- বইয়ের নামঃ দাম্পত্য কলহ ও নেকলেস
- লেখকের নামঃ জয়দেব রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
দাম্পত্য কলহ ও নেকলেস
আমাদের বিশ্ববার্তা খবরের কাগজের অফিসে শিবুদা ছিল সিনিয়র সাব এডিটর, বড় মজলিসি লোক, প্রচণ্ড গল্পবাজ। কিন্তু তার সব গল্পের কেন্দ্রবিন্দু সেই দাম্পত্যকলহ। ও মিলন। বয়সের তারতম্য দাদা মানত না, আমরা যে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, অনেকের যে বিয়ে পর্যন্ত হয় নি, সে সব কথা তার মনে থাকত না, মুখ ছিল বড় আলগা। তার স্ত্রী পদ্মা বউদিকে আমরা ভাল করেই চিনতাম; মোটাসোটা গোলগাল চেহারা, গৌরবর্ণের, বেশ সুদর্শনা। যৌবনে মনে হয় বেশ সুন্দরী ছিল, একমুখ পান নিয়ে সদা হাসি মুখে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। ছেলেমেয়ে নেই।
শিবুদা বেশ কয়েকদিন অত্যন্ত গম্ভীর। নিশ্চিত বউদির সঙ্গে আবার মনোমালিন্য ঘটেছে। এরকম প্রায়ই ঘটত, নিঃসন্তান, নির্ঝঞ্ঝাট মধ্যবয়স্ক দম্পতির মধ্যে অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে যেমন বিবাদ ঘটত, তেমনই সহজে মীমাংসা হয়ে যেত।
ইদানীং টিফিনের মোটা কৌটাটা খুলে যেমন প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে ভাগ করে টিফিন খেত আজকাল টিফিনই আনছে না, অজিতের কাছে টোস্টঘুগনি খাচ্ছে। পানের কৌটাও শূন্য।
সোমবার একেবারে দৃশ্য বদলে গেল, এক মুখ হাসি। কাছে গিয়ে টের পেলাম, রুমালে সেন্ট, গায়ে মেখেছে। এসেই পানের ডিবা খুলে আমাদের পান খাওয়াল, আর সর্বদাই মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তাল বুঝে পন্টু বলল, পদ্মা বউদি পান সাজেন ভাল। আর আজ দেখছি মস্ত বড় টিফিনের কৌটা। ব্যাস, আর বলতে হল না, শুরু হয়ে গেল শিবুদার আত্মপ্রসাদ, কিন্তু শেষে একটু খেদও আছে।
শিবুদা বলল, সব তত ভাল। কিন্তু এ বয়সে নতুন নতুন গয়নার লোভ যে বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। পাড়ার গিন্নিদেরও আর কাজ নেই, নতুন গয়না গড়লেই এসে সর্বপ্রথম তাকে দেখিয়ে যাবে। আর আমার হয়েছে গেঁরো, বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়ের মাথায় গোরার গয়নার দোকান। আর তাকে তো ডাকতেই হয় না। সে দেখি, সবসময়ে চোরের মতো বাড়িতে ঘুরঘুর করে। আর পাড়ার মস্তান ছেলে, তাকে তো কিছু বলা যায় না। তোদের বউদির সঙ্গে ফিসফিস করে কি সব হিসাব দেয়। আর আমাকে দেখলেই চুপ! এবার আবার মল্লিক বৌদি খুব দামী কি একটা নেকলেস বানিয়েছে, তাকে ডেলিভারি দেওয়ার আগে হারামজাদা মামিমাকে একবার না দেখিয়ে কি যেতে পারে? এই নেকলেসটার দাম কত জানিস?
বললাম, তা হোক, আপনাদের মতো আদর্শ দম্পতি একটিও নেই। ৪০ বছর ধরে একটানা ঘর করছে। না দিলেই বা….।
ধমকে উঠল শিবুদা, আহারে! আমার রিটায়ারমেন্ট এসে গেল। এখন এভাবে এতটাকা গয়নায় ঢালা কি সম্ভব?
এই নিয়ে কদিন ঘোঘারতর মনোমালিন্য চলছিল, তবে একটা নাকি সুরাহা হয়েছে। পুরানো সোনা ছিল, সেগুলো দিয়ে তোদের বউদি নেকলেসটা ইতিমধ্যে গড়িয়ে ফেলেছে।
হাসিমুখে বললাম তবে কি! আপনার গ্যাট থেকে তো কিছু খসছে না। গয়নায় গয়না আনছে।
—যাচ্ছে না মানে? মজুরি কত চেয়েছে জানো? কোথা থেকে অত টাকা দেব? তবে তোমার বউদির মাথাটা সাফ আর গোরাও বেশ সজ্জন। কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা দেওয়ার রফা হয়েছে।
আশ্চর্যভঙ্গীতে আমরা বললাম, তা হলে দাম্পত্যকলহ চুকেছে এবার আর কি? আমরা আবার টিফিনের ভাগ পাব…ইয়ে….তার হাতে তৈরি এমন অপূর্ব টিফিন।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা–
শিবুদা দুঃখ করে বলছিল, কখনও ভাই, এমনটি ভুল আগে করি নি। জানই তো ৪০ বস্ত্র আমাদের বিয়ে হয়ে গেল, দুজনেরই বয়স ৫০ ছেড়ে ৬০-এ ধরতে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষে কি ওসব সাজে? তবু এমন অপকর্ম যে কি করে করে বসলাম জানি নে! সাধারণত আমরা বিয়ে বাড়িটাড়ি যাইনে। এখানে কিন্তু লেকসাইডে না গিয়ে উপায় ছিল না। আর জানই তো, বিয়েবাড়িতে যা সব খাওয়ায়, অন্য সময়ে তা মুখে দিতে তোমার সাহসেই কুলোবে না। বাস্তবিক খাওয়াটা বেশ জোরালো হয়ে গিয়েছিল।
প্রভাত অবিশ্যি বলেছিল, চলুন, আপনাদের নামিয়ে দিয়ে যাই। যাবার পথেই তো পড়বে।
তোমার বউদি আমাকে ফিসফিস করে বললনা, না। ওদের সঙ্গে আমি বাপু যাচ্ছি নে। ওর মুটকি বউটা এমন দেমুকে যে পাশে বসতে ইচ্ছা করে না। কেবলই ছেলেমেয়েদের কৃতিত্বের কথা ফলাও করে বলবে। ওর বড় ছেলে এত মাইনে পায়, ছোট ছেলে স্টেটস-এ যাচ্ছে। মেয়েদের জন্যে পাত্রদের মধ্যে হাতাহাতি হচ্ছে—এইসব।
তার চেয়ে চলো, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে যাই। পেটটা এত ভরে গিয়েছে, হাঁটলে হালকা হবে, হজম হবে আর কি? খানিকটা হাওয়া লাগলে মাথাও ঠাণ্ডা হবে। এতক্ষণ বদ্ধ জায়গায় হাঁফ ধরে গিয়েছে।
বহু বছর পরে দুজনে পায়ে হেঁটে লেকের পাশ দিয়ে ফিরছিলাম। ঘদিকেই লোক, আর যত বেড়াবার লোক, তার চেয়ে বেশি ফেরিওয়ালা। কিনা জিনিস তাদের নেই বেচবার? এখন তবে চিনাবাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়িওয়ালা আর হজমিগুলি। বিক্রেতারই বেশি ভিড়। তাদের সকলের এককথা সারাদিন কিছু বিক্রি হয়নি, এক প্যাকেট নিলে বউনি হত।
পেট ভরে খেয়ে হাঁসফাস করছি, এখন এসব জিনিস দেখতেও ভয় লাগছে। তোমার বউদি বলল, পান পেলে মন্দ হত না!
এত লোকের ভিড় এড়িয়ে আমার টালিগঞ্জ রেলষ্টেশনের কাছাকাছি একটা শূন্য বেঞ্চিতে বসলাম। জায়গাটা অন্ধকার নয়, বেশ আলো পড়ছে, তবে নির্জন। তবু এত গয়নাগাটি পরে নির্জন জায়গায় বসাটা আমাদের পক্ষে বোকামি হয়েছে তা ভাবা উচিত ছিল। তবে এত আলো পড়ছে, অবিরাম লোক যাচ্ছে। আর দু’পা গেলেই তো, বাড়ি।
একটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধবুড়ো লোক তখন থেকে পেছনে লেগে আছে, দেখুন মা, খুব ভাল চানাচুর। এক প্যাকেট নিয়ে দেখুন।
স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বললনা বাবা। বললাম না, আমাদের চাইনে। ঘোমটা তার খোলা ছিল, গলার নেকলেসটা স্পষ্ট চোখে পড়ছিল সকলের। তাকে অনেক করে মানা করেছিলাম—এত দামী গয়না পরে প্রকাশ্যে বেরিও না।
তার স্পষ্ট বক্তব্য—এটা লোককে দেখাতে না পারলে আর কি লাভ? হালে তৈরি করেছি, লোকের চোখ টাটাক তারিফ করুক!
এই সময়ে আমাদের তিন চারজন ফেরিওয়ালা ও পথচারী ঘিরে ফেলেছিল। আর সত্যিই ম্যাজিক! স্ত্রী হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—আমার নেকলেস?
সবকজনই নিঃশব্দে সরে পড়েছিল, অন্য কিছু লোক দৌড়ে এল। বার কণ্ঠে সহানুভূতিপূর্ণ ধিক্কার—এই রাত্রিতে এত দামী গয়না পরে এখানে বসেছিলেন কোন্ আক্কেলে?
সবাই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। আমরা সশব্দে বাড়ির দিকে চললাম। আমি ব্ৰিক্তিতে গজগজ করতে করতে আর স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে। এত দামী জিনিসটা এমনভাবে হারানোর দুঃখে বাড়ি গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। ফ্ল্যাট বাড়ি, সব বাড়ি থেকে গৃহিণীরা ছুটে এল। খবর শুনে তারা বেজায় খুশি; যেমন মাগী দেমাক দেখাতে গিয়েছিল। বেশ হয়েছে!
কেউ-কেউ বলল, তোমার বুদ্ধি আর কবে হবে লো! এমন দামী জিনিস পরে রাস্তায় বসতে গিয়েছ?
একজন প্রতিবেশী বলল—ঐ রকম অরক্ষিত স্থানে গেলেই বা কেন?
অন্য সবাই একবাক্যে প্রতিবাদ করে উঠল—কোন্ জায়গাটা সুরক্ষিত বলতে পারেন? এসব কথা বললে উনি বলবেন—এমনটিতে কতই হয়।
একজন পরামর্শ দিল—যান না, একটা ডায়েরি করে আসুন। কাতরভাবে বললাম—আমার সঙ্গে আপনারা যদি কেউ যেতেন….। সবাই নিঃশব্দে সরে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমি একাই গেলাম। তারা তো প্রথমেই যুক্তি দেখালো ও জায়গাটা আমাদের এলাকা, না, লেক থানার এলাকা? ঠিক কোন্ জায়গাটায় আপনারা ছিলেন, বলুন তো?
অনেক তর্কাতর্কির একজন বলল, ঠিক আছে। ডায়েরি নিয়ে নাও, আর নিলেই বুঝি কিছু হবে মনে করছেন? ও, বিনোদ কোথায় গেলে। তবে বলিহারি যাই মশাই, এই বয়সে মেয়েছেলে নিয়ে লেকে বসতে গেছে? আচ্ছা, তিনি নিজেই হাতান নিতো?
হাতজোড় করে বললাম—সঙ্গে যিনি ছিলেন। তিনি আমার আপন স্ত্রী, একরূপ বলতে পারেন একই মায়ের পেটের….। মানে তার নিজের জিনিস তিনি কেন লুকাতে যাবেন?
লোকটির নাম বোধহয় রামহরি, সে হেসে বলল—আজকাল আকছাড়ই এমনি হচ্ছে, মোশাই।
বিনোদ আর আসে না, একটু বিরক্তি প্রকাশ করল রামহরি, ঋজিয়ে উঠল—ওর নাইট ডিউটি, একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। ঝামেলা বাধাবেন আপনারা, আর খেটে মরব আমরা।
বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার প্রেসকার্ডটার কথা মনে পড়ে গেল। ইন্সপেক্টারের ঘরে গিয়ে প্রেসকার্ডটি দেখিয়ে বললাম আমি বিশ্ববার্তা পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। একটা কেস লেখাতে এসেছিলাম।
ইন্সপেক্টার ফোনে কার সঙ্গে চাপা গলায় টাকা পয়সা লেনদেন নিয়ে কথা বলছিল। ফোনটার মাউথপিসটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল—আমার কাছে। আপনাকে কে পাঠিয়েছে? জরুরি কাজ করছিলাম….
তারপর সমস্ত ব্যাপারটা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল—ছেলে ছোঁকরারা লেকে গিয়ে প্রেম করে, আপনারা গেলেন কোন লজ্জায়? বিনোদকে ডাক…।
ঘুম ভেঙে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিনোদ এসে সেলাম করে দাঁড়ালে তাকে বেশ রাগতভাবে বলল—লোকটা আমার কাছে এসে সাফাই গাইছে। দেখো তো ব্যাপারটা।
আবার ফোন নিয়ে সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাইরে বেরুলে বিনোদ আর রামহরি আমাকে ধমকাতে লাগল—ও ঘরে গেলেন কেন?
তবে শেষ পর্যন্ত ডায়েরি লিখে নিয়ে বলল—আর কোনদিন লেকের এ দিকটায় মেয়েছেলে নিয়ে বসবেন না। কানা বাঞ্ছাকে কথা দেওয়া আছে। তার তো প্রেস্টিজ আছে।
টেবিলের ওপর কাচ চাপা থানা এলাকার ম্যাপ পড়েছিল, পাশে পাশে লাল দাঃ দেওয়া। আমার বসার জায়গায় লাল পেন্সিলে গোল করে লেখা কানাবাঞ্ছার এলাকা।
ব্যাপারটার এখানেই ইতি হত। কিন্তু পরদিন আমাদের কাগজে খবরটা বেরুলো ‘লেক এলাকায় সাংবাদিক সর্বস্বান্ত।’
নেকলেসটা হারানোর পর তাদের দাম্পত্য কলহ যে কতটা গুরুতর অবস্থা ধারণ করল আমরা বুঝতে পারলাম। যে শিবুদা কোন দিন নাইট ডিউটি করত না, বউকে একা রেখে আসবে না বলে, সে আমাদের সঙ্গে শিফট বদল করে নাইট ডিউটি নিতে লাগল, অজিতের দোকানে তার টিফিন বরাদ্দ হয়ে গেল। একদিন কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল–পদ্ম আমার ওপর এমন রেগে আছে যে, কয়েকদিন বাড়িতেই থাকছে না, বোনেদের বাড়ি গিয়ে বসে আছে। আচ্ছা, আমার দোষটা কোথায় বলো তো?
ওর মম্ব্য শুনলে আমার এই বয়সে ডিভোর্স করতে ইচ্ছা করছে, যে সমস্ত পুরুষমানুষ নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে না, তার মরণই ভালো। আচ্ছা, আমি কি করতে পারতাম?
আমরা কি আর বলব, চুপ করে থাকলাম। হঠাৎ, উত্তেজিত হয়ে শিবুদা বলল, যেমন করে হোক, আমি নেকলেসটা উদ্ধার করবই। তোদের বউদি আমাকে কি ভেবেছে—তাঁ। আমি যে পুরুষ মানুষ তা প্রমাণ করে ছাড়ব।
ক’দিন পরে শিবুদা বলল কাগজে খবরটা পড়ে নেকলেসটা যে বানিয়েছিল, সেই গোরা এসে নতুন ঝামেলা বাধালো। আমাকে দোকানে ডেকে এনে চুপিচুপি বলল—আমার তৈরি মল আমার কাছেই ফিরে আসবে, মেলোমশায়! তার আগে একটু চেষ্টা করবেন….।
একটু ইতস্তত করে বলল—আমাকে ছাড়া মাসীমা আর কোথাও গয়না গড়ান। তা ছাড়া, এই নেকলেসটা তাঁর বড় পছন্দ ছিল। একটা কাজ করবেন, আমার সঙ্গে একবার কানাবাঞ্ছার ডেরায় যাবে?
ভয়ে বুক ধুকধুক করে উঠল। একবার পুলিশের আড্ডায় গিয়ে মোক্ষম শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এখন আবার চোরের ডেরায়?
চোর তো নয়, একবারে খোদ গুণ্ডারাজের আড্ডায়।
তবু স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে গোরবে সঙ্গে চেনার একটা ঘিঞ্চি বস্তিতে একটা আলাদা ঝকঝকে পাকাবাড়িতে গেলাম। একজন খবরদার এসে আমাদের (আমাদের নয়, গোরার শুধু নামটা জেনে চলে গেল। একটুক্ষণ পরে এসে বলল—যান, ভিতরে।
ভিতরে একটা এয়ারকণ্ডিশন করা মস্ত ঘর। চার দিকে সোফা কেঁচ, মেঝেতে একটা পার্সিয়ান গালিচা। সাত-আটটা বদখদ দেখতে লোক সব গালিচাতে বসে। সোফাগুলি খালি। আমরা ঢুক, সবাই কটমট করে দেখছিল। মাঝখানে একটা ডিভানে শুয়ে দুটি পা টেবিনে তুলে সিগারেট টানছিল অত্যন্ত কদাকার একটা লোক। সারা মুখে তার বসন্তে দাগ, একটা চোখ আবার কানা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গলায় একটা সোনার চেন। খালি গায়ে লুঙ্গি পরনে।
আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে গোরাকে বলল—কি গোরা সাহেব? কি মোতলব?
সে রীতিমত কুর্নিশ করে আমার পরিচয় দিয়ে বলল কয়েকদিন আগে রাত্রিতে ওঁর স্ত্রীর গলা থেকে লেকের ষ্টেশনের নিচে নেকলেসটা গায়েব। আমারই তৈরি নেকলেসটা। আর ইনি আমার মেসোমশাই।
চোখবুজে কানা বাঞ্ছা বলল—দে ওখানে যেদিন কেকে ডিউটিতে ছিল।
তারপর আমাকে খেকিয়ে উঠলকত রাত বললেন? দশটা নাগাদ? অত রাতে ওখানে কি গীতাপাঠ করছিলেন?
একজন খাতা খুলে গম্ভীর হয়ে বলল–৭ নং সেক্টরে ডিউটিতে ঐ সময়ে থাকবার কথা আবদুল বারি আর হারুর।
এবার কানা বাঞ্ছ উঠে বসল, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল-কতবার বলেছি হিন্দু এলাকায় মুছলমান দিবি না। তবে ঐ হারামজাদা বদমাইশ ভারি দপ্তরি থাকে কি বলে?
তারপর প্রসন্ন দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বলল, ঘাবড়াবেন না। রিপোর্টারদের আমি যাস্তি খাত্রি করি। আপনার কাগজে খবরটা বেরোনর পর বেশ ভাল বিজনেস হচ্ছে। আপনি বেফিকির চলে যান। আজ রাত্রির ৭টা নাগাদ আমার ছেলে গিয়ে আপনার মাল ফের দিয়ে আসবে। আমদের কাছে কোন তঞ্চকতা পাবেন না। ঠিক সাতটার সময়ে মাল পাবেন। তবে ওদের একটু পানিটানি খেতে দেবেন ধরুন, গোটা পঞ্চাশেক টাকা। কত পরিশ্রম ওরা করবে তা তো জানেন না।
ঠিকানা বলতে গেলাম, যে বলল–আপনার এলাকার সব বাড়ি আমি চিনি। তিনতলার সামনের ফ্ল্যাটটাতে তো, সামনে বারান্দা আছে একফালি।
ঠিক সাতটার সময়ে বাড়ির সামনে একটা মোটর সাইকেল থামল, দুটি সুদর্শন ছোঁকরা নেমে এসে আমাদের সেলাম করে বলল, সাহেব পঠিয়েছেন।
একজন পকেট থেকে প্লাস্টিকে মোড়া জিনিসটা দিল। আমার স্ত্রীতো নাচতে লেগেছে—এই তো আমার সেই নেকলেস। এই তো গোরার নাম মনোগ্রাম করা আছে পেছনে।
আমি টাকাটা দিতে গেলে ওরা হেসে বলল-স্যার ঠাট্টা করেছিলেন। আপনার। কাছ থেকে কিছু নিতে বারণ করে দিয়েছেন।
তারা নিঃশব্দে চলে গেল।
গোলমালটা বাধাল আমার স্ত্রী। আনন্দে আত্মহারার হয়ে যে সমস্ত, ফ্ল্যাটবাড়ি, পাড়া, আত্মীয়স্বজন সবাইকে জনে জনে দেখিয়ে বেড়াতে লাগল, ওরা নিজেরাই ফেরত দিয়েছে। কেউ বিশ্বাস করল না, নিশ্চয়ই উনি ওটা বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে রেখে আবার খুঁজে পেয়েছেন বলে লাফাচ্ছেন। এও কি কখনও সম্ভব? চোর এসে গৃহস্থের কাছে চোরাই মাল ফিরিয়ে দেয়।
শিবুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আবার সেই দাম্পত্য কলহ, আমার সম্পর্ক তোদের বউদি একেবারে ত্যাগ করেছে। বলছে, কাগজে ফলাও করে মিছামিছি এত হৈ চৈ করেছি, এখন কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না যে, হারটা আমার ছিনতাই হয়েছিল। গোরার কাছে আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না।
বললাম—গোরা মানে আপনার সেই স্যাকরা ছেলেটা? শিবুদা মুখ গম্ভীর করে বলল—সে সত্যিই খুব বিরক্ত। বলল, আপনি কি আমার নাম কাউকে বলেছেন? এ পাড়ায় গগন পিরখ নামে একজন ব্যবসাদার স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে পাটি থেকে ফিরছিল গভীর রাতে। পথে একদল লোক গাড়ি থামিয়ে তাদের সব অলঙ্কার কেড়ে নিয়েছে। এখন আমাকে এসে ধরেছে সেগুলো উদ্ধার করে দিতে। আমি অবশ্য স্রেফ বলে দিয়েছি, আপনার নেকলেস আমি উদ্ধার করে দিই নি। কি জানি আমাকে আবার কোন গণ্ডগোলে না ফাসায়, শুনলাম বিজেপির লোক সে।
শিবুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে স্ত্রীর সেই সাধের নেকলেসটি লকারে বন্ধ করে রেখেছি।