দাম্পত্য কলহকথা – স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
রোজকার মতো অফিস ছুটির পর অফিস ক্লাবে ঘন্টা দুয়েক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর তাস পিটিয়ে ফেরার পথে এক ঠোঙা বাদাম ভাজা খেতে খেতে চৌরঙ্গির ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল শুভময়। উদ্দেশ্য এসপ্ল্যানেড ট্রাম গুমটির কাছে এসে বেহালার ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরবে। এ তার নিত্যদিনের রুটিন।
মেট্রোর কাছাকাছি রাস্তাটা পার হবার মুখেই একেবারে মুখোমুখি।
রিয়া শুভময়কে দেখে যাকে বলে কলকল্লোলিত কণ্ঠে বলে উঠলো, —জামাইবাবু। আপনাকে এখানে এসময়ে দেখবো ভাবতেই পারিনি।
রাস্তা পার হওয়া আর হলো না। সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে শুভময় বাদামের ঠোঙাটা শ্যালিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,—অবাক হবার কিছু নেই। এটাই তো আমার বাড়ি ফেরার সময়। তা তুমি এখন কোথা থেকে?
—আজ আমরা দুজনেই ইভনিং শো-এ একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। মেট্রোর বইটা দেখেছেন জামাইবাবু? দারুণ…….
—আমরা দুজনে মানে? শুভময় শ্যালিকার কথা শেষ হবার আগেই বললো, নিশ্চয়ই তুমি আর বঙ্কিম? একটা বেসরকারি সংস্থার জুনিয়ার কম্পুটার ইঞ্জিনিয়ার বঙ্কিম রায়ের সঙ্গে যে রিয়ার কিছুদিন যাবত ‘ইয়ে’ চলছে তা অবশ্যই ইতিমধ্যেই কানে এসেছে শুভময়ের। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শুভময়ের স্ত্রী রনিতার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট রিয়া রীতিমত সুন্দরী, বিদুষী। একটা মাঝারি শ্রেণীর কমার্শিয়াল ফার্মের রিসেপসনিষ্ট। তা সে যদি মনোমত পুরুষকে পারমানেন্ট রিসেপসান দিতে চায় আপত্তি কি!
হঠাৎ রিয়া বললে,—আচ্ছা জামাইবাবু। এই যে প্রতিদিন অফিস ফেরত এত রাত অবধি ক্লাবে আড্ডা দিয়ে আপনি ঘরে ফেরেন, এতে দিদি আপত্তি করে না?
—কেন, আপত্তি করবে কেন, শুভময় বাদাম চিবুতে চিবুতে বললো, এটুকু বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে আছে। আমরা কেউ কারুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না।
—হুঁ! খুব যে বিশ্বাস দিদির ওপরে, রিয়াজ নাচিয়ে বললো, দাঁড়ান, সবে তো পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে আপনাদের…..
–দেখ রিয়া, শুভময় শ্যলিকার কথা শেষ হবার আগেই বললো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বোঝাপড়া তা প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই যা হবার তা হয়ে যায়, এবং তোমায় আমি বলতে পারি এ ব্যাপারে আমাদের বোঝাপড়া পুরো ষোল আনা। তুমি জানলে হয়তো অবাক হয়ে যাবে রিয়া, এই পাঁচ বছরের মধ্যে একটি দিনের জন্যেও আমাদের মধ্যে কোন দাম্পত্য কলহ হয়নি। আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদের সম্পর্কে কি বলে জান?
—কি?
–একেবারে ‘মেড ফর ইচ আদার’! বলতে বলতে নিজেই হা হা করে হেসে ওঠে শুভময়।
রিয়া এবার কয়েক সেকেন্ড শুভময়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,—আচ্ছা জামাইবাবু, ব্যাপারটা আপনাদের পাসে মনে হয় না?
—পানসে। মানে?
—মানে এই দাম্পত্য কলহহীন জীবন। পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও আপনাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ হয় নি। আমি তো ভাবতেই পারি না। এদিকে দেখ, বঙ্কিমের সঙ্গে তো আমার এখনও বিয়ে হয় নি, কিন্তু এরই মধ্যে আমরা দুজনে প্রায়ই কলহ করি। আবার ভাবও হয়ে যায়।
—কিন্তু আমার সে চান্স নেই। বলতে বলতে এবার বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এল শুভময়ের বুকের ভেতর থেকে, তোমার দিদির আমার ওপর এতই বিশ্বাস……..
—কিন্তু সে বিশ্বাস যদি আমি টলিয়ে দিতে পারি জামাইবাবু। —তুমি!
—হ্যাঁ। কোন অন্য নারীর পক্ষেই সম্ভব আর একজনের সংসারে দাম্পত্যকলহ সৃষ্টি করা।
রিয়ার কথায় আবার হেসে উঠলো শুভময়। হাসতে হাসতেই বললো, আমার ক্ষেত্রে তোমার কোন থিয়োরিই খাটবে না রিয়া সুন্দরী। চেষ্টা করে দেখতে পার।
—বেশ! চ্যালেঞ্জ নিলাম। রিয়া হঠাৎ যেন সিরিয়াস হয়ে যায়।
—কিসের চ্যালেঞ্জ রিয়া?
—আগামী সাত দিনের মধ্যে আমি আপনার সংসারে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি করবো।
—আমার কাছে এটা বেশ একটা মজার খেলা মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি পারবে না রিয়া।
—ঠিক আছে খেলাটা শুরু করেই দেখি না, রিয়া এবার কটাক্ষ করে,-এবং খেলাটা শুরু হোক আজ থেকেই।
—আজ থেকে!
—হ্যাঁ। বলতে বলতে ভ্যানেটি ব্যাগ খোলে রিয়া, আমার আর বঙ্কিমের সিনেমা টিকিটের কাউন্টার ফয়েল দুটো এখনও আমার কাছে রয়েছে, এই এটা আপনার শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আপনি শুধু বাড়ি ফিরে যেন অন্যমনস্কভাবে এদুটো দিদির ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখবেন। দিদি জিগ্যেস করলে বলবেন,অফিস ফেরত আপনি আমাকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলেন। ব্যাস, আপনাকে আর কিছু করতে হবে না।
—ধ্যুস! তাতে কি হবে? শুভময় রিয়ার কথায় গুরুত্ব দেয় না, তুমি আমার শ্যালিকা, তোমায় নিয়ে আমি একদিন সিনেমায় যেতেই পারি। আমি জানি এজন্যে তোমার দিদি কিছু মনে করবে না।
রিয়া মুচকি হেসে বললো,—বেশ তো। আপনি শুধু আমি যা বলবো, তাই করবেন। মনে থাকে যেন সাতদিনের জন্য সময় নিয়েছি।
বলতে বলতেই হাত নেড়ে সামনে একাট ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লো রিয়া। শুভময়ও হাসতে হাসতে গিয়ে বেহালার ট্রাম ধরলো।
শুভময় ঠিকই ভেবেছিল। ড্রেসিং টেবিলে দুটো সিনেমা টিকিটের ইভনিং শো এর কাউন্টার ফয়েল দেখে রনিতা যখন জানলো শুভময় অফিস ছুটির পর তার ছোটবোন রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা গিয়েছিল, তখন শুধু বললো, কই, তোমাদের যাবার কথা ছিল, আগে বলনি তো? শুভময় মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলেছে, ইয়ে…হঠাৎ ঠিক হয়েছে। তোমায় বলার সময় পাইনি। এরপর আর কোন কথা বলেনি রনি। তারপর সব কিছু স্বাভাবিক।