০১. হস্তিচিকিৎসা
বেদের আর্যগণ যখন ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন, তখন উহার হাতী চিনিতেন না। কারণ, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে হাতী পাওয়া যায় না। বেদের আর্যজাতির প্রধান কীর্তি ঋগ্বেদে ‘হস্তী’ শব্দটি পাঁচ বার মাত্র পাওয়া না। তাহার মধ্যে তিন জায়গায় সায়ণাচার্য অর্থ করিয়াছেন, হস্তযুক্ত ঋত্বিক্ বা পদযুক্ত ঋত্বিক্। দুই জায়গায় তিনি অর্থ করিয়াছেন, হাতী। সে দুইটি জায়গা এই—
মহিষাসো মায়িনশ্চিত্রভানবো
গিরয়ো ন স্বতব্সো রঘুষ্যদঃ।
মৃগা ইব হস্তিনঃ খাদথা বনা
যদারুণীষু তবিষীরযুগ্ধং।। ১।৬৮।৭
হে মরুৎগণ, তোমরা বড় লোক, জ্ঞানবান; তোমাদের দীপ্তি অতি বিচিত্র। তোমরা পাহাড়ের মত আপন বলে বলীয়ান। তোমরা হস্তী মৃগের মত বনগুলি খাইয়া ফেল। অরুণবর্ণ দিক্সমূহে তোমার বল যোজনা কর।
সূর উপাকে তম্বং দধানে
বি যত্তে চেত্যমৃতস্য বৰ্পঃ।
মৃগো ন হস্তী তবিষীমুষাণঃ
সিংহো ন ভীমঃ আয়ুধানি বিভৎ।। ৪।১৬।১৪
হে ইন্দ্র, তুমি যখন সূর্যের নিকটে আপনার রূপ বিকাশ কর, তখন সে রূপ মলিন না হইয়া আরও উজ্জ্বল হয়। পরের বলনাশক হস্তী মৃগের ন্যায় তুমি আয়ুধ ধারণ করিয়া সিংহের মত ভয়ংকর হও।
এ দুই জায়গায়ই, হস্তী মুগের ন্যায়, ‘মৃগা ইব হস্তিনঃ’, ‘মৃগো ন হস্তী’ এইরূপ প্রয়োগ আছে। ইহার অর্থ এই যে, উঁহারা হস্তী নূতন দেখিতেছেন। উহাকে মৃগবিশেষ বলিয়া তাহদের ধারণা হইয়াছে। তাই তাঁহারা মৃগজাতীয় হাতী বলিয়া উহার উল্লেখ করিতেছেন। পলিনেসিয়ায় ওটাহিটি দ্বীপের লোক কেবল শূকর চিনিত। ইউরোপীয়েরা যখন সেখানে ঘোড়া, কুকুর, ভেড়া, আরও নানারকম জানোয়ার লইয়া গেলেন, তখন তাহার ঘোড়াকে বলিল চিঁ-হিঁ-হিঁ শূয়ার, কুকুকে বলিল ঘেউ-ঘেউ শূয়ার, ভেড়াকে বলিল ভ্যা-ভ্যা শূয়ার। আর্যগণ সেইরূপ মৃগ চিনিতেন, কেননা তাঁহারা শিকারে খুব মজবুত ছিলেন। ভারতবর্ষে আসিয়া যখন তাহার হাতী দেখিলেন, তখন তাঁহারা তাহাকে হাতওয়ালা মৃগ বলিলেন।
হাতীর আসল বাসস্থান বাংলা, পূর্ব-উপদ্বীপ, বোর্নিও, সুমাত্রা ইত্যাদি দ্বীপ। পশ্চিমে দেরাদুন পর্যন্ত হাতী দেখা যায়, দক্ষিণে মহিসূর ও লঙ্কায় দেখা যায়। আফ্রিকায়ও হাতী দেখা যায়, কিন্তু এত বড় নয়, এত ভালও নয়। সুতরাং বৈদিক আর্যেরা যে হাতীর বিষয় অল্পই জানিতেন, সেকথা একরকম স্থির।
ঋগ্বেদে হাতীর নাম ত ঐ দুইবার আছে। ও যে ঠিক হাতীরই নাম, সে বিষয়েও একটু সন্দেহ। কারণ, ‘হাতওয়ালা’ মৃগ বলিতেছে, যদি স্পষ্ট কবিয়া ‘শুঁড়ওয়ালা’ বলিত, তবে কোন সন্দেহই থাকিত না। আরও সন্দেহের কারণ এই যে, সংস্কৃতে হাতীর অনেক নাম আছে- করী, গজ, দ্বিপ, মাতঙ্গ— ইহার একটি শব্দও ঋগ্বেদে নাই, এমনকি ঐরাবতের নাম পর্যন্তও নাই। যাহারা কালো হাতীই চিনিত না, তাহারা সাদা হাতী কেমন করিয়া জানিবে?
ঋগ্বেদে হাতীর নাম থাকুক বা না থাকুক, তৈত্তিরীয় সংহিতায় উহার নাম আছে। অশ্বমেধের কথা বলিতে বলিতে, যখন কোন্ দেবতাকে কোন্ জানোয়ার বলি দিতে হইবে এই প্রশ্ন উঠিল, তখন প্রথম এগারোজন দেবতাকে বন্য জন্তু দিতে হইবে স্থির হইল। কোন কোন মতে এই বন্য জন্তুর ছবি বলি দিলেই হইল ; কোন কোন মতে বলিল, “না, যেমন গ্রাম জন্তুর বেলায় আসলেরই ব্যবস্থা, বন্য জন্তুর বেলাও সেইরূপ।” এই দেবতা ও জন্তুদিগের নাম যথা– রাজা ইন্দ্রকে শূকর দিতে হইবে, বরুণরাজা্কে কৃষ্ণসার হরিণ দিতে হইবে, যমরাজাকে ঋষ্য মৃগ দিতে হইবে, ঋষভদেবকে গয়ব বা নীল গাই দিতে হইবে, বনের রাজা শার্দূলকে গৌর মৃগ দিতে হইবে, পুরুষের রাজাকে মৰ্কট দিতে হইবে, শকুনরাজ বা পক্ষিরাজকে বর্তক পাখী দিতে হইবে, নীলঙ্গ সর্পরাজকে ক্রিমি দিতে হইবে, ওষধিদের রাজা সোমকে কুলঙ্গ দিতে হইবে, সিন্ধুরাজকে শিংশুমার দিতে হইবে, আর হিমবান্কে হস্তী দিতে হইবে।
ঋগ্বেদে হিমবান্ বলিয়া দেবতার কথা নাই। দশম মণ্ডলে একবার হিমবন্ত শব্দ আছে, তাহার অর্থ বরফের পাহাড়— ঐ পাহাড় ঈশ্বরের মহিমা ঘোষণা করিতেছে। কিন্তু তৈত্তিরীয় সংহিতায় হিমবান দেবতা হইয়াছেন এবং বন্য হস্তী, এখন আর্যগণ যাহা ভাল করিয়া চিনিয়াছেন, তাহাই তাঁহার বলি হইয়াছে। হিমবানের দেবতা হওয়া ও বন্যহস্তীর তাঁহার বলি হওয়া, এই দুই ঘটনায় স্পষ্ট বোধ হইতেছে যে, আর্যগণ এখন ভারতবর্ষের মধ্যে অনেক দূর আসিয়া পড়িয়াছেন।
হিমবান এককালে দেবতা ছিলেন না, পরে দেবতা হইয়াছেন। ইহার একটা কারণ বিষ্ণুপুরাণে দেওয়া আছে। সে পুরাণে প্রজাপতি বলিতেছেন, “আমি যজ্ঞের উপকরণ সোমলতাদির উৎপত্তির জন্ম হিমালয়ের সৃষ্টি কবিয়াছি।” তাই দেখিয়াই কালিদাস বলিলেন, যজ্ঞাঙ্গযোনিত্বমবেক্ষ্য যস্য ইত্যাদি। অর্থাৎ হিমালয়ের দেবত্ব পরে প্রজাপতি করিয়াছেন এবং যজ্ঞে তাঁহার ভাগও একটু পরে নির্দিষ্ট হইয়াছিল।
খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে হাতী পোষা খুব চলিত হইয়া গিয়াছিল। বুদ্ধদেবের এক হাতী ছিল। তাঁহার ভাই দেবদত্তেরও হাতী ছিল। বুদ্ধদেব কুস্তি করিতে করিতে একটা হাতী শুঁড় ধরিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেন, তাহাতে হাতী যেখানে পড়ে সেখানে একটি ফোয়ারা হইয়া গিয়াছিল। উদয়ন রাজার ‘নলাগিরি’ নামে একটি প্রকাণ্ড হাতী ছিল। তাঁহার নিজের ও চণ্ডপ্রদ্যোতের বড় বড় হাতীশালা ছিল, হাতী ধরারও খুব ব্যবস্থা ছিল।