- বইয়ের নামঃ অরণ্য যখন ডাকে
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বিশ্বাসঘাতক
অরণ্য যখন ডাকে (উপন্যাস)
মূল কাহিনী : জ্যাক লণ্ডন
ভাষান্তর : ময়ূখ চৌধুরী
০১. বিশ্বাসঘাতক
খৃঃ ১৮৯৭; আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া নামক অঞ্চলে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বিচারক মিলার তাঁর পোষা কুকুর বাক্-এর গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, সুপ্রভাত বাক, কেমন আছ তুমি?
প্রত্যেকদিন সকালবেলা মর্নিং ওয়াক বা প্রাতভ্রমণের আগে বিচারকমশাই ওইভাবেই তার প্রিয় পোষা কুকুরটির সঙ্গে কথা বলতেন। প্রতিদিনের মতো সেইদিনও বাক মাথা দুলিয়ে মনিবের কথায় সায় দিল। সে জানত না সেই দিনটা অন্যান্য দিনের মতো শুরু হলেও শেষ হবে অন্যভাবে সেইদিন থেকেই তার জীবনে পরিবর্তন আনবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়।
এইখানে গল্প থামিয়ে বাক নামে অভিহিত কুকুরটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের গল্পের নায়ক পূর্বোক্ত চতুস্পদ প্রাণীটির বাপ ছিল সেন্ট বার্নাড এবং মা ছিল স্কটল্যান্ডের মেষপালক জাতীয় কুকুর। বাপের কাছ থেকে বাক পেয়েছিল প্রকাণ্ড পেশীবহুল শরীর আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল নেকড়ের মতো নাক ও চোয়াল।
বিচারকমশাই-এর সঙ্গে ঘোড়ার আস্তাবল আর কুকুরদের আস্তানা পরিদর্শন করল বাক। বিপুল বপু বাক-এর দিকে ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছোটো কুকুরগুলো; বিচারক মিলারের দুই ছেলে পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে আহ্বান জানাল তাকে। বাক কিন্তু কাউকেই আমল দিল, গম্ভীরভাবে তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু মিলার সাহেবের সঙ্গে এগিয়ে চলল। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল বিচারক মিলারের বাগান~ হেমন্তের শেষে বাগানের মধ্যে ফুলের শোভা দেখতে এসেছিলেন মিলার সাহেব, সঙ্গে ছিল আদরের কুকুর বাক। বাককে দেখে উদ্যানরক্ষকের সহকারী ম্যানুয়েল নিজের মনে হাসল, সে জানত পরের দিন থেকে ওই বাগানে আর কোনোদিন বেড়াতে আসবে না বাক, সূর্যালোকে উজ্জ্বল বাগানের পথে আর কখনো পড়বে না বাক-এর পায়ের চিহ্ন…
সেই রাত্রে বিচারকমশাই শয্যাগ্রহণ করার পরে ম্যানুয়েল চুপি চুপি এসে বাককে ডাকল। বাক খুব ভালোভাবেই জানত ম্যানুয়েলকে, ওই লোকটিকে সে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অতএব লোকটির কাছে এগিয়ে যেতে সে দ্বিধা করল না। তৎক্ষণাৎ একটা মোটা দড়ির বাঁধন কুকুরটির গলায় পরিয়ে দিল ম্যানুয়েল। এমন কর্কশ দড়ির স্পর্শ আগে কখনো অনুভব করেনি বাক। বিচারক মিলার ও তার নাম লেখা একটি সুন্দর চামড়ার বন্ধনী লাগানো থাকত তার গলায়। অবাক হয়ে সে ম্যানুয়েলের মুখের দিকে চাইল। কিন্তু ম্যানুয়েল তার দিকে তাকাল না, গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে সে বাককে নিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। সেইখানে একটা মোটরগাড়ি অপেক্ষা করছিল গাড়ির চালকের সঙ্গে ম্যানুয়েল কথা কইল না– গাড়ির দরজা খলে বাককে নিয়ে সে চালকের পিছনের আসনে উঠে বসল। বাক গাড়ি চড়তে ভালোবাসত, কাজেই সে আপত্তি করল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় স্টেশনে এসে গাড়িটা থামল। সেইখানে একটি মস্ত লম্বা চওড়া লোক অপেক্ষা করছিল। সে এগিয়ে এসে ম্যানুয়েলকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, তুমি বেশ দেরি করেছ। ট্রেন এখনই এসে পড়বে।
কি করব? ম্যানুয়েল বলল, কর্তা শুতে যাওয়ার আগে তো আসার উপায় ছিল না। যাই হোক, আমি আমার কথা রেখেছি, এখন আমার পাওনা টাকা মিটিয়ে দাও।
লোকটি ম্যানুয়েলের হাতে কিছু টাকা দিল, তারপর বাক-এর গলার দড়িটা হস্তগত করার জন্য হাত বাড়াল। অপরিচিত মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না বাক, সে চাপা গর্জনে প্রতিবাদ জানাল। লোকটি তার তর্জন-গর্জনে কর্ণপাত করল না, সে হাত বাড়িয়ে ম্যানুয়েলের হাত থেকে দড়িটা নিল। আবার গর্জে উঠল বাক, সঙ্গে সঙ্গে নবাগত মানুষটি দড়িতে এমন পাক মারল যে, বাক-এর গলায় দড়িটা চেপে বসে তার শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম করল। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল বাক। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বিপুল বপু মানুষটি কুকুরের গলায় আটকানো চামড়ার বন্ধনী চেপে ধরে তাকে উলটে ফেলে দিল এবং দড়ি ধরে এমন জোরে কয়েকটা পাক মারল যে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল বাক। তারপর কখন সে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসেছে, কখন যে তাকে তুলে নিয়ে গাড়ির ভিতর রাখা হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারেনি। তার অর্ধ-আচ্ছন্ন চেতনায় সে অনুভব করল যে-গাড়িটা তাকে নিয়ে ছুটছিল, সেটা থামল, তারপর সেখান থেকে একটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে খাঁচা সমেত তাকে আর একটা রেলগাড়িতে তুলে দেওয়া হল। দু-দিন দুরাত ধরে চলল ট্রেন, ওই সময়ের মধ্যে কেউ তাকে খাবার তো দূরের কথা, একফোঁটা জলও দিল না..
বাক চিরকাল আদর-যত্নে অভ্যস্ত, বিচারক মিলারের বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। অতএব লম্বা-চওড়া প্রশস্ত মানুষটি যখন বাক-এর গলার দড়ি খুলে দেওয়ার উদ্যোগ করল, তখনই তার হাতে কামড় বসিয়ে দিল বাক। লোকটি তীব্র কণ্ঠে গালি দিয়ে বাক-এর পাঁজরে এক লাথি হাঁকাল। দারুণ যন্ত্রণায় বাক-এর চোখে ঘনিয়ে এল মুছার অন্ধকার… খাঁচাসমেত বাককে মোটরগাড়িতে তুলে পৌঁছে দেওয়া হল একটি প্রশস্ত গৃহের পশ্চাদ্বর্তী ঘরে। বাক মাথা তুলে সবিস্ময়ে দেখল ঘরের মধ্যে বিভিন্ন খাঁচার মধ্যে রয়েছে আরও অনেকগুলো কুকুর! কুকুরগুলো বেশ বড়ো, তবে তাদের মধ্যে বাক ছিল সবচেয়ে বৃহৎ দেহের অধিকারী। ঘরের মাঝখানে কুকুরদের দেখাশুনা করার জন্য যে বলিষ্ঠ মানুষটি বসেছিল, তার নাম মর্গ্যান। লোকটি লম্বা নয়, কিন্তু দৈর্ঘ্যের অভাব সে পুষিয়ে নিয়েছিল পেশিবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তারে এবং কুকুরদের কাছে সবচেয়ে দরকারি কথা হল যে, তার হাতে ছিল একটা মুগুর।
পরবর্তীকালে ভয়ংকর কঠিন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল বাক; সেই জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিল তাকে মর্গানের হাতের মুগুর। তবে সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।
.
০২. মুগুরের শাসন
যে চারজন লোক বাক-এর খাঁচা বহন করছিল, তারা সশব্দে খাঁচাটাকে নামিয়ে রাখল ঘরের মেঝের উপর। বাহকদের মধ্যে একজন কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, ওহে মর্গ্যান, একটা খ্যাপা জানোয়ারকে আমরা তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম।
মর্গ্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর এসে দাঁড়াল বাক-এর খাঁচার সামনে। সঙ্গেসঙ্গে খাঁচার ভিতর উঠে দাঁড়াল বাক, তীক্ষ্ণদন্ত বিস্তার করে মর্গ্যানকে অভ্যর্থনা জানাল সে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমবার পরস্পরের মুখোমুখি হল। দারুণ আক্রোশে বিদ্যুৎ খেলে গেল বাক-এর শরীরের শিরায় শিরায়, দুর্বল দেহ নিয়েও সে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাঁচার উপর। খাঁচার শক্ত গরাদের উপর ব্যর্থ হল আক্রমণ, খাঁচা ভাঙতে পারল না সে।
মর্গানের ওষ্ঠাধরে ফুটল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, খাঁচার দরজা খুলে দাও।
আরে জন্তুটা খেপে গেছে, একজন প্রতিবাদ করল, ওটাকে একটু ঠান্ডা হতে দেবে তো৷
নিঃশব্দে একটা কুঠার তুলে নিয়ে খাঁচার দরজায় আটকানো তালার উপর সজোরে আঘাত হানল মর্গ্যান, তৎক্ষণাৎ তালা ভেঙে ক্রুদ্ধ কুকুরটার বেরিয়ে আসার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।
এই, সরে যাও সবাই, একজন চিৎকার করে উঠল। যে চারজন বাহক খাঁচাসমেত বাককে বহন করে এনেছিল, তার ঘরের চার কোণে ছিটকে সরে গেল। একজন আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল একটা খাঁচার ছাদের উপর।
তালা-ভাঙা খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে তিরবেগে মর্গ্যানকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল বাক। তার দুই চোয়ালের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি, কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রোধের গর্জনধ্বনি, কিন্তু দম্ভভয়াল দুই চোয়াল নির্দিষ্ট নিশানায় পৌঁছনোর আগেই পিঠের উপর এক প্রচণ্ড আঘাত বাক-এর সর্বাঙ্গ করে দিল অসাড়, আড়ষ্ট- পরক্ষণেই বাক লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর!
ইতিপূর্বে কখনো মুগুরের বাড়ি পড়েনি বাক-এর শরীরে, তাই ব্যাপারটা কি ঘটেছে বুঝতে পারল না সে। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দিকে। এবারও হল আক্রমণ, মর্গানের হাতের মুগুর আঘাত হানল বাক-এর কাঁধের উপর এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও বাক হল ধরাশয্যায় লম্বমান! পর পর দুবার মার খেয়েও বাক পরাজয় স্বীকার করতে চাইল না, সে আবার আক্রমণ করল শত্রুকে অন্যান্য বারের মতো সেবারও তার আক্রমণের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিল মর্গ্যানের মুগুর।
তবু বার বার শত্রুর গলা লক্ষ্য করে আক্রমণ চার্লিয়েছিল বাক, কিন্তু মুগুরটাকে এড়িয়ে একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। অবশেষে আঘাতের পর আঘাতে সে এমন অবসন্ন হয়ে পড়ল যে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও তার রইল না। এবার এগিয়ে এসে চরম আঘাত হানল মর্গ্যান অভ্রান্ত লক্ষ্যে বাক-এর নাকের উপর বসিয়ে দিল মুগুরের এক ঘা! সেই আঘাত সহ্য করতে পারল না বাক, দারুণ যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেল সে…
জ্ঞান ফিরে পেয়ে বাক দেখল তার সামনে বসে আছে মর্গ্যান, বাক-এর গলাবন্ধ আর মুগুরটা ঝুলছে মর্গানের হাতে। বাককে উদ্দেশ করে সে বলল, এখন বুঝতে পারছ তো কে তোমার মনিব?
হ্যাঁ, বাক বুঝেছে, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে সে। মুগুরের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোনো কুকুরই যে জয়লাভ করতে পারে না, এই শিক্ষাই লাভ করল বাক মর্গানের হাতে। পরবর্তী সপ্তাহগুলির মধ্যে সে একবারও মর্গ্যানকে আক্রমণ করতে সচেষ্ট হয়নি, সুবোধ ছেলের মতো খেয়ে ঘুমিয়ে সে আবার সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করল, তার শরীর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল আঘাতের যন্ত্রণা…
.
০৩. কেনা-বেচার বাজারে
বাক যখন আরোগ্যের পথে এগিয়ে চলেছে, সেইসময় নিত্যনতুন কুকুরের আবির্ভাব ঘটতে লাগল তার চোখের সামনে। শুধু যে নতুন-নতুন কুকুর আসছিল তা নয়, পুরোনো কুকুরদের মধ্যেও অনেকেই বিদায় গ্রহণ করছিল কুকুরদের আস্তানা থেকে। অনেক লোক এসে ভিড় করছিল মর্গ্যানের কুকুর-ভর্তি খাঁচাগুলোর সামনে কয়েকটা কুকুরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তারা টাকা দিচ্ছিল মর্গ্যানের হাতে— তারপরই বাহকের দল পূর্ব-নির্দিষ্ট কুকুরদের খাঁচাসমেত নিয়ে যাচ্ছিল ঘরের বাইরে। ওই কুকুরদের আর কখনো ফিরে আসতে দেখেনি বাক। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি তার, তাকে যে কেউ পছন্দ করেনি সেইজন্য সে বেশ খুশি ছিল।
ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল বাক, তার শরীর আগের মতোই পুষ্ট ও বলিষ্ঠ হয়ে উঠল। সেইসময় একটি লোক এল মর্গানের আস্তানায় তার কুকুরদের পরিদর্শন করতে। কার্লি নামে একটি মেয়ে কুকুরকে পছন্দ করল পূর্বোক্ত আগন্তুক, পরক্ষণেই তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল বাক-এর দিকে।
ওহে মর্গ্যান, এটা তো দারুণ কুকুর, বাক-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল আগন্তুক, শক্ত মাংসপেশীগুলো ওকে কঠিন পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেবে, শরীরের ঘন লোম শীত আর তুষার থেকে ওকে রক্ষা করবে– এমন চমৎকার জন্তুটাকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে তুমি?
মর্গানের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, এত জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। যদি কুকুর পছন্দ হয়, তবে টাকা দিয়ে কিনে নাও।
আগন্তুক প্রশ্ন করল, কত টাকা দিতে হবে এই কুকুরটার জন্য?
জবাব এল, তিনশো ডলার। হাজারটা কুকুরের মধ্যে এমন একটি কুকুর তুমি পাবে না।
আগন্তুক বলল, হাজার নয়, দশ হাজার কুকুরের মধ্যেও এমন কুকুর পাওয়া যায় না।
লোকটি মর্গ্যানের হাতে তিনশো ডলার দিল। একটা মস্ত গাড়ির পিছনে বাক আর কার্লির খাঁচা তুলে দেওয়া হল। তাদের নতুন মনিব সামনে উঠে বসল। কুকুর দুটি আর পিছনে ফেলে আসা আস্তানার দিকে চাইল না। তাদের দৃষ্টি এখন সামনের দিকে পিছনে পড়ে রইল অতীত, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
.
০৪. তুষার
যে-লোকটি বাক আর কার্লিকে কিনেছিল তার নাম পেরল্ট। সে কানাডা-সরকারের কর্মী। সে এবং তার অংশীদার ফ্রাঁসোয়া প্রয়োজনীয় সরকারি বার্তা নির্দিষ্ট স্থানে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল এবং ওই কাজ তারা সম্পন্ন করত কুকুরবাহিনী-চার্লিত স্লেজগাড়ির সাহায্যে। তুষারে-ঢাকা জমির উপর কুকুর-টানা স্লেজ ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন তাড়াতাড়ি চলতে পারত না। পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া সিটল থেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে সমুদ্রপথে রওনা হল কুকুরের দল সঙ্গে নিয়ে। তাদের বহন করছিল নারহোয়ল নামে একটি জাহাজ। কার্লির সঙ্গে বাক দাঁড়িয়েছিল পূর্বোক্ত জাহাজের পাটাতনের উপর সে জানত না গরম দেশ থেকে চিরবিদায় নিয়ে তারা চলেছে এক শীতার্ত তুষার-আচ্ছন্ন দেশে…
একদিন বাক আর কার্লিকে দুটি কুকুরের সঙ্গে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে জাহাজের একতলার পাটাতনে নিয়ে গেল পেরল্ট। একটি কুকুরের নাম ডেভ– সে সবসময়েই বিষণ্ণ, তার চোখে-মুখে ঘুমের আবেশ মাখানো থাকে সর্বদা এবং অন্য কুকুরদের সঙ্গে মেলামেশা করতেও সে অনিচ্ছুক। অপর কুকুরটির নাম স্পিটজ; সে কুকুরদের নেতৃত্ব করতে অভ্যস্ত, মানুষ ও কুকুর উভয় পক্ষই তাকে সমীহ করে থাকে। স্পিটজকে দেখে বেচারা কার্লি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।
পেরল্ট কিংবা ফ্রাঁসোয়া ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, কোনো কুকুরকেই বিশেষ অনুগ্রহ করতে তারা ছিল অসম্মত। গোলমাল শুরু হল স্পিটজকে নিয়ে। মনিবরা যখন কুকুরদের নেতা হিসাবে স্পিটজকে বিশেষ সম্মান দিতে রাজি হল না, এমনকী খাদ্যবন্টনের সময়েও তার খাবারের বরাদ্দ রইল অন্যান্য কুকুরদের সমান-সমান তখনই স্পিটজ মনিবদের ভ্রম সংশোধন করে সঙ্গীদের বুঝিয়ে দিতে চাইল যে, সব ব্যাপারেই- বিশেষ করে খাদ্য সম্পর্কে সিংহভাগ তার প্রাপ্য। একদিন যখন কুকুরদের খাবার ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে, সেইসময় অতর্কিতে ছোঁ মেরে বাক-এর খাবার তুলে নিল স্পিটজ। এই ধৃষ্টতার শাস্তি দিতে লাফিয়ে উঠল বাক, কিন্তু সে কিছু করার আগেই পেরন্টের চাবুক বিদ্যুতের মত আছড়ে পড়ল স্পিটজের দেহে! তীব্র আর্তনাদ তুলে মুখের খাবার ফেলে পিছিয়ে গেল স্পিটজ। বাক এগিয়ে এসে মাংসের টুকরোটা তুলে নিয়ে চর্বণ করতে লাগল মনের আনন্দে। পেরন্টের বিচারে খুশি হয়েছিল বাক, কিন্তু স্পিটজের দিকে একনজর তাকিয়েই সে বুঝল স্পিটজ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি- বাক-এর প্রতি নিবদ্ধ তার দুই চোখের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছিল জ্বলন্ত আক্রোশ ও ঘৃণা।
যদিও ব্যাপারটা ছিল বাক আর স্পিটজের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবু কার্লি উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে লাগল তারস্বরে। ডেভ একবার মুখ তুলে তাকাল, তারপর নির্বিকারভাবে তার নিজস্ব খাদ্য চিবিয়ে যেতে লাগল। বাক বুঝল কোনো ঘটনাই ডেভকে বিচলিত করতে পারে না, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ উদাসীন।
একদিন ঝড়ের মুখে পড়ল নারহোয়াল জাহাজ। উত্তাল তরঙ্গের বুকে দোদুল্যমান জাহাজের উপর আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ল বাক আর কার্লি। তাদের দিকে একবার তাকাল ডেভ, তার। দৃষ্টিতে ফুটল বিরক্তির আভাস- পরক্ষণেই নির্বিকারভাবে নিদ্রার আয়োজন করল সে। ডেভ-এর ব্যাবহারে লজ্জা পেয়ে স্থির হয়ে গেল বাক, কিন্তু দারুণ আতঙ্কে চিৎকার করে চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল কার্লি…
অবশেষে একসময়ে নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছে গেল নারহোয়াল জাহাজ। জিনিসপত্র সমেত কুকুরদের নিয়ে জাহাজ ছেড়ে তীরে নামার উদ্যোগ করল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। নীচের পাটাতনে পা দিয়েই চমকে উঠল বাক, তার পা ডুবে গেছে কাদার মতো নরম অথচ সাদা ঝকঝকে একটি বস্তুর মধ্যে! অস্ফুট আওয়াজ করে একলাফে সে পিছিয়ে গেল। পরক্ষণেই সে লক্ষ করল ওই সাদা জিনিসটি শূন্য থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীরও ঢেকে ফেলল ওই অদ্ভুত বস্তু! সে গা ঝাড়া দিয়ে জিনিসটাকে ঝেড়ে ফেলল, কিন্তু বিরামহীনভাবেই ওই আশ্চর্য সাদা বস্তু ঝরে পড়তে লাগল আকাশ থেকে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার আগে কখনো দেখেনি বাক, নিতান্তই কৌতূহলের বশে ওই জিনিসটা সে শুকল, তারপর জিভ দিয়ে চেটে নিল সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক! আগুনের মতোই তার জিভটাকে জ্বালিয়ে দিয়ে ওই বস্তুটি তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল এবং অগ্নিদাহের যন্ত্রণাও মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!
বাক-এর হতভম্ব ভাব দেখে ফ্ৰফ্রাঁসোয়া, পেরল্ট আর পাটাতনের উপর সমবেত নাবিকের দল অট্টহাস্য করে উঠল– উষ্ণ আবহাওয়া থেকে শীতার্ত অঞ্চলে এসেই যে বস্তুটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করল বাক, সেই বস্তুটির নাম তুষার।
০৫. নতুন জীবনের শিক্ষা
০৫. নতুন জীবনের শিক্ষা
জাহাজ থেকে নামিয়ে বাক এবং তার চতুষ্পদ সঙ্গীদের নিয়ে যাওয়া হল খনি শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি তাঁবুতে। ওইখানে বাক ও তার সঙ্গীরা এসে পড়ল এক ভয়ংকর পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে। তাবুর বাসিন্দা ছিল শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ছিল পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মতো ভদ্র ও সহৃদয় অধিকাংশই ছিল বদমেজাজি নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ এবং তাদের হাতে সর্বদাই থাকত চাবুক আর মুগুর। ওই লোকগুলোর সঙ্গে যে কুকুরগুলো ছিল, তাদের স্বভাব-চরিত্র ছিল মনিবদের চেয়েও খারাপ। বাক সবসময়ই প্রস্তুত থাকত অতর্কিত আক্রমণের মোকাবিলার জন্য। হাস্কি নামে অভিহিত ওই ভয়ংকর কুকুররা প্রতিপক্ষকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিত না, নিঃশব্দে দ্রুত আঘাত হানত প্রতিপক্ষের উপর। বাক কোনোদিনই খুব নিরীহ জীব ছিল না, কিন্তু ওই হিংস্র বদমেজাজি জন্তুগুলোর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হতে সে চাইত না। অতএব, যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলত সে।
মাত্র একদিনের জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাক। পরের দিনই ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেল সে। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে…
একদিন ফ্রাঁসোয়া অনেকগুলো চামড়ার ফিতে, বগলস প্রভৃতি সাজসজ্জা নিয়ে এল এবং ওই বস্তুগুলিকে বাক-এর শরীরে জড়িয়ে দিল। পূর্বোক্ত সাজ-সরঞ্জামের সঙ্গে বাক পরিচিত ছিল। তার পূর্বতন মনিব বিচারক মিলারের আস্তাবলে সে দেখেছিল যাত্রা করার আগে ঘোড়াদের ওইসব চামড়ার জিনিস দিয়ে সাজানো হত।
ঘোড়াকে যেভাবে গাড়িতে জুতে দেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবেই একটা স্লেজগাড়ির সঙ্গে লাগাম, বন্ধনী প্রভৃতি জিনিসের সাহায্যে বাককে জুতে দেওয়া হল।
এইখানেই গল্প থামিয়ে স্লেজ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। কারণ, বাংলাভাষী বালক বালিকাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বোক্ত গাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। স্লেজগাড়ি তুষারবৃত উত্তরাঞ্চলের একমাত্র যান– গাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্যান্য গাড়ির মতো স্লেজের তলায় চাকা লাগানো থাকে না, চাকার বদলে থাকে দুটি সমান্তরাল ডাণ্ডা। রানার নামে অভিহিত ওই ডাণ্ডায় ভর দিয়ে কুকুর-টানা স্লেজ দ্রুতবেগে ছুটে যায় মাইলের পর মাইল অক্লেশে। ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকা এবং ঘোড়ার পা হালকা তুষারের উপর বসে যায় বলেই চক্রবিহীন স্লেজগাড়ি কুকুরের সাহায্যে চালানো হয়। কুকুরের দেহের ওজন ঘোড়ার চাইতে অনেক কম– সুতরাং তুষারমাখা কাদায় তাদের পা বসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং স্লেজের কাঠ অথবা ইস্পাত নির্মিত রানার তুষারের উপর দিয়ে পিছলে সবেগে ছুটতে পারে বলেই মানুষ ঘোড়ার বদলে কুকরবাহিত স্লেজ ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকার তুষারবৃত অঞ্চলে। যে কুকুরগুলো স্লেজগাড়ি টানে, তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষিত কুকুর সহজেই চালকের ইঙ্গিত বুঝে বাঁদিকে বা ডানদিকে ঘুরে যায়, থামে, টানতে শুরু করে, সবচেয়ে বড়ো কথা, জমি যেখানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ হালকা তুষারের তলায় যেখানে লুকিয়ে আছে। মৃত্যুফঁদের মতো অতল গহ্বর বা গভীর জলাশয় সেই মরণফাঁদের অস্তিত্ব চালকের চোখে ধরা পড়লেও শিক্ষিত কুকুর সেটা বুঝতে পারে এবং চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দেয় চালকের ইঙ্গিত ছাড়াই!
বাক-এর শিক্ষা শুরু হল ফ্রাঁসোয়ার হাতে। বুদ্ধিমান বাক খুব অল্পদিনের মধ্যেই স্লেজবাহী কুকুরের যাবতীয় নিয়মকানুন আয়ত্ত করে ফেলল। চতুষ্পদ স্লেজবাহকের শুধু গাড়ি টানার কৌশল শিখলে চলে না, যে ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে তাকে দিনযাপন করতে হয়, সেই অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন না থাকলে জীবনসংশয় অবশ্যম্ভাবী।
বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতোই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার নিষ্ঠুর পরিণাম বাককে তার পারিপার্শ্বিক ভয়াল অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। সেই কথাই বলছি..
বাক-এর সঙ্গিনী কার্লি নামে মেয়ে কুকুরটির কথা আগেই বলেছি। কার্লির শরীরটা প্রকাণ্ড হলেও স্বভাব ছিল খুব ভালো, অপরিচিত কুকুরদের সঙ্গে ঝগড়া করার চাইতে বন্ধুত্ব করার পক্ষপাতী ছিল সে। একদিন রাত্রে খাওয়ার পর কালি একটি স্লেজবাহী হাস্কি কুকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে গেল। হাস্কির দেহ ছিল কার্লির প্রায় অর্ধেক কিন্তু ওই ছোটোখাটো জন্তুটার স্বভাব যে কতটা হিংস্র ও ভয়ংকর হতে পারে, মুহূর্তের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। কার্লিকে সতর্ক হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই হাস্কি লাফ দিল– দস্তাঘাতের একটা ধাতব শব্দ, বিদ্যুচ্চমকের মতো পরক্ষণেই আর এক লাফে হাস্কির প্রত্যাবর্তন- কার্লির চোখ থেকে চোয়াল পর্যন্ত বিদীর্ণ হয়ে জেগে উঠল এক সুগভীর রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন!
বুনো নেকড়ে ওইভাবে লড়াই করে, কামড় বসিয়ে সরে যায়, শত্রুর দেহে কামড় বসিয়ে ধরে রাখে না- শত্রুকে বারংবার দংশনে রক্তাক্ত করে দেয় এবং পরিশেষে রক্তপাতে অবসন্ন শত্রুর শরীরে প্রাণঘাতী চরম আঘাত হানে। হাস্কি কুকুরেরা বুনো নেকড়ের মতোই ভয়ংকর, তাদের লড়াই-এর কৌশলও নেকড়ের মতো গৃহপালিত কুকুরের সঙ্গে স্বভাব-চরিত্রে তাদের কোনো মিল নেই।
নিতান্ত অকারণে সঙ্গিনীর উপর হাস্কি কুকুরের নির্দয় আক্রমণ বাককে আতঙ্কে বিহ্বল করে দিল, কিন্তু সশব্দে হেসে উঠল স্পিটজ।
এতক্ষণে যে হাস্কি কুকুরের দল চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছিল, তারা হঠাৎ ছুটে এসে কার্লি ও ক্ষুদ্রকায় হাস্কি কুকুরটিকে ঘিরে বসল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল সাগ্রহে।
বিনাদোষে মার খেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কার্লি, সে সক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাস্কির উপর। কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় হাস্কি তার বিপুল বপু প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল একলাফে সরে গিয়ে–পরক্ষণেই আর এক লাফে কার্লির উপর পড়ে তীব্র দংশনে তাকে রক্তাক্ত করে দিয়ে সরে এল নাগালের বাইরে কার্লি একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। হাস্কি কুকুরটার পরবর্তী আক্রমণে ভারসাম্য হারিয়ে মাটির উপর ছিটকে পড়ল কার্লি, সঙ্গেসঙ্গে চতুর্দিকে অপেক্ষমাণ হাস্কি কুকুরের দল সমবেত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধরাশায়ী কার্লির উপর। অনেকগুলো দাঁতের নিষ্ঠুর আঘাতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল কার্লি…।
বাক বুঝল একদল হিংস্র বন্যপশুর সঙ্গে সে বাস করছে– গৃহপালিত হলেও স্বভাবে তারা বনবাসী শ্বাপদের মতোই রক্তলোলুপ, ভয়ংকর স্বজাতির মাংসে তাদের রুচি নেই কিছুমাত্র। দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ কোনো কুকুর মাটিতে ছিটকে পড়লে তার রক্ষা নেই ধরাশায়ী কুকুর ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ানোর আগেই তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সারমেয়-বাহিনীর সমবেত আক্রমণে। বাক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলেও সে কিছুতেই ভারসাম্য হারিয়ে ধরাশায়ী হবে না, কার্লির মতো অসহায়ভাবে সে মৃত্যুবরণ করবে না কখনোই। কার্লির শোচনীয় পরিণামে উল্লসিত স্পিটজের নিষ্ঠুর হাসির শব্দ তার মনের ভিতর ধ্বনিত হতে লাগল বারবার, পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই স্পিটজ সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগল বাক।
.
০৬. শীতার্তের আশ্রয়
তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি চিঠিপত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব নিয়েছিল পেরল্ট। কার্লির মৃত্যুর ফলে কুকুরবাহী স্লেজগাড়ির গতি হল মন্থর, সুতরাং চিঠিপত্র যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছনোর পরিবর্তে বিলম্বের সম্ভাবনা দেখা দিল। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পেরল্ট ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেইজন্য অর্থব্যয় করতেও সে অসম্মত ছিল না- মধ্যাহ্নভোজনের পরেই দুটি নতুন কুকুর কিনে নিয়ে সে ফিরে এল তাঁবুতে।
ফ্রাঁসোয়া নবাগতদের পরীক্ষা করতে লাগল। কুকুর দুটি সহোদর ভাই হলেও তাদের স্বভাবে একটুও মিল ছিল না। বিলি ছিল মৃত কার্লির মতোই শান্ত নিরীহ, সর্বদাই সে অন্য কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী কিন্তু তার ভাই জো ছিল অত্যন্ত বদমেজাজি– তার ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে ধারাল দাঁতের সারি সবসময়ই কিছুটা বেরিয়ে থেকে প্রমাণ করত দাঁতের অধিকারী ওই অস্ত্রের ব্যবহার করতে বিলক্ষণ প্রস্তুত এবং অবরুদ্ধ ক্রোধের আগুনে তার দুই চক্ষু ছিল সর্বদাই জ্বলন্ত!
স্পিটজ তার স্বভাব অনুযায়ী নবাগতদের শিক্ষা দিতে এগিয়ে এল। বিলি বিনাযুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করল, তা সত্ত্বেও স্পিটজের নিষ্ঠুর দংশন বিলির দেহের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করল।
কিন্তু জো ভাই-এর মতো নিরীহ জীব নয়– হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে দুই চোখে ঘৃণা ও আক্রোশের আগুন জ্বালিয়ে সে এমন ভীষণভাবে রুখে দাঁড়াল যে, স্পিটজ বুঝল এই শত্রু কিছুতেই হার মানবে না– জীবন বিপন্ন করেও সে লড়াই করতে প্রস্তুত। এমন গোঁয়ার শত্রুর সঙ্গে মারামারি করতে চাইল না স্পিটজ, সে চটপট সরে পড়ল এবং মান বাঁচাতে এমন ভাব করল যেন সে জো নামে কুকুরটির সঙ্গে কখনোই লড়াই করতে চায়নি। গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিতে সে আবার হামলা চালাল নিরীহ বেচারা বিলির উপর।
সেইদিনই নৈশভোজের আগে একটি লোক আরও একটি কুকুরকে তাবুতে নিয়ে এল। কুকুরটি লম্বা ও ছিপছিপে, তার ক্ষতবিক্ষত মুখ বহু রক্তাক্ত যুদ্ধের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তার একটি চোখ অন্ধ (সম্ভবত কোনো যুদ্ধের পরিণাম)।
লোকটি পূর্বোক্ত কুকুরটিকে পেরন্টের কাছে বিক্রি করে দিল। ওর নাম সোল-লেকস, লোকটি বলল, কথাটার অর্থ হচ্ছে ক্রুদ্ধ পশু, বুঝলে?
কুকুরদের কাছে সোল-লেকস নামটির অর্থ ব্যাখ্যা করার দরকার হল না। এমন সার্থকনামা জীব বড়ো একটা দেখা যায় না। সে নির্বিকারভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দলের মাঝখানে। স্পিটজ নবাগতকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু একনজর তাকিয়েই সে বুঝতে পারল এই জটাও খুব সুবিধার নয়, এর সঙ্গে লাগতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে- স্পিটজ আবার বসে পড়ল।
ডেভ নামে কুকুরটির মতোই সোল-লে ছিল শান্তিপ্রিয়, তবে কারও সঙ্গে বন্ধুত্বস্থাপনে সে ইচ্ছুক ছিল না– তাকে চুপচাপ থাকতে দিলেই সে খুশি। কিন্তু একটি বিষয়ে সে ছিল অতিশয় স্পর্শকাতর– তার যে চোখটা কানা, সেইদিক থেকে কোনো কুকুর তার নিকটবর্তী হলেই সে হিংস্র প্রতিবাদে চঞ্চল হয়ে উঠত।
নবাগত কুকুরটির চরিত্রগত দুর্বলতার বিষয় প্রথমেই সচেতন হল বাক এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। প্রথম রাতেই বাক আগন্তুকের খুব কাছে এসে পড়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় সোল-লেকস-এর যে-চোখটা কানা, সেইদিকেই অবস্থান করছিল বাক। বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্ত আক্রমণে বাক-এর কাঁধের মাংস হাড় পর্যন্ত কেটে নামিয়ে দিল সোল-লেকস। পেরল্ট তাড়াতাড়ি বাধা না দিলে তখনই একটা রক্তাক্ত বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। ওই ঘটনায় দলের অন্য কুকুরগুলো সতর্ক হয়ে গেল। বেচারা বাক তার অজ্ঞতার প্রায়শ্চিত্ত করল রক্ত দিয়ে।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কাঁধের ক্ষত এবং ক্রমবর্ধমান শীত বাককে দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। একটা তাঁবুর ভিতর জ্বলন্ত মোমবাতির আভাস পেয়ে এগিয়ে গেল বাক। তাঁবুর পর্দা ঠেলে ভিতরে গিয়ে সে দেখল সেখানে বসে আছে পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। কিন্তু তাবুর আরামদায়ক উত্তাপ ভোগ করতে পারল না বাক- পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়া হই হই শব্দে তাকে তাড়া করল, রান্নার যাবতীয় সামগ্রী অর্থাৎ হাঁড়িকড়াই-হাতা প্রভৃতি তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারতে লাগল তার দিকে। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আবার বাক পালিয়ে এল তুষারাবৃত শীতার্ত প্রান্তরের বুকে। একটু উষ্ণ আশ্রয়ের সন্ধানে বাক যখন ইতস্তত পদচালনা করছে, সেইসময় তাকে আক্রমণ করতে এল একদল হিংস্র কুকুর। বাক দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিতেই তারা চটপট সরে পড়ল। ততক্ষণে তুষারপাত শুরু হয়েছে প্রবলবেগে, কাঁধের ক্ষতস্থানে আবার যন্ত্রণাবোধ করছিল ক্লান্ত ও অবসন্ন বাক…
হঠাৎ বাক-এর মস্তিষ্কে একটা নতুন চিন্তা চমকে উঠল বিদ্যুৎ চমকের মতো তার সঙ্গীদের বিশ্রামের জায়গা খুঁজে বার করতে পারলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নতুন উদ্যমে শুরু হল অনসন্ধান পর্ব, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি আর অনেক ঘোরাঘুরি করেও বাক তার সঙ্গীদের সন্ধান পেল না তারা যেন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে তুষার-ঢাকা প্রান্তরের উপর থেকে!.. হতাশভাবে চলতে চলতে বাক যখন আবার মালিকদের তাবুর কাছে এসে পড়েছে, সেইসময়ে আচম্বিতে তার সামনের পা ঢুকে গেল বরফের মধ্যে এবং তার পায়ের তলা থেকে পিছলে সরে গেল কোনো একটি বস্তু! সভয়ে ছিটকে সরে এল বাক, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট ক্রুদ্ধ গর্জন কিন্তু একটা বন্ধুত্বসূচক শব্দে আশ্বস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বাক দেখল বরফের মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে শুয়ে আছে বিলি নামে নিরীহ কুকুরটি।
এবার আর কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করল না বাকবরফের মধ্যে চটপট একটা গর্ত খুঁড়ে সে শুয়ে পড়ল তার শরীরের তাপে গর্তটা ক্রমশ গরম হয়ে উঠল আর সেই উষ্ণ আশ্রয়ের মধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল বাক ধীরে ধীরে…
.
০৭. পথে বিপথে
সারা রাত ধরে তুষারপাত চলল। পরের দিন সকালে মানুষ ও কুকুরের মিলিত শব্দে বাক-এর যখন ঘুম ভাঙল, তখন তুষারের স্তূপ তার শরীর ঢেকে ফেলেছে। গত রাত্রির কথা প্রথমে তার মনে পড়েনি, ঘুম ভাঙার পর যখন সে বুঝল জমাট তুষারস্তূপের তলায় সে শুয়ে আছে, তখনই তার মনে হল একটা বিপজ্জনক ফঁদের মধ্যে পড়ে গেছে সে। বাক গৃহপালিত কুকুর, খাঁচার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও ফাঁদ নামক বস্তুটি তার অজানা কিন্তু বনবাসী পূর্বপুরুষের বন্য সংস্কার তাকে ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন করে দিল- দারুণ আতঙ্কে এক লাফ মেরে স্তূপাকার তুষারের আবরণ ভেদ করে সূর্যের উজ্জ্বল আলোকধারার মধ্যে সে আত্মপ্রকাশ করল।
বাক-এর অভাবিত আবির্ভাবে উল্লসিত পেরল্ট ফ্রাঁসোয়াকে উদ্দেশ করে বলল, কুকুরটা খুব বুদ্ধিমান। দেখ, এক রাতের মধ্যেই সে সব কিছু শিখে ফেলেছে!
ইতিমধ্যে আরও তিনটি হাস্কি কুকুর কিনে ফেলেছে পেরল্ট। কুকুরের সংখ্যা এখন নয়। ওই নয়টি কুকুরকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে একদিন অজানা পথে যাত্রা করল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। বাক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সোল-লেকস আর ডেভ নামে কুকুর দুটি চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে যে-দুটি কুকুর নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, তারা এখন সমবেতভাবে কর্তব্য করতে উৎসুক উৎসাহে, আবেগে তার যেন ছটফট করছে! যাত্রা শুরু হওয়ার পরে দেখা গেল ওই কুকুর দুটির স্লেজবাহক হিসাবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। বরফ-ঢাকা বিপজ্জনক পথে কেমন করে চলতে হয় তারা জানে। দলের অন্যান্য কুকুর ভুল করলে তারা ভীষণ বিরক্ত হত।
বাক প্রথম-প্রথম ভুল করত। সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে ছুটতে পারত না। অনেক সময়ে লাগামে পা জড়িয়ে সে বিভ্রাটের সৃষ্টি করত। গাড়িতে জুতে দেওয়ার সময় হলে সে চটপট হাজির হতে পারত না। ওই ধরনের বিপত্তি ঘটলেই সোল-লেকস অথবা ডেভ বাককে আক্রমণ করত, ধারাল দাঁতের কামড় বসত বাক-এর শরীরে। কিন্তু অকারণে তারা কখনো বাক-এর উপর হামলা করত না। বাক বুঝল কুকুর দুটি তার শত্রু নয়, শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। বাক বুদ্ধিমান জীব, খুব অল্পদিনের মধ্যেই সে পথ চলার কৌশল আয়ত্ত করে ফেলল। অন্য কুকুরদের মতোই মহা-উৎসাহে সে স্লেজ টানতে শুরু করল। সাধারণত ধাবমান স্লেজের সামনের পথের দিশারি হয়ে বরফ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যেত পেরল্ট তার বিশেষভাবে তৈরি জুতো দিয়ে অনুসরণকারী স্লেজবাহক কুকুরদের সে সাহায্য করত যথাসাধ্য। বরফ-ঢাকা পথের অভিজ্ঞ পথিক পেরল্ট একবার তাকিয়েই বুঝতে পারত তুষারের আবরণ কতটা পুরু এবং ওই আবরণ বা আস্তরণের উপর স্লেজগাড়ির নিরাপত্তা বা নিরাপত্তার অভাবও সে অনুমান করতে পারত নির্ভুলভাবে..
পেরল্ট নামে দ্বিপদ মালিক আর ডেভ ও সোল-লেকস নামে চতুষ্পদ সহকর্মী দুটির নেতৃত্বে খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাক একজন অভিজ্ঞ ব্লেজবাহক হয়ে উঠল.. জমাট এবং গভীর বরফপ, বরফ ঢাকা মসৃণ পিচ্ছিল পথ বেয়ে দিনের পর দিন ছুটতে লাগল স্লেজবাহক কুকুরের দল… অবশেষে দেখা গেল একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পার হয়ে এসেছে তারা! পেরল্ট ঘোষণা করল, এতদিন ধরে সে যতগুলো দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্যে বর্তমান কুকুর বাহিনী হচ্ছে সবচেয়ে দক্ষ, সকলের সেরা। বাক এখন খুব খুশি, সোল-লেকস আর ডেভ তার বন্ধু, মালিক পের তার আচরণে সন্তুষ্ট– শৃঙ্খলা মেনে দলের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শিখেছে বাক। পেরন্টের প্রশংসা আর একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পেরিয়ে আসার কথা ভাবতে ভাবতে সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ল বাক।
.
০৮. আদিম সংগীত
বাক ক্ষুধার্ত। সর্বদাই সে ক্ষুধার্ত থাকে। তীব্র শীতার্ত আবহাওয়ায় মাইলের পর মাইল স্লেজ টেনে ছুটে চলার পরিশ্রম তার উদরে যে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পরিমিত মাপা খাদ্য সেই আগুন নিবিয়ে দিতে পারে না। দলের অন্য কুকুরদের চাইতে তাকে বেশি খাবার দেওয়া হত। মালিক দু-জন বুঝেছিল অন্য কুকুরদের চাইতে বাক-এর শরীর অনেক বড়, তাই তুলনামূলকভাবে তাকে বেশি খাবার না দিলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সকলের জন্য বরাদ্দ ছিল এক পাউন্ড শুকনো স্যালমন মাছ, বাক-এর জন্য বরাদ্দ দেড় পাউন্ড। তবু তার পেট ভরত না। অন্য কুকুরদের দেহের আকার ছোটো, তার উপর তারা কঠিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত, তাই কম খেয়েও তাদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে অনভ্যস্ত বাক-এর প্রকাণ্ড শরীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব অনুভব করত প্রতি মুহূর্তে। এমনকী বরাদ্দ খাবারও তার ভাগ্যে অনেক সময় জুটত না, অন্য কুকুরেরা সুযোগ পেলেই তার খাবার খেয়ে ফেলত। বাক একসময়ে শৌখিন খাদ্যরসিক ছিল হাউমাউ করে সে খাবার গিলত না–রসিয়ে রসিয়ে সময় নিয়ে সে আহার্য গ্রহণ করত বনেদি বংশের সন্তানের মতো। কিন্তু এখনকার হ্যাংলা কুকুরগুলো ঝটপট নিজেদের খাদ্য গলাধঃকরণ করেই বাক-এর খাবারে ভাগ বসাত। বাক কিছুতেই তাদের বাধা দিতে পারত না। সে যখন দু-দুটো কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন তৃতীয় কুকুরটি বাক-এর বরাদ্দ মাছটি নিয়ে সরে পড়েছে নিরাপদ দূরত্বে! এমন হাভাতে হ্যাংলা অসভ্য সঙ্গীদের কবল থেকে লড়াই করে খাবার বাঁচানো যায় না এদের ঠেকানোর একটাই উপায় এবং মাথা খাঁটিয়ে সেই উপায়টাই একসময়ে বার করে ফেলল বাক। সে খুব তাড়াতাড়ি খেতে শিখল- অন্য কুকুররা তাদের খাবার শেষ করে বাক-এর উপর হানা দিতে এসে দেখত বাক তার খাদ্য অনেক আগেই শেষ করে বসে আছে।
একটা প্রবাদ আছে, প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ আবিষ্কার করে। কথাটা শুধু মানুষ সম্পর্কে নয়, কুকুর সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বাক চুরি করতে শিখল। এমন সাবধানে সে চুরি করত যে, মনিবরা বুঝতেই পারত না কে চুরি করেছে। মাইক নামে কুকুরটি এবিষয়ে তার পথ-প্রদর্শক। একদিন পেরল্ট যখন রান্না করছে, সেইসময় তার পিছনে এসে নিঃশব্দে এক টুকরো মাংস নিয়ে সরে পড়ল মাইক। দৃশ্যটা বাক-এর চোখে পড়েছিল। বিচারক মিলারের পোষ্য বাক এতদিন চুরির কথা কল্পনাই করতে পারেনি, চুরি তো মহাপাপ! কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাইকের চৌর্যবৃত্তি তাকে উৎসাহিত করল এবং পরের দিনই পেরন্টের অজ্ঞাতসারে তার থালা থেকে একটা মস্ত বড়ো মাংসের চাই সরিয়ে ফেলল বাক। পেরল্ট মাইকের চুরি ধরতে পারেনি, কারণ অপহৃত মাংসের টুকরোটা ছিল খুব ছোটো কিন্তু বিরাট একখণ্ড মাংস উধাও হয়ে যেতেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল পেরল্ট। বাক-এর মতো সভ্যভব্য ভদ্র কুকুরকে চোর বলে ভাবতে পারল না সে, ডাব নামে একটি কুকুরকে সন্দেহ করে তার উপর সে চাবুক চালাল। বাক বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করল না, নিজের কৃতিত্বে দস্তুরমতো খুশি হল সে।
ক্রমশ কঠিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বাক। লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠল তার দেহের মাংসপেশী। সাধারণ ব্যথা-বেদনা সে আর অনুভব করত না। তৃষ্ণার্ত হলে কেমন করে কঠিন বরফের নিরেট আবরণ ভেদ করে তলদেশে অবস্থিত শীতল জলে তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়, নখের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে থাকা বরফের টুকরো কেমন করে বার করতে হয়- সব কৌশল সে রপ্ত করে ফেলল। এখন যে-কোনো খাদ্য তা যত অখাদ্যই হোক– সে নির্বিকারভাবে উদরস্থ করতে পারে। তার সবল পরিপাকযন্ত্র নিতান্ত অখাদ্য থেকেও খাদ্যরস সংগ্রহ করে শরীরকে বলিষ্ঠ করে তুলতে সমর্থ। ওই সঙ্গে জন্মগত ঘ্রাণশক্তি হয়েছে আরও তীব্র, শ্রবণ-ইন্দ্রিয় হয়ে উঠেছে এমন তীক্ষ্ণ যে, ঘুমের মধ্যেও সাম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত বুঝতে তার অসুবিধা হয় না।
শুধু অভিজ্ঞতা থেকেই সে শিক্ষালাভ করেনি, পূর্বপুরুষের আদিম সংস্কার তার রক্তে জেগে উঠছিল ধীরে ধীরে। গৃহপালিত কুকুরের শিক্ষা-দীক্ষা একসময়ে মুছে গেল তার চরিত্র থেকে, জাগ্রত হল পূর্বপুরুষের হিংস্র সত্তা, যুগযুগান্তরের বিস্মৃতির আবরণ ভেদ করে- যেমনভাবে একসময়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে বুনো নেকড়ের দল, ঠিক সেইভাবেই লড়তে শিখল বাক। নেকড়ের মতোই চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠত সে, অন্ধকার অরণ্যের বুকে বিষাদের শিহরন তুলে বাজাত সেই আদিম জান্তব সংগীত।
.
০৯. মৃত্যুর হানা
দলের নেতা স্পিটজ আর বাক-এর বিরোধ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। বাক তার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল, অনর্থক কলহে লিপ্ত হতে চাইত না সে। কিন্তু স্পিটজ ভুল বুঝল, সে ভাবল বাক ভয় পাচ্ছে। স্পিটজ আরও একটা ভুল করল- সে ধরে নিল শুধু বিশাল দেহের অধিকারী বলেই বাককে দলের কুকুরা সমীহ করে, আসলে বাক দুর্বল ও ভীরু লড়াই করতে সে ভয় পায়। লে বার্জ নামক হ্রদের ধারে যে রাতে স্লেজচালকদের তাবু পড়ল, সেই রাতেই বাক-এর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হল স্পিটজ।
কনকনে ঠান্ডা বাতসের ভিতর দিয়ে বরফ ভেঙে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাতাস যেন ধারাল ছুরির মতো ছোবল মারছিল তাদের শরীরে বাধ্য হয়ে অন্ধকার নেমে আসার অনেক আগেই দুই স্লেজচালক সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল। একটা উঁচু পাথরের তলায় বরফ খুঁড়ে রাতের আস্তানা বানাল বাক। বরফের তলায় ওই সদ্যনির্মিত বাসা এত আরামদায়ক যে, সেই আশ্রয় ছেড়ে বাইরে আসতে সে আদৌ ইচ্ছুক ছিল না। ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের ডেকে তাদের বরাদ্দ মাছ বিতরণ করতে শুরু করল, তখন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেবলমাত্র খাওয়ার জন্যই অমন চমৎকার আশ্ৰয়টা ছেড়ে খাদ্যগ্রহণের জন্য এগিয়ে গেল বাক।
চটপট আহার শেষ করেই বাক ফিরে গেল তার আস্তানার দিকে, কিন্তু গর্তের ভিতর সে ঢুকতে পারল না কারণ সেখানে বেশ আরাম করে শুয়েছিল স্পিটজ। বাক যখন খাদ্যগ্রহণে ব্যস্ত, সেইসময়ে তার তৈরি করা গর্তটাকে স্পিটজ অধিকার করেছে। সব কিছুরই শেষ আছে, স্বভাবে শান্ত হলেও বাক-এর ধৈর্য অসীম নয়- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুজনে জড়াজড়ি করে ছিটকে বেরিয়ে এল গর্তের বাইরে, পরক্ষণেই দন্তবিস্তার করে দুই শত্রু পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।
কুকুরদের চরিত্র সম্পর্কে দস্তুরমতো অভিজ্ঞ ছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাক এবং স্পিটজের চালচনল দেখে অনেক আগেই তাদের মনিব দু-জন বুঝতে পেরেছিল একটা ভয়ংকর লড়াই আসন্ন– এই কলহের একমাত্র ও অনিবার্য সমাধান হচ্ছে মৃত্যু!
বাক, হতভাগা স্পিটজকে ভালো রকম শিক্ষা দাও, চিৎকার করে উঠল পেরল্ট, ও একটা ছিঁচকে চোর।
কিন্তু দুই শত্রুর মৃত্যুপণ লড়াই শুরু হওয়ার আগেই বাধা এল-হঠাৎ তীব্রকণ্ঠে একটা কটু শপথ করে হাতের মুগুর সবেগে চালনা করল পেরল্ট– একটা বুনো কুকুর খাবারের বাক্সটার দিকে চুপি চুপি এগিয়ে আসছিল, পেরন্টের মুগুর সজোরে ও সশব্দে নেমে এল তার অস্থিসার দেহের উপর।
পরক্ষণেই খাবারের বাক্সটাকে আক্রমণ করল এক বিরাট সারমেয়-বাহিনী। চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশটা বুনো কুকুর ছিল ওই দলে। তাদের সমবেত আক্রমণে বাক্সটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খাবারগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্টের মুগুরের আঘাত অগ্রাহ্য করে ক্ষুধার্ত জন্তুগুলো খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ডিম, রুটি, মাংস প্রভৃতি খাদ্যসামগ্রী অন্তর্ধান করল বুভুক্ষু কুকুরদের উদরে!
স্লেজবাহক কুকুরের দল সাগ্রহে দেখছিল বাক আর স্পিটজের দ্বন্দ্বযুদ্ধ; বুনো কুকুরদের হঠাৎ আবির্ভাব তাদের চমকে দিয়েছিল। প্রথমে তারা অবাক হয়ে আগন্তুকদের গতিবিধি লক্ষ করছিল। কিন্তু বুনো কুকুরদের দলটা যখন খাবার শেষ করেই পোষা কুকুরদের উপর হিংস্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন পোষা কুকুরগুলো বুঝল নিশ্চেষ্ট দর্শকের ভূমিকায় থাকলে মৃত্যু অবধারিত– প্রথম বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই তারা রুখে দাঁড়াল সমবেতভাবে। স্লেজবাহক কুকুররা ছিল বুনোদের চাইতে অনেক বড়ো এবং ওজনে ভারি– তার উপর নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের ফলে তাদের দেহ হয়েছিল পেশীপুষ্ট, বলিষ্ঠ তাই এক-একটি স্লেজবাহক কুকুর দুদুটো অনশনক্লিষ্ট বুনো কুকুরকে অনায়াসেই মাটির উপর ঝেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু বুনোদের সংখ্যা ছিল স্লেজবাহক কুকুরদের চাইতে অনেক বেশি, সুতরাং বুনোদের চাইতে শারীরিক ক্ষমতায় অধিকতর বলিষ্ঠ হলেও সংখ্যাগুরু শত্রুর আক্রমণে তাদের জীবন হয়ে উঠল বিপন্ন।
একসঙ্গে তিন-তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাক দেখল আরও একটি কুকুর তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। নবাগত শত্ৰু বাক-এর অপরিচিত নয়, সবিস্ময়ে সে দেখল বুনো কুকুরদের দলে যোগ দিয়ে স্পিটজ তার গলায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে! দারুণ আক্রোশে সংহারমূর্তি ধারণ করল বাক- এমন ভয়ংকর, এমন তীব্র সেই আক্রমণ যে, মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল চার-চারটি শত্রু!
ইতিমধ্যে লড়াই করতে করতে পিছু হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করছিল স্লেজবাহক কুকুরের দল। বুনোরা তাদের অনুসরণ না করে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেল খাদ্যের সন্ধানে। পোষা কুকুররা সকলেই কম-বেশি আহত হয়েছিল। ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির আঘাত ছিল মারাত্মক ধারাল দাঁতের কামড়ে তার গলায় ফুটে উঠেছিল বীভৎস ক্ষতচিহ্ন।
সারা রাত ধরেই পোষা কুকুরের দল তাদের রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর পরিচর্যা করল, তারপর ভোরের আলো পৃথিবীতে উঁকি মারার সঙ্গেসঙ্গে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এল পরিত্যক্ত অঁবুতে।
বুনো কুকুররা তখন সরে পড়েছে। পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মনের অবস্থা ভালো নয়। খাবার-দাবার যা ছিল তার অর্ধেক গেছে বুনোদের পেটে, বাকি অর্ধেক অতিকষ্টে বাঁচিয়েছে দুই বন্ধু। অনশনক্লিষ্ট ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরের দল যা পেয়েছে তা-ই খেয়েছে লাগাম, জুতো কিছুই তারা বাদ দেয়নি।
ছিন্নভিন্ন লাগামগুলো মেরামত করে দুই বন্ধু যখন কুকুরগুলোকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে আবার যাত্রা করার আদেশ দিল, তখনও আহত কুকুরদের শরীরে দস্তুরমতো যন্ত্রণা ছিল। কিন্তু কেউ বিদ্রোহ করল না, স্লেজটাকে টানতে টানতে তারা চলতে শুরু করল। কুকুররা কেউ তখন অসমাপ্ত লড়াইটার কথা ভাবছিল না, এমনকী দ্বন্দ্বযুদ্ধের দুই নায়ক স্পিটজ আর বাক-এর মনেও লড়াই-এর চিন্তা উঁকি দেয়নি মুহূর্তের জন্য।
১০. পাদুকাবিলাসী বাক
বুনো কুকুরদের আক্রমণ যেখানে ঘটেছিল, সেখান থেকে স্লেজচালক দুটির নির্দিষ্ট গন্তব্য ডসন নামক স্থানটির দুরত্ব ছিল চারশো মাইল। পথের মধ্যে পড়ল একটা প্রকাণ্ড নদী। নদীর জলস্রোত ছিল অতিশয় প্রখর। নিদারুণ শীত ওই নদীর কয়েক জায়গায় নিরেট বরফের মসৃণ চাদর বিছিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই শীতের আক্রমণ অগ্রাহ্য করে জলস্রোত ছিল অব্যাহত। নদীর যেসব জায়গায় বরফের আবরণে নিরেট জমি তৈরি হয়েছিল, সেইসব জায়গার উপর দিয়ে প্রাণ বিপন্ন করে কুকুরবাহিত স্লেজ চার্লিয়ে নদী পার হল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট। নদীটা পার হতে তাদের সময় লেগেছিল ছয়দিন। খুব সহজে অবশ্য কার্য সম্পন্ন হয়নি। বরফের চাদর ভেঙে একবার তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে পড়েগিয়েছিল পেরল্ট। ভেঙে-পড়া বরফের গর্তের দু-ধারে নিরেট বরফ ঢাকা জমির উপর হাতের লম্বা বাঁশটা আড়াআড়িভাবে আটকে দিয়ে পের কোনোরকমে সলিলসমাধি থেকে আত্মরক্ষা করল বটে, কিন্তু তুষারশীতল জলে তার সর্বাঙ্গ এমন অসাড় ও আড়ষ্ট করে দিল যে, গর্তের ভিতর থেকে উপরের নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে আসার ক্ষমতা তার রইল না। ফ্রাঁসোয়া অতিকষ্টে বিপন্ন বন্ধুকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করল। আর-একবার গোটা স্লেজগাড়িটাই বরফ ভেঙে তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে ছিটকে পড়ল। প্রাণপণ চেষ্টায় দুই বন্ধু যখন স্লেজসমেত কুকুর বাহিনীকে নদীগর্ভ থেকে জমাট বরফের উপর তুলে আনল– তখন দেখা গেল প্রচণ্ড ঠান্ডায় কুকুরদের জলে-ভেজা রোমশ দেহের উপর পড়ে গেছে নিরেট বরফের আবরণ!
আর একবার স্পিটজের পায়ের তলায় ভেঙে গেল বরফ– সঙ্গে সঙ্গে তার পতনজনিত দেহের ভার সমগ্র কুকুরবাহিনীকে জলের মধ্যে টেনে আনার উপক্রম করল। ৰাক আর ডেভ শক্ত বরফ-ঢাকা জমির বুকে নখ বসিয়ে নিজেদের বাঁচাতে সচেষ্ট হল। তাদের চেষ্টা হয়তো সফল হত না, কিন্তু স্লেজটাকে পিছন থেকে টেনে ধরে ফ্রাঁসোয়া কুকুরগুলোকে জলের মধ্যে পড়তে দিল না। ওই অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধার করল পেরল্ট ডেভ আর বাক ছাড়া যে কুকুরগুলো স্পিটজের ছিটকে-পড়া দেহের টানে জলে পড়ে গিয়েছিল, একে একে পেরল্ট তাদের জল থেকে তুলে আনল।
শুধু বিপজ্জনক বরফ নয়, আরও একটা সমস্যা বাককে বিপন্ন করে তুলেছিল। দীর্ঘকাল মানুষের আশ্রয়ে থাকার ফলে বাক-এর পায়ের তলা ছিল নরম। কিন্তু তার সঙ্গী হাস্কি কুকুরদের পা ছিল দীর্ঘভ্রমণে অভ্যস্ত ও কঠিন– ফলে ওই কুকুরগুলো কঠিন বরফ মাড়িয়ে অনায়াসে ছুটত আর বাক চলত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ছুটোছুটির পালা শেষ করে বিশ্রামগ্রহণের সময় হলেই বাক মড়ার মতো শুয়ে পড়ত। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হলেও সে আহার্যগ্রহণের জন্য উঠতে চাইত না। ফ্রাঁসোয়া খাদ্য পৌঁছে দিত তার কাছে এবং নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রতি রাত্রেই তার পা মালিশ করে দিত।
অবশেষে সমস্যার সমাধান করল পেরল্ট তার নিজস্ব মোকাসিন জুতোর উপরাংশ কেটে সেই চামড়া দিয়ে বাক-এর জন্য চারটি জুতো বানিয়ে দিল সে। জুতো পরে পথ চলতে কষ্ট পায়নি বাক। একসময়ে অনুভব করল তার পায়ের তলা বেশ শক্ত হয়ে গেছে, জুতো ছাড়াই সে হাঁটতে পারে সহজভাবে। তখন জীর্ণ পাদুকা চারটি পথেই বিসর্জন দেওয়া হল।
.
১১. কুকুর যখন পাগল হয়
স্পিটজ ছিল দলের নেতা। দলের কোনো কুকুর অবাধ্য হলে তার দেহের উপর পড়ত স্পিটজের দাঁতাল চোয়ালের ধারাল দংশন। কিন্তু বাক সম্পর্কে তার অস্বস্তি ছিল। দক্ষিণের অধিবাসী কোনো কুকুর ইতিপূর্বে তুষার আচ্ছন্ন এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে পারেনি; পথশ্রমে শ্রান্ত দক্ষিণাঞ্চলের কুকুর পথের উপরেই হয়েছে মৃত্যুশয্যায় লম্বমান। বাক ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। প্রথম প্রথম স্বল্প খাদ্য, দুরন্ত শীত আর কঠিন পরিশ্রম তাকে কাবু করে ফেললেও শেষ পর্যন্ত সে তার সহকর্মী হাস্কি কুকুরদের মতোই কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তার প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি আর পরিবর্তিত হিংস্র চরিত্র স্পিটজকে উদবিগ্ন করে তুলেছিল।
কয়েকদিন পরে একটি অভাবিত দুর্ঘটনা দুই শত্রুর তিক্ত সম্পর্ককে আরও বেশি তিক্ত করে দিল। একদিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের স্লেজগাড়িতে জুতে রওনা হওয়ার উপক্রম করছে, সেইসময় প্রভাতের স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল শ্বাপদকণ্ঠের তীব্র উৎকট ধ্বনি! ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে ওই ভয়ংকর শব্দ!
ডলির চিৎকার শুনে ভয়ে চমকে উঠল কুকুরের দল। একবার মাত্র চেঁচিয়ে উঠেছিল ডলি, পরক্ষণেই সে তেড়ে গেল বাক-এর দিকে। বাক লড়াই করার চেষ্টা করল না, ডলির জ্বলন্ত চোখে সে উন্মাদের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল– সভয়ে পিছন ফিরে দৌড় দিল সে। বাক জানত পাগলা কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত- ডলির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও সে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেল না, চেষ্টা করল পালিয়ে বাঁচতে।
বাক ছুটছে আর ছুটছে, দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে তার গতি, তবু ডলির সঙ্গে তার দূরত্ব কমে আসছে। ডলির দেহে এখন উন্মাদের অস্বাভাবিক শক্তি, প্রাণপণে ছুটেও বাক তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারছে না- ডলি একেবারে তার কাছে এসে পড়ল…
প্রাণের আশা যখন বাক ছেড়ে দিয়েছে, সেইসময় তার কান এল ফ্ৰসোয়র কণ্ঠস্বর- তার প্রভু তাকে ডাকছে। চোখ তুলে একবার সে ফ্রাঁসোয়ার মুখের দিকে চাইল, তারপর তিরবেগে ছুটে আসতে লাগল প্রভুর দিকে। বাক দেখল উদ্যত কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রাঁসোয়া। সে বুঝল এই প্রভুই তাকে বাঁচাতে পারে। ফ্রাঁসোয়ার পাশ দিয়ে বাক ছুটে বেরিয়ে গেল, তাকে অনুসরণ করে ফ্রাঁসোয়ার পাশে এসে পড়ল ডলি আর তৎক্ষণাৎ কুঠার তুলে ভীষণ জোরে আঘাত হানল ফ্রাঁসোয়া ডলির মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বুনন কুকুরের দংশনে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল ডলি।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, অতিকষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে শ্বাসগ্রহণের চেষ্টা করছিল সে। স্পিটজ বুঝল এই সুযোগ, ক্লান্ত অবসন্ন বাক-এর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল। স্পিটজের ধারাল দাঁত মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেল– বাক বাধা দিল না, কারণ বাধা দেবার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।
বিপন্ন বাককে সাহায্য করতে আবার এগিয়ে এল ফ্রাঁসোয়া। তার চাবুক পড়তে লাগল স্পিটজের সর্বাঙ্গে। ইতিপূর্বে ফ্রাঁসোয়ার হাতে এমন ভীষম মার খায়নি কোনো কুকুর। মহা-আনন্দে দৃশ্যটাকে উপভোগ করল বাক। এই ঘটনার পর বাক একটা চরম সিদ্ধান্তে উপস্থিত হল- এতদিন সে শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে, এইবার আক্রান্তের ভূমিকা ছেড়ে আক্রমণকারীর ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হবে।
.
১২. সংঘাত
বাক এবার নেতা হল। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট পরিচার্লিত স্লেজবাহক কুকুরদের অবিসংবাদিত নেতা এখনও স্পিটজ, কিন্তু পূর্বোক্ত কুকুরদের মধ্যে যে বিদ্রোহী দলটার সৃষ্টি হয়েছে, সেই দলের অবিসংবাদিত নেতা হল বিপুল বপু বাক।
একদিন সকালে প্রচণ্ড তুষারপাতের পর পাইক নামে অলস কুকুরটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কুকুরদের তখন স্লেজগাড়িতে জুতে দেওয়া হচ্ছে, একটু পরেই স্লেজ ছোটানো হবে, চিৎকার করে পাইকের নাম ধরে ডাকছে ফ্রাঁসোয়া- কিন্তু কোথায় পাইক? সে যেন হঠাৎ হাওয়ায় মিশে গেছে, তার সাড়াশব্দ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকের এই অবাধ্য আচরণে ক্রুদ্ধ স্পিটজ হানা দিয়ে ফিরতে লাগল সব জায়গায়, তবু তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পাবে কি করে? এক ফুট গভীর তুষারের তলায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিল পাইক।
অবশেষে পলাতককে খুঁজে পেল স্পিটজ এবং হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে পলাতককে শাস্তি দিতে উদ্যত হল। কিন্তু স্পিটজের উদ্যম ব্যর্থ করে দিয়ে দুই কুকুরের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাক, তার প্রকাণ্ড দেহের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল স্পিটজ। এতক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল পাইক, এইবার বাককে তার হয়ে রুখে দাঁড়াতে দেখে সে সাহস পেল- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুই শত্রুর মিলিত আক্রমণের মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা স্পিটজের ছিল না, সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপারটা দেখে ফ্রাঁসোয়ার মুখে ফুটল চাপা হাসি, কিন্তু শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে সে চাবুকপেটা করল বাককে আর সেই সুযোগে স্পিটজ ভালোভাবেই দাঁতের ধার পরখ করল পাইকের দেহে।
এই ঘটনার পর দেখা গেল দলের অধিকাংশ কুকুরের মধ্যে বিদ্রোহের সঞ্চার হয়েছে। দলের কোনো কুকুরকে যখনই শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্যে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছে স্পিটজ, তখনই মুর্তিমান বিঘ্নের মতো সেখানে হাজির হয়েছে বাক এবং অন্যায়কারীর সমর্থনে রুখে দাঁড়িয়েছে স্পিটজের বিরুদ্ধে। অবশ্য ফ্রাঁসোয়ার চোখের আড়ালেই ওইসব কাণ্ড ঘটত, দ্বিতীয়বার চাবুকের মার খেতে রাজি ছিল না বাক।
ক্রমশ এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল সব কুকুরের মধ্যে। কেউ আর স্পিটজের সারি সহ্য করতে ইচ্ছুক নয়। দলের মধ্যে আলস্য, বিশৃঙ্খলা আর লড়াই-এর ঘটনা ঘটতে লাগল বারবার। দুটি কুকুর অবশ্য বিদ্রোহীদের দলভুক্ত হতে সম্মত হয়নি- ডেভ আর সোল-লেকস।
বিদ্রোহীদের সাহস এমন বেড়ে গেল যে ভীতু পাইক পর্যন্ত একদিন স্পিটজের বরাদ্দ মাছ ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলল। কাছেই পাহারা দিচ্ছিল বাক, স্পিটজ কিছু করলেই সে তাকে বাধা দিতে প্রস্তুত- অতএব মনের রাগ মনেই চেপে স্পিটজ পাইকের দস্যুবৃত্তি হজম করে নিল। আর একদিন স্পিটজের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াল ডাব আর ডো। একসঙ্গে দু-দুটো কুকুরের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না স্পিটজের, সুতরাং অপরাধীদের শাস্তি না দিয়েই পিছু হটে এল স্পিটজ। দলের কুকুরগুলো ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠল, তারা আর স্পিটজকে দেখে ভয় পায় না। স্পিটজু তাদের ধমক দিলেই তারাও দাঁত খিঁচিয়ে তাকে পাল্টা ধমক দেয়। স্পিটজের সামনে এলেই বাক-এর সর্বাঙ্গে লোম খাড়া হয়ে উঠত এবং গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসত রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জনধ্বনি।
বিদ্রোহ যদি তাঁবুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে বিশেষ ক্ষতি ছিল না। কিন্তু স্লেজ টেনে ছোটার সময়েও ককরদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠত। ঝগড়া, কামড়াকামড়ি, লাগাম জড়িয়ে স্লেজের গতিরোধ প্রভৃতি অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটতে লাগল অনবরত, প্রাণপণে চাবুক চার্লিয়েও যঁফ্রাঁসোয়া দলটার মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারল না। চাবুকের শাসন অগ্রাহ্য করে স্পিটজের বিরুদ্ধে হিংস্র বিদ্রোহ ঘোষণা করতে লাগল স্লেজবাহক সারমেয়-বাহিনী। ফ্রাঁসোয়া বুঝতে পারছিল বাক হচ্ছে এইসব অঘটনের নায়ক, সব নষ্টের গোড়া। কিন্তু তাকে হাতে-নাতে ধরার উপায় ছিল না– প্রথম দিন চাবুক খেয়েই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল বাক, সব কিছুই করত সে ফ্রাঁসোয়ার অগোচরে।
সমগ্র দলটা যখন ডসন নামক গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলার বালাই ছিল না, যে-যার ইচ্ছেমতো চলছে। স্পিটজের পক্ষে উক্ত বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করাও ছিল অসম্ভব। যে-সব সংবাদ পরিবেশনের ভার ছিল পেরন্টের উপর, সেগুলো বিলি করতে তার দেরি হল। কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারার জন্য পেরল্ট দায়ী করল বন্ধুকে, আর বন্ধুর
ফ্রাঁসোয়াও তার জবাব দিল কুদ্ধকণ্ঠে। কুকুরদের কলহ এবার ছড়িয়ে পড়ল তাদের মনিবদের মধ্যে। স্পিটজের সর্দারি যে ফুরিয়ে গেছে তা বুঝতে পেরে ভারি খুশি হয়ে উঠল বাক।
.
১৩. মৃত্যুপণ দ্বৈরথ
এক রাতে নৈশভোজের পর ডাব নামে কুকুরটি বরফ-ঢাকা প্রান্তরের উপর একটি খরগোশ দেখতে পেল। সঙ্গেসঙ্গে সে খরগোশটাকে তাড়া করল। তার পিছনে ছুটল সমগ্ৰ কুকুরবাহিনী। কাছেই ছিল উত্তর-পশ্চিম পুলিশ বাহিনীর তাবু- সেই তাবু থেকে পঞ্চাশটা হাস্কি কুকুর বেরিয়ে এসে ডাব এবং তার সঙ্গীদের দলে যোগ দিল। তুষারাবৃত প্রান্তরের উপর খরগোশের পিছনে তাড়া করে ছুটতে লাগল কুকুরদের এক বিশাল বাহিনী।
দারুণ ঠান্ডায় জমে-যাওয়া নদীর নিরেট বরফের উপর দিয়ে ছুটল ভয়ার্ত খরগোশ, তারপর হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে নদীর ছোটো খাড়ির ভিতর ঢুকল সে। তার হালকা শরীর যেন উড়ে চলল বরফের উপর দিয়ে, কিন্তু অনুসরণকারী কুকুরদের পাগুলো জমাট তুষারের মধ্যে ঢুকে তাদের গতিবেগ কমিয়ে দিচ্ছিল। তবু পলাতক শিকারের পিছনে লেগে রইল নাছোড়বান্দা কুকুরের দল। দলটাকে পরিচালনা করে সর্বাগ্রে ছুটছিল বাক…।
এই ধরনের শিকারে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ছিল স্পিটজের যেখানে খাড়ির মুখটা বেঁকে গেছে, দলের সঙ্গ ত্যাগ করে সেই বাঁকের মুখে উঁচু জমির উপর ওত পেতে পলাতকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই কুকুরদের তাড়া থেকে বাঁচতে বাঁকের মুখে উপস্থিত হল ধাবমান শশক সঙ্গেসঙ্গে এক লাফে শিকারের উপর পড়ে কামড় বসাল স্পিটজ। দুই দাঁতাল চোয়ালের কঠিন পেষণে তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারাল নিরীহ খরগোশ।
কুকুরের দলটার নেতৃত্ব দিয়ে সকলের আগে-আগে ছুটে আসছিল বাক। সে যখন দেখল স্পিটজ তার শিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, সে বুঝল এইবার চরম নিষ্পত্তির সময় হয়েছে- খরগোশের মৃত্যু দেখেও সে গতিবেগ একটুও সংযত করল না, ঝড়ের মতো এসে পড়ল স্পিটজের উপর, শুরু হল মৃতুপণ দ্বৈরথ। পরস্পরের দেহের সংঘাতে দুটি কুকুরই গড়িয়ে পড়ল তুষারের উপর। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল স্পিটজ এবং বাক-এর কাঁধে কামড় বসিয়েই এক লাফে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে সুযোগের অন্বেষণে ঘুরতে লাগল বাক আর স্পিটজ…
মরা খরগোশটাকে উদরসাৎ করে কুকুরের দল প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা দুটিকে ঘিরে বসে পড়ল, তাদের চোখগুলো জ্বলতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।
দ্বৈরথ রণে অভিজ্ঞ যোদ্ধা স্পিটজ। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধরেনর কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছে সে। বারংবার দংশনে বাক-এর স্কন্ধদেশ রক্তাক্ত করে দিল স্পিটজ, কিন্তু বাক একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না- আঘাত করা তো দূরের কথা। কুকুরের দল তাদের ঘিরে অপেক্ষা করছিল দুই যোদ্ধার মধ্যে যে ধরাশায়ী হবে, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করবে তারা। বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, একবার স্পিটজের ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর অপেক্ষমাণ সারমেয়-বাহিনী হিংস্র আগ্রহে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল বাক; কুকুরের দলও আবার বসে পড়ল যোদ্ধাদের ঘিরে এক সুবিশাল জীবন্ত বৃত্তের আকারে।
বাক এতক্ষণ তার সংস্কার আর দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করছিল, এইবার সে তার মস্তিষ্ককে ব্যবহার করল– দ্রুতবেগে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা লক্ষ্য করে কঁপ দিল বাক, পরক্ষণেই নিশানা পরিবর্তন করে প্রায় শায়িত অবস্থায় ছুটে এসে কামড় বসাল স্পিটজের বাঁ পায়ের উপর। সেই প্রচণ্ড দংশনে ভেঙে গেল স্পিটজের বাঁ পা, তিন পায়ে ভর দিয়ে শত্রুর সম্মুখীন হল স্পিটজ। আবার একই কৌশল অবলম্বন করল বাক, ভেঙে গেল স্পিটজের পিছনের ডান পা। আবার আক্রমণ করল বাক, পিছনের দুই পা ভেঙে স্পিটজ এখন অসহায় শত্রুর আক্রমণের বেগ সামলাতে না পেরে সে আবার ধরাশায়ী হল। শত্রুর গলায় কামড় বসিয়ে এক লাফে সরে এল বাক, সঙ্গেসঙ্গে অপেক্ষমাণ কুকুরের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাহত স্পিটজের উপর….
একটু দূর থেকে বাক তার শত্রুর মৃত্যুদৃশ্য উপভোগ করতে লাগল পরমানন্দে- তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে এই নিয়মই প্রচলিত– হয় মারো, নয় মরো।
.
১৪. দলের নায়ক বাক
পরের দিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন স্পিটজকে দেখতে পেল না এবং বাক-এর সর্বাঙ্গে রক্তাক্ত ক্ষতগুলো যখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তখনই সে বুঝল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মৃত্যুপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হয়েছে বাক।
একটা কুকুরের মতো কুকুর ছিল বটে স্পিটজ, বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল ফ্রাঁসোয়া, যেসব কুকুর দলের নেতা হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের মধ্যে সেরা ছিল স্পিটজ। লড়াইতেও সে ছিল ওস্তাদ। পেরল্ট, বাক-এর ক্ষতচিহ্নগুলো একবার তাকিয়ে দেখ।
দেখেছি, পেরল্ট বলল, স্পিটজ ওস্তাদ লড়য়ে বটে, কিন্তু বাক তার চেয়েও বড়ো ওস্তাদ। তা না হলে বাক-এর বদলে স্পিটজকেই আমরা দেখতে পেতাম। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে- স্পিটজের মৃত্যুর পর দলের মধ্যে এখন আর গোলমাল হবে না। আমরা সময়মতো। কাজকর্ম করতে পারব।
সোল-লেকস নামে কুকুরটাকেই দলের অধিনায়ক স্থির করা হল। স্লেজবাহকদের মধ্যে যে স্থানটি সোল-লেকস নামক কুকুরটার জন্য নির্দিষ্ট ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে দলের সর্বাগ্রে তাকে জুতে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসে ফ্রাঁসোয়া দেখল দলের পুরোভাগে অধিনায়কের স্থান অধিকার করে দাঁড়িয়ে আছে বাক! সে এখন দলের নেতা হতে চায়।
ফ্রাঁসোয়া হেসে উঠল, কী ভেবেছ তুমি? স্পিটজকে হত্যা করেছ বলে তোমাকেই দলনেতা করা হবে? যাও, যাও, পিছনে যাও- নিজের জায়গায় দাঁড়াও।
বাক মনিবের আদেশ পালন করল না। সোল-লেকসকে তাড়া করে তার আগেকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে আবার এসে দাঁড়াল দলের পুরোভাগে। সে তার পছন্দমতো জায়গা থেকে এক পা-ও নড়তে রাজি হল না। অবশেষে তার ঘাড়ের চামড়া টেনে ধরে জোর করে তাকে সরিয়ে দিল ফ্রাঁসোয়া।
সরালে কি হবে? বাক দলের নেতৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। সোল-লেকসকে দলের অধিনায়ক করে স্লেজের সামনে জুতে দেওয়ার উপক্রম করতেই দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এল বাক আর সভয়ে পিছিয়ে এসে তাকে দলনায়কের জায়গা ছেড়ে দিল সোল-লেকস।
ফ্রাঁসোয়ার মুখে কৌতুকজড়িত হাসির রেখা মুছে গেল বাক ভেবেছে কী? গায়ের জোরে দলের নেতা হবে?- একটা মুগুর নিয়ে তেড়ে এল ফ্রাঁসোয়া।
বাক ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগে দিয়ে সমস্ত কুকুরের দলটাকে স্লেজগাড়ির সঙ্গে জুতে দেওয়া হল। বাক তখনও সামনে আসেনি। ফ্রাঁসোয়া তাকে গাড়িতে জোতার জন্য ডাকল। বাক অনড়। সে মারধরের ভয় করে না, কিন্তু দলনায়কের স্থানে তাকে স্বীকৃতি না দিলে সে স্লেজ টানতে রাজি নয়! এবার পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, তারা মুগুর ছুঁড়ে মারল। চটপট সরে গিয়ে বাক আত্মরক্ষা করল। তাকে পাকড়াও করার জন্য তাড়া করতেই সে মনিবদের নাগাল থেকে দ্রুত সরে গেল। মনিবরা তাকে গালি দিল, সেও দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিতে লাগল– অবশ্য নিরাপদ দূরত্ব থেকে।
পেরল্ট তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে তাদের রওনা হওয়া উচিত ছিল। বোকার মতো ফ্রাঁসোয়ার দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিল পেরল্ট। বন্ধুর ইঙ্গিত বুঝে সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগ থেকে সরিয়ে এনে আগের জায়গায় তাকে জুতে দিল ফ্লাগোয়া।
এবার ডাকতেই ছুটে এল বাক, স্থানগ্রহণ করল দলের প্রথমে। জোর করেই দলের নেতা হয়ে গেল সে!
সমস্ত দলটা এতদিন যা-খুশি তাই করে এসেছে। অবশ্য বাক-ই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। তার নেতৃত্বেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল কুকুরদের মধ্যে। কুকুরগুলো হয়ে উঠেছিল অবাধ্য, অলস, বিশৃঙ্খল। এখন চট করে বাক-এর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলার বাঁধনে আবদ্ধ হতে তারা রাজি হল না। কিন্তু দলপতি বাক-এর প্রচণ্ড শাসন কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বঝিয়ে দিল, যা হয়েছে তা হয়েছে- এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে বর্তমান অবস্থায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজি না হলে দলপতির দাঁত তাদের শরীরকে করে দেবে রক্তাক্ত! অতএব কিছুদিনের মধ্যেই বিশৃঙ্খল দলটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে স্লেজ টানতে শুরু করল।
পথের মধ্যে রিংক র্যাপিডস নামক জায়গায় দুটি নতুন হাস্কি কুকুরকে দলভুক্ত করা হল। তাদের নাম চিক ও কুনা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বুনো স্বভাবকে বদলে দিল বার্ক। তারা হয়ে উঠল কর্তব্যপরায়ণ স্লেজবাহক। ফ্রাঁসোয়া অভিজ্ঞ স্লেজচালক, ইতিপূর্বে ক্ষমতাশালী বহু দলনায়কের সাক্ষাৎ পেয়েছে সে কিন্তু দলের নেতা হিসাবে বাক-এর দক্ষতা তাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিল।
স্ক্যাগওয়ে নামক স্থানে পৌঁছে তারা হিসাব করে দেখল চোদ্দো দিনের মধ্যে প্রতিদিন তারা প্রায় চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। স্লেজবাহক দলপতির মধ্যে এমন গতিবেগের চাঞ্চল্যকর উদাহরণ ইতিপূর্বে কেউ স্থাপন করতে পারেনি– বাক প্রমাণ করে দিয়েছে দলপতি হিসাবে সে অনন্য।
১৫. আদিম স্মৃতি
একদিন সকালে ফ্রাঁসোয়া ও পেরল্টের কাছে কানাডা সরকারের চিঠি এল- ডাকবাহকদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে সরকার, সেইখানে নতুন ডাকবাহকদের তুষার-আচ্ছন্ন দুর্গম পথে কুকুর বাহিত স্লেজ চালানোর শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফ্রাঁসোয়া আর পেরকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে।
বাককে ডেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ফ্রাঁসোয়া। তারপর সে আর পেরল্ট অন্য কুকুরদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। পরবর্তীকালে কোনোদিন ওই লোকদুটির দেখা পায়নি বাক, তার জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া।
সমস্ত দলটা এবার আর একটি ডাকবহনকারী দলের সঙ্গে যুক্ত হল। বারোটা নতুন কুকুরের সঙ্গে বাক ও তার সঙ্গীদের নিয়ে নবগঠিত দলটার নাম হল সল্ট ওয়াটার মেইল। সোনার সন্ধানে যে-সব অভিযাত্রী উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছিল, তাদের কাছ থেকে এবং তাদের উদ্দেশে প্রেরিত চিঠিপত্র নিয়ে পূর্বোক্ত স্লেজবাহী কুকুরের দল যাতায়াত করছিল। কাজটা খুব কষ্টসাধ্য, কুকুরদের পরিশ্রম করতে হত ভীষণভাবে। বাক যদিও ওই কাজ পছন্দ করছিল না, তবু নিপুণভাবে দলটাকে পরিচালনা করে যথাসাধ্য কর্তব্যপালন করছিল সে। কিন্তু একঘেয়ে জীবন তার ভালো লাগছিল না। প্রত্যেকটা দিন ছিল বৈচিত্র্যহীন প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে রাঁধুনিরা আসত, আগুন জ্বালিয়ে খাদ্য তৈরি করা হত, তারপর প্রাতরাশ শেষ করে স্লেজ টেনে ছুটত কুকুরের দল– অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তাবু ফেলে নিদ্রার আরাধনা এবং পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই আবার বিরামহীন পথ চলার পালা।
রাত্রে কুকুরদের খাওয়ার জন্য মাছ দেওয়া হত। সেই খাদ্য উদরসাৎ করার পর প্রায় ঘণ্টাখানেক কুকুররা এদিক-ওদিক চলাফেরা করত। ওই দলটায় কুকুরের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল মারামারি আর কামড়াকামড়ি করতে ওস্তাদ। দলের ভিতর সবচেয়ে ভীষণ তিনটি কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বাক এবং সব কয়টি লড়াইতেই শত্রুদের পরাজিত করেছিল সে। ফলে, বাক যখন গায়ের নোম ফুলিয়ে সগর্জনে দন্তবিস্তার করত, তখনই অন্য কুকুরগুলো তার সামনে থেকে সরে পড়ত চটপট।
রাতের ভোজনপর্ব ছিল বাক-এর কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। আগুনের সামনে বসে স্বপ্নাতুর দুই চোখের দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে থাকত চঞ্চল অগ্নিশিখার দিকে, কিন্তু তার মন ভ্রমণ করত বিস্মৃত অতীতের পটভূমিতে। কখনো কখনো বিচারক মিলারের মস্ত বড় বাড়ি, সাঁতারের জন্য নির্দিষ্ট পুকুর এবং ঘোড়ার আস্তাবল ভেসে উঠত তার স্মৃতির পটে কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তার মানসপটে ভেসে উঠত মর্গ্যান, তার প্রথম লড়াই- যখন তাকে মুগুরের আঘাত করা হয়েছিল, কার্লির মৃত্যু এবং স্পিটজের সঙ্গে তার ভয়ংকর মৃত্যুপণ দ্বৈরথ…
নৃত্যচঞ্চল অগ্নিশিখার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার মন চলে যেত আরও দূরে, সুদূর অতীতে যেখানে তার সঙ্গে গুহার আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে একটি মানুষ এখন যেসব লোক তার আশেপাশে চলাফেরা করে তাদের সঙ্গে গুহায় উপবিষ্ট ওই মানুষটির সাদৃশ্য নেই কিছুমাত্র মনশ্চক্ষে বাক দেখতে পায় ওই বিচিত্র মানুষের পা দুটি ছোটো, তুলনায় হাত দুটি অস্বাভাবিক লম্বা এবং তার মাথার উপর লটপট করছে লম্বা চুলের জটা। ওই আদিম মানুষ গুহার বাইরে জমাট অন্ধকারের দিকে বার বার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে, তার আচরণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অন্ধকারকে সে ভয় করে। জ্বলন্তু আগুনের উপর দিয়ে দৃষ্টিকে চালনা করে বাক দেখতে পায় আঁধার সমুদ্র ভেদ করে জ্বলে জ্বলে উঠছে জোড়ায় জোড়ায় প্রদীপ্ত চক্ষু। বাক বুঝতে পারে হিংস্র শ্বাপদের দল অন্ধকারে ওত পেতে বসে আছে। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের বাধা এড়িয়ে সামনে আসতে তারা সাহস পাচ্ছে না। এইভাবে মনের চোখে বাক দেখতে পেত সুদুর অতীতের দৃশ্য যে দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিল বাক-এর পূর্বপুরুষ, সেই অতীতের দৃশ্য বাস্তবে আর কোনোদিনই চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবে না বাক। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের নৃত্যপরায়ণ চঞ্চল শিখাগুলোর ভিতর দিয়ে সুদূর অতীত ভেসে আসত বর্তমানে পৌঁছে দিত বাক-এর কাছে আদিম গুহার বার্তা বর্তমানের তুষার ঢাকা তাবুর মধ্যে…।
.
১৬. পালা বদলের পালা
বাক আর তার দল যখন ডসন ছেড়ে স্ক্যাগওয়ের পথে রওনা হল, তখনই প্রবলবেগে তুষার পড়তে শুরু করল। ফলে, নরম তুষারের উপর স্লেজের রানার ঘষা খেতে লাগল ভীষণ জোরে, কুকুরদের পরিশ্রমও তাই বেড়ে গেল দারুণভাবে। শীতের প্রারম্ভেই তারা আঠারো শো মাইল পার হয়ে এসেছে, এখন নতুন যাত্রাপথে স্লেজ টেনে ছুটতে তাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বিলি নামে শান্ত কুকুরটা প্রতি রাত্রেই অস্ফুট আর্তস্বরে ক্রন্দন করতে লাগল।
ত্রিশ দিন পরে বাক ও তার দলভুক্ত পঞ্চাশটি কুকুর অর্ধমৃত অবস্থায় স্ক্যাগওয়ে নামক স্থানে পৌঁছল। তাদের অবস্থা তখন শোচনীয়, দলপতি বাক-এর শরীরের ওজন একশো ছত্রিশ থেকে নেমে হয়েছে একশো পনেরো! অধিকাংশ কুকুর খোঁড়াচ্ছে, কেউ কেউ আবার টানধরা পেশীর যন্ত্রণায় ভুগছে। প্রত্যেকটি কুকুর এখন ক্লান্তির শেষ সীমায় উপস্থিত, তাদের শরীর আর বইছে না। স্লেজ যখন ঢালু জমি বেয়ে নেমে আসে, তখন কোনোরকমে ধাবমান স্লেজের ধাক্কা থেকে তারা আত্মরক্ষা করে।
স্লেজের চালকরা দীর্ঘ বিশ্রাম পাবে বলে আশা করেছিল কিন্তু চিঠি বিলি করতে হবে যথাসম্ভব শীঘ্র, বিলম্বের অবকাশ নেই অথচ এই শ্রান্ত ক্লান্ত কুকুরদের নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা চালকরা স্থির করল এই কুকুরের দলটাকে বিক্রি করে নতুন কুকুরদের নিয়ে স্লেজবাহক নতুন দল গঠন করতে হবে। পর পর তিন দিন কাটল, কোন ক্রেতাই কুকুরগুলোকে কিনে নিতে এগিয়ে এল না। অভিজ্ঞ চালকরা এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারছিল কিছুদিন বিশ্রাম না নিলে এই কুকুরগুলো তাদের হৃতশক্তি ফিরে পাবে না– এখন তাদের কিনলে টাকাটা জলে পড়বে।
চতুর্থ দিন সকালে ভার্জিনিয়া থেকে উপস্থিত হল দুটি মানুষ, তারা খুব কম দামে বাক ও তার সঙ্গীদের কিনে নিল সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম সমেত। ক্রেতা দুজনের একজন মধ্যবয়স্ক, তার সঙ্গীর বয়স কুড়ির বেশি নয়। মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির নাম চার্লস, তার সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সঙ্গীর নাম হাল। হালের চওড়া কোমরবন্ধনীতে ঝুলছিল একটা মস্ত ছোরা ও একটা কোল্ট রিভলভার। হাল মনে করছিল অস্ত্র দুটি তার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসলে ওই অপরূপ সজ্জা তাকে পোড়-খাওয়া মানুষের কাছে হাসির খোরাক করে তুলেছিল। অভিজ্ঞ ব্লেজচালকরা হালকে দেখে অতিকষ্টে হাসি চেপে রাখছিল।
পূর্বোক্ত চার্লস এবং হাল হল বাক-এর নতুন মনিব।
.
১৭. আনাড়ির পাল্লায় বাক
নতুন-কেনা কুকুরদের সাহায্যে স্লেজ চার্লিয়ে চার্লস ও হাল তাদের তাঁবুতে ফিরে এল। তাবুর অগোছালো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র দেখে দস্তুরমতো চমকে গেল বাক। ওই তাবুর ভিতরেই মার্সেডিস নামে মেয়েটিকে সে দেখতে পেল। মার্সেডিস হল চার্লসের স্ত্রী আর হালের ভগ্নী। স্লেজ চালনা সম্পর্কে কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল না মার্সেডিসের, তবু কেমন করে কীভাবে স্লেজে মালপত্র বোঝাই করতে হবে সে বিষয়ে তার সঙ্গীদের সে বিস্তর উপদেশ দিচ্ছিল, কিন্তু হাতে-নাতে কাজ করে সে তাদের একটুও সাহায্য করছিল না। তার পুরুষ সঙ্গীরা তাবুটাকে তালগোল পাকিয়ে একটা মস্ত পুঁটলি বানাল, টিনের থালাগুলো পরিষ্কার না করেই একসঙ্গে জড়ো করল এবং মার্সেডিসের নির্দেশ অনুসারে তার পোশাক-পরিচ্ছদগুলো বার বার উঠিয়ে নামিয়ে শেষ পর্যন্ত স্লেজ বোঝাই করল।
পাশের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে তিনটি লোক সকৌতুকে দুটি আনাড়ি পুরুষ ও একটি মেয়ের কাণ্ড দেখছিল আর নিজেদের মধ্যে হাসাহসি করছিল। অবশেষে আর থাকতে না পেরে তাদের মধ্যে একজন নীরবতা ভঙ্গ করল
দেখ বাপু, তোমাদের ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না, লোকটি বলে উঠল, তবে আমি হলে ওই তাবুটাকে নিয়ে স্লেজের ভারবৃদ্ধি করতাম না।
লোকটির দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মার্সেডিস বলল, তাবুটা আমার দরকার। অতএব, ওটা সঙ্গে যাবে।
এটা বসন্তকাল, লোকটি জবাব দিল, এখন ঠান্ডা নেই। কাজেই তাবুর দরকার হবে না।
মার্সেডিস লোকটির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে সঙ্গীদের মালপত্র বাঁধাবাঁধির কার্য পর্যবেক্ষণ করতে লাগল নিবিষ্টচিত্তে।
আর-একজন মন্তব্য করল, স্লেজটা বড়ো বেশি ভারি হয়ে পড়েছে।
লোকটির দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল চার্লস। তারপর চাবুক তুলে হাঁক দিল, চলো সামনে এগিয়ে যাও।
বাক এবং তার সঙ্গীরা একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ে টান দিল; স্লেজ একটুও নড়ল না! ক্ষণেক বিরতি দিয়ে আবার সবাই মিলে টান মারল; স্লেজ অনড়! আবার টানল সবাই বৃথা চেষ্টা অচল স্লেজ সমবেত চেষ্টাতেও সচল হল না!
হাল চাবুক তুলল, হতচ্ছাড়া অলস জানোয়ারের দল, দাঁড়া তোদের মজা দেখাচ্ছি।
মার্সেডিস চিৎকার করে ভাইকে থামাল, তারপর তার হাত থেকে চাবুক ছিনিয়ে নিল, না, ওদের মারতে পারবে না তুমি। কথা দাও আমাকে ওদের মারবে না।
হাল দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কুকুরদের হালচাল তুমি কিছুই জানে না। চাবুক না মারলে ওদের কাছ থেকে কাজ পাওয়া যায় না। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে এখানে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করো।
প্রতিবেশী তিনজনের দিকে তাকাল মার্সেডিস, ওদের কি সত্যিই চাবুক মারা দরকার? আমি আবার এইসব নিষ্ঠুর কাজ দেখতে পারি না।
প্রথম যে লোকটি নীরবতা ভঙ্গ করেছিল সে, বলে উঠল, কুকুরগুলো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুদিন বিশ্রাম না নিলে ওদের চলার ক্ষমতা হবে না। এই দলটাকে কত টাকা দিয়ে তোমরা কিনেছ জানি না। তবে টাকাটা জলে পড়েছে, তোমরা ঠকে গেছ।
তার স্বামী আর ভাই-এর যে ব্যবসাবুদ্ধি নেই, একথা মানতে পারল না মার্সেডিস, সে চটপট মত বদলে ফেলল, চাবুকটা ভাই-এর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সে বলল, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে। এই জায়গাটা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই ভালো।
কথাটা বলেই সে দণ্ডায়মান তিনটি দর্শকের দিকে ঘৃণামিশ্রিত তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
হালের হাতে চাবুক উঠল আর পড়ল, কুকুরগুলো তাদের বক্ষবন্ধনীর উপর ঝুঁকে পড়ে সজোরে টান মারল– তবু স্লেজ নড়তে চাইল না, সে যেন বরফের তলায় নোঙর গেঁথে মাটি কামড়ে ধরেছে! চাবুক পড়তে লাগল শপাশপ, কুকুরদের টানার বিরাম নেই- স্লেজ অচল, অনড়।
তিন দর্শকের মধ্যে যার বয়স বেশি, সে এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তোমাদের উপর আমার একটুও সহানুভূতি নেই। তোমরা যদি কোনোদিনই গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে না পারো, তাহলেও আমি দুঃখিত হব না। কিন্তু বেচারা কুকুরদের বাঁচাতে চাই বলেই বলছি– স্লেজের পিছনে দাঁড়িয়ে চাপ দাও, তাহলেই স্লেজ চলবে। স্লেজের তলায় বরফ জমে গেছে, চাপ দিলেই ওই বরফ ভেঙে স্লেজ চালু হবে।
লোকটির কথামতো কাজ করল চার্লস ও হাল কিন্তু একবারও তাকে ধন্যবাদ জানাল না। স্লেজ চালু হল। ঘন ঘন চাবুকের মার খেয়ে কুকুরগুলো প্রাণপণে গাড়ি টানতে লাগল। রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে স্ক্যাগওয়ে শহরের প্রধান রাজপথে মিশেছে ওইখান দিয়ে যাওয়ার সময়েই স্লেজ উলটে পড়ল, জিনিসপত্র গড়াগড়ি খেতে লাগল বরফ-ঢাকা মাটির উপর।
কুকুরের দল থামল না। অন্যায়ভাবে মার খেয়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল বাক, তার উপর এতক্ষণ বিষম ভারি বোঝা নিয়ে তাকে ছুটতে হয়েছে- এখন বোঝা হালকা হতেই সে স্লেজ তিরবেগে ছুটল। দলের অন্য কুকুরগুলো তাকে অনুসরণ করে ছুটতে লাগল সবেগে। রাজপথের উপর গড়াগড়ি খেতে লাগল মার্সেডিসের সাধের কাপড়-চোপড়ের পুঁটলি আর উচ্ছিষ্ট-মাখা নোংরা বাসনপত্র।
শহরের লোকগুলো ভালো– রাজপথ থেকে কাপড় আর তার বাসন তারা উদ্ধার করল। জিনিসগুলো গাড়িতে ভোলার সময়ে তারা জানাল এত ভারি ওজন কুকুররা টানতে পারবে না। তখন চার্লস এবং হাল আরও ছয়টা কুকুর কিনে আনল। কিন্তু ওই কুকুরগুলো কঠিন পথশ্রম সহ্য করার মতো বলিষ্ঠ ছিল না।
তবে বিপুলসংখ্যক ওই সারমেয় বাহিনীর মালিক হয়ে চার্লস আর হাল খুবই গর্ববোধ করতে লাগল– কারণ, সেখানে কোমো স্লেজেরই বাহক কুকুরের সংখ্যা চোদ্দো ছিল না। কিন্তু ভার্জিনিয়ার তিন আনাড়ি একবারও ভাবল না কেন অন্যান্য স্লেজের বাহকসংখ্যা কম চোদ্দোটা কুকুরের উপযুক্ত যথেষ্ট খাদ্যসামগ্রী একটি স্লেজের পক্ষে যে বহন করা সম্ভব নয়, একথা তাদের মাথায় ঢুকল না।
তিনি আনাড়ি চোদ্দোটা কুকুরবাহিত স্লেজ ছুটিয়ে দিল গন্তব্য অভিমুখে। সেই সারমেয় বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বাক।
.
১৮. পথের দুর্ভোগ
চার্লস, হাল ও মার্সেডিস উৎসাহে টগবগ করছিল, কিন্তু স্লেজবাহী কুকুরদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত- চলমান ডাকঘরের মতো বিপুল চিঠিপত্রের বোঝা সমেত স্লেজ টেনেছে তারা বেশ কিছুদিন, উপযুক্ত বিশ্রামের অভাবে তাদের শরীর এখনও দুর্বল– সুতরাং ক্লান্ত দেহ আর মন নিয়ে তারা নতুন করে যাত্রা করতে আদৌ উৎসাহিত ছিল না।
স্লেজবাহক কুকুরদের প্রভুরা অর্থাৎ চার্লস, হাল ও মার্সেডিস কিন্তু কুকুরদের দৈহিক বা মানসিক অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায়নি একেবারেই। তুষারাচ্ছন্ন পথে স্লেজ-চালনা বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল না কিছুমাত্র। কোনো অবস্থা থেকেই তারা শিক্ষালাভ করতে চাইত না– সবসময় তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতেই ব্যস্ত থাকত। রাত্রে স্লেজ থামিয়ে তাবু ফেলতে এবং সকালে তবু গুটিয়ে যাত্রা শুরু করতে তারা অনর্থক সময় নষ্ট করত, তার উপর পথের মাঝে স্লেজ থামিয়ে অধিকাংশ সময়েই তারা জিনিসপত্র নতুন করে সাজাতে বাধ্য হত। যাত্রা শুরু করার সময়ে প্রথমেই জিনিসপত্র ঠিকমতো না সাজানোর ফলে মাঝপথেই স্লেজের গতিরোধ হওয়ার উপক্রম হত। যে দলটা ইতিপূর্বে দিনে চল্লিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে, সেই দলটাই এখন সারা দিনে দশ মাইল বা তার চেয়েও কম দূরত্ব অতিক্রম করে।
কতদিন ধরে পথ চলতে হবে সে বিষয়ে হাল একটা ধারণা করে নিয়েছিল এবং সেই ধারণা অনুসারে স্লেজে বোঝাই করেছিল কুকুরদের প্রয়োজনীয় খাদ্য। একসময়ে প্রমাণ হল হাল-এর ধারণা ভুল যে সময়ের মধ্যে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে বলে ভেবেছিল, বাস্তবে সেই সময়ের ভিতর গন্তব্যস্থলের অর্ধেক পথও অতিক্রম করতে পারল না। অথচ কুকুরদের খাদ্য তখন ফুরিয়ে এসেছে। এবার কুকুরদের খাদ্য কমিয়ে দেওযা হল, প্রত্যেক কুকুরকে নির্ধারিত খাদ্যের অর্ধ অংশ দেওয়া হত। অনাহারে অর্ধাহারে কুকুরদের কাহিল অবস্থা হল আরও কাহিল। স্ক্যাগওয়েতে যে ছয়টি কুকুরকে ক্রয় করা হয়েছিল, দুরন্ত পথশ্রম আর উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে তারা পথেই মারা পড়তে লাগল। সঙ্গীদের মৃত্যুদৃশ্য দেখেও বাক তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়নি–প্রভুদের নির্দেশ অনুসারে সে স্লেজ টানছিল যথাসাধ্য।
কুকুরদের চাইতেও খারাপ অবস্থা হল প্রভুদের প্রথম প্রথম অনাহারক্লিষ্ট কুকুরদের দুরবস্থা দেখে কেঁদে ফেলত মার্সেডিস, গোপনে তাদের খাবারও দিয়েছিল কয়েকদিন কিন্তু পরবর্তীকালে তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে সে এমন বিব্রত হয়ে পড়ল যে, কুকুদের দুরবস্থার দিকে তার নজর রইল না।
মার্সেডিসের আদুরে খুকির মতো চালচলন তার স্বামী আর ভাই-এর পক্ষে বেশিদিন সহ্য করা সম্ভব হল না। এতদিন মার্সেডিস তার পুরুষ সঙ্গীদের উপর সব কাজকর্মের দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত ছিল নিতান্ত স্বার্থপরের মতো। সে তাদের সাহায্য তো করতই না, উপরন্তু সামান্য ত্রুটি হলেই ক্রুদ্ধ অভিযোগে মুখর হয়ে উঠত। প্রথম প্রথম চার্লস ও হাল মার্সেডিসের অন্যায় আচরণ সহ্য করলেও পরে তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল, তারাও প্রতিবাদ করতে শুরু করল। পুরুষ সঙ্গীদের রূঢ় ব্যবহার মার্সেডিসকে আরও অবুঝ, আরও স্বার্থপর করে তুলল। সে এবার স্লেজের সঙ্গে না হেঁটে স্লেজের উপর চড়ে বসল। তার স্বামী আর ভাই প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, অনাহারে দুর্বল কুকুরদের পক্ষে এখন মার্সেডিসের একশো কুড়ি পাউন্ডের বাড়তি ওজন সমেত স্লেজ টানা সম্ভব নয়। কথাটা যুক্তিসঙ্গত হলেও মার্সেডিস স্লেজের উপর থেকে নেমে মাটিতে পদার্পণ করতে রাজি হল না।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। বহু চেষ্টাতেও কয়েকদিন পর কুকুরের দল অচল স্লেজটাকে সচল করতে পারল না। তখন হাল আর চার্লস দুজনে মিলে স্লেজের উপর থেকে তুলে এনে মাটির উপর দাঁড় করিয়ে দিল মাসের্ভিসকে। মেয়েটি এবার বসে পড়ল বরফের উপর, সে হাঁটতে রাজি নয়। চালর্স আর হাল তাকে ফেলে রেখেই অগ্রসর হল। প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে আসার পরেও তারা যখন পিছন ফিরে মার্সেডিসকে দেখতে পেল না, তখন বাধ্য হয়েই ফিরে এসে মেয়েটিকে তারা আবার স্লেজের উপর তুলে নিল।
অবশেষে ফুরিয়ে গেল খাদ্য। সেই অবস্থাতেও বাক স্লেজ টানতে চেষ্টা করছিল প্রাণপণে। তার শরীরের চামড়া ঝুলে পড়ল, পাঁজরের হাড়গুলো ঠেলে বেরিয়ে এল, লোমগুলো ঝুলে পড়ল অথবা হাল-এর মগুরের আঘাতে রক্তাক্ত স্থানগুলিতে শুষ্ক রক্তের সঙ্গে জট বেঁধে ঝুলতে লাগল। দলের অন্য কুকুরগুলোর অবস্থাও ভালো নয়, তাদের দিকে এক নজর তাকালেই মনে হত অনেকগুলো কঙ্কাল হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে। একজনের পর একজন তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল। যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি দিতে ধরাশায়ী কুকুরগুলোকে গুলি করতে বাধ্য হল হাল।
হতাবশিষ্ট দলটার মধ্যে ছিল বাক আর চারটি কুকুর। হোয়াইট রিভার নামে একটা নদীর ধারে এসে দলটা থামল। সেটা বসন্তকাল, গাছগুলো বরফের চাপে নুয়ে পড়ছিল, ফাঁক হয়ে যাচ্ছিল মাটির উপর বরফের চাঙড়, কখনো বা মাটিতে পড়ে থাকা বরফের আবরণ সশব্দে ফেটে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল মারাত্মক মৃত্যুফঁদের মতো সুগভীর গহ্বর।
যে তাঁবুটার পাশে কুকুরের দল নিয়ে স্লেজ থামাল হাল ও চার্লস, সেই তাবুর অধিকারী ছিল একটি মাত্র মানুষ। ওই মানুষটি একটি গাছের গুঁড়ির উপর বসে কুঠারের হাতল তৈরি করছিল নিবিষ্টচিত্তে। কুকুররা শুয়ে পড়ল মড়ার মতো। মার্সেডিস যা করতে অভ্যস্ত তাই করছিল অর্থাৎ কাঁদছিল। তার দুই পুরুষ সঙ্গী পথশ্রমের ক্লান্তিতে টলছিল। বাক তার ক্লান্ত মাথাটা তুলে কুঠার তৈরিতে নিবিষ্টচিত্তে মানুষটির দিকে তাকাল এবং জীবনে সর্বপ্রথম জন থনৰ্টন নামে মানুষটিকে দেখতে পেল।
.
১৯. উদ্ধার পেল বাক
ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে তিনটি নরনারীকে জরিপ করে নিল থর্নটন। একনজর তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল নবাগতরা নিতান্তই আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ, কিন্তু অতিশয় উদ্ধতা হাল যখন বরফের অবস্থা কেমন জানতে চাইল, থর্নটন সংক্ষেপে জবাব দিল, খুব খারাপ।
হাল-এর ওষ্ঠাধারে ফুটল তাচ্ছিল্যের হাসি, দুদিন আগেও লোকের মুখে ওই কথা শুনেছি। পথের উপর বরফ নাকি ধসে যাচ্ছে বসে যাচ্ছে। কয়েকটা লোক বলেছিল আমরা এই রাস্তা ধরে এগোলে হোয়াইট রিভার পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না। যত বাজে কথা- এই তো আমরা জমাট বরফের উপর দিয়ে এখানে পৌঁছে গেছি।
লোকগুলো ঠিকই বলেছিল, থর্নটন গম্ভীরভাবে বলল, যে-কোনো সময়ে বরফ ভেঙে পড়তে পারত। মুখ ও নির্বোধকে মাঝে মাঝে ভাগ্য কৃপা করে সেই ভাগ্যের কৃপাতেই মত্যকে ফাঁকি দিয়ে তোমরা এখানে উপস্থিত হতে পেরেছ। কিন্তু এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত। নয়। তোমরা আর এগিও না, বিপদ ঘটতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। আলাস্কার সমস্ত সোনা আমাকে ঢেলে দিলেও আমি ওই পথে পা বাড়াব না।
আমাদের নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না, হাল-এর কণ্ঠে বিদ্রুপের আভাস, কিছু কিছু লোকের সাহস একটু বেশি বিপদের মুখে এগিয়ে যেতে তারা ভয় পায় না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো আমরা নির্ঘাত ডসনে পৌঁছে যাব নিরাপদে।
এবার চাবুক উঁচিয়ে সে স্লেজবাহক কুকুরদের ছুটতে আদেশ করল। ধরাশয্যা ত্যাগ করে কেউ উঠে দাঁড়াতে রাজি হল না। হাল সজোরে চাবুক হাঁকাতে লাগল কুকুরদের উপর। প্রথমে উঠে দাঁড়াল সোল-লেকস– অতিকষ্টে। জো দুবার উঠতে চেষ্টা করেও সফল হল না, তৃতীয় বারের চেষ্টায় সে উঠে দাঁড়াল। বাক ওঠার চেষ্টা করল না, পড়ে পড়ে মার খেতে লাগল। একটি অপরিচিত মানুষের সামনে বাক-এর অবাধ্য আচরণ হালকে ক্ষিপ্ত করে তুলল, চাবুক ছেড়ে সে ধরল মুগুর! কিন্তু মুগুরের প্রচণ্ড আঘাতকেও অগ্রাহ্য করে বাক শুয়ে রইল, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না একবারও। খুব দুর্বল হয়ে পড়লেও বাক অন্য কুকুরদের মতো স্লেজ টানতে পারত। তবু সে উঠে দাঁড়ায়নি, তার কারণ, তীব্র অনুভূতি দিয়ে বুঝেছিল তুষারে ঢাকা ওই পথ মৃত্যুর পথ, ওই পথে পা দিলে মৃত্যু নিশ্চিত তাই মুগুরের প্রচণ্ড আঘাত উপেক্ষা করেও সে শুয়ে রইল, উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল না।
হাল-এর মুগুর পড়তে লাগল সর্বাঙ্গে, ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল বাক-এর দৃষ্টি, শরীর এমন অবশ ও অসাড় হয়ে গেল যে, আঘাতের যন্ত্রণাও সে আর বোধ করতে পারছিল না— বাক বুঝতে পাল তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে…
আচম্বিতে এক তীব্র জান্তব ধ্বনি সকলকে চমকে দিল- ওই ভীষণ অমানুষিক চিৎকার বেরিয়ে এসেছে থর্নটনের গলা থেকে এক লাফে এগিয়ে এসে এক প্রচণ্ড ঘুসি বসাল সে হাল-এর মুখের উপর ছিটকে ধরাপৃষ্ঠে লম্ববান হল হাল।
বাককে আড়াল করে দাঁড়াল থর্নটন, ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আর-একবার যদি কুকুরটাকে তুমি আঘাত করো, তাহলে আমি তোমাকে খুন করব।
এটা আমার কুকুর, নাক থেকে রক্ত মুছে ফেলে উঠে দাঁড়াল হাল, সরে যাও আমার সামনে থেকে। আমি এখনই ডসনের পথে রওনা দেব।
তবুও বাককে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল থর্নটন। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হাল এইবার খাপ থেকে টেনে নিল ছুরি। যে-গাছের ডাল থেকে কুঠারের হাতল তৈরি করছিল থর্নটন, সেটা তার হাতেই ছিল- কবজির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে সেই হাতলটা দিয়ে হাল-এর মুঠিতে আঘাত করে সে ছুরিটা মাটিতে ফেলে দিল। তৎক্ষণাৎ ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার হাল আঘাত হানতে চেষ্টা করল। কুঠারের হাতল এবার মুঠির উপর এত জোরে পড়ল যে, যন্ত্রণায় হাল-এর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল এবং অবশ হাতের মুঠি থেকে আবার ছিটকে পড়ল ছুরি। এবার ছুরিটাকে হস্তগত করল থর্নটন, তারপর বাক-এর শরীর থেকে সাজ-সরঞ্জাম কেটে ফেলে আবার ছুরিটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে।
হাল-এর আর লড়াই করার মতো উৎসাহ বা ক্ষমতা ছিল না। নিঃশব্দে ছুরি, চাবুক আর মুগুর কুড়িয়ে নিয়ে সে স্লেজটাকে চার্লিয়ে দিল। কুকুরগুলো স্লেজ টানতে ইচ্ছুক ছিল না; বাধ্য হয়েই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুর্বল শরীরে অতিকষ্টে স্লেজ টানতে লাগল নদীর বুকে জমাট বরফের উপর দিয়ে।
স্লেজ চলার শব্দে মুখ তুলে তাকাল বাক– দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের আগে এগিয়ে চলেছে পাইক, সকলের পিছনে রয়েছে সোল-লেকস এবং ওই দুজনের মাঝখানে অবস্থান করছে জোর আর টিক– সব কয়টা কুকুরই টলছে আর খোঁড়াচ্ছে। তাদের দুরবস্থা দেখেও হাঁটতে সম্মত হয়নি মাসের্ডিস। চেপে বসেছে স্লেজের উপর। স্লেজের পিছনে গী-পোল নামে যে বক্রাকার বস্তুটি অবস্থান করে, সেই বস্তুটির সাহায্যে স্লেজগাড়িটিকে চালনা করছে হাল সকলের পিছনে স্খলিতচরণে এগিয়ে চলেছে চার্লস।
আচম্বিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল জমাট বরফ, মার্সেডিসের আর্তস্বর শোনা গেল একবার পরক্ষণেই স্লেজসমেত দুটি নরনারী ও চারটি কুকুরকে নিঃশেষে গ্রাস করে আত্মপ্রকাশ করল এক সুগভীর গহ্বর!
নদীবক্ষ থেকে পিছন ফিরে নদীতীরে ফিরে আসতে সচেষ্ট হল চার্লস- তার চেষ্টা সফল হল না, অনেকটা জায়গা নিয়ে ভেঙে পড়ল জমাট বরফ- সেই ভেঙে পড়া জমাট বরফের ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল চার্লস! যেখানে এক মুহূর্ত আগেও ছিল জমাট বরফের নিরেট পথ, এখন সেখানে অবস্থান করছে তরল জলধার!
জন থর্নটন আর বাক পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। থর্নটন বলল, আহা বেচারা! খুব বেঁচে গেছ তুমি!
বাক তার নতুন বন্ধুর হাত চেটে দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাল।
২০. বাক ও জন থর্নটন
জন থর্নটন ছিল স্লেজচালক। স্লেজ চালনাই ছিল তার পেশা। সাধারণত পেশাদার স্লেজচালকদের তাঁবুতে থাকে অনেক কুকুর এবং তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চালনা করার জন্য দুই কি তিনজন অভিজ্ঞ মানুষ। কিন্তু থর্নটনের তাঁবুতে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। নিদারুণ শীত তার পা দুটিকে সাময়িকভাবে অসাড় করে দিয়েছিল বলেই কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে ওই অঙ্গ দুটিকে আবার সচল করে নিতে মনস্থ করেছিল সে। তার দুই অংশীদার ডসন থেকে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে, তাদের জন্যই পূর্বে উল্লিখিত হোয়াইট রিভার নামক নদীর ধারে সে অপেক্ষা করছিল ইতিমধ্যে অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল আমাদের কাহিনির নায়ক বাক!
বাক যখন থর্নটনের জীবনে এল, তখনও একটু খুঁড়িয়ে চলে থর্নটন। তার পায়ের মাংসপেশিতে সাড় এসেছে বটে, কিন্তু এখনও সে আগের শক্তি ফিরে পায়নি। বাক এতদিন যথেষ্ট অনাচার অত্যাচার সহ্য করেছে, তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে থর্নটনের সান্নিধ্যে এসে সর্বপ্রথম বিশ্রামলাভের সুযোগ পেল সে। নদীর ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল চতুষ্পদ বাক ও দ্বিপদ থর্নটন।
ধীরে ধীরে আবার আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেল বাক। ফ্যাকাশে চামড়া আবার উজ্জ্বল হল, যেখানে হাড় দেখা যাচ্ছিল সেখানে দেখা দিল সাবলীল পেশীর তরঙ্গ।
জন থর্নটনের তাঁবুতে এসে আরও দুটি কুকুরের সঙ্গে পরিচিত হল বাক স্কীট ও নিগ। নিগ হচ্ছে ছোটোখাটো চেহারার আইরিশ সেটার, আর নিগ নামক কুকুরটি ব্লাড হাউন্ড ও ডিয়ার হাউন্ড নামক দুই বিভিন্ন জাতীয় কুকুরের সংমিশ্রণে তৈরি এক অতিকায় জীব। বিপুল দেহ এবং প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হলেও নিগ ছিল খুব শান্তশিষ্ট, বাককে সে সহজেই বন্ধু হিসাবে মেনে নিল। স্কীট ছিল মেয়ে কুকুর, জননীর স্নেহে সে গ্রহণ করল বাককে, তার আহত ক্ষতস্থানগুলিকে সে চেটে চেটে পরিচর্যা করতে লাগল। কয়েকদিনের মধ্যে স্কীট-এর জান্তব চিকিৎসার ফল পাওয়া গেল, সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করল বাক।
বাক অবাক হয়ে দেখল থর্নটন তার কুকুরদের সঙ্গে ছেলেমানুষের মতো ছুটোছুটি করে এবং নিত্য-নতুন খেলা আবিষ্কার করে চমকে দেয় সবাইকে। বিচারক মিলারকেও বাক পছন্দ করত বটে, কিন্তু থর্নটনের স্নেহ-ভালোবাসা তাকে অভিভূত করে ফেলল, এমন তীব্র আবেগ ও আকর্ষণ ইতিপূর্বে কারও জন্যেই অনুভব করেনি বাক, বোধহয় এমন একজন প্রভুর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করছিল সে।
অবশেষে থর্নটন যাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তারা এসে উপস্থিত হল- হানস ও পিট, জন থর্নটনের দুই অংশীদার। স্কীট আর নিগ যেভাবে থর্নটনের হাতের তলায় মাথা গলিয়ে আদর পেতে চাইত, ঠিক সেইভাবেইনবাগতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল তারা। তাদের আশা অবশ্য অপূর্ণ থাকেনি। থর্নটনের মতোই কুকুর দুটিকে আদর করত হানস আর পিট। কিন্তু বাক নতুন মানুষদের কাছে ভিড়ল না। সে বুঝেছিল এই মানুষ দুটি তার মনিবের বন্ধু, তাই তাদের সান্নিধ্য সে সহ্য করত– কিন্তু তার সমস্ত অনুরাগ ও ভালোবাসা ছিল থর্নটনের জন্য। সে প্রভর কাছে আদর পেতে চাইত না, থর্নটনের পাশে চুপচাপ বসে তার মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রভুর মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করত। সেই নিমেষহীন দৃষ্টি আকর্ষণে থর্নটন মুখ ফিরিয়ে চাইত, কয়েক মুহূর্তের জন্য তাদের দৃষ্টি বিনিময় ঘটত এবং চোখে চোখে ফুটত পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা…
হ্যাঁ, সুখী হয়েছিল, খুব সুখী হয়েছিল বাক থর্নটনের কাছে এসে, তবু রক্ত-জমানো ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে অগ্নিশিখার চঞ্চল নৃত্যের মধ্যে বাক যেন প্রত্যক্ষ করত তার পূর্বপুরুষদের তাকে যেন আহ্বান করে আদিম অরণ্য। যেখানে ঘুরে বেড়ায় নেকড়ের মতো হিংস্র বুনো কুকুরের দল… বহু যুগের ওপার হতে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের আদিম অরণ্য যেন তাকে টানতে থাকে অমোঘ আকর্ষণে…
.
২১. বিখ্যাত হল বাক
যে-সময়ের কথা বলছি, সেইসময় উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসছিল সোনার সন্ধানে। পার্বত্য নদীর তীরভূমিতে বালির উপর প্রবাহিত জলস্রোত ছড়িয়ে দেয় স্বর্ণরেণু, বালুকামিশ্রিত ওই স্বর্ণরেণু পাত্র বোঝাই করে পরীক্ষার পর খাঁটি নির্ভেজাল সোনার গুঁড়ো অন্বেষণকারীর হস্তগত হয়। যথেষ্ট অর্থ ছিল না বলে তারা ডসন শহরে ফিরে গেল– যদি কোনোরকমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আবার সোনার সন্ধানে তারা অভিযান শুরু করতে পারে, না হলে অর্থাভাবে সমস্ত পরিকল্পনা হবে নষ্ট…
ডসন শহরে পৌঁছে একটি পানাগারে ঢুকল থর্নটন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে উদ্দেশ্য, তৃষ্ণা নিবারণ। বাক সর্বদাই থর্নটনকে অনুসরণ করত, পানাগারের মধ্যেই এক জায়গায় শুয়ে সে প্রভুর উপর নজর রাখছিল।
ব্ল্যাক বার্টন নামে একটা লোক ওই সময় পানাগারের ভিতর মদ্যপান করছিল। বার্টনের দেহে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। স্বভাবেও সে ছিল অত্যন্ত কলহপ্রিয় সর্বদাই সে মারামারির সুযোগ খুঁজত। পানাগারের মধ্যে সে একটি নিরীহ ছোকরার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিল। ছোকরা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল, কোনো অপরাধ না করেও সে ক্ষমা চাইতে লাগল কাচুমাচু হয়ে। বার্টন ছাড়ার পাত্র নয়, সে ছেলেটিকে রূঢ়ভাবে এক ধাক্কা মারল।
ঠিক সেইসময়ে অকুস্থলে প্রবেশ করেছিল জন থর্নটন। সে অন্যায় সহ্য করতে পারত না, বিনাদোষে ছেলেটিকে নিগৃহীত হতে দেখে দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে বার্টনকে নিবৃত্ত করতে চাইল। খুব শান্তভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল থর্নটন, তাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল বার্টন, বিনা বাক্যব্যয়ে সে ঘুসি বসিয়ে দিল থর্নটনের মুখে। ঘুসিটা এমন জোরে পড়েছিল যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে পড়তে কোনোরকমে একটা টেবিল আঁকড়ে ধরে পতন থেকে আত্মরক্ষা করল থটন।
বার্টন আর থর্নটনের কাছাকাছি যে মানুষগুলো ছিল তাদের কানে এল একটা ভয়ংকর জান্তব শব্দ- আওয়াজটা কুকুরের গলার আওয়াজের মতো হলেও উপস্থিত জনমণ্ডলী কোনো কুকুরের গলা থেকে অমন ভয়ংকর শব্দ বেরিয়ে আসতে শোনেনি। পরবর্তীকালে দর্শকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ওই চিৎকারের শব্দকে গর্জনধ্বনি বলেই বর্ণনা দিয়েছিল।
লোকগুলো দেখল একটা প্রকাণ্ড কুকুর মাটি থেকে সগর্জনে লাফিয়ে উঠে যেন শূন্যপথে উড়ে এল বার্টনের গলা লক্ষ্য করে। হাত দিয়ে গলা আড়াল করে কোনোমতে প্রাণ বাঁচাল বার্টন, কিন্তু বাক-এর গুরুভার দেহের আঘাতে সে ছিটকে ধরাশায়ী হল। শত্রুর হাতটাকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তার গলায় কামড় বসাতে উদ্যত হল বাক। সেদিন বার্টনের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত কেবল আশেপাশে অবস্থিত লোকজনের হস্তক্ষেপে বার্টন প্রাণে বেঁচে গেল। প্রথমে সকলেই হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপরেই তাদের সংবিৎ ফিরে এল। সবাই মিলে বাককে বার্টনের দেহের উপর থাকে তাড়িয়ে দিল নিরাপদ দূরত্বে। একজন চিকিৎসককে ডেকে আনা হল। চিকিৎসক যখন বার্টনের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করছিলেন, সেইসময় দণ্ডায়মান জনতার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে আবার বার্টনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল বাক।
তৎক্ষণাৎ শুরু হল বিচার জনতার আদালতে। কুকুরের পক্ষে মানুষকে আক্রমণ করা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হয়। আদালতের বিচারে বাক নিরপরাধ সাব্যস্ত হল- সে যা করেছে, ঠিক করেছে! এক মুহূর্তের মধ্যে নগণ্য অবস্থা থেকে বাক হয়ে গেল হিরো!
উত্তরাঞ্চলের মানুষ কুকুর ভালোবাসে। কুকুর তাদের প্রিয় আলোচ্য বিষয়। প্রভুর পক্ষ নিয়ে বার্টনের উপর বাক-এর আক্রমণজনিত ঘটনা তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছিল। অনেক সময় জন থর্নটন বাককে সমর্থন করতে বাধ্য হত তার নিজস্ব সম্মানরক্ষার তাগিদে।
একদিন কুকুর নিয়ে আলোচনা করতে করতে এক ব্যক্তি জানাল তার কুকুর পাঁচশো পাউন্ড ওজনের জিনিসপত্র-বোঝাই স্লেজ টানতে পারে। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানাল তার কুকুর টানতে পারে ছয়-শো পাউন্ড। তৃতীয় ব্যক্তি সগর্বে ঘোষণা করল তার কুকুরটি অনায়াসে সাত-শো পাউন্ড টানতে সমর্থ। তারপর তিনজনই ফিরে তাকাল থর্নটনের দিকে, অর্থাৎ তারা জানতে চায় থর্নটনের কুকুরের ক্ষমতার বহর কতটা।
লোক তিনটির কথা আর তাকানোর ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ ছিল স্পষ্ট। দারুণ উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত করে থর্নটন বলে উঠল, ওইসব ওজন ধার্তব্যই নয়। আমার বাক হাজার পাউন্ড নিয়ে চলতে পারে।
শ্রোতাদের দৃষ্টিতে ফুটল অবিশ্বাস, একজন বলল, কী বলছ তুমি? বরফে জমে থাকা স্লেজের রানার টেনে হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে তোমার কুকুর?
থর্নটন দৃঢ়ভাবে জানাল তার কুকুর ওই কাজ করতে সমর্থ।
ঠিক আছে, ম্যাথসন নামে যে লোকটি জানিয়েছিল তার কুকুর সাতশো পাউন্ড টানতে পারে, সে বলল, আমার কাছে হাজার ডলার আছে। এই হাজার ডলার বাজি রেখে আমি বলছি তোমার কুকুর হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে চলতে পারবে না।
সোনার গুঁড়োতে ভর্তি একটা চামড়ার থলি সশব্দে টেবিলের উপর রাখল ম্যাথসন।
বিপদে পড়ল থর্নটন। মাল বহন করতে সে বাককে দেখেনি কখনো, তাই বাক-এর বহন ক্ষমতা সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। থর্নটন আর তার দুই অংশীদারের সম্বল মাত্র দু-শো ডলার। হাজার ডলারের বাজিতে টক্কর দিতে হলে তাদের কাছেও হাজার ডলার থাকা দরকার এখন উপায়? একেবারে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি হওয়ার উপক্রম হল যে!
উপায় হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়েছিল থর্নটনের বন্ধু জিম ওব্রায়েন। সে অতিশয় সদাশয় ধনী ব্যক্তি, থর্নটনকে হাজার ডলার ঋণ দিতে সে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
মৃদু হেসে ম্যাথসন বলল, বাইরে আমার কিছু ময়দা আছে। বিশ থলে ভরতি ময়দা। প্রতি থলের ওজন পঞ্চাশ পাউন্ড। এবার বাইরে গিয়ে দেখব তোমার আশ্চর্য কুকুর হাজার পাউন্ডের থলেগুলো কেমন টানতে পারে।
সমবেত জনতার কৌতূহল এখন তুঙ্গে। একটা কুকুর হাজার পাউন্ড টেনে ছুটতে পারে এমন কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
বহু মানুষের চোখের সামনে এবার বাককে নিয়ে আসা হল। ময়দা-ভরতি থলেগুলো টানার জন্য যে দশটি কুকুরকে স্লেজের সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়েছিল, তাদের বাঁধন খুলে দিয়ে সেখানে দশের পরিবর্তে একটিমাত্র কুকুরকে যুক্ত করা হল– বাক!
তার উজ্জ্বল রোমশ দেহের পেশীপুষ্ট সৌষ্ঠব দর্শকদের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি লোক জানাল এখনই আটশো ডলার দিয়ে সে বাককে কিনে নিতে ইচ্ছুক প্রতিযোগিতায় বাক হারল কি জিতল তা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে চায় না।
থর্নটন লোকটির কথার জবাব দিল না। হাত নেড়ে তাকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে সে হাঁটু পেতে বসল বাক-এর পাশে, দুই হাতে তার মাথাটা ধরে মুখের উপর নিজের গাল চেপে ধরে থটন বলল, টানো বাক। যদি আমায় ভালোবাসো, তাহলে সমস্ত শক্তি দিয়ে টানো।
উত্তরে থর্নটনের হাত কামড়ে ধরল বাক। তার ভীষণ ধারাল দাঁতগুলো রেশমের মতো হালকাভাবে স্পর্শ করল রক্ত বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা, হাতের উপর একটা আঁচড় পর্যন্ত পড়ল না। নিজস্ব ভাষায় নীরব থেকেই বাক জানিয়ে দিল সে প্রভুকে ভালোবাসে, তার আদেশ পালন করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পিছিয়ে এসে এবার থর্নটন আদেশ দিল, চালাও!
বাক সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডানদিকে ফিরল, স্লেজের উপর ময়দা থলেগুলো কেঁপে উঠল ঝাঁকুনির বেগে এবং স্লেজের তলেদেশে অবস্থিত রানারের তলা থেকে বরফ ভেঙে পড়ার শব্দ ভেসে এল।
হা! আবার হুকুম দিল থর্নটন। আগের মতোই শরীরটাকে চালনা করল বাক- এইবার বাঁদিকে। বরফ ভাঙার মৃদু শব্দ এবার আরও জোরে বেজে উঠল। রানার দুটিও হড়কে সরে এল বাক-এর প্রবল আকর্ষণে স্লেজের রানার এখন বরফের কঠিন আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়েছে!
এইবার এল শেষ নির্দেশ মাশ!
সামনে ঝুঁকে পড়ল বাক লাগামে টান পড়ে সেটা শক্ত হয়ে এঁটে বসল বাক-এর শরীরে। তার প্রকাণ্ড বুক নেমে এল মাটির দিকে, মাথা উঠল উর্ধ্বে এবং নখের আঁচড়ে জমাট তুষার উড়তে লাগল চারদিকে।
অচল স্লেজ সচল হল! হাজার পাউন্ড ওজন নিয়ে সেটা খুব ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আধা ইঞ্চি… এক ইঞ্চি… দুই ইঞ্চি… প্রতি ঝাঁকুনির সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে চলল স্লেজ… গতি আরও বাড়ল… এখন আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে না বাক, স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছে সে, তার পিছনে লাগামে বদ্ধ স্লেজও এগিয়ে চলেছে সহজভাবে স্বচ্ছন্দ গতিতে।
অনেকগুলো কাটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে একশো গজ দুরের সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছিল, অনায়াসে সেই সীমা পার হয়ে গেল বাক! দণ্ডায়মান জনতা সোল্লাসে চিৎকার করে বাককে অভিনন্দন জানাল, শুন্যে উড়তে লাগল টুপি আর দস্তানা! থর্নটন নিচু হয়ে বাক-এর গলা জড়িয়ে আদর জানাতে লাগল, আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর, ওরে বাক, ওরে হতভাগা, ওরে শয়তান জানোয়ার!
হঠাৎ বাধা পড়ল। যে লোকটি প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে আটশো ডলারের বিনিময়ে বাককে কিনে নিতে চেয়েছিল, সে এগিয়ে এসে থর্নটনকে বলল, আমি বারোশো ডলার দিতে প্রস্তুত, কুকুরটা আমাকে দাও।
মাথা নেড়ে থর্নটন বলল, আমি বরং দাসব্যবসায়ীর কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেব। কিন্তু এই কুকুরটা আমি বিক্রি করব না। দয়া করে আমাকের বারবার বিরক্ত করো না।
পূর্বোক্ত ঘটনার পরেই সমগ্র উত্তরাঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে গেল থর্নটনের কুকুর- বাক!
.
২২. বনবাসী বন্ধু
আশেপাশে দাঁড়ানো আরও অনেক দর্শক বাক-এর বিরুদ্ধে বাজি ফেলেছিল– প্রথমেই হাজার ডলার বাজি ফেলেছিল ম্যাথসন পরে তার পক্ষে ও থর্নটনের বিপক্ষে বাজি পড়েছিল আরও ছয়শো ডলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওই ষোলোশো ডলার জিতে নিল বাক! নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে হঠাৎ ধনী হয়ে গেল জন থর্নটন!
থর্নটন, পিট ও হানস স্থির করল আর মালবহন নয়। এবার সোনার সন্ধানে যাত্রা করবে তারা। টাকার অভাব ছিল না, চটপট কিনে ফেলা হল ছয়টি নতুন কুকুর আর প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম– তারপর মহা-উৎসাহে তারা স্লেজ চার্লিয়ে যাত্রা করল সোনার সন্ধানে।
তাড়াহুড়ো করে নয়। খুব ধীরে ধীরে তারা অগ্রসর হল। তারা স্লেজটাকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করেনি, স্লেজে ছিল সোনা খোঁজার জন্য নিতান্ত দরকারি কিছু যন্ত্র ও অস্ত্রশস্ত্র। খাদ্যের জন্য তারা শিকার করত অথবা নদীর জল থেকে মাছ ধরতে সচেষ্ট হত। সবসময় যে তাদের চেষ্টা সফল হত তা নয়; বনের পশু বা নদীর মাছ যখন বন্দুক অথবা ছিপের মুখে আত্মসমর্পণ করত না, তখন কুকুরের দল ও তাদের প্রভুদের উপবাসী থাকতে হত- ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে প্রচুর মৎস্য ও মাংসে ক্ষুধা নিবারণ করত তারা। এই জীবন ছিল বাক-এর কাছে দারুণ আনন্দের মাঝে মাঝে উপবাসী থাকলেও একঘেয়ে স্লেজবাহকের জীবনযাত্রার চাইতে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ছিল তার কাছে অনেক বেশি আকর্ষক, অনেক বেশি আনন্দদায়ক।
অবশেষে একসময়ে একটি পার্বত্য নদীর জলধারার মধ্যে তারা সোনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করল। ছোটো ছেটো পাত্র নিয়ে নদী থেকে প্রতিদিন তারা সে জল তুলে আনত, সেই জল থেকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিদিনই তারা সংগ্রহ করত হাজার হাজার ডলারের সোনা। চামড়ার থলেগুলো সোনা-ভর্তি করে জ্বালানি কাঠের মতোই একজায়গায় ফেলে রাখা হত। ক্রমে ক্রমে ওই সোনা-ভরতি থলের স্তূপ একদিন উচ্চতায় বাক-কে ছাড়িয়ে গেল।
দু-এক সময়ে খাদ্যসংগ্রহের তাগিদে থর্নটন যখন শিকারে যেত, তখন বাক হত তার সঙ্গী। কিন্তু শিকার অভিযানের ওই সময়টুকু ছাড়া বাক-এর কিছু করার ছিল না। অধিকাংশ সময়েই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে সুদূর অতীতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত বাক– একটি রোমশ মানুষ গাছের উপর বিশ্রামরত, আর সেই গাছের তলায় অতন্দ্র প্রহরায় জাগছে একটি জন্তু ওই জন্তুটি কি বাক? বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে-আসা পূর্বজন্মের স্মৃতি কি তাকে চঞ্চল করে তোলে মাঝে মাঝে?… হঠাৎ ভেসে আসত দূর-দূরান্ত থেকে জান্তব কণ্ঠের বিষণ্ণ সংগীত– নেকড়ের চিৎকার! সেই বিষঃ জান্তব কণ্ঠস্বর যেন তাকেই আহ্বান করছে! শব্দ লক্ষ্য করে বাক ছুটত, কিন্তু কোনোদিনই শব্দের উৎস যার কণ্ঠে, তাকে খুঁজে পেত না…।
এক রাতে গভীর নিদ্রার মধ্যেই সেই তীব্র করুণ শব্দ শুনতে পেল বাক, সঙ্গেসঙ্গে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যের বুকে, তারই ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাক- ঝোপের আড়াল থেকে সে দেখতে পেল একটি কৃশকায় নেকড়ে, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে, তার মুখ উঁচু হয়ে আছে আকাশের দিকে!
ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল বাক। তাকে দেখেই ছুটে পালাল নেকড়ে। পিছনে ছুটল বাক। একসময়ে নেকড়ে ঘুরে দাঁড়াল, হিংস্র দন্ত বিকাশ করে জানিয়ে দিল যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত। বাক আক্রমণ করল না। সে নেকড়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুত্ব জানানোর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করল। নেকড়ে কিন্তু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বাককে লক্ষ করছিল, সহজে সে বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। অবশেষে বাক-এর ভাবভঙ্গিতে আশ্বস্ত হল নেকড়ে, সে বাককে কাছে এগিয়ে আসতে দিল– গৃহপালিত কুকুর ও বনবাসী নেকড়ে পরস্পরের নাকে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ গ্রহণ করল অর্থাৎ পশুজগতের নিয়ম অনুসারে তারা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল।
নেকড়ে আর বাক কিছুক্ষণ খেলা করার পর হঠাৎ খেলা ফেলে নেকড়ে ছুটতে শুরু করল। তার আচরণে সে বুঝিয়ে দিল বাক তার সঙ্গী হলে সে খুশি হবে। নেকড়ের সঙ্গ নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাক-এর মনে হল এইভাবে সে আগেও ছুটেছে। নেকড়ের ছোটার ভঙ্গিতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে সে যাচ্ছে। বাক ভাবল ওই নির্দিষ্ট স্থান থেকেই বোধহয় দূরাগত আহ্বান তার কানে এসেছে বারংবার ওই আহ্বান বন্য প্রকৃতির আহ্বান, অরণ্যের আহ্বান!
একটি ছোটো জলাধারের পাশে এসে থামল তারা, সেইখানে তৃষ্ণা নিবারণ করল আর হঠাৎ তখনই বাক-এর মনে পড়ল তার প্রভু থর্নটনের কথা সে বসে পড়ল। নেকড়ে আবার ছুটতে শুরু করল, কিন্তু এইবার বাক তাকে অনুসরণ করতে রাজি হল না। নতুন বন্ধুর এই হঠাৎ পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে গেল নেকড়ে, সে বারবার বাক-এর কাছে এসে মৃদু শব্দে তার সঙ্গ নিতে অনুরোধ জানাল– তবু বাক ফিরল না। অবশেষে পিছনের দুই পায়ের উপর বসে পড়ল নেকড়ে, আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠল তীব্র তীক্ষ্ণ করুণ স্বরে। বাক তার আস্তানার দিকে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল সেই বিষঃ শব্দের ঝংকার ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে এবং একসময়ে সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে গেল সম্পূর্ণভাবে…
.
২৩. আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ
দুই দিন দুই রাত তাবু ছেড়ে বাইরে গেল না বাক। ওই সময়ের মধ্যে একবারও থর্নটনকে সে চোখের আড়াল করেনি। কিন্তু তারপর আবার অস্থির হয়ে পড়ল সে, প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে লাগল অরণ্যের অদম্য আকর্ষণ। তবুর আশ্রয় ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যেই সে ঘুমাত প্রতি রাত্রে। পর পর কয়েকটা দিন সে কাটিয়ে দিল অরণ্যের অন্তঃপুরে। ওই সময়ে শিকার করে সে পেট ভরাত আর খুঁজে ফিরত তার নতুন-পাওয়া নেকড়ে বন্ধুকে।
বনের মধ্যে বন্য পশুর মতোই চলাফেরা করত বাক। এমন নিঃশব্দে ছায়ার মতো সে বিচরণ করত যে, জলের ভিতর থেকে সে মাছ তুলে আনতে পারত অতর্কিতে। এর মধ্যে একটা বৃদ্ধ মুগ্ধ হরিণকে সে শিকার করল। কাজটা খুব সহজ হয়নি, দলের ভিতর থেকে তাড়িয়ে ওই হরিণটিকে আলাদা করে সে একসময়ে কোণঠাসা করে ফেলল– তারপর বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করার পর সে হরিণটাকে হত্যা করতে সমর্থ হল। হরিণটাকে মারার পরে আবার নিজস্ব আস্তানার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করল এবং ঘরের দিকে ফিরল।
তাঁবু থেকে তিন মাইল দূরে বাক যখন এসে পড়েছে, সেই সময়ে একটা গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে তাকে বিচলিত করে তুলল। গন্ধ অনুসরণ করে সে সতর্কচরণে অগ্রসর হল। কিছুক্ষণ পরেই সে উপস্থিত হল একটা ঝোপের মধ্যে, যেখান থেকে ভেসে আসছে ওই গন্ধ। সেইখানেই সে নিগ নামে কুকুরটার তিরবিদ্ধ মৃতদেহ দেখতে পেল।
তাঁবুর ভিতর থেকে বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান-সংগীত ভেসে এল বাক-এর কর্ণকুহরে। বাক গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য
সোনা-ভরতি থলেগুলোর সামনে পড়ে আছে হানস, তার শরীরে বিঁধে রয়েছে অনেকগুলো তির! বলাবাহুল্য, হানসের দেহে প্রাণ নেই। কাছেই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বিজয়নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠেছে ঈহাট নাম রেড-ইন্ডিয়ান জাতির একটা দল, মিলিত ঐকতান-সংগীতের রেশ ভেসে এসেছে তাদেরই কণ্ঠ থেকে!
বাক-এর সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে জেগে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধ ঝোপের ভিতর থেকে নর্তকদের লক্ষ্য করে সে ঝাঁপ দিলে সগর্জনে! একটা ভয়ংকর শব্দ ভেসে এল ঈহাটদের কানে, পরক্ষণেই বাক-এর ধারাল দাঁতের একটি মাত্র কামড়েই ছিঁড়ে গেল ঈহাট-সর্দারের কণ্ঠনালী! ব্যাপারটা কি ঘটছে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই আরও পাঁচজন ঈহাট তীক্ষ্ণ দস্তাঘাতে মৃত্যুবরণ করল। ঈহাটরা তাড়াতাড়ি তাদের ধনুক তুলে তির ছুড়ল। কিন্তু বাক এত তাড়াতাড়ি স্থান পরিবর্তন করছিল এবং ঈহাটরা এমন ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, নিক্ষিপ্ত তিরগুলো বাক-এর পরিবর্তে ঈহাটদের শরীরেই বিদ্ধ হল। বাক আক্রমণ করেছিল নির্ভুল লক্ষ্যে পর পর আরও কয়েকজন ঈহাট মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল বাক-এর ধারাল দাঁতের মারাত্মক আঘাতে। এইবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ঈহাটদের দলে, তারা পালাতে পালাতে চিৎকার করে বলতে লাগল একটা দুষ্ট আত্মা হানা দিয়েছে তাদের উপর… জঙ্গলের মধ্যে তাড়া করে আরও কয়েকজন ঈহাটকে হত্যা করল বাক…
বাক-এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে যারা জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, এক সপ্তাহ পরে একটি উপত্যকার ভিতর তারা নিখোঁজ সঙ্গীদের খুঁজে পেল আর সেখানে দাঁড়িয়েই তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করতে পারল।
তাঁবুতে ফিরে কম্বলের মধ্যে প্রাণহীন দেহে পিটকে শুয়ে থাকতে দেখল বাক। কিন্তু তার প্রিয় প্রভু কোথায়?..থর্নটনের গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে একটা ছোটো নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল বাক। একটা ভয়ংকর লড়াই-এর চিহ্ন ছিল নদীতীরে। থর্নটনের পদচিহ্ন নেমে গেছে নদীগর্ভে কিন্তু নদীর তীরে মাটির উপর তার ফিরে আসার চিহ্ন নেই।
বাক বুঝল, থর্নটন আর ফিরে আসবে না, তার মৃত্যু হয়েছে। সারাদিন বাক নদীর পারে বসে রইল, অথবা ঘুরে বেড়াল তাঁবুর আশেপাশে অশান্ত পদে। দুঃসহ ক্ষুধার মতো একটা যাতনাদায়ক অনুভূতি জেগে উঠেছে তার মধ্যে, কিন্তু খাদ্য দিয়ে সেই ক্ষুধার্ত অন্তরের শূন্যতাকে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন পায়চারি থামিয়ে সে ঈহাটদের মৃতদেহগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রিয় প্রভুকে হারানোর দুঃখ মুছে গিয়ে তার অন্তরে জেগে উঠছিল দৃপ্ত অহঙ্কার- পশুজগতে মানুষ শিকার নিষিদ্ধ, কিন্তু সেই নিষিদ্ধ জীব মানুষকেই হত্যা করেছে বাক!
.
২৪.অরণ্যের আহ্বান
এল রাত্রি। আকাশে দেখা দিল চাঁদ। অর্ধচন্দ্র নয়– সুবর্তুল আলোকপিণ্ডের মতো পূর্ণচন্দ্র। যে নদীর স্রোতের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে থর্নটনের দেহ, সেই নদীর পারে বসেছিল শোকে দুঃখে মুহ্যমান বাক।
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। বহুদূর থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ জান্তব ধ্বনি। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাগল আরও বহুকণ্ঠের মিলিত ঐকতান। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এসে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বেজে উঠল। বাক অনুভব করল অগ্নিকুণ্ডের নৃত্যচঞ্চল অগ্নিশিখার ভিতর দিয়ে যে বন্য দুনিয়ার আভাস তার মানসপটে ভেসে উঠেছে বারংবার সেই দুনিয়া তাকে ডাকছে, ডাকছে আর ডাকছে! আদিম অরণ্যের বন্য আহ্বান তাকে টানতে লাগল দুর্নিবার আকর্ষণে…
এমন প্রচণ্ড আকর্ষণ এর আগে কখনো অনুভব করেনি বাক, সে প্রস্তুত হল অরণ্যের আহ্বানে সাড়া দিতে– জন থর্নটনের মৃত্যু নিঃশেষে মুছে দিয়েছে বাক-এর সঙ্গে মানুষের সমস্ত সম্পর্ক..
কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী আর বৃক্ষ-সমাকীর্ণ বনভূমি পেরিয়ে বাক-এর অধিকৃত উপত্যকায় প্রবেশ করল নেকড়ের দল। চন্দ্রালোকে আলোকিত নিরেট রূপার ধাবমান স্রোতের মতো একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল নেকড়ে বাহিনী
পূর্বোক্ত ফাঁকা জায়গার ঠিক মাঝখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বাক- মৌন, গম্ভীর, নিশ্চল!
সেই মৌন গাম্ভীর্যে স্থির চতুষ্পদ প্রাণীটির অস্তিত্ব নেকড়ের দলে আতঙ্কের সঞ্চার করল। একটি মুহূর্ত, শুধু একটি মুহূর্তই স্থায়ী ছিল আতঙ্কের ছায়া, পরক্ষণেই দলের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী নেকড়েটা লাফিয়ে পড়ল দণ্ডায়মান জন্তুটার উপর। বিদ্যুঝলকের মতে আঘাত হানল বাক, ঘাড় ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুঃসাহসী নেকড়ে, তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। বাক তখনও নীরব, নিশ্চল– কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ংকর। আরও তিনটি নেকড়ে পরপর আক্রমণ করল তাকে, তিনজনই গলায় অথবা ঘাড়ে রক্তাক্ত ক্ষত নিয়ে পিছিয়ে এল। এবার আর একে একে নয়– সমস্ত দলটা মিলিত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে এল বাক-এর দিকে।
কিন্তু কার সাধ্য তার সামনে এগোয়? সামনে, পিছনে, ডাইনে, বায়ে বিদ্যুচ্চমকের মতো ঘুরতে ঘুরতে দলবদ্ধ আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল বাক- তার দুই চোয়ালের দুর্ভেদ্য প্রহরা এড়িয়ে কোনো নেকড়ে বাক-এর দেহ স্পর্শ করতে পারল না। খনি-মজুরদের খননকার্যের ফলে শুকনো নদীর খাঁড়িতে যেখানে খাড়া পাঁচিল তৈরি হয়েছিল, সেই পাঁচিলের তলায় পিঠ দিয়ে রুখে দাঁড়াল বাক- নেকড়ের দলের কোনো জন্তুকে সে তার পিছনে যেতে দিল না।
শুকনো খাড়ির খাড়া পার আর পাঁচিলের দেয়াল বাক-এর বাম, দক্ষিণ ও পশ্চাৎভাগ আড়াল করে রেখেছিল, শুধুমাত্র সামনের দিক ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে তাকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটল। বাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে বিজয়ী বীরের মতো। নেকড়ের দল তাকে অর্ধবৃত্তের আকারে ঘিরে রক্তাক্ত ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করছে, কেউ আর ওই ভয়ংকর জীবটির সামনে এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ একটি কৃশকায় দীর্ঘদেহী ধূসর বর্ণের নেকড়ে ধীরে ধীরে সতর্ক পদে এগিয়ে গেল বাক-এর দিকে, তার আচরণ বন্ধুর মতো। বাক-এর দুই চোখে পরিচয়ের আলো জ্বলে উঠল সে চিনতে পেরেছে ওই নেকড়েটাকে এরই সঙ্গে কিছুদিন আগে সে মিলিত হয়েছিল অরণ্যের গর্ভে, এরই সঙ্গে সে পাশাপাশি ছুটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নেকড়ে এগিয়ে এল, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল মৃদু কোমল স্বরের লহরী- একই রকম ভাবে কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্ব প্রকাশ করল বাক- তারপর পরস্পরের নাকে নাক লাগিয়ে দাঁড়াল তারা।
এবার এগিয়ে এল একটা বয়স্ক নেকড়ে। তার ক্ষতবিক্ষত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহন করছে বহু যুদ্ধের চিহ্ন। বাক তার নাকে নাক ঠেকাল। বয়স্ক নেকড়ে তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল। তার সঙ্গে যোগ দিল দলের অন্যান্য নেকড়ে। সাগ্রহে তাদের ঐকতানে যোগ দিল বাক।
বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে দেরি হল না নেকড়ে-বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটতে শুরু করল সে…
.
২৫. ভুতুড়ে কুকুর
জন থর্নটন ও তার সঙ্গীদের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যেই ঈহাট জাতীয় রেড-ইন্ডিয়ানরা লক্ষ করল বনবাসী নেকড়ের দলে একটা পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি নেকড়ের মাথায় ও মুখে বাদামি রং-এর ছাপ দেখা যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো জন্তুর বুকের মাঝখানে শ্বেতবর্ণের প্রলেপ।
নেকড়ের দলে এই অস্বাভাবিক বর্ণবৈচিত্র্য ঈহাটদের বিস্মিত করেছিল বটে, কিন্তু তাদের বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল আর একটা ঘটনা নেকড়ের দলকে পরিচার্লিত করে সর্বাগ্রে ধাবমান একটি প্রকাণ্ড কুকুর~ মাঝে মাঝেই আত্মপ্রকাশ করে অরণ্য-প্রান্তরে। ঈহাটরা ওই কুকুরটাকে আখ্যা দিয়েছে প্রেতগ্রস্ত বা ভুতুড়ে কুকুর। উক্ত ভুতুড়ে কুকুর এখন ঈহাটদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। বহু চেষ্টাতেও তারা ওই কুকুরটার হামলা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। তাদের ফাঁদে-আটকানো জন্তুগুলোকে ওই কুকুরটা মেরে খায়- নিজে ফাঁদে পড়ে না, কিন্তু ফাঁদগুলোকে ভেঙে শেষ করে দেয়। তাঁবু থেকে খাবার চুরি করে কুকুরটা, ঈহাটদের পোষা কুকুরগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঈহাটদের মধ্যে যারা শিকার করতে যায়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিকারি আর ঘরে ফেরে না– জঙ্গলের মধ্যে অনুসন্ধান চার্লিয়ে দেখা যায় মাটিতে পড়ে আছে শিকারির মৃতদেহ, তার কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন এবং মাটিতে বরফের উপর যে শ্বাপদের পদচিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে নেকড়ের পদচিহ্নের সাদৃশ্য থাকলেও কোনো নেকড়ের পায়ের ছাপই অত বড়ো হয় না।
ঈহাটরা একটি উপত্যকায় কখনো প্রবেশ করে না। জনশ্রুতি আছে, উক্ত উপত্যকায় বাস করে একটি দুষ্ট আত্মা! ওই উপত্যকায় শিকার করতে গেলে শিকারি যে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না এ বিষয়ে ঈহাটরা নিঃসন্দেহ।
যাই হোক, দ্বিপদ মনুষ্য পূর্বোক্ত উপত্যকায় পদক্ষেপ না করলেও একটি চতুম্পদ জীব প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে সেখানে উপস্থিত হয়। জন্তুটি নেকড়ের মতো দেখতে হলেও নেকড়ে নয়। একটি ছোটো নদীর ধারে সে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে, তারপর একবার মুখ তুলে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে- সেই তীব্র করুণ আর্তনাদের রেশ দীর্ঘসময় ধরে বাজতে থাকে বনভূমির বুকে… তারপর জন্তুটা স্থানত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র…
দীর্ঘ শীতের রাত্রে মাঝে মাঝে নেকড়ের দলের পুরোভাগে ধাবমান কুকুরটিকে দেখা যায়। নেকড়ের দলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সে চিৎকার করে সেই জান্তব কণ্ঠ যেন অরণ্যের আহ্বান জানিয়ে ছুটে যায় দিক হতে দিগন্তরে…