খুনির রং
এক মিনিট, আপনাকে বলছি
বাংলা সাহিত্যে খুনচর্চা অথবা খুনিচর্চা প্রায় ১২০ বছরের পুরোনো। একথা বলছি তথাকথিত ক্রাইমকাহিনি কিংবা গোয়েন্দাকাহিনির কথা মনে রেখে—যেসব কাহিনিতে খুন অথবা খুনির একটা মুখ্য ভূমিকা আছে। ব্যাপারটা ‘ট্রু ক্রাইম স্টোরিজ’—বাংলায় ‘সত্যকাহিনি’ তকমা এঁটে যেসব কাহিনিকে বিপণন করা হয়—ধরনের কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছিল। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’ কিংবা বাঁকাউল্লার বিবরণীতে ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’ সেই অর্থে বাংলা ক্রাইমকাহিনির সূচনার মুখ।
কিন্তু মূলধারার সাহিত্যেও তো ব্যবহার হয়েছে খুন অথবা খুনির। যেমন শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’, রবীন্দ্রনাথের ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, আলবেয়ার কামুর নাটক ‘ক্রস পারপাস’, অথবা তুলনায় আধুনিক সময়ের লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা’ ইত্যাদি। এরকম নজির আরও বহু রয়েছে।
সাহিত্য থেকে যদি এবার জীবনের দিকে তাকাই তা হলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই আমরা টিভি অথবা খবরের কাগজের মাধ্যমে খুনের ঘটনার ‘মুখোমুখি’ হই। সেইসব খুনের আড়ালে রয়েছে একজন অথবা কয়েকজন খুনি। আর সেইসব খুনির আড়ালে রয়েছে খুনির জটিল বিকৃত মনস্তত্ত্ব। এই মনস্তত্ত্বের স্বরূপ এখনও পর্যন্ত অনেকটাই মনোবিদদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খুন যেমন বহু ধরনের হয়, তেমনই খুনিও। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুনের মোটিভও হয় নানান রকম। সেই কারণেই খুন, খুনি ইত্যাদি একটি বহুমাত্রিক বিষয়। তা ছাড়া খুনি কখনও থাকে প্রত্যক্ষে, কখনও বা পরোক্ষে।
এই বহুমাত্রিক বিষয়টির অল্পবিস্তর আভাস দেওয়ার জন্যই এই সংকলনের আয়োজন। মোটামুটিভাবে গল্পের প্রকাশকালের সময় অনুসারে ১৯৫৮ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২৯টি গল্প সাজিয়ে দিয়েছি আপনার জন্য। তার মধ্যে ২০০০ সাল পর্যন্ত, মানে, গত শতকের গল্প রয়েছে ৮টি। বাকি ২১টি গল্প একুশ শতকের। তবে প্রতিটি গল্পেই রয়েছে খুন, খুনি অথবা খুনির মনস্তত্ত্ব।
সংকলনের লেখক তালিকা হয়তো আপনাকে একটু অবাক করলেও করতে পারে। কারণ, সুবিখ্যাত প্রথিতযশা লেখকদের প্রায় কেউই হাজির নেই লেখকসূচিতে। এর কারণ, সংকলনটিকে আমি ‘চরিত্রে’ আধুনিক করতে চেয়েছি। আর চেয়েছি খুন কিংবা খুনিদের বহুমুখী বৈচিত্র্য তুলে ধরতে। এ ছাড়া আরও চেয়েছি, এ সময়ের যেসব লেখক তাঁদের নিত্যনতুন গল্পে আমাকে চমকে দিচ্ছেন —চমকে দিচ্ছেন তাঁদের প্লট, ভাষা এবং স্টাইল দিয়ে—তাঁদের লেখা আপনার কাছে উপহার হিসেবে সাজিয়ে দিতে।
এই সংকলেনর লেখকদের মোট চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত, পরিচিত এবং সুপরিচিত। কিন্তু তাঁদের লেখা গল্পগুলোর শ্রেণি একটাই : দারুণ!
দু—চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সংকলনের প্রায় সবক’টি গল্পই এমন সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোকে আমরা বেশিরভাগ পাঠকই নামে চিনি না। আর কয়েকটি ক্ষেত্রে লেখকের কোনও গল্প সংকলন থেকে নির্বাচিত গল্পটি সংগ্রহ করেছি।
সবশেষে বলি চারটি গল্পের কথা।
সংকলনের শেষ চারটি গল্প লিখেছেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়, জয়দীপ চক্রবর্তী, সুজন ভট্টাচার্য ও দেবার্চন বসু। হয়তো আপনার কাছে এই চারটি নাম নতুন। এই চারজন লেখক নতুন গল্প লিখে দিয়েছেন এই সংকলনের জন্য। এঁদের গল্প আমাকে এতই খুশি করেছে যে, সংকলনে এই চারজনের গল্প প্রকাশ করতে পেরে সম্পাদক হিসেবে আমি গর্বিত। আমার মনে হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের ময়দানে এই চারজন অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া। এই চারজনকে আগাম অভিনন্দন জানাই।
কিন্তু এই সংকলেনর সবক’টি গল্পেরই গুণমান বিচারের সর্বোচ্চচ স্তরে রয়েছেন, হে পাঠক, আপনি। আপনার বিচারই শেষ কথা। শুধু গল্পগুলোর নয়, সম্পাদক হিসেবে আমি ব্যর্থ না অব্যর্থ, সে—বিচারও করবেন আপনি। শুধুই আপনি। তাই আপনার সাধুবাদ কিংবা বকুনির অপেক্ষায় রইলাম।
অব্যক্ত – অমিতাভ সমাজপতি
সমস্ত পৃথিবী এখন চলছে। ছুটে চলেছে কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম—লাইন। শান্তনু কোনওরকমে কলেজ স্কোয়ারের গেটটা দিয়ে ঢুকে দুলতে দুলতে বাঁধানো একটা চত্বরে এসে বসে পড়ে। আজ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আর বাড়ি যাওয়া যাবে না।
রাত আটটা অবধি কফি হাউসে সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছে। তারপর সুমন্ত আর শান্তনু হাঁটতে হাঁটতে হাড়কাটা গলির সেই ঝুপড়িতে বসে মদ খেয়েছে। গ্যাসট্রিকের ব্যথাটা কয়েকদিন ধরে আবার ভোগাচ্ছিল। অ্যালকোহল এখন পেনকিলারের কাজ করছে।
রাত একটা বাজে বোধহয়। কলেজ স্কোয়ারে একটিও জাগা—মানুষ নেই। শুধু সিমেন্টের বেঞ্চে কয়েকজন শয্যাশায়ী। গরমে এই পার্কের হাওয়া, গরিবের এয়ারকন্ডিশন। ঘুমিয়ে নেওয়া সহজ।
শান্তনু পাথরের মসৃণ দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে। নেশা এখন তুঙ্গে। তবুও খেয়াল করে, বিদ্যাসাগরের মূর্তিটার বেদিতে বসে রয়েছে ও। লজ্জা পায় শান্তনু। ওঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে বোঝে হাত—পা প্রায় অচল। ধীরে ধীরে বেদিটাকে ধরে উঠতে চায়।
তুমি বইস। লজ্জার কিছু নাই।
চমকে ওঠে শান্তনু। কে যেন কথা বলল। চারপাশটা ভালো করে দেখে। না, কেউ নেই তো! মাথাটা দু—তিনবার ঝাঁকিয়ে নিতে নিতে মা—বাপ তুলে গালিগালাজ করে সুমন্তকে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল…আমায় গলা অবধি খাইয়ে কখন কেটে পড়েছে।
তুমি দোষারোপ করিও না। ব্যক্তি নিজকর্মে কেবলই অজুহাত খোঁজে। যেন সমস্ত অপরাধসূচক কর্মে অপরের হস্ত।
শান্তনু এবার ভয় পেয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত হলেও মাথাটা এখনও কাজ করছে ঠিক। শেষ পেগটা গেলার সময় নিজের কবিতা গড়গড় করে আউড়ে গেছে। কথাটা এল কোথা থেকে? এদিক—ওদিক তাকাল শান্তনু।
দিশাহারা হইবার কিছু নাই। আমিই কহিতেছি। তোমরা যাহাকে বিদ্যাসাগর বলিয়া থাকো।
শান্তনু অবিশ্বাসের চোখে ধীরে ধীরে উপরের দিকে তাকায়। পাথরের মূর্তিটা যেন মুচকি হাসছে। কাঁপতে কাঁপতে শান্তনু হাতজোড় করে নমস্কার করে, বলে আপনি!
ঈশ্বরচন্দ্র। তুমি আমাকে ঈশ্বর বলিতে পারো।
কী বলছেন কী! আপনি! শান্তনুর কাঁপুনি বাড়ে।
আপনি বিদ্যা…সা…
প্রয়োজন নাই। তুমি কবি? আমি কোনওদিন কাব্য লিখি নাই। সে প্রতিভা আমার ছিল না। অনুবাদ করিয়াছি মাত্র। তুমি প্রতিভাবান। অতএব নমস্য।
শান্তনুর জোড়হাত যেন আটকে গেছে। বলে, কী বলছেন আপনি! কুড়ি বছরে বিদ্যাসাগর উপাধি। একত্রিশে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল আপনি…।
বিদ্যাসাগর খলখল করে হেসে উঠলেন, বললেন—লজ্জা দিও না। পাঠ্য—পুস্তক লেখক ছাড়া নিজেকে কিছুই ভাবি না আজ। তুমি ওইভাবে দাঁড়াইয়া কেন? বইস। কত বৎসর ধরিয়া আমি এভাবে বসিয়া আছি। আমার হাতটা ধরো। একটু নামিয়া তোমার সঙ্গে বসি।
শান্তনু দ্বিধাগ্রস্তভাবে হাত বাড়ায়। বিদ্যাসাগর বেদিটা থেকে ছোট লাফ দিয়ে শান্তনুর পাশের জায়গাটায় বসেন। শান্তনুর মুখ থেকে দেশি মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। লজ্জায় খানিকটা সরে যায় ও। বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরে হেসে ওঠেন—লজ্জা পাইও না। না, না, লজ্জার কিছু নাই। আমার অভ্যাস ছিল। সময়কালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মধুর পাশে বসিয়া থাকিতাম। তুমি জানো বোধহয় শেষদিকে জল ছাড়া শুধু হুইস্কি খাইয়া নিজেকে শেষ করিল তোমাদিগের মধুসূদন।
শান্তনু মাথা নাড়ে। জানি। তাঁর উপর আপনার দয়ার কথা সর্বজনবিদিত। আপনি তাঁকে বড় অসময়ে সাহায্যের হাত…।
বিদ্যাসাগর হাত দিয়ে শান্তনুকে নিবৃত্ত করলেন—দয়া নয়। সম্মান বলো। আমি উহাকে সম্মান করিতাম প্রতিভার জন্য। যেমন এক্ষণে তোমাকে করিতেছি।
সহস্রবার চেষ্টা করিলেও কোনওদিনও মেঘনাদ বধ লিখিতে পারিতাম না। এমনকী প্রথমে তো তাহার ছন্দ—ই ধরিতে পারি নাই। তুমি জানো বোধহয় আমি আর দ্বারিকানাথ, রাজনারায়ণের কাছে ইংরেজি শিক্ষা করিতে গিয়েছিলাম। তখনই বুঝিয়াছিলাম মধু কী অসাধারণ পণ্ডিত!
আপনি তাঁর এই উচ্ছন্নে যাওয়া আটকালেন না কেন? ইচ্ছে করলেই তাকে বাঁচানো যেত।
বিদ্যাসাগর হো—হো করে হাসলেন। বললেন—তুমি সত্যি করিয়া বলো তো তোমাকে কে সুরা পান করাইয়াছেন। তোমার কোনও বান্ধব নিশ্চয়ই?
শান্তনু মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, সুমন্ত।
দেখো, এখন তিনি হয়তো তোমাকেই দোষারোপ করিতেছেন। তাহার স্ত্রী তাহাকে বকিতেছেন। তিনি বমি করিতেছেন এবং তোমাকে অভিসম্পাত করিয়া তৃপ্ত হইতেছেন। আসলে আমরা যাহা করি স্ব—ইচ্ছায়ই করিয়া থাকি। পরে কুফল লাভে অন্যকে দোষারোপ করিয়া শান্তি পাই। তাহা ছাড়া তোমরা কবি, তোমাদের ভাবের জগতে বিচরণ। অতএব শাসন, বাঁধন তোমাদিগের জন্য নহে। মধুসূদনকে বাঁচাইয়া অদ্যকার সভায় কী লাভ হইত? যাহার হয় অষ্টমবর্ষেই হয়, আশির প্রয়োজন নাই।
শান্তনু কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নেড়ে যায়। তারপর একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসে, আপনার যন্ত্রণা হয় না? এই যে অবক্ষয় চলেছে বছরে বছরে, এতে আপনার ক্রোধ হয় না? আপনি তো ক্রোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
বিদ্যাসাগরের মুখটি যেন কেমন পাংশুবর্ণ হয়ে উঠল মুহূর্তে। কিছুক্ষণ উদাসভাবে তাকিয়ে থাকলেন সামনের দিকে। দৃষ্টিতে ইউনিভার্সিটির দেশলাই মার্কা বাড়িটি। তারপর অদ্ভুত গলায় বলেন—জানো, আমি একদিন একদিন করিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকলাপ দেখিতেছি। তোমাদের মধ্যে কে যেন বলিয়াছিলেন—বিশ্বের বিদ্যা যেখানে লয় হয় তাহাই বিশ্ববিদ্যালয়। কথাটি সত্য। তোমরা কেন যে প্রতিবাদ করিতেছ না জানি না। রাজনীতি করিতে করিতে ইহাকে এখন কোথায় লইয়া ফেলিয়াছ। জানো, আমি সাহেবের টেবিলে পা তুলিয়াছিলাম। আজ বিংশ শতাব্দীতে তোমরা পদলেহন কী করিয়া শিখিলে বুঝিলাম না। অথচ কত কী শিখিবার ছিল।
শান্তনু লজ্জা পেয়ে বলে, আমরা আজ রাজনীতি—সর্বস্ব এক আধখেচড়া জাতি। জন স্ট্র্যাচির মতে জনপিণ্ড।
বিদ্যাসাগর মৃদু হেসে বললেন, যথার্থই বলিয়াছ। তা তোমার পড়াশোনার বহর তো বেশ ঠেকিতেছে।
শান্তনুর গর্ব হল এবার। বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে কমপ্লিমেন্ট। ভাবা যায়? নম্রভাবে বলল, আচ্ছা আপনাদের সময়ের সঙ্গে এখনকার বেসিক তফাতটি ঠিক কী? মানে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি, না এগোচ্ছি?
গম্ভীরভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শান্তনু ডাক দিতে গিয়েও থেমে যায়। একসময় বিদ্যাসাগরই বলে ওঠেন, তোমরা পিছাইয়া পড়ো নাই বরং অনেকটাই অগ্রসর হইয়াছ। ইতিহাস বিস্মৃত হইয়া শুধু সামনে অগ্রসর হইয়া খেই হারাইতেছ।
বিদ্যাসাগর হঠাৎ উঠে পড়লেন, শান্তনু অবাক হয়ে দেখে ওঁকে। এত কম উচ্চচতার লোকের এত তেজ!
তুমি বোধহয় আমার খর্বকার শরীর দেখিয়া বিস্মিত হইতেছ?
শান্তনু থতমত খেয়ে যায়। মানে আপনার ছবি দেখেছি…
উহা তো বক্ষ অবধি। আসলে আমি আমার এই আকৃতির জন্য চিরকালই হীনম্মন্যতায় ভুগিয়াছি। আইস জলের কিনারে বসি।
শান্তনু উঠে দাঁড়ায়।
নির্জন কলেজ স্কোয়ার। আকাশে চাঁদ। জলে তার ছায়া পড়ে চকচক করছে। অদ্ভুত একটা দৃশ্যপট। নিঃশব্দ চরাচর। পাশে বসে আছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। একেবারে বন্ধুর মতো। জমি থেকে ঘাস তুলে ছিঁড়ছেন আঙুল দিয়ে। যে মানুষটা রূঢ়, স্পষ্ট কথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, আজ যেন কেমন বিষণ্ণ। মনের ভিতরে কেমন যেন অব্যক্ত অবসন্নতার ছোঁয়া। বিদ্যাসাগর একটি ঢিল ছুড়ে মারলেন জলে, টুপ করে আওয়াজ হল। জলের চাঁদ নড়ে উঠে আবার ধীরে ধীরে স্থির হল।
আমি জলে ইস্টক ছুড়িলাম কেন বলো দেখি? শান্তনু না বুঝে মাথা নাড়ে, ওটা হয়তো স্বভাব। জলের কাছে এলেই ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে হয়। আপনিও দেখছি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন।
—না, আমি কোনওদিনই ব্যতিক্রম ছিলাম না। খানিকটা দৃঢ়চেতা হওয়াই কি ব্যতিক্রম?
শান্তনুর গা থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে গরমে। ঠান্ডা জলে স্নান করে নিলে ভালো লাগত। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্নান করবেন?
বিদ্যাসাগর যেন সংকুচিত হয়ে উঠলেন—না—না, আমি সন্তরণ জানি না।
শান্তনু চমকে ওঠে। ঠাট্টা করছেন বোধহয়। বাঙালি সাঁতারের অনুপ্রেরণা তো আপনার কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই বিখ্যাত গল্প! মা—মা বলে দামোদর পেরোনো সাঁতরে? এটা কোন লোকে না জানে?
বিদ্যাসাগর যেন লজ্জিত হলেন, বললেন,—না, ওটি সর্ব্বৈব মিথ্যা। আমি সত্যিই সন্তরণ জানি না।
তা হলে ওই গল্পটা?
ওটি রটনা। সাহেব আমাকে ছুটি দিলেন না। আমার ভ্রাতার বিবাহের পত্র পাইয়া ছুটি চাহিয়াছিলাম।
শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সন্দেহে মুখে ভাঁজ পড়ল ওর। চাঁদের আলোয় বিদ্যাসাগর যেন সেটা লক্ষ করলেন, বললেন, আসলে দামোদর সেইসময় শুষ্ক। অর্থাৎ যখন আমার ভ্রাতার বিবাহ হয়, তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। গবাদিপশুরা হাঁটিয়া পার হয়। আমি তাহাই করিয়াছিলাম…।
শান্তনু বাধা দিয়ে বলে, কেন? আপনি মায়ের আদেশ তো কখনওই অমান্য করেননি। তাঁর ডাকে সেই ভয়াল নদীতে ঝাঁপ দেননি?
না, কখনওই নহে। আর একটা কথা…
বিদ্যাসাগর চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ।
আমি কেন সেইরাতে বাড়ি আসিয়াছিলাম—জানি শুধুই আমি। আর কেহ নহে। তবে একজন বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তিনি মুখে কিছুই বলেন নাই। বিদ্যাসাগর আবার চুপ করে গেলেন।
বলতে কি আপত্তি আছে? তাহলে থাক। শান্তনু প্রসঙ্গ পালটাতে চেষ্টা করে। একটা কথায় আটকে রাখলে চলবে না। যতটা পারা যায় জেনে নেওয়া যাক। এই সুযোগ আর আসবে না। রাত অনেক হল। প্রায় মধ্যরাত তো বটেই।
বিদ্যাসাগর ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে সোজাসুজি শান্তনুর চোখের দিকে তাকালেন তারপর হঠাৎ আনমনে বলেন, তুমি যাহা দেখিতেছ তাহা ঠিক নহে। তুমি যা দেখিতে চাও তাহাই হয়তো ঠিক। আমি সেই রাত্রে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম বলিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যাটি রচনা হইবে। সত্যটি হইল তখন নতুন বিবাহিত জীবন। গিয়েছিলাম নববধূর অব্যক্ত ডাকে, মায়ের ডাকে নহে।
এই অবধি বলেই বিদ্যাসাগর একটা ঢিল খুঁজে নিয়ে আবার ছুড়ে মারলেন জলে। জলের চাঁদ আর একবার নড়ে উঠল। বিদ্যাসাগর বললেন, আমি তখন এবং এই মুহূর্তে কেন ইস্টকখণ্ড ছুড়িলাম জানো? কারণ, এই জল যতদিন থাকিবে ততদিন ইহার ভিতর চাঁদ দেখা যাইবে। কিন্তু ইহা—তো আসল চাঁদ নহে। চাঁদের প্রতিবিম্ব। দেখিতে অবিকল হইলেও সত্য চাঁদ দেখিতে হইলে স্কন্ধ উপরের দিকে তুলিয়া দেখিতে হইবে। সত্যের দিকে তাকানো এক্ষণে স্কন্ধ ভারাক্রান্ত করা। মানুষমাত্রেই ইহার অবহেলা করে। তাই নকল চাঁদে ইস্টক ছুড়িয়া আমার মোহমুক্তি ঘটাইতেছিলাম। যেমন আজ তোমাকে পাইয়া এতদিনকার মোহমুক্তি ঘটানো গেল।
শান্তনু অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এই মিথ্যেটা প্রায় এক শতাব্দী ধরে সত্যি হিসেবে চলে আসছে।
বিদ্যাসাগর হাসলেন। প্রগাঢ় হাসি। জ্ঞানী লোকের অবজ্ঞা নেই সেই হাসিতে। মনের মধ্যে জমে থাকা গভীর দুঃখের একটুকরো ঝলক যেন হাসি হয়ে ঝরল, বললেন, দেখো, শতাব্দীর সব রটনাই তো সত্য নহে। সত্য হইলে পৃথিবীটা আরও অর্থপূর্ণ হইত। তুমি কি জানো, চলিয়া যাওয়া সময়ের অনেকটাই ফাঁকির মধ্যে নিমজ্জমান। ইহার অধিকাংশটাই অসত্য অথবা সত্যের অপলাপ?
শান্তনুর অপ্রস্তুত ভাবটা এখনও কাটেনি। এই মহান ব্যক্তিত্ব কত যুগ ধরে ঘরে ঘরে মহামানব হয়ে আছেন। তাঁর এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি!
বিদ্যাসাগর শান্তনুর অবাক হওয়াটা যেন ধরে ফেললেন। কাপড়ের খুঁটটি জড়িয়ে বাবু হয়ে বসলেন, বললেন, তুমি সংকুচিত হইও না। এসকল কথা কেহই জানে না। আমার জীবনের আরও কয়েকটি অসত্য আজ উদ্ঘাটিত হইতে পারিত কিন্তু তোমার চিত্তবৈকল্য দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি না সকল কথা তুমি কেমনভাবে লইবে।
শান্তনু হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। নিজের জীবনের একরাশ অব্যক্ত কথা যেন ওর চারপাশ ঘিরে নাচতে শুরু করেছে, যে কথা কাউকে বলা হয়নি। হবেও না বোধহয়। দেড় শতাব্দী পরে এমনভাবে বলার সুযোগ পাবে কি ও! চমক ভাঙল বিদ্যাসাগরের ডাকে।
কী ভাবিতেছ?
কিছু না। আপনি বলুন, আমি শুনব।
বিদ্যাসাগর যেন খুশি হয়ে গায়ের চাদরটা এবার একেবারে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন। কপালটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর। বেশ উঁচু, কিছুটা কামানো। ওটাই বোধহয় স্টাইল ছিল তখনকার দিনের পণ্ডিতদের। তবে চটি জুতোর ব্যাপারটা ওর নিজস্ব স্টাইল। অসাধারণ স্টাইলিস্ট ছিলেন।
শান্তনু কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও চুপ করে যায়। বিদ্যাসাগর জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনমনা মনটি যেন কথার খেই ধরতে চাইছে। গোপন কোনও দুঃখের কথা বলবার আগে প্রত্যেক মানুষ কিছুটা থম মেরে যায়। উনিও এখন সেইরকম রয়েছেন। খানিক পরে বললেন, তোমার সন্তান কয়টি?
দুই,—দুটোই মেয়ে।
তুমি দেখিতেছি বেশ ভাগ্যবান।
শান্তনু অবাক হয়ে বলল, সেকী? ভাগ্যবান বলছেন কেন? ছেলে নেই তাতে আমি আক্ষেপ করি না, তবে এ ব্যাপারে আমার স্ত্রী অবশ্যই দুঃখিত। কিন্তু এতে ভাগ্যবানের কী দেখলেন!
কেন বলিতেছি জানো? তোমার পুত্র থাকিলে কখনওই তোমার সদৃশ হইত না। ইহা হয় না। কখনও কখনও অবশ্য হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীত হয়। সেক্ষেত্রে আক্ষেপ আর, দুঃখ করা ছাড়া কী—ই বা করিবার থাকে। যেমন আমি। লোকে বিদ্যাসাগর নাম দিয়াছে, অথচ আমার পুত্রটি…। শান্তনু এই ঘটনাটি জানে। তাই অন্যপ্রসঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য আগের কথাটারই খেই ধরে বলে, আপনি সাংসারিক জনপ্রিয়তার কথা বলছিলেন।
হ্যাঁ, ঠিকই বলিয়াছ। জনপ্রিয়তা, অর্থাৎ সবাকার মনে তুমি ভেদ্য এবং হাঁ—বাচক থাকিবে, অথবা না বলিবে না। এমনভাবে চলিতে পারিলে তুমি জনপ্রিয় হইবে। ইহাতে তোমার নিদারুণ ক্ষতি হইলেও তোমার মাথাটি হ্যাঁ—র দিকে থাকিবে। যেমন মদীয় মস্তকটি যদি তোমাদিগের ভগবতীদেবীর বিরুদ্ধে লইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার পুত্র কলিকাতাতেই থাকিত। শিক্ষা লাভ করিত। পিতার মৃত্যুর পর উইল লইয়া মামলা করিত না, বংশের নাম মসিলিপ্ত করিত না। তাহা আর হইল কোথায়।
শান্তনু বলল, এটা এমন কিছু দোষের হত না। এ ব্যাপারে আপনি যে একেবারে উদাসীন ছিলেন সেটা ভাবছেন না কেন?
বিদ্যাসাগর বাধা দিলেন, না—ইহা সত্য নয়। আমি চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু তখন আমার মাতৃভক্তি সুপরিচিত। সেই মোহ ভাঙিতে পারি নাই। একদিক রাখিতে হইলে অন্যদিক ছাড়িতে হয়। আমি জনপ্রিয়তাই গ্রহণ করিয়াছিলাম। সংসারে এবং জগৎসংসারে।
কিন্তু আপনার দয়ার কথা সর্বজনবিদিত, বাঙালি এখনও আপনার উদাহরণ দেয়। শুধু মধুসূদন নয়, আমরা সবাই। এটা নিছক জনপ্রিয়তার জন্য—তা তো নয়।
তুমি আবার লজ্জা দিতেছ।
সত্যি বলছি। আপনার বিধবা বিবাহ আইন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সমাজসেবা। আমি আশ্চর্য হই আপনার সাহস দেখে। কত আধুনিক ছিলেন সেই যুগে। ভাবা যায় না। ব্যাপারটা মাথায় এল কীভাবে?
আসলে এক চৌদ্দবর্ষীয় বালিকার বৈধব্য আমাকে পীড়িত করিয়াছিল তাই হয়তো…
আপনি কি মার্কস—এ বিশ্বাস করেন?
কেন? একথা বলিতেছ কেন?
কারণ এটি হল তাঁর মতবাদ।
যদি বিষয়টি পরিষ্কার করিয়া বলো তবে বুঝিতে চেষ্টা করিব।
শান্তনু তার প্রিয় সাবজেক্ট পেয়ে খুশি হয়ে বলল, আপনি আগে বিধবার কষ্ট দেখেছিলেন তারপর তার প্রতিকার। এটি হল কার্ল মার্কসের একটি থিয়োরি, আগে বস্তু দেখি, তারপর মন তার উপর কাজ করে।
বিদ্যাসাগর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, বললেন, কিন্তু কখনও কখনও মনও আগে কাজ করে। পরে কার্য সমাধা হয়। দুইটিই সমানভাবে মনুষ্যের উপর কাজ করিয়া থাকে। শান্তনু মাথা নাড়ে—হয়তো ঠিকই—আপনি বলছেন হেগেলও তাহলে সঠিক।
হ্যাঁ, আমি হেগেল পাঠ করিয়াছি তিনি যেমন অর্ধসত্য, তোমার কার্ল মার্কসও অর্ধমিথ্যা।
কিন্তু মার্কস তো বলেছিলেন হেগেলের থিয়োরি ঠিকই আছে। শুধু পা উপরে মাথা নীচে।
বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসলেন—আসলে দুইজনকেই পাশাপাশি রাখিতে হইবে। ঠোকাঠুকি করিলে চলিবে না। আমি একবার এই পাশাপাশি চিন্তা না করিয়া জীবনে এক বিশাল পাপ করিয়াছিলাম যাহা জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নই।
কীরকম?
তোমার নিশ্চয়ই আমার সেই বিখ্যাত গল্পটি মনে আছে।
কোনটা বলছেন? কারমাটারে ভুট্টা বিলিকরণ?
না—না, সেই যুবকটি—জ্ঞানদানের নিমিত্তে যাহার আমি বাক্স বহন করিয়াছিলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা কে না জানে? ছোটবেলায় কতবার ট্রানস্লেশন করেছি। গল্পটায় আপনি ‘কুলি কুলি’ করে চিৎকার করে ওঠা যুবকের হাত থেকে বাক্স নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, ইতিহাস সেই অবধি জ্ঞাত রহিয়াছে, তাহার পরের ইতিহাস নাই। তাহার পরদিন সেই সময় স্টেশনে যাইতেই প্রায় অনাহার—ক্লিষ্ট এক বৃদ্ধ আমাকে চিৎকার করিয়া ভর্ৎসনা করিয়াছিল। আমি অপ্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেই সে বলিল, সেই রাত্রিতে সে ওই যুবকের বাক্সটি বহন করিতে পারিলে দুই আনা পয়সা পাইত, সে আসিবার আগেই আমি তাহার গ্রাস কাড়িয়াছিলাম। আমি বারংবার তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াও পারি নাই। সেই রাত্রে তার পরিবারের কোনও খাবার জুটে নাই। তৎক্ষণাৎ তাহাকে চারি আনা পয়সা দান করিয়াছিলাম।
শান্তনু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে এর মধ্যে পাপের কী আছে? আপনি তো তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর হাসলেন, বললেন, না আমি স্বনির্ভরতার শিক্ষা দিতে গিয়া প্রথমত একটি সর্বহারার রোজগারে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছিলাম। কারণ, যে যুবক একটি ব্যাগ বহিবার জন্য দুই আনা দিতে রাজি সে নিশ্চয়ই প্রয়োজনের অপেক্ষা অধিক উপায় করে। সে কখনওই পরনির্ভর নহে। অতিরিক্ত উপায়ী। স্বনির্ভরতা শিক্ষা দিতে গিয়া একজন সত্যিকারের উপায়ী লোককে ভিখারি করিয়া ছাড়িয়াছি, ইহা শুধুমাত্র অন্যায় নহে সততই পাপ, যাহা এখনও ভুলিতে পারি নাই।
শান্তনু আশ্চর্য হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। কী অদ্ভুত সৎ হলে এসব কথা বলা যায়। আত্মবিশ্লেষণের কী অসাধারণ প্রচেষ্টা! এর নাম বিদ্যাসাগর।
ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা জায়গা নিয়ে নেয় দুজনের মাঝখানে। কেউ কোনও কথা বলে না আর।
শান্তনুর মনের মধ্যে নিদারুণ এক লজ্জাবোধ চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরতে শুরু করছে। এতদিনকার সব অহংকার যেন তালগোল পাকিয়ে গলার ভিতর থেকে উগলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জীবন বড়ই ভয়ানক নাটক। কত স্মৃতি—বিস্মৃতি দিয়ে তৈরি এই মানবজীবন। কত কথা মনের কুঠুরিতে আটকে থাকে। কাউকে বলা যায় না। কতবার স্ত্রীকে, সুমন্তকে বলতে চেষ্টা করেছে ও। পারেনি। পারা যায় না।
তখন কত বয়স হবে? বারো—তেরো—মেজদার গল্প লেখার খাতা থেকে দশ—বারো পাতা ছিঁড়ে কুচো কুচো করে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল ও। কেউ জানতে পারেনি কার কাজ। পরদিন গল্প জমা দেবার শেষ তারিখ। মেজদা সারারাত কেঁদেছিল। তিনদিন পর শান্তনু প্রাইজ পেল। প্রথম পুরস্কার। মেজদা হাসতে হাসতে বলেছিল ভালোই হল বল, আমি তো প্রত্যেক বারই পাই এবার তুই পেলি।
এক—একটি স্মৃতি সিনেমার ছবির মতো এক—এক করে উঠতে শুরু করছে চোখের সামনে—উনিশশো সত্তর সাল। প্রবীর বাগবাজার থেকে গভীর রাতে দেখা করতে এসেছিল অশোকনগরে। ছেঁড়া জামা, চুলগুলো অবিন্যস্ত। কাঁধে একটি ঝোলা। দরজার কড়া নাড়তেই বুক কেঁপে উঠেছিল। আবার হয়তো এনকাউন্টারের খবর। হয়তো আবার কেউ নেই। বুকের ভিতর হাতুড়ির শব্দ অনুভব করতে করতে খুলে দিয়েছে দরজাটা।
অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকেছিল প্রবীর। দেশলাই জ্বালিয়ে, হ্যারিকেনটার খোঁজ করতে যেতেই হাত দিয়ে আটকে দিয়েছিল প্রবীর।
থাক আলো জ্বালাস না। সময় নেই। খবর আছে।
শান্তনু বালিশের তলায় সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ায়। একটা প্রবীরকে দেয়। আবার দেশলাই জ্বালিয়ে দেখে নেয় প্রবীর কিনা। গত চারমাস কোনও খোঁজখবর নেই। বাঁকুড়ায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে সংগঠনের কাজে ছিল।
দেশলাইয়ের আলোতে ওর গালে কাটা একটা দাগ দেখে শান্তনু।
শান্তনু বলে, আয় খাটে এসে বোস। গালে কীসের দাগ?
প্রবীর পাত্তা দেয় না কথাটার। সিগারেটে দু—চারটে জোরে টান মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে খেতে দে কিছু, খিদে পেয়েছে।
অন্ধকারে প্রবীরের উপস্থিতি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলেছিল শান্তনুকে। খাটের তলা হাতড়ে দুটো রুটি আর গুড়ের ঢেলা হাতে করে দিল ওকে। গোগ্রাসে গিলে ফেলল ও। ওর খাওয়ার মধ্যে এমন একটা আদিমতা ছিল যে শান্তনু ভয়ানক ভয় পেয়ে যায়। যেন প্রবীর এরপর ওকেই খাবে। অন্ধকারে চোখ দুটো ওর জ্বলছিল।
জল খেয়ে আবার সিগারেট চায় প্রবীর। কয়েক মিনিট নীরবতা। যে—কোনও মুহূর্তে কোনও সাংঘাতিক সংবাদ বেরিয়ে আসতে পারে ওর মুখ থেকে। তাই হল। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে এল…প্রদীপ…।
শান্তনু স্নায়ুতে ধাক্কা খেল জোর।
কী হয়েছে?
বেলেঘাটার এনকাউন্টারে শেষ…
শান্তনুর সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে গলা অবধি উঠে এল। কোনওরকমে হাত দিয়ে গলা চেপে ধরল ও।
প্রবীর খাটে এসে বসল। হাত দুটো শান্তনুর হাতে রেখে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ব্যাড লাক। তুই যদি খবরটা ঠিকসময় পৌঁছোতে পারতিস…
কিন্তু আমি…
জানি—সেদিন অশোকনগর রেড হয়েছিল, তুই পালাতে পারিসনি।
এক লাফ দিয়ে প্রবীর নেমে কোমর থেকে বার করে রিভলভারটা। হাতে দেয় শান্তনুর। এটা দীপঙ্করের। শেষ দেখা হওয়ার সময় তোকে দিয়ে গিয়েছিল। ওর লাস্ট প্রেজেন্ট। তোকে খুব ভালোবাসত।
আর একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে প্রবীর বেরিয়ে গিয়েছিল দরজা খুলে।
শান্তনু খাটে বসে রিভলভারটা নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছে সেদিন। সত্যি কথাটা কেউ জানে না। প্রবীরকে বলা যায়ানি। সেই রাতেই প্রবীরের দেহটা লাইনের ধারে পড়েছিল। সত্যি কথা কেউ জানবে না। কাউকে বলা হয়নি। দীপঙ্করের সেই রিভলভারটা গুলি ভর্তি এখনও শান্তনুর কাছে আছে। মাঝে মধ্যেই রাতে একা ছাদে চলে যায় শান্তনু। যখন ঘুম আসে না। যন্ত্রটায় হাত বুলোয়। এইখানে ঘুমিয়ে আছে প্রবীর, প্রদীপ, দীপঙ্কর। একসময় বুকে ঠেকিয়ে ইচ্ছে হয় ট্রিগারে চাপ দিতে। পারে না শান্তনু। চিৎকার করে কী যেন বলে দিতে ইচ্ছে হয়। আপন মনে আউড়ে যায়, অল মাই কনসেন্স হ্যাজ থাউজেন্ডস অব লেগস…।
তুমি শেক্সপিয়র খুব ভালোভাবে পড়িয়াছ বোধহয়?
চমকে ওঠে শান্তনু—এ আমি কোথায়! কলেজ স্কোয়ারের জলের ধারে কুড়ি বছর পর।
সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। বিদ্যাসাগর স্মিত হেসে সন্তর্পণে জায়গা ছেড়ে উঠলেন। গায়ের চাদরটা ঠিক চির পরিচিত ভঙ্গিতে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
শান্তনু অনুনয় করল—আপনি বসুন। আমার কিছু কথা আছে।
বিদ্যাসাগর জোরে হেসে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, অব্যক্ত কথা?
হ্যাঁ, আপনাকে শুনতে হবে। আমি কুড়ি বছর ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছি। আজ বলব। আপনি বসুন প্লিজ। শান্তনু এবার যেন আদেশ করল…
বিদ্যাসাগর মাথাটা ধীরে নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেলেন বেদিটার দিকে—না, অদ্য নহে। পরে বলিও।
শান্তনু চিৎকার করে ওঠে, না আজ, টু নাইট। আমার মনের কথা সব বলতে দিন। প্লিজ, দশ মিনিট।
না বৎস তাহা হইতে পারে না।
কেন? কেন হতে পারে না? আমি কত বছর ধরে জমিয়ে রেখেছি আজ অন্তত বলতে দিন—অন্তত একজনকে বলে দেব আমি—
বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসতে হাসতে বেদিটার উপর উঠে বললেন, দেড় শত বৎসর ধরিয়া ভাবিও, আমার মতো—যে তুমি ঠিক না…ভুল, কুড়ি বৎসর যথেষ্ট কি?
শান্তনু বিকট চিৎকার করে এগিয়ে যায় বেদিটার দিকে। বিদ্যাসাগর নড়তে নড়তে স্থির হয়ে গেলেন।
শান্তনু সমানে চিৎকার করে যায়, প্লিজ বিদ্যাসাগর, প্লিজ ঈশ্বরচন্দ্র—প্লিজ আমি আর কাউকে বলতে পারব না…পারিনি…
খানিকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে আসে ওর। পাথরের মূর্তিটাকে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে একসময় ক্লান্ত হয় শরীরটা। ধীরে ধীরে নেমে আসে বেদিটা থেকে।
চিৎকার করে মূর্তিটাকে বারবার বলে — আমাকে বলতেই হবে। এইবারেই বলতে হবে।
পেটের ভিতরে একরাশ গ্লানি পুষে রয়েছে কত বছর। শান্তনু গলায় আঙুল ঢুকিয়ে যেন বের করে দিতে চায়। হড়হড় করে বমি বেরোয়। মাথাটা ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে জলের দিকে এগিয়ে যায় ও। মার কথা মনে পড়ে বিপন্নতায়। মা বলতেন, রাতে জলের কাছে পাপের কথা বলতে হয়। পাপ দূর হয়।
শান্তনু জলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চিৎকার করে বলে—শোনো সেদিন অশোকনগরে আমি ছিলাম না। আমি জয়ার কাছে গিয়েছিলাম। জয়াদের বাড়িতে কেউ ছিল না। সারারাত গান শুনে শেষরাতে একসঙ্গে শুয়েছিলাম। ও এখন আমার স্ত্রী। সেদিন প্রেমিকা ছিল। এক বিছানায় আমি যখন সম্ভোগে উত্তাল তখন প্রদীপ, দীপঙ্কর ওরা মরে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। ইচ্ছে করলে প্রয়োজনীয় সংবাদ পৌঁছোতে পারতাম আমি। যাইনি।
জলের ভিতর থেকে কে যেন হা—হা শব্দে হেসে উঠল। চমকে উঠল শান্তনু। জলে চাঁদটা নেই। ঝুঁকে পড়ে আবার দেখার চেষ্টা করল ও। নেই। অথচ আলো চকচক করছে। ঘাবড়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায় শান্তনু। পুব আকাশে তখন সূর্য উঠে গেছে। প্রথম আলো কলেজ স্কোয়ারের জলে চকচক করে রাত্রির মৃত্যু ঘটিয়েছে।
হল না। রাতের জলের কাছে বলা হল না। ডুকরে কেঁদে ওঠে শান্তনু। সূর্যের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, তুমিও বিশ্বাসঘাতক—আমারই মতো…।
অর্ধেক পুরুষ – অনীশ দেব
সুপ্রতিম একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর মন বলছিল, ফোনটা আসবে। যদিও স্টুডিয়োতে লাইন পাওয়া বেশ ঝকমারি, তবুও ওর মনে হচ্ছিল সেই মেয়েটি যেরকম নাছোড়বান্দা তাতে লাইন ও পাবেই।
সন্ধে ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা— এই আধঘণ্টা ধরে ‘সাইবার চ্যানেল’-এর ‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠান টিভিতে দেখানো হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সুপ্রতিম আর ওর অনুষ্ঠান-সঙ্গিনী মোনা। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে। মাত্র চারমাসেই ‘মুশকিল আসান’ সকলের মন কেড়ে নিয়েছে।
দর্শকরা নানান প্রশ্ন পাঠান সুপ্রতিমদের কাছে। সুপ্রতিম আর মোনা পালা করে সেসবের উত্তর দেয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠান চলার সময় বহু ফোনও আসে ওদের স্টুডিয়োতে। কেউ-কেউ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন, আর কেউ-বা নিজের কোনো সমস্যা তুলে ধরেন ওদের কাছে।
চিঠিপত্রের উত্তরগুলো ‘সাইবার চ্যানেল’-এর অফিসে কয়েকজন বসে ঠিক করেন। সেখানে সুপ্রতিম আর মোনাও থাকে। তবে টেলিফোনে পাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সুপ্রতিম বা মোনাকেই চটজলদি করে সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হয়। এর জন্য যে-বুদ্ধি এবং স্মার্টনেস দরকার, সেটা সুপ্রতিম আর মোনা দুজনেরই আছে।
সুপ্রতিমের চেহারা বেশ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে কীরকম যেন একটা বনেদি ঢং আছে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। স্বাস্থ্য মাঝারি। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। দাড়ি সুন্দর করে কামানো হলেও ফরসা গালে, থুতনিতে, নীলচে আভা থেকে গেছে। ঠোঁটের ওপরে কালো গোঁফ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। বয়েস পঁয়তিরিশ হলেও অনেক কম দেখায়।
সুপ্রতিম যত না সুন্দর তার চেয়েও অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে। ওকে ঘিরে অনেক দর্শকেরই কৌতূহল— বিশেষ করে মেয়েদের। অনেকেই ওকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি দেয়। আবার কেউ-কেউ ওকে নানান ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায়। সেইসব প্রশ্নের পাশকাটানো মজার উত্তর দেয় সুপ্রতিম।
ওর ডান ভুরুর ওপরে একটা কাটা দাগ আছে। সেটা নিয়ে এক তরুণী জিগ্যেস করেছিল, ‘আপনার ডান ভুরুর ওপরে ওই লাভলি কাটা দাগটা হল কেমন করে?’
সুপ্রতিম জবাব দিয়েছিল, ‘ছোটবেলায় এভারেস্ট থেকে পড়ে গিয়ে।’
একজন কিশোরী চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘আপনার নামটা দারুণ। ভীষণ এক্সাইটিং।’
জবাবে সুপ্রতিম বলেছিল, ‘মোটেই তা নয়। সুপ্রতিম মানে হচ্ছে ভালোর মতো— কিন্তু পুরোপুরি ভালো নয়।’
একজন পুরুষের কৌতূহল: ‘আপনি কি বিয়ে করেছেন?’
সুপ্রতিমের উত্তর: ‘করিনি বললে আমার ছ’জন ওয়াইফ রেগে আগুন হয়ে যাবেন। আর বিয়ে করেছি বললে অনেক দর্শক দুঃখ পাবেন। তাই এই সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।’
আসল ঘটনা হল সুপ্রতিম বিয়ে করেছে। স্ত্রী নয়নার সঙ্গে ওর পরিচয় সাত বছরের। তার মধ্যে প্রথম তিনবছর ওর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে, আর বাকি চারবছর চুটিয়ে সংসার করেছে। এখনও করছে। সুপ্রতিম যা-কিছুই করে, সবসময় চুটিয়ে করতে চায়। তাই নিয়ে নয়নার সঙ্গে মাঝে-মাঝে বেশ ঝামেলাও হয়।
নয়না দেখতে বেশ সুশ্রী, মিষ্টি মেয়ে। তবে সুপ্রতিমের চেহারার পাশে নিজের চেহারা নিয়ে সবসময় ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। সুযোগ পেলেই ওই প্রসঙ্গ তুলে ঠাট্টা করে। সুপ্রতিম রোজ যখন অফিসে রওনা হয়, নয়না তখন আকুল চোখে স্বামীকে দ্যাখে।
সুপ্রতিম অবাক হয়ে বলে, ‘কী ব্যাপার! এমনভাবে তাকিয়ে আছ যেন এই প্রথম চার চোখের মিলন হল!’
নয়না ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায় ওর দিকে, বলে, ‘ইচ্ছে করছে থুতু ছিটিয়ে কানের লতিতে কুট করে কামড়ে দিই।’
সুপ্রতিম ওর দিকে বাঁ-কান এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও, তাই দাও। পারলে কপালের পাশে একটা কাজলের টিপও বসিয়ে দাও।’
নয়না ওর কানটা কষে মলে দিয়ে বলে, ‘সাবধান! কারও দিকে বেশিক্ষণ তাকাবে না। কেউ যেন নজর না-দেয়। তা হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।’
‘টিভির মধ্যে দিয়ে কারও দিকে তাকানো যায়! তবে মোনা তো পাশে থাকে, ওর দিকে না-তাকিয়ে উপায় নেই…।’
‘মোনা খুব ভালো মেয়ে। বরং তোমাকেই বিশ্বাস নেই।’
মোনার সঙ্গে নয়নার পরিচয় আছে। মোনা অনেকবার সুপ্রতিমের বাড়িতে এসেছে। দরকারে-অদরকারে প্রায়ই ফোন করে। নয়না ওকে খুব পছন্দও করে।
মোনা এলাহাবাদের চৌকস মেয়ে। বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ। সুন্দর, স্মার্ট। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুলে সামান্য লালচে ভাব। টানা-টানা চোখ। শুধু ওর বাংলায় সামান্য টান আছে।
ও সুপ্রতিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। ওর কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তেই শেখার চেষ্টা করে। কথায়-কথায় বলে, ‘সুপ্রতিমদা, য়ু আর সিম্পলি লাজবাব। আপনি ”সাইবার চ্যানেল”-এর অ্যাসেট।’
‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সুপ্রতিমের দারুণ লাগে। অনুষ্ঠানের কিছুটা অংশ আগে রেকর্ড করা হয়। আর খানিকটা লাইভ। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নামী-দামি ডাক্তার-উকিল-জ্যোতিষী ইত্যাদি নানান পেশার মানুষ পালা করে এই অনুষ্ঠানে আসেন। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদেরও নিয়ে আসা হয় বিশেষ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। তবে সবশেষে থাকে মজাদার প্রশ্ন-উত্তরের পালা। তখন সুপ্রতিম আর মোনা যেন আরও স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে।
সব মিলিয়ে ‘মুশকিল আসান’ একেবারে সুপারহিট।
দিনকুড়ি আগে একটা খাম এসে পৌঁছয় সুপ্রতিমদের দপ্তরে। খাম খুলেই সুপ্রতিম দ্যাখে ভেতরে একটা টাটকা লাল গোলাপ, আর একটা চিঠি। খামের ওপরে কোনো ডাকটিকিট ছিল না। বোধহয় কেউ কুরিয়ারে পাঠিয়েছে।
চিঠিটা পড়েই সুপ্রতিমের কেমন অস্বস্তি হল।
.
প্রিয় সুপ্রতিম,
তোমাদের অনুষ্ঠান আমি সবসময় দেখি। খুব ভালো লাগে। তবে তার চেয়েও ভালো লাগে তোমাকে। শুধু তোমাকে দেখার জন্যেই অনুষ্ঠানটা প্রাণভরে দেখতে হয়। অনুষ্ঠানগুলো আমি সবসময় ভিডিয়ো ক্যাসেটে ধরে রাখি। তারপর যখনই মনখারাপ লাগে, তখনই ওগুলো চালিয়ে তোমাকে দেখি। তোমার সব সুন্দর— নাক, মুখ, চোখ, ঠোঁট, এমনকী ভুরুর কাটা দাগটাও। জানো, তোমার ওই কাটা দাগটা নকল করে আমি আমার বুকের বাঁ-দিকে একটা কাটা দাগ এঁকেছি! তোমার প্রতিটি অঙ্গের জন্যে আমার প্রতিটি অঙ্গ সবসময় কাঁদে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু অনুষ্ঠান চলার সময় কিছুতেই স্টুডিয়োর ফোনের লাইন পাই না। তাই বলে চেষ্টা ছাড়িনি। আবার চিঠি দেব। সঙ্গে যে-গোলাপটা পাঠালাম, সেটার কথা টিভিতে বলবে তো! বললে বুঝব আমার ভালোবাসা তুমি ফিরিয়ে দাওনি। অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো—
ঝুমুর চৌধুরি
কলকাতা-১৪
‘সাইবার চ্যানেল’-এর দপ্তরে প্রচুর ‘প্রেমপত্র’ আসে। তাতে মোনার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করতে চাওয়া চিঠিই বেশি, সুপ্রতিমের কম। মোনাকে বিয়ে করতে চেয়েও বেশ কয়েকজন ‘সুপাত্রের’ চিঠি এসেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ওরা কেউই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কারণ, এ-ধরনের স্পন্সরড প্রোগ্রামে এসব উৎপাত খুবই মামুলি ব্যাপার। কিন্তু এই চিঠিটা যেন ঠিক মামুলি নয়। কেমন যেন একটু অন্যরকম।
মোনা চিঠিটা নিয়ে সুপ্রতিমের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকি করে পিছনে লেগেছিল। কিন্তু সুপ্রতিম পুরোপুরি সহজ হতে পারেনি। দু-একদিন চিন্তা করার পর ও মোনার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিঠিটার একটা নির্দোষ উত্তর দিয়ে দেবে।
সাধারণত অফিসের সমস্যা বাড়িতে খুব একটা আলোচনা করে না সুপ্রতিম। কিন্তু ঝুমুর চৌধুরির চিঠিটার কথা বলল।
নয়না সেটাকে কোনো গুরুত্বই দিল না। বলল, ‘ওর আর কী দোষ বলো! টিভিতে অমন হেসে-হেসে সুন্দর-সুন্দর করে কথা বলবে, আর প্রেমপত্র আসবে না— এ তো হতে পারে না! তুমি বরং বেচারিকে একটা সান্ত্বনাপত্র লিখে দিয়ো। আর শোনো, তোমাকে একটা গুড নিউজ দেব। আমি একটা বই লিখতে শুরু করেছি। নাম দিয়েছি ”সুন্দর সোয়ামির সমস্যা”—।’
‘ঠাট্টা কোরো না, নয়না।’ কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছে সুপ্রতিম, ‘চিঠিটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।’
নয়না একটা হাতব্যাগে সুতোর নকশা বুনছিল, সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ,ঠিকই বলেছ। খামের মধ্যে ফুল পাঠানো, ভুরুর ওই কাটা দাগ নকল করা…। তুমি বরং একটা মামুলি উত্তর দিয়ে দিয়ো। উত্তর না-দিলে আবার যদি কিছু হয়…।’
পরের ‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠানে উত্তর দিয়েছিল সুপ্রতিম।
‘কলকাতা চোদ্দো থেকে গোলাপফুল পাঠিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানকে ভালোবাসা জানিয়েছেন ঝুমুর চৌধুরি। তাঁকে আমাদের শুভেচ্ছা জানাই। আর আপনারা, যাঁরা এখন এই অনুষ্ঠান দেখছেন, আপনাদের জানাই— আপনারা যত খুশি প্রেমপত্র পাঠান, তবে মনে রাখবেন, সেগুলো যেন শুধু এই অনুষ্ঠানের নামেই হয়। আমার বা মোনার নামে নয়। কারণ আমাদের জীবনে প্রচুর প্রেম আছে। আর বাড়তি প্রেম আমরা চাই না।’ হেসে মোনার দিকে তাকিয়ে সুপ্রতিম জিগ্যেস করেছে, ‘কী বলো, মোনা!’
‘ঠিকই বলেছেন, সুপ্রতিমদা— এই অনুষ্ঠানের জন্যেই প্রেমপত্র দরকার। আর সেইসঙ্গে সমালোচনা। কারণ, এই অনুষ্ঠানকে আমরা আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই। আমরা চাই, এই অনুষ্ঠান হয়ে উঠুক আপনাদের আরও-আরও প্রিয়।’
এই উত্তর ঝুমুর চৌধুরিকে যে খুশি করতে পারেনি, বরং ব্যথা দিয়েছে, সেটা বোঝা গেল ওর পরের চিঠিতে।
প্রিয় সুপ্রতিম,
কিছু দিতেই যদি চাও, তা হলে দুঃখ দাও কেন! তোমার এড়িয়ে যাওয়া উত্তরে খুব দুঃখ পেয়েছি আমি। সারাদিন, সারারাত শুয়ে-শুয়ে কেঁদেছি। তোমাদের অনুষ্ঠানকে ভালোবেসে আমি গোলাপ পাঠাইনি, তোমাকে ভালোবেসে পাঠিয়েছি। তুমি বলেছ তোমার জীবনে প্রচুর প্রেম আছে, বাড়তি প্রেম তুমি চাও না। তোমার মতো সুপুরুষ দেবতাকে অনেকেই যে ভালোবাসবে, সে তো স্বাভাবিক! তাই এ-কথায় দুঃখ পাইনি। তবে তুমি জেনে রাখো, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। আমার বুকের কাটা দাগটায় আমি যখন আঙুল বোলাই তখন বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। মনে হয় যেন আমি তোমার ভুরুতে আলতো করে আঙুলের ছোঁওয়া এঁকে দিচ্ছি। তোমাদের স্টুডিয়োর লাইনটা কবে পাব বলতে পারো! সবসময় খালি এনগেজড! ভাবছি, এবার থেকে বাড়ির ফোনেই তোমাকে ধরার চেষ্টা করব। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে তোমার নাম্বারটা পাব তো! বাড়িতে ফোন করলে তুমি কি রাগ করবে? আমি জানি, তুমি রাগ করবে না— বরং খুশিই হবে। তারপর…একদিন…যখন আমাদের দেখা হবে…ওঃ! আমি আর ভাবতে পারছি না। বিশ্বাস করো সুপ্রতিম, তোমাকে না-পেলে আমি বাঁচব না— তুমিও না। আজ শেষ করছি। অসংখ্য ভালোবাসা নিয়ো—
তোমার, শুধু তোমার
ঝুমুর
চিঠিটা পড়ার পর সুপ্রতিম কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে বসে রইল। ঝুমুরকে ঘিরে এলোমেলো চিন্তা ছুটোছুটি করতে লাগল ওর মাথার ভেতরে। মেয়েটি কেমন যেন অস্বাভাবিকরকম নাছোড়বান্দা। তা ছাড়া চিঠির কোনো-কোনো জায়গায় কি পাগলামির লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে? নইলে সুস্থ কোনো মেয়ে হলে প্রথম চিঠির এড়িয়ে যাওয়া উত্তরেই তো সব বুঝতে পারত, আর তার ভালোবাসার অসুখটাও সেরে যেত।
ঝুমুর বাড়িতে ফোন করতে পারে ভেবে সুপ্রতিম একটু ভয়ও পেল। যদি ও সত্যিই পাগল এবং নাছোড়বান্দা হয় তা হলে তো ফোন করে-করে জ্বালিয়ে মারবে। তখন হয়তো পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া গতি থাকবে না। আর পুলিশে খবর দিলেই তো যত ঝামেলা। বাজে পাবলিসিটি।
আচ্ছা, ও যদি টেলিফোন ডিরেক্টরিতে সুপ্রতিমের ঠিকানা জেনে বাড়িতে এসে হাজির হয়! তা হলে তো আবার সেই থানা-পুলিশ!
প্রায় দু-দিন নানান দুশ্চিন্তার পর সুপ্রতিমের আশঙ্কা ধীরে-ধীরে কেটে গিয়েছিল। ও নয়নাকে বলে রাখল ঝুমুর চৌধুরি নামের কেউ ফোন করলে নয়না যেন বলে দেয় সুপ্রতিম বাড়ি নেই।
পরের দু-দিনে তিনবার ঝুমুরের ফোন এল। তার মধ্যে দুবার সুপ্রতিম সত্যিই বাড়ি ছিল না। আর একবার নয়না আড়চোখে সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে ফোনে বলে দিল, ‘উনি তো এখন বাড়ি নেই।’
‘কখন ওঁকে পাওয়া যাবে বলুন তো?’
‘ওঁর তো ফিরতে-ফিরতে রাত এগারোটা মতন হবে। আপনি বরং প্রোগ্রাম চলার সময় স্টুডিয়োতে ট্রাই করে দেখুন—।’
‘ঠিক আছে। স্টুডিয়োতেই ট্রাই করব।’ রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল ঝুমুর।
নয়না সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, ‘মেয়েটার গলাটা কেমন যেন পিকিউলিয়ার।’
‘পিকিউলিয়ার মানে?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করছে সুপ্রতিম।
‘কেমন যেন আদুরে, খসখসে।’
হো-হো করে হেসে উঠেছে সুপ্রতিম। হাসতে-হাসতেই বলেছে, ‘আদুরে! খসখসে! মাই গুডনেস! কী বিচিত্র অ্যাডজেকটিভ! তুমি সেলাই ছেড়ে সাহিত্য করলে পারতে।’
একটু পরে হাসি থামিয়ে সুপ্রতিম সিরিয়াস ঢঙে জানতে চাইল, ‘অ্যাই, মেয়েটার বয়স কীরকম হবে বলো তো? আঠেরো-উনিশ? নাকি চল্লিশ-বিয়াল্লিশ?’
‘ঠিক বোঝা গেল না। সাতাশ-আটাশ হবে বোধহয়।’ ইতস্তত করে নয়না বলল।
তারপর থেকেই সুপ্রতিম কেমন এক অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে লাগল। ঝুমুর চৌধুরির ছবিটা ওর কাছে কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছিল না। এ-ধরনের গায়ে-পড়া প্রেমিকাদের ও বহুবার সামাল দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম ও যেন ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না। প্রতিদিনিই অনুষ্ঠান শুরু করার পর থেকেই ও স্টুডিয়োতে ঝুমুরের ফোনের জন্য ভয়ে-ভয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
আজ ওর মন বলছে, ফোনটা আসবে। আজ ওদের স্টুডিয়োর ব্যস্ত লাইনে টুক করে ঢুকে পড়বে ঝুমুর।
এবং সুপ্রতিমের আশঙ্কাই সত্যি হল। ঝুমুর যে ফোনটা করেছে সেটা ফোনে সাড়া দেওয়ার পরই ও বুঝতে পারল।
‘হ্যালো— ”মুশকিল আসান”—।’
‘সু-সুপ্রতিম! আমি গো…আমি বলছি…ঝুমুর…।’
নয়না ঠিকই বলেছিল। খসখসে আদুরে গলা। কেমন যেন ফিসফিসে সুরে কথা বলছে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে পেশাদারি ঢঙে কথা বলল সুপ্রতিম, ‘কাইন্ডলি আপনার পুরো নাম বলুন।’
ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর একটু ধাক্কা খেল: ‘আমায়…আমায় চিনতে পারছ না! আমি ঝুমুর চৌধুরি। কলকাতা চোদ্দো থেকে বলছি। কত কষ্ট করে তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম।’
ওদের টেলিফোন-ব্যবস্থাটা এমন যে, সব কথাবার্তাই টিভির দর্শকরা শুনতে পান। সেইজন্যেই সুপ্রতিম বেশ বিব্রত হয়ে পড়ছিল। ও ভাবছিল, কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে টেলিফোনের কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দেবে কি না। না কি রিসিভার নামিয়ে রেখে লাইন কেটে দেবে? কিন্তু পাগল মেয়েটা তো রোজ ফোন করার চেষ্টা করে জ্বালাতন করে মারবে!
এইসব ভাবতেই-ভাবতেই সুপ্রতিম কষ্ট করে পেশাদারি হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে। তারপর ওর নিজস্ব ঢঙে জানতে চাইল, ‘বলুন ম্যাডাম, কী আপনার সমস্যা? ”মুশকিল আসান” নিশ্চয়ই তার সমাধান বাতলে দেবে।’
‘আমার… আমার প্রবলেম তুমি। আমি তোমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করব। যখন…যখন আর কেউ থাকবে না। বাড়িতে তিনবার ফোন করেছিলাম…তোমাকে পাইনি। কে ফোন ধরেছিল? তোমার…তোমার ওয়াইফ?’
শেষ প্রশ্নটা দর্শকরা শুনতে পাওয়ার আগেই কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ টিপে কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দিল সুপ্রতিম। কিন্তু রিসিভার নামিয়ে রাখল না। ঝুমুর চৌধুরি সম্পর্কে একটা কৌতূহল ওর মধ্যে মাথাচাড়া দিল।
‘হ্যাঁ— আমার বউ— নয়না। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’ কথাটা বলার সময় আড়চোখে মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল সুপ্রতিম। ওকে হাত নেড়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
‘হঁঃ! জানতাম!’ বিরক্তি ফুটে উঠল ঝুমুরের গলায়। কিন্তু তারপরই ও কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। খসখসে আদুরে গলার হাসি?
একটু পরে হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কাউকে আমি পরোয়া করি না। কেন জানো? কারণ, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। কবে তোমার বাড়িতে যাব বলো?’ শেষ প্রশ্নটায় যেন কোনো কিশোরীর মিনতি ঝরে পড়ল।
সুপ্রতিমের মন খুব দ্রুত চিন্তা করছিল।
মেয়েটি তো মনে হচ্ছে নিশ্চিত পাগল। ওর সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি বুঝিয়ে বললে কি ওর এই প্রেমের পাগলামি সারতে পারে? ওকে বলবে একবার বাড়িতে আসতে? কিন্তু নয়না যদি কিছু মাইন্ড করে!
প্রতি মঙ্গলবার সন্ধেবেলা নয়না কাছাকাছি একটা সেলাই-স্কুলে এমব্রয়ডারির কাজ শেখাতে যায়। ছ’টায় বেরোয়, দু-আড়াই ঘণ্টা পর ফেরে। ওর হাতের কাজ খুব ভালো। তা ছাড়া সূক্ষ্ম সেলাই নিয়ে সময় কাটাতে ওর বেশ লাগে। মঙ্গলবার সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ তা হলে ঝুমুরকে আসতে বলবে সুপ্রতিম! তখন ফ্ল্যাট ফাঁকাই থাকবে। ঠিকে কাজের লোক বিমলামাসিও রোজ সন্ধেবেলা বাসন মেজে, ঘর মুছে ছ’টার মধ্যেই চলে যায়।
কিন্তু ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে মেয়েটা কোনো কাণ্ড বাধিয়ে বসবে না তো! দূর, কী আর করবে! সুপ্রতিম নিজে ঠিক থাকলে আর ভয় কীসের! কিন্তু মেয়েটার বয়েস কত? সতেরো, আঠেরো, কুড়ি হলে তো ইমোশনাল প্রবলেম হতে পারে।
সুপ্রতিম কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ঠিকমতো আর ভাবতে পারছিল না।
‘কবে যাব বলো?’ খসখসে আদুরে গলায় আবার জানতে চাইল ঝুমুর।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলা। ঠিক সাতটায়।’ সুপ্রতিমের মুখ দিয়ে কেমন যেন আলতোভাবে খসে পড়ল কথাগুলো।
‘তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়িটা আমি দেখে এসেছি। কাঁকুড়গাছিতে।’ সামান্য হাসল ঝুমুর। একটু থেমে তারপর বলল, ‘তোমার ফ্ল্যাটটা তো একতলায়…।’
পলকে ঘাম ফুটে উঠল সুপ্রতিমের কপালে। এর মধ্যেই ওর ঠিকানা বের করে বাড়িটা চিনে এসেছে মেয়েটা! মেয়েটাকে বাড়িতে ডেকে আবার কোনো বিপদ হবে না তো! তখন হয়তো সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে। কিন্তু আর তো ফেরার পথ নেই! তির ছিটকে গেছে হাত থেকে।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলায় যাব। ঠিক…সাতটায়…। দেখা হওয়ার আগে আর তা হলে ফোন করব না।’ একটু চুপচাপ। তারপর: ‘আমাকে একপলক দেখলেই তুমি বুঝবে কেন আমার ভালোবাসা অন্যরকম।’ চাপা গলায় কথাগুলো বলে অল্প হাসল ঝুমুরঃ ‘আই লাভ য়ু, লাভ। তুমি অপেক্ষা কোরো। ঠিক সাতটায়…।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল সুপ্রতিম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্মার্ট ঢঙে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেল। তা সত্ত্বেও সুপ্রতিম মোনার সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে সহজভাবে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল।
‘মোনা, তুমি ভীষণ সেলফিশ।’
‘কেন?’ মোনা দুষ্টু হেসে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে।
‘পাগলের প্রবলেমগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দিব্যি মজায় আছ।’ তারপর দর্শকদের লক্ষ করে: ‘কী, আপনারাই বলুন—।’
মোনাও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, ‘যারা অন্যকে পাগল করে সেইসব পাগলের প্রবলেম তাদেরই সলভ করতে হবে। এটা আপনাদের সকলের প্রতি আমার উপদেশ। আশা করি ঠাট্টা করলাম বলে আপনারা কিছু মনে করবেন না।’ বড় করে হাসল মোনা। তারপর সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, ‘সুপ্রতিমদা, এবার সাক্ষাৎকার-পর্ব শুরু করুন। হাতে আর সময় বেশি নেই—।’
‘হ্যাঁ। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে এসেছেন ডক্টর পার্থসখা মণ্ডল। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। উনি শিশু ও কিশোরদের মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেবেন…।’
এরপর শুরু হয়ে গেল আগে রেকর্ড করা ডক্টর মণ্ডলের সাক্ষাৎকার।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সুপ্রতিম ঠিক করল ঝুমুরের বাড়ি আসার ব্যাপারটা ও নয়নাকে জানাবে না। মোনা ওকে টেলিফোনের কথাবার্তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করেছিল। সুপ্রতিম ওকে সবই বলেছে। শুধু মঙ্গলবার সন্ধে সাতটার ‘সাক্ষাৎকার’-এর কথা বলেনি।
সুপ্রতিম হিসেব করে দেখল মঙ্গলবার আসতে এখনও ঠিক তিনদিন বাকি। সেদিন ওকে স্টুডিয়ো থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
.
দরজায় কেউ ‘টুং-টাং’ করে কলিংবেল বাজাতেই সুপ্রতিম চমকে উঠল। চকিতে ওর নজর চলে গেল দেওয়ালে টাঙানো শৌখিন ইলেকট্রনিক পেন্ডুলাম ঘড়ির দিকে। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই ঘড়িও শব্দ করে ওকে জানিয়ে দিল এখন ঠিক সাতটা।
ড্রইংরুমের সোফায় বসে ঝুমুরের জন্য অপেক্ষা করছিল সুপ্রতিম। অপেক্ষা করতে-করতে ওর টেনশান ক্রমে বাড়ছিল। নয়না, বিমলামাসি, অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। তখন থেকে সুপ্রতিম ফ্ল্যাটে একা। হাতে সময় পেয়ে সামান্য একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। শরীরের এখানে-ওখানে ডিওডোরান্ট স্প্রে করেছে। হয়তো অবচেতনে ঝুমুরের আসার ব্যাপারটা মাথায় ছিল।
আবার বেজে উঠল কলিংবেল।
ঘোর কাটল সুপ্রতিমের। চটপট উঠে দরজার কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক আই’-এ চোখ রাখল।
ঝুমুর নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। ‘ম্যাজিক আই’-এর লেন্স দিয়ে যেটুকু বিকৃত ছবি দেখা গেল তাতে বলা যায় লোকটি ফরসা, দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখে যেন একটা ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ ভাব।
দরজা খুলল সুপ্রতিম। সঙ্গে-সঙ্গে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ওকে ভাসিয়ে দিল।
লোকটি, অথবা ছেলেটি, সামান্য হাসল। হাসিতে লজ্জা, সঙ্কোচ। কোনোরকমে বুকের কাছে হাত তুলে সৌজন্যের নমস্কারের ভঙ্গি করল। তারপর এক পা বাড়িয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়ল, বলল, ‘একটু কথা আছে।’
উচ্চারণগুলো এতই অস্পষ্ট যে সুপ্রতিমকে বেশ কষ্ট করে কথাগুলো বুঝতে হল।
কখনও-কখনও দু-একজন যশোপ্রার্থী মানুষ সুপ্রতিমের সঙ্গে দেখা করতে আসে। কী করে টিভিতে চান্স পাওয়া যায় তার কৌশল বা সুলুক-সন্ধান জিগ্যেস করে সুপ্রতিমকে বিব্রত করে, বিরক্ত করে। ইনিও বোধহয় সেই দলের— ভাবল ও।
লোকটি বেশ রোগা, উচ্চতায় নিতান্তই খাটো, তবে মাথার চুল বেশ বড়— কষে তেল মেখে কীর্তনীয়াদের মতো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখ টানা-টানা— কেমন এক তন্দ্রার ভাব সেখানে জড়িয়ে আছে। বাঁ-গালে, চোখের সামান্য নীচে, সরষের মাপের একটা কালো জড়ুল। পুরুষটি মেয়ে হলে ওটাকে বিউটি স্পট বলা যেত। পরনে সাদার ওপরে হালকা নীল স্ট্রাইপ দেওয়া ফুল শার্ট, আর নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট।
আর বয়স কতই-বা হবে! বড়জোর তেইশ-চব্বিশ।
‘বলুন, কী দরকার?’ সুপ্রতিম জিগ্যেস করল।
এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে গেল।
সুপ্রতিমের চোখে চোখ রেখে লোকটি ডানহাতে খোলা দরজার পাল্লাটাকে ঠেলে বন্ধ করে দিল। ‘ক্লিক’ শব্দে নাইট ল্যাচ আটকে গেল।
তারপর আদুরে খসখসে গলায় বলল, ‘তোমাকে চাই গো, তোমাকে চাই—।’
এবং তাড়া-খাওয়া হরিণের ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সুপ্রতিমের গায়ে। ওকে আঁকড়ে ধরে ‘চকাৎ’ শব্দে এক তীব্র চুমু খেল ওর ঠোঁটে।
গায়ে আরশোলা বা মাকড়সা পড়লে মানুষ যেমন ঘেন্না, অস্বস্তিতে শিউরে ওঠে, ঠিক সেইরকম এক প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দিল সুপ্রতিম। ওর গা ঘিনঘিন করছিল। হাতের পিঠ দিয়ে বারবার করে ঘষে-ঘষে ঠোঁট মুছল।
ছেলেটি পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে উঠে বসে কাতর আকুল চোখে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে। অদ্ভুত এক মেয়েলি সুরে বলল, ‘আমাকে তুমি…চিনতে পারোনি! আমি…আমি…ঝুমুর…ঝুমুর চৌধুরি।’
সুপ্রতিম ভীষণ একটা ধাক্কা খেল।
এতদিন এই ছেলেটাই ওকে মেয়ে সেজে চিঠি দিয়েছে, ফোন করেছে! একটা জঘন্য বৃহন্নলা! এইজন্যই পাগলটা চিঠিতে লিখেছিল: ‘…আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি।’
সুপ্রতিমের গা গুলিয়ে উঠল। ‘ওয়াক’ উঠতে চাইল গলা দিয়ে।
ঝুমুর তখন পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গোলাপ ফুল আর একটা রঙিন কাগজে মোড়া বাক্স বের করে ফেলেছে। সে-দুটো সুপ্রতিমের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই ফুল আর একটা পার্কার পেন…তোমার জন্যে এনেছি। তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না…প্লিজ…।’
ঝুমুর যদি পুরুষ হয় তা হলে ওর গলাটা মেয়েলি। আর যদি ও মেয়ে হত তা হলে বলা যেত গলাটা কেমন যেন পুরুষালি। কিন্তু আসলে ও কী?
ঝুমুর উঠে দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে এল সুপ্রতিমের কাছে। মিষ্টি করে হসে উপহার দুটো বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি একটুও রাগ করিনি গো। আমার ভালোবাসায় প্রথম-প্রথম এরকম হয়— পরে সব ঠিক হয়ে যায়। এই নাও—।’
সুপ্রতিম কেমন এক অশুভ হাওয়া-বাতাসের ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝুমুরের কথায় ঘোর কাটতেই প্রচণ্ড রাগে সপাটে এক ঘুসি বসিয়ে দিল ওর মুখে।
বিশ্রী একটা শব্দ হল। ঝুমুরের ঠোঁট থেঁতলে রক্ত বেরিয়ে এল। ও আবার ছিটকে পড়ল মেঝেতে। উপহারগুলো হাত থেকে পড়ে ছড়িয়ে গেল।
সুপ্রতিম ভেতরে-ভেতরে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছিল। একসঙ্গে অনেক কথা বলতে গিয়ে সব কথা কেমন যেন আটকে যাচ্ছিল। মাথার ভেতরে অনেক কিছু দপদপ করছে। এখুনি যেন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে।
‘এইমুহূর্তে বেরোও। জানোয়ার কোথাকার! আউট!’ হাঁফাতে-হাঁফাতে চেঁচিয়ে বলল সুপ্রতিম।
কিন্তু ঝুমুর ওর ধমক গ্রাহ্য করল বলে মনে হল না।
রক্তাক্ত মুখেই আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা। ওর সাদা জামায় রক্তের ছিটে লেগেছে। সেই অবস্থাতেই বিচিত্র বিভঙ্গে শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল ও। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘আমি কিচ্ছু মনে করিনি, হানি। তোমাকে আমি চাই— সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই। হাজার টরচার করেও তুমি আমাকে টলাতে পারবে না। তোমার হাতের ছোঁওয়া আমার কাছে যে কী, তা তুমি জানো না। আর…আর এইটা দ্যাখো—।’ বলে একটানে জামাটা ছিঁড়ে দিল ঝুমুর। কয়েকটা বোতাম ছিঁড়ে ছিটকে গেল। বুকের কাছটায় অনেকখানি ফেঁসে গেল জামাটা। আর তখনই ঝুমুরের খালি বুক দেখা গেল।
ওর ঈষৎ মেয়েলি ঢঙের বুকে বাঁদিকে সত্যিকারের একটা ছোট্ট কাটা দাগ। সুপ্রতিমের ডান ভুরুর দাগটার মতো।
ঝুমুর চিঠিতে লিখেছিল, ও বুকে একটা কাটা দাগ ‘এঁকে’ নিয়েছে। কিন্তু এ তো সত্যিকারের কাটা দাগ। ব্লেড, ছুরি অথবা ক্ষুর দিয়ে চিরে ও তৈরি করেছে!
আবার খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুমুর। রক্তমাখা মুখে ওর হাসি কেমন অলৌকিক দেখাচ্ছিল।
হঠাৎই ও আবার ঝাঁপিয়ে এল সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম খপ করে এক হাতে ওর গলা চেপে ধরল। তারপর ওর পলকা শরীরটাকে পিছনদিকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে গেল দরজার কাছে।
‘য়ু সান অফ আ বিচ! ফাকিং গে বাস্টার্ড! আর কখনও যদি আমাকে ডিসটার্ব করো তা হলে একেবারে খুন করে ফেলব!’
দরজা খুলে ঝুমুরের দেহটাকে বলতে গেলে বাইরে ছুড়ে দিল সুপ্রতিম। ওর মাথাটা সিঁড়ির রেলিঙে ঠুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। ও কাত হয়ে টলে পড়ে যেতে গিয়েও সিঁড়ির রেলিং ধরে কোনোরকমে সামলে নিল। ঘোলাটে নজরে তাকাল ওর ভালোবাসার পুরুষের দিকে। জড়ানো খসখসে গলায় বলল,’আমি কিছুই মাইন্ড করিনি। যতই ফিরিয়ে দাও, আবার আমি আসব। একদিন-না-একদিন তুমি আমাকে মেনে নেবেই…।’
ওর গায়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল সুপ্রতিম। তারপর দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিমের সারা শরীর অবসাদ আর ক্লান্তিতে কেমন ভারী হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ও চোখ বুজে হাঁফাতে লাগল।
এক অদ্ভুত গ্লানি সুপ্রতিমকে জড়িয়ে ধরেছিল। বারবার ‘ওয়াক’ উঠে আসতে চাইছিল ওর গলা দিয়ে। এরকম গা-ঘিনঘিনে ঘটনার কথা কাউকে কি বলা যায়! শেষ পর্যন্ত কি সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে?
ঝুমুরকে ঘুসি মেরে সুপ্রতিমের ডানহাতের পিঠটা ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছিল। ছড়ে যাওয়া জায়গাটা ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে-জোরে কয়েকবার চুষল ও। তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা দলিত গোলাপ আর রঙিন প্যাকেটটার দিকে তাকাল। ঝুমুরের রক্ত-মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল আবার।
গোপনে কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা করলে সে-ঘটনাটা নয়নার কাছে ও অবশ্যই গোপন করতে চাইত। কিন্তু এই ব্যাপারটা এত অস্বস্তির আর এত লজ্জার যে, এটা আরও বেশি গোপন করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু নয়নাকে বলতে হবেই— সে ও যা-ই ভাবুক।
সবরকম দ্বিধা কাটিয়ে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেল সুপ্রতিম। নয়নাকে সেলাই-স্কুলে ফোন করে এখনই বাড়ি আসতে বলবে। তারপর…।
.
.
নয়নাকে সব কথা খুলে বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের কান্না পেয়ে গেল। একটা অসহ্য রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ওর ভেতরে দলা পাকিয়ে উথলে উঠছিল। নয়নাকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রতিম বাঁচার একটা পথ খুঁজছিল। সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত ওর শত্রু হয়ে দাঁড়াল! এমনই সুপুরুষ-সৌন্দর্য যে, একজন পুরুষও তার প্রেমে পড়ে যায়!
সারাটা রাত ওদের উথালপাথালভাবে কাটল। শেষ পর্যন্ত নয়না ওকে বলল, ব্যাপারটা থানায় জানানো দরকার।
সুপ্রতিম রাজি হল। তারপর মোনাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আপাতত সাত-দশদিন ওর পক্ষে অফিস করা সম্ভব হবে না। না, না, তেমন সিরিয়াস কোনো ব্যাপার নয়। পারিবারিক কয়েকটা ব্যাপারে হঠাৎই চাপ এসে পড়েছে। ওরা যেন সুপ্রতিমের বদলে আর কাউকে দিয়ে ক’টা দিন কাজ চালিয়ে নেয়।
সুপ্রতিম জানে, ওরা বিপ্লব সরকার কিংবা অনির্বাণ পুরকায়স্থকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবে। আগেও দু-একবার এরকম হয়েছে।
মোনা অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু সুপ্রতিম ঝুমুরের ব্যাপারে মোনাকে বিন্দুবিসর্গও বলল না। ও চাইছিল না ব্যাপারটা বেশি জানাজানি হোক। অদ্ভুত এক লজ্জা আর সঙ্কোচ ওর গলা টিপে ধরছিল।
নয়না আর সুপ্রতিম বেলা বারোটা নাগাদ থানায় পৌঁছল।
বাইরের ঘরটায় কয়েকটা লম্বা-লম্বা বেঞ্চি পাতা। একপাশে বড় মাপের একটা টেবিল। তাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। টেবিলে পুরোনো আমলের টেলিফোন, কিছু ফাইলপত্র, বড় কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল।
ঘরটা এমন অন্ধকার-অন্ধকার যে, দিনের বেলাতেও দু-দুটো টিউব লাইট জ্বেলে রাখতে হয়েছে। সিলিং-এ সাবেকি একটা বেঢপ পাখা ঢিমে তালে ঘুরছে। তার হাওয়ায় দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে-থেকে কেঁপে উঠছে।
টেবিলের ওপাশে সাদা য়ুনিফর্ম পরে একজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। বয়স বড়জোর পঁয়তিরিশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে উদাসীন বিরক্ত ভাব।
টেবিলে রাখা কাঠের নেমপ্লেট পড়ে জানা গেল অফিসারের নাম টি. দাস, সাব-ইন্সপেক্টর।
সুপ্রতিম আর নয়না বসল।
দাসবাবু সপ্রশ্ন নজরে ওদের দিকে তাকালেন।
একটু ইতস্তত করে সুপ্রতিম বলল, ‘আমি…আমি…একটা ডায়েরি করতে চাই।’
কথা বলতে-বলতে ও চারপাশে দেখছিল। দু-একজন লোক এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। তাদের চোখেমুখে ব্যস্তসমস্ত ভাব।
সুপ্রতিমের মনে হল, দাসবাবু ছাড়া আর কেউ ওদের কথা শুনতে পাবে না। তাই দাসবাবু যখন ডায়েরি-বইz নিয়ে ডটপেট বাগিয়ে বললেন, ‘বলুন—।’, তখন ও প্রথমে নিজের পরিচয় দিল, তারপর সহজভাবেই ঝুমুরের ব্যাপারটা বলে গেল। টেবিলের আড়ালে নয়না ওর একটা আঙুল ছুঁয়ে ওকে সাহস জোগাচ্ছিল। ও টের পেল, সুপ্রতিমের আঙুল কাঁপছে।
কিছু লেখার আগে দাসবাবু ব্যাপারটা শুনে নিচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝে ছোটখাটো শব্দ করছিলেন, আর ডটপেনটা ডায়েরি-বইয়ের পাতায় ঠুকছিলেন।
শুনতে-শুনতে একসময় তাঁর মুখে মজা পাওয়ার ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
হঠাৎই একজন সাদা-পোশাকের অফিসার সিগারেট টানতে-টানতে এগিয়ে এলেন। ধপ করে বসে পড়লেন দাসবাবুরপাশের চেয়ারটায়। আড়চোখে নয়নার সৌন্দর্য চেটে নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, ‘কী কেস, দাস?’
‘হোমো কেস।’ দাস মুচকি হেসে বললেন।
নয়না আর সুপ্রতিম ‘হোমো’ শব্দটা শুনে কেমন যেন সিঁটিয়ে গেল।
‘বলুন, তারপর কী হল—’ সুপ্রতিমকে তাড়া দিলেন দাস।
খুঁড়িয়ে চলা ছ্যাকড়াগাড়ির মতো থতিয়ে-থতিয়ে কথা শেষ করল সুপ্রতিম। টের পেল, ওর ঘাড়ে, গলায়, কপালে ঘাম জমছে।
ওর কথা শেষ হওয়ামাত্রই সাদা-পোশাকের অফিসারটি বলে উঠলেন, ‘এ-ডায়েরি নিয়ো না, দাস— এই ভদ্রলোক ফেঁসে যাবেন।’
দাসবাবু ওঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, শঙ্করদা।’
নয়না অবাক চোখে জানতে চাইল, ‘কেন? ডায়েরি নেবেন না কেন? লোকটা আমাদের লাইফ হেল করে দিচ্ছে…।’
‘সবুর, ম্যাডাম, সবুর…।’ সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে সাদা-পোশাকের অফিসারটি বললেন, ‘একটু মাথা খাটান, তা হলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। একটা ইয়াং ছেলে আপনার হাজব্যান্ডকে ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছে। মানছি, অন্যায় করেছে। কিন্তু তার বদলে আপনার হ্যাজব্যান্ড কী করেছেন? না ছেলেটাকে তুলোধোনা করে মুখ-মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছেন। কী, ঠিক বলছি তো?’ শেষের প্রশ্নটা সুপ্রতিমকে লক্ষ্য করে।
সুপ্রতিম কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। নয়নাও ঠিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
সাদা-পোশাকের অফিসারের কথার খেই ধরে দাস সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই ছেলেটা যদি থানায় এসে আপনার নামে ডায়েরি করে তা হলে তো আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন। তখন বিচ্ছিরিরকম স্ক্যান্ডাল হবে, লোকজানাজানি হবে— একটা কেলো হয়ে যাবে।’ একটু সময় দিলেন ওদের। তারপর: ‘তার চেয়ে বরং বাড়ি যান। ছেলেটা আবার এলে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে নিন। ওর সঙ্গে মিউচুয়াল করে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনো ওয়ে আউট দেখছি না। শঙ্করদা কী বলেন?’ সাদা-পোশাকের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন দাস।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে-দিতে শঙ্করবাবু বললেন, ‘এ ছাড়া কোনো পথ নেই। এসব হোমো কেস নিয়ে ক্যাচাল যত কম হয় আপনাদের পক্ষে ততই ভালো। তবে এরপর কী হয়-না-হয় সেটা আমাদের ইনফর্ম করতে পারেন। সিরিয়াস কোনো টার্ন নিলে তখন…।’
সুপ্রতিম আর নয়না ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অফিসাররা যে ঠিক কথাই বলছেন, সে নিয়ে ওদের মনে কোনোরকম সন্দেহ ছিল না।
এক অদ্ভুত আতঙ্কে অবশ হয়ে শোলার পায়ে ওরা বাড়ি ফিরে এল। নয়না মনে-মনে ভাবছিল, কেমন দেখতে এই ঝুমুর চৌধুরিকে?
সুপ্রতিম যখন ফ্ল্যাটের দরজায় নাইট ল্যাচের চাবি ঘোরাচ্ছে তখন শুনতে পেল ঘরের ভেতরে টেলিফোন বাজছে।
দরজা খুলে তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরল সুপ্রতিম।
‘হ্যালো—।’
‘সুপ্রতিম…মাই লাভ…আই লাভ য়ু…।’
নয়না স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখল ওর মুখটা চোখের পলকে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নয়না বুঝতে পারল, সুপ্রতিমকে কে ফোন করেছে।
ঝুমুরের টেলিফোনের উৎপাত চলতেই থাকল, কিন্তু সুপ্রতিম কিছুতেই আর বিরক্ত হল না। থানার দুই অফিসারের কথা ওর মনে ছিল। তাই ও মোলায়েমভাবে কথা বলে ঝুমুরকে নিরস্ত করতে চাইল। ওকে অনুনয় করে বলল, ‘তুমি যেরকম ভালোবাসা চাও আমার মধ্যে সেরকম ভালোবাসা নেই। তুমি ভুল করছ—।’
ওকে বাধা দিয়ে আদুরে ঢঙে ঝুমুর বলল, ‘না, না, ভুল নয়। তুমি আমার কাছে ধরা দিলেই বুঝবে আমি ভুল করিনি। আমি মনের মতো মনের মানুষ পেয়েছি।’
সুপ্রতিম অনেক চেষ্টা করেও গা-ঘিনঘিন-করা ভাবটা চেপে রাখতে পারেনি। এবং টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
কিন্তু পরে আবার ঝুমুরের ফোন এসেছে।
সুপ্রতিম প্রতিবারই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। ফোনের ও-প্রান্তে ঝুমুর কেঁদে ভাসিয়েছে। আত্মহত্যা করবে বলে ওকে ভয় দেখিয়েছে। কখনও বলেছে, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। কখনও বলেছে, ট্রেনের তলায় মাথা দেবে। আবার কখনও-বা বলেছে, গলায় দড়ি দেবে।
সুপ্রতিম বেশ বুঝতে পারছিল, ওর জীবনের কোথায় যেন পূর্ণগ্রাস গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে।
ঝুমুরের নিয়মিত ফোন আর ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম সুপ্রতিমকে অতিষ্ঠ করে তুলল। কয়েকদিন পর ওর মনে হতে লাগল ও বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সত্যি-সত্যিই ঝুমুরের ‘অন্যরকম’ ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।
সুপ্রতিমের এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধে সাতটা নাগাদ ওদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে উঠল।
নয়না বাড়িতে নেই। সেলাইয়ের স্কুলে গেছে। সুপ্রতিমকে একা রেখে ও যেতে চায়নি, কিন্তু সুপ্রতিমই জোর করে ওকে পাঠিয়েছে, বলেছে, ‘আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি! তা ছাড়া ওই ঝুমুর চৌধুরিকে ভয়ের কী আছে! আগের দিন তো ওকে বেধড়ক ঠেঙিয়েছি। আজ যদি হতচ্ছাড়াটা আসে তা হলে হকি স্টিক দিয়ে পেটাব।’
সুপ্রতিম একসময় হকি খেলত। ওর হকি স্টিকটা বেডরুমের দেওয়ালের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা থাকে। সেটা এখন ও ড্রইংরুমের সোফার তলায় এনে রেখেছে। কারণ, ওর মন বলছিল, ঝুমুর যেরকম খ্যাপা তাতে ও মঙ্গলবার সন্ধে সাতটায় আবার ওদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দিতে পারে— সুপ্রতিমকে একা পাওয়ার জন্য।
তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই চমকে উঠেছিল সুপ্রতিম। তারপর সতর্ক পায়ে দরজার কাছে গিয়ে ‘ম্যাজিক আই’ দিয়ে উঁকি মেরেছে।
না, ঝুমুর চৌধুরি নয়। দরজায় দাঁড়িয়ে ন্যাড়া মাথা গোঁফওয়ালা একজন লোক।
দরজা খুলে দিল সুপ্রতিম।
রোগা ছোটখাটো চেহারার লোকটি ঘরে ঢুকে পড়ল। তার হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস। শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে একেবারে ফিটফাট। মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি।
সেলসম্যান নাকি! ভাবল সুপ্রতিম। কিন্তু এই সন্ধে সাতটায় কী বিক্রি করতে এসেছে?
সুপ্রতিম ভদ্রতা করে বলল, ‘বলুন, কী চাই?’
‘খুব ইম্পর্ট্যান্ট বিজনেস।’ চাপা গলায় অস্পষ্টভাবে বলল লোকটি। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিল।
সুপ্রতিম লোকটির দিকে পিছন ফিরে সোফার দিকে একটা পা বাড়িয়েছিল, দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ভুরু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
ততক্ষণে ঝুমুর ওর নকল গোঁফটা একটানে খুলে ফেলে দিয়েছে ঘরের মেঝেতে। আর হাতের ব্রিফকেসটাও একপাশে নামিয়ে রেখেছে।
‘তুমি!’
‘হ্যাঁ গো, আমি। তোমার কাছে না এসে থাকতে পারলাম না। ফোনেই তো বলেছিলাম, তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যদি তুমি মুখের ওপরে দরজা দিয়ে দাও, তাই মাথা ন্যাড়া করে নকল গোঁফ লাগিয়ে আসতে হয়েছে…।’
ঝুমুর বিচিত্র ঠমক-ঠামক করে কথা বলছিল। কটাক্ষ হানছিল। ঠোঁটের কোণ কামড়াচ্ছিল।
সুপ্রতিম পাথর হয়ে তাকিয়ে ছিল অদ্ভুত এই প্রাণীটার দিকে। আর প্রাণপণে গা-ঘিনঘিন-করা ভাবটাকে সামাল দিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল।
‘তুমি রাগ করলে না তো! তোমার ওপরে আমার কোনো রাগ নেই। যাকে ভালোবাসি তার ওপরে কি রাগ করে থাকা যায়!’
কথাগুলো বলেই সুপ্রতিমের দিকে ঝাঁপিয়ে এল ঝুমুর। সুপ্রতিম ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই ও আবেগজর্জর প্রেমিকার মতো সুপ্রতিমের বুকে মুখ ঘষতে লাগল, আর ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগল, ‘আমায় আদর করো। লক্ষ্মীসোনা, আমায় আদর করো। আমি আর পারছি না। প্লিজ…প্লিজ…। আমার শুধু বাইরেটা পুরুষ— ভেতরটা নয়।’
সুপ্রতিম মুখ নামিয়ে দেখল একটা ন্যাড়া মাথা ছেলে ওর বুকে মুখ ঘষছে। ও এমন নির্লিপ্তভাবে দেখছিল, যেন ওটা ওর বুক নয়— অন্য কোনও পুরুষের বুক।
হঠাৎই বিকট শব্দে ‘ওয়াক’ তুলল সুপ্রতিম। ওর সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। এবং একইসঙ্গে এক ঝটকায় ঝুমুরকে ছিটকে ফেলে দিল ও। তারপর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বারবার বমির হেঁচকি তুলতে লাগল।
ওর গলার পাশে শিরা ফুলে উঠল। খানিকটা জল আর লালা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
ঝুমুর তখন মেঝেতে সোজা হয়ে বসেছে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে সুপ্রতিমের দিকে। আর গুনগুন করে গাইছে, ‘…তোমার আদর পেলে আমি স্বর্গে চলে যাই/ মর্ত্যে যে আর আমার কিছু নাই…।’
একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল সুপ্রতিমের মাথায়। ওর চোখ চলে গেল সোফার নীচে— হকি স্টিকের দিকে। হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে ওটা। চুলোয় যাক দাসবাবু আর শঙ্করবাবুর হিতোপদেশ! দাঁত বের করে বসে থাকা ওই জানোয়ারটা ওঁদের তো কিছু করেনি! শুধু সুপ্রতিমের জীবনটাকে নরক করে তুলেছে।
কয়েক সেকেন্ড নিজের সঙ্গে লড়াই করল সুপ্রতিম। তারপর ডানহাত বাড়িয়ে দিল হকি স্টিকটার দিকে। ওটা আঁকড়ে ধরল শক্ত মুঠোয়।
আজ শুয়োরের বাচ্চাটার একদিন কি আমার একদিন। দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল ও।
তারপর হকি স্টিক হাতে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। দু-পা ফেলে পৌঁছে গেল ঝুমুরের কাছে। এবং খ্যাপা দাঁতালো শুয়োরের রাগ নিয়ে হকি স্টিক চালাতে শুরু করল।
ছোটবেলায় ধুনুরিদের লেপ-তোশক তৈরি করতে দেখেছে সুপ্রতিম। শীতের রোদে ছাদে বসে জমাট বাঁধা শক্ত তুলোকে তারা পিটিয়ে-পিটিয়ে নরম করে। এখন হকি স্টিক চালাতে-চালাতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। তবে ধুনুরিদের শব্দ যদি সত্তর-আশি ডেসিবেল হয় তা হলে সুপ্রতিমের আঘাতের শব্দ কম করেও একশো ডেসিবেল। তা ছাড়া ধুনুরিদের বেলায় এমন রক্তারক্তি ব্যাপারটা ছিল না।
সুতরাং মেঝেতে বসে থাকা ছোটখাটো ছেলেটাকে নিষ্ঠুরভাবে তালগোল পাকিয়ে দিল সুপ্রতিম। ঝুমুর ওর পায়ের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে কুকুরছানার মতো কেঁউকেঁউ করতে লাগল। শব্দটা কেমন কান্না মেশানো গোঙানির মতো লাগছিল। ওর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, জামায় রক্তের ফোঁটা ছিটকে লেগেছে, শরীরটা যেন ভাঙাচোরা ‘দ’ হয়ে গেছে।
উন্মত্ত রাগ কমে এলে সুপ্রতিম হকি স্টিকটা একপাশে ছুড়ে ফেলে দিল। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাপরের মতো হাঁফাচ্ছিল ও। ভাবছিল, এত শব্দ-টব্দ পেয়ে লোকজন না ছুটে আসে ওর ফ্ল্যাটে। তারপর থানা-পুলিশ…।
কয়েক সেকেন্ড অন্যমনস্ক হয়েছিল সুপ্রতিম। সেই ফাঁকেই ওর ঊরুতে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
তালগোল পাকানো ছেলেটা বিদ্যুৎগতিতে হাত চালাল। একবার, দুবার, তিনবার। প্রথম দুবার ঊরুতে, তৃতীয়বার হাঁটুর নীচে।
সুপ্রতিমের মনে হল ওর পায়ে জ্বলন্ত কয়লা ঘষে দিয়েছে কেউ। ও ঝুঁকে পড়ে পা চেপে ধরল।
আর তখনই ওর কোমরে ক্ষুর চালাল ঝুমুর।
যত না যন্ত্রণা পেল তার চেয়ে বেশি অবাক হল সুপ্রতিম। ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না ওর পায়ের কাছে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা ক্ষীণজীবী মাংসপিণ্ডটা এইরকম ভয়ানক কাজ করতে পারে।
সুপ্রতিম পড়ে গেল মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই পাগলটা লাফিয়ে উঠে এল ওর শরীরের ওপরে। ডানহাতে ধরা ক্ষুরটা চেপে ধরল সুপ্রতিমের বাঁ-কানের নীচে, খসখসে আদুরে গলায় বলল, ‘ভালোবাসা আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই গো। তোমাকে খতম করে দিলে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা না-পেলে কষ্ট যে আরও বেশি! আই লাভ য়ু, ডার্লিং…।’
খুব কাছ থেকে ঝুমুরের মুখটা লক্ষ করে এই প্রথম ওকে ভয় পেল সুপ্রতিম। ওরা দুজনেই হাঁফাচ্ছিল। একজনের নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা কার্বন ডাইঅক্সাইড ঢুকে পড়ছিল আর-একজনের নাকে। তাই ওদের দুজনেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।
এক অজানা ভয়ে সুপ্রতিম কাঠ হয়ে গেল। ও টের পাচ্ছিল, ওর কোমর, ঊরু, পা থেকে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। নয়না এখনই এসে পড়ছে না কেন! নয়নার ফিরে আসার জন্য মনে-মনে আকুল প্রার্থনা করতে লাগল ও।
ঝুমুর হিসহিস করে বলল, ‘অসভ্যতা করলে গলা ফাঁক করে দেব। আর যদি চেঁচাও, তা হলে চিৎকারটা মুখ দিয়ে বেরোবে না— গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে।’
ঝুমুর সুপ্রতিমের বুকের ওপরে উঠে বসল। বাঁহাতে টান মেরে সুপ্রতিমের জামা ছিঁড়ে দিল। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর বুকে ক্ষুর চালিয়ে আড়াআড়ি দাগ টেনে দিল।
সুপ্রতিম যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল।
ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করে ঝুমুর বলল, ‘চুপ, সোনামণি। অনেক কষ্ট সয়ে তবেই আসল ভালোবাসা পাওয়া যায়।’
প্যান্টের পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করল ঝুমুর। ডান হাতে ক্ষুর নাচাতে-নাচাতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা সুপ্রতিমের মাথার দিকটায় গেল। তারপর উবু হয়ে বসে পড়ল। ক্ষুরটা হাতের কাছেই নামিয়ে রেখে ‘নোড়ো না, লক্ষ্মীটি। নইলে বিপদ হবে।’ বলতে-বলতে সুপ্রতিমের দুটো হাত বাঁধতে শুরু করল।
হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেলে দড়ির প্রান্তটা বেঁধে দিল একটা সোফার দু-পায়ার সঙ্গে। এখন অনেক চেষ্টা করে সুপ্রতিম সোফাটাকে সামান্য নাড়াতে পারবে হয়তো, কিন্তু সুপ্রতিম কোনোরকম চেষ্টা করছিল না। ও চোখ ঘুরিয়ে ‘অন্যরকম’ ঝুমুরকে লক্ষ করছিল, আর মৃত্যুভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল।
দড়ির বাকি অংশটা ক্ষুর দিয়ে কেটে নিল ঝুমুর। চলে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। পা দুটো জোড়া করে শক্ত করে বাঁধল।
এমন সময় ঘরের টেলিফোন বাজতে শুরু করল।
ঝুমুর টেলিফোনটার দিকে একবার তাকাল শুধু। তারপর টেলিফোনের শব্দ কোনওরকম গ্রাহ্য না করে আর-একটা সোফা টেনে নিয়ে এল সুপ্রতিমের পায়ের কাছে। জোড়া পা বাঁধা পড়ল সোফার দু-পায়ার সঙ্গে।
ঝুমুর এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে অদ্ভুতভাবে হাসল। ক্ষুরটা রেখে দিল সোফার ওপরে। তারপর নিজের পোশাক খুলতে শুরু করল। সুপ্রতিম ভয়ার্ত চোখে ওকে দেখতে লাগল।
বাজতে-বাজতে ক্লান্ত হয়ে টেলিফোন থেমে গেল একসময়।
ততক্ষণে সুপ্রতিমের চোখের সামনে প্রকাশিত হয়েছে প্রায়-নগ্ন ঝুমুর। ওর পরনে শুধু একটা গাঢ় নীল রঙের জাঙ্গিয়া।
ফরসা ফ্যাকাসে রোগা শরীর, ন্যাড়া মাথা, মাথায় রক্তের দাগ, গলায় সামান্য রক্তের ছিটে, মুখে চওড়া হাসি, অথচ ঠান্ডা চোখ। ঝুমুরকে কেমন যেন অলৌকিক প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল।
এইবার ব্রিফকেসটা টেনে নিয়ে মেঝেতে বসল ঝুমুর। ওটা খুলতেই দেখা গেল মেয়েলি প্রসাধনের নানান জিনিস। একটা হাত-আয়না নিয়ে ঝুমুর সাজতে বসল। আর একইসঙ্গে গুনগুন করে গাইতে লাগল: ‘ভালোবাসার তুমি কী জানো? ভালোবাসার তুমি কী জানো? উঁ…উঁ…উঁ…পায়ের উপর পা-টি তুলে/হিসাবের খাতা খুলে/বসে রও আপন ভুলে/যত বলি ঢের হয়েছে,/মানা না মানো।/ ভালোবাসার তুমি উঁ…উঁ…উঁ…।’
মুখে পাউডার-ক্রিম ইত্যাদি মাখা হয়ে গেলে চোখে কাজল পরতে শুরু করল। তারপর চোখের পাতার ওপরে রং ঘষতে লাগল। মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান দিক থেকে নিজের প্রসাধন আয়নায় পরখ করল।
প্রসাধনে সন্তুষ্ট হয়ে হাতে লিপস্টিক তুলে নিল ঝুমুর। লাল ডগাটা বের করে ঠোঁটে ঘষতে লাগল। এবং সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েকবার কোমর বেঁকিয়ে-চুরিয়ে মেয়েলি নাচের ভঙ্গি করল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে এল অসহায় রক্তাক্ত সুপ্রতিমের দিকে।
সুপ্রতিম শুয়ে-শুয়েই স্নো-পাউডারের গন্ধ পেল।
সুপ্রতিমের ঠোঁটে, মুখে, বুকে লিপস্টিক ঘষে দিল ঝুমুর। তারপর লিপস্টিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওকে কষে চটকাতে লাগল, আর জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি তোমায় বড় ভালোবাসি/তোমায় বড় ভালোবাসি…আমি তোমায় বড় ভালোবাসি…।’
সুপ্রতিম ভাবছিল, ও কি বেঁচে আছে? এই ঘটনাগুলো কি সত্যি? না কি দুঃস্বপ্ন!
‘বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো। একবার বলো, আমায় ভালোবাসো। তুমি আমার— আর কারও নয়। শুধু একবার বলো…।’
অসুস্থ উন্মত্ত ছেলেটা সুপ্রতিমের জামা সরিয়ে দিয়ে খোলা বুকে মুখ ঘষছে। ঠোঁটে, গালে, চোখে যথেচ্ছ চুমু খাচ্ছে। হাতড়াচ্ছে যেখানে-সেখানে। আর অনর্গল ভালোবাসার কথা বলছে।
ঝুমুর ওর প্যান্টের বোতাম খোলা শুরু করতেই সুপ্রতিম চাপা চিৎকার করে উঠল।
‘কী, কষ্ট হচ্ছে?’ ঝুমুর নিষ্পাপ স্বরে জিগ্যেস করল, ‘তুমি শুধু একবার বলো, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে…তা হলেই তোমার সব বাঁধন খুলে দেব। তুমি শুধু আমায় একটা চুমু খাও…একটা…তা হলেই আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে যাব।…শুধু একবার…।’
সুপ্রতিমের গলা দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু গলা ফাঁক হয়ে যাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। ওর মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা করা দরকার…।
দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রতিম কোনোরকমে বলল, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি, ঝুমুর।’
প্যান্টের জিপার খুলতে গিয়ে ঝুমুরের হাত থেমে গেল। ও আদুরে গলায় বলল, ‘কী বললে গো? আর-একবার বলো। প্লিজ…।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরও ভালোবাসতে চাই।…আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও, প্লিজ…।’ কথা বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের দম আটকে যাচ্ছিল।
ছিলে-ছেঁড়া-ধনুকের মতো চট করে উঠে পড়ল ঝুমুর। হাঁফাতে-হাঁফাতে সুপ্রতিমের বাঁধন খুলতে শুরু করল। উত্তেজনায় ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
বাঁধন খোলা হতেই সুপ্রতিমের কপালে হাত বুলিয়ে নরম সুরে ঝুমুর বলল, ‘নাও, এবার ওঠো।’
ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে বসল সুপ্রতিম। কাটা জায়গাগুলো ভীষণ জ্বালা করছে।
ঝুমুরের আর তর সইছিল না। ও সুপ্রতিমের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। ওর কোলে উঠে বসল একেবারে।
সুপ্রতিমের মনে হল একটা কোলাব্যাঙ ওর কোলে বসে আছে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ও ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে-গালে চুমু খেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আই লাভ য়ু, ঝুমুর…।’
শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসা বমির দমক রুখে দিয়ে সুপ্রতিম ভাবল, নয়না এখনও আসছে না কেন।
আর ঠিক তখনই ঝুমুরের নগ্ন কাঁধের ওপর দিয়ে সোফার ওপরে পড়ে থাকা ক্ষুরটা ও দেখতে পেল। হাতের প্রায় নাগাল রয়েছে ওটা।
ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে কোনোরকমে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুপ্রতিম। পলকা ছেলেটা সুপ্রতিমের আশ্লেষে আনন্দে টইটম্বুর হয়ে ভালোবাসার প্রলাপ বকছে শুধু। আর সুপ্রতিম নিজের প্রাণ বাঁচাতে একের-পর-এক চুমু খেয়ে চলেছে ওর স্নো-পাউডার মাখা মুখে।
ক্ষুরটা এখন পুরোপুরি সুপ্রতিমের হাতের নাগালে।
ও মুঠো করে অস্ত্রটা ধরল। তারপর ঝুমুরকে আদর করতে-করতে ক্ষুরটা নিয়ে এল ওর গলার খাঁজের কাছে।
কতক্ষণ আর সুপ্রতিমের শক্তি থাকবে কে জানে! মাথা ঝিমঝিম করছে। রক্তে চটচট করছে হাত-পা-বুক।
চুলোয় যাক ভদ্রতা, সভ্যতা, নীতি, দয়া ইত্যাদি।
আত্মরক্ষা মানুষের একটা আদিম ধর্ম।
বাঁহাতে ঝুমুরের মাথাটা পিছনে ঠেলে দিয়েই ডান-হাতে ক্ষুর টেনে দিল সুপ্রতিম।
ঝুমুরের ভালোবাসার প্রলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। তার বদলে ঘরঘর শব্দ বেরোতে লাগল মুখ আর গলা দিয়ে।
রক্তে মুখ-গলা-বুক ভেসে গেল সুপ্রতিমের। ওর মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ও জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝুমুরের মৃতদেহ তখনও ওকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
একটি অচেতন দেহ ও একটি মৃতদেহ অসাড় হয়ে নয়না অথবা আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রক্তের ধারা তখন মেঝেতে গড়িয়ে-গড়িয়ে সময়ের হিসেব রাখছিল।
আঁধারে সাপ চলে – বিমল সাহা
সাধারণত ছোটগল্পের কোনো ভূমিকা থাকে না ৷ সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ংপ্রকাশ ৷ কিন্তু এ-কাহিনি কোনো তথাকথিত নিয়ন্ত্রিত আঙ্গিকে বাঁধা গল্প নয় ৷ তাই সামান্য দু-একটা কথা বলার দরকার ৷ বছর-দুই আগে দিল্লিতে মামাতো বোনের বাড়িতে বিনতা প্যাটেলের সঙ্গে আলাপ হয় ৷ এটি তারই জীবনের ঘটনা ৷ কিছু তার মুখে শোনা, কিছু তার ইংরেজিতে লেখা ডায়েরির মর্মানুসরণ ৷ সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার ভূমিকা এই কাহিনিতে অনেকটা অনুলেখকের ৷— লেখক
৪ ডিসেম্বর
এ আমি কী ভাবছি? না, না, এ হতে পারে না ৷ তাড়াতাড়ি চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিলাম ৷ আমি তো ঘুমিয়ে নেই ৷ তাহলে এ আমি কী ভাবছি? ভাবছি, না দেখছি? স্পষ্ট যেন আমার চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল ৷
অলকাও এখন কলকাতায়, ওর স্বামী ওখানে বড় ডাক্তার ৷ ওদের বিয়েতে বছর-দুয়েক আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম ৷ দে আর হ্যাপিলি ম্যারেড ৷ তবে এ আমি কী ভাবছি! আমার মনে হঠাৎ ওদের কথাই বা ভাসছে কেন? ভালো লাগছে না ৷ তাড়াতাড়ি উঠে রেডিয়োটা চালিয়ে দিলাম ৷ আবার বন্ধ করলাম ৷ স্টিরিয়োটা চালু করলাম ৷ গমগম করে উঠল ঘর জ্যাজ-এর ঝমঝম আওয়াজে ৷ নিজেও একটু টিউনের সাথে নাচলাম ৷ ধুস! তবুও ছবিটা মন থেকে মুছছে না ৷
এক প্রচণ্ড অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল বিনতা প্যাটেলকে ৷ আসল কথা, হঠাৎ একটা ফ্ল্যাশ, অর্থাৎ, বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো যে-ঘটনা ওর মানসিক পরদায় ছায়া ফেলেছিল, তাই ওকে অস্থির করে তুলছিল ৷
আশ্চর্য! ডক্টর ভর্মা ইজিচেয়ারে শুয়ে নিজের ঘরে কাগজ পড়ছেন, পাশেই বসে অলকা ৷ হালকা নাইটগাউন পরা৷ চুলগুলো এলোমেলো ৷ হঠাৎ একটানে ডক্টরের হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে কী যেন বলতে লাগল ৷ এমন সময়ে ঘরে এল সুন্দর, ফিটফাট চেহারার এক ভদ্রলোক ৷ এসেই অলকার হাত ধরে কাছে টেনে তার স্বামীর সামনেই সজোরে আলিঙ্গন করল ৷ ডক্টর উঠে কী যেন বলতে গেলেন ৷ হঠাৎ তিনি পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে ৷ তারপরই মেঝে ভেসে গেল লাল রক্তে ৷ খুন! খুন!
চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, পাশের ঘর থেকে মা ছুটে এলেন ৷ বললেন, কী হয়েছে বিনী?
কিছু না মা, স্বপ্ন দেখছিলাম ৷
মা তো অবাক ৷ দিনেরবেলায় জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছে মেয়ে! বললেন, কীরে, আজ স্কুলে যাবি না? তুই তো একদিন না গেলেই তোর টিচার-ব্রাদাররা দল বেঁধে এসে হাজির হবে!
ঠিক বলেছ, মা ৷ ক’টা বাজে?
৫ ডিসেম্বর
এ-ব্যাপারটা কাল স্কুলে কাউকে কিছুই বলিনি ৷ শুনলে একদল হাসবে ৷ আবার লতিকা, জহিরা, সুমনারা শুনলে বলবে, আমার বোধহয় মেন্টাল ডিজঅর্ডার হতে চলেছে ৷
কী যে করি! আজও ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না ৷ বিশেষ করে অলকার ঘরে আসা ওই আগন্তুক লোকটার কথা ৷ তার চোখ-মুখ-চাউনি এত তীব্রভাবে মনে পড়ছে যে, আমি যদি শিল্পী হতাম তবে এক্ষুনি তার ছবি এঁকে ফেলতে পারতাম ৷
চওড়া কপাল, ফরসা সুন্দর রং, উজ্জ্বল চোখ, কেবল ডান গালে জুলপির নীচে বেশ বড় একটা জড়ুল ৷ ওই লোকটি কে? ওই কি খুন করল অলকার স্বামীকে? অলকাই বা ও- লোকটার কাছে অত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল কেন?
এ তো মহা জ্বালা! অলকা এখন কত দূরে ৷ হয়তো সব ব্যাপারটাই একটা মিথ্যে কল্পনা ৷ সত্যিই তো, মানুষ তার নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেই, এ-ধরনের হ্যালিউসিনেশন দ্যাখে ৷ তবে কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
৬ ডিসেম্বর
কতদিন অলকাদের খবর রাখি না ৷ কী করব, ওদের একটা টেলিগ্রাম করে দিই— ‘কেমন আছ তোমরা?’ সে-ই ভালো ৷
আজ এখানে প্রচণ্ড শীত ৷ তারই ভিতর আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে ৷ গ্রেটার কৈলাস এলাকায় বোধহয় আমিই এত সকালে উঠেছি ৷ চারদিক কেমন ধোঁয়াটে ৷ সূর্যের আলোর কোনো আভাসই নেই ৷ এ-সময়টা কলকাতাকে মনে হয় সুইজারল্যান্ড ৷ ইউনেস্কোর ট্রেনিং-এ তিনমাস ছিলাম সুইজারল্যান্ডে ৷ তখন ওখানে গ্রীষ্মকাল ৷ ঠিক যেন কলকাতার ডিসেম্বর ৷
এই সুযোগে অলকার খোঁজ নিতে কলকাতায় গেলে কেমন হয়?
মা শুনলে বলবে, নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ৷ কিন্তু কী করব! আমি যে খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না৷ মনের ভিতর একটা যন্ত্রণার ঢেউ উথাল-পাথাল ৷ অকারণে গা-শিরশির ভয়! বিশেষ করে ওই আগন্তুকের চেহারাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না
আজই অলকাকে টেলিগ্রাম করব ৷
৯ ডিসেম্বর
‘আমরা সবাই ভালো আছি ৷ তুই একবার এখানে আয় ৷’
একইসঙ্গে উদ্বেগের অবসান আর কলকাতা দেখার নিমন্ত্রণ ৷ টেলিগ্রামে অলকার জবাব পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম ৷ অলকা কোনোদিনই আমার ‘মোস্ট ইন্টিমেট ফ্রেন্ড’ ছিল না, তবে অনেকের মধ্যেই একজন বিশিষ্টা ৷ দু-বছর পরে তার খবর পেয়ে আনন্দ হওয়ার চেয়ে আমার ওই উদ্বেগটা যে কেটে গেল, তাতেই আনন্দ হচ্ছে বেশি ৷ আজই স্কুলে দু-একজনকে সব বলেছি ৷ তারা তো হেসেই আকুল ৷ বলল, তুই তো বেশি মিস্টিক, সুপারন্যাচারাল বই পড়িস, তাই যত সব বাজে ভাবনা এসে ভিড় করে ৷
বাথরুমে ঢুকে কোনোদিন যা করিনি, আজ তাই করলাম ৷ আনন্দে শাওয়ারের নীচে দু-একবার ‘শেক’ নাচলাম ৷ অকারণেই সাবানটা নিয়ে খানিকটা লোফালুফি করলাম ৷ আর দু-দিন পরেই স্কুল ছুটি হচ্ছে ৷ আজই টেলিগ্রাম করে দেব : ‘কলকাতায় যাচ্ছি!’
মনের সমস্ত মেঘ কেটে গেছে মনে হয়েছিল বিনতার ৷ কিন্তু আশ্চর্য, কলকাতায় যাওয়ার আগের দিন থেকে আবার সেই কল্পনায় দেখা লোকটার চেহারা মনের পরদায় ভেসে উঠল ৷ মনে পড়তে লাগল অলকার লোকটাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য ৷ ওর ডাক্তার স্বামী মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘরের মেঝে!
বুকের ভেতরটা মাঝে-মাঝে ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল ৷ একটা করুণ নিশ্বাস কেঁদে-কেঁদে গলে যাচ্ছে বর্ষার মতো৷ আর তারই সাথে ভয়, ভয়, ভয়, ভয় ৷ কীসের ভয়? মনকে শক্ত করার চেষ্টা করে বিনতা ৷ কন্টিনেন্ট- ঘোরা মেয়ে! একলা-একলা কত দেশ ঘুরেছে সে ৷ আজ এ কী এক বিশ্রী ভয়ের চাবুক তাকে এমন করে মারছে?
না ৷ কলকাতায় তাকে যেতেই হবে ৷ রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হয়ে গেছে ৷ আর পেছুলে চলবে না ৷ কাল বিকেল পাঁচটায় গাড়িতে উঠলে পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাবে ৷ অলকা আসবে স্টেশনে গাড়ি নিয়ে ৷
অতএব আর কোনো ভাবনা নয় ৷ কালই বিনতা রওনা হবে কলকাতা ৷
১৩ ডিসেম্বর
আমার সিটটা জানলার ধার ঘেঁষে ৷ পাশের পর-পর দুটো সিটেই এসে বসলেন দুজন গুজরাটি ভদ্রমহিলা ৷ কে একজন বলল, ফিল্ম স্টার সঞ্জীবকুমারের আত্মীয় ৷ মনে-মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! কারণ রাজধানী এক্সপ্রেসে এই এক মজা ৷ পাশে হয়তো কালো হোঁতকা কোনো দুর্গন্ধওয়ালা জাঁদরেল লোক এসে বসলেও করার কিছু নেই! ঠিক আমার পেছনের সারিটায় মাত্র একজন মাদ্রাজি ভদ্রলোক ৷ গাড়ি চলতে শুরু করল, সুন্দর স্বাগত সম্ভাষণ দিয়ে লাইট মিউজিক বাজতে লাগল ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই চা সার্ভ করল ৷ দু-একটা ম্যাগাজিন কিনে সামনে রেখে দিলাম ৷ তারপর সামনের খাওয়ার ট্রে-টা টেনে তার ওপর রেখে ডায়েরির পাতা লিখছি, হঠাৎ বেশ একটু গম্ভীর গলায় ইংরেজিতে পেছন থেকে আওয়াজ এল ৷ অনুরোধ : ‘আপনার ‘‘ফেমিনা’’টা একটু পেতে পারি?’ পেছন দিকে একবার না তাকিয়েই বাঁ-হাতে ‘ফেমিনা’টা ভদ্রলোককে দিলাম ৷
তারপর কিছুক্ষণ কেটে গেছে ৷ ডিনার এসে গেল ৷ রাজধানীর খাবার চমৎকার! খিদেও পেয়েছিল ৷ খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিনে হাত মুছে মনে পড়ল ‘ফেমিনা’টার কথা ৷ পেছন ফিরে দেখি, আমার পেছনের রো-টার ঠিক পেছনের সিটে ‘ফেমিনা’টা পেটের ওপর উলটে রেখে ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়েছেন ৷ কিন্তু, এ কী! এ যে অবিশ্বাস্য! সেই কপাল, সেই চোখ, সেই মুখ, হ্যাঁ—হ্যাঁ—ওই—তো …গালের ডান দিকে জুলপির নীচে বেশ বড় একটা জড়ুল! নাইটগাউন পরা অলকাকে ইনিই তো জড়িয়ে ধরেছিলেন ৷ ডক্টর ভর্মাকে তো এই লোকটাই খুন করেছিল! ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে৷ ধুত্তোর! ওটা একটা বাজে কল্পনা ৷ অলকা টেলিগ্রামে জানিয়েছে, সবাই ভালো আছে ৷ ডক্টর ভর্মার কিছু হয়ে থাকলে ও কি আমাকে এভাবে নিমন্ত্রণ জানাত!
১৪ ডিসেম্বর
ভদ্রলোককে আজ আবার দেখলাম ৷ বেশ ফিটফাট ৷ চমৎকার চেহারা ৷ আলাপ করতে সাহস হল না ৷ কী জানি কী ব্যাপার ৷ আর কিছুক্ষণ পরই হাওড়া স্টেশন ৷ অলকার সাথে দেখা হলেই সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে যাবে ৷
.
হাওড়া স্টেশন ৷ লোকে লোকারণ্য ৷ হাতের ব্যাগটা নিয়ে সোজা বিনতা এসে দাঁড়াল ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমের সামনে ৷ সে-ভদ্রলোককে আর ও লক্ষ করেনি ৷ কোনদিকে গেছে কে জানে! দূরে বিনতা দৃষ্টি মেলে দিল ৷ কই, অলকা তো আসছে না ৷ ঠিকানাটা অবশ্য মনে আছে ৷ না এলে নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওখানে যাবে ৷ না, ওই তো অলকাই আসছে ৷ বিনতা এগিয়ে গেল ৷ অলকাও ছুটতে ছুটতে এল ৷
বড্ড দেরি হয়ে গেছে ৷— অলকা এসে ওকে জড়িয়ে ধরল ৷
না, তোর দেরি হয়নি ৷ রাজধানী এক্সপ্রেস একটু আর্লি এসেছে ৷— তারপর অলকাকে দেখতে দেখতে বলল, বেশ সুন্দর হয়েছিস ৷ গায়ে সামান্য একটু ফ্যাটও হয়েছে ৷ ডক্টর ভর্মা কেমন আছেন?
ভালো আছে ৷ খু-উ-ব ভালো আছে ৷ — টেনে টেনে বলল অলকা ৷
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিনতা ৷
চল, তাড়াতাড়ি চল ৷ আমাদের নতুন বাড়ি দেখবি ৷
নতুন বাড়ি? কেন, তোরা এখন কনভেন্ট রোডে থাকিস না?
মাস-ছয়েক হল ছেড়ে দিয়েছি ৷ এই ফ্ল্যাটটা নিউ আলিপুরের কাছে ৷ ফার্স্ট ক্লাস জায়গা ৷ চারদিক খোলামেলা ৷ প্রচুর আলো-বাতাস ৷ ফ্ল্যাটটা কিনেই নিয়েছি ৷
তুই আমার টেলিগ্রাম কী করে পেলি? সেটা তো পুরোনো ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম ৷— বিনতা অবাক হয় ৷
ওই বাড়ির লোকেরা রি-ডায়রেক্ট করে এ-ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল ৷
ডক্টর ভর্মা এখন কোন হাসপাতালে অ্যাটাচড? আমার চোখটা একটু দেখাব ৷
ডক্টর ভর্মার সঙ্গে তোর দেখা হবে না ৷ কারণ, উনি ক’দিনের ট্যুরে বাইরে গেছেন ৷ তুই তো থাকবি সাতদিন ৷
ডক্টর ভর্মা নেই! বিনতার মনে কে যেন সপাং করে একটা চাবুক মারল ৷ বাড়ি পালটেছে এরা! নতুন জায়গা, নতুন ফ্ল্যাট ৷ ব্যাপারটা কী? আবার সেই পুরোনো চলচ্চিত্র পর-পর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল ৷ ডক্টর ভর্মা ইজিচেয়ারে শুয়ে ৷ অলকা দাঁড়িয়ে ৷ প্রবেশ করল সেই অচেনা ভদ্রলোক ৷ ডক্টর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন ৷ রক্তে ভেসে গেল গোটা মেঝে ৷ খুন! খুন! গলা পর্যন্ত আওয়াজটা উঠেই আবার নীচে নেমে গেল স্বর ৷ কীরকম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল অলকার গাড়ির মধ্যে ৷ চেতনা ফিরে এল অলকার বাড়িতে ৷
গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি বলে তোকে আর ডিসটার্ব করিনি ৷ শরীর খারাপ নাকি?— কাছে এসে অলকা বিনতার কপালে, গালে, হাত রাখল ৷
না, সেরকম কিছু না ৷
চল, আমরা স্নান, খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিই ৷ পরে বিকেলে বেরোব কলকাতা দেখাতে ৷— অলকা উঠে পড়ে স্নানের জোগাড় করতে গেল ৷
১৫ ডিসেম্বর
আজ বিকেলে বেরোনোর মুখেই দেখা হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে ৷ আবার সেই মুখ, চোখ, নাক আর ডান গালের জুলপির নীচে জড়ুল ৷ একেবারে সামনা সামনি ৷ এ কী করে হয়! মনের ভিতর হঠাৎ দেখা দৃশ্যটি এমনভাবে মিলে যাচ্ছে!
কী রে! দাঁড়িয়ে পড়লি যে! ভদ্রলোককে চিনিস নাকি?— হাসতে হাসতে অলকা বলল ৷
আমি ওঁকে চিনেছি ৷ রাজধানী এক্সপ্রেসে আপনার কাছ থেকেই তো আমি ‘ফেমিনা’টা নিলাম ৷ এইবার চিনতে পারছেন তো?
ও! তোমরা বুঝি একই ট্রেনে এসেছ? কিন্তু আমি তো হাওড়া স্টেশনে বিনতাকে আনতে গিয়েছিলাম ৷ তোমাকে তো দেখলাম না!— অলকার গলার স্বরে অভিমান যেন ৷ ব্যাপার কী? তবে কি ওরা আমার মনে ছবি দেখার মতো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত?
এইবার আমি বললাম, অলকা, তুই এঁকে চিনিস নাকি?
কেন চিনবে না! আমি তো ওদের সামনের ফ্ল্যাটেই থাকি ৷ ডক্টর ভর্মার অনুপস্থিতিতে আমিই তো অলকার ফ্রেন্ড, ফিলসফার, গাইড ৷ কী বলো অলকা?— ভদ্রলোকের সেই হাসি! সেই চাউনি! সেই—!
আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি ৷ তুমি ফ্ল্যাটটার দিকে নজর রেখো ৷— বেশ অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল অলকা ৷ আর এটাও লক্ষ করলাম, ভদ্রলোক অলকাকে নাম ধরে ডাকল, কোনওরকম ‘মিসেস’ সম্বোধন যোগ না করেই ৷ অলকাও ওকে ‘তুমি’ বলল ৷ ডক্টর ভর্মা জেনেশুনে চুপ করে আছেন!
১৬ ডিসেম্বর : দুপুর
আজ সকালে চায়ের টেবিলে অলকাকে হঠাৎ সব বলে ফেললাম ৷ মনের ভিতর হঠাৎ কীভাবে স্বপ্নের মতো ঘটনাটা দেখেছিলাম ৷ আমার উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার কথা, সবই বললাম ৷ অলকা তো শুনে হেসেই অস্থির ৷ বলল, তোর সন্দেহ কাটানোর জন্যে ডক্টরকে কালই টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি ৷ দেখবি, আমার স্বামী তোর মতো সুন্দরীকে দেখলে হয়তো আমাকে ভুলে যাবে! বিয়ের আগে বা পরে ডক্টরের জন্যে আমার এত উদ্বেগ কোনোদিনই হয়নি ৷
বা-ব্বা! বাঁচলাম ৷ ডক্টর ভর্মাকে একবার দেখলেই আমার সব ভাবনা মিথ্যে হয়ে যাবে ৷ আমিও নিরুদ্বেগ মন নিয়ে দিল্লি ফিরে যাব ৷ সত্যি কথা বলতে গেলে, এইজন্যেই তো কলকাতায় আসা ৷
ভদ্রলোকের নাম মণিকুন্তল সেন ৷ বাঙালি ৷ ওকেও আজ ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে অলকা ৷ তবে অবশ্য কথা দিয়েছে, আমার এইসব বাজে ভাবনার কথা কিছু বলবে না ৷ দেখা যাক ৷
১৬ ডিসেম্বর : রাত আটটা
এই অংশটি অনেক পরে ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল
ডাইনিং হলে ঢুকতে যাওয়ার আগে অপরিচিত গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ালাম ৷ মাঝের ঘরের ঝোলানো পরদার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি মণিকুন্তল সেন আর অলকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে ৷ টেবিলের ওপর আমাদের তিনজনের প্লেট, কাঁটা-চামচ, খাবার সাজানো ৷ শুধু আমি গিয়ে বসলেই ‘ডিনার’ শুরু করা যাবে ৷ মণিকুন্তলবাবু অলকার কাঁধে হাত রেখে বলছে, তুমি ভয় পেয়েছ নাকি? এসব কখনও হয়? আমাকে তোমার বন্ধু জীবনে দেখেনি, সে কী করে আমার মুখ দেখল স্বপ্নে?
না, না, স্বপ্ন নয় ৷— অলকার স্বরে আতঙ্ক ৷ বলল, বিনতা জেগে-জেগেই চোখের সামনে দেখেছে ডক্টর ভর্মার খুনের দৃশ্য ৷ আমি তো সত্যিই সেদিন নাইটগাউন পরে তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম ৷ তোমার চেহারা, এমনকী তোমার ডান গালে জুলপির নীচে জড়ুলটার কথাও বলেছে! আমার ভীষণ ভয় করছে ৷ শেষকালে ধরা পড়ে ফাঁসি হবে না তো?— বলতে বলতে অলকা নিবিড় হয়ে গেল মণিকুন্তলের কাছে ৷
তোমারও দেখছি মাথা খারাপ হল! আমি যে খুন করেছি, তা প্রমাণ করতে হবে না? কোন পাগলে এসে কী বলল, তাই বুঝি আইন অমনিই মেনে নেয়? তার ওপর এ-কেস তো পুলিশ সুইসাউড কেস ধরে নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্লোজ করেছে ৷ তবে, তোমার বন্ধুকে যাতে আর ফিরতে না হয়, তার ব্যবস্থাও আজ করব ৷ এই দ্যাখো ৷— বলেই মণিকুন্তল সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটি দেখাল ৷
আর একমুহূর্তও নয় ৷ পা থেকে মাথা অবধি গা-শিরশির করে উঠল ৷ কপাল, চোখ-মুখ ঘেমে নেয়ে উঠল ৷ তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এসে কিছু টাকা আর দু-একটা জরুরি জিনিস নিয়ে ওদের শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম ৷ ওই তো টেলিফোন ৷ পাশেই টেলিফোন গাইড ৷ টেলিফোনের রিসিভার তুললাম লালবাজার হেড কোয়ার্টার্সে ফোন করার জন্যে ৷ এ কী! কোনোরকম ‘রিঙিং টোন’ই তো বাজছে না! তবে? নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, টেলিফোনের তার কাটা ৷ তবে? এখন কী করব? কী করে ঘরের বাইরে যাব? ফ্ল্যাট থেকে বাইরে যাওয়ার একটাই তো পথ!
স্পষ্ট বুঝতে পারছি অলকা-মণিকুন্তল দুজনে মিলে সমস্ত প্ল্যানই তৈরি করে ফেলেছে ৷ ওরা কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না ৷ ডক্টর ভর্মার খুনের একমাত্র মানসিক সাক্ষীকে চিরতরেই ওরা সরিয়ে দেবে ৷ তারপর আমার লাশ গুম করে দিলেই সব শেষ! আসার সময়ে বাড়ির কাউকে অলকার ঠিকানাও দিয়ে আসিনি ৷ না, না, যে করেই হোক, পালাতে হবে৷
বিনতা! বি…ন…তা!— অলকা ডাকছে ৷
পাগলের মতো ঘরের মধ্যেই ছুটোছুটি করতে লাগলাম ৷ ডাইনিং হলে ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে ৷ হঠাৎ বারান্দার এককোণে লাইটের মেন সুইচটা নজরে পড়ল ৷ ভগবানের নাম নিয়ে দিলাম সুইচটা অফ করে! সঙ্গে-সঙ্গে গোটা বাড়ি অন্ধকার ৷ ভালুক-অন্ধকার ৷ পা টিপে-টিপে মেন দরজার কাছে এসে গোদরেজের ল্যাচটা আস্তে-আস্তে খুলেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এলাম সদর রাস্তায় ৷ কানে বাজতে লাগল অলকা-মণিকুন্তলের ছুটোছুটি আর আমার নাম ধরে ডাকাডাকি ৷
.
এরপরের ঘটনা জলের মতো সহজ গতিতে এগিয়ে গেছে ৷ লালবাজারে বিনতা প্যাটেলের পরিচিতি আর সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ নথিভুক্ত হল ৷ পুলিশি তদন্তে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল, মণিকুন্তল সেন-ই ডক্টর ভর্মার হত্যাকারী! আর সেই নৃশংস ব্যাপারে সাহায্য করেছে নিহত ডক্টরেরই সহধর্মিণী অলকা ভর্মা ৷
কিন্তু এই ঘটনার আসল জিজ্ঞাসা হল, তবে কি মানুষের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও মানসিক জগতের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া রয়েছে? চেতনের গভীরে অবচেতনের আঁধারে কোনো-কোনো ইচ্ছা মানুষের মনকে ছোবল মারে বিষাক্ত সাপের মতো ৷ সেই ইচ্ছাই হয়তো তার মানসিক পটে চলচ্চিত্রের জীবন্ত ছায়া হয়ে অজানা জগতের এক নতুন ইশারা দেয় ৷
আততায়ী – যশোধরা রায়চৌধুরী
একটা স্ট্রবেরি রঙের আকাশ, এক কোনায় মেঘ জমে আছে ডিপ চকলেট রঙের। যেন তুলতুলে স্ট্রবেরিটার উপরে জমাট, লোভনীয় ক্রাস্টের মতো ঠান্ডা, শক্ত চকলেট, ভেঙে ফেললেই গড়িয়ে পড়বে রসের মতো আলোমাখামাখি ভোর।
দিবাস্বপ্ন দেখছিল সঞ্চিতা, বারান্দায় বসে। ভোর ফুটে গেছে অনেকক্ষণ। জগিং সেরে এসে ওটস খেয়ে এখন ফেসিয়ালে বসেছে। ওর ছোট্ট নুক, দড়ির দোলনায়।
.
দুলতে দুলতে সমস্ত অ্যাটমসফিয়ার দুলছিল যেন। আকাশের ফ্রেমটাও।
মামপি, শোন।
চটকা ভাঙল।
নিলুপিসি, তুমি ডাকছিলে?
বারান্দা থেকে ঘরের দিকে মুখ বাড়াল সঞ্চিতা। ওর নিটোল ডিমের মতো মুখ। টাটকা ক্রিমিশ ত্বক আপাতত সাদা ধবধবে আস্তরণের তলায়।
—সারা মুখে কী মেখেছিস এসব? অফিসে বেরোনোর আগে, বাবা, পারিসও বটে।
—ধ্যাত, ছাড়ো তো। বলো না কী বলছিলে। সঞ্চিতা হাসল। ফেসিয়াল মাখা মুখ, যেন মুখোশের আড়ালে ঢাকা। কিছুটা ক্লাউন যেন।
—আরে কতবার করে তোর ফোনটা বাজছিল। রিংটোনে এমন একটা ঝাঁঝালো গান লাগিয়েছিস, শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায়। এটা তোর কত নম্বর ফোন?
—আমার তো দুটোই ফোন, জানোই তো। ওটা পুরোনোটা। বাজুক। আমি এখন ধরছি না।
—কেন, ওটা কি হ্যালাফেলার ফোন?
—ফোনটা না, ফোনের কনট্যাক্টগুলো। কলেজের সব বন্ধুরা ওই নাম্বারটা জানে। ভীষণ বোর।
—হুম। বুঝেছি। এখন তোমার নতুন চাকরি, নতুন অফিসের নতুন বন্ধুরা সব। তাদের চিনে নিতে যত মজা, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কি আর তত মজা পাবে?
উফ, ছাড়ো না। ফরগেট ইট ইয়ার। তোমার যত্তসব পুরোনো পুরোনো কথা…
ওরে, কথায় বলে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে।
এবার পুরোটা ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে সঞ্চিতা। হেলায় একবার খাটের উপর থেকে তুলে দেখে পুরনো মডেলের, পুরনো সিম ভরা সেই ফোনটা। যেটায় আটটা মিসড কল রেখেছে ঋদ্ধিমান। ওর পুরোনো বয়ফ্রেন্ড। শিট। কী ভীষণ টায়ারসাম। হতাশ লাগে সঞ্চিতার। কেন যে লোকজন বোঝে না!
.
নিলুপিসিটাও তেমনি। এসব কথা খুঁচিয়ে ওর পেট থেকে বার করবেই। অর্চির ব্যাপারেও খুব কৌতূহল। অর্চিই যেন সবটা জুড়ে আছে সঞ্চিতার। এমন একটা ভাব। না হয় কয়েকদিন ডেট করেইছে। তাই বলে…অর্চি কী খায়, অর্চি কী পরে, অর্চির ফ্যাভ মিউজিক কী। অত জানার কী দরকার?
নিলুপিসি, ইউ জাস্ট গিভ মি এ ব্রেক, ওকে? আমার সব ব্যাপারে মাথা গলাতে হবে না তোমাকে। মা কি গলায়? বাবা? তাহলে তুমি কেন?
নীলুপিসি নিজে তো বেশ ডিভোর্স টিভোর্স করে ছাড়া গরু। এটা মা বলে, ফিসফিসিয়ে। নিজের কোনও ইস্যু নেই বলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে পড়েছে। যেন একদম অ্যাডপ্টই করে ফেলেছে সঞ্চিতাকে, নিলুটা।
.
আজকাল এই নিলুপিসির জন্যেই বাবা—মার সঙ্গে আগের মতো ভুলভাল, অ্যাজিটো কেওটিক বিহেভ করতে পারে না সঞ্চিতা। আগে তো হুটহাট করে হোম ডেলিভারিতে বিরিয়ানি আনিয়ে খেত, পিৎজা আনিয়ে নিত নিজের জন্য। ডালভাত হরিবোল, পটলের ডালনাকে রিজেক্ট করতে ইউজ করত নিজের খ্যাপামি, জোর ফলাত মাথা গরম করে। রাগ করে দুম করে দরজা বন্ধ করা, সারা রাত না ঘুমিয়ে চ্যাটিং, তারপর সকাল দুপুর গড়িয়ে বেলা বারোটা অবধি ভোঁসভোঁস ঘুমোনো…সবটাই চলত। এখন আর মা—বাবা ওকে ভয়ই পায় না। এসব দেখাতে গেলেই সবাই হাসতে শুরু করে।
পিসি এসে কী যেন উল্টো ফ্যাচাং করেছে। সঞ্চিতার আর আগের সম্মান নেই। লোকে আর ওকে ভয় পায় না। হিটলারি যে ব্যাপারগুলো করে দিব্যি চালাচ্ছিল নিজে, মাকে ভয় খাইয়ে, বাবাকে চুপ করিয়ে রেখেছিল নানা কলকাঠি নেড়ে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং করলেই বাবা সুড়সুড় করে টাকা বের করে দিত আগে…স্টুডেন্ট লাইফে, এখন নিজের টাকা নিজের সব…তাহলেও যেন সেরকম মজা নেই বাবা—মায়ের উপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে…
সব ভেস্তে দিয়েছে পিসিই।
যাও না বাবা তুমি তোমার দামড়া কাকুবন্ধুগুলোর সঙ্গে কফি হাউজে আঁতলামো করতে, তা না, সঞ্চিতার সঙ্গেই যত কথা!
২
অর্চি এখনও মেয়ে দেখলে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু সেদিন সঞ্চিতাকে দেখে কী যেন হয়ে গেল। ফানি আছে একটু, কিন্তু ভীষণ কিউট। রোগা, মিষ্টি, ছোট্টখাট্টো একদম, টাইটস কুর্তিতে কেমন যেন পাখি পাখি। খুব উজ্জ্বল দুটো চোখ। দেখলেই মনে হয় মিচমিচে শয়তান। কিন্তু কেন যেন অর্চির ওকে দেখে একটুও ভয় করল না। বেশ পাশে বসে ভাটাল অনেকক্ষণ। তারপর উঠে যাওয়ার সময় ক্যাজুয়ালি বলল, সি ইউ। আর অমনি মেয়েটাও সি ইউ বলে মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিল। সেই থেকে টুকটাক ফোন হচ্ছে। দু’দিন বসল কাফে কফি ডে—তে। অর্চির পয়সা খসল কিছু, একদিন সঞ্চিতাও খাওয়াল। ওদের দুজনের অফিস একটাই বিল্ডিং—এ, সেক্টর ফাইভ—এ। দুটো আলাদা ব্লক অবশ্য। কিন্তু বাসস্টপে, নিচের লবির কফি শপে, এখানে—ওখানে দেখা হয়ে যাওয়ার স্কোপ প্রচুর।
অর্চি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, অবশ্যই ক্লিয়ারলি না, সঞ্চিতার কোনও স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা। সঞ্চিতাও ওকে তো সরাসরি কিছু বলেনি, তবে একটা মেসেজ দিয়েছে। না, ফোনের টেক্সট মেসেজ না। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দিয়েছে, এখন কেউ নেই। আগে হয়তো ছিল। সেটা আপাতত ম্যাটার করে না।
সেই থেকে মোটামুটি লটকে আছে সম্পর্কটা একই জায়গায়। এগোচ্ছে বলা যায় না। কারণ ফিজিকাল হওয়া হয়নি এখনও। হয়তো নেক্সট টাইম আর একটু প্রাইভেসি আছে এমন জায়গায় দেখা হয়ে যাবে।
তবে একটাই আশার কথা, সেদিন ইমেল করেছে অর্চি ওকে, একটা পাতলা পর্দার আড়ালে একটা সেক্সি টপ পরা দীপিকা পাডুকোনের ছবি, পর্দাটায় ক্লিক করলেই ছবিটা একটা মোটকা মহিলায় কনভার্টেড হয়ে যায়। আর একটা গলা বলে ওঠে, দ্যাটস মাই মাম্মি!
সেটা দেখে হি হি হাসির চারটে ইমোটিকন পাঠিয়েছে ওকে সঞ্চিতা।
তার মানে কেস টা এগোচ্ছে। আপাতত অর্চি বসে আছে ওর কিউবিকলে, পাশের কিউবিকল থেকে চুমকি ঘোষটা গলাটা জিরাফের মতো বাগিয়ে বলে উঠল, অর্চি, আমাকে লবিতে বেরোলে একটা কফি এনে দেবে, প্লিইইজ?
কেন কেন, তোমার কফি বওয়া আমার কাজ নাকি? মনে মনে ঝাঁজালেও, অর্চি মেয়েটাকে পুরো কাটাল না। মেয়েটার চোখে একটা থ্রেট দেখতে পেল যেন। আসলে চুমকি ঘোষ দেখেছে, কাজের ফাঁকে চ্যাট করতে অর্চিকে। ওকে ঘাঁটালে ম্যানেজমেন্টকে যদি আবার লাগায়? তার উপর ও শুনেছে, মেয়েটার বাবা দীপেন ঘোষ পুলিশে কাজ করে। কে ঘাঁটাবে ওকে, বাবা!
চুমকি ঘোষের মোটা, ফুলো মুখটা ফর্সা আর মেক আপ লাগানো, কিন্তু ভীষণ চওড়া, ওকে দেখলে ভারতের ম্যাপ না, সাইবেরিয়া, তুন্দ্রা, তাইগাসহ একটা চ্যাপটা রাশিয়ার ম্যাপ মনে পড়ে যায়। এক কান থেকে আর এক কান পর্যন্ত পৌঁছতে দু—দুটো সাদা ধবধবে মরুভূমির মতো গাল আর একটা প্রকাণ্ড নাক পেরোতে হবে…দূর, অতটা পাড়ি দেওয়ার ধক কার আছে?
উল্টোদিকে সঞ্চিতাকে দেখ, ছোট্ট একটা মুখ, ছোট্ট একটা দেশের মতো…না ভারতও নয়, ধানি লংকার শেপের শ্রীলংকা যেন, কুচুত করে দাঁতে কেটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
অর্চি কিছুটা রিপালসানের বশেই চুমকিকে না চটিয়ে দু কাপ কফি এনে নীরবে এক কাপ ওর ডেস্কে রাখে। চুমকি ওর স্থূল শরীরটা যথাসম্ভব পিছিয়ে নেয়, বেন্ডিং ব্যাকওয়ার্ডস যাকে বলে, ঘোরানো চেয়ারের পিঠের উপর ভর দিয়ে, নেকু নেকু গলায় বলে, থ্যাংক্যু সুইটি। নাউ টেল মি, ওয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
মেনশন নট, লাজুক মুখে বলে, অর্চি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কাজে বসে যায়। ইয়ারফোনটা একটা ব্যারিয়ারের কাজ করবে এবার।
সংগোপনে স্কাইপে মেসেজ পাঠায় সঞ্চিতাকে, R u online?’
উত্তর আসে ইমোটিকনে। উত্থিত হাতের ছবি। মানে হ্যাঁ, আই অ্যাম অ্যাট মাই ডেস্ক।
অর্চি এবার লেখে, gr8!
৩
নিলুপিসি উল্টোদিকের রেস্তোরাঁয় বসে থেকে থেকে নজর রাখছে। সঞ্চিতা ঢুকে গেল ওই কাফেটায়। নিলুপিসি বসেছে। সস্তার রেস্তোরাঁয়। অর্চি আসবে। জেনেছে ওদের কনভার্সেশন থেকে, চ্যাটে। গতকাল সাইন আউট না করে কম্পিউটার থেকে উঠে গেছিল মেয়ে।
নীলুপিসি পুলিশগিরি করছে কোনও কৌতূহল থেকে নয়। স্রেফ সিকুউরিটি কনসার্ন থেকে। পরে, ঋদ্ধিমানের মামা, পুলিশ মামা, নিলুপিসিকে ইনপুট দিয়েছেন কিছু। আপাতত, নিলুপিসির ব্রিফ খুব পরিষ্কার। ঋদ্ধিমানের রিসেন্ট ডিপ্রেশনটা নিলুপিসিকে ভাবিয়েছে, প্লাস, একটা ফায়ার আর্ম মিসিং রিপোর্ট। এখন হাতে নাতে ধরতে হবে। যে কোনওদিন অবশ্য অ্যাটাক হতেই পারে, তবে আজকের চান্স খুব বেশি।
বেশ কিছুদিন ধরেই আসলে সঞ্চিতার আগের ফোন—এর কললিস্টের ভেতর থেকে দু—তিনটে কনট্যাক্ট নিলুকে খুব ভাবাচ্ছিল। ফোনটা এখন সঞ্চিতা ইউজই করে না। ওর সময় নেই এতগুলো ফোনের এতগুলো কনট্যাক্টের সঙ্গে সম্পর্ক মেনটেন করার। খাটের উপর ফেলে রাখতে রাখতে একদিন সঞ্চিতা ফোনটার কথা ভুলেই গেল। বাড়িতে পড়ে থাকা ফোনটা কিন্তু নিলুপিসিকে ভাবিয়ে চলেছিল। আর এভাবেই একদিন ঋদ্ধিমানের কলটা রিসিভ করে ফেলে নিলু।
পর পর সাত—আটদিন, ওই ফোনে ঋদ্ধিমানের প্রচুর মিসড কল ছিল।
দেখার পর নিলুপিসি গোপনে সিদ্ধান্তটা নেয়। ফোনটা রিসিভ করে। দায়িত্ব নিয়ে সঞ্চিতার মতো গলা করে কথা বলে। অবশ্য গলা চেঞ্জ না করলেও চলত, কারণ ঋদ্ধিমান সঞ্চিতাই ফোনটা ধরেছে ভেবে এতটাই এক্সাইটেড ছিল, প্রায় আনন্দে উন্মাদ, ও নোটিসই করত না নিলুপিসির গলাটার ডিফারেন্সটা। মুখের কাছে হাত চেপে কথা বলেছে নিলুপিসি। একদম হুঁ হাঁ দিয়ে চালিয়েছে, ঋদ্ধিমান বুঝতেই পারেনি, তাছাড়া ওর বোঝার মতো অবস্থাও ছিল না… হাউ হাউ করে চিৎকার করেছে শুধু।
তারপর থেকে বেশ কয়েকবার ওকে ফোন করে শোনার কাজটা করে গেছে নিলুপিসি।
ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক হয়ে গিয়েছে ঋদ্ধিমানের কমিউনিকেশন। ও এখন একতরফা কথা বলে যায়। কথা শুনতে শুনতে কান জ্বলে যায়, তবু শোনে নিলু। সঞ্চিতাকে ভালো রাখতে চায়, বোধ হয় ঋদ্ধিমানেরও ভালো চায়।
তুমি আমাকে কেন কিছু বলছ না, সঞ্চিতা। কেন বলে গেলে না, সেদিন ওফেলিয়া বার থেকে ওইভাবে উঠে চলে এসেছিলে, কেন? পরদিন কাফেতে তিনঘণ্টা বসেছিলাম… তোমাকে ফলো করে করে তোমার অফিস অবধি গেছিলাম, তুমি আমাকে দেখতেও পেলে না…
এরপর কিন্তু তোমার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে পড়ব। ইউ নো, আই ক্যান কিল মাইসেলফ…কিন্তু আগে তোমাকে বলতে হবে তুমি কী চাও? বলো, বলো সঞ্চিতা…
উফফফ কেন এরকম করছ সঞ্চিতা…আমি ছ’দিন পর পর বাড়ি থেকে বেরোইনি, কিন্তু যেদিন বেরোব, দেখবে কী করি…আমি পাগল হয়ে যাব, আই হ্যাভ নোবডি টু টক টু…
তুমি সেদিন আবার গোলাপি জামাটা পরেছিলে আমি দেখেছিলাম…বাট হাউ ক্যান ইউ বি সো ইনডিফারেন্ট টু মি?
ঋদ্ধিমানের বাড়িটা খুঁজে বার করে ফেলেছে নিলু। ওর কথা ফলো করে করে, নিজে স্বল্প কথা গুনগুন করে বলে, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে, ক্লু ইউজ করে বার করে নিয়েছে ওর ঠিকানা। এখন ঋদ্ধির বাড়ির কাছে অনেকটা সময় কাটায় নিলুপিসি। সামনের লেডিস টেলারটাতে তিন—তিনবার ব্লাউজ বানাতে দিয়েছে, একবার সালোয়ার কামিজ। তাতেই কার্যসিদ্ধি। এখন ঋদ্ধির ছোটমামা, পুলিশের মাঝারি লেভেলের অফিসার, নিলুপিসির পকেটে, ওরই সঙ্গে দু—তিনবার ঋদ্ধিকে দেখেছিল এর আগে, উর্দি দেখে বুঝেছে লোকটা পুলিশ। সুতরাং এবার ভদ্রলোকের সঙ্গে মিট করা, মিসিং রিভলভারের খোঁজ, অনেক বেশি সাবধানতা, সাইকিয়াট্রিক হেল্প এর ব্যবস্থা রাখা, এবং আজ, এই এখন, কাফের সামনে বসে থাকা।
৪
তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, সঞ্চিতা?
সঞ্চিতার ব্লু জামা পরা ছোট্ট চেহারাটা কাফের দরজা থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী ভীষণ সেক্সি, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ধরা দেবে না ওর কাছে, ঠিকই করে নিয়েছে যেন। দু—চারটে ফোনের পর একদিন সারাদিন ফোন আর রিসিভই করল না হয়তো। উইমসিকাল মেয়ে, না ইচ্ছে করে নাচাচ্ছে?
নাচাচ্ছে, নাচাচ্ছে, আমাকে নাচাচ্ছে। উফফ ভাবতেই কান গলা বেয়ে গরম ঢেউ, একটা রাগ আছড়ে পড়ে শিরায় শিরায়। মনে পড়ে যায় পুরনো অপমানগুলো। সেই যে সেবার, অস্মি বলে মেয়েটা। জাস্ট কিছুদিন ডেটিং করে কেটে গেল। জাস্ট নো সাড়া নো শব্দ। বুকের মধ্যে হাঁকপাঁক করে অপমান, রাতের ঘুমে হানা দেয় মেয়েটার তাগড়া শরীর আর ফিল্মসি জামাকাপড়। এভাবেই কষ্ট জমছে বুকের ভেতর। আর রাগ জমছে মাথার মধ্যে। শু্যট করে দেব…জাস্ট শু্যট হার। যেরকম স্বপ্নে দেখেছিল সেদিন…কাছে যাচ্ছে যত, দূরে দূরে সরে যাচ্ছে মেয়েটা…কে ছিল সেটা? অস্মি না সঞ্চিতা? সঞ্চিতাই বোধ হয়।
আর, বন্দুকটা, ওর দিকে তাক করতে করতেই, শু্যট! মাথার মধ্যে বলে ফেলল ওর পৌরুষ। অমনি স্বতোৎসার উঠে এল ফোয়ারায়, রাগের উৎসমুখ খুলে গেল, অনুরাগেরও। সবকিছুর মূলে, একেবারে গোড়ায়, সেই দপদপানি, সেই কষ্টটা আছে, যা ওকে করায় সবকিছু। ফলো করায় সঞ্চিতার মতো তিতলিদের…
ও আজ পকেটে মালটা নিয়েই বেরিয়েছে। শক্ত ধাতব ফিল। ওকে উত্তেজিত করে ফিলটা। অনুভূতি ভোঁতা হওয়ার আগেই কাজটা করে ফেলতে হবে। কার্গো প্যান্টটা, অনেকগুলো পকেটসুদ্ধু, খুব হালকা লাগে আজ। শরীরটাই হালকা লাগে যেন। উড়তে উড়তে কাফেতে ঢুকে যায়। হাসিমুখেই, কিচ্ছুটি না বুঝে, সরল চোখে সঞ্চিতা ওর দিকে মুখ ফেরাবে। যদিও ছেনাল মেয়েমানুষ, তবু সরল। না—বোঝা হরিণ চোখ। বোকা চোখ। সেই ওর সাদা চোখে আস্তে আস্তে বিস্ময়, তারপর বিস্ফারিত দুটি চোখে ধীরে ধীরে ভয়, ধীরে ধীরে বিভীষিকা…আহ, কী মজা!
মা যখন বাবাকে ছেড়ে চলে যায় বাবা বলেছিল, মেয়েমানুষ ছোঁবে না কখনও। তখন বোঝেনি ও। মানেটা কী। তারপর সুচিত্রাকাকিমা যখন এল, বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল তুমি যে বলেছিলে, মহিলা ব্যাপারটাই একটা যাচ্ছেতাই জিনিস, মাউসট্র্যাপ, জীবনকে ভেতর থেকে ফোঁপরা করে দেয়? তখন ওর চোদ্দো। বাবার দিকে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শেখেনি, অথচ ভেতরে ঘৃণা থরথর করত, বাবা যখন সুচিত্রাকাকিমাকে নিয়ে ফিরত বাড়ি, মাল খেত।
অনেক পরে ও অর্জি কথাটা শেখে। অথচ মেয়েরা ওকে চায় না। ও তাদের এমএমএস পাঠায়, অশ্লীল জোকস পাঠায়। তারা কিছুদিন ওর সঙ্গে মেশে, ওকে দেখে নেয়, মেপে নেয়, তারপর সরে যায়। তারা শুধু ওকে শুকনো শুকনো ইমোটিকন পাঠায়। তারপর একদিন চুপ মেরে যায়। একদিন শুধু ওর ইমেল গিয়ে গিয়ে তাদের মেলবক্সে জমে যায়, জমাট বেঁধে যায়। হয়তো সেই ইমেলগুলোকে না দেখেই সোজা ডিলিট করে বা স্প্যাম ফোল্ডারে পাঠিয়ে দেয়। একদিন হয়তো তারা ওকেই পুরো ব্লক করে দেয়। উফফফ।
মেনে নেওয়া যায় না এটা। একদম মেনে নেওয়া যায় না। একটা কিছু করতেই হবে।
দীঘল, কনফিডেন্ট পায়ে কাফের ভেতরটায় ঢোকে ও, তারপর একদম ক্লোজ রেঞ্জে এসে রিভলভারটা সটান তুলে ধরে প্রিয়, নীলরং জামা পরা, পাখি পাখি ছোট্ট চেহারার মেয়েটার দিকে। ব্যাং।
ব্যাং ব্যাং ব্যাং।
সঞ্চিতা লুটিয়ে পড়ে। চেয়ার উল্টে যায়।
নিলুপিসি, এক কাপ চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে তপন। ওর বন্ধু। দুজনেই অ্যালার্ট, কিন্তু অফ গড়িয়াহাট রোড, একটু ভেতরের এক কাফে কফি ডে আর তার উল্টোদিকের চায়ের দোকানের মুখটা এখনও ফাঁকা…ফাঁকা মানে, নাঃ, এখনও কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি ঋদ্ধিমানের। ওর পুলিশ মামা দীপেন ঘোষ মোবাইলে বলেছেন, ঋদ্ধি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। সবকিছু মিলে যাচ্ছে কিন্তু। উনিও উদ্বিগ্ন। রিভলভারটা মিসিং হওয়ার খবর উনিই বলেছিলেন, উইথ লট অফ ওয়ারি।…যেখান থেকে গেছে, সেটাও ঋদ্ধির নাগালে…কিন্তু যতটা পেরেছেন, ঋদ্ধির ঘর সার্চ করে পাওয়া যায়নি জিনিসটা। খোলাখুলি কিছু করতে বা বলতে সাহস পাননি উনি, কেননা ঋদ্ধি যথেষ্ট ডিস্টেবিলাইজড, ওকে সন্দেহ করা হচ্ছে জানলে বলা যায় না, সুইসাইডাল টেনডেন্সি হতে পারে।
বাড়িতেও নজর রাখছেন উনি। কিন্তু ঋদ্ধি বেরিয়ে পড়ার পরই, ওকে ফলো করছে একটা গাড়ি। আর, সঞ্চিতা যে কাফেতে বসেছে, অর্চির সঙ্গে মিট করবে বলে, সেখানে নজর রাখছে সঞ্চিতার পিসি।
ব্যাং ব্যাং ব্যাং। আচমকা পাড়াটাকে চিরে দিয়ে আওয়াজটা, চিৎকার তারপর, হইচই। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল নিলুপিসি, প্রায় চায়ের কাপ উল্টে ফেলে তপনও। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হতবাক, কেননা ঋদ্ধি, ঋদ্ধি তো এখনও বালিগঞ্জ ফাঁড়ি ক্রস করেনি, এখনই জানা গিয়েছে। জাস্ট দু সেকেন্ড আগেই।
কাফে থেকে লাফ দিয়ে বেরোচ্ছে এখন, সঞ্চিতাকে শু্যট করে, তার আততায়ী। গুলিটা মারার পরপর ও কী করবে, ভেবে পায়নি দু—চার মোমেন্ট। বিস্রস্ত কাফেটা, চারিদিকে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে লোকজন। মাতালের মতো ঘুরে গিয়েই হঠাৎ তিরবেগে দৌড়তে শুরু করে দিল অর্চি।
ততক্ষণে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সার্ভিস রিভলভারটা ধোঁওয়া ওঠার পর ঠান্ডা। একরাশ মানুষের স্থির দৃষ্টির সামনে। একমাত্র পাশের কিউবিকলের ওই চুমকি ঘোষ মেয়েটাই অর্চিকে ততটা টানত না…বেশ নিরাপদ রাশিয়ার মতো চেহারার মেয়েটা বাবার ড্রয়ার থেকে সার্ভিস রিভলভার এনে দিয়েছিল অর্চিকে।
রোজ এক কাপ কফির ফেভারের পরিবর্তে।
ঋতির উপহার – পিনাকী মুখোপাধ্যায় (মুখার্জী)
ঋতি যখন মণি মুখার্জি রোডের সাত নম্বর বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল তখন শীতের সন্ধ্যা আরও ঘন হয়েছে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার। সে কোনো ভুল করছে না তো? তার কি একবার মনোজিৎকে ফোন করা উচিত ছিল? কালো রঙের বিশাল লোহার গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে ঋতি ভাবছিল সে ফিরে যাবে কি না। তখনই বেজে উঠল মোবাইলটা।
একটু চমকে উঠল ঋতি। দেবযানীর ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে একটু যেন কেঁপে গেল গলাটা, ‘হ্যালো।’
‘কতদূরে?’
‘আপনাদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।’ আড়ষ্ট গলায় বলল ঋতি।
‘কেন? দাঁড়িয়ে আছ কেন? গেট খুলে চলে এসো ভেতরে। নীচে কলিংবেল বাজালেই রঘুদা দরজা খুলে দেবে।’
‘ঠিক আছে।’—ফোনটা ব্যাগে রেখে ধীরে ধীরে গেট খুলে ঢুকে আসে ঋতি। মোরাম বিছানো চওড়া পথের দুপাশে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা আর গ্যাঁদার মিছিল। বারান্দায় উঠে কলিংবেলে হাত ছোঁয়াল ঋতি।
একটু পরেই একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিলেন। ইনিই বোধহয় রঘুদা। ঋতি কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন, ‘বউদিমণি ওপরে আছেন। এ ঘরের পরেই সিঁড়ি পাবেন। উঠেই প্রথম ঘরটা।’
‘বউদিমণি’ কথাটা কি একটু জোর দিয়ে বললেন ভদ্রলোক? না কি ঋতির কানেই একটু বেশি জোরে বাজল শব্দবন্ধটা? বুঝতে পারল না ঋতি।
ক’টা মাত্র সিঁড়ি। অথচ পা দুটো যেন চলতেই চাইছে না। কেন যে রাজি হল ঋতি এখানে আসতে? সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই বিগড়ে ছিল মেজাজটা। সারা সপ্তাহের লাগামছাড়া ব্যস্ততার মাঝখানে রবিবারের চিলতে অবসরটা একটু ঢিলেঢালাভাবে কাটাতে ইচ্ছে করে ঋতির। ভেবেছিল একটু বেলা করে উঠবে। কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই দরজায় টোকা।
ঘুমচোখে দরজা খুলতেই বিরক্ত গলায় মা বলে উঠেছিলেন, ‘আজও বাজারে না যাওয়ার মতলব নাকি তোর? অন্ধ্রের রুই খেতে খেতে তো চড়া পড়ে গেল জিভে।’
‘সাতটাও তো বাজেনি মা। আটটার আগে তো ভালোভাবে বাজারই বসে না।’ হাই তুলতে তুলতে বলেছিল ঋতি।
‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু মেকাপ নিয়ে রেডি হতেই তো তোমার ঘণ্টাখানেক লাগবে। কুসুম তো আর সারাদিন ধরে বসে থাকবে না। আর যদি ভেবে থাকো আজও ডালসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে পয়সা বাঁচাবে, তবে যাও। আবার শুয়ে পড়ো গিয়ে। তোমার তো ইচ্ছে ঘুম। চিন্তাভাবনা তো নেই কিছু।’
সবসময় সুরমা এইরকম ঠুকে ঠুকে কথা বলেন। সাধারণত চুপ করেই থাকে ঋতি। কিন্তু আজ হঠাৎই গরম হয়ে গেল মাথাটা। বলবে না বলবে না করেও বলে উঠল, ‘কীসে পয়সা বাঁচাতে দেখলে? যা বলছ তাই তো করা হচ্ছে। পয়সার জন্য কী আটকেছে তোমার?’
‘পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে আমার চিকিৎসা করানো পয়সা বাঁচানো ছাড়া কী? সুগার, প্রেসার নর্মাল থাকলেই মানুষ সুস্থ থাকে? হাঁটুর ব্যথাটা কবে থেকে ভোগাচ্ছে, একজন ভালো হাড়ের ডাক্তারকে দেখানোর কথা একবারও মনে হয়েছে তোর?’
‘ডক্টর সাধুখাঁ এম.ডি./মা। যথেষ্ট নামকরা ডাক্তার। উনি যে ব্যায়ামগুলো করতে বলেছিলেন একদিনও করেছ? ব্যায়াম না করলে ব্যথা এমনি এমনি কমবে? যাকেই দেখাও, ব্যায়ামই প্রেসক্রাইব করবেন।’
‘তুই তো সব জেনে বসে আছিস। বেশি জেনেই তো এই দশা। আইবুড়ো থেকে হাড় মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছিস আমার। তোর দিদিদের বাড়ি গিয়ে দু’দিন যে জুড়িয়ে আসব সে উপায় অবধি নেই। জীবনভর মেয়ের হেঁশেল সামলাতে হবে।’
চুপ করে যায় ঋতি। মিথ্যে কথার কী জবাব দেবে সে? বড়দি, মেজদি কখনও মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চায় না। যেহেতু ঋতি ভালো চাকরি করে এবং তার বিয়ে হয়নি, তাই মাকে দেখার দায়িত্বটা শুধুই যেন তার। সে কারণেই ছত্রিশ পেরনো ঋতির বিয়ের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে চলে সকলে। ঋতির হেঁশেল সামলায় রাতদিনের লোক কুসুম। কুটোটা নাড়তে হয় না মাকে। কথা বাড়াতে আর রুচি হল না ঋতির। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘কুসুমকে চা বসাতে বলো। আমি আসছি। আর আসছে সপ্তাহেই একজন অর্থপেডিককে দেখিয়ে আনব তোমায়।’
সুরমা কিছুতেই খুশি হল না। ওঁর কপালে বিরক্তির গভীর আঁচড়গুলো কিছুটা নরম দেখাল শুধু।
বাজার থেকে ফিরে সোফায় বসে তখন দ্বিতীয় দফার চা খাচ্ছিল ঋতি। চোখ বোলাচ্ছিল খবরের কাগজের হেডিংগুলোয়। অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা তখনই এসেছিল। ভুরুতে হালকা ভাঁজ ফেলে ফোনটা ধরেছিল, ‘হ্যালো।’
‘হ্যালো! চিনতে পারছ?’—সুরেলা মহিলা কণ্ঠ মোটেই চেনা নয়। ঋতি যখন স্মৃতি হাতড়াচ্ছে, দূরভাষিণী বলে উঠেছিল, ‘আমি দেবযানী দত্ত বলছি।’
হাতে ধরা চায়ের কাপটা থেকে কিছুটা চা চলকে পড়েছিল ঋতির কামিজে। হৃৎপিণ্ডের গতি মুহূর্তেই কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কথা জোগাচ্ছিল না মুখে।
‘জানি, তুমি খুব অবাক হচ্ছ। হয়তো ভাবছ এটা আমার নতুন কোনো চাল। কিন্তু বিশ্বাস করো এর মধ্যে কোনো চালাকি নেই। সবকিছুর জন্যই তো একটা প্রস্তুতি লাগে তাই না? আমার হয়তো সময়টা একটু বেশিই লেগেছে। আল্টিমেটলি আই হ্যাভ ডিসাইডেড ঋতি। কিন্তু তার আগে একবার আমি দেখতে চাই তোমাকে। আজ একটিবার তুমি আসবে?’ আন্তরিক শুনিয়েছিল দেবযানীর কথাগুলো।
বিশ্বাস—অবিশ্বাসের দোলাচলে কেঁপে উঠেছিল ঋতি। হঠাৎই যেন অনেকখানি অক্সিজেন ঢুকে গিয়েছিল বুকের ভেতর। ঋতি নয়, যেন অন্য কেউ বলে উঠেছিল, ‘যাব…।’
‘আমার আর একটা কথা রাখতে হবে তোমায়।’
থমকে গিয়েছিল ঋতি, ‘বলুন।’
এখানে আসার কথাটা এখন কাউকে বলতে পারবে না তুমি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, হোয়াট আই মিন?’
বুঝতে পেরেছিল ঋতি। কাউকে কিছু বলেনি সে। বিকেলে দার্জিলিং থেকে যখন ফোন করেছিল মনোজিৎ, এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে। আসলে ঋতি ভয় পেয়েছিল। কথার খেলাপ করলে আবার যদি মত বদলায় দেবযানী।
পায়ে পায়ে কখন সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারেনি ঋতি। ভেলভেটের পর্দা সরাতেই ঘরের মাঝখানে চওড়া খাটে শুয়ে থাকা মধ্য বয়সিনী মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘এসো ঋতি। ভেতরে এসো।’
এই দেবযানী? একসময় যে নজরকাড়া রূপসী ছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। এক বছর আগের সেরিব্রাল অ্যাটাক সেই রূপের অনেকখানি কেড়ে নিলেও সবটা পারেনি। ওঁর শরীরের বাঁ দিকটা অ্যাফেকটেড হয়েছিল। নিয়মিত ফিজিওথেরাপিতে কিছুটা উন্নতি হলেও একা একা এখনও চলাফেলা করতে পারেন না দেবযানী। তবে কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই।
বিছানার সামনে একটা গদিআঁটা চেয়ারে ঋতিকে বসতে বললেন দেবযানী। শুয়ে শুয়েই বেডসাইড টেবিলের পাশে একটা সুইচ টিপলেন। ঋতি তখনই লক্ষ করল টেবিলটায় প্রচুর ওষুধপত্র রাখা। কিছুক্ষণের মধ্যে বছর পঁচিশের একটি রোগা বউ দৌড়ে ঘরে এল, ‘ডাকছিলেন বউদিমণি?’
‘আমায় একটু বসিয়ে দে তো শম্পা।’
হেডবোর্ডে কয়েকটা বালিশের ঠেস দিয়ে সাবধানে দেবযানীকে বসিয়ে দিল শম্পা। দেবযানী বললেন, ‘ভালো করে দু’কাপ চা নিয়ে আয়।’
‘আমার কিন্তু চায়ের দরকার নেই।’ অপ্রতিভ গলায় বলল ঋতি।
‘তুমি আজ প্রথম এলে। একটু চা—ও না খাওয়ালে বাইরে গিয়ে নিন্দে করবে যে। সেটি হচ্ছে না।’
শম্পা চলে গেল। ঋতি অনুভব করছিল একটা অপরাধবোধ খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলছে চেতনার গভীরে। যে দেবযানীর কথা শুনে এসেছে ঋতি, সামনের মহিলার সঙ্গে তাকে যেন মেলানো যাচ্ছে না। সব হিসাব কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।
পাশাপাশি টেবিলে কাজ করতে করতে কবে যে একটা সহজ বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল দুজনের ঋতি বা মনোজিৎ কেউই বুঝতে পারেনি।
ঋতি লক্ষ করত হুল্লোড়ে, হাসিখুশি মনোজিৎ মাঝেমাঝেই কেমন বদলে যেত। গুম হয়ে থাকত ক’টাদিন। তারপরে অবশ্য আবার আগের মতো হয়ে যেত।
ক্যান্টিনে একসঙ্গে টিফিন খেতে খেতে একদিন ঋতি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাঝে মাঝে আপনার কী হয় বলুন তো? হঠাৎ এত গম্ভীর হয়ে যান, কথা বলতেও ভয় করে। একটুও ভালো লাগে না তখন।’
কেমন একটা চোখে ঋতির দিকে তাকিয়েছিল মনোজিৎ। শিরশির করে উঠেছিল ঋতির শরীরটা। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আরেকদিন বলব।’
সেই দিনটা আসতে কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। এক শনিবার ছুটির পর মেট্রো অবধি ঋতিকে এগিয়ে দিতে দিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল মনোজিৎ। দেবযানীর কথা সেদিনই প্রথম শুনেছিল ঋতি। শুনেছিল ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্কের জের টেনে চলার যন্ত্রণার কথা।
এক ছাদের তলায় থেকেও দেবযানীর জগৎ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তার ডিকসনারিতে ‘কম্প্রোমাইজ’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। নিজের বুটিকের ব্যবসা, বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, পার্টির বাইরে কারওর জন্য সময় ছিল না দেবযানীর। জন্মের পর থেকেই একমাত্র মেয়ে থাকত আয়ার কাছে। মনোজিৎ—এর আপত্তি সত্ত্বেও মাত্র ক্লাস থ্রি—তেই দেবযানী মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কার্শিয়াং—এর কনভেন্ট স্কুলে। ছুটি ছাটাতে যখন আসত পৌলমি তখনও পেত না মাকে। দিনের পর দিন অফিস ছুটি নিয়ে মেয়েকে সঙ্গ দিত মনোজিৎ। আসলে প্রথম থেকেই বাচ্চচা চায়নি দেবযানী। মনোজিৎ—এর জেদাজিদিতে শর্তসাপেক্ষে মা হতে রাজি হয়েছিল। বলেছিল, বাচ্চচার সবরকম দায়িত্ব সামলাতে হবে মনোজিৎকেই। মনোজিৎ ভেবেছিল মা হলে বদলে যাবে দেবযানী, ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ব্যবসাটাও মন দিয়ে করত না দেবযানী। কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিলে ব্যবসার যা হাল হয় তাই হয়েছিল। কিন্তু ঠাটবাটের কমতি ছিল না। টাকার জোগানে টান পড়লেই তুমুল অশান্তি শুরু করত দেবযানী। মনোজিৎ—এর বড়দা আলাদা থাকলেও পারিবারিক জুয়েলারির ব্যবসাটা যৌথ মালিকানাতেই। বড়দাই মূলত দেখাশোনা করেন। সেখান থেকে যে শেয়ারটা পায় মনোজিৎ সেটাও কম নয়। কিন্তু তবুও যেন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না। একরকম বাধ্য হয়েই এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে দার্জিলিং—এর একটা হোটেল লিজ নিয়েছিল মনোজিৎ।
‘টাকা দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায় হয়তো, কিন্তু শান্তি কেনা যায় না।’ বিষণ্ণ গলায় বলেছিল মনোজিৎ।
ভারী হয়ে উঠেছিল ঋতির মনটাও।
ছ’মাসের মাথায় ঋতি আর মনোজিৎ—এর সম্পর্কটা হঠাৎ করেই বাঁক নিয়েছিল একদিন। অফিসফেরত একটা রেস্তোরাঁর কেবিনে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। স্যান্ডুইচের প্লেট নাড়াচাড়া করতে করতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আমি আর পারছি না ঋতি। একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’
‘দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সহানুভূতির গলায় বলেছিল ঋতি।
‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। কিচ্ছু ঠিক হবার নয়। একদিন দেখো, নিজেকে শেষ করে দেব আমি।’ ভাঙাচোরা গলায় বলে উঠেছিল মনোজিৎ।
আমূল কেঁপে উঠেছিল ঋতি। নিজের অজান্তেই মনোজিৎ—এর একটা হাত টেনে নিয়েছিল দু’হাতের মুঠিতে, ‘এসব কী বলছ যা তা?’
পলকেই কী যে হয়ে গেল! ঋতিকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে বাচ্চচাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠেছিল মনোজিৎ। পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ঋতি। শুরুটা হয়তো আগেই হয়েছিল। বুঝতে পারেনি ঋতি। সমর্পণ তাই বুঝি অমন অনায়াস ছিল। তার উন্মুখ ঠোঁটের গভীর থেকে যেন জীবনের আশ্বাস শুষে নিচ্ছিল মনোজিৎ।
এক ছুটির সকালে লংড্রাইভে যেতে যেতে ঋতি বলেছিল, ‘সমাজের কাছে আমার পরিচয়টা একবারও ভেবে দেখেছ? ঠারে ঠোরে অনেক কথা কানে আসে। কী বলব? চুপ করে থাকি।’
‘ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভেবেছি ঋতি। মিউচুয়াল সেপারেশনের জন্য আমি অলরেডি কথা বলেছি ল’ইয়ারের সঙ্গে।’
‘কিন্তু পৌলমী? সে মেনে নেবে? ও তো আর ছোটটি নেই এখন। ওরও তো একটা মতামত আছে।’
‘ছেলেবেলা থেকেই তো দেখেছে মা কে। মানসিক কোনো সম্পর্কই নেই দেবযানীর সঙ্গে। ছুটিতে যখন বাড়িতে আসে ওর সবকথা আমার সঙ্গে। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। তোমার কথা ও জানে। ওর কোনো আপত্তি নেই।’
অবাক চোখে চেয়ে থাকে ঋতি। মা—মেয়ের বোঝাপড়া কোন তলানিতে এসে ঠেকলে মেয়ের এমন মনোভাব হয়? ভাবছিল ঋতি। তারপর বলেছিল, ‘দেবযানীকে বলেছ?’
গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মনোজিৎ। বলেছিল, ‘তার সঙ্গে যখন রাতে দেখা হয়, কোনোদিনই সুস্থ অবস্থায় থাকে না। আর সকালে আমি যখন বের হই তখন তার মাঝরাত।’ একটু থেমে যোগ করেছিল, ‘তবু বলতে তো হবেই। আজই বলব।’
পরদিন থেকে অফিসে আসছিল না মনোজিৎ। ফোনেও ধরা যাচ্ছিল না তাকে। অস্থির হয়ে উঠেছিল ঋতি।
দু’দিন বাদে ছুটির পর ডালহৌসী থেকে চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশনে যাওয়ার পথে ফোন এসেছিল মনোজিৎ—এর। ঋতি কোথায় আছে জেনে নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিল ঋতিকে। ট্রাম কোম্পানির অফিসের সামনে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাইক নিয়ে হাজির হয়েছিল মনোজিৎ। তাকে দেখে আঁতকে উঠেছিল ঋতি। মাথায় ব্যান্ডেজ, উসকো—খুসকো চেহারা। মনোজিৎ—এর মুখে সবকিছু শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল ঋতি।
পরশুরাতেই ডিভোর্সের কথা বলেছিল মনোজিৎ। সঙ্গে সঙ্গেই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছিল দেবযানী। নোংরা গালাগালি দিতে দিতে জিনিসপত্র ছুড়তে শুরু করেছিল। দেবযানীর ছোড়া ফুলদানিতেই কপাল ফেটে গিয়েছিল মনোজিৎ—এর। তিনটে স্টিচ পড়েছিল। সে রাতেই মণি মুখার্জি রোডের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল মনোজিৎ। ক’দিন বন্ধুর বাড়িতেই ছিল। তারপর গড়িয়াতে একটা টু বেডরুম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছিল।
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল তিনটে বছর। ডিভোর্স পেপারে সই করেনি দেবযানী।
এক বছর আগে যখন সেরিব্রাল হল দেবযানীর, ডাক্তার, নার্সিংহোম সবকিছু মনোজিৎকেই করতে হয়েছিল। মনের অগোচরে পাপ নেই। ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঋতি। ওদের ভাঙা সম্পর্কটা জোড়া লেগে যাবে না তো?
ঋতির আশঙ্কা সত্যি হয়নি অবশ্য। দেবযানী কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরেই সরে এসেছিল মনোজিৎ।
কিছুদিন আগে দেবযানী, মনোজিৎ—এর কমন ফ্রেন্ড তিলোত্তমা মনোজিৎকে জানিয়েছে, এবার নাকি সেপারেশনের ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছে দেবযানী।
বিশ্বাস করতে ভয় করত ঋতির। তবু গোপন একটা অপেক্ষা তো ছিলই।
দীর্ঘ সেই প্রতীক্ষা শেষ হতে চলেছে। কিন্তু উচ্ছ্বাসটা কেন যে আসছে না সেভাবে? কাঁটার মতো কী যেন একট খচ খচ করছে। করেই চলেছে।
‘কী এত ভাবছ বলো তো?’ দেবযানীর প্রশ্নে চমকে ওঠে ঋতি।
‘এখন কেমন আছেন আপনি?’ সহজ হওয়ার চেষ্টা করে ঋতি।
‘ভালোই। দিন—রাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে যতটা ভালো থাকা যায় আর কি। হুইলচেয়ারে বসিয়ে শম্পা মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে নিয়ে যায়। বেশিক্ষণ বসতে পারি না। আবার এনে শুইয়ে দেয়। কী বিড়ম্বনা বলো তো। এরচেয়ে একেবারে চলে যাওয়াই ভালো ছিল। তাই না? তোমাদেরও সুবিধে হত।’
মুখটা কালো হয়ে যায় ঋতির। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তখনই হেসে ওঠেন দেবযানী, ‘ঘাবড়ে গেলে নাকি? মজা করছিলাম।’
দেবযানীর কথার মাঝখানেই চা আর স্ন্যাক্সের ট্রে হাতে ঘরে এল শম্পা। কোনার দিক থেকে একটা গোল টেবিল টেনে এনে ট্রে—টা রাখল। একটা কাপ তুলে ঋতিকে দিয়ে অন্য কাপটা নিয়ে দেবযানীর কাছে গিয়ে বসল।
‘চা টা আমার হাতে দিয়ে তুই এখন যা।’ বললেন দেবযানী।
‘তোমার অসুবিধে হবে তো। চা টা খাইয়ে দিয়ে যাই?’
‘কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। ডান হাতটা তো ঠিক আছে রে বাবা। তাছাড়া ঋতিও তো আছে। তুই যা।’
একরকম বাধ্য হয়েই চলে যায় শম্পা। মাথা নিচু করে চা খাচ্ছিল ঋতি। বুঝতে পারছিল দেবযানী তাকেই দেখে যাচ্ছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। দেবযানী তখনই বললেন, ‘আমি খুব খারাপ। কত যে খারাপ ভাবতেও পারবে না তুমি। মা ছিল না তো। ছোটবেলা থেকেই স্পয়েল্ড হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিকারের সহমর্মিতা, ভালোবাসা কোনোদিন পাইনি। তাই বোধহয় এত ডেস্ট্রাকটিভ আমি, শুভ কিছু, সুন্দর কিছু সহ্য করতে পারি না।’
ঋতি বুঝতে পারছে না, ঠিক কী বলতে চাইছেন দেবযানী। ঋতির দিকে চেয়ে একটু বুঝি থমকে গেলেন দেবযানী। মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমাকে খুব বোর করছি না? আর সময় নষ্ট করব না তোমার। তুমি একটু কষ্ট করে ডানদিকের ওই আলমারিটা খোলো তো।’
‘আমি!’ অবাক ঋতি।
‘তাছাড়া আর কে আছে এখানে? এদিকে বিছানার তলা থেকে চাবিটা নিয়ে আলমারিটা খোলো। একদম ওপরের তাকে একটা ফাইল আছে, সেটা নিয়ে, আর ওই ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা পেন নিয়ে আমার কাছে এসো।’
দেবযানী যা যা বললেন একে একে তাই করে গেল ঋতি। ফাইলটা খুলতেই পাওয়া গেল ডিভোর্স পেপার। গোটা গোটা অক্ষরে সই করে দিলেন দেবযানী। একটু যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। হাঁপ নিয়ে বললেন, ‘ওই গ্লাসটা একটু দেবে ঋতি? বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে।’
টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢাকনা খুলে এগিয়ে দিল ঋতি। জল খেতে গিয়েই ঘটল বিপত্তিটা। বিষম খেয়ে হিক্কার মতো উঠতে লাগল। দেবযানীর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ঋতি। হিক্কাটা কমলেও প্রবলভাবে কাশতে লাগলেন দেবযানী।
ভয় পেয়ে ঋতি বলে উঠল, ‘কষ্ট হচ্ছে আপনার? শম্পাকে ডাকব?’
হাতের ইশারায় ঋতিকে নিষেধ করলেন দেবযানী। থেমে থেমে বললেন, ‘এরকম প্রায়ই হয়। ওই টেবিলে দেখো একটা কালো মতো সিরাপের শিশি আছে। ওখান থেকে দু ঢাকনি দাও তো আমাকে।’
সিরাপের শিশি থেকে ঢাকনি মেপে গ্লাসে ওষুধ ঢালতে ঢালতে ঋতি শুনল কাশতে কাশতেই দেবযানী বলছেন, ‘অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে। কিন্তু তোমাদের নতুন জীবন শুরুর চাবিকাঠিটাও তো দিয়ে দিলাম বলো। অনেক শুভেচ্ছা রইল।’ একটু দম নিয়ে আবার বললেন, ‘ভেবোনা মৌখিক শুভেচ্ছা জানিয়েই দায় সারব আমি। উপহারটা ডিউ থাকল। সময়—মতো ঠিক পাঠিয়ে দেব।’ হাঁপাচ্ছিলেন দেবযানী।
এত কথা কেন যে বলছেন দেবযানী? কাশি তো আরও বেড়ে যাবে। খুব যত্ন করে দেবযানীকে ওষুধটা খাইয়ে দিল ঋতি।
কমে এসেছে কাশিটা। কাশির ধকলেই বোধহয় বেশ কাহিল দেখাচ্ছে দেবযানীকে। শ্রান্ত গলায় দেবযানী বললেন, ‘এবার এসো তুমি। সাবধানে যেও।’
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কেন যেন শির শির করছিল ঋতির চোখ দুটো। হিসেবটা মিলছে না কিছুতেই।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ঋতির। পাহাড়ে রাত গভীর হয় আরও তাড়াতাড়ি। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মনোজিৎ। সুখবরটা কালই দেবে। ভাবল ঋতি।
পরদিন সকালে বেজে চলা পরিচিত রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল ঋতির। মোবাইল কানে চাপতেই ভেসে এল মনোজিৎ—এর উদ্বিগ্ন গলা, ‘কাল তুমি মণি মুখার্জি রোডের বাড়িতে গিয়েছিলে কেন?’
‘তুমি কী করে জানলে?’ অবাক ঋতি।
‘টিভিতে দেখাচ্ছে। প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ এটা।’
‘মানে? ইয়ারকি হচ্ছে?’
‘ইয়ারকি নয়। টিভিটা খুললেই বুঝতে পারবে। কাল রাতে খুন হয়েছে দেবযানী। কাশির ওষুধের সঙ্গে বিষ খাইয়ে খুন করা হয়েছে। রঘুদাদার কাছ থেকেই পুলিশ জানতে পেরেছে তোমার কথা। আমাকেও ফোন করেছিল পুলিশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে বলেছে। কিন্তু আমাকে কিছু না বলে তুমি হঠাৎ কেন যেতে গেলে ও বাড়িতে?’
থর থর করে কাঁপছে ঋতি। ঋতির কাছে কালকের সমস্ত ঘটনা শুনতে শুনতে পাথর হয়ে যাচ্ছে মনোজিৎ। সিরাপের শিশিতে, গ্লাসে, আরও কত জায়গায় কী নিপুণ চালাকিতে ঋতির ফিঙ্গার প্রিন্ট ধরে রেখেছে দেবযানী! ঋতির সঙ্গে তার ঘর বাঁধার ছাড়পত্রে সই করে কী দারুণ সারপ্রাইজটাই না দিয়ে গেল দেবযানী! কী যেন দলা পাকিয়ে যায় মনোজিৎ—এর গলায়।
‘কাল দেবযানীর অনেক কথা হেঁয়ালির মতো লাগছিল জানো। এখন সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার আমার কাছে। আমি বোকা মনোজিৎ…’ কান্নায় বুজে আসে ঋতির গলা।
ঠিক তখনই কারা যেন জোরে জোরে নক করতে থাকে দরজায়। মা, কুসুমের চেঁচামেচি ছাপিয়ে ঋতি শুনতে পায় একটা ভারী গলা, ‘…মিস সেন…দরজাটা খুলুন….মিস সেন….দরজা ভাঙতে বাধ্য করবেন না আমাদের…শুনতে পাচ্ছেন….’
‘হ্যালো! ঋতি! কী হল! কথা বলছ না কেন?…’ মনোজিৎ—এর চিৎকার, দরজার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে একটা অশরীরী হাসিতে। ঋতি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে দেবযানীর গলাটা—’উপহার পছন্দ হয়েছে ঋতি? বলেছিলাম না সময়মতো পাঠিয়ে দেব…।’
একটি খুনের গল্প – প্রচেত গুপ্ত
কাজটা গোপালবাবু সাবধানে এবং ঠান্ডা মাথায় করবেন বলে ঠিক করেছেন ৷ চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হয়ে গেলে যে-কোনও কাজই সাবধানে এবং ঠান্ডা মাথায় করা উচিত ৷ এক-পা ফেলার আগে দশবার ভাবা উচিত ৷ এই কাজের বেলায় গোপাল সান্যাল ভেবেছেন একশোবার ৷ তার পরও বারবার পিছিয়ে এসেছেন ৷ তার কারণ কাজটা কঠিন ৷ শেষ পর্যন্ত সুযোগ এসেছে ৷ গোপালবাবু নিখুঁতভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চান ৷
গোপালবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, কাজ করাবেন ‘প্রফেশনাল’ দিয়ে ৷ পেশাদার খুনি ৷ সুপারি কিলার ৷ সেইমতো একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ৷ সেই লোকের বায়োডাটা ভালো ৷ এই লাইনে দীর্ঘদিন আছে ৷ পয়সা বেশি নেয় তবে কাজে ত্রুটি রাখে না ৷ গোপালবাবু তবু অতিরিক্ত সাবধান হয়েছিলেন ৷ বড় লেভেলের চেনাজানা ধরে সেই লোকের কাছে হাজির হলেন ৷ লোকটার নিতাই নাম ৷ চেহারা চকচকে, গোলগাল ৷ পরনে ধুতি, গায়ে উড়নি ৷ পেট পর্যন্ত লম্বা পৈতে, গলায় কণ্ঠির মালা ৷ কপালে মাটি লেপটানো চন্দন ৷ এই ধরনের লোক ধুতি, উড়নি, মাটির টিপ পরে থাকলে মনে হয় ভান করছে ৷ সাজানো ভক্ত ৷ গোপালবাবু গোড়াতে সেরকম ভেবেছিলেন ৷ পরে জানলেন, ঘটনা সেরকম নয় ৷ নিতাই সত্যিকারের একজন ভক্ত মানুষ ৷ বেলা পর্যন্ত পুজোআচ্চা নিয়ে থাকে ৷ সন্ধেতে নামগান ৷ নামগান শেষে শনিবার শনিবার করে বাতাসা বিতরণ ৷ ঠিক বিতরণ নয়, কাঁসার জাম বাটি থেকে মুঠো করে বাতাসা নিয়ে ওপরে ছুড়ে দেওয়া হয় ৷ একেই সম্ভবত হরির লুট বলে ৷ না ভেঙে আস্ত বাতাসা লোফা বিশেষ পুণ্যির বিষয় ৷
বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড— তিন জায়গায় নিতাইয়ের লোক আছে ৷ সপ্তাহের মাঝামাঝি এলে তারা শনিবার পর্যন্ত থেকে যায় ৷ একেবারে ‘কাজ’ সেরে হরির লুটের বাতাসা নিয়ে দেশে ফেরে ৷ ‘সুপারি’ নেওয়ার সময় নিতাই পার্টির সঙ্গে চট করে দেখা করে না ৷ সেটাই স্বাভাবিক এবং উচিত ৷ এই কাজে রিস্ক খুব ৷ পুলিশের খোঁচড় পার্টি সেজে ঢুকে পড়ে ৷ তাই সোর্সের ব্যবস্থা আছে ৷ সোর্স ধরে নিতাইয়ের কাছে পৌঁছোতে হয় ৷ শুধু সোর্স ধরলে হবে না ৷ সোর্সের কাছ থেকে কোড জেনে আসতে হয় ৷ পাসওয়ার্ড ৷ সকাল বিকেল নিতাই কোড বদলায় ৷ গোপালবাবু সোর্স ধরলেন, বড় লেভেলের চেনাজানা ধরলেন এবং সবশেষে ‘কোড’ জেনে তবে নিতাইয়ের কাছে পৌঁছলেন ৷ সেদিন সকালে কোড ছিল, ‘চিনি বেশি খাই ৷ চায়ে দু-চামচ চিনি দিতে বলবেন ৷’ দুপুরের পর কোড বদলে গেল ৷ তখন কোড হল, ‘চিনি খাই না ৷ সুগার আছে ৷ চিনি ছাড়া চা বলুন ৷’
গোপালবাবু এলেন বিকেলে ৷ নিতাই খাতির করে বসাল ৷ খুন-জখম অপহরণ যাই হোক, পার্টি তো ৷ পার্টি মানে লক্ষ্মী ৷
‘কী খাবেন? শরবত দিতে বলি? এরা আম পোড়া শরবত ভালো করে ৷’
গোপালবাবু বললেন, ‘না, শরবত নয় ৷ চিনি খাই না ৷ সুগার আছে ৷ আপনি বরং এক কাপ চা বলুন ৷ চিনি ছাড়া’ ৷
চায়ের অর্ডার দিয়ে নিতাই বলল, ‘পাখির বয়স কত?’
গোপালবাবু বললেন, ‘আমার বয়স ৷ একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম ৷ কয়েকমাসের এদিক-ওদিক হতে পারে ৷’
‘স্বভাবচরিত্র কেমন? চালাক না বুদ্ধিমান?’
গোপালবাবু প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন না ৷ একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘চালাক না বুদ্ধিমান মানে!’
নিতাই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘চালাক পাখি মারবার একরকম কায়দা, বুদ্ধিমান পাখি মারবার আরেকরকম কায়দা ৷ চালাক পাখি আকাশে উড়তে উড়তে ভল্ট দেয় ৷ ভাবে এতে শিকারির গুলি ফসকে যাবে ৷ বোকা জানে না শিকারি সবসময় পাখির ভল্ট হিসেব করেই গুলি ছোঁড়ে ৷ যাকে দুই ভল্টে মারবে তাকে সেই কায়দায় গুলি, যাকে আড়াইতে মারবে তাকে সেই কায়দায় ৷ বুদ্ধিমান পাখি এটা জানে ৷ তাই তার ডিগবাজি ফাজিতে না গিয়ে স্ট্রেট উড়ে যায় ৷ শিকারির হিসেব গুলিয়ে দেয় ৷ সে ডিগবাজির হিসেব করে গুলি ছোড়ে, সেই গুলি গায়ে লাগে না ৷ তাই বুদ্ধিমান পাখিকে গুলি করতে হয় ভেবেচিন্তে ৷
গোপালবাবু খুশি হলেন ৷ তিনি ঠিক লোকের কাছে এসেছেন ৷ চালাক, বুদ্ধিমানে ফারাক করা সহজ কথা নয় ৷ খুব কম লোক পারে ৷ এই লোক তাদের একজন ৷ গোপালবাবু বললেন, ‘ভবেশ চালাক বা বুদ্ধিমান কোনওটাই নয় ৷ সে বোকা ৷ সহজ সরল প্যাটার্নের ৷’
নিতাই ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ভবেশ! পাখির নাম?’
গোপালবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভবেশ পোড়েল ৷’
নিতাই ইন্টারোগেশনের কায়দায় বলল, ‘ভবেশ পোড়েলকে আপনার সহজ সরল কেন মনে হয়?’
গোপালবাবু মুখ তুলে সামান্য হাসলেন ৷ বললেন, ‘ভবেশ আমার শুধু ছোটবেলার বন্ধু নয়, বারো বছরের বিজনেস পার্টনার ৷ সে বোকা না চালাক, আমি জানব না? তার মানুষকে বিশ্বাস করবার অভ্যেস আছে ৷ বোকা অভ্যেস ৷’
নিতাই গোপালবাবুর চোখের ওপর চোখ রেখে বলল, ‘আপনাকে বিশ্বাস করে?’
গোপালবাবু চুপ করে রইলেন ৷ কী উত্তর দেবেন? ভবেশ তাকে শুধু বিশ্বাস করে না, বাড়াবাড়ি ধরনের বিশ্বাস করে ৷ না করলে কি আর এভাবে টানা পাঁচ বছর বিজনেস থেকে লাভের অংশ সরিয়ে রাখতে পারতেন? হিসেবপত্র দেখতে বললে গাধাটা বলে, আমি ওসব হিসেব টিসেবে নেই গোপাল ৷ বিজনেস শুরুর সময়ই তো কথা হয়ে গিয়েছিল বাপু, গায়ে গতরে খাটব আমি, অফিসে বসে কাগজপত্র নিয়ে কর্মকাণ্ড তোর ৷ সেই মতো আমি ঘুরে ঘুরে অর্ডার আনি, তুই হিসেব করিস ৷’
পার্টনারশিপ ব্যবসার শুরুতে এসব নেকা কথা হতে পারে ৷ পরে হয় না ৷ লাভ আসতে শুরু করলে তো একেবারেই হয় না ৷ ব্যবসায় বাপও নিজের ছেলেকে বিশ্বাস করে না ৷ তবে এখানে শুধু কি আর ব্যবসা? আর কিছু নেই? হ্যাঁ, আছে ৷ আরও বিশ্বাসের ব্যাপার আছে ৷ সেই ব্যাপারের নাম মন্দিরা ৷ ভবেশের বউ ৷ গোপালবাবুর সঙ্গে মন্দিরার আলাপ ভবেশের বিয়ের সময়ে ৷ পাত্রী ফাইনালের সময় গোপালবাবু নিজে উপস্থিত ছিলেন ৷ পরে বিয়ের যাবতীয় ব্যবস্থা, কেনাকাটা, খাটাখাটনি সবই করেছেন ৷ এমনকী ফুলশয্যার খাট পর্যন্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাজিয়েছিলেন৷ সবাই বলেছিল, বন্ধুর বিয়ে দিয়ে গোপাল হাত পাকাচ্ছে ৷ এরপর নিজে বিয়ে করবে ৷ এখন স্টেজ রিহার্সাল চলছে ৷
বিয়ের বছর খানেক পর মন্দিরা বলল, গোপালদা, এবার আপনি বিয়ে করুন ৷’
গোপালবাবু বললেন, ‘কেন? তোমার সমস্যা কী বাপু ৷ নিজেরা বিপদে পড়ে এখন আমাকে ফেলতে চাইছ?’
মন্দিরা হেসে বলল, ‘বাঃ বয়েস হয়ে যাচ্ছে না ৷ বিয়ে না করলে চলবে?’
গোপালবাবুও হেসে বললেন, ‘বেশ তো চলছে ৷ খুব ভালো চলছে ৷ স্বাধীন, ফুরফুরে ৷ রোজগার করছি, খাচ্ছিদাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি ৷’
মন্দিরার গায়ের রং কালোর দিকে হলেও একধরনের সৌন্দর্য আছে ৷ চোখা সৌন্দর্য ৷ চোখে মুখে বুদ্ধির ভাব ৷ শুধু ভাব নয়, গোপালবাবুর বিশ্বাস মেয়েটার সত্যি বুদ্ধি আছে ৷ রূপবতী থেকে বুদ্ধিমতী মেয়ে তার সবসময়েই বেশি পছন্দ ৷ এই কারণে গোড়া থেকেই তিনি বন্ধুর পত্নীকে বেশি নম্বর দেন ৷ মন্দিরা চোখ কপালে তুলে, নাটকীয় গলায় বলল, ‘এটা কি চলা হল নাকি? হোটেলে তেল ঝাল মশলার খাবার খাচ্ছেন, যখন খুশি বাড়ি যাচ্ছেন ৷ অসুখ-বিসুখ করলে দেখার লোক পর্যন্ত নেই ৷ ভগবান না করুন, যদি সেরকম কিছু হয় কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন?’
গোপালবাবু হেসে বললেন, ‘কবে অসুখ করবে তার জন্য এখন থেকে বিয়ে করে বসে থাকতে হবে? অসুখ সামলাতে মানুষ ইনসিওরেন্স করে শুনেছি ৷ হেলথ ইনসিওরেন্স ৷ বিয়ে করে বলে তো শুনিনি ৷’
‘ঠাট্টা করবেন না গোপালদা ৷ বিয়েটা সত্যি করে নিন ৷ আপনার জন্য না করলে অন্তত আমার জন্য করুন ৷’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আমি বিয়ে করব! কথাটার মানে কী! তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি!’
মন্দিরা গোপালবাবুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিল ৷ বলল, ‘আমার একজন সঙ্গী দরকার ৷ আপনার বিয়ে হলে আপনার গিন্নি আমার সঙ্গী হবে ৷ তার সঙ্গে গল্প করব, শপিং করব, সিনেমায় যাব ৷ সারাদিন একা থাকি ৷ আপনার বন্ধু তো মাসের আদ্দেক দিন বাইরে বাইরে ঘোরে ৷’
গোপালবাবু খুব একচোট হাসলেন ৷ বললেন, ‘ও এই কথা ৷ সেটা আগে বলবে তো ৷ আসলে ভবেশ বিজনেসের জন্য ট্যুরে যায় বলে তোমার প্রবলেম হচ্ছে ৷ ইউ ফিল লোনলি ৷ আজই আমি ওকে বলব, এবার থেকে তুই অফিসে থাকবি, বাইরের কাজ আমি করব ৷ বিয়ে করা থেকে বাইরে ঘুরে কাজ করা অনেক সহজ ৷ ভবেশকে দেখে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি ৷’
কথাটা বলে আবার এক চোট হাসলেন গোপালবাবু ৷
মন্দিরা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দেখুন যদি পারেন ৷ মনে হয় না পারবেন ৷’
মন্দিরাই ঠিক বলেছে ৷ গোপালবাবু বন্ধুকে রাজি করাতে পারলেন না ৷ ভবেশ পোড়েল হাত-পা ছুড়ে বললেন, ‘খেপেছিস! ওসব ঘরে বসা কাজে আমি নেই ৷ তাহলে রইল তোর বিজনেস, আমি চললাম ৷’
গোপালবাবু বললেন, ‘আহা, তুই মন্দিরার কথাটা তো একবার ভেবে দেখবি ৷ বেচারির একা লাগে ৷’
ভবেশ পোড়েল তেড়ে ফুঁড়ে বললেন, ‘এ আর কেমন কথা ৷ বিয়ের আগে জানত না, আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়? ওটাই আমার কাজ ৷ ওর কথা বাদ দে তো ৷ অনেকদিন পরে বিজনেস খানিকটা স্পিড পেয়েছে ৷ কোম্পানির নামডাক হয়েছে ৷ এখন যত অর্ডার ধরে আনতে পারব তত লাভ ৷ এখন ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে এক্কা দোক্কা খেলার সময় নয় ৷’
গোপালবাবু বোঝানোর চেষ্টা করলেন ৷ বললেন, ‘তবু, মেয়েটার কথা তো একটু ভাববি ৷’
গোপালবাবুকে থামিয়ে দিয়ে ভবেশ পোড়েল বললেন, ‘ওসব ফালতু ভাবনা নিয়ে তুই বসে থাক ৷ মন্দিরার একা লাগলে তুই সামলাবি ৷ আমাকে টানবি না ৷ আমাকে মন দিয়ে কাজ করতে দে ৷’
‘তুই অকারণে উত্তেজিত হচ্ছিস ৷ ব্যবসা তো আমিও করছি ৷ মন দিয়েই করছি ৷’
ভবেশ পোড়েল হাত ছুঁড়ে বললেন, ‘বলছি, তোর বিষয় তুই বোঝ ৷ আমাকে জড়াবি না ৷’
গোপালবাবু নিজের ‘বিষয়’ নিজে বুঝলেন ৷ শুধু গোপালবাবু নন, মন্দিরাও বুঝল ৷ ভবেশ পোড়েল ট্যুরে গেলে গোপালবাবু মাঝে মধ্যে ‘একা মন্দিরা’র কাছে চলে আসেন ৷ গল্প করেন ৷ ডিভিডি চালিয়ে সিনেমা দেখেন ৷ উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা ৷ পথে হল দেরি, শেষ রক্ষা, শাপমোচন ৷ মন্দিরা এটা সেটা করে এনে গোপালবাবুর পাশে রাখে ৷ গরম গরম বেগুনি, মাছের ডিমের বড়া, গাজরের হালুয়া ৷ গোপালবাবু বলেন, ‘মন্দিরা তুমিও এসো না ৷ আমার সঙ্গে সিনেমা দেখবে ৷’
মন্দিরা হেসে বলে, ‘দাঁড়ান আসছি ৷’
মন্দিরা ফিরে আসে ৷ হাতে তোয়ালে সাবান ৷ বলে ‘যান আগে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসুন তো ৷ অফিস করে এসেছেন ৷ মাগো! গায়ে বিটকেল গন্ধ ৷’
গোপালবাবু গদগদ গলায় বলেন, ‘স্নান করলে ভালো হত ৷’
মন্দিরা স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘ওমা করুন না ৷ কে বারণ করেছে? আমাদের জলের কোনও প্রবলেম নেই ৷ আপনি বরং এক কাজ করুন গোপালদা, আপনার বন্ধুর একটা লুঙ্গি নিয়ে যান ৷ স্নান সেরে পরে নেবেন ৷ হ্যাঙার দিচ্ছি নিজের প্যান্ট-শার্টটা ঝুলিয়ে রাখুন ৷ বেরোবার সময় চেঞ্জ করে নেবেন ৷ আর শুনুন মশাই, স্নানের পর একটু পাউডার ব্যবহার করতে শিখুন দেখি ৷ বিয়ে করেননি বলে পাউডারও দূরে সরিয়ে রাখবেন নাকি?’
মন্দিরা হি হি করে হাসে ৷ গোপালবাবুর ভালোই লাগে ৷ স্নান সেরে, পাউডার মেখে তিনি বন্ধু ভবেশ পোড়েলের লুঙ্গি পরে সিনেমা দেখতে বসেন ৷ মন্দিরা পাশে এসে বসে ৷ নাক টেনে বলে, ‘আঃ, কী সুন্দর ৷’
গোপালবাবু হেসে বলেন, ‘আমি নই, সুন্দর তোমার সাবান, পাউডার মন্দিরা ৷’
মন্দিরা হাসতে হাসতে গোপালবাবুর গায়ে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হয় ৷ কিন্তু পড়ে না ৷ কাঁধ, বুক, পেট, থাইয়ের ছোঁয়া লাগে ৷ একটু নরম নরম, একটু পাপ পাপ, একটু শিরশিরানি ৷ গোপালবাবু ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন ৷ নারী শরীর বুঝি এরকম! তিনি সরে বসবেন ভাবেন ৷ সরেন না ৷ ঠিক করেন, পরেরদিন হাসির কোনও সিনেমা আনবেন ৷ মন্দিরা আবার হাসতে হাসতে গায়ে পড়বে ৷
এই যে বউকে বন্ধুর হাতে রেখে ঘন ঘন বাইরে চলে যাওয়া এটাও কি ভবেশ পোড়েল এক ধরনের বিশ্বাস থেকে করে না? অবশ্যই করে ৷ গোপালবাবু জানেন ৷ এর জন্য মাঝেমধ্যে বন্ধুর ওপর তার রাগও হয় ৷ তিনি মনে করেন, একে বলে গাধার বিশ্বাস ৷
নিতাই বলল, ‘কী হল? বললেন না, আপনার বন্ধু আপনাকে বিশ্বাস করে?’
গোপালবাবু মুখ নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, করে ৷ খুবই করে ৷ ভবেশকে কেন সরাতে চাইছি আপনি কি জানতে চান নিতাইবাবু?’
নিতাই মুখ দিয়ে চুকচুক ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘না ৷ তাতে কাজের কোনও হেরফের হয় না ৷ কারণ হাজারটা হতে পারে, কাজ একটাই ৷ ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুর বউকে নিয়ে ভাগতে চান সেই কারণে বন্ধুকে শেষ করতে চাইছেন ৷ অথবা ব্যবসা থেকে দীর্ঘদিন টাকা সরিয়ে এখন ভয় পেয়ে গেছেন ৷ বুঝতে পারছেন এবার পার্টনারকে ছিক করতে না পারলে বিপদ ৷ সে ধরে ফেলবে ৷’
কথাটা বলার সময় গলার কাছে হাত তুলে গলা কাটার ভঙ্গি করল নিতাই ৷ তারপর আবার শুরু করল ৷
‘কিছু মনে করবেন না গোপালবাবু ৷ কিছু না জেনে, দুটো কারণ বানিয়ে বললাম ৷ এরকম আরও হাজারটা কারণ বলতে পারি ৷ একে পুলিশের ভাষায় বলে মোটিফ ৷ কজ অব ক্রাইম ৷ আমাদের কজ জেনে লাভ নেই ৷ কারণ বানানো হোক, কল্পনা হোক, সত্যি হোক, কাজের কোনও তফাত হবে না ৷ গুলি চালালে গুলি, ছুরি চালালে ছুরি ৷ সুতরাং আমরা কখনোই কারণ জানতে চাই না ৷’
গোপালবাবুর চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ৷ তার বুকের ভেতরটা ধকধক করছে ৷ নিতাই কারণ জানল কী করে! মনের কথা পড়তে পারে নাকি লোকটা? হয়তো পারে ৷ এরা ভক্ত মানুষ ৷ ধন্মকম্ম করে ৷ কত রকম ক্ষমতা আছে কে জানে! একটা নয়, নিতাই যে দু-দুটো কারণ বলল, দুটোই ঠিক! তবে মন্দিরাকে নিয়ে পালানোর কোনও পরিকল্পনা নেই ৷ রয়ে সয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে ৷ পরিকল্পনার কথা মন্দিরা কিছু জানে না ৷ তাকে বলাও হয়নি ৷ স্বামীর মৃত্যুর পর বছরখানেক শোকের মধ্যে থাকুক ৷ তারপর ঝোপ বুঝে বললেই চলবে ৷ তাড়াহুড়ো করলে মন্দিরা সন্দেহ করবে ৷ তবে ঘটনার কয়েকমাস পরই ওকে ব্যবসায় পার্টনার করে নেওয়ার কথা ভাবা হয়ে গেছে ৷ ভবেশ পোড়েলের জায়গায় ৷ সহানুভূতি পার্টনার ৷ বাইরের লোক খুশি হবে ৷ বলবে, মানুষটা বন্ধুকে সত্যি ভালোবাসত ৷ চিন্তা একটাই ৷ মন্দিরা বিজনেসের কাজ কতটা পারবে? কেনই বা পারবে না? মেয়েরা আজকাল সব পারে ৷ তাছাড়া মন্দিরা বুদ্ধিমতী ৷ তার সবকাজেই ইন্টারেস্ট আছে ৷ ব্যবসাতেও আছে ৷ ইতিমধ্যেএকটু-আধটু জানতে শুরু করেছে ৷ লাভ কত? লোকসান কত? এইসব ৷
গোপালবাবু একদিন জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যবসার লাভ-লোকসানের খবর নিয়ে তোমার লাভ কী মন্দিরা?’
মন্দিরা দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে ৷ তার আড়মোড়া ভাঙা নিয়ে গোপালবাবুর আগে কখনও মাথা ব্যথা ছিল না ৷ আড়মোড়া ভাঙা কোনও মাথাব্যথার জিনিস নয় ৷ কেন জানি ইদানীং হয়েছে ৷ মন্দিরা দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলেই আড়চোখে দেখতে ইচ্ছে করে ৷
মন্দিরা বলল, ‘বাঃ, সতীন কেমন জানব না?’
গোপালবাবু বোকার মতো হেসে বললেন, ‘সতীন! সতীনটা আবার কে?’
‘আপনাদের ওই পোড়ার ছাই ব্যবসাই তো আমার সতীন ৷ যার জন্য স্বামী হারিয়ে বসে আছি ৷’
এই কথায় গোপালবাবু মজা পেয়েছিলেন ৷
নিতাই বলল, ‘নিন চা খান ৷’ গোপালবাবু চায়ের কাপ হাতে নিলেন, কিন্তু মুখে দিলেন না ৷ কয়েক মূহূর্ত চুপ করে থেকে নিতাই বলল, ‘এই কাজের খরচখরচা সম্পর্কে কিছু জানা আছে আপনার? কোনও আইডিয়া?’
গোপালবাবু দুপাশে আলতো মাথা নাড়লেন ৷ নিতাই বলল, ‘তা তো ঠিকই ৷ আইডিয়া হবে কী করে ৷ এ তো কাগজে, টিভিতে বিজ্ঞাপন হয় না ৷ যাক ওসব কথা ৷ আপনি জানাশোনা ধরে আমার কাছে এসেছেন ৷ সাধারণ জানাশোনা নয় ৷ হাই লেভেল জানাশোনা ৷ আগেই খরচাপাতির কথা আপনার জেনে রাখা ভালো ৷ দেখুন গোপালবাবু, এইসব কেসে খরচ অনেক ৷ যারা বলে আজকাল কম পয়সাতেই মানুষ মারা যায় তারা ফালতু কথা বলে ৷ ঠাকুরের কৃপায় সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল তো ঠিক আছে, গোলমাল কিছু হলে কিন্তু খরচ ডবল ৷’
গোপালবাবু বললেন, ‘গোলমাল মানে?’
নিতাই চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে বলল, ‘ধরুন, শিকারি ধরা পড়ে গেল ৷ তখন পুলিশ কান টানতে টানতে মাথা পর্যন্ত যাবে ৷ একসময় আপনাকে ধরেও ফেলবে ৷ সেই মামলা আপনাকে লড়তে হবে ৷ তার জন্য টাকা আলাদা করে রাখতে হবে ৷ আপনি তো তখন বলতে পারবেন না, নিতাইবাবু আমাকে আগে বলেনি, আমিও টাকা সরিয়ে রাখিনি৷ এখন আমার টাকা নেই, আমি মামলা লড়তে পারব না ৷ আমি জেলে পচে মরব ৷ কি পারবেন বলতে?’
গোপালবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ভয় দেখাচ্ছেন?’
নিতাই বলল, ‘হ্যাঁ ৷’
‘তাহলে কী করতে বলছেন ৷’
এবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন গোপালবাবু ৷ চা ঠান্ডা জল হয়ে গেছে ৷ সেই জলই গোপালবাবু খেতে লাগলেন ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে ৷ যেন খুব গরম ৷
নিতাই স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কাজটা নিজে করুন ৷’
হাত কেঁপে উঠল গোপালবাবুর ৷ চা চলকে পড়ল টেবিলে ৷ বললেন, ‘নিজে করব!’
নিতাই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, নিজে করবেন ৷ শিকার বিশ্বাস করলে এবং বোকা হলে কাজ অনেক সহজ ৷ জলের মতো ৷ খরচও বেঁচে যাবে ৷ সব থেকে বড় কথা কী জানেন গোপালবাবু?’
‘কী?’
নিতাই সামান্য হেসে বলল, ‘নিজে কাজ করলে ধরা পড়বার রিস্ক কমে যায় ৷ মাঝখানে কান থাকে না ৷ টান দিয়ে মাথা পাওয়া যাবে না ৷ তদন্তে নেমে পুলিশ জলে পড়ে ৷ একজনও সঙ্গে না থাকলে সব থেকে ভালো ৷ আপনি হাই লেভেলের চেনাজানা ধরে আমার কাছে এসেছেন ৷ তাই এত কথা বলছি ৷ ছোট লেভেলে চেনাজানা হলে বলতাম না ৷ নিজের ব্যবসা নষ্ট করতাম না ৷ দেখুন, দুদিন ভাবনাচিন্তা করুন ৷ যদি না পারেন, যদি সাহসে না কুলোয় আবার আমার কাছে আসবেন ৷ আমি তো রইলাম ৷ আর হ্যাঁ, আসার আগে নতুন কোডটা জেনে আসবেন ৷ মাপ করবেন, আজ আমায় উঠতে হবে ৷ আমার নামগানের সময় হয়ে গেল ৷’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আবার কোড লাগবে কেন? আমার মুখ তো চিনে রাখলেন ৷’
নিতাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাসল ৷ বলল, ‘মুখ এক থাকে, কিন্তু মানুষটা বদলে যায় ৷ সেই কারণে কোড লাগবে ৷’
দুদিন নয়, গোপালবাবু একদিন ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলেন, কাজ তিনি নিজে করবেন ৷ কিন্তু কীভাবে? গুলি করে মারবেন? কোথায় নিয়ে গিয়ে গুলি করবেন? ময়দানে? দূর এসব নাটক, সিনেমায় হয় ৷ আচ্ছা, মন্দিরাকে কাজে লাগালে কেমন হয়? ধরা যাক বিষের ব্যবস্থা করা হল ৷ ভবেশের খাবারে মন্দিরা মিশিয়ে দেবে ৷ না, এটাও গোলমালের ৷ মন্দিরা সাক্ষী থেকে যাবে ৷ তাছাড়া কথাটা মন্দিরা কীভাবে নেবে কে জানে! ‘গোপালদা’র সঙ্গে ফাঁকা বাড়িতে হালকা পলকা ঘনিষ্ঠতা আছে ঠিকই, কিন্তু ‘গোপালদা’ যে তার স্বামীকে সরিয়ে তাকে বিয়ে করে সংসার পাতবে এখবর তার জানা নেই৷ জানার পর যদি বেঁকে বসে ৷ যদি স্বামীকে বলে দেয়? থাক, মন্দিরা বাদ ৷ তাহলে কীভাবে?
‘কীভাবে’ নিয়ে বেশি ভাবতে হল না গোপালবাবুকে ৷ ভবেশ পোড়েল নিজেই পথ করে দিলেন ৷ এক বিকেলে অফিসে বসে বললেন, ‘গোপাল, এবার পাটনার ট্যুরটায় তুই আমার সঙ্গে যাবি ৷’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি ট্যুরে যাব! কেন?’
ভবেশ পোড়েল বললেন, ‘আমাদের যে অর্ডার দেয়, তার সঙ্গে আলাপ করবি ৷ ফেরার সময় রাঁচি হয়ে আসব ৷ সেখানেও আলাপ করিয়ে দেব ৷’
গোপালবাবু বললেন, ‘আমি আলাপ করে কী করব?’
‘শুধু পাটনার কোম্পানি নয়, এক-এক করে সবার সঙ্গেই তোর পরিচয় করিয়ে দেব ৷ শিলিগুড়ি, আসানসোল, গুয়াহাটি ৷’
গোপালবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো ভবেশ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ৷’
ভবেশ পোড়েল হেসে বললেন, ‘দুম করে যদি মরে যাই তখন কী হবে? কীভাবে ব্যবসা চলবে? তার আগেই তোর সঙ্গে পার্টিদের আলাপ করিয়ে দিতে চাইছি ৷’
গোপালবাবু চমকে উঠলেন ৷ ভবেশ মরার কথা বলছে কেন! কিছু বুঝতে পেরেছে? নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ছিঃ, এসব কী কথা ৷ খামোকা মরবি কেন?’
ভবেশ পোড়েল আরও জোরে হাসলেন ৷ বললেন, ‘বাঃ, দুম করে মরতে পারি না? হার্ট অ্যাটাক কি আর বলে কয়ে হয়? তারপর ধর যদি অ্যাক্সিডেন্ট ট্যাক্সিডেন্ট কিছু ঘটে ৷ সবসময়ই তো ট্রেনে যাতায়াত করছি ৷ কতদিন মাঝরাতে গার্ডকে ম্যানেজ করে লুকিয়ে লুকিয়ে চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে সিগারেট টানি ৷ হঠাৎ যদি পড়ে যাই ৷ হা হা… ৷’
গোপালবাবুর শরীর ঝিমঝিম করে উঠল ৷ তিনি মাথা নামালেন ৷ তার কি ভেতরে ভেতরে ঘাম হচ্ছে? চলন্ত ট্রেন থেকে পড়া… সত্যি যদি এমন ঘটে…যদি ফেলে দেওয়া হয় …সবাই বলবে অ্যাক্সিডেন্ট… ৷ মন্দিরা কী বলবে?
ভবেশ পোড়েল এগিয়ে এসে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলেন ৷ বললেন, ‘ঘাবড়ে গেলি নাকি?’
গোপালবাবু ঢোক গিলে বিড় বিড় করে বললেন, ‘এসব কী আজেবাজে বকছিস ভবেশ! মন্দিরা যদি শোনে?’
ভবেশ পোড়েল হেসে বললেন, ‘মন্দিরার জন্যই তো ভাবছি ৷ ভাবছি, এবার ক’টাদিন ট্যুর থেকে সরে অফিসে বসে কাজ করব ৷ বাড়িতে মন্দিরাকে টাইম দেব ৷ ঘোরাঘুরির কাজ তুই সামলাবি ৷ তুই বলেছিলি না?’
গোপালবাবু নিশ্চিন্ত হলেন ৷ চওড়া হেসে বললেন, ‘এ তো খুব ভালো কথা ৷ আগে:থেকেই তোর করা উচিত ছিল৷ কিছুদিন বাইরের কাজ তুই অফ কর ৷ আপাতত আমি করে দিচ্ছি পরে অন্য কাউকে শিখিয়ে নেওয়া যাবে ৷ আমাদের বিজনেসের তো এখন একটা গুড উইল তৈরি হয়ে গেছে ৷ পাটনার টিকিট কাট ৷ প্লেনে যাবি? চল প্লেনে যাই ৷ তাড়াতাড়ি হবে ৷’
ভবেশ পোড়েল নাক মুখ কুঁচকে বলল, ‘না, না, প্লেন-ফ্লেন নয়, ট্রেনে যাব ৷ এসি টু-টায়ারে দুজনে আড্ডা মারতে মারতে চলে যাব ৷’
দুই বন্ধুর ট্যুরের কথা শুনে মন্দিরা ঠোঁট ফোলাল ৷ গোপালবাবুর সামনেই আবদার ধরল, ‘আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব ৷’
ভবেশ পোড়েল রেগে গিয়ে বললেন, ‘পাগলামি কোরো না মন্দিরা ৷ আমারা বেড়াতে যাচ্ছি না ৷ কাজ করব ৷’
মন্দিরা বলল, ‘তোমরা কাজ করবে, আমি বেড়াব ৷’
ভবেশ পোড়েল আরও রেগে গেলেন ৷ বললেন, ‘বোকার মতো কথা বলছ কেন? পাটনা শহর বেড়ানোর মতো কিছু জায়গা নয় ৷ আমরা আগ্রা যচ্ছি না যে তুমি তাজমহলের সামনে গিয়ে বসে থাকবে ৷’
গোপালবাবু বানিয়ে হাসলেন ৷ বললেন, ‘আমরা তো দু-তিনদিনের মধ্যে চলে আসছি মন্দিরা ৷ তাছাড়া এরপর থেকে তুমি তোমার পতিঠাকুরকে সবসময় পাশে পাবে ৷ আমরা তার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি ৷ উনি আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেবেন ৷ আগে যখন বলেছিলাম তখন শোনেনি ৷ এখন বউয়ের জন্য মন কেমন করছে ৷’
গোপালবাবু বোকা বোকা রসিকতা করে হাসলেন ৷ মন্দিরা গজগজ করতে লাগল ৷ এই রসিকতা তার পছন্দ হয়নি ৷
দুই
রাত একটা বেজে দশ মিনিট ৷ দশ না, বারো মিনিট ৷ ট্রেন ছুটছে ৷ ছুটছে দিগবিদিগ জ্ঞান হারিয়ে ৷ দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজার সামনে ৷ দুজনের হাতেই সিগারেট ৷ হাওয়া ঢুকছে ঝড়ের মতো ৷ কাচের ঘেরাটোপের ওপাশে এসি কোচের যাত্রীরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে ৷ এমনকী কম্পার্টমেন্টের গার্ড পর্যন্ত ৷ ফলে তাকে আর আলাদা করে ম্যানেজ করতে হয়নি ৷ ভবেশ পোড়েলের পাঞ্জাবি উড়ছে ৷
‘মনে আছে গোপাল, কলেজ জীবনে কেমন লোকাল ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতাম?’
গোপালবাবু অন্যমনস্ক ৷ বললেন, ‘মনে আছে ৷ তখন এত রেসট্রিকশন ছিল না ৷ এখন কত নিয়ম কানুন ৷’
ভবেশ পোড়েল এক হাত দিয়ে দরজা ধরে আছেন ৷ মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে ৷ অন্ধকারের দিকে ৷ ট্রেনের সঙ্গে তার শরীরটা হালকা দুলছে ৷ সিগারেট ধরা হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করতে করতে বললেন, ‘রাখ তোর রেসট্রিকশন, মাঝরাতে ট্রেনের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার মতো আরাম আর কিছুতে নেই ৷ আমি তো প্রতিবারই নিয়ম ভাঙি ৷ একবার দু-হাজার টাকা ফাইন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল ৷ ট্যুর বন্ধ করলে এই একটা দুঃখ থাকবে ৷’ একটু থামলেন ভবেশ, ফের গলার স্বর বদলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে বললেন, ‘গোপাল, এইবার একটা ব্রিজ আসবে…দেখবি হাওয়াটা ঝট করে কেমন ঠান্ডা হয়ে যাবে… ৷ নদীর হাওয়া তো ৷ মিনিট দুয়েক অপেক্ষা কর ৷ শেষ টান দিয়ে ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দেব… ৷’
ঠিকই ৷ দু-মিনিট মধ্যে ঝোড়ো বাতাস ঠান্ডা করে নদীর ওপর ট্রেন উঠে পড়ল ৷ লোহা ইস্পাতের গমগম আওয়াজ ভেঙে ছুটতে লাগল স্পিড কমিয়ে ৷ অন্ধকারে একটার পর একটা বিম সরে যাচ্ছে নকশার মতো ৷ গোপালবাবু মনকে শক্ত করলেন ৷ মনে মনে দ্রুত হিসেব কষে নিলেন ৷ একটা বিমের পর অন্যটা আসছে সেকেন্ডেরও কম ব্যবধানে৷ এর অর্থ, একটা বিম লক্ষ্য করে কাজটা করতে হবে ৷ তবেই পরেরটায় গিয়ে ধাক্কা লাগবে ৷ ভালো হয় সরাসরি মাথাটা লাগলে ৷ মুখ থেঁতলানো, ছিন্নভিন্ন বডি উদ্ধারের পরও চেনা যাবে না ৷ বেশিরভাগ সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে চালান হয়ে যায় ৷ এই দেশে ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা রোজ বিশটা করে ঘটছে ৷ তার বেশিও হতে পারে ৷ কেউ খবর রাখে না ৷ এখানে অবশ্য খবর রাখতে হবে ৷ মন্দিরাকে এনে রেল পুলিশের মর্গে বডি আইডেনটিফাই করতে হবে ৷ সরকারি খাতায় মৃত ঘোষণা না হলে পরে বিয়েতে ফ্যাকড়া হবে ৷
সিগারেটে শেষ অংশ ঘন ঘন টান দিতে লাগলেন গোপালবাবু ৷ কাজ হয়ে গেলে কি মন্দিরাকে একটা ফোন করা যাবে?
‘মন্দিরা, আমি গোপালদা বলছি ৷ ঘুমোচ্ছিলে? শোনো একটা খারাপ খবর আছে ৷ মন শক্ত করো…খানিক আগে চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে ভবেশ সিগারেট খাচ্ছিল…ও নাকি প্রায়ই এই ছেলেমানুষিটা করত…মন শক্ত করো মন্দিরা…আমি তো আছি… ৷’
ভবেশ পোড়েল খোলা দরজার দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন, ‘ওই যে নদী, দেখ দেখ, ওই যে… ৷’
এক হাতে দরজার শিক ধরে এক পা এগোলেন গোপালবাবু ৷
আওয়াজ হল ৷ ভারী কোনও জিনিস ছিটকে পড়লে যেমন হয় ৷ তবে ব্রিজের গমগম আওয়াজের তলায় সেই চাপা আওয়াজ চাপাও পড়ল খুব সহজে ৷
শান্তভাবে লোহার ভারী দরজাটা আটকালেন ভবেশ পোড়েল ৷ লক তুললেন ৷ ছিটকিনি লাগালেন ৷ রুমাল বের করে হাত মুছলেন ৷ তারপর মোবাইলের নম্বর টিপলেন ৷
‘হ্যালো, মন্দিরা? ঘুমিয়ে পড়োনি তো? হ্যাঁ, কাজ হয়ে গেছে ৷’
খগনিশা – নির্বেদ রায়
‘না না ওটা তোমরাই খাও, আমি ও জিনিস ছুঁই না।’ সোমেশ্বরের এগিয়ে দেওয়া ধোঁয়া-ওঠা মুরগির রোস্টের প্লেটটাকে সাত তাড়াতাড়ি তর্জনী, মধ্যমা আর অনামিকার আঙুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন কুমার সাহেব। গোটা মুখ যেন একমুহূর্তে ছাই-এর মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
খাইয়ে হিসাবে কলকাতার রসিক সমাজে কুমার সাহেবের একটা বেশ চওড়া গোছের নাম-ডাক আছে। আর সেই নাম-ডাক দিনে-দিনে ক্রমশ বৃদ্ধিও পাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ হল ভদ্রলোক শুধু নিজে খেতে নয়, অপরকে খাওয়াতেও ভালোবাসেন। তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে খাদ্যরসিক মানুষ মাত্রেই কিছু-না-কিছু চমকের জন্য তৈরি হয়েই যান। বলা তো যায় না, কখন কী আসে? হয়তো প্রথম পাতে চীনে পুডিং কি শেষ পাতে ফরাসি শুক্তো। সুতরাং, এ হেন খাবার-দাবারের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়াটি সামনে থেকে গন্ধে-তর-করে দেওয়া একনম্বর কন্টিনেন্টাল ডিশ তিন আঙুলে সরিয়ে দিয়ে শেষ পাতের পায়েসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, এটা চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন।
‘কেন, শরীর খারাপ করল নাকি কুমার সাহেব?’ বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটুকু সামলে নিয়ে শুধোল সোমেশ্বর।
‘না না শরীর খারাপ করবে কেন, আমি ঠিক আছি।’ বলতে বলতে প্লেটের পায়েসটা বেশ কিছুটা বাকি থাকতেই উঠে পড়লেন কুমার সাহেব।
অদ্ভুত ব্যাপার। কী কারণ থাকতে পারে এই আতঙ্কের? তিনজনে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম, কিন্তু তিনজনের চোখের দৃষ্টিই ফাঁকা। কেউই কিছু আন্দাজ করতে পারিনি এটা পরিষ্কার। এরপর খাওয়াটা যে একেবারেই দায়সারা গোছের ব্যাপার হল সেটা বলাই বাহুল্য। অথচ আজকের এই রাতের পাতটা বেশ ভালোরকম জমাবার কথা ছিল।
.
কলেজে গরমের ছুটি পড়ে যাওয়ার পর ওয়াই এম সি এ-র বিলিয়ার্ড রুমে খাওয়া-দাওয়া সেরে দুপুর দুটোর মধ্যে গিয়ে হাজির হতাম। আড়াইটের মধ্যেই একে একে সব এসে যেত— আড্ডাটা বেশ জমে উঠত, চলত সেই রাত আটটা পর্যন্ত। তার মধ্যে সোমেশ্বর, অশোক আর আমি, এই তিনজনের একটা আলাদা ছোট জগৎ ছিল। তার কারণ তিনজনই এক কলেজের ছাত্র, তিনজনেই খেলাধুলায় একটু-আধটু নাম করেছি, আর তিনজনেই সেই দক্ষিণ কলকাতা থেকে আসি। কুমার সাহেবের সঙ্গে আমাদের মধ্যে প্রথম আলাপ হয় সোমেশ্বরের বিলিয়ার্ড টেবিলে। তার আগে অবশ্য আমরা ওঁকে নামে চিনতাম।
যদিও সেটা এমন কিছু বড় কথা নয়। কারণ কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরিকে শহর কলকাতার অনেকেই নামে চেনে। বাবু গৌরবের কলকাতায় অধিকাংশ বাঙালি জমিদার যখন বুলবুলির লড়াইয়ে বাজি ধরে, বেড়ালের বিয়েতে লাখ-টাকা খরচা করে কি হাজার টাকার নোট বেঁধে ঘুড়ি উড়িয়ে এই গাঙ্গেয় সমভূমির পুঁজির সঞ্চয় দ্রুত সংক্ষিপ্ত করে আনছেন; তখন ভবিষ্যৎ বংশধরদের সর্বনাশের ছবিটা যে ক’জন সামান্য সংখ্যক ভৌমিক কল্পনা করতে পেরেছিলেন দীপেন্দ্রনারায়ণের পিতামহ দীনেন্দ্রনারায়ণ তাঁদের মধ্যে একজন। ফলে ওই বিরাট সম্পত্তি তিনি দেবত্র করে দিয়েছিলেন, যাতে কোনোদিন আর কোনো বংশধরকে অনাহারে কষ্ট পেতে না হয়, অন্যথায় উচ্ছৃঙ্খল হতে না পারে।
কিন্তু দীপেন্দ্রনারায়ণের শিরায়-ধমনীতে যে রক্তের ধারা বইত তার টান ছিল কিছু বেশি, ফলে দাদুর করে যাওয়া ব্যবস্থার জন্যেই হোক অথবা নিজের শিক্ষা-দীক্ষার জন্যই হোক সেই উষ্ণ স্রোত উচ্ছৃঙ্খলতার খাতে বইতে না পেরে, যে ক’টি রুচিশীল আর সম্ভ্রান্ত বিলাসের ফাঁকফোকর ভেদ করে বেরিয়েছিল সেসব ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মিলত প্রচুর। বিলিয়ার্ডের টেবিলেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সোমেশ্বর আমাদের ব্রাঞ্চ চ্যাম্পিয়ন হয়েও মোটামুটি তাকে দর্শক সেজে যেতে হয়েছিল। কুমার সাহেবের ‘কিউ’ জাদু লাঠির মতো সবুজ গালচে পাতা টেবিলের উপর বল তিনটেকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছিল। হেরে যাবার পর সোমেশ্বর বলেছিল ‘কুমার সাহেব, আপনার কাছে হেরেছি বলে তো লজ্জা নয়, লজ্জা এইটাই যে উইলসন জোনস কি মাইকেল ফেরেরার মতো ভারতবর্ষ অন্তত আরও একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তাঁকে চিনতে পারলাম না।’
উত্তরে ঘর কাঁপিয়ে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলেন কুমার সাহেব, তারপর সোমেশ্বরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্রাভো ইয়ংম্যান।’ মোদ্দা কথাটা কী জানো? সেন্স! যে- কোনো খেলায় একবার যদি তোমার এই সেন্স-টা ডেভেলপ করে যায় তাহলে দেখবে যে-কোনো বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে তোমার পার্থক্য হচ্ছে শুধু প্র্যাকটিসের।’
এইভাবেই কুমার সাহেবের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়, কিন্তু সে পরিচয় হৃদ্যতায় গিয়ে ঠেকেছিল মাত্র মাস-দুয়েকের মধ্যেই। এর জন্যে কাউকে দায়ী করতে গেলে পুরোপুরি দায়ী করতে হয় কুমার সাহেবকে। বয়সের হিসাবে প্রৌঢ় প্রায় ষাটের কোঠা ছুঁই-ছুঁই। কিন্তু সে- বয়স তাঁর শরীরের কোথাও এতটুকু ছাপ ফেলতে পারেনি। টকটকে গৌরবর্ণ, ছ-ফুট মাপের বেতের মতো টানটান শরীরে জীবনীশক্তির অফুরন্ত প্রাচুর্য। আর সেই দুরন্ত জীবনীশক্তির প্রকাশ তাঁর দুটি চোখে। আয়ত, গভীর অথচ উজ্জ্বল দুটি চোখ। কথা বলেন পরিষ্কার উচ্চারণে, সংযত আভিজাত্যের ছাপ রেখে, অথচ হাসিটি একেবারে প্রাণখোলা; সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।
আলাপ হওয়ার পর একদিন বাড়ি নিয়ে গেলেন। ঘুরে ঘুরে দেখালেন, ‘এইগুলো গ্রিক অ্যাস্টিক— এটা ডায়ানা, এটা ডেভিড, এটা অ্যাপোলো…এইগুলো আমার শিকারিজীবনের স্মৃতি— গৌরবের মাথা, ওই মোষগুলোকে ‘ওয়াটার বাফেলো’ বলে, এটা সম্বরের শিং আর চিতা-বাঘের যে খড়পোরা মূর্তিটা দেখছ ওটাকে মেরেছিলাম হরিদ্বারের কাছে এক জায়গায়… চলো এবার আর্ট গ্যালরিটা দেখিয়ে আনি।’
এ তো গেল গরমের ছুটির কথা। তার তিনমাস বাদেই পুজোর ছুটিতে এলাম রূপনারায়ণ— কুমার সাহেবের আমন্ত্রণে তাঁর বাংলোয়। নদীর পাড় থেকেই ঝাউয়ের সারি উঠে এসেছে বাংলোর বারান্দা অবধি, মাঝখানে নুড়ি-বিছানো কুঞ্জপথ। সেই পথের দুপাশে ফুলের বাগান। চার কামরার ছোটখাটো ছিমছাম বাংলো। ডানদিকে খানিকটা দূরে জেলেপাড়া, একটা বড় খাটাল-ও রয়েছে কোনো সম্পন্ন মহাজনের। গোটা পনেরো-কুড়ি গরু-মোষ। খোলামেলা সামার হাউস গোছের ব্যবস্থা, ঘেরা পাঁচিলের ব্যাপার নেই।
এখানে এসে প্রথম দু’ দিন খাওয়া-ঘুম আর গল্প করেই কেটে গেল। গল্প বলে মানুষকে জমিয়ে রাখার ক্ষমতা আমাদের গৃহস্বামীটির অসাধারণ, আর অফুরন্ত তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি, বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর। তার মধ্যেই মাঝে-মাঝে সকালবেলার দিকটায় একটু কাছাকাছি অঞ্চলটায় ঘুরতে বেরোতাম! কিন্তু তিন দিনের দিন রাতে খাবার টেবিলে আশাতীতভাবে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা আমাদের এই বর্তমান জীবনধারার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। রীতিমতো ধাক্কা।
রোজকারের মতো সেদিনও বিকেলবেলা সরকার মশাই এসেছিলেন রাতের ‘মেনু’ জানতে। গৃহকর্তারই নির্দেশ। তাই গত দু’দিন ধরে নদীর টাটকা মাছে যে স্বাদটুকু আমাদের জিভে লেগে আছে তারই মাঝে একটু বৈচিত্র আনতে অশোকের ফরমাশ ছিল মুরগির। বলা বাহুল্য দু’দিন আগেও যে কিঞ্চিৎ লোকলজ্জাটুকু আমাদের ছিল সেটা এর মধ্যেই অন্তর্হিত হয়েছে। সরকারমশাই বোধ হয় একটু আমতা আমতা করে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে অশোক পাকা ভোজনরসিকের মতো বললে, ‘তবে দিশি মুরগি, ব্রয়লার বা লেগহর্ন যেন না হয় একটু দেখবেন।’
কথা শেষ করে অশোক আর দাঁড়াল না। চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে বলল ‘চল চল, নদীর পাড়ে সান সেট দেখে আসি…’
আসলে সরকারমশাই-এর পিছনে লাগার জন্য একটু নির্দোষ ডেঁপোমিমাত্র, কিন্তু সেই মুরগি নিয়েই ঘটল অনর্থ—
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে তিনজনেই এসে বারান্দায় বসলাম, কারও মুখেই কোনো কথা নেই। অন্ধকার বারান্দা— কিছুটা দূরেই রূপনারায়ণ বয়ে চলেছে অস্পষ্ট ছল-ছল আওয়াজ তুলে। কয়েকটা জেলেডিঙি পাড়ের উপর শোয়ানো। পাড়ের উপরেই একটা চায়ের দোকান, দোকান না বলে ঝুপড়িই বলা উচিত, সেখান থেকে কেরোসিনের একটা টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। পাশের গোয়াল থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ— টুং-টাং। পরিবেশটা ভারী শান্ত, সুন্দর, কিন্তু মনটা অস্বস্তিতে ভরে আছে, কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। একটু দূরে বারান্দার কোণে ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে পাইপ টানছেন কুমার সাহেব। ‘বলকান সভরেনি’র মিষ্টি গন্ধ হাওয়া ভারী করে তুলেছে।
নিস্তব্ধ বেশ কয়েকটা মুহূর্ত— কেটে যাওয়ার পর প্রথম কথা বললেন কুমার সাহেব, তা-ও যেন অনেকদূর থেকে ভেসে এল।
‘বুঝতে পারছি তোমাদের খুবই খারাপ লাগছে, অস্বস্তি বোধ করছ, ঠিক এইভাবে তোমাদের ”ডিসটার্ব” করতে আমি একেবারেই চাইনি কিন্তু…’ একটু থামলেন কুমার সাহেব কিন্তু খাবারের ওই প্রিপারেশনটা যেন আমাকে একটা ধাক্কা মারল, আমি কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আসলে একটা ঘটনা…’ কথার মাঝে চমকে গেলেন তিনি। আবার বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর শুরু করলেন আবার:
‘তোমাদের আজ বলতে কোনো বাধা নেই, তবে এই ঘটনার কথা আর কাউকে বলিনি, প্রয়োজনও হয়নি বলার—
সনটা বোধহয় ১৯৪১—
পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ তখনও ছড়িয়ে পড়েনি। বন্ধু সতীশচন্দ্রের সঙ্গে বেড়াতে গেছিলাম পূর্ববাংলার বাখরগঞ্জে। সতীশচন্দ্ররা উত্তর শাহাবাজপুরের সম্পন্ন জমিদার। বাংলার দ্বিতীয় স্বদেশি ডাকাতি ওদের বাড়িতেই হয়েছিল। সোনাদানাসুদ্ধু যা মালপত্র স্বদেশি বিপ্লবীরা নিয়ে গিয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবেই প্রায় আশি হাজার টাকার মতো দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ অবশ্য এই ডাকাতির নেতা হিসাবে সতীশচন্দ্রের বড় ভগ্নিপতিকে সন্দেহ করেছিল। এই মানুষটি তখন কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু সতীশের বাবা দুর্গাপ্রসাদ-ই পুলিশের সে সন্দেহ উড়িয়ে দেন, উল্টে তাদের এই ব্যাপারে আর কোনোরকম খানাতল্লাশি করতে বারণ করে দেন। পুলিশ নিতান্ত অমূলক সন্দেহ করেছিল এমন মনে হয় না। যা হোক, এই ডাকাতির জের সামলাতে দুর্গাপ্রসাদের যে বিশেষ কষ্ট হয়নি তার প্রমাণ হিসাবে তিনি তার পরের বছরেই পর পর দুটি মেয়ের বিয়ে দিলেন চূড়ান্ত রকমের ধূমধাম করে, গ্রাম খাইয়ে। সতীশ কলকাতার হিন্দু হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করত। সেই সূত্রেই তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।
কলকাতার বনেদি ঘরের ছেলে বলে নদীমাতৃক পূববাংলা সম্বন্ধে আমার আগ্রহ ছিল যেমন প্রচুর, তেমনি অভিজ্ঞতা ছিল ততই কম। পৌঁছে বুঝলাম, এসে ঠকিনি। মোহানার কাছে পদ্মা-মেঘনার সে রূপ যারা দেখেনি তাদের বলে বোঝাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
সতীশের বাবার সঙ্গে পরিচয় হল। আমি জীবনে এত ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ খুব কমই দেখেছি, সেইসঙ্গে— একটা অদ্ভুত প্রশান্ত চেহারা। শহরের শিক্ষা যে অনেকদিন আগেই এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম গেট পেরিয়ে ঢোকামাত্র। নাটমন্দিরের সংলগ্ন থিয়েটারের স্টেজ— ম্যারাপ বেঁধে তৈরি নয়, রীতিমতো শানবাঁধানো।
সাত-আটটা দিন ঝড়ের মতো কোথা দিয়ে কেটে গেল টেরই পেলাম না। বিকেলবেলা মাঝেমধ্যেই নদীর চরে শিকারে বেরোতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় শিকার ছিল বালিহাঁস, আর বালিহাঁসের মাংসের কাছে মুরগি কোথায় লাগে? সেই শিকারে বেরিয়েই আরেকটা শিক্ষা পেলাম। বন্দুকের নিশানা নিয়ে আমার একটু-আধটু গর্ব ছিল। আর সেটা যে নেহাত অমূলক ছিল না তার প্রমাণ তোমরা কিছু কিছু আমার বাড়িতেই দেখেছ, কিন্তু সে নিশানা যে সমুদ্রের কাছে ডোবামাত্র সেটা সতীশের সঙ্গে না বেরোলে বুঝতে পারতাম না। ইংরাজিতে ‘স্ন্যাপ-শট’ বলতে ঠিক যে-কথাটা বোঝায় সতীশ ছিল তার সার্থকতম উদাহরণ। ডোবা কিংবা জলার মধ্যে থেকে কিংবা ঝোপের মাথায় হাঁস-বক যা-হোক একটা কিছু উড়লেই হল— যে-কোনো দিকে হোক, যতটুকু অল্প সময়ের জন্য হোক বন্দুকের আওতার মধ্যে থাকলে সতীশ আর নিশানা করত না। কোমরের কাছে ধরা বন্দুকটা মুহূর্তের মধ্যে সেদিকে ঘুরিয়ে ট্রিগার টিপত, একটা ধাতব আওয়াজ, কিছু ধোঁয়া, একঝলক আগুন আর সেইসঙ্গে শিকার লুটিয়ে পড়ত মাটিতে। এই ধরনের স্ন্যাপ শুটিং-এর ব্যাপারটা ঠিক অভ্যাস করে আয়ত্ত করা যায় না, ওটা জন্মগত।
শিকার করে একদিন বাড়ি ফিরছি দুজনে; সতীশ বলল, ‘এ ক’টা দিন তো শুধু শিকার করেই কাটালে, দেখার জিনিস তো কিছুই দেখলে না, চলো, কাল এক জায়গায় নিয়ে যাব…’
—’কোথায়’?
—’রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের প্রাসাদে।
—’রাজা লক্ষ্মণমাণিক্য, মানে সেই বারো ভুইঞার লক্ষ্মণমাণিক্য, সে তো ষোড়শ শতাব্দীর ব্যাপার।’
—’হ্যাঁ, এখন অবশ্য নামেই প্রাসাদ, আসলে একটা ভাঙা-চোরা প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি। বংশধররা অন্য জায়গায় থাকেন। কিন্তু তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবার কারণ পোড়োবাড়ি দেখাতে নয়, ‘সাজাকুঠরি’ দেখাতে।
—’সাজা-কুঠরি! মানে?’
—’মধ্যযুগীয় বাংলার অধিকাংশ জমিদাররাই যে দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলেন একথাটা তোমাকে নিশ্চয়ই বলে বোঝাবার দরকার নেই, এমনকী তারা ডাকাতিও করতেন বেনামে। আর বারো ভুইঁঞাদের যে ছিপ নৌকার সারি পদ্মা-মেঘনা-ভৈরবের বুকে দুরন্ত গতিতে টহল মারত সে শুধু সীমান্ত পাহারা দেবার জন্য নয়। তাছাড়া তখন চরের বুকে, গঞ্জের ধারে যে-সব প্রজারা বাস করত তাদের মধ্যে অনেকে জমিদারের লেঠেলকে রেয়াত করত না। খাজনা চাইতে এলে উত্তর দিত লাঠি-সড়কির মুখে। তাই এতসব দিক বজায় রেখে জমিদারি টেঁকাবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ওই ‘সাজা-কুঠরি’, আর সেই কুঠরিতে লক্ষ্মণমাণিক্য আমদানি করেছিলেন বিচিত্র সব শাস্তি দেওয়ার প্রথাপদ্ধতির। তার মধ্যে বাঁশ-ডলা থেকে শুরু করে ইংরাজি ‘এক্স’ অক্ষরের মতো দুটো আড়াআড়ি কাঠে অপরাধীকে বেঁধে চাবুক মারার ব্যবস্থা তো ছিলই, কিন্তু এগুলো নিতান্তই সাবেকি। আশ্চর্য হচ্ছে ‘লৌহভীম।’
—’লৌহভীম মানে সেই মহাভারতের লৌহভীম, যেটা কিনা ধৃতরাষ্ট্র চূর্ণ করেছিল।’
—’না বন্ধু, এ ভীম একেবারেই ভারতীয় নয়, খাস পর্তুগীজ।’
‘পর্তুগীজ!’ বেশ কিছুটা অবাক হলাম আমি, ‘পর্তুগীজ ভীম মানে?’
উত্তরে মৃদু হাসল সতীশ, ‘লক্ষ্মণমাণিক্য ছিলেন ভুলুয়ার রাজা আর তখন ভুলুয়ায় পর্তুগীজদের অবাধ যাতায়াত! সুপুরি, মশলা এইসব কিনে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করত তারা। হুগলি আর সপ্তগ্রামে ছিল তাদের মূল কুঠি। পরে শাজাহান তার সেনাপতি কাসেম খাঁ-কে পাঠিয়ে সেটি ভেঙে দেন। কিন্তু তার আগে এই পর্তুগীজ বণিকদের সঙ্গে লক্ষ্মণমাণিক্যের লেনদেন ছিল বলেই মনে হয়। তাদের কাছ থেকেই ওই লৌহ ভীম জোগাড় করেন তিনি। যন্ত্রটার আসল নাম ‘আয়রন ভার্জিন’, বাংলায় ‘লৌহ কুমারী’ বললেই বোধ হয় ঠিক হয়, কিন্তু লক্ষ্মণমাণিক্যের যন্ত্রটায় মেয়ের আদলের চেয়ে পুরুষের আদলটাই বেশি, তাই ওই নাম। কিন্তু আদলটা বড় কথা নয়…বলতে বলতে থেমে গেল সতীশ।
ততক্ষণে আমরা প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি; সূর্য অনেকক্ষণ ডুবে গেলেও সন্ধের অন্ধকারটা তখনও একটু ফিকে হয়ে আছে। মাথার উপর দিয়ে একটা ছায়া দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল, চকিতে সেদিকে বন্দুক তুলেই সতীশ গুলি চালাল। নিস্তব্ধ মাঠের উপর গুলির আওয়াজটা প্রচণ্ড শোনাল, আর উড়ে যাওয়া ছায়া মূর্তিটা আকাশে গোটা দুই চক্কর খেয়ে ছিটকে এসে পড়ল খানিকটা দূরের মাটির উপর। অসাধারণ টিপ!
‘কী মারলে ওটা!’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘জানি না, চলো গিয়ে দেখি, টিয়াগোছের কোনো কিছু হবে বোধহয়! আজ দুটো শট মিস করেছিলাম, তাই একটু প্র্যাকটিস করে নিলাম। মন্দ হয়নি, কী বলো?’
এগিয়ে গিয়ে দেখলাম টিয়া নয়, একটা পেঁচা। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। গুলিটা ঠিক পেটের কাছে লেগেছে।
‘খেটে-খুটে একটা হাত বাগিয়েছ বটে।’ না বলে আর পারলাম না, ‘কিন্তু তাই দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা পেঁচা…’
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ন আওয়াজে মাথা তুললাম। আমাদের মাথার উপরে আরেকটা ছায়া চক্কর মারছে। সতীশ আবার বন্দুক তুলল বটে কিন্তু তার আগেই পাখিটা বিপদ বুঝে পালিয়েছে। ‘জোড়ার মদ্দাটা’, বলল সতীশ।
ততক্ষণে বাড়ির সদরে আলো হাতে লোকজন বেরিয়ে এসেছে গুলির আওয়াজ পেয়ে। দূর থেকে আমরা সাড়া দিলাম।
সেদিন ঘুমোবার আগে পর্যন্ত লক্ষ্মণমাণিক্যের ইতিহাস শুনে কাটল।
.
পরদিন বিকেলের জলযোগ সেরে বেরোলাম প্রাসাদ দেখতে। নেহাত কম দূর নয়, হাঁটাপথে প্রায় ঘণ্টা-খানেকের পথ। অবশ্য সতীশের দোষ নেই, ও গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল, আমিই বারণ করেছি। এখানে না হাঁটলে আর হাঁটব কোথায়।
প্রাসাদের কাছে যখন এসে পৌঁছলাম তখন সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। এক সময়ের প্রকাণ্ড চক-জিলানো বাড়ির কঙ্কালটাই শুধু পড়ে রয়েছে। বিরাট, বিরাট ঘর, থাম, দালান মিলিয়ে সে এক এলাহি ব্যাপার। তবে পোড়োবাড়ি একটু বেশি ফাঁকা-ফাঁকা আর প্রকাণ্ড মনে হয়। লোকজন থাকলে অতটা মনে হয় না। লক্ষ্মণমাণিক্যের রাজধানী এখানে ছিল না, তবে এই প্রাসাদে তিনি প্রায়ই এসে থাকতেন।
এখন মাঝে মধ্যে দু-চার জন লোক দেখতে আসে। সেই সুবাদে বাড়িটা সাপ-খোপের আড্ডা হয়ে পড়েনি।
‘যজ্ঞেশ্বর, যা তো ক’টা মশাল জোগাড় করে নিয়ে আয় দেখি।’ সঙ্গের লোকটিকে বলল সতীশ।
‘দেখছি বাবু।’ সে চলে গেল।
‘কিন্তু এখানে মশালের কী দরকার, টর্চ তো সঙ্গেই আছে।’ বললাম আমি।
‘আরে মশাল মানে গাছের ডালের মাথায় জড়ানো তেল ভেজানো ন্যাকড়া। তার দরকার আছে, আনলেই বুঝবে।’
আমার হাতে বন্দুকটা দিয়ে সামনের একটা গাছ থেকে দুটো হাত দুয়েক করে লম্বা ডাল ভেঙে নিল সতীশ। আজ একটাই বন্দুক সঙ্গে করে এনেছিলাম, রোজ বিকেলের অভ্যাস।
‘নাও এটা ধরো, বলা তো যায় না সাপ-খোপের ব্যাপার,’ আমার হাতে একটা ডাল দিয়ে বলল সতীশ।
যজ্ঞেশ্বর মশাল নিয়ে হাজির হতে বেশি দেরি করেনি। প্রাসাদে যখন ঢুকলাম সন্ধেটা তখন উতরে গেছে। প্রাসাদ দেখার কিছু নেই। কয়েকটা খিলান, দেউড়ি পার হয়ে শেষে একটা সিঁড়ির তলায় এসে থামল সতীশ। তারপর যজ্ঞেশ্বরের হাত থেকে মশাল নিয়ে দেশলাই মেরে জ্বালাল। প্রাসাদের ভিতরে তখন অন্ধকার, টর্চ জ্বেলেই একরকম পুরো পথটা চলতে হচ্ছিল। তার মধ্যে মশালের আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল একটা ভারী কাঠের তৈরি দরজা, দরজার সর্বাঙ্গে লোহার গজাল পোঁতা।
শিকল খুলে জোরে ঠেলা দিল সতীশ। ক্যাঁচ করে ভারী দরজাটা হাট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভ্যাপসা পুরনো লোহার গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মারল।
সিঁড়ির নীচে চোরকুঠরি। এই তাহলে ‘সাজা ঘর’।
মশালটাকে প্রথমে সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল সতীশ, তারপর আস্তে আস্তে উপর থেকে নীচে অবধি নামিয়ে আনল। এতক্ষণে মশালের দরকারটা বুঝলাম। ঘরে কতটা অক্সিজেন আছে সেটা দেখে নেওয়া অবশ্য ঠিকই। কতদিন যে এ ঘর এভাবে বন্ধ পড়ে আছে কে জানে!
সতীশকে অনুসরণ করে প্রায় গোটা দশেক সিঁড়ি নীচে নেমে তারপর ঘরটায় ঢুকলাম। প্রকাণ্ড ঘর, ঠান্ডা আর ভ্যাপসা গন্ধে-ভরা, সেটা বোধহয় মাটির নীচের ঘর বলেই। ঘরের এককোণে মশালটাকে গুঁজে দিয়ে সতীশ এগিয়ে এল, ‘এটাই সেই ”সাজা-কুঠরি”, ষোড়শ শতকের রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের শাস্তি দেওয়ার ঘর। লোকের ধারণা এ ঘর অভিশপ্ত। অবশ্য নেহাত উড়িয়ে দেওয়ার মতো ধারণা নয় কারণ বহু পাপ জমা হয়ে আছে এই ঘরে। কিন্তু সেকথা নয়, তোমাকে যেটা দেখাতে এনেছি তা হল এ ঘরের অভিনবত্ব। ওটা হল বাঁশডলার ব্যবস্থা— বুকে কি পিঠে বাঁশ দিয়ে জোয়ান লাঠিয়ালরা দু-তিনজনে মিলে ডলা দিত। বাঁশগুলো এখনও লোহার চেয়ে শক্ত রযেছে, তবে এ হল সাবেকি ব্যবস্থা। এদিকে ”ঐ ক্রুশ-কাঠ।” লোহাকাঠ দিয়ে তৈরি, কিন্তু এসব নয়, আসল ব্যাপারটা আছে ওইখানে, সেই লৌহভীম!’
প্রকাণ্ড ঘরটাকে মশাল বা টর্চের আলো কোনোটাই পুরোপুরি আলোকিত করতে পারেনি, তবে তার মধ্যেই চারদিক জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাঠ আর লোহার ফ্রেম, কপিকল, দড়ি, বাঁশ, সড়কি, বিভিন্ন সব যন্ত্র। সবগুলোই কেমন নিষ্ঠুর, স্থূল কলকব্জা দিয়ে তৈরি। লোহার জিনিসগুলোয় তিনশো বছরের মরচে পড়েছে, ফলে সেগুলোকে আরও রুক্ষ, আরও ভয়ংকর মনে হয়। কাল রাতে সতীশের কাছে শোনা গল্পগুলোর কথা মনে পড়ছিল আর মনে হচ্ছিল সত্যিই যেন মধ্যযুগে ফিরে গেছি। একটা বিশ্রী গা ছমছমে, ভারী হয়ে-আসা পরিবেশ!
টর্চের আলোটা সতীশের কথা অনুযায়ী বাঁ-দিকের দেওয়ালে ফেললাম। সেখানে দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আট ফুট উঁচু একটা প্রকাণ্ড লোহার তৈরি মানুষ। তবে নামেই মানুষ, মুখ-চোখ-নাকে একটা পুরুষের আদল আছে মাত্র, নিখুঁত কাজ একেবারেই নয়। তার পেটের কাছে একটা প্রকাণ্ড আংটা লাগানো আর সেই আংটা জড়িয়ে একগাছা মোটা পাটের দড়ি কিছুটা উঁচুতে উঠে ছাদ থেকে ঝোলানো কপিকলের মধ্যে দিয়ে পাক খেয়ে নেমে এসেছে জমির কাছাকাছি। দেখেই বোঝা যায়, অত্যন্ত ভারী একটা মূর্তি, নিরেট লোহার কিন্তু এ বস্তু দিয়ে কোন কাজ সে আমার মাথায় ঢুকল না। সতীশ বোধহয় আমার ধারণাটা বুঝেছিল, তাই বলল, ‘মূর্তিটার স্বরূপ বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছ না, দাঁড়াও এখনি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। যজ্ঞেশ্বর, দড়িটা ধরে জোরে টান তো।
যজ্ঞেশ্বর মানুষটা শক্তি ধরে। সে দড়িটা ধরে টানতে এবার একটু অবাক হলাম। মূর্তিটা নিরেট নয়, ভেতরে ফাঁপা। দুটো ডালার মতো কব্জা দিয়ে আটকানো। দড়ির টানে ট্রাঙ্কের মতো তার সামনের পাল্লাটা ফাঁক হয়ে গেল। ‘এবার এদিকে এসো, আসল মজাটা দেখবে’, সতীশ ততক্ষণে ফাঁক করা ডালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমাকে সেখানেই ডাকল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে যে ব্যাপারটা দেখলাম সেটা মোটেই মজার ব্যাপার নয়। সামনের ডালাটার ভেতর দিকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত প্রায় গোটা পঞ্চাশ বিরাট বিরাট লোহার গজাল বেরিয়ে এসেছে। ‘এইবার বুঝলে তো ব্যাপারখানা,’ সতীশ যেন বেশ মজা পেল, ‘এই নীচের ডালাটার মধ্যে মানুষটাকে হাত-পা বেঁধে ঢুকিয়ে ওই কপিকলের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে দড়িটা আলগা দিতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে গজালগুলো তার সর্বাঙ্গে ফুটতে থাকে, প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর ক্রমে জোর বাড়ানো হয়, শেষপর্যন্ত তাতেও ফল না হলে দড়িটা ছেড়েই দেওয়া হয়, ব্যস…গজালগুলো হাড় পর্যন্ত ফুটো করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে একসময় ভীমের গহ্বর থেকে লাশটাকে বের করে ভাসিয়ে দিলেই হল। দাঁড়াও তোমাকে ব্যাপারটা হাতে কলমে বুঝিয়ে দিই, যজ্ঞেশ্বর দড়িটা আরও টান তো, আমি ঢুকব…’
না না, কোনো দরকার নেই ঢোকার। আমি বেশ বুঝতে পারছি ব্যাপারটা, যন্ত্রটা আমাকে কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিল, সেই সম্মোহন কাটিয়ে উঠেই তীব্র আপত্তি জানালাম আমি। আমার বলার ভঙ্গিতে শুধু সতীশ নয়, যজ্ঞেশ্বরও হেসে উঠল।
‘বাবু, ভয় পেয়েছেন বুঝি, কিচ্ছু ভয় নেই…ছোটবাবু ভিতরে ঢুকবেন না।’
কিন্তু সতীশ কি আর সে মানা শোনে, হাসতে হাসতেই সে ভীমের খোলে ঢুকে পড়ল, ‘নে যজ্ঞেশ্বর, এবার দড়ি ছাড়, একটু আস্তে আস্তে…’
যজ্ঞেশ্বরের শক্ত মুঠোয় ধরা দড়িটা একটু একটু করে এগোতে লাগল আর পাল্লাটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে লাগল— ক্যাঁচ, ক্যাঁচ করে মরচে ধার কব্জাটায় আওয়াজ উঠছিল কেবল।
আমার ঘোরটা বোধহয় তখনও কাটেনি, কাটল সতীশের কথায়, ‘এই দ্যাখো, এবার গজালগুলো প্রায় আমার শরীর ছুঁয়েছে, বড় জোর ইঞ্চি দুয়েক বাকি, এইবার জেরা করা শুরু হয় আর…’
আর কী কী কথা সতীশ বলছিল সেগুলো আমার কানে ঢুকছিল না, কারণ আমার চোখের দৃষ্টি তখন যজ্ঞেশ্বরের পিছনে দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো গোল বস্তুর উপর গিয়ে পড়েছে। ও দুটো কী! চোখ, কিন্তু কীসের চোখ? বেড়ালের, না বেড়ালের চোখ তো ওরকম হয় না, তবে কী ও দুটো…
সন্দেহটার কথা আর মুখ ফুটে বেরোতে পারল না, তার আগেই তীক্ষ্ন একটা চিৎকার করে একটা ধূসর রংয়ের শরীর ছিটকে এসে পড়ল যজ্ঞেশ্বরের মুখের উপর আর সঙ্গে সঙ্গে নখ আর ঠোঁটের আঘাতে খুবলে নিল একটা চোখ।
মা গো! বলে চিৎকার করে দু হাত দিয়ে রক্তাক্ত চোখটাকে চেপে ধরল যজ্ঞেশ্বর আর তার ফলে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা বুঝেই আমি প্রচণ্ড আতঙ্কে লাফ দিলাম দড়িটাকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু আমার সাধ্য কী সে দড়ি ধরে! কপিকলের উপর দিয়ে একঝলক বিদ্যুতের মতো দড়িটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল লৌহভীম।
একটা চিৎকার করার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি সতীশ। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর চমক ভাঙল আরেকটা বিশ্রী আওয়াজে।
তাকিয়ে দেখি লোহার মূর্তিটার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ধূসর রং-এর মদ্দা পেঁচাটা। তার চোখ দুটো তখনও জ্বলছে আগুনের গোলার মতো।
বন্দুকটা তুলে নিয়েই গুলি চালালাম। নিশানা ভুল হবার কথা নয়, হলও না। বুকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল পেঁচাটা, তারপর অনাবশ্যক হলেও আরেকটা গুলি করলাম বন্দুকটাকে একেবারে শয়তানটার গায়ে ঠেকিয়ে। কয়েকটা মাংসের ডেলা আর রক্ত ছিটকে গেল ঘরটার চারিদিকে।
একটু থামলেন কুমার সাহেব, সেই আমার শেষ পাখি শিকার, তারপর থেকে পাখির মাংসও আর কোনোদিন খেতে পারিনি, প্লেটের উপর দেখলেই মনে পড়ে যায় দুটো লাল আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখের কথা। ওই চোখ দুটোয় যে ভয়ংকর প্রতিহিংসা আমি দেখেছিলাম সেটা এই চল্লিশ বছরেও ভুলতে পারিনি, হয়তো সারা-জীবনেও পারব না।
খুন-খুন খেলা – অসিত মৈত্র
রহস্যকাহিনির পাতায়-পাতায় অনেক খুনের গল্পই আপনারা পড়ে থাকেন ৷ সেইসব গল্পের গোয়েন্দাদের দক্ষতা কী অসাধারণ! কত নিপুণ তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা! যে-কোনও জটিল চক্রান্তের বেড়াজাল তারা অনায়াসে বুদ্ধির ছুরি দিয়ে কেটে দু-ফাঁক করে দিচ্ছে, তাদের অদ্ভুত ক্ষমতার তারিফ না করে পারা যায় না ৷ মঁসিয়ে দ্যুপাঁ, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, মিস মারপল, ব্যোমকেশ বক্সী— এঁদের কাজ-কারবার তো রীতিমতো ভেলকি বলেই মনে হয় ৷ কিন্তু সত্যি বলতে কী, সাহিত্যের পাতা থেকে বাস্তব পৃথিবীটার ফারাক প্রায় আশমান-জমিন ৷ এই সমস্ত খুনের গল্পের জমকালো গোয়েন্দাদের যদি বইয়ের পাতা থেকে তুলে এনে পৃথিবীর খোলা হাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া যায়, তবে দেখবেন দু-দিনেই তাঁদের খ্যাতির ফানুস ফেটে চুপসে গেছে ৷ দৈনিক পত্রিকার পাতায় প্রায়ই তো সেইসব বিকৃত দেহের ছবি ছাপা হয়, রেললাইনের ধারে বা জংলা মাঠের মধ্যে যাদের মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে ৷ খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন, হত্যাকারীর হদিশ পাওয়া তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সঠিক পরিচয়টাই খুঁজে বের করতে পারে না পুলিশ৷ তা ছাড়া, পথে-ঘাটে খুন তো আকছারই ঘটছে ৷ তার মধ্যে কতগুলোর কিনারা হচ্ছে, আর কতগুলো পুলিশের ফাইলের চাপে পড়ে বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাচ্ছে তারই বা সঠিক হিসেব রাখছে কে!
এই যেমন আমার কথাই ধরুন না ৷ এ-পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে, কচি-বুড়ো মিলিয়ে মোট পাঁচটা খুন করেছি আমি ৷ রাঁচির পাগলাগারদে বসে আমি আপনাদের গল্প শোনাচ্ছি ভেবে হাসবেন না ৷ আমি এই শহর কলকাতার একজন স্বাধীন নাগরিক ৷ যদি জিগ্যেস করেন, আমাদের সরকার কি এতই বেহেড যে, এমন একখানা খাসা স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরও তারা এখনও আমায় গ্রেপ্তার করছে না? অবশ্য সেদিকটাও আমি বেশ ভালো করে ভেবেচিন্তে রেখেছি ৷ তাদের কাছে এটাকে সোজা গপ্পো বলেই চালিয়ে দেব ৷ গপ্পো লেখার অধিকার তোআপনার-আমার সকলেরই আছে ৷
তবে এমন মনে করবেন না, আমি একের-পর-এক এতগুলো খুন করে গেলাম আর পুলিশের গায়ে তার আঁচটুকুও লাগল না ৷ প্রথম খুনটার পর তো তারা আমাকে যথেষ্টই নেকনজরে দেখতে শুরু করেছিল ৷ জাঁদরেল দারোগা প্রকাশ মিত্তির বার-দু-তিন আমার ডেরায় এসে হানা দিল ৷ জেরায়-জেরায় আমাকে একবারে জেরবার করে তুলতে চাইল৷ কেন এসেছিল? কোথায় গেল? রোজ আসত কি না? আমার সঙ্গে মেয়েটার কীরকমের সম্পর্ক? কী-কী কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে? এই সমস্ত সাত-সতেরো নানান ধরনের প্রশ্ন ৷ কিন্তু আমিও তেমন কাঁচা ছেলে নাকি! সবক’টা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি হিসেব করে ৷ শেষকালে একসময় মুখ চুন করে আস্তে-আস্তে উঠে গেল প্রকাশ দারোগা ৷ এর পরেও অবশ্য কিছুদিন ফেউ-এর মতো লেগে রইল আমার পিছু-পিছু, তবে তাতে কাজ কিছু হয়নি, শুধু হয়রানিই সার হয়েছে ৷
আমাকে যদি আপনারা সাধারণ আর-পাঁচটা পেশাদার খুনির মতো মনে করেন, তা হলেও মস্ত ভুল করবেন ৷ দস্তুরমতো ভদ্রঘরের ছেলে আমি ৷ লেখাপড়া শিখে বি.এসসি.পাশ করেছি ৷ খুন করা আমার পেশা নয় ৷ তবে ইদানীং সুবিধেমতো এবং মনের মর্জিমাফিক দু-চারটে খুন আমি করেছি ৷ লীনাকে দিয়েই আমার খুনের হাতেখড়ি ৷ এখন অবশ্য মাঝে-মধ্যে মেয়েটার জন্যে যে একটু-আধটু মনখারাপ না হয় এমন নয় ৷ আমাকে আপনারা এতটা নিষ্ঠুর ভাববেন না ৷ কিন্তু কথায় আছে, নিয়তির লিখন কে খণ্ডাবে? আমি তো ছার নিমিত্ত মাত্র! এই লীনাকেই তো একদিন বুকভরে ভালোবাসতাম আমি ৷ কলেজ-জীবনের সেই স্বপ্নমদির দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়! লীনার যেদিন বিয়ে হয়ে গেল সেদিন আমার গোটা হৃদয় কি শূন্য হয়ে যায়নি? আমার বুকের ভেতরকার আকাশ-পাখিটা কী অসহ্য যন্ত্রণাতেই না ভগ্নপক্ষ হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটির ওপর! তবে সময়ই সব ব্যথা মুছে দেয় মন থেকে ৷ ক্রমে-ক্রমে আমার বুকের ওপরও বিস্মৃতির প্রলেপ বুলিয়ে দিল সে ৷
ছেলেবেলায় বাবাকে কবে হারিয়েছি সঠিক মনে পড়ে না ৷ তাঁর মৃত্যুর পর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর লাইফ ইনসিয়োরেন্সের একটা থোক টাকা এসে পড়ল মায়ের হাতে ৷ তার ওপর নির্ভর করেই মা আমাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ৷ দুঃখের সংসারের তিলমাত্র আঁচটুকুও কখনও আমার গায়ে লাগতে দেননি ৷ আমার মা ছিলেন যথেষ্ট মিতব্যয়ী প্রকৃতির ৷ তাই বাবার মৃত্যুর পর আঠারো বছর সংসার চালিয়েও সেই টাকার তখনও কিছু অবশিষ্ট রেখে যেতে পেরেছিলেন ব্যাঙ্কে ৷
লেখাপড়ায় কোনোকালেই আমি নেহাত খারাপ ছিলাম না ৷ মায়ের নিজের বিদ্যের দৌড় ‘কথামালা’ আর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত ৷ কিন্তু ছেলের পড়াশুনোর দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল প্রচণ্ড সজাগ ৷ প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমাকে পড়তে বসিয়ে নিজেও বসে থাকতেন কাশীরাম দাসের মহাভারতখানা কোলে টেনে নিয়ে ৷ আমি কী পড়ছি সেটা হয়তো সবসময় বুঝতেন না, কিন্তু পড়ায় আমার মন আছে কি না তা ঠিক বুঝতে পারতেন ৷ আর পাছে নষ্ট হয়ে যাই সেই আশঙ্কায় বাইরের কোনো ছেলের সঙ্গে আদৌ মিশতে দিতেন না আমায় ৷ তাই মা ছাড়া আমার বন্ধু বলতে বিশেষ কেউ ছিল না ৷
স্কুল-জীবনটা মায়ের কড়া নজরের মধ্যে দিয়েই কাটাতে হয়েছে আমাকে ৷ তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় কলেজে এসে ঢুকলাম ৷ ছেলে এবার বড় হয়ে উঠেছে দেখে মায়ের প্রখর দৃষ্টি একটু-একটু করে শিথিল হয়ে এল ৷ তবুও ফার্স্ট ডিভিশনেই আই. এসসি. পাশ করলাম ৷
লীনা যখন আমাদের কলেজে প্রথম অ্যাডমিশন নিল তখন আমি থার্ড ইয়ারের ছাত্র ৷ বড়লোকের মেয়ে ৷ দেখতে-শুনতেও বেশ ভালো ৷ তাই সকলেই একটু বুক ফুলিয়ে চলার চেষ্টা করত ওর সামনে দিয়ে ৷ আর রূপবান ধনীর দুলালেরও অভাব ছিল না আমাদের কলেজে ৷ কিন্তু অদৃষ্টের কী অদ্ভুত পরিহাস— হঠাৎ একদিনের আলাপের পর থেকে কেন জানি না, আমার সঙ্গেই তার সম্পর্কটা নিবিড় হয়ে উঠতে লাগল ধীরে-ধীরে ৷
নারী-চরিত্রের বিচিত্রতম দুর্গমতার অন্ত আমার অজানা ৷ তাই আমার প্রতি লীনার এই আকর্ষণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করিনি কখনও ৷ তার এই ভালোবাসাকে সহজ, সত্য এবং স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম ৷
ছেলেবেলা থেকেই আমি বরাবর নিঃসঙ্গ ৷ পৃথিবীতে সঙ্গী বলতে মা ছাড়া আমার কেউ ছিল না ৷ লীনার সঙ্গ আমায় কোন অপার্থিব আনন্দলোকে নিয়ে গেল! সে যে কী আনন্দ, ভাষায় তাকে ব্যক্ত করা অসম্ভব ৷ আমার দিন-রাতের সমস্ত স্বপ্ন লীনাকে ঘিরে উদ্বেল হয়ে উঠল ৷
বুঝতেই পারছেন, আমার দেহ-মনে তখন নবীন যৌবনের জোয়ার ৷ বয়েস কম— অভিজ্ঞতা কম ৷ বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়িনি একবারও ৷ এই অবস্থায় কল্পনার পাখা কত না সুদূর-বিস্তৃত হয় ৷ আর, এই স্বপ্নগুলোর ওপর দিয়ে যেন দিনগুলো বরাবর হেঁটে চলেছে…হেঁটে চলবে, ভাবতে ভালো লাগে ৷
সেবারে গরমের ছুটিতে লীনারা দার্জিলিং বেড়াতে গেল ৷ লীনার যদিও যাওয়ার ইচ্ছে আদৌ ছিল না, কিন্তু বাড়ির সকলেই যখন যাচ্ছে তখন কোন ছুতোয় বা সে কলকাতায় পড়ে থাকবে! অগত্যা মা-বাবার সঙ্গে তাকেও যেতে হল ৷ যাওয়ার আগের দিন লীনা নিজে থেকেই আমাকে আউটরাম ঘাটে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ৷ সেদিন থেকে কলেজে গরমের ছুটি পড়বে ৷ বিকেলের ক্লাস শেষ করে লীনা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ৷ গঙ্গার ধারে একটা নির্জন বেঞ্চে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম আমরা ৷ দুজনের বুকের ভেতর এত বেশি কথা এসে ভিড় করছিল যে, সেগুলোকে ধীরে-সুস্থে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ ৷ শুধু এক অব্যক্ত বেদনায় ছটফট করে গুমরে-গুমরে কেঁদে মরছিল মনটা ৷ একটু-একটু করে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এল তাকিয়ে দেখিনি ৷ আমাদের স্বপ্নের দিনগুলোর ওপরও বুঝি নিয়তি সন্ধ্যার কালো ছায়া টেনে দিল ৷
মাস-দেড়েক বাদে যখন লীনা ফিরে এল, তখন আর তাকে যেন চেনাই যায় না ৷ আপেলের মতো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে ওর নিটোল গালদুটো ৷ সারা গায়ে টসটস করে ফেটে পড়ছে গোলাপি আভা ৷ শুধু চেহারাতেই নয়, ইতিমধ্যে হাবভাব, স্বভাব-চরিত্রেও যেন এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে ওর ৷ কলেজের করিডরে আমাকে দেখে আড়ষ্ট, ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওর মুখ ৷ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে চলে গেল দ্রুতপায়ে ৷ আমি ব্যথা-বিস্মিত দু-চোখ তুলে তাকিয়ে রইলাম ওর চলে-যাওয়া-পথের দিকে ৷
এর পরের দিন থেকে লীনা আর কলেজেই এল না ৷ শুনলাম, ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে ৷ পাত্র এক তরুণ ডাক্তার ৷ দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে আলাপ হয়েছে দুজনের ৷ তারপর ছেলেটা সুযোগ বুঝে আত্মীয়তা পাতিয়ে নিয়েছিল ওদের পরিবারের সঙ্গে ৷ লীনার বাবাও মৃদু হেসে প্রসন্ন মনে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাকে ৷ এর মাসখানেক বাদে বিয়ে হয়ে গেল ওদের ৷
আমার সে-দিনগুলোর কথা আপনাদের বোঝাই কেমন করে! দুঃখে, অপমানে, লজ্জায়, হতাশায় সমস্ত বিশ্বটাই ঝাপসা হয়ে এল দু-চোখের সামনে ৷ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বটাও বুঝি আর টের পাচ্ছিলাম না নিজের মধ্যে ৷ পাগলের মতো দিনকতক ঘুরে বেড়ালাম সকাল-সন্ধে ৷ তারপর একসময় লীনার স্মৃতিটা ঘুমিয়ে পড়ল বুকের গভীরে ৷
আমি যেবার কলেজ থেকে পাশ করে বেরোলাম, সেই বছরের ডিসেম্বরে মা-ও গত হলেন ৷ এতদিন ধরে মাকে দেখে আসছি, কিন্তু তাঁর যে মরবার মতো বয়েস হয়েছে, এ-কথা কখনও ভাবিনি ৷ তাই প্রথমটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম ৷ মনে হল, এই দুনিয়ায় আমার আর কোনও প্রয়োজনই নেই ৷ সকলের মধ্যে থেকেও আমি যেন সম্পূর্ণ একা ৷ সঙ্গীহীন, সাথীহীন একক নিঃসঙ্গ জীবন ৷ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যেই সময় কাটিয়ে যাওয়া ৷
মনের যখন এইরকম অবস্থা সেইসময় একদিন হঠাৎ ট্রামের মধ্যে নীরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ শুনলাম, টালিগঞ্জে ও এখন একটা পোলট্রি ফার্ম ফেঁদে বসেছে ৷ কী খেয়াল চাপল, নীরেনের সঙ্গে ওর পোলট্রি দেখতে গেলাম ৷ তারপর থেকে আমার মাথাতেও পোলট্রির মতলব ঘুরে বেড়াতে লাগল ৷ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে আমাকে একটা উপায়ের ব্যবস্থা দেখতে হবে ৷ আর শহরের ভিড়ে চাকরি করে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই আমার অসহ্য লাগে ৷ হিসেব করে দেখলাম, ব্যাঙ্কে এখনও হাজার পনেরোর মতো অবশিষ্ট পড়ে আছে ৷ সেই টাকা দিয়েই একটা চান্স নেব ঠিক করলাম ৷ সব যদি ডুবেও যায় তাতেই বা ক্ষতি কী? আমি এখন কোনো কিছুরই পরোয়া করি না ৷
এইসব ভেবেচিন্তে দিনকতক নীরেনের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম ৷ পোলট্রি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হল আমার ৷ তারপর আমার কাজ শুরু করলাম ৷
এদিক থেকে ভাগ্য আমার সুপ্রসন্নই ৷ বলতে হবে ৷ প্রথমে টলমল করলেও আস্তে-আস্তে আমার ফার্ম নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল ৷ আমিও দিনরাত এই ফার্ম নিয়েই পড়ে রইলাম ৷ শহরের এক নির্জন প্রান্তে একা-একা দিনগুলো মন্দ কাটছিল না ৷
চার বছরের মধ্যে আমি আমার পোলট্রিটাকে মোটামুটিভাবে বৈজ্ঞানিক প্রথায় গড়ে তুললাম ৷ কাঠা-ছয়েক জমি নিয়ে আমার এই পোলট্রি ৷ চারধারে উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা ৷ মুরগিদের জন্যে জাল দিয়ে ঘেরা দুটো বিরাট খাঁচা ৷ এককোণে অ্যাসবেসটসের শেড দেওয়া আমার থাকার আস্তানা ৷ বারান্দার একধারে ইনকিউবেটর, আর মুরগিদের জন্যে মাংসের কিমা বানাবার প্রমাণ সাইজের সেই মেশিনটা ৷ যদিও আমার ছোট ফার্মের পক্ষে এত বড় মেশিনের দরকার ছিল না, তবে পার্ক স্ট্রিটের এক নিলামের দোকানে জিনিসটা খুব সস্তায় পেয়েছিলাম বলেই কিনে এনেছিলাম ৷
সেটা শরৎকাল ৷ আকাশ থেকে হিম-হিম ঠান্ডা ঝরছিল সন্ধেবেলা ৷ আমার সারাদিনের কাজের লোক তিনকড়িও ছুটি নিয়ে চলে গেছে কিছু আগে ৷ একা-একা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে একটা বিলিতি ক্রাইম নভেলের পাতা ওলটাচ্ছিলাম অলসভাবে ৷ খুব বেশি আগ্রহ ছিল না বইটার ওপর ৷ এমন সময় সদরে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম ৷ এসে দেখি, ছোট একটা সুইকেস হাতে লীনা দাঁড়িয়ে ৷ লীনা যে আবার কোনো দিন আমার কাছে আসবে, আবার কোনো দিন আমি ওর দেখা পাব, সে-কথা স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ আমার বিমূঢ়, বিস্মিত চোখের সামনে লীনা দাঁড়িয়ে ছিল ৷
আরও কিছুক্ষণ বাদে লীনাকে আমি ঘরে এনে বসালাম ৷ ওকে দেখে আমার মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল, না বেদনায় নীল হয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না ৷ আমার সমস্ত অনুভূতি একবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল ৷ লীনার সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারলাম না ৷
আমার পেছন-পেছন লীনাও ঘরে এসে ঢুকল ৷ প্রথমে একটু ইতস্তত করল ৷ তারপর আমার অনুমতি নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল ৷ যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না ৷ কেননা, এই অসময়ে কেউ কোনোদিন আমার কাছে আসে না ৷
প্রথম কথা কে বলবে লীনা বোধহয় তাই ভাবছিল ৷ দু-একবার ঢোক গিলল ৷ মুখ ফুটে কী যেন বলতে গেল ৷ তারপরই মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ৷
বিস্ময়ের প্রথম চমকটা কেটে যাওয়ার পর আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ৷ এই ক’বছরে বেশ খানিকটা ভারী হয়ে পড়েছে লীনা ৷ দু-চোখের তারায়-তারায় ঝকমকে হাসির ছটাও কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে ৷ মুখটা আরও বেশি স্থুল ৷ এরমধ্যে পুরোপুরিই বদলে গেছে লীনা! ওকে দেখতে এখন আমার ভীষণ বিশ্রী লাগল ৷ ওর এই কান্নাটাও যেন রং-মাখা অভিনেত্রীর ছলাকলা ৷ চোখের জলে মুখের প্রসাধন ধুয়ে গিয়ে ওকে আমার রীতিমতো অসহ্য লাগছিল ৷
আমার তখন সময়ের কোনও হুঁশ ছিল না ৷ কতক্ষণ ও ফুলে-ফুলে কাঁদল তা-ও জানি না ৷ অবশেষে একসময় বর্ষণ-ক্লান্ত লীনা একটু-একটু করে থেমে-থেমে ওর নিজের কথা বলল ৷
ওদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম ক’টা বছর নিরবচ্ছিন্ন সুখের মধ্যে দিয়েই কেটেছিল ৷ আদরে সোহাগে ওর স্বামী ওকে ভরিয়ে রেখেছিল ৷ কিন্তু চিরটাকাল কবে কার একভাবে কেটেছে! ওদের স্বপ্ন-রঙিন প্রেমের আকাশেও অবসাদের কালো মেঘ জমে উঠল ৷ ওর তরুণ স্বামী ডাক্তার অরুণাংশু নবাগতা এক নার্সের আকর্ষণে বৃন্তচ্যুত হয়ে পড়ল ৷ প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা সে গোপন রাখার চেষ্টা করত ৷ লীনাকে কিছু বুঝতে দিত না ৷ কিন্তু ক্রমশই তার সে-ভাব কেটে গেল ৷ অরুণাংশু এখন প্রকাশ্যেই সেই নার্সকে নিয়ে ঘোরাফেরা করে ৷ নাইট শো- তে চৌরঙ্গি পাড়ায় সিনেমা দেখতে যায় দুজনে ৷ অনেক রাতে আকণ্ঠ মদ গিলে টলতে-টলতে বাড়ি ফেরে ৷ লীনা মরে গেলেও কিছুতেই অমন একটা লম্পট লোকের ঘর করতে পারবে না ৷ ইতিমধ্যে এক উকিলকে দিয়ে কোর্টে ডিভোর্সের আবেদন জানাবার ব্যবস্থা করেছে ও ৷ তারপর অনেক খুঁজে আমার বর্তমান আস্তানার সন্ধান পেয়েছে ৷ ও এখন নতুন করে আবার আমায় ফিরে পেতে চায় ৷
একটু-একটু করে থেমে-থেমে লীনা ওর নিজের কথা বলছিল ৷ ওর নিজস্ব যা কিছু অলঙ্কার সব এই সুটকেসের মধ্যে ভরে নিয়ে এসেছে ৷ এখন এটা আমার কাছে রেখে যাবে ৷ হপ্তাখানেক বাদে ও যখন অরুণাংশুকে সবকিছু জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে, তখন যদি এগুলো নিয়ে কোনো গন্ডগোল বাধে, সেইজন্যেই আগে থেকে এই সাবধানতা ৷
লীনাকে দেখে, লীনার কথা শুনে, আমার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল ৷ ভাবলাম, এ কী উটকো ঝঞ্ঝাট হঠাৎ করে আমার ঘাড়ে এসে চাপল! আমার নির্জন শান্তির প্রাঙ্গণে এই স্থুল আপদটা তবে কি চিরকাল অনড় হয়ে বসে থাকবে! কিন্তু লীনাকে আমি ফেরাই কোন মুখে? বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে ও আজ আমার কাছে এসেছে ৷ বিপদে পড়ে ছুটে এসেছে লীনা৷ কোন মুখে আমি ওকে ফিরে যেতে বলব!
ভাবতে-ভাবতে আমি খুব বিব্রত হয়ে পড়লাম ৷ প্রথম যৌবনে ভালোবাসার যে-পাখিটা বুকের মধ্যে মরে গেছে, হাজার বসন্তের ডাকেও সে আর কখনও সাড়া দেবে না ৷ একটা জটিল প্রশ্নের জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতো লীনা আজ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ৷ আমি এর সমাধান করব কোন পথে?
লীনা আমার মনের অবস্থা ঠিকমতো অনুভব করতে পারেনি ৷ সেদিকে কোনো নজর-ই ছিল না ওর ৷ ছটফট করতে-করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি ৷ ভাবনা-চিন্তার গ্রন্থিগুলো সব যেন জট পাকিয়ে গেল মাথার মধ্যে ৷ অতিরিক্ত রক্তের চাপে ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল কান দুটো ৷ আর লীনা তখনও টেবিলে মুখ গুঁজে আমার উত্তরের অপেক্ষায় বসেছিল ৷
আমি যখন ঘুরতে-ঘুরতে ওর চেয়ারের পেছনে এসে-দাঁড়ালাম, তখনও লীনা আমার দিকে চোখ তুলে চায়নি ৷ মাঝে-মাঝে শুধু বোবা কান্নার দমকে থরথর করে কেঁপে উঠছিল ওর সারা শরীরটা ৷ কিন্তু আমি আর সে-দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলাম না ৷ সবল পেশল দুটো হাত দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ওর গলাটা টিপে ধরলাম ৷
না…না, আমি ওকে ফিরে যেতে বলব কেমন করে?
লীনা প্রথমটা ধড়ফড় করে উঠল ৷ ব্যাপারটা কী ঘটতে চলেছে বোধহয় বুঝতে পারেনি ৷ তারপরই আমার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল জোর করে ৷ কিন্তু ওর সে-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল ৷ দাঁতে দাঁত চেপে দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করে আমি ওর গলাটা টিপে ধরেছিলাম ৷ ধীরে-ধীরে লীনার মাথাটা নেতিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর ৷ আর আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগলাম দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ৷ আমার সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছিল দরদরিয়ে ৷
লীনাকে খুন করার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার কোনো বোধশক্তি ছিল না ৷ একটা চেয়ারে গা এলিয়ে নেশাচ্ছন্নের মতো বসে রইলাম চুপচাপ ৷ তারপর ক্রমে-ক্রমে সংবিৎ ফিরে পেলাম ৷
আমি যে কী করলাম আর কেনই-বা করলাম ভেবে ঠিক করতে পারলাম না ৷ যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে গেল মাথার মধ্যে ৷ তুহিন-শীতল ভয়ের একটা স্রোত ছড়িয়ে পড়ল দেহের শিরায়-শিরায় ৷ লীনার মৃতদেহটা সাক্ষাৎ যমদূতের মতো ঘাড় মটকে পড়ে আছে চোখের সামনে ৷ ওকে যতই দেখতে লাগলাম, ততই ভয়ে আড়ষ্ট হতে শুরু করল আমার সর্বাঙ্গ ৷ একবার ভাবলাম, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই ৷ কিন্তু কোথায় যাব? কোথায় গেলে এই বীভৎসতার হাত থেকে নিস্তার পাব? এই দুনিয়াটা যে বড়ই ছোট! তা ছাড়া, আমার মনে হল, আমি যেখানেই যাই না কেন, লীনা নিশ্চয়ই তাড়া করে ফিরবে আমার পেছন পেছন ৷ কোনো দিনই ও আমাকে মুক্তি দেবে না ৷
মার খেতে খেতে মানুষ একসময় মরিয়া হয়ে ওঠে ৷ ভয়ের হাতে মার খেতে খেতে আমিও এবার মরিয়া হয়ে উঠলাম ৷ যেভাবেই হোক না কেন, আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতেই হবে ৷ দু-হাত দিয়ে ভয়কে প্রতিরোধ করে দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়ালাম, আর আশ্চর্যরকমভাবে আমার সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিগুলো ক্রমশই তীক্ষ্ণ আর সচেতন হয়ে উঠতে লাগল৷ একাগ্র চিত্তে আমি উদ্ধারের পথ খুঁজতে সচেষ্ট হলাম ৷ এত রাতে আমার আস্তানায় যে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই ৷ অতএব, এইটুকু অবসরের মধ্যেই আমার অপকর্মের সমস্ত চিহ্ন পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হবে ৷
প্রথমে ভাবলাম, লীনার মৃতদেহটা কোথাও গিয়ে পুঁতে দিয়ে আসি ৷ কিন্তু পরে মনে হল, তাতে বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর ৷ শেয়াল-কুকুরের দৌরাত্ম্য তো আছেই ৷ ওরা কোনোভাবে একবার যদি টের পায়, তবে ঠিক টেনে-হিঁচড়ে সেটাকে মাটির তলা থেকে বের করে আনবে ৷ তা ছাড়া, লীনা বাড়ি ফিরে না গেলে ওর স্বামী অরুণাংশু নিশ্চয় পুলিশে খবর দেবে৷ আর পুলিশও লীনার খোঁজ করতে-করতে আমার পোলট্রি পর্যন্ত এসে হাজির হবে ৷ এ-পর্যন্ত তারা লীনার হদিশ করতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস ৷ কিন্তু তারপর যে লীনা কোথায় হারিয়ে গেল তার কোনো খোঁজই তারা পাবে না ৷ ফলে ওদের সমস্ত সন্দেহটা এসে পড়বে আমার ওপর ৷ আমি যে লীনাকে খুন করতে পারি এ-কথাও তাদের মনে হবে ৷ আর, খুন করার পর লীনার দেহটা কাছাকাছি কোথাও পুঁতে ফেলাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক ৷ ওরা তখন সেটার সন্ধান করতে শুরু করবে ৷ তাই আমি ভুলেও এ-পথ মাড়াব না বলে ঠিক করলাম ৷
তবে আমার মুক্তির উপায় কি হবে না? কোন কুক্ষণেই যে লীনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল! নিজের মৃত্যু দিয়েও লীনা আমায় এ কোন বিপদের অতল গহ্বরে ঠেলে দিল! মনে হল, লীনা যেন ছল করে টেবিলে মাথা গুঁজে নিষ্ঠুরভাবে হেসে চলেছে আমাকে ব্যঙ্গ করে ৷ আমার জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রাহুর মতো গ্রাস করে নেওয়ার জন্যেই বুঝি ওর সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে ৷ বারে-বারে ও এসে আমার সব সোনার স্বপ্নকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ৷ ভাবতে-ভাবতে আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠছিল ৷ এর প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে! আর, ঠিক সেই মুহূর্তে মেশিনটার কথা আমার মনে পড়ল ৷ মুরগিদের খেতে দেওয়ার জন্যে মাংস কিমা করার বিরাট মেশিনটা তো আমার নাগালের মধ্যেই রয়েছে ৷ সাতশো লেগহর্ন আর পাঁচশো রেড আইল্যান্ডের জন্যে মাসে দু-বার মাংসের ব্যবস্থা করতে হয় ৷ … পৈশাচিক আনন্দে আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠল ৷ বিপদের উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে আমার মনটা এতক্ষণে বুঝি কোনও নিরাপদ বন্দরের আশ্রয় পেল ৷ নিষ্ঠুর আগ্রহে লম্বা ধারালো ছুরিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে প্রস্তুত হলাম আমি ৷
সুষ্ঠুভাবে সমস্ত কাজটা শেষ করতে ঘণ্টা তিন-চার সময় লাগল আমার ৷ একটা বড় ঝুড়ির মধ্যে দলা-পাকানো কিমা করা মাংসের তালগুলোকে জড়ো করলাম ৷ লীনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ওর দেহ থেকে বিছিন্ন করার সময় ঘরের মধ্যে চাপ-চাপ রক্ত জমাট বেঁধে উঠেছিল ৷ নিজের হাতে ধুয়ে-মুছে সাফ করলাম সবকিছু ৷
এতখানি অমানুষিক পরিশ্রমের পর স্বভাবতই আমার হাত-পা ক্লান্তিতে অবশ হয়ে এল ৷ চোখের পাতা দুটোও অসহ্য ভারী-ভারী ঠেকল ৷ আপাতত আমার কর্তব্য শেষ ৷ বাকি কাজটুকু খুব ভোরে উঠে সেরে ফেলতে হবে ৷ ঘড়িতে পাঁচটার অ্যালার্ম দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ৷ সঙ্গে-সঙ্গে আমার দু-চোখ জুড়ে ঘুমের ঘোলা বন্যা নেমে এল ৷
পাঁচটা বাজার মিনিট-দুয়েক আগেই আপনা থেকে আমার ঘুম ভেঙে গেল ৷ আমার অবচেতন মন থেকে কে যেন সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমায় জাগিয়ে দিল ৷ মুরগিগুলো দু-একটা করে তখন সবে ভোরের ডাক ডাকতে শুরু করেছে ৷ বারোশো মুরগিদের মধ্যে আমি এক বিরাট ভোজ লাগিয়ে দিলাম ৷ আশাতীত সৌভাগ্যে ওরা বেশ মশগুল হয়ে উঠল ৷ আধঘণ্টার মধ্যে লীনার দেহের শেষ চিহ্নটুকুও অবলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে ৷
যাক!…এতক্ষণ পরে আবার আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম ৷ সবচেয়ে কঠিন সমস্যার নিখুঁত সমাধান আমি করতে পেরেছি ৷ দিনের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে আমার মন থেকেও বিপদের অন্ধকার কেটে যেতে শুরু করল ৷ ভোরবেলার তরুণ সূর্য নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল বুকের মধ্যে ৷ এখন আর আমার কোনো ভয় নেই ৷
নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে এসে লীনার সুটকেসটা খুলে দেখতে লাগলাম ৷ একজোড়া নেকলেস, গন্ডাকতক ইয়াররিং, আংটি, চুড়ি এবং এই জাতীয় আরও অনেক অলঙ্কারে ছোট্ট সুটকেসটা পুরো ঠাসা ৷ কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকার জিনিস তো হবেই! কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, সেগুলোর ওপর বিন্দুমাত্র লোভও আমার হল না ৷ বরং লীনার জিনিস বলে কেমন এক ধরনের বিতৃষ্ণার ভাব জাগল মনের মধ্যে ৷ আর তা ছাড়া, পুলিশ যে লীনার খোঁজ করতে-করতে আমার আস্তানা পর্যন্ত এসে হাজির হবে সে-বিষয়ে আমি প্রায় একশো ভাগ নিশ্চিত ৷ তখন যদি গয়না-ভরতি এই সুটকেসটা তাদের হাতে তুলে দিতে পারি, তা হলে টাকার জন্যে আমি যে লীনাকে খুন করিনি এটুকু অন্তত তারা বুঝতে পারবে ৷ লীনাকে খুন করার পেছনে আমার আর কী মোটিভ থাকতে পারে তার কোনো হদিশই তারা খুঁজে বের করতে পারবে না ৷ পুলিশের সন্দেহের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এই একটা সুবর্ণ সুযোগ ৷ এ-সুযোগ আমি হেলায় হারাতে পারি না ৷ তাই সযত্নে লীনার সুটকেসটা আয়রন সেফের মধ্যে তুলে রাখলাম ৷
এরপরের দিন থেকেই আমি মনে-মনে পুলিশের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম ৷ এই একটি মাত্র বিপদের ঘাঁটি এখন আমায় পার হয়ে যেতে হবে ৷ তারপর আবার আমি আগেকার নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ জীবনে ফিরে যেতে পারব ৷ বুকের মধ্যে থেকে এই অস্বস্তির কাঁটাটা যত তাড়াতাড়ি দূর হয়ে যায় আমার পক্ষে ততই মঙ্গল ৷
পুলিশ এসে আমায় যে-কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, আমিই বা তার কী জবাব দেব, সে-সম্পর্কেও নিজেকে ভালো করে তালিম দিয়ে রাখলাম ৷ অবশ্য, ওরা যে আমায় এত সহজে রেহাই দেবে না, তা আমি জানি ৷ একবার যখন ওদের সন্দেহ আমার ওপর এসে পড়বে, তখন জেরায়-জেরায় আমাকে আরও নাজেহাল করে ছাড়বে ৷ কথার মারপ্যাঁচে কখন যে কী করে বসব তার ঠিক কী? কিন্তু বুদ্ধির খেলায় আমায় জিততেই হবে ৷ দক্ষ দাবাড়ুর মতো আমার প্রতিটি চালই নির্ভুল হওয়া চাই ৷ এর ওপরই আমার জীবন-মরণ সর্বস্ব নির্ভর করছে ৷
এই ঘটনার সতেরো দিন বাদে বরানগর থানার জাঁদরেল দারোগা প্রকাশ মিত্তির আমার সঙ্গে দেখা করতে এল ৷ খুব সমাদর করেই তাকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে এলাম ৷ ঘরে ঢুকে প্রকাশ মিত্তির প্রথমে মাথা থেকে টুপি খুলে টেবিলের ওপর রাখল ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল ৷ তারপর লীনা যে-চেয়ারে বসে ধরাধাম ত্যাগ করেছিল সেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল ৷ আমি তিনকড়িকে চা আর জলখাবারের কথা বলে দিয়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম ৷
আপনি মিসেস লীনা বোসকে চেনেন? ডাক্তার অরুণাংশু বোসের স্ত্রী?
আমি চেয়ারে বসতে-না-বসতেই প্রকাশ দারোগা তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আমায় জেরা শুরু করে দিল ৷
কেন বলুন তো?— আমার গলায় যুগপৎ বিস্ময় ও উদ্বেগের সুর ৷ — দিন পনেরো আগে লীনা একবার আমার এখানে এসেছিল ৷ আর শুধু চেনেন বলছেন কী, লীনা তো একসময় আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল! আমরা দুজনে একই কলেজে পড়তাম ৷
আপনার এখানে তাহলে তিনি প্রায়ই আসতেন, বলছেন?
না…না, প্রায় আসতে যাবে কেন! বিয়ের পর লীনার সঙ্গে এই আমার প্রথম দেখা ৷
তবে যে বললেন লীনা দেবী আপনার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু? তা হলে কি তিনি মাঝে-মধ্যে এখানে আসতেন না?
এবারে আমার গলায় খানিকটা রাগের সুর ফুটিয়ে তুললাম ৷ বেশ ঝাঁজালো স্বরে বললাম, কলেজ-জীবনে আমাদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক ছিল বটে, কিন্তু সেই সূত্রে বিয়ের পরও লীনা আমার এখানে আসত এমন আজগুবি খবর আপনি জোটালেন কোত্থেকে? তা ছাড়া, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সে-সম্পর্কেও দেখছি আপনার জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে!
আমার শেষের কথাটায় বুঝি একটু আঁতে ঘা লাগল প্রকাশ দারোগার ৷ এভাবে কথাটা বলা যে উচিত হয়নি সেটা তার মগজে ঢুকল ৷ তাই একটু নড়েচড়ে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে বলল, আহা…আপনি একটুতেই এত চটে উঠছেন কেন! দিনরাত চোর-ডাকাতের সঙ্গে কারবার করতে হয় কিনা, তাই আমাদের কথাবার্তার ধরন-ধারণও কিছুটা কাটখোট্টাগোছের হয়ে গেছে ৷ ওটাকে ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করবেন না ৷ এখন আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, হপ্তাদুয়েক হয়ে গেল লীনা দেবীর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না ৷ অনুসন্ধান করে আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে এখানে আসার জন্যেই তিনি শেষ বেরিয়েছিলেন ৷ কিন্তু তারপর থেকেই মিসেস বোসের আর কোনো হদিশ নেই ৷ তিনি এখানে আদৌ এসেছিলেন কি না, যদি এসে থাকেন তবে তারপরই-বা কোথায় গেলেন, এটাই হচ্ছে আমাদের আসল জানার বিষয় ৷
এমন সময় চা-জলখাবার হাতে নিয়ে তিনকড়ি ভেতরে ঢুকল ৷ চায়ের সঙ্গে ডবল ডিমের ওমলেট চিবোতে-চিবোতে প্রকাশ মিত্তির আমার কথা শুনতে লাগল ৷
আগাগোড়া সমস্ত ইতিবৃত্তই তাকে খুলে বললাম ৷ লীনার সঙ্গে আমার আগেকার সম্পর্ক, তার বর্তমান দাম্পত্য জীবনের কথা, কেনই-বা সেদিন সন্ধেবেলা লীনা আমার কাছে এসেছিল ৷ সবকিছুই চোখ বুজে শুনে গেল দারোগাসাহেব ৷ অবশেষে লীনার গয়না-ভরতি সুটকেসটাও এনে দেখালাম ৷ বললাম, হপ্তাখানেক বাদে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লীনা সেদিন আমার কাছ থেকে বিদায় নিল ৷ আমি ওকে অবশ্য অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম ৷ অরুণাংশুর সঙ্গে গন্ডগোলটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্যেও বারবার অনুরোধ জানিয়েছি ৷ কিন্তু লীনা বরাবরই ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে স্বভাবের ৷ আমার কোনো কথাই কানে তুলতে চাইল না ৷ বরং উলটে আমাকেই ভয় পাইয়ে দিল ৷ অভিমানের সুরে বলল, তুমি যদি আমায় আশ্রয় না দিতে চাও তবে আমাকে সুইসাইডই করতে হবে— এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই ৷ ওর কথা শুনে মনে-মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম ৷ তাই বাধ্য হয়ে শেষমেশ লীনার প্রস্তাবেই রাজি হতে হল আমাকে ৷ ভাবলাম, আপাতত এটা না-হয় আমার কাছেই থাকুক ৷ পরে ওর মতিগতি বদলে যেতে পারে ৷ তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে গয়নার বাক্সটা ফেরত দিলেই হবে ৷ কিন্তু এই ক’দিনের মধ্যে ওর আর কোনো সংবাদ-ই পাইনি ৷ আমার ধারণা ছিল, ওদের দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো মিটমাট হয়ে গেছে ৷ হাজার হোক, অরুণাংশু ওর স্বামী ৷ তাই লীনা হয়তো লজ্জায় আমার কাছে আসতে পারছে না ৷ কিছুদিন বাদে অন্য কাউকে আমার কাছে পাঠিয়ে সুটকেসটা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে ৷ এই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলাম আমি ৷— তারপর প্রকাশ দারোগাকে লক্ষ করে চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ভাব ফুটিয়ে বললাম, কিন্তু এখন তো মশাই, আপনি আমাকে বেশ ফ্যাসাদে ফেললেন দেখছি! লীনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ তার গয়না-ভরতি সুটকেসটা পড়ে রইল আমার কাছে! এটা নিয়ে আমি এখন কী করি?
আমার কথাবার্তার ধরনে প্রকাশ মিত্তির একটু ঝিমিয়ে পড়ল ৷ এখান থেকে অনেক কিছু খোঁজখবর পাবে বলে ছুটে এসেছিল, কিন্তু যে-তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল ৷ তবু অমায়িক হেসে বলল, মিথ্যেই আপনি ভয় পেয়ে নার্ভাস বোধ করছেন ৷ আপনার আর ফ্যাসাদের কী আছে? শুধু একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে একবার আপনাকে থানায় যেতে হবে ৷ এই সুটকেসটা সেখানে আমরা জমা করে দেব ৷ এর মধ্যে কী-কী আছে তার একটা লিস্ট করা দরকার ৷ তারপর আপনার ছুটি ৷
আমি ভয়ের সুরে বললাম, কী জানি মশাই, কোত্থেকে কী হয়ে যায়! কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা ৷ আপনারাও তো বাঘের চেয়ে কিছু কম যান না ৷
আমার কথার ধরনে প্রকাশ দারোগা হো হো করে হেসে উঠল ৷ তারপর তার বাইকে চেপেই থানায় হাজির হলাম৷ তিনকড়িকে দিয়ে এককুড়ি ডিমও তুলে দিলাম তার ক্যারিয়ারে ৷ দারোগাসাহেব খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, আপনাদের মতো ইয়াং ছেলেদেরই তো এখন দরকার আমাদের দেশে ৷ কী গভীর অধ্যবসায়েই না তিল-তিল করে গড়ে তুলেছেন এই পোলট্রিটাকে! অথচ আজকালকার সব ছেলে-ছোকরাদের দেখুন…রকে বসে গুলতানি করছে, আর মাঝে-মধ্যে এর-ওর কাছ থেকে চাকরির জন্যে দরখাস্ত লিখিয়ে আনছে ৷ নিজের থেকে একটা কিছু করার আগ্রহ একবারেই নেই ৷
আমি তার কথায় বাধা দিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, এ আর কী দেখছেন! কোনোরকমে এটাকে দাঁড় করিয়েছি মাত্র ৷
থানা থেকে কাজ শেষ করে যখন বাইরে বেরুলাম তখন আমার প্রাণ মুক্তির আনন্দে ভরপুর ৷ বিপদের কালো পাথরটা এতদিন ধরে বুকের ওপর চেপে বসেছিল ৷ আজ সেটা নেমে যেতে মনটা হালকা হল ৷ জলভারহীন মেঘের মতো স্ফূর্তির হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে পোলট্রিতে ফিরে এলাম ৷ এখন ওরা অনন্তকাল ধরে লীনার খোঁজ করুক ৷
খুন করাটা যে এত সহজ এ-কথা আগে কখনও ভেবে দেখিনি ৷ সত্যি বলতে কী, খুন করার পর লোকগুলো কী করে ধরা পড়ে সেটাই এখন আমার কাছে খুব আশ্চর্যের মনে হল ৷ আর এইসব মোটা মাথাওয়ালা প্রকাশ মিত্তিররাই তো তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পোরে!
এর পরও প্রকাশ দারোগা আমার ডেরায় বারদুয়েক এসেছিল ৷ ঘুরে-ঘুরে সমস্ত পোলট্রি দেখল ৷ আমার সব কাজ-কারবারও লক্ষ করল খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ৷ অবশেষে একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে বিরস বদনে বিদায় নিল ৷
.
এই ঘটনার মাসদুয়েক বাদে আমি তিনকড়িকে খুন করলাম ৷ তিনকড়ির সেবায় মুরগিগুলো বেশ ভালোই ছিল ৷ তিনকড়িকে সেবা করে তারা আরও পুলকিত হল ৷ ঘাড় ফুলিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করল না ৷ পরের দিন সকালে আমি নিজে থানায় গিয়ে তিনকড়ির নামে একটা ডায়েরি করে এলাম ৷ বললাম, গতকাল রাতে তিনকড়ি আমার আলমারি থেকে হাজার-দুয়েক টাকা নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেছে ৷ ডায়েরি লিখতে-লিখতে গম্ভীর গলায় প্রকাশ মিত্তির আমায় উপদেশ দিল : এখনকার দিনে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই, মশাই! কার মনে কোন মতলব খেলা করছে আগে থেকে তার কোনো আঁচ পাওয়া যায় না ৷ এবার তো শুধু দু-হাজার টাকার ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে গেছে ৷ ও যে আপনাকে খুন করে যথাসর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে যায়নি এর জন্যে মঙ্গলময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন ৷
আমি বিনীত হাসি হেসে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম ৷ প্রকাশ দারোগাকে দেখে আজ আমার খুব মজা লাগছিল ৷
গত দেড় বছরে আরও তিনটে খুন করেছি আমি ৷ তবে শেষের খুনটা আমার মনটাকে একেবারে বিষিয়ে দিয়েছে৷ অনেক খুঁজে-পেতে বিশুকে জোগাড় করেছিলাম ৷ শ্যামবাজারের এক রেস্তোরাঁয় বয়-এর কাজ করত ৷ বছর চোদ্দো বয়েস৷ খুব চটপটে, শরীর-স্বাস্থ্যও খুব ভালো ৷ মুখে সবসময় একটা হাসি-হাসি ভাব ৷ বেশি মাইনে কবুল করায় আমার পোলট্রিতে কাজ করতে রাজি হল ৷ দেশে তার বুড়ো বাপ-মা আছে ৷ মাসে-মাসে মানি-অর্ডার করে টাকা পাঠায় তাদের নামে ৷ মাসদুয়েক কোনো খোঁজখবর না পেয়ে একদিন বুড়ো-বুড়ি দুজনেই সশরীরে হাজির হল আমার ফার্মে ৷ কিন্তু আমি তো কোন ছার, আমার মুরগিগুলোও হয়তো এতদিনে বিশুর কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে ৷ তাদের বললাম, অনেকদিন হল বিশু আমার এখান থেকে কাজ ছেড়ে চলে গেছে ৷ তার হিসেব-পত্তরও সব কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দিয়েছি সঙ্গে-সঙ্গে ৷
আমার কথা শুনে বুড়ি মা-টা তো ভেউভেউ করে কান্না জুড়ে দিল ৷— তবে আমাদের বিশু কোথায় গেল…বাবু? সে কি বুড়ো-বুড়িকে কোনও খবর না দিয়েই পালিয়ে গেল?
তার এই নাকি কান্না আমার ভীষণ অসহ্য লাগল ৷ কড়া ধমক দিয়ে দুজনকেই গেটের বাইরে বের করে দিলাম ৷ কাঁদতে-কাঁদতে ফিরে গেল তারা ৷ কিন্তু এরপর থেকেই আমার মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেছে ৷ ভাবছি, এবার থেকে খুন করার অভ্যেসটা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করব ৷ বড্ড বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় ৷ আগে থেকে হিসেব করে আটঘাট বেঁধে কাজে নামা, কোথাও একচুল ভুলচুক হওয়ার উপায় নেই— তাহলেই একবারে আকাশ ভেঙে পড়বে মাথার ওপর ৷ আর সত্যি বলতে কী, এতে আমার লাভও তেমন কিছু নেই ৷ মাঝে-মধ্যে মুরগিদের পেছনে মাংসের খরচাটা বেঁচে যায় এইমাত্র! তার জন্যে মানুষ খুন করা খাটুনিতে পোষায় না ৷ তবে প্রকাশ মিত্তিরকে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায় ৷ ওকে বাগে পেলে আমি ছাড়ব না ৷ ওই গোবরগণেশ লোকটা মাসে-মাসে গভর্নমেন্টের এতগুলো করে টাকা গিলছে এটাই বা সহ্য করা যায় কেমন করে! একদিন ফাঁক বুঝে দারোগাসাহেবকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে আসতে হবে ৷ মুরগির বিরিয়ানি আর ঝাল-ঝাল কষা মাংসের লোভ দেখালে নিশ্চয়ই না এসে থাকতে পারবে না ৷ তবে সেটা লোকচক্ষুর অগোচরে হওয়া প্রয়োজন ৷ কেউ যেন তার আগমন-বার্তা ঘুণাক্ষরেও টের না পায় ৷ পুলিশের লোক বলে কথা! কোথা থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না ৷ তার জন্যে স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে ৷ তা ছাড়া, দারোগাসাহেব যদি আবার নিজের বাইকে চেপে আসে তবে তো আর-এক ফ্যাসাদ ৷ বাইকটার একটা সদগতির ব্যবস্থা আগে থেকে ভেবে রাখতে হবে ৷ কেননা, সেটা তো আর জোর করে মুরগিদের গিলিয়ে দেওয়া যাবে না ৷
গোলা – জয়ন্ত দে
নোটন মার্ডার হল ৷
নোটনকে মার্ডার করল ছক্কারা ৷ ছক্কারা নোটনকে কীভাবে মেরেছিল এখন আমরা সবাই তা জানি ৷ আমরা মানে আলোদার ছেলেরা ৷ বা পাবলিকের ভাষায় বললে আলোর গ্ৰুপের ছেলেরা ৷
কিন্তু নোটন যখন বেঁচে, আমরা তখনই আঁচ করতে পেরেছিলাম সে মরতে চলেছে ৷ এই মৃত্যুর আঁচ হয়তো আরও অনেকে করেছিল ৷ তারা আলোদার লোকজন নয় ৷ তারা নোটনকে চেনা বান্ধবনগরের পাঁচ পাবলিক ৷ তারা সাহসে ভর দিয়ে মুখে বলত না ৷ কিন্তু বলত, নির্ঘাত বলত, গিলতে গিলতে এবার লিভার ফেটে মরবে ছেলেটা ৷
এই লিভার নিয়ে নোটনের নিজেরও চিন্তা ছিল ৷ তাই সকালের ভাতে পেঁপে সেদ্ধ তার চাই-ই ৷ সকালের ভাত মানে ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ কাম সারাদিনের বাড়ির খাবার এটাই ৷ নোটনের পেঁপে সেদ্ধ খাওয়ার মধ্যে লিভারের দর্শন ছিল ৷ সেদ্ধ পেঁপে লিভার চাঙ্গা রাখে ৷ তেমনই ওর অদ্ভুত যুক্তি ছিল এক বেলা ভাতের ৷ নোটন বলত, চার বেলা বাড়ির ভাত খেয়ে লোহা-লক্কড়ের কারবারি হওয়া যায় না ৷
আমরা আলোদার উদাহরণ দিতাম ৷ বলতাম, এক নম্বর কারবারি তো আলোদা, নোটন হাসত ৷ বলত, আলোদা খোদ কোম্পানি ৷ আর আমরা হলাম লোহা লক্কড়ের খুচরো বিক্রেতা ৷
তো এই এলাকার এক নম্বর কোম্পানি আলোদা বলত, লোহা লক্কড় কোমরে নিয়ে ঘুরলেই কেউ কারবারি হয় না৷ তোকে সবাই জানে— তুই মাতাল ৷ নেতা সেজেছিস মদো মাতালের ৷
তবু আমরা সেই মদো মাতালরাও মিলে মিশে আলোদাকে ঘিরে প্রত্যহ নরক গুলজার করি ৷ আর এখানেই আমরা মাঝে মাঝে এঁকে ফেলি নোটনের মৃত্যুদৃশ্য ৷ আমাদের সামনের চেয়ারে নোটন ৷ সে তখন দাঁতে নখ খোঁটে ৷ মরণদৃশ্যটা আমরা এভাবে আঁকি, বান্ধবনগর পোস্ট অফিসের উলটো দিকের সেই গলি ৷ গলিটা এঁকে বেঁকে নোটনের বাড়ির দিকে গেছে ৷ নোটন মধ্যরাতে সেই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরে ৷ রাস্তার ধারে পর পর ক’টা ডোবা আর পুকুর ৷ আমরা বলেছিলাম, সেই পুকুরের কথা ৷ এঁকে ছিলাম, সেই পুকুর ভরা জলের ছবি ৷
এটা ছিল স্রেফ সাদা কালো একটা দৃশ্য ৷ এখানে যে যেমন খুশি রং দিত ৷ রং ছেটাত ৷ কেউ বলত, জলে একবার পড়লে ও হাঁটু জলে হাবুডুবু খেয়েই শেষ ৷ কেউ বলত, পাঁকে মুন্ডু গুঁজে যাবে ৷ আর নেশার ভারে বাটখারা হয়ে ওই মুন্ডু টপ করে গেঁথে যাবে ৷
নেশা করে করে নোটনের এখন হাত পা কাঁপে ৷ ও যদি পুকুরে পড়ে আর উঠতে পারবে? আমাদের কথা শুনে নোটন হাসত ৷ বলত, এখানকার সব পুকুরের দম আমি জানি— কেউ আমাকে হজম করতে পারবে না!
এবার আমাদের আঁকা নোটনের মরণ দৃশ্যে রং দিল আলোদা ৷
বলল, ছক্কার কথা ৷
আলোদার কাছের ছেলে নোটন মানতে পারল না এ কথা ৷ ও কাঁপা হাত উঁচিয়ে বলল, ছক্কা ভালো হতে চায় আলোদা ৷
আলোদা বলল, ছক্কা ক্রিমিনাল ৷
আজ আমার নাইট ডিউটি ৷ অগত্যা সকালে আলোদার অফিসে ৷ খবরের কাগজ থেকে মুখ নামিয়ে আমি বললাম, এলাকার লোকে কিন্তু আমাদেরও ক্রিমিনাল বলে ৷
আলোদা বলল, আমাদের বলছিস কেন? বল, তোমাদের!
আমি বললাম, অবশ্য ক্রিমিনাল বলার আগে পলিটিক্যাল কথাটা জুড়ে দেয় ৷
আলোদা বলল, ওই জন্যেই তো পার্টিটা ছাড়লাম ৷ সকলের মনে রাখা উচিত বয়েস বাড়ছে ৷ এখনও আমাদের চলতি আছে ৷ যে যেভাবে পারিস ব্যবসা ধান্দা করে গুছিয়ে নে ৷
আমি চাকরি করি ৷ এমন চার-ছ’জন ৷ আর সবাই ধান্দা খুঁজছে ৷ আর ধান্দার তো এখন একটাই জাতীয় সংগীত— কনস্ট্রাকশন ৷ যে সংগীতের মুখড়া দালালি, অস্থায়ী ইট বালি সাপ্লাই, অন্তরা প্রমোটিং ৷
আর এইসব কাজকারবার লাগলে ভালো, না লাগলে ছিঁচকে ! তো আমাদের সবার সব রকম ধান্দা ছিল ৷ হাতে কলমে না থাকলেও মনে মনে তো ছিলই ৷ কিন্তু নোটনের একটাই ধান্দা ছিল, সে মদ খাবে ৷ দিনে খাবে, রাতে খাবে, সারা দিন খাবে ৷ আমরা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম সারা দিন খাস না ৷ রাতে খা আর দশটা বাজার আগে বাড়ি ঢুকে যা ৷ নোটন আমাদের কথা শুনত এই পর্যন্তই ৷ পাত্তা দিত না ৷ বলত, এখন আমাদের ভালো টাইম ৷ কোনো ঝামেলা নেই ৷ যখন সাহেব বাগানের চিল্কা, কালী বাড়ির যিশু-নয়নরা ধরলেই দানা ভরে দিত তখনও আমি এমনই থেকেছি ৷
নোটনের কথায় আলোদা চোখ বন্ধ করল ৷ তারপর আমাদের আঁকা নোটনের সেই মরণ-দৃশ্যের ওপর ভয়ঙ্কর এক পোঁচ কালি বুলিয়ে দিত ৷ বলত, ছক্কারা তোর জন্যে একটাও দানা খরচ করবে না ৷ সেরেফ একটা ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দেবে ৷ নোটন তোর নম্বর লেগে গেছে!
নোটন দু’হাতের চেটোয় মুখ মুছে আমাদের কথাও মুছে ফেলত ৷ তবে এসব কথায় সব সময়ই ও কিছু একটা বলত বিড় বিড় করে ৷ যা আমরা শুনতে পেতাম না ৷
এদিকটা আমাদেরই চলতি ৷ আগে আমরাই পার্টি ছিলাম ৷ পার্টির জন্যে ইলেকশন করতাম ৷ আর পার্টি আমাদের পুলিশটা দেখে দিত ৷ আমাদের যা ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি সব ওই ইলেকশনের আগে পিছে ৷ আর ইলেকশনের দিন আমরা খুল্লাম খুল্লা ওয়ান ডে খেলে দিতাম ৷ এতেই আমাদের বারো মাস চলে যেত ৷ পার্টি প্রশাসন আমাদের ৷ ফলে গড়িয়ে খেলেও ফুরোত না ৷ আর বাদবাকি যেটুকু হাত চালাতে হত তা কিছুটা সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায়, কিছু অন্য কোনও দাদা গজালে ৷ তারপর এত বড় টিম, এত বড় এলাকা— ঝামেলা তো আছেই ৷
তবে ঝামেলা ইদানীং বেড়ে গিয়েছিল পার্টির মধ্যে ৷ পি.এস. পুলক সেনের সঙ্গে আলোদার চিরকেলে খিঁচ ৷ ইলেকশনের আগে আলোদাকে বলা হল, তোমরা বুথ নেবে ৷ ফ্রেশ ছেলে এলাকা চমকাবে ৷ তো ফ্রেশ ছেলেরা এল মহেশতলা থেকে ৷ তারা শেষ তিন দিন থেকে মাল মাংস ধ্বংস করে বুথ চিনল, এলাকার অলিগলি চিনল, বেছে বেছে দু-চারটে বাড়ি, ছ’-আট জন লোক চিনল ৷ ওদের মদ থেকে মেশিন সব দায়িত্ব আলোদার ৷ তারপর ওয়ান ডে ম্যাচ হয়ে গেল ৷ আর শেষে পার্টি ডেকে বলল, তোমাদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের জন্যে পার্টির দু’পার্সেন্ট ভোট কমেছে ৷
আলোদা চোখ বন্ধ করে বলল, থার্টি পার্সেন্ট ছাপ্পা, টেন পার্সেন্ট চমকানো ৷ এক-একটা বুথে নাইন্টি সিক্স নাইন্টি সেভেন পার্সেন্ট পোল করিয়ে দিলাম, তবু টু পার্সেন্টের কেস! সমাজবিরোধী! ইদানীং সব ইলেকশন শেষেই এক গীত ৷ পুলক সেন হাসছে ৷
আলোদা পার্টি ছেড়ে দিল ৷ আলোদার সঙ্গে আমরাও ৷
তবু এ এলাকায় আলোদাই শেষ কথা বলে ৷ আর শেষ কথা বলার হক যেহেতু আলোদার, ফলে আমাদের কাছে কেসের অন্ত নেই ৷ প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে আমাদের কাছে ৷ তারা সবাই আমাদের দিয়ে আলোদাকে ধরতে চায়৷ তাই তারা প্রথমে আমাদের ধরে ৷ ফলে তারাই আমাদের স্পনসর ৷
এছাড়া কাউকে না কাউকে পাওয়া যায় যে আমাদের মুরগি হয় ৷ তারপর ফাউয়ের টাকা আছে ৷ কেস মেটানোর ধান্দা আছে ৷ তারও পরে বৃষ্টি আছে, শীত আছে ৷ পকেটে ক্যাশ আছে ৷ নাহলে ধার আছে ৷ এবং সর্বক্ষণ বান্ধবনগর পোস্ট অফিসের সামনে নোটন আছে ৷
আমি চাকরি করি ৷ খবরের কাগজের চাকরি ৷ দুপুরে বেরিয়ে মধ্য রাতে বাড়ি ফিরি ৷ মাঝে মাঝে রাতে বান্ধবনগরের মোড়ের মাথায় নোটনের দেখা পাই ৷ ও কোনোরকমে চোখ টেনে বলে, তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি পলু ৷ একটু খাবি তো ৷ চিকেন কষা বা রুটি তড়কা যা হোক আনিয়ে নে ৷
আমি ঘাড় নাড়াই, খাব না ৷ নোটন বলে, তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি— না খেলে একশো টাকা দিতে হবে ৷
আমি হাসি— আর খেলে?
নোটনের সোজা হিসেব, ওই একশো ৷ তুই কি ভাবছিস খেলে বেশি নেব?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য রফা হয় ৷ তা এক-একদিন এক-এক রকম ৷ এর মধ্যে বেশির ভাগ দিনই ছিল প্রতিশ্রুতি ৷— আমি পুরো বোতল দেব ৷—আমি চায়না টাউনে নিয়ে যাব ৷ ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ তবে সব হিসেবপত্রের কথা মিটে গেলে প্রতিবার নোটন একটা প্রশ্ন করত ৷— তোর হাতে রোজ বই দেখি, সব বই তুই পড়িস পলু?
— না, সব বই পড়া হয় না ৷ কিনে রাখলাম, পরে পড়ব ৷ তাছাড়া কখন কোন বই দরকার লাগে ৷ রইল হাতের কাছে ৷
আমাদের নিয়ে আলোদা খুব বিব্রত ৷ বলত, এটা মদো মাতালের টিম ৷ আলোদার টিমের এরকম নানা ভাগ ৷ কোনোটা মদো মাতাল ৷ কোনোটা লোহালক্কড় মানে অ্যাকশনের ৷ কোনোটা লাফরা টিম ৷ এই লাফরা টিম বিভিন্ন জায়গায় শুধু ঝামেলা পাকায় ৷ আরও একটা টিম আছে, যাদের দেখিয়ে আলোদা বলে— ওদের দেখ, দেখে শেখ ৷ এরা ব্যবসায়ী ৷ আমরা বলি মুখোশ টিম ৷ ধান্দাবাজদের হাট্টিমা টিম টিম! কিন্তু নোটনের কদর সব টিমে ৷ কেন না নোটন হচ্ছে আলোদার টিমের হোল টাইমার ৷
আসলে অ্যাকশন টিমের ছেলে নোটন ৷ সেই নোটন এখন মদো মাতাল টিমের অবিসংবাদিত নেতা ৷ এই টিমের পুরনো ছেলে দেবু সকালে খায় না ৷ রাত পর্যন্ত কোচিং ক্লাস ৷ ফলে রাতে সময় পায় না ৷ খেলেও মাপ বাঁধা ৷ আর এক পুরনো ছেলে অনু ৷ ও আগের মতো নেই ৷ মুখ চুন করে বলে— বউ ক্যাচাল করে ৷ ছেলেটা বড় হয়েছে ৷
তবু পুরনো ছেলে অনেকই আছে ৷ যাবেটা কোথায়? আর নিত্য নতুন ছেলে আসছে ৷ ক’দিনে তারা পুরোনো হচ্ছে ৷ আসলে আলোদার ছেলেদের গ্ৰুপ সব সময় আলো করা ৷ কেউ না কেউ থেকেই যায় ৷
ইদানীং আমরা কয়েকজন কিছুটা ছিটকে গেছি ৷ ছুটির দিন ছাড়া পারতপক্ষে ওদিকে যাই না ৷ গেলেও কোনো ঝামেলায় ঢুকি না ৷ হাবিজাবি গল্প করে কেটে আসি ৷ এখন মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, কী করতে চাইছে ওরা সবাই? শুধু কি একটাই কাজ— নিজেদের চলতি করা ৷ এলাকায় কায়েম রাখা?
একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে নোটনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ নোটন বলল, পলু একটা জিনিস দেখবি? আমি বললাম, কী?
নোটন প্যান্টের পিছন কোমর থেকে একটা রিভলভার বের করল ৷ বলল, ফরেনের মাল ৷ জাপানি ৷ হেভি জিনিস ৷ পঁচিশ চাইছে ৷ ভাবছি রেখে দেব ৷
আমি বললাম, আর এসবে কী হবে নোটন? লোহা লক্কড়ের গল্প ছাড় না ৷
নোটন হাসল ৷ বলল, যদি কোনো সময় দরকার লাগে ৷ তারপর নোটন আরও হাসতে হাসতে বলল, তুই এত বই কিনিস কেন পলু? সব তো পড়িস না বললি ৷ তোর মতোই আমিও কিনে রাখছি, যদি কখনও দরকার পড়ে ৷ রইল হাতের কাছে ৷
দুই
নোটন মার্ডার হল ৷
নোটনকে মার্ডার করল ছক্কারা ৷ মার্ডার করে ওরা সাত সকালেই চলে গেল পুলিশের কাছে ৷ ওদের কাছে পুলিশ হেপাজতই তখন সব থেকে নিরাপদ ৷ ওরা জানত আলোদার কাছের ছেলে নোটন ৷ আলোদা ওদের ছাড়বে না ৷ তবে পার্টি ওদের পিছনে ৷ পার্টি মানেই আইন প্রশাসন ৷ তাই আপাতত সেফ জেল কাস্টডি ৷ তারপর এলাকা ঠান্ডা হলে বেরিয়ে আসবে ৷
জেল থেকে খবর আসছে— ওরা কীভাবে নোটনকে মেরেছে ৷ জেলে ওদের ফাইলের যে মেড তার থেকে খবর আসছে ৷ ওদের ফাইলের অন্য গ্ৰুপের ছেলে পত্তর নোটন খুনের গল্প শোনাচ্ছে ইন্টারভিউতে ৷
আমরা শুনছি আর আশ্চর্য হচ্ছি ৷ —আরে এ যেন হুবহু আমাদের সেই বলে দেওয়া কথা ৷ আমাদেরই এঁকে ফেলা নকশা! সেই পোস্ট অফিসের উলটো দিকের গলি ৷ সেই মদ খেয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে যাওয়া মাতাল নোটন ৷ মধ্যরাত ৷ ওরা নোটনকে ডেকেছিল ৷ বলেছিল, নোটন এসো একটু খেয়ে যাও ৷
মদলোভী নোটন ‘না’ ‘হ্যাঁ’ করে বসেছিল ওদের সঙ্গে ৷ তারপর সুযোগ বুঝে একজন ওকে জড়িয়ে ধরে ৷ আর একজন পরনের উইন্ডচিটার খুলে হাতা দিয়ে ফাঁস দিয়ে দেয় নোটনের গলায় ৷ তার আগে কী একটা ব্যাপার নিয়ে নোটনের সঙ্গে ঝামেলা লেগেছিল ওদের ৷ কী নিয়ে ওই ঝামেলা তা জানার আমাদের আগ্রহ নেই ৷ কারণ ঝামেলাটা ফালতু! ঝামেলাটা স্রেফ গেম প্ল্যান ৷ পোস্ট অফিসের গলিতেই নোটন মরেছে ৷ তারপর ওকে টানতে টানতে ফেলে দিয়েছে দূরে ৷
কী আশ্চর্য আমরা— আলোদার কথা মিলে গেছে ৷ নোটনকে মেরেছে সেই ছক্কা ৷ আর মারতে একটাও দানা খরচ করেনি ৷ সেরেফ উইন্ড চিটারের ফাঁস, ব্যস!
মদ খেতে খেতে মরে এসেছিল নোটন ৷ ওর হাত পা কাঁপত ৷ ওর কথা জড়িয়ে যেত ৷ ওর মুখের চামড়া তেলা আর লাল হয়ে গিয়েছিল ৷ আলোদা বলত, ওর নম্বর লেগে গেছে ৷
আমরা হাসতাম ৷ নোটনও হাসত ৷ নোটন বলত, মদ খেয়েই তো অ্যাকশন করেছি— এখন অ্যাকশন নেই বলে মদ ছেড়ে দেব? আর যে দিন থেকে লাইনে এসেছি সে দিনই নম্বর লাগিয়ে এসেছি ৷
এই লাইন কথাটা আলোদা বলত ৷ লাইন কথাটা নোটনও অবলীলায় বলতে পারত ৷
নোটনের লাইনে কেমন যেন আলো আর আঁধার থাকত ৷ সেখানে কেমন যেন ঘোর ঘোর এতোল বেতোল পা ফেলা ৷ যেন উলটো দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ট্রেন ছুটে আসছে ৷ দু’চোখ অন্ধ করে দেওয়া তার আলো ৷ গম গম চাকার ঘষটানিতে মৃত্যুর গান ৷
আগে লাইনের কথায় রোমাঞ্চ হত ৷ অ্যাকশন করতে পারতাম না ৷ কিন্তু অ্যাকশনের কথায় ছটফট করতাম ৷ মারপিটের গল্প পেলে হাঁ করে বসে গিলতাম ৷ কী ভয়ঙ্কর এক একটা গল্প! ওরা চিল্কাদের সঙ্গে লড়ছে ৷ কীভাবে আলোদা একা একা ওদের এলাকায় ঢুকছে, এ হাতে রিভলভার, ও হাতে বোম ৷ ওরা যিশু নয়নদের সঙ্গে লড়ছে ৷ রাত নামলেই এলাকা কুরুক্ষেত্র ৷ টান টান উত্তেজনা ৷ দিনে সবার দেখা পাওয়া যায় না ৷ সন্ধে নামলেই সবাই জড়ো হয় ৷ তারপর চিল্কা এলাকা ছাড়ল ৷ যিশু-নয়নও হাওয়া ৷ আলোদা বলে, পিসফুল এলাকা! আলোদা বলে, কিন্তু আমাদের লাইফ পিসফুল নয় ৷ যে-কোনওদিন যে-কেউ সদর দরজার সামনে মার্ডার হয়ে যাবে ৷ কে কোথায় আমাদের কী গেম সাজাচ্ছে আমরা জানি না ৷
আলোদার কথায় আমার ভয় করত ৷ মনে হত আমারও যেন মৃত্যু বাঁধা ৷ ছুরি গুলি বোমা ৷ বোম গুলি ছুরি ৷
এখন এসব কথা শুনলে গা গুলিয়ে ওঠে ৷ মনে হয় সব যেন অচেনা ৷ আমি ক্রমশ সরে আসছি ৷ চার বেলা বাড়িতে খাই ৷ ইদানীং অন্ধকারে ওদের মুখগুলো বড় অচেনা ঠেকে! আলোয় এলে ওদের চেনার চেষ্টা করছি ৷ ওরা কি আলো আর অন্ধকারে পালটে পালটে যায়? কেমন সবাই বলে আমারও কি তাই মনে হয়? তবু যাই ৷ ঘুরে ফিরে ওদের কাছাকাছি চলে যাই ৷ নাইট ডিউটি থাকলে সকালে যাই ৷ ছুটির দিনে রাতে ৷ পাড়ার মেয়ে গিতুর সঙ্গে প্রেম করি ৷ করি না করতাম— কে জানে? সারা সপ্তা ধরে গিতুকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি ৷ ভুলে যাই ৷ কিন্তু ছুটির দিন সন্ধেবেলা গিতু ঠিক টেনে নেয় আমাকে ৷ আগে ওকে নিয়ে বন্ধ ই সি এলের ভেতরে ঢুকতাম ৷ এখন গ্ৰুপের কারোর নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢুকে পড়ি ৷ মিস্তিরিদের কাছ থেকে মাদুর নিয়ে তিনতলা, চারতলায় উঠে যাই ৷ আমি ক’টা খবরের কাগজ নিয়ে আসি ৷ মাদুরে পেতে দারুণ বিছানা করে ফেলি ৷ গিতু আনে মশার জন্যে কয়েল ৷ আমি তখন ওর শরীরে মুখ রগড়াই ৷ গিতু আমাকে প্রশ্রয় দিতে দিতে বলে— এবার একটা ফ্ল্যাট কেনার ধান্দা করো ৷ চার তলায় নেবে ৷ টপ ফ্লোর৷ আমরা জানলা খুলে শোব ৷ অত ওপরে মশা থাকবে না ৷
আমি গিতুর ওপরে শুয়ে হৈমন্তিকার কথা ভাবি ৷ ক্রেডিট কার্ডের চেক নিতে আসা হৈমন্তিকাকে ব্যাপক লাগে ৷ ফোনে গল্প করি ৷ ও মোবাইলে মেসেজ পাঠায় ৷ আমি কাজের ফাঁকে আঙুল আর নখে উত্তর দিই ৷ এমন উত্তর যাতে দু’রকম মানে হয় ৷ বন্ধু বললে বন্ধু, অন্য কিছু হলে অন্য কিছু!
নীচে নামার সময় গিতুকে বলি, আগে যাও ৷
গিতু ফুঁসে ওঠে, কেন আমরা কি চুরি করছি?
— ফাঁকা বাড়ি থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে শুধু শুধু কেস খাবার কোনো যুক্তি নেই ৷
গিতু তেড়িয়া হয়ে জবাব দেয়, যারা কেস দেবে তারা তো হয় ঝি নয় অন্যের বউ নিয়ে ঢোকে! তুমি কি তাই? আমরা সবার সামনে দিয়ে প্রেম করব ৷
গিতু বোঝে না ৷ ও বড় রাস্তায়, আলোতে এসেও আমার শরীরের সঙ্গে মিশে হাঁটতে চায় ৷ অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে জোরে জোরে হাসে ৷ এটা খাওয়াবে? ওটা খাওয়াবে— করে বায়না জোড়ে ৷ টাকা দিয়ে কেটে আসি ৷
এ সময় আমার মানি ব্যাগে বেশি টাকা দেখলে গিতু কেমন ভয় পায়! বলে, এত টাকা নিয়ে মাল খেতে যাচ্ছ? আমার কাছে রেখে দাও— কাল নিয়ে নেবে ৷
আমি যে গিতুকে বলতে পারি না, কাল যে তোমাকে ভুলতে চাই! এই রাত থেকেই তোমাকে ভুলে যাওয়ার অভ্যেস করব! গিতু জানে না, আজ ওর নগ্ন পিঠে আমি একটা একটা আঙুল আর নখ ছুঁইয়ে হৈমন্তিকার জন্যে মেসেজ ভাসিয়েছি! এ সপ্তাহে আমার দুদিন নাইট ডিউটি ৷ নাইট ডিউটির সময় হৈমন্তিকার সঙ্গে দেখা হয় ৷ ও আমাকে ওর অফিসের অনেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে ৷ আমি বুঝি ও কোথাও আলাপ করানোর সময় আমার আগে আমার অফিসের নামটা বলে ৷ খবরের কাগজের নামে কেমন এক জাদু আছে!
ইদানীং আমার পাড়ার বন্ধুরাও তাই করে ৷ ওদের সঙ্গে তাল রেখে আমিও করি ৷ তাতে রেজাল্ট বেশ ভালো! আমার দিকে সবাই কেমন এক সম্ভ্রমের চোখে তাকায় ৷ এলাকার নতুন কেউ আমার সঙ্গে মিশলে, প্রথমে ঢোঁক গিলে, তারপর পারমিশন নিয়ে বলে— ওদের সঙ্গে কী করে মেশেন?
ওরা মানে আলোদা? ওরা মানে আমার বন্ধুরা— আলোদার ছেলেরা ৷
এসব কথায় এখন আমি দারুণ হাসতে শিখেছি ৷ হাসতে হাসতে প্রশ্নকারীকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিই! সে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা নিয়ে গোলকধাঁধায় ছোটাছুটি করে ৷ আমি হেসে যাই ৷ হাসতে হাসতে চেপে যাই ওদের সঙ্গে মিশে আমি বড় হয়েছি, বাঁচতে শিখেছি! এসব কথা চেপে আমি বলি— আমি কাজের স্বার্থে মিশি! আর তারা সাহস পেয়ে বলে, ওরা আপনার লেখার সোর্স— তাই বলুন! ঠিক সন্দেহ করেছি ৷
যথারীতি আমি হাসি ৷ এ হাসিটা আমি আলোদার কাছ থেকে শিখেছি ৷ এই হাসিতে নিজেকে চেপে যাওয়ার কথাটাও আমি আলোদার কাছ থেকে রপ্ত করেছি ৷
এ কায়দায় আলোদা ওদের মদো মাতালের টিম বলে ঘেন্না ঘেন্না করে ৷ অ্যাকশনের মারকুটে ছেলেদের লোহালক্কড়-এর টিম বলে নির্লিপ্ত মুখে তাকায় ৷ যেন এরা আলোদার কেউ নয় ৷ যেটুকু তা শুধু বিরক্তি ৷ এ চালে নতুন যারা তারা খুব ঘাবড়ে যায় ৷ আমরা আলোদার ডায়ালগে হো হো করে হাসি ৷
আর অলোদা মুখোশ টিমকে দেখিয়ে বলে, ওদের কাছ থেকে শেখ ৷ আমরা বুঝি, ইদানীং এদের কাছ থেকেই আলোদা বেশি শেখে ৷ এটা অন্য ছেলেরা শিখবে কী করে, শিখতে গেলে যে বাবার টাকা লাগে ৷ আসলে আলোদা নিজেকে আড়াল করে ৷
আমিও নিজেকে আড়াল করি ৷ পুরনো বন্ধুদের কাছে ভদ্র ভালো ছেলে হয়ে যাই ৷ অফিসে গুলি বোমা ছুরির গল্প করি ৷ হৈমন্তিকার কথা ভাবতে ভাবতে গিতুর শরীরে মুখ গুঁজে থাকি ৷
আসলে আড়ালের ওপারে আমি ৷ আড়ালের এপারে আমি ৷ আমি নিজেকে দেখি ৷ কোথায় যেন একটা চোরা টান৷ ফলে অমাবস্যায় পূর্ণিমায় দিকভ্রান্তের মতো ফুলে ফেঁপে ছুটি ৷ মদো-মাতালের টিমে ভিড়ে গিয়ে গেলাসে মুখ থুবড়ে বসি ৷
বোতল থেকে মদের সঙ্গে গেলাসে গেলাসে নোটনের কথা বিলি হয়ে যায় ৷ যথারীতি নোটনের কথায় গলা-বুক জ্বালিয়ে মদ ঢালি ৷ গেলাসে কালচে-লাল তরল ৷ ঝটকা মেরে দেখি নোটনের গলায় ফাঁস হয়ে বসা উইন্ডচিটারের রং কি এমনই ছিল? চিৎকার করি, গেলাসের রংটা ফিকে করে দে ৷ জল ঢাল ৷ তবু পেটের গহ্বরে চলে যেতে গিয়ে সে তরল গলা রুদ্ধ করে ৷ মনে হয় ফিকে লাল একটা উইন্ডচিটার! তবে কি নোটন একা নয় আমাদেরও শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে রংবেরঙা এক একটা উইন্ডচিটার ৷
তিন
এরকমই একটা ছুটির দিনে ঠেকে যাব না, যাব না করে চলে গেছি ৷ তার আগে সন্ধেবেলা গিতুর শরীরে শরীর রেখে হৈমন্তিকার দিকে মন উড়িয়ে দিয়েছি ৷ ফিসফিস করে গিতুকে বলেছি, আমাকে ছেড়ে দে ৷
গিতু বলল, চলো বিয়ে করি ৷
— আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷
গিতু বলল, তখন রোববারের জন্যে হা পিত্যেস করে বসে থাকতে হবে না, রোজ পাবে ৷
আমি বললাম, আমি তোমায় ভালোবাসি না! খালি মনে হয় তুমি আমার গলা টিপে ধরেছ ৷
গিতু আমাকে গা থেকে ঝটকা মেরে ফেলে লাথি ছুড়ল ৷ বলল, তবে রোববার হলেই এসে মুখ রগড়াও কেন? বিষ ওগরাতে!
আমি কোনো কথা বললাম না ৷
গিতু বলল, এবার বলো, কে কার গলা টিপল!
ঠেকে এসে না না করেও নেশা চড়িয়ে ফেললাম ৷ উইন্ডচিটার-রঙা মদ! খাচ্ছি আর ভাবছি, কে কাকে গলা পেঁচিয়ে মারছি— গিতু আমাকে? না আমি গিতুকে?
গলায় হাত বোলাতে বোলাতে ঠেক থেকে বাড়ি ফিরছি ৷ আমাদের বাড়ির সামনে লাফরা জগার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ৷ আমাকে দেখে লাফরা জগার ভাই দাঁত কেলিয়ে বলল, পলুদা ঠেক থেকে ফিরছ? নিশ্চয় পোগ্গাম ছিল?
আমি দেখলাম জগার ভাইয়ের হাতে কালো রঙের ব্যাগ ৷ ব্যাগের ভেতর কী যেন ধড়ফড় করছে ৷ বুঝলাম কারও বাড়ি থেকে নির্ঘাৎ কিছু ঝেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷ আমি বললাম, ব্যাগে কী রে?
ও আমার কথা শুনেই কেটে যেতে যেতে বলল, কাল বলব ৷
আমি খপ করে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরি ৷— পেটে এক লাথি মারব ৷ কী নিয়ে যাচ্ছিস আগে দেখা ৷
লাফরা জগার ভাই তেরিয়া হয়ে বলল, তুমি কিন্তু মাল খেয়ে বাওয়াল করছ পলুদা ৷
—তুই আমার বাড়ির সামনে থেকে চুরি করে যাবি, আর আমি তোকে ছেড়ে দেব ৷ কথা শেষে ওর গালে একটা চড় কষালাম ৷
চড় খেয়েই ও বলল, ঠিক আছে— তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, মাল খালাস করে দিচ্ছি ৷
আমার সামনেই ও ফস করে ব্যাগের চেন টানল ৷ ব্যাগটা খুলতেই দেখলাম— ভেতরটা নিশ্চুপ অন্ধকার! জগার ভাই ব্যাগের মুখ হাঁ করে বলল, নিয়ে নাও ৷ ব্যাগটা আমার ৷
ব্যাগের পেটের অন্ধকারে আমার কেমন গা শিরশির করছে ৷ আমাকে ভেতরে হাত দিতে বলছে, কী আছে ভেতরে? হাত দিলে কি কামড়ে দেবে? এ শালা আমাকে কামড় খাওয়াতে চাইছে!
আমি দাঁত ঘষটে বললাম, চালাকি করছিস আমার সঙ্গে!
জগার ভাই বলল, চালাকির কী আছে ৷ বলেই ও ব্যাগ উলটে দিল ৷ ব্যাগের ভেতর থেকে থস থস করে দুটো নিষ্প্রাণ পায়রা পড়ে গেল মাটিতে ৷ আর একটা মাটিতে পড়ে মুখ রগড়ে ঝটপট করে উঠল ৷
আমি কিছু বলার আগেই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল জগার ভাই তারপর দুটো পায়রাকে হাতে নেড়ে চেড়ে বলল, মালগুলো মরে গেছে পলুদা ৷
আমি বিড় বিড় করলাম, একটা বেঁচে!
জগার ভাই বলল, প্যারাসুট কাপড়ের ব্যাগ— হাওয়া পাস করেনি, সব কেলিয়ে গেছে ৷
ব্যাগটা ভাঁজ করে একটুখানি ৷ সেটা হাতের থাবার ভেতর নিয়ে জগার ভাই হাওয়া হয়ে গেল ৷
দু’পা এগিয়ে বাড়ির গলিপথে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি ৷ ডাইনে বাঁয়ে এবাড়ি-ওবাড়ির দেওয়ালে, পায়ের নীচে কঠিন মাটি, মাথায় টুকরো করা আকাশ আর সামনে পিছনে নিরেট অন্ধকার ৷ আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম ৷ শুধুমাত্র শ্বাস নেওয়ার জন্যে বুকটা হাপরের মতো করে নাকটা মুখটা ওপরে তুলে ধরলাম ৷
সকালে আলোদার ঠেকে যাওয়ার কথা ছিল না ৷ তবু গেলাম ৷ গিয়ে গড় গড় করে কাল রাতের কেসটা বললাম ৷
আলোদা বলল, ফালতু ব্যাপার— ছাড় তো পলু ৷
আমি বললাম, ফালতু ব্যাপার কী— দম বন্ধ হয়ে পায়রাগুলো মরে গেল!
আমার কথা শুনে অনেকে হেসে উঠল ৷
আলোদা বলল, ওগুলো গোলা পায়রা ৷
আমি চমকে উঠে আলোদাকে দেখলাম ৷ দিনের আলোর মতো চেনা আলোদাকে ইদানীং চন্দননগর চন্দননগর লাগে ৷ আলোদার সব কিছু যেন এখন টুনি বালবের নকশা ডিজাইন করা ৷ জ্বলছে নিভছে ৷ নিভছে জ্বলছে ৷
আমি বললাম, গোলা পায়রার জন্যে তোমার কোনো দুঃখ হয় না?
আলোদা দু’হাতে মুখ মুছল ৷ তারপর খুব শান্ত গলায় বলল, তোর প্রতি আমাদের অনেক আশা পলু! আমি তো সবাইকে বলি, পলু আমাদের অনেক বড় হবে ৷ একদিন আমরা গর্ব করে বলব তোর কথা ৷ বলব, পলু আমাদের ছেলে! আজ কত বড় হয়েছে!
আমি বললাম, কত বড় আলোদা? লক্কা হয়ে মেঘ ধরব, না হোমর হয়ে চাঁদ ধরব?
ঠান্ডা চোখে আলোদা বলল, তুই কেন পায়রা হবি?
— কেন হব না? হয় গোলা, নয় লক্কা, নয় হোমর ৷ উইন্ডচিটার, বা প্যারাসুট কাপড়ে তেমন কোনো তফাত নেই আলোদা ৷
আলোদা কোনো কথা বলল না ৷ আলোদার গলায় ঘাম ৷ নাকের পাটা ফুলছে ৷ রগের চামড়ার নীচে সেই ঠেলে ওঠা রাগের পোকা ৷ দাঁতে দাঁত চেপে আলোদা কঠিন হয়ে বসে থাকল ৷
বেলা গড়িয়ে যায় ৷ ঠেক ভাঙলে একসঙ্গে উঠি ৷ দোতলা থেকে একতলা নীচে নামার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আলোদা আমার কাঁধে হাত রাখল ৷ ফিসফিস করে বলল, তবে গোলা পায়রাকেও বেড়ালে খেলে আমার বড় জ্বালা! এই বয়সেও আবার বেড়াল শিকারে যেতে হবে ৷
এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভাঙি ৷ আমি কি এখন আলোদাকে বলতে পারি, ঠিকই তো বাঘের এলাকায় বিড়াল ঘুরবে তা হয় না! আমি কি এখন আলোদাকে বলতে পারি, বাঘ আর বেড়াল একই!
না বলতে পারি না ৷
আলোদার বাইক গর্জন করে ছুটে গেলে সাদা কালো ফিনফিনে ধোঁয়ায় দাঁড়িয়ে থাকি ৷
চিত্রনাট্য – সুজন ভট্টাচার্য
বন্ধ জানলার ওপার থেকে বৃষ্টির শব্দটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। বাড়িটার সামনে টিনের শেডটার উপরে হুড়মুড় করে জল আছড়ে পড়ছে বলে শব্দটা বেশ জোরেই বাজছে। বাইরের অন্ধকার আর কিছু টের পাবার উপায় নেই। এমনিতেই বাড়িটা একটেরেয়া। দিনের বেলাতেই লোকজনের খুব একটা দেখা মেলে না। সন্ধে নামলে আস্তে আস্তে চারপাশের অন্ধকারে বাড়িটাকে গিলে ফেলতে শুরু করে। নিজস্ব আলোটুকু দূর থেকে যেন আকাশের তারার মতোই লাগে। সুমন্ত্র এখানে পা দিয়েই তাই বোধহয় বলেছিল—বাড়ি করার আর জায়গা পেলে না শঙ্কর! রাতবিরেতে একটা কিছু হয়ে গেলে কেউ তো টেরও পাবে না।
শঙ্কর হাহা করে হেসে উঠেছিল—টের না পাওয়াই তো ভালো গো সুমন্ত্র। সবকিছু ঠিকঠাক নেমে যাবে প্ল্যানমাফিক; অথচ কেউ টেরটিও পাবে না, এমনটাই তো চাই।
তোমার কথা বোঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কম্মো না,—সুমন্ত্রও হেসে ওঠে।
জানলার পর্দাটা সামান্য সরিয়ে শঙ্কর বাইরে চোখ রাখে। নাঃ, বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও নজরে আসছে না। এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করতেই তো কতটা সময় চলে গেল ওর। চাইবাসা স্টেশন থেকে সরাসরি যাবার মতো গাড়ি নেই। জঙ্গলের ট্রাক আর পায়ে হাঁটাই সম্বল। পশ্চিম সিংভূম জেলার গভীর অরণ্যের মাঝখানে তামসাইয়ের এই বাড়িটার সংবাদ ও পেয়েছিল জামসেদপুরেই। যাদবপুরের ফ্ল্যাটে একা একা থাকা তখন ওর পক্ষে প্রায় অসহ্য হয়ে উঠেছে। ভিতর থেকে একটা শূন্যতা যখন হঠাৎই লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে হজম করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কলকাতার পাট প্রায় চুকিয়ে শঙ্কর তাই তখন ঘুরে বেড়ায় এখানে—ওখানে।
জামসেদপুরে দিমনা লেকের ধারে লোকটার সাথে আচমকা আলাপ হয়েছিল। শঙ্কর তখন একটা চেয়ারে বসে একমনে দেখে যাচ্ছিল একটা কাপলকে; বউটার খিলখিল হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে তার পরিবর্তনের বয়েসটা খুব বেশি নয়। মিলিও এমনি করেই ঝিলিমিলিয়ে হাসত। ওরা হানিমুনে গিয়েছিল পেলিং। কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসে শরীর ভেজানোর জন্য মিলি যেন পাগল হয়ে উঠেছিল।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি!—শঙ্কর একটা সময় বিরক্তই হয়ে উঠেছিল।
জেনেশুনেই তো একটা পাগলিকে ঘরে নিয়ে এসেছিলে মশাই—মিলি চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল,—এখন রেগে গেলে চলবে! —মিলির এই উচ্ছ্বাসটাই শঙ্করকে সবথেকে বেশি টানত। রাশভারী বাবা আর ডিপ্রেশনের পার্মানেন্ট পেশেন্ট মার সাথে থাকতে থাকতে শঙ্কর যেন শিখে নিয়েছিল আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই হল ভদ্রতা। বিয়ের পরে মিলি যেন জীবনের খাতার একেকটা পাতা উলটে ওর সামনে নতুন করে পড়াতে শুরু করেছিল।
ডোন্ট মাইন্ড,—পাশ থেকে গলাটা শুনেই চমকে উঠেছিল শঙ্কর। বেশ লম্বাচওড়া একটা লোক, স্কুটারটা স্ট্যান্ড করে দাঁড়িয়েছে। স্কুটার মানে লোকাল লোক। বাঙালি!
আজ দিনতিনেক ধরেই দেখছি আপনাকে। সারাটা দিন লেকের পাশে চুপ করে বসে থাকেন। দিমনা আর জঙ্গল আপনাকে বেশ পাকড়ে ধরেছে বুঝতে পারছি। জঙ্গলে একটা আস্তানা বানাবেন নাকি? আমার সন্ধানে আছে। একদম ভার্জিন ফরেস্ট। দারুণ একটা ছোট্ট বাড়ি আছে; মালিক মারা গেছে বলে ছেলেরা বিক্রি করে দেবে।
পরের দিনই শঙ্কর আর শ্যামল মল্লিক মানে সেই ভদ্রলোক রওয়ানা হল তামসাই। ছোট্ট বাড়িটাকে দেখে শঙ্করের একবারেই পছন্দ হয়ে গেল।
উত্তরে মাইল—তিনেক গেলেই সারান্ডা—সিংভূম রেঞ্জ; আর যদি পশ্চিমে মাইলখানেক যান, পেয়ে যাবেন রুরু নদী। ব্যস, আর কী চাই আপনার।
নিতান্ত জলের দরেই বাড়িটা কেনা হয়েছিল। শ্যামল মল্লিক তেমন কোনো কমিশনও নিতে চায়নি।—আরে দাদা, হঠাৎ করে হাজির হয়ে গেলে একটু জল—নাস্তার বন্দোবস্ত করে দেবেন।
গুছিয়েগাছিয়ে বসতে আরো প্রায় মাসচারেক। হ্যাঁ, কলকাতার সাথে সম্পর্ক একেবারে কেটে ফেলা সম্ভব না; তাই দু—তিনমাস অন্তর যেতেই হয়। সে—ও বড়জোর সপ্তাখানেক।
আমরা কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?—এতক্ষণে মিলি কথা বলে উঠল।
এই দেখেছ! এত করে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এলাম; আজ কিনা দরজার তালাই খুলতে ভুলে যাচ্ছি। চলো, চলো। —বাড়তি উৎসাহে শঙ্কর ওদের ব্যাগদুটোও হাতে তুলে নিয়েছিল। মিলি বাধা দিতে গেলে কোনো কথা না বলে ওর হাতটা শঙ্কর হালকা একটা ছোঁয়া দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শঙ্কর অনুভব করল বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা যেন আচম্বিতে লাফ দিয়ে উঠল। আশ্চর্য! এতদিন পরেও!!
মাসখানেক আগে শঙ্কর যেদিন সুমন্ত্রর ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছিল, মিলি সেদিন ছিল না। সুমন্ত্র প্রথমে অবাক হলেও তারপরে যেন মাঝখানে কোনো ইতিহাস নেই এমন ভঙ্গিতেই কথাবার্তা শুরু করে। শঙ্করও পুরোনো কাহিনির প্রসঙ্গ আর তোলেনি।
একটা ছোট্ট বাসা বানিয়েছি, বুঝলে,—চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শঙ্কর বলেছিল।—জঙ্গল তো তোমাদের খুব প্রিয়। বর্ষার জঙ্গল দেখেছ কোনোদিন? আমার ওখানে চলো। পাগল হয়ে যাবে। তিনদিনে একটা নতুন কবিতার বই হয়ে যাবে।
সব ঠিক হয়ে গেল। শঙ্কর চাইবাসা স্টেশনে চলে আসবে। সুমন্ত্র ওখানে বসেই মোবাইলে ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করে ফেলল।
চাইবাসা স্টেশনে ট্রেনটা ঢোকার পর দেখা দিতে শঙ্কর করেই একটু দেরি করেছিল। দরজা দিয়ে প্রথম বেরিয়েছিল সুমন্ত্র, হাতে লাগেজ। আবছা অন্ধকার কামরার ভিতর থেকে মিলির মুখটা প্রকাশ্য আলোতে বেরিয়ে আসতেই ওর যেন দমবন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও তো ভেবেছিল এই মেয়েটার সবকিছু ওর জানা হয়ে গেছে; অথচ কতকিছুই যে জানার বাকি থেকে গেল! একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পরে কি আর নতুন করে ভাবার কোনো সুযোগ আসে মানুষের জীবনে! ভাবতে ভাবতেই শঙ্কর সামনে এগিয়ে আসে।
এখানে আসতে মিলির ইচ্ছে ছিল না; সুমন্ত্রর চাপেই ও রাজি হয়েছিল। আবার শঙ্করের সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই ওর যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। না, অনুশোচনা নয়, কেমন একটা অজ্ঞাত ভার ওর উপর চেপে বসেছিল। এমন অনেক ঘটনাই থাকে মানুষ আগাপাশতলা না ভেবেই শুরুতে যার সঙ্গ নেয়; তারপর একদিন সেই ঘটনায় সে নিজেই হয়ে ওঠে মূল পরিচালক। মিলিও তো আসলে তাই। কোনো অপরাধ ও করেনি ঠিকই, কিন্তু অন্য একটা মানুষের অসহায় মুখটার কথা মনে পড়লে ওর নিজেরই খারাপ লাগে।
ট্রেনে ওর ঘুম হয়নি। শঙ্করের মুখোমুখি হলে ঠিক কী যে করবে ভেবে ভেবেই সারাটা রাত চোখ বড় বড় করে হালকা নীল আলো—ফ্যানের ঘুরে চলা ব্লেড—ঠিক উলটোদিকের স্লিপারে বাচ্চচা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অবাঙালি বউটাকে দেখে যাচ্ছিল। ট্রেনটা যখন স্টেশনে ঢুকছে তখন ওর যেন আর মাথা কাজ করছিল না।
শঙ্কর, এদিকে—সুমন্ত্রর কথায় ও চমকে উঠে তাকিয়েছিল সামনের দিকে। লম্বা শরীরটা কি সামান্য রোগা লাগছে? গোঁফটা আরেকটু পুরু হয়েছে, চোখদুটোও যেন খানিকটা বদলে গেছে, ভাষাটা যেন ঠিক পড়ে ওঠা যাচ্ছে না। সেই মানুষটাই, অথচ যেন সেই মানুষটা নয়। মিলির বুকের ঠিক মাঝখানে একটা হালকা ব্যথা উঁকি দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। গ্যাসের পেন! নাকি…
ওয়েলকাম, ওয়েলকাম বলে শঙ্কর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সুমন্ত্রর দিকে। তারপর মিলির দিকে ঘুরে বলল—ট্রেনে কোনো অসুবিধে হয়নি তো মিলি?
শঙ্করের মুখে নিজের নামটা শুনে মিলি যেন কেঁপে উঠেছিল। শঙ্কর এত স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে কী করে! হাবভাবে তো টের পাওয়াই যাচ্ছে না জীবনে এতগুলো নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর কাছে কি মিলির জন্য আর একটুও স্পেস নেই! তাহলে মিলিই বা এত ভেবে মরছে কেন! মিলি নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে বলে—নাথিং।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে ওরা যেন চমকে উঠেছিল। একটা মস্তবড় জার্মান শেফার্ড। লম্বা জিভটা মুখের বাইরে বের করে ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখলেই ভয় লাগে, এই বুঝি লাগাল এক কামড়। শরীরে নড়াচড়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। চোখের লালচে আভায় যেন পড়ে নিচ্ছে আগন্তুকদের পরিচিতি।
কিলার ডগ, বুঝলে,—শঙ্কর বলে—অনেক কসরত করে শিখিয়েছি।
তোমার আবার কুকুর পোষার শখ জাগল কবে থেকে?—সুমন্ত্র যেন হঠাৎ চমকে ওঠার ভাবটা আড়াল করার জন্যই বলেছিল।
শখের কি কোনো নিয়মকানুন থাকে সুমন্ত্র! একটা শখ যায়, আরেকটা শখ আসে।—ব্যাগদুটো নিয়ে পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে শঙ্কর বলে। হঠাৎই খেয়াল হয় দরজার মুখে মিলি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, কুকুরে যে ওর খুব ভয়, শঙ্কর জানে।
কী হল, মিলি! ভয় লাগছে?—শঙ্করের কথাতেও মিলি উত্তর না দিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।—কী মুশকিল হল বল দেখি রেক্স! যা, তুই ওঘরে চলে যা। তোকে বেশিক্ষণ দেখলে ম্যাডাম আবার উলটোপথে হাঁটা না লাগায়।
শঙ্করের ইঙ্গিতে কুকুরটা খুব ধীরে ধীরে ওপাশের ঘরে চলে যায়। দরজাটা ডিঙোনোর সময় একবার মুখ ফিরিয়ে অতিথিদের দিকে একঝলক তাকিয়ে দেখে। শঙ্কর শুধু দেখে মিলির মুখটা যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। মিলি এমনিতেই খুব ফর্সা। কিন্তু এক বাড়িতে একটা বাঁধনছাড়া কুকুরের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হবে ভেবে মুখটা যেন কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে।
কী হল, এবারে তো এসো। ভয় নেই, আমি না ডাকলে ও আর আসবে না।
ওটাকে বাঁধলে কি খুব অসুবিধে হবে?—মিলির গলায় ভয়ের ছোপটা খুব স্পষ্ট।
তা একটু হবে বইকি—শঙ্কর হেসে ফেলে। —বেঁধে ফেললে আশপাশে কী হচ্ছে টের পেলেও যে আর ঝাঁপাতে পারবে না। চোর তো ঘুরঘুর করছেই।
বলো কী শঙ্কর, এখানেও চোর!—সুমন্ত্র যেন খুব অবাক হয়েছে।—সবাই যে বলে পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষরা খুব সৎ হয়।
তা তো হয়ই। কিন্তু মুশকিল কী জানো, সেখানেও যে শহরের বাবুবিবিরা হানা দেয়। এই যেমন তোমরা এসেছ।
মানে!—সুমন্ত্র যেন রুখে উঠতে চাইছে,—আমরা কি চোর!
শঙ্কর হাহা করে হেসে উঠেছিল। তারপর বলল—শোনো, এতটা জার্নি করে যে এসেছ। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। স্নান করে খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। বিকেলে জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাব। এইসব জটিল কথা আলোচনার জন্য রাতটা তো পড়েই রইল। ওই ঘরটা তোমাদের জন্য। যাও, আর দেরি কোরো না।
শঙ্কর রান্নাঘর থেকেই টের পেয়েছিল স্নান সেরে মিলি সামনের ঘরে এসেছে। আগে এই সময়টায় মিলি গুনগুন করে গানের সুর ভাজার চেষ্টা করত। আজ কিন্তু তেমন কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না। মিলি কি আরো অনেক কিছুর মতোই এই অভ্যাসটাও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে! রান্নাঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শঙ্কর একবার দেখল মিলি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটা দেখছে। না, যাদবপুরের ফ্ল্যাটটার সাথে মেলাতে গেলে ভুল তো হবেই। কোনোকিছুই কি আর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে!
হাতে ভাতের হাঁড়িটা নিয়ে এই ঘরে ঢোকার আগে শঙ্কর একটা গলাখাঁকারি দেয়। মিলি পিছনে ফিরে শঙ্করকে দেখে চুপ করে থাকে। টেবিলে হাঁড়িটা নামিয়ে শঙ্কর খুব মৃদু স্বরে বলে—কেমন লাগছে এখানে মিলি?
মিলির মুখে একঝলক রক্ত লাফিয়ে উঠে আবার যেন নেমে গেল শিরা আর ধমনীর অন্ধকারে। কেমন একটা ধরা গলায় মিলি বলল—আমি কি তোমায় হেল্প করব?
আরে না, না,—শঙ্কর হেসেই উত্তর দিল—এটুকু নিজেই পারব। পরে হেল্প কোরো।
মিলি টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি কি এখানে একাই থাকো শঙ্কর?
একা থাকব কেন? রেক্স আছে তো।—না, কথাটার মধ্যে খুব ভুল কিছু ছিল না। একাকীত্বের নিজস্ব দুর্গের মধ্যেই বাস করবে বলে বেশ উৎসাহ নিয়ে শঙ্কর এখানে ডেরা পেতেছিল; কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেল ও হাঁপিয়ে উঠছে। তাই একটা জার্মান শেফার্ডের পুঁচকে বাচ্চচা কিনে এনেছিল জামসেদপুর থেকেই। রেক্স তখনো দুধ খায়; কোলের মধ্যেই গুটিসুটি মেরে ঘুমোয়। সময়টা ভালোই কাটছিল যতক্ষণ না বাতাসি ওকে টেনে বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছিল। শঙ্করও অবাক হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট রেক্সের কারবার দেখে।
কোত্থেকে একটা খরগোশ অভিযাত্রীর মতো হাজির হয়েছিল বাগানে। শঙ্করের চোখে আগে কোনোদিন পড়েনি। রেক্স ছিল বারান্দায়। সেখান থেকেই ঝাঁপ দিয়ে বাগানে নেমে খরগোশটাকে তাড়া করে গেটের ঠিক মুখে দাঁতগুলো বসিয়ে দিয়েছে গলার নলিটায়। ওর মুখের হাঁ তখনো বড় হয়নি; সেখানে তাজা রক্তের ছোপ লেগে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল রেক্সকে।
কিলার ডগ সাব—কেনার সময় লোকটা বলেছিল বটে। আর সেইদিন শঙ্কর বুঝে গিয়েছিল, যতই কোলে ঘুমোক আর চুকচুক করে দুধ খাক, কিলার ইনস্টিংক্ট রক্তের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। সময় এলেই বাইরের আবরণটা খসিয়ে আসল চেহারাটা উঠে দাঁড়ায়। তারপর থেকে শঙ্করও রেক্সকে সাধ্যমতো ট্রেনিং দেবার চেষ্টা করে গেছে। জামসেদপুরের সেই লোকটার কাছে বারবার গিয়ে শিখেছে ট্রেনিংয়ের কায়দাকানুন। নাঃ, বিশেষ কিছু ভেবে শঙ্কর রেক্সের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেনি। রক্তের মধ্যে আছে যখন, দেখাই যাক না, এমনটাই ও ভেবেছিল।
শঙ্করের উত্তর শুনে মিলি কী বুঝল কে জানে! আর কোনো কথা না বলে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
জঙ্গল দেখছ? ওদিকে মাইলখানেক গেলেই একটা নদী আছে, রুরু। নদী মানে ঝোরা আর কি।
আজ দেখাবে তো—বলতে বলতে সুমন্ত্র ঘরে ঢোকে।
আরে এত জলদিবাজি করলে হবে?—শঙ্কর হেসে ওঠে।—আগে খেয়ে উঠে একটা ঘুম দিয়ে নাও। সময়ে সব হবে।
মুরগির মাংসটা খেয়ে সুমন্ত্র খুব তারিফ করেছিল। খেতে বসে মিলি আর মুখ খোলেনি। শঙ্করও কথা বলানোর চেষ্টা করেনি। সুমন্ত্রই শুধু বকবক করে যাচ্ছিল। নাটকের মূল প্ল্যানিংয়ে এইসব ছোটখাটো বিষয় ডিরেক্টাররা বাকিদের উপরই ছেড়ে দেয়। লাঞ্চ হয়ে গেলে ওরা পাশের ঘরে ঢুকে যায়। আজ ওরা বেশ লম্বা ঘুমই দেবে। ট্রেনে সাত ঘণ্টার পরে লড়ঝড়ে একটা মারুতি ভ্যানে আরো ঘণ্টা দুয়েক। তার মধ্যে অনেকটাই আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা। কোমরকে জানান দিয়ে ছাড়ে। তা—ও নেহাত শঙ্কর গাড়িটা ম্যানেজ করতে পেরেছিল। নাহলে আরো দেরি হত।
সুমন্ত্র আর মিলি ঘরে ঢুকে যাবার পর শঙ্কর বারান্দায় এসে বসেছিল। তখনো বাইরে সূর্যের দাপট মাটিকে যেন ভয় দেখানোর জন্য লড়ে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মুখেই হাওয়া ছাড়তে আরম্ভ করে দিল। জঙ্গলে এমনটাই হয়। সারাদিন সূর্য যে তাণ্ডবটা নাচে, তাতে হাওয়াও যেন প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে পড়ে গাছগাছালির আড়ালে। আলোটা একটু কমতেই সারাদিনের দাপাদাপির খামতিটা পুষিয়ে নিতেই যেন দুদ্দাড় করে ছুটতে থাকে। কিন্তু আজকের হাওয়াটার মধ্যে একটা অন্যরকম ইঙ্গিত ছিল। পাহাড়ের ঝরনার জল উপর থেকে নিচে ঠিকড়ে পড়ার সময় দুয়েক ফোঁটা গায়ে এসে লাগলে যেমন শিরশিরানি জাগে, অনেকটাই তেমন।
বৃষ্টি আসবে। বাঃ। ডিরেকটোরিয়াল পয়েন্টে এই বিষয়টা ছিল না। জঙ্গলের বৃষ্টির একটা অদ্ভুত রহস্য আছে। অনেকটা বিয়ের পরে পরে নতুন স্বামী—স্ত্রীর রুটিন—ভালোবাসাবাসির মতোই। অন্তত, ওরা বোর হবে না। পরিণতি জেনে ফেলার পরে মানুষ যে কেমন জড়পাথরের মতো হয়ে যায় সেটা তো ও নিজেই ভালো জানে। তার মধ্যে একটু রোমাঞ্চ আনতে পারলে ক্ষতি কী!
সবকিছু মানুষ ভেবেচিন্তে করতে পারে না। শঙ্করও পারেনি। এমনই এক বিকেলের মুখে দুটো বেজির লড়াই দেখে ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। ভালো করে দেখবে বলে বায়নোকুলারটা লাগাল চোখে। বোঝাই যাচ্ছে খাবারের দখল নিয়ে মারামারি। হঠাৎই চোখে পড়ল একটা পাথরের আড়ালে বসে আরেকটা বেজি মাথা উঁচু করে একবার যোদ্ধাদের দেখছে, আবার চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। হাঃ, আদিম খিদে, বুঝে নিতে শঙ্করের অসুবিধে হয় না। মিনিট—পাঁচেকের মধ্যেই মোটাসোটা বেজিটার কাছে হার মেনে অন্যটা পালিয়ে গেল। শঙ্করের উৎসাহ যেন আরো বেড়ে গেল। বারান্দার ধারে এসে ফোকাসটাকে আরো নিখুঁত করার চেষ্টা করল।
ততক্ষণে সেই পাথরটার ছায়ায় অপেক্ষায় থাকা মাদি—বেজিটার শরীরে মদ্দা—বেজিটা নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে। শঙ্কর দেখতে থাকে। হঠাৎই ওকে একদম হতভম্ব করে দিয়ে সেই পালিয়ে যাওয়া বেজিটা কোত্থেকে একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল মদ্দা—বেজিটার উপর; গলায় কামড়টা ঠিকঠাক বসেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মোটা বেজিটা যেন বুঝতে পারছে না ঠিক কী করা যায়। আততায়ীকে সামাল দেবে; নাকি যে কাজটার জন্য এতকিছু, সেখানেই নিবিষ্ট থাকবে। খানিকটা ঝাপটাঝাপটির পর দুটোই চলে গেল পাথরের আড়ালে। খানিকবাদে মাদি—বেজিটার মুখটা দেখা গেল পাথরের বাইরে একটুখানি বেরিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবি খাচ্ছে। বাকি দুটোকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও আর দেখা গেল না। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় শঙ্কর একসময় বায়নোকুলারটা নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। পরের দিন সকালে একটাকেও পাওয়া গেল না। পাবার কথাও না। জঙ্গলে কতরকমের জানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতেই হাপিস করে দিয়েছে।
সেদিন রাতেই শঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। চারপাশের পরিবেশ যেন ওকে এদিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ও শুধু এক মনোযোগী, বাধ্য ছাত্রের মতো সেই নির্দেশগুলো পালন করে যাচ্ছে। কী হওয়া উচিত, সময়ই যখন সব ঠিক করে দিচ্ছে, তখন আরেকটু উদ্যোগী হওয়াটাই ভালো। কিন্তু কীভাবে! প্ল্যানটা ঠিকঠাক তৈরি করতে লেগে গেল আরো দিনসাতেক। তারপর শঙ্কর চলে গেল চাইবাসা। কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে।
ক্যায়া করে ভাইয়া; একেলা আদমি। কব ক্যায়া হো জাতা হ্যায়। —দোকানদারের প্রশ্নের উত্তরে সেফটি ক্যাচটা টেস্ট করতে করতেই শঙ্কর বলেছিল। দোকানদারের আর কী। রুটিন প্রশ্নের রুটিন জবাব শুনে শুনে ও—ও বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
সন্ধে নামার আগেই আকাশ পুরো কালো করে ফেলেছে। হাওয়ার জোরটাও বেড়েছে। বাইরের টিনছাওয়া বারান্দায় বসে শঙ্কর একমনে দেখছিল খানিকটা দূরে গাছের ডালগুলো কেমন যেন তালে তালে গা দুলিয়ে যাচ্ছে। যেন নাচের আসরের দর্শক। মাটি থেকে লাল—লাল ধুলো উড়ছে। শঙ্করের বেশ মজা লাগে। একটা নাটকের প্ল্যান বানানো কি মুখের কথা; কত কী ঘটে যেতে পারত মাঝখানের এই সময়টার মধ্যে। হয়তো শঙ্করই মুছে যেতে পারত পৃথিবী থেকে। হ্যাঁ, মাসদশেক আগে সাপের কামড়টা যদি হাই—নেক জুতোর উপরে না পড়ে আর ইঞ্চিতিনেক উপরে উঠত, সমস্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট তো মাঠেই মারা যেত। কিংবা সুমন্ত্র আর মিলি ওর নেমন্তন্ন স্বীকার নাও করতে পারত। হয়তো ওরাও হারিয়ে যেতে পারত এমন কোনো জঙ্গলে যেখানে কোনোদিন শঙ্কর মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে হাজির হতে পারত না। শঙ্করের হঠাৎই নিজেকে কেমন যেন ঈশ্বর বলে মনে হতে থাকে। অন্তত দুটো মানুষের ভাগ্যের লেখা ও নিজেই স্থির করাতে পেরেছে।
বৃষ্টি নামবে নাকি! —পিছন থেকে সুমন্ত্রর গলাটা পেয়ে শঙ্কর মাথাটা ঘোরায়। তারপর বলে—উঠে পড়লে? চা খাবে তো? মিলি উঠেছে?
আরে দূর, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? —সুমন্ত্র সিগারেটের প্যাকেট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
নাঃ, ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। তুমি খাও।
অ্যাই শঙ্কর, তোমাদের এখানে মহুয়া পাওয়া যায় না? পেলে একবার ট্রাই করতাম। —সিগারেটের প্রথম ধোঁয়াটা ছাড়তে ছাড়তে সুমন্ত্র বলে।
যাঃ, একদম মাথায় আসেনি। কিন্তু আজ তো আর ব্যবস্থা করা যাবে না।
ঠিক হ্যায়, কাল হবে। —সুমন্ত্রর গলায় যেন কেমন একটা ফুর্তির আভাস।
কাল! শব্দটা শুনতে যত ছোট, পিছনের ক্যানভাসটা ততটাই বড়। সারাটা জীবন মানুষ তো এই কাল শব্দটাকে নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সেখানেই তো বেঁচে থাকার আসল মজা। শুধু অতীত আর বর্তমান নিয়েই থাকতে হলে শঙ্করই কি আর বেঁচে থাকত? ও—ও তো বেঁচে আছে স্রেফ সেই কাল শব্দটার ভরসায়। আর সেই কাল শব্দটা যখন আজ হয়ে উঠছে একটু একটু করে, আর কয়েক ঘণ্টা পরই স্রেফ গতকাল হয়ে যাবে, তখন কী করবে ও? বেঁচে থাকবে? কী নিয়ে থাকবে? আর তো কোনো কালের গল্প থাকবে না ওর জন্য। তাহলে?
শঙ্কর উঠে পড়ে। —চা বসিয়ে দিই।
দুপুরের রান্নাটা কি তুমিই করেছিলে? —সুমন্ত্রর সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
নাঃ, একটা মেয়ে আসে সকালে। ওই দুবেলার রান্নাটা করে দিয়ে যায়। বাকিটা আমিই সামলে নিই। বোসো, আমি আসছি,—বলে শঙ্কর ভিতরে ঢুকে যায়।
চা নিয়ে বারান্দায় এসে দেখে ততক্ষণে মিলিও চলে এসেছে। বাইরের অন্ধকারটা বেশ জাঁকিয়ে নেমে এসেছে। বারান্দার লাইটটা এখনো জ্বালানো হয়নি বলে একটা ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। টেবিলের উপর চায়ের কাপগুলো রেখে শঙ্কর লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। একটা হাল্কা সাদা আলোয় হাতদশেক পর্যন্ত নজর করা যায়।
এখানে কি এরকমই লো—ভোল্টেজ থাকে নাকি? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুমন্ত্র বলে।
ওই আর কী। শঙ্কর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়—রেক্স…সঙ্গে সঙ্গে মিলি যে আবার জড়সড় হয়ে পড়ল, সেটা ওর চোখ এড়াল না। —ভয় নেই, এ এখন বাইরের মাঠে নিজের কাজ সেরে আসবে; তোমাদের ডিস্টার্ব করবে না।
লেজ নাচাতে নাচাতে রেক্স বাইরে বেরিয়ে গেল। মিলির হাতে চায়ের কাপটা সামান্য—সামান্য কাঁপছে। শঙ্করের হাসি পায়। এত ভয় কোথায় রাখবে ম্যাডাম যখন সবকিছু জেনে যাবে!
চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। রেক্স এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। হাওয়ার দাপটে বৃষ্টির জল উড়ে এসে গায়ে লাগছে। বেশ রোম্যান্টিক। কিন্তু অতিথিদের কেমন লাগছে সেটাও জানা দরকার।
তোমরা কি এখানেই বসবে? নাকি ভিতরে যাবে?
দারুণ লাগছে কিন্তু যাই বলো মিলি। —সুমন্ত্র আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। —শঙ্কর, ইউ আর রিয়েলি লাকি যে এমন একটা জায়গায় আস্তানা বানাতে পেরেছ। বাই দা বাই, তুমি এখন করো কী?
কী করি! —শঙ্কর মুচকি হাসে।—চিত্রনাট্য লিখি।
গ্রেট। তোমার এই গুণটা তো জানা ছিল না। বুঝেছি। সেই জন্যই এমন একটা জায়গায় বাড়ি বানিয়েছ। ক’টা ফিল্ম হল তোমার চিত্রনাট্যের উপর?
এখনো একটাও না। তবে প্রথমটার কাজ শুরু হয়ে গেছে। জানতে পারবে।
হঠাৎই রাস্তাটার ওপাশের গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যে ঠাসবুনোট অন্ধকার, তার মধ্যে থেকে একটা তীক্ষ্ন ক্যারক্যারে আওয়াজ জলপড়ার শব্দকে ছাপিয়ে নিজেকে জানান দিল। টিমটিমে আলোতেও শঙ্কর টেল পেল মিলি কেঁপে উঠল সেই আওয়াজে।
কীসের শব্দ?—বহুক্ষণ পরে আবার মিলির মুখের কথা শোনা গেল।
মনে হচ্ছে খটাস; সাপ ধরেছে বোধহয়।
এখানে সাপও আছে,—মিলি ঝটতি চেয়ারের উপর পা তুলে বসে।
হাঃ হাঃ ম্যাডাম, এমন সব পোকাও আছে যারা কামড় দিলে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মানুষ দু ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। বর্ষা হলে তারা আবার দালানকোঠায় শেল্টার খুঁজতে আসে।
আমি ভিতরে যাব,—বলেই মিলি উঠে পড়ে। সেই মুহূর্তেই রেক্স আবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখেই মিলি আতঙ্কে প্রায় গায়ের উপরেই উঠে পড়ে আর কি। চারটে বছর পরে মিলির গায়ের গন্ধটা আবার যেন শঙ্করকে ঘিরে ফেলতে চলে এল। ও তো ভুলেই গিয়েছিল বলা চলে। স্ক্রিপ্টে কি এগুলোও লেখা ছিল?
নাঃ সুমন্ত্র, ভিতরেই চলো,—শঙ্কর চায়ের কাপগুলো তুলে ফেলে। —এমনিতেই মিলি ভয় পাচ্ছে। তাছাড়া ঢোকার সময় ডানহাতে কেয়াগাছের ঝোপটা দেখেছ তো; বৃষ্টি নামলে তেনাদের আবার ফুর্তি চাগাড় দিয়ে ওঠে। নাও চলো।
ভিতরে ঢুকতে গিয়েই ও টের পায় রেক্সকে না সরালে মিলি ভিতরে যাবে না। —রেক্স! —শঙ্কর বলতেই রেক্স আবার ওপাশের ঘরে চলে যায়। দরজাটা বন্ধ করে দেবার পর মিলিকে এবার যেন একটু আশ্বস্ত দেখায়।
ও হ্যাঁ, মিলি, সুমন্ত্র, আজ রাতের খাওয়ার কিন্তু বন্দোবস্ত করতে পারিনি। —শঙ্কর বেশ কেটেকেটে বলে।
ছাড়ো তো, একটা রাত না খেলে মানুষ কি মরে যায় নাকি! কী বলো মিলি?
আমি কিন্তু কাল সকালেই চলে যাব, মিলি খুব জোর দিয়ে বলে ওঠে।
সে ঠিক আছে মিলি,—শঙ্কর সামান্য হেসে বলে। —তোমরা একটু বোসো; আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি।
বৃষ্টিটা যে ভালোই চলবে বুঝতে শঙ্করের অসুবিধে হল না। ছাতা মাথায় বাড়িটার পিছন দিয়ে ঘুরে আসতেও বেশ ভালোই ভিজে গেছে।
কোথায় গেছিলে? সুমন্ত্র অবাক হয়ে গেছে যেন। —পুরো ভিজে গেছ তো।
বাইরের গেটে তালা মারতে।
ওই বাগানের গেটে? ওখানে তালা মেরে কি তুমি চোর ঠ্যাকাতে পারবে?
হাসালে সুমন্ত্র,—শঙ্কর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে,—চোরকে তো আমি ইনভাইট করে আনি। তালা মারলাম বারান্দায় যাবার এই দরজাটায়।
মানে! বাইরে থেকে বন্ধ করে বাড়তি সুবিধে কী হবে?—সুমন্ত্র যেন বুঝতে চাইছে বিষয়টা। —তাছাড়া কাল সকালে তোমার ওই রান্নার মেয়েটা যখন আসবে, তখন ও বুঝবে কী করে যে আমরা ভিতরে আছি?
ও আর আসবে না সুমন্ত্র, শঙ্কর যেন মজা করছে এমন ভঙ্গিতে বলল।
ছাড়িয়ে দিলে নাকি?
নাঃ, এখানে সব্বাই জানে কাল ফার্স্ট ট্রেনেই আমি কলকাতায় চলে যাচ্ছি। আর কেউ আসবে না।
তাহলে আমাদের ডেকে এনেছ কেন? —মিলি উঠে দাঁড়িয়েছে। —নেমন্তন্ন করে এনে তুমি নিজেই চলে যাবে মানে?
এত টেন্সড হোয়ো না মিলি, শঙ্কর খুব মৃদু স্বরে বলে।
এটা কি ফাজলামি হচ্ছে? —এতক্ষণে মিলিকে শঙ্করের খুব চেনা চেনা মনে হয়। এই ঝাঁজটাই মিলিকে আর সবার থেকে আলাদা করে দিত।
একদম না মিলি। যে নাটকটা চার বছর ধরে লিখে যাচ্ছি, আজ তার এক ও একমাত্র শো চলছে। আমি একদম সিরিয়াস।
শঙ্কর, পুরনো কথা টেনে নিজেকে আর কষ্ট দিচ্ছ কেন—সুমন্ত্র সোজা হয়ে বসেছে।—তোমার খারাপ লেগেছে; আমাদেরও যে খুব ভালো লেগেছিল, এমনটাও তো নয়। কিন্তু মানুষ তো পরিস্থিতির শিকার।
দারুণ বললে কিন্তু সুমন্ত্র। শঙ্কর হাততালি দিয়ে বলে উঠল। —বন্ধু হিসাবে বাড়িতে ঢুকেছিলে; বেরোলে চোর সেজে।
বাজে কথা বন্ধ করো, সোফার হাতলে বাড়ি মেরে মিলি বলে উঠল।—যা হয়েছে তার জন্য তুমিও দায়ী। আমাকে বোঝার আদৌ কোনো চেষ্টা করেছিলে কোনোদিন?
শঙ্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে—যেদিন বুঝলাম আমি তোমার কাছে একটা বোঝা, সেদিনই তোমাকে বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
শঙ্কর, যাই হোক, তোমাকে আমি বন্ধু বলেই মনে করি,—সুমন্ত্র সোজা ওর দিকে তাকিয়ে বলছে। —তুমি না থাকলে আমি তো কোথায় হারিয়ে যেতাম। তোমার উপকার মনে আছে বলেই তো এতবছর বাদে তোমার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। মিলি আসতে চায়নি। আমিই জোর করে রাজি করালাম।
উপকার! হাঃ হাঃ হাঃ। বিনিময়ে বড় সুন্দর একটা উপহার দিয়েছিলে বন্ধু, উপকারীর বউকে চুরি করে নিয়ে।
বাজে কথা বলবে না,—মিলি আবার ফুঁসে উঠেছে। —আমরা দুজনে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলাম। এটাকে চুরি বলে না।
আর আমার সন্তান!—শঙ্কর যেন সাপের মতোই হিসহিস করে ওঠে। —সেটা চুরি নয়!
শঙ্কর, অ্যাবর্শনটা খুব জরুরি ছিল,—সুমন্ত্র লাফ দিয়ে ওঠে, —নাহলে মিলিই বাঁচত না।
রাইট। সেই সিদ্ধান্তটা যার নেবার কথা, সে কিন্তু জানতে পারল সবকিছু মিটে যাবার পরে। এমনকী সে যে বাবা হতে পারে, সেই সংবাদটাও।
সুমন্ত্র আর মিলি মাথা নিচু করে বসে আছে। শঙ্কর উঠে পড়ে। ভিতরের ঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে বলে—একটু চা খাবে নাকি? আরে, চা খেলে এই গুমোটটা কেটে যাবে।
করো, —সুমন্ত্রর গলাটা কেমন নির্জীব শোনাল। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতেই সুমন্ত্র আর মিলির দুয়েকটা কথার টুকরো টুকরো অংশ কানে পৌঁছে যাচ্ছিল শঙ্করের। যতই তেজ দেখাক, মিলি খুব ভয় পেয়েছে। সুমন্ত্রই ওকে বোঝাচ্ছে। মিলি বুঝতে চাইছে না। মেয়েদের এই ক্ষমতাটা জন্মগত। হয়তো চারিদিকের হাঙর—কুমির সামলাতে সামলাতে ওরা এটা খুব দ্রুত অর্জন করে ফেলে।
তোমার এই বন্ধুটাকে কিন্তু আমার মোটে সুবিধার মনে হয় না। রাতে শঙ্করের বুকে মাথা রেখে মিলিই একদিন বলেছিল। —চোখ দেখলেই অস্বস্তি লাগে; কেমন যেন খিদে—খিদে ভাব।
আরে, রোজগারপাতি নেই; কবিমানুষ। খিদে তো থাকবেই।
এ খিদে সে খিদে নয় মশাই; এ হল অন্য খিদে।
একটা জোয়ান মানুষ, তায় কবি। একটু ছোকছোকানি তো থাকতেই পারে।
আর যদি তোমার বউকেই খেয়ে ফেলে? —মিলি এবার শঙ্করের উপরে উঠে মাথাটা সামান্য উঁচু করে ওর চোখের দিকে সোজা তাকিয়েছিল।
শঙ্কর মুখটা উঁচু করে মিলির ঠোঁটটাকে আলতো স্পর্শ করে বলেছিল— তালে বুঝব, ব্যাটাচ্ছেলের ক্ষমতা আছে।
চা নিয়ে ঘরে ঢুকে শঙ্কর দেখে ওরা দুজনেই মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি করে যাচ্ছে।
ওখানে নেটওয়ার্ক থাকে না সুমন্ত্র। নাও চা খাও।
চা খাওয়া শেষ হতেই শঙ্কর নিজের চেয়ারটা ঘুরিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে। —হ্যাঁ, তাহলে এবারে নাটকটা শেষ করা যাক।
প্লিজ, শঙ্কর, এবার এটা বন্ধ করো। আর ভালো লাগছে না। —সুমন্ত্র আবার সিগারেট ধরিয়েছে।
না না, আর বেশি দেরি হবে না। সুমন্ত্র, মিলি, তোমাদের কেন নেমন্তন্ন করে এনেছিলাম জানো? —শঙ্কর বেশ হাসি হাসি গলায় বলে।
কেন?
তোমাদের পাপের শাস্তি দেব বলে। দুটো জীবনকে খুন করার পাপ।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শঙ্কর, —সুমন্ত্র সোফা থেকে উঠতে যায়।
ওখান থেকে উঠবার চেষ্টা কোরো না সুমন্ত্র। একটা ইঙ্গিত করলেই রেক্স কিন্তু গলার নলিটা ফাঁক করে দেবে। কিলার ডগ মানেটা বোঝো তো? —নিজের নামটা শুনেই বোধহয় রেক্সও ঘরের মধ্যে ঢোকে।—দরজার পাশে বোস। —শঙ্কর কথাটা বলতে রেক্সও থাবা পেতে বসে পড়ল।
সুমন্ত্র তুমি কী বলছিলে? মাথা খারাপ—শঙ্কর আবার হাহা করে এসে ওঠে। —মাথা খারাপ না হলে কেউ কি আর খুনের প্ল্যান কষতে পারে?
তুমি আমাদের খুন করবে শঙ্কর? —মিলি এবারে কেঁদে ফেলেছে।
স্যরি মিলি, দাঁড়িপাল্লাটা একদিকে বড্ড ঝুঁকে রয়েছে; ওটাকে একটু ব্যালেন্স করে দেব।
শঙ্কর,—সুমন্ত্রর গলা কাঁপছে, —তুমি কী চাও বলো! আ—আ—আমরা সবকিছু দিতে রেডি। আমাদের ছেড়ে দাও, প্লিজ।
শঙ্কর উঠে পড়ে। ঘুরে ওদের সোফার পিছনে গিয়ে বলে—যদি বলি মিলিকে ফেরত চাই?
মানে!—সুমন্ত্র যেন বিস্ময়ের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। —মিলিকে ফেরত চাও মানে? তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে।
হতেই পারে সুমন্ত্র। —শঙ্কর যেন মজা পেয়েছে।—একটা লোকের বউ পালিয়ে গেল; বাচ্চচাটাকে খুন করা হল। তার পাগল হবার মতো যথেষ্ট অ্যালিবাই কি থাকতে পারে না? কী বলো?
আমি কোথাও পালাইনি—মিলি এবারে রুখে উঠতে চাইছে—তোমাকে সব জানিয়েই সুমন্ত্রর সাথে চলে গিয়েছিলাম।
আমিও তো তোমাদের সব জানিয়ে দিচ্ছি; আরো জানিয়ে দেব।—শঙ্কর মিটিমিটি হাসছে, যেন বাচ্চচাদের দুষ্টুমি এনজয় করছে।
শঙ্কর, একটা ঘটনা ঘটে গেছে, —সুমন্ত্র বোঝানোর জন্য চেষ্টা করে—সেটা যে খুব ভেবেচিন্তে হয়েছে, এমনটাও তো নয়। হয়ে গেছে, এই পর্যন্তই। তার জন্য খুন করতে হবে!
ধরে নাও, সেটাও এমনি এমনিই হয়ে যাবে। —শঙ্কর হাতের তালুদুটো ঘষতে ঘষতে বলে—তাহলে তো আর বলার কিছু থাকল না; কী বলো সুমন্ত্র?
সুমন্ত্র আর মিলির মুখে আর কোনো কথা নেই। শঙ্কর ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণের নীরবতা বোধহয় রেক্সের পছন্দ হল না। তাই একবার মৃদু স্বরে একটা ঘেউ করে উঠল।
মিলিকে পেলে আমাদের ছেড়ে দেবে? —সুমন্ত্র যেন একটা সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছে, এমনভাবে বলল।
মিলিয়ে ছাড়ব কী করে সুমন্ত্র! তোমাকে ছাড়তে পারি। —আরেকটু ঘুরে গিয়ে শঙ্কর মিলির মুখের দিকে তাকায়। চোখের কোলে জলের দাগটা এখনো শুকোয়নি। নাঃ, মেয়েটা সত্যি বড় মিষ্টি দেখতে। —তুমি কি কিছু বলবে মিলি? শঙ্কর খুব আদুরে গলায় বলে। শুনেই মিলি আবার কেঁদে ওঠে।
আর ইউ সিরিয়াস? সুমন্ত্র জিজ্ঞেস করে।
দেয়ারস নো ডাউট ফ্রেন্ড। মিলিকে চাইলেই যদি দিয়ে দিতে পারো, ইউ আর ফ্রি।
দেন, ইটস ডান। সুমন্ত্র সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে।
মিলি, তুমি কিছু বলবে না? শঙ্কর মিলির সামনে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে। তোমার ফেলে যাওয়া হাজব্যান্ডকে যদি আবার জড়িয়ে ধরতে পারো, তোমার নেক্সট হাজব্যান্ড বেঁচে যেতে পারে। কি পারবে তো?
মিলি কোনো সাড়া দেয় না। শঙ্কর হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে। তারপর ওর হাতদুটো ধরে বলে—আর যদি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে সুমন্ত্রকে রেক্সের সামনে ছেড়ে দিই? তুমি চলে যাবে তো?
মিলি থরথর করে কেঁপে ওঠে। —আ—হা—আমি একা কোথায় যাব? —মনে হল এতক্ষণ যেন বলবার মতো একটা যুক্তি খুঁজে পেয়েছে।
শঙ্কর, তুমি কি খেলা পেয়েছ? —সুমন্ত্র চিৎকার করে ওঠে। কথা ঘোরাচ্ছ কেন?
একা কোথায় যাবে মানে কী, মিলি? —সুমন্ত্রকে পাত্তা না দিয়েই শঙ্কর বলে—সুমন্ত্রকে সঙ্গে নিয়েই যাবে? সেটা তো হবে না। হয় তুমি, না হয় ও, এনি ওয়ান।
আমি একা কোথায় গিয়ে উঠব? আমার তো থাকার জায়গা নেই। মিলির গলাটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে।
ওহো, এটা তো মাথায় আসেনি। ওকে; তুমি আমার এখানেই থাকতে পারো। টিভি নেই, ফোন নেই; এটুকুই প্রবলেম।
মিলি মাথা নিচু করে ফোঁপাতে থাকে।
কি, থাকবে? —শঙ্কর খুব আলতো করে বলে।
আমাকে মেরো না শঙ্কর; যা করতে বলো করব। মিলি সোফার ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে চোখদুটো বুজে কোনোরকমে বলে।
মিলি! —সুমন্ত্র আবার চিৎকার করে ওঠে—ট্রেচারাস হোর।
গালাগালি নয় সুমন্ত্র, —শঙ্কর উঠে পড়ে। —বিশেষ করে মিলির মতো মিষ্টি গালিগালাজ করাটা আমি মেনে নেব না। রেক্সেরও বোধহয় পছন্দ হচ্ছে না। কী রে রেক্স? ঠিক তো?
নিজের নামটা শুনেই রেক্সের জিভটা যেন একটু বেশিই বাইরে বেরিয়ে আসে। —দেখলে তো সুমন্ত্র! —শঙ্কর আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। তারপর মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে—প্রবলেম, প্রবলেম। চারটে বছর একসাথে থাকার পর আজ দুজনেই প্রাণে বাঁচার জন্য অন্যকে খুন হতে দিতে রাজি। তাহলে স্কোপটা কার পাওয়া উচিত? এবারে সত্যি সত্যিই নিজেকে পাগল—পাগল লাগছে।
সুমন্ত্র আর মিলি কেউই কোনো কথা বলে না। শঙ্কর যেন খুব ভাবছে এমন ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলে—আইডিয়া। টস করেই ডিসিশান নেওয়া যাবে। রাইট। সুমন্ত্র, তোমার কাছে কয়েন আছে? —সুমন্ত্র পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কয়েন তুলে সামনে বাড়ায়।
হুম, তাহলে হেড কে নেবে? আর টেল? লেডিস ফার্স্ট। তাহলে মিলিই বলো।
এটা আনফেয়ার, —সুমন্ত্রর গলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে। —আমার নাম উঠলে আমি খুন হব, মিলি তোমার কাছেই থেকে যাবে। আর মিলির নাম উঠলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে মিলিকে তোমার কাছে রেখে দেবে। ইন এনি কেস মিলির কোনো রিস্ক নেই। তাহলে মিলিকেই রেখে দাও; আমি ভোর হলেই চলে যাব।
শঙ্কর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর এগিয়ে আসে সুমন্ত্রর সামনে। তারপর বলে —আর আমার সেই মেরে ফেলা সন্তানটাকে যদি ফেরত চাই? সুমন্ত্র! মিলি! দেবে? দেবে আমার হাতে তুলে? তাহলে কিন্তু তোমাদের দুজনকেই ছেড়ে দিতে পারি।
শঙ্কর, প্লিজ, পাগলামো কোরো না, সুমন্ত্রর গলাটা কেমন যেন অসহায়ের মতো শোনায়।
সিদ্ধান্তটা নেবার সময় নিশ্চিত পাগলামি ছিল সুমন্ত্র; কিন্তু এখন আমি একদম সুস্থ। নাটকের শেষ কার্টেন ফেলা পর্যন্ত আমাকে সুস্থই থাকতে হবে। শোনো তোমাদের দুজনকেই আমি আজ খুন করব।
শঙ্কর, তুমিও কি বাঁচবে ভেবেছ? সবাই জানে আমরা তোমার কাছে আসছি। এখানেও লোকজন আমাদের দেখেছে। দুদিন। তিনদিন। তারপরেই খোঁজখবর শুরু হয়ে যাবে। তখন?
সেটা আমার ডিসিশন, শঙ্কর খুব ঠান্ডা গলায় বলে। —খুন তোমরা দুজনেই হচ্ছ। এই রিভলভারটা দেখেছ? —পকেট থেকে বের করার পর রিভলভারটা আলোতে ঝকঝক করছে। দেখেই মিলি আবার কাঁদতে শুরু করেছে। সুমন্ত্র গুম মেরে গেছে।
নাঃ, এতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হচ্ছে না, —শঙ্কর আবার চেয়ারে বসে পড়ে। —আফটার অল, তোমরা আমার গেস্ট। ওকে, তোমরাই ঠিক করে নাও কীভাবে খুন হবে।
শঙ্কর, প্লিজ, মেরেই যদি ফেলতে চাও, একেবারে মেরে ফেলো। এই টার্চার আর সহ্য হচ্ছে না। —সুমন্ত্রর গলা ভেঙে গেছে। এতটাই ঠান্ডা পড়ে গেল নাকি!
তুমি মহুয়ার কথা বলছিলে না? —শঙ্কর রিভলভারটা আবার পকেটে ভরতে ভরতে বলে—খানিকটা ব্যবস্থা করা যাবে। আমার কাছে কুঁচিলার বিষ আছে; সাঁওতালরা খুব ব্যবহার করে। মহুয়ার সাথে মিশিয়ে দেব। নেশায়া যন্ত্রণাটা টের পাবে না। মুখ দিয়ে যে গ্যাঁজলাটা উঠবে সেটা যে কীসের জন্য ভাবতে ভাবতেই তোমরা চলে যাবে।
চুপ করো প্লিজ, মিলি বলে উঠল।
ওকে, এটা বাদ। এই সুমন্ত্র, তোমরা কি যাবার আগে একবার দুটো শরীর মিলিয়ে দেখবে নাকি? মরে গেলে আর তো চান্স নেই। তাহলে ওঘরে চলে যাও। বাথরুমে একটা বাথটব তো দেখেইছ। ওটাতে দুজনেই ঢুকে পড়ো। তোমাদের খেলা যখন জমে উঠবে ঠিক তখন আমি ইমারশন হিটারটা ভেঙে টবের জলে ছুড়ে দেব। কারেন্টের ঝটকায় তোমাদের উত্তেজনাটাও বেড়ে যাবে। যতক্ষণ টানতে পারবে চলবে।
তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। সুমন্ত্রর চোখদুটো যেন বাইরে বেরিয়ে আসছে।
যাঃ, এমন একটা রোমান্টিক মৃত্যুও তোমাদের পছন্দ না! তুমি তো আবার নাকি কবি। যাকগে, আরেকটা অপশন দিছি। এভাবেই। তবে বাথটবের বদলে বিছানায়। শেষ হলেই আমিও একটা গুলিতেই তোমাদের শেষ করে দেব।
বন্ধ করো, তীব্র চিৎকারে মিলি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কী আশ্চর্য! একটা পছন্দসই মৃত্যুও তোমরা বেছে নিতে পারো না। আমি কিন্তু পারি, জানো। ঠিক আছে। দা লাস্ট ওয়ান। আমি তোমাদের দুজনকেই এক্ষুনি বাইরে বের করে দিচ্ছি। রাত ধরো এখন আটটা হবে। বৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই। তবে কপালে থাকলে কোনো গ্রামে গিয়েও উঠতে পারো। মানে যদি সাপ—হায়না বা অন্য কিছুর পাল্লায় না পড়ো।
ওকে, আমরা এটাতে রাজি। —সুমন্ত্র উঠে দাঁড়িয়েছে।
আগে শোনো হে, এত জলদিবাজি করলে তো ভুল হয়ে যাবে। তোমাদের হাত আমি পিছন করে বেঁধে দেব। আর চোখও থাকবে বাঁধা।
এত অত্যাচার আমি আর সহ্য করতে পারছি না। —মিলি উঠে ওর দিকে এগোতে যায়। —আমাকে গুলি করে দাও।
উহু, এগিয়ো না। রেক্সের আবার এসব হজম হয় না।
রেক্স এতক্ষণ জুলজুল করে সবাইকে দেখছিল। নামটা কানে যেতেই সামান্য গড়গড় করে ওঠে। মিলি আবার সোফায় বসে পড়ে।
ওকে, তাহলে গুলিটাই ফাইনাল। ও, হ্যাঁ সুমন্ত্র, টেবিলে একটা কাগজ আছে, দেখতে পাচ্ছ তো? একটু জোরে জোরে পড়বে? যেন আমরা সবাই শুনতে পারি। আর শোনো, মনে করবে তুমি স্রেফ একজন নিউজরিডার; কোনো আবেগটাবেগ দেখাতে যেও না। নাও।
সুমন্ত্র কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজটা তুলে নেয়। চোখ বোলাতে শুরু করে।
স্টার্ট প্লিজ।
তোমরা দুজন চারটে বছর ধরে আমাকে যে নরকযন্ত্রণা দিয়েছ, একটা গুলিতে তার শোধ হবে না। তাই তোমাদের আমি এক মৃত্যু দেব যার অভিজ্ঞতা তোমাদের আগে আর কারো হয়নি। রেক্স পাহারায় থাকবে। তোমরা সোফা থেকে ওঠবার চেষ্টা করলেই ও ঠিক আটকে দেবে। অবশ্য উঠেও লাভ নেই। পাগলাবাবুর কুঠির দিকে এমনিতেও কেউ আসে না। তারপর বাইরের দরজায় তালা। কেউ উঁকিও মারবে না। তোমরা ওই সোফাতেই এইভাবে বসে থাকবে দিনের পর দিন। স্যরি, খাবার বা জলের ব্যবস্থা থাকছে না। রেক্সের জন্য খানিকটা থাকছে। কিলার ডগ তো! দিনতিনেক পর থেকেই ঘরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে; পোকারা বাসা বেঁধেছে পচাগলা একটা লাশের উপর। তোমাদের মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে; কিন্তু মরতে পারছ না। বসে বসে সেই যন্ত্রণা তোমরা ভোগ করবে।
সুমন্ত্রর হাত থরথর করে কাঁপছে। মিলিও সোজা হয়ে উঠেছে। চোখদুটো যেন ঠিকরে আসছে। সুমন্ত্র অদ্ভুত এক ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল—আর তুমি! তোমার কী হবে?
শঙ্কর রিভলভারটা পকেট থেকে বের করতে করতে বলল—রেক্স, এদিকে আয় বাপ। রেক্স উঠে ওর সামনে গেল। শঙ্কর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উল্টোদিকে আঙুল তুলে দেখাল। রেক্স সোফার দিকে মুখ করে একটু এগিয়ে গেল। তারপর আবার আগের মতোই সুমন্ত্র আর মিলির দিকে তাকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
আমি! —শঙ্কর একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কেমন একটা গাঢ় গলায় বলে উঠল—ওই যে…লাশটার ব্যবস্থা করে যাব। —বলতে না বলতেই কানফাটানো একটা আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি।
সুমন্ত্র আর মিলি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। চোখ খুলতেই দেখল, চেয়ারে মাথাটা হেলিয়ে শঙ্কর পড়ে আছে। ডানদিকের রগ থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখদুটো খোলা। বিস্ফারিত ঠোঁটে যেন একটা বিদ্রূপের হাসি ঝুলছে। রেক্স একবার মুখ ঘুরিয়ে শঙ্করের দেহটা দেখেই ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদু একটা গড়গড় আওয়াজ করতে থাকে।
সুমন্ত্র আর মিলি সোফায় বসে শঙ্করের লেখা চিত্রনাট্য অনুযায়ী অপেক্ষা করতে শুরু করে।
জীবনের রংমশাল – দীপান্বিতা রায়
শাড়িটা পরা হয়ে গেছে ৷ বেড়ার গায়ে ঝোলানো ফাটা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুতহাতে বিনুনি বাঁধছিল পারুল ৷ আয়নার সামনে দাঁড়ানোটা অবশ্য খানিকটা অভ্যাসের মতো ৷ কাচের পিছনে জায়গায় জায়গায় পারা উঠে গেছে ৷ তাই মুখটা দেখায় ঝাপসা, যেন জলে ভিজে ধেবড়ে যাওয়া ছবি ৷ তবে পারুলের যে তাতে খুব কিছু আসে-যায় তা নয় ৷ সিঁথিটা ঠিক রেখে চুলগুলো শুধু টান করে বেঁধে রাখা বই তো নয় ৷ মুখের ওপর চুল এসে পড়লে স্কুলের দিদিরা বকেন ৷ ওইটুকু আয়না ছাড়াই করে নেওয়া যায় ৷ আয়নাটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় বরং ওর দিদি বকুলের একটু দুঃখ আছে ৷ আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের একঢাল কালো চুল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে বকুল ভালোবাসে ৷
চুল বাঁধতে বাঁধতেই এসব এতাল- বেতাল কথা মনে হচ্ছিল পারুলের ৷ যদিও এসব কথা ভাবার আজকে সময় নয় ৷ বুকের ভিতরটা গুড়গুড়িয়ে উঠছে মাঝেমাঝেই ৷ এমন সময় বাইরে থেকে মঞ্জুর গলা শোনা গেল, পারুল হল তোর৷ তাড়াতাড়ি কর ৷
বিনুনির নীচে গার্টারটা টাইট করে লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে আসে পারুল ৷ দরজার চৌকাঠ পেরোলে মাটির দাওয়া ৷ তার ওপর খড়ের চাল ৷ গত দুবছর ছাওয়া হয়নি ৷ খড় আলগা হয়ে এসেছে ৷ দাওয়ার এখানে-ওখানে খড়ের কুটি পড়ে আছে ৷ অন্যদিন বকুল সকালবেলা একপ্রস্থ ঝাঁট দিয়ে দেয় ৷ আজ বোধহয় কোনও কারণে পেরে ওঠেনি ৷ দাওয়ার ওপাশে রান্নাঘর ৷ প্লাস্টিকের চটিটা পায়ে গলাতে গলাতে পারুল গলা তোলে, মা আসছি ৷
দাঁড়া, দাঁড়া, দুদণ্ড দাঁড়া, মা ৷ বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে কাকিমা ৷ পিছনে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা ৷
কাকিমার হাতে একটা ছোট বাটি ৷ বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে পারুলের কপালে দই-হলুদের ফোঁটা দেয় কাকিমা ৷ পারুল জানে, কাল সন্ধেবেলা কাকিমা চেয়ে-চিন্তে ওই আধবাটি দুধ জোগাড় করে এনেছে ৷ তেঁতুলগুলে তাতেই দই পাতা হয়েছে ৷ সকালে এই ফোঁটাটুকু দেওয়ার জন্য এত আয়োজন ৷ ফোঁটা নিয়ে কাকিমাকে প্রণাম করে পারুল, মাকেও ৷ শীর্ণ হাতটা মাথায় রেখে মা অস্ফুটে কী যেন বলে ৷ কাকিমার গেলায় দুগগা দুগগা শুনতে শুনতে দাওয়া থেকে নেমে পড়ে পারুল ৷ মঞ্জু অপেক্ষা করছিল ৷ দুজনে মিলে জোরপায়ে স্কুলের দিকে দৌড় ৷ আজ রেজাল্ট বেরোবে মাধ্যমিকের ৷
রাস্তা অনেকটা ৷ পিচ বাঁধানো নয় ৷ শীত-গরমে সমস্যা নেই ৷ বর্ষায় কষ্ট হয় ৷ তবে বৃষ্টি শুরু হয়নি এখনও ৷ শুকনো রাস্তায় যতটা সম্ভব পা চালিয়ে হাঁটছিল দুজনে ৷ বেশ কিছুটা দূরে আরও চার-পাঁচজন মেয়ের একটা দল যাচ্ছে ৷ তাদের ধরে ফেলতে পারলে ভালো হয় ৷ কিন্তু তার আগেই জোড়ের কালভার্টের পাশে দেখা গেল মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে ৷
ওই দ্যাখ, আবার এসেছে ৷ ফিস ফিস করে বলে মঞ্জু ৷
তাকাস না ৷ পাশ কাটিয়ে চলে যাব ৷ কথা বলতে বলতে আঁচলটা কোমরে গুঁজে নেয় পারুল ৷
এই এক উৎপাত চলছে বেশ কিছুদিন ৷ গোবর্ধন মণ্ডলের ছেলে পরেশ ৷ দ্যাখ না দ্যাখ পারুলের পিছনে লেগে রয়েছে ৷ যখন-তখন পারুলদের বাড়ির সামনে দিয়ে চক্কর ৷ স্কুল যাওয়া-আসার পথে তো রোজ দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধা ৷ গোবর্ধন মণ্ডল এলাকার নাম-ডাকওলা বড়লোক ৷ বিঘের পর বিঘে ধানিজমি ৷ চালকল, লরির ব্যবসা ৷ কী নেই! এককথায় টাকার কুমির ৷ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল বাড়ি ৷ আগে পার্টির লোকেদের সঙ্গেও ভালো ওঠা-বসা ছিল ৷ পালাবদলের পর সেটা কমেছে ৷ কিন্তু ক্ষমতা কমেনি বিশেষ ৷ পয়সার জোর থাকলে ক্ষমতা তো থাকবেই ৷ লোকে বলে এলাকার কুখ্যাত গুন্ডা পোটকাও নাকি গোবর্ধনের বশ ৷ গোবর্ধন তাকে নিয়মিত মাসোহারা দেয় ৷ সেজন্যই এলাকার কোনও পাঁচুর সাহস নেই মণ্ডলবাবুর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার ৷
এহেন গোবর্ধন মণ্ডলের একমাত্র ছেলে পরেশ ৷ অনেক ঠাকুরের দোরধরা, শিবরাত্তিরের সলতে ৷ ছেলে চাইলে গোবর্ধন বোধহয় আকাশের চাঁদটাও পেড়ে এনে দিতে পারে ৷ এমন ছেলের হঠাৎ দিনমজুরি খেটে খাওয়া হারাধন গড়ুইয়ের মেয়ে পারুলকে কেন পছন্দ হল ভগবানই জানে ৷ পারুলকে অবশ্য দেখতে মন্দ নয় ৷ মাজা রং ৷ ছিপছিপে গড়ন ৷ মুখখানাও দিব্যি মিষ্টি ৷ কিন্তু তাদের চালের ফুটো দিয়ে বর্ষার জল পড়ে ৷ বাবা-কাকার কাজ না থাকলে অনেকসময়ই একবেলা উপোস দিতে হয় ৷ আসলে ওই যে সেই কথায় বলে না, যার সঙ্গে যার মজে মন, ব্যাপারটা বোধহয় অনেকটা সেরকমই ৷ কিন্তু এক্ষেত্রে মন মজার ব্যাপারটা পুরোপুরি একপক্ষীয় ৷ পারুলের মন মজেনি ৷ সত্যিকথা বলতে পরেশ যে তারজন্যই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সেটা পারুল প্রথমটায় ভাবেওনি, বুঝতেও পারেনি ৷ পরে বুঝতে পেরে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় ৷ তারপর যতদিন গেছে অবস্থাটা ক্রমশ বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ৷ এদিকে পারুলের যে তাকে পছন্দ না-ও হতে পারে সেটা সম্ভবত পরেশের কল্পনার অতীত ৷ তাই সেও পিছনে লেগে আছে ৷
আজ অবশ্য পরেশকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মনের অবস্থা ছিল না পারুলের ৷ কোনওরকমে পাশ কাটিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় দুজনে ৷ পিছন থেকে রোজকার মতোই অশ্লীল টিপ্পনি উড়ে আসে ৷ কান না দিয়ে জোরে পা চালায় ৷ আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁক নিতেই স্কুলবাড়ির নিচু পাঁচিল ৷ ধারে একটা মস্ত পেয়ারা গাছ ৷ জালি এসেছে অনেক ৷ হজমিওয়ালা তেকোণা বাঁশের খাঁচাটা নামিয়ে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে ৷ পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢোকে পারুল আর মঞ্জু ৷ সোজা বড়দির ঘরে ৷ সেখানে ততক্ষণে জড়ো হয়েছে তাদের ক্লাসের আরও অনেকে ৷ বড় টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে বড়দি আর অঙ্কের সবিতাদি কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন ৷ পারুল আর মঞ্জু ঘরে ঢুকতেই বড়দি মুখ তুলে তাকিয়ে হেসে বললেন, এই তো, এসে গেছে ৷ এবার তাহলে খবরটা দিয়ে দেওয়া যাক ৷ হেসে ঘাড় নাড়লেন সবিতাদিও ৷
শোনো মেয়েরা, আমাদের সরলাবালা হাইস্কুলের মাধ্যমিকের রেজাল্ট এবার খুব ভালো হয়েছে ৷ তোমরা বাহান্ন জন পরীক্ষা দিয়েছিলে ৷ সবাই পাশ করেছ ৷ মেয়েদের গলা থেকে একটা সমবেত উল্লাস ধ্বনি বেরিয়ে আসে ৷ সেটাকে থামতে সময় দিয়ে ফের বড়দি বলেন, ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে দশ জন ৷ আর সবচেয়ে আনন্দের কথা হল এবছর আমাদের এক ছাত্রী চারটে বিষয়ে লেটার নিয়ে স্টার পেয়েছে ৷ সে কে জানো তোমরা? পারুলবালা গড়ুই ৷ আমাদের পারুল ৷
কাঁচা মাটির রাস্তাটা ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে পারুল ৷ পায়ের প্লাস্টিকের চটিটা কখন ছিটকে গেছে, খেয়াল নেই ৷ কাঁটায় দু-চারবার শাড়ি আটকেছে, ভ্রুক্ষেপ করেনি ৷ তাদের মাটির বাড়িটা দেখা যাচ্ছে ৷ চালের খুঁটিটা ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে ৷ হাতের ঝাঁটাটা ছুড়ে ফেলে এগিয়ে আসছে কাকিমা ৷ বোনের দিকে ছুটে আসছে বকুল, মা মা আমি স্টার পেয়েছি ৷ চারটে লেটার ৷ স্কুলে ফার্স্ট হয়েছি মা… আমি ফার্স্ট হয়েছি…
– – –
গল্পটা তো এরকম হতেই পারত ৷ হলে হয়তো আমরা অনেকেই খুশিও হতাম ৷ কিন্তু মেয়েটার নাম যে পারুলবালা গড়ুই ৷ পরিচয়, জনমজুর খাটা হারাধন গড়ুইয়ের মেয়ে ৷ তার জীবনটা এরকম সরলপথে এগোনো যে বড় কঠিন ৷ তাই কল্পনার পারা উঠে যাওয়া ঝাপসা আয়না থেকে এবার চলুন দৃষ্টি ফেরানো যাক চোখধাঁধানো বাস্তবে ৷
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে ৷ কাকিমার বাপের বাড়ি উরালি গ্রামে ৷ পারুলদের মাচানতলা থেকে বাসে যেতে সময় লাগে আধঘণ্টা ৷ তবে বাস তো সেই হাইরোডে ৷ বাড়ি থেকে হেঁটে বাসরাস্তা পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট ৷ ভ্যানরিকশা চলে ৷ কিন্তু তাতে তো আবার পাঁচটা করে টাকা নেবে ৷ আবার বাসভাড়াও দিতে হবে চারটে টাকা ৷ পারুল, তার মা আর কাকিমা তাই হেঁটেই বাসরাস্তা চলে গেছিল ৷ বকুল যায়নি ৷ বাবা-কাকার ভাত-জল করতে হবে ৷ কাকার ছেলে-মেয়ে দুটো ছোট ৷ ওদেরকেও সঙ্গে নেয়নি কাকিমা ৷ নিলেই ভ্যানে চাপতে হবে ৷ অতখানি পথ হাঁটতে পারবে না ৷ তার থেকে বকুলের কাছে একটা রাত দিব্যি থাকবে ৷ বাপের বাড়ি যাওয়াটা জরুরি ৷ একে তো বুড়ি মায়ের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি ৷ তার ওপর একটা জমি বিক্রির কথা হচ্ছে ৷ ডাক-খোঁজ না করলেই ভাইরা বোনেরা ভাগটুকু মেরে দেওয়ার ধান্দা করবে ৷ কিন্তু এসব কাজে একলা গেলে ঠিক জোর পাওয়া যায় না ৷ তাই পারুল আর তার মাকে সঙ্গে নেওয়া ৷ বরকে বলে লাভ নেই ৷ একে তো সে অনেকদিন বাদে খানতিনেক ঘর ছাওয়ার কাজ পেয়েছে ৷ ঠিকঠাক করলে দুটো পয়সা ঘরে আসবে ৷ তার ওপর সে একটা মেনিমুখো গাঁজাখোর ৷ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কোথায় গাঁজা খেয়ে উল্টে পড়ে থাকবে ৷ তখন তার খোঁজ নেওয়াটাই একটা মস্ত কাজ হয়ে দাঁড়াবে ৷ তার চেয়ে বড় জা সঙ্গে থাকা ভালো ৷ রোগা- সোগা ছোটখাটো মানুষটি হলে কী হবে, বুদ্ধি ধরে খুব ৷ মাথাটিও ঠান্ডা ৷ আর পারুলকে তো নিতেই হবে ৷ সে তো তাদের বাড়ির সব থেকে বড় বল-ভরসা ৷ লেখাপড়া-জানা মেয়ে ৷
কাজ-টাজ মিটল ভালোভাবেই ৷ পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে উরালি থেকে বেরোল তিনজনে ৷ মাচানতলা মোড়ে যখন বাস পৌঁছল, বেলা তখন প্রায় চারটে ৷ বাসরাস্তার পাশেই মস্ত হাট বসেছে ৷ বকুলের চুলের ফিতে আর ছোট বোনের লাল রিবন কিনতে কাকিমা দাঁড়াল মনিহারি জিনিস বিক্রির চালাটার সামনে ৷ মা এদিকে পদির ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলছে ৷ একটু বিরক্ত লাগছিল পারুলের ৷ তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে ৷ প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের নার্স দিদির মেয়েটাকে সপ্তাহে ছ’দিন তাকে পড়াতে যেতে হয় ৷ ক্লাস ওয়ানে পড়ে মেয়েটা ৷ কিন্তু ভয়ানক বিচ্ছু ৷ এক জায়গায় বসিয়ে রাখাই কঠিন ৷ একদিন পারুল না গেলেই মুখ ভার হয় দিদিমণির ৷ মাস গেলে দুশোটা টাকা দেয় ৷ না গিয়ে কী করে পারুল! টাকা ক’টা যে তার বড্ড দরকার ৷
ওই ক’টা টাকা ছিল বলে তো পরীক্ষার সময় অন্তত খাতা-টাতা কিনতে পেরেছে ৷ বইয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছিল ৷ কিন্তু উত্তর লেখা প্র্যাকটিস করতে হলে তো খাতা লাগবে ৷ পারুল পাবে কোথায়? তাও তো মঞ্জু ছিল তাই ৷ ওর বাবার পোস্টাপিসে চাকরি ৷ পুরোনো কাগজ এনে দিত আপিস থেকে ৷ হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ ৷ তাতে কী? মঞ্জু আর পারুল তাতেও অঙ্ক কষত ৷ পারুলের বাড়িতে তো আর কারেন্ট নেই ৷ সুয্যি ডুবল তো বই-খাতার পাট চুকল ৷ কেরোসিন থাকলে হ্যারিকেন জ্বালানো যায় ৷ কিন্তু গত দু-বছর বাবা-কাকা কেউই তেমন জন খাটার কাজ পায়নি ৷ ভাত জোটানো যেখানে কঠিন, সেখানে কেরোসিন কে কিনবে? মঞ্জুর বাড়িতেই রাত পর্যন্ত পড়ত পারুল ৷ পড়া শেষ হলে ওর বাবা টর্চ নিয়ে পৌঁছে দিয়ে যেত ৷
এসব কথা বাবা-কাকা জানে কিনা সন্দেহ আছে পারুলের ৷ কাকা তো সন্ধেরাত্তির থেকেই গাঁজার আড্ডায় ৷ বাড়ি যখন ফেরে আগু-পিছু জ্ঞান নেই ৷ বাবার ওসব দোষ নেই ৷ সংসারের জন্য ভূতের খাটনি খাটে ৷ তারপর সন্ধে না লাগতে যা হোক কিছু পেটে দিয়ে মোষের ঘুম ৷ পারুল যে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল, সেটা বাবা জানে কিনা সন্দেহ ৷ ভরসা শুধু মা আর ওই কাকিমাটি ৷ পাখির ছানার মতো আগলায় পারুলকে ৷ কাকিমার পোষা মুরগি আছে গোটা কয়েক ৷ তাদের একটা ডিমও নিজের ছেলেকে পর্যন্ত দেয় না কাকিমা ৷ পারুল খাবে ৷ পড়াশোনা করছে না! ভালো খেতে হবে ওকে ৷ বড় ভরসা তার ওপর কাকিমার ৷ মনে মনে ভাবে পারুল ৷ পরীক্ষা তো ভালোই হয়েছে ৷ এদের আশা পূরণ করতে পারবে তো?
ভাবতে ভাবতেই মনের কোণে তিতকুটে ভাব ৷ হরি ময়রার দোকান পেরিয়ে যেখানে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পরেশ ৷ বড়লোকের বখা ছেলে ৷ ক্লাস সেভেনে উঠে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ৷ তারপর থেকে সারাদিন শুধু ফুলবাবুটি সেজে টো-টো কোম্পানি ৷ আজ এ মেয়ের পিছনে, কাল ও মেয়ের পিছনে হিড়িক দেওয়া ৷ আগে সাইকেল চড়ত, এখন আবার বাইক কিনেছে একখানা ৷ কী কুক্ষণে যে পারুলকে চোখে ধরেছে! নাহোক মাস ছয়েক পিছনে লেগেই আছে ৷ পারুলের একেকদিন ইচ্ছে করে পায়ের চটিটা খুলে দু-চার ঘা দিয়ে দেয় ৷ কিন্তু মঞ্জু বারণ করে, ওসব করতে যাস না ৷ ওরা বড়লোকের ছেলে ৷ কী করতে কী করে দেবে, কোথায় ফাঁসিয়ে দেবে তার ঠিক আছে? তার চেয়ে চুপচাপ থাক ৷ পাত্তা না দিলে এমনিই কেটে যাবে ৷
মঞ্জুর কথাটা মাথায় রেখেই আজও এগোল পারুল ৷ দেরি করা যাবে না ৷ কাল পড়াতে যাওয়া হয়নি ৷ আজও না গেলে নার্স দিদিমণি চারটে কড়া কথা বলতে ছাড়বে না ৷ তবে একবার পিছন ফিরে দেখে নিল ৷ কাকিমার কেনাকাটি হয়ে গেছে ৷ মা-কাকিমা দুজনেই আসছে গুটিগুটি ৷
রাস্তার বাঁকে মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল পরেশ ৷ পারুলকে একা দেখেই এগিয়ে এল ৷ চোয়াল শক্ত করে দেখেও না দেখার ভান করছিল পারুল ৷ কিন্তু পরেশ ছাড়ার পাত্র নয় ৷ রাস্তার মাঝখানে দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বলল, একটা কথা ছিল ৷
উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে পারুল ৷ কিন্তু রাস্তার প্রায় সবটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পরেশ ৷ ফের বলে, বললাম যে একটা কথা ছিল ৷ একমিনিট দাঁড়িয়ে শুনে গেলে ভালো হয় ৷
আমার সময় নেই ৷ রাস্তা ছাড়ুন ৷— হিস হিসিয়ে ওঠে পারুল ৷
এত ব্যস্ত কীসের, হ্যাঁ? বড় যে গুমোর দেখছি ৷
এবার আর সামলাতে পারে না পারুল ৷ সোজা তাকিয়ে বলে, আপনার মতো রাস্তার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার নেই ৷ সরুন, নাহলে এবার চেঁচিয়ে লোক ডাকব ৷ কয়েক সেকেন্ড একটু থতিয়ে যায় পরেশ ৷ তারপর সরে যেতে যেতে দাঁতে-দাঁত ঘষে বলে, কাজটা ভালো করলি না, পারুল ৷
কোনওদিকে না তাকিয়ে সামনে এগোয় পারুল ৷ মাথার ভিতরটা যেন আগুন হয়ে আছে ৷ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রায় দৌড়চ্ছে ৷ মা-কাকিমা যে অনেকটা পিছনে পড়ে গেছে সে খেয়াল নেই ৷ এমনকী মোটরসাইকেলের জান্তব আওয়াজটা যে ক্রমশ কাছে চলে আসছে সেটাও খেয়াল করেনি ৷ যখন করল তখন আর সময় নেই ৷ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া মেয়েটাকে পিষে দিয়ে চলে গেল পরেশ ৷ গোবর্ধন মণ্ডলের শিবরাত্তিরের সলতে ৷
.
আপনারা বলছেন, এটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, খুন? আপনারা দেখেছেন? নিজের চোখে দেখেছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখেছি গো ৷ নিজের চক্ষে দেখেছি ৷ গোবর্ধন মণ্ডলের ছেলে আমাদের মেয়েটার ওপর দিয়ে ভটভটিটা চালায়ে দিল ৷ আমাদের মেয়েটা মরে গেল গো ৷ মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে গেল ৷
থানার বড়বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিল পারুলের কাকিমা ৷ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে পারুলের মা ৷ ভাষাহীন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ৷ হাত-পায়ে কোনও বশ নেই ৷ মঞ্জুর মা তাকে শক্ত করে ধরে না থাকলে যে-কোনো সময় বোধহয় মাটিতে লুটিয়ে পড়বে ৷
পারুলের বাবা আর কাকা হাঁটুতে মুখ গুঁজে মাটিতে বসে ৷
খুনের অভিযোগই লেখা হল ৷ মা আর কাকিমার টিপছাপ নিলেন বড়বাবু ৷ সেদিন রাতেই পরেশকে গ্রেফতার করল পুলিশ ৷ গোবর্ধন মণ্ডল বোধহয় ভাবতেই পারেননি যে জনমজুর হারাধন গড়ুইয়ের সাহস হবে তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে এফ আই আর করার ৷ পরেশ তাই বাড়িতেই ছিল ৷
.
পরদিন তাকে আদালতে তোলা হলে জজসাহেব বারো দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিলেন ৷ সন্ধে হয়ে গেছে ৷ পারুলকে দাহ করে এসে দাওয়ায় পাতা ছেঁড়া দড়ির খাটিয়াটার ওপর বসে ছিল পারুলের বাবা ৷ কাকাও বসে আছে মাটিতে ৷ বকুল এসে দু-কাপ চা দিয়ে গেল ৷ কালকের ঘটনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত একবিন্দু জলও খাওয়ানো যায়নি পারুলের মাকে ৷ একটি কথা ফোটেনি মুখে ৷ কাকিমার কোলে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে আছে শুধু ৷
মোটরসাইকেলের আলোটা দেখা যাচ্ছিল দূর থেকেই ৷ কিন্তু সেটা তাদের বাড়ির কাছে এসে দাঁড়াবে ভাবেনি কেউই ৷ পরপর দুটো বাইক ৷ গোবর্ধনবাবু আর তার দুই শাগরেদকে আসতে দেখে একটু সামলে বসে হারাধন ৷ চাপা গলায় বলে, বকুল, তুই ভিতরে যা ৷
ঘর থেকে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার বার করে দিয়ে নিঃশব্দে ভিতরে চলে যায় বকুল ৷ দাওয়ায় উঠে গোবর্ধনবাবু একটা চেয়ারে বসেন ৷ শাগরেদরা দাঁড়িয়ে থাকে ৷ একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ৷ তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে গোবর্ধন মণ্ডল বলেন, দ্যাখ হারাধন, যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে ৷ তোদের মেয়ে তো আর ফিরে আসবে না ৷ খামোখা আমার ছেলেটা জেলের ঘানি পিষবে ৷ আমার একমাত্র ছেলে ৷ তোরা বাবু মামলাটা তুলে নে ৷ আমি তোদের পুষিবে দেব ৷ মেয়েটা আমার মরে গেছে দাদা ৷ ওর মা একফোঁটা জল খাচ্ছে না ৷ — এর বেশি আর কিছু বলতে পারে না হারাধন ৷
জানি রে, জানি ৷ আমিও তো ছেলেপিলের বাপ ৷ আমার বাড়িতেও তো একই অবস্থা ৷ ওর মা শুধু মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর বলছে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনে দাও ৷ তোদের তো আরও দু-পাঁচটা আছে ৷ আমাদের তো ওই একটিই ৷ আমি কথা দিচ্ছি হারা তোদের কোনও অভাব রাখব না ৷
কীসের অভাব রাখবেন না, বাবু? আমাদের মেয়ের অভাব পুরায়ে দেবেন? আপনি কি ভগবান?
পারুলের কাকিমার আলগা আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে ৷ দু-চোখ যেন দু-খণ্ড আগুনের গোলা ৷
আঃ, তুই ঘরে যা ৷ মেলা কথা বলিস না ৷— ধমকে ওঠে পারুলের কাকা ৷
গোবর্ধন মণ্ডল কিন্তু মিছরিমাখা গলায় বলেন, ছেড়ে দে বাবা ৷ কিছু বলিস না ৷ ওরা মায়ের জাত ৷ কিন্তু আমার কথাটা শোন কিছু করতে হবে না ৷ থানায় গিয়ে কিছু বলতেও হবে না ৷ শুধু কেস যেদিন উঠবে সেদিন সাক্ষী দিতে যাসনি ৷ বাড়িতে একটা বড় মেয়ে আছে ৷ আর একটা বড় হচ্ছে ৷ ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে ৷ এসব কথাও তো মাথায় রাখতে হবে ৷
আরও কিছুক্ষণ ধানাই-পানাই করে চলে যান গোবর্ধনবাবু ৷ কিন্তু তার পরের দিন আবার আসেন ৷ তার পরের দিনও ৷ রোজই ৷ কখনও তিনি নিজে ৷ কখনও তাঁর চেলারা ৷ পারুলের বাবা-কাকার হাতে টাকা গুঁজে দেয় ৷ চালের বস্তা ঢুকিয়ে রাখে রান্নাঘরে ৷ নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বাড়াতে থাকে টাকার অঙ্ক ৷ নাকের ডগায় গাজরের মতো ঝোলাতে থাকে একটা শ্যামলা মেয়ের জীবনের বিনিময়ে সারা পরিবারের নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ৷
কেস ওঠে বারো দিন পরে ৷ বাদী পক্ষের কেউ সাক্ষী দিতে আসেনি ৷ কিন্তু তবু তো খুনের মামলা ৷ তাই আবার দু সপ্তাহের পুলিশ হেফাজত হয় পরেশের ৷
রাস্তায় একদিন পারুলের বাবাকে দেখে চমকে ওঠে মঞ্জু ৷ পরিষ্কার ধুতি-শার্ট পরা ৷ ক্ষৌরি করা গাল ৷ তবে কি লোকে যা ফিসফাস করছে সবই সত্যি? গোবর্ধন মণ্ডল পয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছে পারুলের বাড়ির লোকজনকে? পরেশের ছাড়া পাওয়া এবার শুধু সময়ের ওয়াস্তা ৷
আরও দুবার কেস ওঠে ৷ সাক্ষী না থাকায় হেফাজতের মেয়াদ বাড়ে ৷ থানা থেকে খবর নেন গোবর্ধন মণ্ডল ৷ এবার কেস যখন উঠবে বাদী পক্ষের সাক্ষী না থাকলে জামিন হয়ে যাবে পরেশের ৷ মামলা অবশ্য চলবে ৷ কিন্তু তাতে কী? ছেলে ঘরে ফিরলে বড় উকিল লাগিয়ে ও মামলা যে শেষ পর্যন্ত খারিজ করাতে পারবেন, এমন বিশ্বাস গোবর্ধন মণ্ডলের নিজের ওপর আছে ৷ দশ লক্ষ টাকা আর পাঁচ বিঘে জমি হারাধনদের দুই ভাইয়ের নামে লিখে দেবেন ৷ কাগজপত্র সব তৈরি ৷ সহজে অবশ্য হয়নি ৷ দুই ভাই-ই বেগড়বাঁই করেছে অনেক ৷ মেয়ের জন্য দরদ উথলে দিয়েছে ৷ পাঁচ লাখে হয়ে যাবে ভেবেছিলেন ৷ দশ লাখ পর্যন্ত উঠতে হল ৷ সঙ্গে চাপা শাসানি ৷ জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করার ফল যে ভালো হয় না তার নানারকম উদাহরণ ৷
শেষকালে একদিন পোটকা গিয়ে বড় মেয়েটার সঙ্গে খানিক গল্প-গাছা করে আসার পর সব ঠান্ডা হয়ে গেল ৷ পার্টি ক্ষমতায় থাকলে অবশ্য এত ঝামেলা পোহাতে হত না ৷ পাশা উলটে যাওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে ৷ ব্যবসাপত্তরগুলো সময়মতো গুছিয়ে নেওয়া গেছিল বলেই বাঁচোয়া ৷
২৪ জুন ৷ আজ আবার পরেশের কেস উঠবে আদালতে ৷ এবারটা সামলানো গেলেই জামিন ৷ সকালেই নেতাইকে হারাধনের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন গোবর্ধন মণ্ডল ৷ অ্যাটাচিতে দশ লাখ টাকা আর জমির দানপত্র ৷ পরেশের জামিন হয়ে গেলেই মোবাইলে খবর দেবেন নেতাইকে ৷ ব্যাঙ্কে সব ফিট করা আছে ৷ কাগজপত্র হাতে দিয়ে নেতাই নিজে দুই ভাইকে বাইকে চাপিয়ে ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা নামে টাকা জমা করে দেবে ৷ গোবর্ধন নিজে আদালতে থাকবেন ৷ একেবারে ছেলেকে নিয়ে ফিরবেন ৷
কী ভেবে বেরোনোর আগে নেতাইকে ডেকে গোবর্ধন বলে দিলেন, মেশিনটা সঙ্গে নিয়ে যা ৷ গরিব লোক তো ৷ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যেতে পারে ৷ একবার জামাটা তুলে দেখিয়ে দিবি, ঠান্ডা হয়ে যাবে ৷
সকাল সকালই চলে এসেছে নেতাই ৷ বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে আরাম করে ৷ বাড়ির কেউই আজ ঘর থেকে বেরোয়নি ৷ দাওয়ায় বসে একটার পর একটা বিড়ি খেয়ে যাচ্ছে হারাধন ৷ বকুলের কাকা চা খেয়ে আবার কাঁথামুড়ি দিয়েছে ৷ ছোট ভাই-বোনদুটো বই-শেলেট নিয়ে বসেছে ৷ রান্নাঘরের সামনে কুটনো কুটছে বকুল ৷ উনুনে ভাতের হাঁড়ি বসিয়েছে কাকিমা ৷ রান্নাঘরেরই একপাশে বসে আছে পারুলের মা ৷ চোখে ভাষা নেই ৷ শুধুই বোবা কান্না ৷ ভয় আর অপরাধবোধের একটা গুমোট কম্বল যেন ঢেকে আছে গোটা বাড়িটাকে ৷
বসে বসে ঢুল আসছিল নেতাইয়ের ৷ হঠাৎ পায়ের শব্দে চটকা ভাঙল ৷ ভাঙা বেড়ার গেটটা পেরিয়ে ছুটে ঢুকছে একটা মেয়ে ৷ নীলপাড় শাড়ি পরা ৷ মেয়েটাকে চেনে নিতাই ৷ পোস্টাপিসের বাবুর মেয়ে ৷ মঞ্জু না কী যেন নাম….মরা মেয়েটার বন্ধু ছিল…এ আবার কী ঝামেলা পাকাতে এল…. ভাবতে ভাবতেই চিৎকার করে ওঠে মঞ্জু, কাকিমা…আ…কাকিমা গো …, পারুল ফার্স্ট হয়েছে, ফার্স্ট হয়েছে, স্টার পেয়েছে কাকিমা…. চারটে লেটার পেয়েছে… আমাদের সবার থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে গো পারুল…সব থেকে বেশি… ৷
ছুটে বেরিয়ে এসেছে পারুলের কাকিমা ৷ বিদুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠেছে মা ৷ বঁটি ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে বকুল৷
আমি ভ্যান রিকশা নিয়ে এসেছি কাকিমা, মঞ্জুর গলা কাঁপছে ৷
দিদি চলো ৷—আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে পারুলের মায়ের হাত ধরে টানে কাকিমা ৷ কোন এক অমিতশক্তিতে ভর করে এগিয়ে আসে মা-ও ৷
অ্যাই অ্যাই, কেউ কোথথাও যাবে না ৷ অ্যাই ছুঁড়ি, ভাগ এখান থেকে…নইলে… ৷ — লাফ দিয়ে এগিয়ে এসেছে নিতাই ৷ কোমরে লুকিয়ে রাখা মেশিনটা মূহূর্তে হাতের মুঠোয় ৷
কাকে মারবে তুমি? ক’জনকে মারবে?—কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মঞ্জু ৷
চমকে উঠে নেতাই দ্যাখে বেড়ার ধারে নীল পাড় সাদা শাড়ির ভিড় ৷ শ্যামলা মুখ, শক্ত চোয়াল ৷ আরও আসছে ৷ অনেকে ৷ দূরের আলপথ ধরে ধেয়ে আসছে ৷
বাড়ির সামনে রাখা ভ্যান রিকশায় ততক্ষণে চেপে বসেছে পারুলের মা ৷ উঠতে গিয়েও থেমে যায় কাকিমা ৷ নেতাইয়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, তোর মালিককে গিয়ে বলিস, আমাদের মেয়ে ফার্স্ট হইছে রে…লেটার পেইছে ৷ এসব কথার মানে জানে না তোর মালিক ৷ মানেটা শিখে নিতে বলিস ৷
ভ্যান রিকশা ছেড়ে দেয় ৷ নীলপাড় সাদা শাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকে শহরের দিকে ৷ ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে আবার নতুন করে বুনতে শেখায় শক্তি সংগ্রহ করতে ৷
তুমি জানো না – অমলেন্দু সামুই
তোমাকে আমি প্রায়ই চিঠি লিখি ৷ সপ্তাহে অন্তত তিনখানা ৷ কাজের ফাঁকে-ফাঁকে যখনই সময় পাই— তখনই মনে-মনে কথার পর কথা সাজিয়ে রাখি ৷ তারপর বাড়ি ফিরে দরজায় খিল লাগিয়ে আমার হালকা নীল রঙের প্যাডখানা টেনে নিই৷ চিঠি লেখার জন্যে তুমি হালকা নীল রং খুব পছন্দ করতে ৷ এখন তোমার পছন্দ আমারও পছন্দ হয়ে গেছে ৷ তোমাকে সাদা কাগজে চিঠি লেখার কথা ভাবতেই পারি না ৷ তোমার কাগজের রঙে রং মিলিয়ে লিখতে খুব ভালো লাগে ৷ ভালো লাগে বলেই আমি হালকা নীল রঙের প্যাড ব্যবহার করি ৷ যখনই তোমাকে চিঠি লিখতে বসি— তখনই মনে পড়ে তোমার সেই স্বপ্ন-ঘেরা বাড়ির কথা ৷ কথাটা তুমি প্রায়ই বলতে ৷ বলতে— বেশ সুন্দর একখানা বাড়ি হবে ৷ শহরে নয়— গাঁয়ে ৷ অনেক দূরে, আকাশের গায়ে দু-চারটে পাহাড় দেখা যাবে ৷ কাছেই থাকবে ক্ষীণতনু খরস্রোতা নদী ৷ সেই নদীর কাছে একটা একতলা বাড়ি ৷ সামনে থাকবে ছোট একটা গেট ৷ তার ওপর মাধবীলতার আবরণ ৷ অর্ধচন্দ্রাকৃতি গেটের নীচে ডানদিকে থাকবে ছোট একটা সবুজ রঙের লেটারবক্স ৷ তার গায়ে হলুদ অক্ষরে লেখা থাকবে ‘শিউলিবাড়ি’ ৷ তোমার নামে বাড়ির নাম ৷ তোমার হয়তো মনে নেই, আমি বলেছিলাম, লেটারবক্সের রং হোক হলুদ— তার ওপর নাম সবুজ রঙে ৷ তাহলে বেশ কিছুটা দূর থেকেই বাড়ির নাম, মালিকের নাম চোখে পড়বে ৷ তুমি বলেছিলে, না, সবুজের ওপর হলুদ লেখাই আমার ভালো লাগে ৷ লেখা দেখার জন্যে তাহলে সবাইকে খুব কাছে আসতে হবে ৷ কাছে এলেই দেখতে পাবে— গেট থেকে লাল সুরকির পথটা সোজা বাড়িটার পায়ের কাছে পৌঁছে গেছে ৷ পথের একদিকে সাদা ফুলের মেলা, অপরদিকে রঙিন ফুলের বাসর ৷ সুন্দর সাজানো-গোছানো দুটি বাগিচা ৷ তুমি ‘বাগান’ বলতে না— ‘বাগিচা’ ৷
এর আগে যে-চিঠিখানা তোমাকে লিখেছিলাম— তাতে বলেছি— তোমার স্বপ্নে-ঘেরা বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে ৷ বাংলাদেশের মধ্যেই ছোট একটা পাহাড়ি জায়গা ৷ কাছে নদীও আছে ৷ কিন্তু লোকবসতি খুব কম ৷ হোক কম— তুমি নিরালাই বেশি পছন্দ করতে ৷ বলতে, সেখানে আমি তো কথা বলব না— শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করব ৷ বুদ্ধি দিয়ে, বিবেক দিয়ে কোনোকিছু বিচার করব না ৷ হৃদয়ের কাছে যা কাম্য— তা-ই হবে আমার কাজ ৷
আমি তোমার কথা শুনে হাসতাম ৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হয়েও তুমি বড় বেশি ছেলেমানুষি করতে৷ আমি কিন্তু ওগুলো প্রাণভরে উপভোগ করতাম ৷ তাই তোমার গাম্ভীর্য আমায় ব্যাকুল করে তুলত ৷ মনের মধ্যে নানা প্রশ্নের ঢেউ তুলে তোমার গাম্ভীর্যের কারণ খুঁজতাম— কিন্তু পরক্ষণেই তুমি হাসির ঢেউয়ে সবকিছু ভাসিয়ে দিতে ৷ আমার খুব ভালো লাগত ৷ ভালো লাগত তোমার স্বপ্ন, ভালো লাগত তোমার কথা, ভালো লাগত তোমার সবকিছু ৷ আজও ভালো লাগে ৷ গভীর রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে যখন বিছানার ওপর কর্মক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিই— হয়তো জানলা দিয়ে একঝলক চাঁদের আলো আলনাটার পায়ের কাছে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে— তখন তোমার পুরোনো কথাগুলো আমার কানের কাছে মধুর স্বরে যেন গান শোনাত ৷ তোমার কণ্ঠস্বর এত মিষ্টি, উচ্চারণ-ভঙ্গি এত সুন্দর ছিল যে, তুমি কথা বললেই মনে হত গান গাইছ ৷ অথচ তোমাকে আমি কোনোদিন গান গাইতে শুনিনি ৷ তুমি আবৃত্তি করতে ৷ বিশেষ করে কবিগুরুর প্রেমের কবিতাগুলো তোমার কণ্ঠে শুনতে ভারী ভালো লাগত ৷
আজ যদি তুমি এখানে আসতে— দেখতে তোমার স্বপ্ন-ঘেরা বাড়িকে আমি বাস্তবে রূপায়িত করেছি ৷ ঠিক যেখানে যা চেয়েছিলে তুমি— সব সেইভাবেই সাজিয়ে রেখেছি ৷ আলনায় নতুন কেনা আটপৌরে শাড়ি, তার পাশে আমার ধুতি— তোমার শায়া-ব্লাউজ—আমার গেঞ্জি-জামা— সব পাশাপাশি গুছিয়ে রেখেছি ৷ যদি কোনোদিন তুমি এসে পড়ো— তাহলে অবাক হয়ে যাবে ৷ মনে হবে—এই বাড়িতেই থাকতে তুমি ৷ তোমার প্রয়োজনের সব জিনিসই আমি কিনে রেখে দিয়েছি ৷ তুমি এলে তোমার এতটুকু অসুবিধে হবে না ৷ কিন্তু তুমি আসবে কি? জানি না— আজও তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ কি না ৷ একটা মিথ্যাকে সত্য জেনে তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ ৷ অথচ আমাকে জিগ্যেস করবার প্রয়োজনও মনে করোনি ৷ যদি জিগ্যেস করতে— তাহলে জানতে পারতে কতখানি ভুল তুমি করেছিলে ৷ কিন্তু তুমি নিজের অভিমান নিয়েই পড়ে রইলে ৷ আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলে না ৷
যেদিন তোমাদের বাড়ির দরজা থেকে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল— সেদিন মুহূর্তের জন্যে এই পৃথিবীটাকে বড় কঠিন বলে মনে হয়েছিল ৷ মায়া-মমতা-ভালোবাসা— সবকিছু যেন বইয়ের ভাষা— বাস্তবের এতটুকু ছাপ নেই ৷ পাশাপাশি দুটো মানুষ যেন প্রয়োজনের জন্যেই কাছাকাছি থাকছে ৷ অন্তরের টান এতটুকু নেই ৷ বড্ড শক্ত মনে হয়েছিল তোমাদের বাড়ির সামনেকার সবুজ ঘাসগুলো ৷ তোমাদের বাড়ির দরজা থেকে আমার মেস—পাঁচ মিনিটের পথও নয়— কিন্তু মনে হয়েছিল, ওইটুকু পথ পেরোতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লেগে গেল ৷ সেদিন মনে হয়েছিল— আমার বেঁচে থাকাটা নিরর্থক ৷ কার জন্যে— কীসের জন্যে বাঁচব— কথাটা আবার নতুন করে ভাবতে হয়েছিল ৷
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে— আমরা কয়েকজন ছাত্র তোমার বাবার কাছে পড়তে আসতাম ৷ তোমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ছিলেন ৷ আর আমরা একটা ডিগ্রির লোভে বারবার তোমার বাবার কাছে আসতাম ৷ তুমি বোধহয় তখন থার্ড-ইয়ারে পড়ছ ৷ আর তোমার বোন পাপিয়া সবে কলেজে ভরতি হল ৷
প্রথম দিনই তোমার বাবা তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ৷ বললেন, এটি হল আমার বড় মেয়ে, নাম শিউলি ৷ এর সঙ্গে আলাপ করে রাখো ৷ কারণ আমার লাইব্রেরির চাবি এর কাছেই থাকে ৷
কথাটা বলার ধরনে আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম ৷ আমরা মানে— আমি, চন্দন সোম, অনিরুদ্ধ চৌধুরী আর কৌশিক গুপ্ত ৷
চন্দন সোম অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসেছিল, আপনি কী খেতে ভালোবাসেন?
প্রশ্নটা তোমাকে করা হচ্ছে বুঝতে পেরেও তুমি একটু অবাক হওয়ার ভান করেছিলে ৷ চোখ দুটো একটু নাচিয়ে বলেছিলে, আমি?
চন্দন সোম বলেছিল, হ্যাঁ—আপনি ৷
তুমি বলেছিলে, কেন বলুন তো?
তাহলে রোজ সেই জিনিসটা নিয়ে আসব— আর আপনি আমাদের বেশি করে বই দেবেন ৷
ওভাবে আমি বই দিই না ৷ পড়াশুনোয় যার মনোযোগ বেশি, সে-ই বেশি বই পাবে ৷
তোমার বাবা হেসে বলেছিলেন, আমার মেয়েটি কিন্তু খুব কড়া ৷ বই নিয়ে খেলা করতে দেখলেই রেগে যাবে ৷
আরও দু-চারটে হালকা কথাবার্তার পর তোমার বাবা বললেন, এটাকে তোমরা নিজের বাড়ি বলেই মনে করো ৷ যখনই সময় পাবে চলে আসবে, আমার লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনো করবে ৷ কোনোরকম সঙ্কোচ কোরো না ৷
বলা বাহুল্য, প্রাথমিক আলাপে যে-সঙ্কোচ আমাদের ছিল—দু-চারদিনের মধ্যেই সেটা আমরা কাটিয়ে উঠেছিলাম ৷ আমাদের মধ্যে আমিই ছিলাম একটু লাজুক প্রকৃতির ৷ তাই বোধহয় তোমার দৃষ্টি আমার ওপর আগে পড়েছিল ৷ আরা আসতাম— কোনোদিন তোমার বাবা থাকতেন— কোনোদিন হয়তো থাকতেন না ৷ আমরা সোজা লাইব্রেরি-ঘরে চলে যেতাম ৷ তুমি কোমরে কাপড় গুঁজে সারা ঘরে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে ৷ এখানে এ-বইটা রাখা, ওখান থেকে সেই বইটা নামানো— শাড়ির আঁচল দিয়ে বইগুলো মুছে যথাস্থানে রাখা— আমরা বইয়ের পাতা খুলে পড়ার চেষ্টা করতাম— আর তার মাঝে লীলায়িত ভঙ্গিতে তুমি ঘুরে বেড়াতে ৷ ওদের কথা জানি না— আমি কিন্তু তোমার উপস্থিতিতে বইয়ের পাতায় মনঃসংযোগ করতে পারতাম না ৷ তোমার আলতা-রাঙানো পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম ৷
তোমাদের বাড়িতে একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম— তোমার মাকে কোনোদিন আমরা দেখিনি ৷ অথচ অনুভব করতে পারতাম— তিনি আছেন ৷ তোমার মাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করত ৷ তোমাদের যাওয়া-আসায় যখন দরজার ভারী পরদাটা একটু নড়ে উঠত, সেই ফাঁক দিয়ে আমি তোমার মাকে দেখতে চেষ্টা করতাম ৷ তুমি জানো— আমার মা খুব ছেলেবেলায় মারা গেছিলেন ৷ তাই বোধহয় মা সম্বন্ধে অত দুর্বলতা ৷
একদিন— মনে আছে— সন্ধ্যার সময় আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম ৷ তারিখটাও আমার মনে আছে ৷ কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলে তুমি ৷ আমার ভালোও লেগেছিল, আবার ভয়ও করছিল ৷ ভালো লেগেছিল কারণ ভালো লাগাটা ছিল স্বাভাবিক ৷ আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বেশি না হলেও—তোমার সম্বন্ধে আমি কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম ৷ তোমাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঘরের আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়তাম বটে, কিন্তু ঘুম আসত অনেক দেরিতে ৷ অন্ধকার ঘরের মধ্যে আমি যেন তোমাকে দেখতে পেতাম ৷ তুমি কথা বলছ, হাসছ— কিন্তু চোখ দুটি ব্যথা-মলিন ৷ মনে হয়, কী যেন তুমি বলতে চাও— অথচ বলতে পারছ না ৷ আমি মনে-মনে হাতড়ে মরতাম— কেন অমন সুন্দর চোখদুটি সবসময় ব্যথায় ভরে থাকে? বড্ড জানতে ইচ্ছে করত ৷ অথচ তোমাকে জিগ্যেস করতেও ভয় হত, লজ্জা করত ৷ আমার মনে হত— আমার দুঃখের সঙ্গে তোমার ব্যথাভরা-চোখের কোথায় যেন মিল আছে ৷ আর সেই মিল খুঁজতে গিয়ে কত রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি ৷
সেদিন সন্ধ্যায় তোমাদের বাড়িতে আমি একাই গিয়েছিলাম ৷ তুমি দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলে, আমাকে সামনে দেখতে পেয়ে বললে, ভেতরে আসুন ৷
আমি বললাম, স্যার— ৷
বাড়ি নেই ৷
তাহলে আমি বরং যাই ৷ পরে আসব’খন ৷
ওমা, চলে যাবেন কেন?— ভুরু দুটো একটু কাঁপিয়ে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেশ টেনে তুমি বলেছিলে, ভেতরে আসুন ৷
আমি ভেতরে এসেছিলাম ৷ বুকের ভেতরটা একটা অজানা আনন্দে থরথর করে কাঁপছিল ৷ তোমার কাছাকাছি এলেই ওটা হত ৷ তোমার নির্দেশমতো একটা চেয়ারে বসলাম ৷ তুমি বললে, আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে— একা-একা বোর হয়ে যাচ্ছিলাম ৷
একা-একা কেন?
বা রে—বাবা-মা-পাপিয়া— সব চলে গেল যে!
চলে গেল? কোথায়?
বালিগঞ্জে ৷ পিসিমার বাড়িতে ৷
ও—তাই বলো ৷ আনি ভাবলাম বুঝি— ৷
দাঁড়ান— চা তৈরি করে আমি ৷ চা খেতে-খেতে গল্প করা যাবে ৷
বলে তুমি চলে গেলে ৷ হঠাৎ মনটা আমার খুশিতে ভরে উঠল ৷ তোমাদের অত বড় বাড়ি ৷ অথচ তুমি-আমি ছাড়া কেউ নেই ৷ মনে-মনে এইরকমই একটা সুযোগ আমি যেন চেয়েছিলাম ৷ একা-একা তোমাকে অনেকগুলো কথা বলবার জন্যে মনের ভেতরটা ছটফট করতে লাগল ৷ অথচ ভয়ও করছিল ৷ যদি তুমি আমাকে ভুল বোঝো! আমার স্বাভাবিক চাওয়াকে যদি হ্যাংলামো ভাবো ৷ বলব কি বলব না— মনস্থির করতেই বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল ৷ তুমি চা নিয়ে ঢুকলে ৷ এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, এই অবসরে তুমি মুখে একবার পাউডারের পাফটা বুলিয়ে নিয়েছ ৷ চোখে আর-একবার কাজলের সূক্ষ্ম রেখা টেনেছ ৷ বুঝতে পারলাম, আমার কাছে তুমি নিজেকে সুন্দরতর করে তোলার চেষ্টা করেছ ৷ সেই মুহূর্তে নিশ্চিত হলাম যে, আমার প্রতিধ্বনি তোমার হৃদয়েও বাজে ৷ যে-কথাগুলো এতক্ষণ মনের জোরে সংগ্রহ করছিলাম— সেই কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই তোমাকে বলে ফেললাম ৷ লক্ষ করলাম, আমার কথা শুনতে-শুনতে বারবার তুমি ওপরের দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটা চেপে ধরলে, ভুরু দুটো কী এক চঞ্চলতায় থরথর করে কাঁপতে লাগল, চোখের দৃষ্টি আরও গভীর হল— তোমার দু-গালে সূর্যাস্তের রং ধরল ৷
সেদিন আর পড়া হল না ৷ নিস্তব্ধতার মধ্যে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমি চলে এলাম ৷ এর আগে বহুদিন আমি রাত্রে ঘুমোতে পারিনি, কিন্তু সেদিন না ঘুমোতে পারার মধ্যে এক স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করেছিলাম ৷ মনে হয়েছিল, এ-জীবনে বেঁচে থাকার একটা অর্থ আছে, একটা আনন্দ আছে ৷ একজন নারীর কাছে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মধ্যে যে এত সুখ আছে, তা কে জানত!
তারপর থেকে তোমাদের বাড়িতে আমার যাওয়াটা খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেল ৷ তোমার বাবা ভাবলেন, আমি বুঝি পড়াশোনায় অধিক মনোযোগী হয়েছি ৷ কিন্তু তোমার মুখে সবসময় একটা দুষ্টু হাসি খেলা করত ৷ সকলের চোখ এড়িয়ে তুমি ইশারায় আমাকে একটু বেশিক্ষণ থাকতে বলতে ৷ আমি যখন রসিকতা করে তোমার সঙ্গে আমার বর্তমান সম্পর্কের কথা বলতাম, তুমি কটাক্ষ করে আমাকে শাসন করার ভঙ্গি করতে— আমার খুব ভালো লাগত ৷ ভালো লাগত, বোধহয় তুমি বলেই ৷
এমনিভাবে আমরা আরও কিছু এগোলাম ৷ বাড়ির সীমানার বাইরেও আমাদের দেখা হতে লাগল ৷ কোনোদিন হেদুয়া, কোনোদিন কলেজ স্কোয়ার, কোনোদিন বা আরও একটু দূরে— বালিগঞ্জ লেকে ৷ মাঝে একদিন তোমার সঙ্গে তোমার বোন পাপিয়াও এসেছিল ৷ পাপিয়াকে আমার খুব ভালো লাগত ৷ অমন বোন যদি আমার একটা থাকত! পাপিয়া মাঝে-মাঝে তোমার সামনে আমাকে ‘জামাইবাবু’ বলে সম্বোধন করত ৷ তুমি নকল রাগে তার চুল টেনে দিতে ৷
একদিন তুমি বলেছিলে, সুদীপ্ত, এভাবে আর থাকতে পারছি না ৷ একটা কিছু করা দরকার ৷
আমি বুঝতে না পেরে বলেছিলাম, কীসের কী করা দরকার?
অসভ্য! যেন জানে না!
সত্যি বলছি বুঝতে পারছি না ৷
জানি— তার মানে আমার মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাও ৷ বেশ বাবা— তাই বলছি ৷ —বলে তুমি আনমনে ঘাসের শিষ চিবোতে লাগলে ৷ সেদিনের আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর ছিল ৷ সকাল থেকেই দিনটা মেঘলা ৷ দুপুরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে ৷ বিকেলে কিছুক্ষণের জন্যে সূর্যের মুখও দেখা গেছিল ৷ আকাশে নীল মেঘের খেলা ৷ বালিগঞ্জ লেকটাকে সেদিন সুন্দরী তরুণীর মতো মনে হচ্ছিল ৷
আমি বললাম, কই— বলো ৷
তুমি আধো-আধো স্বরে বললে, এভাবে আর তোমার অপেক্ষায় বসে থাকতে ভালো লাগে না ৷ কখন তুমি আসবে আর আমি সারাদিন ধরে ঘড়ির কাঁটা দেখতে-দেখতে পাগল হয়ে যাই ৷ দুপুরটাকে কী বড় লাগে!
.
আমি কী করব বলো ৷ তবুও তো এখন আমি পড়াশোনার নামে রোজই যাই ৷ আগে যে সপ্তাহে দু-তিনদিন যেতাম— তখন ভালো লাগত কী করে?
আহা— তখন আমি এসব ভাবতাম! তখন তো তুমি শুধু বাবার ছাত্র ছিলে ৷
আর এখন?
এখন— আমারও ছাত্র হয়েছ ৷
তাহলে আমাকে কী করতে হবে আদেশ করুন, মাস্টারমশাই ৷
তোমাকে যাতে সবসময় দেখতে পাই— সেই ব্যবস্থা করো ৷
অর্থাৎ?
তুমি বাবার কাছে যাও ৷
সেদিনই রাত্রে তোমার বাবাকে আমি সব কথা খুলে বলেছিলাম ৷ বলেছিলাম, আপনার জ্যেষ্ঠা কন্যাটিকে আমি চাই ৷ তোমার বাবা আপত্তি করেননি ৷ বলেছিলেন, বেশ তো— তার জন্যে এত তাড়া কীসের! পরীক্ষা হয়ে যাক— তারপর একদিন এ-বিষয়ে আলোচনা করা যাবে’খন ৷
কিন্তু সেই সুযোগ আর এল না ৷ একটা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে ৷ একবার জিগ্যেস করবার প্রয়োজনও অনুভব করলে না ৷ তুমি হয়তো জানতে না যে, তোমার বোন পাপিয়ার সঙ্গে চন্দন সোমের ঘনিষ্ঠতা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছিল ৷ পড়াশোনার ফাঁকে-ফাঁকে আমরা যেমন একসঙ্গে থাকবার সুযোগ খুঁজতাম— ওরাও তাই করত ৷ কিন্তু নিজেদের নিয়ে আমরা বড় বেশি ব্যস্ত ছিলাম বলে ওদের ঘনিষ্ঠতা আমাদের চোখে পড়েনি ৷ চোখে না পড়লেও পাপিয়া চন্দন সোমকে ভালোবাসত, ভালোবাসত গভীরভাবেই ৷
তোমার হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে ৷ গোড়া থেকেই বলি ৷ একদিন সন্ধ্যার সময় তোমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, তুমি বাড়ি নেই ৷ পাপিয়া একটা চেয়ারে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে ৷ আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, বসুন, সুদীপ্তদা— দিদি একটু বেরিয়েছে ৷
কোথায় গেছে?
আসবে এখুনি ৷ বসুন না ৷
বসলাম ৷ অপেক্ষা করতে-করতে ক্রমে ধৈর্যহারা হয়ে পড়লাম ৷ পাপিয়া বুঝতে পেরে বলল, একটা গল্প বলুন, সুদীপ্তদা— গল্প বলতে-বলতে দিদি এসে যাবে নিশ্চয়ই ৷
একটা গল্প বলতে শুরু করলাম ৷ গল্প বলতে-বলতে হঠাৎ টেবিলের তলায় একটা খাম নজরে পড়ল ৷ নিচু হয়ে তুলে নিলাম ৷ পাপিয়া দেখতে পেয়ে তড়িৎগতিতে উঠে এল : ওটা আমার চিঠি— দিয়ে দিন, সুদীপ্তদা ৷
মজা করার জন্যে বললাম, দাঁড়াও— কে দিয়েছে দেখি ৷
ভালো হচ্ছে না কিন্তু— ওটা আমার পারসোনাল লেটার— আপনি পড়বেন না ৷
পারসোনাল লেটার! তাহলে তো একবার পড়ে দেখা দরকার ৷
পাপিয়া আমার হাত থেকে খামখানা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ৷ আমিও একবার এ-হাতে একবার ও-হাতে নিয়ে সেটাকে ঘোরাতে লাগলাম ৷
প্লিজ, সুদীপ্তদা— দিয়ে দিন ৷
কে লিখেছে বলো?
আগে দিন— তারপর বলছি ৷
উঁহু— অত বোকা আমি নই ৷ আগে বলো— তারপর দেব ৷
কথা বলতে-বলতেই ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে খামখানা কেড়ে নিতে গেল পাপিয়া ৷ আমি সেই মুহূর্তে হাতটা পেছনদিকে সরিয়ে নিলাম ৷ টাল সামলাতে না পেরে পাপিয়া আমার বুকের ওপর পড়ে গেল ৷
পারলে না তো! — আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম ৷
আপনি ভীষণ অসভ্য! পরের চিঠি দেখতে আছে বুঝি?
ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার আবির্ভাব হয়েছিল ঘরের মধ্যে ৷ সেদিন বুঝিনি— কিন্তু আজ বুঝতে পারি— আমাদের ওভাবে দেখে তোমার মনে একটা নোংরা সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল ৷ সন্দেহের সঙ্গে ছিল ঈর্ষা ৷ তাই অস্বাভাবিক গম্ভীর গলায় বলেছিলে, পাপিয়া— আজ লেখাপড়া নেই?
আছে তো ৷ দেখ না দিদি— সুদীপ্তদা আমার চিঠি দিচ্ছে না ৷
সুদীপ্ত, চিঠিখানা দিয়ে দাও পাপিয়াকে ৷
সেদিন তোমার এই আদেশকে আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম ৷ তাই চিঠিটা ফেরত দিতে-দিতে বলেছিলাম, নেহাত তোমার দিদির আদেশ— তাই দিলাম— নইলে না-পড়ে কিছুতেই দিতাম না ৷
পাপিয়া এক হাতে বুকের কাপড় ঠিক করতে করতে অপর হাত দিয়ে খামখানা আমার হাত থেকে নিল ৷
তুমি আবার বললে, পাপিয়া— যাও— গিয়ে পড়াশুনো করো ৷
পাপিয়া তোমার দিকে অপলক তাকিয়ে ঘর থেকে চলে গেল ৷ বোধহয় তোমার কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিক রূঢ়তায় সে চমকে উঠেছিল ৷
পাপিয়া চলে যেতে আমি চেয়ার থেকে উঠে এসে বলেছিলাম, কোথায় গিয়েছিলে? আমি এদিকে সন্ধে থেকে এখানে বসে আছি ৷
সন্ধে থেকে এসে বসে আছ?
সন্ধে থেকেই তো! পাপিয়াকে জিগ্যেস করে দ্যাখো ৷
থাক— আর জিগ্যেস করতে লাগবে না ৷ তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি ৷
আমি একটু হেসে বলেছিলাম, জানো—কাল তোমার বাবাকে বলেছিলাম— ৷
তুমি উত্তর দিলে, পরে শুনব’খন, সুদীপ্ত— আজ আমি বড় টায়ার্ড ৷
আমি আর তোমাকে জোর করিনি ৷ সেদিন যদি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারতাম যে, ওটা তোমার ক্লান্তি নয়— সন্দেহ—তাহলে হয়তো তোমাকে আমি বোঝাবার চেষ্টা করতাম ৷ কিন্তু সেটুকু অনুমান করার মতো সুযোগ তুমি আমাকে দাওনি ৷ তাই তোমাকে বিশ্রাম করবার অবকাশ দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম ৷
এই ঘটনার পর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল ৷ আপতদৃষ্টিতে তুমি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলে ৷ লেকে বেড়াতে-বেড়াতে তুমি বলেছিলে, জানো— আমার ভারী ভালো লাগে ভাবতে— বেশ সুন্দর একটা এল-শেপের বাড়ি হবে ৷ সামনে থাকবে ছোট একটা গেট ৷ গেটের ওপর থাকবে মাধবীলতা ৷ সেখান থেকে লাল সুরকি ঢালা রাস্তাটা সোজা চলে যাবে বাড়িটার পায়ের কাছে ৷ রাস্তার দু-দিকে থাকবে ফুলের বাগিচা ৷ একদিকে সাদা, আর একদিকে রঙিন ফুলের মেলা৷ গেটের কাছে একটা লেটার বক্স ৷ সবুজ রঙের ৷ তার ওপর হলুদ রঙে ঠিকানা লেখা থাকবে ৷
সেদিনই মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, পরীক্ষাটা হয়ে গেলে তোমার মনের মতো করে একখানা বাড়ি তৈরি করব ৷ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কিছু টাকা আমার ছিল ৷ সেই টাকা দিয়ে তোমার স্বপ্ন আমি সফল করে তুলব ৷ কিন্তু তুমি তখন সন্দেহের দোলায় দুলছ ৷ ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছ ৷ পাপিয়া আর আমাকে একসঙ্গে দেখলেই তোমার চোখদুটো জ্বলে উঠত ৷
তারপর একদিন সেই ভয়ঙ্কর দিনটা এগিয়ে এল ৷ মনে আছে, কী-একটা উপলক্ষে সেদিন আমাদের সবাইয়ের নেমন্তন্ন ছিল তোমাদের বাড়িতে ৷ হইহই করে আমরা সন্ধ্যার মধেই এসে পড়েছিলাম ৷ তোমার আবৃত্তি, পাপিয়ার গান আসরটাকে বেশ জমিয়ে রেখেছিল ৷ তারপর খাওয়ার সময় এল ৷ আমরা চার বন্ধু একসঙ্গে খেতে বসেছিলাম ৷
চন্দন তোমাকে বলেছিল, আপনারাও আমাদের সঙ্গে বসে পড়ুন ৷ মিথ্যে রাত বাড়িয়ে লাভ কী ৷
তুমি উত্তর দিয়েছিলে, মেয়েদের এখন খেতে নেই ৷ সবাইকে খাইয়ে তারপর খেতে হয় ৷
চন্দন বলল, আপনি দেখছি এখনও সেই পুরাকালে পড়ে আছেন ৷
তুমি হেসে জবাব দিলে, ভুলে যাবেন না, খাওয়ার ব্যাপারটা সেই পুরাকালেও ছিল ৷
অস্বীকার করছি না ৷ তবে পুরাকালে তো অনেক কিছুই ছিল, তার সবগুলোই কি আপনি মানেন?
তুমি ঈষৎ কটাক্ষে বলেছিলে, যেমন?
পুরাকালে তো মেয়েরা পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলত না ৷
সেটা মানতে পারলে ভালোই হত দেখছি— তাহলে এভাবে ঝগড়া করতে হত না ৷
আমরা সকলে হেসে উঠলাম ৷ চন্দন বলল, তাহলে হার স্বীকার করলেন তো?
এখনও করিনি ৷ ঝগড়াটা মুলতুবি রইল ৷ পরে একদিন বোঝাপড়া করা যাবে’খন ৷
তোমার নিশ্চয় মনে আছে, আর আমার তো চিরকাল মনে থাকবে, সেদিন তুমি আমার সঙ্গে একটা কথাও বলোনি ৷ ইচ্ছে করেই বলোনি ৷ নিজেকে জোর করে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রেখেছিলে ৷ এমনকী, পরিবেশন করার সময় একবারও মুখ ফুটে জিগ্যেস করোনি, আমার কোনওকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা ৷ ব্যাপারটা সকলেরই চোখে পড়েছিল ৷ পরের দিন পাপিয়ার মৃত্যুর খবরটা দিতে এসে চন্দনও আমাকে বলেছিল ৷ আর সেইজন্যেই আমার সঙ্গে তোমার কথা-না-বলাটা আরও বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল আমার কাছে ৷
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়েছিল ৷ আর ঘুম ভাঙার পর তোমার কথাই প্রথম মনে পড়েছিল ৷ এরকম প্রায়ই হয় আমার ৷ ঘুম ভাঙার পরেও যখন বিছানায় পড়ে থাকি— তখন শুধু তোমার কথাই মনে হয় ৷ সেদিনও হয়েছিল ৷ আগের রাত্রে তোমার কথা-না-বলা থমথমে মুখখানা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ৷
আগের রাতে খাওয়ার শেষে যখন পাপিয়া আমায় ডাকল, সুদীপ্তদা— আসুন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাব ৷ তখন মুহূর্তের জন্যে তোমার চোখদুটো জ্বলে উঠেছিল ৷ আমিনা-দেখার ভান করে পাপিয়ার সঙ্গে ওর ঘরে গিয়েছিলাম ৷ তোমরা দু-বোন একই ঘরে শুতে ৷ দেখেছিলাম খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো মেয়েলি ঘর একখানা ৷ আর ঢুকতেই নাকে একটা অপরিচিত গন্ধ এসে লেগেছিল ৷ হতে পারে ওটা তোমাদের চুলের গন্ধ, হতে পারে ওটা পুরোনো কোনো সেন্টের গন্ধ ৷ এমনকী শুকনো ফুলের গন্ধ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই ৷
ঘরে পা দিতেই পাপিয়া বলল, বসুন ৷
আমি বসলাম ৷ পাপিয়া দরজা ভেজিয়ে দিল ৷ তারপর বলল, কেন ডেকেছি বুঝতে পারছেন?
বললাম, ওই যে কী একটা দেখাবে বললে ৷
ছাই দেখাব ৷— বলে আঙুল দিয়ে বালিশের ওপর দাগ কাটতে লাগল ৷ আমি বেশ অসহায় বোধ করলাম ৷ ঠিক এইভাবে এত রাতে অনাত্মীয়া কোনো যুবতী মেয়ের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে কথা বলতে আমি অভ্যস্ত নই ৷ নিজের চঞ্চলতা ঢাকার জন্যে পাশবালিশটা কোলের ওপর টেনে নিলাম ৷
আমি চুপ করে রইলাম ৷ মনের উত্তেজনা বাড়তে লাগল ৷
পাপিয়া বলল, আমার কথাগুলো শুনে আপনি যদি আমাকে একটা খারাপ মেয়ে ভাবেন— তাহলে দোষ দেওয়ার মতো কিছু নেই ৷ কিন্তু অনেক ভেবে দেখলাম— আপনি ছাড়া আমার কোনো গতি নেই ৷ কথা দিন— আমাকে সাহায্য করবেন ৷
ভেতরে-ভেতরে আমি ঘামতে শুরু করলাম ৷ তবুও যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বললাম, আগে সব কথা খুলে বলো ৷
আপনি বাবাকে বলে আমার আর চন্দনের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন ৷
পাপিয়ার স্পষ্ট কথায় একটু চমকে উঠেছিলাম ৷ কিন্তু ব্যাপারটা জানা ছিল বলে বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললাম, বেশ তো— তার জন্যে এত তাড়া কেন? ধীরে-সুস্থে একদিন বললেই হবে ৷
না— আর দেরি করা যায় না ৷
কেন? দেরি করা যায় না কেন! আগে তোমার দিদির বিয়ে হোক— তারপর তো— ৷
দিদির কথা জানি না ৷ কিন্তু আমার এখুনি বিয়ে হওয়া উচিত ৷
মনের মধ্যে একটা ছোট্ট সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল ৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাপিয়ার দেহটা দেখতে লাগলাম ৷
পাপিয়া মাথা নিচু করল ৷ বলল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বুঝেছেন— আমি মা হতে চলেছি ৷
বালিশ ফেলে দিয়ে তড়িদাহতের মতো উঠে দাঁড়িয়েছিলাম : কী বলছ তুমি পাপিয়া?
আপনি আমাকে বাঁচান, সুদীপ্তদা ৷
চন্দন জানে?
হ্যাঁ ৷
কী বলছে ও?
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায় ৷
স্কাউন্ড্রেল ৷
একটা তীব্র ঘৃণায় সারা দেহটা রি-রি করে উঠল আমার ৷ ভাবতে লজ্জা হল— চন্দন আমারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ পাপিয়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম, তুমি কিছু ভেবো না পাপিয়া, আমি এখুনি চন্দনকে ডেকে সব বুঝিয়ে বলছি ৷
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে চন্দন ঘরে ঢুকল ৷
আমাকে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই সুদীপ্ত ৷ পাপিয়া যদি আমার কথা শুনত— তাহলে এসব কিছুই হত না ৷ আমি ওকে অনেক বলেছি— ডাক্তার সরকার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু— কাকপক্ষীতেও টের পাবে না ৷
পাপিয়া গর্জে উঠল, থাক— তোমাকে আর বীরত্ব দেখাতে হবে না ৷ যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম যে, শুধুমাত্র ক্ষণিক আনন্দের জন্যে তুমি— ৷
আর বলতে পারল না পাপিয়া— ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ৷
চন্দন আমাকে বলল, তুই নীচে যা, সুদীপ্ত— আমি ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করি ৷
চন্দনের দিকে অপলক তাকিয়ে বারান্দায় পা দিলাম আমি ৷ ওদের ব্যাপার— ওদের মধ্যে বোঝাপড়া হওয়াই ভালো ৷ কয়েক পা এগিয়েছি, চন্দনের কণ্ঠস্বর কানে এল, কেন তুমি সুদীপ্তকে এ-কথা বললে?
আর দাঁড়ালাম না ৷ হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম ৷ সিঁড়ির মুখে তোমার সঙ্গে দেখা ৷ তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিলে ৷ আমি চলে এলাম ৷
.
পরের দিন সকালে চন্দন এসে খবর দিল— পাপিয়া আত্মহত্যা করেছে ৷ চমকে উঠলাম খবরটা শুনে ৷ কয়েক মিনিট আমি কোনো কথা বলতে পারিনি ৷ ঘৃণিত দৃষ্টিতে চন্দনের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম ৷
চন্দন বলল, নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে, সুদীপ্ত ৷ কিন্তু পাপিয়া যে এতখানি ছেলেমানুষি করে ফেলবে ভাবতেও পারিনি ৷
গম্ভীর গলায় বললাম, পাপিয়ার আত্মহত্যাকে তাহলে তুমি নিছক একটা ছেলেমানুষি ভাবছ?
তা ছাড়া আর কী ভাবব বলো ৷ ওর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে— এভাবে হঠাৎ— ৷
আরও অনেক কথা বলেছিল চন্দন ৷ কিন্তু সেসব শোনার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না ৷ চন্দনের সঙ্গে তোমাদের বাড়িতে যখন এসে পৌঁছলাম— তখন পুলিশ এসে পড়েছে ৷ তোমার বাবা পাথর হয়ে একটা সোফায় বসে আছেন ৷ চারিদিকে এক নিদারুণ স্তব্ধতা ৷
পুলিশ গতানুগতিক পদ্ধতিতে সবাইকে কিছু-কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে পাপিয়ার দেহ নিয়ে চলে গেল শবব্যবচ্ছেদের জন্যে ৷
সকলে জানল— পাপিয়া আত্মহত্যা করেছে ৷ চন্দনের কাছেই শুনলাম, তোমার ধারণা পাপিয়ার আত্মহত্যার জন্যে পরোক্ষভাবে আমিই দায়ী ৷ আমিই নাকি তাকে অকাল মাতৃত্বদানে কলঙ্কিত করেছি ৷ আমাদের এতদিনের মেলামেশা— এত ভালোবাসার পর তুমি যে আমার সম্বন্ধে এরকম একটা বিশ্রী ধারণা করে বসবে বিশ্বাস করতে পারিনি ৷ তাই সেই মুহূর্তেই ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে ৷ সেদিনও তোমাদের বাইরের ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল ৷ মনের মধ্যে তীব্র একটা উত্তেজনা নিয়ে কলিংবেল বাজিয়েছিলাম ৷ তুমি এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলে ৷
তোমাকে দেখে একরাশ আশা নিয়ে কথা শুরু করলাম, এই যে, শিউলি— শুনলাম তুমি নাকি চন্দনের কাছে বলেছ— ৷
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তুমি রূঢ়ভাবে বলেছিলে, তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই ৷ বলে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ৷
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আমার হৃৎপিণ্ড বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছিল ৷ চোখের সামনে থেকে তোমাদের বাড়িটা মুছে গিয়ে একরাশ গাঢ় অন্ধকার জমা হয়ে গেছিল ৷ কয়েক সেকেন্ড মাত্র ৷ তারপর পা চালালাম মেসের উদ্দেশে ৷ তোমাদের বাড়ির দরজা থেকে আমার মেস— পাঁচ মিনিটের পথও নয়— কিন্তু মনে হয়েছিল ওইটুকু পথ পেরোতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লেগে গেল ৷
কিছুদিনের বিরতি দিয়ে আবার আমি তোমার কাছে গিয়েছিলাম ৷ গিয়ে শুনলাম, তুমি একটা স্কুলের চাকরি নিয়ে বিহারের কোন এক গ্রামে চলে গেছ ৷ বুঝেছিলাম, তুমি আমাকে এড়ানোর জন্যেই ওভাবে চলে গেছ ৷ আমার সঙ্গ তুমি চাও না— তাই তোমার এই অসহায় পলায়ন ৷ তোমার ঠিকানায় অনেক চিঠি দিয়েছিলাম ৷ কিন্তু একটাও জবাব আসত না ৷ মাঝে-মাঝে তোমার বাবার কাছে যেতাম ৷ তিনি তখন একেবারে ভেঙে পড়েছেন ৷
বলতেন, বুঝলে সুদীপ্ত— শেষ জীবনে কোথায় একটু শান্তিতে দিন কাটাব ভেবেছিলাম— কিন্তু ভগবান তা চাইল না ৷ এক মেয়ে আত্মহত্যা করল— আর-এক মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেল ৷
আমি তোমার মায়ের কথা বলতে চেয়েছিলাম ৷ কিন্তু দেখলাম, তিনি সযত্নে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন ৷ পরে অবশ্য জেনেছি— কেন তোমরা তোমাদের মাকে এড়িয়ে চলতে, কেন তিনি রান্নাঘরের বাইরে আসতেন না ৷ কিন্তু সে-কাহিনি এখানে অবান্তর ৷ তা ছাড়া তুমি তো সবই জানো, তোমাকে নতুন করে শোনাবার মতো কিছুই নেই ৷
তুমি চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন বিশ্রী এক অবসাদের মধ্যে দিয়ে সময় কাটতে লাগল ৷ মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হত— তোমার কাছে চলে যাই, তোমাকে সব বুঝিয়ে বলি ৷ কিন্তু অভিমান এসে পথ আটকে দাঁড়াত ৷ এতদিনেও আমি যখন তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি, তখন এই ক্ষণিক চেষ্টায় সেটা কি ফিরিয়ে আনতে পারব? তাই তোমাকে শুধু চিঠিই লিখতাম ৷ রোজ ভাবতাম, আজ তোমার চিঠি আসবে ৷ আজ না এলে কাল নিশ্চয় আসবে ৷
তোমার চিঠির প্রতীক্ষায় থেকে-থেকে যখন একেবারেই আশা ছেড়ে দিয়েছি— তখন হঠাৎ তোমার একখানা চিঠি এল ৷ সেটাই তোমার শেষ চিঠি ৷ তারপর আরও একবছর কেটে গেছে ৷ তোমার কোনো সন্ধান পাইনি ৷
তুমি লিখেছিলে, তোমার চিঠিখানাই উদ্ধৃত করছি :
আমার সুদীপ্ত,
তুমি যখন আমার এই চিঠিখানা পাবে তখন আমি স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি— ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাব— এখনও কিছু ঠিক করিনি ৷ শুধু অনুরোধ, আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা কোনোদিন কোরো না ৷ সন্ধান তুমি পাবে না ৷ পেলেও আমি ধরা দেব না ৷ এতদিন একা-একা নিজেকে প্রশ্নে-প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করেছি— ধিক্কার দিয়েছি— কিন্তু এতটুকু শান্তি পাইনি ৷ মনের কথা মনে চেপে রাখলে বুঝি কোনো দিনও শান্তি পাওয়া যায় না ৷ তাই তোমার কাছে তোমার এই স্বীকৃতি ৷ আশা আছে, এখন বুঝি একটু শান্তি পাব ৷ তোমরা সবাই জানো, পাপিয়া আত্মহত্যা করেছে ৷ কিন্তু আমি জানি— তাকে হত্যা করা হয়েছে ৷ হ্যাঁ সুদীপ্ত, আমি পাপিয়াকে খুন করেছি ৷ খুন করেছি, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে ৷ সেদিন যখন অত রাত্রে পাপিয়ার ঘর থেকে তোমাকে বের হতে দেখলাম তখন সারা মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল ৷ তুমি আর কাউকে ভালোবাসবে— অথচ আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করবে— কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না ৷ তাই সকলের অজান্তে পাপিয়ার জলের গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম ৷ আমি জানতাম, রোজ রাত্রে শোওয়ার আগে ওর জল খাওয়ার অভ্যেস আছে ৷ তাই ওকে মারার জন্যে আমাকে নতুন কোনো পথ বাছতে হয়নি ৷ এক গ্লাস জল আর ছ’টা ঘুমের ট্যাবলেট ৷ দেখলে তো, পাপিয়ার সে-ঘুম আর কোনোদিন ভাঙল না!
আজ আমি বুঝেছি— আমার সন্দেহ কতখানি ভুল ছিল ৷ আমার সন্দেহ যদি সত্যি হত, তাহলে আমি এখানে চলে আসার পরও সপ্তাহে দু-খানা করে তোমার চিঠি আসত না ৷ কিন্তু ভুল শোধরাবার আর সময় নেই ৷
জানতাম, আমি স্বীকার না করলে কেউ কোনোদিন বুঝতেও পারবে না যে, পাপিয়া আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছিল ৷ কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে-করে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি ৷ এখন তুমি ইচ্ছে করলে আমার এই চিঠিখানা পুলিশের হাতে দিয়ে আমাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারো— আমি আর কোনও কিছুতেই ভয় পাই না ৷ সবকিছুর জন্যে তৈরি হয়ে আছি ৷ ইতি—
তোমার শিউলি ৷
না শিউলি, তোমার এই চিঠিখানা আমি পুলিশকে দেখাইনি ৷ কোনোদিন দেখাতেও পারব না ৷ সকলে যা জেনেছে— সেটাই সত্যি হয়ে বেঁচে থাকুক ৷ কিন্তু তুমি আর আমাকে এভাবে কষ্ট দিও না ৷ তোমাকে আমি আজও চাই ৷ হ্যাঁ— তুমি খুনি জানা সত্বেও আমি তোমাকে চাই ৷ এভাবে আমার সঙ্গে আর লুকোচুরি খেলো না ৷ যেখানেই থাকো— ফিরে এসো ৷ ফিরে এসো আমার কাছে— তোমার স্বপ্ন-ঘেরা বাড়িতে ৷
দুই পৃথিবী – বিনোদ ঘোষাল
তুমি একজন উন্মাদ। তোমার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। একটু আগে অর্চি আমাকে এই কথাগুলো বলে গেল। বলার সময় ও অনেক বড় করে হাঁ করছিল। ওর অন্ধকার মুখের ভেতর দিয়ে খসখসে জিভ আর আলজিভটা থিরথির করে নড়তে দেখছিলাম আমি। একটা অদ্ভুত দৃশ্যকল্প। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ভুলে গেছিলাম অর্চি আসলে কী বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে। ওর চিৎকারগুলো বহু দূর থেকে হাওয়াতে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছতে শুরু করছিল আমার কাছে। টুকরো টুকরো ভাঙা কথা। তার মধ্যে ‘মাকে খুন…মাকে খুন’, শব্দ দুটো বেশ কয়েকবার ছিল। আমি আন্দাজ করছিলাম অর্চি আবার ওর মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু একটা বলছে। বুলার মৃত্যু আমার কাছেও খুব বেদনার তা কি অর্চি জানে? এমনকী আমার নিজের মৃত্যুও যথেষ্ট যন্ত্রণার, তা-ও জানে না কেউ।
আজ আমি মরে যাব। কারণ? মরে যাওয়ার জন্য কোনো যথেষ্ট কারণ লাগে বলে আমি মনে করি না। আমার আজকের পর থেকে আর কোনো কাজ নেই, সুতরাং আমি মরে যেতেই পারি। আর একমাত্র মৃত মানুষদের হাতেই কোনো কাজ থাকে না।
অর্চি আমার ছেলে। উনিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর। আমার সঙ্গেই থাকে। কেন থাকে কে জানে? হয়তো চাকরি কিংবা বিয়ে কিছু একটা করার পরদিন থেকে আর থাকবে না। থাকা সম্ভবও না। এই দুটো ঘরের মধ্যে এত বছর ধরে এত মানুষ এসে দিনের পর দিন থাকে যে, যে-কারওরই মেনে নেওয়া কঠিন। আমি নিজেই হাঁফিয়ে উঠি একেক সময়। ঘরে হাঁটাচলা করতে গিয়ে ধাক্কা লাগে পরস্পরের সঙ্গে। আমি নিজের চোখে দেখি সেসব দৃশ্য। বুলা বিরক্ত হত খুব। একসময় বিরক্তিটা মাত্রা ছাড়াতে শুরু করল। তারপর একদিন অরণ্য নিজে হাতে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করল বুলাকে। আমি নিজে চোখে দেখলাম বুলা ঘুমোচ্ছিল সেইরাত্রে বিছানায়। আমি টেবিলে বসেছিলাম। অরণ্য বেরিয়ে এসে বালিশ নিয়ে বুলার মুখে চেপে ধরল। বুলা দু-হাত ছড়িয়ে তীব্র ছটফট করছিল, হাত বাড়িয়ে বোধহয় আমাকে খুঁজছিল বাঁচার জন্য। কিন্তু ওকে বাঁচাতে যেতে পারিনি। কারণ আমি তখন চেয়ারে বসেছিলাম। কিন্তু সত্যি আমার সেদিন বড় কষ্ট হচ্ছিল। আমি বারবার নিজের চোখের জল মুছছিলাম। কিন্তু অরণ্যর হাত থেকে বুলাকে বাঁচাতে পারিনি, কারণ আমি তো চেয়ারে বসেছিলাম। আমার প্রিয় টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায়।
আমার চোখের সামনে বুলা চলে গেল। তবে খুব বেশি কষ্ট পায়নি। মিনিট খানেক। বড় ভালো ছিল বুলা। আমাকে ভালোবাসত খুব একসময়। সেই বিয়ের কত আগে থেকে। কিন্তু অরণ্য ওকে একটুও সহ্য করতে পারত না। মেরেই ফেলল। আমার চোখের সামনে। খুন করে আবার ঢুকে গেল।
আমার মনে আছে পরের দিন পুলিশ এসে শুধু আমাকে জেরা করছিল। অরণ্যকে কেউ খোঁজেনি। আমার আশ্চর্য লাগছিল। অ্যারেস্ট হওয়া উচিত ছিল অরণ্যর। হলাম আমি। যখন থানায় যাচ্ছি আমি পিছন ফিরে দেখি আমার টেবিলের এককোণে দাঁড়িয়ে অরণ্য মিটিমিটি হাসছে। বুলাকে খুন করে একটুও লজ্জা নেই ওর।
অবশ্য আমি ছাড়া পেয়ে গেলাম। বেকসুর। বুলা নাকি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেনি। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিল। হাই প্রেশার ছিল বুলার। বছর খানেক আগে একটা সিভিয়র অ্যাটাকও হয়েছিল। আমার খুব অবাক লেগেছিল পুলিশ খবর পেল কী করে? পরে বুঝেছি, পুলিশে খবর দিয়েছিল অর্চি। আমার একমাত্র ছেলে অর্চিস্মান। নিজে ছেলে হয়ে বাপকে খুনের আসামি কেন ভেবে বসল কে জানে! ভেবেছিল ওর মা, মানে বুলাকে, আমি খুন করেছি। কেন করব আমি? কারণ কী?
যাই হোক। বুলা চলে যাওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম অর্চিও চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে। গেল না। গেলে ভালোই হত। দুটো মাত্র ঘর। এতগুলো লোক-বাচ্চাকাচ্চা এই দুটো ঘরে কখনও আঁটে? আর মানুষগুলো তো কেউ ঘর ছেড়ে যায় না কোথাও। সামনের দোকানটাতেও যায় না, আমি না বললে, খুব বাধ্য। যখন বলি কথা বলতে, বলে। যখন বলি হাঁটতে, হাঁটে। আদর করতে নির্দেশ দিলে আদর করে। আর যদি বলি কাউকে…।
এই তো অরণ্য, বিদিশা, তপন, পুষ্পল, নীল, স্বর্ণালি, মিঃ সেন, দাশবাবু, নীহারুল, বিক্রম এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন প্রায় আড়াই বছর ধরে আমার বাড়িতে রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অরণ্য, বিদিশা, নীল আর স্বর্ণালীর সঙ্গেই আমার কথা হয় বেশি। বাকিদের সঙ্গে অনেক কম। কয়েকজনকে তো ভুলেই গেছিলাম আমি। তবু ওরা সবাই মিলে এই দুটো ঘরেই থাকত। ওরা যে আসবে এবং থাকবে অনেকদিন সে কথা কিন্তু আমি আগেই বুলা আর অর্চিকে জানিয়েছিলাম। শুনে বুলা শুধু ‘হুম’ বলেছিল। আর কিছু বলেনি। আর অর্চি এবারেও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাও তো?
বাড়িতে লোক আসার সঙ্গে ওষুধ খাওয়ার সম্পর্ক কী? আর এ তো প্রথমবার নয়। এর আগেও অনেকবার এসেছে, নতুন নতুন মানুষ। আমাদের সঙ্গে কেউ মাসের পর মাস, কেউ বছরের পর বছর, কাটিয়েছে। বুলা এ সব জানত। কারণ বিয়ের আগেই আমি ওকে জানিয়েছিলাম এইসব কথা। ও সব শুনে শুধু হেসে বলেছিল, আসুক না। কোনো অসুবিধা নেই। শুধু তোমার আর আমার মাঝখানে না শুলেই হল।
না, কেউ শোয়নি তো! তবু বিয়ের কুড়ি বছর পর কেন যে বুলা হঠাৎ অসহিষ্ণু হতে শুরু করল। আমাকে অসুস্থ ভাবতে শুরু করল। আমি অসুস্থ! কই ঘরের মধ্যে এতগুলো লোক কখনও তো আমাকে সে-কথা বলেনি। কী সম্মান করে আমাকে! এত সম্মান আমাকে আর কেউ করে না।
আমার এই ঘরদুটোর মধ্যে আমি এত বছরে কম কিছু তো দেখিনি। প্রেম-বিরহ-মৃত্যু, বিচ্ছেদ, লোভ-ঘেন্না-ভালোবাসা, অনেক অনেক কিছু। কত সংসার তৈরি হল, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কত শিশুর জন্ম হয়েছে এই ঘরে। তার কান্নায় আমারা ঘরের দেওয়াল, ছাদ, উঠোন ভরে গেছে। আমার মনে রয়েছে দীপ্তেন আর ঊর্মিমালার মেয়ে হয়েছিল এক শরৎকালের ভোরবেলায়। ওরা তিন বছর ছিল এই ছোট্ট ঘরটায়। বাচ্চাটার যখন জন্ম হচ্ছিল আমি বাইরে, জানলার বাইরে, তাকিয়ে দেখছিলাম, উঠোনে শিউলি গাছটার নীচে ফুলে ভরে গেছে। আমি আনন্দে কাঁদছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল শিশুটাকে একবার ওই ভোরের আলোতে ফুলের মধ্যে শোওয়াতে। ঊর্মিকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ঊর্মি অনুমতি দেয়নি। আমি জোর করিনি। ওরই তো মেয়ে। আমি ওর নাম দিয়েছিলাম উমা। সেই নাম পছন্দ হয়েছিল ঊর্মির।
আরও কত কত ইতিহাস রয়েছে এই ঘরে। আমার এই ঘরদুটোতে। এই তো বছর চারেক আগে অম্লান যখন পুলিশের গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার এই ঘরের মেঝে। আমি নিজে হাতে সারা রাত ধরে বালতি বালতি জল ঢেলে সেই রক্ত ধুয়েছি। রক্তের আঁশটে গন্ধে ভরে গেছিল ঘর। মেঝে ধুয়ে আমি যখন উঠে দাঁড়িয়েছি দেখি খাটের এককোণে গুটিয়ে বসে বুলা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমাকে দেখে ভীষণ ভয় পাচ্ছিল ও। অর্চিও কখন যেন নিজের ঘর ছেড়ে এ-ঘরের দরজার সামনে এসে আমার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমার দিকে কেন? মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা মাওবাদী নেতা অম্লানের দিকে ওরা একেবারের জন্যও কেউ তাকাচ্ছিল না কেনও?
আমাকে ওরা দুজনে মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। আমি গেছিও। ওরা যাতে শান্তি পায় করুক না। শুধু ওষুধগুলো না খেলেই হল। আমি জানি ওই ওষুধগুলো খেলে আমি শুধু ঘুমোব, আর ঘুমোব। আর এই লোকগুলো যারা আমার সঙ্গে মাসের পর মাস বছরের পর বছর থাকে, আমার কথায় ওঠে, বসে, সিগারেট খায় ওরা কেউ আর থাকবে না। আর আমি পারব না ওদের ছেড়ে থাকতে।
বুলা অশান্তি করতে শুরু করেছিল অনেকদিন আগে থেকেই। অর্চি বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ও যেন একটা সাপোর্ট পেয়ে অশান্তিটা আরও বাড়তে থাকছিল। আমি ওদের বেশ কয়েকবার বলেছি অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। শোনেনি। শুধু অশান্তি আর অশান্তি। এবারে যেন সবথেকে বেশি। অরণ্য, বিদিশা, তপন, পুষ্পল, নীল ওরাও বিরক্ত হচ্ছিল বুলা অরা অর্চির ওপর। বিশেষ করে অরণ্য খুব রেগে উঠছিল বুলার ওপর। অরণ্য এমনিতেই খুব রাগী। আমিও যথেষ্ট সমঝে চলি ওকে। অনেক সময়ই আমারও কথা শোনে না ও। নিজের ইচ্ছেমতো চলে। আর আমি অসহায় হয়ে চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকি টেবিলের দিকে।
সেদিন রাত্রে এমনই অশান্ত ছিল অরণ্য। মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল। টলছিল। আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম দিশি মদের। সেদিনই সন্ধেবেলা বুলা আবার আমার সঙ্গে খুব ঝগড়া করল। আমাকে পাগল, ব্যর্থ, অসামাজিক ইত্যাদি আরও অনেক শব্দ বলল। শব্দগুলো পীড়া দিচ্ছিল আমাকে। শরীর খারাপ লাগছিল আমার। মাথার ভেতর ঝনঝন শব্দ হতে শুরু করেছিল। তবু নিজের টেবিল চেয়ার ছেড়ে উঠিনি। আমি বুলার করা সব অপমান সহ্য করে নিয়েছিলাম, কিন্তু অরণ্য পারেনি। আসলে ওরা কেউ কোনোদিনই আমার লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারে না। আমি স্পষ্ট দেখলাম মাঝরাতে অরণ্য বেরিয়ে এল। বুলাকে খুন করে আবার ঢুকে গেল।
জানি কেউ বিশ্বাস করবে না এসব কথা। এই যেমন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অর্চির ব্যবহারে বেশ কিছুদিন ধরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে বিদিশা। আমাকে বারবার বলছে, তুমি একজন প্রতিভা। কেন এত অপমান সহ্য করছ মুখ বুজে? ওকে সরিয়ে দাও। ও তোমাকে পছন্দ করে না।
আমি জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমার কাছে থাকে কেন?
থাকে কারণ ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এই মুহূর্তে।
কেন, ওর মা-র কাছে গিয়েই তো থাকতে পারে!
আমার এমন কথায় সামান্য ঠোঁট হেলিয়ে হাসে বিদিশা। সেই হাসিতে ওর ভরা শরীর সামান্য কেঁপে ওঠে। আমার সামনে ঘন হয়ে এসে বলে, বেশ তো, তাহলে ওর মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দাও ওকে। ওখানেই থাকুক। আমি বিদিশার মুখের ভেতর থেকে এলাচের গন্ধ পাই। ওকে এলাচ খাওয়া আমিই অভ্যাস করিয়েছি। বিদিশার কাঁধে হাত রাখি আমি। গত আড়াই বছর ধরে একটু একটু করে ওকে গড়ে তুলেছি আমি। নিজের মনের মতো করে। ও আমার সামনেই স্নান করে, শাড়ি পড়ে, চুল আঁচড়ায়। এতটুকু লজ্জা পায় না। শুধু ও কেন, এই ঘরে বছরের পর বছর ধরে যে ওরা থাকে, ঘোরে ফেরে খায়, ঘুমোয় তারা কেউ কোনোকিছু করতেই লজ্জা পায় না আমার সামনে। ওদের আগে যারা থেকেছে তারাও পায়নি কোনোদিন। কারণ ওরা পুরোটাই আমার। একমাত্র আমার। ওদের প্রতিটা নিঃশ্বাসে শুধুমাত্র আমার অধিকার। আমি ঠিক করি ওরা কতদিন কতক্ষণ কীভাবে নিঃস্বাস ফেলবে। আমার হুকুম ছাড়া ওরা কিচ্ছু করতে পারে না। অথচ এই ঘরের মধ্যেই বুলা আমাকে অস্বীকার করত। আমাকে উন্মাদ বলত, অপদার্থ বলত। আমাকে ওদের সামনে যখন-তখন অপমান করত। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখত ওদের ঈশ্বর তার স্ত্রী, পুত্রের কাছে দিনের পর দিন লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাই একদিন রাত্রে আমার অরণ্য, যাকে আমি সব থেকে ভালোবাসি, বুলাকে আমারই সামনে খুন করল। আমি তখন লিখছিলাম। লিখছিলাম, অরণ্য হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঝুঁকে দেখল একবার। তারপর আচমকা বালিশটা ঠেসে ধরল ওর মুখে…।
ইদানীং অর্চিও একেবারে সহ্য করতে পারছে না আমাকে। একেবারে ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। বিদিশা আমাকে বারবার বলে আমি কোনোদিন অর্চিকে কিছু একটা করে ফেলব। আমি সামলে রাখি বিদিশাকে। কতদিন পারব এভাবে জানি না।
.
অর্চিও এভাবে চলে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আমি প্রাণপণ বিদিশাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি যাতে অর্চিকে আজ রাত্রে ও খাবার না বেড়ে দেয়। আমি জানতাম কিছু একটা ঘটবে। ঠিক তাই ঘটল। রুটি, তরকারি, ডাল ডাইনিং টেবিলে বেড়ে দিল বিদিশা। আর ডাল তরকারির মধ্যে মিশিয়ে দিল বিষ। তীব্র বিষ। খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছটফট করতে করতে ওই টেবিলের মধ্যেই মাথা গুঁজে পড়ে রইল অর্চি। বিদিশা হাসছিল। এমনভাবে অর্চির শরীরটার দিকে তাকিয়ে হাসছিল যেন বহুদিন পর ও জিতে গেছে। আমার কান্না পাচ্ছিল খুব। আমার একমাত্র ছেলে আমারই সামনে মৃত পড়ে রয়েছে। আর আমি অসহায়, কিচ্ছু করতে পারছি না। ক্রমাগত আমাকে লিখে চলতে হচ্ছে, ‘অর্চির শরীরটাকে দু-হাতে কয়েকবার নেড়ে দেখল বিদিশা। কোনো সাড়া নেই। নিশ্চিন্ত হল। অর্চির চোখদুটো বিস্ফারিত। ভীষণ ভয়।’ বিদিশা আমাকে ক্রমাগত বলে চলেছে, এবার লিখুন, নিজের একমাত্র সন্তানকে নিজেরই চোখের সামনে খুন হতে দেখলে কোন পিতা নিজেকে ঠিক রাখতে পারে? আর আমি লিখছি, লিখেই চলেছি। ঠিক যেভাবে আমাকে লিখতে হয়েছিল ‘অরণ্য হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঝুঁকে দেখল একবার। তারপর আচমকা বালিশটা ঠেসে ধরল বুলার মুখে…।’
তপন, পুষ্পল, নীল, স্বর্ণালি, মিঃ সেন, দাশবাবু, নীহারুল, বিক্রম আরও সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্চিকে। ওরা কেউ শোকার্ত, কেউ আনন্দিত। আজ ওরাও চলে যাবে আমাকে ছেড়ে। একটু পরেই। শেষ হবে আমার আঠেরোতম উপন্যাস। আমি আর লিখব না। নিজের স্ত্রী-পুত্র সবাই ছেড়ে গেছে আমাকে এদের জন্য। ওদের দুজনকে খুন করেছে ওরা। আর না। বুলা আমাকে বলত আমি একজন ব্যর্থ লেখক। আমার সতেরোটা উপন্যাসের একটাও বিক্রি হয়নি, কোনো পুরস্কার পায়নি। আমি বুলার রোজগারের টাকায় বই করি। কেউ আমাকে পছন্দ করে না। শুধুমাত্র আমার চরিত্ররা আমাকে ভালোবাসে। ওরা আমার সঙ্গে থাকে, খায়, ঘুমোয়, কথা বলে— যতদিন না আমার লেখা শেষ হয়। শেষ হলে আবার নতুনরা আসে। থাকে, খায়…।
লেখাটা শেষ করি ভোর রাত্রে। আর একে একে মিলিয়ে যেতে থাকে অরণ্য, বিদিশা, নীল, মিঃ দাশ সবাই। কষ্টে আমার বুক ছিঁড়ে যেতে থাকে। এতগুলো দিন একসঙ্গে একই ঘরে থাকার পর চলে যাচ্ছে ওরা। আমাকে ছেড়ে। প্রিয়জনকে শ্মশানে দাহ করে স্নান সেরে ফেরার মতো অনুভূতি হতে থাকে আমার। গোটা বুক ফাঁকা হতে হতে একেবারে শূন্য হয়ে যায়।
আর কেউ নেই ওরা। মধ্যরাতের বাজারের মতো খাঁখাঁ করছে ঘরটা। কলম বন্ধ করে পাণ্ডুলিপির ওপর রেখে ক্লান্ত আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়াই চেয়ার ছেড়ে। আর বিছানার দিকে চোখ পড়তেই শিউরে উঠি। বুলা ঘুমোচ্ছে খাটে! জানলা দিয়ে ভোরবেলার আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। তাহলে?…এতদিন কোথায় ছিল বুলা? আমি পা ঘসে ঘসে হ্যাচোর-প্যাচোর করতে করতে পাশে অর্চির ঘরে যাই, দেখি ও-ও ঘুমোচ্ছে, একেবারে ওর মায়ের মতো করে। তাহলে…!
আমি ফিরে আসি আবার নিজের ঘরে। খুব সাবধানে বুলার পাশে এসে গুটিয়ে শুই। ওর মুখের দিকে তাকাই। বড় সুন্দর লাগে ওর মুখটা। ভালো লাগে ওকে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। টেবিলে ড্রয়ারে যে বিষের শিশিটা রাখা রয়েছে সেটার কথা মনে পড়ে। আমি আবার উঠতে যাই, কিন্তু ঠিক তক্ষুনি খুব আবছা একটা মুখ চোখের সামনে দুলতে শুরু করে। ভোরবেলার মতো নিষ্পাপ কিশোরী মুখ। আমি ওর নাম দিয়ে ফেলি লাজবন্তী। তারপর ভাবতে শুরু করি। ভাবতে থাকি। লাজবন্তী একটু একটু করে আমার কাছে আসতে থাকে। আমার ঘরে।
দুই-এ পক্ষ – ইন্দ্রনীল সান্যাল
মালব্যনগরের অ্যাসাইনমেন্ট চুকিয়ে দিল্লি ফেরামাত্র প্রতিরক্ষামন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ প্রথমা লাহিড়ীকে তলব করলেন। ‘প্র্যাট, তোকে আবার কলকাতা যেতে হবে।’
প্রথমা ভারত সরকারের এলিট ইনটেলিজেন্স উহং ‘কাইমেরা’র সদস্য। র, সিবিআই, আর্মি, নেভি বা এয়ারফোর্স কাইমেরার অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবিলার জন্যে রঞ্জিত নিজের হাতে কাইমেরা তৈরি করেছেন।
ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি থেকে পাশ করার পর প্রথমার পোস্টিং হয় আর্মিতে। পড়াশোনায় তুখোড়, কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার হাতের তালুর মতো জানে, সার্টিফায়েড হ্যাকার, মার্শাল আর্টে পটু। রঞ্জিতের ব্যক্তিগত অনুরোধে সে আর্মি থেকে কাইমেরায় জয়েন করে।
প্রথমা বলল, ‘এই তো বেঙ্গল থেকে ফিরলাম। আবার কেন?’
‘মাননীয় রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জির কার্ডিয়োলজিস্টের নাম ডক্টর চঞ্চল দুবে। পানিহাটিতে ওঁর একটা হার্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে। নাম ”চঞ্চল’স হসপিটাল ইন পানিহাটি” বা ”চিপ”। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী একটা মানথলি ম্যাগাজিন এডিট করেন। তার নেক্সট ইস্যুর জন্যে চঞ্চলের ইন্টারভিউ চাইছেন।’
প্রথমা বুঝতেও পারেনি, ইন্টারভিউ নেওয়ার মতো সোজা ব্যাপার থেকে কত জটিল ঘটনা ঘটতে চলেছে…
দুই
পেনেটিতে, গঙ্গার ধারে দশ বিঘে জমির ওপরে গড়ে উঠেছে চিপ। চারটে পাঁচতলা হাসপাতাল বিল্ডিং ছাড়াও রয়েছে ডাক্তারদের বাংলো, সিস্টার—স্টাফ—রোগীর বাড়ির লোকেদের থাকার জন্যে কোয়ার্টার। গঙ্গার শোভা, নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ দেখলে হৃদয় আপনিই ভালো থাকে।
খোদ চঞ্চলের হৃদয় এই মুহূর্তে ভালো নেই। হার্টব্লকের কারণে বুকে পেসমেকার বসানো হয়েছে। অনেক ফোনাফুনির পরে চঞ্চলের সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেয়েছে প্রথমা।
সে প্রথমবার ফোন করেছিল পেসমেকার বসানোর তিনদিন আগে। সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব শুনে হাসপাতালের ‘অরএমও’ ডক্টর বিকাশ দত্ত ফোন কেটে দেন। দ্বিতীয়দিন ফোন ধরে চঞ্চলের বউ গায়ত্রী। সে ধৈর্য ধরে সবটা শোনে এবং অপারেশনের পরে সময় দেয়। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।
চঞ্চল শুয়ে রয়েছেন নিজের বাংলোর বেডরুমে। মাস্টারবেডের বদলে আইসিসিইউয়ের রেলিং লাগানো বেড। বেডের মাথার দিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে ভাঁজ করা। পেসমেকার বসানোর পরে চঞ্চল সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে বেডরেস্টে রয়েছেন। বেডের পাশে রাখা হয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইভি স্যালাইনের পাউচ এবং স্ট্যান্ড, কার্ডিয়াক মনিটর।
‘তোমার নাম প্রথমা, আমার পদবি দুবে। তুমি ”এক” আর আমি ”দুই”। কী ইন্টারেস্টিং ব্যাপার বলো তো!’ প্রাথমিক আলাপের পরে বললেন চঞ্চল।
প্রথমা মৃদু হাসল। বেডের ডানপাশে বসে থাকা বছর তেরোর কিশোরের মাথায় হাত বুলিয়ে চঞ্চল বললেন, ‘চিপ আমার প্রথম সন্তান। আর এ আমার দ্বিতীয় সন্তান। শাশ্বত।’
শাশ্বত টুকটুকে ফরসা। ভাসাভাসা চোখ, গালে সদ্য ফোটা দাড়ির আভাস, ল্যাকপ্যাকে চেহারা। বয়ঃসন্ধির চৌকাঠে পা রেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। অ্যান্টেনাওয়ালা, রেডিয়ো হার্ডওয়্যার লাগানো ঢাউস ল্যাপটপে সে সোশাল নেটওয়ার্কিং করছে। কি—বোর্ডের ওপরে হাত চলছে বিদ্যুতের গতিতে।
বেডের বাঁপাশে রাখা চেয়ারে বসে স্মার্টফোনের রেকর্ডার অন করে প্রথমা। স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ বেডের বাঁদিকে রেখে সাক্ষাৎকার শুরু করে। ‘রাষ্ট্রপতির কার্ডিয়োলজিস্ট মানে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের একনম্বর কার্ডিয়োলজিস্ট। এই সাফল্যের রহস্য কী?’
‘জীবনে একমিনিট সময়ও নষ্ট করিনি। জীবনের সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি।’ ক্লান্ত গলায় বললেন চঞ্চল।
সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে গলায় বিষণ্ণতার সুর। সুযোগ বুঝে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করে প্রথমা ‘কোনও রিগ্রেট আছে নাকি?’
‘আছে। পেশাদার জগতে প্রথম হতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। এটাই একমাত্র রিগ্রেট।’
‘আপনার স্ত্রীও কি ডাক্তার?’
‘গায়ত্রী হোমমেকার হিসাবেই হ্যাপি।’
‘ছেলের কোন ক্লাস?’
‘শাশ্বতর এখন ক্লাস সেভেন। দিনরাত ভিডিয়ো গেম খেলে আর সোশাল নেটওয়ার্কিং করে। হাফইয়ার্লিতে গাডডু খেয়েছে। আমি ওকে বলি ভিডিয়ট। ভিডিয়ো গেমার আর ইডিয়টের কম্বিনেশান।’
মন্তব্য শুনে বাবার দিকে রাগি চোখে তাকায় শাশ্বত। চঞ্চল বলেন, ‘ভারচুয়াল ধাষ্টামো বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দে। আমাদের ফ্যামিলি তিন জেনারেশানের কার্ডিয়োলজিস্ট। তোকেও কার্ডিয়োলজিস্ট হতে হবে। সামনের মাসেই মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের প্রিপারেটরি কোর্সে ভর্তি করে দেব।’
কি—বোর্ডের উপরে চলতে থাকা শাশ্বতর হাত মুহূর্তের জন্যে থমকায়। সে বলে, ‘দুটো কথা মনে রাখো! এক নম্বর, ভারচুয়াল ইজ রিয়্যাল। নাম্বার টু, আমি বড় হয়ে কার্ডিয়োলজিস্ট হব না। সফটওয়্যার প্রোগ্রামার হব।’
‘দু—দুবার সাইকায়াট্রিক কাউন্সেলিং করিয়েও কোনো লাভ হল না।’ ছেলের চুল ঘেঁটে দিলেন স্নেহময় বাবা, ‘ভারচুয়ালকে কেউ রিয়্যাল বলে? অনুভূতিহীন জোম্বি তৈরি হচ্ছে একটা!’
বাবা—ছেলের কচকচি থেকে বেরোতে পরের প্রশ্নে ঢুকে পড়ে প্রথমা। ‘এত বড় হাসপাতাল সামলান কী করে?’
‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আমি সামলাই না। তার জন্যে মেডিক্যাল সুপারিনটেন্ডেন্ট ডক্টরলক্ষ্মণ মিশ্র আছে। সে আমার পেসমেকার বসিয়েছে। আমার থেকে বছর পাঁচেকের জুনিয়ার।’
চঞ্চলের কথার মধ্যে ঘরে ঢুকল লক্ষ্মণ। ছ’ফুট লম্বা, শ্যামলা গায়ের রং, একমাথার কোঁকড়া চুল, মোটা গোঁফ। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ বার করে প্রথমাকে বলল, ‘আপনার ইন্টারভিউয়ের কথা গায়ত্রী এক্ষুনি আমাকে বলল। আগে জানলে অ্যালাও করতাম না। আপনাকে আর সময় দেওয়া যাবে না। চঞ্চল নিডস অ্যাবসলিউট রেস্ট।’
প্রথমা বলল, ‘আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে…’
‘বাই দ্য ওয়ে, আপনি স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ বেডে রেখেছেন কেন? ওগুলো সরান।’
‘সরি!’ বিছানা থেকে যন্ত্র সরিয়ে প্রথমা ভাবে, শাশ্বতর কম্পিউটার বিছানায় থাকলে অসুবিধে নেই। আমার স্মার্টফোন থাকলেই দোষ! যত্তসব!
পালস দেখে, প্রেশার মেপে লক্ষ্মণ বলল, ‘সব প্যারামিটার স্টেবল আছে। তোমার কিছু লাগবে?’
‘চাঁদুকে পাঠিয়ে দাও। ওষুধ খাব।’
‘আমি এখানেই আছি স্যার।’ প্রথমাকে চমকে দিয়ে বেডের পিছন থেকে উঠে দাঁড়াল বছর পঁচিশের এক যুবক। সে মেঝেয় চাদর পেতে শুয়েছিল। তার উপস্থিতি টের পাওয়া গেল।
চঞ্চল প্রথমাকে বললেন, ‘চাঁদু আমার ড্রাইভার কাম পারসোনাল সেক্রেটারি। টু—ইন—ওয়ান। চাঁদু, ওষুধ দে।’
লক্ষ্মণ বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, ‘তোমার ইন্টারভিউ শেষ হলে গায়ত্রী খাবার নিয়ে আসবে।’
‘খাবার না পিণ্ডি! যত্তসব ন্যাকামো!’ স্বগতোক্তি করেন চঞ্চল।
বউয়ের উপরে এত রাগ কেন। ঝগড়া হয়েছে নাকি? ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক না গলিয়ে প্রথমা বলল, ‘কবে থেকে পুরোদমে প্র্যাকটিস শুরু করছেন?’
‘গতকাল সন্ধেবেলা আইসিসিইউ থেকে ফিরলাম। এখন দু’দিন রেস্ট।’ বুকের বাঁদিকে হাত বোলাচ্ছেন চঞ্চল।
‘এই নিন ওষুধ’, চঞ্চলের হাতে ট্যাবলেট আর জলের গেলাস তুলে দিয়েছে চাঁদু। ট্যাবলেট মুখে ফেলে একঢোক জল খেয়ে গেলাস ফেরত দেয় চঞ্চল। চাঁদু জিজ্ঞাসা করে, ‘দেবীমাতার ক্যাপসুলটা দেব?’
‘ওর ক্যাপসুল আমি খাব না!’ ঘাড় নাড়েন চঞ্চল।
দেবীমাতার নাম শুনে প্রথমা ভাবে, কার্ডিয়োলজিস্টেরও গুরুমা আছে? তার চিন্তার মধ্যে চঞ্চল বুকের বাঁদিকে মালিশ করতে করতে বলেন, ‘চাঁদু…লক্ষ্মণকে ডাক…’
‘কী হল?’ প্রথমা উৎকণ্ঠিত। চঞ্চল কুলকুল করে ঘামছেন। মুখ ফ্যাকাশে, শ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে।
চাঁদু চিৎকার করে বলল, ‘স্যারের শরীর খারাপ লাগছে!’ চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘরে ঢুকল লক্ষ্মণ আর গায়ত্রী। বছর চল্লিশের গায়ত্রীকে মা—মা দেখতে। টুকটুকে ফরসা, বেঁটেখাটো, গিন্নিবান্নি টাইপ।
গায়ত্রী আর লক্ষ্মণকে দেখে শুকনো জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চঞ্চল বললেন, ‘স—ব শে—ষ—হ—য়ে—গে—ল…’
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে হেলিয়ে রাখা বেড মেঝের সমান্তরাল করে দেয় লক্ষ্মণ। চঞ্চলের নাকে অক্সিজেনের নল গোঁজে। হাতে স্যালাইনের সুচ ঢোকায়। প্রথমা আর শাশ্বতকে ধাক্কা মেরে বেডের পাশ থেকে সরায়, ল্যাপটপ বেড থেকে সরিয়ে পাশের টেবিলে রাখে, কার্ডিয়াক মনিটরের তার চঞ্চলের শরীরে জুড়ে দেয়। চাঁদু মোবাইল ফোনে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে।
মনিটর হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠে সবুজ জীবনরেখা দেখাতে শুরু করেছে। পিঁকপিঁক করে হৃদয়ের শব্দ শোনাচ্ছে।
মনিটারের দিকে তাকিয়ে প্রথমা দেখল ঢেউয়ের মতো জীবনরেখা একলহমায় স্ট্রেটলাইন হয়ে গেল। শিশুর হাতে আঁকা মাটি আর আকাশের মধ্যেকার দিগন্তরেখার মতো সোজা।
অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গায়ত্রী স্বামীর নিস্পন্দ বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তিন
‘দেখুন ম্যাডাম, ব্যাপারটা সিরিয়াস,’ প্রথমার দিকে তাকিয়ে বলল পানিহাটি থানার অফিসার ইনচার্জ পুলক দাস, ‘ডক্টর চঞ্চল দুবের আনন্যাচরাল ডেথ নিয়ে ওঁর স্ত্রী গায়ত্রী দুবে এবং ওঁর কোলিগ ডাক্তার লক্ষ্মণ মিশ্র পানিহাটি থানায় আলাদা দুটো এফআইআর করেছে। গায়ত্রীর অভিযোগ দেবীমাতার বিরুদ্ধে। লক্ষ্মণের অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে। দুটি এফআইআর—এই ধারা তিনশো দুই দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ”কালপেবল হোমিসাইড অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার।” দেবীমাতা বা আপনাকে আমি আপাতত জেরা করার জন্যে থানায় নিয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু আপনি আমাকে হেল্প করুন।’
‘আমি আপনাকে কীভাবে হেল্প করব?’ নিরীহ মুখে জানতে চায় প্রথমা।
‘দেখুন ম্যাডাম, আমার কাছে হোম ডিপার্টমেন্ট থেকে অলরেডি খবর চলে এসেছে যে আপনি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। কোন ডিপার্টমেন্ট, সেটা জানার অধিকার নাকি আমার নেই। প্লাস, আমার উপরে চাপ আছে, যেন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল আপনাকে ছেড়ে দিই। কিন্তু কেসটা র্যাপ আপ না করে কী করে ছাড়ি বলুন!’
প্রথমা মাথা নিচু করে ভাবছে। নিজেকে নিয়ে নয়। চঞ্চলকে নিয়ে। অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে চিপ—এর আইসিসিইউতে নিয়ে গিয়েও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। লক্ষ্মণ ডেথ ডিক্লেয়ার করেছে সকাল এগারোটায়। এখন রাত আটটা। কান্নাকাটি, চিৎকার, থানায় ফোন, পুলিশ আসা, পোস্ট—মর্টেমের জন্যে বডি বারাসাত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, ময়না তদন্তের রিপোর্ট টেলিফোন মারফত আনঅফিশিয়ালি জানতে পারা—এইসব করতে করতে সন্ধে সাতটা বেজেছে। চঞ্চলের সেলাই করা দেহ এখন চিপ—এর রিসেপশানে রাখা রয়েছে। আগামিকাল সৎকার হবে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া অনেকক্ষণ এসে গেছে। রাষ্ট্রপতির কার্ডিয়োলজিস্টের মৃত্যু মানে ধুন্ধুমার মিডিয়া সার্কাস।
প্রথমা আর পুলক বসে রয়েছে চঞ্চলের বাংলোর ড্রয়িং রুমে। কপালে হাত দিয়ে প্রথমা বলল, ‘হার্টের রুগির মৃত্যুকে ”আনন্যাচরাল ডেথ” কেন বলা হচ্ছে?’
‘দু—দুটো এফআইআর হয়ে গেছে। মিডিয়ার চাপ আছে। আমাকে প্রসিড করতেই হবে,’ শ্রাগ করে পুলক, ‘পোস্ট—মর্টেম যিনি করেছেন তিনি ফোনে জানিয়েছেন যে পেসমেকার বন্ধ হয়ে হার্টব্লকের ফলে মৃত্যু। লিখিত রিপোর্ট কাল দেবেন। ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস রিপোর্টের প্রাইমারি ফাইন্ডিং আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনে জানাবেন।’
প্রথমা বলল, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই। গায়ত্রীকে ডাকুন। অভিযোগকারিণীকে দিয়ে জেরা শুরু করা যাক।’
চার
ড্রয়িং রুমে ঢুকে গায়ত্রী বলল, ‘ইনস্পেক্টর দাস, আমাকে ডেকেছেন?’
গায়ত্রী সিঁদুর মুছে ফেললেও সিঁথির লাল আভা যায়নি। পরনে নীল, মেরুনপেড়ে শাড়ি। কান্নাকাটির ফলে চোখ জবাফুলের মতো লাল। পুলক বলল, ‘আপনি বসুন।’
‘আপনি কেন মনে করছেন যে আপনার স্বামীকে খুন করা হয়েছে?’ সরাসরি গায়ত্রীকে প্রশ্ন করে প্রথমা।
আঁচলের খুঁট আঙুলের ফাঁকে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে গায়ত্রী বলে, ‘দেবীমাতার নাম শুনেছেন?’
‘বিখ্যাত নিউ—এজ গুরুমা,’ বলে প্রথমা, ‘যোগব্যায়াম, প্রাণিক হিলিং, রিফ্লেক্সোলজি, বিপাসনা, নেচারোপ্যাথির খিচুড়ি বানিয়ে ”আর্ট অফ লাইফ” নামে বিক্রি করে। এক মাসের সেশানের জন্যে কোটিপতিরা লাইন দেয়। এলাহাবাদে বিশাল আশ্রম, অন্যান্য রাজ্যেও হেলথ হাব আছে। আছে নিজস্ব এফএম এবং টিভি চ্যানেল।’
‘গত ছ’মাস ধরে দেবী আমার বরের মাথা খাচ্ছে।’ নিচু গলায় বলে গায়ত্রী।
‘দেবী কেন চঞ্চলের মাথা খাবেন? কীভাবেই বা খাবেন?’
‘চঞ্চল মোটা হয়ে যাচ্ছিল। পেশেন্ট দেখাকালীন দুবার মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তখন ও দেবীকে চিপ—এ আমন্ত্রণ জানায়, ”আর্ট অফ লাইফ” সেশান করার জন্যে। দেবীকে পাশের বাংলোয় থাকতে দেয়। অন্য হার্ট পেশেন্টের সঙ্গে দেবীর সেশানে যোগ দেয়। একমাস সেশান করার পরে চঞ্চল অনেকটা রোগা হয়। মাথা ঘোরাটা কমেনি। কেন না ওটা হার্ট ব্লকের জন্যে হচ্ছিল। আলটিমেটলি পেসমেকার বসাতেই হল। মাঝখান থেকে আমার সববোনাশ হয়ে গেল।’
‘সববোনাশ বলতে?’
‘দেবীমাতা ওঁকে এমন বশ করে ফেলেছে যে ওর ”আর্ট অফ লাইফ”—এর জন্য প্রচুর টাকা তো চঞ্চল দিয়েছেই, উপরন্তু সম্পত্তির অর্ধেক দেবীমাতার বুজরুকি আর্টের নামে উইল করে দিয়ে গেছে। এতে নাকি অনেক মানুষের উপকার হবে! ছেলেটার নাম প্রাণে ধরে কাটতে পারেনি। চঞ্চল মারা যাওয়ার পরে চিপ—এর মালিক এখন দেবী। আমি সন্দেহ করব না এটা মার্ডার?’
কফিতে চুমুক দিয়ে পুলক বলল, ‘কিন্তু দেবী তো প্লেস অফ অকারেন্সে ছিলেনই না!’
‘ঘটনাস্থলে না থেকেও মার্ডার করা যায়, মিস্টার দাস। আজকাল নানা সাসটেইনড রিলিজ ক্যাপসুল বেরিয়েছে। খাওয়ার অনেক পরে অ্যাকশন শুরু হয়। চঞ্চল নিয়মিত দেবীর দেওয়া হারবাল ক্যাপসুল খেত।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ প্রথমা গায়ত্রীকে বলে, ‘আপনি ডক্টর লক্ষ্মণ মিশ্রকে পাঠিয়ে দিন। আর দেবীকে বলে রাখুন, আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলব।’
পাঁচ
‘দেখুন, আমার হাতে একদম সময় নেই। চিপ—এর ম্যানেজমেন্ট সামলানো একটা হেডেক। তার কর্ণধারের অন্ত্যেষ্টি সামলানো আর একটা। এর মধ্যে আমাদের আর জ্বালাবেন না।’ ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসে পুলকের দিকে তাকিয়ে বলল লক্ষ্মণ।
‘চঞ্চল তো প্রাক্তন কর্ণধার হয়ে গেলেন। বর্তমান কর্ণধার কে? আপনি?’ টুক করে প্রশ্ন ছোড়ে পুলক।
‘ট্যালেন্ট আর লেবারকে প্রায়রিটি দিলে সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এখানে ভড়ং আর বুজরুকির জয় হয়। আপনি দেবীমাতার নাম শুনেছেন?’
‘না শুনে উপায় আছে? টিভি খুললেই তাঁর ছবি।’
‘একদিকে মডার্ন মেডিসিন। অন্যদিকে ইন্ডিয়ান মিস্টিসিজম। এই দুই পক্ষের গাঁটছড়া বেঁধে দেবী চিপ—কে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েলনেস হাবে বদলে দিতে চায়। যেখানে মেডিসিন বা সার্জারি ছাড়াই হৃদযন্ত্র ভালো থাকবে। দেবীর মোটো হল, ”বাই দ্য বাইপাস।”
‘দেবী চাইলেই তো আর বদল ঘটবে না! তার জন্যে চঞ্চলের অনুমতি প্রয়োজন।’
‘চঞ্চল উইল করে চিপ—এর অর্ধেক মালিকানা দেবীর নামে করে দিয়েছে। আমি এখন ওই ফ্রডটার বেতনভুক কর্মচারী! কী হিউমিলিয়েটিং!’
‘বাকি অর্ধেক মালিকানা তো শাশ্বতর নামে। অত হিউমিলিয়েশানের কী আছে?’
‘শত এখনও জুনিয়র। সম্পত্তির অর্ধেক ওর নামে থাকলেও ওর লিগাল গার্জেন সেটা হ্যান্ডল করবে। চঞ্চল কাকে লিগাল গার্জেন করে গেছে কে জানে!’
প্রথমা স্যান্ডউইচ খেতে ব্যস্ত ছিল। এতক্ষণে মুখ খুলল। ‘চঞ্চলের পেসমেকার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে?’
লক্ষ্মণ প্রথমার দিকে তাকিয়ে আঙুল নেড়ে বলে, ‘আপনি চঞ্চলের বেডে স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ রেখেছিলেন। আপনি কি জানেন যে এ থেকে পেসমেকার ড্যামেজ হতে পারে?’
‘তাই আপনি আমার নামে এফআইআর করেছেন?’
‘পেসমেকারের সাইজ বিস্কুটের মতো।’ রাগি গলায় বলে লক্ষ্মণ, ‘বুকের ডানদিকে কলার বোনের তলায়, চামড়ার নীচে বসানো থাকে। পেসমেকার থেকে একটা তার ধমনি দিয়ে চলে যায় দক্ষিণ নিলয় ও দক্ষিণ অলিন্দে। পেসমেকারে ইমপালস তৈরি হলে, তারবাহিত হয়ে সেই ইমপালস হৃদয়ে পৌঁছে তাকে ঠিক ছন্দে নাচায়। স্মার্টফোন সরাসরি পেসমেকারের ওপরে কোনো এফেক্ট করে না। কিন্তু ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট পেসমেকারের ইমপালস জেনারেশানে ব্যাগড়া দিয়েছে। সেটাই চঞ্চলের মৃত্যুর কারণ।’
প্রথমার মনে সংশয় বাসা বাঁধছে। তার জন্যে যদি চঞ্চল মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে সে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না।
পুলক নিচু গলায় লক্ষ্মণকে বলল, ‘আপনি যান। দেবীকে পাঠিয়ে দিন।’
ছয়
‘নমস্কার। আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে?’ ড্রয়িং রুমে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে হাত জড়ো করল দেবীমাতা। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। জিনস এবং নামাবলির কুর্তি পরা দেবীকে দেখে পুলক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বসুন।’
সোফায় বসল দেবী। প্রথমা তার হাতে এক কাপ কফি তুলে দিয়ে বলল, ‘গায়ত্রী অভিযোগ করেছেন যে আপনি সাসটেইনড রিলিজ ক্যাপসুল খাইয়ে চঞ্চলকে হত্যা করেছেন।’
‘ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট এলেই সত্যিটা বোঝা যাবে।’ কফিতে চুমুক দেয় দেবী।
‘চঞ্চলের শেষ উইল অনুযায়ী ওঁর অবর্তমানে, যাবতীয় সম্পত্তির অর্ধেক মালিক আপনি। গায়ত্রীর অভিযোগ, এটাই আপনার খুন করার মোটিভ।’
‘অর্থ নিয়ে কথা বলা আমার জীবনদর্শনের বিরোধী।’
এরমধ্যে পুলকের ফোন এসেছে। সে মোবাইলে নিচু গলায় কথা বলছে। ফোন কেটে বলল, ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে জানাল, ভিসেরার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে কোনো পয়জন পাওয়া যায়নি। চাঁদুর দেওয়া যে দুটো ওষুধ উনি খেয়েছিলেন, সেগুলো ব্লাড প্রেসার কমানোর ওষুধ। রক্তে তাদের মাত্রা স্বাভাবিক।’
‘গায়ত্রীর সাসটেইনড রিলিজ পয়জন ক্যাপসুলের তত্ত্ব তা হলে বাতিল!’ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে দেবী, ‘আমি এবার উঠি?’
প্রথমা বলে, ‘চঞ্চল চাঁদুকে বলছিলেন যে আপনার হারবাল ক্যাপসুল উনি আর খাবেন না।’
দেবীমাতা একপরদা গলা চড়িয়ে বলল, ‘পেসিং—এর দুদিন আগে পর্যন্ত চঞ্চল হারবাল ক্যাপসুল খেয়েছে। পেসিং—এর পরে খেয়েছে কি না জানি না। আইসিসিইউতে আমি যাইনি।’
‘আপনি এবার আসতে পারেন।’ নমস্কার করে প্রথমা। তাকে পাত্তা না দিয়ে পুলকের দিকে তাকিয়ে দেবী বলে, ‘লক্ষ্মণের মুখে শুনলাম যে এই জার্নালিস্ট মেয়েটি চঞ্চলের বেডে স্মার্টফোন এবং ইয়ারপ্লাগ রেখেছিল। আমার ‘হেলদি হার্ট উইদাউট ডক্টর’ বইতে পরিষ্কার বলা আছে যে পেসমেকারের তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে ম্যাগনেট থাকলে সেটা ইমপালস জেনারেশানে প্রবলেম করে। অন্যদের জেরা করা বন্ধ করে আপনি আগে একে জেরা করুন। চঞ্চলের মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাবেন।’
পুলক বলল, ‘আপনি চাঁদুকে পাঠিয়ে দিন।’
সাত
দেবী ঘর থেকে বেরোতেই প্রথমা হঠাৎ চনমনে। আগেকার সেই মনমরা ভাব আর নেই। একটুকরো কাগজে খসখস করে একলাইন লিখে পুলকের হাতে ধরিয়েছে। চাঁদু ঘরে ঢুকতেই তাকে কড়া গলায় বলল, ‘তুমি সারাদিন স্যারের সঙ্গে থাকতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘চঞ্চল যে সেকেন্ড উইল করেছিলেন, সেটা তুমি জানতে?’
চাঁদু মুখ খোলার আগে পুলক শাশ্বতকে বলল, ‘বাথরুমটা কোথায়?’
‘আমি দেখিয়ে দিচ্ছি,’ বলল চাঁদু।
‘আমার কথার উত্তর না দিয়ে পালানোর চেষ্টা কোরো না!’ চাঁদুকে ধমক দেয় প্রথমা। শাশ্বত ব্যাজার মুখে পুলককে নিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে বেরোয়।
শাশ্বতর ল্যাপটপের সামনে বসে প্রথমা বলল, ‘আমি চিরকুটে বড়বাবুকে লিখেছিলাম যে উনি যেন শাশ্বতকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে যান। তুমি বড়বাবুকে বাথরুম দেখাতে গিয়ে কেসটা ঘেঁটে দিচ্ছিলে। আমি যে প্রশ্নটা করেছি, তার উত্তর দাও।’
‘হ্যাঁ,’ মাথা নিচু করে বলে চাঁদু।
‘তুমি দুটো উইলের কথাই জানতে?’
‘দুটো নয়,’ এদিক—ওদিক দেখে নিচু গলায় চাঁদু বলে, ‘উইল আসলে তিনটে।’
‘ভুল বকছ কেন?’ ল্যাপটপের ওয়েব হিস্ট্রি ঘাঁটছে প্রথমা।
‘ভুল বকছি না। তিনটে উইলেরই একজন সাক্ষী আমি, আর অন্যজন আরএমও বিকাশ দত্ত। উনি স্যারের ছোটবেলার বন্ধু।’
‘লাস্ট উইল, মানে তিন নম্বর উইলটা কবে হয়েছে?’
‘গতকাল রাতে। আইসিসিইউ থেকে বাড়ি আসার আগে স্যার এই উইলটা করেছেন।’
‘এই উইলে উত্তরাধিকারী কে?’
‘প্রথম আর তিন নম্বর উইলে কোনো তফাত নেই। স্যার মরে যাওয়ার পরে সব সম্পত্তির মালিক এখন আবার গিন্নিমা আর খোকাবাবু।’
ওয়েবহিস্ট্রি ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রথমা বলল, ‘কার্ডিয়োট্রনিক্স।’
তাকে অবাক করে দিয়ে চাঁদু বলল, ‘ঠিক বলেছেন।’
‘কী ঠিক বলেছি?’ প্রথমা জানতে চায়।
‘স্যারের বুকে কার্ডিয়োট্রনিক্স কোম্পানির পেসমেকার বসানো হয়েছে। ওটাই এখন ওয়ার্ল্ডের বেস্ট।’
‘কার্ডিয়োলজিস্টের সঙ্গে থেকে তুমিও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলে নাকি?’ প্রাণখোলা হাসে প্রথমা।
শাশ্বত আর পুলক ড্রয়িংরুমে ফেরত এসেছে। প্রথমাকে ল্যাপটপ ঘাঁটতে দেখে শাশ্বত গলা তুলে বলল, ‘ল্যাপটপ পারসোনাল জিনিস। অন্যেরটা ইউজ করা উচিত নয়।’
‘বিপদের সময় অন্য লোকের জিনিস ইউজ করতে হয়।’ কি—বোর্ডে প্রথমার আঙুল চলছে। তাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করছে শাশ্বত। বলছে, ‘আপনার কেন বিপদ হবে? বিপদ তো দেবীমাতার।’
‘কেন?’ ল্যাপটপ পুলকের হাতে তুলে দিয়ে বলে প্রথমা।
‘আমি ওই হারবাল ক্যাপসুল কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্যে মুম্বাইয়ের ফার্মাকোলজি ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম। রিপোর্টে বলছে, হারবাল ক্যাপসুল হাইডোজ স্টেরয়েডে ভরপুর। রিপোর্ট দেখার পর বাবা আর ওই মেয়েটার মধ্যে বিরাট বাওয়াল হয়!’
চাঁদু বলে, ‘তারপর থেকেই স্যার আর দিদিমণির দেওয়া ওষুধ খাননি। গতকাল রাতের উইলটাও ওই কারণে করেন।’
‘নতুন উইলের কথা কে কে জানে?’
‘স্যার, উকিলবাবু, ডাক্তার বিকাশ দত্ত, খোকাবাবু আর আমি। আমি কিন্তু কাউকে বলিনি।’ কাঁচুমাচু মুখে বলে চাঁদু।
‘আমিও বলিনি,’ ভাঙা গলায় বলে শাশ্বত।
‘তুমি যে কাউকে বলোনি এটা আমি জানি,’ শাশ্বতর মাথায় হাত বুলিয়ে প্রথমা বলল, ‘চাঁদু, সবাইকে একবার স্যারের বেডরুমে ডাকো। ফাইনাল কথাবার্তা বলে আমি উঠব।’
আট
‘বেশি সময় নেব না। সংক্ষেপে বলি।’ চঞ্চলের বেডের চারপাশের চেয়ারে বসে থাকা গায়ত্রী, লক্ষ্মণ আর দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে প্রথমা। চাঁদু বেডের পিছনে, মেঝেয় বসেছে। শাশ্বত পুলকের পাশে বসে ল্যাপটপ নেওয়ার জন্যে ছোঁকছোঁক করছে। পুলক ল্যাপটপ হাতছাড়া করেনি।
‘চঞ্চল মারা গেলে কার লাভ?’ সবার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় প্রথমা। ‘গায়ত্রী এবং লক্ষ্মণ মনে করছে দেবীর লাভ। কেন—না চঞ্চলের যাবতীয় সম্পত্তির মালকিন এখন দেবী।’
‘টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলা আমার অপছন্দ। তাও বলি, দেবীমাতা ট্রাস্টের টাকার অভাব নেই।’ নরম গলায় বলে দেবী।
‘আপনার হারবাল ক্যাপসুলে স্টেরয়েড মেশানো থাকে। এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ট্রাস্টের উপরে মানুষের ট্রাস্ট চলে যাবে। চলে যাবে আপনার কোটি টাকার সম্পত্তি। মিডিয়ার কাছে মুখ খোলার আগে চঞ্চলকে সরিয়ে দেওয়া খুন করার পক্ষে বিরাট বড় মোটিভ।’
‘শাট আপ! বেশি কথা বললে তোমার জিভ ছিঁড়ে নেব!’ হুঙ্কার ছাড়ে দেবী।
পুলক চেঁচায়, ‘বেশি কথা বললে এক্ষুনি আপনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে মিডিয়ার সামনে দিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলব।’ দেবী চুপ করে যায়।
প্রথমা বলে, ‘অন্যদের মোটিভে আসা যাক। দেবী মনে করে, সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ক্ষোভে গায়ত্রী ওঁকে খুন করেছেন। তাছাড়া চঞ্চল মরে যাওয়ায় লক্ষ্মণেরও তো লাভ হল।’
‘আমার আবার কী লাভ?’ হাতা গুটিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে লক্ষণ। ‘চিপ—এর সুপারইনটেন্ডেট হিসেবে আর কত দিন থাকবেন? রাষ্ট্রপতির হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হতে গেলে যদি কারও হৃদয় থামিয়ে দিতে হয়, তবে তাই সই! এর থেকে বড় মোটিভ আর হয় না।’
লক্ষ্মণ বলে, ‘কিন্তু চঞ্চল তো সবকিছু দেবীমাতার নামেই করে গেছে। আমি কেন চঞ্চলকে মারতে যাব? তিন নম্বর উইলের কথা তো আমি জানিই না!’
মৃদু হাসে প্রথমা, ‘মোটিভ ভুলে গিয়ে এবার আমরা কজ অব ডেথে ঢুকি। চঞ্চলের মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক? অস্বাভাবিক হলে এটা কি হত্যা?’
‘দিস ইজ মার্ডার! অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আপনাকে পালাতে দেব না!’ গর্জন করে লক্ষ্মণ। পুলককে বলে, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম যে ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট থেকে পেসমেকার ডিঅ্যাকটিভেটেড হয়েছে। আপনি এই জার্নালিস্টকে অ্যারেস্ট করুন!’
‘আপনি ভুল বলেছিলেন!’ পুলক কিছু বলার আগেই প্রথমার গলা বেডরুম জুড়ে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল, ‘কেন, সেটা জানার জন্যে আপনাকে চঞ্চলের বেডে একবার শুতে হবে। চাঁদু, স্যারের বেডটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে দাও।’
চাঁদু বেডের হেডএন্ড তুলে দিল। লক্ষ্মণ লালচোখে প্রথমাকে মেপে নিয়ে বিছানায় আধশোওয়া হল। প্রথমা বলল, ‘ধরে নিন, আপনি চঞ্চল। আমি জার্নালিস্ট। আমার পুরনো জায়গায় বসছি। স্মার্টফোন আর ইয়ারপ্লাগ পুরনো জায়গায় রাখছি।’
বেডের বাঁ পাশের চেয়ারে বসে প্রথমা লক্ষ্মণকে বলল, ‘পেসমেকার বসানো থাকে বুকের ডানদিকে। ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট কাজ করে তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে। আপনার বাঁদিকে থাকা ইয়ারপ্লাগ এখন আপনার বুকের ডানদিকে বসানো পেসমেকারের থেকে অন্তত দু’ফুট দূরে। আমার ইয়ারপ্লাগের ম্যাগনেট থেকে চঞ্চলের পেসমেকার বন্ধ হয়নি।’
লক্ষ্মণের বডি ল্যাঙ্গোয়েজে আগের আগ্রাসী ভাব আর নেই। বিড়বিড় করে সে বলল, ‘তা হলে? চঞ্চল কীভাবে মারা গেল?’
‘সেটা জানার চেষ্টা করা যাক!’ লক্ষ্মণকে ছেড়ে শাশ্বতকে নিয়ে পড়েছে প্রথমা, ‘খোকাবাবু, তোমার ল্যাপটপের ওয়েব হিস্ট্রিতে কার্ডিয়োট্রনিক্সের লিঙ্ক কেন রয়েছে?’
‘তুমি আমার ল্যাপটপ ফেরত দাও।’ পুলককে মিনতি করে শাশ্বত।
শাশ্বতর কবজি ধরে বেডের ডানপাশে এনে প্রথমা লক্ষ্মণকে বলে, ‘আমি ডাক্তারি বুঝি না। ভুল বললে সংশোধন করে দেবেন। পেসমেকারের প্রাণভোমরা একটা মাইক্রোচিপ। তাতে পেশেন্ট এবং তার রোগ সংক্রান্ত যাবতীয় ডেটা ভরা থাকে। মাইক্রোচিপ থেকে এই ডেটা ওয়্যারলেস রেডিয়ো সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রান্সমিটেড হয়। দরকার পড়লে, বুকের চামড়া না কেটে, পেসমেকারে হাত না দিয়ে, পেশেন্টের হার্টরেট বাড়ানো বা কমানো হয় এই মাইক্রোচিপের সাহায্যে। তাই তো?’
লক্ষ্মণ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে।
‘চঞ্চলের ডানদিকে বসে, রেডিয়ো হার্ডওয়্যার লাগানো ল্যাপটপের মাধ্যমে শাশ্বত রেডিয়ো সিগন্যাল ইন্টারসেপ্ট করেছে। তারপর সেই ডেটার সাহায্যে কার্ডিয়োট্রনিক্সের সার্ভারে ঢুকে চঞ্চলের পেসমেকারের ইমপালস জেনারেশান বন্ধ করে দিয়েছে।’
পুলক বলল, ‘বুঝলাম না। একটু সহজ করে বলুন।’
‘চেষ্টা করছি,’ বলে প্রথমা, ‘মোবাইল ফোন চুরি হলে, এয়ারটাইম প্রোভাইডারকে খবর দিলে ওরা যেভাবে চুরি যাওয়া সিমকার্ড ডিঅ্যাকটিভেট করে দেয়, এটা সেই পদ্ধতি। শাশ্বত একজন ধুরন্ধর হ্যাকার।’
পুলক বলল, ‘এবার বুঝলাম। আমি এই ল্যাপটপ কলকাতার পুলিশের সাইবার ক্রাইম সেলে পাঠাচ্ছি। ওরা হার্ডডিস্ক থেকে সব ডেটা উদ্ধার করে দেবে।’
শাশ্বতর গালে ঠাস করে চড় মেরে তাকে জড়িয়ে ধরে গায়ত্রী। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কেন এইরকম করলি? কেন?’
গায়ত্রীর কোলে মাথা রেখে চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে শাশ্বত। কৈশোরের ভাঙা গলায় বলছে, ‘বাবাটা খালি বলত, ”তোকে কার্ডিয়োলজিস্ট হতে হবে।” আমার ভালো লাগত না মা। বাবাটা আমাকে পাগলের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছিল। স্কুলের বন্ধুরা এই নিয়ে আমায় ”বুলি” করে। আমার ভালো লাগে না মা। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সফটওয়্যার নিয়ে পড়াশোনা করতে আমাকে এনকারেজ করো। ডাক্তার হওয়ার কথা বলে ”বুলি” করো না। ”জোম্বি” বলে গালাগাল দাও না। আর তাছাড়া বাবা তোমাকে খুব কাঁদিয়েছে। আই নিউ ইট মা। তুমি চোখের জল আড়াল করেছ ঠিকই, বাট আমার থেকে গোপন করতে পারোনি।’
প্রথমা নরম গলায় বলে, ‘শাশ্বত, তুমি কি জানো যে তুমি যা করেছ, সেটা মার্ডার?’
‘মার্ডার কেন হবে? দিস ইজ হার্ট হ্যাকিং।’ ভাসাভাসা চোখে নিষ্পাপ দৃষ্টি মেলে বলে শাশ্বত, ‘কার্ডিয়োট্রনিক্সের সার্ভারের সিকিয়োরিটিতে কিছু লুপহোল ছিল। সেটা ধরিয়ে দিয়ে আমি ওদের মেইল করে দিয়েছি। যাতে ওরা ভুলটা কারেকশান করে নেয়।’
পুলক প্রথমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা যে শাশ্বতর কাজ এটা আপনার কখন মনে হল?’
‘লক্ষ্মণ বলেছিল ম্যাগনেট থেকে পেসমেকারের ড্যামেজ হয়। দেবী যখন বলল যে পেসমেকারের তিন সেন্টিমিটারের মধ্যে ম্যাগনেট থাকলে তবেই ড্যামেজ হবে, তখনই আমি নিজেকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখি। কেননা আমার ইয়ারপ্লাগ অনেক দূরে ছিল। কাছে ছিল শাশ্বতর ল্যাপটপ। ‘চিপ’ শব্দটা বারবার শুনে হঠাৎ মনে হল, পেসমেকারেও তো চিপ থাকে। শাশ্বতর দৃষ্টিতে চঞ্চলের প্রতি ঘৃণাই আমাকে বাধ্য করে ওর ল্যাপটপে নাক গলাতে। আপনাকে ওই চিরকুট দেওয়ার আসল কারণ হল, আমি শাশ্বতকে মেশিন থেকে তুলতে চেয়েছিলাম।’
দেবী চুপ করে বসে আছে। চাঁদু মেঝের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পাখির মায়ের মতো দুই পক্ষ দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে গায়ত্রী। শাশ্বত মায়ের কোলে বসে আছে।লক্ষ্মণের মাথা নিচু। পুলক পানিহাটি থানায় ফোন করছে।
একদল পরাজিত মানুষকে পিছনে ফেলে প্রথমা ঘর থেকে বেরোল। অডিয়োভিশুয়াল আর প্রিন্ট মিডিয়া—এই দুই পক্ষের নজর বাঁচিয়ে তাকে ‘চিপ’ থেকে বেরিয়ে দিল্লি ফিরতে হবে। সামনে অনেক কাজ।
নীল রুমাল – প্রণব রায়
বাড়িটা শহরের একটেরে— সীমানার বাইরেও বলা যায় ৷ হঠাৎ দেখলে একটা সাবেককেলে গির্জা বলে মনে হয় ৷ খুঁজে খুঁজে এই বাড়িটাতে নিশীথ তার স্টুডিও করেছে ৷
শহরের কলরব-ব্যস্ততার থেকে দূরে, একান্তে বসে কাজ-কারবারের পক্ষে এই প্রাচীন নিরিবিলি বাড়িটা নাকি চমৎকার ৷ তাছাড়া আশেপাশে একটা জংলা আভাসও আছে ৷ বাড়িটার চারপাশ ঘিরে অনেকটা জমি— সাবু আর বড় বড় দেবদারু গাছে ভর্তি ৷ পিছন দিকে বড় গোছের একটা খালও আছে ৷ এককালে নাকি এই খালপথে বড় বড় ছিপ অন্ধকার রাত্রে নিঃশব্দ কুমিরের মতো ভেসে চলত শিকারের সন্ধানে ৷ শোনা যায়, তারা নাকি চট্টগ্রাম থেকে ছটকে-আসা জলদস্যুর দল ৷ কিন্তু সে বহু বছর আগেকার কথা ৷
এখন হপ্তাহে একবার করে গঞ্জ-ফেরত ব্যবসায়ীদের নৌকো ছাড়া খালের জলে আর কিছু দেখা যায় না ৷
নিশীথ কিন্তু এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতেই একটা স্টুডিও খুলে বসেছে ৷ নামকরা শিল্পী সে— তৈলচিত্র আর প্ল্যাস্টারের মূর্তি গড়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে তার ৷ অদ্ভুত প্রকৃতির লোক এই নিশীথ ৷ তার বহু ছবি, বহু মূর্তি দেশ-বিদেশে প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করেছে, প্রচুর দামে বিক্রি হয়েছে ৷ শিল্প-রসিক বহু নরনারী তার শিল্পকে দেখেছে, তারিফ করেছে, কিন্তু শিল্পীকে বিশেষ কেউই দেখতে পায়নি ৷ কত অভিনন্দন-সভা থেকে আমন্ত্রণ এসেছে—নিশীথ সাড়া দেয়নি, কত অনুরাগীর আসরে উপস্থিত হওয়ার জন্যে অনুরোধ এসেছে— অসুস্থতার অজুহাতে সে উপস্থিত হয়নি ৷ এমনকী নিজের ছবি একখানা— তা-ও সে কোনোদিন আঁকেনি ৷
নিশীথের এই আত্মগোপনের রহস্য আর কেউ না জানলেও একটি মানুষ জানত— সে ‘রোমাঞ্চ’র বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী ৷ পাঠক-পাঠিকারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই অপরাধের গন্ধ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠেছেন ৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, নিশীথের আত্মগোপন-রহস্যের মধ্যে অপরাধের লেশমাত্র গন্ধ নেই ৷ আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই: নিশীথ লোকটা দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত— শুধু কুৎসিত নয়, একেবারে হত-কুৎসিত ৷ মুখখানার গঠন অনেকটা ‘এপ ম্যান’ বা গরিলার মতন ৷ হাত দুটো অস্বাভাবিক দীর্ঘ এবং রোমশ ৷ সারা জীবন যে সুন্দরের পুজো করে আসছে, তার প্রতি সৌন্দর্য-দেবতার কেন যে এতখানি অকরুণ উপেক্ষা— তা বোধ করি ভগবানই জানেন ৷ কিন্তু নিজের কদাকার চেহারার জন্যে নিশীথের লজ্জা বেদনা অভিমানের অন্ত ছিল না ৷ তার শিল্পকলার নিদর্শন দেখে কত অনুরাগিণী নারী অনুরাগপত্র পাঠিয়ে তার দর্শন-প্রার্থিনী হয়েছে ৷ প্রথম প্রথমদু-একজনকে সে আসতেও লিখেছিল ৷ কিন্তু দেখা হলে কেউ-বা তাকে মনে করেছিল ভৃত্য, কেউ-বা আতঙ্কে চিৎকার করে পালিয়ে গিয়েছিল ৷ সেই থেকে নিশীথ লোকচক্ষুর অন্তরালে এই নির্জনবাস বেছে নিয়েছে ৷ সেই থেকেই বিখ্যাত শিল্পী নিশীথের আত্মগোপনের পালা শুরু ৷ প্রতুল তার বাল্যবন্ধু ৷ বন্ধুর জীবনের এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি তার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল ৷ তাই এই নির্জনবাসের মধ্যে প্রতুলই নিশীথের একমাত্র অবসর-সঙ্গী ৷
সেদিনও সন্ধ্যার পর প্রতুল এসেছিল স্টুডিওতে ৷ বাইরে শীতের রাত কুয়াশায় থমথম করছে ৷ মাঝে মাঝে ঝোড়ো বাতাসও দিচ্ছে ৷ দেবদারু-শাখাপুঞ্জের ভেতর দিয়ে তার অতৃপ্ত আত্মার আক্ষেপের মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ৷
পাইপটা আর একবার ধরিয়ে প্রতুল বলল, হুঁ— কী বলছিলে, স্বপ্নের কথা! মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে অবচেতন মনের সংযোগ আছে ৷ কথাটা সোজা করে বলি! মানুষের গোপন ইচ্ছা, গোপন বাসনা অনেক সময় তার স্বপ্নের রূপ ধরে ওঠে ৷ যেমন ধরো, তুমি গায়ক নও, অথচ গান অত্যন্ত ভালোবাসো, গান গাইবার একটা গুপ্ত ইচ্ছাও আছে প্রবল ৷ তুমি কোনোদিন স্বপ্নে দেখতে পারো যে, বিরাট সভায় বসে গান গাইছ— লোকে তোমার অজস্র প্রশংসা করছে ৷ অবশ্য মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সব জিনিসেরই ব্যাখ্যা আছে ৷
থাক তোমার মনোবিজ্ঞানীদের কথা ৷ স্বপ্নের মাঝে এমন কিছুও ঘটে, বিজ্ঞান দিয়ে যার-ব্যাখ্যা চলে না, যা নিতান্ত অস্বাভাবিক ৷— একটা অসমাপ্ত নারীমূর্তি নিয়ে নিশীথ কাজ করছিল প্রতুলের দিকে পিছন ফিরে ৷ পিছন ফিরেই সে এই কথাগুলো বলল ৷
প্রতুল মৃদু হাসল ৷
গোয়েন্দাগিরি করতে করতে শেষ অবধি এই জেনেছি যে, অস্বাভাবিক বলে দুনিয়ায় কিছুই নেই ৷ লোকের মুখে-মুখে শুনে বা খবরের কাগজের রিপোর্টে পড়ে যে ঘটনাটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়, বিশেষ পরিবেশ বা অবস্থার মাঝে তাকে দেখলে নিতান্ত স্বাভাবিক বলেই মনে হয় ৷ কেননা, জীবনে ভালোটাও যেমন স্বাভাবিক, মন্দটাও ঠিক ততখানি স্বাভাবিক নিশীথ!
কিন্তু স্বপ্ন?— নিশীথের হাতের কাজ হঠাৎ থেমে গেল ৷ স্বপ্ন তো ঘটনা নয়, স্বপ্ন জিনিসটাই অবাস্তব ৷ অবাস্তবের ব্যাখ্যা তুমি কী ক’রে করবে প্রতুল?
আগে স্বপ্ন-কাহিনিটা শুনি, তারপর নাহয় চেষ্টা করা যাবে ব্যাখ্যা করবার ৷
নিশীথ আবার কাজে হাত লাগিয়ে বলল, তুমি যুক্তি-তর্কবাগীশ মানুষ, তোমার কাছে আমার এই স্বপ্ন-কাহিনি হয়তো আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হবে ৷
মন্দ কী!— সোফার হাতলের ওপর পা-দুটো তুলে দিয়ে, পাইপে আরাম করে একটা টান দিয়ে প্রতুল বলল, শীতের এই ঠান্ডা রাতে আষাঢ়ে গল্প জমবে ভালো ৷ আজকের মতো কাজ বন্ধ করে গল্প শুরু করে দাও!
নিশীথ বলল, ভেবেছিলাম আমার স্বপ্নের কথা কোনোদিন কাউকে বলব না ৷ কারণ, এ কাহিনি যত মধুর তত ভয়ংকর ৷ সবচেয়ে সেরা মদ আর সবচেয়ে উগ্র বিষ একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে যা হয়, সে-স্বপ্নের কথা মনে পড়লে আমার অবস্থাও হয় ঠিক তেমনি ৷ সে যে কী অদ্ভুত অনুভূতি, তা তোমায় বোঝাতে পারব না প্রতুল ৷ আনন্দ যে এত যন্ত্রণাদায়ক হয়, আগে তা জানতাম না ৷ বলি শোনো প্রতুল ৷
হাতের যন্ত্র ফেলে দিয়ে নিশীথ এতক্ষণে ধীরে ধীরে প্রতুলের দিকে মুখ ফেরাল ৷ এতক্ষণ যে ঝোলানো আলোটার নীচে নিশীথ কাজ করছিল, সেটা এখন তার পেছনে ৷ তার পরিবর্তে নিশীথের মুখে পড়েছে— প্রতুলের সামনে টেবিলের ওপর যে রিডিং-ল্যাম্প, তারই মৃদু আলো ৷ সে-আলোটা নিচু দিক থেকে মুখে পড়ায়, তার গরিলাকৃতি মুখখানা যেন সত্যিই পশুর মতো বীভৎস হয়ে উঠেছে ৷
প্রতুল স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ৷ বাইরে শীতের ঝড়ো হাওয়ার আর্তনাদ একটা খোলা জানলা দিয়ে ঘরে আসছে ৷ দুলছে ঘরের ঝোলানো আলোটা, আর আলো-আঁধারির বিচিত্র ঢেউ খেলে যাচ্ছে দেওয়ালে-দেওয়ালে ৷
আজও সেই স্বপ্নের কথা মনে হলে আমি যেন কীরকম হয়ে যাই প্রতুল ৷ কেমন একটা অস্থির আতঙ্ক আমায় যেন পাগল করে দেয় ৷ মনে হয়, সারাজীবন বুঝি এ-যন্ত্রণা ভোগ করে কাটাতে হবে ৷
বলতে বলতে নিশীথ এগিয়ে এসে প্রতুলের সামনে বসল ৷ ধীরে ধীরে তার মুখের পাশব-ভাব বদলে গিয়ে প্রশান্ত হয়ে এল ৷ চোখ-দুটো আস্তে আস্তে এল বুজে ৷ হাত দুটো জোড় হয়ে বুকের কাছে উঠে এল ৷ নিশীথ বলতে লাগল, কিন্তু অসীম করুণা ভগবানের, আমার এ ভাব কয়েক মুহূর্তের বেশি থাকে না ৷ যখন মনে পড়ে যায়, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই, তখনই নিশ্চিন্ত প্রশান্তিতে মন আবার সুস্থ হয়ে ওঠে ৷
প্রতুলের পাইপটা নিভে গিয়েছিল ৷ কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি তখনও নিশীথের মুখের ওপর ৷ ছাই ঝাড়বার জন্যে পাইপটা ঠুকতেই নিশীথ যেন ধ্যান থেকে জেগে উঠল ৷
মৃদু গম্ভীর গলায় ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করল: ঠিক এক বছর আগেকার কথা ৷ তারিখটা ছিল আজকেরই মতন ১৩ ডিসেম্বর আর রাতটাও ছিল ঠিক এমনি ঝড়ো, কনকনে ৷ পরের দিনই একখানা পোর্ট্রেট সম্পূর্ণ তৈরি করবার কথা ছিল ৷ কেননা, সেখানা জাহাজে করে বিদেশে যাবে ৷ তাই স্টুডিওতে সারাদিন কাজ করে ছবিখানা যখন শেষ করলাম, তখন সন্ধে উৎরে গেছে ৷ সারাদিন একনাগারে চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা কাজ করে ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে পড়েছিল ৷ সেদিন তুমিও আসোনি প্রতুল ৷ খানিকক্ষণ গল্প করে কাটাবারও সময় ছিল না তখন ৷ ভাবলাম, আজ সকাল-সকাল বিশ্রাম নেব ৷ ক্লান্তিতে বাড়ি ফেরারও উৎসাহ ছিল না— যদিও বাড়ি আমার স্টুডিও থেকে আধ মাইল দূরে ৷ নেপালি চাকরটাকে এক কাপ কফি আর দু’টুকরো রুটি দিতে বলে রাত্তিরের মতো তাকে ছুটি দিয়ে দিলাম ৷ স্টুডিওর চাবি আমাকে দিয়ে সে তার ঘরে চলে গেল ৷ তুমি জানো, এ হলটার পশ্চিম দিকে যে ছোট ঘরখানা, সেখানে একখানা লোহার খাটে আমার বিছানা সবসময় পাতা থাকে— কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে ৷ কফি আর রুটি খেয়ে কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইলাম ৷ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, ঘুম ভেঙে গেল দেবদারুর শাখায় শাখায় ঝড়ো হাওয়া আর কাতরানির শব্দে ৷ বাইরে শীতের রাত ঘন কুয়াশায় ঠিক এমনি থমথম করছে ৷
ঘুম ভেঙে যেতে ইচ্ছে হল, পোর্ট্রেটটাকে একবার ভালো করে দেখি, যদি আর এক-আধটুকু তুলির টান দরকার হয় ৷ আমার শোবার ঘরের মোটা পর্দা ঠেলে এই হলের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম ৷ হলের ঝোলানো বাতিটা তখনও জ্বলছিল— বোধ হয় নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম ৷ সেই আলোয় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম— আলোর সামনে হলের মাঝখানে পোর্ট্রেটটা ইজেলের ওপর দাঁড় করানো ৷ আর তারই সামনে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে ৷ ঘন নীল রঙের সিল্কের পোশাক তার পরনে ৷ শুধু অনাবৃত কাঁধ দুটি শঙ্খের মতো সাদা ৷ মসৃণ কালো চুলগুলি কাঁধ পেরিয়ে আর নীচে নামেনি ৷ বোঝা গেল, এদেশের মেয়ে নয়— বিদেশিনী ৷ পাশের সোফায় মেয়েদের একটা টুপি আর ফার-কোট পড়ে আছে ৷ জীবনে এতখানি আশ্চর্য আর আমি কখনও হইনি ৷ রাত তখন কত কে জানে! এত রাতে এই নির্জন স্টুডিওর মধ্যে অচেনা বিদেশিনী মেয়েটি এল কেমন করে? কেনই বা এল? একি স্বপ্ন, না সত্যি, না ভৌতিক ব্যাপার! আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল— কে?
মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে ছবি দেখছিল ৷ আমার গলার আওয়াজে চমকিয়ে ফিরে তাকাল ৷ আশ্চর্য— ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেলাম ৷ মনে হল, পোর্ট্রেট থেকে জ্যান্ত হয়ে নেমে মেয়েটি যেন হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ৷ আজ সাতদিন এই চেহারাই তো আমি রং আর তুলি দিয়ে এঁকেছি ৷ সেই সবুজাভ চোখের তারা, সেই ঈষৎ স্ফুরিত রক্তবর্ণ ওষ্ঠ, সেই পানের মতো মুখের গঠন— পোশাকটার সঙ্গে ছবিটাও হুবহু মিলে যাচ্ছে, পা পর্যন্ত ঝোলানো কাঁধকাটা গাঢ় নীল রঙের সিল্কের পোশাক— ছবি কি কখনও জীবন্ত হয়? না আমার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে? মনে করে দেখলাম, না, অন্যদিনের মতো আমি তো আজ হুইস্কি খাইনি! তবে— তবে এ কী দেখছি?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেয়েটি কুণ্ঠিত স্বরে বললে, ক্ষমা করবেন ৷ আমি না বলে ছবিখানা দেখছিলুম ৷ যদিও আমার এই ছবিখানা আঁকবার ফরমাস আমিই দিয়েছি ৷ তবু— চিত্রকরের দেখা পেলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিতাম ৷
তার প্রয়োজন হবে না ৷ ছবির মালিকের ছবি দেখবার নিশ্চয়ই অধিকার আছে ৷ — আমি জানালাম ৷
মেয়েটির ঈষৎ স্ফুরিত ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েকটি কুন্দদন্ত দেখা গেল ৷ বললে, অনেক ধন্যবাদ ৷
আমি বললাম, আপনিই তাহলে বারবারা স্মিথ? নিজে এসে সিটিং না দিয়ে পোর্ট্রেট আঁকবার জন্যে ফোটোগ্রাফার পাঠিয়েছিলেন কেন জানতে পারি কি?
আমি এক মার্চেন্ট অফিসে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করি ৷ আসবার সময় পাই না ৷ কিন্তু আমার বরাবর ইচ্ছে ছিল এখানে আসবার, চিত্রকরের সঙ্গে দেখা করবার ৷— বারবারার দুই চোখে আগ্রহ ফুটে উঠল ৷
বললাম, তার সময় কি এই? এই অন্ধকার ঝোড়ো শীতের রাত; আপনি একা শহরের বাইরে এতদূরে এলেন কী করে? কে-ই বা আপনাকে দরজা খুলে দিলে?
বারবারা বললে, অনেক খুঁজে আমায় আসতে হয়েছে, এসে দেখলাম দরজা খোলাই আছে ৷ ভেতরে ঢুকে দু-তিনবার ডাকলাম, কোনো সাড়া পেলাম না ৷ তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবিখানা দেখছিলাম— তখন আপনি এলেন ৷
বারবারা কি সত্য কথা বলছে? এতরাত্রে স্টুডিওর দরজা খোলা ছিল? তাই হবে ৷ টেবিলের ওপর ওই তো চাবি পড়ে আছে ৷ বন্ধ করতে আমি নিশ্চয় ভুলে গেছলাম ৷
বারবারা বলতে লাগল, কাল আমি সানফ্রান্সিসকো চলে যাব ৷ কাল হয়তো আসবার সময় হবে না, তাই এলাম আজকে ৷ রাত অবশ্য অনেক হয়েছে, তবু তো চিত্রকরের সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ হারাইনি ৷ কোথায় চিত্রকর? একবার দেখা হবে না?— বারবারার সাগ্রহ কণ্ঠস্বর মধুর বাজনার মতন বেজে উঠল ৷ সে-কণ্ঠস্বরে ছিল উৎসুক আশা আর গভীর শ্রদ্ধা ৷
চিত্রকরের সঙ্গে আজ দেখা হবে না? বারবারা আবার জিজ্ঞাসা করল ৷
সংক্ষেপে বললাম, হবে ৷ আজ রাত্রেই দেখা হবে— আপনি চলে যাওযার আগেই ৷
বারবারার সবুজাভ চোখের তারায় প্রত্যাশার আনন্দ ৷ ঊর্ধ্বমুখী ফুলের মতো আমার দিকে মুখ তুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় তিনি?
বললাম, এই স্টুডিওতেই তিনি আছেন ৷
বারবারা অধীর স্বরে বলল, এই স্টুডিওতেই আছেন? আমার ভাগ্য ভালো দেখছি! চলুন— আমাকে এখুনি তাঁর কাছে নিয়ে চলুন ৷
বারবারা আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল ৷
বাধা দিয়ে বললাম, দাঁড়ান!
আমার কণ্ঠস্বরে কী ছিল জানি না, বারবারা স্তব্ধ হয়ে থেমে গেল ৷
বললাম, তার আগে একটা কথা আমার বলবার আছে ৷ আর্টিস্ট নিশীথ সেনের সঙ্গে আপনি দেখা করতে এসেছেন বটে, কিন্তু দেখা না করে ফিরে যাওয়াই ভালো ৷ যাবার সময় আপনার ছবিখানা আজই নিয়ে যেতে পারেন ৷
বারবারা কয়েক মুহূর্ত আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইল ৷ তারপর বলতে লাগল, কেন একথা বলছেন? আর্টিস্ট নিশীথ সেনের সঙ্গে দেখা না করাটাই ভালো কেন? না-না-না, তা হতে পারে না, দেখা আমি করবই ৷ তাঁর সঙ্গে দেখা না করে আমার সানফ্রান্সিককো যাওয়া হতে পারে না!
কেন বলুন তো? আপনার ছবিখানা কি মনোমতো হয়নি? কোনো ত্রুটি রয়ে গেছে?
না-না, মোটেই তা নয় ৷ এমন চমৎকার পোর্ট্রেট আমি জীবনে কখনও দেখিনি ৷ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এ আমারই ছবি! আর্টিস্টকে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ৷
বললাম, আপনার সে-কৃতজ্ঞতা আমি পৌঁছে দেব আর্টিস্টের কাছে ৷
ধন্যবাদ ৷ কিন্তু আমি বড় আগ্রহ নিয়েই এসেছি ৷
বেশ তো, আপনি ছবি ভালোবাসেন, এই স্টুডিওতে আর্টিস্টের আঁকা আরও ছবি রয়েছে ৷ এগুলো দেখে যান, আপনার আগ্রহ মিটতে পারে ৷
অধীর স্বরে বারবারা বললে, শুধু সৃষ্টিই দেখে যাব? স্রষ্টাকে দেখে যাব না?
স্রষ্টাকে দেখতে পাওয়া যায় না ৷ যেমন দেখতে পাওয়া যায় না বিধাতাকে ৷ রাত অনেক হল, আপনি ফিরে যান মিস স্মিথ ৷
নিজের কণ্ঠস্বর আমার নিজের কানেই রূঢ় লাগল; বারবারার সবুজাভ চক্ষু ম্লান হয়ে এল ৷ ধীরে ধীরে শুভ্র হাত দুটি জোড় করে বুকের কাছে তুলে ধরল ৷ তার ডান হাতের মুঠির মধ্যে ছোট্ট একখানি নীল রুমাল— নীল পদ্মের একটি কুঁড়ির মতো ৷
বারবারা বলতে লাগল, আপনি কে, তা জানি না ৷ যে-ই হোন, আপনাকে মিনতি করছি, চিত্রকরের সঙ্গে একবার দেখা করতে দিন ৷ আমি শপথ করছি, আমি তাঁর বেশি সময় নষ্ট করব না ৷ আপনি জানেন না, আমি আর্টিস্ট সেনের ছবির কতখানি অনুরাগিনী ৷ তাঁর আঁকা ছবি আমার কতখানি ভালো লাগে— তা বলে আমি বোঝাতে পারব না ৷ কলকাতা, প্যারিস, বার্লিন, রোম, পিকিং— পৃথিবীর যেখানে যেখানে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে, সব জায়গায় আমি ঘুরে এসেছি ৷ আর্টিস্ট সেন আমার কাছে দেবতা ৷ কত রাত্রে আমি তাঁর স্বপ্ন দেখি!
বারবারার চোখ-মুখের ভাব আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ৷ কেননা, তার মুখের সামনে ছিল ঝোলানো আলোটা ৷ কিন্তু আমার মুখ তার দৃষ্টির সামনে অন্ধকার অস্পষ্ট ৷ আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঝোলানো আলোটা পেছনে রেখে ৷— আমার এই আত্মগোপন যে ইচ্ছাকৃত— তা তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ প্রতুল!
বারবারা তখনও মিনতির ভঙ্গিতে বলে চলেছে, দয়া করুন— আমাকে ফিরে যেতে বলবেন না— আর্টিস্ট সেনকে, আমার স্বপ্নের দেবতাকে একবার দেখেই আমি চলে যাব ৷ আমি শপথ করছি— ৷
উত্তেজনায় বারবারার গাল দুটি রক্তাভ হয়ে উঠেছে ৷ ঘন নিশ্বাসে তার নাসারন্ধ্র, তার পীবর বক্ষ ফুলে ফুলে উঠছে ৷ বারবারা, সুন্দরী— সুতনু বারবারা বলছে, ‘আমি আর্টিস্ট সেনের অনুরাগিণী ৷ আমি তাঁর স্বপ্ন দেখি?’ মনে হল, আমি খুব দামি নেশা করেছি ৷ আর সেই নেশা আমার মাথার মধ্যে রিমঝিম করছে ৷
তবুও কণ্ঠস্বর আরও রূঢ় করে বললাম, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই স্মিথ ৷ তোমার স্বপ্নের দেবতার সঙ্গে আর্টিস্ট সেনের যদি কিছুমাত্র মিল না থাকে? যদি—যদি সে কুৎসিত হয়? যদি তার মুখের চেহারা হয় পশুর মতো, জানোয়ারের মতো কুৎসিত? তাহলে কি তুমি সহ্য করতে পারবে বারবারা? তার চেয়ে কাজ নেই দেখা করে ৷ তোমার সুন্দর স্বপ্ন, সুন্দর ধারণা নিয়ে ফিরে যাও ৷
বারবারার মুখে-চোখে সন্দেহের ছায়া দেখা দিতে না দিতেই মিলিয়ে গেল ৷ পরম বিশ্বাসের সঙ্গে মৃদু হেসে বললে, ঈশ্বরের দোহাই, মিথ্যে দিয়ে আমায় ভোলাবার চেষ্টা করবেন না ৷ তারপর চারপাশের ছবিগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, যে মানুষ এমন অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে, সে কখনও কুৎসিত হয়? অসম্ভব! মুখের চেহারা তার সুন্দর হোক বা কুৎসিত হোক, আমার কাছে সে সৌন্দর্যের দেবতা হয়েই থাকবে! ঈশ্বরের দোহাই— আপনি বিশ্বাস করুন৷ রাত বোধ করি শেষ হয়ে এল, বলুন কোথায় আর্টিস্ট সেন?
এইখানে— তোমার সামনে ৷
যেন বহুদূর থেকে আমার গলার চাপা আওয়াজ ভেসে এল ৷ ধীরে ধীরে বারবারার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ৷ নীল রুমালখানি সমেত ডান হাতখানি মুখে চাপা দিয়ে সে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে ৷ তারপর আনন্দিত বিস্ময়ে বলে উঠল, তুমি-তুমি আর্টিস্ট সেন? আলোয় এসো— আমাকে দেখা দাও!
আমার সামনে ছিল টেবিলের ওপর এই রিডিং-ল্যাম্প ৷ হাত বাড়িয়ে সেটা জ্বেলে দিলাম ৷
শীতের ঝোড়ো হাওয়া দেবদারু-শাখায়-শাখায় সহসা চিৎকার করে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ সে-চিৎকার আসলে শীতের ঝোড়ো হাওয়ার নয়— সে-চিৎকার বারবারা স্মিথের! তাকিয়ে দেখি, তার পূর্বের ঈষৎ রক্তাভ কপোল যেন ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে ৷ দেহবল্লরী ঝড়ে দীপশিখার মতো কাঁপছে ৷ আর, আধো-নিমীলিত সবুজাভ চক্ষু দুটি আমারই মুখের পানে স্থির-নিবদ্ধ হয়ে ক্রমশ বিস্ফারিত হচ্ছে! অকস্মাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠলে যেমন হয় ৷
কয়েক মুহূর্ত মৃত্যুর মতো শীতল স্তব্ধতা ৷
তারপর নীল রুমালখানি সমেত দুই হাতে চোখ ঢেকে বারবারা আতঙ্ক-বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠল, না-না-না, এ হতে পারে না— তুমি আর্টিস্ট সেন নও, কিছুতেই তুমি আর্টিস্ট হতে পারো না ৷ আর্টিস্ট যে, সে সৌন্দর্যের পূজারি— সে সুন্দরের প্রতিনিধি ৷ সে কখনও এমন হতে পারে না— এ আমি কী দেখলাম! কাকে দেখলাম ৷ কাকে দেখলাম!
গলা দিয়ে আমার প্রত্যুত্তর বেরিয়ে এল, তুমি আর্টিস্ট সেনকে দেখেছ— তুমি যার অনুরাগিনী— তুমি যার স্বপ্ন দেখ, যে তোমার কাছে দেবতা…
কিন্তু—কিন্তু এত কুৎসিত মানুষ হয়?— ধীরে ধীরে বারবারা চোখ থেকে হাত নামাল ৷ তার আঙুলগুলো ছোট ছোট প্রদীপের শিখার মতো তখনও কাঁপছে ৷
বললাম, তার আগে বলো তো বারবারা, যে মানুষ এত সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে, তার দৈহিক আকৃতি যেমনই হোক না কেন, তাকে কি তুমি কুৎসিত বলবে? বলো— এ প্রশ্ন একটু আগে তুমিই করেছিলে— তুমিই এর জবাব দাও ৷
কোনো জবাব এল না ৷ বারবারার পাণ্ডুর মুখখানি সন্ধ্যার পদ্মের মতো ধীরে ধীরে নত হল ৷
কেমন যেন একটা চাপা আবেগ আমার মধ্যে দুরন্ত উচ্ছ্বাসে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল ৷ যে-কথা কোনোদিন কাউকে জানাইনি, যে-কথা গোপনে একদিন আমার তপ্ত যৌবনের রক্তের মধ্যে গুমরে বেড়াচ্ছিল, সেই কথা আজ ঝোড়ো শীত-রাত্রির অদ্ভুত অবাস্তব পরিবেশের মাঝে আমার মুখ দিয়ে অনর্গল জল-কল্লোলের মতো বেরিয়ে আসতে চাইল ৷ আমি বলতে লাগলাম, আমি জানি বারবারা, আমায় দেখে তুমি ভয় পেয়েছ— মনে মনে পেয়েছ প্রচণ্ড আঘাত ৷ কিন্তু আমি কি তোমাকে আগেই বলিনি যে, তুমি ফিরে যাও? বলি নি কি, আমায় দেখলে তোমার ধারণা, তোমার স্বপ্ন নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? তবু কেন তুমি দেখতে চাইলে? কেন তোমার সুন্দর স্বপ্ন— সুন্দর ধারণা নিয়ে এমনিই ফিরে গেলে না? বারবার নিষেধ সত্বেও কেন তুমি আমাকে দেখতে চাইলে? কেন— কেন? শুধু বুকজোড়া ঘৃণা আর অবহেলা দিয়ে ফিরে যাবে বলে? কিন্তু কী আমার অপরাধ বলতে পারো বারবারা যে, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েদের কাছে শুধু ঘৃণা আর উপেক্ষার পাত্র হয়ে থাকব? পশুর মতো আমার এই আকৃতির জন্যে আমি তো দায়ী নই? দায়ী সেই বিধাতা, যে নিষ্ঠুর খেয়ালের বশে আমাকে এমনি কদাকার করে গড়েছে— আমার ভিক্ষার অঞ্জলিতে যে কৃপণ বিধাতা রূপের একটি কণাও দান করেননি!
বলতে বলতে নিষ্ফল অভিমানের তপ্ত অশ্রুধারা কখন যে আমার গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসেছে, আমি তা টের পাইনি ৷ বারবারা সহসা মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কাঁদছেন?
বারবারার আতঙ্ক-পাণ্ডুর মুখ সহানুভূতিতে কোমল হয়ে এল ৷ লক্ষ করলাম, পুরুষের অশ্রু নারীর অন্তর আজও স্পর্শ করে ৷ বারবারা থেমে থেমে কোমল গলায় বলতে লাগল, আমি-আমি ক্ষমা চাইছি ৷ তোমাকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু বিশ্বাস করো, ঘৃণা আমি তোমাকে করিনি ৷ যে শ্রদ্ধা, যে অনুরাগ নিয়ে আমি এসেছিলাম, এখনও আমি তা হারাইনি ৷
কিন্তু সে-শ্রদ্ধা, যে-অনুরাগ কার প্রতি?— প্রশ্ন করলাম?
তোমার প্রতি— ঈশ্বরের দোহাই বলছি—
চুপ করো! ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মিথ্যে কথা বোলো না বারবারা ৷— আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে যেমন করে লাভাস্রোত বেরিয়ে আসে, তেমনি করে আমার এতদিনের রুদ্ধ জ্বালামুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আমি জানি— আমি জানি বারবারা, তোমার অনুরাগ, তোমার শ্রদ্ধা আমার জন্যে নয়— আর্টিস্ট সেনের জন্যে, যে তোমার পোর্ট্রেট এঁকেছে, দেশ-বিদেশের প্রদর্শনীতে যে বহু পুরস্কার পেয়েছে ৷ তারই জন্যে তোমার মতো সুন্দরীর অনুরাগ— তারই জন্যে শীতের এই দুর্যোগ-রাত্রেও তোমার অভিসার! তাই নয় কি? আমি বুঝতে পেরেছি বারবারা, আর্টিস্ট সেনকে না দেখেই তুমি ভালোবেসেছ ৷ আর এ-ও তুমি জেনে রাখো, ঠিক এই কারণেই আর্টিস্ট সেনকে আমি হিংসা করি— আমি তাকে ঘৃণা করি— ভয়ানক ঘৃণা করি ৷ আর্টিস্ট সেন আমার শত্রু— পরম শত্রু ৷ আমাকে সে চিরদিন বঞ্চিত করেছে— সুন্দরী নারীর সঙ্গ থেকে, যৌবনের কামনা থেকে, বহু অনুরাগিনীর ভালোবাসার থেকে ৷ যা আমার হতে পারত, তা হরণ করে নিয়েছে ওই আর্টিস্ট সেন! আর্টিস্ট সেন যদি দ্বিতীয় কোনো পুরুষ হত বারবারা, আমি শপথ করে বলছি, আজ এই মুহূর্তে তাকে আমি দুই হাত দিয়ে গলা টিপে খুন করে ফেলতাম!
আতঙ্কিত বারবারা অস্ফুট আওয়াজ করে এক পা পিছিয়ে গেল ৷ আর সেই সময় হু-হু শব্দে শীতের ঝোড়ো হাওয়া খোলা জানলা-পথে ঢুকে এল ঘরের মধ্যে ৷ দুলতে লাগল ঝোলানো বাতিটা, সজীব হয়ে উঠল হলের দেওয়ালে-দেওয়ালে বিচিত্র সব ছায়ামূর্তি—আমাদেরই দীর্ঘ ছায়ামূর্তি ৷
আতঙ্ক বিবশা বারবারা বলতে লাগল, একী বলছ তুমি?… আমি আর শুনতে পারছি না! রাত শেষ হয়ে এল, কাল ভোরে আমার জাহাজ ছাড়বে— আমায় যেতে দাও— আমি যাই—
ত্রস্ত ব্যাকুল হাতে বারবারা তার টুপি আর ফার-কোট তুলে নিল ৷ তারপর ‘শুভ্ররাত্রি’ বলে দরজার দিকে এগোল৷
দাঁড়াও! —আমার গলা দিয়ে যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে এল ৷
যন্ত্রচালিতের মতন বারবারা ফিরে দাঁড়াল ৷
টেবিলের ওপর থেকে দরজার চাবিটা তুলে নিলাম ৷ তারপর তাকে পার হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম, রাত্রি আজ শুভ নয় বারবারা— তোমার পক্ষে নয়, আমার পক্ষেও নয় ৷
বারবারা যেন কান্নায় ভেঙে পড়ল,— না, না, ওকথা বোলো না ৷ তারপর কম্পিত হাত কপালে-বুকে ঠেকিয়ে ক্রশ-চিহ্ন আঁকতে আঁকতে বললে, আমি যাই—আমি যাই—
দরজায় পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে দুই পাশে দুই হাত প্রসারিত করে বললাম, কোথায় যাবে? যাওয়া আজ তোমার হবে না বারবারা ৷
বিস্ফারিত দুই চোখে তাকিয়ে বারবারা বলে উঠল, হবে না! সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ জেটিতে অপেক্ষা করছে যে!
তুমি না গেলেও সে-জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়বে— আর ঠিক সময়েই সানফ্রান্সিসকোয় পৌঁছে যাবে ৷ বৃথা চিন্তিত হোয়ো না বারবারা ৷
অকস্মাৎ উৎকট একটা চাপা হাসি আমার গলা দিয়ে যেন ফেটে বেরিয়ে এল ৷ সে-হাসি হলের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে, ঝড়ের গোঙানির সঙ্গে মিশে ঘরময় ঘুরপাক খেতে লাগল ৷ সেই বিশ্রী ভয়াবহ আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে বারবারা দুই হাতে কান চেপে ধরল ৷ তারপর ভীত কাতর স্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঈশ্বরের দোহাই, চুপ করো— তুমি চুপ করো ৷ যেতে দাও— আমায় যেতে দাও— তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি—
নীল রুমাল সমেত হাত দুটি জোড় করে বারবারা আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল ৷
আমি তার দিকে এক-পা এগিয়ে এলাম ৷ বললাম, ভিক্ষা পেতে হলে আগে ভিক্ষা দিতে হয় বারবারা ৷ আমিও কাঙালের মতো তোমার মুখের পানে তাকিয়ে আছি, তোমার ভালোবাসার প্রসাদে কখন আমার অঞ্জলি তুমি ভরে দেবে, সেই আশায় ৷
কেন তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না?—বারবারা সঘন নিশ্বাসে যেন হাঁপিয়ে উঠল ৷— আর্টিস্ট সেনকে আমি মনে মনে যা দিয়েছি, সে কি তোমারই উদ্দেশে দেওয়া নয়?
না—না—না, সে তুমি আমাকে দাওনি বারবারা ৷ সে তুমি দিয়েছ তোমার স্বপ্নের সুন্দরকে—আমার মতো কুৎসিত পুরুষকে নয় ৷ কিন্তু কুৎসিত হলেও আমিও কি পুরুষ নই—যে পুরুষ যুগে যুগে সুন্দরী নারীকে আপন অন্তরের সিংহাসনে রানির মতো নিরুপমা করে বসিয়ে রেখেছে? আমারও জীবনে কি সেই সাধ, সেই আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে না বারবারা? আমারও কি ভালোবাসবার আর ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা নেই মনে করো? কুৎসিত পশুও ভালোবাসতে পারে, আর কুৎসিত মানুষ পারে না?
সঘন নিশ্বাসের সঙ্গে বারবারা শুধু এই কথাই বলতে লাগল, যেতে দাও—আমাকে যেতে দাও—
তার মুখের পানে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, প্রাণপণ চেষ্টায় সে উগরে-ওঠা ঘৃণাকে দমন করতে চাইছে—যাতে আমি টের না পাই ৷ তবু সেই ঘৃণা—কুৎসিতের প্রতি তিক্ত ঘৃণা তার সবুজাভ চোখের তারায়, মুখের প্রত্যেকটি পেশিকুঞ্চন থেকে কালো বিষের মতো ঝরে পড়ছে ৷ চকিতে নিজের চেহারাটা যেন অদৃশ্য আর্শিতে দেখতে পেলাম ৷ দেখতে পেলাম গরিলার মতো মুখাকৃতি, থ্যাবড়া নাক আর বিশ্রী পুরু ঠোঁট ৷ অকস্মাৎ মনে হল, একটি বারবারা যেন শত শত সুন্দরী বারবারা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তিক্ত ঘৃণাভরে উপেক্ষার হাসি হাসছে ৷ আর দেখতে দেখতে তাদের সেই সমবেত কণ্ঠের তীক্ষ্ণ খলখল অট্টহাসি, তিক্ত ঘৃণার কুটিল ভ্রুভঙ্গি, তিক্ত বিষের ক্রিয়ার মতো আমার সর্বাঙ্গে আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিল ৷
আমি বলতে লাগলাম—আমার নিজের কানেই আমার আওয়াজ অজগরের হিসহিস শব্দের মতো শোনাতে লাগল : শোনো বারবারা, রাত আর অল্পই বাকি আছে, তবু আজ রাত্রে তোমার যাওয়া হতে পারে না! যেতে যদি হয়, আমার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে ৷
বারবারা তার ফার-কোটের পকেট থেকে একটা নোট-কেস বার করলে ৷
বাধা দিয়ে বললাম, থামো! আজ রাতে তোমার কাছে আমার যা পাওনা, তা টাকা দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া যায় না ৷ পাওনা মেটাতে হলে তোমায় নিজেকে দিতে হবে ৷
এবার দলিতা সাপিনীর মতো মাথা উঁচু করে বারবারা বলে উঠল, কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি ৷—বাধা দিয়ে তাকে থামিয়ে বললাম, মিথ্যে হলেও আজ তোমাকে বলে যেতে হবে, তুমি আমারই অনুরাগিনী ৷ থাক তোমার স্বপ্নের আর্টিস্ট সেন তোমার অনুরাগ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়ে, ওসব ভালো ভালো জিনিসের ওপর আর লোভ করব না বারবারা ৷ শুধু জেনে রাখো, আজ রাতে আমি আর্টিস্ট নই, আমি গুণী নই, আমি শুধু পুরুষ—চিরন্তন পুরুষ—আমার প্রেম, আমার পৌরুষকে তুমি অস্বীকার করে যেতে পারবে না ৷
পঙ্গুর মতো বারবারা আস্তে আস্তে সোফার ওপর বসে পড়ল ৷
সেই দিকে তাকিয়ে কেমন একটা অস্থির উল্লাসে আমি বলে যেতে লাগলাম, সারাজীবন বঞ্চিত থাকার পর ভাগ্য আজ তোমাকে এনে দিয়েছে বারবারা ৷ এ সুযোগ আমি ছাড়ব না! আমার জীবনে এ সুযোগ হয়তো এই প্রথম—হয়তো এই শেষ ৷
পাথরের মতো ভাবলেশহীন চোখে বারবারা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ৷ চোখে পলক পড়ছে না, দেহ স্থির ৷ যেন মৃতদেহ কথা কইছে, এমনি করে শুধু ঠোঁট নেড়ে বারবারা হঠাৎ বলে উঠল, ভাগ্য যদি আমায় এনে দিয়ে থাকে, তবে আজ ভাগ্য-পরীক্ষা করো ৷
ভাগ্য-পরীক্ষা ৷
হ্যাঁ, যদি তোমার জিৎ হয়, তোমার প্রাপ্য তুমি পাবে ৷
জিজ্ঞাসা করলাম, আর যদি আমি হারি?
জবাব এল, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আমার পথ থেকে চিরদিনের মতো তুমি সরে যাবে ৷—রাজি আছ ভাগ্য-পরীক্ষায়?
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলাম ৷ ভাগ্যের জুয়াখেলায় কী হবে আমার? হার না জিৎ? … হার না জিৎ? … হার না জিৎ? কেমন যেন একটা নেশা আমায় পেয়ে বসল ৷ যদি জিৎ হয়, তবে আমার পুরস্কার ওই সুন্দরী — বারবারা—সুতনু, সুমধ্যমা, সুদীপ্তযৌবনা ৷ আমার নিঃসঙ্গ জীবনের, আমার বঞ্চিত জীবনের—
কিন্তু ভাগ্যের পাশাখেলায় মন্দভাগ্য পাণ্ডবদের মতো যদি আমার হার হয়? না, না, হার হবে কেন? হার হবে না—আমার হার হতে পারে না ৷ … বারবার আমার মনে হতে লাগল, আমার জিৎ হবেই—আমার জিৎ হবেই! আবার মনটা দুলে উঠল—যদি জিৎ না হয়, যদি শেষ পর্যন্ত হেরে যাই? বারবারার পথ থেকে চিরদিনের মতো আমাকে সরে যেতে হবে? মুহূর্তে শরীরের সমস্ত রক্তস্রোত যেন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেল ৷ মধুর সুধার পাত্র মুখের কাছে এগিয়ে ধরে ভাগ্য আবার তা কেড়ে নেবে? না, তা হতে পারে না ৷ কেড়ে নিতে আমি দেব না ৷ বারবার আমার মন, আমার যৌবনের সমগ্র চেতনা যেন লক্ষ করতাল বাজিয়ে বলতে লাগল, এ খেলায় জিৎ আমার হবেই ৷ ক্রমশ সেই নেশাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার শিরা-স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ৷
রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে উঠলাম, রাজি আছি—আমি রাজি আছি ৷
বারবারার সবুজাভ চোখের তারা দুটি হীরার টুকরোর মতো ঝকঝক করে উঠল ৷ দেখতে দেখতে তার আইভরির মতো পাণ্ডুর মুখ রক্তোচ্ছ্বাসে রাঙা হয়ে উঠল ৷ কতকটা স্বগতোক্তির মতোই সে বলে উঠল, রাজি আছো! বেশ, তাহলে শুরু হোক আমাদের ভাগ্যপরীক্ষা ৷ তাস আছে?
আছে ৷
আনো ৷
এক মুহূর্ত চিন্তা করে স্টুডিয়োর দরজায় চাবি দিলাম ৷ তারপর পাশের ছোট ঘর থেকে তাস আনতে গেলাম ৷ তুমি তো জানো প্রতুল, অবসর যাপনের জন্যে একজোড়া তাস আমার স্টুডিয়োতে এনে রেখেছি ৷ কতদিন সন্ধ্যায় তুমি আসোনি, একা একা পেশেন্স খেলে কাটিয়েছি ৷
পাইপ মুখে বসে বসে প্রতুল এতক্ষণ নিঃশব্দে স্বপ্ন-কাহিনি শুনে যাচ্ছিল ৷ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মুখখানা তার অস্পষ্ট হয়ে গেছে ৷ সেই ধূম্রজালের আড়াল থেকে আওয়াজ ভেসে এল, হুঁ, তারপর?
নিশীথ আবার শুরু করলে:
তারপর এই টেবিলের মুখোমুখি বসলাম দুজনে ৷ শুরু হল ভাগ্যের জুয়াখেলা ৷ তাসগুলো বারবারা উল্টো করে আমার সামনে বিছিয়ে দিল ৷ তারপর নিজের একখানা টেনে নিয়ে আমাকে বললে, নাও ৷
টেনে নিলাম একখানা তাস—রুইতনের সাহেব ৷ বারবারা তার হাতের তাসখানা দেখাল—ইস্কাবনের নওলা ৷ বললে, তুমি ‘ডিল’ করো ৷
জিজ্ঞাসা করলাম, ক’দান খেলতে চাও?
বারবারা বললে, তিন দানই যথেষ্ট ৷
প্রথমবার আমি ‘ডিল’ করলাম ৷ একখানা করে তিনবার ৷ বারবারা তার তাসগুলি টেবিলের ওপর চিত করে মেলে ধরল ৷ হরতন আর চিড়েতনের টেক্কা, আর রুইতনের বিবি ৷
এবার আমার পালা ৷ উপুড় করা তিনখানা তাস তুলতে গিয়ে আমার আঙুলগুলো একবার কেঁপে উঠল ৷ এ তিনখানা তাসের উল্টো পিঠে আমার ভাগ্যের কী ফলাফল লেখা আছে, কে জানে!
এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইলাম ৷
বারবারা বললে, তোমার তাস দেখাও ৷
আঙুলে যেন জোর করে শক্তি এনে আমার তাস তিনখানা উল্টে দিলাম ৷ ইস্কাবনের আট-নয়-দশ!
উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম, দান আমার!
বারবারার মুখ আবার বিবর্ণ হয়ে এল ৷ অস্বাভাবিক শান্ত গলায় সে শুধু বললে, দ্বিতীয় দানের তাস দাও ৷
বাহান্নখানা তাস ভেঁজে দ্বিতীয়বার তাস দিলাম ৷ বারবারা এবার তার তাস তিনখানা স্পর্শ করে বিড় বিড় করে কী যেন বললে ৷ তারপর ধীরে, অতি ধীরে একখানা করে তাস উল্টে ধরল ৷ তিনখানা বিবি—ইস্কাবন, রুইতন আর হরতন ৷ তারপর আমার দিকে তাকাল ৷
এক নিমেষে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল ৷ বললাম, ভাগ্য এবার তোমার প্রতি কৃপা করেছে দেখছি ৷ বিবির ট্রায়ো তুলেছ ৷ কিন্তু আমিও যদি সাহেবের ট্রায়ো তুলি?
বটে! তোমার ভাগ্য আরও ভালো বলব ৷—বারবারার ওষ্ঠ প্রান্তে সুতীক্ষ্ণ একটু হাসি দেখা দিল ৷ সে কি তিক্ত ব্যঙ্গ?
আমার তাস তিনখানা তুলে সশব্দে টেবিলের ওপর মেলে ধরলাম ৷ না, সাহেবের ট্রায়ো নয় ৷ সাহেব মাত্র একখানা, বাকি দু’খানা পাঁচ আর চার ৷ এবারের দান আমার নয়—বারবারার ৷
সমস্ত তাসগুলো কুড়োতে কুড়োতে অত্যন্ত শান্ত গলায় বারবারা বললে, তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, সেন ৷
মাথার ভেতরটা আমার দপ দপ করে উঠল ৷ উত্তপ্ত রূঢ় গলায় বললাম, চুপ করো! আমার জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার ৷
বারবারার ওষ্ঠপ্রান্তে সেই সুতীক্ষ্ণ হাসি আবার ঝিলিক দিয়ে উঠল ৷ তাসগুলো ভাঁজতে ভাঁজতে আরও শান্ত গলায় সে শুধু বললে, এবার শেষ বাজির খেলা ৷
সহসা লক্ষ মৌমাছির একটানা গুঞ্জনের মতো কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ক্রমাগত বাজতে লাগল: ‘শেষ বাজির খেলা!’ ‘শেষ বাজির খেলা!’ শেষ বাজি কার? আমার না বারবারার? শরীরের সমস্ত রক্ত উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠতে লাগল ৷
এক, দুই, তিন—বারবারার তাস দেওয়া হয়ে গেল ৷ আগের মতোই সে তাসগুলি স্পর্শ করে মুদিত চক্ষে বিড় বিড় করে কী যেন বললে ৷ তারপর তাস তিনখানা উল্টে দিল ৷ সেই দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দুটো পাথরের মূর্তির চোখের মতো পলকহীন হয়ে গেল ৷ বারবারা যে দান তুলেছে, তার চেয়ে বড় দান আর হয় না ৷ তুলেছে তিনখানা টেক্কা—ইস্কাবন, হরতন, আর চিড়েতনের ৷
এক মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ শেষ পর্যন্ত এই হল? শেষ বাজির খেলায় ভাগ্য আমাকেই ছলনা করল?
তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বারবারার শান্ত-কঠিন কণ্ঠস্বর আমার কানে এসে বিঁধল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ বাজি আমারই ৷
অন্ধ আক্রোশে আমার তাসগুলো তুলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম ৷ কিন্তু একী!— আমার বরফের মতো ঠান্ডা থেমে-যাওয়া হৃৎপিণ্ড হঠাৎ যেন তপ্ত রক্তস্রোতে ফের খরবেগে চলতে শুরু করল ৷
সেই শাণিত ব্যঙ্গের হাসি হেসে বারবারা বলে উঠল, তোমার তাসগুলো অনর্থক দেখে লাভ কী, সেন? তিনখানা টেক্কার চেয়ে বড় দান আর হয় না—আশা করি, তা তোমার জানা আছে ৷ ভাগ্যের এই ঠাট্টাটুকু সহজভাবে নিতে চেষ্টা করো, সেন ৷
ফার-কোট আর টুপি নিয়ে বারবারা উঠতে যাচ্ছিল ৷ বললাম, বসো ৷ ভাগ্য আমাকে ঠাট্টা করেনি, করেছে তোমাকে ৷
বারবারা জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল ৷ আমার হাতের তাসগুলো গুনে দেখলাম ৷ এক, দুই, তিন, চার ৷
এবারে হাসবার পালা আমার ৷ বললাম, শেষ বাজির খেলাটা আসলে খেলাই হয়নি ৷ উত্তেজনায় তাস তোমার দিতে ভুল হয়েছে বারবারা ৷ তিনখানার বদলে আমাকে চারখানা দিয়ে ফেলেছ ৷ সুতরাং এবারের খেলা নাকচ ৷—তারপর আমার কুৎসিত মুখে বীভৎস হাসি ফুটিয়ে থেমে থেমে বললাম, ভাগ্যের এই ঠাট্টাটুকু সহজভাবেই নিতে চেষ্টা করো সুন্দরী বারবারা!
বারবারার মুখ দেখতে দেখতে সাদা হয়ে গেল ৷ প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সামলে নিয়ে সে শুধু বললে, বেশ, আবার নতুন করে খেলা শুরু হোক ৷
ঝড়ে যেমন দেবদারুর কচি শাখা কাঁপে, তেমনি কম্পিত হাত বাড়িয়ে বারবারা তাসগুলো কুড়িয়ে নিতে গেল ৷ কিন্তু তার আগেই আমার কালো কর্কশ মুঠির মধ্যে তার হাতখানা ধরে ফেলে বললাম, না, আর খেলা হবে না ৷
বারবারার মুখ-চোখ, সমস্ত দেহ পলকের মধ্যে আড়ষ্ট হয়ে উঠল ৷ কঠিন কণ্ঠে সে বললে, শেষ খেলা খেলতেই হবে সেন, নইলে ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না ৷
বললাম, তার আগে আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করো বারবারা ৷
হাত ছাড়ো—তাস দিতে দাও—
না ৷
হাত ছেড়ে দাও বলছি—
না—না—না!
ঘরের ভেতর পুরুষ ও নারীর এই চিরন্তন দ্বন্দ্বের মাঝখানে বাইরের ঝড়ের বেগ কখন যে বেড়ে উঠেছিল, খেয়াল করিনি ৷ হঠাৎ হু-হু করে ক্ষুব্ধ আত্মার আক্ষেপের মতো শীতল দমকা হাওয়ার ঝলক খোলা জানলা-পথে এসে টেবিলের ওপর থেকে তাসগুলোকে এক ফুঁয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে গেল ৷ প্রবলভাবে দুলতে লাগল ঝোলানো বাতিটা, আর বিচিত্র ঢেউয়ে প্রকাণ্ড হলটা যেন প্রেতরাজ্যের গুহার রূপ ধারণ করল ৷
সঘন নিশ্বাসে বারবারার পীবর বক্ষ, দুই নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠছে ৷ চোখের তারায় শিহরিত আতঙ্ক আর তিক্ত ঘৃণায় মেশানো অদ্ভুত দৃষ্টি ৷ আর আমার মনে হতে লাগল, কোনো এক তীব্র উত্তেজক ওষুধের প্রতিক্রিয়ার ফলে আমার প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ৷ ডাঃ জেকিল যেন মিঃ হাইডে পরিণত হচ্ছে ৷
কী চাও তুমি?—দম নিয়ে বারবারা জিজ্ঞাসা করল ৷
কালো কর্কশ মুঠির মধ্যে ধরা সুন্দর মসৃণ হাতখানা আকর্ষণ করতেই, টেবিল পার হয়ে আচমকা বারবারা আমার বুকের ওপর এসে পড়ল—একরাশ পপি ফুলের স্তবকের মতো ৷ তেমনি সুরভিত, তেমনি মদির, তেমনি মোহময় ৷ ললিতযৌবনা নারীদেহের চক্ষে, অধরে, মোহময় রূপে আর মায়াময় স্পর্শে চিরকালের যে বিচিত্র ইন্দ্রজাল, তার নেশায় আমার বন্য বর্বর যৌবন মাতাল হয়ে উঠল ৷ আর সেই নেশা আকণ্ঠ পান করে মিঃ হাইড অপরূপযৌবনা বারবারার কানে কানে বলতে লাগল, কী চাই? তুমি কি জানো না বারবারা, তোমার কাছে আমি কী চাই? চাই তোমার এতটুকু ভালোবাসা, করুণা আর কোমল দৃষ্টি—পরিণামে যদি তোমার রূপের আগুনে লোভী পতঙ্গের মতো আমি নিঃশেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাই, তবুও—
বারবারার সবুজাভ চোখের তারায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল ৷ প্রবল বিতৃষ্ণায় তার মুখের পেশিগুলো কুঁচকে গেছে ৷ হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে সে বলে উঠল, তোমার কি নরকের ভয় নেই?
বিশ্রী বীভৎস একটা হাসির আওয়াজ আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ৷ বললাম, তুমি যদি নরক হও বারবারা, তবে সে আমার স্বর্গের চেয়েও—
কথা আমার শেষ হল না ৷ তার আগেই আমার মুখময় থুতু ছিটিয়ে এক ঝটকায় নিজেকে টেনে নিয়ে বারবারা দূরে সরে গেল ৷
তারপর—
তারপর শুরু হল শিকারি আর শিকারে দ্বন্দ্বের খেলা ৷ এধার থেকে ওধার, এ- কোণ থেকে ও-কোণ ৷ কেবলই ধরতে চাওয়া—আর এড়িয়ে যাওয়া ৷ একজনের আক্রমণ, আর একজনের আত্মরক্ষা ৷ উল্টে গেল সোফা, ভেঙে পড়ল টেবিল, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কত মূর্তি আর ছবি ৷ একটা চীনে ফুলদানীর টুকরো লেগে রক্তাক্ত হল আমার কপাল, আর নখের আঘাতে বারবারার ছিঁড়ল নীল বক্ষবাস ৷ কনকনে শীতের রাত্রেও কপালে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সঘন নিশ্বাসে দম যেন প্রতি মুহূর্তে ফুরিয়ে আসছে ৷ শিকারি আর শিকারের এ খেলা যেন কোনোদিনও আর শেষ হবে না!
ঝড়ের বেগ ক্রমশ বাড়ছে ৷ বিপুল আক্ষেপে দেবদারুর শাখাগুলি যেন বুক চাপড়ে উঠছে ৷ ঝোলানো বাতিটা বিষম দোলায় এবার বুঝি ছিঁড়ে পড়বে ৷
বিপর্যস্ত পরিশ্রান্ত বারবারা তখন হলের ডান দিকের কোণে একটা ভাঙা মূর্তি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ ডান হাতে সেই নীল রুমালখানি দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে, বাঁ-হাতে ছিন্ন বক্ষবাস ধরা ৷ যেন ঝড়ে ছিন্নপাখা একটি শ্বেত-কপোতী ত্রস্ত হয়ে ঘরের কোনায় আশ্রয় নিয়েছে ৷ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপ যেন মহাকালের অত্যাচার সহ্য করেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷
ক্লান্ত করুণ ভঙ্গিতে বারবারা দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা মূর্তিটার পাশে ৷ দেখে মনে হল, এই প্রাচীন গির্জার মধ্যে কোনো তপস্বিনী শেষ প্রার্থনার মতো তার শেষ মোমের বাতিটি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে!
দেখতে দেখতে আমার মধ্যে সেই তীব্র উত্তেজক মাদকতার প্রভাব ফুরিয়ে আসতে লাগল ৷ শুরু হয়ে গেল তার উল্টো প্রতিক্রিয়া ৷ মরে গেল বর্বরযৌবন পশুপ্রবৃত্তি হাইড, আবার বেঁচে উঠল আর্টিস্ট সেন—সুন্দরের উপাসক, শিল্পী! ভুলে গেলাম সব ৷ ভুলে গেলাম এতক্ষণের দ্বন্দ্ব, কিছুক্ষণ আগেকার সেই নরকের আবহাওয়া ৷ আমার নির্নিমেষ চোখের সম্মুখ থেকে ক্রমশ মুছে গেল পৃথিবীর যা কিছু কুৎসিত, যা কিছু অসুন্দর— জেগে রইল শুধু হলের কোণে ভাঙা মূর্তির পাশে পরিশ্রান্ত বিপর্যস্ত রূপসি বারবারার অপূর্ব করুণ ভঙ্গিমা, ক্যানভাস আর রং-তুলি ৷ পাগলের মতো একখানা নতুন ক্যানভাস ইজেলের ওপর টাঙিয়ে ক্ষিপ্র হস্তে স্কেচ করতে করতে আমি বলে উঠলাম, ঈশ্বরের দোহাই বারবারা, নোড়ো না—যতক্ষণ না আমার আঁকা শেষ হয়, ঠিক অমনি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকো ৷ আজ আমি যে ছবি আঁকব, সেই হবে আমার শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ৷ এ সুযোগ আমাকে দাও বারবারা ৷ ঈশ্বরের দোহাই, তুমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো ৷
ক্ষিপ্রবেগে হাত চলতে লাগল আমার ৷ জীবনে এত দ্রুত আমি আর আঁকিনি ৷ প্রত্যেকটি রেখার অপূর্ব ব্যঞ্জনা ফুটে উঠতে লাগল ৷ শিল্পী নিশীথ সেনের এই শ্রেষ্ঠ কীর্তি হয়তো অমর হয়ে থাকবে জগতে ৷
রাত শেষ হয়ে আসছে ৷ ঝড়ের বেগ এসেছে কমে ৷ স্কেচ সম্পূর্ণ হতে এখনও আর একটু বাকি ৷ বললাম, আর একটু—আর একটু সময় দাও বারবারা ৷ ভোরের আগেই ছবি আমার শেষ হয়ে যাবে ৷
ক্যানভাস থেকে চোখ তুলে তাকাতেই—কোথায়? কোথায় বারবারা? ভাঙা মূর্তি] পাশ থেকে কোথায় হারিয়ে গেল তার সেই অপরূপ মূর্তি?
বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই ঝলমলে নীল রেশমি গাউনটা চোখে পড়ল ৷ উত্তর দিকের খোলা জানলা টপকে বারবারা তখন পালাবার চেষ্টা করছে ৷ চিৎকার করে বললাম, যেও না বারবারা—আর একটু সময় আমাকে দাও ৷ বিশ্বাস করো, আর কোনো ভয় নেই তোমার ৷ কাজ আমার সামান্যই বাকি, তারপর নিজের হাতে আমি দরজা খুলে দোব৷ সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ ছাড়তে এখনও সময় আছে বারবারা—যেও না তুমি—
বারবারা তখন পালাবার জন্যে জানলার ওপর উঠে পড়েছে ৷ হাতের তুলি ফেলে দিয়ে পাগলের মতো ছুটে যেতে যেতে ডাকলাম, ঈশ্বরের দোহাই বারবারা, তোমার দোহাই, চলে যেও না—আমার শ্রেষ্ঠ কীর্তি এভাবে নষ্ট হতে দিও না—
তার কাছে পৌঁছবার আগেই বারবারা লাফিয়ে পড়ল বাইরের বাগানে ৷
.
আবার ডাকলাম, যেও না বারবারা—
জানলার বাইরে কুয়াশা আর অন্ধকারে মাখামাখি ৷ তারই মধ্যে শুধু শোনা গেল পলাতকার পায়ের আওয়াজ ৷
মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলে উঠল ৷ পলকের মধ্যে কী ঘটে গেল জানি না ৷ পায়ের কাছে পড়েছিল একটা ভাঙা কাফ্রীর মুণ্ড—নিরেট, কালো পাথরের তৈরি ৷ চকিতে সেই ভারী মুণ্ডটা কুড়িয়ে অন্ধকারে পায়ের আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলাম—
হু-হু উত্তরে হাওয়া চিৎকার করে একবার ককিয়ে উঠেই চুপ করে গেল ৷
সে কি হাওয়ার শব্দ, না বারবারার শেষ আর্তনাদ?
ছোট ঘর থেকে টর্চটা এনে জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লাম ৷ টর্চের আলোয় কিছুদূরে বাগানের ভিজে মাটির ওপর নীল গাউনটা ঝলমলিয়ে উঠল ৷ পা দুটো যেন সীসের মতো ভারী হয়ে উঠল ৷ সেই ভারী পা-দুটো টেনে টেনে টলতে টলতে কাছে গিয়ে দেখলাম, মাথার খুলির পেছন দিকটা গুঁড়িয়ে গেছে ৷ রক্তে আর কাদায় মিশে একাকার!
খুন! … খুন করেছি আমি!
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শীতের প্রবাহ আমার হাড় পর্যন্ত আড়ষ্ট করে দিল ৷ হাত-পা সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে, আর সেই জমাট করা ঠান্ডায় মস্তিষ্কটাও যেন অবশ হয়ে এল ৷ তারপর ধীরে— অতি ধীরে যেন আমার চেতনা একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগল ৷ মনে হল, এখুনি ভোর হয়ে যাবে, বাগানের ধার দিয়ে দিনের লোক-চলাচল শুরু হবে, খবর যাবে পুলিশ-স্টেশনে, আসবে পুলিশ, খুনের চার্জে নিয়ে যাবে আমাকে ৷ তারপর খবরের কাগজে বড় বড় হরফে ছাপা হবে: আর্টিস্ট নিশীথ সেন খুনি!
তারপর বিচার … জেলখানার সেল … তারপর একদিন ভোররাত্রে ফাঁসির দড়ি …
বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো আমার শিরা-স্নায়ুগুলো ঝন ঝন করে উঠল ৷ আমার আদিম চেতনা আমাকে বলে দিল, নিজেকে বাঁচাও— আগে নিজেকে বাঁচাও—যত শিগগির পারো!
পা দিয়ে ঘষে ভিজে মাটিতে রক্তের দাগগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিলাম ৷ তারপর ফার- কোটটা এনে বারবারার মৃতদেহকে ঢেকে তুলে নিলাম কাঁধে ৷
তখন ভোর হয়ে আসছে ৷ তবু ঘন কুয়াশার চারদিক ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট ৷ ঠাওর করে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ কোথাও নেই ৷ সামনে খালের ধারে ল্যাম্প- পোস্টটার নীচে কনস্টেবলটাও নেই ৷ কে থাকবে এই ঝোড়ো শীতের ভোররাত্রে?
নিশ্চিন্ত আশ্বাসে বাগানের ফটক খুলে বেরিয়ে পড়লাম ৷ আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালাম খালের ওই কাঠের সাঁকোটার ওপর ৷ নীচের দিকে তাকালাম—কালো জলস্রোত অন্ধকার মৃত্যুর মতো বয়ে চলেছে ৷ দম-দেওয়া যন্ত্রের মতো আমার হাত দুটো কাঁধের বোঝাটিকে নামিয়ে একবার খালের ওপরে শূন্যে তুলে ধরল—
তারপর শুধু ঝপ করে একটা শব্দ ৷ মুহূর্তের জন্যে অশান্ত হয়ে উঠল তরল মৃত্যুস্রোত ৷ তারপর আবার স্তব্ধতা ৷
এতক্ষণে বোধ হয় সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ ছাড়বার শেষ ঘণ্টা বাজছে!
সেই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জনহীন সাঁকোর ওপর কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, তা জানি না ৷ আর আমার কিছুই মনে নেই প্রতুল ৷ এইখানে এসে আমার স্মৃতি গেছে হারিয়ে ৷
পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেক বেলা ৷ মাথা অসহ্য ভারী, দারুণ পিপাসায় গলা উঠেছে শুকিয়ে ৷ গতরাত্রের ঘটনাটা মনে পড়তেই মাথার ভেতরটা গোলমাল হয়ে গেল ৷ তাড়াতাড়ি হলের মধ্যে গিয়ে দেখি, না, সব ঠিকই আছে, কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই ৷ বুঝতে পারলাম, দুঃস্বপ্ন দেখেছি—নিছক একটা দুঃস্বপ্ন! নিমেষে দেহ-মন সুস্থ হয়ে উঠল ৷ মাথাটাও হালকা হয়ে গেল ৷ বেরিয়ে এলাম বাগানে ৷ প্রশান্ত দিন, উজ্জ্বল রোদ দেবদারু শাখায় শাখায় ঝলমল করছে ৷ গতরাত্রির দুঃস্বপ্নটা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম ৷ ভুলে গিয়েও ছিলাম, কিন্তু আজ ১৩ ডিসেম্বর, এক বছর পরে সেই স্বপ্ন-কাহিনি আবার নতুন করে মনে পড়ল ৷
কাহিনি বলা শেষ করে নিশীথ থামল ৷ পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল একটা ৷
পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল ৷ তবু সেই নিভন্ত পাইপ মুখে প্রতুল বড় সোফাটায় হেলান দিয়ে পূর্ণাবয়ব ছবির মতো স্থির হয়ে বসেছিল ৷ কপালে অল্প একটু কুঞ্চন-রেখা ছাড়া তার সারা মুখে চাঞ্চল্যের আর কোনো চিহ্ন নেই ৷ এতক্ষণে পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তোমার স্বপ্ন-দেখার পরের দিন বারবারা স্মিথ তার ছবিখানা ডেলিভারি নিতে আসেনি?
নিশীথ বললে, না ৷ আর সবচেয়ে আশ্চর্য, এই দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে বারবারা স্মিথ কোনোদিনই ছবিখানা নিতে আসেনি ৷
হুঁ, না আসাই স্বাভাবিক ৷—পাইপ ঠুকে পোড়া তামাকটা ফেলে দিতে দিতে প্রতুল বললে, ঠিক এক বছর আগে খবরের কাগজে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিল: বারবারা স্মিথ নামে সানফ্রান্সিসকোর একটি মেয়ে ১৩ ডিসেম্বর রাত্রে পার্ক স্ট্রিটে তার ফ্ল্যাট থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে ৷ পুলিশ বহু চেষ্টাতেও তার কোনো সন্ধান পায়নি ৷ তোমার স্বপ্ন-কাহিনির সঙ্গে এই ঘটনাটার অদ্ভুত যোগাযোগ রয়েছে, না নিশীথ? খবরটা তুমিও নিশচয় পড়েছিলে?
এক মুহূর্ত প্রতুলের মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে নিশীথ জবাব দিলে, না, আমি পড়িনি প্রতুল ৷—তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে ভারী ওভারকোটটা গায়ে দিয়ে বললে, যাকগে ও-কথা ৷ রাত অনেক হল, ঝড় আজকে আর থামবে বলে মনে হয় না ৷ চলো, যাওয়া যাক ৷
প্রতুলের ওভারকোটটা গায়েই ছিল, টুপিটা মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, চলো ৷
হলের আলো নিভিয়ে দুজনে বাইরে এল ৷ স্টুডিয়োর দরজা বন্ধ করার জন্যে নিশীথ পকেট থেকে চাবি বার করতেই প্রতুল বললে, একটু দাঁড়াও, তামাকের পাউচটা টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি ৷
ওভারকোটের কলার তুলে দিয়ে নিশীথ বললে, নিয়ে এসো ৷ বেশি দেরি কোরো না কিন্তু ৷ আজ মারাত্মক শীত পড়েছে হে, ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি!
প্রতুল একা হলের মধ্যে ঢুকে বাতি জ্বাললে ৷ তারপর টেবিলের ওপর থেকে পাউচটা নিয়ে পকেটে পুরলো ৷ ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, উত্তরের জানলাটা খোলা ৷ কী অন্যমনস্ক এই নিশীথ, বন্ধ করতে ভুলে গেছে! কিংবা এমনও হতে পারে যে, তার দুঃস্বপ্নের মধ্যে বারবারা স্মিথ এই জানলা দিয়ে পালাতে গিয়ে খুন হয়েছিল বলে নিশীথ এদিকটায় বড়-একটা আসে না ৷ জানলাটায় গরাদ নেই, বন্ধ করে যাওয়াই ভালো ৷ নইলে সারারাত ঝোড়ো হাওয়া আসবে, চোর আসাও বিচিত্র নয় ৷
প্রতুল জানলার কাছে এগিয়ে গেল ৷ কিন্তু কপাট দুটো বন্ধ করতে গিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ জানলার ছিটকিনির হুকে কী যেন একটা বস্তু আটকে রয়েছে না? সেটা তুলে প্রতুল আলোয় ভালো করে দেখল ৷ দেখতে দেখতে তার প্রশস্ত কপালে আবার সেই কুঞ্চন-রেখা দেখা দিল ৷ জীবনে এতখানি আশ্চর্য বোধ হয় আর সে কখনও হয়নি! এতখানি আঘাতও সে কমই পেয়েছে জীবনে ৷
উত্তরের জানলাটা আর বন্ধ করা হল না ৷ ছিটকিনি-খোলা কপাটদুটো ঝড়ে বুক-চাপড়ানির মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে, সেদিকে প্রতুলের খেয়াল নেই ৷
কী হে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা ভাবছ নাকি? আর আমি বেচারি এদিকে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার দাখিল!—দরজা ঠেলে ঢুকে নিশীথ বললে ৷
চকিতে প্রতুল হাতের বস্তুটা পকেটে পুরে ফেললে ৷ তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, তাই বটে!
অসহিষ্ণু কণ্ঠে নিশীথ বললে, সে-কথা আর একদিন শোনা যাবে ৷ আজকে চলো—
প্রতুল এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াল ৷ তীক্ষ্ণ-গভীর দুই চোখের দৃষ্টি নিশীথের মুখের ওপর ফেলে শান্ত গলায় শুধু বললে, না, আজই শুনে যাও ৷
আরও অসহিষ্ণু কণ্ঠে নিশীথ বলে উঠল, কাল শুনব’খন ৷
না, আজই শোনো ৷
প্রতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশীথের গলা কেমন যেন দুর্বল হয়ে এল ৷ শুধু বললে, বলো—
বারবারা স্মিথকে তুমি সত্যিই খু-ন ক-রে-ছ নিশীথ!
অন্ধকারে সাপ দেখার মতো চমকে উঠল নিশীথ ৷ পরক্ষণেই তার গলা দিয়ে বিশ্রী বীভৎস এক অট্টহাসি রোল বেরিয়ে এসে ঘরের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরতে লাগল ৷ তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললে, সাবাস ডিটেকটিভ! বলিহারি তোমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা!
শান্ত-কঠিন স্বরে প্রতুল বললে, মিথ্যে স্বপ্ন দিয়ে সত্য ঘটনাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা কোরো না নিশীথ ৷ আমি জানি, এক বছর আগে ১৩ ডিসেম্বরের রাত্রে বারবারা স্মিথ তোমার এই স্টুডিয়োতে এসেছিল, আর তুমিই তাকে খুন করেছ ৷
বটে! … প্রমাণ?
প্রতুল নিঃশব্দে কোটের পকেট থেকে সেই বস্তুটা বের করে নিশীথের সামনে ধরলে ৷ জিনিসটা আর কিছুই নয়, নীল সিল্কের একটা রুমালের ছিন্ন অংশ ৷ এক বছরের রোদে-জলে নীল রং অনেকখানি বিবর্ণ হয়ে গেছে ৷ এক কোণে পুরোনো রক্তের মতো কালচে লাল সুতো দিয়ে বোনা একটি অক্ষর—B.
প্রতুল বললে, উত্তরের জানলা টপকে পালাতে গিয়ে বারবারার হাতের নীল রুমাল ছিটকিনির হুকে আটকে যায়, সে-রাত্রে তুমি তা লক্ষ করোনি নিশীথ ৷ কিন্তু কে জানত, তারই ছিন্ন অংশ আজ এক বছর আগেকার এক হত্যা-রহস্যের সূত্র ধরিয়ে দেবে ৷
নীল রুমালটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশীথের গরিলাকৃতি মুখখানা রক্তহীন হয়ে গেল ৷ নিচেকার পুরু ঠোঁট ঝুলে পড়ল কদাকারভাবে ৷ তারপর দেখতে দেখতে তার চোখে এল বন্য হিংস্রতা ৷ রোমশ দুই বাহু বাড়িয়ে ক্রুদ্ধ গরিলার মতো সে নিমেষে প্রতুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল, কিন্তু তার আগেই প্রতুলের অপর হাতে দেখা দিয়েছে তার নিত্যসঙ্গী পিস্তল ৷
এক পা-ও এগিয়ো না নিশীথ!
ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মতোই নিশীথ একটা চাপা গর্জন ক’রে উঠল ৷
পিস্তলটা তার দিকে উঁচু করে ধরে প্রতুল শান্ত বেদনাহত কণ্ঠে বলতে লাগল, তোমার আমার বন্ধুত্ব আজ আঠারো বছরের ৷ দিনে দিনে এই বন্ধুতা নিবিড় অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে ৷ তবু, খুনি যে, তাকে বন্ধুতার খাতিরে আমি ছেড়ে দিতে পারব না নিশীথ ৷— হাত তোলো! চলো—
দুই হাত তুলে পিছন ফিরে নিশীথ আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে বেরোলে ৷ প্রতুলের পিস্তলের নলটা তার পিঠ রইল ছুঁয়ে ৷
পিছন ফিরেই নিশীথ বললে, স্টুডিয়োর দরজা চাবি বন্ধ করে দিও প্রতুল ৷
মুখ ফিরে চাবি বন্ধ করতে দু’সেকেন্ডের বেশি লাগেনি, কিন্তু তারই মধ্যে কুয়াশা আর অন্ধকারে ভারী জুতোর আওয়াজ পেয়ে প্রতুল চিৎকার করে উঠল, পালি না নিশীথ—পালাবার চেষ্টা কোরো না! নিশীথ—নিশীথ—
ভারী জুতোর আওয়াজ ক্রমশ খালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ৷ উদ্যত পিস্তল হাতে আওয়াজ লক্ষ্য করে প্রতুল ছুটল৷
পালিয়ো না নিশীথ—নিশীথ—
ভারী জুতোর আওয়াজ কাঠের সাঁকোর ওপর গিয়ে পৌঁছেছে ৷ সাঁকোর ওপর কালো ওভারকোট মোড়া আবছা মূর্তি লক্ষ্য করে প্রতুলের পিস্তল গর্জে উঠল, দুম … দুম …
আবছা কালো মূর্তিটা একবার সাঁকোর রেলিঙের ধারে স্থির হয়ে দাঁড়াল ৷ তারপর শুধু ঝপ করে একটা শব্দ হল মাত্র ৷
প্রতুল ততক্ষণে সাঁকোর ওপরে গিয়ে পৌঁছেছে ৷ নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, তরল কালো মৃত্যুস্রোত মুহূর্তের জন্যে অশান্ত হয়ে উঠে আবার শান্তবেগে বয়ে চলেছে—ঠিক যেমন হয়েছিল এক বছর আগে এই ১৩ ডিসেম্বরের রাত্রে ৷
সাঁকোর ওপর প্রতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ৷ তার এক হাতে পিস্তল, অপর হাতে আর্টিস্ট নিশীথ সেনের স্টুডিয়োর দরজার চাবি ৷
সে-দরজা হয়তো আর কোনোদিনই খুলবে না!
পাগলাবাবার কুঠি – শুভমানস ঘোষ
চিতাবাঘটা এল রাত এগারোটা নাগাদ ৷ ছাদের ওপর থেকে ক্ষয়া চাঁদের আলোয় শঙ্খ স্পষ্ট দেখল, লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাঁটাতারের বেড়া টপকে বাঘটা হুশ করে চলে এল পাগলবাবার কুঠির হাতায় ৷ বাঘ নয়, বাঘিনী ৷ এর ভয়ে কিছুদিন হল আশপাশের গ্রামের আদিবাসীদের চোখ থেকে ঘুম উবে গেছে ৷ গৃহপালিত প্রাণীর সংখ্যা বাদ দিলেও এ পর্যন্ত কাচ্চাবাচ্চা সমেত হাফডজন মানুষ এর পেটে গেছে ৷ চোখের পলকে শঙ্খদ্যুতি হেভি রাইফেলখানা তুলে নিল ৷ ৩৭৫ ম্যাগনাম রাইফেল ৷ ঠিকমতো লাগাতে পারলে এক গুলিতে হাতিকে পর্যন্ত শুইয়ে দেওয়া যায় ৷
শঙ্খদ্যুতি সরকারি শিকারি ৷ শু্যটিংয়েও তার নাম আছে ৷ এখানকার বিট অফিসার শুভ্রকান্তি শঙ্খর বন্ধু ৷ চিতাটাকে গুলি করে মারার সরকারি অনুমতিপত্র নিয়ে কাল সকালে সে আসছে ৷ কিন্তু তার আগেই এটাকে নিকেশ করে কাজ হালকা করে ফেললেই তো হয় ৷ ট্রিগারের ওপর আস্তে আস্তে বেঁকে যাচ্ছিল শঙ্খর হাতের আঙুল ৷ কিন্তু ট্রিগারের ওপর তা চেপে বসার আগেই আচমকা একটা চাপা গর্জন করে বাঘটা নেমে গেল খাদের মধ্যে ৷
মিনিট দুই ৷ হাতে হ্যাজাক নিয়ে পাগলাবাবা দেখা দিলেন ৷ নীচে থেকে গলা তুলে শঙ্খকে বললেন, দেখলে তো? এ বার নেমে এসো বাছাধন ৷ তোমার দৌড় বোঝা গেছে ৷
উত্তেজনায় শঙ্খর হাত দু’টো তখনও থরথর করে কাঁপছিল ৷ বাংলোর হাতার নীচেই খাদের বিকট গড়ান ৷ জঙ্গলের শুরু সেখান থেকে ৷ স্থানীয় লোকেরা বলে চৈতলবিলের জঙ্গল ৷ এক সময় দুর্ভেদ্য ছিল ৷ এখনও ফুরিয়ে যেতে যেতে যা আছে তা বিশাল ৷ একটু আগে চিতাবাঘটা ওখান থেকেই উঠে এসেছিল ৷
সিঁড়ির নীচে আলো ধরলেন পাগলাবাবা ৷ এ সব এলাকায় ইলেকট্রিক লাইন থাকলেও সারাদিন এক ঘণ্টাও কারেন্ট থাকে কি না সন্দেহ ৷ পাগলাবাবা এই রাতে মাথায় একখানা তালপাতার টুপি পরে বসে আছেন ৷ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ৷ কোটরের ভেতর ধকধক করছে একজোড়া চোখ ৷ হট করে দেখলে ভয় ধরে যায় ৷ লোকটি নিদ্রাহীনতার ক্রনিক পেশেন্ট ৷ রোগের জ্বালা থেকে বাঁচবার জন্য তিন-তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রতিবারই অবিশ্বাস্যভাবে প্রাণে বেঁচে যান ৷ একবার তো লাইনের মধ্যে শুয়ে পড়েছিলেন, এক্সপ্রেস ট্রেন চলে যায় ওপর দিয়ে, গায়ে আঁচড়টি লাগেনি তাঁর ৷
পাগলাবাবা হ্যাজাকটা ঘরের দেওয়ালের শিকে ঝুলিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন চেয়ারে ৷ শঙ্খকে দেখতে দেখতে বললেন, শোনো হে ছোকরা, আসল কথাটা তোমায় খুলেই বলি ৷ যাকে দেখলে, ও কিন্তু মোটেই বাঘ নয় ৷ ও আমার ফিয়াসেঁ ৷ ফিয়াসেঁ মানে জানো তো?
আবার শুরু হল পাগলামি ৷ এই জন্যই এখনকার লোকেরা এঁকে পাগলাবাবা নাম দিয়েছে ৷ সেই সূত্রে এটার নাম পাগলাবাবার কুঠি ৷ পাগলামির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক কিছু কিছু সমাজসেবাও করে থাকেন ৷ রোগে-অসুখে গ্রামবাসীদের তাবিজটা-কবজটা ধরে দেন, এক-আধ দাগ ওষুধও মেলে ৷
শঙ্খ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল ৷ হাই উঠছে ৷
পাগলাবাবার নাক কুঁচকে গেল, হাই তুললে হবে না, ব্রাদার ৷ সোজা কথা, ও রাক্ষসীকে মারা তোমার কর্ম নয় ৷ তবে তুমি যদি আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে বসো, আমি নেই ৷ চ্যালেঞ্জের নাম করে আর একটা রাত এখানে থেকে যাবে সেটি হচ্ছে না, বাবা ৷
পাগলাবাবা অনেক দিন হল কলকাতার পাট চুকিয়ে দিয়ে এই আধাপাহাড়ি জঙ্গলে ডেরা পেতেছেন ৷ ভদ্রলোকের ছেলেপুলে নেই, স্ত্রীও মারা গেছেন ৷ একজন আদিবাসী বুড়ো তাঁর দেখাশোনা করে ৷
—বাঘটা কি আপনার এখানে রোজ আসে? বন্দুকটা বিছানায় শুইয়ে শঙ্খ প্রশ্নটা ছুড়ে দিল ৷
পাগলাবাবা খুকখুক করে হাসলেন, না এসে যাবে কই সোনা? আসলে ওই রাক্ষসীর স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না ৷ বটে তুমি আমার অনেক জুনিয়ার, তবু তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, তাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম ৷ তার একটু সুখের জন্য কী না করেছি আমি? উদয়াস্ত মুখে রক্ত তুলে খেটে মরেছি ৷ ঘরে ক’দিন থাকতাম? এক মাস, দু’ মাস, কখনও কখনও টানা তিন মাস বাইরেই পড়ে আছি ৷ কী চমৎকারই না তার প্রতিদান দিয়েছিল মহিলা!
মনে মনে বিরক্ত হলেও শঙ্খ না বলে পারল না, আমি আপনার ছকটা ঠিক ধরতে পারছি না ৷ চিতাবাঘিনীটা আপনার আগের জন্মের কেউ ছিল?
—এগজ্যাক্টলি! পাগলাবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, তবে মাইন্ড ইট, আমার নয়, ওর ৷ মরে গিয়ে আমার বউ চিতাবাঘ হয়ে জন্মেছে ৷ হবে না? খিদের তো শেষ ছিল না মহিলার ৷ এত এত এনে দিয়েছি, তবু তার খিদে মেটেনি ৷ তাই মরে ডাইরেক্ট বাঘ ৷ নে, এ বার কত খাবি খা ৷ পেট ভরে রক্ত খেয়ে মর ৷
বলতে বলতে গলার স্বর বদলে গেল পাগলাবাবার, ইয়াংম্যান, ওটাকে যে করে হোক নিকেশ করতে হবে তোমায়৷ আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে ৷
—আমি? শঙ্খ মাথা দোলাল, এই তো বললেন, কেউ ওকে মারতে পারবে না ৷
—বলেছি না কি, অ্যাঁ? পাগলাবাবার চেহারা বদলে গেল চোখের নিমেষে, বেশ করেছি বলেছি ৷ আমার সঙ্গে চালাকি? বাড়াবাড়ি করবে তো ঘাড়টি ধরে বাইরে বের করে দিয়ে আসব ৷
সর্বনাশ, যত রাত বাড়ছে ভদ্রলোক তত ফেরোসাস হয়ে উঠছেন ৷ ইশ, কী কুক্ষণে যে আজ সকালে এখানে একটা আস্তানা খুঁজতে বেরিয়ে বেছে বেছে এই বাড়িটাই তার পছন্দ হয়ে যায়! পছন্দ হওয়ার কারণ, পাগলাবাবার কুঠির ছাদটা ৷ একটা মানুষখেকো বাঘকে জন্মের মতো ঘুম পাড়িয়ে দিতে একজন শিকারির কাছে এর চেয়ে লোভনীয় জায়গা আর হয় না ৷
সকালে ভদ্রলোককে তো ভালোই লাগছিল ৷ মন দিয়ে তার প্রস্তাব শুনে মুচকি হেসে বলেছিলেন, আমার এখানে? বেশ তো ৷ কিন্তু আগেই বলে রাখছি, আমি লোক সুবিধের নই ৷ এখানকার কেউ তোমায় বলেনি?
—বলেছে ৷ আমি কেয়ার করিনি ৷
—বটে? ব্রেভ ইয়ংম্যান, তুমি স্বচ্ছন্দে এখানে থেকে যেতে পারো ৷ তোমায় আমার ভালোই লাগছে ৷ মোর ওভার, কেমন চেনা চেনাও ঠেকছে ৷
শঙ্খ একদৃষ্টে দেখছিল পাগলাবাবাকে ৷ ঘাড় দুলিয়ে বলল, আমারও ৷ আপনাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি ৷
—বটে? পাগলাবাবা অন্য কথা পেড়েছিলেন, তবে মাইন্ড ইট ব্রেভ ইয়ংম্যান, তুমি কত বড় শিকারি আজ রাতে তার পরীক্ষা দিতে হবে তোমায় ৷ রাজি?
—আনন্দের সঙ্গে ৷ বুক ঠুকে বলে দিয়েছিল শঙ্খ ৷
একে পরীক্ষায় ডাহা ফেল, তার ওপর পাগলাবাবাকেও দিল চটিয়ে ৷ শঙ্খ জড়সড় হয়ে গেল ৷ বাইরে খটাস করে একটা আওয়াজ হল ৷ পাহাড়ে-জঙ্গলে অনেক ঘুরেছে শঙ্খ, তবু চমকে গেল ৷
পাগলাবাবা একটু যেন নরম হলেন ৷ গলা নামিয়ে বললেন, ও পাতা পড়ার আওয়াজ ৷ তুমি শিকারি না ছাই ৷ খালি বড় বড় কথা ৷
শঙ্খ চেয়ে রইল ৷ আর মুখ খুলছে না ৷
পাগলাবাবার গলার স্বর খাদে নেমে এল, বললাম তো, ও রাক্ষসী পিশাচিকে মারা তোমার সাধ্য নয় ৷ আমাকে না খাওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই ৷ সারারাত ধরে দরজা আঁচড়ায়, বারান্দায় ওত পেতে বসে থাকে ৷ একদিন রাতে দরজাটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল আর কী! পরের দিন কোলাপসিবল গেট লাগিয়ে তবে হাঁফ ছাড়ি ৷
শঙ্খ তা-ও মুখ খোলার দিকে গেল না ৷ তবে যত অদ্ভুতই লাগুক, পাগলাবাবার কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগছে না৷
—একটা পুরোনো হিসেব মেটানো এখনও বাকি আছে ৷ বলতে বলতে হঠাৎ পাগলাবাবা কেমন উদাস হয়ে গেলেন, তার জন্যই বেটি এখনও ছোঁকছোঁক করে মরছে ৷ হয় ও মরবে, নয় আমি ৷
আচমকা ফোঁস করে হ্যাজাকের আলোর পিণ্ড থেকে একটা আগুনের জিব বেরিয়ে এসে মিলিয়ে গেল ৷ সঙ্গে সঙ্গে পাগলাবাবা আবার বদলে গেলেন ৷ এগিয়ে এসে শঙ্খর হাত চেপে ধরে ভেঙে পড়লেন, তুমি আমায় বাঁচাও! আমার এক্ষুনি মরে যেতে ইচ্ছা করছে না ৷ বলো বাঁচাবে আমায়? বলো বলো!
—আরে, এ কী করছেন! মুখ খুলতেই হল শঙ্খকে, হাত ছাড়ুন!
—না, ছাড়ব না ৷ আমার কী দোষ? চোখের সামনে ওরকম একটা দৃশ্য দেখলে কার মাথার ঠিক থাকে?
—দৃশ্য!
—হ্যাঁ ৷ সেদিন আমি হঠাৎই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম ৷ ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ একটা হাতুড়ি দিয়ে—৷
থেমে গেলেন পাগলাবাবা ৷ পরক্ষণেই শঙ্খকে ছেড়ে ছিটকে গিয়ে গলা চড়িয়ে দিলেন আবার, অ্যাই অ্যাই এ কী কাণ্ড, একফোঁটা ছেলে, হাঁ করে বসে বসে বড়দের কথা গিলছ? আবার বলছ, দৃশ্য? কেমন ছেলে হে তুমি? খবরদার, যা শুনেছ শুনেছ, কারুর কাছে বলেছ কি, একদম খুন করে ফেলব ৷
প্রলাপ! পাগলের প্রলাপ ৷ কিন্তু সবটাই কি প্রলাপ? শঙ্খর কেমন চেনা চেনা লাগছে কথাগুলো ৷ এই লোকটা যে সত্যি সত্যি খুন করে ফেলতে পারে সেটাও যেন বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ৷ কিন্তু কেন?
শঙ্খ হঠাৎ বন্দুকটা টেনে নিল কোলে ৷
.
অনেক রাতে পাগলাবাবার ঠেলায় ঘুম ভেঙে গেল শঙ্খর ৷ বাইরে সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে ৷ খটাখট করে পাতা ঝরে যাচ্ছে ৷ সেই সঙ্গে বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ ৷ টেনে ধরা গার্টারের মতো বিছানায় সিধে হয়ে বসল শঙ্খ ৷ তার পর খুব সাবধানে জানলার একটা পাল্লা ফাঁক করে একেবারে আঁতকে উঠল ৷
এসব এলাকায় কারেন্ট থাকাটাই আশ্চর্য ৷ সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটিয়ে দিয়ে বাইরের বারান্দার ডুমটা জ্বলছে ৷ বারান্দার ঠিক সিঁড়ির নীচে গুটিসুঁটি মেরে বসে আছে চিতাবাঘিনীটা ৷ কানদুটো তার খাড়া হয়ে আছে ৷ জ্বলজ্বলে চোখ দরজার দিকে স্থির ৷ যেন কারুর বাইরে বেরোনোর অপেক্ষা, চক্ষের নিমেষে তুলে নিয়ে চলে যাবে মুখে করে ৷
—সাহসখানা দ্যাখো একবার! আবার এসেছে ৷ পাগলাবাবা ফিসফিস করে উঠলেন ৷
কাল রাতে একটু বিগড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত মহা গোলমাল কিছু করেননি ভদ্রলোক ৷ তবে বকবক করে গেছেন অনেক রাত অবধি ৷ পাগলের কথার তো মাথামুন্ডু নেই ৷ একবার এই বলছে, পরক্ষণে আর এক ৷ তবে তার মধ্যে একটা কথা শুনে শঙ্খ ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ৷ স্ত্রীকে রিয়েলি ভালোবাসলেও তাকে পাগলাবাবা নিজের হাতেই খুন করেছিলেন ৷ যে ভালোবাসার জন্য তিনি মুখে রক্ত তুলে খেটে মরেছিলেন, সেখান থেকে এত বড় আঘাত তিনি