- বইয়ের নামঃ অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ নিউ বেঙ্গল প্রেস (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী
১. ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল
অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি (উপন্যাস)
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল
০১.
কলকাতার কাছে এক অখ্যাত শহরতলিতে একদিন বিকালে যে-ভদ্রলোকটিকে দেখা গেল, তিনি এই এলাকায় নবাগত- মাঝারি আকারের অত্যন্ত রোগা চেহারার মানুষটি তার চশমার ভিতর দিয়ে একটি বৃহৎ অট্টালিকার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে কী-যেন ভাবছিলেন।
বাড়িটি মস্ত বড়ো, কিন্তু একনজর তাকালেই বোঝা যায় সেখানে জনপ্রাণী বাস করে না;— তার দেয়ালে দেয়ালে ফাটল ধরেছে এবং পাঁচিলের গা ঘেঁষে বাগানের সীমানার মধ্যে বেড়ে-ওঠা আগাছার ঝোঁপ ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একটা ছোটোখাটো গাছ আপাতত সেই গাছটার দিকেই তাকিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন উক্ত ভদ্রলোক।
অকস্মাৎ তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল একটি বালকের কণ্ঠস্বর, এই যে স্যার, আপনিই তো বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী? আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন, তাই না?
চমকে উঠে ভদ্রলোক দেখলেন তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। প্রশ্নটা যে সে-ই করেছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এতক্ষণ যেন অন্য জগতে বিচরণ করছিলেন ভদ্রলোক, ছেলেটির কণ্ঠস্বর আবার তাকে বাস্তব পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে দিল, তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে থাকি। কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কি করে?
ছেলেটি হাসল, খবরের কাগজে মাঝে-মধ্যেই আপনার ছবি দেখতে পাই। কয়েকদিন আগে এই পাড়ারই একটি বাড়ির দরজায় আপনার নাম দেখতে পেলাম। বুঝলাম, আপনি হঠাৎ আমাদের পাড়ায় এসে উঠেছেন। কিন্তু কেন? আপনি তো দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। হঠাৎ এই জায়গায় আপনার মতো বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের উঠে আসার দরকার হল কেন? এখানকার গাছপালা নিয়ে কিছু গবেষণা করছেন নাকি?
অধ্যাপক ত্রিবেদী ভীষণ চমকে গেলেন, কিন্তু মনের ভাব গোপন করে বললেন, না, না, ওসব কিছু নয়। এই অঞ্চলে এখনও তেমন গাড়ি-টাড়ির চলাচল শুরু হয়নি, এখানকার বাতাস কলকাতার মতো দুষিত নয়, তাই এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাব ভাবছিলাম।
–খুব ভালো কথা। কিন্তু হানাবাড়ির দিকে তাকিয়ে আপনি অত মন দিয়ে কী দেখছিলেন?
ত্রিবেদীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, হানাবাড়ি? তার মানে?
–লোকে তো তাই বলে। আমার সঙ্গে কেউ থাকলে একটা রাত ওই বাড়িতে থেকে ভূত দেখার চেষ্টা করতাম। আমার বন্ধুরা ভীতু, কেউ ওখানে রাত কাটাতে রাজি নয়। আর আমি আমি ঠিক ভীতু নই, তবে একা-একা ওই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে আমারও সাহস হয় না।
-কেন? ভূতে ঘাড় মটকে দেবে?
–না, না, তা নয়। তবে ইয়ে মানে, বলা তো যায় না, যদি
বুঝেছি, অধ্যাপক ত্রিবেদী হাসলেন, অর্থাৎ ভূতের ভয় তোমার আছে। কিন্তু ভূত বলে কিছু নেই। এই সব কুসংস্কার তোমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। তুমি যদি আজ এই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে রাজি থাকো, তবে আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
সত্যি বলছেন স্যার? ছেলেটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাহলে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক রাত দশটার সময়ে আপনি এখানে আসুন। আমিও আসব।
ছেলেটি পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছিল, অধ্যাপক তাকে ডাকলেন, শোনো। তোমার নামটি তো আমার জানা হল না।?
আমার নাম গোবিন্দ ঘোষ। এখন আমি চললাম। মনে রাখবেন, ঠিক দশটায় আমি আসব।
-আরে, শোনো, শোনো। তোমার বাবা-মা তোমার মতো ছোটো ছেলেকে সারা রাত এই বাড়িতে থাকার অনুমতি দেবেন বলে আমার মনে হয় না। বরং চলো, আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে আসি।
-দরকার নেই স্যার। মার আবার ভীষণ ভূতের ভয়। তিনি কিছুতেই আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেবেন না।
তাহলে? তাহলে তুমি আসবে কি করে? রাত্রে তোমাকে দেখতে না পেলে বাড়ির সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করবে, হয়তো থানাতে খবর যাবে। নাঃ, তোমার আসার দরকার নেই।
-না, স্যার; আমি বাড়িতে বলেই আসব। তবে হানাবাড়িতে থাকার কথা বলব না। আমাদের ক্লাসের রথীন অঙ্কে খুব ভালো, আমি মাঝে মাঝে তার বাড়িতে অঙ্ক করতে যাই। অনেক সময় রাতেও থাকি। আমি অঙ্কে খুব কঁচা কিনা, তাই রথীনের বাড়িতে অঙ্ক করতে গেলে বাড়ির কেউ কখনো বাধা দেয় না। আজ রাতে আমি রথীনের বাড়ি যাচ্ছি বলেই বেরিয়ে আসব বুঝেছেন?
ত্রিবেদী গম্ভীর হলেন, গোবিন্দ, মিছে কথা বলে বাবা-মাকে ফাঁকি দেওয়া কখনো উচিত নয়। তবে একটা কুসংস্কার পুষে রাখবে, সারা জীবন অলীক ভয়ের দাপটে মনের স্বাস্থ্য নষ্ট করবে, এটাও ঠিক নয়। বিজ্ঞানী হিসাবে তোমার মন থেকে এই অলীক ভুতুড়ে ব্যাপারটা মুছে ফেলা আমার কর্তব্য। শুধু সেইজন্যই তোমার মিথ্যাভাষণ এবারের মতো আমি ক্ষমা করতে রাজি আছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো বাবা-মার কাছে মিছে কথা বলবে না। আমার কথাটা মনে থাকবে?
থাকবে স্যার। তাহলে ওই কথাই রইল। আপনি রাত দশটায় আসছেন তো?
–আসছি। এখন বাড়ি যাও।
.
০২.
কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটার সময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। বাড়ির চারদিক ঘিরে যে পাঁচিলটা রয়েছে, তার গায়ে লাগানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল গোবিন্দ।
পাঁচিলের পরে কিছুটা জমির উপর বাগান। এখন অবশ্য বাগান বলা চলে না, দীর্ঘকাল, অযত্নের ফলে জায়গাটা আগাছার জঙ্গলে পরিণত। সেই একদা-নির্মিত উদ্যান এবং বর্তমানে আগাছার জঙ্গল ভেদ করে একটা সরু পথ এগিয়ে গেছে বাড়ির দরজার দিকে। ওই দরজাই হল বাড়ির প্রবেশ পথ। গোবিন্দের সঙ্গে ওই পথেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন ত্রিবেদী। একটা ঘরের সামনে এসে গোবিন্দ বলল, একটু দাঁড়ান স্যার, আলো জ্বালি।
পকেট থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে আলো জ্বালিয়ে দিল গোবিন্দ। ত্রিবেদী। দেখলেন ঘরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ধুলো বালি নেই এবং মেঝের উপর মাদুর ও চাদর বিছিয়ে যে শয্যাটি প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে দুটি মানুষের স্থান হয়ে যাবে। উপরন্তু শয্যার উপর রয়েছে দুটি বালিশ– অর্থাৎ রাত্রিযাপনের জন্য আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই।
ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, এমন পোড়ো বাড়ি, কিন্তু মেঝেটা দেখছি বেশ পরিষ্কার। এই সব মাদর, চাদর, বালিশ প্রভৃতি সব কিছুই তুমি জোগাড় করেছ নিশ্চয়? আমি তো ওগুলোর কথা একেবারেই ভাবিনি। তুমি বেশ করিকর্মা ছেলে গোবিন্দ।
গোবিন্দ গর্বিতস্বরে বলল, আমি বিকেলবেলা এসে এই ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছিলাম। মাদুর, চাদর আর বালিশ একটু আগে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি।..
ত্রিবেদী বললেন, বেশ, বেশ। এখন কিছুক্ষণ পর্যন্ত জেগে থেকে তুমি ভুতের জন্য অপেক্ষা। করতে পার। অবশ্য কোনো ভূতই যে তোমাকে দেখা দিতে আসবে না এবিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। ভূতের দেখা না পেয়ে তুমি যখন হতাশ হয়ে পড়বে, তখন তুমিও শুয়ে পড়ে নিদ্রার আয়োজন করবে– কী বলো?
গোবিন্দ বলল, আমি ভূতের জন্যে অপেক্ষা করব না স্যার। আমার দারুণ ঘুম পেয়েছে। ভূত যদি এসে গোলমাল বাধায়, তাহলে তো উঠে পড়তেই হবে।
কিন্তু এই বাড়ির আনাচকানাচ হয়ত অনেক ভূত ওত পেতে আছে। সেকথা ভেবেও কি তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে?
আপনি ঠাট্টা করছেন স্যার? আমি একা থাকলে নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু আপনি তো আছেন, তাই নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ছি।
-আচ্ছা, তাহলে গুডনাইট গোবিন্দ।
–গুডনাইট, স্যার।
… গভীর রাত্রে হঠাৎ গোবিন্দের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে সে ঘুম ভাঙার কারণটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা ধুপ-ধাপ শব্দ তার কানে আসতেই সে বুঝল ওই শব্দটাই তার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। দুই হাতে চোখ দুটো ভালো করে ঘষে নিয়ে সে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল তার চোখের সামনে!- নানারকম অঙ্গ-ভঙ্গি করে নাচছেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। ধুপধাপ শব্দের উৎস হচ্ছে তার নৃত্যচপল দুই পা! শুধু যে অশান্ত পদক্ষেপেই নৃত্য অভ্যাস করছেন ত্রিবেদী তা নয়, তার দুটি হাতও এঁকেবেঁকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুরছে! দারুণ আতঙ্কে গোবিন্দের চুল খাড়া হয়ে উঠল, সে বুঝল ত্রিবেদীর উপর ভূতের ভর হয়েছে– নাহলে রাত দুপুরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হঠাৎ নৃত্যকলার চর্চা করতে যাবেন কেন? তাঁর যে হাত দুটি এখন নাচের মুদ্রায় ঘুরছে, সেই হাত যদি হঠাৎ গোবিন্দের গলা টিপতে চায়, তাহলে কি হবে?
কে বাঁচাবে তাকে?… গোবিন্দ ভেবেছিল অশরীরী হঠাৎ শরীর ধারণ করে তাকে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু ভূতেরা যে কখনো কখনো মানুষের উপর ভর করে এবং সেই ভূতে-পাওয়া মানুষ যে নানারকম ভয়াবহ কাণ্ড করে থাকে, একথা অনেকবার শুনলেও গোবিন্দ ভাবতে পারেনি যে, অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপরেই হঠাৎ ভর করবে হানাবাড়ির ভূত!
ভীষণ ভয় পেলেও গোবিন্দের মস্তিষ্ক আতঙ্কে অসাড় হয়ে যায়নি। সে চটপট ভেবে নিল এখন অধ্যাপক ত্রিবেদীর থেকে যথাসম্ভব দুরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। গোবিন্দ শুনেছিল ভুতে-পাওয়া মানুষ নাকি অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী হয়। কিন্তু বরাবর স্কুলের স্পোর্টসে দৌড়-প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে, আজ যদি সে একবার টেনে দৌড় মারতে পারে, তাহলে ত্রিবেদী অথবা ভূত কিংবা ত্রিবেদী ও ভূতের সম্মিলিত শক্তি অর্থাৎ ভূতে-পাওয়া অধ্যাপক ত্রিবেদী যে তার ভৌতিক শক্তি দিয়েও তাকে ধরতে পারবেন না, এবিষয়ে গোবিন্দের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। কিন্তু দৌড় দেওয়ার আগেই ত্রিবেদী যদি তাকে ধরে ফেলেন, তাহলে তাঁর হাত ছাড়িয়ে পালানো যে সম্ভব হবে না একথাও বুঝতে পারছিল গোবিন্দ। নাঃ, সেই সুযোগ গোবিন্দ তাকে দিতে রাজি নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে শরীরটাকে সে গুটিয়ে আনল, এইবার দৌড় দিলেই হয়—
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী, তার হাত পায়ের আন্দোলনও বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!
গোবিন্দ সভয়ে দেখল দরজা এবং তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন ত্রিবেদী! পলায়নের পথ একেবারেই বন্ধ!
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গোবিন্দের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিবেদী। গোবিন্দের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল দারুণ আতঙ্কে- এইবার বোধহয় ভূতগ্রস্ত ত্রিবেদী ঝাঁপিয়ে পড়বেন তার উপর…
প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থায় গোবিন্দের কানে এল ত্রিবেদীর কণ্ঠস্বর, আরে গোবিন্দ, তুমি জেগে বসে আছ? তাহলে সাড়া দিচ্ছ না কেন? ওহে গোবিন্দ, গো-বি-ল-অ-অ-অ!
চোখ খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় সাড়া দিল গোবিন্দ, হ্যাঁ, স্যার। আমি জুজ-জেগে আছি স্যার।
কী কাণ্ড! ত্রিবেদীর গলা খুবই স্বাভাবিক, তাহলে এতক্ষণ আর যন্ত্রণা ভোগ করলাম কেন? আমি ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ, তাই আর তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। যাক, তুমি যখন জেগেই আছ তখন একটা কাজ করো আমার পিঠের এই জায়গাটা একটু চুলকে দাও–
ত্রিবেদী পিছন ফিরে পিঠের একটা জায়গায় হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন, ওই জায়গাটায় কিছুতেই আমার হাত যাচ্ছে না।
বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে গোবিন্দ বলল, আ-আ-আপনি পি-পি-পিঠ চুলকাতে চেষ্টা করছিলেন?
-হ্যাঁ, গোবিন্দ। কখন থেকে চেষ্টা করছি, ঠিক জায়গায় কিছুতেই হাত যাচ্ছে না… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক জায়গায় তুমি হাত দিয়েছ গোবিন্দ… বাঃ, ভালো করে চুলকে দাও, ভালো করে…হ্যাঁ, জোরে আরও জোরে আঃ! কি আরাম! কি আরাম।…
ভোরবেলা হানাবাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসে ত্রিবেদী বললেন, দেখলে তো গোবিন্দ, সারা রাত আমরা অপেক্ষা করলাম, ভূত কি এল? আসলে ভূত-টুত কিছু নেই। ওই সব অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারে কখনো বিশ্বাস করবে না, বুঝেছ?
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গোবিন্দ বলল, হা স্যার, বুঝেছি।
-আচ্ছা, তুমি তাহলে বাড়ি যাও। আমিও আমার বাড়ির দিকেই রওনা হই। পরে আবার দেখা হবে।
অধ্যাপক ত্রিবেদী খুব তাড়াতাড়ি পা চার্লিয়ে গোবিন্দের চোখের আড়ালে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল গোবিন্দ। পথের বাঁকে অধ্যাপকের চলমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং অন্য একটা রাস্তা ধরে বাড়ির উদ্দেশে পদচালনা করতে করতে গোবিন্দ ভাবতে লাগল- ত্রিবেদী স্যার যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িটা তো আমি চিনি। কিন্তু উনি তো নিজের বাড়ির দিকে গেলেন না, আবার ঘুরে হানাবাড়ির দিকেই হাঁটা দিলেন যে ত্রিবেদী স্যার কি ওখানে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন? শুনেছি, পোড়োবাড়িতে অনেক সময় গুপ্তধন থাকে… নাঃ, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে
কিন্তু হানাবাড়ি আর ত্রিবেদীকে নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তার সুযোগ পেল না গোবিন্দ, আচম্বিতে তার কর্ণকুহরে সবেগে ধাক্কা মারল কুকুর ও বিড়ালের মিলিত কণ্ঠের ক্রুদ্ধ আস্ফালন-ভোক! ভোক!-ফ্যাঁসস!
শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে গোবিন্দ দেখল একটা ইটের পাঁজার উপর আশ্রয় নিয়ে সর্বাঙ্গের লোম ফুলিয়ে গজরাচ্ছে একটা কুচকুচে কালো বিড়াল আর সেই ইটের পাঁজার নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ালটাকে ক্রমাগত ধমক দিচ্ছে একটা প্রকাণ্ড কুকুর!
ঈসস! গোবিন্দ বলে উঠল। বগলুর হতভাগা কুকুরটা একটা কালো বিড়ালকে কোণঠাসা করেছে। বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর উঠেছে বলে কুকুরটা ওর নাগাল পাচ্ছে না, উঠতে গেলেই বেড়ালের থাবা পড়ছে নাকে কিন্তু একবার যদি খুনে কুকুরটা বেড়ালটাকে ধরতে পারে তাহলেই বেড়ালের দফারফা। নাঃ, বেড়ালটাকে বাঁচাতে হবে।
গোবিন্দ এগিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে তাড়া দিল, হেট! হেট! যাঃ! বেড়ালকে ছেড়ে কুকুরটা এবার গোবিন্দের দিকে ফিরে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জে উঠল, গরর! গরর! ভো! ভোঃ!
আরে গেল যা! আমাকেই কামড়াবে নাকি? গোবিন্দ নিচু হয়ে দুটো ইট কুড়িয়ে নিল, আমি বেড়াল নই, বুঝেছিস? আমাকে কামড়াতে এলে নাক মুখ আস্ত রাখব না।
কুকুরটা বোকা নয়- গোবিন্দ ইট তুলতেই সে বুঝে গিয়েছিল এই মনুষ্যশাবক দস্তুর মতো বিপজ্জনক, এর শরীরে দন্তস্ফুট করতে গেলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে– অতএব দূরে দাঁড়িয়ে সে সারমেয় ভাষায় গালাগালি করতে লাগল, ভোক! ভোক! ভৌ-উ-উ-উ-ভোঃ!
দ্বিপদ ও চতুস্পদ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাব্য দ্বৈরথ-যুদ্ধে বাধা দিয়ে হঠাৎ অকুস্থলে দেখা দিল গোবিন্দেরই সমবয়সী একটি ছেলে, এই গোবিন্দ! আমার কুকুরের পিছনে লাগছিস কেন রে?
আরে বগলু যে! গোবিন্দ হাতের উদ্যত ইট নামিয়ে নিল, তোর কুকুর ওই বেড়ালটাকে কামড়াতে যাচ্ছিল, তাই আমি কুকুরটাকে তাড়া দিচ্ছিলাম।
বেড়াল? বগলু জানতে চাইল, কোথায়?
গোবিন্দ কিছু বলার আগেই বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর থেকে একলাফে নেমে ছুটে পালাতে লাগল এবং তৎক্ষণাৎ তাকে তাড়া করে ছুটল বগলুর কুকুর। বগলু এবার দেখতে পেল বেড়ালটাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, আরে! আরে! কুচকুচে কালো একটা বেড়াল! জিম- ধর ওটাকে, যা, যা, ধর!
জিম আগেই তাড়া করেছিল, প্রভুর উৎসাহ পেয়ে সে আরও জোরে ছুটল বিড়ালের পিছনে।
গোবিন্দ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, বগলু, তুই কুকুরটাকে লেলিয়ে দিলি? ধরতে পারলে বেড়ালটাকে মেরে ফেলবে। তোর কুকুর এই এলাকাতে তিন-চারটে বেড়াল মেরেছে।
বগলু হাসল, এটাকেও মারবে। ওই দ্যাখ।
বাস্তবিকই বেড়ালটাকে তখন প্রায় ধরে ফেলেছে বগলুর কুকুর। হঠাৎ বেড়াল দিক-পরিবর্তন করল একপাক ঘুরেই সোজা রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিয়ে অদৃশ্য হল বগলুর কুকুর।
.
০৩.
নতুন জায়গায় এসে অধ্যাপক ত্রিবেদী সদ্য ভাড়া-নেওয়া বাড়িটির একটি ঘরে প্রয়োজনীয় বস্তু দিয়ে ছোটোখাটো একটি ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমানে ওই গবেষণাগারের ভিতর একটি কাঁচের টিউবে কিছু তরল পদার্থ নিয়ে তিনি পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ সারমেয় কণ্ঠের তীব্র চিৎকার তাকে চমকে দিল, আর একটু হলেই কাঁচের টিউবটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ত। কুকুরটা তখনও থামেনি, মহাআক্রোশে চিৎকার করে কোন অদৃশ্য শত্রুকে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে!
ত্রিবেদী হাঁক ছাড়লেন, সনাতন! অ্যাই সনাতন!
উত্তর এল, যাই বাবু।
–এখানে আসতে হবে না। বাড়ির সামনে একটা কুকুর, ভীষণ চ্যাচাচ্ছে। ওটাকে তাড়িয়ে দে। যদি সহজে যেতে না চায়, তাহলে লাঠিপেটা করে বিদায় কর। যত সব আপদ- স্থির হয়ে যে একটু কাজ করব, তার উপায় নেই।
নেপথ্য থেকে উত্তর এল, কুকুরের তাড়া খেয়ে নিচের জানালা দিয়ে একটা বেড়াল ঘরে ঢুকেছে। ওটাকে ধরতে না পেরে কুকুরটা চাঁচাচ্ছে। এখন আর আপনাকে কাজ করতে হবেকনি। বেলা হইছে, খাতি আসেন।
-আচ্ছা, আচ্ছা, এখনই যাচ্ছি।
-হ, তাড়াতাড়ি আসেন।
ত্রিবেদী হাতের টিউবটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলেন, একটু ইতস্তত করে টিউবের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিলেন। হাতঘড়িটা চোখের উপর তুলে ভাবতে লাগলেন- জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাকে যে ফরমুলা দিয়েছিলেন, সেই ফরমুলা অনুসারেই তো এই মিকশ্চার তৈরি করেছি। যে-নমুনা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, হানাবাড়িতে তো ঠিক সেই বস্তুটি পেয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। তাগাসাকি বলেছেন পনেরো মিনিট পরেই ফল পাওয়া যায়, আমি না-হয় আধঘণ্টা অপেক্ষা করব।
একতলা থেকে সনাতনের উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল, আপনাকে নিয়ে আর পারি না বাবু। কাজ থাকলে তো ফল-মিষ্টি আর দুধ ছাড়া কিছু খান না। তা-ও যদি সময়মতো না খান, তাহলে শরীর থাকবে কি করে?… আবার দেখছি খাবার টেবিলে কতগুলো গাছের পাতা রেখে গেছেন এগুলো কি হবে?
ওগুলো নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, ত্রিবেদী চেঁচিয়ে উঠলেন, এইবার খেয়ে নেব। পরে হয়তো খাওয়ার সময় পাব না। তুই তাড়াতাড়ি খেতে দে।
তিক্তস্বরে উত্তর এল, অনেকক্ষণ দিয়েছি।
খাবার টেবিলের সামনে চেয়ারের উপর আসন গ্রহণ করতে করতে ত্রিবেদী বললেন, অনেক বেলা হয়েছে, তুই এইবার খেতে যা, সনাতন। আমি তো শুধু ফল-মিষ্টি আর দুধ খাব, পরিবেশনের ঝামেলা নেই। তোর খাওয়া হলে চিঠির বাক্সটা দেখবি, চিঠি আসতে পারে।
সনাতনের গমনপথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ত্রিবেদী এবার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন, আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। সনাতনটাও খেতে গেছে, এই সুযোগে পরখ করে দেখি।
ডাইনিং টেবিল অর্থাৎ খাবার টেবিলটা দুহাতে ধরে সেটাকে ভোলার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী; টেবিল নড়ল না। আবার চেষ্টা করলেন তিনি, এবারও তার চেষ্টা সফল হল না– টেবিল তখনও স্থাণু, নট নড়নচড়ন ন কিছু!
ত্রিবেদীর ভ্রূ কুঁচকে গেল, এ কী হল! টেবিল একটুও নড়ল না! কিন্তু প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনার নমুনা তো এইরকমই ছিল মনে হচ্ছে। তার দেওয়া ফরমুলা মিলিয়েই তো সব করেছি– তবে?… আচ্ছা, নোটবইটা প্যান্টের পকেটেই রয়েছে, খেতে খেতে বরং আর একবার ফরমুলাটা দেখি… নাঃ, সব তো ঠিকই আছে দেখছি, কোথাও তো ভুল হয়নি… তাহলে.. তাহলে কি এটা আসল জিনিস নয়? তাগাসাকি বলেছিলেন আমাজন নদীর অববাহিকায় এই জিনিস তিনি পেয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বিচরণ করেছেন তিনি, কিন্তু ওই বস্তুটি তিনি কোথাও দেখতে পাননি, এমনকি আফ্রিকার গভীর অরণ্যেও নয়- আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটা জায়গায় ওই ধরনের গাছ তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু সেগুলো পরীক্ষার সুযোগ–ঈঃ! থু! থু!
অন্যমনস্ক হয়ে ফল খেতে খেতে টেবিলের উপর পড়ে-থাকা গাছের পাতাগুলোর উপর ত্রিবেদীর হাত পড়ে যায়, নোটবুকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ত্রিবেদী কয়েকটা পাতা তুলে মুখে ফেলে দেন, পরক্ষণেই অতিশয় কটু তিক্তরসে পরিপূর্ণ হয়ে যায় তার মুখগহ্বর- ঈস! কী তেতো রে বাবা! অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা মুখে দিয়ে ফেলেছি… ওই যাঃ!
আবার এক অভাবিত দুর্ঘটনা! হঠাৎ তাঁর হাতের ধাক্কা লেগে উলটে গেল দুধের গেলাস! টেবিলের উপর পাতার রাশি ভিজিয়ে ছুটল দুগ্ধস্রোত! সেই অমল ধবল তরল স্রোতের দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ত্রিবেদী যখন তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করছেন, সেই সময় হঠাৎ জানালার ফাঁক গলে অকুস্থলে উপস্থিত হল একটি কালো বিড়াল। ত্রিবেদীর দিকে এক নজর তাকিয়ে বিড়াল বুঝে নিল এই লোকটি তেমন বিপজ্জনক হবে না। অতএব একলাফে জানলা থেকে টেবিলে উঠে সে বহমান দুগ্ধস্রোতের স্বাদগ্রহণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল…
ত্রিবেদী সম্পর্কে বিড়ালের চরিত্র-বিশ্লেষণ ছিল নির্ভুল, ত্রিবেদী তাকে একবারও তাড়া দিলেন না, দুগ্ধপানে নিবিষ্টচিত্ত মার্জারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, কোথা থেকে একটা কালো বেড়াল এসে জুটেছে!… ওহো, একটু আগে সনাতন বলছিল বটে কুকুরের তাড়া খেয়ে একটা বেড়াল একতলার জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। নিচের তলায় অন্যান্য ঘরে ঘোরাঘুরি করতে করতে বেড়ালটা বোধহয় দুধের গন্ধ পেয়ে এই ঘরে হানা দিয়েছে… তা খাক, দুধটা তো আর আমি খেতে পারলাম না, ও-ই খা… আমি বরং একটু বিশ্রাম করি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল, সব পরিশ্রম ব্যর্থ।
খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে অন্য ঘরে একটা সোফার উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…
ভোক! ভৌউ-উ! ভোঃ- কাঁঈঈঈ!
আচম্বিতে একটা কুকুরের তীব্র ক্রুদ্ধ চিৎকার তন্দ্রাচ্ছন্ন ত্রিবেদীকে জাগিয়ে দিল- পরমুহূর্তেই ক্রুদ্ধ গর্জন পরিণত হল সুদীর্ঘ আর্তনাদে!
একলাফে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। কুকুরের আর্তনাদ তখন থেমে গেছে। বিস্মিত ও বিমূঢ় ত্রিবেদীর মনে হল আওয়াজটা যেন এই বাড়ির একতলা থেকেই এসেছে!
বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই, গজগজ করতে করতে দ্রুত পদক্ষেপে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে একতলার বৈঠকখানায় উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অভাবিত দৃশ্য–
খোলা দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ভৃত্য সনাতন এবং ঘরের মধ্যে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে একটা মস্ত বড়ো কুকুর!
পায়ে পায়ে এগিয়ে কুকুরটার শায়িত দেহের সামনে এসে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন কুকুরটা জীবিত নেই তার বাঁ চোখের তলা থেকে গলা পর্যন্ত হাঁ করে আছে একটা গভীর ও সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন এবং সেই ক্ষত থেকে রক্তধারা ঝরে ঘরের মেঝেটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
ত্রিবেদী কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলেন না, তারপর যখন কণ্ঠস্বর কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে এল, তখন ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, কী সাংঘাতিক কাণ্ড! কুকুরটাকে এমনভাবে খুন করে ঘরের মধ্যে ফেলে গেল কে?
সনাতনের মানসিক অবস্থাও তার প্রভুর চাইতে ভালো নয়, তবু সে অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তর দিতে সচেষ্ট হল, কুকুরটাকে কেউ ঘরের মধ্যে ফেলে যায়নি, বাবু। আমি ঘরে ঢুকে একটা কালো বেড়ালকে বসে থাকতে দেখনু। আমি জানতাম ওটা কুকুরের তাড়া খেয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে; তাই ওটাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দরজা খুলে যেই না চিঠির বাসকো দেখতে গিছি, অমনি এই হতভাগা কুকুর ঘরে ঢুকে বেড়ালটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেড়ালটা প্রথমে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু বন্ধ ঘরে পালাবে কোথায়? দরজাটা আমি খুলে দিয়েছিলাম বটে, কিন্ত সেই রাস্তা আগলে রেখেছিল কুকুরটা- ওদিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করলেই ঘ্যাক করে বেড়ালের ঘাড় কামড়ে কুকুরটা তাকে মেরে ফেলত। বেড়াল যখন দেখল পালিয়ে জান বাঁচানো যাবে না, তখন রুখে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে মারল এক থাপ্পড়। উরি বাস সে কী থাপ্পড়! কুকুরটা একবার কাতরে উঠেই এলিয়ে পড়ল আর বেড়ালটাও দরজা খোলা পেয়ে এক দৌড়ে হাওয়া!
বলিস কী সনাতন, ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, বেড়ালের থাবায় কুকুরের এমন অবস্থা হতে পারে? বেড়াল বাঘের মাসি বটে, কিন্তু তার থাবা তত বাঘের মতো ভয়ংকর নয়। চোয়াল থেকে গলা অবধি ছিঁড়ে রক্তের বান ডেকেছে, বেড়ালের থাবায় এমন রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে না। তুই নিশ্চয় কুকুরটাকে মেরে বেড়ালের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।
কী যে বলেন বাবু, সনাতন রেগে গেল, এমন রক্তারক্তি করতে গেলে তোয়াল কিংবা ভোজালির কোপ বসাতে হয় এ বাড়িতে তো সেসব কিছু নেই, থাকার মধ্যে আছে দুগাছা লাঠি। তাই দিয়ে কি এমনভাবে ঘাড়-গলা-চোয়াল পেঁচিয়ে কাটা যায়?
তাহলে কি বলছিস বেড়ালের থাবার নখ লেগে কুকুরটার এমন দুরবস্থা হয়েছে? ত্রিবেদীর কণ্ঠে অবিশ্বাস, এটা কি বিশ্বাস করার মতো কথা?
হঃ আমি যা দেখনু, তাই বলনু। বেড়ালটা কুচকুচে কালো। কালো বেড়ালের উপর ভূতের ভর হয়, জানেন? ওটাতেও নিচ্চয় ভূতে ভর করেছিল! নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, বেড়ালে এমনভাবে কুকুর মারতে পারে। ওঃ বাবু, আপনি তো দেখেননি– সে কী বিষম থাপ্পড়! কুকুরটা একবার ডেকে উঠেই চোখ উলটে শুয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে মিত্যু! একে দুপুরবেলা, সামনে রয়েছে হানাবাড়ি, তার উপর বেড়ালের রং কুচকুচে কালো- একেবারে তেরোস্পর্শ যোগ। কথায় বলে ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা! নিয্যস ওই কালো বেড়ালটার উপর ভূতের ভর হয়েছিল। ভাগ্যি ভালো, কুকুরের উপর দিয়েই চোটচ গেছে- আমি যদি বেড়ালটাকে তাড়া দিতাম, তাহলে আমারও দশা হতো কুকুরটার মতো।
ওঃ! আবার হানাবাড়ি আর ভূত! ক্রোধে ফেটে পড়লেন ত্রিবেদী, আজকের দিনটাই খারাপ। কুকুর, বেড়াল আর তোর মতো ভূত নিয়ে সকালটা পণ্ড সরিয়ে নে এই কুকুরটাকে।
সজোরে কুকুরটাকে এক লাথি মারলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই যা ঘটল তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি তার লাথি খেয়ে কুকুরের মৃতদেহটা খোলা দরজা দিয়ে তিরবেগে বেরিয়ে গেল এবং শুন্যপথে অনেকগুলো ডিগবাজি খেয়ে প্রায় তিরিশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল! ভাগ্যিস পথে লোকজন ছিল না- নইলে, মৃত কুকুরের এমন বিদ্যুৎগতিতে শূন্য পথ ভ্রমণের কোনো বিশ্বাসযোণ্য কারণ দেখাতে পারতেন না অধ্যাপক মহাশয়!
এই কল্পনাতীত কাণ্ড দেখে সনাতনের চোখ কপালে উঠে গেল, সশব্দে শ্বাসগ্রহণ করে সে বলে উঠল, আরে ব্বাস! আপনার দেহে যে এমন ভীমের শক্তি তা তো জানতাম নি! এক লাথিতে অতবড়ো কুকুরটাকে আপনি বিশ হাত দূরে ছিটকে ফেইলে দিলেন।
য্যাঁ, তাড়াতাড়ি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী, হ্যাঁ, বুঝেছি… ইয়ে হয়েছে সনাতন.. আমার গায়ের জোর একটু বেশি… তা ইয়ে হয়েছে, মানে শোন… তুই এবার একটু বিশ্রাম কর, দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া ভালো… আবার দাঁড়িয়ে রইলি কেন?… যা, যা, শুয়ে পড়।
সনাতন অবাক হয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল তার নিতান্ত রোগা ও নিরীহ প্রকৃতির মনিবটি যে এমন প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তা সে চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। ত্রিবেদী আর একবার তাড়া দিতেই সে নিজের ঘরে বিছানাটির উদ্দেশ্যে প্রস্থান করল…
সনাতন চলে যেতেই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী সমস্ত ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন– এতক্ষণে তিনি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে প্রকৃতিস্থ হয়েছেন এবং তাঁর মস্তিষ্ক দস্তুরমতে সক্রিয় হয়ে চিন্তার জাল বুনতে শুরু করেছে–
জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাজন নদীর ধার থেকে সংগৃহীত যে গাছের পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এখানে বাগচী মশাই-এর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে হানাবাড়ির মধ্যে ঠিক সেইরকম পাতার গাছ আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ওই পাতা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্যই এই পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিলাম। কিন্তু লোকের সামনে ওই গাছের পাতা সংগ্রহ করতে গেলে লোকে হয়তো আমাকে পাগল ভাবত তার চেয়েও বিপদের কথা, কোনো চেনা লোক আমাকে পাতা ছিঁড়তে দেখলে ওই পাতা সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়ত, আর তার ফলে নানাধরনের অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি নাজেহাল হয়ে পড়তাম। তারপর ভেবে দেখলাম বেশি রাত্রে অথবা খুব ভোরে ওই পথে যখন লোক চলাচল বিশেষ থাকে না, সেই সময়ই কাজ হাসিল করতে হবে। আজ খুব সকালে গোবিন্দকে বাড়ির পথে রওনা করে দিয়ে আবার হানাবাড়িতে হানা দিয়ে আমি ওই পাতা অনেকগুলো জোগাড় করে এনেছি। পরে বুঝলাম বুবুসোনা যে-পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এগুলোর সঙ্গে বুবুসোনার নমুনার সাদৃশ্য থাকলেও হানাবাড়ির গাছের পাতা বুবুলোনার সংগৃহীত নমুনার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। বুবুলোনা তাঁর গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেছেন কয়েকটা বিশেষ ধরনের বস্তু ওই পাতার সঙ্গে মিশিয়ে যে-নির্যাস তরি হয়, সেই মিশ্রিত তরল পদার্থ পান করলে কিছুক্ষণের জন্য অসীম শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। হানাবাড়ি থেকে যে-পাতা আমি এনেছি, সেগুলো পিষে রস করে তার সঙ্গে বুবুলোনার ফরমুলার জিনিস মিশিয়ে পান করলে কোনো ফল পাওয়া যায় না কিন্তু ওই পাতা কাঁচা অবস্থায় খেলে শরীরে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার আসে। বেড়ালটা দুধের সঙ্গে নিশ্চয়ই কয়েকটা দুধমাখা পাতা খেয়ে ফেলেছিল, তাই তার থাবার আঘাতে কুকুরটার অমন দুর্দশা। আমিও খাওয়ার সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা চিবিয়ে ফেলেছিলাম– তাতেই আমার দেহে এমন অমানুষিক শক্তির সঞ্চার হল যে, অতবড় কুকুরটা আমার লাথিতে প্রায় বিশ-পঁচিশ হাত দুরে ছিটকে পড়ল!… প্রথমে আমিও হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি। সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছি। এখনও আমার সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার অনুভব করছি। কিন্তু কতক্ষণ? আর কতক্ষণ স্থায়ী হবে আশ্চর্য-পাতার এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা?
আমাদরও প্রশ্ন আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা কতক্ষণ স্থায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে পরবর্তী কাহিনি– অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ!
২. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ
তোমরা যারা আগের কাহিনি অধ্যাপক ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল পাঠ করেছ, সেই পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই জানো উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী কলকাতার নিকটবর্তী একটি শরতলিতে এক আশ্চর্য গাছ আবিষ্কার করেছেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরে অসাধারণ শক্তির উদ্ভব হয়। কিন্তু সেই আশ্চর্য পাতার ভেষজ গুণে সঞ্চারিত আশ্চর্য শক্তি কতক্ষণ স্থায়ী, সেকথা এখনও জানতে পারেননি অধ্যাপক ত্রিবেদী। সেদিন সকালবেলা ওই আশ্চর্য পাতা কয়েকটি ভক্ষণ করে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন অধ্যাপক মহাশয় এবং সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার অনুভব করতে করতে পরমানন্দে পদচালনা করছিলেন। ত্রিবেদীর পা দুটির সঙ্গে সমতা রেখে তার মস্তিষ্ক ছিল সমান সক্রিয় অর্থাৎ পদচালনা করতে করতেই ত্রিবেদী মনে মনে চিন্তা করছিলেন- একঘণ্টা হল কয়েকটি আশ্চর্য-পাতা খেয়েছি; এখনও শরীরে প্রচণ্ড শক্তি অনুভব করছি। কিন্তু কতক্ষণ পর্যন্ত এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা বজায় থাকবে সেইটা জানা দরকার। ওই যে ওখানে কয়েকটা ছোটো ছেলে ফুটবল খেলছে, ওদের সঙ্গে খেললে আশ্চর্য-পাতার শক্তি কিছুটা পরখ করা যায়… আরে! আরে! বলটা যে এইদিকেই আসছে!
হ্যাঁ, সামনের মাঠে কয়েকটা ছেলে ফুটবল খেলছে বটে, তাদের দিকেই অগ্রসর হলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। হঠাৎ একজন খেলোয়াড়ের প্রবল পদাঘাতে বলটা খুব উঁচুতে উঠে শূন্য-পথে পাশের পুকুরের দিকে রওনা হল। যে ছেলেটি বলে লাথি মেরেছিল, সে সক্ষোভে বলে উঠল, ঈস! বড় জোরে হয়ে গেল!
আর একজন খেলোয়াড় বলল, আবার তুই বলটা পুকুরে ফেললি। কিন্তু না, বলটা পুকুরের দিকে রওনা দিলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারল না– এক লাফ মেরে শূন্যপথেই পলাতক ফুটবলকে গ্রেপ্তার করে ফেললেন ত্রিবেদী!
বালক খেলোয়াড়ের দল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ– কোনো মানুষ যে মাটি থেকে হঠাৎ লাফিয়ে আট-দশ ফুট উঁচুতে উঠে শূন্যপথে ধাবমান একটি ফুটবলকে ধরে ফেলতে পারে, এমন অবিশ্বাস্য আশ্চর্য ব্যাপার তারা চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিশেষত আগন্তুক ভদ্রলোক বয়স্ক মানুষ তার চেয়ে অনেক কমবয়সী কোনো যুবকের পক্ষেও এমন হনুমান-সদৃশ লম্ফপ্রদান অসম্ভব সুতরাং ছেলের দল চমকে গিয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথাই কইতে পারল না।
অবশেষে একজন খেলোয়াড়ের গলায় স্বর ফুটল, ইয়ে আপনি স্যার দারুণ লাফাতে পারেন তো!
আর একজন বলল, হাই জাম্প কমপিটিশনে নামলে আপনি সারা দুনিয়াকে চমকে দিতে পারেন।
হয়তো পারি, ত্রিবেদী হাসলেন, তবে আপাতত সেরকম কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বরং তোমরা যদি আমাকে খেলতে নাও, তাহলে আমি খুশি হব।
খেলতে! আপনাকে। আমাদের সঙ্গে! একাধিক কণ্ঠে জাগল বিস্মিত কলরব, না স্যার। আপনি যে-দলে খেলবেন সেই দলই জিতবে। আপনার লাফের যা বহর দেখছি, তাতে অনুমান করছি আপনার শটু-এর ক্ষমতাও দারুণ–আমাদের সঙ্গে খেলে আপনি মজা পাবেন না। আপনি স্যার দয়া করে বলটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিন।
ত্রিবেদী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বেশ বলটা ধরো। তিনি ফুটবলটা ছুঁড়ে দিলেন এবং সবিস্ময়ে দেখলেন বলটা ক্রমশ ছোটো হয়ে শুন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ত্রিবেদী নিজের মনেই বলে উঠলেন, এ কী কাণ্ড! আমি তো খুব জোরে বলটা ছুড়িনি, তবু ওটা অত উপরে উঠে গেল! আশ্চর্য-পাতা আমার শরীরে এমন অসম্ভব শক্তি এনে দিয়েছে যে, আমি নিজেই চমকে যাচ্ছি!
ছেলের দলও বিলক্ষণ চমকে গিয়েছিল, তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে লক্ষ করছিল, ফুটবলের অবতরণ-পর্ব- বল মাটিতে পড়ার আগেই তাকে ধরে ফেলার জন্য প্রস্তুত হল কয়েকজন খেলোয়াড়।
কিন্তু সকলের প্রস্তুতি ব্যর্থ করে ফুটবলটা মাঠ ডিঙিয়ে এত দুরে চলে গেল যে, প্রাণপণে ছুটেও খেলোয়াড়রা তার নাগাল পেল না। খেলার মাঠের পেছন দিক দিয়ে যে পথটা চলে গেছে, সেই পথের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে সাইকেল চার্লিয়ে ছুটে আসছিল এক যুবক–বলটা এসে পড়ল তার ঘাড়ে এবং অতর্কিত আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে সাইকেল সমেত আরোহী হল ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান!
সশব্দে শ্বাস টেনে একটি ছেলে বলে উঠল, সর্বনাশ! এ যে বাঘা মুকুন্দ! শিগগির পালা, ধরতে পারলে পিটিয়ে ছাতু করে ফেলবে।
পরামর্শ গৃহীত হল তৎক্ষণাৎ। মুহূর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছেলের দল যে-যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করল তিরবেগে!
ধরাশায়ী যুবক সাইকেল ফেলে এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর তাড়া করে ধরে ফেলল একটি ছেলেকে। ভয়ে বেচারার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি তোমার গায়ে বল ফেলিনি মুকুন্দদা। আমার দোষ নেই, আমাকে ছেড়ে দাও।
জ্বলন্ত চক্ষে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মুকুন্দ বলল, হতে পারে তুই বল ফেলিসনি, কিন্তু যে ফেলেছে তার নামটা বলে ফ্যা। আজ না-হোক কাল তাকে নির্ঘাত ধরতে পারব। হতভাগার দল, রাস্তা দিয়ে তোক চলাচল করে, খেয়াল নেই?
ছেলেটিকে সজোরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে মুকুন্দ বলল, বোবা থেকে নিস্তার পাবি না। শিগগির বল কে ফেলেছে ফুটবল আমার ঘাড়ে, নইলে—
বাক্য অসমাপ্ত রেখে হাতের ভঙ্গিতে মুকুন্দ বুঝিয়ে দিল অপরাধীর নাম না বললে ধৃত বালকের ভাগ্যে জুটবে অশেষ লাঞ্ছনা।
কাঁদো কাঁদো হয়ে ছেলেটি বলল, ওই যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ওইখানে, উনিই বলটা ফেলেছেন তোমার ঘাড়ে!
ছেলেটির নির্দেশ অনুসারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে মুকুন্দ দেখল নিতান্ত নিরীহ গোছের একটি রোগা চেহারার ভদ্রলোক তাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। এমন একটি বয়স্ক মানুষ ফুটবলের আঘাতে তাকে কাবু করেছেন বলে ভাবতে পারল না মুকুন্দ, ছেলেটিকে আর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে বলল, ফের মিছে কথা? চড়-চাপড় না পড়লে সত্যি কথাটা বেরুবে না দেখছি। বাঁচতে চাস তো বল সত্যি কথা।
আহা! ছোটো ছেলেকে মারধর করছ কেন? ও সত্যি কথাই বলেছে, ত্রিবেদী ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছেন, বলটা আমিই ছুঁড়েছিলাম বটে। তবে তুমি যে ওই সময়ে ওইখান দিয়েই সাইকেল চার্লিয়ে আসবে সেকথাটা জানা ছিল না তত তাই অঘটন ঘটে গেছে। ইচ্ছে করে কেউ কারও ঘাড়ে বল ফেলে না এটা তোমার বোঝা উচিত।
অ! ছেলেটিকে ছেড়ে দুই হাত কোমরে রেখে মুকুন্দ এবার ত্রিবেদীর দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখল, আপনার নাম তো ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী? পাড়ায় নতুন এসেছেন? কী সব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন শুনেছিলাম। তা ওইসব নিয়ে তো বেশ ছিলেন, এখন হঠাৎ শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়েছেন? তো ভিড়েছেন, ভিড়েছেন, ভালোই করেছেন কিন্তু চোখেও কি দেখতে পান না? নাকি চারটে চোখেও চলছে না, অ্যাঁ?
মুকুন্দের দিকে তাকালেন ত্রিবেদী- চাপা গোল গলার গেঞ্জির ভিতর দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে চ্যাটালো বুক, দুই হাতের স্ফীত পেশিগুলোর দিকে একনজর তাকালেই বোঝা যায় নিয়মিত ব্যায়াম না করলে এমন চেহারা হয় না– অধমাঙ্গে শর্টস বা হাফ-প্যান্টের তলা থেকে উরু এবং পায়ের দৃঢ়বদ্ধ মাংসপেশি জানিয়ে দিচ্ছে যুবকটি উর্ধ্বাঙ্গের ন্যায় নিম্নাঙ্গের পেশীগুলির উন্নতি সাধনেও অতিশয় তৎপর! ত্রিবেদী বুঝলেন তার সামনে দণ্ডায়মান যুবকটি একজন ব্যায়ামবীর; তার পেশিপুষ্ট বিশাল দেহের দিকে তাকিয়ে তিনি দস্তুরমতো দমে গেলেন। পরক্ষণেই তার মনে হল আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতা বোধ হয় তার মধ্যে এখনো জাগ্রত, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ত্রিবেদী অনুভব করলেন তার দেহের শিরায় শিরায় ছুটছে অসীম শক্তির তরঙ্গ; কিন্তু এই প্রকাণ্ড দৈত্যের সঙ্গে তিনি কি লড়তে পারবেন?… হঠাই তার মনে পড়ে গেল দুদিন আগের ঘটনা এক পদাঘাতে একটা কুকুরের মৃতদেহকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সামনে দাঁড়ানো দৈত্যটার পক্ষেও ওই কাজ করা কি সম্ভব? মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললেন ত্রিবেদী, যা হয় হবে- আশ্চর্য পাতার ক্ষমতা পরখ করার উপযুক্ত পরিস্থিতি এবং সুযোগ তাঁর সামনে উপস্থিত, এই সুযোগ অবহেলা করা উচিত নয়। সুতরাং মুকুন্দের চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর যথাসম্ভব গুরুগম্ভীর করতে সচেষ্ট হলেন ত্রিবেদী, ভদ্রভাবে কথা বলো, নইলে–
নইলে কী করবেন? হেসে উঠল মুকুন্দ, মারবেন নাকি? আচ্ছা, আমার এই আঙুলটা বাঁকাতে পারবেন?
ত্রিবেদীর নাকের সামনে বুড়ো আঙুল তুলে ধরল মুকুন্দ।
ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী মেধাবী ছাত্র হিসাবে খুব ছোটোবেলা থেকেই গুরুজনদের এবং শিক্ষকমণ্ডলীর প্রশংসা পেয়েছেন। পরবর্তীকালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছেন। কিন্তু কোনোদিনই– এমন কি কিশোর বয়সেও কখনো তিনি হাতহাতি মারামারি করেননি। কখনো কখনো অবশ্য দুর্বিনীত ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে তিনি অনুভব করেছেন সময় বিশেষে মারামারি করার প্রয়োজন আছে। তবে দুর্বল ক্ষীণদেহ নিয়ে তার পূর্বোক্ত অনুভূতিকে বাস্তবে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হলে যে বিপদ ঘটতে পারে, সেটা বুঝেই দুর্জনের সঙ্গ পরিত্যাগ করে তিনি মাঝে-মাঝে সরে এসেছেন। ঐ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে তার অল্পবয়সে– বিজ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর প্রবীণ বয়সে কোনোদিনই তাকে অপ্রীতিকর অপমানজনক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। এখন হঠাৎ এই উদ্ধত যুবকের ব্যবহারে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, মকলের দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বদ্ধাঙ্গলি-প্রসারিত হস্তের কবজি চেপে ধরলেন তিনি, আঙুল বাঁকা করব না বৎস, গোটা শরীরটাকেই বাঁকিয়ে দিচ্ছি।
মুকুন্দের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে যে-ছেলেটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, ত্রিবেদী স্যারের বরাতে আজ দুর্গতি আছে- সে অবাক হয়ে দেখল মর্তিমান বিভীষিকা বিখ্যাত বাঘা মুকুন্দের মুখে ফুটে উঠেছে নিদারুণ যন্ত্রণার চিহ্ন! একবার ঝটকা মেরে সে হাতটাকে ত্রিবেদীর কবল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না… অবশেষে তার গলা থেকে বেরিয়ে এল কাতর আর্তনাদ, ছাড়ুন, ছাড়ুন, লাগছে!
ছেড়ে দেব? ত্রিবেদী খুব নিরীহভাবে জানতে চাইলেন, খুব লাগছে বুঝি? আচ্ছা, তবে ছেড়ে দিলাম।
পরক্ষণেই মুকুন্দর বিশাল দেহ সবেগে শূন্যে উঠে সশব্দে ছিটকে পড়ল মাটির উপর!
ত্রিবেদী বললেন, আচ্ছা, এইবার তুমি উঠে এসে আমার আঙুলটা বাঁকাও তো দেখি।
অতিকষ্টে উঠে বসে যাতনাবিকৃতস্বরে মুকুন্দ বলল, রক্ষে করুন মশাই। আমার নাম মুকুন্দ, লোকে বলে বাঘা মুকুন্দ– সেই বাঘকে আপনি এক আছাড়ে ছাগল বানিয়ে দিয়েছেন!
সে একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেই আবার আর্তনাদ করে বসে পড়ল। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না– দুই হাতে কোমর চেপে ধরে সে নিজেকে খাড়া রাখতে চেষ্টা করছিল এবং তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্পষ্ট আর্তস্বর!
ত্রিবেদী নিজেও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, মুকুন্দের দুরবস্থা দেখে তার মায়া হল, এগিয়ে এসে তিনি বললেন, খুব লেগেছে?
লেগেছে মানে? বিকৃতস্বরে মুকুন্দ বলল, মনে হচ্ছে আমার কোমরের উপর এক ডজন হাতি ডন-বৈঠক দিচ্ছে! আপনি স্যার, আমার আর আমাদের পাড়ার সর্বনাশ করলেন- উঁহু!
তার মানে? ত্রিবেদী হতভম্ব, তোমার মতো জোয়ান ছেলে এই আঘাতের ফলে আর কতক্ষশ কাবু হয়ে থাকবে? আর পাড়ার কথা উঠছে কিসে? আমি তোমাদের পাড়ার কী সর্বনাশ করলাম?
–আজ আমাদের পাড়া অর্থাৎ গোলাপ কলোনির সঙ্গে বাগনান ক্লাবের কপাটি প্রতিযোগিতা আছে। আমি না খেললে আমাদের পাড়া নির্ঘাত হেরে যাবে। কিন্তু আপনি আছাড় মেরে আমার কোমর এমন মচকে দিয়েছেন যে, খেলা তো দূরের কথা, উঠে দাঁড়াতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
হ্যাঁ, স্যার সত্যি কথা, মুকুন্দের কবলমুক্ত হয়ে যে বালকটি এতক্ষণ বাঘা মুকুন্দ আর অধ্যাপক ত্রিবেদীর দ্বৈরথ উপভোগ করেছিল, সে এইবার বলে উঠল, মুকুন্দদা না খেললে আমরা নির্ঘাত কপাটি-ম্যাচে হেরে যাব। বাগনান ক্লাবের গদাই-এর গালে যেমন চাপদাড়ি, গায়েও তেমনি ভীষণ জোর। মুকুন্দদা ছাড়া কেউ তাকে এঁটে উঠতে পারে না।
তাই নাকি? ত্রিবেদী হাসলেন, কপাটি খেলা আমাদের জাতীয় খেলা। এইসব ব্যাপারে আমার ভারি উৎসাহ। মুকুন্দ, তুমি চিন্তা কোরো না, তোমার বদলে আজ আমিই খেলব। চলো, কোনদিকে তোমাদের কপাটি-খেলার মাঠ– আমি সাইকেল চালাচ্ছি, তুমি সামনের রডে বসে আমায় রাস্তা দেখাও।
৩. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও খেলোয়াড় গদাই
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও খেলোয়াড় গদাই
কলকাতার কাছে গোলাপ কলোনি নামে এক শহরতলিতে এসে অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী এক আশ্চর্য-গাছ আবিষ্কার করেছেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে শরীরে অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয় বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত আশ্চর্য-পাতার ভেষজ গুণ চিরস্থায়ী কিনা, অথবা সাময়িকভাবে স্থায়ী হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ, এবিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি অধ্যাপক ত্রিবেদী।
তিনি যেখানে থাকেন, সেই গোলাপ কলোনির সঙ্গে বাগনান ক্লাবের কপাটি-প্রতিযোগিতা শুরু হতে আর বিশেষ দেরি নেই, কিন্তু প্রধান খেলোয়াড় মুকন্দ ওরফে বাঘা মকলের অনুপস্থিতি গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে বোঝা যায় বাঘা মুকুন্দের ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের সহায়তা না পেলে গোলাপ কলোনিকে যে পরাজয়ের কলঙ্ক বহন করতে হবে এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
পল্টু নামে গোলাপ কলোনির এক খেলোয়াড় বলল, চারটে বাজতে আর দেরি নেই। চারটে থেকে খেলা শুরু। মুকুন্দ না এলে তো মহা মুশকিল।
মুশকিল তো বটেই, দলের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তবে খেলা বন্ধ রাখা যাবে না। মুকুন্দ না এলে তাকে বাদ দিয়েই আমাদের খেলতে হবে। কিন্তু ও আসছে না কেন? আমাদের ক্লাবকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, ওকে বাদ দিয়ে খেললে আমরা যে হারব, একথাও সে জানে– তবে? তবে কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল?
হতে পারে, বলাই নামে আর একটি খেলোয়াড় মন্তব্য করল, মুকুন্দ যা কাঠ-গোঁয়াড়, কোথায় হয়তো মারামারি বাধিয়ে বসেছে। রাগলে তো হতভাগার জ্ঞান থাকে না।
সেটাই সম্ভব, উদ্বিগ্নকণ্ঠে শশাঙ্ক বলল, নিশ্চয় কারও সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছে। নইলে আজকের ম্যাচে সে নিশ্চয়ই হাজির থাকত।
অত ভাবছ কেন ক্যাপ্টেন? একটি বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারার খেলোয়াড় এগিয়ে এল, মুকুন্দের উপর আমরা বড়ো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। এটা ঠিক নয়। আমরা কি খেলতে জানি না? মুকুন্দ না খেললে হেরে যাব এটা কেমন কথা?
তোর দম আছে, জোর আছে, খেলিসও ভালো স্বীকার করছি, আর একজন খেলোয়াড় বলে উঠল, কিন্তু মদন, গদাইকে তুই সামলাতে পারবি?
তা-তা-হ্যাঁ, এটাই তো সমস্যা, শুকনো মুখে মদন বলল, গদাইকে নিয়েই তো ভয়। মুকুন্দ ছাড়া আর কেউ গদাইকে সামলাতে পারে না।
বাগনান ক্লাবের তরফ থেকে একজন হেঁকে বলল, ওহে শশাঙ্ক, চারটে তো বাজল– এইবার মাঠে নেমে পড়া যাক, কি বলো?
যে খেলোয়াড়টি হাঁক দিল তার চেহারাটা সত্যি দেখার মতো। তার লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড দেহের সর্বত্র খেলা করছে মাংসপেশীর তরঙ্গ, আর সেই অতিশয় দর্শনীয় দেহের ভারসাম্য রেখে দুই গালের শোভা বর্ধন করছে বিশাল চাপদাড়ি এবং ঠোঁটের উপর একজোড়া ঘন কালো গোঁফ! মাথার চুল ঢেকে বাঁধা রয়েছে একটা রঙিন বুটিদার রুমাল খেলার সময়ে চুলগুলো যাতে মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দৃষ্টিকে না ব্যাহত করে, সম্ভবত সেইজন্যেই রুমালের শাসন। দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে তার চোহরাই সর্বপ্রথম দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম গদাই, যাকে নিয়ে গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের এত দুশ্চিন্তা।
গদাই-এর হাঁক শুনে গোলাপ কলোনির ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, মুকুন্দ এখনো আসেনি। গদাই, আমরা তার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
হ্যাঁ, মুকুন্দ না থাকলে খেলাটা তেমন জমবে না, গদাই তার অভিমত জানাল, আমরা ওর জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
আমিই রাজি নই, মধ্যস্থ অনিলবাবু তার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, চারটে বেজে পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। এবার ম্যাচ শুরু করতেই হবে।
মধ্যস্থের কথার উপর কথা চলে না। উভয়পক্ষের সমর্থক ও দর্শকদের প্রবল উত্তেজনার মধ্যে খেলা শুরু হল…
কিছুক্ষণ খেলা চলার পর দেখা গেল গোলাপ কলোনির অবস্থা কাহিল। দৈত্যাকৃতি গদাই যেন একাই একশো! সে দান দিতে এলে তিন-চারজন মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারে না অপরপক্ষের কোনো খেলোয়াড় বাগনান ক্লাবের সীমানার মধ্যে হানা দিতে এসে দৈবাৎ যদি গদাই এর কবলে ধরা পড়ে, তাহলে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার ক্ষমতা তার হয় না, সেইখানেই তার খেল খতম!
মধ্যবর্তী বিরতির সময়ে দেখা গেল গোলাপ কলোনির সাতজন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজনরেই মোড় হয়েছে, অর্থাৎ বসে পড়েছে। মুকুন্দকে বাদ দিলে ওই দুজনই গোলাপ কলোনির সেরা খেলোয়াড়, কিন্তু উভয়পক্ষই বুঝে গেছে আবার খেলা আরম্ভ হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পূর্বোক্ত দুই খেলোয়াড় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পক্ষে দুজন খেলোয়াড় এখনও কোনোরকমে পরাজয় ঠেকিয়ে রেখেছে, কিন্তু বিরোধীপক্ষ বাগনান ক্লাবে এখনও সক্রিয় হয়ে অবস্থান করছে পাঁচজন খেলোয়াড়–মোড় হয়েছে মাত্র দুজন।
..খেলার মধ্যবর্তী বিরতির নিদিষ্ট পনের মিনিট পেরিয়ে গেল, মধ্যস্থ আবার খেলা শুরু করার নির্দেশ দিতে যাবেন- এমন সময়ে হঠাৎ শোনা গেল বহুকণ্ঠের উল্লসিত কোলাহল, মুকুল এসেছে! মুকুন্দ এসেছে!
সচমকে কোলাহল লক্ষ্য করে চোখ ফেরাতেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক আর মদন দেখতে পেল খেলার মাঠে উপস্থিত হয়েছে মুকুন্দ। কিন্তু এ কী দৃশ্য!–সাইকেলে সামনের রডে বসে আছে মুকুন্দ এবং যথাস্থানে আসন গ্রহণ করে তিরবেগে সাইকেল চুটিয়ে আসছেন অত্যন্ত রোগা ও দুর্বল চেহারার চশমাধারী এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের চেহারা যেমনই হোক, লোকটা খুব দুর্বল নয়। শশাঙ্ক নিজের মনেই বলল, মুকুন্দর মতো যা চেহারার জোয়ানকে নিয়ে যে-লোক এত জোরে সাইকেল চালাতে পারে, তাকে দেখতে যত রোগাই লাগুক, আসলে মানুষটা খুব দুর্বল নয়।
ততক্ষণে একেবারে সামনে এসে পড়েছে মুকুন্দ। সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, এগিয়ে এল মুকুন্দ ক্যাপ্টেনের সামনে। খুব গম্ভীর হয়ে মুকুন্দের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বলল, তোমার আর একটু দায়িত্বজ্ঞান থাকা উচিত ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যে এসে পড়েছ এটাই আশার কথা। আমাদের দলে এখন রয়েছি আমি আর মদন, সুতরাং আমাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। বাগনান ক্লাবের গদাইকে নিয়ে পাঁচজন খেলুড়ে মজুত। এখন মদনকে বসিয়ে ওর বদলে তুমি মাঠে নামবে। একবার চেষ্টা করে দেখি– তুমিই আমাদের শেষ ভরসা, মুকুন্দ।
না হে ক্যাপ্টেন, আমি খেলতে পারব না, মুকুন্দ বলল, আমার কোমরে সাংঘাতিক মচকে গেছে। আমার বদলে এই ভদ্রলোক ওহো, তোমার সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি এ হচ্ছে আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক দত্ত, আর ইনি আমাদের পাড়ায় নবাগত অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। হ্যাঁ, যা বলছিলাম আমার বদলে ত্রিবেদী স্যারই খেলবেন।
আমরা ভীষণভাবে হেরে যাচ্ছি, ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল শশাঙ্ক, এই সময় রসিকতা ভালো লাগে না, মুকুন্দ।
–আরে না, রসিকতা নয়। শোনো এই দিকে, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি..
গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, আমাদের ক্যাপ্টেন শশাঙ্ককে ডেকে নিয়ে মুকুন্দ কী এমন প্রাইভেট টক করছে রে! সঙ্গে আবার একটা রোগা-পটকা লোক।
-ওই তো সাইকেলে চাপিয়ে মুকুন্দকে নিয়ে এল। লোকটা পাড়ায় নতুন এসেছে। কোনো একটা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে, ওরে গদাই, বাঘা মুকুন্দ এসে গেছে। এইবার সাবধানে খেলতে হবে।
গদাই-এর কপালে ভাঁজ পড়ল, কুঁচকে গেল ভুরু। মুকুন্দকে আমি ভয় পাই না। আমরা পাঁচজন আর ওরা মাত্র দুজন… আরে! ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে মনে হচ্ছে।
গদাই, দ্যাখ, বাগনান ক্লাবের এক খেলোয়াড় উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, মুকুন্দ খেলছে না। মুকুন্দের বদলে একটা রোগা-পটকা লোককে ওরা মাঠে নামাচ্ছে!… কী আশ্চর্য! উনি তো অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী, কলোনিতে নতুন এসেছেন।
গদাই অট্টহাস্য করে বলল, মুকুন্দই তো জোর করে লোকটাকে মাঠে নামাল মনে হচ্ছে। মুকুন্দটার মাথা খারাপ হল নাকি? ওই তালপাতার সেপাইকে তো ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে।
গোলাপ কলোনির পাঁচজন খেলোয়াড়ই মোড় হয়ে বসে পড়েছে। নিয়ম-অনুসারে বিরোধী দলের কোনো খেলোয়াড়কে ঘায়েল করতে পারলে নিজের দল থেকে দলপতির নির্বাচন অনুযায়ী একজন মোড় বা বসে-যাওয়া খেলোয়াড় আবার উঠে খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের পাঁচজন খেলোয়াড় যেখানে সক্রিয় আবার তাদের মধ্যে গদাই-এর মতো বিভীষিকাও যেখানে উপস্থিত সেইখানে মাত্র দুজনের পক্ষে গদাই সমেত আর চার-চারটি খেলোয়াড়কে বিধ্বস্ত করা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। তা-ও যদি মুকুন্দ খেলত, তাহলে যৎপরোনাস্তি ক্ষীণ হলেও একটু আশা ছিল কিন্তু মুকুন্দের পরিবর্তে অধ্যাপক মশাইকে মাঠে নামতে দেখে গোলাপ কলোনির সমর্থকরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়ল।
অন্যান্য খেলোয়াড়দের সমবেত আপত্তি তুচ্ছ করেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ত্রিবেদীকে মাঠে নামাল। তার আগে অবশ্য শশাঙ্ককে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চুপি চুপি জানিয়েছিল মুকুন্দ। অন্য খেলোয়াড়দের কাছে অবশ্য ব্যাপারটা সে চেপে গিয়েছিল। বাঘা মুকুন্দকে একটা লোক সজোরে আছাড় মেরেছে এটা তো গর্ব করে বলার বিষয় নয়– শশাঙ্ককে সব কথা খুলে না বললে সে ত্রিবেদীকে মাঠে নামাতে রাজি হত না বলেই তাকে আদ্যন্ত নিগ্রহের ইতিহাস খুলে বলতে বাধ্য হয়েছিল মুকুন্দ। ওই সঙ্গে অবশ্য অনুরোধ করেছিল আছাড় মারার লজ্জাকর ঘটনা যেন শশাঙ্ক গোপন রাখে।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্ষীণকায় অধ্যাপক মশাইকে নিরীক্ষণ করতে করতে শশাঙ্ক বলেছিল, ভদ্রলোককে দেখলে তোমার কথা বিশ্বাস করা শক্ত, মুকুন্দ। তবে অধ্যাপক মশাই যে তোমার মতো গায়ে-গতরে ভারি মানুষকে নিয়ে বন্ বন্ করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন, সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছি। যাক তোমার কথামতো ভদ্রলোককে নামাচ্ছি। একটা এক্সট্রা জার্সি ছিল, কাজে লেগে গেল। এখন দেখা যাক কি হয়।
…চুউউ-ইই-কি-কিৎ-কিৎ, দম নিয়ে একজন বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড় দান দিতে ঢুকল গোলাপ কলোনির ঘরে। হঠাৎ নিচু হয়ে প্রায় ড্রাইভ দেওয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিয়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়টিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল শশাঙ্ক। তার চেষ্টা সফল হল না- বিপক্ষের খেলোয়াড় সজোরে ধাক্কা মেরে আলিঙ্গনে উদ্যত দুই হাতের বন্ধন এড়িয়ে গেল এবং তিরবেগে ছুটে নিরাপদ সীমানার খুব কাছে পৌঁছে গেল কয়েকমুহূর্ত পরেই খেলোয়াড়টি নিজের ঘরে পৌঁছে যাবে আর মোড় হয়ে বসে যাবে ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক! বাগনান ক্লাবের সমর্থকদের ভিতর থেকে একটা তীব্র উল্লাসধ্বনি উঠেই থেমে গেল তৎক্ষণাৎ, কারণ—
আচম্বিতে একটা গতির ঝড় যেন উড়ে এসেছে পলাতক খেলোয়াড়ের দিকে এবং মুহূর্তের মধ্যে একজোড়া পা সাঁড়াশির মতো তার কোমর পেঁচিয়ে তাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে!
ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ধাক্কার চোটে ছিটকে পড়েছিল, এখন ভূমিশয্যা ত্যাগ করে সে ছুটে এল ত্রিবেদীকে সাহায্য করতে। কিন্তু শশাঙ্কর উদ্যম তখন বাহুল্য মাত্র, ত্রিবেদীর দুই সরু ঠ্যাং-এর যাঁতাকলে পড়ে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে গেছে নিজের সীমানায় ছুটে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
এতক্ষণ পরে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটল। নিয়ম-অনুযায়ী বাগনান ক্লাবের ধরা-পড়া খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসে পড়ল এবং মোড় হয়ে বসে পড়া গোলাপ কলোনির দল থেকে একজন খেলোয়াড় খেলাতে অংশগ্রহণ করতে মাঠে নামল। গোলাপ কলোনির অবস্থা এখন আর অতটা শোচনীয় নয়– পাঁচ আর দুই-এর পরিবর্তে চার-এর বিরুদ্ধে তিন-এর লড়াই গোলাপ কলোনির খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার করল।
ত্রিবেদীর কীর্তি বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। একজন খেলোয়াড় গদাইকে উদ্দেশ করে বলল, ওরে গদাই, এ তো সাংঘাতিক খেলুড়ে– বর্ণচোরা আম! চোখে কানে দেখতে দিল না, ঝড়ের মতো উড়ে এসে কাঁচি মারল ঝংকার কোমরে! আরে ব্বাস রে বাস!
গদাই বলল, লোকটা চটপটে আছে। তবে আমার কাছে চালাকি চলবে না। আসুক একবার এইদিকে।
–ওরে গদাই, ওই লোকটাই যে দান দিতে আসছে রে!
আসুক। ঝট করে চেপে ধরলে আর নড়তে পারবে না। যতই চটপটে হোক, অত রোগা লোকের গায়ে জোর থাকে না। চেপে ধরলেই ফিনিশ… সাবধান ঝন্টু, ও আসছে।
ত্রিবেদী এলেন। এ আগমন নয়, আবির্ভাব!
বিদ্যুতের শিখা যেন সহসা প্রকাশ!চুকিৎ-কিৎ শব্দে দম নিতে নিতে ত্রিবেদী যখন নিজের সীমানায় ফিরে গেলেন, তখন দেখা গেল বাগনান ক্লাবের আরও দুই খেলোয়াড় অধ্যাপক মশাই-এর স্পর্শসখ অনুভব করতে করতে মাটির উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে।
যে-ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে গদাই বলেছিল রোগা লোকের গায়ে জোর হয় না, চেপে ধরলেই ফিনিশ, সে এইবার গদাই-এর দিকে তাকিয়ে তিক্তস্বরে বলে উঠল, কী রে গদাই, কী হল? তুই না বলেছিলি চেপে ধরলেই ফিনিশ! এখন দেখছিস তো ফিনিশ হওয়ার জিনিস এ নয়। আরে ব্বাস- যেন একটা ঝড় ছুটে গেল।
অপর দিকের সীমানায় দণ্ডায়মান ত্রিবেদীর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে গদাই বলল, যদি একবার ধরতে পারতাম, তাহলে দেখিয়ে দিতাম ফিনিশ করা যায় কিনা. আচ্ছা, এবার আমি যাচ্ছি।
চুকিৎ-কি-কিৎ দম নিতে নিতে অগ্রসর হল গদাই, মনে মনে বলল, তালপাতার সেপাইটাকে একবার নাগালে পেলে হয়, এমন একখানা ঝাড়ব যে বাছাধনকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
তালপাতার সেপাই অর্থাৎ অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপর এখন গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়দের অগাধ বিশ্বাস ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক ফিস্ ফিস্ করে ত্রিবেদীকে বলল, গদাই আসছে। ত্রিবেদী স্যার, ওকে ধরে ফেলুন। গদাই বসে গেলে নির্ঘাত জিতব। আপনি যদি গদাইকে মাত্র কয়েক সেকেন্ড রুখে দিতে পারেন, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে কাবু করতে পারব।
দরকার হবে না, ত্রিবেদী হাসলেন, গদাইকে ধরতে পারলে কারও সাহায্য ছাড়া আমি একাই ওকে কাবু করতে পারব।
গদাই এসে ঢুকল প্রতিপক্ষের সীমানার মধ্যে। মুখে তার দম নেওয়ার কিৎ-কিৎ ধ্বনি, তার শালের গুঁড়ির মতো দুই পেশিপুষ্ট বাহু ছোবল মারার জন্য প্রসারিত- গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়রাও তাকে ঘিরে ফেলতে সচেষ্ট… দর্শকদের মধ্যেও তখন প্রবল উত্তেজনা– দারুণ খেলছে গদাই… দুজন ওকে জড়িয়ে ধরতে এসে ছিটকে পড়ল… আরও একজন…শাবাশ গদাই, শাবাশ! তিনজনকে মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে গদাই!
-উঃ! আমার চোয়ালটাও যে মেরে উড়িয়ে দিলে মশাই!
-স্যরি! খেলার ঝোঁকে হাত ছুঁড়েছি, কনুইটা আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। কিছু মনে করবেন না।
–না, না, মনে করব কেন? খেলার ঝেকে আমার হাতের মুঠো যদি হঠাৎ মশাই-এর নাকে লেগে যায়, আশা করি আপনিও কিছু মনে করবেন না।
তার মানে? আমার কনুইটা হঠাৎ আপনার চোয়ালে লেগে গেছে। আমি কি ইচ্ছে করে আপনাকে মেরেছি? আর আপনি এখন আমার নাকে ঘুসি মারতে চাইছেন? একবার মেরে দেখুন
–তাই নাকি? দেখবেন তবে?
অনেকগুলো ক্রুদ্ধকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, দুটোকেই ঘাড় ধরে বার করে দেব। ঝগড়া করার বাসনা থাকলে এখান থেকে সরে গিয়ে যত খুশি গুঁতোগুতি করুন। এখানে ঝামেলা করলে দুজনকেই আগাপাশতলা ভালো মতো পালিশ করা হবে।
এমন ভয়ংকর নিরপেক্ষ বিচারের সম্ভাবনা কনুই এবং ঘুসি উভয় পক্ষকেই নিরস্ত ও নীরব করে দিল। জনতা আবার খেলার মাঠের দিকে মনোনিবেশ করল…
গদাই তখন প্রায় নিজের ঘরে ফিরে গেছে, হঠাৎ পিছন থেকে একলাফে এসে তার একটা পা চেপে ধরলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই তিনি অনুভব করলেন তার শরীর থেকে সমস্ত শক্তি অন্তর্ধান করছে, অস্ফুটস্বরে তিনি বলে উঠলেন, সর্বনাশ! আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে!
নিজেকে মুক্ত করার জন্য গদাই পা ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ত্রিবেদীর দেহ শূন্যপথে উড়ে গিয়ে মাঠের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে ছিটকে পড়ল!
দর্শকদের ভিতর থেকে ভেসে এল বিরূপ মন্তব্য। ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা যায় না।
–হুঁ, হুঁ, বাবা; ওর নাম গদাই। এতক্ষণ বাবাজি খুব খেল দেখাচ্ছিলেন, এখন শক্ত পাল্লায় পড়ে হিম্মৎ ছটকে গেছে।
-হা! হা! হা!
ভিড়ের ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল মুকুন্দ! কী হল স্যার? লাগল নাকি?
না, লাগেনি, ত্রিবেদী বললেন, ভাগ্যিস এই গাছটা ছিল, এটার ডালপালার উপর পড়েছিলাম বলেই বেঁচে গেছি, নয়তো হাড়গোড়–আরে! আরে! এ কী!
-কী হল স্যার? হঠাৎ অমন চেঁচিয়ে উঠলেন কেন?
–না, না, ও কিছু নয়। একটা লতা দেখে সাপ ভেবে ভুল করেছিলাম।
ঝোপের মধ্যে সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার কোথাও চোট লাগেনি তাহলে?
-না, না।
–ওখানে আর দাঁড়াবেন না। দলের সবাই যেখানে মোড় হয়ে বসে পড়েছে, সেইখানে গিয়ে বসুন। যদি বরাত ভালো থাকে, আপনি আবার একটা সুযোগ পেতে পারেন।
কিন্তু ত্রিবেদী তখন মুকুন্দের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না– দুই চোখ পাকিয়ে তিনি সেই গাছটার দিকেই তাকিয়েছিলেন, যেটা তার শূন্যপথে ধাবমান দেহকে কঠিন ধরণীর সাংঘাতিক সংঘাত থেকে রক্ষা করেছে। ত্রিবেদীর অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই গাছটার স্বরূপ নির্ণয় করতে পেরেছে, মাঠের একপাশে ঝোপের মধ্যে অভাবনীয় ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে আশ্চর্য-পাতার একটি গাছ!
মুকুন্দের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটা আশ্চর্য পাতা মুখে পুরে দিলেন ত্রিবেদী, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দলের যে সব খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসেছিল, তাদের মধ্যে স্থান গ্রহণ করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বিরোধীপক্ষের একজনকে ছুঁয়ে নিরাপদে ফিরে এল নিজেদের সীমানার মধ্যে। কপাটি খেলার নিয়ম-অনুসারে একপক্ষের যে কয়েকজন খেলোয়াড় মোড় হবে, বিরোধীপক্ষের সম-সংখ্যক সেই কয়জন খেলোয়াড় আবার মাঠে নেমে খেলতে পারে। অতএব আবার মাঠে নামলেন ত্রিবেদী।
মুকুন্দ তাকে উৎসাহ দিল, ভালো করে খেলবেন স্যার।
ত্রিবেদী অভয় দিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মুকুন্দ। এবার আমি খুব ভালো করে খেলব।
আশ্চর্য-পাতার গুণে ইতিমধ্যেই সর্বাঙ্গে অফুরন্ত শক্তির জোয়ার অনুভব করছেন ত্রিবেদী, তাই মুকুন্দকে অভয় দিতে তিনি কিছুমাত্র ইতস্তত করলেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন বিরোধীপক্ষের খেলোয়াড়রা মিলিতভাবে আক্রমণ করেও তাকে কাবু করতে পারবে না।
শানু নামে এক খেলোয়াড় চুপি চুপি শশাঙ্ককে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রলোক তো একটু আগে দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু গদাই-এর পাল্লায় পড়ে ওনার যে অবস্থা হল, তাতে আমি খুব ভরসা রাখতে পারছি না। ভদ্রলোক অবশ্য মুকুন্দকে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন- তা, তুমি কীরকম বুঝছ ক্যাপ্টেন?
ভালো বুঝছি না, শশাঙ্ক ফিসফিস করে বলল, দলের ক্যাপ্টেন হিসাবে আমি খুব নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না।
ত্রিবেদী হাঁক দিয়ে বললেন, শশাঙ্ক, এবার আমি দান দিতে যাচ্ছি। এই দানেই সবাইকে মেরে ফিরে আসব। খেলা এবং তোমাদের দুশ্চিন্তার এইবারেই শেষ।
উভয়পক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে দুই পক্ষকে তফাত করে যে সরলরেখাঁটি অবস্থান করছে, সেই সরলরেখার একপাশে নিজস্ব সীমানা থেকে বিপক্ষের উপর হানা দিতে এগিয়ে গেলেন ত্রিবেদী এবং শিকারি জন্তু শিকারের উপর ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেমনভাবে সমস্ত শরীরকে গুটিয়ে প্রস্তুত হয়, ঠিক সেইভাবেই প্রস্তুত হলেন তিনি। আশ্চর্য পাতা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে দিয়েছে তাকে!
ত্রিবেদীর আক্রমণোদ্যত ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শানু আবার বলল, গদাইকে ধরতে গিয়ে ভদ্রলোকের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়েছিল বটে, কিন্তু উনি যে ভালো কপাটি-খেলুড়ে সে-কথা উনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে এই মাত্র উনি যে কথা বললেন, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। খেলা আর দুশ্চিন্তার শেষ মানে? এখনই খেলা শেষ করতে হলে ওদের দলের সব কয়টি খেলুড়েকে মোড় করে ফিরে আসতে হবে। একজন লোকের পক্ষে এমন অসাধ্য সাধন কি সম্ভব?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ত্রিবেদীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে গম্ভীর ভাবে শশাঙ্ক বলল, সম্ভব কি অসম্ভব এখনই বুঝতে পারবে- অনর্থক মাথা ঘামিয়ে মরছ কেন?
চু-কিৎ-কিৎ, সজোরে দম নিয়ে বিরোধীদলের সীমানায় এসে পড়লেন ত্রিবেদী এবং গোলাপ কলোনির সমর্থকদের জ্বলন্ত উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ধরা পড়লেন বাগনান ক্লাবের এক খেলুড়ের হাতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় সামান্য একটু ধস্তাধস্তি করতে না করতেই তার উপর ঝাঁপ দিল গদাই, সঙ্গে সঙ্গে পুরো দলটাই ঝাঁপিয়ে পড়ল ত্রিবেদীর উপর। সমবেত খেলোয়াড়ের মিলিত আক্রমণে ধরাশায়ী হলেন ত্রিবেদী। অতগুলো জোয়ান খেলোয়াড়ের দেহের আড়ালে তাঁর ছোটোখাটো শরীরটা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল বটে, কিন্তু দম নেওয়ার চুকিৎ-কিৎ শব্দটা সজোরে ভেসে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল তার দম এখনো ফুরোয়নি, এখনও লড়ছেন তিনি!
দর্শকদের ভিতর থেকে মন্তব্য শোনা গেল, লোকটা প্রথমে খুব আশা দিয়েছিল আমাদের। কিন্তু শেষকালে ডুবিয়ে দিল। এমন আনাড়ির মতো কেউ ধরা পড়ে? ও যেন ধরা দেওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছিল।
–কিন্তু যাই বলো, লোকটার দম সাংঘাতিক। তখন থেকে কিৎ-কিৎ করে যাচ্ছে, থামার নাম নেই।
-আরে কিৎ-কিৎ কতক্ষণ করবে? কতক্ষণ দম রাখতে পারবে ও? সারাদিন চেষ্টা করলেও অতগুলো খেলোয়াড়কে ঠেলে উঠতে পারবে না লোকটা।
আরেকটি বিরূপ মন্তব্য ভেসে এল, ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা হয় না, কপাটি খেলতে গদ লাগে।
তাদের পরিচয় পরক্ষণেই পাওয়া গেল হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝটকায় ছিটকে পড়ল বাগনান ক্লাবের খেলুড়ের দল এবং তাদের দেহের তলা থেকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী! তাকে যারা জাপটে ধরে পেড়ে ফেলেছিল, তারা তখন গড়াগড়ি দিচ্ছে মাঠের উপর, পতনজনিত ধাক্কায় তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে রাশি রাশি সর্ষে ফুল উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তাদের ছিল না।
প্রতিপক্ষের সাময়িক বিহ্বলতার সুযোগ নিলেন ত্রিবেদী, নিজের দলের সীমানা লক্ষ্য করে তিনি দৌড় দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের ভিতর জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি
কিন্তু শব্দটা যেমন হঠাৎ উঠেছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল। সকলের মতো গদাইও ছিটকে পড়েছিল ত্রিবেদীর ধাক্কায়, কিন্তু তার অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতা তার সংবিৎ ফিরিয়ে এনেছিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আচম্বিতে একলাফে উঠে এসে পিছন থেকে সে জড়িয়ে ধরল ত্রবেদীকে– তিনি তখন সীমারেখার খুব কাছে এসে পড়েছেন!
এই অভাবিত ঘটনার স্তব্ধ হয়ে গেল গোলাপ কলোনির সমর্থকদের উল্লাসধ্বনি, তবে সেই নীরবতা স্থায়ী হল মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের জন্য কারণ তারস্বরে চিৎকার করে গদাইকে এবার সংবর্ধনা জানাল বাগনান ক্লাবের সমর্থকবৃন্দ।
হঠাৎ পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে চমকে গেলেন ত্রিবেদী। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সমবেত শক্তিও তাকে বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারবে না, তাই ইচ্ছা করেই তিনি বিরোধীদলের খেলোয়াড়দের আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছিলেন। কপাটির নিয়ম অনুসারে বিপক্ষের যে কয়টি খেলুড়েকে ছুঁয়ে খেলোয়াড় আবার সীমানার মধ্যে দম নিতে নিতে ফিরে আসতে পারবে, সেই কয়জন ছোঁয়া লাগা খেলুড়েকেই মোড় হয়ে বসে পড়তে হবে।
বাগনান ক্লাবের প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তাকে পাকড়াও করার আশায় জড়িয়ে ধরেছিল, এখন তিনি যদি নিরাপদে স্বস্থানে প্রস্থান করতে পারেন, তাহলে বিপক্ষের সব খেলোয়াডকেই মোড় হয়ে বসে পড়তে হবে এবং গোলাপ কলোনি লাভ করবে বিজয়লক্ষ্মীর জয়মাল্য! মনে মনে পরিকল্পনাটি সাজিয়ে নিয়ে ধরা পড়ার অভিনয় করেছিলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী, তার পরিকল্পনায় ভুলও হয়নি কিন্তু বিশাল শরীর আর প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে খেলোয়াড় গদাই অধ্যাপক ত্রিবেদীর সমস্ত উদ্যম আর পরিকল্পনা ব্যর্থ করার উপক্রম করল..
দুই হাতে প্রাণপণে ত্রিবেদীকে চেপে ধরেছিল গদাই, হঠাৎ সে অনুভব করল লোহার সাঁড়াশির মতো পাঁচ-পাঁচ দশটি আঙুল তার হাত চেপে ধরেছে, আর সেই আঙুলের চাপে তার হাত দুটি ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও সে নাছোড়বান্দার মতো আঁকড়ে ধরে রইল ত্রিবেদীকে, কিছুতেই হাতের বাঁধন আগা করতে রাজি হল না।
ত্রিবেদী বুঝতে পারছিলেন আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বাহুবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করতে পারবেন, গদাই-এর হাত তার আঙুলের চাপে অসাড় হয়ে আসছে। কিন্তু আড়-চোখে তাকিয়ে তিনি দেখলেন ধরাশায়ী খেলোয়াড়দের মধ্যে কয়েকজন উঠে বসেছে। তারা সবাই মিলে যদি আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতাও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তাঁর দেহের শক্তি এখনও অক্ষুণ্ণ আছে বটে, কিন্তু দম ফুরিয়ে আসছে। অতগুলো খেলুড়ের হাত ছাড়িয়ে নিতে যে সময় লাগবে, সেই সময়টুকু পর্যন্ত দম ধরে রাখার ক্ষমতা তাঁর থাকবে না– সুতরাং যা করার তা এখনই করতে হবে…
জন দুই আহত খেলুড়ে তখন নিজেদের সামলে নিয়ে ত্রিবেদীর দিকে ছুটে আসার উপক্রম করছে; ত্রিবেদী বুঝতে পারছেন তার দেহের উপর গদাই-এর হাতের বাঁধন আগ্ধ হয়ে এলেও আরও কয়েকটি মুহূর্ত তাকে বন্দি থাকতেই হবে। ইতিমধ্যে অন্য দুই খেলোয়াড়ের উদ্যম ও ধরাশায়ী অন্যান্য সকলের শায়িত অবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হওয়ার প্রচেষ্টা সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ করেছেন ত্রিবেদী এবং সেইসঙ্গে অনুভব করছেন ফুরিয়ে আসছে তার দম, অতএব Now or Never, যা করণীয় করতে হবে এই মুহূর্তে–
পরক্ষণেই শত্ৰুমিত্র উভয় পক্ষের খেলোয়াড়দের চোখগুলো উঠল কপালে, আর বাগনান ক্লাবের সমর্থকদের কোলাহল হল স্তব্ধ- সমবেত জনতাকে স্তম্ভিত করে একটি প্রচণ্ড লক্ষে ত্রিবেদী পৌঁছে গেলেন গোলাপ কলোনির সীমানার মধ্যে; তাকে আঁকড়ে ধরে তখনও ঝুলছে নাছোড়বান্দা গদাই! ত্রিবেদী যখন বুঝলেন গদাই-এর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার আগেই অন্য খেলোয়াড়রা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাদের প্রতিরোধ করে নিজেদের ঘরে ফিরে আসার আগেই ফুরিয়ে যাবে তার দম। তখনই আর গদাই-এর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা না করে একটি সুবৃহৎ লক্ষত্যাগ করেছেন তিনি এবং গদাই-এর গুরুভার বিপুল বপুকে অবলীলাক্রমে বহন করে ফিরে এসেছেন স্বপক্ষের সীমানার মধ্যে।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত– তারপরই বিস্ময়মিশ্রিত তীব্র কোলাহলে ত্রিবেদীকে অভিনন্দন জানাল সমবেত জনতা! সেই কোলাহলে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের সঙ্গে সমানভাবে গলা মিলিয়েছিল বাগনান ক্লাবের সমর্থকবৃন্দ! ত্রিবেদীর কল্পনাতীত কার্যকলাপ এবং অমানুষিক শক্তির পরিচয়ে মুগ্ধ জনতার এই অভিনন্দন স্বতঃস্ফূর্ত, সেখানে মুছে গেছে রেষারেষি আর ভেদাভেদ জ্ঞান! উভয় পক্ষের সমর্থকদের সঙ্গে গোলাপ কলোনির খেলুড়ের দলও গলা মিলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল, কিন্তু বাগনান ক্লাবের খেলোয়াড়রা ছিল নির্বাক, স্তব্ধ।
হঠাৎ বাগনান ক্লাবের দল থেকে এক দৈত্যাকৃতি পুরুষ এগিয়ে এল সেই দিকে, যেখানে অধ্যাপক ত্রিবেদীকে কাঁধে তুলে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছে গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়ের দল। একজন হঠাৎ চিৎকার করে উন্মত্ত আনন্দধ্বনিকে ভাষায় রূপান্তরিত করল, থ্রি চিয়ার্স ফর–
কিন্তু অন্য সকলে ধুয়া ধরে ত্রিবেদীর নাম উচ্চারণ করার আগেই সকলের কণ্ঠস্বর ডুবিয়ে জাগল এক ষণ্ড কণ্ঠের ভৈরব গর্জন চুপ! চুপ! চুপ।
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল গোলাপ কলোনির খেলোয়াড়ের দল। তাদের আনন্দ-উৎসবে বাধা দিতে এগিয়ে এসেছে খেলোয়াড় গদাই! কিন্তু কেন? সে কি ঝগড়া করতে চায়? খুবই অবাক ব্যাপার প্রকাণ্ড দেহ আর প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হলেও গদাই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। খেলার মাঠ ও ব্যায়ামাগার ছাড়া অন্য কোথাও সে তার আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেনি। এমন ভদ্র আর শান্ত মানুষটা হঠাৎ খেপে গেল কেন? নাকি, এই অভাবিত বিপর্যয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে হামলা করতে চাইছে বাগনান ক্লাব? গদাই কি আক্রমণকারীদের অগ্রদূত হতে চাইছে?..
গোলাপ কলোনির ছেলেরা ভীতু নয়, যদিও গদাইকে তারা যথেষ্ট সমীহ করে, তবু মনে মনে আসন্ন লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হল তারা, মুছে গেল তাদের মুখের হাসি, চোয়াল হয়ে উঠল শক্ত ও আড়ষ্ট, সম্ভাব্য হামলা রুখতে নিঃশব্দে প্রস্তুত হল গোলাপ কলোনির খেলুড়ের দল…
সেই ত্রস্ত স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে বেজে উঠল মুকুন্দের সুগম্ভীর কণ্ঠ। কেন? চুপ করব কেন? কী বলতে চাস তুই? মনে রাখিস গদাই, বাঘা মুকুন্দ এখনও মরেনি।
মরিসনি বটে, তবে তোর মরাই উচিত, চেঁচিয়ে উঠল গদাই, বলি কপাটি খেলা কি বিদেশি খেলা? স্বদেশি খেলায় জিতে বিদেশী ভাষায় জিগির দিতে লজ্জা করে না তোদের? আমাদের বাংলা ভাষা কি এতই গরিব?
হকচকিয়ে গেল মুকুন্দ, না, মানে, ইয়ে ব্যাপারটা হচ্ছে–
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠল খেলোয়াড় গদাই, বলো ভাই– জয়, অধ্যাপক ত্রিবেদী কী জয়!
মুহূর্ত পরেই ফেটে পড়ল বহু কণ্ঠের গর্জিত উল্লাস, জয়, অধ্যাপক ত্রিবেদীকী জয়!
গদাই-এর কাঁধে হাত রাখল বাগনান ক্লাবের ক্যাপ্টেন বিজয় চৌধুরি, তোর কি মাথা খারাপ হল গদাই? ওদের দলের খেলুড়ের নামে জিগির দিতে তোর লজ্জা করল না?
লজ্জা করবে কেন? গদাই সপ্রতিভ, আমি খেলোয়াড়, তাই ভালো খেলোয়াড়কে সম্মান জানাতে কখনো লজ্জা পাই না। তোমার মধ্যেই বরং খেলোয়াড়ি মনোভাব নেই, লজ্জা তোমারই পাওয়া উচিত, বিজয়।
মাঠের উপর থেকে জনতার অধিকাংশ মানুষই যখন অন্তর্ধান করেছে বা করছে, সেই সময় দেখা গেল দর্শকরা যেখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল, সেইখানে তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি কী-যেন ভাবছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আর একটি লোক পূর্বোক্ত ব্যক্তির মুখের দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করছে।
প্রথম ব্যক্তি দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে ও উচ্চতায় খুবই সাধারণ, গায়ের রং নাফর্সা, নাকালো, তবে খুব ভালোভাবে লক্ষ করলে তার চোখে-মুখে একটা ধূর্ত নিষ্ঠুরতার আভাস ধরা পড়ে। কিন্তু সেটা এমন কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নয়। তবে হ্যাঁ, এই শহরতলিতে কোট-প্যান্ট, নেকটাই ও বুটজুতোয় সজ্জিত নিখুঁত সাহেবি পোশাক-পরা মানুষ বড় একটা চোখে পড়ে না– সেদিক থেকে বিচার করলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি নিশ্চয়ই কিছুটা বৈশিষ্ট্যের দাবি করতে পারে। পরবর্তীকালে আমাদের কাহিনিতে সে যখন আবার আত্মপ্রকাশ করবে, তখন আমরা দেখতে পাব তার চলনেবলনে এমন এক ভয়াবহ বন্য ব্যক্তিত্বের প্রভাব রয়েছে, যাকে তুচ্ছ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যে প্রথম ব্যক্তির চেহারা কারও নজরে পড়ার কথা নয়। কিন্তু তার সঙ্গীর কেশহীন মসৃণ মস্তক, অত্যন্ত খর্ব ও অত্যন্ত পেশীবহুল দুই বাহু ও বিস্তৃত বক্ষপট ভিড়ের মধ্যেও মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। তার গায়ের রং বেশ ফর্সা, আর যে গেঞ্জিটা তার অতি-খর্ব, অতিবলিষ্ঠ গৌরবর্ণ দেহের শোভা বৃদ্ধি করছে, সেই ডোরাকাটা গেঞ্জিটাও রং-এর বাহারে দস্তুরমতো দ্রষ্টব্য বস্তু।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর খর্বকায় দৈত্য সাহেবি পোশাকে সজ্জিত সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ডাক্তার! আমরা তো দিনের আলো থাকতে থাকতে ভালো করে এই এলাকাটাকে একনজরে মেপে নিতে এসেছিলাম, এখন যে বেলা পড়ে গেল, একটু পরেই সব আঁধারে ঢেকে যাবে। কেন যে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ঢুকে এতক্ষণ কপাটি-খেলা দেখে সময় নষ্ট করলেন, তা বুঝলাম না।
ডাক্তার নামে অভিহিত ব্যক্তির মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল, বৎস গজু, কেন যে আমি সময় নষ্ট করলাম, সেটা বুঝলে আমার বদলে তুমিই লিডার হতে। জেনে রাখো বোকারাম আমি অকারণে সময় নষ্ট করি না…।
কে এই ডাক্তার? চেহারা দেখে আর যাই হোক, মানুষটিকে চিকিৎসক বলে তো মনে হয় না। আর ডাক্তারের সঙ্গী গজু নামক জীবন্ত বিভীষিকাকে কোনো চিকিৎসকের অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা সহকারী বলে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। কপাটি-খেলার দর্শকের ভূমিকায় ডাক্তার নামে অভিহিত ব্যক্তির চালচলন দস্তুরমতো রহস্যজনক বলে মনে হলেও রহস্য সমাধানের জন্যে আমাদের পরবর্তী কাহিনির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে, যার নাম অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডাঃ সাটিরা!
৪. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডা. সাটিরা
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডা. সাটিরা
০১. অনাহুত অতিথি
উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী কলকাতার কাছে গোলাপ কলোনি নামে শহরতলিতে ভুতুড়ে। বাড়ি বা হানাবাড়ি বলে অপবাদগ্রস্ত একটি পরিত্যক্ত অট্টালিকার উদ্যানের মধ্যে দৈবক্রমে আশ্চর্য-পাতা আবিষ্কার করেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে অবিশ্বাস্য দৈহিক শক্তি লাভ করা যায়। কিন্তু সেই শক্তি সাময়িক, চিরস্থায়ী নয়। আশ্চর্য-পাতা আবিষ্কার করার পর থেকে ত্রিবেদী মশাই ক্রমাগত বিপদে পড়েছেন, তবে শেষ পর্যন্ত ওই সব বিপদ কাটিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন। এই গ্রন্থে লিখিত পূর্ববর্তী কাহিনিগুলি যে-সব পাঠকের পড়া আছে, তাদের কাছে অধ্যাপক ত্রিবেদীর দুর্ভোগের ইতিহাস অজানা নয়। এখন দেখা যাক অধ্যাপক মশাই-এর জন্যে আবার কোন্ নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে…।
গবেষণাগারের মধ্যে একটি খালি বোতলের ভিতর অন্য একটি পাত্র থেকে রক্তবর্ণ তরল নির্যাস ঢালতে ঢালতে ত্রিবেদী আপনমনেই বলে উঠলেন, বিভিন্ন গাছের শিকড় ও লতা মিশিয়ে যে তরল পদার্থটি প্রস্তুত করেছি, গবেষণার ক্ষেত্রে এটিকে অত্যাশ্চর্য বিশেষণ দিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। তবে মনুষ্যসমাজের পক্ষে আমার এই আবিষ্কার শুভ হবে কি অশুভ হবে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। যদি বুঝতে পারি আমার এই আবিষ্কার মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণকেই ডেকে আনবে, তাহলে অবশ্য এই বস্তুটি যাতে জনসাধারণের হস্তগত না হয় সেই ব্যবস্থাই করব।
আচম্বিতে সনাতনের তীব্র কণ্ঠস্বর অধ্যাপকের চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল, বাবু, আপনাকে দুজন লোক ডাকতিসে- ঈসস!
গভীর চিন্তায় মগ্ন অধ্যাপক এমন চমকে উঠলেন যে, তাঁর হাত থেকে টেবিলের উপর পাত্রটা ছিটকে পড়ে উলটে গেল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ত্রিবেদী ধমকে উঠলেন, এমন হঠাৎ করে কানের কাছে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলি কেন? তোর গলা শুনে হাতের পাত্রটা টেবিলের উপর ফেলে দিলাম। ভাগ্যিস এটার মধ্যে যা ছিল তার সবটাই বোতলে ঢেলে ফেলেছি– নইলে সমস্ত জিনিসটা গড়িয়ে পড়ে পনের দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম পণ্ড করে দিত।
খুব দুঃখ-দুঃখ মুখ করে সনাতন ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, ঈসস!
অধ্যাপক ত্রিবেদী খুব রগচটা মানুষ নন, সনাতনের মুখের ভাব দেখে আর তার কণ্ঠনিঃসৃত অব্যয় শব্দটি শ্রবণ করে তার মনে হল সনাতন বোধহয় যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও অনুতপ্ত, অতএব তার উত্তপ্ত মেজাজ তখনই ঠান্ডা হয়ে গেল এবং তিনি অনুভব করলেন অনুতপ্ত সনাতনকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। অতএব গলার স্বর খুব নামিয়ে যথাসম্ভব কোমল-স্বরে ত্রিবেদী বললেন, যাক গে, তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। তবে জিনিসটা যদি বোতলের মধ্যে আগেই ভরে না ফেলতাম, তাহলে জিনিসটা বাইরে পড়ে গিয়ে আমার সব খাটুনি নষ্ট হত।
সনাতনের ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না, অত্যন্ত দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে সে আবার বলল, ঈস!
ত্রিবেদীর ভ্রূ কুঁচকে গেল, তখন থেকে ঈস, ঈস করছিস কেন? বললাম তো জিনিসটা বেঁচে গেছে, বিশেষ ক্ষতি হয়নি।
-কিন্তু জিনিসটা তো বাঁচলোনি বাবু।
–কী পাগলের মতো বকছিস? পাত্রটা ছিটকে পড়ে উলটে গেছে বটে, কিন্তু ওটার মধ্যে আর কোনো পদার্থ নেই। সব জিনিসটাই আগে-ভাগে আমি বোতলে ঢেলে রেখেছি।
আজ্ঞে, সেই কথাই তো বলছি। বোতলটা যে ফাটা!
য়্যাঁ! বলে কী! টেবিলের উপর বোতলটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন ত্রিবেদী- কী। সর্বনাশ! তার আবিষ্কৃত রক্তবর্ণ নির্যাসের একটি তরল স্রোত বোতলের গা বেয়ে টেবিলের কিছু অংশ লালে লাল করে দিয়েছে!
সনাতন এগিয়ে এসে বোতলটা তুলে ধরতেই ফাটা জায়গাটা নজরে এল। ফোঁটা ফোঁটা করে ফাটা জায়গা দিয়ে গড়িয়ে নামছে অধ্যাপক ত্রিবেদীর তরল আবিষ্কার। এই অভাবিত দুর্ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন অধ্যাপক, কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে এই মুহূর্তে যা করা উচিত সেটা ভেবে নিয়ে সনাতনকে কিছু বলতে গেলেন তিনি। কিন্তু তার নীরব কণ্ঠ সরব হওয়ার আগেই একতলা থেকে একটি উচ্চকণ্ঠের অভিযোগ ভেসে এল দোতলার গবেষণা কক্ষেওহে, কী-যেন নাম তোমার? মিঃ ত্রিবেদীকে ডেকে দাও। কতক্ষণ আর বসে থাকব?
আবার একবার চমকালেন ত্রিবেদী, এখন আবার কে ডাকতে এল?
–ওই যে দুজন লোক এসেছে, তারাই তো ডাকতিছে।
লোক এসেছে সেকথা বলবি তো হতভাগা, মুখ্যু কোথাকার!
আমি তো বলতেই এনু। তা আপনি বলতে দিলেন কই?
–যাক গে, যাক কি কাজ কর সনাতন। টমেটো সস-এর খালি বোতলের মধ্যে ফাটা বোতলের জিনিসটা ঢেলে রেখে ভর্তি বোতলটা ফ্রিজ-এর মধ্যে রেখে দে। আমি একবার বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি এই অসময়ে কে জ্বালাতে এল।
.
০২. সুযোগ? না, দুর্যোগ?
বাইরের ঘরে প্রবেশ করে ত্রিবেদী দেখলেন সেখানে সোফায় বসে তার জন্যে অপেক্ষা করছে দুই মূর্তি। তাদের মধ্যে একজনের পরনে নিখুঁত সাহেবি পোশাক, অপর ব্যক্তির দেহে রয়েছে একটি ডোরাকাটা রঙিন গেঞ্জি ও জি-এর রংচটা প্যান্ট। প্রথম ব্যক্তির নেকটাই ও স্যুট-এর সঙ্গে রং মিলিয়ে চরণের শোভা বর্ধন করছে একজোড়া চকচকে বুট জুতো। দ্বিতীয় ব্যক্তির পায়ে রয়েছে একজোড়া অযত্নে বিবর্ণ কোলাপুরি চটি। একনজর তাকালেই বোঝা যায় দুই ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা ও রুচিতে প্রচুর প্রভেদ। সাহেবি পোশাকে সজ্জিত ব্যক্তির চোখে-মুখে শিক্ষিত মানুষের বুদ্ধিমত্তার ছাপ সুস্পষ্ট। তার সঙ্গীর কেশহীন মস্তক, চোখ মুখ আর শরীরের উপর দৃষ্টিপাত করার সঙ্গে সঙ্গেই অনুমান হয় লোকটির মস্তিষ্কে শিক্ষা ও বুদ্ধির যথেষ্ট অভাব থাকলেও তার অত্যন্ত বেঁটে অথচ নিরেট পেশীপুষ্ট শরীরে রয়েছে আসুরিক শক্তি।
নির্বোধ মস্তিষ্ক আর শক্তিমান দেহ, ত্রিবেদী মনে মনে বললেন, দেহ আর মস্তিষ্কের এমন বিপরীতধর্মী সংমিশ্রণ খুবই বিপজ্জনক। এই লোকটি সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে।
ইতিমধ্যে ত্রিবেদীকে দেখে করজোড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সাহেবি পোশাক; তার সঙ্গী ডোরাকাটা গেঞ্জি প্রথমে আসন ত্যাগ করা দরকার মনে করেনি, কিন্তু প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে। করজোড়ে দণ্ডায়মান দেখে তড়াক করে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে সে হাতজোড় করল।
প্রথাগতভাবে অভিবাদন জানিয়ে ত্রিবেদী বললেন, নমস্কার, নমস্কার। আপনারা কি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
সাহেবি পোশাক বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি মিঃ ত্রিবেদী।
-কিন্তু আমি তো আপনাদের ঠিক চিনতে পারছি না।
–আপনি আমাদের চেনেন না বটে, কিন্তু আমরা আপনাকে চিনি। তাই না গজু? ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনস্ পরিহিত গজু নামক খর্বাকৃতি দৈত্য একগাল হাসল,হে। হে! হে! আমাদের আপনি না চিনলেও আমরা আপনাকে চিনি। আর চেনাশুনাটা যাতে ভালো করে হয়, সেইজন্যই তো এলাম তাই না ডাঃ সাটিরা?
-ঠিক! ঠিক!
ডাক্তার সাটিরা! ত্রিবেদী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বাঙালি!
আলবৎ বাঙালি, ডাঃ সাটিরা নামক ব্যক্তি দন্তবিকাশ করলেন, আমার পিতৃদত্ত নাম বিনয়ভূষণ সাঁতরা। হোপলেস! রট! একেবারে বাজে নাম। ওই নাম নিয়ে আর করে খেতে হত না। তাই ওটা বদলে নাম নিলাম ডাঃ বি.বি. সাটিরা, সংক্ষেপে ডাঃ সাটিরা।
আমতা আমতা করে ত্রিবেদী বললেন, ইয়ে কী বলে ডাঃ সাটিরা, দয়া করে অল্প কথায় আপনার বক্তব্য শেষ করুন। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।
নিশ্চয়, নিশ্চয় ডাঃ সাটিরা সহাস্যে বললেন, আমিও অল্প কথার মানুষ, অল্প কথায় আমার বক্তব্য রাখব। যারা বেশি কথা বলে, তারা বাজে কথা বলে-যারা বাজে কথা বলে, তারা কাজের মানুষ নয়- যারা কাজের মানুষ নয়, তারা অমানুষ। আর অমানুষদের আমি ঘৃণা করি। আপনি যদি–
-প্লিজ ডাঃ সাটিরা। অনুগ্রহ করে খুব অল্প কথায় আপনার বক্তব্য শেষ করুন।
খুব অল্প কথা? ডাঃ সাটিরাকে কিঞ্চিৎ ভাবিত মনে হল, আচ্ছা, আমি খুউব অল্প কথায় আপনাকে সব বুঝিযে বলছি। আপনি যদি আমার কথা বুঝতে না পারেন, তাহলে আপনি আমায় বুঝিয়ে বলবেন যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি– আপনি যদি আমায় বুঝিয়ে না বলেন যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি, তাহলে আমি কী করে বুঝব যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি? বুঝেছেন? হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন? যদি আমার কথা আপনার বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আবার গোড়া থেকে- কী হল?
দুই চোখ কপালে তুলে গজু বলল, কী হল ডাঃ সাটিরা? ত্রিবেদী স্যার হঠাৎ মাটিতে বসে পড়লেন কেন?
সত্যিই তাই। এতক্ষণ অতিথিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন ত্রিবেদী। ভদ্রতাবশত তাদের আসন গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা উচিত ছিল, অতিথি অনাহূত এবং অবাঞ্ছিত হলেও তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা অভদ্রতা। কিন্তু ইচ্ছা করে অভদ্রতা করেননি ত্রিবেদী, অতিথিদের তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে অসমাপ্ত গবেষণাকার্যে মনোনিবেশ করার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন বলেই তিনি তাদের বসতে অনুরোধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, আর নিজেও দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু হঠাৎ তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝের উপর।
এগিয়ে এসে উদ্বিগ্নকণ্ঠে ডাঃ সাটিরা বললেন, আপনি হঠাৎ মাটিতে বসে পড়লেন কেন? অসুস্থ বোধ করছেন নাকি? ডাক্তার ডাকব?
না, না, উপবিষ্ট অবস্থাতেই জড়িতকণ্ঠে ত্রিবেদী বললেন, ডাক্তার ডাকার দরকার নেই।
–তাহলে হঠাৎ মেঝের উপর চোখ উলটে বসে পড়লেন কেন?
–আপনার কথা শুনতে শুনতে মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল।
-ওটা সাময়িক দুর্বলতা। আপনি সোফায় উঠে বসুন… হ্যাঁ, এই তো সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা কইছিলেন বলেই আপনার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এবার আরাম করে সোফায় বসে আমার কথা শুনুন। যেকথা বুঝিয়ে বলছি তা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে–
বাধা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা! প্লিজ! ওভাবে কথা বললে আমি এবার নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাব।
–ও! আচ্ছা! তবে শুনুন, মিঃ ত্রিবেদী- সেদিন কপাটি প্রতিযোগিতায় আপনার খেলা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, চমকিত হয়েছি। খ্যাংরা কাঠির মতো আপনার চেহারা, কিন্তু সাত-সাতটা জোয়ান ছেলে আপনাকে ধরে রাখতে পারে না। শুধু কি গায়ের জোর? যেমন ছোটার ক্ষমতা, তেমনি অফুরন্ত দম! শুনুন মশাই, এমন অদ্ভুত ক্ষমতাকে কপাটির মাঠে অপচয় করা অন্যায়, তাই—
-তাই কী?
–তাই আমি আপনাকে একটি চমৎকার সুযোগ দিতে এসেছি।
–সুযোগ? কিসের সুযোগ?
ডাঃ সাটিরার মুখে ফুটল দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি, তাঁর দুই চোখ জ্বলে উঠল, সামনে ঝুঁকে পড়ে গম্ভীর অথচ মৃদুস্বরে তিনি বললেন, কীসের সুযোগ? লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের দুর্লভ সুযোগ!
.
০৩. চক্রান্ত
কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলেন না ত্রিবেদী। ডাঃ সাটিরার অভাবিত এবং কল্পনাতীত অদ্ভুত আচরণ তাঁকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রিবেদী বললেন, টাকার লোভ আমার নেই। আমি বিজ্ঞান ভবনে অধ্যাপনা করে যে অর্থ উপার্জন করি, তাতে আমার ভালো ভাবেই চলে যায়। তবে অনেক বেশি টাকা পেলে গবেষণার সুযোগ হয় বটে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে হলে আমাকে তো এখন যা করছি, সেসব ছেড়ে দিয়ে টাকার পিছনেই ছুটতে হবে। আপনি যে আমাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অথবা বিজ্ঞান-বিষয়ক অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগারের সুযোগ করে দিতে পারবেন এমন তো মনে হয় না। তবে আপনার প্রস্তাব না শুনে আমি কোনো মতামত
হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর, ভিতরে আসতে পারি?
কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে চোখ তুলতেই যাকে দেখতে পেলেন ত্রিবেদী, সেই ছেলেটি তাঁর পরিচিত, এই পাড়ারই বাসিন্দা। কপাটি প্রতিযোগিতায় ত্রিবেদীর অদ্ভুত কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে গোলাপ কলোনির অধিকাংশ কিশোর ও যুবক তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল- আগন্তুক যুবক অধ্যাপকের অনুরাগী ভক্তদের মধ্যে অন্যতম।
আগন্তুককে উদ্দেশ করে ত্রিবেদী বললেন, আরে, ঘোঁতন যে! কী মনে করে?… ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভিতরে এস।
-না স্যার, ভিতরে যাব না। অনেক কাজ আছে। আপনাকে সাবধান করতে এলাম।
সাবধান করতে এসেছ? কেন? কী জন্য? হঠাৎ সাবধান হওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কেন?
পাড়ায় ভীষণ চুরি হচ্ছে স্যার। আমরা অর্থাৎ পাড়ার ছেলেরা ঠিক করেছি সারারাত ধরে রোজই পাহারা দেব। রোজ-রোজ রাত জেগে পাহারা দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়; তাই আমরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে পালা করে পাহারা দেব বলে ঠিক করেছি। আজ যে দল পাহারা দেবে, সেই দলটার পরিচালনা করার ভার পড়েছে আমার উপর। আপনি স্যার, রাতে একটু সজাগ থাকবেন। যদি চোর আসে তাহলে চিৎকার করবেন। পাড়ায় বলা আছে কোনো বাড়ি থেকে বিপদের আভাস পেলে অন্যান্য বাড়ি থেকে চিৎকার করে সাড়া দেবে তাদের গলার আওয়াজ যাদের কানে যাবে, তারাও চাঁচাবে। আমরা যদি কাছাকাছি না-ও থাকি, তাহলেও চিৎকার শুনতে পাব। কারণ বাড়ি থেকে বাড়ি ছড়িয়ে পড়ে একসময় আওয়াজটা সারা পাড়াতেই ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই সতর্কবার্তা শুনতে পেলেই আমরা ছুটে এসে সমস্ত এলাকা ঘিরে ফেলব। আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো সাইকেল রয়েছে, কাজেই চোর কোনো বাড়িতে ঢুকে সহজে কাজ হাসিল করে সরে পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। আচ্ছা স্যার, এখন চলি। আবারও বলে যাচ্ছি সাবধানে থাকবেন।
ঘোঁতন প্রস্থান করল। ডাঃ সাটিরা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, এইবার মন্তব্য করলেন, যত সব উটকো ঝামেলা। হ্যাঁ, মিঃ ত্রিবেদী, আমি তাহলে আমার বক্তব্য শুরু করতে পারি?
দয়া করে সংক্ষেপে বলবেন।
–সংক্ষেপেই বলছি। যাদের প্রচুর অর্থ আছে, তাদের সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে আমি আমার এবং দলের লোকের শ্রীবৃদ্ধি করতে চাই। মন্দ লোকে অবশ্য আমাদের সমাজবিরোধী, ডাকাত প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করে, কিন্তু বাজে লোকের বাজে কথায় আমরা কান দিই না। উপযুক্ত কর্মীকে আমরা প্রচুর পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি। আপনি আমাদের দলে এলে দলের শক্তি বাড়বে। লুঠের মাল বিক্রি করে যে-টাকা পাওয়া যাবে, তার চারভাগের এক ভাগ আপনাকে দেওয়া হবে। ভাগ্য যদি সদয় থাকে, আর আপনি যদি মন দিয়ে কাজ করেন, তাহলে তিন-চার মাসের মধ্যেই আপনি লাখ টাকা কামিয়ে নিতে পারবেন।
কিন্তু আমি, ইয়ে, মানে… কী বলে. আমি তো এসব কাজ জীবনে কখনো করিনি, ত্রিবেদী সভয়ে বলে উঠলেন, আর ইয়ে হয়েচে… মানে টাকা পয়সার উপর আমার তেমন লোভ নেই। আমায় মাপ করুন ডাঃ সাটিরা।
ডাঃ সাটিরার চোখে ভেসে উঠল নির্দয় হিংসার কুটিল ছায়া, কিন্তু কণ্ঠস্বর শিষ্টাচারে মার্জিত মধুর, মিঃ ত্রিবেদী, আপনি কি পারবেন আর না-পারবেন, সেই বিষয়ে আমার ধারণা খুবই স্পষ্ট… ওঃ! ওই যে ডাবওয়ালা যাচ্ছে, গজ ডাব নিয়ে আয়। বড়ো তেষ্টা পেয়েছে। দাঁড়া, দাঁড়া- মিঃ ত্রিবেদী, ডাব খাবেন নাকি?
দুর্বল স্বরে ত্রিবেদী বললেন, আজ্ঞে না।
অবশ্য এই মুহূর্তে ডাবের জল অথবা ঠান্ডা পানীয় জলের প্রয়োজন তিনি অনুভব করছিলেন, কিন্তু ডাঃ সাটিরার হাত থেকে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করার প্রবৃত্তি তার ছিল না।
গজু গেল ডাব আনতে। একবার সেইদিকে তাকিয়ে আবার ত্রিবেদীর উপর দৃষ্টিপাত করলেন সাটিরা, গজু ডাব নিয়ে ফিরে আসুক। ডাবের জল পান করে আমি চলে যাব। আপনার মূল্যবান সময় আমি নষ্ট করব না। আমার মনে হয় ডাবের জল পান করতে আমার যেটুকু সময় লাগবে, সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই আপনার বর্তমান সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন আপনি অনুভব করবেন।
ত্রিবেদী স্খলিতস্বরে বললেন, কিছু যদি মনে করেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
-অবশ্যই, একটা ছেড়ে হাজারটা প্রশ্ন করুন, আমি কিছু মনে করব না।
–মানে, ইয়ে, ডাঃ সাটিরা
-বলুন, বলুন, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? দলে আসার আগে আপনি অনেক কিছুই জানতে চাইতে পারেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। বলুন, কী জানতে চান?
–পাড়ার ব্যাপারগুলো বোধহয় আপনাদেরই কীর্তি?
–আপনি পাগল হয়েছেন, মিঃ ত্রিবেদী? এমন তুচ্ছ কাজে আমি এনার্জি নষ্ট করি না। আমার কথা হচ্ছে মারি তো গণ্ডার, লুঠি তো ভাণ্ডার। পাড়ার চুরি-টুরি হচ্ছে ছ্যাচড়াদের কাজ। এইসব কাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
ডাক্তার, খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল গজু, হাতে তার একটা বড়োসড়ো ডাব, ডাব এনেছি, এখনই খাবেন তো?
–হ্যাঁ। কেটে দে।
ত্রিবেদী দেখলেন ডাবের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা বোঁটা, অর্থাৎ ডাবের মুখ অক্ষত। তিনি বললেন, ডাবওয়ালাকে দিয়ে ডাবের মুখ কাটিয়ে আনা উচিত ছিল। এখন ডাব কাটবে কি করে? দেখি, বাড়ির ভিতরে যদি একটা কাটারি পাওয়া যায়।
কাটারি আনার জন্য সনাতনের উদ্দেশে বাড়ির ভিতর যাওয়ার উপক্রম করলেন ত্রিবেদী, কিন্তু তাঁকে বাধা দিয়ে ডাঃ সাটিরা বলে উঠলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না, মিঃ ত্রিবেদী। গজুর কাছে ছুরি আছে।
ছুরি! ছুরি কি হবে? ছুরি দিয়ে কি ডাব কাটা যায়?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, গজু বলল, ছুরি দিয়ে সব কিছুই কাটা যায়। মানুষ পর্যন্ত কাটা যায়, আর ডাব কাটা যাবে না?
-তার মানে? তুমি কি মানুষও কাটো নাকি?
–হে! হে! আপনি স্যার দারুণ মজার কথা বলতে পারেন। হে! হে! হে!
ত্রিবেদীর বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বস্তু বার করল গজু খ করে একটা মৃদু শব্দ- পরক্ষণেই সেই চ্যাপ্টা জিনিসটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল শাণিত ইস্পাতের ফলা! স্প্রিং-এর ছুরি!
ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ত্রিবেদী ভাবতে লাগলেন তার কথার মধ্যে মজা কোথায় পেল গজু? নাকি, মানুষ কাটার ব্যাপারটাই তার কাছে মজার ব্যাপার! ত্রিবেদীর সর্বাঙ্গ হল ঘর্মাক্ত, ভীত দৃষ্টি মেলে তিনি দেখলেন ছুরি দিয়ে কচাকচ ডাবের মুখ উড়িয়ে দিল গজু, তারপর মুচকি হেসে ত্রিবেদীর দিকে তাকিয়ে ছুরিটাকে সজোরে বসিয়ে দিল ডাবের মুখে, ছিটকে পড়ল খানিকটা জল সদ্যছিন্ন ডাবের ছিদ্র থেকে।
ডাবটাকে ডাঃ সাটিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে গজু বলল, জল খেয়ে ডাব ফেলে দেবেন না ডাক্তার। শাঁসটা আমি খাব।
এক নিঃশ্বাসে জল পান করে ডাবটা গজুর প্রসারিত হস্তে সমর্পণ করলেন সাটিরা।
ত্রিবেদী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাবের খোলা কি ছুরি দিয়েই কাটবে?
না, না, গজুর তুরন্ত জবাব, ওতে ছুরির ধার নষ্ট হয়ে যায়। আমি ঘুষি মেরে ডাব ফাটাব।
–আজ্ঞে হ্যাঁ, বিগলিত হাস্যে ডাঃ সাটিরা জানালেন, গজু তো ঘুসি মেরেই ডাব ফাটায়।
ডাঃ সাটিরার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই শ্রীমান গজুর বদ্ধমুষ্টি পড়ল ডাবের উপর, সশব্দে ভেঙে গেল ডাবের খোলা! ছুরিটা এইবার চামচের স্থান গ্রহণ করল, ভোলা থেকে শাঁস ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে গজু মুখে ফেলতে লাগল ছুরির সাহায্যে।
ত্রিবেদীর মুখ দেখে তার মনের ভাব আন্দাজ করতে পারলেন ডাঃ সাটিরা, আপনি অবাক হচ্ছেন মিঃ ত্রিবেদী? হাঃ! হাঃ! গজু ছুরি দিয়ে কতরকম কাজ করে ভাবতে পারবেন না। শাক-সবজি ফলমূল কাটে, মাংস খেতে হলেও ওই ছুরি দিয়ে কেটে ফর্ক অর্থাৎ কাটার বদলে ওইটা দিয়েই মাংসের টুকরো বিধে মুখে তোলে– এমনকি মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ খায় গজু ওই ছুরির সাহায্যে। তাছাড়া আত্মরক্ষার জন্যেও ওটা দরকার হয় মাঝে মাঝে।
–আত্মরক্ষার জন্য ছুরি? কারও সঙ্গে ঝগড়া হলে গজু বুঝি ছুরি চার্লিয়ে দেয়?
-আরে, না, জিভ কাটলেন ডাঃ সাটিরা, গজু খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। কারও সঙ্গে যদি ঝগড়া হয়, কেউ যদি ওর গায়ে হাত তোলে, তাহলেও গজু পালটা মার দিতে চায় না, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মারমুখো লোকটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। তবে
-তবে? তবে কী? ত্রিবেদীর উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন।
–তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। গজুর ধৈর্যও অসীম নয়। তাই দু-এক সময় হাত চালাতে হয় নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্য। এই তো কয়েকদিন আগে নটার শোতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ কোথা থেকে এসে তিনটে গুণ্ডা রাস্তার মধ্যেই আমাদের ঘেরাও করে জানাল কয়েকদিন আগে যে কাজটা করে আমরা মাত্র লাখ পাঁচেক টাকা হাতে পেরেছিলাম, সেখান থেকে তিন লাখ টাকা তাদের সেলামি দিতে হবে। আবদারটা শুনুন– আমরা মাথা খাঁটিয়ে কাজ করলুম, পুলিশ আর জনগণের ঠ্যাঙানির ঝুঁকি নিয়ে প্রাণ বিপন্ন করলুম–আর ওরা কিছু না করেই ফোকটে তিন লাখ টাকা মেরে দেবে? বলুন, এটা অন্যায় নয়?
অবাক হয়ে ত্রিবেদী বললেন, এরকম হয় নাকি?
–হয়। একে বলে গুণ্ডা-সেলামি। ওদের এলাকায় কাজ করলেই নাকি সেলামি দিতে হবে। ওদের এলাকা মানে? এলাকা তো সরকারের, অন্যায় হলে সরকার দেখবে- তোমরা কে?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ত্রিবেদী ডাক্তারের ধারাবিবরণীতে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন, তারপর কী হল? গজু ছুরি বার করে ভয় দেখাতেই ওরা সরে পড়ল বুঝি?
না, না, প্রশান্ত হাস্যে বিস্তৃত হল ডাক্তারের ওষ্ঠাধর, গজু শুধু দুটো গুণ্ডাকে খুব আস্তে আস্তে ঘুসি মেরেছিল। আর একটা গুণ্ডা ছুরি বার করেছিল বলে তার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়েছিল। বলব কি মশাই, তাতেই দুটো গুণ্ডা পাঁজর-টাজর ভেঙে অজ্ঞান। আর ছুরি হাতে গুণ্ডাটার নাকি হাত ভেঙে গিয়েছিল।
ছুরি দিয়ে ডাবের শাঁস মুখে ফেলে খুব দুঃখিত মুখে গজু বলল, আমি একহাতে কব্জিটা চেপে ধরেছিলাম, তাতেই লোকটার হাত থেকে ছুরি খসে পড়েছিল। আমি সেই ছুরিটা একবারও তুলে নিতে চেষ্টা করিনি। ডাক্তার সাহেব ভুল বলেছে, আমি ছুরি কেড়ে নিই নি।
ঠিক কথা, ডাক্তার মাথা নেড়ে গজুর কথায় সায় দিলেন, আমারই ভুল হয়েছে। ছুরিটা ওই লোকটার হাত থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু–
শঙ্কিতস্বরে ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু? আবার কিন্তু কীসের? থামলেন কেন ডাঃ সাটিরা? দুজন অজ্ঞান, একজনের হাত ভেঙে ছুরি মাটিতে পড়ে গেছে, আপনারা নিশ্চয়ই চটপট জায়গাটা থেকে চলে এলেন?
কাঁচুমাচু হয়ে খুব বিনীত ভাবে ডাঃ সাটিরা বললেন, সেইরকমই আমাদের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যে-লোকটার হাত ভেঙে গিয়েছিল সেব্যাটা হাত চেপে ধরে এমন চাঁচাতে শুরু করল যে, আমাদের ভয় হল এখনই সেখানে লোকজন ছুটে আসবে, এমনকি পুলিশও উপস্থিত হতে পারে, তাই–
–তাই কী?
এবার আর ডাক্তার নয়, তাঁর সুযোগ্য সাগরেদ গজু বলে উঠল, তাই খুব আস্তে করে গলা টিপে লোকটাকে চুপ করিয়ে দিলাম।
বলো কি গজু! লোকটাকে গলা টিপে চুপ করিয়ে দিলে! তার মানে লোকটার দম বন্ধ হয়ে সে মারা পড়েছিল?
না, বোধহয়, গজুর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, ছুরিটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে বলল, খুব আস্তে গলা টিপেছিলাম তো, বোধহয় মারা যায়নি।
হ্যাঁ, মিঃ ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা বললেন, খুনোখুনি আমরা পছন্দ করি না। তবে পরিস্থিতি সবসময় তো আমাদের অনুকূলে থাকে না। অবস্থা বিশেষে নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাদের কখনও কখনও অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একবার একটা মা
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ এক দারুণ হাঁচি দিলেন ডাঃ সাটিরা। হাঁচির ধাক্কা সামলে সবে তিনি মুখ তুলে কথা বলতে যাবেন, এমন সময়ে আবার হল হাঁচির আক্রমণ! পর পর পাঁচটি হাঁচি দিয়ে ম্রিয়মাণ ডাক্তার পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, হাঁচি বড়ো সাংঘাতিক জিনিস, বুঝলেন মিঃ ত্রিবেদী– কিছুতেই সামলানো যায় না।
ত্রিবেদী অপেক্ষা করতে লাগলেন, মুখে মুখে এখনই নিশ্চয় ডাঃ সাটিরা আবার তার ধারাভাষ্য শুরু করবেন। কিন্তু রুমালটা পকেটে রেখে ডাক্তার যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখনই ত্রিবেদী বুঝলেন এইবার তিনি প্রস্থানের উদ্যোগ করছেন ধারাভাষ্য অসমাপ্ত রেখে!
অসমাপ্ত ধারাভাষ্য ত্রিবেদীর মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল, তিনি বলে উঠলেন, আপনি বলছিলেন খুনোখুনি পছন্দ না করলেও অবস্থা বিশেষে কখনো কখনো আপনারা অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। একবার একটা মা- পর্যন্ত বলেই হাঁচির ধাক্কায় আপনি থেমে গেলেন। আপনি কি বলতে চাইছিলেন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একবার একটা মানুষকে খুন করতে আপনারা বাধ্য হয়েছিলেন?
ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অবশ্য খুনটা করতে বাধ্য হয়েছিল গজু, ডাঃ সাটিরা বললেন, তবে মানুষ নয়, মাসটিফ।
-মাসটিফ!
হ্যাঁ মাসটিফ। আপনি কি কখনো মাসটি কুকুর দেখেননি, মিঃ ত্রিবেদী?
কুকুর! প্রথমে ডাঃ সাটিরার বক্তব্য বুঝতে পারেননি ত্রিবেদী, তারপর তার বোপোদয় হল, বলেন কি ডাঃ সাটিরা! মাসটিফ কুকুর দেখেছি বৈকি! সে তো বাঘের ছোটোখাটো সংস্করণ! অ্যালসেশিয়ন বা ডোবারম্যান তো মাসটিফ-এর তুলনায় দুগ্ধপোষ্য শিশু!
-আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ ত্রিবেদী। ওই মাসটিফ কুকুরটা তেড়ে কামড়াতে এসেছিল আমাদের। তাই গজু নিতান্ত বাধ্য হয়েই ছুরি চার্লিয়েছিল। কুকুরটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা আমাদের ছিল না তাই না গজু?
-আজ্ঞে হ্যাঁ, গজু বলল, কুকুরটা যখন তেড়ে এল, তখন নিজেকে আর ডাক্তারকে বাঁচাতেই ছুরি চার্লিয়েছিলাম। কুকুরটার গলা এত নরম ছিল যে, আস্তে ছুরি চালাতেই তার গলা একেবারে দুর্ফাক হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন ত্রিবেদী স্যার, কুকুরটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে আমার ছিল না।
কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে গজু বুঝিয়ে দিল মাসটিফ কুকুরের অপমৃত্যুতে সে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত।
কিন্তু ত্রিবেদী এমন আধখানা বিবরণ শুনে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মাসটিফ কুকুরটা হঠাৎ আপনাদের আক্রমণ করল কেন?
–আর বলবেন না। বিরক্তভাবে কাঁধ নাচিয়ে ডাঃ সাটিরা বললেন, কুকুরের মালিক মাসটিফকে লেলিয়ে দিয়েছিল যে!
লেলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন? বিনা কারণে কেউ কখনো কুকুর লেলিয়ে দেয়? বিশেষ করে মাসটিফ-এর মতো হিংস্র কুকুরকে?
আর বলবেন না মশাই। মাসটিফ-এর মালিকটা ছিল পাজির পাঝাড়া! আমরা খুব বিনীতভাবে তার আলমারির চাবিটা চেয়েচিলুম। চাবি তো দিলই না, উলটে কুকুর লেলিয়ে দিল। এরা কি ভদ্রলোক? ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা!
ভদ্রলোকের ভদ্রতাবোধ নিয়ে ত্রিবেদী সংশয় প্রকাশ করলেন না, তিনি জানতে চাইলেন, কুকুরটাকে মারার পরে ভদ্রলোক চাবি দিতে নিশ্চয়ই রাজি হয়েছিলেন?
–না, মশাই। এক-একটা লোক ভারি তাঁদোড় হয়। এই যে চাবি দিচ্ছি বলেই ভদ্রলোক দেরাজ খুলে রিভলভার বার করলেন। কী অসভ্য মানুষ বুঝুন আমরা দু-দুজন ভদ্রলোক অতিশয় বিনীতভাবে তার আলমারির চাবি চাইলুম আর সে কিনা কুকুর লেলিয়ে দিল। তাতে সুবিধা হল না দেখে বার করল রিভলভার! আমরা তো তাকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখাইনি, আমাদের সঙ্গে লোকটা কীরকম দুর্ব্যবহার করল, ভেবে দেখুন।
লোকটা খুব দুর্ব্যবহার করেছে, একথা মানতে রাজি হলেন না ত্রিবেদী, আপনারা তার কুকুরটাকে ছুরি মেরে খুন করলেন। তারপর তার আলমারি খুলে তাঁকে সর্বস্বান্ত করতে চাইলেন, তখন যদি ভদ্রলোক রিভলভার বার করেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। যাই হোক, তিনি তো আপনাদের গুলি করেননি বা পুলিশে দেননি, তাহলে এই মুহূর্তে আপনারা আমার সামনে বহাল তবিয়তে উপস্থিত থাকতে পারতেন না।
কী যে বলেন স্যার, গজু হাসল, লোকটা নির্ঘাত আমাদের গুলি করত। ছুরি দিয়ে তো আর রিভলভারের মোকাবিলা করা যায় না। সেদিন আর একটু হলেই মারা পড়তাম।
বাঁচলে কি করে?
–ডাক্তার সাহেবই বাঁচালেন। ঝট করে পকেট থেকে নিজের রিভলভার বার করে এত তাড়াতাড়ি গুলি করলেন যে, ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই লোকটার হয়ে গেল।
–হয়ে গেল, তার মানে? লোকটাকে গুলি চার্লিয়ে মারলেন নাকি ডাঃ সাটিরা?
না, মিঃ ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা হাসলেন, আমি মনে-প্রাণে অহিংস সহজে গুলি চালাই না। লোকটা যখন রিভলভার বার করল, তখন আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই তার কবজিতে একটা ফুটো করে দিলাম।
ত্রিবেদীর চোখে মুখে আতঙ্কের আভাস দেখে তাড়াতাড়ি তাকে সান্ত্বনা দিতে সচেষ্ট হলেন ডাঃ সাটিরা, ভেবে দেখুন, লোকটাকে খুন করে আমরা চাবিটা হাতিয়ে নিতে পারতুম, কিন্তু আমরা তা করিনি। ঘরের ভেতর খোঁজাখুঁজি করে চাবিটা বার করে কাজ হাসিল করলুম। চলে যাওয়ার সময়ে লোকটা চিৎকার করে তোক জমিয়ে ফেলতে পারে ভেবে শ্রীমান গজু তাকে গলা টিপে অজ্ঞান করতে বাধ্য হয়েছিল।
গজু তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানাল, আমি খুব আস্তে গলা টিপেছিলাম এ কথাটা তো আপনি বললেন না, ডাক্তার!
–-হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব আস্তে গলা টিপেছিল গজু।
ডাঃ সাটিরা ও গজুর উদারতায় খুব মুগ্ধ হলেন না ত্রিবেদী। তিনি সভয়ে প্রশ্ন করলেন, ডাঃ সাটিরা, আপনি কি সবসময় পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘোরেন? আমার সঙ্গেও কি আপনি রিভলভার নিয়ে দেখা করতে এসেছেন?
অত্যন্ত লজ্জিতভাবে ডাঃ সাটিরা বললেন, কিন্তু মিঃ ত্রিবেদী, আপনাকে তো আমরা রিভলভার তুলে ভয় দেখাইনি। পুলিশ তো বটেই, তাছাড়া আর দু-একটা ডাকাতের দল আমাদের শত্রু– কাজেই আত্মরক্ষার জন্য আমাকে রিভলভার রাখতে হয়।
খুব ভয়ে ভয়ে থেমে থেমে ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু যাঁর কাছে আপনারা চাবি চেয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোক তো ইচ্ছে করলেই আপনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারতেন। তিনি রিভলভার বার করার পরে আপনি তাকে গুলি করেছিলেন। ভদ্রলোকের মধ্যে নিশ্চয় একটা ইতস্তত ভাবছিল। তিনি ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন, গুলি চার্লিয়ে আপনাদের আহত বা নিহত করতে চাননি।
ত্রিবেদী স্যার, আপনি ডাক্তার সাহেবকে চেনেন না, গজু একগাল হাসল,লোকটার চোখ দেখেই আমরা বুঝেছিলাম ও আমাদের গুলি করবে। কিন্তু সে আমাদের দিকে রিভলভার তা করার আগেই ডাঃ সাহেব পকেট থেকে নিজের রিভলবার বার করে লোকটার ডান হাতের কবজি ফুটো করে দিলেন, ওর হাত থেক অস্ত্রটা পড়ে গেল আর আমরাও বেঁচে গেলাম… ত্রিবেদী স্যার, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না মনে হচ্ছে… ডাক্তার সাব, একবার আপনার কেরামতিটা ত্রিবেদী স্যারকে দেখিয়ে দিন তো।
পরক্ষণেই যা ঘটল, তার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরার দক্ষিণ হস্ত একবার শূন্যে আন্দোলিত হয়েই আবার পকেটে ঢুকে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের গুঁড়ো! ত্রিবেদী দেখলেন মাথার উপর অবস্থিত দুটি বাহু-এর মধ্যে যথাস্থানে বিরাজ করছে একটিমাত্র বাহু, দ্বিতীয়টির হোল্ডার থেকে ঝুলছে অনুপস্থিত বালএর ভগ্নাংশ!
গজু দন্তবিকাশ করল, দেখছেন ডাক্তার সাহেবের হাতের টিপ? আপনি তো রিভলভারটাও দেখতে পাননি, ত্রিবেদী স্যার?
না, কালো মতো কি-যেন একটা দেখেছিলাম মুহূর্তের জন্য, তারপরই সেটা আবার ঢুকে গেল ডাঃ সাটিরার পকেটের মধ্যে, হতবুদ্ধি হয়ে বিভ্রান্ত ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু কোনো আওয়াজ তো পেলাম না। বাশ্বটাকে যদি রিভলভার ছুঁড়ে ভাঙা হয়ে থাকে, তবে গুলির শব্দ পেলাম না কেন?
ওটাতে সাইলেন্সার লাগানো ছিল, তাই আওয়াজ হয়নি, উঠে দাঁড়ালেন ডাঃ সাটিরা, আজ আমরা চলি। তিনদিন পর গজুকে আপনার কাছে পাঠাব। এই তিনদিন আপনি চিন্তা করার সময় পাবেন। আমি অবশ্য নিশ্চিত জানি আপনি আমার প্রস্তাবে সায় দেবেন। নমস্কার। চল গজু।
.
০৪. বিপদের বেড়াজাল
দুই মূর্তি স্থানত্যাগ করার পরেও স্থির হয়ে বসে রইলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। একেই বোধহয় বজ্রাহত অবস্থা বলা হয়। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন ত্রিবেদী। তাঁর মাথার মধ্যে তখন চিন্তার আবর্ত
ডাঃ সাটিরা আমাকে একরকম হুমকি দিয়েই গেল। খুব কায়দা করে ডাব খাওয়া আর গল্প বলার ছল করে ছুরি আর রিভলভার দেখিয়ে গেল আমাকে। অর্থাৎ ওর প্রস্তাবে রাজি না হলে ওরা আমায় খুন করবে… আচ্ছা, গোলাপ কলোনি আর বাগনান ক্লাবের ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়?… না, ওরা ভাববে ত্রিবেদী স্যার ভয় পেয়েছে.. আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে… তাছাড়া ওরা তো সবসময় আমাকে পাহারা দিতে পারবে না, কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে সাটিরা আর গজু নির্ঘাত আমাকে পাকড়াও করে ফেলবে। ছুরি বা রিভলবার দরকার হবে না। গজু ব্যাটা যদি আস্তে গলা টিপে দেয়, তাহলেই আমি মারা পড়ব!… মহাবিপদে পড়লাম তো… এখন কী করা যায়?…
হঠাৎ ত্রিবেদীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আশ্চর্য-পাতা! ঠিক আশ্চর্য পাতা দিয়েই দুই শয়তানকে ঘায়েল করব। ছুরি ভোলার আগেই এক রদ্দায় গজুকে শুইয়ে দিয়ে ঝাঁপ দেব সাটিরার ঘাড়ে। রিভলভারে হাত দেওয়ার সুযোগই ডাক্তার পাবে না। আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতা আমার দেহে আনবে অমানুষিক শক্তি আর বিদ্যুতের গতি।
বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের এক ঘুসি বসিয়ে আপন মনেই হেসে উঠলেন ত্রিবেদী, বাড়িতে আর আশ্চর্য-পাতা নেই। হানাবাড়ি থেকে কয়েকটা পাতা আগে নিয়ে আসি, তারপর দেখে নেব দুই শয়তানকে…
হানাবাড়ির ফটকে এসেই থমকে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। বাড়ির ফটক আজ অরক্ষিত নয়, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক দারোয়ান! দারোয়ানের দেহ দারোয়ানসদৃশ হৃষ্টপুষ্ট, গোঁফজোড়া দস্তুর মতো জমকালো এবং তার হাতে রয়েছে এমন একখানা লাঠি, যার আঘাত মাথায় পড়লে সুন্দরবনের বাঘও অক্কা পাবে- নিতান্তই যদি সে মারা না পড়ে, তাহলেও চিরজীবন তাকে মাথাধরার অসুখে ভুগতে হবে।
ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ত্রিবেদীকে ইতস্তত করতে দেখে দারোয়ান বলল, এ বাবু, আপনি কুথায় যাইবেন?
ত্রিবেদী শুকনো ঠোঁটের উপর জিভ বুলিয়ে নিলেন, এই বাড়িতে কেউ তো থাকত না। তোমরা বুঝি ভাড়া নিয়েছ?
ভাড়া কেন লিবে? এ বাড়ি অনেকদিন পড়িয়ে আসে। এখনো বাবুর লেড়কার শাদি হয়েসেন। তাই ছোটোবাবু বহুজীকে লিয়ে এখানে থাকবেন। তা আপনি এখোন কুথায় যাইতেসেন?
-ইয়ে, আমি, মানে আমি কয়েকটা গাছের পাতা নিতে চাই।
–পাতা! পাতা লিয়ে কী হোবে?
ত্রিবেদী ঢোক গিললেন, ইয়ে কি বলে, ওই পাতার রস খেলে বাত সেরে যায়। আমার আবার বাতের ব্যথা আছে কিনা।
দারোয়ান একগাল হাসল।ছোঃ! উ পাতা-উতা খেয়ে কী হোবে? হামার কথা শোনেন। ডন আউর বৈঠক লাগান, বাত-ফাৎ কুছু থাকবে না– হাঁ।
ডন-বৈঠক?
হ্যাঁ, তিনশো ডন আউর পানশো বৈঠক লাগান রোজ। আপনার বাত জরুর সারিয়ে যাবে।
তিনশো ডন আর পাঁচশো বৈঠক! ত্রিবেদী দারোয়ানের মুখের দিকে চাইলেন, তিনশো ডন আর পাঁচশো বৈঠক দিতে গেলে বাত তো সেরে যাবেই, আমাকেও সরে যেতে হবে দুনিয়া থেকে।
কেয়া?
কিছু না, জোর করে মুখে হাসি টেনে আনলেন ত্রিবেদী, আমি বলছিলাম কি ইয়ে, দারোয়ানজি– তোমাকে দশটা টাকা পান খেতে দিচ্ছি, তুমি আমাকে ওই গাছটা থেকে কয়েকটা পাতা তুলে নিতে দাও।
সীতারাম! সীতারাম! দারোয়ান লাঠি বগলে চেপে দুই হাতে দুই কান স্পর্শ করল, তারপর জিভ কেটে বলল, হামি পান খায় না। আর উ তো ঘুষ আছে। হামার পিতাজি বলিয়েসেন, দেখো হনুমান, তুম্ কভি ঘুষ লিবে না। উ মহাপাপ আছে। ওহি লিয়ে আমি কাভি ঘুষ খায় না– হাঁ।
হতাশ ত্রিবেদী পিছু ফিরলেন, মনে মনে বললেন, এ তো দেখছি পিতৃভক্ত হনুমান। বলে ঘুষ খাব না। কিন্তু দারোয়ানজি ঘুষ না খেলে আমাকে যে খাবি খেতে হবে… ওঃ! ভালো কথা মনে পড়েছে–
ত্রিবেদীর মুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার মনে পড়ল যেখানে কপাটি খেলা হয়েছিল, সেইখানে মাঠের ধারে ঝোপের মধ্যে তিনি একটা আশ্চর্য পাতার গাছ দেখেছিলেন– যে-গাছটা অত্যন্ত সঙ্গীন মুহূর্তে তার ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছিল–
অভীষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে দ্রুতবেগে পা চালালেন তিনি…
কিন্তু জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলেন ত্রিবেদী। ঝোঁপ-জঙ্গল সব সাফ, কিছু নেই ওই সঙ্গে উধাও হয়েছে আশ্চর্য পাতার গাছ!… কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? কয়েকদিন আগেও তো ত্রিবেদী এখানে প্রচুর ঝোঁপঝাড় আর আশ্চর্য-পাতার গাছটাকে দেখতে পেয়েছিলেন- এখন সব কিছু পরিষ্কার ঝোঁপঝাড়ের জায়গায় দেখা যাচ্ছে ঘাসে-ভরা একটা জমি আর সেই জমির উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে একদল ছেলে-ছোকরা। ত্রিবেদী তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন; প্রশ্ন করলেন, জায়গাটা খুব পরিষ্কার দেখছি। এখানে বাড়ি উঠবে নাকি?
না, না, একটি ছেলে উত্তর দিল, বাড়ি-টাড়ি কিছু হবে না। জায়গাটা আমরাই পরিষ্কার করেছি, মানে–
তাকে বাধা দিয়ে আর একটি ছেলে বলে উঠল, তুই থাম। আমি বলছি। মানে আমরা একটা পল্লী সংস্কার সমিতি করেছি। প্রথমে এখানকার ঝোঁপ-জঙ্গল সাফ করে আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। ঝোপঝাড়ে মশা হয়, সাপ থাকে–
ত্রিবেদী বললেন, বলা যায় না, দু-একটা বাঘও হঠাৎ এসে বাসা বাঁধতে পারে।
ঠাট্টা করছেন স্যার?
পাগল! পল্লী সংস্কার অতিশয় মহৎ কার্য। তা নিয়ে ঠাট্টা চলে? ত্রিবেদী হাসলেন, আচ্ছা ভাই, চলি। তোমরা পল্লীসংস্কার চার্লিয়ে যাও।…
বাড়ির পথে চলতে চলতে চিন্তা করছিলেন ত্রিবেদী, ভালো বিপদেই পড়লাম তো! দারোয়ানটা ধর্মপুত্তর যুধিষ্ঠির, বলে ঘুষ খাব না। পাড়ার ছেলেগুলো হয়েছে তেমনি কেন রে বাবা, দুদিন বাদে পল্লীসংস্কার করলে ক্ষতি কী ছিল? আমারই কপাল খারাপ। তবে তিনদিন সময় পাওয়া গেছে। ডা. সাটিরার সাগরেদ গজু আমার বাড়িতে হানা দেবে তিনদিন পরে তার আগেই আমি এখান থেকে সরে পড়ব।
হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এল হেঁড়ে গলার চিৎকার, এই যে ত্রিবেদী স্যার?
চমকে পিছন ফিরলেন অধ্যাপক, পরক্ষণেই তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল, আরে! গজু যে! কোথায় গিয়েছিলে?
কোথাও যাইনি, স্যার। আসছিলাম।
আসছিলে? কোথা থেকে?
আজ্ঞে, আপনি যেদিক থেকে আসছেন, আমিও সেই দিক থেকে আসছি।
তার মানে?
মানে, আপনি যদি কোন বিপদে পড়েন, তাই দূর থেকে আপনার দিকে নজর রাখছিলাম। আপনি তো আমাদের দলে আসছেন, তাই হঠাৎ আপনি যাতে বিপদে না পড়েন, সেটাও তো। আমাদের দেখা উচিত।
কিন্তু হঠাৎ আমি বিপদে পড়ব কেন?
বিপদ-আপদের কথা কী বলা যায়, চোখ টিপে হাসল গজু, দু-দিন বাদেই তো আপনি আমাদের দলে আসছেন, তাই একটা কথা আপনাকে বলে যাই– ডা. সাটিরা আমায় গজু বলে ডাকে, কিন্তু ওই নামে ডাকা আমি পছন্দ করি না। আমার নাম গজানন সরখেল। আপনি আমায় গজানন বলেই ডাকবেন। আচ্ছা, চললাম।
লম্বা লম্বা পা ফেলে অদৃশ্য হল গজানন সরখেল। তার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ত্রিবেদী, তারপর আবার বাড়ির পথ ধরলেন তার মাথার মধ্যে চিন্তার যন্ত্রটা আবার চলতে শুরু করল পালানো মুশকিল। সাটিরার হুকুমে গজু- না, না, গজানন- আমার উপর নজর রাখছে… ওর নজর এড়িয়ে পালাব কেমন করে? …নাঃ, আর ভাবতে পারছি না.. এই তো বাড়ি এসে পড়েছি। আগে একটু বিশ্রাম করি, তারপর বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা উপায় বার করতেই হবে…।
দরজার সামনে এসে চমকে গেলো ত্রিবেদী, দরজাটা হাঁকরে খোলা! সনাতনকে একহাত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সশব্দে গৃহপ্রবেশ করলেন তিনি আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ের চমক! সোফায় বসে মুখের উপর বই তুলে যে-লোকটা বই পড়ছে, বই-এর আড়ালে তার মুখ ঢাকা পড়লেও রঙিন ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রং-চটা জিনসের প্যান্ট দেখেই অতিথির স্বরূপ নির্ণয় করতে ত্রিবেদীর দেরি হল না।
চশমার ভিতর থেকে দুই চোখের দৃষ্টি যথাসাধ্য তীব্র করে চাইলেন ত্রিবেদী– ভুল হচ্ছে না তো?… নাঃ, সেই ডোরাকাটা গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট। পা দুটো সেন্টার টেবিলের তলায় বলে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ত্রিবেদী জানেন ওই পা দুটোতে রয়েছে দুটো কোলাপুরী চটি।
একটু আগেই তার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেছে গজু অন্য একটা রাস্তা ধরে। যে রাস্তা দিয়ে গজু চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরেও তাঁর বাড়িতে আসা যায় তবে তাতে অনেক বেশি সময় লাগার কথা। অথচ দেখা যাচ্ছে তার অনেক আগেই গজু পৌঁছে গেছে তার বাড়িতে! ত্রিবেদী বুঝলেন অন্য পথ ধরে খুব দ্রুত হেঁটে সে তাঁর আগেই এই বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সনাতন তো বিশেষ পরিচিত না হলে কোনো লোককে মনিবের অনুপস্থিতিতে ঘরে বসায় না, তাকেই বা কোন মন্ত্রে বশ করল গজু? গজুকে দেখে কখনই খুব বইয়ের ভক্ত মনে হয়নি ত্রিবেদীর, সে হঠাৎ তার বৈঠকখানায় বসে পুস্তক পাঠে মনোনিবেশ করল কেন?
ত্রিবেদী একবার গলা খাঁকারি দিলেন, গজু বই থেকে মুখ সরাল না। একটু ইতস্তত করে ত্রিবেদী বললেন, এই যে গজু না, না, গজানন, তুমি যে এত বই ভালোবাসো তাতে জানতাম না। তা ইয়ে গজু না, না, গজানন বইটা বুঝি খুব ভালো? তাই ইয়ে, ওই বইটা মুখ থেকে সরিয়ে কথা কইতে কি তোমার খুব বেশি অসুবিধা হবে?
একটুও অসুবিধা হবে না। আপনি ছিলেন না বলে সদ্য কিনে-আনা ইংরেজি উপন্যাসটা পড়ছিলাম। পাঠকের মুখের উপর থেকে বই সরে এল কোলের উপর। আপনার সঙ্গে কথা কইতেই তো এসেছি।
ত্রিবেদী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী! এ তো গজু নয়! এ তো দেখছি
–আপনি যাকে দেখছেন তার নাম গজু অথবা গজানন নয়, আমার একথা বোধ হয় আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ত্রিবেদী মশাই।
-নিশ্চয় বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি যে, মুখে আর কপালের ব্যান্ডেজ বেঁধে আমার ঘরে অসময়ে উপস্থিত হয়েছেন ময়ুখ চৌধুরী!… ব্যাপারটা কি বলুন তো? কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল নিশ্চয় ব্যান্ডেজের ঘটা দেখে মনে হচ্ছে আপনি বেশ ভালোরকম জখম হয়েছেন। কি হয়েছিল ময়ুখবাবু?
-বলছি। তার আগে বলুন তো হঠাৎ আমাকে আপনি গজু বা গজানন নামক ব্যক্তি বলে ভুল করছিলেন কেন?
-ওই লোকটার পরনে ছিল আপনারই মতে ভোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনসের প্যান্ট! নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার, ময়ুখ চৌধুরী বললেন, এইরকম ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনসের প্যান্ট দুর্লভ নয়। বহুলোক এগুলো পরে থাকে। দৈবাৎ আপনার গজু বা গজানন আর আমি এই পোশাক পরেছি পরস্পরের অজ্ঞাতসারে। এখন বুঝছি আমার মুখ ঢাকা ছিল বলেই আপনি আমাকে গজু বলে ভুল করেছেন।
শুধু মুখ নয়, আপনার দুই পা ছিল সেন্টার টেবিলের তলায়, ত্রিবেদী বললেন, পা দেখলেও বুঝতে পারতাম বৈঠকখানায় যিনি বসে আছেন, তিনি যে-ই হোন, অন্তত গজানন সরখেল নন।
পা দেখলে বুঝতেন কেমন করে? বলার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের তলা থেকে পা টেনে এনে সোফার উপর সোজা হয়ে বসলেন ময়ূখ চৌধুরী।
ওই যে আপনার পায়ে রয়েছে একজোড়া মোকাসিন, ওই দুটো দেখেই বুঝতাম মোকাসিনের মালিক গজানন নয়, ত্রিবেদী বললেন, কারণ একটু আগেই তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়েছিল, সেইসময় তার পায়ে ছিল কোলাপুরী চটি। তার পায়ে চটি দেখতেই আমি অভ্যস্ত। হঠাৎ পায়াভারি হয়ে চটির পরিবর্তে মোকাসিন চড়িয়ে আমার বাড়িতে হানা দেবে কেন গজু–না, না, গজানন? তাই বলছি গেঞ্জি আর প্যান্ট এক ধরনের বলেই ভুল হয়েছে, কিন্ত আপনার শ্রীচরণ দর্শন করলেই বুঝতে পারতাম গজুর পরিবর্তে অন্য কোনো ব্যক্তি আমার বৈঠকখানা অলঙ্কৃত করেছেন। যাক গে, এবার বলুন আপনার কপালে আর গালে এতবড়ো ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছিল?
–এমন কিছু নয়। একটু স্নেহের পরশ দিয়েছে হলুদ রাক্ষস।
–হলুদ রাক্ষস! সেটা আবার কেমন বস্তু?
–হলুদ রাক্ষস যে কেমন বস্তু তা আমিও জানি না। তবে তার স্পর্শসুখ আমি অনুভব করেছি।
-আপনার কথায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ব্যাপারটা খুলে বলুন।
–বলছি। প্রফেসর বরেন্দ্রনাথ বসুকে আপনি নিশ্চয়ই জানেন?
–জানি মানে? বরেন তো আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে গবেষণাও করেছি।
–জানি। আপনার মত নাম-ডাক না থাকলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসাবে বরেন্দ্রনাথ বসুর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। তিনি আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। আমি সেই চিঠি নিয়ে এসেছি। এই সেই চিঠি।
ময়ুখ চৌধুরীর হাত থেকে একটা খাম নিলেন ত্রিবেদী। খামের মুখ আঠা দিয়ে আটকানো এবং খামের উপর লেখা আছে অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী।
ত্রিবেদী খামটা ছিঁড়ে চিঠি পড়লেন, তারপর ময়ুখ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনুন, বরেন কি লিখেছে- ভাই তিলু, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে। হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছি। ইতি বরেন।
চিঠি নামিয়ে রেখে ত্রিবেদী বললেন, যেতে পারলে তো ভালো হয়। কিন্তু বরেন যে একটা বাঘের মতো কুকুর পুষেছে, সেটার কথা মনে হলেই আর ওদিকে যেতে সাহস হয় না।
মাভৈঃ! ত্রিবেদী মশাই, মাভৈঃ! ময়ূখ চৌধুরী বললেন, বাঘের মতো কুকুর মানে, ডিকের কথা বলছেন তো? ডিক আর নেই। আপনি নির্ভয়ে বরেনবাবুর বাড়ি যেতে পারেন।
নেই। নেই মানে?
–নেই! মানে, নেই। হলুদ রাক্ষস তাকে খতম করে দিয়েছে।
–য়্যাঁ?
–হ্য, মশাই। ভয়ানক কাণ্ড। তবে শুনুন, গত বুধবার সন্ধের পর বরেনবাবুর বাড়ি গেছি আড্ডা দিতে। হঠাৎ শুরু হল ভীষণ বৃষ্টি। বরেনবাবু বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি যাবেন কি করে? তার চেয়ে ময়ুখবাবু, আপনি এখানেই খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে বাড়ি যাবেন।
বরেনবাবুর প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না। ভদ্রলোক বিপত্নীক, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। ছেলেমেয়েও নেই। বিজ্ঞান চর্চা করেই দিন কাটাচ্ছেন পরমানন্দে। অতএব আমার দিক থেকেও সঙ্কোচ করার কারণ ছিল না। খাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম দুজনে, তারপর শুয়ে পড়লাম। শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করার আগে অবশ্য ডিক একবার আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিল। কুকুরটাকে আমি ভালোবাসতাম। সে বোধহয় আমার মনোভাব বুঝতে পারত। সুযোগ পেলেই আমার কাছে এসে আদর কাড়ার চেষ্টা করত। সেই রাত্রেও বেশ কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে খেলা করে ডিক চলে গেল তার নিজস্ব জায়গায় আর আমিও বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের মধ্যে।
গভীর রাত্রে হঠাৎ কুকুরের তীব্র আর্ত চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাইরে আসতেই বরেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাকে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। আমি বরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার হাতে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড পিচকারি! আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বরেনবাবু আবার আমাকে নিজের ঘরে যেতে বললেন। আমি ইতস্তত করছি, হঠাৎ আবার ভেসে এল সেই আর্তনাদ! কুকুরের এমন যাতনাকাতর আর্ত চিৎকার আগে কখনো শুনিনি। ডিক-এর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল, আর আর্তনাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। যে-ঘর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছিল, সেই ঘরটার দিকে ছুটে গেলাম। অন্ধকার ঘরে ঢুকে আনে টিপতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই আমার মুখের উপর চাবুকের মতো কী-যেন একটা আছড়ে পড়ল, আর ভারসাম্য হারিয়ে মেঝের উপর ছিটকে পড়লাম আমি। শক্ত মেঝেতে মাথা ঠুকে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরে আসতে দেখলাম বরেনবাবু আমার মুখে কপালে ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন। সকালবেলা তার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে চলে এলাম আপনার এই বাড়িতে চলে আসার আগে বরেনবাবুর কাছে শুনেছিলাম আমায় নাকি আক্রমণ করেছিল হলুদ রাক্ষস। মুখে আর কপালে ক্ষতচিহ্নগুলো তারই স্মৃতিচিহ্ন।
–আর ডিক? মানে বরেনের কুকুরের কি হল?
–ত্রিবেদী মশাই, ডিক-এর মৃতদেহ আমি দেখেছি। কুকুরটার চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, জিভটাও প্রায় আধ হাত বেরিয়ে এসেছিল মখের ভিতর থেকে মনে হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো চক্রাকার ক্ষতচিহ্ন দেখেছি আমি। সমস্ত ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।
-আপনার মুখে ব্যান্ডেজটা একবার খুলে দেখব ময়ূখবাবু? ভয় নেই, আবার ঠিক করে বেঁধে দেব।
-উঁহু, সাতদিনের আগে বরেনবাবু আমায় ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছেন। সাতদিন পরে ওঁর কাছে গেলে উনি নিজের হাতে আমার ব্যান্ডেজ খুলে দেবেন। বরেনবাবু বলেছেন সাতদিন বাদে নিশ্চয়ই ঘা শুকিয়ে যাবে। যদি না শুকায়, তাহলে যা ব্যবস্থা করা উচিত, তিনি তা করবেন। কিন্তু অন্য কারও সামনে তিনি আমায় ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছেন।
-ওঃ, তা সে যখন নিষেধ করেছে, তখন আমি আপনাকে ব্যান্ডেজ খুলতে অনুরোধ করব।
বরেনবাবু কিন্তু আমায় একটি অনুরোধ করেছেন। তার হলুদ রাক্ষসের কথা যেন আমি কোথাও না লিখি। আমি যে অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি নিয়ে একটি বই লিখছি সেকথা বরেনবাবু জানেন। তিনি বলেছেন অধ্যাপক মশাই যদি তার বাড়ি গিয়ে হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি থাকেন, তাহলে হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে আমি কিছু লিখলে তিনি আপত্তি করবেন না।
–হলুদ রাক্ষসকে তো আপনি চোখেই দেখেননি। তাকে নিয়ে আর কী লিখবেন?
তাকে আমি দেখতে চাই না। শুধু তার স্পর্শের মহিমা অনুভব করেই আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। আপনি তার সঙ্গে দেখা করলে সেই সাক্ষাতের বিবরণ ও পরিণাম আমি পাঠকদের সামনে উপস্থিত করতে পারি। আচ্ছা, আজ আমি চলি ত্রিবেদী মশাই। আপনি বোধহয় দু-এক দিনের মধ্যেই বরেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন?
-যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু একটা বিপদের ভয় রয়েছে।
–বিপদ? ওঃ, হলুদ রাক্ষসের কথা ভাবছেন বুঝি?
–না, মশাই। হলুদ রাক্ষস কেমন বস্তু জানি না। তবে সে বোধহয় ডাঃ সাটিরা আর গজাননের চাইতে বেশি ভয়ানক নয়।
–ডাঃ সাটিরা! গজানন! তারা আবার কারা? একটু আগেই গজাননের কথা বলছিলেন না আপনি? যার গেঞ্জি আর প্যান্টের রং ঠিক আমার মতো!
হ্যাঁ। কিন্তু তার পোশাকের সঙ্গে আপনার পোশাকের মিল থাকলেও মানুষ হিসাবে তার সঙ্গে আপনার যথেষ্ট তফাত। লোকটা ভয়ংকর, মানুষ খুন করতে পারে হাসতে হাসতে।
-ও বাবা! আর ডাঃ সাটিরা?
–সে আরও সাংঘাতিক। ওদের কথা আর একদিন বলব ময়ূখবাবু।
–আচ্ছা, আজ তাহলে চলি ত্রিবেদী মশাই। নমস্কার।
–নমস্কার।
ময়ুখ চৌধুরীকে বিদায় দিয়ে ত্রিবেদী আবার আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বন্ধুবর বরেনের ওখানে যাওয়া যায় কিন্তু গজুর চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কি ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবেন? ত্রিবেদী একটু আগেই বুঝেছিলেন তাঁর অজ্ঞাতসারে তাকে সর্বদা নজরে রেখেছে গজু তার শ্যেনদৃষ্টিকে কি ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হবে?
বাবু, ত্রিবেদীর চিন্তাস্রোতে বাধা দিল সনাতনের কণ্ঠস্বর, আজ আমাকে ছুটি দিতে হবে। আমি একবার শ্যামবাজারে যাব, কাল বিকেলে ফিরব।
–ও! শ্যামবাজারে তোর সেই পিসির কাছে যাচ্ছিস বুঝি? আচ্ছা যা, কাল বিকেলেই চলে আসবি কিন্তু।
– আজ্ঞে হ্যাঁ।
ত্রিবেদী দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন, সনাতনের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে যাব। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বাগচি মশাই-এর বাড়িতে দাবা খেলব। তারপর বাড়ি এসে খেয়ে ঘুম। ভোর পাঁচটায় উঠে বরেনের বাড়ি পালাব। অত সকালে বোধহয় গজু ব্যাটা পাহারা দেবে না।
সনাতনকে উদ্দেশ করে হাঁক দিলেন ত্রিবেদী, আমার রাতের খাবারটা তৈরি করছিস তো?
–নিশ্চয়। রান্না আর কিছুক্ষণের মধ্যি হয়ে যাবে।
–বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা তোকে দিয়ে আমি বেরুব। তোর সময় হলে তালা বন্ধ করে যাবি। আর রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতে ভুলবি না-বুঝেছিস? আমার আসতে বেশি রাত হতে পারে।
-আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু।
..অনেক রাত্রে বাগচি মশাই-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির পথ ধরলেন ত্রিবেদী! দাবার নেশা বড়ো বিশ্রী, রাত বারোটার সময় দুজনের খেয়াল হল এইবার ক্ষান্ত হওয়া উচিত। খুব জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন ত্রিবেদী এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন বাড়ির দরজায়…
কিন্তু ও কী! ত্রিবেদী বিস্মিত চক্ষে দেখলেন তাঁর বাড়ির দোতলার একটি ঘরে আলো জ্বলছে! ত্রিবেদী জানতেন তার অনুপস্থিতিতে পাড়ার ঠাকুর চাকরদের জুটিয়ে তাসের আড্ডা বসায় সনাতন। আগে একবার তাকে নিষেধ করেছেন তিনি। আজ তিনি বেশি রাতে ফিরবেন শুনে সে হয়তো আজ্ঞার লোভ সামলাতে পারেনি, শ্যামবাজারে পিসির বাড়ি না গিয়ে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে তাস খেলছে- ক্রুদ্ধ ত্রিবেদী মনে মনে স্থির করলেন সনাতনকে খুব একচোট বকাবকি করে তার বন্ধুদের এখনই তাড়িয়ে দেবেন, ত্রিবেদীর পদচালনা দ্রুত থেকে দ্রুততর হল।
দরজার কড়া ধরে নাড়তে গিয়ে ত্রিবেদী লক্ষ করলেন দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে। আস্তে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ত্রিবেদী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন- হতভাগা সনাতন ভেবেছে কী! আড্ডা দিতে এমন মত্ত যে সদর দরজা ভিতর থেকে খিল তুলে বন্ধ করতে ও ভুলে গেছে! ক্রুদ্ধ ত্রিবেদী ঠিক করলেন এমন অবাধ্য আর অমনোযোগী চাকরকে তিনি রাখবেন না। আড্ডাধারীদের হাতে নাতে ধরে ফেলার জন্য তিনি পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতে লাগলেন…
আলো জ্বলছিল খাওয়ার ঘরে। অন্ধকার বারান্দা দিয়ে আলো লক্ষ্য করে চলতে চলতে ত্রিবেদী ভাবতে লাগলেন এ বাড়িতে ঘরের তো অভাব নেই, তবে খাওয়ার ঘরে ওরা আড্ডা জমাতে গেল কেন? তবে কি সনাতন ও তার বন্ধুবান্ধব তারই ডাইনিং টেবিল আর চেয়ার সাজিয়ে ভোজনপর্ব চালাচ্ছে? ব্যাপারটা অনুমান করেই তাঁর তপ্ত মেজাজ আরও তপ্ত হয়ে উঠল, সনাতনকে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মনে মনে একেবারে পাকা করে নিয়ে তিনি নিঃশব্দে ভোজনকক্ষের জানালায় উঁকি দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন ভীষণভাবে
হ্যাঁ, ভোজনপর্বই চলছে বটে, ডাইনিং টেবিলে স্তূপাকার খাদ্য সাজিয়ে তৃপ্তি সহকারে যে দুই ব্যক্তি আহারে মনোনিবেশ করেছে, তাদের চেহারা দেখলে স্বয়ং গজাননও যে দস্তুরমতো ঘাবড়ে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দুজনের পোশাক একই রকম, কালো গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট। দুজনেই যেমন লম্বা তেমনই চওড়া, তাদের কাঁধ, বুক আর হাতের মাংসপেশী বহু ব্যায়ামবীরেরই ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে। তাদের পা দুটো টেবিলের তলায় দৃষ্টির অন্তরালে ছিল বলে তাদের পদযুগল পাদুকা-সজ্জিত অথবা নগ্ন, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু পুরাতন রীতি-নীতি ত্যাগ করে চেহারাও যে বর্তমান পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যথেষ্ট আধুনিক মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, তাদের সাজসজ্জা দেখে সেকথা অনুমান করতে পারলেন ত্রিবেদী। পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে বেপরোয়া চুরির ঘটনায় গৃহস্থদের মধ্যে যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে এবং যার ফলে পাড়ার ছেলেরা সারারাত ঘুরে ঘুরে পাহারা দেওয়ার সঙ্কল্প করেছে এরাই যে সেইসব চুরির জন্য দায়ী তা-ও বুঝতে পারলেন অধ্যাপক মশাই। আশ্চর্য-পাতা হাতের কাছে মজুত থাকলে ত্রিবেদী কি করতেন বলা যায় না, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দুই নরদানবকে বাধা দিতে গেলে সেটা যে আত্মহত্যারই নামান্তর হবে, তা বঝেই সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট রইলেন ত্রিবেদী। তারা যদি পরিতোষ সহকারে ভোজ শেষ করে তারই চোখের সামনে তার জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়ে, তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। একমাত্র ভরসা পাড়ার ভ্রাম্যমাণ রক্ষীদল ঘুরতে ঘুরতে তারা এদিকে এসে পড়লে ত্রিবেদীর পক্ষে চোরদের অগোচরে পাহারাদার দলটিকে দুই তস্করের খবর সরবরাহ করা কঠিন হবে না কিন্তু তস্করযুগল যে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে না এবং রক্ষীদলের পক্ষেও যে অক্ষত দেহে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে না, এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রিবেদীর পক্ষে যা করা উচিত, তিনি তা-ই করলেন, অর্থাৎ চোরদের অগোচরে জানালার ফাঁক দিয়ে তাদের উপর নজর রাখতে লাগলেন…।
মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে এক ব্যক্তি বলল, কাজ করতে এসে খাওয়াটা উপরি পাওনা হল। মুরগির মাংসটা খাসা বেঁধেছে রে!… ও কী রে! তুই আবার কিসের বোতল নিয়ে এলি?
অপর ব্যক্তি বলল, ঠান্ডা বাসকোর মধ্যে একটা টম্যাটো সস-এর বোতল ছিল। মাংসের সঙ্গে টম্যাটো সস তোফা জমবে।
–তাই নাকি? ঢাল, তবে।
অতিশয় উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ত্রিবেদী দেখলেন সদ্য আবিষ্কৃত যে তরল পদার্থটি তিনি একটা ফাটা বোতলে ভরেছিলেন এবং বোতলটার দুরবস্থা দেখে একটা টম্যাটো সস-এর খালি বোতলে তরল পদার্থটি ঢেলে সেটাকে রেফ্রিজারেটরের শীতল গর্ভে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন– সেই নির্যাসপূর্ণ বোতলটি ঠাণ্ডা বাসকোর ভিতর থেকে বার করে দুই চোর এখন গলাধঃকরণের আয়োজন করছে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি বোতলটাকে একটা প্লেটের উপর উপুড় করতেই খানিকটা রক্তবর্ণ তরল পদার্থ প্লেটের শূন্য স্থানকে পূর্ণ করে দিল। সে দিক তাকিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, এটা মোটেই টম্যাটো সস নয়। টম্যাটো সস এত পাতলা হয় না।
প্রথম ব্যক্তি বলল, ঠান্ডা বাসকোর মধ্যে যখন ছিল, তখন ওটা সস না হলেও খাবার জিনিস তো বটে। একটু চেখে দ্যাখ তো।
প্লেটটা তুলে একটা চুমুক দিয়েই দ্বিতীয় ব্যক্তি সোল্লাসে ঘোষণা করল, এ তো দারুণ জিনিস রে, পচা!
প্লেটটা এক চুমুকে খালি করে সে একটা গেলাস টেনে নিল, এটা গেলাসে ঢেলে খেতে হবে। সস-এর মতো ঘন আর আঠালো নয় জিনিসটা।.
পচা নামক ব্যক্তি বলে উঠল, তাহলে আর একটা গেলাসেও ঢাল। আমিও একটু চেখে দেখি কী-এমন দারুণ জিনিস।
তরল পদার্থটি আর একটি গেলাসে ঢালা হল। এক চুমুক খেয়েই টেবিল চাপড়ে পচা বলে উঠল, চুম্পী রে! এ তো জবর জিনিস! ঢাল ঢাল, ভালো করে ঢাল।…
গেলাসটা মুখ থেকে নামিয়ে হটাৎ সঙ্গীর দিকে তাকাল পচা তার ভুরু কুঁচকে গেছে, চোখ দুটো হয়ে উঠেছে লাল টকটকে,ওরে চুম্পী, খুব তো গিলছিস, সব গুছিয়ে নিয়েছিস তো?
ঘরের কোণে যে মস্ত মুখবাঁধা থলিটা পড়েছিল, তার ফুলে-ওঠা অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় অনেক নিরেট বস্তু ওই থলির ভিতর ভরে দেওয়া হয়েছে। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে চুম্পী বলল, সব ঠিক আছে। ইচ্ছে হলে তুই বাঁধন খুলে দেখতে পারিস।
–ওগুলো আর কী দেখব? একগাদা বাসন, কয়েকটা ফুলদানি আর হাবি-জাবি বিক্রি করে কটা পয়সা পাব? আলমারিটা তত খুলতে পারলি না। সেটা খুললে হয়তো সত্যিকার কিছু মালকড়ি পাওয়া যেত। নগদ টাকা পয়সা তো কিছুই পেলাম না।
আলমারি খোলার চেষ্টা তো করেছি। যে-চাবিটা দিয়ে সব তালা খোলা যায়, সেটাও তো লাগালাম আলমারি তবু খুলল না, লাভের মধ্যে চাবিটাই গেল ভেঙে।
-তা তো ভাঙবেই। এ তো জুতোর চামড়ায় উঁচ ঢোকানোর কাজ নয়, এ হল লোহার আলমারি। এখানে বাবা, চালাকি চলবে না।
খবর্দার পচা, ঠকাস করে হাতের গেলাস টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল চুম্পী, তার চোখ দুটিও তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, কী বলতে চাস তুই?
–আমি বলতে চাই যে আলমারিটা লোহার তৈরি, চামড়ার নয়। চামড়াতে ছুঁচ ঢোকানো যত সহজ, লোহার আলমারির চাবি খোলা অত সহজ নয়।
হঠাৎ চামড়ার কথা উঠল কেন? ছুঁচের কথাই বা আসে কেন?
–কি জানি, পচা মুখ টিপে হাসল, মনে হল তাই বললাম। তুই অত চটছিস কেন?
–ন্যাকামি হচ্ছে? কেন চটছি জানিস না? আমার বাবা মুচি, জুতো সেলাই করে। তার ব্যাটা আমি, চামড়ার জুতোয় ফোঁড় তুলে সেলাই দিতে পারব কিন্তু লোহার আলমারির তালা তোড়া আমার কম্ম নয়– এই কথাই তো বলতে চাস তুই?
–আমি এসব কথা বলিনি। আমি শুধু বলেছি লোহার আলমারির তালা ভাঙা সহজ নয়। জুতোর চামড়ায় ছুঁচের ফোঁড় দেওয়া তার চাইতে সহজ। তুই শুধু শুধু মেজাজ গরম করছিস। মেজাজ ঠাণ্ডা কর চুম্পী। কামকাজ করতে গেলে মেজাজ ঠান্ডা রাখতে হয় বুঝলি? নে, আর এক পাত্তর চল্।
বোতল থেকে ত্রিবেদীর আবিষ্কৃত তরল নির্যাস আবার পরিবেশিত হল দুটি গেলাসে… দুই চোর নীরবে সেই তরল বস্তু পান করতে লাগল… হঠাৎ চুম্পীর ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে সেই মৃদু হাসি ফেটে পড়ল সশব্দ অট্টহাস্যে হা! হা! হা! হা!
ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ সঙ্গীকে তীব্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল পচা, তারপর রূঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এত হাসির ঘটা কেন রে?
–একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল– হা! হা! হা!
–কোন ঘটনা? কী ঘটনা? শুনি তো একবার?
ব্যাপারটা হয়েছিল কি জানিস, চুম্পী হাসতে হাসতে হাতের গেলাসে চুমুক দিল, এক ব্যাটা পকেটমার পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, তখন লোকে তাকে এমন ধোলাই দিল যে, তার একটা হাতই গেল ভেঙে। আমার বাপ মুচি, জুতো সেলাই করে হকের পয়সা খায়– কারও কোনোদিন ক্ষমতা হয়েছে আমার বাবার গায়ে হাত তোলার? সেটি আর বলতে হবে না, হ্যাঁ।
হাতের গেলাস এক চুমুকে খালি করে নামিয়ে রাখল পচা, তুই তো আমার বাবার কথা বলছিস? হ্যাঁ, বাবা পকেটমার ছিল। খুব ওস্তাদ পকেটমার। হঠাৎ একবার ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাতে তোর কী? তোর বাপের পকেট মারতে গিয়ে তো ধরা পড়েনি।
আমার বাপের পকেট মারতে গেলে তোর বাপের হাত তত ভাঙতই, ঘাড়ও ভাঙত। আমার বাপ ছিল মস্ত জোয়ান। আমায় দেখে বুঝছিস না?
-হ্যাঁ, তোক দেখে তো বুঝতেই পারছি তোর বাপ কেমন জোয়ান ছিল। বন্ধু বলে কিছু বলি না, নইলে–
— নইলে কী করতি, বল?
–একটি থাপ্পড়ে তোর বদন বিগড়ে দিতাম।
–যা, যা। আর এক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।
–তবে রে!
–তবে রে!
পরক্ষণেই শুরু হল শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই!–টেবিল উলটে পড়ল, চেয়ার ভাঙল, গেলাস। আর কাঁচের বাসন ভেঙে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা কাঁচের গুঁড়ো!.. কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল চুম্পী আর পচা নামক দুটি জীবন্ত বিভীষিকা অচৈতন্য হয়ে শুয়ে পড়েছে ঘরের মেঝের উপর তাদের গালে, কপালে, মাথায় দেখা দিয়েছে অনেকগুলো ছোটো বড়ো আল, তাদের ঠোঁট গেছে ফেটে, থেঁতলে গেছে নাক, বন্ধ-হয়ে যাওয়া চোখের চারপাশে কালো হয়ে জমে গেছে রক্ত!
ত্রিবেদী জানলা দিয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করলেন, তারপর বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন। পাহারাদার ছেলেরা সারারাত পাহারা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবে, সুতরাং একসময়ে তারা এখানেও এসে পড়বে। উপরে খাওয়ার ঘরে যারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, ভোরের আগে যে তাদের জ্ঞান ফিরবে না এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত। তিনি ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন.
একটু পরেই ছেলেরা এসে পড়ল। লোক দুটির অবস্থা দেখে তারা চমকে গেল। একজন তো বলেই ফেলল, আমরা সবাই মিলে ঠ্যাঙালেও এদের এমন অবস্থা করতে পারতাম না। আপনি তো স্যার দারুণ জিনিস দেখছি।
আর একজন বলল, ত্রিবেদী স্যারের গায়ে যে জোর আছে সেকথা কি তুই আজ জানলি? সেদিন কপাটি ম্যাচে দেখলি না গদাই-এর মতো জোয়ানকে স্যার কেমন পটকে দিলেন?
–আরে সেটা হল খেলা। আর এটা যে সাংঘাতিক কাণ্ড, খুনোখুনি ব্যাপার। এদের এক-একটার চেহারা দেখেছিস? গদাই আর বাঘা মুকুন্দ এদের কাছে ছেলেমানুষ।
ওহে তোমরা এদের হাত-পা বেঁধে পুলিশে খবর দাও, ত্রিবেদী বললেন, জ্ঞান ফিরে এলে এরা কি করবে বলা যায় না।
আমাদের লোক চলে গেছে, এখনই পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবে। ওদের জ্ঞান ফিরে এলে আবার আমরাই ওদের অজ্ঞান করে দিতে পারব। এতগুলো ছেলের হাত এড়িয়ে ওরা পালাতে পারবে না। এখন বুঝলাম এরাই এতদিন বাড়ি বাড়ি চুরি করেছে। আপনি ছাড়া অন্য কোনো লোক কি এদের ধরতে পারত? পাঁচ-সাতজন একত্র হয়েও এদের ধরতে পারত না মাঝখান থেকে হয়তো দু-একটা লাশ পড়ে যেত। এদের পাকড়াও করে আপনি পাড়ার লোকের ধনপ্রাণ দুই-ই বাঁচিয়েছেন স্যার।
…খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশের ভ্যান উপস্থিত হল অকুস্থলে। তস্করযুগল তখনও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাদের ধরাধরি করে ভ্যানে ভোলা হল। ত্রিবেদীর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে পুলিশ অফিসার বললেন, শুনলাম আপনিই ওদের ধরেছেন? ভবিষ্যতে মেজাজটা একটু সংযত রাখবেন। লোকে দুটোকে তো প্রায় খুন করে ফেলেছেন।
ইয়ে, মানে, ত্রিবেদী আমতা আমতা করে বললেন, মেজাজ খারাপ হলে আমি নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারি না।
—ভবিষ্যতে সামলাতে চেষ্টা করবেন, নইলে একদিন খুনের দায়ে পড়ে যাবেন মশাই।
গাড়িতে ওঠার আগে পুলিশ অফিসার হঠাৎ ত্রিবেদীর দিকে ফিরলেন, তার গম্ভীর মুখে ফুটল হাসির আভাস, আপনাকে দেখলে কিন্তু মনেই হয় না আপনার শরীরে এমন ভীষণ শক্তি। আমরা পাঁচ-ছয় জন মিলেও এই ষণ্ডা দুটোকে এমনভাবে ঠ্যাঙাতে পারতাম না। আপনি বোধহয় মার্শাল আর্ট, অর্থাৎ ক্যারাটে, জুডো প্রভৃতি জানেন- তাই না?
ত্রিবেদী একটু হাসলেন, কথা কইলেন না।
অফিসারও হাসলেন, বুঝেছি, আচ্ছা চলি। আমার কথাটা মনে রাখবেন। আগেও বলেছি, আবারও বলছি– মেজাজ সামলে চলবেন, নয়তো একদিন নির্ঘাত খুনের দায়ে পড়বেন।
অফিসার লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠতেই পুলিশ-ভ্যান চলতে শুরু করল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অন্তর্ধান করল। ছেলের দলও ত্রিবেদীকে অভিনন্দন জানিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল। আজ রাতে যে আর পাহারা দেওয়ার দরকার হবে না, সেটা সকলেই বুঝেছিল।
ত্রিবেদী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এতক্ষণ পরে আবার তাঁর মস্তিষ্কে শুরু হয়েছে চিন্তার আলোড়ন, আমার নতুন আবিষ্কারটা আর পরীক্ষা করে দেখার দরকার হল না। চোর দুটোর উপরেই পরীক্ষা হয়ে গেল। মানুষের মন যখন বিষণ্ণ হয়, তখন সে ভেঙে পড়ে। আমি এমন কিছু আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম, যা মানুষকে শোক, দুঃখ, বিষাদ ভুলিয়ে আনন্দে মগ্ন করে দেবে। কিন্তু আমার আবিষ্কৃত এই নির্যাস দেখছি মানুষকে মত্ত করে দেয়, হিংস্র করে তোলে। নাঃ, আমার সব পরিশ্রমই ব্যর্থ হয়েছে, আবার নতুন করে গবেষণা শুরু করতে হবে। অনেক রাত হল, এবার শুয়ে পড়ি।
ত্রিবেদী দরজা বন্ধ করার উদ্যোগ করলেন, কিন্তু হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল অন্ধকারে দণ্ডায়মান একটি লোকের দিকে তিনি দরজা খোলা রেখেই এগিয়ে গেলেন, কে? কে ওখানে?.. আরে গজু, না, না; গজানন যে! ওখানে দাঁড়িয়ে এত রাত্রে কি করছ তুমি?
না, মানে, গজানন সামনে এগিয়ে এল, এই আপনার যদি কোনো বিপদ হয়, তাই ভেবে
–আমার বিপদ হবে ভেবে রাত দুটোর সময়ে আমার বাড়ির কাছে এসেছে আমায় পাহারা দিতে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে সেইজন্যেই- যদি আপনি বিপদে পড়েন তাই সাহায্য করার জন্যই এসেছিলাম।
-ও।
আচ্ছা ত্রিবেদী স্যার, গজু একবার মাথা চুলকে নিল, তারপর ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করল, ওই লোক দুটোকে কি আপনিই পিটিয়েছেন স্যার?
-হ্যাঁ। তুমি তখন কি করছিলে?
-আপনি যখন ওদের পেটাচ্ছিলেন, তখন তো আমি এখানে ছিলাম না। আমি যখন এলাম, তখন লোক দুটোকে ভ্যানে তোলা হচ্ছিল। সেই সময় পুলিশ সার্জেন্ট আপনাকে মেজাজ সামলে চলতে বলছিল স্যার।
–এমনিতে আমার মেজাজ খুব ঠান্ডা। সহজে আমি রাগ করি না। কিন্তু হঠাৎ যদি কোনো কারণে মেজাজ বিগড়ে যায়, তখন আমার আর জ্ঞান থাকে না বুঝেছ?
-হ্যাঁ স্যার, বুঝেছি।
–আরও একটা কথা তোমায় বলে দিচ্ছি। আমার বিপদ নিয়ে যদি বেশি মাথা ঘামাও, তাহলে তুমিও বিপদে পড়বে। আমাকে কেউ সর্বদা চোখে চোখ রাখছে, একথা ভাবলেই আমার মাথায় খুন চেপে যায়- বুঝেছ?
–হ্যাঁ স্যার। না স্যার। মানে, আপনাকে আর কখনো পাহারা দেব না। ঠিক আছে স্যার; আপনি যা বলবেন তা-ই হবে।
শোনো গজু, ত্রিবেদী গজুর মুখের উপর তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, তোমাকে গজানন বলে আমি ডাকতে পারব না। অত বড়ো নাম উচ্চারণ করতেই আমার কষ্ট হয়। ডাক্তার সাটিরার মতো আমি তোমায় গজু বলেই ডাকব। তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবে না।
-না, না, সে কি কথা! আপনার উপর কখনো রাগ করতে পারি?… আচ্ছা স্যার, অনেক রাত হল আজ চলি, পরে দেখা হবে।
.
০৫. হলুদ রাক্ষস
এসো তিলু, বরেনবাবু সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, ময়ূখবাবুর হাতে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম, সেটা পেয়েই ছুটে এসেছ বোধহয়?
হ্যাঁ। কিন্তু চিঠি পড়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না, ত্রিবেদী বললেন, চিঠিতে জানিয়েছ কোন এক হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে তুমি নাকি মুশকিলে পড়েছ; অথচ হলুদ রাক্ষস নামক বস্তুটা যে কী, সেকথা পরিষ্কার করে জানাওনি। ময়ুখবাবুর মুখে দেখলাম ব্যান্ডেজ বাঁধা। প্রশ্ন করে জানলাম হলুদ রাক্ষসের স্পর্শে তার মুখে জায়গায় জায়গায় যেসব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তুমি নাকি স্বহস্তে ওষুধ দিয়ে সেইসব ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে আর সাতদিন আগে ওই ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছ। অতএব ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে যে, আক্রমণকারীর স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা করব, সেই উপায়ও ছিল না। ময়ুখবাবু আরও জানালেন তোমার কুকুর ডিক মারা পড়েছে ওই হলুদ রাক্ষসের হাতে। সব শুনে চলে এলাম তোমার কাছে। এখন এই হলুদ রাক্ষস সম্পর্কে আমার দারুণ কৌতূহল জেগে উঠেছে তুমি তো আর কাউকে এই বস্তুটির চেহারা দেখাওনি, আশা করি আমায় দেখবে।
আরে দেখাব বলেই তো তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি। এসো, আমার সঙ্গে।
দোতলা বাড়ি, বরেনবাবু ভাড়াটে নন, তিনি নিজেই বাড়ির মালিক। ভদ্রলোক বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বিয়ের দু-বছর পরেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। আত্মীয়রা তাঁকে আবার বিবাহের পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রথম পক্ষের কোনো সন্তান ছিল না, বরেনবাবুর তৎকালীন বয়সও ছিল খুব কম, স্বচ্ছন্দে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারতেন। কিন্তু স্ত্রীর অকালমৃত্যু তাঁকে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা এনে দিল– তিনি আর বিবাহ করলেন না, পূর্ণ উদ্যমে বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে বরেন্দ্রনাথ বস যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন। করেছিলেন, সুতরাং অধ্যাপক ব্রিলোকনাথ ত্রিবেদীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিছুদিন পরেই তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের বন্ধন। একজন বিপত্নীক, আরেকজন চিরকুমার- দুজনেই গবেষণা করেন উদ্ভিদ নিয়ে– অতএব বন্ধুত্বের বন্ধন দিনে দিনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠল। কোনো অসুবিধা বা সমস্যার উদ্ভব হলেই একজন আর-একজনকে স্মরণ করতেন। বর্তমানে ত্রিবেদী যে-বিপদে পড়েছিলেন, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য বরেনবাবুর পরামর্শ গ্রহণ করার কথা ভাবছিলেন তিনি আর ঠিক সেই সময়েই তাঁকে ডেকে পাঠালেন বরেনবাবু।
বরেনবাবুর সঙ্গে দোতলার একটা তালাবন্ধ ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। ঘরে তালা লাগিয়েছ কেন? ত্রিবেদী জানতে চাইলেন, এই ঘরেই বোধহয় হলুদ রাক্ষসকে বন্দি করে রেখেছ তুমি? কিন্তু দরজা খুললেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমায় আক্রমণ করবে না তো?
তালা খুলতে খুলতে বরেনবাবু বললেন, ঝাঁপিয়ে আক্রমণ করার ক্ষমতা হলুদ রাক্ষসের নেই। দরজার কাছে সে আসতে পারবে না। তুমি বেশি ভিতরে যেও না তিলু। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকো।
দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন বরেনবাবু। ঘরের মধ্যে দুটি জানালার মধ্যে একটি বন্ধ, আর একটি আধখোলা। ওই আধখোলা জানলা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে বটে, কিন্তু মস্ত বড়ো ঘরটা সেই স্বল্প আলোকে বিশেষ আলোকিত হয়নি। বদ্ধঘরে সূর্যকিরণের স্পর্শে অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মাঝখানে একটি বৃক্ষজাতীয় বস্তুকে দেখতে পেলেন ত্রিবেদী। বৃক্ষ?–হ্যাঁ, গাছের গুঁড়ি আর বটের ঝুরির সঙ্গে ওই বস্তুটির সাদৃশ্য থাকলেও তার দেহকে জড়িয়ে পাতার বাহার কোথাও নেই। মেঝেতে বসানো একটা প্রকাণ্ড টবের ভিতর থেকে সটান ঘরের ছাতের দিকে উঠে গেছে প্রায় আট ফুট দীর্ঘ এক গাছের গুঁড়ি। সেই গাছের গুঁড়ির মাথা থেকে শাখা-প্রশাখা এবং পত্রপল্লবের পরিবর্তে নেমে এসেছে বটগাছের ঝুরির মতো অনেকগুলো ঝুরি বা শিকড়। পত্রপল্লবহীন ওই অদ্ভুত-দর্শন গাছটির রং উজ্জ্বল হলুদ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে গাছটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী– এই তাহলে হলুদ রাক্ষস!
বরেনবাবু এগিয়ে গাছের সামনে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে অচল বৃক্ষ হঠাৎ অস্থির আন্দোলনে চঞ্চল হয়ে উঠল– দুটি দীর্ঘ বাহু বা শিকড় বরেনবাবুর দেহের উপর খেলে বেড়াতে শুরু করল– মনে হল গাছটি বরেনবাবুর সর্বাঙ্গে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ওই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন ত্রিবেদী, ভালো করে দেখার জন্যে আর একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বিদ্যুৎবেগে দুটি শিকড় এগিয়ে এল তার দিকে! শিকড় দুটি বোধহয় নবাগতকে অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু বরেনবাবু বাদ সাধলেন চিৎকার করে বন্ধুকে, সাবধান করে এক প্রচণ্ড লম্ফত্যাগ করলেন তিনি এবং শিকড় দুটি ত্রিবেদীর কাছে পৌঁছনোর আগেই বন্ধুর কাছে পৌঁছে গেলেন- পরক্ষণেই বরেনবাবুর দুই হাতের ধাক্কা খেয়ে সশব্দে দরজার উপর ছিটকে পড়লেন ত্রিবেদী।
কোনোরকমে পতন থেকে আত্মরক্ষা করে ত্রিবেদী বন্ধুর দিকে ফিরলেন, ব্যাপার কী? আর একটু হলেই তো মাটিতে আছাড় খেতাম। কোনোমতে সামলে গেছি বটে, কিন্তু কনুইটা দরজায় লেগে এখনও টনটন করছে। তোমার কি হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল বরেন?
আমার মাথা খারাপ হয়নি, ক্রুদ্ধস্বরে বরেনবাবু বললেন, তোমার নিজেরই মাথার ঠিক নেই। তোমাকে বেশি ভিতরে আসতে নিষেধ করেছিলাম, তবু তুমি রাক্ষসটার আওতার মধ্যে এগিয়ে আসছিলে কেন?
-রাক্ষস। এই গাছটা তাহলে মাংসভুক? হ্যাঁ, পোকামাকড় ধরে খায় এমন গাছ আছে। জানি। কিন্তু আস্ত একটা মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে, এমন গাছের কথা কোথাও শুনিনি। তাছাড়া তুমি তো একটু আগেই ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলে, ওর ওই শুড় না শিকড়- তুমিই জানো ওগুলো কি–ওইগুলো চার্লিয়ে গাছটা তোমায় আদর করছিল বলেই আমার কৌতূহল হয়েছিল, আরও সামনে গিয়ে ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় এমন একটি ধাক্কা মারলে যে
ধাক্কা মেরেছিলাম বলেই বেঁচে গেলে তিলু, বরেনবাবু বললেন, একবার যদি ও তোমায় জড়িয়ে ধরতে পারত, তাহলে আজ তোমার নিস্তার ছিল না।
-তাই নাকি? কিন্তু তোমায় তো দেখলাম রাক্ষসটা আদর করছিল।
-হ্যাঁ, আমায় ও চেনে। হয়তো গেছো বুদ্ধি দিয়ে ভালোবাসতেও পারে। আমিই তো ওকে খেতে দিই। তবে আমি ছাড়া কেউ ওর কাছে নিরাপদ নয়। আমার চাকর নিধিরাম মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেয় বটে, কিন্তু ওর নাগালের মধ্যে কখনো যায় না। এক রাতে দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই আমার কুকুর দরজা খোলা পেয়ে ওই ঘরে ঢুকেছিল। সে আর জীবন্ত অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি।
ময়ূখবাবুর কাছে ডিকের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি। কিন্তু তার দেহটাকে তো নিটোল অবস্থাতেই দেখেছেন ময়ুখবাবু। কেউ কুকুরটার মাংস খেলে জন্তুটার দেহ হত ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। সেরকম কিছু তো বলেননি ময়ুখবাবু।
–খুব নিটোল অবস্থায় দেখেছেন? তাহলে বলব ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ-শক্তি নিতান্ত দুর্বল।
–না, না, ত্রিবেদী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এবার মনে পড়েছে তিনি বলেছিলেন কুকুরটার মৃতদেহ দেখলে মনে হয় কেউ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। এছাড়াও তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো ক্ষতচিহ্ন ময়ুখবাবুর চোখে পড়েছিল। কিন্তু গাছটা যদি মাংসভুক হত, তাহলে ডিকের শরীরে থাকত হাড়-পাঁজর বার করা গভীর ও রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন। কিন্তু ময়ুখবাবু দেখেছিলেন চাকার মতো গোল গোল ক্ষত, সেগুলো তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। কাজেই তোমার হলুদ রাক্ষসকে মাংসলোলুপ বলে মনে হয় না।
-না, ও মাংসলোলুপ নয়, রক্তলোলুপ!
–রক্তলোলুপ! হলুদ রাক্ষস রক্ত পান করে?
হ্যাঁ। ওই শিকড়গুলোর তলায় অজস্র চক্রাকার শোষকযন্ত্র আছে। শিকড় বা বাহু দিয়ে জড়িয়ে ওই শোষণযন্ত্র দিয়ে সে শিকারের দেহ থেকে রক্ত চুষে নেয়। অবশ্য ওই সঙ্গে শিকারের গলায় বাহু জড়িয়ে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টাও চলে। আমার কুকুর ডিককে ওই ভাবে শ্বাসরোধ করেই বধ করেছিল রাক্ষস।
–এই ভয়াবহ জীবটিকে তুমি সংগ্রহ করলে কোথা থেকে?
–জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুলোনা আমাজন নদীর অববাহিকা থেকে এই জাতের দুটি গাছ সংগ্রহ করেছিলেন। একটি গাছ তিনি আমায় উপহার দিয়েছেন, আর একটি আছে তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে।
তাগাসাকি বুবুসোনা! জাপানি বৈজ্ঞানিক। তিনি তাঁর যাবতীয় আবিষ্কারের নমুনা কি জনে জনে বিতরণ করছেন নাকি?
অর্থাৎ? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন বরেনবাবু, আমি জানি তুমি বুবুসোনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তোমাকেও কি তিনি কিছু উপহার দিয়েছেন?
না, না, বিব্রত হয়ে পড়লেন ত্রিবেদী, আশ্চর্য-পাতার বিষয়টা তিনি এখনই ভাঙতে চাইছিলেন না, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমাকে বুবুসোনা একটা নমুনা দেখিয়েছিলেন, কোনো কিছু উপহার দেননি। তবে বিজ্ঞানীরা কিছু আবিষ্কার করলে জনসাধারণের সামনে তা উপস্থিত করার আগে কারুকে বিশেষ কিছু জানাতে চান না, তাই বলছিলাম।
বাধা দিয়ে বরেনবাবু বললেন, হলুদ রাক্ষস আমার আবিষ্কার। আমার সৃষ্টি। বুবুসোনা নিমিত্ত মাত্র, কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমার।
-বুঝলাম না।
-বুঝিয়ে দিচ্ছি। তাগাসাকি বুবুসোনা আমাজন নদীর অববাহিকা থেকে দুটি নতুন ধরনের গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। ওই দুটি গাছ পতঙ্গভুক গোষ্ঠীর অন্তর্গত, ইতিপূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল মানুষের কাছে অজ্ঞাত। আগেই বলেছি একটি গাছ তিনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন। আমি সেই গাছটি নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষা চার্লিয়েছি। বুবুসোনার গাছ পূর্ণবয়স্ক হলে চারফুট লম্বা হয়। আমার হলুদ রাক্ষস পূর্ণবয়স্ক হয়নি, এখনই তার দৈর্ঘ্য পাক্কা আট ফুট। না-জানি সে আরও কত বড়ো হবে। এই অত্যাশ্চর্য দৈর্ঘ্য ও মানানসই প্রস্থ কিন্তু গাছটার জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়, আমার আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ মেশানো তরল ও নিরেট খাদ্যের মহিমায় হলুদ রাক্ষস নামক এই দানবের জন্ম হয়েছে। অতএব আমি যদি নিজেকে এই বৃক্ষদানবের পিতা বলে দাবি করি, তাহলে দাবিটা বোধহয় নিতান্ত মিথ্যা বলা চলে না– তুমি কি বলো তিলু?
-ঠিক। এই রাক্ষসকে তুমিই জন্ম দিয়েছ, অতএব স্বচ্ছন্দে তুমি এর পিতৃত্ব দাবি করতে পারো। কিন্তু বরেন, এখন তুমি ওকে নিয়ে কি করতে চাও?
সেই বিষয়েই তো তোমার পরামর্শ চাইছি। হলুদ রাক্ষসের খিদে বা রক্তপানের তৃষ্ণা দিন দিন যেভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে তার রসদ জোগানো আমার পক্ষে আর বেশিদিন সম্ভব হবে না। প্রথম প্রথম ব্যাঙ, গিরগিটি, ইঁদুর প্রভৃতি চার্লিয়েছি, এখন বোজ পাঁচ থেকে ছয়টি মুরগি দিচ্ছি, কিন্তু তাতে বোধহয় ওর তৃপ্তি বা পুষ্টি হয় না। খাদ্য ছাড়া বাসস্থানের সমস্যাও রয়েছে। যেভাবে ও বাড়ছে, তাতে বড়ো জোর বছর দুই ওই ঘরে ওকে রাখা যাবে। তারপর?
সরকারকে জানালে সরকার নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে। আরও একটা কথা মনে হচ্ছে আমার ইঁদুর, বেজি প্রভৃতি জীব মানুষের আহার্য শস্য প্রচুর পরিমাণে নষ্ট করে;— সে ক্ষেত্রে হলুদ রাক্ষসের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে মনুষ্যজাতিরও উপকার করা যায়।
তা হয়তো করা যায়। কিন্তু আমি এখনই আমার আবিষ্কার সরকারের হাতে তুলে দিতে চাই না। হলুদ রাক্ষস রক্তপায়ী জীব হলেও ভালোবাসতে জানে। ও আমায় ভালোবাসে, আমার কথা বুঝতে পারে। ওকে নিয়ে আমি আরও পরীক্ষা করতে চাই।
-তোমার কথা বুঝতে পারে? তাহলে ডিকের মৃত্যু ঘটল কেন?
–ডিক আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমি অকুস্থলে উপস্থিত হতে পারতাম, তাহলে ডিকের মৃত্যু হত না। কিন্তু আমি যখন অকুস্থলে হাজির হয়েছিলাম, তখন হলুদ রাক্ষস রক্তপানে উন্মত্ত। তাছাড়া ডিক কিছু নিরীহ জীব নয়, সেও আঁচড়ে কামড়ে গাছটাকে আহত করেছিল। রক্তপায়ী হলেও হলুদ রাক্ষসের শরীর অন্যান্য গাছের মতো শক্ত নয়, প্রায় কলাগাছের মতো নরম। ওঁর শুঁড় বা বাহুগুলো শক্ত রবাবের মতো, তবে ডিক-এর মতো শক্তিশালী হাউন্ডের ধারাল দাঁত হলুদ রাক্ষসের শুঁড় বা দেহকাণ্ডকে মারাত্মকভাবে জখম করতে সমর্থ। আহত হয়ে হলুদ রাক্ষস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, তার উপর সে তখন রক্তের নেশায় উন্মত্ত- ওই অবস্থায় তাকে নিবৃত্তি করে আমি ডিককে বাঁচাতে পারিনি।
ময়ুখ চৌধুরী বলছিলেন তুমি নাকি একটা পিচকারি হাতে ছুটে এসেছিলে?
হা, হলুদ রাক্ষসকে জব্দ করার জন্য আমি একটা নির্যাস আবিষ্কার করেছি। পিচকারিতে ওই তরল নির্যাস ভরা ছিল। পিচকারির সাহায্যে উক্ত তরল নির্যাস ছড়িয়ে দিলেই হলুদ রাক্ষস কাবু হয়ে পড়ে। গাছটা তখন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে, তার পক্ষে সেই সময় আর শিকারকে আঁকড়ে রাখা সম্ভব হয় না। তবে আমাকেও সাবধান থাকতে হয়, নির্যাসের মাত্রা বেশি হলে রক্তপায়ী উদ্ভিদটির মৃত্যু হতে পারে তৎক্ষণাৎ। ডিক আমার আদরের কুকুর, তাকে বাঁচাতে ওই মারাত্মক ঔষুধ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল, হলুদ রাক্ষস ডিককে ছেড়ে দিলেও তাকে আর বাঁচাতে পারলাম না। শ্বাসরোধ হয়ে কুকুরটার মৃত্যু হয়েছিল। উত্তেজিত অবস্থায় আমিও অতিরিক্ত নির্যাস ছড়িয়ে দিয়েছিলাম গাছটার উপর, ফলে গাছটাও বেশ কয়েকদিন নির্জীব হয়ে পড়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে মুরগিরা তার চারপাশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তাদের স্পর্শ করতেও চায়নি হলুদ রাক্ষস। সবচেয়ে মজার কথা কি জানো? আমি যে তাকে আঘাত করেছি এটা বুঝলেও গাছটা আমার উপর কখনো প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করেনি। হলুদ রাক্ষস যে আমায় ভালোবাসে, অনেকবারই আমি তার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি।
হলুদ রাক্ষস যখন এতই বুদ্ধিমান আর তোমাকে সে যখন ভালোবাসে, তখন আমাকে অমন মারাত্মক ধাক্কা না মেরে রাক্ষসটাকেই তো আক্রমণ করতে নিষেধ করা উচিত ছিল তোমার।
নিষেধ বুঝতে তার সময় লাগত। ততক্ষণে রক্তলোলুপ শোষণযন্ত্রগুলো তোমার শরীরে ছোটো ছোটো চক্রাকার ক্ষতের সৃষ্টি করত। আমার উপস্থিতিতে সে তোমাকে কখনই হত্যা করতে পারত না। কিন্তু অনর্থক তোমাকে কয়েকটা কুৎসিত ক্ষত নিয়ে ভুগতে হত। সেই দুর্ভোগ যাতে তোমায় ভুগতে না হয়, সেইজন্যেই ধাক্কা মেরেছিলাম। বুঝেছ তিলু?
বুঝলাম। আমি অবশ্য হলুদ রাক্ষসের মতো সর্বভুক নই, তবে এই মুহূর্তে আমার উদরেও ক্ষুধার অগ্নি অতিশয় জ্বলন্ত। এখন প্রায় এগারোটা, কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত আমার পেটে এককাপ চা পর্যন্ত পড়েনি।
আরে ছি, ছি, সেকথা বলবে তো? আপাতত রুটি মাখন, ডিম আর চায়ের ব্যবস্থা করছি। তারপর দেখা যাক তোমার উদরের অগ্নিকে প্রশমিত করার জন্যে কোন কোন বস্তুর সমাবেশ ঘটানো যায়।
.
০৬. মৃত্যু আলিঙ্গন
মধ্যাহ্নভোজন বেশ গুরুতরই হয়েছিল। বরেনবাবুর ভৃত্য কয়েক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। ঘরের অন্যান্য কাজের সঙ্গে রন্ধনকার্যের ভারও ছিল তার উপর, কিন্তু তার অনুপস্থিতি ত্রিবেদীকে অসুবিধায় ফেলল না; কারণ, বরেণবাবু ছিলেন রন্ধনবিদ্যায় অতিশয় দক্ষ।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুই বৈজ্ঞানিক যখন গল্পগুজব করছেন, তখন ত্রিবেদীর মনে হল বন্ধুকে একেবারে অন্ধকারে রাখা উচিত হবে না– ডা. সাটিরা ও গজানন ওরফে গজুর কথাটা বরেনবাবুকে খুলে বললেন ত্রিবেদী। ওই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আশ্চর্য-পাতা সম্বন্ধেও মুখ খুলতে বাধ্য হলেন তিনি। কপাটি খেলায় অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে ত্রিবেদীকে পূর্বোক্ত দুই সমাজবিরোধী সাগ্রহে দলে টানতে চেয়েছে এমন কথা বরেনবাবু কখনই বিশ্বাস করতেন না তাই আশ্চর্য-পাতার রহস্য বন্ধুর কাছে ব্যক্ত করেছেন ত্রিবেদী এবং বর্তমানে ওই পাতা আর পাওয়া যাচ্ছে না বলেই যে তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সে কথাও বললেন। আগের রাতে যা ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়ে ত্রিবেদী বললেন, তাগড়া জোয়ান চেহারার চোর দুটোর দুরবস্থা দেখে গজু ব্যাটা ঘাবড়ে গেছে, আর সকলের মতো গজুও ভেবেছে ওদের ওই অবস্থার জন্য ত্রিবেদী স্যারই দায়ী। গজু আমাকে কপাটি প্রতিযোগিতার সময় ছয় সাতজন খেলোয়াড়কে ছিটকে ফেলে দিতে দেখেছে, কাজেই দুটো চোর যতই ষণ্ডা হোক, তাদের ঠেঙিয়ে আধমরা করার ঘটনা গজুর কাছে খুব অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়নি। তারপর পুলিশ অফিসার যখন বলে গেলেন মেজাজ সামলে না চললে ভবিষ্যতে আমায় খুনের দায়ে পড়তে হবে, তখন গজু বিলক্ষণ ভয় পেল। অবশ্য একমুঠো আশ্চর্য পাতা মুখে নিয়ে আমি যদি গজুর মহড়া নিতাম, তাহলে সে জীবনে কোনোদিন কোনো ভদ্র সন্তানকে ভয় দেখাতে সাহস পেত না, একথা আমি জোর গলায় বলতে পারি কিন্তু আশ্চর্য-পাতার সাহায্য ছাড়া আমি একেবারেই অসহায়। বুঝলে বরেন, তোমার এখানে পালিয়ে এসেছি কয়েকদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকব বলে। তারপর এখানে থাকতে থাকতেই হানাবাড়িতে ঢুকে– মানে, এখন আর হানাবাড়ি নয়– সেই বাড়ির বাগানে ঢুকে কেমন করে কিছু আশ্চর্য পাতা হস্তগত করা যায় সেই ফন্দি আঁটতে হবে। ওখান থেকে কিছু পাতা নিয়ে এলে কেউ খেয়াল করত না, কিন্তু এখন যে-দারোয়ান পাহারা দেয়, তার চোখে ধুলো দিয়ে হানাবাড়ির বাগান থেকে আশ্চর্য-পাতা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন কাজ। তোমার কাছে আসার পরিকল্পনা আগেই করেছিলাম, খুব ভোরে উঠে গজুর সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তোমার বাড়িতেই পালিয়ে আসব ভেবেছিলাম কিন্তু হঠাৎ ওই চোর দুটো এসে পড়ায় ঘটনার ধারা বদলে গেল। আমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি, তখন খুব ভালো করে নজর রেখেছি গজু হতভাগাকে কোথাও দেখতে পাইনি। তোমার এখানে যে আমি এসেছি, এটা ওদের জানা নেই। বেশ কিছুদিন আমি ওদের চোখের আড়ালে থাকলে ওরা আমার সম্পর্কে হতাশ হয়ে এলাকা ছেড়ে সরে পড়বে। সেই কটা দিন আমি তোমার বাড়িতেই অজ্ঞাতবাস করব ভাবছি। বাগচি মশাই-এর বাড়িতে টেলিফোন আছে, তাকে ফোন করে জানিয়ে দেব উনি যেন আমার কাজের লোক সনাতনকে জানিয়ে দেন যে, আমি কিছুদিন বাড়ি থাকব না- সনাতন যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। সব কথাই তোমায় আমি খুলে বললাম বরেন, এখন তোমার মতামত জানাও। আমি যা ভেবেছি সেইভাবে চললে বোধহয় শয়তান দুটোকে ফাঁকি দিতে পারব–তুমি কী বলো?
এতক্ষণ নীরবে বন্ধুর বক্তব্য শুনছিলেন বরেনবাবু, এইবার তিনি মুখ খুললেন, তিলু, তোমার কথায় বুঝলাম চোর দুটোর অবস্থা দেখে গজু ওরফে গজানন ভীষণ ভয় পেয়েছে। তার কাছে সবকিছু শুনে ডা. সাটিরাও যদি ঘাবড়ে যায়, তাহলে তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু সাটিরা কি ভয় পাবে? তোমার কি মনে হয়? তুমি ওদের দুজনকেই দেখেছ, চিনেছ। ওদের মনস্তত্ত্ব আমার চেয়ে তুমিই ভালো বুঝবে।
সাটিরা ভয় পাবে কি না বুঝতে পারছি না, চিন্তিতভাবে ত্রিবেদী বললেন, তবে এটা বুঝেছি সাটিরা হচ্ছে দলের মাথা, তার বুদ্ধিতেই সকলে চলে। গজুটা ষাঁড়ের মতো জোয়ান, কিন্তু মগজে বুদ্ধি নেই একফোঁটা- যাকে বলে বোকার বেহদ্দ। আশ্চর্য-পাতা হাতের নাগালে এলে গজুকে আমি ঘোল খাওয়াতে পারব এই বিশ্বাস আমার আছে; ওর ছুরিসমেত হাতখানা আমি আশ্চর্য-পাতার গুণে এক মোচড়েই ভেঙে দিতে পারব, কিন্তু–
কিন্তু বলে থামলে কেন তিলু?
কিন্তু ডাক্তার সাটিরা দস্তুরমতো ধূর্ত, আর হাতের রিভলবার সে ব্যবহার করতে পারে বিদ্যুদ্বেগে। ভাবতে পারো, এক মুহূর্ত টিপ করার সময় না নিয়ে আমার ঘরের একটা বা সে গুলি চার্লিয়ে উড়িয়ে দিল! এত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রিভলভার বার করে গুলি চার্লিয়ে আবার পকেটেই অস্ত্রটাকে সে চালান করে দিল যে, আমি রিভলভারটাকে ভালো করে দেখতেই পেলাম না। শুধু মুহূর্তের জন্য তার হাতে কালো রং-এর কী-একটা জিনিস যেন দেখলাম আর ওই খণ্ড মুহূর্তের অবকাশে বস্তুটার স্বরূপ নির্ণয় করতেও আমি পারিনি। লোকটার রিভলভারে আবার শব্দ হয় না, সে সাইলেন্সর ব্যবহার করে। আশ্চর্য-পাতার সহায়তা পেলেও এমন ধূর্ত আর লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত দুবৃত্তের মোকাবিলা করা খুবই কঠিন। গজুটা নিরেট গাধা, কিন্তু সাটিরা দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তবে ভরসার কথা যে, আমার বর্তমান ঠিকানা সে জানে না। এবার তার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার বদলে ধৈর্যের পরীক্ষাই আমায় দিতে হবে। আশা করি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি জয়লাভ করতে পারব।
আশা করা ভালো, কিন্তু আমি তোমায় আশ্বস্ত করতে পারছি না, তিলু। তুমি আমার পরামর্শ চেয়েছ বলেই বলছি, যে-কোনো সময়ে যে-কোনো জায়গায় সাটিরার সঙ্গে তোমার শুভদৃষ্টি ঘটতে পারে। গজুকে তুমি চেনো, কিন্তু গজু ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি যদি তোমাকে অনুসরণ করে তাহলে সেই লোকটিকে তুমি চিনবে কেমন করে? হয়তো আমার বাড়িতে তোমার উপস্থিতি গুপ্তচরের কল্যাণে সাটিরার অজানা নয়। এই মুহূর্তেই যে তার নিযুক্ত চর তোমার উপর নজর রাখছে না, এমন কথাও জোর করে বলা যায় না।
কী সর্বনাশ, আঁতকে উঠলেন ত্রিবেদী, তাহলে আমি কী করব? কোথায় যাব?
কোথাও যাওয়ার দরকার নেই,বরেনবাবু বললেন, সাটিরা যে তোমার বর্তমান আস্তানার খবর রাখে, এমন কোনো প্রমাণ আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। তুমি বড়ো বেশি নিশ্চিন্ত হচ্ছিলে, তাই একটা বিপজ্জনক সম্ভাবনার কথা তোমাকে জানিয়ে দিলাম। হয়তো তোমাকে কেউ অনুসরণ করেনি, হয়তো সাটিরা বা গজু তোমার বর্তমান আশ্রয়ের খবর রাখে না, কিন্তু যদি তোমার খবর তারা পেয়ে থাকে, তবু
বরেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন, তবু এই মুহূর্তে তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। কাল থেকে তোমার উপর দিয়ে উত্তেজনার ঝড় ছুটছে, ক্লান্ত স্নায়ুকে এবার একটু বিশ্রাম দাও। তোমার আজ কর্তব্য হচ্ছে নিবিষ্টচিত্তে নিদ্রাদেবীর আরাধনা। সামনেই তোমার জন্য বিছানা প্রস্তুত রয়েছে, তোমাকে এই মুহূর্ত থেকেই শরীরের প্রতি কর্তব্য পালনের সুযোগ দিয়ে আমি চললাম আমার ঘরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম গ্রহণের জন্য।
বন্ধুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বরেনবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ত্রিবেদী এবার বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুভব করলেন তাঁর সর্বশরীর এখন ওই বিছানায় আশ্রয়লাভের জন্য অধীর হয়ে উঠেছে- চেয়ার ছেড়ে উঠে তিনি পূর্বোক্ত শয্যার উপর শুয়ে পড়লেন এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার চেতনা…
সন্ধ্যার সময়ে ডাকাডাকি করে ত্রিবেদীর ঘুম ভাঙালেন বরেনবাবু। চা পান করতে করতে কিছুক্ষণ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেন দুই বন্ধু, তারপর বরেনবাবু জানালেন বিশেষ কাজে তাকে একবার বাইরে যেতেই হবে। তবে রাত ন-টার মধ্যে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসবেন, ওই কয়েকঘণ্টার অনুপস্থিতির জন্য বন্ধুবর যেন তাকে ক্ষমা করেন। ত্রিবেদী জানালেন, তার কোনো অসুবিধা হবে না, বরেনবাবুর লাইব্রেরিতে বসে তিনি স্বচ্ছন্দে কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন।
বর্ষাকাল। মাঝে মাঝে মৃদু গম্ভীর গর্জনে আকাশ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে-কোনো সময়ে বর্ষণ শুরু হতে পারে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির ভয়ে কাজের মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারে না, তাই আকাশের ক্রুদ্ধ সঙ্কেত তুচ্ছ করেই বেরিয়ে পড়লেন বরেনবাবু…
নটা, সাড়ে নটা নয়, প্রায় এগারোটার সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বরেনবাবু বাড়ি ফিরে এলেন। ত্রিবেদীর উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, তুমুল বর্ষণের ফলে শহরের বহু রাস্তাই এখন জলের তলায়। ওই সব রাস্তায় যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে। ওই রকম জলমগ্ন পথের উপর অবস্থিত একটি বাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছিলেন বরেনবাবু। অবশেষে রাত বাড়ছে দেখে মরিয়া হয়ে তিনি বৃষ্টিপাতের মধ্যেই পথে নেমে পড়লেন এবং অনেকটা রাস্তা হাঁটুজল ভেঙে অগ্রসর হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত উঁচু জমির উপর একটা ট্যাক্সি পেয়ে তার সাহায্যেই বাড়ি এসে পৌঁছোতে পেরেছেন।
বরেনবাবু ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি ছাতার শাসন উপেক্ষা করে তাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। তলায় জলমগ্ন পথ এবং উপরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ তাকে বিলক্ষণ কাবু করে ফেলেছিল, কোনোমতে রাতের আহার শেষ করে ত্রিবেদীকে শুভরাত্রি জানিয়ে তিনি চলে গেলেন নিজস্ব শয়নকক্ষে…
ত্রিবেদী কিছুক্ষণ একটা বই নিয়ে সময় কাটালেন, তারপর আলো নিবিয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তিনি অনুভব করলেন তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেই একটা অজানা বিপদের আশঙ্কা হানা দিচ্ছিল তার মগ্ন চৈতন্যে… একবার তার মনে হল ডিক নামে যে মস্ত কুকুরটাকে তিনি সভয়ে এড়িয়ে চলতেন, এইসময় সে উপস্থিত থাকলে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারতেন… অবশেষে একসময়ে সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নেমে এল সন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবীর স্নিগ্ধ আশীর্বাদ, ঘুমিয়ে পড়লেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…
গভীর রাত্রে ত্রিবেদীর ঘুম ভেঙে গেল কে যেন বন্ধ দরজায় ঘন ঘন করাঘাত করছে! বন্ধুর পরামর্শে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন ত্রিবেদী, এখন সেই রুদ্ধ দ্বারেই কেউ আঘাত করছে! সভয়ে বিছানার উপর উঠে বসলেন তিনি, প্রথমেই তার মনে হল ডা. সাটিরা আর গজুর কথা– নিচে সদর দরজা অবশ্য ভিতর থেকে বন্ধ, কিন্তু দুই শয়তান যদি গৃহপ্রবেশ করতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে সদর দরজার খিল আটকে তাদের যে বাধা দেওয়া যাবে না, এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত।
দরজায় করাঘাতের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই ত্রিবেদী ভাবলেন কোনোরকমে সদর দরজার বাধা অতিক্রম করে এখন তার শয়নকক্ষের দরজাকেই আক্রমণ করেছে দুই দুর্বৃত্ত। অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ ভেদ করে অন্য কোনো আওয়াজ নিদ্রিত প্রতিবেশীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কি না সন্দেহ। সুতরাং আক্রান্ত হলেও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই।
আবছা অন্ধকারে চারিদিকে একবার দৃষ্টিকে চালনা করলেন ত্রিবেদী ঘরের মাঝখানে রয়েছে একটা টেবিল আর চারটি চেয়ার। ওই জিনিসগুলো টেনে এনে দরজার গায়ে ঠেকা দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা সম্ভব কিনা যখন ভাবছেন তিনি সেইসময় তাকে আশ্বস্ত করে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল বরেনবাবুর কণ্ঠস্বর, ওহে তিলু, দরজা খোলো। তোমার কুম্ভকর্ণের ঘুম দেখছি ভাঙতেই চায় না!
তড়াক করে উঠে দরজা খুলে ত্রিবেদী দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বরেনবাবু, হাতে তার মস্ত বড়ো একটা পিচকারি!
বিস্মিত ত্রিবেদী জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? এত রাত্রে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা মেরে আমার ঘুম ভাঙালে কেন?
ভালো করে শোনো তিল, ভালো করে শোনো।
প্রথমে কিছু শুনতে পেলেন না ত্রিবেদী, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাপিয়ে আর একটা শব্দ ভেসে এল তার কানে কারা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ আর্তস্বর! আর শব্দটা আসছে সেই তালাবদ্ধ ঘরটার ভিতর থেকে, যেখানে অবস্থান করছে রক্তলোলুপ হলুদ রাক্ষস!
বরেনবাবর মখের দিকে তাকালেন ত্রিবেদী।বন্ধর নীরব প্রশ্ন বঝলেন বরেনবাব।তিনিও নীরব থেকেই মাথা নেড়ে জানালেন ওই ঘর থেকেই শব্দটা আসছে বটে? বারান্দা পেরিয়ে বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুজনে-হা, অস্ফুট কাতর গোঙানি ভেসে আসছে ওই ঘরের ভিতর থেকে।
চাবি সঙ্গেই ছিল, তালা খুলে জোরে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে দিলেন বরেনবাবু। বারান্দার আলো আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই আলো এসে পড়ল ঘরের ভিতর। সেই স্বল্প আলোতে দুই বন্ধুর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য—
হলুদ রাক্ষসের অনেকগুলো শুঁড়ের কঠিন আলিঙ্গনের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছে ডা. সাটিরা নিস্পন্দ দেহ, তার হাতের রিভলভার মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার থেকে একটু দুরেই রাক্ষসের আলিঙ্গন থেকে মুক্তিলাভের আশায় ধস্তাধস্তি করছে গজু, তার হাতের ছুরিও খসে পড়েছে মেঝের উপর!
কয়েক মুহূর্ত দৃশ্যটা তাকিয়ে দেখলেন বরেনবাবু, তারপর দুঃখিতস্বরে বললেন, স্যুট পরা লোকটাই বোধহয় ডা. সাটিরা? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তিলু, সাটিরা আর কোনোদিনই তোমায় বিরক্ত করবে না… ওই বুঝি গজু? লোকটা খুব ষণ্ডা, তাই এখনও লড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওকেও বোধহয় বাঁচানো যাবে না। তবু দেখি একবার চেষ্টা করে।
ঘরে ঢুকে সুইচ টিপলেন বরেনবাবু। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করে উঠল ঘর। ত্রিবেদী দেখলেন আক্রান্ত হয়েও যে, দুই মূর্তি প্রাণপণে লড়াই করেছে, তার চিহ্ন রয়েছে রক্তপায়ী উদ্ভিদের সর্বাঙ্গে। হলুদ রাক্ষসের একটা বাহু ও মূল গুঁড়িটার কয়েকটা ছিদ্র থেকে ঝরছে একরকম ঘন সাদা তরল পদার্থের স্রেত (রক্ত?), স্পষ্টই বোঝা যায় সাটিরার রিভলভারের বুলেট থেকেই ওই ছিদ্রগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। গজুর গলা ও শরীরে যে শুড়গুলো জড়িয়ে রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকেটা ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে- তবু তারা নাছোড়বান্দার মতো আটকে রয়েছে গজুর দেহে। দু-হাত দিয়ে গলা থেকে শুড়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে গজু, তার দুই চোখ ঠিকরে যেন বাইরে আসতে চাইছে।
বরেনবাবু এগিয়ে গিয়ে গজুর শরীর থেকে দুটো শুঁড় টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন। হলুদ রাক্ষস তার বন্ধন শিথিল করল না। বরেনবাবুর ভ্রূ কুঁচকে গেল, পিচকারিটা মেঝের উপর রেখে হলুদ রাক্ষসের বাহু ধরে সজোরে এক টান মারলেন। হলুদ রাক্ষসের যে শুড় বা বাহুটা গজুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল, প্রবল আকর্ষণে সেটা খুলে গেল গলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে গজুর ঘাড় ও গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল তপ্ত রক্তের ধারা! ত্রিবেদী বুঝলেন শোষক যন্ত্রগুলি গজুর ঘাড় ও গলা ছেদা করে রক্তপান করছিল, বরেনবাবুর প্রচণ্ড আকর্ষণে বাহুর সঙ্গে সংলগ্ন শোষকযন্ত্রগুলিও সরে এসেছে তাই হঠাৎ ক্ষতস্থানগুলোর মুখ খুলে গিয়ে ছিদ্রপথে রক্তধারা ছিটকে পড়ছে বাইরে।
দুইহাতে বাহুটাকে চেপে রেখেই বরেনবাবু তীব্রকণ্ঠে বললেন, ছেড়ে দে রাক্ষস ছেড়ে দে! বলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বাহুকে সবলে পা দিয়ে চেপে ধরলেন তিনি। ফল হল তৎক্ষণাৎ গজুকে ছেড়ে ওই দুটি বাহু সাপের মতো কিলবিল করে জড়িয়ে ধরল বরেনবাবুকে!
কী! এত বড়ো স্পর্ধা! ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে পিচকারিটা মেঝে থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন বরেনবাবু।
তার চেষ্টা ব্যর্থ হল– আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে ত্রিবেদী দেখলেন বরেনবাবুকে জড়িয়ে ধরেছে হলুদ রাক্ষসের আরও কয়েকটি বাহু! ছেড়ে দে! ছেড়ে দে আমাকে!বরেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন।
হলুদ রাক্ষস তার আদেশ পালন করল না। বরেনবাবুর দেহের উপর গুঁড়ে বন্ধনগুলো যে আরও কঠিন হয়ে চেপে বসছে, তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল। ত্রিবেদীর মনে হল সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় তিনি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছেন– দারুণ আতঙ্কে তার সর্বাঙ্গ হয়ে গেল অসাড়, নড়াচড়া করার ক্ষমতাও তার রইল না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ তিলু? চিৎকার করে উঠলেন বরেনবাবু, পিচকারিটা তুলে নাও। রাক্ষসটা খেপে গেছে, ও এখন আমায় হত্যা করে রক্তপান করতে চায়। তাড়াতাড়ি করো; আমাকে বাঁচাতে চাও তো পিচকারি ছুঁড়ে ওর মর্মস্থানে আঘাত হানো। শুঁড়গুলো ছেড়ে ওর–
পরক্ষণেই একটা শুঁড় বরেনবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে তাঁর কণ্ঠরোধ করে দিল।
বন্ধুর বিপন্ন কণ্ঠস্বর মুহূর্তের মধ্যে ত্রিবেদীর সম্বিৎ ফিরিয়ে দিল, তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল তার বিকল স্নায়ু, নিচু হয়ে মেঝে থেকে পিচকারিটা তুলে নিলেন তিনি বন্ধুর অসমাপ্ত বাক্য থেকেই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পেরেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী- পিচকারি তুলে তিনি নিশানা স্থির করতে লাগলেন…
সপাৎ করে একটা সর্পিল বাহু তাঁর একটা পা জড়িয়ে ধরল, আর একটা বাহু বেষ্টন করল তার কোমর- ত্রিবেদী বিচলিত হলেন না, হলুদ রাক্ষসের বাহুবন্ধন তার শরীরে চেপে বসার আগেই তিনি গাছের মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি লক্ষ্য করে পিচকারি ছুড়লেন। একটি তরল পদার্থ পিচকারির মুখ থেকে ছুটে গেল নির্ভুল নিশানায়। গাছের যে-জায়গাটা তরল পদার্থটি ভিজিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গা থেকে উঠে এল খানিকটা নীলাভ ধোঁয়া!
পিচকারির হাতলটা এবার সম্পূর্ণ টেনে নিয়ে সজোরে চাপ দিলেন ত্রিবেদী- তরল নির্যাসের ধারা গাছের গুঁড়িটাকে ভিজিয়ে দিয়ে আবার ছড়িয়ে দিল নীলাভ ধোঁয়ার কুণ্ডলী! ত্রিবেদী আবার হাতল টেনে সজোরে চাপ দিলেন, কিন্তু পিচকারির মুখ থেকে আর তরল মৃত্যুবাণ শত্রুর দিকে ছুটে গেল না- পিচকারির গর্ভ এখন শূন্য, তরল বস্তুটি নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে।
আর দরকার নেই তিলু বরেনবাবুর শরীর থেকে তখন খুলে গেছে শুড়ের বাঁধন, মেঝের উপর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সমস্ত নির্যাসটাই তুমি ঢেলে দিয়েছ। আর ঢেলেছ একবারে মর্মস্থানে। হলুদ রাক্ষসের মৃত্যু হয়েছে। সে আর কখনো কোনো প্রাণীর রক্তপান করতে চাইবে না।
মৃত্যু হয়েছে?
হ্যাঁ, প্রচুর পরিমাণে তীব্র বিষ মর্মস্থল ভেদ করেছে। ওই নিদারুণ আঘাত সামলে উঠতে পারেনি হলুদ রাক্ষস। আমার হাতে পিচকারি থাকলে গাছের গোড়ায় একটুখানি ছিটিয়ে দিতাম। তাতেই কাজ হত, গাছটা ওর শুড় বা বাহুগুলো গুটিয়ে নিত। ওকে হত্যা করার প্রয়োজন হত না।
অত পরিমাণ মেপে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তুমি বলেছিলে হলুদ রাক্ষস তোমায় ভালোবাসে। সে নাকি পিচাকরির বিষাক্ত নির্যাসে আহত হয়েও তোমাকে কখনো আক্রমণ করেনি; কিন্তু আজ যদি আমি পিচকারি ছুঁড়ে ওকে বধ না করতাম তাহলে হলুদ রাক্ষসের কবলে তোমার মৃত্যু ছিল অবধারিত। এই গাছটাকে হলুদ রাক্ষস নামটা তুমি ভালোই দিয়েছিলে। এমন সার্থকনামা জীব খুব কমই দেখা যায়। ওটা রাক্ষসের মতোই হিংস্র। রক্তলোলুপ। যে-কোনো কারণেই হোক, গাছটা আগে তোমায় আক্রমণ করেনি, আজ সুযোগ বুঝে শোণিত তৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে ও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তুমি মনে করেছ ও তোমায় ভালোবাসত? ফুঃ! রাক্ষসের আবার ভালোবাসা!
না, তিলু,বরেনবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন, গাছটা সত্যিই আমায় ভালোবাসত। কিন্তু গুলি আর ছুরিতে আহত হয়ে ওর হিংস্র স্বভাব আরও হিংস্র হয়ে উঠেছিল, তার উপর রক্তের নেশায় ও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল, আপন-পর জ্ঞান আর ওর ছিল না। তুমি কি জানো না, সার্কাসের পোষা বাঘও অনেক সময় রিং মাস্টারকে হত্যা করে? হিংস্র শাপদের বন্য সংস্কার কিছুক্ষণের জন্য তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। তাই বলে তার ভালোবাসা কি মিথ্যে? না, তিলু, না।
একটু থেমে বরেনবাবু আবার বললেন, তবে তুমি না থাকলে আজ আমার মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। এতদিন পর আঘাতের যন্ত্রণা আর রক্তের নেশা যে ওকে সব কিছু ভুলিয়ে ক্ষিপ্ত করে তুলবে, আমি তা বুঝতে পারিনি। যাই হোক, এবার এই অনাহূত অতিথি দুটির দিকে নজর দেওয়া যাক।
..নজর দেওয়ার কিছু ছিল না। সাটিরার মৃত্যু হয়েছিল অনেক আগে। গজু প্রাণপণ যুঝেও শেষরক্ষা করতে পারেনি। হলুদ রাক্ষসের রক্তলোলুপ শুড়গুলো তার শরীর থেকে অনেক রক্ত শুষে নিয়েছিল, তার উপর শ্বাসনালীর উপরেও চাপ পড়েছিল সাংঘাতিক ত্রিবেদীকে উদ্দেশ্য করে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে নীরব হয়ে গেল গজু ওরফে গজানন, তার মৃত্যু হল…
ওরা দুজনে ঘরে ঢুকল কী ভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল পর্যবেক্ষণের ফলে। জল নিষ্কাশনের যে পাইপটা হলুদ রাক্ষসের জানালার পাশ দিয়ে উপর থেকে নিচে নেমে গেছে, সেইটা অবলম্বন করেই উপরে উঠে এসেছে দুই মূর্তি, তারপর জানালার গরাদ কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই হলুদ রাক্ষসের কবলে পড়েছে।
সাটিরা আর গজু আমাকেই ধরতে এসেছিল বরেন, ত্রিবেদী বললেন, সাটিরা বুকের উপর রিভলবার ধরে আমায় কিডন্যাপ করত। তুমি বাধা দিলে তোমাকে হত্যা করতে সে কুণ্ঠিত হত না। হলুদ রাক্ষস আমাদের দুজনকেই বাঁচিয়েছে।
বাকি রাতটুকু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার,বরেনবাবু ক্লান্তস্বরে বললেন, আজ রাতে বৃষ্টি মাথায় করে কয়েক মাইল হেঁটেছি, দুবার আছাড় খেয়েছি এবং দেহের উপর সহ্য করেছি হলুদ রাক্ষসের হামলা। এর উপর আবার পুলিশের ঝামেলা আমার সইবে না। রাতে ঘুমিয়ে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দি। কাল সকালে পুলিশে খবর দিলেই চলবে। তুমিও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নাও, তিলু।
ত্রিবেদী বললেন, অগত্যা।