেসে বলেছিল, “আরে, খচে যাচ্ছিস কেন? বড় তো কী হয়েছে! আজকাল ম্যাক্সিমাম ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বড়ই হয়! এতে তো অসুবিধে নেই। প্লাস ভাবলাম, বিয়ে-টিয়ে করেনি। বয়স বয়ে যাচ্ছে। ওসবের ইচ্ছে-ফিচ্ছে তো সবারই হয়। ওরও নিশ্চয় হয়। তাই আমি… মানে এটা সোশ্যাল ওয়ার্ক বলতে পারিস! আমার থোবড়টা আমির খানের মতো না হলেও ফিলিংস-এ আমি কিন্তু দিলীপ কুমার! তাই ওর কষ্টের কথা ভেবে…”

মাহির জানে টিটির সঙ্গে কথা বলা বৃথা!

“কী রে, কী বলছি?” তুয়াদি এসে ধাক্কা দিল।

“না গো, আসলে,” মাহির ঢোঁক গিলল, “আমার মোবাইলটা গেছে। এতদিন গার্টার বেঁধে কাজ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ আর কিছুতেই কাজ করছে না!”

“অপদার্থ একটা!” তুয়াদি দাঁতে দাঁত ঘষল।

মাহির মনে মনে বলল, নাও, শুরু হল আজকে! তুয়াদির ক্রিটিকাল অ্যাপ্রিশিয়েশান চালু!

তুয়াদি বলল, “এমন গাবুরের মতো চেহারা, কিন্তু একটা অপদার্থ! এখন তোর রেশমি কোথায়? যার জন্য সব ছেড়ে ক্যালানে হলি সে কোথায়! আমাদের বস্তিতে কেউ তোর মতো লেখাপড়ায় ছিল? ছিল না… শালা, একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে… আমি তোকে নিয়ে যে কী করব!”

“তুয়াদি, ভাই ঘুমোচ্ছে!” মাহির আর কীভাবে তুয়াদিকে চুপ করাবে ভেবে পেল না।

তুয়াদি অনেক কষ্টে নিজেকে আটকাল। আঁচল দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে আচমকা এগিয়ে এসে প্যান্টের চেনের কাছটা খপ করে চেপে ধরে বলল, “তোর চেহারাটা এমন, কিন্তু ভেতরটা এমন ম্যাদামারা কেন? তোর সব যন্ত্রপাতি ঠিক আছে তো?”

এসব কী বলছে তুয়াদি! মাহির চমকে উঠে পিছিয়ে এল। দেখল, তুয়াদি কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে ওর দিকে!

তুয়াদি চোয়াল শক্ত করে বলল, “একদিন দেখব তোর সব ঠিক আছে কি না। কতদিন পালিয়ে থাকবি! এখন আর না বসে ওই রিতুদার অফিসে যা একবার। ডেকেছে। টিটি সেই কথাটাই বলতে এসেছিল।”

মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না! এটা কী বলল তুয়াদি! কী করল! দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে সব মানুষজন!

তুয়াদি বলল, “কী হল যা। দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? যা।”

মাহির আর কথা বাড়াল না। আবার বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। খিদে পেয়েছে ওর। আগে খেলার শেষে ওদের ক্লাব থেকে খাওয়াত। এখন সেটাও কয়েকটা ম্যাচ হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুমিত বলেছিল রোল খাওয়ার কথা। কিন্তু বারণ করেছিল মাহির। এর আগেও দু’দিন রোল আর মোমো খাইয়েছে সুমিত। রোজ-রোজ একজনের কাছ থেকে খাওয়া যায় নাকি?

কিন্তু এখন পেটের ভেতর বেজি ঘুরছে মনে হচ্ছে। কেমন একটা চাপ লাগছে। কিন্তু পকেটে পড়ে আছে আঠারো টাকা। দু’টাকার মুড়ি আর একটু বাদাম খাওয়া যেতে পারে। মা এখনও মাইনে পায়নি এই মাসের।

মাহিরের মাঝে মাঝে মনে হয় বোমার মতো ও যদি ফেটে পড়তে পারত! শরীরে এত বারুদ জমে আছে! এত যন্ত্রণা ঠেসে ভরা আছে! তাই মনে হয় মাথাসমেত গোটা শরীরটা ফেটে পড়লে বেঁচে যেত ও। মনে হয় তা হলে হয়তো এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত।

আগে ভগবানে বিশ্বাস ছিল না মাহিরের। মনে হত ওসব দুর্বল মানুষের লাঠি! ভণ্ডদের ব্যাবসা করার হাতিয়ার! কিন্তু আজকাল কেবলই মনে হয় কেউ একটা তো আছে! না, সে ছেলে না মেয়ে সেটা জানে না, কিন্তু আছে তো কেউ!

যেদিন ভাইয়ের রোগটা ধরা পড়ল, সেদিন রাতে নিজের ওই খুপরিমতো ঘরের জানলার পাশে শুয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল মাহির। ছোট টালির একতলা বাড়ি পাশাপাশি গাদাগাদি করে আছে। তাই জানলা থেকে এখনও আকাশ দেখা যায়।

সেই ধোঁয়াটে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল মাহির। সামান্য কিছু জেদি তারা ওই ধুলোর চাদর ভেদ করেও যে-সামান্য আলো পাঠাচ্ছিল, সেই আলোর দিকে তাকিয়ে মাহিরের মনে হয়েছিল, ভগবান নিশ্চয়ই আছে! এই ছাব্বিশ বছরের জীবনেই এমন নানা কষ্ট, যন্ত্রণা আর কঠিন সময় কখনও এমনি-এমনি হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা আছে। কথাটা ভেবে ওই অন্ধকারে, ওই বিপদের সময়ও হাসি পেয়েছিল মাহিরের। মনে হয়েছিল, মানুষ কিছু পেয়ে বা কোনও বিপদ থেকে বেরিয়ে এসে ভগবানের উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে, কিন্তু ওর জীবনে অসাফল্য, কষ্ট আর খারাপ হওয়ার পর ওর ঈশ্বরবিশ্বাস এল!

এখনও রাস্তায় বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল মাহির। লালচে হয়ে আছে আকাশ। তাই আগের চেয়ে অন্ধকার কিছুটা হলেও কেটেছে। ওদের অঞ্চলের লাগোয়া একটা বিহারি বস্তি আছে। এই আধো-অন্ধকারে কয়েকটা বাচ্চা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এলোমেলোভাবে। দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ি ঘিরে ওরই বয়সি কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিরক্তি লাগল মাহিরের। সবাই জানে ওই ছেলেগুলো মদ আর গাঁজা খায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু কারও কোনও হুঁশ নেই। প্লাস্টিকের বোতলে জলের সঙ্গে মিশিয়ে রাখা মদ সকলের সামনেই খায়। হল্লা করে। কেউ কিছু বলে না ওদের। আসলে কে কী বলবে, এই ছেলেগুলোর মাথার ওপর রিতুদার হাত আছে!

ওর বাড়ি থেকে রিতুদার অফিস খুব কিছু দূর নয়। মাহির ধীরেসুস্থে হাঁটতে লাগল। খিদেটা চাগাড় দিচ্ছে ভালই। শরীরটাও বুজে আসছে ক্লান্তিতে! এখন কার ভাল লাগে এইসব লোকের সামনে যেতে! মা-ও জানলে রাগ করবে। মা কিছুতেই ওকে রিতুদার কাছে যেতে দেয় না। বলে, “একবেলা না খেয়ে থাকব, কিন্তু তুই যাবি না!” কিন্তু একবেলা না খেয়ে থাকা এক জিনিস, আর ভাইয়ের চিকিৎসা আর-এক জিনিস। টাকা খুব দরকার এখন ওদের।

মাহির আকাশের দিকে তাকাল। সেই জন কি সত্যি বসে, দাঁড়িয়ে বা শুয়ে আছে আকাশের ওপারে? ওকে কি দেখতে পাচ্ছে? কেন শুধু ওকে বাঁশ দিয়ে আনন্দ পায় মানুষটি? ওর জীবনে ভাল কিছু কি হতে পারে না? এমন কিছু কি ঘটতে পারে না, যার ফলে ওর মনে হবে সামান্য হলেও ওরও বেঁচে থাকার একটা মানে আছে? একটা কারণ আছে?

অফিসের বাইরে একটু দূরে টিটি দাঁড়িয়েছিল। আবছায়া হলেও মাহিরের চিনতে ভুল হল না। ওরকম ঝাঁকড়া চুল আর পাঁকাটির মতো শরীর কলকাতায় আর কারও আছে কি না সন্দেহ!

টিটিও দেখেছে ওকে, “ওই মাহির!” হাত তুলে ওর কাছে প্রায় দৌড়ে এল ছেলেটা। তারপর ওর হাত ধরে বলল, “শালা, তুই কী করছিস? তোকে ফোন করলে পাওয়া যায় না কেন?”

“জানিস না, খেলা ছিল আজ আমার?”

মাহির দেখল টিটির হাতে একটা রোল। সবে দু’-এক কামড় খেয়েছে।

টিটি বলল, “তোর ওই বেকার খেলা! আর খেলছিস তুই, তো ফোনটা অফ করে রেখেছিস কেন?”

মাহির সময় নিল একটু তারপর টিটির হাত থেকে রোলটা নিয়ে নিল আচমকা। কামড় মেরে বলল, “ফোনটা ভোগের বাসি হয়েছে! পরানদাকে দেখাব একবার।”

টিটি প্যান্টে হাত মুছে বলল, “শালা, হবে না? সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার ফোন! একটা নতুন মোবাইল কিনে ফেল আমার মতো।”

“বোকার মতো কথা বলিস না!” মুখভরতি খাবার নিয়ে কোনওমতে বলল মাহির।

টিটি হাসল, “তোর খিদে পেয়েছে?”

মাহির রোলটা শেষ করে বলল, “আচ্ছা, মানুষ অন্য জিনিস এতগুলো করে খায়, কিন্তু কোল্ড ড্রিঙ্ক এক বোতল আর রোল একটা খায় কেন?”

“সে আমি কী জানি!” টিটি বলল, “তোকে ফোন করতে-করতে দিমাগ ঘেঁটে গিয়েছে আমার! ওদিকে নকুর শালা এক লোচা হয়েছে।”

নকু! মাহিরের সামান্য সময় লাগল ব্যাপারটা মনে করতে। ও, সেই ছেলেটা। বাইকে করে ওকে একদিন নিয়ে এসেছিল। সামনের চুলটা ব্রোঞ্জ রঙে রাঙানো!

“কী হল আবার?”

টিটি বলল, “আরে, নকুর এক আধপাগলা দাদা আছে। বই বিক্রি করে। তাকে আজ পুলিশে ধরেছে। লেক মার্কেটে বই নিয়ে ঘুরছিল। কে একটা লোক নাকি বই কিনে কম পয়সা দিয়েছে। তাকে কলার ধরে মেরেছে পাগলাটা! কাছেই পুলিশ ছিল, মালটাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছে। জানিস, লেখাপড়া করা মানুষ, কিন্তু মাথাটা মায়ের ভোগে পুরো! এইমাত্র ফোন করল নকু। রিতুদাকে বলতে হবে।”

মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না!

“যাক‌ গে,” টিটি বলল, “চল। রিতুদা একটা কাজ দেবে তোকে। একজন এসেছে।”

ওই রোলটা খেয়ে খিদেটা যেন আরও চাগাড় দিয়ে উঠল। খিদে পেলে মাহিরের কষ্ট হয় খুব। ওর মনে হল আশপাশের গাছপালাগুলোকে ধরে ধরে খেয়ে নেয়! কিন্তু তারপরেই মনে হল, ভাই কি কিছু খেয়েছে! ওর তো খাবারের এখন খুব কড়াকড়ি। সব কিছু তো খেতে পারে না। মা রান্না করে রেখে যায়, কিন্তু তুয়াদি কি দিয়েছে খাবার?

“আর দাঁড়াস না, চল…” টিটি মাহিরকে ঠেলল।

আশপাশের অন্ধকারের মধ্যে রিতুদার অফিসটা যেন বিয়েবাড়ির প্যান্ডেল! দুটো ইনভার্টার আছে অফিসে। বেশ বড়। এসিও চলে। তবে এসিটা আছে রিতুদার ঘরে।

সত্যি বলতে কী, এইসব দেখে তাক লেগে যায় মাহিরের। ক্লাস নাইন পাশ রিতুদা। আগে ট্যাক্সি চালাত। সেখান থেকে কী করে যে আজ এই জায়গায় এল কে জানে! চারিদিকে এত মানুষের এত সাফল্য দেখে খুব অবাক হয় মাহির। কী করে লোকজন টাকা রোজগার করে ও জানে না। কোন পথে হাঁটলে বাধ্য ছেলের মতো টাকাপয়সা ঢোকে পকেটে?

অফিসের ভেতরে ঢুকল মাহির। আজও কয়েকজন বসে আছে। তবে বাইরে গুমোট বলে, আজ ভেতরে ফ্যানের তলায় বসে রয়েছে লোকজন।

মাহিরের বড়সড় চেহারাটা সবাই চেনে। সবাই জানে রিতুদা বিশেষ পছন্দ করে মাহিরকে। লোকজন একটু খাতিরের চোখে তাকাল মাহিরের দিকে। মাহির পাত্তা দিল না। এগুলোকে দেখলে গা জ্বলে! কাজের কাজ কিছু নেই শুধু বসে বসে বিনে পয়সায় চা-মুড়ি খাওয়ার ধান্দা! ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের মাতব্বর ভাবা!

মাহির রিতুদার চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল।

“আয়,” রিতুদার গলা পেল মাহির।

দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল ও। আর সঙ্গে-সঙ্গে শরীর জুড়িয়ে গেল যেন। চেম্বারের ভেতরটা কী ঠান্ডা! নিজের অজান্তেই চোখ যেন বুজে এল মাহিরের। কিন্তু তারপর চোখ খুলেই কেমন একটা ধাক্কা লাগল! আরে বাবা, সামনে কে বসে রয়েছে! সেই মেয়েটা!

মাহিরের গলা শুকিয়ে গেল নিমেষে। মেয়েটা ওকে মাথা ঘু্রিয়ে দেখল। মেয়েটাকে দেখেছিল বেশ কিছুদিন আগে গড়িয়াহাটার কাছে। টিটির অটোয় বসে ছিল ও। আর মেয়েটা আরও কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়! মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়েছিল। মাহিরের মনে হয়েছিল মেয়েটা চিনতে পেরেছে নিশ্চয়ই। তাই দোনোমোনো করে, সামান্য হেসেছিল মাহির। আর অবাক হয়ে দেখেছিল মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এত অপমান লেগেছিল ওর! মনে হচ্ছিল চলন্ত অটো থেকে লাফ মেরে মাটির তলায় ঢুকে যায়!

মনের ভেতরে বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল যেন! নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছিল। পাশে বসা টিটিকে নিচু স্বরে বলেছিল কথাটা, “শালা, আমায় চিনল না!”

টিটি হলদে দাঁত বের করে বলেছিল, “কেন চিনবে? শালা, কুম্ভকর্ণের নাতির মতো বিলা জিয়োগ্রাফি! বার্নিশ করা মেয়েদের দিকে হিড়িক দিতে গিয়েছে! আবার অভিমান হচ্ছে! শোন, আমাদের মতো মালেদের কাছে অভিমান মানে অমিতাভ-জয়ার সিনেমা। বুঝেছিস?”

“তুই থাকিস কোথায়?” রিতুদার গলায় বিরক্তি টের পেল মাহির।

মাহির বলল, “খেলা ছিল রিতুদা।”

“তো, ফোনটা অফ রেখেছিলি কেন?”

এবার মাহির কিছু বলার আগেই টিটি বলল, “ওর মোবাইলটা ভোগের বাসি হয়েছে রিতুদা।”

সামনে একটি মেয়ে বসে রয়েছে। টিটির এমন ভাষায় রিতুদা বিরক্ত হল, “তুই এসেছিস কেন ভেতরে? বাইরে যা। ডেকেছি মাহিরকে, তুই এসে কী করছিস?”

টিটি থতমত খেল, “না মানে… রিতুদা ওই ইয়ে… নকুর দাদার ওই…”

রিতুদা চোয়াল শক্ত করে তাকাল টিটির দিকে, “বাইরে পানু আছে, ওকে বল। সব আমি করব? বেরো এখন ঘর থেকে।”

টিটি আর সময় নষ্ট না করে হেসে বেরিয়ে গেল। মাহির অবাক হল। ভাবল, এটাই হল স্ট্রেংথ! সবার সামনে খিস্তি খেয়েও পাবলিক ধন্য হয়ে যাচ্ছে!

রিতুদা সময় নষ্ট না করে মাহিরকে বলল, “শোন, ইনি হচ্ছেন পলি দে। নানা সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে আছেন। তার মধ্যে একটা হল, ওল্ড এজ হোম। কালীঘাট ট্রাম ডিপোর কাছে ওঁদের হোম। কিছু ফিনানশিয়াল এড লাগবে ওঁদের। আমার তো যাওয়ার সময় নেই। তাই তুই যাবি ওঁদের ওখানে। সব দেখে আসবি।”

“আমি?” মাহির ঘাবড়ে গেল।

“পারবি না? শুনেছি তুই টুয়েলভ অবধি পড়েছিস। ইংরেজিতে ভাল ছিলি। আমার কাছে যেগুলো আছে সব টিটিএমপি!”

“মানে?” মাহির অবাক হল। দেখল, পলিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

“মানে টেনে-টুনে মাধ্যমিক পাশ। তাই তুই যাবি। বুঝলি?”

মাহির মাথা নাড়ল।

“ওর সঙ্গে কথা বলে নে কবে যাবি। গিয়ে সব দেখে এসে আমায় রিপোর্ট করবি। ভরসা করছি মাহির, ডোবাবি না!” শেষের কথাগুলো সামান্য শক্ত গলায় বলল রিতুদা।

মাহির পলির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বলুন কবে…”

“এখানে নয়, বাইরে গিয়ে কথা বলবি,” রিতুদা মাহিরকে এককথায় চুপ করিয়ে দিয়ে তাকাল পলির দিকে, “আপনি কাইন্ডলি একটু বাইরে গিয়ে বসবেন প্লিজ়? ওর সঙ্গে একটু কথা আছে আমার। সেরে নিয়ে ও বাইরে আপনার সঙ্গে কথা বলবে।”

“শিয়োর,” পলি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলে রাখা নিজের ফাইলটা গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। শুধু যাওয়ার আগে সামান্য হাসল মাহিরের দিকে তাকিয়ে।

মাহির মাথা নামিয়ে নিল। সেই বিকেল। ভিড়ে ঝুঁকে যাওয়া গড়িয়াহাট আর একটা মেয়ের গম্ভীরভাবে মাথা নামিয়ে নেওয়া আবার মনে পড়ে গেল ওর।

মাহিরের মাথা নামিয়ে নেওয়ায় পলির ভুরুটা সামান্য কুঁচকে গেল।

পলি বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরটাকে অসম্ভব রকম নিস্তব্ধ মনে হল মাহিরের। শুধু এসির গুঞ্জন। ও দেখল রিতুদা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একদৃষ্টে।

মাহির কী করবে বুঝতে পারল না।

রিতুদা বলল, “তোর ভাইয়ের ডায়ালিসিস দরকার? কিডনি গেছে?”

মাহির মাথা নাড়ল শুধু।

রিতুদা মাথায় হাত বোলাল। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, “আমার একটা ভাই ছিল, জানিস। কথা বলতে পারত না। খুব ভালবাসত আমায়। আমি তেমন কিছু করতাম না তখন। বাবা তো অসুস্থ ছিল। মা লোকের বাড়িতে রান্না করত। ভাইয়ের টাইফয়েড হয়েছিল। সেটার ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারিনি। এগারো দিনের মাথায় ভাইটা চলে গিয়েছিল। আজ আমার কী নেই বল! নেই, ভাইটা নেই আমার! তোর টাকার দরকার মাহির। আমার কাজের দরকার। যেসব ছেলে আমার আছে তাদের দিয়ে সবকিছু হবে না। প্লাস মনা পান্ডের কাছেও কেউ-কেউ যায়। তুই প্লেয়ার। প্লেয়াররা দু’মুখো হয় না বলে আমার বিশ্বাস। একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তোর আছে। তুই কাজ কর আমার কাছে। মারামারি করতে বলছি না। মাসে-মাসে টাকা পাবি। ভাইয়ের চিকিৎসা যাতে কম টাকায় হয় আমি দেখব। কী বলিস?”

মাহির তাকাল রিতুদার দিকে। ভাবল বলবে কি না। তারপর মনস্থির করে সব সংকোচ ঝেড়ে বলল, “আসলে মা রাগ করে। পার্টির কাজে রিস্ক। তাই… একটা প্লেয়ার কোটায় চাকরি পেলে সুবিধে হয়। বা যদি ফার্স্ট ডিভিশনে একটা চান্স…”

“ভাইটাকে হারাতে চাস? সোনাঝুরিতে হাউজ়িং-এর প্রসপেক্ট খুব ভাল। অত জায়গা! সঙ্গে আমাদের পার্টিরও ইন্টারেস্ট আছে। ওখানে তারক চক্রবর্তী বলে আমাদের একজন আছে। কিন্তু খুব ঘোড়েল জিনিস। আমায় বলা হয়েছে ওর ওপর নজর রাখতে। আমি যাব মাঝে মাঝে, কিন্তু আমি চাই তুই ব্যাপারটায় থাক। এটা আমার লাস্ট অফার। জোর করছি না। লজিকাল হতে বলছি। আর কিন্তু আমি ডাকব না। আবার ভরসা করছি তোর ওপর।”

“আমার ওপর?” মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না।

আগে খিদের জন্য পেটটা কেমন করছিল, এখন টেনশনে করছে। ও কী করবে? কোথায় জড়িয়ে পড়ছে? টেনশন কি খিদের মতোই কিছু!

রিতুদা বলল, “দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এর চেয়ে বড় প্রজেক্ট নেই। অনেক টাকার ব্যাপার। ওখানে একটা বাড়ি আছে। বিশাল বড়। জুটমিল, বড় জায়গা, প্লাস ওই বাড়ি। নানা কোম্পানি যাচ্ছে। চড়চড় করে দাম বাড়ছে। তারকের পোয়াবারো। তাই আমায় ওটা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বুঝতে পারছিস? এই নে।”

মাহির দেখল রিতুদা টেবিলে ওর সামনে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট রাখল।

“কী হল, নে!”

স্যার বলতেন, “সততার চেয়ে বড় কিছু হয় না মাহির। আর সততা আসে মনের শুদ্ধ ইচ্ছে থেকে। মন যাতে সায় দেয় না সেটা না করাই ভাল। আমাদের অজ্ঞাত মন, জ্ঞাত মনের চেয়ে শক্তিশালী! তাই তার ইশারা মানতে হয়। জানবি, কোনও কিছুর জন্য সততা বিসর্জন দেওয়া যায় না!”

স্যার মারা গিয়েছেন। কিন্তু আসলে স্যার এখনও বেঁচে আছেন মাহিরের মনের মধ্যে। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মুখ বাড়ান। কিন্তু স্যার, আপনি কি দেখতে পান আমার ঘরটা? আমার মাকে? স্যার, আপনি কি জানেন আমার ভাইয়ের কী হয়েছে? কত টাকা লাগবে ভাইকে বাঁচাতে? ওই স্টার, লেটার এসব পাওয়া আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার! ইংরেজিতে ওই নাম্বারটা পাওয়াও ঠিক হয়নি একদম। যারা এসব পায়নি, যারা নিজেদের বিজ্ঞাপন করতে পারে, হ্যাংলার মতো নিজেদের ঢাক পেটাতে দ্বিধা করে না, যারা পয়সা আর ক্ষমতা ছাড়া কিছু বোঝে না, তাদের মতো হতে পারলে খুব ভাল হত স্যার! আমার মাকে এই রাত অবধি আয়ার কাজ করতে হত না। আমার ভাইকে বাঁচাতে পারব কি না এই নিয়ে এত ভাবতে হত না। বন্ধুত্বের আড়ে অন্যের এঁটো খাবার খেয়ে খিদে মেটাতে হত না!

স্যার, আমাদের মতো যাদের কেউ ভালবাসেনি, যাদের মনে এত-এত সেন্টিমেন্ট, এত লজ্জা, যারা অভিমান করে আর কিছু করলই না জীবনে, তাদের ইংরেজিতে একাশি পাওয়া ঠিক নয়। তাদের আপনার মতো স্যার পাওয়াও মস্ত বড় ভুল। আপনি আমার মনের মধ্যে বসে এবার থেকে যতই চিৎকার করুন স্যার, আমি আপনার কথা আর শুনছি না। কিছুতেই আর আপনার কথায় কান দিচ্ছি না।

রিতুদার দিকে তাকাল মাহির। মোটা মানুষটা হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। সামনে, এসি থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে নতুন পাঁচশো টাকার কয়েকটা নোট!

মাহিরের মনে পড়ল নিজের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা সেই আকাশটাকে। ধুলোটে আকাশ। জেদি কিছু তারা মুখ বাড়িয়ে রেখেছে! জীবনও কি এমন? জেদি মানুষরাই কি তবে এই আবছা পৃথিবীর ধূলি-মলিন চাদর ছিঁড়ে মুখ দেখাতে পারে? আর ওই অনেক ওপরের সেই অলক্ষ্যে বসে থাকা মানুষ, সে কি দেখছে মাহিরকে? ফড়িঙের মতো সে-ই কি ফড়ফড় করে উড়ছে সামনে?

মাহির চোয়াল শক্ত করল। তারপর হাত বাড়াল এক জীবন থেকে অন্য একটা জীবনের দিকে।

.

১৪. পেখম

শ্রীকৃষ্ণ বস্ত্রালয় থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল পেখম। বিকেল শেষ হচ্ছে সোনাঝুরিতে। এই রাস্তা ধরে সামনে গেলে গঙ্গার ঘাট। সেখানে নৌকো লেগেছে নিশ্চয়। পিলপিল করে মানুষ আসছে।

অধিকাংশই নিম্নবিত্ত মানুষ। রুজির জন্য গঙ্গার ওই পারে যায়। ওই পারে ইটখোলা আছে কিছু। একটা কটন মিলও আছে।

পেখম একটু সরে দাঁড়াল। রিকশা যাচ্ছে। সাইকেলও। ঘাটের পাশে সাইকেল রাখার একটা বড় জায়গা রয়েছে। ও জানে আর-একটু পরেই আবার সব ফাঁকা হয়ে যাবে।

ও আকাশের দিকে তাকাল। ওই ওপরে একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। ঠাকুরদা বলেন একটা তারা দেখে ঘরে ঢুকতে নেই। অমঙ্গল হয়।

পেখম এদিক-ওদিক তাকাল, আর-একটা তারা যদি চোখে পড়ে! কিন্তু না, আর কিছু ফোটেনি এখনও। একটা মাত্র তারা মিতুকাকিমার নাকছাবির মতো জ্বলজ্বল করছে আকাশে!

পশ্চিমে মেঘ ঘনাচ্ছে! বৃষ্টি হবে কি? এই শীতের শেষটায় মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। মা বলে এতে নাকি পুণ্য হয় খুব!

কীসের যে ভাল, কীসের যে পুণ্য, পেখম বুঝতে পারে না। আশপাশে আর কী ভাল হতে পারে। ওর তো সারাক্ষণ মনমেজাজ খারাপ হয়ে থাকে আজকাল। সারাক্ষণ মনে হয় বুকের ভেতর কে যেন পাথর বেঁধে রেখেছে। শরীরে যেন ঝিঁঝি পোকা ডাকে। একটা এমন বড় জঙ্গল যে শরীরের ভেতর ঘাপটি মেরে ছিল, সেটা এতদিন বুঝতেই পারেনি। পড়ায় মন বসে না। রাতে ঘুম হয় না ভাল। ভাল করে খেতে ইচ্ছে করে না। সাজতে ইচ্ছে করে না। বাড়িতেও আজকাল কারও সঙ্গে কথাই বলে না পেখম। ইচ্ছেই করে না।

টেটু এসে মাঝে মাঝে জ্বালায়। কেন চুপ করে আছে, সেই নিয়ে খোঁচায়। কিন্তু সামান্য হেসে দু’-একটা কথা বলে টেটুকে কাটিয়ে দেয় পেখম। এই কুড়ি বছর বয়সেই মনে হয় অনেকটা ক্লান্তি এসে গিলে নিয়েছে ওকে!

মা যে কাজুকে সরাসরি রাস্তায় ধরে ডেকে ওকে পড়াতে আসতে বারণ করে দেবে, সেটা ভাবতে পারেনি পেখম!

“কী রে, বললাম দোকানের ভেতরে দাঁড়াতে! না শুনে বাইরে এসে কী করছিস?”

নয়নার কথায় ওর দিকে ফিরল পেখম। আজ একটা পঞ্চো পরে আছে নয়না। শাড়ির ওপর ক্রুশের কাজ করা পঞ্চো। সুন্দর দেখতে। পুরী থেকে কিনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু শুধু নিজের জন্য নয়, পেখমের জন্যও এমন একটা কিনে এনেছে!

পেখম নিতে চায়নি। ও কিছু দিতে পারে না নয়নাকে। কখনও কিছু দিতে পারে না। সেখানে কী করে ওর কাছ থেকে এটা-ওটা নেবে ও?

কিন্তু নয়না শোনেনি কথা। আসলে নয়না কারও কথাই শোনে না। এত জেদি একটা মেয়ে যে, বলার নয়!

নয়না বলেছিল, “তুই নিবি না তো? ঠিক আছে আমারটাও তা হলে জ্বালিয়ে দেব। তোরটা আমারটা একসঙ্গে জ্বালিয়ে দেব। খুব দেমাক হয়েছে তোর, না? সব ঘুচিয়ে দেব একবারে!”

পেখম নয়নার সঙ্গে জেদ করে পেরে ওঠে না। আসলে কারও সঙ্গেই ও ঠিক জেদাজেদি করে পেরে ওঠে না। পারলে কি আর মা এমন করে কাজুকে আসতে বারণ করে দিতে পারত!

তাই নিয়েছিল পঞ্চো। কিন্তু আজকাল কিছুই যেমন ভাল লাগে না, কিছুতেই যেমন মন নেই, তেমন ওই পোশাকটাও পড়েই রয়েছে বাড়িতে।

“কী হল তোর? এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কেউ মরে গিয়েছে নাকি?” নয়না ঠেলল ওকে।

পেখমের মনে হল বলে, হ্যাঁ, মরে গিয়েছে! পেখম মরে গিয়েছে!

নয়না আবার বলল, “কাজুদাকে কাকিমা বাড়িতে আসতে বারণ করেছে, তো কী হয়েছে? আচ্ছা, সব কিছুতে মেলোড্রামা না করলে তোর হয় না, না? আমি দেখেছি, যারাই প্রেম করে তাদেরই নানারকম ঝামেলা থাকে। আর ফ্র্যাঙ্কলি, কাকিমা ঠিকই করেছেন।”

“কী বললি?” পেখম ঘুরে তাকাল নয়নার দিকে। এটা কী বলল নয়না?

নয়না বলল, “ঠিক বলেছি। কাজুদা কে এমন যে, এভাবে হেদিয়ে মরছিস? কলেজে পড়িস, ওই বাংলা পড়ানোর জন্য কাজুদার দরকার হয় নাকি? কাকিমা ঠিক করেছেন। আর ভেবে দেখ, কোথায় তোরা আর কোথায় কাজুদা! কাজুদাদের ফ্যামিলি দেখেছিস? ওদের জোনাক-বাড়িতে গিয়ে দেখেছিস? কী চাস তুই এই সম্পর্ক থেকে? প্রেম প্রেম করে মাথা খারাপ করিস? আর কিছু নেই জীবনে? এমন করছিস যেন কী না কী হয়ে গিয়েছে!”

পেখম মাথা নিচু করে নিল। নয়নার গলায় অবিকল মায়ের গলাটা শুনতে পেল ও! সেদিন মা ঠিক এমন করেই বলেছিল।

পেখম ঘরে বসে হারিকেনের আলোয় পড়ছিল সন্ধেবেলা। মা ঘরে ঢুকে পাশে মুড়ির বাটি রেখে দিয়ে বলেছিল, “খেয়ে নে। আর, একটা কথা। কাজুকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছি। মাসে পনেরো টাকা করে আর দিতে পারব না।”

“মানে?” পেখম প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি, “কী বলছ মা?”

মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছে বলেছিল, “বলছি, ওই কলির কেষ্টটিকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছি। কী করবে ও এসে? বেকার টাকার শ্রাদ্ধ! আর এই নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে দরবার করবি না। আমি বাবাকেও বলে দিয়েছি, উনি যেন এ ব্যাপারে আর কোনও কথা না বলেন।”

পেখমের গা-হাত-পা কাঁপছিল। এটা কী করেছে মা? এটা কেন করেছে? কাজুর টাকার দরকার। আর সেখানে ওর মা কাজুকে আসতে বারণ করে দিয়েছে!

মা বলেছিল, “প্রেম করা বের করছি তোর! ওই মাকাল ফল একটা! চাকরি-বাকরির নাম নেই! পার্টি করে। আমাদের কুল গোত্রের কেউ নয়। সেখানে প্রেম! পেখম, তোকে বলে দিচ্ছি, আর যদি ওর সঙ্গে দেখা করিস, তবে দেখিস কী হয়!”

পেখম কিছু বলতেই পারছিল না। মাথা নিচু করে বসেছিল ওই হলুদ আলোর বলয়ের পাশে। চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। পেখম ঝগড়া করতে পারে না। চিৎকার করতে পারে না। কাজু বলে, পেখম এক্সপ্লোড করে না, ইমপ্লোড করে!

এখানেও তাই হচ্ছিল। ভেতরে-ভেতরে যেন ভেঙে পড়ছিল ও। তুবড়ে যাচ্ছিল। আর মাইলের পর মাইল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল জনপদ! বুকের ভেতর জ্বালা করছিল পেখমের। কয়েক হাজার মোম যেন একসঙ্গে পুড়ে যাচ্ছিল নিমেষে! আর তার গলন্ত ফোঁটা টপটপ করে খসে পড়ছিল খুলে রাখা বইয়ে, কাঠের টেবিলে!

মা পায়ের শব্দ তুলে এগিয়ে এসে তুলে ধরেছিল ওর মুখ। ঝাঁজালো গলায় বলেছিল, “এত বাড় বেড়ে গেছিস? এত নোংরা হয়ে গেছিস? এই বয়সেই এত! আর এমন মরাকান্না জুড়েছিস কেন? কে মারা গিয়েছে তোর?”

পেখম মাকে বোঝাতে পারে না, মানুষ বেশির ভাগ সময় অন্যের মৃত্যুতে কাঁদে না! কাঁদে নিজের মৃত্যুশোকে!

নয়না হাত তুলে একটা রিকশা দাঁড় করাল। তারপর নিজে তাতে উঠে পেখমের হাত ধরে টেনে তুলল।

পেখম বসতেই রিকশাটা চলতে শুরু করল।

নয়না বলল, “আমি দাদার দোকানে নেমে যাব। একটা কাজ আছে। তুই বাড়ি চলে যাস। আমি পরে দোকান থেকে তোর বাড়িতে যাব, কেমন?”

দাদা মানে পেখমের জ্যাঠার ছেলে। বারুদা। স্টেশন-রোডের ওপর ফোটোর দোকান আছে বারুদার। সোনাঝুরিতে বারুদার দোকানটাই একমাত্র ফোটো তোলার জায়গা। স্টুডিয়োকে এখানকার লোকজন ফোটোর দোকানই বলে।

নয়নার নতুন শখ হয়েছে ফোটো তোলা শিখবে। বারুদার দোকানে পেখমও গিয়েছে। দুটো ক্যামেরা আছে বারুদার। একটা রোলেইফ্লেক্স, আর-একটা পাজটাস। রোলেইফ্লেক্সটা দেখেছে পেখম। কেমন একটা ছোট বাক্সের মতো ক্যামেরা। মাথার ওপর একটা ঢাকনা খোলা যায়। তারপর সেটা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে হয় ভেতরে। অদ্ভুত লাগে পেখমের। বাইরের ছবি উলটো হয়ে যেন জলের ওপর ভেসে থাকে ক্যামেরার মধ্যে। বারুদা তো ছবিও তুলে দিয়েছে ওর। সাদা-কালো বড় ছবি। পেছনে স্টুডিয়োর দেওয়ালে আঁকা ঝরনা, পাহাড় আর নানা গাছ।

নয়না বলে, বারুদার দোকান দারুণ চলছে। অনেকে নাকি আসে ছবি তোলাতে। বিয়ের ছবিই নাকি বেশি। ও বলে, “ভাল করে শিখে নিই, তারপর দেখবি তোর বিয়ের ছবি আমিই তুলে দেব।”

স্টেশন রোড ধরে রিকশা চলেছে। শীতের শেষ। আশপাশের গাছেদের গায়ে খুব বেশি পাতা নেই আর। সবে সরস্বতী পুজো শেষ হয়েছে। সোনাঝুরিতে অনেক সরস্বতী পুজো হয়। কিন্তু সব ছোট-ছোট। রাস্তার ওপরে কয়েকটা প্যান্ডেল দেখতে পাচ্ছে ও। এখনও খোলা হয়নি।

তারই একটার সামনে ঝিকুদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল পেখম। মলিন পোশাক, এলোমেলো চুল-দাড়ি। শূন্য প্যান্ডেলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ঝিকুদা।

পেখমের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল দৃশ্যটা দেখে। এটাই তো ঝিকুদার জীবনের সত্যি! মেলা ভেঙে যাওয়া, প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পরের শূন্য প্যান্ডেল। এমনটাই তো বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝিকুদা! ওকেও কি এমন শুনশান একটা ম্যারাপবাঁধা শূন্যতা বুকে করে বেড়াতে হবে? মানুষের জীবনে এমন কেন হয়? যাকে সে চায়, তাকে না পেলে এমন ভেঙে যায় কেন সব? সব কিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে কেন? কেন মনে হয় এক-একটা দিনের ওজন বিশাল পাথরের মতো? কেন মনে হয় সেই পাথর রোজ ঠেলে তুলতে হচ্ছে পাহাড়ের মাথায়? ভাঙা মানুষ কি আসলে সিসিফাস?

“ওই দেখ বিলকিস!” হিহি করে হাসল নয়না, “শালাটা প্রেম করে মায়ের ভোগে গেছে! ভাইরাও লাথি মেরে বের করে দিয়েছে!”

“তুই হাসছিস!” পেখম অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল নয়নার দিকে। আগে তো মেয়েটা এমন ছিল না! আজকাল কী হয়েছে ওর! কেমন যেন মুখের ভাষা! আর কেমন একটা চাপা হিংস্রতা কাজ করে কথাবার্তায়! মাঝে মাঝে এই নয়নাকে চিনতে পারে না ও।

“দেখ পেখম,” নয়না বলল, “জীবনে কেউ তোকে প্লেটে সাজিয়ে কিছু দেবে না। সব কিছুর একটা দাম দিতে হয়। বিনেপয়সায় কিছু হবে না। ঝিকুদার যা গল্প আমি শুনেছি, তাতে লোকটা ক্যালানে ছাড়া আর কিছু নয়।”

পেখম আর কথা বাড়াল না। ও একটা জিনিস আজকাল বুঝতে পারে— জীবনটা বীজগণিত বা পাটিগণিত নয়! লোককে বুঝিয়ে লাভ হয় না। যে যেটা ভাল মনে করে, সেটাই করে।

“কী হল, চুপ করে আছিস কেন?” নয়না খোঁচা দিল, “দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস তুই! কী হয়েছে তোর? কাজুদার কথা বাদ দে। কাকিমা বারণ করল আর ব্যস, সেও লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল! বোঝ, মানুষ কেমন বোঝ!”

কথাটা যে ঠিক নয়, সেটা জানে পেখম। কারণ, মায়ের ওই কথার পরে একদিন সোনাঝুরি পাম্প হাউসের পাশে কাজুর সঙ্গে দেখা করেছিল পেখম। মা বেরোতে দিচ্ছিল না। কিন্তু বিজনের সঙ্গে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও।

পাম্প হাউসের মাঠটা শেষ বিকেলে নির্জন থাকে। বিজনকে দিয়ে আগেই কাজুর কাছে খবর পাঠিয়েছিল ও। কাজু এসে অপেক্ষা করছিল পাম্প হাউসের কাছে।

বিজন ছেলেটার বয়স খুব বেশি না হলেও পরিণত অনেক। পেখমকে বলেছিল, “পেখমদি তুমি যাও, আমি ওই সামনের সিনেমা হলের কাছে তেলেভাজার দোকানে আছি। কথা হয়ে গেলে এসো ওখানে।”

পাম্প হাউসের কাছে পেখমকে ছেড়ে দিয়ে বিজন ওই চপের দোকানের দিকে চলে গিয়েছিল।

সেদিন কাজু কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে ছিল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আশপাশে খোলা মাঠ পেরিয়ে শীত শেষের হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল ওর চুল।

“কেন ডেকেছ?” কাজু দূরের দিকে তাকিয়েই মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।

“কেন মানে? তুমি জানো না কেন? আগে সপ্তাহে একদিন দেখা হত তোমার সঙ্গে আর এখন… এখন কী করে দেখা করব?”

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “পেখম আমাদের সম্পর্ক নিয়ে সবার যখন এত আপত্তি তখন আর কী হবে?”

“মানে?” পেখম স্থান কাল ভুলে এগিয়ে গিয়ে কাজুর হাত ধরে টান মেরেছিল, “এটা কী বলছ তুমি? কার মা-বাবা এসব মেনে নেয়? সবাই প্রথমে আপত্তি করে। পরে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কাজু এবার তাকিয়েছিল পেখমের দিকে। হাওয়া এসে মিশে যাচ্ছিল ওর চুলে। ওর কোঁকড়া চুলগুলো নেমে আসছিল কপালে। পেখম বলেছিল, “সামনের বছর আমি পাশ করে যাব। তারপর একটা চাকরি দেখে নেব ঠিক। তুমিও কিছু চেষ্টা কোরো। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই তো আমাদের সমাজে দরকার। সেটা আমাদের থাকলে দেখবে, কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা নিজেদের মতো করে সংসার করব।”

কাজু বলেছিল, “আমার পরিবার? তাদের কী হবে? তাদের তো ছেড়ে আমি যেতে পারব না! আর তোমার বাবা মা…”

“ছাড়তে বলছি না তো! আমরা থাকব একসঙ্গে। আর আমার বাবা-মা কড়া মানুষ। কিন্তু খারাপ নয়। ওরা ঠিক মেনে নেবে।”

কাজু কিছু না বলে হেসেছিল, “জীবন কি উত্তম কুমারের সিনেমা, পেখম?”

পেখম এগিয়ে গিয়ে কাজুর বুকের কাছে দাঁড়িয়েছিল। হাওয়া এসে আরও যেন মিশিয়ে দিচ্ছিল ওদের। অদ্ভুত এক সুন্দর গন্ধ পাচ্ছিল পেখম। ও মুখ তুলে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। ওই বড়-বড় চোখ। বাদামি মণি। নরম পশমের মতো দাড়ি। পেখম যেন অতল এক কুয়োয় পড়ে যাচ্ছিল! বুকের ভেতরে কেমন একটা করছিল! মনে হচ্ছিল হাজার হাজার হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে ওর শরীর দিয়ে! মনে হচ্ছিল কোথায় যেন ঝনঝন করে রুপোর বাসন পড়ে যাচ্ছে হাত ফসকে!

কাজু আচমকা সরে গিয়েছিল, তারপর হাত দিয়ে পেখমকেও সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “আমার সামনে অনেক দায়িত্ব পেখম। অনেক-অনেক দায়িত্ব। অনেক কাজ। তা ছাড়া এভাবে হয় না। এত হোস্টিলিটি তোমার মায়ের! তোমার বাবা-মায়ের একটা মানও তো রয়েছে। আমার মনে হয় এভাবে কিছু করতেও নেই। তুমি এসো এখন।”

মাথা ঘুরিয়ে আবার ঝিকুদাকে দেখল পেখম। ঝিকুদা এখনও তাকিয়ে রয়েছে ফাঁকা প্যান্ডেলের দিকে। আসলে ঝিকুদা নয়, যেন নিজেকেই দেখল ও!

নয়না বলল, “সোজা হয়ে বোস। আর মুখের ওরকম জিয়োগ্রাফি চেঞ্জ কর। তোকে তো যা বলার বলেই দিয়েছে কাজুদা। আর ভাবিস না। তোকে এত সুন্দর দেখতে! সোনাঝুরির প্রায় সবাই তোর পেছনে লাইন দেবে বলে ইট হাতে ঘুরছে! আর সেখানে এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছিস?”

পেখম কিছু বলল না। এই নয়নাকে ওর কাজুর সঙ্গে দেখা হওয়া আর কথা হওয়ার ব্যাপারটা বলাই ভুল হয়েছে। ও ভেবেছিল নয়না কিছু উপায় করবে। কিন্তু নয়না যেন পাত্তাই দিচ্ছে না। পেখমের মনে হল, এভাবে সবার বিরুদ্ধে একা কী করবে ও?

বারুদার স্টুডিয়োর সামনে নেমে গেল নয়না। বলল, “আমার প্যাকেটগুলো তুই নিয়ে যা তো! আমি সাতটা নাগাদ আসব তোদের বাড়ি।”

প্যাকেটগুলো নিয়ে মাথা নাড়ল পেখম। কিছু জামাকাপড় কিনেছে নয়না। কেন কিনেছে কে জানে! মাঝে মাঝেই এসব কেনে ও। জিনিসপত্র কেনাটা ওর বাতিক। ওর বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পশার খুব বেশি নয়। কিন্তু নয়নার দাদা খুব ভাল চাকরি করে মার্চেন্ট নেভিতে। অনেক টাকা রোজগার করে। বোনের সব শখআহ্লাদ দাদাই মেটায়।

বাড়ির সামনে রিকশা ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকল পেখম। আজ সদর দরজা খোলা। কোলাপসিবল গেটটাও পুরো হাট করা। কী ব্যাপার! একটু যেন অবাকই হল ও। সেভাবে ওদের সদর বন্ধ করা না হলেও কোলাপসিবল গেটটা টানাই থাকে। আজ সেটা খোলা কেন?

গেট দিয়ে ঢুকে থমকে গেল পেখম। সামনের লম্বা করিডরের এক পাশে খুলে রাখা জুতো দেখে বুঝল মিতুকাকিমা এসেছে!

কাকিমা সাধারণত সন্ধেবেলা সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আসে। এমন ছ’টার সময় তো আসে না! আর এলেও চুপচাপ কথা হয় মায়ের সঙ্গে। এভাবে জোরে-জোরে হাসি-ঠাট্টা তো কোনওদিন শোনেনি!

জুতোটা খুলে নিজের ছোট ঘরের দিকে গেল পেখম। হাতের কাগজের প্যাকেটগুলো রেখে গায়ের পাতলা চাদরটা খুলে রাখল। একটু পরে পড়তে বসবে। মানে, পড়ার চেষ্টা করবে আর কী। আজকাল কিছুতেই পড়ায় মন বসে না! তাও বসে, চেষ্টা করে।

পেখমের ঘরের জানলার সামনেই অনেকটা ঝোপের মতো। তারপরই পুকুর। সর্দারদের পুকুর।

ওর ঘরে একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্‌ব জ্বলছে। কিন্তু বাইরেটা বেশ অন্ধকার। পুকুরের ওই পাড়ে কলাবাগান। তার আড়ালে একটা বাড়ি আছে। সেখানে অন্যদিন আলো থাকে। কিন্তু আজ ওই বাড়িতেও আলো জ্বলছে না।

অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল পেখম। কীসের যে টান অন্ধকারের, ও বোঝে না! কিন্তু এমন করে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগে ওর। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায় ক্রমশ। অন্ধকার যেন ধীরে-ধীরে গুলে যেতে থাকে ওর মধ্যে। ওর সব মনখারাপ কেমন যেন আলোহীনতার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

আর তখনই ওদের চোখে পড়ল পেখমের। দুটো-চারটে করে অন্ধকারের পরদা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে ওরা। জোনাকিরা। সবুজ-হলুদ আলো জ্বেলে সামনের ঝোপ থেকে লাজুক মুখে বেরিয়ে আসছে জোনাকিরা। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে তারা! যেন মনের না-মেটা ইচ্ছের আলোবিন্দু! যেন সন্ধে নামক নারীর ফেলে যাওয়া টিপ!

পেখম তাকিয়ে রইল ওই আলোর বিন্দুর দিকে। ওর মনে পড়ে গেল কাজুর কথা। এমনই এক সন্ধেবেলা কাজু জোনাকি দেখে বলেছিল:

‘অন্ধ আমার জীবন জুড়ে রাত্রি একা নামে

তোমার বাড়ির মাথায় এসে কাদের আকাশ থামে?

কাদের শহর চমকে ওঠে তোমার ধ্রুবতারায়

কোথায় কারা ভিজল, যখন বৃষ্টি তোমার পাড়া

সাজিয়ে তোলে বর্ষাতি আর একলা বকুল দিয়ে?

তোমার মুখের হলুদ আভা নিজের পিঠে নিয়ে

বন্ধু নামের বিন্দু যেন আলোর মতো ভাসে

তোমার কথা ভাবলে আমার জোনাক মনে আসে!

“দিদি, তুই এসে গেছিস?”

পেখম সামান্য চমকে উঠল টেটুর ডাকে। ও চট করে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছে নিল। তারপর নিজেকে সামলে তাকাল টেটুর দিকে।

টেটু কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল এবার, “তুই কাঁদছিস দিদি?”

“কই, না তো!” পেখম হাসার চেষ্টা করল।

টেটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল পেখমের দিকে। তারপর বলল, “আমি জানি তুই কাঁদছিস। আমি কি বুঝি না? আমিও বড় হয়েছি।”

পেখম হাত বাড়িয়ে ওর গাল টিপে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, খুব বড় হয়েছিস! রাতে একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়, আবার বড় হয়েছে!”

টেটু বলল, “আরে, সে তো সবাই ভয় পায়। তাতে কেউ ছোট হয়ে যায় নাকি? এই যে জেঠু পুলিশে আছে। সেই জেঠুও তো ভয় পায় পাগলা কুকুর দেখলে। আমার বাবা যে বাবা, বাবা তো ভয় পায় মাসের শেষ এলে। আর আমার মা, সেদিন আচমকা ঘুম ভেঙে শুনি মা বাবাকে ফিসফিস করে বলছে, ‘এমন শুধু-শুধু কোরো না, আচমকা কিছু হয়ে গেলে… আমার ভয় লাগে।’ তা হলে?”

এই সেরেছে! টেটু কীসব বলছে! পেখম উঠে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল। ছেলেটা এখনও বাচ্চাই আছে। বলল, “কী বলবি বল।”

“জেমা ওই ঘরে ডাকছে তোকে। খুব দরকার বলল।”

“মা ডাকছে?” অবাক হল পেখম।

“চল, দেখ না কীসব হচ্ছে তোকে নিয়ে…” টেটু আর না দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল!

ওকে নিয়ে! ওকে নিয়ে আবার কী হচ্ছে! পেখম ধীরে-ধীরে মায়ের ঘরের দিকে গেল।

পেখম দেখল ঘরে মা, মিতুকাকিমা, ছোটকাকিমা ছাড়াও বাবা রয়েছে আজ।

ও জানে আজ বাবার অফ ডে। কিন্তু অফ থাকলে তো বাবা দোকানে যায়। আজ যায়নি?

“আয় আয়,” পেখমকে ডেকে ধরে নিয়ে নিজের পাশে মোড়ায় বসাল ছোটকাকিমা। পেখম বুঝতে পারল না কী হয়েছে। এভাবে ওকে ধরে-ধরে বসাচ্ছে কেন?

পেখম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।

মায়ের মুখটা ঝলমল করছে। মা হাসছে। কতদিন পরে মা হাসছে। আর বাবা? বাবা কেমন যেন একটা মুখ করে বসে রয়েছে! ব্যাপারটা কী?

মিতুকাকিমা নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে পেখমের পাশের টুলে বসল। তারপর বলল, “এভাবে পাগলির মতো থাকিস কেন? একটু সাজগোজ করতে পারিস না?”

“কেন?” পেখম অবাক হয়ে তাকাল মিতুকাকিমার দিকে।

ছোটকাকিমা বলল, “সাজগোজ না করেই তো এই! আর সাজলে কী যে হবে!”

“তা ঠিক…” মিতুকাকিমা হাসল, “এমনি-এমনি কি আর এটা হয়েছে?”

“কী হয়েছে?” পেখম বুঝতে পারল না।

মা ঝলমল করে বলল, “মিতুদি তোর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে!”

“আমার? বিয়ের?” পেখমের মনে হল কেউ যেন ঠাস করে ওকে একটা চড় মেরেছে!

মিতুকাকিমা ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, তোর। জানিস, কে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে?”

পেখম কিছু না বলে তাকিয়ে রইল মিতুকাকিমার মুখের দিকে।

মিতুকাকিমা হেসে বলল, “সুদর্শন মালিকের ছেলে সুজিত মালিক। ওই জুট মিলের মালিক, ওই জোনাক-বাড়ির মালিক। বুঝতে পারছিস?”

পেখম স্থির হয়ে গেল নিমেষে। মিতুকাকিমার মুখটাও মায়ের মতো হয়ে উঠছে ক্রমশ। ঘরের আলোয় কাকিমার ছোট্ট নাকছাবিটা চকচক করছে। পেখমের সামনে থেকে সব কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। শুধু চোখের মধ্যে যেন বিঁধে আছে ওই নাকছাবিটা। একলা তারার মতো নাকছাবিটা। পেখম মনে মনে আরও অনেক তারা খুঁজল। কিন্তু আর তারা নেই। আর কোনও তারা নেই। শুধু ওই একটা তারা জ্বলজ্বল করছে আকাশে।

পেখমের মনে পড়ল, একটা তারা দেখে ঘরে ফিরতে নেই। অমঙ্গল হয়। পেখম বুঝল ঠাকুরদা ঠিকই বলেন।

১৫. নিশান

ট্রেন থেকে নেমে ঘড়িটা দেখল নিশান। সাড়ে ছ’টা বাজে। রাতে স্টেশনে যতটা আলো থাকার কথা ততটা আলো নেই। তার ওপর মানুষ নামলেও তার গায়ের জামাকাপড় নামতে পারবে না ধরনের ভিড় এই ট্রেনটায়! এইভাবে কি কাগজ কিনে আনা যায়? কেয়াদিকে বলেছিল, “এমন করে কেন জেদ করছ! কলেজ স্ট্রিটে ডিটিপি করে সেখানেই ছাপতে দিয়ে দাও না। কেন শুধু-শুধু গাধার খাটনি খাটাচ্ছ?”

কেয়াদি কানের বড়-বড় ঝোলা দুল নাড়িয়ে উত্তর দিয়েছিল, “গাধাকে মানুষের মতো খাটাব নাকি? যা বলছি, কর। খালি তর্ক! পার্টি করা মানুষগুলোকে এই জন্য দু’চক্ষে দেখতে পারি না আমি। আর হবি নাই-বা কেন! ওই দেড়েলটার সঙ্গে মিশে-মিশে তুই গেছিস!”

কেয়াদির পত্রিকার নাম ‘সন্দর্ভ’। বছরে তিনটে করে বের করে। এটা বর্ষা সংখ্যা। কেয়াদি পত্রিকাটা সোনাঝুরি থেকেই ছাপাতে চায়। এখানে কম্পোজ় করে, এখানেই ছাপিয়ে, বাঁধাই করে বের করতে চায়।

ডবল ডিমাই সাইজ়ের কাগজ। সঙ্গে কভারের জন্যও মোটা ধরনের কাগজ। এই সব বয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নাকি? পথ বেশ অনেকটা। কলেজ স্ট্রিট থেকে শিয়ালদা স্টেশন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে করে এই সোনাঝুরি। অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে নিশানের।

সোনাঝুরিকে কলকাতার সঙ্গে আরও দ্রুত মেলানোর জন্য একটা ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। ফলে রাস্তাঘাটের হাল খুব খারাপ, তাই ইচ্ছে থাকলেও ট্যাক্সি করে নিয়ে আসা যায়নি কাগজগুলো।

নিশান একা যায়নি। কারণ, এত কাগজ আনা ওর একার পক্ষে সম্ভব নয়। মণীশকে নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে। মণীশের এসব কাজ করা নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু কেয়াদির সঙ্গে বেশ ঝগড়া করে ছেলেটা।

নিশান কাগজের বান্ডিলগুলো একপাশে রেখে দাঁড়াল। স্টেশনে খুব ভিড়। রাস্তার অবস্থা খারাপ বলে প্রায় সকলেই ট্রেনেই যাতায়াত করে আজকাল। সারাটা পথ এই মালপত্তর নিয়ে ট্রেনে ওঠায় লোকের বিরক্তি আর গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে নিশানকে। এখনও কাগজ নিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখতে গিয়ে নিশান গালাগালি খেয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ও এদিক-ওদিক তাকাল। ভিড়টা কমে গেলে বেরোবে। মণীশ ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।

সাতটার সময় ওর একটা কাজ আছে। ও ঠিক করছে কাগজগুলো দিয়ে মণীশকে রিকশা করে কেয়াদির বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। স্টেশনে ওর সাইকেল রাখা আছে। তাই ও আর রিকশায় যাবে না।

সোনাঝুরি আর মফস্‌সল নেই। কলকাতার কাছে বলে শহরের ভাবভঙ্গি খুব দ্রুত এসে ছুঁয়ে দিয়েছে ওদের ছোট শহরটাকে।

নিশান ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখল। হা-ক্লান্ত মানুষজন কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে। পাখি আর মানুষে কী মিল!

“কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?” মণীশের গলায় বিরক্তি।

নিশান বলল, “ভিড়টা বেরিয়ে যাক। এত পেপার নিয়ে যাওয়া যায় নাকি?”

মণীশ নাক দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করল, “শালা, ঘরের খেয়ে যতসব বনের মোষের পেছনে হাওয়া দেওয়া!”

নিশান হাসল, “কেন? কী হল?”

“লিটল ম্যাগ। সব ব্যাঙের জিনিসপত্র! কেয়াদিদার এত টাকা যখন, তখন গরিবদের বিলিয়ে দিলেই তো পারে! বেকার এসব করার কী মানে?”

নিশান হাসল আবার, “আরে, আবার দিদা বলছিস? কেয়াদি শুনলে হেভি খচে যাবে।”

“তো, তাতে আমার বয়ে গেল! অত বুড়ি একজন, দিদা বলব না তো কি দিদি বলব?”

নিশান বলল, “তুই এমন রেগে থাকিস কেন সারাক্ষণ? কীসের এত রাগ বল তো তোর?”

মণীশ আবার নাক দিয়ে বিরক্তির শব্দ করল, “এ পৃথিবীতে না রেগে মানুষ থাকে কেমন করে সেটাই তো আমি বুঝি না! কী আছে যাতে মাথা ঠান্ডা থাকবে? ট্রেনে করে আসতে গিয়ে দেখলে তো মানুষজন কেমন হয়ে গিয়েছে? সব শালা খেঁকি কুত্তা!”

“কিন্তু এর মধ্যেই তো বাঁচতে হবে। রাগ করলে হবে? কুল থাক। অত রেগে যাস না। চল এগোই…” নিশান হেসে পিঠে হাত রাখল ওর।

ভিড়টা কমে গিয়েছে। টিকিট-ঘরের পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে রাস্তা। একটা পাড়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, আর অন্যটা চলে গিয়েছে বড়রাস্তার দিকে। ওই বড়রাস্তার মোড়েই রিকশা-স্ট্যান্ড। আর স্টেশনের পাশে সাইকেলের গ্যারেজ।

নিশানকে দেখে সাইকেল-গ্যারেজের পিন্টু বলল, “কী দাদা, ওই দিকে যাচ্ছ? সাইকেল নেবে না?”

নিশান হেসে বলল, “আসছি দাঁড়া।”

পথটা খুবই এবড়োখেবড়ো। আলো নেই। রাস্তার একদিকে রেলের পুরনো কিছু কোয়ার্টার আর অন্যদিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা দরমার বেড়ার দোকান। ওই দোকানের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে পথ। সামান্য অন্যমনস্ক হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়বে!

নিশান ছোট থেকেই এই রাস্তাটাকে এমন দেখছে। কখনও ঠিক করা হয় না। কেন হয় না কে জানে! মানুষজন এই নিয়ে কিছু বলেও না। নিশান বোঝে আসলে ওরা সবাই আজকাল সেফ খেলতে শিখে গিয়েছে। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নামক ঘরে বসে বিপ্লব করার মতো একটা মাধ্যম এসে যাওয়ায় ড্রয়িংরুম-বিপ্লবীর সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, আসল কাজের কাজ কিছু হয় না। আর এমন চললে আর হবেও না।

ট্রেনের যাত্রীরা চলে যাওয়ায়, মাত্র একটাই রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তার ওই পারে অটো স্ট্যান্ডও রয়েছে। সেখানে ঠেসাঠেসি করে লোক নেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নেওয়ার নিয়মের কেউ তোয়াক্কা করে না!

কেয়াদির বাড়ি চ্যাটার্জিপাড়ার ভেতরে। অটো নামিয়ে দেবে বড়রাস্তায়। সেখান থেকে হেঁটে প্রায় পনেরো মিনিট লাগবে। তাই রিকশাই ভাল। একদম বাড়ির দরজায় গিয়ে নামবে।

মণীশ রিকশায় উঠে বলল, “কেয়াদিদার কাছ থেকে কি আমি টাকা নিয়ে নেব? মানে রিকশা ভাড়া থেকে আজকের যাতায়াতের খরচ? তুমি চাইবে বলে তো মনে হয় না!”

“আরে, একদম ওসব বলবি না,” নিশান তাড়াতাড়ি বলল, “আমি সেটা ঠিক কথা বলে নেব। আর ক’টাই-বা টাকা! ওসব নিয়ে ভাববি না তুই একদম। আর শোন, লক্ষ্মীভাইটি আমার, সামনে দিদা বলিস না। জানিস তো কেমন রাগী।”

মণীশ ভুরু কুঁচকে বলল, “আশ্চর্য তো! এসব কমপ্লেক্স কেন বলো তো? ডাক্তার দেখায় না কেন? দিদার বয়সি মহিলাকে দিদি বলব কেন? বয়স তো হবেই। সেটা লুকোনোর কী আছে? ডেবিট কার্ডের পিন নাম্বার নাকি?”

“ওরে ভাই রে, একটা কথা অনন্ত তর্ক না করে মেনে নে বাবু!” নিশান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিকশাওয়ালাকে ভাড়াটা দিয়ে মণীশকে বলল, “কাল একবার আসিস বিজনদার ওখানে। কথা হবে।”

“আবার?” মণীশ মালপত্তর পায়ের কাছে রাখল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “আবার ছেলে ধরা শুরু করেছ? তোমায় বলেছি না এসব বলবে না আমায়! তোমাদের পার্টিতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই!”

নিশান রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই, তুমি দাঁড়িয়ে কেন? প্যাডেল মারো। যাও।”

রিকশাটা চলতে শুরু করল। মণীশ পেছন ঘুরে রিকশার পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “এভাবে কিছু হবে না। এভাবে র‍্যানডাম ছেলে ধরে লাভ নেই। এই সমাজের একটা টোটাল ওভারহলিং দরকার। সেটা তোমার ওই বিজনদাদুকে দিয়ে হবে না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হওয়ার দিন গেছে নিশানদা। বিপ্লব এখন ব্যাবসাজীবী, পরজীবী, বুদ্ধিজীবী আর সেলফিজীবীদের বাপের মাল। বুঝলে?”

নিশান হাসল। আশপাশের লোকজন দেখছে। পাশের পানের দোকানের বিহারি লোকটি নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, “পাগলা গয়া ক্যা ছোঁড়া?”

নিশান মাথা নাড়ল। মণীশ ভুল কিছু বলছে না। কিন্তু চারিদিকে সব দেখেশুনে খুব মনখারাপ লাগে নিশানের। মানুষের মূল্যবোধ বলে ব্যাপারটাই আর নেই। অবশ্য থাকবেই-বা কী করে? বোধেরই কোনও মুল্য নেই আর! কী করে যে সবটাই এমন টাকা আর শো অফ-এর পৃথিবী হয়ে গেল কে জানে!

নিশান পেছনে ফিরল। সাইকেলটা নিতে হবে। সাতটায় দেখা করতে বলা হয়েছে ওকে। তারক চক্রবর্তীর অফিসে যেতে হবে। কেন ডেকেছে কে জানে!

“নিশান!” আচমকা পেছন থেকে ডাকে থমকে দাঁড়াল ও। চেনা লাগছে গলাটা। ও ঘুরল। আরে, বাদল!

নিশান দেখল মেঘলা আর কাকিমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে বাদল।

নিশান হেসে এগিয়ে গেল, “তুই! কেমন আছিস?”

বাদল কিছু বলার আগেই মেঘলা বলল, “তুমি কে? কে অধিকার দিয়েছে এসব জিজ্ঞেস করার? আমরা কেমন আছি জেনে কী করবে তুমি?”

নিশান হাসল। মেঘলাটা খুব অভিমানী। আসলে বেশ কিছুদিন ওদের বাড়ি যাওয়া হয়নি। নানা কাজে আটকে গেছে। তাই মেয়েটা রেগে গেছে খুব!

ও মেঘলার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখে একটা কালো সানগ্লাস। চিনতে পারল নিশান। এটা ওরই কিনে দেওয়া। বাইরে বেরোলে এটা চোখে দেয় মেঘলা।

নিশান হেসে মেঘলার মাথায় হাত দিল, “তুই জানিস না, আমি কে?”

“না জানি না,” মেঘলা রেগে গিয়ে মাথা সরিয়ে নিল, “কে তুমি? অচেনা মেয়ের গায়ে হাত দিচ্ছ? লম্পট! মলেস্টেশানের চার্জ আনব তোমার নামে।”

“কীসব বলছিস তুই পাগলের মতো?” বাদল মৃদু স্বরে ধমক দিল মেঘলাকে।

নিশান হেসে বলল, “আরে বলুক না ও, পাগলি তো! আমার আসলে কাজ ছিল রে মেঘলা। খুব কাজ। জানিস তো সোনাঝুরিতে কী হচ্ছে! সেই নিয়ে ব্যস্ত আছি।”

মেঘলা মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিচ্ছু জানি না, জানতেও চাই না। তুমি বাজে ছেলে। দাদা যে বাড়িতে ফিরল, সেটাও কি জানো? আমরা কে হই তোমার? দয়ার পাত্র তো শুধু!”

নিশান চুপ করে গেল। আসলে বাদল যে জেল থেকে ছাড়া পাবে সেটা শুনেছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কী ভুলে গিয়েছিল একদম। সোনাঝুরিতে ওই জোনাক-বাড়িসহ জুট মিলের বিক্রির ব্যাপারে একটা ঝামেলা পেকে উঠেছে। সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন হল বেশ ব্যস্ততা বেড়েছে ওর। সেই নিয়ে নানা জায়গায় যেতে হচ্ছে!

কথাটা মনে পড়তেই নিশানের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! সামনে ভেসে উঠল একটা দোলনা। শূন্য একটা দোলনা। বারান্দায় একা একা দুলছে।

বাদল এগিয়ে এসে বলল, “তুই বেশ রোগা হয়ে গেছিস নিশান। খাওয়া-দাওয়া করছিস না?”

নিশান হাসল। বাদল ওর চেয়ে সামান্য বড়। তাই দাদা-টাদা বলে না কখনও। বাদলের চেহারাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে বেশ। চুল উঠে গিয়েছে। পেকেও গিয়েছে। মুখটা পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছে একদম। দেখে মনে হচ্ছে এই ক’দিনে দশ বছর বয়স বেড়ে গিয়েছে ওর!

নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না। বাদলকে তো আর ওর শরীর নিয়ে কিছু বলা যায় না। কারণ, তা হলেই জেলের অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এসে পড়বে।

ও বলল, “আমার কথা বাদ দে। তোরা গেছিলি কোথায়?”

বাদল মাথার চুলে হাত বুলিয়ে এলোমেলো চুলগুলোকে ঠিক করে নিল একটু। তারপর বলল, “মেঘলাকে নিয়ে গেছিলাম ডাক্তারের কাছে। ওই চোখটা দেখানোর ছিল।”

“তো পজ়িটিভ কিছু হল?” নিশান জিজ্ঞেস করল।

“পজ়িটিভ মানে,” বাদল দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “সাউথে নিয়ে যেতে বলছে। অনেক টাকার ব্যাপার। আমার এখন যা পরিস্থিতি…”

নিশান মাথা নামিয়ে নিল। সত্যি, টাকাটা কোথায় পাবে ওরা?

বাদল এগিয়ে এসে হাত ধরল নিশানের, “তুই কিছু করতে পারবি আমার জন্য? কোনও কাজকম্ম দেখে দিতে পারিস? আমি জানি ব্যাপারটা সোজা নয়। জেল থেকে এসেছি শুনলে কেউ বিশেষ কাজ দেবে না। তাও তুই দেখিস একটু। আমি যা করেছি আগে করেছি। আর কোনও খারাপ কাজে যাব না রে। একটা কাজ দেখে দিস ভাই। খুব অসুবিধেয় আছি।”

কথা বলতে-বলতে বাদলের গলা ধরে এল। চোখে জলও এসে গেল যেন। খারাপ লাগল নিশানের। একসময় ওর কাছের বন্ধু ছিল বাদল। ওকে এই অবস্থায় দেখতে ভাল লাগছে না। তা ছাড়া মানুষ তো ভুল করেই। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল ভুলটা রিপিট না করা। বাদলকে দেখেই বুঝতে পারছে, অতীত নিয়ে বাদল খুব অনুতপ্ত। কিন্তু নিশান কাজ দেবে কী করে? ও নিজেই কাজ করে না। বাবাকে বলতে পারে, কিন্তু তাতে লাভের চেয়ে গালাগালি খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাবার সঙ্গে ওর পটে না একদম। নিশান বুঝতে পারল না কী বলবে।

কাকিমা মেঘলার হাত ধরে এগিয়ে এল এবার, “নিশান, তুই এসব ভাবিস না তো আর। আমার ছেলে, মেয়ে দুটোই তোকে দেখলে খালি মাগুনে মানুষের মতো কথা বলে। অবশ্য আমিও আগে এমন বলতাম! ভাল কথা, তোকে বলা হয়নি, রহিম আমার অর্ডার বাড়িয়ে দিয়েছে। ও লোক দিয়ে মাল নিয়ে যায়। শুনলাম তুই নাকি বলে দিয়েছিস!”

নিশান হাসল। যাক, কাকিমা অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছে। মেঘলার রাগ, বাদলের হাহাকার, ওকে কেমন যেন কোণঠাসা করে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ও শ্বাস নিতে পারছে না!

নিশান বলল, “হ্যাঁ, রহিমদাকে বলেছিলাম যেন ব্যাপারটা একটু দেখে নেয়।”

বাদল আবার বলল, “তুই খুব হেল্‌প করেছিস আমি জানি। তোর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। শুধু দেখিস ভাই, যদি কোনও কাজ দেখে দিতে পারিস।”

নিশান হেসে বলল, “তুই এভাবে বলছিস কেন? আমি চেষ্টা করব নিশ্চয়ই।”

“আমরা তা হলে আসি। কেমন?” বাদল হাসল।

“আয়।”

“তুইও আসিস বাড়িতে। জানি তুই ব্যস্ত, কিন্তু তার মধ্যেও আসিস প্লিজ়!” বাদলের গলা ধরে এল আবার।

নিশান হেসে মাথা নাড়ল। দেখল, যাওয়ার আগে মেঘলা আন্দাজে ওর দিকে হাত নাড়ল।

রাস্তা পার করে বাদলরা অটোয় উঠল এবার। নিশান ঘড়ি দেখল, পৌনে সাতটা বেজে গিয়েছে। আর দেরি করলে তারকদা রাগ করবে খুব।

আবার স্টেশনের টিকিট-ঘরের দিকে হাঁটা দিল নিশান। সাইকেলটা নিতে হবে গ্যারেজ থেকে। আকাশের দিকে তাকাল ও। মেঘ করে আছে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভাল লাগছে নিশানের। যা গরম পড়েছে! আর পারছে না!

আর-একটা ট্রেন আসবে। গেট পড়ছে, শুনতে পেল নিশান। তাড়াতাড়ি এবার বেরোতে হবে। না হলে খুব মুশকিল আছে। রাস্তায় সাইকেল চালানো দায় হয়ে যাবে ভিড়ের চোটে।

পিন্টুকে সাইকেল রাখার ভাড়া মিটিয়ে পাড়ার ভেতরের পথ ধরল নিশান। আগে এই রাস্তাগুলোয় ইট পাতা ছিল। বর্ষাকালে পিচিক পিচিক করে কাদা উঠত। খুব অসুবিধে হত। এখন সব রাস্তাগুলো কংক্রিটের হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কোথাও চলটা উঠে গিয়েছে বটে, কিন্তু তাতেও খুব কিছু অসুবিধে হয় না।

আগে যখন ওরা স্টেশনের ওই পারে থাকত, এই পথ দিয়ে নিশান স্কুলে যেত। এখনও চোখ বন্ধ করে সব বলে দিতে পারে ও। একটা বড় কাঁঠাল গাছের পাশের ভাঙাচোরা বাড়িতে একটা বুড়ো পাগল থাকত। জানলা দিয়ে মুখ বের করে বসে থাকত থুত্থুড়ে বুড়োটা। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকদের দিকে তাকিয়ে পুঁচকি একটা হাসি দিয়ে বলত, “বিলকিস!”

তখন ওই ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ত নিশান। ওর খুব কষ্ট লাগত বুড়োটাকে দেখে। এখনও মনে আছে, শনিবার দিন হাফছুটি হত বলে টিফিন খেত না ও। বুড়োটার জন্য বাঁচিয়ে নিয়ে আসত। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আলতো গলায় ডাকত, “বিলকিসদাদু, ও বিলকিসদাদু।”

বুড়োটা আসত। ফোকলা জানলা দিয়ে হাত বের করে বলত, “দে, বিলকিস দে।”

নিশান টিফিনটা বাড়িয়ে দিত। বুড়োটা টিফিনবাক্স থেকেই খাবার খেত। তারপর বাক্সটা ফেরত দিত নিশানকে।

খাবার খাওয়ার সময় বুড়ো কত কী যে বলত! এখনও কিছু কিছু মনে আছে নিশানের। বুড়ো বলত, “শালা, বিলকিস করেছ কী বিলকিস করে দেবে।” বলত, “শালা লাইফটা পুরো বিলকিস হয়ে গেল!” বলত, “কত বারণ করলাম, কিন্তু শুনলে তো আর মালটার অমন বিলকিসের হাল হত না!”

নিশানের সঙ্গে ওর স্কুলের দু’-তিনজন বন্ধুবান্ধবও থাকত। ওরাও নিশানের দেখাদেখি খাবার দিত। হাসত। মজা করত।

সেই বুড়ো একদিন ট্রেনে কাটা পড়ল। স্কুল যাওয়ার পথে তারপর থেকে ওই ফোকলা জানলাটা দেখলে কেমন একটা মনখারাপ করত নিশানের।

আজ সন্ধের অন্ধকারে ওই জায়গাটা পার হতে-হতে বাড়িটার দিকে তাকাল নিশান। বাড়িটা প্রায় ধসে পড়ার মতো অবস্থায়! সারা গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বট আর অশ্বত্থ জড়িয়ে ধরেছে বাড়িটাকে। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে ছিটকে আসা আলোয় এই বাড়িটাকে রুগ্ণ রাক্ষসের মাথার মতো মনে হচ্ছে।

নিশান ভাবল, সময় কেমন দ্রুত চলে যায়! চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় এই তো সেদিন স্কুল যাওয়ার আগে কেমন মায়ের সঙ্গে খেলা করত নিশান! দৌড়ে বেড়াত পেয়ারা গাছের চারপাশে। রোদ এসে গাছের ডালে লেগে ছিটকে কুচি কুচি হয়ে ছড়িয়ে পড়ত উঠোনে। বাবা বাজার নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই ‘বাবু’ বলে ডাকত ওকে। হাতে দিত খেলনা জিপগাড়ি। নিবেদনী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিহিদানা। সকাল দুপুরের দিকে গড়ালে ভীষণ ট্যারা ভগবান নাপিত আসত তার অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস নিয়ে। উঠোনে বসে ঠাকুরদার চুলে কাটত। কুচকুচ শব্দ ছড়িয়ে যেত পাড়ার হাওয়ায়। ওর মনে হল, এই তো সেদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকত এগারো-বারো বছরের নিশান। স্কুলফেরতা পুকুর-বাগানের ঝোপ থেকে রঙ্গন ফুল তুলে মধু খেত। দেখত, একলা টুনটুনি পাখি অস্থিরভাবে লাফিয়ে চলেছে। দামুদার আচারের জন্য অপেক্ষা করে থাকত সারাটা সপ্তাহ। আর তারপর সৌমিদি, লালিদিদের বাড়ির ওদিকে সূর্য নেমে গেলে বুঝত, আজ আর রোগা বৈষ্ণবদাদু আসবে না এ পাড়ায়। তখন কী সুন্দর হাওয়া আসত। আর তাতে ডুবে, ভেসে এই সব দেখতে দেখতে নিশান ভাবত কী মজারই না এই জীবন! ভাবত, হে ভগবান, এ জীবন যেন শেষ না হয়! আর আজ দ্যাখো, সবটাই কেমন ওই বাড়িটার মতো বাতিল হয়ে গিয়েছে! ইরেজ়ার দিয়ে ঘষে কে যেন মুছে দিয়েছে সব ছবি! শুধু খাতার পাতায় পড়ে আছে পেনসিলের মনমরা গভীর দাগ!

রাস্তাটা এখান থেকে ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে। সামনে জামতলা আছে একটা। চারটে বিরাট বড় জাম গাছ। আগে জায়গাটা খোলা থাকত। কিন্তু এখন একটা মন্দির হওয়ায় চাতালের মতো জায়গাটাকে করোগেটেড টিনের শেড দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আগে, গরমকালে রাস্তাটা জাম পড়ে বেগুনি হয়ে থাকত।

এইসব জায়গা দিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে হারিয়ে যাওয়া সোনাঝুরির কথা খুব মনে পড়ে নিশানের। সেখানে এই যে চটকল বিক্রি করে দেওয়া হবে, জোনাক-বাড়িসহ বিশাল জায়গাটা বিক্রি করে বড় ফ্ল্যাট উঠবে, গলফ কোর্স হবে, আরও কত কী হবে! কিন্তু এটা ঠিক মানতে পারে না ও। কষ্ট হয়।

সেই কারণেই তো সেদিন কলকাতায় গিয়েছিল নিশান। বিজনদার সঙ্গে পরামর্শ করেই গিয়েছিল!

আসলে ওদের পার্টির হয়ে বিজনদা যতই আত্মত্যাগ করুক না কেন, এখন তারক চক্রবর্তীই সোনাঝুরির শেষ কথা। কলকাতায় পার্টির হাইকম্যান্ডের সঙ্গে তারকদার নাকি খুব দহরম-মহরম। সেই তারক চক্রবর্তী নাকি চায় এসব কর্মকাণ্ড এখানে হোক। শুনছে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য জুট মিলটাতেও খুব গোলমাল বাধানোর চেষ্টা হচ্ছে!

পার্টির ভেতরে থেকে কিছু করা যাবে না সেটা ওরা বুঝেছে। বিজনদাকে কেউ সামনে অসম্মান না করলেও পাত্তাও খুব একটা দেয় না।

বিজনদার পরামর্শেই নিশান আর কেয়াদি মিলে ‘সেভ সোনাঝুরি’ নামে একটা মঞ্চ করেছে। আর নিশান দেখেছে, বেশ কয়েকজন মানুষ এসে যোগ দিয়েছে ইতিমধ্যে।

প্রতিসপ্তাহে একটা করে মিটিং আয়োজন করছে ওরা। বাড়ি-বাড়ি যাচ্ছে। একটা পিটিশন তৈরি করেছে। সকলের সই নিয়ে সরকারের কাছে যাওয়ার ইচ্ছেও আছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, কতদূর কী হবে সেটা জানে না ও। এখনকার অর্গানাইজ়ড ওয়েলথের কাছে এসব প্রতিরোধ-টোধ তেমন কাজে দেয় না। তাও নিশান চেষ্টা করছে। আর সেই চেষ্টার ফলশ্রুতি হিসেবেই জুনের প্রথম দিকে সেদিন কলকাতায় গিয়েছিল নিশান।

যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিজনদা বলেছিল, “মিলের আর জোনাক-বাড়ির যারা মালিক, একবার তাদের বাড়িতে যা। অফিস-টফিস নয়। সোজা বাড়িতে একদম। নিজেদের কথাটা বল।”

“বাবা! একদম সোজা বাড়িতে?” নিশান একটু অবাক হয়েছিল।

“হ্যাঁ, তাতে কী? আমি ঠিকানা দিচ্ছি। সকলের ওপরে যিনি আছেন, উনি একজন ভদ্রমহিলা, দীপমালা দেবী। গিয়ে কথা বল। দেখ কী হয়, আমার মনে হয় উনি আর-পাঁচজনের মতো নন।”

“কী করে তুমি সেটা বুঝলে? আচ্ছা, তোমার কথাই মানলাম। সে না হয় যাব। কিন্তু তুমি যাবে না?” নিশান তাকিয়েছিল বিজনদার দিকে।

বিজনদা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জানলায়। ধু ধু দুপুরের দিকে চোখ রেখে বলেছিল, “না, আমি যাব না।”

“কেন? তুমি চলো। জোর হবে। বয়সের তো একটা ওয়েট আছে না কি?”

বিজনদা সময় নিয়েছিল একটু। তারপর ওর দিকে ঘুরে বলেছিল, “সব কিছু তোকে জানতে হবে না। যা বলছি কর। আর-একটা কথা। আমার নাম বলবি না কিন্তু। এটা মনে থাকে যেন। বিজন সরখেল নামটা উচ্চারণ করবি না।”

গিয়েছিল নিশান। সঙ্গে বুচা বলে একটা ছেলেও ছিল। বুচা ওদের পাড়ায় থাকে। ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে এখানে-ওখানে যায়। তা ছাড়া ‘সেভ সোনাঝুরি’ প্রোজেক্টেও ওর সঙ্গে আছে।

আলিপুরে বিশাল বাড়ি দীপমালা দেবীর। উঁচু পাঁচিল। পেল্লায় লোহার দরজা। বাড়ির ভেতরে বিশাল লন। একপাশে সুইমিং পুল। দেখে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল নিশানের!

প্রথমে দরোয়ান ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু সোনাঝুরি থেকে এসেছে, খুব জরুরি দরকার বলায় ভেতর থেকে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল।

বসার ঘরটায় ঢুকেই তাক লেগে গিয়েছিল নিশানের! একটা ছোটখাটো ফুটবল মাঠ যেন! ঘরের একপাশ দিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ওপরে। ঠিক হিন্দি সিনেমায় এমন দেখা যায়।

একজন মহিলা ওদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসেছিল। তারপর সোফা দেখিয়ে বলেছিল বসতে।

বুচা তো চোখ গোলগোল করে এদিক-ওদিক দেখছিল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলেছিল, “এ কোথায় আনলে গুরু? আমি যা জামাকাপড় পরে এসেছি, মাটিতে বসব কি?”

নিশান বলেছিল, “চুপ কর। কীসব হাবিজাবি বলছিস?”

বুচা বলেছিল, “আমায় এরা দত্তক নেবে? শালা ডাল, রুটি আর চারাপোনা গিলে-গিলে পেট যোগেন সর্দারের পুকুর হয়ে গিয়েছে! এরা এত টাকা কী করে রোজগার করে গো?”

“তোর কি টাকার দরকার?”

হেসেছিল বুচা, “মাইরি নিশানদা। যা কমিক করো না তুমি! শাহরুখ খানকে জিজ্ঞেস করো, দেখবে ওরও টাকার দরকার। আমার শালা বিড়ি চুষে-চুষে গালে পাঁচশো চাল ধরার মতো গর্ত হয়ে গেল! আর বলে কিনা, টাকার দরকার আছে!”

নিশান কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। আচমকা সিঁড়ির কাছে একটা গলা পেয়েছিল। যে-মহিলাটি ওদের বসতে বলেছিল, সে কথা বলছিল আর-একজনের সঙ্গে। সেখানে নিশান নিজের নামটাও শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু অন্যজন কিছু না শুনে তরতর করে উঠে গিয়েছিল সিঁড়ি বেয়ে।

আর পেছন থেকে হলেও মেয়েটাকে দেখে চমকে গিয়েছিল নিশান। রাধিয়া!

নিশানের বুকের রক্ত যেন চলকে উঠেছিল মাথা পর্যন্ত! ও ভূতে পাওয়া মানুষের মতো উঠে এগিয়ে গিয়েছিল সিঁড়ির দিকে। দেখেছিল, মেয়েটা ক্ষণিকের জন্য যেন থমকে দাঁড়াল। কিন্তু তারপরেই আবার উঠে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল বাড়ির ভেতরে।

সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিশান। জিজ্ঞেস করেছিল, “রাধিয়া না?”

মহিলাটি বলেছিল, “হ্যাঁ। আপনি চেনেন?”

নিশান বলেছিল, “হ্যাঁ তো। খুব ভাল করে চিনি।”

কিন্তু আর কথা হওয়ার আগেই ওপর থেকে একজন বয়স্ক ভৃত্যস্থানীয় মানুষ খবর নিয়ে এসেছিল, আজ দেখা হবে না দীপমালাদেবীর সঙ্গে। হঠাৎ খুব জরুরি কাজ এসে পড়েছে। ম্যাডাম দুঃখিত।

নিশান কিছু মনে করেনি। সত্যিই তো, ও তো আর আগে থেকে সময় নিয়ে আসেনি। এমন করে এলে দেখা হওয়া মুশকিল।

তবে আসার আগে মহিলার হাতে একটা চিরকুটে নিজের মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে এসেছিল। বলেছিল, “এটা রাধিয়াকে দেবেন প্লিজ়। আমি নিশান, বললেই হবে।”

মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছে নিশান। কিন্তু রাধিয়ার ফোন আসেনি।

তারক চক্রবর্তীর বাড়ির নীচের তলাতেই অফিস। বাইরে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করছে। একটা বড় আলো জ্বলছে গেটের কাছে। বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা উঠোনমতো। সেখানেও কয়েকজন লোক প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বসে আছে আর কয়েকজন বসে পাশের বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির মুখে।

এই লোকগুলোর আসলে কী কাজ কে জানে! সিনেমার এক্সট্রার মতো সারাক্ষণ তারকের পেছন-পেছন ঘুরে বেড়ায়। অনেকটা সেই পুরনো দিনের হিন্দি ছবির গাঁও-ওয়ালোর মতো। এমন ‘নন-প্রোডাক্টিভ মাস’ বোধহয় এই তৃতীয় বিশ্বেই সম্ভব!

নিশান দেখল ওদের। অনেককেই চেনে ও। কিন্তু আজ কেমন যেন সবাইকে একরকম লাগল ওর। সেই ছুঁচোর মতো মুখ করে বসে থাকা মানুষ! তারক চক্রবর্তী কখন কী ছুড়ে দেবে সেটা কুড়োবে বলে যেন বসে আছে!

বাড়িতে ঢোকার কোলাপসিব্‌ল গেটের কাছে মোতি দাঁড়িয়ে ছিল। মোতিলাল শর্মা তারকের ডান হাত। অবশ্য শুধু ডান হাত নয়— নাক, কান, চোখ, পা সবই বলা যায়!

লোকটাকে দেখলে আচমকা নানা পটেকরের কথা মনে পড়ে যায়। নিশান মাঝে মাঝে ওকে মজা করে ‘নানা’ বলেও ডাকে।

মোতি পান খায় খুব। কথা বলার সময় মুখটাকে সামান্য আকাশের দিকে তুলে বাটির মতো হাঁ করে কথা বলে। স্বরের ভেতরে কেমন একটা সামান্য তরল শব্দের মতো আওয়াজ পাওয়া যায়!

নিশান মোতিকে দেখে হাসল।

মোতি মুখটা তুলে সামান্য কলকল শব্দ মিশিয়ে বলল, “এত দেরি করলি? দাদা বসে আছে। তাড়াতাড়ি যা।”

দেরি? ঘড়ি দেখল নিশান। সাতটা পাঁচ বাজে। আশ্চর্য! ও কথা না বাড়িয়ে ঢুকে গেল ঘরে।

তারকের বাড়িটা আগে একতলা ছিল। কিন্তু পরপর দু’বার ভোটে জিতে সোনাঝুরির কিছু হোক না হোক, তারকের বাড়িটা তিনতলা হয়েছে। বাড়ির পেছনে বসবাস করা পুরনো মানুষদের হটিয়ে তাদের জমি কিনে নিয়েছে। সেখানেও একটা মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। সবাই সব জানে, কিন্তু কারও কিছু করার নেই! নিশান মাঝে মাঝে ভাবে, আজকাল মানুষ বোধহয় এইসব কারণেই ইনসেনসিটিভ হয়ে গেছে! সব জায়গায় দুর্নীতি আর নোংরামো দেখে দেখে মানুষের মন আর বোধ দুটোই ভোঁতা হয়ে গেছে। এমন একটা মেনে নেওয়া, হচ্ছে-হবে ধরনের সমাজ তৈরি হয়েছে যে, মানুষ আজকাল রাস্তায় পড়ে মরে যাচ্ছে দেখলেও কেউ এসে দাঁড়ায় না তার পাশে! যারা এইসব ছবি খবরের কাগজে দেখে হা-হুতাশ করে, নিশান জানে, তারাও এমন অবস্থায় পড়লে পাশ কাটিয়ে, গা বাঁচিয়েই পালাবে!

তারকের অফিসরুমটা বেশ বড়। কাচের দরজা দিয়ে সামনেটা ঢাকা। ভেতরে এসি চলছে।

তারক দু’হাত দিয়ে ধরে ট্যাবটা নিয়ে কী একটা দেখছিল। ওকে দেখে সেটা রেখে হাসল। তারকের বয়স পঞ্চাশের মতো। মাথায় বড় টাক। মোটা কাঁচাপাকা গোঁফ। কপালে সব সময় কমলা তিলক কাটা থাকে।

নিশান বসে তাকাল তারকের দিকে। তারক সময় নিয়ে পাশের ড্রয়ার খুলে একটা বইয়ের মতো দেখতে স্টিলের কৌটো বের করল। সেটা খুলে একচিমটে জরদা মুখে পুরে চিবোল চোখ বন্ধ করে। তারপর চোখ খুলে শান্ত গলায় বলল, “শুয়োরের বাচ্চা, সোনাঝুরিতে বিপ্লব মারাচ্ছ? আলিপুর অবধি গিয়ে দরবার করার তাল ছিল? কী ভেবেছিস আমি জানব না? তোদের খেদিয়ে দিয়েছে কেন জানিস? আমি ফোন করে বলেছিলাম তোদের যেন পাত্তা না দেয়। কী ভেবেছিস? আমি ঘাস কেটে বেড়াই! তোকে আর তোর ওই বিজনকে না পোঁদে বাঁশ দিয়ে গঙ্গার পাড়ে টাঙিয়ে রাখব! এই প্রোজেক্ট হবে। যে-কোনও মূল্যে হবে। দেখি তোর কোন বাপ আটকায়! বেশি পেঁয়াজি করলে জোনাক-বাড়ির পেছনে পুঁতে দিয়ে কংক্রিট করে দেব। কেমন! এবার ফোট শুয়োর! শালা বিপ্লবী! বোকা…”

নিশানকে কেউ যেন পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে চেয়ারের সঙ্গে। এসির মধ্যে বসেও কুলকুল করে ঘামছে ও! কান লাল হয়ে গিয়েছে! এসব কী শুনল ও! চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যেন! তারকের চেহারাটা কেমন যেন কাঁপছে। শান্ত গলায় কেউ এমন করে বলতে পারে?

নিশান কোনওমতে উঠল। পা টলছে ওর! হাত কাঁপছে! একটা রাগ লাভার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে! নিশানের মনে হচ্ছে এই সময়ই হয়তো মানুষ বোমার মতো ফেটে পড়ে!

ও আর-একবার তাকাল তারকের দিকে। তারক নির্লিপ্তভাবে জরদা চিবোচ্ছে। নিশানের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। ও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। শুনল কড়কড় করে বাজ পড়ল একটা। নিশান সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সেই তীব্র বিদ্যুৎ টেনে নিল নিজের ভেতরে। তারপর টলতে-টলতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

১৬. পুশকিন

বাথরুম থেকেই ফোনের রিংটা শুনতে পাচ্ছিল পুশকিন। কিন্তু জল গায়ে বেরোতে পারেনি তখন। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে শুনছিল ক্রিরিরিরিং ক্রিরিরিরিং শব্দ। পুরনো দিনের টেলিফোন। বড়, কালো রিসিভার। গোল ডায়াল। ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে নাম্বার ডায়াল করতে হয়। বাবা এটাকে রেখে দিয়েছে। বাবার পুরনো জিনিসের প্রতি কীসের এত মায়া কে জানে! নিজে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও টেকনোলজির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ওদের মাইক্রোওয়েভ পর্যন্ত কিনতে দেয়নি। শেষে ভাইয়ের বউ এসে কিনেছে। বাবা যে তাতে খুশি হয়েছে তা নয়। কিন্তু কিছু বলেনি।

মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দোতলাতেই থাকে বেশির ভাগ সময়। খুব দরকার না পড়লে নীচে নামে না।

স্মিতাকে বাড়ির অমতে বিয়ে করার জন্য সবাই বয়কট করেছিল পুশকিনকে। ভাই তো ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে! কিন্তু এখন যেহেতু স্মিতা আর নেই এই পৃথিবীতে, তাই আবার পুশকিনকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে বাবা আর ভাই। পুরনো কথা সবাই ভুলে যেতে চাইছে। চাইছে পুশকিনও ভুলে যাক!

পুশকিন সবটাই বোঝে। ও নিজেও বাবার কাছে আসতে চায়। কিন্তু কোথায় যেন আটকায়। কিছুতেই ভুলতে পারে না মায়ের মৃত্যুর জন্য ওকেই দায়ী করেছিল বাবা! ভুলতে পারে না মায়ের দাহকার্যের সময় ওকে দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল! পুশকিনের সবটাই তো ছিল মা। সেখান থেকেই ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হল!

তবে ভেতরে-ভেতরে যাই মনে হোক না কেন, পুশকিন বাইরে কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। ও নিয়মিত বাবার খবর নেয়। এই বাড়িতে আসে। এমনকী, ওর খুড়তুতো ভাই দীনবন্ধু যখন এসেছিল, তখনও পুশকিন ওর সম্বন্ধ দেখতে গিয়েছিল কয়েক জায়গায়।

গতকাল বাবার জ্বরের খবর পেয়ে এই বাড়িতে এসেছিল ও। জুলাইয়ের প্রথম এখন। কলকাতা জুড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। গতকাল সন্ধে থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি আজ এই সকালবেলাতেও হচ্ছে। কমেনি একটুও। জানলা দিয়ে পুশকিন দেখছে, সারা আকাশে গোলা পায়রার ডানার রঙের মেঘ। পাড়ার রাস্তা ডুবে গিয়েছে জলের তলায়। উলটোদিকের রাজাদের বাড়ির নীচের তলায় ভাড়া থাকা পরিবারের দুটো বাচ্চা নীল-হলুদ রেনকোট পরে প্লাস্টিকের খেলনা-নৌকো ভাসাচ্ছে রাস্তার জমে থাকা জলে। পুশকিনের দেখে মজা লেগেছে। ওদের সময় ওরা কাগজের নৌকা ভাসাত।

ওদের এই রাসবিহারীর বাড়িটা বেশ পুরনো। উঁচু সিলিং। লাল মেঝে। বাথরুমে পাথরের বাথটব। বাবা পুরনো দোতলা বাড়িই কিনেছিল। পরে ভাল করে সারিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই বাড়িতে এলে ভাল লাগে পুশকিনের। বাইরে যতই গরম হোক না কেন, মোটা দেওয়ালের জন্য সব সময় ঠান্ডা থাকে বাড়ির ভেতরটা।

আজ ভাইরা গিয়েছে মধ্যমগ্রাম। ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে। কী একটা নেমন্তন্ন আছে। পুশকিনকেও বলেছিল যেতে। কিন্তু একটাই ছুটির দিন, তার ওপর এমন ওয়েদার। কার ভাল লাগে! তাই ও পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া বাবার কাল জ্বর ছিল। এমন মানুষকে শুধু কাজের লোকেদের ভরসায় রেখে ও যায় কী করে?

গতকাল রাত প্রায় দশটায় এ বাড়িতে এসেছিল পুশকিন। আজকাল অফিসে কাজের চাপ খুব বেড়ে গিয়েছে। সোনাঝুরির প্রজেক্টই শুধু নয়, আপনকে দেওয়া সেই ‘সি ফুড’ কোম্পানির কাজটাতেও ওকে মাথা দিতে হচ্ছে। আপন যদিও গোটা ব্যাপারটা দেখছে, তাও যেহেতু ডিলটা হয়েছিল পুশকিনের হাত দিয়ে, তাই এখনও আপনকে কিছু-কিছু জায়গায় দেখিয়ে দিতে হচ্ছে পুশকিনকে।

ওদের অফিস দু’দিন ছুটি থাকার কথা, কিন্তু পুশকিন শনিবারেও কাজ করে। আসলে ওর মনে হয়, বাড়িতে বসে থেকে কী করবে ও! কে আছে ওর জীবনে? তার চেয়ে অফিসে গেলে, কাজের মধ্যে থাকলে পুরনো কথা ওকে আর চেপে ধরবে না। আসলে ভাল করে ভেবে দেখলে পুশকিনই কোথায় যেন পুরনো কথাদের ছাড়তে পারে না! ও বোঝে, যতদিন ও নিজেকে সরিয়ে নেবে না অতীত থেকে অতীতও ওকে ছাড়বে না!

কিন্তু বললেই তো আর সরে আসা যায় না! মনের মধ্যে তো আর অন-অফ সুইচ নেই! কী করে ও ভুলবে সেই রাতটার কথা! নিজের ঘরের বাইরে এসে দেখা সেই দৃশ্যটির কথা! যাই করুক না কেন, ওটা জীবনেও ভুলতে পারবে না পুশকিন। শুধু প্রতিদিন নানা কাজের মধ্যে ডুবে ভুলে থাকার ভান করে যাবে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে এসে দাঁড়াল পুশকিন। টানা বৃষ্টির জন্য গরমটা আর নেই। বরং ওদের বাড়ির ভেতরে তো বেশ ঠান্ডাই লাগছে।

এই ঘরটা পুশকিনের। ও চলে যাওয়ার পরেও এমনই করে রাখা হয়েছিল। ভাইয়ের কাছে শুনেছে, মা এই ঘরে কাউকে শুতে দিত না।

ঘরটা বেশ বড়। একপাশে ওর বিছানা। আলমারি। অন্যপাশে বড় আয়না আর তার পাশে চেয়ার টেবিল। ঘরের মাঝে বেশ বড় ফাঁকা লাল মেঝে রয়ে গিয়েছে। পুশকিনের এমন ফাঁকা মেঝে খুব ভাল লাগে। মাটিতে বসার মতো, শোওয়ার মতো আরাম ও আর কিছুতে পায় না।

পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে তোয়ালেটা বাথরুমে মেলে দিয়ে এল পুশকিন। তারপর চুলটা আঁচড়ে নিল। কানের পাশে দুটো, তিনটে করে চুল সাদা হয়েছে। এই ছত্রিশেই বয়স গুটিগুটি এসে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। ও চোখ বন্ধ করল। ক্লান্ত লাগছে পুশকিনের। কেন ক্লান্ত লাগছে কে জানে। কাল রাতে তো বেশিক্ষণ জাগেনি! তা হলে? ঘুমের মধ্যে যদিও বেশ আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে। তাই কি ভাল ঘুম হয়নি?

টেবিলে মোবাইলটা রাখা আছে উলটো করে। ও সেটাকে তুলে নিল। দেখল একটা মিস্‌ড কল। স্মরণ কল করেছিল। কেন কে জানে! আজ আর ভাল লাগছে না কথা বলতে।

ওদের বাড়িতে টুকুদি রান্না করে। আজ পুশকিন বলেছে খিচুড়ি করতে। সঙ্গে বেগুনি, আলুভাজা আর ইলিশমাছ ভাজা।

ও ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজে। সকালে পাঁউরুটি খেয়েছে দু’পিস। এখনও খুব একটা খিদে পায়নি ওর। আর-একটু পরে খাবে!

ও ভাবল একবার দোতলায় যাবে। বাবা কী করছে দেখবে। সকালে দেখেছে বাবার জ্বর নেই। ইজ়িচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বাবা। বাড়িতে ছ’টা কাগজ রাখা হয়। বাবা খবরের কাগজ পড়তে খুব ভালবাসে। আর ভালবাসে ফুটবল। নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ইউনিভার্সিটি ব্লু ছিল। পরে কয়েকবছর কলকাতার বড় দলেও খেলেছে। এখনও লেকে হাঁটতে গিয়ে বাচ্চারা ফুটবল খেলছে দেখলে বাবা দাঁড়িয়ে পড়ে।

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল পুশকিন। আর ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল আবার। সেই ঝনঝন শব্দ। অবাক হল পুশকিন, কেন ফোন ধরছে না কেউ! কানুদা বাবার সব কাজ করে দেয়। কানুদা কি নেই? কিংবা সকালবেলায় বাড়ির ঠিকে কাজ করে যে মনুদি? আর টুকুদিই-বা কই? কেউ ফোনটা ধরছে না কেন?

পুশকিন এগিয়ে এসে ফোনটা ধরল, “হ্যালো…”

“পরিতোষ আছে?” ওপারের গলাটা বেশ বয়স্ক লাগল।

চট করে চিন্তা করে নিল পুশকিন। বাবা আজকাল খুব বিরক্ত হয় ফোনটোন এলে। বলে, “আর আমার এসব ভাল লাগে না। সারা জীবন অনেক কাজ করেছি। আর পারছি না আমি।”

পুশকিন একবার ভাবল কাটিয়ে দেয় মিথ্যে বলে। এমনিতেই বাবার শরীরটা ভাল নেই। ফোন এসেছে শুনলে আবার রাগ করবে। কিন্তু লোকটার গলার ভেতরে এমন একটা ব্যাপার আছে যে, লোকটাকে মিথ্যে বলতে পারল না পুশকিন।

ও জিজ্ঞেস করল, “কে বলছেন কাইন্ডলি বলবেন? বাবা ওপরে আছে।”

“আমি বিজন সরখেল,” লোকটা সময় নিল একটু, “ও ওপরে? ওকে কি নীচে নামতে হবে? মানে, তেমন হলে না হয়…”

“আপনি একটু ধরুন, আমি বলে দিচ্ছি।”

পুশকিন রিসিভারটা টেবিলের ওপরে রেখে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেল। দোতলাটাও বেশ বড়। একপাশে টানা একটা বারান্দা আছে। বাবাকে ঘরে দেখতে পেল না পুশকিন! আরে, গেল কোথায় সবাই! তারপরেই কী একটা মনে হওয়ায় বারান্দার দিকে গেল ও। দেখল হ্যাঁ, যা ভেবেছে ঠিক তাই। বাড়ির তিনজন কাজের লোককে নিয়ে বাবা ওখানে দাঁড়িয়ে। আর শুধু দাঁড়িয়েই নেই, তিনজনকেই বকছে বাবা!

পুশকিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনল ব্যাপারটা। বারান্দার একদিকে পাখির খাঁচা করেছে বাবা। নানারকম পাখি আছে সেখানে। বাবা সবাইকে বকছে, কারণ বৃষ্টির জল লেগে পাখিদের নাকি জ্বর হবে! কেন ঠিকমতো খাঁচাটা ঢাকা দেওয়া হয়নি!

পুশকিনের হাসি পেল। পাখিরা কি বর্ষাকালে ছাতা নিয়ে উড়ে বেড়ায়! নাকি রেনকোট পরে? বাবা মাঝে মাঝে এমন ছেলেমানুষি কাণ্ড করে না!

“বাবা,” পুশকিন ডাকল এবার।

বাবা মাঝপথে কথা থামিয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল পুশকিনের দিকে, “কী হল? দেখছিস না আমি কাজ করছি?”

পুশকিন হাসল, “তোমার ফোন এসেছে।”

“আমার?” বাবা অবাক হল।

“হ্যাঁ, ঘরে এসো। আর তোমার না জ্বর! এখানে বৃষ্টির মধ্যে কী করছ? আবার যদি জ্বরটা বাড়ে?”

বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, “কে আবার ফোন করল এখন! আর আমার জ্বরটা ইমপর্ট্যান্ট নয়। ওদের জ্বর হলে কী হবে?”

“তুমি এসো, ফোনটা ধরো…” পুশকিন পাখিদের নিয়ে আর কথা বাড়াল না।

“বলে দে আমি নেই, আমি এখন যেতে পারব না!” বাবা বিরক্ত হল।

পুশকিন তাও বলল, “বিজন সরখেল নামে একজন।”

বাবা এবার ঘুরে দাঁড়াল, “কে?”

পুশকিন নামটা বলল আবার। দেখল, বাবার মুখটা পালটে গেল যেন। সেই বিরক্তি আর নেই।

বাবা আর কথা বাড়াল না। দ্রুতপায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে গেল। নীচের ফোনের সঙ্