ভূতনাথ দেখতে লাগলো! কী অপূর্ব যে লাগলো দেখতে। এত যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বড়বাড়ির, সে ঐশ্বর্য নেই, সে নামডাক নেই, নেই সেই ভোগ, কিন্তু আশ্চর্য, বৌঠানের রূপের যেন পরিবর্তন হতে নেই। প্রথম যেদিন বৌঠানকে দেখেছিল এই ঘরে, আজ এত বছর পরেও সে-রূপ যেন তেমনি আছে। তেমনি অটুট, তেমনি উজ্জ্বল, তেমনি মাথাভরা চুল। তেমনি দুধ-সোনা রং। তেমনি গড়ন, তেমনি স্বাস্থ্য। সত্যি, জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ। যে বলেছিল—সে একতিল বাড়িয়ে বলেনি। পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত একটু কি কোনো খুত থাকতে নেই! ভগবান মানুষকে এমন নিখুত করে এই বুঝি প্রথম গড়েছে। মনে হয়— আজকাল যেন বয়েস আরো কমে এসেছে বৌঠানের, রূপ যেন আরো ফেটে পড়েছে শরীরে। দুঃখে কষ্টে রূপ যেন খুলছে বৌঠানের আরো।
ভূতনাথ বললে—আমি এসেছি বৌঠান।
—ওমা, তুই? হঠাৎ চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বৌঠান।
ভূতনাথ এমন সুস্থ অবস্থায় অনেকদিন দেখেনি বৌঠানকে।
—দেশে যাসনি ভূতনাথ?
ভূতনাথ বললে—না।
—তবে যে বললি যেতেই হবে, না গেলে চলবে না—বলে বৌঠান মেঝের ওপর বসলো।
ভূতনাথও বসলো সামনে। বললে—দেশে যাবার কাজ এখানেই মিটে গেল, তাই আর গেলাম না—কিন্তু আমি আর একটা কথা বলতে এসেছি বৌঠান। এবার ভাবছি এখান থেকে চলে যাবো–অনেকদিন তো রইলুম তোমাদের গলগ্রহ হয়ে।
বৌঠান কী যেন ভাবলে। তারপর বললে—যাবি? কোথায় যাবি?
ভূতনাথ বললে—কোথায় যাবে তা ঠিক করিনি এখনও—কিন্তু যাবো-অনেকদিন কষ্ট দিলুম তোমাদের।
বৌঠান রেগে গেল। বললে—মিথ্যে কথা বলতে তোর মুখে বাধলো না ভূতনাথ?
–মিথ্যে নয় বৌঠান—আর এখানে থাকা ভালো দেখায় না।
বৌঠান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—নিজের সংসার-ধর্ম করতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?
ভূতনাথ মুখ নিচু করে বললে—যদি হয়, তাতে কিছু অন্যায় আছে কি?
—অন্যায় কিছু নেই, কিন্তু সংসার-ধর্ম এ-বাড়িতে থেকেও তো হয়, এ-বাড়িতে এত ঘর পড়ে আছে, বিয়ে করে এখানেই থাকবি, আমি তোকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বিয়ে করতে পাঠাবো, আমার বাড়ির বউ আসবে, দুধে আলতায় পা ঠেকিয়ে বউকে বরণ করে ঘরে তুলবো, এ যে আমার বহুদিনের সাধ রে ভূতনাথ।
—কিন্তু তোমার এ-সাধ কোনো দিন পূর্ণ হবে না বৌঠান।
–কেন?
—হবে না, তোমার ভাগ্যে নেই বলে। কিন্তু সে কথা থাক, আমি যাবোই, আমাকে আর তুমি ঠেকিও না বৌঠান, হাসিমুখে আমাকে যেতে দিও, নইলে আমার আর যাওয়া হবে না। তোমাকে কাঁদিয়ে আমি বোধহয় স্বর্গে গিয়েও সুখ পাবে না।
বৌঠান হাসতে লাগলো। বললে—কিন্তু তোকে যদি আমি যেতে না দিই ভূতনাথ?
ভূতনাথ বললে—ঠিক জানি না বৌঠান, কিন্তু তুমি যেতে না দিলে আমার বোধ হয় আর যাওয়াই হবে না।
বৌঠান বললে—তবে আর যাস নে ভাই, তবু জানবো মরবার সময় আমার জন্যে একজন লোকও কাঁদবে। গুরুদেব বলেছিলেন পটু সিঁথেয় সিঁদুর নিয়ে মরবে, তাই যদি হয় তো ভালো, কিন্তু তা কি হবে? আমার কপালে তা কি সইবে! দিনরাত তো তাই আমার যশোদাদুলালকে বলি যেন ছোটকর্তাকে রেখে আমি আগে যেতে পারি। তোকে বলে রাখলুম, সেদিন তুই আমায় তোর মনের মতো করে সাজিয়ে দিস ভূতনাথ, আমার সিঁথিতে জবজবে করে সিঁদুর লাগিয়ে দিবি, পায়ে আলতা পরিয়ে দিবি, আমার প্যাটরা থেকে বিয়ের দিনের বেনারসীটা পরিয়ে দিবি, গয়নাগাটি সর্বাঙ্গে পরিয়ে দিয়ে আমায় সোনায় মুড়ে দিবি। লোকে যেন বলে—সতীলক্ষ্মী বউ গেল।
ভূতনাথ চুপ করে শুনতে লাগলো। তারপর হঠাৎ বললে— আচ্ছা, আমি যাবো না বৌঠান, কিন্তু…
–কিন্তু কী রে?
—কিন্তু বলছিলাম, যদি আমি ব্রাহ্ম বউ নিয়ে আসি, তাকে ঘরে নেবে তুমি?
–ব্রাহ্ম? কেন রে।
–ধরো যদি তাই-ই হয়, তুমি ঘরে নেবে না তাকে?
—কেন নেবে না, আমার বউকে আমি ঘরে নেবে তাতে কে কী বলবে? তুই বিয়ে করতে পারবি, আর আমি ঘরে নিতে পারবো না—এ তুই কী বলছিস রে?
—তবে আমি বউ আনববা বৌঠান।
–সত্যি তুই বিয়ে করবি ভূতনাথ?
–বিয়ে আমি করেছি বৌঠান।
–করেছিস? কবে রে? আমায় বলিস নি তো?
—তোমায় বলবো কি বৌঠান, আমি নিজেই জানতাম না, আমার তখন পাঁচ-ছ’ বছর বয়েস… বলে সমস্ত ঘটনাটা আগাগোড়া বলে গেল ভূতনাথ। সমস্ত। সমস্ত কিছু বাদ দিলে না। সেই ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র আপিসে চাকরির পর থেকে কেমন করে পরিচয়, তারপর ঘনিষ্ঠতা, সুবিনয়বাবুর মৃত্যু। তারপর কেমন করে নন্দজ্যাঠার কাছ থেকে সমস্ত জানতে পারা।
বৌঠান বললে—তবে আন, আজকেই নিয়ে আয় ভূতনাথ, আমার বহুদিনের সাধ রে যে, বড়দি’র মতো আমিও বউ ঘরে আনবে। তা হলে বংশীকে বল—জিনিষপত্তোর যোগাড় করুক, ধান, দুর্বো, মিষ্টি, কাপড়, গয়না—এখন নতুন করে কখন আর গয়না গড়াবো, আমার শাশুড়ীর সেই জড়োয়া চিকটা দিয়ে তা হলে বউ-এর মুখ দেখবো-কী বলিস–ওরে চিন্তা…
ভূতনাথ বললে—কিন্তু বৌঠান, আজ বউ না এনে একবার বরানগরে গেলে হয় না?
-না, বরানগরে যাওয়া থাক, আজ আমি আমার বউ-এর মুখ দেখবো ভূতনাথ।
৪৮. সেদিন চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে ভূতনাথ
সেদিন চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে ভূতনাথ আবার এই সক কথাই ভেবেছিল। হয় তো বৌঠান নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল সেদিন। ভূমিপতি চৌধুরীর আমল থেকে বংশপরম্পরায় যে-পাপ জমে-জমে পাহাড় হয়ে উঠেছিল, তার বুঝি সন্ধান রাখতে না বৌঠান। ১৮২৫ সালে প্রথম যেদিন কলের জাহাজ এসেছিল, প্রথম রেল লাইন পাতা হয়েছিল দেশের মাটিতে, সেই নতুন যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলে না বলে একটা বংশ এমন করে ধাপেধাপে নেমে এসেছিল। তখন বুঝি আর তার ওঠবার উপায় নেই। বৌঠান একা চেষ্টা করে কী করবে! হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে সমস্ত ইতিহাসটা আলোচনা করতে গিয়ে বার-বার কেবল পটেশ্বরী বৌঠানের মুখটি মনে পড়তো! অমন করে এত ভালোবাসা ভূতনাথ আর কারোর কাছ থেকে জীবনে পায়নি! কোথায় কেমন করে কবে যে বৌঠানের মনের কোণে একটু ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল তা আজ আর মনে নেই। তার জন্যে যতটুকু কৃতিত্ব তা পুরোপুরি বৌঠানেরই। ভূতনাথ তার সামান্যতম অংশও দাবি করতে পারে না যেন।