- বইয়ের নামঃ কায়না
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. কায়না
সৈনিকের প্রথম অভিজ্ঞতা
কায়না
প্রথম পরিচ্ছেদ –রহস্যময় মৃত্যু
কায়না!
মৃত্যুগহ্বর!
হ্যাঁ, উত্তর রোডেশিয়ার স্থানীয় ভাষা কায়না শব্দটির অর্থ-যাতনাদায়ক মৃত্যুগহ্বর!
কায়না! একবার, মাত্র একবারই ওই ভয়ানক শব্দ উচ্চারণ করেছিল স্থানীয় পুলিশ কর্মচারী, তারপরই তার মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মি. হুইংক্লির মুখে পূর্বোক্ত ঘটনা শুনে চমকে উঠলেন পর্যটক আত্তিলিও গত্তি, কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হল?
হ্যাঁ।–উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, স্থানীয় পুলিশ জনৈক নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে তার বক্তব্য পেশ করতে উদ্যত হয়, কিন্তু কায়না শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গেসঙ্গেই তার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। ঘটনাটা হঠাৎ শুনলে খুব অদ্ভুত ও অলৌকিক মনে হয়, তবে একটু ভেবে দেখলে সমস্ত বিষয়টার একটা যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা করা সম্ভব। লোকটির হৃৎপিণ্ডের অবস্থা ভালো ছিল না, আর অনেকটা পথ সে দৌড়ে এসেছিল তাই অত্যধিক পরিশ্রম ও উত্তেজনার ফলে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটা খুব অসম্ভব নয়। আমি স্থানীয় অধিবাসীদের মুখে দু-বার কায়নার নাম শুনেছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও কায়না সম্বন্ধে কোনো জ্ঞাতব্য বিষয় আমার কর্ণগোচর হয়নি; কারণ সেবারেও মৃত্যু এসে অতর্কিতে বক্তার কণ্ঠরোধ করেছিল।
আত্তিলিও বললেন, প্রথমবারের ঘটনা তো শুনলাম। দ্বিতীয়বারের ঘটনাটা বলুন।
কমিশনার মি. হুইংক্লি বললেন, একটি স্থানীয় বৃদ্ধার মুখে আমি দ্বিতীয়বার ওই কথাটা শুনেছিলাম। সে আমাকে জানিয়েছিল, কায়নার ভিতর তার চার পুত্র সন্তানকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর কোনো কথা শোনার সুযোগ আমার হয়নি। কারণ ওইটুকু বলেই বৃদ্ধা চুপ করেছিল।
আত্তিলিও প্রশ্ন করলেন, ভয়ে চুপ করেছিল?
উত্তর এল–না। সেই মুহূর্তেই তার মৃত্যু হয়েছিল।
আত্তিলিও বৃদ্ধার মৃত্যুকে বিষপ্রয়োগে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু কমিশনার হুইংক্লি জানালেন আত্তিলিওর সন্দেহ অমূলক।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মি. হুইংক্লি, তারপর বললেন, আমার মনে হয় কায়নার কথা উল্লেখ করেছিল বলেই যে বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল তা নয়, বরং ঠিক উলটো ব্যাপারটা ঘটেছিল।
অর্থাৎ আপনি বলতে চান মৃত্যু আসন্ন বুঝেই বৃদ্ধা কায়নার বিষয়ে উল্লেখ করতে সাহস পেয়েছিল?
হ্যাঁ। স্থানীয় অধিবাসীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত সজাগ। আসন্ন মৃত্যুকে তারা অনুভব করতে পারে। অন্তিম মুহূর্তে বৃদ্ধা কায়নার রহস্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল; দুর্ভাগ্যক্রমে তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যু তার কণ্ঠ রোধ করে।
গল্প করতে করতে পূর্বোক্ত ঘটনা দুটির বিবরণ দিচ্ছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি এবং দুই বন্ধুর পাশে বসে সাগ্রহে তার কথা শুনছিলেন আত্তিলিও গত্তি। বন্ধু দুটির নাম প্রফেসর ও বিল। বন্ধুদের সম্পূর্ণ নাম আত্তিলিও তার কাহিনির মধ্যে উল্লেখ করেননি, অতএব আমরাও তাদের প্রফেসর আর বিল নামেই ডাকব।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেছিলেন কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আফ্রিকার জীবজন্তু ও মানুষ সম্বন্ধে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করার জন্য উক্ত মহাদেশের কয়েকটি স্থানে তিনি ভ্রমণ করতে উদযোগী হয়েছিলেন। ওই কাজে তার সহায় ছিলেন পূর্বোক্ত দুই বন্ধু, প্রফেসর ও বিল। উত্তর রোডেশিয়ার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত অনেকগুলো জলাভূমি আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও এবং তার দুই বন্ধু। শুধু তাই নয়, বিস্তীর্ণ জলাভূমিগুলোর অবস্থান নির্ণয় করার উপযুক্ত একটি মানচিত্রও তারা তৈরি করে ফেলেছিলেন। স্থানীয় গভর্নর অভিযাত্রীদের সাফল্যে খুশি হয়ে তিন বন্ধুকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আহারাদির পর তারা গভর্নরের লাইব্রেরিতে এলেন কফি পান করার জন্য।
প্রফেসর হঠাৎ উত্তর রোডেশিয়ার বনভূমি সম্বন্ধে একটা মন্তব্য করলেন। জলাভূমিগুলো পরিদর্শন করে ফিরে আসার সময়ে ওই অঞ্চলের গ্রানাইট পাথর দেখেই তিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন–
এমন অদ্ভুত নিসর্গ দৃশ্য আমি আফ্রিকার কোনো জায়গায় দেখিনি।
অরণ্যের পটভূমিতে অবস্থিত অসংখ্য প্রস্তরসজ্জিত গুহার দৃশ্য বিলকেও অভিভূত করে দিয়েছিল।
নৈশভোজে উপস্থিত রাজপুরুষদের মধ্যে প্রাদেশিক কমিশনার মি. হুইংক্লি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উত্তর রোডেশিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত–ওই অঞ্চলের কোনো বৈশিষ্ট্যই তার অজানা ছিল না।
মি. হুইংক্লি বললেন, কোনো শ্বেতাঙ্গ এই অঞ্চল পরিদর্শন করেননি। এখানে গাড়ি চলার রাস্তা নেই। যতদূর জানি, খনিজ দ্রব্যও পাওয়া যায় না। মাম্বোয়া নামক যে নিগ্রো জাতি এখানে বাস করে তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারা লাজুক প্রকৃতির এবং শ্বেতাঙ্গদের সংস্পর্শে আসতে অনিচ্ছুক–সরকারও তাদের ঘাঁটিয়ে অনর্থক বিপত্তির সৃষ্টি করতে চান না।