০১. নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
Rabindranath Ekhane Kokhono Asenni by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯

.

উত্সর্গ :

এ বইটি যাকে উৎসর্গ করার কথা ভেবে রেখেছিলাম তার আকস্মিক মৃত্যু আমাকে একটা উপলব্ধি দিয়ে গেছে : প্রিয়মানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে অপেক্ষা না করাই ভালো!

বড়বোনের স্বামী হিসেবে নয়, তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, বড়ভাই এবং অবশ্যই বন্ধু। অসম্ভব ভালো আর নরম মনের মানুষ, অন্য মানুষের প্রতি যার ছিলো অপরিসীম মমতা, সেই সাব্বির আহমেদ নাজমীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমার কাছে আপনার স্মৃতি অম্লানই থাকবে।

.

মুখবন্ধ

শব্দটাই প্রথমে তাকে সম্মোহিত করে ফেললো।

দূর থেকে শত শত নারী-পুরুষের কণ্ঠ ভেসে আসছে বসন্তের বাতাসে, সেই সাথে বয়ে নিয়ে আসছে উদ্যানের নাম-জানা না-জানা অসংখ্য ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, ছড়িয়ে দিচ্ছে উদ্যানের ঘাসের উপরে মিষ্টি রোদের প্রলেপ।

নুরে ছফা বুকভরে সেই ঘ্রাণ আর রোদের গন্ধ নিলো। কিন্তু ভেসে আসা সুর তাকে সম্মোহিত করে নিয়ে চললো শব্দটার উৎসের দিকে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সে।

গুঞ্জন থেকে সুর। সুর থেকে কথা। শতকণ্ঠের আমন্ত্রণ শুনতে পাচ্ছে এখন।

আয়, আয়, আয়।
সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে
করতালি দিতে হবে…

ঘোরগ্রস্ত সম্মোহন ভেঙে দৃঢ় পদক্ষেপে, কঠিন সঙ্কল্প নিয়ে আরেকবার চোখ বোলালো চারপাশে। শত শত নারী-পুরুষও সম্মোহিত হয়ে একদিকেই ধাবিত হচ্ছে যেনো। সহস্র কপালে সহ লাল সূর্য! কালো মেঘপুঞ্জে চেপে বসেছে শ্বেতশুভ্র ফুলের মেঘ! সেই ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ।

সূর্যের তেজ বাড়ছে ধীরে ধীরে, ছফা টের পেলো তার কপাল ঘেমে উঠেছে, সেই ঘেমে ওঠা কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে দেখতে লাগলো এবার। কিন্তু দৃশ্যের চেয়ে শব্দটাই প্রকট তার কাছে।

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,
কলকল ছলছল
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল
কলকল্‌ ছলছল্‌…

তৃষ্ণার্ত ছফা এগিয়ে চললো আরো সামনের দিকে। বেলিফুলের সৌরভ তার আশেপাশে। হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশটা দেখে নিলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যেটা তার আধো-ঘোর আর আধো জাগরণের মাঝে দুলছে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে।

তুমি যে খেলার সাথি
সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান
তোমাতে জাগায় গান…

সামনেই দেখতে পেলো বিশাল বটবৃক্ষের নিচে জড়ো হওয়া মানুষের দল। লাল-সাদার সমারোহ। তবলার বোল। করতালের টুং টাং। হারমোনিয়ামের বিভ্রান্তিকর স্বর! সঙ্গীতের মুর্ঘনা গ্রাস করে নিয়েছে চারপাশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঘাসের উপরে বসে কয়েক শ’ নারী-পুরুষের সমবতে কণ্ঠের গান শুনছে।

এসো হে প্রবল
কলকল ছলছল…

বৈশাখের প্রথম দিনে নুরে ছফা আবারো ধন্দে পড়ে গেলো। একে একে দেখতে লাগলো সবাইকে। তার মন বলছে, এই ভীড়ের মধ্যে সে আছে। কিন্তু তার যুক্তিবুদ্ধি তাতে সায় দিচ্ছে না।

বিগত তিন বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে একটা মুখ। যেখানেই যায়, যখনই সুযোগ পায়, এই একটা মুখই খোঁজে। গতকাল রাতে হুট করে তার মনে পড়ে যায়, পরদিন পহেলা বৈশাখ। ঢাকার বৈশাখ মানেই ছায়ানট। রমনার বটমূল। সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ সঙ্গীত : এসে হে বৈশাখ, এসো এসো!

আমি আসলেই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। সেই ছোটোবেলা থেকে। আমার মা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো..আমাকেও শিখিয়েছিলো। ছায়ানটের প্রথম দিককার ছাত্র ছিলাম আমি…৬২-তে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হলো, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম…

কথাগুলো ছফার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকে তখন। তার অন্তরাত্মা বলে ওঠে, সে আসবে! নিদেন পক্ষে, আসার সম্ভাবনা আছে।

গত রাতে উত্তেজনার চোটে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি, ভোর হতেই বিছানা ছেড়েছে সে, ছুটে এসেছে এখানে-রমনার এই সবুজ চত্বরে।

নূরে ছফা এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে মুখটি তার নিজের কাছেই ঘোলাটে, অস্পষ্ট। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে সেই মুখটি খুঁজে বের করা রীতিমতো পাগলামি বলেই মনে হচ্ছে এখন।

ঘন্টাখানেক পর কোলাহল থেকে সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। মিষ্টি রোদ এখন মাথার তালুতে আঁচ দিচ্ছে, বিদ্ধ করছে দুচোখ। পায়ের নিচে ঘাসগুলো। হাজার হাজার পদভারে পিষ্ট হচ্ছে তারা। সবুজ চত্বরটি এখন লাল-সাদা-নীল-হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে। সঙ্গীতের মিষ্টিধ্বণি ছাপিয়ে প্রবল হতে শুরু করেছে মানুষের কোলাহল।

নিজেকে বেমানান লাগছে এখানে। অন্যদের মতো পায়জামা-পাঞ্জাবি নয়, ক্রিমরঙের পোলো শার্ট, গাঢ় নীলের গ্যাবাডিনের প্যান্ট আর পায়ে মোকামিস পরে আছে সে।

সিগারেটে টান দিয়ে আবারো জনসমুদ্রের দিকে তাকালো ছফা। খুঁজে খুঁজে তার চোখ ক্লান্ত। টের পেলো, একটু ঘেমে উঠছে। কিন্তু এখনও হাল ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে না।

সিগারেটটা শেষ করে রমনার বটমূলের দিকে পা বাড়ালো। মানুষের ভীড় এখন জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। বটমূলের সামনে বসে থাকা দর্শক শ্রোতাদের দিকে চোখ বুলালো। রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশির ভাগ নারী-পুরুষ মাথার উপরে রুমাল, কাপড়, সানগ্লাস আর সানক্যাপ দিয়ে রেখেছে। তাদের প্রায় সবার চোখ বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে যে মঞ্চ বানানো হয়েছে তার দিকে থাকার কথা কিন্তু অনেকের দৃষ্টিই অন্যদিকে নিবদ্ধ-উপস্থিত দর্শকদের বিরাট একটি অংশ হাতে মোবাইলফোন নিয়ে নিজেদের অহংকে তুষ্ট করার জন্য অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত।

সেল্ফি!

তিক্ততায় একদলা থুতু ফেললো সে। কালের এই উন্মাদনাকে মেনে নিতে একটু কষ্টই হয় তার। মানুষ এখন নিজেদের প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে চায়, জানান দিতে চায় তার উপস্থিতিকে! তাদের মতো ডিবি অফিসাররাও বড়সর কোনো ‘ক্রিমিনাল’কে ধরার পর সেল্ফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয় আজকাল। এ নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রায়শই বচসা বাধে, আর সেটা সব সময় শুরু করে ছফা নিজেই।

সেক্তি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সামনের দিকে তাকালো সে। বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে বসে বিভিন্ন বয়সের শ’খানেক নারী-পুরুষ গান গেয়ে যাচ্ছে। সূর্যালোকের কারণে চোখের উপরে হাত রেখে মঞ্চে বসা মানুষগুলোর দিকে নজর দিলো এবার। ভীড়ের মধ্যে কাউকে খোঁজার যে কৌশল সেটা তার জানা আছে। ধৈর্য ধরে এক এক করে দেখতে হয়। বিক্ষিপ্তভাবে দেখলে দৃষ্টি বিভ্রান্ত হবে।

হতাশার সাথেই এবার ফিরে তাকালো মঞ্চের সামনে বসে থাকা হাজারখানেক দর্শকের দিকে। এক এক করে দেখতে শুরু করলো সে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই তার দৃষ্টি চঞ্চল, অসহিষ্ণু আর উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো। ক্রমশ হতাশা গ্রাস করলো তাকে। তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়ালো। আরেকটা সিগারেট ধরাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। তবে তার পা দুটো ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ভীড় থেকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে যেনো।

এখানে হুট করে চলে আসাটা যে কতো বড় পাগলামি হয়েছে, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুশকান জুবেরি এতোটা বোকা নয় যে, হত্যা-গুমের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পহেলা বৈশাখে ছুটে আসবে রমনার বটমূলে।

হাঁটতে হাঁটতেই পাশ ফিরে তাকালো সে। সমবেত কণ্ঠের গান থেমে গেছে, শুরু হয়েছে একক পরিবেশনা।

নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে,
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে…

নিজেকে ভীষণ বোকা আর নাছোড়বান্দা বলে মনে হচ্ছে তার। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাপারে আর কততদিন হাল না ছেড়ে থাকতে পারবে, জানে না। সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ছফার যৌক্তিক মন জানে, ঐ ভয়ঙ্কর নারী দেশ ছেড়েছে, হয়তো আর কখনও ফিরে আসবে না। ভিনদেশে গিয়ে দিব্যি পুরুষ শিকার করে যাচ্ছে সে, আর নিজেকে করছে কালোত্তীর্ণ!

মাঝে মাঝে সে ভাবে, নিজের অহংবোধকে তুষ্ট করার জন্যই সম্ভবত এখনও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মহিলাকে। এটা যে তার জন্যে প্রথম ব্যর্থ কেস হতে চলেছে, সেটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতাও…

“আশ্চর্য! চোখে দেখেন না নাকি!”

বিরক্তিভরা একটি নারী কন্ঠ বলে উঠলো তাকে উদ্দেশ্য করে।

আক্ষরিক অর্থেই প্রবলভাবে ঝাঁকি খেলো নুরে ছফার ভাবনাগুলো। বুঝতে পারলো, আনমনা থাকার কারণে চলতে চলতে এক মহিলার সাথে ধাক্কা লেগে গেছে। এখানে আসা অন্য সবার মতো এই মহিলাও লালপেড়ের সাদা সুতির শাড়ি পরেছে, মাথায় বেলি ফুলের মালা, কপালে লাল টিপ। মহিলাকে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলো সে।

এখানে যে তাকে দেখতে পাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি!

.

অধ্যায় ১

“স্যার…আপনি?!”

নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত। যে মেয়েটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাবেক ডিবি অফিসার কেএস খান।

“ইয়ে মানে…”

সলজ্জ মুখে কেবল বিব্রতকর হাসিটা ধরে রেখেছে ভদ্রলোক। যেনো লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।

“আপনি উনাকে চেনেন?” শাড়ি পরা তরুণী অবাক হয়ে বললো, একবার নুফে ছফা আরেকবার কেএস খানের দিকে তাকালো সে।

“আপনেরে বলছিলাম না ছফার কথা?” বিব্রত হাসিটা ধরে রেখেই বললো মি. খান। “এই হইলো সেই নুরে ছফা।”

ছেলে-ছোকরাদের মতো টকটকে লাল রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আছে কেএস খান-একেবারে পহেলা বৈশাখের সাজে!

“আর ইনি হইলেন ডাক্তার লুবনা,” মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো কেএসকে। মুখে বিব্রতকর হাসিটা যথাসম্ভব দূর করার চেষ্টা করছে সাবেক ডিবি অফিসার।

নুরে ছফা তরুণীর দিকে তাকালো আবার। মেয়েটার বয়স বেশি হলে ত্রিশ-বত্রিশ হবে। তবে সে নিশ্চিত নয়। মেয়েদের বয়স ধরার বেলায় সে যথেষ্ট আনাড়ি। তার কাছে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের মেয়েরা হলো সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর। কেএস খানের সঙ্গি মেয়েটিও একই রকম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

“সরি…” অবশেষে একটা ঢোঁক গিলে আস্তে করে বললো, “…ম্যাডাম।” মেয়েটাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করা নিয়ে একটু দ্বিধা ছিলো মনে, তারপরও অনেকটা মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে, সম্ভবত কেএস খানের উপস্থিতির কারণে। “আমি আসলে…খেয়াল করিনি।”

“ইটস ওকে,” মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা। নিজের বিরক্তি আর রাগ হজম করে ফেলেছে পুরোপুরি, মুখে এখন সৌজন্যতার হাসি।

“নুরে ছফা হইলেন ডিবির সবচায়া ব্রিলিয়ান্ট অফিসার…অনেক কঠিন কেস সল্ভ করছেন,” মেয়েটাকে বললো মি. খান।

ছফা অবাক হয়েই লক্ষ্য করলো, এমন সুন্দরী তরুণীর সান্নিধ্যেও কেএস খান সাবলীল ভঙ্গিতে চলভাষায় কথা বলছে।

ডাক্তার লুবনা যেনো একটু স্মৃতি হাতরে নিলো। “হুম, মনে পড়েছে…আপনি বলেছিলেন, মিস্ট্রিয়াস লেডি মুশকান জুবেরির কেসটা সল্‌ভ করেছিলেন,” মেয়েটার চোখেমুখে এখন প্রশংসার অভিব্যক্তি।

কেএস খান হাসি হাসি মুখ করে সায় দিলো।

“আপনার ঐ কেসটার কথা শুনেছি মি. খানের কাছ থেকে,” এবার আন্তরিকমাখা হাসি দিয়ে ছফাকে বললো তরুণী। “খুবই ইন্টারেস্টিং ছিলো, একেবারে ভয়ঙ্কর কোনো সিনেমার মতোই!”

নুরে ছফা মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করলো। কেসটা যে সে পুরোপুরি সল্ভ করতে পারেনি সেটা আর বললো না। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা- মেয়েটার সাথে কেএস খানের সম্পর্ক কী?

ভাগ্নি? ভাতিজি?

বান্ধবী??

“আমি ডাক্তার লুবনার রুগি,” যেনো ছফার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিলো কেএসকে। কথাটা বলেই বোকার মতো হাসলো ভদ্রলোক। “আমার যে কন্ডিশন…রেগুলার তার কাছে যাইতে হয়।”

“আমি অবশ্য উনাকে রোগী হিসেবে দেখি না। আই থিঙ্ক উই আর ফ্রেন্ড,” বললো সেই লাস্যময়ি তরুণী।

ছফার ভুরু অনিচ্ছাকৃতভাবেই কপালে উঠে গেলো। বান্ধবী?

কেএস খানের মুখে বোকা বোকা হাসি, আর সেটা ঝুলে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। “ডাক্তার আমারে জোর কইরা নিয়া আসলো এইখানে।” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললো সে।

অবশ্য লাল টকটকে পাঞ্জাবি আর চপ্পল দেখে ছফার মনে হচ্ছে না ‘জোর’ শব্দটা এখানে খাটে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে চলে এসেছে মি. খান।

“তা, আপনের খবর কি, ছফা? অনেক দিন কোনো খোঁজখবর নাই।”

প্রায় দু-মাস হলো মি. খানের সাথে তার দেখা হয়নি। ডিবির অন্য অফিসারদের মতো কোনো কেসে নাকানি চুবানি খেলেই সাবেক এই ইনভেস্টিগেটরের শরণাপন্ন হয় না ছফা। এলিভেটরের ভেতরে অদ্ভুত এক খুনের ঘটনা আর মুশকান জুবেরির কেসের বেলায় পরামর্শ, সাহায্য বাদ দিলে বিগত কয়েক বছরে মি. খানের কাছে কোনো কেস নিয়ে যায়নি সে। তবে ডিপার্টমেন্টে ক্রিমিনোলজির ক্লাস নেবার সময় তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাত হয়। সেটাও দু-মাস ধরে বন্ধ আছে ছফার অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেবার কারণে। ডিবি অফিস এখন মিন্টো রোড থেকে ইস্কাটনের নতুন একটি ভবনে বর্ধিত করা হয়েছে। পুরনো ভবনে কেএস খান এখনও ক্লাস নেয়।

“এই তো, স্যার…” বললো সে। “একটু ব্যস্ত আছি কিছু কে নিয়ে।”

“বাসায় আইসেন, এক কাপ চা খায়া যায়েন। অনেক দিন আলাপ হয়।”

“আসবো, স্যার।”

“এই সপ্তাহে কোনো ক্লাস নাই…ফ্রি আছি। আপনে চইলা আইসেন।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ডাক্তার লুবনা হাতঘড়ি দেখলো। “মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে যাবে, কেএস খানকে মৃদু তাড়া দেবার সুরে বললো সে।

বিব্রত হাসি দিলো সাবেক ডিবি অফিসার।

ছফা যারপরনাই বিস্মিত। মি. খান এক সুন্দরী তরুণীকে বগলদাবা করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবেন?

না। নিজেকে শুধরে দিলো। মেয়েটাই কেএস খানকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে।

“ঠিক আছে, স্যার…আমি যাই, পরে কথা হবে,” বললো ছফা। ডাক্তার লুবনার দিকে চেয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।

বিদায় নেবার সময়ও বিব্রতকর হাসিটা লেগে রইলো কেএস খানের মুখে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো, মি. খানকে মনে মনে হিংসাই করছে সে। ডিভোর্সি এই ভদ্রলোক নিশ্চয় মেয়েটার সাথে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ছফার জীবনে সেভাবে কোনো নারীর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কী কারণে সে নিজেও জানে না।

তার রুক্ষ্ম ব্যবহার কর্মজীবনের ব্যস্ততা? নাকি মানবীয় সম্পর্কের ব্যাপারে তার উসীনতা?-ছফা জানে না।

সম্বিত ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে রমনার উদ্যান থেকে বের হয়ে শিশুপার্কের দিকে যে অস্তাচল নামে গেটটা আছে, সেখানে চলে এসেছে কখন টেরই পায়নি। এখান থেকে কোথায় যাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না।

বাড়ি ফিরে যাবে? সারাটা দিন নিজেকে বন্দী করে রাখবে ঘরে? নাকি লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসির মতো বৈশাখের প্রথম দিনটি পথেঘাটে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেবে?

অবশেষে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্তই নিলো। আরেকটু হেঁটে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে রিক্সা নেবার জন্য পা বাড়ালো সে। পথেঘাটে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে খুব দ্রুত। আরেকটু পরই এই পথঘাট জনস্রোতে তলিয়ে যাবে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে পথের উপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নানান রঙের ছটা।

নুরে ছফা মানুষজনের ভীড় এড়ানোর জন্য ফুটপাত থেকে পথে নেমে পড়লো। জনসাধারণের সুবিধার্থে এই রাস্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

রোদের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য সানগ্লাসটা বের করে পরে নিলো সে, সেই সাথে একটা সিগারেটও বের করে নিলো প্যাকেট থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত ধোয়া টেনে নিলো বুকে।

শাহবাগের মোড়ে, পিজি হাসপাতালের সামনে এসে একটা রিক্সা পেয়ে গেলে উঠে বসলো তাতে। বেতার ভবনের সামনে দিয়ে এগোতে শুরু করলো রিক্সাওয়ালা। প্রচুর যানবাহনের কারণে রিক্সার গতি শ্লথ। কিছু দূর যাবার পর একটা রিংটোন বেজে উঠলে অবাক হলো সে। তার ফোন সব সময় সাইলেন্ট থাকে, আজকেও তা-ই আছে। রিক্সাওয়ালা প্যাডেল মারার গতি কমিয়ে দিয়ে কোমর থেকে সস্তা একটি চায়নিজ মোবাইলফোন বের করলে মুচকি হাসলো ছফা। মোবাইলফোন নেই এমন লোকজন আর চোখে পড়ে না আজকাল।

“মুক্তাররে কইবেন আমি সামনের হপ্তায় বাড়ি আইতাছি…ওর সব ত্যাজ আমি পুটকি দিয়া ভইরা দিমু!” রেগেমেগে বললো রিক্সাওয়ালা। তার প্যাডেল মারার গতি এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। গতি জড়তার কারণে রিক্সাটা ঢিমেতালে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিরক্ত হয়ে রাস্তার ডান দিকে তাকালো ছফা। প্রচুর গাড়ি-বাস-রিক্সা। পুরো শহরের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ মানেই ঘর থেকে বের হওয়া-তারপর রমনা-শাহবাগসহ শহরের কিছু জায়গায় সারাদিন টো টো করে বাড়ি ফেরা। এসব অল্প বয়সী ছেলেছোকরাদেরকে মানায়, বুড়ো খোকাখুকিরাও যোগ দেয়, কিন্তু ছফার কাছে এখন এটা একেবারেই হাস্যকর লাগে।

মুচকি হেসে সিগারেটে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো সে। রোদের উত্তাপ বেড়ে গেছে, টের পেলো শরীর ঘামতে শুরু করেছে। সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে যে-ই না ডান দিকে তাকালো অমনি কিছু একটা ধরা পড়লো তার চোখে।

তার রিক্সার পাশেই একটি প্রাইভেট কার, গাড়ির কাঁচ স্বচ্ছ বলে স্পষ্ট দেখতে পেলো পেছনের সিটে বসে থাকা একমাত্র যাত্রিকে।

আজকের দিনের অনেক মহিলা-তরুণীর মতোই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলিফুলের মালা, কপালে লাল টিপ, গলায় একটি মাটির তৈরি হার-পহেলা বৈশাখের সাজে। তবে চোখে সানগ্লাস আছে।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না ছফা। একটু ঝুঁকে তাকালো। সে। তার রিক্সা আর প্রাইভেটকারটি এখন পাশাপাশি আছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ে গেছে বলে থেমে আছে সব যানবাহন।

একমাত্র যাত্রি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছফাকে লক্ষ্যই করেনি।

মুশকান জুবেরি! তার মতোই ফিরে যাচ্ছে রমনা থেকে?

ছফা টের পেলো তার সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে কিছু করার আগেই গাড়িটা আস্তে করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। এদিকে ছফার রিক্সাওয়ালা পারিবারিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ নিয়ে উত্তেজিত, গালাগালি করে যাচ্ছে মোবাইলফোনে, গতি বাড়ানোর দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। ছফা তার পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো। একবার মনে হলো রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা, কিন্তু গাড়িটা ততোক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।

যেনো মরিচীৎকার মতো ছিলো পুরো দৃশ্যটি-ধরা দিয়েই উধাও!

রিক্সাওয়ালাকে আবারো তাড়া দিলে আরেকটু জোরে প্যাডেল মারলো কিন্তু হতাশ হয়ে ছফা দেখতে পেলো, তার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে গাড়িটা।

আক্ষেপে চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেলো তার। গাড়িটা ধরতে পারেনি বলে নয়, বরং একটি মূল্যবান জিনিস খেয়াল করেনি!

.

অধ্যায় ২

টাইটা আলগা করে নিলো আশেক মাহমুদ, ড্রাইভারকে বললো গাড়ির এসিটা বাড়িয়ে দিতে।

“জি, স্যার,” তার আদেশ পালন করার আগেই বললো ড্রাইভার।

আজকাল তার প্রায় সব আদেশ-নির্দেশের বেলায়ই এই আনুগত্যপূর্ণ ‘জি স্যার’ বলা হয়। এখন যে সিস্টেমের অংশ, সেখানে স্যার-ম্যাডাম মাননীয় বলাটা অলঙ্ঘনীয় আচার। মুচকি হাসলো আশেক মাহমুদ। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।

ক্ষমতা!

এ কয় বছরে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ হিসেবে সে বুঝে গেছে, এটার উত্তাপ কতোটা তীব্র হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব সে। চাইলে যেকোনো মন্ত্রী-এমপিকেও মৃদু বকাঝকা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। এই তো, আজ বিকেলেই, অফিস থেকে বের হবার ঘণ্টাখানেক আগে বিরাট বড় এক শিল্পপতিকে যা-তা ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে। জঘন্য একটা আব্দার করেছিলো লোকটি। তার আদরের ভাগ্নে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর হাতেনাতে রক্তাক্ত বটিসহ গ্রেফতার হয়েছে। এখন চিফ মেট্রোপলিটন কোর্টকে একটু বলে দিলেই ভাগ্নেটা জামিন পেয়ে যাবে-কষ্ট করে আর জেল খাটতে হবে না। বিচার বিচারের মতো চলুক, সেটা পরে ‘দেখা’ যাবে।

আশেক মাহমুদ যে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নয়। কোনো তদবিরে যে সাড়া দেয় না সেটাও বলার উপায় নেই। এই কয় বছরে কেবল ঢাকাতেই কিনেছে তিনটি ফ্ল্যাট, কানাডাতেও আছে একটি। ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স হিসেব করলে এক-দেড়শো কোটি টাকার কম হবে না। এসবই হয়েছে দেশের ধনিকশ্রেণির কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার’-এর বদান্যতায়। সে এমন একটি পদে আছে, যেখানে কিছু চাইতে হয় না, চাওয়ার আগেই প্রাপ্তি এসে বসে থাকে তার কোলে। কিন্তু হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনা থেকে লাভবান হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কী দরকার, মোটা অঙ্কের ট্রানজাকশানের বিনিময়ে এসব কাজ করে বিবেকের দংশন ডেকে আনা! তার মধ্যে এখনও এসব ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গেছে। অতো নীচে নামা সম্ভব হয়নি।

অভাবি একটা মেয়ে, যার তিনকূলে কেউ নেই, পেটের দায়ে শহরে এসে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে আর সেটা করেছে বড়লোকের বখে যাওয়া এক কুলাঙ্গার। সেই কুলাঙ্গারের মামা যতো বড় টাকার কুমিরই হোক না কেন, তার আব্দারে সাড়া দেবে না।

হয়তো তার এমন পণ করার কারণও আছে। আজ সকালে একটা ফোন পাবার পর থেকে নিজের ভাগ্নের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিলো বার বার। নিরীহ আর দ্র একটা ছেলে, অথচ তাকেই কিনা বরণ করে নিতে হলো নির্মম পরিণতি! তার মতো ক্ষমতাবান মামা থাকতেও নিরাপরাধ ভাগ্নের অন্তর্ধান রহস্য বের করে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। আর এদিকে, এক শিল্পপতির লম্পট ভাগ্নে ধর্ষণ-খুন করেও পার পেয়ে যাবে টাকার জোরে!

যাই হোক, প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পপতি মামা ‘ক্ষমতায় গেলে মানুষ কিভাবে বদলে যায়’ বহুল ব্যবহৃত সেই আপ্তবাক্য ঝেড়ে দু-কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলো টেলিফোনে। দুমুখ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি আছে এই লোকের। তার ‘বিখ্যাত’ ব্যবহারের কথাও সবার জানা। কিন্তু আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার পিরামিডের একদম শীর্ষবিন্দুর কাছে। এরকম একজনকে তোয়াক্কা না করলেও সে পারে। লোকটার ইতিহাসও তার ভালো করেই জানা আছে-গণ্ডগ্রামের এক বেয়াড়া যুবক, অতীষ্ঠ করে তুলেছিলো গ্রামের লোকজনের জীবন। শেষে, গ্রামের মসজিদে বসা এক সালিশে জুতাপেটার মতো অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হয় তাকে। ঐ ঘটনার রাতেই, প্রতিশোধ হিসেবে মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে।

আজব এক শহর ঢাকা। হাজার হাজার গলি ঘুপচি এখানে-সবগুলো দৃশ্যমান নয় সবার কাছে। কোটা দিয়ে ঢুকলে টাকার খনির সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানা থাকলে এখানে ‘বড়লোক হওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে সহজতম কাজ। পৃথিবীর আর কোথাও মসজিদের দানবাক্স চুরি করা পুঁজি দিয়ে কোনো লোক মাত্র দশ বছরে শিল্পপতি হতে পেরেছে কিনা আশেক মাহমুদের জানা নেই।

যাই হোক, লোকটার অতীত নিয়ে তীর্যক কথা বলেই শুরু করেছিলো সে। তারপর ঢাকা ক্লাবে জুয়া খেলা, মদের আড্ডায় বেসামাল হয়ে পড়া আর নিত্যনতুন নারীসঙ্গের কথাও বাদ দেয়নি। ফোনালাপটি শেষ করেছিলো এই বলে : “আমি যততদিন আছি, আপনি কিভাবে পিএমের অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান দেখে নেবো। দেখি, কী বালটা ফেলতে পারেন!”

বলাবাহুল্য, মসজিদের টাকা চুরি করা চোরটা আর কথা বাড়ায়নি। আশেক জানে, বদমাশটা এখন ভাগ্নেকে বাঁচানোর জন্য সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। ওই রাস্তাটাও সে বন্ধ করে দিয়েছে জায়গামতো ফোন করে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। চোখের সামনে জন্ম নেয়া তার নিজের ভাগ্নে হাসিবের কথা ভাবলো। অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিলো ছেলেটার। চুপচাপ, শান্তশিষ্ট। কারো সাতে-পাঁচে নেই। ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস করার সুযোগ পেয়েও দেশে থেকে গেছিলো কীসের টানে কে জানে! নিজের মতোই থাকতো। স্বাবলম্বী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি ছেলে। ক্ষমতাবান মামার কাছেও কোনোদিন কিছু চায়নি, কোনো তদবির নিয়ে আসেনি কখনও। এরকম নম্ৰদ্র আর নির্বিবাদি ছেলেরও যে শত্রু থাকতে পারে, কে জানতো!

গাড়িটা গুলশান দুই নাম্বারে ঢুকতেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো প্রধানমন্ত্রীর পিএস। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই বিব্রতকর একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।

.

অধ্যায় ৩

হাড্ডিসার বয়স্ক যে বৃদ্ধা বিছানায় শুয়ে আছে তার চোখে মৃত্যুর ছায়া সুস্পষ্ট।

পাশে বসে থাকা হাউজনার্স মেয়েটি আরো একবার হাই তুললো। মেয়েলী কোনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছে সে। সারা রাত জেগে থেকে এই রোগীর কষ্ট-যন্ত্রণা উপশম করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিতে হয় তাকে। মোবাইলফোন বের করে ফেসবুকে ঢু মারতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই-এই রোগী এটা বরদাশত করতে পারে না। কয়েক দিন আগে মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে সে ফোন বের করে ফেসবুকে লগিং করতে গেছিলো, আর অমনি চোখ খুলে ফেলে রোগী। দুর্বল গলায় কিন্তু কঠিন স্বরে বলে দেয়, তার সামনে যেনো কখনও এ কাজ না করে। এমন কি, এ ঘটনার পর তাকে টিটকারি মেরে ফেবুন্নেসা নামেও ডেকেছিলো কয়েকটা দিন। সম্ভবত, অজানা কোনো কারণে ফেসবুক জিনিসটা সহ্যই করতে পারে না বুড়ি।

মহিলার ঘুম একদম পাতলা। এই পর্যায়ে এসে ঘুম বলে কিছু নেই আর তার মধ্যে। চোখে আই মাস্ক পরে নিথর দেহটা নিয়ে পড়ে থাকে, সম্ভবত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। একটু আগে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর শব্দেও একবার নড়েচড়ে উঠেছিলো তবে কিছু বলেনি, আবারও স্থির হয়ে গেছে।

হঠাৎ পারফিউমের গন্ধ টের পেয়ে হাউজ নার্স জেবুন্নেসা ফিরে তাকালো দরজার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগাজিনটা রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তার নিয়োগকর্তা, এ বাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

“স্যার–”

হাত তুলে মেয়েটাকে থামিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ, তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। “কখন ঘুমিয়েছে?” একেবারে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো সে।

“এই তো–” মেয়েটা নীচুকণ্ঠে জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলো।

“আমি ঘুমাইনি,” বৃদ্ধা বলে উঠলো ঘরের দু-জনকে অবাক করে দিয়ে। “আমার কি আর ঘুম আসে!” চোখ থেকে আই-মাস্কটা কপালের উপর তুলে দিলো রোগী।

বোনের দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তার ইচ্ছে করছে চোখ সরিয়ে ফেলতে, এককালের রূপবতি বড়বোনের এমন করুণ অবস্থা দেখতে চায় না।

“বুবু, কেমন আছো?” প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে। মৃত্যুপথযাত্রি কাউকে এ প্রশ্ন করা অনেকটা তামাশার মতোই শোনায়।

এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলে বৃদ্ধার মুখে। “এখনও মরিনি,” বেশ ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে বললো। “তবে আজ সকালে মনে হচ্ছিলো দুপুর পর্যন্ত দুনিয়ার আলো দেখে যেতে পারবো না।”

আশেক মাহমুদ চুপচাপ তার বোনের শিয়রে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। হাউজনার্স মেয়েটি বুঝতে পারছে না তার এখন চলে যাওয়া উচিত কিনা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে।

“তুমি যাও,” বেশ মৃদু কণ্ঠে নার্সকে বললো রোগী। “রেস্ট নাও।”

মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ। “খুব ব্যস্ত ছিলাম, বুবু। পিএম আজকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করেছেন…নইলে…”

“বুঝেছি রে!” একটা নিশ্বাস ফেলে বললো বৃদ্ধা। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো দুপুরের পর আর…”

আশেক মাহমুদের বলতে ইচ্ছে করছিলো-বুবু, এভাবে বোলো–কিন্তু কিছুই বললো না সে। বড়বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম মমতায়। তার মনে পড়ে যাচ্ছে, ছেলেবেলায় ঠিক এভাবে তার বুবু কতোবারই না তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তার চেয়ে মাত্র দশ বছরের বড় এই বোন অকালে মাতৃহারা আশেককে সন্তানের মতো কোলেপিঠে মানুষ করেছে। মায়ের সবটা আদর আর ভালোবাসা পেয়েছে। এই বোনের কাছ থেকেই।

“আমি যেকোনো সময় চলে যাবোরে, আশেক!”

বোনের এমন কথায় কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলো পিএস।

“আমার মন বলছে কাল সকালটা দেখতে পারবো না।”

আশেক মাহমুদের চোখ ছল ছল করে উঠলো। এরকম মুহূর্তে সান্ত্বনা দেয়া, কিছু একটা বলে প্রবোধ দেয়ার মতো স্বভাব কোনো কালেই তার ছিলো না। জোর করে দিতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে বরং এমন সময় চুপ করে থাকে। যদিও এ মুহূর্তে তার চোখদুটো অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ঠেলেঠুলে বের হয়ে আসতে চাইছে অশ্রু।

“গতরাতে হাসিবকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে বলছিলো, তুমি আসছো না কেন, মা? এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে!”

পিএস নিশ্চুপ রইলো। দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তার বুবু এরকম কথা বেশ কয়েকবার বলেছে। কানাডায় থাকার সময় যখন। মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়লো তখন তার মাতৃসম বড়বোন সিদ্ধান্ত নিলো নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বাকি সময়টা কাটাবে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে জন্মভূমিতেই।

বোনকে কোনো কিছু বলে সান্ত্বনা দিতে পারছে না বলে নিজের কাছেই লজ্জিত আশেক। রাজনীতির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে এসব কায়দা কানুন এখনও শিখতে পারলো না, সেটা ভেবে অবাকই হয় সে।

“ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে হাসিবের কী হয়েছিলো সেটা জেনে যেতে পিরবো,” ক্যান্সারের রোগী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।

“আমি জানি আমার ছেলেটা আর বেঁচে নেই,” কথাটা বলে উদাস হয়ে তাকালো হাসিবের মা। “কিন্তু তার কী হয়েছিলো? কে আমার এতো বড় সর্বনাশ করলো…জেনে যেতে পারবো না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

এবার আশেকের কিছু বলার পালা কিন্তু গলার কাছে একটা গিট আটকে আছে যেনো।

“তুই আমাকে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারিরে, বুল্লা!”

ছোটোবেলার আদুরে ডাকটা অনেকদিন পর শুনতে পেয়ে আশেক মাহমুদ প্রবল আবেগে আক্রান্ত হলো, ছলছল চোখে চেয়ে রইলো বোনের দিকে। হাসিবের কী পরিণতি হয়েছে, কে তার জন্য দায়ী সেটা জানার পর পরই সে জানতে পারে তার বোনের শরীরে বাসা বেধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এমনিতেও খবরটা দিতো কিনা সন্দেহ ছিলো তার মনে, তবে ক্যান্সারের সংবাদ শোনার পর আর কোনো দ্বিধা থাকেনি। পুরো ব্যাপারটা চেপে যায় সে। তদন্ত হচ্ছে…কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না তদন্তকারী অফিসার-এমন কথা বলে বোনকে প্রবোধ দিয়েছিলো।

“আমার এই অবস্থায় হয়তো খারাপ খবরটা জানাতে চাসনি,” আশেকের বুবু আস্তে করে বললো। “কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ধরেই নিয়েছি আমার হাসিব আর নেই।” একটু থেমে দম নিয়ে নিলো মহিলা। “আমি শুধু জানতে চাই, আমার বুকটা কে খালি করেছে। কে এতো বড় সর্বনাশ করলো…কেন করলো!”

আশেক বোনের দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। তার বুবুর দুচোখের কোণ দিয়ে আস্তে করে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। দু-হাতে বোনের হাতটা ধরে নিজের গালে ঠেকালো সে।

“বিশ্বাস কর, বুল্লা…তুই যা ভাবছিস আসলে ঘটনা সেরকম কিছু না।”

কথাটার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললো সে, “কী বলছো, বুবু? কীসের ঘটনা?”

“এই যে…হাসিবের খারাপ পরিণতির কথা জানতে পারলে আমি খুবই কষ্ট পাবো।”

মাথা দোলালো পিএস।

“এই কয়েক বছরে প্রতিটি মুহূর্তে মা হিসেবে আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। কষ্ট পেতে পেতে আমি প্রায় অবশ হয়ে গেছি, নতুন করে আর কী কষ্ট পাবো!” একটু দম নিয়ে নিলো বৃদ্ধা। “আসলে কী, জানিস?” ছোটোভায়ের কাছ থেকে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “সত্যিটা না জেনে, অপরাধীকে শাস্তি পেতে না দেখে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতেই বরং ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”

আশেক একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। মনে হচ্ছে বোনকে অন্তিম মুহূর্তে সবটা বলে দেয়াই ভালো, মা হিসেবে এটা জানার অধিকার সে রাখে। আবার একইসাথে এটাও মনে হচ্ছে, খবরটা জানতে পারলে এই শেষ সুময়ে, ক্যান্সারের ছোবলে যখন যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছে তখন তার কষ্ট বাড়িয়ে দেবার কোনো মানেই হয় না।

কেমো থেরাপি দেবার কারণে সব চুল পড়ে গেছে। মাথায় পরে আছে। একটা স্কার্ফ। এককালের সুন্দর ভুরুজোড়া এখন প্রায় নেই বললেই চলে। হাড্ডিসার হাতটায় কোনো শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও হঠাৎই আবিষ্কার করলো, দুর্বল হাতটা আলতো করে চেপে ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো তাগিদ দিচ্ছে তাকে, অনুনয় করছে!

“বুবু,” অবশেষে বলতে পারলো আশেক মাহমুদ। “হাসিব নিখোঁজ হবার পর যখন পুলিশ কিছু বের করতে পারলো না তারপরই আমি ডিবির এক ইনভেস্টিগেটরকে দিয়ে কেসটা তদন্ত করিয়েছিলাম।”

তার বুবু স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, সবটা শোনার জন্য উন্মুখ সে।

“খুবই মেধাবি ইনভেস্টিগেটর সে,” একটু থেমে ঢোঁক গিলল। “ঐ অফিসার আপ্রাণ চেষ্টা করে খুব দ্রুত বের করতে পেরেছিলো হাসিব কোথায় গিয়ে উধাও হয়েছিলো।”

আশেক মাহমুদ টের পেলো তার বুবুর হাত আরো শক্ত করে ধরে আছে তার হাতটা, দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

“ঢাকা থেকে সুন্দরপুর নামের এক মফস্বল শহরে গেছিলো হাসিব,” কথাটা বলে চুপ মেরে গেলে আশেক।

“কেন?” উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো তার শয্যাশায়ী বোন। “ওখানে কেন গিয়েছিলো হাসিব?!”

“একজনের সাথে দেখা করতে।”

“কার সাথে?”

“এক মহিলার সাথে।”

“মহিলা??” বিস্মিত হলো ক্যান্সারের রোগী।

মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “রহস্যময়ী এক মহিলা। খুবই ভালো একজন কুক…অসাধারণ সব খাবার নাকি রান্না করতো।”

“একজন কুকের সাথে দেখা করতে গেছিলো হাসিব?!” অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলো আশেকের বুবু। যে দুচোখে মৃত্যুর স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে, তাতে এখন অপার বিস্ময়।

“মহিলা ওখানে একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলো…খুবই সুস্বাদু খাবার পাওয়া যেত…হাসিব ওখানেই গেছিলো শেষবার। শুধু এটুকুই জানা গেছে।”

“তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস। ঠিক করে বল, ঐ মহিলার সাথে হাসিব কেন দেখা করতে গেছিলো? খাওয়ার জন্য নিশ্চয় সে যায়নি? আর যদি খেতেই গিয়ে থাকে তাহলে ফিরে এলো না কেন!”

আশেক মাহমুদ আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আসল সত্যটা ঐ অফিসারও বের করতে পারেনি, তবে তার ধারণা, হাসিবের সাথে ঐ মহিলার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে, তাদের মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়েছিলো।”

ফেসবুকের কথা শুনে তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো হাসিবের মায়ের। এই ফালতু জিনিসটা মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু কাজ করে ঠিক উল্টোটা। কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে, দূরের মানুষকে কাছে এনে মিথ্যে এক জগত তৈরি করে, আর দিন দিন সেই জগতে বন্দী হয়ে পড়ছে মানুষজন। কানাডায় যখন মেয়ের কাছে ছিলো, দেখেছে, তার টিনএজার নাতি-নাতনিরা সারাদিন ডুবে থাকে এই ফেসবুক নিয়ে, নানির খোঁজ নেবারও সময় পেতো না। কিন্তু যেদিন অসুস্থ নানির সাথে সেল্ফি তুলে তার নাতি-নাতনিরা ফেসবুকে পোস্ট দিলো ‘প্রে ফর মাই গ্র্যান্ডমাদার,’ সেদিনই আর্জুমান্দ বেগম বুঝে গেছিলো, পৃথিবীটা আসলেই রসাতলে তলিয়ে গেছে।

গভীর করে দম নিয়ে বললো বৃদ্ধা, “ঠিক আছে, হাসিব ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে গেছিলো…এর সাথে তার নিখোঁজের কী সম্পর্ক? কী এমন ঘটনা ঘটেছে…ওখানে গিয়ে সে আর ফিরে এলো না?”

বুবুর দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তারপরই মিথ্যেটা বললো, “সেটা তো জানা যায়নি, তবে ঐ অফিসার মনে করছে, মহিলা কোনো চক্রের সাথে জড়িত।”

“কীসের চক্র?”

বলতে একটু ইতস্তত করলো আশেক। “মহিলা এক সময় ডাক্তার ছিলো, বুবু। পরে কোনো এক কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়। বয়সে বড়, এক ধনী লোককে বিয়ে করে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে যায় সে। ঐ লোকের পূর্বপুরুষেরা সুন্দরপুর নামে এক এলাকার জমিদার ছিলো।”

“কিন্তু ঐ মহিলা কেন হাসিবকে…” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কারণ কী? কীসের জন্য সে এটা করলো? টাকার জন্য নিশ্চয় এ কাজ করেনি সে?”

মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো আশেক মাহমুদ। “জানি না, বুবু।” বোনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। যদিও নুরে ছফা তাকে বলেছিলো, মহিলা সম্ভাব্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী দলের সদস্য কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রি বোনকে সে কথা বলা মানেই স্বাভাবিকভাবে তার মনে কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্যকল্প উসকে দেয়া। বিভৎস সেই দৃশ্য। এমন নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, নিজের সন্তানকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবা নিশ্চয় সুখকর হবে না।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেলো, তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভাঙলো আশেক মাহমুদ নিজেই। “রহস্যময়ী এক নারী। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার।” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো পিএস, “আসল নাম মুশকান সোহেলি, বিয়ের পর হয়ে যায় মুশকান জুবেরি। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকলেও এক সময় দেশে চলে আসে, ঢাকার এক হাসপাতালে চাকরি নেয়। ঐ ইনভেস্টিগেটর আমাকে শুধু এটুকুই জানাতে পেরেছে, বুবু।” পরক্ষনেই পিএস টের পেলো তার বোনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হাত। অবাক হয়ে ফিরে তাকালো বোনের দিকে।

আর্জুমান্দ বেগমের নিষ্প্রাণ চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল জ্বলই করছে না, দুটো ছোট্ট বিন্দু যেনো অস্থির হয়ে লাফাচ্ছে শূন্যে! রাগে না ক্ষোভে, বুঝতে পারলো না। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে কঙ্কালসার হাতটি।

.

অধ্যায় ৪

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করে গেলেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি নুরে ছফার।

ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রভূমি এই অফিসটির ছোটোখাটো কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই কমবেশি ক্ষমতার দম্ভ আর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান হলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের পদটি। এটা পেতে মারাত্মক রকমের লবিং করা হয়, মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকদলের ভেতরে নানান গোষ্ঠি আর চক্র। যারা এখানে কাজ করার সুযোগ পায় তারা ধরেই নেয়, এটাই তাদের সারা জীবনের সবচাইতে বড় সাফল্য-বিশেষ করে ক্ষমতা আর অর্থোপার্জনকেই জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা হিসেবে গণ্য করে যারা।

এ মুহূর্তে নুরে ছফা বসে আছে এরকমই একজন সফল মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের অফিসে। ভদ্রলোক কী একটা কাজে ব্যস্ত আছে। একজন আরদালি এসে তাকে এক কাপ চা দিয়ে বলে গেছে, আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে, একটু পরই চলে আসবেন পিএস।

ছফা যথেষ্ট অবাক হয়েছে আজকের এই কলটির জন্য। এর আগে, সুন্দরপুর থেকে যখন মুশকান জুবেরিকে ধরতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত সচিবের সাথে দেখা করেছিলো তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ভদ্রলোক তার মুখ থেকেই জানতে চেয়েছিলো তদন্তের কী অবস্থা।

হাসিব নামের এক নিখোঁজ ছেলের মামা, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব কেটার তদন্ত করতে বলেছিলো ডিবিকে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলো, নুরে ছফা যেনো কেসটা দেখে। ফলে ওখান থেকে ফিরে আসার পর তার কাছ থেকেই সবটা শুনতে চেয়েছিলো ভদ্রলোক। তবে ছফা পুরো ঘটনাটা বলেনি। সব কিছু বিবেচনায় নিলে, এটা কাউকে বলাও সম্ভব ছিলো না। তাই সে বলেছিলো, নিখোঁজ হাসিবের শেষ গন্তব্যস্থল ছিলো ঢাকা থেকে বহু দূরে, সুন্দরপুরে অদ্ভুত নামের একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের মালিক মুশকান জুবেরি নামের রহস্যময়ী এক মহিলা। ছফা তদন্ত করে দেখেছে, ফেসবুকে এই মহিলার সাথে হাসিবের পরিচয় হয়েছিলো।

তাহলে ওখানে যাবার পর হাসিব কেন নিখোঁজ হলো?

এমন প্রশ্নের জবাবে ছফা তাকে জানায়, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়, তাই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তার কাছে শক্ত কোনো প্রমাণও নেই, হাসিব নামের ছেলেটি কী ভাগ্য বরণ করেছিলো। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সে আমেরিকায় ছিলো। পেশায় একজন মেডিকেল ডাক্তার। তখন অবশ্য নাম ছিলো মুশকান সোহেলি। অনেকদিন আমেরিকায় থাকার পর দেশে চলে আসে। ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কাজও করেছে বেশ কিছু দিন। তারপর হুট করেই সেই চাকরি ছেড়ে দেয়। গুজব আছে, অনৈতিক কাজের সাথে মহিলা জড়িত ছিলো। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুনাম বজায় রাখার জন্য পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়, তাই সত্যিটা বের করা সম্ভব হয়নি।

যাই হোক, ঐ হাসপাতালে কাজ করার সময়ই ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রোগীকে বিয়ে করে মহিলা। পঞ্চাশোর্ধ রাশেদ জুবেরি ছিলো উত্তরাঞ্চলের এক জমিদারের একমাত্র বংশধর। ওখানকার বিপুল পরিমাণের স্থাবর সম্পত্তির মালিক ছিলো সে। এভাবে ভদ্রলোকের বিপুল সম্পত্তি করায়ত্ত করে নেয় মহিলা। পেশায় ডাক্তার হলেও মুশকান নামের ঐ মহিলার ঝোঁক ছিলো রান্নাবান্নার দিকে। অসাধারণ একজন কুক। মি. জুবেরি ক্যান্সারে মারা গেলে সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের অদ্ভুত একটি রেস্টুরেন্ট দেয় সে। তার খাবারের অসাধারণ স্বাদের কারণে ক্রমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ছুটে যেতে শুরু করে ওখানে। ফলে, মফশ্বল শহর হলেও ঐ রেস্টুরেন্টের সুবাদে ভোজন রসিকদের কাছে সুন্দরপুর হয়ে ওঠে তীর্থস্থানে।

কিন্তু হাসিবের সাথে মহিলার কী সম্পর্ক ছিলো?-প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ অধৈর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলো ছফার কাছে।

সে জানিয়েছিলো, সম্ভবত ঐ মহিলার সাথে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো হাসিবের। মহিলা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

ঠিক আছে, সুন্দরপুরের এক রহস্যময়ী, সুন্দরী, গুণবতী মহিলার সাথে ফেসবুকে হাসিবের ঘনিষ্ঠতা হলো, তারপর একদিন সেখানে গেলো মহিলার সাথে দেখা করতে-কিন্তু ওখানে যাবার পর কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, সে নিখোঁজ হয়ে গেলো? তার আসলে কী হয়েছিলো?

আশেক মাহমুদের কাছ থেকে এমন যৌক্তিক প্রশ্ন যে আসবে সেটা আগে থেকেই জানতো নুরে ছফা। জবাবটাও সে প্রস্তুত করে রেখেছিলো। সে জানায়, খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শুধু হাসিবই নয়, এই মুশকান জুবেরি আরো তিন-চারজনকে এভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে সখ্যতা তৈরি করে সুন্দরপুরে নিয়ে গেছে…তাদের কারোরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো আশেক মাহমুদ-কেন?

ছফা তখন আরেকটি মিথ্যে বলে-অবশ্য এটা সত্যের অনেক কাছাকাছি : তার ধারণা মুশকান জুবেরি অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতো, তবে পার্থক্য হলো, সে ভিক্টিমের অগ্যানও কালেক্ট করে।

এ কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলো পিএস। ফ্যাকাশে হয়ে গেছিলো তার চোখমুখ।

ছফা আরো জানায়, স্থানীয় পুলিশ-এমপি সবার সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মহিলাকে ধরা কঠিন ছিলো তার পক্ষে। তারপরও সে যখন মুশকান জুবেরিকে তার বাড়িতে গিয়ে হাসিবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, তখন মহিলা তার লোকজন দিয়ে ছফাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ওরা তার অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। ঐ বাড়ির একটি ঘরে তাকে বন্দী করে রেখে পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই মহিলা। কিন্তু ভাগ্য ভালো, অল্পের জন্য প্রাণে বেচে গেছে, সেজন্যে সুন্দরপুর থানার ওসি আর ওখানকার এসপি’র কাছে সে কৃতজ্ঞ। তারা সঠিক সময়ে না এলে মারাই যেতো।

ছফাকে এরকম গল্প বলতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কারণ, তার কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, সে বলবে মুশকান জুবেরি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ ভক্ষণ করে নিজের যৌবন দীর্ঘায়িত করে। নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে সেই অঙ্গটি খেতে হয়। এটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছে মহিলা। হাসিবসহ আরো কয়েকজন নিখোঁজের ভাগ্যে এমন পরিণতিই ঘটেছে-তারা সবাই মুশকান জুবেরির শিকার। এ কথা শুনে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবে। ভাববে, তদন্তে ব্যর্থ হয়ে, আসামিকে ধরতে না পেরে এমন গালগল্প ফাঁদছে সে। তারচেয়েও বড় কথা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনো ভিক্টিমের পরিণতি নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যায় না। মুশকানকে যদি ধরতে পারতো, তার কাছ থেকে জবানবন্দী আদায় করে নিতে পারতো তাহলে নিশ্চিত করে সেটা বলা যেতো। অন্যের জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করে এরকম কোনো ধারণা করা ঠিক হবে না।

ছফার কাছে একমাত্র যে প্রমাণটি ছিলো সেটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের স্বীকারোক্তি। সেটাও আবার সরাসরি নুরে ছফার কাছে স্বীকার করেননি তিনি, করেছিলেন ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের কাছে। সেই ডাক্তারও ঘটনার পর পর দেশ ছেড়েছেন। ছফা একবার ভেবেছিলো, নিছক সন্দেহ হিসেবেই কথাটা বলবে কিনা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, ভিক্টিমের নিকটাত্মীয় হিসেবে কথাটা শুনে কী রকম অনুভূতি হতে পারে ভদ্রলোকের।

অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরি আমেরিকার কোথায় ছিলো সেটা বের করতে সক্ষম হয়নি নুরে ছফা। তাছাড়া, আন্দিজের ঐ ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে হাতেগোণা যে কয়জন জীবিত আছে এখনও তাদের খোঁজ করাটাও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এদের বেশির ভাগই বয়সের কারণে মারা গেছে। হাতেগোনা যে কয়জন বেঁচে আছে তারা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের নাগরিক। বর্তমানে কে কোথায় আছে কেউ জানে না। তারপরও কাকতালীয়ভাবে একজনকে পেয়ে গেছিলো ফেসবুকে, কিন্তু ভদ্রলোক আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। অতো আগের ঘটনা তো দূরের কথা, সকালে নাস্তা করেছে কিনা সেটাই ভুলে বসে থাকে!

আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশে বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের নিয়ে পিয়ার্স পল রিড যে বইটি লিখেছেন-অ্যালাইভ : দ্য স্টোরি অব দি আন্দিজ সারভাইভার্স-সেটাকে সূত্র হিসেবে ধরেও কিছুটা খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু ভদ্রলোক ছফার মেইলের জবাবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের মধ্যে যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছে তাদের ব্যাপারে তিনি কোনো রকম তথ্য দিতে পারবেন না।

“কী ব্যাপার, চা খেলেন না যে?”

নম্রভদ্র কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ একটি কণ্ঠ শুনে ছফা সম্বিত ফিরে পেলো। তাকিয়ে দেখলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব ঘরে ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো সে।

ভদ্রলোক নিজের ডেস্কে বসে ছফাকেও বসার জন্য ইশারা করলো। “আপনি বোধহয় একটু আগে চলে এসেছেন?”

“জি, স্যার,” বললো নুরে ছফা। “জ্যামের কারণে দেরি হতে পারে বলে একটু আগেভাগে রওনা দিয়েছিলাম, পরে দেখলাম আজকে তেমন একটা জ্যাম নেই।”

“পিএম অফিস শেষ করলেন একটু আগে,” কথাটা এমনভাবে বললো আশেক মাহমুদ, যেনো জবাবদিহির মতো না শোনায়।

ছফা কোনো কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

“কাজকর্ম কেমন চলছে?”

“জি, স্যার…ভালোই।”

“ঐ কেসটার আর কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি বোধহয়, তাই না?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। ব্যর্থতার কথা বলতে তার কখনও ভালো লাগে না, জঘন্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। আর ক্ষমতাবানদের সামনে ব্যর্থতার কথা বললে নিজেকে কেমন তুচ্ছ, অপাংক্তেয় মনে হয় তার।

“কিন্তু কদিন আগে, পহেলা বৈশাখে সম্ভবত এক ঝলক দেখেছিলাম তাকে।” কথাটা বলার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলে দিলো ছফা। নিজেকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইলো না। সে যে এই কেসটা নিয়ে এখনও কতোটা মগ্ন হয়ে আছে, কোটা মরিয়া, এই ক্ষমতাবান মানুষটি জানে না, তাকে জানানো দরকার।

বিস্ময়ে ভুরু কপালে উঠে গেলো আশেক মাহমুদের। “আপনি তাকে দেখেছেন!?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “শাহবাগের দিকে…আমি তখন রিক্সায় ছিলাম…মহিলা একটা প্রাইভেটকারে ছিলো।”

“তারপর?” উৎসুক হয়ে উঠলো পিএস।

“আমি রিক্সায় ছিলাম বলে গাড়িটা ধরতে পারিনি।”

পিএস এখনও উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাটা শোনার জন্য।

“গাড়ির নাম্বারটা টুকে রাখতে পারিনি উত্তেজনার চোটে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। আরেকবার আশ্বস্ত করার মতো সংবাদ শুনতে না পেয়ে হতাশই হলো। “যাই হোক, আপনি তো এতোদিনেও ঐ মহিলার কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেননি?”

মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো নুরে ছফা। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি-মুশকান জুবেরির কোনো ছবি সে জোগাড় করতে পারেনি। যে হাসপাতালে সে কাজ করতো সেখানকার এম্প্রয়ি ফাইল থেকে সব কিছু গায়েব হয়ে যায় মহিলার অন্তর্ধানের পর পর। আর এ কাজটা যে মহিলার ডাক্তার বন্ধু এবং সহকর্মী আসকার ইবনে সায়িদ করেছেন সে-ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

“আমি তার ছবি জোগাড় করার অনেক চেষ্টা করেছি,” ছফা বললো। “কিন্তু মহিলা অনেক চতুর, সবখান থেকে নিজের ছবি সরিয়ে ফেলেছে। ছবি থাকলে কাজটা সহজ হতো অনেক।”

“হুম,” গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো একান্ত সচিব। “এ-ব্যাপারে আমার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো সে। “আপনি বলেছিলেন মহিলা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়…সুন্দরী…যেকোনো পুরুষকে কাবু করার মতো?”

“জি, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস। তারপর ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা এনভেলপ বের করে বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে। “এটা দেখুন।”

একটু অবাক হয়েই ছফা এনভেলপটা হাতে নিলো, খুলে দেখতেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেলো সে। অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে গেলো তার।

ছয় বাই দশ হবে। বেশ পুরনো হলেও ছবিটা সাদাকালো নয়-রঙ্গিন। সেই রঙ লালচে হয়ে গেছে।

“চিনতে পেরেছেন?”

আশেক মাহমুদের দিকে পলকহীন চোখে তাকালো নুরে ছফা। “এ এটা তো…” ঢোঁক গিললো সে। “…মুশকান জুবেরি!”

“মুশকান সোহেলি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “এটাই তার আসল নাম।”

ছফা স্থির চোখে চেয়ে রইলো কেবল।

এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ, “মাই গড! তাহলে বুবুর কথাই ঠিক!”

.

অধ্যায় ৫

দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!

আশেক মাহমুদ মনে মনে বললো। নুরে ছফার হতভম্ব মুখটা দেখতে তার ভালোই লাগছে।

ছফার ডানহাতে বহুকাল আগের রঙ্গিন ছবিটি, সেই ছবি থেকে তার চোখ সরছেই না। অবিশ্বাসে তার কপালে পড়েছে ঘন ভাঁজ। চোখদুটো প্রায় স্থির, পলক পড়ছে বেশ ধীর গতিতে।

“ঐ মহিলা আমেরিকায় থাকার সময় ভোলা ছবি…কমপক্ষে চল্লিশ পাঁচচল্লিশ বছর আগেকার ছবি।”

ছফা বুঝতে পারলো সে বিপদে পড়ে গেছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হতে লাগলো তার। দ্রুত খেলা করে গেলো কিছু ভাবনা। মুখ তুলে তাকালো সে। প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মুখে বিজয়ীর হাসি।

“এ ছবি আপনি কোত্থেকে পেলেন, স্যার?”

“অনেক লম্বা গল্প,” বললো আশেক মাহমুদ। “তার আগে বলুন, আপনি এই মহিলা সম্পর্কে আর কী জানেন?”

ছফা নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। দ্রুত ভেবে গেলো পরবর্তী কথাগুলো নিয়ে। সত্যিটা তাকে বিপদে ফেলে দেবে। আর মিথ্যেটা? সে জানে না। তার সামনে যে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বসে আছে সে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে কতোটুকু জানে, তার কোনো ধারনাই নেই। এই ছবিটাই বা কোত্থেকে জোগাড় করেছে তা-ও বুঝতে পারছে না।

নুরে ছফার আরেকটু সময় দরকার-কী বলবে সেটা গুছিয়ে নেবার। জন্য। “আমি এই কেসটা তদন্ত করতে গিয়ে যতোটুকু জেনেছি সবটাই আপনাকে বলেছি।” অবশেষে নিজের বক্তব্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্তই নিলো

সে। কোনো কিছু না-জানাটা দোষের হতে পারে কিন্তু অন্যায় নয়। তবে জেনেবুঝে কোনো কিছু লুকোনোটা ভীষণ অন্যায়-ছফা অবশেষে দুটোর মধ্যে প্রথমটাই বেছে নিলো।

“তাহলে আমি বলবো আপনি আসলে কিছুই জানেন না,” আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিলো আশেক মাহমুদ।

হাফ ছেড়ে বাঁচলো ছফা। ক্ষমতাধর মানুষেরা তাদের নীচের দিকে থাকা মানুষজনের অযোগ্যতা আর অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারলে এক ধরণের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এখন সেই ঢেঁকুর তুলছে।

“আপনার এই মুশকান জুবেরি-মানে, ডাক্তার মুশকান সোহেলি কোনো অগ্যান পাচারকারী কিংবা সিরিয়াল কিলার নয়,” ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বললো আশেক মাহমুদ। “অবশ্য আপনার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়।” ক্ষমতাধর লোকটি বাঁকাহাসি দিলো। “তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতোই।”

ছফা আরেকটু আশার আলো দেখতে পেলো। উৎসুক হবার ভান করলো সে।

“আপনি তো তিন বছর আগে তাকে দেখেছেন, তখন তার বয়স কতত ছিলো?”

একটু ভেবে নিলো নুরে ছফা। তিন বছর আগে কী বলেছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। মিথ্যে বলতে গেলে যে তুখোড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হয় সেটা আরেকবার টের পেলো হাড়ে হাড়ে। “উমম…ত্রিশ-বত্রিশের মতো হবে?”

আশেক মাহমুদের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “তাহলে আপনি অবাক হচ্ছেন না কেন?”

“মানে?” ছফা হুট করেই বলে ফেললো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা করলো সে। ধ্যাত্ব! এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

“জি, স্যার…মহিলার মধ্যে তো কোনো পরিবর্তনই দেখছি না?” একেবারে নিদোষ ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বললো। আমি তাকে তিন বছর আগে এরকমই দেখেছি…অথচ এই ছবিটা বেশ পুরনো!”

“পঁচাত্তুর সালের দিকে তোলা,” আশেক মাহমুদ জানালো তাকে। “প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগেকার…ভাবতে পারেন??”

ছফা চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব আনার চেষ্টা করলো। এই প্রথম অভিনেতাদেরকে ঈর্ষা করলো মনে মনে। এর আগে তাদেরকে জোকার বলেই করুণা করতো। “মাই গড!” বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ানোর জন্য ইংরেজিতে বললো এবার। “এটা কী করে সম্ভব!?”

বাঁকাহাসি দিলো আশেক মাহমুদ। “অবিশ্বাস্য ঘটনা…বুঝলেন? কিন্তু এটাই ঘটেছে।”

মাথা দোলালো নুরে ছফা। তার বিশ্বাস হচ্ছে না-এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করলো। “বলেন কী, স্যার!”

“হুম,” আশেক মাহমুদ ডান হাতটা ডেস্কের উপরে রেখে তর্জনি দিয়ে টোকা দিতে শুরু করলো। এখন আমি যেটা বলবো সেটা আপনি বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।”

আমাকে আর নতুন করে কী অবিশ্বাস্য গল্প শোনাবেন? মনে মনে বললো সে, কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই ভিন্ন। “কী, স্যার?”

“বলবো, তার আগে এক কাপ চা-কফি হয়ে যাক।” আশেক মাহমুদ ইন্টারকমটা তুলে নিলো। “আপনি কি চা নেবেন নাকি কফি?”

সামনে থাকা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে চট করে তাকিয়ে বললো নুরে ছফা, “কফি।”

.

অধ্যায় ৬

নুরে ছফার চোখেমুখে সত্যিকারের বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে হাসিবের ক্ষমতাধর মামার কাছ থেকে মুশকান জুবেরির আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ আর ক্যানিবালিজমের কথা শোনার পর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই ক্ষমতাধর মানুষটি কী করে জানতে পারলো এটা, আর মুশকানের পুরনো ছবিটাই বা কী করে জোগাড় করলো-কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার।” নুরে ছফা নিজেই অবাক হলো, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পড়লে যে, সে-ও দারুণ অভিনয় করতে পারে সেটা বুঝতে পারছে আজ। তবে নিজের সৌভাগ্যকেই কৃতিত্ব দিচ্ছে সে। প্রথমে ভেবেছিলো, তার বলা মিথ্যেগুলো বুঝি ধরা পড়ে গেলো কিন্তু এখন অনেকটা নির্ভার লাগছে।

“আমি যখন প্রথম শুনলাম আমার অবস্থাও আপনার মতোই হয়েছিলো,” এবার সামনের দিকে ঝুঁকে এলো আশেক মাহমুদ। “বিশ্বাসই হতে চাইছিলো না। বিশেষ করে, মহিলা এতোগুলো বছর পরও কী করে নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”

নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিলো। “সত্যি অবিশ্বাস্য!”

“শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন,” একটু থেমে আবার বললো, “কে বিশ্বাস করবে এসব কথা?!”

কেউ না, স্যার, মনে মনে বলে উঠলো ছফা। আর সেজন্যেই আমি আপনাকে এটা বলিনি। নিজের সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকবার শক্তিশালী যুক্তিটা খুঁজে পেলো।

“এই মহিলা আস্ত একটা ডাইনি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “প্লেন ক্র্যাশের পর বাঁচার জন্য নরমাংস খেয়েছিলো, তারপর থেকে এর স্বাদ পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে ক্যানিবালিজম প্র্যাকটিস শুরু করে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার!”

ছফাও চোখেমুখে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো। “আপনি এসব জানলেন কী করে, স্যার?” প্রশ্নটা না করে আর পারলো না।

চোখেমুখে আমুদে ভঙ্গি ফুটে উঠলো আশেক মাহমুদের। ক্ষমতাধরদের এমন ভঙ্গির সাথে ছফা বেশ পরিচিত-তোমাদের ধারণাও নেই আমার হাত কতো লম্বা-এরকম একটি ভঙ্গি থাকে তাতে।

“হাসিবের মা, আমার বড়বোন…” আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ। “…আপনি হয়তো জানেন না, আমার বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। গত বছর।”

“ওহ্,” কথাটা শুনে সত্যি সত্যি দুঃখিত হলো ছফা। এততক্ষণ ধরে অভিনয় করে গেছে, এখন যেনো কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।

“আমার এই বোন যুদ্ধের পর পরই স্বামীর সাথে আমেরিকায় চলে যায়। ওখানেই ছিলো দীর্ঘদিন। হাসিব জন্ম নেবার পর বাকি সন্তানসহ তারা আবার চলে আসে দেশে। বুবুর বড় মেয়ে আর ছেলে পড়াশোনা করার জন্য কানাডায় চলে গেলেও হাসিব দেশেই থেকে যায়। আমার দুলাভাই আর বোনও দেশে ছিলো দীর্ঘদিন, কিন্তু দশ বছর আগে তারা চলে যায় তাদের বড় মেয়ের কাছে….কানাডায়।” একটু থেমে আবার বললো, “হাসিব তো বিয়ে-শাদি করেনি, একা থাকতো। বাবা-মাকে টেক কেয়ার করাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাদেরও বয়স হয়ে গেছিলো…দু জনেরই টেক কেয়ারের দরকার ছিলো।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলো একনিষ্ঠ শ্রোতা নুরে ছফা।

“হাসিব নিখোঁজ হবার দু-মাস পরই আমার দুলাভাই হার্ট ফেইলিওরে মারা যান,” একটু থেমে আবার বললো, “আর গত বছর বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর যখন ডাক্তার জানিয়ে দিলো কোনো আশা নেই, টার্মিনাল স্টেজে আছে রোগটা, তখন বুবু এখানে চলে আসে। এখন উঠেছে আমার বাসায়।” একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিলো পিএস। “আমার ওয়াইফ আবার হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করছে এক বছর ধরে, ফলে তাকে দেখাশোনা করার জন্য সার্বক্ষণিক নার্স রাখতে হয়। আমি তো সারা দিন ব্যস্ত থাকি…বুঝতেই পারছেন।” জবাবদিহি করার মতো শোনালো তার শেষ কথাটা।

আরো একবার মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তবে সে ভালো করেই জানে, প্রধানমন্ত্রীর পিএস যা বললো তা পুরোপুরি সত্যি নয়। এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বহু মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখনও চলছে সেই ধারা। এদের কর্মকাণ্ডের কারণেই কানাডার মন্ট্রিলের একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে বেগমগঞ্জ-সব বেগমদের ঠিকানা! সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেগমসাহেবারা উন্নত দেশে নিরাপদ জীবনযাপন করছে আর তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাসঙ্কুল, দরিদ্র একটি দেশ লুটপাট করে, চুষে চুষে তাদের পতিদেবেরা স্ত্রী সন্তানদের জন্য স্বর্গীয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে-এই স্বর্গে স্বামীরাও যোগ দেবে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে কিংবা রক্ত খাওয়া শেষ হলে।

“কাল বুবু আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, তার ছেলের কেসটার কী অবস্থা।”

সম্বিত ফিরে পেলো ছফা, আবারো মনোযোগ দিলো প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কথাবার্তার দিকে।

“বুঝতেই পারছেন, খুব বেশি সময় তো আর নেই,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “বুবু খুব করে চাইছে, তার ছেলের কী হয়েছিলো সেটা জানতে…কে তার এতো বড় সর্বনাশ করলো, কেন করলো।”

“জি, স্যার…এটা খুবই স্বাভাবিক।”

“কিন্তু আমি তো তার এমন অবস্থায় খারাপ কোনো সংবাদ দিতে পারি, পারি কি?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।

“আমি তাকে শুধু জানালাম, হাসিবের শেষ গন্তব্য ছিলো মুশকান জুবেরির ঐ রেস্টুরেন্টটায়…কী যেনো নাম…রবীন্দ্রনাথ ওখানে…?”

“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি…” ছফা বলে দিলো।

“হুম। বুবুকে বললাম, সুন্দরপুরের ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো হাসিব, তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার।” একটু থেমে আবার কফির কাপে চুমুক দিলো। “যখন তাকে বললাম, মুশকান কে, কী করে, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলো, একজন মেডিকেল ডাক্তার, বিয়ের আগে তার নাম ছিলো মুশকান সোহেলি…তখনই বুবু চমকে ওঠে।”

ছফাও চমকে উঠলো সত্যি সত্যি। “উনি ঐ মহিলাকে চিনতেন?!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “হুম। কী আর বলবো, আমেরিকায় যাওয়ার পর বুবুরা ঐ মহিলারই প্রতিবেশী ছিলো!”

“বলেন কী, স্যার!”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভদ্রলোক। “দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!”

কাকতাল আর ঘটনাচক্র নিয়ে ছফা বরাবরই অবাক হয় কিন্তু এরকম কাকতালীয় ঘটনার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সে। নিজের বিস্ময় আর লুকাতে পারলো না।

“আন্দিজ থেকে বেঁচে যাওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা এটি,” বললো আশেক মাহমুদ। “মুশকান সোহেলির নরমাংস খাওয়ার কথাটা কিভাবে যেনো বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেলে মহিলা রীতিমতো একঘরে হয়ে পড়ে।”

ছফাও আনমনে তার কফির কাপটা তুলে নিলো এবার।

“যাই হোক, এসব জানাজানির আগেই আমার বুবুর সাথে ঐ মহিলার বেশ সখ্যতা হয়ে গেছিলো, প্রায় সমবয়সী ছিলো তারা। যে ছবিটা দেখছেন সেটা তখনকার সময়ই ভোলা। ওরা আরো কিছু বন্ধুবান্ধবসহ একটা পার্কে গেছিলো পিকনিক করতে, তখন এই ছবিটা তুলেছিলো আমার বুবু।”

ছফা অবাক হয়ে আশেক মাহমুদের দিকে তাকিয়েই কফিতে প্রথম চুমুকটা দিলো। সে উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাগুলো শোনার জন্য।

আশেক মাহমুদ যখন তার বোনের কাছ থেকে শুনতে পেলো মুশকান সোহেলি নামের একজনকে সে চিনতো বহুকাল আগে, তখন ভেবেছিলো এটা হতেই পারে না। যে মুশকান হাসিবের অন্তর্ধানের জন্য দায়ী সে কোনো যুবতীই হবে-তা না হলেও মাঝবয়সী কোনো মহিলা হবে নির্ঘাত। কিন্তু সত্তুর বছরের কোনো নারী? অসম্ভব। এদিকে, নুরে ছফা তাকে বলেনি মুশকান জুবেরির বয়স কতো ছিলো। কঠিন এক অনিশ্চয়তা আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় সে।

যাইহোক, তার বুবু এতোটা কাকতালীয় ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। কানাডায় ফোন করে মেয়ের কাছে থাকা তার পুরনো ছবির অ্যালবাম থেকে মুশকানের একটি ছবি মেইল করে দিতে বলে, তারপর সেই ছবিটা দেখায় আশেককে। ছবি দেখে পিএস বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ পঁচাতুর সালেও মহিলা পরিপূর্ণ যুবতী ছিলো, প্রায় তার বুবুর বয়সী একজন। এরকম একজনের সাথে কী করে হাসিব হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবে?

কিন্তু ছফার কাছ থেকে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে যা যা শুনেছে সেগুলোর প্রায় সবটাই মিলে যাচ্ছে বিয়ের আগের নাম মুশকান সোহেলি। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার। আমেরিকায় ছিলো দীর্ঘদিন। পরে দেশে চলে আসে! এটাকে যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কাকতালীয় ঘটনা বলে মেনে নেবে না। এরপরই আশেক মাহমুদের বড় বোন জানায়, মুশকান সোহেলি আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন। আর তার নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য, গা গুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাটি।

নিশ্চিত হবার জন্য আশেক ছবিটা নিয়ে নেয় ছফাকে দেখাবে বলে। এখন সে দেখতে পাচ্ছে, তার বুবুর কথাই ঠিক।

“আস্ত একটা ডাইনি এই মহিলা,” কফির কাপ রেখে কথাটা আবারো বললো আশেক মাহমুদ। “এতোদিন আপনার কাছে তার কোনো ছবি ছিলো না, এখন আছে। আর ভাগ্য ভালো, পুরনো ছবিটাই কাজে লাগবে। কারণ। ঐ ডাইনি অলৌকিকভাবেই নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরির কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেনি সে। এমনকি সুন্দরপুরের জমিদারের বিশাল সহায়সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দেয়ার যে কাগজপত্র সেগুলো খতিয়েও দেখেছে, কোনো লাভ হয়নি। ছফা অবাক হয়ে দেখেছে, ওখানে মালিক হিসেবে মুশকান জুবেরির কোনো ছবি নেই-রাশেদ জুবেরির ছবি দেয়া! আর ট্রাস্টের সমস্ত কাগজপত্র রাশেদ জুবেরি মারা যাবার আগেই তৈরি করা হয়েছে!

“সে কোনো সিরিয়াল কিলার নয়…মানুষখেকো এক ডাইনি,” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। “মানুষ খেয়ে খেয়েই সে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে। এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”

ছফা চোখেমুখে বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি ধরে রাখলেও মুখে কিছু বললো না। নিজের অভিনয় দক্ষতার উপরে তার খুব বেশি আস্থা নেই।

“আরেকটা ঘটনার কথাও বুবু আমাকে বলেছে।”

“কী ঘটনা, স্যার?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো ডিবির নুরে ছফা।

“ঐ ডাইনি আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবার প্রায় বিশ বছর পর, বুবু আর দুলাভাই লন্ডনে গেছিলো কী একটা কাজে…হিথ্রো’তে তখন ঐ মুশকানকে নাকি বুবু দেখেছিলো!”

“বলেন কি!”

“তখনও মহিলার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেনি বুবু…একদম অবিকল বিশ বছর আগে যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেছিলো!”

ছফার ভুরু কপালে উঠে গেলো।

“বুবু বলেছে, ঐ মহিলা তাকে দেখামাত্রই সটকে পড়ে। আমার দুলাভাইকে বুবু এ কথা বললে, তিনি মোটেও বিশ্বাস করেননি। দুলাভাইয়ের ধারণা, ওটা বুবুর হেলুসিনেশান ছিলো, নয়তো লোকজনের ভীড়ে মুশকানের মতো কাউকে দেখেছে।”

ছফা কী বলবে ভেবে পেলো না।

“বুবুও ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি…বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো, যা দেখেছে ভুলই দেখেছে, কিন্তু আমার কাছ থেকে সব শোনার পর বুবুর মনে হয়েছে, ঐদিন তার সেই দেখাটা মোটেও ভুল ছিলো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবি অফিসার।

“যাই হোক, আপনি যে খুব একটা ভুল করেছেন তা-ও বলা যাবে না,” বললো আশেক মাহমুদ। “মহিলা সিরিয়াল কিলারদের মতোই…পার্থক্য হলো, সে তার শিকারদের নিছক খুন করে আনন্দ পায় না, তাদেরকে…” কথাটা আর শেষ করলো না, তার কোনো দরকারও নেই।

চুপ মেরে রইলো নুরে ছফা।

“এখন যেভাবে পারেন ওই ডাইনিকে খুঁজে বের করুন। যতো দ্রুত সম্ভব!” বললো আশেক মাহমুদ। “আমি চাই আমার বুবু যেনো জেনে যেতে পারে, তার সন্তানের হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”

মুখ তুলে তাকালো ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর। তিন বছরে যেটা করা সম্ভব হয়নি সেটা এই ছবি পাবার পর কি এতো দ্রুত করা যাবে?

“বুবুর জন্য খুব বেশি সময় নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব। “আপনাকে যতো রকম সাহায্য সহযোগীতা করা দরকার করবো। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করবো আমি। দরকার হলে ক্ষমতার বাইরে গিয়েও যা করার করবো!”

নুরে ছফা স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদের দিকে। পিএসের দৃঢ়তা সুস্পষ্ট। ব্যক্তিগত আবেগে ভাসছে।

“আপনি যা চাইবেন পাবেন। সব ধরণের সহযোগীতা,” একটু থেমে আবারো বললো, “সব কিছু মানে সব কিছু!

এটাকে আমি লাইসেন্স টু কিল’ হিসেবে ধরে নেবো কি? মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে ভালোমতোই অবগত আছে সে। এরা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই। পুলিশের বড় কর্তাদের বদলি থেকে শুরু করে টিভি স্টেশন ব্যাঙ্ক-বীমার লাইসেন্স পাইয়ে দেবার কাজও অনায়াসে করে দিতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করে কোনো মন্ত্রীর গদিও টলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।

ছবিটার দিকে আবারো তাকালো ছফা। একটা মাত্র ছবি তাকে কতোটুকু সাহায্য করবে, জানে না। তবে এটা দিয়ে নতুন করে আবার শুরু করা যাবে-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “আপনি একটা সরকারী প্লটের জন্য আবেদন করুন, আমি বাকিটা দেখবো। আর প্রমোশন নিয়ে ভাববেন না। ধরে নিন, ওটা হয়ে গেছে।”

এরকম লোভনীয় প্রস্তাব শুনে ছফা বিব্রত বোধ করলেও অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো। এ দেশে কাউকে ম্যানেজ করতে হলে তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা হয়-পদ, পদক আর প্লট। ছফাকে পদোন্নতি আর প্লটের টোপ দেয়া হচ্ছে! পদকও হয়তো জুটে যাবে।

“স্যার, এসবের জন্য না,” অবশেষে বিনীতভাবেই বলার চেষ্টা করলো সে। “আমি এই কেসটা সল্ভ করার জন্যই মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করবো। আমি চাই না আমার কোনো কেস আনসভ থাকুক।”

“দ্যাটস গুড,” বললো আশেক মাহমুদ। “খুঁজে বের করুন এই ডাইনিকে…যতো দ্রুত সম্ভব!”

.

অধ্যায় ৭

অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে রোমানার আর ভালো লাগছে না। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের সেলস এক্সিকিউটিভ সে। তার ছোট্ট, কিউবিকল সদৃশ অফিসটি ঢাকা বিমানবন্দরের আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ভবনের নীচতলায় অবস্থিত। তারা মোট তিনজন কাজ করে এখানে। অসুস্থতার কারণে একজন অনুপস্থিত। আজকে সুমিত নামের এক জুনিয়র আর রোমানা কাজ করছে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হচ্ছে না, এখন বলতে গেলে অফ সিজন। এই মওসুমে পর্যটক কম থাকে, ফলে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটের সংখ্যাও কমে আসে, কমে আসে তাদের ব্যস্ততাও।

শেষ ফ্লাইটটা ছিলো বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে, এরপরও পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। কেউ কেউ মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রোমানা আবার বইয়ের পোকা, সাধারণত পকেটবুক সাইজের পেপারব্যাক বের করে পড়ে সে। এ নিয়ে তার কিছু কলিগ হাসাহাসি করে, খোঁচা মেরে তাকে প্রফেসর আপা বলে ডাকে। আজকেও সে পিডি জেমসের একটি ডিটেক্টিভ বই হাতে নিয়েছিলো কিন্তু গল্পটা তাকে টানেনি। কম্পিউটারে বসে একটা গেম খেলারও চেষ্টা করেছিলো, সেটা আরো বেশি বিরক্তিকর লেগেছে। অগত্যা চুপচাপ বসে আছে সে। আর এক ঘণ্টা পর ছুটি, এই এক ঘণ্টাকে সহ্য করতে একটু বেশিই কষ্ট করতে হয়। সারাটা দিন কাজে ডুবে থাকলে কী হবে, ছুটির আগের সময়টায় এসে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়-কখন বাড়ি যাবো!

রোমানা ঠিক করলো কফি খাবে, ছুটির আগে সব সময়ই এটা করে সে।

“কই যান, আপা?” জুনিয়র ছেলেটা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জানতে চাইলো। এতোক্ষণ কম্পিউটারে সেলসের হিসেব দেখছিলো সে।

“একটু আসছি,” ইচ্ছে করেই কফির কথা বললো না, বললে এই ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে তার জন্যেও এক কাপ নিয়ে আসার জন্য তার মানে পুরো একশ’ টাকা গচ্চা। কী দরকার, এই ছেলে তো এখানে জয়েন করার পর থেকে খেয়েই যাচ্ছে, কখনও কি তার জন্য এক কাপ নিয়ে এসেছে?

রোমানা কিউবিকল থেকে বের হয়ে প্রথমেই কফি-বুথের দিকে গেলো, সে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই থমকে দাঁড়ালো। তাকে হাত নেড়ে ইশারা করছে তাদের এয়ারলাইন্সের কাস্টমার সার্ভিসের সুরভি নামের এক মেয়ে। তিনমাস হলো এখানে জয়েন করেছে, ফ্রন্টডেস্কে ডিউটি তার।

ফ্রন্টডেস্কের কাছে যেতেই সুরভি নিচুকণ্ঠে বললো, “আপা, একটু হেল্প করবেন?

রোমানা হাসিমুখে বললো, “কী ব্যাপার, বলো।”

“আপনি কি একটু ডেস্কে বসবেন? আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে। কিন্তু ডেস্কে কেউ নেই এখন।”

“বাকিরা কোথায় গেছে?” অবাক হলো রোমানা। ডেস্কে সাধারণত তিনজন থাকে। এখানেও দু-জন ছেলে একজন মেয়ে।

“ওরা সিগারেট খেতে গেছে।”

“ওহ্।” ছেলেগুলো সুযোগ পেলেই যে এ কাজ করে। এয়ারপোর্টে সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা জোন আছে, আর সেটা তাদের ডেস্ক থেকে। বেশ দূরে। সুতরাং, ছুটির আগে একটু ফাঁকা হয়ে এলে ধুমপায়ি এপ্লয়িরা হন্যে হয়ে ওঠে সিগারেট খাওয়ার জন্য। রোমানা কিছু না বলে ডেস্কের পেছনে চলে এলো। “তুমি যাও।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, আপা,” চপল কিশোরীর মতো দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেলো সুরভি।

ডেস্কে বসে এদিক ওদিক তাকালো রোমানা। আজকের জন্য তাদের। এয়ারওয়েজের সব ধরণের ফ্লাইট শেষ হয়ে গেছে। এখন পাততারি গোটানোর পালা। সবগুলো বেসরকারী এয়ারলাইন্সই একটু পর বন্ধ করে দেবে নিজেদের কাউন্টার আর ফ্রন্ট ডেস্ক।

আনমনে ডেস্কের দিকে চোখ যেতেই রোমানা কিছু একটা দেখতে পেয়ে কৌতূহলি হয়ে উঠলো।

একটা ফটোগ্রাফ।

ছবিটা হাতে নিতেই ভুরু কুঁচকে গেলো তার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এই ছবি এখানে কেন? এরকম ছবি সাধারণত পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দিয়ে যায়। কেন দিয়ে যায় এটা এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই জানে।

ক্রিমিনাল! বিরোধী দলের পলিটিশিয়ান? নাকি জঙ্গি?

আপন মনেই কাঁধ তুললো সে। তার অবশ্য সেরকমই কিছু মনে হচ্ছে।

“এই ছবি এখানে কেন? কিসের জন্য?” সুরভি ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইলে রোমানা।

ছবিটা দেখে ভুরু কপালে তুললো সুরভি। “ওহ্…এটা…আর বলবেন না, ডিবির এক অফিসার এসে দিয়ে গেছে আজকে।”

“মহিলা জঙ্গি নাকি?”

কাঁধ তুললো মেয়েটা। “আমাদেরকে তো কিছুই বলেনি। তবে মনে হচ্ছে, কোনো ক্রিমিনাল।”

“ক্রিমিনাল!” অবাক হলো রোমানা। “কি করেছে?”

“কী আর হবে, হয়তো খুনটুন করেছে। টেররিস্ট কানেকশানও থাকতে পারে। আজকাল তো বেশির ভাগ কেস এমনই হচ্ছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। জঙ্গি-সন্ত্রাসী নিয়েই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজকাল এয়ারপোর্টে বেশি আসে, এরকম ছবি দিয়ে যায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলোতে।

“আবার পলিটিশিয়ানও হতে পারে,” বললো সুরভি।

রোমানা অবশ্য সেরকম কিছু মনে করছে না। যদিও আজকাল এরকমটি প্রায়ই হচ্ছে-অমুক পলিটিশিয়ান যেনো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন ক্রশ করতে না পারে, তমুক এলে যেনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়-এরকম আদেশ-নির্দেশ হরদম দেয়া হচ্ছে।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। “আজকে দুপুরে এক লেডি প্যাসেঞ্জার অদ্ভুত আচরণ করেছিলো, বুঝলে?”

“কি রকম?” সুরভি আগ্রহ দেখালো।

“মহিলা সকাল দশটার ফ্লাইট মিস্ করে জ্যামের কারণে, পরে ফিফটি পার্সেন্ট ফাইন দিয়ে টিকেটটা রিশিডিউল করিয়ে নেয় পরের ফ্লাইটের জন্যে, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো?” সুরভির কাছ থেকে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “মহিলা ঐ ফ্লাইটটাও মিস্ করে। অথচ আমি তাকে ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি লাউঞ্জে বসে থাকতে।”

“বলেন কি!” অবাক হলো সুরভি। “আপনি শিওর, মহিলা ফ্লাইট মিস্ করেছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। “ফ্লাইট ছাড়ার পনেরো-বিশ মিনিট আগে আমাকে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে জানানো হয়েছিলো আমি যেনো ফোন করে ক্লায়েন্টকে ইনফর্ম করি। আমি তাকে ফোন করার পর পেয়েও যাই…কিন্তু মহিলা যখনই শুনতে পেলো আমি এয়ারলাইন্স থেকে কল করেছি তখনই লাইনটা কেটে দিলো।”

সুরভি অবাক হলো কথাটা শুনে। “এটা কেন করলো ভদ্রমহিলা…আজব তো!”

ঠোঁট ওল্টালো রোমানা। “আসলেই আজব। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে কি জানো, এই ছবির মহিলাই ছিলো ওই প্যাসেঞ্জার।”

সুরভির চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেলো।

“সম্ভবত লাউঞ্জে ওয়েট করার সময় ডিবি অফিসারকে দেখে সটকে পড়েছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুরভি। “তা হতে পারে।”

“আমি নিশ্চিত, এটাই হয়েছে, রোমানা জোর দিয়ে বললো।

“তাহলে কি আপনি বসূকে জানিয়ে দেবেন এটা?”

“হুম। জানানো তো দরকার, তাই না?”

.

অধ্যায় ৮

তিন দিন ধরে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজের মোবাইলফোনটা পাচ্ছে না খোদাদাদ শাহবাজ খান। ঠিকভাবে মনেও করতে পারছে না, শেষবার ফোনটা কবে কখন ব্যবহার করেছিলো। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, আগের বারের মতো প্রশিক্ষিত কোনো পিগমি বানর ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে যায়নি।

এমন না যে, মোবাইলফোন না থাকলে তার অনেক সমস্যা হবে, যোগাযোগ করতে পারবে না কারোর সাথে। সত্যি বলতে, এই যুগেও তার সাথে বেশির ভাগ মানুষজন যোগাযোগ করে পুরনো আমলের ল্যান্ডফোনেই। কিন্তু একটা জিনিস হারিয়ে গেলো আর তার ইনভেস্টিগেটর সত্তা সেটার খোঁজ করবে না তা কি হয়? অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ব্যর্থ হয়ে এখন বসে আছে চুপচাপ। ভাবার চেষ্টা করছে জিনিসটা গেলো কোথায়!

আইনস্টাইনও তার সাথে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। এমন সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে যেখানে কেবলমাত্র ইঁদুর আর টিকটিকির পক্ষেই ঢোকা সম্ভব। এখন তাকে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে চা আনতে পাঠিয়েছে।

এমন সময় ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলে কেএস খান আনমনেই ফোনটা তুলে নিলো।

“হ্যালো।” ডাক্তার লুবনার সুমিষ্ট কণ্ঠটা বলে উঠলো ওপাশ থেকে।

“আরে আপনে…আছেন কেমন?” পহেলা বৈশাখের পর আর মেয়েটার সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। জরুরী একটা দরকারে গ্রামের বাড়িতে গেছিলো।

“ভালো আছি। আপনার কি অবস্থা?”

“ভালাই…সামান্য সর্দি ছাড়া আর সব ঠিক আছে।”

“অ্যালার্জি থেকে হয়েছে,..ঘরে অ্যালাট্রল আছে না?”

“আছে মানে, আমার ঘর তো ছোটোখাটো ডিসপেন্সারি,” কথাটা বলেই চওড়া হাসি দিলো কেএস খান। যদিও ফোনে সেটা দেখতে পাবে না ডাক্তার লুবনা।

“আমি আপনার মোবাইলফোনেও কল দিয়েছিলাম…বন্ধ পেলাম যে?”

“বন্ধ না…আসলে খুঁইজা পাইতাছি না।”

“হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?”

“পয়লা বৈশাখের পর থেইকা পাইতাছি না। সারা ঘর খুঁইজা শেষ। কই রাখছি মনে করবার পারতাছি না। আমার আবার মেমোরি খুব উইক।”

“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।”

“আমার মেমোরি?” বুঝতে না পেরে বললো সাবেক ডিবি কর্মকর্তা।

“আরে না,” হেসে বললো ডাক্তার। “ফোনের কথা বলছি। রমনা থেকে ফেরার সময় ফোনটা পিট পকেট হয়ে গেছে মনে হয়। আপনি তো পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিলেন ফোনটা।”

“হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান। চাকরিজীবনে পকেটমারদের সাথে বেশ কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে তার। এরকম এক পকেটমার তাকে একবার বলেছিলো, কেউ পাঞ্জাবির পকেটে কিছু রাখলে নাকি তারা ধরে নেয় জিনিসটা আসলে তাদের পকেটেই রাখা হয়েছে! “তাইলে সেইটাই হইছে…পকেটমার মাইরা দিছে।”

“খারাপ লাগছে?” আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইলো ডাক্তার।

“আরে না।” একটু থেমে আবার বললো সাবেক ডিবি অফিসার, “আমি টিনেজ পোলাপান নাকি, মোবাইল হারাইলে মুখ বেজার কইরা বইসা থাকুন? এর আগে কতোবার আমার ফোন হারাইছে! এইটা কোনো ব্যাপারই না।”

“আমি যদি আপনাকে জোর করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না নিয়ে যেতাম তাহলে ফোনটা হারাতো না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে ওপাশ থেকে বললো ডাক্তার।

“কী যে বলেন না,” কেএস খান সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো মেয়েটাকে। “ফোন তো হারায়ই…এইটা আর এমন কী।”

একটু চুপ থেকে ডাক্তার লুবনা বললো, “ঐদিন আপনার ছাত্র…ঐ যে, নুরে ছফা…সে আমাদের একসাথে দেখে ফেলায় কি আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“আরে না, কেএসকে বললো। “ছফা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ…এইটা কোনো ব্যাপার না। আমি কার সাথে কই যামু না যামু এইটা নিয়া সে ক্যান ভাবতে যাইবো? আর ভাবলেই আমি পরো

“হুম। তা তো ঠিকই,” সায় দিলো ডাক্তার লুবনা।

“আপনে এইটা নিয়া খামোখা ভাবতাছেন। এইটা কোনো ব্যাপারই না।”

“আসলে আমার মনে হলো আপনি খুবই বিব্রত হয়েছিলেন, তাই বললাম।”

“আরে না, সেইরকম কিছু না…বুঝতেই পারছেন, জুনিয়রদের সামনে পইড়া গেলে তো একটু ইয়ে হয়-ই।”

ডাক্তার লুবনা হেসে ফেললো। “যাক, বাঁচলাম। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি।” একটু চুপ থেকে আবার। বলে উঠলো সে, “কাল বিকেলে কি ফ্রি আছেন? ভাবছি, একটু কফি খেতে যাবো।”

আনন্দে মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসারের। “আপনে ঢাকায় এখন?”

“হুম। আজ দুপুরে এসেছি।”

চওড়া হাসি ধরে রেখেই বললো, “আমি তো ফ্রিই আছি, কোনো সমস্যা নাই।”

“দ্যাটস গ্রেট।” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো ডাক্তার লুবনা।

“কয়টার দিকে বাইর হইবেন?”

“বিকেলে পাঁচটায়?”

“ওকে…ননা প্রবলেম…কোন্ জায়গায় আসতে হইবো, কন?”

“ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে চলে আসুন। আমি ওখানেই থাকবো।”

“ওকে।”

“রাখি। বাই। কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে, মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা।

“বাই, কলটা কেটে গেলেও কেএস খান ফোনটা কানে চেপে রাখলো আরো কিছুক্ষণ। সেই সুপরিচিত হৃদস্পন্দনটা টের পেলো। এক ধরণের ধুকপুকানি। নতুন প্রেমে পড়লে যেমনটা হয়। ডাক্তার লুবনার সাথে প্রতিবার কথা বললেই এটা হয় তার।

ফোনটা রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবার রিং বেজে উঠলো, বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে নিলো সে।

“কী খবর তোমার?” এবার নিয়মমাফিক কলটা এসেছে।

“এই তো…আছি,” বললো মহিলার সাবেক স্বামী।

“তোমার ফোন খুঁজে পেয়েছো?”

গতকাল ফোন করলে সাবেক স্ত্রীকে মোবাইলফোন হারানোর কথা জানিয়েছিলো সে। “না। ওইটা আসলে পিট পকেট হইছে মনে হয়।”

“বলো কি!” অবাক হলো ফোনের অপর পাশের কণ্ঠটা। “কাল না বললে হারিয়ে ফেলেছিলে?”

“হ…কিন্তু আজ মনে হইতাছে পয়লা বৈশাখে যে রমনায় গেছিলাম, সেইখান থেইকা ফিরা আসার সময়…” কথাটা শেষ করার আগেই কেএস খান বুঝে গেলো বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। এখন কী প্রতিক্রিয়া আর প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না।

“পহেলা বৈশাখে রমনায় গেছিলে?!” বিস্ময় আর অবিশ্বাসটা একেবারেই সঙ্গত। বিবাহিত জীবনে কখনও ইনভেস্টিগেটর স্বামী তাকে নিয়ে পহেলা বৈশাখে বের হয়নি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো। কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর অবশেষে খুবই স্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইলো, “একা গেছিলে, নাকি…?”

কেএস খান কী বলবে ভেবে পেলো না। “ইয়ে মানে—”

“ওহ্…ভুলে গেছিলাম,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো এবার। “জুবায়েরকে পড়াতে হবে…এখন রাখি।”

কলটা কেটে যাবার পরও কেএসকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে। ঈর্ষা শব্দটি এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না সে। এটার উৎপত্তির কারণ তার ভালো করেই জানা আছে, কিন্তু এর ব্যাপ্তি কতোটা জানে না। তবে জানে, আগামি দুয়েকদিন তাকে আর কল করবে না এই মহিলা। ঈর্ষা হলো আগুন, সেই আগুন স্তিমিত হতে একটু সময় লাগেই।

“স্লামালেকুম, স্যার।”

জাঁদরেল একটি কণ্ঠ বলে উঠলে কেএস খান অনেকটা চমকে তাকালো দরজার দিকে।

.

অধ্যায় ৯

“তুমি শিওর?” রিগ্যাল এয়ারলাইন্সের অপারেশন হেড মঞ্জুর কাদের ভুরু কুঁচকে আবারো জানতে চাইলো।

“জি, স্যার।” জবাব দিলো রোমানা।

তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে ফ্রন্টডেস্ক থেকে একটু দূরে।

“মহিলা ফ্লাইট মিস করে আবার রিশিডিউল করে,” ডিবির সরবরাহ করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো মঞ্জুর কাদের।

রোমানা বুঝতে পারলো না এটা প্রশ্ন কিনা, তারপরও মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“ছবির এই মহিলাই ছিলো তাহলে?” মুখ তুলে তাকালো অপারেশন হেড। “তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর?”

রোমানা এবার ধন্দে পড়ে গেলো। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শব্দটা তাকে সব সময়ই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। জগতের কোনো কিছু সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যে টেকনিক্যালি ভুল এটা সে কর্মজীবনে প্রবেশ করেই বুঝে গেছে।

“না, মানে,..”

মঞ্জুর কাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর কিভাবে হবো, স্যার?”

“কিভাবে হবেন মানে? আপনি না তাকে দেখেছেন?”

“দেখেছি কিন্তু ঐ মহিলার চোখ ছাড়া তো কিছু দেখিনি।”

“কি!” অবাক হলো অপারেশন হেড। “চোখ ছাড়া কিছু দেখেননি মানে!?”

“মহিলা হিজাব পরা ছিলো, স্যার,” তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দিলো রোমানা।

“হিজাব?” কপালে ভাঁজ পড়লো অপারেশন হেডের।

“জি, স্যার…শুধু চোখদুটো দেখা গেছে।”

গভীর করে দম নিয়ে মাথা দোলালো মঞ্জুর কাদের। আর তাতেই আপনি বুঝে গেলেন এটা সেই মহিলা?”

রোমানা ঢোঁক গিলল।

“শুধু একজোড়া চোখ দেখে?”

“স্যার, একজন প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট মিস্ করার পর রিশিডিউল করলো, তারপর সেটাও মিস্ করলো ইচ্ছেকৃতভাবে। ভদ্রমহিলাকে আমি ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও লাউঞ্জে ওয়েট করতে দেখেছি।”

“এ থেকেই আপনি ধরে নিলেন এই মহিলা কোনো ক্রিমিনাল না হয়ে যায় না…ডিবি যার ছবি দিয়ে গেছে এটা সে-ই হবে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। তাছাড়া আমি মহিলার চোখদুটো ভালো করে দেখেছি, আমার কিউবিকলের খুব কাছেই বসেই ছিলো…ছবির এই মহিলার মতোই, স্যার। তার অদ্ভুত আচরণের ব্যাপারটা কনসিডার করলে একটা বিষয়ই মাথায় আসে আর সেটা-”

“আপনি আসলে ঐ মহিলার এই ব্যাপারটাকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখেছেন,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো অপারেশন চিফ। “তাই তো?”

“জি, স্যার।”

“কিন্তু উনার ফ্লাইট মিস্ করার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, এটা ভেবে দেখেছেন কি?”

বসের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোমানা।

মঞ্জুর কাদের বুকে দু-হাত ভাঁজ করে গম্ভীর হয়ে বললো, “মনে করুন, একেবারে শেষ সময়ে মহিলার পরিবারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, ভদ্রমহিলা ফোন পেয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরকমটা কি হতে পারে না?”

রোমানা মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো। অপারেশন হেডের সৃজনশীলতায় মুগ্ধ সে। এটার সম্ভাবনা আছে, তবে তার কাছে মনে হচ্ছে সেই সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। “স্যার, আমি আরো জানতে পেরেছি, ডিবি অফিসার যখন এসেছিলো তার কিছুক্ষণ পরই ঐ ফ্লাইটটা ছেড়ে যায়। তার মানে, মহিলা নিশ্চয় ঐ অফিসারকে দেখে ভয় পেয়ে কেটে পড়েছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মঞ্জুর কাদের। “বুঝলাম, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি-আমি কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত না হয়ে সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের কোনো কাস্টমারকে ঝামেলায় ফেলতে পারি না। বোঝা গেলো আমার কথাটা?”

চুপসে গেলো রোমানা। “জি, স্যার।”

“ওরা একটা ছবি দিয়ে গেছে…” বলতে লাগলো অপারেশন হেড। “…আমাদের ফ্রন্টডেস্ক যদি ঐ ছবির সাথে মিল আছে এমন কাউকে প্যাসেঞ্জার হিসেবে পেতে তাহলে আমরা ওদেরকে জানাতাম। কিন্তু আপনি দেখেছেন একজোড়া চোখ…তার সাথে পর পর দু-বার ফ্লাইট মিস্ করার ঘটনাটা জুড়ে দিয়ে মনে করছেন এই ছবির মহিলাই ঐ প্যাসেঞ্জার হতে পারে। দ্যাটস নট এনাফ টু রিপোর্ট ইট।”

“জি, স্যার,” বিমর্ষ মুখে বললো রোমানা।

“মনে রাখবেন, আমাদের কাছে সবার আগে আমাদের কাস্টমার, ওই সব ল-ইনফোর্সমেন্টের রিকোয়েস্ট না। ওকে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সেলস এক্সিকিউটিভ। আসল কথাটা এবার তার কাছে পরিস্কার। খালি চোখে দেখলে কপোরেট দুনিয়ার আসল দেবতা হলো টাকা, কিন্তু সেটা আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে না, ওগুলো আসে কাস্টমারের পকেট থেকে! সুতরাং এখানে আসল দেবতা তারাই।

“আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কখনও আমাদের কোনো কাস্টমারের বিরুদ্ধে কিছু করবো না-এটা সব সময় মাথায় রাখবেন।”

“জি, স্যার।”

“ঐ প্যাসেঞ্জার কী কারণে রিশিডিউল করা ফ্লাইট মিস করলেন সেটার ব্যাখ্যাও আমাদের খোঁজার দরকার নেই। আমরা আমাদের টিকেট বিক্রি করেছি, ফাইনের টাকা পেয়েছি, দ্যাটস ইট।”

চুপ মেরে রইলো রোমানা।

মঞ্জুর কাদের হাতঘড়ির দিকে তাকালো। “সময় হয়ে গেছে, বাসায় চলে যান।”

“জি, স্যার,” কথাটা বলে রোমানা পা বাড়ালো নিজের কিউবিকলের দিকে। ওখানে তার ব্যাগ-পার্স আছে।

“শুনুন?”

পেছনে থেকে বসের ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালো সে।

“এখন থেকে ডিটেক্টিভ নভেল একটু কম পড়বেন, ওকে?”

অপারেশন হেড মাপা হাসি দিয়ে রোবটের মতো ঘুরে চলে গেলো।

এমন উপদেশ পেয়ে অপমাণিত বোধ করলো রোমানা। সেই অপমান হজম করে আবারো পা বাড়ালো কিউবিকলের দিকে। মনে মনে বললো সে, জি, স্যার, এখন থেকে কম কম বই পড়বো আর আপনার মতো রোবট হবার চেষ্টা করবো!

.

অধ্যায় ১০

নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে কেএস খানের খোলা দরজার সামনে।

তাকে দেখেই ফোনটা ক্রাডলের উপরে রেখে দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আরে, ছফা যে,” এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। “আপনে যে আসবেন জানতাম না তো।”

নুরে ছফা ঘরের ভেতরে পা ফেললো। “আমি আপনার মোবাইলফোনে কল দিয়ে দেখি সেটা বন্ধ, তারপর ল্যান্ডফোনেও কল দিয়েছিলাম। আইনস্টাইন বললো, আপনি একটু বাইরে গেছেন হাটাহাটি করতে।”

“হ…রোজ বিকালে একটু হাটাহাটি করি পার্কে।”

“তাকে আমি বলেছিলাম, আমি আসছি…সে আপনাকে বলেনি?”

হেসে ফেললো কেএসকে। “পোলাপান মানুষ, মনে হয় ভুইলা গেছে।” একটু থেমে আবার বললো, “বসেন।” নিজেও বসে গেলো সোফায়। “আজকে কি আপনার অফ ডিউটি?”

“না, স্যার…ছুটি পেয়েছি।”

কেএস খান বুঝতে পারলো না। তাদের পেশায় ছুটি নিয়েছি’ পরিচিত শব্দ কিন্তু ছুটি পেয়েছি,’ এটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। “আচ্ছা,” কোনো রকমে নিজের কৌতূহল দমিয়ে বললো সাবেক ডিবি অফিসার।

“ইয়াল্লা!” দরজার দিক থেকে একটা অল্প বয়েসী কণ্ঠ বলে উঠলে তারা দু-জন সেদিকে তাকালো।

আইনস্টাইন জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক।

“আমি ভুইল্যা গেছিলাম…স্যারে আমারে ফোনে কইছিলো আইবো।”

“থাক, তরে আর কিছু কইতে হইবো না। যা, দুই কাপ চা দে তাড়াতাড়ি।”

আইনস্টাইন দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় নুরে ছফার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে গেলো। ছফাও হেসে আশ্বস্ত করলো তাকে।

“ছুটি পাইছেন মানে বুঝলাম না?” উৎসুক কেএসখান অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেললো।

নুরে ছফা গম্ভীর হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।

সাবেক ডিবি অফিসার ভাবলো, ছফা কোনো কারণে পানিশমেন্টের শিকার হয়েছে কিনা।

“আমাকে স্পেশাল ছুটি দেয়া হয়েছে, স্যার।”

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেএস খান।

“মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য।”

“এরজন্যই কি পয়লা বৈশাখে আপনে ছায়ানটের প্রোগ্রামে গেছিলেন?”

মাথা দোলালো ছফা। “না, স্যার। ছুটি আমি পেয়েছি আজকে।”

“ও।”

“ঐদিন গিয়েছিলাম এমনি। হঠাৎ করেই মনে হয়েছিলো মুশকান জুবেরি ওখানে থাকতে পারে।”

“বলেন কি?” অবাক হলো কেএস খান। “এইটা আপনের মনে হইলো কেন?”

কাঁধ তুললো ছফা। “তা তো জানি না। কেনজানি মনে হলো মহিলা ওখানে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাকি কখনও মিস করেনি।”

“বুঝছি।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “মজার ব্যাপার কি জানেন, স্যার? আমার ধারণা মোটেও মিথ্যে ছিলো

“মানে?!” ডিবির সাবেক অফিসারকে বিস্মিত দেখালো।

“ফেরার পথে ঐ মহিলাকে আমি এক ঝলক দেখেছি…শাহবাগের দিকে।”

“কি!”

“একটা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিলো…আমি ছিলাম রিক্সায়।”

গাল চুলকাতে শুরু করলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “তারপর?”

“গাড়িটা ধরা সম্ভব হয়নি।”

“নম্বরটা দেখেন নাই? ওইটা ট্রেস করলে তো–”

“না, স্যার…ওটার কথা খেয়াল ছিলো না তখন,” উৎসুক কেএস খানকে মাঝপথে দমিয়ে দিলো ছফা।

“ওহ্,” একটু হতাশ হলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

এমন সময় দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো আইনস্টাইন।

“কীরে, আইজকাল তোর চা আনতে এতো দেরি হয় ক্যান?” জানতে চাইলো কেএস খান।

চায়ের কাপ দুটো সোফার সামনে কফি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জবাবদিহি করলো ছেলেটা, “নিচের দোকান থিকা তো এহন আর চা আনি না…ঐ হালারপুতে মুর্দালাশে যে চা-পাতা দেয় ওইগুলা সস্তায় কিইন্যা আনে…ওয়াক থু! চিন্তা করছেন কারবারটা!”

“তরে এইসব কথা কে কইলো?”

কেএসকের দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো আইনস্টাইন। “ওই হালারপুতেরে আমি এক বেটার কাছ থিইক্যা চা কিনতে দেখছি…পাঁচ কেজি কিনলো মাত্র দুইশো ট্যাকা দিয়া। আপানেই কন, অরিজিনাল চা কি এতো সস্তা? তহনই আমি বুইজ্যা হালাইছি, হালারপুতে দুই নম্বরি করে।”

“আইজকাল দেহি কথায় কথায় হালারপুত কস্…ঘটনা কি?” কেএস খান ভুরু কপালে তুলে বললো।

জিভে কামড় দিলো পিচ্চিটা। একটু শরমিন্দা হয়েছে সে, আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো।

“চা নেন, ছফা,” নিজের কাপটা নেবার আগে বললো কেএস খান। “আপনে তারে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখছেন,” কাপে চুমুক দিলো মি, খান। “এইটা তো রিলায়েবল হইতে পারে না…অন্য কিছুও হইবার পারে।”

“কী রকম?” ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।

অমায়িক হাসি দিলো কেএসকে। “আপনের তো হেলুসিনেশানও হইবার পারে, পারে না?”

ছফা একটুখানি বিষম খেলো যেনো। “হেলুসিনেশান?”

“অবাক হওনের কিছু নাই,” ছফাকে আশ্বস্ত করে চায়ে চুমুক দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আপনের ধ্যান-জ্ঞান হইলো ঐ মহিলা, তারে তিনটা বছর ধইরা পাগলের মতো খুঁজছেন। এরকম সিচুয়েশনে হেলুসিনেশান তো হইবারই পারে।”

ছফা চায়ের কাপটা তুলে নিলো। “কিন্তু আমার মনে হয় না হেলুসিনেশান ছিলো ওটা।”

খোদাদাদ শাহবাজ খানকে দেখে মনে হলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “সার্ভিসে জয়েন করার পর আমার তিন নম্বর কেসটা খুব ভুগাইছিলো, বুঝলেন?”

নুরে ছফা বুঝতে পারলো অতীত রোমন্থনের মেজাজে চলে গেছে মি. খান। জোর করে আগ্রহী হবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে।

“একটা মার্ডার কেস ছিলো। আমি খুব দ্রুত বাইর করতে পারছিলাম খুনটা কে করছে, কিন্তু সাসপেক্ট ততোক্ষনে পগাড় পার।”

ছফা কিছু বললো না। জানে, গল্পটা শেষ হয়নি। চায়ে চুমুক দিলো সে।

“এরপর কী হইলো জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো আবার, “আমি যেইখানেই যাই ঐ ব্যাটারে খুঁজি। এক পর্যায়ে তারে দেখতেও শুরু করলাম!”

“দেখতে শুরু করলেন মানে?”

“এই ধরেন, মানুষজনের ভীড়ে, পথেঘাটে মনে হইতো তারে দেখছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আসলে পুরাটাই ছিলো হেলুসিনেশন। এইটারে আপনে ডিশনও কইবার পারেন।”

কাঁধ তুলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। “হতে পারে ওটা হেলুসিনেশান। কিন্তু আমি আজকে সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আসলে, আপনার সাথে জরুরী একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, সেই সঙ্গে একটা জিনিসও দেখাতে এসেছি, স্যার।”

“কি জিনিস?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আনলো নুরে ছফা। “এই যে, স্যার।”

কেএস খান আগ্রহভরে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো কয়েক মুহূর্ত। “মুশকান জুবেরির ছবি??” বিস্ময়ে বলে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসার।

“জি, স্যার। এটাই মুশকান জুবেরি। অবশেষে তার ছবি আমি পেয়েছি।”

“কইত্থেন পাইলেন এই জিনিস?”

“একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প। আপনার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে।” ছফার মুখে রহস্যময় হাসি।

উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো খোদাদাদ শাহবাজ খান।

১০. কেএস খানের খোলা দরজা

অধ্যায় ১০

নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে কেএস খানের খোলা দরজার সামনে।

তাকে দেখেই ফোনটা ক্রাডলের উপরে রেখে দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আরে, ছফা যে,” এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। “আপনে যে আসবেন জানতাম না তো।”

নুরে ছফা ঘরের ভেতরে পা ফেললো। “আমি আপনার মোবাইলফোনে কল দিয়ে দেখি সেটা বন্ধ, তারপর ল্যান্ডফোনেও কল দিয়েছিলাম। আইনস্টাইন বললো, আপনি একটু বাইরে গেছেন হাটাহাটি করতে।”

“হ…রোজ বিকালে একটু হাটাহাটি করি পার্কে।”

“তাকে আমি বলেছিলাম, আমি আসছি…সে আপনাকে বলেনি?”

হেসে ফেললো কেএসকে। “পোলাপান মানুষ, মনে হয় ভুইলা গেছে।” একটু থেমে আবার বললো, “বসেন।” নিজেও বসে গেলো সোফায়। “আজকে কি আপনার অফ ডিউটি?”

“না, স্যার…ছুটি পেয়েছি।”

কেএস খান বুঝতে পারলো না। তাদের পেশায় ছুটি নিয়েছি’ পরিচিত শব্দ কিন্তু ছুটি পেয়েছি,’ এটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। “আচ্ছা,” কোনো রকমে নিজের কৌতূহল দমিয়ে বললো সাবেক ডিবি অফিসার।

“ইয়াল্লা!” দরজার দিক থেকে একটা অল্প বয়েসী কণ্ঠ বলে উঠলে তারা দু-জন সেদিকে তাকালো।

আইনস্টাইন জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক।

“আমি ভুইল্যা গেছিলাম…স্যারে আমারে ফোনে কইছিলো আইবো।”

“থাক, তরে আর কিছু কইতে হইবো না। যা, দুই কাপ চা দে তাড়াতাড়ি।”

আইনস্টাইন দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় নুরে ছফার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে গেলো। ছফাও হেসে আশ্বস্ত করলো তাকে।

“ছুটি পাইছেন মানে বুঝলাম না?” উৎসুক কেএসখান অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেললো।

নুরে ছফা গম্ভীর হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।

সাবেক ডিবি অফিসার ভাবলো, ছফা কোনো কারণে পানিশমেন্টের শিকার হয়েছে কিনা।

“আমাকে স্পেশাল ছুটি দেয়া হয়েছে, স্যার।”

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেএস খান।

“মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য।”

“এরজন্যই কি পয়লা বৈশাখে আপনে ছায়ানটের প্রোগ্রামে গেছিলেন?”

মাথা দোলালো ছফা। “না, স্যার। ছুটি আমি পেয়েছি আজকে।”

“ও।”

“ঐদিন গিয়েছিলাম এমনি। হঠাৎ করেই মনে হয়েছিলো মুশকান জুবেরি ওখানে থাকতে পারে।”

“বলেন কি?” অবাক হলো কেএস খান। “এইটা আপনের মনে হইলো কেন?”

কাঁধ তুললো ছফা। “তা তো জানি না। কেনজানি মনে হলো মহিলা ওখানে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাকি কখনও মিস করেনি।”

“বুঝছি।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “মজার ব্যাপার কি জানেন, স্যার? আমার ধারণা মোটেও মিথ্যে ছিলো

“মানে?!” ডিবির সাবেক অফিসারকে বিস্মিত দেখালো।

“ফেরার পথে ঐ মহিলাকে আমি এক ঝলক দেখেছি…শাহবাগের দিকে।”

“কি!”

“একটা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিলো…আমি ছিলাম রিক্সায়।”

গাল চুলকাতে শুরু করলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “তারপর?”

“গাড়িটা ধরা সম্ভব হয়নি।”

“নম্বরটা দেখেন নাই? ওইটা ট্রেস করলে তো–”

“না, স্যার…ওটার কথা খেয়াল ছিলো না তখন,” উৎসুক কেএস খানকে মাঝপথে দমিয়ে দিলো ছফা।

“ওহ্,” একটু হতাশ হলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

এমন সময় দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো আইনস্টাইন।

“কীরে, আইজকাল তোর চা আনতে এতো দেরি হয় ক্যান?” জানতে চাইলো কেএস খান।

চায়ের কাপ দুটো সোফার সামনে কফি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জবাবদিহি করলো ছেলেটা, “নিচের দোকান থিকা তো এহন আর চা আনি না…ঐ হালারপুতে মুর্দালাশে যে চা-পাতা দেয় ওইগুলা সস্তায় কিইন্যা আনে…ওয়াক থু! চিন্তা করছেন কারবারটা!”

“তরে এইসব কথা কে কইলো?”

কেএসকের দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো আইনস্টাইন। “ওই হালারপুতেরে আমি এক বেটার কাছ থিইক্যা চা কিনতে দেখছি…পাঁচ কেজি কিনলো মাত্র দুইশো ট্যাকা দিয়া। আপানেই কন, অরিজিনাল চা কি এতো সস্তা? তহনই আমি বুইজ্যা হালাইছি, হালারপুতে দুই নম্বরি করে।”

“আইজকাল দেহি কথায় কথায় হালারপুত কস্…ঘটনা কি?” কেএস খান ভুরু কপালে তুলে বললো।

জিভে কামড় দিলো পিচ্চিটা। একটু শরমিন্দা হয়েছে সে, আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো।

“চা নেন, ছফা,” নিজের কাপটা নেবার আগে বললো কেএস খান। “আপনে তারে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখছেন,” কাপে চুমুক দিলো মি, খান। “এইটা তো রিলায়েবল হইতে পারে না…অন্য কিছুও হইবার পারে।”

“কী রকম?” ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।

অমায়িক হাসি দিলো কেএসকে। “আপনের তো হেলুসিনেশানও হইবার পারে, পারে না?”

ছফা একটুখানি বিষম খেলো যেনো। “হেলুসিনেশান?”

“অবাক হওনের কিছু নাই,” ছফাকে আশ্বস্ত করে চায়ে চুমুক দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আপনের ধ্যান-জ্ঞান হইলো ঐ মহিলা, তারে তিনটা বছর ধইরা পাগলের মতো খুঁজছেন। এরকম সিচুয়েশনে হেলুসিনেশান তো হইবারই পারে।”

ছফা চায়ের কাপটা তুলে নিলো। “কিন্তু আমার মনে হয় না হেলুসিনেশান ছিলো ওটা।”

খোদাদাদ শাহবাজ খানকে দেখে মনে হলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “সার্ভিসে জয়েন করার পর আমার তিন নম্বর কেসটা খুব ভুগাইছিলো, বুঝলেন?”

নুরে ছফা বুঝতে পারলো অতীত রোমন্থনের মেজাজে চলে গেছে মি. খান। জোর করে আগ্রহী হবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে।

“একটা মার্ডার কেস ছিলো। আমি খুব দ্রুত বাইর করতে পারছিলাম খুনটা কে করছে, কিন্তু সাসপেক্ট ততোক্ষনে পগাড় পার।”

ছফা কিছু বললো না। জানে, গল্পটা শেষ হয়নি। চায়ে চুমুক দিলো সে।

“এরপর কী হইলো জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো আবার, “আমি যেইখানেই যাই ঐ ব্যাটারে খুঁজি। এক পর্যায়ে তারে দেখতেও শুরু করলাম!”

“দেখতে শুরু করলেন মানে?”

“এই ধরেন, মানুষজনের ভীড়ে, পথেঘাটে মনে হইতো তারে দেখছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আসলে পুরাটাই ছিলো হেলুসিনেশন। এইটারে আপনে ডিশনও কইবার পারেন।”

কাঁধ তুলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। “হতে পারে ওটা হেলুসিনেশান। কিন্তু আমি আজকে সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আসলে, আপনার সাথে জরুরী একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, সেই সঙ্গে একটা জিনিসও দেখাতে এসেছি, স্যার।”

“কি জিনিস?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আনলো নুরে ছফা। “এই যে, স্যার।”

কেএস খান আগ্রহভরে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো কয়েক মুহূর্ত। “মুশকান জুবেরির ছবি??” বিস্ময়ে বলে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসার।

“জি, স্যার। এটাই মুশকান জুবেরি। অবশেষে তার ছবি আমি পেয়েছি।”

“কইত্থেন পাইলেন এই জিনিস?”

“একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প। আপনার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে।” ছফার মুখে রহস্যময় হাসি।

উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো খোদাদাদ শাহবাজ খান।

.

অধ্যায় ১১

“তাজ্জব ব্যাপার!”

নুরে ছফার কাছ থেকে সবটা শুনে বললেন কেএস খান।

বিশাল কাকতালীয় ঘটনাই বটে! মুশকান জুবেরির এক ভিক্টিম, হাসিবের মরণাপন্ন মা আবিষ্কার করেছে সতুর দশকের মাঝামাঝিতে আমেরিকায় যখন স্বামীর সঙ্গে থাকতো তখন তাদের প্রতিবেশী ছিলো মুশকান।

কেএস খানের বিস্ময়ের ঘোর যেনো কাটছেই না। “পুরাই ড্রামা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। “আশেক মাহমুদ এখন চাচ্ছেন আমি যেনো আবার নতুন করে কেসটা নিয়ে কাজ করি।”

মুশকানের ছবিটা একহাতে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে কেএস খান।

“উনার বোন আর বেশি দিন বাঁচবে না। সম্ভবত উনি চাইছেন এই সময়ের মধ্যে আমি যেনো মুশকানকে ধরার ব্যবস্থা করি। এরজন্যে আমাকে সব ধরণের সাহায্য করবেন।”

ছবিটার দিকে তাকিয়েই বললো মি. খান, “এইভাবে টাইম-ফ্রেম কইরা দিলে কিন্তু ইনভেস্টিগেশন করাটা খুব টাফ হয়া যায়। তাছাড়া, আবেগ টাবেগ দিয়া কোনো ইনভেস্টিগেশন করাও ঠিক না। ভদ্রলোক ইমোশনাল হয়া গেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ঠিক বলেছেন, স্যার। কিন্তু আমি এই সুযোগটা নেবো।”

ছফার দিকে তাকালো কেএস খান। “কিছু মনে কইরেন না, একটা কথা বলি।”

“জি, স্যার…বলেন?”

“পলিটিশিয়ানদের সাথে কাজ করনের ঝক্কি থাকে, আর এইটা বেশি ভোগায় সৎ অফিসারগো। কথাটা মাথায় রাইখেন।” তারপর একটু থেমে আবার বললো, “বেসিক্যালি, অল অব দেম আর বাস্টার্ডস! আপনে তো এখনও সার্ভিসে আছেন, আপনেও এইটা জানেন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। তদন্তে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ, নাক গলানো, প্রভাব বিস্তার করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা এ দেশে। এ নিয়ে তার নিজের মধ্যেও কম তিক্ততা নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করে, তাতে করে এই বাহিনীতে কর্মরতদের মধ্যে কেএস খানের বলা কথাটার বেশ প্রচলন আছে।

“আমি সেটা জানি, স্যার। তারপরও, যেভাবে কেসটা এগোচ্ছিলো তাতে করে তো কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছিলো না, এখন যদি ক্ষমতাবান কারোর কাছ থেকে সব ধরণের সাপোর্ট পাওয়া যায় তাহলে কি সেটা কাজে লাগানো উচিত না?”

ডিবির সাবেক কর্মকতা কিছুই বললো না। যাই হোক, এখন আপনের কাছে মুশকান জুবেরির একটা ছবি আছে…যদিও অনেক পুরানা কিন্তু মহিলার তো তেমন একটা চেঞ্জ হয় নাই, একই রকম আছে, তাই এই ছবিটা অনেক কাজে দিবো।”

“হুম,” সায় দিয়ে বললো ছফা। “ছবিটা হাতে পাবার পরই দ্রুত কাজে নেমে পড়েছি, স্যার। আমার দেখাটা হেলুসিনেশান নাকি সত্যি, সেটা যেহেতু নিশ্চিত করে জানি না তাই আমি আজকেই এয়ারপোর্টে গিয়ে সবগুলো সরকারী-বেসরকারী এয়ারলাইন্সে ছবি দিয়ে এসেছি। দেশের সবগুলো স্থলবন্দরে ফ্যাক্স করে দিয়েছি ছবিটা।”

“ভালো করূছেন,” একটু থেমে আবার বললো কেসকে। “ছবিটা সাকুলেট করা জরুরী ছিলো। ঐ মহিলা যদি দেশে ঢোকে কিংবা বাইর হওনেরও চেষ্টা করে, তাইলে সে ধরা পড়বো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “এখন তো আমি হাত-পা গুটিয়ে। বসে থাকতে পারি না। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

কেএস খানের মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি যেনো বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। “সব সময় যেইটা আমি কই,” লম্বা করে সশব্দে চায়ে চুমুক দিলো সে। “যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইব।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো নুরে ছফা।

“আপনেরে ফিরা যাইতে হইবো সুন্দরপুরে।”

“সুন্দরপুরে?!” বিস্মিত ছফা ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিলো। মুশকান পালিয়ে যাবার পর সুন্দরপুরে এমন কী আছে যে, ওখান থেকে মহিলাকে ট্র্যাক করবে? সুন্দরপুর থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলো ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের উপরে। কিন্তু ভদ্রলোক তার হাত থেকে বাঁচতে বিদেশে চলে যান।

“ওখানে গিয়ে আমি কী খুঁজব?” প্রশ্নটা না করে পারলো না। “ঐ মহিলার সাথে সুন্দরপুরের কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ঘটনার পর পরই ওখানকার মাস্টারের পেছনে আমার এক বিশ্বস্ত লোককে লাগিয়েছিলাম, কিছু পাইনি। ভদ্রলোক ট্রাস্টি হবার পর স্কুল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হয় না, মুশকান জুবেরি তার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখে।”

“তারপরও, আপনেরে যদি এই কেসটা আবার শুরু করতে হয়, তাইলে ওইখান থেইকাই শুরু করন লাগবো,” পুণরায় জোর দিয়ে বললো কেএস খান।

নুরে ছফা চুপ মেরে রইলো। অভিজ্ঞ এই ডিবি অফিসারের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারছে না সে, কিন্তু এটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

“আপনের কথায় লজিক আছে…তয় পুরানা বাংলা প্রবাদটায় যদি আস্থা রাখেন, তাইলে সেইখান থেইকাই আপনেরে শুরু করতে হইবো আবার।”

.

অধ্যায় ১২

এক সময় দূর দুরান্ত থেকে যে রেস্তোরাঁয় ছুটে আসতো লোকজন, সেটার উল্টোদিকে, রাস্তার ওপারে চায়ের ছোট্ট টঙ দোকানের মালিক রহমান মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। কালো মেঘের পুঞ্জ জড়ো হচ্ছে, শেষ বিকেলে ধেয়ে আসছে কালবোশেখি ঝড়। চোখমুখ বিকৃত হয়ে উঠলো তার। ওয়াক থু শব্দ করে এক দলা থুতু ফেললো দোকানের পাশে।

আজ সারাটা দিন খুব গরম পড়েছিলো, কাস্টমারও খুব বেশি পায়নি। বিকেলের দিকে, সন্ধ্যার পর গ্রামের মানুষজন রোদের তাপ কমলে যে আড্ডা দিতে আসবে, কালবোশেখি মনে হয় সেটা হতে দেবে না। আখের গুড়ের যে পিণ্ডটা আছে তার উপরে কিছু মাছি বসেছে কিন্তু অন্য সব দিনের মতো সেগুলো তাড়িয়ে দেবার তাগাদা অনুভব করলো না। মনে মনে ঠিক করলো, আকাশের অবস্থা আরেকটু খারাপ হলেই দোকানের ঝাপি ফেলে বাড়ি চলে যাবে।

আকাশের দিকে আরেকটু ভালো করে তাকালো রহমান। সে নিশ্চিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় হবে, সেই সাথে হবে বৃষ্টিপাত। এরইমধ্যে গুড়গুড় শব্দ তুলে মেঘ জানান দিচ্ছে সেটা। কালো কালো মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশে, পাগলা ষাড়ের মতো ফুঁসে উঠছে যেনো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আনতেই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেলো। তার টঙ দোকানের পাশ দিয়ে যে সড়কটা চলে গেছে তার ঠিক বামদিকে, পরিত্যক্ত পেট্রল পাম্পটার কাছে একটা ট্যাক্সিক্যাব এসে থেমেছে। গত আড়াই বছরে এটা বিরল ঘটনা। পাম্পটা বন্ধ হবার পর কোনো গাড়ি সেখানে থামতে দেখেনি।

উৎসুক হয়ে দেখলো, একটু পরই গাড়ি থেকে নামলো একজন। লোকটাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলো সে। যদিও প্রায় তিন বছর পর দেখলো তাকে। ক্ষমতাবান সেই লোকটি গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে দাঁড়িয়ে রইলো রবীন্দ্রনাথের সামনে।

কয়েক বছর আগে এই লোক ঠিক এভাবেই এক বিকেলে এসে হাজির হয়েছিলো সুন্দরপুরে, তারপর এখানে ঘটে যায় কিছু ঘটনা-জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়িটা আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়; গোরখোদক ফালু পালিয়ে যায় সুন্দরপুর থেকে; রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের রেস্টুরেন্টটি রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়; পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় এর মালেকিন; এরপরই সুন্দরপুরের এমপি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করে।

রহমান মিয়ার মতো এলাকাবাসিও জানে না এসব ঘটনার পেছনে আসল কারণগুলো কী। তারা কেবল নিজেদের মতো করে ঘটনাগুলো বয়ান করে। তবে এসবের পেছনে প্রয়াত এমপির কালোহাত যে ছিলো সে ব্যাপারে কারোর মধ্যে সন্দেহ নেই।

জমিদারের নাতবৌ সেজে সুন্দরপুরে জেঁকে বসেছিলো মুশকান নামের ঐ মহিলা। তার রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করে বিক্রি করা হতো। গোরখোদক ফালুকে দিয়ে কবরস্তান থেকে কঙ্কাল তুলে ব্যবসাও করাতো সে!-এ ধরণের কথা প্রথম দিকে সুন্দরপুরের অনেকে বিশ্বাস করলেও এখন খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা এসবে বিশ্বাস করে। বরং ইদানিং মানুষজন বলে বেড়ায়, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহ ঐ মহিলাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, যাতে করে জমিদার অলোকনাথের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে। এমন কি ঢাকা থেকে এক ভাড়াটে পুলিশ এনে লেলিয়ে দিয়েছিলো মহিলার পেছনে। শেষে, ঐ লোক জমিদার বাড়িতে আগুন দিয়ে মহিলাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায় জমিদারের নাতবৌ। তার আগে এমপির আশার গুড়ে বালি দিয়ে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দান করে গেছে সুন্দরপুরে একটি স্কুল করার জন্য। ওদিকে হতাশ আর ব্যর্থ এমপি ঢাকায় বসে রাগে-ক্ষোভে, হতাশায় মদ্যপান করতে গিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তার নাজুক হৃদপিণ্ড আর সহ্য করতে পারেনি, মদে ডুবেই সাঙ্গ হয়েছে তার ভবের লীলা।

রহমান দেখতে পাচ্ছে, এমপির ভাড়া করা সেই পুলিশ, যার পেছনে ইনফর্মার আতর লাট্টুর মতো ঘুরতো, সেই লোক এখন রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবল বাতাসে লোকটার শার্ট-প্যান্ট লেপ্টে আছে শরীরের সাথে, চুলগুলো উড়ছে সেই বাতাসের ঝাপ্টায়।

রহমান মিয়ার কাছে এটা এক ধরণের অশনি সংকেত। তার অন্তরাত্মা বলে উঠলো, এই লোক সঙ্গে করে ঝড় নিয়ে এসেছে সুন্দরপুরে! খারাপ। কিছু হবার আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠলো তার মনে।

*

একটু আগেও রোদের উত্তাপ ছিলো, কোত্থেকে যে মেঘ এসে ভর করলো আকাশে! এখন রীতিমতো প্রবল বাতাস বইছে। সূর্য ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে, কমে এসেছে আলো। প্রকৃতির যে রূপ সেটা দেখে ভোরের মতো লাগছে নুরে ছফার কাছে।

একটু আগে দূর থেকে পেট্রল পাম্পটা দেখতে পেয়ে ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারকে বলেছিলো, রাস্তার বামপাশে রাখতে গাড়িটা। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। পেট্রল পাম্পটা যে পরিত্যক্ত সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি তার। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, দীর্ঘদিন থেকেই ওটা আর সচল নেই। মাঝারি আকারের ফ্রিজের মতো দেখতে ফুয়েল ডিসপেন্সরগুলো ধুলোয় মলিন। অফিস ঘরটিও বন্ধ, বাইরে থেকে বিশাল তালা ঝুলছে। প্রবল বাতাসে পাম্প স্টেশনের পাকা ছাউনির উপরে কোনোমতে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ডটা দুলছে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। সামনের প্রাঙ্গনে ছোটোখাটো ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এখন।

পেট্রল পাম্প স্টেশনটা পেরিয়ে, আরেকটু সামনে গিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখেছিলো তিন বছর আগের পরিচিত জায়গাটা-এখনও ‘রবীন্দ্রনাথ’ টিকে আছে!

এখন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের সাইনটা বেশির ভাগ অংশ হারিয়ে এখনও টিকে আছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ হয়ে! আগে যেটা রেস্টুরেন্টের সামনের প্রাঙ্গন আর পার্কিং এরিয়া ছিলো সেটা এখন ছোটোখাটো বাগান। সেই বাগানের মাঝখান দিয়ে দশ-বারো ফুটের মতো প্রশ্বস্ত একটি রাস্তা চলে গেছে প্রধান ফটক পর্যন্ত। দু-পাশের ফুলের বাগানটি বড়জোর কয়েক মাস আগে করা।

ছফা ভেবেছিলো এই স্থাপনাটি আর দেখতে পাবে না। কিংবা সেটা হয়তো পরিত্যক্ত অবস্থায় পাবে।

তিন বছর পর নুরে ছফা আবারো পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে!

.

অধ্যায় ১৩

“ওইদিকে তাকায়া আছে ক্যান, মিয়া?”

কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো রহমান, রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলো ইনফর্মার আতর আলী দাঁড়িয়ে আছে তার দোকানের সামনে। লোকটাকে দেখে অবাক হলো না সে। মাথা যখন দেখা গেছে লেজটা তো দেখা যাবেই!

“এক কাপ চা দাও,” টঙ দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চটায় বসে বললো আতর। “আর একটা বেনসনও দিও।”

আতর আর সেই আতর নেই, তার বেশভূষাও বেশ বদলে গেছে। আড়ালে আবডালে তাকে ইতর বলার লোকজনও দিন দিন কমে আসছে এখন। তবে রহমান মিয়ার কাছে সে সব সময়ই আস্ত একটা ইতরের বাচ্চা।

“এই অবেলায় এইহানে কী মনে কইরা?” প্রশ্নটার জবাব জানা সত্ত্বেও বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো রহমান। “এটু বাদে তো তুফান আইবো।”

“কাম না থাকলে এই আতর মুততেও আইতো না তোমার দোকানে, তাচ্ছিল্যের সাথে বললো সুন্দরপুর থানার ইনফর্মার।

“তা, কী কাম তুমার এই ঝড়-তুফানের দিনে?” সিগারেটটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো দোকানি। “আজকাইল তো এইহানে বেশি আহো না…টাউনেই নাড় গাঁড়ছে।”

সিগারেটটা লাইটার দিয়ে ধরালো আতর, দীর্ঘ একটা টান দিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো। “এতো কিছু তোমার জানোনের দরকার নাই, তুমি চা বানাও।”

বাঁকাহাসি দিলো রহমান। দ্রুত এক কাপ গুঁড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কমদামি বিড়ি সিগারেট আর গুল খাওয়া আতর আলী এখন বেনসন ছাড়া অন্য কিছু মুখেই তোলে না। বিগত তিন বছরে তাকে কেউ গুল খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। সবটাই কপাল। শহর থেকে এক লোক এসে এই ইতরের ভাগ্যটাই বদলে দিয়েছে। এখন একটা বাইকও কিনেছে সে। সারাদিন ওটা নিয়েই ছুটে বেড়ায় সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকায়। এক শ’ সিসির ছোটোখাটো পুরনো সেই বাইকটা যখন ইনফর্মার চালায় তখন রহমানের কাছে মনে হয়, দুর্বল আর নিরীহ ছাগলের পিঠে বুড়ো একটা শেয়াল সওয়ার হয়েছে।

“তুমার ভটভটি কই?”

ভুরু কুঁচকে রহমানের দিকে তাকালো আতর। এই বদটা তার মোটরসাইকেলকে ভটভটি বলে ডাকে সব সময়। এটা যে ঈর্ষা থেকে করে তা ভালো করেই জানে। রাগ দমন করে বললো, “মিস্তিরির কাছে দিছি…এটু টেরাবল দিতাছিলো।”

রহমান মিয়া দাঁত বের করে হাসলো। “পুরানা জিনিস কিনলে তো টেরাবল দিবোই।”

কিছু বলতে গিয়েও বললো না আতর। মানুষের এমন ঈর্ষা উপভোগ করে সে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না নিজের ভেতরে থাকা অস্থিরতার কারণে।

রহমান আড়চোখে দেখতে পেলো ইনফর্মার বার বার সড়কের দিকে তাকাচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করেও একবার দেখে নিয়েছে এরমধ্যে।

“ক্যাঠায় আইবো?” চামচ দিয়ে চায়ের সাথে গুড় মেশাতে মেশাতে জানতে চাইলো দোকানি। “কার লাইগ্যা এতো পেরেশান হয়া আছো?”

সিগারেটে টান দিয়ে একটু ঝারি মেরেই বললো আতর, “এতো কথা কও ক্যান, অ্যাঁ? আদার বেপারী তুমি…খালি জাহাজের খবর নিতে চাও!”

মুখে সেই বাঁকাহাসি ধরে রেখেই চায়ের কাপটা আতরের দিকে বাড়িয়ে দিলো রহমান মিয়া। “আমি বেপারী অইতে যামু কুন দুঃখে! তয় আমি কইলাম আন্ধা না, সব কিছু দেখবার পারি।”

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো আতর, “কী দেখছো তুমি?” তারপর পিরিচে চা ঢেলে সশব্দে আয়েশ করে চুমুক দিলো।

“এই অবেলায় এইহানে ক্যান আইছো আমি জানি, বিজ্ঞের মতো বললো রহমান।

আতর আলী পায়ের উপর পা তুলে একহাতে সিগারেট আর অন্য হাতে পিরিচ ধরে রেখেছে। চায়ের কাপটা রেখেছে তার পাশে বেঞ্চের উপরে। “কও কি, মিয়া!” কৃত্রিম বিস্ময়ের ভাব করলো সে। “তুমিও কি নিজেরে বিবিচি ভাবোনি?”

পিরিচটা রেখে পকেট থেকে আবারো ফোনটা বের করে দেখে নিলো, একটা নাম্বারে কল দিয়ে কানে ফোনটা ঠেকিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ, একটু পর চিন্তিত ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখলো সেটা। রহমান মিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হলো সে।

“ওই মিয়া…হাসসা ক্যান?” একটু রেগেই বললো।

“না…এমনেই,” দোকানি বললো হাসিমুখে।

“ঠিক কইরা কও তো, হাসতাছো ক্যান…মিজাজ খারাপ করবা না। কইলাম!” মৃদু হুমকি দিয়ে বললো ইনফর্মার।

“আমি হইলাম আদার বেপারী, জাহাজের খবর জানাই কেমতে!”

ভুরু কুঁচকে ফেললো আতর। “বুঝলাম না, কী কও তুমি?”

“যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে সে তো বেটির হুটেলে ঢুকছে এটু আগে, রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বললো রহমান।

অবাক হয়ে রাস্তার ওপারে তাকালো আতর। “ঐটা কি এহন আর হোটেল আছেনি, অ্যাঁ?” তারপরই টনক নড়লো তার। “কার কথা কইতাছো তুমি? কে ঢুকছে ওইখানে?”

“কইলাম না, তুমি যার লাইগ্যা পেরেশান হয়া আছে।”

আতর আলী কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দাঁত বের করে হাসতে থাকা দোকানির দিকে, তারপর হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। “ধুর মিয়া! খালি ফালতু পেচাল পাড়ো…আগে কইবা না!” কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো সে।

“আরে, আমার ট্যাকা?”

রহমান জোরে বলে উঠলো পেছন থেকে কিন্তু আতর সে-কথা কানেই তুললো না, হনহন করে ছুটে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে। এক কাপ চা আর সিগারেট বিক্রি করবে বলে সে আসল কথাটা দেরি করে বলেছিলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বাকির খাতায় যোগ হলো আরো কিছু টাকা।

“ইতরের বাচ্চা ইতর!” চোখমুখ বিকৃত করে বললো সে। “কয়লা, ধুইলেও যায় না ময়লা। খাইসলত এহনও আগের মতোই আছে।”

.

অধ্যায় ১৪

প্রায় তিন বছর আগে সুন্দরপুরে এসে যেখানে প্রথম প্রবেশ করেছিলো সেখানে পা রাখতেই বিস্মিত নুরে ছফা।

তখন তাকে প্রলুব্ধ করেছিলো মাদকতাপূর্ণ খাবারের গন্ধ আর সুতীব্র কৌতূহল। এখনও তার মনে কৌতূহল রয়েছে, তবে সুস্বাদু খাবারের কোনো গন্ধ পাচ্ছে না। যদিও পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী খাবারে পরিপূর্ণ আছে ঘরটা!

বই।

রবীন্দ্রনাথের ভেতরটা আর আগের মতো নেই। আগের মতো যে থাকবে সে আশাও করেনি, তবে চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি! পাতা ওল্টানোর খসখসে শব্দটা শুনতে পেলো। হাতেগোনা কিছু পাঠক একমনে বই পড়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির চিরায়ত দৃশ্য।

নুরে ছফা দরজা খুলে ঢুকতেই সেই ঝড়ো বাতাসের কিছুটা ঢুকে পড়েছিলো ঘরের ভেতরে, বই পড়ুয়ারা মুখ তুলে তাকালেও আবারো ফিরে যায় শব্দের জগতে। এক সময়কার রেস্টুরেন্টের দেয়ালগুলো দখল করে আছে বইয়ের শেল্ফ, আর সেগুলোতে ঠাঁই করে নিয়েছে অসংখ্য বই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিন বছর আগের দৃশ্যটার সাথে এক ধরণের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলো সে-প্রথমবার দেখেছিলো চার-পাঁচজন ভোজনরসিক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খাবারের আস্বাদন নিচ্ছে, আর এবার দেখেছে। অল্প বয়সী কিছু পাঠক ডুবে আছে বইয়ের পাতায়। চারপাশে বইয়ের শেঙ্কের মাঝে দুটো বিশাল রিডিং টেবিলে বসে আছে নিবিষ্ট পাঠকের ছোট্ট দলটি। মাথার উপরে ঘুরছে সিলিংফ্যান। সেগুলোর গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নেই।

একটু আগে রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে ছফা খুবই অবাক হয়েছিলো, রেস্টুরেন্টের সুদীর্ঘ নামটি একটিমাত্র শব্দে রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে এখনও টিকে আছে বলে।

সুন্দরপুরে এতো কিছু ঘটে যাবার পর কী করে নামটা টিকে আছে।

যেহেতু এটা আর এখন রেস্টুরেন্ট হিসেবে নেই, তাই শুধু ‘খেতে’ নয়, ‘এখানে কখনও আসেননি’ও বাদ দেয়া হয়েছে-যদিও সুন্দরপুরের জন্য এটাই সত্যি।

পুরনো ‘রবীন্দ্রনাথ’ সাইনটার নীচে ছোট্ট করে যুক্ত করা হয়েছে ‘স্মৃতি গ্রন্থাগার’ লেখাটি।

রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগার!

সুন্দরপুরের মতো কোনো অঞ্চলে এরকম একটি লাইব্রেরি আছে দেখে খুশিই হলো ছফা। কাজটা যে মাস্টার রমাকান্তকামারের সেটা বুঝতে বাকি। রইলো না। মুশকান জুবেরি যতো বড় ক্রিমিনালই হোক না কেন, জায়গা জমি যোগ্য একজনের হাতেই দিয়ে গেছে।

ছফা দেখতে পেলো ঘরের এককোণে বিশাল আকারে একটি গ্লোবও রাখা আছে। ঘরে বই ছাড়াও আছে বেশ কিছু মনীষীর ছবি। তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বড় আর প্রধান ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে চোখ গেলো এবার। ওটাও একটা ছবির ফ্রেম তবে তাতে কোনো ছবি নেই। বিশাল একটি বাদামি কাগজে কিছু লেখা। ছফা যেখানে আছে সেখান থেকে লেখাটা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এই প্রথম সে টের পেলো চল্লিশের আগেই চালশে অবস্থা তার। ছোটো ছোটো অক্ষরগুলো পড়তে বেগ পাচ্ছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালো। লেখাটা যেই না পড়তে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ পেছন থেকে বলে উঠলো :

“স্যার! কখন আইলেন?”

কথাটা এতো জোরে উচ্চারণ করা হলো যে, নুরে ছফাসহ লাইব্রেরিতে থাকা চার-পাঁচজন পাঠকের প্রায় সবাই চমকে ঘুরে তাকালো।

“আমি তো আপনেরে ফোন দিসিলাম কিন্তু ফোন-”

“আস্তে!” মৃদু ধমকের সুরে আতর আলীকে চুপ করিয়ে দিলো ছফা। ভ্যাবাচ্যাকা খেলো ইনফর্মার। তাকে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।

“কী হইছে, স্যার?” আতর বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো বাইরে এসে। তাকে কেন আস্তে কথা বলতে বলছে বুঝতে পারলো না।

“আরে, দেখছো না…এটা একটা লাইব্রেরি,” বললো ছফা।

“তো কী হইছে!” আতর এখনও বুঝতে পারছে না।

এই লোককে লাইব্রেরি কালচার নিয়ে জ্ঞান দেবার কোনো ইচ্ছে নেই ছফার।

“কিছু না,” বলেই রবীন্দ্রনাথের সামনের খোলা প্রাঙ্গনে কাছে এসে দাঁড়ালো সে। প্রবল বাতাসের সাথে ধুলো উড়ছে এখন। বৃষ্টি আসি আসি করছে। অনেক দিন পর দেখা হলো…এখন বলল, কেমন আছো?”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর আলী। “আমি ভালাই আছি, স্যার, আপনের ফোন বন্ধ পাইয়া আমি তো অস্থির হয়া গেছিলাম।”

“আসার পথে আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো, তাই তোমাকে কল দিতে পারিনি।” এর আগে ইনফর্মারের সাথে তার কথা হয়েছিলো, সুন্দরপুর ঢুকেই তাকে কল দেবে।

বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই তারা দু-জন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রবেশদ্বারের সামনে শেডের নীচে এসে দাঁড়ালো।

“আপনে কিমুন আছেন, স্যার?” জিজ্ঞেস করলো ইনফর্মার। “এইদিকে তো আর আসেনই না।”

“ঢাকায় কাজের অনেক চাপ, ছফা বললো। “অনেকগুলো কেস তদন্ত করছি, দম ফেলার সময় পাই না।”

“আপনেরে দেইখ্যা কী যে ভালা লাগতাছে!” আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললো আতর।

মুচকি হাসলো ছফা। সুন্দুরপুরের ইনফর্মারের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে তার জামা-কাপড় একটু গোছালো আর দামি। মাথার চুলগুলোও পরিপাটি। নিয়মিত গোসল করে বলেও মনে হচ্ছে।

“তা, বলো…এখানকার খবর কী?” এমনি জানতে চাইলো।

“খবর তো ভালাই,” বললো আতর, “কতো কিছু যে হয়া গেছে, কী আর কমু আপনেরে।”

সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার পর আতরের সাথে কয়েক মাস যোগাযোগ ছিলো ছফার। মাস্টারের পেছনে লেলিয়ে দেবার পরও যখন দেখা গেলো উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যাচ্ছে না তখন ধীরে ধীরে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে সে, আতরের সাথেও যোগাযোগ কমে যেতে শুরু করে। এরপরও ইনফর্মার তাকে মাঝেসাঝে ফোন দিয়ে জানাতো মাস্টারের স্কুল নিয়ে ব্যস্ততার কথা, সেসবের প্রতি কোনো আগ্রহ তার ছিলো না। এক পর্যায়ে আতরের ফোন ধরাও বন্ধ করে দেয়-সময়ে অসময়ে ফোন দিতো সে নানান ধরণের তদবির নিয়ে। উপরন্তু দু-বছর আগে পুরনো ফোন নাম্বারটা পাল্টে ফেলায় আতরের পক্ষে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি দীর্ঘদিন।

“রহমান মিয়ার টঙ দোকানটা দেখলাম আগের মতোই আছে।”

ছফার মুখ থেকে রহমান মিয়ার নামটা শুনে ভেতরে ভেতরে মর্মাহত হলো আতর। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার জন্য সে বললো, “মাস্টরের কিন্তু এখন বিরাট অবস্থা। এই যে দেখতাছেন…” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো, “…এইটা তো মাস্টরেরই কাম। বিরাট বড় একটা স্কুলও দিছে, কতো কী যে…”

আতরকে এভাবে কথার মাঝখানে থেমে যেতে দেখে অবাক হলো নুরে ছফা। ইনফর্মারের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকালো। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা আর গালে শুভ্র লম্বা দাড়ি-গোঁফ-সৌম্যকান্তির অবয়বটি দেখেই চিনতে পারলো সে।

মাস্টার রমাকান্তকামার বগলে চামড়ার ব্যাগ আর হাতে একটি কালো রঙের ছাতা নিয়ে বের হয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে।

ছফা বুঝতে পারলো, লাইব্রেরির ভেতরে যে ছোট্ট একটি অফিস ঘর আছে, এতোক্ষণ নিশ্চয় সেখানে ছিলেন।

মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে, ছফাকে দেখতে পেয়ে রমাকান্তকামারের চোখদুটোতে নেমে এসেছে বিস্ময়।

“আদাব, মাস্টারসাহেব…ভালো আছেন?” বললো ছফা।

আনমনেই মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক। “আপনি?…এখানে?!” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি।

.

অধ্যায় ১৫

নুরে ছফা চায়নি সুন্দরপুরে পা রাখতেই মাস্টার রমাকান্তকামারের সাথে দেখা হয়ে যাক। সে জানতো না লাইব্রেরিতে এ সময় মাস্টার থাকবেন। ভদ্রলোকের মুখোমুখি হবার চেয়েও বেশি অস্বস্তিকর ছিলো তার করা প্রশ্নটি।

আপনি…এখানে?

ছফা এর জবাবে কী বলবে ভেবে পায়নি। কয়েক মুহূর্ত লেগে গেছিলো জবাব দিতে। “এইতো…একটা কাজে আসতে হলো আবার।” একটু সময় নিলেও বলতে পেরেছিলো সে। “বৃষ্টির কারণে এখানে আটকা পড়ে গেছি।”

রমাকান্তকামার অবশ্য বেশি কিছু জানতে চাননি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ ছাতা ফুটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে যান।

“বিকালবেলা মাস্টর এইহানেই থাকে,” রমাকান্তকামার চলে যাবার পর বললো আতর আলী। “দুনিয়ার যতো বই আছে কিইন্যা ভইরা ফালাইতাছে, পোলাপানের মাথা খায়া ফালাইছে এক্কেবারে।”

ছফা এ কথার জবাবে কিছু বললো না। আতর আলীর মতো লোকের কাছে কেন, অনেক দ্র আর সজ্জন মানুষও বই পড়াকে ফালতু কাজ হিসেবে দেখে এ দেশে। তার ছোটোবেলার একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার আগে গল্পের বই পড়তে গিয়ে বাবার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়, তারপর সে কী বকুনি! যেনো বিশাল এক গর্হিত কাজ করে বসেছে।

আতর আরো বক বক করে গেলো। সুন্দরপুরে বিগত তিন বছরে কী কী ঘটেছে তার সবটাই যেনো এক লহমায় উগলে দিতে চাইছে সে। বাইরের বৃষ্টি দেখে দেখে কিছুটা আনমনা হয়ে ছফা তার কথা শুনে গেলো।

এমপির মৃত্যু সুন্দরপুরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিন মাস পর উপনির্বাচনে নতুন যে এমপি নির্বাচিত হয়েছে, মানুষ হিসেবে সে বেশ সজ্জন। নতুন এমপি বয়সে তরুণই বলা চলে। রমাকান্তকামারের সাবেক ছাত্র সে। স্নেহধন্য ছাত্র এমপি হবার পর তার সাহায্যে খুব দ্রুতই জমিদার বাড়িতে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল। এ অঞ্চলের সবচাইতে বড় আর অন্য রকম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান-ছবি আঁকাসহ অনেক কিছুই শেখানো হয়।

“আগের এমপির যেইসব জায়গা-জমি দখলে রাখছিলো সেইগুলা নয়া এমপি দখল কইরা স্কুরে দিয়া দিছে, আর বলতে লাগলো। “বেটা তো মরছেই, হের জায়গা-জমিও সব গেছে। ঐ যে, পেট্রল পাম্পটা আছে না…ঐটাও বন্ধ কইরা দিছে এমপিসাবে। হুনতাছি, ওইটা নিজেই লিজ নিবো।”

“আগের এমপির ছেলেমেয়েরা বাধা দেয়নি, মামলা-মোকদ্দমা করেনি?”

“হেরা তো বিদেশে থাকে, এইসব নিয়া হাউকাউ ক্যামনে করবো। কইরা কোনো লাভ হইবো? কাগজপত্রে ঘাপলা আছে না?”

“আচ্ছা, ফালুর কোনো খবর জানো? সে আর সুন্দরপুরে আসেনি?”

আতরের মুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো। “চুতমারানির পোলায়…” গালিটা দিতেই সামলে নিলো সে। “আইছিলো তো রাইতের বেলায়… বইনের লগে দেহা করতে! চোরের মতো আইছে আবার চোরের মতোই। কাইট্টা পড়ছে। আমি যদি ওরে পাইতাম মাটিতে পুইত্যা ফালাইতাম!” শেষ কথাটা দাঁতে দাঁত পিষে বললো ইনফর্মার। ফালু যে তাকে জিন্দা কবর দেবার ব্যবস্থা করেছিলো সেটা এখনও ভোলেনি।

“ঐ রাতকানা মেয়েটা এখনও আছে?” একটু অবাক হলো ছফা।

“হ। ঐ মাইয়া এহন মাস্টরের স্কুলে কাম করে। স্কুলটা ম্যালা বড়…কতোজন যে কাম করে জানেন না।”

“ফালু যে এখানে এসেছিলো সে-কথা তুমি জানলে কিভাবে?”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো আতর। “মাস্টরের স্কুলে আমার এক লোক আছে, স্যার,” খুবই গর্বিত ভঙ্গিতে জানালো কথাটা। “হে আমারে কইছে।”

গোরখোদক ফালুকে নিয়ে অবশ্য ছফার কোনো আগ্রহ নেই, যেমনটা আগ্রহ আছে তার সিনিয়র কেএস খানের মধ্যে।

“আচ্ছা, এখানে আসার পর দেখলাম রহমান মিয়া আগের জায়গাতেই আছে,” প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো সে। “তার ব্যবসা কেমন চলে। এখন? রেস্টুরেন্টটা তো নেই, মানুষজন আসে এখানে?”

“পাম্পটাও তো বন্ধ,” আতর বললো। “এই রোডে এহন আর গাড়িঘোড়া থামে না…হের ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে। তয় অন্য কিছু তো করবার পারে না, পারে খালি গুড়ের চা বানাইতে আর গপসপ করতে। হেরে কইছিলাম, নতুন হোটেল দুইটার সামনে গিয়া নাড় গাঁড়ো, এইখানে তো কেউ মুততেও আহে না সারাদিনে। কিন্তু হে তো আইলসা, বইস্যা বইস্যা

“নতুন দুটো হোটেল হয়েছে মানে?” ইনফর্মারের কথায় বাধা দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।

জিভে কামড় দিলো আতর আলী, যেনো মূল্যবান একটি তথ্য জানাতে ভুলে গেছিলো। “আপনেরে তো কই নাই, বেটির হোটেলের দুই পোলায় বিরাট বড় আকাম করা ফালাইছে। গত বছর হিটলু হারামজাদা বেটির হোটেলটা আবার দিছে, তারে দেইখ্যা ফজলুও আরেকটা দিছে। হালারপুতেগো মাথায় চিকনা বুদ্ধি গিজগিজ করে!”

.

অধ্যায় ১৬

নিজের বাড়ির বারান্দায় ভেজা ছাতাটা মেলে রাখলেন রমাকান্তকামার। বৃষ্টির প্রকোপ এখন কমে এসেছে, আর কিছুক্ষণ পরই থেমে যাবে। এরইমধ্যে নেমে গেছে সন্ধ্যা। তবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে রাত বলেই মনে হচ্ছে।

পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। বিদ্যুৎ চলে গেছে, ঘরে ঢুকে পুরনো হারিকেনটা জ্বালিয়ে দিলেন। অন্ধকার তার কাছে সব সময়ই অপ্রিয়। তিনি পছন্দ করেন আলো, সেই আলোয় অন্যকে আলোকিত করতে। সারাটা জীবনই চলে গেছে এ কাজ করে করে। এখন জীবন সায়াহ্নে এসে হাতে একটি আলোকবর্তিকা পেয়ে গেছেন, সেটা দিয়ে যতোটুকু সম্ভব অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মনেপ্রাণে চাইছেন, তার অনুপস্থিতিতেও যেনো এই কর্মযজ্ঞ থেমে না যায়। কয়েক বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে নিজের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করতে পেরেছেন। কিন্তু সবকিছু যখন গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন, তখনই সুন্দরপুরে এসে হাজির হয়েছে ঐ লোকটি।

নুরে ছফা।

একটু আগে তাকে লাইব্রেরির সামনে দেখামাত্র এক ধরণের আশঙ্কা জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। মনে হচ্ছে, অশুভ কিছু ঘটবে আবার। বিগত তিন বছর ধরে এই লোকের কোনো টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তাহলে কী কারণে আবার এসেছে এখানে?

ভাবনাটা মাস্টারের মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। তিনি এমন কিছু করেননি, এমন কিছুতে জড়িত নন যে, একজন পুলিশ কর্মকতার আগমনে বিচলিত হয়ে উঠবেন। এসবই নিছক আশঙ্কা। সম্ভবত, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর তার মধ্যে সবকিছু হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে। আগে তার কিছুই ছিলো না, হারানোরও কোনো ভয় ছিলো না তখন।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। এই এক জীবনে কম তো দেখলেন না। উত্থান আর পতনের খেলাটা যেনো তার কাছে ঋতুচক্রের মতোই-ঘুরে ফিরে আসে বার বার।

ঘরের জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকালেন। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার ভাবনায় খেলা করে যাচ্ছে অনেক কিছু। স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি।

এক সময় তার অনেক কিছুই ছিলো, তারপর সবকিছু কেড়ে নিলো পাক হানাদারেরা। আবারো তিনি কিছু ফিরে পেলেন স্কুলের ছোটোছোটো বাচ্চাগুলোকে আলোকিত করার কাজ পেয়ে। সেগুলোও এক সময় হাতছাড়া হয়ে গেলো। সারাজীবনের যে ব্রত ছিলো শিক্ষকতা করার, সেখান থেকেও বিতাড়িত করা হলো তাকে। অবশেষে জীবনের শেষ সময়ে এসে, অনেকটা আচমকাই, জাদুমন্ত্রের মতো সবকিছু পাল্টে গেলো চোখের নিমেষে। তিনি পেয়ে গেলেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সোনার চাবিকাঠি! আর সেটা এমন একজনের কাছ থেকে, যার ব্যাপারে তার মনে ছিলো যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয়। শঠ আর ধান্দাবাজ মানুষজন তিনি সারাটা জীবন এড়িয়ে চলেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এতোটাই বড় ছিলো যে, তিনি আর এসব পরোয়া করেননি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছেন, যা করছেন বৃহত্তর স্বার্থেই করছেন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কিছু করছেন না।

তাছাড়া মুশকান জুবেরি যা করেছে সেটা জমিগুলোর আসল মালিকের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু না। জমিদার বাড়ির সম্পত্তিগুলো কখনও তার ছিলো না, যখন বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যতেও থাকবে না, তখন সেগুলো যাকে দেবার তাকে দিয়ে চলে গেছে। রাশেদ জুবেরি মৃত্যুর আগেই বলে গেছিলো, তার নামে থাকা বিশাল সম্পত্তির প্রায় সবটাই যেনো ট্রাস্টে দিয়ে দেয়া হয়। ঐ মহিলা চাইলে তার রেস্টুরেন্টের জায়গাটাসহ আরো কিছু জমি রেখে দিতে পারতো কিন্তু সুন্দরপুরে যখন আর থাকা সম্ভব নয় তখন ঐ সম্পত্তিগুলোও স্কুলের ট্রাস্টে দিয়ে দিয়েছে সে।

রাশেদ জুবেরির কথা মনে পড়ে গেলো। বেশ সখ্যতা ছিলো মাস্টারের সাথে। তিনি ভালো করেই জানেন, মায়ের বাপের কাছ থেকে পাওয়া সুন্দরপুরের জমিজমাগুলো নিয়ে রাশেদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিলো না কোনো কালে। মনেপ্রাণে চাইতো জমিগুলো যেনো ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়-মাস্টারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বেশ কয়েক বার রাশেদ তাকে বলেছিলো, এখানকার জয়াগাজমিগুলোর প্রতি তার কোনো আগ্রহ না থাকলেও তার ঠাকুরদার বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। সে চায় না, ওগুলো খারাপ লোকের খপ্পরে পড়ে থাকুক। বিশেষ করে যে লোক তার মা-সহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করিয়েছে তারই কুপুত্র ওগুলো ভোগদখল করবে এটা কোনোভাবেই হতে দেবে না সে। জমিগুলো উদ্ধার করে ভালো কাজের জন্য দান করে দেবে। কী কাজে দান করা হবে সেটা জানতে ইচ্ছে করলেও মাস্টার জিজ্ঞেস করেননি কখনও। তবে রাশেদ নিজে থেকেই বলেছিলো, সময় হলে নাকি মাস্টারই সবার আগে সেটা জানতে পারবেন।

মুশকান জুবেরি যে উদ্দেশ্যেই এখানে এসে থাকুক, যা-ই করে থাকুক, তার সাথে রমাকান্তকামারের কিংবা অলোকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ওগুলোর নিয়তিই হয়তো এমন ছিলো। কতোগুলো কালোহাত ঘুরে শেষমেষ ভালো কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে।

মহিলা সুন্দরপুর না এলে অবশ্য এতো কিছু ঘটতো কিনা সন্দেহ আছে। জমিগুলো হয়তো ঐ কোলাবরেটরের ছেলে আসাদুল্লাহর করায়ত্তেই থাকতো। আবার এ-ও ঠিক, নুরে ছফা নামের লোকটা না এলেও মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে সহসা পালাতো না, জমিগুলোও মাস্টারের কাছে দিয়ে যেতো কিনা সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে দেখলে ছফার কাছেও মাস্টার কিছুটা ঋণী। কিন্তু লোকটার চাতুর্য তার কাছে ভালো লাগেনি শুরু থেকেই। সুন্দরপুরে এমনও গুজব আছে, ঐ লোক আসলে আসাদুল্লাহর হয়েই কাজ করেছে। ঢাকা থেকে উড়ে এসে মহিলাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলো, শেষে উপায় না দেখে জমিদার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টাও করে। কিন্তু মহিলা প্রাণ নিয়ে সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যায়।

অবশ্য অন্য রকম গুজবও আছে, মুশকান জুবেরি নাকি বিরাট বড় এক অপরাধী। কী অপরাধ করেছে সে-ব্যাপারে সুন্দরপুরের কারোর কোনো ধারনা নেই। তারা এমপির চক্রান্তের গল্পটাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস করে এখন।

আজ প্রায় তিন বছর পরে আবারো সেই লোক এসে হাজির হয়েছে। সুন্দরপুরে। আবারো অশুভ কিছু ঘটবে বলেই আশঙ্কা করছেন মাস্টার। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ঘটনাই যেনো তার স্বপ্নের স্কুল আর লাইব্রেরিটাকে ছুঁতে না পারে।

.

অধ্যায় ১৭

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি।

তিক্ততার সাথেই সাইনবোর্ডের লেখাটা পড়লো নুরে ছফা। বেশ বড় করেই লেখা হয়েছে নামটা, সাইনের ফন্ট অবিকল আগেরটার মতোই, তবে সেটার নীচে ছোট্ট করে লেখা : রেস্টুরেন্ট।

রবীন্দ্রনাথের উল্টোদিকে তাকালো সে।

মুশকান রেস্টুরেন্ট!

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। সুন্দরপুর টাউনে, সুরুত আলীর নোংরা হোটেল থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে, রাস্তার দু-পাশে এই দুটো রেস্টুরেন্ট ঝড়বাদলা শেষে, ভর সন্ধ্যায়ও কাস্টমারের ভীড়ে গমগম করছে। দেখলেই বোঝা যায় বেশ নতুন। আকার এবং আকৃতিও প্রায় সমান। যেনো অলিখিত একটি প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে তারা।

আতর আলী তাকে বলেছে, এ দুটো রেস্টুরেন্ট দিয়েছে মুশকান জুবেরির সাবেক দুই কর্মচারী হিটলু আর ফজলু-অন্য সব কর্মচারীর মতো রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি বন্ধ হবার পর বেকার হয়ে পড়েছিলো তারা। একজন আগের রেস্টুরেন্টের নামটা প্রায় হুবহু বগলদাবা করলেও অন্যজন খোদ মুশকান জুবেরিকেই আত্মসাৎ করে ফেলেছে। চতুর ঐ কর্মচারী আগের নাম থেকে ‘খেতে’ শব্দটা বাদ দিয়েছে সম্ভবত আইনী ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। যদিও ছফা নিশ্চিত, মুশকান কখনও রেস্টুরেন্টের নামটা দাবি করে আইনী পদক্ষেপ নেবে না, ফিরে আসবে না সুন্দরপুরে।

তিন বছর আগে, সুন্দরপুর ছেড়ে চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের কর্মচারীরা রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েছিলো। চাকরিহারা মানুষগুলোর সবাই নতুন কাজ জুটিয়ে নিতে পারেনি, বেশির ভাগই বেকার হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে কিছু দিন। এই অঞ্চলে এমন রেস্টুরেন্ট নেই যেখানে কাজ করে তারা আগের মতো বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা পাবে। তো তাদের মধ্যে প্রথমে হিটলু নামের এক কর্মচারী এগিয়ে আসে, সাহস করে দিয়ে বসে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট-প্রায় হুবহু আগের নামটার মতোই।

দ্বিতীয়জনের বুদ্ধি খুলেছে একটু দেরিতে। সে রেস্টুরেন্টের নামটা করায়ত্ত করতে না পারলেও স্বয়ং এর মালেকিনকেই নিয়ে নিয়েছে!

কর্মচারী দুজন যেমন চালাক, তেমনি সৃজনশীলও বটে!

বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছে, অল্প খরচেই ছিমছাম সাজগোজ করা হয়েছে রেস্টুরেন্ট দুটোর। সাধারণত অন্য রেস্টুরেন্টগুলোতে সামনের দিকটায় চুলা রাখা হয় গরম গরম পরোটা, লুচি, পুরি, ডিম ভাজার জন্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি আর মুশকান একটু ব্যতিক্রম, আগেরটার মতোই।

সামনের এক চিলতে যে খালি জায়গাটুকু আছে, সেখানে ফুলের টব বসানো হয়েছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে জায়গাটার দু-পাশ ঘেরা। সেই বেড়াতে আবার সাদা-লাল রঙে রঙ করা। রেস্টুরেন্ট দুটো জমজ ভাই বোনের মতোই দেখতে, শুধু ললাটের তিলক দুটো আলাদা-আর সেটাই তাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে!

“দ্যাখছেন?” আতর আলী বলে উঠলো পাশ থেকে। “দুইটাতেই কাস্টমারে গিজ গিজ করতাছে।”

“কিন্তু ওদের খাবার কি আগের রেস্টুরেন্টটার মতো হয়?”

আতর দাঁত বের করে হাসলো। “হয় তো…নাইলে কি অ্যাতো। মাইনষে খাইতে আহে?”

অবাক হলো ছফা। তার ধারণা ছিলো, মুশকান জুবেরির সমস্ত রেসিপিই সিক্রেট, কেউ সেটা নকল করতে পারে না।

“তুমি না বলেছিলে, এর আগে ওই রেস্টুরেন্টের কিছু কর্মচারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা রেস্টুরেন্ট করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ওরকম স্বাদের খাবার তৈরি করতে?”।

আবারো দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার। “ঠিকই কইছিলাম, স্যার…তয় হিটলু আর ফজলুর কপাল ভালা। বেটি যে রাইতে পলাইলো, তার আগে ওগোর কাছে মেডিচিনগুলা দিয়া গেছিলো…ওইগুলান দিয়াই তো খাওনের স্বোয়াদ বাড়ায়।”

বুঝতে পারলো ছফা। মুশকান জুবেরির রেসিপিগুলো সিক্রেট ছিলো, তবে রান্না করার পর প্রতিটি খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিরাপ মেশাতো, আর সেটাই খাবারের স্বাদকে অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতো। এই সিরাপগুলো কী দিয়ে তৈরি সেটা ঐ মহিলা ছাড়া আর কেউ জানতো না।

“ওই দুই বাটপার বহুত মাথা খাটায়া মেডিচিনগুলার নকল বানাইছে। মেডিচিনগুলা নিয়াই দুই হালারপুতের মইদ্যে যতো ক্যাচাল।”

নুরে ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি একটা কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালো তারা।

“আরে, আতরভাই যে!”

ছফা আর ইনফর্মার দেখতে পেলো মাঝবয়সী হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, মুখে এঁটে রেখেছে কৃত্রিম হাসি। কিন্তু হাসির আড়ালে যে আশঙ্কা জেঁকে বসেছে সেটা পুরোপুরি লুকাতে পারেনি।

“স্লামালেকুম।”

“ফজলুমিয়া নাকি,” আতর মুখ বেঁকিয়ে বললো। “ব্যবসা তো জমজমাট তোমার।”

ফজলু নামের লোকটি অমায়িক হাসি দিলো। “সব আপনাগোর দোয়া।”

“ধুর মিয়া, কী কও!” বাঁকাহাসি দিলো আতর। “আমাগো দোয়া হইবো ক্যান, সব তোমার চিকনা বুদ্ধির খেইল। ভালাই খেল দেখাইছে তোমরা…বেটির নাম ভাঙ্গাইয়া পকেট ভরতাছো!”

বিব্রত বোধ করলো ফজলু। “কী যে কন, আতরভাই।”

চোখমুখ নাচিয়ে নুরে ছফার দিকে তাকালো ইনফর্মার। “ইনি আমাগো ছফাস্যার…বিরাট বড় ডিবি অপিসার…ঢাকা থিকা আসছেন…তগো বেটি যার ডরে হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা পলাইছিলো!”

রবীন্দ্রনাথের সাবেক কর্মচারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো একটু। সম্ভ্রমের সাথে বলে উঠলো, “স্লামালাইকুম, স্যার…ভালো আছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।

“হিটলু কই, দেখতাছি না যে?” রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননির দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার।

“হের খবর আমি রাখি না!” তিক্তমুখে জবাব দিলো ফজলু।

মুখোমুখি দুই রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রতিযোগীতাটি যে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে গড়িয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না ছফার।

“আমাগো এই ফজলুমিয়া একটু লেট কইরা ফালাইছিলো, স্যার, বুঝলেন?”

ছফা কিছু বললো না।

“বেটি ভাগনের পর বেকার হয়া ঘুইরা বেড়াইতো, তারপর গত বছর যখন দেখলো তার ইয়ারদোস্ত হিটলু কাম সাইরা ফালাইছে, তহন হের বুদ্ধি খুললো।” ফজলু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবার বলতে লাগলো সে, “হিটলু তো হিটলারি বুদ্ধি নিয়া চলে…বেটির হোটেলের নামটাই মাইরা দিছে।” বিচ্ছিরি হাসি দিলো ইনফর্মার। যেনো ফজলুর এই বোকামিতে সে ভীষণ মজা পেয়েছে। “হেয় আর কী করবো, চোর ভাগনের পর বুদ্ধি খুলছে। তয়, হে-ও কম যায় না, এক্কেবারে বেটিরেই মাইরা দিছে!” শেষ কথাটা মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে অদৃশ্য কোথাও প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দেবার মতো বিচ্ছিরি একটা ইঙ্গিত করে বললো আতর।

ফজলু একটু কাচুমাচু খেলো। “আরে না, ভাই…আমি তো আমার মাইয়ার নামে এইটা রাখছি। আমার মাইয়ার নাম—”

“রাখো মিয়া!” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো ইনফর্মার। “মিছা কও ক্যান! তোমার মাইয়া যহন পয়দা হইলো, নাম তো রাখছিলা গুলনাহার, হে আবার মুশকান হইলো কবে থিকা?” ছফার দিকে তাকালো। “ওয় মনে করছে আমি এইসব বাইর করতে পারুম না। আরে, আমার নাম হইলো বিবিচি…সুন্দরপুরে কী হয় না-হয় সব আমি জানি!” গর্বিত ভঙ্গিতে বললো সে।

“আতরভাই, আপনে ভুল কন নাই। গুলনাহার তার আসল নাম, ডাক নাম কিন্তু মুশকানই রাখছি।”

“এইসব বুজ আমারে দিয়া কাম হইবো না, আমারে মদনা পাইছোনি!”

“আহ,” ইনফর্মারকে থামিয়ে দিলো ছফা। “বাদ দাও তো এসব কথা।” সে বুঝতে পারছে, ফজলুর চিকন বুদ্ধির কাজকারবার। মুশকান জুবেরির খাবারের সুনাম ছিলো, এটা অস্বীকার করবার জো নেই। মহিলার অনুপস্থিতিতে তার সুনাম ব্যবহার করার মতো কেউ থাকবে না তা কি হয়? এই দেশে এরকমটা আশা করা যায় না। এখানে সফলতাকে অনুসরণ নয়, অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে পুরোপুরি হাইজ্যাকও করে কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথের সাবেক দুই কর্মচারী সেটাই করেছে।

“স্যার, ফজলুর লগে কিন্তু আমাগো মাস্টরের হট টেরাম,” আঙটার মতো করে দুই তর্জনি আঁটকে দেখালো আতর।

ছফা অবাক হয়ে তাকালো লোকটার দিকে।

মুশকানের মালিক ব্যাখ্যা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। “আতরভাই ভুল বুঝছে, স্যার। উনার স্কুলে তো অনেক বাচ্চা…তিনবেলা খানা দিতে হয়, বিরাট আয়োজন করা লাগে। মাস্টারসাব আমারে এই কাজের দায়িত্ব দিসেন। আমি তারে হেল্প করি।”

ছফা কিছু বললো না।

“উনি হইলেন এই এলাকার মুরুব্বি, মাইন্যগণ্য মানুষ। এমপিসাবে যখন আমারে বললেন, আমি যেন মাস্টারসাবরে হেল্প করি তখন কি না কইরা পারি, কন?”

এবার আতরের দিকে তাকালো নুরে ছফা, “চলো, যাই।”

“কিছু না খাইয়া যাইবেন, তা কি হয়?” ফজলু বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেও ছফার কাছে মনে হলো লোকটা খাতির করে ভাব জমাতে চাচ্ছে। “গরীবের হোটেলে আসছেন, একটু খানাপিনা কইরা যান?”

“এখন না, মাত্র এলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে নেই তারপর আসবো।” কথাটা বলেই আতরকে নিয়ে চলে গেলো ছফা। ফজলু আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার সুযোগ পেলো না।

“আপনে উঠবেন কই? এসপির বাসায়?” হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু সামনের দিকে যেতেই আতর আলী বলে উঠলো।

“না, টাউনের হোটেলেই উঠবো,” নুরে ছফা বললো।

“সুরুত আলীর হোটেলে?” ইনফর্মার বিস্মিত হলো। “ঐটা তো এহন পুরা খান” জিভে কামড় দিয়ে দিলো সে। আরেকটু হলে বেফাঁস কথাটা বলেই ফেলতো। “যাউক গিয়া, আপনে যে-কয়দিন আছেন হোটেলটা ঠিকঠাকমতোই চলবো, চিন্তার কিছু নাই।”

সুন্দরপুরের আগের এসপি বদলি হয়ে গেছে বহু আগেই। নতুন এসপির বাংলোতে ওঠার কথা ভেবেছিলো ছফা কিন্তু ভদ্রলোক সপরিবারে থাকেন, তাই ওখানে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই তার।

“দুইটার খাওন-দাওনই ভালা,” বললো আতর। “আমি মাজেমইদ্যে খাই। তয়, হিটলুর চায়া ফজলুর হাত বেশি ভালা।”

ছফা কিছু বললো না। তার ধারনা, এই নতুন হোটেলে নিয়মিত খায়দায় ইনফর্মার, আর সেটা অবশ্যই বিনে-পয়সায়। তবে এখানে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার। নাম দুটো তাকে একটি ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা এক ধরণের পুরনো ক্ষত, যেটার উপশম এখনও হয়নি।

যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইকাই আপনেরে উঠতে হইবো-কেএস খানের কথাটা যেনো মাথার ভেতরে উচ্চারিত হলো আরেকবার। মনের অজান্তেই হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেলো তার।

এখানেই আমি ব্যর্থ হয়েছি, এখান থেকেই আমাকে আবার শুরু করতে হবে…নতুন করে, মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা।

.

অধ্যায় ১৮

সুন্দরপুরে রাত নেমে এসেছে। নিরিবিলি হয়ে গেছে এর মহাসড়ক। থানা থেকে বেশ কিছুটা দূরে পরিত্যক্ত একটি বসত বাড়ির উঠোনের সিঁড়িতে বসে আছে আতর আলী। এককালে এখানকার সম্ভ্রান্ত ভট্টাচার্য পরিবারের বাস ছিলো। একাত্তরে তাদের যে কয়জন বেঁচে ছিলো, সবাই চলে গেছিলো কলকাতায়। কেউ আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে নানাজনের হাত ঘুরেছে এটা। কখনও কোনো সারের ডিলারের গোডাউন, তো কখনও আগের এমপির পোলাপানদের আখড়া। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে আছে। তবে শোনা যাচ্ছে, এই বাড়িটা সুন্দরপুরের ফেকু সরকারের অরিন্দম নাট্যসংঘের কাছে দিয়ে দেবে বর্তমান এমপি।

সিগারেটে আয়েশ করে টান দিচ্ছে আতর। একটু আগে নুরে ছফাকে হোটেল সানমুনে রেখে এসেছে, তখন বিস্তারিত কথা হয়েছে তার সাথে। তাকে যে কাজ করতে বলেছে সেটা খুবই অবমাননাকর। তবে সমস্যা নেই, সব ধরণের কাজের জন্যই মানুষ আছে এই দুনিয়াতে। একটু আগে আতর সেরকম একজনকে খবরও দিয়েছে। তারপরই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটো কল দেয় সে। এখন সেই দু-জন মানুষের অপেক্ষায় আছে।

পনেরো-ষোলো বছরের এক কিশোর এলো এ সময়। মলিন জিন্স আর টি শার্ট গায়ে। তার হাতে একটা ব্যাগ।

আতরের কাছে এসে চুপচাপ সালাম ঠুকে ব্যাগটা দিয়ে দিলো তাকে, সেই সাথে পকেট থেকে কিছু টাকাও। টাকাগুলো না শুনেই পকেটে ভরে নিলো সে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলো কেরু অ্যান্ড কেরু কোম্পানির একটি বোতল।

“কতত দিছোস?”

“দুইশো।”

“আইজকা আমদানি এতো কম ক্যারে, হারামজাদা?”

গালিটা গায়েই মাখলো না কিশোর, যেনো হররোজ এরকমটা শুনতে হয় তাকে। “আইজ তো টাউনের বাইরে যাই নাই।”

“ক্যান, আলেকবর মেম্বারের মাইয়ার না বিয়া হইতাছে…ওইখানে যাস নাই?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো সে।

মলিন মুখ করে মাথা দোলালো কিশোর। “ওই বাড়ির বেবাক্‌তে আমারে চিনে, গেলেই ধরা খামু।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। বয়স কম হলেও ছেলেটা যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। “কাইলকার কামটা কিন্তু টাইম মতোন করন লাগবো, মনে থাকে যে। একটু এদিক ওদিক হইছে তো পুটকি দিয়া বাঁশ ঢুকামু।”

মাথা নেরে সায় দিলো ছেলেটা। “ওইটা নিয়া আপনে এটুও টেনশন নিয়েন না, ওস্তাদ।”

আতর রেগেমেগে তাকালো। “ওই হালারপুত, আমারে ওস্তাদ কস্ ক্যান?” হারুকাটা মারা যাবার পর এই পিচ্চি কিছু দিনের জন্য ওস্তাদ বানিয়েছিলো গঞ্জের কাঙ্গালি মজিদকে-বছর গড়াতে না গড়াতেই মজিদও পটল তুলেছে কম দামি স্পিরিট পান করে। সেই থেকে আতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর যাই হোক, বল্টুর ওস্তাদ হওয়া যাবে না!

গাল চুলকালো ছেলেটা। ইনফর্মারের রাগের কারণটা ধরতে পারলো না। “কিন্তু এহন তো আপনেই আমার–”

কথার মাঝখানে হাত তুলে থামিয়ে দিলো ছেলেটাকে। “আমি তোর বস্…ওস্তাদ না। কথাটা খিয়াল রাখবি। এহন যা।”

চুপচাপ চলে গেলো ছেলেটা।

প্রথম সিগারেটটা যখন প্রায় শেষ তখনই পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকলো হ্যাংলা মতোন এক লোক। তার পরনের জামা-কাপড় অবশ্য পরিপাটি। চুলগুলো বেশ ছোটো করে ছাটা। পাতলা গোঁফেও যত্নের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

“সালাম, আতর ভাই।”

বোতলটা পাশে রেখে নিঃশব্দে সালামের জবাব দিলো ইনফর্মার। আগে এই বেয়াদপটা তাকে সালাম দিতো না, কিন্তু এখন শুধু সালামই দেয় না, সম্ভ্রমও করে আর সেটা অবশ্যই ভয় থেকে।

সবই হলো ক্ষমতা। এটা থাকলে মেথরও রাজা, না থাকলে রাজাও মেথর।

“কিছু হইছেনি? এতো জরুরী তলব করলেন যে?”

বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো আতরের ঠোঁটে। এ ধরণের কাজের সময় তার ভাবভঙ্গি একটু বেশি নাটকীয় হয়ে যায়। “ট্যাকা কামাইতে কামাইতে তো আন্ধা হয়া গেছো…সুন্দরপুরে কী হইতাছে না হইতাছে, কুনো খবর রাখো?”

লোকটা কিছুই বুঝতে পারলো না, চেয়ে রইলো ইনফর্মারের দিকে।

“উনি তো আবার আইছেন!” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বললো। “এহন কী করবেন কে জানে!”

“কার কথা কইতাছেন?” অবাক হলো হ্যাংলা মতোন লোকটি।

“যার ডরে তোমাগো ম্যাডাম হোগার কাপড় মাথায় তুইল্যা সব ফালায়া-ফুলায়া পলাইছিলো।” একটু থেমে আবার বললো, “তোমার হিটলারি মাথায় এহনও ঢুকতাছে না, হিটলুমিয়া?”

লোকটা ঢোঁক গিললো আলগোছে। “আবার কী হইছে?”

চোখ কপালে তুললো আতর। “কী হইছে মাইনে?” আক্ষেপে মাথা দোলালো। “এহনও বুঝবার পারো নাই?” পাশ থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে মুখটা খুলতে শুরু করলো সে। “বেটির নামটা তো পুরা মাইরা দিয়া বইয়া আছো…এইবার ঠ্যালা সামলাও!” বোতল থেকেই দুই ঢক পান করে গলাটা ভিজিয়ে নিলো। কেরু মদের তেঁতো স্বাদে সাময়িক চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সে। “স্যারে আমারে কইছে, ঐ ডাইনি পলানোর পর কার এতো বড় সাহস হইলো, তার হোটেলটা আবার দিছে!”

হিটলু বোঝার চেষ্টা করছে আতরের কথার মমার্থ।

“তুমাগো দুইজনের লুঙ্গি তুইল্যা পলানোর টাইম হয়া গেছে, বুঝলা?” বোতলটা পাশে রেখে দিলো ইনফর্মার।

“ভাই, আমরা কী অন্যায়টা করছি, ক? চুরি চামারি তো করি নাই, কর্ম কইরা খাইতাছি।”

কথাটা আতরের আঁতে ঘা বসালো। মনে হলো তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। একে তো সাবেক চোর, তার উপরে এই জীবনে নির্দিষ্ট কোনো কাজকর্ম করেনি কখনও। আর পুলিশের ইনফর্মারগিরি যে কোনো পেশা নয়, সেটা কে না জানে।

“চুরি করো নাই মাইনে?!” একটু তেঁতে উঠলো আতর। “ঐ হোটেলটা কি বেটি তুমারে লেইখ্যা দিয়া গেছে, অ্যাঁ?”

হিটলু ঢোঁক গিললো আবার। “না…তা দিবো ক্যান।”

“তাইলে তার হোটেলের নাম তুমি নিলা কুন সাহসে?”

“আমি তো তার নাম নেই নাই। আমার হোটেলের নাম রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি। আর ওইটার নাম আছিলো”।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো আতর। “রাখো তোমার দুই নম্বরি কথাবার্তা। এইসব বুজ আমারে দিবা না, সুন্দরপুরের আবলা-ভ্যাবলা মানুষজরে দিবা, তারা লুঙ্গির নীচ দিয়া পুটকি খাউজ্যাইতে খাউজ্যাইতে হ-হ কইরা তোমার কথা বিশ্বাস করবো।”

হিটলু একটু কাচুমাচু খেলো। নামের এই বুদ্ধিটা সে পেয়েছিলো মাস্টারের দেয়া নতুন লাইব্রেরির ভেতরে রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে একটি লেখা থেকে। কবি যে এই সুন্দরপুরে কখনও আসেননি সেটা নিয়েই ছিলো লেখাটা।

“কিন্তু শহর থেইক্যা যে আইছে, তারে যদি তুমি এইসব কইতে যাও…” কথাটা শেষ না করে ঢুলু ঢুলু চোখে চেয়ে রইলো শিকারের দিকে।

হিটলু একটু ভেবে নিলো। “ভাই, তার লগে তো আপনের বহুত খাতির, আপনে একটু দেখেন না ব্যাপারটা?”

আতর আলী বাঁকাহাসি দিলো। “সব কিছু আমি দেখুম ক্যান? আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে, অ্যাঁ?”

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’র মালিক একটু কাছে এগিয়ে এলো। “আপনের দিকটা আমি দেখুম, ভাই। আপনে খালি আমার দিকটা একটু দেখেন।”

আতর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

“হাজার দুয়েক দিমুনে, ঠিক আছে?”

কৃত্রিম আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো ইনফর্মার। “এতো হিটলারি বুদ্ধি মাথায় রাখো আর এইটা বোঝো না, এই কাম দুই-তিনে হইবো না?”

চেহারাটা মলিন করে ফেললো হিটলু।

“তুমি আসলেই একটা খাইষ্টা,” বোতলটা আবার তুলে নিলো হাতে, ঢক ঢক করে পান করলো। “তোমার চায়া ফজলু অনেক চিকন বুদ্ধি মাথায় রাখে, দিলদরিয়াও আছে। তারে আমি কিছুই বলি নাই, নিজ থেইক্যাই পাঁচ দিয়া গেলো।”

একটু গাল চুলকে নিলো হিটলু। “হেয় তো দাগি আসামির নামে হোটেল দিসে…বেশি দিবারই পারে।”

চোখমুখ খিচে ফেললো আতর। “হে দাগি আসামির নামে দিছে, আর তুমি নাটকিরপোলা ঐ আসামির হোটেলটার নামই মাইরা দিছো। ক্রিমিনাল তো কেউ কারোর চায়া কম না।”

হিটলু একটু ভেবে নিলো। “তাইলে আমিও পাঁচ দিমুনে, কী ক?” কথা আর বাড়াতে চাইলো না সে।

“এতোক্ষণে লাইনে আইছো, বোতলটা পাশে রেখে দিলো আবার। “এই জিনিস খালি খাইতে ভাল লাগে না, বুঝছো?”

হিটলু কিছুই বললো না।

“তোমার হোটেলের গরুর ভুনা তো ফেমাচ…একটা পোলারে দিয়া এক প্লেট পাঠায়া দিও এইখানে।”

“আচ্ছা, ভাই।”

“আর ট্যাকাটা কাইলকার মইদ্যে দিতে হইবো, তেড়িবেড়ি করবা না।” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো হিটলু।

আতরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। একটু পর ফজলু আসবে, তাকেও একই কথা বলবে। পাঁচ পাঁচ দশ! এক দানে এতোগুলো টাকা পাবার পর গঞ্জে যাবে সে খুব জলদি। গত সপ্তাহে শেফালি নামের নতুন যে মেয়েটা এসেছে, ঐ শালি সুন্দরপুরের আশেপাশে যতো লুঙ্গি আর গামছার বেপারী আছে, সব শালাকে যেনো গলায় গামছা বেঁধে টেনে আনছে। খুব ডিমান্ড তার। আর এবার তার ডিমান্ড মেটাবে!

বোতলটা তুলে নিয়ে লম্পট ঠোঁটটা ছোঁয়ালো, আবারো পান করলো ঢক ঢক করে।

.

অধ্যায় ১৯

ভ্রমণের ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও রাতে ভালো ঘুম হলো না ছফার। সুরুত আলীর নোংরা আর জঘন্য আবাসিক হোটেলকে এজন্যে দায়ী করা যায় না। বৈশাখ মাসের খামখেয়ালি আবহাওয়া এমনই যে, বিকেলের ঝড় সন্ধ্যার পর পরই উধাও হয়ে যায়, রাতের বেলায় সুন্দরপুরে নেমে আসে ভ্যাপসা গরম। ওদিকে হোটেলের পাশে সদ্য দেয়া জনপ্রিয় দুটো রেস্টুরেন্টের খাবার পরিহার করার মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। নামবিহীন এক খাবারের দোকানের খাবার খেয়ে পেট ফেঁপে গেছিলো তার। এটাই তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

ভোরের দিকে ক্লান্তি থেকে আসা ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টারও পরে। তারপরও বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল রাতে এই হোটেলে ওঠার আগে আতরের সাথে একটা জরুরী কাজ নিয়ে আলাপ করেছে সে। তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, বেশ সতর্কতার সাথে কাজটা করতে হবে, একদমই সময় নষ্ট করা যাবে না।

“এইসব কাম তো আমি কবেই ছাইড়া দিছি,” অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিলো ইনফর্মার। “তয় চিন্তা কইরেন না, অন্য একজরে দিয়া করামুনে।”

“আরে না,” সঙ্গে সঙ্গে ছফা বলে উঠেছিলো। সে চায়নি অন্য কেউ এ কাজ করুক। গোপন জিনিস যত কম জানা যায় ততো ভালো। “যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ করানো যাবে না…বুঝতে হবে এটা। “

“ওয় আমার হাতের মুঠিতে থাকে,” আশ্বস্ত করে বলেছিলো ইনফর্মার। “ওরে নিয়া কুনো চিন্তা কইরেন না, স্যার।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ছফা জানতে চেয়েছিলো, “কে সে?”

“বল্টু। আমাগো সুন্দরপুরের আলী বাবা! চল্লিশ চোরের কাম একাই করবার পারে সে। কব্বরে গেলেও এই কথা কাউরে কইবো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেও সন্দেহটা পুরোপুরি যায়নি ছফার।

“কিন্তু লোকটা যদি ধরা পড়ে যায়?”

“লোক না তো…পোলা,” শুধরে দিয়ে বলেছিলো আতর। “ওর বয়স চৌইদ্দ-পরো অইবো।”

“কি!” অবাকই হয়েছিলো সে। “তুমি একটা পিচ্চিকে দিয়ে এরকম কাজ করাবে?”

“বয়সে পিচ্চি হইলেও ওর মতো সেয়ানা এই সুন্দরপুরে দুইটা নাই। এই বয়সেই খানকি পাড়ায়…” কথাটা শেষ না করে আবার বলে, “আপনে যেইটা চাইতাছেন ওইটা বই করবার পারবো। মাইনষের ভীড়ে কাম সাইরা ফালায় সে, আর এইটা তো খালি বাড়ি…ওর কাছে ডাইলভাত।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো ছফা।

আতর আলী দাঁত বের করে হেসে বলে, “তাইলে ধইরা লন, আপনের কাম হয়া যাইবো।”

এখন বিছানা থেকে নিজেকে জোর করে তুলে নিয়ে টয়লেটে চলে গেলো ছফা। সে টের পেয়েছে, এই হোটেলে ওঠার সাথে সাথে এখানকার ‘ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হয়ে গেছে। নতুন ম্যানেজারের বেজার করা মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে, তার উপস্থিতি যতো প্রলম্বিত হবে এই মুখ ততোই চুপসে যেতে থাকবে। নিশ্চয় ভদ্রলোককে সাবধান করে দিয়েছে আতর।

যাই হোক, হোটেল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চলে এলো রবীন্দ্রনাথ আর মুশকানের সামনে। পথের দু ধারে দুটো রেস্টুরেন্টে এই সাত সকালেও কাস্টমারের বেশ সমাগম হয়েছে। আতরের কাছ থেকে এখানকার খাবারের বেশ সুনাম শুনেছে সে। দেখেও মনে হচ্ছে, এদের খাবার-দাবার শুধু সুস্বাদুই নয়, বেশ স্বাস্থ্যসম্মতও হবে-যদি তারা মুশকান জুবেরিকে সত্যি সত্যি অনুকরণ করে থাকে তো!

হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা, এখনও বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় হাতে আছে। গতকালের নামবিহীন খাবারের দোকানে নাস্তা করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া, দুটো রেস্টুরেন্ট থেকে যে ঘ্রাণ ভেসে আসছে সেটা তার ক্ষিদেটাকে চাগিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে প্রবোধ দিলো-নামে কী আসে যায়! রেস্টুরেন্ট দুটোর মালিক ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে নামদুটো নিয়েছে, এর সাথে আগের রেস্টুরেন্ট কিংবা তার মালেকিনের কোনো সম্পর্ক নেই। অগত্যা, অনেকটা হুট করেই সে ঢুকে পড়লো মুশকানের ভেতরে!

রেস্টুরেন্টের প্রায় সব সিটই দখল করে রেখেছে ভোজন রসিকেরা, তারপরও একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়লো সে। ওয়েটারকে দ্রুত অর্ডার দিলে নাস্তার জন্য-সজি, রুটি আর ডিম ভাজি, সেই সাথে এক কাপ চা।

রবীন্দ্রনাথের খাবারের মতো সুস্বাদু না-হলেও মুশকানের স্বাদ বেশ ভালো। তৃপ্তি নিয়েই খেলো নুরে ছফা। ঝটপট নাস্তা সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই একটা শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সে।

আতর আলী বাইক নিয়ে চলে এসেছে। বাইক থামিয়ে হাসিমুখে বললো ইনফর্মার, “নাস্তা করতে আইছিলেননি?”

সত্যিটা বলবে কিনা বুঝতে পারলো না ছফা, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আতর আবার বলে উঠলো।

“এগোর খাওন-দাওন কিন্তু মাশাল্লাহ। কিন্তু ভুলেও ইমামুদ্দির হোটেলে খায়েন না…হাতে এক্কেবারে লোটা ধরায়া দিবো।”

ইমামুদ্দির ব্যাপারে আতর আলীর কথাটা যে সত্যি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গত রাতে।

“দেখছেন, সকাল সকাল পীপড়ার মতো ভীড় লাইগ্যা গেছে, রাস্তার দু-পাশে রেস্টুরেন্ট দুটোর দিকে ইঙ্গিত করে বললো ইনফর্মার। “এইহানেই খাওন-দাওন কইরেন। আমি ফজলুরে

“এটা কবে কিনলে?” প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বাইকটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো ছফা।

“কিনছি তত তিন মাস হইলো। আমাগো টাউনের সেকান্দার মিয়ার আছিলো এইটা, ওর আবার ট্যাকার খুব দরকার পড়লো…আমারে কইলো, দোস্ত, কিছু টাকা দেও…হুন্ডাটা রাখো। আমি দেখলাম, এতো সস্তায় এই জিনিস আর পামু না, তাই কিইন্যা ফালাইলাম।” নিজে থেকেই বাইক কেনার গল্পটা বলে গেলো আতর।

ছফা চাচ্ছে না, এইসব বানোয়াট গল্পের পরিসর আরো বাড়ুক। “চলো, আমাদের কাজে নেমে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

দাঁত বের করে হেসে ফেললো ইনফর্মার। “উইঠ্য পড়েন, স্যার।” ছফা চুপচাপ উঠে বসলো আতরের বাইকের পেছনে।

ইনফর্মারের চোখেমুখে গর্বিত ভঙ্গি ফুটে উঠলো। এলাকার অনেকেই দেখবে, ঢাকা থেকে আসা মহাক্ষমতাধর পুলিশ অফিসার তার বাইকের পেছনে বসেছে।

সুন্দরপুরের মহাসড়ক দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতরের বাইকটা চলে এলো রহমান মিয়ার টঙ দোকানের সামনে।

“অনেকদিন বাদে আইলেন…আছেন কিমুন?” তাকে দেখে গদগদ হয়ে বললো দোকানি।

“আছি ভালোই। আপনি কেমন আছেন?” ছফা বাইক থেকে নেমে জানতে চাইলো।

দাঁত বের করে চওড়া একটা হাসি দিলো রহমান। “আছি আর কি…গরীব মানুষ।”

আতরের চোখমুখ বিরক্তিতে সামান্য কুঁচকে গেলো। টঙের সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো ছফা।

“তা, এতোদিন পর আইলেন যে, কিছু হইছেনি আবার?”

“দুই কাপ চা বানাও, মিয়া, বাইকটা স্ট্যান্ডের উপর রাখতে রাখতে বললো আতর। তার চোখেমুখে বিরক্তি। “খালি বেশি কথা কও।”

রহমান আর কিছু না বলে চা বানাতে মনোযোগি হলো। “আপনার ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?” জানতে চাইলো ছফা।

রহমান মিয়া মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আর ব্যবসা! ঐ হুটেল বন্ধ হওনের পর আমার ব্যবসা উঠছে চাঙ্গে।” রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করলো। “এহন তো এইদিকে কেউ খাইতে আহে না, যারা আহে তারা সব পণ্ডিত, খালি বই পড়ে।”

আতর আলী ছফার পাশে এসে বসলো। “বেটির হোটেলটারে তো দুই চক্ষেও দেখবার পারতা না, ওইটা যখন বন্ধ হয়া গেলো ঈদের মতো খুশি হইছিলা, এহন আবার এই গীত গাইতাছছা ক্যান, মিয়া।”

বিরক্ত হয়ে তাকালো রহমান। “আমি খুশি হইছি তুমারে কে কইলো? খালি আজাইরা কথা!”

ইনফর্মার দাঁত বের করে হাসলো।

“আপনি নতুন রেস্টুরেন্ট দুটোর পাশে টঙটা সরিয়ে নিলেই পারেন, বললো ছফা। “ওখানে তো ভালো কাস্টমার পাবেন।”

রহমান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আতর আলী কথা কেড়ে নিলো। “আপনে ওরে যতো বোকা ভাবেন ওয় আসলে অতো বোকা না, স্যার। ইচ্ছা কইরা এইহানে পইড়া আছে। এতো সহজে ওইখানে যাইবো না।”

রহমান মিয়া ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো আতরের দিকে।

অবাক হলো ছফা। “কেন?”

“এইহানে থাকলে তো বইসা বইসা কামাইতে পারে, বুঝলেন না?”

“কি কও এইসব?” প্রতিবাদ করে উঠলো দোকানি।

বিজ্ঞের মতো হাসি দিলো ইনফর্মার। “মনে করো আমি কুনো খবর রাখি না,” তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে ছফার কাছে বয়ান করলো সে, “হিটলুর লগে হের হট টেরাম, বুঝলেন? হেয় ওরে কইছে, খিচ মাইরা যেইহানে আছো সেইহানে পইড়া থাকো, রহমান। শহর থিকা লোকজন বেটির হোটেলের খুঁজ করলে তুমি আমার নতুন হোটেলটার কথা কইবা। ফজলুরটা নকল…আমারটা আসল।”

“সব মিছা কথা!” প্রতিবাদ করে উঠলো টঙ দোকানি। “এইসব কথা ক্যাঠায় কইছে তুমারে?”

“আরে, আমি সব খবরই রাখি। তুমি হিটলুর কাছ থিকা কমিশন পাও।”

বিস্মিত রহমান মাথা দোলালো। ছফার দিকে ফিরে তাকালো সমর্থন পাবার আশায়, “ছার, বিশ্বাস করেন মিছা কথা–”

হাত তুলে থামিয়ে দিলো নুরে ছফা। আতর আলীর দিকে তাকালো সে, “এসব বাদ দাও তো।” তারপর আবার দোকানির দিকে ফিরলো, “এক প্যাকেট বেনসন দিন।”

রহমান মিয়া ঝটপট সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো চা বানাতে। কমিশনের আলাপ থেকে মুক্ত হতে চাইছে যেনো।

একটা সিগারেট ঠোঁটে নিতেই আতর আলী নিজের পকেট থেকে লাইটার বের করে বাড়িয়ে দিলো। মুচকি হেসে সিগারেটটা ধরালো ছফা।

রহমান মিয়া গুঁড়ের চা বানিয়ে দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলে নিজের কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিতে শুরু করলো ছফা। আতরের দিকে আড়চোখে তাকালো একবার। জোরে জোরে চুমুক দিয়ে চা-টা দ্রুত শেষ করে উঠে দাঁড়ালো ইনফর্মার।

“স্যার, আমি তাইলে যাই,” ছফার উদ্দেশ্যে বললো। “আমার একটা কাম আছে টাউনে।”

“আচ্ছা। পরে দেখা হবে।”

পকেট থেকে টাকা বের করে রহমান মিয়াকে দিয়েই চুপচাপ বাইকটা স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো আতর।

“এখনকার এমপি মানুষ হিসেবে কেমন?” ইনফর্মার চলে যাবার পর রহমান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলো ছফা।

“মানুষ ভালাই, তয় বয়স অনেক কম,” জানালো দোকানি। “আসাদুল্লাহ যহন বাঁইচ্যা আছিলো তহন হে সুবিধা করবার পারে নাই। মামলা-মুমলা দিয়া বহুত পেরেসানে রাখছিলো…তহন হে ঢাকায় থাকতো। ফেরাউনটা মরনের পর গেরামে ঢুকছে, তারপর কেমনে কেমনে এমপিও হইয়াও গেলো। সবই কপাল।”

“তারা দু-জন কি একই পার্টি করতো না?” সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইলো ছফা।

“হ, একই পার্টি করতো কিন্তু বনিবনা আছিলো না। আসাদুল্লাহ এন্টি পাটির লুকজনরে যিমুন পেরেসানিতে রাখতো, নিজের পাটির অনেরেও দৌড়ের উপর রাখছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “শুনলাম মাস্টারের সাথে নাকি নতুন এমপির খুব খাতির?”

“হ। জোনায়েদভাই তো মাস্টরের কাছে ছুটকালে পড়ছে…খুবই মাইন্যগণ্য করে তারে।”

“মাস্টারের এখন কী অবস্থা?”

“সুন্দরপুর তো এহন মাস্টরই চালায়,” হেসে বললো রহমান। “পুলিশ-ডিচি-এচপি-টিনও, সব হের পকেটে থাহে। আমাগো নয়া এমপিও হের কথায় উঠে আর বহে।”

ছফী বুঝতে পারলো আবারো ক্ষমতাধর একজনকে মোকাবেলা করতে হবে তাকে। তবে এদের চেয়েও প্রবল ক্ষমতাধর মানুষ আছে তার মাথার উপরে। বাধাবিপত্তি যতোই আসুক না কেন, সব কিছু সামলাবে ঐ লোক। যদিও স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কিছু সুবিধা থাকে। অনেক সময় তাদেরকে ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে ওঠে না। তাই ছফাকে এবারও সতর্ক থাকতে হবে।

“তয় মাস্টর মাটির মানুষ, হে আগের মতোই আছে,” বললো। দোকানি। “চাইলে, সুন্দরপুরে যা খুশি করবার পারে কিন্তু স্কুল আর লাইবেরি লইয়াই পইড়া থাহে সারা দিন, কারো আগে পিছে কুনোকালেই হে ছিলো না, এহনও নাই।”

কথাটা মেনে নিতে কষ্টই হলো ছফার। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার আগে এই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে কথা বলেছে। তার ধারনা, এখনও এই লোকটার সাথে মহিলার কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে-তবে সেটা

তিনি করেন খুবই সঙ্গোপনে। ভদ্রলোক নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট থাকেন।

“মাস্টরের স্কুল খালি আমাগো গেরামেই না, বাইশ গেরামের মইদ্যে সেরা।”

রহমান মিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো ছফা।

“বাপ-মায়েরা পোলাপান নিয়া আইস্যা পড়ে মাস্টরের কাছে। ছার, আমার পোলাটারে মানুষ কইর‍্যা দেন…ওরে আপনের কাছেই দিয়া গেলাম।” দোকানি এমনভাবে কথাটা বললো যেনো ঘটনাগুলো তার চোখের সামনেই ঘটে। “স্কুলের আবার হুস্টেলও আছে। এত্ত বড় জমিদার বাড়ি…জায়গার অভাব আছেনি?”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলে ছফার মুখে। “স্কুল দিতে না দিতেই এতো সুনাম!”

“স্কুল নতুন হইবার পারে, মাস্টর তো নতুন মানুষ না। হেরে চেনে না এমুন মানুষ আছে এই এলাকায়? পোলাপানগো হে গানও শিখায়, ছবি আঁকায়…কত্তো কী যে করায়। ঢাকা-কলিকাতা থেইক্যাও মাস্টর নিয়া আসছে। এলাহি কাজ-কারবার।”

নুরে ছফা উঠে দাঁড়ালো। “আসলেই বিরাট কাজকারবার।”

ছফার কথাটার সুর বুঝতে পারলো রহমান। এই লোক যে মাস্টারকে খুব একটা পছন্দ করে না, সেটাও তার অজানা নয়।

“কতো হয়েছে আমার?” চওড়া হাসি দিলো দোকানি। “আতর তো বিল দিয়া দিছে।”

“ওহ্।” ছফা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টঙ দোকান থেকে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে।

রহমান ঘাড় উঁচু করে সেদিকে চেয়ে রইলো। রাস্তা পার হয়ে নতুন স্কুলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নুরে ছফা।

“মাস্টারের কথা শুনলে তো মুখ কালা হয়া যায়,” বিড় বিড় করে বললো দোকানি। “আবার দেহি হের কাছেই যায়!”

২০. অনেক কিছু বদলে গেছে

অধ্যায় ২০

প্রায় তিন বছর পর এলেও পথটি তার ঠিকই মনে আছে। যদিও অনেক কিছু বদলে গেছে এই সময়ে।

রবীন্দ্রনাথের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথটি চলে গেছিলো জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়ির দিকে, সেটা এখন পাশাপাশি দুটো রিক্সা যেতে পারে এমন প্রশস্ত পিচঢালা পথ। খুব বেশি হলে এক বছরের পুরনো হবে রাস্তাটি। পথের দু-ধারে কিছু দিন আগে লাগানো হয়েছে গাছের চারা, সেগুলো ছোটোছোটো গোলাকার বাশের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত।

নুরে ছফা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে গেলো সেই পথ দিয়ে। পথের দু পাশের বিস্তীর্ণ ফসলিজমি আগের মতোই রয়েছে। মহাসড়ক থেকে সবুজ ফসলি জমির বুক চিড়ে চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। মাথার উপরে দগদগে সূর্য। চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি চারপাশে। তার নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেলো। প্রতিটি গ্রামই প্রায় একই রকম লাগে তার কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির কাছে চলে এলে দেখতে পেলো, সদর দরজাটা আর আগের মতো নেই, বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটিও বেশ বদলে গেছে। দেখেই বোঝা যায়, নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এক সময়কার জমিদার বাড়ির মূল ফটকটি এখন শক্ত মজবুত লোহার গ্রিলের বিশাল দরজায় বদলে গেছে। সেই দরজার উপরে অর্ধ-বৃত্তাকারের খিলান সদৃশ একটি সাইনবোর্ড : সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়।

ভুরু কপালে উঠে গেলো নুরে ছফার। এমন রবীন্দ্রপ্রীতির গূঢ় রহস্য কি বুঝে উঠতে বেগ পেলো না। মুশকান জুবেরির ভুত মাস্টারের ঘাড়েও চড়ে বসেছে! নাকি মুশকান জুবেরির ইচ্ছে বাস্তবায়ন করেছেন রমাকান্ত মাস্টার? প্রশ্নটা ছফার মনে উদয় না হয়ে পারলো না।

স্কুলগেটটা আগলে রেখে যে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে সে যেমন বলশালি তেমনি কঠিন। চোখেমুখে সেই কাঠিন্য ধরে রেখে যেনো জানান দিচ্ছে, এখান দিয়ে অযাচিত কেউ ঢোকার কথা স্বপ্নেও যেনো না ভাবে।

ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। “গেট খোলো,” হুকুমের স্বরে বললো সে।

মনে হলো দারোয়ান এমন হুকুম শুনতে অভ্যস্ত নয়। চোখদুটো গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আপনে কে…কী জন্যে আসছেন?” বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।

“আমি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে এসেছি।”

দারোয়ান সন্দেহের দৃষ্টিতে ছফাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। “আইডিকার্ড আছে?”

কথাটা শুনে খুব অবাক হলো, তারপরও পকেট থেকে পরিচয়পত্রটা বের করে দেখালো লোকটাকে। সম্ভবত দারোয়ান এর আগে কোনো পুলিশের পরিচয়পত্র দেখেনি। ছফার আইডিটা হাতে নিয়েও সন্দেহ দূর হলো না তার।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো দারোয়ান। “এই কার্ডটা যে নকল না সেইটা কেমনে বুঝুম?”

ভুরু কপালে উঠে গেলো ছফার। গ্রামের স্কুলের দারোয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। ঢাকা শহরের শিক্ষিত আর কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনও কখনও তার কার্ড দেখে এই প্রশ্ন করেনি। বলতে গেলে, পুরো কর্মজীবনে এই কার্ডটা হাতেগোনা মাত্র কয়েকবারই দেখিয়েছে। আর যাদেরকে দেখিয়েছে তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছে।

“তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছো?” দাঁতে দাঁত পিষে বললো সে।

আইডিকার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে দারোয়ান বললো, “আপনের কার্ড দেইখ্যা আমি কিছুই বুঝতে পারতাছি না, ভাই। এইটা নকলও হইতে পারে।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ছফা। লোকটা যে তাকে ভাই বলে সম্বোধন করছে সেটাও খেয়াল করেছে। তার মানে, সত্যি সত্যি সে বিশ্বাস করছে না ছফা পুলিশের লোক। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে বললো, “এটা তো স্কুল, নাকি?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান। “হ। এখন বলেন, আপনে এইখানে কার কাছে আসছেন?”

“মাস্টারসাহেবের কাছে এসেছি…উনি আছেন না স্কুলে?”

“উনি ভিতরে আছেন…অফিসে, দারোয়ান লোকটা বললো।

“তাহলে উনার কাছে খবর পাঠাও,” আদেশের সুরে বললো সে। “বলো, ঢাকা থেকে নুরে ছফা আসছে।”

“নুরে সাফা?” দারোয়ান তার নামটা ধরতে পারলো না।

মাথা দোলালো নামের মালিক। এটা তার জন্য মোটামুটি নিয়মিত একটি ব্যাপার। প্রথমবার খুব কম মানুষজনই তার নামটা ঠিকমতো ধরতে পারে। “সাফা না, ছফা…ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান, তারপরই গেটের ভেতরে ঢুকে কাউকে ডাকলো সে। ছফা দেখতে পেলো বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক দৌড়ে চলে এলো গেটের কাছে।

“মাস্টরসারে গিয়া বলো, ঢাকা থিইক্যা নুরে ছফা নামের এক পুলিশ আইছে…স্যারের লগে দেখা করতে চায়।”

দারোয়ানের কথা শুনেই ছেলেটা আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। “ক-দিন ধরে এখানে কাজ করো?” জানতে চাইলো ছফা।

“এই স্কুলের শুরু থেইক্যাই আমি আছি,” গর্বিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো দারোয়ান। “দেড় বছর তো অইবোই।”

“এর আগে কোথায় চাকরি করতে?”

“এইটাই আমার পথম চাকরি।”

“তাই নাকি? তোমার ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ অভিজ্ঞ এই কাজে।”

দারোয়ান কিছু বললো না।

গ্রিলের গেটটা দিয়ে ভেতরে তাকালো ছফা। জমিদার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটি বেশ বদলে গেছে। মাঝখানে যে ফোয়ারাটা ছিলো সেটা আর নেই। সবুজ ঘাসের জায়গাটি এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। জমিদার বাড়ির সেই পুরনো ভবনটিও নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে একতলার একটি টিনশেড ভবন।

ছফার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগে এক রাতে কিভাবে সে দেয়াল টপকে এখানে ঢুকেছিলো, ফোয়ারাটার কাছে এসে ঘাপটি মেরে ছিলো কিছুক্ষণ। রোমাঞ্চকর একটি অভিযান ছিলো সেটা। গল্প করার মতোই ঘটনা। কতোটাই না ভড়কে গেছিলো ভবনের পেছনে, জোড়পুকুরের পাশে মাটি চাপা দেবার দৃশ্যটা দেখে। তারপর মুশকান জুবেরির সেই চাহনি, দ্রুত ঝোঁপের আড়াল থেকে পালিয়ে…

“আসেন।”

দারোয়ানের কথায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলো সে।

“স্যার আপনেরে ভিতরে যাইতে বলছেন।”

ছফা মুচকি হাসি দিয়ে গেটের ভেতরে পা রাখলো। সেই বিশ-বাইশ। বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে, সম্ভবত তার পুলিশ পরিচয়ের কারণে।

“তুমি উনারে স্যারের কাছে নিয়া যাও, শ্যামল,” ছেলেটাকে বললো দারোয়ান।

তিন বছর পর নুরে ছফা মেইন গেটটা পেরিয়ে এক সময়কার জমিদার বাড়ির ভেতরে পা রাখলো আবার।

.

অধ্যায় ২১

ছোট্ট এই জীবনে অনেক চুরি করেছে বল্টু। শুরুটা হয়েছিলো মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখা টাকা-পয়সা সরানো থেকে। তার মা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো রান্না করার সময় আঁচল থেকে চুপিসারে টাকা সরাচ্ছে সে। কী নিখুঁতই ছিলো তার হাত! সেই প্রথম থেকেই।

একটু বড় হবার পর বুঝেছিলো, ঘরের টাকা চুরি করার মধ্যে বীরত্ব যেমন নেই, তেমনি লাভজনকও না। অর্থনীতির জটিল সমীকরণে না গিয়েই সে বুঝে গিয়েছিলো, ঘরের বাইরে নজর দিতে হবে। সেই থেকে চুরি করার বিদ্যেটা ভালোমতোই কাজে লাগাতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের পকেট কেটে বিখ্যাত হারুকাটা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে। পাশে ছাতা রেখে চায়ের দোকানে বসে এক মুরুব্বি চা খাচ্ছিলো, বল্ট সেই ছাতাটা সবার অলক্ষ্যে মেরে দেয়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হারুকাটা পকেটমার তাকে ধরে ফেলে হাতেনাতে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো সে। ওটাই ছিলো তার প্রথম ‘কট খাওয়া’র কেস। কিন্তু হারু যখন বললো, “গাধার বাচ্চা, বুইড়ার পকেটে কয়েক শ’ ট্যাকা থাকতে বালের এই বিটিশ আমলের ছাত্তিটা মারলি ক্যান?” তখনই সে বুঝে গেছিলো, যোগ্য ওস্তাদের খপ্পরেই পড়েছে।

এরপর থেকে হারু তার ওস্তাদ বনে যায়। কিভাবে পকেট কাটতে হয়, তালা খোলা যায়, কিভাবে বুঝবে কার পকেটে টাকা আছে আর কার পকেটে আছে বিড়ি-গুলের মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস-সবই শিখিয়ে দিয়েছিলো। বিনিময়ে প্রথম দু-বছর তাকে হারুর চ্যালা হয়ে কাজ করতে হয়। ইনকামের প্রায় বেশির ভাগই নিয়ে নিতো হারুকাটা। ততোদিনে তার বাবা আরেক মহিলাকে বিয়ে করে ফেলেছে, আর তাকে ফেলে চলে গেছে জন্মদাত্রি মা। কার সাথে কোথায় যে গেছে সেটা আজো জানতে পারেনি বল্টু। এরপর থেকে তার আশ্রয় জোটে হারুকাটার ঘরে। ভোরে উঠেই তাকে চলে যেতে হতো বাসস্টেশনে, ‘ইনকাম করার পরই কেবল নাস্তা জুটতো কপালে। ওস্তাদ হিসেবে এমনই কঠিন ছিলো হারু।

সারাটা দিন টই টই করে ঘুরে বেড়িয়ে পকেট মারতো, চুরি করতো। তবে আলতু ফালতু জিনিস চুরি করলে হারুকাটার লোহার মতো শক্তহাতের থাপ্পড় জুটতো দুই গালে। সেই থাপ্পড়ের ভয়ে চুরিবিদ্যেটা আরো শাণিত করে নেয় সে। বড় বড় দান মারতে শুরু করে কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হতো না। দিনকে দিন হারু তার শশাষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।

অনেক রাত শুয়ে শুয়ে বল্টু ভেবেছে, হারুর কাছে তার যে ঋণ সেটা শোধ হয়ে গেছে অনেক আগেই-এখন তাকে মুক্তি পেতে হবে। তার ছোট্ট মাথা থেকে অবশ্য কোনো উপায় বের হতো না। এক পর্যায়ে সে ধরেই নিয়েছিলো, হারুকাটার সাথেই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবনটা।

সেটা অবশ্য হয়নি। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই মুক্তি পেয়ে যায় সে। পাশের এক টাউনে পকেট মারতে গিয়েছিলো তার ওস্তাদ, বড় দান মারতে বেছে নিয়েছিলো বিয়ে বাড়ির মতো একটি অনুষ্ঠান। কপাল খারাপ ছিলো, ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে। মারমুখি জনতার গণপিটুনি আর সহ্য করতে পারেনি, ভবের লীলা সাঙ্গ করে হারুকাটা চলে যায় পরপাড়ে।

ওস্তাদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর একটু মন খারাপ করেছিলো বল্টু। ইশ, ওস্তাদ যদি তার মতো গণপিটুনি খাওয়ার সময় পায়খানা করে দিতো। সেই পায়খানা হাতে নিয়ে লোকজনকে দেখিয়ে বলতো : আর মাইরেন না…দেহেন, হাইগ্যা দিসি!-তাহলে তার মতোই বেঁচে থাকতো এখন। বল্টু এই পদ্ধতি খাঁটিয়ে বেশ কবার বেঁচে গেছে। লোকজন জ্যান্ত মানুষকে মারতে ভয় পায় না, কিন্তু মানুষের গু নিজের হাতে-পায়ে-শরীরে লাগাতে ভয় করে! শেষ অস্ত্র হিসেবে এটা খুবই কার্যকরী। কাঁদো কাঁদো হয়ে মানুষের মায়া-মমতা আদায় করার যে পুরনো টেকনিক তার ওস্তাদ তাকে শিখিয়েছে সেটা এখন আর কাজে লাগে না। মানুষ বড়ই পাষান হয়ে গেছে!

বল্টুর হাতে অনেক সময় আছে। মাস্টার এখন আছেন স্কুলে, তার আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। সেজন্যে তাড়াহুড়ো করার কোনো মানেই হয় না।

মাস্টারের ভিটের কাছে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা দেখে নিলো আরেক বার। রমাকান্ত মাস্টার থাকেন এমন এক ভিটায়, যার চারপাশে খুব কম বাড়িঘরই আছে। ভিটার চারদিকে ক্ষেতিজমি, সেইসব জমিতে কিছু কামলা আগাছা সাফ করতে ব্যস্ত। মাস্টারের ভিটা থেকেও তাদের অবস্থান বেশ দূরে। তার চেয়েও বড় কথা, সবাই মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আজাইরা আর অকর্মা মানুষ নয় যে, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে। সেদিকে নজর রাখবে।

বল্টু আস্তে করে উঁচু ভিটাতে উঠে গেলো সবার অগোচরে। পুরো বাড়িটা যেনো শশ্মানের মতোই খাঁ-খাঁ করছে। চারদিকে গাছগাছালি থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। আমগাছের মুকুল থেকে গন্ধ ভেসে আসছে।

মাস্টারের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে আরেকবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো। এরকম সতর্কতা তাকে শিখিয়েছে হারুকাটা ওস্তাদই-ভুলেও ধরে নেয়া যাবে না, আশেপাশে কেউ নেই।

বল্টুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এখন যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা পানির মতোই সহজ। এখানে ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একটা মাঝারি আকারের চায়নিজ তালা মারা আছে মাস্টারের ঘরের দরজায়। ওটা খোলার জন্য তেমন কিছুই করতে হবে না। তার কাছে একটা মাস্টার-কি আছে, সেটা দিয়ে সুন্দরপুরের অর্ধেক তালা খোলা যাবে!

মানুষের বোকামির কথা ভেবে হাসি পায় বল্টুর। তালা কেনার সময়ই তারা সবচেয়ে বেশি কিপ্টেমি করে। লাখ টাকার জিনিস পাহারা দিতে কিনা পঞ্চাশ টাকা দামের তালা কেনে!

পকেট থেকে মাস্টার কি-টা বের করে তালাটা খুলে ফেললো সে। ঘরটাতে বেশি কিছু নেই। তবে মানুষ কোথায় কী রাখতে পারে সেই ট্রেনিংও দিয়েছে তার ওস্তাদ।

ঘরে কাপড়-চোপড় রাখার একটা আলনা, পুরনো দিনের নক্সাওয়ালা পালং, বই, নানান রকম ফাইলভর্তি একটি আলমিরা আর পড়ার টেবিল চেয়ার। বল্টু প্রথমে টেবিলের ছোট্ট ড্রয়ারটার দিকেই হাত বাড়ালো। এটারও লক রয়েছে, সেই লক খুলতেও বেগ পেতে হলো না।

ড্রয়ারের ভেতরে কিছু চিঠিপত্র আর একটা মোবাইলফোন আছে চাজারসহ।

বল্টুর চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। চিঠিগুলোসহ ফোনটা নিয়ে নিলো সে। চাজারটা নেবার দরকার না থাকলেও বাকি জিনিসের সাথে ওটা পকেটে ভরে নিলো। সস্তা চায়নিজ ফোনের চার্জার, কিন্তু বিশ টাকা হলেও চোরাই মার্কেটে বিক্রি করা যাবে। তার কাজ শেষে হয়ে গেলেও স্বভাবগত কারণেই ঘরের আশেপাশে নজর বুলালো আরেকবার। মাস্টার এখন বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনা করেন, বিরাট বড় একটা স্কুল আর লাইব্রেরি চালান, প্রচুর টাকা খরচ করতে হয় তাকে। নিশ্চয় ঘরে কিছু না কিছু থাকবে।

পরক্ষণেই আতর আলীর সাবধান বাণীটা তার মগজে উচ্চারিত হলো : কোনো কিছু যদি সরাইছোস তো তুই শ্যাষ! এক্কেবারে কব্জি থেইক্যা হাত কাইট্যা ফালামু!

সঙ্গে সঙ্গে চার্জারটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো বল্টু। আতর আলী তার ওস্তাদ না হতে পারে, কিন্তু এই লোককে জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। থানার সাথে তার সেইরকম খাতির। তাকে বিগড়ানো ঠিক হবে না।

এই প্রথম বল্টু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় খালি হাতেই বের হয়ে এলো কোনো বাড়ি থেকে! তবে বের হবার সময় দরজার তালাটা আর লাগালো না। আবারও তাকে আসতে হবে-একটু পরই। কী দরকার লক করে রাখার।

.

অধ্যায় ২২

এটা যে ঘটবে, রমাকান্তকামার জানতেন। গতকাল লোকটাকে দেখার পরই বুঝতে পেরেছিলেন, তার কাছে এসে আবারো সেই একই কথা জানতে চাইবে। তিন বছর আগে যখন অলোকনাথের নাতবৌ জমিদার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, তার সপ্তাহখানেক পরই এই লোক দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দরপুরে এসেছিলো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। লোকটার সন্দেহগ্রস্ত মানসিকতা পছন্দ করেন না তিনি। জগতের সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখাটা এক ধরণের বাতিক। এটাকে তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া অভিশাপ বলেও মনে করেন।

দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আবারো সেই একই প্রশ্ন করবে এই লোক-আপনাকে কেন ট্রাস্টি করে দিয়ে গেলো মুশকান জুবেরি? সে এখন কোথায়? তার সাথে আপনার কি যোগাযোগ আছে?

রমাকান্তকামার জানেন, তার দিক থেকে জবাবটা আগের মতোই হবে-এটা আপনি ঐ ভদ্রমহিলাকেই জিজ্ঞেস করলে ভালো হয়। তার খবর আমি রাখি না।

ভদ্রমহিলা?!

ঐদিন ছফা নামের লোকটা যেনো ক্ষেপে গেছিলো কথাটা শুনে। আপনি তাকে ভদ্রমহিলা মনে করেন? বলেছিলো সে, মাথা দোলাতে দোলাতে। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনি। শুধু বলেছিলো, তার নাকি কোনো ধারনাই নেই ঐ মহিলা কী করে।

“এসব জেনে আমি কী করবো?” রমাকান্তকামার সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিলেন। “উনার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো লেনদেন নেই।”

ডিবি অফিসার মুচকি হেসেছিলো কথাটা শুনে। “কিছুই নেই, তারপরও আপনাকেই ট্রাস্টি করে এতো বড় সম্পত্তি দিয়ে গেলো?”

রমাকান্তকামার বিরক্ত হয়েছিলেন কথাটা শুনে। “আমাকে উনি একরত্তি সম্পত্তিও দিয়ে যাননি। আপনি ভুলে গেছেন, উনি একটি ট্রাস্টে দান করে গেছেন সবকিছু।”

“আর সেটার ট্রাস্টি করে গেছেন আপনাকে!”

লোকটার চোখেমুখে সন্দেহ উপচে পড়ছিলো। যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি, তবে সেটা প্রকাশ করেননি, বরং যুক্তি দিয়ে কথা বলেছিলেন। “ঐ ভদ্রমহিলা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।”

কথাটা শুনে ছফার ভুরু কপালে উঠে গেছিলো। “বাধ্য হয়েছেন?!”

“হুম। সম্পত্তিটা যার নামে, সেই রাশেদ জুবেরি এটা চেয়েছিলেন, একটু থেমে আবার বলেছিলেন, “আর মহিলা সেটাই করেছেন।”

“তাহলে এতো দিন পরে কেন? পালিয়ে যাবার ঠিক আগেই?”

“সেটা ঐ মহিলাই ভালো জানেন,” বলেছিলেন রমাকান্তকামার। “ধরে নিলাম উনি আসলেই একজন অপরাধী…তাতে কী? সম্পত্তিটা তো উনার ছিলো না।”

ডিবি অফিসার এ কথার কোনো জবাব দেয়নি।

“উনার অপরাধ প্রমাণিত হয়ে থাকলেও সম্পত্তিগুলো দান করার অধিকার উনি রাখতেন…যদি না আদালত এ ব্যাপারে কোনো বাধা দিতো।”

তার এমন কথায় মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিলো লোকটার ঠোঁটে। “আইন-কানুন সম্পর্কে তো দেখি ভালো ধারণাই রাখেন।”

টিটকারিটা গায়ে না মেখে তিনি বলেছিলেন, “তা রাখি না। তবে জগতের সকল আইন-কানুন তৈরি হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান থেকে, সেটা নিশ্চয় আমার আছে।”

এ কথা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চলে গেছিলো ডিবি অফিসার। সেই যে গেলো আর আসেনি। বিগত তিন বছরে তার টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তবে লোকটার ছায়া ঠিকই মাস্টারকে অনুসরণ করে গেছে পরবর্তী কয়েকটি মাস।

এই সুন্দরপুরের সবাই তাকে পুলিশের ইনফর্মার হিসেবেই চেনে। চুরি থেকে শুরু করে মাদক বিক্রি, হেন কাজ নেই সে করে না। মাস্টার লক্ষ্য করেছেন, লোকটা কেমন ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। তাকে। তিনি যেখানেই যেতেন, পিছু নিতো আতর।

একদিন পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, ঢাকা থেকে জরুরী একটা চিঠি এসেছিলো তার। ডাক হরকরা সুবিদ মিয়া তাকে দেখে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাইয়ে চিঠিটা দিয়ে দেয়। সেই চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিশাল বড় এক বটবৃক্ষের নিচে একটু জিরিয়ে নেন তিনি। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে চিঠিটা পড়তে গিয়ে টের পান দূর থেকে আতর আলী উৎসুক চোখে তাকে দেখছে। তিনি চিঠিটা পড়ার পর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেন পাশে, তারপর উঠে রওনা দেন বাড়ির দিকে। কিছুটা পথ যাবার পর একটা পুরনো শিব মন্দিরের ধ্বংস্তূপের কাছে এসে পেছনে ফিরে দেখেন আতর সেই চিঠির টুকরোগুলো কুড়াতে ব্যস্ত। এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিলো তার ভেতর থেকে।

এখনও সেই একই দীর্ঘশ্বাস আর ভাবনা তাকে পেয়ে বসলো।

“আদাব, মাস্টারসাহেব।”

রমাকান্তকামারের ভাবনায় ছেদ পড়লো, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ডিবি অফিসার নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি তো দেখি বিশাল কাজ করে ফেলেছেন, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো সে।

চোখেমুখে নির্বিকার ভঙ্গি মাস্টারের। “বসুন,” তার ডেস্কের সামনের চেয়ারগুলোর একটা দেখিয়ে বললেন।

মাস্টারের এই অফিস ঘরটি এককালে জমিদার বাড়ির মূল ভবনের পাশে যে লাগোয়া দোতলাটি ছিলো সেটার নিচতলায় অবস্থিত। ভেতরে এবং বাইরে, পুরোপুরি নতুন করে সাজানো হলেও মূল স্থাপনাটি একই আছে।

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ছফা। “কেমন আছেন?”

“ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলেন রমাকান্তকামার।

“স্কুলটার খুব নামডাক হয়ে গেছে। এতো অল্প সময়ে দারুণ কাজ করেছেন মনে হচ্ছে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন মাস্টার। এসব আলগা কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই। আসল কথার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

“এখানকার নিরাপত্তা দেখি সেই রকম!” কথাটা প্রশংসার মতো শোনালো না অবশ্য। “আমি তো খুবই অবাক হয়েছি। ঢাকার স্কুলেও এরকম নিরাপত্তা দেখিনি। ভালো, খুব ভালো।”

“এটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। এখানে। ছাত্র-ছাত্রিদের দুটো ডরমিটরি আছে। এর সাথে অন্য স্কুলের তুলনা করলে ভুল করবেন।”

ভুরু কপালে তুলে বললো ছফা, “তা অবশ্য ঠিক।”

“এখন বলুন, আমার কাছে আবার কীজন্যে এসেছেন।”

মাস্টারের কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতাবিবর্জিত সুরটা ধরতে বেগ পেলো না। “আপনার কি তাড়া আছে?”

“হুম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”

“আচ্ছা, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো ছফা। “ঐ মহিলা…মুশকান জুবেরি কি আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলো এরপর?”

আস্তে করে গভীরভাবে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “না।”

“এ কয় বছরে একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?”

এবার শুধু মাথা দুলিয়ে জবাব দিলেন মাস্টার।

“অন্য কারোর মাধ্যমেও না?” রমাকান্তকামারের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবার বললো, “এতো কিছু করলেন আর মহিলা একটা ধন্যবাদও দিলো না আপনাকে? অন্তত কাউকে দিয়ে তো এটুকু বলতেই পারতো, ‘মাস্টারসাহেব, আপনি দারুণ কাজ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ’?”

মাস্টার কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে একটু চমকে গেলেন কথাটা শুনে।

“রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো,” আফসোসের সুরে বললো নুরে ছফা। “তার সাধের রেস্টুরেন্টটা না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিকই টিকে আছে। লোকে আগেও বলতো রবীন্দ্রনাথে যাই, এখনও সেটাই বলে।”

“আপনি ধরেই নিয়েছেন এমন নামকরণের সাথে ঐ ভদ্রমহিলার সম্পর্ক আছে,” একটু রুষ্ট হয়ে বললেন রমাকান্তকামার।

মুচকি হাসলো ছফা। “ধরে নেবার কিছু নেই, যুক্তিবুদ্ধি সেটাই বলে।”

“আপনি সম্ভবত জানেন না, রবীন্দ্রনাথের ‘ন্দরপুরে আসার উপলক্ষ্যে এখানে একটি লাইব্রেরি উদ্বোধন করার কথা ছিলো। সেজন্যে অলোকনাথ বসুর পিতা ত্রিলোকনাথ চমৎকার একটি লাইব্রেরি করেছিলেন।”

নুরে ছফা ভুরু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাস্টারের দিকে।

“বটগাছের কাছে, এখন যেখানে পেট্রলপাম্পটা আছে…ওখানেই ছিলো পয়ষট্টি সাল পর্যন্ত। এর পর রায়টের সময় ওটা পুড়িয়ে দেয় দাঙ্গাবাজেরা।”

ছফাও জানে, সব যুগেই দাঙ্গাবাজ আর ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েছে গ্রন্থাগার। পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনার সাথে গ্রন্থাগারের বিরোধ সুপ্রাচীন।

“পরে আর ওটা মেরামত করার চেষ্টা করেনি জমিদার বাড়ির কেউই। অলোকনাথ বসু অবশ্য আমাকে বলেছিলেন লাইব্রেরিটা আবার নতুন করে করার কথা ভাবছেন তিনি। এরপর একাত্তর চলে এলো, জমিদারের বংশ শেষ!” দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন তিনি। “স্বাধীনের পর সরকার মহাসড়ক বানানোর জন্য জমিদারদের সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ অধিগ্রহণ করে…লাইব্রেরিটা যেখানে ছিলো, ওটার উপর দিয়েই চলে যায় নতুন সড়কটি।”

“তাই আপনি ঠিক করলেন আবার একটা লাইব্রেরি করা দরকার ওখানে?”

মাস্টার কিছুই বললেন না।

“বুঝলাম। কিন্তু এটা বুঝলাম না, মহিলার রেস্টুরেন্টের সাইনটা রেখে দিলেন কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। রেস্টুরেন্টটার সাইন যখন সরানো হচ্ছিলো তখন তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সেটা। ডান দিক থেকে সাইনটার একেকটি শব্দ খুলে ফেলা হচ্ছিলো। শেষে যখন ‘রবীন্দ্রনাথটা খুলতে যাবে তখন মাস্টারের মন সায় দিলো না। এ নামেই তো লাইব্রেরিটা হবে, তাহলে নামটা থেকে গেলে কী আর সমস্যা! লাইব্রেরি যদি আলোর আধার হয়ে থাকে, তাহলে আলোকিত রবীন্দ্রনাথ থাকতেই পারে! সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথ নামটা অপসারণ করতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না।

“শুনুন ছফাসাহেব,” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মাস্টার। “রবীন্দ্রনাথ শুধু একজনের পছন্দের মানুষ নন। তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, অনুসরণ করে এরকম মানুষ এই ভূ-ভারতে অনেক আছে। আমিও তাদের একজন। তাই বলে ভাববেন না, আমার ইচ্ছেয় নামটা দিয়েছি। সত্যিটা হলো, অলোকনাথ বসুর পিতা যে লাইব্রেরিটি দিয়েছিলেন, স্বয়ং কবিগুরুর যেটা উদ্বোধন করার কথা ছিলো, সেটার নাম ছিলো ‘শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণগ্রন্থাগার।’ এটা সুন্দরপুরের খুব কম মানুষই এখন জানে। বিস্মৃত ইতিহাস বলতে পারেন। আমি শুধু নতুন করে ওটা আবার দিয়েছি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি এবার আসতে পারেন।”

ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরটা ভরে উঠলো মাদকতাপূর্ণ একটি গন্ধে।

“রমাকান্ত মশাই…” সুললিত একটি কণ্ঠ বলে উঠতেই মাঝপথে থেমে গেলো।

পেছন ফিরে ছফা দেখতে পেলো এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তাতের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখেই মনে হলো পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হওয়া হাজারো তরুণীদের একজন।

মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হলো ছফার। মাস্টারের ঘরে অপরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে।

“আপনি মনে হচ্ছে ব্যস্ত, আমি তাহলে পরে আসি?”

“কোনো সমস্যা নেই, বলুন, কী বলতে এসেছিলেন,” বললেন রমাকান্তকামার।

ছফার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাস্টারের দিকে ফিরলো তরুণী। “বোশেখের অনুষ্ঠানে তানপুরাটার তার ছিঁড়ে গিয়েছিলো, ওটার তার কেনা লাগবে।”

“শ্যামলকে বলে দিচ্ছি, ও কিনে নিয়ে আসবে।”

“ঠিকাছে।” বলেই ছফার দিকে আবার আড়চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো মেয়েটি।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, মেয়েটাকে দেখে নুরে ছফার কেন জানি মুশকান জুবেরির কথাই মনে পড়ে গেলো! এটার কারণও সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারলো সে-তাদের দুজনের বাচনভঙ্গি আর সাজপোশাকের বেশ মিল আছে। মেয়েটা প্রমিত বাংলায় কথা বলে, মুশকান জুবেরিও এভাবে কথা বলতো। বলে। শুধরে দিলো নিজেকে। ঐ মহিলা তো আর লোকান্তরিত হয়ে যায়নি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও, আর শিকার করে যাচ্ছে।

“আমাদের গানের শিক্ষিকা।”

“ও,” আস্তে করে বললো ছফা। “আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে?”

রমাকান্তকামার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ছফার দিকে, তারপর আস্তে করে ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন।

কার্ডটা হাতে নিয়ে হতাশ হলো সে-ল্যান্ডফোনের নাম্বার। “এটা তো এখানকার অফিসের নাম্বার?”

“হুম।”

“আপনার নিজের কোনো ফোন নেই?”

“আপনি এই নাম্বারেই আমাকে পাবেন।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছফা। “ঠিক আছে, আমি তাহলে আসি।” দরজার দিকে যেতেই আবার ঘুরে দাঁড়ালো। “আপনার স্কুলটা কি ঘুরে দেখতে পারি? অনেক পুরনো স্মৃতি আছে এখানে, বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া, স্কুলটার অনেক প্রশংসা শুনে ফেলেছি, তাই একটু ঘুরে দেখার লোভটা সামলাতে পারছি না।”

স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন মাস্টার, “ঘুরে দেখতে পারেন, সমস্যা নেই।”

“ধন্যবাদ, আপনাকে।” কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। ডেস্কের বেলটা বাজাতেই কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলো মাঝবয়সী এক লোক।

“স্যার?”

“আলী, একটু আগে আমার ঘর থেকে যে লোকটা বের হয়ে গেলো তাকে একটু চোখে চোখে রেখো। সে কী করে না করে লক্ষ্য রাখতে হবে।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

আলী নামের লোকটা ঘর থেকে চলে গেলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। এরকম কাজ করার কোনো ইচ্ছে কিংবা রুচি নেই তার, কিন্তু এখন না করেও পারলেন না। নুরে ছফা নামের লোকটাকে তার সুবিধার বলে মনে হয়নি কখনও। তার চাইতেও বড় কথা, এর মতিগতি বুঝতে পারছেন না।

.

অধ্যায় ২৩

মাস্টার রমাকান্তকামারের অফিস থেকে বের হয়ে চারপাশে তাকালো নুরে ছফা। জমিদার বাড়িটা বেশ বদলে গেছে। এক সময় জমকালো পুরনো ভবনটি আর নেই। ওটা যে তিন বছর আগে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে সে-কথা তার চেয়ে ভালো কে জানে!

তবে বাড়িটার চৌহদ্দি আগের মতোই আছে, ভেতরে কিছু নতুন স্থাপনা তৈরি হওয়াতে প্রথম দেখায় মনে হয় অন্য কোনো জায়গা বুঝি। সামনের প্রাঙ্গনটা একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। ওটা এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। চত্বরটাতে সাদা রঙ দিয়ে দাগ টানা। ছাত্রছাত্রিরা এখানে জড়ো হয় ক্লাস শুরুর আগে। তারপর হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে-ছফারা যেটাকে বলতো পিটি ক্লাস।

আরামে দাঁড়াও…সোজা হও।

স্কুলের পিটি স্যারের পুরু গোঁফের মুখটার ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সাদা গেঞ্জি আর সাদা প্যান্ট পরা থাকতো, মাথায় থাকতো সানক্যাপ। একটা হুইসেল বাজিয়ে তাদেরকে অর্ডার দিতেন। খুবই জাঁদরেল ছিলেন, নানান ধরণের খেলাধূলায় উৎসাহ দিতেন। লোকটার ভুড়ি ছিলো বলে আড়ালে আবডালে তাকে তারা পেটালি’ বলেও ডাকতো।

প্রাঙ্গনের মাঝখানে ফ্ল্যাগপোলটা চোখে পড়লো এবার। সবই আছে, পতাকাটা নেই। ক্লাস শুরুর আগে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় ওটাতে ফ্ল্যাগ লাগানো হয় নিশ্চয়। এখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রিরা গেয়ে ওঠে : আমার সোনার বাংলা…আমি তোমায় ভালোবাসি।

ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। চত্বরটা ঘুরে দেখলো সে। সীমানা প্রাচীরটা আরো উঁচু করা হয়েছে, তার উপরে লাগানো হয়েছে তিন ফুটের মতো উঁচু লোহার নেট। সীমানা প্রাচীরের যেদিক দিয়ে ছফা এখানে অনুপ্রবেশ করেছিলো একরাতে, সেদিকে দিকে তাকালো। গাছটা এখনও অক্ষত আছে, তবে সেটার গোঁড়ার দিক থেকে কোমর সমান উচ্চতায় সাদা রঙ করা।

মাঝখানে যে ফোয়ারাটা এখন নেই সেটা ঢোকার সময়ই দেখেছিলো। এখন দেখতে পেলো, মেইন গেটের পাশে আগের দারোয়ানের যে ঝুপড়ি ঘরটা ছিলো সেটাও নেই। পুরো জায়গাটা যথেষ্ট পরিস্কার।

জমিদার বাড়ির দোতলা স্থাপনাটির জায়গায় এখন নতুন একটি একতলা ভবন গড়ে উঠেছে। টিনের চালার এই ভবনটি স্কুলের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভবনের অনেকগুলো দরজা-জানালা। সম্ভবত শিক্ষকেরাও এখানেই বসে।

ছফা এবার ভবনের পাশ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে পেছনের দিকে চলে গেলো। আগের রাস্তাটা আরো চওড়া করা হয়েছে। পুরনো ইটগুলোর বদলে বসানো হয়েছে নতুন ইট। ভবনের পেছনে যে বাগানটা ছিলো, যেখানে লুকিয়ে থাকার সময় ছ্যাঙ্গার কবলে পড়েছিলো ছফা সে-জায়গাটা আর নেই। ওখানে তিনদিক ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তিনটি ভবন। কেবল উত্তর দিকটা খোলা আছে। সেদিক দিয়ে সীমানা প্রাচীর ঘেষে চলে গেছে নতুন রাস্তাটি।

নবনির্মিত ভবনগুলোর দেয়াল ইটের তৈরি, ছাদগুলো টিনের। সারি সারি দরজা জানালা বলে দিচ্ছে এগুলোই স্কুলের ক্লাসরুম। দরজা বন্ধ থাকলেও কিছু খোলা জানালা দিয়ে সে দেখতে পেলো বেঞ্চগুলো।

রাস্তাটা ধরে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। ঠিক এভাবেই রাতের অন্ধকারে সে এগিয়ে গেছিলো রহস্যময়ী মুশকান জুবেরিকে অনুসরণ করে, তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্য ধোঁকা খেয়েছিলো দুটো দেয়ালের কারণে।

আশ্চর্য হয়ে ছফা দেখতে পেলো, দেয়াল দুটো এখনও আছে। এতে কিছুর পরিবর্তনের মধ্যে এরকম একটি দেয়াল কেন টিকিয়ে রাখা হলো সেটা বুঝতে পারলো না।

ঠিক তখনই শুনতে পেলো, দূর থেকে ভেসে আসছে একদল ছেলেমেয়ের সমবেত কণ্ঠের গান :

…আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি…
আহা হাহা হা

আরেকটু এগিয়ে গেলো সে। গানের আওয়াজ বেড়ে গেলো এবার।

কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি
আহ হাহা হা…

দেয়ালের প্রবেশ মুখ দিয়ে ঢুকে ছফা এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক এ জায়গাতেই, একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে সে দেখেছিলো মুশকান জুবেরিকে কিছু একটা মাটি চাপা দিতে। মহিলার সঙ্গে ছিলো গোরখোদক ফালু। তবে এখন আর কোনো ঝোঁপ নেই। জায়গাটা বেশ পরিস্কার। পুকুর পাড়ের চারপাশ ঘিরেই সবুজ ঘাসের চত্বর।

মুশকান জুবেরি যেখানে বস্তাবন্দী করে রেডওয়াইন মাটির নিচে পুঁতে ফেলছিলো, ঠিক সেখানেই একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে শতরঞ্জির উপরে। তাদের সামনে বেতের মোড়াতে বসে আছে ঐ তরুণী-মাস্টারের

অফিস রুমে একটু আগে যাকে দেখেছিলো।

কেয়া পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে
তালদীঘিতে ভাসিয়ে দেব চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে…

ছেলেমেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে কথা আর সুর ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখছে সেই তরুণী, কিন্তু মেয়েটা চকিতে ছফাকেও দেখে নিলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। একজন আগন্তুক যে দূর থেকে তাদেরকে দেখছে সেটা গান গাইতে থাকা বাচ্চাগুলো অবশ্য এখনও টের পায়নি।

“আমাদের গানের মাস্টার।”

ছফা চমকে তাকালো পেছনে, দেখতে পেলো বাদামি রঙের কুতা আর পায়জামা পরা মাঝবয়সী এক লোক নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“খুবই ভালো গান করে…শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে।”

ভুরু কপালে তুললো ছফা। “তাই নাকি।”

“জি।”

“আপনি…?”

“আমি এখানকার কেয়ারটেকার। আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন?”

“ঢাকা থেকে এসেছি,” আর কিছু বললো না ছফা। পুকুর পাড়ের ওপাশে, যেখানকার ডোবায় মুশকান জুবেরি কুমির চাষ করতো, সে জায়গাটার দিকে চোখ গেলো তার। একদমই বদলে গেছে। মাটি ফেলে জায়গাটা উঁচু করা হয়েছে এখন, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দুটো ভবন-মূল স্কুল ভবনের আদলেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলোইটের দেয়াল আর টিনের ছাদ।

তবে দুটো ভবনের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে পৃথক করা।

“ওগুলো ডরমিটরি,” ছফার চোখ অনুসরণ করে কেয়ারটেকার বললো। “ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা দুটো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা, দেখতে পেলো ডরমিটরিতে ঢুকতে দুটো আলাদা মেইন গেট আছে, আর পুরো জায়গাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “মাস্টারসাহেব দেখি ছোটোখাটো শান্তিনিকেতন বানিয়ে ফেলেছেন!”

হেসে ফেললো কেয়ারটেকার। “এটা উনার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিলো।”

“বিশাল কাজ করেছেন,” সত্যি সত্যিই বললো ছফা, কথাটার মধ্যে টিটকারির লেশমাত্রও নেই।

মাথা নেড়ে সায় দিলো মাঝবয়সী কেয়ারটেকার। মুখে এখনও হাসি ধরে রেখেছে।

“কিন্তু এতো কিছু কিভাবে করলেন?”

লোকটার হাসি মিইয়ে গেলো। ছফার এ প্রশ্নের মধ্যে কেমনজানি একটা ইঙ্গিত আছে। “কিভাবে মানে?”

“এই যে, বিরাট একটি আবাসিক স্কুল, এতো বড় আয়োজন, এসব করতে তো অনেক টাকা লাগার কথা।”

আবারো হাসি ফিরে এলো কেয়ারটেকারের মুখে। “ট্রাস্টের জমিজমার পরিমাণ তো অনেক। তাছাড়া স্থানীয় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভোনেশন দিয়েছে। আমাদের নতুন এমপি আবার মাস্টারসাহেবের ছাত্র ছিলেন,

অনেক সাহায্য করেছেন উনি, সরকারী অনুদানের ব্যবস্থাও করেছেন।”

“হুম,” মাথা নেড়ে বললো ছফা।

“কিন্তু আপনি কে, সেটা তো বললেন না?”

লোকটার দিকে স্থিরচোখে তাকালো ছফা। “আমি ঢাকা থেকে এসেছি…ঢাকার ডিবি অফিস থেকে। আমার নাম নুরে ছফা।”

কেয়ারটেকার একটু বিস্মিত হবার ভান করলো। “কিছু হয়েছে নাকি আমাদের এখানে?”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে। “এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকেই জেনে নেবেন, যিনি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন আমাকে চোখে চোখে রাখার জন্য।”

.

অধ্যায় ২৪

মাস্টারের স্কুল থেকে সোজা নিজের হোটেল রুমে ফিরে এসেছে নুরে ছফা। হোটেল রুমের ছোট্ট ঘরটায় পায়চারী করার মতো জায়গা কমই আছে, তবুও সে পায়চারী করতে করতে একটা কথাই ভেবে যাচ্ছে-সুন্দরপুরে মাস্টার রমাকান্তকামারের ঘর থেকে কী পাওয়া যেতে পারে। সে নিশ্চিত, সেলফোন অবশ্যই আছে, তবে সঙ্গত কারণেই সেটা লুকিয়ে রাখেন।

মাস্টার এখন খুবই শক্তিশালী মানুষ। যদিও ক্ষমতার দাপট দেখান না, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেই নিমগ্ন থাকেন সব সময়, তারপরও তিনি যদি জেনে যান ছফা তার ঘরে চোর পাঠিয়েছিলো তাহলে হয়তো এমপির কাছে নালিশ দেবেন, তাই ছফাকে এ ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আতরকেও বলে দিয়েছে, খুব সাবধানে কাজটা করা দরকার।

এমন সময় দরজায় নক হলে ছফার ভাবনায় ছেদ পড়লো।

“আতর?”

“হ, স্যার।” দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠলো ইনফর্মার। তার কণ্ঠের খুশিখুশি ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

নুরে ছফা দরজা খুলে দিলে আতর আলী রুমে ঢুকে পড়লো। কোনো কিছু না বলে পকেট থেকে একটা কমদামি চায়নিজ মোবাইলফোন আর কিছু চিঠিপত্র বের করে আনলো সে।

“এই লন,” এমনভাবে দু-হাতে ধরে রাখলো ওগুলো যেনো দামি কোনো উপহার তুলে দিচ্ছে। “কইছিলাম না বলুই পিরবো।”

ছফা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালে ফোনটার দিকে। দ্রুত সেটা চালু করলো সে। উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো আতর আলী। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হতাশা ভর করলো ছফার চোখেমুখে। রেগেমেগে ফোনটার পেছনের অংশ খুলে ফেললো।

“ধুর!” প্রচণ্ড রাগে বলে উঠলো সে।

“কী হইছে?” আতর কিছুই বুঝতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথ দুই-৮

“এটার তো সিমই নেই!”

“সিম নাই?!” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ইনফর্মার। “কন্ কি!”

ছফা কিছু বললো না।

“সিম না থাকলে কি কুননা কামে দিবো না এইটা?”

আতরের দিকে তাকালো নুরে ছফা। ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টি, মানে আইএমইআই নাম্বার দিয়েও যে সিমের হদিস বের করা যায় সেটা এই স্বল্পশিক্ষিত ইনফর্মারকে বললেও বুঝবে না। তাছাড়া কাজটা করা একটু সময়সাপেক্ষ। সিম থাকলে অনেক সহজেই কল হিস্ট্রি বের করা যেতো।

সিম নেই দেখে আতর মুখ বেজার করে বসে আছে।

এখন একটা ব্যাপারে ছফা নিশ্চিত-রমাকান্তকামার নিজের মোবাইলফোনটা গোপন রাখেন, তারচেয়েও বড় কথা, সেই ফোনের সিম খুলে রাখেন নিরাপদ কোনো জায়গায়! ভদ্রলোক এতোটা সতর্ক কেন-এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে আছে-কারো সাথে তার যোগাযোগের ব্যাপারটা যেনো ফাঁস না হয়ে যায় তাই সদা সতর্ক থাকেন। আর এরকম একজন মানুষই আছে-মুশকান জুবেরি!

মাস্টারের মোবাইলফোনটার ব্যাটারির পেছনে থাকা আইএমইআই নাম্বারটার ছবি তুলে রাখলো নিজের মোবাইলফোনের ক্যামেরায়। তারপর যে চিঠিগুলো বল্টু চুরি করে এনেছে সেগুলোর দিকে নজর দিলো সে। একটু নেড়েচেড়েই বুঝতে পারলো, সবগুলো অফিশিয়াল চিঠি। খামের উপরে প্রেরক আর প্রাপকের জায়গায় বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেখে সেগুলো আর ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে করলো না। নতুন স্কুল আর লাইব্রেরি দেবার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ করতে গিয়ে বিভিন্ন সরকারী আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির সাথে চিঠিপত্র আদান প্রদান করেছেন মাস্টার।

“মনে লয় মাস্টর টের পায়া গেছে, অবশেষে বিজ্ঞের মতো বললো আতর আলী।

“উনি কিভাবে টের পাবেন?” ছফা বিরক্ত হয়ে বললেও তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথে প্রথম দিন দেখা হয়ে যাওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। তার উচিত হয়নি ওখানে যাওয়া। কে জানতো, মাস্টার ঐ সময় লাইব্রেরিতে থাকেন।

“হে অনেক বড় পণ্ডিত,” ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো ইনফর্মার। “সব কিছু আগে থেইক্যা বুইজ্যা ফালায়। মাথা তো না যে কমপিটার।”

ছফা কিছু বললো না। মাস্টার যে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফোনের ব্যাটারিটা আবার লাগিয়ে নিলো সে।

“এখন তাড়াতাড়ি এগুলো জায়গামতো রেখে আসা দরকার।”

মোবাইল ফোনসহ চিঠিপত্রগুলো ইনফর্মারের দিকে বাড়িয়ে দিলো ছফা। এমন সময় দুটো খাম পড়ে গেলো মেঝেতে। যেই না ও দুটো। তুলতে যাবে আতর তখনই ছফার নজরে কিছু একটা ধরা পড়লো-দুটো খামের মাঝখানে ছোট্ট একটা চিরকুট আছে। উপুড় হয়ে নিজেই চিরকুটটা তুলে নিলো। অন্য চিঠিগুলোর খামে ভরা থাকলেও এটার কোনো খাম নেই। বাকিগুলো কম্পিউটারে টাইপ করা হলেও চিরকুটটা হাতেলেখা। লেখাটা বেশ সুন্দর। মনোযোগ দিয়ে পড়লো সেটা :

সম্পদ-সম্পত্তি খারাপ মানুষের হাতে পড়লে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। ভালো মানুষের হাতে পড়লে মহৎ কিছুর জন্ম হয়। আপনি এ সম্পত্তি নিয়ে কি করবেন সে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই। শুধু ছোট্ট একটি অনুরোধ, রবীন্দ্রনাথকে চমৎকার একটি লাইব্রেরি বানাবেন। বইয়ের চেয়ে শক্তিশালী খাবার এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি! ওই লাইব্রেরিটা যদি রবীন্দ্রনাথের নামে হয় তাহলে আমি ভীষণ খুশি হবো। একটা কথা মনে রাখবেন, এটা আমি আপনাকে দেইনি। রাশেদ জুবেরি তার জীবন বাঁচানোর জন্য আপনার কাছে চিরটাকালই কৃতজ্ঞ ছিলো। সে হয়তো মুখ ফুটে সেটা কখনও বলতে পারেনি।

ভালো থাকবেন।

বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে।

.

অধ্যায় ২৫

স্কুল দেবার পর দুপুরের আগে কখনও নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন কিনা স্মরণ করতে পারলেন না মাস্টার রমাকান্তকামার। এমনকি ছুটির দিনেও তিনি বিকেল পর্যন্ত স্কুল আর লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আজকে যে এর ব্যতিক্রম করলেন সেটার কারণ যুক্তিবুদ্ধি নয়-তার স্বজ্ঞা!

নুরে ছফার কিছু কথা, কিছু আচরণ তাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে : রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো-এরকম কথা কেন বললো ঐ ডিবি অফিসার? সে কি কোনোভাবে টের পেয়ে গেছে, রাশেদের স্ত্রী, ঐ মহিলা তার সাথে যোগাযোগ করেছিলো? সেজন্যে তার সন্দেহ, মহিলা আবারো যোগাযোগ করে থাকবে হয়তো?

অসম্ভব!

এ কথা সে কিভাবে জানতে পারবে? সবটাই কি তাহলে অহেতুক ভয়?

ডিবি অফিসার তার কাছে তার ফোন নাম্বারটা চেয়েছিলো-আপনার নিজের কোনো ফোন নেই? তিনি সচেতনভাবে সত্যি-মিথ্যে কিছুই বলেননি, এড়িয়ে গেছেন।

নুরে ছফা স্কুল থেকে চলে যাবার পরই রমাকান্তকামার এই দোলাচলে দুলেছেন। তার অন্তরাত্মা বলছিলো, ঐ চিরকুটটা রেখে দিয়ে মোটেও ভালো কাজ করেননি। যদিও এতোদিনে ওটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলেন।

অনেকক্ষণ স্কুলের অফিসে বসে থাকার পর হুট করেই উঠে পড়েন তিনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো, ছফা নামের ঐ ডিবি অফিসারের ভাবসাব মোটেও ভালো নয়। এক ধরণের আশঙ্কা করতে থাকেন তিনি, সেটা যে কী, নিজেও জানেন না। জরুরী একটা দরকারে বাসায় যাচ্ছেন বলে সোজা চলে আসেন নিজের বাড়িতে।

এখন ঘরে ঢুকতে গিয়েই মাস্টার দেখতে পাচ্ছেন তার ঘরের তালাটা খোলা! দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, এরপর আস্তে করে ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলেন। কেমনজানি একটা অনুভূতি হলো তার। টের পেলেন, প্রচ্ছন্ন একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে তার পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ঘরটাতে। তিনি যথেষ্ট সাফ-সুতরো থাকেন। তার ঘরে আর যাই হোক, বাজে গন্ধ ভেসে বেড়ানোর কথা নয়-গাঁজার গন্ধ তো দূরের কথা!

দেখে মনে হচ্ছে, ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তারপরও পকেট থেকে চাবি বের করে ড্রয়ারটা খুলতে গিয়ে দেখলেন, সেটাও খোলা আছে-ঠিক দরজার তালাটার মতোই!

ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবার। যে আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে : জরুরী অনেক চিঠিপত্রের সাথে তার মোবাইলফোনটা নেই! তারচেয়েও বড় কথা, ঐ চিরকুটটাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

মাস্টারের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। আইনের লোক হয়ে বেআইনীভাবে আরেকজন মানুষের ঘরে চোর পাঠিয়ে তার কাগজপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হলেন। তিনি নিশ্চিত, ঐ নুরে ছফা লোকটি সম্ভবত আতর আলীকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এক সময় ঐ লোকের পেশা তো চুরিই ছিলো। যেকোনো সময় পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়াটা তার জন্য এমন আর কী।

রমাকান্তকামার চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। গভীর করে নিশ্বাস নিলেন। তিনি যে বুদ্ধের মতো অক্ৰোধি সেটা দাবি করেন না, তবে সজ্ঞানে সব সময়ই চেষ্টা করেন রেগে না যেতে। কিন্তু এ মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর উটকো এক লোক এসে সব কিছু তছনছ করে দেবার পায়তারা শুরু করে দিয়েছে।

এই নুরে ছফা লোকটা কি সুন্দরপুরে পা রাখার পর জমিদার বাড়িটা পুড়ে খাক হয়ে যায়নি?

নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মাস্টার রমাকান্তকামার বেশ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন, ঠিক যেভাবে কোনো মা তার সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, আগলে রাখার চেষ্টা করে। কততক্ষণ বিছানায় মূর্তির মতো বসেছিলেন তিনি জানেন না। কিছু একটা শব্দ পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলেন।

কেউ তার বাড়ির আঙিনায় পা রেখেছে।

জন্ম থেকে আজ অবধি, আশি বছর ধরে এ বাড়িতে বাস করছেন, বাড়িটা তার দেহেরই অংশ হয়ে গেছে। এখানকার সব কিছু যেনো তার সঙ্গে কথা বলে। কেউ তার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখলে তিনি টের পেয়ে যান-যেনো কেউ তার শরীর স্পর্শ করছে।

রমাকান্তকামার আস্তে করে উঠে আলনার পেছনে গিয়ে কাপড়চোপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন, কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলেন, দরজা ঠেলে সতর্ক পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলো এক কিশোর। ছেলেটাকে চিনতে কোনো সমস্যাই হলো না তার। সুন্দরপুরের সবাই তাকে চেনে, তার নাম জানে। খারাপ সঙ্গ আর মাতৃপিতৃহীন এই ছেলেটি অকালেই নষ্ট হয়ে গেছে।

আড়াল থেকে তিনি দেখলেন, বল্টু তার সব কাগজপত্রের সাথে মোবাইলফোনটাও ড্রয়ারে রেখে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে বের হয়ে গেলো। তারপরই শুনতে পেলেন, বাইরে থেকে দরজার তালা লাগাচ্ছে। সে।

“তালা মারার দরকার নেই…আমি ঘরে আছি!” আড়াল থেকে বের হয়ে রমাকান্তকামার বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন।

এরপর শুধু দৌড়ে চলে যাবার শব্দটাই শুনতে পেলেন তিনি।

প্রচণ্ড রাগ হলো তার। বিছানায় বসে কয়েক বার গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলেন। পাজামার পকেট থেকে চশমার কেসিংটা বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা সিম বের করে আনলেন এবার। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে তাতে সিমটা ভরলেন। কিছুক্ষণ পর একটা নাম্বারে ডায়াল করলেন মাস্টার।

একজনের সাথে জরুরী কথা বলা দরকার।

.

অধ্যায় ২৬

সুরুত আলীর সানমুন হোটেলে বসে বসে সিগারেট ফুকছে আর আতরের জন্য অপেক্ষা করছে ছফা।

একটু আগে ইনফর্মার মাস্টারের ফোনসহ চিঠিপত্রগুলো নিয়ে চলে যাবার আগে তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই মাস্টারের ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে নিয়ে আসছে সে।

হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা। বুঝতে পারছে না, আতর আলী কোত্থেকে মাস্টারের নাম্বারটা জোগাড় করবে। ধোঁয়ার কারণে ঘরটা গুমোট হয়ে গেছে, জানালাটা খুলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত, মাস্টারের সাথে মুশকান জুবেরির যোগাযোগ আছে। তার অনুরোধেই লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। অথচ মাস্টার তার কাছে এটা স্বীকার করেননি। কী সব পুরনো ইতিহাস কপচে গেছেন।

দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আবারও তার রুমের দরজায় টোকা পড়লো।

“আসো।”

হাসিমুখে ঘরে ঢুকেই আতর আলী বলে উঠলো, “নম্বর তো পায়া গেছি, স্যার।”

“তাই নাকি?!” দারুণ অবাক হলো ছফা। “এতো দ্রুত কিভাবে জোগাড় করলে?”

দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার, যেনো ছফার বিস্ময় উপভোগ করছে, সেই সাথে নিজের কেরামতি দেখাতে পেয়ে বেশ খুশি।

“মাস্টর ফোন লুকায়া রাখবার পারে, সিমও খুইল্যা রাখবার পারে,” রহস্য করা ভঙ্গিতে বলে যেতে লাগলো সে, “কিন্তু ফোনে তো টাকা ভরনই লাগে, লাগে না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তার মাথায় এটা আগে আসেনি। মনে মনে ইনফর্মারের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। ফোনে ব্যালান্স ভরার জন্য মাস্টারকে নাম্বারটা দিতেই হয়।

“তাইলেই বুঝেন।” হেসে ফেললো সুন্দরপুরের বিবিসিখ্যাত আতর আলী। “এইহানে তো ফোনের দোকান একটাই…আমাগো শামসু মিয়া চালায়, হের লগে আমার আবার হট টেরাম।”

মনে মনে আরেক বার ইনফর্মারের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে।

“মাস্টরের একটা পোলা আছে, স্কুলে কাম করে, ঐ পোলায় মাজেমইদ্যে ফোনে টাকা ভরনের লাইগ্যা শামসুর দোকানে যায়। হের তো নিজের ফোন নাই…আমি পুরা শিওর, নম্বর দুইটা মাস্টরেরই হইবো।”

“দুটো নাম্বার?” আশাহত হলো ছফা।

“হ, স্যার। পোলাটা দুইটা নম্বরে ট্যাকা ভরে। ওয় হইলো মাস্টরের ডাইনহাত,” কথাটা বলেই ছোট্ট একটা ময়লা কাগজ বের করে ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।

কাগজটা হাতে নিয়ে দুটো ফোন নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো নুরে ছফা। দুটোই একই টেলিকমের। তার মন বলছে, এই নাম্বার দুটোর একটা অবশ্যই মাস্টারের-আবার দুটো নাম্বারও তিনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই নাম্বার দুটো থেকেই জানা যাবে মুশকান জুবেরির ফোন নাম্বারটা-যদি মাস্টারের সাথে তার যোগাযোগ থেকে থাকে।

সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে তার সহকারী জাওয়াদের নাম্বারে ডায়াল করলো সে।

*

সুন্দরপুর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে!

হন হন করে হেঁটে টাউনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে ভাবলো। বল্টু। কী ভয়টাই না পেয়েছিলো সে। রাতবিরাতে ভুতের সাথে দেখা হয়ে গেলেও এতোটা ভয় পেতো কিনা সন্দেহ। যে ঘরে কোনো মানুষ নেই, পুরো ফাঁকা দেখেছে, পনেরো-বিশ মিনিট পরই সেখানে মাস্টার কিভাবে চলে এলো সে জানে না।

একটু আগে আতর আলীর কাছ থেকে মাস্টারের ঘর থেকে চুরি করা জিনিসগুলো আবার রেখে যেতে গেছিলো জায়গামতো, তখনও সবই ঠিকঠাক ছিলো, পুরো ভিটেটা ছিলো সুনশান। কাজের সুবিধার্থে সে মাস্টারের ঘর আর ড্রয়ারের তালা দুটো আর লাগায়নি, ধরেই নিয়েছিলো এটা করার দরকার নেই, একটু পরই তো চুরি করা জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে দিতে হবে। কিন্তু জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে যেই না দরজা লাগাতে যাবে অমনি ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের গম্ভীর কণ্ঠটা বলে ওঠে, দরজা লাগানোর দরকার নেই।

এটা কিভাবে সম্ভব হলো?!

বল্টুর মাথায় ঢুকছে না। এখনও তার বুক ধরফর করছে। কী দৌড়টাই

দিয়েছিলো। পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছিলো সে, শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলেও গেছে। কিছুক্ষণ তো মনেই হয়েছিলো, কণ্ঠটা মাস্টারের নয়, ভুতের!

বল্টুর স্পষ্ট মনে আছে, মাস্টারের ঘরে দ্বিতীয় বারের মতো যখন। ঢুকলো তখনও ঘরে কাউকে দেখেনি। মুহূর্তে কী করে ওখানে একজন চলে এলো?

কণ্ঠটা ভুত হলে তার বিপদ কমই হবে, কিন্তু সে ভালো করেই জানে। ওটা মাস্টারের কণ্ঠস্বর। তার মানে, আগামি কয়েক সপ্তাহ সুন্দরপুরে না থাকাই ভালো। সে এমন মানুষের ঘরে চুরি করেছে, যাকে এখানকার এমপি পর্যন্ত সালাম দেয়, সম্মান করে। এমপির ছেলেপেলেগুলো তার হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটাচ্ছে-এরকম একটি দৃশ্য ভেসে উঠলো বল্টুর চোখে। নিশ্চয় তার মুখ থেকে সব কথা বের না করা পর্যন্ত চলবে এই পিটুনি। এক পর্যায়ে সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।

বাসস্টেশনে আসতেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এলো পালিয়ে গেলে বিপদ কমবে না, বাড়বে। তারচেয়ে বরং সুন্দরপুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। কী করলে এ যাত্রায় রেহাই পাবে সেই বুদ্ধিটাও চট করেই মাথায় এসে গেছে।

উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো বল্টু। মনে মনে একটাই প্রতীজ্ঞা করলো, এ জীবনে আর কখনও আতর আলীর কাজ করবে না।

.

অধ্যায় ২৭

দুপুরে খেয়েদেয়ে সুরুত আলীর হোটেল সানমুনের ছোট্ট ঘরটায় পায়চারী করছে নুরে ছফা। আজকে তার হোটেল রুমেই খাবার পাঠিয়েছে মুশকানের মালিক ফজলু। এটা যে আতর আলীর কাজ, বুঝতে বাকি নেই তার।

যাই হোক, আতরের সংগ্রহ করা দুটো সেলফোন নাম্বার হাতে পাবার পর কাজটা সহজ হয়ে গেছে এখন। নইলে আইএমইআই নম্বর দিয়ে প্রথমে সিমের হদিস বের করা লাগতো, তারপর সেই সিম দিয়ে মাস্টার কোন্ কোন্ নাম্বারে ফোন করেছেন, তাকেই বা কোন্ কোন্ নাম্বার থেকে কল করা হয়েছে সেসব বের করা হতো।

এখন এসবের দরকার নেই। জাওয়াদকে নাম্বার দুটো দিয়ে বলে দিয়েছে, কার নামে সিম দুটো রেজিস্টার্ড করা, আর সেগুলো থেকে বিগত এক মাসে যেসব নাম্বার থেকে আউটগোয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে-সবকিছু জেনে নিতে হবে। কাজটা সময়সাপেক্ষ হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর পিএসের কল্যাণে দ্রুততম সময়েই করা যাবে।

সে এখন অপেক্ষা করছে জাওয়াদের ফোনের জন্য। তার উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠে গেলো ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই। সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করতে যেয়ে থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। একটা অপরিচিত নাম্বার। মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। দরকারের সময় এরকমটা হলে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। কলটা রিসিভ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “হ্যালো…কে বলছেন?”

“আপনে ক্যারে! উসমান কই?” ফোনের ওপাশ থেকে একটা খসখসে কণ্ঠ বলে উঠলো।

“আপনি ভুল নাম্বারে ফোন দিয়েছেন।”

“আপনে ক্যাঠায়…অ্যাঁ? কই থাহুন?”

ছফার মেজাজ গেলো বিগড়ে। “ফোন রাখ, বানচোত!” কলটা কেটে দিয়ে জোরে জোরে সিগারেটে টান দিতেই আবার বেজে উঠলো সেটা, তবে ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখে তার সমস্ত রাগ কৌতূহলে পরিণত হলো।

“হ্যাঁ, জাওয়াদ…বলো?”

“স্যার, আশেকসাহেবের রেফারেন্স ভালোই কাজে দিয়েছে,” ওপাশ থেকে ডিবির জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর বলে উঠলো। “খুব দ্রুতই অনেক ইনফো কালেক্ট করেছি। দুটো সিমই শ্যামল কুমার দাস নামে রেজিস্টার্ড করা…মদনগঞ্জের ঠিকানা দেয়া আছে। আমি গুগলিং করে দেখেছি, ওটা সুন্দরপুরের খুব কাছেই।”

“হুম,” বললো নুরে ছফা।

“ঐ দুটো সিম থেকে বিগত এক সপ্তাহে যেসব আউটগোয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে তার সবকিছু আমি আপনাকে মেইল করে দিয়েছি।”

“এক মাসের কল-হিস্ট্রিটাও আমার দরকার হবে।”

“ওটা করতে একটু সময় লাগবে। কালকের মধ্যে দিতে পারবো আশা করি।”

“ওকে।”

“স্যার, একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে,” জাওয়াদ বললো।

“কিভাবে বুঝলে?” আগ্রহী হয়ে উঠলো ছফা।

“নাম্বার দুটো নিজেদের মধ্যেও কল করেছে কয়েক বার।”

“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ঠিক আছে, যতো দ্রুত পারো বাকি ইনফোগুলো পাঠিয়ে দিও।”

“ওকে, স্যার।”

ফোনটা রেখে জানালার বাইরে তাকালো। দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে! শ্যামল কুমার দাস! মনে মনে বলে উঠলো সে। কে হতে পারে এই লোক? মাস্টারের আত্মীয়?

আতর আলীকে কল দিলো এবার। “শ্যামল কুমার দাস নামের কাউকে তুমি চেনো?”

“আরে, আমি যে পোলার কথা কইছিলাম আপনেরে, তার নামই শ্যামল! মাস্টরের ডাইনহাত।”

“যে ছেলেটা ফোনের ব্যালান্স ভরে?”

“হ।”

“ও তাহলে স্কুলের কর্মচারী, প্রশ্নের মতো করে বললো না ডিবির নুরে ছফা।

“হ। মাস্টর ওরে দিয়াই সব কাম করায়।”

“তাহলে ওর সাথে কথা বলতে হবে।”

“ঐ হালারপুতেরে ধরবেনুনি, স্যার?”

“হ্যাঁ।” নাম্বার দুটো কে বা কারা ব্যবহার করে সেটা বের করার সহজ উপায় হলো শ্যামলের স্বীকারোক্তি। যদিও সে নিশ্চিত, একটা নাম্বার অবশ্যই মাস্টার রমাকান্তকামার ব্যবহার করেন। কিন্তু ছেলেটাকে স্কুলে গিয়ে ধরতে চাইছে না সে। যদিও, চাইলে এখানকার যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তারপরও, স্কুলের বাইরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটা নাজুক অবস্থায় থাকবে। কারোর কাছ থেকে সত্য কথাটা বের করার সময় ভঙ্গুর আর নাজুক নার্ভই বেশি কার্যকরী।

“কিন্তু স্কুলে গিয়ে ওর সাথে কথা বলাটা ঠিক হবে না। স্কুলের বাইরে ধরতে হবে ওকে।”

“ঐ পোলায় রোজ বিকালে ফজলুর হোটেল থিকা কার লাইগা জানি খাওন নিয়া যায়,” আতর জানালো।

“তাহলে তুমি আর আমি একটু পরেই চলে যাবো রহমান মিয়ার দোকানে…ছেলেটা তো ওখান দিয়েই যাবে, নাকি?”

“হ, স্যার, “ বললো আতর।

“তাহলে তুমি আমার হোটেলে চলে আসো একটু পর।”

.

অধ্যায় ২৮

রহমান মিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, বেচা-বিক্রি ভালো হয়নি আজ। শহর থেকে কোনো কাস্টমারও আসেনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐ রেস্টুরেন্টের খোঁজে। এরকম কেউ চলে আসার পর যখন দেখে ওটা লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তখন খুবই অবাক হয়, তারচেয়েও বেশি হয় হতাশ। রহমান তখন আগ বাড়িয়ে তাদের হতাশা দূর করে দেয়ার কাজটা করে-”ঐ হুটেল তো এহন টাউনে সইরা গেছে…এইখান থিকা রিস্কা দিয়া গেলে দশ টাকা নিবো।”

এমন কথায় বেশ কাজে দেয়। খাদ্যরসিকেরা এতো দূর এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যায় না। তারা রহমানের নির্দেশনা পেয়ে খুশিমনে চলে যায় হিটলুর ঐ রেস্টুরেন্টে। কেউ কেউ এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দোকানিকে উপকারের প্রতিদান দেয়, কেউ বা হাসিমুখে ধন্যবাদ দিয়ে রিক্সা ধরে-তাতে অবশ্য রহমানের কোনো আক্ষেপ থাকে না। প্রতিটি কাস্টমারের জন্য হিটলু তাকে দশ টাকা করে দেয়।

রহমান অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে, এখন পর্যন্ত কোনো কাস্টমারই হিটলুর চালাকিটা ধরতে পারেনি। জমিদারের বৌয়ের রেস্টুরেন্টের নামটা হুবহু নেয়নি সে, কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, খেতে এসে কোনো খাদ্যরসিক ‘খেতে’টা যে নেই, সেটাই লক্ষ্য করে না। বড়জোর পুরনো কাস্টমাররা বলে, আগের মতো আর অতো স্বাদের হয় না খাবারগুলো। তবে একদম নতুন যারা আসে, তারা সেটাও বুঝতে পারে না।

তিক্ত মুখে রহমান ওয়াক করে থুতু ফেললো দোকানের পাশে, আর তখনই শব্দটা কানে গেলো তার। আতর আলী আসছে মোটরসাইকেলে করে, তার পেছনে বসে আছে শহর থেকে আসা পুলিশের সেই লোকটি। সুন্দরপুরে যে আবারো খারাপ কিছু ঘটবে সেটা নিশ্চিত। তারপরও আপাতত দু-জন কাস্টমার পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

বাইকটা দোকানের সামনে এসে থামতেই শহুরে লোকটা নেমে গেলো আস্তে করে।

“রহমান মিয়া, কেমন আছেন?”

“ভালা, ছার। আপনে কিমুন আছেন?” বিগলিত হাসি দিয়ে বললো দোকানি।

“আমি ভালো আছি। তা, আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?” নুরে ছফা দোকানের সামনে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।

“ব্যবসা মন্দা…কাস্টমার নাই,” হাসিমুখটা আবারো বেজার করে বললো টঙের মালিক।

“আমাগো কি কাস্টমার মনে করো না তুমি?” বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো আতর আলী।

“তা ক্যান মনে করুম না। আমি কইতাছি সারাদিনের কথা।”

“হুম,” আতর বিজ্ঞের মতো বলে বসে পড়লো ছফার পাশে। “এহন পেচাল বাদ দিয়া দুই কাপ গুড়ের চা বানায়া ফালাও জলদি।”

“প্যাচাল পাড়লাম কুনহানে!” মর্মাহত হলো রহমান। “তুমার খালি আজাইরা কথা।” এই বলে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

“মাস্টর কি ওইহানে আছেনি?” রাস্তার অপর পাশে রবীন্দ্রনাথের দিকে ইশারা করে বললো ইনফর্মার।

“হ, বিকালে তো ওইহানেই থাহে,” চামচ নেড়ে নেড়ে চায়ের সাথে গুড় মিশিয়ে বললো রহমান। সারা দিন স্কুলে কাম করার পরও মাস্টর জিরায় না…এইহানে আহে আবার। বিয়াশাদিও তো করে নাই, বাড়িত গিয়া করবোটা কী।” কথাটা বলে ছফা আর আতরের দিকে কাপ দুটো বাড়িয়ে দিলো। “আপনেরা কি স্কুলে যাইবেনি?”

রহমানের প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হলো আতর। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো-আদার বেপারি তুমি, এতো জাহাজের খবর লও ক্যান-কিন্তু সে প্রসন্নভাবে হেসে বললো, “না…শ্যামরে একটু দরকার আছিলো। হেরে দেখছোনি?”

শ্যামলের কথা শুনে রহমানের ভুরু কুঁচকে গেলো। “হেরে আবার কী দরকার?”

“সব কথা তোমার জানোন লাগবো, না?” এবার আর বিরক্তি লুকালো ইনফর্মার। “সুন্দরপুরের বিবিচি হইবার চাও মনে হইতাছে।”

“ওইসব হওনের কুনো শখ আমার নাই,” আস্তে করে বললো রহমান। “নিজের কাম নিয়া থাহি, অইন্যের খবর জাইন্যা আমার কী লাভ!”

আতর কিছু বলতে যাবে কিন্তু ছফার চোখের ইশারা পেয়ে থেমে গেলো।

“শ্যামল কি স্কুল থেকে বের হয়েছে?” নুরে ছফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো।

গাল চুলকালো রহমান। “হেয় তো একটু আগে ঐদিকে গ্যাছে,” টাউনের দিকটা দেখিয়ে বললো সে।

“কততক্ষণ আগে?”

“দশ-পোন্ডা মিনিট তো হইবোই।”

নুরে ছফা আর আতর আলী একে অন্যের দিকে তাকালো। রহমানের টঙে বসেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো তারা।

চা শেষ করে ছফা যখন সিগারেট ধরাবে তখনই আতর তাকে ইশারা করলো সুন্দরপুরের মহাসড়কের দিকে। এক তরুণ হাতে পলিব্যাগ নিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

ছফার ইশারা পেয়ে উঠে দাঁড়ালো আতর। তাকে রাস্তার দিকে যেতে দেখে রহমান মিয়ার কৌতূহলি চোখ স্থির হয়ে রইলো যেনো।

ছেলেটাকে ইশারায় ডাকলো ইনফর্মার। অবাক হলো শ্যামল।

রহমান মিয়া এখন চোখের পলকই ফেলছে না। পুরো নাটকটার এক মুহূর্তও মিস করতে চাইছে না সে-রসিয়ে রসিয়ে মানুষের কাছে যখন গল্পটা বলবে তখন যেনো বর্ণনায় একটুও খামতি না থাকে।

শ্যামল কিছুটা ভিরু পায়ে এগিয়ে এলো আতরের কাছে, আর ঠিক তখনই রহমান মিয়ার দোকানে নুরে ছফাকে দেখতে পেলো। এই লোক যে পুলিশ এরইমধ্যে জেনে গেছে সে। তার চোখেমুখে ভয় জেঁকে বসলো।

“এই যে, আমাগো ছফাস্যার,” রহমানের দোকানের কাছে এসে বললো আতর আলী। “সেলাম দে স্যারে।” ধমকে উঠলো শ্যামল নামের ছেলেটাকে। “তরে কিছু পুছতাছ করববা…ভালায় ভালায় সব কইবি, ঠিক আছে?”

শ্যামল ভ্যাবাচ্যাকা খেলো, রহমানের দিকেও তাকালো চকিতে। দোকানি হঠাৎ করেই গুড়ের পিণ্ডের উপর থেকে মাছি সরানোর কাজে ব্যস্ত। হবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটা মাছিও নেই সেখানে।

“তোমার নাম কি শ্যামল?” নুরে ছফা সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইলো।

“হ,” ছেলেটা ঢোঁক গিলল।

“তুমি মাস্টারের স্কুলে কিসের কাজ করো?”

“আ-আরদালির, “ ছেলেটা নার্ভাস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।

ছফা আর প্রশ্ন না করে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এই নাম্বার দুটো কার?”

কাগজটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো শ্যামল, যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না।

“তোর তো নিজের ফোন নাই, তাইলে এইগুলান কার নম্বর?” চোখমুখ শক্ত করে বললো আতর।

শ্যামল আস্তে করে আবারো ঢোঁক গিলল।

“তুই এই নম্বরে ট্যাকা ভরোস। ভালা কইরাই জানোস কার নম্বর এইগুলা। না চিনার তো কথা না।”

“চিনুম না ক্যান, আজিব, ঢোঁক গিলে বললো ছেলেটা। “এইগুলা আমাগো মাস্টকাকা আর দিদির নম্বর।”

আতর আর নুরে ছফা দৃষ্টি বিনিময় করলো। “দিদি?” ইনফর্মারই প্রশ্নটা করলো অবশেষে। “কার কথা কস?”

“ঐ যে, আমাগো গানের টিচার…এইটা ওই দিদির নম্বর।” দুটো নাম্বারের একটা দেখিয়ে বললো শ্যামল।

“কিন্তু এই সিম দুটো তো তোমার নামে রেজিস্টার্ড করা।”

ছফার দিকে অবাক হয়ে তাকালো শ্যামল। “হ, আমিই কিনছিলাম আমার কার্ড দিয়া।”

“তাদের সিম তুমি কেন তোমার নামে কিনলে?”

“মাস্টকাকা তো আইডিকার্ড হারায়া ফেলছেন সেই কবে। ঢাকায় গেছিলেন, বাসে কইরা ফিরার সময় ব্যাগ হারায়া ফেলছিলেন, হের পর আর কার্ড তোলেন নাই।”

ছফা ছেলেটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আর তোমাদের গানের টিচার? তারও কি আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে?”

“দিদি তো শান্তিনিকেতন থেইকা আসছে, তার কেমনে কার্ড থাকবো?”

“হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কথাটা আগেও শুনেছে।

“এইজন্যেই মাস্টকাকা আমারে কইলো আমি যে আমার আইডি দিয়া দিদির জইন্যও একটা সিম কিইন্যা দিই।”

“ব্যাটা, তুই এক নামে এতোগুলান সিম কিনছোস ক্যান, অ্যাঁ? কাহিনী কি?” ধমকের সুরে বললো আতর।

“একটা কার্ড দিয়া সাতটা সিম কিনা যায়…এইটা সরকারী নিয়ম, ব্যাখ্যা করে বললো শ্যামল।

আতর কিছু বলার আগে তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো ছফা। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। একটা কার্ড দিয়ে সর্বোচ্চ সাতটা সিম কেনা যায়। ফালতু নিয়ম! মনে মনে গজ গজ করলো সে। “কার জন্য এই খাবার নিয়ে যাচ্ছো?” ছেলেটার হাতে থাকা পলিব্যাগের দিকে ইশারা করলো।

“এইগুলান দিদির…ফজলুর হোটেলের ক্র্যামচপ দিদি খুব পছন্দ করে।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও,” ছফার আর কিছু জানার নেই এই ছেলের কাছ থেকে।

তবে আতরকে দেখে মনে হলো সে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শ্যামলকে আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ভাবছিলো, এতো দ্রুত এই পর্ব শেষ হবে আশা করেনি।

ছেলেটা চুপচাপ চলে গেলো, একবার পেছনে ফিরেও তাকালো সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে।

“পোলাটা মাস্টরের কিমুনজানি আত্মীয় হয়,” রহমান মিয়া বলে উঠলো এবার, অনেকক্ষণ ধরে চুপ ছিলো সে। “গানের মাস্টনিও মনে লয় মাস্টরের আত্মীয়। হিন্দু মানুষ তো, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন থাকবারই পারে।”

ছফা কিছু বললো না। রহমান মিয়া হয়তো নির্দোষভাবেই কথাটা বলেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে দোকানিকে দিয়ে এবার আতরকে বললো, “তুমি এখানেই থাকো, আমি আসছি।”

ইনফর্মার কিছু জানতে চেয়েও চাইলো না, সে দেখতে পেলো নুরে ছফা রাস্তা পার হয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে যাচ্ছে।

.

অধ্যায় ২৯

পড়ন্ত বিকেলে রমাকান্তকামার নিজের অফিসে বসে আছেন। প্রায় প্রতি দিনই স্কুল থেকে বের হয়ে সুন্দরপুর মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এই রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগারে গিয়ে বসেন। এখানে সময় কাটাতে তার অদ্ভুত রকমের আনন্দ হয়।

দিন দিন লাইব্রেরির সদস্য বাড়ছে, বাড়ছে পড়ুয়াদের আগমন। নিত্য নতুন বইয়ের খোঁজ করে তারা। মাস্টার সে-সব টুকে রাখেন, মাস শেষে সেখান থেকে বাছাই করা বইগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। যে বইগুলো যুগ যুগ ধরে আগলে রেখেছিলেন সেগুলোর একটা সদগতি হয়েছে দেখাটা তার কাছে ভীষণ আনন্দের, তারচেয়েও বেশি আনন্দ পান যখন দেখেন অল্পবয়সীরা সে-সব বই পড়ছে। ছোট্ট একটা কামরায় বসে জানালা দিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখেন পড়ুয়াদের।

এ মুহূর্তেও তিনি সেটাই করছেন, কিন্তু আজকে সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে খানিকটা। আইনের লোক হয়ে তার ঘরে চোর পাঠিয়েছে। কিছু জিনিস ফিরিয়ে দিলেও ঐ চিরকুটটা আর ফেরত দেয়া হয়নি। এটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হলেও মাস্টারের মানসপটে ভেসে উঠলো কিছু দগদগে স্মৃতি।

সদ্য মেট্রিকুলেশন পাস করেছেন, দিনের বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকেন শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণগ্রন্থাগারে। তার কাছে সুন্দরপুরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিলল ওটাই। কী মনোরম পরিবেশ! বিশাল এক বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার নীচে অবস্থিত দোচালা ঘরের মাঝারি আকৃতির একটি পাঠাগার। দু-পাশে অসংখ্য জানালা, সেই জানালা দিয়ে যতোদূর চোখ যেতে দেখা যেতো সুন্দরপুরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমেও সুশীতল বাতাসের কমতি ছিলো না। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। বইয়ে ডুবে থাকার জন্য চমৎকার একটি জায়গা।

তারপরই একদিন শুরু হলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সুন্দরপুর থেকে হাজার মাইল দূরে কাশ্মীর নিয়ে দুই প্রতিবেশীর লড়াই। সেই লড়াইয়ের হিংস্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো সুন্দরপুরেও। চারদিকে ফিসফাস শোনা যেতে শুরু করলো। এক বিকেলে বাল্যবন্ধু কিসমত এসে জানালো, তার কাছে নাকি পাক্কা খবর আছে, আজ সন্ধ্যায় মুসলিমলীগার হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে একদল দাঙ্গাবাজ লোক রবীন্দ্রনাথ-এর নামনিশানা মুছে দেবে-সেরকমই পরিকল্পনা হয়েছে। থানার পুলিশকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা যেনো চোখকান বন্ধ রাখে!

রমাকান্তকামারের বুক ভেঙে গেছিলো কথাটা শুনে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না হিংস্র আর ধর্মান্ধ রাজনীতির শিকার হতে পারে একটা লাইব্রেরি! তারপরই মনে পড়ে গেলো, যারা দেশ চালাচ্ছে তারা কোন্ প্রকৃতির মানুষ। এরাই কি ক্ষমতায় আসার পর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করার মতো জঘন্য কাজ করেনি? বাঙলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিককে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করেনি, শুধুমাত্র হিন্দু হবার কারণে? যদিও মূর্খ আর ধর্মান্ধগুলোর জানা ছিলো না, কবিগুরু ধর্মে ছিলেন ব্রাহ্ম! হিন্দু আর ব্রাহ্মর মধ্যে তফাৎ বোঝার মতো মানুষ অবশ্য তারা ছিলো না।

রমাকান্তের আরো মনে পড়ে গেলো সেই বিকেলের শেষ দিকে, কিসমতকে নিয়ে তিনি কী করেছিলেন। তারা দুই বন্ধু গেছিলেন জমিদার অলোকনাথের সাথে দেখা করে এ কথাটা বলার জন্য। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বয়োজ্যেষ্ঠ জমিদার বলেছিলেন, তিনি কীই বা করতে পারবেন। নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েই এখন চিন্তিত, লাইব্রেরি নিয়ে ভাবার সময় কই!

জমিদারের এমন অসহায় অবস্থা দেখে রমাকান্তকামার আর দেরি করেননি, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দ্রুত। কিসমতকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করার কাজে। লুটেরা আর দাঙ্গাবাজদের হিংস্র আগুনে রবীন্দ্রনাথ পুড়ে যাবার আগেই ওটার মূল্যবান সম্পত্তিগুলো রক্ষা করতে হবে : দেশ মানে যদি মৃন্ময় না হয়ে চিন্ময় হয়ে থাকে, তো গ্রন্থাগার মানে দোচালার একটি ঘর নয়, এর সমস্ত বইগুলো!

চটের বস্তায় সেই বইগুলো ভরে, ক্ষেতের আইল ধরে মাথায় করে দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে গেছে তারা দুই বন্ধু। এভাবে সন্ধ্যার আগে রবীন্দ্রনাথ যখন অর্ধেক রক্ষা করে ফেললো তখনই দূর থেকে দেখতে পায় আগুনের মশাল নিয়ে দাঙ্গাবাজেরা ধেয়ে আসছে।

অ্যাকশন অ্যাকশন! ডাইরেক্ট অ্যাকশন!

ভারতের দালালেরা নিপাত যাক নিপাত যাক!

এমন শ্লোগান তাদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো। রমাকান্তকামার আর তার বন্ধু কিসমত অসহায়ের মতো শেষ একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো তারপরও, কিন্তু এক বস্তার বেশি বই সংগ্রহ করার আগেই হিংস্র লোকগুলো চলে আসে রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে। ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয় কিসমত। অবশ্য দরজা খোলার চেষ্টাও করেনি দাঙ্গাবাজেরা, তারা লাইব্রেরির চারপাশে কেরোসিন ঢেলে নিজেদের হাতের মশালগুলো নিক্ষেপ করতে থাকে ঘৃণ্য উল্লাসে। কেউ কেউ জানালা ভেঙে ভেতরেও ছুঁড়ে মারে আগুনের মশাল। দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ!

রমাকান্তকামার আর কিসমত পেছনের একটা জানালা ভেঙে এক বস্তা বই নিয়ে বের হতে সক্ষম হয়। তারা যখন মাথায় বস্তা নিয়ে একটু দূরে ক্ষেতের আইলের উপর দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকায়, দেখতে পায় সন্ধ্যার ফিকে হয়ে আসা আলোকে সমৃদ্ধ করে জ্বলন্ত চিতার মতোই জ্বলছে রবীন্দ্রনাথ।

সবগুলো বই রক্ষা করতে না পারার আক্ষেপটা সারা জীবনই তাকে পীড়া দিয়ে গেছে। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশাল পরিমাণের বই রক্ষা করার আনন্দটাও কম ছিলো না।

ছোট্ট জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে আরেকবার চোখ বুলালেন রমাকান্তকামার। এখন অজস্র নতুন বইয়ের ভীড়ে সেই সব দুষ্প্রাপ্য বইগুলো এই গ্রন্থাগারের মূল্যবান সম্পত্তি হয়ে শোভা বর্ধন করছে।

একাত্তরে পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ধরেই নিয়েছিলেন, সংগৃহীত বইগুলো শেষ হয়ে গেছে, সেই সাথে তার মৃত্যুও সন্নিকটে। ধীরস্থিরভাবে মৃত্যুকে মেনে নেবার জন্য মানসিকভাবে তৈরিই ছিলেন। কিন্তু এরপরই দিলুমিয়া নামের স্থানীয় এক ছোকরা, যে কিনা মসজিদের পাশে নিমের মাজনসহ তসবিহ, টুপি, আতর বিক্রি করতো, সে তাকে প্রস্তাব দেয় ধর্মান্তরিত হবার জন্য আল্লাহর পাকিস্তানে মালাউনদের কোনো ঠাই নাই! ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে রমাকান্তকামর বেঁচে যাবেন। পাকবাহিনী তো সাচ্চা মুসলমান, তারা কি আরেক মুসলমানকে হত্যা করবে?

দিলুর এ কথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিলো মাস্টারের ঠোঁটে। পাকবাহিনী যে অকাতরে মুসলমানও হত্যা করে বেড়াচ্ছে সেটা কে না জানতত। তাদের কাছে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই ছিলো বাঙালি। তবে অস্বীকার করবার উপায় নেই, হিন্দুদের উপরে নির্যাতনের মাত্রাটা অনেক বেশি ছিলো।

দিলুমিয়া যখন জানায়, ধর্মান্তরিত না হলে মিলিটারিরা তাকে তো মেরে ফেলবেই, তার ঘরে আগুন দিয়ে ভিটায় ঘু ঘু চড়াবে। কথাটা শুনে তিনি আৎকে ওঠেন-তার ঘরে আছে সেই সব দুষ্প্রাপ্য বইপত্র! আর কোনো দ্বিধা

করে তিনি ধর্মান্তরিত হবার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

যুদ্ধশেষে অনেক বছর পর সুন্দরপুরে আবারো কালোছায়া নেমে আসে-কোলাবরেটর হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ এই এলাকার এমপি হয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী বদনাম ঘোচাতে স্কুলের নামকরন করতে চাইলো বাবার নামে, বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মাস্টার, তার সঙ্গে যোগ দিলো আরো অনেকে। কিন্তু এমপিকে থামানোর মতো শক্তি তাদের কারোর ছিলো

। মাস্টারের পুরনো অনেক ছাত্র সরকারী চাকরিতে বড়সর পদে অধিষ্ঠিত আছে, তাদের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী হামিদুল্লাহর নামে স্কুলের নামকরণের পায়তারা থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। এই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ এমপি মাস্টারের চাকরিটা খেয়েছিলো রিটায়ারমেন্টের অল্প কিছু দিন আগেই। এতেও ক্ষান্ত হয়নি আসাদুল্লাহ, লোক দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেছিলো, অনেক শাসিয়েছিলো কিন্তু তার চোখ রাঙানিকে একটুও পাত্তা দেননি রমাকান্তকামার।

স্মৃতি থেকে ফিরে এসে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো।

এই লোক আবার কেন তার কাছে আসছে!

৩০. রবীন্দ্রনাথে দ্বিতীয়বার প্রবেশ

অধ্যায় ৩০

ছফা যখন রবীন্দ্রনাথে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করলো তখন ভেতরটা বেশ নিরিবিলি-মাত্র দু-জন পাঠক বই পড়ছে। এর কারণ হয়তো একটু পরই লাইব্রেরিটা বন্ধ করে দেয়া হবে।

এমন পরিবেশ দেখে খুশিই হলো সে। ভালো করেই জানে, ভেতরের ছোট্ট একটা প্রাইভেট রুমে আছেন মাস্টার রমাকান্তকামার-আগে যেখানে মুশকান জুবেরি বসতো।

লাইব্রেরির ভেতরে ঢোকার সময় দু-জন মগ্ন পাঠকের কেউই মুখ তুলে তাকালো না, বইতে পুরোপুরি ডুবে আছে তারা। যতোটা সম্ভব কম আওয়াজ করে ধীরপদক্ষেপে লাইব্রেরির শেষ মাথায় ছোট্ট রুমটার দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। আল্‌তো করে টোকা দিলো দরজায়। পর পর দু-বার।

“দরজা খোলাই আছে।”

ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের কণ্ঠটা ভেসে এলো। ছফাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে মোটেও অবাক হলেন না প্রবীণ শিক্ষক।

“আদাব, স্যার,” ভেতরে ঢুকে বললো সে। “কেমন আছেন?”

“ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলেন মাস্টার।

স্বল্প পরিসরের ঘরটায় একমাত্র টেবিলের ওপাশে বসে আছেন তিনি। টেবিলের সামনে মাত্র দুটো চেয়ার। দড়ি দিয়ে বাধা কিছু বইয়ের স্তূপ আছে ঘরে, আর দেয়ালে তিনটি সাদা-কালো ছবি টাঙানো।

খালি চেয়ারটায় বসে পড়লো ছফা। “এরা কারা?” দেয়ালের ছবিগুলো দেখিয়ে জানতে চাইলো সে।

“ত্রিলোকনাথ বসু, অলোকনাথ বসু আর রাশেদ জুবেরি,” বললেন মাস্টার। “এই লাইব্রেরির পেছনে তাদের অবদানই বেশি।”

“তাহলে তো আরেকজনের ছবি থাকার কথা ছিলো এখানে!”

মাস্টার স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন।

“নতুন করে এই লাইব্রেরিটা দেবার পেছনে মুশকান জুবেরির অবদানই সবচেয়ে বেশি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি কী জন্যে এসেছেন সেটা বলেন।”

“বলছি বলছি,” মুচকি হেসে বললো ছফা। “আমি আগে ভাবতাম আপনি সত্য কথা বলেন সব সময়। অন্তত সুন্দরপুরের মানুষ তা-ই ভাবে-রমাকান্তকামার কখনও মিথ্যে বলেন না।” একটু থেমে আবার বললো, “সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!”

মাস্টার এবারও নির্বিকার রইলেন।

“কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো আপনিও মিথ্যে বলেন!”

“ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলুন, কী জানতে এসেছেন?” রমাকান্তকামারের কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে গেছে।

কয়েক মুহূর্ত মাস্টারের দিকে চেয়ে থেকে বললো ছফা, “আপনি যে মোবাইলফোন ব্যবহার করেন সেটা আমাকে বলেননি।”

“আমি তো অনেক কিছুই ব্যবহার করি…” গম্ভীর মুখে বললেন মাস্টার। “…তার সবই কি আপনাকে বলেছি? আর আপনিও কি আমার কাছ থেকে সব কিছু জানতে চেয়েছেন?”

“সব কিছু না হোক, ফোনের কথা বলেছিলাম আপনাকে…গতকালই।”

“আমি আপনাকে স্কুলের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম।”

“তা ঠিক। কিন্তু মোবাইলফোনটার নাম্বার দেননি।”

“আপনি সেটা চানওনি,” চট করে জবাব দিলেন মাস্টার।

মুচকি হাসলো ছফা। “তা চাইনি। তবে আজকাল নিজের ফোন মানে কিন্তু মোবাইলফোনই বোঝায়। সেটা কারো কাছে গোপন করার মানে বিশেষ কোনো কারণ আছে!”

ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন মাস্টার। “বিশেষ কারণ তো আছেই।”

“সেটা কী, জানতে পারি?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “আপনার কাছে কৈফিয়ত দেবার কোনো দরকার নেই আমার, তারপরও বলছি। ধরে নিন আপনার সন্দেহগ্রস্ত মনটাকে শান্ত করার জন্যই বলা, একটু থেমে আবার বললেন, “যে জিনিস আমি সব সময় ব্যবহার করি না, খুব দরকার পড়লে ব্যবহার করি, সেটার নাম্বার সবাইকে কেন দেবো?”

“বিশেষ কারোর সাথে যোগাযোগ করার দরকার পড়লেই ব্যবহার করেন?”

ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও মাস্টার মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “হ্যাঁ।”

“সেই বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে কি মুশকান জুবেরিও আছে?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে মাস্টারের দিকে দৃষ্টি বিদ্ধ করে রাখলো, কিন্তু লোকটার অভিব্যক্তি হতাশ করলো তাকে।

মাস্টার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন। “ভদ্রমহিলার সাথে আমার কোনো ধরণের যোগাযোগ নেই-এ কথা সেদিনও বলেছি, আজকেও বলছি। চাইলে আপনি এটা খতিয়ে দেখতে পারেন।”

“তা আমি দেখবো। আপনার মতো যুধিষ্ঠির তো নই…ডিবির সামান্য একজন ইনভেস্টিগেটর। সন্দেহবাতিকতা আমার যোগ্যতারই অংশ। ওটা না থাকলে আমিও সুন্দরপুরবাসিদের মতো যাকে তাকে দেবতাজ্ঞান করে বসে থাকতাম!”

মাস্টারের মুখ পাথরে খোদাই করা গ্রিক দেবতাদের মতো হয়ে গেলো।

“ঐ মহিলা যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তার কিন্তু শক্ত প্রমাণ আছে আমার কাছে।”

ছফার প্রশ্নটা শুনে মাস্টার একটুও অবাক হলেন না। সেটা যে কী তা আমি জানি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “আমার ঘরে চোর পাঠিয়ে তল্লাশি করিয়েছে কেউ, কিছু জিনিস নিয়েও গিয়েছিলো, আবার ফেরত দিয়ে গেছে।”

একটু হেসে বললো সে, “চোর না বলে আপনার বলা উচিত অনুসন্ধানকারী।”

“বলতাম, যদি সে সত্যি সত্যি চোর না হতো!”

অবাক হলো ছফা-ভদ্রলোক কী করে এটা বুঝলেন? যাই হোক, সিদ্ধান্ত নিলো সরাসরিই বলবে এখন, ঘোরপ্যাঁচের আর দরকার নেই।

“মুশকান জুবেরির চিঠি পেয়েছিলেন আপনি, আর সেটা বেমালুম অস্বীকার করেছেন আমার কাছে।”

“ওটা চিঠি না…চিরকুট,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। “চিঠি আর চিরকুটের মধ্যে পার্থক্য আছে।”

বাঁকাহাসি দিলো নুরে ছফা। “কোনটা চিঠি আর কোনটা চিরকুট সেটা যদি একটু বলতেন উপকৃত হতাম।”

নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন মাস্টার, “চিঠিতে প্রেরকের নাম লেখা থাকে…ডাকের মাধ্যমে আসে ওটা। আর চিরকুট লোকমারফত দেয়া হয়।

অনেক সময় নাম-ধামেরও বালাই থাকে না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “ধন্যবাদ। অনেক কিছু শিখলাম,” একটু থেমে আবার বললো, “তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, মুশকান জুবেরি আপনাকে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলো।”

“উনি পাঠিয়েছিলেন কিনা বলতে পারবো না।”

নুরে ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো। “আপনি বলতে চাইছেন, ওটা কে পাঠিয়েছিলো সে-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন?”

“চিরকুটে উনার নাম লেখা ছিলো না, আর ভদ্রমহিলার হাতের লেখার সাথেও আমি পরিচিত নই, নিশ্চিত হবে কী করে?”

“ফেরারি আসামি হিসেবে নিজের নাম না লেখাটাই তো স্বাভাবিক।”

মাস্টার নির্বিকার রইলেন, কিছুই বললেন না।

“তবে আমি নিশ্চিত, ওটা কোনো মহিলার হাতের লেখাই। নারী পুরুষের হাতেরলেখা দেখলেই আমি চিনতে পারি। আপনি এটাকে আমার আরেকটি গুণ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। শুধু সন্দেহবাতিকতা দিয়ে তো ইনভেস্টিগেশনের কাজ চালানো যায় না,” বাঁকা হাসি দিয়ে আবার বললো সে, “চিরকুটের কথাগুলো পড়লে দুধের বাচ্চাও বলে দেবে ওটা মুশকান জুবেরিই পাঠিয়েছে।”

মাস্টার এ কথারও কোনো জবাব দিলেন না।

“এখন বলুন, চিরকুটটা আপনাকে কে দিলো?”

আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাস্টার। “এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কি আমি বাধ্য?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “অবশ্যই আপনি বাধ্য। কারণ যে জানতে চাচ্ছে সে যদুমধুকদুজাতীয় কেউ নয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন তদন্তকারী কর্মকতা…বেশ কয়েকজন মানুষের নিখোঁজ এবং সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডের কেস তদন্ত করছে। আপনার উচিত তাকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করা। অবশ্য, আপনি যদি কোনো ক্রিমিনালকে রক্ষা করার পণ না করে থাকেন তো।”

রমাকান্তকামার খোঁচাটা হজম করে নিলেন নির্বিকার থেকেই। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, “ট্রাস্টের ল-ইয়ার ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার। উনিই চিরকুটটা দিয়েছিলেন আমাকে ট্রাস্টের কাগজপত্রের সাথে।”

অবাক হলো নুরে ছফা। তার উচিত ছিলো ট্রাস্টের ল-ইয়ার কে সেটা খতিয়ে দেখা, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা কিন্তু সে তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলো ডাক্তার আসকারের উপরে।

“উনাকে আপনি আগে থেকে চিনতেন?”

“চেনার প্রশ্নই ওঠে না। ঐ মহিলা এখান থেকে চলে যাবার কিছু দিন পর এই ভদ্রলোক ডাকযোগে আমাকে সব কিছু জানান। ট্রাস্টের কিছু কাগজপত্রের সাথে তখন চিরকুটটাও দিয়েছিলেন।”

মাথা দোলালো নুরে ছফা। অবশেষে একটা সূত্র তাহলে পেলো। এই সুন্দরপুর থেকে! যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইক্যাই উঠতে হইবো-কেএস খানের আপ্তবাক্যটি তার মাথার ভেতরে অনুরণিত হলো আবার। এই ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের সাথে মুশকান নিশ্চয় যোগাযোগ রাখে! হয়তো সে-ই তাকে নিয়োগ দিয়েছে।

হঠাৎ কিছু একটা টের পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। দেখতে পেলো তিন-চারজন যুবক ঘরে প্রবেশ করেছে। তাদের সবার চোখমুখ বেশ

.

অধ্যায় ৩১

সুন্দরপুরের নতুন এমপি জোনায়েদ রহমানের পৈতৃক বাড়িটি বেশ ছিমছাম আর বিশাল। মূল বাড়িটি কাঠের তৈরি, এখনও ভিটেয় পাকা দালান ওঠেনি।

ছফা অবাকই হলো। এই দেশে এমপি হবার সাথে সাথে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে ওঠে আর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বাড়িঘর!

এমপির বাড়ির বিশাল উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে ছফা। তার সামনে আরেকটা খালি চেয়ার আছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এমপি এখানে এসে বসবেন। ছফাকে যে চারজন যুবক নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যজন গেছে বাড়ির ভেতরে। ইচ্ছে করেই এইসব চ্যাংড়াদের কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করেনি সে। এরা এমপির চ্যালাচামুণ্ডা। নেতার পেছনে ঘুরে গর্ব বোধ করে। এককালে জমিদার, জোতদার, তালুকদার আর গ্রাম্য মোড়লেরা লাঠিয়াল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, এখনকার দিনে নেতারা এরকম যুবকদেরকে সে-কাজে ব্যবহার করে। পিএসের ক্ষমতা বরং ওদের নেতাকে দেখানোই বেশি ভালো হবে।

ঘৃণাভরে মাটিতে থুতু ফেললো ছফা। তাকে এ কাজ করতে দেখে চোখমুখ আরো শক্ত করে ফেললো এমপির ছেলেগুলো। এমন সময় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা এক তরুণ বের হয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে, তার সঙ্গে এই যুবকদের একজন। ছফা বুঝতে পারলো, এই তরুণই নতুন এমপি জোনায়েদ রহমান। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে সালাম দেয়া সরকারী কর্মকতা ছফার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু সেটা করলো না সে। ব্যাপারটা যেমন তরুণ এমপির চোখ এড়ালো না, তেমনি এড়ালো না তার সাঙ্গপাঙ্গদেরও।

এমপির চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মুহূর্তে। ছফার সামনে চেয়ারে বসে পড়লো সে। “আপনি একজন ডিবি অফিসার?” শান্তকণ্ঠেই জানতে চাইলো।

“হ্যাঁ।” ইচ্ছে করেই ‘স্যার’ সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকলো।

“সুন্দরপুরে কী কাজে এসেছেন?”

“একটা কেস ইনভেস্টিগেট করতে।”

“কোন্ কেস?”

“কিছু মানুষের নিখোঁজ হবার কেস তদন্ত করছি আমি। আর ঐ মুশকান জুবেরি সেই কেসের প্রাইম সাসপেক্ট।”

“বুঝলাম, কিন্তু আপনি মাস্টারসাহেবের পেছনে লেগেছেন কেন?”

“আমি উনার পেছনে লাগিনি, শুধুমাত্র একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তা ও খুবই ভদ্রভাবে।”

“এই কেসে উনাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন?” ভুরু কুঁচকে ফেললো এমপি।

“কারণ উনার সাথে ঐ মহিলার যোগাযোগ আছে।”

অবিশ্বাসে মাথা দোলালো জোনায়েদ রহমান। “এটা সুন্দরপুরের কেউ বিশ্বাস করবে?” নিজের চ্যালাদের দিকে তাকালো সে। “মাস্টারসাহেব ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ রাখতে যাবেন কেন? আশ্চর্য!”

“কেন রাখবেন সেটা মাস্টারসাহেবই ভালো জানেন। আমি শুধু সেই কারণটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”

এমপি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “মহিলা এখান থেকে চলে যাবার পর দেখা গেলো, জমিদার বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দিয়ে গেছে তার প্রয়াত স্বামী রাশেদ জুবেরি। তিনিই মাস্টারসাহেবকে সেই ট্রাস্টের ট্রাস্টি করেছেন। এখানে ঐ মহিলার কোনো অবদান নেই।”

মুচকি হাসলো ছফা। পলিটিশিয়ানদের কথার মারপ্যাঁচ তার ভালো করেই জানা আছে। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে পালিয়েছে না বলে এমপি বলছে, সে চলে গেছে-এটাই প্রমাণ করে মহিলা এবং মাস্টারের ব্যাপারে তার পক্ষপাত।

“আপনি কি জানেন, আমিও সেই ট্রাস্টের একজন মেম্বার?” এমপি বললো।

“কিন্তু আপনার সাথে সম্ভবত ঐ মহিলা যোগাযোগ রাখেন না।”

ছফার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো তরুণ এমপি।

“শুনুন,” শীতল কণ্ঠে বললো নুরে ছফা। “আমি একটা কেস তদন্ত করছি, দরকার পড়লে যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি। আপনি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার কাজে বাধা দিতে পারেন না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে।”

“আমি বাধা দিলাম কোথায়?” অবাক হবার ভান করলো জোনায়েদ রহমান।

“এই যে, মাস্টারের ওখান থেকে এইসব ছেলেপেলেদের দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন…এটাকে আপনি কী বলবেন?”

এমপি হেসে ফেললো। “এটাকে তদন্ত কাজের বাধা হিসেবে দেখছেন আপনি? আশ্চর্য!” কাঁধ তুললো জোনায়েদ রহমান। “যাই হোক, আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন, আমার কিছু করার নেই। আমি শুধু আপনাকে একটা কথা পরিস্কার বলে দেবার জন্য ডেকে নিয়ে এসেছি-মাস্টারসাহেবকে কোনো রকম ডিস্টার্ব করবেন না।” শেষ কথাটা তর্জনি উঁচিয়ে, একেবারে রাজনৈতিক নেতাদের মতো করে বললো।

“ডিস্টার্ব বলতে কী বোঝাচ্ছেন?” শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো ছফা। এমপির হুমকিকে পাত্তাই দিলো না সে। “উনাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না আর?”

নিজের রাগ দমন করলেও বেশ ধমকের সাথে বললো সুন্দরপুরের এমপি, “ডিস্টার্ব বলতে, উনার বাসায় চোর-বাটপার পাঠিয়ে চুরি করাকে বুঝিয়েছি! এ কাজ করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

“আমি চুরি করিয়েছি কে বললো?” ছফা একটুও বিচলিত হলো না।

জোনায়েদ রহমানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। “যাকে দিয়ে চুরি করিয়েছেন সে তো নিজেই মাস্টারসাহেবের কাছে গিয়ে পা ধরে মাফ চেয়ে গেছে। এ-ও বলে গেছে, ঐ আতর হারামজাদা তাকে এ কাজ করতে বলেছিলো।”

ছফার কপালে হালকা ভাঁজ পড়লো।

“ভাই, এই লোক তো ঐ ইতরের মোটরসাইকেলে কইরা ঘুইর‍্যা বেড়ায়, যুবকদের একজন বলে উঠলো।

“ইতরটা এখন জাতে উঠে গেছে, নিজে আর এ কাজ করে না,” বললো এমপি। “আপনি আতরকে বলেছেন মাস্টারসাহেবের বাড়িতে চুরি করার জন্য, সে নিজে না করে ঐ ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে।”

ছফা বুঝতে পারলো, বল্টু নামের ছেলেটা চুরির কথা স্বীকার করে ফেলেছে। এখন এটা অস্বীকার করলে খামোখাই আতরের উপরে নির্যাতন নেমে আসবে। ইনফর্মারকে আগেই বলেছিলো যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ না করাতে।

“আপনি চাইলে আমি সেই চোরকেও হাজির করতে পারি।” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে বললো এমপি।

“শুনুন,” গভীর করে দম নিয়ে বললো ছফা। “তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশকে অনেক কিছুই করতে হয়, আমিও তাই করেছি। এরজন্যে কারোর কাছে জবাবদিহি করার দরকার দেখছি না। তবে আপনাকে শুধু এটুকু বলবো, আপনি যে দলের এমপি, সেই দলের অনেক উপরের দিকের একজন এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী। এখানে উনার স্বার্থ জড়িত। আপনি যদি এই তদন্তে কোনো রকম নাক গলান তাহলে আমি বাধ্য হবো তাকে সব কিছু জানাতে।”

কথাটা যেনো এমপিসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের গায়ে জ্বলুনি ধরিয়ে দিলো। ছেলেদের মধ্যে একজন তেড়ে এসে কিছু বলতে যাবে অমনি হাত তুলে থামিয়ে দিলো জোনায়েদ রহমান। “আপনি কার কথা বলছেন?” নিজের রাগ দমন করে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।

“আপনার সাথে ফোনে আলাপ করিয়ে দেবো?” ছফা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো।

এমপির ভুরু কুঁচকে গেলো। “ঠিক আছে, ফোন দিন।”

ছফা পকেট থেকে ফোনটা বের করে পিএসের নাম্বারে ডায়াল করলো। তিনবার রিং হবার পর কলটা ধরলো আশেক মাহমুদ। নীচুকণ্ঠে পিএসকে জানালো সুন্দরপুরের এমপি তার কেসে ইন্টারফেয়ার করছে, রীতিমতো নিজের লোকজন দিয়ে তার বাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছে।

এমপির দিকে তাকালো ছফা। তরুণ এমপি রেগেমেগে চেয়ে আছে তার দিকে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ শুনে গেলো। “উনাকে বলে দিন, আমার কেসের ব্যাপারে যেনো নাক না গলায়,” কথাটা বলে জোনায়েদ রহমানের দিকে তাকালো, তারপর ফোনটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। “নিন…উনার সাথে কথা বলুন।”

জোনায়েদ রহমান দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে চেপে ধরলো। “সুন্দরপুরের এমপি জোনায়েদ রহমান বলছি। আপনি কে বলছেন?” ওপাশ থেকে আশেক মাহমুদের পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হলো এমপি। এরকম কাউকে যে আশা করেনি বোঝাই যাচ্ছে।

তার মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি।

“স্লামালেকুম, ভাই…ভালো আছেন?” ছফার দিকে তাকালো চকিতে। “জি, ভাই…আমিও ভালো আছি।” তারপর ঘিরে থাকা ছেলেগুলোকে এক হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইশারা করলো, মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো ফোনের ওপাশের কথা।

এমপির ছেলেগুলো অবাক হলেও চুপচাপ চলে গেলো উঠোন ছেড়ে। তারাও ভড়কে গেছে কিছুটা।

“ভাই…বুঝতে পেরেছি, কিন্তু মাস্টারসাহেব এই অঞ্চলের সম্মানিত একজন মানুষ…সবাই উনাকে”।

ছফা বুঝতে পারলে, এমপির কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কথা বলছে আশেক মাহমুদ। অনেকক্ষণ ফোনের ওপাশের কথা শুনে গেলো জোনায়েদ রহমান।

“জি, ভাই…ঠিক আছে…” মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হুম, বুঝতে পেরেছি…স্লামালেকুম, ভাই।” ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছফার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো সুন্দরপুরের নতুন এমপি। “আশেকভাইয়ের সাথে এই কেসের সম্পর্ক কী?”

উঠে দাঁড়ালো ছফা। হাত বাড়ালো ফোনটা নেবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোনটা দিয়ে দিলো এমপি।

“এসব আপনার জানার দরকার নেই।” ফোনটা পকেটে ভরে নিলো সে। “আপাতত মাস্টারের সাথে আমার কাজ শেষ। ভদ্রলোক আমার কাছে স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি কবে কিভাবে উনার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। উনার কোনো দরকারই ছিলো না আপনাকে এসব জানানোর।”

হতভম্ব এমপি চেয়ে রইলো ছফার দিকে।

“আতর আলী আর তার ঐ ছেলেটা,” শান্তকণ্ঠে বললো নুরে ছফা। “তারা আমার হয়ে কাজ করেছে…তাদেরকে কিছু করবেন না, ঠিক আছে?”

জোনায়েদ রহমান হ্যাঁ না কিছুই বললো না। চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে রইলো।

তাকে একা রেখে চলে গেলো ছফা। এখানে আর কোনো কাজ নেই। সুন্দরপুরের পাট চুকে গেছে আপাতত।

.

অধ্যায় ৩২

রমাকান্তকামার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এলেন।

একটু আগে তার স্নেহধন্য ছাত্র জোনায়েদ লোকমারফত তার কাছে খবর পাঠিয়েছে, ঐ নুরে ছফার পেছনে নাকি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মতো ক্ষমতাবান একজন মানুষ। তিনি যেনো ঘুণাক্ষরেও সন্দেহভাজন কারোর সাথে যোগাযোগ না করেন। এসব থেকে তার দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো হবে।

অলোকনাথের নাতবৌ তিন বছর আগে তার কাছে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলো ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের মাধ্যমে-সে কথা ডিবি অফিসারকে বলা উচিত হয়েছে কিনা বুঝতে পারছেন না এখন। এরকম সততা না দেখালে কী এমন ক্ষতি ছিলো? যুধিষ্ঠিরও প্রয়োজনে মিথ্যে বলেছিলেন তিনি কি বলতে পারতেন না? তার তো মিথ্যে বলারও দরকার ছিলো না। স্রেফ বলে দিলেই পারতেন, কে পাঠিয়েছিলো সেটা তার মনে নেই। তিন বছর আগে কে একটা চিরকুট পাঠিয়েছে সেটা তার মতো বয়স্ক মানুষের স্মরণে না থাকারই কথা। তার চেয়েও ভালো হতো, চিরকুটটা নষ্ট করে ফেললে।

উকিল ভদ্রলোককে পুরো বিষয়টা জানিয়ে সতর্ক করার দরকার কিন্তু জোনায়েদের সতর্কবাণীর কারণে সে কাজও করতে পারছেন না। ডিবি অফিসার কিছুক্ষণ আগেই সুন্দরপুর ছেড়ে চলে গেছে, তার পরবর্তী টার্গেট যে উকিল হবে তাতে কোনো সংশয় নেই।

ডাক্তার আসকারের সাথে যে তার যোগাযোগ হয় মাঝেমধ্যে সেটাও ছফা বের করে ফেলবে খুব দ্রুত। আজকাল মোবাইলফোন হয়ে উঠেছে খুবই দরকারি আর ক্ষতিকর একটি জিনিস। এটা না থাকলে চলে না, আবার এটাই হয়ে উঠেছে সব নষ্টের মূল।

অবশ্য ডাক্তারকে তিনি ট্রাস্টের সদস্য করেননি, করার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলোকের সাথে তার পরিচয়ও ছিলো না। তিনি জানতেন না, লোকটার সাথে রাশেদের স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো। ভদ্রমহিলা যখন সুন্দরপুরে ছিলো তখন নাকি মাঝেমধ্যে এখানে আসতেন-এ কথা তিনি জেনেছেন অনেক পরে।

ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন অবশ্য দাবি করেছে, রাশেদ জুবেরি নিজেই নাকি তাকে সদস্য করার কথা বলে গেছিলেন। অন্যদিকে, ভদ্রলোককে ট্রাস্টের সদস্য করায় বেশ উপকারও হয়েছে। প্রখ্যাত চিকিৎসক তিনি, তার সামাজিক অবস্থান আর উঁচুমহলে ভালো যোগাযোগ ট্রাস্টের বেশ কাজে লেগেছে। যখনই দরকার পড়েছে ভদ্রলোক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন কি বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি সাহায্য করেছেন। মাস্টারের সাথে খুব অল্প ক-দিনেই তার সাথে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তার ফোনে যে কয়জনের নাম্বার আছে, তার মধ্যে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ অন্যতম। তাকে কি ফোন করে সব কিছু বলা দরকার?

রমাকান্তকামার এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। তার ধারণা, ডাক্তারের সাথে রাশেদের স্ত্রীর যোগাযোগ আছে।

মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন।

আরেকটা বিষয় তার মাথায় ঢুকছে না-প্রধানমন্ত্রীর পিএস কেন মুশকান জুবেরির কেসে আগ্রহী? ভদ্রলোকের সাথে এসবের কী সম্পর্ক?

এর আগে সুন্দরপুরের অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন, প্রয়াত এমপি আসাদুল্লাহই ছফাকে লেলিয়ে দিয়েছিলো মহিলার পেছনেতার উদ্দেশ্য ছিলো, অলোকনাথের সমস্ত সম্পত্তি করায়ত্ত করা। কিন্তু সুদূর ঢাকা থেকে এরকম ক্ষমতাবান একজন মানুষ কেন ঐ ভদ্রমহিলার পেছনে লাগবে? তার উদ্দেশ্যটাই বা কী?

কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না রমাকান্তকামারের।

.

অধ্যায় ৩৩

ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত আছে। এই পেশায় সুনাম-দুনাম দুটোই সমানভাবে হাত ধরাধরি করে চলে। উকিলদের দুর্নাম থাকবে না তা কি হয়-ময়েজ উদ্দিন ওসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না। পেশাদার আইনজীবি হিসেবে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ সে। ঢাকা ক্লাবের মতো বনেদী জায়গায় সুযোগ না পেলেও সদ্য গজে ওঠা উত্তরা ক্লাবে ঠিকই ঠাই করে নিতে পেরেছে।

তার গ্রামের ক-জন আসতে পেরেছে এমন অবস্থানে? ঝালকাঠি নামের এক জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের কৃষকের ছেলে হিসেবে তার পক্ষে বড়জোর সারের ডিলার হওয়া ছাড়া আর কিছু হবার সুযোগ ছিলো না। তার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে তাকে বাদ দিলে, ঐ সারের ডিলারই সবচেয়ে ভালো পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়।

আদালতে গিয়ে কালো কোট পরে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার যে পরিচিত দৃশ্যটি দেখা যায় নাটক-সিনেমায়, সেরকম কোনো আইনজীবি ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার নয়। তার কাজকারবার সব কাগজে কলমে। অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার সে, পাশাপাশি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল পেপারওয়ার্কের কাজ করে থাকে। যে কোনো ব্যবসায়িক দলিল-চুক্তি আর বেচাকেনার কাজগুলো ক্লায়েন্টের স্বার্থে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। আর বলাই বাহুল্য, ক্লায়েন্টের হয়ে এরকম কাজ করতে গেলে প্রায়শই অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। এসব নিয়েও ময়েজ উদ্দিনের কোনো মাথাব্যথা নেই। নীতি-নৈতিকতা হলো অতি আদর্শবাদীদের মানসিক সমস্যা। ওই দলে সে পড়ে না। তবে এসব করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে যে পুলিশি ঝামেলায়ও পড়তে হয় সেটাই একমাত্র বিড়ম্বনা। আইনের সমঝদার হিসেবে এসব ঝামেলা থেকে কিভাবে নিস্তার পাওয়া যায় তাও সে ভালো করেই জানে।

এ মুহূর্তে দুপুরে লাঞ্চ করে পুরানা পল্টনের চেম্বারে বসে আছে সে, তার সামনে বসে আছে ডিবির এক কর্মকতা। আইনজীবী হিসেবে এসব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে ময়েজ উদ্দিন ভয় পায় না কখনও। তাদের হম্বিতম্বিকে ঠাণ্ডা মাথায় দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয় খুব সহজেই। এখনও সেটাই করছে।

“আমি তো বললামই, মুশকান জুবেরি নামের কাউকে চিনি না,” কথাটা বেশ জোর দিয়ে কিন্তু ধীরস্থিরভাবে বললো উকিল ভদ্রলোক। “আপনি আমার কাছে কেন এই মহিলা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।”

বাঁকাহাসি দিলো নুরে ছফা।

“আপনি তো এটাও বলছেন না, মহিলা করেছেটা কি?” যেনো নিদোষভাবেই জানতে চাইলো উকিল।

“মুশকান জুবেরি বেশ কয়েকজন মানুষ হত্যা এবং গুমের সন্দেহভাজন আসামি।”

আইনজীবী ভুরু কপালে তুলে ছফার কথাটা পুণরুক্তি করলো, “সন্দেহভাজন আসামি। আচ্ছা। মহিলা কেন ঐসব লোকজনকে গুম করলো? মানে, তার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো?”

বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “এটা আপনার না জানলেও চলবে।”

কাঁধ তুললো ভদ্রলোক। “তা ঠিক। এসব আমার জানার দরকার নেই।” একটু থেমে আবার বললো, “যাই হোক, আমার ক্লায়েন্টের সাথে এই মুশকান জুবেরি নামের সন্দেহভাজনের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিলো, তবে যে-সব লিগ্যাল পেপারওয়ার্ক করেছি ট্রাস্টের ট্রাস্টি রমাকান্তকামারের হয়ে, তার সাথে এই মহিলার কোনো সম্পর্ক নেই।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছফা, তারপর পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিলো উকিলের দিকে। “এটা একটু দেখুন।”

ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট ওল্টালো। “এটা কি? কে লিখেছে…কাকে লিখেছে?”

হেসে ফেললো ছফা। “আপনার স্মৃতিশক্তি দেখি বেশ দুর্বল।”

“তা বলতে পারেন, বয়স তো কম হলো না। সামনের বছর ষাটে পা দেবো।” নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে সে।

মুচকি হাসলো ছফা। “রমাকান্তকামার আমার কাছে গতকালই স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এটা পাঠিয়েছিলো আপনার মাধ্যমে…তিন বছর আগে।”

“তিন বছর আগে?” অবাক হবার ভান করলো আইনজীবী। “বলেন কি! যে মহিলার সাথে জীবনে যোগাযোগ হয়নি, তার চিঠি আমি রমাকান্তবাবুকে দিয়েছি?”

চোয়াল শক্ত করে ফেললো ছফা। “এটা চিঠি না, চিরকুট। চিঠিতে প্রেরক আর প্রাপকের নাম লেখা থাকে, চিরকুটে থাকে না।”

ঠোঁট ওল্টালো উকিল। “চিঠি হোক আর চিরকুট, আমার আসলেই মনে পড়ছে না এটা আমি রমাকান্তকামারকে দিয়েছিলাম কিনা। তিন বছর আগের কথা…কতো কাগজপত্রই তো লেনদেন করতে হয় আমাকে, সব কি মনে রাখা সম্ভব?” একটু থেমে আবার বললো, “আমার ক্লায়েন্ট রমাকান্তবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে, উনি হয়তো গুলিয়ে ফেলেছেন। ভদ্রমহিলা তো খুব সহজেই বেনামে ডাকযোগে উনার কাছে এটা পাঠাতে পারতেন।”

ছফার ইচ্ছে করলো উকিলের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাছাড়া একজন আইনজীবীকে চড় মেরে খামোখা মামলা খাওয়ারও কোনো ইচ্ছে তার নেই। এরা পান থেকে চুন খসলেই মামলা ঠুকে দেয়।

“তা পারতেন, কিন্তু মহিলা সেটা করেনি, সে আপনাকেই বেশি বিশ্বস্ত মনে করেছে।”

দাঁত বের করে হাসলো আইনজীবী। “আমার পেশায় কিন্তু বিশ্বস্ততা বিশাল বড় একটি রেপুটেশন। অনেক সময় লেগে যায় এটা অর্জন করতে। কিন্তু যার সাথে আমার পরিচয় নেই তিনি কেন আমাকে বিশ্বাস করতে যাবেন?”

“তাহলে অস্বীকার করছেন, এটা মাস্টারকে দেননি আপনি?”

আবারো নিঃশব্দে হাসলো আইনজীবী। “বললাম না, মনে নেই। আন্দাজে কেন বলবো এটা আমি পাঠিয়েছি? আর অস্বীকারই বা করবো কেন! কতো চিঠিপত্র লেনদেন করতে হয় আমাকে…সব কি মনে থাকে?”

“শুনুন, আমি শুধু একটা তথ্য জানতে চাই,” ধীরকণ্ঠে বললো নুরে ছফা, “মুশকান জুবেরির সাথে আপনার কখন কোথায় যোগাযোগ হয়েছিলো-এখনও যোগাযোগ আছে কিনা। সে এখন কোথায় আছে।”

হেসে ফেললো উকিল, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জোর দিয়ে বললো, “তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আর ওই মহিলা আমার ক্লায়েন্টও না। এটা বিশ্বাস না করলে আপনার এই তদন্ত কানাগলিতে ঢুকে পড়বে।” এরপর আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিলো সে। “আমার ধারণা, আপনি এরইমধ্যে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছেন।”

গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। “আচ্ছা। তাহলে বলুন, কিভাবে রমাকান্তকামারের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হলেন আপনি? ভদ্রলোক বলেছেন, আপনি কাগজপত্র পাঠানোর আগে উনি আপনাকে চিনতেনই না।”

মাথা দোলালো আইনজীবী। “কথা সত্যি।”

“রমাকান্তকামারের সাথে কিভাবে কন্ট্যাক্ট হয়েছিলো আপনার? কে করিয়ে দিলো সেটা?”

মাথা দোলালো ময়েজ উদ্দিন। “এটা তো বলা যাবে না। কেউ যদি নিজের পরিচয় গোপন রেখে তৃতীয় পক্ষ হয়ে অন্য কারোর ক্লায়েন্ট হবার জন্য আমাকে অনুরোধ করে সেটা কিন্তু বেআইনী নয়। এরকমটা প্রায়ই হয়ে থাকে আমাদের পেশায়। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, মুশকান জুবেরি এ কাজ করেনি।”

ছফার ধৈর্যসীমা শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকলো। “মনে হচ্ছে ঐ মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন।”

এবার আইনজীবী ভদ্রলোকের কৃত্রিম হাসিহাসি ভাবটা উবে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আমি কিন্তু এটাকে হুমকি হিসেবে দেখবো। আপনি সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন আমাকে!”

“আমি হুমকি দিচ্ছি না…বলছি, ঐ মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন বলে মনে হচ্ছে,” শুধরে দিলো ছফা। “এটা আমার পারসেপশান।”

“আচ্ছা,” মাথা দোলালো উকিল। “তাহলে সম্ভবত আপনি এটাও আন্দাজ করতে পারছেন, কিভাবে কারা আমার ক্ষতি করতে পারে?”

“তা তো পারছিই।”

“কারা?”

“সেটা কিছুক্ষণ পরই টের পাবেন।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আইনজীবী। “কার কথা বলছেন? কাদের কথা বলছেন আপনি?”

“এমন একজন যার কথা আপনি কোনোভাবেই ফেলতে পারবেন না।”

“হা-হা-হা,” ময়েজ উদ্দিনের অট্টহাসিতে ছোট্ট চেম্বারটা ভরে গেলো। “অনেক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে সেই লোক?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে হেলান দিলো নুরে ছফা।

“আইনের দিক থেকে আমাকে ধরা, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো কিছু আপনার এবং আপনার ঐ ক্ষমতাধর মানুষটার কাছে নেই-এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।”

“তা মাথায় রাখছি, কিন্তু আপনাকেও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এই দেশে সব কিছু আইন মোতাবেক চলে না, একটু থেমে আবার বললো, “এটা আমার মতো আপনিও ভালো করেই জানেন ক্ষমতাবানেরা আইনের পরোয়া করে না।”

আইনজীবী ভদ্রলোকের কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো। “আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? যা বলার স্পষ্ট করে বলুন।”

“এই মুশকান জুবেরির একজন শিকার হলো প্রাইমিনিস্টারের পিএস আশেক মাহমুদের ভাগ্নে।”

কথাটা শুনে উকিল একটু অবাক হলো।

“তিনি এখন নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে একটা তথ্যই জানতে চাইছেন-মুশকান জুবেরি কোথায় আছে।”

ময়েজ উদ্দিন অপেক্ষা করলো আরো কিছু শোনার জন্য।

“আমি তাকে এই চিরকুটটা দেখিয়েছি…বলেছি, এটা আপনার মাধ্যমে রমাকান্তবাবুকে দিয়েছে ঐ মহিলা। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি যদি ভালোয় ভালোয় বলে দেন ঐ মহিলা এখন কোথায় আছে তাহলেই আপনার মঙ্গল। নইলে আপনার কাছ থেকে যেভাবেই হোক এটা বের করে নেবেন।”

“তাহলে উনি আপনাকে কেন পাঠিয়েছেন…নিজে ফোন করলেন না কেন? নাকি সরাসরি ফোন করে হুমকি দিতে ভয় পাচ্ছেন?”

মাথা দোলালো ছফা। উকিল সম্ভবত ভাবছে ক্ষমতাধর একজনের নাম ভাঙিয়ে সে ভয় দেখাচ্ছে তাকে। “উনি কিছু করার আগে আমি নিজে একবার চেষ্টা করে দেখতে এসেছি।”

“উনার হয়ে হুমকিটা দিতে?” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো উকিল।

“না। আপনার পাছা বাঁচাতে!”

ভদ্রলোকের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো আপত্তিকৰ শব্দটা শুনে। কোনো রকমে রাগ দমন করে বললো, “আমার পাছা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের পাছা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার আছে।” কথাটা বলে গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “আপনি যে আপনার কেসটা নিয়ে কিছুই করতে পারছেন না সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আপনার ঐ পিএস হয়তো অধৈর্য হয়ে আপনাকে খুব চাপের মধ্যে রেখেছে, এখন নিজের পাছা বাঁচাতে এসেছেন আমার কাছে অদ্ভুত এক আব্দার নিয়ে-রাশেদ জুবেরির স্ত্রীর হদিস জানতে চাইছেন!”

ছফার চোখমুখও শক্ত হয়ে গেলো, তারপরও উকিলকে অবাক করে দিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ঠিক বলেছেন, উনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বলতে পারেন, উনার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছে।”

দাঁত বের করে হাসলো উকিল। “এটাই স্বাভাবিক। তিন বছর ধরে একটা কেস সমাধান করতে পারছেন না, অধৈর্য হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।”

“শুনুন, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ক্ষমতাবান মানুষেরা তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান মানুষজনের সাথে ডিল করার সময় খুব বেশি ধৈর্য দেখান না।”

“এটাই স্বাভাবিক। আপনি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।”

মুচকি হেসে মাথা দোলালো নুরে ছফা। “শুধু আমার কথা না ভেবে নিজেকেও হিসেবের মধ্যে রাখবেন।”

“আপনি আবারো হুমকি দিচ্ছেন কিন্তু!” তেঁতে উঠলো ভদ্রলোক।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। “একটু ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাটা শুনুন, এই তদন্তের জন্য দরকার শুধু সামান্য একটি তথ্য। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়তো আপনি দেবেন কিন্তু অনেক জল ঘোলা করে।”

ছফার কথাটা শুনে চিন্তিত দেখালো আইনজীবীকে কিন্তু মেজাজের ঝাঁঝ একটুও কমালো না। “জল ঘোলা করতে কী বোঝাচ্ছেন? উনি কী করবেন, অ্যাঁ?”

“কী আর করবেন, সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে জেনে নেবেন মুশকান জুবেরি এখন কোথায় আছে।”

“আরে, বার বার এক কথা বলছেন কেন!” চটে গেলো উকিল। “বললাম না, ঐ মহিলার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই! জীবনে তার সাথে আমার কথাও হয়নি, দেখা হবার তো প্রশ্নই ওঠে না! আমি কিভাবে তার খোঁজ দেবো?!”

“তাহলে উনার চিরকুটটা রমাকান্তকামারকে দিলেন কিভাবে?”

উকিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আমি সেটা কাউকে বলতে বাধ্য নই। আপনার ঐ ক্ষমতাধর পিএস কী বাল ফেলবে ফেলুক!” ময়েজ উদ্দিন ক্ষেপে গেলো এবার। “উনাকে বলে দেবেন, এইসব মাস্তানি আর গুন্ডামি আমার সাথে যেনো করতে না আসে!”।

আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা দোলালো ছফা। তাহলে উনাকে বলে দেই, আমি ব্যর্থ…যা করার উনিই করুক।”

ছফার কণ্ঠের শীতলতা টের পেয়ে উকিল বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “কী করবে আপনার ঐ পিএস, অ্যাঁ? আমাকে তুলে নিয়ে যাবে?” চেঁচিয়ে উঠলো এবার। “গুম করবে?”

“সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

ভদ্রলোকের চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো, কপাল গেলো কুঁচকে। চট করে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। “গেট লস, ইউ স্কাউড্রেল!” রীতিমতো কাঁপতে লাগলো সে। “গুম-খুন করতে করতে সাহস অনেক বেড়ে গেছে, অ্যাঁ? দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে শালারা! যা খুশি তাই করবে?!”

ছফা নির্বিকার মুখে বসে রইলো চেয়ারে হেলান দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করলো লম্বা, পেটানো শরীরের একজন মানুষ। ছোটো করে ছাটা চুল, শ্যাম বর্ণের কঠিন মুখ। লোকটাকে ঢুকতে দেখে উকিল ভদ্রলোক ভড়কে গেলো।

.

অধ্যায় ৩৪

“কে আপনি?”

“চুপ!” উকিলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো এইমাত্র ঘরে প্রবেশ করা বলিষ্ঠ দেহের লোকটি। “কথা বললেই গুলি করে দেবো!” কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে আনলো সে, উকিলের মুখের কাছে অস্ত্রটা নেড়ে ইশারা করলো তাকে বসে পড়ার জন্য।

“আস্তে,” ছফা বললো সেই লোকের উদ্দেশ্যে। “সেফটি লক অফ আছে তো? গুলিটুলি না আবার বের হয়ে যায়!”

বলিষ্ঠ দেহের লোকটা পিস্তল নামিয়ে রাখলেও জায়গা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়ালো না।

“আপনি বসুন,” ছফা আদেশের সুরে বললো ময়েজ উদ্দিনকে।

চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বসে পড়লো উকিল, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“ও একা না, বাইরে আরো লোকজন আছে, একটা মাইক্রোবাসও আছে।”

ঢোঁক গিললো ভদ্রলোক।

“তবে আমি ঝামেলা করতে চাইছি না। আপনাকে তুলে নিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। পিএসকে আমি কথা দিয়েছি, আপনি যদি আমার সাথে কো-অপারেট করেন তাহলে এসবের কোনো দরকারই হবে না।”

ছফার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার। “ওটা যে মুশকান জুবেরির চিরকুট আমি জানতাম না…সত্যি বলছি,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বললো সে। “আমি শুধু কিছু কাগজপত্রের সাথে ওটা রমাকান্তবাবুকে দিয়েছিলাম।”

“চিরকুটটা আপনাকে কে দিতে বলেছিলো?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে উকিল বললো, “ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।”

তথ্যটা বিস্মিত করলো ছফাকে। মুশকানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ডাক্তারকে আগে থেকেই সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত ছিলো, কিন্তু প্রবীন এই ভদ্রলোককে মুশকান জুবেরি ব্যবহার করেছে, আদতে ডাক্তার আসকার এসব কর্মকাণ্ডের সাথে মোটেও জড়িত নন, মুশকানের কারণেই ভদ্রলোক আমেরিকায় পালিয়ে যান ঝামেলা থেকে বাঁচতে-কিছু দিন তার পেছনে সময় ব্যয় করার পর এমন ধারণাই পোষণ করতো ছফা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, লোকটার পেছনে আরো সময় এবং শ্রম ব্যয় করা উচিত ছিলো।

“উনি কেন আপনাকে দিয়ে এটা পাঠালেন?”

একটু ইতস্তত করলো উকিল। “উনিই আমাকে ট্রাস্টের ল-ইয়ার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।”

নুরে ছফা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এটা। পরক্ষণেই তার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো-ডাক্তার আসকার আমেরিকায় যাবার আগে না পরে এ কাজ করেছেন?

“চিরকুটটা উনি কবে দিয়েছিলেন আপনাকে?”

“অনেক দিন আগে, তিন বছর তো হবেই।”

“আমি সঠিক সময়টা জানতে চাইছি।”

“আমাকে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। ট্রাস্টের কাগজপত্র তৈরি করে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম রমাকান্তবাবুকে…ওটার রেকর্ড আছে।”

“তাহলে কাগজপত্র দেখে বলুন,” ছফা আদেশের সুরে বললো।

উকিল ভদ্রলোক প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে ডেস্কের ড্রয়ার ঘেটে অবশেষে একটা নথি বের করে আনলো। “এটা…”

উকিলের হাত থেকে নথিটা নিয়ে তারিখটা দেখে নিলো ছফা।

“চিরকুটটা পাঠিয়েছি এই তারিখে, তবে ওটা পেয়েছি আরো দু-দিন আগে।”

ছফা নড়েচড়ে বসলো। মুশকানের কেসের অনেক কিছুই তার মুখস্ত। সে ভালো করেই জানে, কবে কখন ডাক্তার দেশ ছেড়েছিলেন।

“এটা কিভাবে সম্ভব! ডাক্তার তো তার আগেই আমেরিকায় চলে গেছিলেন!” অনেকটা আপন মনেই বলে উঠলো সে।

“তা তো জানি না। উনি আমার চেম্বারে না এসে বাসায় গিয়ে চিরকুটটা দিয়েছিলেন। একটা মুখবন্ধ খামে ছিলো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। মুশকান জুবেরি নিজে এসে চিরকুট দেবার মতো কাঁচা কাজ করবে না। তাছাড়া আইনজীবীর সাথেও তার সম্ভবত কোনো রকম যোগাযোগ নেই–এসব কাজ ডাক্তার আসকারই করেছেন।

“ডাক্তার তাহলে ঢাকায়ই ছিলেন!” কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না। ভদ্রলোক যে আমেরিকায় চলে গেছেন এটা খতিয়ে দেখা দরকার ছিলো। সম্ভবত দেশের ভেতরেই কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন, তারপর হয়তো বিদেশে চলে যান। আবার এমনও হতে পারে, ডাক্তার বিদেশে গিয়ে কিছু দিন পর দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তততদিনে ছফা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিলো তার ব্যাপারে। ধরেই নিয়েছিলো, ভদ্রলোক সহসা দেশে ফিরে আসবেন না।

“উনি কোথায় ছিলেন না ছিলেন সেটা তো আমি জানি না,” উকিল এখন পরাভূত মানুষ, নিজ থেকেই বলতে লাগলো। আমি যা জানি তা-ই বললাম আপনাকে। এটাই সত্যি। বিশ্বাস করুন।”

“এরপর কি আপনার সাথে উনার আর যোগাযোগ হয়নি?”

“হয়েছে, তবে ফোনে।”

“কোত্থেকে ফোন করেছিলেন উনি?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।

একটু ইতস্তত করলো উকিল। “দেশের বাইরে থেকে।”

“কোন দেশ থেকে?”

“নাম্বার দেখে মনে হয়েছে আমেরিকা থেকেই কলটা করেছিলেন।”

ছফার সমস্ত উত্তেজনা দপ করে নিভে গেলো। কয়েক মুহূর্ত উকিলের দিকে চেয়ে থেকে বললো, “শেষ কবে যোগাযোগ হয়েছিলো উনার সাথে?”

“গত বছর।”

“ডাক্তার যে নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন…”

কথাটা শেষ করার আগেই ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার মাথা দুলিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলো। “এক বছর আগের ঘটনা, নাম্বারটা আর কললিস্টে নেই।”

একটু ভেবে নিলো ছফা। “উনি আপনাকে কী জন্যে ফোন দিতেন?”

“ট্রাস্টের কাজকর্ম ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, খোঁজখবর নিতেন আর কি।”

“উনি ট্রাস্ট নিয়ে এতো মাথা ঘামান কেন?”

প্রশ্নটা শুনে ময়েজ উদ্দিন একটু অবাক হলো যেনো। “ট্রাস্ট্রের একজন মেম্বার হিসেবে খোঁজখবর নেবেন না?”

ছফা চমকে গেলো। ডাক্তার আসকার ট্রাস্ট্রেরও সদস্য! এটা সে জানতো না। আসলে, রমাকান্তকামার ছাড়াও যে ট্রাস্টে আরো কয়েকজন সদস্য আছে সেটা নিয়ে কখনও আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। “উনাকে কি মাস্টার নিজে ট্রাস্টের মেম্বার করেছেন নাকি…?”

“এটা রাশেদ জুবেরির ইচ্ছেতে হয়েছে। ডাক্তারের সাথে মি. জুবেরির ঘনিষ্ঠতা ছিলো।”

“হুম…বুঝতে পেরেছি,” শুধু এটুকুই বললো ছফা। মাস্টার তাকে এটা বলেননি। সেজন্যে ভদ্রলোককে দোষও দেয়া যায় না। দরকারের বাইরে আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু বলার মতো লোক নন তিনি।

“দেখুন, আমি যা জানতাম বলে দিয়েছি, এর বেশি কিছু জানি না,” উকিল ভদ্রলোক বললো। “এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা, তারপর পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন চেহারার লোকটার দিকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে গেলো ময়েজ উদ্দিনের দিকে।

“কী হচ্ছে! কী হচ্ছে!” একদম ভড়কে গিয়ে বলে উঠলো উকিল, নিজের চেয়ারে সেঁটে থাকার চেষ্টা করলো। “আমি সত্যিই বলেছি…বিশ্বাস করুন!”

জাঁদরেল চেহারার লোকটি উকিলের কলার ধরলো আস্তে করে।

ময়েজ উদ্দিন সাহায্যের আশায় তাকালো ছফার দিকে। “আ-আপনি আমাকে বলেছিলেন সত্যিটা বললে আমার কোনো ক্ষতি করবেন না…আমি কিন্তু সব সত্যি বলেছি!”

“হুম, তা বলেছিলাম,” বললো ছফা। “কিন্তু সত্যি বলেছেন নাকি মিথ্যে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে আমাকে।”

উকিলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “খতিয়ে দেখবেন মানে?” একটা ঢোঁক গিলে আবার বললো, “কিভাবে?”

এবার মুচকি হাসি দিলো ছফা। “ভয়ের কিছু নেই। আপনি আপনার ফোনটা ওকে দিয়ে দিন।” পিস্তল হাতে লোকটাকে দেখিয়ে বললো সে। “ডেস্ক ড্রয়ার আর ক্যাবিনেটের চাবিটাও।”

উকিল ভদ্রলোক স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু অস্ত্রধারী অপেক্ষা করলো না, ময়েজ উদ্দিনের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলফোনটা বের করে আনলো, তারপর আইনজীবীর কাঁধে টোকা দিয়ে চাবিগুলো চাইলো সে।

মন্ত্ৰতাড়িতের মতো ময়েজ উদ্দিন ডেস্কের উপরের দিকে একটা ড্রয়ার থেকে চাবির গোছাটা বের করে দিয়ে দিলো লোকটাকে।

নুরে ছফা ষণ্ডাটার কাছ থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে নিলো। “তুমি সবগুলো ড্রয়ার চেক করে দেখো। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে।”

“জি, স্যার,” লোকটা বললো, তারপর উকিলের দিকে তাকালো। “চুপচাপ এখানেই বসে থাকুন। একদম শব্দ করবেন না।”

উকিলের ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করে দিলো ছফা। ওদিকে পিস্তল হাতে লোকটা উকিলের ফাইল কেবিনেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

“আপনি আমার কাগজপত্র এভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন না!” আহত কণ্ঠে বললো ময়েজ উদ্দিন। “অনেক জরুরী কাগজপত্র আছে…ক্লায়েন্টদের অনেক গোপনীয়-”।

ছফা শীতল চোখে তাকালে উকিল ভদ্রলোক কথার মাঝপথে থেমে গেলো, আবারও নিজের কাজে ফিরে গেলো সে।

কয়েক মুহূর্ত পর, আইনজীবী ভদ্রলোকের দিকে তাকালো নুরে ছফা। ফোন ঘাঁটতে গিয়ে সে দেখেছে, রুবিনা নামের একজনের সাথে ভদ্রলোকের প্রণয়ঘটিত অসংখ্য মেসেজ। এই সেলফোন জিনিসটা যে আজকাল মানুষের সবচাইতে বড় প্রাইভেসি স্টোররুম হয়ে উঠেছে সেটা তার মতো তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে ভালো আর কে জানে। কারোর ফোন মানেই অসংখ্য গোপনীয় কাজকারবারের ভাণ্ডার।

“আমার কথা আপনি বিশ্বাস করেননি!” আশাহত কণ্ঠে বললো উকিল।

“এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার না,” চোখ না তুলেই বললো ছফা। “এটা একেবারেই বিশুদ্ধ একটি তদন্তের বিষয়।”

“অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করাকে আপনি তদন্ত বলছেন?”

মুচকি হাসলো ছফা, তার চোখ এখনও ফোনের দিকে নিবদ্ধ। “তদন্ত করার সময় প্রাইভেসি লঙ্ঘন হলে কী হলো না এসব নিয়ে মাথা ঘামালে এগোনোই যায় না। তারপর মুখ তুলে আশ্বস্ত করে বললো, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, আমার কেসের সাথে সম্পর্ক নেই এরকম কোনো কিছু নিয়ে আগ্রহ দেখাবো না। সেটা কোনো পরনারীর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারই হোক কিংবা গোপন কোনো ক্লায়েন্টের কথাই হোক না কেন।”

উকিলের চেহারা আরক্তিম হয়ে গেলো কথাটা শুনে।

আবারও মনোযোগ দিয়ে কললিস্ট আর মেসেজ বক্স ঘাঁটতে লাগলো ছফা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ময়েজ উদ্দিনের ভেতর থেকে। “আপনি আমার ফোনটা রাখনু, মি. ছফা, কয়েক মুহূর্ত পর আস্তে করে বললো সে। “আর ওকেও থামতে বলুন,” ষণ্ডাটাকে ইঙ্গিত করলো এবার।

মুখ তুলে তাকালো ছফা। তার চোখেমুখে প্রশ্ন।

গভীর করে দম নিলো ভদ্রলোক। “এসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ডাক্তারের খোঁজ পাবেন না,” ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বললো উকিল। “ডাক্তার আসকার আমাকে না বললেও আমার ড্রাইভার জানে উনি কোথায় থাকেন।”

.

অধ্যায় ৩৫

ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের চেম্বার থেকে বের হয়েই প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদকে ফোন করেছিলো ছফা। উকিল ভদ্রলোক যে অবশেষে মুখ খুলেছে সেটা জানিয়ে দেয়া হয় তাকে।

তিন বছর আগে সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর মুশকান জুবেরি উঠেছিলো ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের ফ্ল্যাটে। তারপর একই ভবনে অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকা নিঃসঙ্গ এমপি আসাদুল্লাহকে হত্যা করার পর পর আত্মগোপনে চলে যায় সে। মহিলার সঙ্গে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদও লাপাত্তা হয়ে যান। সুতরাং মুশকানকে ধরতে হলে ডাক্তারকে কজায় নিতে হবে সবার আগে। ডাক্তারই জানেন মুশকান কোথায় আছে। তাই ছফা এখন পিএসের ব্যক্তিগত গানম্যান আসলামকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বনানীতে।

ময়েজ উদ্দিনকে যতোটা ভয় দেখানোর দরকার ছিলো ততোটাই করেছে। একটুও বাড়াবাড়ি করেনি। তা করার অবশ্য দরকারও ছিলো না। তার মেদহীন পেটানো শরীর আর জাঁদরেল চেহারাটাই যথেষ্ট ছিলো। পিস্তল হাতে অমন কঠিন মুখের কাউকে দেখলে ভয় পাবারই কথা। তার আরেকটি গুণ হলো, দরকার না পড়লে সে খুব একটা কথা বলে না। বাড়তি কোনো প্রশ্নও করে না।

এতো দিন ছফা জানতো, ডাক্তার আমেরিকায় চলে গেছেন, কিন্তু ট্রাস্টের উকিল তাকে জানিয়েছে, ভদ্রলোক আমেরিকায় গেলেও মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। আর ঢাকায় কোথায় থাকেন সেটাও উকিলের জানা আছে!

এখন দরকার আসকার ইবনে সায়িদকে নিজের কজায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার। স্বনামখ্যাত ডাক্তার হিসেবে তার সাথে রয়েছে সমাজের উঁচু মহলে ভালো যোগাযোগ। পিএস যেনো ছফাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন-এমন অনুরোধের কথা শুনে আশেক মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছে, এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রশাসন কিংবা বড় কোনো রাজনৈতিক নেতা তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এগুলো সামাল দেবার ক্ষমতা তার রয়েছে।

যে গাড়িটা আসলাম চালাচ্ছে সেটা পিএসের দুটো সরকারী গাড়ির একটি-পথে কোনো রকম ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে যেনো পড়তে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা-আশেক মাহমুদ যেচে এই গাড়িটা আর নিজের গানম্যান আসলামকে দিয়েছে তাকে। আরো বলে দিয়েছে, লোকবলের দরকার পড়লে ছফা যেনো কোনো রকম সঙ্কোচ না করে। অবশ্য এ মুহূর্তে সেটার কোনো দরকারও দেখছে না সে। সত্তুরোর্ধ এক ডাক্তার, কেএস খানের মতো ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের একজন সাবেক ডিবি অফিসারের সামনেই ঘাবড়ে গিয়ে সব গরগর করে বলে দিয়েছিলেন, ছফার মুখোমুখি হলে কী করবেন তিনি?

মুচকি হাসলো নুরে ছফা। উকিল ভদ্রলোক যখন বুঝতে পারলো নিজের উপরে ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছে তখন ঠিকই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার আসকার কখনও উকিলকে বলেননি তিনি কোথায় আছেন, কিন্তু ময়েজ উদ্দিন অদ্ভুতভাবেই জেনে গেছিলো তার বাড়ির হদিস।

প্রায় বছরখানেক আগে তার দীর্ঘ দিনের ড্রাইভার চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গেলে একজন নতুন ড্রাইভারের দরকার পড়ে, তখন পরিচিত একজনের রেফারেন্স নিয়ে এক ড্রাইভার আসে তার কাছে ইন্টারভিউ দিতে। ময়েজ উদ্দিন যখন জানতে চায় এর আগে সে কোথায় কাজ করেছে, তখন ঐ লোক জানায়, দীর্ঘদিন সে কাজ করেছে। ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নামের এক ডাক্তারের ড্রাইভার হিসেবে।

নড়েচড়ে ওঠে উকিল। ডাক্তারের চাকরিটা তাহলে ছেড়ে দিলে কেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার জানায়, ডাক্তার এখন ঘন ঘন দেশের বাইরে যান, মাসের পর মাস বাইরে থাকেন, সেজন্যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন।

ডাক্তারের সাবেক ড্রাইভারকেই ময়েজ উদ্দিন তার ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ঐ ইন্টারভিউয়ের পরে। ফলে নিজের ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে, খুব সহজেই তার পুরনো মনিবের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নেয় উকিল।

ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের পুরানা পল্টনের অফিস থেকে বিকেলে বের হলেও বনানীতে পৌঁছাতে পাক্কা দেড় ঘণ্টা লেগে গেলো ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের কারণে। বনানীর তিন নাম্বার রোডের ১২ নাম্বার বাড়িটার সামনে ছফাদের গাড়ি থামলো সন্ধ্যার একটু আগে।

গাড়ির ভেতর থেকেই বাড়িটার দিকে তাকালো সে। এটা বনানীর খুব কম সংখ্যক অভিজাত বাড়ির একটি, যা এখনও ডুপ্লেক্স হিসেবে টিকে আছে। আশেপাশে সবগুলো বাড়ি সময়ের আবর্তে মাল্টিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্টে রুপান্তরিত হয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়লো নুরে ছফা, বন্ধ গেটটায় টোকা মারলো সে। আসলাম ড্রাইভিং সিট থেকে বের হয়ে এসে গেটের ডানদিকে থাকা কলিংবেলের সুইচ টিপে দিলো।

প্রায় তিন-চার মিনিট পর বিশাল গেটটার মাঝে যে ছোটো দরজা আছে সেটা খুলে মাথা বের করলো এক লোক। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ছফা মুখ খুললো।

“ডাক্তারসাহেব আছেন না?”

ভুরু কুঁচকে গেলো তার। “আপনারা কারা?!”

আসলাম খপ্‌ করে তার কলার ধরে ফেললো। “ডাক্তার কোথায়?”

আসলামের এমন আচরণে ভড়কে গেলো লোকটা।

“আমরা পুলিশ। বুঝতে পেরেছিস?”

লোকটার চেহারা দেখে মনে হলো এই জীবনে কখনও কোনো পুলিশ তার কলার ধরে কিছু জানতে চায়নি।

“ডাক্তার ছাড়া আর কে থাকে এখানে?” ছফা বেশ শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো। তার ভাবভঙ্গিটাই এমন, ভালো করেই জানে এখানে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ থাকেন।

লোকটা ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে আছে দেখে আসলাম একটা ঝাঁকুনি দিলো তাকে। “স্যারের কথার জবাব দে, বানচোত!”

“আ-আর তো কেউ থাকে না।”

ছফা আর আসলাম আস্তে করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

“দরজা বন্ধ করে দে,” হুকুমের স্বরে বললো আসলাম।

দারোয়ান ভড়কে গেলেও কথামতোই কাজ করলো।

“স্যার, একে কী করবো?” ছফার কাছে জানতে চাইলো গানম্যান।

“ওকে আমাদের সাথে নিয়ে আসো,” কথাটা বলেই ছোট্ট লনটা পেরিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে।

আসলাম যুবকের এক হাত শক্ত করে ধরে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চললো ছফার পেছন পেছন।

“ডাক্তার কি নীচতলায় থাকেন?” পেছনে না তাকিয়েই জানতে চাইলো ছফা।

“না, উপর তলায় থাকেন,” জবাব দিলো যুবক।

নীচ তলায় ঢুকে একটা আধপেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো তারা তিনজন। কেউ কোনো শব্দ করলো না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ছফা দেখতে পেলো ডাক্তার আসকার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। নিরিবিলি বাড়িতে শোরগোলের আওয়াজ শুনে হয়তো খোঁজ নেবার জন্য নীচে নামতে যাচ্ছিলেন তিনি।

.

অধ্যায় ৩৬

সিঙ্কের নাইট গাউন পরা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সৌম্যকান্ত অবয়বটি সামান্য কুঁজো হয়ে আছে, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। একটু আগে কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনি যথেষ্ট অবাক হয়েছিলেন। এরকম কিছুর আশঙ্কা যে তার মনে উঁকি দেয়নি তা নয়, কিন্তু সত্যি বলতে, নুরে ছফাকে মোটেও আশা করেননি তিনি!

“কেমন আছেন, ডাক্তারসাহেব?” সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মুচকি হেসে বললো ছফা। “খুব অবাক হয়েছেন মনে হয়।”

ঘটনার আকস্মিকতায় ডাক্তার কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো প্রকট হলো।

“আপনার পেছনে আমার আরো সময় ব্যয় করা দরকার ছিলো,” অনেকটা অফসোসের সুরে বললো সে। “বলতে লজ্জা নেই, আপনাকে আমি খাটো করে দেখেছিলাম।”

ডাক্তার কিছুই বললেন না।

“তো, আমেরিকা থেকে কবে এলেন?”

“যাওয়া আসার মধ্যেই আছি। শেষবার এসেছি গত মাসে,” বেশ শান্ত কণ্ঠেই বললেন ভদ্রলোক।

কপালে চোখ তুলে ফেললো ছফা।

“এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি ফ্রিকোয়েন্টলি ট্রাভেল করি…এটা সবাই জানে।”

“কিন্তু সবাই যেটা জানে না তা হলো, আপনি আগে কখনও ঢাকায় এসে চোরের মতো ঘাপটি মেরে থাকতেন না।”

ডাক্তার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন, তবে চোর শব্দটার ব্যবহারে ভেতরে ভেতরে যে রুষ্ট হয়েছেন সেটা অবশ্য বোঝা গেলো। “দেশে ফিরে এলে ঘোষণা দিয়ে জানাতে হবে তা তো জানতাম না,” আস্তে করে বললেন তিনি। “নাকি আমি কোনো ফেরারি আসামি? থানায় গিয়ে রিপোর্ট করার কথা ছিলো?”

ছফা অবাক হলো ডাক্তারের এমন কথায়। কেএস খান আর জাওয়াদের কাছ থেকে যতোটুকু জেনেছে, এই লোক খুব সহজেই ভেঙে পড়েছিলেন-নরম, ভঙ্গুর আর ভদ্র একজন মানুষ। কিন্তু এখন তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, লোকটা অতো নরম স্বভাবের নয়।

“আপনি তো আপনার নিজের হাসপাতালকেও কিছু জানাননি?”

“আমার নিজের হাসপাতাল, আমি কাকে জানাবো?” মাথা দোলালেন ডাক্তার। “আপনাকে মনে রাখতে হবে, ওখানকার কারো কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয় না, বরং হাসপাতালের সবাই আমার কাছে জবাবদিহি করে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “হুম, তা ঠিক। এই সুবিধাটুকু আপনার আছে। হাজার হলেও, ওটার ত্রিশ পার্সেন্ট মালিক তো আপনিই।”

“তিন বছর আগের কথা,” ডাক্তার বললেন। “মনে হচ্ছে আপনি পুরোপুরি আপডেটেড নন। পার্সেন্টেজটা এখন পাঁচচল্লিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।”

কপালে চোখ উঠে গেলো নুরে ছফার। “তাহলে কংগ্র্যাচুলেশন্স, ডাক্তার।”

গুভেচ্ছাটি গ্রহণ করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না আসকার ইবনে সায়িদের অভিব্যক্তিতে। “এখন বলুন, জোর করে আমার বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?”

হাসলো নুরে ছফা, আসলামের দিকে তাকালো সে। চোখমুখ কঠিন করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে। এই বাড়ির দারোয়ান।

“আমি যে মুশকান জুবেরির খোঁজ করছি আপনি সেটা ভালো করেই জানেন।”

বাঁকাহাসি দিলেন ডাক্তার। “আপনার ধারণা, সে এই বাড়িতে আছে?”

মাথা দোলালো ছফা। “নাহ্। আমার মনে হয় না, ঐ মহিলা এরকম কাঁচা কাজ করবে।” ডাক্তারের দিকে চোখ স্থির করে বেশ জোর দিয়ে বললো, “তবে সে কোথায় আছে, আপনি জানেন।”

আসকার ইবনে সায়িদের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। “তিন বছর ধরে তাকে খুঁজে না পেয়ে শেষে আমার কাছেই এলেন?”

ছফা এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে আশেপাশে তাকালো। “চলুন, কোথাও বসি…আপনার সাথে অনেক কথা বলতে হবে আমাকে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার, ড্রইংরুমের দিকে যেতে যেতে পেছন দিকে না তাকিয়েই বললেন, “ওয়াহাবকে ছেড়ে দিন, ও গেটের কাছে থাকুক, ও এ বাড়ির দারোয়ান, ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”

আসলামকে ইশারা করলো ছফা। দারোয়ান ছেলেটাকে হাত নেড়ে নীচে চলে যেতে বললো সে।

ডাক্তার তার বিশাল ড্রইংরুমের একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়লেন। “আপনার ধারণা, মুশকান কোথায় আছে সেটা আমি জানি?”

আসলামকে নিয়ে বড় সোফাটাতে বসে পড়লো ছফা। “হ্যাঁ, আমার সেরকমই ধারণা।”

“তাহলে তো, আমার মতো মানুষকে এরকম একটি তথ্য জানিয়ে দিয়ে মুশকান বেশ কাঁচা কাজই করে ফেলেছে,” ব্যঙ্গ করে বললেন আসকার ইবনে সায়িদ।

“মানুষ তো, ভুল করতেই পারে,” ছফা হেসে বললো। “কেউই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়। যতোই বুদ্ধিমান মানুষ হোক, ভুল তো করেই।”

“তা ঠিক, আর সেটা আপনার বেলায়ও খাটে।”

“তবে মুশকান জুবেরি কোথায় আছে সেটা কেবল আপনিই জানেন-এ ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত। এখানে আমার কোনো ভুল নেই।”

“আপনার এমন ধারণার কারণ?”

পকেট থেকে রমাকান্তকামারকে দেয়া সেই চিরকুটটা বের করে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিলো নুরে ছফা। “এটা দেখুন, আশা করি চিনতে পারবেন।”

চিরকুটটা হাতে নিয়ে একটু দূর থেকে দেখার চেষ্টা করলেন ডাক্তার, তারপর নাইটগাউনের বুক পকেট থেকে রিডিং গ্লাসটা বের করে নাকের উপর চাপিয়ে দিলেন। একটু সময় নিয়ে পড়লেন চিরকুটটা। “এটা কার?” পড়া শেষে জানতে চাইলেন।

“আপনি বলতে চাইছেন, আপনি জানেন না?”

“আমি কিভাবে জানবো? মুখবন্ধ একটা খাম দিয়েছিলাম উকিলকে…সেটা তো খুলে দেখিনি। অন্যের চিঠি পড়ার মতো বদঅভ্যেস আমার নেই।”

“কিন্তু অন্যের হয়ে চিঠি পাঠানোর অভ্যেসটা ঠিকই আছে।”

“কী বলতে চাইছেন?” চোখমুখ শক্ত করে জানতে চাইলেন ডাক্তার।

“রমাকান্তকামার স্বীকার করেছেন আমার কাছে, এটা তাকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দির খোন্দকার দিয়েছিলো তিন বছর আগে…সুন্দরপুর থেকে মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার ক-দিন পর।”

ডাক্তার অপেক্ষা করলেন আরো কিছু শোনার জন্য।

“আর ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারও একটু আগে স্বীকার করেছে, চিরকুটটা আপনি তাকে দিয়েছিলেন।”

আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “হ্যাঁ। মুশকান আমার ফ্ল্যাট থেকে চলে যাবার আগে একটা মুখবন্ধ খাম রেখে গেছিলো, একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “সেই সাথে ছোট্ট একটা নোট। তাতে সে অনুরোধ করেছিলো, আমি যেনো খামটা রমাকান্তকামারকে দেবার ব্যবস্থা করি।”

ছফার মুখে হাসি দেখা গেলো কিন্তু সেই হাসি সন্তুষ্টির নয়।

“আমার পক্ষে সুন্দরপুরে গিয়ে এটা দেয়া সম্ভব ছিলো না বলে মি. খোন্দকারের মাধ্যমে খামটা মাস্টারের কাছে পাঠিয়েছিলাম।”

“ঐ উকিলকেও আপনিই নিয়োগ দিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ। রাশেদ আমাকে বলেছিলো, আমি যেনো ভালো কোনো ল ইয়ারকে অ্যাপয়েন্ট দেই ট্রাস্টের জন্য।”

“মি. জুবেরিকে আপনি তাহলে ভালো করেই চিনতেন?”

“অবশ্যই। ও আমার দূরসম্পর্কের কাজিন হয়। আমার মাধ্যমেই ওর সাথে মুশকানের পরিচয় হয়। আমার হাসপাতালেই দীর্ঘদিন ট্রিটমেন্ট নিয়েছে।”

একটু ভেবে নিলো ছফা। “মুশকান জুবেরির সাথে আপনার শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছিলো?”

“প্রায় তিন বছর আগে।”

মুচকি হাসি দেখা দিলো তার ঠোঁটে। “এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?”

“নাহ্,” শান্তকণ্ঠেই বললেন ডাক্তার। “আপনি একজন পুলিশ অফিসার…তদন্ত করে দেখেন, তারপর কী বিশ্বাস করবেন না করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ভালো কথা, মুশকানের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগটা আসলে কি?”

ডাক্তারের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে দারুণ অবাক হলো। “আমার তো ধারণা, এটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন।” আসলামের সামনে এসব কথা বলতে একটু দ্বিধা কাজ করলেও এখন সেটা না বলে উপায় নেই। এ মুহূর্তে তাকে এই আলাপ থেকে সরিয়ে দেয়াটা খুবই বেমানান দেখায়। “মুশকান জুবেরি অনেকগুলো মানুষ হত্যা করে গুম করে ফেলেছে।”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “ও কেন এটা করবে?”

“এ কথা জানতে চাইছেন আপনি??”

“আপনার কথা বুঝলাম না?”

দাঁতে দাঁত পিষে ফেললো নুরে ছফা। “আপনি সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন?”

“সব কিছু মানে?”

“মি. খান…আমার সিনিয়র…আপনি তার কাছে যা যা বলেছিলেন তিন বছর আগে, সেসবের কথা বলছি।”

বাঁকা হাসি দিলেন ডাক্তার। “এরকম আজগুবি কথা তাহলে আপনিও বিশ্বাস করে বসে আছেন!”

ভুরু কুঁচকে গেলো ছফার।

“আপনি কী করে বিশ্বাস করলেন, আমি যা বলেছি তার সবই সত্যি?”

ডাক্তারের দিকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। ভদ্রলোক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছে না। “আপনি বলতে চাইছেন, আপনি আমার সিনিয়রকে ওরকম কথা বলেননি?”

আসকার ইবনে সায়িদ আলতো করে মাথা দোলালেন। “না, সেটা আমি বলছি না। ঐ ক্রনিক ডিজিজে ভোগা ভদ্রলোককে আসলেই এরকম উদ্ভট কথা বলেছিলাম। যাই হোক, সেটা যে কেউ বিশ্বাস করবে জানতাম না।”

“কী বলতে চাইছেন, আপনি? সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন এখন?”

কাঁধ তুললেন ডাক্তার। “ওটা অবশ্য কোনো জবানবন্দী ছিলো না। আর যিনি এসেছিলেন, তিনিও রিটায়ার্ড করা এক ডিবি অফিসার। তার কাছে কী বলেছি না বলেছি সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।”

ছফার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো। “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন-”।

তার কথা শেষ করা আগেই আসকার ইবনে সায়িদ বলতে শুরু করলেন, “যা বলেছিলাম সেটা একজনের অনুরোধেই বলেছিলাম। ওসব কথা মোটেও সত্যি নয়।”

অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।

“খুবই উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য একটি গল্প বলেছিলাম তার অনুরোধে।”

.

অধ্যায় ৩৭

মুশকান জুবেরি আন্দিজের বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়নি?!

হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ঐ সময় তার জন্মই হয়নি!

তিন বছর আগে কেএস খানের কাছে যে কাহিনী বলেছিলেন ডাক্তার, সেখান থেকে পুরোপুরি ইউ-টার্ন নিয়ে, সব কিছু অস্বীকার করে নতুন আরেকটি গল্প বলছেন এখন। নুরে ছফার মনে হচ্ছে, সে একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। সব কিছু ঘোলাটে আর প্রহেলিকাময় করে তুলছেন আসকার ইবনে সায়িদ।

গভীর করে নিশ্বাস নিলো সে।

“আমি অবশ্য এমন গল্প বলতে রাজি হইনি,” বললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “কিন্তু ও যখন সবটা খুলে বললো, তখন তাকে বাঁচাতে এমন কাজ করতে রাজি হই।”

“সবটা মানে?”

“সুন্দরপুরের এমপি তার নামে আজগুবি সব অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলো, মানুষের কাছে তাকে ডাইনি বলে প্রচার করেছে, যাতে করে সে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। “লোকটার আসল উদ্দেশ্য ছিলো জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দখল করা।”

ছফাও এরকম কথা শুনেছিলো আতরের কাছ থেকে।

“মুশকানের ধারণা, ঐ এমপিই আপনাকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলো। তাই আপনাকে উদ্ভট একটা গল্প বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলো সে।”

“আমি এমপির হয়ে কাজ করেছি?!” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ছফা।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “ও সেরকমই ধারনা করেছিলো।”

ছফা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। সুন্দরপুরের অনেকেই এমন ধারনা করে ইদানিং কিন্তু তাই বলে স্বয়ং মুশকান জুবেরি?! “আপনি আমাকে হাসালেন, ডাক্তার,” বললো সে। “তাহলে যেসব মানুষকে সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলেছে মুশকান, তাদের ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?” ইচ্ছে করেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়ার কথাটা এড়িয়ে গেলো আসলামের উপস্থিতির কারনে।

“এ ব্যাপারে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় এসে আমার ফ্ল্যাটে ওঠার পর।”

“সে আপনাকে কী বলেছিলো?”

“ওর ধারনা, এমপি আসাদুল্লাহই ওদেরকে কিছু করেছে।”

“কি?!” নুরে ছফা আৎকে উঠলো। “এমপি!?” মাথা দোলালো সে। “আপনার মুশকান এমন একজনের উপর পিণ্ডি চাপিয়ে দিচ্ছে, যে এখন মৃত! দারুণ অ্যালিবাই!”

“দেখুন, বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার ব্যাপার। আমি শুধু, ও কী বলেছে, সেটা বলছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ছফা, “আচ্ছা, বলুন…মুশকান আপনাকে কী বলেছে।” কথাটা একটু তীর্যক শোনালো যদিও।

“ওখানকার এমপি কড়া নজরদারিতে রাখতো ওকে। ওর সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক হোক, তা সে চাইতো না। ওর ধারনা, সম্ভবত ঐ দু-জন লোক সুন্দরপুরে যাবার পর থেকে এমপির লোকজন তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছিলো। সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার সময় ঐ লোকগুলোই তাদেরকে গুম করে ফেলে।” একটু থেমে ছফার দিকে তাকালেন তিনি। সে এখন অবিশ্বাসে হাসছে। “তবে ও নিজেও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না। এটা নিছকই ওর ধারণা।”

“তাহলে এমপি আসাদুল্লাহই সব করেছে…মুশকান জুবেরি ধোঁয়া তুলসী পাতা?”

কাঁধ তুললেন ডাক্তার। “একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সব কিছু খতিয়ে দেখে, প্রমাণের উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করাটাই আপনার উচিত হবে। ও কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখেন। আর সত্যি বলতে, ও যা বলেছে তা-ই আপনাকে বললাম। এখানে আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “সেটা তো আমি করবোই,” একটু থেমে আবার বললো, “তাহলে কি প্রতিশোধ নেবার জন্য এমপিকে খুন করেছে মুশকান?”

ঠোঁট ওল্টালেন ডাক্তার। “সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সে এমপির সাথে দেখা করে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো।”

“মুশকান যে এমপির সাথে দেখা করেছিলো সেটা আপনাকে বলেছে?”

“অবশ্যই। ও আমাকে বলেছিলো এমপির সাথে কথা বলবে। সম্ভবত রাশেদের সম্পত্তিগুলো যে ট্রাস্টের নামে দান করেছে সেটা জানানোর জন্য…সেই সাথে, মাস্টারের যেনো কোনো ক্ষতি না করে সেটাও হয়তো বলতে চেয়েছিলো।” গভীর করে নিশ্বাস নিলেন আবার। “হয়তো ভদ্রলোকের কাছে জানতে চেয়েছিলো, কেন সে তার পেছনে এভাবে লাগলো, এসব করে তার কী লাভ হলো…এই আর কি।”

“মুশকান তাহলে এমপির সাথে কথা বলেছিলো?”

“বলেছিলো। ওর সাথে কথা বলার পর, সেদিন রাতেই ভদ্রলোক মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলো লোকটা। মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করায় হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়।”

“দারুণ! সব পাজল মিলিয়ে দিচ্ছে আপনার বলা এই গালগল্প!” তিক্ত মুখে বললো ছফা, “এমপির মৃত্যুর জন্য তো কেউ মুশকানকে সন্দেহই করেনি…পোস্টমর্টেম রিপোর্টও বলেছে ওটা মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্কের ফলাফল, তাহলে সে চোরের মতো পালিয়ে গেলো কেন?”

“ও আগেই ঠিক করে রেখেছিলো এমপির সাথে কথা বলে দেশ ছাড়বে। এমপির মৃত্যুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।”

কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ছফার মুখে। “তা এখন বলুন, আপনার মুশকান জুবেরি কোন্ দেশে গেছে?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “সেটা আমাকে বলেনি। আর আমিও জানতে চাইনি।”

“এতো কিছু বললো আর এটা বললো না আপনাকে? আপনি বলতে চাইছেন, মুশকান আপনাকে বিশ্বাস করতো না?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, আমি নিজেই জানতে চাইনি। ওটা জানা থাকলে আমি হয়তো পুলিশি জেরার মুখে সব বলে দিতাম।”

বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “সবই না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনি দেশ ছাড়লেন কেন?”

গভীর করে দম নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “দুটো কারণে দেশের বাইরে গেছিলাম কিছু দিনের জন্য আপনার জ্বালাতন থেকে বাঁচতে আর আমার হার্টের চেকআপ করাতে।”

“আপনার নিজের হাসপাতাল থাকতে আমেরিকায় কেন? আপনার তো দেখি নিজের হাসপাতালের উপরেই ভরসা নেই।”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার হাসপাতালেই চেক আপ করি, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে গেলে সেখানেও করাই। এর মানে, নিজের হাসপাতালের উপর ভরসা নেই যদি ভাবেন তো কিছু করার নেই।”

ছফা কিছু বললো না। ডাক্তারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে সে। “যাই হোক, কয়েক মাস পরই আবার দেশে ফিরে এসেছিলাম আমি।”

“কাউকে না জানিয়ে!”

“দেশে এসে আমি যদি সেটা গোপন রাখি তার কারনও কিন্তু আপনি। উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতেই এটা করেছি।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো নুরে ছফা। “আপনি মনে করছেন আমি আপনার এই নতুন গল্পটা বিশ্বাস করবো? আমার কাছে প্রমাণ নেই বলতে চাইছেন?”

মুচকি হাসলেন ডাক্তার। “থাকলে তো আপনি মুশকানের বিরুদ্ধে হিউম্যান অর্গ্যান পাচারের সন্দেহ করে মামলা করতেন না! সম্ভবত আপনি তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগই করেছেন, তাই না?”

ছফা টের পেলো রাগে রীতিমতো তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। সত্যিটা হলো, মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে সে মানব-অঙ্গ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগও করতে পারেনি-সেই সব অঙ্গ ভক্ষণের অভিযোগ তোলা তো দূরের কথা। সে কেবল ঐ মহিলার বিরুদ্ধে কিছু লোকজনকে গুম করার প্রাথমিক অভিযোগ করে একটি মামলা করেছে। সেই মামলায় এমনকি এটারও উল্লেখ নেই, মহিলা লোকজনকে কি উদ্দেশ্যে গুম করেছে-কেন করেছে। তবে সরকারী তদন্তে বাধা দেয়া, ছফাকে হত্যাচেষ্টাসহ তার অস্ত্র কেড়ে নেবার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে আরো দুটো মামলা করেছে সুন্দরপুর থানায়।

“এ থেকেই বোঝা যায়, ওর ধারণাই সত্যি,” ডাক্তার বললেন।

সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো ছফা।

“এই উদ্ভট গল্পটা যে কেউ বিশ্বাস করবে না সেটা আপনি নিজেও জানতেন।”

ভুরু কুঁচকে তাকালো ডিবির জাঁদেরল ইনভেস্টিগেটর। “আপনি কী বলতে চাইছেন, আন্দিজের ঘটনা মিথ্যে?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “এটাই তো এই ঘটনার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট।”

“আপনি পরিস্কার করে বলেন, হেয়ালি করবেন না। আমি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং কোনো গল্প শুনতে আসিনি।”

“আপনার কাছে গল্প বলে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমারও নেই।” একটু থেমে আবার বললেন, “তাহলে শুনুন, সংক্ষেপেই বলি। আন্দিজের ঘটনাটা যে মিথ্য নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওটা সত্যি সত্যি ঘটেছিলো। দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে আঠারোজন বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে এক বাংলাদেশি তরুণী ডাক্তারও ছিলো। এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। সেই তরুণীও অন্যদের মতো নরমাংস খেয়েই জীবন বাঁচায়।”

কথাটা শুনে এই প্রথম আসলামের অভিব্যক্তিতে বিস্ময় দেখা গেলো। অনেকটা আৎকে উঠলো সে।

“কিন্তু ওই তরুণী মুশকান ছিলো না!”

“তাহলে সে কে ছিলো?” অবিশ্বাসে প্রশ্নটা করলেও ছফার ইচ্ছে করছে ডাক্তারের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। তাকে ছেলে ভোলানো গল্প বলে বিশ্বাস করাতে চাইছে! লোকটার দুঃসাহসের তারিফ না করে পারলো না।

“সমস্যা হলো, আমি যা বলবো সেটা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। ঐ আজগুবি গল্পটাই বিশ্বাস করতে চাইবেন আপনি। তবে সবটা শোনার পর, আশা করি সন্তুষ্ট না হলেও কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝে নিতে পারবেন।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। ডাক্তার যেনো সাসপেন্স গল্প। বলছেন। ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছেন উত্তেজনা।

“আমি যে তরুণীর কথা বলছি সে কে ছিলো, জানেন?”

নুরে ছফা চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে।

“রুখসান!”

“এই রুখসানটা কে?” অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো ছফা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, মুশকানের মেয়ে!”

.

অধ্যায় ৩৮

নুরে ছফার মনে হচ্ছে তাকে ঠেলেঠুলে প্রহেলিকাময় গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাক্তারের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শুধু বুঝতে পারছে, তার সাথে বিরাট কোনো চালাকি করা হচ্ছে।

কথাটা শোনার পর থেকে সে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার আসকারের দিকে। নতুন একটি চরিত্র রুখসান আমদানি করে মুশকানের সাথে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু ছফার কাছে এমন কিছু আছে যা ডাক্তারের এসব গল্পকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে এক লহমায়।

“আপনি যদি জানতেন আমার কাছে কতো শক্তিশালী প্রমাণ আছে, তাহলে এসব বলার আগে অন্তত এক শ’ বার ভেবে নিতেন,” তিক্তমুখে বললো। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে অবার।

ডাক্তার আসকারের নির্বিকার মুখ দেখে বোঝা গেলো না তিনি ভড়কে গেছেন কিনা। পিএসের গানম্যান আসলাম শক্তমুখে চেয়ে আছে তার দিকে।

নুরে ছফা সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “পৃথিবীটা অনেক বেশি ছোটো, ঝুঝলেন ডাক্তার? আর কেন জানি বাঙালিদের জন্য এই পৃথিবীটা আরো বেশি ছোটো।”

ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে গেলো সামান্য।

“মুশকান জুবেরির যে শিকারের কেসটা নিয়ে আমি তদন্ত করছি, সেই হাসিবের মা সত্তর দশকে আমেরিকায় ছিলেন স্বামীর সাথে। ওখানে তিনি প্রতিবেশী হিসেবে কাকে পেয়েছিলেন, জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললো, “মুশকান জুবেরিকে!”

এ কথা শোনার পরও ডাক্তার নির্বিকার থাকলেন।

ছফার কাছে মনে হচ্ছে, ডাক্তার জোর করে অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। “খুব বেশি কাকতালীয় মনে হচ্ছে?”

স্মিত হাসলেন আসকার ইবনে সায়িদ, তবে কিছু বললেন না।

“হাসিবের মায়ের সাথে প্রতিবেশী মুশকানের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তিনি এ-ও জানতেন, আন্দিজে প্লেন ক্র্যাশের শিকার হয়েছিলো মুশকান, মৃত মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিলো আশি দিনেরও বেশি সময়।”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ডাক্তার আসকার, যেনো কী বলবেন গুছিয়ে নিচ্ছেন।

“ঐ ভদ্রমহিলা এখন দেশে আছেন…মৃত্যুপথযাত্রি। তার মাধ্যমে মুশকানের একটি ছবিও জোগাড় করেছি আমি।”

আসকার ইবনে সায়িদের ভুরু কুঁচকে গেলো সামান্য।

“আপনার এই বানোয়াট গল্পটা যে এভাবে ধরা খাবে সেটা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। আমার কথাটা পুরোপুরি না শুনেই-”

হাত তুলে ডাক্তারকে থামিয়ে দিলো ছফা। “অনেক হয়েছে, আর এসব গাঁজাখুরি গল্প বলবেন না আমাকে। আমার ধৈর্য কিন্তু অসীম নয়।”

কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ। “পুরোটা শুনতে না চাইলে কী আর করা!”

ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো। “পুরোটা বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আবার বললো সে, “আমি যা বললাম তারপরও আপনার বলার কিছু আছে নাকি?”

“সত্যটাকে যদি গল্পই বলেন তাহলে বলবো, আমি তো কেবল শুরু করেছি। এখন আপনি শুনতে চাইলে বলতে পারি, নইলে নিজেই তদন্ত করে বাকিটা জেনে নেবেন। এক সময় না এক সময় এই সত্যটাই আবিষ্কার করবেন আপনি।”

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন ডাক্তারের দিকে। এই ভদ্রলোক কেএস খানের সামান্য চাপেই ভেঙে পড়েছিলেন, গরগর করে বলে দিয়েছিলেন সবকিছু। কিন্তু এখন তার মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে, তাতে আগেরবারের সাথে কোনো মিলই পাচ্ছে না সে।

“আপনি এমন চালাকি করেছেন, যেটা আমাকে ভুলপথে পরিচালিত করবে, তদন্তটাকে কানাগলিতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে।”

এবার পরিহাসের হাসি হাসলেন ডাক্তার। অবশ্য, আগেরবার আমি সেটাই করেছিলাম।” একটু থেমে আবার বললেন, “সেজন্যে আপনাকে দোষও দিতে পারছি না।”

ছফা কিছু বললো না। তার কাছে মনে হচ্ছে, যে ডাক্তার এখন তার সামনে বসে আছে সে অন্য কেউ। ছফার সহকারী জাওয়াদ তাকে সবটাই বলেছিলো। কিভাবে মি, খান কথার মারপ্যাঁচে স্বনামধন্য ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদকে কাবু করেছিলো কোনো রকম হুমকি-ধামকি ছাড়াই।

“এবারও যে আপনি চালাকি করছেন সেটার প্রমাণ তো আমি দিলামই।”

“কীসের প্রমাণ?” ডাক্তার যেনো বুঝতে পারেননি কিছু।

“এততক্ষণ আমি আপনাকে যা বললাম সেটা শোনার পরও বুঝতে পারছেন না?”

কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আসলেই বুঝতে পারছি না।”

দাঁতে দাঁত পিষে ছফা বললো, “আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন…তারা দীর্ঘদিন প্রতিবেশী ছিলো।”

“হ্যাঁ, সেটা তো বুঝেছি কিন্তু আপনি এটাকে প্রমান বলছেন কেন?”

“এজন্যে বলছি, আর্জুমান্দ বেগম মুশকানের মায়ের বান্ধবী ছিলেন না, উনি মুশকানের বান্ধবী ছিলেন!”

হাসলেন ডাক্তার। “আপনার ঐ পিএসের বোন, তিনি কি কখনও মুশকানের মেয়েকে দেখেছেন?” একটু থেমে হিসেব করে নিলেন যেনো। “সম্ভবত দেখেননি। দেখার কথাও না। ওর তখন বিয়েই হয়নি…মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলো।”

“কার কথা বলছেন আপনি?” ছফা অবাক হয়ে জানতে চাইলো।

“মুশকান জুবেরির মায়ের কথা বলছি।”

“উফ!” অধৈর্য হয়ে উঠলো ছফা। বার বার এক প্যাচাল পাড়ছেন কেন! আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন…তার মাকে না!”

“আমি তো সেটাই বলছি,” চট করে বললেন ডাক্তার।

“তাহলে বার বার তার মায়ের কথা কেন বলছেন?”

“কারণ ওই মহিলাই মুশকান জুবেরির মা ছিলো, আপনি যে মুশকানকে খুঁজছেন সে ছিলো তার মেয়ে!”

“স্টপ ইট!” ধমকে উঠলো ছফা। “মুশকান…মুশকান জুবেরি মা! বার বার কী সব বলে যাচ্ছেন! আপনি ভেবেছেন কি, আমি আপনার গোলকধাঁধায় পড়ে খাবি খাবো?”

মাথা দোলালেন ডাক্তার। “দুঃখিত, আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। আসলে আপনাকে দোষ দেয়া যায় না, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না…আর মাঝখানে অনেক প্রশ্ন করায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে। “ঠিক আছে, বলুন আপনার আজগুবি গল্প!”

“যে মুশকানকে আপনি চেনেন তার আসল নাম রুখসান! আর তার মায়ের নাম ছিলো মুশকান সোহেলি!”

.

অধ্যায় ৩৯

মুশকানের নাম আসলে রুখসান! আর তার মায়ের নাম মুশকান সোহেলি?!

এরকম অসম্ভব কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ছফা। তার কাছে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমনজানি অনুভূতি হলো। বুঝতেও একটু সময় নিলো সে। ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“এসবের মানে কি?”

মুচকি হাসলেন ডাক্তার, তবে সেই হাসিতে কোনো তাচ্ছিল্যভাব নেই। যেনো তিনিও জানেন, এ কথা শুনে যে কেউ অবাক হবে।

“আপনার ঐ পিএসের বোন যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন,” আস্তে করে বললেন বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। “কিন্তু মহিলা তো আর জানতেন না, পরবর্তীকালে মুশকান সোহেলি বিয়ে করে ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম দেয়, একটু থেমে ছফাকে দেখে নিলেন তিনি। সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। “আর সেই মেয়ে দেখতে হয়েছিলো অবিকল তার মায়ের মতোই।”

এতে অবাক হলো না ছফা। অনেক ছেলে-মেয়েই দেখতে বাবা-মায়ের মতো হয়। একেবারে হুবহুও হয়। তার নিজের মা-ই দেখতে ছিলো হুবহু তার নানীর মতো। তবে নানীকে তারা দেখেছে বয়সকালে, ফলে তাদের কাছে মিলটা তেমনভাবে ধরা না পড়লেও, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে। ঠিকই ধরা পড়েছিলো। নানীর যুবা বয়সের ছবি দেখেও ছফা বুঝতে পেরেছিলো মিলটা ছিলো বিস্ময়কর রকমেরই। একই বয়সের নানী আর তার মায়ের ছবি দেখলে মনে হতো একজনের ছবিই দেখছে-কিংবা যমজ বোনের!

“নিউটনের বাবার নাম কি ছিলো জানেন?”

ডাক্তারের এমন প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।

“নিউটন! ওয়েস্টে এটা খুবই পপুলার ট্রেন্ড-বাবার নামে সন্তানের নাম রাখা। সন্তানের বেলায় কেবল যোগ করা হয় ‘জুনিয়র’ শব্দটি। যেমন জুনিয়র বুশ, ওর বাবার নামও ছিলো বুশ।”

“আপনি বলতে চাইছেন, মুশকানের মা নিজের মেয়ের নাম রেখেছিলো মুশকান?”

ছফার কথায় মাথা দোলালেন ডাক্তার আসকার। “না, না…ওর মা এ কাজ করেনি।”

“তাহলে?”

“মুশকানের মেয়ের নাম ছিলো রুখসান, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো, কিছুই বললো না। মুশকান আর রুখসানের গোলকধাঁধা থেকে এখনও বের হতে পারছে না।

“সুন্দর নাম, সন্দেহ নেই কিন্তু পরবর্তীকালে কিছু ঘটনার কারনে রুখসান তার নামটা পাল্টে ফেলে।”

“কি ঘটনা?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো নুরে ছফা।

“মুশকান সোহেলি, মানে মুশকানের মা আন্দিজ থেকে ফিরে আসার পর বাঙালি কমিউনিটিতে কোণঠসা হয়ে পড়ে, বাধ্য হয়ে সে চলে যায় বৃটেনে, মেডিকেল প্র্যাকটিস শুরু করে সে। ওখানেই এক বাঙালি ডাক্তারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, প্রেম হয়, তারা বিয়েও করে ফেলে। তাদের ছোট্ট সংসারে আসে রুখসান।” একটু থামলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “রুখসানের জন্মের কয়েক বছর পরই দেশের টানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চলে আসে ঢাকায়। মেয়েটার বয়স যখন ছয় কি সাত, তখনই ওর বাবা আন্দিজের ঘটনাটা জেনে যায়। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে চুপ মেরে গেলেন। “দোষটা মুশকানেরই!…আন্দিজ সারভাইভারদের উপরে অনেকগুলো পেপার ক্লিপিংসের একটি অ্যালবাম সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো ও। ঘটনাচক্রে অ্যালবামটা ওর স্বামী দেখে ফেলে।”

ছফার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগের ঘটনাটি। মুশকান জুবেরি তাকে এরকম একটি অ্যালবাম দেখিয়েছিলো। কয়েকটি ছবি দেখার পর সে অচেতন হয়ে পড়ে। এখন কেবল ঝাপসা একটা স্মৃতি আছে। কখনও কখনও স্বপ্নে হানা দেয় সেই মুহূর্তটির কিছু অংশ। একেবারেই বিক্ষিপ্তভাবে।

“এই ঘটনার পর থেকে স্বামীর সাথে ওর দূরত্ব বেড়ে যায়,” ডাক্তার বললেন। “মুশকান কেন স্বামীকে বিয়ের আগে এটা বলেনি, কেন সে কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলো-এই ছিলো ভদ্রলোকের অভিযোগ। তো, ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের দিকেই মোড় নেয়। ও খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর স্বাধীনচেতা ছিলো, স্বামীর এমন আচরণের পর একসাথে আর থাকেনি, মেয়েকে নিয়ে আলাদা বসবাস করতে শুরু করে। ওর বাবাও কখনও মেয়ের দাবি নিয়ে সামনে আসেনি আর। ভদ্রলোক ডিভোর্সের এক বছরের মাথায় আবার বিয়ে করে ফেলে। তবে মুশকান আর সে পথে যায়নি। পুরুষবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলো সম্ভবত। একমাত্র সন্তান রুখসানকে নিয়ে একাকি জীবন বেছে নেয়, নিজের মতো করে গড়ে তোলে মেয়েকে। ও আবার রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলো। রুখসানও মায়ের প্রভাবে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মা-মেয়ের সুখের এই ছোট্ট সংসারটি বেশি দিন টেকেনি। রুখসানের বয়স যখন চৌদ্দ, ওর মা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পায় রুখসান। বলতে পারেন, ভয়াবহ এক ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। নানান রকম অ্যাবনরমালিটি গ্রো করে ওর মধ্যে। সম্ভবত, সে কারণেই মায়ের মৃত্যুর পরের বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার সময় এলো, নিজের নাম পাল্টে সে মুশকান সোহেলি রাখলো।”

ছফার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। আগে ক্লাস নাইনে থাকতে এসএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করা হতো, তখন ইচ্ছে করলে নিজের নাম, জন্মসাল, তারিখ, সব কিছু ইচ্ছেমতো বদলে ফেলার সুযোগ ছিলো। এখনকার মতো স্মার্টকার্ড, ভোটার আইডিকার্ড কিংবা জন্মসনদের বালাই ছিলো না তখন।

ছফার মনে পড়ে গেলো, তার নিজের নামটাও পাল্টানোর খুব ইচ্ছে ছিলো-জ্ঞান হবার পর থেকে নুরে ছফা নামটার মধ্যে গেঁয়ো একটা গন্ধ পেতো সে। আর লোকজনও ঠিকভাবে ধরতে পারতো না প্রথমবার শোনার পর। অন্য অনেকের মতো সে-ও চেয়েছিলো নামটা একটু ‘স্মার্ট’ করতে, কিন্তু তার কঠিন শাসনের বাবার কড়া ধমক খেয়ে নিজেকে বিরত রাখে।

দুই দুইটা খাসি জবাই দিয়া আকিকা কইর‍্যা আমার বাপে এই নাম রাখসে!…আর পোলায় কিনা সেয়ানা হইয়া এখন সেই নাম বাদ দিবার চায়! এত্ত বড় সাহস হইসে…এমুন পোলারে কাইট্টা…! নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তার জাঁদরেল বাবার এইসব গালমন্দ আর রাগি চেহারাটা এখনও চোখে ভাসে।

আজাদ রহমান-নিজের পছন্দ করা নামটা এখনও তার মনে আছে।

“সম্ভবত মায়ের মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারেনি বলে এমনটা করেছিলো,” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার আবার বললেন। “মায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যেও করে থাকতে পারে…কে জানে।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আসকার ইবনে সায়িদের ভেতর থেকে। এভাবেই সে রুখসান থেকে হয়ে গেলো মুশকান সোহেলি। তারও অনেক বছর পরে, বিয়ের পর হলো মুশকান জুবেরি।”

“আপনি এতো সব জানলেন কিভাবে?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো ছফা। “এসব কথা তো সত্য না-ও হতে পারে?”

হেসে ফেললেন ডাক্তার। “তখন তো কেউ মুশকানের পিছে লাগেনি যে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য বানোয়াট একটা গল্প বলবে সে। তাছাড়া মুশকানের সাথে…মানে, রুখসানের মায়ের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমার। বয়সেও আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম। একসাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছি আমরা। ও মারা গেলে আমিই ওর মেয়ের অভিভাবক হয়ে উঠি। যা বললাম, তার অনেক কিছুই নিজের চোখে দেখেছি আমি।”

চুপ মেরে রইলো নুরে ছফা। ডাক্তারের বয়স আর পেশা হিসেবে নিলে, রুখসানের মায়ের সাথে তার বন্ধুত্বের ব্যাপারটা খাপ খেয়ে যায়।

“আমার কী মনে হয় জানেন?” আসকার ইবনে সায়িদ বললেন। “ও ওর মায়ের ব্যাপারে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড হয়ে পড়েছিলো…কাইন্ড অব অবসেসড।”

মাথা নেড়ে সায় দিতে গিয়েও দিলো না ছফা।

“মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা ছিলো একেবারে অন্য রকম। বন্ধু…একমাত্র সঙ্গি…একমাত্র অভিভাবক!” আবারো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ডাক্তারের ভেতর থেকে। ঘরে নেমে এলো কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।

“কিন্তু আপনি কেন আমার সিনিয়র মি. খানের কাছে এরকম উদ্ভট গল্প বললেন?” জানতে চাইলো ছফা।

গভীর করে নিশ্বাস নিলেন ডাক্তার। “এটা আগেই বলেছি…ও মনে করেছিলো আপনি সুন্দরপুরের এমপির হয়ে ওর পেছনে লেগেছেন, ঐ এমপি যেহেতু ওর রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করার উদ্ভট একটি অপবাদ রটিয়েছিলো, তাই ও মনে করেছিলো আপনাকেও এরকম কথা বিশ্বাস করাতে, যাতে সবাই বোঝে আপনি এমপির লোক। আপনার উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলো সে। আপনাকে নাজেহাল করার জন্যই এটা করতে বলেছিলো আমাকে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছফা।

“ও জানতো, এরকম উদ্ভট গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। বড় কর্তাদের কাছে আপনি হাস্যকর পাত্র হয়ে উঠবেন।”

ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো।

“ওর ধারণাটা যে ঠিক ছিলো তার প্রমাণ তো আপনি নিজেই। ঐ অভিযোগ তুলে মামলা করার সাহসও দেখাননি।”

ছফার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। মহিলা এদিক থেকে সফলই বলা যায়। সে নিজেও এমন উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য গল্পটা চেপে গেছে সবার কাছ থেকে। এসব বললে যে তাকে পাগল, নয়তো উর্বর মস্তিষ্কের মানুষ ভাববে শুধু সে কারণে নয়, বরং তার আরেকটা ভয় ছিলো-মানুষ চিরযৌবন লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।

“মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অগ্যান খেলে চিরযৌবন লাভ করা যায়-এ কথা তো বিশ্বাস করবে অতি আশাবাদী মানুষ, নয়তো বোকারহদ্দরা।”

ছফার কাছে মনে হলো ডাক্তার প্রকারান্তরে তাকে বোকা বলছেন! এমন সময় কিছু একটা মনে পড়ে গেলো তার, সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠলো সে।

“কিন্তু যতোটুকু জেনেছি, আপনার অরিয়েন্ট হাসপাতালে আমেরিকা থেকে এক ডাক্তার এসে মুশকান জুবেরিকে নিয়ে এসব কথা রটিয়েছিলো…ঐ লোকের ব্যাপারটা কি তাহলে?”

আক্ষেপে মাথা দোলালেন ডাক্তার। “মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়ার ফলে যে ভবিষ্যতে ঝামেলা হতে পারে সেটা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। ঐ ডাক্তারের আবির্ভাবের পরই সেটা প্রথম টের পায়।”

ছফা তাকালো আসলামের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে সে ঘরের আসবাবপত্রের মতোই নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে।

“হাসপাতালের একজন ওনার হিসেবে ওই সিচুয়েশনটা সামাল দিতে গিয়ে আমাকে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছিলো। ভদ্রলোককে বোঝাতেই পারছিলাম না, মুশকান তার মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়াতে এই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। লোকটা যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলো-চিরযৌবন লাভের সিক্রেট জানতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সে। একেবারে ছেলেমানুষি ভাবনা! যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ঐ লোককে আমি বোঝাতে পেরেছিলাম, তবে ঐ ঘটনার কিছু দিন পর মুশকান ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে চাকরিটাই ছেড়ে দেয়।” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “অবশ্য তার চাকরি ছাড়ার কারণ অন্য কিছু ছিলো। এখানকার রোগীদের আত্মীয়স্বজন রোগী মারা গেলে ডাক্তারদের উপরে যেভাবে চড়াও হয়, সেটা ওকে ভীষণ আপসেট করতো। চোখের সামনে এরকম কয়েকটি ঘটনা দেখে ভড়কে গেছিলো। আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিলো বলতে পারেন। আমাকে ও জানিয়েছিলো, হাসপাতালে চাকরি আর করবে না।”

“যে ডাক্তার মুশকানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলো সে এখন কোথায়?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। ছফার সন্দেহটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। “চার-পাঁচ বছর আগে ভদ্রলোক দুবাইর এক হসপিটালে কাজ করতো, এখন কোথায় আছে জানি না।”

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না সে, তবে এ নিয়ে কিছু বললোও না।

হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন ডাক্তার। “আমার শরীর ভালো নেই, একটু পর ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা কিন্তু উঠে দাঁড়ালো না, তার বদলে গানম্যান আসলামের দিকে ফিরলো। লোকটা কয়েক মুহূর্ত চোখের ভাষা পড়েই উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেলো ডাক্তারের দিকে।

“আপনার মোবাইলফোনটা দিন,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে।

অসহায়ের মতো তাকালেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “আ আমার…” কণ্ঠ ধরে এলো তার। ছফার দিকে ফিরলেন। “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?”

“আমি সত্যি-মিথ্যা খতিয়ে না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।” ভু

রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন আসকার ইবনে সায়িদ।

“মুশকানকে হাতের মুঠোয় না পেলে কী করে বুঝবো আপনার গল্পটা সত্যি নাকি মিথ্যে!”

ডাক্তারের নিশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করলো। আক্ষেপে মাথা দোলালেন তিনি। কিন্তু ও কোথায় আছে সেটা তো আমি জানি না।”

এবার বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “এতোক্ষণ ধরে আপনি যা বলেছেন তাতে হয়তো সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন যেটা বলছেন সেটা একদমই নির্জলা মিথ্যে। মুশকানের সাথে আপনার বেশ ভালোই যোগাযোগ আছে, আর আমি সেটাই প্রমাণ করবো এখন।”

স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার।

“আপনার ফোন আর পাসপোর্ট-ও দুটো হাতে পেলেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”

“আ-আমি তো সেলফোন ইউজ করি না।”

কথাটা শুনে হেসে ফেললো ছফা, আদেশ করলো গানম্যানকে, “সার্চ করো।”

ডাক্তার হতভম্ব হয়ে তাকালেন ছফার দিকে। “আপনি বিনা ওয়ারেন্টে আমার বাসায় ঢুকেছেন, এখন আবার আমাকে সার্চ করতে বলছেন! আপনি এটা করতে পারেন না!”

“আইনত করতে পারি না,” জবাব দিলো সে, “কিন্তু আমি আপনার সাথে আইন-টাইন দেখাচ্ছি না এখন।”

আসলাম আগ্রাসি মনোভাব নিয়ে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর ইশারা করলো।

চুপচাপ উঠে দাঁড়ালেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আপনার নামে কপ্লেইন করবো!” অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করার পরও হুঙ্কার দেবার চেষ্টা করলেন তিনি। “ওকে আমি বলবো-”

“আপনি প্রাইমিনিস্টারের কাছেও যেতে পারেন,” ডাক্তারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো নুরে ছফা। “ওসব জুজুর ভয় আমাকে দেখাবেন না। ভালোয় ভালোয় যা চাই তা দিয়ে দিন, নইলে আপনার সাথে অসম্মানজনক কিছু করা হবে।”

সন্দেহভাজনদের যেভাবে দেহতল্লাশি করে পুলিশ, তেমনিভাবে ডাক্তারের সারা শরীর তল্লাশি করলো পিএসের গানম্যান আসলাম, কিন্তু কিছুই পেলো না।

“ফোন তো নাই, স্যার। আমি এই লোকের ঘরগুলো তল্লাশি করি?”

ডাক্তারের দিকে তাকালো ছফা, “নিজে থেকে আপনার পাসপোর্ট আর ফোনটা দিয়ে দিন…নইলে ও কিন্তু ঠিকই তল্লাশি করে ওগুলো খুঁজে বের করবে, মাঝখান থেকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে আপনার ঘরগুলো।”

ডাক্তার আসকার বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। “আপনি আমার পাসপোর্ট চাইছেন!?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “আমি যা যা চাইবো তার সবই আপনাকে দিতে হবে, নয়তো সেটা আদায় করে নেবো।”

“আপনি বেআইনী কাজ করছেন, অফিসার!”

হেসে ফেললো নুরে ছফা। “মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করার জন্য যা যা করার করার দরকার সবই আমি করবো।”

ডাক্তার তাকিয়ে রইলেন ছফার দিকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না কী শুনছেন!

“আসলাম, তুমি উনার ঘরগুলো সার্চ করো।”

৪০. ডাক্তার আসকার

অধ্যায় ৪০

“দাঁড়ান!”

দাঁতে দাঁত পিষে বললেন ডাক্তার আসকার।

ছফা তার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ভদ্রলোক। তার শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসলাম। দরজার নবের দিকে হাত বাড়াতে উদ্যত সে।

“আমি নিজেই এনে দিচ্ছি।” কথাটা বলে নুরে ছফার জবাবের অপেক্ষা করেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

আসলামকে ইশারা করলো ছফা, দরজার নবটা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে। ডাক্তার তার শোবার ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সে-ও ঢুকে পড়লো ভেতরে। দরজাটা হাট করে খুলে রাখা হলো, সেই খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার তার ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে কী যেনো খুঁজছেন। তাকে শ্যেনদৃষ্টিতে বিদ্ধ করে রেখেছে আসলাম।

ডাক্তার নীলরঙের একটি পাসপোর্ট বের করে আসলামকে দেখাচ্ছেন, গানম্যান সেটা হাতে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার ফিরিয়ে দিলো তাকে, তারপর পুরো ঘরটা তল্লাশি করতে নেমে পড়লো। হতভম্ব ডাক্তার তাকালেন ছফার দিকে, হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করলো সে। দূর থেকেই বুঝতে পারলো, ডাক্তারের বৃটিশ পাসপোর্ট রয়েছে।

হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার আসকার চুপচাপ ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। “আমি আসলেই মোবাইলফোন আর ইউজ করি না…আগে করতাম।”

ছফা এ কথার কোনো জবাব দিলো না। এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য কথা। তার মতো একজন মানুষ মোবাইলফোন ব্যবহার না করে থাকতেই পারে না।

“আপনারা চাইলে আমার ল্যান্ডফোনটা ট্র্যাক করে দেখতে পারেন।”

“দরকার হলে সব কিছুই করবো আমি,” জবাব দিলো ছফা। হাত বাড়িয়ে দিলো ডাক্তারের দিকে।

ভদ্রলোক আস্তে করে পাসপোর্টটা দিয়ে দিলেন তাকে।

“তাহলে আপনি ডুয়েল সিটিজেন,” প্রশ্নের মতো শোনালো না ছফার কথাটা।

ডাক্তার এই পাসপোর্ট দিয়ে তিন বছর আগে যে আমেরিকায় গেছিলেন সেটার সত্যতা পাওয়া গেলো ভিসার সিল দেখে। কিন্তু নুরে ছফা অবাক হলো, খুব বেশি ভ্রমণের উল্লেখ নেই তাতে। এই পাসপোর্ট দিয়ে তিন বছরে পাঁচ বার বিদেশ যাবার নজির আছে। দু-বার আমেরিকায় আর বৃটেনে, একবার কানাডায়। শেষ বার তিনি যে আমেরিকায় গেছিলেন সেই সময় ওখানে মাত্র এক মাস ছিলেন, তারপরই ফিরে আসেন দেশে।

অবাক হয়ে তাকালো সে। “আপনি আপনার ড্রাইভারকে বলেছেন, খুব যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন, তাই তাকে নিয়মিত রাখার দরকার নেই?”

এমন তথ্য শুনে আসকার ইবনে সায়িদ চমকে উঠলেন একটু। “আমার ড্রাইভার?!”

“হ্যাঁ। আপনার আগের ড্রাইভার,” ছফা আত্মতুষ্টির সাথে বললো। “ওর সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে, আপনি অনেকটা সময় বাইরে থাকেন, দেশে আসেন অল্প সময়ের জন্য তাই রাখার দরকার নেই। কিন্তু এখানে যা দেখছি তাতে তো কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন ডাক্তার। “আমি আসলে ওকে ভুল বলেছিলাম।”

“কেন?”

“ওকে রাখবো না তাই।”

“কেন রাখবেন না? সমস্যা কি ছিলো?”

“আমি খুবই কম বাইরে যাই এখন,” গভীর করে দম নিয়ে নিলেন। “এতো অল্প মুভ করি যে, তার জন্যে ড্রাইভার রাখার কোনো দরকার দেখি না। তাছাড়া, চাইলে আমি হাসপাতালের গাড়ি ব্যবহার করতে পারি…নিজের জন্য আলাদা ড্রাইভার রাখার কোনো দরকার নেই।”

ছফা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“বুঝতেই পারছেন, সহজ অঙ্ক…সহজ হিসেব।”

এমন সময় গানম্যান আসলাম সবুজ রঙের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

ডাক্তারের দিকে তাকালো ছফা। আসলামের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। তার কপালে রীতিমতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।

সবুজ রঙের পাসপোর্টটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো গানম্যান। “আমার মনে হয় এই লোক তার মোবাইলফোনটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, স্যার।”

ডাক্তারের দিকে তাকালো নুরে ছফা। পরাজিত সৈনিকের মতো লাগছে তাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। দৃষ্টিতে শূণ্যতা।

“ভেঙেটেঙে কমোডে ফ্ল্যাশও করে দিতে পারে,” আসলাম যোগ করলো।

দেশি পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো ছফা। “আপনার কথাই ঠিক,” পাসপোর্টের পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখতে লাগলো সে। “আপনি ঘন ঘন বিদেশে যান।”

কপালে সদ্য জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। কোনো কথা বললেন না।

ভুরু কুঁচকে গেলো ছফার। পাসপোর্টের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, “ইন্ডিয়াতে গেছেন অনেক বার!”

আসকার ইবনে সায়িদ অনেক চেষ্টা করেও চোখেমুখে ভড়কে যাবার অভিব্যক্তিটা লুকাতে পারলেন না।

ডাক্তারের দিকে স্থিরচোখে তাকালো নুরে ছফা। “কলকাতায়!”

আস্তে করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ভদ্রলোক। “ওখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “তা থাকতেই পারে কিন্তু আপনি সেটা লুকানোর চেষ্টা করলেন কেন? আর এই পাসপোর্টটার কথাই বা চেপে গেলেন কেন?”

ডাক্তার ভড়কে গেলেন সামান্য।

“বৃটিশ পাসপোর্ট দেখিয়ে বিভ্রান্ত করলেন…এই পাসপোর্টটা, যেটা দিয়ে আপনি ঘন ঘন কলকাতায় যাতায়াত করেছেন, সেটা লুকিয়ে রাখার

চেষ্টা করলেন…কেন?”

আসকার ইবনে সায়িদ কিছুই বললেন না। সম্ভবত বলতে পারলেন না।

“আপনি কিছু না বললেও উত্তরটা আমি জানি, ডাক্তার, নুরে ছফা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রবীন চিকিৎসককে বিদ্ধ করলো যেনো। “মুশকান থাকে ওখানে!”

চোখ বন্ধ করে ফেললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।

“আমি নিশ্চিত!” ডাক্তারকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললো ছফা, “ওখানে কোথায় থাকে সে? আপনাকে বলতেই হবে।” শেষ কথাটা বেশ ধমকের সাথে বললো।

ডাক্তারকে দেখে মনে হচ্ছে, ছফার ধমকে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছেন তিনি।

.

অধ্যায় ৪১

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না তাতে নুরে ছফার রাগ হবার কথা কিন্তু এ মুহূর্তে সে বরং উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে। বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, শুধু দেখতে পাচ্ছে প্রবীন লোকটির কপালে ঘাম ছুটছে, নিজের বুকের উপর একটা হাত রেখে মেসেজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তীব্র ব্যথা হচ্ছে বুকে।

একটু আগে ছফার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার নিশ্চপ ছিলেন বলে আসলাম তাকে ভয় দেখানোর জন্য কোমর থেকে পিস্তল বের করেছিলো, এরপরই ভড়কে যায় ভদ্রলোক। এই কাজটা করার কোনো দরকারই ছিলো না। খুব সহজেই ছফা তার কাছ থেকে জরুরী তথ্যটা আদায় করে নিতে পারতো।

“কী হয়েছে?” বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। “বুকে ব্যথা হচ্ছে আপনার?”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। তার চোখেমুখে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে।

মনে মনে প্রমাদ গুণলো ছফা। “ঘরে এসি আছে?” জানতে চাইলো।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। সোফার সামনে টেবিলের উপর থাকা সাদা রঙের একটি রিমোট দেখিয়ে দিলেন ইশারায়।

“এসিটা ছাড়ো, আসলাম।”

নিজের পিস্তলটা কোমরে রেখে, রিমোটটা হাতে নিয়ে এসিটা অন করে দিলো গানম্যান।

“আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?” ছফা ঝুঁকে এলো ডাক্তারের দিকে।

খুব কষ্টে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক। “আ-আমাকে…” কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার, “…হাসপাতালে নিয়ে যান…”-প্লিজ!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না, এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।

যন্ত্রণাকাতর অবস্থায়ই আঙুল তুলে সোফার এক পাশে ল্যান্ডফোনটার দিকে ইশারা করলেন তিনি। “৯-১১…”

ছফা উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিলো।

“…৪-৬-৭-৮-৪-২…আমার হাসপাতালে…ওদেরকে বলুন আমার কথা…এ-একটা অ্যাম্বুলেন্স…” ডাক্তারের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে পড়লো। “এ-এক্ষুণি…” কথা জড়িয়ে এলো তার।

উদ্বিগ্ন হয়ে অরিয়েন্ট হাসপাতালে ফোন করে ডাক্তার আসকারের বাসায় দ্রুত একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করলো সে। রিসিভারটা ক্র্যাডলের উপর রেখে চেয়ে রইলো যন্ত্রণাকাতর ডাক্তারের দিকে। আসলাম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, কোনো রকম করুণা কিংবা সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে না তার অভিব্যক্তিতে। বরং ডাক্তারের আচমকা শরীর খারাপ হওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত সে।

নুরে ছফার আশঙ্কা, বৃদ্ধ এই চিকিৎসক হয়তো হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে আছেন। ডাক্তারের কাছ থেকে মুশকান জুবেরির অবস্থানের ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য জানা দরকার, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়। এরকম অবস্থায় ভদ্রলোককে চাপ দিয়ে কিছু আদায় করাটা বিপজ্জনক। তার নাজুক হৃদপিণ্ড হয়তো সহ্য করতে পারবে না। মরেটরেও যেতে পারেন!

তার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ডাক্তার যদি এ যাত্রায় বেঁচেও যান, তাহলে বলে দেবেন, ছফা আর আসলাম তার বাড়িতে বেআইনীভাবে ঢুকে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলো তাকে, বিনা ওয়ারেন্টে সার্চ করেছে তার ঘর।

ডাক্তার মরে গেলে ছফা আরো বেশি বিপদে পড়ে যাবে। এ বাড়ির দারোয়ান ছেলেটা তাদেরকে দেখেছে। পুলিশকে সে জানাবে তাদের কথা।

প্রধানমন্ত্রীর পিএস হয়তো সব কিছু সামলাতে পারবে, কিন্তু সেই পদ্ধতিটা যে কী হতে পারে, ভেবে গা শিউরে উঠলা-নিরপরাধ মানুষ হত্যা?

কক্ষনোই না!

মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলো ছফা, “আপনার এখন কেমন লাগছে?”

মাথা দোলালেন আসকার ইবনে সায়িদ, যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বললেন, “বুকে ব্যথা হচ্ছে…খু-উ-উ-ব!”

সর্বনাশ! যা ভেবেছিলো তা-ই। লোকটা হার্ট অ্যাটাকের শিকার! কিংবা কে জানে, এরইমধ্যে হয়ে গেছে কিনা!

সোফা থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে পকেট থেকে দ্রুত ফোনটা বের করে পিএসের নাম্বারে কল দিলো সে।

“হ্যালো, স্যার?” নীচুস্বরে বললো।

“কী হয়েছে?” ওপাশ থেকে জানতে চাইলো পিএস।

ছফা তাকে জানালো, ডাক্তার আসকারকে জেরা করতে গেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সম্ভাব্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

এ কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস শান্তকণ্ঠে বললো, “অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই আপনি আসলামকে নিয়ে ওখান থেকে চলে যান। এ মুহূর্তে ওখানে থাকার কোনো দরকার নেই আপনাদের।”

“কিন্তু এরকম অবস্থায় ডাক্তারকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে, স্যার?” নুরে ছফা দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইলো।

এ প্রশ্নের জবাবেও একই কথা বললো প্রধানমন্ত্রীর পিএস আর সেটা আগের চেয়েও জোর দিয়ে, “আপনারা এক্ষুণি ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার আগেই।

“কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার আগেই যদি ডাক্তারের কিছু হয়ে যায়?” ছফা আতঙ্কের সাথে বললো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন সময় নষ্ট না করে ওখান থেকে চলে আসুন।”

“ঠিক আছে, স্যার।” নুরে ছফা মোবাইলফোনটা পকেটে রেখে কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। আসকার ইবনে সায়িদের কাছে এসে জানতে চাইলে সে, “এখন কী অবস্থা, আপনার?”

“বুকে ব্যথা হচ্ছে!” ডাক্তার তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, তার চোখমুখ কুঁচকে আছে।

“অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়বে এক্ষুণি,” কথাটা বলে আসলামকে নিয়ে ঘরের এক কোণে চলে গেলো সে, নীচুকণ্ঠে বললো, “এই পাসপোটার সবগুলো পেইজের ছবি তুলে নাও…আমাদেরকে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে ঝটপট ছবি তুলতে শুরু করে দিলো আসলাম। “বুড়া অ্যাক্টিং করছে…” ছবি তুলতে তুলতেই নীচু কণ্ঠে বললো সে।

ছফা কিছু বললো না। তার কাছে মনে হচ্ছে না ডাক্তার অভিনয় করছেন। লক্ষণ বলছে, হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন ভদ্রলোক।

*

প্রায় পাঁচ মিনিট পর অসুস্থ ডাক্তার চোখ খুলে তাকালেন। তার ঘরে এখন কেউ নেই। একটু আগে দু-জন মানুষ কোনো কিছু না বলে তাকে একা রেখে চলে গেছে। সামনের টেবিলের উপর তার বৃটিশ আর বাংলাদেশি পাসপোর্ট দুটো পড়ে আছে। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা বাদ দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, এই পাসপোর্ট থেকে নুরে ছফা নামের ঐ ডিবি অফিসার কী-ই বা বের করতে পারবে?

আর যাই হোক, ওর ব্যাপারে কিছু জানার কথা নয়! অবশেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি।

.

অধ্যায় ৪২

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিজ বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন রমাকান্তকামার। চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগাছালি থেকে ঝিঁঝিপোকার দল একচ্ছত্র সুনসান পরিবেশকে বিরামহীন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যেনো। কালচে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। সেখানে অন্ধকারের সাথে পেরে উঠছে না ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো। দৃশ্যটা একটু উদাস করে দিলো তাকে। তাহলে কি আবারো তার জীবনে কালোছায়া নেমে এলো?

সারা দিন স্কুলে সময় দিয়ে বিকেলের দিকে চলে যান রবীন্দ্রনাথে, সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়-আজও তার ব্যতিক্রম করেননি, কিন্তু অন্যসব দিনের মতো ঘরে বসে বই পড়ে কিংবা স্কুলের কাগজপত্র নিয়ে না বসে একমনে ভেবে যাচ্ছেন। একটু আগে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার তাকে ফোন করেছিলো। ভদ্রলোক অনেকটা ক্ষোভের সাথেই জানতে চেয়েছেন, চিরকুটের বিষয়টা নুরে ছফা নামের ডিবি অফিসারকে তিনি কেন বলতে গেলেন! ভদ্রলোককে নাকি পিস্তল দেখিয়ে বাধ্য করেছে স্বীকার করতে, চিরকুটটা ডাক্তার আসকার তাকে দিয়েছিলেন। উকিলের কাছ থেকে সব শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন রমাকান্তকামার।

এ জীবনে কখনও সজ্ঞানে আইন ভঙ্গ করেননি তিনি, অপরাধীর সাথে যোগাযোগ রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। সমাজের হীন আর কুটিল লোকজনকে ঘেন্না না করে বরং সব সময়ই এড়িয়ে চলেন-এটাই তার নীতি। ঐ ছফাকেও এড়িয়ে যেতেন, কিন্তু সে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক, তাকে সাহায্য করা নৈতিক কর্তব্যই নয়, আইনত বাধ্যও তিনি। তাই চিরকুটের ব্যাপারে সত্যিটা বলেছিলেন। বেনামি একটি চিরকুট পাঠিয়ে শুধু নির্দোষ একটি অনুরোধ করেছিলো মহিলা-অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টটির জায়গায় একটি গ্রন্থাগার করা। রাশেদের স্ত্রী এমন অনুরোধ না করলেও সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি লাইব্রেরি করতেন মাস্টার-আর সেটা হতো বহুকাল আগের বিস্মৃত আর ধ্বংস হওয়া একটি প্রতিষ্ঠানকে পুণরুজ্জীবিত করার শামিল।

তিন বছরেরও বেশি আগে, রাশেদ জুবেরির স্ত্রী সুন্দরপুর ছাড়ার আগে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। সত্যি বলতে, এখানে আসার পর থেকে বার কয়েকই চেষ্টা করেছিলো ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিন্তু মাস্টার এড়িয়ে গেছেন। মহিলা যে রাশেদের স্ত্রী সেটা নিয়ে তার মনে ছিলো সন্দেহ। তবে সমস্ত সন্দেহ, সংশয় আর দূরত্ব ঘুচিয়ে অবশেষে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সেটা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। মহিলা তাকে বলেছিলো, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহর কারণেই এই ট্রাস্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। যদি সে ট্রাস্টের ঘোষণা দিতো, এমপি নির্ঘাত মাস্টারের ক্ষতি করতো। আর সেটা যে কী, বললেও চলে। তাই আসাদুল্লাহর লোলুপ দৃষ্টি থেকে জমিগুলো আগলে রাখার চেষ্টাই করে গেছে এতো দিন। মাস্টারের কাছেও মনে হয়েছে, কথাটার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। আসাদুল্লাহর রূপ তো তিনি কম দেখেননি।

ক্ষয়িষ্ণু চাঁদটার দিকে তাকালেন রমাকান্তকামার। তিনি এখনও বিশ্বাস করেন গাছের সাথে মানুষের পার্থক্য আছে। আম গাছে জাম হবে না, আমই হবে। কিন্তু মানুষের বেলায় এটা খাটে না। চোরের ছেলে চোর হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার সাধুর ছেলে যে চোর হবে না তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না। তারপরও বাস্তবতা হলো, অনেক সময়ই দেখা যায় চোরের ছেলে চোরই হয়! এ হলো সঙ্গদোষের ব্যাপার। পরিবেশ আর সময় তাকে প্রভাবিত করে। জন্মের পর মানবশিশু সাদা কাগজের মতোই নিষ্কলঙ্ক থাকে, কিন্তু তাতে দাগ ফেলে তার অভিভাবক, পরিবার, পরিবেশ আর সময়। এসব যদি শিশুর অনুকূলে না থাকে, সে শিশু মানুষ হবে কিভাবে? কয়জন পারে নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ আর সময়কে জয় করতে?

সুন্দরপুরের মুসলিম লীগের পাণ্ডা হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ কি তার বাপের মতো হয়নি?

হামিদুল্লাহ ছিলো আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিলো তার দুচক্ষের বিষ জমিদার থেকে মুচি; ব্রাহ্মণ থেকে নমশূদ্র, এমনকি ব্রাহ্মরা পর্যন্ত। তার কাছে তাদের সবার পরিচয় ছিলো একটাই-মালাউনের বাচ্চা! ইন্ডিয়ার দালাল! ব্রাহ্মরা যে হিন্দু না এটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও রাজনৈতিক আর জাগতিক ফায়দার কথা ভেবে চেপে যেতো। এই ঘেন্নার রাজনীতি তাকে শেষ পর্যন্ত অমানুষে পরিণত করে। একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাস সুন্দরপুরের সবাই সেই অমানুষটাকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছে।

কী একটা সময়ই না ছিলো!

নিজের অজান্তেই, কখন যে স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন টেরই পেলেন না রমাকান্তকামার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি বড় বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। এই নিঃসঙ্গ জীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আগের চেয়ে অনেক বেশি পুরনো স্মৃতি তাকে কাতর করে তোলে। এই যেমন এখন, একাত্তরের নানান ঘটনা তার মানসপটে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

রাশেদ জুবেরির মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। কী সহজ সরল আর ভালো মানুষই না ছিলো! এতো সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জাগতিক বিষয়ে এক ধরণের বৈরাগ্য ছিলো তার মধ্যে। সম্ভবত এক লহমায় বাবা-মা, নানাসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর কারণে তার এই বৈরাগ্যভাবের জন্ম। সেদিন যমের তালিকায় সে-ও ছিলো, কিন্তু রমাকান্তকামারের বাসায় থাকার দরুন বেঁচে যায়। বইয়ের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণই তাকে টেনে এনেছিলো এই বাড়িতে। সুন্দরপুরে সপরিবারে বেড়াতে এসে হাপিয়ে উঠেছিলো সে। একটাও লাইব্রেরি নেই, এ কেমন মফশ্বল! কিন্তু সে তখনও জানতো না, এক সময় এই সুন্দরপুরে ছিলো রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার, ঘেন্নার রাজনীতিতে সেই রবীন্দ্রনাথ পুড়ে খাক হয়ে গেছিলো। তবে রবীন্দ্রনাথের অমূল্য সম্পদের বিরাট একটি অংশ রক্ষা করতে পেরেছিলেন মাস্টার। পয়ষট্টি থেকে গত বছর রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরিটি পুণরায় দেবার আগ পর্যন্ত সযত্নে নিজের বাড়িতে আগলে রেখেছেন বইগুলো। একটা বইও পোকায় খেতে পারেনি, অনাদরে নষ্ট হয়নি। সন্তানের স্নেহে সেগুলো আগলে রেখেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছর।

রাশেদের মা অঞ্জলি জানতো এটা। মাস্টারের সাথে তার ছিলো বেশ ভালো সম্পর্ক। অঞ্জলিই ছেলেকে গল্পটা বলেছিলো-এক সময় সুন্দরপুরে ছিলো রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি, আর সেটা দিয়েছিলেন ত্রিলোকনাথ বসু। পয়ষট্টির দাঙ্গায় লাইব্রেরিটা কিভাবে পুড়ে যায়, আর বইগুলো কিভাবে মাস্টার রমাকান্তকামার রক্ষা করেছিলেন, এই গল্পটাও করেছিলো সে। রাশেদ সব শুনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, মাস্টারের বাড়িতে হানা দেয়। বইয়ের সংগ্রহ দেখে ছেলেটার ভুরু কপালে উঠে গেছিলো। বহু দুষ্প্রাপ্য বই তাকে আকর্ষিত করেছিলো পতঙ্গের মতোই। বইয়ের টানে মাস্টারের বাড়িতে পড়ে থাকার সময়ই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি। সুন্দরপুরে হানা দেয় পাক-হানাদাররা, আর তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলো সেই জঘন্য লোকটি-আসাদুল্লাহর বাপ, মুসলিম লীগার হামিদুল্লাহ্। নয়টা মাস সে কখনও যমের দোসর ছিলো তো কখনও নিজেই যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কতো মানুষ হত্যা করেছে, কতো লুণ্ঠন আর ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিলো কে জানে। তার নয় মাসের পশুরাজত্ব শেষ হয় পনেরোই ডিসেম্বর-স্বাধীনতা পাবার ঠিক এক দিন আগে।

একাত্তরের মোলোই ডিসেম্বরের আগের দিন সুন্দরপুর যখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মুক্ত করে ফেললো তখন হামিদুল্লাহ্ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তার লুণ্ঠিত ধনসম্পদের কিছু অংশ নিয়ে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরে ফেলে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, যে বাড়িতে মিলিটারি ক্যাম্প করে মানুষজন হত্যা করতো, নির্যাতন করতো সেই জমিদার বাড়িতে নিয়ে গিয়েই তাকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক বছর পর সেই আল-বদর নেতার ছেলে যখন এলাকার এমপি হয়ে গেলো তখন মাস্টারকে একদিন ডেকে নিয়ে গেছিলো একটা কথা জানার জন্য-মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলে রাশেদ জুবেরি ছিলো কিনা!

রমাকান্তকামার জানতেন, এতোদিন পর এই লোক এটা কেন জানতে চায়-জমিদারের সম্পত্তিগুলো জবর দখল করার জন্য যুৎসই একটি বাহানা খুঁজছে বাপের যোগ্য ছেলে!

মাস্টার তাকে বলেছিলেন, ঐদিন রাশেদকে দেখেননি তিনি। তখন সে সুন্দরপুরে এসেছিলো কিনা তা-ও তার জানা নেই। তার সাথে জুবেরির দেখা হয়েছিলো সতেরোই ডিসেম্বর সকালে। সমগ্র জীবনে সজ্ঞানে মাত্র তিনটি মিথ্যা বলেছিলেন তিনি দ্বিতীয় মিথ্যাটি বলার সময় তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। যুধিষ্ঠিরকেও তো মিথ্যে বলতে হয়েছিলো সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য! নিজেকে এভাবেই বুঝ দিয়েছিলেন মাস্টার।

তবে এটাও ঠিক, তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না আসলেই ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি হামিদুল্লাহকে হত্যা করেছিলো সেই দলে রাশেদ ছিলো কিনা। যুদ্ধফেরত ছেলেটার সঙ্গে তার দেখা হয় হামিদুল্লাহর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর। নরম স্বভাবের রাশেদ জুবেরির চোখমুখ দেখে মাস্টার শুধু কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

স্বাধীনতার পর, মাঝেমধ্যে কিছু দিনের জন্য সুন্দরপুরে এসে মাস্টারের বাসায় উঠতো রাশেদ, নানার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেও যেতো না। সম্ভবত ওখানে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছিলো বলে পারিবারিক বধ্যভূমিটা এড়িয়ে চলতো সে। তো, এরকমই একদিন রাশেদ জুবেরি মাস্টারের বাড়িতে বেড়াতে এসে এ কথা ওকথা বলার এক পর্যায়ে বলেছিলো, যুদ্ধের আগে একটা মুরগি কাটতে দেখলেও তার বুক কেঁপে উঠতো, মায়া হতো, এমনকি যুদ্ধের সময় হানাদার পাকবাহিনী মারতেও তার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করতো, কিন্তু খুন হবার আগে হামিদুল্লাহর করুণ চেহারাটা দেখলে নাকি তার একটুও মায়াদয়া হতো না!

নাকি হয়নি?!

মাথা থেকে আবারো পুরনো স্মৃতিগুলো বিদায় করে হাই তুললেন মাস্টার। বর্তমান সমস্যাটা নিয়ে আবার ভাবতে লাগলেন। ট্রাস্টের সদস্য ডাক্তার আসকার কোথায় আছে সেটা নাকি ময়েজ উদ্দিন বলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে ছফা কী করে কে জানে! তাকে আগেভাগে বলে দিলেই পারতেন! কিন্তু জীবনে প্রথম তিনি স্বার্থপরের মতো হাতপা গুটিয়ে রেখেছেন। আর এটা মোটেও নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য নয়-তার স্বপ্নের গায়ে যাতে আঁচড় না লাগে সেজন্যে।

.

অধ্যায় ৪৩

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বাড়ি থেকে দশ-পনেরো গজ দূরে, ছায়াঘন এক জায়গায়, ইনসাইড লাইট বন্ধ করে গাড়ির ভেতরে বসে আছে নুরে ছফা আর আসলাম। গাঢ় হয়ে উঠেছে সন্ধ্যা, জ্বলে উঠেছে রাস্তার বাতিগুলো।

একটু আগে ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। এখনও কোনো কথা হচ্ছে না। দু-জনেরই দৃষ্টি ডাক্তারের সুনশান বাড়িটার দিকে। ওখান থেকে বের হবার আগে দারোয়ানকে অবশ্য ডাক্তারের অসুস্থতার কথা বলে এসেছে। আরো বলেছে, কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে, চিন্তার কিছু নেই, সে যেনো ডাক্তারের সাথে থাকে।

এ কথা শুনে দারোয়ান যা বলেছে সেটা নিয়ে নুরে ছফা এখন চিন্তিত। লোকটা তাদের দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যেনো, দু-দুজন দস্যু জোর করে বাড়িতে ঢুকে ডাক্তারকে হত্যা করার জন্য পয়জন ইনজেকশান দিয়ে চলে যাচ্ছে!

“হায় আল্লাহ! স্যারে আপনেরা কী করছেন?”

লোকটা ভয়ার্ত চোখেমুখে এ প্রশ্ন করলে আসলাম রেগেমেগে তার কলার ধরে বসেছিলো, অবশ্য ছফা তাকে বিরত রাখে। তার নিজেরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিলো দারোয়ানের এমন কথা শুনে। তারপরও রাগ সামলে ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিলো, এসব উল্টাপাল্টা কথা যেনো সে না বলে। তার স্যারের তেমন কিছু হয়নি। বৃদ্ধ মানুষ, একটু জিজ্ঞাসাবাদের কারণে ঘাবড়ে গেছেন। সম্ভবত তার প্রেসার বেড়ে গেছে, তাই বুকে একটু ব্যথা হচ্ছে। তার নিজের হাসপাতালে ফোন করা হয়েছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।

কিন্তু সেই অ্যাম্বুলেন্স এখনও আসেনি। ছফার চিন্তা এখন একটাই-ডাক্তারের না আবার খারাপ কিছু হয়ে যায়!

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার জন্য গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো সে। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলাম তাকালো তার দিকে। “স্মোক করবো,” আস্তে করে বললো ছফা। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে একটাতে আগুন ধরালো। সিগারেটে যখন দ্বিতীয় টানটা দেবে তখনই দেখতে পেলো অরিয়েন্ট হাসপাতালের লোগো আর নাম লেখা একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির ডাক্তারের বাড়ির সামনে। তড়িঘড়ি দারোয়ান ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিলো, অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়িতে ঢুকতেই বন্ধ করে দিলো আবার।

“সব ভুগিচুগি,” আসলাম বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো।

তার দিকে তাকালো ছফা। বিরক্তভরা দৃষ্টি নিয়ে ডাক্তারের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিএসের গানম্যান।

“অ্যাক্টিং করেছে,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “আমি একদম শিওর।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা, তবে কিছুই বললো না। ডাক্তার যদি অভিনয় করে থাকেন তাহলে বলতেই হবে, তিনি বেশ পাকা অভিনেতা। কিন্তু ভদ্রলোকের ঘর্মাক্ত কপাল, যন্ত্রণাকাতর চোখমুখ-এসব দেখে অভিনয় বলে মনে হয়নি তার কাছে। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে সেটা বের করে দেখলো পিএস আশেক মাহমুদ কল দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তার মতোই ক্ষমতাধর এই মানুষটিও চিন্তিত।

“স্যার?”

“এনি আপডেট?” ওপাশ থেকে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ, তার কণ্ঠেও উদ্বিগ্নতা।

“অ্যাম্বুলেন্স এসেছে,” ছফা বললো। “এখন বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে…ডাক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।”

“আপনারা কোথায়?”

“ডাক্তারের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আছি, স্যার।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে পিএস বললো, “মরেটরে যাবে না তো?”

“বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা, ঐ দারোয়ান ছাড়া আর কে দেখেছে আপনারা বাড়িতে ঢুকেছেন?”

জবাবটা দেবার আগে একটু সময় নিলো ছফা। পিএস কি উইটনেস এলিমিনেট করার কথা ভাবছে?! চিন্তাটা আবারো ভড়কে দিলো তাকে।

“আর কেউ না, স্যার,” বললো সে। “কিন্তু ঐ দারোয়ান সম্ভবত অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে হাসপাতালে যাবে।” ছফার আশঙ্কা, পিএস হয়তো তার গানম্যানকে নির্দেশ দেবে, একমাত্র সক্ষি দারোয়ানকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু সেটার জন্যেও যে একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই যেনো বলতে চাইলো।

কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো পিএস। “আরেকটু পর আমি আবার কল দেবো আপডেট জানতে। দেখা যাক কী হয়।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ফোনটা পকেটে রেখে আনমনা হয়ে গেলো ছফা। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলামের দিকে চকিতে তাকালো। গানম্যানের দৃষ্টি এখনও গেটের দিকেই নিবদ্ধ। সামনের দিকে তাকালো সে। দারোয়ান নির্ঘাত এরইমধ্যে তাদের কথা অ্যাম্বুলেন্সে করে আসা লোকজনকে বলে দিয়েছে। তাছাড়া, ডাক্তার যদি মারা যাবার আগে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পারেন, তাহলেও তাদের কথা জানিয়ে দিতে পারবেন নিজেই। সব দিক থেকে ভালো হয়, ডাক্তার যদি এ যাত্রায় টিকে যান। নুরে ছফা মনে মনে সেই কামনাই করলো।

“মরবে না,” আস্তে করে বললো আসলাম, যেনো ছফার আশঙ্কাটা টের পেয়ে গেছে সে। “চিন্তার কিছু নেই।”

গানম্যানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি এখনও সামনের দিকেই নিবদ্ধ। এই লোকটা কি তার মনের কথা পড়তে পেরেছে? নাকি তার উদ্বিগ্নতা আঁচ করতে পেরেছে?

“হুম।” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। ডাক্তার যেনো এ যাত্রায় বেঁচে যান!

কিছুক্ষণ পরই ডাক্তারের বাড়ির মেইন গেটটা খুলে গেলো আবার। অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে একটু সময়ের জন্য থামলো। এই ফাঁকে মেইনগেট বন্ধ করে তালা মেরে অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে উঠে বসলো দারোয়ান। কোনো রকম সাইরেন না বাজিয়ে, অনেকটা চুপিসারে চলে গেলো গাড়িটা।

ওটা ফলো করো-এরকম কোনো আদেশ দিতে হলো না ছফাকে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটাকে অনুসরণ করতে শুরু করে দিলো আসলাম।

কিন্তু ছফাকে হতাশ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত এই অনুসরণ পর্বটি শেষ হলো অরিয়েন্ট হাসপাতালে গিয়েই। দূর থেকে তারা দেখতে পেলো অ্যাম্বুলেন্সটি ঢুকে পড়ছে হাসপাতালের ভেতরে।

“ওখান দিয়ে তো লাশ বের করে,” আসলাম বললো সন্দেহের সুরে। “আমি এই হাসপাতালে এর আগেও এসেছি…ওটা এমার্জেন্সি এন্ট্রান্স না।”

তার দিকে তাকালো নুরে ছফা। “লাশ বের করে ওখান দিয়ে?” কথাটা বলার সময় তার কাছে মনে হলো ডাক্তার বুঝি মারাই গেছেন।

“গত বছর আমার এক খালাতো ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিলো এই হাসপাতালে, ওর লাশটা ওখান দিয়েই বের করেছিলো।”

ছফা কিছুই বললো না।

“বুড়ো অ্যাক্টিং করেছে,” আসলাম আবারো বললো কথাটা।

পিএসের গানম্যানের দিকে তাকালো সে, তার চোখেমুখে রাগ, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।

.

অধ্যায় ৪৪

“তাহলে আপনি মনে করছেন ঐ মহিলা কলকাতায় আছে?”

“জি, স্যার,” বললো ছফা। “আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।”

তারা এখন বসে আছে গুলশান নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে, জায়গাটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাসা আর অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে খুব একটা দূরে নয়। আসলাম তাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে আবার চলে গেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালে। ডাক্তার সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে গেছে সে।

“ডাক্তারের পাসপোর্ট সেটাই বলছে। উনি যে ঘন ঘন কলকাতায় যান সেটা লুকানোর চেষ্টা করেছেন। এর মানে একটাই-মুশকান জুবেরি কলকাতায় আছে। তা না-হলে ভদ্রলোক এটা করতেন না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “হুম। ইট ডাজ মেক সেন্স।”

ছফা বুঝে উঠতে পারছে না, ডাক্তার যে নতুন গল্পটা বলেছেন মুশকানের ব্যাপারে সেটা পিএসকে বলবে কিনা। তার কাছে মনে হচ্ছে, আগেভাগে না বলাই ভালো, আরেকটু খতিয়ে দেখা দরকার। ঐ ভদ্রলোকের কোন কথাটা যে সত্যি, সে নিজেও জানে না। একটা প্রহেলিকা তৈরি করেছেন বৃদ্ধ ডাক্তার। গোলকধাঁধাতুল্য সেই প্রহেলিকা থেকে বের হবার একটাই উপায়-মুশকানকে হাতের মুঠোয় নেয়া।

“তাহলে “খন কী করবেন?” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে জানতে চাইলে পিএস আশেক মাহমুদ।

ছফা কোনো সময় না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, “আমার কলকাতায় যাওয়া দরকার। বেশি দেরি করলে ঐ মহিলা ওখান থেকেও সটকে পড়তে পারে।”

“এতোক্ষণে সটকে পড়েছে কিনা কে জানে,” তিক্তমুখে বললো পিএস।

“আমার তা মনে হয় না, স্যার, জোর দিয়ে বললো। “ডাক্তার যদি এরইমধ্যে মুশকানকে সব জানিয়েও দেন, অতো দ্রুত কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না মহিলা।”

“আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?”

“ডাক্তার জানেন আমি কেবল তার ঘনঘন কলকাতায় যাবার বিষয়টি আবিষ্কার করেছি…তিনি ওখানে কোথায় উঠতেন, কোথায় যেতেন সেটা আমি জানি না। তাছাড়া আমার মনে হয় না, ডাক্তারের সাহায্য ছাড়া ঐ মহিলা আবারো নতুন কোনো আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সহজে। একটু সময় লাগবেই।”

“হুম,” গম্ভীরভাবে বললো পিএস।

“কলকাতার মতো শহরে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা অসম্ভব না হলেও অনেক কঠিন আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”

“তাহলে আপনি তাকে কিভাবে খুঁজে বের করবেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ।

একটু ভেবে নিলো ছফা। প্রথমেই তার মনে পড়লো কেএস খানের কথা। সাবেক এই ইনভেস্টিগেটর তাকে নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভালো সাহায্য করতে পারবে। “ঐ মহিলাকে খুঁজে বের করার একটা উপায় বের করতে হবে দ্রুত,” বললো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস।

“ওখানে এক পুলিশ অফিসারের সাথে আমার বেশ ভালো জানাশোনা আছে, আশা করছি তার কাছ থেকে সাহায্য পাবো।”

“তাহলে আপনি কবে যেতে চাইছেন?” একটু থেমে আবার বললো পিএস, “আপনার কি ভিসা আছে?”

“আমার পাঁচ বছরের ভিসার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি, স্যার।”

“গুড। আপনি তাহলে আমাকে জানান, কবে যেতে চান। এয়ার। টিকেট নিয়ে ভাববেন না। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের মালিক আমার পরিচিত। টিকেট না থাকলেও যখনই চাইবেন, আপনার জন্যে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে সে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“ঐ ডাক্তার যাতে বিদেশে চলে যেতে না পারে সেটার ব্যবস্থাও করা যাবে। আপনি তার পাসপোর্টের ছবি আসলামের ফোনে সেন্ড করে দেবেন। আমি ইমিগ্রেশনে বলে দেবো, ঐ ডাক্তার দেশের বাইরে যেতে পারবে না।” ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবার বললো, “ঐ ডাক্তার যদি বেঁচে থাকে তাহলে আপনি ওখান থেকে ফিরে এসেও তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।”

“আমি খুব দ্রুতই যেতে চাইছি, স্যার…কাল-পরশুর মধ্যেই।”

“হুম,” গম্ভীর হয়ে সায় দিলো পিএস। “একটা কথা। আপনি যদি ওই মহিলাকে ওখানে ট্র্যাক ডাউন করে ফেলতে পারেন তখন কী করবেন?”

“মুশকানকে ওখানে খুঁজে পেলেও তাকে গ্রেফতার করে দেশে আনাটা সহজ হবে না। ওদের সাথে আমাদের এক্সট্রাডিশান প্যাক্ট রয়েছে, কিন্তু সেটা করতে অনেক সময় লাগে, মামলার নথিপত্রও সবমিট করতে হয়। এ কাজটা আমি একটু অন্যভাবে করতে চাই।”

“কিভাবে?”

“আমার ধারনা ঐ মহিলা অবৈধভাবে ওখানে গেছে। এখান থেকে সরকারীভাবে অনুরোধ জানালে তাকে পশ্চিবঙ্গের অথরিটি খুব সহজেই পুশব্যাক করে দিতে পারবে সীমান্ত দিয়ে। সেখান থেকে আমি তাকে নিজের হেফাজতে নিয়ে নেবো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস। এভাবে অসংখ্য পুশব্যাকের মাধ্যমে আসামি আদানপ্রদান করে দুই প্রতিবেশী দেশ। “আর মহিলা যদি বৈধভাবে ওখানে গিয়ে থাকে, তাহলে?”

“তাতেও সমস্যা নেই। তার বিরুদ্ধে যে কেসগুলো আছে সেগুলো ওদেরকে জানাবো, আসামিকে পুশব্যাক করতে বলবো।”

একটু ভেবে নিলো পিএস। “সে যদি ওখানকার সিটিজেনশিপ বাগিয়ে নেয়? তিন বছর আগে গিয়ে থাকলে তো এই দীর্ঘ সময়ে নাগরিকত্ব নিয়ে নেয়াটা অসম্ভব কিছু না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। এটারও সম্ভাবনা আছে।

“নিরাপদ থাকার জন্য, সম্পূর্ণ নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে ভিন্ন একটি দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারে ঐ মহিলা।”

একটু চিন্তায় পড়ে গেলো নুরে ছফা। ওখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে নিলে মুশকানকে দেশে নিয়ে আসাটা সহজ হবে না।

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,” ছফাকে আশ্বস্ত করে বললো আশেক মাহমুদ। “ওরকম কিছু হলে তাকে সবার আগে নিজের কজায় নিয়ে নিরাপদ কোথাও রেখে দেবেন, বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা আমি করতে পারবো।”

.

অধ্যায় ৪৫

গভীর করে শ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকালো আসলাম। অরিয়েন্ট হাসপাতালের ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে যে ওয়েটিং এরিয়াটি আছে সেখানে বসে আছে সে। অন্য রোগীদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনও আছে বাকি চেয়ারগুলো দখল করে। কেউ কেউ পায়চারী করছে চিন্তিত মুখে। তাকে দেখলে, ঐসব আত্মীয়স্বজনদেরই একজন বলে মনে হবে। আদতে সে এসেছে চতুর আর ধূর্ত ডাক্তার আসকারকে নজরদারি করতে-আসলাম পুরোপুরি নিশ্চিত, বুড়োটা অসুস্থ হবার ভান করেছে।

এরকম কাজ পিএসের গানম্যান হিসেবে চাকরি নেবার পর আরো দুয়েক বার করেছে, সুতরাং সে জানে, কতটা বিরক্তিকর হতে পারে এটা। চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ এমনিই তাকে নিয়োগ দেয়নি। যদিও মুরে ছফার মতো অনেকেই জানে না, সে আসলে পিএসের নিছক কোনো গানম্যান নয়। আশেক মাহমুদের এমন সব ব্যক্তিগত কাজ সে করে দেয় যেগুলো অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় না। গানম্যান কিংবা গানম্যান থেকে তার কাজ আরো বিস্তৃত-বহুমুখি!

নিয়ম অনুযায়ি, প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে পুলিশ বাহিনী থেকে একজন গানম্যান পায় আশেক মাহমুদ, কিন্তু ওকে নিয়ে খুব একটা ঘুরে বেড়ায় না, কেবলমাত্র সরকারী অনুষ্ঠানেই ওই গানম্যান তার সঙ্গে থাকে, বাকি সময়ে তার সারাক্ষণ সঙ্গী হয় আসলাম।

এ মুহূর্তে তার হাতে একটি পত্রিকা, মাঝে মাঝে ওটা খুলে পড়ার ভান করছে, তবে তার নজর আসলে ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের দরজার দিকেই নিবদ্ধ। এর আগেও এক আত্মীয়ের হার্ট অ্যাটাক হলে এই হাসপাতালে এসেছিলো, তখন দেখেছে কিভাবে এই হাসপাতালটি চলে। এখন অপেক্ষা করছে, ডাক্তারের সত্যিকারের হালহকিকত জেনে নিতে।

আসলাম জানে, তাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এই ইউনিটে এখন পর্যন্ত পাঁচজন রোগীর নাম সে মুখস্ত করেছে। সিকিউরিটি অফিসার-কাম-রিসেপশনিস্ট বসে আছে সে মাঝেমধ্যেই রোগীর নাম ধরে তার আত্মীস্বজনদের খোঁজ করছে। একজন রোগীর নাম উচ্চারণ করে আর ওয়েটিং এরিয়ায় বসে থাকা উদ্বিগ্ন আত্মীয়ের দল ছুটে যায় তার কাছে। সে তখন জানায় তাদের মধ্যে একজন ভেতরে ঢুকতে পারে রোগীকে দেখার জন্য। রোগী নিজেই নাকি বলেছে অমুকের সাথে দেখা করতে চাইছে।

আবার অনেক সময় রোগীর আত্মীয়েরা হন্যে হয়ে খোঁজ নেয় রিসেপশনিস্টের কাছে তাদের রোগীর অবস্থা জানতে। তখন ঐ লোক ইন্টারকমের মাধ্যমে ভেতরের ডাক্তারের সাথে কথা বলে একজন-দুজনকে অনুমতি দেয় দেখা করার জন্য।

শিকারির মতো ধৈর্য নিয়ে আসলাম এখন বসে আছে ওয়েটিং এরিয়ায়। ক্ষিদেয় তার পেট চৌ চৌ করলেও সেটা দমিয়ে রেখেছে। সব কিছু দেখে তার মনে হচ্ছে, একটু পরই আইসিসিইউতে ঢোকার সুযোগ পেয়ে যাবে।

যেহেতু ডাক্তারের কোনো আত্মীয়স্বজন এখনও আসেনি, ইচ্ছে করলে সে আত্মীয় সেজে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে জানে, এটা করা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি বিরাট বড় বোকমি হবে। এই হাসপাতালটি ডাক্তারের নিজের, তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এখানে ঢোকা সম্ভব নয়। এখানকার অনেকেই লোকটার নিকটাত্মীয়দের চেনে। তাছাড়া, অন্য রোগীর তুলনায় তার বেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। বুড়োটা যদি ভান করে থাকে, তাহলে সতর্কতার মাত্রা হবে আরো বেশি। আসলাম তাই অন্যভাবে কাজটা করবে।

একটা হাই তুলে পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরলো আবার। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলো রিসেপশন থেকে বলা হচ্ছে :

“আবিদুর রহমানের লোক আছে এখানে?”

ওয়েটিং এরিয়ার দিকে তাকালো আসলাম, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সম্ভবত এই রোগীর আত্মীয়স্বজন নীচে গেছে চা-সিগারেট খেতে। চট করে উঠে দাঁড়ালো সে, এগিয়ে গেলো রিসেপশনের দিকে।

“কি হয়েছে, বলুন?” উদ্বিগ্ন আত্মীয় হিসেবে জানতে চাইলো সে।

“আপনার সাথে ডাক্তারসাহেব কথা বলবেন…ভেতরে যান,” বললো রিসেপশনের লোকটা।

আসলাম আর কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ভেতরে ঢোকার পর একজন পুরুষ নার্স তাকে গাউন আর হেডক্যাপ পরতে বললো। দরজার পাশে থাকা র‍্যাক থেকে গাউন আর হেড-ক্যাপটা নিয়ে পরে ফেললো সে। এরপর নার্স ইশারা করলো বিশাল বড় রুমটায় ঢোকার জন্য।

আইসিসিইউ’র বিশাল রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো আসলাম। দু-পাশে সারি সারি বেড, প্রত্যেকটাই কার্টেন দিয়ে আড়াল করা। প্রত্যেক বেডের পাশেই অনেকগুলো যন্ত্রপাতি আর মনিটর আছে। রোগীদের বেশির ভাগ অক্সিজেন মাস্ক পরা। এক দু-জন বাদে সবাই নিথর হয়ে পড়ে আছে। ঘরের শেষ মাথায় কম্পিউটার আর কিছু মেশিনসংবলিত বিশাল একটি ডেস্কের ওপাশে অ্যাপ্রোন পরা এক ডাক্তার বসে আছে। বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নার্স থাকলেও তারা বলতে গেলে নিঃশব্দেই চলাফেরা করছে এক বেড় থেকে আরেক বেডের দিকে।

আসলাম ভালো করে দু-পাশে তাকালো, ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখে গেলো কোন্ বেডে ডাক্তার আসকার আছেন। তার এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধীরগতির ভ্রমণটি শেষ হলো ঘরের শেষ মাথায় থাকা ডেস্কের সামনে এসে।

এখানে ডাক্তার নেই! বিস্ময়ের সাথেই আবিষ্কার করলো সে।

“আমি আবিদুর রহমানের ছোটোভাই,” ডেস্কে বসে থাকা ডাক্তারকে বললো আসলাম। “আমার রোগীর কী অবস্থা, বলেন?” কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাও করলো না।

ডেস্কের ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে করুণ মুখে বললো, “আপনার রোগীর অবস্থা তো ভালো না। তার হার্ট মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট কাজ করছে, অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।”

আসলামের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। এখন কী করবো তাহলে?”

“অবস্থা বেশি খারাপ হলে কি লাইফ সাপোর্ট দেবো?”

শালার বানচোতের দল! গালিটা মনে মনেই দিলো সে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কখনও কোনো রোগী বাঁচাতে পেরেছিস! অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা জানে, তারপরও বিলের অঙ্ক ভারি করার জন্য হাসপাতালগুলো এ কাজ করতে দারুণ তৎপর থাকে সব সময়।

“না। তার কোনো দরকার নাই,” কাটাকাটাভাবে বললো সে। অচেনা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের টাকা বাঁচিয়ে দেবার মতো পূণ্য কাজটা করলো।

ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো আসলামের দিকে, যেনো পাষণ্ড কোনো ছোটোভাইকে দেখছে।

“আমার ভাই বলে দিয়েছেন তাকে যেনো লাইফ সাপোর্টে দেয়া না হয়।”

“ওহ্,” আশাহত ডাক্তার শুধু এটুকুই বললো, তারপর ফিরে তাকালো কম্পিউটার মনিটরের দিকে।

আসলাম তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়ালো, যা বোঝার বুঝে গেছে সে। মাত্র পা বাড়াবে দরজার দিকে অমনি একটা বুদ্ধি খেলে গেলো তার মাথায়। আবারো ফিরলো ডেস্কের দিকে।

“আচ্ছা, আমি শুনেছি এখানে ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট…উনার কী অবস্থা?”

তরুণ ডাক্তার বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে। “ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট?!”

“হুম, সেরকমই তো শুনলান। আমার বাবার বন্ধু উনি,” মিথ্যেটা সুন্দরভাবে বললো পিএসের গানম্যান। এখানে আসার পর শুনলাম উনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে…অ্যাডমিট হয়েছেন আজই।”

ডাক্তার কী বলবে ভেবে পেলো না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “উনি তো এখানে অ্যাডমিট হননি,” অবশেষে বললো সে। “আমি এরকম কিছু শুনিওনি।”

“তাহলে কি উনাকে এমার্জেন্সি থেকেই রিলিজ দিয়ে দেয়া হয়েছে?”

ঠোঁট ওল্টালো তরুণ ডাক্তার। “নিজের হাসপাতালে এলে ইমার্জেন্সি থেকে চলে যাবেন?” মাথা দোলালো। “মিনিমাম কয়েক দিন অবজার্ভেশনে থাকবেন না?”

আসলাম কিছুই বললো না।

মাথা দোলাতে দোলাতে তরুণ ডাক্তার কম্পিউটার মনিটরের দিকে মনোযোগ দিলো আবার। নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে এখনও। ডাক্তার আসকারের এমন খবর শুনে সে-ও ভিরমি খেয়েছে।

উল্টো দিকে ঘুরে চুপচাপ আইসিসিইউ থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালো আসলাম।

ডাক্তার এই হাসপাতালে নেই।

.

অধ্যায় ৪৬

সুবিশাল একটি ড্রইংরুমে বসে আছে আশেক মাহমুদ। ঢাকা শহরে তিনটি ফ্ল্যাটের মধ্যে এই ফ্ল্যাটটায় মাঝেমধ্যেই রাত্রি যাপন করে। তার বোন যে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে আছে সেটার উপর তলায় থাকে সে। এছাড়া অন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।

গুলশান নিকেতনের এই ফ্ল্যাটটা বলতে গেলে খালিই পড়ে থাকে, তবে বিশেষ দরকারে এখানে আসে-একাকীত্ব ঘোচায়! আজ রাতেও সেটা করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উপঢৌকন চলে আসবে তার কাছে!

হাতে দামি হুইস্কির গ্লাসটায় চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে, কিন্তু তার ভাবনা বার বার চলে যাচ্ছে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের দিকে। প্রথম প্রথম বৌ-বাচ্চাদের যখন কানাডায় পাঠিয়ে দিলো, তখন প্রতিদিন বাসায় ফিরে তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা হতো, তারাও খোঁজখবর নিতে তার। ইদানিং সেটা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে সপ্তাহে একবারে গিয়ে ঠেকেছে। এর কারণ এই নয় যে, তার ব্যস্ততা। বরং অবাক হয়েই লক্ষ্য করেছে, তার স্ত্রী আর সন্তানেরা ফাস্ট ওয়ার্ল্ডে গিয়ে নিজেদের নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেও হিমশিম খায়। তবে মাস শেষ হবার আগে এই যোগাযোগ সামান্য একটু বেড়ে যায় ওদের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে তার স্ত্রী তখন প্রতিদিনই খোঁজ নেয়। এই নশ্বর পৃথিবীর আসল ঈশ্বর যে কী, সেটা আশেক মাহমুদ বুঝে গেছে এতো দিনে।

এখন তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠজন হলো আসলাম। তার সব গোপন কাজের তদারকি করে সে। হোক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক।

সরকার থেকে গানম্যান পেলেও তাদেরকে নিয়ে সবখানে যাতায়াত করে না। করা সম্ভবও নয়, আর সেজন্যেই পিএসের চাকরিটা পাবার পর থেকেই একজন বিশ্বস্ত আর সাহসী লোকের দরকার পড়েছিলো। আসলাম ছিলো পুলিশের একজন এসআই, নিজের অবিশ্বস্ত বৌকে পুলিশ সোর্স দিয়ে হত্যা করিয়ে ফেঁসে যায় সিসিক্যামেরার ফুটেজের কারণে। তদন্তে বেরিয়ে আসে সব কিছু। কিন্তু পুলিশে তার অতীত কর্মকাণ্ডের অবদানের পাশাপাশি, পুলিশ বাহিনীর সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া হয় উচ্চপর্যায় থেকে। তারা চায়নি, জনগণ জেনে যাক এই বাহিনীতে এমন লোকও রয়েছে যে নিজের স্ত্রীকে খুন করাতে পারে!

আসলাম স্ত্রী হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেলেও চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি। স্বয়ং ডিআইজি ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো, তাকে বাঁচিয়ে দেয়া হবে যদি সে নিজ থেকে চাকরিতে ইস্তফা দেয়-আসলাম সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারেনি। এরপরই এক ঘনিষ্ঠ লোকের পরামর্শে তাকে গানম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় আশেক মাহমুদ। আজ প্রায় চার বছর ধরে আছে সে। দিন দিন বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

কলিংবেলটা বেজে উঠলে বর্তমানে ফিরে এলো আশেক মাহমুদ। আসলামের কাছে এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটা চাবি আছে, তাকে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হবে না।

একটু পরই এক মেয়েকে নিয়ে ঢুকলো গানম্যান। প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে দেখে নিঃশব্দে সালাম ঠুকলো মেয়েটি।

“ওই ঘরে যাও…আমি আসছি,” বেডরুমের দিকে ইশারা করে মেয়েটাকে বললো।

চুপচাপ শোবার ঘরে চলে গেলো মিডিয়াতে একটু-আধটু নামকরা অভিনেত্রী মেয়েটি।

আসলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এরকম মুহূর্তে সে বলতে গেলে কথাই বলে না।

“ঐ ডাক্তারের কী খবর?”

“আমি আইসিসিইউতে গিয়ে দেখেছি, ডাক্তার ওখানে নেই। লোকটা হাসপাতালে অ্যাডমিট কিনা ওখানকার কেউ জানে না, স্যার।”

মুচকি হাসলো পিএস, মদের গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিলো। “মনে হচ্ছে, তোমার কথাই ঠিক-ডাক্তার অভিনয় করেছে।”

আসলামের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিলো। লোকটা যে ধোঁকা দিয়েছে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু ঐ ডিবি অফিসার ছফা ধরতে পারেনি। সে যতোই তুখোড় ইনভেস্টিগেটর হোক না কেন, এক বুড়ো ভামের অভিনয়ে পটে গেছে। ছফা যদি ডাক্তারকে তার হাতে ছেড়ে দিতো তাহলে পাঁচ মিনিটেই সব কথা তার পেট থেকে বের করে ছাড়তো সে। কিভাবে করতো সেটা নিয়ে তাকে খুব একটা মাথাও ঘামাতে হতো না। সরাসরি নাইন এমএমের পিস্তলটার নল ঠেকাতো বুড়োর কপালে, তারপর চোখমুখ শক্ত করে যা জানতে চাইতো সবই বলে দিতো ঐ শয়তানটা।

“ওটা ওর নিজের হাসপাতাল, সত্যি সত্যি অসুস্থ হলে হৈচৈ পড়ে যেতো। অথচ কেউ কিছু জানে না!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো গানম্যান। “কিন্তু সে এখন কোথায় আছে সেটা তো বের করতে হবে।”

“আমি কি আবারো ডাক্তারের বাড়িতে যাবো? ঐ দারোয়ান ব্যাটা-”

“না।” আসলাম কথা শেষ করার আগেই বললো পিএস। “কোনো দরকার নেই। আমি এটা জেনে নিতে পারবো…অন্যভাবে।”

হাফ ছেড়ে বাঁচলো গানম্যান, তবে সেটা তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলো না। ডাক্তার এখন কোথায় আছে সেটা বের করা সহজ কাজ হতো না। তবে আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে, সবখানে তার লোক আছে। এসব খবর বের করা তার পক্ষে খুব একটা কঠিন কিছু হবে না নিশ্চয়।

“তুমি বাসায় যাও…বিশ্রাম নাও।” কথাটা বলেই হুইস্কির গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে রেখে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো পিএস।

“জি, স্যার।” ঘর থেকে চলে গেলো আসলাম। কাল সকালে তাকে আবারো আসতে হবে এখানে। যেটাকে নিয়ে এসেছে সেটাকে আবার পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বাইরের দরজাটা বন্ধ হবার শব্দ কানে গেলে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো আশেক মাহমুদ। একবার রিং হবার পরই তার কলটা রিসিভ করা হলো। এরকম লোকজন তার কল পেলে ধন্য হয়ে যায়। সরকারদলীয় ডাক্তারদের যে অঙ্গসংগঠনটি আছে সেটার মধ্যমগোছের নেতা সে।

“ওয়ালাইকুম আসোলাম। কেমন আছো, ডাক্তার?” প্রধানমন্ত্রীর পিএস হাসিমুখে বললো।

ওপাশ থেকে গদগদ ভঙ্গিতে কথা বলে গেলো সেই ডাক্তার। পিএসের ফোন পেয়ে যে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে, সেটা প্রকাশ করতে মোটেও কুণ্ঠিত হলো না। কিছুক্ষণ এ কথা ও কথা বলার পর আসল কথায় চলে এলো আশেক মাহমুদ।

“আসকার ইবনে সায়িদ তোমাদের হাসপাতালের একজন ওনার না?”

“জি, ভাই। বলতে গেলে উনিই মালিক। লায়ন শেয়ার তো উনারই।”

“হুম। ভদ্রলোক কি এখন তোমাদের হাসপাতালে অ্যাডমিট?”

“নাহ তো!” বিস্ময় ঝরে পড়লো ওপাশ থেকে। “এরকম কোনো কথা শুনিনি, ভাই। কে বললো আপনাকে?”

“শুনলাম আর কি।” একটু থেমে আবার বললো, “তুমি একটু খোঁজ নিয়ে কাল সকালে আমাকে জানাও। ব্যাপারটা জরুরী, বুঝতে পেরেছো?”

“জি, ভাই। কাল সকালে আমি খোঁজ নিয়েই আপনাকে জানাচ্ছি।”

“ওকে।”

কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পিএস। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো শোবার ঘরের দিকে। খোলা দরজার কাছে আসতেই টের পেলো কড়া পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে।

এসব মেয়েরা কেন যে সব সময় কড়া মেকআপ আর এরকম সেন্ট ব্যবহার করে সে জানে না।

.

অধ্যায় ৪৭

সকালে নাস্তা করেই কেএস খান একটি বই নিয়ে বসেছে-খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সেটা। নাকের উপরে থাকা রিডিংগ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছে অক্ষরগুলো। গতকাল থেকে পড়তে শুরু করার পর আর বিরতি দেয়নি। এ মুহূর্তে, দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হবে গবেষণার কাজে মগ্ন একজন অধ্যাপক।

খোদাদাদ শাহবাজ খান সব সময় নিজের বিছানায় শুয়ে-বসে বই পড়ে। ঘরে একটা টেবিল আছে কিন্তু ওটাতে বসে পড়ার অভ্যেস তার নেই। বিছানায় শুয়ে দু-পা ক্রশ করে পড়তেই বেশি ভালো লাগে। অবশ্য পাশে গরম চা থাকলে তার এই পাঠ আরো বেশি সুখকর হয়ে ওঠে। অল্পবয়সী আইনস্টাইন সেটা জেনে গেছে এততদিনে, সাবেক ইনভেস্টিগেটরকে বই পড়তে দেখলেই এক কাপ চা বানিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখে যায় সে।

বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বেডসাইড টেবিলে হাত বাড়ালো কেএস খান, কিন্তু সেখানে কোনো কাপ-পিরিচের নাগাল পেলো না।

পড়া থেকে বিরতি দিয়ে তাকালো পাশের ঘরের দরজার দিকে। আধখোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন মেঝেতে বসে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে-মটু-পাতলু নামের স্কুল এক কার্টুন দেখছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। ছেলেটা যতোই পাকনামি করুক, তার শৈশব এখনও অটুট আছে।

খোদাদাদ শাহবাজ খান আবারও নজর দিলো বইয়ের পৃষ্ঠায়। এখন যে বইটা পড়ছে সেটা পল্টনের ফুটপাত থেকে কয়েক দিন আগে কিনেছে মাত্র আশি টাকা দিয়ে। দোকানির বইয়ের স্তূপে অবহেলায় পড়েছিলো। গ্রাহাম হ্যাঁনককের বেস্টসেলার নন-ফিকশন ম্যাজিশিয়ান্স অব দি গডস যে পল্টনের ফুটপাতে গড়াগড়ি খাবে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। বইয়ের কাভারটা ছেঁড়াফাড়া হলেও ভেতরের পাতাগুলো সব অক্ষত ছিলো। দোকানি সম্ভবত কাভারের করুণ দশার জন্য বেশি দাম হাঁকেনি তার কাছে।

এই লেখকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট অব গড আগেই পড়া ছিলো তার। ম্যাজিশিয়ান্স পড়ে আরো মুগ্ধ হচ্ছে। তুরস্কের গোবেলি তেপে নামক একটি জায়গায় প্রায় ১২০০০ বছরের প্রাচীন পূরাকীর্তি পাওয়া গেছে, আর সেটা নাকি তৈরি করেছিলো মহাপ্লাবন সংঘটিত হবার পর বেঁচে যাওয়া উন্নত প্রজাতির কিছু মানুষ! লেখক বলার চেষ্টা করছেন, এরা সেই আটলান্টিসের অধিবাসী যাদের উন্নত মহাদেশটি তলিয়ে গেছিলো জলরাশির তলে।

এমন সময় কেএস খানের ফোনটা বেজে উঠলে বিরক্তি ভর করলো চোখেমুখে। পড়ার সময় দু-জন মানুষের ফোন তাকে বিরক্ত করে না। একজনের ফোন পেলে বরং খুশিই হয়, আর অন্যজনের ফোন নিয়মিত ব্যাপার, অনেকটা তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, এদের কেউ না, ফোনটা দিয়েছে ডিবির ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা। সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠলো তার।

“আরে, ছফা যে…কী খবর আপনের?” হাসিমুখে বললো খোদাদাদ শাহবাজ খান।

“স্যার, খবর ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“আছি ভালাই…আপনের খবর বলেন, সুন্দরপুরেই আছেন নাকি ঢাকায়?”

সুন্দরপুর থেকে ফিরে এসে কেএস খানের সঙ্গে দেখা করেনি ছফা, এমনকি ফোনও দেয়নি, সোজা চলে গেছিলো অ্যাডভোকেট ময়েজ উদ্দিনকে ধরার জন্য। “আমি কালকে এসেছি, স্যার।”

“ঐখানকার খবর কি? কিছু পাইলেন?” আগ্রহী হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

“জি, স্যার…দারুণ খবর আছে, সেজন্যেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনি কি ফ্রি আছেন?”

“বলেন, আমি বাসায়ই আছি…কোনো ক্লাস নাই আজ।”

এরপর টেলিফোনেই ছফা সংক্ষেপে জানালো মাস্টার রমাকান্তকামারের ঘর থেকে মুশকান জুবেরির চিরকুট পাবার কথা, সেখান থেকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে ধরা, তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, আর ডাক্তারের পাসপোর্টের কথাটা। কিন্তু বৃদ্ধ ডাক্তার অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে যে নতুন কাহিনীটা তাকে বলেছে সেটা একেবারে চেপে গেলো। তার ধারণা, ঐ কাহিনী শোনার পর কেএস খান মাথা ঘামাতে শুরু করে দেবে। ছফার আশঙ্কা, সম্ভবত কাহিনীটায় বিশ্বাসও করে বসবে তার সিনিয়র। সব সময় যৌক্তিক বিষয়েই তার পক্ষপাতিত্ব থাকে বেশি। আর ডাক্তারের নতুন গল্পটি যে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভদ্রলোকের কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। লোকটা ধূর্ত। তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য, ঐ মহিলাকে রক্ষা করার জন্য সম্ভবত নতুন একটি গল্পের অবতারণা করেছেন।

“আপনের মতো আমার মনে হইতাছে, ঐ ডাক্তারই মুশকান জুবেরিরে কলকাতায় নিয়া গেছে, সব শোনার পর বললো মি. খান।

“জি, স্যার। ভদ্রলোক এটা লুকানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি নিশ্চিত, তিন বছর আগে ডাক্তার যখন আমেরিকায় চলে যাওয়ার কথা বলে দেশ ছাড়লেন তখনই মুশকান জুবেরিকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেছিলেন।”

“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো কেএস খান। “এতো জায়গা থাকতে কলকতায় কেন, সেইটা বুঝবার পারতাছি। বাড়ির একেবারে পাশে…পাসপোর্ট ছাড়াও বর্ডার দিয়া যাওন যায়।”

“জি, স্যার। ইন্ডিয়ান বর্ডার কিন্তু সুন্দরপুর থেকে বেশি দূরেও নয়…ঘণ্টাখানেকের পথ সম্ভবত।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার।

“তাছাড়া কলকাতায় ডাক্তারের পরিচিত মানুষজনও থাকতে পারে।”

“হুম…তা হইতে পারে। নামকরা ডাক্তার, দেশ-বিদেশে ঘুইরা বেড়ায়, বিরাট বড় হাসপাতালের ওনার…রিসোর্সফুল তো হইবোই।”

“ডাক্তারের পাসপোর্ট বলছে, তিনি অনেক বছর আগে থেকেই ফ্রিকোয়েন্টলি কলকাতায় যাতায়াত করছেন।”

“এইটা একটা ভালা পয়েন্ট,” কৌতূহলি হয়ে বললো কেএস খান। “তার মাইনে, ঐখানে ডাক্তারের রিসোর্স আছে, জানাশোনা লোকজন আছে।”

“জি, স্যার। কিন্তু উনার পেট থেকে সব কথা বের করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এখন আছেন আইসিসিউতে…মনে হয় না সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার নাগাল পাবো।”

“আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক দেশ ছাড়বো। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চইলা গেলে তারে কেমনে আটকাইবেন?”

“উনার পক্ষে সেটা করা সম্ভব হবে না, স্যার। পিএস আশেক মাহমুদ এই বিষয়টা দেখবেন, ইমিগ্রেশনে বলে দিয়েছেন তিনি।”

“ও,” মি. খান আর কিছু বললো না। সব ধরণের ক্ষমতার অপব্যবহার তার ভীষণ অপছন্দ, সেটা যদি তদন্তের কাজে সাহায্য করে তারপরও।

“আমার তো ইচ্ছে, আজকের দুপুরের ফ্লাইটেই কলকাতায় চলে যাওয়া, কিন্তু অতো বড় শহরে কী করে মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করবো বুঝতে পারছি না, স্যার।”

“হুম।” গম্ভীর হয়ে বললো ছফার সিনিয়র। চিন্তিত মুখে ঘরের সবচাইতে দূরের দেয়ালের দিকে তাকালো। আইনস্টাইনের জিভ বের করে রাখা সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকালেই একটা কথা মনে পড়ে যায় তার : জটিল চিন্তা বোকারহদ্দরা করে! বুদ্ধিমানেরা করে সহজ চিন্তা!

কিন্তু সহজ চিন্তা যায় না করা সহজে!

তারপরই বলার মতো কিছু একটা পেয়ে গেছে এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “শুনেন…মনে হইতাছে মুশকান জুবেরিরে ট্রেস করার সহজ রাস্তা একটাই আছে।”

“সেটা কী, স্যার?” ফোনের ওপাশে থাকা নুরে ছফা খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলো।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সবেক ইসভেস্টিগেটর। “মানুষ সব কিছু পাল্টাইতে পারে, সিটিজেনশিপ, ধর্ম, এমনকি চেহারাও বদলাইতে পারে, কিন্তু অভ্যাস…এইটা বদলানো এতো সহজ না। মনে রাখবেন, অভ্যাসের চায়া বদঅভ্যাস হইলো আরো কঠিন জিনিস।” একটু থেমে আবার বললো, “আপনে মহিলার বদঅভ্যাসটা ফলো করেন।”

.

অধ্যায় ৪৮

সকাল দশটায় পিএসের সেই ফ্ল্যাটে আবারো ফিরে এসেছে আসলাম, যেখানে গত রাতে এক মেয়েকে নিয়ে এসেছিলো। একটু আগে আশেক মাহমুদ তাকে ফোন করে জানিয়েছে, মেয়েটাকে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যাবার জন্য।

পিএস আরো সকালে উঠে পিএমের অফিসে চলে গেছে। সারা রাত যতোই মদ্য পান করুক, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করুক, সকাল সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে, তারপর দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে যাবার জন্য।

আশেক মাহমুদের এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটি চাবি আছে তার কাছে। পিএস ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় বাইরে থেকে দরজা লক করে গেছে। আসলাম এসে দরজা খুলে মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে তার বাসায়-এমনটাই সব সময় হয়ে আসছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আসলাম ভাবলো, সে যদি ফ্ল্যাটে যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়, কিংবা খারাপ কিছু হয়ে যায় তার, তাহলে কী হবে? মেয়েটা নির্ঘাত আটকা পড়ে যাবে। পিএসের ফোন নাম্বার এসব মেয়ের কাছে থাকে না, আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েটাকেও সঙ্গে করে মোবাইলফোন আনতে দেয়া হয় না। ফলে তাকে কোনোভাবেই জানাতে পারবে না যে, ফ্ল্যাটে আটকা পড়ে গেছে সে। বাধ্য হয়ে তখন চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকবে সাহায্যের জন্য, আর সেটা হবে আশেক মাহমুদের জন্য বিরাট কেলেংকারির ব্যাপার।

মুচকি হাসলো সে। আসলে এরকম কিছু হবে না। তার যদি কিছু হয়, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যেই পিএস সেটা জেনে যাবে। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারবে, তার ফ্ল্যাটের মেয়েটা নিশ্চয় আটকা পড়েছে। তখন অন্য কাউকে দিয়ে মেয়েটাকে জায়গামতো পৌঁছে দেয়া হবে। এরকম লোকজনের কোনো অভাব নেই আশেক মাহমুদের।

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে পিএসের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে ডোর লকের ভেতরে চাবি ঢোকাতেই এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেলো তার মধ্যে। আস্তে করে দরজা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

পুরো ফ্ল্যাটটা সুনশান-তার মানে মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে। এরকমটিই হয় সব সময়। এরা বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে।

শোবার ঘরের সামনে এসে দেখতে পেলো দরজাটা খোলাই আছে, বিছানায় পড়ে আছে প্রায় নগ্ন সেই মেয়েটি।

ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে ভালো করে দেখলো আসলাম। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। মুখের কড়া মেকআপের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। আশেক মাহমুদের লালসায় ধুয়েমুছে তার আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে, আর সেটা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। তবে তার দেহসৌষ্ঠব কামনা জাগানোর জন্য যথেষ্ট।

পাশ ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটি। টিভিতে টুকটাক অভিনয় করে। একটি টেলিকমের অ্যাডেও দেখা গেছে কিছু দিন আগে। ঐ টেলিকমই কর-ফাঁকির এক তদন্তে ফেঁসে গিয়ে পিএসের দ্বারস্থ হয়েছিলো। আশেক মাহমুদ সেটা মিটমাট করে দেবার ব্যবস্থা করে দিলে, বিনিময়ে যেমন বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঢুকেছে তার অ্যাকাউন্টে, তেমনি উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হয়েছে। এটাকে!

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটাকে দেখে গেলো সে। ধীরে ধীরে নিজের ঘুমন্ত কামনা মাথাচাড়া দিতে শুরু করলো। এর আগেও এরকম কাজ করেছে আসলাম। পিএসের পরে সে-ও একটু পরখ করে দেখেছে। ভালো করেই জানে, এ ধরণের মেয়েগুলো চুপচাপ এসব ব্যাপার হজম করে নেয়। কেউ কেউ খুশি হয়েও নিজেকে সমর্পণ করে, কখনও কারোর উপরে জোর খাটাতে হয়নি তাকে।

কিন্তু এখন তার খুব জোর খাটাতে ইচ্ছে করছে! ইচ্ছে করছে অন্যভাবে কামনা মেটাতে। দিনকে দিন স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার থেকে তার আগ্রহ উবে যাচ্ছে! মর্ষকামীতার পাশাপাশি ধর্ষক সত্তাটাও যেনো জন্ম নিচ্ছে ক্রমশ।

এই মেয়েটাকে ধর্ষণ করলে কী হবে?

বিচার দেবে? কার কাছে?

মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার লম্পট ঠোঁটে। এ সমাজে বেশ্যাদের ধর্ষণ করা জায়েজ। যারা টাকার বিনিময়ে অন্য পুরুষের সাথে শোয়, তাদের সাথে জোর খাটালে কী আর এমন হবে! পিএসের কাছেও নালিশ দেবে না। এর আগে টাকার বিনিময়ে পুরুষ মানুষের সাথে শুতে যেয়ে কত বার ধর্ষিতা হয়েছে কে জানে!

আসলাম জানে, প্রতিটি পুরুষের মধ্যেই একজন ধর্ষক বাস করে দরবেশ থেকে প্রতিবন্ধী-সব পুরুষই জোর করে পেতে আনন্দ পায়। সম্ভবত পৌরুষের অংশ এটা। আদিমকাল থেকেই চলে আসছে। আদিপুরুষেরা বীরভোগ্যা ছিলো। নারীকে জোর করে ভোগ করাটা বীরত্বই ছিলো তখন। জৈবিক তাড়না থেকে যে সঙ্গম হয় সেখানে এরকম ব্যাপার স্যাপার হতেই পারে!

তার খুব ইচ্ছে করছে ঘুমন্ত মেয়েটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে। টের পাচ্ছে, তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে ধর্ষণ করার প্রবল বাসনায় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। একটু উপুড় হয়ে যেই না মেয়েটার উপরে হামলে পড়বে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো।

মাথায় খুন চেপে গেলো আসলামের। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগই পেলো সে। কিন্তু যেই না দেখলো কলটা করেছে পিএস, হকচকিয়ে গেলো। এরকম সময় আশেক মাহমুদ সচরাচর তাকে ফোন দেয় না।

কলটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো, ভেতরের সমস্ত উত্তেজনা দপ করে নিভে গেছে। নেতিয়ে পড়েছে তার ধর্ষকামী ছোট্ট পশুটি!

.

অধ্যায় ৪৯

কলকাতা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে দমদম নামক স্থানে যে বিমানবন্দরটি অবস্থিত সেটার অফিশিয়াল নাম ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’, কিন্তু লোকমুখে দমদমই বেশি উচ্চারিত হয়।

এই বিমানবন্দর দিয়ে কলকাতায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা ছফার জন্য নতুন নয়, তবে বিগত দু-বছরে এই প্রথম পদার্পণ করলো সে। ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধবদের সাথে অবশ্য দুয়েকবার সড়কপথে যশোর-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যাবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে চাকরি জীবনে ঢোকার পর যতোবারই গেছে কাজের প্রয়োজনেই গেছে। দু-বছর আগে, এক স্ত্রী আর তার পাঁচ বছরের শিশুকন্যার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হবার যে কেসটা তদন্ত করেছিলো সেটার এক পর্যায়ে তাকে কলকাতায় যেতে হয়। ঐ সময়ই প্রথমবারের মতো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার, আর তখন বেশ কিছু পুলিশ অফিসারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সব অফিসাররা ছফার মতোই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। তাদের কারো কারোর সাথে বিদেশের মাটিতে ইন্টারপোলের সম্মেলনে দুয়েকবার দেখাও হয়েছে, তবে নিয়মিত যোগাযোগ মাত্র একজনের সাথেই হয়-ছফার গন্তব্য এখন সেই মানুষটির অফিস।

কোনো এক অদ্ভুত কারণে, প্রিয় মানুষজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে না সে। এক ধরণের অনীহা জেঁকে ধরে তাকে। এমন না যে, ঐসব মানুষের সঙ্গ কিংবা আলাপচারিতা তার ভালো লাগে না। সম্ভবত দীর্ঘকাল একা একা থাকার কুফল এটি।

রিগ্যাল এয়ার ওয়েজের বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করতেই নুরে ছফার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো। তার মন বলছে এখানেই আছে মুশকান জুবেরি। যুক্তিবুদ্ধিও তাতে পুরোপুরি সায় দিচ্ছে। ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সে কখনও এমনও দেখেছে, যুক্তি নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে পরিচালিত করে নিয়ে গেছে সত্যের কাছাকাছি। কিন্তু এবার তার যুক্তি-বুদ্ধি আর সজ্ঞা একই কথা বলছে!

কলকাতায় আসার আগেই ওখানকার পুলিশ হেডকোয়াটারের সহকারী নগরপাল সুশোভন মিত্রের সাথে সে যোগাযোগ করেছে। বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের বড় হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে দারুণ সখ্যতা। সুশোভনকে এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে ওয়াকিবহাল করেছে সে। তবে কাজটা কিভাবে করবে সে নিয়ে কিছু বলেনি। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, সব কথা আর অনুরোধ টেলিফোনে সেরে ফেলাটা বোকামি। ঢাকা থেকে কলকাতায় উড়ে এসে কোনা অনুরোধ করলে সেটা রক্ষা করার তাগিদ অনেক বেশি অনুভব করবে। সেজন্যে ছফা শুধু জানিয়েছে, তার কাছে। নিশ্চিত তথ্য আছে, বাংলাদেশ থেকে এক সাসপেক্ট কলকাতায় আত্মগোপন করে আছে, তাকে ট্র্যাক ডাউন করতে চাইছে সে। এ কথা শুনে সুশোভন তাকে আশ্বাস দিয়েছে যথাসম্ভব সাহায্য করার জন্য।

ছফাও জানে তার কাছ থেকে ভালো রকম সাহায্য পাওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এই সাহায্যের আবেদনটি ইন্টারপোলের মাধ্যমে করা হয়নি, কিংবা দু দেশের পুলিশ বিভাগের মধ্যেকার কোনো অনুরোধের ভিত্তিতেও নয়-এটা হচ্ছে একান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে। এর কারণও রয়েছে-মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ আনা যায়নি যে, ইন্টারপোলে মহিলাকে ফেরারি আসামি হিসেবে তালিকাভূক্ত করানো যাবে। তাছাড়া, মুশকানের সত্যিকারের কাহিনীটাও কারো কাছে বলেনি ছফা। তাই অন্য অনেকের মতো সুশোভন মিত্রের কাছেও গোপন রেখেছে।

আমি কি তাকে উদ্ভট গল্পটা বলবো? কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এটা বিশ্বাস করবে?

নিজেকে অনেকবার এ প্রশ্ন করেছে। কেউ যদি মুশকানের এই গল্পটা বিশ্বাসও করে, তাতেও ঝুঁকি আছে। যে কারনে খোদাদাদ শাহবাজ খান তাকে ছাড়া আর কাউকেই বলেনি, মানুষের শরীরের বিশেষ একটি প্রত্যঙ্গ খেয়ে মুশকান জুবেরি নিজেকে চিরযৌবনা করে রেখেছে। গল্পটা যে বিশ্বাস করবে সে হয়তো হন্যে হয়ে জানতে চাইবে, ঠিক কোন প্রত্যঙ্গটি খেলে এমন আরাধ্য লাভ করা যায়-আর এটা করার একটাই উপায় আছে-মুশকান জুবেরিকে নিজের কজায় নিয়ে, নির্যাতন করে তার কাছ থেকে তথ্যটা জেনে নেয়া। সিক্রেটটার আর্থিক মূল্য হতে পারে কয়েক কোটি টাকা। আর এজন্যে যেকোনো কিছু করতেও পিছপা হবে না এ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ।

বিমানবন্দর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছফা চলে গেলো লালবাজারে অবস্থিত কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সদর দপ্তরে, সুশোভন মিত্র বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছে। লালবাজারের লাল ইটের বিশাল আর মনোরম ভবনের সামনে যখন ছফার ট্যাক্সিটা থামলো তখন বিকেল প্রায় চারটা।

মেইন গেটের সিকিউরিটিকে আগেই বলে দিয়েছিলো সুশোভন, তাই পরিচয় দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে দেয়া হলো কতো তলার কলো নম্বর রুমে যেতে হবে।

“আরে ছফা, তুমি দেখি একই রকম আছো, তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালো সুশোভন মিত্র। “একটুও বদলাওনি! ঘটনা কি?” সহাস্যে বললো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সহকারী নগর পাল।

অমায়িক হাসি দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলো নুরে ছফা। “তুমিও তো খুব একটা বদলাওনি, দাদা…আগের চেয়ে একটু স্লিমও হয়ে গেছে।”

হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি দিলো সুশোভন। “তার কারণ ডায়েট নয়…কাজের ভীষণ চাপ। সেই সাথে তোমার বৌদির দারোগাগিরি।”

হেসে ফেললো ছফা।

“বসো,” ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসার ইশারা করে নিজেও বসে পড়লো। “এক বছর ধরে আমাকে ভেজ থাকতে বাধ্য করছে সে।”

“বৌদি কিন্তু ঠিকই করছে,” বললো ছফা। “এখন বলল, আছো কেমন?”

কাঁধ তুললো সুশোভন মিত্র। “চলে যাচ্ছে। তোমার কি খবর? ক-টা প্রমোশন বাগালে?”

“মাত্র দুটো, তবে কাজের অনেক চাপ বেড়ে গেছে।”

“হুম, চাপে না পড়লে কি ঢাকা থেকে উড়ে আসতে কলকাতায়,” হেসে বললো নগর পাল। “কততদিন থাকছে এখানে?”

“সত্যি বলতে, কাজটা করতে কতোদিন লাগবে সে-ব্যাপারে আমার কোনো ধারনাই নেই। বুঝতে পারছি না কতো দিন থাকতে হবে।”

“সাসপেক্ট ট্র্যাক-ডাউন করাটা খুবই কঠিন কাজ, সুন্দর করে ছাটা পুরু গোঁফের বামপ্রান্ত মোচড়াতে মোচড়াতে বললো সুশোভন মিত্র। এই গোঁফ নিয়ে তার বাতিকের কথা ছফা জানে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সাক্ষাতের সময় থেকেই। ফ্রান্সের লিওঁতে ইন্টারপোলের সদর দফতরে এক সেমিনারে দেখা হয়েছিলো, তারা উঠেছিলো একই হোটেলে। রাতে ছফার রুমে এসে বেশ গল্প করতো নগরপাল।

“এক হপ্তায় তোমার কাজ হয়ে যাবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

“না হলে আর কি, তোমাকে আরেকটু জ্বালাতে হবে,” হেসে বললো। “তবে কাজটা দ্রুত করার তাড়া আছে।”

“ইনভেস্টিগেশনের টাইমফ্রেম দেয়া আছে নাকি?”

“হুম।”

“তাহলে কঠিন হয়ে যাবে তোমার জন্য।”

“তা বলতে পারো।” পকেট থেকে মুশকান জুবেরির একটা ছবি বের করে দেখালো সে। “সাসপেক্টের ছবি।”

ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেললো সুশোভন। “এটা কবেকার?”

ভিরমি খেলো ছফা। ছবিটা যে বেশ পুরনো সেটা যেকোনো অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলে, এ কারণে ডিবির ফটো রিকন্সট্রাকশন করে যে ছেলেটা তাকে দিয়ে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কাট-আউট করে নিয়েছে যাতে করে পেছনের পার্কে থাকা অন্যসব মানুষজনের সত্তুর দশকের বেলবটম প্যান্ট পরা কাউকে দেখে সময়টা ধরতে না পারে। তারপরও সুশোভনের অভিজ্ঞ পুলিশি চোখ ধরে ফেলেছে, এটা বেশ পুরনো ছবি। ছফা যদি বলে এটা ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে তোলা তাহলে মুশকানের বয়স এখন সত্তুরেরও বেশি! এই বয়সের একজন সাসপেক্ট বেশ কিছু তরতাজা যুবকের অন্তর্ধানের সাথে জড়িত, এমন কথা কোনো মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর সেই মানুষটা যদি পুলিশ হয় তাহলে তো কথাই নেই।

“কতো পুরনো জানি না, মনে হয় নব্বইয়ের দিকে হবে,” অবশেষে মিথ্যেটাই বললো ছফা।

সুশোভনের কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো। “নব্বই!? বলো কী! দেখে তো মনে হচ্ছে আরো পুরনো,” ছবির দিক থেকে মুখ না তুলেই বললো। “হেয়ারস্টাইলটা একেবারে মিড-সেভেন্টির মতো।”

মনে মনে প্রমাদ গুনলো ছফা।

“আচ্ছা, তুমি কী সাসপেক্ট করছো?”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা বুঝতে পারলো না কী বলবে। “কী সাসপেক্ট করছি?” প্রশ্নটাই আওড়ালো আবার। “এই মহিলা হিউম্যান অগ্যান পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত বলে সন্দেহ করছি।”

“তুমি বলেছিলে সে একজন মেডিকেল ডক্টর?”

“হুম, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলো, ওখানেই পড়াশোনা করেছে। তারপর বেশ কবছর আগে বাংলাদেশে চলে আসে। তবে আমার মনে হয়, এখানে আসার পর ঐ চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে মহিলা।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “মহিলা দেখতে কিন্তু সেই রকম মাইরি।” কথাটা বলেই হেসে ফেললো সে। “সি হ্যাড দ্য গ্ল্যামার ইন হার আর্লি এইজ।”

এখনও তা-ই আছে, মনে মনে বললো সে। সত্যিটা তুমি যদি জানতে!

“তুমি শিওর, মহিলা একাই অপারেট করে?”

একটু গাল চুলকালো ডিবির নুরে ছফা। “সম্ভবত…তবে নিশ্চিত নই।”

“আমার তো মনে হয় না সে একা একা অপারেট করে,” ছবিটা ডেস্কের উপর রেখে বললো সুশোভন। “অগ্যান স্মাগলারদের চক্রটা বেশ বড় হয়ে থাকে। অনেকগুলো ধাপ থাকে, প্রতিটি ধাপেই থাকে একাধিক লোক। আমাদের এখানেও এরকম কিছু চক্র রয়েছে। ওদের সাথে এই মহিলার কোনো যোগসাজশ নেই তো?”

কাঁধ তুললো ছফা। “এটা তো জানি না। তবে আমার ধারণা এই মহিলা ওভাবে কাজ করে না, সে একা একাই কাজ করে। কালেক্ট করার পর হয়তো তার পরিচিত স্মাগলারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেজন্যে তার সম্পর্কে তথ্য আদায় করা সহজ হয়নি, শক্ত কোনো প্রমাণও জোগাড় করতে পারিনি।”

“এরকম একজন বয়স্ক মহিলা কী করে এটা করে? এ ছবিটি যদি নব্বইর দিকের হয়ে থাকে তাহলে তো এখন তার বয়স কম হবে না।”

অবাকই হলো কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল।

“মহিলা একজন মেডিকেল ডক্টর,” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললো ছফা। “তার কাজের ধরণটাও বেশ আলাদা। সে প্রতিটি ভিক্টিমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে তাদেরকে নিজের ডেরায় নিয়ে কাবু করে ফেলে।” কথাটা বলার পর পরই নিজের কাবু হওয়ার ঘটনাটির কথা মনে পড়ে গেলো তার। মুশকান জুবেরির ঘরে ঢোকার পর কী বোকার মতোই না সে নাকাল হয়েছিলো!

মাথা দোলালো সুশোভন মিত্র। “তুমি শিওর, মহিলা এখন কলকাতায় আছে?”

“হুম। যতোটুকু জানি, সে পালিয়ে এখানেই চলে এসেছে।”

“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিলো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের নগরপাল। “তাহলে কিভাবে কাজটা শুরু করতে চাইছো তুমি?”

“বিগত তিন বছরে কলকাতা মহানগরীতে যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছে তাদের তালিকাটা আমার দরকার…ইন ডিটেইল্স।”

“শুধু কলকাতার?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো সুশোভন।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর নামক প্রত্যন্ত এক মফশ্বলে বসে শিকার করলেও তার সব শিকার এসেছিলো ঢাকা শহর থেকে। অন্তত ছফার জানা যে কয়জন শিকার আছে তাদের বেলায় এ কথা খাটে। সুতরাং মহিলা কলকাতায় থাকলেও এখান থেকেই শিকার খুঁজে বের করবে। শহুরে শিকার!

“সাসপেক্ট পুরো রাজ্যে অপারেট করছে না, কী করে শিওর হলে?”

একটু ভাবলো ছফা। “প্রথমে আমি শুধু কলকাতা মহানগরীর তালিকাটাই খতিয়ে দেখবো, যদি ওখান থেকে কিছু না পাই তাহলে পুরো পশ্চিমবঙ্গের তালিকা দেখতে হবে।”

চোখ কপালে তুললো সুশোভন। “গোটা রাজ্যে প্রচুর মানুষ নিখোঁজ হয় প্রতি বছর। সংখ্যাটা অনেক হবে কিন্তু!”

“তা জানি, তবে শুধুমাত্র ২০ থেকে ৩৫ বছরের পুরুষ মানুষই খুঁজবো…আর অবশ্যই মার্জিত এবং শিক্ষত।”

অবাক হলো সুশোভন। “মার্জিত আর শিক্ষিত? বাপরে! অগ্যান সিলেক্ট করার বেলায় মহিলা এসবও দেখে নাকি!”

ছফা একটু হাসার চেষ্টা করলো। “তা জানি না, তবে এখন পর্যন্ত সে এভাবেই টার্গেট সিলেক্ট করেছে। এটা তার প্যাটার্ন বলতে পারো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নগরপাল। “তারপরও সংখ্যাটা নেহায়েত কম। হবে না মনে হচ্ছে।”

“সবার ডেটা তো থাকে তোমাদের কাছে, তাই না?”

“তা থাকে। রাজ্যের সবগুলো পুলিশস্টেশন থেকে সব ধরণের ক্রাইমের ডেটাই সংরক্ষণ করা হয়। বিশাল ডেটা-বেইজ। তবে মার্ডার, হাইজ্যাক, ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে নিখোঁজদের তালিকাগুলো ক্যাটাগরাইজড করা আছে।”

ছফা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তাদের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ এখনও পুরোপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। যেটুকু তথ্য সংরক্ষণ করা হয় তা বেশ অপ্রতুল। ওসব তথ্য থেকে খুব কম সময়ই সাহায্য পাওয়া যায়।

“ডেটা বেইজ থেকে তথ্যগুলো পেতে কি কোনো সমস্যা হবে?” এবার আসল প্রসঙ্গে চলে এলো সে।

“উমমম…” একটু ভেবে নিলো সুশোভন। “অফিশিয়াল রিকোয়েস্ট ছাড়া ডেটাগুলো অন্য কারোর সাথে শেয়ার করি না আমরা। তবে, আমি চাইলে তোমাকে সেটা দিতে পারবো। আমার অ্যাকসেস আছে ওটাতে। মাঝেমধ্যে এরকম রিকোয়েস্ট আমরা নন-গভমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকেও পেয়ে থাকি। বিভিন্ন ধরণের অপরাধের স্ট্যাটিস্টিক্স চায় তারা। প্রেসও চায়। তারপরও বলবো, তুমি যদি তোমাদের ওখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিকোয়েস্ট করো তাহলেই বরং বেটার হয়। নইলে সাসপেক্টকে লোকেট করার পর অ্যারেস্ট করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছো তো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “আমিও সেটা বুঝি। কাল-পরশুর মধ্যেই ওখান থেকে একটা রিকোয়েস্ট করা হবে। তবে আমি চাইছি তার আগেই সাসপেক্ট লোকেট করার কাজটা শুরু করে দিতে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “আচ্ছা, তুমি ইন্টারপোলের হেল্প নিচ্ছো না কেন?”

“অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। খুব দ্রুত মহিলাকে ট্র্যাক করতে না পারলে সে হয়তো এখান থেকেও সটকে পড়বে, তাই আমি সময় নষ্ট করতে চাইছি না। তোমার কাছ থেকে একটু হেল্প পেলেই আশা করি কাজটা শুরু করতে পারবো। “

“ওকে,..কালকেই পেয়ে যাচ্ছো ওটা।”

“থ্যাঙ্কস দাদা।”

“এখন বলো, উঠবে কোথায়? তুমি তো সঙ্গে করে ছোট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজ ছাড়া আর কিছুই আনননি দেখছি।”

ছফা কখনও ভ্রমণের সময় বড়সর লাগেজ বয়ে বেড়ায় না। ব্রিফকেস আকারের ছোট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজই তার সম্বল। প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় আর দরকারি জিনিসপত্র ছাড়া বাড়তি কিছুই সঙ্গে নেয়নি।

“কোথায় উঠলে সুবিধা হয়, বলো তো?”

সুশোভন একটু ভেবে বললো, “চাইলে হোটেলের খরচাটা সেভ করতে পারো। তবে শেষ পর্যন্ত ওটা অবশ্য জলেই যাবে!” চোখ টিপে দিলো নগরপাল।

হেসে ফেললো ছফা। জলে যাবে বলতে, মদের পেছনে যে ব্যয় করতে হবে সেটা বুঝতে পারছে।

“তোমার বৌদি বাপের বাড়িতে আছে এখন। তুমি আমার ওখানেই উঠছে, ঠিকাছে?”

“বাপের বাড়িতে চলে গেছে? ঝগড়া করেছো নাকি?”

“আরে না, মেয়েছেলেদের সাথে আমি ঝগড়া-টগড়া করি না। ওকে কয়েকটা মাস ওখানেই থাকতে হবে।”

“কেন? অসুখ করেছে?”

“হুম।”

সুশোভনের মুখের হাসি দেখে ছফা অবাক হলো, কারণটাও ধরতে পারলো না সে।

“আরে, সিরিয়াস কিছু না…সি কন্সিড।”

“ওহ্,” হেসে ফেললো ছফা। হাতটা বাড়িয়ে দিলো সুশোভন মিত্রের দিকে। “কগ্র্যাচুলেশন্স।”

“থ্যাঙ্কস, করমর্দন করতে করতে বললো সহকারী নগরপাল।

“ফার্স্ট ইস্যু?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “তুমি তাহলে আমার ওখানেই উঠছে।”

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা।

৫০. লাইব্রেরিটা ফাঁকা

অধ্যায় ৫০

ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে…

বিকেলের পরই নতুন এই লাইব্রেরিটা ফাঁকা হয়ে যায়, আর তখনই সে চলে আসে এখানে। লোকজন থাকলে কখনও আসে না।

একজন নারী হিসেবে লক্ষ্য করে দেখেছে, তাকে দেখলেই লোকজন কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অবশ্য এটা এ দেশের সবখানেই দেখা যায়-একটা মেয়েমানুষ আশেপাশে থাকবে, হেঁটে যাবে আর তার দিকে তাকাবে না, মনোযোগ আকর্ষিত হবে না কোনো পুরুষমানুষের?

এমনকি, মেয়েরাও মেয়েদের দিকে তাকায়, যদি সেই মেয়েটি চোখে পড়ার মতো হয়, কিংবা তার ব্যক্তিত্ব হয় প্রখর। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এই তাকানোর মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে-ছেলেগুলো যেখানে চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে চায়, মেয়েগুলো সেখানে অবধারিতভাবেই ঠোঁট বেঁকিয়ে, এমন একটি অভিব্যক্তি করে, যেনো নিজের ভেতরে বাম্পায়িত ঈর্ষা ঠেলেঠুলে উদগীরিত করতে চাইছে।

লালসা আর ঈর্ষা-মুগ্ধতার দেখা সে খুব কমই পেয়েছে।

অবশ্য এটাও ঠিক, এরকম প্রত্যন্ত এক গ্রামে তাকে দেখে হয়তো বেমানান লাগে লোকজনদের কাছে। তার বেশভূষা আর সৌন্দর্য তাদেরকে বাধ্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে। আর এই ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন খুবই বিব্রতকর অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে কারো কৌতূহলি দৃষ্টি দেখে সে ঘাবড়েও যায়-তাকে চিনে ফেললো না তো?!

না। এখন পর্যন্ত এরকমটি হয়নি। তবে যেকোনো সময়ই যে হতে পারে সে-ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সতর্কতার অংশ হিসেবেই, এই প্রত্যন্ত গ্রামে যারা বেড়াতে আসে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সযত্নে আড়ালে রাখে সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। যখনই কোনো জায়গার প্রতি তার মায়া জন্মে, সেটা ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে-এখন পর্যন্ত এরকমটিই হয়ে আসছে।

ঔষধি গাছ আর নানান ধরণের ফুলের বাগান করার বাতিক জন্মেছে এখানে আসার পর। তার ঘরের সামনে এক চিলতে জায়গাটা ভরিয়ে তুলেছে শুভ্র কালেনডুলা, লালাভ লাভেন্ডার, গোলাপী-বেগুনীর পাঁচ পাপড়ির ক্যালোট্রপিস, সাদা মুক্তোর দানার মতো পার্থেনিয়াম, সবুজ-লাল পাতার ক্যালাডিয়াম, লালচে-গোলাপীর ওলিয়েন্ডার, সাদা-লালের অশ্বগন্ধা, শুভ্র বেগুনীর স্বর্পগন্ধা, শুভ্র লিলি, সবুজ আইভি, মধুনাশিনী, গোলাপী জটামানসি আর শুভ্র-গোলাপীর নাগালিঙ্গ দিয়ে। ওদের পরিচর্যা করেই কাটিয়ে দেয় অখণ্ড অবসরের প্রায় সবটুকু। যত্নে বড় করা গাছগুলো, এখানকার প্রকৃতি আর এই লাইব্রেরিটার প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে অল্প ক-দিনেই।

চারপাশে তাকালো সে। দিন দিন নতুন নতুন বইয়ের আগমণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে গ্রন্থাগারটি। এখানকার খুব কম মানুষজনই জানে, নতুন এই লাইব্রেরিটির পেছনে তার অবদানের কথা।

রবীন্দ্রনাথের স্মরণে দেয়া এই লাইব্রেরিটির দক্ষিণ দিকের এককোণের ফ্রেঞ্চ জানালার পাশে যে রিডিং টেবিলটা আছে, সেটা তার খুব প্রিয়। একান্তে, নির্জন লাইব্রেরিটি হয়ে ওঠে তার সময় কাটানোর জায়গা। ইচ্ছে। করলে এখান থেকে বই নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েও পড়তে পারে, লাইব্রেরি থেকে খুব কাছেই সেটা, কিন্তু তার এখানে এসে বই পড়তেই বেশি ভালো। লাগে।

এ মুহূর্তেও তার কানে গোঁজা আছে হেডফোন, বাজছে আরেকটি প্রিয় একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত :

আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,
তুমি অবসরমত বাসিয়ো।
নিশিদিন হেথায় বসে আছি,
তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো…

কিছু একটা টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো।

“নমস্কার দিদি,” লাইব্রেরিতে কর্মরত এক ছেলে এক কাপ গরম চা টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ চলে গেলো।

ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে নেবে, এমন সময় বন্ধ হয়ে গেলো গান। থমকে গেলো সে। পরক্ষনেই বেজে উঠলো ফোনের রিংটোন।

হাতেগোণা দুয়েকজন ছাড়া তাকে সচরাচর কেউ ফোন দেয় না। কিন্তু এখন যে তাকে ফোন দিয়েছে সে তার সবচাইতে কাছের একজন মানুষ। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে খুব কমই ফোন করে সে। তারপরও যখন ফোন দেয়, দেখা যায় সেটা সুসংসবাদ দেবার জন্য নয়। এখনও সেরকমই কিছু আশঙ্কা করছে।

কলটা দ্রুত রিসিভ করলো। ওপাশে যে আছে তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠটা শুনেই বুঝতে পারলো, সত্যি খারাপ কিছু ঘটে গেছে। তারপরও ধীরস্থিরভাবে শুনে গেলো কিছুক্ষণ। তার প্রশান্তিময় অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো সবটা শোনার পর। নীচের ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরলো। চা পানের রুচি উবে গেছে। দুচোখ বন্ধ করে ফেললো কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, আর কতোটা সতর্ক থাকতে হবে ঠাণ্ডা মাথায় বলে দিয়ে ফোনালাপটি শেষ করলো সে।

অনেক সতর্ক আর সজাগ থাকলেও এরকম খবর শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কলটা শেষ হতেই এক ধরণের বিষণ্ণতা জেঁকে বসলো। তার কারণে ঘনিষ্ঠ কোনো মানুষের উপর দুর্ভোগ নেমে আসুক এটা সে চায় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। জানালা দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকালো। গাছগাছালির ভীড়ে অনতি দূরে প্রবাহিত ভৈরব নদীটি এখান থেকে দেখা না গেলেও ভেসে আসা শীতল বাতাসে নদীর গন্ধটা ঠিকই অনুভব করা যায়।

জায়গাটা তার নামের মতোই সুন্দর!

.

অধ্যায় ৫১

সুশোভন মিত্রের ফ্ল্যাটটা লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে খুব কাছেই, বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে অবস্থিত।

গৃহকত্রীর অনুপস্থিতি ছফাকে এক ধরণের স্বস্তিই দিলো। তবে গৃহকর্তার বেলায়ও একই কথা খাটে! সুশোভনের ভাষায়, নিজেকে নাকি আপাতত ব্যাচেলর ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ডিনারের পরই সিগারেট নিয়ে বসলো সে, তারপর অর্ধেক খাওয়া হুইস্কির একটি বোতল। কিন্তু দুই পেগের পরই ছফা ক্ষান্ত দিলো। হালকা মাথাব্যথার কারণে রাত একটার পরই ঘুমোতে গেলো সে। হ্যাঁঙ্গওভারের জন্য ভালো ঘুমও হলো না, তারপরও খুব সকালেই বিছানা ছাড়লো। নিজের ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেলো ড্রইংরুমে ইয়োগা ম্যাট বিছিয়ে ধ্যানে মগ্ন সুশোভন। কোনো এক দুর্বোধ্য যোগাসনে বসে আছে মূর্তির মতো।

ছফার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। হুইস্কির বোতল শেষ করেও সাত সকালে এমন ধ্যানমগ্ন ঋষিকে দেখবে আশা করেনি।

ছফা যে-ই না ধ্যানমগ্ন সুশোভনকে একা রেখে চলে যাবে ঠিক তখনই সে বলে উঠলো : “ফ্রেশ হয়েছে?”

“না। মাত্র উঠলাম।”

“ঘুম ভালো হয়েছে তো?” জানতে চাইলো কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল।

মাথা দোলালো ছফা।

“চাইলে আরেক দফা ঘুমিয়ে নিতে পারো। হ্যাঁঙ্গওভার খুব বাজে লাগে আমার কাছে।” ইয়োগা ম্যাট থেকে উঠে দাঁড়ালো। “আমি একটু পর অফিসে চলে যাবো। বাসু আছে…তোমার নাস্তা রেডি করে রাখবে ও। যেকোনো দরকারে ওকে বললেই হবে।”

“ঠিক আছে।”

“আমি অফিসে গিয়েই তোমাকে ঐ লিস্টটা পাঠিয়ে দেবো।”

“থ্যাঙ্কস।”

গত রাতে প্রথম কয়েক পেগ পেটে যেতেই সুশোভন কবি হয়ে উঠেছিলো, তারপর রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভারতবর্ষের রাজনীতি নিয়ে তিক্ত বক্তৃতা। শেষে চড়াও হয় হাল আমলের সঙ্গীত নামের অসঙ্গতির উপরে! সুরের নামে নাকি অসূরের বজ্জাতি চলছে! অটোটিউন নিয়ে কী সব বলেছে, ছফার মনেও নেই। এককালে সে ক্লাসিক গানের চর্চা করেছিলো, সে কথা জানিয়ে একটা ঠুমরির কয়েক লাইন গেয়েও শুনিয়েছে। খুব একটা মন্দ ছিলো না তার গান। চর্চা করলে আরো ভালো গাইতে পারবে সেন্দহ নেই।

ছফা একমনে শুনে গেছে তার কথা। বেশির ভাগ সময় মাথা নেড়ে, হু হা করে সায় দিয়ে গেছে। হুইস্কির বোতল যখন অর্ধেক খালি তখনও ছফার গ্লাস শেষ হয়নি। সুশোভন অবশ্য তাকে আরো বেশি পান করার জন্য বললেও জোর খাটায়নি।

এরপর নিজের ঘরে ফিরে এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যায় আবার, সুশোভন কখন অফিসে চলে গেছে টেরই পায়নি ছফা।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বিছানা থেকে জোর করে নিজেকে তুলতে হলো। ঘর থেকে বের হয়েই দেখতে পেলো ড্রইংরুমের ফ্যাক্স মেশিনে একটি লম্বা ফ্যাক্স চলে এসেছে। সুশোভন যে এতোটা করিৎকর্মা বুঝতে পারেনি। অফিসে গিয়ে প্রথমেই তার কাজটা করেছে। ফ্যাক্সের কাছে গিয়ে চোখ বুলালো সে। যেমনটা আশা করেছিলো, সুদীর্ঘ তালিকা। এটাতে মনোযোগ দেবার আগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবে বলে ঠিক করলো।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখতে পেলো ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দেয়া আছে। সুশোভনের হাউজকিপার ছেলেটার নাম সম্ভবত বাসুদেব।

দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে নিলো সে, চোখ বুলালো এরপর ফ্যাক্সের কাগজে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে থেকে মুশকান জুবেরির শিকার খুঁজে বের করা সহজ হবে না, তবে সে ভেবেছিলো, বয়স আর লিঙ্গ নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে তালিকাটি অতত বড় হবে না হয়তো। এখন যে সুদীর্ঘ তালিকা দেখতে পাচ্ছে সেটা তাকে ভাবনায় ফেলে দিলো কিছুটা।

ডাইনিং টেবিলের উপর আজকের আনন্দবাজার আর আজকালসহ ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান রাখা থাকলেও তাতে চোখ বুলালো না। নাস্তার পর চমৎকার এক মগ কফি খেয়ে তালিকাটা নিয়ে চলে এলো গেস্টরুমে। রোল করা দীর্ঘ লম্বা কাগজের শুরু থেকে পড়তে শুরু করলো। ভালো করেই জানে, এ কাজ করতে যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি দরকার হবে সেটা হলো ধৈর্য। সেই সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও, যেনো নিখোঁজদের মধ্যে কোনো প্যাটার্ন তার চোখ এড়িয়ে না যায়।

সুশোভনের ছিমছাম নির্জন ফ্ল্যাটে বসে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করতে করতে নিখোঁজদের তালিকায় চোখ বুলিয়ে যেতে শুরু করলো নুরে ছফা। বিগত তিন বছরের সুদীর্ঘ তালিকা দেখে বুঝতে পারছে, সারাটা দিন এ কাজেই চলে যাবে।

.

অধ্যায় ৫২

আসলাম আবারো ফিরে এসেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালের সামনে।

গতকাল পিএস তাকে ফোন করে মূল্যবান একটি তথ্য দিয়েছিলো-বুড়ো ডাক্তার নিজের হাসপাতালের একটি সুরক্ষিত ‘স্পেশাল কেবিন’-এ আছে। তবে ভদ্রলোক মোটেও অসুস্থ নয়।

আসলাম অবাক হয়নি একটুও। এরপরই সে হাসপাতালে চলে আসে, ডাক্তারকে নজরদারি করতে শুরু করে দেয়-কিন্তু সারা দিনেও উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়েনি। জানতেও পারেনি নতুন কিছু।

কিন্তু একটু আগে আশেক মাহমুদ আরেকটি তথ্য দিয়েছে তাকে : ডাক্তারের সব চাইতে বড় দুর্বলতার সন্ধান পাওয়া গেছে, আর সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে, ঐ ধুরন্ধর লোকটাকে বাগে আনা যাবে খুব সহজে। পিএসের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোই অবগত আছে সে। অরিয়েন্ট হাসপাতালের ভেতরেও তার লোক আছে, সম্ভবত ঐ লোকই এরকম খবর দিয়েছে।

এখন কালো রঙের গাড়িটা নিয়ে হাসপাতাল থেকে একটু দূরে পার্ক করে বের হয়ে এলো সে। মেইনগেটের পরে যে বিশাল ওয়েটিং এরিয়া আর রিসেপশনটি আছে সেখানে এসে কিছু উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পেলো। হাসপাতালে এমন দৃশ্যই স্বাভাবিক-রোগীর নিকটাত্মীয়েরা বসে থাকে। রাজ্যের যতো দুশ্চিন্তা নিয়ে। কাঁচের বিশাল দরজাটার পাশেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির রিসেপশন ডেস্ক, ওখানে বসে আছে এক তরুণ আর তরুণী। ছেলেটা মনোযোগ দিয়ে কী যেনো দেখছে, কিন্তু মেয়েটা কানে ফোন ঠেকিয়ে আলাপে ব্যস্ত। তার দিকে তাকালো মেয়েটা। গতকাল থেকে দেখছে তাকে, চেহারাটা চিনে ফেলেছে সম্ভবত। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। রোগীর আত্মীয়স্বজন তো ঘনঘন হাসপাতালে আসতেই পারে।

রিসেপশন এরিয়া থেকে সোজা লিফটের দিকে চলে গেলো সে। তার গন্তব্য আবারো পাঁচ তলায়-ওখানেই এক স্পেশাল কেবিনে আছে বুড়োটা।

প্রায় বিশ মিনিট ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে অপেক্ষা করার পর দেখতে পেলো, ওয়াশরুমের পাশে ছোট্ট একটি প্যাসেজ দিয়ে এক তরুণী আর অল্প বয়েসী এক ছেলে বেরিয়ে আসছে। পিএসের দেয়া তথ্যমতে ওখানেই আছে স্পেশাল কেবিনটা। তাহলে এই মেয়েটাই ডাক্তারের দুর্বলতা!

ওয়েটিং এরিয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো আসলাম। তরুণী আর ছেলেটা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন। চুপচাপ তাদের পেছনে এসে দাঁড়ালো সে। লিফটের দরজা খুলে গেলে ঢুকে পড়লো ঐ দুজন, তাদের পেছন পেছন ঢুকে পড়লো আসলাম। তিন জন মানুষকে নিয়ে লিফটটা নামতে শুরু করলো এবার।

লিফটের ভেতরে কেউ কোনো কথা বলছে না। আসলাম ভালো করে তরুণীকে দেখে নিলো। চেহারাটা তার মুখস্ত করে রাখা দরকার। সঙ্গে থাকা তরুণকেও দেখে নিলো। একেবারেই সাদামাটা চেহারার। দেখে মনে হয়, মেয়েটার বাসায় কাজ করে। বড়লোকের বাড়িতে যে-রকম গরীব আর অভাবী আত্মীয়স্বজন আশ্রয়ে থাকে, ঠিক সেরকম।

গ্রাউন্ডফ্লোরে থামলে ওই দু-জন লিফট থেকে বের হয়ে গেলে আসলামও তাদের অনুসরণ করলো নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। ওরা কেউই তাকে একবারের জন্যে লক্ষ্য করেনি। আসলাম মেয়েটার দিকে এক ঝলক

তাকিয়ে পারলো না। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে কাঁচের দরজাটা খুলে বের। হয়ে এলো সে। ওদের আগে তাকে তার গাড়ির কাছে পৌঁছাতে হবে।

হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে উঠে বসলো ঐ তরুণী আর ছেলেটা। গাড়িটা সম্ভবত উবার হবে। দূর থেকে দেখলো, ড্রাইভার মোবাইলফোন হাতে নিয়ে ট্রিপটা কনফার্ম করছে।

গুলশান থেকে উবারের গাড়িটা চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরের আরেক অভিজাত এলাকা বনানীর দিকে। যেমনটা ভেবেছিলো, গাড়িটা এসে থামলো বনানীর তিন নাম্বার রোডে ডাক্তারের বাড়ির সামনেই।

তরুণী আর অল্পবয়েসী ছেলেটা গাড়ি থেকে নামতেই ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিলো দারোয়ান, বাড়িতে ঢুকে পড়লো ওরা।

গাড়িতে বসে, একটু দূর থেকে সবটাই দেখলো আসলাম। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলে হাসি।

পিএসের তথ্য একেবারেই ঠিক।

.

অধ্যায় ৫৩

এদিকে ঢাকা থেকে আধঘণ্টা পিছিয়ে থাকা কলকাতা মহানগরীর বেনটিঙ্ক স্ট্রিটে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে প্রায় উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই হেঁটে যাচ্ছে নুরে ছফা। তার মাথায় একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই। চিন্তাভাবনা পরিস্কার করার জন্যই ঘর থেকে বের হয়েছে সে। প্রায় সারাটা দিনই সুশোভনের ফ্ল্যাটে ছিলো।

সন্ধ্যা নামার একটু আগে মাথাটা ভার হয়ে এলে সুশোভনের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পড়ে একটু হাটাহাটি করার জন্য। বিকেলের দিকে সহকারী নগরপাল ফোন দিয়ে জানিয়েছিলো তার ফিরতে একটু দেরি হবে আজ। কাজ শেষে শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে বৌকে দেখে আসবে। ছফার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলো সে। তাকে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত নিখোঁজদের সুদীর্ঘ তালিকা থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছে যাদের ব্যাপারে আরো খোঁজ নেওয়া দরকার। সুশোভন তাকে বিস্তারিত তথ্য দেবার আশ্বাস দিয়েছে।

যাই হোক, নিখোঁজদের তালিকার বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবর্গের। কিছু অপ্রকৃতিস্থ লোকজনও আছে। ছফা মনে করে না, মুশকান জুবেরি প্রতিবন্ধীদের উপর চড়াও হবে! মহিলার রুচিবোধ আছে। তার আগের কোনো শিকারই এমন ছিলো না। কিন্তু তারপরও কথা থাকে-অভাবে পড়লে বাঘ যেমন ঘাস খাওয়া শুরু করে, তেমনি মুশকানের পক্ষেও শিকারের ধরণ পাল্টানো সম্ভব। হয়তো ‘সফট টার্গেট’ বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে মহিলা। তবে এটাও ঠিক, কলকাতা মহানগরীতে শিক্ষিত আর মার্জিত পুরুষ মানুষের অভাব হবার কথা নয়। বিগত তিন বছরের তালিকায় কিছু শিক্ষিত-মার্জিত পুরুষ মানুষও রয়েছে যারা মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর নিখোঁজ হয়েছে, তবে তাদের মধ্যে কেবল দুজনই সব দিক থেকে শিকার হবার যোগ্যতা রাখে বলে মনে করছে ছফা।

নিখোঁজদের অনেকের বিরুদ্ধে ড্রাগ অ্যাডিকশনের অভিযোগ থাকায় ছফা তাদেরকে বাদ দিয়েছে। সে মনে করে না, নেশাগ্রস্ত কোনো মানুষকে মুশকান জুবেরি শিকার বানাবে। যে প্রত্যঙ্গটি ঐ মহিলার বিশেষভাবে দরকার, সেটা সুস্থ থাকা চাই।

তবে দু-জন সম্ভাব্য শিকারের মধ্যে একজনকে নিয়ে ছফা বেশি আগ্রহী-ভদ্রলোক একজন ডাক্তার! বয়স আটত্রিশের মতো হবে। মুশকানের শিকার হিসেবে সামান্য বেশি কিন্তু পদমর্যাদা আর শিক্ষার ব্যাপারটা হিসেবে নিলে তার দিকেই মনোযোগ চলে যায়। ঐ ডাক্তার নিখোঁজ হয়েছে। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার প্রায় এক বছর মাস পর। কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেবার পর পরই মহিলা শিকারে নামবে, এমনটা আশা করে না ছফা। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। মুশকান ঠিক কবে থেকে শিকার শুরু করেছে কে জানে!

তালিকাটা এখনও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি, ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে বাকি নামগুলো দেখবে। আশা করছে, সুশোভন ফিরে আসার আগেই কাজটা শেষ করতে পারবে। এই দীর্ঘ তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জনকে শিকার বানানোর কথা ঐ মহিলার-এটা বিবেচনায় নিলে তালিকাটি এখন পর্যন্ত ছফার জন্য হতাশাজনকই। তবে, নতুন জায়গায় এসে মুশকান যদি নিজেকে সংযত রেখে থাকে, তাহলে এরকমটি হতেই পারে।

তালিকায় নিখোঁজদের শুধু নাম, বয়স, নিখোঁজ হবার দিনক্ষণ আর পেশার উল্লেখ আছে। তার দরকার সম্ভাব্য দু-জন শিকারের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত তথ্য।

দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ করে নুরে ছফা পা বাড়ালো সুশোভনের ফ্ল্যাটের দিকে।

.

অধ্যায় ৫৪

রাত দশটার পর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলো সুশোভন, সঙ্গে করে একটা বোতলও এনেছে। ছফার বুঝতে বাকি রইলো না ওটা কি। আৎকে উঠলো সে। আবারো মদ্যপান! না। তার পক্ষে আজ আর এ জিনিস পান করা সম্ভব হবে না। সে ওকেশনাল ড্রিঙ্কার, বছরে টেনেটুনে তিন-চার বার খায়। তা-ও এক বসায় দুই পেগের বেশি না। কাল রাতে হাফ গ্লাস শেষ করতেই বেগ পেয়েছে, বুঝে গেছে তার শরীর এর চেয়ে বেশি অ্যালকোহল সহ্য করতে পারে না।

“আজকে আমি কিন্তু নেই,” ছফা আত্মসমর্পন করার ভঙ্গিতে বললো। “তোমাকে একাই ড্রিঙ্ক করতে হবে, দাদা।” সে বসে আছে সুশোভনের ড্রইংরুমে। ডিনারের পর টিভি দেখছিলো।

সুশোভন হেসে ফেললো। “তুমি না বড় ইয়ে…এতো কম খাও এ। জিনিস! লিও’তে কনিয়াক-এর মতো জিনিসও ছুঁয়ে দেখলে না।” ছফার পাশে এসে বসলো সে।

“ওসব খেলে আমার হ্যাঁঙ্গওভার হয়…কালকেও হয়েছিলো।”

“বেশি করে মেরে দিলে হ্যাঁঙ্গওভার হতো না,” বোতলটায় টোকা মেরে বললো, “লন্ডন থেকে এক বন্ধু গিফট করেছে…গ্লেনফিডিখ…কুড়ি বছরের পুরনো মাল! চেখে না দেখলে হয়?”

“একশ’ বছরের হলেও আমি নেই আজ,” ছফা হেসে বললো।

কাঁধ তুললো সুশোভন। “কী আর করা।” একটু থেমে আবার বললো সে, “তা বলো, সারাদিন খেটেখুটে কী পেলে?”

“এই লিস্ট থেকে মাত্র দু-জনকে পেয়েছি, যারা ঐ মহিলার সম্ভাব্য টার্গেট হতে পারে,” বললো ছফা।

“সেটা তো বিকেলেই বলেছো, এরপর আর কাউকে পাওনি?”

মাথা দোলালো সে। “তবে যে-দুজনকে পেয়েছি তাদের ডিটেইলস ইনফো লাগবে আমার।”

“ও তুমি পেয়ে যাবে। ওদের নিখোঁজ কেসগুলোর তদন্ত চলছে এখনও।”

“তাহলে তদন্তকারী অফিসারের কাছ থেকে হেল্প পাওয়া যাবে নিশ্চয়?”

“সেটার ব্যবস্থা করা যাবে, চিন্তা কোরো না।” একটু ভেবে আবার বললো সুশোভন, “তুমি বলেছিলে দুজনের মধ্যে একজন ডক্টর আছে?”

“হুম। কিন্তু কীসের ডাক্তার, কোথায় কাজ করতো সেসব কিছু ডিটেইল্স নেই তালিকায়।”

“ডেটাবেইজে অতো ডিটেইল্স থাকে না। যেগুলো দিয়েছি তার সবগুলোরই তদন্ত হচ্ছে, কেস প্রগ্রেস করলে আপডেট করা হয়।”

“আনসভ কেসগুলোর লিস্ট দিয়েছো বলে থ্যাঙ্কস। এটা আমার আগেই বলে দেয়া উচিত ছিলো তোমাকে।”

হেসে ফেললো সুশোভন মিত্র। “আরে ভুলে যাচ্ছো কেন, আমিও পুলিশ! ঘটে কিছু বুদ্ধি তো রাখিই, নাকি?”

“রাখো মানে…বেশিই রাখো।”

“হা-হা-হা,” করে প্রাণখোলা হাসি দিলো সহকারী নগরপাল।

“তবে তালিকা অনেক বড় দেখে আমি কিন্তু অবাক হয়েছি, দাদা।”

“কেন? কলকাতা মহানগরী কি কম বড় নাকি? কতো মানুষ থাকে জানো? দিন দিন এসবের সংখ্যা বাড়ছে।”

“আমাদের ওখানেও তাই।”

একটু চুপ থেকে বললো নগরপাল, “ডিনার করে ফেলেছে তো?”

“হুম। তুমি তো ফোনে বলেই দিয়েছিলে তোমার জন্য ওয়েট না করতে।”

“হ্যাঁ, আমি ওখান থেকেই খেয়ে এসেছি,” উঠে দাঁড়ালো সুশোভন। “তুমি বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।” বোতলসহ শোবার ঘরের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালো সে।

“তোমার ঐ ডাক্তারের নামটা কি?”

“ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিক।”

“কি!” অবাক হলো নগরপাল। ভুরু কুঁচকে গেলো তার। “ডিপি মল্লিক??”

“চেনো তাকে?”

“আমি তো ভেবেছিলাম তার কেসটা এরইমধ্যে সল্‌ভ করে ফেলেছে পুলিশ।”

ছফা আরো কিছু জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলো। “তোমার ঐ সাসপেক্ট…কী যেনো নাম?”

“মুশকান জুবেরি।”

“হুম। মহিলা তো দারুণ টার্গেট বেছে নিয়েছে, মাইরি,” প্রশংসার সুরে বললো।

“কী রকম?” উৎসুক হয়ে উঠলো সে।

“ডিপি মল্লিক একজন ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন, বুঝতে পেরেছো তো?”

কথাটার মধ্যে যে ইঙ্গিত আছে সেটা ধরতে পারলো ছফা।

.

অধ্যায় ৫৫

মুশকান জুবেরির সম্ভাব্য শিকার একজন প্লাস্টিক সার্জন?!

চিন্তাটা ছফার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিগত দশ-পনেরো মিনিট ধরে।

একজন সন্দেহভাজন পালিয়ে গেলো পাশের দেশে, তারপর দ্বারস্থ হলো এক প্লাস্টিক সার্জনের। কেন-এর জবাব পেতে কোনো কিছু ভাবার দরকার নেই। সুশোভনের মতো সে-ও জানে জবাব একটাই-মুশকান জুবেরি সম্ভবত তার চেহারাটা পাল্টে ফেলার চেষ্টা করেছে।

না, পাল্টে ফেলেছে! নিজেকে শুধরে দিলো মনে মনে।

“মহিলা দারুণ স্মার্ট,” বললো সুশোভন মিত্র। “এক ঢিলে দুটো পাখি মেরেছে।”

ছফাও জানে কথাটা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি।

“চেহারাটা পাল্টে ফেলে শিকারকে হত্যা করে তার অগানটারও একটা বন্দোবস্ত করেছে।”

মাথা নেড়ে সায় না দিলেও মনে মনে ঠিকই সায় দিলো ছফা। “এই কেসটা যে অফিসার দেখছে তার সাথে কথা বলা যাবে?”

“অবশ্যই যাবে,” জোর দিয়ে বললো সুশোভন। চাইলে এখনই কথা বলিয়ে দিতে পারি।”

“এখনই?” অবাক হলো সে।

“যদি তুমি চাও তো…রাত খুব একটা বেশি হয়নি কিন্তু।”

একটু ভেবে নিলো ছফা। তর সইছে না তার, তবে রাত দশটার পর কোনো অফিসারকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। ডিউটি শেষে নিশ্চয় বাড়িতে গিয়ে বৌ-বাচ্চার সাথে সময় কাটাচ্ছে। “এখন কল করলে বিরক্ত হবে না?”

“তা তো হবেই,” হাসিমুখে বললো সুশোভন। “কিন্তু আমার কাছ থেকে রাত দশটার পর ফোন পেলে মোটেও বিরক্ত হবে না, এ আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।”

হেসে ফেললো ছফা। “তাহলে কল দাও।”

“ওকে।” উঠে পাশের ঘরে গিয়ে মোবাইলফোনটা নিয়ে এলো। “আমি জানি কোন্ অফিসার এই কেসটা দেখছে,” এ কথা বলে একটা নাম্বারে ডায়াল করে ছফার পাশে এসে বসলো সে। কলটা রিসিভ হতেই কানে চেপে বললো : “হ্যা…দেবাঞ্জন, একটা ভীষণ দরকারে ফোন না দিয়ে পারলাম না…” ওপাশ থেকে কিছু শুনে গেলো নগরপাল। “তুমি তো ঐ। প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের কেসটা দেখছো, তাই না?…কেসের আপগ্রেডটা জানতে চাইছি আমি,” একটু থেমে উৎসুক ছফার দিকে তাকালো সে, মুচকি হেসে চোখও টিপে দিলো। ওপাশের কথা শুনে গেলো কিছুক্ষণ। “কোনো কূলকিনারাই করা যায়নি, বলো কি!” ছফার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ওল্টালো। “আচ্ছা…বুঝতে পেরেছি…হুম…সেটাই…ঠিক আছে…থ্যাঙ্কস…পরে দরকার হলে আবার কল দেবো তোমাকে।”

“কী বললো?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।

“কানাগলিতে গিয়ে আটকে আছে কেসটা। কোনো কূলকিনারা করা যায়নি।”

“কাউকে সাসপেক্ট হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়নি?”

“প্রাইমারিলি মি. মল্লিকের কিছু কলিগকে সাসপেক্ট মনে করলেও সেগুলোর কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি। দেবাঞ্জন বলছে, ওর ধারণা ভদ্রলোক ইলিগ্যাল প্র্যাকটিস করতো…বুঝতেই পারছো কী রকম। এসবের সাথে তার নিখোঁজের সম্পর্ক থাকতে পারে।”

ছফাকে আশাহত দেখালো।

“ও বললো, কেসটা নাকি খুবই রহস্যময়। মি. মল্লিক একদিন বলা নেই কওয়া নেই, হুট করেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিজের বাসা থেকে বের হয়েছিলো, কী কাজে সেটাও কাউকে বলেনি,” একটু থেমে আবার বললো সুশোভন, “এজন্যে সামান্য কুও বের করা যায়নি কেসটার।”

ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কথাটা শুনে।

“কী?” আগ্রহী হলো কলকাতা পুলিশের নগরপাল।

“মুশকান জুবেরি এর আগে যাদেরকে শিকার করেছে তাদের কেসগুলোও এমনই ছিলো, একদম কুলেস। পুলিশ সামান্য অগ্রগতিও করতে পারেনি বলে আমাকে কেসটা দেয়া হয়।”

“তুমি তো তাহলে বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছে, সাসপেক্টকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলে। নিখোঁজদের কী হয়েছিলো সেটাও বের করে ফেলেছিলে।”

“কিন্তু ঐ মহিলাকে…” কথাটা আর শেষ করলো না। নিজের ব্যর্থতার কথা বলতে সব সময় তার খারাপ লাগে।

“তুমি বসো, আমি আসছি,” শোবার ঘরে চলে গেলো সুশোভন।

ছফার মাথায় এখন অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে, উঁকি দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনা। তাহলে কি কেএস খানের কথাটাই সত্যি? সে যে মুশকানকে রমনা থেকে ফেরার সময় দেখেছিলো, সবটাই ছিলো হেলুনিসেশন? কিংবা ডিশন!

এখন যা বুঝতে পারছে মুশকান জুবেরি ঢাকায় গিয়ে থাকলেও তাকে দেখে চিনতে পারতো না ছফা।

“তুমি বসে বসে মাথা ঘামাও,” বোতল আর গ্লাসসহ ঘরে ঢুকে বললো। সুশোভন মিত্র, “আমি একটু চেখে দেখি।”

“বৌদির অ্যাবসেন্সটার ভালোই ফায়দা নিচ্ছো।”

হেসে ফেললো নগরপাল। “আমার কি সেটা নেয়া উচিত হচ্ছে না?” তারপর চোখ টিপে দিলো। “বিয়ে থা করো, তখন বুঝতে পারবে। এখন

তো ঝাড়া হাত-পা, ব্যাচেলর মানুষ…আমাদের দুঃখ বুঝবে না তুমি।”

কিছু বললো না ছফা। তার মাথায় এখন অজস্র চিন্তা। একটু উদাস হলেও আড়চোখে দেখতে পাচ্ছে সুশোভন বেশ আয়েশ করে গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে। লালচে তরলে ভর্তি গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো কয়েক মুহূর্ত, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের লিও’তে ইন্টারপোলের সদর দফতরে এক সেমিনারে অংশ নিতে গেলে ওখানে প্রথমবারের মতো সুশোভনের সাথে। এক রুমে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার। যে ক-দিন তারা ছিলো, প্রতি রাতেই দামি দামি সব ফরাসি মদ নিয়ে আসতো কলকাতার এই নগরপাল। বেশ আয়েশ করে মদ্যপান করতো। এক্ষেত্রে সে আবার ফরাসিদের সমকক্ষই বলা চলে-কোন মদের জন্য কোন গ্লাস, কী তার প্রিপারেশন সবই তার নখদর্পনে। হুইস্কি পানের সময় গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঠিক এভাবেই ঘ্রাণ নিতো তখন।

“কঠিন জিনিস, বুঝেছো?”

সুশোভনের কথায় লিও থেকে কলকাতায় ফিরে এলো ছফা।

“আস্তে আস্তে গলা দিয়ে নামতে দেবে…এ জিনিস সরবতের মতো খেতে হয় না। ছোট্ট একটা চুমুক দিলো এরপর। “আহ্!” আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো। “দুর্দান্ত জিনিস।”

“ডিপি মল্লিক যদি মুশকান জুবেরির শিকার হয়ে থাকে তাহলে ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভ নয়তো ডিলিট করা থাকবে।”

“তাই নাকি?” গ্লাসের তরলে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো নগরপাল।

“এর আগের প্রায় সব শিকারের সাথেই মহিলা এ কাজ করেছে, শুধু একটার বেলায় এটা করতে পারেনি, আর সেই ভিক্টিমের সূত্র ধরেই তাকে আমি খুঁজে বের করতে পেরেছিলাম।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলো সুশোভন মিত্র। “তাহলে ফেসবুক ঘেঁটে দেখো ডিপি মল্লিকের আইডিটার কী অবস্থা। আমার তো ওয়াইফাই আছে, সেলফোন থেকে লগ-ইন করো।”

পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করলো ছফা। “পাসওয়ার্ডটা বলো?”

“শিভাস রিগ্যাল।”

“কি!”

হেসে ফেললো সুশোভন। “মজা করলাম। এবার আসলটা বলছি। এসএইচভিএন০২০৩১৯৭৮।”

“তোমার ডেট অব বার্থ নাকি?” পাসওয়ার্ডটা ইনপুট দিতে দিতে বললো ছফা।

মাথা নেড়ে সায় দিলো নগরপাল। “সহজ আর মনে থাকবে এমন পাসওয়ার্ডই আমি দেই। র‍্যান্ডম ডিজিট আমার মুখস্ত থাকে না। তবে ভেবো না, ফেসবুক, ইমেইল কিংবা ক্রেডিট কার্ডের বেলায়ও একই কাজ করি।”

মুচকি হাসলো ছফা। “তুমি অহোটা বোকা যে নও সেটা আমি জানি।”

হা-হা করে হেসে চোখ টিপে দিলো। “ওকে…তুমি কাজ করো, আমি একটু মদমত্ত হই।”

ছফা ফেসবুকে ঢুকে সার্চ করতে শুরু করে দিয়েছে এরইমধ্যে। “আমার ধারণা ভদ্রলোকের আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভ….অথবা ডিলিটেড।”

সুশোভন গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিলো। “তা হলে তো হয়েই গেলো, স্পষ্ট হয়ে যাবে, ওটা তোমার ঐ সেক্সি-গ্লামারাস মহিলারই কাজ।”

ছফা বুঝতে পারলো, সুশোভন এখন আস্তে আস্তে অশোভন হতে থাকবে।

“আচ্ছা, এখানকার মানুষজন ইংরেজিতে এভাবে মল্লিক লেখে কেন?”

ভুরু তুললো নগরপাল। “এম-ইউ-এল-এল-আই-সি-কে?”

“হুম।”

“কেন, তোমাদের ওখানে অন্যভাবে লেখে নাকি?”

“এম-ও-এল-এল-আই-কে লিখতে দেখেছি অনেককে।”

মাথা দোলালো সুশোভন। চোখ বন্ধ করে কী যেনো ভাবছে।

ছফা আর কথা না বাড়িয়ে নামটা টাইপ করে সার্চ দিলো। কিছুক্ষণ পরই ভেসে উঠলো রেজাল্ট। আৎকে উঠলো সে। “ওরে বাপরে! এতো দয়াল প্রসাদ মল্লিক আছে ভারতে।”

“কলকাতায় এ নাম কমই আছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষ হিসেবে নিলে অনেক হবারই কথা।”

“তুমি কি ভদ্রলোককে কখনও দেখেছো?” ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো ছফা।

“না। তবে পত্রিকায় ছবি দেখেছি।”

“তাহলে তো ছবি দেখলে চিনতে পারবে?”

“হুম।” গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো নগরপাল। “এক কাজ করো, নামের আগে ‘ডক্টর’ লাগিয়ে সার্চ করো। ডক্টরদের মাইরি অদ্ভুত বাতিক থাকে, বুঝলে?” গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো আবার, “নামের আগে ‘ডক্টর বসাতে না পারলে ওদের পোঁদের মধ্যে এক ধরণের চুলকোনি হয়। আমি কখনও ‘ডক্টর’ পদবী ছাড়া কোনো ডক্টরকে তার নাম লিখতে দেখিনি। এটা কিন্তু

তুমি অন্য প্রফেশনালদের বেলায় সব সময় দেখবে না।”

মুচকি হাসলো ছফা। পনেরো বছরের পুরনো দ্রব্যের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, সামান্য মাতলামিতে ধরেছে সুশোভনকে।

নামের আগে সংক্ষেপে ‘ডক্টর’ যোগ করে সার্চ দিলো এবার।

ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিক

রেজাল্ট আসতেই চমকে উঠলো-এ নামে কোনো আইডিই নেই! নুরে ছফা হতাশ হয়ে তাকালো সুশোভনের দিকে।

“কি?” নগরপাল আবারো মদ ঢালতে উদ্যত হচ্ছিলো গ্লাসে। “এ নামে কোনো ফেসবুক আইডি নেই দেখছি!”

একটা সেঁকুর তুলে তার দিকে তাকালো সুশোভন মিত্র। আইডি না পেয়ে ছফার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কেন বুঝতে পারছে না সে।

.

অধ্যায় ৫৬

প্লাস্টিক সার্জন ডিপি মল্লিকের আইডিটা খুঁজে না পেয়ে মনে মনে ছফা এখন একটাই কামনা করছে-এই সার্জনের নিখোঁজের পেছনে যেনো মুশকান জুবেরিই জড়িত থাকে।

“একটু চেখে দেখবে নাকি? টেনশনে এ জিনিস ভালো কাজে দেবে।”

মাথা দুলিয়ে না করে দিলো ছফা। সে এখন ভাবছে, ডিপি মল্লিকের ব্যাপারে কিভাবে তথ্য জোগাড় করা যায়।

“একা একা মদ খাওয়া কী রকম, জানো?” সহকারী নগরপাল বললো হতাশার সুরে। “হস্তমৈথুনের মতো। মজাটা তুমি পাবে কিন্তু আসলটার মতো না!”

“কীসের সাথে যে কী বলো না!” ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়েই বললো ছফা। তার হাসিই পাচ্ছে।

“সত্যি বলছি, মাইরি,” সুশোভন ঝুঁকে এলো একটু। “এ জিনিস খেতে হয় কয়েক জনে মিলে, তাহলে জমে ভালো। বুঝতে পেরেছো?”

মাতালের সাথে তাল মেলানোর জন্যই মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।

“তিনজন হলে তো কথাই নেই,” জোরে ঢেঁকুর তুলে বললো এবার। “অসাম! একেবারে থ্রি-সামের ফিলিংসটা পাবে।”

আক্ষেপে মাথা দোলালো নুরে ছফা। “দাদা, সাবধান! তুমি অন্যদিকে চলে যাচ্ছো।”

“কথা কিন্তু সত্যি বলেছি। আর চার-পাঁচ জন হলে কি হয় জানো তো? গ্যাং ব্যাং!”

ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নগরপালের দিকে তাকালো। মাতালের সাথে তাল দেবার দরকার নেই আর। একা একা যতোক্ষণ পারে বকবক করুক। আবারো সে মনোযোগ দিলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।

“তোমার ঐ গ্লামারাস সাসপেক্ট কিন্তু কঠিন মাল,” সুশোভন বলে যেতে লাগলো। “নিজের চেহারাটাই পাল্টে ফেলেছে। এখন যদি সে কোনোভাবে এখানকার পাসপোর্ট বাগিয়ে নিতে পারে তাহলেই হয়েছে, একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।”

ছফাও এরকম আশঙ্কা করছে এখন।

“না না, ভুল বললাম, মাতাল কণ্ঠে বললো সহকারী নগরপাল। “ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে না!”

কৌতূহলি হয়ে সুশোভনের দিকে তাকালো ছফা।

“আই উড রাদার সে…মহিলা আরো কাছে চলে আসবে। কিন্তু কোন্ শালা তাকে চিনবে, উম?” এবার কণ্ঠটা গম্ভীর করে বললো, “কিপ ইওর ফ্রেন্ডস ক্লোজ…ইওর এনিমিজ ক্লোজার!”

ছফা কিছু বললো না, চেয়ে রইলো নগরপালের দিকে।

“ঐ ডেঞ্জারাস লেডি তোমার খুব কাছে আসার প্ল্যান করেছে, বুঝতে পেরেছো! তোমাকেও তার শিকার বানানোর প্ল্যান-ট্রান করছে বোধহয়।”

ছফা মাথা দোলালো মাতালের কথা শুনে।

“হতাশ মনে হচ্ছে?” ঢুলু ঢুলু চোখে জানতে চাইলো। “এতো সহজে হতাশ না হয়ে ডিপি মল্লিকের কোনো পেইজ আছে কিনা খুঁজে দেখো,” মদে চুমুক দিয়ে বললো সুশোভন। “অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা, ডি-অ্যাক্টিভ করা সহজ, পেইজের বেলায় কাজটা কিন্তু অতো সহজ না।”

নড়েচড়ে উঠলো ছফা।

“ফেমাস প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জন…তার তো পেইজ থাকবেই।” একটা সেঁকুর তুলে আবার বললো, “বিশেষ করে তার ক্লিনিক কিংবা হসপিটালের নামেও থাকার কথা।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দ্রুত ফেসবুকে পেইজটার সার্চ করতে শুরু করে দিলো সে। পাঁচ মিনিট পরই খুঁজে পেলো, ডিপি মল্লিকের আসলেই একটা পেইজ আছে! সেটাতে ক্লিক করলো ছফা।

হাসি হাসি মুখের, সাদা অ্যাপ্রোন পরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ডা. দয়াল প্রসাদ মল্লিকের প্রোফাইল পিকটা ভেসে উঠলো। সুন্দর করে ছাটা গোঁফ, ছোটো করে ছাটা পরিপাটি চুল, হালকা নাদুসনুদুস শরীর, বড় বড় চোখ।

ছফা জানে প্লাস্টিক আর কসমেটিক্স সার্জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে লোভনীয় পেশা হিসেবে প্লাস্টিক সার্জনেরা কসমেটিক্স সার্জারির দিকেই ঝুঁকে পড়ে বেশি। ডিপি মল্লিকও তাই করেছে সম্ভবত।

নিখোঁজ হবার আগে এই সার্জন কাজ করতো চেঞ্জমেকার নামের একটি ক্লিনিকে।

“কিছু পেলে?” সুশোভন অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জানতে চাইলো।

“পেইজটা দেখছি,” ফোনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বললো সে।

“ঐ সার্জন কিন্তু সেলিব্রেটিদের সাথে ইয়ে করে বেড়াতো। আমার এক কলিগ বলেছিলো, এখন মনে পড়েছে। ঐ যে, এক অ্যাক্ট্রেস আছে না?…আরে ঐ যে…” সুশোভনের বেয়াড়া স্মৃতি এখন সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতো। “ঐ মেয়েটার সাথে একটা কেলেঙ্কারির খবর বেরিয়েছিলো।”

“কি রকম কেলেংকারি?”

“আরে আজকাল যা শুরু হয়েছে…ওরকম,” একটু থেমে আবার বললো, “ঐ যে মিটু মুভমেন্ট চলছে না? ওটাতে ওর নাম এসছিলো। এক অ্যাক্ট্রেস অ্যাকুইজ করেছিলো ওকে।”

ছফা অবশ্য এ মুহূর্তে কেলেঙ্কারি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ ফোনের ছোট্ট পর্দায়। প্রায় সব পোস্টই আগ্রহী কসমেটিক্স সার্জারির ক্লায়েন্টদের। কোনটা করতে কত টাকা লাগতে পারে, কতো দিন লাগবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, এইসব জানতে অনেকেই আগ্রহী। ডা. মল্লিকও সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। তবে ছফার ধারনা এসব জবাব ভদ্রলোক নিজে দেয়নি। এরকম পেইজগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কেউ চালায়, এখানেও সম্ভবত তাই হয়েছে। ডাক্তারের মতো ব্যস্ত কেউ দিনরাত বসে বসে প্রশ্নের জবাব দেবার কথা না।

বেশির ভাগ পোস্টই ছবিসহ। সেইসব ছবি স্ক্রল করতে করতে একটা ছবিতে এসে থমকে গেলো ছফা। ভুরু কুঁচকে তাকালো সে।

“মাই গড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো।

.

অধ্যায় ৫৭

ডা. ডিপি মল্লিকের পেইজে তার অসংখ্য সাফল্য আর কর্মকাণ্ডের ছবি রয়েছে। সেসব ছবির সংখ্যা কয়েক শ’ হবে। বিদেশের কোন্ মেডিকেল থেকে কী কোর্স করেছে, কোথায় কোন্ সম্মাননা পেয়েছে, তার চেঞ্জ মেকার ক্লিনিক কী কী সুবিধা দিয়ে থাকে, কতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, এ পর্যন্ত কতোজন ক্লায়েন্টকে সেবা দিয়েছে, সে-সবের ছবিসহ ফিরিস্তি দেয়া আছে। তবে তার সেলিব্রেটি ক্লায়েন্টের মধ্যে খুব কমই নিজেদের পরিচয় কিংবা ছবি দেখাতে রাজি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ডাক্তার এটা নিজেই স্বীকার করেছে। তার দাবি, প্রচুর সেলিব্রেটির কসমেটিক্স সার্জারি করেছে সে, তাদের অনুরোধেই নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে কিছু কিছু সেলিব্রেটি উদারতা দেখিয়ে তাদের নাম আর ছবি দিয়েছে, সেইসাথে ডাক্তারের প্রশংসা করতেও ভোলেনি। তাদেরকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেছে ডিপি মল্লিক।

এসব কিছু নিয়ে ছফার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই, থাকার কথাও নয়, কিন্তু একটা ছবি দেখে তার চোখ আটকে গেছে একটু আগে। এখন সেই

ছবিটার দিকেই ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে সে।

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ!

ডিপি মল্লিকসহ আরো অনেক ডাক্তারের সাথে দাঁড়িয় আছেন ভদ্রলোক। ছবিটা ২০১৩ সালের অক্টোবরের। আর সেটা বাংলাদেশেই।

ছবির নীচের ক্যাপশন বলছে : ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার নামকরা অরিয়েন্ট হাসপাতালের আমন্ত্রণে ডাক্তার ডিপি মল্লিক গিয়েছিলো সেখানকার প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক্স সার্জারি ডিপার্টমেন্টের একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে।

ছফা টের পেলো উত্তেজনায় তার রক্ত টগবগ করছে। সে আরো কিছু ছবি দেখলো। মোট তিনটি ছবি পাওয়া গেলো যেগুলো ডিপি মল্লিকের অরিয়েন্ট হাসপাতাল সফরের সময়ে তোলা। তবে কেবলমাত্র একটি ছবিতেই ডাক্তার আসকারের সাথে, আর সেটা ডিপি মল্লিক নিজেই তুলেছে-সেফি। এই ছবির নীচে ক্যাপশনটা দেখলো ছফা : প্রখ্যাত সার্জন এবং অরিয়েন্ট হাসপাতালের কর্ণধার ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সঙ্গে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো সে। ঐ সময়ে মুশকান জুবেরি অরিয়েন্ট হাসপাতালে কাজ করতো না, ততোদিনে সুন্দরপুরে চলে গেছে।

“হোগা!” বেশ জোরে বলে উঠলো সুশোভন, সেই সাথে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো।

ছফা যারপরনাই অবাক, কিছুই বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো তার দিকে। “কী হয়েছে? কী বলছো এসব?”

কোনোমতে হাসির দমক থামিয়ে সুশোভন বলতে লাগলো, “তোমার এই ডিপি মল্লিকের কথা শুনে আরেক মল্লিকের কথা মনে পড়ে গেছে আমার।”

মল্লিকের সাথে ‘হোগা’র কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা ছফার মাথায় ঢুকছে না।

“স্কুলে আমাদের এক টিচার ছিলেন, আমরা সবাই তাকে মল্লিকস্যার বলে ডাকতাম…” একটা সেঁকুর তুললো নগরপাল। “মল্লিকস্যার একবার আমাদেরকে খুব মজার একটি গল্প বলেছিলেন,” কথাটা বলেই আবারো হেসে ফেললো সে।

“কী বলেছিলেন?”

হাসি থামিয়ে ছফার দিকে স্থিরচোখে তাকালো সুশোভন। তারপর গ্লাসের তলানিতে যতোটুকু হুইস্কি ছিলো শেষ করে ফেললো এক ঢোঁকে। “ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন…ভালোই পড়াতেন।”

মুচকি হাসলো ছফা। তার মাথায় ঘুরছে ডা. আসকার, মুশকান আর ডিপি মল্লিক, এদিকে আরেক মল্লিকের গল্প বলে যাচ্ছে তার হোস্ট। না শুনেও উপায় নেই।

“প্রায়ই ক্লাসে পড়ার ফাঁকে মজার মজার গল্প করতেন, আমরাও বেশ এনজয় করতাম। ভগবানই জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলতেন নাকি আসলেই সব সত্যি ঘটনা ছিলো,” হুইস্কির বোতলটা হাতে তুলে নিলো সে।

“আর খেয়ো না, দাদা…অনেক তো খেলে,” বারণ করলো ছফা। “কী বলেছিলেন উনি, সেটা বলো?”

কয়েক মুহূর্ত ভেবে বোতলটা রেখে দিলো সুশোভন। “ভদ্রলোক আবার পূর্ববাংলার লোক ছিলেন, আদিবাড়ি ছিলো তোমাদের বরিশালে, ওখান থেকেই স্কুল পাস দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন কলেজে পড়ার জন্য। যাই হোক, হকসাহেবের বাড়ি ছিলো ওঁর গ্রামেই।”

“শেরেবাংলা ফজলুল হক?”

“হ্যা…ওঁ-ই…ফজলুল হক। ঘটনাটা সম্ভবত চল্লিশের দশকে, ভারতবর্ষ তখনও বৃটিশরাজের অধীনে। হকসাহেব তো করতেন মুসলিমলীগ…তার এক বাল্য বন্ধু ছিলো বেশ নামকরা রাজনীতিক, সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টি করতো সে। তো, হকসাহেব সবাইকে অবাক করে দিয়ে কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধলে ওঁর সেই বাল্যবন্ধু ভীষণ ক্ষেপে যায়। ওদের গ্রামের বাড়ি ছিলো আবার খুব কাছাকাছি…খাল-বিল দিয়ে যেতে হতো নৌকোয় করে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।

“হকসাহেব গ্রামের বাড়িতে গেলে সেই বাল্যবন্ধুর বাড়িতে একবার হলেও দেখা করে যেতেন। তো, কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধার পর গ্রামে গেলে এক বিকেলে তিনি নৌকো নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গেলেন। নৌকোটা যখন ঘাঁটে ভিড়ছে তখন সেই বন্ধু ঘাঁটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলো, হকসাহেবকে দেখে রাগেক্ষোভে বলে উঠলো, ‘কিরে ফৈজ্যা, তর লাইগ্যা তো মাইনুষের কাছে আর মুখ দেহাইতে পারতেসিনা।’” সুশোভন বেশ চেষ্টা করলো বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাটা বলার জন্য, তার প্রচেষ্টা মোটামুটি সফলও বলা যায়। “হকসাহেব ছিলেন খুবই আউটম্পোকেন পার্সন, বুঝলে…সেইরকম রসবোধও ছিলো। কথাটা আর মাটিতে পড়তে দিলেন না। নৌকো থেকে নামতে নামতেই জবাব দিলেন, ‘মুখ দেহাইতে পারলে হোগা দেখাগিয়া!’” কথাটা বলার পর ছফা আর কী হাসবে, সুশোভন হাসতে হাসতে সোফার উপর গড়িয়ে পড়লো।

ছফাও হাসি ধরে রাখতে পারলো না।

“ওঁর সেন্স অব হিউমারটা দেখেছে? মুখ না দেখাতে পারলে হোগা দেখা! হা-হা-হা!” হাসতে হাসতে পেট ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো তার। “চিন্তা করো, কী জবাবটাই না দিয়েছিলেন! আই ক্যান ইমাজিন…সেই বন্ধুর চেহারাটা কেমন হয়েছিলো এ কথা শুনে! একেবারে লাজওয়াব!”

গল্পটা সত্যি হোক আর মিথ্যে, হাসি পাবার মতোই। কিন্তু ছফার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। সুশোভনের হাসিটা যেনো ব্যাকগ্রাউন্ড স