ভূতনাথ বংশীর মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। বংশী তার দৃষ্টি তখন অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে। বললে—কিন্তু কেন দেখা করবে না, আমাকে তা বলবে তো? আমার ভালোটা না-হয় আমাকেই জানালে?
বংশী বললে—সব কথায় আপনার কান দেওয়া চাইনা শুনলেই ভালো করতেন। যা হোক, এই এখন বেণী এসেছিল, সে-ই এখন আমাকে বলে গেল।
-কী বলে গেল?
—আপনি যেন আবার কাউকে বলবেন না, বেণী আমাকে চুপি চুপি বলে গেল—মেজবাবু সব খবর পেয়েছে এ-বাড়ির, আপনাকে মারবার জন্যে গুণ্ডা রেখেছে আজ্ঞে।
ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। বললে—আমাকে মারবার জন্যে। গুণ্ডা রেখেছে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, মেজবাবুকে তো আপনি চেনেন না, গুণ্ডা কি। আজ থেকে আছে? সেকাল থেকে দেখে আসছি মেজবাবু গুণ্ডা। পোষে, মেয়েমানুষ মদ যারা করে,তাদের গুণ্ডাও রাখতে হয় আজ্ঞে, ও বরাবর আছে। ছোটবাবুর গুণ্ডার দল ছিল জানবাজারে, ছেনি দত্তর ছিল, ও সকলেই রাখে, নইলে অত রাত্তির করে ঘোরাফেরা। করে, গুণ্ডা না রাখলে কলকাতা শহরে চলবে কেন।
–-তা গুণ্ডা আমাকে মারবে কেন?
–ওই যে আপনাকে দেখেছিল সেবার ছোটমা’র ঘরে, তারপর খপর তো’সব পায়, গরাণহাটায় চলে গিয়েছে বটে, কিন্তু খপর সব রাখে এ-বাড়ির। কী দিয়ে আমরা ভাত খাই, কী করি, সব খপর যায় গরাণহাটায়।
-কী করে যায়?
—শুধু কি গরাণহাটায়! পাথুরেঘাটায়, ছুটুকবাবুর শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত এ-বাড়ির রোজকার খপর চলে যায়, আবার গরাণহাটা, পাথুরেঘাটার খপর আমরা জানি। ঝি-চাকর থাকলে এমন খপর–চালাচালি তো হবেই শালাবাবু।
-কিন্তু আমাকে গুণ্ডা দিয়ে কেন মারবে বংশী?
-আমি তো জানি না কিচ্ছু, বেণী এসে আমায় যা বললে তাই বললাম। বললে—শালাবাবু নাকি ছোটমা’র ঘরে যায় রাত্তির বেলা, মদ খায় দুজনে, বাইরে বেরোয় গাড়ি করে—এটা তো ভাল নয়। মেজবাবু বলে—আমাদের বংশে বউরা কখনও সূয্যির মুখ পর্যন্ত দেখেনি, তা কথাটা সত্যি শালাবাবু, আমার মনে আছে, সেকালে আমরা চাকররা পর্যন্ত অন্দরে ঢুকতে পেতুম না। ঝি-এর মারফৎ ফরমাশ আসতো আর হুকুম তামিল করতাম আমরা—তা একালে তো সব বেহ্ম হয়ে গিয়েছে। সাহেব-সুবো এসে খানা খাচ্ছে-রাস্তায়, ঘাটে মেয়েছেলেরা বেড়াচ্ছেতা তাই মেজবাবুর রাগ আপনার ওপর, বলে দিয়েছে রাস্তায় বেরোলে ফাঁক পেলেই একেবারে খুন করে ফেলতে।
ভূতনাথ শুনে চুপ করে রইল।
বংশী বললে—একা-একা রাত-বিরেতে রাস্তায় না-ই বেরোলেন, গুণ্ডার কাণ্ড তো, কখন কী করে বসে!
ভূতনাথ খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলে। তারপর বললে—নিজের জন্যে আমার কোনো ভয় নেই বংশী, আমি তো দেখেছি, আমার পেছন-পেছন লোক ঘোরাঘুরি করে—যখন যেখানে যাই, সেখানে যায়। একদিন ভাবলাম জিজ্ঞেস করবে—তা সরে গেল তাই।
—ওই—ওই—ওই, ও ঠিক মেজবাবুর লোক।
—কিন্তু সে তো ভাবছি না আমি, আমি ভাবছি বৌঠানের জন্যে। আমার জন্যে কি বৌঠানের বদনাম হবে-বিপদ হবে— তার চেয়ে আমি চলেই যাই না কেন এখান থেকে মিছিমিছি আমি অন্ন ধ্বংস করছি এ-বাড়ির।
বংশী বললে—এমন কথা বলবেনু না হুজুর—আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি—ছোটমা পর্যন্ত জানে না কিন্তু আপনার টাকাতেই তো এখনও…
ভূতনাথ বললেও-কথা থাক, ওই গুণ্ডার কথা যা বললে, ওটা আর কেউ জানে?
-না, কেউ জানে না হুজুর, কিন্তু বেণী সাবধান করার জন্যেই বললে আমাকে।
ভূতনাথ বললে—কিন্তু একবার বৌঠানকে নিয়ে যে বরানগরে যেতেই হবে।
-বরানগরে আপনারা কোথায় যান বলুন তো শালাবাবু?
—সে—এক সাধুর কাছে, বৌঠান ছোটকর্তার অসুখের জন্যে পূজো দেবে, আমিও বৌঠানের ভালোর জন্যে পূজো দেবোবাজারেই তো যাচ্ছে, আমাদের দুজনের জন্যে পাঁচ গোছ পান আর পাঁচ পণ করে সুপুরি আনতে পারো?
—তা পারবো না কেন শালাবাবু।
—আনতে পারলে আজই যাই, এই পয়সাটা রাখো।
বংশী বললে–পয়সা আর দেবেন না হুজুর, কত পয়সা আপনি পাবেন আমার কাছে, তারই হিসেব করুন আগে।
ভূতনাথ বললে—আমাকে তবে একবার বৌঠানের ঘরে পৌঁছে দে বংশী।
৪৭. সকাল বেলার গণ্ডগোল শেষ হতে বিকেল
সকাল বেলার গণ্ডগোল শেষ হতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সকাল থেকে খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। মেজবাবু এসে ছোটকর্তার সঙ্গে এক মিনিট দেখা করে আবার যেমন এসেছিল, তেমনি চলে গিয়েছে। ইব্রাহিম গাড়ি চালিয়ে গিয়েছে একলাই। ইয়াসিন বোধ হয় বরখাস্ত। কিন্তু আজ আর ব্রিজ সিং নেই যে, গাড়ির ঘণ্টা শুনেই গেট খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠবে—হুঁশিয়ার হো। আজ আর আস্তাবলবাড়িতে ঘোড়ার ডলাই-মলাই নেই, আজ আর পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজানো নেই, আজ আর ঐশ্বর্য, বিলাস, বাবুয়ানি, মোসায়েব, কিছুই নেই। সেই পেটের ব্যথাটা হবার পর থেকেই নাকি মেজবাবু মদ ছেড়ে দিয়েছে। আশ্চর্য! মেজবাবু, ছোটবাবু সবাই মদ ছাড়তে পারলো! বৌঠানই পারলে না শুধু, এ কেমন কথা।
বৌঠানের ঘরের কাছে যেতেই চিন্তা বললে–ছোটমা পূজো করছে। তারপর ঘোমটার আড়াল থেকে চিন্তা আবার বললেআপনি ভেতরে যান—এইবার উঠবে ছোটমা।
যশোদাদুলালের গায়ে তখনও সোনা মোড়া। সোনার বাঁশী।. সোনার মুকুট। হীরের চোখ। বৌঠান ঠাকুরের দিকে মুখ করে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তখনও একমনে প্রণাম করছে। বৌঠানের ঠাকুর প্রণাম যেন আর শেষ হয় না। শাড়ির আঁচলটা গলায় জড়ানোমস্ত বড় খোঁপাটা মাথার সঙ্গে আঁটা। তার ওপরে সোনার চিরুণী। চিরুণীতে মীনে-করা ছবি। লতা পাতা ফুল। মাঝখানে বড়-বড় করে লেখা—পতি পরম গুরু’। বৌঠান বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছে। এইবার বুঝি শেষ হলে পূজো। ভূতনাথ অপেক্ষা করতে লাগলো। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়ালো বৌঠান।