মুকুন্দের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটা আশ্চর্য পাতা মুখে পুরে দিলেন ত্রিবেদী, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দলের যে সব খেলোয়াড় মোড় হয়ে বসেছিল, তাদের মধ্যে স্থান গ্রহণ করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন শশাঙ্ক বিরোধীপক্ষের একজনকে ছুঁয়ে নিরাপদে ফিরে এল নিজেদের সীমানার মধ্যে। কপাটি খেলার নিয়ম-অনুসারে একপক্ষের যে কয়েকজন খেলোয়াড় মোড় হবে, বিরোধীপক্ষের সম-সংখ্যক সেই কয়জন খেলোয়াড় আবার মাঠে নেমে খেলতে পারে। অতএব আবার মাঠে নামলেন ত্রিবেদী।
মুকুন্দ তাকে উৎসাহ দিল, ভালো করে খেলবেন স্যার।
ত্রিবেদী অভয় দিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মুকুন্দ। এবার আমি খুব ভালো করে খেলব।
আশ্চর্য-পাতার গুণে ইতিমধ্যেই সর্বাঙ্গে অফুরন্ত শক্তির জোয়ার অনুভব করছেন ত্রিবেদী, তাই মুকুন্দকে অভয় দিতে তিনি কিছুমাত্র ইতস্তত করলেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন বিরোধীপক্ষের খেলোয়াড়রা মিলিতভাবে আক্রমণ করেও তাকে কাবু করতে পারবে না।
শানু নামে এক খেলোয়াড় চুপি চুপি শশাঙ্ককে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রলোক তো একটু আগে দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু গদাই-এর পাল্লায় পড়ে ওনার যে অবস্থা হল, তাতে আমি খুব ভরসা রাখতে পারছি না। ভদ্রলোক অবশ্য মুকুন্দকে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন- তা, তুমি কীরকম বুঝছ ক্যাপ্টেন?
ভালো বুঝছি না, শশাঙ্ক ফিসফিস করে বলল, দলের ক্যাপ্টেন হিসাবে আমি খুব নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না।
ত্রিবেদী হাঁক দিয়ে বললেন, শশাঙ্ক, এবার আমি দান দিতে যাচ্ছি। এই দানেই সবাইকে মেরে ফিরে আসব। খেলা এবং তোমাদের দুশ্চিন্তার এইবারেই শেষ।
উভয়পক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে দুই পক্ষকে তফাত করে যে সরলরেখাঁটি অবস্থান করছে, সেই সরলরেখার একপাশে নিজস্ব সীমানা থেকে বিপক্ষের উপর হানা দিতে এগিয়ে গেলেন ত্রিবেদী এবং শিকারি জন্তু শিকারের উপর ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেমনভাবে সমস্ত শরীরকে গুটিয়ে প্রস্তুত হয়, ঠিক সেইভাবেই প্রস্তুত হলেন তিনি। আশ্চর্য পাতা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে দিয়েছে তাকে!
ত্রিবেদীর আক্রমণোদ্যত ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শানু আবার বলল, গদাইকে ধরতে গিয়ে ভদ্রলোকের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়েছিল বটে, কিন্তু উনি যে ভালো কপাটি-খেলুড়ে সে-কথা উনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে এই মাত্র উনি যে কথা বললেন, সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। খেলা আর দুশ্চিন্তার শেষ মানে? এখনই খেলা শেষ করতে হলে ওদের দলের সব কয়টি খেলুড়েকে মোড় করে ফিরে আসতে হবে। একজন লোকের পক্ষে এমন অসাধ্য সাধন কি সম্ভব?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ত্রিবেদীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে গম্ভীর ভাবে শশাঙ্ক বলল, সম্ভব কি অসম্ভব এখনই বুঝতে পারবে- অনর্থক মাথা ঘামিয়ে মরছ কেন?
চু-কিৎ-কিৎ, সজোরে দম নিয়ে বিরোধীদলের সীমানায় এসে পড়লেন ত্রিবেদী এবং গোলাপ কলোনির সমর্থকদের জ্বলন্ত উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ ধরা পড়লেন বাগনান ক্লাবের এক খেলুড়ের হাতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় সামান্য একটু ধস্তাধস্তি করতে না করতেই তার উপর ঝাঁপ দিল গদাই, সঙ্গে সঙ্গে পুরো দলটাই ঝাঁপিয়ে পড়ল ত্রিবেদীর উপর। সমবেত খেলোয়াড়ের মিলিত আক্রমণে ধরাশায়ী হলেন ত্রিবেদী। অতগুলো জোয়ান খেলোয়াড়ের দেহের আড়ালে তাঁর ছোটোখাটো শরীরটা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল বটে, কিন্তু দম নেওয়ার চুকিৎ-কিৎ শব্দটা সজোরে ভেসে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল তার দম এখনো ফুরোয়নি, এখনও লড়ছেন তিনি!
দর্শকদের ভিতর থেকে মন্তব্য শোনা গেল, লোকটা প্রথমে খুব আশা দিয়েছিল আমাদের। কিন্তু শেষকালে ডুবিয়ে দিল। এমন আনাড়ির মতো কেউ ধরা পড়ে? ও যেন ধরা দেওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছিল।
–কিন্তু যাই বলো, লোকটার দম সাংঘাতিক। তখন থেকে কিৎ-কিৎ করে যাচ্ছে, থামার নাম নেই।
-আরে কিৎ-কিৎ কতক্ষণ করবে? কতক্ষণ দম রাখতে পারবে ও? সারাদিন চেষ্টা করলেও অতগুলো খেলোয়াড়কে ঠেলে উঠতে পারবে না লোকটা।
আরেকটি বিরূপ মন্তব্য ভেসে এল, ওই চেহারা নিয়ে কপাটি খেলা হয় না, কপাটি খেলতে গদ লাগে।
তাদের পরিচয় পরক্ষণেই পাওয়া গেল হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝটকায় ছিটকে পড়ল বাগনান ক্লাবের খেলুড়ের দল এবং তাদের দেহের তলা থেকে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী! তাকে যারা জাপটে ধরে পেড়ে ফেলেছিল, তারা তখন গড়াগড়ি দিচ্ছে মাঠের উপর, পতনজনিত ধাক্কায় তাদের চোখের সামনে ফুটে উঠেছে রাশি রাশি সর্ষে ফুল উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তাদের ছিল না।
প্রতিপক্ষের সাময়িক বিহ্বলতার সুযোগ নিলেন ত্রিবেদী, নিজের দলের সীমানা লক্ষ্য করে তিনি দৌড় দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোলাপ কলোনির সমর্থকদের ভিতর জাগল তীব্র উল্লাসধ্বনি
কিন্তু শব্দটা যেমন হঠাৎ উঠেছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল। সকলের মতো গদাইও ছিটকে পড়েছিল ত্রিবেদীর ধাক্কায়, কিন্তু তার অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতা তার সংবিৎ ফিরিয়ে এনেছিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আচম্বিতে একলাফে উঠে এসে পিছন থেকে সে জড়িয়ে ধরল ত্রবেদীকে– তিনি তখন সীমারেখার খুব কাছে এসে পড়েছেন!
এই অভাবিত ঘটনার স্তব্ধ হয়ে গেল গোলাপ কলোনির সমর্থকদের উল্লাসধ্বনি, তবে সেই নীরবতা স্থায়ী হল মাত্র কয়েকটি মুহূর্তের জন্য কারণ তারস্বরে চিৎকার করে গদাইকে এবার সংবর্ধনা জানাল বাগনান ক্লাবের সমর্থকবৃন্দ।