- বইয়ের নামঃ অন্নদাশঙ্কর রায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ অন্নদাশঙ্কর রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
ও
অন্নদাশঙ্কর রায়
মার্কারের সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলতে খেলতে প্রিন্সিপাল সাহেব দারুণ একটা ‘ব্রেক’ করলেন। কিন্তু এর জন্যে তাঁকে বাহবা দেবার জন্যে সন্ধ্যাবেলা ক্লাবে মার্কার ভিন্ন আর কেউ ছিল না।
‘শাবাশ, হুজুর! শাবাশ! বহুৎ ফাস কিলাস!’ মার্কার তাঁকে হাস্যমুখে অভিনন্দন জানাল। তাঁর কাছ থেকে তাঁর কিউ চেয়ে নিয়ে চক ঘষতে লাগল ও-র ডগায়।
‘কিন্তু আজ জজ সাহেবের এত দেরি হচ্ছে কেন?’ প্রিন্সিপাল সাহেব তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বিতীয় কি তৃতীয়বার এই প্রশ্ন করলেন।
মার্কার বলল, ‘শায়দ মালুম হোতা কি জজ সাব আজ নেহি আওয়েঙ্গে হুজুর।’ পরবর্তী প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা না করেই উত্তর দিল, ‘বড়া জবর খুনী মামলা, হুজুর।’
খুনী মামলা শুনে প্রিন্সিপাল বিস্মিত হলেন না, কিন্তু জজ সাহেব আসবেন না শুনে খেলা থেকে তাঁর মন উঠে গেল। মার্কারের সঙ্গে কাঁহাতক খেলা যায় যেন সে তাঁকে জিতিয়ে দেবে বলে বদ্ধপরিকর। ওই ‘ব্রেক’টা তা বলে মার্কারের অনুগ্রহ নয়। কিন্তু মজা হচ্ছে এই, জজ সাহেবের সঙ্গে খেলবার সময় এত বড় একটা ‘ব্রেক’ হয় না।
এবার মার্কারের পালা। সে ওস্তাদ লোক। ছেলেবেলা থেকে এই কর্ম করে আসছে। একবার আস্তে আলগোছে কিউ ছুঁইয়ে দেয় অমনি খেলার টেবিলের সবুজ মসৃণ আস্তরণের উপর দিয়ে সাদা বল গড়িয়ে যায় ধীর মন্থর গতিতে অব্যর্থ তার টিপা পট করতে চায় পট হয়, ইন অফ করতে চায় ইন অফ, ক্যানন করতে চায় ক্যানন। কিন্তু ইচ্ছে করেই সে পয়েন্টের সংখ্যা বাড়তে দেয় না। প্রিন্সিপালকে হারিয়ে দেওয়া তার পলিসি নয়। সে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে পেছিয়ে থাকে।
মার্কারের সঙ্গে খেলে প্রিন্সিপাল সাহেব জয়ী হন, কিন্তু জয়গৌরব পান না। সেদিন আরো কিছুক্ষণ খেলে তিনি কিউ ফেরত দিলেন মার্কার একটু সকাল সকাল বাড়ি যাবার তালে ছিল। একগাল হেসে হাসি চেপে বলল, ‘বড়ি আফসোসকি বাত হুজুর জজ সাব আজ আনেওয়ালা নেহি হ্যায়।’
তারপর সেলাম ঠুকে পুছল, ‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’ প্রিন্সিপাল নিজেই নিজেকে পান করাচ্ছেন। হুকুম করলেন ‘পানি।’
‘বহুৎ খুব’ বলে মার্কার সেলাম ঠুকে অদৃশ্য হলো। এমন সময় শোনা গেল বাইরে মোটরের আওয়াজ। মার্কার সেই দিকেই ছুটল। ‘হ্যালো প্রিন্সিপাল।’
‘হ্যালো জজ।’
দু’জনে দু’জনের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। দু’জনেই উৎফুল্ল। কিন্তু সব চেয়ে উৎফুল্ল হলো মার্কার। যদিও সব চেয়ে দুঃখিত হয়েছে এখন তার বাড়ী যাওয়া। জজ সাহেব আর। প্রিন্সিপাল সাহেব একসঙ্গে খেলতে শুরু করলে রাত ন’টার আগে ছুটি মিলবে না একটু সরে দাঁড়িয়ে থেকে একবার এঁকে ‘শাবাশ’ ও একবার ওঁকে ‘বাহ বাহ দিতে হবে। মাঝে মাঝে কিউ হাতে নিয়ে চক মাখিয়ে দিতে হবে। ডাকলে খেলা দেখিয়ে দিতে হবে। ঝগড়া বাধলে আমপায়ার হতে হবে আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর পুছতে হবে ‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’ নেপথ্যে থেকে নিয়ে আসতে হবে ফরমাসী পানীয়।
জজ আর প্রিন্সিপাল দু’জনে দুটো কিউ বেছে নিয়েই হাঁক ছাড়লেন, ‘মার্কার।’ তা শুনে মার্কার সেলাম ঠুকে হাজির হতেই এক কণ্ঠে বললেন, ‘পুছো।’
বেচারা পড়ে গেল উভয়সঙ্কটো যদি জজ সাহেবকে পহিলে পোছে তা হলে তার সামনে দাঁড়ায় সে প্রিন্সিপাল সাহেবের হুকুম পহিলে মানো। আর যদি প্রিন্সিপাল সাহেবকে আগে প্রশ্ন করে তবে তার কাছে জজ সাহেবের আদেশ অগ্রগণ্য। বহুকালের মার্কার চাকরিটা এক কথায় যাবে না। তবু কাজ কী কাউকে চটিয়ে? সাহেবসুবোদের মেহেরবানীতে তার ছেলে ভাইপো ভাগনে জামাই কেউ বসে নেই। শীতের এই ক’মাস পরে হুজুরদের আপিসে ‘পাঙ্খা পুলার’ দরকার হবে। তখন জ্ঞাতিদের জন্যে দরবার করতে হবে তো।
মার্কার জানত যে প্রিন্সিপাল সাহেব যদিও বিদ্বানশ্রেষ্ঠ ও বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে তবু জজ সাহেব হলেন দণ্ডমুণ্ডের মালিক। চাইকি ফাঁসী দিতে সমর্থ। স্বএলাকায় তাঁকেই পূজা করতে হয়।
‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’ সে প্রিন্সিপাল সাহেবকেই আগে পুছল।
তিনি হেসে ফেললেন যা ভেবেছিলেন তাই বললেন, ‘নেম্বু পানী।’
জজ বললেন, ‘জিন।’
এর পর দু’জনে খেলায় মেতে গেলেন। তাঁদের মুখে কেবল খেলার বুলি। মতভেদ হলে মার্কারকে ডাকেন সেক্ষেত্রে তার বাক্যই আপ্ত বাক্য। সে তখন কারো মুখ চেয়ে রায় দেয় না। তারও একটা কোড আছে। তার দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে তার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন জান গেলেও সে তার মহিমা থেকে বিচ্যুত হবে না। অন্যায় করে জজ সাহেবকে জিতিয়ে দেবে। না। যদিও তার মাইনে হয়তো জজের মাইনের শতাংশ। সাহেবরাও তাকে চটাতে সাহস পান না। সে যদি চাকরি ছেড়ে দেয়, আর ও-রকম ওস্তাদ পাওয়া যাবে না।
সেদিন খেলা কিন্তু জমল না। জজ অন্যমনস্ক ছিলেন তাঁর কিউ বার বার বল ছুঁতে গিয়ে কুশন ছোঁয় কিংবা তাঁর বল অপর বলকে ছুঁতে না পেয়ে ভ্রষ্ট হয়। মার্কার পয়েন্টের হিসেব রাখো বোর্ডের দিকে নজর পড়লে তিনি শিউরে ওঠেন। মাইনাস টোয়েন্টি। তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘নো লাক।’
‘ব্যাপার কি, সুর?’ প্রিন্সিপাল বললেন, ‘তুমি যে একেবারেই খেলছ না?’