- বইয়ের নামঃ বনগীতি
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি
আহির ভৈরব তেতালা
অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি।
নীরবে হেসে দাঁড়াইলে এসে
প্রখর তেজ তব নেহারিতে নারিল।
রাস-বিলাসিনী আমি আহিরিনি
শ্যামল কিশোর রূপ শুধু চিনি,
অম্বরে হেরি আজ এ কী জ্যোতিঃপুঞ্জ
হে গিরিজাপতি! তোথা গিরিধারী॥
সম্বর সম্বর মহিমা তব, হে ব্রজেশ ভৈরব, আমি ব্রজবালা
হে শিব সুন্দর, বাঘছাল পরিহরো, ধরো নটবর বেশ পরো নীপমালা॥
নব মেঘচন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি
প্রিয় হয়ে দেখা দাও ত্রিভুবনপতি
পার্বতী নহি আমি, অমি শ্রীমতী,
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরিধারী॥
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি
এসেছি দেয়ালি জ্বালাতে।
শুধু ক্রন্দন হয়ে আসিনি,
এসেছি চন্দন হতে থালাতে।
ধরায় আবার আসিয়াছি প্রিয়া
তব মুখখানি দেখিব বলিয়া,
তাই প্রদীপ হইয়া নীরবে পুড়ি গো
তোমার বরণডালাতে॥
তব মিলন-বাসরে ঘুম ভাঙাইতে আসিনি
তুমি কেন লাজে ওঠ আকুলি?
তব রাঙা মুখখানি রাঙাইয়া যাব চলে গো
আমি সাঁঝের ক্ষণিক গোধূলি॥
তব কাজল নয়ন-পল্লব ছায়ে
অশ্রুর মতো রহিব লুকায়ে,
ঝরিতে এসেছি ফুল হয়ে আমি
তোমার বুকের মালাতে॥
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
আশাবরি দাদরা
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
দেখে যা আলোর নাচন।
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন॥
আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
(মায়ের) একটুখানি রূপের ঝলক
ওই স্নিগ্ধ বিরাট নীল-গগন॥
পাগলি মেয়ে এলোকেশী
নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ
নেচে বেড়ায় দিনের চিতায়
লীলার রে তার নাইকো শেষ॥
সিন্ধুতে ওই বিন্দু খানিক
তার ঠিকরে পড়ে রূপের মানিক;
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না
মা আমার তাই দিগ্বসন॥
আমি ডুরি-ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
চাষার গান
ঝুমুর কাহারবা
আমি ডুরি-ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
চলছি উড়ে প্রাণ সই॥
ছুটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ঝড়-বাতাসে
পড়ব কোতায় কেমনে কই॥
তোর থেকে লো চলে এসে
আমার বুকের পাঁজরা গেছে খসে,
সেই ভাঙা বুকের খাপরা ভরে
কুল কাঠেরই আগুন বই॥
কাঁদিয়ে তোরে ও প্রেয়সী,
তোরও চেয়ে কাঁদছি বেশি,
আমার পাকা ধানের খেতে আমি
আপন হাতে দিলাম মই॥
তোর কাঁদনের গাঙের তীরে,
আমি নৌকা বেয়ে আসব ফিরে,
তুই ভেজে রাখিস দুখের তাতে
মন-আখাতে প্রেমের খই॥
আমি মুসলিম যুবা মোর হাতে বাঁধা
ইসলামি গান (দ্বৈত)
পু॥ আমি মুসলিম যুবা, মোর হাতে বাঁধা
আলির জুলফিকার।
স্ত্রী॥ আমি মুসলিম নারী জ্বালিয়া চেরাগ
ঘুচাই অন্ধকার॥
পু॥ ধরিয়া রাখিতে দীনের নিশান
আনন্দে করি জান কোরবান
স্ত্রী॥ কত ছেলে মোর শহিদ হয়েছে মরুতে কারবালার।
আমি নন্দিনী ফতেমার॥
পু॥ য়ুরোপ এশিয়া আফ্রিকা জুড়ে ছড়ানু খোদার বাণী
স্ত্রী॥ মোর একা গৃহ-মক্কাতে আমি আনি জমজম-পানি।
পু॥ আমি জিনিব পৃথিবী আছে মোর আশা
স্ত্রী॥ আমি প্রাণে দিব তেজ, বুকে ভালোবাসা
উভয়ে॥ মুসলিম নর মুসলিম নারী দু-ধারী তলোয়ার॥
আর লুকাবি কোথায় মা কালী
বাগেশ্রী একতালা
আর লুকাবি কোথায় মা কালী।
আমার বিশ্ব-ভুবন আঁধার করে
তোর রূপে মা সব ডুবালি॥
আমার সুখের গৃহ শ্মশান করে
বেড়াস মা তায় আগুন জ্বালি
আমায় দুঃখ দেওয়ার ছলে মা তোর
ভুবন-ভরা রূপ দেখালি॥
আমি পূজা করে পাইনি তোরে
এবার চোখের জলে এলি,
আমার বুকের ব্যথায় আসন পাতা
বস মা সেথা দুখ-দুলালি॥
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
গজল গান
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফঁস গয়ি।
বিনোদ বেণির জরিন ফিতায়
আন্ধা এশ্ক্ মেরা কস গয়ি॥
তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিল লোভী আমার মন,
বেহুঁশ হো কর গির পড়ি হাথ মে
বাজুবন্দ মে বস গয়ি॥
কানের দুলে প্রাণ রাখিলে বিঁধিয়া,
আঁখ ফেরা দেয়া চোরি কর নিদিয়া,
দেহের দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া
আউর নেহিঁ, উয়ো ওয়াপস গয়ি॥
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
শস্যশ্যামল ফসলভরা
মাঠের ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
তুমি কতই দিলে রতন
ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,
ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও
মানি চাই না মানি॥
খোদা! তোমার হুকুম তরক করি আমি প্রতি পায়,
তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।
শ্রেষ্ঠ নবি দিলে মোরে
তরিয়ে নিতে রোজ-হাশরে ,
পথ না ভুলি তাই তো দিলে
পাক কোরানের বাণী।
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
এলে কি বঁধু ফুল-ভবনে
পিলু কাহারবা
এলে কি বঁধু ফুল-ভবনে
মেলোয়া পাখা নীল গগনে॥
একা কিশোরী লাজ বিসরি
তোমারে স্মরি সঙ্গোপনে,
এসো গোধূলির রাঙা লগনে॥
পাতার আসন শাখায় পাতা,
বালিকা কলির মালিকা গাঁথা,
দিনু গন্ধ-লিপি ভোর পবনে॥
এসো মুরলীধারী বৃন্দাবনচারী
মান্দ কাহারবা
এসো মুরলীধারী বৃন্দাবনচারী
গোপাল গিরিধারী শ্যাম।
তেমনই যমুনা বিগলিতকরুণা,
কুলুকুলুকুলু স্বরে ডাকে অবিরাম॥
কোথায় গোকুলবিহারী শ্রীকৃষ্ণ,
চাহিয়া পথপানে ধরণি সতৃষ্ণ,
ডাকে মা যশোদায় নীলমণি
আয় আয় ডেকে যায় নন্দ শ্রীদাম॥
ডাকে প্রেম-সাধিকা আজও শত রাধিকা
গোপ-কোঙারি,
এসো নওল-কিশোর কুল-লাজ-মান-চোর
ব্রজবিহারী!
পরি সেই পীতধড়া সেই বাঁকা শিখীচূড়া
বাজায়ে বেণু
আরবার এসো গোঠে, খেলো সেই ছায়া-বটে,
চরাও ধেনু।
কদম- তমাল-ছায়ে এসো নূপুর-পায়ে
ললিত বঙ্কিম ঠাম॥
এসো হৃদি-রাসমন্দিরে এসো
ঝিঁঝিট একতালা
এসো হৃদি-রাসমন্দিরে এসো
হে রাস-বিহারী কালা।
মম নয়নের পাতে রাখিয়াছি গেঁথে
অশ্রু-যূথীর মালা॥
আমার কাঁদন-যমুনার নদী
ভাঁটি-টানে শুধু বহে নিরবধি,
তারে বাঁশরির তানে বহাও উজানে
ভোলাও বিরহ-জ্বালা॥
আমি ত্যজিয়াছি কবে লাজ মান কুল,
বহি কলঙ্ক এসেছি গোকুল,
আমি ভুলিয়াছি ঘর শ্যাম নটবর
করো মোরে ব্রজ-বালা॥
ও দুখের বন্ধু রে, ছেড়ে কোথায় গেলি
চাষানির গান
ঝুমুর কাহারবা
ও দুখের বন্ধু রে, ছেড়ে কোথায় গেলি।
ছেড়ে কোথায় গেলি রে বন্ধু, একলা ঘরে ফেলি॥
আমায় গঞ্জনা দেয় ঘরে পরে,
আমি ভুলতে তবু নারি তোরে রে,
আমি লবণ দিতে পান্তা ভাতে হলুদ দিয়ে ফেলি॥
তোর লাঙল তোর কাস্তে নিয়ে,
আমি খুঁজে বেড়াই মাঠে গিয়ে,
আমার চোখের জলে মাঠ ভেসে যায়
তুই তবু কই এলি॥
তেল মেখে কী গায়ে তোরা
পিরিতি করিস মনোচোরা,
ধরিতে কী না ধরিতে
যাস রে পিছলি॥
ও মন চল অকূল পানে
ভজন
(‘আরে দাতা শোন’ সুর)
ও মন চল অকূল পানে
মাতি হরিপ্রেম-গুনগানে।
নদী যেমন ধায় অকূলে
কূল যত তায় টানে॥
তুই কোন পাহাড়ে ঠেকলি এসে
কোন পাথারের জল,
হরির প্রেমে গলে এবার
সেই অসীমে চল,
তুই স্রোতের বেগে দুলবি রে
কূল বাধা যদি হানে॥
কুলু কুলু কুলুকুলু হরি-গুনগান
গাইবি অবিরল,
আর দুই কূলে প্রেম-ফুল ফুটায়ে
করবি রে শ্যামল,
যত তাপিত প্রাণ হবে শীতল
তোর জলে সিনানে॥
এ- পারের সব যাত্রী যাবে
তোর বুকে ওপারে,
তোর কূলে শ্যাম বাজিয়ে বাঁশি
আসবে অভিসারে,
তুই শ্যামের ছবি ধরবি বুকে
মাতবি প্রেম-তুফানে॥
ওগো প্রিয়তম এত প্রেম দিয়ো না গো
ওগো প্রিয়তম! এত প্রেম দিয়ো না গো, সহিতে পারি না আর।
তটিনীর বুকে ঝাঁপায়ে পড়িলে কেন মহা-পারাবার?
তোমার প্রেমের বন্যায় বঁধু হায়!
তুই কূল মোর ভাঙিয়া ভাসিয়া যায়,
আমি নিজেরে হারাতে চাহিনি বন্ধু
দিতে চেয়েছিনু হার॥
তুমি চাহ বুঝি তুমি ছাড়া আর রহিবে না মোর কেউ,
তাই কি পরানে তুফান তোল গো, এত রোদনের ঢেউ?
দেহ ও মনের সীমা ছাড়াইয়া মোরে,
কোথা নিয়ে যেতে চাও মোর হাত ধরে?
বলো, কোন মধুবনে শেষ হবে বঁধু আমাদের অভিসার?
ওমা ফিরে এলে কানাই মোদের
কীর্তন ভাঙা
ওমা ফিরে এলে কানাই মোদের
এবার ছেড়ে দিসনে তায়
তোর সাথে সব রাখাল মিলে
বাঁধব সে ননীচোরায়॥
তারে তুই যখন মা রাখতিস বেঁধে,
ছড়ায়েছি কেঁদে কেঁদে
তখন জানতে কে, যে, খুললে বাঁধন
পালিয়ে যাবে মথুরায়॥
এবার আমরা এসে ডাকলে শ্যামে
গোঠে যেতে দিসনে তায়।
ওই পথে অক্রুর মুনির সাথে
পালিয়ে যাবে শ্যামরায়॥
মোরা কেউ যাব না বনে মা আর
খেলব তোর এই আঙিনায়,
শুধু খেলব লুকোচুরি লো
আগলাতে চোরের রাজায়॥
কালা এত ভালো কি হে কদম্ব গাছের তলা
ঝুমুর খেমটা
কালা এত ভালো কি হে কদম্ব গাছের তলা।
আমি দেখছি কত দেখব কত তোমার ছলাকলা॥
আমি জল নিতে যাই যমুনাতে
তুমি বাজাও বাঁশি হে,
মনের ভুলে কলস ফেলে
তোমার কাছে আসি হে,
শ্যাম দিন-দুপুরে গোকুলপুরে দায় হল যে চলা॥
আমার চারদিকেতে ননদ সতিন দু-কূল রাখা ভার,
আমি সইব কত আর,
ওরা লুকিয়ে হাসে দেখে মোদের
গোপন লীলার ছলা॥
কুসুম-সুকুমার শ্যামল তনু
বাগেশ্রী – সিন্ধু কহারবা
কুসুম-সুকুমার শ্যামল তনু
হে ফুল-দেবতা লহো প্রণাম।
বিটপী-লতায় চিকন পাতায়,
ছিটাও হাসি কিশোর শ্যাম॥
পূজার থালা এ অর্ঘ্য-ডালা
এনেছি দিতে তোমার পায়,
দেহো শুভ বর কুসুম-সুন্দর
হউক নিখিল নয়নাভিরাম॥
এ বিশ্ব বিপুল কুসুম-দেউল
হউক তোমার ফুল-কিশোর,
মুরলী-করে এসো গোলোক-বিহারী
হউক ভূলোক আনন্দ-ধাম॥
কে এলে মোর চির-চেনা
বেহাগ মান্দ কাহারবা
কে এলে মোর চির-চেনা
অতিথি দ্বারে মম।
ফুলের বুকে মধুর মতো
পরাগে সুবাস সম॥
বর্ষা-শেষে চাঁদের মতন
উদয় তোমার নীরব গোপন,
জ্যোৎস্না-ধারায় নিখিল ভুবন
ছাইয়া অনুপম॥
হৃদয় বলে, চিনি চিনি,
হৃদয়ের এ স্বদেশিনি,
আঁখি বলে, দেখিনি তায়,
মন বলে, ‘প্রিয়তম’॥
কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল
তিলং-খাম্বাজ মিশ্র তালফেরতা
কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল।
টগর যূথী বেলা মালতী
চাঁপা গোলাব বকুল।
নার্গিস ইরানি গুল॥
আমার যৌবন-বাগানে
হাওয়া লেগেছে ফুল জাগানে,
চলে যেতে ঢলে পড়ি
খুলে পড়ে এলোচুল।
তনু মন আকুল, আঁখি ঢুলু ঢুল॥
ওগো ফুটেছে এত ফুল, ফুল-মালি কই,
গাঁতিবে মালা কবে, সেই আশে রই,
সে মালা দিব কারে, ভেবে সারা হই,
সহিতে পারে না এ ফুল-ঝামেলা
চামেলী পারুল॥
কেমনে কহি প্রিয় কী ব্যথা প্রাণে বাজে
পিলু-খাম্বাজ কাহারবা
কেমনে কহি প্রিয়
কী ব্যথা প্রাণে বাজে।
কহিতে গিয়ে কেন
ফিরিয়া আসি লাজে॥
শরমে মরমে মরে
গেল বন-ফুল ঝরে
ভীরু মোর ভালোবাসা
শুকাল মনের মাঝে॥
আগুন লুকায়ে বুকে
জ্বলিয়া মরি যে দুখে,
ভুলিয়া রয়েছ সুখে
তুমি তো আপন কাজে॥
আজিকে ঝরার আগে
নিলাজ অনুরাগে
ধরিতে যে সাধ জাগে
হৃদয়ে হৃদয়-রাজে॥
কোকিল সাধিলি কি বাদ
পিলু-বারোয়াঁ আন্ধা কাওয়ালি
কোকিল, সাধিলি কি বাদ।
নিশি অবসান হল
না মিটিতে সাধ॥
মিলনের মোহ কেন
ডাকিয়া ভাঙিলি হেন,
তুই রে সতিনি যেন
চন্দ্রাবলীর ফাঁদ॥
সার নিশি অভিমানে
চাহিনি শ্যামের পানে,
জেগে দেখি কুহু তানে –
নাহি শ্যাম চাঁদ॥
ননদিনি কুটিলা কি
পাঠায়েছে তোরে পাখি,
সুখের বাসরে ডাকি
আনিলি বিষাদ॥
কোথায় তুই খুঁজিস ভগবান
ভজন
পাহাড়ি কাহারবা
কোথায় তুই খুঁজিস ভগবান
সে যে রে তোরই মাঝে রয়,
চেয়ে দেখ সে তোরই মাঝে রয়।
সাজিয়া যোগী ও দরবেশ
খুঁজিস যারে পাহাড় জঙ্গলময়
সে যে রে তোরই মাথে রয়॥
আঁখি খোল ইচ্ছা-অন্ধের দল
নিজেরে দেশ রে আয়নাতে,
দেখিবি তোরই এই দেহে
নিরাকার তাঁহার পরিচয়॥
ভাবিস তুই ক্ষদ্র কলেবর
ইহাতে অসীম নীলাম্মর,
এ দেহের আধারে গোপন
রহে রে বিশ্ব-চরাচর,
প্রাণে তোর পাণের ঠাকুর
বেহেশতে স্বর্গে কোথাও নয়॥
এই তোর মন্দির মসজিদ
এই তোর কাশী বৃন্দাবন,
অপনার পানে ফিরে চল
কোথা তুই তীর্থে যাবি, মন!
এই তোর মক্কা-মদিনা,
জগন্নাথ-ক্ষেত্র এই হৃদয়॥
কোন বন হতে করেছ চুরি হরিণ-আঁখি
গজল
জংলা কাহারবা
কোন বন হতে করেছ চুরি হরিণ-আঁখি(গো ওই)।
যেন আননে বেঁধেছে বাসা কানন-পাখি (ভীরু),
চুরি করা ওই নয়ন কি তাই ভয় এত চোখে।
নীল সাগর বলে, ডাগর ও চোখ আমারই নাকি॥
চিরকালের বিজয়িনী ও উজল নয়নে,
(তুমি) দু-ধারী তলোয়ার রেখেছ জহর মাখি॥
পুড়িল মদন তোমারই ওই চোখের দাহে,
সে গেছে তোমার ওই চোখে তার ফুল-বাণ রাখি॥
কোন রস-যমুনার কূলে বেণু-কুঞ্জে
কোন রস-যমুনার কূলে বেণু-কুঞ্জে
হে কিশোর বেণুকা বাজাও।
মোর অনুরাগ যায় যেথা, তনু যেতে নারে,
তুমি সেই ব্রজের পথ দেখাও॥
মোর অন্ধ আঁখি কাঁদে চাঁদের তৃষায়
তব পানে চেয়ে রাত কেটে যায়।
বঁধু এই ভিখারিনি সেই মাধুকরী চায়
মধুবনে, গোপীগণে যে মধু দাও॥
প্রেমহীন নীরস জীবন লয়ে,
পথে পথে ফিরি বৈরাগিনী হয়ে –
বুঝি আমি চাই তাই তব প্রেম নাহি পাই,
কৃপা করো প্রেমময়, তুমি মোরে নাও॥
খোদা এই গরিবের শোনো শোনো মোনাজাত
খোদা এই গরিবের শোনো শোনো মোনাজাত।
দিয়ো তৃষ্ণা পেলে ঠাণ্ডা পানি,
ক্ষুধা পেলে লবণ-ভাত॥
মাঠে সোনার ফসল দিয়ো
গৃহভরা বন্ধু প্রিয়,
আমার হৃদয়ভরা শান্তি দিয়ো
সেই তো আমার আবহায়াত॥
আমায় দিয়ে কারও ক্ষতি
হয় না যেন দুনিয়ায়।
আমি কারুর ভয় না করি,
মোরেও কেহ ভয় না পায়।
যবে মসজিদে যাই তোমার টানে
যেন মন নাহি ধায় দুনিয়া পানে
আমি ঈদের চাঁদ দেখি যেন
আসলে দুখের আঁধার রাত॥
চলো মন আনন্দ – ধাম
ভজন
ভৈরবী কাহারবা
চলো মন আনন্দ – ধাম
চলো মন আনন্দ-ধাম রে
চলো আনন্দ-ধাম॥
লীলা-বিহার প্রেম-লোক,
নাই রে সেথা দুঃখ শোক
সেথা বিহরে চির-ব্রজ-বালক
বনশিওয়ালা শ্যাম রে
চলো আনন্দ-ধাম॥
সেথা নাহি মৃত্যু, নাহি ভয়,
নাহি সৃষ্টি, নাহি লয়,
খেলে চির-কিশোর চির-অভয়
সংগীত ওম্ নাম রে
চলো আনন্দ-ধাম॥
চিরদিন কাহার ওসমান নাহি যায়
মান্দ কাহারবা
চিরদিন কাহার ওসমান নাহি যায়।
আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়॥
অবতার শ্রীরামচন্দ্র যে জানকীর পতি
তারও হল বনবাস রাবণ-করে দুর্গতি।
আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়॥
স্বামী পঞ্চ পাণ্ডব, সখা কৃষ্ণ ভগবান।
দুঃশাসন করে তবু দ্রৌপদীর অপমান।
পুত্র তার হল হত যদুপতি যার সহায়॥
মহারাজা শ্রীহরিশচন্দ্র রাজ্যদান করে শেষ
শ্মশান-রক্ষী হয়ে লভিল চণ্ডাল বেশ।
বিষ্ণু-বুকে চরণ-চিহ্ন, ললাট-লেখা কে খণ্ডায়॥
জয় বানী বিদ্যাদায়িনী (সরস্বতী বন্দনা)
সরস্বতী বন্দনা
জয় বানী বিদ্যাদায়িনী।
জয় বিশ্বলোক-বিহারিণী॥
সৃজন-আদিম তমঃ অপসারি
সহস্রদল কিরণ বিথারি
আসিলে মা তুমি গগন বিদারি
মানস-মরাল-বাহিনী॥
ভারতে ভারতী মূক তুমি আজি
বীণাতে উঠিছে ক্রন্দন বাজি
ছিন্ন-চরণ শতদলরাজি
কহিছে বিষাদ-কাহিনি॥
ঊর মা আবার কমলাসীনা
করে ধরো পুন সে রুদ্র বীণা,
নব সুর তানে বাণী দীনাহীনা
জাগাও অমৃত-ভাষিণী॥
জয় বিবেকানন্দ বীর সন্ন্যাসী চীর গৈরিকধারী
জয় বিবেকানন্দ বীর সন্ন্যাসী চীর গৈরিকধারী।
জয় তরুণ যোগী, শ্রীরামকৃষ্ণ-ব্রত-সহায়কারী॥
যজ্ঞাহুতির হোমশিকা সম,
তুমি তেজস্বী তাপস পরম
ভারত-অরিন্দম নমো নমো
বিশ্ব মঠ-বিহারী॥
মদ-গর্বিত বলদর্পীর দেশে মহাভারতের বাণী
শুনায়ে বিজয়ী, ঘুচাইলে স্বদেশের অপযশ গ্লানি।
নব ভারতে আনিলে তুমি নব বেদ,
মুছে দিলে জাতি ধর্মের ভেদ
জীবে ঈশ্বরে অভেদ আত্মা
জানাইলে হুংকারি॥
ঝলমল জরিন বেণি দুলায়ে প্রিয়া কি এলে
মাঢ় কাহারবা
ঝলমল জরিন বেণি
দুলায়ে প্রিয়া কি এলে।
সজল শাওন-মেঘে
কাজল নয়ন মেলে॥
কেয়া ফুলের পরিমল
ঝুরে মরে তোমার পথে,
হেরি দিঘল তব তনু
তাল পিয়াল তরু পড়ে হেলে॥
পরিবে বলিয়া খোঁপায়
ঝরিছে বকুল চাঁপা,
তোমারে খুঁজিছে আকাশ
চাঁদের প্রদীপ জ্বেলে॥
তোমারই লাবণি প্রিয়া
ঝরিছে শ্যামল মেঘে,
ফুটালে ফুল মরুভূমে
চঞ্চল চরণ ফেলে॥
তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি
বাউল খেমটা
তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি, হরি!
দাও ব্যথা যতই, তোমায় ততই নিবিড় করে ধরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
আমি শূন্য করে তোমার ঝুলি
দুঃখ নেব বক্ষে তুলি,
আমি করব দুখের অবসান আজ
সকল দুঃখ বরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
তুমি তুলে দিয়ে সুখের দেয়াল
ছিলে আমার প্রাণের আড়াল
আজ আড়াল ভেঙে দাঁড়ালে মোর
সকল শূন্য ভরি।
আমি ভয় করি কি হরি॥
তুমি ফুল আমি সুতো গাঁথিব মালা
[ দ্বৈত ] গান
পুরুষ॥ তুমি ফুল আমি সুতো গাঁথিব মালা॥
স্ত্রী॥ তাহে মোরেই সহিতে হবে সূচির জ্বালা॥
পু॥ দুলিবে গলে মোর বুকের পরে,
স্ত্রী॥ ফেলে দিবে বাসি হলে নিশিভোরে,
আমি বন-কুসুম ঝরি বনে নিরালা॥
পু॥ তব কুঞ্জ-গলি
আসে দখিন-হাওয়া,
আসে চপল অলি॥
স্ত্রী॥ তারা রূপ-পিয়াসি
তারা ছিঁড়ে না কলি।
তারা বনের বাহিরে মোরে নেবে না কালা॥
পু॥ তবে চলিয়া যাই আমি নিরাশা লয়ে,
স্ত্রী॥ না, না, থাকো বুকে শিশির হয়ে,
তব প্রেমে করিব আমি বন উজালা॥
দিতে এলে ফুল হে প্রিয়
গজল
যোগিয়া মিশ্র কাহারবা
দিতে এলে ফুল, হে প্রিয়,
কে আজি সমাধিতে মোর।
এত দিনে কি আমারে
পড়িল মনে মনোচোর॥
জীবনে যারে চাহনি
ঘুমাইতে দাও তাহারে।
মরণ-পারে ভেঙো না
ভেঙো না তাহার ঘুম-ঘোর॥
দিতে এসে ফুল কেঁদো না প্রিয়
মোর সমাধি পাশে,
ঝরিল যে ফুল অনাদরে হায় –
নয়ন-জলে বাঁচিবে না সে!
সমাধি-পাষাণ নহে গো
তোমার সমান কঠোর॥
কত আশা সাধ মিশে যায় মাটির সনে
মুকুল ঝরে কত ফুল কীটেরই দহনে।
কেন অ-সময়ে আসিলে,
ফিরে যাও,
মোছো আঁখি-লোর॥
দীন দরিদ্র কাঙালের তরে এই দুনিয়ায় আসি
দীন দরিদ্র কাঙালের তরে এই দুনিয়ায় আসি
হে হজরত, বাদশাহ হয়ে ছিলে তুমি উপবাসী॥
তুমি চাহ নাই কেহ হইবে আমির, পথের ফকির কেহ
কেহ মাথা গুঁজিবার পাইবে না ঠাঁই, কাহারও সোনার গেহ,
ক্ষুধার অন্ন পাইবে না কেহ, কারও সত দাসদাসী॥
আজ মানুষের ব্যথা অভাবের কথা ভাবিবার কেহ নাই
ধনী মুসলিম ভোগ ও বিলাসে ডুবিয়া আছে সদাই,
তাই তোমারেই ডাকে যত মুসলিম গরিব শ্রমিক চাষি॥
বঞ্চিত মোরা হইয়াছি আজ তব রহমত হতে
সাহেবি গিয়াছে, মোসাহেবি করি ফিরি দুনিয়ার পথে,
আবার মানুষ হব কবে মোরা মানুষেরে ভালোবাসি॥
দেখে যা তোরা নদিয়ায়
কীর্তন মিশ্র
দেখে যা তোরা নদিয়ায়।
গোরার রূপে এল ব্রজের শ্যামরায়।
মুখে হরি হরি বলে হেলে দুলে নেচে চলে,
নরনারী প্রেমে গলে ঢলে পড়ে রাঙা পায়॥
ব্রজে নূপুর পরি নাচিত এমনই হরি,
কুল ভুলিয়া সবে ছুটিত এমনই করি।
শচি মাতার রূপে কাঁদে মা যশোদা,
বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে কাঁদে কিশোরী রাধা।
নহে নিমাই নিতাই, ও যে কানাই বলাই,
শ্রীদাম সুদাম এল জগাই মাধাই-এ হায়॥
অসি নাই বাঁশি নাই, এবার শূন্য হাতে,
এসেছে ভুবন ভুলাতে
লীলা-পাগল এল প্রেমে মাতাতে,
ডুবু ডুবু নদিয়া, বিশ্ব ভাসিয়া যায়॥
দোলে নিতি নব তূপের ঢেউ-পাথার
ভজন
ভীমপলশ্রী কাহারবা
দোলে নিতি নব তূপের ঢেউ-পাথার
ঘনশ্যাম তোমারই নয়নে॥
আমি হেরি যে নিখিল বিশ্বরূপ-সম্ভার
তোমারই নয়নে॥
তুমি পলকে ধরো নাথ সংহার-বেশ,
হও পলকে করুণা-নিদান পরমেশ!
নাথ ভরা যেন বিষ অমৃতের ভাণ্ডার
তোমার দুই নয়নে॥
ওগো মহা-শিশু, তব খেলাঘরে
এ কী বিরাট সৃষ্টি বিহার করে,
সংসার চক্ষে তুমিই হে নাথ,
সংসার তোমারই নয়নে॥
তুমি নিমেষে রচি নব বিশ্বছবি
ফেল নিমেষে মুছিয়া হে মহাকবি,
করে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড ভুবন-সঞ্চার
তোমারই নয়নে॥
তুমি ব্যাপক বিশ্ব চরাচরে
জড় তীবতন্তু নারী-নরে,
কর কমল-লোচন, তোমার রূপ বিস্তার হে
আমারই নয়নে॥
ধ্যান ধরি কীসে হে গুরু
ভীমপলশ্রী মধ্যমান
ধ্যান ধরি কীসে হে গুরু,
তুমি যোগ শিখাইতে এলে।
কানন-পথে শ্যাম যে প্রেম-বাণী
মধুকর-করে পাঠালে,
হে গুরু, কী যোগ আমি শিখিব তা ফেলে।
তুমি যোগ শিখাইতে এলে॥
নদীর নাম সই অঞ্জনা
গ্রাম্য সংগীত
নদীর নাম সই অঞ্জনা
নাচে তীরে খঞ্জনা,
পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি।
আমি যাব না আর অঞ্জনাতে
জল নিতে সখী লো,
ওই আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি॥
সেদিন তুলতে গেলাম
দুপুর বেলা
কলমি শাক ঢোলা ঢোলা
হল না আর সখী লো শাক তোলা,
আমার মনে পড়িল সখী,
ঢলঢল তার চটুল আঁখি,
ব্যথায় ভরে উঠল বুকের তলা।
ঘরে ফেরার পথে দেখি,
নীল শালুক সুঁদি ও কী ফুটে আছে
ঝিলের গহিন জলে।
আমার অমনি পড়িল মনে
সেই ডাগর আঁখি লো,
ঝিলের জলে চোখের জলে
হল মাখামাখি॥
নম নম নমো বাংলাদেশ মম
স্বদেশি গান
নম নম নমো বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর॥
শিয়রে গিরি-রাজ হিমালয় প্রহরী,
আশিস-মেঘ বারিসদা তার পড়ে ঝরি,
যেন উমার চেয়ে এ আদরিণী মেয়ে,
ওড়ে আকাশ ছেয়ে মেঘ-চিকুর॥
গ্রীষ্মে নাচে বামা কাল-বোশেখি ঝড়ে,
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে,
শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে
গাহিয়া আগমনি- গীতি বিধুর॥
হরিত অঞ্চল হেমন্তে দুলায়ে
ফেরে সে মাঠে মাঠে শিশির-ভেজা পায়ে,
শীতের অলস বেলা পাতা ঝরার খেলা
ফাগুনে পরে সাজ ফুল-বধূর॥
এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে,
যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে,
এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে
ঘুমাব এই বুকে স্বপ্নাতুর॥
নিশীথ হয়ে আসে ভোর
গজল
ভৈরবী মিশ্র কাহারবা
নিশীথ হয়ে আসে ভোর
বিদায় দেহো প্রিয় মোর।
রজনিগন্ধার বনে হেরো
গুঞ্জরিছে ভ্রমর॥
হেরো ওই তন্দ্রা-ঢুলু ঢুল
জড়ায়ে হাতে এলোচুল,
বধূ যায় সিনান-ঘাটে
পথে লুটায় বসন আকুল॥
খোলো খোলো বাহুর মালা,
মোছো মোছো প্রিয়া আঁখি।
শোনো কুঞ্জ-দ্বারে তব কুহু
মুহুমুহু ওঠে ডাকি॥
হেরো লো, শিয়রে তব
প্রদীপ হয়ে এল ম্লান,
দাঁড়াল রাঙা উষা ওই,
রঙের সাগরে করি ম্লান।
আকাশ-অলিন্দে কাঁদে
পাণ্ডুর-কপোল শশী,
শুকতারা নিবু-নিবু ওই,
মলয়া ওঠে উছসি।
কাঁদে রাতের আঁধার
মোর বুকে মুখ রাখি॥
নূপুর মধুর রুনুঝুনু বোলে
খাম্বাজ কাওয়ালি
নূপুর মধুর রুনুঝুনু বোলে
মন-গোকুলে রুনুঝুনু বোলে॥
কূলের বাঁধন টুটে
যমুনা উথলি উঠে,
পুলকে কদম ফুটে,
পেখম খোলে
শিখী পেখম খোলে॥
ব্রজনারী কুল ভুলে
লুটায়ে সে পদমূলে,
চোখে জল, বুকে প্রেম-
তরঙ্গ দোলে॥
শ্রীমতী রাধার সাথে
বিশ্ব ছুটিছে পথে,
হরি হরি বলে মাতে
ত্রিভুবন ভোলে॥
নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া (আবির্ভাব)
আবির্ভাব
নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া
কে এল মক্কায় আমিনার কোলে।
ফাগুন-পূর্ণিমা-নিশীথে যেমন
আশমানের কোলে রাঙা-চাঁদ দোলে॥
‘কে এল কে এল’ গাহে কোয়েলিয়া,
পাপিয়া বুলবুল উঠিল মাতিয়া,
গ্রহ তারা ঝুঁকে করিছে কুর্ণিশ
হুরপরি হেসে পড়িছে ঢলে॥
জিন্নাতের আজ খোলা দরওয়াজা পেয়ে
ফেরেশতা আম্বিয়া এসেছে ধেয়ে
তহ্রিমা বেঁধে ঘোরে দরুদ পেয়ে
দুনিয়া টলমল, খোদার আরর্শ টলে॥
এল রে চির-চাওয়া, এল আখেরে-নবি
সৈয়দে মক্কি-মদনি আল-আরবি,
নাজেল হয়ে সে যে ইয়াকুত -রাঙা ঠোঁটে
শাহাদতের বাণী আধো-আধো বোলে॥
পথ-ভোলা কোন রাখাল ছেলে
বাউল লোফা
পথ-ভোলা কোন রাখাল ছেলে।
সে একলা বাটে শূন্য মাঠে
খেলে বেড়ায় বাঁশি ফেলে॥
কভু সাঁঝ গগনে উদাস মনে
চাহিয়া হেরে গো কারে,
হেরে তারার উদয়, কভু চেয়ে রয়
সুদূর বন-কিনারে।
হেরে সাঁঝের পাখি ফিরে গো যখন
নীড়ের পানে পাখা মেলে॥
তার ধেনু ফিরে যায় গ্রামের পানে
আনমনে সে বসিয়া থাকে,
ওই সন্ধ্যাতারার দীপ যে জ্বালায়
সে যেন কোথায় দেখেছে তাকে।
তার নূপুর লুটায় পথের ধূলায়
সে ফিরে নাহি চায়, কাহারে খোঁজে,
দূর চাঁদের ভেলায় মেঘ-পরি যায়
সে যেন তাহার ইশারা বোঝে।
সে চির-উদাসী পথে ফেরে হায়
সকল সুখে আগুন জ্বেলে॥
পথে পথে কে বাজিয়ে চলে বাঁশি
বাউল কাহারবা
পথে পথে কে বাজিয়ে চলে বাঁশি।
হল বিশ্ব-রাধা ওই সুরে উদাসী॥
শুনে ওই রাখালের বেণু
ছুটে আসে আলোক-ধেনু,
ওই নীল গগনে রাঙা মেঘে
ওড়ে গোখুর-রেণু,
আসে শ্যাম-পিয়ারি গোপ-ঝিয়ারি
গ্রহতারার রাশি॥
সেই বাঁশির অন্বেষণে
যত মন-বধূ ধায় বনে,
তাদের প্রেম-যমুনায় বাণ ডেকে যায়
কুল খোয়ায় গোপনে।
তারা রাস-দেউলে রসের বাউল
আনন্দ-ব্রজবাসী॥
পদ্মদিঘির ধারে ওই
গ্রাম্য সংগীত
পদ্মদিঘির ধারে ওই
সখী লো কমল-দিঘির ধারে।
আমি জল নিতে যাই
সকাল সাঁঝে সই,
সখী, ছল করে সে মাছ ধরে
আর চায় সে বারে বারে॥
মাছ ধরে সে, বড়শি আমার
বুকে এসে বেঁধে,
ওলো সই বুকে এসে বেঁধে,
আর, চোখের জলে কলসি আমার সই
আমি ভরাই কেঁদে কেঁদে
সই দেখি যত তারে॥
ছিপ নিয়ে যায় মাছ জলে তার,
তাকায় না তার পানে,
মন ধরে না – মীন ধরে সে
সখী লো সেই জানে।
মন-ভিখারি মীন-শিকারি
মুখের পানে চায়,
সখী লো চোখের পানে চায়,
আমি বড়শি-বেঁধা মাছের মতো(গো)
সখী, ছুটিয়া মরি হায়, অকূল পাথারে॥
পাঠাও বেহেশ্ত হতে হজরত পুন সাম্যের বাণী
পাঠাও বেহেশ্ত হতে, হজরত পুন সাম্যের বাণী,
আর দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি॥
বলিয়া পাঠাও, হে হজরত
যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত
সকল মানুষে বাসে তারা ভালো খোদার সৃষ্টি জানি।
সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি॥
আধেক পৃথিবী আনিল ইমান যে উদারতা-গুণে
তোমার যে উদারতা-গুণে,
শিখিনি আমরা সে উদারতা, কেবলই গেলাম শুনে
কোরানে হাদিসে কেবলই গেলাম শুনে।
তোমার আদেশ অমান্য করে
লাঞ্ছিত মোরা ত্রিভুবন ভরে,
আতুর মানুষে হেলা করে বলি, ‘আমরা খোদারে মানি’॥
পানসে জোছনাতে কে চলো গো পানসি বয়ে
গজল
পিলু খাম্বাজ মিশ্র দাদরা
পানসে জোছনাতে কে চলো গো পানসি বয়ে।
ঢেউ-এর তালে তালে বাঁশিতে গজল গেয়ে॥
মেঘের ফাঁকে ফোটে বাঁকা শশীর চিকন হাসি,
উজান বেয়ে চলো তুমি কি তার চোখে চেয়ে॥
ওপারে লুকায়ে আঁধার গভীর ঘন বন-ছায়,
আকাশে হেলান দিয়ে আলসে পাহাড় ঘুমায়।
ঘুমায়ে দূরে সে কোন গ্রাম বাসরে পল্লি-বধূর প্রায়।
ওপারে ধুধু বালুচর যেন নদীর আঁচল লুটায়।
ছাড়ি এ-সুখবাস চলেছ কোথায় গো নেয়ে॥
নদীর দু-তীরে টানে বেতস-লতা উত্তরীয়,
চমকি উঠি চখি ডাকে মুহু মুহু ‘কিয়ো!’
চকোরী চাঁদে ভুলি চাহে তব মুখ পানে,
কেঁদে পাপিয়া শুধায়, ‘পিউ কাঁহা, কাঁহা পিয়ো।‘
তুমি যাও আপন-বিভোল স্বপনে নয়ন ছেয়ে॥
পাষাণের ভাঙালে ঘুম
ভীমপলশ্রী মিশ্র দাদরা
পাষাণের ভাঙালে ঘুম
কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়।
গলিয়া সুরের তুষার
গীতি-নির্ঝর বয়ে যায়॥
উদাসী বিবাগি মন
যাচে আজ বাহুর বাঁধন,
কত জনমের কাঁদন
ও-পায়ে লুটাতে চায়॥
তোমার চরণ-ছন্দে মোর
মুঞ্জরিল গানের মুকুল,
তোমার বেণির বন্ধে গো
মরিতে চায় সুরের বকুল।
চমকে ওঠে মোর গগন
ওই হরিণ-চোখের চাওয়ায়॥
পেয়ে আমি হারিয়েছি গো
কানাড়া মিশ্র কাওয়ালি
পেয়ে আমি হারিয়েছি গো
আমার বুকের হারামণি।
গানের প্রদীপ জ্বেলে তারেই
খুঁজে ফিরি দিনরজনি॥
সে ছিল গো মধ্যমণি
আমার মনের মণি-মালায়,
রেখেছিলাম লুকিয়ে তায়
মানিক যেমন রাখে ফণী॥
স্নিগ্ধ জ্যোতি নিয়ে সে মোর
এসেছিল দগ্ধ বুকে,
অসীম আঁধার হাতড়ে ফিরি
খুঁজি তারই রূপলাবণি॥
হারিয়ে যে যায় হায় কেন সে
যায় হারিয়ে চিরতরে,
মিলন-বেলাভূমে বাজে
বিরহেরই রোদনধ্বনি॥
প্রিয় যাই যাই বোলো না
গারা মিশ্র দাদরা
প্রিয় যাই যাই বোলো না,
না না না।
আর কোরো না ছলনা,
না না না॥
আজও মুকুলিকা মোর হিয়া মাঝে
না-বলা কত কথা বাজে,
অভিমানে লাজে বলা যে হল না॥
কেন শরমে বাধিল কে জানে,
আঁখি তুলিতে নারিনু আঁখি পানে।
প্রথম প্রণয়-ভীরু কিশোরী
যত অনুরাগ তত লাজে মরি,
এত আশা সাধ চরণে দলো না॥
ফিরে আয় ভাই গোঠে কানাই
কীর্তন ভাঙা
ফিরে আয় ভাই গোঠে কানাই
আর কত কাল রবি মথুরায়।
তোর শ্যামলী ধবলী কাঁদে তৃণ ফেলি,
বারেবারে পথে ফেরে চায়॥
রাখাল-সাথিরে ফেলি কোথা আজ
রাজ্য পেয়েছ, হে রাখাল-রাজ!
তোর ফেলে-যাওয়া বাঁশি নিয়ে যারে আসি,
মোরা আঁখি-জলে ভাসি দেখে তায়॥
তুই শিখী-পাখা ফেলে মুকুট মাথায়
দিয়েছিস নাকি, শুনে হাসি পায়!
তুই পীতধড়া ছেড়ে রাজবেশে ভাই
সেজেছিস নাকি, মোদের কানাই!
তুই অসি ফেলে নেচে আয় হেলে দুলে,
নূপুর পরিয়া রাঙা পায়।
ফিরে আয় ননী-চোর ব্রজের কিশোর
মা বলে ডাক যশোদায়॥
বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি
জংলা দাদরা
বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি
যূথী বেলি।
এসো এসো কুসুম-সুকুমার
শীতের মায়া-কুহেলি অবহেলি॥
পরানে দেয় দোলা দেয় দোলা দেয় দোলা
উতল দখিনা হাওয়া,
কোকিল কুহরে কুহুকুহু স্বরে,
মদির স্বপন-ছাওয়া।
হাসে গীত-চঞ্চল জোছনা-উজল
মাধবী রাতি,
এসো এসো যৌবন-সাথি
ফুল-কিশোর, হে চিতচোর, দেবতা মোর!
মম লাজ-অবগুন্ঠন ঠেলি॥
বোলো না বোলো না ওলো সই
হাম্বির তেতালা
বোলো না বোলো না ওলো সই
আর সে কথা।
ভোমরা চপল-মতি
ফিরে সে যথা তথা॥
তরু কি লতার কাছে
এসে কভু প্রেম যাচে,
তরু বিনা নাহি বাঁচে
অসহায় লতা॥
ভুলিতে যার নাই তুলনা,
সখী তার কথা তুলো না,
প্রাণহীন পাষাণে গড়া
সে যে দেবতা॥
ভালোবাসার ছলে আমায় তোমার নাম গাওয়ালে
তিলক-কামোদ ।। রূপক ।।
ভালোবাসার ছলে আমায় তোমার নাম গাওয়ালে।
চাঁদের মতন সুদূর থেকে সাগরে মোর দোল খাওয়ালে।।
কাননে মোর ফুল ফুটিয়ে উড়ে গেলে গানের পাখি,
যুগে যুগে আমায় তুমি এমনি করে পথ চাওয়ালে।।
আঁকি তোমার কতই ছবি, তোমায় কতই নামে ডাকি,
পালিয়ে বেড়াও, তাই তো তোমায় রেখার সুরে ধরে রাখি।
মানসী মোর! কোথায় কবে আমার ঘরের বধূ হবে,
লোক হতে গো লোকান্তরে সেই আশে তরী বাওয়ালে।।
ভালোবাসায় বাঁধব বাসা আমরা দুটি মানিক-জোড়
[ দ্বৈত ] গান
উভয়ে॥ ভালোবাসায় বাঁধব বাসা
আমরা দুটি মানিক-জোড়।
থাকব বাঁধা পাখায় পাখায়
মাখামাখি প্রেম-বিভোর॥
পু॥ আমার বুকে যত মধু
স্ত্রী॥ আমার বুকে ঢালবে বঁধু!
পু॥ আমি কাঁদব যখন দুখে
স্ত্রী॥ আমি মুছাব সে নয়ন-লোর॥
পু॥ আমি যদি কভু মনের ভুলে
তোমায় প্রিয়া থাকি ভুলে,
স্ত্রী॥ আমি রইব তাতেই ফুলের মালায়
লুকিয়ে যেমন থাকে ডোর॥
উভয়ে॥ মোরা নীল গগনের নীল স্বপনে
চিরকালের চাঁদ-চকোর।
ভোলো লাজ ভোলো গ্লানি জননী
স্বদেশি গান
ভোলো লাজ ভোলো গ্লানি জননী
মুক্ত আলোকে জাগো।
কবে যে ঘুমালি মরণ-ঘুমে মা
আর জাগিলি না গো॥
চরণে কাঁদে মা তেমনই জলধি,
বক্ষ আঁকড়ি কাঁদে নদ নদী,
ত্রিশ কোটি সন্তান নিরবধি
কাঁদে আর ডাকে মা গো॥
শূন্য দেউল বন্ধ আরতি,
কাঁদিছে পূজারি; নাহি মা মুরতি,
পূজার কুসূম চন্দন যায়
আঁখিজলে – ভালিয়া মা গো॥
যে তিতিক্ষা যে শিক্ষা লয়ে,
অতীতে ছিলি মা রাজরানি হয়ে,
লয়ে সে মহিমা পুন নির্ভয়ে,
বিশ্ব-বুকে দাঁড়া গো॥
বিশ্বের এই খল কোলাহলে
তুই আয় কল্যাণ-দীপ জ্বেলে,
বিরোধের শেষে তুই শান্তি মা
মৃত্যু শেষে সুধা গো॥
মন নিয়ে আমি লুকোচুরি-খেলা খেলি প্রিয়ে
[ দ্বৈত ] গান
পুরুষ॥ মন নিয়ে আমি লুকোচুরি-খেলা খেলি প্রিয়ে।
স্ত্রী॥ ধরিতে পারি না পেতে তাই প্রেম-ফাঁদ
আমি মেঘ তুমি চাঁদ, ফের গো কাঁদিয়ে॥
পু॥ মন্দ বায় আমি গন্ধ লুটি শুধু
চাইনে আমি সে মধু,
স্ত্রী॥ চাইনে চাইনে বঁধু!
তাহে নাই সুখ নাই,
আমি পরশ যে চাই।
পু॥ স্বপন-কুমার ফিরি যে আমি
মন ভুলিয়ে।
উভয়ে॥ চলো তবে যাই মোরা স্বপ্নের দেশে
জোছনায় ভেসে
নন্দন-পারিজাত ফুল ফুটিয়ে॥
মরম-কথা গেল সই মরমে মরে
ইমনকল্যাণ কাওয়ালি
মরম-কথা গেল সই মরমে মরে।
শরম বারণ যেন করিল চরণ ধরে॥
ছল করে কত শত
সে মম রুধিত পথ,
লাজ ভয়ে পলায়েছি
সে ফিরেছে ব্যথাহত,
অনাদরে প্রেম-কুসুম গিয়াছে মরে॥
কত যুগ মোর আশে বসে ছিল পথ পাশে,
কত কথা কত গান জানায়েছে ভালোবাসে,
শেষে অভিমানে নিরাশে গিয়াছে সরে॥
মাধব বংশীধারী বনোয়ারি গোঠচারী
ভৈরবী কাহারবা
মাধব বংশীধারী বনোয়ারি গোঠচারী
গোবিন্দ কৃষ্ণ মুরারি।
গোবিন্দ কৃষ্ণ মুরারি হে,
পাপ-তাপ-দুখ-হারী॥
কালরূপ কভু দৈত্য-নিধনে,
চিকন কালা কভু বিহর বনে,
কভু, বাজাও বেণু, খেল ধেনুসনে,
কভু বামে রাধা-প্যারি,
গোপনারী মনোহারী
নিকুঞ্জ-লীলা-বিহারী॥
কুরুক্ষেত্র-রণে পাণ্ডব-মিতা,
কণ্ঠে অভয় বাণী ভগবদ্গীতা,
হে পূর্ণ ভগবান পরম পিতা,
শঙ্খ চক্র গদাধারী,
পাপ-তারী, কাণ্ডারি
ত্রিভুবন সৃজনকারী॥
মৃতের দেশে নেমে এল মাতৃনামের গঙ্গাধারা
মৃতের দেশে নেমে এল মাতৃনামের গঙ্গাধারা।
আয় রে নেয়ে শুদ্ধ হবি অনুতাপে মলিন যারা॥
আর আশাহীন ভাগ্যহত,
শক্তিবিহীন অনুন্নত,
আয় রে সবাই আয়
আয় এই অমৃতেই ডুববি এসে জীবন্মৃত সর্বহারা॥
ওরে এই শক্তির গঙ্গাস্রোতে, অনেক আগে এই সে দেশে
মৃত সগর-বংশ বেঁচে উঠেছিল এক নিমেষে।
এই গঙ্গোত্রীর পরশ লেগে
মহাভারত উঠল জেগে,
এই পুণ্য স্রোতেই ভেঙেছিল দেশ-বিদেশের লক্ষ কারা॥
মেরো না আমারে আর নয়ন-বাণে
খাম্বাজ মিশ্র কাহারবা
মেরো না আমারে আর নয়ন-বাণে।
কী জ্বালা ব্যাধের বাণে
বনের হরিণই জানে॥
একে এ পরান দহে
মদির ও-আঁখির মোহে
চাহনির জাদু মাখা তার।
জ্বলিছে আলেয়া-শিখা
নয়ন-জলের মরীচিকা
পিয়াসি পথিক ছোটে হায়
তাহারই টানে॥
তব রূপের সায়রে ও নয়ন
শাপলা সুঁদির ফুল,
তুলিতে গিয়া ডুবিল
শত যে পথিক বেভুল।
সুন্দর ফণীর শিরে
ও যেন যুগল মণি,
যে গেল সে মণির মায়ায়
তারে দংশিল অমনি।
শত সে হৃদয়-নদী
কেঁদে যায় নিরবধি,
সাগর-ডাগর ও-আঁখির পানে॥
মোর মন ছুটে যায় দ্বাপর যুগে
ভজন
মোর মন ছুটে যায় দ্বাপর যুগে
দূর দ্বারকায় বৃন্দাবনে।
মোর মন হতে চায় ব্রজের রাখাল
খেলতে রাখাল-রাজার সনে॥
রূপ ধরে না বিশ্বে যাহার
দেখতে যায় সাধ কিশোর-রূপ তার,
কেমন মানায় নরের রূপে
অনন্ত সেই নারায়ণে॥
সাজত কেমন শিখী-পাখা
বাজত কেমন নূপুর পায়ে,
থির কেমন থাকত ধরা
নাচত যখন তমাল ছায়ে।
মা যশোদা বাঁধত যখন
কাঁদত ভগবান কেমনে॥
বাজত সে বেণু যখন
উঠত না কি বিশ্ব কেঁপে,
ছড়িয়ে যেত সে সুর কোথায়
আকাশ গ্রহ তারা ছেপে।
রাধার সনে ছুটত না কি
পাগল নিখিল বাঁশির স্বনে॥
তারে সাজত কেমন বন-মালায়
বিশ্ব যাহার অর্ঘ্য সাজায়;
যোগী-ঋষি পায় না ধ্যানে
গোপবালা কেমনে পায়।
তেমনি করে কালার প্রেমে
সব খোয়াব এই জীবনে॥
মোরে সেই রূপে দেখা দাও হে হরি
কীর্তন মিশ্র
মোরে সেই রূপে দেখা দাও হে হরি।
তুমি ব্রজের বালারে রাইকিশোরীরে
ভুলাইলে যেই রূপ ধরি॥
হরি বাজায়ো বাঁশরি সেই সাথে,
যে বাঁশি শুনিয়া ধেনু গোঠে যেত
উজান বহিত যমুনাতে।
যে নূপুর শুনে ময়ূর নাচিত
এসো হে সেই নূপুর পরি॥
নন্দ-যশোদা-কোলে গোপাল
যে রূপে খেলিতে, ক্ষীর ননী খেতে,
এসো সেই রূপে ব্রজ-দুলাল॥
যে পীতবসনে কদমতলায় নাচিতে
এসো সে বাস পরি॥
কংসে বধিলে যে রূপে শ্যাম
কুরুক্ষেত্রে হইলে সারথি
এসো সেই রূপে এ ধরাধাম।
যে রূপে গাহিলে গীতা, নারায়ণ,
এসো সে বিরাট রূপ ধরি॥
মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে
মোহাম্মদ নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।
তাই কি রে তোর কণ্ঠের গান এমন মধুর লাগে॥
ওরে গোলাব! নিরিবিলি
বুঝি নবির কদম ছুঁয়েছিলি,
তাই তাঁর কদমের খোশবু আজও তোর আতরে জাগে।
মোর নবিরে লুকিয়ে দেখে
তাঁর পেশানীর জ্যোতি মেখে
ওরে ও চাঁদ, রাঙলি কি তুই গভীর অনুরাগে॥
ওরে ভ্রমর, তুই কি প্রথম
চুমেছিলি নবির কদম,
আজও গুনগুনিয়ে সেই খুশি জানাস রে গুলবাগে।
মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে
মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ততই মধুর লাগে।
নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে॥
ওই নামেরই মধু চাহি
মন-ভোমরা বেড়ায় গাহি
আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা নাহি
ওই নামের অনুরাগে॥
ও নাম প্রাণের প্রিয়তম
ও নাম জপি মজনুঁ সম
ওই নামে পাপিয়া গাহে
প্রাণের গোলাব-বাগে॥
আমি ওই নামে মুসাফির রাহী
তাই চাই না তখ্ত্ শাহানশাহি
নিত্য ও নাম য়্যা ইলাহি
যেন হৃদে জাগে॥
মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি
মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি
মোহাম্মদ মোর জপ-মালা।
ওই নামে মিটাই পিপাসা
ও নাম কওসারের পিয়ালা॥
মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি
মোহাম্মদ নাম গলায় পরি,
ওই নামেরই রওশনিতে
আঁধার এ মন রয় উজালা॥
আমার হৃদয়-মদিনাতে
শুনি ও নাম দিনে রাতে
ও নাম আমার তসবী হাতে
মন-মরুতে গুলে-লালা॥
মোহাম্মদ মোর অশ্রু চোখের
ব্যথার সাথি, শান্তি শোকের,
চাই না বেহেশ্ত, যদি ও নাম
জপতে সদাই পাই নিরালা॥
যমুনা-কূলে মধুর মধুর মুরলী সখী বাজিল
পাহাড়ি তেতালা
যমুনা-কূলে মধুর মধুর মুরলী সখী বাজিল।
মাধব নিকুঞ্জচারী শ্যাম বুঝি আসে –
কদম্ব তমাল নব-পল্লবে সাজিল॥
ময়ূর তমাল-তলে পেখম খোলে,
ব্যাকুলা গোপ-বালা শুনিয়া সে তান,
যুগ যুগ ধরি যেন শ্যাম
বাঁশরি বাজায় গো,
বাঁশিতে শ্যাম মোরে যাচিল॥
যমুনা-সিনানে চলে তন্বী মরাল-গামিনী
পিলু দাদরা
যমুনা-সিনানে চলে
তন্বী মরাল-গামিনী।
লুটায়ে লুটায়ে পড়ে
পায়ে বকুল কামিনী॥
মধু বায়ে অঞ্চল,
দোলে অতি চঞ্চল,
কালো কেশে আলো মেখে
খেলিছে মেঘ দামিনী॥
তাহারই পরশ চাহি
তটিনী চলেছে বাহি,
তনুর তীর্থে তারই
আসে দিবা ও যামিনী॥
যায় ঢুলে ঢুলে এলোচুলে
কাফি ঝাঁপতাল
যায় ঢুলে ঢুলে এলোচুলে
কে বিষাদিনী।
তার চোখে চেয়ে ম্লান হয়ে
যায় গো চাঁদিনি॥
তার সোনার অঙ্গ অনাদরে
হয়েছে কালি,
হায় ধুলায় লুটায় নবীন যৌবন
ফুলের ডালি,
কোন মদির আঁখির খেয়েছে তির
বন-হরিণী॥
তার চটুল চরণ নাচত যেন
নোটন-কপোতী,
মরুর বুকে ফুল ফোটাত
তার দোদুল গতি,
আজ ধীরে সে যায় যেন শীতের
মৃদুল তটিনী॥
রাখো এ মিনতি ত্রিভুবনপতি
ভজন
ভৈরবী কাওয়ালি
রাখো এ মিনতি ত্রিভুবনপতি
তব পদে মতি (রাখো)।
আঁখির আগে যেন সদা জাগে
তব ধ্রুব জ্যোতি॥
সংসার-মরু মাঝে তুমি মেঘমায়া,
বিষাদ-শোক-তাপে তুমি তরুছায়া,
সান্ত্বনাদাতা তুমি দুঃখত্রাতা
অগতির গতি।
দোলে কালো নিশার কোলে
আলো-উষসী,
তিমির-তলে তব তিলক জ্বলে
ওই পূর্ণশশী।
ঝঞ্ঝার মাঝে তব বিষাণ বাজে,
সহসা ঢলি পড় বনে ফুল-সাজে,
কোমলে কঠোরে হে প্রভু বিরাজে
তব মহিমা শকতি॥
রাখো রাখো রাঙা পায় হে শ্যামরায়
তিলক-কামোদ আদ্ধা কাওয়ালি
রাখো রাখো রাঙা পায় হে শ্যামরায়।
ভুলে গৃহ-স্বজন সবই সঁপেছি তোমায়॥
সংসার মরু ঘোর, নাহি তরু ছায়া,
নব নীরদ শ্যাম আনো মেঘ-মায়া,
আনন্দ-নীপবনে নন্দদুলাল এসো
বহাও উজান, হরি অশ্রুর যমুনায়॥
একা জীবন মোর গহন বন ঘোর
এসো এ বনে বনমালী গোপ-কিশোর,
কুঞ্জ রচেছি দুখশোক-তমালছায়।
প্রেম-প্রীতির গোপীচন্দন শুকায়ে যায়॥
দারা সুত প্রিয়জন, হরি হে নাহি চাই,
পদ্ম-পলাশ আঁখি যদি দেখিতে পাই,
রাখাল-রাজা এসো, এসো হে হৃষীকেশ,
গোকুলে লহো ডাকি, অকূলে ভাসি, হায়॥
রুমু রুমঝুম রুমুঝুমু বাজে নূপুর
বেহাগ খাম্বাজ
রুমু রুমঝুম
রুমুঝুমু বাজে নূপুর।
তালে তালে দোদুল দোলে
নাচের নেশায় চুর॥
চঞ্চল বায়ে আঁচল উড়ায়ে
চপল পায়ে, ও কে যায়
নটিনি কল-তটিনীর প্রায়, –
চিনি বিদেশিনো, চিনি গো তায়;
শুনি ছন্দ তারই এ হিয়া ভরপুর॥
নাচন শিখালে ময়ূর মরালে,
মরীচি-মায়া মরুতে ছড়ালে,
বন-মৃগের মন হেসে ভুলালে
ডাগর আঁখির নাছে সাগর দুলালে;
গিরি-দরি বনে গো
দোল লাগে নাচনের
শুনে তার সুর॥
রোদনে তোর বোধন বাজে
ভৈরবী একতালা
রোদনে তোর বোধন বাজে
আয় মা শ্যামা জগন্ময়ী।
আমরা যে তোর মানব-ছেলে
আমরা তো মা দানব নই॥
তোর মাথায় গেছে রক্ত চড়ে
তাই পা রেখেছিস শিবের পরে,
স্বামীকে তুই চিনতে নারিস
চিনবি ছেলেয় কেমনে কই॥
তোর বাবা যেমন অটল পাষাণ,
তেমনি অটল তোরও কি প্রাণ!
তুই সব খেয়েছিস সকল-খাগী,
এবার শুধু ভিক্ষা মাগি –
তোর আপন ছেলের মাথা খা তুই
মোরাও দুঃখ-মুক্ত হই॥
লায়লি তোমার এসেছে ফিরিয়া
লায়লি তোমার এসেছে ফিরিয়া
মজনুঁ গো আঁখি খোলো।
প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের
নিশি বুঝি ভোর হল॥
মজনুঁ! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু, নদী, পর্বতে
বন্দিনী আজ পিঞ্জর ভেঙে বাহির হয়েছে পথে।
দখিনা বাতাস বহে অনুকূল,
ফুটেছে গোলাব নার্গিস ফুল,
ওগো বুলবুল, ফুটন্ত সেই গুলবাগিচায় দোলো॥
বনের হরিণ হরিণী কাঁদিয়া পথ দেখায়েছে মোরে,
হুরি ও পরিরা ঝুরিয়া ঝুরিয়া চাঁদের প্রদীপ ধরে
পথ দেখায়েছে মোরে।
আমার নয়নে নয়ন রাখিয়া
কী বলিতে চাও- হে পরান-প্রিয়া!
ডাক নাম ধরে, ডাকো মোরে স্বামী
ভোলো অভিমান ভোলো॥
লায়লি লায়লি ভাঙিয়ো না ধ্যান
লায়লি! লায়লি! ভাঙিয়ো না ধ্যান
মজনুর এ মিনতি।
লায়লি কোথায়? আমি শুধু দেখি
লা-এলার জ্যোতি॥
পাথর খুঁজিয়া ফিরিয়াছি প্রিয়া
প্রেম-দরিয়ার কূলে,
খোদার প্রেমের পরশ-মানিক
পেলাম কখন ভুলে।
সে মানিক যদি দেখ একবার
মজনুরে তুমি চাহিবে না আর,
জোহরা ইয়সুফ লাজ মানে হেরি
তাহার খুবসুরতি ॥ (লায়লি)
শ্যামা তুই বেদেনির মেয়ে
সিন্ধুকাফি যৎ
শ্যামা তুই বেদেনির মেয়ে
(তাই) মাঠে ঘাটে বেড়াস ধেয়ে।
তুই কোন দুখে এই ভেক নিলি মা
থাকতে নিখিল ছেলে-মেয়ে॥
হেম কৈলাসে তোর আগুন জ্বালি
গৌরী মেয়ে সাজলি কালী,
তুই অন্নপূর্ণা নাম ভুলিলি
ভূতনাথের সঙ্গ পেয়ে॥
ডুগডুগি ওই বাজায় মহেশ
খ্যাপা ব্যাটা গাঁজা খেয়ে,
তাই দেখে তুই চণ্ডী সেজে
খেপে গেলি হাবা মেয়ে॥
রাজার মেয়ের এ কী খেয়াল,
মেরে বেড়াস অসুর-শেয়াল,
তুই দানব ধরে বাঁদর নাচাস
কাজ নাই তোর খেয়ে-দেয়ে॥
সখী বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া
কাজরি কাহারবা
সখী বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া।
নামিল মেঘলা মোর বাদরিয়া॥
চলো কদম তমাল তলে গাহি কাজরিয়া
চলো লো গোরী শ্যামলিয়া॥
বাদল-পরিরা নাচে গগন-আঙিনায়,
ঝমাঝম বৃষ্টি-নূপুর পায়
শোনো ঝমঝম বৃষ্টি নূপুর পায়
এ হিয়া মেঘ হেরিয়া ওঠে মাতিয়া॥
মেঘ-বেণিতে বেঁধে বিজলি-জরিন ফিতা,
গাহিব দুলে দুলে শাওন-গীতি কবিতা,
শুনিব বঁধূর বাঁশি বন-হরিণী চকিতা,
দয়িত-বুকে হব বাদল-রাতে দয়িতা।
পরো মেঘ-নীল শাড়ি ধানি-রঙের চুনরিয়া,
কাজলে মাজি লহো আঁখিয়া॥
সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে
সন্ধ্যামালতী
সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে,
কে আসি বাজালে বাঁশি ভৈরবী সুরে॥
সাঁঝের পূর্ণ চাঁদে অরুণ ভাবিয়া
পাপিয়া প্রভাতি সুরে উঠিল গাহিয়া
ভোরের কমল ভেবে সাঁঝের শাপলা ফুলে
গুঞ্জরে ভ্রমর ঘুরে ঘুরে॥
বিকালের বিষাদে ঢাকা ছিল বনভূমি
সকালের মল্লিকা ফোটাইলে তুমি,
রাঙিলা উষার রঙে গোধুলি লগন
শোনালে আশার বাণী বিরহ-বিধুরে॥
সুন্দর বেশে মৃত্যু আমার
গান
সুন্দর বেশে মৃত্যু আমার
আসিলে কি এতদিনে?
বাজালে দুপুরে বিদায় পুরবি
আমার জীবন-বীণে!
ভয় নাই রানি, রেখে গেনু শুধু
চোখের জলের লেখা,
রাতের এ লেখা শুকাবে প্রভাতে;
চলে যাব আমি একা!
* * *
দিনের আলোকে ভুলিয়ো তোমার রাতের দুঃস্বপন,
ঊর্ধ্বে তোমার প্রহরী দেবতা,
মধ্যে দাঁড়ায়ে তুমি ব্যথাহতা,
পায়ের তলার দৈত্যের কথা ভুলিতে কতক্ষণ?
সেই রবিয়ল আউওলেরই চাঁদ এসেছে ফিরে (তিরোভাব)
তিরোভাব
সেই রবিয়ল আউওলেরই চাঁদ এসেছে ফিরে
ভেসে আকুল অশ্রুনীরে॥
আজ মদিনার গোলাপ-বাগে বাতাস বহে ধীরে
ভেসে আকুল অশ্রুনীরে॥
তপ্ত বুকে আজ সাহারার
উঠেছে রে ঘোর হাহাকার,
মরুর দেশে এল আঁধার-লোকের বাদল ঘিরে
আকুল অশ্রুনীরে॥
চবুতরায় বিলাপ করে কবুতরগুলি
খোঁজে নবিজিরে।
কাঁদিছে মেষশাবক, কাঁদে বনের বুলবুলি
গোরস্থান ঘিরে।
মা ফতেমা লুটিয়ে পড়ে
কাঁদে নবির বুকের পরে
আজ দুনিয়া জাহান কাঁদে কর হানি শিরে
আকুল অশ্রুনীরে॥
হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল
সাঁওতালি গান
হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল।
এনে দে, এনে দে, নইলে বাঁধব না বাঁধব না চুল।
কুসমি রং শাড়ি, চুড়ি বেলোয়ারি।
কিনে দে হাট থেকে, এনে দে মাঠ থেকে,
বাবলা ফুল আমের মুকুল॥
তিরকূট পাহাড়ে শালবনের ধারে
বসবে মেলা আজি বিকালবেলায়।
দলে দলে পথে চলে সকাল হতে
সাঁওতাল সাঁওতালনি নূপুর বেঁধে পায়
যেতে দে ওই পথে বাঁশি শুনে শুনে পরান বাউল
মহুয়া-কুঁড়ির মালা গেঁথেছি নিরালা তুহার তরে,
মনের আদর মেখে পিয়াল পাতা ঢেকে রেখেছি ঘরে।
পলার মালা নাই,
কী যে করি ছাই,
গাঁথব মালা রে, এনে দে, এনে দে রে শিঁয়াকুল॥
হৃদয়-সরসী দুলালে পরশি গত নিশি
ভৈরবী দাদরা
হৃদয়-সরসী দুলালে পরশি গত নিশি।
নিশিশেষে চাঁদ – পূর্ণিমা চাঁদ –
গেলে মিশি,
গত নিশি॥
নয়ন মুদি কুমুদী ওই –
কাঁদে প্রিয় কই,
পিউ কাহাঁ, পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা,
দশ দিশি।
গত নিশি॥
হে গোবিন্দ, ও অরবিন্দ চরণে শরণ দাও হে
বেহাগ একতালা
হে গোবিন্দ, ও অরবিন্দ চরণে শরণ দাও হে।
বিফল জনম কাটিল কাঁদিয়া, শান্তি নাহি কোথাও হে॥
জীবন-প্রভাত কাটিল খেলায়,
দুপুর ফুরাল মোহের মেলায়,
ডাকিব যে নাথ সন্ধ্যাবেলায় ডাকিতে পারিনি তাও হে॥
এসেছি দুঃখ-জীর্ণ পথিক মৃত্যু-গহন রাতে।
কিছু নাই প্রভু সম্বল, শুধু জল আছে আঁখি-পাতে॥
সন্তান তব বিপথগামী,
ফিরিয়া এসেছে হে জীবন-স্বামী,
পাপী-তাপী তবু সন্তান আমি ধুলা মুছে কোলে নাও হে॥
হে বিধাতা দুঃখ-শোক মাঝে তোমারই পরশ রাজে
ভজন
মেঘ তেতালা
হে বিধাতা!
দুঃখ-শোক মাঝে তোমারই পরশ রাজে,
কাঁদায়ে জননী-প্রায় কোলে কর পুনরায়,
শান্তিদাতা।
হে বিধাতা॥
ভুলিয়া যাই হে যবে সুখ-দিনে তোমারে
স্মরণ করায়ে দাও আঘাতের মাঝারে।
দুঃখের মাঝে তাই হে প্রভু, তোমারে পাই
দুঃখত্রাতা।
হে বিধাতা॥
দারা-সুত-পরিজন-রূপে প্রভু, অনুখন
তোমার আমার মাঝে আড়াল করে সৃজন।
তুমি যবে চাহ মোরে লও হে তাদের হরে
ছিঁড়ে দিয়ে মায়া-ডোর, ক্রোড়ে ধর আপন।
ভক্ত সে প্রহ্লাদ ডাকে যবে ‘নারায়ণ’,
নির্মম হয়ে তার পিতারও হর জীবন,
সব যবে ছেড়ে যায় দেখি তব বুকে হায়
আসন পাতা।
হে বিধাতা॥
হে মদিনার নাইয়া
হে মদিনার নাইয়া!
ভবনদীর তুফান ভারী
করো করো পার।
তোমার দয়ায় তরে গেল লাখো গুনাহ্গার
করো করো পার॥
পারের কড়ি নাই হে আমার হয়নি নামাজ রোজা
আমি কূলে এসে বসে আছি নিয়ে পাপের বোঝা
‘য়্যা রসুল আমায় পার করো’ বলে কাঁদি জারেজার॥
তোমার নাম গেয়েছি শুধু কেঁদে সুবহশাম
তরিবার মোর নাই তো পুঁজি বিনা তোমার নাম।
হাতারোবার দরিয়াতে ডুবে যদি মরি
ছাড়ব না মোর পারের আশা তোমার চরণ-তরি,
সবার শেষে পার যেন হয় এই খিদমতগার ॥
হে মদিনার বুলবুলি গো
হে মদিনার বুলবুলি গো
গাইলে তুমি কোন গজল।
মরুর বুকে উঠল ফুটে
প্রেমের রঙিন গোলাপ দল॥
দুনিয়ার দেশ-বিদেশ থেকে
গানের পাখি উঠল ডেকে,
মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনি
উঠল ভেদি গগনতল॥
সাহারার দগ্ধ বুকে রচলে তুমি গুলিস্তান
সেথা আসহাব সব ভ্রমর হয়ে শাহদতের গাইল গান।
দোয়েল কোকিল দলে দলে
আল্লা-রসুল উঠল বলে,
আল-কোরানের পাতার কোলে
খোদার নামের বইল ঢল॥
হেলে দুলে নীর ভরণে ও কে যায়
বেহাগ ধাম্বাজ দাদরা
হেলে দুলে নীর ভরণে ও কে যায়।
ছল করে কলসি নাচায় (কিশোরী)॥
দুলে দোদুল তনু-লতা বাহু দোলে,
দুলে অঞ্চল চঞ্চল বায়।
দুলে বেণি, দুলে চাবি আঁচলায়॥
নাচে জল-তরঙ্গে তটিনী রঙ্গে
জলদ দাদরা বাজায়।
মম পরান নূপুর হতে চায় (তার পায়)॥