মাহির টিটির দিকে তাকাল। রোগা বেঁটে একটা ছেলে। ওরও তো জীবনটা কষ্টের। কিন্তু কী করে এমন সব সময় টগবগে থাকে কে জানে! কালীঘাটের ওই বড় গলিতে ওর বাড়ি। ইটের গাঁথনি দেওয়া ছোট্ট টালির ঘর। দুটো কামরা। একটায় ও থাকে। অন্যটাতে ওর মা। মায়ের কাছে যখন ক্লায়েন্ট আসে টিটি বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে। কী যে জীবন ছেলেটার! তাও কখনও টিটিকে ও গোমড়ামুখে থাকতে দেখে না! সারাক্ষণ হাসে, নেশা করে। ইকিরমিকির কথা বলে।
টিটিদের বাড়িতে বহুবার গিয়েছে মাহির। আসলে ওইখানেই একটা স্কুলে পড়ত তো। যদিও ইলেভেন পাশ করে আর পড়েনি। তবু ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন অবধি ওই পাড়াতেই তো গিয়েছে। জানে তো কী পরিবেশে সেখানে মানুষজন থাকে!
টিটিও ওদের সঙ্গে পড়ত। তবে ক্লাস নাইনের পর আর পড়েনি। কিন্তু বন্ধুত্বটা ঠিক টিকে গিয়েছে। টিটির জীবন ওদের বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোনওদিন অসুবিধে করেনি। বরং স্কুলে পড়ার সময় তো মাঝে মাঝেই ওদের ওখানে যেত মাহির। আড্ডা মারত। খেলত। ওদের ওখানকার অনেকের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে মাহিরের। এখনও কখনও-সখনও মাহির ওখানে যায়, আড্ডা মারে। তবু টিটির মতো কিছুতেই হতে পারে না ও। চেষ্টা করে কষ্ট নামক অতিরিক্ত বোঝাটা নামিয়ে রাখতে। কিন্তু কে যেন সেটাকে ওর শরীরের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছে।
টিটি বলল, “কী রে? শালা, আজকাল তোদের পতাদা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ধ্যান করা শেখাচ্ছে নাকি! মাইরি তোকে বুঝতে পারি না আমি। এক-একদিন এক-এক কিসিমের ক্যালানে হয়ে যাস। এসব আর কতদিন চলবে?”
“কী জন্য এখানে দেখা করতে বলেছিস বল,” মাহির ব্যাগটা কাঁধ বদল করে বলল।
টিটি হাসল। হলুদ কালোর ছোপ-ধরা উঁচু দাঁত। হাসলে বড় মাড়ি দেখা যায়। ও বলল, “রিতুদা ডেকেছে তোকে। আর্জেন্ট কাজ।”
“আমায়?” মাহির অবাক হল সামান্য!
“কেন? তোকে তো আগেও ডেকেছে অনেকবার! তুই তো ঢ্যামনামো মেরে যাসনি। আমি গতসপ্তাহে বলেছিলাম তোর কথা। আসলে কাকিমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কাকিমাকে দেখে কষ্ট হল আমার। আর কত লোকের গু-মুত ঘাঁটবে বল তো! এবার একটু মাকে রেহাই দে। আমি তো আমার মাকে বলেছি। আর বছরখানেক, তারপর ঘরে বাবু বসানো বন্ধ। অনেক হয়েছে শালা। আর না। ছোটবেলা থেকে শালা লাগানোর আওয়াজ আর স্টিম ইঞ্জিনের হেঁচকি শুনে বড় হলাম। আর পোষায় না।”
মাহির বলল, “ঠিক আছে। চুপ কর। কী কাজ বল।”
“আরে শালা, চল না,” এবার টিটি হাত ধরে টানল ওকে, “আগে থাকতেই হাজার প্রশ্ন! রিতুদা এখানকার নেতা। পার্টিতে ঘ্যামা হোল্ড। শালা যত ফ্ল্যাট হয় তার থেকে টাকা আসে। আমাদের পাড়া থেকে টাকা আসে। আরও হাজারটা গলতা আছে টাকা রোজগারের। প্লাস ইট-বালি-পাথর-সিমেন্টের সাপ্লাই থেকে টাকা আসে। এত সোর্স! সব তো আর নিজে দেখাশোনা করতে পারে না। দেখিস না নেতাদের পাশে ক্যালানের মতো মুখ করে বেশ কিছু মানুষ ঝুলে থাকে সবসময়? তুইও থাকবি। আমেরিকায় তো জন্মাসনি যে, কর্পোরেশনের মইয়ের মতো চেহারা বলে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে নেবে! এখানে শালা গতরটার ডিসপ্লে দে। রিতুদার সঙ্গে থাক। পার্টি অফিসে এসে বোস। প্লাস রিতুদা পার্টিতে আরও ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজছে। এমনভাবে কিছু উন্নয়ন না ভাটের কী করে পার্টির উপরমহলের চোখে পড়তে চায়। শুধু এমপি-তে পোষাচ্ছে না। মন্ত্রী হতে চায়। কিন্তু সেসব ঘুঁটি সাজাতে গেলে একটা টিম তো চাই। তোকে চায় টিমে। কোনও বেআইনি কাজ নয়। সোজা কাজ। চল।”
মাহির তাকাল টিটির দিকে। এসব ব্যাপারগুলো খুব ভাল বোঝে ও। রিতুদাকেও সামান্য চেনে। বছর পঞ্চাশের মতো বয়স। মোটা। বেঁটে। মাথায় টাক। সারাক্ষণ লজেন্স খায়। কাঁধে সব সময় একটা তোয়ালে থাকে। মাহির দেখেছে, লোকটা শীতকালেও কুলকুল করে ঘামে! ও ভাবে কর্পোরেশনের কল যদি এই লোকটার মতো হত!
এর আগেও রিতুদা ওকে লোক মারফত ডেকে পাঠিয়েছে। কাজ দেবে বলেছে। কিন্তু মা করতে দেয়নি। আর সত্যি বলতে কী, মাহিরেরও ইচ্ছে ছিল না। তাই মা যখন বলেছে, “ওই মোটার কাছে যেতে হবে না। হেন খারাপ কাজ নেই ও করে না! পুলিশের ঘানি ঘোরাতে চাস? না গুলি খেয়ে মরতে চাস? জানিস না ওদের পার্টির ভিতরেই দশখানা পার্টি আছে? ভাগ আছে? জানিস না, রিতুর সবচেয়ে বড় শত্রু মনা পান্ডে? দু’জন দু’জনকে পারলেই দেখে নেয়! আর এসব বলছিস কেন? আমার রোজগারে তোর চলছে না? আর আমি তো কয়েকজনকে বলেছি। হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় বা হোটেলে বেয়ারার কাজ ঠিক হয়ে যাবে। তবে খেলে যদি কিছু পাস, তবে তো কথাই নেই! কিন্তু ওর কাছে যাবি না।”
মায়ের কথা থেকে সব বাদ দিয়ে শুধু অসমর্থনটুকু নিজের মনে তুলে নিয়েছিল মাহির। ভেবেছিল মা যখন বারণ করছে, তখন যাবে না। মনা পান্ডের সঙ্গে রিতুদার আকচাআকচি সবাই জানে। ঝিলের মাঠে মাঝে মাঝে বোমাবাজি হয়। পেপারে বেরোয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু রিতুদা বলে অপজ়িশন হামলা করেছিল! সবাই সব জানে, তাও সব অন্ধ হয়ে বসে আছে! মাহির একটা জিনিস খুব বোঝে, টাকার চেয়ে বড় শাসক আর কেউ নেই। এর চেয়ে বড় চাবুক আর কিছু নেই।
মাহির বলল, “তুই এমন করতে গেছিস কেন? মা পছন্দ করে না!”