- বইয়ের নামঃ বিজয়া
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
এবার নবীন মন্ত্রে হবে
এবার নবীন মন্ত্রে হবে
জননী তোর উদ্বোধন।
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে,
হবে না তোর বিসর্জন॥
সকল জাতির পুরুষ নারীর প্রাণ
সেই হবে তোর পূজা-বেদি
মা তোর পীঠস্থান।
(সেথা) শক্তি দিয়ে ভক্তি দিয়ে
পাতব মা তোর সিংহাসন॥
(সেথা) রইবে নাকো ছোঁয়াছুঁয়ি
উচ্চ-নীচের ভেদ,
সবাই মিলে উচ্চারিবে
মাতৃনামের বেদ।
(মোর) এক জননীর সন্তান সব, জানি
ভাঙব দেয়াল, ভুলব হানাহানি,
দীন দরিদ্র রইবে না কেউ,
সমান হবে সর্বজন।
বিশ্ব হবে মহাভারত
নিত্য-প্রেমের বৃন্দাবন॥
খড়ের প্রতিমা পূজিস রে তোরা
খড়ের প্রতিমা পূজিস রে তোরা,
মাকে তো তোরা পূজিসনে॥
প্রতিমার মাঝে প্রতিমা বিরাজে
হায় রে অন্ধ, বুঝিসনে॥
বছর বছর মাতৃপূজার করে যাস অভিনয়,
ভীরু সন্তানে হেরি লজ্জায় মা-ও যে পাষাণময়।
(মাকে) জিনিতে সাধন-সমরে
সাধক তো কেহ যুঝিসনে॥
মাটির প্রতিমা গলে যায় জলে,
বিজয়ায় ভেসে যায়,
আকাশ বাতাসে মা-র স্নেহ জাগে
অতন্দ্র করুণায়।
তোরই আশে পাশে তাঁর কৃপা হাসে
(কেন) সেই পথে তাঁরে খুঁজিসনে॥
মানুষ : কে তুমি মা, তোমায় যেন কোথায় দেখেছি।
ভিখারিনি : আমি ভিখারিনি। আমার দুর্বৃত্ত ছেলেরা আমায় তাড়িয়ে দিয়ে, আমায় মৃতা বলে ঘটা করে মাতৃশ্রাদ্ধ করছে, তাই দেখতে এসেছি।
জনৈকা নারী : মা! মাগো! আমি তোকে চিনেছি। মা ছলনাময়ী!–
ভিখারিনি : চুপ! তুই তো চিনবিই, তুই যে আমারই শক্তির অংশ। এই মাতৃশ্রাদ্ধের অভিনয়ে মা, তুইও যোগ দিস্নে ; যদি পারিস, মূর্তিমতি শক্তিরূপে আমার এই সব জড় সন্তানদের মাঝে প্রাণ সঞ্চার কর।
মানুষ : একী! একী! ভিখারিনি কোথায় গেল! ও যেন দেবীমূর্তির মাঝে–
নারী : (মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া) হাঁ, ভিখারিনি দেবীমূর্তির মাঝে বিলীন হয়ে গেল। তোমরা রাংতার ঐশ্বর্য দিয়ে যে যড়ৈশ্বর্যময়ী শ্রীদুর্গার বছর বছর পূজার অভিনয় কর, তিনি ভিখারিনি হয়ে দ্বারে দ্বারে তোমাদের জন্য শক্তি-ভিক্ষা, কল্যাণ-কামনা করে বেড়াচ্ছেন। তাঁরই পূজামণ্ডপে শিব-শক্তি আসেন ভিখারি-ভিখারিনির রূপে। তোমরা মাটির প্রতিমা পূজা কর, তাই প্রাণের প্রতিমাকে দেখতে পাও না, মাকে পাও না।
বিজয়োৎসব ফুরাইল মা গো
[বিজয়ার ঢাক-ঢোল বাজিতেছে। নাট-মন্দির হইতে সানাই-এর করুণ সুর (মুলতানি বা পুরবি) ভাসিয়া আসিতেছে।]
[ঊর্ধ্ব হইতে দেবদেবীদের সংগীত ভাসিয়া ক্রমেই নিকটে আসিতেছে।]
গান
[পুরুষ ও স্ত্রী সমবেত কন্ঠে]
বিজয়োৎসব ফুরাইল মা গো,
ফিরে আয় ফিরে আয়।
মা আনন্দিনী গিরিনন্দিনী
শিব-লোকে অমরায়
ফিরে আয় ফিরে আয়॥
কৈলাসে শিব যাপিতেছে দিন
শব-সম, হয়ে শক্তি-বিহীন ;
সপ্ত স্বর্গ দেবদেবী কাঁদে
আঁধারে মা নিরাশায়॥
(দূরে দূরে শব্দ দূরে চলিয়া গেল।)
[নিম্নে ধরণির সন্তানের আর্ত মিনতি শোনা যাইতেছে – কন্ঠস্বর ক্রমশ নিকটবর্তী হইতেছে।]
মাকে ভাসায়ে ভাটির স্রোতে
জনৈক দেবতা : আমরা দেবতা হলে কী হবে, কথায় ও কান্নায় ধরণির মানুষকে জিততে পারব না।
মানুষ : মা গো! জানি আমরা দুর্বল। রোগ, শোক, দুঃখ, জরা, মৃত্যু অভাব, ঋণে নিত্য-জর্জরিত। আমাদের আয়ু শেফালি ফুলের মতো ; সন্ধ্যায় ফোটে, সকালে যায় ঝরে। তবু তারই মাঝে ডাকি তোকে, এই মায়া, এত অবিদ্যার ঊর্ধ্বে তুলে নিতে। ফুল ঝরে, তার আশা থাকে, পূজারি তাকে কুড়িয়ে স্থান দেবে দেবতার পায়ে। কিন্তু মানুষের জীবনে আজ সে-আশাও গেছে ফুরিয়ে।
দেবতা : দেখেছিস, বলছিলাম না, ওরা কান্না আর চাটুবাদের জোরেই জিতে গেল।
মানুষ : আমরা অসহায়, তাই ছেলে-ভুলানো খেলনা দিয়ে রাখিস ভুলিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে। মাতৃহীন শিশু-সন্তানকে ফেলে দিস দাসীর কোলে, কান্না ভুলাতে দিস হাতে চুষি-কাঠি!
দেবতা : এই রে, সেরেছে! ওরা যা কান্না জুড়ে দিয়েছে, তাতে মা দয়াময়ী এতক্ষণ গলে গঙ্গাজল হয়ে গেছেন বুঝি! দে, ওদের শিগগির রাগিয়ে দে। ওরা একবার রেগেও যদি মাকে চলে যেতে বলে, অমনি মা ছলনাময়ী পালিয়ে আসবেন।
মানুষ : ওই শোন, আমাদেরই মতো হতভাগ্য একদল সন্তান মাকে ভাসিয়ে দিয়ে গান গাইতে আসছে।
গান
মাকে ভাসায়ে ভাটির স্রোতে
কেমনে রহিব ঘরে।
শূন্য ভবন শূন্য ভুবন
কাঁদে হাহাকার করে॥
মা যে নদীর জল-তরঙ্গ প্রায়
ভরা কূলে কূলে, তবু ধরা নাহি যায় ;
রাখিতে নারিনু পাষাণীরে মোরা
পাষাণ দেউল ধরে॥
মানুষ : সত্যই যদি মা পাষাণী হয়, তবে তার সন্তানও হোক পাষাণ। তারাও হোক অনুভুতিহীন, নির্মম। হাঁ, এই আমাদের সাধনা। নিষ্ঠুর হস্তে এই পাষাণের বুক চিরে বহাব স্নেহের নির্ঝরিণী-ধারা।
মাটির ছেলে, দু-দিন পরে মাটিতে মিশাই
(মোরা) মাটির ছেলে, দু-দিন পরে মাটিতে মিশাই।
(আসে) খড়ের প্রতিমা হয়ে মা আমাদের তাই॥
(সে) কয় না কথা, দেয় না স্নেহ-কোল,
মা, মা বলে যতই কেন বাজা না ঢাক-ঢোল,
(তোর) ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা মেটে হয়ে
শ্মশান-ছাই॥
(সে) দেবতাদের চিন্ময়ী মা,
অসুরও পায় দেখা
মা-র অসুরও পায় দেখা–
(মা-র) জড় পাষাণ মূর্তি হেরে
শুধু মানুষ একা রে ভাই,
শুধু মানুষ একা।
(মোরা) মরে এবার আসব অসুর হয়ে,
মুণ্ড মোদের দুলবে, রে ভাই,
মার কন্ঠে রয়ে।
(নাই) বিসর্জন যে জননীর,
(সেই) মাকে মোরা চাই॥
যাসনে মা ফিরে যাসনে জননী
যাসনে মা ফিরে যাসনে জননী
ধরি দুটি রাঙা পায়।
শরণাগত দীন সন্তানে
ফেলি ধরার ধূলায়॥
(মা গো) ধরি দুটি রাঙা পায়॥
(মোরা) অমর নহি মা দেবতাও নহি,
শত দুখ সহি ধরণিতে রহি ;
মোরা অসহায়, তাই অধিকারী
মা গো, তোর করুণায়
দিব্য শক্তি দিলি দেবতারে
মৃত্যুবিহীন প্রাণ,
তবু কেন মা গো তাহাদেরই তরে
তোর এত বেশী টান!
(আজও) মরেনি অসুর, মরেনি দানব,
ধরণির বুকে নাচে তাণ্ডব,
সংহার নাহি করি সে-অসুরে
কেন যাস্ বিজয়ায়॥
(কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে দূরে সরিয়া যাইতেছে)