সেদিকে তাক করে অচ্যুত টর্চ জ্বালল৷ এবং দৃশ্যটা ওকে পাথর করে দিল৷
রাজীব উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে৷ ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে রয়েছেন সত্যবানস্যার৷ স্যারের দাঁতের সারি চকচক করছে৷ ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ তার আশেপাশে কয়েক জায়গায় লিপস্টিকের মতো লালচে ছোপ৷ সবুজ চোখ দুটো তীব্রভাবে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে৷
স্যার তখনও খিলখিল করে হাসছেন৷
অচ্যুত বুকফাটা চিৎকার করে উঠল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঝুঁকে পড়া নেকড়েটা সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ এবং অচ্যুতকে তাক করে লাফিয়ে পড়ার জন্য সামান্য কুঁজো হল৷
অচ্যুত পাগলের মতো ছুট লাগাল৷ ওর হাতের টর্চ কোথায় যেন ছিটকে পড়ল৷ টর্চের আলোর বৃত্তটা পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের গায়ে এপাশ-ওপাশ দুলে আগাছার জঙ্গলে কোথায় হারিয়ে গেল৷
ভয়ংকর মৃত্যু তেড়ে এলে মানুষ যেভাবে মরিয়া হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়, ঠিক সেভাবে দৌড়ল অচ্যুত৷ হাঁকপাঁক করে পৌঁছে গেল সাইকেলের কাছে৷ সাইকেল টানতে-টানতেই একলাফে তাতে চড়ে বসল৷ তারপর শুরু হল একা-একা সাইকেল রেস৷
তারই মধ্যে পিছনে তাকিয়ে দেখল সত্যবানস্যার আর-একটা সাইকেলে চড়ে ছুটে আসছেন৷ অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান হয়েও আজ আর অচ্যুতের রক্ষা নেই৷
প্যাডেল করতে-করতে ভয়ে কান্না পেয়ে গেল অচ্যুতের৷ মায়ের পিছুডাকটা না শুনে ও আজ মারাত্মক ভুল করেছে৷ পোষা সাইকেলটাকে ও মনে-মনে বলতে লাগল, ‘আজ আমাকে বাঁচাতেই হবে৷ নইলে আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব মিথ্যে৷ ছোট—ছোট…আরও জোরে ছোট…৷’
রাস্তার দু-চারজন লোক অচ্যুতের ছুটন্ত সাইকেল দেখে ভাবল, এক্ষুনি ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে৷ কয়েকটা সাইকেল রিকশা চটপট পাশে সরে গিয়ে ওর বেপরোয়া গতির সাইকেলকে পথ করে দিল৷
বাড়ির কাছে পৌঁছে সাইকেলে ব্রেক কষল অচ্যুত৷ একলাফে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা ঠেলে ফেলে দিল একপাশে৷ তারপর দুমদুম করে দরজায় ধাক্কা দিল আর একইসঙ্গে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মা! মা! দরজা খোলো—জলদি৷’
বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অচ্যুত উসখুস করতে লাগল৷ গলা উঁচু করে দেখল, সত্যবানস্যার তিরবেগে সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসছেন৷ ওঁর সবুজ চোখ এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে৷
দরজা তখনও খুলছে না দেখে একলাফে মউলিদের দরজায় চলে গেল অচ্যুত৷ ঠেলা মারতেই দরজা খুলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে ঝটপট দরজায় খিল তুলে দিল৷ তারপর দরজায় পিঠ দিয়ে হাপরের মতো হাঁফাতে লাগল৷
.
৷৷আট৷৷
দরজা বন্ধ করার সময় দড়াম করে শব্দ হয়েছিল৷ খিল দেওয়ার সময়েও৷
অচ্যুত চোখ বুজে হাঁফাচ্ছিল৷ আর ভাবছিল, সত্যবানস্যার ওকে মউলিদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন কি না৷ মউলিদের বাড়িতে এর আগে কোনওদিন ও ঢোকেনি৷
এমন সময় দরজার কাছটায় একটা জোরালো আলো জ্বলে উঠল৷
‘এ কী, তুমি! এ সময়ে!’
মউলি৷
চোখ খুলল অচ্যুত৷ কয়েক হাত দূরেই চোখ বড়-বড় করে দাঁড়িয়ে মউলি৷ পরনে সাদা টপ, নীলচে স্কার্ট, কপালে টিপ, আর জোড়া বিনুনি৷
এই বিপদের মুহূর্তে মউলিকে সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে হল অচ্যুতের৷ ও হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, ‘শিগগির ওপরে চলো—৷’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘পরে বলব৷ আগে চলো, দোতলা থেকে উঁকি মেরে একটা জিনিস দেখতে হবে৷’
অচ্যুতের মুখ-চোখ দেখে মউলি আর কথা বাড়াল না৷ ওকে নিয়ে ওপরে উঠল৷ উঠতে-উঠতে বলল, ‘তুমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছ…৷’
অচ্যুত কোনও জবাব দিল না৷
দোতলায় উঠে মউলির মা-কে দেখতে পেল ও৷ মউলি মায়ের কাছে গিয়ে চাপা গলায় কী যেন বলল৷ তারপর অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে, ‘এসো৷’
একটা ঘরে ঢুকল ওরা৷ ঘরের লাগোয়া বারান্দা৷ সেখানে দাঁড়ালে রাস্তা দেখা যায়৷ গত বৃহস্পতিবার রাতে মউলি এই বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল৷
অচ্যুত চাপা গলায় মউলিকে বলল, ‘সাবধানে উঁকি মেরে দ্যাখো তো, আমাদের বাড়ির দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না…৷’
ওকে বিছানার ওপরে বসতে বলে মউলি বারান্দায় গেল৷
অচ্যুত ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখল৷
দেওয়ালে তিনটে রঙিন পোস্টার৷ এক কোণে পড়ার টেবিল—বই- খাতায় ভরতি৷ তার পাশে বইয়ের
র্যাক৷ র্যাকের পাশে দড়িতে মউলির জামাকাপড় ঝুলছে৷
অচ্যুত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল৷ বুঝল, ও মউলির ঘরে বসে আছে৷
পড়ার টেবিলের পাশে মেঝেতে একটা জলের জগ ছিল৷ অচ্যুতের বুকটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছিল৷ জগটা দেখে তেষ্টাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও উঠে গিয়ে জগ থেকে ঢকঢক করে জল খেল৷
জগটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল মউলি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকছে৷
অচ্যুতের কাছে এসে মউলি বলল, ‘একজন ফরসা রোগামতন লোক তোমাদের দরজায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তোমার মায়ের সঙ্গে কীসব কথা বলছে৷ আর রাস্তায় পড়ে থাকা একটা সাইকেল দেখিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে—যেন কাউকে খুঁজছে৷’
‘লোকটার চোখে চশমা আছে?’
‘হ্যাঁ—৷’
‘রাস্তায় যে-সাইকেলটা পড়ে আছে, ওটা আমার—৷’
মউলি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘লোকটা কে?’
‘আমাদের স্কুলের অঙ্কস্যার৷ ওর তাড়া খেয়েই তো আমি তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি৷ মা দরজা খুলতে দেরি করছিল…৷’
মউলির মাথায় কিছুই ঢুকছিল না৷ ও হাঁ করে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে রইল৷
অচ্যুত মউলিকে দেখছিল৷ ডিয়োডোর্যান্টের হালকা গন্ধ কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল৷