‘আমার আর একটা কথা রাখতে হবে তোমায়।’
থমকে গিয়েছিল ঋতি, ‘বলুন।’
এখানে আসার কথাটা এখন কাউকে বলতে পারবে না তুমি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, হোয়াট আই মিন?’
বুঝতে পেরেছিল ঋতি। কাউকে কিছু বলেনি সে। বিকেলে দার্জিলিং থেকে যখন ফোন করেছিল মনোজিৎ, এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে। আসলে ঋতি ভয় পেয়েছিল। কথার খেলাপ করলে আবার যদি মত বদলায় দেবযানী।
পায়ে পায়ে কখন সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারেনি ঋতি। ভেলভেটের পর্দা সরাতেই ঘরের মাঝখানে চওড়া খাটে শুয়ে থাকা মধ্য বয়সিনী মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘এসো ঋতি। ভেতরে এসো।’
এই দেবযানী? একসময় যে নজরকাড়া রূপসী ছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। এক বছর আগের সেরিব্রাল অ্যাটাক সেই রূপের অনেকখানি কেড়ে নিলেও সবটা পারেনি। ওঁর শরীরের বাঁ দিকটা অ্যাফেকটেড হয়েছিল। নিয়মিত ফিজিওথেরাপিতে কিছুটা উন্নতি হলেও একা একা এখনও চলাফেলা করতে পারেন না দেবযানী। তবে কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই।
বিছানার সামনে একটা গদিআঁটা চেয়ারে ঋতিকে বসতে বললেন দেবযানী। শুয়ে শুয়েই বেডসাইড টেবিলের পাশে একটা সুইচ টিপলেন। ঋতি তখনই লক্ষ করল টেবিলটায় প্রচুর ওষুধপত্র রাখা। কিছুক্ষণের মধ্যে বছর পঁচিশের একটি রোগা বউ দৌড়ে ঘরে এল, ‘ডাকছিলেন বউদিমণি?’
‘আমায় একটু বসিয়ে দে তো শম্পা।’
হেডবোর্ডে কয়েকটা বালিশের ঠেস দিয়ে সাবধানে দেবযানীকে বসিয়ে দিল শম্পা। দেবযানী বললেন, ‘ভালো করে দু’কাপ চা নিয়ে আয়।’
‘আমার কিন্তু চায়ের দরকার নেই।’ অপ্রতিভ গলায় বলল ঋতি।
‘তুমি আজ প্রথম এলে। একটু চা—ও না খাওয়ালে বাইরে গিয়ে নিন্দে করবে যে। সেটি হচ্ছে না।’
শম্পা চলে গেল। ঋতি অনুভব করছিল একটা অপরাধবোধ খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলছে চেতনার গভীরে। যে দেবযানীর কথা শুনে এসেছে ঋতি, সামনের মহিলার সঙ্গে তাকে যেন মেলানো যাচ্ছে না। সব হিসাব কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি টেবিলে কাজ করতে করতে কবে যে একটা সহজ বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল দুজনের ঋতি বা মনোজিৎ কেউই বুঝতে পারেনি।
ঋতি লক্ষ করত হুল্লোড়ে, হাসিখুশি মনোজিৎ মাঝেমাঝেই কেমন বদলে যেত। গুম হয়ে থাকত ক’টাদিন। তারপরে অবশ্য আবার আগের মতো হয়ে যেত।
ক্যান্টিনে একসঙ্গে টিফিন খেতে খেতে একদিন ঋতি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাঝে মাঝে আপনার কী হয় বলুন তো? হঠাৎ এত গম্ভীর হয়ে যান, কথা বলতেও ভয় করে। একটুও ভালো লাগে না তখন।’
কেমন একটা চোখে ঋতির দিকে তাকিয়েছিল মনোজিৎ। শিরশির করে উঠেছিল ঋতির শরীরটা। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আরেকদিন বলব।’
সেই দিনটা আসতে কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। এক শনিবার ছুটির পর মেট্রো অবধি ঋতিকে এগিয়ে দিতে দিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল মনোজিৎ। দেবযানীর কথা সেদিনই প্রথম শুনেছিল ঋতি। শুনেছিল ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্কের জের টেনে চলার যন্ত্রণার কথা।
এক ছাদের তলায় থেকেও দেবযানীর জগৎ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তার ডিকসনারিতে ‘কম্প্রোমাইজ’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। নিজের বুটিকের ব্যবসা, বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, পার্টির বাইরে কারওর জন্য সময় ছিল না দেবযানীর। জন্মের পর থেকেই একমাত্র মেয়ে থাকত আয়ার কাছে। মনোজিৎ—এর আপত্তি সত্ত্বেও মাত্র ক্লাস থ্রি—তেই দেবযানী মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কার্শিয়াং—এর কনভেন্ট স্কুলে। ছুটি ছাটাতে যখন আসত পৌলমি তখনও পেত না মাকে। দিনের পর দিন অফিস ছুটি নিয়ে মেয়েকে সঙ্গ দিত মনোজিৎ। আসলে প্রথম থেকেই বাচ্চচা চায়নি দেবযানী। মনোজিৎ—এর জেদাজিদিতে শর্তসাপেক্ষে মা হতে রাজি হয়েছিল। বলেছিল, বাচ্চচার সবরকম দায়িত্ব সামলাতে হবে মনোজিৎকেই। মনোজিৎ ভেবেছিল মা হলে বদলে যাবে দেবযানী, ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ব্যবসাটাও মন দিয়ে করত না দেবযানী। কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিলে ব্যবসার যা হাল হয় তাই হয়েছিল। কিন্তু ঠাটবাটের কমতি ছিল না। টাকার জোগানে টান পড়লেই তুমুল অশান্তি শুরু করত দেবযানী। মনোজিৎ—এর বড়দা আলাদা থাকলেও পারিবারিক জুয়েলারির ব্যবসাটা যৌথ মালিকানাতেই। বড়দাই মূলত দেখাশোনা করেন। সেখান থেকে যে শেয়ারটা পায় মনোজিৎ সেটাও কম নয়। কিন্তু তবুও যেন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না। একরকম বাধ্য হয়েই এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে দার্জিলিং—এর একটা হোটেল লিজ নিয়েছিল মনোজিৎ।
‘টাকা দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায় হয়তো, কিন্তু শান্তি কেনা যায় না।’ বিষণ্ণ গলায় বলেছিল মনোজিৎ।
ভারী হয়ে উঠেছিল ঋতির মনটাও।
ছ’মাসের মাথায় ঋতি আর মনোজিৎ—এর সম্পর্কটা হঠাৎ করেই বাঁক নিয়েছিল একদিন। অফিসফেরত একটা রেস্তোরাঁর কেবিনে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। স্যান্ডুইচের প্লেট নাড়াচাড়া করতে করতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আমি আর পারছি না ঋতি। একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’
‘দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সহানুভূতির গলায় বলেছিল ঋতি।
‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। কিচ্ছু ঠিক হবার নয়। একদিন দেখো, নিজেকে শেষ করে দেব আমি।’ ভাঙাচোরা গলায় বলে উঠেছিল মনোজিৎ।
আমূল কেঁপে উঠেছিল ঋতি। নিজের অজান্তেই মনোজিৎ—এর একটা হাত টেনে নিয়েছিল দু’হাতের মুঠিতে, ‘এসব কী বলছ যা তা?’