কিন্তু দরজা খুলে বেরোতে যেতেই ধাক্কা লাগল একজন লোকের সঙ্গে। লোকটি বোধহয় ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল।
মাপ করবেন, লোকটি বলল, আপনিই কি মিসেস সুচরিতা চৌধুরী?
হ্যাঁ। সুচরিতার ভ্রূ-কুঞ্চিত হল। কী চায় লোকটি? একে তো ও চেনে বলে মনে হচ্ছে না।
লোকটি ওর দিকে চেয়ে হাসল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করে বলল, আপনার সঙ্গে একটু ব্যাবসার ব্যাপারে গোপন কথা আছে।
গোপন কথা! খুবই অবাক হল সুচরিতা।
প্লিজ, দয়া করে দরজাটা ছাড়ুন, ম্যাডাম। এখানে দাঁড়িয়ে তো আর কথা হতে পারে না! বলল লোকটি।
ইতস্তত করে সুচরিতা বলল, আচ্ছা–আসুন, ভেতরে আসুন।
ভেতরে গিয়ে বসল দুজনে।
বিচিত্রভাবে হাসল লোকটি ও আমার কাছে কতকগুলো কাগজ আছে। বলল সে।
কাগজ! আবার অবাক হল সুচরিতা।
লেখা কাগজ।
কী বলতে চাইছেন?
আপনার লেখা কাগজ।
আমার লেখা?
কাউকে আপনার লেখা চিঠির কাগজ।
আমার লেখা চিঠি! দেখি!
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সুচরিতা চৌধুরীর হাতে দিল লোকটি ও অনেকগুলো চিঠির একটি।
চিঠি দেখে মনে-মনে হাসল সুচরিতা। এ-চিঠি ও কোনওদিনই লেখেনি। ওর হাতের লেখাও নয় এগুলো। শুধু লেখিকার নামের জায়গায় ওর নাম লেখা আছে।
কিন্তু কী উদ্দেশ্য এই লোকটির? ব্ল্যাকমেলিং? নাকি অন্য কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে?
মনে-মনে নিশ্চিত কিছু একটা ভেবে নিয়ে সুচরিতা বলল, এগুলো আপনি কেমন করে পেলেন?
দেখুন, আমার এখন খুব অভাব চলছে। তাই হাজার পঁচিশেক টাকার ব্যবস্থা যদি করেন… সব চিঠিগুলোর জন্যে। অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল লোকটি।
মনে-মনে অতি দ্রুত চিন্তা করল সুচরিতা। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। ভাবল, দেখিই না কী মতলব।
সুচরিতা বলল, দেখুন, আপাতত আমার কাছে তো এত টাকা নেই। এই চিঠিটার জন্যে আমি শদুয়েক টাকা দিচ্ছি। আগামীকাল রাতে আপনি আসুন, তখন বাকি চিঠিগুলোর ব্যাপারে কথা বলা যাবে।
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে লোকটির হাতে দিল ও। চিঠিটা রেখে লোকটি চলে গেল।
চিঠিটা পড়ল সুচরিতা। নিছক একটা প্রেমপত্র। কী কারণে কে কাকে লিখেছিল তা বুঝতে পারল না। চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে উঠে গিয়ে ফোন করল তরুণের অফিসে। সেখান থেকে। অশোক বোসের হোটেলের নাম জেনে সেই হোটেলে ফোন করল।
হ্যালো, হোটেল কন্টিনেন্টাল?
হ্যাঁ–কাকে চান?
অশোক বোসকে।
কাইন্ডলি একমিনিট অপেক্ষা করুন, লাইন দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর টেলিফোনে কারও কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে কথা বলছেন?
আমি কি অশোক বোসের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে বলছেন?
মিসেস সুচরিতা চৌধুরী।
ওদিকের কণ্ঠস্বর চমকে উঠল মনে হলঃ মিসেস চৌধুরী!
হ্যাঁ। আপনার কাছেই তো নটোরিয়াস ম্যানাস্ক্রিপ্টটা রয়েছে, না?
কাছাকাছি গিয়েছিলেন। আছে নয়, ছিল।
তার মানে! তার মানে আপনি?
ঠিকই ধরেছেন। ওটা এখন মেহেতা অ্যান্ড সন্সের কাছে। আজ সকালেই ওটা ওদের হাতে তুলে দিয়েছি।
ওঃ– সুচরিতা যেন আশাহত হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রিসিভার নামিয়ে রাখল।
ওপারের কণ্ঠস্বর তখনও বলছিল, কিন্তু মিসেস চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার–।
সুরেন্দ্র পালিত, কুমার রণজিৎ, মৃত কুমার অতলান্ত রায়, মানেকজি, প্রসাদজি, তরুণ, অমিত এবং অশোক বোস–সবাই যেন সুচরিতার চারপাশে এসে ছায়ার মতো ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। সবাই হাত বাড়িয়ে ওর থেকে যেন কিছু চাইছেন।
চকিতে সুচরিতার মনে পড়ল ব্ল্যাকমেলারটির কথা। আবার আগামীকাল! চোখ বুজল সুচরিতা।
.
পরদিন রাত দশটার সময় ক্লাব থেকে ফিরল সুচরিতা। একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে আজ। কিন্তু সদর দরজা হাট করে খোলা কেন! দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকল। যতীনকে কোথাও দেখতে পেল না। কোথায় যেতে পারে! হঠাৎই লক্ষ করল, একটুকরো কাগজ মেঝেতে হাওয়ায় উড়ছে। কৌতূহলে কুড়িয়ে নিল ওটা। এ যে একটা চিঠি! তাতে লেখাঃ
যতীন,
শিগগিরই চাঁদনি চকের বাজারের কাছে চলে আয়। অনেক জিনিসপত্র কিনে ফেলেছি।
–দিদিমণি।
অবিশ্বাস্য। কোনও চিঠি ও যতীনকে পাঠায়নি। অবশ্য একথা ঠিক যে, ক্লাবের ফোন খারাপ থাকলে মাঝে-মাঝে এ ধরনের চিঠি ও ক্লাব থেকে পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু ক্লাবের ফোন তো ঠিকই আছে!
অর্থাৎ, সব জেনেশুনেই এই চিঠিটা কাউকে দিয়ে পাঠানো হয়েছে।
পায়ে-পায়ে শোবার ঘরে এসে সুচরিতার বিস্ময় আতঙ্কে পালটে গেল। শোওয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একজন চেনা লোক। একটা সুদৃশ্য ছুরি তার হৃৎপিন্ডকে এফেঁড়-ওফেঁড় করে দিয়েছে। লোকটি এই হিসেবে চেনা যে, তাকে আগের দিনই সুচরিতা দেখেছে। এ সেই ব্ল্যাকমেলার।
তার মানে টাকার জন্য সে আজ সময়মতোই এসেছিল। কিন্তু কে মারল ওকে?
হতভম্ব অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুচরিতা। আজই ওকে কবুতরে যেতে হবে। ও মিটিং এ যাবে, কারণ অশোক বোসের ব্যাপারটা মিটে গেছে। কিন্তু এ কী ঝামেলা? এরপর পুলিশ আসবে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ব্ল্যাকমেলিংয়ের কথা বেরিয়ে পড়বে। ও যে শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানোর জন্যই দুশো টাকা দিয়েছে তারা তা শুনবে না। তার মানে নিঃসন্দেহে ওঁকে কিছুদিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মিটিং-এ যাওয়া যাবে না। কিন্তু কারা ওকে এভাবে রহস্যের জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।