.
সেই দিন জোছনা হঠাৎই লাল হয়ে গেল মধ্যরাতের পর!
আঁশটে দুর্গন্ধময় খালের কালো জল যেটা এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখছিল, জোছনা মাখছিল শরীরে। সেই জলের রং লাল হয়ে গেল হঠাৎই!
চপার দিয়ে আয়েশার ক্ষত—বিক্ষত ধপধপে শরীরটা কালো পাঁক গোলা জলের মধ্যে আধ ডোবা পড়ে আছে, সেই রাতের আকাশ বাতাস জোছনা দেখল চেয়ে চেয়ে।
.
ফ্যালফ্যাল করে টেবিলে রাখা উদ্ধার হওয়া চপারটা দেখছে শেখ মিরাজ।
চপারটা তো নোংরা পচা গলা খলের জলে ফেলে দিয়েছিল সে আয়েশার সঙ্গে!
—আর পারতেছিলাম না স্যর! বড্ড বাড়াবাড়ি করতেছিল। বিয়া করো বিয়া করো বইল্যা মাথার পোকা বার কইরা দিচ্ছিল।
—তাই? তা বিয়া করতে অসুবিধা কী ছিল? দুইডা বউ হইত। ‘মন্দ কী?’ হাসছেন অফিসার নুরুল ইসলাম।
—আমার বউ অনেক সুন্দরী স্যর। আর সে আমার ছাড়া কিস্যু বুঝে না স্যর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করে। আমার দুইডা বাচ্চচা, বুড়া মা—বাপ ঘরসংসার সামলায়। সে যদি জানতে পারে আমি বিয়া করছি তা হইলে বিষ খাইবে স্যর।
—বাব্বা! ধর্মের কথা শোনাইলি যে বাবা!
—স্যর, ফতেমাকে আমি কষ্ট দিতে পারুম না। হেইডা তো চুক্তির থাকা। দুইজনাই একলা। আমার বাসা ভাড়া, ওর বাজার খরচ, রান্না। বিনিময়ে দুই জনাই একটু ফুর্তিফার্তা কইরে থাকা। কিন্তু ও যে এমনভাবে সিরিয়াস হইয়া যাইবে এমনডা ভাবতে পারি নাই। মার দিছি কত। তাইতে বেটির আরও পেরেম!
.
—রান্না করিস নাই?
—না।
—ক্যান?
—এমনি, শরীল ভালো নাই।
—কী হইসে?
—দুই মাস হয় নাই।
—তাতে চিন্তার কী আছে? কাল আমার সঙ্গে যাবি হাসপাতালে। খালাস হইয়া আসবি।
—ক্যান? আমি তো তোমারে বুইঝ্যা লইসি। আমাদের দুইজনার দুই জনারে বুঝবার কথা হইছিল।
—তা হইছিল?
—আমি তোমারে ছাইড়া কারুর সঙ্গে আর বিয়া বসাইতে পারুম না জানো! আমি এক্কেবারে তোমার হইয়া গেছি!
—আমার বউ মানব না।
—বউ! বউ আর বউ। আমি বুঝি তোমার কেউ না? এই যে ঘরসংসার রান্নাবান্না করতেছি তোমার—! এই যে যত্ন আত্তি…। সেগুলো কিস্যু না?
তোমার শরীলটার ক্ষুধা মিটাইছি রাতভর—! আমি তোমার বউ নই এখনও?
—আমার বউ বিষ খাইব জানতে পারলে। ও খুব ভালো। বোরকা পইরা চক্ষু দুটি শুধু বাইর কইরা রাখে সে। অনেক সুন্দর। অনেক ভালো সে। তোর মতো খানকিবিত্তি করে না। বুঝলি মাগি? তুই বাইর হ এখনই। আমার বাসা থেকে বাইর হ।
—ক্যান যামু? আমারও অনেক খরচ হইছে। কুত্তারবাচ্চচা! তুই তো আমার পয়সাও চুইস্যা খাইছস। আমার টাকাপয়সা…ফিরত দে। যামু গিয়া। বউ দেখাইতেছে! নে! দেখ গা বোরকার তলে তলে কী করতেছে তোর বউ!
—তবে রে মাগি! গলা টিপে ধরেছে, মিরাজ আয়েশার! আর তারপরই হাতের পাশে থাকা চপারের কোপ নেমে এল আয়েশার গলায়, মুখে।
.
থমথমে রাত। শেখ কামাল নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ফতেমা বিবির ঘর থেকে। চাটাই দেওয়া জানলায় চোখ রেখে তাকিয়ে আছে ফতেমা। অস্পষ্ট উচ্চচারণ করল, খোদা হাফিজ।
.
মধ্যপিরের বাগের দুর্গন্ধময় খালের জলে ছুড়ে ফেলে দিল আয়েশার দেহ মিরাজ। বলল, আল্লা হাফিজ রাতটুকু সময়। ভোর না হতেই গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে।
.
—পাপ বাপকেও ছাড়ে না জানিস তো? বোকা! দিব্যি দুইডা বউ নিয়া সংসার করতে পারতিস! এখন জেলের ভাত খা।’ অফিসার নুরুল ইসলাম মুচকি হাসলেন।
সীতা – সায়ন্তনী পূততুণ্ড
এক
অবশেষে বনোয়ারিলাল শ্রীঘরে গেল!
সংবাদটা শুনে আদৌ বিস্মিত হইনি ৷ বরং এতদিন কেন যে ও জেলে যায়নি, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার! গত কয়েক বছর ধরেই হাজতবাসের ফাঁড়াটা ওর মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছিল ৷ কিন্তু কোনোবারই জেলের ভাত খেতে হয়নি ওকে ৷ এই প্রথমবার ব্যতিক্রম ঘটল!
খবরটা পেলাম সুখিয়ার কাছে ৷ সুখিয়া বনোয়ারিলালের দাদা বংশীলালের বউ ৷ ওরা দুই ভাই-ই কয়লাখনির অস্থায়ী শ্রমিক ৷ বলাই বাহুল্য, সকালে বেরোলে বিকেলে ফিরে আসবে কিনা, সে গ্যারান্টি ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না ৷ তার ওপর একা রামে রক্ষা নেই, দোসর লক্ষ্মণ! ওই বিপজ্জনক কাজের ফাঁকেই দুই ভাই মিলে আবার সুযোগ পেলেই কয়লা চুরি করে ৷ তাতে সংসারে দুটো পয়সা বেশি আসে ঠিকই, কিন্তু কয়লা চুরি করায় প্রাণের ঝুঁকি আছে ৷ যে কোনো সময় মারা পড়তে পারে ৷ উপরন্তু ধরা পড়লে জেলের ভাত খেতেও হতে পারে ৷
.
বনোয়ারিলালের শ্রীঘরে গমনের স্বপক্ষে কয়লাচুরি ও বে-আইনিভাবে বিক্রি করার কারণই যথেষ্ট ছিল ৷ কিন্তু শুধু এটুকুতেই তার কার্যকলাপ থেমে থাকেনি ৷ জেলে যাওয়ার রাস্তাটা সে আরও বেশি প্রশস্ত করেছিল নিজের বউ রামদুলারিকে নিয়মিত ঠেঙিয়ে! যার শহুরে ও পোশাকি নাম— ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স! কিন্তু রামদুলারি বা সুখিয়ারা জানে না ফোর নাইন্টি এইট কাকে বলে ৷ বরং তাদের ধারণা, মরদ যখন, তখন তো পেটাবেই! খেতে, পরতে দেয়, আর ‘লুগাইকে’ একটু পেটাবে না?
একটি নামকরা এনজি ও-’র পক্ষ থেকে যখন আমি বিহারের এই প্রত্যন্ত প্রদেশে এসে পৌঁছই তখন প্রথমদিকে জায়গাটাকে শান্তিপ্রিয় বলেই মনে হয়েছিল ৷ এখানকার বেশির ভাগ লোকই কয়লাখনিতে দিন-মজুর হিসাবে খাটে ৷ আবার কেউ বা অন্যের জমিতে মাটি কোপানো, লাঙল চালানোর কাজ করে ৷ যখন কাজ থাকে, দিনান্তে পয়সা পায়, তখন বাড়িতে দুবেলা হাঁড়ি চড়ে ৷ অন্যথায় পেটে কিল মেরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই ৷ বিনোদন বলতে বিড়ি, বা গাঁজার ছিলিমে সুখটান ৷ সঙ্গে উৎকট গন্ধওয়ালা দেশি মদ! কখনও কখনও মুরগি লড়াই, কিংবা ছোটখাটো ‘ নৌটঙ্কি’ বা কুস্তির ‘দঙ্গল’ ৷ এর বেশি ফুর্তি করার সামর্থ্য ওদের নেই ৷ ইলেকট্রিসিটি থাকলেও সারি সারি ঝুপড়িগুলোয় তার চোখ ধাঁধানো আলোর অনুপ্রবেশ এখনও হয়নি ৷ বরং সন্ধে হলেই তেলের কুপি জ্বলে ওঠে ৷ আমার আজন্ম শহুরে চোখ সেই শান্ত আলোয় বড় আরাম পায় ৷ মনে হয়, একমুঠো জোনাকির স্নিগ্ধ আলো কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে ৷ ঝুপড়িগুলোয় যেন নেমে এসেছে এক অদ্ভুত ঠান্ডা দীপ্তি! প্রায় রাতেই এনজি-ও’র সবেধন নীলমণি গেস্টহাউসের বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকতাম ওই বিন্দু বিন্দু আলোর দিকে ৷ বড় ভালো লাগত ৷