মন্থরগতি চলচ্চিত্রের মতো পুরো ঘটনাটা দেখতে পেলাম। একটু একটু করে অ্যাডভানির ডান হাতটা নেমে এল। অবশেষে রিভলভারটা খসে পড়ল হাত থেকে। ওর দু-হাত একে একে ভাঁজ হয়ে এসে জড়ো হল পেটের কাছে। ওর শরীরটা সামনে পেছনে কয়েক সেকেন্ড ধরে দুলতে লাগল। তারপর খুব ধীরে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মেঝেতে।
এক লাথিতে অ্যাডভানির রিভলভারটা খাটের তলায় ঠেলে দিলাম। আমারটা আবার ঢুকিয়ে রাখলাম হোলস্টারে, এবং সুটকেস থেকে দুটো পরিষ্কার গেঞ্জি বের করে নিলাম।
প্রতাপ অ্যাডভানির মনোযোগ এখন শুধু নিজের তলপেটের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের দিকে। একটা গেঞ্জি ওর বেল্টের নীচে ক্ষতস্থানে গুঁজে দিলাম–যদি রক্তপাত একটু বন্ধ হয়। অন্য গেঞ্জিটা আমার বাঁ-হাতের বাইসেপে বেঁধে নিলাম। প্রতাপ অ্যাডভানি আচ্ছন্ন চোখে আমাকে লক্ষ করতে লাগলেন। ওঁকে ওই অবস্থায় রেখে বেরিয়ে এলাম কাউন্টারে। ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলাম। ইতিমধ্যে হোটেলের বহু গেস্টই নীচের লবিতে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু তাদের কৌতূহলী নজরকে কোনও আমল দিলাম না।
দশ মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। স্ট্রেচারে করে অ্যাডভানিকে পেছনের তোলা হল। আমি উলটোদিকে লম্বা সিটে মাথা নীচু করে বসলাম। অ্যাম্বুলেন্স অ্যাটেনড্যান্ট আমার পাশে এসে বসল। পরমুহূর্তেই একটা আলতো কঁকুনি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা চলতে শুরু করল।
জড়ানো গলায় অ্যাডভানি বললেন, মিস্টার বরাট, আপনি আমাকে খুন করলেন? আমি—আমি–।
অ্যাম্বুলেন্স-অ্যাটেনড্যান্ট অ্যাডভানির কথা শুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি পা দিয়ে ওর পা চেপে ধরলাম। ও চুপ করে গেল। আমি জানি, অ্যাটেনড্যান্ট ছেলেটা বলতে যাচ্ছিল যে, অ্যাডভানির মরার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আর সেটা আমিও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কোনও মানুষ যদি সত্যি-সত্যি বিশ্বাস করে যে, সে মারা যাচ্ছে, তা হলে তার যে কোনও স্বীকারোক্তির দাম তখন মৃত্যুকালীন স্বীকারোক্তির সমান। এখন আমার কাজ হল অ্যাডভানিকে ভুল ধারণার মধ্যে থাকতে দিয়ে যে করে তোক একটা ডাইং ডিক্লেয়ারেশন আদায় করা।
সুতরাং আমি বললাম, আপনার কিছু বলার থাকলে এখনই বলতে পারেন, মিস্টার অ্যাডভানি। পরে আর হয়তো সময় পাবেন না।
প্রতাপ অ্যাডভানি চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। আমার কথায় নিষ্পলক চোখে অসহায়ভাবে তাকালেন। তারপর চোখ সরিয়ে নিলেন। অ্যাম্বুলেন্সের দোলানিতে ওর মাথাটা এপাশ-ওপাশ নড়তে লাগল।
কিছুক্ষণ পর আপনমনেই বললেন অ্যাডভানি, ক্যারাটে শেখাই আমার কাল হয়েছে, নইলে বিশ্বনাথ শিভালকর আজ বেঁচে থাকতেন, আর…আর আমাকেও এভাবে মরতে হত না। ওঁর গলার স্বর নিস্পৃহ, দুর্বল অথচ তিক্ততায় ভরা।
মিস্টার শিভালকর ক্যারাটে চপ-এর আঘাতে মারা গেছেন? আমি নীচু স্বরে প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ, ওই হীরে আর চুনিগুলো দেখে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। মিস্টার শিভালকরের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দরজাটা অর্ধেক ভোলা ছিল। দেখলাম, উনি হুইস্কির বোতল হাতে বিছানার বসে আছেন। ভাবলাম, মদ খেয়ে ওঁর শরীর ঠিক নেই। তাই দরজাটা ভেজিয়ে দিতে গেলাম। তখনই দেখলাম সাদা আর লাল পাথরগুলো বিছানার ছড়িয়ে পড়ে আছে। ব্যস– একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অ্যাডভানির বুক ঠেলে।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একটু পরেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, লোভ সামলাতে পারলাম না। এই হোটেল-ম্যানেজারি করে কপয়সাই বা পাই! সারাজীবন আমাকে পয়সার জন্যে কষ্ট করতে হয়েছে। ভাবলাম, পাথরগুলো সরিয়ে নিলে মিস্টার শিভালকর এ অবস্থায় টেরও পাবেন না। তাই করলাম। আমার পকেটে একটা ছোট পাউচ ছিল, পাথরগুলো তাতে ভরে ফেললাম। চলে আসতে যাব, ঠিক তখনই মিস্টার শিভালকর আমার দিকে ফিরে তাকালেন…।
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। অতগুলো জহরত হাতছাড়া হয়ে যাবে এ যেন ভাবতেই পারলাম না। চকিতে আমার ক্যারাটে ব্লো ছুটে গেল মিস্টার শিভালকরের কপাল লক্ষ করে। তারপর…বললাম তো, ক্যারাটে শেখাই আমার কাল হল। প্রতাপ অ্যাডভানি থামলেন।
আমি বললাম, তারপর ওঁকে জানলা দিয়ে ফেলে দিলেন?
না, তখন ফেলিনি। অনেক পরে ওই মতলবটা আমার মাথায় আসে। অ্যাডভানির শ্বাস-প্রশ্বাস এখন আরও দ্রুত হয়ে এসেছে, কণ্ঠস্বরও অনেক দুর্বল বাকিটা তো আপনি জানেন। লিপস্টিক, টেলিফোন, প্যাটেল…নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরাতে গিয়ে আমি সব গোলমাল করে ফেলেছি। তার ওপর পেটের এই আলসারের যন্ত্রণা। আমার মাথার ঠিক ছিল না…আমি ভেবেছিলাম…।
কী ভেবেছিলেন? উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলাম।
দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন অ্যাডভানি। বিড়বিড় করে বললেন, আমার চেয়ে বোকা আর কেউ নেই।
অ্যাম্বুলেন্সটা ততক্ষণে হসপিটালের কাছাকাছি এসে গেছে। হঠাৎই ভীষণ ক্লান্ত লাগল। না, এখন প্রতাপ অ্যাডভানির ভুল ধারণাটা ভেঙে দেওয়া দরকার। তাই পাশে বসা অ্যাটেনড্যান্টকে বললাম, এবার সত্যি কথাটা ভদ্রলোককে বলতে পারো।
অ্যাডভানির ওপর ঝুঁকে পড়ল ছেলেটা। একটা চোখের পাতা উলটে দেখল, তারপর অভ্যাসগত সুরে বলল, লাভ নেই, স্যার। মারা গেছেন।