- বইয়ের নামঃ গোয়েন্দা এসিজি সমগ্র
- লেখকের নামঃ অনীশ দেব
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
গোয়েন্দা এসিজি সমগ্র
অন্তরে পাপ ছিল (উপন্যাস)
কে যেন বলে গেছেন, খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য।
এ-কথাটা ভাবামাত্রই হেসে ফেললেন বৃদ্ধ হুনুর ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি। কারণ, এই কথাটা কোনও মহাপুরুষ মোটেই বলে যাননি। বহু বছর ধরে খুন এবং খুনি ঘাঁটাঘাঁটি করে এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই পৌঁছে গেছেন। একটা কথা বহুদিন ধরে বিশ্বাস করলে একসময় মনে হয়, কথাটা নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও মহাপুরুষ বলে গেছেন। নিজের বিশ্বাসের দায় তখন অনায়াসে কোনও মহাজনের ঘাড়ে চেপে যায়।
একটু আগেই একটা টেলিফোন এসেছিল। গড়পাড় থেকে কে এক দীপ্তিমান বসাক এসিজিকে ফোন করেছিলেন।
‘হ্যালো, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আছেন?’ একটু ভারি অথচ বেশ চমৎকার গলায় প্রশ্ন করল কেউ।
‘হ্যাঁ—বলছি।’
‘আ-আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। আ-আমাকে আপনি চিনবেন না।’ থতিয়ে-থতিয়ে বললেন দীপ্তিমান, ‘একটা জরুরি ব্যাপারে আপনার হেলপ চাইছি। যদি কাইন্ডলি আপনার সঙ্গে দেখা করার পারমিশান দেন…।’
দীপ্তিমান বসাক নামে কাউকে চেনেন না এসিজি। কী করে তিনি এসিজির ফোন-নম্বর পেলেন কে জানে! তবে ভদ্রলোকের গলা বেশ উত্তেজিত এবং নার্ভাস বলে মনে হল।
‘কী ব্যাপারে দেখা করতে চান আপনি?’ আন্তরিক গলায় জানতে চাইলেন এসিজি।
অশোকচন্দ্র একসময় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। সেটা জেনে অনেকে ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা সবই পাড়ার লোক। আর এলাকার বাইরে থেকে অনেকে যোগাযোগ করেন ছাত্র পড়ানোর জন্য। তাতে তিনি বিব্রত হন—অনেকসময় বিরক্তও হন। কারণ, কোচিং ক্লাস তিনি অপছন্দ করেন।
দীপ্তিমান কি ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে দেখা করতে চান নাকি?
‘আমার খুব ক্লোজ একজন রিলেটিভ পাঁচদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। তবে…।’
এসিজি সজাগ হলেন পলকে। মাথার ধবধবে চুলের গোছায় আলতো করে কয়েকবার টান মারলেন।
‘তবে কী?’
‘আপনাকে…আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা…ব্যাপারটা জেনুইন অ্যাক্সিডেন্ট। অন্য কিছু নয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে দীপ্তিমানের গলা কাঁপছিল।
‘আপনার কি ধারণা ব্যাপারটা আসলে মার্ডার?
‘হতেও তো পারে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান বসাক : ‘আবার নাও হতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’
দীপ্তিমানের কথায় একটা আকুল ভাব টের পাচ্ছিলেন এসিজি। তাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে রাজি হলেন। বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দীপ্তিমানকে বললেন সন্ধে সাতটায় আসতে।
আর তারপরই মনে হল ওই কথাটা : খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, আপাতভাবে নির্দোষ যে-মানুষটা স্বাধীনভাবে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, তার দিকে বেপরোয়া আঙুল তুলে খুনের কলঙ্কের সিলমোহর তার কপালে স্থায়ীভাবে এঁকে দেওয়া—সত্যিই খুব জঘন্য। তখন এসিজির নিজেকেই কেমন অপরাধী বলে মনে হয়।
একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কাছে এসে দীপ্তিমান কী বলবেন কে জানে! তা ছাড়া, তাঁর ওই রিলেটিভ কোন থানার এলাকায় মারা গেছেন এসিজি জানেন না। যদি সত্যি-সত্যিই তাঁকে রহস্যভেদের কাজে নামতে হয় তা হলে ব্যাপারটা অনেকটা নাক গলানোর মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
সুতরাং সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ডায়াল করলেন।
দীপ্তিমান বসাক যখন এসিজির শ্যামবাজারে ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন তখন সাতটা বেজে মিনিট পনেরো হয়েছে।
রঘুপতি যাদব এসেছে অনেক আগেই। বসবার ঘরে বসে আয়েস করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল রঘুপতি। আর প্রাক্তন স্যারের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে নানান কথা শুনছিল। সম্প্রতি এসিজি পাখির ডাকের স্পেকট্রাল অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটে এ নিয়ে গবেষণা করে সিগনাল রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কোনও-কোনও পাখির ডাকের হুবহু নকল করতে পেরেছে। এমনকী, তারা বহু স্ত্রী-পাখির ব্রিডিং কল নকল করে পুরুষ-পাখিকে গাছের আড়াল থেকে বাইরে টেনে এনেছে।
এসব রোমাঞ্চকর গবেষণার কথাই এসিজি শোনাচ্ছিলেন রঘুপতিকে। আর রঘুপতি অবাক হয়ে লম্বা ছিপছিপে মানুষটাকে দেখছিল। কোথায় ফিজিক্স, আর কোথায় পাখি! আর কোথায়ই বা গোয়েন্দাগিরি!
‘স্যার, কী করে যে আপনি এতদিকে মন লাগাতে পারেন সে আপনিই জানেন!’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল রঘুপতি।
হাতের সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘মন তো লাগাই না! মন লেগে যায়।’
ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
এসিজি ওঠার আগেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রঘুপতি। প্রাক্তন স্যারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে…।’ এবং এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল।
‘নমস্কার। আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। জ্যামের জন্যে পনেরো মিনিট দেরি হয়ে গেল।’