বরেনবাবু ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি ছাতার শাসন উপেক্ষা করে তাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। তলায় জলমগ্ন পথ এবং উপরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ তাকে বিলক্ষণ কাবু করে ফেলেছিল, কোনোমতে রাতের আহার শেষ করে ত্রিবেদীকে শুভরাত্রি জানিয়ে তিনি চলে গেলেন নিজস্ব শয়নকক্ষে…
ত্রিবেদী কিছুক্ষণ একটা বই নিয়ে সময় কাটালেন, তারপর আলো নিবিয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তিনি অনুভব করলেন তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেই একটা অজানা বিপদের আশঙ্কা হানা দিচ্ছিল তার মগ্ন চৈতন্যে… একবার তার মনে হল ডিক নামে যে মস্ত কুকুরটাকে তিনি সভয়ে এড়িয়ে চলতেন, এইসময় সে উপস্থিত থাকলে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারতেন… অবশেষে একসময়ে সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নেমে এল সন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবীর স্নিগ্ধ আশীর্বাদ, ঘুমিয়ে পড়লেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…
গভীর রাত্রে ত্রিবেদীর ঘুম ভেঙে গেল কে যেন বন্ধ দরজায় ঘন ঘন করাঘাত করছে! বন্ধুর পরামর্শে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন ত্রিবেদী, এখন সেই রুদ্ধ দ্বারেই কেউ আঘাত করছে! সভয়ে বিছানার উপর উঠে বসলেন তিনি, প্রথমেই তার মনে হল ডা. সাটিরা আর গজুর কথা– নিচে সদর দরজা অবশ্য ভিতর থেকে বন্ধ, কিন্তু দুই শয়তান যদি গৃহপ্রবেশ করতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে সদর দরজার খিল আটকে তাদের যে বাধা দেওয়া যাবে না, এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত।
দরজায় করাঘাতের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই ত্রিবেদী ভাবলেন কোনোরকমে সদর দরজার বাধা অতিক্রম করে এখন তার শয়নকক্ষের দরজাকেই আক্রমণ করেছে দুই দুর্বৃত্ত। অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ ভেদ করে অন্য কোনো আওয়াজ নিদ্রিত প্রতিবেশীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কি না সন্দেহ। সুতরাং আক্রান্ত হলেও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই।
আবছা অন্ধকারে চারিদিকে একবার দৃষ্টিকে চালনা করলেন ত্রিবেদী ঘরের মাঝখানে রয়েছে একটা টেবিল আর চারটি চেয়ার। ওই জিনিসগুলো টেনে এনে দরজার গায়ে ঠেকা দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা সম্ভব কিনা যখন ভাবছেন তিনি সেইসময় তাকে আশ্বস্ত করে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল বরেনবাবুর কণ্ঠস্বর, ওহে তিলু, দরজা খোলো। তোমার কুম্ভকর্ণের ঘুম দেখছি ভাঙতেই চায় না!
তড়াক করে উঠে দরজা খুলে ত্রিবেদী দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বরেনবাবু, হাতে তার মস্ত বড়ো একটা পিচকারি!
বিস্মিত ত্রিবেদী জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? এত রাত্রে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা মেরে আমার ঘুম ভাঙালে কেন?
ভালো করে শোনো তিল, ভালো করে শোনো।
প্রথমে কিছু শুনতে পেলেন না ত্রিবেদী, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাপিয়ে আর একটা শব্দ ভেসে এল তার কানে কারা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ আর্তস্বর! আর শব্দটা আসছে সেই তালাবদ্ধ ঘরটার ভিতর থেকে, যেখানে অবস্থান করছে রক্তলোলুপ হলুদ রাক্ষস!
বরেনবাবর মখের দিকে তাকালেন ত্রিবেদী।বন্ধর নীরব প্রশ্ন বঝলেন বরেনবাব।তিনিও নীরব থেকেই মাথা নেড়ে জানালেন ওই ঘর থেকেই শব্দটা আসছে বটে? বারান্দা পেরিয়ে বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুজনে-হা, অস্ফুট কাতর গোঙানি ভেসে আসছে ওই ঘরের ভিতর থেকে।
চাবি সঙ্গেই ছিল, তালা খুলে জোরে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে দিলেন বরেনবাবু। বারান্দার আলো আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই আলো এসে পড়ল ঘরের ভিতর। সেই স্বল্প আলোতে দুই বন্ধুর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য—
হলুদ রাক্ষসের অনেকগুলো শুঁড়ের কঠিন আলিঙ্গনের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছে ডা. সাটিরা নিস্পন্দ দেহ, তার হাতের রিভলভার মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার থেকে একটু দুরেই রাক্ষসের আলিঙ্গন থেকে মুক্তিলাভের আশায় ধস্তাধস্তি করছে গজু, তার হাতের ছুরিও খসে পড়েছে মেঝের উপর!
কয়েক মুহূর্ত দৃশ্যটা তাকিয়ে দেখলেন বরেনবাবু, তারপর দুঃখিতস্বরে বললেন, স্যুট পরা লোকটাই বোধহয় ডা. সাটিরা? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তিলু, সাটিরা আর কোনোদিনই তোমায় বিরক্ত করবে না… ওই বুঝি গজু? লোকটা খুব ষণ্ডা, তাই এখনও লড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওকেও বোধহয় বাঁচানো যাবে না। তবু দেখি একবার চেষ্টা করে।
ঘরে ঢুকে সুইচ টিপলেন বরেনবাবু। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করে উঠল ঘর। ত্রিবেদী দেখলেন আক্রান্ত হয়েও যে, দুই মূর্তি প্রাণপণে লড়াই করেছে, তার চিহ্ন রয়েছে রক্তপায়ী উদ্ভিদের সর্বাঙ্গে। হলুদ রাক্ষসের একটা বাহু ও মূল গুঁড়িটার কয়েকটা ছিদ্র থেকে ঝরছে একরকম ঘন সাদা তরল পদার্থের স্রেত (রক্ত?), স্পষ্টই বোঝা যায় সাটিরার রিভলভারের বুলেট থেকেই ওই ছিদ্রগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। গজুর গলা ও শরীরে যে শুড়গুলো জড়িয়ে রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকেটা ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে- তবু তারা নাছোড়বান্দার মতো আটকে রয়েছে গজুর দেহে। দু-হাত দিয়ে গলা থেকে শুড়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে গজু, তার দুই চোখ ঠিকরে যেন বাইরে আসতে চাইছে।