তাই বলে কি ঘটছে সেটা জানবারও অধিকার নেই নাকি আমাদের?
আছে। সময় হলেই সব জানতে পারবে। আগেই যদি হার্টফেল করে। বসো, কাজের অসুবিধে হবে আমার।
অর্থাৎ, আমাদের দিয়েও কাজ আছে?
নিশ্চয়ই। কাজ না থাকলে এখন কোথায় চলেছ? অভিসারে?
ভলেনহোভেন কোম্পানীর গলিটায় ঢুকল ওরা। গত কালকের মতই নির্জন। তেমনি ছমছমে একটা ভাব। রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো সারি সারি উঁচু বাড়ির মাথাগুলো মনে হচ্ছে আরও কাছে চলে এসেছে আজ, আগামীকাল এই সময় নাগাদ লেগে যাবে একটার সঙ্গে আরেকটা। পায়ের তলায়। কাকরগুলোও আজ যেন কড়মড় করছে একটু বেশি বেশি।
নিশ্চিন্ত মনে চলতে চলতে হঠাৎ আৎকে ওঠা ঘোড়ার মত থমকে দাঁড়াল। সোহানা, খপ করে চেপে ধরল রানার হাত। বিস্ফারিত চোখে ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে সে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রানা দেখল, ডাইনীর নখের মত দেখাচ্ছে সারবাধা পাঁচতলা দালানগুলোর মাথার হয়েস্টিং বীমগুলোকে। ওপরে আকাশ-বীমগুলোর সিলুয়েট দেখে মনে হচ্ছে অশুভ কিছু।
পৌঁছে গিয়েছি। ফিসফিস করে বলল সোহানা। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এসে গেছি আমরা ঠিক জায়গায়।
মেয়েদের থাকে এই ক্ষমতা, জানে রানা, তবু অবাক হলো সে সাহানার। অশুভকে অনুভব করার ক্ষমতা দেখে। অনেক কিছুই বুঝে ফেলে ওরা আগে থেকে। কিন্তু এখন ওসব পাত্তা দিলে চলবে না। সহজ কণ্ঠে বলল সে, এসে তো গেছিই। তাই বলে অমন কুঁকড়ে যাওয়ার কি আছে?
এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা। পছন্দ হয়নি রানার স্বরে টিটকারির ভাবটা। কিন্তু রানা যখন আবার হাতটা তুলে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল, বাধা দিল না।
কেমন যেন গা ছমছম ভাব এই গলিটায়। ওই বিদঘুটে জিনিসগুলো কি?
ওগুলো হয়েস্টিং বীম। আগেকার দিনে বাড়ির সামনেটা কতখানি চওড়া, তাই দেখে ট্যাক্স ধরা হত। কৃপণ ডাচরা তাই সরু করে বানাত বাড়ি। ফলে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়িটাও চিকন রাখতে হত–ভারী জিনিস ওই সিঁড়ি দিয়ে। ওঠানো নামানো যায় না। তাই বড়সড় জিনিসের জন্যে এই হয়েস্টিং বীমের ব্যবস্থা। ধরো, একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো তুলতে হবে ওপরে, কিংবা কফিন নামাতে হবে
চুপ করো! কাঁধ দুটো একটু উঁচু করে শিউরে উঠল সোহানা। এটা ভয়ঙ্কর এক জায়গা। মনে হচ্ছে মরণের হাতছানি টের পাচ্ছি আমি এখানে। এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি আমাকে? রানার মুখের দিকে চাইল, কক্সবাজারের সেই ডক্টর শিকদারের কথা মনে আছে? সেই রকম অশুভ প্রেতাত্মার ছায়া দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটা হালকা করবার চেষ্টা করল রানা। শিকদারের ভয়ে আমার। সাথে কি করেছিলে, সেসব মনে হচ্ছে না?
আমি করেছিলাম?–না তুমি জোর করে হেসে ফেলল সোহানা, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠাট্টা নয়, রানা। তুমি কিছু অনুভব করতে পারছ না? এ গলির আনাচে কানাচে দেখতে পাচ্ছ না মৃত্যুর কালো ছায়া?
না। পাচ্ছি না। কঠিন সুরে বলল রানা। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে এদিকে, যে শিরশির করে শীতল একটা ভয়ের যোত ওঠানামা শুরু করেছে, বুকের ভিতর গুড়গুড় করছে বিপদের আশঙ্কা, সেকথা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিল না সে সোহানাকে। গভীর কণ্ঠে বলল, এসব আজগুবি কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না, সোহানা। চলো, এগোনো যাক।
আজগুবি কল্পনা! ভয়ানক ভাবে শিউরে উঠল সোহানা একবার। বেত পাতার মত থির থির করে কাঁপছে ওর সর্বাঙ্গ। কয়েক পা এগিয়ে বলল, কল্পনা নয় রানা, আমি মনের ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছি। এই ভয়ঙ্কর গলিতে আমাদের না ঢুকলেই কি নয়?
থমকে দাঁড়াল রানা। যে রাস্তায় এসেছ সেটা চিনতে পারবে? অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকাল সোহানাপারবে। রানা বলল, ভেরি গুড। সোজা। হোটেলে ফিরে যাও। পরে দেখা করব আমি তোমার সাথে।
হোটেলে ফিরে যাব? রানা যে ঠিক কি বলছে এখনও বুঝতে পারেনি সোহানা। মানে?
হোটেলে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করো আমার জন্যে। কোন চিন্তা নেই, তোমার ভূতেরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যাও, রওয়ানা হয়ে যাও।
ঝট করে একটানে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা রানার হাতের নিচ থেকে। রানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই হাতে ওর কোটের দুই কলার। ধরল। পাগলের মত আঁকাবার চেষ্টা করছে সে রানাকে কলার ধরে। বহুবার। বহু ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু সোহানার এমন রুদ্রমূর্তি আগে কোনদিন দেখেনি রানা। ভয়ডর কোথায় উড়ে গেছে তার পাত্তা নেই, এখন কাঁপছে রাগে। আঙুলের গিটগুলো সাদা হয়ে গেছে প্রাণপণ শক্তিতে কলার চেপে ধরায়।
খবরদার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সোহানা। আর কোনদিন এ ধরনের কথা বলবে না আমাকে।
রানা বুঝল, অপমানিত বোধ করেছে সোহানা ওর কথায়। এখন ওর। মেজাজের গোড়ায় বারুদ ধরা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মৃদুহেসে বলল, ঠিক আছে, আর কোনদিন বলব না।
আচ্ছা। রানার কুঁচকে যাওয়া কলার ছেড়ে দিয়ে ওটাকে সোজা করবার চেষ্টা করল সে হাত বুলিয়ে। মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে ওর রাগ। সহজ ভঙ্গিতে খপ করে ওর ডানহাতটা পেঁচিয়ে ধরে টানল সামনের দিকে। ঠিক আছে, চলো এবার। আর…এরকম একটা বাজে ব্যবহার করে বসায় মাফ করে দাও আমাকে। রানার মুখের দিকে চাইল ঘাড় বাকিয়ে। পায়ে ধরতে হবে, না এমনিই মাফ করবে?
আগে শোনা যাক মাফ না করলে কি করবে?
জালাতন করে মারব–শয়নে, স্বপনে।