আজো মনে আছে সেদিন পথ দেখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিই বুঝি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন—আমাদের জাতির, আমাদের ইতিহাসের, আমাদের সভ্যতার সমস্ত ব্যর্থতা আর অভাব। তিনিই নতুন করে আবিষ্কার করলেন গীতাকে। নতুন ব্যাখ্যা দিলেন গীতার। চারিদিকে নৈরাশ্য আর পরাধীনতার গ্লানির মধ্যে গীতার শ্লোকে সবাই দেখতে পেলে জয়ের আশ্বাস। ককে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে উৎসাহ দিয়ে শক্তিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গিয়েছে, তবু তার মন্ত্র বুঝি সজীব হয়ে আবার তরুণ মনে শক্তির আশ্বাস এনে দিলে। শ্রীকৃষ্ণের সে-বাণী আত্মবোধের বাণী, নিজেকে চেনবার বাণী। শ্রীঅরবিন্দ এই গীতাকেই তুলে ধরলেন নতুন করে। তিনি শোনালেন—এই যুদ্ধ, এই মৃত্যু, এই অস্ত্র, এই ধর্ম, এই তীর আর এই ধনুক এ-ও ঈশ্বরের সৃষ্টি। তিনি বললেন—‘We do not want to develop a nation of women who know only how to weep and how not to strike.’
তারপর আলিপুর বোমার মামলার সময় অরবিন্দ বুঝি তার মহা-জিজ্ঞাসার উত্তর পেলেন—‘Man shall attain his Godhead.’
জানালার পাশেই ছিল ভূতনাথের খাটিয়া। ওখানে শুয়ে-শুয়ে খোলা আকাশটা দেখা যেতো। সেইখানে শুয়ে-শুয়েই আকাশপাতাল কত কী ভেবেছিল। সেইদিকে চেয়ে-চেয়ে অনেকদিন ভেবেছে ভূতনাথ–কোথায়ই বা গেল বোঠান! কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে রইল এতদিন! আকাশের নীলের মধ্যে বার-বার প্রশ্ন করেও সে-উত্তর পাওয়া যায়নি সেদিন।
তবু সেদিন বার-শিমলেয় যাবার সময় বংশী ধরেছিল—খেয়ে যাবেন না শালাবাবু?
ভূতনাথ বলেছিল—আজ আর খাওয়ার সময় নেই আমার।
–রান্না হয়ে এসেছে, আর বেশি দেরি নেই কিন্তু, ঝোলটা নামলেই দিয়ে দেবো।
—তা হোক, আমি বরং ফিরে এসে খাবো।
অগত্যা বংশীকে রাজী হতেই হয়েছিল। কিন্তু বারবার বলেছিল—যেন রাত করবেন না শালাবাবু, বেণীর কথা শোনবার পর থেকে আমার বড় ভয় করে আজ্ঞে।
-কীসের ভয়?
বংশী বলেছিল—বলা তো যায় না, মেজবাবু গুণ্ডা লাগিয়েছে শুনেছি, গুণ্ডা দিয়ে মেজবাবু সেকালে কত কাণ্ড করেছে দেখেছি, নটে দত্ত দেখলেন না সেবার ছোটবাবুকে কী কাণ্ড করলে। সেই থেকেই ছোটবাবু তো আর উঠতে পারলে না।
—না রে বংশী, ভয় পাসনে, আমার কিছু হবে না, তুই আমাদের পান আর সুপুরি এনেছিস তত?
—তা এনেছি, কিন্তু আজকে আর কখন যাবেন বরানগরে? বেলা পড়ে এল যে?
—তা আজ যদি না হয় তো কালই যাবো।
বংশী বললে—সেই ভালল শালাবাবু, আজ সারাদিন যে-হুজ্জত গেল সকাল থেকে, ভাবুন তো একবার, যাক, তবু হাঙ্গামা যে চুকলো এই ভালল, বড় ভাবনায় ছিলাম আজ্ঞে। ননীবাবু যে শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন এইটেই ভালল—কতদিন থেকে যে মহাপ্রেভুর কাছে মানত করে রেখেছি—এবার দেশে গেলে পূজো দিয়ে আসবে।
সেদিন বড়বাড়ি থেকে বেরিয়েও যেন পা আর চলতে চায়নি ভূতনাথের। জবাকে সে কেমন করে তার দাবি জানাবে। কেমন করে সে জানাবে–সে-ই তাহার স্বামী! কেমন করে জানাবে অতুল আর কেউ নয়—ভূতনাথেরই আর একটা নাম। বাবার দেওয়া নাম। যে-নামে এক নন্দজ্যাঠা ছাড়া এখন আর কেউ ডাকে না! বাবার মৃত্যুর পর সে নীলমণি পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে তো ভূতনাথ নামে। এত কথা জানানোর মধ্যে কোথায় যেন একটা ভিক্ষুক-বৃত্তি লুকিয়ে আছে। কেমন ভাবে জবা তাকে গ্রহণ করবে কে জানে! এ ক’দিনের মধ্যে জবার যদি কোনো পরিবর্তন হয়ে গিয়ে থাকে!
বাড়ির সামনে গিয়েও দ্বিধা যেন কাটতে চায় না ভূতনাথের। সেদিন বেলগাছিয়ার খালের ধারে মনের যে সংযম সঞ্চয় করেছিল ভূতনাথ, আজ যেন তা হারিয়ে গিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে যেন জানতে পারলে ভালো হতো-ভেতরে জবা কেমন আছে! কী করছে।
চারিদিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ–পবিত্র আছে নাকি কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বিকেল বেলার গলিতে রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল করছে নিজের-নিজের কাজে। ছোট সরু গলি, দু’পাশে নর্দমা। মশা উড়ছে ভনভন করে। দরজার কড়া নাড়তে গিয়েও যেন হাতটা সরিয়ে নিলে ভূতনাথ। জবা যদি বাড়িতে না থাকে। যদি ভূতনাথের দেরি দেখে সে হাসপাতালেই কাজ নিয়ে থাকে এতদিনে। এ ক’দিন এ-বাড়িতে আসেনি ভূতনাথ। কেবল ভেবেছে। ভেবেছে শুধু নিজের কথা! বড়বাড়ির এত গণ্ডগোল, রূপচাঁদবাবুর আপিস, সমস্ত কাজের মধ্যেও একটু ফাঁক পেলেই ভেবেছে। নিজের কথা ভেবেছে আর নিজের পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে সুপবিত্রর কথা। আর সঙ্গে-সঙ্গে জবার কথা।
সেদিনও যখন ভূতনাথ এ-বাড়িতে ঢুকছিল হঠাৎ দেখলে জবার ঝি একটা ঝুড়িতে করে নানা জিনিষপত্র রাস্তায় ফেলতে যাচ্ছে। কিন্তু ঝুড়িটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখেই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল ভূতনাথ।
ভূতনাথ বললে—ক্ষুদির মা, ঝুড়িতে ওসব কী গো?
ক্ষুদির মা বললে—দিদিমণি এগুলো রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে বললে দাদাবাবু।
—দেখি, দেখি, ওতে কী? বলে ঝুড়িটা নামাতেই ভূতনাথ দেখে অবাক হয়ে গেল। ভালো ভালো দামী-দামী সব জিনিষ। একটা ফুলদানি, একটা বই, ছোট ঘড়ি একটা, নানারকম কাজের জিনিষ। একটা ফটো ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করা। সুপবিত্রর ছবি।
জবা বলেছিল—ওগুলো আর রেখে কি হবে ভূতনাথবাবু, ও-ই আমাকে নানা সময়ে উপহার দিয়েছিল—ও আমার কাছে এখন না রাখাই ভালো।
—কিন্তু রাস্তায় ফেলে দেবে তা বলে?