কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করেই ও টুপ করে বসে পড়ল৷ কিন্তু গুনগুন করে গান করার ব্যাপারটা থামাল না৷ টেলিফোনের তারের ডগাটা ধরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল টেবিলের নীচে৷ তারপর তারের দুটো প্রান্ত প্লাগের গর্তে গুঁজে দিল৷
এবার শরীরটাকে বেঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিল৷ কানে চেপে ধরেই বুঝতে পারল যা ভেবেছিল তাই—কোনও ডায়াল টোন নেই—টেলিফোনটা ডেড৷ তারটা আবার খুলে দিয়ে টেবিলের নীচ থেকে ও বেরিয়ে এল৷
গান গাইতে-গাইতেই আবার বিছানার কাছে ফিরে এল প্রিয়াংকা৷ আড়চোখে দেখল, মাসির কোনও হেলদোল নেই৷ ও সামান্য গলা তুলে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে৷’
দেওয়াল ঘেঁষে বসে থাকা পাথরের মূর্তি ড্রামের আড়ালে গুটখার পিক ফেলে বলল, ‘দশটায় খেতে পাবে৷’
প্রিয়াংকা বারবার করে বলল যে, ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে, কিন্তু মাসি আর কোনও জবাবই দিল না৷
এমন সময় প্লেনের শব্দ পেল৷ ও তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এল৷ খাতায় সময়টা টুকে নিল৷ সবে আটটা দশ বাজে৷ কিন্তু খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে৷ দশটা বাজতে এখনও ঢের দেরি৷ প্রায় দু-ঘণ্টা ওকে এই খিদে চেপে বসে থাকতে হবে৷ জীবনে কখনও এই হেনস্থা কল্পনাও করেনি প্রিয়াংকা৷ ওর চোখে জল এসে গেল৷ সেই অবস্থাতেই ওর মনে হল, টেলিফোনটা নিয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা ওকে করতেই হবে৷ মনে-মনে কিডন্যাপার লোকগুলোর ওপরে ভীষণ রাগ হল ওর৷ কিছু একটা করে ওদের শায়েস্তা করা যায় না? ওই টেলিফোনটা…৷
হঠাৎই ঘরের দরজা খুলে গেল৷
রোগা মতন যে-লোকটা পিস্তল উঁচিয়ে ওকে ভয় দেখিয়েছিল সে ঘরে এসে ঢুকল৷ তার হাতে প্রিয়াংকার মোবাইল ফোন৷
লোকটাকে দেখে মাসি উঠে দাঁড়াল৷ চটপটে পায়ে লোকটা প্রিয়াংকার কাছে এগিয়ে এল৷ মোবাইল ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা লাইনে আছে—কথা বলো৷’
ফোনটা হাতে নিয়ে প্রিয়াংকা উঠে দাঁড়াল৷ ও ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বাপি বলল, ‘পিয়া! তুই ভালো আছিস তো?’
প্রিয়াংকা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না৷ ওর মনে হল, কয়েকঘণ্টা নয়—যেন কয়েকবছর পর ও বাপির গলা শুনতে পেয়েছে৷ ও হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল৷ অনেক—অনেক কথা ও বলতে চাইছিল, কিন্তু মুখ দিয়ে কান্না আর গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরোল না৷ আর দু-গাল বেয়ে জল গড়াতে লাগল৷
প্রিয়াংকা জীবনে কখনও এরকম করে কাঁদেনি৷
বেশ কিছুক্ষণ পর ও শান্ত হল৷ ধরা গলায় বলল, ‘বাপি…বাপি… আমাকে এরা এখানে আটকে রেখেছে৷ তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও…শিগগির নিয়ে যাও৷ নইলে দিজ বাস্টার্ডস উইল কিল মি…৷’
‘পিয়া, লিসন কেয়ারফুলি৷ ওরা আমার কাছে টাকা চায়নি৷ কী একটা মাইক্রো-ক্যাসেট চাইছে৷ ওটা নাকি তোর কাছে আছে৷ ওটা দিলেই ওরা তোকে ছেড়ে দেবে৷ পিয়া, তুই আমাকে বল ওটা কোথায় রেখেছিস—আমি ওদের দিয়ে দিচ্ছি৷ তারপরই ওরা তোকে ছেড়ে দেবে৷ শিগগির বল, ওটা কোথায় আছে…৷’
‘বললেও তুমি খুঁজে পাবে না, বাপি৷ ওটা আমি এমন জায়গায় রেখেছি যে, আমি নিজে না বের করে দিলে আর কেউ ওটা খুঁজে পাবে না৷ ইট ইজ অ্যাবসোলিউটলি ইমপসিবল৷’
‘তা হলে কী করি বল তো এখন!’ বাপির গলা বিভ্রান্ত শোনাল, ‘ওরা আমাকে তোর মোবাইল থেকে দু-তিনবার ফোন করেছে৷ বারবার একই কথা বলছে৷ বলছে…ওই ক্যাসেটটা না দিলে ওরা…ওরা তোকে…শেষ করে দেবে৷’ কথা বলতে-বলতে বাপির গলা ভেঙে গেল৷
প্রিয়াংকার মধ্যে কী একটা যেন হয়ে গেল৷ ও শক্ত গলায় বলল, ‘ক্যাসেটটা কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না, বাপি৷ আমি একদম ভুলে গেছি—৷’ তারপর হঠাৎই ওর কান্না পেয়ে গেল৷
এক থাবা মেরে প্রিয়াংকার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিল লোকটা৷ বোতাম টিপে লাইন কেটে দিল৷
প্রিয়াংকার চোখে জল৷ কিন্তু সেই অবস্থাতেই ও দাঁতে-দাঁত চেপে বলল, ‘জানোয়ার—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল ওর গালে৷ প্রিয়াংকা ছিটকে পড়ে গেল বিছানায়৷ ওর ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে৷ গালটা অসহ্য জ্বালা করছে৷ ও গালে হাত চেপে জ্বালাযন্ত্রণা কমাতে চাইল৷
লোকটা দাঁত বের করে অসহায় প্রিয়াংকাকে দেখতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘মাইক্রো-ক্যাসেটটা বসের চাই৷ নয়তো তোমাকে ছিবড়ে করে ছাড়ব৷ তুমি খরচ হয়ে গেলে তোমার বাপি আর সোনমের কী হাল হবে ভেবে দেখেছ!’ লোকটা একবার মাসির দিকে তাকাল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘বসকে রিপোর্টটা দিই…তারপর দেখি তোমাকে নিয়ে কী করতে বলে…৷’
লোকটা হঠাৎই ঘুরে দাঁড়াল৷ কী একটা যেন আচমকা মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে চটপট বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷
প্রিয়াংকা কষ্ট পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে ওর ভেতরে একটা রাগ টগবগ করে উঠল৷ লোকগুলো ভেবেছে কী! যখন খুশি যাকে-তাকে খুন করবে, যখন খুশি যাকে-তাকে কিডন্যাপ করবে৷ নাঃ, পালটা কিছু একটা করতে হবে৷ কিছু একটা…৷
বিছানায় শুয়ে নানান কথা ভাবছিল প্রিয়াংকা, আর মাঝেমধ্যেই মায়ের স্মৃতি মনে পড়ছিল, বাপির কথা মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল সোনমের কথা৷ আর বুকের ভেতরের কষ্ট আর যন্ত্রণা কান্না হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছিল৷
এইভাবে শুয়ে থাকতে-থাকতে কখন যেন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল৷
মাসির ধাক্কায় ওর ঘুম ভাঙল৷ ও ধড়মড় করে উঠে বসল৷ অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করতে লাগল৷ টিউবলাইটের আলো চোখে পড়ায় চোখ পিটপিট করে তাকাল৷