কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে। বংশী গলা নিচু করে বলে কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে হুজুর—এখন এক-একজন চাকরি পাবে আর মধুসূদনকে পাঁচ টাকা করে বা দিতে হবে—আর চাকরি যতদিন না হবে, ততদিন বছরে তাদের কাছে এক টাকা করে বাব আদায় করবে—এই যে আমার বিয়ে হলো না—ওকে দিতে হলো ওর দস্তুরী—বিয়ের দস্তুরী আজ্ঞে দশ টাকা—এই ধরুন যদি আমার সঙ্গে যদুর মার ঝগড়া হয় আর ও যদি মিটিয়ে দেয়—ওর আদায় হবে চার আনা, আমি দেবো দু’ আনা, আর যদুর মা দেবে দু’ আনা—আমার যদি ছেলে হয় আজ্ঞে তো ওকে দিতে হবে সোয়া শ’ পান আর পৌনে পাঁচ গণ্ডা সুপুরী-—এই হলো নেয়ম—তা এত বড় পিশে আজ্ঞে ওই মধুসূদন—আমার যদ্দিন চাকরি হয়নি, তদ্দিন এক টাকা করে আমার মাইনে হবার পর থেকে কেটে নিয়েছে। তা মাস্টারবাবুর কাছে শুনেছি আপনি এখানে থাকবেন এখন—চাকরি করবেন এখানে—অনেক সব দুঃখের কথা বলবো আপনাকে—আমি পুরুষ মানুষ, আমার জন্যে ভাবিনে আজ্ঞে নিজে গতরে খেটে দেনা-পত্তর শশাধ করে দেবো একদিন—কিন্তু ওই চিন্তার জন্যেই তো ভাবনা।
ভূতনাথ বললে—কেন?
–আজ্ঞে গরীবের ঘরে জন্মেছে, না খাটলে চলবে কেন, কে তোকে বসে বসে খাওয়াবে—সোয়ামী থাকলে সেও খাটিয়ে নিত, শুধু শুধু খেতে দিত না, তা সোয়ামীকে খেয়েছে, এখন ছোটমা-ই তো ভরসা—তা ছোটমা-ই বা ক’দিক দেখবে।
ভূতনাথ বললে—তোমার ছোটমা বুঝি চিন্তাকে খুব ভালোবাসেন।
—ভালোবাসলে হবে কি শালাবাবু, তার যে নিজেরই শতেক জ্বালা।
–কিসের জ্বালা।
—সে সব অনেক কথা, পরে বলবো আপনাকে—তা ছোটমা ভালোবাসে বলেই তো মধুসূদন দেখতে পারে না আমাদের। শুধু মধুসূদন কেন, মধুসূদনের দলের কেউ দেখতে পারে না, ও গিরিই বলুন, সিন্ধুই বলুন, সদুই বলুন, রাঙাঠাকমাই বলুন—কেউ না, এমন কি বেণীও নয়।
—বেণী কে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—আজ্ঞে বেণী হলো মেজবাবুর চাকর—অথচ দেখুন সবাই এক জেলার লোক আমরা—বেণী তো আমার গায়ের লোকই বটে।
আশ্চর্য। ভূতনাথও আশ্চর্য হয়ে গেল।
–রাঙাঠাকমাকে আপনি দেখেন নি আজ্ঞে।
—কে রাঙাঠাকমা?
—ভাড়ারে থাকে, ভাড়ার দেখে শোনে, ওই মধুসূদনের সম্পর্কে রাঙাঠাকমা হয় বলে—এ-বাড়ির আমরাও সবাই রাঙাঠাকমা বলি
—তা সেই রাঙাঠাকমাকে গিয়ে কাল বললাম আজ্ঞে—পোটাক সাবু দাও আর মিছরি আধপো-। শুনে নানান কথা—কে খাবে, কেন খাবে, হান্ ত্যা। আমি বললাম—ছোটমা’র হুকুম। তখন বলে ছোট বোমা নিজের ঝিকে দিয়ে বলে পাঠালে না, তোকে দিয়ে কেন বললে রে বংশী। আমি বললাম-চিন্তার যে অসুখ, সে কি নড়তে পারে। তখন বললে–ছোট বৌমাকে গিয়ে বলগে—একটা চিরকুট নিখে দিক—আমি গিয়ে বললাম সব ছোটমাকে। ছোটমা বললে–কাজ নেই বংশী—–পয়সা নিয়ে দোকান থেকে কিনে আনগে, ঝঞ্চাট চুকে যাক। বলে টাকা দিলে আমাকে।—অথচ দেখুন আজ্ঞে–বংশী আবার বলতে লাগলো–অথচ দেখুন, এই যে গিরি, মেজমা’র পেয়ারের ঝি, তার একাদশীতে ফল, পুণ্যিমেতে পাকা ফলার—সব যোগান দেবে রাঙাঠাকমা। ছোটমা ভালো মানুষ, তা সংসারে ভালো মানুষ হওয়াও খারাপ শালাবাবু।
বংশীর কথার হয় তো শেষ নেই। কিন্তু যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার উঠলো সে। বললে—যাই আবার—ছোটবাবু হয় তো ঘুম থেকে উঠবে এখনি—উঠে যদি ওপরে যায় তো মুশকিল।
ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। বললে—এখন? এই বারোটার সময়?
বংশী বললে—তা ছোটবাবুর এক-একদিন ঘুম থেকে উঠতে দুপুর দুটোও বেজে যায়—তারপর তখন উঠে ভাত খাবেন সেই বিকেল পাঁচটায়। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললে—যাই আমি, অনেকক্ষণ বসলাম, আজকে বিকেল বেলা আবার বার-বাড়িতে রাক্ষস দেখতে যাবে—যাবেন নাকি দেখতে? ডাকবো’খন আপনাকে—
রাক্ষস? ভূতনাথ যেন ভুল শুনেছে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ, নর-রাক্ষস আর কি-একটা জ্যান্ত পাঠা খাবে। কালকে সরকারবাবু নিজে হাতীবাগানের বাজার থেকে কিনে এনেছে—ওই যে দেখুন না, জানালা দিয়ে পুকুরের পাড়ে খোটায় বাঁধা রয়েছে, চরে চরে ঘাস খাচ্ছে—ত কচি বেশ, এখনও শিং গজায় নি-কালো রং–
ভূতনাথের বিস্ময় বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে বংশী বললেএ আপনার গিয়ে সব মেজকত্তার সখ, ভারি সৌখীন মানুষ আপনার এই মেজকত্তা—সেদিন সুখচর থেকে একজন লোক এসে বাজি রেখে দশ সের রসগোল্লা খেয়ে গেল—বাজি ছিল খেতে পারলে মেজকা নগদ পাঁচ টাকা দেবে—ভৈরববাবুও খেতে বসেছিলতিন সের খেয়েই হেঁচকি তুলতে লাগলোতা সে নগদ পাঁচটা টাকাও নিলে, দশ সের রসগোল্লাও খেলে, আবার মেজকত্তা খুশি হয়ে একটা গরদের উড়ুনি দিলেন তাকে।
একলা ঘরে ঘুরে ঘুরে ভূতনাথের সময় আর কাটে না। একবার মনে হলো—রাস্তায় বেরোয়। কিন্তু অচেনা জায়গা, কোথায় গিয়ে শেষে চিনে চিনে বাড়ি ফিরতে পারবে না। আসুক ব্ৰজরাখাল। প্রথম দিন তার সঙ্গে বেরুতে হবে।
জানালা দিয়ে আবার চেয়ে দেখলে দক্ষিণ দিকে। পুকুরের পাড়ে বাঁধা রয়েছে ছাগলটা। আপন মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘাস খেয়ে চলেছে। বাগানে একজন মালী গাছের গোড়াগুলো খুড়ে দিচ্ছে। কোণের মেথরপাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলা করছে রাস্তার ওপর। আর তারপর বুঝি ধোপাদের ঘর। দড়িতে সার সার অসংখ্য শাড়ি কাপড় জামা শুকোচ্ছে।
ঘরের দেয়ালের তাকে হঠাৎ ভূতনাথের নজর পড়লো—পুরনো কাগজপত্রের জঞ্জালের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে এক জোড়া বাঁয়া তবলা। কার জিনিস কে জানে। ব্রজরাখালের এ দিকেও সখ আছে নাকি! সর্বাঙ্গে ধুলো মাখা। বোধ হয় বহুদিন কেউ হাত দেয়নি। মনে পড়লো ভূতনাথের—সেই ফতেপুরের বারোয়ারিতলার যাত্রাদলের কথা। একদিন এই নিয়ে কত মাথাই না ঘামিয়েছে। সাত মাত্রার যৎ, আবার আট মাত্রার যৎ! বিলম্বিত লয়ের কাওয়ালি আর একতালা। দুন, চৌদুন, তেহাই। রসিক মাস্টার বলেছিল—ড়ুগি তবলায় খাসা হাত তত ছোকরার।