- বইয়ের নামঃ অরণ্য যখন ডাকে
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বিশ্বাসঘাতক
অরণ্য যখন ডাকে (উপন্যাস)
মূল কাহিনী : জ্যাক লণ্ডন
ভাষান্তর : ময়ূখ চৌধুরী
০১. বিশ্বাসঘাতক
খৃঃ ১৮৯৭; আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া নামক অঞ্চলে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বিচারক মিলার তাঁর পোষা কুকুর বাক্-এর গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, সুপ্রভাত বাক, কেমন আছ তুমি?
প্রত্যেকদিন সকালবেলা মর্নিং ওয়াক বা প্রাতভ্রমণের আগে বিচারকমশাই ওইভাবেই তার প্রিয় পোষা কুকুরটির সঙ্গে কথা বলতেন। প্রতিদিনের মতো সেইদিনও বাক মাথা দুলিয়ে মনিবের কথায় সায় দিল। সে জানত না সেই দিনটা অন্যান্য দিনের মতো শুরু হলেও শেষ হবে অন্যভাবে সেইদিন থেকেই তার জীবনে পরিবর্তন আনবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়।
এইখানে গল্প থামিয়ে বাক নামে অভিহিত কুকুরটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের গল্পের নায়ক পূর্বোক্ত চতুস্পদ প্রাণীটির বাপ ছিল সেন্ট বার্নাড এবং মা ছিল স্কটল্যান্ডের মেষপালক জাতীয় কুকুর। বাপের কাছ থেকে বাক পেয়েছিল প্রকাণ্ড পেশীবহুল শরীর আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল নেকড়ের মতো নাক ও চোয়াল।
বিচারকমশাই-এর সঙ্গে ঘোড়ার আস্তাবল আর কুকুরদের আস্তানা পরিদর্শন করল বাক। বিপুল বপু বাক-এর দিকে ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছোটো কুকুরগুলো; বিচারক মিলারের দুই ছেলে পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে আহ্বান জানাল তাকে। বাক কিন্তু কাউকেই আমল দিল, গম্ভীরভাবে তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু মিলার সাহেবের সঙ্গে এগিয়ে চলল। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল বিচারক মিলারের বাগান~ হেমন্তের শেষে বাগানের মধ্যে ফুলের শোভা দেখতে এসেছিলেন মিলার সাহেব, সঙ্গে ছিল আদরের কুকুর বাক। বাককে দেখে উদ্যানরক্ষকের সহকারী ম্যানুয়েল নিজের মনে হাসল, সে জানত পরের দিন থেকে ওই বাগানে আর কোনোদিন বেড়াতে আসবে না বাক, সূর্যালোকে উজ্জ্বল বাগানের পথে আর কখনো পড়বে না বাক-এর পায়ের চিহ্ন…
সেই রাত্রে বিচারকমশাই শয্যাগ্রহণ করার পরে ম্যানুয়েল চুপি চুপি এসে বাককে ডাকল। বাক খুব ভালোভাবেই জানত ম্যানুয়েলকে, ওই লোকটিকে সে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অতএব লোকটির কাছে এগিয়ে যেতে সে দ্বিধা করল না। তৎক্ষণাৎ একটা মোটা দড়ির বাঁধন কুকুরটির গলায় পরিয়ে দিল ম্যানুয়েল। এমন কর্কশ দড়ির স্পর্শ আগে কখনো অনুভব করেনি বাক। বিচারক মিলার ও তার নাম লেখা একটি সুন্দর চামড়ার বন্ধনী লাগানো থাকত তার গলায়। অবাক হয়ে সে ম্যানুয়েলের মুখের দিকে চাইল। কিন্তু ম্যানুয়েল তার দিকে তাকাল না, গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে সে বাককে নিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। সেইখানে একটা মোটরগাড়ি অপেক্ষা করছিল গাড়ির চালকের সঙ্গে ম্যানুয়েল কথা কইল না– গাড়ির দরজা খলে বাককে নিয়ে সে চালকের পিছনের আসনে উঠে বসল। বাক গাড়ি চড়তে ভালোবাসত, কাজেই সে আপত্তি করল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় স্টেশনে এসে গাড়িটা থামল। সেইখানে একটি মস্ত লম্বা চওড়া লোক অপেক্ষা করছিল। সে এগিয়ে এসে ম্যানুয়েলকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, তুমি বেশ দেরি করেছ। ট্রেন এখনই এসে পড়বে।
কি করব? ম্যানুয়েল বলল, কর্তা শুতে যাওয়ার আগে তো আসার উপায় ছিল না। যাই হোক, আমি আমার কথা রেখেছি, এখন আমার পাওনা টাকা মিটিয়ে দাও।
লোকটি ম্যানুয়েলের হাতে কিছু টাকা দিল, তারপর বাক-এর গলার দড়িটা হস্তগত করার জন্য হাত বাড়াল। অপরিচিত মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না বাক, সে চাপা গর্জনে প্রতিবাদ জানাল। লোকটি তার তর্জন-গর্জনে কর্ণপাত করল না, সে হাত বাড়িয়ে ম্যানুয়েলের হাত থেকে দড়িটা নিল। আবার গর্জে উঠল বাক, সঙ্গে সঙ্গে নবাগত মানুষটি দড়িতে এমন পাক মারল যে, বাক-এর গলায় দড়িটা চেপে বসে তার শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম করল। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল বাক। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বিপুল বপু মানুষটি কুকুরের গলায় আটকানো চামড়ার বন্ধনী চেপে ধরে তাকে উলটে ফেলে দিল এবং দড়ি ধরে এমন জোরে কয়েকটা পাক মারল যে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল বাক। তারপর কখন সে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসেছে, কখন যে তাকে তুলে নিয়ে গাড়ির ভিতর রাখা হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারেনি। তার অর্ধ-আচ্ছন্ন চেতনায় সে অনুভব করল যে-গাড়িটা তাকে নিয়ে ছুটছিল, সেটা থামল, তারপর সেখান থেকে একটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে খাঁচা সমেত তাকে আর একটা রেলগাড়িতে তুলে দেওয়া হল। দু-দিন দুরাত ধরে চলল ট্রেন, ওই সময়ের মধ্যে কেউ তাকে খাবার তো দূরের কথা, একফোঁটা জলও দিল না..
বাক চিরকাল আদর-যত্নে অভ্যস্ত, বিচারক মিলারের বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। অতএব লম্বা-চওড়া প্রশস্ত মানুষটি যখন বাক-এর গলার দড়ি খুলে দেওয়ার উদ্যোগ করল, তখনই তার হাতে কামড় বসিয়ে দিল বাক। লোকটি তীব্র কণ্ঠে গালি দিয়ে বাক-এর পাঁজরে এক লাথি হাঁকাল। দারুণ যন্ত্রণায় বাক-এর চোখে ঘনিয়ে এল মুছার অন্ধকার… খাঁচাসমেত বাককে মোটরগাড়িতে তুলে পৌঁছে দেওয়া হল একটি প্রশস্ত গৃহের পশ্চাদ্বর্তী ঘরে। বাক মাথা তুলে সবিস্ময়ে দেখল ঘরের মধ্যে বিভিন্ন খাঁচার মধ্যে রয়েছে আরও অনেকগুলো কুকুর! কুকুরগুলো বেশ বড়ো, তবে তাদের মধ্যে বাক ছিল সবচেয়ে বৃহৎ দেহের অধিকারী। ঘরের মাঝখানে কুকুরদের দেখাশুনা করার জন্য যে বলিষ্ঠ মানুষটি বসেছিল, তার নাম মর্গ্যান। লোকটি লম্বা নয়, কিন্তু দৈর্ঘ্যের অভাব সে পুষিয়ে নিয়েছিল পেশিবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তারে এবং কুকুরদের কাছে সবচেয়ে দরকারি কথা হল যে, তার হাতে ছিল একটা মুগুর।