পিসীমা বলতো—তোর যখন বিয়ে হবে, তখন ওই রকম লাঠি গড়িয়ে দেবো।
বিয়ের সঙ্গে লাঠির যে কী সম্বন্ধ তা ভূতনাথ বুঝতে পারতো না। পিসীমা বলত—তোর শ্বশুর তো ওমনি-ওমনি খেতে দেবে, কাজ করতে হবে, হয় তো গরু চরাতে বলবে—তখন? তখন লাঠি কোথায় পাবি?
শুনে যেন কেমন ভয় হতে মনের ভেতর। দুর-দুর করতে বুক। ভূতনাথ বলতো—তবে আমি বিয়ে করবো না পিসীমা।
পিসীমা বলতে—বিয়ে করবি না তো ভাত বেঁধে দেবে কে? আমি তো মরে যাবো একদিন।
পিসীমা মরে যাবে শুনলেই কেমন যেন ভয় করতো। বেজিটা কেমন করে মরে গিয়েছে তা তখনও মনে আছে ভূতনাথের। চোখে জল আসতো। হঠাৎ পিসীমার কোলের ভেতর মুখ লুকিয়ে ফেলতে ভূতনাথ।
পিসীমার তখন সান্ত্বনা দেবার পালা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোত বলতো—আচ্ছা, আচ্ছা, বিয়ে দেবো না তোর, হলো তো!
নন্দজ্যাঠা মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন বাইরে-বাইরে ঘোরে। বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন হয় তো মুটের মাথায় মাল-পত্তোর নিয়ে বাড়ি এসে হাজির। কাঁঠাল দুটো, এক বোরা নারকোল, এক বাণ্ডিল ঝাটার কাঠি, কেষ্টগঞ্জের কদমা, ভাজা মুগের ডাল, কেরোসিন তেল। বলত—ছেলেমেয়েরা সব দূরে সরে যাও কেরোসিন তেল আছে ওতে।
কেরোসিন তেল-এর নামে তখন কী ভয়ই যে ছিল। মনে হতো হাতে লাগলেই বুঝি হাত জ্বলে-পুড়ে যাবে।
কিন্তু মাল-পত্তার খোলা হলে জ্যাঠা বলতে—ভূতোর আর রাধার হাতে দুটো করে কদমা দিও তো?
নন্দজ্যাঠা বলতে—তোর বাবা কদমা খেতে ভালোবাসতে খুব। তা সেবার ছিন্নাথপুরে গাজনের মেলায় গিয়ে বললে— দাদা, কদম খেতে হবে আমার তখন কাজ পড়ে রয়েছে, সতীশেরও কাজ, কিন্তু খিদে পেলে কাজের কথা খেয়াল থাকতো না। সতীশ বললে-রেলবাজারের সাদা চিড়ে, মামারাকপুরের দই, কলের চিনি, কেষ্ট ময়রার কাঁচাগোল্লা আর কেষ্টগঞ্জের কদমা দিয়ে ফলার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে দাদা..হা রে, বাপকে তোর মনে পড়ে অতুল?
ভূতনাথের কিছুই মনে পড়ে না।
নন্দজ্যাঠা বলে—সেই, মনে নেই, তোকে সঙ্গে নিয়ে টুঙিতে গিয়ে কী হয়রানি? রাত্তির বেলা বিছানার মধ্যে সাপ, সাপের
গুষ্টি—তুই অঘোরে ঘুমোচ্ছিস—আর ওদিকে…
খানিক থেমে নন্দজ্যাঠা আবার বলে—তবে ধন্যি ছেলে বটে তুই, পাঁচ-ছ’ বছরের ছেলে—কি হাঁটাটাই হাঁটতে পারতিস! তোর বাবা বলতো—ওকে বড় হলে ডাক-পিওন করে দেবো দাদা।
শেয়ালদ’ স্টেশনের কল-কোলাহল বাড়ছে। ওদিক থেকে কয়েকটা ট্রেন হুশ-হুশ করে আসে। আর গিজগিজ করে লোক নামে।
একজনকে জিজ্ঞেস করলে—আর কত দেরি মশাই পোড়াদ’র ট্রেনের?
নন্দজ্যাঠাই ঠিক লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে। বাবার সঙ্গে নন্দজ্যাঠাও ঘুরতে গ্রামে-গ্রামে। নন্দজ্যাঠা ছিল বাবুদের নায়ের, আর বাবা ছিল গোমস্তা। জমিদারীর কাজে অনেক জায়গায় কাছারি করেছে। আদায়-পত্তোর করতে, মামলা-মোকদ্দমার তদ্বির করতে নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। আর মা-মরা ছেলেটাকে কোনো কোনো বার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে বিশেষ পীড়াপীড়িতে।
হঠাৎ পেছন থেকে যেন কে ডাকলে—ঠাকুরমশাই?
-আরে, প্রকাশ? কোত্থেকে ফিরছো? ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে।
প্রকাশ বললে—এই তত ফিরে এলাম ফতেপুর থেকে আজ্ঞে। গিয়ে শুনি পাত্তোরের দাদামশাই আবার এখানে এসেছে, আর ওদিকে আমি ওখানে গিয়ে হাজির। এখন মিছিমিছি দুনন খরচ…তা আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
-দেশে।
—দেশে! তা সন্ধ্যেবেলার গাড়িতে চলুন না কেন, একসঙ্গে আবার যাবো, পাত্তোরের দাদামশাইও যাবে আমার সঙ্গে, আপনাদের গাঁয়েরই লোক, আহা, ভারী ভদ্দরলোক, মাটির মানুষটি। আমি মেয়ের মাকেও তাই বলেছি—এমন দাদাশ্বশুর কারো হয় না, বৌমাকে আদর-আত্তি করতে—মাথায় তুলে রাখবে একেবারে …
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আমাদেরই গায়ের লোক? নামটা কী বলো তো?
—নন্দ চক্কোত্তি।
—নন্দজ্যাঠা?
প্রকাশ বললে—তা হবে, শুনলাম বাবুদের খালের ধারের পাটের আড়তে উঠেছে, চেনেন নাকি?
ভূতনাথ বললে—খুব চিনি, তার সঙ্গে দেখা করতেই তো যাচ্ছিলাম দেশে, বিশেষ জরুরী দরকার ছিল একটা।
—তা বেশ তো, চলুন—আমিও যাচ্ছি।
এমন অনায়াসে যে সমস্ত ঘটনার নিষ্পত্তি হতে পারে ভাবা যায়নি। নন্দজ্যাঠা নিশ্চয়ই জানেন। বাবার অত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নন্দজ্যাঠাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করতেন না বাবা।
ভূতনাথ বললে—তাহলে তাই চলো—আমারও খরচা বেঁচে গেল—সময় বেঁচে গেল।
প্রকাশ বললে—ভালোই হলো ঠাকুরমশাই, তাহলে একসঙ্গে সন্ধ্যেবেলার ট্রেনে সবাই মিলে যাওয়া যাবে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেন-জ্যাঠার কার বিয়ে?
—ওঁর নাতির, বিধবা যে এক মেয়ে আছে, তারই ছেলে—তা জামাই দেখে চোখ ফেরাতে পারবে না। কনের বাড়ির লোক—তা আমি আগেই বলে রেখেছি ওদের।
আজো মনে আছে ভূতনাথের। সেদিন নন্দজ্যাঠাকে দেখে ভূতনাথ যতখানি অবাক হয়েছিল, ভূতনাথকে দেখে নন্দজ্যাঠাও ঠিক ততখানি অবাক। কিন্তু নন্দজ্যাঠাকে চিনিয়ে না দিলে চেনা যেতো না। সে-চেহারাই নেই আর। বাবুদের পাটের আড়তের একধারে লোকজনদের থাকবার জায়গা। নৌকো থেকে নেমে আড়তে ওঠে পাটের গাঁট। সোজা চালান আসে নদী ধরে-ধরে। এখানে ওজন হয়, বাছাই হয়। তারপর বিক্রি হয় ব্যাপারীদের কাছে।
খালের জলে দেদার নৌকোর ভিড়। এক-এক গাঁট পাট, নামে আর বাবুদের লোক গুণতি করে।
একটা গাঁট নামে আর চিৎকার করে গুণতি হয়—রামে রাম— আবার নামে গাঁট।
—দুই-এ-দুই—