- বইয়ের নামঃ বনগীতি
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি
আহির ভৈরব তেতালা
অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি।
নীরবে হেসে দাঁড়াইলে এসে
প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারিল।
রাস-বিলাসিনী আমি আহিরিনি
শ্যামল কিশোর রূপ শুধু চিনি,
অম্বরে হেরি আজ এ কী জ্যোতিঃপুঞ্জ
হে গিরিজাপতি! তোথা গিরিধারী॥
সম্বর সম্বর মহিমা তব, হে ব্রজেশ ভৈরব, আমি ব্রজবালা
হে শিব সুন্দর, বাঘছাল পরিহরো, ধরো নটবর বেশ পরো নীপমালা॥
নব মেঘচন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি
প্রিয় হয়ে দেখা দাও ত্রিভুবনপতি
পার্বতী নহি আমি, অমি শ্রীমতী,
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরিধারী॥
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি
এসেছি দেয়ালি জ্বালাতে।
শুধু ক্রন্দন হয়ে আসিনি,
এসেছি চন্দন হতে থালাতে।
ধরায় আবার আসিয়াছি প্রিয়া
তব মুখখানি দেখিব বলিয়া,
তাই প্রদীপ হইয়া নীরবে পুড়ি গো
তোমার বরণডালাতে॥
তব মিলন-বাসরে ঘুম ভাঙাইতে আসিনি
তুমি কেন লাজে ওঠ আকুলি?
তব রাঙা মুখখানি রাঙাইয়া যাব চলে গো
আমি সাঁঝের ক্ষণিক গোধূলি॥
তব কাজল নয়ন-পল্লব ছায়ে
অশ্রুর মতো রহিব লুকায়ে,
ঝরিতে এসেছি ফুল হয়ে আমি
তোমার বুকের মালাতে॥
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
আশাবরি দাদরা
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
দেখে যা আলোর নাচন।
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন॥
আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
(মায়ের) একটুখানি রূপের ঝলক
ওই স্নিগ্ধ বিরাট নীল-গগন॥
পাগলি মেয়ে এলোকেশী
নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ
নেচে বেড়ায় দিনের চিতায়
লীলার রে তার নাইকো শেষ॥
সিন্ধুতে ওই বিন্দু খানিক
তার ঠিকরে পড়ে রূপের মানিক;
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না
মা আমার তাই দিগ্বসন॥
আমি ডুরি-ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
চাষার গান
ঝুমুর কাহারবা
আমি ডুরি-ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
চলছি উড়ে প্রাণ সই॥
ছুটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ঝড়-বাতাসে
পড়ব কোতায় কেমনে কই॥
তোর থেকে লো চলে এসে
আমার বুকের পাঁজরা গেছে খসে,
সেই ভাঙা বুকের খাপরা ভরে
কুল কাঠেরই আগুন বই॥
কাঁদিয়ে তোরে ও প্রেয়সী,
তোরও চেয়ে কাঁদছি বেশি,
আমার পাকা ধানের খেতে আমি
আপন হাতে দিলাম মই॥
তোর কাঁদনের গাঙের তীরে,
আমি নৌকা বেয়ে আসব ফিরে,
তুই ভেজে রাখিস দুখের তাতে
মন-আখাতে প্রেমের খই॥
আমি মুসলিম যুবা মোর হাতে বাঁধা
ইসলামি গান (দ্বৈত)
পু॥ আমি মুসলিম যুবা, মোর হাতে বাঁধা
আলির জুলফিকার।
স্ত্রী॥ আমি মুসলিম নারী জ্বালিয়া চেরাগ
ঘুচাই অন্ধকার॥
পু॥ ধরিয়া রাখিতে দীনের নিশান
আনন্দে করি জান কোরবান
স্ত্রী॥ কত ছেলে মোর শহিদ হয়েছে মরুতে কারবালার।
আমি নন্দিনী ফতেমার॥
পু॥ য়ুরোপ এশিয়া আফ্রিকা জুড়ে ছড়ানু খোদার বাণী
স্ত্রী॥ মোর একা গৃহ-মক্কাতে আমি আনি জমজম-পানি।
পু॥ আমি জিনিব পৃথিবী আছে মোর আশা
স্ত্রী॥ আমি প্রাণে দিব তেজ, বুকে ভালোবাসা
উভয়ে॥ মুসলিম নর মুসলিম নারী দু-ধারী তলোয়ার॥
আর লুকাবি কোথায় মা কালী
বাগেশ্রী একতালা
আর লুকাবি কোথায় মা কালী।
আমার বিশ্ব-ভুবন আঁধার করে
তোর রূপে মা সব ডুবালি॥
আমার সুখের গৃহ শ্মশান করে
বেড়াস মা তায় আগুন জ্বালি
আমায় দুঃখ দেওয়ার ছলে মা তোর
ভুবন-ভরা রূপ দেখালি॥
আমি পূজা করে পাইনি তোরে
এবার চোখের জলে এলি,
আমার বুকের ব্যথায় আসন পাতা
বস মা সেথা দুখ-দুলালি॥
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
গজল গান
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফঁস গয়ি।
বিনোদ বেণির জরিন ফিতায়
আন্ধা এশ্ক্ মেরা কস গয়ি॥
তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিল লোভী আমার মন,
বেহুঁশ হো কর গির পড়ি হাথ মে
বাজুবন্দ মে বস গয়ি॥
কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিঁধিয়া,
আঁখ ফেরা দেয়া চোরি কর নিদিয়া,
দেহের দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া
আউর নেহিঁ, উয়ো ওয়াপস গয়ি॥
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
শস্যশ্যামল ফসলভরা
মাঠের ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
তুমি কতই দিলে রতন
ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,
ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও
মানি চাই না মানি॥
খোদা! তোমার হুকুম তরক করি আমি প্রতি পায়,
তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।
শ্রেষ্ঠ নবি দিলে মোরে
তরিয়ে নিতে রোজ-হাশরে ,
পথ না ভুলি তাই তো দিলে
পাক কোরানের বাণী।
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
এলে কি বঁধু ফুল-ভবনে
পিলু কাহারবা
এলে কি বঁধু ফুল-ভবনে
মেলোয়া পাখা নীল গগনে॥
একা কিশোরী লাজ বিসরি
তোমারে স্মরি সঙ্গোপনে,
এসো গোধূলির রাঙা লগনে॥
পাতার আসন শাখায় পাতা,
বালিকা কলির মালিকা গাঁথা,
দিনু গন্ধ-লিপি ভোর পবনে॥
এসো মুরলীধারী বৃন্দাবনচারী
মান্দ কাহারবা
এসো মুরলীধারী বৃন্দাবনচারী
গোপাল গিরিধারী শ্যাম।
তেমনই যমুনা বিগলিতকরুণা,
কুলুকুলুকুলু স্বরে ডাকে অবিরাম॥
কোথায় গোকুলবিহারী শ্রীকৃষ্ণ,
চাহিয়া পথপানে ধরণি সতৃষ্ণ,
ডাকে মা যশোদায় নীলমণি
আয় আয় ডেকে যায় নন্দ শ্রীদাম॥
ডাকে প্রেম-সাধিকা আজও শত রাধিকা
গোপ-কোঙারি,
এসো নওল-কিশোর কুল-লাজ-মান-চোর
ব্রজবিহারী!
পরি সেই পীতধড়া সেই বাঁকা শিখীচূড়া
বাজায়ে বেণু
আরবার এসো গোঠে, খেলো সেই ছায়া-বটে,
চরাও ধেনু।
কদম- তমাল-ছায়ে এসো নূপুর-পায়ে
ললিত বঙ্কিম ঠাম॥
এসো হৃদি-রাসমন্দিরে এসো
ঝিঁঝিট একতালা
এসো হৃদি-রাসমন্দিরে এসো
হে রাস-বিহারী কালা।
মম নয়নের পাতে রাখিয়াছি গেঁথে
অশ্রু-যূথীর মালা॥
আমার কাঁদন-যমুনার নদী
ভাঁটি-টানে শুধু বহে নিরবধি,
তারে বাঁশরির তানে বহাও উজানে
ভোলাও বিরহ-জ্বালা॥
আমি ত্যজিয়াছি কবে লাজ মান কুল,
বহি কলঙ্ক এসেছি গোকুল,
আমি ভুলিয়াছি ঘর শ্যাম নটবর
করো মোরে ব্রজ-বালা॥