• বইয়ের নামঃ সাহেব বিবি গোলাম
  • লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
  • প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃ উপন্যাস

ভূমিকা – উৎসর্গ – পূর্বাভাষ

সাহেব বিবি গোলাম
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

প্রথম সংস্করণে ভূমিকা দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি অতি স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এখন অবস্থাভেদে সে-প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

আমি প্রধানত গল্পকার, ইতিহাসবেত্তা নই। গল্পের প্রয়োজনে কখনো কখনো ইতিহাস, বিজ্ঞান বা সমাজ তত্ত্বের আলোচনা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গল্পেরই প্রয়োজনে আমি প্রাচীন কলকাতার সমাজ বা জীবন-আলোচনা করেছি এবং গল্পের প্রয়োজনে তা করা অপরিহার্য বলেই করেছি, ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন আলোকপাত করবো বলে করিনি। এখানে গল্পই মুখ্য, ইতিহাস বা অন্য সব কিছুই গৌণ। কিন্তু ইতিহাসের পাখায় চড়ে আমার গল্প রস-বিহার করলেও, গল্পের পাখায় চড়ে ইতিহাস যাতে রস-বিহার না করে, সেদিকে আমার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। সর্বত্র নিজেকে আমি সত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখেছি। গল্পের সুবিধের জন্যে ইতিহাসের কিছু অংশ গ্রহণ বা বর্জন করেছি বটে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তাকে বিকৃত করিনি।

বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন–“ইতিহাসের উদ্দেশ্য কখন কখন উপন্যাসে সুসিদ্ধ হইতে পারে।” ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসের দ্বারা যদি কোথাও কোনোপ্রকারে ইতিহাসের উদ্দেশ্য সুসিদ্ধ হয়ে থাকে তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তা হয়েছে। আমি কোথাও ইতিহাস শোনাবো বলে গল্প শোনানোর ভান করিনি।

এই উপন্যাস রচনায় যে-সব প্রাচীন, অপ্রচলিত বা আধুনিক গ্রন্থাদির সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে, তার জন্যে আমি স্বকৃতজ্ঞ ঋণ স্বীকার করছি। বাহুল্যবোধে তার দীর্ঘ তালিকা দিয়ে ভূমিকা দীর্ঘতর করা অনাবশ্যক। বিশেষ করে উপন্যাস পাঠকের পক্ষে তা একান্তই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি।

গ্রন্থকার

 —————

Thus from the midday halt of Charnock
grew a city,
As the fungus sprouts chaotic from its
bed
So it spread.
Chance-directed, chance-erected, laid and
built
On the silt,
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side.

-Kipling

—————–

উৎসর্গ
রমাপদ চৌধুরী
বন্ধুবরেষু

——————

পূর্বাভাস

ওদিকে বউবাজার স্ট্রীট আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ। মাঝখানের সর্পিল গলিটা এতদিন দুটো বড় রাস্তার যোগসূত্র : হিসেবে কাজ চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু আর বুঝি চললো না। বনমালী সরকার লেন বুঝি এবার বাতিল হয়ে গেল রাতারাতি। এতদিনকার গলি। ওই গলিরই পশ্চিমদিকে তখন বনমালী সরকারের পূর্বপুরুষ রাজত্ব করে গিয়েছিলেন সূতানুটী আর গগাবিন্দপুরের সময় থেকে। কথায় ছিল, “উমিচাঁদের দাড়ি আর বনমালী সরকারের বাড়ি”। দুটোরই বোধহয় ছিল সমান জাঁকজমক আর বাহার। সে-যুগে সদগোপ বনমালী সরকার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে পাটনায় দেওয়ানী পেয়েছিলেন। আর কলকাতায় পেয়েছিলেন কোম্পানীর অধীনে ব্যবসা করবার অধিকার। সে-সব অনেক যুগ আগের কথা। সেকালের কুমোরটুলীতে তিনি লাটসাহেবের অনুকরণে এক বাড়ি করেন। তার দেখাদেখি সেকালের আর এক বড়লোক মথুর সেন বাড়ি করেন নিমতলায়। কিন্তু বনমালী সরকারের বাড়ির কাছে সে-বাড়ির তুলনাই হতো না যেন। তারপর কোথায় গেল সেই কুমোরটুলীর বাড়ি–কোথায় গেল বনমালী সরকার নিজে আর কোথায় গেল মথুর সেন! সত্যিই তো ভাবলে অবাক হতে হয়। কোথায় গেল সেই আরমানী বণিকরা, যারা করতে সূতা আর নুটীর ব্যবসা! আর কোথায় গেল জব চার্নকের উত্তরাধিকারী ইংরেজরা—যারা কালিকট থেকে পর্তুগীজদের ভয়ে পালিয়ে এসে সূতানুটীতে আশ্রয় নিলে—আর পরে কালিকটের অনুকরণে সূতানুটীর নামকরণ করলে ক্যালকাটা। আজ শুধু কোম্পানীর সেরেস্তার কাগজপত্রে পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে সূতানুটীকে খুঁজে বার করতে হয়। তবু যে বনমালী সরকার ওই এদোপড়া গলির মধ্যে এতদিন দম আটকে বেঁচেছিলেন তা কেবল কলকাতা কর্পোরেশনের গাফিলতির কল্যাণে। এবার তাও গেল। এবার গোবিন্দরাম, উমিচাঁদ, হুজরি মল, নকু ধর, জগৎ শেঠ আর মথর সেনের সঙ্গে বনমালী সরকারও একেবারে ইতিহাসের পাতায় তলিয়ে গেল। আধখানা আগেই গিয়েছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরি হবার সময়ে, এবার বাকি আধখানাও শেষ।

ভার পড়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওপর। গলির মুখে ছিল হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালাদের মেটে টিনের দোতলা। হোলির এক মাস আগে থেকে খচম খম শব্দে খঞ্জনী বাজিয়ে “রামা হো” গান চলতো। তারপর সোজা পুব মুখো চলে যাও। খানিকদূর গিয়ে বাঁয়ে বেঁকে আবার ডাইনে বেঁকতে হবে। সদ্‌গোপ বনমালী সরকারের প্যাঁচোয়া বুদ্ধির মতো, তার নামের গলিটাও বড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মিশেছে গিয়ে বউবাজার স্ট্রীটে। গলিটাতে ঢুকে হঠাৎ মনে হবে বুঝি সামনের বাড়ির দেয়ালটা পর্যন্ত ওর দৈর্ঘ্য। কিন্তু বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক মজা মিলবে। নিচু নিচু বাড়িগুলোর রাস্তার ধারের ঘরগুলোতে জম্-জমাট দোকান-পত্তর। বাঁকের মুখে বেণী স্বর্ণকারের সোনা রূপোর দোকান। তারপর পাশের একতলা বাড়ির রোয়াকের ওপর “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল”। কিছুদূর গিয়ে বাঁ হাতি তিন রঙা ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ আঁকা সাইনবোর্ড। প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার”। তারপরেও আছে গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজার”। যখন স্বদেশী জিনিস কিনতে খদ্দেরের ভিড় হয় তার জেরটা গিয়ে ঠেকে পাশের বাড়ির সবুজ সঙ্ঘের দরজা পর্যন্ত। এক একদিন “সবুজ সঙ্ঘ” হঠাৎ মুখর হয়ে ওঠে আলোতে আর জাঁকজমকে। একটা উপলক্ষ্য তাদের হলেই হলো। সেদিন পাড়ার লোকের ঘুমোবার কথা নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি “সবুজ সঙ্ঘের জয় ঘোষণা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও ঘটনা ঘটে না। লোকে আপিসে যায় না, বাজার করে না, ঘুমোয় না, খায় না—শুধু সবুজ সঙ্ঘ আর সবুজ সঙ্ঘ। কিন্তু তারপরেই আছে জ্যোতিষার্ণব শ্রীমৎ অনন্ত ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম” যেখানে এই কলিকালের ভেজালের যুগেও একটি খাঁটি নবগ্রহ কবচ মাত্র ১৩টাকা ১০আনায় পাওয়া যায়—ডাকমাশুল স্বতন্ত্র। সত্য ত্রেতা দ্বাপর—বর্তমান, ভূত ভবিষ্যৎ—ত্রিকালদর্শী রাজজ্যোতিষীর প্রস্তুত বশীকরণ, বগলামুখী আর ধনদা কবচের প্রচার ইংলণ্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, চীন, জাপান, মালয়, সিঙ্গাপুরের মতো দূর-দূর দেশে। বনমালী সরকার লেন-এর “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম’-এর আরো গুণাবলী সাইনবোর্ডে লাল, নীল আর হলদে কালিতে সবিস্তারে লেখা আছে। তারপরের টিনের বাড়িটার সামনের চালার নিচে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকান। আশে পাশের চার পাঁচটা পাড়ায় বাঞ্ছার তেলেভাজার নাম আছে। তিন পুরুষের দোকান। বাঞ্ছা এখন নেই। বাঞ্ছার ছেলে অধর। অধরের ছেলে অক্রর এখন দোকানে বসে। অক্রর কারিগর ভালো। বেসনটাকে মাটির গামলায় রেখে বাঁ হাতে একটু সোডা নিয়ে বেসনটা এমন ফেটিয়ে নেয় যে, কড়ার গরম তেলে ফেলে দিলে প্রকাণ্ড ফোস্কার মতো নিটোল হয়ে ফুলে ফুলে ওঠে বেগুনিগুলো। হাতকাটা কেলো এসে সকাল থেকে বসে থাকে। তখন ঝাঁপ খোলেনি অক্রর। শীতকালের সকালবেলা চারদিকে গোল হয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেররা—আর অক্রর ঝাঁঝরি খুন্তিটা দিয়ে বেগুনিগুলো ভেজে ভেজে তেলে চুবড়িতে। সময় সময় চুবড়িতে তোলবারও অবসর দেয় না কেউ। জিভ পুড়ে ফোস্কা পড়বার অবস্থা। তেমনি চলে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। এমনি করে আরো হরেক রকমের দোকান বাঁদিকে রেখে বনমালী সরকার লেন এঁকে বেঁকে ঘুরে ফিরে গিয়ে পড়েছে বউবাজার স্ত্রীটে। দোকানপত্তর যা কিছু সব বাঁদিকে কিন্তু অত বড় গলিটার ডানদিকটায় প্রায় সমস্তটা জুড়ে কেবল একখানা বাড়ি। নিচু নিচু ছোট ছোট পায়রার খোপের মতন ঘরগুলো। ভাড়াটের চাপাচাপিতে কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতন আর তিল ধরবার জায়গা নেই ওতে। লোকে বলতো “বড়বাড়ি”। তা এদিককার মধ্যে সে-যুগে ও-পাড়ায় অত বড় বাড়ি আর ছিল কই! বালির পলেস্তারার ওপর রঙ চড়িয়ে চড়িয়ে যতদিন চালানো গিয়েছিল ততদিন চলেছে। তারপর রাস্তার দিকের চারপাঁচখানা ঘর নিয়ে কংগ্রেসের “ন্যাশন্যাল স্কুল” হয়েছিল ইদানীং। আর একটা ঘরে তঁত বসেছিল অনেক আগে থাকতে। সমস্ত দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেটাঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ হতো। টিফিনের সময় লেবেনচুওয়ালা আর জিভে-গজার ফেরিওয়ালারা ঠুন ঠু বাজনা বাজিয়ে ছেলেদের আকর্ষণ করতো। কোনও দিন হয়তো এক ভাড়াটের ছোট বৈঠকখানার মধ্যে সন্ধ্যেবেলা গানের আসর বসে। তানপুরার একটানা শব্দের সঙ্গে বাঁয়া তবলায় কাহারবা তালের রেলা চলেছে। পিয়া আওয়াত নেহি’র সঙ্গে মিঠে তবলার তেহাই পাড়া মাত করে দেয়। কোনও কোনদিন ‘মিঞা কি মল্লারের সঙ্গে মিষ্টি হাতের মধ্যমানের ঠেকায় আকৃষ্ট হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে রসিক লোকেরা। জানালা দিয়ে উঁকি মারে। এককালের মালিকরাই আজ ঘটনাক্রমে অবস্থার ফেরে ভাড়াটে হয়ে পড়েছে। তবু বড়বাড়ির ভেতরে ঢুকতে কারো সাহস হয় না। ছোট ফ্রকপরা একটা মেয়ে হয়তো টপ করে এক দৌড়ে অক্র রের দোকান থেকে এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে আবার ঢুকে পড়ে কোঠরের মধ্যে। দোতলার ওপর থেকে হঠাৎ তরকারীর খোসা ঝুপ করে পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়ে হয়তো কোনও লোকের মাথায়। লোকটা ওপর দিকে বেকুবের মত চোখ তুলে চায়, কিন্তু কে কোথায়! এ-বাড়ির রান্নাঘর থেকে আসে কুচো চিংড়ি আর পেয়াজের ঠাট্টা আর হয়তো পাশের রান্নাঘর থেকেই আসছে মাংস গরম-মশলার বিজয়ঘোষণা। একটা দরজার সামনে এসে থামলো ট্যাক্সি মেয়েরা যাবে সিনেমায়। আবার হয়তো তখনই পাশের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা থার্ড ক্লাশ ঘঘাড়ার গাড়ি মেয়েরা যাবে হাসপাতালের প্রসূতি-সদনে। জন্ম-মৃত্য-সঙ্গমের লীলাবিলাস কবে ষাট-সত্তর-আশী-একশ’ বছর আগে এ-পাড়ার বাড়িগুলোতে প্রথম শুরু হয়েছিল আভিজাত্যের খরস্রোতে, আজ এই ক’টি বছরের মধ্যে তা যেন বইতে শুরু করেছে নিতান্ত মধ্যবিত্ত খাতে।

হোক মধ্যবিত্ত! না থাক সেই সেকালের জুড়ি, চৌঘুড়ি, ল্যাণ্ডো, ল্যাণ্ডোলেট, ফিটন আর ব্রুহাম। নাই বা রইল ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কি, তসর-কাপড়-পর ঝি, কিম্বা সোনালি-রূপালি কোমরবন্ধ পর দরোয়ান, সরকার, হরকরা, চোদার, হুকাবরদার, আর খানসামা। নাই বা চড়লাম চল্লিশ দাড়ের ময়ুরপঙ্খী। ছিল চিংড়ি মাছ, পেঁয়াজ, পুইশাক, মাথার ওপর একটা ছাদ আর সূতিকা-রুগী বউ। এবার তাও যে গেল। এবারে দাঁড়াব কোথায়?

নোটিশ দিয়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যথাসময়ে।

জোর আলোচনা চলে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকানে। “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল-এ”। গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজারে”র সামনে, প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডারে”র ভেতরে বাইরে। আর ‘সবুজ সঙ্ঘের আড্ডায়। আরো আলোচনা চলে ত্রিকালদর্শী শ্রীমৎ অনন্তহরি ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রমে”। জ্যোতিষার্ণব বলেন—আগামী মাসে কর্কট রাশিতে রাহুর প্রবেশ—বড় সমস্যার ব্যাপার—দেশের কপালে রাজ-রোষ— অনেক আলোচনা চলে বড়বাড়িতে। এর থেকে ভূমিকম্প ছিল ভালো। ছিল ভালো ১৭৩৮ সনের মতো আশ্বিনে ঝড়। যেবার চল্লিশ ফুট জল উঠেছিল গঙ্গাতে। তাও কি একবার! বড়বাড়িতে যারা বুড়ো, তারা জানে সে-সব দিনের কথা। তোমরা তখন জন্মাওনি ভাই। আর আমিই কি জন্মিয়েছি, না জন্মেছে আমার ঠাকুর্দা। এ কি আজকের দেশ? কত শতাব্দী আগেকার কথা। গঙ্গা তো তখন পদ্মায় গিয়ে মেশেনি। নদীয়া আর ত্রিবেণী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশতে। ওই যে দেখছো চেতলার পাশ দিয়ে এক ফালি সরু নদৰ্মা, ওইটেই ছিল যে আদিগঙ্গা, ওকেই বলতে লোকে বুড়িগঙ্গা। তারপর যেদিন কুশী এসে মিশলো গঙ্গার সঙ্গে, স্রোত গেল সরে। ভগীরথের সেই গঙ্গাকে তোমরা বলে হুগলী নদী আর আমরা বলি ভাগীরথী। তখন হুগলীর নামই বা কে শুনেছে, আর কলকাতার নামই বা শুনেছে কে! প্লিনি সাহেবের আমল থেকে লোকে তত শুধু সপ্তগ্রামের পাশের নদীকেই বলতে দেবী সুরেশ্বরী গঙ্গে! তারপর উত্থান আর পতনের অমোঘ নিয়মে যেদিন সাতগাঁ’র পতন হলো, উঠলো হুগলী, সেদিন পর্তুগীজদের কল্যাণে ভাগীরথী নাম হলো গিয়ে হুগলী নদী।

গল্প বলতে বলতে বুড়োরা হাঁপায়। বলে—পড়োনি হুতোম প্যাঁচার নক্সায়—

“আজব শহর কলকাতা
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারী ঐক্যতা,
যত বক-বিড়ালী ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা—”

চূড়ামণি চৌধুরী আলীপুরের উকীল। বলেন—আরে কিপলিং সাহেবই তো লিখে গিয়েছে—

Thus from the midday halt of Charnock
Grew a city……
Chance-directed chance-erected laid and
Built
On the silt
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side……

বড়বাড়ির নতুন মালিকরা সেই সব দিনের কাহিনী জানে না। গড়গড়ায় তামাক খেতে নাকি ওয়ারেন হেস্টিংস আমাদের মতন। বড় বড় লোকদের নেমন্তন্নর চিঠিতে লেখা থাকতো ‘মহাশয় অনুগ্রহ করে আপনার হুকাবরদারকে ছাড়া আর কোনও চাকর সঙ্গে আনবার প্রয়োজন নেই।‘ আর সেই জব চার্নক। বৈঠকখানার মস্ত বড় বটগাছটার নিচে বসে হুঁকো খেতে, আড্ডা জমাতো, এবং সন্ধ্যে হলেই চোর-ডাকাতের ভয়ে চলে যেতে বারাকপুরে। বিয়েই করে ফেললে এক বামুনের মেয়েকে। ডিহি কলকাতায়, গোবিন্দপুর আর সূতানুটীতে বাস করবার জন্যে নেমতন্ন করে বসলো সকলকে। একদিন এল পর্তুগীজরা। এখন তাদের দেখতে পাবে মুরগীহাটাতে। আধা-ইংরেজ, আধা-পর্তুগীজ। নাম দিয়েছিল ফিরিঙ্গী। ওরাই ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম যুগের কেরানী। তারাই শেষে হলো ইংরেজদের চাপরাশী, খানসামা আর ওদের মেয়েরা হলো মেমসাহেবদের আয়া। আর এল আরমানীরা। তাদের কেউ কেউ খোরাসান, কান্দাহার, আর কাবুল হয়ে দিল্লী এসেছিল। কেউ এসেছিল গুজরাট, সুরাট, বেনারস, বেহার হয়ে। তারপর চু চুড়াতে থাকলে কতকাল। শেষে এল কলকাতায়। ওদের সঙ্গে এল গ্রীক, এল ইহুদীরা, এল হিন্দু-মুসলমান—সবাই।

এমনি করে প্রতিষ্ঠা হলো কলকাতার। সে-সব ১৬৯০ সালের কথা।

পাঠান আর মোগল আমল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। লোকে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলে ইন্দ্রপ্রস্থ আর দিল্লী কোথায় তলিয়ে গিয়েছে। তার বদলে এখানে এই সুন্দরবনের জলো হাওয়ার মাটিতে গজিয়ে উঠেছে আর এক আরব্য উপন্যাস। ভেল্কি বাজি যেন। কলকাতার একটি কথায় রাজ্য ওঠে, রাজ্য পড়ে। জীবনে উন্নতি করতে গেলে এখানে আসতে হয়। রোগে ভুগতে গেলে এখানে আসতে হয়। পাপে ড়ুবতে গেলে এখানে আসতে হয়। মহারাজা হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। ভিখিরী হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। তাই এলেন রায় রায়ান রাজবল্লভ বাহাদুর সূতানুটীতে। মহারাজ নন্দকুমারের ছেলে রায় রায়ান রাজা গুরুদাস এলেন। এলেন দেওয়ান রামচরণ, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর দেওয়ান কান্তবাবু, এলেন হুইলারের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, এলেন কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র, উমিচাঁদ—আর এলেন বনমালী সরকার।

এই যার নামের রাস্তায় বসে তোমাদের গল্প বলছি—

চূড়ামণি চৌধুরীর মক্কেল হয় না। কালো কোটটার ওপর অনেক কালি পড়েছে। সময়ের আর বয়েসের। হাতে কালি লেগে গেলেই কালো কোটে মুছে ফেলেন। বাইরে থেকে বেমালুম। কোর্টে যান। আর পুরনো পূর্বপুরুষের পোকায় কাটা বইগুলো ঘাঁটেন। তোমরা তো মহা-আরামে আছো ভাই। খাচ্ছ, দাচ্ছ, সিনেমায় যাচ্ছ। সেকালে সাহস ছিল কারো মাথা উচু করে চৌরঙ্গীর রাস্তায় হাঁটবার? বুটের ঠোক্কর খেয়ে বেঁচে যদি যাও তো বাপের ভাগ্যি। সেকালে দেখেছি সাহেব যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হাত বেতের ছড়ি। দু’পাশের নেটিভদের মারতে মারতে চলেছে। যেন সব ছাগল, গরু, ভেড়া। আর গোরা দেখলে আমরা তো সাতাশ হাত দূরে পালিয়ে গিয়েছি। ওদের তো আর বিচার নেই। নেটিভরা আর মানুষ নয় তা বলে। রেলের থার্ড ক্লাশে পাইখানা ছিল না ভাই। নাগপুর থেকে আসানসোল এসেছি—পেট টিপে ধরে। কিছু খাইনি—জল পর্যন্ত নয়—পাছে…

তা হোক, তবু ইপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নোটিশ দিতে বাধা নেই। বড়বাড়ির ছোট ছোট মালিকরা নোটিশ নিয়ে সই দিলেন।

নোটিশের পেছন পেছন এল চেন, কম্পাস, শাবল, ছেনি, হাতুড়ি, কোদাল, গাঁইতি, ডিনামাইট—লোকলস্কর, কুলিকাবারি। আর এল ভূতনাথ। ওভারসিয়ার ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া। গ্রাম—ফতেপুর, পোস্ট আপিস—গাজনা।

দুপুরবেলা ধুলোর পাহাড় ওড়ে। টিনের চালাগুলো ভাঙতে সময় লাগবার কথা নয়। এদিকে ভুজাওয়ালাদের টিনের দোতলা বাড়িটা থেকে শুরু করে সবুজ সঙ্ঘের ঘরটা পর্যন্ত ভাঙা হয়ে গিয়েছে। শীতকাল। দল বেঁধে কুলির দল লম্বা দড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুর করে চিৎকার করে—

—সামাল জোয়ান—

—হেঁইও—

—সাবাস জোয়ান—

—হেঁইও—

–পুরী গরম—

—হেঁইও—

গরম পুরী ওরা খায় না কিন্তু। দুপুরবেলায় এক ঘণ্টা খাবার সময়। সেই সময় ছাতু কাঁচালঙ্কা আর ভেলী গুড় পেটের ভেতর পোরে। বউবাজার স্ত্রীটের ট্রামের ঘড় ঘড় শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে আসে—আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউতে তখন দুপুরের ক্লান্তি নেমেছে। মাঝখানে “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম”-এর অশথ গাছটার তলায় একটু গড়িয়ে নেয় ওরা। বনমালী সরকার লেন-এর সর্পিল গতি সরল হয়ে গিয়েছে। ভাঙা বাড়ির সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে বেহারী কুলিরা জানতেও পারে না—কোন্ শাবলের আঘাতে জীবনের কোন্ পর্দায় কোন্ সুর মূৰ্ছিত হয়ে উঠলো। এক একটা ইট নয় তো যেন এক একটা কঙ্কাল। ইতিহাসের এক একটা পাতা ভাঙা ইটের সঙ্গে গুড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়—আর তারপর উত্তরে হাওয়ায় আকাশে উঠে আকাশ লাল করে দেয়।

চূড়ামণি চৌধুরী কোর্ট ফেরৎ বাড়ি যেতে যেতে তখন ফিরে চেয়ে দেখেন। মনে হয় আকাশটা যেন লাল হয়ে গিয়েছে। আশে পাশে ট্রামে লোক বসে আছে—মুখে কিছু বলেন না। বাড়িতে এসে ইতিহাসটা খুলে কসেন। কোথায়, কবে সিরাজদ্দৌলা শহর পুড়িয়ে ছারখার করে দিলে। আবার দেখতে দেখতে নতুন করে গড়ে উঠলো কলকাতা। পোড়া কলকাতা যেন আবার আজ পুড়ছে—নতুন করে গড়ে ওঠবার জন্যে। ভালোই হলো। বহু বিষ জমে উঠেছিল ওখানে। খোলা হাওয়া ঢুকতে না ঘরগুলোতে। পুরুষানুক্রমে বড়বাড়ির অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে সরিকের সঙ্গে সরিকের আর পাশাপাশি বাস করা চলতো না। বড়কর্তাদের সে আমলের একটা রূপোর বাসন নিয়ে মামলা হয়ে গেল সেদিন। তবু আজকালকার ছেলেরা সে-সব দিন তো দেখে নি। চূড়ামণি চৌধুরীও তখন খুব ছোট। মেজ-কাকীমার পুতুলের বিয়েতে মুক্তোর গয়না এসেছিল ফ্রান্স থেকে। আর মেজকর্তার পায়রা নিয়ে মোকর্দমা লাগলে ঠঠনের দত্তদের সঙ্গে। সে কী মামলা। সে মামলা চললো তিন বছর ধরে। কজ্জনবাঈ সেকালের অত বড় বাঈজী। গান গাইতে এসেছিল দোলের দিন। ধর্মদাসবাবু ড়ুগি-তবলা বাজিয়েছিলেন। বড়দের দোলের উৎসবে ছোটদের ঢোকবার অধিকার ছিল না তখন। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলেন দপ্তরখানার ভেতর দরজার ফাঁক দিয়ে। সে কী নাচ। সেই কজ্জনবাঈ-ই এসেছিল আর একবার দশ বছর পরে। তখন সে চেহারা আর নেই। মেজ-কাকীর কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিয়ে গেল। অনেক বলা-কওয়াতে একটা গান গাইলে। সে গানটা সে দশ বছর আগে একবার গেয়েছিল।

বাজু বন্ধ্‌ খুলু খুলু যায়—

ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো বড় মিঠে লেগেছিল সেদিন। বুড়ীর গলায় যেন তখনও যাদু মেশানো। ঠুংরীতে ওস্তাদ ছিল কজ্জনবাঈ। আজকালকার ছেলেরা শোনে নি সে গান।

কোর্টে আসা-যাওয়ার পথে ট্রামের জানালা দিয়ে বাড়িখানা আর একবার দেখেন। এদিককার সব ভাঙা হয়ে গিয়েছে। বড়বাড়িটা এখনও ছোঁয়নি ওরা। এদিকটা শেষ করে ধরবে ওদিকটা।

চূড়ামণি চৌধুরীর মনে হয় যেন এখনও কিছু বাকি আছে। চোখ বুজলেই যেন দেখতে পান সব। পাল্কি এসে দাঁড়ালো দেউড়িতে। মেজ-কাকীমার পেয়ারের ঝি গিরি এসে দাঁড়িয়েছে তসরের থান পরে। সদর গেটে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে ব্রিজ সিং। হটো সব, হটো সব। পাল্কি বেরুচ্ছে। বড় ছোট সব যোগে মেজ-কাকীমার গঙ্গাস্নান চাই। তারপরেই মনে হয় ভালোই হয়েছে। সেই বড়বাড়িতে একটা চাকরও রইল না তোষাখানাতে। মধুসূদন ছিল বড়কর্তার খাস চাকর। চাকরদের সর্দার। সে-ও একদিন দেশে গেল পূজার সময়, আর ফিরলো না।

যখন চোখ খোলেন চূড়ামণি চৌধুরী, তখন ট্রাম হাতীবাগানের কাছ দিয়ে হু হু করে চলেছে। পাতলা হয়ে গিয়েছে ভিড়। কালো কোটের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে চুপ করে বসে থাকেন আর ভাবেন, বাড়িতে গিয়েই কটন সাহেবের হিস্ট্রিটা পড়তে হবে। আর বাস্‌টীডের বইটা। সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ম্যাডাম। গ্র্যাণ্ডের প্রণয়কাহিণী। কী রাজত্বই করেই গিয়েছে বেটার। সাত সমুদ্র থেকে জব চার্নক আর ছ’ জন সহকারী আর সঙ্গে মাত্র তিরিশ জন সৈন্য। আকবর বাদশা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি এত বড় সাম্রাজ্যের কথা।

বেহারী মজুররা পেতলের থালা ধুয়ে মুছে আবার ইট ভাঙতে শুরু করে। দুম-দাম করে পড়ে ইট। চুন-সুরকীর গুড়ো আকাশে উড়ে চলে। চোখ-মুখ ধুলোয় ধুলো হয়ে যায়। তবু ঠিকাদারের লোক হুঁশিয়ার নজর রাখে। কাজে কেউ ফাকি দেবে না। সায়েব কোম্পানী শহর বানিয়েছে, রাস্তা বানিয়েছে। বড় বড় তালাও কেটেছে। জলের কল বসিয়েছে। মাথায় বিজলী বাতি আর পাখা দিয়েছে। সব দিয়েছে সায়েব কোম্পানী। বনমালী সরকারের গলি ভেঙে দেশের কোনও ভালো করবে নিশ্চয়ই সায়েবরা।

—সেলাম হুজুর—বলে সরে দাঁড়ালো বৈজু।

—সেলাম হুজুর—গাইতি থামিয়ে দুখমোচনও সেলাম জানায়।

দু’পাশে পদে পদে সেলাম নিতে নিতে চলতে লাগলো ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। একবারে সোজা এসে দাঁড়ালো বড়বাড়ির সামনের সদর গেটে।

কুলির সর্দার চরিত্র মণ্ডল সামনে এসে নিচু হয়ে সেলাম করলে।

এতক্ষণে ভূতনাথও মাথা নোয়াল। বললে—দাগ শেষ করেছে। চরিত্র?

চরিত্র মণ্ডল মাথা নাড়লে—আজ বড় দাগ দিতে হবে হুজুর, কাল আরো চল্লিশজন কুলি লাগাচ্ছি, এদিকটা তত দিলাম শেষ করে, সন্ধ্যে নাগাদ সব সমান করে তবে কুলিরা ছুটি পাবে হুজুর।

ভূতনাথ চারিদিকটা চেয়ে দেখলে একবার। অনেকদিন আগেই সব বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছিল। এবার যেটুকু আছে, তা-ও নিঃশেষ করে দিতে হবে। কোথায় বুঝি কোন্ অভিশাপ কবে এ-বংশের রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছিল শনির মতো নিঃশব্দে, আজ তা নিশ্চিহ্ন হলো।

চরিত্র মণ্ডল আবার কথা বললে—কাল তা হলে ওই দাগটা ধরবো তো হুজুর?

একদিন এই বাড়ির আশ্রয়ে এসেই নিজকে ধন্য মনে করেছিল ভূতনাথ। সারা কলকাতায় সেদিন এই বাড়ি আর এই বাড়িরই আর একজন মানুষকে কেবল নিজের বলে মনে হয়েছিল। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!

চরিত্র মণ্ডল আবার বললে—কাল তা হলে কোথায় হাত লাগাবো হুজুর?

হঠাৎ ভূতনাথ বললে-না না, মদ টদ আমি খাইনে—-বলেই চমকে উঠছে। চরিত্র মণ্ডলও কম চমকায় নি। ওভারসিয়ার বাবুর দিকে হঠাৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখলে সে।

কিন্তু এক নিমেষে নিজেকে সামলে নিয়েছে ভূতনাথ। এরই মধ্যে কি তার ভীমরতি ধরলো নাকি। সামলে নিয়ে ভূতনাথ বললে—কী বলছিলে যেন চরিত্র?

—আজ্ঞে দাগের কথা বলছিলাম, বলছিলাম এদিকটা তো শেষ করে দিলাম, কাল কোত্থেকে শুরু করবো তাহলে হুজুর?

ঈশ্বরের কী অভিপ্রায় কে জানে! যদি সেই অভিপ্রায়ই, হয়, তো সে বড় নিষ্ঠুর কিন্তু। একদা নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থলকে নিজের হাতেই আবার একদিন তাঙবার আদেশ দিতে হবে, কে জানতে! একদিন এই বড়বাড়িতে প্রবেশ করবার অনুমতির অভাবে এইখানে এই রাস্তার ওপর হাঁ করে পাঁচ ছ’ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। ব্রিজ সিং ওইখানে লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতে সঙ্গীন উচু করা বন্দুক। আর বুকের ওপর মালার মতন বন্দুকের গুলীভরা বেল্ট। সেদিন এমন সাহস ছিল না যে, ওইখানে ব্রিজ সিং-এর সামনে দিয়ে ভেতরে যায় ভূতনাথ।

কোথায় সে গেট! কোথায়ই বা সে ব্রিজ সিং! ব্রিজ সিং ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচাতে—হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার—হো-

ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেট যখন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে রাস্তায় বেরুতোতখন সাড়া পড়ে যেতো এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। কড়ির মতো সাঈ জুড়ি ঘোড়া টগবগ্ করতে করতে গেট পেরিয়ে ছুটে আসতো রাস্তায়। আর রাস্তায় চলতে চলতে লোকেরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে ঘোড়া দুটোকে।

গাড়িটা যখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে, তখন ব্রিজ সিং আবার সেই আগেকার মতো কাঠের পুতুল সেজে সঙ্গীন খাড়া করে দাঁড়িয়ে থেমে থাকতো।

সে-সব অনেক দিনের কথা। তারপর কত শীত কত বসন্ত এল। কত পরিবর্তন হলো কলকাতার। কত ভাঙা কত গড়া। ভূতনাথের সব মনে পড়ে।

এখনও দাঁড়ালে যেন দেখা যাবে ব্ৰজরাখাল রোজকার মতন আপিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেই গলাবন্ধ আলপাকার কোট। সামনে ধুতির কোঁচাটা উল্টে পেট-কোমরে গোঁজা। মুখে গালের ভেতর পান গোঁজা। হাতে পানের বোঁটায় চুন। রোগা লম্বা শক্তসামর্থ্য মানুষটি।

ব্ৰজরাখাল বলতোনা না, এটা কাজ ভালো করোনি ভূতনাথ, আমরা হলাম গিয়ে গোলাম—ওদের গোলাম—আর বাবুরা হলো সায়েব-সায়েব বিবির সঙ্গে কি গোলামদের মেলে-কাজটা ভালো করোনি বড়কুটুম।

চরিত্র মণ্ডল সামনে এল আবার। বললে—তা হলে আজ আমরা আসি হুজুর।

তার মানে! ওভারসিয়ার ভূতনাথ চোখ ফিরিয়ে দেখলে চারদিকে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। শীতকালের বেলা দেখতে দেখতে যায়। বললে—তা হলে ওই কথাই রইল, এই দাগেই হাত দেবে কাল সক্কাল বেলা।

চরিত্র মণ্ডল সেলাম করে চলে গেল। সঙ্গে দু’চারজন যারা অবশিষ্ট ছিল সবাই সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিকে পা বাড়ালো। একটা কুকুর হঠাৎ কোথা থেকে ভূতনাথের পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়াতে লাগলো। ধুলোয় ধুলো সারা গা। সমস্ত দুপুর বোধহয় বসে বসে রোদ পুইয়েছে। এবার হয়তো ইটের স্কুপের মধ্যে আশ্রয় নেবে রাতটুকুর জন্যে। কেমন যেন মায়া হলো ভূতনাথের। যারা মালিক, যারা ভাড়াটে, তারা কবে নোটিশ পেয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। কিন্তু কুকুরটা বোধহয় কাস্তুভিটের মায়া ছাড়তে পারছে না। ও-পাড়ায় গিয়ে, ওই হিদারাম বড়য্যের গলিটা পর্যন্ত গেলেই চপকাটলেটের এটো টুকরো খেয়ে আসতে পারে। বউবাজারের পাটার দোকানের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালেও দু’চারটে টেংরি মেলে। তবে কীসের মায়া ওর? বাস্তুভিটের? কুকুর একটা, তার আবার বাস্তুভিটে, তার আবার মায়া!!

–দূর, দূর, দূর হ—ভূতনাথ কুকুরটার দিকে একটা লাথি ছুঁড়লে।

মেজকর্তার অত সখের পায়রা সব। তা-ই রইল না একটা। এক-একটা পায়রা ময়ুরের মতন পেখম তুলে আছে তো তুলেই আছে। হাতে করে ধরলেও পেখম উঁচু করে ছড়িয়ে থাকতো।

কী সব বাহার পায়রার। তাই বলে একটা রইল না।

—দূর, দূর, দূর হ–

ক্রমে অল্প অল্প অন্ধকার হয়ে এল। দূরে বউবাজারের ট্রাম লাইন-এর ঘড় ঘড় আওয়াজ আরো কর্কশ হয়ে আসে। রাস্তায় রাস্তায় আলো দেখা যায়। বনমালী সরকার লেন-এ আর আলো জ্বলবে না এবার থেকে। লোক চলবে না। ইতিহাস থেকে বনমালী সরকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।

বনমালী সরকারের সঙ্গে এই বড়বাড়ির ইতিহাসও তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই ভূতনাথ কেমন যেন অবশ হয়ে এল। তারপর একবার আশে পাশে ছেয়ে নিয়ে টুপ করে ঢুকে পড়লো সদর দরজা দিয়ে। কেউ কোথাও নেই, কে আর দেখতে আসছে তাকে। কিন্তু দেখতে পেলে হয়তো তাকে পাগলই ভাববে। ভূতনাথ পাশের ঘড়িঘরটার নিচে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে সোজা চলতে লাগলো।

মনে আছে তখন এই ঘড়িঘরের ঘণ্টার ওপর নির্ভর করেই সমস্ত বাড়িখানা চলতো।

সকাল ছ’টায় বাজতো একটা ঘণ্টা। ব্রজরাখাল উঠতো তারও আগে। তারই মধ্যে তখন তার মুখ ধোওয়া, প্রাতঃকৃত্য সমস্ত শেষ হয়েছে। পাথর বাটিতে ভিজোনো খানিকটা ছোল আর আদা-নুন নিয়ে কচ কচ করে চিবোচ্ছে।—ওঠো হে বড়কুটুম, ওঠো, ওঠো-ব্রজরাখাল ঘন ঘন তাগাদা দেয়।

আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে বসতে দু’চার মিনিট দেরিই লাগে ভূতনাথের। তখনও একতলার আস্তাবল থেকে ঘোড়া ডলাই-মলাই-এর শব্দ আসে। ছপছপছপ-ছ—হিস্‌স্‌-হিস্‌স্‌–ক্লপ-ক্লপ! ও-ধারে দরোয়ান ব্রিজ সিং আর নাথু সিং-এর ঘরে তখন হু হু করে ডনবৈঠকের আওয়াজ হচ্ছে। সিমেন্টের দাগরাজি করা সামনের উঠোনের ওপর দাসু জমাদারের খ্যাংরা ঝাটার খর-খর শব্দ আসছে। বোঝা যায় সকাল হলো। আর চোখ বুজে থাকা যায় না। ভূতনাথ দেউড়ি পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল।

বাঁদিকের এই ঘরটার ওপরে থাকতো ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের গালপাট্টা দাড়ির কথা এখনও মনে পড়ে ভূতনাথের। একটা কাঠের চিরুণী নিয়ে ছাদের নিচু বারান্দাটায় বসে ইয়াসিন সহিস ইব্রাহিমের লম্বা বাবড়ি চুল আঁচড়ে চলেছে তো আঁচড়েই চলেছে। কিছুতেই আর ইব্রাহিমের মনঃপুত হয় না। ইব্রাহিম কাঠের কেদারাটায় বসে এক মনে বাঁ হাতের কাঠের আশিতে মাথা কাত করে নিজের চুলের বাহারই দেখছে। কোনও দিকে হৃক্ষেপ নেই—তারপর হঠাৎ এক সময় ফট করে উঠে দাঁড়াতে। অর্থাৎ চুলটা বাগানো তার পছন্দ হয়েছে। এবার সে নিজের হাতে চিরুণী নিয়ে বাগাবে পাঠানী দাড়িটা।…এমনি করে চলতে সকাল সাতটা পর্যন্ত।

ভূতনাথ আরো এগিয়ে চললো পায়ে পায়ে ইতিহাসের সিংহদ্বার যেন আস্তে আস্তে খুলছে ওভারসিয়ার ভূতনাথের চোখের সামনে। সন্ধ্যে হয়ে এল। কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-একশ’–দেড়শ’ বছর পেছনে যেন ভূতনাথ চলে গিয়েছে। কালের নাটমঞ্চ যেন ক্রমশঃ ঘুরতে লাগলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদকুলী খাঁ’র কানুনগোর শেষ বংশধর বদরিকাবাবু যেন সামনের একতলার বৈষ্ঠকখানা-ঘরের শেতলপাটি ঢাকা নিচু তক্তপোশটার ওপর হঠাৎ উঠে বসেছেন।

সাধারণত সমস্ত দিন ওইভাবে ওই তক্তপোশটার ওপরই চিত হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে শুয়ে থাকেন বদরিকাবাবু। তাঁর ভয়ে ও-ঘর কেউ মাড়ায় না। তবু কাউকে দেখতে পেলেই হলো। ডাকেন। কাছে বসান। টাকে একটা ছোট্ট ঘড়ি। বলেন— বাড়ি কোথায় হে ছোকরা?

–বাপের নাম কী?

–গাঁ? কোন জেলা?

—বামুন কায়েত ক’ ঘর?

–বিঘে প্রতি ধান হয় কত?

—দুধ ক’ সের করে পাও?

এমনি অবান্তর অসংখ্য প্রশ্ন। ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়েন সবাইকে। গ্রীষ্মকালে খালি গা। একটা চাদর কাঁধে। আর শীতকালে একটা তুলোর জামা। প্রথমটা কেউ সন্দেহ করে না। সরল সাধাসিধে মানুষ। তারপর যখন শুরু করেন গল্প—সে-গল্প আর শেষ হতে চাইবে না। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে লর্ড ক্লাইভ হালসীবাগান, কাশিমবাজার আর…ফিলিপ ফ্রান্সিস, ওয়ারেন হেস্টিংস…নন্দকুমার—

সব শুনতে গেলে আর ধৈর্য থাকে না কারো। তারপর যখন রাত ন’টা বাজে, তোপ পড়ে কেল্লায়, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসেন বদরিকাবাবু। হাই তোলেন লম্বা একটা। তারপর দুটি আঙুলে তুড়ি দিয়ে একবার চিৎকার করে ওঠেন—ব্যোম্ কালী কলকাত্তাওয়ালী। তারপর টাকঘড়িটা বার করে মিলিয়ে নেন সময়টা।

বাঁ ধারে বদরিকাবাবুর বৈঠকখানাআর ডানদিকে খাজাঞ্চীখানা। খাজাঞ্চীখানা মানে বিধু সরকারের ঘর। সামনে একটা ঢালু কাঠের বাক্স নিয়ে বসে থাকে বিধু সরকার। চশমাটা ঝুলছে নাকের ওপর। মাদুরের ওপর উবু হয়ে বসে চাবি দিয়ে খোলন বাক্সটা। ভারি নিষ্ঠা বিধু সরকারের ওই ক্যাশবাক্সটি আর ওই চাবির গোছাটির ওপর। প্রতিদিন ঠনঠনে কালীবাড়ির ফুল আর তেল সিঁদুর আসে তার জন্যে। বিধু সরকার নিজের হাতে চাবির ফুটোটার তলায় ত্রিশূল এঁকে দেয় একটা। আর একটা ত্রিশূল আঁকে পশ্চিমের দেয়ালে আঁটা লোহার সিন্দুকটার চাবির ফুটোর নিচে।

সামনে বরফওয়ালা মেঝের ওপর ঠায় বসে আছে পাওনা টাকার তাগাদায়। সেদিকে বিধু সরকারের নজর দেবার কথা নয়।

ত্রিশূল আঁকার পর বিধু সরকার ক্যাশবাক্সটি খুলবে। খুলে ফুলটি রাখবে তলায়। তারপর বার করবে ছোট একটি ধুনুচি। বিধু সরকারের নিজস্ব ধুনুচি। একটি ছোট কোটো থেকে বেরুবে ধুনো, বেরুবে কাঠ কয়লা আর একটি দেশলাই। দেশলাইটি জ্বালিয়ে আগুন ধরাবে ধুনোয়। তারপর ঘন ঘন পাখার হাওয়া। করতে করতে যখন গল্ গল্ করে ধোঁয়া বেরুবে, ধোঁয়ায় চোখ নাক মুখ অন্ধকার হয়ে আসবে বিধু সরকারের, তখন সেই মজার কাণ্ডটি করে বসবে। আগুন সমেত ধুনুচিটি বাক্সর মধ্যে বসিয়ে বাক্সর ডালাটি ঝপাং করে বন্ধ করে দেবে। নিচু হয়ে বাক্সে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নমস্কার করবে বিধু সরকার। তারপর মাথা তুলে। বাক্স খুলে ধুনুচি বার করে আবার ডালা বন্ধ করবে। তখন কাজ আরম্ভ করার পালা। সামনের দিকে চেয়ে বলবে-এবার বলো তোমার কথা।

বিধু সরকারের মতো খাজাঞ্চীর কাজে এমন নিষ্ঠা ভূতনাথ আর কারও দেখেনি।

দু’পাশে দুটি ঘর, মধ্যেখান দিয়ে বারবাড়িতে ঢোকবার রাস্তা। রাস্তার ওপাশেই বারমহলের উঠোন। উঠোনের দক্ষিণমুখে পূজোর দালান। সেই পূজোর দালানটা এখনও যেন তেমনি আছে। আশে পাশের আর সবই গিয়েছে বদলে। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির টালিগুলো সবই প্রায় ভাঙা। বোধহয় এখনও পূজোট। চলছিল। ওটা বন্ধ হয়নি।

একবার নবমী পূজোর দিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। শোনা গল্প। এই বাড়িতে এখানেই ঘটেছিল।

পূজো টুজো সব শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রাসাদ বিতরণ হচ্ছে। রাঙাঠাকমা তসরের কাপড় পরে পুরুমশাই-এর জন্যে নৈবেদ্যর থালাগুলো সাজিয়ে গুণে গুণে তুলছে। ওধারে উঠোনে রান্নাবাড়িতে, গোলাবাড়িতে, আস্তাবলবাড়িতে যে-যেখানে ছিল সবাই ছুটে এসেছে। প্রসাদ পাবে। ভেতরে অন্দরমহলের জন্যে বারকোষ ভর্তি প্রসাদ গেল ঠিকে লোকদের মাথায় মাথায়।

ওদিকে ভিস্তিখান, তোশাখানা, বাবুর্চিখানা, নহবৎখানা, দপ্তরখানা, গাড়িখানা, কাছারিখানা সমস্ত জায়গায় যারা কাজের জন্যে আসতে পারেনি, আটকে গিয়েছে তাদের কাছেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

দরদালান, দেউড়ি, নাচঘর, স্কুলঘর, সব জায়গায় সবাই প্রসাদ খাচ্ছে। হঠাৎ এদিকে এক কাণ্ড হলো।

–খাবো না আমি–

–-কেন খাবিনে—

–পূজো হয়নি—

—সে কি–কে তুই—

–আমি হাবু—

–কোথাকার হাবু? কাদের হাবু? বাড়ি কোথায় তোর?

আশে পাশে ভিড় জমে গেল। সবাই জিজ্ঞেস করে—কী হলো? কে ও? কাদের ছেলে? কিন্তু চেহারা দেখেই তো চিনতে পারা উচিত। পাগলই বটে! পাগলা হাবু। বাপের জন্মে কেউ মনে করতে পারলে না যে দেখেছে ওকে কোথাও। আধময়লা কাপড়, খালি গা, এক পা ধুলো, চুল একমাথা। উদাস দৃষ্টি! খেলো না তো বয়ে গেল। সেধো না ওকে। কলাপাতা আসন পেতে রূপোর গেলাস দিয়ে আসুন বসুন করতে হবে নাকি! দাও তাড়িয়ে। হাঁকিয়ে দাও দূর করে।

মেজকর্তা খবর পেয়ে ছুটে এলেন। মেজকর্তা শুধু নামে–আসলে কিন্তু মেজকর্তাই মালিক। সারা গায়ে গরদের উড়নি, পরনে গরদের থান। কপালে চন্দনের ফোটা। ভারিক্কী মানুষ। নিখুত করে দাড়ি কামানো—শুধু তীক্ষ একজোড়া গোঁফ মুখের দু’পাশে সোজা ছুঁচলো হয়ে বেরিয়ে রয়েছে। গায়ে আতরের গন্ধ কিন্তু আতরের গন্ধকে ছাপিয়েও আর একটা তীব্র গন্ধ আসছে গা থেকে। যারা অভিজ্ঞ তারা জানে ওটা ভারি দামী গন্ধ। দামী আতরের গন্ধের চেয়েও আরো দামী। মেজকর্তাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়ালো। এসে বললেন—কই দেখি–

দেখবার মতো চেহারা নয় তার। ভয় নেই। ও নেই। মেজকর্তাকে দেখে নমস্কার করাও নেই। শুধু একদিকে আপন মনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

একবার জিজ্ঞেস করলেন-প্ৰসাদ খাবিনে কেন?

—আজ্ঞে পূজো হয় নি—

—পূজো হয়নি মানে—

–পিতিমের পাণ পিতিষ্ঠে হয়নি—

মেজকর্তা হাসলেন না। কিন্তু হাসলেন রূপলাল ভট্টাচার্য। পাশে তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পায়ে খড়ম। পরনে কোসার থান। গায়ে নামাবলী। মাথার লম্বা শিখায় গাঁদা ফুল। বললেন—পাগলের কথায় কান দেবার প্রয়োজন নেই বাবাজী-তুমি এসো।

কিন্তু মেজকর্তা সহজে ছাড়বার পাত্র নন। বললেন-না ঠাকুরমশাই, আমার বাড়িতে বসে অতিথি নবমীর দিন অভুক্ত থাকবে—এটা ঠিক নয়।

রূপলাল ঠাকুর কেমন যেন চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেনপ্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি তুই বুঝলি কিসে?

পাগলা হাবু বললে–মা তো নৈবিদ্যি খায়নি।

রূপলাল ঠাকুর এবার বিরক্ত হলেন।

আশে পাশের ভিড়ের মধ্যে যেন একটা কৌতুক সঞ্চার হয়েছে!

রূপলাল ঠাকুর এবার জিজ্ঞেস করলেন-প্রাণ প্রতিষ্ঠা তা হলে কীসে হবে?

—আমি পিতিষ্ঠে করবো!

–বামুনের ছেলে তুই?

—আজ্ঞে মায়ের কাছে আবার বামুন শুদ্দুর কী—মা যে জগদম্বা জগজ্জননী।

পাগলা হাবুর কথায় যেন সবাই এবার চমকে গেল। নেহাৎ বাজে কথা নয় তো। মেজকর্তা কেমন যেন মজা পাচ্ছেন মনে হলো। তিনি যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি মৌজে আছেন। আজ কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছেন।—তা কর তুই প্রাণ প্রতিষ্ঠা—বলছে যখন, তখন করুক ও।

রূপলাল ঠাকুর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বৃথা। মেজকর্তার ওপর কথা বলা চলে না।

ততক্ষণ খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বারমহল ঝেটিয়ে এসে জুটেছে পূজোর দালানে। কেউ বলে ছদ্মবেশী সাধু বটে। পাগলাটার সঙ্গে কথা বলবার লোভ হচ্ছে। রান্নাবাড়ি থেকে ঠাকুররা এসেছে রান্না ফেলে। শুধু মেজকর্তার ভয়ে কেউ বেশি এগোতে সাহস পায় না। দাসু মেথর আজ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। নিজে পরেছে চীনা-সিল্কের গলাবন্ধ কোট—আর বউ ছেলে-মেয়েদেরও গায়ে নতুন জামা-কাপড়-শাড়ি।

পাগলা হাবুকে নিয়ে যাওয়া হলে পূজোমণ্ডপে। পূজোর দালানের ভেতর।–কর প্রাণ প্রতিষ্ঠে-কর তুই।

—কলার বাশ্না দাও—

—কলার বাশ্না কী হবে—

—আগে দাওই না, দেখোই না, কী করি–

এল গাদা গাদা কলার বাশ্না দক্ষিণের বাগান থেকে। মেজকর্তার হুকুম। দেখাই যাক না মজা। পূজোর বাড়িতে মজা করতে আর মজা দেখতেই তো আসা। ভিড় করে সবাই দাঁড়ালো শ্বেত মার্বেল পাথরের সিঁড়ির ওপর। ঝুঁকে দেখছে সামনে পাগলা হাবুর দিকে।

পাগলা হাবু কিন্তু নির্বিকার। ধারালো কাটারি দিয়ে কলার বাশ্নাগুলো ছোট ছোট করে কাটলে। তারপর এক কাণ্ড! সেই এক-একটা বাশ্না নেয় আর কী মন্ত্র পড়ে, আর জোরে জোরে ছুঁড়ে মারে প্রতিমার গায়ে, মুখে, পায়ে, সর্বাঙ্গে।

রূপলাল ঠাকুর বাধা দিতে যাচ্ছিলো হাঁ হাঁ করে। কিন্তু মেজকর্তার দিকে চেয়ে আর সাহস হলো না। মেজকর্তা তখন এক দৃষ্টে পাগলা হাবুর দিকে চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন।

পাগলা ততক্ষণ মেরেই চলেছে। সে কী জোর তার গায়ে। হঠাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখলে দুর্গা প্রতিমার শরীর দিয়ে আঘাতের চোটে রক্ত ঝরছে। এক-একটা বাশ্না ছুঁড়ে মারে পাগলা, আর ঠাকুরের গায়ে গিয়ে সেটা লাগতেই রক্ত ঝরে পড়ে সেখান থেকে। সমস্ত লোক হতভম্ব।

শেষে এক সময় পাগলা থামলো। মেজকর্তার দিকে চেয়ে বললে—হয়েছে, এবার মায়ের পাণ পিতিষ্ঠে হয়েছে, এবার পেসাদ খাবো, দাও।

সে কী ভিড়। তবু সেই ভিড়ের মধ্যেই প্রসাদ আনতে পাঠানো হলো। দেখতে দেখতে খবর রটে গিয়েছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি, এ-পাড়া, সে-পাড়া। হাটখোলার দত্তবাড়ি, পোস্তার রাজবাড়ি, ঠনঠনের দত্তবাড়ি, শোভাবাজারের রাজবাড়ি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়ি, মল্লিকবাড়ি, সব জায়গা থেকে লোকের পর লোক আসতে লাগলো।

এদিকে ভেতরবাড়ি থেকে প্রসাদ আনানো হয়েছে। ভালো করে বসিয়ে প্ৰসাদ খাওয়ানো হবে, মেজকর্তার হুকুম।

কিন্তু পাগলা হাবু উধাও।

খোঁজ খোঁজ-কোথায় গেল। দশজন লোক দশদিক খুঁজতে গেল। কোথাও নেই সে। পাগলা হাবু সেই যে গেল আর কেউ দেখেনি তাকে কোনদিন।

তখনও লোকের পর লোক আসছে। সবাই দেখতে চায় পাগলা হাবুকে। প্রতিমার শরীরে তখনও রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত। সেই ভিড়, সেই লোকারণ্য চললে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত ধরে—

পুরনো বড়বাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথ অতীতের আবর্তে ড়ুবে গিয়েছিল যেন। হঠাৎ এক সময় বংশী এসে ডাকতেই ভূতনাথের চটকা ভাঙলো।

—শালাবাবু—

–আমাকে ডাকছিস বংশী–ভূতনাথ ফিরে তাকালো।

—ছোটমা আপনাকে একবার ডাকছে যে—

আজ আর সে-বয়েস নেই ভূতনাথের। এখন অনেক বয়েস হয়েছে। কিন্তু তবু এই নির্জন শ্মশানপুরীতে দাঁড়িয়ে সেদিনকার ছোটবৌঠানের ডাক যেন অমান্য করতে পারলো না সে। আজ সে-বাড়ি আর সে-রকস নেই। পার্টিশনের ওপর পার্টিশন হয়ে হয়ে অতীতের স্মৃতিসৌধের সিং-দরজা, প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। তবু ছোটবৌঠানের ডাক শুনে কেমন করে ভূতনাথই বা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

-তুই চল বংশী, আমি এখুনি আসছি—ভূতনাথ উঠলো। বারমহল পেরিয়ে অন্দর মহল। অন্দর মহলে ঢুকতেই যেন সেই গিরির সঙ্গে হঠাৎ মুখোমুখি দেখা। গিরি মেজগিন্নীর পান সাজতে এসেছে। পান নিতে এসে ঝগড়া বাধিয়েছে সদুর সঙ্গে। সদু হলো সৌদামিনী।

সৌদামিনীর গলা খুব। বলে—আ ভগমান, কপাল পুড়েছে বলেই তো পরের বাড়িতে গতর খাটাতে এইচি

—গতরের খোটা দিমনি সদু, তোর গতরে পোকা পড়বে— সেই পোকাশুদ্ধ গতর আবার নিমতলার ঘাটে মুদ্দোফরাসরা পুড়োবে একদিন, দেখিস তখন–

—হালা গিরি-গতরের খোটা আমি দিলুম না তুই দিলি—যারা গতরখাকী তারাই জন্ম জন্ম গতরের খোঁটা দিক—

—কী, এত বড় আস্পদ্দা—আমাকে গতরখাকী বলিস—বলচি গিয়ে মেজমা’র কাছে—বলে দুম দুম্ করে কাঠের সিঁড়ির ওপর উঠতে গিয়ে সামনে ভূতনাথকে দেখেই যেন থমকে দাঁড়ালো গিরি তারপর জিভ কেটে এক গলা ঘোমটা দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিলে।

সেই নির্জন সিঁড়ি। সেই নিরিবিলি অন্দর মহল। কোথায় গেল সেই যদুর মা। সিঁড়ির ওপাশে রান্নাবাড়ির লাগোয়া ছোট্ট ঘরখানাতে বসে কেবল বাটনা বেটেই চলেছে। হলুদ আর ধনে বাটনার জল গড়িয়ে পড়ছে রোয়াক বেয়ে নর্দমার ভেতর। কখন সূর্য ড়ুবতো, কখন উঠতো, কখন বসন্ত আসতো, শীত আসতে আবার চলেও যেতো, খোঁজও রাখতে না বুড়ী। যখন কাজ নেই, দুপুরবেলা, তখন হয়তো ডাল বাছতে বসেছে। সোনামুগের ডাল, খেসারি, মসুর, ছোলা-আরো কতরকমের ডাল সব। কখনও কথা ছিল না মুখে। শুধু জানতে কাজ। কাজের ফুটো দিয়ে কোন ফাঁকে কখন তার জীবনটুকু নিঃশেষ হয়ে ঝরে পড়ে গিয়েছে—কেউ খবর রাখেনি। সিঁড়ি দিয়ে ভূতনাথ উঠতে যাবে, হঠাৎ আবার পেছনে ডাক—

—শালাবাবু—ও শালাবাবু–

ভূতনাথ পেছন ফিরে তাকালো। শশী ডাকছে।—শিগগির আসুন–

-কেন?

—ছুটুকবাবু ডাকছে—গোঁসাইজী আসেনি—আসর আরম্ভ হচ্ছে না–

ছুটুকবাবুর আসরে তবলচী বুঝি অনুপস্থিত। ছুটুকবাবু বসবে তানপুরা নিয়ে। ওদিকে কান ধীরু ইমনের খেয়াল ধরেছে আর গোঁসাইজী তবলা। সমের মাথায় এসে সে কী হা-হা-হা-হ্যাঁ চিৎকার। ঘর বুঝি ফেটে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত চলবে আসর। এক-একদিন মাংস হবে। মুরগীর ঝোল আর পরটা। আর পর্দার আড়ালে এক-একবার এক-একজন উঠে যাবে আর মুখ মুছতে মুছতে ফিরে আসবে।

ছুটুকবাবুর মলমলের পাঞ্জাবি তখন ঘামে ভিজে গিয়েছে। কপালে দর দর করে ঘাম ঝরছে। গলার সরু সোনার চেনটা চি চিক্ করছে ইলেকটিক আলোয়। তালে তালে মাথা দুলবে ছুটুকবাবুর। বলবে কুছ পরোয়া নেই—শালাবাবু, তুমি এবার থেকে তবলার ভারটা নাওগোঁসাই-এর বড় গ্যাদা হয়েছে—শশী কাল গোঁসাই এলে তুই জুতো মেরে তাড়াবি-বুঝলি—এবার দেখাচ্ছি গোঁসাই-এর গ্যাদা।

কিন্তু ব্ৰজরাখালের কথাটা ভূতনাথের আবার মনে পড়ে ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম কেন ভূতনাথ, বাবুরা হলো সায়েবের জাত, আর আমরা হলুম ওদের গোলাম—গোলামদের সঙ্গে কি সায়েব-বিবির মেলে খুব সাবধান ভূতনাথ খুব..

ভূতনাথ শেষ পর্যন্ত বললে—ছুটুকবাবুকে গিয়ে বল শশী ছোটমা আমাকে ডেকেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো ভূতনাথ। দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা। ডানদিকে রেলিং ঘেরা। চক্-মিলানো মহল। চারদিকে ঘের রেলিং—রেলিং-এর ওপর ঝুকলে নিচে একতলার চৌবাচ্চা আর উঠোন দেখা যায়। রান্নাবাড়ি থেকে রান্না করে সেজখুড়ী একতলার রান্নার ভাঁড়ারে ভাত ডাল তরকারী এনে সাজিয়ে রাখে। এখানে দাঁড়ালে আরো দেখা যায় যদুর মা শিল নোড়া নিয়ে দিনের পর দিন হলুদ বেটেই চলেছে। আর তার পাশের জানালা দিয়ে দেখা যায় আনাজঘরের এক টুকরো মেঝে— সেইখানে হয়তো সৌদামিনী ঝি তারকেশ্বরের বিরাট একটা বঁটি পেতে আলু বেগুন কুমড়ো কুটছে। চারদিকে কাঁচা আনাজের পাহাড় আর তার মধ্যে সদু একলা বঁটি নিয়ে ব্যস্ত। কিম্বা হয়তো পান সাজছে—খিলি তৈরি করছে—কিম্বা বিকেল বেলা প্রদীপের সুলতে পাকাতে বসেছে—জানালার ওই ধারটিতে ছিল সদুর বসবার জায়গা। হাতে কাজ চলছে আর মুখও চলছে তার। কার সঙ্গে যে কথা বলছে কে জানে। যেন আপন মনেই বকে চলে—আ মরণ, চোক গেল তো তিভূবন গেল-ভোলার বাপ তাই বলতো– ফুলবউ, চোক কান থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও–তা সে ভোলার বাপও নেই, ভোলাও নেই—আমি মরতে পরের ভিটেয় পিদিম জ্বলছি—আর আমার সোয়ামীর ভিটে আজ অন্ধকার ঘুরঘুটি।

যদুর মা’র কানে যায় সব। কিন্তু সে কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। কিন্তু হঠাৎ গিরির কানে যেতেই বলে-কার সঙ্গে বক্ বক্ করছিস লা সদু—এবার হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সৌদামিনী।

ভূতনাথ রেলিং ধরে ধরে এগুতে লাগলো। ভাঙা রেলিং-এর ফাঁকগুলো যেন উপপাসী জন্তুর মতো হাঁ করে আছে। এর পর ডাইনে বেঁকে, বাঁদিকে ঘুরে-এ-গলি সে-গলি পার হয়ে উত্তরদিকে। তিনচারটে ধাপ উঠে পড়বে বউদের মহল। আকাশ-সমান উচু কাঠের ঝিলিমিলি দিয়ে ঢাকা। আর তার সামনে দক্ষিণমুখখা সার-সার বউদের ঘর। ছোটবৌঠানের ঘর একেবারে শেষে। ডানদিকে প্রথমেই বড় বউ-এর ঘর। তিনি বিধবা। কোথা থেকে যে এ-বাড়ির সব বউরা এসেছিল! মেম-সায়েবদের মতো গায়ের রং। ফরসা দুধে-আলতার ছোপ। বড় বউ-এর বয়েস হয়েছে, তবু চেহারায় বয়েস ধরবার উপায় নেই। পরনে সাদা ধবধবে থান।

ভূতনাথকে দেখে সিন্ধু সরে দাঁড়ালো। বড় বউ-এর ঝি সিন্ধু।

ভেতর থেকে গলার আওয়াজ এল—ওখানে কে রে সিন্ধু।

ভূতনাথ শুনতে পেলে সিন্ধু বলছে—মাস্টারবাবুর শালা।

তারপরেই মেজগিন্নীর ঘর। পর্দাটা ভোলা। ভূতনাথের নজরে পড়লো এক পলক। মেজগিন্নী মেঝের ওপর বসে তাকিয়া হেলান দিয়ে গিরির সঙ্গে বাঘ-বন্দী খেলছেন। চোখ সরিয়ে নিয়ে ভূতনাথ একেবারে শেষ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

পায়ের আওয়াজ পেতেই কে দরজা খুলে দিলে যেন। কত বছর আগের ঘটনা। তবু অতীতের মায়াঞ্জন যেন আজো চোখে লেগে আছে স্পষ্ট। ভূতনাথ যেন আজ স্মৃতির পাখীর পিঠে চড়ে বর্তমানের লোকালয় ছেড়ে অতীতের অরণ্যে ফিরে গিয়েছে।

ছোটবৌঠান দরজা খুলে ডাকলে—কে ভূতনাথ-আয়।

হঠাৎ দুটো হাত ধরে ফেলেছে পটেশ্বরী বৌঠান।একটা কাজ তোকে করতে হবে ভাই—বলে ছোটবৌঠান তার কালো কালো চোখ দুটো তুলে সোজা তাকালো ভূতনাথের মুখের ওপর।—সেইজন্যেই তোকে ডাকা।

–কী কাজ-বলো না–

—এই নে টাকা—বলে ভূতনাথের হাতের মুঠোর মধ্যে গুজে দিলো টাকাটা।

—কী আনবে এতে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—মদ—গলাটা নিচু করে ছোটবৌঠান বললে।

সত্যি চমকে উঠেছে ভূতনাথ। মদ? কানে ঠিক শুনেছে তো সে।

-হ্যাঁ মদ—

—এতো রাত্তিরে—

–হ্যাঁ যেখান থেকে পারিস যেমন করে পারিস—খুব ভালো মদ, খুব দামী। কিন্তু এততেও যেন স্বস্তি পেলে না ছোটবৌঠান। হঠাৎ কান থেকে হীরের কানফুলটা খুলে ভূতনাথের মুঠোর মধ্যে পুরে দিলে ছোটবৌঠান জোর করে। বললেও টাকাতে যদি না কুলোয় তো এটাও রেখে দে ভাই—

–এ কী করলে, এ কী করলে তুমি বৌঠান—চিৎকার করে উঠলে ভূতনাথ। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে গিরি, মেজগিন্নী, সিন্ধু আর বড় বউ। কী হলো? কী হলো রে ছোট বউ?

হঠাৎ যেন নিজের চিৎকারে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। ছোটবৌঠান নয়, ভূতনাথই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো যেন। বুড়ো বয়েসে এ কি করলে সে। কেউ তো কোথাও। নেই। সে তো আজ একলাই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা বাড়িটার মাথায়। সে তো ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওভারসিয়ার ভূতনাথ : ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া, গ্রাম—ফতেপুর, পোস্টাপিস—গাজনা। কোনও ভুল নেই। হীরের কানফুল আর টাকাটা আর একবার দেখবার জন্যে হাতের মুঠো খুলতেই ভূতনাথের নজরে পড়লোকই কিছু তো নেই, শুধু সাইকেলের চাবিটা রয়েছে মুঠোর মধ্যে। হঠাৎ কেমন যেন ভয় হতে লাগলো ভূতনাথের। এ অভিশপ্ত বাড়ি। ভালোই হয়েছে এর ধ্বংস হচ্ছে। এই এত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো তার। কেউ কোথাও নেই। বিষাক্ত বাড়ির আবহাওয়া ছেড়ে সে যতো শিল্পীর বেরিয়ে যেতে পারে ততই মঙ্গল। কালই চরিত্র মণ্ডল এখানে এসে গাঁইতি বসাবে। বনমালী সরকার লেন-এর স্মৃতির সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসও বিলুপ্ত হয়ে যাবে একেবারে। তাই যাক। তাই যাক। তাই ভালো।

অন্দরমহল, রান্নাবাড়ি, বারবাড়ি, বৈঠকখানা, দপ্তরখানা, দেউড়ি সব পেরিয়ে ভূতনাথ একেবারে সাইকেলটা নিয়ে উঠতে যাবে—এমন সময় কাপড় ধরে কে যেন টানলে—ভয়ার্ত একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। কিন্তু ভালো করে চেয়ে দেখতেই একটা লাথি ছুড়লো—দূর–দূর হবেরো—সেই কুকুরটা! অনেকদিন আগে আর এক দিন এমনি করে এ-বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় যে বাধা দিয়েছিল সে ছোটবৌঠান। আর আজ বাধা দিলে এই কুকুরটা।

সাইকেল চড়ে অন্ধকার বনমালী সরকার লেন দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথের মনে হলো অর সমস্ত অতীতটা যেন ওই কুকুরের মতো তাকে আজ কেবল পেছু টান দিতে চেষ্টা। করছে। ওই কুকুরটার মতোই তার অতীত কালো, বিকলাঙ্গ, মৃতপ্রায় আর অস্পষ্ট।

ভূতনাথের সাইকেলের চাকার ঘূর্ণায়িত তরঙ্গে ক্রমে ক্রমে উদ্বেলিত হতে লাগলো তার বিস্মৃত প্রায় কাহিনী-মুখর অতীত।

০১. কাহিনী

ফতেপুর গ্রাম থেকে তিন ক্রোশ পথ হেঁটে তবে মাজদিয়া ইস্টিশান। সেই ইস্টিশানে ট্রেন ধরে একদিন এসেছিল ভূতনাথ এই কলকাতায়।

শেয়ালদা ইস্টিশানের চেহারা, লোকজন, চিৎকার আর বাইরের দৃশ্য দেখে হা হয়ে গেল ভূতনাথ। কোথায় এসে পড়েছে সে। কুলিদের টানাটানি বাঁচিয়ে কোনওরকমে বাইরে এসে দাঁড়ালো। দুটো টাকা ছিল পকেটে–সে দুটো পুরে নিলো ট্যাঁকে। ব্ৰজরাখাল বলেছিল—খুব সাবধান, পকেটে টাকাকড়ি থাকলে সে আর দেখতে হবে না-কলকাতা শহর তোমার ফতেপুর নয় যে…

কলকাতা শহর যে ফতেপুর নয় তা ভূতনাথ জানতো। মল্লিকদের তারাপদ সেবার বারোয়ারি পার্টির যাত্রার নাটকের বই কিনতে এসেছিল কলকাতায়। ‘হরিশ্চন্দ্র’ পালার বই। তার কাছেই শোনা। বললে—ওই যে দেখছে মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছ—ওই টিপ-চালতে গাছের হাজার-ডবল উঁচু সব বাড়ি, বুঝলে কাকা—সেই উঁচু বাড়ির মাথায় দেখি না মেয়েমানুষরা দিব্যি আরামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে—

ভূষণ কাকার বয়স হয়েছে। প্রচুর টাকার মালিক। তবু কলকাতায় যায়নি কখনও। যাবার প্রয়োজনও হয়নি। কাকা বললে—মাথায় ঘোমটা-টোমটা কিছু নেই।

তারাপদ বললে–ঘোমটা দেবে কেন শুনি—কোন্ দুঃখে ভালো করে কি ছাই দেখতে পাচ্ছে কেউ তাদের—আমি রাস্তা থেকে দেখছি ঠিক যেন এই একটা য়্যাট্টুক কড়ে আঙুলের মতো–

ভূষণ কাকা বললো রে শুনেছি নাকি কলকাতায় আজকাল বিয়ে-অলা মেয়েরা সিঁদুর পরে না—ঘোমটা খুলে সোয়ামীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে হাওয়া খেতে যায়, শ্বশুর-ভাসুরের সামনে সোয়ামীর সঙ্গে কথা বলে—

মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা কাকা-তারাপদ মাথা নাড়তে লাগলো।—তা হতে পারে না—আমি যে নিজের চোখে সমস্ত দেখে এলাম কাকা—ধরে না কেন সকালবেলা নামলাম তো ট্রেন থেকে—আর সন্ধ্যেবেলা আবার ট্রেন ধরলামকলকাতার কিছু দেখতে তো আর বাকি রাখিনি কাকা-রানাঘাট থেকে পাউরুটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম—আর মাজদের রসগোল্লা-পেটটি পুরে তাই খেয়ে নিয়ে সব খুটে খুটে দেখলাম ঘোড়ার ট্রাম গাড়ি দেখলাম—কী জোরে যায় যে কাকা–সামনে আসতে দেখলে বুকটা দুর দুর করে ওঠে।

—কেন, বুক দুর দুর করে কেন?—জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ। জবাব দিয়েছিল ভূষণ কাকা। বলেছিল—তুই থাম তত ভূতে—বোকার মতো কথা বলিস নে–লোকে হাসবে।

ভূতনাথ সত্যি সত্যি আর কথা বলেনি। চুপ-চাপ শুনে গিয়েছিল।

তারাপদ বলেছিল-আমার একবার ইচ্ছে করে কাকা ভূতোকে দিই ছেড়ে গিয়ে কলকাতার রাস্তায়ও ঠিক হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলবে—দেখো–

ভূষণ কাকাও যেন বিজ্ঞের মতো জবাব দিয়েছিল—তা তো বটেই—এ কি আর ছিন্নাথপুরের গাজনের মেলা যে, রাত হয়ে গেলে ভাবনা নেই—কেষ্ট ময়রার দোকানের মাচায় দুটো চিড়ে মুড়কি চিবিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মল্লিকদের বাড়ির তারাপদর কথায় সেই ছোটবেলা থেকেই কলকাতার নাম শুনলে যেন রোমাঞ্চ হতো ভূতনাথের। একদিন মিত্তিরদের ঢিপ-চালতে গাছটার মগডালে গিয়েও উঠেছিল ভূতনাথ। এর হাজার-ডবল উঁচু। সে যে কতখানি—তা অনুমান করা শক্ত। তবু অনেক অনেক দূরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সে। সোজা পশ্চিমদিকে চাইলে শুধু দেখা যায় কেবল গাছ আর গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ। তারপর আকাশ। শুধু আকাশ আর আকাশ। আকাশময় চারিদিক। সন্ধ্যেবেলা বাদুড়গুলো ওদিক থেকে ফল-পাকড় খেতে একটার পর একটা উড়ে আসে। ওই শইরের দিক থেকে। মাজদে’ স্টেশনের চেয়েও অনেক দূরে—কত শহর—ফতেপুরের মতো কত গ্রাম পেরিয়ে তবে কলকাতা। সেখানে ঘোড়ার ট্রামগাড়ি চলে খুব জোরে-সামনে আসতে দেখলে বুক দুর দুর করে। (কেন করে তা বলা যায় না) মিত্তিরদের টিপু-চালতে গাছের হাজার-ডবল উচু সব বাড়ি। তার মাথায় লোক গুলো দেখায় এতটুকু কড়ে আঙুলের মতো।

এমতি ভাবতে ভাবতে গাছ থেকে একসময় নেমে পড়ে ভূতনাথ।

এর পর আর একদিনের ঘটনা। তখন অনেক বড় হয়েছে ভূতনাথ। ইস্কুলে এসে ভর্তি হলো গঞ্জের হাসপাতালের বড় ডাক্তারের ছেলে ননী। ভারি ফুটফুটে ছেলেটা। যেমন ফরসা, তেমনি কালো কালো চোখ, বড় বড় চুল। পরে অনেকবার ভূতনাথ ভেবেছে ননী যেন ছেলে নয়। অনেক ভাব হবার পরেও ননীর হাতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে কেমন যেন শিউরে উঠতে ভূতনাথ। ইস্কুল থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসার পথে ননীর কথাই সারা রাস্তাটা ভাবতো। এক-এক সময় মনে হতো, ননী তার বোন হলে বেশ হতো। তাহলে দুজনে এক বাড়িতে থাকতো, শুতে এক বিছানায়। অনেক ছুটির দিন ভূতনাথ হেঁটে হেঁটে একা চলে গিয়েছে ইস্কুলের কাছে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালের আশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। ননীকে যদি একবার এক ফাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। আবার লজ্জাও হতে। যদি ননী তাকে সত্যি সত্যিই দেখে ফেলে। যদি ননী জিজ্ঞেস করে-কী রে ভূতনাথ, তুই এখানে কেন—তখন কী জবাব দেবে সে।

ননীকে তো বলা যায় না যে তাকে দেখতেই তার আসা। ভুল করে নিজের একটা বই কতদিন নীর বই-এর মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে। তবু যদি সেই অছিলায় স্কুলের পরেও তারে সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ হয়। সেই ননী কতোদিনই বা ছিল তাদের স্কুলে। তবু কত গল্প হতো। কত জায়গায় তার বাবা বদলি হয়েছে। কত স্কুলের গল্প—কত ছেলের গল্প।

সেই ননী একদিন চলে গেল। চলে গেল চিরকালের স্বপ্নের দেশ–কলকাতায়। যাবার আগের দিন কেমন যেন মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথর। ননীর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় যাবে–
ননীর তাই আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু ভূতনাথ অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করেছিল-তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, না ননী।

—কেন? কষ্ট হবে কেন?

কলকাতায় যাওয়াতে কষ্ট হওয়ার যে কী আছে তা ননীর মাথায় আসেনি। কিন্তু ভূতনাথের মনে হয়েছিল তার নিজের যেমন কষ্ট হচ্ছে—ননীর তেমন হলেই যেন ভালো হতো। কেন যে ননীর মনে কষ্ট হওয়া উচিত—তা ভূতনাথ লজ্জায় ব্যাখ্যা করে আর বলতে পারেনি। ভূতনাথের সে-দুঃখ সেদিন বুঝতে পারেনি ননী। না পারবারই কথা। কত দেশ সে দেখেছে। কত বড় লোক তারা। কতো ভূতনাথ তার জীবনে আসবে যাবে। মনে আছে ননীরা কলকাতায় চলে যাবার দিন খাটরোর বিলের ধারে শাড়া গাছটার তলায় বসে হাউহাউ করে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল সে।

কিন্তু একদিন ননীর চিঠি এল। খাস কলকাতা থেকে। জীবনে সেই তার প্রথম চিঠি পাওয়া। সেদিন সে-চিঠি পড়ে যে-আনন্দ ভূতনাথ পেয়েছিল—তা আর কোনদিন কোনও চিঠি পড়ে পায়নি। চিঠিখানা সে কতবার পড়েছে। বালিশের তলায় রেখে ঘুমিয়েছে দিনের পর দিন। চিঠিখানা জামার তলায় বুকের ওপর রেখেছে। যেন ননীর হাতটার স্পর্শ আছে ওই একটুকরো কাগজে। অথচ কী-ই বা লিখেছে ননী। বলতে গেলে কিছুই নয়। ননী লিখেছিল—

‘প্রিয় ভূতনাথ,

আমরা গত শনিবার দিন এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। কলিকাতা বেশ বড় দেশ—কী যে চমৎকার দেশ বলিতে পারিব না। এখানে আসিয়া অবধি বাবার সঙ্গে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। বড় বড় বাড়ি আর বড় বড় রাস্তা। খুব আনন্দ করিতেছি, তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি কেমন আছো জানাইও। উপরের ঠিকানায় চিঠি দিও–

সেই চিঠির উত্তর দিতেই ভূতনাথের দশখানা খাতার কাগজ নষ্ট হয়ে গেল। তবু সেদিন ননীর চিঠির উত্তর আর কিছুতেই পছন্দ হয়নি তার। কত কথা ভূতনাথ লেখে—আবার কেটে দেয়। বড় লজ্জা করে। কলকাতা থেকে ননীর চিঠি আসাটাই সেদিন মনে হয়েছিল জীবনের চরম স্মরণীয় ঘটনা। সেই ননীর চিঠির উত্তর পাঠাতে হবে কলকাতায়! এ যেমন বিস্ময়কর তেমনই অবিশ্বাস্য যে। শেষ পর্যন্ত চিঠি ভূতনাথ কোনওরকমে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার উত্তর আসেনি আর এ-জীবনে। সেদিনকার মতো ননী হারিয়েই গিয়েছিল ভূতনাথের জীবন থেকে একেবারে। কিন্তু কলকাতার স্বপ্ন ভূতনাথের মন থেকে কোনোদিন মুছতে পারেনি কেউ!

এর পর আর এক ঘটনা ঘটলো। ভূতনাথের বয়েস তখন বারো কি তেরো আর রাধার এগারো। রাধার বিয়ে হবে। রাধাকে দেখতে এল কলকাতা থেকে। সে যে কী রোমাঞ্চ! রাধার রোমাঞ্চ হলো কিনা ভূতনাথ জানতে পারেনি সেদিন। কিন্তু যদি হয়েই থাকে তত তার হাজারগুণ হয়েছিল ভূতনাথের। রাধা! সেই রাধা! তার শ্বশুরবাড়ি হবে কলাকতায়। কী যে হিংসে হয়েছিল ভূতনাথের মনে। রাগও হয়েছিল খুব। রাগে রাধার সঙ্গে ভূতনাথ ক’দিন দেখাও করেনি, কথাও বলেনি।

কোঁচানো চাদর আর বার্নিশ করা পম্পসু পায়ে কয়েকজন ভদ্রলোক একদিন এল ফতেপুরে। একটা রাত থাকলোও। খেলও খুব। নন্দ জ্যাঠা গাছের ডাব, পুকুরের মাছ, গাওয়া ঘি, ছিন্নাথপুরের কেষ্ট ময়রার কাঁচাগোল্লা আর কাটারিভোগ চালের ভাত খাওয়ালেন।

রাধাকে পছন্দও করে গেল তারা। মাজদিয়া ইস্টিশন থেকে পাল্কি চড়ে একদিন ব্ৰজরাখাল এল বর হয়ে। ব্ৰজরাখাল কলকাতা থেকে বিয়ে করতে এসেছে। বর দেখে রাধার পছন্দ হলো কিনা কে জানে কিন্তু ভূতনাথের হলো না। বরের গোঁফ নেই এ কী রকম বর! ফতেপুরে যত বর এসেছেসব বরের গোঁফ ছিল। রাধার সই হরিদাসীর বরেরও গোঁফ ছিল আর ভূষণ কাকার মেয়ে জ্ঞানদার বর এখনও আসে— তারও গোঁফ। কিন্তু সেদিন সেই অল্প বয়সে ভূতনাথের মনে হয়েছিল রাধার বরের গোঁফ থাকলেই যেন মানাতো। এখন অবশ্য ভাবলেই হাসি পায়। যা হোক, সেদিন ব্ৰজরাখালের গোঁফ না থাকায় যে ক্ষোভ হয়েছিল ভূতনাথের, অপুষিয়ে গিয়েছিল রাধার কলকাতার শ্বশুরবাড়ি হওয়ার সৌভাগ্যে।

বাসরে অনেক রাত পর্যন্ত ভূতনাথ বসেছিল বরের পাশে। কত লোক কতরকম প্রশ্ন করছে—একে একে সব উত্তর দিচ্ছে ব্ৰজরাখাল। রাঙাকাকী ভূতনাথকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল

—একে দেখছো তো—এ তোমার বড় সম্বন্ধী–সম্পর্কে গুরুজন

মল্লিকদের আন্না বলেছিল—ত গুরুজন যদি, এখেনে আমাদের সঙ্গে বসে কেন বাপু-বাইরে যাও না তুমি ভূতেদাদা।

সবাই হেসে উঠেছিল।

লজ্জায় ভূতনাথও আর বেশিক্ষণ বসতে পারেনি সেখানে। আস্তে আস্তে এক ফাঁকে উঠে চলে আসতে হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল— ব্ৰজরাখালের সঙ্গে আলাপ করে, কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করে কলকাতার বড় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীকে চেনে কিনা জেনে নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি কত কথা মনের ভেতরে গুঞ্জন করছিল, কিন্তু কিছুই হলো না। পরের দিন যতক্ষণ ব্ৰজরাখাল ছিল বাড়িতে, তার সামনে যেতেও লজ্জা হলো তার।

সকালবেলা, মনে আছে, কুয়োতলার পাশে আতাগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভূতনাথ শুনতে পেলে রাধা জ্যাঠাইমাকে বলছে

—মা, ভূতেদাদা বলছিল ও আমার সঙ্গে যাবে।

–কোথায়?—অবাক হয়ে গিয়েছে জ্যাঠাইমা।

-আমার সঙ্গে।

—তোর শ্বশুরবাড়িতে? কেন?

—তা জানিনে-ভূতোদাদা বলছিল।

—পাগল—বলে হেসে উঠেছিল জ্যাঠাইমা। ছি ছি—কী ভাবলো জ্যাঠাইমা। রাধা যে সে-কথা জ্যাঠাইমাকে বলবে কে জানতো। কী বোকা মেয়ে।

কিন্তু পরে শুনতে পেলে ভূতনাথ। রাধার শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় নয়। কলকাতা থেকে অনেক দূরে গ্রামের মধ্যে। কামারপুকুরে। কোথায় কামারপুকুর কে জানে। রাধা সেইখানে থাকে। আর ব্রজরাখাল কলকাতার আপিসে চাকরি করে। শনিবার-শনিবার শুধু বাড়ি যায়।

রাধা যখন প্রথম বাপের বাড়ি এল—সে-রাধাকে আর যেন চেনাই যায় না।

রাধা হেসে উঠলো হো হো করে-ওমা, ভূতোদাদা আমার দিকে কেমন হাঁ করে চাইছে দেখো–

ভূতনাথ কিন্তু অন্য জিনিস দেখছিল। রাধা এই ক’দিনে এতো মোটা-সোটা হলে কী করে! আরো ফরসা হয়েছে যেন। ভালো ভালো জামা-কাপড় পরেছে। আরো গয়না হয়েছে।

রাধা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল-না বাপু, তুমি আমার পানে অমন করে চেয়ে না ভূতোদাদা-ভয় করে আমার

ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছিল—কেন, ভয় কিসের–

—বারে নজর লাগে না বুঝি, আমার নতুন বিয়ে হয়েছে— নজর লাগা বুঝি ভালো

-আহা। তাই নাকি আবার লাগে।

—আর আমি যদি নজর দেই—তোমার কেমন লাগে শুনি

—দে না, যতো পারিস নজর দে—কিসে নজর দিবি দে—বলে ভূতনাথ রাধার দিকে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

রাধা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলে। ভূতনাথের নজর দেবার মতো কিছু আছে কিনা হয় তো তাই দেখলে। তারপর বললে—এখন তো দেবে না, তোমার বউ আসুক তখন দেবো

সে অবকাশ রাধা পায়নি। পরের বার রাধা এল।

ভূতনাথ চেহারা দেখে অবাক—এ তোর কী চেহারা হয়েছে। রে রাধা

রাধা বললে—তোমারও তো চেহারা খারাপ দেখছি ভূতোদাদা

—আমার হোক—কিন্তু তোর কেন হবে—

রাধা এবার যেন একটু গম্ভীর-গম্ভীর। কিছু কথা বললে না। মাথা নিচু করে রইলো।

ভূতনাথ বললে—সেবার আমি নজর দিয়েছিলাম বলে, নারে–

—দূর, তা কেন—বলে রাধা চুপ করলো। আর কিছু বললে। শেষে মল্লিকদের আন্নার কাছে শুনতে পেলে ভূতনাথ। আন্না বললে-জানো ভূতেদা—রাধাদি’র ছেলে হবে–

সেদিন খবরটা শুনে ভূতনাথ যে কেন অমন চমকে উঠেছিল কে জানে। কিন্তু চমকানো শেষ হলো ভূতনাথের, যেদিন পেটে ছেলে নিয়ে রাধা মারা গেল। কেমন করে যে কী হলো সব আজ মনে নেই। তবু মনে আছে, খবর পেয়ে ব্রজরাখাল এসেছিল শেষ দেখা দেখতে। গম্ভীর মানুষ ব্ৰজরাখাল। বেশি কঁদেনি। রাধার গায়ের গয়না-টয়নাও কিছু নিলে না। নন্দজ্যাঠার একমাত্র মেয়ে। তার শোকটাও সমান গভীর। তবু বারবার পীড়াপীড়ি করলে।

ব্ৰজরাখাল বললে—মানুষটাই যখন চলে গেল—তখন আর মিছিমিছি ওসব…।

নন্দজ্যাঠা কিন্তু এদিকে শক্ত মানুষ। বললে—তুমি আবার বিয়ে করো বাবা—আমি বলছি

সেইবারই ব্রজরাখালের সঙ্গে প্রথম যা হোক দু একটা কথা বললে ভূতনাথ।

ব্ৰজরাখাল বললে-কলকাতা? তা আমি তো কলকাতাতেই থাকি আমার বাসায়—দেখাবো তোমায় কলকাতা। সে আর বেশি কথা কি—কলকাতা দেখতে তোমার এতো সাধ?

ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে ভূতনাথ। ঠিক হলো—ভূতনাথ চিঠি লিখলেই সব ব্যবস্থা করবে ব্রজরাখাল। তারপর যতোদিন ইচ্ছে তার বাসায় থাকো আর দেখে বেড়াও কলকাতা শহর!

ব্ৰজরাখাল পরদিনই চলে গিয়েছিল কলকাতায়। আর আসেনি।

তারপরেই এল ভূতনাথের পরীক্ষা। মহকুমা থেকে একদিন এন্টান্স পরীক্ষাও দিয়ে এল। কোথা দিয়ে দিন আর রাত কাটতে লাগলো কে জানে। আর তারপরেই বিধবা পিসী পড়লে অসুখে। পিসী ছিল মা’র মতন। ভারি কঠিন অসুখ। কয়েক মাস চললো পিসীকে নিয়ে।

পিসী প্রায়ই বলতো—ভূতত মানুষ হবার পর যেন মরি—এই কামনা করে মা তোমরা

লোকে বলত—তুমি নিজের পরকাল তিথি-ধম্মো নিয়ে থাকো কেন—ছেলে হয়ে জন্মেছে, যেমন করে হোক ওর উপায় ও করে নেবেই—

পিসী বলতো—পেটেই ধরিনি-নইলে বাপ-মা কী জিনিস ও জানে না তো—আমি চোখ বুজলে ওকে দেখবার কেউ নেই যে

পাড়ার বউদের সঙ্গে গল্প করতে পিসী আর ভূতনাথ শুনতে পাশে বসে-বউ-এর ছেলে হয় আর মরে যায়—শেষে বামুনগাছির পঞ্চানন্দের থানে মানত করলাম আমি—সেই পঞ্চানন্দের দোর ধরেই তো হলো এই ছেলে। ওর বাপ সতীশ বললে—নাম রাখো ‘অতুল’-আমি বললাম-শিবের দোর ধরে যখন বেঁচেছেনাম থাক ভূতনাথ। তা ভূতনাথ তো ভূতনাথই আমার-আমার ভোলানাথ-বই পড়ছে তো পড়ছেই—ঘুমুচ্ছে তত ঘুমুচ্ছেই— খেতে ভুলে যায় এমন ছেলে কখনো দেখেছো মা তোমরা-ওকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো মা।

সেই পিসীমাও একদিন মারা গেল।

পিসীমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে বিধবার নামে পাঁচ টাকা করে মাসোহারা আসতো—তা গেল বন্ধ হয়ে। তখন আর করবার কিছু নেই। ভূতনাথ বারোয়ারিতলায় গিয়ে আড্ডা জমালো। আডও বলতে পারে, আবার যাত্রার মহড়াও বলতে পারো।

‘নল-দময়ন্তী’ পালায় একবার ভূতনাথ প্রতিহারীর পার্ট করলে যাত্রার আসরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু বড় ভয় করতে লাগলো তার। কাঁপতে লাগলো পা দুটো। কেমন গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগলো। গ্লাশ-গ্লাশ জল খেলে খুব।

ভূষণ কাকা বললেও তারাপদ, ভূতোকে কেন পার্ট দিলে শুধু-শুধু—কোনও কম্মের নয়—লেখাপড়া শিখলে কী হবে–মাথায় যে গোবর পোরা।

কিন্তু ভূতোর তবলা শুনে সবাই অবাক। রসিক মাস্টার বললে—ড়ুগিতবলায় খাসা হাত তত ছোকরার—

দিনকতক তবলা নিয়েই পড়লো ভূতনাথ। বহুদূর থেকে শোনা যায় ভূতনাথের তবলার চাটি। অন্ধকার রাত্রে ঘরে বসে বসে সাধনা করে ভূতনাথ। বোল মুখস্ত করে—তা গে না ধিন, না গে ধিন-আবার কখনো–

তা ধিন
তা তা ধিন
ধিন ত্রে কেটে ত্রে কেটে তাক্‌—
ধিন…

কিন্তু তবলাও ঠিক শান্তি দিতে পারলে না ভূতনাথকে। পিসীমা’র মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন হঠাৎ তার জীবনের একটা পরিচ্ছেদের একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। মনে হলো একান্ত নিরাশ্রয় সে। আজ এর বাড়ি, কাল ওর বাড়ি—এমনি করে পরের অন্নদাস হওয়ার অগৌরব যেন তার ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসলো সেদিন প্রথম আর প্রখর হয়ে। ভূতনাথ একদিন বাঁয়া তবলা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে এল বারোয়ারিতলায়। আর ও-মুখো হলো না।

খুব ছোটবেলায় ভূতনাথ একটা বেজি পুষেছিল। বুনো বেজি। বেশ পোষ মেনেছিল। কিন্তু সংসারে যারা পোষ মানে তারাই বুঝি কষ্ট পায় বেশি। ভূতনাথেরই অত্যাচারে মারা গেল একদিন বেজিটা। সেই বেজির মৃত্যু প্রথম আর শেষ পিসীমা। দুই প্রান্তের দুই চরম শোকের মধ্যে ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীর বিচ্ছেদ আর রাধার মৃত্যু—সমস্ত মিলিয়ে ভালোমানুষ ভূতনাথ কেমন যেন মনে মনে স্তিমিত হয়ে এল।

এমন সময় এল ব্রজরাখালের চিঠি। রাধার স্বামী ব্রজরাখাল। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথের চিঠি পেয়েছে অনেক পরে। এজরাখাল যে-ঠিকানা দিয়েছিল ভূতনাথকে, সে-ঠিকানা বদলে গিয়েছে। তাই চিঠি পেতে অত দেরি।

পরীক্ষায় পাশ করেছে জেনে ব্রজরাখাল খুশি হয়েছে। লিখেছে —চাকরি চেষ্টা করলে হতে পারে। কিন্তু এখনি কিছু বলা যায় না। তবে কলকাতায় কিছুদিন থাকতে হবে—ঘোরাঘুরি করতে হবে। শেষে লিখেছে—চলিয়া আইস—যেমন যেমন নির্দেশ দিলাম ওইভাবে আসিবে। বাসস্থান ও আহারের বন্দোবস্ত আমি করিব। এ কলিকাতা শহর—ট্রেনে ও রাস্তায় খুব সাবধানে আসিবে। জুয়াচোরেরা নতুন মানুষ জানিলে…ইত্যাদি ইত্যাদি।

পিসীমা’র পেতলের ঘটিটা আর রূপোর গোট ছড়াটা হর গয়লানীর কাছে বন্ধক রেখে বাড়ির দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে ভূতনাথ রাত থাকতে বেরিয়ে পড়েছে পায়ে হেঁটে। তারপর সকালবেলা এই কলকাতা। রেলের টিকিট কিনে, বাকি দুটো টাকা রয়েছে। টাকা দুটো সাবধানে টাকে পুরে নিয়ে ভূতনাথ শেয়ালদা’ স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালো।

০২. ১৬৯০ সালের জব চার্নকের কলকাতা

১৬৯০ সালের জব চার্নকের কলকাতা নয়। বিংশ শতাব্দীর ও শুরু হয়নি তখন। চৌধুরীদের লাইব্রেরী ঘরে সে-কলকাতার ছবি দেখেছে ভূতনাথ। করফিল্ড সাহেবের ছবির বইতে চৌরঙ্গীর সেই ছবি। ১৭৮৭ সালের চৌরঙ্গী। এর্দোপড় পুকুর চারদিকে। ছই ঢাকা গরুর গাড়ি চলেছে চৌরঙ্গী দিয়ে। লোক চলেছে উটের পিঠে চড়ে। তারই পাশাপাশি আবার সঙ্গীন উঁচু করে সৈন্যরা প্যারেড করতে করতে যাচ্ছে। এখন ভাবলে হাসি পায়।

অথচ যে-দিন ভূতনাথ শেয়ালদা স্টেশনে এসে প্রথম ট্রেন থেকে নেমেছিল—সে-শেয়ালদা’র সঙ্গে আজকের শেয়ালদা’রও কোনো মিল নেই। মনে আছে—ভূতনাথ স্টেশন থেকে বাইরে এসে বৈঠকখানা বাজারের সামনের ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে লাগলো কোথায় কোন দিকে যাওয়া যায়। ব্ৰজরাখাল বলে দিয়েছিল-সোজা পশ্চিম দিকে যেতে। পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়েই চলতে লাগলো ভূতনাথ।

কিন্তু ঠিক পথেই চলেছে কিনা কে জানে। এতে লোক একসঙ্গে কখনও দেখেনি সে। ঘোড়ার গাড়ির কী বাহার। ঘোড়াগুলোর মাথার দু পাশে কানের দিকে ছোট ছোট ঝালর লাগানো। কারো কারো গলায় ঠুংঠুঙি বাজছে তালে তালে। হৈ হৈ করতে করতে ছুটেছে। একটা গাড়ি যেমন-ইচ্ছে একবার রাস্তার ডাইনে, একবার বাঁয়ে হাঁকিয়ে চলেছে। সামনে কে একজন পড়েছিল—চাবুক দিয়ে বেদম মেরে পলকের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।

বুক কাঁপতে লাগলো ভূতনাথের। তাকেও যদি মারে কেউ। সরে এসে দাঁড়ালো রাস্তার ধারে গা ঘেঁষে।

দুটো ঘোড়ার গাড়ি টেক্কা দিতে দিতে চলেছে। ঘোড়ার লাগাম ধরে গাড়োয়ান দুটো চিৎকার করছে-উ-উ-উ-উ-

এক-একবার মনে হয় বুঝি ধাক্কা লাগলে ট্রামগাড়ির সঙ্গে। কিন্তু লাগলো না। উ-উ-উ-উ-করতে করতে গাড়োয়ান দুটো দাঁড়িয়ে উঠে চালাচ্ছে গাড়ি। কে আগে যাবে—

একদৃষ্টে ওই দিকে চেয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়লো ভূতনাথ। যতো রাজ্যের জঞ্জালের পাহাড় জমে ছিল রাস্তার ওপর। একগাদা ময়লার ওপর পড়ে আবার উঠে দাঁড়ালো। সবাই দেখছে তার দিকে। ভূতনাথ মাথা নিচু করলো। সবাই হয় তত ভাবছে—নতুন কলকাতায় এসেছে। ভারি লজ্জা হলো। সকলের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে পাশের এক গলির মধ্যে ঢুকলো সে। একটা খাবারের দোকানের সামনে গরম-গরম জিলিপী ভাজছে একটা লোক। ভূতনাথ খানিকক্ষণ দেখলে চেয়ে চেয়ে।

দোকানদার বললে—কী দেখছো গা ছেলে–?

ভূতনাথ লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে। আদুড় গা। বড় উনুনের ওপর বিরাট একটা কড়া চাপিয়েছে। নারকোল মালার তলা দিয়ে মশলা ছাড়ছে হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একিয়ে বেঁকিয়ে, আর হলদে-হলদে জিলিপীগুলো ভেসে উঠছে গরম ঘিয়ের ওপর। লোকটা আবার বললে–হাঁ করে কী দেখছে। গা ছেলে

—জিলিপী ভাজা দেখছি তোমার—বললে ভূতনাথ।

—দেখো না অমন করে জিলিপীর দিকে—যারা খাবে তাদের পেট কামড়াবে যে—সরে যাও ভাই-পয়সা আছে পকেটে?

–পয়সায় ক’টা করে—জিজ্ঞেস করলে ভূতনাথ। ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। খেলে হয়। এক পয়সার নিলে। চারটে করে পয়সায়। তা হোক—এ তো আর ফতেপুর নয়। কলকাতা মাগগি-গণ্ডার দেশ। বললে— আর এক পয়সার দাও তো।

খেতে খেতে ভাব হলো। ফতেপুরের পাশের গ্রাম মামারাকপুরে ভগ্নির শ্বশুর বাড়ি। লোকটা আসলে ভালো। ময়রার ছেলে। জাত-ব্যবসা ধরেছে। বললে—আমিও ভাই একদিন তোমার মতন নতুন এসেছিলুম কলকাতায়—তারপর এই ধরেছি—কে দেবে চাকরি বলো না, লেখাপড়া তো শিখিনি কিছু, তোমার মতো লেখাপড়া শিখলে দশ-বারো টাকার চাকরি একটা জুটিয়ে নিতুম ঠিক—পাঁচ টাকায় মাস চালাতুম আর পাঁচ টাকা পাঠাতুম দেশে।

পেট ভরে এক গ্লাশ জল খেলে ভূতনাথ।

লোকটা বললে—বনমালী সরকার লেন? বড়বাড়িতে যাবে— তাহলে এখান থেকে বড় রাস্তা ধরে নাক-বরাবর সোজা চলে যাও—তারপর বাঁ দিকে গিয়ে আবার ডান দিকে প্রথম যে রাস্তা পড়বে…

রাস্তার নির্দেশ পেয়ে উঠলো ভূতনাথ। বললে-তোমার নামটা।

—প্রেকাশ—আর তোমার?

—ভূতনাথ চক্রবর্তী—বামুনগাছির পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছি কিনা তাই পিসী ওই নাম রেখেছিল—পরে দেখা করবো–

সমস্ত কলকাতার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা আশ্রয় পেয়ে গেল ভূতনাথ। ব্ৰজরাখালের ঠিকানা যদি খুঁজে না-ই পাওয়া যায় আজ, এখানে এই প্রকাশ ময়রার কাছে এসেই ওঠা যাবে। মামারাকপুরে ওর ভগ্নির বিয়ে হয়েছে—আত্মীয়ই বলা চলে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে ভূতনাথ। ভগবান সহায় থাকলে নরকে গিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কথাটা ভূষণ কাকার। সে-কথার সত্যতার প্রমাণ আজ যেন হাতে-হাতে পাওয়া গেল এই কলকাতায় এসে।

রাস্তায় চলতে-চলতে একবার মনে হলো—এখন যদি হঠাৎ ননীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এত বড় কলকাতা শহরে খুঁজে পাওয়া অবশ্য মুশকিল। তা আজ না হোক-কাল হোক, পরশু হোক একদিন দেখা হবেই। ননীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

বউবাজার স্ট্রীট দিয়ে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকতেই প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। বেশ ছায়া হয়েছে চারদিকে। এইখান দিয়েই ঢুকতে হবে গলির ভেতরে।

একটা বেঁটে কালোপানা লোক গাছতলায় বসে ছিল। ডাকলে–আসো বাবু আসো–

ভূতনাথকে বাবু বলে ডাকা এই বুঝি প্রথম। মনে হলো— তার হাব-ভাব দেখে বুঝতে পেরেছে নাকি যে গ্রাম থেকে আজ নতুন এসেছে ভূতনাথ।

—তোমার বাসনা সিদ্ধ হবে বাবু, সিদ্ধ হবে–বলতে বলতে এক কাণ্ড করে বসলো লোকটা। বলা নেই কওয়া নেই, কড়ে আঙুলে সিঁদুরের ফেঁটা নিয়ে লাগিয়ে দিলে ভূতনাথের কপালে। বললে—সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে কিছু প্রণামী দাও বাবু—যাত্রা শুভ হবে—মনবাঞ্ছা পূরণ হবে–

ভূতনাথ এতক্ষণে ভালো করে দেখলে। বটগাছটার তলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে ইটের উচু বেদী বাঁধানো। তারই ওপর নানা জানা-অজানা দেব-দেবীর মূর্তি ছড়ানো। শুধু সিদ্ধিদাতা গণেশ নয়। কালী, শিব, দুর্গা, মনসা, জগদ্ধাত্রী পুতুলের মতন মাপের সব দেবতামণ্ডলী। ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর আর অসংখ্য

আধলা আর পয়সা ছড়ানো চার পাশে।

লোকটা আবার বলতে লাগলো—কপালে রাজটীকা আছে বাবু—অনেক পয়সা হবে—-অনেক সুখ হবে—বাবুর তিনটা বিবাহ হবে—

গড় গড় করে লোকটা অনেক সুসংবাদ শুনিয়ে গেল। হাসি পেলে ভূতনাথের। তিনটে বিয়ে। মরেছি। চাকরি-বাকরি নেই, খাওয়াবো কি। ভূতনাথ পাশ কাটিয়ে চলে আসছিল। বেলা হয়ে আসছে। স্নান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে।

—প্রণামী দাও বাবু, প্রণামী-গণেশের ফোঁটা নিলে প্রণামী দিলে না—মহাপাতক হবে—দেবতার শাপ লাগবে

বোধহয় রেগে গেল পূজারী বামুন। টাক থেকে একটা আধলা বার করে দিলে ঠাকুরের পায়ে, তারপর গড় হয়ে প্রণাম করলে বেদীতে মাথা ঠেকিয়ে। দেবতা সন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে কিন্তু পূজারী বামুনের মুখ প্রসন্ন হলো।

হাতে একটা ফুল দিয়ে পূজারী বললে-বলে-নমামিহাত জোড় করে ভূতনাথও বললে—নমামি—

—সর্বসিদ্ধিদাতাঃ

–সর্বসিদ্ধিদাতাঃ

—বিনায়কং

—বিনায়কং—

আরো কী কী বলেছিল মনে নেই। লম্বা সংস্কৃত শ্লোক। ছাড়া পেয়ে ভূতনাথ গলি দিকে চলতে-চলতে বাড়ির নম্বরগুলো দেখতে লাগলো। পকেট থেকে ব্রজরাখালের চিঠিটা আর একবার বার করলে ভূতনাথ। পাঁচ নম্বর-বনমালী সরকার লেন। এক নম্বর, দু’ নম্বর করে—পাঁচ নম্বর বাড়িটা দেখেই চমকে গেল ভূতনাথ। এত বড় বাড়ি! এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সমস্তটা ঘুরে দেখে নিলে একবার। এ-বাড়ির নম্বর যে পাঁচ, সে-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু সন্দেহ হলে। এই ব্রজরাখালের বাড়ি। এখানে থাকে নাকি ব্রজরাখাল!

সামনে লোহার গেট খোলা। কিন্তু বিরাট এক যমদূতের মতো চেহারার দারোয়ান বন্দুক উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বুকে মালার মতো গুলী গুলো সাজানো।

সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে চেয়ে দেখতে ভয় হলো। বলা নেই– কওয়া নেই–অমনি ভেতরে গিয়ে ঢুকলেই হলো নাকি। বাড়িটার উল্টো দিকে অনেকগুলো বাড়ি। একটা বাড়ির সামনে ছোট এক ফালি সিমেন্ট বাঁধানো বোয়াক। বসলো সেখানে ভূতনাথ। সেই সকাল থেকে হাঁটছে। পা দুটো বুঝি ব্যথা করে না। দেয়ালে পিঠ দিয়ে হেলান দিলে একটু। বনমালী সরকার লেন খুব বড় রাস্তা নয়। ট্রাম নেই এ-রাস্তায়। তবু লোকজন চলাচল আছে খুব। আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে এল। রাস্তাটা যেন একটু নিরিবিলি হয়ে আসছে। ভূতনাথের সমস্ত শরীরটা যেন ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে এল। একবার মনে হলো ফিরে যায় সেই জিলিপীর দোকানে প্রকাশ ময়রার কাছে। একটা রাত তো থাকা যাবে তবু সেখানে। তারপর কাল তাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই চলবে। প্রকাশ লোকটা ভালো। ভগ্নিপতির দেশের লোক শুনে জিলিপীর দাম নেয়নি।

 

একটা ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভাঙলো ভূতনাথের। কখন সেই কঠিন রোয়াকের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। সামনে দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছে নজরে পড়লো। ঘোড়ায় টানছে গাড়িটা। চ্যাপটা চেহারার গাড়ি। কিন্তু পেছনের একটা অসংখ্য ফুটোওয়ালা নল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ধুলোর ওপর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। ধুলো ওড়া বন্ধ হঝে। কিন্তু খোয়ার রাস্তার ওপর গাড়ির লোহার চাকা লাগতে কী বিকট শব্দই না হচ্ছে।

উঠলো ভূতনাথ। সেই প্রকাশের জিলিপীর দোকানেই ফিরে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। বামুনের ওপর ভারি ভক্তি প্রকাশের। প্রকাশ শুধু চাল আর জল দিয়ে হাঁড়ি চাপিয়ে দেবে উনুনে, আর ভাত হলে নাবিয়ে নেবে ভূতনাথ। ময়রার এটো বামুনকে খাইয়ে মহাপাতক হবে নাকি সে। যে-রাস্তা দিয়ে এসেছিল ভূতনাথ, আবার সেই রাস্তা দিয়েই চলতে হয়।

—এ কী বড়কুটুম না—

চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ভূতনাথ আশে-পাশে সামনে পেছনে চেয়ে দেখলে। চেনা মুখ কেউ নেই। কে তবে ডাকলে তাকে। কিন্তু সামনের গোঁফ দাড়িওয়ালা লোকটাই যে ব্ৰজরাখাল

একথা কে বলবে।

ব্ৰজরাখাল বললে—কখন এলে?

–সকাল বেলা। বললে ভূতনাথ।

-–আচ্ছা মুশকিল তো, সেই সকাল থেকে এই বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় কাটিয়েছে। নাকি? কী কাণ্ড দেখোদিকিনি—একটা চিঠি দিতে হয় তো আসবার আগে কিছু খাওয়া-দাওয়া হয়নি বোধহয়

সারাদিন হরিমটর—কপালে কী?

ভূতনাথ কপালে হাত দিয়ে মুছতেই হাতের পাতায় সিঁদুর লেগে গেল। বললে—গণেশের ফোটা

–ওই নরহরি দিয়েছে বুঝি——দেখোদিকিনি, ঠিক টের পেয়েছে, তুমি নতুন এসেছে। গা থেকে—চলল—এখন আমার সঙ্গে যদি দেখা না হতে-টানতে টানতে নিয়ে এল ব্রজরাখাল বাড়ির ভেতর।

ব্রিজ সিং আপত্তি করলে না। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথকে নিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলো। বিরাট বাড়ি। কোথায় কোন্ দিকে কে থাকে, কোথায় রান্না হয়, কে কোথায় খায়। অসংখ্য লোক ঘোরাফেরা করছে। কেন করছে কেউ বলতে পারে না।

ব্রজরাখাল সোজা চললো সামনে। আসল বড় বাড়িটা ডানদিকে রেখে, পেছনের পুব-পশ্চিম বরাবর লম্বা বাড়িটার নিচে এসে দাঁড়ালো। একতলায় সার-সার তিনটে পাল্কি। তারপর ঘোড়ার গাড়ি। তার ওপাশে কয়েকটা ঘোড়া। মুখের দু’পাশে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত ইটের মেঝের ওপর ঘন ঘন পা ঠুকছে। তারই পাশ দিয়ে সরু সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ব্রজরাখালের পেছনে ভূতনাথ চললো।

ওপরে ডানদিকে সার-সার ঘর। চাকর-বাকর ঘোরা ফেরা করছে। মেঝের ওপর ময়লা বিছানা গোটানো পড়ে রয়েছে পর পর। নাথু সিং তখন নিজের ঘরে লেঙটু পরে পেতলের থালায় একতাল আটা মাখছে।

সব পার হয়ে পুবদিকের একেবারে শেষ ঘরটায় এসে দরজার তালা খুললো ব্রজরাখাল। ঘরে ঢুকে বললে—এই হলো আমার ঘর—আর এর পাশের ঘরটাও তোমায় দেখাই চলো—বলে পাশের আর একটা ঘর খুললে।–এটাও আমারই, কিন্তু আমার আর কে আছে বলো—খালিই পড়ে থাকে—যতো রাজ্যের জঞ্জাল জমে আছে–তুমিই না হয় এ-ঘরটায় থেকো

তারপর বললে— বিছানা-টিছানা তো কিছু আনননি দেখছি –তাতে কিছু অসুবিধে হবে না, কিন্তু তুমি হলে আবার বড়কুটুম কিনা, একটু খাতির-যত্ন না করলে নিন্দে হবে— কী বলো–

ব্ৰজরাখাল নিজের তোষক বিছানা পেতে দিলে ভূতনাথের জন্যে। বললে—আমার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি সন্নিসী মানুষ—আমার ও-সব কিছু লাগে না।

সত্যিই বজ্ররাখাল সন্ন্যাসী মানুষ। আপিসের ধুতি আলপাকার কোট খুলে একটা গেরুয়া রং-এর ছোট ফতুয়া পরলে। আর গেরুয়া ধুতি-কাছা কোঁচাহীন। ভূতনাথের এতক্ষণে নজরে পড়লো—দেয়ালের গায়ে একটা মস্ত বড় সাধুর ছবি। ফুলের মালা ঝুলছে ছবির গায়ে। নিচে কুলুঙ্গীর ওপর কয়েকটা বই–অনেকটা গীতার মতন চেহারা। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেও কার ছবি ব্রজরাখাল?

—প্রণাম করে ওঁকে—বলে ব্রজরাখাল নিজেই আগে সভক্তি প্রণাম করলে। তারপর মাথা তুলে বললে—আমার গুরুদেবপরমহংসদেব—এখন দেহরক্ষা করেছেন

খানিক থেমে বললে–সারাদিনটাতো উপোষ-আজ রাত্রে কী খাবে বলো তো বড়কুটুম—আমি তের মাছ মাংস খাইনে—অড়র ডাল ভাতে দিয়ে দেবো’খন—আর গাওয়া ঘি আছে ব্রিজ সিং-এর দেশ থেকে আনা-সঙ্গে একটু আলুর দম করি, কী বলো–

ভূতনাথের মনে আছে সেই বিকেলবেলা ব্রজরাখাল নিজের হাতে উনুনে আগুন দিয়ে ভাত চড়িয়ে দিলে। তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে রান্না সেরে, খাওয়া-দাওয়া করে নিয়ে বললে—এইবার শুয়ে পড়ো আরাম করে—আমি ততক্ষণ ছেলেদের পড়িয়ে আসি–

ব্ৰজরাখাল ধুতি চাদর পরে ছেলে পড়াতে গেল। ভূতনাথ নিজের বিছানায় শুয়ে আবোল-তাবোল নানা কথা ভাবতে লাগলো সেদিনকার সেই ব্ৰজরাখাল-বর-বেশী ব্ৰজরাখাল—এ হঠাৎ এমন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে যেন। মাছ-মাংস খায় না। কোন সাধুর শিষ্য! কোথাকার পরমহংসদেব। কে তিনি? কেনই বা এই চাকরি করছে সে? কার জন্যে? ঘুমের মধ্যে কত রকম শব্দ কানে আসতে লাগলো। একতলায় ঘোড়াগুলো শক্ত সিমেন্টের মেঝের ওপর পা ঠুকছে। গেটের ঘড়িঘরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। আশে পাশের ঘর থেকে চাকর-বাকরদের হাঁক-ডাক শোনা যায়। কোথা থেকে যেন কালোয়াতী গানের সুর ভেসে আসছে। ইমনকল্যাণের খেয়াল। সঙ্গে তবলা। রাত বাড়তে লাগলো। রাধার কথা মনে পড়লো। এ-সংসার তো তারই। কপালে নেই তার। হয় তো রাধা মরে গিয়েছে বলেই ব্রজরাখালের এই বৈরাগ্য।…ননীর সঙ্গে দেখা করলে হয় একবার। খুব চমকে যাবে। ননী কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে কে জানে। প্রকাশ ময়রা জিলিপী ভাজতে জানে বটে। জিলিপী করা কি যার-তার কাজ। অমন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে…কিন্তু গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে বটে প্রকাশের। এই বাজারে দুটো পয়সা কে ছাড়ে অমন!…অনেক রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হলো যেন গেট খোলার শব্দ হলো। ঘোড়ার পায়ের টগবগ শব্দ–একটা গাড়ি যেন এসে দাঁড়ালো নিচের একতলায়। লোকজনের কথাবার্তা। চাকরদের ছুটোছুটি।

কেমন যেন ভয় করতে লাগলো ভূতনাথের। নতুন জায়গা, নতুন বিছানা। তার মধ্যে যেন কেমন একটা অসহ্য অস্বস্তিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো। যেন গলা শুকিয়ে এসেছে। ডাকবে নাকি ব্ৰজরাখালকে। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ঘরের ভেতরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মনে পড়ে গেল ফতেপুরের কথা। কাল এই সময় সে ছিল ফতেপুরে আর আজ এই কলকাতায়। ফতেপুরের আকাশেও এমনি চাঁদের আলো এখন। গাঙের ধারে কুঁচগাছের ঝোপে জঙ্গলে আচমকা ছাতার পাখীর পাখা-ঝাপটানির শব্দ হচ্ছে। মাঝরাত থাকতেই হর গয়লানীর মেয়ে বিন্দী উঠেছে মল্লিকদের বাগানে আম কুড়োতে। মালোপাড়ায় বেহুলার ভাসান গানের ঢোলের আওয়াজ অস্পষ্ট ভেসে আসছে। কত দেশ কত বিচিত্র মানুষ—এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের মিল নেই—কিন্তু আকাশ একটা যে-আকাশ কলকাতার মাথায় —সে-আকাশ ফতেপুরের মাথাতে—সে-আকাশ সর্বত্র। এক শ’ বছর আগেও এই আকাশ ছিল—এক শ’ বছর পরেও থাকবে…

ভূষণ কাকা বলতো—তুই থাম তো ভূতে—যতে সব বিদঘুটে বিদঘুটে ভাবনা–

মল্লিকদের তারাপদ বলতো—ও বোধহয় বড় হয়ে কবি হবে কাকা—মধু কামারের মতো পালা-যাত্রার গান বাঁধবে—

কবি ভূতনাথ হয়নি। হয়েছে শেষ পর্যন্ত ওভারসিয়ার! কিন্তু সে-সব কথা যাক, সেই মাঝরাত্রে ভূতনাথ ডাকতে লাগলো–ব্ৰজরাখাল—ও ব্রজরাখাল–ও শব্দটা কিসের। উত্তর নেই। মাঝখানের দরজাটা ভেজানো ছিলো। সেটা খুলতেই ভূতনাথ অবাক হয়ে দেখলে ঘরের মাঝখানে যোগাসনে বসে আছে ব্রজরাখাল। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না—কিন্তু মনে হলো ব্রজরাখাল যেন তন্ময় হয়ে আছে কোন দুশ্চর তপস্যায়। বাহ্যজ্ঞানশূন্য। সামনের দেয়ালে সেই সাধুর ছবিটা ঝুলছে। শিরদাঁড়া সোজা-চোখ দুটিও বোজা-শরীরে প্রাণস্পন্দনের লেশমাত্রও নেই বুঝি। ভূতনাথ আবার ডাকলে—ব্রজরাখালএবারও উত্তর নেই। ভূতনাথের মনে হলো—ব্রজরাখাল এখন যেন আর সামান্য ব্রজের রাখাল নয়, মথুরায় গিয়ে রাজা হয়ে বসেছে—রাধার নাগালের বাইরে ফতেপুরের নলজ্যাঠার এগারো বছর বয়সের সেই নগণ্য মেয়ে রাধা!

 ০৩. সকাল বেলা ব্রজরাখালের ডাকে

সকাল বেলা ব্রজরাখালের ডাকেই ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ব্ৰজরাখাল ততক্ষণে স্নান করে তৈরি। বললে—ওঠো হে বড়কুটুম— এত দেরি করলে চলবে না, এখানে ঘড়ি ধরে সব কাজ হয়—এ কলকাতা—তোমার গিয়ে ফতেপুর নয়—

কত রাত্রে যে ব্রজরাখাল শুলো, কখন ঘুমোলো আর কখনই বা উঠলে কে জানে। ভূতনাথ উঠে দেখলে ব্রজরাখাল ততক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। সকাল বেলা বাড়িটার চারদিকে চেয়ে দেখলে এক পলক। দক্ষিণ দিকে জানালা দিয়ে দেখা যায় মস্ত বড় বাগান। মাঝখানে একটা পুকুর।

ব্ৰজরাখাল এল হঠাৎ। বললে—এটা খেয়ে নাও দিকিনি বড়কুটুম–

এক কাসি ফ্যানে-ভাত। ব্রজরাখাল বললে–খেয়ে দেখো খাঁটি ঘি দিয়েছি—তোমাদের ফতেপুরের ঘিয়ের চেয়ে ভালো–

ব্ৰজরাখালের ব্যবহারে ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। কোথাকার কে নন্দজ্যাঠা-তার মেয়ে রাধ—সেও তো আর বেঁচে নেইকী-ই বা সম্পর্ক—অথচ এমন করে আপন করে নিতে পারে পরকে! ভূতনাথ বললে—তুমি খাবে না?

—আমার ভাত ওদিকে তৈরি—এখনি ন’টার ঘণ্টা পড়বে— আমিও আপিসে বেরুবোহাঁটতে হাঁটতে আপিসে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো ঠিক—তারপর ফিরতে যার নাম সেই খানিক পরেই খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরি হয়ে পড়লো ব্রজরাখাল। সেই ধুতির কোঁচাটা কোমরে গুজে আলপাকার কোটটা চড়ালে গায়ে। তারপর যাবার আগে বললে—এইটে রাখো তত বড়কুটুম—এই পুরিয়াটা–

—কী এটা—ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—হোমিওপ্যাথিক ওষধর পুরিয়া, যদি কেউ এসে ওষুধ চায়— বলে–মাস্টারবাবু কোন ওষুধ রেখে গিয়েছে—ত দেবে এইটে। আমি বলেছি কিনা বংশীকে যে, আমার সম্বন্ধীর কাছে রেখে যাবে–

ভূতনাথের বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে ব্ৰজরাখাল হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—চেয়ে দেখছে কি—ডাক্তারিও জানি তোমার বোনকেই শুধু যা বাঁচাতে পারলাম না—আমার রুগীদের মধ্যে ওই একজনই যা মরে গিয়েছে—নইলে এ পাড়ায় আমার খুব নাম-ডাক হে—বলে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেল। আবার ফিরে এল খানিক পরে। বললে—একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি—যদি রাস্তায় বেরোও তত বেশি দূর যেও না—নতুন মানুষ হারিয়ে যাবে —আর একটা কথা, তুমি ভেবো না, তোমার চাকরিরও

একটা চেষ্টা করছি—তবে বাজার বড় খারাপ কি না—

ব্ৰজরাখাল চলে গেল। এ যেন একেবারে অন্য মানুষ। কখন সে ভাত রাঁধলে নিজের হাতে, কখন খেলে—আবার আপিসেও চলে গেল—ন’টার ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে। কাজের মানুষ বটে! ঘর ছেড়ে আর একবার বাইরে এসে দাঁড়ালো ভূতনাথ। কত বড় বাড়ি। এখানে দাঁড়ালে বাড়ির বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। বড়বাড়িটার ভেতরে যে কোনও মানুষ বাস করে বাইরে থেকে তা। বোঝবার উপায় নেই। শুধু বাইরেই যা তোড়-জোড়-নড়া-চড়া হাঁক-ডাক। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতেই বেলা বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে রান্না বাড়ির দিকে গেল। পাশেই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেবে স্নান করবার জায়গা। নতুন জলে স্নান করা উচিত নয়। মুখ হাত পা ধুয়ে ওপরে রান্নাঘরে ঢুকলো। খাবার ঢেকে রেখেছে ব্রজরাখাল। এক হাতে অনেক রান্না করেছে বটে। ডাল, ঝোল, ভাত।

সবে থালা বাটি গেলাশ সাজিয়ে বসেছে খেতে—এমন সময় দরজার পাশে কে যেন উঁকি দিলে।

—কে? ভূতনাথ দরজার দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করলে। লোকটা কিন্তু সামনে এল না। আড়াল থেকে বললে—আপনি খান আজ্ঞে-আমি আসবো’খন পরে—

 

লোকটা সত্যি সত্যিই পরে এল। ভূতনাথ ততক্ষণে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসন কোসন মেজে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে।

এসে বললে—আপনি মাস্টার বাবুর শালা

রোগ ক্ষয়-ক্ষয় চেহারা। তেল-চকচকে তেড়ি কাটা মাথা। আধ-ময়লা ধুতিটা কোঁচা করে কোমরে গোঁজা। বললে—আমি বংশী

ভূতনাথ ওষুধের পুরিয়াটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলে—অসুখ কার

-আজ্ঞে চিন্তার

–চিন্তা কে?

—ছোটমা’র ঝি—

–কী অসুখ?

–ম্যালেরিয়া-ডাক্তারবাবু তো বলেন ম্যালেরিয়া—দেশে গিয়ে অসুক বাধিয়ে এনেছে, আমার বোন হয় সে, এই ছোট বেলা থেকে কলকাতায় আছে কিনা, দেশে-গাঁয়ের জল আর সহ্য হয় না পেটে, আমার বিয়েতে সেবার গেল দেশে, বললুম অতো করে পুকুর ঘাটে জল ঘাঁটিসনে চিন্তা, তা কি শুনবে—ছোটমা’র আদর পেয়ে পেয়ে কথার বড় অবাধ্য হয়ে উঠেছে আজ্ঞে—এখন আমার ভোগান্তি—ছোটমা’র ভোগান্তি-মাস্টারবাবুর ভোগান্তি –এখন এক গেলাশ জল খেতে গেলে ছোটমা’কে নিজে গড়িয়ে খেতে হয়–

তারপর চলে যেতে গিয়ে থামলো বংশী—ছোটমা বলে বটে যে বংশী তোর নিজের মায়ের পেটের বোন, তুই বউবাজারের শশী ডাক্তারকে দেখা। আমি বলি—থাক। মাস্টারবাবু কি ছোট ডাক্তারবড়বাড়ির সমস্ত লোক ভালো হয়ে যাচ্ছে ওর ওষুদ খেয়ে—তা আজ্ঞে ছোটমা’র দেখুন কি জ্বলা, এই সাবু আনন। মিছরি আনো—ফলফুলুরি আনোহান্ আনো ত্যান্ আনোতা খরচার বেলায় তো সেই ছোটমা।

বংশী গলা নিচু করলো এবার। বললে—এ-বাড়ির সবার যে আজ্ঞে হিংসে আমাদের দুজনের ওপর কেউ তো ভালো চোকে দেখে না কি না—

ভুতনাথ জিজ্ঞেস–সের হিংসে—হিংসে কেন–

ওই যে মধুসূদনকে দেখছেন—

–কে মধুসূদন? ভূতনাথ মধুসূদন কেন কাউকেই এখনও দেখেনি।

বংশী বললে-তোষাখানায় একদিন যাবেন—ওই মধুসূদনই তোষাখানার সর্দার কিনা—আমাদের পাশের গায়ে বাড়ি হুজুরবললে বিশ্বেস করবেন না, আমার আপন পিসীর সম্পর্কে ভাসুর হয় আজ্ঞে——আর তার এই কাণ্ড-বুঝুন—

—কী কাণ্ড–

—সে অনেক কথা হুজুর—অনেক কথা বলে বসলে বংশী। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গলা আরো নিচু করলো।

বংশীর অনেক অভিযোগ। এত বড় বাড়ি—কত পুরুষ আগে থেকে বংশপরম্পরায় কত দাস-দাসী, কত লোকজন আসা-যাওয়া করেছে। কত বংশের ভরণ-পোষণ জীবিকা নির্বাহ নির্ভর করেছে এই চৌধুরী পরিবারের দান-ধ্যান ধর্মানুষ্ঠানের সূত্রে। গ্রাম-কে-গ্রাম ঝেটিয়ে এসেছে চাকরির চেষ্টায় এখানে। উঠেছে এসে এই চৌধুরী বাড়িতে। ওই মধুসূদন এখন তোষাখানার সর্দার। ওর কোন্ পূর্ব পুরুষ কবে কী সূত্রে এসে আশ্রয় পেয়েছিল কর্তাদের আমলে। তারপর সংসারের আয়তন বেড়েছে, আয়োজন বেড়েছে, আয় বেড়েছে, ধনে জনে প্রতিষ্ঠায় প্রতিপত্তিতে চৌধুরী বংশের প্রসার বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়, স্বজন, পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, পারিষদ, মোসাহেব, দাস দাসী—তাদের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন্ সুদূর বালেশ্বর, কটক, বারিপদা জেলা থেকে মধুসূদনের পূর্ব পুরুষের আত্মীয় পরিজন-গ্রামবাসীরা এসে জুটেছিল এখানে। এসে ভার নিয়েছিল এক একটা কাজের। ভিস্তিখানা, তোষাখানা, রান্নাবাড়ি, কাছারিবাড়ি, বৈঠকখানা সেরেস্তা অলঙ্কৃত করেছে। পূজোয়, পার্বণে, উৎসবে, আনন্দে যোগ দিয়েছে পরিবারের একজনের মতো। দেশে গিয়েছে, বিবাহ করেছে—আবার ফিরেও এসেছে, দেশে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে মাসে মাসে। এ-সংসারে তাদের প্রয়োজন যেমন অপরিহার্য, এ-সংসারও তেমনি তাদের জীবিকার পক্ষে অনিবার্য। এ-পরিবারের কেউ-ই পর নয়। সাধারণ পর্ব উপলক্ষে, দোল-দুর্গোৎসবে তারা নতুন কাপড় পেয়েছে, পার্বণী পেয়েছে। শুধু তারা কেন, একটা কুকুর-বেড়ালেরও ন্যায্য অধিকার আছে এ-বাড়ির ওপর। এখানে কেউ অনাত্মীয় নয় সবাই আপন—সবাই অনস্বীকার্য!

কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে। বংশী গলা নিচু করে বলে কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে হুজুর—এখন এক-একজন চাকরি পাবে আর মধুসূদনকে পাঁচ টাকা করে বা দিতে হবে—আর চাকরি যতদিন না হবে, ততদিন বছরে তাদের কাছে এক টাকা করে বাব আদায় করবে—এই যে আমার বিয়ে হলো না—ওকে দিতে হলো ওর দস্তুরী—বিয়ের দস্তুরী আজ্ঞে দশ টাকা—এই ধরুন যদি আমার সঙ্গে যদুর মার ঝগড়া হয় আর ও যদি মিটিয়ে দেয়—ওর আদায় হবে চার আনা, আমি দেবো দু’ আনা, আর যদুর মা দেবে দু’ আনা—আমার যদি ছেলে হয় আজ্ঞে তো ওকে দিতে হবে সোয়া শ’ পান আর পৌনে পাঁচ গণ্ডা সুপুরী-—এই হলো নেয়ম—তা এত বড় পিশে আজ্ঞে ওই মধুসূদন—আমার যদ্দিন চাকরি হয়নি, তদ্দিন এক টাকা করে আমার মাইনে হবার পর থেকে কেটে নিয়েছে। তা মাস্টারবাবুর কাছে শুনেছি আপনি এখানে থাকবেন এখন—চাকরি করবেন এখানে—অনেক সব দুঃখের কথা বলবো আপনাকে—আমি পুরুষ মানুষ, আমার জন্যে ভাবিনে আজ্ঞে নিজে গতরে খেটে দেনা-পত্তর শশাধ করে দেবো একদিন—কিন্তু ওই চিন্তার জন্যেই তো ভাবনা।

ভূতনাথ বললে—কেন?

–আজ্ঞে গরীবের ঘরে জন্মেছে, না খাটলে চলবে কেন, কে তোকে বসে বসে খাওয়াবে—সোয়ামী থাকলে সেও খাটিয়ে নিত, শুধু শুধু খেতে দিত না, তা সোয়ামীকে খেয়েছে, এখন ছোটমা-ই তো ভরসা—তা ছোটমা-ই বা ক’দিক দেখবে।

ভূতনাথ বললে—তোমার ছোটমা বুঝি চিন্তাকে খুব ভালোবাসেন।

—ভালোবাসলে হবে কি শালাবাবু, তার যে নিজেরই শতেক জ্বালা।

–কিসের জ্বালা।

—সে সব অনেক কথা, পরে বলবো আপনাকে—তা ছোটমা ভালোবাসে বলেই তো মধুসূদন দেখতে পারে না আমাদের। শুধু মধুসূদন কেন, মধুসূদনের দলের কেউ দেখতে পারে না, ও গিরিই বলুন, সিন্ধুই বলুন, সদুই বলুন, রাঙাঠাকমাই বলুন—কেউ না, এমন কি বেণীও নয়।

—বেণী কে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—আজ্ঞে বেণী হলো মেজবাবুর চাকর—অথচ দেখুন সবাই এক জেলার লোক আমরা—বেণী তো আমার গায়ের লোকই বটে।

আশ্চর্য। ভূতনাথও আশ্চর্য হয়ে গেল।

–রাঙাঠাকমাকে আপনি দেখেন নি আজ্ঞে।

—কে রাঙাঠাকমা?

—ভাড়ারে থাকে, ভাড়ার দেখে শোনে, ওই মধুসূদনের সম্পর্কে রাঙাঠাকমা হয় বলে—এ-বাড়ির আমরাও সবাই রাঙাঠাকমা বলি

—তা সেই রাঙাঠাকমাকে গিয়ে কাল বললাম আজ্ঞে—পোটাক সাবু দাও আর মিছরি আধপো-। শুনে নানান কথা—কে খাবে, কেন খাবে, হান্ ত্যা। আমি বললাম—ছোটমা’র হুকুম। তখন বলে ছোট বোমা নিজের ঝিকে দিয়ে বলে পাঠালে না, তোকে দিয়ে কেন বললে রে বংশী। আমি বললাম-চিন্তার যে অসুখ, সে কি নড়তে পারে। তখন বললে–ছোট বৌমাকে গিয়ে বলগে—একটা চিরকুট নিখে দিক—আমি গিয়ে বললাম সব ছোটমাকে। ছোটমা বললে–কাজ নেই বংশী—–পয়সা নিয়ে দোকান থেকে কিনে আনগে, ঝঞ্চাট চুকে যাক। বলে টাকা দিলে আমাকে।—অথচ দেখুন আজ্ঞে–বংশী আবার বলতে লাগলো–অথচ দেখুন, এই যে গিরি, মেজমা’র পেয়ারের ঝি, তার একাদশীতে ফল, পুণ্যিমেতে পাকা ফলার—সব যোগান দেবে রাঙাঠাকমা। ছোটমা ভালো মানুষ, তা সংসারে ভালো মানুষ হওয়াও খারাপ শালাবাবু।

বংশীর কথার হয় তো শেষ নেই। কিন্তু যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার উঠলো সে। বললে—যাই আবার—ছোটবাবু হয় তো ঘুম থেকে উঠবে এখনি—উঠে যদি ওপরে যায় তো মুশকিল।

ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। বললে—এখন? এই বারোটার সময়?

বংশী বললে—তা ছোটবাবুর এক-একদিন ঘুম থেকে উঠতে দুপুর দুটোও বেজে যায়—তারপর তখন উঠে ভাত খাবেন সেই বিকেল পাঁচটায়। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললে—যাই আমি, অনেকক্ষণ বসলাম, আজকে বিকেল বেলা আবার বার-বাড়িতে রাক্ষস দেখতে যাবে—যাবেন নাকি দেখতে? ডাকবো’খন আপনাকে—

রাক্ষস? ভূতনাথ যেন ভুল শুনেছে!

—আজ্ঞে হ্যাঁ, নর-রাক্ষস আর কি-একটা জ্যান্ত পাঠা খাবে। কালকে সরকারবাবু নিজে হাতীবাগানের বাজার থেকে কিনে এনেছে—ওই যে দেখুন না, জানালা দিয়ে পুকুরের পাড়ে খোটায় বাঁধা রয়েছে, চরে চরে ঘাস খাচ্ছে—ত কচি বেশ, এখনও শিং গজায় নি-কালো রং–

ভূতনাথের বিস্ময় বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে বংশী বললেএ আপনার গিয়ে সব মেজকত্তার সখ, ভারি সৌখীন মানুষ আপনার এই মেজকত্তা—সেদিন সুখচর থেকে একজন লোক এসে বাজি রেখে দশ সের রসগোল্লা খেয়ে গেল—বাজি ছিল খেতে পারলে মেজকা নগদ পাঁচ টাকা দেবে—ভৈরববাবুও খেতে বসেছিলতিন সের খেয়েই হেঁচকি তুলতে লাগলোতা সে নগদ পাঁচটা টাকাও নিলে, দশ সের রসগোল্লাও খেলে, আবার মেজকত্তা খুশি হয়ে একটা গরদের উড়ুনি দিলেন তাকে।

 

একলা ঘরে ঘুরে ঘুরে ভূতনাথের সময় আর কাটে না। একবার মনে হলো—রাস্তায় বেরোয়। কিন্তু অচেনা জায়গা, কোথায় গিয়ে শেষে চিনে চিনে বাড়ি ফিরতে পারবে না। আসুক ব্ৰজরাখাল। প্রথম দিন তার সঙ্গে বেরুতে হবে।

জানালা দিয়ে আবার চেয়ে দেখলে দক্ষিণ দিকে। পুকুরের পাড়ে বাঁধা রয়েছে ছাগলটা। আপন মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘাস খেয়ে চলেছে। বাগানে একজন মালী গাছের গোড়াগুলো খুড়ে দিচ্ছে। কোণের মেথরপাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলা করছে রাস্তার ওপর। আর তারপর বুঝি ধোপাদের ঘর। দড়িতে সার সার অসংখ্য শাড়ি কাপড় জামা শুকোচ্ছে।

ঘরের দেয়ালের তাকে হঠাৎ ভূতনাথের নজর পড়লো—পুরনো কাগজপত্রের জঞ্জালের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে এক জোড়া বাঁয়া তবলা। কার জিনিস কে জানে। ব্রজরাখালের এ দিকেও সখ আছে নাকি! সর্বাঙ্গে ধুলো মাখা। বোধ হয় বহুদিন কেউ হাত দেয়নি। মনে পড়লো ভূতনাথের—সেই ফতেপুরের বারোয়ারিতলার যাত্রাদলের কথা। একদিন এই নিয়ে কত মাথাই না ঘামিয়েছে। সাত মাত্রার যৎ, আবার আট মাত্রার যৎ! বিলম্বিত লয়ের কাওয়ালি আর একতালা। দুন, চৌদুন, তেহাই। রসিক মাস্টার বলেছিল—ড়ুগি তবলায় খাসা হাত তত ছোকরার।

কেমন যেন ইচ্ছে হলো ভূতনাথের তবলা বাজাতে। কিন্তু ভয় হলে যদি কেউ আপত্তি করে। কোথায় পরের বাড়িতে থাকা। ব্ৰজরাখালের নিজের বাড়ি তো আর নয়। তবলাটায় হাত বুলিয়ে সামনের তর্জনীটা দিয়ে দুই একটা টোকা মেরে আবার রেখে দিলে। ঘাটগুলো বাধা নেই। কেমন যেন মরা আওয়াজ বেরুলো। সামনের রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালার ডাক কানে আসে–বাসন চাই—পেতল কাঁসার বাসন—

কাঁসি ঘণ্টা বাজিয়ে কাঁসার বাসন বেচতে চলেছে। সামনের আস্তাবল বাড়ির কার্নিসের ওপর একটা চিল চুপ করে বসে ছিল, এবার হঠাৎ অকারণে চিঃ হিঃ ইঃ শব্দ করে তীর বেগে উড়ে পালালো। আর একজন ফেরিওয়ালা কী একটা অদ্ভুত চিৎকার করতে করতে চলেছে। প্রথমটা কিছু বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ। শোনার পর বোঝা গেল। বলছে—কুয়োর—ঘটি তো-লা-আ–আ–

ভূতনাথের আজও মনে আছে সে কলকাতার সেই প্রথম দিনের দুপুরটা যেমন রোমাঞ্চময় লেগেছিল, জীবনে আর কোনও দিন তেমন লাগেনি। সেই তার স্বপ্নে দেখা কলকাতার সঙ্গে চোখের সামনের কলকাতাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল সে। শুধু বাড়ি—আর বাড়ি। এত বড় বড় বাড়ি। মল্লিকদের তারাপদ’র দেখা কলকাতার সঙ্গে কি তা মিলেছে? পিসীমা যদি বেঁচে থাকতো তো ভয়ে হয় তো তার ঘুমই হতো না। তার ভূতনাথ এত বড় কলকাতায় কোথায় হয় তো হারিয়ে যাবে, হয় তো গাড়ি চাপা পড়বে—সেই ভয়।

বিকেল হতে তো অনেক দেরি আছে। ভূতনাথ ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় বেরুলো।

ব্রিজ সিং বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলো গেট-এ। কিছু বললে না।

খোয়ার রাস্তা। এবড়ো খেবড়ো। বনমালী সরকার লেন-এ তখনও পিচ বাঁধানো হয় নি। দুপুরের নির্জন রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে মমাড়ের মাথায় আসতেই মনে পড়লো সেই নরহরির কথা। বুড়ো অশথ গাছটার তলায় চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। কেউ নেই কোথাও। দেব-দেবীর সব সাজানো পড়ে আছে। ফুল বেলপাতা শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। নৈবিদ্যির চাল দু’একটা ছড়ানো এদিক ওদিক। কিন্তু নরহরি নেই। এবার হঠাৎ যেন ভক্তি ভরে ভূতনাথ —কোন্ দেবতাকে লক্ষ্য করে কে জানে-প্রণাম করলে। বেদীর কাছে গিয়ে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করলে। ফতেপুরের বারোয়ারিতলার মণ্ডলচণ্ডীর কাছে যেমন প্রণাম করে কামনা করতে ভূতনাথ, তেমনি মনে মনে প্রার্থনা করলে—মঙ্গল করে মা, মঙ্গল করো। ভূতনাথের আর কোনও প্রার্থনা মনে এল না। কার মঙ্গল, কী মঙ্গল, সে প্রশ্ন নয়। সমস্ত মঙ্গল হোক। তার নিজের মঙ্গল, ব্রজরাখালের মঙ্গল—তারপদ, ভূষণ কাকা—ননী, রাধার আত্মার মঙ্গল। বিশ্ব সংসারে সকলের মঙ্গল। ওই বংশী, ওর বোন চিন্তা, ওর ছোটমা, ছোটবাবু, মধুসূদন সকলের মঙ্গল।

বড় রাস্তার ওপর যেতে ভয় করলো ভূতনাথের। টগবগ করে সেই কালকের মতো ট্রাম গাড়ি চলেছে। ঘোড়ার গাড়িওয়ালা ঘোড়াকে ছিপটি মারতে মারতে চলেছে হু হু করে। মুখে এক অদ্ভুত শব্দ করছে—উ-উ-উ-উ আবার কেউ বলছেটি-টি-টি-টি–

একটু ও-পাশে একটা বাড়িতে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজলো। ছেলেদের স্কুল। ভূতনাথ পড়লে। বেঙ্গল সেমিনারি। স্কুলের সামনে গোটাকতক কাবুলিওয়ালা অদ্ভুত ভেলভেটের কুর্তা আর ঢিলে-ঢালা সাদা পাঞ্জাবী পরে বসে আছে। বসে বসে ফল বেচছে। একটা কাপড়ের ওপর আঙুর—বেদানাবাদাম—ছড়ানো।

গঞ্জের স্কুলের কথা মনে পড়লো। সে ছিল প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা ঘর। এমন দোতলা পাকা দালান নয়। সামনের দিকে এগিয়ে গেল ভূতনাথ। তাদের ফাস্ট ক্লাশে সংস্কৃত বই ছিল হিতোপদেশ। পড়াতেন শরৎ পণ্ডিত। লম্বা করে নস্যি নিতেন। সর্বদাই বোয়াল মাছের মতো লাল-লাল গোল চোখ। টিকিতে ফুল বাঁধা থাকতো তার। ভূতনাথ ভারি ভয় করতে তাকে। ধাতুরূপ মুখস্ত বলতে না পারলে মাথায় গাট্টা মারতে মারতে ঢিপ করে কিল বসিয়ে দিতেন পিঠে! রাগ হলে চিৎকার করে বলতেন—এই গর্ধভ—

শরৎ পণ্ডিতের অস্ত্র ছিল শুধু হাতের গাঁট্টা।

অঙ্কের মাস্টার হরনাথবাবুর অস্ত্র ছিল খাকের কলম। দুই আঙুলের মধ্যে খাকের কলমটি দিয়ে জোরে এমন টিপে ধরতেন যে মনে হতো বুঝি বিছে কামড়িয়েছে।

আর হেডমাস্টার অবনীবাবুর বেত। দারোয়ান সত্যনারায়ণ ছিল বেতের ভাড়ারি। বড়, মাঝারি, ছোট, নানা মাপের বেত সাজানো থাকতো লম্বা লম্বা বাঁশের নলের মধ্যে। চিৎকার করে অবনীবাবু ডাকতেন—আমার কেন্–

কেন মানে বেত।

অবনীবাবু বাঙলা ভাষায় বেত বলতেন না। শাস্তির গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে বোধ হয় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ যেন বেতের আঘাত কম, আর কেন-এর আঘাত প্রচণ্ড। সত্যনারায়ণ সব বেত গুলো এনে হাজির করতে হেডমাস্টারের সামনে।

অপরাধীর অপরাধের তারতম্য হিসেবে বেতের আকারেরও তারতম্য হতো। অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় বই থেকে নকল করলে বড় বেত। পেছনের বেঞ্চে বসে ব্যাঙের ডাকের নকল করলে মাঝারি বেত। আর সত্যনারায়ণের কাছ থেকে ধারে জিভে-গজা খেয়ে ধার শোধ না করলে-ছোট বেত।

পঞ্চাননের ভাগ্যে তিন রকম বেতই জুটতত।

সেই পঞ্চানন! ভূতনাথের এতদিন পরে আবার পঞ্চাননকে মনে পড়লো। একদিন হঠাৎ পুলিশে ধরে নিয়ে গেল সেই পঞ্চাননকে। ম্যাজিস্ট্রেটের বাগান থেকে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। বিচারে জেল হয়ে গেল পঞ্চাননের তিন মাস। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে পঞ্চানন আর গ্রামে আসেনি। কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানতে পারলে না।

স্কুলের সামনে যেতেই কেমন একটা হৈ-চৈ গণ্ডগোল শোনা গেল। ওদিক থেকে ছেলেরা চিৎকার করছে—আর এদিক থেকে কাবুলিওয়ালারও চিৎকার করে। কী বিকট ভাষা এদের। গোটাকতক শব্দ কেবল—কিছু মানে বোঝা যায় না। ওদিক থেকে ঢিল ছুড়তে লাগলো ছেলেরা—আর এরা কিছু না পেয়ে বড় বড় বেদানা ছুড়তে লাগলো ছেলেদের লক্ষ্য করে।

রাস্তাময় বেদানা ডালিম আঙুর নাশপাতির ছড়াছড়ি। ভিড় জমে গেল চারিদিকে। চার পাঁচটা কাবুলিওয়ালা যেন পাগলের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো। হাতের লম্বা লাঠিগুলো নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। দমাদম জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে গেল বেঙ্গল সেমিনারির। স্কুলের নাম লেখা সাইন বোর্ডখানা। টেনে নামিয়ে ভেঙে দিলে।

ভুতনাথের কেমন অবাক লাগলো—কেন হঠাৎ এই মারামারি। অথচ একটু আগেও তো কোনো কিছু ছিলো না। ছেলেরা ফল কিনছিল ওদের কাছে।

-কী হলো মশাই–কী হলো।

যে যা পারলে দুটো চারটে বেদানা কুড়িয়ে পকেটে পুরলে।

একজন বললে—ছেলেদেরই দোষ।

-কেন?

–ওরা ওদের বেইমান বলেছে।

–বেইমান! বেইমান বলা এত বড় অপরাধ! হট্টগোলের মধ্যে থেকে ভূতনাথ বেরিয়ে এল। কয়েকটা লাল চামড়ার সাহেব পুলিশ ততক্ষণ এসে পড়েছে। ভয়ে যে যেদিকে পারলে দৌড় দিলে। এখনি হয় তো লাঠি মারবে। ওরা ভয়ানক মারে। গোরাদের ক্ষমতা কি কম। এসেই চার পাঁচটা কাবুলিওয়ালাকে ধরে ফেললে। তারপর দমাদম লাথি মারতে লাগলো স্কুলের বন্ধ দরজার ওপর। রাস্তার গাড়ি ঘোড়া ট্রাম লোক-চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। হৈ হৈ কাণ্ড!

আবার বনমালী সরকার লেন-এর মধ্যে ঢুকে পড়লো ভূতনাথ। বুকটা তখনও তার দূর দূর করে কাঁপছে। বেইমান! কথাটার মানে কী!

মনে আছে বহুদিন আগে পঞ্চানন একবার হেডমাস্টার অবনী বাবুর কাছে খুব মার খেয়েছিল। দুই হাতের পাতায় তখনও লাল দাগ আছে। রাস্তায় এসে বলেছিল—এই বইগুলো একটু ধর তো—বোধ হয় জ্বর আসছে।

পঞ্চাননের কপালে হাত দিয়ে ভূতনাথ চমকে উঠেছিল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যেন। জ্বরের ঝোঁকে সেই রাস্তার মধ্যেই শুয়ে পড়েছিল পঞ্চানন।

মনে আছে সেই জ্বরের ঘোরেই পঞ্চানন বলেছিল—শালা হেডমাস্টারটা বেইমান।

ভূতনাথ সেদিন মানে বোঝেনি পঞ্চাননের কথাটার। বেঙ্গল সেমিনারির ছেলেদের বেইমান বলায় কাবুলিওয়ালাদের রাগের কারণটাও ভূতনাথ বুঝতে পারেনি সেদিন। কিন্তু মানে বুঝতে পেরেছিল অনেকদিন পরে, যেদিন ছোটবৌঠান বলেছিল—ভূতনাথ তুই এত বড় বেইমান–

হেডমাস্টারের বেইমানি বোঝবার বয়েস তখন হয়নি ভূতনাথের। কাবুলিওয়ালাদের বেইমানির অর্থও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেদিন। কিন্তু ভূতনাথ যে কেমন করে বেইমান হলো সে প্রশ্ন…কিন্তু ছোটবৌঠান তো তখন অপ্রকৃতিস্থ। তাকে অবশ্য ক্ষমা করেছিল ভূতনাথ। ছোটবৌঠানকে চিনেছিল বলেই তো ভূতনাথ পরে। তাকে ক্ষমা করতে পেরেছিল।

০৪. সেদিন আপিস থেকে ব্রজরাখাল ফিরলো

সেদিন আপিস থেকে ব্রজরাখাল ফিরলো একটা মস্ত বড় বাণ্ডিল নিয়ে। বললে—তোমার ও জামা-কাপড়ে চলবে না বড় কুটুমভদ্রলোকের কাছে চাকরি করতে গেলে একটু ভদ্র হয়ে যেতে তো হবে–

একেবারে তৈরি কামিজ নিয়ে এসেছে। ধুতিও একজোড়া। লাট্ট মার্কা রেলির ধুতি। যেমন মিহি তেমনি খাপি।

-আর এই নাও জুতো—এ তো ফতেপুরের রাস্তা নয়। এখানে খোয়ার রাস্তা, খালি পায়ে চললে পা ছিঁড়ে যাবে একেবারে।

ভূতনাথ জুতো জোড়া পায়ে দিলে। ব্ৰজরাখাল নিজের হাতে ফিতে বেঁধে দিলে। বললে—পছন্দ হয়েছে তো। টেরিটি বাজারের খাস চিনে-বাড়ির জুতো।

সেই বিকেল বেলা ভূতনাথকে জুতা জামা কাপড় পরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারদিক থেকে দেখলে ব্রজরাখাল। তারপর বললে–এইবার সব ছেড়ে রাখখা, পরশু আমার ছুটি আছে আপিসের, ওইদিন আবার পরতে হবে।

-কেন?

ব্ৰজরাখাল উত্তর দিলে না। কিন্তু খেতে বসে কথাটা বললে ব্ৰজরাখাল। বললে—চাকরি তো কখনও কয়রানি বড়কুটুম চাকরির শতেক জ্বালা—এক-একবার ভাবি ছেড়ে দেবো-আমার কিসের দায়। না-আছে বাপ-মা, না-আছে বউ-ছেলে,—কিন্তু ঠাকুর বলতেন—

ভূতনাথ মুখে ভাত পুরে বললে—কোন্ ঠাকুর?

—আমার ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-গেঁয়ো ভূত, নাম শোনননি তুমি—দেখবে, বলে রাখছি তোমাকে—ওই ঠাকুরের ছবিই একদিন দেশের ঘরে ঘরে থাকবে—আমার চোখ খুলিয়ে দিয়েছেন ঠাকুর। তোমার বোন যখন মারা গেল বড়কুটুম, সে বড় কষ্টের মধ্যে কাটাতে লাগলাম—সে যে কী কষ্ট কী বলবো। বড় ভালোবাসতাম রাধাকে—বলে ভাত খেতে খেতে হো হো করে হেসে উঠলো ব্রজরাখাল।

ব্ৰজরাখাল হাসলো না কেঁদে উঠলো দেখবার জন্যে ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের মুখের দিকে তাকালে। কিন্তু ব্রজরাখাল কোনো দিকেই যেন চেয়ে নেই।

আবার বলতে লাগলো বজ্ররাখাল—তোমার বোন আমায় একদিন কী বলেছিল জানো–

ভূতনাথ বললে—কী।

-এই অসুখ হবার কিছুদিন আগে, আমি শনিবার দিন বাড়ি গিয়েছি। রাধা বললে—তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল— বললাম—কী কথা বলো। রাধা বললে-আমার ভূতোদাদার বড় ইচ্ছে কলকাতা দেখবার। আমায় কতবার বলেছে-তুমি চাকরি করে কলকাতায়, ওকে একবার কলকাতা দেখাতে পারো না? বললাম—পারি। পারি তো বললাম, কিন্তু তার কিছুদিন পরেই ও মারা গেল। আমার মনের অবস্থা তখন তত বুঝতে পারছো—ফতেপুর থেকে ফিরে এসে লম্বা ছুটি নিয়ে দিনরাত কেবল দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে পড়ে থাকতাম। বেশ ভালো লাগতো। মনে হলো দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে আর সংসারে ফিরে যাবো না কিন্তু ফিরে এলাম ভাই,ঠাকুরই আমায় ফিরিয়ে দিলেন—কেমন করে দিলেন সেই কথা বলি–

সেদিন সব ভক্তরা বসে আছি। নরেন আছে, লাটু আছেগিরিশও ছিলো বোধহয়। আমি বললাম—ঠাকুর আমি আর সংসারে ফিরে যাবো না।

ঠাকুর জানতেন সব। রাধার মারা যাওয়ার খবর শুনে খুব কেঁদেছিলেন। জানতেন আমার কেউ নেই সংসারে—সংসারে কারো ওপর কোনও দায়িত্ব নেই। কার জন্যেই বা চাকরি করছি, কার জন্যেই বা টাকাকড়ি—একটা পেট, সে-জন্যে ভাবিনে। ঠাকুর শুনলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, একটা গল্প শোন। বললেন-দেখ নারদ মুনির ভারি অহঙ্কার ছিল যে, ত্রিভুবনে তাঁর মতন ভক্ত আর কেউ নেই। বিষ্ণু শুনে বললেন—তোমার চেয়েও আর একজন বড় ভক্ত আমার আছে হে—সে এক চাষী, যাও তাকে গিয়ে দেখে এসো নারদ। নারদ গেলেন দেখতে। গরীব চাষা। সারাদিন ক্ষেতে খামারে কাজ করে—ফুরসুৎ নেই মরবার। কেবল সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে শুতে যাবার আগে দু’বার মাত্র হরির নাম করে। নারদ কিছু বুঝতে পারলেন না। এলেন বিষ্ণুর কাছে। বললেন-দেখে এলাম তোমার ভক্তকে—কী এমন তার ভক্তি যে এতো বড়াই করছে। বিষ্ণু তাকে একটা বাটিতে টইটুম্বুর তেল দিয়ে বললেন—যাও নারদ, এই বাটিটা নিয়ে একবার সারা শহরটা ঘুরে এসো—কিন্তু সাবধান, তেল যেন একফোঁটাও না পড়ে। নারদ চললেন। অনেকক্ষণ পরে ফিরে এলেন আবার বাটিভর্তি তেল নিয়ে। তেল এক ফোটাও পড়েনি। বিষ্ণু জিজ্ঞেস করলেন—নারদ, আমার কথা ক’বার স্মরণ করেছো তুমি? নারদ বললেন,—প্রভু, আপনার নাম স্মরণ করবার সময় পেলাম কই। আমি তো সারাক্ষণ তেল নিয়েই ব্যস্ত। তখন বিষ্ণু নারদকে বুঝিয়ে দিলেন–সেই সামান্য চাষার ভক্তি কেন নারদের চেয়েও বড়। সেই চাষা হাজার কাজের মধ্যেও দু’বার তো অন্ততঃ হরিকে স্মরণ করে—

ঠাকুর এমনি কথায় কথায় কেবল গল্প বলতেন। গল্প শুনে চুপ করে রইলাম। তখনও যেন বিশ্বাস হলো না। ঠাকুর বুঝলেন। বুঝে হাসলেন এবার। বললেন–ওই গিরীশকে জিজ্ঞেস করে দেখ—ওকে বলেছিলাম যখন প্রথম ও এসেছিল—শুধু দিনের মধ্যে দু’বার নাম-জপ করতে, একবার খাবার আগে, আর একবার শোবার আগে। ও শেষ পর্যন্ত পেরেছে। তুই-ই বা পারবি না কেন। তার বেশি তোকে কিছু করতে হবে না। মা তোর কাছে আর কিছু চায় না রে বোকা ছেলে। তারপর হাসি থামিয়ে নৱেনের দিকে চেয়ে বললেন–ওরে দেখ, ব্ৰজরাখালের বিশ্বাস হচ্ছে না। ওরে এ-সংসারে যত মত তত পথ যে,—কোনও মতটাই নিখুত নয়। তা ভেবে তোর কী দরকার। তুই যা করছিস করে যা-সংসারের সমস্ত জীবের মধ্যেই শিবকে পাবি। আর যদি না-ই পাস তাতেই বা কী। মা তো তোর মনের কথা জানে রে। এই দেখ না, সবাই ভাবে তার হাতঘড়িটাই ঠিক সময় দেয় কিন্তু কোনও ঘড়ির সঙ্গে কোনও ঘড়ির তো মিল নেই—অথচ আসলে সঠিক সময়টা যে কী তা কেউ জানে না—তা নাই বা জানলো, তাতে কারো কোনও কাজের ক্ষতি হচ্ছে?

গল্প করতে করতে কখন যে খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে কারোর খেয়াল ছিল না। ভূতনাথ একমনে ব্রজরাখালের কথা শুনছিল। হঠাৎ চমক ভেঙে ব্ৰজরাখাল বললে—যা হোক—রাধার কাছে সেই কথা দিয়েছিলুম তার ভূতোদাদাকে কলকাতা দেখাবে। তা

এন্তোদিন মনে ছিল না, তোমার চিঠি পেয়ে মনে পড়লো।

রাত্রে ভূতনাথ বললো-ও বাঁয়া তবলা কার ব্রজরাখাল।

ব্ৰজরাখাল বিছানা পাততে পাততে বললেও আমারই, এককালে আমিই বাজাতাম—-তারপর এখন বাজাই খোল, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সামনে খোল বাজিয়ে আর তবলা ভালো লাগে না।

শোবার আগে ব্রজরাখাল বললে–ঠাকুরকেই দেখলে না বড়কুটুম, কলকাতার আর কী দেখলে তবে…তা হলে পরশুদিন যাওয়া মনে রেখো, আবার ভুলে যেও না যেন—আমার ছুটি আছে সেদিন।

—কোথায়? ভূতনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে।

—এরই মধ্যে ভুলে বসে আছো, তোমার চাকরি হে—মাইনে এখন পাবে সাত টাকা করে, আর এক বেলা ওখানেই খাবে। বেশ নিষ্ঠাবান ধার্মিক লোক সুবিনয়বাবু। নববিধান সভার ব্রাহ্ম ওঁরা—

—সে কী ব্ৰজরাখাল।

—সে তুমি বুঝবে না এখন—ব্রজরাখাল পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে।

পাশের ঘরে শুয়ে অনেকক্ষণ ভূতনাথের ঘুম এল না। সেই কালকের মতো ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দ, অনেক চাকরের গোলমাল। তারপর রাত্রি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে সেই তন্দ্রার মধ্যে কালোয়াতি গানের সঙ্গে তবলার ঠেকা। অনেক রাত্রে লোহার গেট খোলার ঘড় ঘড় শব্দ। আর তারপর…তারপরের কথা আর ভূতনাথের মনে থাকবার কথা নয়।

 

শেষ পর্যন্ত চাকরি হলো ভূতনাথের। সাত টাকা মাইনে আর এক বেলা খাওয়া। তা সাত টাকাই কি কম।

ব্ৰজরাখাল বললে—সাত টাকাই কি কম। আমি তো এল.এ. পাশ করে দশ টাকায় ঢুকেছিলাম। তুমি লেখাপড়া-জান ছেলে, বিদ্যে রয়েছে পেটে—দেখবে, ও সাত টাকাই শেষে সতেরো টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে দেরি হবে না। তুমি কিছু দ্বিধা করে না তা বলে।

দ্বিধা নাকি ভূতনাথের আছে! দ্বিধা কিসের। ব্রজরাখালের বিনাভাড়ার ঘরে থাকা আর একবেলা খাওয়া আবার সাত টাকা নগদ মাস গেলে। জলখাবার, জামাকাপড় নিয়ে মাসে তিন টাকাই খরচ হোক—তারপর চার টাকা করে জমা! কত বাবুয়ানি করবে করো না!

ব্ৰজরাখালের কেনা নতুন জামা-কাপড় জুতো পরে রওনা দিলে ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের সঙ্গে। রাস্তায় বেরিয়ে ব্রজরাখাল বললেখুব মন দিয়ে কাজ করবে বড়কুটুম—দেখো আমার বদনাম না হয়। ওরা আবার ব্রাহ্ম কিনা।

–ব্রাহ্ম মানে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—এই তোমরা যেমন হিন্দু, উনি তেমনি ব্রাহ্ম—অর্থাৎ এই দুর্গা কালী গণেশ ও-সব পূজো টুজো করেন না-বলেন পুতুল পূজো, তা সে-সব নিয়ে তোমার কী দরকার—তুমি চাকরি করবে মন দিয়ে-ফাঁকি দেবে না, ব্যস চুকে গেল ল্যাঠা।

ভূতনাথ বললে—আমাকে আমার হিন্দুধর্ম ছাড়তে যদি বলেন–

–তা তো বলবেনই—ব্রজরাখাল বললে।

—তা হলে?

—তুমি ছাড়বে না।

—তাতে যদি চাকরি যায়?

–যাবে, যাবে। তা বলে তো আর রাতারাতি ধর্ম বদলাতে পারে না। ধর্ম হলে তোমার মনের বিশ্বাসের ব্যাপার–আর যদি মনে করো সাত টাকাই তোমার কাছে বড় তা হলে হবে ব্রাহ্ম, ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে নেবে দীক্ষা।

ভূতনাথ উত্তর দিলে না। চুপ করে ভাবতে ভাবতে চললো। খানিক পরে বললে—এ-চাকরিতে তোমার মত আছে তো ব্রজরাখাল—তোমার মত না থাকলে দরকার নেই চাকরির। শেষে হয় তো গরু-শোর খেতে বলবে।

ব্ৰজরাখাল বললে—না না ওসব ভয় তোমার নেই। সুবিনয়বাবু লোক খুব ভালো, আমার চেয়েও ভালো, তবে একটু গোঁড়া। তাতেই বা তোমার কী! ওর ধারণা কেশববাবু যা বলেন তাই-ই ঠিক তাই-ই ধ্রুব আর কারোর কথা কিছু নয়। না হয় তাই-ই বললেন, তাতে তোমারই বা কী আর আমারই বা কী।

ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের কথা কিছু বুঝতে পারলে না।

ব্ৰজরাখাল বলেই চললো—অথচ দেখো বড়কুটুম, আমার ঠাকুর বলতেন—ও হিন্দুধর্মই বলো আর খৃস্টধর্ম কিম্বা ইসলামধর্মই বলো, সব চর্চা করে দেখেছি—দেখলাম আসলে সেই ভগবানকেই সবাই ডাকে—শুধু বিভিন্ন নামে। একটা পুকুরের যেমন অনেকগুলো ঘাট থাকে তার এক ঘাটে হিন্দুরা ঘড়ায় করে ‘জল’ তোলে। আরেক ঘাটে মুসলমানেরা মশকে করে পানি তোলে, আর একটা ঘাটে খৃস্টানরা তোলে ‘ওয়াটার’—আসলে সেই জলই তো সবাই-এর লক্ষ্য—শুধু নামটা নিয়ে মারামারি।

বউবাজার স্ত্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাধববাবুর বাজার পেরিয়ে সোজা উত্তরে চলতে লাগলো দুজনে।

এক ঘণ্টা সময় লাগলো পৌঁছতে।

বাড়ির সামনে বড় সাইনবোর্ডের ওপর লেখা-মোহিনী-সিন্দুর কার্যালয়।

দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ছোটখাটো আপিসের মতন। চেয়ার-টেবিল সাজানো। কাগজ-পত্র গোছানো রয়েছে। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন।

কে একজন এগিয়ে এল সামনে। এসে বললে—বাবু আপনাদের বসতে বলেছেন, আপনারা কি বনমালী সরকার লেন থেকে আসছেন—

খানিক পরে আবার ফিরে এল লোকটা। এসে ব্রজরাখালকে বললে—আপনাকে ওপরে ডাকছেন।

ভূতনাথকে বসতে বলে ব্রজরাখাল ওপরে চলে গেল। ঘরটার চারধারে চেয়ে দেখলো ভূতনাথ। আপিস ঘর। দেয়ালের গায়ে অনেকগুলো ফটো টানানো। ভূতনাথ কাউকে চেনে না। অনেকগুলো সাহেব মেমদের ছবি। সোনালি ফ্রেমে বাঁধা। সদর দরজার মাথার ওপর দেয়ালের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে— “ব্ৰহ্মকৃপাহি কেবলম।

সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ভূতনাথ চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলো। খানিক পরে কোথা থেকে যেন গানের শব্দ কানে এল।

ধন্য ধন্য তুমি বরেণ্য নমি হে জগত বন্দন
প্রণতজনে কৃপাবিধানে ঘুচাও কলুষ বন্ধন।
সত্যসার নির্বিকার সৃজন পালন কারণ
জীবনে মরণে শ্মশানে ভবনে জীবনের অবলম্বন
পূর্ণ পরম অনাদি চরম, অনন্ত জ্ঞান নয়ন
ওতপ্রোত তোমাতে চিত জগত-চিত্তরঞ্জন।
অযাচিত দয়ার সিন্ধু, দুঃখ দারিদ্র ভঞ্জন,
পবিত্র পাপনাশন পতিতজন পাবন।।

গান গাইছে একজন মহিলা। ভূতনাথ অভিভূতের মতন সমস্ত গানটা শুনলে। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। একা একা বসে থাকতে ভূতনাথের কেমন অসহ্য লাগছিল।

খানিক পরে আবার সেই লোকটা ঘরে এসে বললেআপনাকে ওপরে ডাকছেন বাবু।

ভূতনাথ লোকটার পেছন পেছন গিয়ে হাজির হলে ভেতরের বারান্দায়। সেখানে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠবার রাস্তা। ওপরে উঠে লোকটা পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে বললে—ভেতরে যান।

দরজা খুলতেই ভূতনাথ দেখলে। প্রকাণ্ড এক ঘর। মাঝখানে এক গোল টেবিলের চারপাশে নিচু নিচু চেয়ারে বসে আছেন সবাই। আর সব মুখ অচেনা। কেবল ব্রজরাখালের দেখা পেলে। একপাশে।

ভূতনাথকে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে ব্রজরাখাল বললে— এই হলো আমার বড়কুটুম, এখন আপনার হাতেই এর ভার দিলাম। নেহাৎ গ্রাম্য সরল ছেলে—এখনও শহরের হাওয়া গায়ে লাগেনি।

সামনের ভদ্রলোক একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে হাসতে লাগলেন। হা হা করে হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন—বেশ নামটি। ভূতনাথ-ভূতনাথ। কয়েকবার নামটা উচ্চারণ করলেন মুখে। তারপর বললেন—শিবের আর-এক নাম ভূতনাথ। উপনিষদে পড়েছি ‘ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ–ওই শিবেরও বিত্ত নেই— বিভব নেই—ভোলানাথ।

ভূতনাথ বললেবামুনগাছির পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছি কি না, তাই পিসীমা আমার নাম রেখেছিল ভূতনাথ….

খুক খুক করে পাশ থেকে হাসির শব্দ এল।

ভদ্রলোক বললেন—ছি মা, হাসতে নেই, এ-হাসি তোমার চাপল্যের লক্ষণ মা–ভূতনাথবাবু ঠিকই বলেছেন—সেই ব্রহ্মেরই কত নাম—পঞ্চানন্দও এক নাম তার—আপনি কী বলেন ব্ৰজরাখালবাবু

ভূতনাথ ব্ৰজরাখালের উত্তরের দিকে কান না দিয়ে দেখলে যে হাসছে সে একটি মেয়ে। অনেকটা রাধার বয়সী। কিম্বা হয় তত রাধার চেয়েও কিছু বড়। কিন্তু বড় সুন্দর দেখতে। তখনও হাসিটা মুখে লেগে রয়েছে তার। ভূতনাথের চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি আবার হাসিতে ফেটে পড়তে যাচ্ছিলো—কিন্তু কেন জানি না বোধহয় বাবার মুখ চেয়েই চেপে গেল। মেয়েটির পাশে আরেকজন মহিলা বসে আছেন। বোধ হয় মেয়েটির মা। দুই হাতে কী একটা বুনছেন। সেই দিকেই নজর তার। মাঝে মাঝে এক-একবার সুবিনয়বাবুর দিকে তাকাচ্ছেন।

-আমার বাবা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু বুঝলেন ব্রজরাখালবাবু–

সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে গল্প করতে লাগলেন।—ভারি গোঁড়া হিন্দু—কালীভক্ত—প্রতি শনিবার মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কালীপূজো করে রোববার দিন জল গ্রহণ করতেন—আমার এই খুকু যখন হলে উনি নাম রাখলেন জবাময়ী কালীর যেমন জবা—শিবের তেমনি ধুতুরা—তুমি হাসছিলে মা, কিন্তু ভূতনাথবাবুর নামটা আমার ভারি পছন্দ হয়েছে-সেই গানটা গাও তো মা–

এতক্ষণে মহিলাটি হাতের বোনা বন্ধ করে চোখ তুললেন একটু।

–আর তুমি গাইতে বলল না ওকে–এখনি যদি গলা ভাঙিয়ে বসে থাকে, আসছে শনিবার দিন গাইতেই পারবে না যে একেবারে।

ব্রজরাখাল জিজ্ঞেস করলে—আসছে শনিবার গান-বাজনা আছে নাকি?

সুবিনয়বাবু বললেন—আসছে শনিবার আমার জবার জন্মদিন কিনা—তা হলোই বা জন্মদিন—জবার গলায় এ-গানটা আমার ভারি মিষ্টি লাগে ব্ৰজরাখালবাবু-খাটি জয়জয়ন্তীর ধ্রুপদগাও—গাও না মা-বলে সুবিনয়বাবু নিজেই হাতে তাল দিতে দিতে ধরলেন—

–নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ, গান থামিয়ে ব্রজরাখালবাবুর দিকে চেয়ে বললেন—চৌতালে তাল দিয়ে যান তো-বলে আবার আরম্ভ করলেন

—নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ,
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি অনাদি, তুমি অশেষ—

হঠাৎ এক সময় ভূতনাথের মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত কোকিল যেন এক সঙ্গে গান গেয়ে উঠলো। আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষের সমস্ত অশ্রুত সুর এক সঙ্গে ধ্বনিত হয়ে উঠলো। মধুকামারের পাল-যাত্রায় শ্রীকণ্ঠ হাজরাও বুঝি খেদের গান এমন করে গাইতে পারে না। অবাক হয়ে ভূতনাথ দেখলে, বাবার সঙ্গে জবাও গলা মিলিয়ে গাইছে—মুখে তার সে বিদ্রূপের হাসি আর নেই, চোখ অর্ধমুদ্রিত—স্থির মূর্তিতে এক অলোকসামান্য জ্যোতি বেরুচ্ছে। সেই মুহূর্তে জবাকে যেন আরো সুন্দর দেখাতে লাগলো।

–জল স্থল মরুত ব্যোম, পশু মনুষ্য দেবনোক
তুমি সবার সৃজনকার, হৃদাধর ত্রিভুবনেশ।
তুমি এক, তুমি পুরাণ, তুমি অনন্ত সুখ সোপান,
তুমি জ্ঞান, তুমি প্রাণ, তুমি মোক্ষধাম…

পাশের ব্রজরাখালের দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। হাতে তাল দিচ্ছে আর লম্বা লম্বা চুল ভর্তি মাথাটা মাতালের মতো দুলছে–আর চোখ দিয়ে অঝোরধারে জল গড়িয়ে পড়ছে। সুবিনয়বাবুরও সেই অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যজবার মা আপন মনে মাথা নিচু করে একমনে বুনে চলেছেন, সঙ্গীত তার কানে যাচ্ছে। কিনা কে জানে।

এক সময়ে গান থামলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

সুবিনয়বাবু নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। বললেন—তাল কেটেছি নাকি ব্ৰজরাখালবাবু——? আপনি ভালো খোল বাজিয়ে—আর চৌতালটা আপনার ঠিক ধরতেও পারি না আমি-সুরের দিকে নজর দিতে গেলে আমার তালটা ওদিকে আবার গোলমাল হয়ে যায়। তারপর জবার দিকে চেয়ে বললেন—দেখলে তো মা, তুমি ভূতনাথ নাম শুনে হাসছিলে—যে ভূতনাথ সে-ই মহেশ, সে-ই ব্ৰহ্ম, সে-ই বিষ্ণু—সবই সেই এক ধ্রুব নিবিকার অনন্ত জ্ঞান-স্বরূপ পরমাত্মা—উপনিষদ বলেছে ‘একং রূপং বহুধা যঃ কবোতি’—যিনি এক রূপকে বহুপ্রকার করেন—

এবার মহিলাটি আবার মুখ তুললেন, বললেন—কেন তুমি বার বার জবাকে বকছো বলো তো-ও তো হাসেনি।

জবা বললে—না বাবা, আমি হেসেছিলাম।

সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন—কেন হেসেছিলে মা, ভূতনাথবাবুকে দেখে, ঠিক বললো তো।

এবার ভূতনাথ কথা কইলে। বললে হাসলেনই বা উনি, আমি তো সে-জন্যে কিছু মনে করিনি–রাধাও হাসতো।

—রাধা কে? প্রশ্ন করলেন সুবিনয়বাবু।

–নন্দজ্যাঠার মেয়ে—ভূতনাথ জবাব দিলে।

ব্ৰজরাখাল বুঝিয়ে দিলে—আমার পরলোকগতা স্ত্রীর কথা বলছে বড়কুটুম।

—রাধা হাসতো, রাধার সই হরিদাসী হাসত, হরিদাসীর বর হাসতো, আন্না হাসতে, রাধার বিয়েতে বাসর ঘরে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল—তোমার মনে আছে ব্ৰজরাখাল? তা হাসুক গে—আমি কিছু মনে করি না—বলে ভূতনাথ নিজেই হাসলো।

কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। জবা হাসলো, সুবিনয়বাবু হা হা করে হাসলেন, ব্ৰজরাখালও হেসে উঠলো। জবার মা হাসলেন কিনা দেখা গেল না। তিনি নিজের মনেই বুনতে লাগলেন, মুখ নিচু করে।

সুবিনয়বাবু হাসতে হাসতে বললেন-জরাখালবাবু, আপনার বড়কুটুমটি বেশ লোক—ভূতনাথবাবুকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

অতদিনের কথা। এখন সব মনে নেই। কিন্তু সুবিনয়বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি বলছিলে ওঁরা ব্রাহ্ম, কিন্তু বেশ লোক ওঁরানা ব্ৰজরাখাল?

আমি তো ওঁকে খারাপ লোক বলিনি বড়কুটুম—লোক খুব ভালল, বেশ আমুদে মানুষ, ওঁদের সমাজের একনিষ্ঠ সভ্যও বটেন টাকাও আছে অনেক, কিন্তু মনে ওঁর শান্তি নেই।

 

—কেন?

–মাঝে মাঝে ওঁর ওই স্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে যায়, তখন ওঁকে ঘরে বন্ধ করে রাখতে হয়—যখন ভালো থাকেন তখন কেবল আপন মনে একটা কিছু নিয়ে বুনে যান—তা ওসব নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই তুমি তোমার চাকরিটা মন দিয়ে করে যাবে।

রাস্তায় আসতে আসতে ভূতনাথ কেবল সেই কথাটাই ভাবছিল—অমন প্রাণখুলে হা হা করে হাসতে পারেন কী করে সুবিনয়বাবু!

০৫. মোহিনী-সিঁদুর

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরি হয়ে গেল ভূতনাথের।

বার-বাড়িতে রাত্রে শোয়া আর সকাল বেলা স্নান করে একটু জলখাবার খেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে আপিসে পৌঁছনো। তা হেঁটে যেতে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। সকাল থেকেই কাজ শুরু। দুপুর বারোটার সময় ডাকতে আসে ঠাকুর—বাবু ভাত বেড়েছি—

তাড়াতাড়ি হাতের কাজটা রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসা। একতলায় বাড়ির পেছন দিকের সমস্ত ঘরটাই রান্নাঘর। তারই এক কোণে এক একদিন আসন পেতে জলের গ্লাশ দেয় ঠাকুর। কলাপাতার ওপর গরম গরম ভাত ফেলে দেয়, হাতায় করে। বলে—মধ্যিখানটায় একটু গর্ত করুন তো-ডাল দিই—

এক রাশ গরম ভাতের ওপর গরম ডাল পড়ে। তারপর আলুকুমড়োর একটা তরকারি দেয় এক থাবা। কোনো দিন শাকচচ্চড়ি গাদাখানেক।

ছোট বেলায় ফতেপুরে মাছ না হলে খেতে পারতো না ভূতনাথ। তা পরের বাড়ি। এমনিতেই খেতে লজ্জা করে। তার ওপর আবার চাওয়া।

আরো ভাত দিলে যেন ভালো হতো। কিন্তু ঠাকুর যেমন তাড়া দেয়, তাতে কেমন লজ্জা হয়। একদিন জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ-মাছ নেই ঠাকর?

ঠাকুর বলেছিল—গোণাগুন্তি মাছ—সে তো সব ওপরে চলে গিয়েছে—তারপর তাড়া দিয়ে বলে—একটু হাত চালান বাবু, হাবুর মা এখুনি এসে আবার এটো পাড়বে।

সুতরাং কোনো রকমে খাওয়া সেরে নিয়ে আবার কাজে বসতে হয়। কাজ না কাজ। হাজার হাজার প্যাকেট ভর্তি সিঁদুর। সেই কাগজের কৌটোয় সিঁদুর ভরা-তারপর মুখ বন্ধ করে ছাপানো লেবেল লাগিয়ে দেওয়া। এক একটি কৌটোর দাম—আড়াই টাকা। এক মাসের ব্যবহারের জন্য আড়াই টাকা। কত দূর দূর দেশে যায়। কোথায় রাজসাহী, চট্টগ্রাম, সিহাচলম, পেনাঙ, আন্নামালাই, জাভা, বোর্নিও–

ফলাহারী পাঠক সিঁদুর ভরে, প্যাকেট আঁটে, লেবেল লাগায়–

আর চিঠিপত্র লেখে ভূতনাথ। মনি-অর্ডার এলে সুবিনয়বাবুর কাছে পাঠিয়ে দেয়। ভি-পি. করে পার্সেল যায়। যত এজেন্ট আছে, তাদের কাছে পাঠাতে হয় হ্যাণ্ডবিল। নানান ভাষায় লেখা হ্যাবিল। হ্যাণ্ডবিল-এ লেখা থাকত–

‘অদ্ভুত ত্বড়িৎশক্তি সম্পন্ন সিঁদুর। মোহিনী-সিঁদুরে’র গুণে মুগ্ধ হইয়া হাজার হাজার নরনারী অসংখ্য প্রশংসাপত্র পাঠাঁইয়াছেন। কোনো মানুষের জীবনে হতাশ হইয়া আত্মহত্যা করিবার মতো অবস্থা আসিলে ইহার এক প্যাকেট পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন। যাঁহারা জীবনে প্রিয়পাত্র কিম্বা প্রিয়পাত্রীর প্রেম পাইতে চান; প্রিয়জনকে আপনার বশীভূত করিতে চান, প্রণয়িনীকে যদি আপনার করতলগত করিতে চান, কিম্বা যে স্ত্রীলোক আপনাকে ঘৃণা করে, অবজ্ঞা করে বা দূরে পরিহার করে তাহাকে যদি হৃদয়েশ্বরীরূপে লাভ করিতে চান, আমাদের এই বহু পরীক্ষিত বহু প্রশংসিত ‘মোহিনী-সিঁদুর’ পরীক্ষা করিয়া দেখুন। স্বামী-স্ত্রী, প্রভু-ভৃত্য, পিতা-পুত্র, শিক্ষক-ছাত্র, গুরু-শিষ্য সকলের পক্ষেই অপরিহার্য। নিত্য হাজার হাজার গ্রাহক ইহার কল্যাণে বিষময় সংসারে অপার শান্তিলাভ করিতেছেন। ইহা ছাড়া মকদ্দমায় জয়লাভ, দূরারোগ্য ব্যাধির উপশম, নিরুদ্দিষ্ট প্রিয়জনের সাক্ষাৎলাভ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ইহার দ্বারা কার্যসিদ্ধি হয়। এক স্ত্রী এই মোহিনী-সিঁদুর’ ব্যবহার করিয়া তাহার পানাসক্ত স্বামীকে পুনরায় সংসারাশ্রমে ফিরাইয়া আনিয়াছে, আর একজন দারিদ্র্য লাঞ্ছিত হতভাগ্য লটারীতে বিশ সহস্র অর্থ পাইয়া সুখে কালযাপন করিতেছে, আর একজন…বিফলে মূল্য ফেরৎ…সংসারে শান্তি ফিরাইতে, হতভাগ্যদের সৌভাগ্য সঞ্চারে, অপুত্রককে পুত্ৰ মুখ দেখাইতে, ঋণীকে অঋণী করিতে, প্রবাসীকে ঘরে ফিরাইতে, ইহা অদ্বিতীয়.. ইত্যাদি ইত্যাদি–

হ্যাণ্ডবিল ছাড়া পাঁজিতে বিজ্ঞাপনের পাতায় বড় বড় হরফে লেখা থাকতে ‘মোহিনী-সিঁদুর’—‘মোহিনী-সিঁদুর’–

স্বদেশে বিদেশে, বাঙলায়, ইংরেজীতে, জার্মানী, চীন, জাপানী, তারপর হিন্দুস্থানী, গুজরাটী, গুরুমুখী, পুস্তু সর্ব ভাষায় সর্বত্র এই ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র বিজ্ঞাপন।

যত বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো–তত বিক্রির অর্ডার। প্রশংসাপত্রও আসতো অসংখ্য। এক প্যাকেট ব্যবহার করে যারা অল্প ফল পেয়েছে, তারা আরো দু’ প্যাকেটের অর্ডার দিতো।

আরো দুটি পণ্য ছিল সুবিনয়বাবুর। মোহিনী আংটি আর ‘মোহিনী আয়না।

গুণাগুণ অল্পবিস্তর তিনটেরই এক। কিন্তু তিনটের মধ্যে নামডাক ‘মোহিনী-সিঁদুরে’রই বেশি। মোহিনী-সিঁদুরে’র চিঠি পত্র লিখতে লিখতেই হাত ব্যথা হয়ে যেত ভূতনাথের।

আপিস ঘরের পেছনে গুদাম ঘরে ফলাহারী পাঠকের আপিস বা কারখানা। ফলাহারী হেড আর তার দশজন য়্যাসিস্টেন্ট। তারাও হিন্দুস্থানী। আপিসের ছুটির পর যখন তারা বেরোয়, তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত লালে-লাল হয়ে গিয়েছে শরীর।

সিঁদুর ঢালাঢলি, কৌটোয় ভরা, লেবেল আঁটা আর তারপর প্যাকিং করার পর পোস্টাপিসে ডাকে পাঠানো সমস্ত ভার ফলাহারীর। কিন্তু তদারক করতে হবে ভূতনাথকে। কোন্ অর্ডারটি কখন এল, সেটা রেজিস্ট্রি করা, কত তারিখে ডেসপ্যাচ করা হলো— সেটি লিখে রাখা। এজেন্টদের চিঠি লেখা, ভি-পি’র ফরম পূরণ করা।

সুবিনয়বাবু এক একবার সকালের দিকে তদারক করতে আসতেন। বলতেন—কাজকর্ম কেমন হচ্ছে ভূতনাথবাবু—

কালো চাপকান গায়ে, পরনে পায়জামা, কোঁচানো চাদর বুকের ওপর ক্রসের মতন লটকানো। পায়ে কখনো চটি কখনও য্যালবার্ট। এটা সেটা দেখতেন। বলতেন—চমৎকার হচ্ছে ভূতনাথবাবু—বলে একটু পরেই চলে যেতেন। হাসি হাসি মুখ। সদাশিব মানুষ। টাকার ব্যাপারটা নিয়ে যেতে হত ওপরে। ওপরে সেই বড় ঘরটায় বসে থাকতেন তিনি। কখনও আপিসের কাগজপত্র নিয়ে। কখনও বই নিয়ে। হয় তো হেলান দিয়ে একটা কিছু পড়তেন। আশে পাশে সাধারণত কেউ থাকে না।

সই করবার আগে একবার জিজ্ঞেস করেন—এটা ভালো করে দেখে নিয়েছেন ভূতনাথবাবু-তারপর আবার বই-এর দিকে মনোযোগ দেন। বাঁধানো বই সব। আলমারিতে থাকে থাকে সাজানো। দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কামিনীকুমার’, ‘হংসরূপী-রাজপুত্র’, ‘বিজয়-বসন্ত’ প্রভৃতি আরো অনেক বই। সোমপ্রকাশ, ‘বিবিধার্থ-সংগ্রহ’, ‘রহস্য-সন্দৰ্ভ’, ‘ব্রাহ্মিক দিগের প্রতি উপদেশ, ‘ব্ৰহ্মসঙ্গীত ও সংকীর্তন।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় না। একটু পরেই নিচে চলে আসতে হয়।

তারপর ঠাকুর রোজকার মতো ডাকতে আসে—বাবু ভাত বাড়া হয়েছে—খেতে আসুন।

সেই গরম ভাতের ওপর ডালের গর্ত, আর এক থাবা, তরকারি। প্রত্যহের আপিসের কাজের মধ্যে খাওয়াটা যেন এক শাস্তির মতন অসহ্য হয়ে উঠলো।

ফলাহারীদের অন্য ব্যবস্থা। দুপুর বেলা কারখানা ঘরের মধ্যেই পেতলের কাঁসি বেরোয় এক একটা করে। কাগজের ঠোঙা করে ছাতু বেঁধে আনে কাপড়ে, সেটা ঢালে, তার ওপর ঢালে জল। অতি সংক্ষিপ্ত সরল প্রণালী। খাওয়ার পর বাঁ হাতে জলের ঘটিটা উপুড় করে মুখের মধ্যে। কী খাটতে পারে সব! সিঁদুর ঘাঁটতে ঘাঁটতে লাল হয়ে যায় চোখ মুখ—তবু ক্লান্তি নেই। তারা মাইনে পায় পাঁচ টাকা করে। মাসে মাসে মনি-অর্ডার করে তিন টাকা দেশে পাঠায়।

ঠাকুর সেদিন যথারীতি ডাকতে এসেছে। রান্নাঘরের কোণে আসন পেতে বসিয়ে ভাত আর ডাল দিয়ে ঠাকুর বললে—আজ ওই দিয়েই খেতে হবে বাবু-তরকারি হবে না।

 

ভূতনাথ মাথা উচু করে বললে সে কি?

—সব ফুরিয়ে গিয়েছে, কম করে ভাড়ার থেকে আনাজ বেরুলে আমি কী করবো বাবু—ভাড়ার তো আমার হাতে নয়।

ভূতনাথ ভাবলে তাও তো বটে। বললে—ভাড়ারের ভার তবে কার ওপর?

“আজ্ঞে সে তো হাবার মা’র হাতে জবা দিদিমণি পাঠিয়ে দেয়। ভূতনাথ বললে—হাবার মাকে একবার ডাকো দিকি।

এল হাবার মা। আধ-ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ালে দরজার একপাশে।

ঠাকুর বললে—ওই তো হাবার মা এসেছে—ওকে জিজ্ঞেস করুন।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমাদের খাবার জন্যে আনাজ তরকারি কিছু দেওয়া হয়নি—তোমাকে?

ঘোমটার ভেতর থেকে আবার মা কী বললে বোঝা গেল না।

ঠাকুর বুঝিয়ে বললে তাকে–আনাজ-তরকারি কিছু তোমাকে আজ দেওয়া হয়নি-কেরানীবাবু তোমাকে জিজ্ঞেস করছেন।

–আজ্ঞে হ্যাঁ, দেওয়া হয়েছিল। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-আজ কম দেওয়া হয়েছিল কি?

—যেমন বরাদ্দ থাকে তেমনি দেওয়া হয়েছিল।–কতখানি বরাদ্দ থাকে?–আমি নেকাপড়া জানিনে, যা বরাদ্দ থাকে তাই নিয়ে আসি। হাবার মার কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের সমাধান যে পাওয়া যাবে এমন মনে হলো না।

এবার ভূতনাথ ঠাকুরকে বললে–তুমি বলো কর্তাদের যে, বরাদ্দ যেন বাড়ানো হয়—যা দেওয়া হয়, তাতে পেট ভরে না কারো—সারাদিন খাটবো-খুটবো, না খেতে পেলে তোমরাই বা কাজ করতে পারবে কেন—তোমরাও তো উপোষ করবে।

ঠাকুর বললে—তা তো ঠিক বাবু—কিন্তু কর্তাদের ও-কথা বলতে পারবো না।

–কেন পারবে না,সবাই খেতে পেলে কি না-পেলে তা তো তোমাকেই দেখতে হবে?

ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করে ভূতনাথ জানতে পারলে—এ-বাড়ির নিয়ম প্রতিদিন সকাল বেলা জব দিদিমণি ভাড়ার খুলে তালিকা দেখে দেখে সারাদিনের জিনিষ একসঙ্গে বের করে দেয়। বাড়ির লোকজন ছাড়া চাকর-ঠাকুর-ঝি, কেরানীবাবু, গরু-ঘোড়-পাখী সকলের খাবার জিনিষ দিয়ে দেয়। চাকরদের তামাক পর্যন্ত। চাল ডাল তেল নুন তরি-তরকারি, কাঁচা আনাজ, ঘোড়ার দানা, গরুর খোল, ভূষি, চুনি সমস্ত। সমস্ত ওজন করে মেপে দেওয়া। কম পড়বার কথা নয়।

সুবিনয়বাবু যেমন ভালো লোক, তাকে এই নিয়ে বিব্রত করতে কেমন যেন লাগলো। ব্রজরাখালকে বললেও হয়। কিন্তু ব্ৰজরাখালই বা কী ভাববে। হয় তত এর পরে চাকরিটাই হাতছাড়া হবে শেষ পর্যন্ত। এত কষ্টের চাকরি।

বাড়িতে ফিরে এসে ব্ৰজরাখাল বলে—কী গো বড়কুটুম, কেমন চাকরি বাকরি চলছে—কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?

না, কষ্ট আর কী! অন্য কিছু কষ্ট তো নেই তার। তবু মুখ ফুটে বলতে গিয়ে কেমন বাধে যেন। কিন্তু একদিন বলেই ফেললে। বললে—আজকে চালটা একটু বেশি নাও ব্রজরাখাল।

—কেন? পেট ভরে না বুঝি?

—ভরে।

–তবে?

ভূতনাথ বললে—আজ সকাল সকাল খেয়েছি ওবেলা, আর খিদেটাও পেয়েছে একটু বেশি।

সত্যি পিসীমার মতো কে আর সামনে বসিয়ে খাওয়াবে ভূতনাথকে। পেটের কাপড় সরিয়ে পিসীমা পেট দেখে তবে ছাড়ান দিতে। খা একটু দুধ দিয়ে। হরগয়লানী নতুন গরুর দুধ দিয়ে গিয়েছে, তার চাছি পড়েছে এতখানি—তাই দিচ্ছি আর নতুন আমসত্ত্ব। ও ভাত ক’টা ফেলিসনে আর, আজ খাজা কাঁঠালটা ভাঙছি, বোস একটু—কত সব আদর, কত ভালোবাসা।

সন্ধ্যেবেলা নিজের ঘরটাতে বসে ভূতনাথ সেই আগেকার কথাগুলো ভাবে। ব্ৰজরাখাল বড়বাড়ির ভেতরে বাড়ির ছেলেদের পড়াতে চলে গিয়েছে। ডান দিকে নিচু একতলা বাড়িটার বারান্দায় এখন কেউ নেই। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে ইব্রাহিম কোচোয়ান আর ইয়াসিন সহিস। ঘরের ভেতরে টিম টিম করে বাতি জ্বলছে। বোরখা পরা দু একটা মূর্তি কখনও সখনও ছাদের দিকে এসে পড়ে। আর দক্ষিণ দিক থেকে দাসু মেথরের ঢালের চাটির শব্দ ভেসে ভেসে আসে। উত্তরের সদর গেটের দু পাশে রেঢ়ির তেলের বাক্স বাতি দপ দপ করে জ্বলছে—যেন দিন হয়ে গিয়েছে ওখানটায়—ঠিক যেমন রাস্তায় আলো জ্বলে তেমনি। ব্রিজ সিং-এর ডিউটি নয় এখন। নাথু সিং বন্দুক উচিয়ে পুতুলের মতন কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে পাহারা দিচ্ছে।

ব্ৰজরাখালের বাঁয়া তবলা জোড়া নিয়ে এবার বসলো ভূতনাথ। আগেকার অনেক বোল আবার তার মনে আসতে শুরু করেছে। চর্চাটা রাখা ভালো তো। আর তাছাড়া সন্ধ্যেটা এই অচেনা দেশে কাটেই বা কী করে। প্রথমটা আস্তে আস্তে। তারপর একবার লয়-এর স্রোতে গা ঢেলে দিলে আর কোনো দিকে খেয়াল থাকে না। অন্ধকার ঘর। শুধু চাঁদনী রাত থাকলে—দক্ষিণের জানালাটা দিয়ে ঘরে আলো এসে পড়ে। আর ওধারের বাগানের টগর আর চাপা ফুলের গন্ধতে ঘর ভুর ভুর করে সারা রাত। আর তারপর ছুটুকবাবুর আসরে শুরু হয় আর একজোড়া বাঁয়া তবলার চটি। হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ঘাটগুলো বেঁধে নেয় তানপুরার সঙ্গে। এক দিকে তানপুরা ছাড়তে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে সাধা গলার শব্দ বেরিয়ে আসে। খেয়াল দিয়ে কোনো দিন আরম্ভ হয় আসর, কোনো দিন হয় না। কিন্তু জমে বেশি ঠুংরিতে নয় টপ্পায়। সেটা বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে শোনা যায়। নিধুবাবুর টপ্পা।

প্রেমে কী সুখ হোত–
আমি যারে ভালবাসি সে যদি ভালবাসিত।
কিংশুক শোভিত ঘ্রাণে,
কেতকী কণ্টক বিনে
ফুল হোত চন্দনে, ইক্ষুতে ফল ফলিত—

কোনো দিন আরো বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে শোন যায়—মেজকর্তার গাড়ির শব্দ। তখন সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বনমালী সরকার লেন-এর দূর থেকে ইব্রাহিম গাড়ির ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে আসে, ঘোড়ার গতি মন্থর হয়ে যায়। ব্রিজ সিং ঘড় ঘড় শব্দ করে গেট খুলে দেয়। তারপর সেই গাড়ি এসে দাঁড়ায় খাজাঞ্চীখানা আর বৈঠকখানার মধ্যে লম্বা গাড়ি-বারান্দার তলায়। পাশের ঘর থেকে মেজকর্তার চাকর বেণী শব্দ পেয়ে ছুটে যায় নিচে। দরজা খুলে হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে তাকে। এক একদিন পা দুটো খুব টলে। সেদিন বেণীর ঘাড়ে ভর দিয়ে চলেন। অন্দর মহলে আর যান না, বাইরে বসবার ঘরে ঢালা ফরাস তাকিয়া পাশবালিশ আছে, সেইখানেই শয্যা পাতেন। কচিৎ কদাচিৎ যদি কখনও ইচ্ছে হয়, সোজা চলে যান মেজগিন্নীর শোবার ঘরে। কিন্তু মেজগিন্নীর ঘুম বড় সাংঘাতিক। একবার ঘুমোলে কার সাধ্য জাগায় তাকে।

বংশী বলে—বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে মেজকর্তা দমাদম লাথি মারতে থাকেন—ঘরের ভেতরে মেজগিন্নীরও যত ঘুম, গিরিরও ঘুম তত।

শেষে বুঝি গিরির ঘুম ভাঙে। মস্ত বড় ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দেয়। তারপর নিজের বিছানাটা গুটিয়ে নিয়ে বাইরে এসে বারান্দায় আবার পাতে।

কিন্তু ছোটকর্তা আসেন আরো অনেক রাতে। যখন রাত প্রায় শেষ হবার উপক্রম। তখন কেউ জেগে থাকে না। টেরও পায় না কেউ। ঘুমে ঢোলে ব্রিজ সিং। ছোটবাবুর সাদা ওয়েলার-জোড়া পায়ে ঠকঠক শব্দ করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ঢং ঢং বাজে ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেটের ঘণ্টা। ভেতরে জেগে বসে আছেন তিনি একলা। বেশি কথার লোক নন। গাড়ি এসে গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়ালে নিজেই নামেন। বংশী দরজা খুলে বাতিটা জ্বেলে দেয় ঘরের। এক এক করে গায়ের জামা, হাতের হীরের আংটি, পায়ের জুতো খুলে নেয়। তারপর নতুন কোঁচানো ধুতি এগিয়ে দিতে হবে—সেটা পরে শুয়ে পড়বেন।

এ-সব বংশীর কাছে শোনা। এমনি দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।

কিন্তু যদি ভূতনাথের এই ঘরের ছাতের ওপর ওঠা যায়, দেখা যাবে অন্দর মহলের সব আলোগুলো এখন নেভানো। বউদের মহলের বারান্দায় শুধু ঝিলমিলির ফাঁক দিয়ে টিম টিম করে জ্বলছে একটা তেলের ঝাড়। কিন্তু সব চেয়ে উজ্জ্বল বাতিটা জ্বলছে ছোটমা’র ঘরে।

বংশী বলে—ছোটমা তো ঘুমোয় না–সমস্ত রাতই পেরায় ঘুমোয় না।

ভূতনাথ বলে-ঘুমোন না তো—করেন কী?

–ছোটমা যে নেখাপড়ি জামে শালাবাবু, বই পড়ে-নয় তো গল্প করে চিন্তার সঙ্গে—নয় তো পুতুলের জামাকাপড় তৈরি করে দুজনে। ছোটমা’র পুতুলের সঙ্গে চিন্তার পুতুলের বিয়ে হয়। আমরা মুচি খাই—রসমুণ্ডি খাই—নয় তো পূজো হয় যশোদাদুলালের–

—সমস্ত রাত? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—হ্যাঁ মাঝে মাঝে সমস্ত রাত।

তারপর যখন খবর পেছোবে যে, ছোটকর্তা ফিরেছে, তখন আলো নিভবে ছোটমা’র ঘরের। চিন্তা ঘরের দরজায় হুড়কো বন্ধ করে ছোটমা’র ঘরের মেঝের ওপর ছোটমা’র বিছানার পাশে শুয়ে পড়বে।

এ সমস্ত বহুদিন আগের ঘটনা। কিন্তু অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের বাঁকা তৃতীয়ার চাঁদের মতন সমস্ত এখনও আঁকা আছে ভূতনাথের মনে।

 

‘মোহিনী-সিঁদুরে’র আপিসে ঢুকে খাওয়ার কথাটা মনে পড়লেই কেমন যেন ঘৃণা হতে ভূতনাথের। বরাবর পেটুক মানুষ। ভালো জিনিষ খাওয়ার দিকে বরাবরের ঝোঁক তার। বড়বাড়িতে রাত্রের খাওয়া তেমন পছন্দ হয় না। ব্ৰজরাখাল নিরামিষাশী। তাছাড়া নিজের হাতে সে রান্না করে। বাজার করারই সময় হয় না তার। আর এই ষড় রিপুকে বশে আনতেই সে ব্যস্ত। কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য কোনোটাকেই সে প্রশ্রয় না দেবার পক্ষপাতী। সাধন পথে ওরা বড় অন্তরায়।

কিন্তু কালীঘাটের পাঁঠা এনে যখন পেছনের বাগানে বেঁধে রাখা হয়, পরের দিন মাংস খাবার জন্যে, তখন সারা দিন রাত কী চিৎকারটাই না করে। এক একদিন অন্দরের রান্না-বাড়ির আব্রু পেরিয়ে বাইরে ভেসে আসে গরম মশলা আর মাংসের গন্ধ। সারা বাড়িটা সে গন্ধে মাতাল হয়ে যায়।

ব্ৰজরাখালের নাকেও গন্ধ যায়। নাকে কোঁচার কাপড় চাপা দেয়। বলে—জালালে দেখছি।

ভূতনাথ বলে—গন্ধটা ভালো লাগছে না তোমার ব্রজরাখাল? পেঁয়াজ রসুন আর…।

ব্ৰজরাখাল বলে—রাখো তোমার পেঁয়াজ রসুন–শরীরের পক্ষেও কি এত সব মশলা পত্তর ভালো হে—কেবল তমো গুণ বাড়ায়, ও সব তামসিক খাওয়া।

কিন্তু ভূতনাথের পক্ষে লোভ সম্বরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ব্ৰজরাখাল বলে–বুঝি, তোমার রাতের খাওয়াটা সুবিধের হচ্ছে না—কিন্তু সুবিনয়বাবুর বাড়িতে দুপুরবেলাটা তো ভালোই খাও।

কিন্তু ব্রজরাখালকে তার অসুবিধের কথাটা যেন বলতে কেমন বাধে।

সেদিন সকালবেলা আপিস যাওয়ার মুখে হঠাৎ বংশী এসে ডাকলে—শালাবাবু।

সার্ট আর ধুতিটা তখন পরা হয়ে গিয়েছে। জুতোটা পায়ে গলিয়ে বেরোবার বন্দোবস্ত করছে সে। ব্ৰজরাখাল তখন রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত।

বাইরে থেকে বংশী আবার ডাকলে—শালাবাবু।

—কী রে বংশী?

বাইরে আসতেই বংশী হঠাৎ কাছে সরে এল। চারিদিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে গলাটা নিচু করলে। বললে একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

-কী কথা রে—ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে রইল।

বংশী ইতস্তত করে বললে—ছোটমা আপনাকে একবার ডেকেছেন।

-–ছোটমা? ছোটমা কে? বড়বাড়িতে ছোটমা একজনই মাত্র। তবু কি জানি কেন ভূতনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে ছোটমা কে রে!

–আজ্ঞে ছোটকর্তার বউঠাকরুণ, ছোটবউঠাকরুণ এ-বাড়ির—

কানে কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেলে ভূতনাথ। কিন্তু যেন বিশ্বাস হলো না। বললে—আমাকে না মাস্টারবাবুকে?

–মাস্টারবাবুকে নয়, আপনাকে, আমি ঠিক শুনেছি।

এত লোক থাকতে তাকে যে কেন ছোটবউঠাকরুণ ডাকবে তা বুঝতে পারলে না ভূতনাথ। এত আবু চারিদিকে। এতদিন আছে এ-বাড়িতে কোনো দিন কোনো সূত্রে বাড়ির কোনো মেয়েবউকে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি ভূতনাথের। চারদিকে ঝিলিমিলি, পর্দা, পাল্কি—সব চিকে ঢাকা। বাড়ির ভেতরেও বাইরের পুরুষদের যাওয়া নিষেধ। সে-বাড়ির বউ তাকে ডাকছে—সে কী রকম? ছোটমা’র নাম শুনেছে চাকর-বাকরদের কাছে। তাদের কথাবার্তা থেকে ছোটবউঠাকরুণ সম্বন্ধে একটা ধারণাও করে নিয়েছে। কিন্তু বাইরের অজ্ঞাত পুরুষকে ছোটবউঠাকরুণ ডেকে দেখা করতে চেয়েছেন—তাই বা কেমন বিচিত্র ব্যাপার! তাছাড়া এ তো আর সুবিনয়বাবুর বাড়ি নয়। তাঁরা হলেন ব্রাহ্ম। জবাময়ী ভূতনাথের সামনে বেরিয়েছে, কথা বলতেও তার আপত্তি নেই হয় তো কিন্তু তা বলে বড়বাড়ির ছোটবউ?

ভূতনাথ বললে—কী জন্যে, কিছু বলেছেন নাকি তোমার ছোটমা?

—তা কিছু বলেনি।

ভূতনাথ কী বলবে ভেবে পেলে না। ব্ৰজরাখালকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত যাবার আগে।

বংশী বললে—তা হলে আমি সন্ধ্যেবেলা আপনাকে ডেকে নিয়ে যাবো কী বলেন?

ভূতনাথ ‘আচ্ছা’ বলে আপিসে বেরিয়ে পড়লো।

যথাসময়ে ঠাকুর এসে সেদিনও ডাকলে—ভাত বেড়েছি বাবু।

 ০৬. সেদিন তেমন কিছু গোলমাল হলো না

সেদিন তেমন কিছু গোলমাল হলো না। কিছু তরকারিও দিলে পাতে। তবু গত কয়দিন ধরে যেমন ব্যবহার করছিল, তার চেয়ে যেন কিছুটা ভালো। ভূতনাথ নিজের মনে মনে লজ্জিত হলো। ঠাকুরের ওপর অন্যায় করে সে অবিচার করছিল এ ক’দিন। হয় তো তার কোনো হাত নেই। আসলে তার জবা দিদিমণিই হয় তো। ভাঁড়ার থেকে চাল-ডাল তরকারি দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। জবাময়ীর তাচ্ছিল্যের প্রমাণ ভূতনাথ তো আগেই পেয়েছে। যেদিন ব্ৰজরাখালের সঙ্গে সে প্রথম চাকরি হবার দিন এসেছিল। বাপ-মা–পিসীমা’র দেওয়া নামই সকলের থাকে। জবার নামও রেখেছিল সুবিনয়বাবুর কালীভক্ত হিন্দু বাবা। নিজের নামের জন্যে সকলকে পরের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তা ছাড়া ‘ভূতনাথ’ নামটার মধ্যে কোথায় যে হাস্যকরতা আছে তা ভেবে পাওয়া যায় না। সকলেরই ঠাকুর-দেবতার নাম। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের একজন দেবতা মহেশ্বর

—তাঁরই এক নাম ভূতনাথ! আর সুবিনয়বাবুর বাবার নামই তো রামহরি। রামহরি ভট্টাচার্য। তার বেলায়!

সেদিন সুবিনয়বাবুই গল্প করেছিলেন প্রথম যেদিন দীক্ষা নিলাম সে কী কাণ্ড ভূতনাথবাবু—শুনুন তবে—

জবা সুবিনয়বাবুর মাথার পাকা চুল তুলে দিচ্ছিলো। বললে— আমি সে গল্প দশবার শুনেছি বাবা।

–তুমি শুনেছো মা, কিন্তু ভূতনাথবাবু তো শোনেন নি—কী ভূতনাথবাবু, আপনি শুনেছেন নাকি। তারপর ভূতনাথের উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বললেন–আর শুনলেই বা—ভালো জিনিষ দশবার শোনাও ভালো বলে সুবিনয়বাবু গল্প শুরু করেন–

এই যে ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র ব্যবসা দেখছেন, এ আমার বাবার। বাবা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু, তান্ত্রিক, কালীভক্ত। ছোটবেলায় মনে পড়ে-বাড়ির বিগ্রহ কালীমূর্তির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করছেন—‘ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’–।কালীমন্ত্র জপ করতে করতেই তিনি স্বপ্নে এই মন্ত্র পান। সেই মন্ত্রপূত সিঁদুরই ‘মোহিনী-সিঁদুর’ নামে চলে আসছে। তা বাবা ছিলেন বড় গরীব, ওই যজন-যাজন নিয়েই থাকতেন, কিন্তু বোধ হয় দারিদ্র্যের জন্যেই দয়াপরবশ হয়ে কালী ওই মন্ত্র দিয়েছিলেন যাতে সংসারে স্বাচ্ছল্য আসে—আমরা মানুষ হই—দু মুঠো খেতে পাই— মনে আছে খুব ছোটবেলায় বাবা শেখাতেন—বাবা তোমরা কোন্ জাতি? তারপর নিজেই বলতেন—বলো, আমরা ব্রাহ্মণ।

আবার প্রশ্ন—কোন্ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ? নিজেই উত্তর দিতেন বলল, দাক্ষিণাত্য বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তারপর প্রতিদিন পূর্বপুরুষের নাম মুখস্ত করাতেন।

—তোমার নাম কী?

—তোমার পিতার নাম কী?

—তোমার পিতামহের নাম কী?

পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধপ্রপিতামহ-সকলের নাম মুখস্ত করাতেন আমাদের। এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই তাঁকে, বুঝলেন ভূতনাথবাবু–। মনে আছে আমি ছোটবেলায় হুকে। কলকে নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতুম। দিনের মধ্যে অন্তত দশ-বারোটা মাটির কলকে ভাঙতুম—তা বাবা দেখতাম সেই উঠোনের ধারে বসে বসে আমার জন্যে মাটির কলকে তৈরি করে শুকিয়ে পোড়াচ্ছেন। তখন এক পয়সায় আটটা কলকে সে-পয়সাও খরচ করবার মতো সামর্থ্য ছিল না তাঁর।

তারপর অবস্থা ফিরলো। “মোহিনী-সিঁদুরের কৃপায় চালা থেকে পাকা বাড়ি হলো—দোতলা দালান কোঠা হলো—মা’র গায়ে গয়না উঠলো। আর আমি এলাম কলকাতায় পড়তে। সেই পড়াই আমার কাল হলো, আমি চিরদিনের মতো বাবাকে হারালাম। গল্প বলতে বলে হঠাৎ থেমে যান সুবিনয়বাবু।

জবা বলে-থামলেন কেন—বলুন–

সুবিনয়বাবু তেমনি চোখ বুজে মাথা নাড়তে লাগলেন—না আর বলবো না—তোমাদের আমার গল্প শুনতে ভালো লাগে না।

—না, ভালো লাগে বাবা, ভালো লাগে, আপনি বলুন-জবা আদরে বাবার গায়ের ওপর ঢলে পড়লো।

—আপনার ভালো লাগছে, ভূতনাথবাবু—সুবিনয়বাবু এবার ভূতনাথের দিকে চোখ ফেরালেন।

ভূতনাথ বললে—আপনি আমাকে ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে বলেন— আমি বড় লজ্জা পাই।

—তবে তাই হবে—আচ্ছা, তুমি মা একবার জানালা দিয়ে দেখে এসো তত তোমার মা ভাত খেয়েছেন কি না?

জবা চলে গেল।

সুবিনয়বাবু বলতে লাগলেন—যেবার সেই ডায়মণ্ডহারবারে ঝড় হয়—সেই সময় আমার জন্ম-সে এক ভীষণ ঝড়, বোধ হয় ১৮৩৩ সাল সেটা-কলকাতায় সেই প্রথম গুলাউঠো হলো—জন্মেছি ঝড়ের লগ্নে—সারাজীবনটা কেবল ঝড়ের মতনই বয়ে গেল, দীক্ষাও নিলাম আর পৈতেও ত্যাগ করলাম—বাবাকেও একটা চিঠি লিখে দিলাম সব জানিয়ে—বাবা খবর পেয়ে নিজেই দৌড়ে এলেন। এসে নিয়ে গিয়ে দেশে একটা ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন একমাসের মধ্যে আর ঘরের বাইরে বেরোতে পারলাম না—আমি একেবারে বন্দী।

জবা এসে বললে–মা এখনও ভাত খায়নি—বলেছে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে।

-ও, তা হলে বাবা, আমি জবার মাকে ভাত খাইয়ে আসি, আবদার যখন ধরেছেন তখন কিছুতেই তো আর ছাড়বেন না।

ভূতনাথের বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে বললেন—জবার মা’র অসুখটা আবার বেড়েছে কি না কাল থেকে বেশ ভালো থাকেন মাঝে মাঝে—কিন্তু আবার…

সুবিনয়বাবু চলে গেলেন। যাবার সময় বললেন—তুমি বসো মা জবা, ভূতনাথবাবুর সঙ্গে গল্প করো—আমি তোমার মাকে ভাতটা খাইয়ে আসছি।

হঠাৎ ভূতনাথ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। তবু কথা বলতে চেষ্টা করলে–তোমার মা’র এ-রকম অসুখ কতদিনের?

জবা মাথা নিচু করে বসেছিল, কথাটা শুনেই মাথাটা বেঁকিয়ে চাইলে ভূতনাথের দিকে। বললে—আপনি আবার আমার সঙ্গে কথা কইছেন!

—কেন? ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল—কেন? এমন কোনো কড়ার ছিল নাকি যে জবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না সে।

–যদি আমি আবার হেসে ফেলি। সেদিন সুনীতি-ক্লাশে বাবা রিপোর্ট করে দিয়েছেন।

-সুনীতি-ক্লাশ? সে কোথায় আবার?

—সুনীতি-ক্লাশ জানেন না, যেখানে আমি বোজ রোববার সকালবেলা যাই। এ সপ্তাহে সবার রিপোর্ট ভালো, সুজাতাদি আর স্মৃতিদিরা দুজনেই এবারে very good পেয়েছেন, সরল, সুবল, ননীগোপাল…

–ননীগোপাল? কোন ননীগোপাল? কী রকম চেহারা বলল তো-ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে উঠলো। সেই গঞ্জের স্কুলের হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর ছেলে যদি হয়!

—চেনেন নাকি তাকে? ভারি দুষ্ট, আমাকে বাবা যা পয়সা দেন হাতে, জানতে পারলেই কেড়ে নেবে-খালি লজেঞ্জ খাবে। মিস পিগট যদি একবার জানতে পারেন—নাম কাটা যাবে ওর।

ভূতনাথ বললে—একদিন যাবদ তোমাদের সুনীতি-ক্লাশে দেখবে আমাদের ননীগোপাল কি না—

—আপনাকে যেতে দেবে কেন?

—তুমি বলবে আমি তোমার দাদা।

—আপনি তত হিন্দু, আপনি কী করে আমার দাদা হবেন! যারা ব্রাহ্ম তারাই শুধু ওখানে যেতে পায়।

-কী শেখায় সুনীতি-ক্লাশে?

–নীতি শিক্ষা দেয়–সত্য কথা বলা, গুরুজনদের ভক্তি করা, পরমেশ্বরের উপাসনা করা আর ব্ৰহ্ম সঙ্গীত।

—তোমার গান আমার খুব ভালো লাগে, সেদিন শুনেছিলাম—

—আমি রাঁধতেও পারি—আমার জন্মদিনে আমি মুরগী বেঁধেছিলাম—সবাই…।

—তোমরা মুরগী খাও? ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল।

–রোজ রোজ খাই।

—কে রাঁধে?

—কেন ঠাকুর—ওই যে ঠাকুর আছে—ও—

-–ঠাকুর তত হিন্দু।

—তা হোক, রাঁধে—আপনি খান না? বাবা বলেন-মুরগ খেলে শরীর ভালো হয়—

ভূতনাথের কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। তা হোক—চাকরি করতে হলে এ-সব উৎপাত সহ্য করতে হবে। হঠাৎ ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, ভাঁড়ারের জিনিষ কে বের করে দেয় বোজ?

—আমি, কেন? ও তো লেখা আছে সব ‘র আমল থেকে—আমি সেই দেখে দেখে বের করে দিই—আগে মা-ই দিতে, তারপর আমার ভাই মারা যাওয়ার পর থেকেই মা’র শরীর খারাপ হয়ে গেল—আমিই তারপর থেকে…কিন্তু ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

ভূতনাথ উত্তর দেবে কি না ভাবছে এমন সময় সুবিনয়বাবু এসে পড়লেন। বললেন—তোমার মাকে খাইয়ে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে এলাম মা,—তা যাক গে যে-কথা বলছিলাম ভূতনাথবাবু—সেই দীক্ষা নেবার পর—সুবিনয়বাবুর গল্প চলতে লাগলো। পুরোনো দিনের কাহিনী। ঝড়ের লগ্নে জন্ম। ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন সুবিনয়বাবু। আর দলে দলে গ্রামের আশে পাশের বাড়ির মেয়েরা জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখতো। পৈতে ত্যাগ করেছে, ধর্ম ত্যাগ করেছে, এ কেমন অদ্ভুত জীব। কেউ কেউ মা’কে জিজ্ঞেস করতো-মাঠাকরুণ তোমার ছেলে কথা কয়? মুড়ি খেতে দেখে মেয়েরা অবাক হয়ে গিয়েছে–এই তো মুড়ি খাচ্ছে মাঠাকরুণ,

এ তো সবই আমাদেরই মতন।

ভাত খেতে বসে ভূতনাথের এই সব গল্পের কথাই মনে পড়ছিল। খাওয়ার পর উঠে হাত ধুয়ে চলে যাবার সময় ঠাকুর হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো-বাবু

–কী বলো–

ঠাকুরের চোখ দুটো যেন জ্বলছে। লাল টকটকে। ভয় পাবার মতন। গাঁজা খায় নাকি?

ঠাকুর ভূতনাথের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেবাবুর কাছে আপনি আমার নামে নালিশ করেছেন?

—নালিশ! ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল।

—হ্যাঁ নালিশ! কিন্তু এ-ও বলে রাখছি, আমাদের সঙ্গে এমনি করলে এখানে আপনি তো টিকতে পারবেন না

—সে কি, কী বলছো ঠাকুর তুমি?

—হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, কত কেরানীবাবুকে দেখলাম, যদি ভালো চান তো বুঝে শুনে চলবেন—বলে হন্ হন্ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

ঘটনাটা এক মিনিটের বটে। প্রথমটা থতমত লাগিয়ে দেয়। কিন্তু একটু ভাবতেই ভূতনাথ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো। খুব সামান্য ঘটনা তো নয়। আর একদিনও দেরি করা চলবে না এর পর। কিন্তু কী-ই বা উপায় আছে! নিজের টেবিলে এসে আবার কাজে মন দিলে ভূতনাথ। কিন্তু চোখের সামনে কিছু যেন স্পষ্ট দেখা যায় না। ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা। চাকরির জন্যেই সমস্ত অপমান আজ সহ্য করতে হলো তাকে।

হঠাৎ বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেন সুবিনয়বাবু।

মুখ তুলতেই চোখোচোখি হয়ে গেল। যথারীতি কুশল প্রশ্ন করে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভূতনাথ হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পেছন পেছন গিয়ে বললে—আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল স্যার

থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এমন করে কখনও তো কথা বলে ভূতনাথবাবু! বললেন—খুব জরুরী কথা? কেমন যেন তোমাকে উদ্বিগ্ন দেখছি ভূতনাথবাবু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আর এখানে খাবো না কাল থেকে। আমার চাল নেওয়া যেন বন্ধ হয়—

কথাটা শুনে চুপ করে রইলেন সুবিনয়বাবু। একবার চেয়ে দেখলেন ভূতনাথের দিকে। কিন্তু দাড়ি গোঁফের প্রাচুর্যের মধ্যে মুখের কোনো ভাবান্তর প্রকাশ পেলো না। তারপর হঠাৎ ‘আচ্ছা তাই হবে’–বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।

ভূতনাথ নিজের টেবিলে এসে আবার বসলো। কাজ করতে আর মন বসে না। এখানে খাওয়া তো বন্ধ, তারপর! তারপর ব্ৰজরাখাল ভরসা। ব্রজরাখালকে মুক্তি দিতে পারলে না ভূতনাথ। এবারও সেই ব্রজরাখালেরই ওপর নির্ভর করতে হবে।

কিম্বা যদি খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত না হয়, তাকে অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা দেখতে হবে। ব্রজরাখাল ওদিকে চেষ্টা করতে থাকুক, ভূতনাথ নিজেও ঘুরে চেষ্টা করবে। তারপর যা হয় হোক।

কিন্তু বিকেলবেলা আপিস থেকে বেরোবার আগেই হঠাৎ ডাক এল।

ফলাহারী পাঠক এসে বললে—মালিক আপনাকে একবার ডাকছে,কেরানীবাবু—

ফলাহারী পাঠকের হাসি মুখ দেখে ভূতনাথের কেমন যেন অবাক লাগলো। জিজ্ঞেস করলে—কী ব্যাপার ফলাহারী।

ফলাহারী বললে—নিজের চোখে গিয়ে দেখুন বাবু–

দোতলায় নয়। একতলায় ওপরে ওঠবার রাস্তাতেই সুবিনয়বাবুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। একেবারে রান্নাঘরের দিক থেকেই শব্দটা আসছে।

সামনে গিয়ে ভূতনাথ আরো অবাক। সুবিনয়বাবু একলা নন। জবাও পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

সুবিনয়বাবু সিংহ-গর্জনে বলছেন—রাখ রাখ হাত বেড়ি রাখ— এখনি ঘর থেকে বের হয়ে যা

ঠাকুর ঠক ঠক করে সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

সুবিনয়বাবু আবার চিৎকার করে উঠলেন—বেরিয়ে যা এখনি, এক মুহূর্তও আর তোকে স্থান দেওয়া চলবে না—বেরিয়ে যা, হাতা বেড়ি রাখ—

জবা পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে সব শুনছে—

হঠাৎ ভূতনাথকে দেখেই সুবিনয়বাবু বললেন—ঠাকুর তোমায় কী বলেছে ভূতনাথবাবু বলো তো? এসো এদিকে সামনে এসো–

ভূতনাথ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। সুবিনয়বাবুর এ-মূর্তি কখনও সে দেখেনি আগে। বললে-তেমন কিছু বলেনি আমাকে ঠাকুর—আপনি…।

সুবিনয়বাবু হঠাৎ জুতোসুদ্ধ পা’টা মেঝের ওপর সজোরে ঠুকে বললেন—আঃ, কী বলেছে তাই বলে? বাজে কথা শুনতে চাই না

—আজ্ঞে ও বলেছিল ওদের সঙ্গে এমন করলে আমি এখানে টিকতে পারবো না-ওই পর্যন্ত আমাকে অপমান কিছু করেনি

সুবিনয়বাবু বললেন-তা হলে বলতে আর বাকি রেখেছে কি? তোমায় দু’ ঘা জুতো মারলে কি সন্তুষ্ট হতে ভূতনাথবাবু? বলে ঠাকুরের দিকে ফিরে বললেন—যা তুই, এ-বাড়ির চাকরি গেল তোর—এখানে তো টিকতে পারলিই নে, গায়েও টিকতে পারবি কি না পরে ভাববো–

যে-কথা সেই কাজ। আর মুহূর্ত মাত্র দেরি নয়। ঠাকুর নিজের কাপড়-গামছা গুছিয়ে পুটলি বেঁধে নিয়ে তৈরি হলো। ” তারপর চোরের মতন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে।

সেদিনকার সেই ঘটনায় ভূতনাথের মনটা যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল। সুবিনয়বাবু বলেছিলেন—তোমরা ইয়ং বেঙ্গল বড় মিমিনে ভূতনাথবাবু, সেইজন্যেই সবাই তোমাদের অপমান করতে সাহস পায়-গুণ্ডার ভয়ে মেয়েদের পুরে রেখেছে পর্দার মধ্যে আর ওদিকে গোরার ভয়ে তেত্রিশ কোটি লোক দেশটাকে পরাধীন করে রেখেছে—তোমাদের গলায় দড়ি জোটে না—

ঠিক এমন কথা সুবিনয়বাবুর মুখ থেকে শোনবার আশা করেনি ভূতনাথ। আমতা আমতা করে বললে—আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি—

সুবিনয়বাবু আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন—তা হলে বলতে চাও-জবা মা মিথ্যে কথা বলেছে–

হঠাৎ জবার দিকে চোখ পড়তেই জবা বলে উঠলো—আমি যে নিজের কানে সব শুনেছি ভূতনাথবাবু, আপনি ঠিক বলুন তো ঠাকুর আপনাকে শাসিয়ে ছিল কি না?

ভূতনাথ বললে কিন্তু সে তো অন্য কারণে–

—কী কারণে, বলুন—জবা জবাবের জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইলো।

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না। একটু ভেবে বললে—ঠাকুর বলছিল, আমি নাকি পেট ভরে খেতে পাই না বলে আপনার কাছে নালিশ করেছি।

সুবিনয়বাবু বললেন—আমার তো তাই বক্তব্য—তুমি এতদিন নালিশ করোনি কেন ভূতনাথবাবু?

জবা বাবার দিকে চেয়ে জবাব দিলে—ভূতনাথবাবু বোধ হয় ভেবেছিলেন আমি কম করে ভাড়ার বার করে দিই।

—তুমি তাই ভেবেছিলে নাকি, ভূতনাথবাবু?—সুবিনয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন।

ভূতনাথ কিছু জবাব দেবার আগেই জবা বললে আপনি যা ভেবেছিলেন বাবা, ভূতনাথবাবু তেমন লোক নন। দেখলেন তো, ব্ৰজরাখালবাবু বলেছিলেন—সরল পাড়াগাঁয়ের ছেলে—এখন বুঝুন—আচ্ছা, আপনাকে কম খেতে দিয়ে আমার কী স্বার্থ আছে বলুন–আপনার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক? আপনি চাকরি করবেন, মাইনে নেবেন, পেট ভরে খেয়ে যাবেন সেটা আপনার ন্যায্য পাওনা-অসুবিধে হয় নালিশ করবেন–

—ঠিক কথা, জবা ঠিক কথাই বলেছে—তুমি এতদিন নালিশ করোনি কেন ভূতনাথবাবু?

জবা তেমনি উত্তেজিত হয়ে বলে চললো—উনি ঠাকুরের কথাই ধ্রুব বলে জেনেছিলেন, আর আমাকেই চোর বলে ঠিক করেছিলেন–তাই রাগ করে আপনার কাছে ভাত খাবেন না বলেছিলেন— বাবা আপনি ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করুন তো সত্যি করে উনি বলুন যা বলছি আমি সত্যি কি না?

–সত্যি তুমি তাই ভেবেছিলে নাকি ভূতনাবাবু?

জবা আবার বলতে লাগলো—কিন্তু ভাগ্যিস আমি নিজের কানে শুনতে পেলাম কথাটা। উত্তেজনার মুখে জবা যেন আরো কী কী সব বলে গেল, সব কথা ভূতনাথের কানে গেল না। ঘটনাচক্র এমনই দাঁড়ালো যেন ভূতনাথই আসল অপরাধী ভূতনাথই যেন সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূলে। আসামী একমাত্র সে-ই। সুবিনয়বাবু আর তার মেয়ে দুজনে মিলে ভূতনাথের অপরাধেরই যেন বিচার করতে বসেছেন। ভূতনাথের চোখ কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো।

যখন আবার তার সম্বিৎ ফিরে এল তখন খেয়াল হলো সুবিনয়বাবু বলছেন—অন্যায় যারা করে তাদের যতখানি অপরাধ, সেই অন্যায় যারা ভীরুর মতো সহ্য করে তাদের অপরাধও কি কম সুরেন বাড়য্যে মশাই-এর কথাটা ভাবব তো একবার, একরকম বিনাদোষেই তাঁর সেদিন চাকরি গেল— ভাবো একবার গোরাদের অত্যাচারের কথা–পয়সা দিয়েও রেলের কামরায় সাহেবদের সঙ্গে একসঙ্গে যাবার অধিকার নেই—সত্যি কথা বললে হয় রাজদ্রোহ-বুটের লাথির চোটে চা-বাগানের কুলির পিলে ফেটে গেলেও প্রতিবাদ করলে হয় জেল—এমনি করে আর কতদিন অত্যাচার সহ্য করবে ভূতনাথবাবু? একদিকে গোঁড়া বামুনদের অত্যাচার, বিলেত গেলেই, মুরগী খেলেই জাতিচ্যুত। আর একদিকে সাহেবদের লাথি-ইয়ং বেঙ্গল তোমরা, তোমরাই তো ভরসা—আমরা আর ক’দিনের–

অভিভূতের মতে কখন যে ভূতনাথ রাস্তায় বেরিয়েছে, কখন বাড়ির পথে চলতে শুরু করেছে খেয়াল ছিল না। গোলদিঘীর কাছে আসতেই খোলা হাওয়ার স্পর্শ লেগে সমস্ত শিরা উপশিরাগুলো যেন আবার সজীব হয়ে উঠলো। ভূতনাথের মনে হলো যেন কিছুক্ষণ আগে তার আপাদমস্তক বেঁধে কেউ চাবুক মেরে ছেড়ে দিয়েছে। সমস্ত শরীরে যেন এখনও তার যন্ত্রণার সঙ্কেত। সুবিনয়বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসবার সময় সে তো কিছু বলে আসেনি। আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা নয়। কিন্তু ওদের ভুল সংশোধনের চেষ্টাও তো ও করতে পারতো। কিম্বা ক্ষমা ভিক্ষা। জবাকে নীচ প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা তো তার ছিল না। ঠাকুরকেই সে তত অবিশ্বাস করে এসেছে। ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগই তো সে করতে গিয়েছিলো।

আবার ফিরলে ভূতনাথ। চারদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। তবু যত অন্ধকারই হোক, যত রাত্ৰিই হোক আজ, ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে ফিরে গিয়ে আবার তাকে দুজনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে।

পাশে একটা মদের দোকান। উগ্র গন্ধ নাকে এল। ভেতরে বাইরে ভিড়। সামনে মাটির ওপর বসে পড়েছে ভাড় নিয়ে লোকগুলো। আবছা অন্ধকারেও যেন হঠাৎ চমকে উঠলো ভূতনাথ! ঠাকুর না!

ভালো করে চেয়ে দেখবার সাহস হলো না তার। এক ঘণ্টা আগে যার চাকরি গিয়েছে সে-ও বুঝি বসে গিয়েছে এখানে ভাঁড় নিয়ে। হন্ হন্ করে পা চালিয়ে সোজা চলতে লাগলো ভূতনাথ। ঠাকুর তাকে দেখতে না পেলেই ভালো। অপ্রকৃতিস্থ মানুষ ভূতনাথের যুক্তিগুলো বুঝবে না ঠিক।

আরো আধ ঘণ্টা পরে যখন ভূতনাথ ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে গিয়ে পেঁছিলো তখন সদর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দরজা খুলে দিলে বৈজু দারোয়ান। বললে—আবার ফিরে এলেন যে কেরানীবাবু?

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-বাবু কোথায়?

-ওপরে।

সোজা মন্ত্রচালিতের মতো ওপরে গিয়ে বড় হলঘরে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। এদিক-ওদিক সব দিকে চেয়ে দেখলে ‘ভূতনাথ। অন্দরে যাবে কি না ভাবছে—হঠাৎ হাবার মা সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো—

হাবার মা বললে—বাবু এখন মাকে খাওয়াচ্ছেন।

—আর দিদিমণি?

—নিচে রান্নাঘরে।

সেই সিঁড়ি দিয়ে আবার তেমনি করে নিচে নেমে এসে সোজ। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো ভূতনাথ। চারজন ঝি সাহায্য করছে। জবাকে। জবা রান্না করছে। এ দৃশ্য হয় তো এ-বাড়ির লোকের কাছে নতুন নয়—কিন্তু ভূতনাথের কাছে অভিনব মনে হলো। পেছন থেকে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ দেখতে লাগলো জবাকে। হঠাৎ সেই অবস্থায় ভূতনাথের মনে হলো জবাই তো এ-বাড়ির আসল গৃহিণী।

পেছন ফিরে কী একটা জিনিষ নিতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়লো।

নজরে পড়তে জবাও অবাক হয়ে গিয়েছে। বললে—একি, আবার ফিরে এলেন যে আপনি–বাবা তো ওপরে।

ভূতনাথ প্রথমটা কেমন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর বললে—তোমার সঙ্গেই আমার দরকার ছিল জবা—আজকে আমার সত্যি বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে—বাবাকে বলল তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন

আরো যেন কী কী বলবার ছিল ভূতনাথের, কিন্তু আর কিছু তার মুখ দিয়ে বেরোলে না।

জবা হেসে ফেললে। বললে—আশ্চর্য, এই কথা বলতেই আবার এখন ফিরে এলেন নাকি?

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে ভেবে পেলে না!

জবা এবার হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—যে আপনার নাম রেখেছিল, তার দূরদৃষ্টির প্রশংসা করছি—তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলে কিন্তু কেন? কেন আপনি ক্ষমা চান বলুন তো?

ভূতনাথ একটু ইতস্তত করে বললে—আমার জন্যেই তো তোমায় আজ রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছে–আমার জন্যেই তো ঠাকুরকে।

জবা বললে—রান্না করতে আমি ভয় পাই না ভূতনাথবাবু, কারণ বাবা যার-তার হাতের রান্না খান না—ঠাকুর নেহাৎ দেশের লোক ছিল তাই…আর…কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কখ—আপনি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছেন তো?

ভূতনাথ বুঝতে পারলে না। বললে—কীসের ভয়?

—জাত যাওয়ার ভয়।

–কেন?

—এবার থেকে তো আমিই রান্না করবো—ভুলে যাচ্ছেন কেন? আমি তো ম্লেচ্ছো।

কথাটা ভাববার মতন। ভূতনাথও হঠাৎ কথাটার জবাব দিতে পারলে না।

জবা বললে—আজ বাসায় গিয়ে ভাবুন—সমস্ত রাত ধরে সেইটেই ভাবুন আগে—তারপর কাল যা বলবেন, সেই ব্যবস্থা করবে—এখন রাত হয়ে গেল–আপনি বাড়ি যান বরং—বলে উনুনে আর একটা হাঁড়ি চড়িয়ে দিলে।

ভূতনাথ নির্বোধের মতো আস্তে আস্তে বাইরে চলে আসছিল। অন্ধকারে রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়ে পেছনে যেন জবার গলার আওয়াজ পেলে—

—শুনুন।

ভূতনাথ আবার ফিরলো।

জবা বললে–বৈজুকে সঙ্গে নিয়ে যান—রাত্তির হয়ে গিয়েছে—এদিককার রাস্তাটা খারাপ—আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক ও–

ভূতনাথ মুখ তুলে জবার চোখের দিকে চেয়ে দেখলে। কথাটার মধ্যে বিদ্রূপের খোঁচা আছে যেন!

কিন্তু অন্ধকারে জবার মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না।

ভূতনাথ আর সময় নষ্ট না করে রাস্তায় পা বাড়ালো। কেন মিছিমিছি সে আবার ফিরে এল। কার কাছে সে ক্ষমা চাইলে! কে জানে, কী সমাজের মানুষ এরা সবাই। রাধা, আন্না, হরিদাসী তারা তো কেউ এমন আড়ষ্ট করে কথা বলতো না। শহরের সব মেয়েরাই কি এমনি? না শুধু ব্রাহ্মসমাজের মেয়েরাই এই রকম।

ভূতনাথ চলতে চলতে বললে—না, সঙ্গে কারোর যাবার দরকার হবে না—আমি মেয়েমানুষ নই।

 ০৭. বনমালী সরকার লেন

বনমালী সরকার লেন-এর বড়বাড়ির সামনে আসতেই ব্রিজ সিং দেখতে পেয়ে ডাকলে—এ শালাবাবু, এ শালাবাবু—এ–

ভূতনাথ প্রথমটায় অবাক হয়ে গেল। তাকে হঠাৎ ডাকে কেন? তারপর বললে—কী দারোয়ান?

–আরে আপনাকে ছুটুকবাবু ডাকিয়েছেন–

ভূতনাথ আরো অবাক হয়ে গেল। ছুটুকবাবু তাকে ডাকবেন কেন! ব্ৰজরাখাল কিছু জানে নাকি। ছুটুকবাবু তাকে চিনলেই বা কী করে! বড়বাড়িতে কে-ই বা তাকে চেনে। সবার অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে রোজ বাড়িতে এসে ঢোকে সে——আবার সকালবেলা নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় চাকরি করতে। কারুর সঙ্গে পরিচয় বা আলাপ করবার সাহসও হয় না তার। বংশী অবশ্য আসে মাঝে মাঝে। নিজের সমস্যা নিয়ে সে বিব্রত। তার কাছেই এ-বাড়ির সকলের নাম শুনেছে সে। স্নান করতে গিয়ে ভিস্তিখানার মধ্যে অন্য চাকর-বাকরদের সঙ্গে কথাবার্তা কয়েছে একটু কিন্তু সে সামান্যই।

ওই ভিস্তিখানার পাশ দিয়ে যেতেই একদিন লোচন ধরেছিল। খোঁচা খোঁচা কদমফুলের মতো দাড়ি। গলায় দু’ সারি কণ্ঠী। একটা চোখ বোধ হয় ট্যারা। বুড়ো মানুষ বটে।

তখন আপিস যাবার তাড়া ছিল। কোনোরকমে একটুখানি জল নিয়ে স্নান সেরে হাঁটা দিতে হবে। কিন্তু ভিস্তিখানায় তখন জল নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। জল তুলছে শ্যামসুন্দর। সকাল বেলায় এ-বাড়িতে বিশেষ তাড়াহুড়ো থাকে না। কর্তারা বেলা করে ওঠেন। তাই বেলাতেই কাজের চাপ।

লোচন ডেকে বসিয়েছিল বেঞ্চিতে। বললে—অধীনের নাম লোচন দাস–

চারিদিকে হুঁকো গড়গড়া ফরসি আর তামাকের বোয়েম। দেয়ালের গায়ে সার সার নল ঝুলছে। লাল নীল রেশমের সিস্কের জরির কাজ করা সব। হুঁকোর নলের মধ্যে শিক পুরে দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে।

শিক চালাতে চালাতে লোচন বললে—তামাক ইচ্ছে করবেন নাকি শালাবাবু

এ-বাড়িতে শালাবাবু নামেই ভূতনাথকে সবাই চেনে। আর সুবিনয়বাবুর বাড়িতে সে কেরানীবাবু।

ভূতনাথ বললে—তামাক খাইনে তো আমি–

কথাটা শুনে লোচন মনোযোগ সহকারে ভূতনাথের দিকে চেয়ে দেখলে খানিকক্ষণ, তারপর বললে-কিন্তুক এই তো তামাক ধরবার বয়েস আপনার—এবার ধরে ফেলুন আজ্ঞে—আর দেরি করবেন না

ভূতনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। ভূষণ কাকা তামাক খেতে খুব। রাধার বাবা নন্দজ্যাঠাও তামাক খেতেন। তাছাড়া বারোয়ারি ক্লাবের যাত্রার দলে ছোট বড় সবাই কম বেশি তামাক খেতে। কেউ সামনে—কেউ বা লুকিয়ে। মল্লিকদের তারাপদ খেতে ‘বার্ডস-আই’। একবার যাত্রাঘরের প্রায়-নিভন্ত হুঁকোতে টানও দিয়েছিল ভূতনাথ। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিল তখনি। বাইরে রসিক মাস্টার আসছিল। ঘরে ঢুকতেই বললে—কাশে কে—

তারপর ভূতনাথকে দেখে বললেও, নতুন খাচ্ছো বুঝি ছোকরা—তা প্রথম প্রথম অমন হবেই তো-একটু জল খাওহেঁচকি উঠবে না–

সেই হেঁচকির চোটে আর খাওয়া হলো না তামাক। তারপর কলকাতায় এসে ব্ৰজরাখালের সঙ্গেই কাটলো দিনরাত। শহরের আশে পাশে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে ব্ৰজরাখাল। তার ওসব নেশা-টেশার বালাই নেই। আর সুবিনয়বাবু ঘোর ব্রাহ্ম। তার বাড়িতে ও-পাটই নেই। ফলাহারী পাঠকরা বিড়ি খায়—তাও কারখানার ভেতরে বসে নয়। রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে খেয়ে আসে।

লোচন বললে-তেল মাখার পরেই তামাকটা জমে কি না— দিই সেজে—বলে সত্যি সত্যিই সাজতে লাগলো লোচন। বললে –মেজকত্তা যেটা ভাত খাবার আগে খান—সেই তামাকটা দিই আপনাকে—দেখবেন খিদে হবে—রাত্তিরে ঘুম হবে ভালো।

ভূতনাথ বললে—না লোচন, তামাক আমাকে ধরিও না— গরীব লোক, শেষকালে—

লোচন বললে–পয়সা খরচ আপনার কিসে হচ্ছে—এই তো ভৈরববাবু খান–বাড়িতে তামাকের পাট রাখেননি—আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছি—দিনে একটি করে পয়সা দেন, যতবার খুশি খেয়ে যান—ওঁর ডাবা হুঁকো আমি কাউকে ছুঁতে দিইনে—

লোচন বেশ চুরিয়ে চুরিয়ে তামাক সাজতে সাজতে বললে— এ-বাড়িতে কোনো জিনিষের তো আর হিসেব নেই—ছত্রিশ রকমের নেশা বাবুদের-তারি মধ্যে যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন ওই তামাকটাই যা খান—ওই যে ছুটুকবাবুকে দেখেছেন তো–

ভূতনাথ বললে—দেখেছি বৈ কি-ওই যে গানের আসর বসান–

—আজ্ঞে, ওই ছুটুকবাবুকে তো আমিই ধরিয়েছি—হালের ছোকরা মানুষ—তামাকের চেয়ে সিগারেটের দিকেই ঝোক বেশি, দশ পয়সায় এক কৌটো সিগারেট হয়—আর বাহারও খোলে চেহারার—আমি একদিন বড়মাকে গিয়ে বললাম—খোকাবাবুর বয়েস হচ্ছে, এবার তামাক ধরিয়ে দেই—

তা বড়মা বললেন—তামাক ধরাবি খোকাবাবুকে তা আমার অনুমতি কেন–

বড়মা আমার ভারি রাশভারি মানুষ, বিধবা হয়েছেন ওই খোকাবাবু হবার পরকারো সাতে পাঁচে থাকেন না, চেহারা নয় তো, যেন সাক্ষাৎ ভগবতী।

আমি হেসে বললাম—তা কি হয় বড়মা, যদ্দিন আপনি বেঁচে আছেন তদ্দিন আপনার হুকুম না মেনে কি কিছু করতে পারিশেষকালে অধমকে অপরাধী করবেন আপনারা সবাই

লোচন বলতে লাগলো তারপর থেকে খোলাখুলি হুঁকোর ব্যবস্থা করে ফেললাম, খাজাঞ্চীখানায় গিয়ে সরকারবাবুকে ধরলুম, বড়মা’র হুকুম পেয়েছি—আর কার তোয়াক্কা–চিৎপুরের নতুন বাজার থেকে রূপোর গড়গড়া, ফরসি সব এল—ভসচায্যি মশাইকে দিয়ে দিনক্ষণ দেখিয়ে হাতে নল ধরিয়ে দিলুম-কলকেয় ফুঁ দিতে দিতে লোচন বললে—গোলাপ জল দিয়ে কাশীর কলকেয় বেশ করে তাওয়া দিয়ে বালাখানা তামাক সেজেছিলুম, ছুটুকবাবু খেয়ে এক গাল হাসি, ভারি খুশি হয়েছিলেন, একটু কাশি নয়, হেঁচকি নয়—বললে বিশ্বেস করবেন না, নগদ এক টাকা আমায় বকশিস করে ফেললেন, আর সরকারবাবুকে বলে দিলেন আমার নামে একটা গামছার খরচা খাতায় লিখতে

তারপর একটা কড়ি বাঁধা ডাবা হুঁকোয় কলকে বসিয়ে ভূতনাথের দিকে এগিয়ে দিলে। বললে—এটা বামুনের হুঁকোতারকবাবু মতিবাবু সব এতেই খান–

ভূতনাথ বললে—কেন মিছিমিছি পেড়াপীড়ি করছে লোচন, আমি ও খাইনে—

—এ কেমনধারা কথা হলো আজ্ঞে?

লোচন যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে এল। তারপর যেন একটা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করতে পেরেছে এমনি ভাবে বললে মরুকগে তা না হয় আপনি একটা করে আধলাই দেবেন রোজ, আমি তো রইলাম, রোজ এসে খেয়ে যাবেন যখন ইচ্ছে হয়–এই যে আজ দেখছেন এ-বাড়িতে সকলের মুখে মুখে হুঁকো, এ কেবল এই অধমের জন্যেই, নইলে কবে উঠে যেতে এ-বাড়ি থেকে তামাক খাওয়ার পাট-আর তামাক খাওয়াই যদি উঠে যায় তো এ অধমের চাকরি কিসে থাকে বলুন তোএতদিন ধরে তামাক সেজে সেজে, এখন বুড়ো বয়সে তো আর ঘর ঝাঁট দেওয়া কাপড় কুঁচোনো কি মোসায়েবি করা পোষাবে না—

ভূতনাথ বললে—তা এতদিন ধরে তুমি এই কাজ করছে, এখন কি আর তা বলে তোমার জবাব হয়ে যাবে রাতারাতি

—তা হুজুর সবই সম্ভব, এই দেখুন না বাবুরা শুনছি মটর গাড়ি কিনবে, তা কিনলে ইব্রাহিম মিয়ার চাকরি কি আর থাকবে, আগে এই বাড়িতেই ছোটবেলায় দেখেছি পাঁচখানা পাল্কি, এখন যেখানে দাসু জমাদারের ঘর দেখছেন ওইখানে থাকতে পাল্কি-বেহারারা, কোথায় সব চলে গেল—এখন চুরুট সিগারেট যদি বাবুরা ধরে তা হলে গড়গড়া হুঁকো কে আর খাবে বলুন-–

লোচন আরো বলতে লাগলোবাবু এই বয়েসে কত দেখলুম —ঘোড়ার টেরাম ছিল—এখন কলের টেরাম হলো—তারপর কলের গাড়িও হবে—তা আর ভেবেই বা কী হবে, একদিন হয় তো হুঁকো কেউ খেতেই চাইবে না, তখন…কিন্তু তার আগেই যেন যেতে পারি বাবু—নিন—ধরুন, গুলের আগুন কি না—গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে—তাহলে ওই কথাই রইলো, আপনি একটা করে আধলা-ই দেবেন—

কিন্তু ভূতনাথকে নিতে হলো না। বাধা পড়লো।

—এই যে ভৈরববাবু এসে গিয়েছেন।

লোচন তাড়াতাড়ি ভৈরবাবুর হুঁকো তৈরি করতে ভেতরে গেল। ভূতনাথ চেয়ে দেখলে—বাবু বটে ভৈরববাবু! ঢেউখেলানো বাড়ি চুল, বাঁকা সিঁথি, পরনে ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি, গায়ে চকচকে বেনিয়ান, গলায় মিহি চুনোট করা উড়নি, পায়ে বগলস আঁটা চিনে-বাড়ির জুতো

লোচন হুঁকো বাড়িয়ে দিয়ে বললে—আজ যে এত সকালসকাল ভৈরববাবু?

—আজ যে ছেনি দত্তর সঙ্গে পায়রার লড়াই আছে রে— শুনিসনি তুই—মেজবাবু সেবার হেরে গিয়েছিল না, এবার পশ্চিম থেকে নতুন পায়রা এসেছে-ছেনি দত্তর গুমোর ভাঙবো এবার, ভালো গমের দানা খাওয়ানো হচ্ছে তো ওই জন্যে—এবার দেখৰি ছেনি দত্তর পায়রা তিনবার চক্কর খেয়েই বোম্-এ বসে পড়বে— মেজবাবুর সঙ্গে টেক্কা দিতে এসেছে ঠঠনের দত্তরা—

খানিক ভুড়ক ভুড়ক করে হুঁকো টানতে লাগলো ভৈরববাবু—

লোচন বললে-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো হুজুর–

—বল না–

—শুনেছি ছেনিবাবু নাকি হাটখোলায় তেনার মেয়েমানুষকে পাকাবাড়ি করে দিয়েছে—

–শুনছিস ঠিকই লোচন, কিন্তু সে-বাড়ি তিন-তিনবার মর্টগেজ হয়ে এখন সে-বাড়ি মায় মেয়েমানুষ মল্লিকদের হাতে গিয়ে পড়েছে—সে খবর রাখিস–মাগগি গণ্ডার বাজারে মেয়েমানুষ পোষা ছেনি দত্তর কম্ম নয়—আর এদিকে আমাদের চুঁচড়োর বাগানে গিয়েছিলি নাকি এদানি?

—আজ্ঞে না।

—গিয়ে একদিন দেখে আসিস লোচন, খড়দা’র রামলীলার মেলায় সেদিন তিনটে মেয়েমানুষকেই নিয়ে গিয়েছিল মেজবাবু, দূর থেকে ছেনি দত্ত আড় চোখে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছিল— মেজবাবু বারণ করলো, নইলে শালাকে…

হঠাৎ এতক্ষণে ভূতনাথের দিকে নজর পড়তেই জিজ্ঞেস করলো —এ কে রে লোচন?

—আজ্ঞে উনি আমাদের মাস্টারবাবুর শালা, এখানেই থাকেন।

ভৈরববাবু তামাক খাওয়া বন্ধ করে বললে-তাই নাকি? কী নাম তোমার ছোকরা?

ভূতনাথ বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে—আমার নাম শ্ৰীভূতনাথ চক্রবর্তী।

—দেশ কোথায়?

–নদেয়—ফতেপুর গাঁ।

–কী করা হয় এখানে?

–‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে চাকরি করি।

–কত বেতন পাও?

–সাত টাকা আর একবেলা খাওয়া।

—আর উপরি, উপরি কত…উপরি নেই? চলা শক্ত, নেশাটাআশটা করতে গেলে একটু টেনে-বুনে চলতে হবে ভাই—আগে সস্তা-গণ্ডার দিন ছিল, আগের কালে তুই বললে বিশ্বাস করবিনি লোচন, ওই এক পাটের দাম ছিল চার আনা,—ওই গাঁজাই বল আর চরস-ই বল সব জিনিষের দাম কেবল বেড়েই চলেছে—এমন করে দিন দিন জিনিষের দাম বাড়লে কী খেয়ে মানুষ বাঁচে বল—

লোচন বললে–উনি তামাকই খান না—তায় আবার বোতলের কথা বলছেন—

ভৈরববাবু বললে—তা তামাক খাও আর না-খাও ভাইপাড়াগাঁ থেকে নতুন এসেছো, বড় ভাই-এর মতো ভালো কথা বলছি ওটি খাবেনইলে এ লোনা হাওয়ার দেশ এমন পেট ছাড়বে— তখন…বলে ভৈরববাবু আবার টান দিলে হুঁকোয়। তারপর থেমে বললে-বিশ্বেস হচ্ছে না বুঝি ভাই। মেজবাবু তো লেখা-পড়াজানা লোক, মেজবাবু তো আর মিথ্যে বলবে না। তা ওই মেজবাবুর কাছেই শুনেছি, সেকালের মস্ত বড় একজন বাবু রামমোহন রায় খেতো আর সকলকে ডেকে ডেকে খাওয়াতো। রাজনারায়ণ বোস খেতো, মাইকেল মধুসূদন খেতে। তাছাড়া রামমোহন রায় তো ছিল মাল খাওয়া শেখাবার গুরু রে। তারপর এক টান টেনে ভৈরববাবু বললে—এই এখন তো আমার এই চেহারা দেখছিস, আগে ছিল প্যাকাটির মতন, মেজবাবু বললেন—নোনা লেগেছে—মাল খেতে হবে। মেজবাবুর কথায় খেতে শুরু করলুম—শেষে নীলু কবিরাজের সালসায় যা হয়নি, মাল খেয়ে তাই হলো, এখন যা খাই দিব্যি হজম হয়ে যায়। জিনিষটা যদি খারাপই হতো তো সাহেব বেটারা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এখানে এসে আর রাজত্ব করতে পারে?

কথাটা ভাববার মতন। না বিশ্বাস করে উপায় নেই।

তারপর ভৈরববাবু বললে—একবার চুপি চুপি খবরটা নাও তো লোচন মেজবাবুর ঘুম ভাঙলো কিনা। তারপর পকেট থেকে বার করলে একটা তামার পয়সা। বললে—নাও তোমার মামুলি নাও।

লোচন পয়সাটা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজলো।

সেদিন ওই পর্যন্ত। এ-বাড়ির হাল চাল দেখে ভূতনাথ এখন আর অবাক হয় না। রবিবার দিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসের ছুটি। ব্রজরাখাল সেদিন সকাল-সকাল বেরিয়ে যায়—বরানগরের বাগানে। ঠাকুরের চেলারা ওখানে থাকে। সারাদিন কী করে সেখানে, তারপর আসে সেই অনেক রাত্রে।

মেজবাবুকে এক-এক রবিবার দেখা যায়। গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়ায় ইব্রাহিম মিয়া গাড়ি নিয়ে। আরো দুখানা গাড়িতে থাকে মেজবাবুর মোসাহেবের দল। সকলেরই চুনোট করা উড়নি। বাঁকা সিঁথি, বাবড়ি চুল। ইব্রাহিমের গাড়ির ভেতর মেজবাবুর মেয়েমানুষ। ভালো করে দেখা যায় না। ফরসা টুকটুকে চেহারা। ঘোমটা খোলা। নাকে নাকছাবি। পানের ডিবে হাতে নিয়ে নামে এক-একদিন।

মেজবাবুর চাকর বেণী বলে—শালাবাবু সরে যান এখেন থেকে—বাবু দেখতে পেলে রাগ করবে।

সদলবলে চলে যায় সবাই। কখনও বাগানবাড়িতে। কখনও গঙ্গায় নৌকো-ভ্রমণে। কখনও খড়দা’র মেলায়। সঙ্গে থাকে ড়ুগি তবলা, ঘুঙুর। মেঝের ওপর শোয়ানো থাকে নাকি সার সার বোতল। খাবারের চাঙারি গাড়ির মাথায়।

বেণী বলে—ওই যে কমবয়সী মেয়েমানুষটা দেখলেন, ও যা নাচে–

কমবয়সী মেয়েমানুষটার নাম হাসিনী। হাসিনী নাকি যেমন নাচে তেমনি গায়। ওর মা এসেছিল কাশী থেকে একবার দোলের সময় এ-বাড়িতে গান গাইতে। সঙ্গে এসেছিল হাসিনী। তখন হাসিনীর বয়স আট কি দশ। মেজবাবুর ভারি ভালো লাগলো দেখে। মা আর মেয়েকে আর ফিরে যেতে হলো না কাশীতে। এখানে বাড়ি ভাড়া করে দিলেন। আসবাবপত্র চাকর দারোয়ান বহাল হলো। তারপর হাসিনী বড় হলে, বুড়ী মা গেল মরে। এখন হাসিনী মেজবাবুর সম্পত্তি।

প্রথমে ছিল একজন। তারপর একজন বেড়ে হলো দুই। এখন তিনজন। মেজবাবুর বাবুয়ানি দেখে কলকাতার বাবু-সমাজের তাক লেগে গিয়েছে।

ভূতনাথ বললে-মেজগিন্নী এসব জানেন তো?

বেণী বলে–মেজমা বড় ঘরের মেয়ে-ওসব গা-সওয়া। মেজবাবুর শ্বশুর এখন বুড়ো থুত্থুড়ো, তবু এখনও রবিবার রাতটা বাড়িতে কাটান না, বাঁধা মেয়েমানুষ আছে তার। মেজমা তাকে রাঙামা বলে ডাকে। এ-বাড়ি থেকে পূজোর নেমন্তন্ন গেলে রাঙামা’র বাড়িতেও খবর দিতে হবে—তত্ত্ব এলে দু’বাড়ি থেকেই আসে। সেবার মেজমা’র অসুখ হলো—রাঙামা নিজে এসে সাতদিন সাত রাত্তির সেবা করলে। কারো নিজের মা-ও অমন সেবা করতে পারে না। আহা, সাক্ষাৎ সতীলক্ষ্মী, যেমন রূপ…তেমনি…এদানি তত মেজবাবু তবু যা হোক রাত্তিরে বাড়ি ফেরেন—আর আগে?

আগেকার ব্যাপার ভূতনাথের জানবার কথা নয়।

-আগে সেখানেই পড়ে থাকতেন যে। খাজাঞ্চীবাবু আমার হাতে দপ্তরের কাগজপত্তর দিতেন, আমি সেই মেজবাবুর মেয়েমানুষের বাড়ি থেকে সই সাবুদ করে নিয়ে আসতুম। মদ খেলে মেজবাবুর আর জ্ঞান থাকতো না কিনা, কাপড় সামলাতে পারতেন না। আমি গেলেই জুতো পেটা করতেন। ও ছাই ভস্ম খেলে কি আর জ্ঞান গম্যি থাকে মানষের? আমি হাসতুম—কিন্তু মাঠাকরুণ খুব বকুনি দিতেন। বলতেন—নেশা করেছে বলে কি একেবারে বেহেড হয়ে গিয়েছে। তুই কিছু মনে করিসনে বাবা, এই চার আনা পয়সা নেমেঠাঁই কিনে খাস।

বেণী বলে—ওই যে পানের ডিবে হাতে বুড়োপানা মেয়েমানুষকে দেখলেন—ওই হলো বড়মাঠাকরুণ। মেজবাবু ওঁকে ভারি ভয় করেন। বড়মাঠাকরুণ যদি বলেন মদ খাওয়া বন্ধ—তো বন্ধ। মেজমাঠাকরুণ বলুন আর ছোটমাঠাকরুণই বলুন—বড়মাঠাকরুণ একবার ‘না’ বললে কারু সাদ্যি নেই মেজবাবুকে দিয়ে হাঁ বলায়।

রবিবার মোসাহেব আর মেয়েমানুষের দল নিয়ে মেজবাবু চলে গেলেন। হয় তো গঙ্গার ওপর পানসিতে বসে খানা-পিনা হবে। বড়মাঠাকরুণ নিজে মেপে মেপে মদ ঢেলে দেবেন। তার নিজের পূজো-আর্চা ব্রত-পার্বণ আছে। সব সময় তিনি দলে যোগ দেন না। বড়মাঠাকরুণ পূর্ণিমে-অমাবস্যা তিথি-নক্ষত্র দেখে চলেন। ভারি বিচার সব বিষয়ে। বাসি কাপড়ে মদ খান না। কাচা কাপড় পরে ঠাকুরঘরে ঢোকেন। কালীবাড়িতে বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজো পাঠিয়ে দেন পাণ্ডার হাতে।

আর মেজমা?

বেণী বলে—আর মেজমাকে দেখে আসুন গিয়ে। তেতলায় পালঙে বসে সিন্ধুর সঙ্গে বাঘ-বন্দী খেলছেন—নতুন নতুন গয়না গড়াচ্ছেন, একবার গোটছড়া ভেঙে বিছে হার হচ্ছে, বিছে হার পুরোনো হলে অনন্ত হচ্ছে, অনন্তও পুরোনো হয়ে গেলে চূড় হচ্ছে। হয় তো এবার পূজোয় হলো কমল হীরের নাকছাবি, আবার কালীপূজোয় হবে চুণী বসানো কান-ফুল, মুক্তোর চিক নয় তো পান্না বসানো লকেটওয়ালা চন্দ্রহার।

মেজবাবুর গাড়ি চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ভূতনাথ চুপ চাপ সেইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে। পিসীমা’র কথা মনে পড়ে যায়। পিসীমা’র শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঁচ টাকা মনি-অর্ডার আসতে। ওই টাকাতেই মাস চলবে। ওই পাঁচটা টাকার জন্যেই পিসীমা’র কত ভাবনা। গাজনার পোস্টাপিসে ভূতনাথ হয় তো গিয়ে দেখলে মাস্টারবাবু নেই। শোনা গেল, পোস্টমাস্টারবাবুর অসুখ। বলে পাঠিয়েছে—আজ আর উঠতে পারছিনে—কাল এসো।

পোস্টমাস্টারবাবু বুড়ো মানুষ। এক-একদিন হয় তো গরুর জাব দিচ্ছে। বলে পাঠিয়েছে-এবেলা আর হবে না, বড় কাজে ব্যস্ত আছি, ওবেলা সকাল-সকাল এসো হে।

ওবেলা যেতে মাস্টারবাবু হয় তো বললে—গায়ে তো যাচ্ছে, তা গায়ের চিঠিগুলো নিয়ে যাও না সঙ্গে। পিওন আর আজকে ওদিকে যেতে পারবে না, গঞ্জের হাটে পাঠিয়েছি তাকে।

ছোটো একটা বাক্সর মধ্যে সেই পাঁচটি টাকা রেখে একটি করে গুণে গুণে পয়সা খরচ করতে পিসীমা। ভূতনাথ মাঝে মাঝে চাইতে–একটা আধলা দাও না পিসীমা।

আধলা পিসীমা দিতো না। বলতে—রইল তত তোরই জন্যে—আমি মরে গেলে তুই-ই নিস।

কিন্তু সে পয়সা-কড়ি পিসীমা’র অসুখেই সব খরচ হয়ে গেল। তা তার জন্য আর কি থাকবে?

আর এ-বাড়িতে কোথায় কেমন করে কে পয়সা উপায় করে কে জানে। বাবুরা ঘুম থেকেই ওঠে দুপুর একটার সময়। আপিসেও কেউ যায় না। ব্যবসাও কেউ করে না। অথচ এতগুলো লোক—সব বসে বসে খাচ্ছে।

 ০৮. আয়ের বহরটা বোঝা যায় না

আয়ের বহরটা বোঝা যায় না। কিন্তু খরচের বহরটা বোঝ যায় খাজাঞ্চিখানায় গেলে।

বিধু সরকার মধ্যেখানে উবু হয়ে বসে, আর দু পাশে আরো চার পাঁচজন ঢালু বাক্সর ওপর খেরো খাতায় লেখাপড়া করছে।

বিধু সরকার কানে কলমটা গুজে হাত বাড়ায়—পাট্টা-বইটা দেখি কেশব।

মোটা খেরো খাতাটা এগিয়ে দিয়ে আবার লিখতে বসে কেশব।

ভূতনাথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। খেরো খাতার ওপর মোটা মোটা হরফে লেখা—ফিরিস্তি কাগজ পাট্টা-নকল বহি, শ্ৰীযুৎ মিস্টার উইলিয়ম ফ্র্যাঙ্কল্যাণ্ড সাহেব, সন…

বিধু সরকার চিৎকার করে কেশবকে বলে—আমি বলি তুমি লেখো-আরকুলী সিমলা মছলন্দপুর গ্রামে পুষ্করিণী খনন জন্য শোভারাম বসাককে ৩০ বিঘা জমি লাখেরাজ স্বরূপে জমা দেওয়া হইল। বামাপদ সেন পোদ্দারের পৌত্র ক্ষমাপদ সেন, তাহার মছলন্দপুরের বাস্তুভিটা ভুক্ত ১৮ কাঠা জমি তারাপদ মুন্সীকে আঠারো শত সিক্কা-টাকায় বিক্রয়.. হঠাৎ মাথা তুলে সামনে ভূতনাথকে দেখে বলে—তোমার কী?

ভূতনাথ হাতের কাগজখানা এগিয়ে দিয়ে বলে—আমি ব্ৰজরাখালবাবুর সম্বন্ধী, তার এ মাসের মাইনেটা আমার হাতে…

—রোসো–বলে বিধুসরকার সমস্তটা পড়ে বলে—এ সই কার?

—আজ্ঞে ব্ৰজরাখালের।

-–ও ব্রজরাখাল শুধু বললে তো চলবে না, ব্ৰজরাখাল কী, দাস রুইদাস, বামুন না কায়েত, কার পুত্র, নিবাস কোথায়-আর তুমি কে, শুধু ভূতনাথ চক্রবর্তী বললে তো আমি শুনবো না, কার পুত্র, নিবাস কোথায়, এসব পোসাপিস নয় হে ছোকরা, জমিদারী সেরেস্তার কাজ অমন সোজা নয়, সই মিললেই ছেড়ে দিলাম, সে সরকারী আপিসে পাবে, এখেনে চলবে না..তুমি লিখে দিলে কেলার পাতে আর আমি অমনি টাকা দিয়ে দিলাম, তেমন কাজ করলে বিধু সরকার আর বাবুদের জমিদারী রাখতে পারতো না—তা তিনি আসতে পারলেন না কেন শুনি?

—আজ্ঞে তিনি গিয়েছেন বরানগরে?

—ওসব আমি দিতে পারবে না, তা সে যাই বলুক আর তাই বলুক। হাতকড়ি পড়বার কাজ আমি করিনে…এবার তোর কী?

ভূতনাথ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার তার পাশের লোকের ডাক পড়লো।

হিন্দুস্থানী। সামনে এগিয়ে বললে—হুজুর আমার সেই টাকাটা–

–কিসের টাকা বল না বেটা, তুই কি আমার বাপের সম্বন্ধী যে তোকে চিনে বসে আছি, লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার এখানে, হাজার হাজার প্রেজার নাম আর বংশ পরিচয় অমনি মুখস্ত রাখতে পারে মানুষে?

–আজ্ঞে, বরফের পাওনা, চার মাসের একেবারে জমে গেল।

-বোস, দৈনিক জমা খরচের খাতাটা দেখি কেশব।

বিচিত্র লোক এই বিধু সরকার। ভূতনাথের মনে পড়ে—প্রথম দিন ভারি রাগ হয়েছিল তার। যেন লাট না বেলাট!

বিধু সরকার বলে—মেজবাবু বললে কী হবে, মুখের কথায় খাজাঞ্চীখানা চলে না হে, এখানে লেখা-পড়ি সই-সাবুদের কারবার। মেজবাবুর হাতের লেখা দেখ, আমি টাকা ফেলে দেবো। আমার কী, আমি তো হুকুমের চাকর-জমা-খরচের খাতায় সব লিখে রাখবে। সিকিপয়সা, কড়ি, দামড়ি, ছেদামাটি পর্যন্ত হিসেবে ভুল হবে না। এ তোর কারবারের পয়সা নয়, এ হলো জমিদারী, এর হিসেব রাখা যার তার কম্ম নয়। তারপর থেমে আবার বলে—গোমস্তা যদি লেখে সুখচরের কালেক্টরীর কাছারিতে উমাচরণ মুহুরীকে পান খাওন বাবদ ১৫ দেওয়া হইল, আমার খাতায় অমনি খরচ পড়ে যাবে ৩১৫ উমাচরণ মুহুরীর পান খাওন বাবদ কাউকে বলে—এ পোস্টাপিসের সরকারী কাজ নয় হে যে, পাঁচটা বাজলে আর দরজায় তালা পড়লো। অত তাড়াহুড়ো করলে চলে না এখানে, ছোটকাল থেকে এ-কাজ করছি, এ তো আমার জাত-পেশাই বলা চলে, এখনো এ-কাজের হদিস পেলাম না। রোজই নতুন, রোজই নতুন একটি পয়সা এদিক-ওদিক হলে নায়েব-গোমস্তার গলা টিপে ধরবো না। বাবুদের ধম্মের পয়সা, বিধু সরকার আর সব পারে দাদা অধৰ্ম্ম সইতে পারে না। তারপর হঠাৎ ভূতনাথের দিকে নজর পড়ায় বললে—তুমি দাঁড়িয়ে কেন ছোকরা? আমি তো বলেছি তোমায়, কাজের সময় বিরক্ত করো না আমায়—আমি কম কথার মানুষ… লেখো কেশব, সেখ আসানুল্লার পুত্র সেখ জয়নুদ্দীনকে মৌরুসীমোকরীর..এখন বিরক্ত করে না যাও দিকি সব—বলে বিধু সরকার আবার নিজের কাজে মন দেয়।

ভূতনাথ চলে এল।

ব্ৰজরাখাল এসে সব শুনে বললে—তা ভালোই তো করেছে। নগদ-টাকাকড়ির কারবার, একটু দেখে শুনে হিসেব করে দেওয়াই তো নিয়ম। বিধু সরকার খুব হুঁশিয়ার লোক কি না—তা ছাড়া তোমায় চেনে না। একটু মুখচেনা হয়ে যাক—তখন আবার…

 ০৯. এখন এই পরিবেশের মধ্যে

এখন এই পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ ছুটুকবাবু যে কেন ডেকেছেন বোঝা গেল না।

ঘরে গিয়ে ভূতনাথ সবে জামা কাপড় ছাড়তে শুরু করেছে, এমন সময় শশী এল। বললে—শালাবাবু ছুটুকবাবু আপনাকে ডেকেছে একবার।

ছুটুকবাবুর চাকর শশী। তোষাখানার কাছে দু একবার দেখেছে তাকে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কেন রে? ডেকেছে কেন?

শশী বললে—বিরিজ সিংকে বলে রেখেছিলাম—আপনি এলেই খবর দিতে, বলেনি আপনাকে?

ভূতনাথ বললে—বলেছে সে, কিন্তু কি দরকার বুঝতে পারছিনে—জানিস কিছু তুই?

শশী বললে—ছুটুকবাবু আজ বিকেল বেলা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, মাস্টারবাবুর ঘরে ড়ুগি তবলা বাজায় কে রে? আমি বললাম—মাস্টারবাবুর শালা, শুনে বাবু বললেন—আজ একবার ডাকিস তো, বেশ হাত—তা চলুন আজ্ঞে।

–বলে দে আমি আসছি এখুনি। বলে খাওয়া-দাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে ভূতনাথ সেদিনই ছুটুকবাবুর আসরে গিয়েছিল। অনেক দিন আগেকার কথা। স্মৃতির মণিকোঠায় সব কথা জমা করবার মতো হয় তো জায়গা নেই আর। তবু ছুটুকবাবুকে বোধহয় কখনও ভোলা যাবে না। শুচিবায়ুগ্রস্থ বিধবা বড়বউঠাকরুণের একমাত্র ছেলে। কার্তিকের মতো চেহারা। অমন স্বাস্থ্য। কিন্তু যে-বংশের ঐশ্বর্যের আর বিলাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি প্রবেশ করেছে তাকে কে বাঁচাতে পারবে।

বদরিকাবাবুর একটা কথা বার বার মনে পড়ে ভূতনাথের।

বদরিকাবাবু বলতে—এ সংসারে যে খেলতে জানে সে কাণাকড়ি নিয়েও খেলে—যে ভালো হতে চায়, ভালো থাকতে চায়, তার জন্যে সব পথই খোলা।

হয় তো তাই।

নইলে ছুটুকবাবুই বা অমন হবে কেন।

ছুটুকবাবু দেখেই বললে—আরে আসুন, আসুন স্যার, ঘরে বসে রোজ তবলা শুনি আর ভাবি, এ তো পেশাদারী হাত। কানির কাজ এমন তো শুনিনি আগে—কোন ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন ভাই?

ছুটুকবাবুর বন্ধুবান্ধবে ঘর ভর্তি। একজন তানপুরা ধরেছে। আর একজন হারমোনিয়ম। সকলেরই ঢেউ তোলা বাবরি ছাঁট চুল। চুনোট করা উড়নি। কোঁচানো ধুতি। মেঝের ওপর একহাত পুরু গদিতে ঘর জোড়া। ধবধবে সাটিনের চাদর। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ছুটুকবাবু বসে বসেই ঘামছে। পানের ডিবে, জরদার কৌটো। সিগারেট।

ঠুংরি গানের তানের সময় ছুটুকবাবু মাঝে মাঝে চিৎকার করছে—কেয়াবাৎ-কেয়াবাৎ

সমের মাথায় এসে তবলার চাটির সঙ্গে গানের ঝোক মিলে গেলেই বলছেন—শোহ-আল্লা—শোহন্‌-আল্লা–

অনেক দিন অভ্যেস নেই ভূতনাথের। গাঁয়ের ওস্তাদের কাছে শেখা। দারা, কাহারবা আর একতালা নিয়েই বেশি ঘাটাঘাটি ছিল। কচিৎ কদাচিৎ যৎ, মধ্যমান, চলত। পূজোর সময় রসিক মাস্টারের ইয়ার-বক্সির এলে ঠুংরি টপ্পা হতো। যাত্রার আসরে মেথর-মেথরাণীর গানের সঙ্গে খেমটারই বেশি চল।

ছুটুকবাবু চিৎকার করে বললে—আর ঠুংরি ভালো লাগছে না–এবার গজল হোক মাইরি-গজল গা বিশে।

ছুটুকবাবুর হুকুম। গজল ধরলো বিশে মানে বিশ্বম্ভর। গলাটা ভালো। ধ ধরতে না ধরতেই জমে উঠলো।

সঙ্গে ভূতনাথের কাওয়ালির আড়ির ঠেকা।

ছুকবাবু আর পারলে না। দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে— এবার গান জমে গিয়েছে মাইরি। তারপর উঠে গিয়ে পাশের পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। খানিক পরেই কাপড়ের কোঁচায় ঠোট মুছতে মুছতে আবার এসে তাকিয়ায় হেলান দিলে। গান তখন বেশ জমে উঠেছে। ছুটুকবাবু আরও ঘামতে লাগলো। লয় বাড়ছে। হাত তখন টন্ টন্ করছে ভূতনাথের। সমস্ত ঘরখানা মজে গিয়েছে সুরে।

বিশ্বম্ভর দুলছে। চোখ বোজা। উন্মাদ হয়ে গাইছে :–জখমী দিলকো না মেরে দুখায়া করো—

তারপর এক সময় সম পড়লো। হো হো হো করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ছুটুকবাবু। এক এক করে সবাই এক-একবার পর্দার ভেতরে গিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে ফিরে এসেছে। চোখ লাল সবার।

নেশার ঝেকে ছুটুকবাবু ভূতনাথের পা ছুঁতে এল।

–করেন কী, করেন কী, আহা হা—বলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় ভূতনাথ।

মোসাহেবরা বলে—তা পায়ে না হয় হাতই দিলেন ছুটুকবাবু, পা তো আর আপনার ক্ষয়ে যাচ্ছে না!

ছুটুকবাবু পায়ে হাত দেবার চেষ্টায় উপুড় হয়ে পড়লো। বললে বাড়ির মধ্যে এমন গুণী রয়েছে, আর তোরা গোঁসাইজীর খোশামোদ করিস, খবরদার—এই শশী, শশে।

পর্দার ভেতর থেকে শশী বেরিয়ে এল।

ছুটুকবাবু বললে—শোন বেটা, কাল থেকে যদি গোঁসাইজীকে বাড়িতে ঢুকতে দিবি তো তোকে খুন করে ফেলবো, ব্রিজ সিংকেও খুন করব আমি। তারপর হঠাৎ শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ছুটুকবাবু মুখের কাছে মুখ এনে বললে-বড় খাটুনি গিয়েছে আপনার, একটু হবে নাকি স্যার?

ছুটুকবাবুর কথা কিছু বুঝতে পারলে না ভূতনাথ। মুখ দিয়ে মদের গন্ধ অবশ্য আসছিল। তবু ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কী?

—ভালো জিনিষ ভাই, দিশি মাল নয়, বেশি নয়, একটুখানি, শ্যাম্পেন দিক একটু–

ভূতনাথ বড় বিব্রত বোধ করলো।

সামনের একজন বললে—ছুটুকবাবু ভালোবেসে দিচ্ছেন, না বলবেন না ভূতনাথবাবু—বলুন হ্যাঁ।

ছুটুকবাবু বললেন—বেশ, তা হলে–সিদ্ধির সরবৎ দিকতাও আছে। ওরে শশে—বেশ পেস্তা বাদাম দিয়ে যুং করে..পর্দার ভেতরে চলে যান, কেউ দেখতে পাবে না।

রাত বারোটা পর্যন্ত এমনি চললে সেদিন। গজলের পর টপ্পা। নিধুবাবুর টপ্পা। তারপর “চামেলী ফুলি চম্পা–”

শেষে যখন সবাই উঠলো, ছুটুকবাবুর তখন উথান শক্তি রহিত। তাকিয়ায় মাথা দিয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত বাড়ি নিঝুম হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ ভূতনাথেরও জ্ঞান ছিল না। সমস্ত পরিবেশটা যেন কেমন সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। গানবাজনা বন্ধ হবার পর, বাইরে আসতেই আচমকা যেন একটা আঘাত পেলে ভূতনাথ।

ভূতনাথ বিশুবাবুকে বললে—আপনার গানটা বেশ জমেছিল আজ।

বিশ্বম্ভর বললে—মনের মতো সঙ্গত করেছিলেন স্যার—গান গেয়ে বেশ আয়েশ হলো।

সকলেই অল্পবিস্তর অপ্রকৃতিস্থ। সবাই প্রায় ভূতনাথের সমবয়স্ক।

পরেশ বললে—সবাই আমরা অমৃত খেলাম—আপনি স্যার একেবারে নিরস্তু—এ কেমন যেন এক যাত্রায় পৃথক ফল…

কান্তিধর বললে—আহা, আজকে প্রথম দিন, যাক না, তুই বড় তাড়াহুড়ো করিস পরেশ। ছুটুকবাবুও কি প্রথম প্রথম খেত, কত কষ্টে নেশাটি ধরিয়ে দিয়েছি—আর এখন?

দরজা পর্যন্ত সবাইকে এগিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসে নিজের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দাঁড়ালো ভূতনাথ। ব্রজরাখাল জানতে পেরেছে নাকি? বজ্ররাখালকে যাবার সময় জিজ্ঞেস করাও হয়নি। এখানে ব্ৰজরাখালের পরিচয়-সুবাদেই থাকা। যাতে ব্ৰজরাখালের কোনো মর্যাদা হানি হয়, এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়। আস্তে আস্তে ঘরের চাবি খুলে দরজায় খিল বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ কেমন থমকে দাঁড়ালো সে!

মনে হলো গাড়ি বারান্দার সদর রাস্তা দিয়ে কে যেন সন্তর্পণে বেরোলো। অস্পষ্ট মূর্তি। কিন্তু মেয়েমানুষ বলেই যেন মনে হয়। চারিদিকে নির্জনতা। সমস্ত ঘরের আলো নিভে গিয়েছে। ইব্রাহিমের ঘরের ছাদের ওপর একটা তেলের বাতি জ্বলছে, সেই আলোর কিছু রেখা এসে পড়েছে ইট-বাঁধানো দেউড়ির ওপর। আশে পাশে কেউ কোথাও নেই। শুধু গেটের এক পাশে বসে ব্রিজ-সিং বন্দুক হাতে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় সদর-দরজা দিয়ে কে বেরোবে।

কেমন যেন কৌতূহল হলো ভূতনাথের।

আজকের মতন এত রাত্রে এ-বাড়ির এখনকার দৃশ্য কখনও দেখবার সৌভাগ্য হয়নি আগে। কিন্তু তবু, এ-বাড়ির আবহাওয়া আর হালচালের যতখানি পরিচয় সে পেয়েছে, তাতে যেন ওই নারী-মূর্তি দেখে অবাক হওয়ারই কথা।

উঠোন পার হবার পথে ওপরের আলোটা এসে পড়তেই যেন চেনা-চেনা মনে হলো। তারপর মূর্তিটা নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো ছুটুকবাবুর বৈঠকখানার সামনে।

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কে যেন দরজা খুলে দিলে। ভূতনাথ ঘরের ভেতরকার আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলে শশীকে। ছুটুকবাবুর চাকর শশী। আর নারী-মূর্তিটাও এক নিমেষের জন্যে ভূতনাথের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো!

গিরি! মেজগিন্নীর ঝি গিরি!

কিন্তু একটি মুহূর্ত। তারপরেই ঘরের দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সমস্ত অন্ধকার। একটা অন্যায় কৌতূহল ভূতনাথের সমস্ত মনকে যেন পঙ্কিল করে তুললে। এখনও কর্তারা কেউ বাড়ি ফেরেননি। আকাশের তারার দিকে চেয়ে রাতটা অনুমান করবার চেষ্টা করলে একবার। দ্বিতীয় প্রহর শেষ হবার উপক্রম। মেজকর্তা এখনও ফেরেননি। ছোটকর্তা ফিরবেন কিনা কোনো নিশ্চয়তা নেই। আজ না-ও ফিরতে পারেন। বন্ধ বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে শুধু দুজন—আধ-অচেতন ছুটুকবাবু, আর শশা। ওদের মধ্যে কে?

ঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল কিন্তু শুতে গিয়ে ঘুম এল না তার।

 

ব্ৰজরাখাল সকাল বেলা দেখা হলেই জিজ্ঞেস করলে-কাল কোথায় ছিলে বড়কুটুম? তারপর সব শুনে বললে—তা ভালো তবে বুঝে শুনে চলে।

—কেন? ভূতনাথ একটু অবাক হয়ে গেল।

ব্রজরাখাল বললে—এখন সময় নেই আমার, আপিসে যেতে হবে, তবে একটা কথা বলি, ঠাকুর বলতেন—কাঁদলে কুম্ভক আপনিই হয়। গান-বাজনা টপ্পা-ঠুংরি ভালো বৈকি—কিন্তু মাঝে মাঝে একটু কেঁদো বড়কুটুম।

—কাঁদবো কেন মিছিমিছি।

—সে অনেক কথা বড়কুটুম, এখন আর আমার সময় নেই, আজকে আমার বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হবে, শীগ্রি নরেন আসছে, তারই তোড়জোড় হবে সব…

-নরেন কে—ব্রজরাখাল?

–ওই তোমার বিবেকানন্দ। ঠাকুর বলতেন,নরেন একদিন সমস্ত পৃথিবী কাপিয়ে দেবে—তা কাঁপিয়ে শুধু নয়, ভূমিকম্প লাগিয়ে দিয়েছিল আমেরিকায়। প্রতাপ মজুমদার, আনিবেশান্ত সব থ’ হয়ে গিয়েছেন। সেদিনকার ছোকরা নরেন তারই মধ্যে এত—তারা তো কেউ জানে না—এ শুধু ঠাকুরেরই লীলা.. তারপর থেমে আবার বললে—দেখবে বড়কুটুম, এবার আর ঠেকাতে পারবে না কেউ, একদিন এই নরেনই সমস্ত দেশকে বাঁচাবে। অনেক নেড়া-নেড়ী এসেছে, অনেক পাদরী এল, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাও হলো অনেক—কিন্তু দরিদ্রনারায়ণদের কথা আগে কেউ অমন করে বলেনি।

ভূতনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো।

–আপিস যাবার দেরি হয়ে গিয়েছে। তবু ব্ৰজরাখাল বলতে লাগলোনরেন আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে এবার। বলেছে— সাত শ’ বছরের মুসলমান রাজত্বে ছ’ কোটি লোক মুসলমান হয়েছে, আর এক শ’ বছরের ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ খৃস্টান—এটা কেন হয়? কেন হয়, এটা আগে কেউ এতদিন ভাবেনি বড়কুটুম, এবার মাদ্রাজে বক্তৃতা দিয়েছে নরেন তাতে বলেছে অনেক কথা। দাসত্ব বড় খারাপ জিনিষ বড়কুটুম—দেখো না, অনেকে কলম্বোতে গেল নরেনের সঙ্গে দেখা করতে—আমি পারলুম না।

আপিস যাবার সময় কোনো দিকে খেয়াল থাকে না আর। খানিক বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল ব্রজরাখাল। বললে— মাইনে পেয়েছে। বড়কুটুম? পেয়েছে শুনে বললে—একটা টাকা দাও তো আমাকে।

–কেন, তুমিও তো কাল পেয়েছে। মাইনে?

—পেয়েছি, কিন্তু…ব্রজরাখাল হাসলে। বললে-পেয়েছিলাম, কিন্তু বরানগরে গিয়ে দেখি গুরুভাইরা সব উপোস করছে, ঠাকুর দেহ রাখবার পর থেকে গুরুভাইদের বড় কষ্টে দিন কাটছে, ভিক্ষে করে পেট চালায় সব, কাল গিয়ে দেখি রান্না-বান্নার যোগাড় নেই —তা শুধু তো বেদ-বেদান্ত পড়লে পেট ভরবে না, কারো খাবার কথা মনেই ছিল না, নরেন আমেরিকা থেকে কিছু পাঠিয়েছিল— আর আমিও সব মাইনেটা দিয়ে এলাম গুরুভাইদের হাতে।

একটা টাকা দিয়ে ভূতনাথ বললে—তারপরে সারা মাস যে সামনে পড়ে আছে-তখন?

ব্ৰজরাখাল হাসতে লাগলো। বললে তোমাকে উপোস করাবো না বড়কুটুম, ভয় নেই। তারপর বললে-ঠাকুর বলতেন–কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে না পারলে ভজন-সাধন হয় না। তা তোমার বোন মরে একটা দিক থেকে আমার বাঁচিয়ে গিয়েছে। আর টাকা, সেটা কী করে যে ত্যাগ করি, আজই যদি চাকরিটা ছেড়ে দেই তো কালই অনেক গুলো পরিবার উপোস করতে শুরু করবে। প্রত্যেক মাসের শেষে আমার মুখ চেয়ে যে বসে থাকে তার। এক টাকা এগারো আনা জোড়া কাপড়—তা-ই একখানা কাপড়ে বছর চালায় সব হতভাগীরা।

বেশি সময় ছিল না। ব্রজরাখাল চলে গেল।

 

সেদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে আসবার পথে সেই কথাই মনে পড়লো। ফতেপুরে থাকতে মানুষের দারিদ্র এমন করে কখনও তত চোখে পড়তো না। এখানে কলকাতা শহরের মধ্যে থাকতে ক’মাস থাকতেই যেন চোখ খুলে গিয়েছে ভূতনাথের। চারদিকে বড় অভাব। বড় হাহাকার। রাস্তায় একটা ভিখিরী আধলা চাইতে চাইতে বড়বাজার থেকে একেবারে মাধব বাবুর বাজার পর্যন্ত পেছন পেছন আসে। বলে–একটা আধলা-পয়সা দাও বাবু—একটা আধলা-পয়সা দাও।

ভূতনাথ বলে—কোথায় বাড়ি তোমার?

বুড়ো মানুষ। গেরো দিয়ে দিয়ে কাপড়খানা কোনোমতে কোমরে জড়িয়ে আছে। বলে-বন্যে হয়ে আমাদের দেশ-গাঁ সব ড়ুবে গিয়েছে গো, ভাসতে ভাসতে ডাঙায় এসে উঠেছি—দু’দিন কিছু খাইনি—একটা আধা পয়সা দাও বাবু।

সেদিন শিব ঠাকুরের গলি দিয়ে আসতে আসতে আর একজন এক বাড়ির ভেতর থেকে ডেকেছিল।

—বাবা শুনছো—ও বাবা—

কেউ কোথাও নেই। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তায় লোকজন কেউ নেই বললেই চলে। স্ত্রীলোকের গলার শব্দ।

—এই যে বাবা, আমি এই দরজার ফাঁক দিয়ে কথা বলছি।

–দরজা খুলুন না, কী হয়েছে আপনার?

—কিছু মনে নিও না বাবা, তুমি আমার ছেলের মতন, একখান কাপড় নেই যে বেয়েই সামনে, এই দুটো পয়সা দিচ্ছি, দু’ পয়সার মুড়ি কিনে ওই জানালা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দাও না বাবা।

কোথায় মেদিনীপুরের দুর্ভিক্ষ, ফরিদপুরের বন্যা—সবাই বুঝি জড়ো হয়েছে এখানে। অথচ বড়বাড়িতে অতগুলো লোক, অকারণে কত অপব্যয় হয়, কেউ দেখে না। বিলেত থেকে কাঠের বাক্স ভর্তি নানান জিনিষ। কাঠ-গ্লাশের ঝাড়-লণ্ঠন। একবার এল সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি উড়ন্ত পরী! গায়ে কাপড় নেই। হাতে একটা সাপ জড়ানো। মেজবাবুর নাচ ঘর সাজানো হলো। হাতীবাগানের বাজার থেকে নীলেমে অর্কিড গাছ কিনে নিয়ে এল ভৈরববাবু। চীনে-অর্কিড। একটা বাচ্চা গাছের দাম তিন শ’ টাকা। কলকাতা কেন, সারা বাঙলা দেশে কারো বাড়িতে এ-গাছ পাবে না। এই এক চিলতে গাছের জন্যে খদ্দের হলো অনেক। সবাই এল কিনতে। খাস লাট সাহেবের বাড়ি থেকে বাগানের সাহেব মালী এল, এল ঠণ্ঠনে, পাথুরেঘাটা, হাটখোলা, সব বাড়ির লোক। পাঁচ টাকা থেকে হু হু করে দর উঠতে লাগলো।

ভৈরববাবু যদি বলে—পঞ্চাশ—

ঠনঠনের দত্তবাবুরা বলে—বাহান্নো—

মল্লিকবাবুর লোক বলে—পঞ্চান্নো–

সেই গাছ কেনা হলো শেষ পর্যন্ত তিন শ’ টাকা দিয়ে। ভৈরববাবু সগর্বে বুক ফুলিয়ে সকলকে হারিয়ে দিয়ে গাছ নিয়ে এলেন বড়বাড়িতে। গাছ দেখতে জড়ো হলো বার-বাড়ির সবাই। অন্দর মহলেও পাঠানো হলো। মেজগিন্নী দেখতে চেয়েছেন। তিন শ’ টাকার গাছ। সোনা-দানা নয়, কুকুর-বেড়াল নয়, কিছু নয়-গাছ। মরে গেলেই গেল।

তা হোক, ভৈরববাবু গোঁফে তা দিতে দিতে বলতে লাগলো— বাবু তো বাবু মেজবাবু—ছেনি দত্ত বাবুয়ানি করতে এসেছে কার সঙ্গে জানে না।

সেই গাছ প্রতিষ্ঠা হলো। তার জন্যে ঘর তৈরি হলো। মেজবাবু নিজে এসে তদারক করে গেলেন।

ওদিকে খবর পৌঁছুল লাট সাহেবের কাছে। চীনে-অর্কিড তিন শ’ টাকায় কিনে নিয়েছে বড়বাড়ির চৌধুরী বাবুরা। লাট সাহেব খবর পাঠালে—গাছ দেখতে আসবেন তিনি। সোজা কথা নয়। সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। ভেলভেটের চাদর পড়লে নাচঘরে। ঝাড়-লণ্ঠন ঝাড়-পোছ হলো। চুনকাম হলো ভেতরে বাইরে। রাজা-রাণীর ছবি দু’খানা মুছে টাঙানো হলো মস্ত আয়নাটার মাথায়। তার ওপর লাল শালু দিয়ে লেখা হলোGod Save the King. লাট সাহেব এসে তো শুধু মুখে যেতে পারেন না। খানার ব্যবস্থাও হলো। খাসগেলাশের ভেতর গ্যাসের বাতি জ্বললো। বাড়ি সুদ্ধ লোকের নতুন সাজ-পোষাকের ফরমাশ গেল ওস্তাগরের কাছে।

তিন শ’ টাকা গাছের পেছনে কিছু না হোক তিন হাজার টাকা বেরিয়ে গেল নগদ।

সেকালের বনমালী সরকার লেন-এর চৌহদ্দি গাড়িতে গাড়িতে ছেয়ে গেল।

তখন বড়কর্তা বেঁচে। লাট সাহেবকে গিয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন তিনি। লাট সাহেব আর লাট সাহেবের মেম।

অনেক খানাপিনা হলো। খানার চেয়ে পানীয়ই বেশি।

তা গাছ দেখে ভারি প্রশংসা করলেন লাট সাহেব। ইণ্ডিয়ায় এত সব ধনী মহাধনী রয়েছে। পরিচয় করে কৃতার্থ হলেন তিনি। খানা খেলেন। ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়িটা দেখলেন। বাঈজীর দল এসেছিল লক্ষ্ণৌ থেকে। পাঁচ শ’ টাকার মুজররা। সে-নাচ দেখলেন। বেনারসী পান খেলেন।

যাবার সময় বড়কর্তা সামনে এগিয়ে গিয়ে চীনে-অর্কিড গাছটা নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন। হুজর যদি গ্রহণ করেন তো চৌধুরী বংশ নিজেদের কৃতকৃতাৰ্থ বোধ করবেন।

লাট সাহেব নিজে হাতে করে আর নিলেন না। সঙ্গের লোক নিলে। যার জন্যে এত কাণ্ড, সেই গাছই চলে গেল শেষ পর্যন্ত লাট সাহেবের বাগানে।

কিন্তু ফল ফললো কয়েক বছর পরেই। বড়বাবু বৈদূর্যমণি চৌধুরী খেতাব পেলেন। তখন থেকে হলেন রাজাবাহাদুর বৈদূর্যমণি চৌধুরী।

বড়ভাই বৈদূর্যমণি চৌধুরী, মেজভাই হিরণ্যমণি চৌধুরী আর ছোট কৌস্তুভমণি চৌধুরী। বৈদূর্যমণির ইয়া পালোয়ানি চেহারা। কাশীর পালোয়ান বাড়িতে পুষেছিলেন শরীরটা গড়ে তোলবার জন্যে। লোহাকাঠের মস্ত দুটো মুগুর দু হাতে নিয়ে ভাজতেন দু’ ঘণ্টা ধরে। সংসারের মাথায় ছিলেন তিনি। ওদিকে জমিদারী দেখা, বাড়ির প্রত্যেকটি লোকের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখা, তা ছাড়া তাঁর ছিল নিজের কুস্তির সখ। পৈত্রিক সম্পত্তির শুধু রক্ষা নয় আয়তনও বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। তার আমলে বড়বাড়ির এ অবস্থা ছিল না। তখন এই বড়বাড়ির নাম করলে চিনতে পারতো সব লোক। আর এখন

এ সব গল্প বদরিকাবাবুর কাছে শোনা। কোথায় কোন্ পূর্বপুরুষ মুর্শিদকুলী খাঁ’র কাছে কানুনগোর কাজ করেছিল—তারই বংশধর।

বদরিকাবাবু বলেন–তাই তো বলি খেলতে জানলে কাণাকড়ি নিয়েও খেলা যায় হে—তা বড়বাবু যখন রাজাবাহাদুর হলো, চারদিকে কত ধুম-ধাম—সায়েব মেমের খানা-পিনা হলো—আমি এই ঘরটিতে চুপ করে বসে রইলাম। পিপে-পিপে মদ খেলে সবাই। আমি বললাম—তোমরা যাও, আমি ওর মধ্যে নেই, রাজাবাহাদুর হয়নি তত বড়বাবু, ‘রাজসাপ’ হয়েছে—যা বলেছিলুম সব ফলে গিয়েছে—সেই বড়বাবু মরলে একদিন, মরবার সময় এক ফোটা জল পর্যন্ত পায়নি।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করে—কেন?

বদরিকাবাবু রেগে গেল। বললে—তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস, কেন? সাত শ’ বছর মোগল রাজত্বে ছ’ কোটি লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছে, আর এক শ’ বছর ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ লোক খৃস্টান হয়ে গেল—সে কি ভাবছিস ওমনি-ওমনি? নিমকহারামির গুনেগার দিতে হবে না? দেখবি সব যাবে—সব যাবে—কিছু থাকবে না, তাই দেখবো বলেই তো সারাদিন চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে থাকি—আর টাক ঘড়িটার টিক-টিক শব্দ শুনি।

আজো ভূতনাথের মনে পড়ে বদরিকাবাবুর কথাগুলো বর্ণে বর্ণে কেমন মিলে গেল একে একে।

আপিস থেকে ফেরবার পথে বাড়ির সামনে আসতেই সেদিনও ব্রিজ সিং ডাকলে—শালাবাবু, ছুটুকবাবু বোলায়া আপকো।

» ১০. একা পেয়ে সেদিন বংশী এসে ধরলো

একা পেয়ে সেদিন বংশী এসে ধরলো। রবিবার। বললে— আজকে আপনাকে যেতেই হবে শালাবাবু-ছোটমা আমাকে রোজ বলেন—তোর শালাবাবুকে একবার ডেকে দিলিনে, আমি আপনাকে সুযোগ মতো ধরতেই পারিনে, আপনি ছুটুকবাবুর আসরে গিয়ে বসেন, আর রাত হয়ে যায়।

ভূতনাথ বললে-কী দরকার কিছু শুনিসনি তুই?

—তা তত ছোটমা আমাকে বলেন নি আজ্ঞে।

–কিন্তু ব্ৰজরাখালকে জিজ্ঞেস না করে যাই কি করে—তা ছাড়া বাড়ির মধ্যে, অন্দর মহলে…আমি অচেনা পুরুষমানুষ—যদি কেউ কিছু বলে—তখন?

—সে ছোটমা ডেকেছেন, আপনি কী করবেন? তা ছোটবাবু তো আর জানতে পারছেন না হুজুর—ছোটবাবু সন্ধ্যের সময় বেরিয়ে গিয়েছেন–আসবেন সেই আবার কাল ভোর বেলায়।

—কোথায় যান তোর ছোটবাবু?

–আজ্ঞে, সেই পিশেচ-মাগীর কাছে, জানবাজারে, ছোটমা বলেন—বামুনের শাপে নাকি অমন হয়েছে, আর জন্মে বামুনকে অপমান করেছিলেন—তাই এ জন্মে এই ভোগ।

–তুই তাকে দেখেছিস নাকি বংশী?

—দেখিনি আবার, ছোটমার পায়ের যুগ্যি নয় সে—তাতেই আবার কত ঠ্যাকার, নিজের হাতে এক ঘটি জল পর্যন্ত গড়িয়ে খান না। বাবু যেদিন আসেন না, সেদিন ছোটম পাঠায় কিনা আমাকে, মরতে মরতে যাই—এই এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি তাকে, কী ছিল আর কী হয়েছে। ওই যে যদুর মা বাটনা বাটে, ওই কাজ আগে করত ওর মা—আমরা ডাকতুম রূপা বলে

—সেই রূপো দাসীর মেয়ে চুনী, তখন ছিল আট বছর বয়েস। তারপর কেমন করে ছোটবাবুর নজরে পড়ে গেল, তখন ছোটবাবুর। বিয়ে হয়নি, তারপর যখন ছোটমা এ-বাড়িতে এলেন, তখন রূপোর মেয়ের বয়েস তেরো। তখন থেকে আলাদা বাড়ি করে দিলেন ছোটবাবু, রূপো এ-বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে উঠলো জানবাজারের নতুন বাড়িতে—তা সমস্তই ছোটমা’র কপালের লিখন শালাবাবু, রূপোরই বা কি দোষ, আর তার মেয়েরই বা কী দোষ—তারপর বললে—তা হলে ওই কথাই রইল, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিন—আমি ঠিক সময়ে আসবে খন।

তারপর সন্ধ্যে হলো। গেটের পেটা ঘড়িতে ছ’টা বাজলো, সাতটা বাজলল, আটটাও বাজলো। তখনও ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে ভূতনাথ। অনেকবার অনেক রকম করে ভাবতে লাগলো ব্ৰজরাখালকে না বলে কি বাড়ির বউ-এর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ভালো। তাও আবার ছোটবাবুর অসাক্ষাতে। যে-সে বাড়ি নয়, রাজা-রাজড়ার বাড়ি। এতদিন ধরে এ-বাড়িতে আছে, কোনোদিন বউদের মুখ দেখা দূরে থাক, চেহারাও দেখেনি সে। পেছনের দরজা দিয়ে মেয়েদের যাওয়া-আসার রাস্তা। সে গেট চাবি বন্ধই থাকে। যখন গাড়ি ঢোকে, তখন চাবি খোলা হয়। বড়বউ যখন কোনো শুভ-তিথিতে গঙ্গায় স্নান করতে যান, তখন খোলা হয় মাঝে মাঝে। মেজবউ বাপের বাড়ি যান মাঝে মাঝে। তাঁর মা আসেন, রাঙামা আসেন।

আর ছোটবউ?

বংশী বলে—ছোটমার তো মা নেই যে আসবে, গরীবের ঘরের মেয়ে, বাপের একটি মাত্তোর মেয়ে, ছোটমা’র রূপ দেখে বড়বাবু এ-বাড়িতে বউ করে এনেছিলেন, তা বাপও এখন মারা গিয়েছেন, যখন বেঁচে ছিলেন তখনও চলা-হাঁটা করতে পারতেন না, ধম্ম কম নিয়ে থাকতেন, এক গুরু ছিল, গুরুর আশ্রমই ছিল তার ভরসা।

ছোটবউকে দেখেনি ভূতনাথ। কোনো বউকেই দেখেনি। কিন্তু ভূতনাথের মনে হয় যেন তাদের প্রত্যেককে সে চেনে। রাজাবাহাদুর বৈদূর্যমণি চৌধুরী মারা গেলেন জমিদারীতে। একলাই যেতেন তিনি। নিজে গিয়ে দেখা শুনো করে আসতেন। নদীর ধারে চৌধুরীদের বিরাট কাছারি-বাড়ি। মাসের মধ্যে একবার করে তার যাওয়া চাই-ই। প্রজাদের নালিশ শোনা, তাদের খাজনা মকুব করা, এমন কত কাজ তাঁকে করতে হতো। গাঁয়ের পালোয়ানদের ডেকে তাদের কুস্তি দেখতেন। কুস্তিগীর হলে সাত খুন মাফ! সময় সময় লড়তেন তাদের সঙ্গে। তার কুস্তির আখড়ায় হনুমানজীর মস্ত একটা মূতি আজো আছে। তেল-সিঁদুর মাখানো মানুষ সমান মূর্তি। বদরিকাবাবু বলে—কিন্তু মরবার সময় এক ফোঁটা জল পর্যন্ত পেলে না–ও রাজাবাহাদুর নয় রে, রাজসাপ।

তা অত রাত্রে কে-ই বা জল দেয়। আর কে-ই বা খবর নেয়। আর কেউ জানতে পারলে তবে তো! সকালবেলা সবাই টে পেলে। অনাদি মৌলিক বুড়োমানুষ। তিন পুরুষের গোমস্তা। তিনি দেখলেন। দারোয়ান, সেপাই, বরকন্দাজ, সবাই দেখলে।

অতখানি লম্বা-চওড়া দশাসই শরীর বড়বাবুর। কুঁকড়ে নীল হয়ে পড়ে আছে উঠোনের মধ্যিখানে। আর পায়ের কাছেই আর একটা জিনিষ পড়ে আছে। সেটাও কম লম্বা-চওড়া নয়। উল্টে পাল্টে চিত হয়ে পড়ে আছে সেটা। দুটোই প্রাণহীন—অনাদি মৌলিক অন্ধকারে দেখেই সাত হাত পেছিয়ে এসেছিলেন। এক শনিবার, তায় জাত কালকেউটে।

সে সব পুরোনো ইতিহাস। ওই ছুটুকবাবু তখন ছোট। বড়বউ ছিলেন বড় ধর্মশীল। সাতদিন জলস্পর্শ করলেন না। তারপর যখন উঠলেন ভূমিশয্যা ছেড়ে, তখন আর সে মানুষ নন। এখন ভাত খাবার পর চৌষটিবার সাবান দিয়ে হাত না ধুলে শুদ্ধ হয় না শরীর। একটা সাবানকে কেটে চৌষট্টি টুকরো করতে হয়। সিন্ধু। সেই চৌষট্টি টুকরো সাবান আর চৌষট্টি ঘটি জল ঢেলে হাত ধুয়ে দেয় বড়বউ-এর। ঠাকুরবাড়ির প্রসাদের সন্দেশ, তা-ও ধুয়ে খেতে হবে। এমনি বিচার তাঁর।

বৈদূর্যমণি চৌধুরীর পর জমিদারীর ভার পড়লো হিরণ্যমণির ওপর। কিন্তু বড়মাঠাকরুণ ছাড়লেও, মেজবাবই বা ছাড়বেন কেন তাকে। বরং সুবিধেই হলো। দুজনের দুটো বাড়ি হলো। তারপর এল হাসিনী। হাসিনীরও কাঁচা বয়েস। অনাদি মৌ লক টাকা পাঠান। সে টাকাও কম পড়ে। চিঠি যায় জোর তাগাদা দিয়ে। বিধু সরকার নিজে যায় তাগাদা করতে।

মেজবাবুর পানসি গঙ্গার বুকে পাল তুলে বরানগরের দিকে ভেসে চলে। আশে পাশের গ্রামের লোক শুনতে পায় গানের সুর, ঘুঙুরের শব্দ। নৌকোর ভেতর সুতীব্র বাতি জ্বলে, গঙ্গার বুকের একটা অংশ আলোয় আলো হয়ে যায়।

ছোটবাবু কৌস্তুভমণি চৌধুরীর তখন কম বয়েস। ওই ছুটুকবাবুর মতো। সবে লেখাপড়া ছেড়েছেন। ল্যাণ্ডোতে উঠতে যাবেন বিকেলবেলা। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই মাথায় একটা আঘাত লাগলো সজোরে।

সর্বনাশ! একটা বাতাবি নেবুর খোসার টুকরো মাথায় লেগে পায়ের কাছে মাটিতে ছিটকে পড়লো।

প্রথমে রেগে গিয়ে ছলেন ছোটবাবু। তারপর বললেন—কে রে ও?

তোষাখানার সর্দার মধুসূদন যাচ্ছিলো সেখান দিয়ে। বললে–আজ্ঞে ও রূপো দাসীর মেয়ে চুনী।

–রূপো দাসী কে?

–আজ্ঞে বাটনা বাটে আর ডাল ঝড়ে ওই কোণের ঘরে বসে।

–ও-বলে বেরিয়ে গেলেন যেমন যাচ্ছিলেন। কিন্তু মধুসূদন ছাড়লে না। পাঁচ টাকা জরিমানা হয়ে গেল। মধুসূদনের জরিমানা। এ ওর প্রাপ্য। ওর আর নড় চড় নেই। মাইনেই তো পায় রূপো এক টাকা মাসে আর মা-মেয়ের খাওয়া পরা। মার কাছে বারো বছরের চুনী ঢিপ ঢিপ করে কিল খেলে গোটা কতক। চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচড়ে নাকালের একশেষ করলে রূপো দাসী। শেষে কান্না–শতেক খোয়ারীর জন্যে আমার কি মরেও শান্তি নেই মা, কবে মরবি তুই, যম কি ভুলে গিয়েছে নিতে। পোড়া পেটের জন্যে ভূতের মতন খাটি—তাতেও শান্তি নেই।

মধুসূদনের কাছে আর্জি গেল।

মধুসূদন বলে—ছোটবাবুর হুকুম, আমি কি করবে তার। কিন্তু রূপোর সাহস আছে বলতে হবে বৈকি। পাঁচটা টাকা তত কম কথা নয়। কেঁদে কেটে ছোটবাবুকেই ধরে পড়লো সে। চুনী ছিল সঙ্গে। বারো বছর বয়সের চুনীবালা। কাঁদা কাটার ফল ফললল দিন কতক পরেই। রঙিন শাড়ি উঠলো চুনীবালার গায়ে, কানে মাকড়ি। পায়ে আবার আলতা। মাইনে বেড়ে এক টাকা থেকে দু’ টাকা হলো। রূপো দাসীর মুখে কথা ছিল না আগে। সেই মুখের ঝাল বাড়লো।

সৌদামিনী আনাজ কুটতে কুটতে সব দেখে। অত যে মুখ তার, তাও কিছু বলতে পারলে না। তবু স্বভাব যায় না মরলে। গজ গজ করে বলতে থাকে—চোক গেল তত তিভুবন গেল—ভোলার বাপ তাই বলতো-ফুলবউ, চোক কান থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও। কপাল না কপাল, ছি ছি, গলায় দড়ি জোটে না তোদর।

এ সব পুরোনো দিনের কথা। ওই ওরা সব জানে। ওই মধুসূদন, লোচন, বংশী, বেণী, শশী, সিন্ধু, গিরির দল।

রাত আটটা বাজলো অথচ বংশী তখনও এল না। কিন্তু এল অনেক পরে, যখন ছুটুকবাবুর আসরে ভূতনাথ তবলা বাজাচ্ছে।

গান তখন জমে উঠেছে। হঠাৎ বংশী পেছন থেকে আস্তে আস্তে ডাকলে–শালাবাবু—

ভূতনাথ পেছনে ফিরে দেখে বললে–দাঁড়া।

কিন্তু ছুটুকবাবু দেখতে পেয়েছে। বললে—কী বলছিস রে-বংশী?

–আজ্ঞে ছোটমা একবার শালাবাবুকে ডাকছেন।

–কেন?

বংশী বললে— জানিনে।

ছুটুকবাবুর তখন খোশ মেজাজ। একটু আগেই নিধুবাবুর টপ্পা শুনেছে। নেশার ঘোর রয়েছে। বললে—যাও না ভাই, ছোটমা ডাকছে, যাও না, দোষ কী।

কান্তিধরকে তবলা দিয়ে ভূতনাথ উঠলো। বললে—আমি আসছি এখনি।

অন্দর মহলের সিঁড়ির কাছে এসে ভুতনাথের যেন কেমন সঙ্কোচ হলে।

বংশী বললে—চলে আসুন শালাবাবু, দাঁড়ালেন কেন-বলে একবার গলা খাকরি দিলে। তারপর সে-সিঁড়ির শেষে দোতলার সিঁড়ি পড়লো। সিঁড়ির মাথায় তেলের আলো জ্বলছে টিম টিম করে। লম্বা বারান্দায় একটা কাকাতুয়া চিৎকার করে ডেকে উঠলো। একটু ভয় করতে লাগলো ভূতনাথের। তারপর কোথা দিয়ে কোন্ বারান্দা পেরিয়ে কোন সিঁড়ি দিয়ে উঠে তেতলার মহলে গিয়ে পড়েছিল সেদিন চিনতে পারেনি।

তেতলার বউদের মহলে পড়তেই সিন্ধুর গলা—কে?

– আমি বংশী।

-এখন একটু সবুর করতে হবে, বড়মা হাত ধুচ্ছে।

বংশী পেছন ফিরে বললে—একটু দাঁড়ান শালাবাবু।

একটু মানে যার নাম এক ঘণ্টা। ঠায় দুজনে দাঁড়িয়ে সেখানে। কী হলো!

বংশী বললে—বড়মা’র ছুচিবাই কিনা, হাত ধুতে একটু দেরি লাগবে।

সিন্ধুর গলা শোনা গেল—বড়মা আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, উঠুন, উঠুন।

বড়মার গলা শোনা গেল অনেক ডাকাডাকির পর। বললেন —কবার হলো?

—আর তিন বার। কথাটা কানে যেতেই বংশী বললে—আর দেরি নেই, হয়ে এসেছে, একষট্টি বার হয়েছে—আর তিনবার হলেই শেষ।

তারপর অনুমতি পাওয়া গেল। সিন্ধু বড়মা’কে তখন ঘরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বললে—এবার এসো গা

ভূতনাথ সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে হাজির হলো একেবারে শেষ ঘরখানার সামনে।

ডাকলে—চিন্তা, ও চিন্তা—

কালো কুচকুচে একখানা মুখ বাইরে এসেই হঠাৎ ভূতনাথকে দেখে ঘোমটায় ঢেকে গেল।

বংশী বললে–হ্যাঁ রে, তোর ছোটমা কী করছেন?

মুখ নিচু করে চিন্তা কী বললে বোঝা গেল না। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দুজনকেই আসতে বলে একপাশে সরে দাঁড়ালো।

» ১১. আজ এতদিন পরে ভাবতে অবাক লাগে

আজ এতদিন পরে ভাবতে অবাক লাগে, সেদিন সেই প্রথম দেখা ছোটমা’র চেহারাটা কেমন করে অমন সুন্দর লেগেছিল। ভূতনাথ যেন অত রূপ মানুষের শরীরে আর কখনও দেখেনি। এক এক জনের রূপ আছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, প্রশান্তির প্রলেপ লাগায়, আলা ধরায় না—সে-ও বুঝি তেমনি। হঠাৎ তার সমস্ত শরীরে কে যেন চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে দিলো। চোখ নাক মুখের অমন শ্ৰী বুঝি মানুষের মধ্যে দুর্লভ। কিন্তু তা ছাড়াও সব মিলিয়ে যে-টা সব চেয়ে প্রথম নজরে পড়ে সে তত ছোটমা’র চেহারার খুটিনাটি নয়। ভূতনাথের মনে হয়েছিল—সেই চারটে দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে যেন কোটি কোটি মানুষের প্রাণের নিভৃততম কল্পনা। যুগযুগান্তের লাখ লাখ যুগের সমস্ত সৌন্দর্যের তিল তিল আহরণ করে যেন ছোটমা’র অবয়বে তিলোত্তমা মূর্তি নিয়েছে। তবু সে রূপ যেন শারীররূপ নয়, যেন তাকে স্পর্শ করা যায় না, ধরা ছোঁয়ার অনেক ঊর্ধ্বে সে, চাওয়া-পাওয়ার জগতের বাইরে এক অব্যক্ত বাণীময় রূপক কাব্য। যেন দেহ স্পর্শ করলে দেখা যাবে–দুধের ফেনার চেয়ে তা নরম, কাছে গেলে মনে হবে–আকাশের রামধনুর চেয়ে তা বর্ণাঢ্য। এতখানি প্রশান্তি বুঝি প্রশান্ত মহাসাগরেও নেই।

ভূতনাথের দিকে চোখ তুলে ছোটমা এক বার ছোট করে ঘোমটা তুলে দিলে মাথায়।

তারপর বংশীই যেন চোখের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলে—এই-ই মালাবাবু।

ছোটমা বললে—এসো-বোসো এখানে।

মেঝেতে একখানা গালচে পাতা। ভূতনাথ বসলো।

ছোটমা বললে—বংশী তুই একটু বাইরে দাঁড়া গিয়ে, আমি ডেকে পাঠাবো।

চিন্তাকেও কী একটা কাজের হুকুম করে বাইরে পাঠিয়ে দিলে ছোটমা। কেমন যেন প্রচণ্ড এক অস্বস্তিতে ঘামতে লাগলো ভুতনাথ। ছোটমা’র চেহারার দিকে বিশেষ করে মুখের দিকে যেন হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখলেও তৃপ্তি হয় না। মাথা নিচু করে বসেছিল ভূতনাথ। কিন্তু কেবল মনে হচ্ছিলো–আর একবার মুখ তুলে দেখা যায় না মুখখানার দিকে।

ছোটমা’র গলা শোনা গেল—ওরা তোমাকে শালাবাবু বলে ডাকে সবাই। আসল নামটা কেউ জানে না। বংশীকে বলেছিলুম,

ও-ও বলতে পারলে না।

ভূতনাথ মাথা নিচু করেই বললে—আপনিও ওই নামেই ভাকবেন।

—তবু বাপ মায়ের দেওয়া একটা নাম তত আছে তোমার।

–বাপ মাকে চোখে দেখিনি, আমার নাম রেখেছিল পিসীমা। আমার নাম শ্ৰীভূতনাথ চক্রবর্তী। নামটা সকলের পছন্দ হয় না।

—তুমি ব্রাহ্মণ–তা হোক, তবু তোমাকে আমি ভূতনাথ বলে ডাকবো–কেমন? বয়সে আমি তোমার ছোট হলেও সম্পর্কে তো বড়-আমাকে তুমি বৌঠান বলে ডেকো।

ভূতনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর চোখ তুলে বললে—আমাকে ডেকেছিলেন কী জন্যে, বংশী বলছিল—

—বলছি, কিন্তু তার আগে তুমি একটু জল খেয়ে নাও। আমার হাতে খেতে তোমার আপত্তি নেই তো?

বৌঠানের চাবির আর চুড়ির শব্দ কানে এল। পায়ের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। চওড়া পাড় শান্তিপুরে শাড়ির নিচে যে-টুকু দেখা যায় তা হয় তো শরীরের এক সামান্যতম অংশ। ছোট ছোট আঙুলগুলো আলতার বেষ্টনীতে অপরূপ অনবদ্য মনে হলো। ধবধরে দুধের মতো সাদা নখ—আলতায় ঘেরা। টোপা কুলের মতো যেন রসে ভরা।

চিন্তা শ্বেতপাথরের রেকাবীতে এনে রাখলে খাবার।

বৌঠান বললে—সব আমার যশোদাদুলালের প্রসাদ-তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—চিন্তা একটু জল দে ভূতনাথের হাতে।

বৌঠানের মুখে নিজের নামটা যেন আজ কেমন সুন্দর মনে হলো। ও নামটা আগে আর কারুর মুখে তো এত সুন্দর ঠেকেনি। মন্ত্রচালিতের মতো এক-একটা করে মিষ্টি মুখে পুরতে লাগলো ভূতনাথ। তারপর আশে পাশে চেয়ে দেখলে। ঘরের এক পাশে একটা প্রকাণ্ড পালঙ্ক। ছাদের কড়িকাঠ থেকে একটা রঙিন মশারি ঝুলছে। চূড়ো করে বাঁধা। এতখানি পুরু গদির ওপর শাখের মতো সাদা চাদর ঢাকা। দুটো মাথার বালিশ। সবই প্রকাণ্ড। পঙ্খের কাজ করা দেয়ালের গায়ে অনেক ছবি। পটের ছবি, শ্রীকৃষ্ণের পয়স ভক্ষণ। গিরি-গোবর্ধনধারী যশোদাদুলাল। ‘ময়ন্তীর সামনে হাসরূপী নলের আবির্ভাব। মদন ভস্ম-শিবের কপাল দিয়ে ঝাটার মতন আগুনের জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। আরো কত কি। একটা কাচের আলমারিতে কত পুতুল! বিলিতি মেমঘাগরা পরা। গোরা পল্টন-মাথায় টুপি। খোপ মাথায় কালীঘাটের বেনে-বউ। আর মেঝের এক কোণে ছোট একটা জলচৌকির উপর ধূপ ধুনো জ্বলছে। ফুল আর বেলপাতার ভিড়ের মধ্যে রূপোর সিংহাসনের ওপর বসা শ্ৰীকৃষ্ণ। বৌঠানের যশোদাদুলাল। সোনার মূর্তি। বাঁশিটা পর্যন্ত সোনার তৈরি।

–পান খাও?

–না তো।

—খাও, একদিন খেলে দোষ হয় না, বৌঠান দিচ্ছে খেতে হয়।

পান চিবুতে চিবুতে ভূতনাথ ভাবছিল, হঠাৎ কীসের জন্যে এত আয়োজন আপ্যায়ন। এখন যদি হঠাৎ কোনো কারণে ছোটবাবু এসে পড়ে ঘরের মধ্যে। বংশী অবশ্য বলেছে—ছোটবাবু রাত্রে কোনোদিন বাড়ি থাকেন না। চুনীর কাছে থাকেন। রূপো দাসীর মেয়ে চুনীবালা। বাড়ি করে দিয়েছেন তাকে জানবাজারে। ভূতনাথ বললে—এখন আসি তা হলে বৌঠান—

—সে কি, আসল কথাটাই যে বলা হলো না—বংশী বলছিল, তুমি নাকি ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে কাজ করে?

–সে এমন কিছু নয়, ব্ৰজরাখাল বলেছে, যদ্দিন ভালো চাকরি পাই…তারপর ওদের আপিসে চাকরি খালি হলেই সায়েবকে বলে…

আমি সে-কথা বলছি না—’মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয় বলতে পারে?

হঠাৎ এবার ভূতনাথ সোজাসুজি বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। পাতলা দুটি ঠোট। লালচে আভা বেরোচ্ছে। কানের হীরে দুটো টিক টিক করে দুলছে। আর কপালের ওপর দু একটা অবাধ্য চুলের ওড়া। ঠিক তার নিচে দুটো কালো চোখের সহজ অথচ সুগভীর চাউনি। কাজল পরেছে নাকি বৌঠান!

বৌঠান আবার বললে-বংশী কিছু বলেনি তোমায়?

ভূতনাথ জবাব দিলে–বংশী শুধু বললে—আপনি আমায় ডেকেছেন। আমি আসবো-আসবে করে আসতে পারিনি—আপিস থেকে ফিরতেই দেরি হয়ে যায় রোজ।

–খুব বুঝি কাজ সেখানে? সহানুভূতি মেশানো বৌঠানের গলায়।

–একা তো সব আমাকেই করতে হয় কিনা—সুবিনয়বাবু শুধু টাকাকড়ির হিসেবটা রাখেন।

–সুবিনয়বাবু কে? তোমার মনিব বুঝি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, ব্রাহ্ম ওঁরা, কিন্তু তোক খুব ভালো। আমার জন্যে ওদের ঠাকুরটাকেও তাড়িয়ে দিয়েছেন।

–কেন?

ভূতনাথ সবিস্তারে সব বললে। কত টাকা মাইনে, জবার ব্যবহার, জবার মা’র পাগল হওয়ার কথা—বাদ দিলে না কিছুই। যেন অনেক কথা বলতে আজ ভালো লাগলো ভূতনাথের। কোনো নারী আগে কোনোদিন ভূতনাথের কথা এমন করে মন দিয়ে শোনেনি, শুনতে চায়নি। এখানে এই বড়বাড়ির অন্দরমহলে এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে কে জানতো। সহজ সাদাসিধে দুঃখের কাহিনী ভূতনাথের। ভালো করে গুছিয়ে বলবার ক্ষমতাও নেই তার। অথচ কে এমন করে ওকে আদর করে বসিয়ে খাইয়েদাইয়ে তার মুখ থেকে গল্প শোনে। এখন বৌঠানের মুখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতেও যেন আর লজ্জা হলো না ভূতনাথের। বৌঠানের হাতে চাবির গোছাটা মাঝে মাঝে টুং-টুং করে বাজছে। সঙ্গে সঙ্গে চুড়িগুলোও। সিঁথির ওপর জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সিঁদুরের রক্তিমা। মনে হয়, বৌঠান যেন এখনই সিঁদুর পরে উঠলে টাটকা। পাতাকাটা চুলের ওপর এখনও জল চকচক করছে। অল্প অল্প হাসি-হাসি মুখ। পাতলা ঠোট দুটো গল্প শুনতে শুনতে একটু একটু দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে বৌঠান। ভূতনাথের এমন ভালো আর যেন আগে কখনও লাগেনি। ভূতনাথ আবার বললে—এবার আসি বৌঠান, আপনার খুব দেরি করে দিলাম।

কিন্তু কথাটা বলে ভয়ও হলো। যদি সত্যি সত্যিই এখনি উঠে চলে যেতে হয়।

বৌঠান বললে—খুব তো বুদ্ধি তোমার-সাধে কি আর জবা তোমায় বোকা বলে—এতদিন এ-বাড়িতে আছো, এখনও টের পাওনি কিছু? এ-বাড়িতে রাত বারোটায় সন্ধ্যে হয়, জানো না?

ভূতনাথ চুপ করে রইল এবার।

বৌঠান এবার বললে—তা হলে কত দাম ওর—এই ‘মোহিনীসিঁদুরে’র?

—দাম, দু’ টাকা সওয়া পাঁচ আনা—কিন্তু এখন আমার টাকার দরকার নেই।

—কেন? চুরি করে আনবে বুঝি? তা হচ্ছে না। তারপরে বৌঠান ‘চিন্তা’ বলে ডাকতেই চিন্তা ঘরে ঢুকলো। বৌঠান বললে—এই চাবি নে চিন্তা, ভূতনাথকে পাঁচটা টাকা বের করে দে তো।

—পাঁচ টাকা আমি কী করবে? ভূতনাথ প্রতিবাদ করতে গেল।

—বাকিটা না হয় ফেরৎ দিও—বলে পাঁচটা চকচকে রূপোর টাকা হাতের মধ্যে গুজে দিলে বৌঠান। তারপর বললে সিঁদুরের কথাটা কাউকে যেন বলল না আবার।

ভূতনাথের ততক্ষণে বাকশক্তি রোধ হয়ে গিয়েছে। মনে হলো “বৌঠানের হাতের মধ্যে যেন কোনো যাদু আছে! এত নরম। এত স্নিগ্ধ! বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। এখন যেন হঠাৎ বড় গম্ভীর দেখাচ্ছে বৌঠানের মুখটা।

বৌঠান বললে—সিঁদুরের ব্যাপারটা কাউকে বলবে না—মনে থাকবে তো?

–আপনি যখন বারণ করছেন, তখন কাউকেই বলবো না।

–বারণ না করলে বুঝি বলে বেড়াতে? বৌঠান হেসে ফেললে। ভূতনাথ এ-হাসির অর্থ ঠিক বুঝতে পারলে না। বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে বোবার মতো চুপ করে রইল।

বৌঠান বললে হাঁ করে দেখছো কী? জানো না, এ-সব কথা কাউকে বলতে নেই।

এবার আরো হেঁয়ালি ঠেকলে ভূতনাথের। সিঁদুর কিনতে দেওয়ার মধ্যে এমন কী গোপনীয় থাকতে পারে! কত লোকই তে সিঁদুর চেয়ে চিঠি পাঠায়। দোকানেও আসে কত লোক। কিন্তু কোন্ দুর্বোধ্য রহস্য আছে বৌঠানের এই সিঁদুর চাওয়ার পেছনে?

ভূতনাথ বললে—আপনাকে কথা দিচ্ছি বৌঠান–আমি কাউকে বলবো না।

—এমন কি বংশীকেও নয়।

–বংশীকেও নয়-কথা দিচ্ছি।

–তোমার ভগ্নীপতিকেও নয়।

–কথা দিলাম।

–এমন কি জবাকেও নয়—সে-ও ঠিক বুঝতে পারবে না, বিয়ে হলে বুঝতো।

ভূতনাথ নিজের অজ্ঞাতসারেই প্রশ্ন করল—কেন?

সে তুমি বুঝবে না ভাই, বিয়ে হবার আগে সব মেয়েমানুষরাও বোঝে না।

ভূতনাথ আবার প্রশ্ন করলো—আর রাধা? রাধার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বেঁচে থাকলে সে-ও বুঝতে পারতো তো?

বৌঠানের চোখে মুখে কেমন ফিকে হাসি ফুটে উঠলো। বললে—তা কি বলা যায়, যার কপাল ভাঙে, সেই বোঝে, মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় লজ্জা, এর চেয়ে বড় অপমান আর যে নেই ভাই।

ভূতনাথ বৌঠানের গলার আওয়াজে কেমন যেন চমকে উঠলো। ভালো করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। কাঁদছে নাকি বৌঠান! তবে চোখে মুখে অত হাসির ছটা কেন! সেই ভাবে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক সময়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হেসে উঠলো বোঠান। সাদা সাদা ঝিনুকের মতো দাঁত চিক চিক করে উঠলো বৌঠানের। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে এবার হরদম হাসতে লাগলো। বললে—এ এক অবাক বাড়ি ভাই—অবাক-বাড়ি। আমার বাপের বাড়িও দেখেছি—-আমার মা-র কথাও একটু-আধটু মনে পড়ে। আমি গরীব লোকের মেয়ে বটে—কিন্তু এ এক অবাক বাড়ি—অবাক বাড়ি এটা-আবার মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তেমনি হাসতে লাগলো বৌঠান। ভূতনাথ যেন কেমন অভিভূতের মতো বসে রইল সেই দিকে চেয়ে। পাগল নাকি ছোটমা। এতক্ষণ কি উন্মাদের সঙ্গে বসে সে গল্প করছে ধবধবে ফরসা হাত, মুখ, পা-সব থর থর করে কাঁপছে বৌঠানের। টোপাকুলের মত আলতা মাখা পায়ের আঙুলগুলো এক একবার বোধহয় হাসির দমকে সঙ্কুচিত হচ্ছে।

একবার মনে হলো হাত দিয়ে জোর করে বৌঠানের আঁচলটা টেনে নিয়ে দেখে বৌঠান কাঁদছে না সত্যি সত্যি হাসছে।

কিন্তু আঁচল যখন খুললো বৌঠান তখন একেবারে স্বাভাবিক মানুষ। বললে—আমাদের বাড়ির পুরুষমানুষদের দেখছো তো ভাই, শুনেছোও নিশ্চয় অনেক কিছু–এক এক সময় ভাবি, এ কী রকম করে হলো, এত বড় বাড়ি, এত নাম-ডাক, এত পয়সা এঁদের, কার পাপে এমন হলো এরা, কিন্তু তখনি মনে হয়, দোষ আর কারো নয়, দোষ আমারই কপালের। আর জন্মে কত পাপ করেছিলাম—তাই সব পেলাম, মেয়েমানুষ যা চায় সব’ পেলাম, রূপ পেয়েছি জগদ্ধাত্রীর মতো, লোকে তো তাই বলে, অমন দেবতার মতো বাপ, মায়ের অভাব বুঝতে দেননি, এত বড় বাড়ির বউ হলাম, টাকাকড়ি, গাড়ি, বাড়ি, চাকর, বাঁদি-যা কেউ পায় না—কিন্তু আসল জিনিষেই ফাঁকি—এর চেয়ে—

ভূতনাথ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলো।

বৌঠান বললে—স্বামিজীকে তুমি চেনো না, আমার বাপের বাড়ির কুলগুরু, তাঁকে বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন—পটুর কপাল এমন করে ভাঙলো কেন গুরুদেব?—( আমার ভালো নাম পটেশ্বরী কি না, বাবা আমাকে তাই পটু বলে ডাকতেন) তা গুরুদেব বললেন:..। যাকগে সে-সব তোমার শুনে কাজ নেই ভাই।

ভূতনাথ কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলোনা, বলুন বৌঠান—শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে কিন্তু–

বৌঠান বললে—স্বামিজীকে তুমি দেখোনি ভাই, তাই হয় তত বিশ্বাসও হবে না তোমার—কিন্তু বাবা বলেন—উনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ, ওর কথা মিথ্যে হয় না, হিমালয়ে গিয়ে তিনি পঞ্চাশ বছর ধ্যানে কাটিয়েছেন, তারপর এখানে এসে এখন ধর্ম প্রচার করছেন।

-কী বললেন তিনি?

বৌঠান এবার মুখে আঁচল চাপা না দিয়েই খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললে-গুরুদেব বললেন, পটু আর জন্মে ছিল দেবোলা, দেবসভায় বাহ্মণের অপমান করেছিল—তারই শাপে এ-জন্মে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে—এ জন্মটা ওর এমনি করেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন—কীসে মুক্তি হবে ওর?

গুরুদেব বললেন–স্বামী সেবায়।

–স্বামী সেবায়?

—হ্যাঁ ভাই, স্বামী সেবায়, এ-বাড়ির ছোটকর্তাকে দেখছে তো? এতদিন আছো দেখেছো নিশ্চয়ই, তোমার কী মনে হয় জানিনে ভাই, কিন্তু আমাদের ভাড়ারে যে রাঙাঠাকমা আছে–সবাই তাকে রাঙাঠাকমা বলে, এ-বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো ঝি, আমার শাশুড়ীর বিয়ের সময় এ-বাড়িতে আসে, তা তারই মুখে শুনেছি ছোটবেলায় ছোটকর্তাকে নাকি দেখতে ছিল ঠিক দেবকুমারের মতো–যেমনি সুন্দর শ্ৰী, তেমনি সুন্দর গড়ন, তা শুনে ভাবি আমিই যদি দেবোলা হতে পারি তো ছোটকর্তারও দেবকুমার হতে দোষ কী! হয় তো শাপভ্রষ্ট দেবকুমারই হবেন, কী বলে ভাই, পৃথিবীতে এসেছেন প্রায়শ্চিত্ত-কাল পূর্ণ করতে। তা যেন হলো, কিন্তু একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয় ভাই-একএকদিন যখন রাত্রে ঘুম আসে না, যশোদাদুলালের পায়ের তলায় মাটিতে শুয়ে পড়ে থাকি, তখন এক-একবার ভাবি আমার বিধাতা পুরুষের দেখা পেলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতুম।

–কী কথা বৌঠান?

বৌঠান থামলো। বললে—না ভাই থাক, তুমি এক কাজ করো—সিঁদুরটা নিয়ে এসো–আর যদি পারো তত তোমার মনিবকে জিজ্ঞেস করে, মানুষদের বেলায় তোমাদের মোহিনীসিঁদুর’ যদিই বা খেটে থাকে, দেবকুমারদের বেলায় এ-সিঁদুর খাটবে কি না—

ভূতনাথ হেসে উঠলো।

বৌঠান বললে—হাসি নয় ভাই, আমি সত্যিই বলছি, বাবা আর গুরুদেব তো বলেছেন স্বামীসেবা করতে—কিন্তু স্বামীকে কাছে পেলে তবে তো সেবা করবো! তাই সেদিন পাঁজি পড়তে পড়তে হঠাৎ ওই বিজ্ঞাপনটা নজরে পড়লো তারপর বংশীও বললে কথায় কথায়—তুমিও নাকি কাজ করে ওখানে।

অনেক দিনের আগেকার সব কথা। সাইকেল-এ যেতে যেতে ভূতনাথের আজো যেন সে-দৃশ্যটা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ মনে পড়ে। সেই বড়বাড়ির তেতলার শেষ ঘরখানার কথা। পটেশ্বরী বৌঠানের ঘর। উঁচু পালঙ্ক। বিলিতি পুতুলে ভর্তি আলমারি। আর সামনে বসে অপরূপ রূপসী বাড়ির ছোটবউ। যে-ঘরে ছোটকর্তার পদধূলি পড়ে না। যে-ঘরে বসন্ত-বাহার করুণ আর্তনাদ করে রাত্রের নির্জনে। যশোদাদুলালের সেবায় স্বামী-সেবা যেখানে হাস্যকর হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের হিন্দু-আভিজাত্য যেখানে মোগল আমলের চৌকাঠ পেরিয়ে ব্রিটিশ আমলের নাচ-দরবারে গিয়ে থেমেছে। অনেক কোতল-কচ্ছলের পর শাসন মানতে চায় না নবজাগ্রত মন। নিয়মানুবর্তিতাকে যখন শৃঙ্খল বলে মনে হয়। কিন্তু ওদিকে চোখ রাঙিয়ে ছুটে আসছে আর এক সভ্যতা। ঘড়ির কাটার মতো সময়নির্দেশ করে পদক্ষেপ করে করে চলে যন্ত্রযুগ। গম-ভাঙা কন্স থেকে শুরু করে রেল-চলা পর্যন্ত অনেক পথ অনেক প্রান্তর পার হয়ে আসছে ১৮৯৭ সন। ওরা চেয়ে দেখলে না কেউ। মুখ ফিরিয়ে রইল। ওই হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণিরা। বড়বাড়ির ইট চুন সুরকীর মধ্যে গাছের শেকড় তখন হাত বাড়িয়েছে অনেকখানি। মিছিমিছি মাদুলি পরে ছোটবউ, যশোদাদুলালকে মিছরিভোগ দেয়, শাড়ি গয়না আলতা পরে সারারাত প্রতীক্ষায় বসে থাকে। আর পাঁজির পাতায় উদ্গ্রীব আগ্রহে ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র বিজ্ঞাপনটায় চোখ বুলোয়।

অত বড় বাড়ির বউ। ঠিক এমন করে আলাপ পরিচয় হবে ভাবা যায়নি। ভূতনাথ ভেবেছিল-দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে সে আর পর্দার আড়াল থেকে কথা হবে ঝি-র মারফৎ। কিন্তু এ যেন কেমন হলো। এত ঘরোয়া। এত ঘনিষ্ঠতা। প্রথম দিনের পরিচয়ে বিশ্বাস না হবার মতো। তফাৎ তো কিছু নেই আর পাঁচজনের সঙ্গে। তবে হয় তো আড়ালে থাকে বলেই এত কৌতুহল, এত কল্পনা-বিলাস ওদের নিয়ে। কিম্বা হয় তত বৌঠান গরীব ঘরে মেয়ে বলেই এ-বাড়িতে এক ব্যতিক্রম।

যাবার আগে বৌঠান কললে—আমার যশোদাদুলালকে প্রণাম করলে না ভূতনাথ।

ভূতনাথ সপ্রতিভ হয়ে এগিয়ে গেল বিগ্রহের দিকে। যশোদাদুলাল একপদ হয়ে সোনার বাঁশি বাজাচ্ছেন। টানা টানা প্রকাণ্ড দুটি চোখ। সামনে গিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করলো ভূতনাথ। কিন্তু মনে হলো তার সে-প্রণাম যেন ঠাকুরের পায়ে গিয়ে পেঁছিলো না। বাইরে বেরিয়ে এসেও তার যেন মনে হয়েছিল-প্রণাম সে কাকে করেছে? সত্যি সত্যিই কি বৌঠানের ঠাকুরকে? না আর কাউকে। অথচ ঠোনকে প্রণাম করার তো কোনো অর্থ হয় না। বৌঠানকে দেখে কি শুধু ভক্তিই হয়েছিল? আর কিছু নয়?

চলে আসবার আগে বৌঠান বলেছিল—সিঁদুরটা নিয়ে তুমি নিজেই চলে এসো, বংশীকে বললেই বংশী তোমায় পথ দেখিয়ে দেবে।

বাইরে বেরিয়ে এসে ভূতনাথের মনে হলো—বৌঠান যেন তাকে আগে থেকেই চিনতো। কিন্তু কেমন করে চিনলে! তবে কি বংশীই তাকে সব বলেছে।

বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে বংশী বললেন শালাবাবু, আমি কেন বলতে যাবো, আমি তো কিছু বলিনি—আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ছোটমা-শালাবাবু লোক কেমন। তা আমি যা যা জানি সব বলেছি—মাইরি বলছি, আমি আপনার নিন্দে করিনি আমি তেমন লোক নই শালাবাবু।

বংশী চলে গেল কাজে।

ছুটুকবাবুর গানের আসর তখনও চলছে। চামেলি ফুলি চম্পা। হৈ হৈ শব্দে সমে এসে গান থামলো। এখন আর আসরে যাওয়া যায় না।

সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। ইব্রাহিমের ঘরের ওপর টিম টিম করে বাতিটা জ্বলছে। কলকাতার শহরও নিস্তব্ধ। বাইরের গেটে নাথু সিং পাহারা দিচ্ছে অবিশ্রান্ত। ঘরে গিয়ে দেখলে— ব্ৰজরাখাল অনেকক্ষণ এসে গিয়েছে। কী যেন একটা পড়ছে। ব্ৰজরাখালকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখে ভূতনাথ যেন কেমন চমকে উঠলো। একটু আগেই যেন কী একটা মহা অপরাধ করে এসেছে সে। মুখ দেখাতে যেন লজ্জা হলো।

ব্ৰজরাখাল সব শুনে বললে—তা বৌঠান কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল—বললে কেন আমাকে?

—তোমাকে সবই বলা যায় ব্রজরাখল।

শেষে ব্রজরাখাল বললে—তা ভালো, কিন্তু কাজটা ভালো কররানি বড়কুটুম, ওরা হলে গিয়ে সাহেব বিবি আর আমরা হলাম গোলাম—ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম ভালো নয়—কাজটা ভালো করোনি বড়কুটুম।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়েও সেই কথাটা মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। কাজটা কি সত্যিই ভালো করেনি সে।

বৌঠানের ডাকে না গেলেই কি ভালো করতে সে। কিন্তু খারাপটাই বা হলো কোথায়। প্রণাম তবে করেছিল সে কাকে? শুধু কি বৌঠানের যশোদাদুলালকে?

১২. মোহিনী-সিঁদুর আপিসে

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে সেদিন সকাল থেকেই বড় কাজের তাড়া। একটা নিঃশ্বাস নেবার পর্যন্ত ফুরসুৎ পাওয়া যায় না। পাঠকজী তারই মধ্যে দুপুরবেলা ছাতু ভিজিয়ে খেয়ে নিলে। ভূতনাথেরও খুব খিদে পেয়েছে। তবে কি আজকে কেউ আর ডাকতে আসবে না!

একটা মনি-অর্ডারের কাগজ নিয়ে সোজা ওপরে চলে গেল। ভূতনাথ। সুবিনয়বাবু তেমনি ভাবে বসেছিলেন। পাশে জবা। আর একটা চেয়ারে জবার মা। বসে বসে বই পড়ছেন।

কাছে যেতেই ভূতনাথ লক্ষ্য করলে সুবিনয়বাবু মেয়ের সঙ্গে কী যেন আলোচনা করছেন। ভূতনাথ কাছে যেতেই জবা উঠছিল।

সুবিনয়বাবু বললেন–না, উঠে যেও না মা, বোসোলজ্জা কি মা?

জবা বললে—ভূতনাথবাবুর খাওয়ার এখনও যোগাড় হয়নি বাবা—আমি যাই।

—কেন? সুবিনয়বাবু অবাক হয়ে গেলেন। ভূতনাথবাবুর খাবার দিতে এত দেরি করা বড় অন্যায় মা।

—কিন্তু উনি কি আমাদের হাতে খাবেন? ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না বাবা।

-কেন, ও-কথা কেন বলছে মা? বৃদ্ধ যেন কিছু বুঝতে পারলেন না।

ভূতনাথ কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু।

জবার মা আপন মনেই বই পড়ছেন। তাঁর যেন এ-সব কথা কানে যাচ্ছে না।

জবা পরিষ্কার করে বললে—আমরা তত ব্রাহ্মণ নই বাবা।

-ও, তাও তো সত্যি। তা হলে তোমার খাওয়ার বন্দোবস্ত কী হবে ভূতনাথবাবু? এ-কথাটা আগে ভাবিনি তো মা-একটা ঠাকুরের ব্যবস্থা করতে হয়। পাঠককে একবার খবর দিতে হবে। ওরে রতন–

—সে যখন হবে, তখন হবে, কিন্তু এখনি তো আর ঠাকুর আসছে না—আজকে কি উনি উপোস করবেন?

—সে কি একটা কথা হলো? বলে সুবিনয়বাবু হতবুদ্ধির মতো ভূতনাথের দিকে চেয়ে রইলেন।

ভূতনাথেরও এই পরিস্থিতিতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।

জবা এবার সোজাসুজি ভূতনাথকে প্রশ্ন করলে—আমি হাঁড়িটা চড়িয়ে দিলে, আপনি নামিয়ে নিতে পারবেন না—তাতেও আপনার কিছু আপত্তি আছে?

ভূতনাথ বললে—পারবো।

—এ তো বেশ কথা, খুব উত্তম কথা, যতদিন ঠাকুর না পাই, ততদিন এই রকম একটু কষ্ট করো ভূতনাথবাবু, জবা ঠিক বলেছে।

তা হলে আমি ব্যবস্থা করি গিয়ে। সুবিনয়বাবু বললেন—তা হলে, একটা কথা শুনে যাও মা, ভূতনাথবাবুকে আমি তা হলে রবিবার দিন আসতে বলি? কী বলো?

জবা মুখ নিচু করে বললে—সে তোমার অভিরুচি বাবা।

-না না, সে কি, তোমার বিয়ে, উৎসবটা তোমাকে কেন্দ্র করে, যাদের যাদের তুমি নিমন্ত্রণ করবে, তাদেরই আমি ডাকবো-আর ভূতনাথবাবু তো আমাদের ঘরের লোক—ব্রজরাখালবাবুর নিজের বিশেষ আত্মীয়।

-আমি ভূতনাথবাবুর রান্নার ব্যবস্থা করি গে বাবা—বলে দ্রুতপায়ে জবা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল এক নিমেষে।

ভূতনাথ এবার হাতের কাগজপত্র সুবিনয়বাবুর সামনে এগিয়ে ধরলে। যেখানে সই করবার, সেখানে সই করলেন তিনি। তারপর বললেন-বোসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে ভূতনাথবাবু।

ভূতনাথ বসলো।

সুবিনয়বাবু বললেন—জবার বিয়ের কথা বলছিলাম, তা আসছে রবিবার দিন একটা ছোটোখাটো উৎসবের দিন স্থির করেছি। পরস্পর কথাবার্তা হবে। পাকাপাকি কথা সেই দিনই হয়ে যাবে। ভেবে দেখলাম আমার আর ক’দিন—আর উনিও–

পাশে-বসা জবার মা’কে নির্দেশ করে বলতে লাগলেন–আর উনিও না-থাকারই মতো। ওদিকে জবারও বিবাহের উপযোগী বয়েস, ভালো পাত্রও পেয়েছি, ছেলেটি মেধাবী, এম-এ পাশ করেছে। এবার আইন পড়ছে—বাপ বেঁচে নেই—তা হোক, এ সব সম্পত্তির ভার তো একদিন জবাকেই নিতে হবে। আমাদের পৈত্রিক কারবার

-বাবা ছিলেন গোঁড়া কালীভক্ত হিন্দু। আমি ধর্ম বদলেছি বটে, কিন্তু বংশের ধারা কোথায় যাবে—নিজের ছেলে নেই, তা না থাক, জামাইকেই ছেলের মতন করে নিতে হবে। তারপর খাওয়াপরার জন্যে চিন্তা করতে হবে না–আমি যা রেখে গেলাম…কী বলো, অন্যায় কিছু বলছি।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। ভূতনাথ বললে—আমি আসি এবার।

—না রোসস একটু, তোমাকে সেই গল্পটা বলা হয়নি। প্রথম যেদিন দীক্ষা নিলুম—সে কী কাণ্ড ভূতনাথবাবু—শুনুন তবে

ভূতনাথ বললে—সে-গল্প আপনি আমাকে বলেছেন।

-বলেছি নাকি? তা বলেছি বটে, কিন্তু কেবল মনে হয় বুঝি বলা হলো না কাউকে। কেউ কি মনে রাখবে সে-কথা ভূতনাথবাবু? আমার সময় তো ঘনিয়ে এল-শ্রীমদ্ভাগবতে পড়েছি রন্তিদেবের গল্প, সমস্ত দিন ধরে সব দান করে যখন নিজের খাবার জলটুকুও এক ভিক্ষার্থী চণ্ডালকে দিয়ে দিলেন, তখন নিজের মনে যা বললেন— ভাগবতকার বলছেন তা অমৃত—ইদমাহামৃতং বচঃ—কী বললেন? না, বললেন—আমি ভগবানের কাছে পরম গতি চাই না, অষ্ট সিদ্ধিও চাই না-পুনর্জন্মও চাই না—আমি চাই আমি যেন সমস্ত জীবের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের দুঃখকে পাই, যাতে তাদের দুঃখ না থাকে—আর এক জায়গায় ভাগবতকার বলছেন–

“ন ত্বহং কাময়ে রাজ্যং ন স্বর্গং ন চ পুনর্ভবম
কাময়ে দুঃখপ্তানাং প্রাণিনামার্তিনাশনং”—

—আহা, বাবাকে দেখেছি বাড়ির বিগ্রহের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করছেন “ত্বমেকং জগকারণং বিশ্বরূপং”। বাবা ছিলেন আমার বড়ই গরীব–যজন-যাজন নিয়েই থাকতেন। মনে আছে আমি ছোটবেলায় হুঁকো কল্কে নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতুম, দিনের মধ্যে অন্তত দশ-বারোটা কল্কে ভাঙতুম। মনে আছে বাবা সেই উঠোনের ধারে বসে বসে.. তোমার শুনতে ভালো লাগছে তো ভূতনাথবাবু? খারাপ লাগলে বলবে।

বহুবার শোনা গল্প। অনেকবার বলেছেন। তবু ভূতনাথ বললে—না খুব ভালো লাগছে, আপনি বলুন।

সুবিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে আবার আরম্ভ করলেন—তখন এক পয়সায় আটটা কল্কে—সে পয়সাও খরচ করবার মতো সামর্থ্য ছিল না তার—কোথায় গেল সে-সব লোক। সেই অবস্থার মধ্যেই একদিন ঈশ্বরের কৃপা পেলেন বাবা, ধ্যানে পেলেন ‘মোহিনী-সিঁদুরের মন্ত্র–তাই থেকে চালা ভেঙে পাকা দালান উঠলো, দোতলা কোঠা হলো, মা’র গায়ে গয়না উঠলো। আর আমি এলাম কলকাতায় পড়তে, সেই পড়াই আমার কাল হলো ভূতনাথবাবু, আমি চিরদিনের মতো বাবাকে হারালুম। গল্প। বলতে বলতে চোখ ছল ছল করে ওঠে সুবিনয়বাবুর।

-জানো ভূতনাথবাবু যেবার সেই ডায়মণ্ডহারবারে ঝড় হয়, সেই সময় আমার জন্ম, সে এক ভীষণ ঝড়, বোধহয় ১৮৩৩ সাল সেটা, কলকাতায় সেই প্রথম ওলাউঠো হলো, জন্মেছি ঝড়ের লগ্নে, সারাজীবনটা কেবল ঝড়ের মতনই বয়ে গেল, বাবাকে যা কষ্ট দিয়েছি, বাবা প্রতিজ্ঞা করলেন আমার মুখদর্শন করবেন না—সত্যিই আর করলেনও না। আমি একমাত্র সন্তান, আমার অসুখের সময় বাবা কবিরাজ ডেকে আনলেন, কিন্তু ঘরে ঢুকলেন না, পাছে আমার মুখদর্শন করতে হয়। সেই বাবা আমার প্রেতলোকে এক গণ্ডুষ জলও পেলেন না তাঁর একমাত্র বংশধরের হাতে। তাই সেই পাপেই বোধহয় আমি আজ নির্বংশ—বলে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ভূতনাথের দিকে।

–কিন্তু কী করবো বলো ভূতনাথবাবু মন বলে অন্য কথা। হৃদয়ের কথা মন শোনে না। বলে–ভুল, ভুল-সব তোমার ভুল ধারণা। তথাগত প্রচার করলেন–জন্মেই বন্ধন, জন্মরহিত হতে পারলেই মুক্তি। তাই তো ভাবি—দ্বৈতের জগতে স্বর্গরাজ্য আসতে পারে না, নিত্য বৃন্দাবনের পরমানন্দ ব্রহ্মের রসোল্লাস যেখানে একত্বের মধ্যে সকল বহুত্বের চির-অবসান তা-ই কাম্য হওয়া উচিত—আমার জীবনের শেষ-দিনটা পর্যন্ত এর মীমাংসা বুঝি আর করতে পারবো না—মন বলে–ঠিক করেছে, হৃদয় বলে-না। অথচ দেখো ভূতনাথবাবু ‘মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসাও ত্যাগ করতে পারলাম না-ও ভড়ংটাও রাখতে বাধ্য হয়েছি।

সে কি! ভূতনাথ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলে। সব তবে ভড়ং। কিছু তবে সত্যি নেই এর পেছনে। খানিকটা দৈবশক্তি বা মন্ত্রশক্তি! ভূতনাথের মনে হলো কিছুটা দৈবশক্তি আছে জানতে পারলে যেন সে তৃপ্তি পায়। অন্তত একবারের জন্যেও সে বৌঠানের কাছে গিয়ে তা হলে এর গুণের কথা বলতে পারে।

সকাল থেকে যে-প্রশ্নটা বারবার মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিলো, এই সুযোগে ভূতনাথ সেই প্রশ্নটাই করলে। বললে—আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয়?

কিন্তু প্রশ্নটা করবার আগেই বাধা পড়লো। হঠাৎ পাশ থেকে বই পড়তে পড়তে জবার মা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।

সুবিনয়বাবু সচকিত হয়ে উঠেছেন। কি হলো রাণু—কী হলো রাণু?

সুবিনয়বাবু যেন ভুলে গিয়েছেন ভূতনাথ এখানে বসে আছে। সুবিনয়বাবু হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে স্ত্রীর মাথাটা দুই হাতে ধরলেন। জবার মা’র হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। আঁচলটা খসে গেল বুক থেকে। ছোট মেয়ের মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

—কী হলো রাণু, কী হলো? বৃদ্ধ অথর্ব শরীর নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। উঠে স্ত্রীর মাথাটি ধরে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে লাগলেন।

—কী হলো রাণু, বলল আমাকে? বলো—

কাঁদতে কাঁদতে জবার মা বললেন—আমার খিদে পেয়েছে।

—খিদে পেয়েছে, বেশ তো, কান্না কেন, খাও, খাবার আনছি আমি।

—কিন্তু এই মাত্র খেলাম যে—আরো প্রবল বেগে কাঁদতে লাগলেন জবার মা।

—তাতে কী হয়েছে রাণু, আবার খাও।

ভূতনাথ এই পরিস্থিতিতে কেমন বিব্রত বোধ করতে লাগলো। বললে—আমি এখন আসি তাহলে।

সুবিনয়বাবু মুখ ফেরালেন। তুমি যাবে?…তা হঠাৎ এই রকম হয় জবার মা’র, এই-ই অসুখ কি না, কিছুতেই সারলো না আর, আমার খোকার মৃত্যুর পর থেকেই এই রকম হচ্ছে। তোমারও খেতে দেরি হয়ে গেল ভূতনাথবাবু-তুমি যেন রাগ করো না জবার ওপর।

আর বাক্য ব্যয় না করে সোজা নিজের চেয়ারে এসে বসলো ভূতনাথ।

 

খানিক পরেই রতন খেতে ডাকতে এল।

খাবার সময় প্রথমে বিশেষ কথা হলো না। সারাক্ষণ জবা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

একবার জবা বললে—ভাত নষ্ট করবেন না। ওগুলো সব খেতে হবে কিন্তু আপনাকে।

ভূতনাথ মুখ তুলে চাইলো। বললেপাড়াগাঁয়ের ছেলেরা ভাত একটু বেশিই খায়—কিন্তু তা বলে এত বেশি? চাল একটু কম নিতে বললেই পারতে।

—শেষে পেট না ভরলে, তখন?

জবার মুখ যেন গম্ভীর-গম্ভীর। বেশি কথার আবহাওয়া নেই তার। আবার অনেকক্ষণ চুপ চাপ। এ যেন কেমন বি ব্যাপার। এখানেই রোজ খেতে হবে—অথচ নিজের হাতে সব রান্নার ব্যবস্থা। যতদিন ঠাকুর না আসে, ততদিন! এ-ছাড়া গতিও নেই।

খানিক পরে ভূতনাথ আবার কথা কইলো। বললে–তোমার বাবা রবিবার দিন আমাকে আসতে বললেন, কিন্তু সন্ধ্যেয় না সকালে—কিছু বললেন না তো?

-সেটা বাবাকেই জিজ্ঞেস করবেন।

—কিন্তু তোমারই যখন বিয়ে, তখন তুমিও তো কিছু জানোনা আর হাতের কাছে তুমি থাকতে আবার…

-বিয়েটা আমার বলেই তো, আমার মুখে ও-কথা শোভা পায় না।

—বিয়ে জিনিষটা কি লজ্জার? সময় হলে একদিন সবারই বিয়ে হবে।

–হবে নাকি? আমার কিন্তু সন্দেহ আছে।

ভূতনাথ বললে—পাড়াগাঁয়ের ছেলে, ভাত বেশি খাই বলে কথাও বেশি বলতে পারবে এমন কথা নেই, কিন্তু এটা জানি যে সব মেয়েই আর তোমার মতো নয় জবা।

-ক’টা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে আপনার?

ভূতনাথের মনে হলো—সকলের নাম করে দেয় সে। হরিদাসী, রাধা, আন্না, তাদের ব্যবহারও তো সে দেখেছে। আর কাল রাত্রের বৌঠান। বৌঠানের কথা মনে হতেই যেন সমস্ত মন প্রশান্ত হয়ে এল তার। এক মুহূর্তে যেন এই আপিস-বাড়ি ছেড়ে সে সোজা বড়বাড়ির তেতলায় শেষ ঘরখানায় গিয়ে পৌঁছেছে। হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ভূতনাথ এক নিমেষে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে। বসলো—আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমাকে, তোমাদের ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কাজ হয়?

জবা যেন প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললে—এটাও কি বাবাকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হয় না?

মানছি ভালো হয়, কিন্তু তোমাকেই না হয় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিছু জানো?

—পাঁজির বিজ্ঞাপনে তো সব লেখা আছে।

-সে তো সবাই জানে, তুমিও জানো আমিও জানি—আরো হাজার হাজার লোক জানে।

—আমিও তার বেশি কিছু জানি না, আমার নিজের কখনও ও সিঁদুর ব্যবহার করবার দরকার হয়নি-জবা হাসলো এবার। তারপর হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো—আপনার বুঝি দরকার হয়েছে?

ভূতনাথ খাওয়া থামিয়ে বললে–হ্যাঁ।

জবা শাড়ির আঁচলটা নিজের শরীরে বিন্যস্ত করে বললেপ্রয়োগটা কি আমার ওপরে করবেন নাকি? তা হলে কিন্তু ঠকবেন বলে রাখছি!

ভূতনাথ বললে-ঠাট্টা নয়, আমার বিশেষ দরকার, আজকেই জানা দরকার—তা হলে আজই কিনে নিয়ে যাই এক কৌটো। আমায় পাঁচটা টাকা দিয়েছেন কিনতে।

-কে?

—সে আমার এক বৌঠান।

–কী হলো আবার তার?

—সে কি তুমি বুঝবে? বৌঠান বলে–বিয়ে হবার আগে ওসব মেয়েরা বুঝবে না, তা ছাড়া বলতেও বারণ আছে। মেয়েমানুষের অতবড় লজ্জা, অতবড় অপমান নাকি আর নেই।

—বৌঠানটি আপনার কে শুনি?

–বলেছি তো বলতে বারণ আছে।

জবা বললে—ডাক্তারের কাছে লজ্জা করা বিপজ্জনক, রোগ সারাতে গেলে সমস্ত প্রকাশ করে বলতে হবে।

ভূতনাথ কী যেন একবার ভাবলে। তারপর বললে–কিন্তু বৌঠানকে যে আমি কথা দিয়েছি—কথা দিয়েছি, ব্ৰজরাখালকে বলবো না, বৌঠানের চাকর বংশীকেও বলবো না, কাউকেই না, এমনকি, তোমাকেও না।

–আমাকে তিনি চেনেন নাকি?

–আমি বলেছি তোমার কথা। জবা এবার হেসে বসে পড়লো সামনে। বললে—আমার সম্বন্ধে কী বলেছেন শুনি? খুব নিন্দে করেছেন নিশ্চয়।

—নিন্দে তোমার শত্রুতেও করবে না জবা—আর আমি তো তোমার শত্রুও নই—আর তাছাড়া তুমি আমার কে বলে না যে, খামকা তোমার আমি নিন্দে করতে যাবো।

—আপনার সঙ্গে তো আমার মনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক, কী বলেন —আর কিছু নয়।

—আমিও তাই-ই বলেছি। কথাটা বলে ভূতনাথ আবার নিচু মুখে খাওয়ায় মনোযোগ দিলে। জবাও খানিক চুপ করে রইল। তারপর বললে—আপনি দেখছি শুধু অকৃতজ্ঞই নন, আপনি মিথ্যেবাদী।

ভূতনাথ খেতে খেতেই জবাব দিলে—আমি তাও বলেছি।

–তার মানে?

ভূতনাথ এ কথার কোনো জবাব দিলে না! যেমন খাচ্ছিলো তেমনি খেতে লাগলো।

—চুপ করে রইলেন যে-জবাব দিন!

ভূতনাথ এবার মুখ তুললে। দেখলে জবার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বললে—আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে একটু বেশি ভাত খাই, গুছিয়ে বলতে পারিনে বটে কিন্তু মান-অপমান জ্ঞান আমাদেরও আছে।

জবা বললে—শুধু আছে নয়, বেশি মাত্রায়ই আছে, নইলে মেয়েমানুষ বলে অপমান করতে সেদিন আপনার মুখে বাধতো।

ভূতনাথ এক মুহূর্তে বুঝে নিলে আবহাওয়াটা। তারপর বললে—সেদিন আমি অন্যায় করেছিলাম স্বীকার করি—কিন্তু ক্ষমা চাইতে ফিরে আসার পর তুমিই বা কোন্ আমার মর্যাদা রেখে কথা বলেছিলে? তারপর একটু থেমে আবার বললে-তোমাকেও তো দেখছি, আর বৌঠানকেও দেখলাম, অথচ

—অথচ কী বলুন?

ভূতনাথ হাসলো। বললে—না থাক, তুমি রাগ করবে।

-রাগ যদি করিই তো ভাত আপনাকে কম খেতে দেবো না তা বলে।

ভূতনাথ বললে—না, সে কথা হচ্ছে না, তোমাকে রাগালে আমার লোকশানই তো মোল আনা, তা জানি আমি, তোমার বাবা বলছিলেন, এ-সংসারের মালিক তো একদিন তুমিই হবে, তখন? তখন আমার সাত টাকার চাকরিতে টান পড়তে পারে কিম্বা সাত টাকা থেকে সতেরো টাকা হবার আশাতেও জলাঞ্জলি পড়বে হয় তো।

—দেখছি নামে আর চেহারাতেই শুধু ভূতনাথ—কিন্তু কথাগুলোর বেলায় কলকাতার ছোঁয়া লেগেছে এরি মধ্যে।

খাওয়ার পর হাত ধুতে ধুতে ভূতনাথ হাসতে হাসতে বললে—তুমি নিজের মুখে আসতে না বললে রোববার কিন্তু আমি আসবো না জবা।

জবাও হাসলো। বললে—আপনার আশা তো বড় কম নয় ভূতনাথবাবু!

ভূতনাথ জবার মুখের দিকে চেয়ে মনের কথাটা একবার ধরবার চেষ্টা করলো, কিন্তু জবা ততক্ষণে নিজের কাজে স্থানত্যাগ করে চলে গিয়েছে।

 ১৩. ১৮৯৭ সাল

১৮৯৭ সাল। ব্ৰজরাখাল রাত্রে বাড়ি আসেনি। আগের দিন রাত্রে বলেছিল—খুব ভোরে উঠবে বড়কুটুম-নইলে হয় তো দেখতে পাবে না। ভিড়ও হবে খুব—এখন তো আর নরেন দত্ত নয়—এখন স্বামী বিবেকানন্দ। ট্রেনটা বোধ হয় সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই এসে পৌঁছোবে, তার আগেই গিয়ে হাজির হয়ো–-আমি থাকবে।

স্বামী বিবেকানন্দ! কথা বলতে বলতে ব্ৰজরাখাল থর-থর করে কাঁপে। বলে—যাবার আগে নরেন বলেছিল—“I go forth to preach a religion of which Buddhism is nothing but a rebel child and Christianity but a distant echo.” হলোও তাই।

খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে ভূতনাথ। বড়বাড়িতে একটু দেরি করে সকাল হয়। তবু অন্ধকারে স্নান সেরে নিয়ে জামাটা গায়ে দিয়ে চাদর জড়িয়ে নিলে। কনকনে শীত। তখনও বাড়ির আনাচ-কানাচের আলোগুলো নেবেনি। নাথু সিং পাহারা দিতে দিতে বুঝি একটু ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। পায়ের আওয়াজ পেয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সমস্ত বাড়িটা নিদ্রাচ্ছন্ন। এখন বৌঠান কী করছে! এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। সারা রাত জেগে কী করে কে জানে! আশ্চর্য হয়ে যায় ভূতনাথ।

ব্ৰজরাখালের কথাগুলো তখনও কানে বাজছিল—বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে এসে বলেছেন—এসো, মানুষ হও, তোমার আত্মীয়স্বজন কাঁদুক, পেছনে চেও না—সামনে এগিয়ে যাও, ভারতমাতা অন্তত এমনি হাজার হাজার প্রাণ বলি চান, মনে রেখো-মানুষ চাই, পশু নয়।

সাত টাকা মাইনের কেরানীকে চায় না কেউ। পরান্নভোজী ভূতনাথ। এতদিন কলকাতায় এসে কী দেখেছে সে? মানুষ দেখেছে ক’টা! বড়বাড়ির মানুষগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। ওদের গায়ে কোনো ছোঁয়া লাগে না। সমস্ত ঘরগুলোর ভেতরে ঢুকলে যেন অশান্তির আবহাওয়ায় দম আটকে আসে। বৌঠান বলেছিল—অবাক বাড়ি এটা, বড় অবাক বাড়ি।

অবাক বাড়িই এটা সত্যি। সেদিন বদরিকাবাবুর কাছ থেকে এই কথাই শুনেছিল ভূতনাথ।

ডান পাশের ঘরটা খাজাঞ্চিখানা আর বাঁ দিকের বড় ঘরখানা খালি পড়েই থাকে।

দরজাটা খোলা ছিলো বুঝি। চিত হয়ে তক্তপোশের ওপর কে যেন শুয়ে ছিল। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে শব্দ এল—কে যায়?

—আমি।

‘আমি’ বলে চলে আসছিল ভূতনাথ। কিন্তু আবার যেন ডাক এল—শুনে যাও, শুনে যাও হে।

আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকেছিল ভূতনাথ। ঘরে ঢুকে দেখলে একটা তুলোর জামা গায়ে মোটাসোটা বৃদ্ধ মানুষ। ভূতনাথকে দেখে উঠে বসলো। বংশীর কাছে শুনেছিল এর কথা। এরই নাম বদরিকাবাবু।

বংশী বলেছিল—ওদিকে যাবেন না বাবু, বদরিকাবাবু দেখলেই ডাকবে—ওই ভয়ে কেউ যায় না।

কিন্তু ভয়টা কিসের!

–বোসো এখানে। ভূতনাথ বসলো।

-নাম কী তোমার?

শুধু নাম নয়। বাবার নাম। জাতি। কর্ম! নাড়ী-নক্ষত্রের পরিচয় খুটিয়ে খুটিয়ে নিলেন। সব শুনে বললেন—ভালো কয়রানি ছোকরা, গেঁজে যাবে।

ভূতনাথ কিছু বুঝতে পারলে না।

–হ্যাঁ, গেঁজে যাবে। বদরিকাবাবু মিছে কথা বলে না হে। যদি ভালো চাও, পালাও এখনি, নইলে গেঁজে যাবে! মুর্শিদকুলী খা’র আমল থেকে সব দেখে আসছি। লর্ড ক্লাইভকে দেখলুম, সিরাজউদ্দৌলাকে দেখলুম, এই কলকাতার পতন দেখলুম-হালসীবাগান দেখলুম। শেষটুকু দেখবার জন্যে এই ট্যাকঘড়ি নিয়ে বসে আছি সময় মিলিয়ে নেবে বলে। তারপর দেয়ালের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন—ওই দেখো, তাকিয়ে দেখো—সব কুষ্ঠি-ঠিকুজি সাজানো রয়েছে, সব বিচার করে দেখেছি—মিলতে বাধ্য।

ভূতনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলে দেয়ালের গায়ে আলমারিতে সাজানো সার সার বই সব। মোটা মোটা বই-এর মিছিল। সোনালি জলে লেখা নাম-ধাম।

—সব বিচার করে দেখেছি—মিলতে বাধ্য। যদি না মেলে তো আমার টাকঘড়ি মিথ্যে। কেল্লার তোপের সঙ্গে রোজ মিলোই ভাই—একটি সেকেণ্ড এদিক-ওদিক হবার জো নেই। বলে টাক থেকে বার করলেন ঘড়িটা। মস্ত গোলাকার ঘড়ি। চকচক করছে। ঘড়িটাকে নিয়ে কানে একবার লাগিয়ে আবার টাকে রেখে দিলেন। বললেন—১৩৪৫ সালে তৈরি আর এটা হলে গিয়ে ১৮৯৭। পাঁচ শ’ বাহান্ন বছর ধরে ওই একই কথা বলছে ঘড়িটা।

ভূতনাথ মুখ খুললে এবার। বললে—কী বলছে?

—বলছে, সব লাল হয়ে যাবে!

—লাল?

-হ্যাঁ, নীল নয়, সবুজ নয়, হলদে নয়, শুধু লাল। দিল্লীর বাদশা বুঝেছিল, রণজিৎ সিং বুঝেছিল, সিরাজউদ্দৌলা, আলীবর্দি খাঁ, জগৎ শেঠ, মীরজাফর, রামমোহন, বঙ্কিম চাটুজ্জে সবাই বুঝেছে শুধু ‘বঙ্গবাসী’ বুঝলে না।

-বঙ্গবাসী?

—খবরের কাগজ পড়িস না? নইলে ওই লোকটাকে, ওই বিবেকানন্দকে বলে গরুখোর, মুর্গীখোর? নইলে সাত শ’ বছর মোছলমান রাজত্বে ছ’ কোটি মোছলমান হয় আর এক শ’ বছর ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ লোক খৃস্টান হয়। ও কি ওমনি-ওমনি? নেমকহারামির গুনোগার দিতে হবে না? পালা এখান থেকে ভালো চাস তো পালিয়ে যা, নইলে গেঁজে যাবি, আর যদি না-যাস তোমর এখেনে। যখন এই বড়বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে যাবে, শাবল গাঁইতি নিয়ে বাড়ি ভাঙবে কুলী মজুররা, তখন কড়িকাঠ চাপা পড়বি, পাঁচ শ’ বাহান্ন বছরের ঘড়ি দিনরাত এই কথা বলছে, আমি শুনি আর চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকি।

এ এক অদ্ভুত লোক। ভূতনাথ সাইকেল চড়ে চলতে চলতে ভাবে, সেই এক অদ্ভুত লোক দেখেছিল জীবনে। সারা জীবন শুধু স্থবিরের মতো শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে ভাবতো। ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ কেমন করে সেই উন্মাদ লোকটার মস্তিকে আবির্ভাব হয়েছিল কে জানে!

অনেকদিন ভূতনাথ ভেবেছে, বদরিকাবাবুর কোথায় যেন একটা ক্ষত আছে। বাইরে থেকে দেখা যায় না।

বংশী বলে—এই বাড়িতে যত ঘড়ি দেখছেন, সব ওই বদরিকাবাবুর জিম্মায়। দম দেন উনি, আর ন’টার সময় কেল্লার তোপের সঙ্গে ট্যাকঘড়িটা মিলিয়ে নেন।

সে অনেক কালের কথা। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। দিল্লীর বাদশা’র কাছে রাজস্ব পৌঁছে দিতে যাবে জবরদস্ত নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ। দর্পনারায়ণ তখন তার প্রধান কানুনগো। তার সই চাই, নইলে বাদশা’র সরকারে রাজস্ব অগ্রাহ্য হবে। জমিদারদের রক্ত চোষা টাকায় তখন মাটিতে পা পড়ে না মুশিদকুলী খাঁ’র। একদিন খাজনা দিতে দেরি হলে জমিদারদের ‘বৈকুণ্ঠ’ লাভ। সে-বৈকুণ্ঠ নরকের চেয়েও যন্ত্রণাকর।

দর্পনারায়ণ বেঁকে বসলেন। বললেন—তিন লক্ষ টাকা চাই, তবে সই দেবো।

মুর্শিদকুলী খাঁ বললেন—এখন সই দাও, ফিরে এসে টাকা দেবো।

দর্পনারায়ণও সোজা লোক নন। বললেন—তবে সইও পরে দেবো।

শেষ পর্যন্ত মুর্শিদকুলী খাঁ সই না নিয়েই চলে গেলেন দিল্লী। সেখানে গিয়ে ঘুষ দিয়ে কার্য সমাধা করলেন। কিন্তু অপমান ভুললেন না। ফিরে এসে তহবিল তছরূপের দায়ে জেলে পুরলেন দর্পনারায়ণকে। সেই জেলের মধ্যেই না খেতে পেয়ে মারা গেলেন দর্পনারায়ণ। ইতিহাস ভুলে গেল তাঁকে।

সেই দর্পনারায়ণের শেষ বংশধর বদরিকাবাবু আজ বড়বাড়ির ঘরে ঘরে ঘড়িতে দম দিয়ে বেড়ান। বোধ হয় ঘড়ির টিকটিক শব্দের সঙ্গে তাল রেখে কালের পদধ্বনি শোনেন।

তারপর কতকাল কত পুরুষ পার হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল নাজির আহম্মদ আর কোথায় গেল রেজা খাঁ। কোথায় গেল মধুমতী তীরের সীতারাম, আর ফৌজদার আবুতোরাপ। নেই পীর খাঁ, নেই বক্স আলী। এক এক পুরুষের পর আর এক পুরুষ উঠেছে আর শেষ হয়েছে। কিন্তু দর্পনারায়ণের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি আজও। সে-বংশ এবার নির্বংশ হতে চললো। তবু বড়বাড়ির বৈঠকখানা ঘরটার ভেতরে বসে দুর্বল বদরিকাবাবু ইতিহাস পড়েন, আর অভিশাপ দেন। অভিশাপ দেন সমস্ত পৃথিবীকে। যে-পৃথিবী অত্যাচার করে, অন্যায় করে, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না। যে-পৃথিবী শুধু টাকার গর্ব করে। সেই সামন্ত সভ্যতার শিরে প্রতি মুহূর্তে দুর্বল আঘাত হেনে হেনে একটি দুর্বলতর মানুষ শুধু আরো দুর্বল হয়ে যায়।

বলেন—ঘড়ি বলছে—সব লাল হয়ে যাবে—দেখিস—

পাঁচ শ’ বাহান্ন বছর আগেকার সৃষ্টি যন্ত্রযুগের প্রথম দান ঘড়ি। ঘড়ির মধ্যেই যেন যন্ত্রসভ্যতার সমস্ত বাণী সঙ্কুচিত হয়ে আছে। ও বলছে— কিছুই থাকবে না। সব লাল হয়ে যাবে। অমৃতের পুত্র মানুষ, মানুষের জয় হবেই।

বদরিকাবাবু বলেন—একদিন দেখবি তুই, জয় হবেই আমাদের, আমি হয় তো সেদিন থাকবে না—এই বড়বাড়ি থাকবে না, এই মেজবাবু, ছোটবাবু তুই আমি কেউই থাকবে না। এই ছোটলাট, বড়লাট, ইংরেজরাজত্ব, কেউ নয়—কিন্তু আমার কথা মিথ্যে হবে না, দেখে নিস।

শীতের মধ্যে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে ভূতনাথ চলছিল।

রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট বন্ধ। অন্ধকার ভালো করে কাটেনি। চারদিকে শুধু ধুলো আর ময়লার গন্ধ। অন্ধকারে চলতে চলতে ভূতনাথের কেবল মনে হয়েছিল, বদরিকাবাবু পাগল হোক, কিন্তু তার ভবিষ্যৎবাণী যেন সত্য হয়।

শেয়ালদা স্টেশনের সামনে তখন বেশ ভিড় জমেছে। আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না মুখ। তবু ব্ৰজরাখালকে খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগলো। এক-এক জায়গায় দল বেঁধে জটলা করছে লোকজন। বেশির ভাগ যেন ছেলের দল। চারদিকে প্রতীক্ষমান মানুষ। এই দেশেরই এক ছেলে মহাবাণী বহন করে নিয়ে আসছে। যে বলেছে—জগতের একটা লোকও যতদিন অভুক্ত থাকবে, ততদিন পৃথিবীর সমস্ত লোকই অপরাধী। যে বলেছে—“আজ হতে সমস্ত পতাকায় লিখে নাও—যুদ্ধ নয়, সাহায্য,—ভেদ বিবাদ নয়, সামঞ্জস্য আর শান্তি। যে বলেছে—তোমরা পাপী নও, অমৃতের সন্তান, পৃথিবীতে পাপ বলে কিছুই নেই, যদি থাকে তবে মানুষকে পাপী বলাই এক ঘোরতর পাপ। তুমি সর্বশক্তিমান আত্মা, শুদ্ধ, মুক্ত, মহান! ওঠো জাগগা স্ব স্বরূপ বিকাশ করতে চেষ্টা করো, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।

ক্রমে ভোর হলো। আরো ভিড় জমলো। ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে দেখলে সমস্ত শেয়ালদা’ স্টেশনের আশেপাশে শুধু মানুষের মাথা। এরা কোথায় ছিল এতদিন! কারা এরা। এরাও কি বিবেকানন্দের ভক্ত ব্রজরাখালের মতন?

হঠাৎ জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। ইঞ্জিনের বাঁশি শোনা গেল। চিৎকার উঠলোজয় রামকৃষ্ণদেব কী জয়জয় বিবেকানন্দ স্বামিজী কী জয়।

ভিড়ের স্রোতের সঙ্গে ভূতনাথ ঢুকলো স্টেশনে।

ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। বিপুল জনতা ঘন ঘন মহামানবের জয় ঘোষণা করছে। তারপর সেই অসংখ্য জন-সমুদ্রের কেন্দ্রে আর এক দিব্যপুরুষ আবিভূত হলো। মাথায় বিরাট গেরুয়া পাগড়ী, গেরুয়ায় ভূষিত সর্বাঙ্গ। দুই চোখে অস্বাভাবিক দীপ্তি। ভূতনাথের মনে হলো—মানবের সমাজে যেন এক মহামানব এসে দাঁড়ালেন। সমস্ত ভারতবর্ষের আত্মা মথিত করে নবজন্ম গ্রহণ করলে যেন এক অনাদি পুরুষ। হিমালয়ের ভারতবর্ষ, বৈদিক ভারতবর্ষ, উপনিষদের ভারতবর্ষ, আজ যেন নরদেবতার রূপ নিয়েছে। মানুষ বুঝি অমৃতের সন্তান হয়ে আবার জন্মগ্রহণ করলো। ভূতনাথের মনে হলো—যেন শেয়ালদা স্টেশনের স্বল্পপরিসর প্ল্যাটফরম এটা নয়। অশ্রান্ত-কল্লোল বারিধির বুকে বুঝি প্রথম জেগেছে একখণ্ড ভূমি। হিমালয়ের শীর্ষ জেগে উঠেছে বুঝি মহাসম্ভাবনার ইঙ্গিত নিয়ে। এইবার জন্ম হবে মানুষের। নতুন মানুষের হৃদস্পন্দনের মধ্যে ধ্বনিত হবে সেই আদি প্রশ্ন—কে আমি? কোথা থেকে আমি এলাম? তারপর গ্রহ নক্ষত্র সূর্য পৃথিবীর সমস্ত সঙ্গীত স্তব্ধ করে এক মহাবাণী উচ্চারিত হবে আবার। আবার নতুন করে সৃষ্টি হবে নতুন পৃথিবীর। নতুন মানুষ আর এক নতুন উত্তর পাবে মহামানবের মহাবাণীর মধ্যে! মানুষ অমৃত, মানুষ আর কেউ নয়। মানুষ অমৃতস্য পুত্রাঃ-মানুষ অমৃতের। সন্তান।

ঠিক এই কথাগুলোই যে বর্ণে বর্ণে সেদিন মনে হয়েছিল তা নয়। কিন্তু পরে যখন অনেক শিখে অনেক পড়ে তার মনের তৃতীয় নয়ন খুলে গিয়েছিল তখন সে ভেবেছে তার অপরিণত মনের কল্পদৃষ্টিতে সেদিন তার এই ভাবনা হওয়াই উচিত ছিল।

জনস্রোত ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে। ভূতনাথ মন্ত্রচালিতের মতো জনতাকে অনুসরণ করে এল। বাইরেও এক বিপুল সমুদ্র, কিন্তু প্রতীক্ষায় অস্থির অশান্ত।

ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন মহামানব। চারঘোড়ার গাড়ি।

হঠাৎ ছেলেরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ঘোড়াগুলোকে খুলে দিলে তারা। তাদের উপাস্যকে তারা নিজেরা বহন করবে। স্বামিজীকে তারা মাথায় তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। তাদের অন্তরের উৎস আজ অবারিত।–জয়, স্বামী বিবেকানন্দ কী জয়।

শেয়ালদা স্টেশনের বাইরে সেই উল্লাসধ্বনিতে সমস্ত শহর প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে গাড়ি গিয়ে হাজির হলো একটা গলির সামনে। রিপন কলেজের ভেতর স্বামিজীকে কিছু বলতে হবে। অন্তত একটু বিশ্রাম। তারা সবাই দু’চোখ ভরে দেখবে।

মনে হলো, হঠাৎ যেন ব্ৰজরাখালকে দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্যে। তাড়াতাড়ি ভূতনাথ ভিড় সরিয়ে কাছে যাবার চেষ্টা করতেই আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ব্রজরাখাল। এ-দিক ও-দিক কোথাও দেখা পাওয়া গেল না তাকে।

কিন্তু হঠাৎ এক আশ্চর্য উপায়ে দেখা হয়ে গেল আর একজনের সঙ্গে। আবার এতদিন পরে এমন ভাবে দেখা হবে ভাবা যায়নি।

ননীলাল! ননীলালও চিনে ফেলেছে। বললে—তুই? তুই এখেনে?

প্রথমটা যেন বিশ্বাস হয় না। সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। কী এক অদ্ভুত চেতনা। ননীলালের সে চেহারা আর নেই। সেই কেষ্টগঞ্জের স্কুলের সহপাঠী, ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীলাল। এর দেখা পাওয়ার জন্যে কী কষ্টই না একদিন স্বীকার করেছে ভূতনাথ। ননীলাল সিগারেট টানছে। ছোটবড় চুল। গোফ দাড়ি উঠেছে।

—তারপর?

—এখানে কী করতে? স্বামিজীকে দেখতে?

—দূর, ও-সব দেখবার সময় নেই আমার। বলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লে লম্বা করে। তারপর বললে—যত সব বুজরুক—

একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগলো ননীলালের কথায়। কিন্তু কিছু বলতে পারলে না। তারপর জিজ্ঞেস করলে—কী করছিস এখন?

—বি-এ পাশ করেছি। এবার ল’ পড়ছি—তুই?

—আমার পড়াশোনা হলো না, পিসীমা মারা গেল। এখানে আমার ভগ্নীপতি থাকে। তার কাছেই আছি, একটা ভালো চাকরি পেলে করি, ঘোরাঘুরি করছি।

—চল, চা খাস?

–না, এখনও ধরিনি।

—এখনও পাড়াগেঁয়েই রয়ে গেলি-বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চললল ননীলাল। ননীলালের গা থেকে এসেন্সের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। সুন্দর জামাকাপড় পরেছে। ননীলালের কাছে নিজেকে যেন বড় বেশি দরিদ্র মনে হলো আজ। কিন্তু কেন কে জানে, ভূতনাথের মনে হলো—ননীলাল যেন আর আগেকার মতন নেই। সেই আগেকার ননীলালই যেন ছিলো ভালো। এখন যেন চোখে কালি পড়েছে। চোখের সে জ্যোতি কোথায় গেল তার। যেন অনেক ‘বয়স বেড়ে গিয়েছে তার এই ক’বছরের মধ্যেই।

—চা না খাস তো অন্য কিছু খা।

একটা দোকানের সামনে এসে ভূতনাথকে নিয়ে ঢুকলো ভেতরে।

—ডিম খাস?

—হাঁসের ডিম তো।

-কলকাতা শহরে এসে এখনও তোর বামনাই গেল না-ইয়ং বেঙ্গল আমরা, এই করে করে দেশটা গেল, গায়ে শক্তি হবে কী করে? বিফ খায় বলেই তো সাহেবরা অত দূর দেশ থেকে এদেশে এসে রাজত্ব করতে পেরেছে—আর তোরা পৈতে টিকি নিয়ে তাদের গোলামি করে মরছিস, ছাড় ও-সব, আমার সঙ্গে দু’দিন থাক, মানুষ করে দেবো তোকে-তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরালে ননীলাল। বললে—আছিস কোথায় বললি?

—বৌবাজারে, বড়বাড়িতে।

—চৌধুরীদের বাড়ি? তা ওদের ওখানে আছিস, ওরা তো জমিদার, শুনেছি ও-বাড়ির বোঁগুলো খুব সুন্দরী, না?

—তুই জানলি কেমন করে? কেমন একটা রহস্যময় হাসি হাসলো ননী। বললে—রূপ আর গুণ কখনও চাপা থাকে রে?

কী জানি কেন, ভূতনাথের মনে হলো—সেই ননীলালের এমন পরিবর্তন হওয়া উচিত হয়নি যেন।

ননী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আরম্ভ করলে—চূড়ামণিকে চিনিস, যার ডাক নাম ছুটুক? ওই তো আমার ক্লাশ ফ্রেণ্ড ছিল রে। দু’বার ফেল করে এখন সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ছে— বাড়ির ঝি-টি কাউকে আর বাদ দেয়নি। শেষে একদিন অসুখ হলো, কিন্তু মিথ্যে বলবো না ভাই, বহু টাকা খরচ করেছে আমাদের জন্যে—এখন দেখা হয় না বটে, কিন্তু রোগ হবার পর থেকে…রোগটা সেরেছে?

রোগ? ভূতনাথ কিছু বুঝতে পারলে না।—জিজ্ঞেস করলে কী রোগ?

ননীলালের মুখে রোগের নামটা শুনে শিউরে উঠলো ভূতনাথ। ননীলাল কেমন বেপরোয়াভাবে রোগের নাম উচ্চারণ করে গেল, যেন ম্যালেরিয়া কিম্বা ইনফ্লুয়েঞ্জা। ও-রোগ ভদ্রলোকদের হয় ভূতনাথের জানা ছিল না।

ননীলাল সিগারেট ফুকতে ফুকতে বললে হবে না রোগ? চেহারাটা দেখছিস তো—আগে আরো লাল টুকটুকে ছিল, ক্লাশে বসে আমরা ওর গাল টিপে দিতুম, তা আজকাল কত রকম ওষুধ বেরোচ্ছে, ডাক্তার-ফাক্তার কাউকে দেখালে না, একদিন সারা গায়ে দাগড়া দাগড়া দাগ বেরোলো—শেষে একদিন আর হাঁটতে পারে না। আর একটু মাংস নিবি?

—না।

—তা সেই অসুখের সময় গিয়েছিলুম ওদের বাড়িতে। অনেক চেষ্টা করেছিলুম ভাই দেখতে—কিন্তু এমন আঁটা বাড়ি, কিছছু দেখা গেল না, যারা ঘন ঘন যেতো, তারা বলতো-ওর কাকীদের নাকি পরীর মতন দেখতে—দেখেছিস তুই?

ভূতনাথ উত্তরটা এড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে বললে-দেখেছি, পরীদের মতো তো নয়।

—পরীদের মতো নয়, তবে কীসের মতন? ভূতনাথ যেন কী ভাবলে। তারপর বললে–জগদ্ধাত্রীর মতন।

ননীলাল হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—তুই আবার এত ভক্ত হয়ে উঠলি কবে?..

ভূতনাথ বললে—পরী তো দেখিনি কখনও, জগদ্ধাত্রী দেখেছি যে।

—জগদ্ধাত্রী কোথায় দেখলি?

—কেন, ছবিতে।

—পরীর ছবি দেখিসনি?

পরীর ছবি কোথাও দেখেছে কিনা ভাবতে লাগলো ভূতনাথ।

ননীলাল বললে—পরী যদি দেখতে চাস, তো দেখাবো তোকে—আমার বিন্দী যাকে বলে ডানাকাটা পরী।

—বিন্দী কে?

—আজ বিন্দীর বাড়ি যাবি? চল তোকে পরী দেখিয়ে নিয়ে আসি। ছুটুক ওকে দেখে একরাতে পাঁচ শ’ টাকা খরচ করে ফেলেছিল—শেষে বিন্দী ওরই মুঠোর মধ্যে চলে যেতো, কিন্তু আমার বাবাও তখন তিপ্পান্ন হাজার টাকা রেখে মারা গিয়েছেআমাকে পায় কে?

—বাবা মারা গিয়েছেন তোর?

বাবার মৃত্যুর সংবাদ এমন করে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে কেউ পারে, এ-যেন ভূতনাথ বিশ্বাস করতে পারে না।

–বাবা মারা গিয়েছে বলেই তো বেঁচে গেলুম ভাই, নইলে কি ছুটুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি পারি? ওরা কি কম বড়লোক। ওরা হলো সুখচরের জমিদার বংশ, প্রজা ঠেঙানো পয়সা, এখানে বসে কর্তারা শুধু মেয়েমানুষ নিয়ে ওড়ায়—ওদের সঙ্গে তুলন? ছোটবেলায় ওর কাকীমা’র পুতুলের বিয়েতে কত নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছি, তা এখন শুনতে পাই চূড়ামণি নাকি বাড়িতেই আচ্ছা বসিয়েছে, গান-বাজনা নিয়ে থাকে, আর একটু একটু মালটাল খায়, কিন্তু রক্তের দোষ ওদের যাবে কোথায়, তোকে বলে রাখছি ভূত, তুই দেখে নিস, চূড়ামণির ও অভ্যেস-দোষ যাবে না, অমৃতে কখনও অরুচি হয় ভাই?

আরো অনেক কথা বলতে লাগলো ননীলাল। ননীলাল তত আগে এমন কথা বলতো না। বিশেষ মুখচোরা লাজুক ছেলে ছিল। কেমন করে এমন হলো কে জানে!

ননীলাল আবার বলতে লাগলো—তা আমার এখন একটা নেশা আছে ভাই, তোকে বলেই ফেলি, একটা বেশ বড়লোক গোছের লোকের মেয়েকে যদি বিয়ে করে ফেলতে পারি, তত আর কাউকে ভয় করি না আমি। বাবার টাকাগুলো সব ফুরিয়ে এল কিনা-ও-পাড়ার দিকে আছে কোনো সন্ধান?

সেদিন যতক্ষণ ননীলালের সঙ্গে গল্প করেছিল ভূতনাথ, ততক্ষণই কেবল অবাক হয়ে ভেবেছিল। কই ব্রজরাখালও তো রয়েছে। এখানে। স্বামী বিবেকানন্দর চার ঘোড়ার গাড়ি যারা কাধে করে টেনে নিয়ে গেল, যারা গলা ফাটিয়ে ‘বিবেকানন্দ স্বামিজী কী জয়’ বলে চিৎকার করলো, যারা ভোরের শীত উপেক্ষা করে শেয়ালদা’ স্টেশনে মহাপুরুষকে দেখবার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে, তারা তবে কারা? তারাও কি বাঙলা দেশের ছেলে? কলকাতার ছেলে? তারাও কি ননীলালের ক্লাশ ফ্রেণ্ড? তারা কি তবে ছুটুকবাবু কিম্বা ননীলালের মতন নয়? তাদের জাত কি আলাদা?

যাবার সময় ননীলাল বললে-সন্ধ্যে বেলা হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে, ঠিক আসিস—বিন্দীর বাড়ি যাবো বুঝলি? আর ছুটুককে যেন আমার কথা বলিসনি।

ভূতনাথ বললে—কেন?

-পরে বলবো তোকে—এখন আবার ক্লাশ আছে আমার।

কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, যার হাতের ছোঁয়া লাগলে একদিন ভূতনাথের শরীরে রোমাঞ্চ হতো, যাকে দেখবার জন্যে ছুটির দিনেও কত ছুতো করে সাত মাইল হেঁটে গিয়েছে ইস্কুল পর্যন্ত,

সেই ননীলাল!

বাড়িতে গিয়ে ভূতনাথ নিজের বাক্সটা খুললে। অনেক পুরোনো জিনিষ জমে আছে ভেতরে। পিসীমা’র হরিনামের মালা একটা। পুরোনো মনি-অর্ডারের রসিদ কয়েকটা। দেশের বাড়ির সদর দরজার চাবি, তারই মধ্যে থেকে একটা চিঠি বেরোলো। বহুদিন আগের ননীলালের লেখা। সেখানা খুলে ভূতনাথ আবার পড়তে লাগলো।

“প্রিয় ভূতনাথ,

আমরা গত শনিবার দিন এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। কলিকাতা বেশ বড় দেশ, কী যে চমৎকার দেশ বলিতে পারিব না। এখানে আসিয়া অবধি বাবার সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। বড় বড় বাড়ি আর বড় বড় রাস্তা। খুব আনন্দ করিতেছি। তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি কেমন আছো জানাইও, উপরের ঠিকানায় চিঠি দিও”।

পড়তে পড়তে সেদিনকার ননীলালের সঙ্গে আজকের দেখা ননীলালের তুলনা করে দেখলে ভূতনাথ। কিন্তু কেন এমন হলো। একবার মনে হলো দরকার নেই, চিঠিটা ছিঁড়েই ফেলে। কিন্তু আবার বাক্সের ভেতরে রেখে দিলে সে। থাক। সে-ননীলাল হয় তত সত্যিই মরে গিয়েছে। কিন্তু শৈশবের সে ননীলালের স্মৃতি যেন অক্ষয় হয়ে থাকে সারাজীবন।

 ১৪. ভোর বেলাই বংশী এসেছে

ভোর বেলাই বংশী এসেছে। বললে—শালাবাবু, আপনাকে কাল রাত্তিরে দু’বার খুঁজে গিয়েছি, ছোটমা পাঠিয়েছিল দেখতে।

ভূতনাথ তাড়াতাড়ি ‘মোহিনী-সিঁদুরের কৌটোটা প্যাকেটে মুড়ে বংশীর হাতে দিয়ে বললে—এটা গিয়ে বৌঠানকে দে, আর আর এই টাকা ক’টাও দিয়ে আয়।

বংশী বললে-ছোটমা বলেছে, আপনাকে নিজে যেতে। আজ ভোর বেলাই যে চিন্তাকে পাঠিয়েছিল আবার।

সকালবেলা। এখন আপিসে যাবার তাড়া। অনেক কাজ বাকি। ব্রজরাখাল ক’দিন বাড়ি আসছে না। মেতে আছে গুরুভাইদের নিয়ে। রান্না-বান্নার দিকটা একটু দেখতে হবে। রাত্রে রান্না করা হয়েছিল। তার বাসনগুলো মাজতে হবে। রাত্রের খাওয়ার জন্যে বাজারেও একবার যাওয়ার দরকার।

ভূতনাথ বললে—তা হলে আজ রাত্রে তুই আসিস, আমি নিজে গিয়ে বৌঠানকে দিয়ে আসবো’খন।

বংশী চলে গেল কিন্তু আপিসে যাবার পথে মনে পড়লো। সন্ধ্যে বেলা তো ননীলালের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে তার। হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে যে সে।

একবার মনে হলো যাবে না সে। আর কিসের সম্পর্ক তার ননীলালের সঙ্গে। ননীলালের কাছ থেকে আর কিছু আশা রাখে না সে।

আপিসে যেতে পাঠকজী হাসতে হাসতে এল। সেলাম করলো।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—অত হাসিমুখ কেন পাঠকজী?

লম্বা পাঞ্জাবী পরা ফলাহারী পাঠক। এখনও বুঝি কুস্তি করে। ভারী জোয়ান চেহারা। পরিশ্রমে কাবু হয় না, হনুমানজীর ওপর সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে জীবনের। গোঁফে তা দেয়।

ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—মাইনে বাড়লো নাকি পাঠকজী তোমার।

পাঠকজী বলেছে—যতদিন দিদিমণি থাকবে বাড়িতে, ততদিন তার মাইনে বাড়বার কোনো আশা নেই। তারপর বলে—লেকিন হনুমানজী রাখে তো মারে কৌন, কেরানীবাবু?

পাঠকজীর বয়স বেশি নয়। কিন্তু প্রচুর স্বাস্থ্যের জন্যে একটু বয়স দেখায়। কারখানায় বসে প্যাকেট তৈরি করে আর ভজন গায় আপন মনে। বেপরোয়া মানুষ। কত কেরানীবাবু এ-বাড়িতে এল গেল, পাঠকজী কিন্তু হনুমানজীর কৃপায় এখনও টিকে আছে। কেন যে টিকে আছে কে জানে।

পাঠকজীকে জিজ্ঞাসা করলে বলে—সব হনুমানজীর কিরপা হুজুর।

লোকটা হনুমানজীর কথা বলে বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। মুখেই ওর যত ভক্তি। ভূতনাথের কতদিন সন্দেহ হয়েছে, আপিস থেকে যেন চুরিটা চামারিটা করে। এখানে বউ নেই। বলে–বিয়ে করেনি। আসলে বিয়ে করেছিল, বউ মারা গিয়েছে। খবর পেয়েছে ভূতনাথ। এই বাড়ির এক কোণে একটা ছোট ঘরে রান্না করে আর রাত্রে সেখানেই শুয়ে থাকে। এ-বাড়ির অনেক দিনের লোক।

—তা হাসি কেন অত পাঠকজী?

এবার হাসির কারণটা প্রকাশ করে বললে পাঠক। পাঠকও তা হলে খবর পেয়েছে? ফলাহারীর মনে হয়েছে—দিদিমণির বিয়ের পর শ্বশুর ঘরে তো চলে যাবে দিদিমণি, তখন বাবুকে বলে মাইনেটা বাড়িয়ে নেবে সে। বাবু তো লোক ভালো।

ভূতনাথও কিছু বললে না। দরকার নেই প্রকাশ করে দিয়ে। আশায় থাকা ভালো।

—আপনারও ভালো হবে কেরানীবাবু, দেখবেন।

কে জানে হয় তো সত্যি! পাঠকজী এতদিন ধরে দেখছে—ও হয় তত ঠিকই চিনেছে জবাকে! কিন্তু ভূতনাথের কিছুতেই মাথায় আসে না ব্যাপারটা। রহস্যময়ী মনে হয় জবাকে। যেন পাঠকজীর কথাটাও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। অমন যার বাবা, মাকেও যেন ভালো বলেই মনে হয়। অন্তত পাগল হবার আগে জবার মতন অমন অস্থির প্রকৃতির নিশ্চয়ই ছিলো না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কেমন ধীর-স্থির। আবেগ আছে কিন্তু অবিবেচক নয় যেন। শুধু জবার বেলাতেই একটু অন্ধ। অথচ জবা যেন বাড়ির কাউকেই মানুষ বলে মনে করে না। যেন তারা সবাই জবারই কর্মচারী। ইচ্ছে করলে জবা তাদের বরখাস্ত করতে পারে। একটু যেন বেশি সংসারী। হিসেবী। কে-কোথায় ফাঁকি দিচ্ছে, সেদিকে যেন গোপনে দৃষ্টিও রাখে। কথায় ঝাল মেশানো। ভূতনাথ ভেবে দেখলে—তার জানা-শোনা কোনো মেয়ের সঙ্গেই জবার যেন কোনো মিল নেই। রাধা ছিল সরল সাদাসিদে। ব্রজরাখালের স্ত্রী হয়েও সে যে নন্দজ্যাঠার মেয়ে, তা সে ভোলেনি। আর আন্নাসে ছিলো ছেলেমানুষ। গাছে ওঠাতেও যেমন, আবার সই-এর বিয়ের বাসর জাগতেও তেমনি। আর হরিদাসী ছিল ছোটবেলা থেকেই গিন্নী। বিয়ে হবার আগেই যেন সে স্ত্রী হয়ে গিয়েছে। আর বৌঠান! পটেশ্বরী বৌঠানের সঙ্গে মাত্র একদিনের আলাপ। ‘কিন্তু তার সম্বন্ধে এত কথা শুনেছে—যেন তার সব জানা হয়ে গিয়েছে। বৌঠান তো ভূতনাথের চেয়ে বয়সে কিছু ছোট, কিন্তু তবু যেন সামনে গেলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে ভালো লাগে। মনে হয় মাথাটা ঠেকিয়ে রাখে আলোপর পা-জোড়ার ওপর। বৌঠান যেন একাধারে সব। মা হয়নি বৌঠান, কিন্তু মা হলেই যেন মানাতো। স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি বৌঠান, কিন্তু ছোটবাবু চাইলেও যেন তাকে সহধর্মিণী করে নিতে পারবেন না—বৌঠান যেন ব্যক্তিত্বে ছোটবাবুর চেয়েও উঁচুতে। আর এ-বাড়ির জবা। জবা সত্যিই রহস্যময়ী! ধরা সে দেয় না, কিন্তু কেউ ধরে এটাই যেন সে চায়। কিন্তু নিজের আভিজাত্য যেন সমস্ত হৃদয় জুড়ে বসেছে। স্নেহ মমতা দয়া দাক্ষিণ্য প্রেম ভালোবাসা সমস্ত তার কাছে তার পরে।

কাজ করতে করতে সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একটা জরুরি কাগজ নিয়ে ওপরে যেতে হলো ভূতনাথকে। সুবিনয়বাবুর সই দরকার। সিঁড়িতে উঠে ডান দিকে হলের মধ্যে যাবার মুখে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। ওপাশেই সুবিনয়বাবুর সঙ্গে জবার কথা হচ্ছে। খানিকটা কানে আসতেই ভূতনাথ সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো।

সুবিনয়বাবু বলছেন—তুমি পছন্দ করেছে—আমি এতে কী বলবো মা।

জবা বলছে—তবু আপনি একবার বলুন আপনার অনুমতি আছে এ বিয়েতে।

—আমি তত কোনো দিন তোমার কোনো ইচ্ছেতে বাধা দিইনি মা, নিজে বরাবর বাবাকে দুঃখ দিয়েছি বলে—আমি চাইনে মা তোমার কোনো ইচ্ছেতে আমি বাধাস্বরূপ হই—আর তোমার মা যদি ভালো থাকতেন তো তাকে আমি জিজ্ঞেস করে দেখতাম, কিন্তু তিনি তো এখন এ সংসারের বাইরে।

জবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—কিন্তু আপনি তো দেখেছেন বাবা–আপনি তো চিনেছেন তাকে।

শুধু একদিন নয়, ওরা আমাদের সমাজের পুরোনো লোক— ওকে বিদ্বান বুদ্ধিমান আর খুব স্থিরবুদ্ধি বলে মনে হয়েছে আমার, ওর বাবাকে আমি বহুদিন থেকে চিনি। তোমার জন্মদিনে যারা যারা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে তুমি ঠিক মানুষটিকেই বেছে নিয়েছে বলে মনে করি—আমি আশীর্বাদ করি, তোমরা সুখী হবে।

জবা বললে—কিন্তু কি জানি কেমন যেন ভয় করছে আমার। আমি আপনাকে ছেড়ে থাকবো কেমন করে?

—তুমি থাকবে মা আমার কাছে—তোমরা দুজনেই থাকবে। নইলে এসব কে দেখবে, আমরা আর ক’দিন? উনি তো

-থাকার মধ্যে—আর আমি? যতদিন বেঁচে থাকি আমাকেও তোমরাই দেখবে—দেখবে না মা?

জবা চুপ করে রইল।

সুবিনয়বাবু বললেন—আর এই ‘মোহিনী-সিঁদুর’, ওটা যতদিন আছে থাক, তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়ে, যদি ইচ্ছে হয় চালিও, আর যদি না চলে তবে ক্ষতিও নেই। তোমাদের জন্যে যথেষ্ট অর্থ রেখে যাবো মা–তোমাদের কোনো দিন উপার্জন করতে হবে না, তবে যদি পারো অন্য ব্যবসা করো—নতুন যুগ আসছে। আমি আর কিছু চাইনে, পরম গতিও চাই না, অষ্টসিদ্ধিও চাই না। সেই গানটা একবার গাইবি মা, অনেক দিন শুনিনিজয়জয়ন্তীর ধ্রুপদ-নাথ তুমি ব্ৰহ্ম তুমি বিষ্ণু–

জবা একটু পরেই গান আরম্ভ করলে—

নাথ তুমি ব্ৰহ্ম তুমি বিষ্ণু
তুমি ঈশ তুমি মহেশ
তুমি আদি তুমি অন্ত,
তুমি অনাদি তুমি অশেষ…

নিঃশ্বব্দে ভূতনাথ সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। তখনও জবার গান চলেছে। কাল সকাল বেলা কাগজটা সই করালেই চলবে। টেবিল পরিষ্কার করে আরো খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে গানটা শুনতে লাগলো ভূতনাথ। গানে সত্যিই যেন জবার তুলনা নেই। অন্তত এই একটা বিষয়ে সে যেন সকলের চেয়ে বড়।

রাস্তা দিয়ে সোজা আসতে আসতে একবার সময়টা আন্দাজ করলে। ননী হয় তো হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ। বাঁ দিকের একটা গলি দিয়ে সোজা গেলেই হেদোর কোণটা পড়বে। ভূতনাথ হেদোর সামনে এসে দাঁড়াতেই চারপাশে নজর দিয়ে দেখলে। মনে হলো দক্ষিণ দিকের একটা আলোর নিচে যেন ননীলাল দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। কাছে যেতেই ভুল ভাঙলো। ননীলাল নয়, অন্য লোক। অনেকটা যেন ভৈরববাবুর মতন দেখতে। আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ভূতনাথ। তবে হয়তো তার দেরি দেখে চলেই গিয়েছে। ভালোই হয়েছে। ভূতনাথ রাস্তায় পা বাড়িয়েই ভাবলে ভালোই হয়েছে। দেখা হয়ে গেলে আর এক কাণ্ড হতো। হয় তো এড়াতে পারতো না।

আবার বড়বাড়ির দিকে ঘোর পথ দিয়ে চলতে লাগলো ভূতনাথ। তাড়াতাড়ি পেঁছুতে হবে। বৌঠানকে সিঁদুরটা দিতে হবে আজ। হঠাৎ পেছনে কে যেন ডাকলে—শালাবাবু

অবাক হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। এখানে এত রাত্রে কে তাকে ওই নামে ডাকবে। ভালো করে দেখে ভূতনাথ বললে-শশী! তুই!

ছুটুকবাবুর চাকর-শশী! শশীর এ কী চেহারা হয়েছে। এত রাত্রে এখানে কেন? গানের আসর কি তবে বসছে না আজ?

শশী বললে—শালাবাবু কিছু পয়সা দিতে পারেন?

পয়সা! পয়সা তো সঙ্গে নিয়ে আসেনি ভূতনাথ। বললে—পয়সা কি হবে? আর এত রাত্রে এখানে কেন তুই? ছুটুকবাবু কোথায়?

—আজ্ঞে ছুটুকবাবু তাড়িয়ে দিয়েছে আমায়।

শণীর চুল উস্কোখুস্কো। মনে হয় যেন অনেকদিন খায়নি। অথচ শশীর চুলের কি বাহার ছিল। ঢেউ-খেলানো চুলটার কী কসরৎ করতে। কাল-পরশুই যেন দেখেছে বড়বাড়িতে।

—কেন, তোকে তাড়িয়ে দিলে কেন?

সঙ্গে সঙ্গে শশীও চলতে লাগলো। বললে—এতদিন ছুটুকবাবুর সেবা করলাম, আপনি তো দেখেছেন সব, গানের আসরে আমি না হলে চলতো না, রাত একটা দুটো পর্যন্ত আমি নিজের হাতে সিদ্ধি বেটেছি, গেলাশ সাজিয়েছি, এখন আমার অসুখ হতেই তাড়িয়ে দিলে।

ভূতনাথ ভালো করে শশীর আপাদমস্তক দেখলে। রোগটা কী! জিজ্ঞেস করলে রোগটা কি তোর?

শশী শালাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে—এই বামুনের পা ছুঁয়ে বলছি, মাইরি শালাবাবু জগন্নাথের দিব্বি, আমার কোনো দোষ নেই, আমি বাড়ির বাইরে একটা রাতও কাটাই না, নেশা-ভাঙটা পর্যন্ত করি না, আমার নামে মিছিমিছি দোষ দিয়েছে গিরি।

—গিরি!

–হ্যাঁ, মেজমা’র ঝি গিরি।

—সে কেন লাগবে তোর পেছনে?

—আপনি সব জানেন না শালাবাবু, গানের আসর যখন শেষ হয়, তখন কতদিন ঘুম পায় আমার, কিন্তু তখন গিরি আসে ছুটুকবাবুর ঘরে। ছুটুকবাবু তখন নেশায় অজ্ঞান থাকে, আমি হেন চাকর বলেই সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করি।

ভূতনাথ যেন কিছু বুঝতে পারলে। গিরির চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করলে ভূতনাথ। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে গিরির সেই লম্বা ঘোমটা টেনে দেওয়া। আর অসাক্ষাতে বাড়ির মধ্যে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করা। তারপর সেই প্রথম রাত্রে যেদিন ছুটুকবাবুর আসরে তবলা বাজাতে গিয়েছিল, সেদিন সেই মধ্যরাত্রের অন্ধকারে ঝাপসা ছায়ামূর্তি।

শশী বললে-বংশীকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন শালাবাবু–ছুটুকবাবুর যখন অসুখ হয়েছিল এই শশী সেদিন কি সেবা করেছিল, ব্যথায় ছুটুকবাবু ছটফট করেছে, নিজের ছুচিবেয়ে মা পর্যন্ত কাছে মাড়ায়নি, এই শশীই সেদিন পূজ-রক্ত পরিষ্কার করে দিয়েছে, কাপড় সাফ করে দিয়েছে। বাবুদের বেলায় কোনো দোষ নেই— চাকরদের বেলাতেই যত অশুদ্ধ।

বাড়ির কাছাকাছি এসে গিয়েছিল হাঁটতে হাঁটতে।

শশী বললে—আর ওদিকে যাবে না হুজুর, মধুসূদন দেখতে পেলেই অনগ্ধ বাধাবে।

—মধুসূদন কী করবে তোর!

—আজ্ঞে, মধুসূদন কি কম লোক, বলে—চাবুক মেরে পিঠের চামড়া তুলে দেবে এ তল্লাটে এলে—অথচ বুড়ো সব জানে, কার দোষ, কার দোষ নয়, সব জানে বুড়ো। একটা পয়সা নেই যে দেশে চলে যাই।

শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়েই শশী চলে গেল।

বড়বাড়িতে ঢোকবার মুখে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মুখখামুখি হয়ে গেল ভূতনাথের।

ভদ্রলোক সামনা-সামনি এসে বললেন—ব্রজরাখালবাবু এ বাড়িতে থাকেন?

ভূতনাথ বললো।

একবার ডেকে দেবেন তাঁকে, বড় দরকার। ভূতনাথ তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে চারদিক দেখে নিলে। আশেপাশের দু’একজনকে জিজ্ঞেস করলে। তারপর এসে বললে—তিনি

তো বাড়িতে নেই এখন–কিছু বলতে হবে?

ভদ্রলোক কেমন যেন অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক চাইতে লাগলেন। বললেন—আজ তিন-চার দিন দেখা নেই তার—এখানে আছেন তো তিনি?

–আছেন এখানে, তবে সব দিন এখানে আসেন না রাত্রে ভূতনাথ বললে।

—আজ যদি আসেন তো একটা খবর দেবেন তাকে, বলবেন, মেছোবাজারের সেই ফুলবালা দাসী, আজ দুপুর থেকে আবার ভেদবমি শুরু হয়েছে তার, একটা ওষুধ নিয়ে যেন যান আজ রাত্রেইব্রজরাখালবাবু আপনার কে হন?

—আমার ভগ্নীপতি।

ভদ্রলোক যেন খুব ব্যস্ত। বললেন—তাহলে এখন চলি আমি, বলবেন তাকে, ভুলবেন না যেন।

ভূতনাথ বললে—ফুলবালা দাসীর নাম করলেই চিনতে পারবেন তো তিনি?

ভদ্রলোক ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন—তা চিনবেন বৈকি! উনি আর শিবনাথ শাস্ত্রী ফুলবালাকে পাদরীদের হাত থেকে বাঁচালেন, হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন, সেই ফুলবালা আবার বিধবা হলো। একটা পয়সা নেই হাতে যে, নিজের পেটটা চালায়,ওই ব্ৰজরাখালবাবু না থাকলে ফুলবালা হয় তো দেখতেন কবে খৃস্টান হয়ে যেতো। নিজের পকেট থেকে মাসোহারা দিয়ে এতদিন চালাচ্ছেন–আর নামটা ভুলে যাবেন? আর যদিই চিনতে না পারেন তো বলবেন কদম এসেছিল।

–কদম?

–হ্যাঁ, আমার নাম। আমার ডাক-নাম। আর পুরো নামটা যদি মনে থাকে তো বলবেন—যুবক সঙ্ঘর কদমকেশর বোস। তারপর যাবার সময় বললে—উনিই তো যুবক সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট কি না।

হন হন করে ভদ্রলোক চলে গেলেন। এতক্ষণে ভূতনাথ ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলে–কামিজ গায়ে, অল্প-অল্প দাড়ি গোঁফ উঠেছে। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হয় না, তবু বেশি বয়স হয়নি যেন ভদ্রলোকের। লোকটি অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যাবার পর ভূতনাথ বাড়ির ভেতর আবার ঢুকলো।

১৫. সেদিন আবার

সেদিন আবার।

রাত হয়েছে বেশ। সেদিনও রাত্রে যথারীতি অন্দরমহলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সোজা তেতলায়। আগে আগে বংশী পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে ভূতনাথ। সদুর ঘরে তখনও টিম টিম করে আলো জ্বলছে। তরকারি কোটা শেষ করে তখন জানালার ধারে বসে পান সাজছে সদু। যদুর মা অত রাতেও একমনে শিল-নোড়া নিয়ে বাটনা বেটে চলেছে। সদু পান সাজে আর বক বক করে বকে চলে—শীতের মরণ, শীতের ছিরিছাঁদ নেই, একটু তেল নেই যে পায়ে দিই মা, পা ফেটে একেবারে অক্ত বেরোচ্ছে গা, ভোলার বাপ থাকতে পায়ের কি এই দশা ছিল? মিনসে মোল আর কপাল পুড়লো আমার—মিনসে মরেচে তত হাড় জুড়িয়েছে, কিন্তু একটা মরা-হাজা ছেলে তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল গা মিনসে বলতো-ফুলবউ—তিভুবনে কেউ কারো নয়।

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই বাঁ দিকে কর্তাদের শোবার ঘর। এখন অন্ধকার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বেণী তখন একমনে মেজবাবুর কাপড় কোঁচাচ্ছে। তারপর দোতলা আর অন্দরমহলের তেতলার মধ্যেকার পোলটা পেরিয়ে ওধারে যেতে হবে।

বংশী বললে—এখানে একটু দাঁড়ান শালাবাবু—দেখি বড়মা এখন রাস্তায় আছে কিনা।

ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বড়বো তখন নিজের ঘরে। বংশী ফিরে এসে বললে—আসুন।

একেবারে বরাবর ছোটমা’র ঘর। বংশী ভেতরে ঢুকে খবর দিলে। চিন্তা বেরিয়ে এল।

—যান, ভেতরে যান।

সেদিনও বৌঠানকে যেমন দেখেছিল ভূতনাথ, আজও তেমনি। তেমনিই অবিসম্বাদী রূপ। তবু অনেক না পাওয়ার প্রাচুর্য যেন অনেক পাওয়াকে ম্লান করে দিয়েছে। হয় তো বৌঠানের ইতিহাস শোনা ছিল বলেই এ-কথা মনে হলো ভূতনাথের। কিন্তু হঠাৎ দেখলে বুঝি মনে হতো ওটা তার অহঙ্কারের আত্মপ্রকাশ। অহঙ্কারের সঙ্গে মিশে আছে প্রশান্ত মনের লালিত্য। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সুখী কি দুঃখী—সে প্রশ্ন আর মনে আসে না। দু’চোখের শান্তগাম্ভীর্য যেন দর্শকের সমস্ত বিচার-বুদ্ধিকে শিথিল করে দেয়।

অথচ সেই মানুষ যখন কথা বলে। যাকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়, শান্তি হয়, হয় তো খানিকটা ভয়ও হয়, তার কথা শুনলে যেন ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

বৌঠান বসেছিল সেদিনকার মতো। একটু সরে বসে বললে–এসো ভাই।

ভূতনাথ বসে পকেট থেকে কৌটোটা বের করে দিয়ে বললে— এনেছি সেটা—কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে সব লেখা আছে এতে।

তারপর ঠিক সেদিনকার মতোই চিন্তা আবার ঘরে ঢুকলো এক থালা খাবার নিয়ে।

ভূতনাথ বললে—আমি এত খেতে পারবো না বৌঠান।

খিদে যে পায়নি ভূতনাথের তা নয়, কিন্তু বৌঠানের সামনে বসে খেতে কেমন লজ্জা-লজ্জা করে। কিন্তু বৌঠানও ছাড়বার পাত্রী নয়। বললে—না খেলে আমি কথাই বলবো না তোমার সঙ্গে। সব খেতে হবে।

সত্যিই খেতে হলো। খাওয়ার শেষে বৌঠান বললে—একট বসো, আসছি, বলে,—উঠে পাশের ঘরে চলে গেল। এতক্ষণে নজরে পড়লো ভূতনাথের। পাশেই আর একটা ঘর। সেদিন নজরে পড়েনি। ঘরখানার চারদিকে আর একবার ভালো করে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। আলমারি ভর্তি পুতুলগুলো স্থির হয়ে রয়েছে কাচের ভেতরে। তাদের মধ্যে একটা বড় কাচের পুতুল যেন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে ভূতনাথের দিকে। সোনালি রূপালি পাড় বসানো শাড়ি-পর, গায়ে পুতির গয়না। হঠাৎ মনে হলো পুতুলটা যেন একবার নড়ে উঠলো। আশ্চর্য! যেন চোখের ইঙ্গিতে তাকে ডাকলে। ভূতনাথ আবার ভালো করে চেয়ে দেখলে। না, ওটা তো নিষ্প্রাণ পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়।

বৌঠান আবার ঘরে এল। ননীর মত নরম আলতা-পরা পা দুটো ঘুরিয়ে আবার বসলো সামনে। হাতে একটা পাজি। পাঁজি খুলে পাতা উল্টে দেখে বৌঠান বললে–কাল তো একাদশী দেখছি

—দিনটাও ভালে—কালকেই এটা পরবো তা হলে।

তারপর ভূতনাথের দিকে চেয়ে বললে—ছোটকর্তার কোনো খারাপ হবে না তো এতে, ভূতনাথ? শরীর তো ওঁর ভালো নয়, জানো, মাঝে মাঝে ভোগেনও খুব, অত অত্যাচার শরীর সইকে কেন।

ভূতনাথ কী বলবে ভেবে পেলে না। খানিক পরে বললেএকদিন’পরেই দেখুন না।

-তাই ভালো।

তারপরে কী যেন ভাবতে লাগলো বৌঠান নিজের মনে। যেন চিন্তাগ্রস্ত। খানিক পরে মুখ তুলে বৌঠান বললে—আজ পর্যন্ত সজ্ঞানে মিথ্যে কথা বলিনি ভূতনাথ, কিন্তু হয় তো তাই-ই আমায় বলতে হবে। আমার যশোদাদুলাল জানে, আমি কারোর ওপর কোনো অন্যায় করিনি, কাউকে জীবনে একটুও কষ্ট দিইনি, তুমি ব্রাহ্মণ, তোমার কাছেও স্বীকার করছি। বাবার উপদেশ আমি বর্ণে বর্ণে মেনে এসেছি কিন্তু স্বামী-সেবার জন্যে তা-ও করবো আমি বলে ডাকলে—চিন্তা–

চিন্তা আসতে বৌঠান বললে-বংশীকে একবার ডেকে দে তো এখেনে।

বংশী আসতে বৌঠান বললে—ছোটবাবু আজ কখন বেরিয়েছে রে?

–আজ্ঞে সন্ধ্যে সাতটার সময়।

-আচ্ছা, কালকে দুপুরবেলা একবার আমার ঘরে নিয়ে আসতে পারবি ছোটবাবুকে? বলবি—আমার ভীষণ অসুখ, একবার যেন দেখতে আসেন। যে-কোনো রকমে একবার তোকে এ-ঘরে আনতেই হবে ছোটবাবুকে, আর চিন্তা, তুই রাঙাঠাকমাকেও বলে দিস আমার অসুখ—আমি কিছু খাবো না আজ।

বংশী বললে—ছোটবাবু যে দুপুরে ঘুমোবে।

—ঘুম থেকে ওঠার পর বলবি।

—সেই ভালো।

–আচ্ছা এবার যা।

বসে বসে ভূতনাথের কেমন অস্বস্তি লাগছিল। এই সুযোগে বললে—আমিও তা হলে এবার আসি বৌঠান।

-তুমি একটু বোসো, এত তাড়া কিসের তোমার, কোনো কাজ আছে?

ভূতনাথ বললে—না, কাজ নেই।

—তবে, লজ্জা করছে বুঝি? সেদিন মেজদিও তত বলছিলেন— ছেলেটি লাজুক বড়।

—মেজদি কে?

–এ-বাড়ির মেজগিন্নি, এই পাশের ঘরেই থাকেন। আমাকে প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করেছেন—কে তোর ঘরে এসেছিল রে ছোটবউ? আমি বললাম—আমার গুরুভাই। এ-বাড়ির ভেতরে এমন করে আগে আর কখনও বাইরের পুরুষমানুষ আসেনি তো, তা আজকাল এ-বাড়ির নিয়ম-কানুন তো একটু একটু করে ভাঙছে, মেজদি’র বাবাও এখন এই অন্দরমহলে আসেন—তা আমিই বা..

কথা অসমাপ্ত রেখে বৌঠান থামলো। তারপর আবার বললে-আজই তোমার সঙ্গে হয় তত শেষ দেখা ভূতনাথ, এ-বাড়িতে বউদের সঙ্গে সাধারণত কেউ কথা বলতে পায় না, আমারও আর দেখা পাবে না, কিন্তু দিদিকে মনে রেখো—আর তোমার যদি কোনো উপকার করতে পারি, দরকার হলে বংশীকে দিয়ে খবর পাঠিও—কেমন?

ভূতনাথ উঠলো। তারপর যশোদাদুলালের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে প্রণাম করলে একবার।

বংশী এসে আবার তেমনি করে নিচে নিয়ে গেল সঙ্গে করে।

ভূতনাথের মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল অনেকক্ষণ। আর দেখা হবে না! একটা সামান্যতম উপলক্ষ্যকে আশ্রয় করে দু’দিনের সামান্য পরিচয়। কিন্তু তবু পটেশ্বরী বৌঠানের সঙ্গে যেন একটা পরম আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল দু’দিনেই। এতখানি স্নেহকরুণ আত্মীয়তা ভূতনাথ যেন জীবনে কখনও পায়নি আগে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সেই কথাই ভাবছিল ভূতনাথ। উঠোনের ওপর এসে দাঁড়াতেই বংশী বললে—একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে শালাবাবু।

-আমার সঙ্গে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা কাজ করে দিতে হবে আপনাকে, আপনিই পারেন।

-কী কাজ, বল না।

—ছুটুকবাবুর আসরে তো আপনি তবলা বাজাতে যান, ওঁর একটা চাকরের দরকার, আমার ভাই-এর জন্যে যদি বলেন একটু

—কেন, ছুটুকবাবুর চাকরের কী হলো?

—আপনি সে-কাণ্ড জানেন না?

–কিসের কী কাণ্ড?

–শশীকে ছুটুকবাবু যে তাড়িয়ে দিয়েছে।

শশীর কথাটা মনে পড়লো এতক্ষণে। আজই তো সন্ধ্যেবেলা দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। বললে—শশী যে আমার কাছে পয়সা চাইছিল, আজই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে রাস্তায়।

—তাই নাকি, ছোঁবেন না আজ্ঞে ওকে।

—কী হয়েছিল তার?

—পারা, পারা ঘা বেরিয়েছিল সারা গায়ে মুখে—এক সঙ্গে শোয়া-বসা করি, শেষকালে ছোঁয়াচ লেগে আমাদের হোক আর কি—মধুসূদন কাকাকে গিয়ে লোচন বলে দিলে। মধুসূদন কাকা বলে দিলে ছুটুকবাবুকে, সরকার মশাই খাজাঞ্চীখানার খাতা থেকে নাম কেটে দিলে ওর।

ভূতনাথ বললে–বেচারি বলছিল বড় কষ্টে পড়েছে, দেশে যাবার পয়সা নেই।

—তা তখন মনে ছিল না। আমরা পইপই করে মানা করেছি আজ্ঞে, ও-সব বাবুদের পোষায়, টাকা আছে, রোগ সারিয়ে ফেলে, ছুটুকবাবুর হয়েছিল—সেরে গেল—কিন্তু ভদ্দরলোকের বাড়িতে ও-রোগ হলে সে-চাকরকে রাখবে কেন?

বংশী একটু থেমে বললে—তা আজ্ঞে ওই জায়গায় আমার ভাইকে আপনি ঢুকিয়ে দিন না ছুটুকবাবুকে বলে।

–আচ্ছা বলবো-বলে ভূতনাথ নিজের ঘরে এল। ব্রজরাখালের ঘরের দিকে চেয়ে দেখলে একবার। এখনও আসেনি। এখন ব্রজরাখাল ব্যস্ত বড়। সেই কদমকেশর বোস। ভদ্রলোকের জরুরি কাজ ছিল ব্রজরাখালের সঙ্গে। ফুলদাসী মৃত্যু শয্যায়। কে জানে কত কাজ—কত প্রতিষ্ঠান ব্রজরাখালের। ঠাকুরের নাম প্রচার করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দ এসেছেন। কাজ আরো বেড়ে গিয়েছে। বেদান্ত আর অদ্বৈতবাদ প্রচার করতে হবে। মিস্টার আর মিসেস সেভিয়ারও সঙ্গে এসেছেন শিষ্য হয়ে। সাহেব মেম শিষ্য—এ-কেমন জিনিষ। কিসের আকর্ষণে এসেছে ওরা।

অন্ধকার ঘরের ভেতর বিছানায় শুয়ে রইল ভূতনাথ। হঠাৎ যেন সমস্ত বড়বাড়ি একটা গুঞ্জন শুরু করলো। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট। ভূতনাথের মনে হলো—কবে ১৩৪৫ সালে কে ঘড়ি তৈরি করেছিল প্রথম, সেই ঘড়ির কল-কজা ধীরে ধীরে আজ বুঝি চলতে শুরু করেছে। আজ এতদিন পরে। বদরিকাবাবুর কথাই বুঝি সত্য হবে। সব লাল হয়ে যাবে। কিন্তু লাল কেন হবে? এ-বাড়ির প্রত্যেকটা ইট কি টের পেয়েছে? কবে মোগল বাদশাহদের আমলে এ-বাড়ির পূর্বপুরুষ জমিদারীর সনদ পেয়েছিল। পেয়েছিল কোতল করবার অধিকার। কবে হাজার হাজার লাঠিয়ালের আঘাতে গ্রাম-জনপদ ভীত-বিপর্যস্ত হয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, কত নারীর সৌন্দর্য-সৌজন্য-শালীনতা আর সতীত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এ-বাড়ির পূর্বপুরুষ! এই চৌধুরী পরিবারের অত্যাচারের তরঙ্গ কত সুদূর সীমান্তে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভিশাপকে থামিয়ে দিয়েছে! বদরিকাবাবুর কাছে সব সেদিন শুনেছে ভূতনাথ। আর শুধু কি এর! কলকাতার প্রাচীন সমস্ত বংশের ইতিহাসের পেছনে যে-মর্মান্তিক বিশ্বাসঘাতকতা আর জাতিদ্রোহিতার কলঙ্ক লুকিয়ে আছে, আজ এই রাত্রে সব যেন একসঙ্গে তারা মুখর হয়ে উঠলো। ওই যে বদরিকাবাবু শুধু নিষ্ক্রয় হয়ে বসে বসে দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করে যায়, ওর ব্যথা কে বুঝবে? বোঠান বুঝি কাঁদছে এখন তেতলার অন্দরমহলের একান্তে। কে ঘোচাবে তার দুঃখ? ননীলালের জন্যে কি কেউ দায়ী নয়? আর ওই সুবিনয়বাবু! তার স্ত্রী উন্মাদগ্ৰস্ত কার শাপে! শশী কেন হঠাৎ বেকার হয়ে যায়? একদিন জলাভূমির ওপর যে শহরের পত্তন হয়েছিল জব চার্নকের আমলে, সেই শহর আজ দিনে দিনে সৌধমালায় সেজে উঠেছে কি অকারণে? ছুটুকবাবুর ঘর থেকে তখনও গানের আলাপ কানে আসছে’চামেলি ফুলি চম্পা। পাশের জানালা খোল ছিল। ওধারে দক্ষিণের বাগানে বুঝি দাশু জমাদারের ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে। ‘বিল্বমঙ্গলের’ গানের সুর—’ওঠা নামা প্রেমের তুফানে।‘ ভূতনাথের মনে হলো—সমস্ত কলকাতা শহর যেন কাঁদছে। তার প্রথম জীবনে ভূতনাথ যে-বেজিটা পুষেছিল, সেই বেজিটা মরবার দিন ঠিক এমনি অদ্ভুত সুরেই কেঁদেছিল যেন।

কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগলো ভূতনাথের। কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না। হয় তো পটেশ্বরী বৌঠানের দুঃখটাই আজ তাকে বড় অভিভূত করে দিয়েছে। মনে হলো—এখন এই সময়ে প্রাণ ভরে বায়া-তবলা বাজাতে পারলে হত। তবলায় চাটি দিয়ে মনের সমস্ত দুর্ভাবনাগুলোকে হয় তো এড়াতেও পারা যেত। কিন্তু হঠাৎ একটা আচমকা শব্দে চমকে উঠেছে ভূতনাথ।

-কে?

—আমি, এখনও ঘুমোওনি বড়কুটুম?

—এত দেরি হলো? তোমাকে এক ভদ্রলোক খুজতে এসেছিলেন।

আলো জ্বললে ব্ৰজরাখাল। তারপর গায়ের জামা খুলে ফেললে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে ব্রজরাখালকে।

-আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি, কিছু খাবার আছে বড়কুটুম?

—মুড়ি আছে, খাবে? দিচ্ছি—আমি আজ রাঁধিনি, বাইরে খেয়েছি। বলে ভূতনাথ টিনের কৌটা থেকে মুড়ি বার করে দিলে। সারা গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ব্রজরাখাল মুখ হাত-পা ধুয়ে এল। হাত-পা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বললে—সারাদিন খুব ঘোরাঘুরি গেল, শেয়ালদা’ থেকে গেলাম রিপন কলেজে, সেখান থেকে বাগবাজারে রায় বাহাদুর পশুপতি বোসের বাড়ি, তারপর সেখান থেকে স্বামিজী আর সেভিয়ারদের নিয়ে গেলাম কাশীপুরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে। ওঃ, খুব সাজিয়েছে বাগানবাড়িটা।

—দুটি খেয়ে নিলে না কেন ওরই মধ্যে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—সময় পেলাম না। কাল আবার সক্কালবেলাই ছুটতে হবে কাশীপুরে, সন্ধ্যেবেলা আবার যেতে হবে আলমবাজারের মঠে।

তেল-মাখা মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে ব্ৰজরাখাল বললে-কে খুজতে এসেছিল বললে?

-কদমকেশর বোস নামে এক ভদ্ৰলোক।

-কেন, কিছু বলেছে?

-তোমায় বলতে বলেছে যে, মেছোবাজারের ফুলবালা দাসীর দুপুর থেকে ভেদবমি শুরু হয়েছে, একটু ওষুধ চাইছিল।

—ভেদবমি? তবে আর খাওয়া হলো না বলে উঠলো ব্ৰজরাখাল। আবার জামা গায়ে দিয়ে পায়ে জুতো গলিয়ে নিলে।

ভূতনাথ বললে—আবার চললে নাকি?

-যেতেই হবে।

–কাল সকালে গেলে চলে না?

—কাল সকালে অনেক কাজ—বলে বাইরে বেরোলো ব্রজরাখাল।

—মুড়ি ক’টা খেয়ে যাও। কিন্তু কথাটা হয় তত শুনতে পেলে না ব্ৰজরাখাল। ততক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে সে। বাইরে শীত-শেষের রাত। ইব্রাহিমের ঘরের ছাদের কোণের টিমটিমে আলোতে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিটা উঠোনের উপর একবার দেখা গেল শুধু। যেন হাঁটছে না, দৌড়চ্ছে।

ভূতনাথ ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। ছুটুকবাবুর ঘর থেকে তখনও গানের সুর ভেসে আসছে—’চামেলি ফুলি চম্পা, বিশ্বম্ভরের গলা। কান্তিধরের তবলার চাটি। আর ওদিকে দক্ষিণের বাগানের কোণ থেকে দাসু জমাদারের ছেলের বাঁশিতে ‘বিমঙ্গলের’ গান-‘ওঠা নামা প্রেমের তুফানে—‘

 » ১৬. আজো মনে আছে সেটা শুক্রবার

আজো মনে আছে সেটা শুক্রবার। কী একটা উপলক্ষ্যে বুঝি ছুটি ছিল। বংশী এল। বললে—ছুটুকবাবু একলা আছেন, এখন আজ্ঞে দেখা করলে চাকরিটা হয়ে যায়। শশীর কাছে শুনতাম ছুটুকবাবু আপনাকে খুব পছন্দ করেন কিনা।

শেষ পর্যন্ত যেতে হলো।

ঠিক সন্ধ্যে হয়নি তখনও। গানের আসর বসতে তখনও দেরি আছে। একটা তাকিয়া হেলান দিয়ে কী একটা বই পড়ছিলেন ছুটুকবাবু। কোঁচানো ধুতি। ঢেউ ভোলা বাবরি ছাঁট চুল।

পাশে পানের ডিবে। জরদার কৌটো। সিগারেট। আর মেঝের ওপর গড়গড়া। বোধ হয় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছেন।

ভূতনাথকে দেখতে পেয়ে বললেন—আসুন স্যার, কী খবর–অনেক দিন পদধূলি পড়েনি।

ভূতনাথ বসলো গদির ওপর।

ছুটুকবাবু বললেন-কালকে এলেন না, বেনারসের ওস্তাদ আনোয়ার আলী এসেছিল, আহা-হ্যাঁ কী আলাপ আর কী খেয়াল গাইলে যে কী বলবো, যেমন তৈরি গলা তেমনি লয়-জ্ঞান, সঙ্গত করছিল বৈজু। যাই বলুন বৈজুর হাত বড় মিঠে স্যার, রাত তিনটের সময় দরবারি কানাড়ার খেয়াল ধরলে একখানা—আ হা হা কোথায় লাগে আপনাদের ইয়ে। তারপর একটু থেমে বললেন–আমাদের বাড়িতেই ছোটবেলা গান শুনেছি কজ্জন বাঈ-এর দোলের দিন। সে কী নাচ আর গান। আমার বাবা মশাই-এর বন্ধু ধর্মদাসবাবু ড়ুগি-তবলা বাজিয়েছিলেন। আমরা স্যার তখন ছোট, দপ্তরখানার ভেতর দরজার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলুম। নাচতে নাচতে সোনার থালা থেকে ঠোট দিয়ে সবগুলো মোহর তুলে নিলে। তারপর আর একবার তাকে দেখেছিলাম অনেক দিন পরে, সে চেহারা আর নেই। মেজকাকীর কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিয়ে গেল। অনেক বল কওয়াতে একটা গান গাইলে–-বাজু বন্দ, খুলু খুলু যায়–ভৈরবীর রে-গা-ধা-নি-র মোচড়গুলোতে তখনও যেন যাদু মেশানো রয়েছে। সেই কজ্জন বাঈ-এর গান শুনেছিলুম আর কালকের আনোয়ারের দরবারি,আ-হা-হা-

গানের গল্প আর থামতে চায় না ছুটুকবাবুর। একটু ফুরসত পেতেই ভূতনাথ বংশীর কথাটা আরম্ভ করতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ বাধা পড়লো। কে যেন ঘরে ঢুকছে। সামনে চেয়েই ভূতনাথ

অবাক হয়ে গেল। ননীলাল!

ননীলালও বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে। বললে-আরে, ভূতনাথ যে! তারপর ছুটুকবাবুর দিকে চেয়ে বললে-চূড়ামণি, একটা কাজে এলুম তোর কাছে।

ছুটুকবাবুও যেন বেশ খুশি। বললে—কাজ হবে’খন—তোর খবর কী? বিন্দির খবর কী?

–বিন্দি ভালো আছে, তোর খবর জিজ্ঞেস করে। আমি বলি সে এখন সাধু হয়ে গিয়েছে, গান বাজনা নিয়ে আছে, কিন্তু আজকে সে-সব গল্প করবার সময় নেই—এখনি যেতে হবে।

ছুটুকবাবু বললে—সে কী রে, একটু বোস। সরবৎ খা।

—না ভাই, ও-সব ছেড়ে দিয়েছি।

কথাটা ছুটুকবাবুর কাছে যেন বিশ্বাস না হবার মতো। বললে সে কী?

-হ্যাঁ ভাই, বিন্দির কাছেও আর যাই না।

–কেন?

—বিয়ে করছি।

ভূতনাথও এবার অবাক হলো। বললে-বিয়ে?

ছুটুকবাবু জিজ্ঞেস করলেন—ননীলালকে আপনি চিনলেন কেমন করে ভূতনাথবাবু?

—ও যে আমার সঙ্গে এক ক্লাশে পড়েছে, আমাদের গায়ের স্কুলে।

কিন্তু ননীলালের তখন বাজে আলোচনা করবার সময় নেই। বললে—সেই জন্যেই তো এসেছি তোর কাছে, কিছু টাকা চাই আমার, বিয়ের পর সব শোধ করে দেবে। বেশি না এক হাজার টাকা।

ছুটুকবাবু কিছু কথা বললেন না। একটা সিগারেট ননীলালকে দিয়ে নিজে আর একটা ধরালেন। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে ননীলাল বললে—সত্যি বলছি, টাকাটার বিশেষ দরকার, তারা তো জানে না, বাড়ি-টাড়ি সব বাঁধা পড়ছে। জানে বড়লোক, টাকার অভাব নেই। তা যা হোক, এবার আমিও ভাই তোর মতন বিয়ের পর সাধু হয়ে যাবে, সত্যি বলছি

ছুটুকবাবু বললেন—সে সব কথা থাক—বিয়ে করছিস কোথায়, মেয়ে কেমন? ননীলাল বললে-মেয়েমানুষের নেশা আমার চলে গিয়েছে ভাই, এখন শুধু টাকা চাই—টাকার বড় দরকার—ওদের অগাধ টাকা, ওখানে বিয়ে হলে সারাজীবনের মতো টাকার ভাবনাটা ঘুচবে—কিন্তু তার আগে আমার নিজের খরচটার জন্যে হাতে কিছু টাকা চাই।

ছুটুকবাবু আবার বললে—বিয়ে করছিস কোথায়?

ননীলাল টপ করে কথাটার জবাব দিতে পারলে না। একবার ভূতনাথের দিকে চাইলে। যেন সঙ্কোচ হচ্ছিলো। ভূতনাথ উঠলো। হয় তো গোপনীয় কোনো কথা আছে। বললে—আমি এখন উঠি ছুটুকবাবু—পরে আসবে।

বংশীর ভাইটার চাকরির কথা বলতেই আসা। হলো না। তা পরে হবে একদিন।

বাইরে আসতেই বংশী ধরেছে। বললে-বলেছেন আজ্ঞে?

-না রে, বলা হলো না, একজন বন্ধু এসে পড়লোতা তোর ভাবনা নেই, বলবো’খন একদিন।

আজ সেই বংশীও নেই, তার ভাই-এর চাকরিটাও হয়নি সেদিন। কিন্তু সে-চাকরির উপলক্ষ্যে ছুটুকবাবুর কাছে না গেলে তো

ননীলারের সঙ্গে দেখাও হতে না ভূতনাথের। অথচ সমস্ত সর্বনাশের বীজ বুঝি সেইদিন প্রথম বোনা হয়ে গেল। শুধু ভূতনাথের জীবনেই বা কেন? ওই ছোটবাবু, ওই পটেশ্বরী বৌঠান সকলের জীবনের ওপরই এক ধূমকেতুর মতন আবির্ভাব হলো ননীলালের। ননীলাল যেন উনবিংশ শতাব্দীর বণিক সভ্যতার বিষ! বিষের আঙুর। আজ ঘরে ঘরে সে আঙুরের চারা গজিয়েছে যেন। কিন্তু সেদিন সেই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাটা না ঘটলে হয় তত বড়বাড়ির ইতিহাস অন্যরকম করে লেখা হতো।

 

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে বেরিয়ে ভূতনাথ হাঁটা পথে আসছিল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বাগবাজারের ভেতর দিয়ে গলি রাস্তা। চারদিকে অন্ধকার। দু’ পাশের নর্দমার নোংরা এড়িয়ে রাস্তার মধ্যেখান দিয়ে আসতে হয়। ছাড়া ছাড়া খোলার বাড়িতে টিমটিমে বাতি। দুটো রাস্তার মোড়ের কাছে সেই দিশী মদের দোকানটার কাছে আসতেই নাকে গেল চেনা গন্ধ। এড়িয়েই যেতে চেয়েছিল ভূতনাথ। রাস্তার ওপরেই বসে বসে কয়েকজন ভাঁড়ে করে মদ খাচ্ছে। সুর ভাঁজছে। হল্লা করছে। একজন গাইছে—

পোড়ারমুখী কলঙ্কিনী রাই লো।
ওলো রাধে, রাজার মেয়ে,
ভুলে গেলি রাখাল পেয়ে, ছি লো,
খাসা দৈকে ফেলে দিয়ে কাপাস খেলি তুই লো,
লাজে মরে যাই লো—

আর একজন পাশ থেকে সমের মাথায় চিৎকার করে উঠলো–হ্যাঁ হা হা হাঃ…

অন্ধকারে মূর্তিগুলোকে সব দেখা যায় না। হট্টগোলের মধ্যে কয়েকটা মাতালের নৈশ-উল্লাস। কিন্তু এমন সময়েই কাণ্ডটা ঘটলো। হঠাৎ সামনে একটা মূর্তিকে দেখে যেন চিনতে পারলে ভূতনাথ। সেই জবাদের বাড়ির পুরোনো ঠাকুরটা না? কিন্তু সামলে নেবার আগেই একটা আস্তো থান ইট ভূতনাথের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়েছে। মাতাল ঠাকুরটার কথাগুলোর কিছু অংশ যেন কানে গেল—শালার কেরানীবাবুকে দে শেষ করে–

তারপর আর কিছু মনে নেই ভূতনাথের।

 ১৭. তখন বিংশ শতাব্দীর শুরু

তখন বিংশ শতাব্দীর শুরু। লর্ড কার্জনেব রাজত্ব। আজও সাইকেল-এ যেতে যেতে স্পষ্ট মনে পড়ে সব। সেদিনকার আঘাতে সে যে মরেনি এই-ই তো আশ্চর্য! গোলদীঘির ধারেই বুঝি কোন্ একটা বাড়িতে কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাকে।

প্রথম যখন চোখ মেললে, দেখলে—একটা পাকা ঘর। পুরোনো ময়লা দেয়াল। চারিদিকে লাল কালিতে লেখা-“বন্দেমাতরম্। কয়েকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। জানালা খোলা ছিল। দেখা যায়—সামনে কুস্তির আখড়া। বাইরে বিকেল হয়ে এসেছে। সমস্ত শরীরে ব্যথা! একটু ওঠবার চেষ্টা করতেই কে একজন এসে ধরলে। কামিজ পরা, অল্প অল্প দাড়ি গোঁফ উঠেছে। চেহারাটা যেন চেনা চেনা মনে হলো।

মাথাটা ধরে বললে—এখন উঠতে চেষ্টা কোরো না ভাই। তারপর কাকে যেন ডেকে বললে—শিবনাথ আর একটু দুধ আনো তো।

শিবনাথ দুধ এনে দিতে লোকটি বললে—এটুকু খেয়ে নাও দিকি।

দুধ খেয়ে আবার যেন একটু তন্দ্রা এসেছিল খানিকক্ষণ। আবার যখন তন্দ্রা ভাঙলে কানে এল কাদের কথাবার্তা। বেশ অন্ধকার হয়েছে চারিদিকে। একটা হারিকেন জ্বলছে টিম টিম করে। ভূতনাথ মনে মনে ভাবছিল এ কোথায় এল সে। যারা একটু আগে এসে তাকে দুধ খাইয়ে গিয়েছে, তারা বোধ হয় বাইরেই রয়েছে।

কে একজন বলছে—কদমদা’, এবার ওদের একটা শিক্ষা দিতেই হবে। কালকে গড়ের মাঠেও একজন গোরা বুটের লাথি মেরে

একজনকে একেবারে অজ্ঞান করে দিয়েছে।

—গোরাতে একে মেরেছে জানলি কী করে?

–গোরাতে না মারলে কি ভূতে মারতে এল?

-গুণ্ডাও তো হতে পারে? নিজের চোখে তো দেখিসনি তুই? কলকাতার রাস্তায় গুণ্ডাও তো কম নেই আর তা ছাড়া একটা গোরাকে মেরেও তো লাভ হবে না কিছুক’টা গোরাকে সামলাবি? শেষকালে কেল্লা থেকে যখন হাজার হাজার গোরা বেরিয়ে মারতে শুরু করবে তখন বাঙালীরা পালাবে কোথায়? সাহস তো খুব বোঝা গিয়েছে। একটা কুস্তির আখড়াতেই মেম্বর যোগাড় করা যায় না।

—কিন্তু কদমদা’ ভারতবর্ষ জয় করতে ক’টা ইংরেজ এসেছিল?

খানিকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না। তারপর কে যেন বলতে লাগলো—তোরা ভুল করছিস শিবনাথ, আমাদের যুবক সঙ্ঘের’ উদ্দেশ্যই যে তা নয়—স্বামিজী বলেছেন—“The world is in need of those whose life is one burning love-selfless. That love will make every word tell like a thunder-bolt. Awake, awake great souls! The world is burning in misery, can you sleep?” রাজনীতি দিয়েও দেশের উপকার হবে না, ধর্মের জয়ঢাক পিটিয়েও কিছু হবে না, অর্থনীতি দিয়েও অভাব মিটবে না আমাদের, আমরা যুবক সজের সভ্যরা একটা জিনিষ চাই, সে এই যে, দেশের ওপর মাতৃভূমির ওপর প্রেম—জ্বলন্ত প্রেম। সে প্রেম তোর আত্মা, তোর বিত্ত, তোর সন্তানের চেয়েও বড়। যে সেই জ্বলন্ত প্রেম নিয়ে গরীব বড়লোক, হিন্দু মুসলমান, জৈন খৃস্টান সকলকে সমান চোখে দেখতে পারবে, সেই শুধু পারবে। তবেই সমস্ত ভারতবর্ষ এক হবে। তোরা ভুল বুঝিসনে আমাকে, সিস্টার নিবেদিতাও সেদিন সেই কথাই বললেন—বড়দা’রও সেই মত।

হঠাৎ অনেকগুলো গলার আওয়াজ এক সঙ্গে উঠলো—ওই যে বড়দা এসে গিয়েছেন।

বড়দা এসেই জিজ্ঞেস করলে—কীসের কথা হচ্ছে?

শিবনাথ বললে-সেদিন আর একজনকে এক গোরা মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে।

–কই? কোথায়?

–ওই যে ঘরের ভেতর রয়েছে।

ঘরে আসতেই চেহারা দেখে চমকে উঠলো ভূতনাথ।

ব্ৰজরাখালও কম বিস্মিত হয়নি। বললে—এ কী, বড়কুটুম?

ভূতনাথের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। কিন্তু মুখে কিছু বলবার ক্ষমতা নেই।

ব্ৰজরাখাল মাথায় হাত বুলোতে বুলোত বললে কাঁদছো কেন বড়কুটুম, কোনো ভয় নেই তোমার, আমাদেরই ‘যুবক সঙ্ঘে’ রয়েছে, এখানে কোনো অসুবিধে হবে না তোমার, কদম রয়েছে শিবনাথ রয়েছে, বরং বড়বাড়িতে থাকলে দেখাশোনা করতে কে? তারপর শিবনাথের দিকে চেয়ে বললে—আরে এ যে আমার বড়কুটুম হয়—কোথায় পেলি একে!

যাবার সময় ব্ৰজরাখাল বলে গেল—আসবো আবার আমি, এখন কিছুদিন বড় ব্যস্ত আছি।

 

সে কতকাল আগের কথা! গোলদীঘির ধারের সেই যুবক সঙ্ঘের’ ঘরটাতে ভূতনাথ তারপরেও কতদিন গিয়েছে। জীবনের এক সন্ধিক্ষণে নিতান্ত অসহায়ের মতন যে কয়েকদিন সে শুয়ে পড়েছিল ওখানে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তার স্মৃতি যেন জড়িয়ে আছে। শুয়ে শুয়েই সব দেখতে সব শুনতে সে। ছেলেরা কুস্তি করতে, মুগুর ভাজতে লাঠি খেলতে আর গান করতে। কয়েকটা গান এখনও মনে আছে—

“মা গো যায় যেন জীবন চলে
বন্দে মাতরম বলে–
বেত মেরে কি মা ভোলাবে
আমি কি মা’র সেই ছেলে!
দেখে রক্তারক্তি বাড়বে শক্তি
কে পালাবে মা ফেলে–”

আর একটা গান–

“শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত মোরা
অভয়া চরণে নম্র শির।
ডরি না রক্ত ঝরিতে ঝরাতে
দৃপ্ত আমরা ভক্তবীর–”

নিবারণের কথাও মনে পড়লো। ছেলেটা মাথার কাছে বসে ছিল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সামনের আখড় ফাকা। কারো গলার শব্দ আসছে না। হঠাৎ মাথার কাছে একটা শব্দ হতেই ভূতনাথ চোখ তুলে দেখলে কে যেন বসে আছে তার দিকে চেয়ে।

নিবারণ বলেছিল নিচু হয়ে কিছু কষ্ট হচ্ছে আপনার?

ভূতনাথ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখেছিল নিবারণের মুখের দিকে। কিছু কথা বলেনি।

নিবারণ শেষে নিজেই বলেছিল—একটু জল খাবেন?

জল খেয়েও ভূতনাথ তেমনি তাকিয়ে আছে দেখে নিবারণ বলেছিল—কিছু বলবেন আমাকে?

ভূতনাথ বলেছিল—তুমি কে?

নিবারণ বলেছিল—আমি নিবারণ, আমায় চিনতে পারবেন না—আমি ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ থেকে নতুন এসেছি—আপনার কাছে রাত্রে থাকবে।

ভূতনাথ বললে–’আত্মোন্নতি সমিতি’ কোথায়?

–আগে খেলা ইনস্টিটিউশনে বসতে—এখন যুবক সঙ্ঘের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, যেদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ফিরিঙ্গীদের সঙ্গে মারামারি হয়, সেদিন থেকেই ঠিক হয়েছে দুটো সমিতি এক হয়ে যাবে। ফিরিঙ্গীগুলো বড় অত্যাচার আরম্ভ করেছে কিনা, যাকে তাকে রাস্তায় মারধোর করছে। আমরাও ঠিক করেছি ফিরিঙ্গী ছোকরা দেখলেই মারব, কিন্তু কদমদা’ বলে, ওতে কাজ হবে না, তাই নিয়েই তো আজকে মিটিং ছিল আমাদের।

–মিটিং-এ কী ঠিক হলো।

—ঠিক হলো না কিছুই, বড়দা’ হাজির ছিলেন না।

—বড়দা’ কে?

–ব্ৰজরাখালবাবু, উনিই আমাদের প্রেসিডেন্ট কিনা।

ব্ৰজরাখাল! নামটা শুনেই ভূতনাথ যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। একথা তো ব্রজরাখাল কখনও বলেনি।

নিবারণ কিন্তু তখন নিজের মনেই বলে চলেছে—কিন্তু কদমদা’ যাই বলুন, আমরা ঠিক করেছি আমরাও আমাদের নিজেদের পথে চলবে। বৃটিশ রাজত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন মনুষ্যত্ব বজায় রেখে বেঁচে থাকা কঠিন।

আজো মনে পড়ে সেদিনকার নিবারণের সেই কথাগুলো। কী জ্বলন্ত আগুনের ফুল্কির মতো সব ছেলে। কথাগুলো যেন আজো কানে বাজছে। সেই ২২শে জুন তারিখের ঘটনা যেন তার কণ্ঠস্থ। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ডায়মণ্ড জুবিলী উৎসবের পর পুণার গণেশখণ্ডের লাটসাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল প্লেগ কমিশনার র্যা সাহেব। দুর্দান্ত বদমাইশ সাহেব। সামনে গিয়ে মুখখামুখি দাঁড়িয়ে খুন করলে দুই ভাই দামোদর চাপেকার আর বালকৃষ্ণ চাপেকার। শিবাজী মহারাজার বংশধর। বাঙলার বিপ্লব আন্দোলনের সেই তো আরম্ভ। আর সেই চাপেকার সঙ্ঘের সদস্যরাই তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরু। সে বুঝি ১৮৯৯ সাল। একদিন শেষ রাত্রে দুই ভাই-এর ফাসি হয়ে গেল নিঃশব্দে। কিন্তু যে-বিশ্বাসঘাতকরা চাপেকার ভাইদের ধরিয়ে দিলে, তারাও তো প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত।

নিবারণ হঠাৎ থেমে বললে—কিন্তু বাঙালীরাই বা পেছিয়ে থাকবে কেন। তাই চাপেকার সঙ্ঘ থেকে লোক কলকাতাতেও আসছে—আমি চিঠি দেখেছি। একটা ব্যাণ্ডকে খুন করলে তোল কিছু কাজ হবে না, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ র্যাণ্ড ছড়িয়ে রয়েছে যে ভারতবর্ষে, নীলকর সাহেবরা গিয়েছে কিন্তু চা-বাগানের সাহেবরা?

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কারা আসছে কলকাতায় বললে?

—তিনজন বাঙালী, যতীন বাঁড়ুজ্জে, বারীন ঘোষ আর তার দাদা অরবিন্দ ঘোষ। আর এখানে আমাদের ব্যারিস্টার সাহেব পি. মিত্তির রয়েছেন। একটা সমিতি করার কথা হয়েছে, নাম হবে ‘অনুশীলন সমিতি’। মানিকতলা স্ত্রীটের মানিক দত্তের বাড়িতে ওদের আড্ডা বসছে। তারপর একটু থেমে নিবারণ আবার বললে

-আপনি ওখানে যাবেন একদিন?

—আমাকে যেতে দেবে কেন?

-খুব যেতে দেবে। নিবারণ বললে–আপনি ব্ৰজরাখালবাবুর শালা, কেউ আটকাবে না, আর সবাই মিলে না লাগলে কিছু হবেও না, এই সেদিন বুয়র যুদ্ধ হয়ে গেল, আবার রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ বাধছে। দেখবেন শাদা চামড়ারা এবার হারবেই হারবে। আপনি ম্যাটসিনি গ্যারিবল্ডির লাইফ পড়েছেন? আপনাকে আমি বই দিতে পারি। এইরকম করেই তারাও তো স্বাধীন হয়েছিল। সেদিন সিস্টার নিবেদিতা এসেছিলেন এখানে, তিনিও আশীর্বাদ করে গিয়েছেন আমাদের, বলেছেন—তোমরা স্বামিজীর মতন হও।

নিবারণের কথা শুনতে শুনতে ভূতনাথের চোখ দুটো বুজে এল। মনে হলো—এ এক আশ্চর্য জগতে এসে পৌচেছে সে। কলকাতার কেন্দ্রে বসে ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। জব চার্নক আর লর্ড ক্লাইভের কলকাতার এ যেন এক বিস্ময়কর রূপান্তর। যে-কলকাতায় ননীলাল থাকে, থাকে ছুটুকবাবু, ছোটবাবু, ছোটবৌঠান আর থাকে সুবিনয়বাবু আর জবা—এ যেন সে-কলকাতা নয়। কলকাতায় এসে ভূতনাথও তো নিজের চোখে কত কি দেখেছে।

সেদিনের সেই ঘটনাটা মনে পড়লো। বৌবাজার থেকে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকতে সেই যে বটগাছটার তলায় সান বাঁধানো বেদীটার ওপর নরহরি মহাপাত্রের বিগ্রহগুলোলক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, দুর্গা, মনসা, শিব, কালী, ছোট পুতুলের মাপের অসংখ্য ঠাকুর সব! প্রথম যেদিন কলকাতায় এসে পৌঁছোয় ভূতনাথ, নরহরি তাকে ওইখানে প্রণাম করিয়ে পয়সা নিয়েছিল। মন্তর পড়িয়েছিল। তারপর ‘মোহিনী-সিঁদুর আপিসে যাতায়াতের পথে কতবার কত পয়সা আদায় করেছে। মিথ্যে হোক, বুজরুকি হোক, তবু ঠাকুর দেবতা তো! যে অদৃশ্য শক্তি এই বিশ্ব চরাচরের নিয়ামক, তাকে অগ্রাহ্য করবার শক্তি তো ভূতনাথের নেই। ভূতনাথের নিজেরই জন্ম তত পঞ্চাননতলায় মানতের ফলে। হোক ওটা নরহরি মহাপাত্রের ব্যবসা বা দোকান, তবু ঈশ্বরের নাম করে যখন চাইছে, তাতে কী-ই বা এমন ক্ষতি। তাই আসা-যাওয়ার পথে প্রণাম করতে কখনও ভোলেনি ভূতনাথ।

কিন্তু সেদিন দুপুরে কী অভাবনীয় কাণ্ড!

গোটা কতক গোরা সৈন্যই বুঝি! বনমালী সরকার লেন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো শিষ দিতে দিতে। সামনে যথারীতি নরহরি মহাপাত্র সবে গঙ্গাস্নান সেরে মাথার শিখাতে একটা গাঁদাফুল ঝুলিয়ে পথচারীদের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে! এমন রোজই থাকে সে। নতুন কিছু নয়। কিন্তু ওই দৃশ্য দেখে গোরা সৈন্য দুটোর কী মতলব হলো মনে কে জানে? একজন হাতের ছড়িটা দিয়ে মারলে নরহরির মাথার গাঁদা ফুলটাকে। উদ্দেশ্য হয় তো রসিকতাই, কিন্তু ভয় পেয়ে নরহরি চিৎকার করে উঠলো। সে-চিৎকারে ফল ফললে উল্টো। পাশ থেকে একজন গোরা সৈন্য বট দিয়ে মারলে নরহরির মুখে। কিন্তু মুখ তা বলে বন্ধ হলো না নরহরির। রাস্তার ধারে এক নিমেষে ছিটকে পড়লো নরহরি আর কাটফাটা চিৎকার করতে লাগলো। শব্দ শুনে এদিক-ওদিক থেকে জনতা কতক বেরিয়েও এল ব্যাপার দেখতে।

ভূতনাথও শব্দ শুনে বড়বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখতে এসেছে।

কিন্তু সে কি লোমহর্ষণ ব্যাপার! বুক দুর দুর করে কাঁপছে সকলের। কারো কিছু বলবার সাহস নেই।

ভারি ভারি বুট দিয়ে দুটো গোরা তখন লাথি মারতে শুরু করছে। এক একটা লাথি মারে আর লক্ষ্মী গণেশ ঠাকুরগুলো দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। শিব, দুর্গা মনসা, সব মার্বেল গুলির মতো যেদিকে খুশি ছিটকে ফেলছে। শান বাঁধানো বেদীটাও বুঝি ভেঙে-চুরে গেল বুটের ঠোকর লেগে। আর একপাশে পড়ে নরহরি মহাপাত্র চিৎকার করে পাড়া মাত করছে।

শেষকালে যেন ক্ষেপে উঠলো গোরা দুটো। যাকে সামনে পায়, তাকেই মারতে যায়। বড়বাড়ির গেটে ব্রিজ সিং দাঁড়িয়েছিল। বুকে গুলীর বেল্ট। হাতে সঙ্গীন লাগানো বন্দুক। লোহার গেট বন্ধ করে দিলে। যে-যেখানে পারলে লুকোলে গিয়ে। সব বাড়ির দরজা জানালা খড়খড়ি খটাখট বন্ধ হয়ে গেল।

এমন সময় বড়বাড়ির মেজকা হিরণ্যমণি চৌধুরী বেরুচ্ছিলেন।

কোচোয়ানের বসবার জায়গায় আমিরী ভঙ্গিতে ইব্রাহিম লাগাম ধরে জুড়ি চালাচ্ছে। শঙ্কর মাছের চাবুকটা খাপের ওপর খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। মোম লাগানো মস্ত গোঁফ জোড়া দু’পাশে কাকড়া বিছের মতো চিতোনো। মাথায় বাবরি চুল কাঁধের ওপর গিয়ে ঠেকেছে। মাথার পেছনে কাঠের চিরুনি আঁটা। জরির কাজ করা শাদা প্লেটের ওপর সোনার তক্তি ঝুলছে গলায়। আর ইয়াসিন সহিস পেছনে পাদানির ওপর দাঁড়িয়ে সাবধান করছে সবাইকে। হুঁশিয়ার হো-হুঁশিয়ার হো–-

ব্রিজ সিং লোহার গেট খুলে দিয়ে ম্যাটেনসনের ভঙ্গীতে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ি বেরুবার আগে চিৎকার করে উঠলো— হুঁশিয়ার—হুঁশিয়ার হো—

সে-চিৎকারে হঠাৎ যেন কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চমকে উঠেছে। গোরা দুটো লড়াই থামিয়ে যেন একটু ইতস্তত করতে লাগলো।

ততক্ষণে গাড়ি সামনে এসে গিয়েছে। ভেতরে ভৈরববাবু বসেছিলেন। চেঁচিয়ে বললে—ইব্রাহিম গাড়ি থামাও-মেজবাবু গাড়ি থামাতে বলছেন—থামাও গাড়ি।

আগে মেজকর্তা নামলেন। পেছনে ভৈরববাবু। মেজবাবু হাঁকলেন—ইব্রাহিম চাবুকটা দে তো।

কিন্তু গোরা দুটো তখন রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে পোঁ পোঁ ছুটতে শুরু করেছে।

মেজবাবু নরহরির কাছে গিয়ে এক ধমক দিলেন—উল্লুক, শুয়ার-কা-বাচ্চা, কাঁদছিস কেন? মারতে পারলি না দু’ঘা—আবার পড়ে পড়ে কাঁদছিস। বেল্লিক কাঁহিকা—বলে সপাং সপাং করে চাবুকটা দিয়ে বেদম মারতে লাগলেন নরহরি মহাপাত্রের পিঠে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! নরহরি কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগলো রাস্তার ওপর। যারা এতক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ করে মজা দেখছিল, তারা এবার দরজা খুলে নির্ভয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ নরহরিকে মারা বন্ধ করে তাদের দিকে চাবুকটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন মেজকর্তা। বললেন—কি দেখছিস সব

বেরো এখান থেকে বেরো

আবার ঝটাপট সব দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শান্ত সৌম্য মেজকর্তা হিরণ্যমণি চৌধুরীকে কেউ রাগতে দেখেনি। সেই তিনিও রেগে লাল হয়ে উঠলেন। তারপর ভৈরববাবু আর মেজকর্তা গাড়িতে উঠে বসতেই জুড়ি আবার বনমালী সরকার লেন পার হয়ে গেল।

পরদিন খাজাঞ্চী বিধু সরকারের ডাক পড়লো। বেলা তিনটে তখন। বিধু সরকার আসতেই বললেন—নরহরি মহাপাত্রকে এক শ’ টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও তো বিধু—আর সুখচরের গোমস্তাকে চিঠি লিখে দাও, রাজীবপুরের বিলের ধারের দশ বিদ্বে জমি ওর নামে প্রজাবিলি করে দেয় যেন।

যে হুকুম সেই কাজ। তারপরে নাথু সিংকে ডেকে বললেন

নরহরি যেন এ গলির মধ্যে কখনও না ঢোকে আর তাকে যদি কখনও দেখতে পাই তো গুলী করবো, ওকে বলে দিস।

তারপর থেকে নরহরিকে আর কখনও ভূতনাথ দেখেনি কলকাতায়।

 

গল্প করতে করতে নিবারণ যেন একবার থামলো। বোধ হয় ঘুম আসছিল ওর। ঘরের আলোটা একটু একটু কাঁপছে। ভূতনাথেরও চোখে যেন কেমন তার ভাব। আর শুধু কি নিবারণ আর ভূতনাথ? সমস্ত ভারতবর্ষই বুঝি ছিল তন্দ্রাচ্ছন্ন। বাদশাহী আফিঙের নেশা। জাগতে চেষ্টা করলেও ভালো করে চোখ মেলা যায় না। এক শ’ বছরে রাজ্য ভাঙা-গড়ার ইতিহাস নেই, রাজবংশের উত্থান-পতনের গুরুগর্জন নেই। বেশ নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় সবাই ঘুমিয়েছে। সেই সর্বনাশা ঘুমের অন্তরালে কখন ধানকল এসেছে চুপিচুপি, এসেছে পাটকল আর গম-পেষা কল, কাপড়ের কল, আরে এসেছে স্টীম ইঞ্জিন, স্টীমার, ছাপাখানা আর টাকাছাপানো কল—কেউ টের পায়নি। তৈমুর লঙ-এর আরবী ঘোড় আর নাদির শা’র তলোয়ার যা পারেনি তাই করেছে এক শ’ বছরের ইংরেজ রাজত্ব। ওপর-নিচে সমস্ত ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভেতরে ভেতরে সমাজের ভিত গিয়েছে সে। বুদ্ধ-যিশু-মহম্মদ আর চৈতন্য যা পারেননি তাই পেরেছে বাষ্প আর বাষ্পীয় যান।

ঘুম ভেঙে গিয়েছে নিবারণের।

ঘুম ভেঙে গিয়েছে ভূতনাথেরও।

বাইরে কে যেন জোরে কড়া নাড়ছে। ডাকছে—নিবারণ–নিবারণ-ও নিবারণ–

নিবারণ ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলে দিলে। বললে-কে, কদমদা’ নাকি?

-হ্যাঁ, শিগগির চলবেলুড়ে যেতে হবে।

–কেন? এত রাত্রে?

—হ্যাঁ, স্বামিজী মারা গিয়েছেন।

—স্বামিজী? —হ্যাঁ, স্বামী বিবেকানন্দ!

১৮. কোথা দিয়ে ঘুমের মধ্যে দিয়ে

কোথা দিয়ে ঘুমের মধ্যে দিয়ে রাতটা কেটে গিয়েছিল মনে নেই ভূতনাথের। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও যেন স্বপ্ন দেখেছে ব্রজরাখালকে। মনটা ছটফট করেছে ব্রজরাখালের কাছে যাবার জন্যে। ব্ৰজরাখাল এত বড় সংবাদকে কেমন করে সহ্য করবে কে জানে! বাঙলা দেশে এত বড় নীরব ভক্ত আর কে ছিল!

ভোরবেলা কিন্তু আর এক কাণ্ড ঘটলো। যুবক সঙ্ঘের সদর দরজার সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো একটা। ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দ। তারপরেই সুবিনয়বাবুর গলা–কই? এই বাড়িতে নাকি?

শিবনাথ বুঝি ছিল সামনে। বললে—ভূতনাথবাবু এখন ঘুমোচ্ছন একটু—তা আপনি ভেতরে আসুন।

সুবিনয়বাবু বললেন—অথচ ক’দিন থেকেই আমি ভাবছিলাম— কী হলো, কী হলো—ভূতনাথবাবু আসে না কেন, ব্ৰজরাখালবাবুকে জিজ্ঞেস করি—তিনিও বলতে পারেন না—শেষে আজ ভোরবেলা…

হঠাৎ ঘরের মধ্যে উদয় হলেন। সেই কালো চাপকানের ওপর কোণাকুণি পাকানো চাদরটা ফেলা। দাড়ি-গোঁফের প্রাচুর্যের মধ্যেও মুখের উদ্বিগ্নভাব ধরা পড়লো। ভূতনাথকে জেগে থাকতে দেখে সামনে এসে ঝুঁকে বললেন—কেমন আছো এখন ভূতনাথবাবু? তারপর একটু থেমে আবার বললেন—গোরাদের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই, কিন্তু আঘাতটা যে মারাত্মক হয়নি এই রক্ষে। সর্ব জীবের যিনি নিয়ন্তা, যিনি ভূলোক দ্যুলোকের অধিপতি সেই পরম…

শিবনাথ বললে—আমরা যথাসাধ্য সমস্ত রকমের যত্ন নিয়েছি। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়নি।

সুবিনয়বাবু বললেন—কিন্তু জবা মা যে বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, আমাকে বলে দিয়েছে ও-জায়গায় ভূতনাথকে রেখে আসা ঠিক হবে না—হয় তো ঠিকমতো সেবা হচ্ছে না। জবা যে আমার বড় একগুয়ে মেয়ে শিবনাথবাবু। নিজেই আসতে চাইছিল, আমি তাকে বারণ করলাম—বললাম আমি তাকে নিয়েই আসবো। আমি যে জবা মাকে কথা দিয়ে এসেছি একেবারে।

শিবনাথ বললে—ব্রজরাখালবাবুর বড়কুটুম—তাকে জিজ্ঞেস না করে–

সুবিনয়বাবু বললেন—তিনি যদি আপত্তি করেন, তাই বলছেন শিবনাথবাবু?

শিবনাথ বললে—তাকে না জিজ্ঞেস করে নিয়ে যাওয়া কি ভালো হবে?

সুবিনয়বাবু বললেন—তা-ও তো ঠিক হবে না জানি, কিন্তু জবা মাকে আমি গিয়ে কি জবাব দেবো? বড় একগুয়ে মেয়ে কি না! কিন্তু ব্ৰজরাখালবাবুকে এখন একবার খবর দিলে হয় না?

—তিনি তো এখন বেলুড়ে—স্বামিজীর ব্যাপারে…তার দেখা পাওয়া শক্ত।

-তা হলে কি হবে শিবনাথবাবু?

এতক্ষণে ভূতনাথ যেন কথা বলবার ক্ষমতা ফিরে পেল। বললে–আমি আপনার সঙ্গেই যাবে সুবিনয়বাবু।

সুবিনয়বাবু যেন অকূলে কূল পেলেন। বললেন—আমাকে বাঁচালে ভূতনাথবাবু, জবা ভোরবেলা খবরটা পাওয়া অবধি বড় কাতর হয়ে আছে কি না—ক’দিন থেকেই আমরা ভাবছিলুম, ভূতনাথবাবু সেদিন বাড়ি গেল, আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। খবর পাঠালুম ব্রজরাখালবাবুকে, তিনিও নেই, খবর পেলাম তিনিও নাকি বাইরে গিয়েছেন।

শিবনাথবাবু ধরাধরি করে ভূতনাথকে উঠিয়ে দিয়েছিল সুবিনয়বাবুর গাড়িতে। সারা রাস্তা সুবিনয়বাবু কথা বলেছেন। শিবনাথও সঙ্গে ছিল। মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে এসে পাঠকজী আর শিবনাথ নামিয়ে দিলে গাড়ি থেকে!

যে-ঘরে শোয়ানো হলো সে-ঘরটা জবার মা’র ঘর। একেবারে অন্দরমহলে এনে ওঠানো হলো। জবা তৈরিই ছিল। বললে বাবা আপনি এখন একটু বিশ্রাম করুন, ভূতনাথবাবুকে আমি দেখছি। তারপর আবার মাকে ডেকে বললে—বৈজুকে বল ডাক্তারবাবুকে একবার যেন খবর দেয় আর একটা গামলায় খানিকটা গরম জল করে নিয়ে আয় তো তুই।

অনেকখানি পরিশ্রমের পর ভূতনাথ বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে টের পায়নি। যখন আবার তন্দ্রা ভাঙলো মনে হলো কোথায় এসেছে সে। স্মরণ করতে একটু সময় লাগলো। তারপর ভালো করে নজর পড়তেই দেখলে পাশে বিছানার ওপর জবা বসে আছে। মাথায় জল-পটি দিচ্ছে। হঠাৎ এ মূর্তি দেখলে যেন চিনতে পারার কথা নয়। ভূতনাথের একেবারে কাছাকাছি বসে। এতখানি সান্নিধ্যের অবকাশ অবশ্য আগে কখনও মেলেনি। জবার শরীরের গন্ধ যেন নাকে এসে লাগছে। হাতের স্পর্শে যেন রোমাঞ্চ হয়। ভূতনাথের শরীরের উত্তাপ যেন আরো বেড়ে গেল।

সুবিনয়বাবু একবার ঘরে ঢুকলেন। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করার আগেই জবা বললে—বাবা, আপনি আবার কেন এলেন? ডাক্তারবাবু তো বলে গেলেন কোনো ভয় নেই-জ্বরটাও একটু কম। আপনি যান বসুন গিয়ে, আমি যাচ্ছি।

সুবিনয়বাবু বললেন—মাথার ঘা’টা কেমন আছে মা।

জবা জলপটি দিতে দিতে বললে—ডাক্তারবাবু বললেন আরো কিছুদিন সময় নেবে। শুকোবার মুখ এখন, চুপচাপ কেবল শুইয়ে রাখতে বলেছেন, ঘা’টা ভালোর দিকে গেলেই জ্বরটাও কমে আসবে।

—দেখো মা, ছেলেদের ইচ্ছে ছিল না ভূতনাথবাবুকে এখানে পাঠায়, তোমার জন্যেই নিয়ে এলাম এখানে, যেন বিপদ না হয় দেখো-বলে সুবিনয়বাবু চলে গেলেন।

জবা ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে এসে আবার বসলো পাশে। ভূতনাথের জ্বরের ঘোরেও মনে হলো জব যেন তার বড় কাছাকাছি ঘেঁষে বসেছে। জবার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে যেন। এ এক নতুন অনুভূতি। এমন করে এত কাছাকাছি যেন কেউ আগে এসে বসেনি। অস্পষ্ট কুয়াশার মতো ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে শুধু পিসীমা’র কথা। অসুখ হলে এমনি করে পিসীমা কাছে এসে বসতো। বড় ভালো লাগতো তখন। কত বায়না করতে ভূতনাথ। অসুখ থেকে সেরে ওঠবার পর পিসীমা ভাত খেতে পারতো না। বিধবা মানুষ। দুপুর বেলা শুধু একবার পাথরের থালাটা নিয়ে বসতে খেতে। কিন্তু টের পেয়েই ভূতনাথ আস্তে আস্তে পাশে গিয়ে বসতো।

পিসীমা বলতো–ও মা, তুই ঘুমোচ্ছিস দেখে দুটো ভাত নিয়ে বসলাম।

ভূতনাথ নিবিষ্টচিত্তে দেখতো পিসীম কেমন করে ডাল দিয়ে ভাত মাখছে। কেমন করে মুখে তুলছে। ভাতের লোভে সমস্ত শরীরটা যেন লালায়িত হয়ে উঠতে তার।

—পিসীমা, কুলের অম্বল করোনি আজ?

-না বাছা, কুলের অম্বলে আর কাজ নেই, বাড়ির ছেলের অসুখ আর আমি কুলের অম্বল দিয়ে কি না ভাত খাবো, তোর অসুখ ভালো হলে তখন আবার কুলের অম্বল করবো।

–কবে ভাত খাবো পিসীমা?

পিসীমা’র গলা দিয়ে যেন ভাত নামতো না। সান্ত্বনা দিয়ে বলত—অসুখ থেকে উঠে কি কি খাবি বল দিকিনি শুনি?

কত তালিকা তৈরি করতে ভূতনাথ। শুয়ে শুয়ে লিখতে কাগজের ওপর অসুখ সারলে কী কী খাবে সে। কুলের আচার। বড়ি ভাজা। সজনে ডাটা চচ্চড়ি। কত সাধারণ জিনিষ সব। কিন্তু অসুখের সময় ভাবতে কি ভালোই যে লাগতো! কিন্তু সেরে ওঠবার পর আবার যে-কে-সেই।

পিসীমা বলতো-ও কি রে, আর দুটি ভাত নে।

–পেট ভরে গিয়েছে পিসীমা।

—তবে যে বললি আজকে অনেক ভাত খাবি! এই তোর খাওয়া, তুই-ই যদি না খাবি তো কার জন্যে এত সব রান্না।

অসুখের সময় যে-মানুষ খাবার জন্যে অত ব্যস্ত, অসুখের পর সেই মানুষকেই খাওয়াবার জন্যে কী পেড়াপীড়ি! বোধ হয় এমনিই হয় সকলের। এ-বাড়িতে এসেও সেই সব কথা মনে পড়ে ভূতনাথের। দিনের বেলা যখন ভূতনাথ জেগে থাকে, কেউ থাকে না ঘরে—চারিদিকে চেয়ে দেখে। ঘরের বাইরেই বসবার হল-ঘর। জবা তার সুবিনয়বাবুর গলা শোনা যায়।

জবা মাঝে মাঝে বই পড়ে শোনায় বাবাকে। আধো জাগা আধো তন্দ্রার মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের সুর ভেসে আসে। মনে পড়ে যায় নিবারণের কথা। ছেলেটা যেন স্বপ্ন দেখছে কোন্ দূর স্বর্গের। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন। মনে পড়ে যায় সেই গানটা—“মা গো যায় যেন জীবন চলে, বন্দে মাতরম্ বলে। কবে আসবে সেই তিনজন বাঙালী। যতীন বাড়জ্জে, বারীন ঘোষ আর অরবিন্দ ঘোষ। মনে পড়ে যায় প্লেগ কমিশনার র্যাণ্ড সাহেবের হত্যার কাহিনী। এমন চমৎকার করে বলতে পারে নিবারণ। পুণার বড়লাটের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে র্যা সাহেব। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে সে-দৃশ্য। আর মনে পড়ে ১৮৯৯ সালের একটা দিন। নিঃশব্দে নাকি একদিন প্রত্যুষে ফঁসি হয়ে যায় চাপেকার ভাইদের। সেই রক্তের বীজ বাঙলা দেশে এসে বুনেছে ওরা। ওই ‘আত্মোন্নতি সমিতি’, ‘অনুশীলন সমিতি’ আর ‘যুবক সঙ্ঘের’ ছেলেরা। একা-একা শুয়ে শুয়ে আরো এলোপাতাড়ি কত কি কথা মনে পড়ে।

বড়বাড়ির কথাও মনে পড়ে। ব্ৰজরাখাল আর তাকে দেখতে আসেনি। কত কাজ ব্রজরাখালের। কখন সে আসবে। কোথায় ফুলবালা দাসীর ভেদবমি, কার অসুখের ওষুধ, আলমবাজারের মঠ, দক্ষিণেশ্বরের আশ্রম, নিজের যোগসাধনা। তারপর আছে চাকরি। তবু যে কেন চাকরি করে ব্রজরাখাল! কাদের জন্যে! বড়বাড়ির ছেলেদের রাত্রে পড়ানো তো সব দিন হয় না। প্লেগের যেবার হিড়িক হলো—কি কাণ্ডটাই না করলো সে ক’দিন। কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সেই অমানুষিক সেবা আর অমিত পরিশ্রম। এখনও মনে আছে ভূতনাথের। লম্বা লম্বা ছুচের মতো যন্ত্র নিয়ে ইনজেকশন দিতে আসতো। বড়বাড়ির চাকর-ঝি কেউ বাদ গেল না। কি ব্যথা হয়েছিল হাতে ক’দিন ধরে। রাস্তায় রাস্তায় যাকে দেখতে পায় তাকেই দেয় ছুঁচ ফুটিয়ে। হাত ফুলে ঢোল হয়ে ওঠে। দলে দলে প্লেগের ভয়ে পালাতে শুরু করলো লোক। শেয়ালদা’ স্টেশনে নাকি ভিড়ের জন্যে টিকিট কাটাই দায়। সারাদিন পরিশ্রমের পর ব্রজরাখাল যখন রাত্রে ফিরতে কি চেহারা তার!

ভূতনাথ একদিন জিজ্ঞেস করেছিল—আপিস যাচ্ছে না ব্রজরাখাল, তোমার চাকরি থাকবে তো?

ব্ৰজরাখাল বলেছিল—চাকরি বড় না মানুষের প্রাণ বড়। তারপরে একটু থেমে বলেছিল—আর পারছিনে বড়কুটুম—এ সাহেব আসে স্যালিউট দাও, ও সাহেব আসে স্যালিউট দাও একটু স্যালিউট দিতে ভুল হয়েছে কি চাকরি নট—কিন্তু আমিও ঠিক করেছি এক ঠাকুর ছাড়া কারুর কাছে মাথা নোয়বো না বড়কুটুম—বলে ঠাকুরের ছবিটার দিকে চেয়ে চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করেছিল।

ভূতনাথ বলেছিল কিন্তু তবে কেন তোমার ছাই চাকরি করা?

ব্ৰজরাখাল নিজের মনেই বলেছিল—সাধ করে কি আর চাকরি করি বড়কুটুম!

ভূতনাথও জানতে সে-কথা। ক’দিন ব্ৰজরাখাল বাড়িতে না এলেই লোকের পর লোক এসে হাজির। এ এসে জিজ্ঞেস করে—ব্রজরাখালবাবু আছেন? ও এসে জিজ্ঞেস করে—ব্রজরাখালবাবু আছেন? মাসের প্রথম দিকটা অনেকগুলো লোক হাঁ করে বসে থাকে ব্ৰজরাখালের পথ চেয়ে।

বড়বাড়ির কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় ছোটবৌঠানের কথা। সেই তেতলার ঘরখানার কথা। উঁচু পালঙ্ক। কড়িকাঠ থেকে একটা রঙিন মশারি ঝুলছে। দিনের বেলায় চূড়ো করে বাঁধা। এতখানি পুরু গদির ওপর শাখের মতো সাদা চাদর পাতা। সারা দেয়ালে পটের ছবি। শ্রীকৃষ্ণের পায়স-ভক্ষণ। গিরিগোবর্ধনধারী যশোদাদুলাল। দময়ন্তীর সামনে হংসরূপী নলের আবির্ভাব। ঠোটে একটা ভাঁজ করা চিঠি। মদন ভস্ম। শিবের কপাল ফুড়ে ঝাটার মতন আগুনের জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। পাশের কাচের আলমারিতে পুতুল। বিলিতি মেম—ঘাগরা পরা। গোরাপল্টন-মাথায় টুপি।

চোখ বুজলেই সব নিখুত মনে পড়ে যায়। আর মনে পড়ে যায় ছোটবৌঠানের আলতা-পরা পা-জোড়া। টোপাকুলের মতো টলটলে আঙুলগুলো। মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয়েছে কি না কে জানে। অনেকদিন তো হয়ে গেল। ছোটকর্তা কি আজো সেইরকম নিয়ম করে বিকেলবেলা ল্যাণ্ডোলেট চড়ে বনমালী সরকার লেন পেরিয়ে চলে যায়। কড়ির মতো সাদা ঘোড়া দুটো টগবগ করতে করতে কি তেমনি বড়বাড়ির গেট পেরিয়ে ছুটতে শুরু করে।

সুবিনয়বাবু সেদিন এলেন ঘরে। বললেন—এখন কেমন আছো ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথ বললে—একটু ভালো বোধ করছি—আর কিছুদিন বাদেই কাজ আরম্ভ করতে পারবো ভাবছি।

–কীসের কাজ?

-আপিসের কাজ-ভূতনাথ বললে।

—কোন্ আপিসের কাজ?

ভূতনাথ হঠাৎ এ-প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলে না। তারপর বললে—আপনি একলা সব পেরে উঠেছেন না।

–ও-ও-ও-সুবিনয়বাবু যেন এতক্ষণে বুঝতে পারলেন। বললেন—না ভূতনাথবাবু, ভাবছি, ও আমি তুলে দেবো-ও বুজরুকি আর করবো না, বিবেকে বাধছে, অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিতের দেশ, এখনও ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র কাটতি আছে এবং কাটতি আরো বাড়ছে, বোধকরি যতদিন চালাবে ততদিন চলবে, আমার অর্থ সম্পত্তি সব দিয়েছে ওই ‘মোহিনী-সিঁদুর’—উপনিষদে আছে…

বাধা পড়লো। জবা ঢুকলো ঘরে। বললে—বাবা, আপনি বিশ্রাম করুন গে যান, আমি ভূতনাথবাবুকে দেখছি।

সুবিনয়বাবু চলে গেলেন নিঃশব্দে। কিন্তু কথাটা শুনে ভূতনাথের কেমন ভয় হলো। মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসা যদি তুলে দেন তা হলে সে করবে কি?

জবা এসে বিছানার পাশেই বসলো। তারপর ভূতনাথের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে—কিছু বলবেন আমাকে?

ভূতনাথ প্রথমে কেমনভাবে কথাটা পাড়বে বুঝতে পারলে না। শেষে বললে–বাবা যা বলছিলেন সত্যি?

—বাবা কী বলছিলেন?

—ওই যে বলছিলেন মোহিনী-সি দুরে’র কারবার তুলে দেবেন?

জবা বললে—বাবার কথায় কান দেবেন না, বাবার এখন মাথার ঠিক নেই, এখন ওঁর কেবল মনে হচ্ছে এ লোক-ঠকানো ব্যবসা, কিন্তু লোকে যদি ইচ্ছে করে ঠকে তো আমরা কী করতে পারি। এ হচ্ছে কর্তাভজার দেশ, মন্ত্র-তন্ত্রের দেশ, অবতারবাদের পীঠস্থান, এর মতন ফলাও ব্যবসা আর আছে নাকি? এর পেছনে আরো মূলধন ঢালতে পারলে এ আরো চলবে।

ভূতনাথ খানিকটা আশ্বস্ত হলেও যেন নিঃসন্দেহ হতে পারলে। বললে—কিন্তু উনি যে বললেন, এ সব বুজরুকি।

জবা বললে—আজকাল ওই রকম ওঁর মনে হচ্ছে—বাবার এখন মাথার ঠিক নেই।

হঠাৎ আর একটা কথা মনে পড়লো ভূতনাথের। তবে তো ছোটবৌঠানকে সে ঠকিয়েছে। কোনো কাজই হয় নি সে-সিঁদুরে। মিছিমিছি ছোটবৌঠান সেই সিঁদুর নিয়ে আজও ছোটকর্তার পথ চেয়ে প্রতীক্ষা করে থাকে হয় তো। এখনও হয় তত পরীক্ষা-নীরিক্ষার শেষ নেই। এখনও হয় তত তেমনি রাতের পর রাত ছোটকর্তার জন্যে জেগে জেগে কাটে। তারপর ভোরের দিকে যখন ছোটকর্তা আসে, যখন বংশী কাপড় বদলিয়ে দোতলার ঘরে শুইয়ে দেয়, নেশায় অচৈতন্য হয়ে বাড়িতে ফেরে, তখন খবর যায় ছোটবৌঠানের ঘরে। ছোটবৌঠানের যশোদাদুলাল তেমনি জলচৌকির ওপর নিশ্চল নিথর দৃষ্টিতে পাথরের চোখ দিয়ে সব দেখে। সমস্ত বংশের পাপের জন্যে এক ছোটবৌঠানই হয় তো প্রায়শ্চিত্ত করে। তবে বুঝি পটেশ্বরী বৌঠানের বাবার গুরুদেবের কথাই সত্যি। পূর্বজন্মে পটেশ্বরী ছিল বুঝি দেবোলা। দেবসভায় ব্রাহ্মণের অপমান করায় এ-জন্মটা এমনি প্রায়শ্চিত্ত করেই কাটিয়ে দিতে হবে।

পটেশ্বরী বৌঠানের কথা মনে পড়তেই ভূতনাথের যেন কেমন অশ্বস্তি হতে লাগলো। মনে হলো—-অনেকদিন যেন দেখেনি ছোটবৌঠানকে। আর যদি কখনও দেখা না হয়! এখনি ছুটে যেতে পারলে যেন ভালো হতো! অন্ততঃ বড়বাড়িতে যেতে পারলেও শান্তি পাওয়া যেতো। কিছুটা তত কাছাকাছি। দেখতে না-পাওয়া যাক। একটু সান্নিধ্য। একই বাড়ির ঘেরাও-এর মধ্যে। এক ছাদের তলায়। একই আবহাওয়ার মধ্যে। অন্ততঃ বংশীর কাছে থাকতে পারলেও যেন ভালো হতো। বংশী মুখে ছোটবৌঠানের কথা শুনতে। এ-যেন এক অপূর্ব আকর্ষণ! মাত্র দু’দিনের দেখা। তা-ও অত অল্প সময়ের জন্যে। কিন্তু মনে হলো বৌঠানের কাছে

গেলে সে যেন বাঁচবে না। সে শুধু একবার গিয়ে বলবে—ছোটবৌঠান—সব মিথ্যে—সব মিথ্যে কথা। মোহিনী-সিঁদুরে’ কিছু কাজ হয় না।

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—আগে তবে বললানি কেন যে মোহিনীসিঁদুরে’ কিছু হয় না। সব তোমাদের বুজরুকি। কেন তবে বললানি আমাকে?

জবা ভূতনাথের এই কথায় কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। কিন্তু সান্ত্বনার সুরে বললে—বাবার কথা বিশ্বাস করে মিছিমিছি কেন মন খারাপ করছেন। বাবার কি এখন মাথার ঠিক আছে, মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা কেবল ওই কথা বলছেন?

ভূতনাথ যেন বুঝতে পারলে না। বললে–মা? তোমার মা?

–আপনি শোনেন নি? মা তো মারা গিয়েছেন!

–সে কি? কবে? কী হয়েছিল? জবা বললে—এখনও পনেরো দিনও হয়নি হঠাৎ হার্টফেল করলেন, রাত্রে যেমন শুয়ে থাকেন বিছানায় তেমনি শুয়ে ছিলেন, ঠিক এই ঘরেই…সকাল বেলা জানতে পারলুম—রাত্রে কেউ টেরও পাইনি। কাউকে এতটুকু কষ্ট দিয়ে যাননি। বলতে বলতে জবার চোখ দিয়ে যেন জল পড়বার উপক্রম হলো।

ভূতনাথ বললে-কই! আমি তো কিছুই জানতুম না, বাবাও কিছু বলেন নি—অন্তত ব্যবহারেও কিছু জানতে দেন নি।

জবা বললে–বাবাকে আপনি চিনলেন না, যে দিন মা মারা গেলেন সেদিনও বাবা সমাজে গিয়ে রোজকার মতো প্রার্থনা করে এসেছেন, সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন, কেউ বুঝতে পারেনি আমাদের এত বড় দুর্ঘটনার কথা, রাত্রে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেয়েছি বাবা যেন কেবল জপ করছেন—“ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’—“ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’-পরের দিন আমাকে সেই বাবার প্রিয় ব্ৰহ্ম সঙ্গীতটি গাইতে বলেছেন

-নাথ, তুমি ব্ৰহ্ম, তুমি বিষ্ণু, তুমি ঈশ, তুমি মহেশ
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি অনাদি, তুমি অশেষ—

আমি আপন মনেই গেয়ে চলেছি আর বাবা হাতে চৌতালে তাল দিয়ে চলেছেন। শেষে আমার সঙ্গেই গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলেন। আমি গান থামালুম, বাবা তখনও গাইছেন—

জল স্থল মরুত ব্যোম পশু মনুষ্য দেবলোক
তুমি সবার সৃজনকার হৃদাধর ত্রিভুবনেশ…

বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না বাবাকে দেখে, বেশ স্বাভাবিক মানুষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমূল বদলে গিয়েছেন। কেবল বলেন, লোক-ঠকানোর পাপেই আমার এই ঘটলো—এ ব্যবসা আমি তুলে দেবো মা।

কথা বলতে বলতে জবা যেন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল ভূতনাথের। ভূতনাথ আস্তে আস্ত জবার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে ধরলো। জবা কোনো আপত্তি করলে না। তারপর কি জানি কোন্ অজ্ঞাত আকর্ষণে ভূতনাথ জবার হাতটা নিয়ে নিজের ঠোটে স্পর্শ করলে। তবু যেন জবার কোনো সম্বিত নেই। জবা যেন নিষ্প্রাণ প্রস্তর-প্রতিমা। ভূতনাথ অনেকক্ষণ তেমনি করে জবার স্পর্শের সান্নিধ্য আস্বাদ করতে লাগলো।

জবা হাত না সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে—’মোহিনী-সিঁদুর’ উঠে গেলে আপনার ভয় কেন? চাকরি যাবে বলে?

ভূতনাথ দুই হাতে জবার হাতটা তখনও তেমনি করে ধরে আছে। মুখ আর বুকের মাঝামাঝি জায়গায় হাতটা লাগিয়ে রেখে বললে—ঠিক তা নয়–আগে জানতে পারলে ছোটবৌঠানকে অন্তত আমি বিশ্বাস করে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ দিতাম না।

—ছোটবৌঠান আবার আপনার কে? কী হয়েছিল তার?

একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল ভূতনাথ পটেশ্বরী বৌঠানের কাছে যে, এ-কথা কাউকে বলবে না। এমন কি জবাকেও না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে-প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল ভূতনাথ। বললে—তার কথা তত তোমায় বলেছি, বড়বাড়ির ছোটবউ। ছোটকর্তা রাত্রে বাড়ি আসেন না—তাকে বশ করবার জন্যে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ কিনে দিয়েছিলাম।

জবা যেন কি ভাবলো। তারপর বললে—আপনার ছোটবৌঠানের বয়েস কত?

–তোমার চেয়ে বড়, আমার চেয়ে কিছু ছোট।

জবা হেসে বললে—ছোটবৌঠানের জন্যে আপনার এতখানি দরদ তো ভালো নয়?

ভূতনাথ কিন্তু হাসতে পারলে না। বললে—পটেশ্বরী বৌঠানকে দেখলে তুমি এ-কথা বলতে পারতে না জবা।

জবা তেমনি হেসে বললে—আমি না দেখলেও কল্পনা করে নিতে পারি।

ভূতনাথ বললে—আর সবাইকে কল্পনা করা যায় কিন্তু ছোটবৌঠান কল্পনার বাইরে। তাকে না দেখলে কল্পনা করা শক্ত, দেখবার আগে আমারও সেই ধারণাই ছিল।

জবা বললে—তা হলে দেখছি জল অনেকদূর গড়িয়েছে। তারপর একটু থেমে বললে—‘মোহিনী-সিঁদুর’ কখনও বিফল হয় না জানতুম।

ভূতনাথ বললে—তার মানে?

-তার মানে, বড়লোকের বাড়ির স্বামী পরিত্যক্তা রূপসী বউ, আপনার…হঠাৎ জবা হাত টেনে নিলে। রতন ঘরে ঢুকেছে।

রতন বললে—দিদিমণি খোকাবাবু এসেছেন।

জবা বিছানা ছেড়ে উঠে বললে-বসতে বল হ-ঘরে, আর চা করে আন—আমি আসছি। বলে এক নিমেষে জবা পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ভূতনাথ যেন হতবাকের মতো অসহায় অপ্রস্তুত হয়ে শুয়ে পড়ে রইল। কিছু যেন করবার নেই। নিরূপায় সে। কে এ খোকাবাবু! কিন্তু সে যে-ই হোক এই মুহূর্তেই কি তাকে আসতে হয়! যেন অনেক কথা বলবার ছিল জবাকে, সবে মাত্র সূচনা হয়েছিল, কিন্তু বলা হলো না।

ও-পাশের হ-ঘর থেকে ওদের গলার শব্দ কানে আসছে। জবা কথায় কথায় হাসছে। জবা এত হাসতে পারে। এত হাসির কথা হচ্ছে কার সঙ্গে। একবার মনে হলো চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দেখে আসে। আজ সবে ভাত খেয়েছে সে এতদিন পরে! এটুকু পরিশ্রমে কিছু ক্ষতি হবে না তার। কিন্তু লজ্জাও হলো। যদি ধরা পড়ে যায়। হঠাৎ মনে হলো যেন চেনা চেনা গলার আওয়াজ। যেন ননীলালের গলা! ঠিক সেইরকম কথার ভঙ্গী! ভারী কৌতূহল হলো দেখবার!

উঠতেই যাচ্ছিলো ভূতনাথ। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে উঁকি দিয়ে দেখে আসতে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ রতন আবার ঘরে ঢুকলো। কী একটা জিনিষ নিয়ে চলে যাবে। ভূতনাথ ডাকলো।

রতন ঘাড় ফেরালো-আমায় ডাকছেন নাকি কেরানীবাবু?

—হাঁ, শোনো এদিকে, কাছে এসো।

রতন কাছে সরে এল।

ভূতনাথ গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করলেও-ঘরে কে এসেছে।

রতন বললেও খোকাবাবু।

—খোকাবাবু? খোকাবাবু কে? এ-বাড়ির কে হয়?

–এ-বাড়ির জামাইবাবু হবে, দিদিমণির সঙ্গে বিয়ে হবে!

–ওর আসল নামটা কী?

—তা জানিনে আমি—বলে রতন চলে গেল।

 

সেদিন রাত্রে শোবার আগে জবা একবার ঘরে এল। বললে। —ওষুধটা খাননি কেন?

ভূতনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। কোনো জবাব দিলে। জবা ওষুধের শিশিটা নিয়ে কাছে এল। বললে-জ্বর ছেড়ে গিয়েছে বলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবেন নাকি? নিন হাঁ করুন—

ভূতনাথের কী মনে হলো কে জানে। নিঃশব্দে ওষুধটা খেয়ে নিলো। কোনো ওজর-আপত্তি করলে না। কিন্তু হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলো।

জবা ওষুধ খাইয়ে চলেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ ভূতনাথ শাড়ির আঁচল চেপে ধরতেই কাঁধ থেকে কাপড়টা খসে পড়লে জবার।

একটি মুহূর্ত মাত্র। কিন্তু এক মুহূর্তে দুজনই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। এক নিমেষের মধ্যে যেন একটা খণ্ড প্রলয় ঘটে গেল।

জবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে বললে—অভদ্র নীচ কোথাকার—বলে আর দ্বিরুক্তি না করে ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

 

পরদিন খুব ভোরেই ঘুম ভাঙলো। কিম্বা হয় তো সারা রাত ঘুমই হয়নি ভূতনাথের। নিজের মনের মধ্যে সারারাত কেবল একটা দুশ্চিন্তাই জেগেছে যে, এ-বাড়িতে সে জবার কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। জবা তো শুধু নারী নয়, সে যে একাধারে তার মনিব। মাসে মাসে সাত টাকা মাইনে আর এক বেলা খাওয়ার পরিবর্তে সে এখানে দাসত্ব করে। মানুষের পক্ষে যা অপরাধই মাত্র, তার পক্ষে যে তা ঘোরতর অপরাধের সামিল।

যথারীতি সুবিনয়বাবু রোজ ভোরবেলা একবার ঘরে এসে কুশল প্রশ্ন করেন। সেদিনও এলেন। তখনও ভালো করে সকাল হয়নি। কিন্তু এসে বললেন—ভূতনাথবাবু তোমার একটা চিঠি আছে।

চিঠি! চিঠি ভূতনাথের বড় একটা আসে না কখনও। চিঠি তাকে কে লিখতে গেল। বিশেষ করে এই ঠিকানায়। সুবিনয়বাবু বললেন—একটি লোক চিঠি নিয়ে এসেছে—নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

চিঠিটা খুলে পড়তেই ভূতনাথের সমস্ত শরীরে রোমাঞ্চ হলো। ছোটবৌঠানের চিঠি!

সুবিনয়বাবু বললেন—তা হলে রতনকে বলছি ওকে ডেকে দিক এ-ঘরে-বলে সুবিনয়বাবু চলে গেলেন।

ভূতনাথের সমস্ত শরীর কাঁপছিল। চিঠিটা আবার পড়লো সে।

“প্রাণাধিক ভূতনাথ,

পরে বংশীর নিকট এইমাত্র তোমার সংবাদ পাইলাম। কেমন আছো এখন। বড় উদ্বেগ বোধ করিতেছি। বংশীকে তোমার নিকট পাঠাঁইলাম। যদি সম্ভব হয় এখানে চলিয়া আসিবে। পাল্কি পাঠাঁইলাম। আশীর্বাদ জানিবে।

তোমার ছোটবৌঠান”

বার বার চিঠিটা পড়ে যেন তৃপ্তি হলো না ভূতনাথের। এমন করে পটেশ্বরী বৌঠান যে তাকে চিঠি লিখবে এ যেন কল্পনাও করা যায় না। ভূতনাথের জীবনে এই সামান্য কাগজের একটা টুকরো যেন এই মুহূর্তে এক অমূল্য সম্পদ বলে মনে হলো। ক্ষমতা থাকলে এখনি উঠে বসতো ভূতনাথ। তারপর বিশ্বশুদ্ধ লোককে এই চিঠিখানা দেখাতো।

বংশী এল। ভূতনাথকে দেখবার জন্যে তারও যেন আগ্রহের শেষ নেই। এসেই বললে—শালাবাবু, এ কী চেহারা হয়েছে আপনার আজ্ঞে।

ভূতনাথ যেন এতদিনে একজন নিতান্ত আপনার লোক পেয়ে গিয়েছে। শুধু বললে—বংশী তুই…।

বংশী বললে—ক’দিন থেকেই খবর করছি—শালাবাবু কোথায় গেল—ছোটমা’ও অস্থির-থানায় তোক পাঠান, বড়বাড়ির চাকরবাকর সবাইকে শুধোই, ভৈরববাবু দশ জায়গায় ঘোরেন, তাকেও শুধোলাম, তিনি বললেন—কেল্লার গোরারা বোধহয় জখম-টখম করে দিয়েছে দেখ—মধুসূদনকে শুধোলাম— সে বললে—আপদ গিয়েছে তো বাঁচাই গিয়েছে, তার গায়ের জ্বালা আছে কিনা আপনার ওপর।

ভূতনাথ বললে—কেন, তার গায়ের জ্বালা কেন রে আমার ওপর।

–ওই যে আপনি হলেন গিয়ে আমাদের তরফের লোক, ওর সুবিধে হচ্ছে না, আপনি আসার পর থেকে তেমন বাব আদায় হচ্ছে না, আর ঝি-চাকরে ঝগড়া হলে তো ওরই লাভ, বা এনে নতুন লোক বসিয়ে দেবে, বা নেবে, তারপর চাকরি করে দিলে এক টাকা করে মাইনে থেকে কেটে নেবে—সেটা পুরোপুরি হচ্ছে না।

ভূতনাথ বললে—আমি তো আর ওর পাওনায় ভাগ বসাতে যাচ্ছি নে।

—ভাগ বসাতে যাবেন কেন, কিন্তু ওর ভয় তো আছে, আপনি যদি ছোটমা’কে বলে দেন, ছুটুকবাবুর সঙ্গে আপনার পেয়ার আছে, দেখেছে আপনি ছুটুকবাবুর আসরে গান-বাজনা করতে যান—যদি বলে দেন? ও সব জানে যে, সব দেখে যে—চোখজোড়া ছোট হলে কী হবে—নজর যে আছে আঠারো আনা।

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে দিয়ে বংশী বললে—ওদিকে এক কাণ্ড হয়েছে শোনেন নি—না আপনি আর শুনবেন কী করে, ঠনঠনের দত্তবাবুরা মেজবাবুর পায়রা চুরি করেছিল।

—পায়রা?

–হ্যাঁ শালাবাবু, পায়রা, গেরোবাজ পায়রা, পশ্চিম থেকে নিলেমে কিনেছিল ভৈরববাবু দেড় শ’ টাকা দিয়ে একজোড়া, সেই পায়রা তিনবার লড়াই-এ জিতেছিল, ক’দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো না তাদের, মেজবাবু সকালবেলা উড়িয়ে দিয়েছে রোজকার মতে, বার কয়েক আকাশে চক্কর মেরে তারা যেমন ঘুরে আসে রোজ, সেদিন আর তেমন এল না, শ্যামবাজারের দিকে উড়ে গিয়েছিলো, তারপর কোথায় মিলিয়ে গেল—সন্ধ্যে পর্যন্ত দেখা নেই, মেজবাবুর মেজাজ খারাপ রইল ক’দিন ধরে, বেণীও সামনে যেতে ভরসা পায় না। শেষে পাওয়া গিয়েছে ছেনিবাবুর হাটখোলার মেয়েমানুষের ঘরে।

—সে কি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, পুলিশ এল, মামলা হলো, দু’ শ’ টাকা আদালতে গুণে দিয়েছে ছেনিবাবু-পরশু যে আমাদের বড়বাড়িতে তাই ধুমধাম হলো খুব, বেণীর দু’ টাকা বকশিশ হয়ে গিয়েছে, চাকরদের কাপড় হলো একখানা করে, মেজবাবু দলবল নিয়ে গঙ্গায় পানসি চালাতে গেলেন, সঙ্গে বড়মাঠাকরুণ, মেজমাঠকরুণ, ছোটমাঠাকরুণ সবাই গিয়েছিলো, নাচ-গান-বাজনা খানা-পিনা করে সমস্ত রাত কাটিয়েছেন, কিন্তু আমার মনটা ভালো ছিল না। কেবল ভাবছিলাম শালাবাবুর কী হলো!

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-বদরিকাবাবুর খবর কী?

—তাকেও শুধোলাম আজ্ঞে, অত যে হৈ চৈ, তিনি সেই বৈঠকখানা ঘরে শেতলপাটির ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছেন, বললেন—ছোকরা বেঁচে গিয়েছে খুব, ভেগেছে নির্ঘাৎ—বলে টাকঘড়িটা একবার বড়ঘড়িটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিলেন। পাগল না পাগল-কিন্তু আর দেরি নয়, আপনি চলুন আজ্ঞে, অনেক কাজ ফেলে এসেছি, ওদিকে আবার ছুটুকবাবুর বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে।

ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। ছুটুকবাবুর বিয়ে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, বড়মা ধরে বসেছেন, তার ভারী ইচ্ছে, নিজের তো ছুচিবাই, কবে আছেন কবে নেই, সখ হয়েছে বউ দেখে যাবেন, অধর ঘটকী ক’দিন ধরে যাতায়াত করছে, সিন্ধু বলছিল আসছে মাসে নাকি হবে। তা এখন থেকে তো তৈরি হতে হবে, ঘর-বাড়ি সাফ করা, কেনা-কাটা হাতে আর সময় কই বলুন।

রতন ঘরে এল। বললে-দিদিমণি বললেন, আপনার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে কেরানীবাবু।

ওষুধ! ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু দিদিমণি কোথায়?

—দিদিমণি ভাঁড়ার বার করে দিচ্ছেন।

—একবার ডেকে দিতে পারো? কিন্তু তারপর কী ভেবে বললে—আচ্ছা থাক, বাবু কোথায়?

—বাবুকে ডাকবে? বলে রতন চলে গেল। ভূতনাথ বংশীর দিকে ফিরে বললে—বড়বাড়ির আর কী খবর?

কী জানি ছোটবৌঠানের কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করতে কেমন লজ্জা করতে লাগলো ভূতনাথের। আর কখনও তার কাছে যাবার সুযোগ মিলবে কিনা কে জানে। আর একবার যদি তার কাছে যাওয়া যেতো।

বংশী বললে—লোচন ক’দিন ধরে আপনার খোঁজ করছিল।

—আমার খোঁজ করে কেন সে?

—আজ্ঞে আয় কমে গিয়েছে যে তার, তামাক আর কেউ খাচ্ছে, ছুটকবাবুর আসরে বরাদ্দ ছিল তিন সের তামাক হপ্তায়, তাও এদানি বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন—তামাক কেউ খায় না, বিড়ি খায় সবাই, তা সবাই যদি বিড়ি-সিগারেট ধরে, ওর চলে কী করে আজ্ঞে, লোচন আমাকে বলছিল সেদিন—শালাবাবুর সঙ্গে তোর এত ভাব, ওকে তামাক ধরাতে পারিস না, না হয় মাসে আটটা করে পয়সাই নেবো আমি—আর ওদিকে ইব্রাহিমেরও ভারী ভয় লেগে গিয়েছে।

-কেন?

বংশী হাসতে লাগলো। বললে—যে-যার ভাবনা নিয়ে আছে শালাবাবু, আমার ভাইটাকে আমি যেমন বড়বাড়িতে ঢোকাবার কত চেষ্টা করছি কিছুতেই পারছি না, ওরও তেমনি–

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেও আবার কাকে চাকরিতে ঢোকাবে?

-আজ্ঞে চাকরিতে ঢোকাবে আর কাকে, নিজের চাকরি তাই-ই থাকে কিনা দেখুন, মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে ভাবনায়, অমন বাবরি চুল, পাঠানী দাড়ি, তাই বলে আর ভালো করে আঁচড়াচ্ছে না…

-কেন?

০০আজ্ঞে খবর সব পেয়েছে ও, খবর তো আর জানতে কারো বাকি নেই, বাবুরা যে হাওয়া-গাড়ি কিনছে, সে গাড়ি চালাতে তো আর কোচোয়ান লাগবে না, ঘোড়াও লাগবে না, হাওয়ায় চলবে, বিলেতে একরকম গাড়ি উঠেছে শোনেন নি?

—হাওয়া-গাড়ি। বাবুরা কিনবে নাকি হাওয়া-গাড়ি? কার কাছে শুনলি তুই?

বংশী বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল। শেষে বললে—আজ্ঞে শুনেছি আমি ভালো লোকের মুখ থেকেই, চুনী দাসী—ছোটবাবুর মেয়েমানুষ…

চুনী দাসী! রূপো দাসীর মেয়ে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে গিয়েছিলি নাকি চুনী দাসীর বাড়িতে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ শালাবাবু, গিয়েছিলাম, ছোটবৌঠান যেতে বলেছিল বলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু না গেলেই ভালো হতো আজ্ঞে।

–কেন?

—আজ্ঞে ছোটমা’র সেদিন উপোস, উনি পুজো-আচ্ছা করেন তো মাঝে মধ্যে, নীলের উপোস ছিল সেদিন, নির্জলা একেবারে, সারাদিন ধকল গিয়েছে নিজের পূজোয়, রূপলাল ঠাকুর এসে যশোদাদুলালের পূজো করে গিয়েছে, দুপুর বেলা চিন্তা সেই নৈবিদ্যির থালা বারকোষে সাজিয়ে বার-বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে সরকারী পূজোবাড়ির সিধে পত্তোর সব নিয়ে একসঙ্গে বারবাড়ির লোক গিয়ে রূপলাল ঠাকুরের বাড়ি দিয়ে আসবে। আমি যেমন গিয়েছি সন্ধ্যেবেলা, দেখি ছোটমা’র মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে—তখনও জল খাওয়া হয়নি। বরাবর উপোসের পর আমি গিয়ে ছোটবাবুর কাছে জলের বাটি নিয়ে যাই, ছোটবাবু পায়ের বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দেন, তারপর সেই জলটুকু খেয়ে ছোটমা উপোস ভাঙেন, কিন্তু ছোটবাবু সেদিন বাড়ি আসেন নি, ছোটমা’রও কিছু পেটে পড়েনি।

-কেন, ছোটবাবু বাড়ি আসেন নি কেন?

–তা কি আমি জানি? না ছোটমা জানেন! ছোটমা আমাকে বললে—যা বংশী তুই একবার জানবাজারে যা একবাটি জল নিয়ে আর দেখে আসিস বাবু কেমন আছেন। তা সেই অন্ধকারেই গেলাম আজ্ঞে জানবাজারে। গেলাম মরতে মরতে গিয়ে দেখি সে এক কাওছোটবাবু শুয়ে আছে পা ভেঙে, খুব বেশি নাকি খেয়ে ফেলেছিলেন, মাথার ঠিক ছিল না, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা ফস্কে পড়ে গিয়েছেন—আমাকে দেখে কী রাগ, বললেন—বংশী তোকে বারণ করেছি না-এ-বাড়িতে আবার এসেছিস।

ছোটবাবুর রাগের মাথায় কিছু উত্তর দিতে নেই। তা হলেই আরো রেগে যাবেন। কিছুই বললাম না, চুপ করে রইলাম। আস্তে আস্তে পায়ের কাছে বাটিটা নিয়ে ধরলাম গিয়ে। ছোটবাবু পা সরিয়ে নিলেন। বললেন—কে তোকে আসতে বলেছে এখেনে? বেরো এখান থেকে—তবু কিছু উত্তর দিলাম না। মাথা হেঁট করে চুপ করে বসে রইলাম। জানি কথা বললে আরো রাগ চড়ে যাবে। তারপর খানিক পরে ছোটবাবু বললেন—পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দে তো।

বুঝলাম এবার ঘুম আসবে। তারপর ছোটবাবু যেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছেন, অমনি পায়ের আঙুলটা টপ করে জলে ছুঁইয়ে নিলাম আজ্ঞে—কিন্তু জলটা নিয়ে চলে আসছি হঠাৎ দেখি সামনে নতুন-মা

ভূতনাথ বললে-নতুন-মা কে?

—আজ্ঞে ওই চুনী দাসী, ওকে আমরা নতুন-মা বলি কি না, তা আমাকে দেখেই নতুন-মা বলে উঠলো-বংশী তুই কখন এলি?

বললাম—বাবু কাল বাড়ি যাননি তাই দেখতে এসেছিলাম আজ্ঞে।

—হাতে কী?

–আজ্ঞে ছোটমা’র আজ নীলের উপোস গিয়েছে কি না।

নতুন-মা’র হাতে ছিল পানের ডিবে। দিনরাত পান খায় নতুন-মা, এক মুখ পান, ভালো করে চেয়ে দেখলাম নতুন-মা যেন আরো ফরসা হয়েছে, আরো মোটা হয়েছে, এক গা গয়না, নাকে নাকছাবিটা চকচক করছে।

নতুন-মা খানিক ভেবে বললে—হ্যাঁ রে বংশী তোর ছোটমা শুনেছে আমি মোটরগাড়ি কিনছি?

বললাম-হাওয়া-গাড়ি? কই শুনিনি তো?

—তোর ছোটমাও গাড়ি কিনবে নাকি? শুনেছিস কিছু?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে চলেই আসছিলাম। ছোটমা বাড়িতে না-খেয়ে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি সিঁড়ির কাছে এসেছি, নতুন-মা আবার ডাকলে-বংশী শুনে যা একবার!!

কাছে যেতেই নতুন-মা বললে—এই রাস্তা দিয়েই তো যাচ্ছিস, যাবার পথে ওই মোড়ের দোকানে একবার খবর দিয়ে যাবি তো, বলবি আরো পনেরোটা সোডার বোতল যেন পাঠিয়ে দেয়, আজ রাতটা ওতেই চলে যাবে। কাল সকালবেলা আবার খবর দেবো, আর দু’ সের বরফ ওই সঙ্গে। এই নে টাকা—বলে তিনটে টাকা দিলে আমার হাতে।

ভূতনাথ বললে—পনেরো বোতল সোড়া! অত সোড়া কী করবে বংশী?

বংশী হাসলো। বললে—মদ খাবে আজ্ঞে, কপালে ভাত জুটতো না যার এককালে, এখন সেই লোকের আজ ছোটবাবুর দৌলতে—

হঠাৎ সুবিনয়বাবু ঘরে ঢুকলেন—আমাকে ডাকছিলে নাকি ভূতনাথবাবু? না, না, উঠতে হবে না।

ভূতনাথ উঠে বসে বললে—আমি তো একটু ভালো হয়েছি, বড়বাড়ি থেকে ওঁরা পাল্কি পাঠিয়েছেন—তাই ভাবছি

সুবিনয়বাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন—তা হলে বেশ তো …কিন্তু জবা মাকে একবার খবর দাও। তার অনুমতিটা একবার-–ওরে রতন।

সেদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে পাল্কি করে যেতে যেতে বার-বার মনে হয়েছিল বটে যে, জবা যাবার সময় একবার দেখা করতেও এল না! কিন্তু আর একটা দুর্বার আকর্ষণে ভূতনাথ তখন সে-অপমানও ভুলতে পেরেছে। অসভ্য ছোটলোকের মতনই তো ব্যবহার করেছে সে জবার সঙ্গে। অমন ব্যাপারের পর ভূতনাথেরও তো লজ্জার আর সীমা ছিল না।

মাধববাবুর বাজার পেরিয়ে ভূতনাথের পাল্কি তখন দুলতে দুলতে চলেছে। পাল্কি-বেহারাদের মুখের সেই বোল এখনো যেন এত বছর পরেও কানে এসে বাজে—হি-তাল, হি-তাল, হিন-তাল, হিন্-তাল,—হি-তাল, হি-তাল, হিন্-তাল হিন্-তা–ল—ল…

 

পাল্কি এসে সদর দরজা দিয়েই ঢুকলে বটে। কিন্তু তারপর কোথা দিয়ে কোথায় চললো ঠিক ধরা গেল না। আস্তাবলবাড়ি, রান্নাবাড়ি, ভিস্তিখানা পেরিয়ে গিয়ে থামলো একেবারে বাড়ির দক্ষিণে। সে দিকটায় গিয়ে নজরে পড়ে থোপাদের কাপড় কাচবার জায়গা, বাগান, পুকুর। এদিকে কখনও আসেনি ভূতনাথ আগে।

বংশীর গলা কানে এল—এইবার পাল্কি নাবাও হলধরা। পাল্কি নামালে ওরা।

বংশী এসে দরজা ফাঁক করে মখমলের ঝালর-দেওয়া পর্দা সরিয়ে দিলে। মুখ বাড়িয়ে বললে—শালাবাবু এখানেই নামতে হবে আজ্ঞে।

দুর্বল শরীরটা ঠিক যুৎসই হয়নি এখনও। একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা ঘুরে যায়। বংশী ধরলো এক পাশে। তারপর বললে—আমার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে চলুন।

প্রথমটা সিঁড়ির মুখে অন্ধকার। ছোটো ছোটো সিঁড়ি ভালো ঠাহর পাওয়া যায় না। তারপর ভেতরে ঢুকে বেশ ফুটফুটে। চলতে চলতে একটা জায়গায় উঠে বংশী একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলে। ছোটখাটো ঘরটা। এককালে বুঝি সাজানো ছিল এ ঘর। এখনও পালঙ আছে একটা। দেয়ালে পঙ্খের কাজ করা। উড়ন্ত পরী, বেশ-বাস অবিন্যস্ত। কোথাও পাখী উড়ে যাচ্ছে, মুখে তার রঙিন চিঠি। আরো কত কী আঁকা। দেয়ালের বালি খসে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। তবু ছবিগুলো ঠিক রুচিশীল বলা যায় না। চারদিকে চেয়ে দেখে ভূতনাথের দৃষ্টিতে কেমন কৌতূহল ফুটে উঠলো।

বংশী বললে—ছোটমা এই ঘরটাতেই আপনার থাকবার ব্যবস্থা করছেন আজ্ঞে। কোনো অসুবিধে হবে না আপনার এখেনে।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু ব্ৰজরাখাল যদি খোঁজে তোমাদের মাস্টারবাবু?

বংশী বললে—মাস্টারবাবু? তিনি তো আর আসেন না এখানে।

—সে কি! ব্রজরাখাল কোথায় গেল?

—আজ্ঞে তা বলতে পারিনে। বহুদিন আসছেন না তিনি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এ-বাড়ির।

সে কি!

আকাশ থেকে পড়লো যেন ভূতনাথ। তার সঙ্গে এ-বাড়ির সম্পর্ক তো ব্ৰজরাখালকে কেন্দ্র করেই। ব্রজরাখালই যদি চলে গেল তা হলে এখানে থাকবে সে কোন্ অধিকারে। ওদিকে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসও যদি উঠে যায় তা হলে সে যে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়বে! কেমন যেন অসহায় বোধ করলো ভূতনাথ নিজেকে। আবার সেই গ্রামে ফতেপুরেই ফিরে যেতে হবে নাকি। খাবে কী সে সেখানে। থাকবেই বা কোথায়। এতদিনে সে বাড়ি কী অবস্থায় আছে কে জানে। পাশের বিপিন কলুদের তেঁতুল গাছের জঙ্গল বোধহয় আরো বেড়ে বেড়ে তাদের বাড়িটাও গ্রাস করে নিয়েছে। সেইখানে বাঘের আড্ডা হয়েছে হয় তো। হয় তো সাপ ক্ষোপের বাসা হয়েছে। রান্নাঘরটা তো ছিল বাঁশঝাড়ের লাগোয়া। বাঁশগুলো কে আর কাটছে! বাঁশগুলো সব হয় তো নুয়ে পড়েছে খড়ের চালের মাথায়। উই টিপিতে ঢেকে গিয়েছে দাওয়া। পিসীমা’র অত যত্নের রান্নাঘর। গোবর লেপে লেপে কী সুন্দরই বাহার করতে পিসীমা। তারপর গোবর লেপা হলে মাটির দাওয়ার ওপর ঘুটের আগুনে পোরের ভাত চাপিয়ে দিতো। কত বছর খায়নি পপারের ভাত। কাঁঠাল বিচি ভাতে, পোরের ভাত আর সরের ঘি!.. কিন্তু সে কথা থাক, ব্রজরাখাল তাকে ফেলে গেল কোথায়? কেনই বা গেল। বংশীকে জিজ্ঞেস করলে সে-ও বিশেষ কিছু বলতে পারে না।

ওই ঘরটার মধ্যেই কাটলো সমস্তটা দিন।

একবার ডাক্তারবাবু এসে দেখে গেল ভূতনাথকে। কোট ধুতি বুট জুতো পরা ডাক্তার। কী একটা ওষুধও বুঝি নিয়ে এল বংশী। বললে—খেয়ে ফেলুন দিকি ওষুধটা বেশি তেতো লাগলে এই ফলগুলো খাবেন—বেদানা, আঙুর, নাশপাতি কুঁচিয়ে কেটে এনেছে রেকাবিতে। বললে—আপনার জন্যে আজ্ঞে বকুনি খেতে হলো ছোটমা’র কাছে।

–কেন?

বংশী বললে—আমার হয়েছে জ্বালা শালাবাবু, চিন্তা কাজ করবে না তা-ও আমার দোষ, এই যে আপনি রুগী মানুষ বাড়িতে এসেছেন, ফলগুলো কুঁচিয়ে রাখতে পারে না ও, ভাড়ারে গিয়ে যদি রাঙাঠাকমাকে বলি তত শত হেনস্থা হবে আমার, ফিরিস্তি দাও কি হবে, কে খাবে, কেন খাবে, কী অসুখ, শালাবাবু তোর ছোটমা’র কে হয়। হ্যাঁ ত্যান, ছোটমা তাই চিন্তাকে দিয়েছিল ফল কুঁচোতে, অথচ ওর কাজ কী বলুন, আমার মতো কাজ করতে হতো তো বুঝতো। মেয়েমানুষের সোয়ামী থাকলে সেও কি বসিয়ে খাওয়াতে ওকে—না কি বলুন শালাবাবু—অন্যায্য কিছু বলেছেন ছোটমা।

ভূতনাথ ঢক ঢক করে ওষুধ খেয়েই মুখটা বিকৃত করে উঠলো। বললে-বড়ো তেতো ওষুধ বংশী।

—আজ্ঞে, খাঁটি ওষুধ তত তেতো হবেই, শশী ডাক্তারের সব খাটি ওষুধ কিনা, ছোটমা বলেছেন যত টাকা লাগে সব দেবো আমি, রোগ সারা চাই—সস্তা ওষুধ হলে চলবে না। তা ছোটমা’রও তো ক’দিন থেকে মেজাজ ভালো যাচ্ছে না কি না।

–কেন? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।

—ছোটমা যে নেকাপড়া জানা মেয়ে শালাবাবু, মেজমা’র মত নয় তো.যে দিন-রাত কেবল বাঘবন্দি খেলবে, কি বড়মা’র মতন নয় যে, দিনের মধ্যে চৌষট্টিবার চানই করছে কেবল, কেবল সাবান আর জল ঘটছে, ছোটমা হলো মনিষি যাকে বলে—কিন্তু পড়েছেন আজ্ঞে ছোটবাবুর মতন মানুষের হাতে, কপালের লেখন কে খণ্ডাবে বলুন। এই যে এতদিন পরে বাড়ি এলেন, মানুষটা পড়েছিলেন বাড়ির বাইরে সেই জানবাজারে নতুন-মা’র বাড়িতে, কেমন আছেন, ছোটমা’র দেখতেও তো ইচ্ছে হয়, কিন্তু না-ডেকে পাঠালে সে-হুশও নেই, শেষে ডেকে আনলুম ছোটমা’র ঘরে। ছোটবাবু তখন বেরোচ্ছেন, কাপড় কুঁচিয়ে দিয়েছি, জুতো পরিয়ে দিয়েছি, রুমাল দিয়েছি, আংটি দিয়েছি, টাকাকড়ি গুছিয়ে দিয়েছি, সব শেষে বললুম—ছোটমা একবার ডাকছিলেন আপনাকে ওপরে।

ছোটবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। বললেন—কেন?…আচ্ছা চল যাচ্ছি—যাবার মুখে এলেন ঘরে। আমিও এলুম পেছন পেছন। সব শুনলুম আড়ি পেতে। ছোটবাবু বললেন-ডেকেছিলে নাকি আমাকে? ছোটমা গলায় আঁচল দিয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম করলেন। বললেন—কেমন আছো?

ছোটবাবু জিজ্ঞেস করলেন—কিছু দরকার আছে কি?

—না, দরকার আর কি, এমনি একবার দেখতে ইচ্ছে হলো, অনেকদিন দেখিনি। আজ আমার হিতসাধিনী ব্রত।

ছোটবাবু হো হো করে হাসলৈন।—আবার তোমার সেই ন্যাকামি আরম্ভ হলো।

ছোটমা কিছু কথা বললেন না। ছোটবাবু রেগে গেলেন বুঝি। বললেন—সেই কান্না আর কান্না, কেন, হাসতে পারো না, হাসতে পারে না আর সব বউদের মতে, দেখো তত বড়বৌঠান, মেজবৌঠান সবাই কেমন হেসে খেলে আছে, হাসোগাও–যা খুশি করে—যা দু’চক্ষে দেখতে পারি না তা-ই হয়েছে।

—কিন্তু হাসি যে আমার আসে না।

—কেন আসে না? কী হয়েছে তোমার?

—কিন্তু তুমিই কি হাসো-এ-ঘরে তোমার হাসি তো দেখিনি কখনও? অথচ শুনতে পাই তুমি ভারী আমুদে লোক, আমি কী দোষ করলুম বলতে পারো?

—তার কৈফিয়ৎ তোমার কাছে দিতে হবে নাকি আমি, চললুম। এখন সময় নেই তোমার ন্যাকামি শোনবার বলে ছোটবাবু ফিরছিলেন।

ছোটমা সরে এসে তাড়াতাড়ি ছোটবাবুর চাদরের খুটটা ধরলেন। বললেন–না গেলেই নয়?

ছোটবাবুর ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বোধ হয়। ল্যাণ্ডোগাড়ি জোতা রয়েছে, একবার উঠলেই টগবগ করে ছুটতে আরম্ভ করকে ঘোড়া দুটো। ওদিকে নেশার সময় বয়ে যাচ্ছে, জানি তো সব, নতুন-মা গেলাশ সাজিয়ে বসে থাকবে কি না, আর ছোটবাবুও মেজাজী লোক, সব কাজ ঘড়ি ধরে, নেশা মাথায় চড়ে গেলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না আজ্ঞে। তা ছোটবাবু একবার শুধু ফিরে তাকালেন ছোটমা’র দিকে। ছোটমা আবার বললেন-না-ই বা গেলে আজ সেভেনে।

ছোটবাবু রেগেই ছিলেন। বললেন—না গিয়ে তোমার আঁচল। ধরে বসে থাকবে, কেমন?

ছোটমা কিছু কথা বললেন না। ছোটবাবু বলতে লাগলেন বড়বাড়ির পুরুষমানুষদের তুমি তেমনি অপদার্থ ভাবব নাকি?

—কিন্তু তুমি তো মানুষ—তোমারও তো মনুষ্যত্ব…

ছোটবাবু এ-কথার আর জবাব দিলেন না আজ্ঞে, শুধু যেতে যেতে হেসে বললেন—বউ-এর কাছ থেকে যে মনুষ্যত্ব শেখে তার গলায় দড়ি ছোটবউ!

বংশী গল্প বলতে পারে বেশ। ভূতনাথ একমনে শুনছিল। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ছোটবৌঠানের এতটুকু যদি উপকারে আসতে পারা যেতো। হঠাৎ ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে আচ্ছা বংশী তোর ছোটমা সিঁদুর পরে কপালে?

—আজ্ঞে পরেন বৈকি, এতখানি জ্বলজ্বলে টিপ রোজ পরেন।

—তোর ছোটমা’কে বারণ করে দিস ও-সিঁদুর পরতে।

–কেন আজ্ঞে?

—তুই বারণ করে দিস, ও-সব বুজরুকি—আগে জানলে…বলেই ভূতনাথ ‘সতর্ক হয়ে গেল। বংশীর সঙ্গে অত কথা বলবার দরকার কী! আগে যদি সে জানতো তা হলে অমন করে ঠকাতো না ছোটবৌঠানকে। মিছিমিছি গোটাকতক টাকা নষ্ট হলো। হঠাৎ যেন রাগ হলে সুবিনয়বাবুর ওপর। রাগ হলো জবার ওপর। ওরা সব পারে। যাদের জাত নেই, তারা আবার ভগবানের কথা মুখে আনে! সব মিথ্যে কথা ওদের। ও-বাড়ির চাকরিটা যদি চলেও যায়, কোনো দুঃখ থাকবে না তার। আর একটা নতুন চাকরি যোগাড় করে নিতে হবে। শরীরটা একটু ভালো হলেই ঘুরবে চাকরির চেষ্টায়। ওই যুবক সঙ্ঘে’র নিবারণকে বলে একটা যা হয় কিছু চাকরি নেবে। ওরা কলতাতার লোক। জানে শোনে সব। ব্রজরাখাল যদি ফিরে আসে তাকেও ধরতে হবে। এন্ট্রান্স পাশ করেছে সে, চাকরির জন্য এত ভাবনা! ডালহাউসি স্কোয়ারের ওদিকটায় জাহাজ কোম্পানীর সব আপিস হয়েছে কয়েকটা। ওখানে ঘোরাঘুরি করতে হবে। ঘোরাঘুরি না করলে কে এসে সেধে চাকরি তুলে দেবে তার হাতে। নতুন রেল-লাইন খুলছে পুরীর দিকে, সেখানেও একবার চেষ্টা করতে হবে। রেলের চাকরি ভালো। ঢুকেই পনেরো টাকা মাইনে।

 ১৯. বিকেলবেলার দিকে ভূতনাথ

বিকেলবেলার দিকে ভূতনাথ বিছানা ছেড়ে ওঠে। একলা একলা শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। মাসের পর মাস এই শুয়ে থাকা। আরো কত মাস শুয়ে থাকতে হবে কে জানে। প্রায় এক বছর হতে চললল তো। ঘরের বাইরেই একটা সরু চলাচলের পথ। লোক আসা যাওয়া করে না বড় একটা। দক্ষিণ দিকে গেলে রাস্তাটা সোজা নেমে গিয়েছে সিঁড়ি দিয়ে। তারপর বাগান, পুকুর, ধোপাদের বাড়ি, হীরু মেথরের ঘর। আর উত্তর বরাবর চলে গিয়েছে আর একটা পথ সোজা। সে পথটা গিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একটা দরজার সামনে। দরজাটা বন্ধই থাকে। খিল দেওয়া। ওর ও-পাশেই বুঝি বাড়ির বউদের কথাবার্তা শোনা যায়।

বোঝা যায় এ-জায়গাটা না-দোতলা, না-তেতলা, না-বারমহল, না-অন্দরমহল। কবে এ-বাড়ির খোদ মালিক অতীতে এইখানে এই চোরকুইরির মধ্যে তার কোন নৈশ-অভিযানের খোরাক এনে পুষে রেখে দিয়েছিলেন। রোজ রাত্রে বুঝি গোপনে সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলতো তার অভিসার। আজো ভাঙা দেয়ালের গায়ে তাঁর স্মৃতি তাই জড়িয়ে আছে বুঝি।

বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণিরা তখন ছোট তিন নাতি। নিমকমহলের বেনিয়ান হয়ে খোদ কর্তা ভূমিপতি চৌধুরী এখানে বাড়ি করেন। ইটালিয়ান সাহেব এসেছিল নতুন বাড়ির দেয়ালে-দেয়ালে ছবি আঁকতে। বর্ধমানের সুখচর মহকুমা থেকে তখন নতুন এসেছেন জমিদারবাবু। পাশের বস্তীতে কুলিরা থাকে— আর সারা দিন খাটে বাড়ির পেছনে। ইটালিয়ান সাহেব থাকে হেস্টিংস হাউসের কাছে খাড়ির ধারের বাগান বাড়িতে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে গিয়ে সাহেব দেখে—মেমসাহেব একলা নয়, সামনে বসে কাছে ঘেঁষে গল্প করছেন ভূমিপতি চৌধুরী।

সাহেবের মেজাজ গেল বিগড়ে। কয়েকদিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো সাহেবের। মেমসাহেব যেন একটু বেশি সাজে, গুন্ গুন করে গান গায়। একটু অন্যমনস্ক ভাব। আজ হাতে হাতে ধরা পড়ে গেল দুজনেই।

মেমসাহেব সাহেবকে দেখেই চমকে উঠেছে। ভূমিপতি চৌধুরীও কম চমকাননি। এমন দিনে সাধারণতঃ সাহেব বাড়ি ফেরে না। বাড়ি ফেরবার কথা নয় আজকে।

দুজনের ভাব লক্ষ্য করে সাহেব আর থাকতে পারলো না। কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে দুজনকে লক্ষ্য করেই গুলী ছুড়লো। ভূমিপতি বেঁচে গেলেন একটুর জন্যে, কিন্তু অব্যর্থ গুলী গিয়ে লাগলো মেমসাহেবের গায়ে। মেমসাহেব ঢলে পড়লো মাটিতে।

ভূমিপতি তখন সামলে নিয়েছেন নিজেকে। একমুহূর্তে উঠে খপ করে হাত ধরে ফেলেছেন সাহেবের।

ভয়ে সাহেবেরও বুঝি মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। বললে—লেট মি গো বাবুলেট মি গো-আমাকে ছেড়ে দাও।

কিন্তু ভূমিপতির বজ্রমুষ্টির চাপে বুঝি পালাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। ক্ষমা চেয়ে সাহেব তো ছাড়া পেল। কিন্তু পিস্তল কেড়ে নিলেন ভূমিপতি। বললেন—তুমি খুন করেছে তোমার বউকে, তোমাকে পুলিশে দেবো।

হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শিল্পী এসেছিল জীবিকার জন্যে জলামাটির দেশে। রাস্তায় মেমসাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়ে জাহাজেই তাদের নাকি বিয়ে হয়ে যায়। তারপর ভাগ্যের ফেরে আজ এই অবস্থা। সাহেব খানিক পরে বললে—ফরগিভ মি বাবু, আমি কাউকে কিছু বলবো না। আমায় শান্তিতে দেশে ফিরে যেতে দাও। আমি আর কখনও তোমাদের দেশে আসবে না।

ভূমিপতি বিশ্বাস করে ছেড়ে দিলেন সাহেবকে। সেই রাত্রেই সাহেব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আর দেখা যায়নি তাকে। যে লোক এসেছিল এদেশে ছবি আঁকতে, কী ছবি সে একে নিয়ে গেল নিজের চিত্তপটে কে জানে!

কিন্তু মেমসাহেব বুঝি সত্যি সত্যিই মরেনি। একটু জ্ঞান ছিল তখনও। সাহেবের বাড়ির চাকরবাকরদের টাকাপয়সা দিয়ে মুখবন্ধ করে ভূমিপতি সেই রাত্রেই নিজের পাল্কিতে করে তুলে নিয়ে এসেছিলেন মেমসাহেবকে। নিজের বাড়িতে একেবারে। এনে তুলেছিলেন এই চোরকুঠুরিতে। বাড়ির পুরোনো কবিরাজ এসেছিল। দেখে গেল। নাড়ি টিপে বললে—প্রাণ আছে এখনও—বাঁচবে এ রোগী।

সত্যি সত্যি মেমসাহেব বেঁচেও উঠলো একদিন। ঘা শুকিয়ে গেল হাতের। নতুন করে যেন নবজন্ম হলো মেমসাহেবের। নতুন ঘোড়ার গাড়ি কেনা হলো মেমসাহেবের জন্যে। মেমসাহেব ঘরের বৌ হয়ে গেল তারপর থেকে। পান খেতো, তামাক খেতে, শুক্ত, চচ্চড়ি, কুলের অম্বল খেতে। কিন্তু তবু বাড়ির মেয়েরা ছুতো না কেউ তাকে। বলতেও গরু খেয়েছে, ও মেলেচ্ছে–ওর জল চল্ নয় বাছা হিদুর বাড়িতে।

মেমসাহেব ওই ঘরে থাকতো আর এক আয়া ছিল তার কাজ করবার জন্যে।

সারা বাড়ির মধ্যে তাকে ছুঁতেন শুধু ভূমিপতি। বাড়ির মালিক। তা-ও রাত্রে। দেওয়ানি কাজের ঝঞ্চাট এড়িয়ে যখন রাত্রে চোখে তার লাল-নেশা ধরতো। ছেলে—একমাত্র ছেলে—সূর্যমণি চৌধুরী তখন রীতিমতো সাবালক হয়েছে। ওদিকে মেমসাহেবেরও ছেলে হয়েছে একটি। এমন সময় ভূমিপতি মারা গেলেন হঠাৎ। ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ হলো জবর। কিন্তু মেমসাহেব তারপর আর এ-বাড়িতে থাকতে চাইলে না। নিজের আর ছেলের আজীবনের ভরণপোষণের মতো নগদ টাকা নিয়ে চলে গেল স্বদেশে। ভূমিপতি তার উইলে সে-ব্যবস্থা করে যেতে ভোলেননি নাকি!

বড়বাড়ির চারপুরুষ আগের ইতিহাস এ-সব। বাড়ির চাকর থেকে আরম্ভ করে নায়েব গোমস্তা, বদরিকাবাবু সবাই এ-ইতিহাস জানে। তার চাক্ষুষ সাক্ষী আজকের এই চোরকুঠুরির লাগোয়া এই এক ফালি বারান্দা।

রোজ সকালে জানালাটা দিয়ে দেখা যায়—সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মাঝখানের সময়টা কেমন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় দিনের পর দিন। ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে সমস্ত মন। কেবল ওষুধ আর পথ্য। বিশ্রাম আর ঘুম। একঘেয়ে ক্লান্তিকর দিনগুলো যেন আর কাটতে চায় না ভূতনাথের!

কিন্তু ভূতনাথের সেদিন যে কী খেয়াল হলো। উত্তরদিকের দরজাটা খোলা যায় কিনা দেখতে ইচ্ছে হলো একবার! এই দরজা দিয়েই অন্দরমহল পেরিয়ে রাত্রে আসতেন বুঝি ভূমিপতি মেমসাহেবের ঘরে!

একটি দরজা শুধু। কিন্তু ভূতনাথ জানতে কি অন্দরমহলের এত ঘনিষ্ঠ এই একটি মাত্র দরজা তাকে ছোটবৌঠানের এত কাছাকাছি পৌঁছিয়ে দেবে।

কেন যে এ-ঘরে তার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল কে জানে! হয় তো এ-ঘরটা একটু নিরিবিলি বলে। চাকর-দারোয়ান-গাড়িঘোড়া, রান্নাবাড়ি, সমস্ত গোলমাল হট্টগোল থেকে দূরে থাকলে রোগীর পক্ষে সেটা ভালোই। কিন্তু দরজাটা খুলতে গিয়ে যেন রোমাঞ্চ হলো সারা শরীরে। এ যেন নিষিদ্ধ দরজা। তার এলাকার বাইরে সে যাচ্ছে। অধিকার-বোধের চৌকাঠ পেরিয়ে তার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করছে।

ওপার থেকে যেন সিন্ধুর গলা শোনা গেল–ও লো ও গিরিওখান থেকে সরে যা তো।

গিরি বললে-থাম বাছা, সবুর কর একটু-হাতের কাজটা গুছিয়ে নি।

সিন্ধুও ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে—তোর হাতের কাজটাই বড় হলে লা, ওদিকে বড়মা সাজাঘরে যাবে, তোর জন্যে বসে থাকবে নাকি। সর শীগগির, চোখের আড়াল হ’।

মেজবউ-এর গলা কানে আসে। খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলে-ও গিরি তোর সুপুরি কাটা রাখ বাপু–শুনছিস বড়দি সাজাঘরে যাবে।

গিরি গজ গজ করতে করতে বলে—আমি তো আর পুরুষ। মানুষ নই মা যে আমাকে না। সাতজন্মে যেন ছুচিবাই না হয় মানষের—-ছিঃ।

ভেতর থেকে হুড়কো সরাতেই দরজাটা একটু ফাঁক হলো। ভূতনাথ স্পষ্ট দেখতে পেলে সব। বিকেলের ছায়া-ছায়া আলো চারদিকে। একেবারে মাথার ওপরেই অন্দরমহলের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সে।

সিন্ধু চিৎকার করে উঠলো—তোর কাপড়টা সরিয়ে নিলিনে গিরি, বড়মা’র ছোঁয়া লেগে যাবে যে, ছুঁয়ে শেষে কি নোংরা হবে নাকি মানুষ।

—হলো, এই নিলাম সরিয়ে—হলো? বলে গিরি দড়ির ওপর থেকে কাপড়খানা সরিয়ে নিলে।

আর চোখের সামনে…আর ভূতনাথের চোখের সামনে এক কাণ্ড ঘটে গেল সেই মুহূর্তে!

বোধহয় এ-বাড়ির বড়বউ। বিধবা বড়বউ। সম্পূর্ণ নিরাবরণ নিরাভরণ অবস্থা। ত্বরিত গতিতে নিজের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকলেন গিয়ে সাজঘরে। পেছন পেছন চললো সিন্ধু গামছা সাবান নিয়ে।

কাণ্ডটা ঘটলো এক নিমেষের মধ্যে। কিন্তু সমস্তটা দেখবার আগেই ভূতনাথ নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে! ছি-ছি! ছি!!

 » ২০. সেদিন ছোটবৌঠান ডেকে পাঠালেন

সেদিন ছোটবৌঠান ডেকে পাঠালেন।

বংশী বললে—অত ঘুরে যাবার দরকার কী শালাবাবু—এই তো সামনেই দরজা।

কী জানি কেমন যেন সঙ্কোচ হলো ভূতনাথের। সেদিন দরজার ফাঁক দিয়ে অন্দরমহলের যে নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখেছে তারপর ওটা খুলতে আর সাহস হয়নি তার। এ ক’দিন একটু একটু বাগানে গিয়ে বেড়িয়েছে। পুকুরের পাড়ে গিয়ে হাওয়া খেয়েছে।

ছুটুকবাবু দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল—কী খবর ভূতনাথবাবু, দেখাই পাওয়া যায় না যে আপনার। সেদিন ওস্তাদ ছোট্ট, খ এসেছিল, আহা, পুরিয়ার খেয়াল যা শোনালে ভাই-কানা বাদল খাঁ’র পরে অমন পুরিয়া আর শুনিনি মাইরি।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আজকে আসর বসবে নাকি?

—আর আসর—আসরই বোধহয় ভেঙে দিতে হবে। এখন যাত্রা-থিয়েটারের গানেরই আদর বেশি দেখছি—ওস্তাদী গানের আর কদর কই—তেমন ওস্তাদও আর জন্মাচ্ছে না—তা আসুন আজকে আপনি।

-কখন?

–সন্ধ্যেবেলা।

 

বাড়ির চারদিকে রাজমিস্ত্রী খাটছে। ছুটুকবাবুর বিয়ের জন্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে।

সেই লোচন আবার দেখতে পেয়ে ডাকলে একদিন।—আসুন শালাবাবু।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—এ-সব কী হচ্ছে লোচন?

এ-ঘরেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ঘর বোয়া মোছ। চলছে। হুঁকো নল ফরসি সব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছে লোচন। বললে—ছুটুকবাবুর বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে হুজুর। নতুন ফরসি এসেছে সব, নতুন তামাক এসেছে গয়া থেকে, খেয়ে দেখবেন নাকি?

ভূতনাথ বললে—না, এখনও খাইনে।

—বড় ভালো জিনিষ ছিল আজ্ঞে, ন’ সিকে ভরির জিনিষ, এখানে বসে খেলে এ-বৌবাজার অঞ্চলটা একেবারে খোশবায় হয়ে যাবে, মেজবাবু ফরমাশ দিয়ে আনিয়েছে হুজুর, ছোটবাবুর বিয়ের সময় একবার এসেছিল। খাস নবাবী মাল কিনা তা আধলা না-হয় নাই দিলেন, কে আর জানতে পারছে।

আতরের শিশি নিয়ে ঢেলে তামাক মাখতে বসলে লোচন।

তাড়াতাড়ি লোচনকে এড়িয়ে ভিস্তিখানায় জল নিয়ে স্নান সেরে নিলে ভূতনাথ। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে ভাবলে, একবার ব্রজরাখালের ঘরটায় গিয়ে দেখলে হয়। কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। কেমন ধারা লোক ব্ৰজরাখাল! একটা খবর পর্যন্ত দিলে না। কোথায় গেল! কেমন আছে সেখানে। কিন্তু ব্ৰজরাখালের ঘর তেমনি তালাবন্ধই পড়ে আছে।

পাশের ঘরে ব্রিজ সিং আটা মাখছিল। বললে-মাস্টার সাব তো নেহি হ্যায় শালাবাবু।

—কোথায় গিয়েছেন জানো ব্রিজ সিৎ?

—কেয়া মালুম বাবু, রোজ রোজ হামেশা দশ বিশঠো আদমি এসে পুছে—লেকিন মাস্টার সাব তো পাত্তা ভেজলো না।

দুপুরবেলাটাও কাটতে চায় না তার। সেই কর্কশ এক-একটা চিলের ডাক বাতাসে ভেসে আসে। এখানে বসে ফতেপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ‘কুয়োর ঘটি তোলা— আ—আ’ শব্দ করতে করতে যায়। কখনও যায় মুশকিল আসান। তখন অন্দরে বেশ গুলজার চলে। দরজাটার কাছে গিয়ে কান পাতলে বিচিত্র কথা শোনা যায়।

মেজবৌ প্রশ্ন করো বড়দি,, সিন্ধু যে তোমায় খাইয়ে দিচ্ছে বড়!

সত্যি সত্যি বড়বৌ-এর ঝি সিন্ধুই ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আজ।

—ওমা একি! গিরিও এসে পাশে দাঁড়িয়ে গালে হাত দেয়।

শুচিবায়ুগ্রস্ত বড়বৌ-এর বিচিত্র কাণ্ড দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে।

সিন্ধু বলে—বড়মা’র দুটো হাতই অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে আজ।

মেজবৌ হাসতে হাসতে বলে—এরকম অশুদ্ধ হলে কী করে বড়দি?

বড়বৌ হাসেন না। বলেন—কাপড় শুকোবার দড়িতে হাত দিয়েছিলুম মরতে আর ওমনি পোড়ারমুখো একটা কাক কোত্থেকে এসে বসলো দড়িতে।

হাসি চাপতে পারে না গিরি।

মেজবৌ আবার জিজ্ঞেস করে-তা এমন অশুদ্ধ, ক’দ্দিন চলবে তোমার?

বড়বৌ বুঝি রাগ করেন। বলেন—হাসিস নে মেজবৌ, হাসতে নেই-হাসলে তোরও হবে।

মেজবৌ বলে—রক্ষে করো মা, আমার হয়ে কাজ নেই, সাত জন্মে অমন রোগ আমার যেন না হয়। আমার ভাতার আছে, আমার কেন হতে যাবে।

বড়বৌ মেজবৌকে কিছু বলেন না। বলেন সিন্ধুকে—শুনলি লো সিন্ধু, তবু যদি ওর ভাতার ঘরে শুতে।

মেজবৌ কিন্তু রাগে না কথা শুনে। খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসির দমকে হাতের চুড়ি গায়ের গয়না টুংটাং করে বেজে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে—আর ভাসুর ঠাকুর কা’র ঘরে শুতে বলবো বড়দি—বলে দেবো?

কথা শুনতে শুনতে ভূতনাথের একবার কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে। এত বড় বাড়ির বউ সব—এরা কী ভাষায় কথা বলে!

বড়বৌ একবার চিৎকার করে ডাকেন—ছোটও ছোট–ও ছোটবউ—ছুটি—

চিন্তা খর খর করে এগিয়ে আসে—ছোটমাকে ডাকছো নাকি বড়মা?

—ডাকতো একবার ছোটমাকে তোর—এসে কাণ্ড দেখে যাক।

—কী হলো বড়দি?

ছোটবৌঠান বুঝি এতক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বলে–আবার বুঝি তুমি বড়দিকে কিছু বলেছে মেজদি।

—দেখো না ভাই—সারা দিনমান উনি ন্যাংটো হয়ে ঘোরাঘুরি করবেন, কিছু বললেই দোষ, আমরাও গা খুলে বেড়াই, কিন্তু পরনের কাপড়টা পর্যন্ত…

—ওর না হয় রোগ হয়েছে মেজদি, কিন্তু তোমাকেও তো দেখেছি, তুমিই বা কম যাও কিসে?

তুই আর বলিসনি ছোট, তোর আবার বড় বাড়াবাড়ি, কে আছে শুনি দশটা চোখ মেলে? অত জামা কাপড়ের বাহার কেন শুনি, ঘরের মানুষেরা তো ফিরেও চায় না!

ছোটবৌঠান কী জবাব দেবে বুঝি ভেবে পেলে না। তারপর বললে—তুমি কি সত্যিই চাও মেজদি যে, ঘরের মানুষ ঘরে থাকুক।

—তুই আর কথা বাড়াসনে ছোট, বড়ঘরের পুরুষমানুষেরা কবে আর ঘরে কাটিয়েছে শুনি, আমার বাপের বাড়িতেও দেখেছি, এ-বাড়িতেও দেখছি। তোর বাপের বাড়ির কথা অবিশ্যি আলাদা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। নাপতিনী আসে আলতা পরাতে। মেজবৌ আলতা পরে, নখ চাঁছে, পায়ে ঝামা ঘষে। গল্প করে ইনিয়ে বিনিয়ে। সাদা-সাদা পা বাড়িয়ে দিয়ে মেজবৌ গল্প করে— হ্যাঁ রে রঙ্গ, কাল রাত্তিরে তোদের পাড়ায় শাঁখ বাজছিল কেন রে?

নাপিতবৌ বলে—ধোপাবৌ-এর ছেলে হয়েছে যে মেজমা শোননি?

—ওমা, এই সেদিন যে মেয়ে হলো রে একটা–বছর বিয়ুনি নাকি? খুব ভাগ্যি ভালো তো ধোপাবৌ-এর।

হঠাৎ তেতলার সিঁড়ি দিয়ে বংশী উঠে আসে। বলে— ছোটবাবু আসছে মা।

নাপতিনী সন্ত্রস্ত হয়ে এক মাথা ঘোমটা টেনে দেয়। মেজবৌ গায়ের কাপড়টা টেনে দেয়। গিরি লম্বা করে ঘোমটা টেনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো।

মেজবৌ বলে—ওমা, ছোট দেওর যে…কী ভাগ্যি?

ছোটবাবু তর তর করে উঠে আসে তেতলায়। বাতাসে একটা মৃদু গন্ধ। চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায় এক মুহূর্তে।

প্রতিদিন এই দৃশ্যেরই রকম-ফের অন্দরের বউ-মহলে। ভূতনাথের মনে হলো এত বড় বাড়ির বৌ সব—এরাও তত আর পাঁচ বাড়ির বৌদের মতনই সাধারণ। অতি সাধারণ। শুধু দূর থেকেই বুঝি একটা রহস্যের আবরণ থাকে। অন্দরমহলের ভেতরে যখন এই দৃশ্য, বাইরের মহলেও ওমনি সাধারণ ঘটনাই ঘটে সব।

বংশী সেদিন শশব্যস্ত হয়ে ডাকতে এসেছিল।—আসুন শালাবাবু, মজা দেখবেন আসুন, গন্ধবাবা এসেছে।

—গন্ধবাবা?

-আজ্ঞে হ্যাঁ, বারবাড়িতে লোক আর ধরছে না, গন্ধবাবা এসেছে, যে-যা গন্ধ চাইছে তাই-ই দিচ্ছে।

ভূতনাথও ছুটলো। গাড়িবারান্দার নিচে পৈঁঠের ওপর বসে আছে এক সাধু। মাথায় জটা। কপালে সিঁদুরের প্রলেপ। বিকটাকার মূর্তি। চার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে চাকর-বাকর লোকলস্কর সবাই। দাসু জমাদারের ছেলেমেয়েরাও এসে দূরে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ইব্রাহিমের ছাদের ওপরেও লোক।

অনেক কষ্টে বংশী ভূতনাথকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকলো ঠেলে ফুলে।

লম্বা চওড়া চেহারা লোকটার। বলছে—বেহেস্ত কা হুরী আউর জাহান্নম্ কা কুত্তি ইয়ে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়–হামারা ইয়ে পাথ দেওতা মহাদেওতানে আপনা হাতসে দিয়া হুয়া হ্যায়— ই পাঙ্খ দেখো-গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মোকমামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা-মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ দেনেওয়ালাই পাথ দেখো—দেওতাকে জরিমানা পাঁচ পাঁচ আনা।

মধুসূদন ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে গন্ধবাবা, আমাকে পদ্মফুলের গন্ধ করে দাও দিকি হাতে-দেখি একবার।

গন্ধবাবা পাথরটা দিয়ে মধুসূদনের হাতের তেলোয় ঘষে দিলে।

মধুসূদন হাতের তেলোটা শুঁকে দেখে। সত্যিই তো! খাঁটি পদ্ম ফুলের গন্ধ।

—দেখি মধুসূদন কাকা, দেখি শুঁকে।

—দেখি, আমি শুঁকে দেখি।

সবাই শুঁকে পরীক্ষা করে দেখে ভুল নেই। কোনো ভুল নেই। পদ্মফুলই বা কোত্থেকে এল।

—গন্ধবাবা, আমার হাতে কোরোসিন তেলের গন্ধ করে দাও তো দেখি?

গন্ধবাবা পাথরটা তার হাতে ঘষে দিলে আবার। যে-হাতে পদ্মফুলের গন্ধ ছিল সেই হাতেই এখন কেরোসিন তেলের কড়া গন্ধ।

দেখি, শুঁকে দেখি—ওমা, কেরোসিনের গন্ধই তো বটেক— সবাই ঝুঁকে পড়ে। গন্ধবাবা আবার বক্তৃতা দেয়—বেহেস্ত কা হুরী আউর জাহান্নম্ কা কুত্তি ইসসে সব কুছ ঘায়েল হোতি হ্যায়— হামারা, ইয়ে পাথ দেওতা মহাদেওতানে আপনা হাতসে দিয়া হুয়া হ্যায়ই পাঙ্খল দেখো—গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মকমামে সিদ্দি দেনেওয়ালা, মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ দেনেওয়াল—দেওতাকো জরিমানা পাঁচ পাঁচ আনা…

পাঁচ আনার পূজো দিতে হবে। মাত্র পাঁচ আনাতেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে। এমন সুযোগ বোধহয় কেউ ছাড়তে চাইলে না। বংশী চুপি চুপি বললে—শালাবাবু, ভাইটার চাকরির জন্যে পাঁচ আনা জরিমানা দেবো নাকি?

মধুসূদনেরও বুঝি কিছু মনস্কামনা ছিল। দেশের একটা ধানজমির ওপর বহুদিনের লোভ ওর। নিজের জমির লাগোয়া। দরে পোষাচ্ছিলো না। সে-ও পাঁচ আনা দিলে জরিমানা। হুড় হুড় করে আরো পয়সা পড়তে লাগলো।

গন্ধবাবা তখনও বক্তৃতা দিয়ে চলেছে—সব ইয়ে পাথকা খেল, মহাদেও মহদেওকী খে, ইয়ে পাথ…দুনিয়ামে যো কুছ মানা হ্যায় তো মাঙ লেও, ইয়ে পাথকে দৌলতমে সব কুছ মিলনেওয়াল হ্যায়, বেহেস্তকা হুরী আউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়, হামারা ইয়ে পাথ—গরীবোকো রূপিয়া দেনেওয়ালা, মকদমামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা মাঙনেওয়ালোকো সব কুছ মিলনেওয়ালা দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট টাকার খুচরো পয়সা জমে উঠলো গন্ধবাবার সামনে।

হঠাৎ ভূতনাথেরও মনে হলো যেন তারও কিছু মনস্কামনা আছে। নিজের চাকরি নয়। সংসারে কারোর কিছু নয়। কিন্তু অন্তত ছোটবৌঠানের জন্যে যেন পাঁচ আনা জরিমানা দিলে হয়। যেন সুখী হয় ছোটবৌঠান। যেন স্বামীসেবা করতে পারে ছোটবৌঠান। যেন মনস্কামনা সিদ্ধি হয় ছোটবৌঠানের। যেন ‘মোহিনী-সি দুরে’ যে-কাজ হয়নি তা সফল হয়।

গন্ধবাবা জিজ্ঞেস করলে তুলসীপাতা হ্যায় ইধার?

—আছে বাবা, আছে, তুলসীপাতা আছে।

গন্ধবাবা সবার হাতে গাঁজার কল্কে থেকে নিয়ে একটু করে পোড় তামাক দিলে। সেই পোড়া তামাক হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে তুলসীগাছকে প্রণাম করে এসে আবার হাতের মুঠো খুলতে হবে।

বংশী, মধুসূদন, লোচন, বেণী, দাসু জমাদার, ইব্রাহিম কোচোয়ান, ইয়াসিন সহিস, ব্রিজ সিং সবাই মনস্কামনা নিয়ে মহাদেবকে পাঁচ আনা জরিমানা দিয়েছে। সবাই হুকুম মতো কাজ করলো।

গন্ধবাবা এবার সকলের মুঠোর ওপর তার স্ফটিক পাথরটা ছুঁইয়ে দিলে। মনে মনে কোনো মন্ত্র পড়লে কিনা কে জানে। তারপর বললে—আভি মুঠি খোলল।

বংশী ভূতনাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বংশীও মুঠো খুললো।

ভূতনাথ দেখলে তার মুঠোর মধ্যে পোড় তামাকের বদলে একটা নীল কাগজ। নীল কাগজের ওপর একটা ত্রিভুজ আঁকা। সেই ত্রিভুজের ভেতর আরেকটা ত্রিভুজ।

সকলের হাতের মুঠোর মধ্যে ওই একই ব্যাপার।

গন্ধবাবা বললে—মাদুলী করে ওটা গলায় পরতে হবে। একমাস পরে গন্ধবাবা আবার আসবে এ-বাড়িতে, তখন যদি না মনস্কামনা পূর্ণ হয় তত সকলের পয়সা ফেরৎ দিয়ে যাবে।

বংশী বললে—শালাবাবু, আপনিও একটা জরিমানা দিন না আজ্ঞে।

ভূতনাথও সেই কথা ভাবছিল।

গন্ধবাবা তখন টাকাপয়সাগুলো কুড়োচ্ছে আর মুখে বক্তৃতা বেহেস্ত, কা হুরী, আউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হোতি হ্যায়–ই পাখ-মহাদেওনে দিয়া হুয়া হ্যায়—গরীবোকো রূপে দেনেওয়ালা, মকদ্মামে সিদ্ধি দেনেওয়ালা মাঙনে

ওয়ালোকো সব কুছ…

হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটে গেল।

বদরিকাবাবু বুঝি গোলমাল শুনে বেরিয়ে এসেছেন। বললেনকী হচ্ছে রে? এত গোলমাল কীসের?

মস্ত বড় ভুঁড়ি। গায়ে তুলোর জামা। বরাবর বৈঠকখানা ঘরে শুয়েই থাকেন। বড় একটা লোকচক্ষুর সামনে বেরোন না। এই আজকের অস্বাভাবিক গোলমালে আকৃষ্ট হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন প্রথম।

—কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া? গন্ধবাবার সামনে এসে বললেন–কেয়া হুয়া? কোন্ হ্যায় তুম্?

বংশী বললে—উনি গন্ধবাবা।

আরো অনেকে বললে—যা গন্ধ চান, উনি করে দেবেন আজ্ঞে।

সব শুনলেন বদরিকাবাবু। বললেন—দাও দিকি আমার হাতে গন্ধ করে—ফুলের গন্ধ করে দাও–নিমফুলের গন্ধ।

নিমফুল! তাই সই।

গন্ধবাবা স্ফটিক পাথরটি একবার হাতে ঘষে দিলে বদরিকাবাবুর। তারপর আওড়াতে লাগলো-বেহেস্তকা হুরী ওউর জাহান্নমকা কুত্তি ইসে সব ঘায়েল হেতি হ্যায়…কেয়া বাবুজি মিলা?

বদরিকাবাবু বার-বার নিজের হাতটা শুকতে লাগলেন। যেন অবাক হয়েছেন একটু। বললেন—কী করে করলে বলো দেখি বাপধন?

—ইয়ে পাথষ্কা খেল হ্যায় বাবুজি, মহাদেওতানে দিয়া হুয়া হ্যায়।

—দেখি বাবা তোমার পাথরখানা—ছোট স্ফটিকখানা নিয়ে বার বার দেখতে লাগলেন বদবিকাবাবু। সামান্য এক টুকরো পাথরের কারসাজি! অবিশ্বাসের বিদ্রূপ ফুটে উঠলে ভাব-ভঙ্গীতে। ছোট ছেলে যেমন রসগোল্লা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে! মুর্শিদকুলী খা’র কানুনগো দর্পনারায়ণের শেষ বংশধরও সহজে বিচলিত হবার লোক নন। কত রাজা মহরাজাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তুড়ি দিয়ে। ইতিহাসের বিলুপ্তপ্রায় অধ্যায়ের এক টুকরো ফসিল যেন হাতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বসেছেন। বললেন—কী হয় এতে বাপধন?

গন্ধবাবা বললে—সব কুছ হো স্যাক্তা হ্যায় বাবুজি—মহাদেওকা কিরপা মে…

–অমর হওয়া যাবে?

—জী হাঁ, অমর ভি হোস্যাক্তা হ্যায়।

—তবে অমরই হয়ে যাই—বলে বলা-নেই, কওয়া-নেই বদরিকাবাবু পাথরটা নিয়ে টপ করে মুখে পুরে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে গন্ধবাবা চিৎকার করে উঠলো—সত্যনাশ হো গয়া, সত্যনাশ হো গয়া…

—আরে রাখ তোর সর্বনাশ, সর্বনাশের মাথায় বলে বদরিকাবাবু যেন কেমন নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু যেন কিছু অস্বস্তি বোধ করছেন। বললেন—লোচন এক গ্লাশ জল দে তো।

গন্ধবাবা বলেন—বাবুজী ম যাইয়ে গা।

কিছুক্ষণ পরেই মনে হলো যেন বদরিকাবাবুর দম আটকে আসছে। আইঢাই করতে লাগলো সারা শরীর। চোখ দুটো উল্টে এলো। গেলাশ গেলাশ জল খেলেন। মস্ত বড় ভুঁড়ি আরো ফুলে উঠলে দেখতে দেখতে। সাক্ষাৎ মহাদেবের দেওয়া স্ফটিক যে!

গন্ধবাবা চলে গেল এক ফাঁকে। যাবার সময় বলে গেল বাবুজী মহাবীর হ্যায়—লেকিন্ হরগীজ মর যায়গা।

মধুসূদন ভয় পেয়ে গেল—কী সর্বনেশে কাণ্ড!

লোচনও ভয়ে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কী জানি কী কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। বদরিকাবাবু যদি মারাই যায়, সাক্ষীসাবুদ, পুলিশআদালত নানান হ্যাঙ্গাম পোয়াও। মেজবাবু যদি টের পায়, কানে যদি যায় কোনোরকমে। মেজবাবুর যা মেজাজ, জরিমানা হবে সকলের।

বদরিকাবাবু গাড়িবারান্দার তলায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে হাঁসাস করছেন।

বংশী বললে—চলে আসুন শালাবাবু ওখান থেকে—কাজ কী এসব হ্যাঙ্গামে।

হ্যাঙ্গাম দেখে সত্যিই তখন সবাই সরে পড়েছে একে একে। ভূতনাথ চেয়ে দেখলে জায়গটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

বংশী আবার কামিজটা ধরে টানলে চলে আসুন শালাবাবু, কাজ কি ছেড়া ঝঞ্চাটে—আমার আবার ওদিকে কাজ পড়ে রয়েছে।

ভূতনাথবাবু বললে—তুই বরং যা বংশী, ছোটবাবু জানতে পারলে আবার।

—তাই যাই—বলে বংশীও চলে গেল।

ভূতনাথ নিচু হয়ে বদরিকাবাবুর মাথায় হাত দিলে। মুর্শিদকুলী খাঁ’র কানুনগোর শেষ বংশধর। এখানে এই বেঘরেই বুঝি গেলএবার।

হঠাৎ যেন অস্পষ্ট শব্দ বেরোলো। বদরিকাবাবু কথা বলছেন— বেটা গিয়েছে নাকি হে ছোকরা?

ভূতনাথও কম অবাক হয়নি। বললে—কেমন আছেন?

চোখ মিট মিট করতে করতে বদরিকাবাবু বললেন—বেটা গিয়েছে নাকি হে ছোকরা?

—চলে গিয়েছে—কিন্তু আপনি কেমন আছেন?

বদরিকাবাবু এবার উঠে বসলেন। নিজের জামা-কাপড় সামলাতে সামলাতে বললেন—আমার হয়েছে কি যে কেমন থাকবে—বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নিজের বৈঠকখানার দিকে চলতে লাগলেন।

ভূতনাথও সঙ্গে সঙ্গে গেল। বদরিকাবাবু ঘরে ঢুকে শেতলপাটি বিছানো তক্তপোশের ওপর আবার চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে একবার টক ঘড়িটা বার করে সময় দেখে নিলেন।

ভূতনাথের যেন ভারি অবাক লাগছিল সমস্ত ঘটনাটা ভেবে। বললে—আপনি শুধু শুধু কেন খেতে গেলেন পাথরটা—সাধুসন্ন্যাসীদের পাথর।

—খেতে যাবো কেন,-“খাইনি তো-বদরিকাবাবু বিস্মিতের মতো চাইলেন। আমার আর কাজ-কম্ম নেই, আমি ওই পাথর গিলতে যাবো। বলে কি ছোকরা, ‘এই দেখো-বলে আর এক টাক থেকে স্ফটিক পাথরটা বার করলেন—এই দেখো।

—তাজ্জব ব্যাপারই বটে।

–নবাবের আমলের পুরোনো বংশ আমাদের হে, আমি সেই বংশের শেষ বংশধর বটে, তা আমি গলায় পাথর আটকে মরতে যাবো কেন শুনি? এতদিন ধরে ঘড়ি ধরে বসে আছি অপঘাতে মরবো বলে? সব দেখতে হবে না! ইতিহাস কি মিথ্যে হবে নাকি? সব লাল হয়ে যাবে না। রণজিৎ সিং তো মিথ্যে বলবার লোক নয়, নাজির আহমদ রইল না, রইল না রেজা খাঁ, বলে মধুমতীর তীরের সীতারাম আর ফৌজদার আবুতোরাব—তারাই রইল না! কোথায় গেল পীর খাঁ, কোথায় গেল তোর বক্স আলী-এক পুরুষের পর আর এক পুরুষ উঠেছে আবার নামছে—চৌধুরীরাও নামবে—এই বড়বাড়িও ভাঙবে একদিন, রাজসাপ যখন কামড়েছে, একেবারে ভিটেমাটি উচ্ছন্ন করবে না! এখনও যে দর্পনারায়ণের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি রে।

কী কথায় কী কথা উঠে গেল।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু গন্ধবাবা কি দোষ করলো?

-আরে, এটা যে গন্ধবাবার যুগ রে, গন্ধবাবারাই তো আজ রাজা হয়ে বসেছে—ওদের তাড়াতে হবে না? এই আমাদের মেজবাবু, ছোটবাবু, তোর এই ‘মোহিনী-সিঁদুর’ সব যে গন্ধবাবার দল।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না ভূতনাথ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল হঠাৎ। ও-কথার তো আর শেষ নেই। সব কথার মানেও বোঝা যায় না বদরিকাবাবুর। সেদিন সুবিনয়বাবুও বললেন, ‘মোহিনী-সিঁদুর’ বুজরুকি। এই এত ঐশ্বর্য, গাড়ি, বাড়ি, লোকজন, চাকর-বাকর সব উচ্ছন্নে যাবে! কী অদ্ভুত যুক্তি, কী অদ্ভুত হেঁয়ালী!

সন্ধ্যেবেলা ছুটুকবাবুর ঘরে গিয়ে ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে আজ এখনও কেউ আসেনি?

ছুটুকবাবু আসর সাজিয়ে বসেছিলো। বললে—এই আপনার কথাই ভাবছিলাম, কোথায় ছিলেন এ্যাদ্দিন, ননীলাল খুঁজছিল?

-ননীলাল? গঞ্জের ডাক্তারবাবুর ছেলে সেই ননীলাল? নামটার সঙ্গে যেন অনেক রোমাঞ্চ, অনেক স্মৃতি জড়ানো আছে। অনেক সমারোহ, অনেক সৌরভ। ননীলালের নামটা মনে পড়লেই যেন সমস্ত ছেলে-বেলাটা আবার সজীব হয়ে ওঠে। তার সেই চিঠি। সেই চিঠিটা আজো সযত্নে টিনের বাক্সের মধ্যে যে রেখে দিয়েছে সে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমার খোঁজ করছিল কেন?

—ওর বিয়ে হলো কি না? আপনাকে নেমন্তন্ন করতে চেয়েছিল।

—বিয়ে? হয়ে গিয়েছে?

ছুটুকবাবু বললে–হ্যাঁ, হয়ে গেল বিয়েটা। ননীটা যা হোক খুব দাও মেরেছে বিয়েতে। তিনখানা বাড়ি-সাত লক্ষ টাকা।

সেকি? ভূতনাথও কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। এই সেদিন যে সে টাকা ধার করতে এসেছিল ছুটুকবাবুর কাছে। এরই মধ্যে এত টাকার মালিক হয়ে গেল সে!

ছুটুকবাবু আবার বললে—এ যাত্রায় খুব বেঁচে গেল ননীটা, বরাবর জানতুম ও একটা সোজা ছেলে নয়। আমাদের টাকায় বরাবর বাবুয়ানি করে আমাদের ওপরই টেক্কা মেরেছে—তা বাহাদুরি আছে ননীর, কোত্থেকে কার সঙ্গে ভাব জমিয়ে শেষ পর্যন্ত কী যে করে বসলো—

—কী করে কী হলো ছুটুকবাবু?

ননীলাল অবশ্য তার কল্পনায় চিরকালই উচু ছিল। ছোটবেলা থেকে ননীই ছিল ভূতনাথের আদর্শ। অমন চমৎকার সুন্দর চেহারা। রূপবানই বলা যায়। কিন্তু মাঝখানে যেদিন দেখা হয় ওর সঙ্গে, সেইদিনই কেমন আঘাত পেয়েছিল ভূতনাথ মনে মনে। তার সেই আগেকার চেহারা যেন আর নেই। সেই লাবণ্য মুছে গিয়েছে মুখ থেকে। তার সেই ঘন ঘন সিগারেট খাওয়া। সেই কোঠরগত চোখ। আর সেই অশ্লীল প্রসঙ্গ আলোচনা। যে-মানুষ এত নিচে নামতে পারে, চরিত্রহীনতার একেবারে শেষ ধাপে, সে কেমন করে জীবনে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে! কেমন করে সে সাত লক্ষ টাকার মালিক হবে—তিনখানা বাড়ির স্বত্ত্বাধিকারী হবে।

ছুটুকবাবু বলতে লাগলো–হেন রোগ নেই, যা ওর হয়নি ভূতনাথবাবু, আমরা কত বারণ করেছি এ-পথে আর যাসনি—কিন্তু ননী বলতো’ও-সব তোদের কুসংস্কার,—এটা আর কুলমর্যাদার যুগ নয় রে—এটা টাকার যুগ’ বলতো’টাকা স্বর্গ, টাকা ধর্ম, টাকা বংশ, টাকা গোত্র—টাকাই জপ-তপ-ধ্যান—সবার চাইতে বড় কুলীন টাকা, শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ টাকা’ বলতাম—তোর স্বাস্থ্য গেলে টাকা কে খাবে?

ননী বলতো—টাকা না থাকলে এ স্বাস্থ্য নিয়ে কী হবে? কখনও বলতো—এ যুগের খৃস্ট, বুদ্ধ আর চৈতন্যদেব কে জানিস? আমরা প্রশ্ন শুনে হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম–খৃস্ট, বুদ্ধ আর চৈতন্যদেব—ওরা আবার যুগে যুগে বদলায় নাকি?

ননীলাল বলতে-বলতে পারলিনে? এ যুগের অবতার হলেন শেঠ-শীল আর মল্লিক।

ছুটুকবাবু কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়লো। হাসির চোটে ভুঁড়ির মাংস থল থল করে নেচে ওঠে। যেন একটা কৌতুক করবার দারুণ বিষয় পাওয়া গিয়েছে।

আমাদের কলেজের ভেতর ঢুকতে মস্ত বড় সদর-দরজার ওপর লেখা ছিল—“God is Good”। একদিন কলেজে মহা সোর গোল বেধে গেল। হৈ-চৈ কাণ্ড। কী সর্বনাশ ব্যাপার! দেখা গেল কে যেন বড় বড় হরফে সেখানে লিখে রেখেছে—“God is Money”। আমরা তো অবাক সবাই। সেকালে রসিকলাল মল্লিক আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যখন বলেছিল-“I do not believe in the holiness of the Ganges’ তখনও হিন্দুসমাজ এত চমকায়নি—ত সেই ননীলাল শেষ পর্যন্ত…

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে–বউ কেমন হয়েছে?

-বউটাও রূপসী ভূতনাথবাবু, তাই তো বলছি— ওর কপালটা ভালো, কাল নেমন্তন্ন খেয়ে এসে পর্যন্ত ওই কথাই তো ভাবছি। শালাটা করলে কী? আজ এসেছিল সবাই গান-বাজনা করতে মন বসলো না। পাঁচ শ’ টাকা ধার নিয়ে গিয়েছে ননী এই সেদিন–এখনো শোধ করেনি। তার কাছে পাঁচ শ’ টাকা চাইতেই এখন লজ্জা করবে আমার। পাঁচ শ টাকার জন্যে নয়, পাঁচ হাজার টাকা গেলেও কিছু ভাবতম না। ননী আমার কাছ থেকে অমন অনেক টাকা নিয়েছে—হিসেব রাখিনি কখনও-কিন্তু এমনভাবে ননী আমাকে টেক্কা দিয়ে যাবে ভাবিনি তা কখনও।

ছুটুকবাবু যেন কেমন মুষড়ে পড়েছে। বলতে লাগলো— এই যে সব নেশা-টেশা দেখছেন এ-সব ও-ই আমাকে প্রথম শেখায়, এই যে গান-বাজনার সখ—এ-ও ওরই কাছ থেকে প্রথম শিখি—তখন কলেজে সবে ঢুকেছি। চাকরের সঙ্গে গাড়িতে যাই আর গাড়ি করে ফিরে আসি। একদিন হঠাৎ দুপুরবেলা কলেজ ছুটি হয়ে গেল—দুজনে একসঙ্গে বেরোলাম রাস্তায়। কোন রাস্তা দিয়ে ঢুকে কোন রাস্তায় বেরিয়ে শেষে এক গলির মধ্যে নিয়ে গেল ননী, সেখানে একটা বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছিলো। আমাকে বললে—পেছন পেছন চলে আয় চূড়োবলে নিজেই আগে ঢুকে পড়লো।

আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি দোতলার ওপর গানের আসর বসেছে গান গাইছে একটা মেয়ে, নাকে একটা প্রকাণ্ড নথ।

ননী একপাশে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে পড়লো। আমাকেও টেনে পাশে বসালো।

গান থামলো। সারেঙ্গী বাজাচ্ছিলো যে সে-ও থামলো। তবলচিও থামলো।

ননী গিয়ে মেয়েটার কানে কানে চুপি চুপি কী বললো কে জানে! মেয়েটা আমার দিকে দু হাত তুলে সেলাম করে বললে— আপনার বহুত, মেহেরবানি—কী গান গাইবো ফরমাশ করুন?

তা বুঝলেন, তখন আমার বুক কাপছে, বয়েসও কম, গোঁফও ওঠেনি বলতে গেলে, তা ছাড়া ওসব জায়গায় কখনও যাই নি আগে, আমি কিছু কথাই বলতে পারলুম না। গান-বাজনা শোনা অবশ্য অভ্যেস ছিল আমার, বাড়িতে এসে কত বাঈজী গান গেয়ে গিয়েছে, নজরানা নিয়ে গিয়েছে, নাচ দেখেছি, সে-সব অন্য রকম। নাচঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছি আমরা, বাড়ির চাকর-বাকর সবার কাছে কত কিছু শুনেছি, কাকামশাইরা বাঈজীদের সঙ্গে সারারাত ধরে ফুর্তি করেছে। খাওয়া দাওয়া হয়েছে, নেশা-টেশাও চলেছে, তোষাখানায় যখন গিয়েছি চাকরদের মুখে বাবুদের কীর্তিকলাপ শুনেছি। বড় ছোট মাঝারি নানান মাপের রঙ বেরঙের বোতলের চেহারা দেখেছি, কিন্তু আমরা মানুষ হয়েছি ও-সব আওতার বাইরে। ওসব চলতো আমাদের চোখের আড়ালে। কিছু আমাদের জানতে পারবার কথা নয়! মা’র কাছে গিয়ে বাবামশাই-এর অন্য চেহারা দেখতুম! বড় ভয় করতাম কিনা কর্তাদের—কিন্তু এমন করে বাঈজীর মুখখামুখি হই নি কখনো। ননী মেয়েটাকে বললে—কিছু খাওয়াও ভাই আমাদের—আমার বন্ধু আজ এই প্রথম এল এ-সব জায়গায়।

আমার দিকে চেয়ে বললে—কী রে চূড়ো—খিদে পেয়েছে— কী খাবি বল? তোর তো আজ বিকেলের বরাদ্দ দুধ খাওয়া হয়নি।

আমার তখন ভাই ঘাম ঝরছে—খাবো কি মাইরি, খেতেই ইচ্ছে করছে না। ননী জানতে বিকেলবেলা এক গেলাশ দুধ আর ফল খাওয়া অভ্যেস আমার। কতদিন কলেজের পরে আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে ও ফলটল খেয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন কে আমার কথা শোনে ভাই! মেয়েটা কাকে যেন কী বললে। আর খানিক পরেই এল সব খাবার। ফলও এল, মিষ্টিও এল। আর আমার জন্যে দুধও এল। মেয়েটা আমাকে বললে—আপনার বড় লজ্জা বুঝি।

কিন্তু ননীটা কী বদমাইশ জানেন! মেয়েটাকে বললে—তুমি তো লজ্জাহারিণী ভাই—ওর লজ্জা আজ ভাঙতে পারবে না?

মেয়েটা জিব কেটে বললে—তেমন অহঙ্কার আমার নেই ননীবাবু, আপনাদের মতন ভদ্রলোকের পায়ের ধুলো পড়ে আমার কুঁড়ে ঘরে, তাইতেই আমি ধন্য।

ননী বললে—বাজে কথা থাক, খাবার দিলে, আর মুখশুদ্ধি দিলে না, এ কী রকম! তেষ্টা পাচ্ছে যে।

মেয়েটা ঝলমল করে উঠে পড়লো। বললে—ছি ছি আগে বলতে হয়।

বেনারসী ওড়নার ঘোমটা সরিয়ে খস্ খস্ শব্দ করতে করতে গিয়ে এবার দাঁড়িয়ে দেরাজ খুলে পেছন ফিরে তাকালে আমার দিকে। বললে—কড়া জিনিষ চলবে আপনার?

তখন কড়া মিঠে কিছুই জানিনে। কখনও খাইনি ওসব। কিন্তু খেলাম। কড়া খেলাম কি মিঠে খেলাম জানি না ভাই কিন্তু খেলাম! সেদিন কী আদর আমার! আমাকে তোয়াজ করাই একমাত্র কাজ হলো বাড়িসুদ্ধ লোকের।

তারপর গান চলতে লাগলো। মতিয়ার মুখেই ওই গানটা প্রথম শুনি। এখনও মনে আছে সেটা—’জখমী দিলকো না মেরে দুখায়া করো’–

একে গজল তায় মতিয়ার গলা, সঙ্গে সারেঙ্গী আর পেশাদারী হাতের সঙ্গত্। তার ওপর আবার একটু অমৃত পেটে গিয়েছে। কখন যে কোথা দিয়ে সময় চলেছে টের পাবার কথা নয়। তখন বাড়ির কথাও আর মনে নেই, কারোর কথাই মনে নেই। তখন মতিয়াকে নাকি আমি কেবল বলেছি নেশার ঘোরে-তোমায় বিয়ে করবো আমি—তোমায় ছাড়বো না আমি।

ভোর বেলা যখন ঘুম ভেঙেছে নেশা কেটেছে তখন ননী এল।

এসেই গালাগালি। বললে—ছি ছি চূড়া তোর একটা জ্ঞানগম্যি নেই, সারা রাত বাঈজীর বাড়ি কাটালি এত বড় বংশের ছেলে হয়ে।

আমি তো অবাক। বলে কী। আমাকে ওই-ই নিয়ে এল আর এখন কিনা আমাকেই গালাগালি!

আড়ালে নিয়ে এসে চুপি চুপি বললে—আমরা ভদ্দরলোকের ছেলে—একটু ফুর্তিটুতি করে চলে যাবো নিজের বাড়ি, তা না রাত কাটাবো এখানে? কত বললুম—চল চূড়ো চল, চল—তুই কিছুতেই শুনলি না। ছি ছি—এখানে কি রাত কাটাতে আছে?

তখন আমরে। তাই মনে হচ্ছিলো মাইরি। এ কী করলুম! আমি তো ভদ্রলোক! আমি বড়বাড়ির ছেলে—আমি নিমক মহলের বেনিয়ান ভূমিপতি চৌধুরীর প্রপৌত্র। সূর্যমণি চৌধুরীর নাতি, বৈদূর্যমণি চৌধুরীর ছেলে—আমার এ কী পরিণাম। বললাম

—চল বাড়ি চল।

ননীলাল বললে—সে কি? বাড়ি যাবি কী রে?

আবার কী দোষ হলে বুঝতে পারলাম না! বললাম—কেন?

—ওকে কিছু দে-মতিয়ার তত এটা ব্যবসা–ও এত কষ্ট করলো-সারা রাত জাগলো।

তাও তো বটে! কিন্তু সঙ্গে তো কিছু আনিনি।

ননী বললে—বাড়ি থেকে আনিয়ে দে—কিছু না দিলে খারাপ দেখাবে যে—তোদের বংশের মুখে চুনকালি পড়বে যে।

বললাম—কত দিতে হবে??

–তোর যা খুশি, মতিয়া কিছু চাইবে না, ও তেমন মেয়ে নয়, তা হলে আর তোকে এখানে আনতুম না, অন্য মেয়ে হলে অবশ্যি হাজার টাকা চেয়ে বসতো, তা ছাড়া তুই তো কিছু বলিসনি, আমিই এনেছি তোকে দায়িত্বটা তো আমারই। তবে ওর তো এটা ব্যবসা, ওরই বা চলে কিসে—আর তোদর বংশের নামডাক আছে—দেখিস যেন বদনাম না হয়।

—কত দেবো তুই বল।

ননী গলা নিচু করে বললে—নবাবী করে যেন আবার বেশি দিতে যাসনি তুই। আসলে তো ওরা বাঈজী—পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে নমো নমো করে সেরে দে এ-যাত্রা।

তা এই হলো ননীলাল! আপনি ভেবেছেন ননী সেই পাঁচ শ’ টাকার সবটা দিয়েছে মতিয়াকে? নিশ্চয়ই অর্ধেক নিজে মেরে দিয়েছে। তারপর যখন আবার পরে একদিন মতিয়ার কাছে গেলুম-জিজ্ঞেস করলুম।

মতিয়া বললে সে কি, আমাকে একটা পয়সাও তো দেয়নি সেদিন?

তা ননীলালকে চিনতে আমার আর বাকি নেই ভূতনাথবাবু। আর শুধু কি আমাকে! আমার মতন আরো কত বড়লোক আছে কলকাতায়। সারা কলকাতার লোকের কাছ থেকে ধার করেছে। ঠনঠনের ছেনি দত্তর ছেলে নটে দত্তর কাছ থেকেও নিয়েছে। একটু বড়লোক দেখলেই তার কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। শোধ কাউকেই দেয়নি। শুধু কি একবার। বারবার আমার কাছে একটা-না-একটা ছুঁতে করে ধার চেয়েছে। ওর ওই একটা গুণ। ও চাইলে কেউ না বলতে পারে না। খানিক থেমে ছুটুকবাবু বললে—একটু চলবে নাকি আজ? একটুখানি?

ভূতনাথ ছুটুকবাবুর হাত দুটো চেপে ধরে বললে–মাপ করবেন ছুটুকবাবু। সেদিন তো খেয়েছিলাম—আজকে আর নয়…

ছুটুকবাবু বললে—তবে বলছেন যখন থাক, কিন্তু আমি একটু খেয়ে আসি-বলে পর্দার ভেতরে গিয়ে আবার মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। এসে বললে— সেই কথাই কাল থেকে ভাবছি, ননীটা বাহাদুর ছেলে বটে—কত ঘাটের যে জল খেয়েছে আর কত ঘাট যে পার হয়েছে তার শেষ নেই। অথচ একজামিনেও পাশ করলে, আর নেশা ধরে গেল আমাদেরই…

হঠাৎ সুযোগ বুঝে ভূতনাথ বললে—আপনার সেই শশী কোথায় গেল—শশীকে দেখছিনে।

–না ভাই, ও-সব চাকর আর রাখবো না ঠিক করেছি, পারা ঘা হয়েছিল সারা গায়ে।

–বংশীর একটা ভাই আছে, বংশী বলছিল ওর ভাইটাকে যদি…

কথাটা শুনে ছুটুকবাবু যেন চটে গেল। বললে—না ভাই ও-সব এক ঝাড়ের বাঁশ, ওদের কাউকেই আর বিশ্বাস নেই, বেটারা সবাই পাজিও সবাই যেন মালকোষের ধৈবত—যেখানেই থাকুক ঘুরে ফিরে ঠিক সেই ধৈবতে এসে দাঁড়াবে…তা এবার ভাবছি পরীক্ষাটা আবার দেবো—একটা মাস্টার ঠিক করেছি। হপ্তায় চারদিন লেখাপড়া আর তিনদিন গান-বাজনা আর এই নেশাভাঙটাও ছাড়তে হবে—বলে আবার উঠলে ছুটুকবাবু। উঠে পর্দার আড়াল থেকে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। বলে— আপনি বেশ ভালো আছেন স্যার—কোনো নেশাটেশার মধ্যে নেই–এ একবার ধরলে ছাড়ায় কোন শালা।

হঠাৎ বাইরে যেন কার ছায়া পড়লো।

ছুটুকবাবু চিৎকার করে উঠলো—কে রে, কে ওখানে? কে?

-আমি বংশী আজ্ঞে।

—তা বাইরে কেন? ভেতরে আয়-কী দরকার?

বংশী বললে—আমি শালাবাবুকে একবার ডাকছিলাম।

–ও–বলে ভূতনাথ উঠে বাইরে এল।

ভূতনাথ বাইরে আসতেই বংশী গলা নিচু করে বললে—কই, ছোটমা’র কাছে যাবেন বলেছিলেন—যাবেন না?

ভূতনাথ বললে–ছোটবাবু আছেন, না চলে গিয়েছেন?

বংশী বললে–ছোটবাবুর তো অসুখ খুব—পেটে যন্তরণা হচ্ছে কতদিন থেকে বাড়িতেই থাকেন।

-তাহলে?

–আমি ছোটমা’কে বাইরে ডেকে আনবো’খন, আপনি কথা বলবেন—তাতে কি—ছোটমাও যে আপনার কথা বলছিলেন আজ্ঞে।

—তবে চল। ছুটুকবাবুর ঘরে ঢুকে ভূতনাথ বললে—তাহলে আজ আসি ছুটুকবাবু, আর একদিন আসবো। বাইরে বেরিয়ে ভূতনাথ বললে—কোন্ দিক দিয়ে যাবি বংশী?

বংশী বললে—কেন আপনার সেই চোরকুইরির সরু বারান্দা দিয়ে?

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ইটবাঁধানো উঠোনের ওপর তখন ইব্রাহিমের ছাদের আলোটা থেকে একফালি আলো এসে পড়েছে। ওদিকে খাজাঞ্চীখানার দরজায় তালা পড়ে গিয়েছে। দক্ষিণের বাগানের কোণ থেকে দাসু মেথরের ছেলেটা বাঁশীতে বিমঙ্গলের সুর ভাঁজছে—“ওঠা নাবা প্রেমের তুফানে’— আস্তাবলের ভেতর ছোটবাবুর শাদা ওয়েলার জোড়া অন্ধকারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঠকাঠক পা ঠুকে চলেছে। আস্তাবলের ওপর দোতলায় ব্ৰজরাখালের ঘরটা তেমনি অন্ধকার। তার পাশে ব্রিজ সিং-এর ঘরে টিম টিম আলো জ্বলছে। বোধ হয়, আটা মাখছে এখন। থপ থপ শব্দ আসছে সে-ঘর থেকে। তার পেছনে তোষাখানায় চাকরদের ঘরে এখন তাস-পাশা চলছে। সন্ধ্যেবেলা কাজ কম। বাবুরা বেরিয়ে গিয়েছেন বেড়াতে।

ভূতনাথ আস্তাবল বাড়ির পাশ দিয়ে একেবারে বাগানের কাছে এল। বংশী আগে আগে চলেছে। মনে হলো—প্রথমে গিয়ে কী কথা বলবে। বহুদিন থেকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ছোটবৌঠানকে। গিয়ে বলতে হবে–“মোহিনী-সিঁদুর আগাগোড়া সব মিথ্যে কথা! সব বুজরুকী! ছোটবৌঠান যেন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ না পরে। আগে যদি জানতো ভূতনাথ ‘মোহিনী-সিঁদুর’ দিতে কখনও।

বংশী এবার ডাকলে—চলে আসুন শালাবাবু।

-এ আবার কোন্ রাস্তা বংশী?

চোরকুঠুরির ঠিক সামনাসামনি একটা দরজা। এতদিন নজরে পড়েনি তো! সেই ইটালিয়ান সাহেবের মেমসাহেব! এখান দিয়ে এই গুপ্ত পথে বুঝি অভিসারের আয়োজন হতো। ভূমিপতি চৌধুরী বুঝি এই দরজা খুলে দিতেন মধ্যরাত্রে। নিমক মহলের বেনিয়ানের হৃদয় নিয়ে লেনদেন চলতে বুঝি এইখানে। এই লোকচক্ষুর অন্তরালে!!

বংশী বললে—এই রাস্তা দিয়েই ছোটমা আনতে বলছেন আপনাকে আজ্ঞে।

অতি নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। ভূতনাথের মনে হলোভূমিপতি চৌধুরীর পর এ-দরজা এই প্রথমবার বুঝি আবার খোলা হলে এতদিন পরে। নিঃশব্দে সে বুঝি পেরিয়ে চলে এসেছে সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যায়ে। সেদিনটা এই বারান্দার মতোই বুঝি অন্ধকারাচ্ছন্ন। কলিকাতা শহর তখন সবে গড়ে উঠছে।’ সূতানুটীতে তখন কেবল হোগর জঙ্গল। সেই হোগর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আর্মেনিয়ানরা মেয়েমানুষের ব্যবসা করে আর ডাকাতরা টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে পথিকদের খুন করে ফেলে দেয় গঙ্গার জলে। মানুষ বলি দেয় কালীঘাটের কালীর সামনে। তারপর জব চার্নকের আমল থেকে শুরু হয়ে শহর যখন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলে এসে প্রথম এক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো, তখন এল স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস আর এক মাদাম গ্র্যাণ্ড! পৃথিবীর সেরা প্রেমের কাহিনী। সেদিন সেই রাত্রে যখন মাদাম গ্র্যাণ্ডের শোবার ঘরে প্রথম ধরা পড়লে ফ্রান্সিস সাহেব তখন ভূমিপতি চৌধুরীরও জন্ম হয়নি। কিন্তু মাদাম গ্র্যাণ্ড বুঝি বার-বার বিভিন্ন রূপ নিয়ে জন্মেছে সংসারে। কখনও ফ্রান্সিস সাহেবকে, কখনও ভূমিপতি চৌধুরীকে, আবার কখনও জবার রূপ নিয়ে ছলনা করেছে পুরুষ জাতকে। এই অসময়ে ছোটবৌঠানের আকর্ষণের পেছনেও যেন সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে এক মহা-অপরাধের পূর্বাভাষ। নইলে এত আকর্যণ কেন? ব্রজরাখাল তো বারবার বলেছিল–কাজটা ভালো করোনি বডোকুটুম—ওরা হলো সাহেব-বিবির জাত—আর আমরা হলাম গিয়ে গোলাম—ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম ভালো নয়।

সেই অন্ধকারাবৃত আবহাওয়ায় বংশীর পেছনে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল ভূতনাথ। কেন সে পাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে। কার কাছে যাচ্ছে। এ কি তার কলকাতা দেখতে আসা। জীবনে সে প্রতিষ্ঠা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে—তবে আজ কেন এই অভিসার! রোজ রোজ ঘরের অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে কেন এই তিমিরাভিসার! যে-পথ দিয়ে স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস, ভূমিপতি চৌধুরী সবাই একদিন গিয়েছে, আজ ভূতনাথও আবার সেই পথ দিয়ে বুঝি যাত্রা করছে-তার এই অবৈধ নৈশ যাত্রা!

বংশী পেছন ফিরে আর একবার ডাকলে কই, আসুন শালাবাবু।

হঠাৎ কী যেন হলো। মনে পড়লো ছোটবৌঠানের যশোদাদুলালকে! মনে পড়লো ফতেপুরের বারোয়ারিতলার মা মঙ্গলচণ্ডীকে। আর মনে পড়লো—নরহরি মহাপাত্রের সর্বসিদ্ধিদাতা বিনায়ককে। ভূতনাথ বললে-চল—যাই।

দরজাটা খুলেই সামনে ছোটবৌঠানের ঘর। একেবারে মুখোমুখি।

আগে থেকেই বুঝি বন্দোবস্ত ঠিক ছিল সব। বংশী দরজার সামনে যেতেই ছোটবৌঠান বেরিয়ে এল। ঘরের আলো পড়ে ছোটবৌঠানের কানের হীরেটা চক চক করে উঠলো। ভূতনাথকে তখনও বুঝি ভালো করে দেখতে পায়নি ছোটবৌঠান। বললে— কই রে বংশীভূতনাথ কই?

ভূতনাথ সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। বললে—বৌঠান এই যে আমি!

—ও, এসেছে—এসো-মাথা থেকে নিঃশব্দে ঘোমটাটা খসে গেল বৌঠানের। এতক্ষণে ভালো করে যেন দেখতে পেল মুখটা। সেই ছোটবৌঠান। ভূতনাথের যেন চোখ নামতে চায় না। ছোটবৌঠানের নজরে পড়লো। একটু হেসে বললে–এসো, ঘরের ভেতরে এসো।

তবু ভূতনাথের যেন দ্বিধা হলো। বললে–ছোটবাবু কোথায়?

—আছেন, কিন্তু সেজন্যে তোমার কিছু ভয় নেই—তুমি এসো। ঘরে যেতেই ছোটবৌঠান বললে—কেমন আছো ভূতনাথ?

ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে দেখলে একবার। সব ঠিক তেমনি আছে। আলমারির পুতুলগুলো ঠিক তেমনি করে তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সোনার বাঁশি হাতে করে ছোটবৌঠানের যশোদাদুলাল তেমনি অচল অটল দাঁড়িয়ে। ছোটবৌঠানের দিকে চাইতেই ভূতনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। মনে হলো, একটু আগেই যেন ছোটবৌঠান খুব কেঁদে ভাসিয়েছে। কিন্তু ভূতনাথের চোখে চোখ পড়তেই ছোটবৌঠানের ঠোটে হাসি ফুটে উঠলো। বললে—কী দেখছো ভাই অমন করে?

ভূতনাথ বললেন, আমি আপনাকে বলতে এসেছিলাম একটা কথা।

—কী কথা-বলল না শুনি?

—ও সিঁদুর আর আপনি পরবেন না—ওই ‘মোহিনী-সিঁদুর।

-কেন, সিঁদুরে আবার কী দোষ করলো ভাই—জবার সঙ্গে বুঝি ঝগড়া হয়েছে?

—না, ঠাট্টা নয়, সুবিনয়বাবু নিজে বলছেন, ওসব বুজরুকী।

—তা হোক, কিন্তু আমার কাজ হয়েছে ভাই!

—সে কি!

-হ্যাঁ, ‘মোহিনী-সি’ দুরে’র ফল ফলেছে আমার, অনেক ওষুধবিষুধ আগে খেয়েছি, মাদুলি-তাগা, কিছুই বাদ রাখিনি, পূজোমানত সব করে দেখেছি, কিছুতে কিছু হয়নি আগে—কিন্তু ‘মোহিনী-সিঁদুরে’ কাজ হয়েছে।

—সে কি বৌঠান, সুবিনয়বাবু নিজেই বললেন যে ও বুজরুকীর ব্যবসা তুলে দেবেন।

—তা হোক।

—কী করে হলো?

—সব কথা তো তোমাকে বলা যায় না, তুমি শুনতেও চেও না কিছু—কিন্তু..

—কিন্তু কী বৌঠান?

ছোটবৌঠান যেন একটু দ্বিধা করলো। তারপর বললেছোটকর্তা কথা দিয়েছেন আমাকে, জানবাজারের বাড়িতে আর যাবেন না। বরাবর রাত্রে বাড়িতেই থাকবেন, যদি আমি…

–যদি আপনি…?

–এখন এর বেশি আর শুনতে চেও না—এর বেশি আমি বলবোও না।

ছোটবৌঠান যেন নিজেকে সামলে নিলে।

তারপর বংশীকে ডেকে ছোটবৌঠান বললে—বংশী তুই এখন যা—পরে ডেকে পাঠাবে।

বংশী চলে যাবার পর ছোটবৌঠান গলা নিচু করে বললে— কিন্তু ভূতনাথ, তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবেআজকেই।

ভূতনাথের উৎসুক দৃষ্টির সামনে চোখ রেখে পটেশ্বরী বৌঠান বললে-করবে? পারবে?

–পারবো। কী?

–কেউ যেন জানতে না পারে-বংশীও নয়।

–কেউ জানবে না বৌঠান।

—আমাকে মদ কিনে এনে দিতে হবে।

—মদ?

—হ্যাঁ, মদের অভাব নেই এ-বাড়িতে তা সবাই জানে। এ-বাড়িতে ছেলে বুড়ো সবাই খায়, কিন্তু তবু দরকার, খুব ভালো মদই নিয়ে এসে, বেশি নয়, সামান্য হলেই চলবে’খন, কিন্তু আজ রাত্রেই—আমি টাকা দিচ্ছি। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে টাকা বার করে দিলে—বললে—এই জন্যেই তোমায় ডেকেছিলাম।

ভূতনাথ উঠলো। পটেশ্বরী বৌঠান বললে—হ্যাঁ ভাই যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। রাস্তা তো চিনে নিলে—ওইখান দিয়ে আসবে, কেউ জানবে না।

হতবুদ্ধির মতো ভূতনাথ বেরিয়ে এল বাইরে। কোথাও কিছু নেই, কিন্তু এমন যে হবে ভাবতে পারেনি ভূতনাথ। বড়বাড়ির রহস্যই বুঝি আলাদা। অন্য কোনো নিয়মে বুঝি একে বাঁধা যায় না। ইতিহাসের পাতায় এর মানুষগুলো বড় বেশি নড়ে চড়ে, কথাও বুঝি বেশি বলে—কিন্তু কিছুতেই বুঝতে দেয় না নিজেদের। ভূতনাথের মনে হলো পটেশ্বরী বৌঠান যেন সত্যিই ইস্কাপনের বিবির মতন—হাতে যদিই বা আসে সে শুধু হাতের বাইরে চলে যাবার জন্যে!

ভূতনাথ সন্ধ্যের অন্ধকারেই গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।

২১. আজ এতদিন পরে ভাবতে যেন কেমন লাগে

আজ এতদিন পরে ভাবতে যেন কেমন লাগে। সে-মানুষগুলো, সে-দিনগুলো কোথায় গেল। সেই লঘুপক্ষ দিন আর রাত গুলো। উঠে বসে ধীরে সুস্থে চলা, ভাবা আর বাঁচা! দিন যেন আর ফুরোয় না, রাত যেন আর কাটে না। সূর্য উঠতে যেন বড় আস্তে আস্তে! ড়ুবতে যেন বড় দেরি করে। গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে সময়ের চাকা! হচ্ছে, হবে। অত তাড়া কিসের। তামাক খাও। আর একটু জিরোও। সমস্ত দিন তো পড়ে রয়েছে। কত কাজ করবে করো না!

সে অনেকদিন আগের ঘটনা। সেবার হুজুগ উঠলে চৈত্রমাসের অমাবস্যার দিন মহাপ্রলয় হবে! প্রলয় মানে এক ভীষণ কাণ্ড! কলিযুগ শেষ হয়ে যাবে। পাঁজিতে লিখেছে—অমাবস্যা তিথিতে দ্বাদশ ঘটিকা সপ্তম পল ত্রয়োদশ দণ্ড গতে ঘাতচন্দ্র দোষ।

ভৈরববাবু এসে বললেন—লোচন, দে বাবা, ভালো করে তামাক খাইয়ে দে—আর তো কটা দিন।

লোচনও কথাটা শুনেছিল। বললে-বলেন কি ভৈরববাবু কলি উল্টে যাবে?

—উল্টে যাবেই তো, কলির চারপো পূর্ণ হয়েছে যে— উল্টোবে না!

লোচন বললে—উল্টে গেলে কী হবে?

ভৈরববাবু বললেন—সত্য যুগ শুরু হবে।

লোচন বললে—আমরা দেখতে পাবো তো?

—বেঁচে যদি যাস তো দেখতে পাবি বৈকি—কিন্তু বেঁচে থাকলে, তত—কী হয় আগে দেখ?।

লোচন সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লো। বললে—বাঁচবো না ভৈরববাবু—বলেন কি!

ভৈরববাবু ইকো টানতে টানতে বললেন-বাবুর বাঁচবে কিনা তাই আগে দেখ! বাবুরা বাঁচলে তবে তো চাকর-বাকরেরা। মনে কর, সাততলা বাড়ির মতো উচু জল দাঁড়িয়ে গেল এখানে, কলকেতা শহর হয় তত সমুদ্র হয়ে গেল—তখন কোথায় থাকবি তুই, আর কোথায় থাকবো আমি—মেজবাবু পর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছে।

সমস্ত কলকাতার লোকগুলো ভয় পেয়ে গেল। যেখানে যায়, সেখানেই ওই আলোচনা। রাস্তার ধারে নোয়াকগুলোতে আড়া বসে। জোর আলোচনা চলে।

নিশা ছুটি নিয়ে দেশে চলে গেল। বলে—যদি বেঁচে থাকি তো আবার ফিরে আসবো শালাবাবু, মরবার আগে জমি-জিরেতের পাওনাগণ্ডা সব বুঝে নেই তোমরে গেলে কে আর দেবে।

লোচন বলে—পেট ভরে ভাত খেয়ে নে বংশী—এ জন্মে আর খেতে পাবি কি না-পাবি।

বংশীও বড় ভয় পেয়ে গিয়েছে। বলে—কী হবে শালাবাবু? বোনটার জন্যেই ভাবি, বিয়ে দিয়েছিলুম, আট কুড়ি টাকাও খরচ হয়ে গেল, সোয়ামীও বাঁচলো না ওর। এখানে যাহোক ছোটমা’র পায়ের তলায় বসে দু’মুঠো খেতে পাচ্ছিলুম—কিন্তু এখন এ কী কাণ্ড বলুন তো!

এক-এক করে দিন যায়। চৈত্র মাসের অমাবস্যা এগিয়ে আসে। একদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে গিয়ে সুবিনয়বাবুর কাছে কথাটা পাড়লে ভূতনাথ। আপনি কিছু শুনেছেন স্যার?

সব শুনে সুবিনয়বাবু বললেন—শেষ দিনটার জন্য অত ভয় পাও কেন ভূতনাথবাবু, গানেরও তো সম্ আছে, ছন্দেরও তে যতি আছে, কিন্তু নদী যেখানে থামে, নদী যেখানে শেষ হয়, সেখানে একটা সমুদ্র আছে বলেই তো শেষ হয়—তাই শেষ হয়েও তার তো কোনো ক্ষতি নেই—

I have come from thee-why I know not;
But thou art, God! What thou art;
And the round of eternal being is the pulse of
thy beating heart.

জানো ভূতনাথবাবু-ফল যখন পাকে, তখন ডাল থেকে ছিঁড়ে পড়াই তার গৌরব, কিন্তু শাখা ত্যাগ করাকে যদি সে দীনতা বলে মনে করে তবে তার মতো কৃপার পাত্র আর কে আছে—কথা বলতে গেলে সুবিনয়বাবুর আর মাত্রাবোধ থাকে না।

শেষে সেই অমাবস্যা তিথি এল। সমস্ত বাড়িতেই যেন একটা উত্তেজনা। ইব্রাহিম সহিসও আজ অসুখের ভান করে কাজে আসেনি। তোষাখানা, ভিস্তিখানা, খাজাঞ্চিখানা আজ যেন থম থম করছে। রান্নাবাড়ির কাজ সকাল সকাল শেষ হয়ে গিয়েছে। ব্ৰজরাখাল তখন ছিল এখানে। কিন্তু তারও দেখা নেই।

বিকেল বেলা ভূতনাথ ব্ৰজরাখালকে বলেছিল—আজ সন্ধ্যেবেলা একটু সকাল-সকাল ফিরো ব্ৰজরাখাল।

ব্ৰজরাখাল বলেছিল—কেন?

-কী সব শুনছি হবে—পাঁজিতে লিখেছে?

-তুমিও যেমন বড়কুটুম, পাঁজির কথা বিশ্বাস করো, অত ‘দৈবের ওপর বিশ্বাস করলে কাজ চলে না, ওটা মৃত্যুর চিহ্ন কাপুরুষতা!’

—কিন্তু পাঁজি কি মিথ্যে লিখেছে? কত জ্ঞানী পণ্ডিত লোকদের লেখা সব।

ব্রজরাখাল বলেছিল—রেখে দাও পাজিওয়ালাদের জ্ঞান; জ্ঞানের পরেও আছে বিজ্ঞান, ঠাকুর বলতেন—“যে দুধের কথা একেবল কানে শুনেছে, সে অজ্ঞান, যে দুধ দেখেছে সে জ্ঞানী, আর যে দুধ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, সে হলো বিজ্ঞানী’। যাই বলো বড়কুটুম আমার ও-পাঁজিতে বিশ্বেস নেই-জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাইরে ওরা বলে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল নিজের কাজে।

ব্ৰজরাখাল বিশ্বাস করেনি, সুবিনয়বাবুও গুরুত্ব দেননি, কিন্তু মেজবাবু সেদিন বাড়ি থেকে বেরোলেন না। সকাল সকাল খানা সেরে নিলেন। নাচঘরেই সেদিন আড্ডা বসলো। ভৈরববাবু এলেন গোঁফে তা দিয়ে। বগলেশ-আঁটা জুতোজোড়া সন্তর্পণে দরজার পাশে রেখে-ফরাসের ওপর গিয়ে বসলেন। মতিবুও এলেন। ছাতাটা একপাশে রেখে কোঁচানো ওড়না আর কোঁচা সামলে বসলেন এগিয়ে। সকলেরই বাকা সিঁথি, বাবরি চুল। আর এলেন বড়মাঠাকরুণ। ভারিক্কি চেহারা। হাতে পানের ডিবে। বারো গাছা করে মোটা বেঁকি চুড়ি দু’হাতে। টাঙ্গাইলের কড়কড়ে দাঁতওয়ালা চওড়া পাড়ের শাড়ি। এসেছে তিনকড়ি। তিনকডির বয়েস কালে চেহারা ভালো ছিলো বোঝ যায়। নাকে হীরের নাকছাবি। গালভর্তি পানদোক্তা। মোটাসোটা মেয়েটি। এককালে হাসিনী আসার আগে ওই ছিল সুয়োরাণী। তারপর আসে হাসিনী। হাসিনী বয়সে কচি। গায়ের গয়না তারই বেশি। বেশি কথা বলে। ছটফটে। চুলবুল।

মেজবাবু গড়গড়ায় মুখ দিয়েই হুঙ্কার দিলেন—বেণী-বেণী

বেণী এলে মেজবাবু বললেন—রূপলাল ঠাকুরকে ডেকে নিয়ে আয় তো।

ভৈরববাবু বললেন—আজ্ঞে পাজি আমি নিজে দেখেছি—রাত বারোটা বেজে সাত পল ত্রয়োদশ দণ্ডে ঘাতচন্দ্রদোষ।

মেজবাবু বললেন—না, না, রূপলাল আসুক না, যদি মহাপ্রলয় হয়ই তো ঠাকুর মশাই বা কেন বাদ যাবেন—সকলের একযাত্রা হওয়াই তো ভালো।

মতিবাবু বললেন—আজ্ঞে আমি তো গিন্নীকে বলে এসেছি, আজ সব যেন একঘরে এসে শোয়—কিন্তু ঘুম কি আর কারো আসবে। সবাই জেগে বসে আছে।

ভৈরববাবু বললেন—কলিযুগ শেষ হয়ে গেল, একরকম বাঁচা গেল স্যার। ছোটলোকদের আস্পর্ধা দিন দিন যেমন বাড়ছিল, সত্যযুগ এলে আবার জিনিষপত্তরের দাম কমবে, জামাকাপড় সস্তা হবে, আট আনা মণ চাল কিনবে-চাই কি দামই লাগবে না।

মতিবাবু বললেন—সে গুড়ে বালি, এ রামরাজত্ব তো নয়, এবার ইংরেজের রাজত্ব। এখানে অবিচার চলবে না আর।

মেজবাবু বললেন—সেদিন বেহ্মজ্ঞানী শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জানেন!

সবাই উন্মুখ হয়ে উঠলো।

মেজবাবু বললেন—জিজ্ঞেস করলাম—কী বুঝছেন? তিনি বললেন—মানুষের ডাকে যেমন দেবতার আসন টলে, তেমনি মানুষের পাপেও তাঁর আসন টলে।

—তা মিথ্যে তিনি বলেন নি স্যার, টলবেই তো, এই যে কলিযুগে প্রজারা জমিদারকে মানতে চায় না, ব্রাহ্মণকে ভক্তি করে না, এ-ও পাপ বৈকি স্যার।

মেজবাবু একটু পরে বললেন—ক’টা বাজলো দেখে তো?

—এই তো সবে সন্ধ্যে সাতটা বেজে চল্লিশ মেজবাবু বললেন—তাহলে এখন তো অনেক দেরি, তা হলে বলে বড়মাঠাকরুণের দিকে তাকালেন।

বড়মাঠাকরুণ পান সাজতে সাজতে বললেন—আজকে আর গাইতে বোলো না হাসিনীকে। কাবোর মেজাজ ভালো নেই।

মেজবাবু বললেন—গান না হয় না হলে, তুমি তবে ওইগুলো বার করো, বরফও তত এসেছে।

বড়মাঠাকরুণ তাতেও নারাজ। বললেন—তোমার মতিচ্ছন্ন হচ্ছে দিন দিন। আজকে কোথায় বসে বসে জপতপ করবার দিন।

—তবে সিদ্ধিই হোক, সিদ্ধির সরবৎ, গরমটাও পড়েছে খুব, বেশ করে পেস্তা বাদাম বেটে, একটু ল্যাভেণ্ডার দিয়ে…কী বলে। ভৈরববাবু?

ইতিমধ্যে রূপলাল ঠাকুর এসে পড়লেন। গায়ে গরদের চাদর। পায়ে খড়ম।

পাশের ঘরের ফাঁক দিয়ে সবাই দেখেছিল। ভূতনাথ, লোচন, আরো সবাই। আজকে প্রায় সকলের ছুটি। সকাল সকাল রান্নাঘরের পাট শেষ।

বংশী তাড়াতাড়ি এসে বললে—শালাবাবু, ওদিকে সব্বনাশ হয়েছে-শিগগির আসুন!

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কী হলো রে বংশী?

একরকম জোর করেই টানতে টানতে ভূতনাথকে বাইরে নিয়ে এল বংশী।

বংশী বললে—শিগগির চলুন একবার জানবাজারে—ওসব পরে দেখবেন আজ্ঞেও সমস্ত রাত ধরেই চলবে আজ।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কেন?

—আজ্ঞে, এখুনি খবর এসেছে জানবাজারের বাড়ি থেকে, ছোটবাবর অসুখ—-আমাকে ছোটমা ডেকে বলে দিলেন—তোর শালাবাবুকে নিয়ে যা।

সেই রাত্রেই বেরোলো ভূতনাথ। সঙ্গে বংশী। রাস্তায় বেরিয়ে বংশী বললে—এমনি করেই প্রাণটা খোয়াবেন ছোটবাবু, ও ছাই-ভস্ম খেয়ে-খেয়ে পেটে একেবারে ঘা হয়ে গিয়েছে, আজ থেকে তো নয়, সেই বিয়ের আগে থেকে—মানুষের শরীর কত সয়, বলুন?

জানবাজারের অন্ধকার গলিতে ছোটবাবুর ল্যাণ্ডেলেট দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়া দুটো চুপচাপ মাথা নিচু করে পা ঠকছে।

বংশী একেবারে সোজা গিয়ে কড়া নাড়তে লাগলো—বিন্দাও বিন্দা

বৃন্দাবন দরজা খুলে দিয়েছে।

বংশী বললে—ছোটবাবু আমার কেমন আছে বৃন্দাবন?

বৃন্দাবন বললে—এখনও জ্ঞান হয়নি। যা না ওপরে যা–বাবুর কাছে নতুন-মাও বসে আছে।

বংশী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললে—চলে আসুন শালাবাবু, ছোটমা বলছে রাত বারোটার আগে যেমন করে হোক ছোটবাবুকে বড়বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে—বারোটার পর কি হয় কে জানে।

ছোটবাবুর ঘরের কাছে পৌঁছতেই ভেতর থেকে কে যেন পায়ের শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এল। ভূতনাথকে দেখে একটুখানি ঘোমটা টেনে দিলে। বললে-কে, বংশী এলি? ভালোই হয়েছে।

বংশী বললে—আমার বাবু কেমন আছে এখন নতুন-মা?

—এখনও জ্ঞান হয়নি বংশী, ডাক্তার ডেকেছিলুম, বড় ভয় করছে।

—কই দেখি—বলে বংশী ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ভূতনাথও গেল পেছন-পেছন। চুনীবালার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। বেশ সুন্দরী দেখতে। কিন্তু যেন বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বোধ হয় অনেকক্ষণ ধরে সেবা করছে একটানা।

বৃন্দাবন এসেছিল ঘরে। বললে–মা তুমি এবার খেয়ে নাও গে–বংশী তো রয়েছে।

নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে ছোটবাবু। ধপধপে ফরসা রং-এর মানুষটা। ওষুধ খেয়ে বোধ হয় বেহুশ হয়ে গিয়েছে। বংশী গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে একবার স্পর্শ করলো। মনে হলো বংশী যেন ছোটবাবুকে জাগিয়ে তুলতে চায়। সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বংশীর চোখ দুটো যেন একেবারে পাথরের মতো নিষ্প্রাণ কঠিন হয়ে এসেছে। ভূতনাথের মনে হলো—বংশীর এ রূপ যেন দেখেনি কখনও আগে। এই মুহূর্তে ছোটবাবু উঠে দাঁড়িয়ে তাকে চাবুক মারলে যেন বংশী খানিকটা স্বস্তি পেতো। যেন প্রাণ ফিরে আসতে বংশীর শরীরে।

সেই রকম চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একেবারে ফেটে পড়লো বংশী। বললে—ও ছাই-ভস্মগুলো তুমি কেন খাও নতুন-মা? নিজে না হয় গেলো কিন্তু আমার ছোটবাবুকে কেন গেলাও বলতে পারে?

বংশীর কথায় ভূতনাথও কেমন যেন চমকে উঠলো।

চুনীবালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বংশীর দিকে একবার চাইলে। মনে হলো–বংশীর এ ধরনের কথার জন্যে যেন চুনীবালা প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু কিছু উত্তর ও দিলে না।

বংশী আবার হঠাৎ বলে উঠলো—ছোটবাবু মরলে তোমরা বাঁচো, না নতুন-মা?

এতক্ষণে যেন কথা খুঁজে পেল চুনীবালা। দৃঢ়কণ্ঠে বলতে গেল—বংশী…

বংশী আবার চিৎকার করে বলে উঠলো—হাঁ, নিশ্চয় বলব, হাজার বার বলবো, তোমাকে আমি ভয় করি নাকি?

চুনীবালা চাপা গলায় বললে—চেঁচাতে হয় বাইরে গিয়ে চেঁচা।

—কেন, অত দরদ কিসের, বিষগুলো খাওয়াবার সময় মনে থাকে না। কার দৌলতে খেতে পরতে পাচ্ছো? কার দৌলতে রাজরাণী হয়েছে?

চুনীবালা নিজেকে সামলে নিয়ে বললে-বংশী তোর তো বড় আস্পর্ধা দেখছি…

বৃন্দাবন এসে বংশীর হাত ধরলে এবার। বললে–চুপ কর তুই বংশী, একে সারাদিন মার খাওয়া হয়নি, তুই আর জ্বালাসনে।

বংশী কান্নার মতো হাউহাউ শব্দ করে উঠলো—খায়নি তো কার কি, বারণ করতে পারে না ছোটবাবুকে যে ও বিষগুলো খেও না?

চুনীবালা যেন স্বগতোক্তির সুরে বলে উঠলো—বিয়ে করা বউ-এর কথা যে শোনে না, সে শুনরে আমার কথা—কথা শুনলি বৃন্দাবন।

বংশী বললে—বিয়ে করা বউ-এর কথাই যদি ছোটবাবু শুনবেন তো ছোটমা’র আমার দুঃখ কিসের? এই আমার শালাবাবু সাক্ষী আছেন, ছোটমা’র কপাল যে পুড়িয়েছে তার কখখনো ভালো হবে না, কখনো ভালো হবে না—এই বলে রাখছি আমি—তারপর ভূতনাথের দিকে চেয়ে বললে—আসুন শালাবাবু, ধরুন তো একবার।

সেই ছ’ ফুট লম্বা শরীর। কাঁচা সোনার মতো গায়ের রং। সারা শরীরে আতরের ভুর ভুর গন্ধ। ভারিই কি কম। বৃন্দাবনও এসে হাত লাগালে। তারপর তিন জনে মিলে ধরে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে তোলা! গাড়ি ছাড়বার আগে বৃন্দাবন ভূতনাথকে বললে—আপনাকে একবার নতুন-মা ডাকছে।

–কে ডাকছে?

—আমার নতুন-মা।

—কোথায়? বলে ভূতনাথ বৃন্দাবনের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে যেতেই দেখলে দরজার একপাশে চুনীবালা দাঁড়িয়ে আছে। বললে—আমায় ডেকেছিলেন?

চুনীবালা বললে—তুমি বড়বাড়িতে নতুন ঢুকেছে বুঝি, আগে দেখিনি। তা একটা কাজ তোমায় করতে হবে।

ভূতনাথ বললে—বলুন?

–ছোটকর্তাকে তত তাড়াহুড়ো করে তোমরা নিয়ে চললে, শরীরের অবস্থা ওঁর বড় খারাপ, ডাক্তার নড়া-চড়া করতে বারণ করেছিলেন, কাল একবার খবর দিয়ে যাবে কেমন থাকেন উনি?…পারবে আসতে?…নইলে শান্তি পাবে না মনে।

ভূতনাথ কি বলবে ভেবে পেলে না।

চুনীবালা আবার বললে—আর এই ওষুধটা নাও—ডাক্তার বলেছিলেন যন্ত্রণা হলে এটা খাওয়াতে। রাত্রে যদি ব্যথা বাড়ে তো…তাহলে তুমি আসবে তত ঠিক?

পরের দিন যাবার কথাই দিয়েছিল ভূতনাথ। কিন্তু ঠিক পরের দিনই যাওয়া হয়নি।

সেদিন রাত্রে ছোটমা’র ঘরেই নিয়ে গিয়ে একেবারে তুলেছিল ছোটবাবুকে।

ছোটমা’র হাতে ওষুধের শিশিটা দিয়ে ভূতনাথ বলেছিল— ছোটবাবুর জন্যে এই ওষুধটা দিয়েছে নতুন-মা।

শিশিটা না নিয়ে বৌঠান বলেছিল—ও ওষুধ তুমি রাস্তায় ফেলে দিও ভূতনাথ—ওতে বিষ থাকতে পারে।

তারপর বৌঠানের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িবারান্দার তলায় ভূতনাথ অনেকক্ষণ বসেছিল। রাস্তায় সেদিন লোকের ভিড়। অত রাত্রেও গঙ্গাস্নান করতে চলেছে দলে দলে। মহাপ্রলয়ের আগে মানুষ পুণ্যসঞ্চয় করে মরবে। পরলোকের পাথেয়স্বরূপ। ওপরের নাচঘরে তখনও মেজবাবুর আড়া চলছে। শেষ পর্যন্ত হাসিনীর গান হয়েছে, নাচও হয়েছে। তারপর নাকি মদও চলেছে। মহাপ্রলয়ই যদি হয় তা হলে মনে কেন মিছিমিছি আপসোস থেকে যাবে।

রাত তখন এগারোটা। বংশী এল। বললে–ছোটবাবুর এতক্ষণে জ্ঞান হয়েছে শালাবাবু-শশী ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে। গেল। তারপর বললে—ছোটবাবুর জ্ঞান হতেই পালিয়ে এসেছি আজ্ঞে, যে-রাগী মানুষ, আমাকে এখন সামনে পেলে খুন করে ফেলবে হয়তো।

ভূতনাথ বললে–কেন?

—আজ্ঞে আমিই তো নতুন-মা’র বাড়ি থেকে ছোটমা’র ঘরে এনে তুলেছি। ছোটবাবু তো আমাকেই দুষবে।

তারপর ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজলো। পৌনে বারোটা। বারোটা বাজলো। আজ আর সারা বাড়ি নিঝুম নয়। আজ ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। উদগ্র প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে মানুষ। এবার কী ঘটে। তারপর বাজলে সাড়ে বারোটা। একটা। দুটো। তিনটে। রাত পুইয়ে গেল নিশ্চিন্তে নির্বিবাদে।

কিছুই ঘটলো না। প্রতিদিনকার মতো পুরোনো সূর্য ইব্রাহিমের ছাদের কোণ দিয়ে উঠলো আকাশে। তারপর সেই দাসু মেথরের উঠোন ঝাঁট দেওয়া। তোষাখানায় চাকরদের হৈ-হল্লা। ভিস্তিখানায় জল তোলার শব্দ। লোচনের হুঁকো পরিষ্কার করা। নাথু সিং-এর ডন-বৈঠক। খাজাঞ্চীখানায় বিধু সরকারের বক্তৃতা। ইয়াসিন সহিসের ঘোড়া ডলাই-মলাই। রান্নাবাড়ির পাশে সদুর তরকারির ঝুড়ি নিয়ে বসা। যদুর মা’র বাটনা বাটা। ঘরে ঘরে দিনগত পাপক্ষয়। বদরিকাবাবুর টাকঘড়ি নিয়ে ঘরে ঘরে ঘড়িতে দম দিয়ে বেড়ানো। কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেটটা আর ঘোড় জোড়া আজ প্রথম বুঝি এ-বাড়িতে রাত কাটালো। ছোটবাবুর আস্তাবল বাড়িটাকে আজ আর খালি পড়ে থাকবার অগৌরব বহন করতে হয়নি। এ-ঘটনা আজই বুঝি প্রথম! রাস্তায় বেরিয়ে ভূতনাথ এই কথাগুলোই ভাবছিল।

 

রাত হয়ে এসেছে। এত রাতে মদ কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে কে জানে। কোথায় দোকান তাও জানা নেই। একটি মাত্র জায়গা আছে। সেখানে গেলে এখন পাওয়া যেতে পারে। জবাদের বাড়ির ঠাকুর হয় তো এখন সেখানে রাস্তার ওপর ইট পেতে মাটির ভাঁড় নিয়ে বসেছে। আর সেই গান গাইছে ‘পোড়ারমুখী কলঙ্কিনী রাই লো’—কিন্তু এত রাত্রে অত দূরেই বা সে যায় কী করে। হঠাৎ বংশীর সঙ্গে মুখোমুখি।

বংশী বললে—এত রাতে কোথায় চলেছেন শালাবাবু?

কিন্তু বৌঠান তো বংশীকেও বলতে বারণ করে দিয়েছে। বংশীর কথার উত্তরে কী বলা যায় ভেবে পেলে না ভূতনাথ। বললে—তুই কোত্থেকে বংশী?

—চিন্তার আবার জ্বর এসেছে শালাবাবু, মাস্টারবাবু নেই, গিয়েছিলাম শশী কবিরাজের কাছে—কিন্তু আপনি চললেন কোথায় আজ্ঞে?

কেমন যেন বিব্রত বোধ করলে ভূতনাথ।

বংশী বললে—কোথায় আপনি যাচ্ছেন তা আমি জানি শালাবাবু। সন্ধ্যেবেলা থেকেই আপনাকে ডাকছে ছোটমা, আমার তো সন্দেহ হলে, বলি, ছোটবাবুর শরীরটা এখনও ভালো করে সারেনি, রাতের বেলা আজকাল বাড়িতেই থাকছেন, তবু শালাবাবুকে কেন ডাকে ছোটমা।

ভূতনাথ বললে—ছোটবাবু আজকাল বাড়ি থাকছে?

শুনে কেমন যেন অবাক হয়ে গেল ভূতনাথ। এ-খবরটা তো জানা ছিল না।

বংশী বললে—ওঠবার কি সাধ্যি আছে তেমন! কোনো রকমে একবার ছোটমা’র ঘরে যান, আর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়েন। ডাক্তার মানা করেছে যে। বলেছে, যদ্দিন না সেরে ওঠেন একেবারে ওঠা-হাঁটা বন্ধ। কী-চেহারা কী হয়েছে শালাবাবু, দেখলে আপনার কান্না পাবে মাইরি।

–মদ খাওয়া ছেড়েছেন নাকি?

–ও বিষ কি আর কেউ ছাড়তে পারে আজ্ঞে! এই আমিই দেখুন না কেন—আজকাল যখন ছোটবাবু শয্যাশায়ী থাকেন, গেলাশে ঢেলে দিই, তা একটু-আধটু জল মিশিয়ে দিই শালাবাবু, মনে হয় মানুষটাকে তো আমিই মেরে ফেলেছি। ডাক্তার পই পই করে বলেছে, ও-খেলে আর বাঁচবে না। তবে কার কথা কে শোনেসেই আগৈকার মতনই খাচ্ছেন, আর আমিই সেই বিষ নিজের হাতে ঢেলে দিচ্ছি। সকালবেলায় এক-একদিন নিজের ঘরের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ান, বাইরে চেয়ে দেখেন একবার দিনের বেলাটায় তত নেশা থাকে না বাবুর, কিন্তু সন্ধ্যে হলেই

আন বরফ, আন বোতল—তবু ভালো যে নতুনমা’র বাড়ি যাবার ক্ষেমতা নেই, ক্ষেমতা থাকলে কি আর ছাড়তেন—ঠিক ছুটতেন। মাগী ওকে কী বশই যে করেছে–

তারপর হঠাৎ থেমে বংশী বললে—হ্যাঁ, ভালো কথা, জানেন সেদিন নতুন-মা যে বড়বাড়িতে এসেছিল–শোনেন নি?

—কবে? টের পাইনি তো কিছু?

—আপনি টের পাবেন কি করে, তখন আপনি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, রাত তখন অঢেল, নাথু সিং এসে চুপি চুপি আমায় খবরটা দিলে। বললে-বংশী, রূপোদাসীর মেয়ে চুনীবালা এসেছে। ছোটবাবুর কাছে যেতে চায়, গেট খুলবো?

আমি ভাবলাম—চুনীবালা এসেছে ছোটবাবুর কাছে, ক’দিন যেতে পারেননি বাবু, বাবু শুনলে যদি আবার অনখ বাধায়, বললাম–দাঁড়া—বলে সোজা ছোটমা’র কাছে দৌড়ে গেলাম। ছোটমা তখন পূজো সেরে সবে উঠেছে। কথাটা শুনেই রেগে একেবারে আগুন! ছোটমা’কে দেখেছেন তো ওই রকম ভালোমানুষ, কিন্তু রাগলে আবার ওই মানুষেরই চেহারা বদলে যায়। বললেন—ছোটবাবুর গাড়ির চাবুকটা নিয়ে দু’ ঘা মারতে পারবি রাক্ষুসীর পিঠে-পারবি বংশী—আর না পারিস তো ডাক নাথুসিংকেই ডাক—আমিই তাকে বলছি।

আমার কেমন ভয় হলো দেখে। ছোটমা বললে—পারবি না?

বললাম—জানতে পারলে ছোটবাবু আমার মাথাটা আর আস্ত রাখবে না ছোটমা।

–আমিও এ-বাড়ির ছোটবউ, যা বলছি কর গিয়ে—চাবুক মেরে পিঠের চামড়া তুলে রক্ত বের করে দিগে যা।

বললাম—মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে কেবল বাধে, নইলে…

–ওকে তুই মেয়েমানুষ বলিস, ডাইনি ও, তুই না পারিস নাথু সিংকে ডাক। ও যদি বড়বাড়ির মাটি ছুঁয়েছে তো তোদের সকলের চাকরি যাবে বলে দিচ্ছি—আর যদি যা বললুম করতে পারিস তো তোদের দু’ ভাই-বোনের জীবনে কখনও খাওয়া-পরার ভাবনা থাকবে না—এই বলে দিচ্ছি।

ছোটমা’র চিৎকারে তখন মেজমা, বড়মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

মেজমা বললে—কী হলো রে ছোট?

সব শুনে মেজমা হেসেই আকুল। বললে—তুই অবাক করলি আমাদের, পুরুষমানুষের চরিত্তির তো তসর কাপড়—ওর আবার শুদ্ধ-অশুদ্ধ কি? তোর সব তাতেই বাড়াবাড়ি—আমার রাঙামাকেও দেখেছি, আর মেজকর্তাকেও দেখেছি—ওসব মনে করতে গেলে কবে গলায় দড়ি দিতুম।

বড়মা বললে—তোর সবই আদিখ্যেতা ছোটবউ।

তা বললে বিশ্বাস করবেন না শালাবাবু, সেই রাতের বেলা গেলাম। নাথু সিং নিয়ে গেল গেটের সামনে। নতুন-মা তার নতুন কেনা মোটর গাড়িতে করে এসেছে। আমাকে দেখে ডাকলে— বংশী ছোটবাবু কেমন আছে?

বললাম—একটু ভালো।

—ওষুধ খাচ্ছেন তো?

–খাচ্ছেন।

—আমাকে ভেতরে নিয়ে চল একবার—নতুন-মা বললে।

তা তখন কী আর বলবো! মিথ্যে কথাই বললুম আজ্ঞে। বললাম—বাবু যে মানা করে দিয়েছে তোমাকে আসতে দিতে মাইরি বলছি নতুন-মা, বলেছে—তোর নতুন-মা যদি আসে তো ঢুকতে দিবি নে বাড়িতে—ওর মুখ দেখতে চাইনে।

–নতুন-মা কী যেন ভাবলে কতক্ষণ। বললে-বলেছে ওই কথা?

–আজ্ঞে, আমি কি মিথ্যে মিথ্যে বলতে গিয়েছি—আমার লাভ কি বলো?

–তবে আমার সামনে বলুক ও-কথা, নিজে আমাকে ছোটকর্তা বলুক চলে যেতে নিজের কানে না শুনে আমি যাচ্ছিনে। এপথে আমি নিজে আসিনি, ছোটকর্তাই নিয়ে এসেছে আমাকে।

-কী বিপদেই যে পড়েছিলুম শালাবাবু সেদিন কী বলবো। ছিল রূপো দাসীর মেয়ে, হয়েছে রাজরাণী, সে কেন অত সহজে হাল ছাড়বে। জানবাজারের বাড়ি, চারটে দাসী, তিনটে চাকর, মোটর গাড়ি ও হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গিয়েছে! আর কী চাই। নষ্ট মেয়েমানুষের তো কেবল ওই দিকেই নজর। ছোটবাবুর অসুখ বলে তো ওর রাতে ঘুম হচ্ছে না একেবারে!

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—তা গেল শেষ পর্যন্ত চলে গেল চুনীবালা?

—তা কি আর আমি দেখতে গিয়েছি শালাবাবু, যাবে না তো করবে কী? আমি নাথু সিংকে গেট বন্ধ করতে বলে চলে এসেছি। তারপর আর কি হয়েছে জানি না—আমার তখন অন্য ভাবনা।

-কীসের ভাবনা?

—ভাবনা নয়? বলেন কী? ছোটবাবু যদি শোনে সব তত অনখ বাধাবে না? তখন আমার চাকরিটা ঠেকাবে কে? চিন্তার হাত ধরে আবার তো সেই দেশে গিয়ে না খেয়ে মরবে। দেশে কি জমিদারি আছে আমার যে ভাঙাবো আর খাবো। সেই যে কথায় আছে না—’তোর ভাবনা কি লো ভাবি’… আমার তো আর তা নেই শালাবাবু।

–তা বলে ছোটমা তোকে আর ছাড়বে না বংশী-এত করছিস তুই ছোটমা’র জন্যে।

বংশী বললে—কিন্তু ছোটমা’র কথা কে শুনবে শালাবাবু, ছোটকর্তাই আমল দেয় না তো শুনবে বাড়ির লোকে! এই যে এত রাতে আপনি ছোটমা’র জন্যে মদ কিনতে যাচ্ছেন-–

সাপ দেখে সরে আসার মতো ভূতনাথ এক পা পিছিয়ে এল!—তুই কী করে জানলি বংশী?

বংশী নির্বিকারভাবে সঙ্গে চলতে চলতে বললে—বলবে আবার কে শালাবাবু, এতদিন বড়বাড়িতে চাকরি করছি, সব জানতে পারি, চাকর-বাকর যদি না জানে তো জানবে পাড়ার পাঁচজনে? আমি যা জানি তা ছোটমাও জানে না, মেজমাও জানে না, ছোটকর্তা মেজকর্তা কেউ জানে না, কোন ঘরে কার রাত কাটে, কবে চুপি চুপি বড়বাড়িতে ডাক্তার আসে, দাই আসে, ওষুধ-বিষুধ, রোগ-জারি, সব টের পাই আমরা। এই তো গেল-বছরে বড়বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে সক্কালবেলা লোকের ভিড়, পুলিশ পেয়াদা, হৈ চৈ, কাক-চিল-শকুনির পাল–সবাই অবাক হয়ে দেখে কী?, একটা একদিনের মরা ছেলে—সবে জন্মেছে আজ্ঞে। সব জানি, কে ফেলেছে—কোন্ ঘর থেকে বেরিয়েছে-কিন্তু আমরা চাকর মনিষ্যি, আমাদের অত সাত-সতেরোতে থাকার কী দরকার। পুলিশ এল—জিজ্ঞাসাবাদ করলে—বললুম-কিচ্ছু জানি না বিত্তান্ত —চুকে গেল ল্যাটা।

ভূতনাথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, ছোটমা হঠাৎ এই বিষ কিনতে দিলে কেন জানিস বংশী।

বংশী খানিক চুপ করে রইল। তারপর বললে—মাইরি শালাবাবু, আপনি বামুন মানুষ, আপনার এই পা ছুঁয়ে বলতে পারি, ছোটমা’কে আমি ঠাকুর দেবতার মতো ভক্তি করি, ছোটমা’র দুঃখু ঘোচাতে আমি প্রাণ দিতে পারি আজ্ঞে। লোচন, মধুসূদনকাকা ওরা তো তাই হিংসে করে, বলে—আর জন্মে তুই ছোটমা’র পেটের ছেলে ছিলি। তা পেটের ছেলে তো ছোট কথা হলো হুজুর, পেটের ছেলেই কি দেখতে পারে সব মা’কে তেমন মায়ের মতন আবার মা তো হওয়া চাই। তা সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাবু ঘরে এসেছে, আমিই ডেকে এনেছি তাকে। মা ডাকতে পাঠিয়েছিল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছি আজ্ঞে।

ছোটমা বলছে—তুমি আবার যাবে নাকি ওখানে?

ছোটবাবুর তখনও বিষ পেটে পড়েনি কিছু। জ্ঞান আছে বেশ। বললে-যাই যদি তো তোমার কী!

–-ছোটকর্তার তো ওই রকমই কথার ঢং।

ছোটমা বললে-নাই বা গেলেনা গেলে হয় না?

–বউ-এর আঁচল ধরে থাকি তেমন বংশে জন্ম নয় আমার ছোটবউ।

ছোটমা যেন কিছুক্ষণ ভাবলে। তারপর বললে—আঁচল ধরে থাকতে বলছি না, কিন্তু আঁচল না ধরেও তো ঘরে থাকা যায়।

–ঘরে বসে তোমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে নাকি?

—চেয়ে থাকতে ভালো না লাগে চেও না, মুখ ফিরিয়ে থেকো—আমি তোমার সেবা করবো।

ছোটবাবুর হাসির শব্দ শুনতে পেলুম আজ্ঞে। অপগেরাজ্যির হাসি। একটু পরে ছোটবাবু বললে সেবা করতে জানো তুমি ছোটবউ?

ছোটমা বললে—একবার পরখ করেই দেখোনা সেবা করতে জানি কিনা।

ছোটবাবু বললে—আমি তত তোমার যশোদাদুলাল নই, পাথরের কিংবা সোনা-রূপোর ঠাকুরদেবতাও নই—আমি মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ—আমাকে সেবা করতে পারবে? ভেবে দেখো।

ছোটমা’র গলা শুনতে পেলুম—এতে ভাববার কিছু নেই, হিন্দু মেয়েদের স্বামীসেবা শিখতে হয় না।

ছোটবাবু আর একবার হেসে উঠলো আজ্ঞে, সেই অপগেরাজ্যির হাসি। বললে—আমি তো তেমন স্বামী নই ছোটবউ। বড়বাড়ির পুরুষমানুষের জন্মের আগে থেকে মদ খেতে শেখে, মানুষ হয় ঝি-চাকরের কোলে, আটদশ বছর বয়সে অন্দরমহলে ঢোকা বন্ধ তাদের, বয়সকালে রক্ষিতা রাখে, পাল্লা দিয়ে বাবুগিরি করে, মোসাহেব পোষে—এমন স্বামীকে সেবা করে খুশি করা তোমার কম্ম নয় ছোটবউ।

—একবার পরখ করেই দেখো না তুমি।

ছোটবাবু বললে-মিথ্যে পরখ করা ছোটবউ, মেহনতই সার হবে, ঘরের বউরা সে পারবে না, বড়বাড়ির কোনো বউই পারেনি আজ পর্যন্ত, শুধু বড়বাড়ি কেন, দত্তবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, শীলবাড়ি, শেঠবাবুদের বাড়ির কোনো বউ চেষ্টাও করেনি পারেও নি। ওতে অনেক ল্যাঠা, সে পারে ওরা—ওই বাগানবাড়ির মেয়েমানুষেরা–ওরা কায়দা-কানুন জানে।

ছোটমা’র গলার শব্দ কেমন কঁদো কাঁদো শোনালো আজ্ঞে। বললে—এই তোমার পায়ে ধরে বলছি ওগো—দেখো, কেউ পারেনি, কিন্তু আমি পারবো-ওরা সবাই বড়লোকের ঘরের মেয়ে, আমায় গরীবের ঘর থেকে এনেছে। আমি পারবে—তুমি যা বলবে তাই করবো, যেমন করে সাজতে বলবে তেমনি করে সাজবো, যেমন করে কথা বলতে বলবে তেননি করে বলবো,, তোমার মাথা টিপে দেবো, পা টিপে দেবো।

—গান গাইতে পারবে?

ছোটমা বললে—গান তো বাবার কাছে শিখেছিলাম, সেই সব গান যদি তোমার পছন্দ হয় গাইবো।

—নাচ?

ছোটমা বললে—নাচিনি কখনও, কিন্তু শিখিয়ে নিলে তাও পারবে—তোমার জন্যে আমি সব পারি জানো।

ছোটবাবু এবার হঠাৎ বললে—আর মদ? মদ খেতে পারবে? যেমন করে চুনীবালা মদ খায়?

খানিকক্ষণ চুপচাপ। কোনো কথা শুনতে পেলাম না আজ্ঞে। ছোটমা বুঝি ভাবতে পারেনি ছোটকর্তা এমন কথা বলতে পারে। আমিও কেমন যেন বোব হয়ে গেলাম। নিজের সোয়ামী কেমন করে একথা বিয়ে-করা ইস্তিরীকে বলতে পারে আজ্ঞে! ও মদ আর বিষ তো একই জিনিষ, সেই বিষ নিজের ইস্তিরীকে কেমন করে খাওয়াতে পারে মানুষ! তা ছোটবাবু তো আজ্ঞে মানুষ নেই আর। নতুন-মা’র কাছে থেকে থেকে মানুষটার মধ্যে আর কিছু নেই হুজুর। কিন্তু ধন্যি আমার ছোটমা, মা তো নয় সাক্ষাৎ সতীলক্ষ্মী। তা মা-ও সেই কথা বললে—আমার মা’র মতন উপযুক্ত কথাই বললে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে–কী বললে?

—বললে–তা খাবো, মদই খাবো, তুমি হাতে করে তুলে দিলে আমি বিষও খেতে পারি হাসিমুখে।

ছোটবাবু হেসে উঠলো। বললে—কিন্তু নিয়ম তো তা নয়, আমি তুলে দেবো না, তুমিই বরং আমার হাতে গেলাশ তুলে দেবে ছোটবউ।

—তা-ই দেবো, আমি মদ খেলে তুমি যদি ঘরে থাকো তো তা-ই করবো।

শুনতে শুনতে আমার শরীর হিম হয়ে এল শালাবাবু! শেষকালে ছোটমা বিষ গিলবে আর আমরা তাই দেখবো! মনে হলো-বড়বাড়িতে একটি মানুষ ছিল যার পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করতে বুক ভরে যায়, তা সে মানুষটাও গেল। কী যে কষ্ট হলো মনটার ভেতর! মনে হলো গিয়ে মানা করি ছোটমা’কে বলি যে খেয়ো না তুমি, ও বিষ খেলে তুমি বাঁচবে না মা—কিন্তু চাকর হয়ে জন্মেছি, ছোট মুখে বড় কথা মানায় না।

—চলে গেল ছোটবাবু। আমিও অন্ধকারে চলে আসছিলাম আজ্ঞে, কিন্তু ছোটমা ডাকলে। গেলাম।

বললে-তোর শালাবাবুকে একবার ডেকে নিয়ে আয় তো।

বললাম—এখুনি?

ছোটমা বললে হ্যাঁ এক্ষুণি, বলবি খুব জরুরী দরকার। এখনি যেন একবার আসে আমার কাছে।

তাই তো তখন আপনাকে ডেকে আনলাম—তা আমি সব জানি, আমার কাছে আপনি লুকোতে পারবেন না আজ্ঞে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কিন্তু এ জিনিষ কোথায় কিনতে পাওয়া যায় তাও আমি জানি না—কত দাম তাও জানি না। শুধু এই দশটা টাকা আমায় দিয়েছে বৌঠান।

বংশী বললে–ছোটবাবুর মদের আলমারির চাবি তো আমার কাছে, আমি জেনে ফেলবে বলেই আপনাকে কিনতে দিয়েছে ছোটমা, কিন্তু আমি হলে ও বিষ হাতে তুলে দিতে পারতাম না শালাবাবু।

ভূতনাথ বললে—তুই কি বলিস আমি টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আসবো?

–তাই-ই দিন আজ্ঞে—সেই-ই ভালো হবে বরং।

—তবে ফিরে চল। তাই ভালো—ফিরিয়েই দিয়ে আসি টাকা–বলিগে আমি পারবো না।

বংশী বললে—কিন্তু আমার নাম করতে পারবেন না শালাবাবু, বলবেন না যেন আমি বলেছি সব কথা।

আবার সেই পথেই ফিরলো ভূতনাথ। বললেন রে বংশী, তা কখনও বলি।

 ২২. শহর তখন নিঝুম

শহর তখন নিঝুম। কিন্তু বড়বাড়ি তখনও সরগরম। ছুটুকবাবুর আসরে বুঝি অনেকদিন পরে আবার গানের আসর বসেছে। আজকাল সব দিন আসর বসে না। আস্তাবলের ভেতর অনেক গাড়ি-ঘোড়ার মধ্যে ছোটবাবুর ঘোড়া দুটোও আজ পা ঠুকছে। শুধু মেজবাবু নিত্যকার মতো বাইরে গিয়েছেন মোসায়েবদের নিয়ে। তোষাখানায় চাকরদের তাস-পাশা-দাবার আড়ার শব্দ। খাজাঞ্চীখানার দরজায় একটা পাঁচসেরি ওজনের ভারী তালা ঝুলছে। ইব্রাহিমের ঘরের কোণে রেড়ির তেলের বাতিটা থেকে এক ফালি তেরছা আলো এসে পড়েছে শানবাঁধানো উঠোনের ওপর। বড়বাড়িতে সব ঘরে ইলেকটিক আলো জ্বলে আজকাল। তবু রেড়ির তেলের বাতিটা তুলে নেবার কথা কারো মনে আসেনি। বদরিকাবাবুর ঘর থেকে জানালার ফুটো দিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা যায়। আর দেখা যায় এখান থেকে একেবারে বারান্দার ধারে ব্রজরাখালের ঘরখানা অন্ধকার নিস্তব্ধ নির্জীব। জীবনে ওই একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয়ে এসেছে ভূতনাথ। এই কলকাতা শহরে যে-লোকটা শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটতে জানে। আর সেই লোকটাই আজ হারিয়ে গিয়েছে।

পাশ দিয়ে শ্যামসুন্দর যাচ্ছিলো। ভূতনাথকে দেখেই থামলো। ডাকলে—শালাবাবু।

–আমাকে ডাকছিস?

—আপনার একটা চিঠি।

—কোথায় চিঠি?

—মধুসূদনকাকার কাছে আছে, আপনাকে দেবে।

–কা’র চিঠি, ডাকপিওন দিয়ে গেল?

—তা জানিনে—বলে শ্যামসুন্দর নিজের কাজে চলে গেল।

ভূতনাথ একবার দাঁড়ালো। কা’র চিঠি হতে পারে। নিশ্চয়ই ব্ৰজরাখালের। কদিন থেকেই আশা করছিল চিঠির। অন্তত একটা খবর তো দেবে! তেমন মানুষ তো ব্রজরাখাল নয়। কাজের লোক বটে। কিন্তু ব্ৰজরাখাল নেই, আর তার পরিচয়সুবোদেই থাকা এ-বাড়িতে। ব্রজরাখালের অনুপস্থিতিতে কতদিন আর এখানে থাকা যায়। লোকেই বা কী বলবে। আজকাল—সেই চোট লাগার পর এ-বাড়িতে পাল্কি করে আসার পর থেকে ভাত-তরকারি আসে তার রান্নাবাড়ি থেকে। কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। খাজাঞ্চীখানার খাতায় বিধু সরকার প্রত্যেকটি জিনিষের হিসেব রাখে। একদিন দেখতে পেলে হয়তো বলবে—কে তুমি? কোন্ তরফের লোক? নাম কি তোমার? কোন্ খাতায় তোমার নাম? রান্নাবাড়ি না বারবাড়ি না দেউড়ি না তোষাখানা না…

বিধু সরকারের হিসেবের বাড়তি লোক সে। হিসেবের বাইরে এখন সে। এতদিন সে যে ধরেনি কেন, এইটেই আশ্চর্য!

যারই চিঠি হোক সে পরে দেখলেই হবে। এখন আর সময় নেই। ভূতনাথ অন্ধকার পেরিয়ে সেই দক্ষিণের চোরকুইরির বারান্দা দিয়ে আবার গিয়ে হাজির হলো মুখোমুখি। ভেতরে যথারীতি রোজকার মতো আলো জ্বলছে। ছোটবৌঠান বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিল। বেড়া খোঁপাটা এলিয়ে পড়েছে। ঘাড়ের ওপর বিছে হারটা ইলেকটি ক আলোয় চিক চিক করছে। ওদিকে যশোদাদুলালের সামনে দু’চারটে ধূপকাঠি জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হবার মত। আলমারির ভেতরের সেই পুতুলটা যেন কটাক্ষ করলো আবার। চিন্তাকে আশে পাশে কোথাও দেখা গেল না। ভূতনাথ দরজার চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে ডাকলো—বৌঠান?

এক নিমেষে চমকে-ওঠা হরিণীর মতন ঘাড় বেঁকিয়ে দেখেই উঠে পড়লো ছোটবৌঠান। তারপর কাপড়টা গুছিয়ে বললে— কে, ভূতনাথ? এনেছো? তারপর সামনে এসে বললে-দাও।

ভূতনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছোটবৌঠান আবার বললে—কই, দাও দেখি।

ভূতনাথ এবার স্পষ্ট করে জবাব দিলে—আনিনি।

—আনননি? কেন? দোকান খোলা পেলে না?

–দোকান পর্যন্ত যাইনি।

—কেন? পটেশ্বরী বৌঠানের আর বিস্ময়ের সীমা নেই।

ভূতনাথ বললে—আমি আনতে পারবো না বৌঠান, এই তোমার টাকা ফেরৎ নাও-ও-বিষ আমি আনতে পারবো না।

বৌঠান এবার শক্ত হয়ে দাঁড়ালো। তাকালো ভালো করে ভূতনাথের মুখের দিকে। বললে—তুমি আনতে পারবে না তাহলে?

ভূতনাথ বললে–তুমি আমাকে আনতে বোলো না বৌঠান।

-কেন ভূতনাথ, কী হলো হঠাৎ তোমার?

ছোটবৌঠান এবার ভূতনাথেব দুটো হাত ধরে বললে—আচ্ছা পাগল যা হোক, কেউ কিছু বলেছে নাকি শুনি?

ভূতনাথ কেমন যেন নরম হয়ে এল। মনে হলো, এক্ষুণি সে বুঝি কেঁদে ফেলবে। বললে—কেন তুমি খেতে যাবে ওই ছাই-পাশ-ও বুঝি কোনো মানুষ খায়? লক্ষ্মীছাড়ারাই কেবল ওই সব খায় যে।

ছোটবৌঠান বললে–কেন, এ-বাড়ির ছোটকর্তা তত খায়— কেউ না খেলে ওদের দোকান চলে কী করে?

–যে-খায় সে-খায়, কিন্তু তুমি খেতে পাবে না, তোমাকে আমি খেতে দেবো না–কিছুতেই। ওগুলো খেয়ে তুমি বাঁচবে না।

ছোটবৌঠান এবার খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললে–মরাই আমার ভালো ভূতনাথ, স্বামী যার দিকে ফিরে দেখে না, তার বেঁচে থেকে লাভ কী! তবু একবার দেখি না আমার ফেরাতে পারি কি না। মহাভারতে পড়েছি, সেকালের সতীরা কত কী করেছে—কলাবতী, মাদ্রী, লোপামুদ্রা, তাদের মতো হতে চাইছি না, কিন্তু স্বামীর কথা একবার শুনেই দেখি না! ও-খেলে তো কেউ মরে না।

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—মরতে তোমার বড় সাধ, না বৌঠান?

ছোটবৌঠান বললে—না ভাই, বরং ঠিক তার উল্টো, আমার মতো এমন করে কেউ বাঁচতে চায় না সংসারে, তবে স্বামীর জন্যে মরতেও আমার আপত্তি নেই কিন্তু এই না-বাচা, না-মরা অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভূতনাথ।

—কিন্তু এতেও যদি ছোটকর্তার মতিগতি না ফেরে, তখন?… তখন কী করবে বৌঠান?

ছোটবৌঠান বললে—তখন তোমার ভয় নেই ভূতনাথ–তোমায় দোষ দেবে না তা বলে—কাউকেই দোষী করবো না, আমার কপালেরই দোষ বলে মানবব…কিন্তু সে কথা থাক, আমার জন্যে তোমার এত মাথাব্যথা করতে হবে না। এ-বাড়িতে একটা ঘোড়ার জন্যেও ভাববার লোক আছে, কিন্তু বউ বড় সস্তা, বউ মরলে বউ আসবে, কিন্তু ঘোড়া মরলে ঘোড়া কিনতে পয়সা লাগে যে।

–তবে একটা কথা দাও বোঠান, মদ তুমি বেশি খাবে না।

—তা কি হয়, ছোটকর্তা যত খেতে বলবে তত খাবো, আমি যে কথা দিয়েছি, যা বলবে ছোটকর্তা, সব করবো।

ভূতনাথ খানিক থেমে বললে কিন্তু ছি, এমন কথা কেন দিতে গেলে তুমি?

ছোটবৌঠান হেসে উঠলো। গলা নিচু করে বললে তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, না ভূতনাথ!

লজ্জায় ভূতনাথের কান দুটো বেগুনি হয়ে উঠলো। ঝা ঝা করে উঠলো মাথাটা এক নিমেষে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো নামিয়ে নিলে। খানিকক্ষণের মধ্যে মাথা তুলতে পারলো না সে।

ছোটবৌঠান কিন্তু অপ্রস্তুত হয়নি একটুও। বললে—পরস্ত্রীকে ভালোবাসা পাপ-তা জানো তো।

ভূতনাথ একবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো।

ছোটবৌঠান আবার বললে—তা যদি সত্যিই ভালোবাসে। আমাকে—তত ওটা নিয়ে এসো। যদি নিয়ে আসতে পারে আজ রাত্রে তো বুঝবো সত্যিই ভূতনাথ আমাকে ভালোবাসে।

এ-কথার পর ভূতনাথ আর একমুহূর্তও দাঁড়ায়নি সেখানে।

সেদিন বংশীকে নিয়ে সেই রাত্রেই শেষ পর্যন্ত মদ কিনে নিয়ে এসেছিল ভূতনাথ। যে-হাতে একদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর এনে দিয়েছিল বৌঠানের হাতে, সেই হাতেই এনে দিয়েছিল মদের বোতল। আজ অবশ্য অনুতাপ হয় সেজন্য। এত বছর পরে অবশ্য অনুতাপের কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু সেদিন সে তা না দিলে বড়বাড়ির ইতিহাস হয় তো অন্য রকম হতো। কিন্তু তা হোক, ছোটবাবু তো ফিরেছিল। ফিরেছিল তার মতিগতি! এতদিন পরে সেইটেই শুধু ভূতনাথের সান্ত্বনা!

 

তোষাখানার সর্দার মধুসূদন বললে—এই নিন শালাবাবু আপনার চিঠি—কাল থেকে পড়ে আছে।

চিঠি খুলে কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ। চিঠি লিখেছেন সুবিনয়বাবু। মোহিনী-সিঁদুরের মালিক। আলোটার তলায় এসে অত রাত্রেই পড়ে দেখলে।

সুবিনয়বাবু লিখেছেন–

ব্ৰহ্ম কৃপাহি কেবলম্‌–

সুচরিতে,

শুভানুধ্যায় বিজ্ঞাপনঞ্চ বিধায়–

পরে ভূতনাথবাবু, প্রেমময় ঈশ্বরের কৃপায় তুমি এতদিনে নিশ্চয় আরোগ্য লাভ করিয়াছ। তুমি যথাসত্বর আমার সহিত একবার দেখা করিবে। বিশেষ প্রয়োজন বিধায় পত্র লিখিলাম। আমার বড় দুঃসময় যাইতেছে। আমি পাপী, অপদার্থ, আমি অনুতাপ অনলে নিরন্তর দগ্ধ হইতেছি। তুমি আসিলে কথঞ্চিত শান্তি পাইব। ইতি সত্যং জ্ঞানমনন্তং–

নিবেদক,

শ্ৰী……

অত রাতে আর ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র আপিসে যাবার উপায় নেই তখন। কিন্তু রাতটা যেন একরকম জেগেই কাটালো ভূতনাথ। হঠাৎ আধো ঘুমের মধ্যে যেন তন্দ্রা ছুটে যায়। যেন সে বিছানায় শুয়ে নেই। যেন সে ছোটবৌঠানের ঘরে গিয়েছে। পাশাপাশি বসে আছে তারা। চিন্তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বোঠান। অনেক গল্প করছে দুজনে। বৌঠান বলছে—“তুমি আমাকে অত ভালোবাসো কেন ভূতনাথ’। বৌঠানের শাদা চোখের ভেতর দুটো কালো কুচকুচে তারা। তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঠোট দুটো একটা আর একটাকে দাত দিয়ে কামড়ায়। ঠিক দু’ কানের নিচে ঘাড়ের দিকের কয়েকটা চুল উড়ে এসে সামনে পড়েছে। বৌঠান তেমনিভাবে চেয়ে বললে—“আমি যদি মদ খাই—তাতে তোমার কি এসে যায়—আমি তোমার কে বলো না যে, আমায় তুমি বারণ করছে। অসম্পূর্ণ কথার সব টুকরো। ঘুমের ঘোরের মধ্যেই যেন স্পষ্ট দেখতে পেলে ছোটবৌঠানকে। হঠাৎ বৌঠান বোতলটা কাত করে ঢালতে গেল।

ভূতনাথ খপ করে বৌঠানের চুড়িসুদ্ধ হাতটা ধরে ফেলেছে।–তুমি আবার খাচ্ছে বৌঠান?

বৌঠান একবার কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকালো ভূতনাথের দিকে। বললে—হাত ছেড়ে দাও বলছি!

—এই তো খেলে, আবার খাচ্ছো কেন?

ছোটবৌঠান সে-কথার জবাব না দিয়ে বললে—তুমি এবার যাও ভূতনাথ—তুমি এবার যাও—অনেক রাত হয়ে গেল।

—আগে বলো, আর খাবে না।

ছোটবৌঠান বললে—একটু অভ্যেস করে নিই। একটু একটু অভ্যেস না করলে যে হেরে যাবো ছোটকর্তার কাছে—কিন্তু বডেড়া ঝাঁঝ ভূতনাথ।

ভূতনাথ দেখলে—বৌঠান গেলাশটা নিয়ে অতি সঙ্কোচে যেন একবার জিভে ছোঁয়ালো। ছোঁয়াতেই গেলাশটা সরিয়ে নিলে। মুখটা কেমন বিকৃত হয়ে উঠলো। বড় ঝাঝ বুঝি। তারপর আর একবার ছোঁয়ালে জিভে। এবার সবটা। তারপর সমস্ত শরীরটা যেন কেমন শিউরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা পান মুখে পুরে দিলে। দরদর করে ঘাম ঝরছে সারা শরীরে। লাল হয়ে উঠলো। সারা মুখখানা। একটা আবেগ ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কেমন লাগছে এখন?

ছোটবৌঠানের চোখ দুটো স্তিমিত হয়ে এল। শুধু একবার বললে—বড় জ্বালা করছে—আর একটু বরফ-জল দাও তো ভূতনাথ।

ভূতনাথ জল গড়িয়ে দিলে গেলাশে।

জল খেয়ে বৌঠান বললে—আমার ঠাকুরমা’র যিনি মা ছিলেন ভূতনাথ, শুনেছি, তিনি সহমরণে গিয়েছিলেন, মহা ঘটা হয়েছিল সে-সময়ে, তিনি নাকি হাসতে হাঁসতে চিতায় উঠেছিলেন, তার হাতে-পায়ে দড়ি বাঁধতে হয়নি, দেশের লোক ধন্য ধন্য করেছিল—আর আমিও আজ সহমরণে যাচ্ছি ভূতনাথ—দেখো আমি মরলেও ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।

হঠাৎ ভূতনাথ হাত দিয়ে ছোটবৌঠানের মুখ চাপা দিয়ে দিলে–মরা ছাড়া তোমার কথা নেই মুখে।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই কী যে কাণ্ড ঘটে গেল। ছোটবৌঠান নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলে। কোমল হাতের চড়! কিন্তু চড়টা ভূতনাথের গালের ওপর ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

চিৎকার করে উঠলো বৌঠান-যাও, বেরিয়ে যাও—এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।

এক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা-বিপর্যয়ে যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। হঠাৎ মনে হলো যেন ছোটকর্তার জুতোর আওয়াজ কানে এল। আর দাঁড়ানো যায় না। ভূতনাথ ভয় পেয়ে গিয়েছে। এখনি ছোটকর্তা এসে ঘরে ঢুকবে। ভূতনাথ পেছন ফিরে এক নিমেষে চোরের মতো নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে পালিয়ে এসেছে। শুধু মনে হলো তার এই ভয় পাওয়া দেখে যেন হেসে উঠলো বোঠান। প্রচণ্ড হাসি। সে-হাসি আর থামতে চায় না। পাগলের মতো, মাতালের মতো বৌঠান ঘর ফাটিয়ে হাসছে!

আর তারপরেই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল ভূতনাথের। প্রথমটা যেন ঠিক বোঝা গেল না। তারপর জ্ঞান হলে বোঝ গেল, ভূতনাথ তার ছোট চোরকুঠুরিতেই শুয়ে আছে। আর তারপরেই খেয়াল হলো—কে যেন দুমদাম শব্দ করে দরজা ঠেলছে অনেকক্ষণ ধরে। ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখা গেল বংশীকে। বংশী একা নয়। সঙ্গে একজন চীনেম্যান, আর একজন নুরওয়ালা লোক। মনে হয় মুসলমান।

বংশী বললে—কী ঘুম আপনার শালাবাবু-কত বেলা হয়ে গেল, কতক্ষণ ধরে দরজা ঠেলছি!

ভূতনাথ যেন একটু লজ্জায় পড়লো। চারদিকে বেশ কড়া রোদ উঠে গিয়েছে। ছোটঘর বলে বিশেষ কিছু বোঝা যায়নি।

বংশী তখন চীনেম্যানকে বললে—হাঁ করে দেখছো কি সাহেব এই পায়ের মাপ নিয়ে নাও।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কী ব্যাপার আবার?

—আপনার পায়ের মাপ নিতে হবে, ছোটমা’র হুকুম—ছুটুকবাবুর বিয়েতে বাড়িসুদ্ধ লোকের পায়ের মাপ নিতে হচ্ছে যে।

চীনেম্যান পায়ের মাপ নেবার পর বংশী পাশের লোকটিকে বললে—খলিফা সাহেব, এবার তুমি এগিয়ে এসো, দেরি করে না বাপু আবার, একটা কামিজ আর একটা কোট—আমার ওদিকে আবার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। ছোটবাবু আবার আজ বাড়িতে রয়েছে।

মাপ নেওয়া হলো। চীনে মুচি আর ওস্তাগর চলে গেল।

ভূতনাথ ডাকলে–ও বংশী, শোন ইদিকে?

বংশী এল। বড় শশব্যস্ত।

—কী ব্যাপার বল তো? আমার এ-সব কেন?

—আজ্ঞে, এই যে রেওয়াজ, বাড়িসুদ্ধ সবার হচ্ছে আর আপনার হবে না? ভৈরববাবু, মতিবাবু, তারকবাবু, ওঁয়ারা সব এ-বাড়ির কে বলুন না, ওঁদেরও হলো, আর শুধু ওঁদেরই নাকি? ওঁদের ছেলে নাতি সবাই সক্কাল বেলা এসে গায়ের পায়ের মাপ দিয়ে গেল যে—তাই তো ছোটমা বলে পাঠালে

—ছোটমা নিজে বলেছে?

—তা ছোটমা নিজে বলবে না তো কি মেজমা বলেছে। মেজম’র বয়ে গিয়েছে।

কেমন যেন অবাক লাগলো ভূতনাথের। এ ক’দিন এখানে থাকতেই খারাপ লাগছিলো তার। যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে সে এ-বাড়িতে। কোন্ দিন খাজাঞ্চীখানার বিধু সরকার না…

ভূতনাথ বললে—অথচ আমি ভাবছিলাম কোন্ দিন সরকার মশাই হয় তো কী বলে বসবে আবার, ভাবছিলাম ব্ৰজরাখাল নেই, আম