- বইয়ের নামঃ গোয়েন্দা এসিজি সমগ্র
- লেখকের নামঃ অনীশ দেব
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
গোয়েন্দা এসিজি সমগ্র
অন্তরে পাপ ছিল (উপন্যাস)
কে যেন বলে গেছেন, খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য।
এ-কথাটা ভাবামাত্রই হেসে ফেললেন বৃদ্ধ হুনুর ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি। কারণ, এই কথাটা কোনও মহাপুরুষ মোটেই বলে যাননি। বহু বছর ধরে খুন এবং খুনি ঘাঁটাঘাঁটি করে এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই পৌঁছে গেছেন। একটা কথা বহুদিন ধরে বিশ্বাস করলে একসময় মনে হয়, কথাটা নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও মহাপুরুষ বলে গেছেন। নিজের বিশ্বাসের দায় তখন অনায়াসে কোনও মহাজনের ঘাড়ে চেপে যায়।
একটু আগেই একটা টেলিফোন এসেছিল। গড়পাড় থেকে কে এক দীপ্তিমান বসাক এসিজিকে ফোন করেছিলেন।
‘হ্যালো, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আছেন?’ একটু ভারি অথচ বেশ চমৎকার গলায় প্রশ্ন করল কেউ।
‘হ্যাঁ—বলছি।’
‘আ-আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। আ-আমাকে আপনি চিনবেন না।’ থতিয়ে-থতিয়ে বললেন দীপ্তিমান, ‘একটা জরুরি ব্যাপারে আপনার হেলপ চাইছি। যদি কাইন্ডলি আপনার সঙ্গে দেখা করার পারমিশান দেন…।’
দীপ্তিমান বসাক নামে কাউকে চেনেন না এসিজি। কী করে তিনি এসিজির ফোন-নম্বর পেলেন কে জানে! তবে ভদ্রলোকের গলা বেশ উত্তেজিত এবং নার্ভাস বলে মনে হল।
‘কী ব্যাপারে দেখা করতে চান আপনি?’ আন্তরিক গলায় জানতে চাইলেন এসিজি।
অশোকচন্দ্র একসময় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। সেটা জেনে অনেকে ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা সবই পাড়ার লোক। আর এলাকার বাইরে থেকে অনেকে যোগাযোগ করেন ছাত্র পড়ানোর জন্য। তাতে তিনি বিব্রত হন—অনেকসময় বিরক্তও হন। কারণ, কোচিং ক্লাস তিনি অপছন্দ করেন।
দীপ্তিমান কি ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে দেখা করতে চান নাকি?
‘আমার খুব ক্লোজ একজন রিলেটিভ পাঁচদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। তবে…।’
এসিজি সজাগ হলেন পলকে। মাথার ধবধবে চুলের গোছায় আলতো করে কয়েকবার টান মারলেন।
‘তবে কী?’
‘আপনাকে…আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা…ব্যাপারটা জেনুইন অ্যাক্সিডেন্ট। অন্য কিছু নয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে দীপ্তিমানের গলা কাঁপছিল।
‘আপনার কি ধারণা ব্যাপারটা আসলে মার্ডার?
‘হতেও তো পারে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান বসাক : ‘আবার নাও হতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’
দীপ্তিমানের কথায় একটা আকুল ভাব টের পাচ্ছিলেন এসিজি। তাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে রাজি হলেন। বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দীপ্তিমানকে বললেন সন্ধে সাতটায় আসতে।
আর তারপরই মনে হল ওই কথাটা : খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, আপাতভাবে নির্দোষ যে-মানুষটা স্বাধীনভাবে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, তার দিকে বেপরোয়া আঙুল তুলে খুনের কলঙ্কের সিলমোহর তার কপালে স্থায়ীভাবে এঁকে দেওয়া—সত্যিই খুব জঘন্য। তখন এসিজির নিজেকেই কেমন অপরাধী বলে মনে হয়।
একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কাছে এসে দীপ্তিমান কী বলবেন কে জানে! তা ছাড়া, তাঁর ওই রিলেটিভ কোন থানার এলাকায় মারা গেছেন এসিজি জানেন না। যদি সত্যি-সত্যিই তাঁকে রহস্যভেদের কাজে নামতে হয় তা হলে ব্যাপারটা অনেকটা নাক গলানোর মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
সুতরাং সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ডায়াল করলেন।
দীপ্তিমান বসাক যখন এসিজির শ্যামবাজারে ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন তখন সাতটা বেজে মিনিট পনেরো হয়েছে।
রঘুপতি যাদব এসেছে অনেক আগেই। বসবার ঘরে বসে আয়েস করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল রঘুপতি। আর প্রাক্তন স্যারের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে নানান কথা শুনছিল। সম্প্রতি এসিজি পাখির ডাকের স্পেকট্রাল অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটে এ নিয়ে গবেষণা করে সিগনাল রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কোনও-কোনও পাখির ডাকের হুবহু নকল করতে পেরেছে। এমনকী, তারা বহু স্ত্রী-পাখির ব্রিডিং কল নকল করে পুরুষ-পাখিকে গাছের আড়াল থেকে বাইরে টেনে এনেছে।
এসব রোমাঞ্চকর গবেষণার কথাই এসিজি শোনাচ্ছিলেন রঘুপতিকে। আর রঘুপতি অবাক হয়ে লম্বা ছিপছিপে মানুষটাকে দেখছিল। কোথায় ফিজিক্স, আর কোথায় পাখি! আর কোথায়ই বা গোয়েন্দাগিরি!
‘স্যার, কী করে যে আপনি এতদিকে মন লাগাতে পারেন সে আপনিই জানেন!’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল রঘুপতি।
হাতের সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘মন তো লাগাই না! মন লেগে যায়।’
ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
এসিজি ওঠার আগেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রঘুপতি। প্রাক্তন স্যারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে…।’ এবং এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল।
‘নমস্কার। আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। জ্যামের জন্যে পনেরো মিনিট দেরি হয়ে গেল।’
এ-কথা বলে ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁকে ভালো করে জরিপ করলেন এসিজি।
প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা ভদ্রলোকের খুঁড়িয়ে চলা। বোধহয় ছোটবেলায় পোলিও বা ওইরকম কোনও অসুখ হয়েছিল। চৌকোনা মুখ। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটো অস্বাভাবিকরকম বড়। গাল সামান্য ভাঙা। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। পুরু ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফ। গায়ের রং ময়লা। বয়েস তেতাল্লিশ কি চুয়াল্লিশ।
চেহারায় বেঁটেখাটো দীপ্তিমানকে দেখে প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সেটা ভালো নয়। কিন্তু ওঁর গলার স্বর একেবারে হিপনোটাইজ করে ফেলার মতো।
এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিমানকে প্রতি নমস্কার জানালেন। তারপর একটা খালি সোফায় বসতে ইশারা করলেন।
দীপ্তিমান বসতেই এসিজি গলা চড়িয়ে বিশুকে ডাকলেন। বিশু বোধহয় ভেতরের ঘরে টিভি দেখছিল। ডাক শুনে এসে দাঁড়াল। বারো-তেরো বছরের এই ছেলেটি অশোকচন্দ্রের দিন-রাতের সঙ্গী।
‘ভালো করে তিনকাপ কফি কর দেখি—।’
অর্ডার পেয়েই বিশু ব্যস্তভাবে চলে গেল কফির আয়োজন করতে।
রঘুপতির সঙ্গে দীপ্তিমানের আলাপ করিয়ে দিলেন এসিজি। দীপ্তিমান সতর্ক চোখে রঘুপতিকে দেখলেন।
পরনে সাদা-পোশাক, তবু পুলিশ-পুলিশ ভাবটা বোঝা যায়। ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচা-পাকা গোঁফ। চওড়া কাঁধ দেখেই বোঝা যায় এঁর সঙ্গে হিসেব করে মোকাবিলায় নামলে ভালো হয়।
‘বলুন, মিস্টার বসাক। যা বলার খোলাখুলি বলুন—কোনও অসুবিধে নেই। আপনারটা পুরোপুরি শোনার পর আমার ওপিনিয়ন দেব।’
এক পলক দুজনের দিকে তাকালেন দীপ্তিমান। তারপর পুরু ঠোঁটের ওপরে জিভের ডগা বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে গলাখাঁকারি দিলেন। গায়ের হালকা নীল সোয়েটারটা বারকয়েক টানলেন। ওঁর ইতস্তত ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন সেটা ভেবে খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর হ্যাঁচকা দিয়ে চলতে শুরু করা মোটরগাড়ির মতো কথা বলতে শুরু করলেন দীপ্তিমান।
এসিজির হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। অবশেষটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। দীপ্তিমানকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘নিন, শুরু করুন…।’
আপনমনেই ছোট করে কয়েকবার মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান। তারপর রেডিয়োতে শোকসংবাদ পাঠ করার মতো ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন ‘ব্যাপারটা যেখানে হয়েছে সেই বাড়িটা বাদুড়বাগান স্ট্রিটে। চার নম্বর বাড়ি। আর যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম চারুবালা মজুমদার। বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। তিনি ছিলেন ও-বাড়ির আশ্রিতা…।’ মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি যোগ করলেন, ‘আমি ওঁকে মা বলে ডাকতাম—চারুমা। আসলে আমি অনাথ। সংসারে আমার আপন বলতে কেউ কোনওদিন ছিল না। কিন্তু বছর পনেরো আগে চারুবালার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে কেমন যেন স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।’
রঘুপতি পকেট থেকে কাগজ-পেন বের করে দরকারমতো নোট নিচ্ছিল। ও জানে, স্মৃতির ওপরে পুরোপুরি নির্ভর না করে লিখে রাখাই ভালো। ওর স্যার অবশ্য মনে-মনে মাথায় সবকিছু লিখে নেন। নিজেকে থিঙ্কিং মেশিন বলে জাহির করাটা ওঁর পক্ষেই মানায়।
বিশু কফির ট্রে নিয়ে ঘরে এল। কফির কাপ আর বিস্কুটের প্লেট তিনজনের সামনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘মাসি আটটার পর এসে রান্না করে দেবে বলে গেছে।’
এসিজি ঘাড় নাড়লেন। মাসি বলতে ললিতের মা—এসিজির ঠিকে কাজের লোক।
বিশু চলে যেতেই এসিজি আর রঘুপতি কফির কাপে চুমুক দিলেন। দীপ্তিমানকে ইশারায় কফি খেতে অনুরোধ করলেন এসিজি। কিন্তু দীপ্তিমান যেন ওঁর ইশারা দেখেও দেখলেন না। কেমন এক শূন্য চোখে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
‘নিন, কফি নিন—।’ এসিজি বললেন।
‘ওঃ, হ্যাঁ—’ চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘যা বলছিলাম। চারুবালার সঙ্গে আমি স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে কেন জড়ালাম সে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোটবেলায় অনাথ আশ্রম থেকে কী করে যেন আমি দেওঘরের সৎসঙ্গ আশ্রমে পৌঁছে যাই। সেখান থেকে পরে কলকাতায় আসি। গড়পাড়ে একটা বাড়িতে সিঁড়ির তলায় একটা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। আর হালসীবাগানে সৎসঙ্গের একটা ছোট ব্রাঞ্চ আছে—সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিষে আমার আগ্রহ ছিল। বড় হয়ে সেই জ্যোতিষচর্চা করেই আমার দিন চলতে লাগল।
‘চারুবালা হালসীবাগানের আশ্রমে যাতায়াত করতেন। সেই থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ। খুব অল্পবয়েসে ওঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকেই উনি ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। সংসারে ভাই-ই ছিল ওঁর একমাত্র আপনজন। কিন্তু সেই ভাই—মনোহর রায়—বছরআষ্টেক আগে ক্যান্সারে মারা যান। এমনিতেই চারুবালার মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। আশ্রমে গিয়ে আমাকে তার কিছু-কিছু বলতেন। ভাই চলে যাওয়ার পর ওঁর দুর্দশা অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঁর উপায় ছিল না। কপদর্কহীন বিধবা আর কোথায়-ই বা ঠাঁই পাবে! আর আমি যেখানে থাকি সেখানে আমারই জায়গা হয় না, তো চারুমা!’
চোখে কী পড়েছে এই ভান করে বোধহয় চোখের কোণ মুছে নিলেন দীপ্তিমান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘চারুমা ঠিক কপর্দকহীন ছিলেন না। তবে ওঁর নিজস্ব চল্লিশ হাজার টাকা ওঁর বড় ভাইপো অজয়েন্দ্রর সঙ্গে জয়েন্টলি ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল। তার ওপরে চারুমার কোনও কন্ট্রোল ছিল না। আর, আজকের দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকায় কী-ই বা হয়!
‘লাস্ট চার-পাঁচ বছর ধরে চারুমার মাথায় একটু গোলমাল দেখা দেয়। ঠিক পাগল হয়ে যাননি, তবে খানিকটা ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। আমার কাছে এসে হঠাৎ-হঠাৎ ভাইয়ের বউ আর ভাইপোদের নামে নানান অকথা-কুকথা বলতেন। কখনও-কখনও বউমারা বা নাতি-নাতনিরাও বাদ যেত না। অনেক চেষ্টা করেও তখন ওঁকে শান্ত করা মুশকিল ছিল।
‘ব্যাপারটা আমি বয়েসের দোষ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁর কোনও-কোনও কথায় বুঝতাম, পাগলামির ঝোঁকে উনি যা-যা বলেন তার অনেকটাই সত্যি। হয়তো কারও কথায় বা ব্যবহারে ব্যথা পেয়েছেন, অভিমান হয়েছে—আমার কাছে এসে চারুমা সবকিছু যেন উগরে দিতেন। আমি ওঁকে সান্ত্বনা দিতাম, শান্ত করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যেটা ছিল—ওঁর বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই ওঁকে পাগলের মতো ট্রিট করতেন।
আমি—।’
দীপ্তিমানকে বাধা দিয়ে এসিজি বললেন, ‘উনি কীভাবে মারা গেছেন?’
স্রোতে আচমকা বাধা পড়ায় দীপ্তিমান পলকের জন্য যেন বেসামাল হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। আজ শুক্রবার। চারুমা মারা গেছেন শনিবার—সন্ধেবেলা।’
একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। দীপ্তিমানকে অফার করতে তিনি বললেন, ‘না, থাক। আমি কখনও-কখনও খাই।’
রঘুপতি যে সিগারেট খায় না তা এসিজি ভালো করেই জানেন।
সিগারেটে টান দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত জানতে চাইলেন, ‘চারুবালা ছাদ থেকে পড়ে গেলেন কীভাবে?
‘ওঁদের বাড়িটা ভীষণ পুরোনো। বহুবছর ধরেই ডেঞ্জারাস কন্ডিশানে রয়েছে। রিপেয়ার-টিপেয়ার কখনও করা হয়নি। রং চটে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে। ছাদের পাঁচিল জায়গায়-জায়গায় ভাঙা। কড়ি-বরগার অবস্থাও ভালো নয়। ও-বাড়ির ছাদের সাউথ-ওয়েস্টের দিকটায় মেঝেতে বড় একটা ফাটল আছে। তা ছাড়া, ওদিকটার পাঁচিলও ছিল ধসে পড়া। চারুমা সাধারণত ছাদে উঠতেন না। তবু হয়তো কোনও কারণে ভুল করে ওদিকটায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর…।’
মাথা নিচু করে আবার চোখ মুছলেন দীপ্তিমান।
‘পুলিশের কী আইডিয়া?’ প্রশ্নটা করল রঘুপতি যাদব।
কপালে হাত রেখে মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান ‘সরাসরি কোনও আইডিয়া পাইনি। আবছাভাবে যা শুনেছি তাতে পুলিশ ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্টই ভাবছে।’
‘আবছাভাবে শুনেছেন কেন?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান। কফির কাপে ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, ‘লুকোছাপা না করে একটা কথা আপনাকে খুলে বলি, ডক্টর গুপ্ত। ও-বাড়ির মানুষজন আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। বিশেষ করে আমার মামিমা—প্রভাবতী তো বছরদুয়েক ধরে আমাকে দেখতেই পারেন না।’
‘প্রভাবতী মানে?’
বিষণ্ণ হাসলেন দীপ্তিমান, বললেন, ‘মনোহর রায়ের বিধবা স্ত্রী। বয়েস প্রায় সত্তর। প্যারালিসিস হয়ে অনেকটাই কাবু। তবে তিনিই রায়বাড়ির শেষ কথা। সবাইকে সবসময় পায়ের আঙুলের ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। ও-বাড়িতে চারুমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মামিমা যেভাবে আমাকে কথা শোনাতেন তাতে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই প্রায় বছরখানেক হতে চলল, আমি ও-বাড়িতে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতাম। বিশেষ করে চারুমার অসুখ-টসুখের খবর পেলে তখন মামিমার অপমান সইতে হবে জেনেও যেতাম।’
‘আপনাকে এরকম ডিসলাইক করার পজিটিভ কোনও কারণ ছিল?’
আবার মলিন হাসলেন দীপ্তিমান : ‘থাকতে পারে—তবে আমার সেটা জানা নেই।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, ‘হয়তো ভেবে থাকবেন, চারুমা ওঁর শেষ সম্বল আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।’
‘চারুবালাদেবীর শেষ সম্বল কি অনেক কিছু ছিল?’ অশোকচন্দ্র সিগারেটে টান দিয়ে লম্বা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘তেমন কিছু আর কোথায়! ওই চল্লিশ হাজার টাকা…আর, গলার একটা সোনার হার…চার-সাড়ে চারভরি মতন হবে…। চারুমা সবসময় ওটা গলায় পরে থাকতেন। কিছুতেই কাছ-ছাড়া করতেন না।’ মাথা নামিয়ে আলতো গলায় দীপ্তিমান আরও বললেন, ‘পাগলামির সময়েও হারটার কথা চারুমার খেয়াল থাকত। ক’বছর ধরেই খালি আমাকে বলতেন, ‘দীপ্তিরে, তর বউরে এটা আমি দিয়া যামু। আর কাওরে দিমু না।’ আমি হেসে বলতাম, ‘চারুমা, বিয়া করলে তয় না বউ আইব।’ দীপ্তিমান হাসলেন আপনমনে, বললেন, ‘দু-বছর ধরে চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে একেবারে খেপে উঠেছিলেন। আমার সামান্য আয়…তার ওপরে শরীরে খুঁত আছে। আমায় কে বিয়ে করবে বলুন!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান ‘কিন্তু চারুমা কোনও কথা শুনতে চাইতেন না। যাকে সামনে পেতেন তাকেই আমার পাত্রী দেখার জন্যে রিকোয়েস্ট করতেন। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। কিন্তু চারুমা কষ্ট পাবেন এই ভেবে তেমন করে কিছু বলতে পারিনি। যাক, এখন নিয়তিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল।’
এসিজি চোখ ছোট করে কী যেন ভাবছিলেন। একটু ফাঁক পেতেই দীপ্তিমানকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘প্রভাবতীদেবীর সঙ্গে আপনার কখনও কথা-কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?’
একটু চিন্তা করে তারপর দীপ্তিমান জবাব দিলেন, ‘না, কখনও হয়নি।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ আপনমনেই মন্তব্য করলেন এসিজি। তারপর ‘আচ্ছা, প্রভাবতী তো জানতেন চারুবালার শেষ সম্বল কতটুকু। তা হলে তার জন্যে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন কেন? আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন—নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে।’
ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতরে হাতড়াতে শুরু করলেন দীপ্তিমান বসাক। এসিজি আর রঘুপতি চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর দীপ্তিমান মাথা নামালেন। এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘রায় পরিবারের অনেকেরই আমি কোষ্ঠীবিচার করেছি। পাথর-টাথরও অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, কখনও ওঁদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে দাম নিইনি, কিংবা ঝুটো পাথর দিয়ে ঠকাইনি। তবে মনোহরবাবুর—মানে, আমার মামার সবসময়েই একটা পেটের যন্ত্রণা হত। সেটা কমানোর জন্যে আমি একবার যজ্ঞ করেছিলাম, আর মামাকে পাথর দিয়েছিলাম। কিন্তু মামা শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারে মারা যান। এখন মনে পড়ছে…তারপর থেকেই প্রভাবতী আমার সঙ্গে একটু কোল্ড বিহেভিয়ার শুরু করেন। ধীরে-ধীরে সেটা আরও খারাপের দিকে গেছে। হয়তো আমি মামাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, এটাই আমার অপরাধ…।’ হাত উলটে হতাশার একটা ভঙ্গি করলেন দীপ্তিমান।
এসিজি একবার কাশলেন। এ-বছর শীত যাই-যাই করেও অন্তত বারদুয়েক ফিরে এসেছে। তাতেই এসিজির একটু ঠান্ডা লেগে গেছে। দীপ্তিমানের কথা তিনি যেমন মন দিয়ে শুনছেন তেমনই মনোযোগ দিয়ে ওঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ করছেন। ভদ্রলোককে এসিজির বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল।
এইবার এসিজি লাখ টাকার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন দীপ্তিমানের দিকে।
‘চারুবালার ব্যাপারটা আপনি অ্যাক্সিডেন্ট বলে মেনে নিতে পারছেন না কেন?’
এই প্রশ্নে দীপ্তিমান কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লেন। ওঁর মুখ যে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সেটা এসিজি ও রঘুপতি দুজনেরই চোখে পড়ল।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘আপনি তা হলে কী ভাবছেন? সুইসাইড, না মার্ডার?’
একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর ভেতরে-ভেতরে কোনও গোপন শক্তি সঞ্চয় করে বললেন, ‘সুইসাইডের তো কোনও প্রশ্নই নেই! চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। এ-অবস্থায় কেউ সুইসাইড করে না। তা ছাড়া, ওঁর গলার হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা হঠাৎ পাওয়া গেল চারুমা মারা যাওয়ার দিন। ছাদের ভাঙা জায়গাটার কাছেই পড়ে ছিল। কে ওটা চুরি করেছিল, কেন চুরি করেছিল, কেনই বা ওটা চারুমার মারা যাওয়ার দিন ছাদে ফিরে এল—এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই…।’
‘ফির ভি, অ্যাক্সিডেন্ট তো হতে পারে।’ রঘুপতি বলল।
রঘুপতির দিকে তাকালেন দীপ্তিমান ‘হ্যাঁ, হতে পারত—যদি না চারুমার শেষ একটা কথা আমার কানে বাজত…।’
‘কী কথা?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
দীপ্তিমান একটু ইতস্তত করলেন। ভুরু উঁচিয়ে দু-চোখে হাত ঘষলেন। যেন কোনও কারণে তিনি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপর দু-একটা টুকরো শব্দ করে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আগেই তো বলেছি, মামিমাদের বাড়িতে আমার যাতায়াতের অসুবিধে ছিল। চারুমা আশ্রমে এলে তবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হত। তবে ওঁর বয়েস হয়েছিল, একা-একা আসতে পারতেন না। পাড়ার একটি সাদাসিধে ছেলে—নাম, রতন—ওকে সঙ্গে করে আসতেন। কোনও খবর দেওয়ার থাকলে রতনকে দিয়ে বলে পাঠাতেন। মোটামুটি রতনই আমাদের মধ্যে অনেকটা টেলিফোনের কাজ করত।’ হাসলেন দীপ্তিমান ‘আর দরকার পড়লে আমি চারুমাকে ও-বাড়িতে ফোন করতাম। সে-নিয়েও অবশ্য চারুমাকে কথা শুনতে হত। প্রভাবতী নাকি বলতেন : ”দিদি, আপনার এত ফোন আসে কেন? এ-বয়েসে এত ফোন আসা ভালো না।” অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন!…যাই হোক, চারুমা বোধহয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলেন। এমন কিছু, যেটা ভালো কাজ নয়। তাই মারা যাওয়ার দিনদশেক আগে থেকেই একটা কথা ওঁর মুখে শুনতাম : ”ছি ছি ছি, এই অন্যায় আমি সইহ্য করুম না! কিয়ের লেইগ্যা সইহ্য করুম? সারাটা জীবন সংসার আমারে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া খাইল। পাঁচকান কইর্যা দিলে বুঝব’অন ঠ্যালা! আমারে চিনে না।” ‘
‘কী অন্যায় তিনি পাঁচকান করে দেওয়ার কথা বলছিলেন সেটা আপনি জানতে চাননি?’
‘আমি অনেকবার চারুমাকে জিগ্যেস করেছি—কিন্তু চারুমা কোনও স্পষ্ট জবাব দেননি। বরং পাগলামির তোড়ে ভেসে গেছেন। পরে কখনও জানতে চাইলে বলতেন, ”কী কস? কুন কথা পাঁচকান করুম? আমি কইসি!” মানে, ওঁর ব্যাপারটা আর মনে পড়ত না। ও-বাড়ির সকলেই বোধহয় চারুমার এ-কথা শুনেছে। হয়তো পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়েও দিয়েছে…’ একটু থামলেন দীপ্তিমান। তারপর সিরিয়াস গলায় বললেন, ‘…শুধু একজন ছাড়া। যে সেই অন্যায়টা করেছিল। সে ব্যাপারটাকে মোটেই পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়নি। বরং ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, পাগল বিধবাটা এই বোধহয় ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আর প্রভাবতী একবার জানতে পারলেই সর্বনাশ! চরম শাস্তি দিয়ে ছাড়বেন। ওঁকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। তাই সেই লোকটা হয়তো ভয় পেয়েই পাগল বিধবাটাকে কিছু একটা…’ দীপ্তিমানের গলা বুজে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে জড়ানো গলায় তিনি কোনওরকমে বললেন, ‘ওই পাগল বিধবাটাকে আমি ”মা” ডেকেছিলাম। ঈশ্বর জানেন, ওঁর গয়না বা টাকাপয়সার জন্যে কোনও লোভ আমার ছিল না। ঈশ্বর জানেন, চারুমা মারা যাওয়ায় আমি কী কষ্ট পেয়েছি। আমি…আমি…।’
আর বলতে পারলেন না দীপ্তিমান। মাথা নিচু করে বাচ্চাছেলের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
এসিজি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। দীপ্তিমানকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘আপসেট হবেন না, দীপ্তিমানবাবু…প্লিজ। যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না!’
রঘুপতি যাদব চুপচাপ নোট নিচ্ছিল। দীপ্তিমানের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিল।
হাতের সিগারেট কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসিজি সেটা অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে বারকয়েক কাশলেন। মেয়ে ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত সিগারেট হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাসন করার মতো কেউ আর কাছে নেই। যে সবচেয়ে কাছাকাছি থাকত, সবসময় থাকত, সে চলে গেছে বছরদশেক আগে। আকাশে। সেখানে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুললেন দীপ্তিমান। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ফোনে আপনাকে এসব কথা বলতে পারিনি। বুঝতেই তো পারছেন, বলা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি কাইন্ডলি চারুমার মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখেন তা হলে আমি শান্তি পাব। চারুমার জন্যে আমি কর্তব্য করতে পারিনি। এমনকী মুখাগ্নিও ওরা করতে দেয়নি আমাকে। হয়তো শ্রাদ্ধের সময়েও ডাকবে না। তাই আমার খুব ইচ্ছে, ওঁর মৃত্যুতে যে শুধুমাত্র নিয়তির হাত ছিল না, সেটা প্রমাণ হোক। তা হলেই আমার শান্তি। আপনি আমাকে ফেরাবেন না…প্লিজ। আপনার ফিজ আমি দেব…হয়তো খুব বেশি পারব না…।’ জল-ভরা চোখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন দীপ্তিমান।
‘এ কী করছেন! শান্ত হয়ে বসুন।’ এসিজি বললেন, ‘ফিজের কথা আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। বরং ও-বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আর যা-যা জানেন সেগুলো আমাকে বলুন। কাজে নামার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা যতটা ডিটেলে জানা যায় ততই কাজের সুবিধে। আর আপনার খোলাখুলি মতামতও বলবেন কিন্তু…।’
এরপর দীপ্তিমান বলে চললেন, আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে আধবোজা চোখে সব শুনতে লাগলেন। রঘুপতি যথারীতি কাগজ-কলম নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যস্ত হল।
বিশু ফরমাশ পেয়ে আর-একদফা কফি দিয়ে গেল।
এসিজির আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে লাগল। আর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দীপ্তিমানের কথা শেষ হল।
এসিজি ওঁকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘সম্ভবত আমি রোববার প্রভাবতীদের বাড়িতে যাব। তার আগে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি.-র সঙ্গে কথা বলে রঘুপতি ফরমালিটিগুলো সেরে রাখবে। তা না হলে ইনভেস্টিগেশানে প্রবলেম হতে পারে। আপনাকে খবর পাঠিয়ে দেব। সেদিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
‘তাতে মাসিমা হয়তো মাইন্ড করতে পারেন।’ দীপ্তিমান বললেন।
‘মাইন্ড করলেই হল!’ বলল রঘুপতি যাদব, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, মিস্টার বসাক। দ্যাট ইজ মাই প্রবলেম। কী বলেন, গুপ্তাসাব?’
রঘুপতির শেষ প্রশ্নটা প্রাক্তন স্যার এসিজিকে লক্ষ করে।
এসিজি হাসলেন। রঘুপতির মেজাজ যখন-তখন হারিয়ে যায়। তাই এসিজি প্রায়ই ওকে সাবধান করে বলেন, ‘রঘুপতি, ডোন্ট লুজ ইয়োর টেম্পার। ওটা খুব দামি জিনিস।’
দীপ্তিমান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একদফা অনুরোধ করে গেলেন অশোকচন্দ্রকে।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘স্যার, রঙ্গলালবাবুকে কি ইনফর্ম করতে হবে?’
প্রশ্নটা শুনে এসিজির হাসি পেয়ে গেল। আজকাল এমন একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে যে, তদন্তের সময় স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামী পাশে-পাশে না থাকলে তিনি যেন ঠিক মেজাজ পান না। ‘লালমহল’-এর চুনিলালবাবুর দামি পাথর খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁর ভাই রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গে এসিজির প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে স্বভাবকবি রঙ্গলাল এসিজির গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। রঙ্গলালের প্রশংসার দুটি অভিনব নমুনা মনে পড়ল এসিজির ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’, আর ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি’। এই স্বভাব-কবি কখনও এসিজির ‘তদন্তরসে’ বঞ্চিত হতে চান না।
সুতরাং, হাসতে-হাসতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতিকে বললেন, ‘ওঁকে ইনফর্ম অবশ্যই করবে, রঘুপতি। তা না হলে, ওঁর মতো স্বভাব-কবিতায় বলি—তোমার আমার মুন্ডুপাত/হয়ে যাবে অকস্মাৎ।’
রঘুপতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল প্রাক্তন স্যারের টেলিফোনের দিকে।
এসিজি পায়ে-পায়ে চলে এলেন জানলার গা ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে। এটা তাঁর পাঁচমিশেলি কাজের টেবিল। টেবিলে বই, পেন, কাগজপত্র সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা রুবিক কিউব।
রঙিন কিউবটা হাতে নিয়ে তার একটা থাক মোচড় দিতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র। সাজানো রংগুলো ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল।
আপনমনে বিড়বিড় করে এসিজি বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড, না মার্ডার?’
‘…কে দেবে তার কারেক্ট আনসার।’
প্রভাবতীদের পুরোনো পলেস্তারা-খসা বাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে আগের দিনের বিড়বিড় করে বলা কথাটাই জোরে-জোরে উচ্চারণ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। প্রশ্নটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী রঙ্গলালবাবুর দিকে। ব্যস!
রঙ্গলাল তৎক্ষণাৎ ওঁর স্বভাব-কবিতা রচনার তীব্র প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ছন্দ মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
এসিজি হেসে বললেন, ‘উত্তর দিতে হবে আমাকেই। কোনও উপায় নেই। আমাকে নিয়ে রঘুপতির অনেক গর্ব। ওর মানটা তো বাঁচাতে হবে!’
প্রভাবতীদের বাড়িটা দেখামাত্রই ফিটন গাড়ি, ভোরবেলা গঙ্গার জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া, ভিস্তিওয়ালা—এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। একটা ভাঙা শ্বেতপাথরের ফলকে শুধু ‘…নিবাস’ টুকু পড়া যাচ্ছে। তিনতলা বাড়ির এখানে-সেখানে বট-অশ্বত্থের চারা মাথাচাড়া দিয়েছে। হালকা শীতের বাতাসে তাদের রোদ-চকচকে পাতা নড়ছে।
আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মার সঙ্গে রঘুপতি কথা বলে নিয়েছিল। কেসের ফাইলের একটা কপিও রঘুপতি পৌঁছে দিয়েছে এসিজিকে। তারপর জরুরি একটা তদন্তের কাজে ওকে আচমকা ভুবনেশ্বর চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তার আগে ও সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে।
প্রভাবতীদের বাড়িতে বিজন শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন ইনভেস্টিগেটর দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে রবিবার সকাল ন’টায় প্রভাবতীদের বাড়িতে আসবেন। বাড়ির প্রত্যেকে যেন তাঁর সঙ্গে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কো-অপারেট করেন। তা না হলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারে।
সুতরাং, রবিবার সকালে এসিজি, রঙ্গলাল ও দীপ্তিমান, পৌঁছে গেছেন প্রভাবতীদের বাড়িতে।
বিশাল সদর দরজায় বিশাল মাপের কড়া। বোঝাই যায়, কলিংবেলের ব্যাপারটা আধুনিক সংযোজন।
বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। বছর পঞ্চাশের একজন টাক-মাথা ভদ্রলোক বিগলিত হেসে এসিজিদের অভ্যর্থনা জানালেন। তবে দীপ্তিমানকে দেখামাত্রই তাঁর ফরসা কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।
‘আসুন, আসুন, ডক্টর গুপ্ত।’ রঙ্গলালবাবুকে নমস্কার জানিয়ে বললেন তিনি, ‘থানা থেকে আমাকে সবকিছু জানিয়ে আগাম খবর দিয়ে দিয়েছে। আমার নাম অজয়েন্দ্র—অজয়—আমারই পিসিমণি অ্যাক্সিডেন্টালি ছাদ ধসে পড়ে মারা গেছেন।’
এসিজি কিছু বলার আগেই রঙ্গলাল গোস্বামী ভুল ধরিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি হলেম রঙ্গলাল স্বভাব-কবিবর/উনি হলেন এসিজি গোয়েন্দাপ্রবর।’
কবিতার আকস্মিক দাপটে অজয়েন্দ্র কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলেন রঙ্গলালের কীর্তনীয়াগোছের চেহারার দিকে।
এসিজি সামান্য হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিস্টার রায়—আমরা ওই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে এসেছি। মানে…ব্যাপারটা তো সুইসাইডও হতে পারে। পুলিশ ঠিক সেই অ্যাঙ্গেলটা এক্সপ্লোর করে দেখেনি।’
অস্বস্তির হাসি হাসলেন অজয়েন্দ্র : ‘মানে, কেউ কি পুলিশে কোনও নালিশ-টালিশ করেছে?’
অশোকচন্দ্র লক্ষ করলেন, অজয়েন্দ্রর চোখ চট করে দীপ্তিমানকে ছুঁয়ে গেল।
‘না, নালিশ-টালিশ কেউ করেনি। পুলিশই ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে।’ তারপর একটু শক্ত গলায় বললেন, ‘হঠাৎ আপনার নালিশের কথা মনে হল কেন?’
‘মা বলছিল এই সাধারণ ব্যাপারটাকে নিয়েই হয়তো জল ঘোলা হবে—তাই।’ গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বোলালেন অজয়েন্দ্র।
বসবার ঘরে ওঁদের বসাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এসিজি বাদ সাধলেন ‘কিছু মনে করবেন না, আমরা আগে ছাদে যাব। জায়গাটা ভালো করে দেখব। তারপর আপনাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেব।’
‘সামান্য একটু চা-টা না খেলে কি চলে…।’ ইতস্তত করলেন অজয়বাবু।
‘সে পরে হবেখ’ন—’ জবাব দিলেন রঙ্গলাল, ‘থিতু হয়ে বসব যখন।’
ছন্দের গন্ধ পেয়ে এসিজি আড়চোখে তাকালেন রঙ্গলালের দিকে। কবিবর কাঁচুমাচু মুখ করে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন। দীপ্তিমান কিছু বললেন না, তবে রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতা উপভোগ করছিলেন।
‘মা জানতে পারলে খুব রেগে যাবেন…’ বিড়বিড় করে এই কথা বলতে-বলতে অজয়েন্দ্র ওঁদের নিয়ে চললেন ওপরে।
সবসময়েই অশোকচন্দ্র গুপ্ত প্রথম অকুস্থল দেখাটা পছন্দ করেন। ওঁর মতে, আগে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরে অকুস্থল দেখলে দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক নিরপেক্ষ থাকে না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে এসিজি বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
ঢালাই লোহার রেলিং, মেঝেতে সাদা-কালো পাথর বসানো, দেওয়ালের খানিকটা পর্যন্ত সাদা টালি, লাল-নীল-সবুজ-হলদে কাচের শার্সি, বারান্দার সিলিং এর কার্নিশে গোলা পায়রার আস্তানা। তবে শুধু গোলা পায়রাগুলোই চকচকে-ঝকঝকে নতুন—বাকি সবই ময়লা, চিড় ধরা, ভাঙা।
বাড়ির ভেতরটায় যেরকম অন্ধকার-অন্ধকার ভাব ছিল, ছাদে পা দিতেই ছবিটা বদলে গেল। অকৃপণ রোদ সেখানে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
বিশাল ছাদ। সেখানে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে তা হল, কাপড় ছড়ানোর গোটা সাত-আট দড়ি নানান কায়দায় এ-মাথা ও-মাথা বাঁধা রয়েছে। কোনওটা নাইলনের দড়ি, কোনওটা সাদা কাপড়ের তৈরি, আর কোনওটা নিতান্তই পুরোনো শাড়ির পাড়।
ছাদের ডানদিকে প্রচুর টব। সেখানে সাধারণ সস্তার গাছ। কেউ কখনও টবগুলোর যত্ন নেয় বলে মনে হয় না। টবের সারির পিছনের পাঁচিলে দুটো কাক বসে আছে।
ছাদের মেঝেতে কম করেও তিন-চার জায়গায় ফাটল ধরেছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটায় পাঁচিল ভাঙা, মেঝের খানিকটা অংশ নেই।
এসিজির নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘পিসিমণি ওখানটা দিয়েই পড়ে গেছেন।’
এসিজি পায়ে-পায়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলেন। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই অজয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আর যাবেন না! আর যাবেন না!’
এসিজি থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালেন।
সে-চাউনিতে প্রশ্ন ছিল। তার উত্তরে ছাদের মেঝের দিকে আঙুল দেখালেন অজয়েন্দ্র ‘ওই দেখুন, দাগ দিয়ে সাবধান করা আছে। ওই দাগের ও-পাশে আমরা কেউ কখনও যাই না। করপোরেশান দুবার নোটিশ দিয়ে গেছে। বাচ্চাদের তো ছাদে ওঠাই বারণ—।’
এসিজি লক্ষ করে দেখলেন। সত্যিই সাদা তেল রং দিয়ে অপটু হাতে একটা চওড়া দাগ টানা আছে। দাগের ও-পাশে বেশ বড় মাপের একটা ফাটল—দেখলে ভয় হয়। সেই ফাটল ফুট তিনেক যাওয়ার পরই বড় হাঁ হয়ে গেছে। ছাদের সেই অংশটা চারুবালাকে নিয়ে ধসে পড়েছে নীচে। খোঁদল দিয়ে দোতলার একটা ঘরের অংশ নজরে পড়ছে।
এসিজিদের নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘ও-ঘরটায় কেউ থাকে না। এমনই স্টোররুম মতন—।’
একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। ধোঁয়া ছাড়লেন কয়েকবার। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন।
বাড়ির কেউ ওই দাগের ও-পাশে যেত না। সবাই ব্যাপারটা জানত। তা হলে চারুবালা গেলেন কেন? সে কি ওঁর মাথায় ছিট ছিল বলেই?’
‘দাগটা কবে আঁকা হয়েছে, অজয়বাবু?’
‘প্রায় সাত-আট বছর আগে। রং চটে গেলে আমিই আবার লাগিয়ে দিই।’
‘লাস্ট কবে রং লগিয়েছেন?’
‘তা প্রায় বছরখানেক হবে।’ একটা ছোট ঢেঁকুর তুললেন অজয়েন্দ্র, পেটে বারকয়েক হাত বোলালেন।
দীপ্তিমান বলেছেন, চারুবালার মাথায় ছিট দেখা দেয় চার-পাঁচ বছর ধরে। দাগ দেওয়ার ব্যাপারটা তারও আগের—চারুবালা যখন সুস্থ ছিলেন। তা ছাড়া, ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়ার পরেও এতদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। নাকি চারুবালা প্রায়ই ছাদের ওই বিপজ্জনক অংশে যাতায়াত করতেন? তারপর হঠাৎ একদিন ওই অংশটা ওঁকে নিয়ে ধসে পড়েছে?
‘আপনার পিসিমা ছাদে কি প্রায়ই উঠতেন?’
‘না, না।’ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন অজয়েন্দ্র, ‘বরং বলতে পারেন ন’মাসে ছ’মাসে কখনও-কখনও রোদ পোয়াতে উঠতেন। পিসিমণির অনেক বয়েস হয়েছিল। হাঁটুতে গেঁটে বাত ছিল। ওই শনিবার…মানে, যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হয়…কেন উঠেছিলেন কে জানে?’
এসিজি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। যে-মানুষ্টা ছাদে বলতে গেলে প্রায় আসতই না, সে হঠাৎ ছাদে উঠতে গেল কেন? আত্মহত্যা করার জন্য?
সুস্থ অবস্থা থেকেই লক্ষ্মণের গণ্ডি ওই সাদা দাগ দেখে এসেছেন চারুবালা। অসুস্থ অবস্থায় ওঁর কি সেসব কিছুই মনে ছিল না?
সাদা দাগটাকে ধরে ছাদের পাঁচিলের কাছে চলে গেলেন এসিজি। লক্ষ করলেন, পাঁচিলের গায়েও সরু-সরু ফাটল। গলা বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে নীচের গলির দিকে তাকালেন।
ঘাড় ঘুরিয়ে অজয়বাবুকে ডাকলেন এসিজি ‘অজয়বাবু, আপনার পিসিমার বডিটা কোন জায়গায় পড়েছিল দেখান তো—।’
অজয়েন্দ্র এসিজির পাশে চলে এলেন। আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন জায়গাটা ‘ওই যে—ওইখানটায়…।’
এখান থেকে পড়লে কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু চারুবালা যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তা হলে ছাদের ওই ভাঙা জায়গাটাকেই বা বেছে নিলেন কেন! অন্য বহু জায়গা দিয়েই তো নীচে লাফ দেওয়া যেত!
‘আপনি জানেন, আপনার পিসিমার ডানহাতের মুঠোয় একটা ক্লিপ পাওয়া গিয়েছিল?’ অজয়েন্দ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন এসিজি।
‘ক্লিপ!’ অজয়েন্দ্র কেমন হকচকিয়ে গেলেন।
‘হ্যাঁ—’ সিগারেটে আয়েসী টান দিয়ে এসিজি বললেন ‘কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ। লাল রঙের।’
ক্লিপের তথ্যটা এসিজি কেস-ফাইল থেকে পেয়েছেন। পুলিশ এটা নিয়ে আর এগোয়নি কেন কে জানে!
‘ন-না, আমি তো শুনিনি।’ থতমত খেয়ে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘জানলে মা হয়তো জানবে।’
‘আপনার পিসিমা কি কখনও-কখনও কাপড় ছড়াতে ছাদে উঠতেন?’
‘আগে হয়তো উঠতেন—এখন আর বয়েসের জন্যে পারতেন না। আরতিই মা আর পিসিমার সব কাজ করে দেয়।’
দীপ্তিমানের কাছে সব শুনেছেন অশোকচন্দ্র। সেরিব্রাল হেমারেজের পর প্রভাবতী প্রায় পঙ্গু হয়ে যান। তারপর ফিজিয়োথেরাপি, আকুপাংচার, আরও বহুরকম চেষ্টাচরিত্র করে ওঁর শরীর অনেকটা সচল হয়। এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা-চলা করতে পারেন। তবে সিঁড়ি ভাঙতে একেবারেই পারেন না। আরতি নামে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে প্রভাবতীর রাত-দিনের সঙ্গী।
এমনসময় একজন ভদ্রমহিলা ছাদে এলেন। ময়লা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। ছাদের দরজার কাছ থেকেই তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তোমাকে মা ডাকছে—।’
অজয়েন্দ্র ওঁর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘যাও, যাচ্ছি।’
‘যাচ্ছি বললে হবে না—মা এক্ষুনি যেতে বলেছে।’ বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।
এসিজি অনুমান করলেন, ইনি অজয়েন্দ্রর স্ত্রী মনীষা।
‘আমি যাই—’ অজয়েন্দ্র এসিজিকে বললেন, ‘আপনারা কাজ সেরে দোতলায় মায়ের ঘরে আসুন।’
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন এসিজি। তাতে ছাদের ভাঙা জায়গাটার একটা স্কেচ আঁকা ছিল। সেটা সামনে ধরে আসলের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে লাগলেন।
একটু পরে বললেন, ‘সোনার চেনটা ওইখানটায় পড়ে ছিল।’
উৎসুক দীপ্তিমান ও রঙ্গলাল এসিজির কাছে এলে ওঁর হাতের কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। স্কেচের একটা জায়গায় একটা কাটা চিহ্ন আঁকা ছিল। সেটাতে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘ধসে পড়া পোরশানটার ঠিক পাশেই হারটা পাওয়া গেছে। চারুবালা ওটা হাতে তুলে নেওয়ারও সময় পাননি।’
‘হারটা হারানোর পর কী করে এখানে আবার ফিরে এল বলুন তো!’ দীপ্তিমান যেন আপনমনেই বললেন।
ছাদটা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখার পর এসিজি বললেন, ‘চলুন, নীচে যাই।’
হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছাদে ফেলে পায়ে রগড়ে দিলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘সে-কথাই তো ভাবছি…।’
রঙ্গলাল গোস্বামী আচমকা মন্তব্য করলেন, ‘এসিজি স্যার, এ-বাড়িতে মোট চারটে ফ্যামিলি থাকে।’
‘কী করে বুঝলেন?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
‘অ্যান্টেনা গুনে।’ হেসে বললেন রঙ্গলাল, ‘ফ্যামিলি পিছু একটা করে অ্যান্টেনা—চারটে অ্যান্টেনা, চারটে ফ্যামিলি।’
‘দারুণ বলেছেন।’ বলেই কী যেন ভাবলেন এসিজি। তারপর দীপ্তিমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছিলেন, প্রভাবতীর দু-ছেলে—অজয়েন্দ্র, বিজয়েন্দ্র। দুটো ফ্যামিলি, দুটো অ্যান্টেনা, আর-একটা অ্যান্টেনা ধরে নিচ্ছি প্রভাবতীর। তা হলে চার নম্বরটা কার? চারুবালার?’
‘কী যে বলেন!’ হেসে ফেললেন দীপ্তিমান ‘চারুমার জন্যে আলাদা টিভি! তা ছাড়া, দোতলার গলির দিককার একটা বড় ঘরে মামিমা আর চারুমা একসঙ্গে থাকতেন। তবে ঘরের টিভিটা অন-অফ হত মামিমার কথায়। ওই বাড়তি অ্যান্টেনাটা মামিমার বড় মেয়ে সুনন্দাদির। আপনাকে সেদিন বোধহয় বলিনি—মামিমার মেয়ে-জামাই এ-বাড়িতেই থাকেন। ঘরজামাইগোছের বলতে পারেন। সুনন্দাদির হাজব্যান্ড অমলেশদা কন্সস্ট্রাকশনের কীসব বিজনেস করেন। তবে চারুমা বলতেন, সে বিজনেসে নাকি সবসময়েই লস হত। প্রায়ই নাকি ছেলেদের লুকিয়ে অমলেশদা মামিমার কাছ থেকে টাকা নিতেন। মামিমার সব পুঁজি তো এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘চলুন, এবার নীচে যাওয়া যাক। সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে—বিশেষ করে আপনার মামিমার সঙ্গে।’
দীপ্তিমান কাঁচুমাচু মুখ করে তাকালেন এসিজির দিকে ‘মামিমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি সামনে না থাকলে হয় না? উনি একদম শিওর ভাববেন আমি আপনাদের ডেকে এনে অকারণে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পাকাচ্ছি…।’
এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন কেন! উনি কিছুই বলবেন না…।’
ওঁরা তিনজনে নীচে নামছিলেন। দীপ্তিমানের নামতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ছাদে রোদে ঘুরে যেটুকু তেতে উঠেছিলেন, বাড়ির ছায়ায় ঢোকামাত্রই ঠান্ডা আমেজ ওঁদের ঘিরে ধরল। ড্যাম্প-ধরা, পুরোনো বাড়ির বাড়তি শীত ওঁরা টের পেলেন।
কোথাও বকবকম করে গোলাপায়রা ডাকছিল। হঠাৎই সে-আওয়াজ ছাপিয়ে ঝগড়ার রুক্ষ চিৎকার ওঁদের কানে এল।
অজয়েন্দ্র কাউকে বলছিলেন, ‘পিসিমণির ওই টাকার আবার শেয়ার কী! পিসিমণি ঠিক করেছিল টাকাটা আমাকেই দিয়ে যাবে—তাই আমার সঙ্গে জয়েন্ট ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। মা বললেই তোদের ভাগ দিতে হবে নাকি!’
উত্তরে কোনও মহিলার চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল।
‘অজু, বুঝেশুনে কথা বল। তোর সঙ্গে জয়েন্ট নামে রাখা মানেই সব তোর হয়ে গেল! ওই টাকা দিয়ে পিসিমণির কাজ হবে। ও-টাকার ভাগ আমার দরকার নেই।’
দীপ্তিমান চাপা গলায় বললেন, ‘সুনন্দাদি—অজুদা-বিজুদার বড়দি।’
অজয়েন্দ্র তখন বলছেন, ‘তোর আবার ভাগ দরকার হবে কেন! তুই আর অমলেশদা তো যা পেরেছিস এর মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিস। ভাবিস, কিছু টের পাই না, জানি না! মা-কে বশ করে আমাদের এগেইনস্টে লেলিয়ে দেওয়া! আমি বিজুকে সব বলব। তারপরে…।’
‘অজু, কী হচ্ছে! চুপ কর বলছি!’ এক বৃদ্ধার তেজী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সুনন্দা, তুই নিজের ঘরে যা। বাড়িতে এখন বাইরের লোক এসেছে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল যা কিছু পরে মেটানো যাবে।’
সঙ্গে-সঙ্গে সব চুপচাপ। ভয় অথবা ভক্তি ছাড়া এ-ধরনের ‘জো হুজুর’ ছেলেমেয়ে আজকের দিনে পাওয়া মুশকিল।
‘বুঝতে পারলেন তো…মামিমা!’ দীপ্তিমান চাপা গলায় আবার বললেন।
এসিজি মাথার চুলের গোছায় দু-বার টান মেরে বললেন, ‘আমাদের প্রভাবতীদেবীর কাছে নিয়ে চলুন।’
দীপ্তিমান চমকে ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে। বোধহয় ‘দেবী’ শব্দটা ওঁর কানে লেগেছে।
রঙ্গলাল এতক্ষণ গুম মেরে সব শুনছিলেন। হঠাৎই বললেন, ‘লোভ অতি সর্বনাশা/চেঙ্গিস খাঁ, কামাল পাশা।’
এসিজি স্বভাব-কবিবরের দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঁর স্বভাব-কবিতায় উপমা, প্রতীক ইত্যাদি এতই অদ্ভুত যে, প্রথম-প্রথম শ্রোতারা একটু ধাক্কা খায়।
দীপ্তিমান হাসি চাপছিলেন, ছোট্ট করে বললেন, ‘এ-বাড়িতে লোভ একটা মেজর জায়গা নিয়ে আছে। কারণ, টাকাপয়সা, সম্পত্তি সবকিছুর কন্ট্রোল মামিমার হাতে।’
‘তা হলে সোনার হারটা ছাদ থেকে চুরি গেল না কেন?’ রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন।
‘ওটাই তো আমার আসল খটকা।’ আনমনাভাবে অশোকচন্দ্র বললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করে বসালেন।
ওঁরা প্রভাবতীর ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওষুধ আর ফিনাইলের হালকা একটা গন্ধ সকলের নাক ছুঁয়ে গেল।
বৃদ্ধা একটা লম্বা সোফায় বসে ছিলেন। সামনে দুটো টেবিল। তাতে দুটো ছোট রেডিয়ো, কিছু ম্যাগাজিন, বইপত্তর, আর একটা দম দেওয়া কলিংবেল।
ঘরটা মাপে বেশ বড়। মেঝেতে পুরোনো দিনের মার্বেল পাথর। দু-প্রান্তে দুটো খাট। দেখে বোঝা যায়, একটা প্রভাবতীর—অন্যটায় চারুবালা শুতেন। দুটো আলমারি। একটা ছোট টিভি। আর একটা ড্রেসিং টেবিল।
প্রভাবতীর রোগা শরীরে সাদা শাল জড়ানো। চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। মাথায় ঘোমটা। সামনের দিকের চুলে এখনও কালো ছোপ রয়েছে। হাতে সরু-সরু দু-গাছা চুড়ি। আর ডানহাতে একটা লাঠি।
ঘরে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। এসিজি অনুমানে বুঝলেন, আরতি।
দীপ্তিমান পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং দেওয়ামাত্রই প্রভাবতী ওঁকে অনেকটা হুকুমের সুরে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পারো। আমাদের কথাবার্তার সময় তোমার থাকার দরকার নেই।’ তারপর আরতির দিকে ফিরে : ‘ওদিকের জানলাটা খুলে দে। আর টেবিলের ওই ঘটি থেকে আমাকে আধগ্লাস জল দে।’
প্রভাবতীর কাছাকাছি চারুবালার খাটের কিনারায় এসিজিরা বসেছিলেন। এসিজি সূক্ষ্ম নজরে রুগ্ন ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধাকে দেখছিলেন। সারা মুখে অহঙ্কারের ছাপ। এমনকী বলিরেখাগুলোও সেই অহঙ্কারী ঢঙে সামিল হয়েছে।
এসিজির গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেটের জন্য। কিন্তু এখানে সিগারেট মানায় না। একটু কেশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিসেস রায়, দীপ্তিমানবাবু আমাদের সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি।’
‘তার মানে! কী বলতে চান আপনি! আমাদের ফ্যামিলির কথা বাইরের কোন এক দু-পয়সার জ্যোতিষীর সামনে বলতে হবে!’ ঘাড় কাত করে ওপরওয়ালার ভঙ্গিতে এসিজির দিকে দেখলেন প্রভাবতী : ‘আপনার কাছে ও জরুরি হতে পারে, আমার কাছে নয়।’
এরপর আর কোনও কথা চলে না।
দীপ্তিমান মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এসিজির দিকে ‘আপনাকে বলেছিলাম না!’ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
‘চারুবালা কীভাবে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়?’ এসিজি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
‘সবাই যা জানে তাই—’ আরতির দেওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিলেন ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’ তারপর আরতিকে : ‘তোকে আধগ্লাস বললাম, এতটা দিলি! যা বাকি জলটা ঘটিতে ঢেলে রাখ। ঘটিটা ঠিকমতো ঢাকা দিবি। কোনও কাজের একটা ছিরি নেই।’
আরতি কোনও জবাব না দিয়ে হুকুম তামিল করল।
‘যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয় তবে আর কীভাবে চারুবালা মারা যেতে পারেন?’
বিরক্তির একটা শব্দ করে বৃদ্ধা বললেন, ‘সুইসাইড হতে পারে। পাগলের খেয়াল—কী করে বলব বলুন!’
‘খুনও হতে পারে।’
‘তার মানে! খুনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে! তখন তো ছাদে আর কেউ যায়নি!’
‘আপনি কী করে জানলেন?’ এসিজি হেসে প্রশ্ন করলেন। তারপর ‘আপনি শুধু আপনারটা বলতে পারেন।’
‘না, আমি জানি। দিদি যখন ছাদে যায়—ছাদ থেকে পড়ে যায়—তখন এ-ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি কতকগুলো জরুরি কথা বলছিলাম। অমলেশ বাড়ি ছিল না। আপনারা যেখানে বসে আছেন, অজু-বিজু, ওদের দু-বউ, ওখানে বসেছিল। আর সুনন্দা আমার বিছানায়। আরতি নীচে কলতলায় গিয়েছিল। এরপর বাকি রইল বাচ্চারা। ওরা নিশ্চয়ই তাদের ”দিদু”কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি!’
অশোকচন্দ্রের মনে হল তিনি কোনও জজসাহেবের এজলাসে বসে আছেন। প্রভাবতীর কথা শুনে মনে হল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি যেন আগেভাগেই জেনে তৈরি করে নিয়েছেন।
রঙ্গলাল এসিজিকে দেখছিলেন। থিঙ্কিং মেশিনকে খানিকটা যেন নাজেহাল দিশেহারা লাগছে।
‘আপনার দিদির হাতে কাপড় ছড়ানোর একটা ক্লিপ ছিল। উনি কি তখন কাপড় ছড়াতে গিয়েছিলেন, না তুলতে গিয়েছিলেন?’
‘পাগলের কখন কী খেয়াল হয়, আমি কী করে জানব!’
এসিজি দু-হাতের দশ আঙুল মাথায় ঠেকালেন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘পুলিশ এসে ছাদে কিন্তু কোনও কাপড় পায়নি।’
‘বললাম তো, পাগলের খেয়াল! হয়তো ক্লিপ হাতে এমনই ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল।’
‘ওঁর সোনার হারের ব্যাপারটা জানেন তো!’
‘জানাজানির আবার কী আছে! ওটা হয়তো দিদির কোমরেই বরাবর গোঁজা ছিল—ছাদে কোনওভাবে খসে পড়েছে।’
‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চারুবালা কারও একটা গোপন অন্যায় দেখে ফেলেছিলেন। সেটার কথা উনি মাঝে-মাঝেই বলতেন। আপনি কখনও শুনেছেন?’
‘না তো!’ তারপর আরতিকে : ‘বেলা হয়ে গেছে। তুই গিয়ে আমার স্নানের গরম জল বসিয়ে দে। কালকের মতো বেশি গরম করিস না।’
আরতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
‘ভালো করে মনে করে দেখুন, মিসেস রায়। কোনও কিছু একটা জেনে ফেলার ব্যাপারে…।’
‘আপনি কার থেকে এসব আজেবাজে কথা শুনেছেন বলুন তো!’
এসিজি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। এও বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই প্রভাবতীর কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন।
প্রভাবতী সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োর এফ. এম. চ্যানেল চালিয়ে শুনতে শুরু করলেন। গলা তুলে বললেন, ‘যাওয়ার আগে একটু চা-টা খেয়ে যাবেন—।’
একতলার দিকে নেমে-যাওয়া সিঁড়ির পাশে দীপ্তিমান অপাংক্তেয়র মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁর কাছে এসে বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। এবারে ছোটভাই আর দু-ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, ও-ঘরে চলুন। বিজুদার ঘরে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে।’
বিজয়েন্দ্রর ঘরে বসে চা খেতে-খেতে কথাবার্তা সেরে নিলেন এসিজি।
আলোচনাটা টাকাপয়সা আর বিষয়-সম্পত্তির দিকে চলে গেল।
এই বাড়িটা মনোহর রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে সেটা আইনমাফিক গিফট করে যান। টাকাপয়সার সবরকম দায়িত্বও প্রভাবতীর ওপরে। ফলে বিরাট বিষয়আশয়ের মালিক হয়েও ছেলেমেয়েরা মালিক নন। সবটাই মা-নির্ভর। প্রভাবতী যাঁকে পছন্দ করেন তাঁরই বাড়বাড়ন্ত। যেমন, এখন সুনন্দা আর অমলেশ প্রভাবতীর দু-নয়নের মণি। কিছুদিন পরই হয়তো অজয়েন্দ্র কিংবা বিজয়েন্দ্রর পালা আসবে। কলকাতার আশেপাশে জমিজিরেত অনেক ছিল। কিন্তু তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির টাকা প্রভাবতী অমলেশকে দিয়েছেন—কন্সট্রাকশানের ব্যবসা দাঁড় করাতে।
এসিজি বুঝলেন, মা-কে নিয়ে দু-ছেলে আর তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ কিছু করারও নেই—কারণ, প্রভাবতীই এ-বাড়িতে শেষ কথা।
এরপর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলে উলটো ছবি পাওয়া গেল। বড় মেয়ে মায়ের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। সারা জীবন ধরে প্রভাবতী যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত বললেন সুনন্দা। মায়ের স্নেহ-মমতা-দয়া সম্পর্কেও এত বলতে লাগলেন যে, এসিজির মনে হচ্ছিল তিনি ভগিনী নিবেদিতা অথবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী শুনছেন।
অমলেশ বাড়িতে নেই। তিনি দু-দিন আগে ব্যবসার কাজে ভাইজাগ গেছেন—পরশু ফিরে আসবেন। তবে অমলেশ থাকলেও বোধহয় কোনও লাভ হত না। কারণ, সুনন্দার কথারই প্রতিধ্বনি বোধহয় শুনতে পাওয়া যেত।
এসিজির মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। চারুবালা ছাদে গেলেন কাপড় ছড়াতে অথবা কাপড় তুলতে। অথচ ছাদে কোনও কাপড় পাওয়া গেল না। দীপ্তিমান, অজয়েন্দ্র—দুজনেই বলেছেন চারুবালা সাধারণত ছাদে যেতেন না। তা হলে সেদিন হঠাৎ গেলেন কেন! অন্যান্য দিন ওঁর কাপড়খানা কে ছড়াত, কে তুলত? নিশ্চয়ই আরতি! আরতির সঙ্গে একবার আলাদা কথা বলা দরকার।
বিজয়েন্দ্রকে ডেকে এসিজি বললেন, ‘বিজয়বাবু, আরতিকে একবার ডেকে দেবেন? নীচে বসবার ঘরে ওর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব। তবে কেয়ারফুলি ডাকবেন—আপনার মা যেন টের না পান। টের পেলেই হয়তো রাগারাগি করবেন…।’
বিজয়েন্দ্র ওঁর স্ত্রী তুলিকাকে ডেকে চাপা গলায় কী যেন বললেন। তুলিকা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
‘আপনারা নীচে যান—ও আসছে। তবে বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখবেন না। একটু পরেই মা চান করতে যাবে। তখন আরতিকে ডেকে না পেলে পরে তুলোধোনা করে ছাড়বেন।’ কথা শেষ করে অদ্ভুত হাসলেন বিজয়েন্দ্র।
নীচের বসবার ঘরে ওঁরা তিনজন সবে গুছিয়ে বসেছেন, আরতি দরজায় এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা।
‘আমায় ডেকেছেন, দাদাবাবু?’
‘তুমি তো জানো আমরা পুলিশের লোক—’ গম্ভীর চালে কথা শুরু করে এখন একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। গায়ের শালটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলে পড়েছিল, সেটা কাঁধের দিকে টেনে নিলেন।
আরতির শ্যামলা মুখ পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, জানি—।’
‘তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। একদম ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। উলটোপালটা চালাকি করলে…।’
‘মা কালীর দিব্যি—সত্যি বই মিথ্যে কইব না।’
‘চারুবালা—মানে, তোমার পিসিমার শাড়ি-জামাকাপড় রোজ কে ছাদে শুকোতে দিয়ে আসত, আর কে তুলে নিয়ে আসত?’
‘আ-আমি?’
‘অন্য কেউ কখনও যেত না?’
‘না। তবে কিছুদিন হল মা মাঝে-মাঝে বড়দিকে পাঠাতেন। কখনও বা পিসিমাকে পাঠাতেন।’
‘পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন পিসিমার কাপড় কে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল?’
একটু চিন্তা করে আরতি বলল, ‘বড়দি।’
‘শনিবার, পিসিমা যখন ছাদ ভেঙে পড়ে যান, তখন সত্যি-সত্যি বড়দি, দাদাবাবুরা, বউদিরা—সবাই মায়ের ঘরে ছিল?’
আবার সময় নিল আরতি। তারপর ‘হ্যাঁ। তবে তারপরই বড়দি আবার ছাদের দিকে গেছল। আমরা তখন বারান্দা দিয়ে গলিতে দেখচি কী পড়ল, কীসের ওরকম আওয়াজ হল।’
‘পিসিমার গলার চেনটা চুরি হয়েছিল তুমি জানো?’
‘মা কালীর দিব্যি, ও-হার আমি নিইনি, দাদাবাবু।’ আরতি আর একটু হলেই এসিজির পায়ে পড়ে আর কী!
‘না, না—তুমি নাওনি আমরা জানি। তবে হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়ে থাকবে…। তারপর—পিসিমা মারা যাওয়ার দিন—ছাদে পাওয়া গেছে।’
আরতি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘হারটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তুমি জানো?’ আবার প্রশ্ন করলেন এসিজি।
‘মনে হয় হারায়নি কোথাও। হয়তো মায়ের কাছটিতেই রেখে দিয়ে পিসিমা পাগলামির খেয়ালে ভুলে গেছে।’
এসিজির ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একবার দীপ্তিমানের দিকে দেখলেন। দুজনে চোখাচোখি হল।
‘হারটা সত্যি-সত্যি হারালে মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। দোকান-ফেরত সামান্য চার আনা আট আনার গণ্ডগোল হলেই আমায় যেরকম মুখ করে!’
এসিজির কোঁচকানো ভুরু সোজা হচ্ছিল না। মনে-মনে নতুন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, চারুবালাকে শুধু নিয়তির অদৃশ্য হাত পিছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, তারও পিছনে হয়তো মানুষেরও হাত ছিল।
এসিজি আনমনা হয়ে গেলেন। মাথার পিছনে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মারতে শুরু করলেন।
তারপর হঠাৎই আরতিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। আমার সঙ্গে যেসব কথা হল কাউকে বলবে না। বললে তোমারই বিপদ হবে।’
আরতি ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল।
কাজের লোকরা সত্যি-সত্যিই কাজের লোক। এটাকে কি যমক অলঙ্কার বলা চলে? আপনমনেই হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘গোস্বামী রঙ্গলাল / বাদ বাকিটা হবে কাল।’
‘কী বুঝলেন, ডক্টর গুপ্ত?’ দীপ্তিমান ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন।
‘মোটামুটি বোধহয় বুঝতে পারছি। আপনার সন্দেহ সত্যি হলেও হতে পারে। কাল আমি আর রঙ্গলালবাবু এ-বাড়িতে আর-একবার আসব। কী, রঙ্গলালবাবু, সময় হবে তো আপনার?’
আকর্ণ হাসলেন রঙ্গলাল ‘প্রশ্নটি অতি অবান্তরম/সময় হইবে সুনিশ্চিতম।’
দিনের আলোয় যে-বাড়িটাকে জীর্ণ অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল, রাতের আঁধারে সেটাকে ভুতুড়ে বলে মনে হল।
অশোকচন্দ্র ও রঙ্গলাল বাড়িতে ঢুকতেই সুনন্দার সঙ্গে দেখা হল। টেলিফোনে আগাম বলা ছিল। সুতরাং অপছন্দ মুখে সুনন্দা ওঁদের দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এসিজি টিভি চলার শব্দ পাচ্ছিলেন, বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রভাবতীর ঘরে ঢুকতেই টিভির শব্দ ওঁদের কানে ধাক্কা মারল।
গতকালের গন্ধটা আরও উগ্রভাবে এসিজির নাকে এল।
প্রভাবতী সম্রাজ্ঞীর ঢঙে সেজেগুজে সোফায় বসে ছিলেন। শরীর টান-টান। মুখে প্রসাধনের সামান্য আস্তর।
আরতি ওঁর পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিল। এসিজিদের দেখেই উঠে দাঁড়াল।
প্রভাবতী ওকে বললেন, ‘টিভির আওয়াজটা একদম কমিয়ে দে।’
হুকুম তামিল হল। টিভিতে মূকাভিনয় শুরু হল।
‘বলুন, ডক্টর গুপ্ত, কী ব্যাপারে দেখা করতে চেয়েছেন?’ প্রভাবতী মাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই এসিজি রঙ্গলালকে নিয়ে চারুবালার খাটের কিনারায় বসে পড়লেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা ছিল।’
সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম হল : ‘আরতি, তুই এখন যা। আমি ডাকলে তবে আসবি।’
আরতি তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে গেল। যেন পালিয়ে বাঁচল।
সুনন্দাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি ওঁকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর কাপড় ছড়াতে ছাদে গিয়েছিলেন? পরে, পিসিমা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও আপনি আবার ছাদে গিয়েছিলেন। অথচ তখন তো সকলের গলির দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। এটা একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’
সুনন্দা দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকালেন।
প্রভাবতী স্থির গলায় বললেন, ‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’
সুনন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এসিজির দিকে তাকিয়ে বোকা-বোকা হেসে চটপট চলে গেলেন।
‘যা বলার আমাকে বলুন, ডক্টর গুপ্ত। ওরা সব ছেলেমানুষ—।’
প্রভাবতীর গলায় সামান্য চ্যালেঞ্জের ছোঁওয়া ছিল। ঘরের জোড়া টিউব লাইটের আলোয় ওঁর বলিরেখাগুলো নিষ্ঠুর দেখাল।
এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পে হয়তো অনেক ফাঁকফোকর থাকবে—সেগুলো আপনাকেই ভরাট করতে হবে…।’
প্রভাবতীর মুখ পাথরের মতো। চোখ টিভির দিকে।
কাল সারাটা রাত ধরে বহু ভেবেছেন বৃদ্ধ হুনুর। মনে-মনে এমন একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন যেটা প্রতিটি সূত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সোনার হার, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, সুনন্দার ছাদে যাতায়াত—আর, সবশেষে চারুবালার নিয়তি। এখন সেই গল্পই শোনাতে এসেছেন প্রভাবতীকে।
সামান্য কেশে নিয়ে এসিজি বলতে শুরু করলেন ‘আপনি একটা চান্স নিয়েছিলেন, মিসেস রায়। চারুবালাকে আপনি নানান ছল-ছুতোয় ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গাটায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁর ভেজা কাপড় ইদানীং ওই বিপজ্জনক জায়গাতেই ছড়ানো হত। কে ছড়াতেন জানি না। তবে আপনি নন। সুনন্দা হতে পারে, আরতি হতে পারে। হয়তো ছড়ানোর জন্যে ওরা লাঠি বা অন্য কিছু ব্যবহার করত—যাতে ওই লক্ষ্মণের গণ্ডির ভেতরে ঢুকে পড়তে না হয়। তা ছাড়া, আমি দেখেছি, দড়িটা লাঠি দিয়ে টেনে এনেও নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় ছড়ানো যায়, ক্লিপ আঁটা যায়। আপনি সেই শনিবার চারুবালাকে বকাঝকা করে ওঁর শুকনো কাপড় তুলে আনতে পাঠিয়েছিলেন—আমার সেরকমই মনে হয়।
‘কিন্তু চারুবালা ছিলেন কিছুটা ছিটগ্রস্ত। তাই সবসময় হয়তো ছাদে গিয়েও ওই জায়গাটায় পা দিতেন না। হয়তো সাদা দাগটা ওঁকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিত—উনি সাবধান হয়ে যেতেন।
‘আপনি তখন খানিকটা সমস্যায় পড়লেন। তখন সোনার হারের টোপটা আপনার মাথায় এল। ওটা আপনি চারুবালার কাছ থেকে কোনও অজুহাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গায় হারটা রেখে দিয়ে এলেন। না, আপনি নন—আপনার হয়ে অন্য কেউ। আপনি যে সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না তা আমি জানি।
‘এইবার কাজ হল। চারুবালা ছাদে গেলেন। সোনার চেনটা দেখতে পেলেন। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। উনি শাড়ি থেকে ক্লিপটা আগে খুলেছেন, নাকি চেনটা আগে কুড়িয়ে নিয়েছেন কে জানে! চেনটা আগে নিয়ে থাকলে ওটা হয়তো আবার ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ছাদেই। কিন্তু ক্লিপটা হাতে থেকে গিয়েছিল…।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি। তারপর আবার খেই ধরলেন : ‘নিয়তি তার কাজ করল। চারুবালা পড়ে গেলেন। আর আপনার এ-ঘর থেকে সুনন্দা সঙ্গে-সঙ্গে ছাদে চলে গেল পিসিমণির শাড়িটা তুলে আনতে…।’
এসিজি থামলেন।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রভাবতী। টিভির দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁর দু-চোখ থেকে ভাঙা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। টিভির আলোয় জলের রেখা চকচক করছিল।
চাপা খসখসে গলায় বললেন, ‘হারটা আমি দিদির কাছ থেকে নিইনি। দিদিই আমাকে ওটা গলা থেকে খুলে রাখতে দিয়েছিল—পরে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য চাইলে আমিও অস্বীকার করতাম।
‘আপনার একটা গোপন অন্যায় চারুবালা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা কী আমি আঁচ করতে পারিনি—।’
নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক গলায় প্রভাবতী বললেন, ‘এই বাড়িটা আমি সুনন্দার নামে উইল করে গেছি। অমলেশ যেদিন কাগজপত্র সই করিয়ে নেয় দিদি সেদিন দেখেছিল। তারপর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারত। বলত, ”এ তুমি ঠিক করলা না। অজু-বিজু ভিটা ছাইরা কই যাইব!” কিন্তু কী করব! সুনন্দা-অমলেশের জন্যে যতটা আমার মন টানে অজু-বিজুর জন্যে ততটা না। ওরা অনেক পেয়েছে—।’
চোখের জল তখনও গড়িয়ে পড়ছিল—।
প্রভাবতীকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে তারপর এসিজি বললেন, ‘মিসেস রায়, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? আপনি দু-দুটো অন্যায় করেছেন—তার মধ্যে একটা এখনও শুধরে নেওয়ার সময় আছে। আমি হলে শুধরে নিতাম…।’
‘আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়েই প্রশ্ন করলেন।
‘না—’ হেসে মাথা নাড়লেন এসিজি ‘প্রমাণ নেই। প্রমাণই কি সব! একটা কথা আপনাকে বলি। ঈশ্বর কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ—এইসব পাংচুয়েশান মার্ক আমাদের হাতে দেন—তবে দাঁড়িটা নিজের হাতে রাখেন। সময় হলেই আমাদের জীবনে দাঁড়ি টেনে দেন। সেই দাঁড়িটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে ঈশ্বরকে অসম্মান করা। আপনি সেটাই করেছেন। প্রমাণ না থাকুক, যে-অন্যায়টা এখনও শোধরানো যায় আপনি সেটা অন্তত শুধরে নিন…।’
‘দিদিকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করব…সুনন্দাদের জন্যে পাগল-পাগল টান। কেন এমন টান কে জানে! আমার জন্যে দিদি…ছিল শুকতারা, সন্ধ্যাতারা হয়ে গেল। আমার জন্যে…।’
বৃদ্ধার মুখ ভেঙেচুরে গেল। জলভরা কাতর চোখে এসিজির দিকে তাকালেন তিনি। কিছু একটা বলতে চাইলেন।
এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’
একজন সর্বস্বান্ত রানিকে তাঁর মেকি সিংহাসনে বসিয়ে রেখে এসিজি আর রঙ্গলাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
টিভিতে তখনও মূকাভিনয় চলছিল।
আকাশঘুম (উপন্যাস)
খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ আরও জঘন্য।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই দামি মন্তব্যটা করেছেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করার সময় এই সংক্ষিপ্ত নামটাই বেশি চালু ছিল। কিন্তু রিটায়ার করার পর কেউ এ-নামে ডাকলে এবং তার সঙ্গে ‘স্যার’ যোগ করলে কানে যেন কেমন লাগে—বিশেষ করে সে যদি পুরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ না হয়।
রঙ্গলাল গোস্বামী সেই দলেরই একজন। তিনি হঠাৎ এসিজিকে প্রশ্ন করে বসেছেন, ‘এসিজি স্যার, খুন অতি জঘন্য, খুনি ধরা আরও/ সেই কাজে আপনার কেন পোয়াবারো?’
স্বভাবকবি রঙ্গলাল ছন্দ তৈরি করেন কথায়-কথায়। এ-বিষয়ে প্রশ্ন করলে সঙ্কুচিতভাবে মাথা নিচু করে জবাব দেন, ‘আমি একজন স্বভাবকবি/ কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’
এসিজির গুণমুগ্ধ এই ব্যাচিলার কবিমানুষটি সবসময় এসিজির সঙ্গী হতে ভালোবাসেন। আর সুযোগ পেলেই ছাত্রের মতো প্রশ্ন করেন এসিজিকে।
মাথার সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘পোয়াবারো কথাটার আসল মানে জানেন?’
রঙ্গলাল অবাক হয়ে তাকালেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন ‘না, জানি না।’
‘পোয়াবারো মানে হল পাশাখেলার একটা দান। তো ধরে নিন, খুনির সঙ্গে বুদ্ধির পাশা খেলতে আমার ভালো লাগে। তাই খুনি ধরার কাজটা খুনের চেয়েও জঘন্য জেনেও আমার খুনি ধরতে ভালো লাগে। আপনার স্বভাব-কবিতার নেশার মতো এটাও একটা নেশা।’
‘স্বভাব-কবিতা’ শব্দটা মোটেই এসিজির আবিষ্কার নয়, ওটা রঙ্গলাল গোস্বামীর সম্পত্তি। ওঁর প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘স্বভাব-কবিতা সমগ্র’।
ব্যাঙ্গালোর এয়ার টার্মিনালে বসে অশোকচন্দ্র আর রঙ্গলাল কথা বলছিলেন। ইন্দিরানগর ছাড়িয়ে এইচ.এ.এল. এরিয়ার এই এয়ার টার্মিনালে ওঁরা এসেছেন পাক্কা দু-ঘণ্টা। কিন্তু কলকাতার উড়ান ফ্লাইট নম্বর-এইট ডব্লিট ফাইভ ওয়ান এইট ছাড়তে এখনও অনেক দেরি। আবহাওয়ার কী একটা যেন গোলমাল হয়েছে—বোধহয় কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশা।
রঙ্গলাল বারবার বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘এসিজি স্যার, আজ বোধহয় কপালে কলকাতা পৌঁছোনো নেই।’
স্পিকারের নানারকম ঘোষণা চলছিল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রঙিন মনিটরগুলো রাজ্যের উড়ান-সংবাদ অক্লান্তভাবে পেশ করছিল। মোল্ডেড প্লাস্টিকের আর্গোনমিক চেয়ারে বসে বহু যাত্রী অপেক্ষা করছিলেন। টার্মিনাল বিল্ডিং-এর আধুনিক আলোকসজ্জা সবজায়গায় হিসেবমতো আলো পৌঁছে দিয়েছে। মার্বেল পাথরের গ্রানাইট পালিশ করা মেঝেতে আয়নার মতো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। অনেক যাত্রীই ব্যস্তভাবে এদিক-ওদিক যাতায়াত করছিলেন। কেউ-বা ট্রলিবোঝাই মালপত্র ঠেলে নিয়ে চলেছেন টার্মিনাল বিল্ডিং-এর বাইরে।
এসিজি ও রঙ্গলালের বোর্ডিং পাস নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন ওঁরা সিকিওরিটি চেক শুরু হওয়ার ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
কলকাতার একটা স্মাগলিং-এর কেসের ব্যাপারে অশোকচন্দ্র গুপ্ত ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন। কতকগুলো জেমস্টোনের স্পেক্ট্রাল ক্যারেকটারিস্টিকস খতিয়ে দেখার জন্য রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউট আর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স-এ ওঁর জরুরি কাজ ছিল। তিনদিনেই সবকাজ ঠিকমতো মিটে যাওয়ায় আজ হালকা মনে বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়েছেন।
রঙ্গলাল গোস্বামী বাগবাজারের ‘লালমহল’-এর বাসিন্দা। বছরতিনেক আগে ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ওঁর দাদার একটা হারানো চুনি খুঁজে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে এসিজির আলাপ।
এসিজি লক্ষ করেছেন, লাউঞ্জে অনেকেই রঙ্গলাল গোস্বামীকে লক্ষ করছেন। আর খানিকটা নজর কাড়ছেন এসিজিও। কারণ, বোধহয় ওঁদের দু’জনের পোশাক।
এসিজির পরনে পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি, তার ওপরে জড়ানো সাদা শাল। ভেতরে অবশ্য লুকোনো একটা উলের স্যান্ডো গেঞ্জিও রয়েছে। আর রঙ্গলালবাবুর পরনে সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, তার ওপরে মেরুন রঙের এক বিচিত্র জহরকোট। আর গলায় সবুজ রঙের একটা মাফলার।
এসিজির সঙ্গে রঙ্গলালের এই একটি জায়গাতেই বেশ মিল : দু’জনেই শীতকাতুরে। নইলে ব্যাঙ্গালোরে সেরকম শীত কোথায়!
রঙ্গলাল গোস্বামীর রং শ্যামলা। ডানহাতের তিন আঙুলে রুপোয় বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। মাথার তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুলের ঠিক মাঝখান দিয়ে সিঁথি। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট্ট আঁচিল। নাকটা বেশ জম্পেশ। দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে কামানো। গা থেকে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। বোঝাই যায়, বেশ শৌখিন মানুষ।
রঙ্গলালকে অনেকেই দক্ষিণ ভারতীয় ভেবে ভুল করছিল। তাদের দক্ষিণী কথার জবাবে রঙ্গলাল আকর্ণ হাসছিলেন এবং ‘থ্যাঙ্ক য়ু’ বলছিলেন।
এসিজি একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। এরপর প্রায় আড়াই ঘণ্টা সিগারেট ছেড়ে থাকবে হবে। প্লেন ওড়ার সময় ‘স্মোকিং প্রহিবিটেড’-এর আইন জারি হয়ে গেছে।
‘পোয়াবারো’ মানে যে পাশা খেলার একটা দান এ-কথা শোনার পর রঙ্গলাল সমঝদারের মতো মাথা নাড়ছিলেন। তখন সময় কাটানোর জন্য গোয়েন্দাপ্রবর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে নিয়েছেন একটা রুবিক কিউব—এবং শুরু করে দিয়েছেন রং-মেলান্তির খেলা।
এই বিচিত্র রঙিন কিউবটা রঙ্গলাল আগেও এসিজির কাছে দেখেছেন। দু-একবার ওঁর কাছ থেকে কিউবটা চেয়ে নিয়ে রং মেলানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা দেখে সহজ মনে হলেও আসলে যাচ্ছেতাইরকম কঠিন।
এই সদা-চুল মানুষটি রঙ্গলালকে সবসময় অবাক করে দেন। কোনওরকম সমস্যা পেলেই হল—এসিজি তার সমাধান করতে মনে-মনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজেকে যখন তিনি ‘থিঙ্কিং মেশিন’ বলেন, তখন মোটেই নিজেকে জাহির করেন না—যা সত্যি তাই বলেন। তাঁর কথায় সি. অগাস্ত দুপাঁ, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো থেকে শুরু করে পরাশর বর্মা, ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির সকলেই থিঙ্কিং মেশিন। আসল কথা হল, গোয়েন্দাদের থিঙ্কিং মেশিন না হলে চলে না।
এখন বসে-বসে তিনি কী ভাবছিলেন কে জানে। হঠাৎই একজন ফরসা, বেঁটে এবং মোটাসোটা ভদ্রলোক অনেকটা হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে এসিজির বাঁ-পাশের খালি চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নিভাঁজ বাংলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কলকাতার ফ্লাইট ক’টায় ছাড়বে কিছু বলল?’
এসিজি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘এটুকু বলেছে, যে-কোনও সময় সিকিওরিটি চেক-এর জন্যে ডাক পড়তে পারে।’
এরপর ভদ্রলোক অশোকচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। বললেন, তিনি পেশায় ডাক্তার। নাম ভবানীপ্রসাদ দে। লেক প্লেসে থাকেন। ওঁর একমাত্র মেয়ে ব্যাঙ্গালোরের একটা মেডিকেল কলেজে এ-বছরের মাঝামাঝি অ্যাডমিশন নিয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
পরিচয় বিনিময় করার সময় এসিজি নিজের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু রঙ্গলাল গোস্বামী—যিনি এসিজির এমন গুণমুগ্ধ যে, ওঁকে নিয়ে স্বভাব-কবিতা লিখেছেন : ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/ আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’—তিনি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। এসিজির পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষতা, পাখির নেশা, অপরাধবিজ্ঞান চর্চা, খুনি ধরার নেশা, রুবিক কিউব সমাধানের ‘অলৌকিক ক্ষমতা’—সবই সবিস্তারে পেশ করলেন ডক্টর দে-র কাছে।
এই বিস্তারিত পরিচয়ে এসিজি লজ্জা এবং সঙ্কোচ ছাড়াও ভয় পাচ্ছিলেন। ভবানীপ্রসাদবাবু ভেবে না বসেন যে, রঙ্গলাল গোস্বামী এসিজির প্রচারসচিব। আজকাল নানা মহলে এই পদটির বেশ চল হয়েছে।
অশোকচন্দ্রের ‘জীবনী’ জানার পর ভবনীপ্রসাদ একেবারে বিগলিত হয়ে পড়লেন। জানা গেল, ভদ্রলোক গোয়েন্দাকাহিনির অন্ধ ভক্ত। এসিজির দু-একটি কীর্তিকলাপ যে পড়েছেন সেটা ওঁর বেশ মনে পড়ছে।
‘সত্যি, আমি খুব লাকি। আপনার মতো জিনিয়াসের সঙ্গে এরকম আচমকা পরিচয় হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।’
আজকাল ‘জিনিয়াস’ আর ‘জিনিস’—দুটো শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। বেপরোয়া অতিব্যবহারে বিশেষণের ক্ষয় হয়। যেরকম হয়েছে ‘শহিদ’ শব্দটার। মনে মনে ভাবছিলেন এসিজি।
ভবানীপ্রসাদ এসিজির হাত চেপে ধরলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘এয়ারবাসে তো অনেক সিট খালি থাকবে…এয়ারহোস্টেসকে ম্যানেজ করে আপনার পাশে বসব। তারপর দু-আড়াই ঘণ্টা ধরে আপনার সব থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স শুনতে-শুনতে যাব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’
এসিজি হেসে বললেন, ‘আপত্তি কেন, বরং ভালোই লাগবে। কী বলেন, রঙ্গলালবাবু?’
রঙ্গলাল গোস্বামী মাথা হেলিয়ে বললেন, ‘ডাক্তার, ডক্টর, কী বা মিশ্রণ/ অনাবিল স্বাদে মোর ভরিবে ভ্রমণ।’
স্বভাবকবির উত্তর শুনে ভবানীপ্রসাদ হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসির দমক থামলে চোখ বড়-বড় করে বললেন, ‘মশাই আপনিও তো দেখছি আর-এক ধরনের জিনিয়াস!’
রঙ্গলাল গোস্বামী সলজ্জভাবে নিজের পরিচয় দিলেন।
আর ঠিক তখনই অডিয়ো সিস্টেমে ঘোষণা করা হল, কলকাতাগামী উড়ান এইট ডব্লিউ ফাইভ ওয়ান এইট-এর যাত্রীদের সিকিওরিটি চেক-এর জন্য এগোতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
এসিজি চটপট উঠে দাঁড়ালেন। হাতের সিগারেটটা একটু দূরে রাখা লিটারবিন-এ ফেলে দিলেন। তারপর রুবিক কিউবটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে দিয়ে রঙ্গলালকে তাগাদা দিলেন : ‘চলুন, রঙ্গলালবাবু, শেষ পর্যন্ত তা হলে আমরা কলকাতা পৌঁছোতে পারব।’
রঙ্গলাল নির্মল হাসি হেসে ওঁর ট্র্যাভেল ব্যাগটা তুলে নিলেন। এসিজিও ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ালেন ওঁর ব্রিফকেসের হাতলের দিকে।
দীর্ঘকায় এসিজির হাতে ব্রিফকেসটা অনেকটা খেলনাগোছের দেখাচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ নজর বুলিয়ে তিনি ডক্টর দে-কে বললেন, ডাক্তারবাবু চলুন—।’
তখই তিনি খেয়াল করলেন, ডক্টর দে বেশ মনোযোগ দিয়ে একজন লম্বা ভারী চেহারার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ভদ্রলোকের বয়েস ষাট কি বাষট্টি হবে। পরনে গাঢ় নীল রঙের সাফারি সুট। ডানহাতের মধ্যমায় একটা বড় হিরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। মাথা ভারতি কাঁচাপাকা চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের আধুনিক ডিজাইনের চশমা। পুরুষ্ট গোঁফ। দু-গালে এবং চিবুকের নিচে চর্বির থাক।
ডক্টর দে চাপা গলায় বললেন, ‘ওই ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন?’
এসিজি আর রঙ্গলাল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।
মুখটা যেন চেনা-চেনা মনে হল এসিজির। এই মুখের ছবি কোথায় যেন দেখেছেন?
রঙ্গলাল ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন! ‘দেখে মনে হয় নাকো চিনি উহারে…।’
‘মদনমোহন চ্যাটার্জি—’ ছোট্ট করে বললেন ভবানীপ্রসাদ।
ব্যস! তক্ষুনি সব মনে পড়ে গেছে এসিজির।
মদনমোহন চ্যাটার্জি। বিখ্যাত বিজনেস টাইকুন। খবরের কাগজের পাতায় প্রায়ই নানান কারণে ওঁর ছবি ছাপা হয়ে থাকে। এই তো মাসখানেক আগে কাগজে খবর ছিল, হলদিয়াতে মদনমোহন চ্যাটার্জি দু-হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা স্টিল প্ল্যান্ট শুরু করতে চলেছেন। আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক আর লস এঞ্জেলসে ওঁর শিপিং কোম্পানি রয়েছে। আমেরিকাতে একবছর—বোধহয় ১৯৯৮ কি ১৯৯৯ সালে—’ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন।
এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি একা নন। ওঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা।
‘আপনি মিস্টার চ্যাটার্জিকে চেনেন নাকি?’ এসিজি ভবানীপ্রসাদকে জিগ্যেস করলেন।
ভবানীপ্রসাদ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, একসময়ে…মানে, বছরদশেক আগে…আমি ওঁর ট্রিটমেন্ট করেছিলাম।’
‘কীসের ট্রিটমেন্ট?’
‘অ্যাজমার। মিস্টার চ্যাটার্জির হাঁপানির প্রবলেম আছে।’
‘এখন আপনার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই?’
হাসলেন ডক্টর দে। মুখে কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘নাঃ। কী করে আর থাকবে! আমি মশাই সস্তার ডাক্তার। আমি যখন ওঁর ট্রিটমেন্ট করতাম তখন উনি এত বড়লোক ছিলেন না। এখন আমাকে দেখে হয়তো চিনতেই পারবেন না।’
এসিজি সায়ে দিয়ে মাথা নাড়লেন : ‘হ্যাঁ—পয়সা অনেকসময় মানুষকে বদলে দেয়…।’
রঙ্গলাল এসিজির সঙ্গে তাল দিয়ে বললেন, ‘ধন বড় বিচিত্র/ বদলে দেয় চরিত্র।’
‘ইকনমিক টাইমস’, ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ‘মানি ম্যটারস’, ‘ইয়োর শেয়ার’ ইত্যাদি পত্রিকায় মদনমোহন চ্যাটার্জিকে নিয়ে প্রায় লেখালিখি হয়। ব্যবসায়ীদের দুনিয়ায় ওঁর ডাকনাম হজমমোহন চ্যাটার্জি। কারণ, উনি নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের জ্যান্ত গিলে খেয়ে হজম করেন। লোকে বলে, বহু ইন্ডাস্ট্রিকে উনি প্যাঁচ কষে সিক হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তারপর সেই সিক ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিয়েছেন। অন্তত চারজন ইন্ডাস্ট্রির মালিক ভাগ্যের ফেরে এখন মদনমোহন চ্যাটার্জির নানান কোম্পানিতে ম্যানেজার কি ডেপুটি ম্যানেজারের চাকরি করছেন।
মদনমোহনের চলাফেরার ভঙ্গি আর হাবভাবে পয়সা ফুটে বেরোচ্ছিল। তিনি আঙুল তুলে ইশারা করেছিলেন আর ওঁর সঙ্গী চারজন পড়ি-কি-মরি করে সেই হুকুম তামিল করছিলেন।
সিকিওরিটি চেকের পর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। স্পিকার ঘোষণা শুনে যাত্রীরা রওনা হলেন প্লেনের দিকে।
প্লেনটা এয়ারবাস-এ থ্রিটোয়েন্টি। এতে প্রায় শ’আড়াই কি তার বেশি সিট থাকলেও এসিজি লক্ষ করলেন, প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বেশ কম। এই শীতের সময়, বিশেষ করে শনিবারে, হয়তো রাশ কম থাকে—কে জানে! আর সেইজন্যই ডক্টর দে এসিজি আর রঙ্গলালের সঙ্গে বসার সুযোগ পেলেন।
রঙ্গলাল উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন। এটা ওঁর জীবনের দ্বিতীয় প্লেন জার্নি। প্রথমটা কয়েকদিন আগে এখানে আসার সময়। তখনও বাচ্চাছেলের মতো উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন।
প্লেনের সিটের ব্যবস্থা দুই-চার-দুই ঢঙে সাজানো। দুই আর চারের মাঝে দুটো অলিপথ সমান্তরালভাবে প্লেনের লেজের দিক থেকে নাক পর্যন্ত চলে গেছে। সামনের দিকে এক্সিকিউটিভ ক্লাস—পরদার আড়াল দিয়ে সেটাকে ইকনমি ক্লাস থেকে আলাদা করা হয়েছে।
ইকনমি ক্লাসের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁ-দিকের দুটো সিটে পরপর বসলেন রঙ্গলাল ও এসিজি। তারপরই অলিপথ। অলিপথের পরের সিটটাতে ভবানীপ্রসাদ বসলেন। ফলে এসিজির সঙ্গে কথা বলতে ওঁর তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না।
এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি ওঁর সঙ্গী একজন সুন্দরী মাঝবয়েসি মহিলা ও একজন পুরুষকে নিয়ে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ঢুকে গেলেন। অন্য দু’জন ইকনমি ক্লাসে, এসিজিদের কাছ থেকে একটু দূরে, ডানদিকের সিটে বসে পড়লেন।
মদনমোহনের এক্সিকিউটিভ ক্লাসের সঙ্গী দু’জন কি তা হলে ওঁর আত্মীয়? ভাবলেন এসিজি…আর ইকনমি ক্লাসের এই দু’জন কি কর্মচারী?
ডক্টর দে একমনে মদনমোহন ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের লক্ষ করছিলেন। এসিজিও একপলকে ওঁদের দেখে নিয়েছিলেন। তাতে এসিজির ধারণা হয়েছে, ওঁরা কেউই অন্তর থেকে মদনমোহন চ্যাটার্জির হুকুম তামিল করছেন না। কে জানে, এসিজির ধারণা হয়তো ভুলও হতে পারে।
রঙ্গলাল হঠাৎই বললেন, ‘এসিজি স্যার, ফিরে গিয়ে ভাবছি আমার সেই লেখাটায় হাত দেব…।’
‘কোন লেখাটায়?’ ভুরু কোঁচকালেন এসিজি।
‘ওই যে, বলেছিলাম না, আমি স্বভাব-কবিতায় আপনার জীবনী লিখব…।’
হাসি পেয়ে গেল এসিজির। সত্যি, রঙ্গলালের খেয়ালের কোনও জুড়ি নেই! এসিজির জীবনী—তাও আবার কাব্যে!
এমনসময় ঘোষণা শুরু হল।
বিপদ দেখা দিলে কীভাবে অক্সিজেন-মাস্ক ব্যবহার করতে হবে সেটা ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূকাভিনয় করে দু’জন হোস্টেস হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল। ধূমপান না করার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হল। অনুরোধ করা হল মোবাইল ফোন অফ করে রাখার জন্য। এবং যাঁর-যাঁর সিটবেল্ট বেঁধে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল।
সবশেষে জানানো হল, এই উড়ানে যাত্রাপথ দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিটে সম্পন্ন করা হবে।
শেষ কথাটি শুনে নিয়তি বোধহয় মুচকি হেসেছিল।
সিনিয়ার এয়ারহোস্টেস ইরিনা বিশ্বাস যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে এসে ঢুকল তখন ওর ফরসা কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। মনে হল যেন বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে।
চিফ স্টুয়ার্ড কুমারমঙ্গলম সেটা লক্ষ করল। ইরিনা সবসময় হাসিমুখে কাজ করে—সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। তাই কুমারমঙ্গলম মুড ফেরানোর চেষ্টায় ওকে বলল : ‘হোয়াটস আপ, ইরিনা? এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে কোনও খিদে পাওয়া নেকড়ে ঢুকে পড়েছে নাকি—যে তোমাকে দেখে থাবা চাটছে?’
শেষ কথাটা বলে চোখ ঠেরে হাসল কুমারমঙ্গলম। কিন্তু ইরিনার কপালে ভাঁজ সমান হল না। অন্যসময় ঠাট্টা-ইয়ারকিতে ইরিনা যেমন খিলখিল করে হেসে ওঠে, তেমনটাও হল না। বরং গম্ভীর গলায় ও বলল, ‘শোনো, টয়লেটের মধ্যে একজন প্যাসেঞ্জার বোধহয় আটকে পড়েছে…।’
‘বলছ কী? একজন, নাকি দু’জন? আই মিন…।’
কুমারমঙ্গলম একগাল হেসে আরও কীসব ফাজিল মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, ইরিনা ওকে বাধা দিল : ‘ধুত, এসব নয়, আমি সিরিয়াসলি বলছি। কে জানে খারাপ কিছু হল কিনা! ভদ্রলোক টয়লেটে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ…অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার। ওঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন ওঁরাই আমাকে বললেন চেক করতে। আমি টয়লেটের দরজায় বারকয়েক টোকাও দিয়েছি, কিন্তু নো রেসপেন্স—কেউ সাড়া দেয়নি।’
কুমারমঙ্গলম বিরক্তির শব্দ করল একটা। প্যাসেঞ্জারের টয়লেটে আটকে পড়ার কেস সাধারণত দেখা যায় না—তবে একেবারে যে হয় না তা নয়। বছর পাঁচেক আগে একশো পাঁচ কি দশ কেজি ওজনের এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোককে একরকম টেনে-হিঁচড়ে টয়লেট থেকে বের করতে হয়েছিল। সে-কাজ করতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে আর বলার নয়—বরং ভুলে যাওয়াই ভালো।
‘এই হতভাগা প্যাসেঞ্জারটার নাম কী?’
‘প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দেখেছি—মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি! তা হলে তো বুঝতেই পারছেন!’
কুমারমঙ্গলম সোজা কপালে হাত চাপড়ে বলে উঠল, ‘মাই গুডনেস! ওঁর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছি! লোকটা রাইভাল বিজনেসম্যানদের জ্যান্ত চিবিয়ে খায়—তা হলে তোমার-আমার মতো চুনোপুঁটির কী হাল করবেন কে জানে! শিগগির চলো, গিয়ে দেখা যাক কেসটা কী! দেরি হলে তো উনি আমাদের এয়ারলাইনের চোদ্দোটা বাজিয়ে ছাড়বেন। চলো, চলো…।’
কুমারমঙ্গলম চটপট পা চালাল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের দিকে। ইরিনাও দেরি না করে ওর পিছন-পিছন রওনা হল।
টয়লেটের আশেপাশে আর কেউ ছিল না। টয়লেটের দরজায় ‘এনগেজড’ ফ্ল্যাগটা কুমারমঙ্গলমের চোখে পড়ল। দরজার কাছে গিয়ে ও চাপা গলায় ডেকে উঠল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি! ইজ এভরিথিং ওকে, স্যার?’
কোনও সাড়া নেই।
আরও একবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল কুমারমঙ্গলম, কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
তখন ও তাকাল ইরিনার দিকে। তারপর নক করল টয়লেটের ধাতব জায়গায়।
না, কোনও উত্তর এল না ভেতর থেকে।
কুমারমঙ্গলম ইরিনার দিকে ফিরল : ‘তুমি শিয়োর, ইরিনা, মিস্টার চ্যাটার্জি আধঘণ্টার ওপর টয়লেটে ঢুকেছেন?’
‘ওঁর সঙ্গের লোকরা তো তাই বলেছে।’
‘আর কোনও উপায় নেই। মে বি সামথিং ইজ রং উইথ দ্য লক।’ ইরিনার দিকে একবার তাকিয়ে দরজার খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল কুমারমঙ্গলম। গলা সামান্য তুলে বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি, স্যার, আপনি বোধহয় কোনও প্রবলেমে পড়েছেন। ডোন্ট য়ু উয়ারি, স্যার। আমি দরজা ভাঙছি। আপনি যতটা পারেন দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ান, স্যার।’
তারপরই কুমারমঙ্গলম খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়াল। বুট-পরা ডান পা-টা উঁচিয়ে প্রচণ্ড জোরে এক লাথি বসিয়ে দিল দরজার লকের কাছটায়। প্লেনের টয়লেটের দরজাগুলো তেমন মজবুত কিচ্ছু নয়। তাই এক লাথিতেই লকের কয়েকটা স্ক্রু বেরিয়ে পড়ল, দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ঢুকে গেল ভেতরে।
কুমারমঙ্গলম আর-একবার লাথি কষাল।
লকটা ভেঙে গিয়ে দরজাটা প্রায় ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে গেল।
‘স্যার…?’ দরজায় ফাঁক-হয়ে যাওয়া জোড়ের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল কুমারমঙ্গলম। ও দরজাটা ঠেলে খুলতে চাইলেও দরজাটা আর খুলছিল না—কোথাও একটা আটকে যাচ্ছিল।
ধাক্কাধাক্কির শব্দ পেয়ে আর-একজন হোস্টেস সাবরিনা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে চলে এল।
ইরিনা, কুমারমঙ্গলম এবং টয়লেটের ফাঁক-হয়ে-থাকা দরজার দিকে তাকিয়ে সাবরিনা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। ইরিনাকে জিগ্যেস করল, ‘হোয়াটস, আপ, ইরিনা? এনি প্রবলেম?’
ইরিনা সংক্ষেপে ওকে জানাল, প্রবলেম’টা কী।
ততক্ষণে কুমারমঙ্গলম দরজাটা ঠেলেঠুলে আরও খানিকটা ফাঁক করে ফেলেছে। এবং সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে ভেতরে।
পরক্ষণেই কুমারমঙ্গলমের মাথা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এবং ওর মুখের চেহারা এখন দেখবার মতো।
শ্যামলা মুখ থেকে রক্ত সরে যাওয়ায় ছাইরঙা ফ্যাকাসে লাগছে। ছোট-ছোট বুদ্ধিদীপ্ত চোখে বুদ্ধির দীপ্তির বদলে ভয় আর অবিশ্বাসের কুয়াশা। ওর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না।
ইরিনা আর সাবরিনা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কুমারমঙ্গলমের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ওরা বেশ বুঝতে পারছিল, কুমারমঙ্গলম ওদের খারাপ কিছু শোনাতে চলেছে।
বেশ কয়েকমিনিট জিভ আর ঠোঁট নিয়ে ধস্তাধস্তির পর কুমারমঙ্গলমের মুখ দিয়ে কয়েকটা মারাত্মক শব্দ বেরিয়ে এল। চাপা অস্পষ্ট গলায় ও বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি ইজ ডেড। আই থিং হি হ্যাজ বিন শট।’
তার মানে!—অবাক হয়ে ভাবল ইরিনা আর সাবরিনা : বন্ধ টয়লেটের ভেতরে মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ গুলি করেছে। ইমপসিবল! এ হতেই পারে না!
টয়লেটের দরজাটা আবার টেনে ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুমারমঙ্গলম ইরিনাকে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে খবর পাঠিয়েছিল যে, একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন অ্যারাইজ করেছে। ক্যাপ্টেন যদি একবার আসেন তা হলে খুব ভালো হয়।
খবরটা পাওয়ামাত্রই ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি চলে এসেছেন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের কাছে।
অর্জন সিনিয়ার পাইলট। ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এ আছেন প্রায় পাঁচবছর। শক্তসমর্থ পেটানো শরীর। ঠান্ডা চোখ আর চৌকো চোয়াল যেন বলে দিচ্ছে অর্জন সুখানিকে টলানো বড় সহজ ব্যাপার নয়।
ফ্লাইট ডেক থেকে অর্জন যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের অলিপথ দিয়ে হেঁটে আসছিলেন, তখন ওঁর ঠোঁটে ছিল পেশাদারি স্মিত হাসি, আর একই সঙ্গে প্যাসেঞ্জারদের লক্ষ করে ছোট-ছোট ‘নড’ করছিলেন।
বাইরের ভাবটা এরকম বজায় রাখলেও অর্জনের মনে ছিল বিরক্তি। কারণ, উড়ান সময়ের একঘণ্টা পার হয়ে গেছে…এখন এই ঝামেলার জন্য যদি কোনও এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে হয় তা হলে প্রচুর সময় নষ্ট হবে। কলকাতায় পৌঁছতে কত দেরি হবে কেউ বলতে পারে না। আর কাছাকাছি এয়ারপোর্ট বলতে বিশাখাপত্তনম। সুতরাং, সেখানকার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এর চিফ ফ্লাইট ম্যানেজারের সঙ্গেও। আবার, যদি তিনি বলেন তা হলে হয়তো চেয়ারম্যান কি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে অর্জনকে কথা বলতে হবে।
ইতিমধ্যে কুমারমঙ্গলম এক্সিকিউটিভ ক্লাসের প্যাসেঞ্জারদের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছে যে, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করা যাবে না। প্যাসেঞ্জাররা যেন ইকনমি ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করেন। এই অপ্রত্যাশিত অসুবিধে তৈরি হওয়ার জন্য ‘আকাশ এয়ারলাইনস’ দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন সুখানি বুঝলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। কারণ, কুমারমঙ্গলম, ইরিনা এবং সাবরিনার মুখের চেহারা সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কুমারমঙ্গলমকে অর্জন বেশ ভালো করেই জানেন। ছেলেটা বছরদুয়েক ধরে অর্জনের সঙ্গে ফ্লাই করছে। চটপটে, ঠাট্টা-রসিকতার সমঝদার, বুদ্ধিমান। কিন্তু এখন ওকে দেখে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আর ইরিনা, সাবরিনা যেন দুই যমজ বোন—কারণ, দু-জনেরই মুখ ফ্যাকাসে, বিহ্বল, ভয়ে দিশেহারা।
অর্জন ওদের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে টয়লেটের লক-ভাঙা দরজার দিকে তাকালেন : ‘এই টয়লেটটায়?’
‘হ্যাঁ—।’ কুমারমঙ্গলম জবাব দিল।
নিজের শরীরের ভার দরজাটার ওপরে ছেড়ে দিয়ে চাপ দিলেন ক্যাপ্টেন। দরজাটা ফাঁক হল আবার। সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলেন।
মদনমোহন চ্যাটার্জির দেহটা টয়লেট-সিটের ওপরে এলিয়ে রয়েছে। পোশাক-আশাক ফিটফাট। দুটো হাত অসাড় হয়ে দু-পাশে ঝুলছে। পাদুটো ছড়িয়ে রয়েছে সামনের দিকে। পায়ে আটকে যাওয়ার জন্যই দরজাটা পুরোপুরি খোলা যাচ্ছে না।
নিস্পন্দ দেহটার বাকি অংশের চেহারা যাচ্ছেতাইরকমের বীভৎস।
মুখ থেকে বুক পর্যন্ত রক্ত-মাংস-হাড় তালগোল পাকিয়ে ছড়িয়ে আছে। দু-গাল থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মাংসের টুকরো ঝুলছে। রক্ত ছিটকে লেগেছে দু-পাশে দেওয়ালে। ঠিক মনে হচ্ছে, একটা স্কন্ধকাটা মূর্তি টয়লেট-সিটের ওপরে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে।
অর্জন সুখানির শরীরের ভেতরটা কেমন পাক দিয়ে উঠল। বমির দমক উথলে উঠতে চাইল গলা দিয়ে। কিন্তু প্রবল চেষ্টায় তিনি সেটা রুখে দিলেন।
কুমারমঙ্গলম আগেই ওঁকে বলেছিল যে, মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ মুখে গুলি করেছে। সেইজন্যই অর্জন টয়লেটের মেঝেতে জরিপ নজর বুলিয়ে নিলেন। না, কোনও পিস্তল কিংবা রিভলভার চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা একটু অবাক করার মতো। তাই আরও একবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন সুখানি। এমনকী, বডির দু-পাশে শিথিলভাবে ঝুলে-থাকা দুটো হাতের মুঠোও ভালোভাবে নজর করে দেখলেন।
না, মুঠোয় কোনও অস্ত্র ধরা নেই।
মিস্টার চ্যাটার্জি যখন সুইসাইড করেছেন তখন অস্ত্রটা নিশ্চয়ই টয়লেটের কোথাও-না-কোথাও পড়ে থাকবে। সেটা দেখতে না পেয়ে অর্জন সুখানির ভুরু কুঁচকে গেল। এছাড়াও কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। কিন্তু গরমিলটা সুখানিকে বারবার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।
জরিপের কাজ সেরে অর্জন সুখানি কুমারমঙ্গলমের মুখোমুখি হতেই ও রুমাল দিয়ে মুখ মুছল, টেনশন কমানোর চেষ্টায় আলতো করে বলল, এইরকম সিচুয়েশানের কথা আমাদের কোম্পানির ইমার্জেন্সি ম্যানুয়ালে লেখা নেই। লোকটা সুইসাইড করার আর জায়গা পেল না—একেবারে আকাশে, টয়লেটের মধ্যে!’
অর্জন মাথা নেড়ে বললেন, ‘সুইসাইড বলছেন? কিন্তু টয়লেটের মধ্যে তো কোনও ফায়ার-আর্মস চোখে পড়ল না!’
কুমারমঙ্গলম, ইরিনা আর সাবরিনা বড়-বড় চোখে তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে।
‘প্যাসেঞ্জারদের এদিকটায় আসতে বারণ করেছেন ভালোই করেছেন। কিন্তু এখন কী করবেন কিছু ভেবেছেন?’ ক্যাপ্টেন সুখানি কুমারমঙ্গলমকে জিগ্যেস করলেন।
‘দুদিকে পরদা লাগিয়ে এই সেকশানটা আইসোলেট করে দেব। তারপর বোধহয় বডিটাকে বাইরে বের করতে হবে।’
‘ভদ্রলোক শুনলাম খুব বিগ শট?’
ইরিনা এবার জবাব দিল, ‘তার চেয়েও বেশি। মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি। ওঁর কথায় শেয়ার মার্কেট ওঠানামা করে।’
‘তার ওপর পলিটিক্যাল কানেকশানের ব্যাপারটা তো আছেই!’ কুমারমঙ্গলম যোগ করল, ‘এই কেসটা ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে না পারলে পার্লামেন্টে আমাদের এয়ারলাইনস কোম্পানির পিণ্ডি চটকানো হবে।’
‘ওঁর সঙ্গে আর যাঁরা আছেন তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে? ওঁর সঙ্গে কে যেন আছেন বললেন না?’ শেষ প্রশ্নটা ইরিনাকে লক্ষ করে ছুড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন সুখানি।
ইরিনা মাথা নেড়ে সায় দিল : ‘হ্যাঁ—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ওঁর সঙ্গেই দু’জন ট্রাভেল করছেন। সিটে বসানোর সময়ে খেয়াল করেছিলাম, উনি তাঁদের সঙ্গে বেশ কথাবার্তা বলছিলেন, ঠাট্টা করছিলেন…।’
‘তাঁদের ইনফর্ম করেছেন?’
‘করেছি। তবে শুধু বলেছি, একটা প্রবলেম হয়েছে—ব্যস, এইটুকুই।’
ক্যাপ্টেন সুখানি কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন : ‘প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দেখুন কোনও ডক্টর আছে কি না। বডি রিমুভ করার আগে একটা ফরম্যাল মেডিক্যাল ওপিনিয়ান খুব জরুরি। আমাদের কোম্পানির মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি রুটিনের যা গাইডলাইন আছে আমরা সেটাই ফলো করব। আর আমি হেড অফিসে ব্যাপারটা ইনফর্ম করছি।
কুমারমঙ্গলম সায় দিয়ে ঘন-ঘন মাথা নাড়ল।
ক্যাপ্টেনের কথা শোনামাত্রই সাবরিনা ব্যস্তসমস্ত হয়ে একটা ক্যাবিনেটের কাছে গেল। ওটার ছোট্ট পাল্লা খুলে প্যাসেঞ্জার লিস্টটা বের করে নিল। তারপর লিস্টের নামগুলোর ওপরে তাড়াহুড়ো করে চোখ বোলাতে লাগল।
একটু পরেই ও চোখ তুলে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে।
‘ক্যাপ্টেন, ইকনমি ক্লাসে দু’জন ডক্টর আছেন। এক্সিকিউটিভ ক্লাসে কেউ নেই।…’
‘সিট নাম্বার কত?’ কুমারমঙ্গলম জিগ্যেস করল।
‘এম-টু আর কিউ ফোর…।’
‘ওঁদের একজনকে চট করে ডেকে নিয়ে আসুন।’ হাত নেড়ে বললেন অর্জন সুখানি। তারপর তাকালেন ইরিনার দিকে : ‘মেডিক্যাল চেকআপের পর মিস্টার চ্যাটার্জির কম্প্যানিয়নদের যে-কোনও একজনকে এখানে ডাকব। কারণ, ডেডবডির ফরমাল আইডেন্টিফিকেশানটাও খুব ইমপর্ট্যান্ট। উই উইল হ্যাভ টু প্লে দিস স্ট্রিক্টলি বাই দ্য কোম্পানি রুলস। নিয়মের মধ্যে কোনও ফাঁক আমি রাখতে চাই না।’
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন সুখানি খুব টেনশনে রয়েছেন। ওঁর ভুরু এখনও কোঁচকানো, কপালে ভাঁজ। আর আনমনাভাবে নিজের কাঁচাপাকা গোঁফে আলতো করে আঙুল বোলাচ্ছিলেন।
সাবরিনা অলিপথ ধরে পেশাদারি ছন্দে হেঁটে এগিয়ে এল এম-টু সিটটার কাছে।
ভদ্রলোকের পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির ওপরে কাশ্মীরি কাজ করা সাদা শাল। মাথায় ধবধবে সাদা চুল, চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা। বয়েস ষাট-পঁয়ষট্টি কি তার একটু বেশি। ভদ্রলোক একটা অদ্ভুতরকমের রঙিন কিউব নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।
এই ভদ্রলোক ডাক্তার! কে জানে!
ঝুঁকে পড়ে সাবরিনা নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত?’
ভদ্রলোক হাসিমুখে চোখ তুলে তাকালেন সাবরিনার দিকে।
বয়কাট চুল। শ্যামলা রং। টানা-টানা চোখ। পরনে আকাশ-নীল সিল্কের শাড়ি। মেয়েটি বেশ লম্বা হওয়ায় শাড়িটা দারুণ লাগছে। হাওয়াসখি হিসেবে শতকরা একশো ভাগ মানানসই।
‘ইয়েস মিস,’ বললেন এসিজি, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প য়ু?’
‘ডক্টর, আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড দ্যাট উই হ্যাভ আ মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। আমাদের এক্সিকিউটিভ ক্লাসের একজন প্যাসেঞ্জারের একটু মেডিক্যাল প্রবলেম হয়েছে। যদি আপনি এসে একটু দেখেন তা হলে ক্যাপ্টেন খুব খুশি হবেন। প্লিজ, স্যার।’
কোম্পানির ম্যানুয়ালের মুখস্থ করা ফরমুলার মতো সাবরিনা কথাগুলো বলল। ট্রেনিং-এর সময়ে যেরকম যান্ত্রিক ঢং ওদের শেখানো হয়েছে তার বাইরে ও যেতে পারেনি। এবং কথার শেষে ট্রেনিং-এ শেখানো নিয়ম মেনে ও একচিলতে হাসি জুড়ে দিল।
সাবরিনার কথায় এসিজির হাসি একটু চওড়া হল : ‘সরি মিস, আমি ফিজিক্সের ডাক্তার—আই মিন ডক্টরেট। নট মাচ হেল্প টু য়ু। মনে হয় আপনি আমার এই বন্ধুকে চাইছেন। ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে। হি ইজ আ মেডিক্যাল ডক্টর…অ্যাকচুয়ালি হোয়াট য়ু নিড।’ কথা বলতে-বলতে ভবানীপ্রসাদের দিকে ইশারা করে দেখালেন অশোকচন্দ্র।
সাবরিনা ওর ঠোঁট আঠা দিয়ে সাঁটা যান্ত্রিক হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল ডক্টর দে-র দিকে। তাকিয়েই ও ভদ্রলোককে খেয়াল করতে পারল। কিউ-ফোর থেকে সিট চেঞ্জ করে এখানে এসে বসেছেন।
ভবানীপ্রসাদ সাবরিনার কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন। তাই ওকে আর ফরমুলা মুখস্থ বলতে হল না। তার আগেই ভবানীপ্রসাদ উঠে দাঁড়িয়েছেন।
‘চলুন, মিস, তবে আমার সঙ্গে কোনও মেডিক্যাল ব্যাগ নেই। আমি একটু পার্সোনাল কাজে ব্যাঙ্গালোর এসেছিলাম। যদি সেরকম…।’
‘আমাদের প্লেনে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিট আছে, ডক্টর। কিন্তু আমার মনে হয় না ওসবের আর দরকার হবে।’
ভবানীপ্রসাদ একটু অবাক হলেন, ভুরু কুঁচকে তাকলেন সাবরিনার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সাবরিনা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের দিকে হাঁটা দিয়েছে।
রঙ্গলাল এসিজির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
উত্তরে এসিজি ঠোঁট ওলটালেন। তারপর মন দিলেন রুবিক কিউবের দিকে।
ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে টয়লেট কিউবিকল থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ক্যাপ্টেন সুখানি এবং কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন। তারপর চোখ ফেরালেন হাতঘড়ির দিকে।
‘রক্ত যেভাবে জমাট বেঁধেছে তাতে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা হয়েছে আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে…এই ধরুন সাড়ে আটটা কি পৌনে নটা নাগাদ।’
ক্যাপ্টেন সুখানি ছোট্ট করে ‘হুম’ শব্দ করলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘কীভাবে মারা গেছেন?’
ডক্টর দে মাথা চুলকোলেন, ঠোঁট কামড়ালেন বারকয়েক। খানিক সময় নিয়ে ইতস্তত করে বললেন, ‘বডিটা বাইরে বের করার ব্যবস্থা করুন। ডেফিনিট কিছু বলতে হলে আগে ফুল ইন্সপেকশান হওয়ার দরকার। তবে তার আগে একটা সাজেশান আছে…।’
‘কী সাজেশান?’
‘আমার সঙ্গেই একজন বিখ্যাত ক্রিমিনোলজিস্ট ট্র্যাভেল করছেন। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশানের ব্যাপারে রিমার্কেবল জিনিয়াস…ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত…। ওঁর সঙ্গে আচমকা এই ফ্লাইটে দেখা। উনি একবার বডিটা দেখে যদি একটা ওপিনিয়ান দিতেনে তা হলে ভালো হত।’
অর্জন সুখানি কিংবা কুমারমঙ্গলম কেউই অশোকচন্দ্র গুপ্তের নাম শোনেনি। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
ডক্টর দে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, এটা আমার সিরিয়াস রিকোয়েস্ট। য়ু হ্যাভ গট নাথিং টু লুজ…।’
সত্যিই তো! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ডক্টর গুপ্তকে একবার ডেডবডি ইন্সপেক্ট করতে দিলে কী আর ক্ষতি হবে! কিন্তু…।
ক্যাপ্টেন সুখানি ভবানীপ্রসাদ দে-র মুখের দিকে তাকালেন। খুঁটিয়ে দেখতে চাইলেন ওর কথার আড়ালে কোনও উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে কি না। তা ছাড়া…।
অর্জন বললেন, ‘ডক্টর, কেসটা যদি প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল সুইসাইড হয় তা হলে একজন ক্রিমিনোলজিস্ট সেখানে…।’
‘ক্যাপ্টেন, আপনি অযথা হয়রান হচ্ছেন!’ একটু বিরক্ত হয়েই ভবানীপ্রসাদ বললেন, ‘অ্যাজ আই সেইড, য়ু হ্যাভ গট নাথিং টু লুজ।’
অগত্যা কী আর করা যায়!
একটু পরেই ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত টয়লেটের কাছে এলেন। তাঁর খানিকটা পিছনেই দাঁড়িয়ে রঙ্গলাল। ভদ্রলোক হতভম্ব চোখে একবার তার মুখের ওপরে চোখ বোলালেন।
ক্যাপ্টেন ভুরু কুঁচকে রঙ্গলালকে দেখে ডক্টর দে-র দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন, ‘ইনি কে?’
ভবানীপ্রসাদ দেখলেন বিশদ ব্যাখ্যায় গেলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যেতে পারে। তাই হেসে বললেন, ‘ওঁর খুব ক্লোজ। সাম সর্ট অফ অ্যাসিস্ট্যান্ট।’
রঙ্গলাল ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে তাকিয়ে আকর্ণ হাসলেন।
অশোকচন্দ্র টয়লেটের ভেতরটায় উঁকি মারলেন। মাত্র কয়েকমিনিট। তারপরই বেরিয়ে এলেন বাইরে।
মাথায় ধবধবে সাদা চুলের গোছায় বারতিনেক টান মেরে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘ভারি অদ্ভুত!’
‘কী অদ্ভুত?’ জানতে চাইলেন অর্জন সুখানি।
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। এসিজি। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হেসে বললেন, ‘খবর বোধহয় ভালো নয়, ক্যাপ্টেন।’ রসিকতার সামান্য ছোঁওয়া টের পাওয়া গেল এসিজির কথায়, ‘বডিটা আগে সাবধানে বাইরে বের করে নিয়ে আসুন। ডক্টর দে খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বলুন, মিস্টার চ্যাটার্জির মৃত্যুর কারণটা কী? তারপর আমরা বুঝতে চেষ্টা করব, ঠিক কীভাবে ভদ্রলোক দুর্ঘটনাটা ঘটালেন…।’
‘দুর্ঘটনা! অ্যাক্সিডেন্ট! সুইসাইড নয় বলছেন…।’ এসিজির মুখের দিকে বিভ্রান্তভাবে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি।
‘আমি এখনও কিছু বলিনি…’ হাসলেন এসিজি : ‘যা বলার ডক্টর দে আগে বলবেন…তারপর আমি।’
নার্ভাসভাবে ঘাড়ে হাত বোলালেন ক্যাপ্টেন, বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আমাদের চেয়ারম্যানকে এক্ষুনি রেডিয়ো মেসেজ পাঠাতে হবে। এরকম ভাসা-ভাসা বললে উনি খুব বিরক্ত হবেন। হি ইজ লাইক টু হ্যাভ সামথিং মোর স্পেসিফিক! যদ্দূর মনে হয়, মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে ওঁর হয়তো আলাপ থাকলেও থাকতে পারে। ওঁদের অনেক কমন সার্কল আছে। আমাদেরই হয়েছে যত জ্বালা!’
‘কমন সার্কল আছে নয়, ছিল। আপনি আপনাদের চেয়ারম্যানসাহেবকে অনায়াসে বলতে পারেন যে, মিস্টার মদনমোদন চ্যাটার্জি এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটে…যতদূর মনে হচ্ছে…মার্ডার্ড হয়েছেন।’
অর্জন সুখানি একটা জোরালো ধাক্কা খেলেন।
মার্ডার! বন্ধ টয়লেটের মধ্যে সেটা কেমন করে সম্ভব! কিন্তু এটাও তো তিনি লক্ষ করেছেন যে, টয়লেটের মধ্যেও কোনও রিভলভার কি পিস্তল নেই।
ক্যাপ্টেন সুখানির সবকিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।
সুইসাইড হলেও ব্যাপারটার ঠিক হদিস পাওয়া যাচ্ছে না, আবার মার্ডার হলেও তাই।
এমন সময় ইরিনা হন্তদন্তভাবে এসে হাজির হল। প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ক্যাপ্টেন, মিস চ্যাটার্জি…মানে, মিস্টার চ্যাটার্জির বোন…ওঁর সঙ্গে ট্র্যাভেল করছেন…উনি খুব উতলা হয়ে পড়েছেন। এখানে আসতে চাইছেন…।’
‘ওঃ হো,’ বেশ বিরক্ত হলেন অর্জন সুখানি। হাত নেড়ে ইরিনাকে বললেন, ‘ওঁকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করুন। বলুন, ব্যাপারটা আমরা হ্যান্ডল করছি। আর এদিকটায় যেন কেউ না আসে। দিস ইজ অ্যান অর্ডার। অ্যাড্রেস সিস্টেমে এটা অ্যানাউন্স করে দিন—এক্ষুনি।’
ইরিনা চটপটে পায়ে চলে গেল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের দিকে।
ভবানীপ্রসাদ দে এসিজির কথাগুলো ভাবছিলেন। বৃদ্ধ গোয়েন্দার কথাগুলো একটু অতিনাটকীয় শোনাচ্ছে না কি? সুতরাং তিনি ছোট্ট করে কেশে গলা পরিষ্কার করে একটু চাপা গলায় এসিজিকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, এত তাড়াহুড়ো করে ডিসিশান নেওয়ার দরকার কী? আসলে আমার মনে হচ্ছিল…।’
বৃদ্ধ হুনুর আপত্তি করে মাথা নাড়লেন, শান্ত গলায় বললেন, ‘ডক্টর দে, লক্ষ করেছেন, কী বীভৎসভাবে ভদ্রলোকের মুখের নীচের দিকের অংশটা ছত্রখান হয়ে উড়ে বেরিয়ে গেছে। চোখের নীচটায়…বিশেষ করে নাক আর মুখের জায়গাটা কিছু আর নেই। মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে গুলি করলে এরকম হওয়া সম্ভব। নাঃ, মিস্টার চ্যাটার্জি ডায়েড ইনস্ট্যান্টলি…নো ডাউট অ্যাবাউট ইট…।’
অর্জন সুখানি ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। যে-গরমিলটা অনেকক্ষণ ধরে ওঁকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল সেটা এখন হঠাৎই মনে পড়ে গেল। টয়লেটের ভেতরে পিস্তল কিংবা রিভলভার ফায়ার করলে…।
ক্যাপ্টেন সুখানি অশোকচন্দ্রের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোণে তেরছা একটা হাসির ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আপনার থিয়োরিতে এমনিতে কোনও ফাঁক নেই—শুধু একটা পয়েন্ট ছাড়া। টয়লেটের ভেতরে কোনও লো ক্যালিবারের ফায়ার আর্মসও যদি ফায়ার করা হয়ে থাকে…মানে, মুখে রিভলভারের নল ঢুকিয়ে…তা হলে মাথা ফুটো করে গুলিটা সোজাসুজি গিয়ে লাগবে টয়লেটের দেওয়ালে। ওটা যে-ফোর্সে গিয়ে লাগবে তাতে দেওয়াল অনায়াসে ফুটো হয়ে যাবে। দ্যাট উইল কজ ডিকম্প্রেশান। বুঝতেই পারছেন, এই তেত্তিরিশ হাজার ফুট উঁচুতে একটা বুলেট যদি এয়ারক্র্যাফটের দেওয়াল ফুটো করে দেয়, তা হলে কী প্রবলেম হতে পারে?’
রঙ্গলাল সুখানির কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট ইজ ডিকম্প্রেশান, ক্যাপ্টেন?’
ক্যাপ্টেন সুখানি বিরক্ত হয়ে কুমারমঙ্গলমের দিকে কড়া চোখে তাকালেন। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারায় ওঁকে সরিয়ে নিতে বললেন।
কুমারমঙ্গলম রঙ্গলাল গোস্বামীকে একপাশে টেনে নিয়ে বলল, ‘আসুন, আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি…।’
ক্যাপ্টেনের কথার সুরে একটা বাঁকা ভাব এসিজি লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তাতে বৃদ্ধ হুনুর কিছু মনে করেননি। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই অ্যানালিটিক্যাল মাইন্ড থাকতে হবে এই চাহিদা বড্ড বাড়াবাড়ি। আর আই. কিউ. লেভেলও সকলের উঁচু তারে বাঁধা থাকতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। শরীরের ব্যায়াম না করলে কখনও শরীর চোস্ত হয় না। মগজের বেলাতেও ঠিক তাই। থিঙ্কিং মেশিনটার কলকবজায় নিয়মিত তেল দিলে তবে না মেশিন কাজ করবে! ক্যাপ্টেন সুখানিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোম্পানির হোমরাচোমরাদের তেল দিতেই বেশি ব্যস্ত। ফলে ওঁর জং-ধরা মগজটা যেমন থাকার কথা তাই-ই আছে।
সুতরাং নরম হেসে মোলায়েম গলায় এসিজি বললেন, ‘একটা বোধহয় ভুল হচ্ছে, ক্যাপ্টেন। আমি কখনও বলিনি যে, মিস্টার চ্যাটার্জি বুলেট ফায়ারিং-এই খুন হয়েছেন। আমি বলেছি, মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে গুলি করলে এরকম হওয়া সম্ভব…।
কুমারমঙ্গলম তখন হাত-পা নেড়ে রঙ্গলালকে ডিকম্প্রেশান বোঝাচ্ছিল।
‘…গ্রাউন্ড লেভেল থেকে অ্যাবাউট থার্টি থ্রি থাউজ্যান্ড ফুট হাইটে অ্যাটমসফিয়ার খুব থিন হয়ে যায়। মানে, বাতাস এত পাতলা যে, তার প্রেসার নেগলিজিবলি স্মল হয়ে যায়। এই পাতলা বাতাসে মানুষ বাঁচতে পারে না…।’
ঘাড় নেড়ে রঙ্গলাল বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—সেইজন্যেই সবাই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পাহাড়ে ওঠে।’
‘অ্যাবসলিউটলি রাইট।’ কুমারমঙ্গলম বলল, ‘সেইজন্য প্লেনের ভেতরে গ্রাউন্ড লেভেলের অ্যাটমসফেরিক প্রেসারে বাতাস ভরা থাকে। যদি কোনও কারণে প্লেন ফুটো হয়ে যায়…খুব ছোট ফুটো হলেও চলবে…তা হলে আলপিন ফোটানো বেলুন যেমন হাওয়া বেরিয়ে চুপসে যায় সেরকম আমাদের প্লেনের ভেতরকার বাতাসও ফুস করে বাইরে বেরিয়ে যাবে। তখন শ্বাসকষ্টে প্যাসেঞ্জার, ক্রু—সবাই কাহিল হয়ে পড়বে। সেইজন্যেই ডিকম্প্রেশানকে আমরা ভয় পাই।’
‘বুঝেছি, বুঝেছি—’ মাথা নেড়ে বললেন রঙ্গলাল, ‘যদি না থাকে বায়ুচাপ/ বলবে সবাই বাপরে বাপ।’
কুমারমঙ্গলম রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতার কী বুঝল কে জানে! তবে একগাল হেসে ঘন-ঘন মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওরা এসিজিদের কাছে এসে দাঁড়াল আবার।
এসিজি মাথার চুলে হাত বোলালেন। তারপর সামান্য কেশে ক্যাপ্টেনকে লক্ষ করে বললেন, ‘আসলে আমি বলতে চাইছি, ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস। উন্ডটা গানশটের মতো, অথচ টয়লেটের দেওয়াল ফুটো হয়নি…।’
এসিজিকে বাধা দিয়ে কুমারমঙ্গলম বলল, ‘ব্যাপারটা সুইসাইড হতে বাধা কোথায়, মিস্টার গুপ্ত? ভদ্রলোক টয়লেটের ভেতরে দরজা লক করে বসেছিলেন। সেখানে বাইরে থেকে…ওঃ, ইমপসিবল।’
এসিজি চোখ ফেরালেন চিফ স্টুয়ার্ডের দিকে : ‘আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। তবে নেচার অফ উন্ড দেখে মনে হচ্ছে মিস্টার চ্যাটার্জি ইনস্ট্যানটেনিয়াসলি মারা গেছেন। তা হলে সুইসাইড করার পর তাঁর পক্ষে অস্ত্রটা কি লুকিয়ে ফেলা সম্ভব? সুতরাং, সুইসাইড যদি হয়, তা হলে অস্ত্রটা কোথায় গেল? আর মার্ডার যদি হয়, তা হলে মার্ডারার টয়লেটের দরজাটা ভেতর থেকে লক করল কীভাবে? এখন এই দুটোই হচ্ছে আমাদের কাছে মোস্ট ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন। সেইজন্যেই বলেছি, ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস। কী বলেন, ডক্টর দে?’
ভবানীপ্রসাদ দে কেমন যেন ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন। সেটা সামলে নিয়ে ক্যাপ্টেন এবং কুমারমঙ্গলমের দিকে একবার দেখলেন। তারপর এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘ওই ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তর তো আপনাকেই দিতে হবে, ডক্টর গুপ্ত।’
‘হুঁ…হুঁ…’ বলে সহাস্যে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ হুনুর।
ক্যাপ্টেন সুখানি অবিশ্বাসের চোখে দীর্ঘকায় বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকালেন। এঁকে ডেকে এনে আরও ঝামেলা হল দেখছি। আমতা-আমতা করে তিনি বললেন, ‘মার্ডার ওয়েপনটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখলে হয় না? হয়তো দরজার আড়ালে বা টয়লেট সিটের পেছনে আনাচে-কানাচে কোথাও একটা পড়ে আছে…।’
অশোকচন্দ্র এ-কথার কোনও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
অর্জন সুখানি মরিয়া হয়ে অন্তত একটা খড়খুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলেন। কারণ, লকড রুম প্রবলেম বড় বিচ্ছিরি জিনিস।
এসিজির দিকে আকুল চোখে তাকিয়ে তিনি একটা নতুন থিয়োরির প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনার কী মনে হয়, ডক্টর গুপ্ত? মিস্টার চ্যাটার্জিকে কোথাও খুন করে তারপর টয়লেটে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে?’
এসিজি বোধহয় ক্যাপ্টেনের মনের কথা আঁচ করতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘সেটা হলেও তো লকড রুম প্রবলেমটাকে এড়ানো যাচ্ছে না, ক্যাপ্টেন। কারণ, ডেডবডিটা টয়লেটে সিটের ওপরে বসিয়ে দিয়ে মার্ডারার হয়তো সটকে পড়ল…ভালো কথা। কিন্তু টয়লেটের দরজাটা সে ভেতর থেকে লক করবে কী করে? তা ছাড়া, টয়লেটের ওয়ালে যেভাবে রক্ত ছিটকে লেগেছে তাতে এটা খুবই স্পষ্ট যে, মিস্টার চ্যাটার্জি যখন মারা যান তখন তিনি টয়লেট সিটেই বসেছিলেন এবং টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল।’
কুমারমঙ্গলমের দিকে ঘুরে তাকালেন এসিজি : ‘কী, মিস্টার কুমারমঙ্গলম, ঠিক বলছি তো?’
ঠোঁট চেপে অস্বস্তির চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে একবার তাকাল কুমারমঙ্গলম, তারপর এসিজির দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন—টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল।’
‘তা হলে কী করে…।’
উত্তেজিত ক্যাপ্টেনকে বাধা দিলেন এসিজি : ‘সেটাই আমাকে বের করতে হবে…যদি আপনি আমাকে দয়া করে অনুমতি দেন…।’
‘কীসের অনুমতি?’
‘ওই যে বললাম…মোস্ট ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অনুমতি।’
ক্যাপ্টেন সুখানি দোনামনা হয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমি তা হলে আমাদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলছি। আমার চেয়েও ওঁর পারমিশান নেওয়াটা জরুরি। ওঁকে বলি, প্লেনে একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে। এক্সিকিউটিভ ক্লাসের একজন প্যাসেঞ্জার…ওয়েলনোন বিজনেস টাইকুন মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি হ্যাজ…।’
‘বিন মার্ডার্ড।’ ক্যাপ্টেনের কথা স্পষ্ট গলায় শেষ করলেন এসিজি : ‘আপনি আপনাদের চেয়ারম্যানকে আমার কথাও বলতে পারেন। এম.পি. মিস্টার পরেশ সান্যাল আমাকে পার্সোনালি জানেন। দরকার হলে সেকথাও আপনি জানাতে পারেন। এ ছাড়া আমার মনে হয়, ইনভেস্টিগেশানের ব্যাপারটা আমাদের প্লেনের মধ্যেই যতটা সম্ভব সেরে ফেলা উচিত। তাতে আমাদের সাইকোলজিক্যাল অ্যাডভানটেজ আছে। কারণ, মার্ডারার প্লেনে বন্দি থেকে আনসেফ ফিল করবে। হি অর শি উইল বি আন্ডার এক্সট্রিম টেনশান। ফলে আমরা সহজে তাকে চিনে নিতে পারব। দেন পুলিশ ক্যান টেকওভার।’
ক্যাপ্টেন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কলকাতা পৌঁছোতে তো আর একঘণ্টাও বাকি নেই! সেখানে এয়ারক্র্যাফট ল্যান্ড করলে প্যাসেঞ্জারদের কিছুতেই আর প্লেনে আটকে রাখা যাবে না। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বিগ শট। ওঁরা আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন…।’
হাত তুলে ক্যাপ্টেনকে অভয় দিলেন এসিজি। হেসে বললেন, ‘এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ক্যাপ্টেন। প্যাসেঞ্জারদের বলুন যে, প্লেনে একটু টেকনিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেটা ঠিক করার জন্যে বিশাখাপত্তনম এয়ার টার্মিনালে আমাদের ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে হবে। আশা করি দু-একঘণ্টার মধ্যে রিপেয়ারের কাজটা মিটে যাবে। অ্যান্ড দ্য ইনকনভেনিয়েন্স কজড ইজ রিগ্রেটেড।’ শেষ কথাটা এসিজি বেশ নাটকীয়ভাবে ঘোষণার ঢঙে বললেন।
ক্যাপ্টেন সুখানির মুখে পলকে হাসি ফুটে উঠল। তিনি হাত বাড়িয়ে এসিজির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন : ‘দ্যাট ওয়াজ আ রিয়েল বিউটি, ডক্টর গুপ্ত। নাউ আই বিলিভ য়ু ক্যান ন্যাব দ্য কিলার। থ্যাঙ্ক য়ু ভেরি মাচ।’
ক্যাপ্টেনের নির্মেঘ মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পেল কুমারমঙ্গলম। কারণ, ক্যাপ্টেন সুখানি লোক চিনতে ভুল করেন না। তা ছাড়া, কুমারমঙ্গলমের কেন জানি না মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ এই লোকটা পারলেও পারতে পারে।
ফ্লাইট ডেকের দিকে রওনা হওয়ার আগে ক্যাপ্টেন ডক্টর গুপ্তকে জিগ্যেস করলেন, ‘আমাদের এম.পি-র নামটা কী বললেন যেন?’
‘মিস্টার পরেশ সান্যাল। কিন্তু চেয়ারম্যানসাহেবকে এতসব কি বলার দরকার আছে?’
‘আছে। এম.পি-টেম.পি. শুনলে ওঁরা একটু বেশি ভরসা পান। আর আমি এখুনি অ্যানাউন্সমেন্টেরও ব্যবস্থা করছি। ধরে নিন, আমরা ভাইজাগের দিকে রওনা হয়ে গেছি। কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি : ‘কুমারমঙ্গলম, য়ু প্লিজ লুক আফটার দিস অড কাপল অফ ডক্টরস। ওঁরা যা-যা বলেন কো-অপারেট করুন। নাউ দে আর দ্য বস। আমি এক্ষুনি আমাদের চেয়ারম্যান মিস্টার সুরেশ ওয়ালিয়ার সঙ্গে কথা বলে সব ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নিচ্ছি।’
তড়িঘড়ি পা ফেলে ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি পরদা সরিয়ে চলে গেলেন।
এসিজি ডক্টর দে-র দিকে ফিরে বললেন, ‘ডক্টর’ দে, আসুন, এবারে বডিটা সাবধানে বের করে ফেলা যাক।’
কুমারমঙ্গলম একেবারে হাঁ-হাঁ করে এসিজিকে বাধা দিল, বলল, ‘আপনি কেন হাত লাগাবেন, ডক্টর গুপ্ত! আপনি এপাশটায় দাঁড়ান…আমি আর ডক্টর দে ম্যানেজ করে নিচ্ছি।’
সরে এলেন এসিজি। হাসলেন মনে-মনে। এম.পি.-র নাম নেওয়ার অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! এইসব নাম-টাম নেওয়া ওঁর অভ্যেস নয়। এখানে এরকম একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন হয়েছে বলে বাধ্য হয়ে পরেশ সান্যালের নামটা বলতে হয়েছে। বছরতিনেক আগে মিস্টার সান্যালের একটা চুরি-যাওয়া সোনার হাতঘড়ি এসিজি উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই পরিচয়টা গাঢ় হয়েছে।
এসিজি খেয়াল করেননি, কখন যেন রঙ্গলাল ওঁর খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। ওঁর কানের কাছে মুখ এনে রঙ্গলাল যখন চাপা গলায় বললেন, ‘আকাশে মার্ডার/ প্রবলেম হার্ডার’, তখনই এসিজি ওঁকে খেয়াল করলেন। এবং হেসে ফেললেন।
মিনিট-পনেরোর মধ্যেই অর্জন সুখানি ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে এলেন। ততক্ষণে মদনমোহন চ্যাটার্জির দেহটা টয়লেট স্পেস থেকে বের করে বাইরে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং ভবানীপ্রসাদ দে ওঁর প্রাথমিক পরীক্ষা সেরে ফেলেছেন।
পরীক্ষা করে এসিজির সঙ্গে একমত হয়েছেন ভবানীপ্রসাদ। পিস্তল কিংবা রিভলবার, যা-ই ব্যবহার করা হয়ে থাকুক না কেন, সেটা ফায়ার করা হয়েছে মুখের মধ্যে নল ঢুকিয়ে। এবং মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ।
অর্জন সুখানি ডেডবডির দিকে একবার তাকালেন। তারপর এসিজির মনোযোগ পাওয়ার আশায় ছোট্ট করে বারদুয়েক কাশলেন।
এসিজি কপালে ভাঁজ ফেলে মুখ তুলে তাকালেন ক্যাপ্টেনের দিকে।
‘ডক্টর গুপ্ত, আমাদের চেয়ারম্যানকে গোটা ব্যাপারটা জানিয়েছি। উনি আপনাকে এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করার পুরো অথরিটি দিয়েছেন। মনে হয়, মিস্টার পরেশ সান্যালের সঙ্গে ওঁর পরিচয় আছে—কারণ, উনি মিস্টার সান্যালের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। আমরা আশা করছি, ভাইজাগেই ব্যাপারটা মিটে যাবে। তখন লোকাল অথরিটির কাছে কেসটা হ্যান্ডওভার করে দিতে হবে। মিস্টার ওয়ালিয়ার কথা মনে হল, হি ইজ কনভিন্সড অ্যান্ড ইমপ্রেসড অ্যাবাউট ইয়োর এবিলিটি। হয়তো মিস্টার সান্যাল কিছু বলে থাকবেন। ওয়েল…’ দু-পাশে হাত ছড়িয়ে বললেন ক্যাপ্টেন, ‘নাউ ইটস ইয়োর গেম।’
‘আমাদের প্লেন এখন তা হলে বিশাখাপত্তনমের দিকে যাচ্ছে?’ ভবানীপ্রসাদ জিগ্যেস করলেন।
‘হ্যাঁ। চেয়ারম্যানসাহেব বললেন, মিস্টার চ্যাটার্জি যখন মারাই গেছেন তখন অযথা তাড়াহুড়ো করে প্লেন ডাইভার্ট করে ডাক্তার-নার্সিং হোম খোঁজার কোনও মানে হয় না। আপনি কাজ শুরু করুন, ডক্টর গুপ্ত।’
‘গুড। তাহলে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে যেখানে বেশ কিছু সিট ফাঁকা আছে সেরকম একটা জায়গা আমাদের দিন, ক্যাপ্টেন। মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে যাঁরা ট্র্যাভেল করছেন তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। তবে অন্য প্যাসেঞ্জাররা যেন অযথা ভয়-টয় না পেয়ে যায় সেটাও খেয়াল রাখবেন। তা হলে আমাদের কাজের অসুবিধে হবে।’
‘কুমারমঙ্গলম, আপনি এক্সিকিউটিভ ক্লাসে একটু স্পেসের ব্যবস্থা করুন।’ চিফ স্টুয়ার্ডকে নির্দেশ দিলেন অর্জন, ‘দেখবেন, ডক্টর গুপ্তদের ওয়ার্কিং স্পেসের কাছাকাছি যেন কোনও প্যাসেঞ্জার না থাকে। অনেক সিট তো খালি আছে—সেরকম হলে তাদের একটু শিফট করিয়ে দেবেন।’
কুমারমঙ্গলম ‘ইয়েস, স্যার’ বলে বেরিয়ে গেল।
ক্যাপ্টেন এবার হালকা গলায় এসিজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাকে আপনার সন্দেহ হয়, মিস্টার গুপ্ত? নরমালি দ্য কিলার ইজ সামওয়ান রিলেটেড টু দ্য ভিকটিম…।’
সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন এসিজি। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে চারজন ট্রাভেল করছিলেন। দু’জন ওঁর সঙ্গেই বসেছেন—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে। আর বাকি দুজনে আছেন ইকনমি ক্লাসে।’
সুখানি বললেন, ‘হ্যাঁ মদনমোহন চ্যাটার্জির বোন তো খেপে লাল! ইরিনাকে যা-তা ভাষায় অ্যাটাক করেছেন। তারপর আমি গিয়ে ওঁকে অনেক কষ্টে ঠান্ডা করেছি। কিন্তু ইকনমি ক্লাসে কোন দু’জন ওঁর গ্রুপের?’
‘ডক্টর দে বোধহয় এ-ব্যাপারে আপনার হেলপ করতে পারবেন…।’ কথা বলতে-বলতে ভবানীপ্রসাদের দিকে ফিরলেন এসিজি।
কিন্তু রঙ্গলাল গোস্বামী তৎপরভাবে বলে উঠলেন, ‘আমার সঙ্গে কেউ চলুন…আমি ওঁদের চিনিয়ে দিচ্ছি।’
ক্যাপ্টেন চট করে এগিয়ে গেলেন পরদার কাছে। পরদা সরিয়ে উঁকি মারতেই সাবরিনাকে দেখতে পেলেন। ওকে ইশারায় ডাকলেন।
সাবরিনা আসতেই রঙ্গলালকে বললেন, ‘আপনি কাইন্ডলি হোস্টেসের সঙ্গে যান। যতটা ইনকন্সপিকুয়াসলি পারেন ওই দু’জন প্যাসেঞ্জারকে চিনিয়ে দিন…।’
‘ইনকন…কী বললেন?’ রঙ্গলাল প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ক্যাপ্টেনের চোখে।
এসিজি হেসে রঙ্গলালকে বললেন, ‘এমনভাবে চেনাবেন যেন কেউ বুঝতে না পারে।’
ওঁরা দু’জন চলে যেতেই এসিজি ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘মিস্টার চ্যাটার্জির বোনের সঙ্গে প্রথম কথা বলা যাক। উনি তো শুনলাম বেশ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া, ডেডবডির ফরমাল আইডেন্টিফিকেশানটা এখন করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’
এমনসময় কুমারমঙ্গলম ফিরে এল। বলল যে, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এক্সিকিউটিভ ক্লাসে একটা কর্নার স্পেসে বসে ডক্টর গুপ্ত সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে প্যাসেঞ্জাররা বেশ রেস্টলেস হয়ে পড়েছে একজন রেগুলার প্যাসেঞ্জার তো বলেই বসেছে, প্লেন হঠাৎ কোর্স চেঞ্জ করে ভাইজাগের দিকে যে যাচ্ছে তার আসল কারণটা কী? সত্যিই কোনও টেকনিক্যাল প্রবলেম, নাকি অন্য কিছু? কুমারমঙ্গলম তাকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে-টুঝিয়ে শান্ত করেছে।
ক্যাপ্টেন কুমারমঙ্গলমকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্তদের কাজের সময় প্যাসেঞ্জাররা এদিক-ওদিক চলে-ফিরে বেড়ালে প্রবলেম হবে। আপনি ইরিনাকে বলুন পি. এস. সিস্টেমে অ্যানাউন্স করে দিক, সব প্যাসেঞ্জার যেন নিজের-নিজের সিটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নেয়। কারণ, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই টারবুলেন্স আশা করছি। একে তো কুয়াশার জন্যে ফ্লাইট লেট হয়েছে, ফলে প্যাসেঞ্জাররা ধরে নেবে আজ প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে নেই।’ ডক্টর গুপ্তর দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি : ‘এবার তা হলে মিস চ্যাটার্জিকে খবর দেওয়া যাক?’
সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লেন এসিজি। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেনের মনে হল বৃদ্ধ হুনুরের মন পড়ে আছে অন্য কোথাও—গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছেন তিনি।
কুমারমঙ্গলমকে ইশারায় নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। অর্থাৎ মিস চ্যাটার্জিকে পাঠিয়ে দিন।
কুমারমঙ্গলম ব্যস্তভাবে চলে গেল।
ক্যাপ্টেন ভুরু উঁচিয়ে তাকালেন এসিজির দিকে। পুরোনো প্রশ্নটাই করলেন আবার : ‘কী বুঝছেন, ডক্টর গুপ্ত? হু কুড বি দ্য পসিবল কিলার? মিস্টার চ্যাটার্জির চেনা-জানা কেউ? না কি…।’
উত্তরে হাসলেন অশোকচন্দ্র : ‘এখনই কিছু বলা অসম্ভব। তবে, ক্যাপ্টেন, আপনার প্লেন চালানোর যেমন কিছু রুলস আছে, থিয়োরি আছে, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশানেও ঠিক তাই। যারা সাসপেক্ট তাদের মধ্যে একজনকে খুঁজে বের করুন যার খুন করার উদ্দেশ্য আছে, সুযোগ আছে, আর সাহস আছে…।’
‘ইজ ইট সো?’ মজা করে জিগ্যেস করলেন অর্জন সুখানি।
‘ইয়েজ, ক্যাপ্টেন—মোটিভ, অপারচুনিটি অ্যান্ড গাটস—দ্য রুল অফ থ্রি ফর আ কিলিং।’
‘উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট, ডক্টর। আমি ফ্লাইট ডেক-এ যাচ্ছি। কিপ মি ইনফরমড অফ এনি ডেভেলাপমেন্টস।’
ইরিনার সঙ্গে যে-ভদ্রমহিলা এসিজিদের কাছে এলেন ওঁকে দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল উনি যথেষ্ট বড়লোক এবং বিরক্ত।
বয়েস পঁয়তাল্লিশ পেরোলেও মেকাপ সেটাকে প্রাণপণে পিছনদিকে টানছে। ছিপছিপে ফরসা চেহারা, পানপাতার মতো মুখ। বয়েসে সুন্দরী ছিলেন অবশ্যই—ফলে এখনও যে কেন মিস থেকে গেছেন সেটাই আশ্চর্যের।
ভদ্রমহিলার কপালে টিপ, চোখের পাতায় মাসকারা, চোখের ঢাকনায় আইলাইনার, আরও কত কী! ওঁকে ঘিরে থাকা পারফিউমের হালকা গন্ধ মনটা ভালো করে দিচ্ছিল। পরনে সোনালি পাড়ের এক অদ্ভুত রঙের শাড়ি—যেন কেউ স্প্রে করে কয়েকটা আবছা রং মোলায়েমভাবে শাড়িতে বুলিয়ে দিয়েছে। আর কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা কালো চকচকে শৌখিন লেডিজ ব্যাগ। ভদ্রমহিলার পোশাক দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখন শীতকাল।
ওঁর শরীরে গয়না বলতে মাত্র তিনটি। হাতে আংটি এবং ব্রেসলেট। আর গলায় সরু সোনার চেনে বসানো লকেট। তবে তিনটে গয়নাতেই যথেচ্ছভাবে হিরে বসানো।
এসিজি জোরে নাক টানলেন। হয়তো পারফিউমের গন্ধ ছাপিয়ে টাকার গন্ধ পাওয়া যায় কি না দেখতে চাইছিলেন।
‘এসব কী শুনছি! দাদার নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! কোথায়, দাদা কোথায়? সেই কখন টয়লেটে গেছে! তখন থেকে এই অকর্মা মেয়েগুলোকে বলছি খোঁজ নিতে। কী করে যে এরা হোস্টেসের চাকরি পায় কে জানে! হোপলেস! এদিকে সিটে বসে আমি আর রমেশ দুশ্চিন্তায় মরছি—সেদিকে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি রমেশকে বললাম…।’
‘ম্যাডাম—’ ভদ্রমহিলার কথাপ্রপাতে বাধা দিলেন অশোকচন্দ্র : ‘আপনার নামটা প্লিজ আমাদের বলবেন—।’
এতক্ষণ ভদ্রমহিলা ভবানীপ্রসাদ দে-কে লক্ষ করে কথা বলছিলেন—হয়তো ওঁর কম বয়েসটাই তার কারণ। এখন চমকে ঘুরে তাকালেন পঁয়ষট্টি পেরোনো বৃদ্ধের দিকে। কয়েকপলক তাচ্ছিল্যের চোখে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন ওঁর নাম না জানাটা এসিজির পক্ষে অপরাধ। তারপর বোধহয় এসিজির সাদা চুলের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধকে ক্ষমা করতে পারলেন।
দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, ‘শ্রাবণী—শ্রাবণী চ্যাটার্জি। আমি মদনমোহন চ্যাটার্জির বোন। তার আবার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে না কি!’
এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে হাসলেন। শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, একসময় এই চোখে তির ছিল। কত যুবক সেই তিরে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আজ তুণ খালি—তবুও সোনার দিনটা আন্দাজ করা যায়। ‘না, মিস চ্যাটার্জি, কোনও সার্টিফিকেট আপনাকে দেখাতে হবে না। বরং আমরাই আপনার কাছে সার্টিফিকেট চাইছি।’ এসিজি নরম গলায় বললেন।
‘তার মানে!’
‘আপনি ডক্টর দে-র সঙ্গে ওই পরদার আড়ালে একবার যান। ওখানে একটা ডেডবডি আছে। প্লিজ, এর পরের কথাটা শুনে হঠাৎ করে যেন চেঁচিয়ে উঠবেন না—কারণ, অন্য প্যাসেঞ্জাররা এখনও জানে না, এই প্লেনে একটা মার্ডার হয়েছে। আপনি কাইন্ডলি গিয়ে আপনার দাদার ডেডবডিটা আইডেন্টিফাই করুন। হি প্রব্যাবলি হ্যাজ বিন শট ইন দ্য মাউথ।’
সঙ্গে-সঙ্গে শ্রাবণী একটা অদ্ভুত শব্দ করে টলে পড়ে গেলেন। ইরিনা সময়মতো ওঁকে ধরে না ফেললে হয়তো মাথায় কিংবা ঘাড়ে চোট লাগতে পারত।
ইরিনা শ্রাবণীকে একটা সিটে বসিয়ে দিল। তারপর ছুটে গিয়ে একগ্লাস জল নিয়ে এল।
ওর হাত থেকে জলের গ্লাসটা শ্রাবণীর চোখে-মুখে সামান্য ছিটিয়ে দিলেন এসিজি। ভবানীপ্রসাদ চটপট শ্রাবণীর বাঁ-হাতের কবজি চেপে ধরে পালস রেট মাপতে চাইলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই শ্রাবণীর চেতনা ফিরে এল। ধীরে-ধীরে চোখ খুললেন। অশোকচন্দ্র ওঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘প্লিজ, একটু শক্ত হোন, ম্যাডাম। আপনার সামনে এখন অনেক কাজ। এসময়ে ভেঙে পড়বেন না।’
কয়েকবার চোখ পিটপিট করে শ্রাবণী বললেন, ‘সরি। ইট ওয়াজ আ গ্রেট শক। দাদাকে খুব ভালোবাসতাম আমি…’ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিলেন : ‘ওয়েল, হু ডিড ইট?’
অশোকচন্দ্র ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মেরে বললেন, ‘সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি, মিস চ্যাটার্জি।’
‘আপনি কি পুলিশের লোক নাকি? সন্দেহে ভুরু কুঁচকে গেল ম্যাডামের।
এসিজি কিছু বলে ওঠার আগে ভবানীপ্রসাদ গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর শ্রাবণীর কাছে এসে হেসে বললেন, ‘ইনি ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—দ্য গ্রেট ইনভেস্টিগেটর। থিঙ্কিং মেশিন। দ্য বেস্ট ইন দ্য গেম।’
এসিজি এত প্রশংসার ওজন সামলাতে মাথা নিচু করলেন।
শ্রাবণী চ্যাটার্জির ভুরু কুঁচকেই ছিল। এবার ঠোঁটের কোণাটা সামান্য বেঁকে গেল : ‘য়ু মিন ডিটেকটিভ?’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম, আমি একজন হুনুর—হুনুরি করে আনন্দ পাই।’ এসিজি অপ্রস্তুভাবে হেসে বললেন, ‘যাঁকে সহজ কথায় বলে গোয়েন্দা…।’
বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসিজিকে খুঁটিয়ে দেখলেন শ্রাবণী। তারপর বেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘ডিটেকটিভ? আপনি? দেখে তো মনেই হয় না!’
‘ওটা আমার ছদ্মবেশ, ম্যাডাম।’ হাত নেড়ে একটা ভঙ্গি করে এসিজি বললেন, ‘আসলে কী জানেন? চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়—সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারের মতো মোমের পালিশ দেওয়া ছুঁচলো গোঁফ আমার নেই। দেবেন্দ্রবিজয়, হুকা-কাশি, রবার্ট ব্লেক কিংবা ব্যোমকেশের মতো প্রতিভা আমার নেই। কোনও ক্যারিশমা নেই—আমার মাথার পেছন থেকে জ্যোতি বেরোয় না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি : ‘তবে আমার মতো গোয়েন্দা—রিয়েল লাইফ ডিটেকটিভরা—জোড়াতালি দিয়ে যা-হোক করে কাজ চালিয়ে নেয়। মানে, শেষ পর্যন্ত খুনিকে ধরে ফ্যালে। ইন সিম্পল টার্মস, উই আর এফেক্টিভ।
‘অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, ম্যাডাম, আর নয়। প্লিজ, দাদার বডিটা আইডেন্টিফাই করে আপনি জলদি এখানে চলে আসুন। আই নিড ইয়োর হেলপ। ডক্টর দে, আপনি মিস চ্যাটার্জির সঙ্গে যান।’ কথা শেষ করে ইরিনাকেও সঙ্গে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন এসিজি। যদি ডেডবডি দেখে শ্রাবণী আবার অজ্ঞান-টগগান হয়ে যান!
ওঁরা তিনজন চলে গেলেন।
রঙ্গলাল অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসিজি স্যার, আমার কিন্তু শ্রাবণী চ্যাটার্জিকে সন্দেহ হয়।’
চোয়ালে আলতো টোকা মারতে-মারতে এসিজি বললেন, ‘সন্দেহ হয় খুব ভালো কথা। এবারে বলুন তো, মিস চ্যাটার্জি ওঁর দাদাকে কীভাবে খুন করলেন?’
কাঁচুমাচু মুখ করে রঙ্গলাল বললেন, ‘সে কি ছাই জানি? ওটা বের করবেন আপনি।’
অশোকচন্দ্র এই ছড়া-কাটা উত্তর শুনে মোটেই হাসলেন না। শুধু আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রথমে বুঝতে হবে হাউ, তারপর হোয়াই, আর সবশেষে হু।’
‘তার মানে?’
‘মানে তো সিম্পল! প্রথমে বুঝতে হবে ঠিক কীভাবে মদনমোহন চ্যাটার্জি খুন হলেন—হাউ। তারপর বের করতে হবে, কেন উনি খুন হলেন—হোয়াই। এ-দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলেই শেষ প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে : কে ওঁকে খুন করেছে—হু।’
ফ্যাকাসে মুখে শ্রাবণী চ্যাটার্জি ফিরে এলেন। ওঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, বয়েস অনেকটা বেড়ে গেছে। ইরিনা ওঁকে ধরে-ধরে নিয়ে আসছিল।
অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ভবানীপ্রসাদ ইশারা করে বোঝালেন, ঠিকঠাকভাবে আইডেন্টিফিকেশানের ব্যাপারটা মিলে গেছে।
শ্রাবণীকে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে ইরিনা চলে গেল। প্লেনের ক্রুদের সেরকমই নির্দেশ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন সুখানি : জিজ্ঞাসাবাদের সময় কেউই এসিজির কাছে থাকবে না—অবশ্য যদি এসিজি কাউকে ডেকে পাঠান তা হলে আলাদা কথা।
সুতরাং এসিজি, ভবানীপ্রসাদ, আর রঙ্গলাল ছাড়া শ্রাবণীর সামনে আর কেউ নেই।
‘মিস্টার চ্যাটার্জির ওয়ার্থ কত ছিল?’ শ্রাবণীর পাশের সিটটায় বসে অশোকচন্দ্র প্রথম প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন।
‘ওয়ার্থ মানে?’ ক্লান্ত গলায় জানতে চাইলেন শ্রাবণী।
‘মানে, স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ওঁর সম্পত্তি কীরকম দাঁড়াবে?’
বিষণ্ণভাবে হাসলেন শ্রাবণী, অনেকটা আপনমনেই বললেন, ‘ঠিক জানি না, তবে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা তো হবেই। টাকার নেশা দাদাকে পাগল করে দিয়েছিল। টাকার পেছনে ছুটতে কী ভালোবাসত! আমি বাড়াবাড়িরকম ঝামেলা করলে দাদা বলত, ”শানু, কী করে তোকে বোঝাব এটা একটা দারুণ নেশা—অনেকটা মোটর রেসের মতো—থামলে কোনও মজা নেই, ছুটলেই বরং মজা।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত থামতে তো হলই! কী প্যাথেটিক…।’ গলা ভেঙে গেল শ্রাবণীর, চোখের কোণে জল এসে গেল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট লেডিজ রুমাল বের করে চোখের কোণ মুছে নিলেন।
‘এখন…মানে, উনি চলে যাওয়ার পর…এই বিশাল সম্পত্তির মালিক কে হবেন?’
‘অনেকটাই আমার কপালে এসে জুটবে।’ তেতো গলায় শ্রাবণী বললেন, ‘কী করব আর বলুন…একেই বলে নিয়তি।’
‘কেন, আপনি সম্পত্তি ভালোবাসেন না?’
ধারালো চোখে তাকালেন এসিজির দিকে : ‘ভালোবাসি অবশ্যই—তবে দাদার জীবনের বদলে নয়।’
এসিজি বেশ বুঝতে পারছিলেন, শ্রাবণী চ্যাটার্জির ইমোশানের পোটেনশিয়াল ক্রমেই চড়ছে। সত্যি, মানুষের ভেতরকার আবেগগুলো অনেকটা ইলেকট্রিক পোটেনশিয়ালের মতো। বাড়তে-বাড়তে হঠাৎই বাজ পড়ার ঢঙে ডিসচার্জ করে যায়। তখন বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো মনের খুব গভীরের ভাবনাগুলো চট করে বেরিয়ে আসে। মানুষটাকে ঠিকঠাক চেনা যায়।
দাদাকে সত্যিই কি এতটাই ভালোবাসতেন ভদ্রমহিলা!
‘আপনি ছাড়া মিস্টার চ্যাটার্জির ফ্যামিলি বলতে আর কারা আছেন?’
‘আমি ছাড়া দাদার আর কেউ ছিল না…কেউ না। তেমনি আমারও যা কিছু ছিল দাদা। এখন…এখন আমি একা হয়ে গেলাম। একেবারে একা…।’
কথা বলতে-বলতে শ্রাবণীর চোখের পাতা ভারী হয়ে গিয়েছিল, সেইসঙ্গে গলাও। রুমালটা আর-একবার ব্যবহার করলেন তিনি।
এসিজি ওঁকে বেশ খুঁটিয়ে জরিপ করছিলেন। ওঁর মনে হল, দুঃখটা মিথ্যে নয়।
শ্রাবণীকে একটু সময় দিয়ে তারপর কিছু একটা জিগ্যেস করতে যাবেন, অলিপথের ওপারের একটা সিটে বসেছিলেন ডক্টর দে—তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন, ম্যাডাম, মিস্টার চ্যাটার্জি তো ম্যারেড ছিলেন—ওঁর ওয়াইফকে আমি দেখেছি…।’
ডক্টর দে-র দিকে তাকালেন শ্রাবণী : ‘দেখতেই পারেন—দাদার সঙ্গে বহু প্রোগ্রামেই বউদি যেত—কাগজেও একবার ছবি বেরিয়েছিল। তবে সবই ছ-বছর আগের কথা। নাইনটি সেভেনে বউদি সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা গেছে। তারপর দাদা আর বিয়ে করেনি—যদিও আমি বহুবার দাদাকে রিকোয়েস্ট করেছি। আর…’ এসিজির দিকে চোখ ফেরালেন শ্রাবণী : ‘দাদা-বউদির কোনও ইস্যু ছিল না।’
তারপর ভবানীপ্রসাদের দিকে তাকালেন : ‘বউদিকে আপনি কোথায় দেখেছিলেন? কোনও অনুষ্ঠানে?’
‘না, আপনাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে…প্রায় বছরদশেক আগে। মিস্টার চ্যাটার্জির অ্যাজমার প্রবলেম ছিল। আমি ওঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন অবশ্য আপনাকে দেখিনি।’
‘না, আমি তখন ও-বাড়িতে থাকতাম না।’ ঠোঁট টিপে বললেন শ্রাবণী। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে দিলেন : ‘ঠিকই বলেছেন, দাদার হাঁপানির প্রবলেমটা ভীষণ ভোগাত। বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে ওটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।’
এরপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন। এবার মুখ খুললেন।
‘যদি কিছু মাইন্ড না করেন তাহলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব, ম্যাডাম?’
ভুরু কুঁচকে এসিজির দিকে তাকালেন শ্রাবণী। এসিজি দেখলেন, সত্যি, ওঁর চোখদুটোর একফোঁটা বয়েস বাড়েনি।
শ্রাবণী বললেন, ‘দাদার এই ব্রুটাল মার্ডার কেসটা সলভ করার জন্যে যদি পার্সোনাল প্রশ্ন করাটা জরুরি হয় তা হলে অবশ্যই করবেন। আই ওন্ট মাইন্ড।’
‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’ প্রশ্নটা করেই হাত তুলে ইশারা করলেন এসিজি : ‘ম্যাডাম, ইচ্ছে করলে আপনি জবাব না-ও দিতে পারেন।’
‘না, সেরকম কিছু নয়।’ মাথা সামান্য নিচু করলেন শ্রাবণী : ‘বিয়ে করেছিলাম। ওই যে, ডক্টর দে যখন দাদাকে চেক-আপ করতে গিয়েছিলেন, তখন আমি হাজব্যান্ডের সঙ্গে সল্টলেকে থাকতাম। পরে…পরে বিয়েটা নষ্ট হয়ে যায়…।’
‘সরি ম্যাডাম।’ ছোট্ট করে বললেন অশোকচন্দ্র।
‘না, ঠিক আছে।’ মুখ তুলে তাকালেন শ্রাবণী চ্যাটার্জি।
মাথা হেলিয়ে ঘাড়ে হাত বোলালেন এসিজি : ‘এবারে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে আপনারা মোট চারজন ট্র্যাভেল করছিলেন…আপনি ছাড়া বাকি তিনজন কে-কে একটু বলবেন…?’
শ্রাবণী রুমালটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, ‘আমি ছাড়া রমেশ—রমেশ শর্মা, ব্রজেন দাস, আর শাওনি রাঘবন। রমেশ আমার সঙ্গে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে আছে। আর বাকি দু’জন ইকনমি ক্লাসে।’
‘এদের একটু-আধটু ইনট্রো দিলে সুবিধে হয়…।’
‘রমেশ শর্মা লাস্ট পাঁচবছর ধরে দাদার পারসোনাল সেক্রেটারি। এমনিতে প্রায় দশবছর কাজ করছে দাদার কাছে। প্রথমে ”চ্যাটার্জি মাইনিং করপোরেশন”-এ—এম.পি-র কোরবাতে দাদার দুটো কপার মাইন আছে। শুনেছি ভালো প্রফিট হয়। সেখানে রমেশ জুনিয়ার ম্যানেজার ছিল। পরে দাদার ওকে ভালো লেগে যায়। তাই ওকে পার্সোনাল সেক্রেটারি করে নেয়। হি ইজ আ জেম অফ আ ওয়ার্কার। দিন-রাত কাজ করতে ভালোবাসে। এই তো, প্লেনে বসেই ব্রিফকেস খুলে দাদা কীসব কাগজপত্র বের করে রমেশের সঙ্গে ডিসকাস করছিল।’
এমনসময় কুমারমঙ্গলম এসিজিদের কাছে এল। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ থাকায় বেচারি দূর থেকেই ইশারায় কাছে আসার অনুমতি চেয়েছে। এসিজি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই ও চটপট করে চলে এসেছে ভবানীপ্রসাদের কাছে। ঝুঁকে পড়ে ডক্টর দে-র কানে-কানে কী যেন বলে কুমারমঙ্গলম চলে গেল।
অশোকচন্দ্র প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ভবানীপ্রসাদের দিকে।
ভবানীপ্রসাদ একবার শ্রাবণীর দিকে দেখে নিয়ে এসিজিকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন জিগ্যেস করছেন, আইডেন্টিফিকেশান যখন হয়ে গেছে তখন ওঁদের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিট নিয়ে আমি বডিটা যতটা সম্ভব থরো চেকআপ করে একটা রিপোর্ট লিখে দেব কি না—তাতে ”আকাশ এয়ারলাইনস”-এর সুবিধে হবে। ওঁদের চেয়ারম্যান তাই চাইছেন—বলছেন, ইটস পার্ট অফ রুটিন প্রসিডিয়োর।’
‘আমিই সে-কথা আপনাকে বলব ভাবছিলাম। বুলেট যদি না হয় তা হলে মিস্টার চ্যাটার্জির মুখে কী হিট করল? আর অত মারাত্মক ইমপ্যাক্টের ফোর্স জিনিসটা পেল কোথা থেকে? তবে ডক্টর দে, কুড য়ু ওয়েট ফর আ ফিউ মিনিটস? মিস চ্যাটার্জিকে আমি এখুনি ছেড়ে দিচ্ছি…তারপর…।’
‘ও. কে.—আই ক্যান ওয়েট।’
‘তারপর, মিস চ্যাটার্জি?’ এসিজি শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন।
‘এরপর ব্রজেন দাস। ওকে কম্বাইড হ্যান্ড বলতে পারেন। অড জব ম্যান। সবরকমের কাজই একটু-একটু পারে। এই তো, লাস্ট উইকে আমাদের কর্ডলেস ফোনটা খারাপ হয়েছিল, ব্রজেন কীসব খুটখাট করে সেটা সারাই করে দিল। আমাদের বাড়ির টিউব লাইট কেটে গেলে সেটা পালটাতেও ব্রজেন, আবার ডাইনিং টেবিলের গ্রানাইট পাথরটা ঝকঝকে তকতকে করে রাখার ব্যাপারেও ব্রজেন। ওর ওপরে আমরা খুব ডিপেন্ডেন্ট। কিন্তু দাদা ওকে বাড়াবাড়িরকম আশকারা দিত, বিশ্বাসও করত। আমি মাঝে-মাঝেই দাদাকে অ্যালার্ট করতাম। বলতাম, ”বিশ্বাস করার একটা লিমিট আছে। তুমি কিন্তু সেটা প্রায়ই ভুলে যাও।” কিন্তু কে শোনে কার কথা!’
‘আর শাওনি রাঘবন?’
‘ও স্টেনো কাম টাইপিস্ট। বছরখানেক হল জয়েন করেছে। ওকে ঠিক বোঝা যায় না। তবে দাদা ওকে লাইক করত। ওকে তো এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ফ্লাই করাতে চেয়েছিল, আমি বারণ করেছি! সামান্য একটা দু-পয়সার স্টেনো-টাইপিস্ট—সে চড়বে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে! প্লেনে চড়ছে তাই না কত! দাদার সেই এক প্রবলেম! ওকে ভীষণ স্নেহ করত। শাওনিও সেটা বুঝত—তাই ঢং করত। নাঃ, ডক্টর গুপ্ত, দাদার মিসহ্যাপের ব্যাপারে আমাকে যদি কাউকে সন্দেহ করতে বলেন সে ওই শাওনি রাঘবন। এবার আপনি ইনভেস্টিগেট করে দেখুন…। ক্যাপ্টেন আমাকে বলেছেন যে, উনি আপনার ওপরে খুব ডিপেন্ড করছেন…আপনাকে পুরো অথরিটি দিয়েছেন…।’
‘মিস চ্যাটার্জি, থ্যাঙ্ক য়ু সো মাচ।’
এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। সেই সঙ্গে শ্রাবণীও।
রঙ্গলাল গোস্বামী কিছু একটা বলবেন-বলবেন করছিলেন। ওঁর উসখুসুনি দেখে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘কিছু বলবেন, রঙ্গলালবাবু?’
বিনয়-গদগদ ঢঙে ঘাড় কাত করে রঙ্গলাল বললেন, ‘ম্যাডাম, একটা স্বভাব-কবিতা রচনা করেছি…অধমের অপরাধ নেবেন না…।’
এসিজি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘বলুন, বলুন, রঙ্গলালবাবু—মিস চ্যাটার্জি কিছুই মনে করবেন না।’
‘বলি তা হলে?’ ঘাড় কাত করে জানতে চাইলেন রঙ্গলাল।
শ্রাবণী হেসে ঘাড় নাড়লেন : ‘স্বভাব-কবিতা! সেটা আবার কী! যা হোক, বলুন—।’
‘শ্রাবণী ও শাওনিতে দ্বন্দ্ব যথেষ্ট/ একই নাম দুই রূপ কৃষ্ট ও খ্রিস্ট।’
শ্রাবণীর মুখটা পলকে অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু তারপরই চট করে মেঘ সরিয়ে হেসে উঠে বললেন, ‘য়ু আর অ্যাজ অ্যামেজিং : অ্যাজ রিডিকিউলাস। লাইক য়ু।’ তারপর এসিজির দিকে তাকিয়ে : ‘দারুণ মজার মানুষ, তাই না?’
শ্রাবণী চ্যাটার্জি অহঙ্কারী পা ফেলে নিজের সিটের দিকে চলে গেলেন।
ডক্টর দে পরদা সরিয়ে টয়লেট কিউবিকলের সামনে এলেন। ভাবছিলেন ইরিনা কিংবা সাবরিনাকে বলবেন প্লেনের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু ঠিক তখনই একটু চেঁচামেচি শোনা গেল যেন।
এসিজি, রঙ্গলাল এবং ভবানীপ্রসাদ—তিনজনেই শব্দ লক্ষ করে চোখ ফেরালেন। দেখলেন, ইরিনা এবং একজন যুবক কথা-কাটাকাটি করতে-করতে এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেট স্পেসের সামনে চলে এসেছে।
ইরিনা ছেলেটিকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
‘বলছি তো, আমি স্যারের বাড়ির কাজের লোক। স্যারের বিপদ শুনলে আমাকে তো ছুটে আসতেই হবে। আমাকে এভাবে…।’ বেশ গলা চড়িয়েই কথা বলছিল ছেলেটি।
‘আপনি ব্যাপারটা বুঝতে চাইছেন না, স্যার। এটা এক্সিকিউটিভ ক্লাস। আপনি ইকনমি ক্লাসের টিকিট নিয়ে এখানে আসতে পারেন না।’
‘বিপদের সময় আবার ক্লাস কী!’ একরকম তেড়ে উঠে বলল ছেলেটি, ‘আমার স্যারের—মানে, মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জির যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে আমাকে অ্যালাউ করতেই হবে, দিদি।’
এয়ারহোস্টেসকে দিদি!
এই ডাক শুনে ইরিনা আর থাকতে পারল না—ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল। আড়চোখে তাকাল এসিজির দিকে : কী করা যায় এখন?’
এসিজি চট করে ব্রজেন দাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মদনমোহন চ্যাটার্জির বাড়ির কাজের লোক হলেও ব্রজেনকে কাজের লোক বলে ঠাহর করা মুশকিল।
লম্বা ফরসা চেহারা। কাটা-কাটা মুখ-চোখ। তেল মাখানো চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। নাকের নীচে পুরু গোঁফ। চোখের তারা বেশ চঞ্চল। গায়ে সাদা ফুলহাতা শার্ট, তার ওপরে ছাই আর কালো রঙের ডোরাকাটা হাফ সোয়েটার। প্যান্টের রং হালকা নীল—তবে সামান্য ময়লা।
‘আপনার নাম কি ব্রজেন দাস?’
এসিজির প্রশ্নে পলকে সব ছটফটানি থেমে গেল। বৃদ্ধের দিকে সন্দেহের ঠান্ডা চোখে তাকাল ব্রজেন : ‘আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’
ডক্টর দে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এসিজি হাত তুলে ওঁকে ক্ষান্ত করলেন। তারপর মোলায়েমভাবে হেসে ব্রজেনকে বললেন, ‘উত্তেজিত হবেন না, ব্রজেনবাবু। এখানে এসে ঠান্ডা হয়ে বসুন, সব বলছি…।’
ব্রজেন দাস এসিজির অনুরোধ মেনে নিল। এসিজিদের কাজের জায়গায় একটা সিট বেছে নিয়ে বসে পড়ল। ওর নজর কিন্তু বারবার ছিটকে যাচ্ছিল টয়লেটের কাছে পলিথিন শিট ঢাকা দেওয়া ডেডবডিটার দিকে। বোধহয় ভাবছিল, মেঝেতে ওটা কী ঢাকা দেওয়া রয়েছে!
হঠাৎ অশোকচন্দ্রের দিকে ঘুরে তাকিয়ে ব্রজেন বলে উঠল, ‘স্যার কোথায়? স্যারের কী হয়েছে?’
ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ ধীরে-ধীরে সময় নিয়ে এসিজি টয়লেট স্পেসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই পলিথিন শিটের নীচে আপনার স্যারের ডেডবডি আছে। ওঁকে কেউ খুন করেছে।’
‘খুন!’ তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল ব্রজেন। ওর হাত সামান্য কাঁপছিল, ‘কী করে হল এসব? কে খুন করল স্যারকে? আমি স্যারকে একবার দেখব…প্লিজ…।’
এসিজি ভবানীপ্রসাদকে ইশারা করলেন। তারপর ব্রজেনকে বললেন, ‘আপনি যান, স্যারকে শেষ দেখা দেখে আসুন। ডক্টর দে আপনাকে বডি দেখাবেন।’
ব্রজেন ডক্টর দে-র সঙ্গে পা বাড়াল।
ইরিনা চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে এসিজি নিচু গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ব্রজেন দাস মিস্টার চ্যাটার্জির ব্যাপারটা জানল কী করে?’
হাতের নখ খুঁটতে-খুঁটতে ইরিনা বলল, ‘হয়তো আমার দোষে জেনেছেন। আমি আর সাবরিনা ব্যাপারটা ডিসকাস করছিলাম, তখন এই ভদ্রলোক আমাদের পাশ দিয়ে ইকনমি ক্লাসের টয়লেটে যাচ্ছিলেন। তখনই ওভারহিয়ার করেছেন।’
‘ঠিক আছে,’ বলে ঘাড় নেমে ইরিনাকে বিদায় দিলেন বৃদ্ধ।
আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ব্রজেন দাস চোখ মুছতে-মুছতে ফিরে এল এসিজির কাছে। কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘স্যারই যখন আর নেই তখন আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে! কোন হতভাগ্য আমার দেবতার মতো স্যারকে এইভাবে খতম করল! এবার আমার কী হবে? কোথায় যাব আমি?’
এসিজির ইশারায় রঙ্গলাল গোস্বামী ব্রজেন দাসের কাছে এলেন। ওকে ধরে যত্ন করে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খুনি ধরতে ভাই/ আপনার হেলপ চাই। খুনির পেলে পাত্তা/ জুড়োবে স্যারের আত্মা।’
ব্রজেন দাস পলকে শোক ভুলে কবিমানুষটির দিকে এমনভাবে তাকাল যে, মনে হল স্যারের মৃত্যুর শকের চেয়ে রঙ্গলালের কবিতা ওকে আরও বেশি শক দিয়েছে। কিন্তু রঙ্গলাল অবিচলিতভাবে আকর্ণ হেসে একটা সিটে গিয়ে বসে পড়লেন।
‘মিস্টার দাস, আপনি জানলেন কী করে যে, মিস্টার চ্যাটার্জির বিপদ হয়েছে?’ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি জিগ্যেস করলেন।
ব্রজেন দাস চোখ মুছে ইরিনার কথাটাই বলল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘স্যারের সারা মুখে-বুকে এত রক্ত কেন? কীভাবে খুন হয়েছেন স্যার?’
‘আমরা তো সেটাই জানার চেষ্টা করছি।’ এসিজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন, ‘আপনি ওঁর কাছে কাজ করছেন কতদিন?’
‘তা চারবছরের বেশি হবে।’
‘ঠিক কী ধরনের কাজ করতেন একটু বলবেন?’
‘সবরকম। টাই বেঁধে দেওয়া, জুতোর ফিতে বাঁধা, গাড়ি চালানো, টুকটাক এটা-সেটা সারিয়ে দেওয়া, এমনকী দরকার পড়লে স্যারকে রান্না করেও খাওয়াতাম। স্যার একবার ”ব্রজ” বলে হাঁক দিলেই হল—আমি সটান গিয়ে হাজির হতাম। আমি বলতে গেলে স্যারের ছায়া ছিলাম—এখন আমার কপালে কী আছে কে জানে!’
‘শুনলাম, গত সপ্তাহে আপনি মিস্টার চ্যাটার্জির কর্ডলেস ফোন সারিয়ে দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। তবে শুধু কর্ডলেস কেন, আমি স্যারের টেপ-ডেক সারিয়েছি, স্যারকে একটা এফ. এম. ট্রানজিস্টার রেডিয়ো বানিয়ে দিয়েছি…।’
‘একজন সাধারণ কাজের লোকের পক্ষে এসব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির কাজ জানাটা একটু আনকমন—মানে সাধারণত দেখা যায় না, তাই না?’
হাসল ব্রজেন। মাথার তেল-চকচকে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি সাধারণ কাজের লোক এটা আপনাকে কে বলল? দিদি?’
‘দিদি মানে?’
‘শ্রাবণীদি—স্যারের বোন।’
‘না-না, উনি কিছু বলেননি। উনি আপনার খুবই প্রশংসা করেছেন।’ ব্রজেনের ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালটা পরখ করবেন বলে এসিজি একটু মিথ্যে বললেন।
‘হুঁঃ—’ তেতো হাসল ব্রজেন : ‘স্যার আমাকে যেরকম বিশ্বাস করতেন, দিদি সেরকম করেন না। কী আর করা যাবে! সবার তো মন রাখা সম্ভব নয়!’
‘আপনি মাইনে কীরকম পান?’
‘সেটা কি বলতেই হবে?’ এসিজির দিকে বিদ্রোহী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ব্রজেন।
‘ঠিক আছে, বলতে হবে না। আপনার স্যারের কোনও শত্রু ছিল?’
‘বড়লোকদের শত্রু থাকবে না এ কখনও হয়! বরং বলতে পারেন স্যারের চারপাশে প্রচুর শত্রু কিলবিল করত। তবে হ্যাঁ, তারা কেউ থাকত বন্ধুর ছদ্মবেশে, আর কেউ-বা ছিল কর্মচারীর ছদ্মবেশে।’
কথাটায় একটা ইঙ্গিত ছিল। এসিজি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেই ইঙ্গিতটাই ধরার চেষ্টা করলেন।
‘আপনি কতদূর পড়াশোনা করেছেন, ব্রজেনবাবু?’
মাথা নিচু করল ব্রজেন, আলতো করে বলল, ‘আমি বি. এসসি. পাশ।’ তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, ‘কী করব বলুন! বহু চেষ্টা করেও তেমন কোনও চাকরি-বাকরি জোটেনি। তাই লজ্জা-টজ্জা ঝেড়ে ফেলে বড়লোকের চাকরের কাজ করছি—ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছি। তো এখানে স্যারের কাছে বেশ ভালোই ছিলাম…।’
ব্রজেনের কাছে ঝুঁকে এলেন এসিজি। গলা নিচু করে বললেন, ‘কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?’
‘কীসের সন্দেহ?’ অনেকটা যেন চমকে উঠল ব্রজেন। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ছোটমানুষ—সন্দেহ কাকে করব! তবে স্যার যে-ই খুন করে থাকুক টাকার লোভে করেছে। স্যারের টাকাপয়সা সম্পত্তির তো কোনও হিসেব ছিল না…আশপাশের অনেকেই তক্কেতক্কে ছিল।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন এসিজি। তারপর হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘ঠিক আছে…অনেক ধন্যবাদ, ব্রজেনবাবু। আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন…সেরকম কোনও খবর হলে আপনাকে জানাব।’
ব্রজেন উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলে গেল, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল…আমার লাইফটা শেষ হয়ে গেল…।’
এসিজি ব্রজেনের আগের কথাটা ভাবছিলেন : ‘আশপাশের অনেকেই তক্কেতক্কে ছিল…।’
তার মানে?
ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে এসিজিকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, একজন হোস্টেস ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিটটা গ্যালিতে দিয়ে গেছে। বলছে, তাড়াতাড়ি চেক আপের কাজটা সেরে ফেললে ভালো হয়…।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত আনমনাভাবে কী যেন চিন্তা করছিলেন। ঘোর ভেঙে চমকে উঠে ভবানীপ্রসাদের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘আপনি বরং চেক আপটা সেরেই নিন। আমি ততক্ষণে এদিককার কাজ এগিয়ে নিই। আপনি যখন টয়লেটের ওখানে যাচ্ছেন তখন একজন হোস্টেসকে ডেকে একটু বলে দিন মিস্টার চ্যাটার্জির পারসোনাল সেক্রেটারিকে এখানে পাঠিয়ে দিতে…প্লিজ।’
‘উইথ প্লেজার—’ বলে ডক্টর দে উঠে গেলেন।
রঙ্গলাল অলিপথের ওপারে একটা সিটে চোখ বুঝে বসেছিলেন। ভবানীপ্রসাদ চলে যেতেই চোখ খুলে তাকালেন এসিজির দিকে : ‘স্যার, কাকে আপনার সন্দেহ হয়?’
এসিজি মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘এখনও বলা সম্ভব নয়।’
বৃদ্ধের ছড়া-কাটার দুষ্টুমিটা ধরতে পেরে হেসে ফেললেন রঙ্গলাল।
রমেশ শর্মাকে অশোকচন্দ্রের কাছে নিয়ে এল ইরিনা।
পারসোনাল সেক্রেটারির পারসোনালিটি কম নয়। অন্তত রমেশকে দেখে এসিজির তাই মনে হল।
ফিটফাট স্যুটেড-বুটেড স্মার্ট চেহারা। চোখে মেটাল ফ্রেমের ছোট্ট চশমা। মাথার চুল পাতলা হয়ে কপালটা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে ব্যক্তিত্ব বেড়েছে বই কমেনি।
রমেশ শর্মার বয়েস খুব বেশি হলে চল্লিশের ওপাশে। তবে মুখে কেমন একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আছে। বেবিফেস বোধহয় একেই বলে!
‘মিস্টার রমেশ শর্মা, ডক্টর গুপ্ত’, বলল ইরিনা, ‘উনি মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে ট্র্যাভেল করছিলেন।’
রমেশকে এসিজির কাছে বসিয়ে ইরিনা চলে গেল।
এসিজি লক্ষ করলেন, রমেশ মাঝে-মাঝেই নার্ভাসভাবে গালে হাত বোলাচ্ছে।
এসিজি চুপ করে বসে রইলেন। রমেশের টেনশনকে বেড়ে ওঠার সময় দিলেন। দেখা যাক ও কী বলে!
অনেকগুলো সেকেন্ড-মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর রমেশ আর থাকতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত মিস্টার চ্যাটার্জি মার্ডার্ড হলেন…।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’ সঙ্গে-সঙ্গে তির ছুড়লেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
‘আমি জানলাম মানে…শ্রাবণী…মানে, মিস চ্যাটার্জি আমাকে বললেন। ভেরি স্যাড।’
‘স্যাড তো বটেই—ব্যাডও।’ বললেন এসিজি, ‘কে ওঁকে খুন করতে পারে? কাউকে সন্দেহ হয় আপনার? এনি আইডিয়া?’
হাত আর ঠোঁট একসঙ্গে ওলটাল রমেশ : ‘কী করে বলব! তবে যার মনে রাগ আছে, লোভ আছে, সে-ই এমন কাজ করতে পারে। কীভাবে মার্ডার্ড হয়েছেন স্যার? মিস চ্যাটার্জি বলছিল—মানে, বলছিলেন, বুলেট-ফুলেট কিচ্ছু। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, মার্ডারার এয়ারপোর্ট সিকিওরিটির এক্স-রে আইকে ফাঁকি দিয়ে একটা রিভলভার কী করে স্মাগল করে নিয়ে আসবে। দ্যাটস আ ভেরি টাফ ডিল, ইজনট ইট?’
মাথা নেড়ে সায় দিলেন এসিজি : ‘ঠিকই বলেছেন। এই পয়েন্টটা আমাকে গোড়া থেকেই ডিসটার্ব করছে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রমেশ, বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে মার্ডার করার কোনও দরকার ছিল না। এমনিতে বয়েস হয়েছিল…তার ওপর অসুস্থ ছিলেন…।’
‘ষাট-বাষট্টি আর এমনকী বয়েস! তবে অসুখ-বিসুখ থাকলে…কী অসুখের কথা বলছেন আপনি?’
‘অ্যাজমা। টান ধরলে স্যারের ভীষণ ব্রিদিং প্রবলেম হত। আর যখন খুব টেনশান বাড়ত…বুঝতেই পারছেন, কোটি-কোটি টাকার বিজনেস, টেনশান তো থাকবেই…ফলে তখনই টানটা বেড়ে যেত। ওঁর সঙ্গে তো খুব ক্লোজলি কাজ করছি, তাই ব্যাপারটা জানি।’
‘উনি আপনার কোলিগের মতো ছিলেন, কী বলেন?’
‘কোলিগ!’ সরাসরি এসিজির চোখে তাকাল রমেশ, বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘উনি আমার বস ছিলেন। সেটা উনি সবাইকে সবসময় মনে করিয়ে দিতেন—কিছুতেই আমরা ভুলতে পারতাম না যে, মিস্টার চ্যাটার্জি আমাদের ভাগ্যবিধাতা, অন্নদাতা…অবশ্য ওঁর মন বেশ উদার ছিল…কারণে-অকারণে আমাদের বাড়তি টাকাপয়সা দিতেন। কিন্তু ওই যে বললাম, ওঁর কথাই ছিল শেষ কথা—এটা কোম্পানির দারোয়ান থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবাইকে উনি সমানভাবে বুঝিয়ে দিতেন। আপনার ওপরে কোনও কারণে বিরক্ত হলেই চাকরি থেকে ছুটি—আপনি ওঁর কোম্পানিতে কতবছর কাজ করেছেন, কত কী স্যাক্রিফাইস করেছেন সেসব তখন আর মাথায় থাকত না।’
এসিজি বেশ অবাক হচ্ছিলেন। মেঘ না চাইতেই জল! এক্সাইট করার আগেই ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের প্রদর্শনী! রমেশ শর্মার কথায় বেশ তেতো ভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল।
‘আপনাকে কখনও জবাব দিতে চেয়েছিলেন না কি?’
ঠোঁটে হাসল রমেশ। সিটের হাতলে নখের আঁচড়ে কাটতে-কাটতে বলল, ‘বারদুয়েক সেরকম অবস্থা হয়েছিল। তবে কোনওরকমে বেঁচে গেছি। আমি বোধহয় খুব লাকি।’
‘মিস্টার চ্যাটার্জির তা হলে তো অনেক শত্রু থাকার কথা…।’
‘ওঁর বন্ধু বলেই কেউ ছিল না—শুধু দু-চারজন ছাড়া…।’
ব্রজেনের কথাটা মনে পড়ল এসিজির। তাই জিগ্যেস করলেন, ‘সেই দু-চারজনের মধ্যে কি আপনি পড়েন?’
‘অবশ্যই—’ জোর গলায় বলল রমেশ, ‘অন্তত আমি তাই মনে করি। এছাড়া ব্রজেন দাসের ওপরেও স্যার বেশ ভরসা করতেন। আর শ্রাবণী চ্যাটার্জি তো স্যারের ফ্যামিলি মেম্বার।’
‘শাওনি রাঘবন?’
‘ও তো বেশিদিন আসেনি। তবে ও স্যারের বেশ পছন্দের ছিল।’
আপনি তো বছরদশেক মিস্টার চ্যাটার্জির কাছে কাজ করছেন। যাকে পছন্দ করেন না তাঁর সঙ্গে এতবছর কাজ করাটা নেহাত মামুলি ব্যাপার নয়।’
‘এর সঙ্গে স্যারের মার্ডারের কী কানেকশান আছে জানতে পারি?’ একটু রুক্ষভাবে জানতে চাইল রমেশ।
‘সেরকম ডায়রেক্ট কানেকশান কিছু নেই। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড একটু বুঝতে চাইছি।’ হাতের একটা ভঙ্গি করে বললেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর ‘মিস্টার চ্যাটার্জি হার্টের কোনও প্রবলেম ছিল?’
‘যদ্দূর জানি, ছিল না। শ্রাবণী—মানে, মিস চ্যাটার্জি হয়তো আরও ভালো বলতে পারবেন।’
‘আপনি নাকি জেম অফ আ ওয়ার্কার? এসিজি আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের খোঁজে।
রমেশ অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধের দিকে। চশমাটা ঠিক করে নাকের ওপরে বসিয়ে বলল, ‘আর য়ু মেকিং ফান অফ মি?’
‘না-না মোটেই না।’ হাত নেড়ে রমেশকে ম্যানেজ করলেন এসিজি ‘মিস চ্যাটার্জি আপনার প্রশংসা করে এ-কথা বলেছেন।’
রমেশ চট করে নরম হয়ে গেল। বিনয়ে মাথা নামাল।
‘আপনি তো পারসোনাল সেক্রেটারি, মিস্টার শর্মা—আপনার জানা উচিত। এই ট্রিপে মিস্টার চ্যাটার্জির টেনশান কেমন ছিল?’
‘হাই টেনশান। তবে এটা নতুন কিছু নয়। কোটি-কোটি টাকার কারবার। সবসময়ে ওঁকে হাই টেনশনেই চলতে হত। যেমন, এই যে আমরা কলকাতা যাচ্ছিলাম…কাল সকালেই আমাদের হলদিয়া রওনা হওয়ার কথা ছিল। সেখানে একটা হাই টেনশান মিটিং ছিল—আমাদের নতুন স্টিল প্ল্যান্টের প্রজেক্ট নিয়ে। এসব ওঁর গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল…।’
‘প্লেন ফ্লাই করার পর আপনি ওঁর বিহেভিয়ারে অ্যাবনরম্যাল কিছু নোটিস করেননি?’
‘না। সেই একইরকম জেদি, একরোখা, অহঙ্কারী একজন মালটিমিলিয়নেয়ার। কলকাতায় গিয়ে মিস্টার চ্যাটার্জি ছ’জনকে ছাঁটাই করবেন ঠিক করেছিলেন। কাউকে ছাঁটাই করার ব্যাপার হলে উনি করতেন কি একেবারে পাবলিক নোটিস দিয়ে আর সব স্টাফকে জানিয়ে রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তারপর ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরাতেন। ইউনিয়ন কিছু করতে পারত না। কারণ, টাকা দিয়ে ইউনিয়নের মুখ বন্ধ করার সহজ পথ উনি জেনে গিয়েছিলেন। বোঝেনই তো, সব ইউনিয়নই তো আর সমান নয়!’
মুখে একবার হাত বুলিয়ে নিল রমেশ। তারপর বলল, ‘এসব করে মিস্টার চ্যাটার্জি কেমন একটা স্যাডিস্টিক আনন্দ পেতেন। তো ব্রিফকেস খুলে-নানান কাগজপত্র দেখছিলেন আর আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই এটা-সেটা ডিসকাস করছিলেন…হঠাৎ…।’
একটু থামল রমেশ, ওর চোখে কেমন একটা দ্বিধা খেলে গেল। তারপর বেশ ধীরে-ধীরে বলল, ‘…হঠাৎই ওঁর টান শুরু হল—ওই টেনশান থেকে ওঁর যেমন হত আর কী!’
‘টান শুরু হলে মিস্টার চ্যাটার্জি কী করতেন, ওষুধ খেতেন?’
‘না, ইনহেলার ব্যবহার করতেন। উনি ভাবতেন আমরা কেউ ব্যাপারটা জানি না। আসলে মিস্টার চ্যাটার্জি খুব দাম্ভিক ছিলেন—এই টাইপের লোকেরা যেমন হয় আর কী! এরকম একজন বিখ্যাত মানুষ…সে হাঁপানির টানের কাছে কাবু হয়ে পড়েছে…এটা পাবলিক জানুক তিনি চাননি। তাই টান ধরলেই উনি ইনহেলার পকেটে নিয়ে উধাও হয়ে যেতেন—দু-চারবার পাম্প নিয়ে আবার ফিরে আসতেন আমাদের কাছে। আমি সবই জানতাম, কিন্তু না জানার ভান করতাম।’
‘আপনি ইনহেলারের ব্যাপারটা জানলেন কী করে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রমেশ বলল, ‘ব্রজেন আমাকে একদিন কথায়-কথায় বলেছিল।’
‘ব্রজেন দাস জানল কী করে?’
‘ও স্যারের সবই জানত। ওকে দিয়েই তো স্যার ইনহেলার কেনাতেন। ব্রজেন আমাকে একবার নামটা বলেছিল…”বেকলেট-ফিফটি” না কী যেন।’
‘মিস্টার চ্যাটার্জি তা হলে টয়লেটে গিয়েছিলেন ইনহেলারের পাম্প নিতে?’
‘আমার তো তাই মনে হয়। তারপর অনেকক্ষণ ধরে উনি ফিরছেন না দেখে মিস চ্যাটার্জি এয়ারহোস্টেসকে ডেকে বলেন…।’
‘উনি ফিরছেন না দেখে আপনার চিন্তা হয়নি?’
‘হয়েছিল—মালিকের জন্যে একজন এমপ্লয়ির যতটুকু চিন্তা হয় ঠিক ততটুকু—তার বেশি নয়। কারণ, মদনমোহন চ্যাটার্জি যে আমার মালিক সেটা আমি কখনও ভুলতে পারতাম না। তা ছাড়া, আপনাকে তো বললাম, উনি সেটা ভুলতে দিতেন না…।’
‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে আপনি একদমই পছন্দ করতেন না…।’
মাথা নাড়ল রমেশ। এসিজির দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ব্যাপারটা পছন্দ-অপছন্দের নয়। একটা কাজ করার জন্যে উনি মাসে-মাসে আমাকে মাইনে দিতেন—আমি সেই কাজটা দিতাম, মাইনে নিতাম। এসব ব্যাপারে আমি খুব প্রফেশন্যাল।’
রমেশ শর্মাকে হঠাৎই থামিয়ে দিয়ে এসিজি রঙ্গলালকে বললেন, ‘রঙ্গলালবাবু, আপনি আমাকে একটু হেলপ করুন। মিস শ্রাবণী চ্যাটার্জির কাছে একটু যান—মিস্টার চ্যাটার্জির ব্রিফকেসটা নিয়ে আসুন—বলবেন আমি চেয়েছি।’
রঙ্গলাল গোস্বামী রওনা হয়ে যেতেই রমেশ উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘এটা কি ঠিক হচ্ছে, মিস্টার গুপ্ত?’
এসিজি হেসে বললেন, ‘প্লিজ, উত্তেজিত হবেন না, মিস্টার শর্মা। প্লেনের ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি আমাকে এই অথরিটি দিয়েছেন। কিলিং ইজ নট আ ম্যাটার অফ জোক। খুনিকে খুঁজে বের করতে গেলে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় জানেন!’
রমেশ চুপ করে গেল বটে, কিন্তু উসখুস করতে লাগল।
একটু পরেই রঙ্গলাল ফিরে এলেন—হাতে বাদামি রঙের একটা ছোট ব্রিফকেস।
ওটা নিয়ে কোলের ওপরে বসালেন এসিজি। আঙুলের চাপ দিয়ে খুলতে যাবেন, রমেশ আলতো করে অনেকটা অনুরোধের ঢঙে বলল, ‘মিস্টার গুপ্ত, এটা কি না খুললেই নয়?’
থেমে গেলেন এসিজি : ‘কেন বলুন তো? কী আছে এতে?’
‘কোম্পানির সব কনফিডেনশিয়াল কাগজপত্র…।’
হাসলেন এসিজি…’য়ু আর রিয়েলি আ জেম অফ আ ওয়ার্কার। ড্যাম ডেডিকেটেড। বাট ম্যান, উই আর ডিলিং উইথ আ কিলিং। এর গুরুত্ব আপনি কেন বুঝতে পারছেন না কে জানে!’
কথা বলতে-বলতেই ব্রিফকেস খুলে ফেললেন এসিজি, এবং ভেতরের কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করলেন।
হঠাৎই একটা কাগজ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। কাগজটা বের করে নিলেন। কয়েকবার চোখ বুলিয়ে রমেশ শর্মাকে দেখালেন।
‘অ্যাজমার টান শুরু হওয়ার আগে মিস্টার চ্যাটার্জি কি এই কাগজটা দেখছিলেন?’
‘ঠিক বলতে পারছি না। হতে পারে। এরকমই কী একটা কাগজ দেখছিলেন—এর চেয়ে ডেফিনিট কিছু আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’
এসিজি যে-কাগজটা দেখছিলেন সেটা একটা কবিতার বইয়ের একটি পৃষ্ঠার জেরক্স কপি। সেই পৃষ্ঠায় মাইকেলের বিখ্যাত কবিতা ‘আত্মবিলাপ’-এর পুরোটা এবং ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার প্রায় অর্ধেকটা রয়েছে। আর পৃষ্ঠার মাথায় হেডিং দেওয়া আছে ‘গীতিকবিতা’।
কিন্তু অশোকচন্দ্রের চমকে ওঠার কারণ অন্য। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার দুটি লাইন লাল কালি দিয়ে কেউ আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। এবং সেই লাইন দুটি হল ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে।’
‘এর অর্থ কী বলতে পারেন?’ এসিজি কপালে ভাঁজ ফেলে রমেশ শর্মাকে জিগ্যেস করলেন।
এমনভাবে হাসল রমেশ যেন এসিজির বোকামিতে বেশ মজা পেয়েছে। তারপর বলল, ‘মিস্টার গুপ্ত, বেঙ্গলি আমার মাদার টাং নয়—আমি কী করে এই কবিতার মানে বুঝব!’
এসিজি মিথ্যের বাণ ছুড়লেন। বেশ সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘মিস চ্যাটার্জি বলছিলেন যে, আপনি একটু-আধটু বাংলা পড়তে পারেন…।’
চোখ পিটপিট করল রমেশ। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা ইংরেজিতে ট্রানস্লেট করার চেষ্টা অবশ্যই অডাসিটি। তবে তদন্তের স্বার্থে একটা খোঁড়া তর্জমা আপনাকে করে শোনাচ্ছি : ”ইফ য়ু আর বর্ন, য়ু আর টু ডাই/ ইমমরটালিটি ইজ অ্যান ইটারনাল লাই। তো এই লাইনদুটোর তলায় লাল কালি দিয়ে কেন দাগ দেওয়া হয়েছে বলতে পারেন? এই দাগের মানেটাই আমি জানতে চাইছিলাম।”
‘হতে পারে, এটা হয়তো খুনের হুমকি। মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ ভয় দেখাচ্ছিল।’
‘একজ্যাক্টলি! কিন্তু কে ওঁকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল?’
‘আপনি কি ভাবছেন আমি?’ রুক্ষভাবে পালটা প্রশ্ন করল রমেশ।
‘হতে পারে।’ নির্বিকারভাবে বললেন বৃদ্ধ হুনুর, ‘আবার অন্য কেউও হতে পারে। ওঁর তো শত্রুর অভাব ছিল না!’
রমেশ বাঁকাচোখে এসিজির দিকে একবার তাকাল শুধু—কোনও মন্তব্য করল না।
‘কী করে এটা মদনমোহন চ্যাটার্জির ব্রিফকেসে গিয়ে পৌঁছল বলুন তো?’
‘কী করে আবার, কেউ রেখেছে।’ তাচ্ছিল্যের ঢঙে বলল রমেশ।
‘হ্যাঁ, ঠিকই—কিন্তু রাখার চান্সটা তো পেতে হবে!’
‘আপনি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে অ্যাকিউজ করতে চাইছেন? ওহ ইয়েস, আই হেটেড হিম। কিন্তু সেজন্যে গলায় ফাঁসির দড়ি পরতে আমি রাজি নয়। মিস্টার চ্যাটার্জি শকুনের মতো ঠোকরাতেন বটে, কিন্তু সোনার ডিমও পাড়তেন। এরকম একজনকে সরানোর চেষ্টা করে আমার কী লাভ!’
‘হুঁ…ঠিকই বলেছেন।’ বিড়বিড় করে বললেন বৃদ্ধ। তিনি মনে-মনে ভাবছিলেন, লাল দাগ দেওয়া এই কবিতার পাতাটা চারজনের যে-কেউ মদনমোহন চ্যাটার্জির ব্রিফকেসে রাখতে পারে।
কাগজপত্র ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আরও একটা জিনিস পাওয়া গেল।
একটা সুন্দর রাইটিং প্যাড। তার একটা পৃষ্ঠায় বড়-বড় হরফে লেখা, ইমডিয়েট ডিসমিসাল। তার নীচে ছ’জনের নাম—নাম ঠিক নয়, নামের আদ্যক্ষর। আর পৃষ্ঠার নীচের দিকে আগামীকালের তারিখ দেওয়া।
রমেশ বেশ অস্বস্তি নিয়ে এসিজির কাজকর্ম লক্ষ করছিল। এসিজি হঠাৎই ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এই হাতের লেখাটা কার? মিস্টার চ্যাটার্জির?’
‘হ্যাঁ, আপনাকে বলছিলাম না, উনি ছ-জনকে ছাঁটাই করার ডিসিশান নিয়েছিলেন। এই লিস্টটায় যেসব নাম আছে সেগুলো কিছুদিন আগেই মিস্টার চ্যাটার্জি আমাকে বলেছিলেন।’
নামের আদ্যাক্ষরগুলোর ওপরে বারবার চোখ বোলাচ্ছিলেন এসিজি। একটি নাম ছাড়া আর কোনওটাই চেনা হল না। নামটার নীচে তিনবার দাগ দেওয়া এবং পাশে লেখা : ‘কালসাপ। নো পে অফ।’
সেই নামটায় আঙুল দিয়ে এসিজি রমেশকে জিগ্যেস করলেন, ‘এই বি. ডি. মানে কি ব্রজেন দাস। নাকি একই ইনিশিয়ালের অন্য কোনও স্টাফ আছে?’
রমেশ শর্মার মাথা ঝুঁকে পড়ল, হতাশায় মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন…ব্রজেন দাস। এই ইনিশিয়ালের আর কোনও স্টাফ নেই। খুব স্যাড ডিসিশান।’
‘ব্রজেন এই ডিসিশানের কথা জানত?’
‘না বোধহয়। ভুলে যাবেন না, মিস্টার গুপ্ত, আমি ছিলাম স্যারের পারসোনাল সেক্রেটারি—তাই অনেক কিছু আমি একাই জানতাম…এমনকী শ্রাবণী, মানে, মিস চ্যাটার্জিও সেগুলো জানতেন না।’
‘ব্রজেন দাস জানলে পরে ওর হুমকি দেওয়ার এবং খুন করার একটা পজিটিভ মোটিভ তৈরি হতে পারে…।’
‘হাউ ডু আই নো?’ কাঁধ ঝাঁকাল রমেশ : ‘য়ু আর দ্য স্লুথ।’
‘আচ্ছা, ওর নামের পাশে কালসাপ কথাটা লেখা কেন?’
রমেশ শর্মা নখ খুটতে শুরু করল। বলবে-কি-বলবে না ভেবে কয়েকবার মাথা ওঠাল-নামাল। তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চেপে রেখে লাভ নেই…আপনি পরে তো জানতেই পারবেন। ব্রজেন দাস স্যারের বিশ্বাসী লোক হয়ে ওঠার পর থেকে রেগুলার টাকা চুরি করত। এইভাবে ও কয়েকলক্ষ টাকা সরানোর পর স্যার ব্যাপারটা ধরতে পারেন। সপ্তাহদুয়েক আগে আমাকে বলেছিলেন। এটা আর কেউ জানে না। মিস চ্যাটার্জিও না।
অশোকচন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়ল, চোখ ছোট হয়ে গেল চিন্তায়। ওঁর চশমার কাচে আলো চকচক করছিল। রহস্যের জায়গাগুলো কি ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে?
একসময় ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে পরদার আড়াল সরিয়ে টয়লেট স্পেসের দিক থেকে বেরিয়ে এলেন। কিছু একটা দেখাবেন বলে ইশারায় এসিজিকে ডাকলেন।
এসিজি ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করতেই ডক্টর দে তৃপ্তির সুরে বললেন, ‘বোধহয় খুনের কায়দাটা আমি বুঝতে পেরেছি, ডক্টর গুপ্ত। বলব, কী করে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে টয়লেটের ভেতরে মার্ডার করা হয়েছে?’
হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। উঠে দাঁড়িয়ে দু-পা সামনে এগিয়ে গেলেন। তারপর একটা হাত শূন্যে তুলে ডক্টর দে-কে বাধা দিলেন, ‘না, আমি বলছি। ভুল হলে শুধরে দেবেন, ও. কে.? অ্যাজামার অ্যাটাক হতেই মিস্টার চ্যাটার্জি ইনহেলার নিয়ে ওই টয়লেটে গিয়ে ঢুকেছিলেন। ইনহেলারের মাউথপিস কভার খুলে ক্যানিস্টারের স্প্রে বেরোনোর দিকটা মুখে ঢুকিয়ে অভ্যাসমতো পেছনদিকটায় চাপ দিয়েছিলেন…এবং সঙ্গে-সঙ্গে গুড়ুম…!’ মুখে পিস্তল ছোড়ার শব্দ করতে চাইলেন এসিজি : ‘ব্যস, সব শেষ।’
হেসে কাঁধ ঝাঁকালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
আবিষ্কারের কৃতিত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ভবানীপ্রসাদকে বেশ হতাশ দেখাল। অবাক হয়ে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘কী করে বুঝলেন বলুন তো?’ তারপর এসিজির পাশ দিয়ে রমেশ শর্মার দিকে সন্দেহের চোখে একবার তাকালেন।
রমেশ মাথা নিচু করে আঙুল খুঁটছিল, উসখুস করছিল, আর মাঝে-মাঝেই ডক্টর দে-র দিকে তাকাচ্ছিল।
ভবানীপ্রসাদ এসিজির চোখে চোখ রেখে রমেশের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘মার্ডারার কি কনফেস করেছে? সব বলে দিয়েছে আপনাকে?’
হেসে ফেললেন এসিজি, মাথা নেড়ে বলনে, ‘ধুস, কী যেন বলেন!’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর : ‘যাগগে, এবার বলুন দেখি, আমি ঠিক বলেছি কি না…।’
তারিফ করে মাথা নাড়লেন ভবানীপ্রসাদ : ‘ঠিক বলেছেন, তবে কনফার্ম করতে গেলে ল্যাবরেটরির হেলপ দরকার। এতক্ষণ ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে আমি ডেডবডির মুখের গর্তে বেশ কয়েক জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকের পার্টিকল পেয়েছি। মনে হচ্ছে, ইনহেলারের পুশটায়…মানে, ক্যানিস্টারের পেছনটায়…চাপ দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা এক্সপ্লোশান হয় এবং একটা ছোট্ট স্টিলের বুলেট এত জোরে টাকরার দিকে ছুটে যায় যে, ওটা টাকরা ফুটো করে সোজা ব্রেনে গিয়ে লাগে। আপনি গোড়াতেই যা আন্দাজ করেছিলেন—মিস্টার চ্যাটার্জি ওয়াজ কিলড ইনস্ট্যান্টলি। আর বুলেটটাকে কী কায়দায় ট্রিগার করা হয়েছে সেটা বলা একটু মুশকিল—কারণ, সেই মেকানিজমটা ওই হাই ইমপ্যাক্টে বলতে গেলে ধুলো হয়ে গেছে। সেইজন্যেই ডেডবডির শুধু মুখে আর গালে কয়েকটা ছোট-ছোট টুকরো গেঁথে ছিল…আর সেরকম কোনও এভিডেন্স পাওয়া যায়নি। তবে টয়লেট কিউবিকলে অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকের কিছু টুকরো পাওয়া গেছে। ওঃ, এককথায় ডায়াবলিক্যাল! নৃশংস!’
রমেশ শর্মা হাঁ করে ভবানীপ্রসাদ দে-র কথা শুনছিল। ওর চোখজোড়া যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
রঙ্গলাল গোস্বামীও নিপাট কৌতূহলে দুই ডক্টরের কথাবার্তা প্রায় গিলে খাচ্ছিলেন।
এসিজি মাথার পিছনে হাত নিয়ে চুলের গোছায় বারকয়েক টান মারলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মদনমোহন চ্যাটার্জির ইনহেলার ব্যবহারের অভ্যেসের কথা খুনি অবশ্যই জানত। এও জানত, তিনি সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে ইনহেলার ইউজ করেন। প্লেনে আড়াল বলতে এই টয়লেট। সুতরাং, খুনিকে যা করতে হয়েছিল সেটা হল মিস্টার চ্যাটার্জির ইনহেলারটাকে কোনও একফাঁকে বদলে দেওয়া—আসল ইনহেলারের বদলে ইনহেলার-বন্দুক। ব্যস, তারপর শুধু অপেক্ষা…।’
‘ঘটনাটা ঘটে যেতেই আমরা ভাবলাম, বন্ধ টয়লেটের ভেতরে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে কেউ গুলি করেছে। লকড রুম প্রবলেম—যার সমাধান মোটেই সহজ নয়। কিন্তু এখন ”হাউ” বোঝার পর ”হোয়াই” আর ”হু” টাও বোঝা যাচ্ছে।’
রঙ্গলাল উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শাবাস, এসিজি স্যার, শাবাশ! স্বভাব-কবিতায় বলতে ইচ্ছে করছে : হাউ হোয়াই হু/ হু ক্যান ডু/ এরকম খুন/ মুখ সবার চুন/ জানে শুধু এসিজি/ খুনির সব ঠিকুজি! মিস্টার চ্যাটার্জিকে কে খুন করেছে, এসিজি স্যার?’
রমেশ শর্মা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখ-চোখ লাল, হাত অল্প-অল্প কাঁপছে।
এসিজিকে লক্ষ করে রমেশ বলল, ‘ডক্টর গুপ্ত, আমি বোধহয় মার্ডারারকে চিনতে পেরেছি…।’
‘প্লিজ, মিস্টার শর্মা—এ-বিষয়ে একটি কথাও নয়।’ প্রায় আদেশের সুরে বললেন অশোকচন্দ্র, ‘আপনি সিটে ফিরে যান। আমি এখন শাওনি রাঘবনের সঙ্গে কথা বলব। দরকার হলে আপনাকে আবার ডাকব।’
রমেশ শর্মা যেন গালে একটা থাপ্পড় খেল। ওর মুখে লালচে ছোপ দেখা দিল। দু-একবার ইতস্তত করে ও হাঁটা দিল।
এসিজি রঙ্গলালবাবুকে বললেন, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর একটু পরে দিচ্ছি। সবদিক বিচার না করে হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। আপনি, প্লিজ, একটু শাওনি রাঘবনকে খবর দিন…।’
শাওনি রাঘবনের বয়েস বাইশ কি তেইশ। মাজা রং। মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা। চোখে রিমলেস চশমা। চিবুকে বিউটি স্পট। সরু-সরু আঙুলে দীর্ঘ নখ—তাতে চকোলেট রঙের নেলপলিশ। ঠোঁটে একই রঙের লিপস্টিক। গায়ে কালো চুড়িদারের ওপরে গোলাপি কার্ডিগান। কানে চকচকে দুল। কপালে টিপ। চোখের দৃষ্টি গভীর—মনে হয় যেন অতলান্তিক।
এসিজির মনে হল, অসংখ্য চৌম্বক বলরেখা শাওনিকে ঘিরে রেখেছে। তার আওতায় এসে পড়লে একটা চোরাটান টের পাওয়া যাবে।
মিস্টার চ্যাটার্জির খবরটা শোনার পর শাওনি তেমন একটা মুষড়ে পড়ল না। শুধু বলল, ‘হোয়াট আ ফেটফুল এন্ড। হি সার্টেইনলি ডিডন্ট ডিজার্ভ ইট।’
‘মিস্টার চ্যাটার্জি’ আপনাকে পছন্দ করতেন শুনলাম—।’ এসিজি বললেন।
‘ঠিকই শুনেছেন,’ বেপরোয়া ভঙ্গিতে জবাব দিল শাওনি, ‘কিন্তু সেটা মিস চ্যাটার্জি পছন্দ করতেন না।’
‘কেন বলুন তো?’
‘উনি খুব স্ট্যাটাস কনশাস। ওঁর কথাবার্তায় চালচলনে বড়লোকের দুর্গন্ধ বেরোয়। সেইজন্যেই গরিবদের অপছন্দ করাটা ওঁর অভ্যোসে দাঁড়িয়ে গেছে।’
‘রমেশ শর্মা বা ব্রজেন দাসের বেলাতেও তাই?’
‘ব্রজেন দাসের বেলা ওঁর অ্যাটিটিউডটা সেরকম বোঝা যেত না। তবে রমেশ শর্মার বেলায় বোঝা যেত। আর জানবেন, মেয়েরা সহজে মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। আমরা চোখের নজর রিড করতে পারি। বাট রমেশ ইজ আ ভেরি নাইস চ্যাপ।’
এসিজি ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের সমীকরণগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। কী বলতে চাইছে শাওনি?
‘মিস্টার চ্যাটার্জি আপনাকে ঠিক কী চোখে দেখতেন? ফাদারলি অ্যাফেকশান? না কি…।’
ঠোঁট বেঁকিয়ে খিলখিল করে হাসল শাওনি। জলতরঙ্গের বাজনা বেজে উঠল যেন।
‘আমার কাছে কি অ্যাফেকশানের কোয়ালিটি বা কোয়ান্টিটি মাপার যন্ত্র আছে নাকি যে, মেপে দেখব ওটা ফাদারলি, ব্রাদারলি…নাকি লাভারলি!’ আবার খিলখিল করে হাসি। তারপর : ‘সোজা কথা হল, মিস্টার চ্যাটার্জি ওয়াজ আ নাইস গাই। আই লাইকড হিম আ লট। আই উইল মিস হিম।’
‘ওঁর হাঁপানি রোগ—মানে, অ্যাজমা ছিল জানতেন?’
‘না—।’
‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে কে মার্ডার করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’
‘দ্যাট ভেনমাস লেডি, আর কে! উনি এখন কত কোটি টাকার মালিক হলেন আপনার কোনও ধারণা আছে!’
‘মালিক হিসেবে মিস্টার চ্যাটার্জি কেমন ছিলেন?’
‘গুড—কোয়াইট গুড। খুব সফট হার্টেড ছিলেন। ছোটবোনকে খুব ভালোবাসতেন—মানে, ব্রাদারলি…।’ আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল শাওনি, ‘লাস্ট উইকে আমাকে বলেছিলেন যে, একটা দারুণ নিউজ দেবেন। দারুণ আনন্দের খবর।’
কৌতূহলী হয়ে উঠলেন এসিজি : ‘খবরটা কি পেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী খবর?’
‘শ্রাবণী চ্যাটার্জির বিয়ে—রমেশ শর্মার সঙ্গে। রমেশ খুব লাকি। ইট ওয়াজ গুড নিউজ ফর মিস চ্যাটার্জি, বাট আই থিংক ব্যাড নিউজ ফর রমেশ।’
এসিজির মুখে সামান্য অবাকভাব দেখে শাওনি বলল, ‘কেন, ওরা আপনাকে বলেনি? শুনলাম তো আপনি ওদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছেন…।’
‘আচ্ছা, মিস রাঘবন, আপনি ব্যাড নিউজ ফর রমেশ বললেন কেন?’
হাসল শাওনি : ‘বিয়েটা টিকবে বলে মনে হয় না—সেইজন্যে।’
এসিজি আনমনা হয়ে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলেন। শাওনি ‘ডক্টর গুপ্ত’ বলে তিনবার ডাকার পর ওঁর হুঁশ ফিরল।
‘থ্যাংক য়ু সো মাচ, মিস রাঘবন। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু য়ু।’
‘কেন জানতে পারি?’ চোখের কোণ দিয়ে তাকাল শাওনি।
‘এখুনি জানতে পারবেন—একটু অপেক্ষা করুন।’
এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। গল্পটা কি ঠিক-ঠিক খাড়া করা যাচ্ছে? ক্যাপ্টেনকে কি খবর দেওয়া যায় এখন?
ভবানীপ্রসাদ একটা সিটে চোখ বুজে শরীর এলিয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁকে ডেকে বললেন, ‘ডক্টর দে, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?’
ভবানীপ্রসাদ চোখ মেলে তাকালেন।
‘উঠে পড়ুন—আমরা লাস্ট চ্যাপ্টারে পৌঁছে গেছি। আমি ক্যাপ্টেনকে ডেকে পাঠাচ্ছি আর মিস্টার চ্যাটার্জির বাকি সঙ্গী-সাথীদেরও ডাকছি। আর-একটু পরেই আমরা ভাইজাগে নেমে পড়ব।’
এসিজির কথা শুনে ভবানীপ্রসাদের ঘুম চটকে গেল। সাততাড়াতাড়ি মুখ-টুখ মুছে সোজা হয়ে বসলেন। লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘সরি, ভীষণ টায়ার্ড লাগছিল…।’
রঙ্গলাল গোস্বামীকে দিয়ে খবর পাঠাতেই ক্যাপ্টেন সুখানি মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে চলে এলেন।
এসিজির কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, ডক্টর গুপ্ত, আর য়ু থ্রু?’
‘ইয়েস, ক্যাপ্টেন। আই থিংক দ্য গেম ইজ ওভার। আপনি কাউন্ডলি মিস্টার চ্যাটার্জির বাকি তিনজন কম্প্যানিয়ানকে ডেকে পাঠান। সকলের সামনেই তাস খুলে দেখাতে চাই আমি।’
বৃদ্ধ মুচকি-মুচকি হাসছিলেন—অনেকটা দুষ্টুমির হাসি। ক্যাপ্টেন চলে গেলেন টয়লেট স্পেসের দিকে। পরদা সরিয়ে ঢুকে গেলেন ভেতরে। আর-একটা পরদা সরালেই ওপাশে ইকনমি ক্লাস—সেখানে সাবরিনাকে দেখতে পেলেন। ওকে ডেকে নিচু গলায় এসিজির নির্দেশটা জানিয়ে দিলেন।
ক্যাপ্টেন এসিজির কাছে ফিরে আসার মিনিটখানেকের মধ্যেই মদনমোহন চ্যাটার্জির বাকি তিনসঙ্গী এসে হাজির হল : ব্রজেন দাস, রমেশ শর্মা এবং শ্রাবণী চ্যাটার্জি।
এসিজি লক্ষ করলেন, শ্রাবণী ধারালো দৃষ্টিতে শাওনিকে একঝলক দেখলেন। রমেশও একবার তাকাল শাওনির দিকে। আর ব্রজেন দাস নির্বিকার।
এসিজির অনুরোধে সবাই বসে পড়ল। ক্যাপ্টেন সুখানি বসলেন এসিজির পাশের সিটটায়।
মাথার পিছনের সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে উঠে দাঁড়ালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, বললেন, ‘এটা গোয়েন্দাকাহিনির খুব বিখ্যাত শেষ দৃশ্য। আমার রিকোয়েস্ট, আপনারা প্রত্যেকে মনোযোগ দিয়ে গল্পটা শুনবেন। যদি কোথাও আমার ভুল হয়, তা হলে দয়া করে ভুল ধরিয়ে দেবেন।’
উঠে দাঁড়ানোর ফলে এসিজি সবাইকে কম-বেশি দেখতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল, ওরা এক-একটি রংবেরঙের পাখি। তার মধ্যে আসল পাখিটাকে খুঁজে বের করতে হবে। দুষ্টু পাখি।
এসিজি বলতে শুরু করলেন, ‘মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জিকে আপনারা সকলেই মোটামুটি জানতেন। দাম্ভিক একরোখা ক্ষুরধার বুদ্ধির বিজনেসম্যান। কাউকে কোম্পানি থেকে ছাঁটাই করতে হলে তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে তারপর তাকে বরখাস্ত করতেন। আগামীকাল তিনি ছ-জনকে ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরাবেন ঠিক করেছিলেন। এই কাগজটায় সেই ছ-জনের নাম লেখা আছে…।’
ঝুঁকে পড়ে মিস্টার চ্যাটার্জির ব্রিফকেস থেকে নামের লিস্টটা তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। সেইসঙ্গে মাইকেলের কবিতার জেরক্স করা পৃষ্ঠাটাও। তারপর : ‘…ছ-জনেরই নামের তলায় তিনবার দাগ দেওয়া এবং পাশে লেখা : ”কালসাপ। নো পে অফ।” আমার মনে হয়…।’
ব্রজেন দাস কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘বিনা কারণে স্যার আমাকে বরখাস্ত করছিলেন। স্যারকে আমি হাতে-পায়ে ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করেছি, কিন্তু উনি শুনতে চাননি। বলেছি, ঘরে আমার সাতবছর আর দু-বছরের দুটো বাচ্চা রয়েছে—কিন্তু স্যারকে কিছুতেই টলাতে পারিনি—।’
‘সেইজন্যেই তুমি দাদাকে মার্ডার করলে!’ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন শ্রাবণী চ্যাটার্জি, ‘ছোটলোকের এতবড় সাহস!’
‘প্লিজ ম্যাডাম—’ শ্রাবণীকে হাত তুলে ইশারা করলেন এসিজি : ‘দয়া করে একটু শান্ত হোন—আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।’ এসিজি ব্রজেনের দিকে ফিরলেন : ‘ব্রজেনবাবু, এই কাগজটা একবার দেখুন তো! চিনতে পারেন?’
মাইকেলের কবিতার পাতাটা ব্রজেন দাসের মুখের সামনে ধরলেন অশোকচন্দ্র। ব্রজেন দাসের মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল পলকে।
‘ ”বঙ্গভূমির প্রতি” কবিতাটার দুটো লাইনের তলায় লাল কালিতে দাগ দিয়েছেন আপনি : ”জন্মিলে মরিতে হবে,/ অমর কে কোথায় কাবে”। এইভাবে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে খুনের হুমকি দিয়েছেন আপনি। ক্ষুরধার বুদ্ধির মালিক মদনমোহনবাবু কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, এটা আপনারই কীর্তি—তাই আপনার বরখাস্তের সিদ্ধান্তটা আরও পাকা করেছিলেন। সেটাই আপনি মেনে নিতে পারেননি। আক্ষেপের ব্যাপারটা কী জানেন? আপনি ”জন্মভূমির প্রতি” কবিতা পড়েছেন বটে, কিন্তু ওই একই পৃষ্ঠায় ছিল আর-একটি কবিতা—”আত্ম-বিলাপ”—সেটা আপনি পড়েননি।’ এসিজি আবৃত্তির ঢঙে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়…।’
ভবানীপ্রসাদ জিগ্যেস করলেন, ‘কিন্তু মিস্টার দাসকে স্যাক করার ডিসিশান নেওয়া হয়েছিল কেন?’
একবার রমেশ শর্মার দিকে তাকালেন এসিজি, তারপর বললেন, ‘মিস্টার চ্যাটার্জির বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ব্রজেনবাবু নিয়মিতভাবে টাকা সরাতেন। এভাবে কয়েকলক্ষ টাকা তিনি চুরি করেছিলেন…।’
‘মি-মিথ্যে কথা!’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রজেন দাস।
দূরে বসা প্যাসেঞ্জাররা বিরক্ত এবং কৌতূহলী চোখে এসিজিদের দিকে তাকালেন।
ক্যাপ্টেন সুখানি ব্রজেন দাসকে বসতে বললেন। তারপর চাপা গলায় যোগ করলেন, ‘প্লিজ কন্ট্রোল ইয়োর টেম্পার। কথাবার্তা আস্তে আস্তে বলুন, নইলে অন্য প্যাসেঞ্জাররা ইরিটেটেড হবে।’
এসিজি হেসে বললেন, ‘চিন্তা করার কোনও কারণ নেই, দাসবাবু, আমার কথা সত্যি কি মিথ্যে সেটা পুলিশ তদন্ত করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে। যখন আপনি দেখলেন, বাঁচার আর কোনও পথ নেই তখন মিস্টার চ্যাটার্জির মরার পথ বেছে নিলেন। আপনাকে উনি ভীষণ বিশ্বাস করতেন। আপনার কথায়, একবার ”ব্রজ” বলে হাঁক দিলেই হল—আপনি সটান গিয়ে হুকুম তামিল করতে হাজির হতেন। আপনি জানতেন, মিস্টার চ্যাটার্জির অ্যাজমার প্রবলেম—উনি ইনহেলার ব্যবহার করেন। এও জানতেন, উনি সবার সামনে ইনহেলার ব্যবহার করেন না—করেন আড়ালে। প্লেনে সেই আড়াল বলতে একমাত্র টয়লেট। সুতরাং, আপনার প্ল্যান তৈরি হল। এবার দরকার মারণাস্ত্র—মার্ডার ওয়েপন।’ একটু থামলেন এসিজি। তারপর বললেন, ‘ব্রজেনবাবু, কর্ডলেস ফোন যে সারাতে পারে, টেপ-ডেক সারাতে পারে, এফ. এম. ট্রানজিস্টার তৈরি করতে পারে, সে একটা ইনহেলারকে অবশ্যই মারণাস্ত্রে বদলে দিতে পারবে। আপনি সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট, টেকনিক্যাল কাজ জানেন, আপনি কেন লোকের বাড়ি চাকরের কাজ করবেন! করবেন এই কারণে যেহেতু আপনি—আপনারই কথায়—ভাগ্য ফেরাতে চান। সত্যিই তো! নিয়মিতভাবে হাজার-হাজার টাকা চুরি করে আপনি তো ভাগ্যই ফেরাচ্ছিলেন!’
ব্রজেন দাস বসে পড়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। এবার ওর মাথা ঝুঁকে পড়ল। ফোঁপানির আওয়াজ শোনা গেল মুখ থেকে। তারই মাঝে ও কীসব কথা বলছিল, কিন্তু কান্নাজড়ানো কথার একটি বর্ণও বোঝা গেল না।
শ্রাবণী চ্যাটার্জি জিগ্যেস করলেন, ‘ইনহেলারটাকে ওই শয়তানটা মার্ডার ওয়েপনে কনভার্ট করলে কী করে?’
‘কাজটা কঠিন—তবে ব্রজেন দাসের মতো টেকনিশিয়ানের কাছে অবশ্যই ততটা কঠিন নয়। ইনহেলারের যে-জায়গা দিয়ে ওষুধের স্প্রেটা বেরোয় ঠিক সেই জায়গা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা স্টিলের বুলেট। মিস্টার চ্যটার্জির বডি পোস্টমর্টেম করার সময় নিশ্চয়ই ওটা খুঁজে পাওয়া যাবে। তো ওই বুলেটটাকে নিশ্চয়ই ছিটকে দিয়েছে কোনও জোরালো স্প্রিং অথবা বারুদ। আমার খুব বিশ্বাস, ব্রজেন দাসের আস্তানা সার্চ করলে বেশ কয়েকটা খালি ইনহেলার পাওয়া যাবে—চাই কি মার্ডার ওয়েপনের একটা ডুপ্লিকেট মডেলও পাওয়া যেতে পারে। কারণ, বারকয়েক টেস্ট না করে ব্রজেন দাস এ-ঝুঁকি কিছুতেই নেবেন না—কী, ঠিক বলেছি তো, দাসবাবু?’ ঠাট্টার সুরে এসিজি বললেন, ‘এই হল আমার মোটামুটি গল্প।’
এসিজি থামার পর অনেকেই অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। জানতে চাইল, ঠিক কীভাবে খুনটা হয়েছে, এসিজি প্রথম কখন ব্রজেন দাসকে সন্দেহ করলেন—ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসিজি এতটুকু বিরক্ত না হয়ে ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে চললেন।
ক্যাপ্টেন সুখানি উঠে দাঁড়িয়ে অশোকচন্দ্রের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, বললেন, ‘থ্যাংকু য়ু, ডক্টর, ফর সলভিং অ্যান অ্যাপারেন্টলি ইমপসিবল ক্রাইম।’
আর সবাই ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু শ্রাবণী চ্যাটার্জি মাথা নিচু করে চোখ মুছছেন।
সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে এসিজি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘একমিনিট। আপনারা কেউ যাবেন না। আমার গল্প এখনও একটু বাকি আছে।’
সবাই অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে।
শাওনি বলল, ‘তার মানে!’
হাসলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত : ‘তার মানে আসল খুনির নাম আমি এখনও বলিনি।’
পলকে সবাই চুপ করে গেল। কয়েক সেকেন্ড। তারপরই শুরু হল গুঞ্জন।
‘আসল খুনি?’ শ্রাবণী কান্না ভুলে মুখ তুলে তাকালেন।
‘বলেন কী, এসিজি স্যার!’ রঙ্গলাল গোস্বামী।
‘ইজ দিস আ জোক?’ ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি।
‘আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, ডক্টর গুপ্ত।’ ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে।
এসিজি বললেন, ‘একটা কথা আপনারা কেউই আমার কাছে জানতে চাননি।’ একটু থামলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর ‘ব্রজেন দাস কী করে জানলেন যে, ওঁকে ছাঁটাই করা হবে? মিস্টার চ্যাটার্জি যে-ধরনের মানুষ ছিলেন তাতে এ-কথা ব্রজেনবাবুকে তিনি কিছুতেই আগে জানাতেন না। আমার ধারণা…।’
ব্রজেন দাস চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল এসিজির দিকে।
এসিজি ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনাকে ছাঁটাইয়ের খবরটা কে দিয়েছিল? রমেশ শর্মা?’
ব্রজেন দাস সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।
হাসলেন এসিজি, বললেন, ‘অবস্থাটা আপনারা সবাই বুঝে দেখুন। ব্রজেনবাবুর চাকরি গেলে উনি যে খেপে যাবেন এটা স্বাভাবিক। তারপর মিস্টার চ্যাটার্জি ও ব্রজেন দাসের মাঝখানে থেকে ঠিকমতো একটু খেলতে পারলে ব্রজেন দাসকে দিয়ে খুনটা করানো সম্ভব। ব্রজেন দাসের খুনের অস্ত্র ছিল স্পেশাল ইনহেলার, আর রমেশ শর্মার নিখুঁত খুনের অস্ত্র ছিল ব্রজেন দাস। কিন্তু তারপর?
‘তারপর তো পথ পরিষ্কার! মিস্টার চ্যাটার্জি মারা গেলে শ্রাবণী চ্যাটার্জি সবকিছুর মালিক হচ্ছেন। সুতরাং, শ্রাবণীদেবীর সঙ্গে যদি রমেশ শর্মার বিয়ে হয়—এই খবরটা শাওনি আমাকে দিয়েছেন, আর শাওনিকে খবরটা দিয়েছিলেন মদনমোহন চ্যাটার্জি নিজে—হ্যাঁ, যা বলছিলাম…বিয়েটা হয়ে গেলে রমেশ শর্মা সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক। যদি কোনও কারণে বিয়ে পরে ভেঙেও যায়, তা হলেও সম্পত্তির অনেকটা বাগিয়ে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া…।’
‘য়ু ওল্ড ফুল! আপনমনে কীসব বকে চলেছেন? ক্যাপ্টেন সুখানির নির্দেশ ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রমেশ শর্মা, ‘কোনও প্রমাণ আছে আপনার কাছে?’ শ্রাবণীর দিকে ফিরে ‘তুমি একটা কথাও বিশ্বাস কোরো না, শ্রাবণী। দিস ওল্ড বাগার ইজ লায়িং লাইক আ সিঙিং ক্যানারি। আই উইল—।’
এসিজি রমেশকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখানে আমার ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব হাজির থাকলে আপনার কপালে অনেক দুঃখ ছিল। এনি ওয়ে, প্রমাণের কোনও দরকার নেই। দোষ স্বীকার করার পর ব্রজেন দাস যদি পুলিশকে শুধু বলে যে, এর মধ্যে আপনিও ছিলেন, তা হলেই আপনি ফেঁসে যাবেন—জাল কেটে আর বেরোতে পারবেন না। আপনার কথাবার্তা খুবই ইনটেলিজেন্ট। কায়দা করে ব্রজেন দাসের ব্যাপারে আমাকে সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম সব সূত্র দিয়ে গেছেন। যাতে কখনওই মনে না হয় যে, আপনি ইচ্ছে করে ব্রজেন দাসকে ফাঁসাচ্ছেন, সেজন্যে দরকারমতো অভিনয়ও করে গেছেন। হ্যাটস অফ টু য়ু, মিস্টার শর্মা!’
শ্রাবণী উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, রমেশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘রমেশ, এসব কী শুনছি! তুমি…তুমি সত্যি এরকম! আমি…আমি…।’
ব্রজেন দাস হঠাৎ চেঁচিয়ে এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘স্যার! ডক্টর গুপ্ত! শর্মাজি আমাকে চাকরি খোয়ানোর খবর তো দিয়েছেন—এ ছাড়াও আমাকে সবসময় মিস্টার চ্যাটার্জির এগেইনস্টে ওসকাতেন। বলতেন, ”এই গোঁয়ার লোকটা আমাদের সবার সর্বনাশ করবে।” আমি, স্যার, ওঁকে ছাড়ব না!’
এসিজি শ্রাবণীকে বললেন, ‘ম্যাডাম, যদি মনে করেন, তা হলে এই বুড়ো লোকটার একটা পরামর্শ নিতে পারেন।’ নিজের মাথার চুলে হাত দিলেন এসিজি : ‘রমেশ শর্মাকে আপনি বিয়ে করবেন না। মিস্টার শর্মা খুব লোভী, অ্যামবিশাস এবং ধূর্ত বটে। উনি ঠিক মানুষ নন, মানুষের চেয়ে একটু কম…।’
এমনসময় কুমারমঙ্গলম এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন সুখানির কাছে। নিচু গলায় বলল, স্যার, ভাইজাগ এসে গেছে—প্লেন এখন ল্যান্ড করবে।’
ক্যাপ্টেন সুখানি সকলের মুখের ওপরে একবার নজর বুলিয়ে বললেন, ‘আমরা আর কয়েকমিনিটের মধ্যেই ভাইজাগে ল্যান্ড করছি। পুলিশের কাছে এখনই রেডিয়ো মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা যার-যার সিটে বসে সিট-বেল্ট বেঁধে নিন। প্লিজ, মেক ইট কুইক।’
সবাই যখন চলে যাচ্ছে তখন অর্জন সুখানি এসিজিকে আর-একবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আই থ্যাংক য়ু এগেইন অন বিহাফ অফ ”আকাশ এয়ারলাইনস”। আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে রেডিয়ো মেসেজে সব জানাচ্ছি।’
ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর রঙ্গলাল গোস্বামী গুটিগুটি পায়ে এসিজির কাছে এসে দাঁড়ালেন, চাপা গলায় বললেন, ‘এসিজি স্যার, দেখা গেল আপনার প্রতিভার লাইটনিং/ আকাশপথে খুনির সঙ্গে আপনার ফাইটনিং।’
এসিজি ভুরু কুঁচকে তাকালেন কবিবরের দিকে : ‘লাইটনিং না হয় বুঝলাম, রঙ্গলালবাবু, কিন্তু ফাইটনিংটা কী কেস?’
হাত কচলে বিনয়ে মাথা নোয়ালেন রঙ্গলাল, বললেন, ‘ওটা কবিতার আবেগ—মানে, ভেলোসিটি, এসিজি স্যার। ফাইট শব্দটাকে নিপাতনে সিদ্ধ করে ফাইটনিং করে দিয়েছি। স্বভাব-কবিতার এটাই তো বিউটি, স্যার…।’
এক ইঞ্চির গরমিল (উপন্যাস)
কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম ‘এসিজি’। বয়েসকালে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করার সময় এই সংক্ষিপ্ত নামে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এখন এই নামে কেউ উল্লেখ করলে বেশ অস্বস্তি হয়। কলিংবেলের সঙ্গে-সঙ্গে সেই নামেই কেউ ডেকেছেন বাইরে থেকে ‘এসিজি স্যার আছেন?’
কলিংবেল সাতসকালে বেজে ওঠা মানেই অতিথি ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব—এসিজির প্রাক্তন ছাত্র। সময় পেলেই সে চলে আসে স্যারের এই শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে। এসিজির পাখির শখ নিয়ে নানারকম কৌতূহল দেখায়। সেইসঙ্গে খুন-জখম-রাহাজানি নিয়ে বিস্তর আলোচনা।
একটু আগেই ব্রেকফাস্ট শেষ করেছেন এসিজি। তারপর এককাপ কফি খেয়ে উইলস ফিলটার ধরিয়েছেন। সকাল-সন্ধের কাজের বউ ‘ললিতের মা’ বাথরুমে কাপড় কাচছে—এখান থেকে জল পড়ার শব্দ আর কাপড় আছড়ানোর শব্দ দিব্যি কানে আসছে।
দু-আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে দরজা খুলে দিয়েছেন অশোকচন্দ্র। আর সঙ্গে-সঙ্গেই শোনা গেছে অতিথির প্রশংসাবাণী : ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ—।’
খাঁটি দুধের সঙ্গে তুলনা করে এসিজিকে আজ পর্যন্ত কেউ প্রশংসা করেনি। সুতরাং অতিথিকে দেখে তিনি যতটা অবাক হয়েছিলেন, তার অদ্ভুত প্রশংসায় ঠিক ততটাই বেসামাল।
কিন্তু অতিথিকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না। ‘লালমহল’-এর রঙ্গলাল গোস্বামী—যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এই কথা বলে : ‘আমি একজন স্বভাব-কবি/কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’
গতবছর পুজোর সময় এসিজি রঘুপতি যাদবের সঙ্গে রঙ্গলালবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন—বাগবাজার গঙ্গার ঘাটের কাছে দু-মহলা বাড়ি ‘লালমহল’। সেখানে রঙ্গলালবাবুর দাদার একটা হারানো চুনি খুঁজে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবার কী রহস্য দেখা দিল ‘লালমহল’-এ?
সে-কথা জিগ্যেস করতে আকর্ণবিস্তৃত হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘না, না, না—সেসব কিছু নয়/করতে এসেছি গভীর পরিচয়। আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, এসিজি স্যার। শুনে আপনার গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছি।’
পাছে রঙ্গলাল আবার ‘খাঁটি দুগ্ধের’ উপমা দেন সেই আতঙ্কে অশোকচন্দ্র তড়িঘড়ি অতিথি-সৎকারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রঙ্গলালবাবুকে ড্রইংরুমের সোফায় বসতে বলে এসিজি ললিতের মা-কে অতিথির খবর দিতে গেলেন।
একটু পরে ফিরে এসে দেখেন রঙ্গলালবাবু ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর অবাক চোখে ঘরের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখছেন। অশোকচন্দ্রকে দেখেই ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি।’
হাসি চাপতে পারলেন না এসিজি। কোনওরকমে হাসি থামিয়ে জানতে চাইলেন, ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনির মানে?’
রঙ্গলাল সোফায় বসে বিনীতভাবে বললেন, ‘তিনটি বিচিত্র গুণের সমাহার। আসলে আমার উপমাগুলো একটু বেশি সিম্বলিক। কিন্তু জানেন তো, কবিতায় সিম্বলের ব্যবহার একটা আর্ট।’
অশোকচন্দ্র নতুন চোখে মানুষটাকে দেখছিলেন।
শ্যামলা রং। ডানহাতের তিন আঙুলে রুপো দিয়ে বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। পরনে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। মাথায় তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুল। ছোট-ছোট উজ্জ্বল চোখ। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট আঁচিল। নাকটা মাপে সামান্য বড়। দাঁড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। আর ভদ্রলোকের শরীর ঘিরে পারফিউমের হালকা সুবাস।
অন্য কেউ এরকম প্রশংসা করলে ব্যাপারটাকে চাটুকারিতা বলা যেত। কিন্তু রঙ্গলালবাবুর সবকিছুই এমন স্বাভাবিক আর আন্তরিক যে, ওঁর মুখে এ-ধরনের কথা শুনলে বেশ মজা পাওয়া যায়। তা ছাড়া, একজন কবিকে বন্ধু হিসেবে পেলে মন্দ কী!
সোফায় বসে রঙ্গলালবাবুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন এসিজি। সিগারেটের ধোঁয়ার রেখা ওঁর মাথার সাদা চুলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।
গল্পের মাঝেই আবার বেজে উঠল কলিংবেল। ঘণ্টির ছন্দ শুনেই অশোকচন্দ্র এবার চিনে নিতে পারলেন নতুন অতিথিকে। তাই রঙ্গলালের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘রঘুপতি যাদব—।’
‘হরি হে মাধব!’ পাদপূরণ করলেন রঙ্গলাল। তাঁর মুখে সামান্য আশঙ্কার ছাপ ফুটে উঠল।
দরজা খুলতেই দেখা গেল এসিজির অনুমান সঠিক। ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে—অনেকটা পড়া-না-পারা ছাত্রের মতো। ওর হাতে বেশ বড় মাপের সবুজ প্লাস্টিকের কভার দেওয়া একটা ফাইল। এই মুহূর্তে ওকে যতটা না ইন্সপেক্টর তার চেয়ে ঢের বেশি ছাত্র-ছাত্র দেখাচ্ছে।
‘আরে, এসো ইন্সপেক্টর সাহেব, এসো—এসো। মুখটা যেরকম বাংলার পঞ্চান্নর মতো করে রেখেছ তাতে মনে হচ্ছে পাখি নিয়ে সমস্যায় পড়েছ।’
মজা করে প্রাক্তন ছাত্র রঘুপতিকে আহ্বান জানালেন এসিজি।
রঘুপতি যাদব ঘরে ঢুকল। বয়েস চল্লিশের এপিঠে। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচাপাকা চওড়া গোঁফ। ফরসা মুখে সামান্য বসন্তের দাগ। হাতের শিরা এবং পেশি দুই-ই চোখে পড়ার মতো।
রঘুপতি চাপা গলায় গজগজ করে বলল, ‘আপ তো মজাক কর রহে, স্যার—লেকিন মেরা তো নিদ খরাব হো গই।’
‘কেন, কেন, ঘুম শিকেয় উঠল কেন?’ চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমাটা খুলে অশোকচন্দ্র ঠাট্টার সুরেই প্রশ্ন করেছেন প্রাক্তন ছাত্রকে।
‘স্রেফ এক ইঞ্চির জন্যে—’ রুক্ষভাবে বলল রঘুপতি। তারপর যেন এই প্রথম দেখতে পেল রঙ্গলাল গোস্বামীকে।
রঙ্গলাল প্রায় বিগলিত হয়ে রঘুপতি যাদবকে আকর্ণবিস্তৃত হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘মনে পড়েছে মহললাল? আমি সেই রঙ্গলাল।’
রঘুপতি অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল অশোকচন্দ্রের দিকে : ‘কী ব্যাপার, গুপ্তাসাব? আবার কি পান্না-চুনির প্রবলেম, নাকি হাস্যকবি সন্মেলন?’
‘রঘুপতি, রঘুপতি—’ ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন এসিজি। আদরের গলায় বললেন, ‘তোমার মেজাজটাকে একটু ডাউন করো, প্লিজ। কর্পূরের মতো ভোলাটাইল মেজাজ নিয়ে কখনও মিস্ট্রি সলভ করা যায়! নাও বোসো—একটু কফি-টফি খাও, তারপর তোমার এক ইঞ্চির গরমিল নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে।’
রঙ্গলাল গোস্বামী রঘুপতির আচরণে খানিকটা হকচকিয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। অশোকচন্দ্রের ‘কফি-টফির’ প্রস্তাবে গলা বাড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘কফি আমার প্রিয় নয়/টফি হলেই ভালো হয়—।’
রঘুপতি সোফায় বসতে গিয়ে হেসে ফেলল, দেখল রঙ্গলালের দিকে। তারপর বলল, ‘আপনি এই বয়েসেও টফি খান?’
রঙ্গলাল লজ্জায় মুখ নিচু করে বললেন, ‘কী করব, ভালো লাগে। ভালো লাগার কি কোনও বয়েস আছে?’ তারপর রঘুপতিকে সৌজন্যের নমস্কার জানিয়ে, ‘আমি বাগবাজারের লালমহলের রঙ্গলাল গোস্বামী। স্যারের সঙ্গে গভীর পরিচয় করতে এসেছি—।’
এমনসময় দরজা ঠেলে ঢুকল বিশু। বছর বারো-তেরোর কিশোর। এসিজির কাছেই থাকে, ফাইফরমাশ খাটে। বিশুর হাতে পলিথিনের ক্যারিব্যাগ—তাতে ঠোঙা আর বাক্স।
এসিজি ওকে বললেন, ‘ললিতের মা-কে বল দুজন গেস্ট আছে। আর কফি তিনকাপ।’ তারপর রঙ্গলালকে লক্ষ করে, ‘সরি, রঙ্গলালবাবু, আজ আপনাকে টফি খাওয়াতে পারলাম না। আজ কফি দিয়ে কাজ চালান—অন্য আর-একদিন টফি খাওয়াব।’
এরপর রঘুপতির সঙ্গে রঙ্গলালের ‘গভীর’ পরিচয় করিয়ে দিলেন এসিজি।
সব শুনে রঙ্গলাল চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ফিজিক্সের লোক, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর! এই কম্বিনেশান বড় সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর।’
এসিজি হেসে বললেন, ‘আবার অমর, আকবর, অ্যান্টনি—কী বলুন!’
রঘুপতি অবাক হয়ে তাকাল স্যারের দিকে ‘অমর, আকবর, অ্যান্টনি মানে? আপনি আজকাল হিন্দি পিকচার-টিকচার দেখছেন নাকি, গুপ্তাসাব?’
এসিজি আবার হাসলেন। চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ও এক মজার ব্যাপার—তোমাকে পরে বুঝিয়ে দেব। এবারে তোমার এক ইঞ্চির গরমিলের গল্পটা বলো—।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। ওঁর চোখ বুজে এল। বোঝা গেল, ‘থিঙ্কিং মেশিন’ নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।
সোফায় বসে ফাইলটা ঠিক পাশেই রেখেছিল রঘুপতি। সেটা হাতে তুলে নিয়ে খুলতে-খুলতে বলল, ‘গুপ্তাসাব, ব্যাপারটা ঠিক সুইসাইড নয়—তবে সুইসাইডের মতো—।’
এসিজি চোখ খুললেন। রঙ্গলাল গোস্বামীকে লক্ষ করে বললেন,
‘রঙ্গলালবাবু, এবার একটু খুন-জখমের গল্প শুনুন। আপনি কবি মানুষ, এসব গল্পে হয়তো বোর হয়ে যাবেন…তবু—।’
দু-হাত তুলে এসিজিকে থামিয়ে দিলেন রঙ্গলাল, খানিকটা সুর করে বললেন, ‘রঘুপতি যাদব এবং আপনি/ তৎসহ কিঞ্চিৎ খুন কিংবা খুনি/ সুগভীর পরিচয়ের অঙ্গ বলে মানি/ ইন্টারেস্ট তীব্র মম শুনিতে কাহিনি।’ স্বভাব-কবিতা শেষ করে বিনয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন রঙ্গলাল।
অশোকচন্দ্র পালটা হেসে রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, তুমি ননস্টপ তোমার কাহিনি বলে যাও। আমরা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছি। খুঁটিনাটি কিচ্ছু বাদ দেবে না।’
রঘুপতি বলতে শুরু করল, ‘ওই যে বললাম, ব্যাপারটা ঠিক সুইসাইড নয়—সুইসাইডের মতো। কেসটা প্রথম এসেছিল মানিকতলা থানায়—সুইসাইডের কেস হিসেবে। ব্যাপারটা বেশ স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ছিল। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ধুতি বেঁধে খুদকুশি। কিন্তু পরে দেখা গেল, সবকুছ ঠিকঠাক হ্যায়, লেকিন সিরফ এক ইঞ্চির গরমিল। আর সুইসাইড নোটেও থোড়াবহত গড়বড় আছে।’
এরপর রঘুপতি যাদব ওর জগাখিচুড়ি ভাষায় যা বলে গেল তা মোটামুটি এই। ব্যাপারটা হয়েছে দিন কুড়ি আগে, লালাবাগানে—মানিকতলা থানা এলাকায়। গুরুদাস কলেজের বাংলার অধ্যাপক ডক্টর রণতোষ দত্ত আত্মহত্যা করেছেন। ভদ্রলোকের বয়েস চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন মতো হবে। সুন্দর, লম্বা, সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান চেহারা ছিল—তবে কে জানে কেন বিয়ে-থা করেননি। দোতলা বাড়ির ছাদের একটা ঘরে দিনরাত বইপত্র নিয়ে ডুবে থাকতেন। সেই ঘরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন—সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ধুতি বেঁধে। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা ঠিকই ছিল, কিন্তু পরে একটা গরমিল দেখা দেয়। বাড়িতে আরও লোকজন থাকেন। একতলায় একঘর ভাড়াটে। আর দোতলায় থাকেন রণতোষবাবুর ভাই পরিতোষ দত্ত, ভাইয়ের স্ত্রী অন্তরা দত্ত আর ওঁদের একটা বছর চারেকের মেয়ে টুসি। বাড়ির মালিক পরিতোষ দত্ত আর রণতোষ দত্ত। ওঁদের বাবা বছর কুড়ি আগে মারা গেছেন। তবে এই ঘটনার পর এখন মালিক পরিতোষ দত্ত। পরিতোষবাবু স্টেটব্যাঙ্কের বউবাজার ব্রাঞ্চে চাকরি করেন—বেশ ভালো পোস্টেই। ভদ্রলোকের চাকরির রেকর্ড একদম পরিষ্কার—কোনও গন্ডগোল নেই।
‘রঘুপতি রঘুপতি—’ হাত তুলে রঘুপতিকে থামতে ইশারা করলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত : ‘তোমাকে তো বহুবার বলেছি, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। তুমি এত তাড়াহুড়ো করে গল্পটা বোলো না—গাড়ির স্পিড একটু স্লো করো। এবার বলো দেখি, রণতোষবাবুর সুইসাইডে গন্ডগোলটা কোথায়, আর সুইসাইড নোটের কেসটাই বা কী? তারপর পরিতোষবাবুর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট শুনব।’
রঘুপতি যাদব ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রণতোষ দত্তের বডিটা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছিল। আর তাঁর বডির ঠিক নীচেই মেঝেতে উলটে পড়ে ছিল একটা চেয়ার। মানিকতলা থানার এ. এস. আই. মজুমদার কেসটা ইনভেস্টিগেট করছিলেন—প্রথমে তিনি ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। পরে মাপজোখ করে পতা চলা কে হ্যাঙিং বডি আর ওই চেয়ারের মধ্যে এক ইঞ্চি মতো ফাঁক থেকে যাচ্ছে। লেকিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একদম ও. কে.—ক্লিন সুইসাইড বাই হ্যাঙিং—মানে, সেরকম হলে যেরকম হয় আর কী। তবে স্টমাকে সামান্য একটু ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে।’
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘রণতোষ দত্ত ধুতি পরতেন।’
‘হ্যাঁ—’
এমনসময় বিশু ট্রে-তে করে খাবার-দাবার আর কফি নিয়ে এসে টি-টেবিলে রাখল।
এসিজির অনুরোধে রঙ্গলাল আর রঘুপতি খেতে শুরু করল। এসিজি নিজে কফির কাপ তুলে নিলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে মাথার সাদা চুলের গোছা ধরে টান মারলেন কয়েকবার।
রঘুপতি ফাইলের একটা পৃষ্ঠায় চোখ রেখে খেতে-খেতে জড়ানো গলায় বলল, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যা বলছে তাতে সন্দেহ হওয়ার কোনও কারণ নেই। সিক্সথ সার্ভিকাল ভার্টিব্রা মেডালা, পন্স, আর মিডব্রেইনে গিয়ে হিট করেছে। নতিজা রেসপিরেশন আর কার্ডিয়াক ফাংশানের ভাইটাল কন্ট্রোল সেন্টার ড্যামেজ হয়ে ডেথ—।’
কফিতে বারতিনেক লম্বা চুমুক দিয়ে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘বুঝেছি। কিন্তু তুমি সুইসাইড নোটের কথা কী যেন বলছিলে—।’
ইতিমধ্যে খাওয়া শেষ করে কফি শুরু করেছে রঘুপতি। কফির কাপ টেবিলে রেখে ফাইল থেকে একটা চিরকুট বের করে এগিয়ে দিল এসিজির দিকে : ‘দেখিয়ে গুপ্তাসাব, ইয়ে রহা আপকা সুইসাইড নোট।’
কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। তারপর প্রাক্তন ছাত্রের হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে ভালো করে দেখলেন। রণতোষ দত্তের লেখা সুইসাইড নোট। রুলটানা কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে লেখা।
‘কোনও ব্যক্তির আত্মার সর্বনাশ হওয়া কেমন ভয়ানক ও গুরুতর বিষয়, তাহা বলা অসাধ্য; কিন্তু ধিক ২! মনুষ্যেরা ঈশ্বরের নিয়ম জানিয়াও মনে করে, যদ্যপি আমরা পাপ করি, তথাপি তিনি দয়ালু হইয়া পরলোকে আমাদিগকে অবশ্য ভালো স্থান দিবেন।’
—ফুলমণি ও করুণার বিবরণ
এটাকে কি সুইসাইড নোট বলা যায়? সিগারেটে গভীর টান দিলেন এসিজি। এরকম পুরোনো ধাঁচের বাংলায় কি কেউ সুইসাইড নোট লেখে! তা ছাড়া, শেষে ওই ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ব্যাপারটাই বা কী? এটা কোনও লেখা থেকে কোট করা হয়নি তো!
সেটা রঘুপতিকে জিগ্যেস করতেই ও বলে উঠল, ‘আমরা ইনভেস্টিগেট করে দেখেছি, স্যার। এটা পুরোনো একটা স্টোরি থেকে নেওয়া—ফুলমণি ও করুণার বিবরণ—রাইটারের নাম হানা ক্যাথেনিন ম্যালেন্স। বাংলার প্রফেসররা এসবের খোঁজখবর রাখেন।’
কাগজটা দেখতে-দেখতে মাথার সাদা চুলের গোছা ধরে টান মারলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত! আনমনাভাবেই বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, রঘুপতি, সুইসাইড নোটটা যেন কেমন-কেমন। তা ছাড়া, কাগজটা কোনও বড় পৃষ্ঠা থেকে সাবধানে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। যদি রণতোষবাবু এই অদ্ভুত সুইসাইড নোটের ব্যবস্থা করে গিয়ে থাকেন, তা হলে বলতে হয়, তাঁর আত্মার সর্বনাশ হয়েছিল, তিনি কোনও একটা পাপ কাজ করে সেই অনুতাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্ত এখানে আর-একটা খটকা লাগছে : ‘যে-ভদ্রলোক অনায়াসে নিজের পাপ স্বীকার করেন তাঁর পক্ষে স্পষ্ট সুইসাইড নোট লিখতে অসুবিধে কোথায়!’
‘ঠিকই বলেছেন স্যার—’ গম্ভীরভাবে সায় দিল রঘুপতি যাদব, ‘ওই সুইসাইড নোট আর এক ইঞ্চির ব্যাপারটা নিয়ে আমরা থোড়াসা মুসিবতে পড়ে গেছি। রণতোষবাবু মহল্লায় বেশ পপুলার আদমি ছিলেন। তো এসব কী করে জানাজানি হয়ে গিয়ে লোকাল থানায় পাবলিকের প্রেসার এসেছে। তাতে এই কেস ঘুরেফিরে এখন আমার হাতে—।’
‘আর তুমি সেই রিলে রেসের লাঠিটা এখন আমার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছ!’ বলে হো-হো করে হেসে উঠলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
রঘুপতি না হেসে সিরিয়াস মুখে বলল, ‘আপ জো ভি সমঝে, গুপ্তাসাব, এই কেস আপনাকে সেটল করতে হবে—নো আদার অলটারনেটিভ।’
এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, ‘তা হলে চলো, স্পটে একবার যাওয়া যাক। জায়গাটা কোথায় যেন বললে, লালাবাগান?’
‘হ্যাঁ। আমি একবার ওখানে ঘুরে এসেছি। তার রিপোর্ট এই ফাইলেই আছে। য়ু ক্যান গো থ্রু ইট। এখন বলুন, আপনি কবে যেতে পারবেন—।’
ভুরু উঁচিয়ে চোখ কপালে তুললেন অশোকচন্দ্র কবে মানে! আজ—এখনই! তোমার কোনও অসুবিধে নেই তো?’
‘আমার অসুবিধে! এটাই এখন আমার সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট অ্যাসাইনমেন্ট। আপনি তা হলে রেডি হয়ে নিন, নীচে আমার গাড়ি আছে।’
রঙ্গলাল গোস্বামী এতক্ষণে মুখ খুললেন, এসিজিকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘আপনার তদন্তরসে হব কি বঞ্চিত/লালাবাগানে রঙ্গলাল সঙ্গী অবাঞ্ছিত?’
রঙ্গলালের কাব্যের সুড়সুড়িতে এসিজি হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ছি, ছি, কী যে বলেন! আপনি সঙ্গী হলে আমাদের দারুণ ভালো লাগবে।’
তৈরি হয়ে ওঁরা তিনজনে নেমে এলেন রাস্তায়। তারপর উঠে পড়লেন রঘুপতির নিয়ে আসা গাড়িতে।
কোনও-কোনও সৌন্দর্য এমন হয় যা পুরুষকে স্থবির করে দেয়। তার অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। সে সেই সৌন্দর্যের ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তাকে অপলকে দেখতে চায়, স্পর্শ করতে চায়—তার মাঝেই সবরকম পাওয়া পূর্ণ হয়।
একতলার একফালি বারান্দায় মেয়েটিকে দেখার পর অশোকচন্দ্র গুপ্তের সেইরকমই মনে হল।
বয়েস সাতাশ/আটাশ, সুঠাম শরীর, ফরসা রং, মাথায় ঘন কালো চুল। নাকের ডানপাশে—ঠোঁটের কাছাকাছি একটা স্পষ্ট তিল। চোখের রং সামান্য কটা। শরীরে বাড়তি মেদের আভাস। সিঁথিতে সিঁদুরের কোনও রেখা নেই।
এসিজির পিছন থেকে রঘুপতি যাদব চাপা গলায় বলল, ‘সুমিতা নিয়োগী। রণতোষবাবুদের ভাড়াটে। ওঁর হাজব্যান্ড বছরতিনেক আগে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। একটা বছর আটেকের লেড়কি আছে—নাম বকুল। এ ছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন—।’
পুরোনো বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অশোকচন্দ্র রঘুপতির চাপা গলার ধারাবিবরণী শুনছিলেন। ও সুমিতা নিয়োগী, তার শ্বশুর জলধর নিয়োগী, শাশুড়ি পারুল নিয়োগী সম্পর্কে টুকরো-টুকরো খবর বলছিল। অবশ্য তথ্যগুলো এতই সাদামাটা যে, সেগুলোকে ঠিক খবর বলা যায় না।
সুমিতার স্বামী শশধর নিউ আলিপুরে একটা প্রাইভেট ফার্মে স্টোর অফিসারের চাকরি করতেন। খুব সরল-সোজা মানুষ ছিলেন। সুমিতার সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে । সুমিতার বাপের বাড়ি বাগনান। সেখানকার অবস্থা তেমন একটা সচ্ছল নয়। শশধর প্রায়ই ওদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। অবশ্য বাবা-মাকে লুকিয়ে।
দোতলায় উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে এসিজি রঘুপতিকে জিগ্যেস করলেন, ‘এত হাঁড়ির খবর তুমি পেলে কোথা থেকে?’
রঘুপতি বলল, ‘সুমিতা নিয়োগীর সঙ্গে আলাদা কথা বলেছি। আর শশধরবাবুর দফতরে খোঁজ নিয়েছিলেন মানিকতলা থানার অফিসার মজুমদার।’
রঙ্গলাল গোস্বামী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। তবে বেশ কৌতূহল নিয়ে চারপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখছিলেন, আর কান পেতে এসিজি ও রঘুপতির কথাবার্তা শুনছিলেন। ওঁর মুখে একটা গোয়েন্দা-গোয়েন্দা ভাব ফুটে উঠেছিল।
দোতলায় পৌঁছতেই তিনি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জীর্ণ বাড়ির অজীর্ণ রোগ/বাড়ির গন্ধে মৃত্যুযোগ—।’
অশোকচন্দ্র একবার রঙ্গলালবাবুর দিকে শুধু দেখলেন, কিছু বললেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল, রঙ্গলালবাবুর কথা বুঝি একেবারে মিথ্যে নয়। বাড়িটা যে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরোনো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, বাড়িটায় ঢোকার পর থেকেই কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ তাঁর নাকে আসছে। গন্ধটার মধ্যে সাবান অথবা ডিটারজেন্টের গন্ধের ধরন আছে।
ওঁদের তিনজনকে প্রথম দেখতে পেলেন অন্তরা দত্ত। একটু মোটাসেটা গিন্নি-গিন্নি চেহারা। চোখে বুদ্ধির ছাপ। মহিলা বোধহয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আর-একটা ঘরে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, তিনজন অতিথিকে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই রঘুপতি যাদবকে চিনতে পেরে মুখে একচিলতে সৌজন্যের হাসি ফুটিয়ে তুললেন।
‘মিসেস দত্ত, রণতোষবাবুর সুইসাইডের ব্যাপারে আমরা একটু বাতচিত করতে এসেছি। ইনি আমার স্যার, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত। আর ইনি মিস্টার রঙ্গলাল গোস্বামী—পোয়েট।’
রঙ্গলালবাবু ঘাড় হেলিয়ে বিনীত হেসে বললেন, ‘পোয়েট নয়, ন্যাচারাল পোয়েট। মানে, স্বভাব-কবি।’
অন্তরা দত্ত শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ওঁদের ভেতরে আসতে বললেন। ছিমছামভাবে সাজানো ছোট মাপের বসবার ঘরে ওঁদের বসিয়ে মিসেস দত্ত চলে গেলেন। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন পরিতোষ দত্ত। লম্বা রোগাটে চেহারা। চোখে চশমা। রং মাঝারি। কপালে কয়েকটা ভাঁজ।
পরিতোষ দত্ত যে চেষ্টা করে বিরক্তির ভাব লুকিয়ে রেখেছেন সেটা বুঝতে এসিজির কোনও অসুবিধে হল না। পোশাক দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোক অফিসে বেরোচ্ছেন।
‘কী ব্যাপার, ইন্সপেক্টর যাদব, দাদার সুইসাইডের ইনভেস্টিগেশান এখনও শেষ হয়নি! আমি এখন অফিসে বেরোচ্ছি—।’
রঘুপতি যাদব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোয়ালের রেখা দেখে কিছুটা বিপদ আঁচ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। তাঁর অনুমান মিথ্যে হল না।
পরিতোষ দত্তর চোখে সরাসরি তাকিয়ে রঘুপতি বলল, ‘আপনি আজ অফিসে যাচ্ছেন না, পরিতোষবাবু। আর আপনার বড়া ভাই সুইসাইড করেননি—মে বি ইট ওয়াজ মার্ডার।’
পরিতোষ দত্তর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল পলকে। আর তখনই দেখা গেল, দরজার পরদার পাশটিতে কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন অন্তরা দত্ত। ওঁর মুখেও এখন রক্তের অভাব।’
‘মার্ডার!’ পরিতোষবাবু ভীষণ চমকে গেলেন। হতবুদ্ধিভাবে তিনজনের দিকে পালা করে দেখলেন : ‘কেন, আপনারাই তো বললেন, ব্যাপারটা প্লেন সুইসাইড!’ একটু থেমে ইতস্তত করে তারপর : ‘তা ছাড়া, আমরা তো জানি, দাদা বেশ ক’দিন ধরে ডিপ্রেশানে ভুগছিল।’
‘আপনি এত এক্সাইটেড হয়ে পড়ছেন কেন জানি না, মিস্টার দত্ত—’ শক্ত গলায় বলল রঘুপতি, ‘ইনভেস্টিগেশান করার সময় আমাদের যা-যা মনে হয়েছে বলেছি। লেকিন কে আপনাকে বলল যে, ইনভেস্টিগেশান খতম হয়েছে!’ পরিতোষ দত্তর হাত ধরে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে দিল রঘুপতি ‘আইয়ে, বয়েঠ যাইয়ে। আমার স্যার আপনার সঙ্গে থোড়াবহত বাতচিত করবেন।’
স্কুল ছুটির পরে জোর করে আটকে রাখা ছাত্রের মতো গোমড়া মুখ করে পরিতোষ দত্ত একটা চেয়ারে বসলেন। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলেন শুভ্রকেশ হুনুরের দিকে।
অশোকচন্দ্র শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তারপর নিজের পরিচয় দিলেন, হেসে বললেন, ‘আমি এক হুনুর, এখানে হুনুরি, মানে, গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছি। ইন্সপেক্টর যাদব কলেজ-জীবনে আমার ছাত্র ছিল—।’
রঘুপতি বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘এখনও তাই।’
রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গেও পরিতোষ দত্তর পরিচয় করিয়ে দিলেন এসিজি। তারপর গলা তুলে বললেন, ‘মিসেস দত্ত, আপনি ভেতরে আসুন। আপনি এখানে এসে বসলে আমাদের কাজের কোনও অসুবিধে হবে না।’
অন্তরা দত্ত একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। তারপর কুণ্ঠিত পায়ে ঘরের ভেতরে এসে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলার মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। পরনে সামান্য অগোছালো ছাপা শাড়ি। বোঝা যায়, রান্নাবান্নার কাজে সাময়িক ইস্তফা দিয়ে কৌতূহল মেটাতে চলে এসেছেন এ-ঘরে।
স্ত্রীকে দেখে পরিতোষ দত্ত যেন অকূল পাথারে খড়কুটো খুঁজে পেলেন। সাততাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলে উঠলেন, ‘দ্যাখো না, এনারা এখন বলছেন দাদা আত্মহত্যা করেনি, ব্যাপারটা খুনও হতে পারে…।’
অন্তরা দত্ত বেশ শান্ত গলায় বললেন, ‘খুন হোক আর আত্মহত্যা হোক, যে-মানুষ্টা চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না।’
এসিজি বেশ অবাক হয়ে অন্তরাকে দেখলেন। ওঁর চেহারার সঙ্গে এই ধীর স্থির মন্তব্য যেন একেবারেই বেমানান।
অন্তরা এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘আমাদের যা-যা বলার পুলিশকে বহুবার বলেছি। নতুন কিছু আর বলার নেই। তবু যদি কিছু আপনাদের জিগ্যেস করার থাকে তা হলে বলুন…।’
ক’দিন ধরে বেশ গুমোট চলছে। আকাশে মেঘ আছে, কখনও-কখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টিও পড়ছে। কিন্তু থার্মোমিটারের পারা তাতে নড়ছে বলে মনে হয় না।
ছোট্ট ঘরটার একজোড়া জানলা দিয়ে আকাশ দেখা না গেলেও তার চেহারা-চরিত্র স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছিল। ঘরের সিলিং ফ্যানের ব্লেডগুলো ক্রমাগত ঘুরপথে ছুটে-ছুটে এখন যেন হাঁফাচ্ছে। সেইসঙ্গে সামান্য ক্যাঁচকোঁচ শব্দও তুলছে।
এসিজি স্বামী-স্ত্রীকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখলেন।
পরিতোষ দত্ত বেশ সচকিত। সাপের ঝাঁপির ডালা আচমকা খুললে সাপ যেরকম সতর্ক হয়ে যায়। অথচ অন্তরা দত্ত অবিচলিত—অন্তত দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। একেই বোধহয় পরিভাষায় বলে ‘কুল-কাস্টমার।’
‘রণতোষবাবু আপনাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করতেন?’ অন্তরাকে লক্ষ করে প্রথম প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এসিজি।
‘হ্যাঁ। আমার হাতের রান্না দাদা খুব পছন্দ করতেন।’
‘মারা যাওয়ার আগে বেশ ক’দিন ধরে উনি ডিপ্রেশানে ভুগছিলেন শুনলাম। এর কারণ কিছু আঁচ করতে পারেন?’
পরিতোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওঁকে বাধা দিয়ে অন্তরা বললেন, ‘সেরকম কিছু না। তবে দাদা ইদানীং পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এসব নিয়ে খুব পড়াশোনা করছিলেন…।’
অশোকচন্দ্র আড়চোখে রঘুপতির দিকে তাকালেন।
পরিতোষ দত্ত আলতো গলায় বললেন, ‘দাদা এমনিতে খুব ইমোশনাল ছিল। যে-কোনও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভীষণ সিরিয়াসলি ভাবত।’
‘উনি বিয়ে করেননি কেন?’
‘সংসারের নানান কর্তব্য করতে গিয়ে নিজের বিয়েটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।’
পরিতোষ দত্তর উত্তর শুনে অশোকচন্দ্র গুপ্ত তেমন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শাকের আড়ালে কোথায় যেন মাছের গন্ধ পেলেন। এও লক্ষ করলেন, অন্তরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন—চোখে শাসনের ভ্রূকুটি।
এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। কার্বন ফ্রেমের চশমাটাকে নেড়েচেড়ে ঠিক করে বসালেন। তারপর অন্তরার থেকে সৌজন্য অনুমতি নিয়ে নতুন একটা উইলস ফিলটার ধরালেন।
ধোঁয়া ছেড়ে বহুক্ষণ ধরে পরিতোষ দত্তকে দেখলেন এসিজি। সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এমন নার্ভাস মানুষ। রণতোষ দত্তর চেয়ে প্রায় আঠারো-বিশ বছরের ছোট। কিন্তু স্বাস্থ্যের হাল এমনই যে, ওঁর পক্ষে দাদার ওপরে শারীরিক জোর খাটানো অসম্ভব। যদি না কেউ ওঁকে সাহায্য করে থাকে। তা ছাড়া, এখানে আসার পথে রঘুপতি যা বলেছে তাতে মৃতদেহে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন ছিল না। শুধু পাকস্থলীতে সামান্য পরিমাণে ভ্যালিয়াম পাওয়া গেছে। রণতোষ দত্ত যদি সত্যি-সত্যিই খুন হয়ে থাকেন তা হলে তাঁকে বোধহয় আগে থেকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কাবু করে ফেলা হয়েছিল।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘রণতোষবাবুর সঙ্গে কারও কোনও প্রেম—মানে, অ্যাফেয়ার ছিল?’
‘এর সঙ্গে সুইসাইডের সম্পর্ক কী?’ হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে গিয়েই পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন পরিতোষ। তারপর চকিতে একবার তাকালেন অন্তরার দিকে।
অন্তরা চোখ নামিয়ে ফেলেছিলেন।
রঘুপতি অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ইনভেস্টিগেশান আপ কর রহে হ্যায় ইয়া হম! স্যার যা জানতে চাইছেন তার সহি জবাব দিন—।’
রঙ্গলাল গোস্বামী কপালে ভাঁজ ফেলে সবাইকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। ওঁর মুখের গোয়েন্দা-গোয়েন্দা ভাবটা এখনও যায়নি।
একটু ইতস্তত করে অন্তরা দত্ত বললেন, ‘দাদার একটা—ইয়ে ব্যাপার ছিল। এটা প্লিজ পাঁচকান করবেন না—ওঁর সুনাম নষ্ট হবে।’ কিছুক্ষণ সময় নিলেন অন্তরা। তারপর : ‘বছরচারেক আগে দাদার সঙ্গে ওঁর এক ছাত্রীর একটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল। ছাত্রীটি ম্যারেড ছিল—তাই একটু-একটু স্ক্যান্ডালও হয়েছিল। মেয়েটি পরে কলকাতার পাট চুকিয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। তখন দাদা খুব শকড হয়েছিলেন—ডিপ্রেশানে ভুগেছিলেন। তারপর ধীরে-ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়…।’
এসিজি স্বামী-স্ত্রীকে লক্ষ করছিলেন।
কখনও কোনও শক পেলে তার জন্য চারবছর পর কেউ সুইসাইড করে না। তা হলে কি রঘুপতির ‘মার্ডার’ থিয়োরিটাই সত্যি!
এরপর আরও কিছুক্ষণ ওঁদের সঙ্গে কথা বলার পর এসিজি বললেন, ‘রঘুপতি, চলো, এবার আসল জায়গায় যাওয়া যাক। রণতোষবাবুর ঘরটা আমি ভালো করে একবার দেখতে চাই।’
দত্ত দম্পত্তির অনুমতি নিয়ে ওঁরা তিনজনে ছাদের দিকে রওনা হলেন।
অগোছালো বই আর কাগজপত্রের স্তূপের কথা বাদ দিলে বলতে হয় ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো।
ছাদের দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে ঘরটা দাঁড়িয়ে। ছাদে উঠে কোনাকুনি চলে যেতে হয় ছাদের অপর প্রান্তে। সেখানেই কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অকুস্থল। একুশ দিন আগে এখানেই ঘটে গেছে দুঃখের ঘটনা।
ঘরের সিলিং বেশ নিচু। সেখান থেকেই ঝুলছে চকোলেট রঙের সিলিং ফ্যান। ঘরের বাঁ-দিক ঘেঁষে মামুলি বিছানা। আর ডানদিকে লেখাপড়ার টেবিল আর একটা চেয়ার। ঘরের দু-দেওয়ালে ছোট মাপের একজোড়া করে জানলা।
বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকায় ঘরে কেমন একটা গুমোট ভাব ছিল। তা ছাড়া সর্বত্র ধুলো ছড়িয়ে আছে। রঘুপতি নাক সামান্য কুঁচকে টেবিলের দিকের জানলা দুটো খুলে দিল।
রঙ্গলালবাবু আলতো গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘এসিজি স্যার, আমি কি বিছানায় আসন গ্রহণ করতে পারি?’
এসিজি ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। রঙ্গলালের প্রশ্নে সামান্য চমকে উঠে বললেন, হ্যাঁ, পারেন—এবং ওখানেই বসে থাকবেন, নইলে আমাদের কাজের অসুবিধা হবে। রঘুপতির দিকে তাকিয়ে : ‘ওটাই সেই চেয়ার?’
‘হ্যাঁ, গুপ্তাসাব—ওয়ান অ্যান্ড ওনলি চেয়ার।’
এ-কথা শুনে বৃদ্ধ হুনুর তৎপরভাবে চলে গেলেন চেয়ারটার কাছে। ওটা তুলে নিয়ে এসে রাখলেন সিলিং ফ্যানের ঠিক নীচে। তারপর জ্বলন্ত সিগারেট হাতেই উঠে পড়লেন চেয়ারের ওপরে।
মাথা তুলে সিলিং ফ্যানটাকে একবার দেখলেন এসিজি, তারপর হাত বাড়ালেন তার দিকে।
এসিজির হাত ফ্যানে পৌঁছে গেল, কিন্তু তার ডাউন রড পর্যন্ত পৌঁছল না—খানিকটা ফাঁক থেকে গেল।
রঘুপতি বলল, ‘রণতোষ দত্ত প্রায় আপনার মতোই লম্বা ছিলেন—পাঁচ-আট।’
ঘরের একমাত্র পাখা বন্ধ থাকায় ওঁরা তিনজনেই দরদর করে ঘামছিলেন। রঙ্গলালবাবু ডানহাতের চেটো নেড়ে নিজেকে বাতাস করার চেষ্টা করছিলেন।
এসিজি চেয়ার থেকে নেমে পড়ে রঘুপতিকে বললেন, ‘পাখাটা চালিয়ে দাও—।’
সিলিং ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। অশোকচন্দ্র তার নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মাথার ভেতরে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর তাঁর নজর হেঁটে বেড়াচ্ছিল ঘরের সর্বত্র।
চারিদিকে শুধু বই আর বই। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাতা এবং কাগজপত্র। ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা বাংলা ও একটা ইংরেজি ক্যালেন্ডার। একটা খাটো টুলের ওপরে বসানো চোদ্দো ইঞ্চি সাদা-কালো টিভি। তার পাশেই মেঝেতে সাদা রঙের জলের জগ।
ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে একটা মাঝারি মাপের আয়না। তার নীচের তাকে চিরুনি, ক্রিম, পাউডার আর ওষুধপত্র। তার পাশে দেওয়ালের হুক থেকে ঝুলছে বেশ কয়েকটা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি-লুঙ্গি।
অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসিজি হাতের সিগারেট শেষ করলেন। তারপর আনমনাভাবে এগিয়ে গেলেন টেবিলের কাছে। টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা গুঁজে দিলেন।
মাথার চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে বৃদ্ধ হুনুর এবার বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করলেন।
তারই মাঝে রঘুপতিকে জিগ্যেস করলেন, ‘ওঁর কোনও ডায়েরি-টায়েরি পাওয়া যায়নি?’
‘না—।’ নির্লিপ্ত গলার জবার দিল রঘুপতি।
রণতোষ দত্ত মানুষটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। রঘুপতির ফাইলে অধ্যাপক দত্তের ছবি দেখেছেন তিনি। নীচের বসবার ঘরে তাঁর দেওয়ালে-টাঙানো ফটোও দেখেছেন—ফটোয় ফুলের মালা দেওয়া। এখন ফুলের মালাটাকে গলার ফাঁস বলে মনে হচ্ছিল।
গাড়িতে করে এখানে আসার পথে রঘুপতির দেওয়া ধারাবিবরণী এসিজির মনে পড়ছিল।
ঘটনার দিন সকালে রণতোষবাবুর চা দিতে গিয়ে অন্তরা দত্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। তখন প্রায় আটটা বাজে। তিনি ছুটে এসে স্বামীকে দুর্ঘটনার কথা জানাতেই ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়। পরিতোষবাবু সঙ্গে-সঙ্গে মানিকতলা থানায় ফোন করে খবর দেন। ওঁদের এই বিপদের সময় একতলায় ভাড়াটেরাও পাশে এসে দাঁড়ান। বিশেষ করে সুমিতা তো পরিবারের একজন হয়ে প্রতিটি কাজে অন্তরাকে সাহায্য করেছেন।
রণতোষ দত্তর ব্যাপারটা যদি সত্যিই খুন হয় তা হলে কার-কার উদ্দেশ্য এবং সুযোগ থাকতে পারে সেটাই এসিজি মনে-মনে খতিয়ে দেখছিলেন। কিন্তু বারবারই তাঁর হিসেব হোঁচট খাচ্ছিল।
নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে গভীর টান দিলেন অশোকচন্দ্র। তাঁর মাথা—যাকে তিনি ‘থিঙ্কিং মেশিন’ বলেন—কি বিগড়ে গেল! সুইসাইড, না মার্ডার? খুন, না আত্মহত্যা?
হাতড়াতে-হাতড়াতে হঠাৎই কতকগুলো কাগজ খুঁজে পেলেন এসিজি। প্রথম কাগজটার মাথায় শিরোনাম লেখা : পাপ ও মৃত্যু।
তারপর পাতার পর পাতা শুধু বিভিন্ন লেখা থেকে উদ্ধৃতি টোকা রয়েছে। বিখ্যাত-বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে মন্তব্য—ছোট-বড়, ইংরেজি-বাংলা নানারকম। তারই মধ্যে জন মিলটনের লেখা একটা ইংরেজি লাইন দেখতে পেলেন এসিজি :
‘Death is the golden key that opens the palace of eternity.’
তার নীচে বাংলা তর্জমাও চোখে পড়ল ‘মৃত্যু হল সোনার চাবি—যা দিয়ে অনন্তের প্রাসাদের দরজা খুলে যায়।’
প্রায় প্রতি পৃষ্ঠাতেই রণতোষবাবুর হতে লেখা বেশ কিছু মন্তব্য এসিজি লক্ষ করলেন। একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় বড়-বড় হরফে লেখা : ‘মৃত্যু যদি স্বর্গ হয়, জীবন তা হলে নরক। আমি মানুষ বলেই আমার অন্তরে পাপ আছে।’
পৃষ্ঠাগুলো প্রথম থেকে পরপর দেখছিলেন অশোকচন্দ্র। সাধারণ রুলটানা দিস্তে কাগজে লেখা। প্রত্যেক পাতায় পৃষ্ঠার সংখ্যা বসানো।
সুইসাইড নোটটা যে একই ধরনের কাগজে লেখা সেটা এসিজির বেশ মনে ছিল। হঠাৎই একটা ব্যাপার লক্ষ করে তিনি চমকে উঠলেন। পাতাগুলোর মধ্যে দু-নম্বর পৃষ্ঠাটা নেই!
সাদা চুলের গোছায় আলতো করে টান মারলেন এসিজি। তাঁর থিঙ্কিং মেশিনের চাকা বনবন করে ঘুরতে শুরু করল।
মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য। রুলটানা কাগজ। বলপয়েন্ট পেন। সুইসাইড নোট। পাপ ও মৃত্যু।
রণতোষ দত্ত কি কোনও কারণে পাপবোধে কাবু হয়ে পড়েছিলেন? সেইজন্যেই পাপ ও মৃত্যু নিয়ে এতসব কথা ভাবছিলেন? নাকি তিনি নেহাতই পড়াশোনা বা গবেষণার তাগিদে মৃত্যু সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য সংগ্রহ করছিলেন?
আনমনাভাবে সিগারেট টানতে-টানতে চেয়ারটার কাছে চলে এলেন বৃদ্ধ হুনুর। বিড়বিড় করে বললেন, ‘মৃত্যু যদি স্বর্গ হয়, জীবন তা হলে নরক…’ তারপর চেয়ারে বসে পড়লেন।
মৃত্যু সকলের অপছন্দের, অথচ মৃত্যু অনিবার্য। তাই মৃত্যুকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কতরকম মহিমাই না তার ওপরে আরোপ করেছেন দার্শনিক ও সাহিত্যিকরা! মৃত্যু হল সোনার চাবি! মৃত্যু হল স্বর্গ!
এসিজি মাথা নাড়লেন। না, মৃত্যু অতি জঘন্য, মৃত্যু অত্যন্ত কুৎসিত। বিশেষ করে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
মাথা তুলে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন এসিজি। তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, রণতোষ দত্তর কঠোর সুপুরুষ শরীরটা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে। কোন এক অলৌকিক বাতাসে শরীরটা সামান্য দুলছে। তাঁর পায়ের চেটো অল্পের জন্য এসিজিকে স্পর্শ করছে না।
দরজায় শব্দ হতেই ঘোর ভাঙল এসিজির।
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন পরিতোষ দত্ত। তাঁর চোখেমুখে অপ্রস্তুত বিব্রত ভাব। কিন্তু তার সঙ্গে সামান্য কৌতূহলও যে মিশে আছে, সেটা এসিজির নজর এড়াল না।
ঘরের চারপাশে ঝটিতি একপ্রস্থ নজর চালিয়ে নিয়ে পরিতোষ বললেন, ‘ভাবলাম… একবার… ইয়ে… দাদার ঘরটা ঘুরে আসি। আপনাদের ইনভেস্টিগেশানে…ইয়ে…ডিসটার্ব করলাম না তো?’
পরিতোষ দত্তর আচমকা হাজির হওয়াটা এসিজি তেমন পছন্দ করেননি। হাতের সিগারেটে একটা ছোট্ট টান দিয়ে পরিতোষবাবুর দিকে সরাসরি না তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ভাড়াটের সঙ্গে আপনাদের কেস চলছে?’
পরিতোষ দত্ত স্পষ্ট চমকে উঠলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমতা-আমতা করলেন, কোনও জবাব খুঁজে পেলেন না। তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন, ‘না, কেস ঠিক নয়…সবে উকিলের সঙ্গে একটু কথা-টথা বলেছি। আসলে আমাদের ঘরগুলো ভীষণ ছোট-ছোট। তা ছাড়া, অন্তরা…ইয়ে…আমার ওয়াইফ বলছিল একতলাটায় একটা সেলাইয়ের স্কুল খুলবে। ওর সেলাইয়ের হাত খুব ভালো…।’
এসিজি আপনমনেই হেসে ফেললেন। অঙ্কটা যে কত সহজ এবার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
পরিতোষকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘আপনি যান, আপনার ওয়াইফকে গিয়ে বলুন, আমাদের কাজ হয়ে গেছে। এক্ষুনি আমরা নীচে নামছি।’
ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিতোষ চলে গেলেন।
এসিজি এবার রঘুপতিকে লক্ষ করে প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু আন্দাজ করতে পারলে, রঘুপতি?’
রঘুপতি যাদবের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। বোধহয় ও কিছু একটা ভাবছিল। অশোকচন্দ্রের প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল : ‘কী, স্যার?’
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন বৃদ্ধ হুনুর। হাতের ছোট হয়ে আসা সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে চলে গেলেন টেবিলের কাছে। সিগারেটের টুকরোটা গুঁজে দিলেন অ্যাশট্রেতে। তারপর হেসে বললেন, ‘আমাদের তদন্ত কেমন চলছে সেটা দেখার জন্যে অন্তরা দত্ত বোধহয় স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন। আর দাদা মারা যাওয়ার পর পরিতোষবাবু বাড়ির মালিক হওয়ামাত্রই ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করার জন্যে কেস করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। সেটা কার পরামর্শে তা তো আন্দাজ করতেই পারছ—।’
‘সব বাড়িওয়ালাই তো টেনান্টের এগেইনস্টে কেস করে—’ রঘুপতি সাদামাঠা গলায় বলল।
এসিজি বিড়বিড় করে বললেন, ‘সেরকম হলে তো প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল ছিল। কিন্ত সুমিতা নিয়োগীকে দেখার পর আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা বোধহয় ততটা প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল নয়—।’
রঙ্গলাল গোস্বামী ছোট্ট করে মন্তব্য করলেন, ‘একে তো যুবতী তায় এক্সট্রিম সুন্দরী/তাঁকে ঘিরে জমে উঠবে স্যারের হুনুরি।’
কথায়-কথায় জানা গেল, জলধর নিয়োগী দশ বছর হল চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। কিন্তু মানুষটিকে দেখে তা বোঝায় উপায় নেই। লম্বা, শক্ত কাঠামো। মাথায় টাক পড়েছে। তাকে ঘিরে কাঁচাপাকা চুল। দু-কানেও খানিকটা করে চুল। চোখে কালো ফ্রেমের সাধারণ চশমা। তবে চামড়ার ভাঁজ খুঁটিয়ে দেখলে বয়সের আঁচ করা যায়।
এসিজি জলধর নিয়োগীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। তাঁর ডানপাশে বসা রঙ্গলালবাবু ঘরের ছাদের দিকে মুখ তুলে আনমনাভাবে কিছু একটা আওড়াচ্ছিলেন। তাঁর চায়ের কাপ অনেকক্ষণ আগেই শেষ।
কথাবার্তার সময় সুমিতা দু-একবার ঘরে ঢুকেছিল। কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে ছিল অশোকচন্দ্রের দিকে। তারপর আবার চলে গেছে ঘর থেকে। ওর বছর দশেকের মেয়ে বকুল একবার চলে এসেছিল ‘দাদুর’ কাছে। সুমিতা ‘পড়া শেষ হয়নি এখনও—পড়তে চলো’ বলে স্নেহের ধমক দিয়ে ডেকে নিয়ে গেছে।
ঘরটা ছোট মাপের। চেহারায় নিম্ন মধ্যবিত্ত, মলিন। একপাশে ছাপা চাদরে ঢাকা বিছানা। তার পাশে ট্রাঙ্ক, আলনা, ঠাকুরের আসন। সেখান থেকেই বোধহয় হালকা ধূপের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। জলধরবাবু বিছানায় বসেছেন। অশোকচন্দ্র আর রঙ্গলাল নড়বড়ে চেয়ারে। সামনে যথেষ্ট মেরামত করা একটা টেবিল।
জলধরবাবুর সঙ্গে সহজ-সরল গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন অশোকচন্দ্র। সেই গল্প করতে-করতেই কীভাবে যেন অধ্যাপক রণতোষ দত্তর কথা এসে পড়েছিল।
‘দারুণ মানুষ ছিলেন। চাকরিজীবনে বহু লোক চরিয়েছি। লোক চিনি। অন্তরটা বড় পরিষ্কার ছিল।’ থেমে-থেমে স্মৃতিচারণের সুরে কথাগুলো বললেন জলধর নিয়োগী। ওঁর চোখ সামান্য ঘোলাটে লাগছিল। কথা থামিয়ে পরনের লুঙ্গি আর হাফহাতা সাদা ফতুয়া টেনেটুনে ঠিকঠাক করলেন। তারপর এসিজির দিকে তাকালেন।
স্থির চোখে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে জলধরবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘এইরকম একটা মানুষ—হঠাৎ কেন সুইসাইড করল বলুন তো?’
এসিজি হাসলেন। মাথার পিছনে হাত চালিয়ে সাদা চুলোর গোছায় বারদুয়েক টান মেরে বললেন, ‘সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তো আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি—।’
‘বিরক্ত হওয়ার কী আছে।’ বৃদ্ধ মানুষটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ‘কেউ সুইসাইড করলে তার তো একটা কারণ নিশ্চয়ই থাকবে। যদি না অবশ্য অন্য কিছু হয়। আপনার কী মনে হচ্ছে?’
সময় নিতে একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। তারপ লাইটার পকেটে রেখে ঠোঁটে সিগারেট নিয়েই বললেন, ‘মনে হওয়ার ব্যাপারটা এখনও ঝাপসা, মিস্টার নিয়োগী—।’
কিন্তু সতিই কি ঝাপসা? রণতোষ দত্ত মানুষটা কি একটু-একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে না? ছবিটা যখন পুরোপুরি স্পষ্ট হবে তখন বোঝা যাবে মানুষটা কেন মারা গেল, কীভাবে মারা গেল। সুইসাইড না মার্ডার?
গত দু-দিন ধরে রঘুপতি যাদবের দেওয়া কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন এসিজি। প্রতিটি কাগজের প্রতিটি অক্ষর মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। তারপরই মনে হয়েছে, বছর পঞ্চান্নর এক সুদর্শন অধ্যাপককে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। অকৃতদার, কর্তব্যপরায়ণ, ভালোমানুষ। কিন্তু মানুষটার মুখটা এখনও অস্পষ্ট, আর চোখ দুটো ঝাপসা।
এসিজি রঘুপতিকে বলেছিলেন, তিনি বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চান। রঘুপতি তাতে হেসে বলেছে, স্যার যত খুশি কথা বলুন, ওর আপত্তি নেই। ওর শুধু অঙ্কের উত্তর চাই।
অতএব তৃতীয় দিন সন্ধেবেলা অশোকচন্দ্র এসে হাজির হয়েছেন লালাবাগানের এই জীর্ণ বাড়িতে। সঙ্গে রঙ্গলাল গোস্বামী। রঙ্গলালবাবুর শখ হয়েছে এসিজির মতো ‘প্রতিভাবান’ গোয়েন্দার কার্যকলাপ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো পর্যবেক্ষণ করবেন। তাই পর্যবেক্ষণের এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি।
কিছুক্ষণ একমনে সিগারেটে টান দিলেন এসিজি। তারপর হঠাৎই বৃদ্ধ মানুষটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘রণতোষবাবুর ভাই পরিতোষবাবু কীরকম লোক?’
বড় মাপের একটা নিশ্বাস ফেললেন জলধর নিয়োগী, তারপর বললেন, ‘এমনিতে বোধহয় তেমন খারাপ লোক নন। দোষের মধ্যে বউয়ের কথায় চলেন। দাদার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কথা কাটাকাটি হত।’
‘কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হত?’ শান্ত গলায় জিগ্যেস করলেন অশোকচন্দ্র।
ঠোঁট ওলটালেন জলধর নিয়োগী : ‘ঠিক কী নিয়ে তা জানি না। তবে কথাবার্তার মধ্যে ব্যাঙ্ক, টাকাপয়সা, লোন—এসব শুনতাম।’
‘আপনাদের বাড়িভাড়ার টাকা কে নিত?’
‘প্রথম-প্রথম আমিই দিয়ে আসতাম। রণতোষবাবুর কাছে। বছর দশেক হল আমি গেঁটে বাতে ভুগি। তাই পরের দিকে খোকা—মানে, শশধর দিয়ে আসত—’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধের বুক ঠেলে : ‘ও—ইয়ে—চলে যাওয়ার পর থেকে বউমা—মানে, সুমিতা দিয়ে আসে।’
‘কাকে? রণতোষবাবুকে?’
‘কখনও-কখনও বড়ভাইকে দিয়ে আসত। কখনও ছোটভাইকে। কখনও বা ছোটভাইয়ের বউকে—।’
‘বাড়িওয়ালা হিসেবে এঁরা কেমন?’
ফতুয়ার ভেতরে হাত চালিয়ে গায়ে হাত ঘষলেন জলধর, বললেন, ‘রণতোষবাবু তো দারুণ মানুষ ছিলেন। খোকা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের জন্যে কী না করেছেন! খোকার অফিসে দৌড়োদৌড়ি করা, ই এস আই অফিসে যাওয়া, এল আই সি, প্রভিডেন্ট ফান্ড—সব ব্যাপারে আমাদের হেল্প করেছেন। সেইজন্যেই তো সংসারটা ভেসে যায়নি। তা ছাড়া, খোকা মারা যাওয়ার পর বাড়িভাড়া সাড়ে চারশো থেকে তিনশো করে দিয়েছিলেন। আজকের যুগে এরকম ভাবা যায়?’
এসিজির কাছে রণতোষ দত্তর মুখটা একটু-একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল। তিনি আচমকা একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বৃদ্ধের দিকে : ‘যদি শোনেন পরিতোষবাবু ভাড়াটে উচ্ছেদ করার জন্যে কেস করার তোড়জোড় শুরু করেছেন, তা হলে আপনার কেমন লাগবে?’
‘অবাক লাগবে না। এটাই তো নিয়ম। পারুলকে বলেছি। সুমিতাকেও আমার সন্দেহের কথা বলেছি। দিনদশেক আগে পাড়ার মাদার ডেয়ারির দোকানে খবরটা পেলাম। যাকগে, যা হয় হবে…।’
এসিজি ভাগ্যনির্ভর বৃদ্ধকে দেখছিলেন। দেবতা, ধূপ আর ভাগ্য কখনও দুর্ঘটনাকে রুখতে পারে না।
রঙ্গলাল গোস্বামী বোধহয় অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। কারণ তিনি বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। একফাঁকে এসিজির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এনাকে নিয়ে অনেক হল, এবার ক্ষান্ত দিন/তেনাকে ডেকে করুন শুরু, জবানবন্দী নিন।’
অশোকচন্দ্র হাসি চেপে জলধরবাবুকে লক্ষ করে বললেন, ‘যদি আপনি অনুমতি দেন তা হলে আপনার বউমা সুমিতাদেবীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
জলধরবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই যেন চমকে উঠে বললেন, ‘ওহ, হ্যাঁ—হ্যাঁ। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি—।’
উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ট্রাঙ্কের ওপরে রাখা একটা তোবড়ানো সস্তা অ্যাশট্রে তুলে নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। সেটা এসিজির সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘খোকা খুব সিগারেট খেত…।’
অভিনয় শেষ করে মঞ্চ ছেড়ে বৃদ্ধ অভিনেতা যেমন সহজ ছন্দে উইংসের দিকে এগিয়ে যায়, কথাটা বলে ঠিক সেইভাবে নিষ্ক্রান্ত হলেন জলধর নিয়োগী।
পাশের কোনও বাড়িতে সময়ের ঘণ্টা বাজছিল। অশোকচন্দ্র ঘণ্টা গুনলেন আটটা। তারপর সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতেই সুমিতা এসে ঘরে ঢুকল।
পরনে ওর আটপৌরে ছাপা শাড়ি। কিন্তু সেও যেন কালি লেপে সূর্যদেবতাকে মলিন করার মিথ্যে চেষ্টা। সুমিতার রূপ উষ্ণ তরঙ্গের মতো ঘরের পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিল। এ যেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের অমোঘ ভ্রমণ। অশোকচন্দ্রের মনে পড়ে গেল জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের কথা।
‘আমাকে ডেকেছেন?’
আড়চোখে রঙ্গলালকে দেখলেন বৃদ্ধ হুনুর। স্বভাবকবি মানুষটি স্তব্ধ বিস্ময়ে অপলকে সুমিতাকে দেখছেন।
সুমিতা বিছানার এককোণে সঙ্কুচিতভাবে বসল।
অশোকচন্দ্র ইতস্তত করে আলতো স্বরে বললেন, ‘সবই তো জানেন। আপনাকে বিরক্ত করতে খুবই খারাপ লাগছে। রণতোষবাবুর ব্যাপারেই কয়েকটা কথা বলব…।’
‘বলুন—।’
‘আপনি ওঁকে কীরকম চিনতেন?’
‘ভালো করেই চিনতাম।’ সঙ্কোচহীন গলায় উত্তর দিল সুমিতা, ‘ওরকম ভালোমানুষ ক’জন হয়! উনি চলে যাওয়াতে আমাদের সবার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামল সুমিতা। তারপর ভুরু কুঁচকে এসিজির দিকে তাকিয়ে হঠাৎই প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ওঁর সুইসাইড নিয়ে এতদিন পর আবার খোঁজ করছেন কেন?’
অশোকচন্দ্র কী যেন ভাবলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে ব্যাপারটা সুইসাইড নয়, মার্ডার।’
সুমিতার ফরসা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ চঞ্চল হয়ে ওকে উদভ্রান্তের মতো দেখাল।
‘খুন! অসম্ভব! রণতোষবাবু খুন হতেই পারেন না। ওঁর কোনও শত্রু ছিল না। দেবতার মতো মানুষ ছিলেন। ওঁকে প্রত্যেকে ভালোবাসত—।’
শেষ শব্দটা এসিজির কানে বাজল। দেবতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা! সুমিতাকে সামান্য খোঁচা দেওয়ার জন্যই তিনি বললেন, ‘ভালোবাসলে কি আর খুন করা যায় না!’
সুমিতা মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, ‘হয়তো যায়। আপনি খুন-জখম-রাহাজানি অনেক দেখেছেন। আপনি ভালো জানবেন। তবে রণতোষবাবুর বেলায় এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
সুমিতাকে একটু সহজ হওয়ার সময় দিয়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘মাঝে-মাঝে বাড়িভাড়া দিতে যাওয়া ছাড়া আপনার সঙ্গে ওঁর আর কোনও কথা হত না?’
‘কেন হবে না! আমার—আমার হাজব্যান্ড মারা যাওয়ার পর উনি সব ব্যাপারে হেলপ করেছেন। বাবা কিংবা আমি ওসব পেরে উঠতাম না। সব জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন লিখে দেওয়া, ফর্ম ফিল-আপ করা, দৌড়োদৌড়ি করা—সব রণতোষবাবু করেছেন। কোনওরকম ধকল আমাদের টের পেতে দেননি—’
‘একটা কথা আপনাকে জিগ্যেস করছি। কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট আছে—এটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না…।’
সুমিতা মুখে একবার হাত বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘আলোচনা করার আমার আমার কে-ইবা আছে! আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।’
‘শুনেছি বছর-চারেক আগে রণতোষবাবুর সঙ্গে তাঁর এক ছাত্রীর একটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে একটু-আধটু স্ক্যান্ডালও হয়—’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর এসিজি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?’
সুমিতা মুখ নিচু করল। ওর চোয়াল শক্ত হল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘না, জানি না। তবে তার সঙ্গে রণতোষবাবুর সুইসাইডের সম্পর্ক কী?’
‘না, সেরকম কিছু নয়। আমার মনে হচ্ছিল উনি বোধহয় খুব আবেগপ্রবণ মানুষ।’
‘আবেগপ্রবণ হওয়াটা কি অপরাধ?’ এসিজির চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করল সুমিতা।
‘না, অপরাধ কেন হবে?’ হাসলেন অশোকচন্দ্র।
‘আসলে গন্ডগোলটা কোথায় জানেন?’ সপ্রতিভভাবে বলে উঠল সুমিতা, ‘কোনও একটা অ্যাফেয়ার হলেই পুরুষদের দোষটা সকলের আগে চোখে পড়ে। এ-ব্যাপারেও মনে হয়, রণতোষবাবুকে অনেকে দোষী ভাবছে, আর ছাত্রীটিকে নির্দোষ। কে জানে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমিতা : ‘যার-যার বিচার তার-তার কাছে…’
সুমিতা নিয়োগীকে এখন আর মোটেই অসহায় বিধবা মনে হচ্ছিল না। ওর সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটিকে ক্রমশই ভালো লাগছিল এসিজির।
আর কিছু বলে ওঠার আগেই ঘরে এসে ঢুকল বকুল। ফরসা রং, একমাথা কোঁকড়া চুল, কটা চোখ—একেবারে মায়ের মতো হয়েছে।
বকুল ঘরে ঢুকেই মায়ের কাছে গিয়ে বায়নার সুরে বলল, ‘আমার পড়া হয়ে গেছে। এখন ওই ম্যাজিকটা আলমারি থেকে বের করে দাও—।’
এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘কী ম্যাজিক, মা-মণি?’
বকুল চটপট জবাব দিল, ‘দুটো প্যাঁচ খাওয়া পেরেকের ম্যাজিক।’
এসিজি হেসে বললেন, ‘বুঝেছি। ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে নাড়াচাড়া করে পেরেক দুটোকে আলাদা করতে হয়, তাই না?’
‘হ্যাঁ—’ মাকে ছেড়ে এসিজির দিকে দু-পা এগিয়ে এল বকুল। চোখ বড় করে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কী করে জানলে?’
অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘আমি অনেক ম্যাজিক জানি। এখুনি তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছি। তুমি আমাকে দু-গ্লাস জল এনে দাও।’
‘দু-গ্লাস জল কেন?’ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল বকুল।
‘একগ্লাস খাব, আর-একগ্লাস জল দিয়ে ম্যাজিক দেখাব।’
‘আমি নিয়ে আসছি—’ বলে সুমিতা তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল জল নিয়ে আসতে।
দু-গ্লাস জল এসে পড়ল একটু পরেই। এসিজি একটা গ্লাস তুলে নিয়ে সেটার জল দ্বিতীয় গ্লাসে খানিকটা ঢেলে দিলেন। তাতে দ্বিতীয় গ্লাসটা কানায় কানায় ভরতি হল। তখন প্রথম গ্লাসের জল ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন তিনি। তারপর একটু দম নিয়ে সুমিতাকে বললেন, ‘একটা পুরোনো পোস্টকার্ড দিতে পারেন?’
সুমিতা একটা পোস্টকার্ড খুঁজে এনে দিল।
পোস্টকার্ডটা টইটম্বুর গ্লাসের ওপর চেপে বসিয়ে দিলেন এসিজি। তাতে গ্লাসের মুখটা ঢাকা পড়ে গেল। তখন পোস্টকার্ড সমেত জল ভরতি গ্লাসটাকে সাবধানে ধরে সেটাকে উলটে দিলেন। তারপর ধীরে-ধীরে নীচের হাতটা সরিয়ে নিলেন। পোস্টকার্ড ঢাকা দেওয়া গ্লাস-ভরতি জল দিব্যি স্থির হয়ে রইল।
এ-দৃশ্য দেখে বকুল খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল।
এসিজি গ্লাসটা আবার সাবধানে সোজা করে রেখে দিলেন টেবিলে।
বকুল এবার চলে এল এসিজির কাছে। আবদার করে বলল, ‘আমাকে এর সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’
এসিজি ওকে বুঝিয়ে বললেন, বাতাসের চাপ পোস্টকার্ডে চাপ দিয়ে একগ্লাস জলকে কীভাবে সহজে ধরে রাখতে পারে।
বকুল অবাক বিস্ময়ে বৃদ্ধের কথা শুনছিল।
ওকে বোঝানো শেষ করে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘আমি আরও অনেক ম্যাজিক জানি। তোমাকে সেগুলোর সিক্রেট শিখিয়ে দেব পরে।’
বকুলের গাল টিপে আদর করে অশোকচন্দ্র উঠে পড়লেন। সুমিতাকে বললেন, ‘চলি, মিসেস নিয়োগী। আমাকে হেলপ করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।’
সুমিতা উঠে দাঁড়িয়েছিল। এসিজির কথায় ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘আপনার সামান্য ক’টা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি—একে হেলপ বলে না।’
অশোকচন্দ্র কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা পরিতোষ দত্ত, অন্তরা দত্ত কেমন মানুষ বলুন তো—।’
সুমিতার মুখটা পালটে গেল। নিজেকে সামলে নিতে খানিকটা সময় নিল, তারপর চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘মানুষ? আচার-আচরণ দেখে তো মনে হয় না।’
বকুল শাড়ি ধরে ওকে বিরক্ত করছিল। সুমিতা আলতো ধমক দিয়ে মেয়েকে বলল, ‘ভেতরে যাও—।’
মেয়েটা একটা জলের গ্লাস আর ভিজে পোস্টকার্ড নিয়ে চলে গেল ভেতরে।
এসিজি একাগ্র ছাত্রের মতো সুমিতার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সুমিতা বলল, ‘ভদ্রমহিলা তো প্রায়ই নোংরা ভাষায় চিৎকার করে ঝগড়া করেন। কখনও কাজের বউয়ের সঙ্গে, কখনও স্বামীর সঙ্গে, আর কখনও বা ভাসুরের সঙ্গেও ঝগড়া করতেন। অবশ্য এগুলোকে ঠিক ঝগড়া বলা যায় না, কারণ ব্যাপারগুলো সবসময়েই একতরফা হত। রণতোষবাবু এ নিয়ে আমার কাছে বারকয়েক আক্ষেপও করেছেন।’
‘পরিতোষবাবু স্ত্রীকে কখনও বারণ করতেন না?’
‘না, ওঁর পক্ষে বারণ করা সম্ভব নয়। সে-ক্ষমতা ওঁর নেই—।’
বিষণ্ণ হাসল সুমিতা : ‘ওঁদের সঙ্গে কথা বললেই আপনি সব বুঝতে
পারবেন।’ কী খেয়াল হতেই ও আরও বলল, ‘আপনি তো ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন—।’
‘হ্যাঁ, বলেছি…’ চিন্তিতভাবে জবাব দিলেন এসিজি, ‘আবারও বলব।’
রঙ্গলালবাবু অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন কিছু একটা বলার জন্য। এখন সুযোগ পেয়ে বলে বসলেন, ‘রণতোষবাবু যদি সুইসাইড করে থাকেন তা হলে তার কারণ কিছু আন্দাজ করতে পারেন?’
সুমিতার মুখটা হঠাৎ পালটে গেল। মাথা নিচু করে চোখের কোণ টিপল কয়েকবার। যখন মুখ তুলল তখন ফরসা মুখ খানিকটা লালচে, থমথমে। একটু সময় নিয়ে ও বলল, ‘কী জানি, জানি না…’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আরও যোগ করল, ‘ওঁর কাছে যেটা যথেষ্ট কারণ বলে মনে হয়েছে সেটা হয়তো অন্য কারও কাছে কোনও কারণই নয়। সুইসাইডটা হয়তো সম্পূর্ণ অকারণে…।’
‘আর মার্ডার হলে?’ অশোকচন্দ্র জানতে চাইলেন।
‘তা হলেও একই কথা বলব। ওঁকে খুন করারও কোনও যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে না।’
একটু ভাবলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর বললেন, ‘রাত বাড়ছে। এবার চলি, মিসেস নিয়োগী। পরে আবার দেখা হবে।’
রঙ্গলাল গোস্বামী সুমিতাকে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, তা হলে এবার যাই। খুনির যেন দেখা পাই।’
ভাঙাচোরা আলো-আঁধারি অলিপথে পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন দু-জনে।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
‘রঙ্গলালবাবু, খুনির দেখা পাওয়া খুব সহজ নয় বলে মনে হচ্ছে। আর-একদিন এসে অন্তরা দত্তর সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
রঙ্গলালবাবু হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আইডিয়ার ওপরে বেস করে দু-লাইনের একটা ছোট্ট কবিতা শোনাব?’
এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘শোনান। আমি বারণ করলে কি আপনি ক্ষান্ত হবেন!’
গলাখাঁকারি দিয়ে রঙ্গলাল বললেন, ‘স্যার, আপনার কথার মানে অনেকটা এইরকম। সহজে খুনি ধরতে আমায় কহ যে/খুনি কখনও দেয় না ধরা সহজে।’
‘সাধু! সাধু!’ শান্তিনিকেতনী ঢঙে স্বভাব-কবিকে বাহবা দিলেন অশোকচন্দ্র।
জানলা দিয়ে বিকেলের আলো দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ভাবছিলেন, এখনই যদি ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে তা হলে কেমন হয়। অথচ এখনও সন্ধে হতে অনেক দেরি।
রণতোষ দত্তর জীবনে অতর্কিতে সন্ধে নেমে এসেছে। সেই সন্ধের আঁধারে এসিজি পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন। অন্তরা দত্তের শেষ কথাটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলছিল।
রঙ্গলাল গোস্বামীকে সঙ্গী করে বিকেল-বিকেল দত্তবাড়িতে চলে এসেছেন এসিজি। পরিতোষ দত্ত এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। অন্তরার মেয়ে টুসি বোধহয় ভেতরে কোথাও রয়েছে। কলতলার দিক থেকে বাসন মাজার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
অন্তরা চা-বিস্কুট দিয়ে এসিজি ও রঙ্গলালকে আপ্যায়ন করলেন। তারপর সন্দিহান সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে ওঁদের সামনে বসলেন।
চা শেষ করা পর্যন্ত অশোকচন্দ্র মামুলি কথাবার্তা বলছিলেন। তারপর শেষ চুমুক শেষ হতেই অন্তরার কাছ থেকে সৌজন্যের অনুমতি নিয়ে একটা উইলস ফিলটার ধরালেন। রণতোষবাবুর কথা তুলে প্রথম প্রশ্ন করলেন অশোকচন্দ্র, ‘ওঁর সুইসাইডের ব্যাপারটা আপনি প্রথম জানতে পারেন?’
অন্তরা সহজ স্বরে সপ্রতিভ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। সকালবেলা চা দিতে গিয়েছিলাম। রোজ সকালে আমিই দাদাকে চা দিয়ে আসি। তো গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো। দু-একবার ডাকাডাকি করে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। আর তখনই সব দেখতে পেলাম—মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে যেন শিউরে উঠলেন অন্তরা। চাপা গলায় বললেন, ‘বীভৎস দৃশ্য!’
‘উনি মারা যাওয়াতে সবাই খুব শকড হয়েছেন। নীচের তলার জলধরবাবু, সুমিতা ওঁর কথা খুব বলছিলেন, খুব প্রশংসা করছিলেন।’
‘সে তো করবেই!’ বিরক্তভাবে উত্তর দিলেন অন্তরা, ‘ভাড়া না নিলে, বিনিপয়সায় পড়ালে লোকে প্রশংসা তো করবেই।’
এসিজি অবাক হলেন। সিগারেটে গভীর টান দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘রণতোষবাবু বিনি পয়সায় কাকে পড়াতেন, বকুলকে?’
‘না, বকুলের মাকে—।’
খবরটা শুনে অশোকচন্দ্র যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সুমিতাকে পড়াতেন রণতোষবাবু! কই, সুমিতা নিয়োগী তো এ-কথা তাঁকে বলেননি!
‘সুমিতাকে কী পড়াতেন?’
‘বাংলা। ওর নাকি বাংলা নিয়ে পড়াশোনার খুব আগ্রহ। সত্যি-মিথ্যে ও-ই জানে।’
বোঝা গেল, সুমিতার ছাত্রী হওয়াটা অন্তরা মোটেই পছন্দ করেননি। বিশেষ করে পুরোনো এক ছাত্রীর সঙ্গে আবেগতাড়িত সম্পর্কের বিড়ম্বনার পর।
‘সুমিতা কোথায় পড়তেন? একতলায় নিজেদের ঘরে, নাকি রণতোষবাবুর ঘরে?’
‘কখনও নীচে, কখনও চিলেকোঠার ঘরে—’ নিস্পৃহভাবে বললেন অন্তরা, ‘তবে দাদা খুব ভদ্র, সংযমী মানুষ ছিলেন।’
‘আপনারা ছাড়া ছাদের ঘরে আর কে-কে যাতায়াত করত? সুমিতা দেবী?’
‘হ্যাঁ—’ একটু থেমে অন্তরা আরও বললেন, ‘ওর মেয়েটাও যখন-তখন যেত। বকুলকে দাদা খুব ভালোবাসতেন। কথায়-কথায় নানান গিফট দিতেন। আসলে দাদার ভেতরে কোথায় যেন একটা অভাববোধ ছিল—।’
কিছুক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন এসিজি। তারপর অন্তরার চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মিসেস দত্ত, দাদার ঘরে কখনও এমন কিছু আপনার চোখে পড়েছে যা আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?’
ঠোঁটে দাঁত চেপে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন অন্তরা, তারপর বললেন, ‘না, সেরকম কিছু দেখিনি।’
‘আগের দিন আপনি বলছিলেন আপনার দাদা ইদানীং পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এইসব নিয়ে ভাবছিলেন। এসব উনি কেন ভাবছিলেন আন্দাজ করতে পারেন?’
‘জানি না। দাদা এমনিতে খুব নীতিবাগীশ মানুষ ছিলেন। পাপ করার লোক উনি ছিলেন না। তবু কেন ওসব ভাবছিলেন কে জানে!’
এসিজি প্রশ্ন করার মতো আর কিছু ভেবে পেলেন না।
রঙ্গলাল গোস্বামীকে ইশারা করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অন্তরাকে বললেন, ‘চলি—।’
অন্তরা দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। সামান্য উদ্বিগ্ন স্বরে জিগ্যেস করলেন, ‘ঠিক করে বলুন তো, মিস্টার গুপ্ত, ব্যাপারটা কী—সুইসাইড, না মার্ডার?’
অশোকচন্দ্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসলেন, বললেন, ‘খুন হোক আর আত্মহত্যা হোক, যে-মানুষ্টা চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না।’
অন্তরা বুঝতে পারলেন এসিজি ওঁর বলা কথা ওঁকেই ফেরত দিলেন। ওঁর মুখে সামান্য লালচে আভা ফুটে উঠল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত আর রঙ্গলাল গোস্বামী বাইরের চাতালে বেরিয়ে এলেন। হাতের সিগারেটের টুকরোটা এককোণে রাখা আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিলেন এসিজি।
রঙ্গলাল গোস্বামী বললেন, ‘প্রশ্ন উত্তরের পালা শেষ হল, স্যার / এবারে বলুন সুইসাইড না মার্ডার।’
এসিজি বললেন, ‘এখন শুধু আর-একজনের সঙ্গে কথা বলা বাকি—।’
‘কে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন রঙ্গলাল।
‘বকুল—’ হেসে বললেন এসিজি।
দোতলা থেকেই ওঁরা বকুলের গলা পাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, ও ছুটতে-ছুটতে জীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।
সিঁড়ির মুখে দুজনকে দেখেই ফুটফুটে মেয়েটা একগাল হেসে বলল, ‘তোমার জন্যে ওয়েট করছিলাম। এখন একটা ম্যাজিক দেখিয়ে তার সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’
এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘ছাদে চলো, তোমাকে আজ অনেকগুলো ম্যাজিক শিখিয়ে দেব। তবে একটা কন্ডিশান আছে—।’
‘কী কন্ডিশান?’ বকুল চোখ গোল-গোল করে প্রশ্ন করল।
‘ছাদে চলো, বলছি—।’
সরু সিঁড়ি বেয়ে ওরা তিনজন উঠে এলেন ছাদে।
একপাশে কয়েকটা ফুলগাছের টব। এলোমেলোভাবে টাঙানো নাইলনের দড়িতে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় ঝুলছে। বিকেলের রোদ মরে এসেছে, তবে একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। একটু দূরেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অকুস্থল।
এসিজি ছাদের সুরকি ওঠা ময়লা মেঝেতে বসে পড়লেন। বকুলকে কাছে ডেকে বললেন, ‘আমি তোমাকে অনেক ম্যাজিকের সিক্রেট শিখিয়ে দেব। তবে এক্সচেঞ্জে তোমাকেও কিছু সিক্রেট বলতে হবে।’
‘কী সিক্রেট, বলো—।’
‘রণতোষ জেঠুর সুইসাইডের ব্যাপারে।’
চোখের পলকে বাচ্চা মেয়েটার মুখ পালটে গেল।
বোঝা গেল, এসিজির আন্দাজে ছোড়া ঢিল ঠিক জায়গায় লেগেছে। রঙ্গলালের মনে হয়, বকুল বোধহয় সত্যিই কোনও সিক্রেট জানে।
বকুলকে পিঠ চাপড়ে সাহস দিলেন এসিজি, বললেন, ‘বলো, কোনও ভয় নেই। আমরা কাউকে বলব না—।’
একটুক্ষণ কী যেন ভাবল বকুল। তারপর যান্ত্রিক স্বরে বলল, ‘রনো আঙ্কলের ঘর থেকে আমি শুধু একটা বাক্স নিয়ে এসেছি—।’
‘কীসের বাক্স?’ ভেতরে-ভেতরে সামান্য উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন এসিজি। চেষ্টা করে তাঁকে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে হল।
‘মায়ের বাক্স—’ অম্লানবদনে এসিজির প্রশ্নের জবাব দিল বকুল।
‘মায়ের বাক্স তোমার আঙ্কলের ঘরে গেল কী করে?’ রঙ্গলালবাবু এবার সক্রিয় ভূমিকা নিলেন।
‘তা তো জানি না। বোধহয় মা নিজেই আঙ্কলকে দিয়েছে।’
‘তুমি ঘরের কোথায় বাক্সটা পেলে?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
‘ফ্লোরে পড়ে ছিল—।’
‘বাক্সটা তুমি কবে নিয়ে এসেছে?’
‘যেদিন সকালে রনো আঙ্কল সুইসাইড করেছিল, সেদিন।’
‘রনো আঙ্কল তখন কী করছিল?’
‘ওপরদিকে…অল্প-অল্প দোল খাচ্ছিল…।’
‘মাই গড!’ শিউরে উঠে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন এসিজি।
রঙ্গলালবাবুও বেশ ঘাবড়ে গিয়ে অবাক চোখে বাচ্চা মেয়েটাকে দেখতে লাগলেন।
বকুলকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানা গেল তার সারমর্ম এই, সুযোগ পেলেই ও রনো আঙ্কলের ছাদের ঘরে চলে যেত। ঘটনার দিন সকালে ও একটা নতুন ওয়াটার বটল আঙ্কলকে দেখাতে গিয়েছিল। গিয়ে দ্যাখে, রণতোষবাবু সিলিং পাখা থেকে বিশ্রীভাবে ঝুলছেন। ও ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে চলে আসে মায়ের কাছে। মাকে ফিসফিস করে সব বলতেই মা ভয়ে কেঁদে ফ্যালে। তারপর ওকে চুপিচুপি একটা কাজ করতে বলে। কাজটা হল, রণতোষ দত্তর ঘর থেকে খুঁজে একটা কাঠের বাক্স নিয়ে আসা। বাক্সটা মায়ের। সবুজ রঙের ওপরে সাদা আলপনা দেওয়া। অনেকটা বাঁধানো বইয়ের মতো দেখতে। বাক্সের ভেতরে কী আছে বকুল জানে না। ও চুপিচুপি আবার চিলেকোঠার ঘরে ফিরে যায়। এদিক-ওদিক একটু নজর দিতেই দেখতে পায় মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে থাকা একটা চেয়ারের পাশে বাক্সটা পড়ে আছে। সেটা বগলদাবা করে ও একছুটে পালিয়ে আসে ওর মায়ের কাছে। মাকে বাক্সটা দিতেই মা সেটা আঁকড়ে ধরে ভীষণ কাঁদতে থাকে। খানিক পরে মা চুপিচুপি ওপরে চলে যায়। একটু পরেই আবার ফিরে আসে। এসে বকুলকে বলে গোটা ব্যাপারটা সিক্রেট রাখতে।
কথার শেষ দিকটায় বকুল বারবার দম নিচ্ছিল, সামান্য হাঁফাচ্ছিল যেন। বক্তব্য শেষ করে এবার ও ওর প্রথম আবদারে ফিরে গেল ‘এবার একটা ম্যাজিক দেখিয়ে তার সিক্রেটটা শিখিয়ে দাও—।’
এসিজি পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট রুবিক কিউব বের করলেন। কিউবটার এক-একটা পিঠে নানারঙের রঙিন খোপ। অভ্যস্ত হাতে কিউবটাকে বারকয়েক মোচড় দিলেন তিনি। একটু পরেই দেখা গেল কিউবটার ছ’পিঠে তৈরি হয়ে গেছে সুন্দর রঙিন নকশা। সেটা বকুলকে দেখিয়ে এসিজি বললেন, ‘এটার নাম হল রুবিক কিউব। প্রমিস করছি, কাল তোমার জন্য এরকম একটা কিউব এনে দেব। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে। মায়ের বাক্সটা তোমাকে এক্ষুনি লুকিয়ে নিয়ে আসতে হবে। ওটা দেখেই আমি তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে দেব। ঠিক পারবে তো?’
বেণী দুলিয়ে ঘাড় হেলাল বকুল ‘হ্যাঁ, পারব—’
কথা শেষ হতে-না-হতেই ছাদের সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল বকুল।
ছুটে চলে যাওয়া মেয়েটিকে দেখতে-দেখতে অশোকচন্দ্র আনমনাভাবে মন্তব্য করলেন, ‘দেখা যাক বাক্স-রহস্য থেকে রণতোষবাবুর মৃত্যু-রহস্য ভেদ করা যায় কি না।’
বিকেলের আলো মলিন হয়ে এসেছে। আকাশে দু-একটা পায়রা। রাস্তা দিয়ে ছুটে-চলা গাড়ির শব্দ হালকাভাবে কানে আসছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রণতোষ দত্তর ঘরটা এখন যেন অনেকে বেশি অর্থময়। রুবিক কিউবটা পকেটে রেখে চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমা খুলে নিলেন এসিজি। পাঞ্জাবির কোণ দিয়ে কাচ দুটো মুছলেন। তারপর চশমাটা ঠিকঠাক করে নাকের ওপরে বসালেন। এখন কি সবকিছু আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে?’
ঠিক সেই মুহূর্তে হাঁপাতে-হাঁপাতে ছাদে ফিরে এল বকুল। হাতে বইয়ের মাপের একটা সবুজ কাঠের বাক্স।
বাক্সটা বৃদ্ধ হুনুরের হাতে দিয়েই মেয়েটা হাত বাড়াল তাঁর দিকে ‘তোমার রুবিক কিউবটা আমাকে একটু দাও, আমি একটু খেলি—।’
এসিজি হেসে কিউবটা পকেট থেকে বের করে বকুলের হাতে দিলেন, বললেন, ‘এই নাও। বাক্সটা আনার সময় তোমার মা দেখতে পায়নি তো?’
বকুল মাথা ঝাঁকাল : ‘না।’
এসিজি বললেন, ‘তুমি এবার নীচে চলে যাও। সন্ধে হয়ে আসছে—তোমার মা চিন্তা করবে। আমি যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাব।’
রুবিক কিউবটা হাতে নিয়ে বকুল লাফাতে-লাফাতে চলে গেল।
অশোকচন্দ্র রঙ্গলালবাবুকে বললেন, ‘আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন, রঙ্গলালবাবু। নীচে গিয়ে আপনি সুমিতা নিয়োগীকে ডেকে নিয়ে আসুন। জলধরবাবু বা ওঁর স্ত্রীর যেন জানতে না পারেন। বলবেন, খুব জরুরি ব্যাপার—আমি ওঁর সঙ্গে নিরিবিলি একটু কথা বলতে চাই।’
রঙ্গলালবাবু বিহ্বল চোখে অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বৃদ্ধের কথা শেষ হতেই ঠোঁট উলটে বললেন, ‘মিস্টিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার বুঝিতে না পারি/খুনি যেন চেনা কিন্তু চিনিতে না পারি।’ স্বভাব-কবিতা বলে রঙ্গলাল সুমিতাকে ডেকে নিয়ে আসতে চলে গেলেন।
সুমিতাকে নিয়ে রঙ্গলাল যখন ফিরে এলেন তখন সন্ধের ছায়া মন্থরভাবে নেমে এসেছে।
এসিজি বাক্সটা সুমিতাকে দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এটা আপনার?’
অস্পষ্ট আলোতেও সুমিতা বাক্সটা চিনতে পারল, বলল, ‘হ্যাঁ—কিন্তু এটা আপনি কী করে পেলেন?’
‘বকুল নিয়ে এসেছে। ও আমাদের সব বলেছে—।’
সুমিতা আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আকাশের কালচে নীল স্লেটে তখন সন্ধ্যাতারাই একমাত্র আলো।
সুমিতার কান্না-একটু স্তিমিত হয়ে এলে অশোকচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, ‘বাক্সের ভেতরে কী আছে, মিসেস নিয়োগী?’
সুমিতা কান্না-প্লাবিত চোখে এসিজির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ছোটবেলার সব জিনিস। মা জমিয়ে রেখেছিল—বিয়ের সময় বাক্সটা আমাকে দিয়েছিল। ওতে আমার ছোটবেলার ফটো আছে, চুলের কাঁটা-ফিতে আছে, খেলার পুতুল আছে, হাতের লেখা আছে—দামি কিছুই নেই।’
‘বাক্সটা রণতোষবাবুকে আপনি দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। উনি আমার ছোটবেলার ফটো, হাতের লেখা—এসব দেখতে চেয়েছিলেন।’
‘কেন?’
এই প্রশ্নে আবার অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলল সুমিতা। অনেক কষ্টে অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সবই আমাদের পোড়া কপাল। আমরা এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সবসময় একটা চোরা টান টের পেতাম—।’
‘সেইজন্যেই কি রণতোষবাবু ইদানীং অপরাধবোধে ভুগছিলেন?’
সুমিতা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। তা ছাড়া, আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল।’
‘কী ব্যাপার?’
‘রনোদা…রনোদা…আমাকে পড়াতেন।’ ইতস্তত করে বলল সুমিতা।
‘জানি—’ আলতো করে বললেন এসিজি।
‘একদিন বাংলা উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে-করতে উনি রবীন্দ্রনাথের ”শেষের কবিতা” প্রসঙ্গে চলে এসেছিলেন। তারপর হঠাৎই কেমন বেসামাল হয়ে গিয়ে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ”সুমিতা, কিছুদিন ধরে কেবলই মনে হচ্ছে তুমি আমার বন্যা, তুমিই আমার মিতা—” এ-কথা বলেই রনোদা আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন…’ সুমিতা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল।
অশোকচন্দ্র ওকে কান্নার সময় দিয়ে অপেক্ষা করে রইলেন।
সুমিতা একটু পরে কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি রনোদাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভালোওবাসতাম। তাই ধৈর্য হারানোটা আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু তারপরই দেখলাম আক্ষেপে গ্লানিতে ”ছি-ছি” করে উনি একেবারে ভেঙে পড়লেন। বারবার বলতে লাগলেন, ”এ কী অন্যায় আমি করে বসলাম!” আমি যতই ওঁকে বোঝালাম যে এটা অন্যায় নয়, এমনকী কোনও দুর্ঘটনাও নয়। বরং যা স্বাভাবিক তাই-ই হয়েছে। কিন্তু রনোদা মানতে পারেননি। অপরাধবোধে একেবারে ডুবে গিয়েছিলেন। আমি অনেক করে বুঝিয়েও ওঁকে শান্ত করতে পারিনি। পাপ, শাস্তি, মৃত্যু—এসব নিয়ে লিখে-লিখে পাতার পর পাতা ভরতি করে ফেললেন। তারপর…।’
এসিজির মনে পড়ল, ‘পাপ ও মৃত্যু’ শিরোনামে এই লেখাগুলোই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন।
‘তারপর…’ আবার বলতে লাগল সুমিতা, ‘তারপর সেই ডিপ্রেশন থেকেই সুইসাইড করলেন।’
‘সুইসাইড কেমন করে বুঝলেন?’
আবছা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সুমিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘রনোদার সুইসাইড নোটটা আমার কাছে আছে। বকুল ওই বাক্সটা নিয়ে আসার পর আমি চুপিচুপি রনোদার ঘরে আসি। দেখি সুইসাইড নোটটা রনোদার লেখার টেবিলে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। তাতে লেখা, ”তোমাকে কখন ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আর বুঝতে পারিনি বলেই বশ হারিয়ে ওই পাপে তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছি। তারপর থেকে বারবার লজ্জায় আমি মরে গেছি। এবার সত্যি-সত্যি মরলাম।”
সুমিতা এবার হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল—সর্বস্বান্ত দিশেহারা মানুষ যেভাবে কাঁদে।
এসিজি কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিলেন।
অনেকক্ষণ পর সুমিতার কান্না থামল।
ও বলল, ”ওই সুইসাইড নোট পুলিশের হাতে গেলে রনোদাকে জড়িয়ে বাজে একটা স্ক্যান্ডাল হত। সেটা আমার পক্ষে সহ্য করা খুব কঠিন হত। আমি আমার চিন্তা করিনি—শুধু রনোদার কথাই ভেবেছিলাম…বিশ্বাস করুন…।’
‘সেইজন্যেই আসল সুইসাইড নোট সরিয়ে রণতোষবাবুর লেখা থেকে একটা পাতার খানিকটা ছিঁড়ে সুইসাইড নোট হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন?’
সুমিতার শরীর ফুলে-ফুলে উঠছিল। বড় করে শ্বাস টেনে ও বলল, ‘হ্যাঁ—রনোদার ওই ”পাপ ও মৃত্যু” নামে লেখার পাতা থেকে—আপনি হয়তো দেখেছেন…।’
অন্ধকারেই ঘাড় হেলালেন এসিজি।
ভারি গলায় সুমিতা বলল, ‘আমাকে যা-খুশি সাজা দিন, কিন্তু দেখবেন, দেবতার মতো ওই মানুষটার কোথাও যেন কালি না লাগে। উনি যে-ভুল করেছিলেন সেটা কোনও ভুলই নয়। কিন্তু ওঁর নীতিবাগিশ মন ভেতরে-ভেতরে ওঁর গলা টিপে ধরেছিল, ওঁকে কুরেকুরে খাচ্ছিল…।’
পাশের কোনও বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ শোনা গেল কয়েকবার।
এসিজি নরম গলায় বললেন, ‘এবারে নীচে চলুন। ব্যাপারটা যাতে ঠিকমতো মিটে যায় সেজন্যে ইন্সপেক্টর যাদবকে আমি রিকোয়েস্ট করব। আপনি সুইসাইড নোটটা আমাকে দিন।’
‘নীচে চলুন, দিচ্ছি—।’
তিনজন ছায়া-ছায়া মানুষ অকুস্থলের পাশ দিয়ে হেঁটে এল সিঁড়ির কাছে। অবসন্নভাবে সিঁড়ি নামতে লাগল।
একতলার কাছাকাছি এসে সুমিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘অনেকবার ভেবেছি সুইসাইড নোটটা পুড়িয়ে ফেলব, কিন্তু পারিনি…ওঁর শেষ লেখা…।’ সুমিতা আবার কেঁদে ফেলল।
রঙ্গলালবাবু বললেন, মিসেস নিয়োগী, প্লিজ… জলধরবাবুরা শুনতে পাবেন।’
এসিজি বললেন, ‘আমরা আর ভেতরে ঢুকব না। আপনি শুধু বকুলকে একবার ডেকে দেবেন। আর…এই নিন আপনার বাক্স…।’
সুমিতা চোখ মুছতে-মুছতে বাক্সটা নিল। তারপর ওঁদের অলিপথে দাঁড় করিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
একটু পরেই সুমিতা ফিরে এল, একটা ভাঁজ করা কাগজ তুলে দিল এসিজির হাতে। এসিজি সেটা না দেখেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল বকুল।
ওকে দেখে এসিজি বললেন, ‘মা-মণি, আমরা এবার গুডবাই—।’
‘আবার যেন দেখা পাই—’ সপ্রতিভভাবে বলল বকুল।
এসিজি অবাক চোখে রঙ্গলালবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘স্বভাব-কবিতা কি সংক্রামক ব্যাধি?’
রঙ্গলাল হাসলেন, কিছু বললেন না।
বকুল অশোকচন্দ্রের রুবিক কিউবটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘আমারটা কাল মনে করে আনবে কিন্তু—।’
এসিজি কিউবটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, ‘অবশ্যই—’ তারপর সুমিতাকে বললেন, ‘মিসেস নিয়োগী, আপনি কোনওরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আর আমরা কাল সন্ধেবেলা আসছি। তখন শুধু চায়ে চলবে না, চায়ের সঙ্গে টা-ও চাই।’
সুমিতা ভেজা চোখ মুছে হাসতে চেষ্টা করল, বলল, ‘আসবেন কিন্তু—।’
রঙ্গলালবাবুকে সঙ্গে নিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।
সন্ধ্যের কলকাতা গালে-ঠোঁটে রং লাগিয়ে যথারীতি চঞ্চল হয়ে পড়েছে। এসিজি নতুন একটা সিগারেট ধরাতেই রঙ্গলালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘সবই তো বুঝলাম, স্যার, কিন্তু ওই এক ইঞ্চির গরমিলের ব্যাপারটা কী হল?’
এসিজি সিগারেটে জম্পেশ টান দিয়ে কুলকুল করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘বুঝতে পারেননি! ব্যাপারটা তো খুব সোজা। চেয়ার পেতে তার ওপরে ওই কাঠের বাক্সটা রেখে তবেই সিলিং ফ্যানের ঠিকমতো নাগাল পেয়েছিলেন রণতোষবাবু। তারপর ওঁর পায়ের ছটফটানিতে চেয়ার, বাক্স দুটোই উলটে গিয়েছিল—।’
রঙ্গলালবাবু প্রশংসার উজ্জ্বল চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। তারপর সুর করে বললেন, ‘দেখে আপনার তীক্ষ্ন বুদ্ধি/হলেম আমি নিহতবুদ্ধি—।’
এসিজি চমকে রঙ্গলালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘নিহতবুদ্ধি মানে?’
রঙ্গলালবাবু বিনীত হেসে বললেন, ‘এই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান, স্যার। নিহতবুদ্ধি মানে হল সাঙ্ঘাতিক হতবুদ্ধি অবস্থা—।’
এসিজি আর হাসি চাপতে পারলেন না।
চুনিলালবাবুর লাল চুনি (গল্প)
গুপ্তাসাব, ব্যাপারটা ঠিক খুন নয় তবে অনেকটা খুনের মতো।’
গাড়ির জানলার বাইরে চোখ রেখে বিকেলের কলকাতা দেখতে-দেখতে কথাটা বলল ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
ক্যাডবেরি রঙের মারুতি আটশো শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় ছুঁয়ে এগোচ্ছিল বাগবাজারের দিকে। গাড়ির পিছনের সিটে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল রঘুপতি। ওর পাশেই বসে অধ্যাপক ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত, সংক্ষেপে এসিজি। তাঁর সরু-সরু আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত ডানহিল সিগারেট।
এমনিতে এসিজির প্রিয় উইলস ফিলটার। কিন্তু রঘুপতি কোথা থেকে যেন এক কার্টন ডানহিল জোগাড় করে এসিজিকে উপহার দিয়েছে একটু আগেই। আর সেই সঙ্গে উপহার দিয়েছে একটা সমস্যা যেটা ঠিক খুন নয়, খুনের মতো।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে প্রাক্তন ছাত্র রঘুপতিকে দেখছিলেন এসিজি।
ছোট করে ছাঁটা চুল, কাঁচা-পাকা চওড়া গোঁফ, তামাটে মুখে সামান্য বসন্তের দাগ। হাতের শিরা এবং পেশি দুশমনদের সাবধান করে দেওয়ার মতো। আর চোয়ালের উদ্ধত রেখা সেখানে জুড়ে দিয়েছে একটা বেপরোয়া ভাব। এ ছাড়াও একটা ‘কিলার ইন্সটিংক্ট’ যেন আবছাভাবে খুঁজে পাচ্ছিলেন এসিজি।
ছাত্রজীবনের রঘুপতির সঙ্গে আজকের কাজ-পাগল ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদবের কতটা অমিল, সেটাই ভাবছিলেন ওর প্রাক্তন ‘স্যার’ অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
‘এ ছাড়া, স্যার, ব্যাপারটার মধ্যে পাখিও আছে—’ এসিজির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল রঘুপতি, ‘আপকা ফেবারিট—পঞ্ছি। অওর উসকে সাথ এক রুবিকি কাহানি।’
মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মেরে চোখে জিজ্ঞাসা ফুটিয়ে তুলে অশোকচন্দ্র বললেন : ‘রুবির কাহিনি? তার মানে!’
‘রুবি—যাকে বাংলায় আপনারা চুনি বলেন। জেমস্টোন। খুব কস্টলি।’
ধোঁয়া ছেড়ে হাসলেন এসিজি। বললেন, ‘তোমার টেনশন কমাও রঘুপতি। তখন থেকে যেরকম খাপছাড়াভাবে ইনফরমেশানের টুকরো ছড়িয়ে চলেছ, তাতে আমার মতো থিঙ্কিং মেশিনেরও মস্তক ঘূর্ণিত। তোমাকে তো বহুবার বলেছি, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। নাউ কাম অন, বেশ রয়েসয়ে গুছিয়ে গল্পটা বলো আমাকে।’
একটু আহত হয়ে রঘুপতি বলল, ‘বলছি, গুপ্তাসাব, কিন্তু ”ঘূর্ণিত” মানে কী?’
হো-হো করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধ হুনুর। ছোট-হয়ে আসা সিগারেটের টুকরোটা গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘সে তোমাকে পরে বলে দেব। এখন শুরু করো তোমার ”রুবিকি কাহানি”—।’
ওঁদের গাড়ি তখন বাগবাজারের বাটার দোকানের কাছে বাঁদিকে বাঁক নিচ্ছে।
রঘুপতি যাদব একটু গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করল। ওর ভুরু কুঁচকে গেল, চোখ সামান্য ছোট হয়ে এল।
ওর পাশে বসা খদ্দরের ঢোলা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা বৃদ্ধ মানুষটি তখন আনমনাভাবে মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারছেন, আর বাগবাজার বাটার মোড়ে পুজোর কেনাকাটার ভিড় দেখছেন। কিন্তু তাঁর কান ও মস্তিষ্কের মনোযোগ পুরোপুরি রঘুপতির দিকে। রঘুপতির কাছ থেকে সংক্ষেপে যা জানা গেল, তা হল এই :
বাড়িটার নাম ‘লালমহল’। বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটের কাছাকাছি দু-মহলা পুরনো বাড়ি। বাড়ির দালানে বিশাল-বিশাল ডোরাকাটা থাম। থামের মাথায় কার্নিশের খাঁজে গোলা পায়রার বাস। বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে এখনও ছোট মাপের দুর্গাপুজো হয়।
বাড়িটার রং লাল। অন্তত এককালে তাই ছিল। কালের প্রকোপে সেই লাল কোথাও গোলাপী, কোথাও বা বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। বাড়ির সদর দরজায় রং-চটা শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা ‘রায়বাহাদুর রবীন্দ্রলাল গোস্বামী’।
রবীন্দ্রলাল অন্তত চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগে ইহলোক ছেড়েছেন। তবে তাঁর চার ছেলে এখনও বহাল তবিয়তে ‘লালমহল’-এ বাস করেন।
বড় ছেলে শ্যামসুন্দরলাল গতকাল মারা গেছেন। তিনি সবসময় পাখি নিয়ে মেতে থাকেন—মানে, থাকতেন। বাড়ির অনেকটা অংশ তাঁর খাঁচায়-খাঁচায় ছয়লাপ।
মেজো ছেলে চুনিলাল মণিরত্নের ব্যবসা করেন। দেব-দেবীভক্ত ধর্মভীরু, মানুষ। অন্য ভাইদের মতো সংসার-ধর্ম করেননি।
সেজো রঙ্গলাল হিসেব মতো বেকার। তবে শোনা গেছে তিনি নাকি টুকটাক সাপ্লাইয়ের কাজ করেন।
আর সকলের ছোট গজেন্দ্রলাল এখনও ঠিক কোনও ব্যবসায় থিতু হয়ে বসতে পারেননি।
ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল, দুপুর দুটো নাগাদ।
শ্যামসুন্দরলালের কাছে একটা ফোন এসেছিল। কে ফোন করেছিল সেটা জানা যায়নি। টেলিফোনে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে-বলতেই তিনি আচমকা হার্টফেল করে মারা যান।
তাঁর চিৎকারে বাড়ির অনেকে ছুটে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ব্যাপারটায় এমনিতে কোনও জটিলতা ছিল না। অত্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু। তা ছাড়া শ্যামসুন্দরলালের বয়েসও হয়েছিল প্রায় বাষট্টি।
কিন্তু গোলমাল বাঁধালেন চুনিলালবাবু। তিনি বললেন যে, প্রায় দু-লাখ টাকা দামের একটা টকটকে লাল চুনি তিনি তাঁর বড়দার কাছে রাখতে দিয়েছিলেন।
সেটার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সেইজন্যই গুপ্তাসাবকে জরুরি তলব করেছে রঘুপতি। খুঁজে বের করতে হবে চুনিলালবাবুর চুনি।
রঘুপতির কথা শেষ হতে-না-হতেই এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘শ্যামসুন্দরলালের মারা যাওয়ার ব্যাপারটাকে তুমি ”খুনের মতো” বলছ কেন?’
‘বলছি কী আর সাধে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঘুপতি। তারপর বলল, ‘ওই হতচ্ছাড়া জেবরাতের জন্যে ক’দিন ধরেই কোন এক আদমি শ্যামসুন্দরবাবুকে থ্রেট করছিল। তাতে উনি ভয়ও পেয়েছিলেন, আবার খুব এক্সাইটেডও হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, উনি এভাবে মারা না গেলে হয়তো ওই আননোন পারসনের হাতে খুন হয়ে যেতেন…।’
এসিজি এক ফাঁকে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছিলেন আবার। চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘সেই লোকটা কেমন করে জানল যে, চুনিটা শ্যামসুন্দরলালবাবুর কাছে আছে?’
ঠোঁট উলটে রঘুপতি বলল, ‘কে জানে! হয়তো কারও কাছ থেকে ইনফরমেশান পেয়েছে।’
‘যখন শ্যামসুন্দর মারা যান তখন চুনিলাল কোথায় ছিলেন?’
‘বাড়িতেই।’ কথাটা বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রঘুপতি কী যেন দেখল। তারপর বলল, ‘স্যার, আমরা লালমহলে এসে গেছি।’
বাড়ির সামনে ভাঙাচোরা ট্রাম-রাস্তা। কোথাও কোথাও জল জমে আছে। বাড়ির উলটোদিকে দুটো বিশাল মাপের গোডাউন। তার পিছনেই বোধহয় গঙ্গা।
ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলে রঘুপতি এসিজিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, ‘আইয়ে, স্যার—ওয়েলকাম টু লালমহল।’
এসিজি প্রাক্তন ছাত্রের ভঙ্গি দেখে সামান্য হাসলেন। তারপর মাথার সাদা চুলে হাত চালিয়ে বললেন, ‘চলো, দেখা যাক তোমার চুনিলালবাবুর চুনি উদ্ধার করা যায় কিনা।’
কলিংবেল টিপতেই বাড়ির দরজায় একজন বয়স্ক পুরুষ এসে হাজির হলেন। দেখে বনেদি বাড়ির ‘পুরাতন ভৃত্য’ বলেই মনে হল। রঘুপতি নিজের পরিচয় দিতেই দ্রুত আদর-আপ্যায়ন শুরু হয়ে গেল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে রঘুপতি যাদব নিচু গলায় বলল, ‘ব্যাপারটা লালবাজার পর্যন্ত গড়াত না। তবে চুনিলালবাবুর থোড়াবহত আপার লেভেল কানেকশান্স আছে। সেইজন্যেই…।’
কথা বলতে-বলতে ওঁরা চৌকো মাপের বিশাল ঠাকুর-দালানে এসে পড়েছিলেন। তার একপাশে চণ্ডীমণ্ডপ। সেখানে প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে। এখন শুধু শেষ তুলির টান আর সাজসজ্জা বাকি।
হঠাৎই ওঁদের সামনে এসে দাঁড়ালেন শ্যামলা রঙের একজন ভদ্রলোক। তাঁর ডান হাতের তিন আঙুলে রুপো দিয়ে বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। প্রকট হেসে তিনি বললেন, ‘আগমনের খবর পেয়েছি/তাই রিসিভ করতে এসেছি। অধমের নাম রঙ্গলাল/চুনিটা বেপাত্তা হয়েছে গতকাল।’
এসিজি অবাক হয়ে লালমহলের রঙ্গলালবাবুকে দেখছিলেন।
পরনে ফতুয়া গোছের পাঞ্জাবি আর ধুতি। মাথার মাঝখানে সিঁথি। তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুল। ছোট-ছোট চোখ। কপালের বাঁদিকে একটা ছোট আঁচিল। নাকটা সামান্য বড় মাপের। দাড়ি-গোঁফ কামানো। মুখে প্রসাধনের সুবাস। আর সদাসঙ্গী আকর্ণবিস্তৃত হাসি।
‘শ্যামসুন্দরলালবাবু কোন ঘরে মারা গিয়েছিলেন?’ রঘুপতি জানতে চাইল।
রঙ্গলাল অতিরিক্ত বিনয় প্রকাশ করে বললেন, ‘দোতলার পাখিঘরে/ওই ঘরটার ঠিক ওপরে…’ আঙুল তুলে দূরের কোণে একটা ঘর দেখালেন তিনি।
এসিজি যে-কথাটা মনে-মনে ভাবছিলেন, সেটাই মুখে প্রকাশ করলেন, ‘আপনি কি সবসময় ছড়া কেটে কথা বলেন?’
রঙ্গলালবাবু মাথা সামান্য নিচু করে বললেন, ‘আমি একজন স্বভাব-কবি/ কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’
রঘুপতি যে এই উত্তর শুনে ঠোঁট টিপে হাসল সেটা বৃদ্ধ গোয়েন্দার চোখ এড়াল না।
দুর্গাপুজো এবার দেরিতে। তাই রোদ্দুর পড়ে আসছে তাড়াতাড়ি। উঠোন থেকেও রোদ সরে যাচ্ছে পুবের দিকে।
মাথার ওপরে কয়েকটা পায়রা ঝটপট করছিল। শান-বাঁধানো উঠোনে নানা জায়গায় ওদের অপকীর্তির ছাপ।
ওঁরা তিনজনে উঠোন পেরিয়ে এগোলেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। তখনই কোথা থেকে ছুটে এল বছর ন’-দশের একটা ছোট মেয়ে। হাঁফাতে-হাঁফাতে রঙ্গলালবাবুকে লক্ষ করে বলল, ‘জেঠু, মেজো-জেঠু বলেছে ওঁদের পাখিঘরে নিয়ে বসাতে।’
কথাটা বলেই মেয়েটা ছুট্টে চলে গেল।
রঙ্গলালবাবু বললেন, ‘গজেন্দ্রর ছোট মেয়ে। সবসময়—’
‘—চলে ধেয়ে।’ পাদপূরণ করে হেসে উঠলেন এসিজি।
পুরোনো আমলের শান-বাঁধানো চওড়া সিঁড়ি। পালিশ করা মেহগনি কাঠের রেলিং। সিড়ির ল্যান্ডিং-এর দেওয়ালে এক অভিজাত পুরুষের তৈলচিত্র। গিল্ট ফ্রেমে বাঁধানো। কে জানে, ইনিই হয়তো স্বর্গীয় রবীন্দ্রলাল গোস্বামী।
এসিজি আর রঘুপতি রঙ্গলালকে অনুসরণ করে উঠছিলেন। রঘুপতি চাপা গলায় ওর প্রাক্তন স্যারকে বলল, ‘অজীব ব্যাপার, গুপ্তাসাব। যাঁর নাম চুনিলাল তিনি চুনি, মানে হিরে-জহরতের বেওসা করেন। যাঁর নাম রঙ্গলাল তিনি সবসময় মজাক করে কথা বলেন। তবে যিনি মারা গেছেন…।’
রঘুপতির কথায় বাধা দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত বললেন, ‘শ্যামসুন্দরলাল গোস্বামীর নামটা প্রথম থেকেই আমার পিকিউলিয়ার লাগছিল। এরকম নাম কখনও শুনিনি। তবে ”শ্যামসুন্দর” নামে একরকম মুনিয়া পাখি পশ্চিমবাংলার স্থায়ী বাসিন্দা। বেহালার অক্সফোর্ড মিশনের বাগানে এরা বাসা বাঁধে। মাপে চড়ুই পাখির মতো। মাথা কালো, বুক সাদা, বাকিটা গাঢ় বাদামি রঙের। ইংরেজি নাম ”ব্ল্যাক হেডেড মুনিয়া”, আর ল্যাটিন নাম ”লোনচুয়া মলাক্কা”। সুতরাং শ্যামসুন্দরলালবাবুর শখটাও তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে।’
‘তা হলে বাকি রইলেন গজেন্দ্রলালবাবু। তিনি কি হাতির ব্যবসা করেন, নাকি হাতির খোঁজখবর রাখা তাঁর শখ?’
সামান্য মজা করে বলা রঘুপতি যাদবের শেষ কথাটা বোধহয় রঙ্গলালবাবুর কানে গিয়ে থাকবে। কারণ, হঠাৎই তিন-চার ধাপ ওপর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘হস্তী নয়—হস্তীদন্ত/গজেন্দ্রর পয়মন্ত।’
এসিজি আর রঘুপতি চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। গজেন্দ্রলাল তা হলে হাতির দাঁতের ব্যবসা করেন!
গতকালই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে এ-বাড়িতে। অথচ রঙ্গলালকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না তেমন কোনও আঘাত পেয়েছেন। তবে বাড়িটাকে কেমন যেন বেশিরকম চুপচাপ মনে হল। শুধু পায়রার বকবকম ওঁদের কানে আসছিল।
এসিজির সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল খানিক আগেই। দোতলার পাখিঘরে পৌঁছেই তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরালেন। ঘরটাকে একপলক দেখার পর তিনি যে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, সেটা রঘুপতি যাদব স্পষ্ট বুঝতে পারল।
কারণ, পাখিঘরে সাজানো রয়েছে অসংখ্য পাখির স্টাফ করা মডেল। নানান মাপের রংবেরঙের পাখি। কিন্তু ওরা সকলেই স্থির, চুপচাপ।
পাখিঘরটাকে ঘর না বলে হলঘর বলাই ভালো। ঘরের মাপ অন্তত বিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট। ঘরের মেঝেতে সাদা-কালো মার্বেল পাথরের নকশা। সেই নকশায় সময়ের কোনও ছাপ পড়েনি। এখনও দিব্যি ঝকঝকে তকতকে।
চুনিলালবাবু একটা আরাম-কেদারায় চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চোখ লাল।
ওঁদের ঢুকতে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সংক্ষেপে পরিচয়ের পালা শেষ করে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, ইন্সপেক্টর যাদব। সরাসরি কাজের কথায় আসি। অশৌচ অবস্থায় কী বিশ্রী ঝঞ্ঝাটে পড়লাম বলুন তো!’ একটু থেমে কয়েকটা চেয়ার দেখিয়ে তিনি অশোকচন্দ্র গুপ্ত আর রঘুপতি যাদবকে বসতে বললেন, ‘বসুন, আপনারা বসুন। আপনারা আসছেন শুনে ছোটভাইকে বাইরের কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমি আপনাদের জন্যে ওয়েট করছি।’
এমন সময় ছোট্ট মেয়েটা এক দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকল। রঙ্গলালবাবুর কাছে গিয়ে বলল, ‘বসন্তদা চা নিয়ে আসছে। মা পাঠিয়ে দিয়েছে—।’
কথাটা শেষ করেই মেয়েটা বেণী দুলিয়ে আবার দে ছুট।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই চা-মিষ্টি ইত্যাদি ট্রেতে সাজিয়ে ঘরে এসে ঢুকল মাঝবয়েসি একজন লোক। শ্বেতপাথরের তৈরি একটা গোল টেবিলে কাপ-প্লেটগুলো নামিয়ে রাখতেই রঙ্গলালবাবু সেগুলো সবিনয়ে এগিয়ে দিলেন রঘুপতি ও অশোকচন্দ্রের দিকে।
চুনিলালবাবুর পরনে হাফহাতা সাদা শার্ট আর পাজামা। গলায় সরু সোনার চেন। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। জুলপির কাছটায় চুলে দিব্যি পাক ধরেছে। ভুরু, লোমশ। দুই ভুরুর মাঝখানে চিরস্থায়ী বিরক্তির ভাব।
এসিজি ঘরটায় চোখ বুলিয়ে দেখছিলেন।
ঘরের আসবাবপত্র যা কিছু সবই ব্রিটিশ আমলের। একপাশে বড় মাপের চেয়ার-টেবিল। চেয়ারে ফুলকাটা তাকিয়া বসানো। আর টেবিলে গাদা-গুচ্ছের বই আর কাগজপত্র। সেইসঙ্গে রয়েছে পেন-পেনসিল, আতসকাচ, পেতলের পেপারওয়েট আর কয়েকটা পাখির পালক। টেবিলের বাঁ দিকে রাখা কর্ডলেস টেলিফোন।
দেখে বোঝাই যায়, এটা ছিল শ্যামসুন্দরলালের পড়াশোনার ঘর।
ঘরটার তিনদিকের দেওয়ালে বড়-বড় মাপের দেওয়াল আলমারি। তাতে ঠাসা রাজ্যের বই। এসিজির নজরে পড়ল সেখানে সালিম আলি ও ডিলন রিপলির কয়েকখণ্ডে লেখা ভারত ও পাকিস্তানের যাবতীয় পাখির হাত-বই পরপর সাজানো রয়েছে।
ঘরের সিলিং-এ ঝুলছে দুটো চার ব্লেডের পাখা। দেখে বোঝা যায়, ব্লেডগুলো কাঠের তৈরি। আর ঘরের দু-দিকের দেওয়ালে ডিজাইন করা শৌখিন পিতলের ব্র্যাকেটে ঝুলছে আধুনিক বৈদ্যুতিক বাতি। অন্ধকার ঘন হয়ে আসায় চুনিলালবাবু সুইচ টিপে বাতিগুলো জ্বেলে দিলেন। তারপর রঘুপতির কাছে এসে বললেন, ‘আমার দাদা দেবতুল্য মানুষ ছিলেন। ওঁর হার্টের প্রবলেম ছিল ঠিকই, কিন্তু হয়তো আরও কয়েক বছর বাঁচতেন। আমার জন্যেই অকালে বড়দার প্রাণটা গেল। বউদির দিকে আমি আর তাকাতে পারছি না। অথচ আমারও উপায় নেই। চুনিটা খুঁজে না পাওয়া গেলে আমাকেও হয়তো গুপ্তঘাতকের হাতে মরতে হবে। তাই শোক তাকে তুলে রেখে পাগলের মতো চুনি খুঁজতে বসেছি…।’
চুনিলালবাবু থামতেই রঘুপতি তাকাল অশোকচন্দ্রের দিকে।
বৃদ্ধ তখন চোখ বুজে সিগারেটে জম্পেশ টান দিচ্ছেন।
রঘুপতি বলল, ‘গুপ্তাসাব, আমার সঙ্গে চুনিবাবুরই টেলিফোনে কথা হয়েছিল। আপনি ওকে কী জিজ্ঞাসা করবেন করুন—।’
এসিজি চোখ খুলে পাখির মেলার দিকে তাকালেন। কম করেও একশো পাখি সাজানো রয়েছে ঘরের ডানদিকটায়। তার সবই পশ্চিমবাংলার পাখি। ছোট মাছরাঙা, বাঁশপাতি, টুনটুনি, চন্দনা, দোয়েল, কাদাখোঁচা, শ্যামা, ময়না, নীলকণ্ঠ, চাক দোয়েল, বেনেবউ, এমনকী একটা মোহনচূড়াও রয়েছে। পাখিগুলোর পায়ের কাছে সাদা কার্ডে ওদের পরিচয় লেখা—ঠিক যেমনটি জাদুঘরে থাকে।
এসিজি মাথার সাদা চুলে টান মেরে জানতে চাইলেন, ‘ট্যাক্সিডার্মি করা এই পাখিগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে?’
চুনিলালবাবু বললেন, ‘দাদার খেয়াল। বেশিরভাগই কেনা। তবে কয়েকটা বোধহয় নিজে অর্ডার দিয়ে করিয়েছেন।’
‘চুনির ব্যাপারটা আমাদের একটু খোলসা করে বলুন—।’
চুনিলালবাবু ওঁদের কাছাকাছি একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ উশখুশ করে তারপর বললেন, ‘আমি মণিরত্নের ব্যবসা করি। মানে, দামি পাথর কেনা-বেচা করি। নিজে পাথর কাটিংও করি, পালিশও করি। তবে সেরকম এক্সপার্ট নই। ছাদের দক্ষিণ দিকের একটা ছোট ঘরে আমার কাটিং মেশিন আর গ্রাইন্ডিং মেশিন আছে।’
‘সে যাই হোক, পাথরের কাজকারবারে আমাকে প্রায় রোজই বটতলা আর মেছুয়ায় যেতে হয়। সেখানে মহাজনদের কাছ থেকে দরকার মতো মাল নিয়ে আসি। তো দিনসাতেক আগে মেছুয়াতে এক মহাজনের ঘরে আমি একটা বার্মিজ রুবি পেয়ে যাই। চুনিটার রং ঠিক পায়রার রক্তের মতো গাঢ় লাল। আর একেবারে বেদাগ।’
‘আমি সেখানে গিয়েছিলাম খড় কিনতে—’
‘খড় মানে?’ চুনিলালকে বাধা দিয়ে জানতে চেয়েছেন এসিজি।
‘খড় মানে একেবারে র’পাথর—যেটা দেখে দামি পাথর বলে একেবারেই বোঝা যায় না। সেগুলো অ্যাসিড ট্রিট করে ঠিকমতো কেটে পালিশ-টালিশ করতে পারলে অনেকগুলো দামি পাথর পাওয়া যেতে পারে। এর আগে বেশ কয়েকবার খড় কিনে আমি ভালো প্রফিট করেছি।’
‘তারপর কী হল?’ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল রঘুপতি।
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমার একজন কোটিপতি কাস্টমার বার্মিজ চুনির কথা বলে রেখেছিল। এই চুনিটার হদিস পেতেই আমার মনটা নেচে উঠল। এটা তাকে বেচতে পারলে অন্তত থার্টি পার্সেন্ট প্রফিট করা যাবে।’
‘সেই কাস্টমারের নাম কী?’ রঘুপতি গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল।
চুনিলালবাবু অবাক চোখে তাকালেন রঘুপতির দিকে, বললেন, ‘মাপ করবেন, ইন্সপেক্টর যাদব। কাস্টমারের নাম বলতে পারব না—ট্রেড সিক্রেট।’
মাথার সাদা চুলের গোছায় হাত চালিয়ে এসিজি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাথরটার সাইজ কীরকম ছিল?’
চুনিলাল গোস্বামী ব্যবসায়ীর ঢঙে বললেন, ‘প্রায় সাড়ে ন’ রতি। মানে, পৌনে ন’ ক্যারাট-এর কাছাকাছি।’
‘ক্যারাট-এর হিসেব কেমন জট পাকিয়ে যায়’, হেসে বললেন এসিজি, ‘এক ক্যারাট মানে কত গ্রাম?’
‘দুশো মিলিগ্রাম। এই পাথরটার ওজন প্রায় পৌনে দু-গ্রাম মতো ছিল। আর বেশ লম্বাটে।’
‘ফির কেয়া হুয়া?’ রঘুপতির ধৈর্যে যে ভালোরকম টান পড়েছে সেটা তার প্রশ্নের ঢঙেই বোঝা গেল।
চুনিলাল কী যেন চিন্তা করছিলেন। রঘুপতির প্রশ্নে চমকে উঠে বললেন, ‘পাথরটা আমি চেনা মহাজনের কাছ থেকে দু-সপ্তাহের ধারে নিয়ে আসি। কিন্তু ওটা নিয়ে আসার পরদিন থেকেই কেউ আমাকে টেলিফোন করে হুমকি দিতে থাকে। বলে যে, পাথরটা যেন আমি কাউকে বিক্রি না করে সোজা আবার মহাজনের কাছে ফেরত দিয়ে আসি।’
‘মিস্টার গুপ্ত, আমাদের হিরে-জহরতের লাইনে উড়ো টেলিফোনে হুমকি দেওয়ার ব্যাপারটা নেহাতই মামুলি। তাই আমি প্রথম-প্রথম ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু দিনতিনেক যেতে-না-যেতেই হুমকির ব্যাপারটা সিরিয়াস চেহারা নিতে থাকে। মার্কেট থেকে কানাঘুষোয় খবর পেলাম, এতবড় বার্মিজ চুনি বাজারে বহুদিন আসেনি। তাই হিসেব-ছাড়া দাম দিয়ে কেনার মতো দু-তিনজন কাস্টমার নাকি ওটার জন্যে হন্যে হয়ে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের এজেন্টরা নাকি মারাত্মকরকম ডেঞ্জারাস।’
‘তখন আমি…’ একটু থেমে চুনিলালবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তখন আমি ব্যাপারটা বড়দাকে খুলে বলি। বড়দা ছিলেন দেবতুল্য মানুষ। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে একরকম পুত্র স্নেহে ছোট-ছোট ভাইদের মানুষ করেছেন। আমাদের বিষয়সম্পত্তি সজাগ হয়ে দেখাশোনা করেছেন। আমাদের সবরকম বিপদ-আপদ থেকে আগলে-আগলে রেখেছেন—’ চুনিলালবাবুর চোখে জল এসে গেল। মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিয়ে শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন, ‘বড়দা চলে গিয়ে আমাদের মাথার ওপর থেকে বটগাছের ছায়া সরে গেল। আমার বিপদের কথা শুনে বড়দা আমাকে বললেন, ”তোর কোনও চিন্তা নেই। তুই চুনিটা আমার কাছে দে, আমি ওটা রেখে দেব। তারপর দেখি, কে ওটা আমার কাছ থেকে নিতে পারে!” ‘
‘আমি সেইমতো বড়দাকে পাথরটা দিয়ে দিই পরশুর আগের দিন—মানে, শুক্রবার। কিন্তু আশ্চর্য, তার পরদিন থেকেই সেই নাম-না-জানা লোকটা বড়দাকে যা-তা বলে শাসাতে থাকে।’
‘দাদার একটাই দোষ ছিল—অল্পেতেই ভীষণ রেগে যেতেন। এই করে-করেই হার্টের ট্রাবল বাঁধিয়েছিলেন। আগে দু-বার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল। তাই দাদা যখন লোকটার সঙ্গে টেলিফোনে চিৎকার করে কথা বলতেন তখন আমার ভয় করত। পরশু রাতেই আমি ঠিক করি, ঢের হয়েছে, চুনি বেচে প্রফিটে আর কাজ নেই। ওটা আমি মহাজনকে ফেরতই দিয়ে দেব। কিন্তু দাদাকে সে-কথা বলতেই তিনি একেবারে অগ্নিশর্মা। ফলে আমি গৃহশান্তির কথা ভেবে চুপ করে যাই।’
‘তারপর…তারপর, কাল দুপুরে, ওই লোকটা আবার টেলিফোন করে। দাদা তখন এই ঘরে ওই চেয়ারটায় বসেছিলেন। দাদার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আমি পাখিঘরে ছুটে আসি। দাদা তখন টেলিফোনে বলছেন, ”আমি থাকতে কেউ চুনির গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত কাটতে পারবে না। আমাকে ভয় দেখানো অত সহজ নয়…।” ‘
‘আমি দাদাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কারণ, দাদার তখন চোখ-মুখ লাল, বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছেন। ভয় হচ্ছিল, খারাপ কিছু না একটা হয়ে যায়…।’
চুনিলালবাবু একটু থামতেই এতক্ষণ নীরবে সাক্ষী হয়ে বসে থাকা রঙ্গলাল বললেন, ‘সেই মুহূর্তে আমিও ছুটে আসি/গজেনকেও পেলাম পাশাপাশি।’
চুনিলালবাবু বিরক্ত হয়ে তাকালেন ছোট ভাইয়ের দিকে, বললেন : ‘আঃ, রঙ্গ, কী হচ্ছে! পদ্য নিয়ে পাগলামির একটা লিমিট থাকা দরকার। এখন কি একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায় না!’
রঙ্গলালের মুখে আহত ভাব ফুটে উঠল। তিনি মিনমিন করে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘লিমিট থাকলে সেটা কখনও কবিতা হয় নাকি! কবিতার নামে সেটা তখন হয়ে যায় ফাঁকি…।’
‘দোহাই, তোর স্বভাবকবিতা এবার বন্ধ কর।’ চুনিলালবাবু যে বেশ রেগে গেছেন সেটা তাঁর মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল।
একটু সময় নিয়ে তারপর তিনি খবর পড়ার মতো নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘তারপর আমাদের তিন ভাইয়ের চোখের সামনেই বুক খামচে ধরে বড়দা টেবিলে কাত হয়ে পড়েন। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই তিনি টেবিলে পড়েছিলেন বলে সেরকম আঘাত পাননি। কিন্তু বুকের কষ্টটা নিশ্চয়ই খুব মারাত্মক হচ্ছিল। কারণ, তিনি বুকের কাছে হাত ঘষছিলেন বারবার। আর যন্ত্রণার টুকরো-টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসছিল তাঁর মুখ দিয়ে।
‘আমি গজেনকে পাঠালাম পাড়ারই এক ডাক্তারকে তক্ষুনি ধরে নিয়ে আসতে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, বড়দার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শরীর প্রায় স্থির। মুখ থেকে একটানা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছিল।
‘বড়দা আমাকে বলেছিলেন, চুনিটা তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছেন যে, কেউ ওটা খুঁজে পাবে না। সে-কথা আমার মনে ছিল। তাই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরের মতো চেঁচিয়ে জানতে চেয়েছি, ”বড়দা, চুনিটা কোথায় রেখেছ?”
‘উত্তরে বড়দা গোঙানির মতো শব্দ করে দুবার বললেন, ”পেলি না গো, পেলি না গো—”, তারপরই সব শেষ।
‘কাল দুপুর থেকে আমরা দাদার সৎকার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর কাল সারা রাত ধরে আমি চুনিটার খোঁজ করেছি। বউদি ওই শোকের মধ্যেই আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছেন। আমাকে হয়তো সবাই অমানুষ ভাবছে, মিস্টার গুপ্ত, কিন্তু আমার অবস্থাটা একবার বুঝুন। একে ওই হুমকি। তার ওপর চুনিটার দাম প্রায় পৌনে দু-লাখ টাকা। মহাজনকে যে এক কথায় দাম দিয়ে দেব তারও উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে লোকজন ধরে লালবাজারে খবর দিয়েছি।’
কথা শেষ করে চুনিলালবাবু মাথা নিচু করলেন। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন কয়েকবার।
রঘুপতি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা সব জায়গা খুঁজে দেখেছেন? সিন্দুক-টিন্দুক, ব্যাঙ্কের লকার—সব?’
চুনিলালবাবু ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ। তারপর বললেন, ‘আজ সকালেই বউদিকে ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়েছিলাম। লকারে ওটা নেই।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত ইতিমধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে-করতে চলে গিয়েছিলেন পাখির ঝাঁকের কাছে। রংবেরঙের পাখিগুলো দেখতে-দেখতে কল্পনায় যেন ওদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। ঘাড়ের কাছে সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। তারপর দূর থেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন চুনিলালবাবুর দিকে, ‘কোনও জায়গায় খুঁজতে বাকি রাখেননি? সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন?’
চুনিলালবাবু বিষণ্ণ হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রাণের দায়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। যে করে হোক চুনিটা মহাজনকে ফেরত দিয়ে আমাকে আগে প্রাণে বাঁচতে হবে।’
পাখিগুলো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন এসিজি। আর একইসঙ্গে কী যেন ভাবছিলেন।
নিচের তলা থেকে একটা বাচ্চার কান্না ভেসে এল। সেই সঙ্গে কোনও মহিলার বকাবকির শব্দ।
রঙ্গলালবাবুও বোধহয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি হঠাৎই বলে উঠলেন, ‘মেজদা, এমনও তো হতে পারে, বড়দা মারা যাওয়ার সময় চুনিটা কোথায় আছে সেটা বলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন…।’
বোঝা গেল, মেজদার ধমকে স্বভাবকবি তাঁর কাব্য প্র্যাকটিস আপাতত মুলতুবি রাখার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু রঙ্গলালবাবুর কথায় ঝটিতি ঘুরে তাকালেন থিঙ্কিং মেশিন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। দু-ভাইয়ের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘শেষ কথাটা আপনারা ঠিক শুনেছিলেন?’
চুনিলাল ইতস্তত করে বললেন, ‘আমার তো ”পেলি না গো” বলেই মনে হয়েছিল। গোঙানির মধ্যে স্পষ্ট করে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।’ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুই কী শুনেছিস, রঙ্গ?’
একটু আমতা-আমতা করে রঙ্গলাল বললেন, ‘আমার…আমার যেন ”গেলি না গো” বলে মনে হয়েছিল…।’
‘এর তো বাংলাটাও গণ্ডগোলের।’ এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, ‘বাক্যের প্রথমটা ”তুই” সম্বোধনে, আর শেষটা ”তুমি”…কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে…।’
রঘুপতি যাদব বেশ চিন্তিতভাবে রঙ্গলালবাবুকে বলল, ‘আপনি ওই শেষ কথাটা একবার আপনার বড়দার মতো করে বলে শোনাতে পারেন?’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয় এ তো কোনও শক্ত কাজ নয়।’ মেজদার দিকে একপলক তাকিয়ে রঙ্গলাল সোজা গিয়ে শ্যামসুন্দরলালবাবুর চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘গেলি না গো, গেলি না গো!’
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো টান-টান হয়ে গেলেন এসিজি। হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে। তারপর হো-হো করে হেসে উঠলেন। সে-হাসি আর থামতেই চায় না।
ঘরের সকলেই তো এসিজির কাণ্ডকারখানা দেখে হতবাক।
রঘুপতি অবাক সুরে বলল, ‘স্যার, কেয়া বাত হ্যায়? কোই চুটকুলা ইয়াদ আয়া?’
কোনওরকমে হাসি থামিয়ে এসিজি বললেন, ‘চুটকুলা মানে, চুটকিই বটে, রঘুপতি। আশা করি তোমার মিস্ট্রি সলভ হয়ে গেছে।’ চুনিলালবাবুকে লক্ষ করে তিনি বললেন, ‘একটা চিমটে এনে দিন। আপনার অমূল্য চুনি বোধহয় আমি খুঁজে দিতে পারব।’
কথাটা শোনামাত্রই রঙ্গলালবাবু তীরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পরেই তিনি ফিরে এলেন, হাতে একটা লম্বা চিমটে—যা দিয়ে অনায়াসে কোনও দৈত্যের মাথার পাকাচুল বাছা যায়।
রঙ্গলালের পিছু-পিছু যিনি এলেন, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি গজেন্দ্রলাল। চুনিলালবাবু তাঁকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় কীসব বলতে লাগলেন।
কিন্তু ততক্ষণে রঙ্গলালবাবুর হাত থেকে চিমটে নিয়ে স্টাফ করা পাখিগুলোর একটার কাছে গিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন অশোকচন্দ্র।
পাখিটা মাপে পায়রার চেয়ে ছোট। মেটে রঙের শরীরে কালো ছোপ-ছোপ দাগ। পেটের দিকটা সাদা। আর সরু লম্বা ঠোঁট।
এসিজি ওঁদের সকলের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘এই পাখিটার নাম কাদাখোঁচা। মাছ, শামুক-টামুক খায়। নাকি সুরে ডাকে। গ্রাম-বাংলার সব জায়গাতেই দেখা যায়। এটার ডান চোখটা দেখুন—দেখেই বোঝা যায়, এটা নিয়ে কারিকুরি করেছে কেউ…।’
এসিজি কথা বলতে-বলতেই ডান চোখের পুঁতিটা খুঁচিয়ে তুলে চিমটে দিয়ে তার ভেতরটা আরও ভালো করে খোঁচাচ্ছিলেন।
হঠাৎই বেরিয়ে পড়ল হারানো চুনিটা। মেঝেতে ঠিকরে পড়ে কয়েকবার লাফিয়ে তারপর থামল।
ঘরের আলোয় ওটা লাল আভা ছড়িয়ে চিকচিক করতে লাগল।
একটা অস্ফুট শব্দ করে চুনিলালবাবু ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিলেন লাল টুকটুকে পাথরটা। ওটা শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে ঘরের সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে চোখ বুজে আবেগ থরথর গলায় বললেন, ‘মা তারা ব্রহ্মময়ী!’
তারপর পাথরটা শার্টের বুকপকেটে রেখে এসিজির হাত চেপে ধরে বললেন : ‘মিস্টার গুপ্ত, আপনি দেবদূত হয়ে আজ আমাকে বাঁচালেন—।’
এসিজি হেসে বললেন, ‘আমি নয়, আপনাকে বাঁচিয়েছেন রঙ্গলালবাবু। উনি ঠিকই বলেছেন। শ্যামসুন্দরলালবাবু মারা যাওয়ার সময় ”পেলি না গো, পেলি না গো” বলেননি, উনি বলেছিলেন, ”গেলিনাগো গেলিনাগো”। কথাটা বাংলা নয়—কাদাখোঁচা পাখির বৈজ্ঞানিক নাম। এই দেখুন, এই কার্ডে ইংরেজি আর ল্যাটিন নাম—দুটোই আছে।’
সকলে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল কার্ডে লেখা নাম দুটো :
Fantail Snipe (gallinago gallinago)
রঘুপতি যাদব এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানিয়ে এসিজিকে বলল : ‘স্যার, য়ু আর এ জিনিয়াস!’
অশোকচন্দ্র নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘সে শুধু তোমার মতে, রঘুপতি। নাও, এবার চলো—।’
রঙ্গলালবাবু এসিজির সামনে এসে জোড়হাত করে দাঁড়ালেন। আকর্ণ হেসে ছন্দে বললেন, ‘প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানী ছিলেন অ্যারিস্টটল/আপনি আরও জ্ঞানী দুঁদে ব্যারিস্টটল।’
এসিজি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যারিস্টটল মানে!’
‘ওই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান—’ মাথা নামিয়ে বিনয়ের হাসি হেসে রঙ্গলাল বললেন : ‘কবিতার শেষটা মেলানোর জন্যে ব্যারিস্টার আর অ্যারিস্টটলের সন্ধি করেছি—।’
আবার হো-হো করে হেসে উঠলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
ছাইয়ের আড়ালে (গল্প)
খুন-জখমের পক্ষে দিনটা মোটেই আদর্শ ছিল না।
শীতের সবে শুরু।
আকাশ মেঘলা, থমথমে, আর নির্জন। সেখানে একটিও পাখি উড়ছে না। প্রতিটি গাছের পাতা স্থির, চুপচাপ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সর্বাঙ্গে যেন অবসাদ আর ক্লান্তির ছাপ।
দোতলার ফ্যাটের জানলার কাছে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনাভাবে কীসব ভাবছিলেন অধ্যাপক অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি।
মেয়ে ঊর্মিলাকে অনেকদিন পর তিনি লম্বা চিঠি লিখতে বসেছেন। চিঠিতে ‘লালমহল’-এর স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামীর প্রসঙ্গও এসে পড়েছে। এসিজি লিখেছেন : ‘…এই বিচিত্র কবি ভদ্রলোক কীভাবে আমার প্রশংসা করেন তার কয়েকটি নমুনা তোকে শোনাই। তুই তো আমাকে গোয়েন্দা বলে মনেই করিস না! অথচ এই ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে কী-কী বলেছেন শোন, ”প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানী ছিলেন অ্যারিস্টটল/আপনি আরও জ্ঞানী দুঁদে ব্যারিস্টটল।” ‘ কিংবা ‘ ”আমি আপনার গুণমুগ্ধ/ আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ!”’ আবার ‘ ”গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/ অমর, আকবর, এবং অ্যান্টনি।”’ আর সবশেষে ‘ ”দেখে আপনার তীক্ষ্নবুদ্ধি/ হলেম আমি নিহতবুদ্ধি।” ‘
‘আমি তোর বাবা বলেই তুই আমাকে গোয়েন্দা হিসেবে পাত্তা দিস না। নইলে…’
উইলস ফিলটারে চোস্ত টান দিয়ে আপনমনেই হাসলেন অশোকচন্দ্র। ছোটবেলা থেকেই বরাবর ঊর্মিলাকে প্রশংসায় অবিচল থাকার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। অথচ আজ স্বভাবকবি রঙ্গলালের কথা বলতে গিয়ে, মেয়ের সঙ্গে চিঠিতে মজা করতে গিয়ে, সেইসব উদ্ভট ধরনের প্রশংসায় তিনি নিজেই অল্পসল্প তৃপ্তির আমেজ টের পাচ্ছেন।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন এসিজি।
যা ভেবেছেন তাই। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
‘গুড মর্নিং, স্যার, রঘুপতি বলছি।’
‘বলো।’
‘মুড খারাপ করার জন্যে মাফ চাইছি। তবে ব্যাপারটা ক্লোজড রুম প্রবলেম। ইসি লিয়ে আপকো ডিসটার্ব কর রহা হুঁ।’
‘কেউ মারা গেছেন নাকি?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।
‘হ্যাঁ। ওল্ড ম্যান পরমেশ্বর সরকার।’
‘মার্ডার?’ মাথার সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা।
‘সেটাই তো পারফেক্টলি ক্লিয়ার নয়। দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক।’
এসিজি একপলক আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি চলে এসো। আর রওনা হওয়ার আগে রঙ্গলালবাবুকে একটা ফোন করে দিয়ো। ওর ফোন নাম্বারটা লিখে নাও…।’
ফোন নম্বরটা বলার পর এসিজি যেন আপনমনেই মন্তব্য করলেন, ‘লালমহলের রঙ্গলাল/দেখা হয়নি বহুকাল।’
তারপর ফোন রেখে দিয়ে ঊর্মিলার চিঠিটা শেষ করতে বসলেন।
হাতের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই নতুন আর-একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
কলিংবেলের শব্দটার মধ্যে রঘুপতির বাজানো চেনা সুর ছিল না। সুতরাং দরজা খুলতেই যে রঙ্গলাল গোস্বামীর মুখোমুখি হবেন সেটা এসিজি ভেবেই রেখেছিলেন।
পরনে হাফহাতা পাঞ্জাবি, ধুতি, আর হালকা বাদামি শাল। তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুলের মাঝবরাবর সিঁথি। ছোট-ছোট চোখ, কপালের বাঁদিকে একটা ছোট আঁচিল। সামান্য ঘামে ভেজা মুখে প্রসাধনের ছাপ।
আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘বহুদিন পরে এলাম/ গোয়েন্দাকে কবির সেলাম।’
রঙ্গলালের ঠিক পিছনেই ছিল রঘুপতি যাদব। প্রথম-প্রথম রঙ্গলালের আচরণে কিছুটা বিরক্ত হলেও এখন রঘুপতি ব্যাপারটা মানিয়ে নিয়েছে। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় এখন ও স্যারের মতো মজাই পায়।
ড্রইংরুমে তিনজনে গুছিয়ে বসামাত্রই রঘুপতি ওর কাজের কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রকে বাধা দিলেন অশোকচন্দ্র। বললেন, ‘রঘুপতি, আগে একটু আরাম করে কফি খাও, তারপর শুরু করো তোমার রাজধানী এক্সপ্রেস—।’
জানলার বাইরে শীতের সন্ধে নেমেছে। এসিজির ঠিকে কাজের লোক ‘ললিতের মা’ আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। তবে বছর তেরো বয়েসের ‘কম্বাইন্ড হ্যান্ড’ বিশু রয়েছে। একটু আগেই এসিজির জন্য দু-প্যাকেট সিগারেট এনে দিয়েছে ও। নিজের কাজের ঝক্কি কমাতে এসিজি ওকে কফি তৈরি করা শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন ওকে ডেকেই তিনকাপ কফির ফরমাশ করেছেন।
কফি খেতে-খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল। তারই মধ্যে রঙ্গলাল গোস্বামী হঠাৎ জানালেন, ‘আমার একটা কবিতার বই বের করছি।’
অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘এ তো খুবই ভালো খবর। তা কবে বেরোচ্ছে বইটা?’
‘সামনের মাসের অমাবস্যায়। বইয়ের নাম দিয়েছি ”স্বভাবকবিতাসমগ্র”।’
রঘুপতি যাদব জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ অমাবস্যায় রিলিজ করছেন কেন?’
রঙ্গলাল লাজুক হেসে বললেন, ‘আমি মা-কালীর একটু ইয়ে কিনা…। আমার স্বভাবকবিতার প্রথম বই…তাই ঈশ্বরের একটু-আধটু ইয়ে দরকার…।’
রঘুপতি মুচকি হেসে তাকাল এসিজির দিকে। এসিজি তখন কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন। সেই অবস্থাতেই তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর এখন থাক। বরং পরমেশ্বরের কথা শুনি—পরমেশ্বর সরকার। বলো, রঘুপতি, শোনাও তোমার ”বন্ধ ঘরের রহস্য”।’
রঘুপতি যাদব গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করল তার কাহিনি।
পরমেশ্বর সরকারের বাড়ি কেশব সেন স্ট্রিটে—আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকায়। ওঁরা কয়েক পুরুষের বনেদি বড়লোক—রইস আদমি বলতে যা বোঝায় তাই। কলকাতা আর তার আশেপাশে ওঁদের প্রায় গোটা আটেক সিনেমা হল আছে। এ ছাড়া জমিজমা আর বাড়ির কোনও হিসেব নেই।
পরমেশ্বর সরকারের বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। ভদ্রলোক বিপত্নীক। তাঁর এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে অর্কদেবের বয়েস পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে, বউয়ের নাম সুভদ্রা। ওঁদের বছর আট-দশের পিঠোপিঠি দুই ছেলে—তুতুন আর মিমো।
অর্কদেবের পরের বোনের নাম ঈশানী। বছর পনেরো আগে বিয়ে হয়ে গেছে। ঈশানী দিনসাতেক হল বাপের বাড়িতে এসে রয়েছেন।
পরমেশ্বরবাবুর ছোট মেয়ে হিমানীর বয়েস প্রায় চল্লিশ হবে। বিয়ে করেননি। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে এম. এসসি. করার পর সেখানেই ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করছেন।
ঘটনা ঘটেছে আজ সকালে।
দোতলায় পুবদিক ঘেঁষে পরমেশ্বরবাবুর পড়াশোনার ঘর। ঘরের লাগোয়া বড় বারান্দা। সেখানে আরামকেদারা আর টেবিল পাতা থাকে। পরমেশ্বরবাবু সেখানে বসে দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন। কখনও চায়ের কাপ হাতে আয়েস করতেন, কখনও বা বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন।
আজ সকালে ন’টা নাগাদ অর্কদেব হঠাৎ দেখেন পরমেশ্বরবাবু তাঁর ঘরে একটা চেয়ারে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসে আছেন। তাঁর সামনে টেবিলে আধ কাপ চা, অ্যাশট্রেতে জ্বলন্ত সিগারেট, আর তার পাশেই খানিকটা পোড়া ছাই।
বারান্দার দিকের কাচের জানলা দিয়ে অর্কদেব তাঁর বাবাকে ওই অবস্থায় দেখতে পান। কেমন যেন সন্দেহ হওয়ায় তিনি দরজার কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকতে থাকেন। তারপর কোনও সাড়া না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
সুতরাং শেষ পর্যন্ত লোকজন জড়ো করে অর্কদেব দরজা ভাঙতে বাধ্য হন। সে সময় দু-বোন তাঁর কাছেই ছিলেন।
ঘরের সব ক’টা জানলাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। সুতরাং ব্যাপারটা সহজ-সরল আত্মহত্যা বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। ডাক্তারি পরীক্ষায় চায়ের কাপে পোকামাকড় মারার বিষও পাওয়া গেছে। আর পোস্ট মর্টেমের প্রাথমিক খবর অনুযায়ী সরকারসাহেবের পাকস্থলীতে ওই একই বিষের হদিস মিলেছে।
কিন্তু সবকিছু মিলে যাওয়া সত্ত্বেও একটা গোলমাল দেখা দিয়েছে।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, পরমেশ্বরবাবু সকাল ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে মারা গেছেন। অথচ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে অর্কদেববাবুরা চায়ের কাপে সামান্য গরম চা পেয়েছেন। এ ছাড়া জ্বলন্ত সিগারেটের ব্যাপারটাও সমস্যা বাঁধিয়েছে।
এমনিতে পরমেশ্বরবাবু প্রায় দশ বছর হল ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কখনও-সখনও কাজের লোকদের দিয়ে এক-আধটা আনিয়ে খেতেন। অথচ সমস্যা হল, তাঁর ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও দেশলাই বা সিগারেট লাইটার পাওয়া যায়নি। আর শেষ সমস্যা ওই ছাই।
ধারাবিবরণী শেষ করে একটা জোরালো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটুতে চাপড় মারল রঘুপতি, বলল, ‘এইজন্যেই স্যার আপনাকে ফোনে বলেছি, মার্ডার না সুইসাইড ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক।’
এসিজি রোগা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে হাতের ছোট-হয়ে-আসা সিগারেটের টুকরোটাকে টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। সামান্য হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘সুইসাইড বা মাডার যা-ই হোক, কেসটা তোমার কাছে গেল কেমন করে?’
তেতো হাসল রঘুপতি। তারপর বৃদ্ধ হুনুরের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সিরফ আপকে লিয়ে, স্যার।’
এসিজি অবাক হয়ে প্রাক্তন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আমার জন্যে! তার মানে? ঠাট্টা করছ?’
হাসল রঘুপতি যাদব, বলল, ‘আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মা আমার খুব বন্ধু। আমার কাছে ও আপনার কথা অনেক শুনেছে। আপনার পিকিউলিয়ার ইন্টারেস্টের কথা ও জানে। তাই পি. এম. রিপোর্টের খবর পাওয়ামাত্রই আমাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। আপনি চাইলে কাল আমরা পরমেশ্বর সরকারের বাড়ি ভিজিট করতে পারি। অব আপকি মরজি—।’
রঙ্গলালবাবু, এতক্ষণ চুপটি করে বসে রঘুপতির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এখন হঠাৎই সক্রিয় হয়ে এসিজিকে অনুরোধের সুরে বললেন, ‘অবশ্যই যেতে হবে গোয়েন্দাপ্রবর/সুইসাইড না মার্ডার—রহস্য জবর।’
দু-হাতের দশ আঙুল মাথায়-মাথায় ঠেকালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক সেকেন্ড আপনমনে কী যেন ভাবলেন। তারপর মুখ তুলে রঘুপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাব তো নিশ্চয়ই, তবে তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।’
রঘুপতি ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘মাফ করনা, গুপ্তাসাব। আপনার যা কিছু কোয়েশ্চেন আছে সব কাল শর্মাকে করবেন। ও অনেক বেটার উত্তর দিতে পারবে। আমি বরং ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। যদি বলেন, কাল আমি আর ও আপনার এখানে চলে আসব। তারপর একসঙ্গে স্টার্ট দেব—।’
অশোকচন্দ্র একটু ভেবে বললেন, ‘তুমি শর্মাকে নিয়ে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে এখানে চলে এসো। কারণ, আমি আটটা থেকে ন’টার মধ্যে পরমেশ্বরবাবুর ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখতে চাই।’
এসিজির কথায় রঘুপতি তেমন একটা ভরসা পেল না। অস্পষ্ট স্বরে ও বলল, ‘শর্মা তো সব ছানবিন করে দেখেছে। আপনি কি আর নতুন কিছু পাবেন?’
রঘুপতির কথায় অশোকচন্দ্র হাসলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় বারকয়েক টান মেরে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে কেন এসেছ, রঘুপতি? তুমি জানো, তোমার ওই শর্মাকে দিয়ে যা হবে না তা এই শর্মাকে দিয়ে হতেও পারে—তাই না? ঠিক আছে, তুমি যাতে হতাশ না হও সে-চেষ্টা আমি করব। নাউ চিয়ার আপ। এসো, একটু জমিয়ে গল্প করা যাক।’
রঙ্গলাল গোস্বামী হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘এসিজি স্যার, একটা কথা বলব?’
‘নিশ্চয়ই বলুন।’
চোখ নামিয়ে সঙ্কুচিতভাবে রঙ্গলাল বললেন, ‘যাতে কথাটা মোলায়েম শোনায় তাই স্বভাবকবিতায় বলছি। ”অকুস্থলে তিনজন মহা অনাচার/রঙ্গলাল সঙ্গী হলে সংখ্যা হবে চার।” এর ইনার মিনিংটা বুঝতে পারলেন, স্যার?’
অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। কাল সকালে তিনজন নয়, চারজন একসঙ্গে রওনা হব। তা না হলে আপনি আমার তদন্তরসে বঞ্চিত হবেন, আর আমরা বঞ্চিত হব আপনার কাব্যরস থেকে। এবার আপনার কয়েকটা কবিতা শোনান দেখি।’
‘কবিতা নয়, স্বভাবকবিতা।’ এসিজিকে শুধরে দিলেন রঙ্গলাল।
বাড়িটার নাম ‘সরকারভিলা’ শুধু নামে নয়, কাজেও।
প্রায় আট কাঠা জায়গা জুড়ে তিনতলা বাড়ি, আর লাগোয়া ছোট বাগান। বাড়িটার রং হালকা সবুজ। তবে বারান্দা আর জানলায় গাঢ় সবুজের বর্ডার দেওয়া।
সদরের বিশাল লোহার গেট খুলে দিল উর্দি পরা দারোয়ান। এসিজি, বিজন শর্মা, রঘুপতি যাদব আর রঙ্গলাল গোস্বামী ভেতরে ঢুকলেন।
সামনেই শান বাঁধানো বিশাল চাতাল। সেখানে দুটো নাদুস-নুদুস বাচ্চা ছেলে লাল রঙের একটা বল নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে। ওদের বয়েস আট-দশ বছর হবে। পরনে টি-শার্ট, সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট।
দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তরে বিজন শর্মা বলেছেন যে, ওঁরা অর্কদেববাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান। দারোয়ান তখন ইশারা করে বাঁদিকের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়েছে।
বাড়িটা সদর দরজার বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বাড়ি আর উঠোন পেরোলেই শুরু হয়ে গেছে বাগানের এলাকা। সদরের কাছ থেকেই বাগানের বেশ কয়েকটা গাছের মাথা নজরে পড়ছিল।
বাঁদিকের দরজা লক্ষ করে এগোতেই ডানপাশে গ্যারেজ চোখে পড়ল। সেখানে একটা মারুতি জেন, আর একটা অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে।
মার্বেল পাথর বাঁধানো দুটো সিঁড়ির ধাপ উঠলেই বড় মাপের ভারী কাঠের দরজা। যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই অর্কদেব সরকার বলে মনে হল এসিজির।
টকটকে ফরসা গায়ের রং। পরনে সামান্য লাট হয়ে যাওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি। তার ওপরে একটা সাদা শাল জড়ানো। চোখে চশমা। মুখের চামড়ায় বয়েসের ভাঁজ পড়েছে। কাঁচা-পাকা চওড়া গোঁফ, জোড়া ভুরু, চোখের তারায় কটা ভাব, মাথার এলোমেলো চুল বেশ পাতলা হয়ে এসেছে।
বিজন শর্মা সৌজন্যের হাসি হেসে বললেন, ‘নমস্কার, অর্কদেববাবু। কাল রাতে আপনাকে তো ফোন করে বলে রেখেছিলাম। ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আপনার বাবার…মানে…ইয়ের ব্যাপারে আমাদের একটু হেলপ করতে এসেছেন।’
চঞ্চল চোখ ঘুরিয়ে অর্কদেব এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আপনি ডাক্তার?’
মাথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে এসিজি বললেন, ‘হ্যাঁ, লেখাপড়ার ডাক্তার। আরও ভালো করে বলতে গেলে ফিজিক্সের ডাক্তার।’
অর্কদেব অপ্রস্তুতভাবে হাসলেন, বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। আসুন, ভেতরে আসুন বসুন।’
ওঁরা চারজন বসবার ঘরে ঢুকলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা যেন পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেল।
ঘরের মেঝেতে চকচকে ইটালিয়ান মার্বেল পাথর বসানো। ডানদিকে পুরোনো ধাঁচের কারুকাজ করা ডিভান—বোধহয় মেহগনি কাঠের তৈরি। সোফা-সেটি যেন কারুকাজ করা ছোটখাটো সিংহাসন। ডিভানের পাশে দাঁড় করানো প্রায় আলমারির মাপের এক বিচিত্র পিতামহ-পেন্ডুলাম-ঘড়ি। তার নকশা কাটা পেন্ডুলামের সামনে ঝুলছে তিনটে পিতলের চোঙ। ঘণ্টি বাজানোর কাজটা বোধহয় ওরাই করে।
বাঁদিকে জানলার কাছে একটা সুদৃশ্য টেবিলে রাখা আছে দুটো টেলিফোন—একটা পুরোনো ধাঁচের, আর-একটা আধুনিক। সিলিং থেকে ঝোলানো রয়েছে সিলিং পাখা। তবে নজর করে দেখলে সেখানে ব্রিটিশ আমলের হাতে টানা পাখার আংটাও চোখে পড়ে।
সোফায় বসে অশোকচন্দ্র ঘরটাকে জরিপ করে দেখছিলেন।
এখানে আসার পথে ও. সি. বিজন শর্মা আর রঘুপতি যাদবের কাছে যা-যা শুনেছেন তাতে সরকাররা লাখপতি নয়, কোটিপতি। ওঁরা প্রায় চার পুরুষের ধনী।
পোস্ট মর্টেমের পর পরমেশ্বরবাবুর মৃতদেহ এখনও অর্কদেবরা হাতে পাননি। বিজন শর্মা সামান্য অপরাধী-সুরে জানালেন, ‘ডেডবডি পেতে-পেতে হয়তো বিকেল হয়ে যাবে।’
অর্কদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণ মুছে নিলেন, বললেন, ‘আমাদের যা-কিছু দেখছেন সবই বাবার দান। বাবাকে আমরা সবাই খুব শ্রদ্ধা-সমীহ করতাম। হঠাৎ কেন যে উনি সুইসাইড করলেন…যদিও কিছুদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন।’
শর্মা একটু গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর সকলের সঙ্গে অর্কদেবের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘ওই সুইসাইডের ব্যাপারটা নিয়েই খানিকটা গোলমাল থেকে গেছে। সেইজন্যেই ডক্টর গুপ্তকে রিকোয়েস্ট করে নিয়ে এসেছি।’
‘গোলমাল! কীসের গোলমাল?’ শোকের মধ্যেও খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন অর্কদেব।
রঘুপতি ভুরু কুঁচকে অর্কদেবকে দেখছিল। এসিজি বুঝতে পারলেন, ও যদি সরাসরি এই কেসের দায়িত্বে থাকত তা হলে এখনই হয়তো রুক্ষভাবে কিছু বলে বসত।
বিজন শর্মা শান্তভাবে নরম গলায় বললেন, ‘মিস্টার সরকার, আপনার বাবার ঘরের দরজা-জানলা ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে বন্ধ ছিল। সেই অবস্থায় টেবিলে জ্বলন্ত সিগারেট আর কাগজপোড়া ছাই পাওয়া গেল—অথচ ঘরের কোথাও দেশলাই কিংবা লাইটারের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য দেশলাই কি লাইটার পাওয়া গেলেও আমাদের সন্দেহ থেকে যেত ওই সিগারেট পরমেশ্বরবাবু আদৌ ধরিয়েছেন কিনা। কারণ, উনি মারা গেছেন সকাল ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে, অথচ সিগারেটটা ন’টার সময়েও জ্বলছিল। সুতরাং অন্য কেউ নিশ্চয়ই ওই সিগারেট ধরিয়েছে, কাগজ পুড়িয়েছে। কিন্তু…।’
শর্মার কথার খেই ধরে রঘুপতি বলল, ‘লেকিন অওর কোই যদি সিগারেট জ্বালাবে তো সে দরওয়াজা-খিড়কি বন্ধ করে ঘর থেকে পালাবে কেমন করে?’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত অর্কদেব সরকারের অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। সেটায় গভীর টান দিয়ে আমেজে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, ‘সুইসাইড হোক বা হোমিসাইড হোক, তাতে আপনার তো কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়, অর্কদেববাবু!’
‘না, তা নয়…তবু…।’
রঙ্গলাল গোস্বামী এই প্রথম মুখ খুললেন, ‘আসলে এসিজি স্যার জানতে চান : ”সুইসাইড, না হোমিসাইড/খাঁটি গোল, না সেমসাইড।” ‘
অর্কদেব অবাক হয়ে রঙ্গলালের মুখের নিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাইরের উঠোনে বাচ্চা দুটো ‘গোল! গোল!’ করে প্রবল চিৎকার করছিল। অর্কদেব বিরক্ত হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন জানলার কাছে। চেঁচিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘তুতুন! মিমো! কী হচ্ছে! গোলমাল কোরো না—এখানে আমি গেস্টদের সঙ্গে কথা বলছি।’
সাময়িকভাবে বাচ্চাদুটোর চেঁচামেচি কমে গেল।
এসিজি অর্কদেবকে বললেন, ‘আমি আপনার বাবার ঘরটা একবার দেখব।’
পেন্ডুলাম-ঘড়িতে মিষ্টি সুরে সাড়ে আটটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল।
ওঁরা উঠে দাঁড়াতেই কোথা থেকে একটা বড়সড় মাপের কানঝোলা লোমওয়ালা কুকুর ঘরে এসে ঢুকল। কুকুরটার গায়ের রং উজ্জ্বল হলদে-বাদামি। সামান্য লেজ নেড়ে কুকুরটা অর্কদেব সরকারের পায়ের কাছে গা ঘষতে লাগল।
এসিজি কুকুরটার জাত চিনতে পারলেন : গোল্ডেন রিট্রিভার।
অর্কদেব কুকুরটাকে ‘টমি! টমি! গো।’ বলতেই ওটা গম্ভীর চালে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এসিজিকে উদ্দেশ করে অর্কদেব বললেন, ‘চলুন, ওপরে চলুন। মিস্টার শর্মা তো ঘরটা সিল করে রেখে গেছেন—।’
বিজন শর্মা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। চলুন, খুলে দিচ্ছি।’
দোতলায় ওঠার সিড়ির মুখে মার্বেল পাথরের খাটো স্তম্ভ। সেখান থেকে শুরু হয়ে গেছে পালিশ করা কাঠের মসৃণ রেলিং।
মার্বেল পাথরের ধাপে পা ফেলে ওঁরা ওপরে উঠতে যাবেন, ঠিক তখনই তুতুন আর মিমো ছুটে চলে এল ওঁদের কাছে।
বয়েসে সামান্য ছোট ছেলেটি বল আঁকড়ে ধরে লুকিয়ে পড়তে চাইল অর্কদেবের পিছনে। একইসঙ্গে অনুযোগের সুরে বলল, ‘দ্যাখো না বাপি, দাদা আমার থেকে বল কেড়ে নিচ্ছে।’
বড়জন প্রতিবাদে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, অর্কদেব তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন : ‘তুতুন, কেন এরকম অসভ্যতা করছ! বলো তো, ওঁরা কী ভাববেন!’
তারপর এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার দুই ছেলে…ভীষণ দুরন্ত…।’
এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বাচ্চা দুটোকে বললেন, ‘তোমাদের দুজনকে একটা ইন্টারেস্টিং ধাঁধা দিই, সলভ করতে পারলে প্রাইজ পাবে।’
এ-কথা শুনেই গোলগাল দু-ভাই ঝগড়া ভুলে এসিজির কাছে চলে এল।
এসিজি বললেন, ‘বলো তো, একটা মশা আর একটা মাছির লড়াই হলে কে জিতবে?’
সঙ্গে-সঙ্গে দুজনে হাঁ করে ভাবতে শুরু করল।
এসিজি হেসে ওদের বললেন, ‘উত্তরটা ভেবে পেলেই আমাকে বলে যাবে—আমি দোতলায় তোমাদের ঠাকুরদার ঘরে আছি।’
ওঁরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন।
অশোকচন্দ্রের প্রশ্নটা শোনার পর থেকেই রঙ্গলাল গুম হয়ে কী যেন ভাবছিলেন। সেই ভাবুক ভাবটা বজায় রেখেই তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রশ্নটা বড় কঠিন, বড় ইন্টারেস্টিং/মশা জেতে, নাকি মাছি, করিলে ফাইটিং।’
বিজন শর্মা আর অর্কদেব অবাক হয়ে রঙ্গলালকে দেখলেন। অর্কদেবের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও দেখা গেল।
প্রাচীন বিলাসবহুল বাড়িটার প্রতিটি অংশই এসিজিকে মুগ্ধ করছিল। দোতলায় উঠতে-উঠতে তিনি মনে-মনে ভাবছিলেন এইবার বোধহয় একটা বড়সড় পাখির খাঁচা দেখতে পাবেন, অথবা দাঁড়ে বসা অস্ট্রেলিয়ার অপূর্ব কাকাতুয়া।
কিন্তু এসিজিকে হতাশ হতে হল। তবে অর্কদেবকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, তিনতলার ছাদে পাখির খাঁচা একটা ছিল—দেশি-বিদেশি বহু পাখিও ছিল সেখানে। কিন্তু কী এক মড়ক লেগে রাতারাতি সব পাখি মারা যায়। তারপর থেকে পরমেশ্বর আর পাখি পোষেননি।
দোতলায় উঠে পরমেশ্বর সরকারের ঘরের দিকে এগোতে-এগোতে মহিলা-কণ্ঠের কথা শোনা গেল। তার একটু পরেই চওড়া বারান্দার লাগোয়া একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুজন ভদ্রমহিলা।
একজনের সিঁথিতে সিঁদুর। ফরসা মোটাসোটা ভারী চেহারা। চোখে চশমা। পরনে গোলাপি তাঁতের শাড়ি। বয়েস পয়তাল্লিশের এদিক-ওদিক হবে।
রঘুপতি যাদব আর বিজন শর্মার কাছে বিশদ বিবরণ যা শুনেছেন তাতে এসিজি অনুমান করলেন ইনি পরমেশ্বরবাবুর বড় মেয়ে ঈশানী মজুমদার।
দ্বিতীয় মহিলার রোগা ছিপছিপে চেহারা। পরনে হালকা রঙের আধুনিক নকশা কাটা শাড়ি। চোখে মানানসই চশমা। এখন চল্লিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও বেশ সুন্দরী। তবে চোখে মুখে চোয়ালে কেমন একটা একরোখা উদ্ধত ভাব। মনে হয় ইনি নির্দেশ দিতে অভ্যস্ত, নিতে নয়।
পরমেশ্বর সরকারের ছোট মেয়ে হিমানী সরকার। মনে-মনেই যেন আওড়ালেন এসিজি।
পরমেশ্বরবাবু মারা যাওয়ার ফলে তিন ছেলেমেয়েই সরাসরি বিশাল বড়লোক হয়ে যাবেন। বৃদ্ধ যদি সত্যি-সত্যিই খুন হয়ে থাকেন তা হলে এই তিনজনের মধ্যেই খুনি লুকিয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে ওঠার জন্য খুনি ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন?
পরমেশ্বর সরকার যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছিলেন। আর বছরকয়েক অপেক্ষা করলে স্বাভাবিকভাবেই হয়তো তাঁর মত্যু হত। তা হলে…।
অর্কদেব, ঈশানী আর হিমানীকে দেখে ওঁদের কাউকে খুনি বলে ভাবতে বেশ কষ্ট পেলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তুতুন আর মিমোর কথা মনে পড়ল তাঁর। বাপি অথবা পিসিদের একজনকে ঠাকুরদার হত্যাকারী হিসেবে মেনে নিতে কী কষ্টই না হবে ওদের! নেহাত বয়েস কম বলে হয়তো পুরো ব্যাপারটা ততটা বুঝে উঠতে পারবে না।
নাঃ, খুন যেমন জঘন্য কাজ তেমনই খুনি খুঁজে বের করার কাজটাও জঘন্য।
পরমেশ্বর সরকারের ঘরের কাছে এসে বিজন শর্মা সিল ভেঙে ঘরের তালা খুলে দিলেন।
অর্কদেব, হিমানী ও ঈশানীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ওঁরা চারজন ঢুকে পড়লেন ভেতরে।
ঘরে ঢুকেই রঙ্গলালবাবু নাক কুঁচকে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন কয়েকবার।
অশোকচন্দ্র অবাক হয়ে স্বভাবকবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’
চোখে সবজান্তার দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলে রঙ্গলাল বললেন, ‘অন্তরীক্ষ, জল, স্থল/সবার ওপরে অকুস্থল।’
বিজন শর্মা আর রঘুপতি ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর রঘুপতি আঙুল তুলে পুবদিকের কাচের জানলার কাছে রাখা একটা বড় মাপের টেবিল দেখিয়ে মন্তব্য করল, ‘পরমেশ্বরবাবু ওই টেবিলে বসেছিলেন…।’
বিজন শর্মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
শুধু টেবিল নয়, গোটা ঘরটাকেই জরিপ করে দেখছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
পুরোনো সময়ের ছাপ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চেয়ার, টেবিল, ছোট মাপের পেন্ডুলাম দেওয়াল-ঘড়ি, আলমারি, আর বইয়ের র্যাক—সবকিছুর গায়েই সেই পরিচয়ের সিলমোহর। বইয়ের র্যাকের অসংখ্য বই জানিয়ে দেয় পরমেশ্বর পড়ুয়া লোক ছিলেন।
জানলার কাছে রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন এসিজি।
কাচের জানলাটা প্রায় চার ফুট বাই চার ফুট। জানলা বন্ধ ছিল।
জানলার বাইরেই চওড়া বারান্দা। সেখানে একটা টেবিল আর ইজিচেয়ার রয়েছে। ওই চেয়ারে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকার আর কখনও শরীর এলিয়ে বিশ্রাম নেবেন না সেটা ভাবতেই কেমন অস্বস্তি হল এসিজির। পুরোনো আসবাবগুলো রয়ে গেছে, শুধু পুরোনো মানুষটা চলে গেছে।
বারান্দায় সকালের রোদ এসে পড়েছিল। কাচের জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে পরমেশ্বরের ঘরের টেবিলেও। টেবিলের ঝকঝকে পালিশ করা কাঠ সেই রোদের প্রতিবিম্ব ছিটকে দিয়েছে ঘরের দেওয়ালে।
হাতঘড়ি দেখলেন এসিজি। প্রায় পৌনে ন’টা। সূর্য যত ওপরে উঠবে টেবিলের রোদ ততই সরে যাবে জানলার দিকে। এখন টেবিলের মাত্র সিকিভাগ রোদের আওতায় রয়েছে। আরও আধঘণ্টা আগে নিশ্চয়ই বেশি ছিল।
টেবিলে একটা পাথরের তৈরি অ্যাশট্রে পড়ে ছিল। হাতের ছোট হয়ে আসা সিগারেটটা কী করে যেন নিভে গিয়েছিল। সেটা অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিয়ে অশোকচন্দ্র ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা পরমেশ্বরবাবুর সেই অ্যাশট্রে?’
বিজন শর্মার কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ দেখা যাচ্ছিল। হয়তো বুঝতে চাইছিলেন রঘুপতি যাদবের প্রাক্তন স্যার এই বৃদ্ধ হুনুর তদন্ত করে নতুন আর কোন তথ্য আবিষ্কার করেন। এসিজির প্রশ্নে তটস্থ হয়ে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, একই অ্যাশট্রে। অ্যাশট্রের খাঁজে রাখা জ্বলন্ত সিগারেটটা আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, সিগারেটের ফিলটারের দিকে ঠোঁটের চাপের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হয়তো খেয়ালবশে পরমেশ্বর সরকার সিগারেটটা ধরিয়েছিলেন, তবে খাননি। খোঁজ করে জেনেছি, উনি গত পরশু একজন কাজের লোককে দিয়ে একটা সিগারেট আনিয়েছিলেন। হয়তো কাল সকালে সেটাই ধরাবেন বলে ভাবছিলেন।’
এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। তারপর ছোট্ট করে বললেন, ‘হুঁ—কিন্তু ধরাননি।’
‘কাগজ-পোড়া ছাইটা ওই জায়গায় ছিল—’ অ্যাশট্রের কাছাকাছি চক দিয়ে দুটো ‘ক্রস’ চিহ্ন দেওয়া ছিল। তারই একটা দেখিয়ে বিজন শর্মা বললেন।
তখন রঘুপতি অন্য ‘ক্রস’ চিহ্নটা দেখিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওইখানে তা হলে চায়ের কাপ ছিল…।’
এসিজি লক্ষ করলেন, অ্যাশট্রে এবং চকের মার্ক দেওয়া জায়গা দুটো রোদের বেশ কাছাকাছিই রয়েছে। একটু আগেই হয়তো ওখানে রোদ পড়েছিল।
রঘুপতি কী যেন ভেবে ইতস্তত করে বলল, ‘গুপ্তাসাব, রোদ পড়ে চা গরম হয়ে যায়নি তো!’
অশোকচন্দ্র তারিফের নজরে ফিরে তাকালেন রঘুপতির দিকে, বললেন, ‘ভালো বলেছ। গুড ডিডাকশন। কিন্তু সিগারেটে আগুন ধরল কী করে, আর কাগজ পুড়ে ছাই হল কী করে?’
‘সেটাই তো আমি কাল থেকে ভাবছি।’ ব্যাজার মুখে মন্তব্য করলেন শর্মা।
টেবিলটাকে ঘিরে বারকয়েক পাক খেলেন এসিজি। একইসঙ্গে তিনি কাচের জানলার দিকে দেখছিলেন। হঠাৎই তিনি বিজন শর্মাকে লক্ষ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘জানলার লকটা ভালো করে চেক করেছেন তো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিজন শর্মা। তারপর শ্রান্ত গলায় বললেন, ‘চেক করেছি মানে! কাল এক চাবিওয়ালাকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে এসেছিলাম। সে জানলা-দরজা সব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছে। তারপর স্পষ্ট বলেছে, কোনও অবস্থাতেই জানলা দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে খোলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া কেউ যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কায়দা করে জানলা বা দরজা টেনে দিয়ে ভেতরের ছিটকিনি আটকে দেবে, তাও অসম্ভব। সুতরাং বুঝতেই পারছেন…।’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘লকড রুম পাজল…আপনার ফেভারিট, স্যার।’
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন এসিজি, পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে নতুন আর-একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে আরও একবার ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
ঘরটার মাপ বড়জোর দশ বাই দশ। ঘরে দুটো একই মাপের জানলা, একটা পুবদিকের দেওয়ালে, আর-একটা দক্ষিণে—দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকটায়। দুটোই কাচের জানলা, তার ওপরে পরদা টেনে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। জানলা দুটোর ছিটকিনি ভেতর থেকে আঁটা। ঘরের একটিমাত্র দরজা ভারী কাঠের তৈরি, তবে তার ছিটকিনিটা ভাঙা। গতকাল এই সময়ে অর্কদেবরা ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ঘরে ঢুকেছেন। ঘরের আসবাবপত্র বলতে দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, একটা টিভি, আর চারটে বইয়ের র্যাক।
বিজন শর্মার কাছেই অশোকচন্দ্র শুনেছেন ঘরটা পরমেশ্বরবাবুর পড়াশোনার আর বিশ্রামের ঘর ছিল। দোতলার কোণের দিকে তাঁর শোওয়ার ঘর। রোজ ঘুম থেকে উঠেই তিনি এ-ঘরে চলে আসতেন। সকালের রোদ টেবিলে রেখে চা খেতেন, বই পড়তেন, ছেলেমেয়েরা বা অন্য কেউ কথা বলতে এলে এ-ঘরে বসেই সেইসব কথাবার্তা সারতেন।
কিছুদিন ধরে পরমেশ্বরবাবু নাকি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তাঁর বিষয়-সম্পত্তির অনেকটা অংশ রামকৃষ্ণ মিশন বা ওইরকম কোনও প্রতিষ্ঠানে দান করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এমনকী ফোন করে উকিলের সঙ্গে এ-ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তাও নাকি বলেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, কিছু দিন ধরেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি তর্ক-বিতর্ক চলছিল। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, ছেলেমেয়েরা তাঁকে গুরুজন হিসেবে ছিটেফোঁটাও গুরুত্ব দেয় না। এ-কথা তিনি প্রায়ই চিৎকার করে বলতেন। দু-নাতির কাছেও এ-নিয়ে আক্ষেপ করতেন। কথনও-কখনও নাকি কান্নাকাটিও করতেন। বাড়ির কাজের লোকরা সব শুনেছে।
ঘরটা দেখতে-দেখতে বিজন শর্মার কথাগুলো মনে পড়ছিল এসিজির।
তা হলে ডিপ্রেশানের শিকার হয়ে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকার সত্যি-সত্যিই সুইসাইড করেছেন? নাকি ব্যাপারটা খুব…আর রঘুপতি যাদবের কথামতো ‘দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক’!
কিন্তু খুনই যদি হবে, তা হলে দরজা-জানলার ছিটকিনি ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে খুনি ঘর থেকে পালাল কেমন করে?
এইসব ভাবতে-ভাবতে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন এসিজি। কার্বন ফ্রেমের চশমাটাকে সামান্য নেড়েচেড়ে সিগারেটে টান দিতে লাগলেন।
রঙ্গলাল গোস্বামী বইয়ের র্যাকের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন। হঠাৎই একটা বই তাক থেকে টেনে নিয়ে তিনি চলে এলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার কাছে। বইটা এসিজির মুখের কাছে ধরে বললেন, ‘এই পুস্তকটি লক্ষ্যণীয়, এসিজি স্যার।’
এসিজি বইটার দিকে তাকালেন। জেমস হিলটনের লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস ‘ওয়াজ ইট মার্ডার?’ ১৯৩১ সালে গ্লেন ট্রেভর ছদ্মনামে লেখা।
সামান্য হেসে রঙ্গলালের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন, স্বভাবকবিবর, আমি এখন এই প্রশ্নটা নিয়েই ভাবছি।’
রঙ্গলাল একটু ইতস্তত করে বইটা আবার জায়গামতো রেখে দিয়ে এলেন।
রঘুপতি স্যারকে লক্ষ করছিল। ও আলতো গলায় জিগ্যেস করল, ‘অন্ধকারে কোনও রোশনি চোখে পড়ল, স্যার?’
এসিজি প্রাক্তন ছাত্রের দিকে ফিরে অনেকটা যেন আপনমনেই বললেন, ‘সেটাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আচ্ছা, এমন যদি হয়, ধরো, খুনি বিষ মেশানো চা-টা পরমেশ্বর সরকারকে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তারপর পরমেশ্বরবাবু দরজা-জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন, এবং বিষাক্ত চা খেয়ে মারা গেলেন। তখন—’
বিজন শর্মা এসিজিকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তাতে গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে চারটে ব্যাপার : গরম চা, জ্বলন্ত সিগারেট, কাগজ পোড়া ছাই, আর—।’
‘ঘরের ভেতরে নো দেশলাই—’ শর্মাকে বাধা দিয়ে ছন্দে পাদপূরণ করলেন রঙ্গলাল।
‘ব্যাপারটা মার্ডার বলে ভাবতে চাইলে যে-সমস্যা, সুইসাইড বলে ভাবলেও সেই একই। মানে, প্রবলেমের সেকেন্ড পার্টটা থেকেই যাচ্ছে।’ আপনমনে বললেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, ‘তা হলে সেকেন্ড পার্টটাই প্রথমে সলভ করার চেষ্টা করে দেখি।’
রঘুপতি তার স্যারের কথায় হেসে বলল, ‘আপনার যা মরজি।’
এসিজি আনমনাভাবে সিগারেটে টান দিয়ে চললেন, আর একইসঙ্গে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকারকে অনুভব করার চেষ্টা করলেন। ছেলেমেয়েদের ওপরে তিতিবিরক্ত মানসিক অবসাদে ক্লান্ত বৃদ্ধ মানুষটি কি সত্যই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন? নাকি বৃদ্ধ পিতার ওপরে তিতিবিরক্ত তিন ছেলেমেয়ের কেউ রাগের মাথায় একটা জঘন্য কাজ করে ফেলেছে?
আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে, সিগারেট ধরিয়ে কাগজ পোড়ানোর পর সেই আগুনে পরমেশ্বরবাবু দেশলাইটাকেও পুড়িয়ে ফেলেছেন! অথবা, দেশলাই বা লাইটারটাকে কারও হাত দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিংবা জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জানলা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন!
তাই যদি হবে, তা হলে উনি মারা যাওয়ার কম করে একঘণ্টা পরেও চা কী করে গরম ছিল, আর সিগারেটই বা কেমন করে জ্বলছিল।
এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েও বিষয়গুলো রঘুপতি আর শর্মার সঙ্গে আলোচনা করলেন এসিজি। এবং যথারীতি চা আর সিগারেটের সমস্যায় এসে ধাক্কা খেলেন।
সুতরাং এই সিদ্ধান্তেই তা হলে পৌঁছতে হয় যে, ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ হওয়ার পর বাইরে থেকে চা-সিগারেটের ব্যাপারটা করা হয়েছে। অথচ আপাতভাবে কাজটা অসম্ভব।
নিজের ওপরে যেন খানিকটা বিরক্ত হয়েই ঘরের বাইরে চলে এলেন বৃদ্ধ হুনুর।
অর্কদেব ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছিলেন। আত্মীয়স্বজন কয়েকজন চলে এসেছেন বাড়িতে। পরমেশ্বরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া বলতে একমাত্র নিস্তব্ধতা। সকলেই বেশ নিচু গলায় কথা বলছিলেন।
বিজন শর্মা এসিজির পিছন-পিছন বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি এসিজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি অর্কদেব, ঈশানী বা হিমানীর সঙ্গে কথা বলতে চান?’
এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘নতুন আর কী জিগ্যেস করব! যা জানার আপনার কাছেই তো জেনে গেছি। বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ করতে পারলেই বাকি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে।’
রঘুপতি যাদবের কথা মনে পড়ল আবার ‘দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক—।’
কিন্তু কী সেই ট্রিক, কী সেই কৌশল?
এইসব ভাবতে-ভাবতে পুব দিকের বারান্দায় চলে এলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। সকালের রোদ সরতে-সরতে এখন পরমেশ্বরের ঘরের বাইরে, বারান্দার মেঝেতে। মেঝেতে পড়ে থাকা রোদের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন।
বারান্দার নিচেই বাগান। বাগানে অনেক সবুজ। রোদ পড়ে মসৃণ পাতাগুলো চিকচিক করছে। ছোট হয়ে আসা সিগারেটের টুকরোটা বাগানের দিকে ছুড়ে দিলেন এসিজি।
বাগানে নিয়মিত পোকামাকড় মারার ওষুধ দেওয়া হয়। সেই ওষুধই কেউ মিশিয়ে দিয়েছে পরমেশ্বরের চায়ের সঙ্গে। সকালে একসঙ্গে সকলের চা তৈরি হয়েছে। কাজের লোকরাই চা ভাগ করে যার-যার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। চা খাওয়ার সময় অর্কদেব একবার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। তাতে বৃদ্ধ পরমেশ্বর বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। গতিক সুবিধের নয় দেখে অর্কদেব চলে এসেছিলেন ঘর থেকে।
অর্কদেবকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন বিজন শর্মা।
অর্কদেব ঘটনাটা অস্বীকার করেননি। তিনি যা বলেছেন তা সংক্ষেপে এই : ব্যারাকপুরে ওঁদের তিনটে সেকেলে ধাঁচের সিনেমা হল আছে। অর্কদেবের ইচ্ছে, দুটো হল বিক্রি করে সেই টাকায় অন্য সিনেমা হলটাকে ভোল পালটে একেবার আধুনিক করে তোলেন। এ-ব্যাপারে তিনি লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তাও এগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পরমেশ্বর সরকার বেঁকে বসেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, সেকেলে হলেই কি যে-কোনও জিনিস বিক্রি করে দিতে হবে। তারপর সিগারেট খাওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে অর্কদেবের একটু কথাকাটাকাটি হয়।
সম্পত্তি থাকলে ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকে। কিন্তু তার জন্য এতবড় দুঃসাহসী কাজ কি অর্কদেব বা অন্য কেউ করতে পারেন! যদিও বা করে থাকেন তা হলে কীভাবে? তার ওপর গরম চা আর জ্বলন্ত সিগারেটের জট তো আছেই!
চুলের গোছায় টান মেরে চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমাটা খুলে নিলেন এসিজি। সঙ্গে-সঙ্গে বাগানের গাছপালা তাঁর চোখে কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেল। যে চোখ থাকতেও ভালো করে দেখতে পায় না তার ঝাপসা দেখাই ভালো—নিজের ওপরে বিরক্ত হয়ে ভাবলেন এসিজি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে তাকালেন পরমেশ্বরবাবুর ঘরের জানলার দিকে। কাচের ভেতর দিয়ে আবছাভাবে রঘুপতি, বিজন শর্মা ও রঙ্গলাল গোস্বামীকে দেখা যাচ্ছে। ওঁরা ঘরের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছেন।
হঠাৎই অশোকচন্দ্রের চোখ পড়ল বারান্দার মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর রোগা শরীরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
বারান্দার মার্বেল পাথরের মেঝেতে অনেকটা অংশ জুড়ে রোদ পড়েছে। আর একইসঙ্গে এসিজির হাতে আলতো করে ধরা চশমার ছায়াও পড়েছে সেখানে। চশমার কাচের ছায়ার মাঝখানটায় একটা করে রোদের উজ্জল টিপ : সূর্যের প্রতিবিম্ব।
এসিজি চশমাটা বারকয়েক নেড়েচেড়ে কাচের ছায়া দুটো লক্ষ করলেন। যদিও চোখে চশমা না থাকায় লক্ষ করার কাজটা খুব ভালোভাবে করা যাচ্ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা বুঝতে কোনওরকম অসুবিধে হল না।
চশমাটা চোখে দিয়ে পরমেশ্বরবাবুর জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন অশোকচন্দ্র। জানালার কাচে টোকা দিয়ে রঘুপতিদের ইশারা করে বাইরে আসতে বললেন। তারপর আপনমনেই হেসে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ হুনুর।
‘কী ব্যাপার, গুপ্তাসব? এনি সলিউশান?’ কাছে এসে দাঁড়ানোমাত্রই কৌতূহলী প্রশ্ন ছুড়ে দিল রঘুপতি যাদব।
উত্তরে অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘আমি একটা খাঁটি গর্দভ, রঘুপতি। বুঝতে পারছি, ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনায় আমার অনেক ফাঁক থেকে গেছে। বিশেষ করে অপটিক্সে—মানে, আলোক-বিজ্ঞানে…।’
‘আপনার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ হতবম্ব হয়ে মন্তব্য করলেন বিজন শর্মা।
এসিজি শর্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার মার্ডার মিস্ট্রি আমি এখনও সলভ করতে পারিনি, তবে বন্ধ ঘরের মিস্ট্রি সলভ করতে পেরেছি।’
রঙ্গলাল বললেন, ‘অধম এখনও ইন অন্ধকার/ আজ্ঞা হোক খুলে বলিবার।’
এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মেরে বিজন শর্মাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনি অর্কদেববাবুকে একবার এখানে আসতে বলুন। আর ওঁর দু-বোনকেও আসতে বলবেন।’
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ওঁরা তিনজনে বারান্দায় এসে হাজির। অর্কদেব চেষ্টা করে শান্ত স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেছেন। তবে ঈশানী ও হিমানীর মুখে বিব্রত ও বিরক্ত ভাব বেশ স্পষ্ট।
অর্কদেব নরম গলায় বললেন, ‘ওপরের কাজ হয়ে গেলে নিচে চলুন—সেখানে আপনাদের জন্যে সামান্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এসিজি মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, যাব—তবে তার আগে একটু জরুরি কাজ সেরে নেব।’
তারপর সরাসরি হিমানীর চোখে তাকিয়ে কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন বললেন, ‘হিমানীদেবী, আপনার কাছে কি চার-পাঁচ ইঞ্চি ডায়ামিটারের কোনও ম্যাগনিফাইং গ্লাস—মানে, আতসকাচ আছে?
চশমার পিছন থেকে কয়েক সেকেন্ড ঠান্ডা চোখে অপলকে অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন হিমানী। তারপর বললেন, ‘সবই বুঝতে পেরেছেন তা হলে?’
অর্কদেব আর ঈশানী অবাক চোখে ছোট বোনের দিকে তাকালেন।
হিমানীর বাঁকা প্রশ্নের উত্তরে এসিজি হেসে বললেন, ‘না, সবটা বুঝতে পারিনি—যেটুকু পেরেছি বলি—ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন।’
‘সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে কোনও এক সময় আপনি পরমেশ্বরবাবুর ঘরে এসেছিলেন—হয়তো ওঁর সঙ্গে কোনও কথা বলার ছিল। আপনি এসে দেখলেন, ঘরের দরজা-জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। আর বারান্দার লাগোয়া ওই জানলার কাছে টেবিলে মাথা রেখে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আপনার বাবা।
‘এ ছাড়াও কয়েকটা জিনিস দেখতে পেলেন আপনি। অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ, তার কাছাকাছি একটা কাগজ, আর অ্যাশট্রের খাঁজে রাখা একটা গোটা সিগারেট।
‘পরমেশ্বরবাবু যে সুইসাইড করেছেন, সেটা বুঝতে আপনার বিশেষ কষ্ট হল না। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, আপনার মনে হল ব্যাপারটা একটু জট পাকিয়ে দেওয়া যাক। তাই ঘর থেকে আতসকাচটা নিয়ে এলেন। এই বারান্দায় তখন রোদ এসে পড়েছিল। ওই কাচের জানলা দিয়ে সেই রোদ পরমেশ্বরবাবুর টেবিলে গিয়েও পড়েছিল। সুতরাং, এরপর আপনার কাজ হল, আতসকাচ দিয়ে সূর্যকে ফোকাস করে টেবিলের ওপরে ফেলা। বড় ডায়ামিটারের আতসকাচ থাকলে কাজটা মোটেই কঠিন নয়।
‘তারপর আতসকাচ তার যা-কাজ তা-ই করেছে। সিগারেট ধরিয়েছে, কাপের চা গরম করেছে, আর টেবিলে পড়ে থাকা কাগজটা পুড়িয়েছে। আমার ধারণা, কাগজটা পরমেশ্বরবাবুর সুইসাইড নোট ছিল—তাতেই স্পষ্ট লেখা ছিল, কেন তিনি আত্মহত্যা করছেন—।’
এসিজির কথা শেষ হল।
সবাই ভাবছিল, হিমানী নিশ্চয়ই চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন, অথবা কান্নায় ভেঙে পড়বেন। কিন্তু হিমানী কোনওটাই করলেন না। বরং ঠান্ডা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ডক্টর গুপ্ত। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমার ঘরেই আছে। আমার রিসার্চের কাজে লাগে—গ্রাফ থেকে কোনও ভ্যালু নেওয়ার সময়, কিংবা কোনও ফটোগ্রাফ খুঁটিয়ে দেখার সময়। আপনি ফিজিক্সের লোক—আপনি বুঝতে পারবেন।’ চোখের চশমাটা একবার ঠিক করে নিলেন হিমানী। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘বাবার দিন-দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মানসিক অবসাদে হয়তো ভুগছিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে ভীষণ বদমেজাজি আর খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের তিনজনের সঙ্গে তো প্র্যাকটিক্যালি চাকর-বাকরদের মতো ব্যবহার করতেন।’
‘কিন্তু প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল সুইসাইডটাকে আপনি হঠাৎ জট পাকাতে গেলেন কেন?’ বিজন শর্মা হিমানীর কাছে জানতে চাইলেন।
‘দাদার জন্যে।’ নিষ্প্রাণ গলায় স্পষ্ট উত্তর দিলেন হিমানী। তারপর অর্কদেবের দিকে ফিরে বললেন, ‘দাদা, কিছু মনে কোরো না। তোমার লোভ তোমাকে একটু-একটু করে অন্যরকম করে দিচ্ছে। বাবার সঙ্গে তোমার যেসব ব্যাপার নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হত তার অনেকটাই আমার কানে এসেছে। তোমার হাতে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির দায়িত্ব দিয়ে আমি বা দিদি কেউই নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না। এ নিয়ে আমাদের খোলাখুলি আলোচনা করা দরকার। বাবার শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যাপারটা আগে মিটে যাক—।’
অর্কদেবের চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনও জবাব দিলেন না।
ঈশানী চোখে আঁচল চেপে হঠাৎই কাঁদতে শুরু করলেন।
এসিজি রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, আমার কাজ শেষ—এবার আমি যাই। তুমি আর শর্মা মিলে এই ব্যাপারটা নিয়ম-টিয়ম মেনে ফাইল বন্দি কোরো।’
বিজন শর্মা এসিজিকে বললেন, ‘চলুন, ডক্টর গুপ্ত, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। হেলপ করার জন্যে মেনি থ্যাঙ্কস।’
অর্কদেব কাছে এগিয়ে এসে খুব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘একটু চা না খেয়ে যেতে পারবেন না…প্লিজ…।’
অশোকচন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে রাজি হলেন।
রঘুপতি বলল, ‘শর্মা, চায়ের পর তা হলে ফরমালিটিগুলো সেরে নেওয়া যাবে।’
অর্কদেব ওঁদের চারজনের সঙ্গে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ঈশানী আর হিমানী একইভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
যেতে-যেতে অর্কদেব বললেন, ‘কাল সকালে সিগারেট খাওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে রাগারাগির সময় বাবার লাইটারটা আমিই কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম…কিন্তু তারপর…এরকম সব ব্যাপার হবে বুঝিনি।’
রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘হিমানীদেবীকে আপনি কী করে সন্দেহ করলেন, স্যার?’
‘লেন্সের ব্যাপারটা বুঝতে পারার পরই মনে হয়েছিল এটা বোধহয় বিজ্ঞান জানা কোনও লোকের কাজ। আর সেরকম লোক তো এ-বাড়িতে একজনই…। কিন্তু আতসকাচ নিয়ে ওইসব কাণ্ড করার সময় হিমানীকে দোতলার বারান্দায় কেউ দেখতে পেল না, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে!’
এসিজির এই সমস্যার সমাধান করে দিল দুই মূর্তিমান : তুতুন আর মিমো।
মশা-মাছি সমস্যার সমাধান করে দুটো বাচ্চাই উন্মুখ হয়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দার জন্য অপেক্ষা করছিল।
এসিজি ওদের বললেন, ‘ধাঁধার উত্তর শোনার আগে তোমাদের একটা প্রশ্ন করব। কাল সকালে দোতলায় তোমাদের ঠাকুরদার বারান্দায় কাউকে দেখতে পেয়েছিলে?’
ওরা একইসঙ্গে জানাল, হ্যাঁ। ছোটপিসি বারান্দায় ঠাকুরদার জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল। হাতে সেই বড় কাচটা ছিল—যেটা দিয়ে লেখা বড়-বড় দেখায়। ওরা তখন বাগানে খেলছিল।
অশোকচন্দ্র আপনমনেই হাসলেন। ওদের সঙ্গে কথা বললে অনেক আগেই বন্ধ ঘরের রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। বাচ্চারা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখে।
এইবার তিনি মশা-মাছির সমস্যার উত্তর জানতে চাইলেন বাচ্চা দুটোর কাছে।
উত্তরে মিমো প্রথমে বলল, ‘মশা জিতবে, মাছি হেরে যাবে।’
এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘কেন?’
‘মশা মাছিটাকে তাড়া করে হুল ফুটিয়ে সব রক্ত টেনে নেবে। তাতে মাছিটা উইক হয়ে গিয়ে মারা যাবে।’
তখন তুতুন বলল, ‘না, জেঠু, দুজনেই মরে যাবে। মশা মাছিটাকে কামড়ে দিলে মাছিটার ম্যালেরিয়া হবে, আর মাছির থেকে মশার হবে কলেরা—তাতে দুজনেই মরে যাবে।’
তুতুনের উত্তর শুনে কেউ আর হাসি চাপতে পারলেন না।
অশোকচন্দ্র পকেট থেকে টাকা বের করে অর্কদেবকে অনুরোধ করলেন কাউকে দিয়ে দুটো ক্যাডবেরি চকোলেট আনিয়ে দেওয়ার জন্য। ওদের প্রাইজ।
রঙ্গলাল গোস্বামী মাথা নেড়ে বললেন, ‘কোশ্চেনটা ছিল শক্ত, ছিল ইন্টারেস্টিং/মশা-মাছি দুজনেই ইকোয়াফাইটিং।’
রঘুপতি যাদব অবাক হয়ে রঙ্গলালকে প্রশ্ন করলেন, ‘ইকোয়াফাইটিং মানে?’
সলজ্জ হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘ওই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান। ”ইকোয়াল ইন ফাইটিং”-কে প্রথমে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসের নিয়মে সমাসবদ্ধ করেছি। তারপর নিপাতনে বয়েল করে সন্ধি করে ছেড়ে দিয়েছি।’
অশোকচন্দ্র গুপ্ত খোলা গলায় হেসে উঠে বললেন, ‘স্বভাবকবিবর, আপনার সত্যিই কোনও জবাব নেই।’
রঙ্গলাল বললেন, ‘স্বভাবকবিতায় ব্যাকরণের অ্যাপ্লিকেশানটাই আসল, স্যার।’
যেন বলে গেছেন, খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য।
এ-কথাটা ভাবামাত্রই হেসে ফেললেন বৃদ্ধ হুনুর ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি। কারণ, এই কথাটা কোনও মহাপুরুষ মোটেই বলে যাননি। বহু বছর ধরে খুন এবং খুনি ঘাঁটাঘাঁটি করে এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই পৌঁছে গেছেন। একটা কথা বহুদিন ধরে বিশ্বাস করলে একসময় মনে হয়, কথাটা নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও মহাপুরুষ বলে গেছেন। নিজের বিশ্বাসের দায় তখন অনায়াসে কোনও মহাজনের ঘাড়ে চেপে যায়।
একটু আগেই একটা টেলিফোন এসেছিল। গড়পাড় থেকে কে এক দীপ্তিমান বসাক এসিজিকে ফোন করেছিলেন।
‘হ্যালো, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আছেন?’ একটু ভারি অথচ বেশ চমৎকার গলায় প্রশ্ন করল কেউ।
‘হ্যাঁ—বলছি।’
‘আ-আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। আ-আমাকে আপনি চিনবেন না।’ থতিয়ে-থতিয়ে বললেন দীপ্তিমান, ‘একটা জরুরি ব্যাপারে আপনার হেলপ চাইছি। যদি কাইন্ডলি আপনার সঙ্গে দেখা করার পারমিশান দেন…।’
দীপ্তিমান বসাক নামে কাউকে চেনেন না এসিজি। কী করে তিনি এসিজির ফোন-নম্বর পেলেন কে জানে! তবে ভদ্রলোকের গলা বেশ উত্তেজিত এবং নার্ভাস বলে মনে হল।
‘কী ব্যাপারে দেখা করতে চান আপনি?’ আন্তরিক গলায় জানতে চাইলেন এসিজি।
অশোকচন্দ্র একসময় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। সেটা জেনে অনেকে ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা সবই পাড়ার লোক। আর এলাকার বাইরে থেকে অনেকে যোগাযোগ করেন ছাত্র পড়ানোর জন্য। তাতে তিনি বিব্রত হন—অনেকসময় বিরক্তও হন। কারণ, কোচিং ক্লাস তিনি অপছন্দ করেন।
দীপ্তিমান কি ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে দেখা করতে চান নাকি?
‘আমার খুব ক্লোজ একজন রিলেটিভ পাঁচদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। তবে…।’
এসিজি সজাগ হলেন পলকে। মাথার ধবধবে চুলের গোছায় আলতো করে কয়েকবার টান মারলেন।
‘তবে কী?’
‘আপনাকে…আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা…ব্যাপারটা জেনুইন অ্যাক্সিডেন্ট। অন্য কিছু নয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে দীপ্তিমানের গলা কাঁপছিল।
‘আপনার কি ধারণা ব্যাপারটা আসলে মার্ডার?
‘হতেও তো পারে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান বসাক : ‘আবার নাও হতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’
দীপ্তিমানের কথায় একটা আকুল ভাব টের পাচ্ছিলেন এসিজি। তাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে রাজি হলেন। বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দীপ্তিমানকে বললেন সন্ধে সাতটায় আসতে।
আর তারপরই মনে হল ওই কথাটা : খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, আপাতভাবে নির্দোষ যে-মানুষটা স্বাধীনভাবে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, তার দিকে বেপরোয়া আঙুল তুলে খুনের কলঙ্কের সিলমোহর তার কপালে স্থায়ীভাবে এঁকে দেওয়া—সত্যিই খুব জঘন্য। তখন এসিজির নিজেকেই কেমন অপরাধী বলে মনে হয়।
একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কাছে এসে দীপ্তিমান কী বলবেন কে জানে! তা ছাড়া, তাঁর ওই রিলেটিভ কোন থানার এলাকায় মারা গেছেন এসিজি জানেন না। যদি সত্যি-সত্যিই তাঁকে রহস্যভেদের কাজে নামতে হয় তা হলে ব্যাপারটা অনেকটা নাক গলানোর মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।
সুতরাং সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ডায়াল করলেন।
দীপ্তিমান বসাক যখন এসিজির শ্যামবাজারে ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন তখন সাতটা বেজে মিনিট পনেরো হয়েছে।
রঘুপতি যাদব এসেছে অনেক আগেই। বসবার ঘরে বসে আয়েস করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল রঘুপতি। আর প্রাক্তন স্যারের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে নানান কথা শুনছিল। সম্প্রতি এসিজি পাখির ডাকের স্পেকট্রাল অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটে এ নিয়ে গবেষণা করে সিগনাল রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কোনও-কোনও পাখির ডাকের হুবহু নকল করতে পেরেছে। এমনকী, তারা বহু স্ত্রী-পাখির ব্রিডিং কল নকল করে পুরুষ-পাখিকে গাছের আড়াল থেকে বাইরে টেনে এনেছে।
এসব রোমাঞ্চকর গবেষণার কথাই এসিজি শোনাচ্ছিলেন রঘুপতিকে। আর রঘুপতি অবাক হয়ে লম্বা ছিপছিপে মানুষটাকে দেখছিল। কোথায় ফিজিক্স, আর কোথায় পাখি! আর কোথায়ই বা গোয়েন্দাগিরি!
‘স্যার, কী করে যে আপনি এতদিকে মন লাগাতে পারেন সে আপনিই জানেন!’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল রঘুপতি।
হাতের সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘মন তো লাগাই না! মন লেগে যায়।’
ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।
এসিজি ওঠার আগেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রঘুপতি। প্রাক্তন স্যারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে…।’ এবং এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল।
‘নমস্কার। আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। জ্যামের জন্যে পনেরো মিনিট দেরি হয়ে গেল।’
এ-কথা বলে ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁকে ভালো করে জরিপ করলেন এসিজি।
প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা ভদ্রলোকের খুঁড়িয়ে চলা। বোধহয় ছোটবেলায় পোলিও বা ওইরকম কোনও অসুখ হয়েছিল। চৌকোনা মুখ। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটো অস্বাভাবিকরকম বড়। গাল সামান্য ভাঙা। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। পুরু ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফ। গায়ের রং ময়লা। বয়েস তেতাল্লিশ কি চুয়াল্লিশ।
চেহারায় বেঁটেখাটো দীপ্তিমানকে দেখে প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সেটা ভালো নয়। কিন্তু ওঁর গলার স্বর একেবারে হিপনোটাইজ করে ফেলার মতো।
এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিমানকে প্রতি নমস্কার জানালেন। তারপর একটা খালি সোফায় বসতে ইশারা করলেন।
দীপ্তিমান বসতেই এসিজি গলা চড়িয়ে বিশুকে ডাকলেন। বিশু বোধহয় ভেতরের ঘরে টিভি দেখছিল। ডাক শুনে এসে দাঁড়াল। বারো-তেরো বছরের এই ছেলেটি অশোকচন্দ্রের দিন-রাতের সঙ্গী।
‘ভালো করে তিনকাপ কফি কর দেখি—।’
অর্ডার পেয়েই বিশু ব্যস্তভাবে চলে গেল কফির আয়োজন করতে।
রঘুপতির সঙ্গে দীপ্তিমানের আলাপ করিয়ে দিলেন এসিজি। দীপ্তিমান সতর্ক চোখে রঘুপতিকে দেখলেন।
পরনে সাদা-পোশাক, তবু পুলিশ-পুলিশ ভাবটা বোঝা যায়। ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচা-পাকা গোঁফ। চওড়া কাঁধ দেখেই বোঝা যায় এঁর সঙ্গে হিসেব করে মোকাবিলায় নামলে ভালো হয়।
‘বলুন, মিস্টার বসাক। যা বলার খোলাখুলি বলুন—কোনও অসুবিধে নেই। আপনারটা পুরোপুরি শোনার পর আমার ওপিনিয়ন দেব।’
এক পলক দুজনের দিকে তাকালেন দীপ্তিমান। তারপর পুরু ঠোঁটের ওপরে জিভের ডগা বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে গলাখাঁকারি দিলেন। গায়ের হালকা নীল সোয়েটারটা বারকয়েক টানলেন। ওঁর ইতস্তত ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন সেটা ভেবে খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর হ্যাঁচকা দিয়ে চলতে শুরু করা মোটরগাড়ির মতো কথা বলতে শুরু করলেন দীপ্তিমান।
এসিজির হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। অবশেষটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। দীপ্তিমানকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘নিন, শুরু করুন…।’
আপনমনেই ছোট করে কয়েকবার মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান। তারপর রেডিয়োতে শোকসংবাদ পাঠ করার মতো ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন ‘ব্যাপারটা যেখানে হয়েছে সেই বাড়িটা বাদুড়বাগান স্ট্রিটে। চার নম্বর বাড়ি। আর যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম চারুবালা মজুমদার। বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। তিনি ছিলেন ও-বাড়ির আশ্রিতা…।’ মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি যোগ করলেন, ‘আমি ওঁকে মা বলে ডাকতাম—চারুমা। আসলে আমি অনাথ। সংসারে আমার আপন বলতে কেউ কোনওদিন ছিল না। কিন্তু বছর পনেরো আগে চারুবালার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে কেমন যেন স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।’
রঘুপতি পকেট থেকে কাগজ-পেন বের করে দরকারমতো নোট নিচ্ছিল। ও জানে, স্মৃতির ওপরে পুরোপুরি নির্ভর না করে লিখে রাখাই ভালো। ওর স্যার অবশ্য মনে-মনে মাথায় সবকিছু লিখে নেন। নিজেকে থিঙ্কিং মেশিন বলে জাহির করাটা ওঁর পক্ষেই মানায়।
বিশু কফির ট্রে নিয়ে ঘরে এল। কফির কাপ আর বিস্কুটের প্লেট তিনজনের সামনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘মাসি আটটার পর এসে রান্না করে দেবে বলে গেছে।’
এসিজি ঘাড় নাড়লেন। মাসি বলতে ললিতের মা—এসিজির ঠিকে কাজের লোক।
বিশু চলে যেতেই এসিজি আর রঘুপতি কফির কাপে চুমুক দিলেন। দীপ্তিমানকে ইশারায় কফি খেতে অনুরোধ করলেন এসিজি। কিন্তু দীপ্তিমান যেন ওঁর ইশারা দেখেও দেখলেন না। কেমন এক শূন্য চোখে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
‘নিন, কফি নিন—।’ এসিজি বললেন।
‘ওঃ, হ্যাঁ—’ চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘যা বলছিলাম। চারুবালার সঙ্গে আমি স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে কেন জড়ালাম সে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোটবেলায় অনাথ আশ্রম থেকে কী করে যেন আমি দেওঘরের সৎসঙ্গ আশ্রমে পৌঁছে যাই। সেখান থেকে পরে কলকাতায় আসি। গড়পাড়ে একটা বাড়িতে সিঁড়ির তলায় একটা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। আর হালসীবাগানে সৎসঙ্গের একটা ছোট ব্রাঞ্চ আছে—সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিষে আমার আগ্রহ ছিল। বড় হয়ে সেই জ্যোতিষচর্চা করেই আমার দিন চলতে লাগল।
‘চারুবালা হালসীবাগানের আশ্রমে যাতায়াত করতেন। সেই থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ। খুব অল্পবয়েসে ওঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকেই উনি ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। সংসারে ভাই-ই ছিল ওঁর একমাত্র আপনজন। কিন্তু সেই ভাই—মনোহর রায়—বছরআষ্টেক আগে ক্যান্সারে মারা যান। এমনিতেই চারুবালার মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। আশ্রমে গিয়ে আমাকে তার কিছু-কিছু বলতেন। ভাই চলে যাওয়ার পর ওঁর দুর্দশা অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঁর উপায় ছিল না। কপদর্কহীন বিধবা আর কোথায়-ই বা ঠাঁই পাবে! আর আমি যেখানে থাকি সেখানে আমারই জায়গা হয় না, তো চারুমা!’
চোখে কী পড়েছে এই ভান করে বোধহয় চোখের কোণ মুছে নিলেন দীপ্তিমান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘চারুমা ঠিক কপর্দকহীন ছিলেন না। তবে ওঁর নিজস্ব চল্লিশ হাজার টাকা ওঁর বড় ভাইপো অজয়েন্দ্রর সঙ্গে জয়েন্টলি ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল। তার ওপরে চারুমার কোনও কন্ট্রোল ছিল না। আর, আজকের দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকায় কী-ই বা হয়!
‘লাস্ট চার-পাঁচ বছর ধরে চারুমার মাথায় একটু গোলমাল দেখা দেয়। ঠিক পাগল হয়ে যাননি, তবে খানিকটা ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। আমার কাছে এসে হঠাৎ-হঠাৎ ভাইয়ের বউ আর ভাইপোদের নামে নানান অকথা-কুকথা বলতেন। কখনও-কখনও বউমারা বা নাতি-নাতনিরাও বাদ যেত না। অনেক চেষ্টা করেও তখন ওঁকে শান্ত করা মুশকিল ছিল।
‘ব্যাপারটা আমি বয়েসের দোষ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁর কোনও-কোনও কথায় বুঝতাম, পাগলামির ঝোঁকে উনি যা-যা বলেন তার অনেকটাই সত্যি। হয়তো কারও কথায় বা ব্যবহারে ব্যথা পেয়েছেন, অভিমান হয়েছে—আমার কাছে এসে চারুমা সবকিছু যেন উগরে দিতেন। আমি ওঁকে সান্ত্বনা দিতাম, শান্ত করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যেটা ছিল—ওঁর বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই ওঁকে পাগলের মতো ট্রিট করতেন।
আমি—।’
দীপ্তিমানকে বাধা দিয়ে এসিজি বললেন, ‘উনি কীভাবে মারা গেছেন?’
স্রোতে আচমকা বাধা পড়ায় দীপ্তিমান পলকের জন্য যেন বেসামাল হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। আজ শুক্রবার। চারুমা মারা গেছেন শনিবার—সন্ধেবেলা।’
একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। দীপ্তিমানকে অফার করতে তিনি বললেন, ‘না, থাক। আমি কখনও-কখনও খাই।’
রঘুপতি যে সিগারেট খায় না তা এসিজি ভালো করেই জানেন।
সিগারেটে টান দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত জানতে চাইলেন, ‘চারুবালা ছাদ থেকে পড়ে গেলেন কীভাবে?
‘ওঁদের বাড়িটা ভীষণ পুরোনো। বহুবছর ধরেই ডেঞ্জারাস কন্ডিশানে রয়েছে। রিপেয়ার-টিপেয়ার কখনও করা হয়নি। রং চটে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে। ছাদের পাঁচিল জায়গায়-জায়গায় ভাঙা। কড়ি-বরগার অবস্থাও ভালো নয়। ও-বাড়ির ছাদের সাউথ-ওয়েস্টের দিকটায় মেঝেতে বড় একটা ফাটল আছে। তা ছাড়া, ওদিকটার পাঁচিলও ছিল ধসে পড়া। চারুমা সাধারণত ছাদে উঠতেন না। তবু হয়তো কোনও কারণে ভুল করে ওদিকটায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর…।’
মাথা নিচু করে আবার চোখ মুছলেন দীপ্তিমান।
‘পুলিশের কী আইডিয়া?’ প্রশ্নটা করল রঘুপতি যাদব।
কপালে হাত রেখে মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান ‘সরাসরি কোনও আইডিয়া পাইনি। আবছাভাবে যা শুনেছি তাতে পুলিশ ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্টই ভাবছে।’
‘আবছাভাবে শুনেছেন কেন?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান। কফির কাপে ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, ‘লুকোছাপা না করে একটা কথা আপনাকে খুলে বলি, ডক্টর গুপ্ত। ও-বাড়ির মানুষজন আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। বিশেষ করে আমার মামিমা—প্রভাবতী তো বছরদুয়েক ধরে আমাকে দেখতেই পারেন না।’
‘প্রভাবতী মানে?’
বিষণ্ণ হাসলেন দীপ্তিমান, বললেন, ‘মনোহর রায়ের বিধবা স্ত্রী। বয়েস প্রায় সত্তর। প্যারালিসিস হয়ে অনেকটাই কাবু। তবে তিনিই রায়বাড়ির শেষ কথা। সবাইকে সবসময় পায়ের আঙুলের ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। ও-বাড়িতে চারুমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মামিমা যেভাবে আমাকে কথা শোনাতেন তাতে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই প্রায় বছরখানেক হতে চলল, আমি ও-বাড়িতে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতাম। বিশেষ করে চারুমার অসুখ-টসুখের খবর পেলে তখন মামিমার অপমান সইতে হবে জেনেও যেতাম।’
‘আপনাকে এরকম ডিসলাইক করার পজিটিভ কোনও কারণ ছিল?’
আবার মলিন হাসলেন দীপ্তিমান : ‘থাকতে পারে—তবে আমার সেটা জানা নেই।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, ‘হয়তো ভেবে থাকবেন, চারুমা ওঁর শেষ সম্বল আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।’
‘চারুবালাদেবীর শেষ সম্বল কি অনেক কিছু ছিল?’ অশোকচন্দ্র সিগারেটে টান দিয়ে লম্বা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘তেমন কিছু আর কোথায়! ওই চল্লিশ হাজার টাকা…আর, গলার একটা সোনার হার…চার-সাড়ে চারভরি মতন হবে…। চারুমা সবসময় ওটা গলায় পরে থাকতেন। কিছুতেই কাছ-ছাড়া করতেন না।’ মাথা নামিয়ে আলতো গলায় দীপ্তিমান আরও বললেন, ‘পাগলামির সময়েও হারটার কথা চারুমার খেয়াল থাকত। ক’বছর ধরেই খালি আমাকে বলতেন, ‘দীপ্তিরে, তর বউরে এটা আমি দিয়া যামু। আর কাওরে দিমু না।’ আমি হেসে বলতাম, ‘চারুমা, বিয়া করলে তয় না বউ আইব।’ দীপ্তিমান হাসলেন আপনমনে, বললেন, ‘দু-বছর ধরে চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে একেবারে খেপে উঠেছিলেন। আমার সামান্য আয়…তার ওপরে শরীরে খুঁত আছে। আমায় কে বিয়ে করবে বলুন!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান ‘কিন্তু চারুমা কোনও কথা শুনতে চাইতেন না। যাকে সামনে পেতেন তাকেই আমার পাত্রী দেখার জন্যে রিকোয়েস্ট করতেন। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। কিন্তু চারুমা কষ্ট পাবেন এই ভেবে তেমন করে কিছু বলতে পারিনি। যাক, এখন নিয়তিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল।’
এসিজি চোখ ছোট করে কী যেন ভাবছিলেন। একটু ফাঁক পেতেই দীপ্তিমানকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘প্রভাবতীদেবীর সঙ্গে আপনার কখনও কথা-কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?’
একটু চিন্তা করে তারপর দীপ্তিমান জবাব দিলেন, ‘না, কখনও হয়নি।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ আপনমনেই মন্তব্য করলেন এসিজি। তারপর ‘আচ্ছা, প্রভাবতী তো জানতেন চারুবালার শেষ সম্বল কতটুকু। তা হলে তার জন্যে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন কেন? আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন—নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে।’
ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতরে হাতড়াতে শুরু করলেন দীপ্তিমান বসাক। এসিজি আর রঘুপতি চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর দীপ্তিমান মাথা নামালেন। এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘রায় পরিবারের অনেকেরই আমি কোষ্ঠীবিচার করেছি। পাথর-টাথরও অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, কখনও ওঁদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে দাম নিইনি, কিংবা ঝুটো পাথর দিয়ে ঠকাইনি। তবে মনোহরবাবুর—মানে, আমার মামার সবসময়েই একটা পেটের যন্ত্রণা হত। সেটা কমানোর জন্যে আমি একবার যজ্ঞ করেছিলাম, আর মামাকে পাথর দিয়েছিলাম। কিন্তু মামা শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারে মারা যান। এখন মনে পড়ছে…তারপর থেকেই প্রভাবতী আমার সঙ্গে একটু কোল্ড বিহেভিয়ার শুরু করেন। ধীরে-ধীরে সেটা আরও খারাপের দিকে গেছে। হয়তো আমি মামাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, এটাই আমার অপরাধ…।’ হাত উলটে হতাশার একটা ভঙ্গি করলেন দীপ্তিমান।
এসিজি একবার কাশলেন। এ-বছর শীত যাই-যাই করেও অন্তত বারদুয়েক ফিরে এসেছে। তাতেই এসিজির একটু ঠান্ডা লেগে গেছে। দীপ্তিমানের কথা তিনি যেমন মন দিয়ে শুনছেন তেমনই মনোযোগ দিয়ে ওঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ করছেন। ভদ্রলোককে এসিজির বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল।
এইবার এসিজি লাখ টাকার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন দীপ্তিমানের দিকে।
‘চারুবালার ব্যাপারটা আপনি অ্যাক্সিডেন্ট বলে মেনে নিতে পারছেন না কেন?’
এই প্রশ্নে দীপ্তিমান কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লেন। ওঁর মুখ যে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সেটা এসিজি ও রঘুপতি দুজনেরই চোখে পড়ল।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘আপনি তা হলে কী ভাবছেন? সুইসাইড, না মার্ডার?’
একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর ভেতরে-ভেতরে কোনও গোপন শক্তি সঞ্চয় করে বললেন, ‘সুইসাইডের তো কোনও প্রশ্নই নেই! চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। এ-অবস্থায় কেউ সুইসাইড করে না। তা ছাড়া, ওঁর গলার হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা হঠাৎ পাওয়া গেল চারুমা মারা যাওয়ার দিন। ছাদের ভাঙা জায়গাটার কাছেই পড়ে ছিল। কে ওটা চুরি করেছিল, কেন চুরি করেছিল, কেনই বা ওটা চারুমার মারা যাওয়ার দিন ছাদে ফিরে এল—এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই…।’
‘ফির ভি, অ্যাক্সিডেন্ট তো হতে পারে।’ রঘুপতি বলল।
রঘুপতির দিকে তাকালেন দীপ্তিমান ‘হ্যাঁ, হতে পারত—যদি না চারুমার শেষ একটা কথা আমার কানে বাজত…।’
‘কী কথা?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
দীপ্তিমান একটু ইতস্তত করলেন। ভুরু উঁচিয়ে দু-চোখে হাত ঘষলেন। যেন কোনও কারণে তিনি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপর দু-একটা টুকরো শব্দ করে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আগেই তো বলেছি, মামিমাদের বাড়িতে আমার যাতায়াতের অসুবিধে ছিল। চারুমা আশ্রমে এলে তবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হত। তবে ওঁর বয়েস হয়েছিল, একা-একা আসতে পারতেন না। পাড়ার একটি সাদাসিধে ছেলে—নাম, রতন—ওকে সঙ্গে করে আসতেন। কোনও খবর দেওয়ার থাকলে রতনকে দিয়ে বলে পাঠাতেন। মোটামুটি রতনই আমাদের মধ্যে অনেকটা টেলিফোনের কাজ করত।’ হাসলেন দীপ্তিমান ‘আর দরকার পড়লে আমি চারুমাকে ও-বাড়িতে ফোন করতাম। সে-নিয়েও অবশ্য চারুমাকে কথা শুনতে হত। প্রভাবতী নাকি বলতেন : ”দিদি, আপনার এত ফোন আসে কেন? এ-বয়েসে এত ফোন আসা ভালো না।” অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন!…যাই হোক, চারুমা বোধহয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলেন। এমন কিছু, যেটা ভালো কাজ নয়। তাই মারা যাওয়ার দিনদশেক আগে থেকেই একটা কথা ওঁর মুখে শুনতাম : ”ছি ছি ছি, এই অন্যায় আমি সইহ্য করুম না! কিয়ের লেইগ্যা সইহ্য করুম? সারাটা জীবন সংসার আমারে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া খাইল। পাঁচকান কইর্যা দিলে বুঝব’অন ঠ্যালা! আমারে চিনে না।” ‘
‘কী অন্যায় তিনি পাঁচকান করে দেওয়ার কথা বলছিলেন সেটা আপনি জানতে চাননি?’
‘আমি অনেকবার চারুমাকে জিগ্যেস করেছি—কিন্তু চারুমা কোনও স্পষ্ট জবাব দেননি। বরং পাগলামির তোড়ে ভেসে গেছেন। পরে কখনও জানতে চাইলে বলতেন, ”কী কস? কুন কথা পাঁচকান করুম? আমি কইসি!” মানে, ওঁর ব্যাপারটা আর মনে পড়ত না। ও-বাড়ির সকলেই বোধহয় চারুমার এ-কথা শুনেছে। হয়তো পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়েও দিয়েছে…’ একটু থামলেন দীপ্তিমান। তারপর সিরিয়াস গলায় বললেন, ‘…শুধু একজন ছাড়া। যে সেই অন্যায়টা করেছিল। সে ব্যাপারটাকে মোটেই পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়নি। বরং ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, পাগল বিধবাটা এই বোধহয় ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আর প্রভাবতী একবার জানতে পারলেই সর্বনাশ! চরম শাস্তি দিয়ে ছাড়বেন। ওঁকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। তাই সেই লোকটা হয়তো ভয় পেয়েই পাগল বিধবাটাকে কিছু একটা…’ দীপ্তিমানের গলা বুজে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে জড়ানো গলায় তিনি কোনওরকমে বললেন, ‘ওই পাগল বিধবাটাকে আমি ”মা” ডেকেছিলাম। ঈশ্বর জানেন, ওঁর গয়না বা টাকাপয়সার জন্যে কোনও লোভ আমার ছিল না। ঈশ্বর জানেন, চারুমা মারা যাওয়ায় আমি কী কষ্ট পেয়েছি। আমি…আমি…।’
আর বলতে পারলেন না দীপ্তিমান। মাথা নিচু করে বাচ্চাছেলের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
এসিজি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। দীপ্তিমানকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘আপসেট হবেন না, দীপ্তিমানবাবু…প্লিজ। যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না!’
রঘুপতি যাদব চুপচাপ নোট নিচ্ছিল। দীপ্তিমানের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিল।
হাতের সিগারেট কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসিজি সেটা অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে বারকয়েক কাশলেন। মেয়ে ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত সিগারেট হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাসন করার মতো কেউ আর কাছে নেই। যে সবচেয়ে কাছাকাছি থাকত, সবসময় থাকত, সে চলে গেছে বছরদশেক আগে। আকাশে। সেখানে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুললেন দীপ্তিমান। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ফোনে আপনাকে এসব কথা বলতে পারিনি। বুঝতেই তো পারছেন, বলা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি কাইন্ডলি চারুমার মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখেন তা হলে আমি শান্তি পাব। চারুমার জন্যে আমি কর্তব্য করতে পারিনি। এমনকী মুখাগ্নিও ওরা করতে দেয়নি আমাকে। হয়তো শ্রাদ্ধের সময়েও ডাকবে না। তাই আমার খুব ইচ্ছে, ওঁর মৃত্যুতে যে শুধুমাত্র নিয়তির হাত ছিল না, সেটা প্রমাণ হোক। তা হলেই আমার শান্তি। আপনি আমাকে ফেরাবেন না…প্লিজ। আপনার ফিজ আমি দেব…হয়তো খুব বেশি পারব না…।’ জল-ভরা চোখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন দীপ্তিমান।
‘এ কী করছেন! শান্ত হয়ে বসুন।’ এসিজি বললেন, ‘ফিজের কথা আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। বরং ও-বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আর যা-যা জানেন সেগুলো আমাকে বলুন। কাজে নামার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা যতটা ডিটেলে জানা যায় ততই কাজের সুবিধে। আর আপনার খোলাখুলি মতামতও বলবেন কিন্তু…।’
এরপর দীপ্তিমান বলে চললেন, আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে আধবোজা চোখে সব শুনতে লাগলেন। রঘুপতি যথারীতি কাগজ-কলম নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যস্ত হল।
বিশু ফরমাশ পেয়ে আর-একদফা কফি দিয়ে গেল।
এসিজির আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে লাগল। আর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দীপ্তিমানের কথা শেষ হল।
এসিজি ওঁকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘সম্ভবত আমি রোববার প্রভাবতীদের বাড়িতে যাব। তার আগে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি.-র সঙ্গে কথা বলে রঘুপতি ফরমালিটিগুলো সেরে রাখবে। তা না হলে ইনভেস্টিগেশানে প্রবলেম হতে পারে। আপনাকে খবর পাঠিয়ে দেব। সেদিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
‘তাতে মাসিমা হয়তো মাইন্ড করতে পারেন।’ দীপ্তিমান বললেন।
‘মাইন্ড করলেই হল!’ বলল রঘুপতি যাদব, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, মিস্টার বসাক। দ্যাট ইজ মাই প্রবলেম। কী বলেন, গুপ্তাসাব?’
রঘুপতির শেষ প্রশ্নটা প্রাক্তন স্যার এসিজিকে লক্ষ করে।
এসিজি হাসলেন। রঘুপতির মেজাজ যখন-তখন হারিয়ে যায়। তাই এসিজি প্রায়ই ওকে সাবধান করে বলেন, ‘রঘুপতি, ডোন্ট লুজ ইয়োর টেম্পার। ওটা খুব দামি জিনিস।’
দীপ্তিমান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একদফা অনুরোধ করে গেলেন অশোকচন্দ্রকে।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘স্যার, রঙ্গলালবাবুকে কি ইনফর্ম করতে হবে?’
প্রশ্নটা শুনে এসিজির হাসি পেয়ে গেল। আজকাল এমন একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে যে, তদন্তের সময় স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামী পাশে-পাশে না থাকলে তিনি যেন ঠিক মেজাজ পান না। ‘লালমহল’-এর চুনিলালবাবুর দামি পাথর খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁর ভাই রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গে এসিজির প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে স্বভাবকবি রঙ্গলাল এসিজির গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। রঙ্গলালের প্রশংসার দুটি অভিনব নমুনা মনে পড়ল এসিজির ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’, আর ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি’। এই স্বভাব-কবি কখনও এসিজির ‘তদন্তরসে’ বঞ্চিত হতে চান না।
সুতরাং, হাসতে-হাসতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতিকে বললেন, ‘ওঁকে ইনফর্ম অবশ্যই করবে, রঘুপতি। তা না হলে, ওঁর মতো স্বভাব-কবিতায় বলি—তোমার আমার মুন্ডুপাত/হয়ে যাবে অকস্মাৎ।’
রঘুপতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল প্রাক্তন স্যারের টেলিফোনের দিকে।
এসিজি পায়ে-পায়ে চলে এলেন জানলার গা ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে। এটা তাঁর পাঁচমিশেলি কাজের টেবিল। টেবিলে বই, পেন, কাগজপত্র সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা রুবিক কিউব।
রঙিন কিউবটা হাতে নিয়ে তার একটা থাক মোচড় দিতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র। সাজানো রংগুলো ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল।
আপনমনে বিড়বিড় করে এসিজি বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড, না মার্ডার?’
‘…কে দেবে তার কারেক্ট আনসার।’
প্রভাবতীদের পুরোনো পলেস্তারা-খসা বাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে আগের দিনের বিড়বিড় করে বলা কথাটাই জোরে-জোরে উচ্চারণ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। প্রশ্নটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী রঙ্গলালবাবুর দিকে। ব্যস!
রঙ্গলাল তৎক্ষণাৎ ওঁর স্বভাব-কবিতা রচনার তীব্র প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ছন্দ মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
এসিজি হেসে বললেন, ‘উত্তর দিতে হবে আমাকেই। কোনও উপায় নেই। আমাকে নিয়ে রঘুপতির অনেক গর্ব। ওর মানটা তো বাঁচাতে হবে!’
প্রভাবতীদের বাড়িটা দেখামাত্রই ফিটন গাড়ি, ভোরবেলা গঙ্গার জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া, ভিস্তিওয়ালা—এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। একটা ভাঙা শ্বেতপাথরের ফলকে শুধু ‘…নিবাস’ টুকু পড়া যাচ্ছে। তিনতলা বাড়ির এখানে-সেখানে বট-অশ্বত্থের চারা মাথাচাড়া দিয়েছে। হালকা শীতের বাতাসে তাদের রোদ-চকচকে পাতা নড়ছে।
আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মার সঙ্গে রঘুপতি কথা বলে নিয়েছিল। কেসের ফাইলের একটা কপিও রঘুপতি পৌঁছে দিয়েছে এসিজিকে। তারপর জরুরি একটা তদন্তের কাজে ওকে আচমকা ভুবনেশ্বর চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তার আগে ও সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে।
প্রভাবতীদের বাড়িতে বিজন শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন ইনভেস্টিগেটর দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে রবিবার সকাল ন’টায় প্রভাবতীদের বাড়িতে আসবেন। বাড়ির প্রত্যেকে যেন তাঁর সঙ্গে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কো-অপারেট করেন। তা না হলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারে।
সুতরাং, রবিবার সকালে এসিজি, রঙ্গলাল ও দীপ্তিমান, পৌঁছে গেছেন প্রভাবতীদের বাড়িতে।
বিশাল সদর দরজায় বিশাল মাপের কড়া। বোঝাই যায়, কলিংবেলের ব্যাপারটা আধুনিক সংযোজন।
বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। বছর পঞ্চাশের একজন টাক-মাথা ভদ্রলোক বিগলিত হেসে এসিজিদের অভ্যর্থনা জানালেন। তবে দীপ্তিমানকে দেখামাত্রই তাঁর ফরসা কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।
‘আসুন, আসুন, ডক্টর গুপ্ত।’ রঙ্গলালবাবুকে নমস্কার জানিয়ে বললেন তিনি, ‘থানা থেকে আমাকে সবকিছু জানিয়ে আগাম খবর দিয়ে দিয়েছে। আমার নাম অজয়েন্দ্র—অজয়—আমারই পিসিমণি অ্যাক্সিডেন্টালি ছাদ ধসে পড়ে মারা গেছেন।’
এসিজি কিছু বলার আগেই রঙ্গলাল গোস্বামী ভুল ধরিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি হলেম রঙ্গলাল স্বভাব-কবিবর/উনি হলেন এসিজি গোয়েন্দাপ্রবর।’
কবিতার আকস্মিক দাপটে অজয়েন্দ্র কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলেন রঙ্গলালের কীর্তনীয়াগোছের চেহারার দিকে।
এসিজি সামান্য হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিস্টার রায়—আমরা ওই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে এসেছি। মানে…ব্যাপারটা তো সুইসাইডও হতে পারে। পুলিশ ঠিক সেই অ্যাঙ্গেলটা এক্সপ্লোর করে দেখেনি।’
অস্বস্তির হাসি হাসলেন অজয়েন্দ্র : ‘মানে, কেউ কি পুলিশে কোনও নালিশ-টালিশ করেছে?’
অশোকচন্দ্র লক্ষ করলেন, অজয়েন্দ্রর চোখ চট করে দীপ্তিমানকে ছুঁয়ে গেল।
‘না, নালিশ-টালিশ কেউ করেনি। পুলিশই ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে।’ তারপর একটু শক্ত গলায় বললেন, ‘হঠাৎ আপনার নালিশের কথা মনে হল কেন?’
‘মা বলছিল এই সাধারণ ব্যাপারটাকে নিয়েই হয়তো জল ঘোলা হবে—তাই।’ গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বোলালেন অজয়েন্দ্র।
বসবার ঘরে ওঁদের বসাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এসিজি বাদ সাধলেন ‘কিছু মনে করবেন না, আমরা আগে ছাদে যাব। জায়গাটা ভালো করে দেখব। তারপর আপনাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেব।’
‘সামান্য একটু চা-টা না খেলে কি চলে…।’ ইতস্তত করলেন অজয়বাবু।
‘সে পরে হবেখ’ন—’ জবাব দিলেন রঙ্গলাল, ‘থিতু হয়ে বসব যখন।’
ছন্দের গন্ধ পেয়ে এসিজি আড়চোখে তাকালেন রঙ্গলালের দিকে। কবিবর কাঁচুমাচু মুখ করে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন। দীপ্তিমান কিছু বললেন না, তবে রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতা উপভোগ করছিলেন।
‘মা জানতে পারলে খুব রেগে যাবেন…’ বিড়বিড় করে এই কথা বলতে-বলতে অজয়েন্দ্র ওঁদের নিয়ে চললেন ওপরে।
সবসময়েই অশোকচন্দ্র গুপ্ত প্রথম অকুস্থল দেখাটা পছন্দ করেন। ওঁর মতে, আগে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরে অকুস্থল দেখলে দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক নিরপেক্ষ থাকে না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে এসিজি বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
ঢালাই লোহার রেলিং, মেঝেতে সাদা-কালো পাথর বসানো, দেওয়ালের খানিকটা পর্যন্ত সাদা টালি, লাল-নীল-সবুজ-হলদে কাচের শার্সি, বারান্দার সিলিং এর কার্নিশে গোলা পায়রার আস্তানা। তবে শুধু গোলা পায়রাগুলোই চকচকে-ঝকঝকে নতুন—বাকি সবই ময়লা, চিড় ধরা, ভাঙা।
বাড়ির ভেতরটায় যেরকম অন্ধকার-অন্ধকার ভাব ছিল, ছাদে পা দিতেই ছবিটা বদলে গেল। অকৃপণ রোদ সেখানে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে।
বিশাল ছাদ। সেখানে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে তা হল, কাপড় ছড়ানোর গোটা সাত-আট দড়ি নানান কায়দায় এ-মাথা ও-মাথা বাঁধা রয়েছে। কোনওটা নাইলনের দড়ি, কোনওটা সাদা কাপড়ের তৈরি, আর কোনওটা নিতান্তই পুরোনো শাড়ির পাড়।
ছাদের ডানদিকে প্রচুর টব। সেখানে সাধারণ সস্তার গাছ। কেউ কখনও টবগুলোর যত্ন নেয় বলে মনে হয় না। টবের সারির পিছনের পাঁচিলে দুটো কাক বসে আছে।
ছাদের মেঝেতে কম করেও তিন-চার জায়গায় ফাটল ধরেছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটায় পাঁচিল ভাঙা, মেঝের খানিকটা অংশ নেই।
এসিজির নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘পিসিমণি ওখানটা দিয়েই পড়ে গেছেন।’
এসিজি পায়ে-পায়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলেন। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই অজয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আর যাবেন না! আর যাবেন না!’
এসিজি থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালেন।
সে-চাউনিতে প্রশ্ন ছিল। তার উত্তরে ছাদের মেঝের দিকে আঙুল দেখালেন অজয়েন্দ্র ‘ওই দেখুন, দাগ দিয়ে সাবধান করা আছে। ওই দাগের ও-পাশে আমরা কেউ কখনও যাই না। করপোরেশান দুবার নোটিশ দিয়ে গেছে। বাচ্চাদের তো ছাদে ওঠাই বারণ—।’
এসিজি লক্ষ করে দেখলেন। সত্যিই সাদা তেল রং দিয়ে অপটু হাতে একটা চওড়া দাগ টানা আছে। দাগের ও-পাশে বেশ বড় মাপের একটা ফাটল—দেখলে ভয় হয়। সেই ফাটল ফুট তিনেক যাওয়ার পরই বড় হাঁ হয়ে গেছে। ছাদের সেই অংশটা চারুবালাকে নিয়ে ধসে পড়েছে নীচে। খোঁদল দিয়ে দোতলার একটা ঘরের অংশ নজরে পড়ছে।
এসিজিদের নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘ও-ঘরটায় কেউ থাকে না। এমনই স্টোররুম মতন—।’
একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। ধোঁয়া ছাড়লেন কয়েকবার। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন।
বাড়ির কেউ ওই দাগের ও-পাশে যেত না। সবাই ব্যাপারটা জানত। তা হলে চারুবালা গেলেন কেন? সে কি ওঁর মাথায় ছিট ছিল বলেই?’
‘দাগটা কবে আঁকা হয়েছে, অজয়বাবু?’
‘প্রায় সাত-আট বছর আগে। রং চটে গেলে আমিই আবার লাগিয়ে দিই।’
‘লাস্ট কবে রং লগিয়েছেন?’
‘তা প্রায় বছরখানেক হবে।’ একটা ছোট ঢেঁকুর তুললেন অজয়েন্দ্র, পেটে বারকয়েক হাত বোলালেন।
দীপ্তিমান বলেছেন, চারুবালার মাথায় ছিট দেখা দেয় চার-পাঁচ বছর ধরে। দাগ দেওয়ার ব্যাপারটা তারও আগের—চারুবালা যখন সুস্থ ছিলেন। তা ছাড়া, ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়ার পরেও এতদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। নাকি চারুবালা প্রায়ই ছাদের ওই বিপজ্জনক অংশে যাতায়াত করতেন? তারপর হঠাৎ একদিন ওই অংশটা ওঁকে নিয়ে ধসে পড়েছে?
‘আপনার পিসিমা ছাদে কি প্রায়ই উঠতেন?’
‘না, না।’ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন অজয়েন্দ্র, ‘বরং বলতে পারেন ন’মাসে ছ’মাসে কখনও-কখনও রোদ পোয়াতে উঠতেন। পিসিমণির অনেক বয়েস হয়েছিল। হাঁটুতে গেঁটে বাত ছিল। ওই শনিবার…মানে, যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হয়…কেন উঠেছিলেন কে জানে?’
এসিজি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। যে-মানুষ্টা ছাদে বলতে গেলে প্রায় আসতই না, সে হঠাৎ ছাদে উঠতে গেল কেন? আত্মহত্যা করার জন্য?
সুস্থ অবস্থা থেকেই লক্ষ্মণের গণ্ডি ওই সাদা দাগ দেখে এসেছেন চারুবালা। অসুস্থ অবস্থায় ওঁর কি সেসব কিছুই মনে ছিল না?
সাদা দাগটাকে ধরে ছাদের পাঁচিলের কাছে চলে গেলেন এসিজি। লক্ষ করলেন, পাঁচিলের গায়েও সরু-সরু ফাটল। গলা বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে নীচের গলির দিকে তাকালেন।
ঘাড় ঘুরিয়ে অজয়বাবুকে ডাকলেন এসিজি ‘অজয়বাবু, আপনার পিসিমার বডিটা কোন জায়গায় পড়েছিল দেখান তো—।’
অজয়েন্দ্র এসিজির পাশে চলে এলেন। আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন জায়গাটা ‘ওই যে—ওইখানটায়…।’
এখান থেকে পড়লে কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু চারুবালা যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তা হলে ছাদের ওই ভাঙা জায়গাটাকেই বা বেছে নিলেন কেন! অন্য বহু জায়গা দিয়েই তো নীচে লাফ দেওয়া যেত!
‘আপনি জানেন, আপনার পিসিমার ডানহাতের মুঠোয় একটা ক্লিপ পাওয়া গিয়েছিল?’ অজয়েন্দ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন এসিজি।
‘ক্লিপ!’ অজয়েন্দ্র কেমন হকচকিয়ে গেলেন।
‘হ্যাঁ—’ সিগারেটে আয়েসী টান দিয়ে এসিজি বললেন ‘কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ। লাল রঙের।’
ক্লিপের তথ্যটা এসিজি কেস-ফাইল থেকে পেয়েছেন। পুলিশ এটা নিয়ে আর এগোয়নি কেন কে জানে!
‘ন-না, আমি তো শুনিনি।’ থতমত খেয়ে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘জানলে মা হয়তো জানবে।’
‘আপনার পিসিমা কি কখনও-কখনও কাপড় ছড়াতে ছাদে উঠতেন?’
‘আগে হয়তো উঠতেন—এখন আর বয়েসের জন্যে পারতেন না। আরতিই মা আর পিসিমার সব কাজ করে দেয়।’
দীপ্তিমানের কাছে সব শুনেছেন অশোকচন্দ্র। সেরিব্রাল হেমারেজের পর প্রভাবতী প্রায় পঙ্গু হয়ে যান। তারপর ফিজিয়োথেরাপি, আকুপাংচার, আরও বহুরকম চেষ্টাচরিত্র করে ওঁর শরীর অনেকটা সচল হয়। এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা-চলা করতে পারেন। তবে সিঁড়ি ভাঙতে একেবারেই পারেন না। আরতি নামে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে প্রভাবতীর রাত-দিনের সঙ্গী।
এমনসময় একজন ভদ্রমহিলা ছাদে এলেন। ময়লা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। ছাদের দরজার কাছ থেকেই তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তোমাকে মা ডাকছে—।’
অজয়েন্দ্র ওঁর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘যাও, যাচ্ছি।’
‘যাচ্ছি বললে হবে না—মা এক্ষুনি যেতে বলেছে।’ বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।
এসিজি অনুমান করলেন, ইনি অজয়েন্দ্রর স্ত্রী মনীষা।
‘আমি যাই—’ অজয়েন্দ্র এসিজিকে বললেন, ‘আপনারা কাজ সেরে দোতলায় মায়ের ঘরে আসুন।’
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন এসিজি। তাতে ছাদের ভাঙা জায়গাটার একটা স্কেচ আঁকা ছিল। সেটা সামনে ধরে আসলের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে লাগলেন।
একটু পরে বললেন, ‘সোনার চেনটা ওইখানটায় পড়ে ছিল।’
উৎসুক দীপ্তিমান ও রঙ্গলাল এসিজির কাছে এলে ওঁর হাতের কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। স্কেচের একটা জায়গায় একটা কাটা চিহ্ন আঁকা ছিল। সেটাতে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘ধসে পড়া পোরশানটার ঠিক পাশেই হারটা পাওয়া গেছে। চারুবালা ওটা হাতে তুলে নেওয়ারও সময় পাননি।’
‘হারটা হারানোর পর কী করে এখানে আবার ফিরে এল বলুন তো!’ দীপ্তিমান যেন আপনমনেই বললেন।
ছাদটা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখার পর এসিজি বললেন, ‘চলুন, নীচে যাই।’
হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছাদে ফেলে পায়ে রগড়ে দিলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘সে-কথাই তো ভাবছি…।’
রঙ্গলাল গোস্বামী আচমকা মন্তব্য করলেন, ‘এসিজি স্যার, এ-বাড়িতে মোট চারটে ফ্যামিলি থাকে।’
‘কী করে বুঝলেন?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
‘অ্যান্টেনা গুনে।’ হেসে বললেন রঙ্গলাল, ‘ফ্যামিলি পিছু একটা করে অ্যান্টেনা—চারটে অ্যান্টেনা, চারটে ফ্যামিলি।’
‘দারুণ বলেছেন।’ বলেই কী যেন ভাবলেন এসিজি। তারপর দীপ্তিমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছিলেন, প্রভাবতীর দু-ছেলে—অজয়েন্দ্র, বিজয়েন্দ্র। দুটো ফ্যামিলি, দুটো অ্যান্টেনা, আর-একটা অ্যান্টেনা ধরে নিচ্ছি প্রভাবতীর। তা হলে চার নম্বরটা কার? চারুবালার?’
‘কী যে বলেন!’ হেসে ফেললেন দীপ্তিমান ‘চারুমার জন্যে আলাদা টিভি! তা ছাড়া, দোতলার গলির দিককার একটা বড় ঘরে মামিমা আর চারুমা একসঙ্গে থাকতেন। তবে ঘরের টিভিটা অন-অফ হত মামিমার কথায়। ওই বাড়তি অ্যান্টেনাটা মামিমার বড় মেয়ে সুনন্দাদির। আপনাকে সেদিন বোধহয় বলিনি—মামিমার মেয়ে-জামাই এ-বাড়িতেই থাকেন। ঘরজামাইগোছের বলতে পারেন। সুনন্দাদির হাজব্যান্ড অমলেশদা কন্সস্ট্রাকশনের কীসব বিজনেস করেন। তবে চারুমা বলতেন, সে বিজনেসে নাকি সবসময়েই লস হত। প্রায়ই নাকি ছেলেদের লুকিয়ে অমলেশদা মামিমার কাছ থেকে টাকা নিতেন। মামিমার সব পুঁজি তো এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘চলুন, এবার নীচে যাওয়া যাক। সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে—বিশেষ করে আপনার মামিমার সঙ্গে।’
দীপ্তিমান কাঁচুমাচু মুখ করে তাকালেন এসিজির দিকে ‘মামিমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি সামনে না থাকলে হয় না? উনি একদম শিওর ভাববেন আমি আপনাদের ডেকে এনে অকারণে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পাকাচ্ছি…।’
এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন কেন! উনি কিছুই বলবেন না…।’
ওঁরা তিনজনে নীচে নামছিলেন। দীপ্তিমানের নামতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ছাদে রোদে ঘুরে যেটুকু তেতে উঠেছিলেন, বাড়ির ছায়ায় ঢোকামাত্রই ঠান্ডা আমেজ ওঁদের ঘিরে ধরল। ড্যাম্প-ধরা, পুরোনো বাড়ির বাড়তি শীত ওঁরা টের পেলেন।
কোথাও বকবকম করে গোলাপায়রা ডাকছিল। হঠাৎই সে-আওয়াজ ছাপিয়ে ঝগড়ার রুক্ষ চিৎকার ওঁদের কানে এল।
অজয়েন্দ্র কাউকে বলছিলেন, ‘পিসিমণির ওই টাকার আবার শেয়ার কী! পিসিমণি ঠিক করেছিল টাকাটা আমাকেই দিয়ে যাবে—তাই আমার সঙ্গে জয়েন্ট ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। মা বললেই তোদের ভাগ দিতে হবে নাকি!’
উত্তরে কোনও মহিলার চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল।
‘অজু, বুঝেশুনে কথা বল। তোর সঙ্গে জয়েন্ট নামে রাখা মানেই সব তোর হয়ে গেল! ওই টাকা দিয়ে পিসিমণির কাজ হবে। ও-টাকার ভাগ আমার দরকার নেই।’
দীপ্তিমান চাপা গলায় বললেন, ‘সুনন্দাদি—অজুদা-বিজুদার বড়দি।’
অজয়েন্দ্র তখন বলছেন, ‘তোর আবার ভাগ দরকার হবে কেন! তুই আর অমলেশদা তো যা পেরেছিস এর মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিস। ভাবিস, কিছু টের পাই না, জানি না! মা-কে বশ করে আমাদের এগেইনস্টে লেলিয়ে দেওয়া! আমি বিজুকে সব বলব। তারপরে…।’
‘অজু, কী হচ্ছে! চুপ কর বলছি!’ এক বৃদ্ধার তেজী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সুনন্দা, তুই নিজের ঘরে যা। বাড়িতে এখন বাইরের লোক এসেছে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল যা কিছু পরে মেটানো যাবে।’
সঙ্গে-সঙ্গে সব চুপচাপ। ভয় অথবা ভক্তি ছাড়া এ-ধরনের ‘জো হুজুর’ ছেলেমেয়ে আজকের দিনে পাওয়া মুশকিল।
‘বুঝতে পারলেন তো…মামিমা!’ দীপ্তিমান চাপা গলায় আবার বললেন।
এসিজি মাথার চুলের গোছায় দু-বার টান মেরে বললেন, ‘আমাদের প্রভাবতীদেবীর কাছে নিয়ে চলুন।’
দীপ্তিমান চমকে ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে। বোধহয় ‘দেবী’ শব্দটা ওঁর কানে লেগেছে।
রঙ্গলাল এতক্ষণ গুম মেরে সব শুনছিলেন। হঠাৎই বললেন, ‘লোভ অতি সর্বনাশা/চেঙ্গিস খাঁ, কামাল পাশা।’
এসিজি স্বভাব-কবিবরের দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঁর স্বভাব-কবিতায় উপমা, প্রতীক ইত্যাদি এতই অদ্ভুত যে, প্রথম-প্রথম শ্রোতারা একটু ধাক্কা খায়।
দীপ্তিমান হাসি চাপছিলেন, ছোট্ট করে বললেন, ‘এ-বাড়িতে লোভ একটা মেজর জায়গা নিয়ে আছে। কারণ, টাকাপয়সা, সম্পত্তি সবকিছুর কন্ট্রোল মামিমার হাতে।’
‘তা হলে সোনার হারটা ছাদ থেকে চুরি গেল না কেন?’ রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন।
‘ওটাই তো আমার আসল খটকা।’ আনমনাভাবে অশোকচন্দ্র বললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করে বসালেন।
ওঁরা প্রভাবতীর ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওষুধ আর ফিনাইলের হালকা একটা গন্ধ সকলের নাক ছুঁয়ে গেল।
বৃদ্ধা একটা লম্বা সোফায় বসে ছিলেন। সামনে দুটো টেবিল। তাতে দুটো ছোট রেডিয়ো, কিছু ম্যাগাজিন, বইপত্তর, আর একটা দম দেওয়া কলিংবেল।
ঘরটা মাপে বেশ বড়। মেঝেতে পুরোনো দিনের মার্বেল পাথর। দু-প্রান্তে দুটো খাট। দেখে বোঝা যায়, একটা প্রভাবতীর—অন্যটায় চারুবালা শুতেন। দুটো আলমারি। একটা ছোট টিভি। আর একটা ড্রেসিং টেবিল।
প্রভাবতীর রোগা শরীরে সাদা শাল জড়ানো। চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। মাথায় ঘোমটা। সামনের দিকের চুলে এখনও কালো ছোপ রয়েছে। হাতে সরু-সরু দু-গাছা চুড়ি। আর ডানহাতে একটা লাঠি।
ঘরে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। এসিজি অনুমানে বুঝলেন, আরতি।
দীপ্তিমান পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং দেওয়ামাত্রই প্রভাবতী ওঁকে অনেকটা হুকুমের সুরে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পারো। আমাদের কথাবার্তার সময় তোমার থাকার দরকার নেই।’ তারপর আরতির দিকে ফিরে : ‘ওদিকের জানলাটা খুলে দে। আর টেবিলের ওই ঘটি থেকে আমাকে আধগ্লাস জল দে।’
প্রভাবতীর কাছাকাছি চারুবালার খাটের কিনারায় এসিজিরা বসেছিলেন। এসিজি সূক্ষ্ম নজরে রুগ্ন ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধাকে দেখছিলেন। সারা মুখে অহঙ্কারের ছাপ। এমনকী বলিরেখাগুলোও সেই অহঙ্কারী ঢঙে সামিল হয়েছে।
এসিজির গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেটের জন্য। কিন্তু এখানে সিগারেট মানায় না। একটু কেশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিসেস রায়, দীপ্তিমানবাবু আমাদের সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি।’
‘তার মানে! কী বলতে চান আপনি! আমাদের ফ্যামিলির কথা বাইরের কোন এক দু-পয়সার জ্যোতিষীর সামনে বলতে হবে!’ ঘাড় কাত করে ওপরওয়ালার ভঙ্গিতে এসিজির দিকে দেখলেন প্রভাবতী : ‘আপনার কাছে ও জরুরি হতে পারে, আমার কাছে নয়।’
এরপর আর কোনও কথা চলে না।
দীপ্তিমান মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এসিজির দিকে ‘আপনাকে বলেছিলাম না!’ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
‘চারুবালা কীভাবে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়?’ এসিজি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
‘সবাই যা জানে তাই—’ আরতির দেওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিলেন ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’ তারপর আরতিকে : ‘তোকে আধগ্লাস বললাম, এতটা দিলি! যা বাকি জলটা ঘটিতে ঢেলে রাখ। ঘটিটা ঠিকমতো ঢাকা দিবি। কোনও কাজের একটা ছিরি নেই।’
আরতি কোনও জবাব না দিয়ে হুকুম তামিল করল।
‘যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয় তবে আর কীভাবে চারুবালা মারা যেতে পারেন?’
বিরক্তির একটা শব্দ করে বৃদ্ধা বললেন, ‘সুইসাইড হতে পারে। পাগলের খেয়াল—কী করে বলব বলুন!’
‘খুনও হতে পারে।’
‘তার মানে! খুনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে! তখন তো ছাদে আর কেউ যায়নি!’
‘আপনি কী করে জানলেন?’ এসিজি হেসে প্রশ্ন করলেন। তারপর ‘আপনি শুধু আপনারটা বলতে পারেন।’
‘না, আমি জানি। দিদি যখন ছাদে যায়—ছাদ থেকে পড়ে যায়—তখন এ-ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি কতকগুলো জরুরি কথা বলছিলাম। অমলেশ বাড়ি ছিল না। আপনারা যেখানে বসে আছেন, অজু-বিজু, ওদের দু-বউ, ওখানে বসেছিল। আর সুনন্দা আমার বিছানায়। আরতি নীচে কলতলায় গিয়েছিল। এরপর বাকি রইল বাচ্চারা। ওরা নিশ্চয়ই তাদের ”দিদু”কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি!’
অশোকচন্দ্রের মনে হল তিনি কোনও জজসাহেবের এজলাসে বসে আছেন। প্রভাবতীর কথা শুনে মনে হল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি যেন আগেভাগেই জেনে তৈরি করে নিয়েছেন।
রঙ্গলাল এসিজিকে দেখছিলেন। থিঙ্কিং মেশিনকে খানিকটা যেন নাজেহাল দিশেহারা লাগছে।
‘আপনার দিদির হাতে কাপড় ছড়ানোর একটা ক্লিপ ছিল। উনি কি তখন কাপড় ছড়াতে গিয়েছিলেন, না তুলতে গিয়েছিলেন?’
‘পাগলের কখন কী খেয়াল হয়, আমি কী করে জানব!’
এসিজি দু-হাতের দশ আঙুল মাথায় ঠেকালেন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘পুলিশ এসে ছাদে কিন্তু কোনও কাপড় পায়নি।’
‘বললাম তো, পাগলের খেয়াল! হয়তো ক্লিপ হাতে এমনই ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল।’
‘ওঁর সোনার হারের ব্যাপারটা জানেন তো!’
‘জানাজানির আবার কী আছে! ওটা হয়তো দিদির কোমরেই বরাবর গোঁজা ছিল—ছাদে কোনওভাবে খসে পড়েছে।’
‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চারুবালা কারও একটা গোপন অন্যায় দেখে ফেলেছিলেন। সেটার কথা উনি মাঝে-মাঝেই বলতেন। আপনি কখনও শুনেছেন?’
‘না তো!’ তারপর আরতিকে : ‘বেলা হয়ে গেছে। তুই গিয়ে আমার স্নানের গরম জল বসিয়ে দে। কালকের মতো বেশি গরম করিস না।’
আরতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
‘ভালো করে মনে করে দেখুন, মিসেস রায়। কোনও কিছু একটা জেনে ফেলার ব্যাপারে…।’
‘আপনি কার থেকে এসব আজেবাজে কথা শুনেছেন বলুন তো!’
এসিজি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। এও বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই প্রভাবতীর কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন।
প্রভাবতী সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োর এফ. এম. চ্যানেল চালিয়ে শুনতে শুরু করলেন। গলা তুলে বললেন, ‘যাওয়ার আগে একটু চা-টা খেয়ে যাবেন—।’
একতলার দিকে নেমে-যাওয়া সিঁড়ির পাশে দীপ্তিমান অপাংক্তেয়র মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁর কাছে এসে বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। এবারে ছোটভাই আর দু-ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, ও-ঘরে চলুন। বিজুদার ঘরে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে।’
বিজয়েন্দ্রর ঘরে বসে চা খেতে-খেতে কথাবার্তা সেরে নিলেন এসিজি।
আলোচনাটা টাকাপয়সা আর বিষয়-সম্পত্তির দিকে চলে গেল।
এই বাড়িটা মনোহর রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে সেটা আইনমাফিক গিফট করে যান। টাকাপয়সার সবরকম দায়িত্বও প্রভাবতীর ওপরে। ফলে বিরাট বিষয়আশয়ের মালিক হয়েও ছেলেমেয়েরা মালিক নন। সবটাই মা-নির্ভর। প্রভাবতী যাঁকে পছন্দ করেন তাঁরই বাড়বাড়ন্ত। যেমন, এখন সুনন্দা আর অমলেশ প্রভাবতীর দু-নয়নের মণি। কিছুদিন পরই হয়তো অজয়েন্দ্র কিংবা বিজয়েন্দ্রর পালা আসবে। কলকাতার আশেপাশে জমিজিরেত অনেক ছিল। কিন্তু তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির টাকা প্রভাবতী অমলেশকে দিয়েছেন—কন্সট্রাকশানের ব্যবসা দাঁড় করাতে।
এসিজি বুঝলেন, মা-কে নিয়ে দু-ছেলে আর তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ কিছু করারও নেই—কারণ, প্রভাবতীই এ-বাড়িতে শেষ কথা।
এরপর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলে উলটো ছবি পাওয়া গেল। বড় মেয়ে মায়ের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। সারা জীবন ধরে প্রভাবতী যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত বললেন সুনন্দা। মায়ের স্নেহ-মমতা-দয়া সম্পর্কেও এত বলতে লাগলেন যে, এসিজির মনে হচ্ছিল তিনি ভগিনী নিবেদিতা অথবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী শুনছেন।
অমলেশ বাড়িতে নেই। তিনি দু-দিন আগে ব্যবসার কাজে ভাইজাগ গেছেন—পরশু ফিরে আসবেন। তবে অমলেশ থাকলেও বোধহয় কোনও লাভ হত না। কারণ, সুনন্দার কথারই প্রতিধ্বনি বোধহয় শুনতে পাওয়া যেত।
এসিজির মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। চারুবালা ছাদে গেলেন কাপড় ছড়াতে অথবা কাপড় তুলতে। অথচ ছাদে কোনও কাপড় পাওয়া গেল না। দীপ্তিমান, অজয়েন্দ্র—দুজনেই বলেছেন চারুবালা সাধারণত ছাদে যেতেন না। তা হলে সেদিন হঠাৎ গেলেন কেন! অন্যান্য দিন ওঁর কাপড়খানা কে ছড়াত, কে তুলত? নিশ্চয়ই আরতি! আরতির সঙ্গে একবার আলাদা কথা বলা দরকার।
বিজয়েন্দ্রকে ডেকে এসিজি বললেন, ‘বিজয়বাবু, আরতিকে একবার ডেকে দেবেন? নীচে বসবার ঘরে ওর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব। তবে কেয়ারফুলি ডাকবেন—আপনার মা যেন টের না পান। টের পেলেই হয়তো রাগারাগি করবেন…।’
বিজয়েন্দ্র ওঁর স্ত্রী তুলিকাকে ডেকে চাপা গলায় কী যেন বললেন। তুলিকা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
‘আপনারা নীচে যান—ও আসছে। তবে বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখবেন না। একটু পরেই মা চান করতে যাবে। তখন আরতিকে ডেকে না পেলে পরে তুলোধোনা করে ছাড়বেন।’ কথা শেষ করে অদ্ভুত হাসলেন বিজয়েন্দ্র।
নীচের বসবার ঘরে ওঁরা তিনজন সবে গুছিয়ে বসেছেন, আরতি দরজায় এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা।
‘আমায় ডেকেছেন, দাদাবাবু?’
‘তুমি তো জানো আমরা পুলিশের লোক—’ গম্ভীর চালে কথা শুরু করে এখন একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। গায়ের শালটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলে পড়েছিল, সেটা কাঁধের দিকে টেনে নিলেন।
আরতির শ্যামলা মুখ পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, জানি—।’
‘তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। একদম ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। উলটোপালটা চালাকি করলে…।’
‘মা কালীর দিব্যি—সত্যি বই মিথ্যে কইব না।’
‘চারুবালা—মানে, তোমার পিসিমার শাড়ি-জামাকাপড় রোজ কে ছাদে শুকোতে দিয়ে আসত, আর কে তুলে নিয়ে আসত?’
‘আ-আমি?’
‘অন্য কেউ কখনও যেত না?’
‘না। তবে কিছুদিন হল মা মাঝে-মাঝে বড়দিকে পাঠাতেন। কখনও বা পিসিমাকে পাঠাতেন।’
‘পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন পিসিমার কাপড় কে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল?’
একটু চিন্তা করে আরতি বলল, ‘বড়দি।’
‘শনিবার, পিসিমা যখন ছাদ ভেঙে পড়ে যান, তখন সত্যি-সত্যি বড়দি, দাদাবাবুরা, বউদিরা—সবাই মায়ের ঘরে ছিল?’
আবার সময় নিল আরতি। তারপর ‘হ্যাঁ। তবে তারপরই বড়দি আবার ছাদের দিকে গেছল। আমরা তখন বারান্দা দিয়ে গলিতে দেখচি কী পড়ল, কীসের ওরকম আওয়াজ হল।’
‘পিসিমার গলার চেনটা চুরি হয়েছিল তুমি জানো?’
‘মা কালীর দিব্যি, ও-হার আমি নিইনি, দাদাবাবু।’ আরতি আর একটু হলেই এসিজির পায়ে পড়ে আর কী!
‘না, না—তুমি নাওনি আমরা জানি। তবে হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়ে থাকবে…। তারপর—পিসিমা মারা যাওয়ার দিন—ছাদে পাওয়া গেছে।’
আরতি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘হারটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তুমি জানো?’ আবার প্রশ্ন করলেন এসিজি।
‘মনে হয় হারায়নি কোথাও। হয়তো মায়ের কাছটিতেই রেখে দিয়ে পিসিমা পাগলামির খেয়ালে ভুলে গেছে।’
এসিজির ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একবার দীপ্তিমানের দিকে দেখলেন। দুজনে চোখাচোখি হল।
‘হারটা সত্যি-সত্যি হারালে মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। দোকান-ফেরত সামান্য চার আনা আট আনার গণ্ডগোল হলেই আমায় যেরকম মুখ করে!’
এসিজির কোঁচকানো ভুরু সোজা হচ্ছিল না। মনে-মনে নতুন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, চারুবালাকে শুধু নিয়তির অদৃশ্য হাত পিছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, তারও পিছনে হয়তো মানুষেরও হাত ছিল।
এসিজি আনমনা হয়ে গেলেন। মাথার পিছনে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মারতে শুরু করলেন।
তারপর হঠাৎই আরতিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। আমার সঙ্গে যেসব কথা হল কাউকে বলবে না। বললে তোমারই বিপদ হবে।’
আরতি ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল।
কাজের লোকরা সত্যি-সত্যিই কাজের লোক। এটাকে কি যমক অলঙ্কার বলা চলে? আপনমনেই হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘গোস্বামী রঙ্গলাল / বাদ বাকিটা হবে কাল।’
‘কী বুঝলেন, ডক্টর গুপ্ত?’ দীপ্তিমান ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন।
‘মোটামুটি বোধহয় বুঝতে পারছি। আপনার সন্দেহ সত্যি হলেও হতে পারে। কাল আমি আর রঙ্গলালবাবু এ-বাড়িতে আর-একবার আসব। কী, রঙ্গলালবাবু, সময় হবে তো আপনার?’
আকর্ণ হাসলেন রঙ্গলাল ‘প্রশ্নটি অতি অবান্তরম/সময় হইবে সুনিশ্চিতম।’
দিনের আলোয় যে-বাড়িটাকে জীর্ণ অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল, রাতের আঁধারে সেটাকে ভুতুড়ে বলে মনে হল।
অশোকচন্দ্র ও রঙ্গলাল বাড়িতে ঢুকতেই সুনন্দার সঙ্গে দেখা হল। টেলিফোনে আগাম বলা ছিল। সুতরাং অপছন্দ মুখে সুনন্দা ওঁদের দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এসিজি টিভি চলার শব্দ পাচ্ছিলেন, বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রভাবতীর ঘরে ঢুকতেই টিভির শব্দ ওঁদের কানে ধাক্কা মারল।
গতকালের গন্ধটা আরও উগ্রভাবে এসিজির নাকে এল।
প্রভাবতী সম্রাজ্ঞীর ঢঙে সেজেগুজে সোফায় বসে ছিলেন। শরীর টান-টান। মুখে প্রসাধনের সামান্য আস্তর।
আরতি ওঁর পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিল। এসিজিদের দেখেই উঠে দাঁড়াল।
প্রভাবতী ওকে বললেন, ‘টিভির আওয়াজটা একদম কমিয়ে দে।’
হুকুম তামিল হল। টিভিতে মূকাভিনয় শুরু হল।
‘বলুন, ডক্টর গুপ্ত, কী ব্যাপারে দেখা করতে চেয়েছেন?’ প্রভাবতী মাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই এসিজি রঙ্গলালকে নিয়ে চারুবালার খাটের কিনারায় বসে পড়লেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা ছিল।’
সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম হল : ‘আরতি, তুই এখন যা। আমি ডাকলে তবে আসবি।’
আরতি তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে গেল। যেন পালিয়ে বাঁচল।
সুনন্দাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি ওঁকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর কাপড় ছড়াতে ছাদে গিয়েছিলেন? পরে, পিসিমা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও আপনি আবার ছাদে গিয়েছিলেন। অথচ তখন তো সকলের গলির দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। এটা একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’
সুনন্দা দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকালেন।
প্রভাবতী স্থির গলায় বললেন, ‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’
সুনন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এসিজির দিকে তাকিয়ে বোকা-বোকা হেসে চটপট চলে গেলেন।
‘যা বলার আমাকে বলুন, ডক্টর গুপ্ত। ওরা সব ছেলেমানুষ—।’
প্রভাবতীর গলায় সামান্য চ্যালেঞ্জের ছোঁওয়া ছিল। ঘরের জোড়া টিউব লাইটের আলোয় ওঁর বলিরেখাগুলো নিষ্ঠুর দেখাল।
এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পে হয়তো অনেক ফাঁকফোকর থাকবে—সেগুলো আপনাকেই ভরাট করতে হবে…।’
প্রভাবতীর মুখ পাথরের মতো। চোখ টিভির দিকে।
কাল সারাটা রাত ধরে বহু ভেবেছেন বৃদ্ধ হুনুর। মনে-মনে এমন একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন যেটা প্রতিটি সূত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সোনার হার, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, সুনন্দার ছাদে যাতায়াত—আর, সবশেষে চারুবালার নিয়তি। এখন সেই গল্পই শোনাতে এসেছেন প্রভাবতীকে।
সামান্য কেশে নিয়ে এসিজি বলতে শুরু করলেন ‘আপনি একটা চান্স নিয়েছিলেন, মিসেস রায়। চারুবালাকে আপনি নানান ছল-ছুতোয় ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গাটায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁর ভেজা কাপড় ইদানীং ওই বিপজ্জনক জায়গাতেই ছড়ানো হত। কে ছড়াতেন জানি না। তবে আপনি নন। সুনন্দা হতে পারে, আরতি হতে পারে। হয়তো ছড়ানোর জন্যে ওরা লাঠি বা অন্য কিছু ব্যবহার করত—যাতে ওই লক্ষ্মণের গণ্ডির ভেতরে ঢুকে পড়তে না হয়। তা ছাড়া, আমি দেখেছি, দড়িটা লাঠি দিয়ে টেনে এনেও নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় ছড়ানো যায়, ক্লিপ আঁটা যায়। আপনি সেই শনিবার চারুবালাকে বকাঝকা করে ওঁর শুকনো কাপড় তুলে আনতে পাঠিয়েছিলেন—আমার সেরকমই মনে হয়।
‘কিন্তু চারুবালা ছিলেন কিছুটা ছিটগ্রস্ত। তাই সবসময় হয়তো ছাদে গিয়েও ওই জায়গাটায় পা দিতেন না। হয়তো সাদা দাগটা ওঁকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিত—উনি সাবধান হয়ে যেতেন।
‘আপনি তখন খানিকটা সমস্যায় পড়লেন। তখন সোনার হারের টোপটা আপনার মাথায় এল। ওটা আপনি চারুবালার কাছ থেকে কোনও অজুহাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গায় হারটা রেখে দিয়ে এলেন। না, আপনি নন—আপনার হয়ে অন্য কেউ। আপনি যে সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না তা আমি জানি।
‘এইবার কাজ হল। চারুবালা ছাদে গেলেন। সোনার চেনটা দেখতে পেলেন। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। উনি শাড়ি থেকে ক্লিপটা আগে খুলেছেন, নাকি চেনটা আগে কুড়িয়ে নিয়েছেন কে জানে! চেনটা আগে নিয়ে থাকলে ওটা হয়তো আবার ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ছাদেই। কিন্তু ক্লিপটা হাতে থেকে গিয়েছিল…।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি। তারপর আবার খেই ধরলেন : ‘নিয়তি তার কাজ করল। চারুবালা পড়ে গেলেন। আর আপনার এ-ঘর থেকে সুনন্দা সঙ্গে-সঙ্গে ছাদে চলে গেল পিসিমণির শাড়িটা তুলে আনতে…।’
এসিজি থামলেন।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রভাবতী। টিভির দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁর দু-চোখ থেকে ভাঙা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। টিভির আলোয় জলের রেখা চকচক করছিল।
চাপা খসখসে গলায় বললেন, ‘হারটা আমি দিদির কাছ থেকে নিইনি। দিদিই আমাকে ওটা গলা থেকে খুলে রাখতে দিয়েছিল—পরে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য চাইলে আমিও অস্বীকার করতাম।
‘আপনার একটা গোপন অন্যায় চারুবালা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা কী আমি আঁচ করতে পারিনি—।’
নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক গলায় প্রভাবতী বললেন, ‘এই বাড়িটা আমি সুনন্দার নামে উইল করে গেছি। অমলেশ যেদিন কাগজপত্র সই করিয়ে নেয় দিদি সেদিন দেখেছিল। তারপর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারত। বলত, ”এ তুমি ঠিক করলা না। অজু-বিজু ভিটা ছাইরা কই যাইব!” কিন্তু কী করব! সুনন্দা-অমলেশের জন্যে যতটা আমার মন টানে অজু-বিজুর জন্যে ততটা না। ওরা অনেক পেয়েছে—।’
চোখের জল তখনও গড়িয়ে পড়ছিল—।
প্রভাবতীকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে তারপর এসিজি বললেন, ‘মিসেস রায়, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? আপনি দু-দুটো অন্যায় করেছেন—তার মধ্যে একটা এখনও শুধরে নেওয়ার সময় আছে। আমি হলে শুধরে নিতাম…।’
‘আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়েই প্রশ্ন করলেন।
‘না—’ হেসে মাথা নাড়লেন এসিজি ‘প্রমাণ নেই। প্রমাণই কি সব! একটা কথা আপনাকে বলি। ঈশ্বর কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ—এইসব পাংচুয়েশান মার্ক আমাদের হাতে দেন—তবে দাঁড়িটা নিজের হাতে রাখেন। সময় হলেই আমাদের জীবনে দাঁড়ি টেনে দেন। সেই দাঁড়িটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে ঈশ্বরকে অসম্মান করা। আপনি সেটাই করেছেন। প্রমাণ না থাকুক, যে-অন্যায়টা এখনও শোধরানো যায় আপনি সেটা অন্তত শুধরে নিন…।’
‘দিদিকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করব…সুনন্দাদের জন্যে পাগল-পাগল টান। কেন এমন টান কে জানে! আমার জন্যে দিদি…ছিল শুকতারা, সন্ধ্যাতারা হয়ে গেল। আমার জন্যে…।’
বৃদ্ধার মুখ ভেঙেচুরে গেল। জলভরা কাতর চোখে এসিজির দিকে তাকালেন তিনি। কিছু একটা বলতে চাইলেন।
এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’
একজন সর্বস্বান্ত রানিকে তাঁর মেকি সিংহাসনে বসিয়ে রেখে এসিজি আর রঙ্গলাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
টিভিতে তখনও মূকাভিনয় চলছিল।
দরজা বন্ধ ছিল (উপন্যাস)
…কিন্তু তবুও নিলয় মজুমদার খুন হয়ে গেলেন।
যেভাবে তিনি খুন হলেন তাতে খুনির নাম যে কিছুতেই ‘করুণাসিন্ধু’ হতে পারে না সেটা হলফ করে বলা যায়। কারণ, নিলয়ের মাথার পিছনে ভারী কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, এবং তার ওপরে গলায় চেপে বসেছিল রবারের মোটা ‘দড়ি’-র ফাঁস। চুয়াত্তর বছরের একজন বৃদ্ধকে খুন করার জন্য কখনওই এত আয়োজনের প্রয়োজন হয় না।
রঘুপতির মুখে খুনের ঘটনার বিবরণ শুনতে-শুনতে এসিজি-র অন্তত সেরকমই মনে হল।
মাথার পিছনে ঝুলে থাকা ধবধবে সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝোলালেন। সামনের টেবিলের ওপরে দেশলাইয়ের বাক্স পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে সিগারেট ধরালেন।
আর তখনই ঊর্মিলার কথা মনে পড়ল। ও সামনে থাকলে কিছুতেই বাবাকে সিগারেট ধরাতে দিত না। ভাগ্যিস তিনবছর আগে ওর বিয়ে হয়ে গেছে!
সিগারেট খাওয়া নিয়ে এখন অশোকচন্দ্রকে বকাঝকা করার কেউ নেই। স্ত্রী মালিনী প্রায় এগারো বছর হল অসুস্থ কিডনির কাছে ইনিংসে হেরে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে। মালিনী সিগারেট খাওয়া নিয়ে ছোট্ট-ছোট্ট কিন্তু মিষ্টি আপত্তি জানাত। এসিজি ওকে খুশি করতে বহুবার সিগারেটের নেশা ছাড়তে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ওই—যা হয়!
মালিনীর তুলনায় ঊর্মিলা ছিল একেবারে জঙ্গি সিগারেটবিরোধী। নেহাত অশোকচন্দ্র ওর বাবা বলে ঊর্মি শারীরিক শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নইলে কী যে হত কে জানে!
একেবারে ছাড়তে না পারলেও অশোকচন্দ্র সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা পঁচাত্তর পার্সেন্ট কমিয়ে দিয়েছেন। একসময় দিনে তিনি আট প্যাকেট সিগারেট খেতেন, এখন মাত্র দু-প্যাকেট।
সিগারেট ধরিয়ে মনের সুখে গভীর টান দিলেন। ধোঁয়া ছাড়লেন এবং বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিলেন। চশমার কাচের ফাঁক দিয়ে রঘুপতি যাদবের মুখের দিকে ভাবনা-বিভোর চোখে দেখলেন একবার। চোখের চশমাটা একটু নেড়েচেড়ে নাকের গোড়ায় ঠিকঠাক করে বসালেন। তারপর তাকালেন খোলা জানলার দিকে। সেই সকাল থেকেই বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। এখন বেলা এগারোটা দশ। বৃষ্টি আজ বারোটা বাজাবেই!
নিলয় মজুমদারের খুনের ঘটনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং আর অন্যরকম। এতক্ষণ ধরে ইনস্পেকটর রঘুপতি যাদবের কাছে শোনা বিবরণ আর বর্ণনার কথাগুলো মনে-মনে রিক্যাপ করছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। এই মার্ডার মিস্ট্রিটা এমন যে, লোকাল থানার পুলিশ বারবার হোঁচট খেয়ে আটকে গেছে। সেইজন্যই ব্যাপারটা গড়িয়ে গেছে লালবাজার পর্যন্ত—মানে, লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াড পর্যন্ত। এবং সবশেষে এই খুনের সমস্যাটা এসে আশ্রয় নিয়েছে রঘুপতি যাদবের কোলে।
নিজের কোল থেকে সমস্যাটা এসিজি স্যারের কোলে ট্রান্সফার করবে বলে রঘুপতি আজ সকাল সাড়ে ন’টার পরপরই এসে হাজির হয়েছে ওর প্রাক্তন স্যারের শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে।
বৃদ্ধ নিলয় মজুমদার খুন হয়েছেন পঁচিশ দিন আগে—গত মাসের বাইশ তারিখে। কিন্তু পুলিশ এই খুনের কিনারা করা তো দূর অস্ত কাউকে অ্যারেস্ট পর্যন্ত করতে পারেনি।
রঘুপতির কোলে খোলা রয়েছে একটা মোটা ফাইল—নিলয় মজুমদারের কেস ফাইল। এতক্ষণ ধরে সেটা কনসাল্ট করেই গোটা কেস হিস্ট্রিটা ও এসিজি স্যারকে শুনিয়েছে।
ফাইলটা পড়ার জন্য রঘুপতি চোখে রিডিং গ্লাস লাগিয়েছে। বয়েসটা চল্লিশ পেরোলেও চেহারা ভীষণ শক্তপোক্ত। চোয়ালের রেখা এবং চোখ বলে দিচ্ছে, নিজের শারীরিক শক্তির ওপরে ওর আস্থা নেহাত কম নয়।
রঘুপতির ঠোঁটের ওপরে কাঁচাপাকা গোঁফ। মুখে বসন্তের দাগ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স নিয়ে এম. এসসি. পড়ার সময় ও ‘স্যার’ হিসেবে এসিজিকে পেয়েছিল। তখন থেকেই স্যারের অ্যানালিটিক্যাল বুদ্ধির সঙ্গে ওর সরাসরি পরিচয়।
এখন স্যারের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে ওরা দুজনে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে রয়েছে। ওদের মাঝখানে নীচু টি-টেবিল। টেবিলে দুটো খালি কফির কাপ আর স্ন্যাক্সের প্লেট। প্লেটে কয়েকটা লেফট ওভার বিস্কুট পড়ে রয়েছে।
রঘুপতির গায়ে সাধারণ পোশাক—তাতে কোনও পুলিশি ছাপ নেই। ওর প্যান্টের নীচের দিকটা ভেজা। গাড়ি থেকে নেমে স্যারের বিল্ডিং-এ ঢোকার সময় বৃষ্টির ছাট এই কাণ্ডটা করেছে। হাতের ছাতা মাথা বাঁচালেও পা পুরোপুরি বাঁচাতে পারেনি।
রঘুপতি যাদব ওর প্রাক্তন স্যারের দিকে তাকাল। স্যার এখন পুরোদস্তুর ‘মিস্টার হোয়াইট’। গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা। মাথায় লম্বা-লম্বা সাদা চুল। আর স্যারের মাথা ঘিরে ভেসে বেড়াচ্ছে সিগারেটের সাদা ধোঁয়া।
অশোকচন্দ্র রঘুপতি যাদবের দিকে চোখ খুলে এক-একবার দেখছেন, আবার কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আপনমনে কী ভাবছেন।
এসিজি রঘুপতির বর্ণনা আর বিবরণের কথাই ভাবছিলেন। শুরু থেকে শুরু করে কেস হিস্ট্রিটা মনে-মনে খতিয়ে দেখছিলেন। রঘুপতি যাদবের কথাগুলো যেন আবার শুনতে পাচ্ছিলেন।
কলকাতার নিউ আলিপুর অঞ্চলে নিলয় মজুমদারের তিনতলা বাড়ি। জায়গাটা নিউ আলিপুর হলেও অঞ্চলটা নিতান্তই মধ্যবিত্ত এলাকা।
নিলয় মজুমদার সেলফ মেড ম্যান। ছোটবেলায় বাবা-মা-কে হারিয়েছেন। কাকার কাছে মানুষ। অনেক কষ্ট সহ্য করে, পরিশ্রম করে, পড়াশোনা করে বড় হয়েছেন। যাদবপুর ইউনিভারসিটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন সসম্মানে, ভালো রেজাল্ট করে। প্রথম জীবনে আট বছর মতন চাকরি করার পর ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ নামে নিজের কনস্ট্রাকশন কোম্পানির শুরুওয়াত করেন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কোম্পানি ধাপে-ধাপে বড় হয়েছে। অনেক বড়-বড় টাউনশিপ তৈরি করেছেন। রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ নানান প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে রাজ্য সরকারের কনট্রাক্টরদের তালিকায় ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ একজন নামিদামি বিল্ডার।
চৌষট্টি বছর বয়েসে নিলয়বাবুর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন তিনি একটু ভয় পেয়ে যান। তাই স্ত্রীর পরামর্শে ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ান। ওঁদের একমাত্র ছেলে তনয় মজুমদার—তাঁর কোনও বোন-টোন নেই। তনয় সাধারণ বি. কম. পাশ। কিন্তু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস থেকেই নিলয় ওঁকে ব্যবসায় টেনে নেন। তনয়ের ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে নিলয়বাবুর সিরিয়াস অভিযোগ ছিল, বাট উপায় কী—হাজার হলেও ছেলে এবং ওনলি চাইল্ড!
তনয় মজুমদারের বয়েস এখন সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ মতন। বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম টুনি মজুমদার। বিয়ের আগে মডেলিং করতেন। এখনও সেই অভ্যাস ধরে রেখেছেন। ফ্যাশান নিয়ে বেশ ইন্টারেস্ট আছে। বড়লোকের বউ-টউ হলে যা হয়! রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একটা বুটিক আছে। সেখানে প্রিমিয়াম প্রাইস ট্যাগ লাগানো সব প্রিমিয়াম আইটেম বিক্রি হয়।
একটাই ফাঁকা জায়গা রয়েছে টুনি আর তনয়ের লাইফে—ওঁদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। যদিও দশবছর হল বিয়ে হয়েছে।
নিলয়বাবুর পার্সোনাল দেখাশোনার জন্য কাজের মেয়ে রয়েছে সাবি—মানে, সাবিত্রী। বিয়ে হয়ে গেছে বাট হাজব্যান্ড চারবছর ধরে লাপাতা। সাবির বয়েস তিরিশ-টিরিশ হলেও আরও ইয়াং দেখায়। তা ছাড়া দেখতেও বেশ সুন্দরী—মানে, কাজের মেয়ের পক্ষে। সাবি রাতে নিলয়বাবুর বাড়িতেই থাকে। নিলয় মজুমদারের ঘরের লাগোয়া লম্বা-চওড়া বারান্দা আছে। বারান্দাটা ওয়েল প্রোটেক্টেড—মোটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সাবি রাতে সেখানেই শোয়।
নিলয়ের বাড়িটা তিনতলা। একতলায় রয়েছে দুটো গেস্টরুম আর কমন বাথরুম, তার সঙ্গে কলতলা।
দোতলায় নিলয়বাবুর দুটো ঘর—বেডরুম আর স্টাডি—পাশাপাশি। দুটো ঘরের মাঝে যাতায়াতের দরজা রয়েছে। স্টাডিতে ঢুকতে হলে নিলয়বাবুর বেডরুম দিয়ে ঢুকতে হয়। এ ছাড়া দোতলায় ছোট্ট একটা ড্রয়িংরুম মতন রয়েছে—সেটা কমন, সবাই ইউজ করে। ব্যস, দোতলায় নিলয়বাবু ছাড়া আর কেউ থাকে না। তনয়বাবু অনেকবার এই একা থাকা নিয়ে খিচিরখিচির করলেও নিলয় মজুমদার সেসব কথা কানে ঢোকাননি। তনয় এ নিয়ে কখনও জোরজবরদস্তি করতে পারেননি কারণ, নিলয় মজুমদার ওয়াজ দ্য বস। বয়েস চুয়াত্তর হলেও তাঁর কথাতেই সবাই চলত—মানে, চলতে হত। কারণ, বাড়ির মালিক তিনি, কোম্পানির মালিক তিনি। বরাবরই ওঁর বিহেভিয়ার একটু রুক্ষ, বস টাইপের—তার ওপর বছর দেড়েক আগে ওঁর ওয়াইফ এক্সপায়ার করার পর থেকে উনি আরও বেশি খিটখিটে হয়ে পড়েন। এ-কথা তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার যেমন জানিয়েছেন, তেমনই সাবিত্রীর কাছ থেকেও একই টাইপের কমেন্ট পাওয়া গেছে। মানে, বেসিক্যালি নিলয়বাবু বদমেজাজি ছিলেন। তাই সবাই ওঁকে খুব সমঝে চলত।
এরপর আসছে ও-বাড়ির লাস্ট মেম্বারের কথা। প্রজেন বসু রায়। বয়েস তেতাল্লিশ। ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। উনি নিলয়বাবুদের কোনও ব্লাড রিলেশান নন, বাট ও-বাড়িতে পারমানেন্টলি থাকতেন—আই মিন, থাকেন।
তিনতলায় তনয় মজুমদার আর টুনি মজুমদার থাকেন। প্রজেন থাকেন ওঁদের পাশের ঘরেই। আর উনি হলেন ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’-এর ম্যানেজার এবং টুয়েন্টি পারসেন্টের পার্টনার। প্রজেনের বাবা-মা নেই। অরফ্যান। ওঁর বাবা ব্রজেন বসু রায় যাদবপুর ইউনিভারসিটিতে নিলয় মজুমদারের ক্লাস মেট ছিলেন। শুধু ক্লাসমেট নয়, খুব বন্ধু ছিলেন দুজনে।
এ রকম সময়ে রঘুপতি যাদবের কাহিনির স্রোতকে বাধা দিয়েছিলেন অশোকচন্দ্র।
‘এই ব্যাপারটা কি ভীষণ আনইউশুয়াল নয়, রঘুপতি?’ রঘুপতির দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকালেন এসিজি। ভুরু উঁচিয়ে সেরকম ইশারাও করলেন : ‘যতই বন্ধুর ছেলে হোক, যতই অনাথ হোক, তাকে সরাসরি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে পারমানেন্টলি থাকতে দেওয়াটা বেশ বেসুরো লাগছে…।’
রঘুপতি হেসে বলল, ‘গুপ্তাসাব, এই কাহানিটাই আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম। নিলয় মজুমদার যখন নিজের কোম্পানি খোলেন তখন ব্রজেন বসু রায়কে ডেকে নিয়ে এসে এইটি-টুয়েন্টির পার্টনার করে নেন। ওঁদের কাজকর্ম ভালোই চলছিল। কিন্তু বাইশ-তেইশ সাল পহেলে একটা হাদসা হয়। তখন ওঁরা কাশীপুর এরিয়ায় একটা ছোট ফ্লাইওভার বানাচ্ছিলেন। কনস্ট্রাকশন যখন ফিফটি কি সিক্সটি পার্সেন্ট মতন হয়েছে তখন একদিন লগভগ রাত এগারোটার সময় ওটা সাডেনলি ভেঙে পড়ে। ওই অ্যাক্সিডেন্টে তিনজন মারা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রজেন বসু রায়। তিনি সেসময়ে সাইটে ছিলেন। ব্যাড লাক। তখন ওঁর ছেলে প্রজেনের বয়েস অ্যাবাউট টুয়েন্টি ইয়ার্স।
‘ওই অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে এফ. আই. আর. হয়েছিল। পুলিশ-কেসও হয়েছিল। কিন্তু নিলয় মজুমদার শেষ পর্যন্ত রিহা হয়ে যান। ইনভেস্টিগেশানে এটা জানা গিয়েছিল যে, ফ্লাইওভার কনস্ট্রাকশনের মেটিরিয়াল ”বি” গ্রেডের ছিল। বাট সেটার জন্যে নিলয়বাবুর কোম্পানি যে ডিরেক্টলি রেসপনসিবল সেটা প্রূভ করা যায়নি। কারণ, বিল্ডিং মেটিরিয়াল পারচেজের যেসব পারচেজ বিল উনি দেখিয়েছিলেন সেগুলো সবই ছিল ”এ” গ্রেড মেটিরিয়ালের বিল। কিন্তু পাবলিকের সন্দেহ যায়নি। এর পরেও নিলয় মজুমদারের কোম্পানির নামে কখনও-কখনও কনস্ট্রাকশনে চিটিং-এর রিপোর্ট হয়েছে…।’
‘তার মানে, প্রজেন বসু রায়কে এরকম একটা ফেভার দেওয়া হয়েছে অ্যাজ কমপেনসেশান?’
‘শুধু কমপেনসেশান নয়, স্যার—তার সাথ-সাথ গিল্ট কমপ্লেক্সও হয়তো আছে। সেটা এখন আর আমরা প্রূভ করতে পারব না। আওয়ার ব্যাড লাক।’
আরও অনেকক্ষণ ধরে রঘুপতির সঙ্গে কথা বললেন এসিজি। রঘুপতি বারবার যেটা ইমপ্রেস করতে চাইল সেটা হল, এই মার্ডার মিস্ট্রিটা বেশ কমপ্লেক্স আর ইন্টারেস্টিং।
‘আপনার মতো ”থিংকিং মেশিন”-এর এটা ক্র্যাক করতে বেশ মজা লাগবে, স্যার।’ সবকিছুর শেষে রঘুপতি যাদব মন্তব্য করল। তারপর : ‘আমার সঙ্গে একদিন চলুন, স্যার। স্পটটা একটু ঘুরেফিরে দেখবেন, ক্যারেকটারগুলোর সঙ্গে বাতচিত করবেন, ওদের নেড়েচেড়ে দেখবেন…।’
‘হ্যাঁ, তোমার কাছে সব শুনে-টুনে ইন্টারেস্টিং বলেই মনে হচ্ছে। তবে স্পট তো এখন আর হট নেই, ক্রাইমের এতদিন পর কোল্ড স্পট হয়ে গেছে।’
‘কী করব স্যার—ম্যাটারটা আমার হাতে এলই তো অনেক দেরি করে! এ ছাড়া…।’ কথার মাঝে থেমে গেল রঘুপতি।
‘এ ছাড়া কী?’ প্রশ্ন করলেন এসিজি।
‘এ ছাড়া মার্ডারটার মধ্যে একটা ”লকড রুম প্রবলেম” টাইপের ডায়মেনশন আছে…।’
‘বলো কী হে?’ অশোকচন্দ্রের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল আগ্রহে।
রঘুপতি জানে, কোন বিষয়ে ওর স্যারের স্পেশাল ইন্টারেস্ট।
‘স্যার, এবারে বলুন, কবে আপনার সময় হবে। সেইমতো লোকাল থানার ও. সি-কে আমি ইন্টিমেট করে রাখব।’
এসিজি ঘরের সিলিং-এর দিকে দেখলেন। ঘাড়ের পিছনে হাত নিয়ে ঝুলে পড়া চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন।
নিলয় মজুমদার হয়তো খিলখিটে দাপুটে অসৎ ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু ওঁর বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। বরং মার্ডারারের ওঁর লাইফ টার্মিনেট করার অধিকার ছিল না। খুনের পদ্ধতি আর রঘুপতির বর্ণনা শুনে এসিজির মনে হয়েছে, খুনি যেন অহংকারে মদমত্ত হয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছে, ‘কাম অন। সলভ দ্য মিস্ট্রি অ্যান্ড ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান।’
এসিজি রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, সামনের রোববার সকাল ন’টা কি সাড়ে ন’টা নাগাদ আমরা মজুমদারদের বাড়িতে যাব। তুমি একটু আগাম খবর দিয়ে রেখো। সবাই যেন বাড়িতে থাকে। অবশ্য সানডেতে সবারই বাড়িতে থাকার কথা…।’
‘ও. কে., গুপ্তাসাব। তা হলে সেরকমই অ্যারেঞ্জমেন্ট করছি।’
রঘুপতি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইলটা হাতে নিল।
সেটা দেখে বৃদ্ধ হুনুর বললেন, ‘উঁহু, উঁহু—ওই ফাইলটা রেখে যাও, রঘুপতি। ওটা উলটেপালটে দেখে আমি একটু হোমওয়ার্ক সেরে নেব। আমার কাজ হয়ে গেলে তোমাকে ফোন করে দেব। তুমি কাউকে পাঠিয়ে ফাইলটা নিয়ে যেয়ো—।’
‘ও. কে., স্যার।’ ফাইলটা টেবিলে আবার নামিয়ে রাখল রঘুপতি।
‘ওতে মজুমদার-বাড়ির সবার স্টেটমেন্ট আছে তো?’
‘বিলকুল হ্যায়, স্যার। সঙ্গে ইচ অ্যান্ড এভরিবডির ফোটোগ্রাফভি আছে।’
‘আর ক্রাইম সিনের ফোটো…?’
‘সেও আছে, স্যার। একটা-দুটো ফোটো নয়, অনেক ফোটোগ্রাফ। ক্রাইম সিনের নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ফোটো। এভিডেন্সের ফোটো। বাড়ির নানান পোরশানের ফোটো। প্রত্যেকটা রুমের পিকচার—সব আছে, স্যার।’
‘গুড—ভেরি গুড।’
‘তা হলে ওই কথাই রইল, স্যার। নেক্সট সানডে।’
‘ইয়েস—নেক্সট সানডে।’
‘এই চিড়িয়াটাকে যে করে হোক খাঁচায় ঢোকাতে হবে, স্যার।’
এসিজি খুনি কিংবা অপরাধীকে প্রায়ই পাখির সঙ্গে তুলনা করেন। সেইজন্যই রঘুপতি পাখিকে খাঁচায় ঢোকানোর কথা বলল।
অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘সিনসিয়ার চেষ্টা তো করব, রঘুপতি। কিন্তু জানো তো, খুন অতি জঘন্য কাজ—বাট খুনি ধরার কাজটা আরও জঘন্য…।’
নিলয় মজুমদারের বাড়ির নাম যদি ‘নিলয় নিবাস’ হয় তা হলে টেকনিক্যালি আপত্তি করার কিছু না থাকলেও গ্র্যামাটিক্যালি বোধহয় আছে। তা ছাড়া নামকরণের প্রবণতা দেখে এটা মনে হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয় যে, নিলয় মজুমদার আত্মপ্রচার ভালোবাসতেন। সেইজন্যই ওঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’ এবং বাড়ির নাম ‘নিলয় নিবাস’। ভদ্রলোক বোধহয় কম-বেশি মেগালোম্যানিয়াক ছিলেন।
রং চটে যাওয়া লালচে-গোলাপি তিনতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে এসিজি মনে-মনে এইসব কথাই ভাবছিলেন।
বেশ উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা বনেদি ঢং-এর বাড়ি। বাড়ির লাগোয়া মাঝারি মাপের বাগান। বাগানে কয়েকটা বড়-বড় গাছ অগোছালোভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ছোট-ছোট দু-চারখানা ফুলগাছ। লাস্ট একমাস ধরে বলতে গেলে রোজই এক-দু পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাগানের মাটি ভিজে স্যাঁতসেতে। বাগান পেরিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার যে-সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা সেটা বেশ সরু এবং বাটিক প্রিন্টের মতো ফাটল ধরা।
বাগানের একপাশে পাঁচিল ঘেঁষে তিনটে ছাতারে পাখি চঞ্চলভাবে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল। এসিজিদের চারজনকে ঢুকতে দেখে চট করে উড়ে পালাল। সেখানে অনেকগুলো গাছের ডাল কেটে লম্বালম্বিভাবে স্তূপের মতো করে সাজিয়ে রাখা ছিল। ছাতারে পাখিগুলোর লাফালাফিতে দুটো ডাল গড়িয়ে পড়ল নীচে। এই ডালগুলো দিয়ে হয়তো বেড়া দেওয়া হবে অথবা ওগুলোকে জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগানো হবে।
বাড়িটাকে দেখে বেশ শান্ত স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল। রোববারের সকালে যেন ছুটির দিনের আলসেমি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাউন্ডারি ওয়ালে গাঁথা প্রমাণ মাপের লোহার মেন গেট। তার একদিকের পিলারে সাদা পাথরের ফলক বসানো। তাতে কালো হরফে লেখা ‘নিলয় নিবাস’।
মেন গেট পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা। সদর দরজা ভেজানো থাকলেও খোলাই ছিল। তা ছাড়া সেখানে কোনও দারোয়ান বা সিকিয়োরিটি গার্ড মোতায়েন ছিল না। হয়তো সেরকম প্রয়োজন নেই বলেই।
সবার প্রথমে রঘুপতি যাদব দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ওর পিছন-পিছন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর ঢুকলেন নিউ আলিপুর থানার ও. সি. নিজামুল হক। আর তাঁর সঙ্গী থানার একজন কনস্টেবল ভগবান মিস্ত্রি।
ভগবান উর্দি পরে থাকলেও রঘুপতি এবং নিজামুল হক সাদা পোশাকে এসেছেন। রঘুপতির হাতে একটা প্লাস্টিকের ফোল্ডার—তার মধ্যে নিলয় মজুমদারের মার্ডার ইনভেস্টিগেশানের জরুরি কাগজপত্র আর ফোটোগ্রাফ। তবে ও. সি. হকসাহেবের হাত খালি, কারণ, তাঁর কাগজপত্রের ফাইলটি ভগবান মিস্ত্রি বহন করছেন। সেটা দেখে এসিজির মনে হয়েছে, সত্যিই ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়!
গাড়িতে করে আসার সময় নিজামুল হক তাঁর ভিউপয়েন্ট থেকে গোটা কেসটার একটা সংক্ষিপ্ত রিক্যাপ অশোকচন্দ্র গুপ্তকে শুনিয়ে দিয়েছেন। এও বলেছেন, সরাসরি প্রমাণ-টমান না পেলেও তাঁর বিশ্বাস, এই মার্ডারের পিছনে প্রজেন বসু রায়ের ইনভলভমেন্ট আছে।
এ-কথায় অশোকচন্দ্র হেসে মাথা নেড়েছেন, বলেছেন, ‘পুলিশের ইনস্টিংট একটা ইমপরট্যান্ট ফ্যাক্টর। আপনার সন্দেহটা আমি মাথায় রাখলাম।’ মনে-মনে ভাবলেন, প্রজেন মজুমদার ফ্যামিলির ব্লাডকিন নয়—সেইজন্যই কি এই সন্দেহ?
এসিজিদের রিসিভ করার জন্য তনয় বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঘুপতি ওঁকে এই স্পেশাল ভিজিটের দিনক্ষণ আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া আজ গাড়ি থেকে নেমেই ওঁকে ফোন করে জানিয়েছে, ‘আমরা এসে গেছি—।’
টুকটাক পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। অশোকচন্দ্র মুখ তুলে গাছের পাতা আর ডালপালার দিকে তাকিয়ে পাখিগুলোকে খুঁজছিলেন। ডাক শুনে অবশ্য কয়েকটাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। শালিখ, বসন্তবৌরী আর বুলবুলি।
অশোকচন্দ্রের পাখি খোঁজার আগ্রহ দেখে নিজামুল হক একটু অবাক হচ্ছিলেন। সেটা লক্ষ করে রঘুপতি বলল, ‘চিড়িয়া স্টাডি করা স্যারের হবি। ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা না করলে উনি অবশ্যই অরনিথোলজিস্ট হতেন…।’
হকসাহেব ভদ্রতার হাসি হেসে বললেন, ‘ভালো, ভালো। ডিটেকটিভদের দু-একটা স্পেশাল হবি থাকা দরকার।’
অশোকচন্দ্র হকসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জানেন তো, কোনও-কোনও হবি ইনভেস্টিগেশানে খুব হেলপ করে…।’
তনয় মজুমদার এইসব টুকরো কথা চুপ করে শুনছিলেন। ঠোঁটে একচিলতে হাসি। একটু ফাঁক পেতেই নিজের পরিচয় দিয়ে সৌজন্য বিনিময় করলেন। ও. সি. নিজামুল হকের দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসলেন। হকসাহেবও পালটা হাসিতে জবাব দিলেন। বোঝা গেল, হকসাহেব তদন্তের খাতিরে এ-বাড়িতে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছেন।
নিজামুল হক উচ্চতায় খাটো গোলগাল মানুষ। মাথায় টাক, গালে কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। গায়ের রং বেশ ময়লা। মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। ফলে ময়লা রঙের অন্ধকার হাসির আলো দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন।
অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে তনয় বললেন, ‘আপনার কথা ইনস্পেকটর যাদবের কাছে অনেক শুনেছি। আপনি তো ফিজিক্সের প্রফেসার…রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ছিলেন…।’
‘হ্যাঁ—’ সায় দিয়ে বললেন এসিজি, ‘কয়েকবছর হল রিটায়ার করেছি।’
‘ফিজিক্স খুব কঠিন সাবজেক্ট।’
এসিজি মোটেই বিনয় করে বললেন না, ‘না, না, কী আর এমন কঠিন!’ বরং বললেন, ‘হ্যাঁ, একটু কঠিন তো বটেই!’ তারপর মনে-মনে ভাবলেন, ‘যে কমার্স নিয়ে পড়াশোনা করে বি. কম. পাশ করেছে, তার কাছে ফিজিক্স তো লোহা কিংবা পাথরের মতো কঠিন হবেই!’
এসিজি তনয়কে লক্ষ করছিলেন।
ফরসা। একটু থলথলে চেহারা। বয়েস সাঁইতিরিশ কি আটতিরিশ। চোখে কালো ফ্রেমের আধুনিক চশমা। চশমার কাচের পিছনে থাকা চোখজোড়া যেন কিছু বলতে চায়। রঘুপতির ফাইলে তনয়ের ফোটোগ্রাফ দেখেও এসিজির ঠিক একই কথা মনে হয়েছিল।
তনয়ের পরনে সাদা পাজামা আর গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট। টি-শার্টের বুকের ওপরে বড়-বড় করে লেখা ‘Being Human’।
তনয়ের গা থেকে সিগারেটের হালকা গন্ধ পাচ্ছিলেন এসিজি। মনে-মনে হেসে ভাবলেন, ‘তনয় তা হলে আমারই মতো—স্মোকার। কিন্তু ও কোন ব্র্যান্ড খায়?’
এসিজি রঘুপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রঘুপতি, আমি নিলয়বাবুর বেডরুমে প্রথমে যেতে চাই। শুধু তুমি আর আমি। বাকিরা অন্য কোথাও ওয়েট করতে পারে…।’
নিজামুল হেসে বললেন, ‘মিস্টার গুপ্ত, আমাকে একটু আপনাদের সঙ্গে দোতলায় যেতে হবে—নিলয়বাবুর ঘরের দরজার সিলটা খুলে দেওয়ার জন্যে।’
‘অবশ্যই। চলুন।’ নিজামুলকে কথাগুলো বলে তনয়ের দিকে তাকালেন এসিজি : ‘আপনি আপনার রুমে গিয়ে ওয়েট করুন, তনয়বাবু—আমি দরকার মতো আপনাকে ডেকে নেব…।’
তনয় ‘থ্যাংক ইউ’ বলে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিল।
হকসাহেব ভগবানকে সদর দরজায় মোতায়েন থাকতে বললেন। ওঁর হাত থেকে ফাইলটা চেয়ে নিলেন। রঘুপতির দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘এটা আমার কাছে থাক। জাস্ট ইন কেস…।’
নিলয়বাবুর ঘরটা থেকে খুনের গন্ধ বেরোচ্ছিল। অন্তত অশোকচন্দ্রের তাই মনে হল।
বেশ বড় মাপের সাজানো-গোছানো ঘর। একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে খাট। তার ওপরে বিছানা। এই বিছানাতেই নিলয়বাবুর বডি পড়ে ছিল। বৃদ্ধের পরনে ছিল সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ডোরাকাটা নীলচে পাজামা।
বিছানার চাদর ছিল রক্তমাখা। নিলয়ের গেঞ্জিতেও রক্ত লেগে ছিল। ওঁর মাথার পিছনে ভারী কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করেছিল খুনি। পরিভাষায় যাকে বলে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট। সেটার আঘাতে ওঁর মাথার পিছন থেকে এবং মুখ দিয়ে যথেষ্ট ব্লিডিং হয়েছে।
এ ছাড়া খুনি নিলয়ের গলায় রবারের ফিতের ফাঁস এঁটে মরণটান দিয়েছিল—স্লাইডিং উইন্ডোয় যে-রবারের ফিতের লাইনিং দেওয়া হয়, সেই ফিতে। তার টানে কোনও মানুষের দমবদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াই স্বাভাবিক।
ফোরেনসিক অ্যানালিসিস আর পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে তাতে মাথার পিছনের আঘাত, নাকি গলার ফাঁস—ঠিক কোনটার জন্য নিলয় মজুমদার মারা গেছেন সেটা শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়নি। দুটোর যে-কোনও একটার জন্যই কোনও মানুষের মৃত্যু হতে পারে। যেমন, স্ট্র্যাংগুলেশানের জন্য হাইঅয়েড বোন ভেঙে গেছে, ল্যারিংস ড্যামেজ হয়েছে। অবশ্য বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে হাইঅয়েড ব্রিটল হয়ে যায় বলে মডারেট প্রেশারেই ভেঙে যায়।
নিলয় খুন হয়েছেন রাত সাড়ে দশটা থেকে একটার মধ্যে। সেই সময় সাবি ঘুমিয়ে ছিল। আর তনয় মজুমদার, ওঁর স্ত্রী এবং প্রজেন বসু রায় তিনতলায় তাস খেলছিলেন। যেদিন নিলয় খুন হন তার পরদিন ভোর ছ’টা নাগাদ সাবি জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখতে পায় যে, নিলয় রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। তখন ওর চেঁচামেচিতে তনয়, টুনি আর প্রজেন তিনতলা থেকে ছুটে আসেন। ওঁদের চেঁচামেচিতে তার পরপরই দু-চারজন প্রতিবেশী এসে জড়ো হন।
অশোকচন্দ্র নিলয়ের ঘরটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলেন। ঘরে একটা টেবিল, তিনটে চেয়ার। আর একটা ছোট্ট শো-কেস। সবই মামুলি স্ট্যান্ডার্ডের। রঘুপতি হাতের ফোল্ডারটা টেবিলে রেখে ওর স্যারের পাশে-পাশে ঘুরছিল আর খুনের বিষয়ে বকবক করে যাচ্ছিল।
এসিজি প্রথমে বিছানা পরীক্ষা করার পর জানলাগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
ঘরে মোট তিনটে জানলা—দুটো বারান্দার দিকে, একটা বাইরের বাগানের দিকে। তিনটে জানলাই একরকম দেখতে। প্রতিটি জানলায় ঘরের ভেতরদিকটায় স্লাইডিং দুটো কাচের পাল্লা, আর তার বাইরে মোটা লোহার গ্রিল।
ঘরের বাগানের দিকের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো চারটে রঙিন ফোটো ঝুলছে। ফোটোগুলো বেশ পুরোনো, আর তাদের বিষয় একই : মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিলয় মজুমদার পুরস্কার জাতীয় কিছু একটা নিচ্ছেন।
নিলয় মজুমদার জানলা-দরজা সব বন্ধ করে ঘুমোতেন। ঘরে দশ বাই দশ ইঞ্চির তিনটে ভেন্টিলেটর বসানো থাকায় সাফোকেশানের কোনও ভয়-টয় ছিল না।
খুনের পরদিন ভোরবেলা তনয়বাবুরা দরজা ভেঙে নিলয়ের ঘরে ঢোকেন। তনয়, টুনি, প্রজেন এবং সাবিত্রী সবাই এটা কমফার্ম করেছে যে, ঘরের সব জানলা এবং দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
নিলয়বাবুর ঘরের দুটো দরজা। একইরকম দেখতে। শক্তপোক্ত। তার মধ্যে একটা দরজা ভাঙা। সেটা বাইরে থেকে ফিতে দিয়ে সিল করে দিয়েছে পুলিশ। অন্য দরজাটা দিয়ে এসিজি আর রঘুপতি যাদব নিলয় মজুমদারের ঘরে ঢুকেছেন।
রঘুপতি এবার ওর স্যারকে দরজা নিয়ে বলতে শুরু করল।
‘জানলার ডেসক্রিপশান তো আপনাকে আগেই দিয়েছি, স্যার।’ ভাঙা দরজাটার কাছে এগিয়ে যেতে-যেতে রঘুপতি বলল, ‘এবারে দরজার কেসটা দেখুন। যে-দরজাটা ভাঙা হয়েছে সেটা দিয়েই নিলয়বাবু অন্দর-বাহার করতেন। দেখুন, স্যার, এটার ছিটকিনিটা ভাঙা। মানে, রাতে শোয়ার সময় মিস্টার মজুমদার ছিটকিনি দিয়ে শুয়েছিলেন। বাইরে থেকে দরজা ভাঙার সময়ে এই ছিটকিনিটাও ভেঙে গিয়েছে।
‘অন্য দরজাটা—মানে, যেটা দিয়ে আমরা এ-ঘরে ঢুকলাম—সেটা মিস্টার মজুমদার ইউজ করতেন না। ওটা সবসময় বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকত। আর সেই তালার চাবি থাকত মিস্টার মজুমদারের কাছে। তো সেকেন্ড দরজাটা অ্যাজ ইউশুয়াল তালা দেওয়া অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছিল। ওটার চাবি পাওয়া গেছে বিছানায়, ডেডবডির পাশে।’
রঘুপতির কথায় সামান্য ফাঁক পেতেই এসিজি জানতে চাইলেন, ‘চাবিটা ভিকটিমের পাশে বিছানায় কেন পাওয়া গেল বলতে পারো? পুলিশ কি এর কোনও এক্সপ্ল্যানেশান খুঁজে পেয়েছে?’
‘না, স্যার—পায়নি।’ ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নড়ল রঘুপতি।
ঘরে ঢোকার সময় অশোকচন্দ্র দেখেছেন, দ্বিতীয় দরজাটার বাইরে হাঁসকল লাগানো। তাতেই সবসময় ভারী তালা ঝোলানো থাকে। এখনও তাই ছিল। তবে সেই বন্ধ তালাটা কাপড় জড়িয়ে গালা দিয়ে সিল করা ছিল। ও. সি. নিজামুল হক একটু আগে সেই সিল ভেঙে দরজাটা এসিজিদের জন্য খুলে দিয়ে গেছেন। এখানকার তদন্তের পাট চুকে গেলে আবার সিল করে দেবেন।
‘তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’ এসিজি মনে-মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন।
একটা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ—যেটা ভেঙে সবাই ঘরে ঢুকেছে এবং নিলয়বাবুর মৃতদেহের মুখোমুখি হয়েছে।
দ্বিতীয় দরজাটা বাইরে থেকে বরাবর যেরকম হাঁসকল এঁটে তালা ঝোলানো থাকে সেরকমই ছিল। চাবি ছিল নিলয়বাবুর কাছে।
ঘরের তিনটে জানলারই স্লাইডিং কাচের পাল্লা আটকানো ছিল। শুধুমাত্র ঘরের ভেতর থেকে সেগুলো খোলা-বন্ধ করা যায়।
এই অবস্থায় মার্ডারার ঘরে ঢুকল কেমন করে? যদি নিলয়বাবু তাকে দরজা খুলে ঘরে ঢুকিয়ে থাকেন তা হলে ওঁকে খুন করার পর খুনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কেমন করে? সব জানলা-দরজা ভেতর থেকে বন্ধ রেখে?
এইজন্যই রঘুপতি বলেছিল, খুনটাতে একটা ‘লকড রুম প্রবলেম’-এর ডায়মেনশন আছে।
এসিজি মনে-মনে ধাঁধাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন আর একইসঙ্গে ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
ঘরে একটা বড়সড় স্টিলের আলমারি। তার পাল্লা দুটো সামান্য খোলা। নিলয় মজুমদার মার্ডার হওয়ার পর এই আলমারিটা খোলা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ইচ্ছে করে সেই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে—যাতে ক্রাইম সিন ডিসটার্বড না হয়। এই আলমারি থেকে কিছু খোয়া গেছে বলে বাড়ির লোকেরা দাবি করেননি।
এসিজি পকেট থেকে একটা পেন নিয়ে সেটা দিয়ে খুব সাবধানে আলমারির একটা পাল্লা আরও একটু ফাঁক করলেন।
সেটা দেখে রঘুপতি হেসে বলল, ‘অত কেয়ার নেওয়ার দরকার নেই, স্যার। ফোরেনসিকের লোকজন অনেকদিন আগেই ওদের ডাস্টিং আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের কাজ শেষ করে গেছে।’
পেন পকেটে রেখে দু-হাতে আলমারির দুটো পাল্লাই হাট করে খুলে দিলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা।
ভেতরের দৃশ্য অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক। আর-পাঁচটা আলমারি যেমন হয়! সবক’টা তাকে জামাকাপড় আর কাগজপত্র ঠাসা। তবে একটা তাকে দুটো সাহেবি হ্যাট চোখে পড়ল। নিলয় মজুমদারের হ্যাটের শখ ছিল।
এসিজি একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে খোলা আলমারির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এরকমই তিনটে হ্যাট বাইরের বাগানে পাওয়া গেছে। হয়তো মার্ডারার ও-দুটো ছুড়ে দিয়েছে ওখানে। দোতলার বারান্দার মুখ থেকে টুপিগুলো ফ্রিসবির মতো ছুড়ে দিলে ওগুলো বাতাসে ভেসে ওই জায়গায় গিয়ে পড়তে পারে।
এসিজি আলমারির লকের কাছটা একবার দেখলেন। না, আলমারিটা মোটেই জোরজবরদস্তি করে খোলা হয়নি। যে খুলেছে সে চাবি দিয়েই খুলেছে। হয় খুনি, নয়তো নিলয়বাবু নিজেই। খুনি যদি খুলে থাকে তা হলে কেন খুলেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না—কারণ, বাড়ির লোকের কথামতো আলমারি থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। তা ছাড়া খুনি যে সেখানে কিছু খুঁজেছে আলমারির তাকগুলোর চেহারা দেখে সেরকমটাও মনে হচ্ছে না।
আলমারি ছাড়া ঘরে রয়েছে তিনটে কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল, আর একটা শো-কেস। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে সেগুলো বেশ খুঁটিয়ে দেখলেন অশোকচন্দ্র।
রঘুপতির দেওয়া ফাইলের কাগজ ঘেঁটেঘুঁটে আর সব দেখেশুনে বৃদ্ধ গোয়েন্দার মনে হল, নিলয় মজুমদার বেশ ভালোরকম বড়লোক ছিলেন এবং ভালোরকম কিপটে ছিলেন। তার সঙ্গে ছিল খিটখিটে মেজাজ এবং বসগিরির দাপট। এসব মানুষকে খুন করার মোটিভ অনেক সময় স্রেফ বিরক্তি আর ঘেন্না থেকে দানা বাঁধে। ফলে যাঁরা ওঁর ক্লোজ এবং সাফারার তাদেরই কেউ হয়তো এই জঘন্য কাজটা করেছে।
খুনি বাইরের লোক হওয়ার পসিবিলিটি যে একেবারে নেই তা নয়। কারণ, এ-বাড়ির চৌহদ্দির পাঁচিল যথেষ্ট খাটো। সেটা টপকে কারও পক্ষে ভেতরে ঢোকা মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু তারপর? তাকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, বারান্দা, নিলয়বাবুর ঘর সবকিছু ঠিকঠাক চিনতে হবে। তারপর…তারপর…।
আবার সেই ‘লকড রুম পাজল’-এ এসে ঠোক্কর খেলেন অশোকচন্দ্র।
একটা জানলার শার্সি সরিয়ে বাইরে বাগানের দিকে দেখলেন। বাউন্ডারি গেটের খানিকটা অংশ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে। গাছের ডালে দুটো কাঠবিড়ালি ছুটোছুটি করছে।
এসিজি আপনমনে বললেন, ‘নিলয়বাবু যে মারা গেছেন সে ব্যাপারে কনফার্মড হওয়ার জন্যে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট আর গ্যারোটিং। বুঝলে, রঘুপতি—’ রঘুপতির দিকে ফিরে তাকালেন এসিজি। ছোট হয়ে আসা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললেন, ‘এই খুন শুধু বিরক্তি আর ঘেন্না থেকে নয়—তার সঙ্গে হয়তো রাগও মিশে ছিল। যদি দেখা যায় যে, এই খুনটার পেছনে মোটিভ শুধু টাকাপয়সা বা বিষয়আশয়, তা হলে আমরা সেই মোটিভটাকে বলি ”মার্ডার ফর গেইন”। কিন্তু আমি সবদিক অ্যানালিসিস করে দেখলাম, তার সঙ্গে ”মার্ডার ফর রিভেঞ্জ” অ্যাঙ্গেলটাও জড়িয়ে আছে—।’
সিগারেটের টুকরোটা নিভে গিয়েছিল। ঘরে কোনও অ্যাশট্রে না থাকায় সেটা জানলা দিয়ে নীচের বাগানে ফেলে দিলেন এসিজি।
রঘুপতি বলল, ‘সবই তো বুঝলাম, স্যার, বাট মার্ডারার?’
‘হুঁ—মার্ডারার।’ এসিজি জানলার ফ্রেমের দিকে তাকালেন : ‘আচ্ছা, গলায় ফাঁস দেওয়া হয়েছে এই রাবার দিয়ে, তাই না?’ প্রশ্নটা করার সময় স্লাইডিং উইন্ডোর ফ্রেমের কিনারায় লাগানো রবারের ফিতের গায়ে আঙুল ছোঁয়ালেন।
‘হ্যাঁ, স্যার। মার্ডারের ব্যাপারটা হওয়ার রাফলি ফিফটিন ডেজ আগে এ-ঘরের তিনটে খিড়কিতে স্লাইডিং উইন্ডো লাগানোর হুকুম দেন মিস্টার মজুমদার। তো মিস্তিরিরা এসে সেই কাজ করে যায়। তারই স্পেয়ার রাবার টেপ হয়তো এ-ঘরে কোথাও পড়ে-টরে ছিল। তারই একটাকে মার্ডারার ইউজ করেছে…।’
এরপর স্টাডিরুমটা ঘুরেফিরে দেখলেন অশোকচন্দ্র।
ঘরটা মাপে ছোট। একটামাত্র জানলা—বাগানের দিকে। বাইরে বেরোনোর আর কোনও দরজা নেই।
ঘরে তিনটে বুক কেস। তাতে ভরতি বই। বেশিরভাগই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বই—কংক্রিট, স্ট্রাকচার, কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা। তবে একটা বুক কেস নানান ধর্মগ্রন্থে ঠাসা। তার মধ্যে ভারতের সাধক, কৃত্তিবাসি রামায়ণ, কাশীদাসি মহাভারত ইত্যাদি বই রয়েছে।
রঘুপতির ফাইল থেকে জানা গেছে, নিলয় মজুমদার রোজ রাতে নিয়ম করে রামায়ণ অথবা মহাভারত সুর করে পাঠ করতেন। খুন হওয়ার দিনও তিনি মহাভারত পাঠ করেছিলেন। সাবিত্রী সেটা শুনেছে। ও তখন সারাদিনের কাজ সেরে বারান্দায় বিশ্রাম করছিল। আলো নিভিয়ে নিজের মোবাইল নিয়ে খুটুরখাটুর করছিল, এক তুতো বোনকে ফোন করছিল, এ-কথা সে-কথা বলছিল। তারই মধ্যে ও সেই সুর তুলে পাঠ করা শুনেছে। দাদুবাবা তখন পাশা খেলার জায়গাটা পড়ছিলেন। মাঝখানে পড়া থামিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আবার পড়ছিলেন। নিলয় মজুমদারকে সাবিত্রী ‘দাদুবাবা’ বলে ডাকত।
‘চলো, রঘুপতি—এ-ঘরে আর দেখার কিছু নেই।’ হাতে হাত ঘষতে-ঘষতে নিলয় মজুমদারের বেডরুমে ফিরে এলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘এবারে এ-বাড়ির চার বাসিন্দার সঙ্গে একটু কথা বলা যাক…।’
রঘুপতি বলল, ‘লেকিন গুপ্তাসাব, পুলিশ তো চারজনকে ভালোমতন ইনটারোগেট করেছে। সেসব ইনটারোগেশানের হার্ড কপি তো আমার ফাইলে ছিল—আপনি পড়িয়েছেন ভি…।’
‘আঃ, রঘুপতি, ডোন্ট বি ইমপেশেন্ট। আমি বুড়ো মানুষ। ওঁদের সঙ্গে একটু বকবক করতে ইচ্ছে হয়েছে তো করি না কেন?’
স্যারের কথায় রঘুপতি তিনটে চেয়ার আর একটা টেবিলকে বেডরুমের একদিকে সাজিয়ে নিল। তারই একটা চেয়ারে বসে স্যার প্রাক্তন ছাত্রকে জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, মার্ডার ওয়েপন—মানে, ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা পুলিশ এখনও ট্রেস করতে পারেনি, না?’
‘না, স্যার—উও আভি তক মিলা নেহি।’ রঘুপতির গলায় হেরে যাওয়া সুর। ও একটু আনমনাভাবে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে স্যারের পাশে বসে পড়ল।
‘অদ্ভুত ব্যাপার!’ আপনমনেই বললেন এসিজি, ‘রাবারের ফিতেটা নিলয়বাবুর গলায় এঁটে বসে রইল, অথচ মাথা ক্রাশ করার অস্ত্রটা খুনি সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেল…!’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন এদিক-ওদিক।
‘কিন্তু নিয়ে গিয়ে ওয়েপনটা সে লুকোবে কোথায়?’
‘গাছের পাতা লুকোনোর সেরা জায়গা হল বাগান অথবা জঙ্গল।’ এসিজি হেসে বললেন, ‘বই লুকোনোর সেরা জায়গা হল লাইব্রেরি অথবা বইয়ের দোকান। একটা লোহার রড লুকোনোর ভালো জায়গা হল কনস্ট্রাকশন সাইট।’
‘আপনি কি বলতে চাইছেন ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা একটা লোহার রড? আর তনয় মজুমদার, প্রজেন বসু রায় এঁরা তো কনস্ট্রাকশনের কাজ করে…!’
‘আমি কিছুই বলতে চাইছি না, মাই ডিয়ার, রঘুপতি। আই অ্যাম ওনলি থিংকিং লাউডলি। যাকগে, তুমি মিস্টার তনয় মজুমদারকে একবার এ-ঘরে আসতে বলো—একটু কথা-টথা বলি…।’
রঘুপতি যাদব চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় সাবিত্রী একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। ট্রে-তে দু-কাপ কফি, আর দুটো প্লেটে বিস্কুট, সিঙ্গাড়া আর সন্দেশ।
কাপ-প্লেটগুলো ট্রে থেকে নামিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিল সাবিত্রী।
‘এগুলো আপনারা খেয়ে নেবেন, স্যার।’
এসিজি সাবিত্রীকে দেখছিলেন।
বেশ সুন্দর দেখতে। দেখে ‘কাজের মেয়ে’ বলে মনেই হয় না। মাঝারি গায়ের রং। চামড়া বেশ সজীব, তেলেতেলে। গোল মুখ। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। চোখ দুটো জ্যান্ত—যেন কথা বলছে।
সাবিত্রী একটা হলদে চুড়িদার পরেছে—তার ওপরে ছাপা রয়েছে ছোট-ছোট সাদা আর কালো ফুল। ওর মাথার চুল বেশ ঘন আর কোঁকড়ানো। তাতে একটা লাল রঙের ‘বো’ লাগানো রয়েছে।
‘তুমি সাবিত্রী?’ এসিজি ওকে জিগ্যেস করলেন। রঘুপতির ফাইলে ওর ফোটো আগেই দেখেছিলেন। সত্যিই ছবির মতো মুখ।
‘হ্যাঁ, স্যার—’ সাবিত্রী এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিল। ওর মধ্যে সংকোচের কোনও ছায়া খুঁজে পাওয়া গেল না।
রঘুপতি ওকে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে যে আরও দুজন এসেছেন…।’
‘হ্যাঁ, ওনাদেরকেও কফি, সিঙ্গাড়া এসব দিয়েছি। ওনারা ড্রয়িং-এ বসেছেন।’
‘সাবিত্রী, তুমি একটু বোসো—তোমার সঙ্গেই আগে কথা বলি।’
এসিজির কথায় সাবিত্রী সহজভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
অশোকচন্দ্র সিঙ্গাড়ায় কামড় দিলেন এবং চুমুক দিলেন কফির কাপে।
রঘুপতিও ‘স্যার’-কে অনুসরণ করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘পেট মে চুহা দওড় রহা থা…।’
খুনের দিন সন্ধে থেকে রাত্রি পর্যন্ত ঠিক কী-কী হয়েছিল সেটা এসিজি জানতে চাইলেন সাবিত্রীর কাছে।
উত্তরে সাবিত্রী যা-যা বলে গেল সেসব ইনস্পেকটর যাদবের ফাইলে আগেই পেয়েছেন অশোকচন্দ্র। তবুও ওর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
সাবিত্রী বারান্দায় শুয়েছিল। খুন নিশ্চয়ই হয়েছে অনেক রাতে। তখন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। একবার ঘুমিয়ে পড়লে তারপর ওর আর কোনও হুঁশ থাকে না। সকালে উঠে দাদুবাবাকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ও জানলার শার্সি দিয়ে উঁকি মারে। তখনই ওই ভয়ংকর দৃশ্য ও দেখতে পায়। বিছানায় একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড।
সাবিত্রী কথা বলতে-বলতে শিউরে উঠল।
‘তুমি কি এখনও ওই বারান্দাতেই শুচ্ছ?’ এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার ভূতের ভয় নেই?’
সাবি ঘাড় নেড়ে যেন লজ্জা পেয়ে হাসল : ‘হ্যাঁ, স্যার—ওখানেই শুই। আমার কোনওদিনই ভূত-পেতনির ভয়-টয় নেই। তা ছাড়া দাদুবাবা আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি আগে বারান্দায় যেমন শুতাম, ওই মার্ডারের পর ছ’দিন শুইনি। পুলিশ বারণ করেছিল। তারপর থেকে আবার ওখানে শুই।’
‘আচ্ছা, সাবি, তুমি তো পুলিশকে সবই বলেছ…’ স্নেহময় বাবা যেভাবে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক সেই সুরে বলতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র, ‘এমন কিছু কি তোমার মনে পড়ছে যেটা তোমার একটু অদ্ভুত মনে হয়েছে? ভালো করে ভেবে দ্যাখো। এমন কোনও ব্যাপার যেটা স্রেফ এলেবেলে মনে হতে পারে, বাট পিকিউলিয়ার…।’
সাবি হেসে বলল, ‘ভালো করে ভাবতে হবে না, এমনিই মনে আছে। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয় ভেবে পুলিশকে আর বলিনি। আপনি, স্যার, যখন জানতে চাইছেন তখন বলছি…।’
রাত্রি তখন ন’টা কি সওয়া ন’টা হবে। সাবি বারান্দায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। হঠাৎ ও শুনতে পায় দাদুবাবা মহাভারত থেকে সুর করে পাঠ করছেন। চুপচাপ শুয়ে সেই পাঠ শুনতে বেশ লাগছিল। তারপর, যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পাশা খেলায় বাজি ধরলেন তখন হঠাৎই দাদুবাবা পাঠ থামিয়ে দুবার হাঁচলেন, তারপর আবার পড়তে শুরু করলেন।
‘এবারে, স্যার, পিকুলিয়ার ব্যাপারটার কথা বলি…।’
একটা সময়ে দাদুবাবা মহাভারত পড়া শেষ করেছিলেন। তার পরপরই সাবি ছোটদাদাবাবুকে—মানে, তনয়কে—দাদুবাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দ্যাখে। সাবির দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুতভাবে তনয় বলেন, ‘বাবা এখন ব্যস্ত। মহাভারত পড়ছেন। তার মাঝে ডিসটার্ব করলেই তো আবার খেপে যাবেন! যা-তা বলতে শুরু করবেন। যাকগে, পরে আসব’খন।’
মহাভারত পড়া শেষ হয়ে গেলে সাবিত্রী বারান্দার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তখন ও তিনতলা থেকে কথাবার্তা হইচই শুনতে পাচ্ছিল। ছোটদাদাবাবুরা তিনজনে মিলে তাস খেলছিলেন। রোজ রাতে ওঁরা তাসের আসর বসান। কল ব্রে না কী যেন খেলেন। খেলা অনেক রাত পর্যন্ত চলে।
হয়তো এভাবে ঘণ্টাখানেক বড়জোর কেটেছিল, তারপরই সাবির হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ওর মনে হল কে যেন ওকে ডাকল। ঘুম চটে গিয়ে ও শুনতে পায়, দাদুবাবা মহাভারত পড়ছেন এবং ওই পাশা খেলার জায়গাটাই আবার পড়ছেন।
সাবিত্রীর ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগে। কিন্তু ও ধরে নেয় যে, ওটা খিটখিটে বুড়োর অদ্ভুত খেয়াল। ও আধোঘুমে মহাভারত শুনতে থাকে।
আলো নেভালেও বারান্দাটা কখনও তেমন অন্ধকার হয় না, কারণ, এদিক-সেদিক থেকে রাস্তার কমলা রঙের আলো ছিটকে এসে দেওয়ালে পড়ে। সেই আবছা আলোয় সাবিত্রী হঠাৎ খেয়াল করে, ‘নতুন দাদাবাবু’—মানে, প্রজেন বসু রায়—দাদুবাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, দরজায় নক করবেন কি না ভাবছেন।
সাবি যে জেগে গেছে সেটা বুঝতে পেরে তিনি আপনমনেই বলেন, ‘না বাবা, এখন স্যারকে ডিসটার্ব করে লাভ নেই। হয়তো ব্যাপক চটে গিয়ে চেঁচামেচি করে বাড়ি একেবারে মাথায় তুলবেন…। যাই, তাস খেলায় বসি গিয়ে। যা বলার কাল বলব’খন…।’
এই কথা বলতে-বলতে প্রজেন বসু রায় চলে যান।
তখনও মহাভারত পড়া চলছিল। একটু পরেই হাঁচির শব্দ শুনতে পায় সাবি। ও ভাবছিল, দাদুবাবা এই বোধহয় ওকে ডাকবেন, হাঁচি-কাশির ওষুধ দিতে বলবেন।
কিন্তু না, দাদুবাবা ওকে ডাকেননি।
এরপর সাবিত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর সকালবেলা…।
প্রজেন বা তনয় ব্যবসার নানান কাজে প্রায়ই নিলয়বাবুর ঘরে আসতেন। কারণ, ওঁকে জিগ্যেস না করে কোনও ডিসিশন নিলে উনি ভীষণ রেগে যেতেন। মুখে যা আসে তাই বলে অপমান করতেন। তাই প্রজেন এবং তনয় সবসময় খুব চাপে থাকতেন।
সেদিন রাতে ওঁরা দুজনে যে দাদুবাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সেটা সাবি পুলিশকে প্রথমেই জানিয়েছিল। পুলিশের রিপোর্টে সে-কথা লেখা আছে। যেটা নেই সেটা হল দুবার মহাভারত পড়ার পিকিউলিয়ার ব্যাপারটা।
এসিজি সেটা নিয়েই একটু ভাবছিলেন।
রঘুপতি আড়চোখে স্যারের দিকে তাকাল। লক্ষ করল, স্যারের ভুরু কুঁচকে গেছে। শূন্য নজরে তাকিয়ে আছেন একটা জানলার দিকে।
সাবিত্রীর আর কিছু বলার ছিল না। তাই এসিজি ওকে বললেন, ‘এবারে তুমি এসো, সাবি—।’
সাবিত্রী চলে গেল। যাওয়ার আগে প্লেটগুলোর দিকে ইশারা করে বলে গেল, ‘সব খেতে হবে কিন্তু—।’
‘গুপ্তাসাব, কিছু বোঝা গেল?’ রঘুপতি আলতো গলায় জিগ্যেস করল।
‘হুঁ..’ আনমনাভাবে বললেন এসিজি, ‘কিছু-কিছু তো বোঝা গেল অবশ্যই।’
একটু পরে বললেন, ‘আচ্ছা, রঘুপতি, একটা ব্যাপার তুমি নোট করেছ?’
‘কী, স্যার?’
‘এই মার্ডার কেসটায় বড্ড বেশি ক্লু। আর তার সঙ্গে আনন্যাচারাল সব কাণ্ড।’
‘মতলব?’
‘মতলব, রঘুপতি, টু মেনি ক্লুজ। টু মেনি পয়েন্টার্স। দ্যাখো, প্রথমেই হচ্ছে, মালটিপল মার্ডার মিনস : গলায় ফাঁস দেওয়া, আর তার সঙ্গে মাথার পেছনে ভারী কিছু দিয়ে জোরে হিট করা। অথচ নিলয়বাবু ওয়জ অ্যান ওল্ড ম্যান—চুয়াত্তর বছর বয়েস ছিল ওঁর। তারপর, রাবার স্ট্রিপটা ডেডবডির গলায় শক্ত করে এঁটে রইল, বাট ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টটা মার্ডারার সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। নেক্সট হচ্ছে, লকড রুম মিস্ট্রি। একটা দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি আঁটা, আর অন্য দরজাটা বাইরে থেকে হাঁসকল এঁটে তাতে প্যাডলক ঝোলানো—সেই প্যাডলকের চাবি আবার নিলয়বাবুর বিছানায়। ঘরের তিনটে জানলাতেই গ্রিল দেওয়া এবং জানলার স্লাইডিং গ্লাস উইন্ডো ঘরের ভেতর দিকে থেকে আটকানো। নিলয় মজুমদারের আলমারি খোলা, কিন্তু কিছু খোয়া যায়নি। শুধু আলমারি থেকে তিনটে টুপি নিয়ে খুনি বাইরের বাগানে ছুড়ে ফেলে গেছে।
‘এসবের মানে কী, রঘুপতি? এতগুলো ব্যাপারকে আমরা যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে কোরিলেট করব কেমন করে? তার ওপর তো সাবিত্রীর বলা পিকিউলিয়ার ব্যাপারটা আছেই। নাঃ, কিছু একটা উত্তর বের করতেই হবে।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এসিজি। মাথার পিছনের সাদা চুলের গোছা ধরে কয়েকবার টান মারলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।
রঘুপতি ওর প্রাক্তন স্যারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাতঘড়ির দিকে একপলক চোখ রেখে স্যারকে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, তনয় মজুমদারকো বুলায়ে কেয়া?’
‘হ্যাঁ, ডাকো—।’
তনয় মজুমদার নিলয়ের ঘরে এলেন মিনিট-পাঁচেক পরেই। সকালে যে-পোশাক পরে তিনি এসিজিদের মুখোমুখি হয়েছেন এখনও সেই পোশাকই পরে আছেন।
তনয় থিতু হয়ে বসার পর এসিজি বললেন, ‘সবকথাই তো পুলিশকে আপনি বলেছেন। সেসব রিপোর্ট আমি দেখেছি। আপনার নতুন কিছু বলার থাকলে বলুন…।’
‘নতুন কথা আর কী বলব!’ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তনয় বললেন। ওঁর কিছু জানা নেই, আর কে ওঁর বাবাকে খুন করতে পারে সে-বিষয়ে ওঁর কোনওরকম ধারণাও নেই। খুনটা যে-সময়ে হয়েছে বলে পুলিশের আইডিয়া, সেসময়ে তিনি তাস খেলায় বিজি ছিলেন। ওই তাসই ওঁর একমাত্র নেশা।
বাইরে থেকে কেউ এসে নিলয়বাবুকে খুন করতে পারে কি না, এ-প্রশ্নের জবাবে তনয় বলেছেন, এ-বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালটা খাটো। বাইরে থেকে কোনও আততায়ী সহজেই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে। না, নিলয়ের কোনও শত্রু ছিল বলে ওঁর জানা নেই। তবে নিলয় খুব মাথাগরম রগচটা মানুষ ছিলেন। হয়তো নিজের ব্যবহারের জন্য কোনও শত্রুর জন্ম দিয়ে থাকতে পারেন।
তনয় আর প্রজেন মিলে ‘নিলয় কনস্ট্রাকশনস’-এর কাজ দেখত। তবে নিলয়ের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল না নিয়ে কোম্পানির একটি কাজও করা যেত না।
‘বাবা ব্যবসা ছেড়েও দেবেন, আবার ছেড়েও দেবেন না।’
এটা একটা দম আটকানো অবস্থা ছিল। প্রজেন আর তনয় বলতে গেলে রোজ পালা করে নিলয়ের হাতে অপমানিত হতেন।
না, খুনি ধরা পড়ল কি পড়ল না এ নিয়ে তনয়ের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তনয়ের কথার ভঙ্গিতে ওঁকে বেশ বিরক্ত বলে মনে হল।
খুনের দিন রাতে নিলয় মজুমদার দুবার মহাভারত পড়েছিলেন কেন সে ব্যাপারে তনয়ের কোনও আইডিয়া নেই। তবে একই অংশ দুবার পড়েছেন শুনে তনয় একটু অবাক হল। তারপর তেতো হেসে বলল, ‘বাবার খেয়াল! এ নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। হি ওয়জ দ্য বস।’
তনয় মজুমদার চলে যাওয়ার পর রঘুপতি প্রজেন বসু রায়কে খবর পাঠাল।
এমন সময় রঘুপতির মোবাইল ফোনে সুরেলা মিউজিক বেজে উঠল : ফোন এসেছে। রঘুপতি পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ওর এক জুনিয়ার সহকর্মীর ফোন। বসুমিত্র জানা।
রঘুপতি কলটা রিসিভ করে বলল, ‘হ্যালো, জানা—আমি আজ একটা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশানের কাজে নিউ আলিপুরে এসেছি। একটু বিজি আছি। কাল অফিসে গিয়ে তোমার সঙ্গে ডিসকাস করি?’
ওপাশ থেকে বসুমিত্র জানা কী বললেন সেটা শোনা গেল না। তবে রঘুপতি বারদুয়েক মাথা নাড়ল। শেষে ‘ও. কে.’ বলে রিসেট বোতাম টিপে দিল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতির মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আধুনিক ডিজাইনের স্মার্টফোন। রঘুপতি অল্পসল্প শৌখিন মানুষ।
হঠাৎই এসিজি উত্তেজিত হয়ে রঘুপতিকে কী একটা বলতে গেলেন, কিন্তু প্রজেন বসু রায় ঘরে ঢুকে পড়ায় নিজেকে সামলে নিলেন।
প্রজেনের চেহারা লম্বা-চওড়া, রোদে জলে পোড় খাওয়া। বয়েস চল্লিশের খারাপ দিকে। রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। মাথায় কোঁকড়া চুল, চোখা নাক, চোখে চশমা, হাতে বেশ বড় মাপের মোবাইল ফোন। সেটা থেকে একটা তার বেরিয়ে ওঁর ডানকানে গিয়ে ঢুকেছে। অন্য কানের ফুটোটা দয়া করে খোলা রয়েছে এসিজিদের কথা শোনার জন্য।
প্রজেনের গায়ে গোলাপি রঙের একটা রাউন্ড নেক টি-শার্ট, পায়ে পাজামা আর প্যান্টের মাঝামাঝি একটা ক্যাজুয়াল উইয়্যার।
ওঁর হাবভাব অথবা চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা উদ্ধত মাত্রা আছে।
এসিজি প্রজেনকে বসতে বললেন। আড়চোখে খেয়াল করলেন, রঘুপতির চোখে-মুখে একটা অপছন্দ অথবা বিরক্তির ছাপ।
ফাইলে দেখা ফোটোগ্রাফের সঙ্গে প্রজেন বসু রায়ের চেহারা মিলে গেলেও এই উদ্ধত ভাবভঙ্গিটা ফোটোগ্রাফে ধরা পড়েনি।
প্রজেন চেয়ারে বসে বললেন; ‘এতদিন পরে আবার পুলিশ! বলুন কী বলবেন।’
রঘুপতি বলল, ‘পহেলে কান কা তার খোল লিজিয়ে…।’
প্রজেন একটু অবাক হয়ে রঘুপতির দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে গেছে। প্রশ্ন জেগে উঠেছে ওঁর চোখে, যার অর্থ ‘হু দ্য হেল আর ইউ?’
রঘুপতি অশোকচন্দ্র গুপ্তর পরিচয় দিল। তারপর নিজের পরিচয় দিল : ‘ইনস্পেকটর রঘুপতি যাদব। হোমিসাইড স্কোয়াড, লালবাজার। নাউ টেক দ্য ব্লাডি ইয়ার প্লাগ অফ।’
কথার সুরে এসিজি বুঝলেন, রিখটার স্কেলে রঘুপতির টেম্পার চড়ছে।
এসিজি তাড়াতাড়ি প্রজেনকে বললেন, ‘ইনস্পেকটর যাদবের ধৈর্য খুব কম। কানের ছিপিটা জলদি খুলে ফেলুন…নইলে রঘুপতি ওটা টান মেরে খুলে দেবে। সেটা আপনার ভালো লাগবে না।’
এ-কথায় প্রজেন কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি ইয়ার প্লাগটা খুলে ফেললেন।
প্রজেনের স্টেটমেন্ট এবং ইনটারোগেশানের ট্রানস্ক্রিপশান এসিজি রঘুপতির দেওয়া ফাইল থেকে পড়েছেন। খুনের দিন রাতে প্রজেনও সেরকম কিছু দেখেননি বা শোনেননি।
সত্যি, এঁদের সবারই অবস্থা সেই বিখ্যাত তিনটি বানরের মতো : একজনের চোখে হাত চাপা দেওয়া, একজনের ঠোঁটের ওপরে, আর একজনের দু-কানে আঙুল গোঁজা।
এসিজি প্রজেনকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি তো ”নিলয় কনস্ট্রাকশনস”-এর ম্যানেজার এবং টুয়েন্টি পারসেন্টের পার্টনার…?’
প্রজেন চুপ করে রইলেন।
‘কী, কিছু বলুন…।’
‘এটা কি কনফার্ম করতে হবে নাকি? আগে তো বহুবার বলেছি যে, হ্যাঁ।’
‘আপনি যে এই মজুমদার বাড়িতে থাকেন তাতে আপনার অস্বস্তি হয় না, খারাপ লাগে না?’
‘কেন? খারাপ লাগবে কেন? এটা তো আমার রাইট—অধিকার। কেন, আপনারা জানেন না, আমার বাবা ব্রজেন বসু রায় কী ভাবে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন? এবং হু ওয়জ রেসপনসিবল ফর দ্যাট ব্লাডি অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘এখন তো নিলয় মজুমদার মারা গেছেন। হি ডায়েড ভায়োলেন্টলি।’ একটু চুপ করে রইলেন এসিজি। তারপর : ‘এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? এ-বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা কনটিনিউ করবেন, নাকি অন্য কোনও অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাবছেন?’
‘হঠাৎ এ-কথা জিগ্যেস করছেন? অন্য কোনও অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাবতে যাব কেন? এখন তো এ-বাড়িটা অনেক বেশি পিসফুল। সবচেয়ে বাজে লোকটাই তো চলে গেছে।’
‘এভাবে কথা বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? একজন বয়স্ক রেসপেক্টেবল মানুষ…ওরকম ব্রুটালি খুন হয়ে গেলেন…।’
‘অনেক আগেই ওঁর ব্রুটালি খুন হওয়া উচিত ছিল। আর রেসপেক্টেবল! রেসপেক্ট মাই ফুট! আপনি জানেন, নিলয়বাবু ডেইলি বেসিসে আমাকে কী রেটে ইনসাল্ট করতেন? ছোট-বড় যে-কোনও কাজ করতে গেলেই ওঁর কাছ থেকে আগে পারমিশান নিতে হত!’
রঘুপতি প্রজেনের হাতের দিকে দেখছিল। শিরা বের করা শক্তসমর্থ হাত। এ-হাতে শক্তির কোনও ঘাটতি নেই।
এসিজি প্রজেনকে জিগ্যেস করলেন, ‘খুনের দিন রাতে আপনি মিস্টার মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি মহাভারত পড়ছিলেন…।’
‘হ্যাঁ, আমাকে উনি দেখা করতে বসেছিলেন। তনয়ের ঘরে বসে আমরা তখন কল ব্রে খেলছিলাম। খেলার মাঝেই আমি দশ মিনিট সময় চেয়ে উঠে যাই। বাট উনি তখন বিজি ছিলেন—ওই রামায়ণ বা মহাভারত কিছু একটা পড়ছিলেন। তাই আমি আর ডিসটার্ব করিনি। যা খ্যাঁচখেঁচে পাবলিক!’
প্রজেনকে আর কিছু জিগ্যেস করার ছিল না। এসিজি ওঁর দিকে তাকিয়ে মনে-মনে কিছু একটা হিসেব কষছিলেন।
‘আমি কি এবার যেতে পারি?’ প্রজেন জিগ্যেস করলেন।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—অবশ্যই যেতে পারেন।’
‘থ্যাংক ইউ—’ বলে প্রজেন উঠে দাঁড়ালেন। রঘুপতি যাদবের দিকে একবার ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেতে-যেতে ডানকানে ইয়ার প্লাগটা আবার গুঁজে নিলেন।
বেলা যে অনেক বেড়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না মেঘের জন্য। এখন জানলার বাইরে তাকালে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও চোখে পড়ছে।
রঘুপতি মাথার ওপরে ঘুরে চলা সিলিং ফ্যানটার দিকে একবার তাকাল। ‘ওর বোধহয় গরম লাগছে,’ এসিজি ভাবলেন।
নিজামুল হকসাহেব দরজায় এসে উঁকি দিলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কী, সার, কতদূর? বসে-বসে তো বোর হয়ে গেলাম—।’
এসিজি পালটা হেসে বললেন, ‘মনে হয় ব্যাপারটা একটু-একটু ধরতে পেরেছি। আসলে লকড রুম পাজলটা সলভ করার পরই আসল সলিউশানটা আবছাভাবে সামনে চলে এসেছে।’
রঘুপতি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল, ‘সচমুচ, স্যার?’
এসিজি পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘টুনি মজুমদারের সঙ্গে একটু কথা সেরে নিই, তারপর তোমাদের বলব বন্ধ ঘরের পাজলের সলিউশান। তারপর মার্ডারারকে জালে তোলা তোমার আর ও. সি.-সাহেবের কাজ।’
নিজামুল হক হেসে বললেন, ‘শয়তানটার দিকে একবার ইশারা করেই দেখুন না, সার। জালে তুলে এমন মেডিসিন দেব যে, গড়গড় করে সব উগরে দেবে। তার ওপরে ইনস্পেকটর যাদববাবুও তো রয়েছেন…।’
রঘুপতি বলল, ‘স্যার, একটু জলদি করুন—অলরেডি দুটো বেজে গেছে। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে।’
‘বুঝতে পারছি, রঘুপতি। বাট আর-একটু—বড়জোর হাফ অ্যান আওয়ার কি ওয়ান আওয়ার…প্লিজ!’
সিগারেটে পরপর তিনটে টান দিয়ে সেটা টেবিলের পায়ায় ঘষে নিভিয়ে দিলেন এসিজি। কারণ, টুনি মজুমদার এখুনি আসবেন। কোনও মহিলার সামনে স্মোক করাটা শিষ্টাচার নয়।
নিভে যাওয়া সিগারেটটা নিয়ে এসিজি উঠে গেলেন জানলার কাছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলেন বাগানে।
রঘুপতি মিসেস মজুমদারকে খবর দেওয়ার জন্য নিজামুলকে রিকোয়েস্ট করল। হকসাহেব চোখ মটকে হেসে চলে গেলেন।
একটু পরে টুনি মজুমদার যখন এলেন তখন হকসাহেবের চাউনি এবং হাসির মানে বোঝা গেল।
টুনি মজুমদার লাল, সবুজ এবং হলুদ রঙের গডি কম্বিনেশনের একটা পাতিয়ালা চুড়িদার পরেছেন। তার সঙ্গে চড়া দাগের সাজগোজ। সব মিলিয়ে আপাদমস্তক মেকাপ এবং ফ্যাশনের চলমান বিজ্ঞাপন। এই ঘোর দুপুরে যে এরকম উৎকট সাজগোজ করে বাড়িতে ঘোরাঘুরি করা যায় সেটা এসিজি কিংবা রঘুপতির আগে জানা ছিল না। অবশ্য এও হতে পারে যে, এ-ঘরে ডাক পাওয়ার জন্য উনি সাজগোজ করে তৈরি হচ্ছিলেন। সাজগোজ ছাড়াও পারফিউমের উৎকট গন্ধে এসিজিদের দম বন্ধ হয়ে এল।
টুনির আবির্ভাবের প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে এসিজি ওঁকে বসতে বললেন। লক্ষ করলেন, রঘুপতির ভুরু কুঁচকে গেছে। এবং সেই অবস্থাতেই ও ফ্রিজ শট হয়ে আছে।
রঘুপতি টুনিকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
টুনি মজুমদারের বয়েস বত্তিরিশ কি তেত্তিরিশ হবে। কিন্তু সাজগোজ আর হাবভাবে কচি সেজে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা বেশ নজরে পড়ছে।
রঘুপতির দেওয়া ফাইল খুঁটিয়ে পড়ে এসিজি টুনি মজুমদার সম্পর্কে যেটুকু বুঝেছেন সেটা হল, এই ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা মজুমদারবাড়ির সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, এমনকী সাত আর পাঁচের যোগফল বারোতেও নেই।
পুলিশের যে-কোনও কোশ্চেনের উত্তরে ওঁর স্ট্যান্ডার্ড রেসপন্সগুলো হল : ‘জানি না’, ‘দেখিনি’, ‘শুনিনি’ আর ‘মনে নেই’। সত্যি, তিন বানরকে হার মানানোর মতো।
ভদ্রমহিলা অকারণে নিজের বুটিক নিয়ে বকবক করে যাচ্ছিলেন। এ-বাড়ির মালিক নিলয় মজুমদার নামের মানুষটা যে বাইশ দিন আগে ব্রুটালি মার্ডারড হয়ে গেছে সেটা যেন ওঁর মাথাতেই কখনও ঢোকেনি। এই ভদ্রমহিলাকেই এসিজির সবার সেরা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট বলে মনে হল। তনয় মজুমদার এই অদ্ভুত ‘জিনিস’-টিকে নিয়ে কী করে দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন সেটা ভেবে এসিজি শিউরে উঠলেন।
টুনি মজুমদারের কাছ থেকে সেরকম কোনও তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তিনি বাইরে ব্যস্ত থাকেন। এত ব্যস্ত যে, তনয়ের সঙ্গে ওঁর দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা খুবই কম হয়। নেহাত একই বাড়িতে থাকেন বলে দেখা হয়। আর রোজ রাতে তিনি তনয় এবং প্রজেনবাবুর সঙ্গে তাস খেলতে বসেন। তখনই যেটুকু আড্ডা, হুল্লোড় কিংবা কথাবার্তা হয়।
এসিজি জানতে চাইলেন, নিলয় মজুমদার শ্বশুর হিসেবে কেমন ছিলেন।
উত্তরে এসিজির দিকে কয়েকসেকেন্ড স্থির নজরে তাকিয়ে রইলেন টুনি।
এসিজি হঠাৎই ভাবলেন, টুনি ওর চার্মের স্পেল দিয়ে এসিজিকে হিপনোটাইজ করতে চাইছেন কি না। সন্দেহ নেই, অশোকচন্দ্র যথেষ্ট বৃদ্ধ এবং এসব চার্ম-টার্ম-এর রিং-এর বাইরে চলে গেছেন বহুবছর। কিন্তু তবুও ওঁর নজরটা যেন কেমন-কেমন—কোথাও যেন একটা গোপন নষ্টামির ছোঁয়া লেগে আছে।
‘শ্বশুর হিসেবে কেমন ছিলেন জানতে চাইছেন?’ চোখ সরু করলেন টুনি : ‘উনি শ্বশুর ছিলেন না—উনি ছিলেন মহা-শ্বশুর।’
ওঁর কথা বলার ঢঙে যথেষ্ট ঘেন্না এবং বিরক্তির উপাদান টের পেলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা। ওর মনে হল, নিলয় মজুমদারের জন্য এঁদের কারও মনেই বোধহয় একফোঁটা ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা ছিল না।
‘মহা-শ্বশুর মানে?’ এসিজি শব্দটার মর্মার্থ বুঝতে চাইলেন।
‘যা মানে, তাই…।’ একটু বাঁকা সুরে মন্তব্য করলেন টুনি।
রঘুপতি এসিজির দিকে তাকাল। যার মানে, ভদ্রমহিলার এই বাঁকা কথার স্টাইলকে সবক শেখাতে রঘুপতি ওর নিজস্ব স্টাইলে কোনও স্টেপ নেবে কি না।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত চোখের ইশারায় রঘুপতিকে শান্ত থাকতে বললেন। তারপর টুনির দিকে সরাসরি চোখ রেখে জানতে চাইলেন, ‘শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে আপনার রিলেশান কেমন ছিল?’
‘ভালো—বিকজ সেরকম কোনও রিলেশানই তো ছিল না যে খারাপ-টারাপ হবে। আমার বুটিক দেখতে আসার জন্যে বহুবার ওঁকে ইনভাইট করেছিলাম, কিন্তু ওঁর টাইম হয়নি। আমার বুটিকে যেসব ড্রেস আমি ডিসপ্লে করি সেগুলোর মেটিরিয়াল আর ডিজাইন দেখলে আপনি স্টানড হয়ে যাবেন। বড়-বড় ব্র্যান্ডের ডিজাইনার ড্রেসও আমার বুটিকের আইটেমের কাছে হার মেনে যাবে। আমাদের ইউ. এস. পি. কী জানেন? আমরা…।’
এসিজি আর বাধা না দিয়ে পারলেন না। বললেন, ‘প্লিজ, ম্যাডাম, এখন আমার ”শিবের গীত” শোনার সময় নেই। পরে কখনও শুনব…।’
‘ ”শিবের গীত” মানে?’ টুনির ভুরু কুঁচকে গেল।
‘ও আপনি বুঝবেন না—’ এসিজি হাসলেন। তারপর : ‘আচ্ছা, বলুন তো, নিলয়বাবুকে কে বা কারা এরকম নৃশংভাবে মার্ডার করতে পারে?’
টুনি মজুমদার উত্তরটা ভাবার জন্য এতটুকুও সময় নিলেন না। ফস করে বলে উঠলেন, ‘যে-কেউ খুন করতে পারে। ওনার বিহেভিয়ার এত খারাপ ছিল যে আর বলার নয়। মানুষকে মানুষ বলে মনে করতেন না—বলতে গেলে জন্তুর মতো ব্যবহার করতেন। শাশুড়ি-মা চলে যাওয়ার পর থেকে ওনার ব্যবহার একেবারে যা-তা হয়ে গেছে…।’
এসিজি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো নিলয় মজুমদারের ফোটোগুলোর ওপরে চোখ বোলালেন একবার। তারপর : ‘আচ্ছা, মিসেস মজুমদার, নিলয়বাবুর মার্ডারার কি বাইরে থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে আসতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’
টুনি পোশাকের ভাঁজ ঠিক করতে-করতে নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলেন, ‘আসতে পারে—অবশ্যই আসতে পারে। আমাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালটা যেরকম শর্ট হাইটের! আমার তো মনে হয় এটা একটা স্ট্রং পসিবিলিটি…।’
একটু থেমে টুনি আবার মুখ খুললেন, ‘স্যার, আপনার নামটা কী যেন বললেন?’
অশোকচন্দ্র একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বললেন, ‘অশোকচন্দ্র গুপ্ত…।’
‘তো হ্যাঁ, অশোকস্যার, এই যে-ড্রেসটা আমি পরে আছি, এটা আমার নিজের ডিজাইন করা। দারুণ হয়েছে না? এটা আসলে…।’
ওঁর বকবকানি চলতেই লাগল।
এসিজির ধৈর্যের জন্য রঘুপতি ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করে। কিন্তু সেই এসিজি টুনি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হঠাৎই ধৈর্য হারালেন এবং কথাবার্তার চ্যাপ্টার আচমকাই ক্লোজ করলেন।
টুনি চলে যাওয়ার পর রঘুপতি ঠাট্টার সুরে ওর প্রাক্তন স্যারকে বলল, ‘স্যার, ইয়ে আনোখা এক্সপিরিয়েন্স আপকো ক্যায়সা লগা?’
এসিজি হেসে বললেন, ‘লাজবাব।’ তারপরই মাথা পিছনে হেলিয়ে ঘাড়ের কাছে ঝুলে পড়া চুলের গোছায় টান মেরে বললেন, ‘রঘুপতি, এবারে লাস্ট চ্যাপ্টারের জন্যে তৈরি হও। ও. সি. সাহেবকে এ-ঘরে ডেকে নাও। আমরা তিনজন এই মার্ডার মিস্ট্রির সলিউশান নিয়ে ডিসকাস করব। তারপর ঠিক করব কী করে মার্ডারারকে ট্র্যাপ করব…আর সবার শেষে এই ঘরে ডেকে নেব চারজন সাসপেক্টকে—তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার, প্রজেন বসু রায় আর সাবি, মানে সাবিত্রীকে।’
‘সাবিত্রীও সাসপেক্ট, স্যার?’
‘অবশ্যই। ও কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ-কাজটা করে থাকতে পারে। এ দুনিয়ায় ইমপসিবল বলে কিছু নেই, রঘুপতি…।’
‘ও. কে., স্যার—আমি হকসাহেবকে ডেকে নিয়ে আসছি। বাট সত্যিই কি এটা লাস্ট চ্যাপ্টার?’
‘আমরা তো তাই মনে হচ্ছে…।’
একটু হেসে রঘুপতি যাদব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটের ঘর ছাড়িয়ে পাঁচটার দিকে গড়িয়ে চলেছে। আকাশে এত মেঘ জমেছে যে, সূর্যের আলো এর মধ্যেই মলিন হয়ে চারপাশে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে। এর আগে দু-একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তবে এখন মনে হয় মুষলধারে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। একবার শুরু হলেই সবকিছু ভাসিয়ে দেবে।
রঘুপতি বেশ কয়েকবার তাড়া দিলেও অশোকচন্দ্র কাজ সেভাবে সংক্ষেপ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোকের তদারকিতে এসিজিরা চারজন স্যান্ডউইচ ইত্যাদি দিয়ে ‘ওয়ার্কিং লাঞ্চ’ জাতীয় ব্যাপারটা সেরে নিয়েছেন।
নিলয়বাবুর বেডরুমের সবক’টা আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ঘরের একমাত্র টেবিলকে ঘিরে তিনটে চেয়ারে বসে আছেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, নিজামুল হক, আর রঘুপতি যাদব। এসিজি বসেছেন মাঝখানের চেয়ারে, বাকি দুজন ওঁর দুপাশে। এসিজি শান্ত দৃষ্টিতে ঘরের বাকি চারজনকে পালা করে লক্ষ করছিলেন।
ঘরের একমাত্র দরজার কাছে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কনস্টেবল ভগবান মিস্ত্রি।
নিলয় মজুমদারের বিছানায় পাশাপাশি বসে আছেন তিনজন : তনয় মজুমদার, টুনি মজুমদার, আর প্রজেন বসু রায়। চতুর্থজন সাবিত্রী। ওকে বসতে বলা হলেও ও বসেনি। স্টাডিরুমের দরজার কাছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাড়ির আঁচলে কী কারণে যেন আঁচড় কাটছে।
চারজনের হাতেই মোবাইল ফোন। অশোকচন্দ্র কিছু বলা শুরু করবেন তারই অপেক্ষায় রয়েছেন চারজন। মোবাইল ফোন নাড়াচাড়া করে ওরা সেই অপেক্ষার সময়টুকু পার করছেন।
রঘুপতি যখন চারজনকে এ-ঘরে আসার জন্য বলেছে, তখন জানিয়েছে, ‘আপনারা আপনাদের পারসোনাল মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে আসবেন—মানে, যে-ফোনটা আপনারা রেগুলার ইউজ করেন। আমি আপনাদের ফোনের কল হিস্ট্রি চেক করে দেখব যে, সেখানে কারেন্ট আউটগোয়িং আর ইনকামিং কলের ঠিকঠাক লিস্ট আছে কি না…।’
রঘুপতি যাদবের এই ইনস্ট্রাকশনের আড়ালে একটা চাপা থ্রেট ছিল। সেই কারণেই কেউ নির্দেশ অমান্য করতে ভরসা পায়নি।
প্রজেন একবার শুধু প্রোটেস্ট করে বলেছিলেন, ‘মোবাইল ফোন আমাদের প্রাইভেট প্রপার্টি—আমাদের পারসোনাল ব্যাপার। আমাদের প্রাইভেসি আপনি এভাবে ডিসটার্ব করতে পারেন না, অফিসার। আপনাকে আপনার হায়ার অথরিটির কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসতে হবে।’
‘তাই নাকি?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসেছে রঘুপতি : ‘মিস্টার প্রজেন বসু রায়, পুলিশ আপনাকে কতরকমভাবে ডিসটার্ব করতে পারে তার কোনও আইডিয়া আপনার নেই। আর এই রঘুপতি যাদব আরও কতরকমভাবে আপনাকে সুপারডিসটার্ব করতে পারে তার থোড়াবহত আইডিয়া দিলে আপনার হাওয়া বেরিয়ে যাবে। ছিবড়েটা মেঝেতে পড়ে থাকবে। আর আপনি আমাকে হায়ার অথরিটি দেখাচ্ছেন? এই কেসের ইনভেস্টিগেশানে আমিই হায়ার অথরিটি, আমিই লোয়ার অথরিটি। অ্যাট লিস্ট আজ, এই স্পটে। সো ডু অ্যাজ ইউ আর ইনস্ট্রাকটেড। ডোন্ট ফোর্স মি ট