- বইয়ের নামঃ জোনাকিদের বাড়ি
- লেখকের নামঃ স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. পেখম
আকাশজুড়ে জোনাকিদের বাড়ি
বুকের নীচে পাগলা রাজার ঘোড়া
তখন থেকে সবার সঙ্গে আড়ি
তখন থেকে আমার শহর পোড়া!
ধ্বংস ঘেঁটে তোমায় পেলাম মোহর
তোমার আলোয় বাঁচল আমার প্রাণী
কক্ষ থেকে ছিটকে যেত গ্রহ…
উল্কা তোমার কাচের ফুলদানি!
কেমন ছিল সেসব ধুলোখেলা!
কেমন ছিল সাগরপারের রানি!
এই জীবনের নরম বিকেলবেলায়…
আমরা দু’জন, কেবল দু’জন জানি
আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন জানি।
আজ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কাঁঠালচাঁপার গন্ধ চৌধুরীদের ওই লম্বা পাঁচিল টপকে, ঝুমাদিদের কলতলা ঘুরে, হেমন্তকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে আসছে এই এত দূরে, দীপমালা মানে পেখমের কাছে। আজ হাওয়াও দিচ্ছে খুব। ওই দূরে চ্যাটার্জিপাড়ার দিকের জলট্যাঙ্কের পিছন থেকে হাওয়া ভেসে আসছে। হাওয়া উড়ে আসছে। আর ডুবিয়ে দিচ্ছে পেখমকে। ডুবিয়ে দিচ্ছে সোনাঝুরি নামে এই ছোট্ট মফস্সলটিকে।
পেখম সামনের দিকে তাকাল। জ্যোৎস্নার হলুদ লেগে রয়েছে কাজুর মুখে। কাজুর চোখ দুটো বন্ধ। এতক্ষণ নরম গলায় কবিতাটা বলে এখন চুপ করে আছে। যেন হাওয়ায় তুলোর বীজ উড়িয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ! যেন দূরে, আরও দূরে সেইসব বীজ উড়িয়ে, ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এই জ্যোৎস্নার নীচে ভাসিয়ে দিতে চাইছে অক্ষর!
পেখম কিছু বলল না। তাকিয়েই রইল। এই বাসন্তী লুকোচুরি আলোয় ও তাকিয়ে দেখল কাজুকে। একমাথা কোঁকড়া চুল। নরম ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ। টানা ভুরুর তলায় বড়-বড় চোখ। বন্ধ। পেখমের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় পৃথিবীর আর সব কিছু ভুল। আর সব কিছু বাড়তি! শুধু কাজু সঙ্গে থাকলেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে ও।
পেখম তাকিয়ে রইল চোখ বন্ধ করে বসা কাজুর দিকে। আজ ইলেকট্রিক চলে গিয়েছে। ওদের এই ছোট্ট একতলা পাড়াটা কেমন যেন নিঝুম! কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। কিন্তু ঘরে আলো না থাকায় ওরা উঠে এসেছে ছাদে।
পেখম জানে, মা থাকলে ওকে এমন করে কাজুর সঙ্গে ছাদে আসতে দিত না। কিন্তু মা আজ নেই। শুক্রবার বলে পাঠ শুনতে গিয়েছে। কাছেই শানিপাড়ায় গীতাপাঠ হয় শুক্রবার করে। ‘দ্য লাইফ’-এর কাকিমার সঙ্গে মা যায় সেই পাঠ শুনতে।
‘দ্য লাইফ’ এই সোনাঝুরির সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকান। খুব চলে। সারাক্ষণ লোকজন ভরতি থাকে। কাকিমার আসল নাম মিতু।
মিতুকাকিমাদের বাড়িটা পেখমদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট মতো লাগে। খুব বড় বাড়ি কাকিমাদের। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঢালাই লোহার নকশা করা দরজা। মাথার উপর কাগজফুলের কেয়ারি করা।
পেখমের কী ভাল লাগে! মনে হয়, এমন একটা বাড়ি যদি ওদের থাকত!
কিন্তু ওদের এমন বাড়ি হবে কোথা থেকে? ওদের বাড়িটা তো ছোট্ট। একতলা। মাথায় ছাদ থাকলেও গায়ে প্লাস্টার নেই। ঠাকুরদা ভাড়া নিয়েছিল পনেরো বছর আগে। সেই পঞ্চাশ সালে, যখন ওরা সকলে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এসেছিল, তখনই ভাড়া নেওয়া হয়েছিল এই বাড়িটা।
পেখমের আবছা মনে পড়ে। তখন তো ওর মোটে পাঁচ বছর বয়স। তাই প্রতিটি স্মৃতিই কেমন যেন আবছা, ঘষা কাচের ওপারে রাখা কোনও ছবি! ভাল মনে পড়ে না। এই বাড়িতেই ওর জ্ঞান হওয়া, বড় হওয়া। তাই এই বাড়ি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না পেখম। কিন্তু তাও ওই মিতুকাকিমাদের বাড়িটা দেখলে মনে হয়, ইস, এমন যদি একটা বাড়িতে থাকতে পারত!
পেখমের ঠাকুরদা বগলাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই অঞ্চলে একটা টেলারিং শপ চালান। ওই দেশ থেকে আসার পর ঠাকুরদা কী করবেন বুঝতে না পেরে শেষে এই দোকানটি নেন। ঠাকুরদার যৌবন কেটেছিল কুমিল্লায়। সেখানেই ঠাকুরদাদের মামার বড় কাপড়ের দোকান আর টেলারিং শপ ছিল। এই দর্জির কাজ সেই মামাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন ঠাকুরদা।
দোকানটার নাম মুখার্জি ব্রাদার্স। তবে শুধু টেলারিং নয়, সঙ্গে চা, চানাচুর, বাদাম, বিস্কিটও রাখা হয়। সোনাঝুরি জায়গাটা বড় নয় খুব। কিন্তু যেহেতু একটা বড় জুটমিল আছে, তাই লোকজনের আনাগোনা খুব। ঠাকুরদার দোকানটা খারাপ চলে না।
পেখমের বাবা চাকরি করে পুলিশে। লোকাল থানার মেজবাবু। লোকজন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বেশ। তবে পেখম বোঝে আসলে এটা ভয়। কেন কে জানে সাধারণ লোকজন পুলিশকে বেশ ভয় খায়। কিন্তু ওই ভয়টুকুই যা আছে। তাতে তো আর পেট ভরে না! পেখম প্রায়ই মাকে গজগজ করতে শোনে। মাইনে তো আর বেশি নয়। তবে পেখম শুনেছে বাবাদের চাকরিতে উপরির বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু বাবা ওসব দিকে যায় না। লোকে বলে “সবুজবাবু খুব সৎ।” কথাটা শুনলে বাবা রাগই করে। বাবার কথা হল, “আমি যা কাজ করি, তার জন্য সরকার আমায় টাকা দেয়। আমি কেন উপরি রোজগার করতে যাব? আর এই মাইনে যে পাব, সেটা জেনেই তো কাজে ঢুকেছিলাম!”
পেখম জানে সকলে বাবার মতো ভাবে না। কেন ভাববে? মায়ের ভাষায় সবাই তো আর ‘বোকা’ নয়!
তবে ভাল বাড়িতে থাকতে না পারলেও ওদের অভাব নেই। পেখমের কলেজের মাইনে। টিউশনির খরচ। গানের স্যারের খরচ। এসব চালাতে বাবার অসুবিধে হয় না।