- বইয়ের নামঃ ভূতপ্রেত-রক্তচোষা
- লেখকের নামঃ অনীশ দাস অপু
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
ভূতপ্রেত-রক্তচোষা
আতংকের দিনরাত
এক
সারা সপ্তাহ ধরে উত্তুরে হাওয়া বইবার কথা বলছিল ওরা। বিষুদবার হামলে পড়ল ঝড়। বিকেল চারটার মধ্যে আট ইঞ্চি তুষার জমে উঠল রাস্তায়, থামার কোনও লক্ষণ নেই। আমরা অভ্যাসমতো বিকেল পাঁচটা/ছটার দিকে হাজির হয়ে গেলাম হেনরির নাইট আউল-এ। ব্যাঙ্গোরের এই একটাই মাত্র দোকান যা ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় খোলে।
হেনরি কেউকেটা কোনও ব্যবসায়ী নয়, কলেজ ছাত্রদের কাছে বিয়ার আর মদ বিক্রি করে। আমাদের মতো অকর্মার ধাড়িদের আড্ডার চমৎকার জায়গা হেনরির বার।
আজ বিকেলে হেনরি বসেছে কাউন্টারে। আমি, বিল পেলহ্যাম, বার্টি কনরস আর কার্ল লিটলফিল্ড ঘিরে বসেছি চুল্লি। বাইরে, ওহায়ো স্ট্রিটে কোনও গাড়ি চলছে না। বৈদ্যুতিক লাঙল দিয়েও জমাটবাঁধা তুষার কাটতে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। শোঁ শোঁ শব্দে বইছে প্রবল হাওয়া। ডাইনোসরের মেরুদণ্ডের মতো উঁচু আর তূপ হয়ে আছে তুষার বাড়িঘরের ছাদে।
হেনরির দোকানে আজ বিকেলে খদ্দের বলতে মোটে তিনজন–অবশ্য কানা এডিকে যদি এর কাতারে ফেলা যায়। এডির বয়স সত্তরের কাছাকাছি, পুরোপুরি অন্ধ নয় সে। সপ্তাহে দুতিনদিন আসে সে এখানে। কোটের নিচে ব্রেড লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়, তোমাদেরকে আবার কেমন বোকা বানালাম এমন ভাব নিয়ে। হেনরি এডিকে পছন্দ করে বলে তার কাছ থেকে কখনোই রুটির দাম রাখে না।
আমরা বসে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল দরজা, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা নিয়ে। টলতে টলতে ভিতরে ঢুকল এক কিশোর। মেঝেতে পা ঠুকে জুতা থেকে বরফ ঝাড়ছে। ওকে দেখেই চিনে ফেললাম। রিচি গ্রেনাডাইনের ছেলে। চেহারায় তীব্র উৎকণ্ঠা। মুখ ফ্যাকাসে। কণ্ঠমণি ওঠানামা করছে, ঘন ঘন ঢোক গিলছে বলে।
মি, পার্মালি, হেনরির উদ্দেশ্যে বলল সে, চোখের মণি ঘুরছে সকেটের মধ্যে। আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে। ওঁর জন্য বিয়ার নিয়ে যাব। আমি ও বাড়িতে আর ফিরতে চাই না। আমার ভয় লাগছে।
একটু সুস্থির হয়ে বসো, কসাইর সাদা অ্যাপ্রনটা খুলে রেখে কাউন্টার ঘুরে এল হেনরি। কী হয়েছে? তোমার বাবা মাতাল হয়ে গেছে?
হেনরির কথায় বুঝলাম রিচি বেশ কয়েকদিন ধরে ওর দোকানে আসছে না। প্রতিদিনই ওর একটা বিয়ার চাই, সবচেয়ে সস্তাটা কিনবে সে। বিশালদেহী, নোটকু রিচি বিয়ার খেতেও পারে। ক্লিফটনের করাতকলে কাজ করত সে। কিন্তু কী একটা ভুলের অপরাধে চাকরিটা চলে যায়। করাত-কল কোম্পানি অবশ্য ওকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। চাকরি ছাড়ার পর থেকে সারাদিন বিয়ার খেতে খেতে আরও ফুলেছে রিচি। এখন ছেলেকে পাঠায় বিয়ার কিনতে।
বাবা মাতাল হয়েছে, শুনতে পেলাম ছেলেটা বলছে। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা…সমস্যা… ওহ্ ঈশ্বর, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর।
হেনরি কার্লকে বলল, কার্ল, তুমি এদিকে দুমিনিট খেয়াল রাখতে পারবে?
অবশ্যই।
বেশ। টিমি স্টকরুমে চলো। শুনি কী হয়েছে।
ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল হেনরি। কার্ল কাউন্টারে এসে বসল হেনরির টুলে। কেউ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না। আমরা হেনরির গভীর, ধীর গলা শুনতে পেলাম। টিমি উত্তেজিত ও দ্রুত কণ্ঠে কথা বলছে। তারপর কুঁপিয়ে উঠল সে।
বিল পেলহ্যাম গলা খাঁকারি দিয়ে পাইপে তামাক ভরতে লাগল।
রিচিকে অনেকদিন দেখি না। বললাম আমি।
ঘোঁত ঘোত করে উঠল বিল, তাতে কিছু আসে যায় না।
অক্টোবরের শেষে একবার এসেছিল, জানাল কার্ল। হ্যালোইনের সময়। এক কেস বিয়ার কিনল। দিনদিন ফুলে যাচ্ছিল ও।
তারপর আর কিছু বলার মতো পেলাম না। ছেলেটা এখনও কাঁদছে। তবে কাঁদতে কাঁদতে কথাও বলছে। বাইরে গর্জন ছাড়ছে বাতাস, দরজা জানালায় চাবুক কষাচ্ছে। রেডিওতে বলল সকালের মধ্যে আরও ছয় ইঞ্চি পুরু হয়ে বরফ পড়বে। এখন জানুয়ারির মাঝামাঝি। ভাবছিলাম অক্টোবরের পর থেকে রিচির চেহারা আদৌ কেউ দেখেছি কিনা।
আরও কিছুক্ষণ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলল হেনরি। তারপর ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ছেলেটা কোট খুলে ফেলেছে তবে হেনরি তার কোট গায়ে চাপিয়েছে। ছেলেটার বুক হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে, চোখ লাল।
হেনরিকে উদ্বিগ্ন দেখাল টিমিকে ওপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। ওর খিদে পেয়েছে। আমার বউ ওকে খাইয়ে দেবে। আমি রিচির বাসায় যাব।
তোমরা কেউ আমার সঙ্গে চলো। টিমি বলল ওর বাপের বিয়ার লাগবে। টাকাও দিয়েছে। হাসার চেষ্টা করল হেনরি, কিন্তু হাসি ফুটল না মুখে।
কী বিয়ার? জানতে চাইল বার্টি। আমি নিয়ে আসি।
হ্যারোস সুপ্রিম, বলল হেনরি। কয়েকটা প্যাকেট আছে ওখানে।
আমি উঠে পড়লাম। হেনরির সঙ্গে বার্টি যাবে, আমাকেও যেতে হবে। ঠাণ্ডায় কার্লের বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। আর বিলি পেলহ্যাম এখানেই থাকছে।
বার্টি হ্যাঁরোস-এর চারটা প্যাকেট নিয়ে এল। ওগুলো বাক্সে ভরলাম। আমি। হেনরি দোতলায়, ওর বাসায় নিয়ে গেল ছেলেটাকে। টিমিকে বউয়ের কাছে রেখে নেমে এল নিচে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ আছে কী না। বিলি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হয়েছেটা কী? রিচি মেরেছে। ছেলেটাকে?
না, বলল হেনরি। আমি এখনই কিছু বলতে চাই না। শুনলে পাগলের প্রলাপ মনে হবে। তবে একটা জিনিস দেখাচ্ছি। টিমি বিয়ারের দাম দেয়ার জন্য যে টাকাটা এনেছে ওটা দেখো। পকেট থেকে চারটে ডলার বের করল হেনরি, রাখল কাউন্টারের কিনারে। টাকাগুলোর গায়ে ধূসর, পিচ্ছিল, ঘিনঘিনে কী একটা জিনিস লেগে আছে। কার্লকে বলল, এ টাকা কেউ যেন নাছোঁয়। ছেলেটা যা বলেছে তার অর্ধেকও যদি সত্যি হয় এ টাকায় হাত দেয়া যাবে না।