- বইয়ের নামঃ দামেস্কের কারাগারে
- লেখকের নামঃ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
- প্রকাশনাঃ আল-এছহাক প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
দামেস্কের কারাগারে
১. সাতানব্বই হিজরী
দামেস্কের কারাগারে / মূল : এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ / ভাষান্তর: জহীর ইবনে মুসলিম
অনুবাদকের কথা
আমাদের দেশে গল্প-উপন্যাসের পাঠক একেবারে কম নয়। গল্প উপন্যাসও বাজারে অনেক রয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, সেসব উপন্যাস-গল্পের অধিকাংশই আপত্তিজনক ও চরিত্র বিধ্বংসী। যেহেতু মার্জিত ও আদর্শ মণ্ডিত গল্প-উপন্যাস একেবারেই অপর্যাপ্ত তাই পাঠক সচরাচর যাচ্ছে তা-ই হাতে তুলে নিচ্ছে, এতে করে যুব সমাজের একটা বৃহৎ অংশ বিপদগামী হচ্ছে। এদিক থেকে মার্জিত ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
বর্তমানে ইসলামী ঐতিহাসিক উপন্যাস জগতে ‘এনায়েতুল্লাহ আল তামাশ’ এক আলোচিত নাম। তার পরিচয় নতুনভাবে পেশ করার দরকার আছে বলে আমরা মনে করি না। তিনি ইসলামী ইতিহাসকে গল্পোচ্ছলে অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জলভাবে হৃদয়াহগ্রী করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এতে তিনি পূর্ণ মাত্রায় সফল। বর্ণনার ক্ষেত্রে মূল : ইতিহাসকেও ধরে রাখতে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছেন। এ নন্দিত লেখকের আলোচিত উপন্যাস ‘দামেস্ককে কয়েদ খানেমে’ নামক গ্রন্থ দামেস্কের কারাগারে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের সামনে পেশ করতে পেরে আমরা সত্যিই আনন্দিত। মানুষ মাত্রই ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। দামেস্কের কারাগারের ক্ষেত্রেও হয়তো এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাই ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্যে পাঠক মহলের প্রতি রইল আন্তরিক নিবেদন।
আল-এছহাক প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জনাব তারিক আজাদ চৌধুরী ভাই বইটি প্রকাশের পথ সুগম করে কৃতজ্ঞতাবেশে আবদ্ধ করেছেন। তাই তাকে মুবারকবাদ না জানালে অকৃতজ্ঞ হতে হয়। অনুবাদের সময় বন্ধুমহলের অনেকে এবং আমার কিছু স্নেহভাজন ছাত্র সাহস ও প্রেরণা, যুগিয়েছে, তাদের সকলকেই জানাই আন্তরিক মুবারকবাদ। লেখকের বাকী বইগুলোও আমরা অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার আশাবাদী। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দিন।
–জহীর ইবনে মুসলিম
৫/১/২০০৩
.
দামেস্কের কারাগারে
সাতানব্বই হিজরী। সাত শ পনের খৃষ্টাব্দ। মক্কা নগরীতে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে, কোথাও তিল ধারনের ঠাই নেই। শহর-বন্দর, হাট-বাজার সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। এ উদ্বেলিত ভিড়ের একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাদের সকলের পোষাক-পরিচ্ছদ এক। কাঁধ হতে টাখনু পর্যন্ত সাদা চাদরে আবৃত। এক স্কন্ধ, মাথা ও পদযুগল উন্মুক্ত। তাদের চিন্তা-ফিকির, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, অন্তর ও মনের মারকাজ এক, তাহলে খানায়ে কাবা।
যেমনিভাবে তাদের পোশাক-আষাক এক, তেমনিভাবে তাদের চিন্তা-চেতনা, ধর্ম বিশ্বাসও এক। লা-ইলাহা ইল্লাল্ লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্। তারা সবাই মুসলিম। তারা হারাম শরীফ আবাদকারী। তারা হাজী, হজ্জের ফরজ আদায় করতে সমবেত হয়েছে।
মক্কা নগরীর অদূরে গড়ে উঠেছে, ভাবুর এক ঘন পল্লী। সে পল্লীতে রয়েছে। নারী-পুরুষ এমন কি শিশু-কিশোররাও।
তাদের সকলের পরিচ্ছদ এক কিন্তু গায়ের রং ভিন্ন। কেউ ফর্সা, কেউ নিকষ কালো। কেউ গোরা আবার কেউ ধলা। তাদের মাঝে যেমন রয়েছে প্রভাব। প্রতিপত্তিশালী তেমনি রয়েছে দুর্বল-হীন। যেমনি রয়েছে সিপাহসালার তেমনি আছে মামুলী সৈনিক। আছে মুনিব, আছে গোলাম। এ ভেদাভেদ থাকার পরেও মনে, হচ্ছিল তারা সকলে এক অভিন্ন, একই রংগে রঞ্জিত। তাদের সকলের চলা-ফেরা, কথা-ঝর্তার ধরন এক।
তারা কোন এক দেশের বাসিন্দা নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। তাদের মাঝে রয়েছে আফ্রিকী, চীনী, হিন্দুস্তানী, ইরানী মোটকথা যেখানে ইসলামের জ্যোতি পৌঁছেছে, সেথা হতে মুসলিম উম্মাহ্ একত্রিত হয়েছে পবিত্র মক্কা নগরীতে।
তারা একে অপরের মুখের ভাষা অনুধাবন করতে পারছিল না কিন্তু অন্তরের কথা ভাল করেই অনুভব করতেছিল। হাজার হাজার ক্রোশ দূরে বসবাসকারীদের হৃদয় মন ছিল একই সূতিকায় গ্রোথিত। কারো অন্তরে ছিলনা বিন্দুপরিমাণ বিভেদ। সকলের মাঝে ছিল সুনিবীড় সম্পর্ক। কেউ নিজেকে একাকী মনে করছিল না। ইহরামের সাদা কাপড় পরিহিত প্রতিটি ব্যক্তিই মনে করছিল যেন সে এখানেই জন্মেছে এবং জীবন তরীর সফর এ মঞ্জিলেই শেষ হবে।
অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা সকলের মাঝে এক অপার্থিব অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। পূণ্যভূমি মক্কা নগরীতে সৃষ্টি হয়েছিল অবিরাম গুঞ্জন। সবার মুখে অনুরিত হচ্ছিল ‘তালবিয়া”,
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকাওয়াল মুলক, লা-শারীকালাক। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ আমীর, ধনী-গরীব সকলের শির হচ্ছিল নত। মুখের অনুরিত ধ্বনিতে অন্তরের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছিল। বংশ গৌরব ও শরীরের রং-এর পার্থক্য না করে সকলে হচ্ছিল আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত।
হজ্জের এখনও বেশ কিছুদিন বাকী। দূর-দূরান্ত থেকে এখনো কাফেলা আসছে। তাবুর সংখ্যা বাড়ছে। উট ও দুম্বার আওয়াজ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ভিড়ের মাঝে কিছু লোক এখানে-সেখানে হাত পেতে বসেআছে। কারো কারো সামনে রয়েছে কাপড় বিছান, আবার অনেকের হাতে রয়েছে ঝুলি। এরা ভিখারী। তাদের কিছু সংখ্যক শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধি, তবে বেশীর ভাগই মরুভূমিতে বসবাসকারী গ্রম্য। হজ্জের মৌসুমে তারা মক্কায় এসে ভিক্ষা করে বেশ টাকা-পয়সা উপার্জন করে নিয়ে যায়।
হাজীরা তাদেরকে দান করেন। তাদের মাঝে কে ভিক্ষার উপযুক্ত আর কে উপযুক্ত না সেদিকে তারা লক্ষ্য করেন না। তারাতো আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। এ ভিখারীদেরকে দান করা হজ্জের অবশ্যপালনীয় কাজের একটা অংশ হিসেবে তারা জ্ঞান করেন।
ঐসব ভিখারীদের মাঝে আরো একজন ভিখারী এসে শামিল হয়েছিল যা কোন হাজী লক্ষ্য করেননি। লক্ষ্য করারই বা কি প্রয়োজন, অন্যান্য ভিক্ষুকদের মত সেও একজন ভিক্ষুক। এ নতুন ভিক্ষুকের মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র, হাতে-পায়ে ময়লা, দাড়িতে জমে রয়েছে ধূলাবালু, তার মাঝে যদি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে তাহলে তা হলো সে অতিবৃদ্ধ ও ভীষণ দূর্বল, বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম নয়।
তার মাঝে আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল; যদ্বরুন মানুষ গভীরভাবে তাকে লক্ষ্য করছিল- তাহলো তার পায়ে শিকল, বুঝা যাচ্ছিল সে কয়েদী, বিশেষ অনুগ্রহ করে তাকে ভিক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তুমি কি কয়েদী? প্রথম দিনই একহাজী তাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, সে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিল। তার চোখ দুটো ছিল-অশ্রুসজল।
“চুরি করেছ?”
“যদি চুরি করতাম তাহলে হাত কাটা থাকত। সে তার কম্পমান হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে জবাব দিল।
“কোন মহিলার সাথে জিনায় লিপ্ত হয়েছিলে?”
“এমন হলে তো আমি জীবিতই থাকতাম না, আমাকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হত।” সে কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিল।
“তাহলে তুমি কি অপরাধ করেছ?”
“ভাগ্যের নির্মম পরিহাস” বৃদ্ধ ভিক্ষুক উত্তর দিল।
“অপরাধীদের ভাগ্য তাড়াতাড়ি বিপর্যয় ডেকে আনে, বুঝলে বুড়া!” পাশে দাঁড়ান অন্য আরেক হাজী বলল,
বুড়ো ভিখারীর চেহারায় বেদনার ছাপ ফুটে উঠল। তার আশে-পাশে দাঁড়ান লোকদেরকে অসহায় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগল।
অন্য আরেক হাজী বলল, “অপরাধী তার অপরাধের কথা স্বীকার করে না। জবাবে বুড়ো ভিক্ষুক বলল, “খলিফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক ইন্তেকাল করেছেন। আর তার জায়গায় তার ভাই সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক মসনদে বসেছেন। দামেস্কের বন্দী শালায় গিয়ে দেখ, আমার মত কয়েকজন বন্দী, নিরাপরাধী হয়েও অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে।
এক হাজী জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? তোমার নাম কি? তুমি কোন গোত্রের
প্রতি উত্তরে বুড়ো ভিখারী বলল, “এক সময় আমার নাম ছিল। এখনই নেই। নাম তো কেবল আল্লাহরই থাকবে, সে আকাশের দিকে ইশারা করে বলল, কেবলমাত্র আল্লাহর নামই বাকী থাকবে, কিছু দিলে তা আল্লাহকে দেবে। আল্লাহ তোমাদের হজ্জ কবুল করুন,আমি আমার অপরাধের কথা বলতে পারব না, অপরাধের কথা বলাটাও আমার অপরাধ হবে, তিনি যাকে ইচ্ছে সম্মান দান করেন, যাকে ইচ্ছে অপমানিত করেন।”
হাজীরা তাকে কিছু পয়সা দিয়ে চলে গেল। বুড়ো ভিখারী তার পায়ের শিকল কাপড় দ্বারা ঢেকে দিল। এ শিকলের কারণেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। তার জবাব তার কাছেই আছে, কিন্তু জবাব দেয়ার সাহস নেই। সে খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের সাথে দামেস্ক থেকে এসেছে। মক্কাতে ভিক্ষা করানোর জন্যে তাকে বাদশাহর কাফেলার সাথে আনা হয়েছে। এটা তার শাস্তির একটি অংশ। সে সামনে হাত বাড়িয়ে চুপচাপ বসে থাকত। হাজীরা তাকে বৃদ্ধ মনে করে কিছু পয়সা-কড়ি বেশি দিত। কিন্তু সে তাতে খুশী হত না। এশার নামাজের পর হাজীরা যখন নিজ নিজ তাবুতে চলে যেত তখন সে যৎসামান্য পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খেয়ে সারা দিনের ভিক্ষার পয়সা গণনা করতে বসত। গণনা শেষে দুঃখ-কষ্টে তার অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠত। দু’লক্ষ্য দিনার পূর্ণ করা তার জন্যে বড় প্রয়োজন। হজ্জের এ স্বল্প সময়ে এত পরিমাণ টাকা জমা করা তার পক্ষে সম্ভব না।
সে বুঝতে পারল, যেহেতু সে চুপচাপ বসে থাকে তাই পয়সা কম পায়। সে কথা বলা শুরু করল, কিন্তু অন্য ভিক্ষুকদের মত হৃদয় বিদারক সুরে চিৎকার করত না। আবার ছোট ছেলে-মেয়ের অনাহারের দোহায় দিয়ে ক্রন্দনও করতো না। সে শুধু একটা কথাই বলতো, “তিনি যাকে ইচ্ছে ইজ্জত দান করেন আর যাকে ইচ্ছে বেইজ্জতি করেন।
***
সে ভিক্ষা চাচ্ছিল, এক ব্যক্তি পিছন দিক থেকে এসে পা দিয়ে গুতো মারল, ভিখারী পিছন ফিরে দেখলো,
“পালাবার চিন্তে-ভাবনা করছ না তো বুড়ো?” গুতো দানকারী জিজ্ঞেস করল।
বুড়ো ভিখারী বললো, স্পেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে কেউ পলায়ন করেছেন এমন কথা শুনেছ কি? আমি যদি পলায়নকারী হতাম তাহলে তো…।
“এখনো তোমার মাথা থেকে স্পেনের কথা বের হয়নি” আগত ব্যক্তি তাকে আরো একটা গুতো মেরে বলল।
বৃদ্ধ ভিক্ষুক বলল, তোমার খলীফাকে বলে দিও, তার রাজত্ব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, মুহাম্মদ বিন কাসেমের হত্যাকারীকে আমার এ পয়গাম পৌঁছে দেবে। আর তোমার এ দুগুতোর জবাব কিয়ামতের দিন দিব।
গুতোদানকারী ভিক্ষুককে গভীরভাবে কড়া দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে, তিরস্কার করে চলে গেল।
একদিন দক্ষিণ আফ্রিকার দু’জন হাজী চলতে চলতে ভিখারীর কাছে আসলে ভিখারী তার নির্ধারিত শব্দে আওয়াজ করলে এক আফ্রিকী বলল, এ কোন জ্ঞানী ভিখারী বলে মনে হচ্ছে। অন্য জন বলল,
“হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে, অন্য ভিখারীদের মত সে নিজের অভাবের কথা কেঁদে কেটে প্রকাশ করছে না।”
দু’জন আফ্রিকী থলী হতে পয়সা বের করছিল। ভিখারী মাটিতে বসে উপরের দিকে চেয়ে তাদেরকে দেখছিল। এক আফ্রিকী তাকে পয়সা দিতে গিয়ে থমকে গেল, সে ভিখারীর সামনে বসে চিবুকের নিচে হাত দিয়ে চেহারা দেখে, ভিখারীকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কি?” ভিখারী বলল, “আমার কোন নাম নেই।” আল্লাহ তায়ালার এ ফরমান “তিনি যাকে ইচ্ছে সম্মান দান করেন আৰু যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন, এর বাস্তম নমুনা আমি।”
আফ্রিকী বলল, “খোদার কসম! তুমি মূসা… মূসা ইবনে নুসাইর!”
আমীরে আফ্রিকা স্পেন বিজেতা? অপর আফ্রিকী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
বুড়ো ভিখারীর চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
এক আফ্রিকী জিজ্ঞেস করল, “কোন্ অপরাধের শাস্তি তুমি ভোগ করছ?”
বৃদ্ধ ভিখারী আকাশের দিকে ইশারা করে বলল, কোন অপরাধেরই নয়।
অন্য আফ্রিকী বলল, “আমরা শুনেছি তুমি খলীফার রোষানলে পড়েছ, কিন্তু আমরা এটা তো কখনো কল্পনাও করিনি যে তুমি ভিক্ষুক হয়েছ।”
“ভিক্ষুক বানানো হয়েছে, মুসা ইবনে নুসাইর বললেন, পায়ের ওপর হতে। কাপড় সরিয়ে আরো বললেন, আমি বাদশাহর কয়েদী, দামেস্কের ঐ কয়েদ খানায় বন্দি হয়েছি যেখানে এ বাদশাহ্ সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দুশমনদের হাতে নানা ধরনের শাস্তি দিয়ে হত্যা করেছে। বাদশাহ হজ্জ্ব করতে এসেছে আর আমার প্রতি এ হুকুম জারি করে এখানে এনেছে যে, আমি ভিক্ষা করে দু’লাখ দেরহাম তাকে পরিশোধ করব তানাহলে এভাবে পায়ে শিকল পরিহিত অবস্থায় সারা জীবন ভিক্ষা করব। এক আফ্রিকী আশ্চর্য হয়ে বলল, “দু’লাখ দেরহাম। এটা কি স্পেন বিজয়ের জরিমানা?”
এ প্রশ্নের জবাব বেশ কিছুটা লম্বা ছিল। এত বেশী কথা বলার শক্তি হয়তো মুসার ছিল না বা তিনি জবাব দিতে চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি প্রশ্নের জবাবে প্রশ্নকারীর দিকে একবার মাথা উঁচু করে তাকালেন তারপর মাথা এমনভাবে নিচু করে ফেললেন যেন তন্দ্রা এসেছে। তার বয়স আশির দোর গোড়ে পৌঁছেছিল। জীবনের কম-বেশী ষাট বছর তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে, সফর করে ও তাবুতে অতিবাহিত করেছেন। তিনি কয়েকটা যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার শরীরে এমন কোন অংশ ছিল না যেখানে ক্ষত চিহ্ন ছিল না।
তার ক্ষত-বিক্ষত অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব এক জীবন্ত উজ্জ্বল ইতিহাস, ইসলামী মুজাহিদ বাহিনীর ইতিবৃত্ত। তিনি একজন বিজ্ঞ আলেম ও পণ্ডিত ছিলেন। বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার অসাধারণ খ্যাতি ছিল।
যে দুজন আফ্রিকী তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা দু’জনই দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী বর্বর ছিল এবং দুজনই ছিল নিজ নিজ গোত্রের সর্দার। বর্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঙ্গাবাজ ও হিংস্র একটা জাতি ছিল। বর্তমানে জুলুম ও নির্যাতনের ব্যাপকতা ও কঠোরতা বুঝানোর জন্যে যে বর্বরতা শব্দব্যবহার করা হয় তা ঐ বর্বর জাতির থেকেই উদ্ভূত ও প্রচলিত।
বর্বররা মারামারি, হানাহানি, রাহাজানী, হত্যা, লুণ্ঠনের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিদ্যায় তারা পুরোপুরি পারদর্শী ছিল না। তাদের বীরত্ব, হত্যাযজ্ঞের দরুন তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষও ভীতু হয়ে পড়ত। তারা বেশ কয়েকবার পরাজিত হয়েছে কিন্তু কোন বিজেতাই তাদের ওপর বেশি দিন প্রভাব খাটাতে পারেনি। পরিশেষে আররের মুসলমানরা তাদের প্রতি মনোনিবেশ করে। মুজাহিদ বাহিনীর সিপাহ্ সালার উকবা ইবনে নাফে ফাহুরী গুরুতর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে বর্বরদের উপর বিজয় অর্জন করেন।
বর্বররা বেশ কিছু কাল বিদ্রোহ করেছিল, কিন্তু আরবের সিপাহসালাররা রন শক্তিতে সে বিদ্রোহের আগুন না নিভিয়ে বরং ইসলামী নিয়ম-কানুন ও নীতির ভিত্তিতে চিরতরে খুতুম করেন। বর্বরদের একটা ধর্ম ছিল কিন্তু তাদের কৃষ্টি কালচারের কোন ভিত্তি ছিল না। বিজয়ী মুসলমানরা যখন তাদের সম্মুখে ইসলামের মর্মবাণী তুলে ধরেন তখন তারা অতিদ্রুত ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মুসলমানরা তাদেরকে সৈন্যবাহিনী ও ব্যবস্থাপনার বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। তাদের দ্বারা পুরোপুরি যুদ্ধ করান হয়েছিল। এভাবে তাদের মাঝে শৃংখলা ফিরে আসে আর বর্বররা ইসলামের এক বড় যুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়।
***
তখন মুসা ইবনে নুসাইর আফ্রিকার আমীর ছিলেন। তিনি তার দূরদর্শিতা বলে বর্বরদের বিদ্রোহের সর্বশেষ আগুনকেও নিভিয়ে দিয়ে ছিলেন। যে মুসা যুদ্ধের ময়দানে চরম কঠোর ও গোস্বায় অগ্নিশর্মা হয়ে পড়তেন তিনি বিদ্রোহী বর্বরদের জন্যে রেশমের চেয়েও বেশী নরম আর মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি হয়ে ছিলেন। তার এ সুন্দর কর্ম পন্থা বর্বরদেরকে বিশেষ করে তাদের সর্দারদেরকে ইসলামের পাগল ও মন জয়ী মুজাহিদ বানিয়ে দিয়েছিল।
***
যে দু’জন বর্বর সর্দার মক্কাতে মুসা ইবনে নুসাইয়ের সামনে বসেছিল তারা উভয়ই তার হাতে গড়া এবং তার থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাদের একজন ছিলেন ইউসুফ ইবনে হারেছ অপর জন ছিলেন খিজির ইবনে গিয়াস। ইসলাম গ্রহণ করার পর আরবরা তাদের এ নাম রেখেছিল। মুসা আফ্রিকার আমীর থাকা অবস্থায় তার প্রতি তাদের যে সম্মান ছিল তাকে ভিখারী অবস্থায় দেখেও তারা সে সম্মান প্রদর্শন করছিলেন।
ইউসুফ ইবনে হারেছ বললেন, আমীরে আফ্রিকা আপনি আমাদেরকে বলুন, আমরা আপনার জন্যে কি করতে পারি?
মুসা বললেন, তোমাদের কিছুই করার নেই, আল্লাহ হয়তো আমাকে কোন গুনাহের শাস্তি দিচ্ছেন।
খিজির ইবনে গিয়াস বললেন, কিছুতো আপনি বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব।
ইউসুফ ইবনে হারেছ মুসার কানেকানে বললেন, আমরা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে হত্যা করতে পারি। সে হজ্জ পালন করতে এসেছে আর লাশ হয়ে ফিরে যাবে দামেস্কে।
তারপরে কি হবে? মুসা জিজ্ঞেস করলেন,
‘নতুন খলীফা আপনাকে মাফ করে দেবেন’ ইউসুফ বললেন, আমরা শুনেছি আপনি সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের ব্যক্তিগত ক্রোধ ও হিংসার পাত্রে পরিণত হয়েছেন।
মুসা বললেন, আমি যদি তাকে হত্যা করাই তাহলে আমিও আল্লাহর দরবারে ব্যক্তিগত আক্রোশের অপরাধে অপরাধী হব। আমি নিজেও তার খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাতে পারতাম কিন্তু বন্ধুরা! আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চেয়ে ইসলামের মান-মর্যাদা অনেক বেশি। আমি এবং আমার পূর্বের আমীররা তোমাদের গোত্রের বিদ্রোহকে কেন খতম করেছিলেন? তোমাদেরকে নিজেদের গোলাম বানানোর জন্যে নয় বরং মুসলমানদের মাঝে একতা সৃষ্টি করা এবং কুফরের বিরুদ্ধে ইসলামকে একক শক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করানোর জন্যে। আমি আর কতদিনই বা জীবিত থাকব? আর কয়েকদিন সূর্য উদিত হতে দেখব। সুলায়মানইবা কত দিন জীবিত থাকবে? তাকেও তো মরতে হবে। ইসলামই কেবল জীবিত থাকবে। একবার যদি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় তাহলে এ বিদ্রোহের আগুন প্রত্যেকটি মুসলিম রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আমি নিজেকে নয় ইসলামকে বাঁচাতে চাই।
যে সময় বর্বর ইউসুফ ইবনে হারেছ এবং খিজির ইবনে গিয়াস মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে হত্যা এবং তার খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা আলোচনা করছিলেন, সে সময় একজন হাজী এসে কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথা-বার্তা শুনছিল। ইউসুফ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি এ দুর্বল ভিক্ষুকের তামাশা দেখছ? যদি কিছু দিতে চাও তাহলে দিয়ে চলে যাও।
সে ব্যক্তি বলল, ভিখারী ও তোমাদের কথা-বার্তা শুনছি ভাই! এর দুঃখে আমার অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। আল্লাহর কসম! এ মহৎ ব্যক্তি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার জীবন বাজী রেখে খলীফাকে হত্যা করব… এ মহৎ, ব্যক্তিকে যেই চিনবে সেই তার ব্যাপারে একথা বলবে যা আমরা পরস্পরে আলোচনা করলাম।
খিজির বললেন, তুমি কে? চাল-চলনে, কথা-বার্তায় তো মনে হচ্ছে শামী। সে ব্যক্তি বলল, তুমি ঠিকই বলেছ ভাই, ঠিকই বলেছ, আমি শামী।
সে থলী হতে দু’টো স্বর্ণ মুদ্রা বের করে মুসার কোলের উপর ফেলে দিয়ে বলল, আমি অচিরেই তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব এবং সম্ভব কোন ভাল খবরই নিয়ে আসব।
সে চলে গেল।
***
খিজির মুসাকে বললেন, দেখলেন ইবনে নুসাইর? যে আপনাকে চিনে সেই আপনার মুক্তির জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত।
মুসা বললেন, কিন্তু আমি নিজের জীবনের জন্যে অন্য কারো জীবনকে বিপদের সম্মুখীন করতে চাইনা। আমি মুক্তি কামনা একমাত্র আল্লাহর কাছেই করি।
ইউসুফ বললেন, আপনার দু’লাখ জরিমানা আমরা ফিরে গিয়ে আদায় করে দেব। এখন তো আমরা কেবল রাস্তার খরচ নিয়ে এসেছি।…
খিজির বললেন, আমার গোত্রের লোকেরা আপনার জন্যে দান করে দেরহাম দিনারের স্তূপ বানিয়ে দেবে।
তারা দু’জন মুসার সামনে থেকে উঠার কোন চিন্তেই করছিলেন না। মুসার প্রতি তাদের এ পরিমাণ ভক্তি শ্রদ্ধা যে, তারা তাকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। মুসা তাদেরকে বললেন, তোমরা চলে যাও, আমি খলীফার বন্দি, সে আমাকে এখানে বসিয়ে আমার কথা ভুলে যায়নি। তার সৈন্য বাহিনীর মাধ্যমে আমার প্রতি লক্ষ্য রাখছে। সে জানে আমি যাদের আমীর ছিলাম তারা আমার মান মর্যাদার কথা ভুলে যায়নি, ফলে আমাকে এ লাঞ্ছনা-গুঞ্জনার মাঝে দেখে কেউ প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করতে পারে।
তারা দু’জন সেখান থেকে কেবলি উঠতে যাচ্ছিল এরি মাঝে হঠাৎ করে চারজন ব্যক্তি খোলা তলোয়ার হাতে তাদের দুজনের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মাঝ থেকে একজন ইউসুফ-খিজিরকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের দু’জনকে খলীফা তলব করেছেন।
খলীফা আমাদেরকে কি উদ্দেশ্যে ডেকেছেন? ইউসুফ জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যক্তি বলল, এর জবাব কেবল খলীফা দিতে পারবেন, আমরা তো হুকুমের দাস, তোমরা তাড়াতাড়ি চল।
খিজির বললেন, “যদি আমরা না যাই?”
সে ব্যক্তি বলল, তাহলে তোমাদেরকে এখান থেকে টেনে-হেঁছড়ে নেয়া হবে এ ব্যাপারেও খলীফার নির্দেশ রয়েছে। তোমাদেরকে ঘোড়ার পিছে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তোমরা দ্রুত রওনা হও।
মুসা বললেন, বন্ধুরা আমার! তোমরা খলীফার হুকুম অমান্য করোনা, তাদের সাথে রওয়ানা হয়ে যাও, লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচ, আল্লাহ তোমাদের হিফাজতকারী।
আগত চারজন দু’জন বর্বরকে নিয়ে চলে গেল। মুসা ইবনে নুসাইরের নয়ন যুগল অশ্রুতে ভরে উঠল।
***
হাজীদের তাবুর অদূরে আরেকটি তাবুর বসতি স্থাপিত হয়েছিল। এ তাবুগুলোর মাঝে একটা তাবু বেশ বড় ছিল। এটা নামে ছিল তাবু, মূলত: ছিল রঙিন ঝালর বিশিষ্ট শামিয়ানার সুসজ্জিত কামরা। তার মাঝে রেশমী পর্দা ঝুলছিল। একটা বড় পালং তার উপর রেশমের মশারী ঝুলান ছিল। নিচে অত্যন্ত দামী গালিচা বিছান। পালং এর অদূরেই সোফার মত একটা চেয়ার রাখা ছিল। চেয়ারের সামনে ছোট একটা খাটে মখমলের গিলাফে ঢাকা গদি বিছান। চেয়ারে উপবেসনকারী ঐ গতিদে পা রাখেন।
ঐ নরম আরাম চেয়ারে আরবী পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি বসে ছিল। তার পোশাক এমন ছিল, যে কেউ দূর থেকে দেখেই বলতে পারত সে কোন দেশের বাদশাহ। এক ব্যক্তি কপালে হাত রেখে মাথানত করে তাকে সম্মান জানিয়ে বলল, খলীফাতুল মুসলিমীন! দু’জনকেই নিয়ে এসেছি। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, তাদের কাছে কি অস্ত্র আছে?
সে ব্যক্তি জবাব দিল না, খলীফাতুল মুসলিমীন! তদের কাছে কোন অস্ত্র নেই। তারা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় আছে, তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছি।
খলীফাতুল মুসলিমীন সুলায়মান বিন আব্দুল মালেক শাহী ভঙ্গিতে হালকা মাথা নাড়লেন, তার সম্মুখে দাঁড়ান ব্যক্তি চলে গেল।
বর্বর ইউসুফ ইবনে হারেছ ও খিজির ইবনে গিয়াস ভিতরে প্রবেশ করলেন, আসলামু আলাইকুম আমীরুল মু’মিনীন! দু’জন এক সাথে বলে উঠলেন। খলীফা বললেন, বর্বরদের ব্যাপারে যা শুনেছি তা দেখা যায় ভুল শুনেনি।
খিজির জিজ্ঞেস করলেন, খলীফা বর্বরদের ব্যাপারে কি শুনেছেন?
খলীফা বললেন, তারা সভ্যতার ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ, জংলী। তোমাদের চেয়ে আমাদের গ্রাম্যরা যারা সভ্যতা-সংস্কৃতি কিছু বুঝে না তারাও অনেক ভাল।
ইউসুফ-খিজিরের চেহারায় পেরেশানির ছাপ ফুটে উঠছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
খলীফা শাহী প্রতাপে বললেন, একে অপরের দিকে কি দেখছ? আমার দিকে লক্ষ্য কর। তোমরা একেবারে নিষ্পাপ, তোমাদেরকে খলীফার দরবারের আদব শিক্ষা দেয়া হয়নি। তোমাদেরকে বলা হয়নি যে খলীফার সামনে ঝুঁকে সালাম করতে হয়?
ইউসুফ বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! আমরা তো কেবল সে দরবারে ফুঁকতে চাই, এত দূর হতে যার দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্যে এসেছি। আল্লাহর দরবারে আমরা শুধু কেবল ঝুঁকেই পড়ি না বরং সেজদাও করি। এ আদব ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে।
এখন তোমরা খলীফাতুল মুসলিমীনের দরবারে আছে। খলীফা ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন, “এখানেও নত হওয়া জরুরী।”
ইউসুফ বললেন, খলীফাতুল মুসলিমীন! ইসলামের নিয়মনীতি আমাদের ভাল লেগেছিল তাই আমরা গ্রহণ করেছি। ইসলামের এটাও একটা বিধান- মানুষ মানুষের সামনে মাথা নত করে না, ইসলাম কেবল আল্লাহ্ তা’য়ালার সামনে মাথা নত করার নির্দেশ প্রদান করে। আপনি যদি আমাদেরকে আপনার সামনে মাথা নত করার নির্দেশ দেন তাহলে আমরা আমাদের ধর্মে ফিরে যাই।
“আমি ইসলামেরই খলীফা” সুলায়মান বললেন, ইসলামের কি বিধি-বিধান তা আমাকে বলতে হবে না, বন-বাদাড়ে বসবাসকারি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ বর্বর কেউ আমাকে ইসলামের বিধান শিক্ষা দেবে তার অনুমতি আমি আদৌ দিতে পারি না।
“বর্বরদের তাহযীব, আখলাক যদি দেখতে চান তাহলে স্পেনে গিয়ে দেখুন খলীফা। খিজির উত্তেজিত হয়ে বললেন,আপনি কি জানেন না স্পেন বিজয়ের অগ্রনায়ক বর্বররা। ইউসুফ বললেন, তারেক ইবনে যিয়াদও বর্বর, যে বর্বরদেরকে আপনি অশিক্ষিত ও জংলী বলেছেন, তারা স্পেনের কাফেরদের অন্তর জয় করে তাদেরকে ইসলামের শীতল ছায়া তলে এনেছে।”
খিজির বললেন, খলীফাতুল মুসলিমীন! বর্বর সিপাহ্ সালারের অধীনে আরব সৈন্যবাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় আপনি স্পেন বিজয়ীদেকে ফিরিয়ে এনেছেন, তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেন সাগর পাড়ে পৌঁছে তাবৎ নৌকা জ্বালিয়ে দিয়েছিল যাতে ফিরে আসার কোন রাস্তাই না থাকে। কিন্তু যখন সে অর্ধেক স্পেন বিজয় করে ফেলেছে তখন আপনি তাকে দামেস্কে ডেকে এনে তার চলার রাস্তা চির তরে বন্ধ করে দিলেন যাতে তার নাম ইতিহাসের পাতা হতে মুছে যায়। আর বিজয়ী, আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরকে শিকল পরিয়ে ভিখারী বানিয়েছেন। স্পেনে গিয়ে দেখুন, ঐ বর্বররাই স্পেনের কেন্দ্রস্থলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন। করেছে।
খলীফা বললেন, শুনতে পেলাম তোমরা নাকি মুসার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার প্রতিশোধ আমার থেকে নিবে? আমাকে হত্যা করার ক্ষমতা কি তোমাদের রয়েছে? তোমরা নাকি বিদ্রোহ করে আমার খিলাফতের মসনদ তছনছ করে দিতে চাচ্ছ?
ইউসুফ বললেন, মুসা ইবনে নুসাইর যদি সামান্যতম ইঙ্গিতও প্রদান করেন তাহলে আমরা বিদ্রোহ করে দেখিয়ে দিতে পারি। আমরা মুসার সাথে সে আলোচনা করেছি। তা যদি আপনার চররা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে থাকে তাহলে আমরা তা অস্বীকার করব না। আপনার কানে কি এ কথা পৌঁছেনি, যে তিনি বলেছেন, বিদ্রোহের নামও মুখে আনবেনা তাহলে ইসলামী হুকুমত দূর্বল হয়ে পড়বে? কিন্তু আপনি তো এদিকে ইসলামের মুলোৎপাটন করছেন।
খলীফা গর্জে উঠে বললেন, নিয়ে যাও এ দু’তর্কবাজকে, তাদেরকে দামেস্কের বন্দিশালায় পাঠিয়ে দাও। ঐখানেই তাদের আখিরী ঠিকানা হবে। সাথে সাথে খলীফার ছয়-সাতজন ফৌজ দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করল, তাদের তলোয়ারের খোঁচা দুই বর্বরের শরীরে লাগতে লাগল। সৈন্যরা তাদেরকে জোরপূর্বক টেনে হেঁচড়ে তাবু থেকে বের করে নিয়ে গেল।
ইউসুফ ও খিজিরের আওয়াজ খলীফা শুনতে ছিলেন, “আমাদেরকে হজ্জ্ব পালনে বাধা প্রদানকারী। তোমার বাদশাহীর দিন বেশি দিন নেই। তাদের আওয়াজ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসল এবং এক সময় হাজীদের সম্মিলিত ধ্বনি “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকের নিচে চাপা পড়ে গেল। তারপর আর সে দু’ বর্বরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
***
খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের ভাই ছিলেন। তার পূর্বে খলীফা ছিলেন ওয়ালীদ। তিনি তার ছেলেকে নিজের স্থলাভিষিক্ত বানাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি এমন গুরুতর অসুস্থহয়ে পড়লেন যে কিছু দিনের মাঝেই তার ইন্তেকাল হয়ে গেল। ফলে খলীফা হিসেবে নিজের ছেলের নামটাও ঘোষণার অবকাশ পেলেন না। তার মৃত্যুরপরে খেলাফতের মসনদে সুলায়মান অধিষ্ঠিত হন।
দুই ভাইয়ের মাঝে পার্থক্য এই ছিল যে, ওয়ালীদ মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থানে যুদ্ধের জন্যে প্রেরণ করে সৈন্য বাহিনীসহ যত ধরনের সাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন। অপর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার আমীর মুসা ইবনে নুসাইর যে আবেদন করেছিলেন, স্পেনের উপর হামলা করার এবং তার নেতৃত্ব বর্বর সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদকে দেয়ার জন্যে, ওয়ালীদ তার এ আবেদন কেবল মঞ্জুরই করেননি বরং স্পেন আক্রমণের অনুমতির সাথে সাথে সর্বোপরি সাহায্য প্রেরণ করেছেন।
ওয়ালীদের ভাই সুলায়মান খলীফা হয়ে মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থান হতে সে সময় অপরাধী হিসেবে তলব করে বন্দীকরে হত্যা করেন। যখন সিন্দুকে ইসলামের পতাকাতলে এনে বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অপর দিকে মুসা ইবনে নুসাইরকে দামেস্কে ডেকে বন্দী করেছিলেন যখন মুসা তারেক ইবনে যিয়াদ এর পরে স্পেনে পৌঁছে ঐসব এলাকা বিজয় করছিলেন যে এলাকায় তারেক পৌঁছেন নি, সুলায়মান তারেককেও ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যদি খলীফা ওয়ালীদের পুত্র খলীফা হত এবং তিনি যদি তার পিতার পদাংক অনুসরণ করতেন তাহলে ইউরোপ ও হিন্দুস্থানের ইতিহাস অন্য রকম হতো। সুলায়মান কুতায়বা বিন মুসলিমকেও বাধ্যবাধকতার শিকল পরিয়ে দেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, হিন্দুস্থান ও ইউরোপে মুসলিম সৈন্য বাহিনী প্রেরণ ও এ দু’দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছানোর পিছনে কুতায়বা বিন মুসলিমের অবদান ও বড় ভূমিকা ছিল। কুতায়বা যখন চীনে ছিলেন তখন সুলায়মান তাকে দামেস্কে ফিরিয়ে আনেন।
***
মুসা ইবনে নুসাইর হজ্জের সময় মক্কায় ভিক্ষা করতে থাকেন। ভিক্ষা করে সারা দিনে তিনি যা পেতেন তা খলীফা সুলায়মানকে দিয়ে দিতেন।
পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে মুসাকে বসিয়ে দেয়া হতো। একজন পাহারাদার তার কাছে উপস্থিত থাকত। তাকে কোন প্রকার খাবার দেয়া হত না। তিনি নিজের ভিক্ষার পয়সা হতে খাবার কিনে খেতেন। তিনি এক বছর ধরে দুর্বিসহ কষ্ঠভোগ করছিলেন। খলীফা সুলায়মান তার সারা গৌরব গাঁথা বিজয়ের কথা ভুলে তো গিয়ে ছিলেনই অধিকন্তু তার জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্রও পক্ষেপ করেননি। তিনি তো তার জীবনের আখিরী মঞ্জিলে পৌঁছে গিয়ে ছিলেন। খলীফা সুলায়মান কেবল মাত্র তার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাকে কেবল বন্দীশালাতেই নিক্ষেপ করেননি বরং তাকে মানষিক নির্যাতন করে তার বৃদ্ধ শরীরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছিলেন। প্রচণ্ড রোদ্রের মাঝে তপ্তবালুর উপর মুসাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত। যখন তিনি বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন তখন তার মুখে কয়েকফোঁটা পানি দেয়া হতো যাতে তিনি জীবিত থাকেন। জীবিত রাখার জন্যেই কেবল মাত্র তাকে যৎ সামান্য খাবার দেয়া হতো।
মুসা ইবনে নুসাইরকে প্রথমে খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক বিশেষ– কোন উদ্দেশ্যে স্পেন হতে ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যখন তিনি দামেস্কে ফিরে এসেছিলেন তখন ওয়ালীদ শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি সুলায়মানের হাতে বন্দী হন। সুলায়মান তার ওপর বিভিন্ন অভিযোগ আরোপ করে অত্যন্ত লোমহর্ষকভাবে তার ওপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে দু’লক্ষ দিনার জরিমানা চালিয়ে তাকে একথা বলে মক্কাতে নেয়া হয়ে ছিল যে ভিক্ষা করে টাকা পরিশোধ কর।
***
খলীফার ইঙ্গিতে যখন খিজির ও ইউসুফকে টেনে-হেঁছড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হল তখন খলীফার তাবুর সাথে ঝুলান যে পর্দা ছিল তা সরিয়ে এক অপরূপ সুন্দরী রমণী সম্মুখে আসল। সে সিরিয়া অঞ্চলের সৌন্দর্যের রাণী ছিল। রমণী এসে সুলায়মানের পিছনে দাঁড়াল। সে তার হাত সুলায়মানের কাঁধে রেখে তার ঘাড়ে আঙ্গুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। সুলায়মান তার হাতের মাঝে রমণীর হাত নিয়ে নিলেন।
সুলায়মান মৃদু সুরে আহ্বান করলেন, “কুলসুম!”
কুলসুম তখনও ছিল পূর্ণ যৌবনা যুবতী, সে সুলায়মানের সামনে এসে তার উরুর ওপর বসে পড়ল।
তুমি কি শুনেছ আমি কি করেছি?
কুলসুম সুলায়মানের গোঁফের ওপর আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, হ্যাঁ আমিরুল মু’মিনীন! আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
সুলায়মান কুলসুমের কমর ধরে ব্যাঙাত্মক মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, হতভাগা বর্বর। আফ্রিকা হতে এত দূর আমার হুকুমে মরার জন্যে এসেছে। কত বড় দুঃসাহস! মুসাকে বাঁচানোর জন্যে বিদ্রোহের কথা বলছিল।
আপনি কি নিশ্চিত যে এখন আর কেউ আপনার রাজ্যে বিদ্রোহের কথা বলবে না? কুলসুম জিজ্ঞেস করল।
সুলায়মান বললেন, যে বলবে তার পরিণাম এ বর্বরদের মত হবে। মানুষ আমাকে জালিম বলবে, ঐতিহাসিকরা ইতিহাস লেখার সময় আমাকে নির্দয়, অত্যাচারী হিসেবে অবহিত করবে। কিন্তু আগত প্রজন্ম একথা শ্রবণ করবে না যে, আমার খেলাফতকালে কোথাও বিদ্রোহ হয়েছে।
কুলসুম বলল, এরূপ ধারণা করা কি ভুল নয় আমিরুল মু’মিনীন! কেবল দু’জন বর্বরকে হত্যা করে পুরো রাজ্যের বিদ্রোহের আশংকা খতম করা যায় না। কুলসুম সুলায়মানের সাথে রোমান্টিক ও প্রেমপূর্ণ আচরণের মাঝে বলল, মুসাকে বন্দী করে আপনি বিপদের বড় আশংকা জন্ম দিয়েছেন।
সুলায়মান রোমান্টিক অবস্থায় লোলুপ দৃষ্টে কুলসুমের চেহারার প্রতি অপলক নয়নে চেয়ে ছিলেন। যেন তাকে যাদু গ্রাস করেছে।
কুলসুম বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, মুসা যে তার ছেলে আব্দুল আজীজকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করে এসেছে? আব্দুল আজীজের কাছে হয়তো এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তার বাবার ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তাকে আস্তে আস্তে মৃত্যুমুখে পতিত করা হচ্ছে। তারেক ইবনে যিয়াদ যাতে দামেস্কের বাহিরে না যেতে পারে সে ব্যাপারে আপনি হুকুমজারী করেছেন। তারেক ও আব্দুল আজীজ দু’জন। এক। স্পেনে আমাদের সৈন্যরা মুসা, তারেক ও আব্দুল আজীজকে মর্যাদাবান ও সম্মানের অধিকারী জ্ঞান করে।
“তুমি কি এটা বলতে চাচ্ছে যে, আব্দুল আজীজ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে?
কুলসুম জবাব দিল, কেন করব না? সে তার বাবার বেইজ্জতির প্রতিশোধ অবশ্যই নিবে। তামাম ফৌজ তার সাথে রয়েছে, ফলে সে স্বাধীন রাজ্যের ঘোষণা দিতে পারে। আপনি হয়তো এটাও ভুলে গেছেন যে, অর্ধেকের চেয়ে বেশী ফৌজ বর্বর। বর্বররা এ দাবী অবশ্যই করতে পারে যে তারাই স্পেন বিজেতা। আজ আপনি দু’জন বর্বরকে শাস্তি দিয়েছেন, যে বর্বররা হজ্জ করতে এসেছে তারা তাদের সর্দারকে খোঁজ করতে করতে যে কোন ভাবে এক সময় জেনে যাবে আপনি তাদেরকে কোথায় পাঠিয়েছেন।
সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক বললেন, থামো, আমি তো আব্দুল আজীজ বিন মুসার কথা চিন্তাই করিনি, আমাকে তার ব্যাপারে ভাবতে দাও।
***
খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের চিন্তা-চেতনায় ছিল আত্মম্ভরিতা। তিনি ছিলেন ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কুলসুমের সৌন্দর্য-মাধুর্য ও প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক সুলায়মানের সে আত্মম্ভরিতাকে আরো বাড়িয়ে ছিল। খেলাফতের মসনদে বসার কয়েক দিন পূর্বে কুলসুম তার বালাখানায় এসেছিল। কুলসুমকে সুলায়মানের একবন্ধু হাদিয়া হিসেবে পেশ করেছিল। কুলসুম পূর্ব হতেই পুরুষকে আয়ত্ত করার যাদুকরী কৌশল সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞ ছিল, এ কারণে সে এসেই সুলায়মানকে নিজের করতলগত ও অন্যান্য নারীদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করেছিল।
কুলসুমের সৌন্দর্যের মাঝে যাদু ছিল বা সে যাদু কারিণী ছিল তা নয়, বস্তুত: কমজরী ছিল সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের। তিনি মদ ও নারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। উম্মতে মুহাম্মদীর দুর্ভাগ্য যে, তিনি খেলাফতের মসনদে আসীন হয়েছিলেন। তিনি তার যোগ্যতানুসারে খেলাফতকে বাদশাহী রংগে রঞ্জিত করে অন্যান্য বাদশাহদের মত হুকুমজারী করেছিলেন।
ইতিহাস ও বাস্তবতা এ কথার সাক্ষী দেয়, যে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব ও বংশ গৌরবকে পিছে ফেলে নারীর ওপর সোয়ার হয়েছে সে কেবল নিজে ধ্বংস হয়নি বরং সে যদি তার গোত্রের সর্দার হয় তাহলে পুরো গোত্রকে ধ্বংস করে। আর সে যদি কোন দেশের প্রধান হয়, তাহলে গোটা দেশকে, পুরো মিল্লাতকে ধ্বংস করে দেয়।
কুলসুম সুলায়মানের বিবি ছিল, না তার মহলে সেবিকা ছিল এ ব্যাপারে ইতিহাস একেবারে নিশ্চুপ। তবে ইতিহাস এ ব্যাপারে অনেক ঘটনা বর্ণনা করে, যে ঘটনা সুলায়মানকে এক স্বৈরশাসক এবং জালেম বাদশাহ হিসেবে প্রমাণ করে। তার খেলাফত প্রকৃত অর্থে বাদশাহী ছিল। তিনি বাহ্যত হজ্জ পালনের জন্যে গিয়েছিলেন তবে বাদশাহী শান-শওকত সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। খলীফার দেহরক্ষী দল, গোয়েন্দা বাহিনীও সাথে ছিল। তিনি আল্লাহর ঘরে গিয়েও নিজের দরবার বসিয়েছিলেন।
সুলায়মান যে দিন বিকেলে দু’জন বর্বর সর্দারকে শাস্তি দিলেন সেদিন রাত্রে তিনি তার তাবু হতে বেরিয়ে দু’জন দেহ রক্ষি ও দু’জন মশালধারীকে সাথে নিয়ে মুসার শয়ন স্থলে গেলেন। মুসা শায়িত অবস্থায় ছিলেন।
সুলায়মান, মুসাকে লাথি মেরে বললেন, উঠ।
বৃদ্ধ-দুর্বল মুসা ইবনে নুসাইর অতি কণ্ঠে উঠে বসে উপরের দিকে লক্ষ্য করলেন।
সুলায়মান বললেন, “তোর বিবেক ঠিক হয়ে গেছে নাকি? ঐ দুই বর্বর বিদ্রোহের কথা বলছিল আর তুই নিষেধ করছিলি।”
তোমার ভয়ে নয় ইবনে আব্দুল মালেক। মুসা আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন, আল্লাহর ভয়ে, এখনও আমার তোমার ও তোমার খেলাফতের কোন ভয় নেই।
সুলায়মান বিদ্রুপাত্তক অট্টহাসি হাসলেন। সুলায়মান বললেন, হতভাগা! তুই কি মনে করিস আমার কোন খোদাভীতি নেই।
মুসা বললেন, না। তুমি তো আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কেও জ্ঞাত নও। কুরআন খুলে দ্বিতীয় পারা পড়, আল্লাহর ফরমান “হজ্জের সময় সহবাস হতে দূরে থাক, মন্দ কাজ করিও না, কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়োনা, তোমরা যে সৎ কাজ করে তা আল্লাহ্ জ্ঞাত। হজ্জের সফরে পাথেয় সাথে নিয়ে যাও আর উত্তম। পাথেয় হলো আল্লাহভীতি। সুতরাং হে জ্ঞানী সম্প্রদায় আমার নাফরমানী করবে না।” তুমি কি এ বিধানের উপর আমল করছ? খলিফা সুলায়মান!
খলীফা সুলায়মান তাকে বাঁকা চোখে দেখে ফিরে গেলেন।
***
হজ্জ শেষ হলো। হাজীদের কাফেলা ফিরে চলেছে। খলীফা সুলায়মানের কাফেলাও দামেস্কের দিকে রওনা হয়ে গেল। মুসাকে প্রতিদিন সামান্য কিছু পথ .উটে চড়িয়ে নেয়া হতো বাকী সারা দিন পায়ে হেঁটে চলতে হতো।
দেড় দু’মাসে এ কাফেলা দামেস্কে পৌঁছল। মুসাকে কয়েদ খানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।
দামেস্কে প্রথম রাতেই কুলসুম সুলায়মানকে স্মরণ করিয়ে দিল, স্পেনে মুসার ছেলে আমীর, সেখানে তার বাপের শাস্তির প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে যে কোন সময় বিদ্রোহ করে নিজেকে স্বাধীন শাসক দাবী করে বসতে পারে।
সুলায়মান বললেন, কুলসুম! মুসলমানদের খলীফা। মুসলমানরা একটা নতুন দেশ স্বাধীন করেছে। সে নতুন নতুন নিয়ম-নীতি চালু করা হচ্ছে, কিছু অঞ্চলে এখনো যুদ্ধ চলছে। খলীফা হিসেবে সেখানে যাওয়াটা আমার জন্যে কি জরুরী নয়? .. এ দ্বারা আমার গুরুত্ব ও গ্রহণীয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
কুলসুম বলল, না খলীফাতুল মুসলিমীন! আপনি যাবেন না। আমি আপনার জীবনের আশংকা বোধ করছি। সম্ভবতঃ এমন হতে পারে, আপনার সাথে যারা যাচ্ছে তাদের কেউ সেখানে বলেদিল যে মুসা ইবনে নুসাইর জেল খানায় আর তার অবস্থা খুবই শোচনীয়, তাহলে সে অবস্থায় সেখান থেকে জীবিত ফিরে আসা আপনার জন্যে খুবই দুস্কর।
সুলায়মান বললেন, সেখানের অবস্থা আমার পর্যবেক্ষণ করা খুবই জরুরী। যদি বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার সামান্যতমও ইঙ্গিত পাই তাহলে আব্দুল আজীজের ওপর পাবন্দী লাগিয়ে দেব।
পরের দিন খলিফা প্রথম কাজ এটাই করলেন যে, একজন দ্রুত গামী ঘোড় সোয়ারীকে এ নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করলেন, সে যেন সেখানের অবস্থা জেনে আসে। খলীফা তাকে কোন্ কোন্ বিষয় অবগত হতে হবে তা বিস্তারিত বলে দিলেন আর তাগিদ দিলেন যেন সে দ্রুত ফিরে আসে।
সুলায়মান শেষ কথা কাসেদকে এটাই বললেন, কেউ যেন জানতে না পারে তুমি আমার প্রেরিত কাসেদ। তুমি নিজের ব্যাপারে বলবে, এ দেশে যদি বসবাস করি তাহলে ভাল হবে কিনা এটা দেখার জন্যে এসেছি।
***
অত্যন্ত দ্রুত যাতায়াত করার পরও কাসেদের ফিরে আসতে দেড় মাস সময় লেগে গেল। এরি মাঝে মুসাকে হুকুম দেয়া হয়েছিল সে অতি সকালে কয়েদ খানা থেকে বের হয়ে শহরে ভিক্ষা করবে আর সারা দিনের ভিক্ষের পয়সা সন্ধ্যেবেলা কয়েদখানা প্রধানের কাছে জমা দেবে।
কাসেদ স্পেনের হালাবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, খলীফাতুল মুসলিমীন! এর চেয়ে সুন্দর ও এরূপ সবুজ শ্যামলে ঘেরা আর অন্য কোন দেশ মনে হয় নেই। সুলায়মান বললেন, আমি দেশের প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে শুনতে চাইনা তুমি শুধু আমাকে বল, আমীর আব্দুল আজীজ ইবনে সুলায়মান কি করছে এবং তার সৈন্য বাহিনী ও সাধারণ লোকদের মাঝে তার ব্যাপারে কি ধরনের মন্তব্য চলছে। কাসেদ বলল, ফৌজ ও সাধারণ জনগণের কাছে যদি কোন গ্রহণীয় ও নির্ভরযোগ্য লোক থেকে থাকে তাহলে সে শুধু স্পেনের আমীর আব্দুল আজীজই আছে। সে আলেম, মুত্তাকী, পরহেজগার, আরব ও বর্বররা তো তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেই অধিকন্তু খৃষ্টানদের মাঝেও সে গ্রহণীয় ব্যক্তিত্ব ও তার সুনাম রয়েছে।
আব্দুল আজীজ স্পেন অধিবাসীদের জন্যে কি কি কল্যাণকর কাজ করেছে এবং করছে তার বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করল কাসেদ।
কাসেদ বলল, স্পেনের আমীর সেখানের মানুষের অবস্থা পালটে দিয়েছেন, সেখানে গরীব খ্রীষ্টানের ওপর ধনী খ্রীষ্টানরা রাজত্ব চালাত, সেখানে ইনসাফ-ন্যায় বিচার সেই পেত যার কাছে টাকা ছিল, তাদের জীবনেই তাবৎ সর্বোপরি সুখ-শান্তি ছিল। আমীর আব্দুল আজীজ দরিদ্রদেরকে এমন জীবনদান করেছেন, তারা কেবল পেট ভরে ভাতই খেতে পায় না বরং তারা মান-মর্যাদা, ইজ্জত-সম্মান ফিরে পেয়েছে।
আব্দুল আজীজ ইবনে মুসা স্পেন বিজয়ের পর পরই সেখানের লোকদেরকে কি কল্যাণ কর কাজ করেছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা এ পুস্তিকার শেষভাবে পেশ করা হবে এখানে বলার বিষয় হলো খলীফা সুলায়মান বিন আব্দুল মালেক আব্দুল আজীজের ব্যাপারে অন্য কিছু শোনার আশা করছিলেন।
বর্বরা আব্দুল আজীজের ব্যাপারে কি বলে? সুলায়মান কাসেদকে জিজ্ঞেস করলেন। প্রতি উত্তরে কাসেদ বলল, খলীফাতুল মুসলিমীনের হয়তো জানা থেকে থাকবে, সেনাপতি তারেক ইবনে যিয়াদের সাথে যে সকল সৈন্য স্পেন সাগর পাড়ে পৌঁছে ছিল তারা সকলেই বর্বর ছিল। বর্বর সৈন্যরা যে মালে গণিমত পেয়েছিল তা তারা কোন দিন স্বপ্নেও দেখেনি। আমীর আব্দুল আজীজ তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ সম্মান দান করেছে। মুসা ইবনে নুসাইর দীর্ঘদিন আফ্রিকার আমীর ছিলেন, তিনি বর্বর জাতির প্রতি এ অনুগ্রহ করেছেন যে, তারা মুসাকে মুর্শিদ মনে করে। এজন্যেই বর্বররা আমীর আব্দুল আজীজের জন্যে জান-মাল সর্বোপরি কুরবানী করতে প্রস্তুত রয়েছে।
খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, তাদের মাঝে কেউ আমাকেও কি স্মরণ করে?
কাসেদ বলল, খলীফাতুল মুসলিমীন যদি বেয়াদবী মাফ করেন তাহলে বলি, খলিফার সাথেই কুলসুম বসা ছিল, খলীফার পরিবর্তে কুলসুম বলল, অনুমতি আছে, তুমি নির্ভয়ে সবকিছু খুলে বল।
কাসেদ বলল, খলীফাতুল মুসলিমীন! আমি অনেক শহর-বন্দর, পল্লীতে গিয়েছি। মুসলমান, খ্রীষ্টান, বর্বর মুসলমান সকলের সাথে কথা হয়েছে। কেউ দামেস্কের খিলাফতের নাম নেয়নি। সেখানে যে নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছে তাতে গিয়েছি সেখানেও কেউ খলীফার নাম স্মরণ করেনি। তারা যদি কাউকে স্মরণ করে তাহলে আব্দুল আজীজকেই স্মরণ করে।
খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, মুসা ইবনে নুসাইর ও তারেক ইবনে যিয়াদের আলোচনাও কি হয়?
কাসেদ বলল, তাদের ব্যাপারে বেশ কিছু মানুষকে আলোচনা করতে দেখেছি। তারা একে অপরকে মুসা ইবনে নুসাইর ও তারেক ইবনে যিয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল আর বলছিল তারা যে কোথায় চলে গেল…। খলীফাতুল মুসলিমীন! যে ব্যক্তিই জেনেছে যে আমি দামেস্ক থেকে এসেছি সেই জিজ্ঞেস করেছে, মুসা এবং তারেক দামেস্কে আছে কিনা। তারা এটাও জিজ্ঞেস করেছে তারা কবে ফিরে আসবে। আমি গভীর ভাবে লক্ষ্য করলাম কেন্দ্রের খেলাফতের সাথে স্পেনের কোন সম্পর্কই নেই। খলীফাতুল মুসলিমীন! আপনার সেখানে যাওয়া দরকার।
খলীফা বললেন, হ্যাঁ, আমার সেখানে অবশ্যই যাওয়া উচিৎ। তানাহলে একদিন খুৎবা হতেই আমার নাম বাদ পড়ে যাবে।
“তুমি যেতে পারো, কুলসুম কাসেদকে বলল, কাসেদ চলে গেলে কুলসুম সুলায়মানকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি স্পেনে যাবেন না। আপনি কি কাসেদের এত খোলামেলা কথা ও আলোচলার দ্বারা বুঝতে পারেননি যে, স্পেন একদিন কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আপনি বনু উমাইয়্যার খেলাফতকে খতম করতে চান? মুসা ইবনে নুসাইরের বংশধরকে কি আপনি কেলাফতের। মসনদে বসাতে চান?
সুলায়মান বললেন, না! আমি মুসার বংশ নিপাত করে মরব।
কুলসুম বলল, মুসাকে এ অধিকার কে দিয়েছিল যে, সে এক নব বিজিত দেশের আমীর তার ছেলেকে বানিয়ে এসেছে? মুসাকে খতম করার দ্বারা তো আর তার বংশ শেষ হবে না তার পুরো বংশ শেষ হওয়া দরকার।
আবু হানিফ কে ডাক, সুলায়মান বললেন,
কুলসুম যাবার জন্যে উদ্যত হলো, সুলায়মান তাকে বাধা দিয়ে বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ, দারোয়ানকে পাঠাও।
কুলসুম বলল, আবু হানিফকে আপনার দরবারে আনার জন্যে আমার যাওয়া প্রয়োজন, সে আপনার হকুমের অপেক্ষায় কাছেই বসে আছে।
কুলসুম কামরা হতে বেরিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কামরাসহ আরো দুটো কামরা অতিক্রম করে তৃতীয় একটা কামরার দরজা খুলল। এ কামরাটা অত্যন্ত সুন্দর ও সাজানো গোছানো ছিল। তাতে মাঝ বয়সী এক সুদর্শন লোক বসেছিল। সে কুলসুমকে দেখে দাঁড়িয়ে দু’হাত প্রসারিত করে দিল, কুলসুম সোজা তার বুকে চলে গেল, এ ব্যক্তিই আবু হানিফ।
বস, কুলসুম তাকে বসতে বলে নিজে তার কাছে বসে বলল, স্পেনে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছো তো? তুমি খলীফার পরামর্শ দাতা… পরামর্শ দাতা আরো আছে, কিন্তু আমি তোমাকে একেবারে তার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দিয়েছি।
আবু হানিফ বলল, এটাতো পুরাতন কথা, নতুন কিছু বল, দূত কি খবর নিয়ে এসেছে? সুলায়মান কি বলেছেন?
কুলসুম তাকে দূতের তাবৎ কথা শুনাল এবং সে খলিফাঁকে যে পরামর্শ দিয়েছে তাও বর্ণনা করল। আবু হানিফ বলল, এ পরামর্শ আমিও দেব। যদি সুলায়মানের খেলাফত কায়েম থাকে তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে…। একথাও স্মরণ রাখবে কুলসুম! স্পেনের যে সকল দাসীকে মুসা ইবনে নুসাইর সুলায়মানকে উপহার হিসেবে দিয়েছে তারা সকলেই অপরূপ সুন্দরী। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। তাদের বুদ্ধিমত্তাও অনেক বেশী। এসব রমণীরা সেখানে দাসী-বাদী ছিল না বরং তারা প্রত্যেকেই শাহী মহল ও আমীর ওমরাদের পরিবারের মেয়ে। তাই তাদের মাঝে কেউ যেন তোমাকে পিছনে ফেলে নিজে বেশী বাদশাহর নিকটবর্তী না হয়ে যায়। কুলসুম বলল,এ ব্যাপারে পরে আলাপ হবে, এখন খলীফা তোমাকে তলব করেছেন, তিনি তোমার কাছে স্পেনের আমীর আব্দুল আজীজের ব্যাপারে পরামর্শ চাবেন। কি পরামর্শ দেবে?
কুলসুব বলল, তাড়াতাড়ি যাও, তিনি তোমার প্রতিক্ষা করছেন, তাকে স্পেন যাবার পরামর্শ দেবে না।
আবু হানিফ দ্রুতপদে খলীফার কামরায় পৌঁছে গেল এবং দু’জনে গোপনে পরামর্শ করতে লাগল।
***
ঐ দিনই শেষ প্রহরে দামেস্ক হতে একজন দূত স্পেনের দিকে রওনা হয়ে গেল। সে একটা লিখিত পত্র নিয়ে যাচ্ছিল। পত্র একটা চামড়ার থলীর মাঝে ছিল। থলীর মুখে আবু হানিফ নিজ হাতে খলীফার সম্মুখে মহর লাগিয়ে ছিল। পত্র খলীফার নির্দেশে আবু হানিফ লেখেছিল। এ পত্র বাহকের নাম ইতিহাসে আবুন নছর পাওয়া যায়। এ পত্র বাহককেই সুলায়মানের পূর্বে খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক মুসাকে স্পেন হতে ডেকে আনার জন্যে পাঠিয়ে ছিলেন। আবুন নছর শাহী মহলে খুবই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিল।
সুলায়মান তার পয়গাম স্পেনে পাঠাবার জন্যে আবুন নছরকে ডেকে বলেছিলেন, আবুন নছর তুমি তো জান, আমার বড় ভাই ওয়ালীদ তোমাকে কি পরিমাণ বিশ্বাস করতেন। তোমার সে বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা এখনও বহাল– রয়েছে। এ পয়গাম পথিমধ্যে খুলবেনা। যদি নষ্ট হয়ে যাবার আশংকা থাকে তাহলে থলির মহর খুলে পত্র জ্বালিয়ে দেবে বা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে যাতে অন্য কারো হাতে না পড়ে।
আবু নছর বলল, এমনটি হবে আমীরুর মু’মিনীন!
খলীফা সুলায়মান বললেন, আরেকবার ভাল করে শুনে নাও। এ পয়গাম হাবীব ইবনে উবায়দার হাতে পৌঁছুবে। অন্য কেউ যেন না জানতে পারে যে তুমি কোন পয়গাম নিয়ে এসেছ…। বাকী সবকিছু তো তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
***
সে সময় স্পেনের রাজধানী টলেডো ছিল। আব্দুল আজীজ সেখানেই অবস্থান করছিলেন। আবুন নছর রাত্রে রাজধানীর কাছে পৌঁছেছিলেন। কেল্লার দরজা বন্ধ থাকার দরুণ রাত্র তাকে শহরের বাইরেই কাটাতে হয়।
সকালে দরজা খুললে সে শহরে প্রবেশ করে তার চাল-চলন ও পোশাক আষাক বদলে ফেলেছিল ফলে তাকে আরবী মনে হচ্ছিল না। পূর্বেও সে এখানে কয়েকবার এসেছিল তাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সম্পর্কে তার জানাছিল। হাবীব ইবনে উবায়দাহ কোথায় থাকে তাও সে জানত।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে হাবীব ইবনে উবায়দাহ সৈন্য বাহিনীর কোন গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে এবং কিছুদিনের জন্যে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল এ কারণে ইতিহাসে তার নামে আমীর শব্দ যোগ করে আমীর হাবীব ইবনে উবায়দাহ্ লেখা হয়।
আবু নছর হাবীবের ঘরে পৌঁছুলে সে সময় হাবীবের এক সহকারী বন্ধু তার সাথে আলাপ করছিল। চাকর খবর দিল এক ব্যক্তি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়। হাবীব বাহিরে আসল। কে? হাবীব গভীরভাবে আবু নছর কে দেখে বলল, তুমি আবু নছর না? কারো জন্যে খলীফার পয়গাম নিয়ে এসেছে?
আবু নছর উত্তর দিল, তোমার জন্যে খলীফার কোন বিশেষ ও গোপন পয়গাম রয়েছে। নির্দেশ রয়েছে আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি তা যেন, কেউ জানতে না পারে। পয়গাম নিয়ে নাও এবং আমাকে গোপনীয়ভাবে থাকার ব্যবস্থা কর। আমি জবাব নিয়ে ফিরে যাব।
হাবীব থলে নিয়ে নিল, আর খাদেমকে নির্দেশ দিল, এ মুসাফিরকে পৃথক কামরাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে এবং তার খানা-পিনার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবে। হাবীব নিজ কামরাতে ফিরে বন্ধু যায়েদ ইবনে নাবার সম্মুখে থলে খুলে পত্র বের করে পড়তে লাগল। পত্র পড়ার সময় তার হাত কাঁপছিল। পয়গাম বেশী লম্বা ছিল না। ঐতিহাসিক দুজী এবং স্কট লেখেন, পত্র হাবীরের হাত থেকে পড়ে যায় আর তার চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। পয়গাম যায়েদ উঠিয়ে নিয়ে পড়তে থাকে
“স্পেনের আমীর আব্দুল আজীজকে হত্যা করে তার মাথা দামেস্কে পাঠিয়ে দাও। আর এ বিষয়টা যেন কেউ জানতে না পারে।”
হাবীব বলল, ইবনে নাবা! তুমি জান, মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক কত গভীর। আমি তার ছেলেকে কিভাবে হত্যা করব? না… একাজ আমার পক্ষে সম্ভব না।
যায়েদ ইবনে নাবা বলল, তাহলে নিজের মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও। খলীফার হুকুম যদি না মান তাহলে তিনি তোমাকে এবং তোমার বংশের ছোট বড় সকলকে হত্যা করবেন। হত্যার পূর্বে তোমাকে বন্দী করে এমন কষ্ট দেবেন যে রাতে দিনে কয়েকবার মৃত্যু বরণ করবে আবার জীবিত হবে।
হাবীব বলল, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
তুমি যদি বল তাহলে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব। ইবনে উবায়দাহ! খলীফার এ হুকুম তোমাকে অবশ্যই মানতে হবে।
***
তাদের দুজনের মাঝে আরো অনেক বিষয়ে আলোচনা হলো। প্রায় সকল ইউরোপীয়ান ও মুসলমান ঐতিহাসিকরা লেখেন, হাবীব ইবনে উবায়দার বন্ধুত্ব মুসার সাথে তো অবশ্যই ছিল কিন্তু খলীফা ওয়ালীদ ও তার ভাই সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের অনুগ্রহ হাবীব ও তার পরিবারের প্রতি এত বেশী ছিল যে তা হাবীরের জন্যে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সুলায়মানের শাস্তির ভয়েও হাবীবের জন্যে তার হুকুম অমান্য করার সাহস ছিল না। হাবীব পাঁচজন ফৌজি অফিসারকে কাছে ডেকে তাদেরকে বিশ্বস্ত বানিয়ে ফেলল, তারা পাঁচজনই বনী উমাইয়্যা গোত্রের ছিল। তারা আমীর আব্দুল আজীজকে হত্যার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো, আব্দুল আজীজ উন্নয়ন কাজে এত ব্যস্ত ছিলেন যে কোন এক জায়গায় স্থিরভাবে অবস্থান করতে পারছিলেন না। স্পেনের অনেক এলাকায় তখনও যুদ্ধ চলছিল। খ্রীস্টানরা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করতে তো অক্ষম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা বাকী স্পেনকে রক্ষা করার জন্যে জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করছিল। আমীর আব্দুল আজীজ হঠাৎ করে কোন কোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হতেন।
তাকে হত্যার জন্যে কয়েকবার আক্রমণ চালান হয়েছে কিন্তু তা এমনভাবে ব্যর্থ হয়েছে যে তিনি বুঝতেও পারে নি তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পরিশেষে হাবীব এমন এক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করল যে ছিল খুব জেদী, বুদ্ধিমান ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। সে ব্যক্তি আব্দুল আজীজকে ছায়ারমত অনুসরণ করতে লাগল, আব্দুল আজীজ সব সময় নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীতে থাকতেন। তাই তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করাও সম্ভব ছিল না।
ঐ হত্যাকারী যার নাম কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেন নি। একদা সুযোগ পেয়ে গেল। সে সময় সৈন্য বাহিনীতে সিপাহসালার ইমামতির দায়িত্ব পালন করতেন আর রাজধানীর জামে মসজিদে স্বয়ং আমীর ইমামতি করতেন। একদিন আমীর আব্দুল আজীজ ফজরের নামাজের ইমামতি করছিলেন। তিনি সবে মাত্র সুরা ফাতিহা শেষ করে সূরা ওয়াকিয়া শুরু করেছিলেন এরি মাঝে হঠাৎ সামনের কাতার হতে এক ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হয়ে তলোয়ার বের করে চোখের পলকে আমীর আব্দুল আজীজের মাথা শরীর থেকে পৃথক করে ফেলল। ঘটনা কি হলো মুসল্লীরা তা জানার পূর্বেই সে ব্যক্তি কর্তিত মাথা নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে উধাও হয়ে গেল।
সে ব্যক্তি কর্তিত মাথা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে হাবীবের বাড়ীতে পৌঁছুল। হাবীব তার অপেক্ষাতেই ছিল। হাবীব পূর্বেই একটা থলে বানিয়ে রেখেছিল। মাথা থলিতে ভরে তার মুখ সেলাই করে এ থলিকে মখমলের আরেকটা থলের মাঝে ভরে দূত আবু নছরকে দিয়ে দিল।
হাবীব বলল, এটা খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে দেবে।
আবু নছর জিজ্ঞেস করল, এর মাঝে কি?
প্রতি উত্তরে হাবীব বলল, খলীফার পয়গামের জবাব। তুমি দ্রুত রওনা হয়ে যাও, দেরী করবে না।
আবু নছর সে সময়ই রওনা হয়ে গেল এবং প্রায় বিশ দিন পর দামেস্কে এসে পৌঁছুল। থলে খলীফার কাছে অর্পণ করল।
সুলায়মান আব্দুল আজীজের মাথা দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন।
খলীফা হুকুম দিলেন, স্পেনের আমীরের মাথা কয়েদ খানাতে নিয়ে গিয়ে তার বাপ মুসার সম্মুখে রেখে দাও।
হুকুম তামীল করা হলো, আব্দুল আজীজের মাথা মুসার সম্মুখে রেখে দেয়া হলো। মুসা পূর্ব হতেই অনেক কষ্ঠ, নির্যাতন, নিপীড়নের কারণে অত্যন্ত কাতর ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ছেলের মাথা দেখার সাথে সাথে বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। তিনি যখন চেতনা ফিরে পেলেন তখন মাথা সেখানে ছিল না।
ঐ কয়েদ খানাতেই মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে ঐ খলীফার নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। মুহাম্মদ ইবনে কাসেম মৃত্যুর একদিন পূর্বে বলে ছিলেন, তারা এক যুবককে ধ্বংস করল আর কেমন যুবকেইনা ধ্বংস করল? মুসা তার ছেলের মাথা দেখে বললেন, তারা এমন একজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনে আদল ও ইনসাফ ও উন্নয়নমূলক কাজ করত আর রাতে করতো আল্লাহর ইবাদত। আমার ছেলে সারাদিন রোযা রাখত, আর সারা রাত নামাজ পড়ত।
সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকেও বাদশাহ হত্যা করেছিলেন। কয়েদ হওয়ার পূর্বে ইবনে মুসলিম বলেছিলেন, হে উম্মতে রাসূলে আরাবী! আমি তো তোমার উত্থানের জন্যে প্রচেষ্টাকারী ছিলাম এখন তোমাকে পতন থেকে কে বাঁচাবে?
স্পেনের আমীর আব্দুল আজীজের হত্যার পর মুসা ইবনে নুসাইর বেশি দিন জীবিত থাকতে পারেননি। তার এক দেড় বছর পরে সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকও ইন্তেকাল করেন।
এটা কাহিনী নয়। এটা একটা রোমাঞ্চকর ও ঈমান উদ্দীপক উপাখ্যানের পরিণাম। এ উপাখ্যানের সূচনা হয়েছিল ৫ রজব ৯২ হিজরী মুতাবেক ৯ জুলাই ৭১১ খৃষ্টাব্দে। যখন এক খ্রীষ্টান গভর্নর আফ্রিকা ও মিসরের আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের দরবারে এ ফরিয়াদ নিয়ে এসেছিল যে, স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক তার কুমারী কন্যার ইজ্জত হরণ করেছে আর সে এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায় যা মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করলেন।
২. মিসর ও আফ্রিকার আমীর
“আমি আমার দুই বেটীকে তোমার কাছে পণ হিসেবে রাখছি, আমি অথবা মুগীছ যদি তোমার সৈন্যের সাথে ধোকাবাজী করি, তাহলে আমার দুই বেটীকে বর্বরদের কাছে সোপর্দ করে দেবে।”
বেশী দিন পূর্বের কথা নয়, তিন-চার বছর আগের ঘটনা। এক খ্রীষ্টান গভর্নরের আবেদনে মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করেছিলেন। দামেস্কের বন্দীশালায় বসে বিগত দিনের প্রতিটি ঘটনা মুসা ইবনে নুসাইরের, মনে পড়ছিল। তার চোখের সামনে অতীত জীবনের ছবি স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছিল। তিনি স্মরণ করতে চাচ্ছিলেন না তবুও স্মৃতির দলরা এসে ভিড় জমাচ্ছিল। অতীত দিনের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠার দরুণ তার ব্যথিত হৃদয় আরো ব্যথিত হচ্ছিল। তিনি তো পরিত্যক্ত ও গযব নিপতিত জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছিলেন। তার মনে কোন প্রকার দুঃখ, পরিতাপ ও আফসোস ছিল না। তিনি আল্লাহর নাম ও দীনের পয়গাম আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। নিরাপরাধী হওয়ার পরও তিনি শাস্তি ভোগ করছেন এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ করেন না। তিনি জানেন, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তিনি দুনিয়ার সাথে সর্বোপরি সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গিয়ে ছিলেন যে, তাকে কয়েদ খানাতেই মৃত্যু বরণ করতে হবে এবং তাকে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হবে। হয়তো তার জানাযাও পড়া হবে না।
তিনি জানতেন না যে তাকে যেখানেই দাফন করা হোকনা কেন বা একেবারেই যদি দাফন নাও করা হয় বরং তার লাশ যদি সাগরে নিক্ষেপ করা হয় তবুও তার নাম ইসলামী ইতিহাসে আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। যতদিন সূর্য তার আলোকরশ্মি দ্বারা পৃথিবীকে সতেজ রাখবে, চাঁদ-তারা রাতকে করবে আলোক উজ্জ্বল ততদিন মুসা ইবনে নুসাইরের নাম থাকবে অম্লান।
তারেক ইবনে যিয়াদ কোথায় আছেন? তার তা জানা ছিল না। খলীফা দুজনকেই দামেস্কে আহ্বান করেছিলেন। তারেকের ব্যাপারে তার ভীষণ চিন্তে হচ্ছিল যে, সে যুবক সিপাহসালার স্পেন বিজেতা তার সাথেও এরূপ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেও হয়তো এ কয়েদখানারই কোন এক অন্ধকার কুঠিতে পড়ে মৃত্যুর। প্রহর গুনছে।
মুসা ইবনে নুসাইরকে কিরূপ নির্যাতন নিপীড়ন করা হচ্ছিল তা কিছু বর্ণনা করা হলো। এরূপ নিপীড়নের মাঝে তার ছেলের মাথা কেটে এনে তার সামনে রাখা। হয়েছিল।
চিন্তায় পরিক্ৰান্ত-পরিশ্রান্ত, বার্ধক্যে কাতর, লাঞ্ছনা ও কষ্টে অর্ধ মৃত মুসা ইবনে নুসাইরের ঐ দিনের কথা স্মরণ হলো যে দিন আফ্রিকার ছোট একটি রাজ্য সিওয়াস্তার (মরক্ক) গভর্নর জুলিয়ন তার কাছে এসেছিল। সে সময়ের তাবৎ দৃশ্য তার মানস পটে ভেসে উঠল। সেদিন মুসা উত্তর আফ্রিকার একটা শহর তানজেনিয়ায় ছিলেন। তখন মুসা মিশর ও উত্তর আফ্রিকার আমীর ছিলেন। তিনি মর্দে মুজাহিদ ও সিপাহ্ সালার এবং মানব জীবনোপকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি কখনো আরামে বসে থাকতেন না, শহরে-শহরে, পল্লীতে-পল্লীতে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন।
বর্বরদের বিষয়টা তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, অনেক সময় এ বিষয়টা নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়তেন।
বর্বররা উত্তর আফ্রিকার বাসিন্দা ছিল। লড়াকু নির্ভীক এক জাতি। তাদের ইতিহাস যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মারদাঙ্গার এর বিশাল উপাখ্যান। বিভিন্ন জাতি তাদের ওপর আক্রমণ করেছে কিন্তু পরিণামে তারা নিজেদের পুরো সৈন্য বাহিনী নিঃশেষ করে ফিরে গেছে, যদিও কেউ তাদের ওপর বিজয়ার্জন করেছে কিন্তু সে বিজয় খুব স্বল্প সময়ই ধরে রাখতে পেরেছে। বর্বরা বিদ্রোহ করে বিজয়ীদের চলে যেতে বাধ্য করেছে। রোম রাজ্যের মত বড় শক্তি তারা রক্ত সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। হিসপাহানিকরা এসেছে তারাও রোমদের মত এমন পরাজিত হয়েছে আর কোনদিন বর্বরদের অভিমুখি হওয়ার কল্পনা করেনি।
বর্বরদেরকে যদি কেউ পরাজিত করে থাকে তাহলে আরবের মুসলমানরাই করেছে। কেবল পরাজিত করলেই সবশেষ হয় না, আসল কাজতো শুরু হয় পরাস্ত করার পর, তাহলো বিজীতদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম পর্যায় বর্বরদের ওপর মুসলমানের যারা আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন তারা বর্বরদেরকে নিচু শ্রেণীর ও দাঙ্গাবাজ জাতি মনে করে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেননি। বর্বররা অবাধ্য জাতি ছিল। তাদের পৃথক ধর্ম ও সংস্কৃতি ছিল। তারা মুসলমানদের ধর্মগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করতে থাকে।
মুসা ইবনে নুসাইরের পূর্বে যিনি আমীর ছিলেন তিনি বর্বররা অধিনস্ত ও দাস, এ মনোভাব পরিহার করে তাদেরকে শহরের ব্যবস্থাপনা ও সৈন্য বাহিনীতে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। তাদেরকে বড় বড় পদ মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান। করে ইসলামী সমতা মূলনীতির আলোকে তাদেরকে আরবী সভ্যতা সংস্কৃতিকে অভ্যস্ত করে তোলেন। তবে সমস্যা হলো এ কারণে যে, বর্বররা আরবের গ্রাম্যদের মত গোত্রকে আঁকড়ে ধরে ছিল, প্রত্যেক গোত্রের পৃথক পৃথক সর্দার ছিল আর প্রতিটি গোত্রছিল স্বাধীন। এ কারণে তাদের সকলকে একটি জাতি হিসেবে একত্রিত করা যাচ্ছিল না। কিছু গোত্র আনুগত্য স্বীকার করলে বাকীরা হয়ে উঠত বিদ্রোহী। তাসত্ত্বেও আমীরের সদ্ব্যবহার ও তাবলীগে মুগ্ধ হয়ে বর্বররা ইসলাম গ্রহণ করতে ছিল।
তারপর মুসা ইবনে নুসাইর আমীর হিসেবে আগমন করেন। তিনি এসেই বর্বরদের একটা পৃথক ও নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। মুসা প্রতিটি গোত্রে স্বয়ং নিজে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে অবহিত করেন। যেখানে শক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন সেখানে শক্তি প্রয়োগ করেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের অস্ত্র ব্যবহার করেন। স্বল্প কিছু দিনের মাঝে সকলে মুসলমান হয়ে যায়।
আমীরে মুসা ইবনে নুসাইর বর্বর ফৌজকেও আরবীদের ন্যায় শৃংখলাবদ্ধ করেন। বর্বররা লড়াকু তো ঠিকই ছিল কিন্তু যুদ্ধ বিদ্যা ও যুদ্ধ ময়দানের নিয়ম কানুন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। তারা হত্যা-লুণ্ঠন ও দুশমনদের বসতি ধ্বংস সাধনে, ছিল অভ্যস্ত। মুসা তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের নিয়ম শৃংখলা ও কমান্ডারের হুকুমে যুদ্ধ করার নীতিতে আবদ্ধ করেন।
এটা মুসা ইবনে নুসাইরের অবদান যে, তিনি সকল বর্বর গোত্রকে এক জাতিতে পরিণত করেছিলেন তবে প্রত্যেক গোত্রের সর্দারের সর্দারী বাকী রেখেছিলেন। ফলে তারা স্পৃহায় আরবদের সমপর্যায়ে পৌঁছে ছিল।
***
একদিন মুসা ইবনে নুসাইর উত্তর আফ্রিকার তানজানিয়া শহরে অবস্থান করছিলেন। তাকে খবর দেয়া হলো সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়ন তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে এসছে। জুলিয়ন! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে মুসা বললেন, সে খ্রীষ্টান গভর্নর, আমার সাথে কি উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করতে চায়?
তার সাথে আরো কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছে। খবর দাতা জবাব দিল, তাদেরকে শাহী মহলের লোক বা বড় কোন গভর্নর বলে মনে হচ্ছে, তারা কিছু উপঢৌকন নিয়ে এসেছে।
মুসা বললেন, খোদার কসম! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আর কেউ কি এটা বিশ্বাস করতে পারে, যার সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে এবং যার সাথে আমাদের দুশমনি রয়েছে সে হঠাৎ করে আমাদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে? না,. এটা হতে পারে না, সম্ভবতঃ সে সন্ধির ফন্দি করতে এসেছে। আমি তার ফন্দির জালে পা দেব না।
মুসার এক গভর্নর বলল, আমীরে মুহতারাম! সে এত দূর হতে এসেছে, তাকে মুলাকাতের মওকা দিন।
সিওয়াস্তা একটা বড় শহর সমপরিমাণ রাজ্য যা জাবালুত তারেক (জিব্রালটাল)-এর বিপরীতে রোম সাগরের পাড়ে আফ্রিকার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। তাকে ইউরোপের প্রবেশ দ্বার বলা হতো। সিওয়াস্তা রাজ্য ও জাবালুত্ ত্বারেকের মাঝে যে সাগর ছিল তার প্রসস্ত ছিল বার মাইল। সিওয়াস্তা স্পেনের বাদশাহ রডারিকের তত্ত্বাবধানে ছিল। রডারিক তার ফৌজ সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়নকে দিয়ে ছিল অধিকন্তু জুলিয়নের নিজস্ব ফৌজও ছিল।
জুলিয়ন যেহেতু রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহর তত্ত্বাবধান ও মদদ পাচ্ছিল এ কারণে সে তার সৈন্যবাহিনী দ্বারা আশে-পাশের এলাকা কবজা করার কোশেসে রত ছিল। আমীরে আফ্রিকা মুসা তাকে শায়েস্তা করার জন্যে কয়েকবার সৈন্য প্রেরণ করেছেন ফলে মুসা ও জুলিয়নের মাঝে বেশ কয়েকবার লড়াই হয়েছে। দু’তিনবার মূসা পূর্ণ দমে হামলা করিয়েছেন, কিন্তু সিওয়াস্তার কেল্লা এত মজবুত ছিল যে তা দখলে আনা সম্ভব হয়নি। জুলিয়নের ফৌজকে কেল্লার মাঝে বন্দি করে রাখার জন্যে মুসা কেল্লার চতুষ্পর্শে বর্বর সৈন্য মুতায়েন করেছিলেন এবং এ এলান করেছিলেন যে জুলিয়নের ফেত্না চিরতরে খতম করার জন্যে তিনি পূর্ণদমে হামলা করবেন এবং অবরোধ দীর্ঘায়িত করে কেল্লার ফৌজ ও অন্যান্য লোকদেরকে ক্ষুধা পিপাসায় কতর বানিয়ে জুলিয়নকে মজবুর করবেন আত্মসমর্পণে। এ অবস্থায় রডারিকের সৈন্য বাহিনী যার সংখ্যা দুলাখেরও বেশি, জুলিয়নের মদদে এগিয়ে আসার আশংকা ছিল।
মুসা দু’বার দূত মারফত পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন জুলিয়নের কাছে যে, সে যেন শান্তিতে থাকে এবং অন্যকে শান্তিতে থাকতে দেয় তাহলে তাকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। জুলিয়ন উভয় পয়গামের জবাব দিয়ে ছিল কিন্তু তার মাঝে তুচ্ছ তাচ্ছিলভাব ছিল।
উভয় বার জওয়ারী পয়গামে জুলিয়ন বলেছিল, হে ইসলামী সালতানাতের আমীর! সিওয়াস্তাকে অবরোধ করার পূর্বে স্পেনের ফৌজের হিসেব করেন যাতে পরে পছতে না হয়।
এত বড় প্রকাশ্য দুশমন মুসার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। মুসা তাকে অন্দরে আনার নির্দেশ দিলেন।
***
দু’তিন জন মুশির ও দু’জন সেনাপতিসহ মুসা যে কামরায় বসা ছিলেন জুলিয়ন শাহী লেবাছে বাদশাহী ঢং এ সে কামরাতে প্রবেশ করল। তাকে দেখে মুসা উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে মুসাফাহার জন্যে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। জুলিয়ন তার ভাষায় কি যেন বলল, দু’ভাষী তার তরজমা করে দিল,
“আমি নিরাপদে এসেছি এবং নিরাপদে প্রস্থান করব। বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে এসেছি এবং বন্ধুত্বের ভান্ডার নিয়ে ফিরে যাব।”
মুসা ইবনে নুসাইর জুলিয়নকে বুকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আমাদের ঘরে যদি কোন চরম দুশমনও আসে তাহলে তাকে আমরা দোস্ত মনে করি। আপনার দিলে যত বড়ই খারাপ ইরাদা থাকুক আমরা আপনাকে দোস্তই মনে করব।
তরজুমান উভয়ের কথাবার্তা বর্বর জবানে তরজমা করে শুনাচ্ছিল। জুলিয়নের সাথে চমকদ্বার পোশাক পরিহিত নেজাহ্ হাতে দুরক্ষি ছিল, তারা আধো বন্ধ আধো খোলা দরজার সামনে দাঁড়ান ছিল। জুলিয়ন তাদেরকে ইশারা করলে তারা রোবটের মত বুকে সালাম করে চলে গেল।
তারা চলে যাবার পর দু’জন কৃষ্ণকায় আদমী যাদের মাথায় সফেদ টুপি আর পরনে ঝলমলে তহবন্দ। তারা দু’জন একটা বাক্স নিয়ে এসে তা মুসা ইবনে নুসাইরের সামনে রেখে ঢাকনা খুলে দিয়ে তারা নতজানু হয়ে মুসার সামনে সিজদায় পড়ে গেল। তারা সিজদা থেকে উঠে নিচু হয়ে পিছন ফিরে চলে গেলে সাথে সাথে এরকম আরো দু’জন হাবশী গোলাম ঐ রকম বাক্স নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
মুসা : আমীরে সিওয়াস্তা! আপনি এদেরকে বলেদেন এরা যেন আমার সামনে সিজদা না করে।
জুলিয়ন : আমীরে সালাতানাতে ইসলামীয়া! এরা গোলাম, শাহী খান্দানের আফরাদ নয় ফলে তাদেরকে সিজদা করতে বাধা দেবেন না।
মুসা : আমীর জুলিয়ন! আমরা সকলেই গোলাম। আমরা একজন বাদশাহের সামনে কেবল সিজদাবনত হই। মুসা শাহাদত আঙ্গুল আসমানের দিকে তুলে ইশারা করে বললেন, আর সে বাদশাহ হলেন আল্লাহ! এসব আদব-কায়দার পাবন্দী আপনি আপনার দরবারে করবেন, আমরা সকলে এখন আল্লাহর দরবারে বসে আছি। মুসা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনো মুসলমানদেরকে একত্রে নামাজ পড়তে দেখেননি।
জুলিয়ন : দেখে ছিলাম আমীরে আফ্রিকা! যখন আপনার সৈন্য বাহিনী সিওয়াস্তা অবরোধ করেছিল সে সময় একদিন সন্ধ্যায় কেল্লার প্রাচীরের উপর গিয়ে আপনার তামাম ফৌজকে এক ব্যক্তির পিছনে কাতার বন্দি হয়ে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম।
মূসা : আপনি কি কিছু বুঝতে পেরে ছিলেন? সেনাপতি-সেপাহী, আলা আদনা, সফেদ সিয়া-রাজা-প্রজা সকলে একত্রে দাঁড়ান ছিল। সেখানে এমন কোন কানুন ছিলনা যে কর্মকর্তা সামনের কাতারে আর কর্মচারী পেছনে। ইসলামে মনিব ও গোলামের মাঝে কোন ইমতিয়াজ নেই। আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে সকলে সমান হয়ে যায়। মানুষ মানুষের সামনে নত হওয়া ও সিজদা করা ইসলামে বড় পাপের কাজ।
তিনটি বাক্স কামরার ভেতর আনা হলো। মুসা ইবনে নুসাইর নিষেধ করার পরও বাক্স আরোহনকারীরা নত হয়ে সিজদা করছিল আর জুলিয়ন তা দেখে মুচকি হাসছিল।
জুলিয়ন যা এনেছিল তা অত্যন্ত মূল্যবান হাদিয়া-তুহফা ছিল।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরের জন্যে একটি ঘোড়াও নিয়ে এসেছি। তা বাহিরে রয়েছে। শাহী আস্তাবলের ঘোড়া, এত দ্রুতগামী যেন উড়ে চলে। কেবল মাত্র শাহী লোককে তার পিঠে চড়তে দেয়। আবার লাগাম ধরার সাথে সাথে থেমে যায়। কয়েকটা ময়দানে যুদ্ধ করেছে। যেন শাহী আস্তাবলের বাদশাহ।
মুসা : আমি নিজের পক্ষ হতে এবং খলিফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ হতে শুকরিয়া আদায় করছি। আপনি কি এখন আপনার তাশরীফ আনার মাকসাদ বলবেন?
***
তিনজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক~ লেইন পোল, প্রফেসর দুর্জী ও স্যার মেক্যুয়েল, মুসা ইবনে নুসাইর ও জুলিয়নের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল তা তারা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা ও মিশর! আমি আপনার জন্যে আরো একটি তুহফা নিয়ে এসেছি তবে সে তুহফা আপনাকে নিজে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ করতে হবে, আমি আপনার সাথে থাকব, পথিমাঝে কৃষ্ণসাগর বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার পথ প্রদর্শক প্রেরণ করব।
মুসা : আমাদের দিলের লুক্কায়িত বিষয় তো কেবল আল্লাহ জানেন। এক তো আপনার আগমনের বিষয়টাই আমার বোধ ক্ষমতার উর্ধ্বে তারপর আপনি তুহফার কথা বলছেন এবং যে আঙ্গিকে বলছেন তা অনুধাবনের শক্তিতো আমার একেবারেই নেই। আপনি আপনার শরীফের মাকসাদ ও মানশা এমনভাবে বর্ণনা করবেন না যা আমার মত কম আকলের লোকের অনুধাবন করতে কষ্ট হয়।
জুলিয়ন : সেই তুহফার নাম স্পেন। স্পেন একটা দেশ যে ব্যাপারে আপনি না ওয়াকিফ নন। আপনি ঐ মুলুককে ইসলামী সালতানাতের মাঝে শামিল করতে পারেন। সামনে ফ্রান্স। আপনি স্পেনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফ্রান্সকেও অধীনে আনতে পারেন।
মুসা : সালতানাতে ইসলামীর সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আর আপনার স্বজাতি, স্বগোত্রের বাদশাহ রডারিকের সাথেই বা আপনার কি দুশমনি?
জুলিয়ন : আপনি কি জানেন না যে আমি বাদশাহ রডারিকের জায়গীরদার? সে আমাকে আপনার রাস্তায় প্রতিবন্ধক বানিয়ে রেখেছে। সে সব সময় এ আশংকায় আছে যে, আরবের মুসলমান এত মক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে যে তারা পারস্য-রোম সম্রাটকে পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আজ তারা আফ্রিকার উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বর্বরজাতিকেও তারা ইসলামে দাখিল করে ফৌজি বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ফলে সে ভয় পাচ্ছে, এখন মুসলমানরা স্পেন হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করবে।
মুসা : আপনি কি স্পেন ও আমাদের মাঝে একটা আযাদমুলক হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন?
জুলিয়ন : সে কথা পরে হবে, আগে আপনি আমার পূর্ণ কথা শ্রবণ করে আমার এক সওয়ালের জওয়াব দেন। আপনি কি স্পেনের ওপর হামলা করে সুন্দর ও শ্যামল রাজ্যকে আপনার বিশাল সালতানাতের মাঝে শামিল করবেন?
মূসা : না, আমার কাছে এত পরিমাণ সৈন্য নেই। কেন্দ্র থেকে সৈন্য সাহায্য পাবার আশা নেই, ফলে স্পেনের মত অত বড় ফৌজি বাহিনীর ওপর হামলা করার ক্ষমতা আমার নেই।
মুসা ইবনে নুসাইর অসত্য কথা বললেন, তিনি বহুবার স্পেনের ওপর হামলার ইরাদা করে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। তিনি তার সেনাপতিদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে ছিলেন এবং তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে খলীফা যেন তাকে স্পেন আক্রমণের অনুমতি দিয়ে দেন। সে সময় খলীফা ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক, তিনি সব সময় যুদ্ধ করে অন্যান্য মূলুককে ইসলামী মুলুকে শামিল করার ফিকিরে থাকতেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে তিনি সিন্দু আক্রমণে পাঠিয়ে ছিলেন। মুসা তার নিজের একটা কমজোরীর কথা চিন্তে করতেন তাহলে আরবরা তখন পর্যন্ত নৌ যুদ্ধে দক্ষ হয়ে উঠতে পেরে ছিল না। জাহাজ চালনায় তারা মাহের ছিল কিন্তু নৌ যুদ্ধের কিছু কলাকৌশল ছিল যে সম্পর্কে তখনও তারা নাওয়াকিফ ছিল। স্পেন ও আফ্রিকার মাঝে প্রাচীর হিসেবে ছিল সাগর, স্পেনে হামলার সময়ে স্পেনের জংগী জাহাজ তাদেরকে সমুদ্রের মাঝে বাধা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু মুসলমানরা সাগরে যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না।
জুলিয়নকে মুসা জবাব দিলেন, স্পেনের ওপর হামলা করার কোন চিন্তাই তার নেই। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, সে এ তথ্য নিতে এসেছে যে, স্পেনের ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তা-ফিকির কি। তিনি জুলিয়নের ব্যাপারে এ শুবাহও করেছিলেন যে সে মুসলমানদের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এসেছে। মুসলমানরা যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে তাদের ওপর হামলা করে তাদের আফ্রিকা ও মিসর হতে। বিতাড়িত করা হবে।
জুলিয়ন : আপনি হয়তো জানেন না যে, স্পেন কুতরতের এক ঈর্ষনীয় মুলুক। চারিদিকে সুবজ নয়নাভিরাম ক্ষেত, ঘন সন্নিবিশিষ্ট্য গাছ-পালা, পত্র-পল্লব, এত সৌন্দর্য মণ্ডিত যে যদি মৃত ব্যক্তিও দেখে তাহলে সে জীবিত হয়ে উঠবে। স্পেন সমুদ্র ও নদী প্রধান দেশ। তা সবুজ-শ্যামল পাহাড় ও মনোহরী উপত্যাকার মুলুক। সেথাকার মাটি সোনা, ফলায়। মাটির নিচে রত্নভান্ডার লুকিয়ে আছে। আপনি যদি সেখানে যান তাহলে আরবের বালুময় ও আফ্রিকার পাথুরী জমিনের দিকে ফিরে থাকাবেন না…
সেখানের মানুষ সৌন্দর্যের প্রতীক, সেখানের রমণীদের সৌন্দর্য যাদুর আবেশে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আপনি জান্নাতের কথা শুনেছেন যা মৃত্যুর পরে পাওয়া যাবে। কে পাবে কে পাবে না তা মালুম নেই। আপনি যদি স্পেনে যান তাহলে বলে উঠবেন এটাই সে জান্নাত যার ওয়াদা আল্লাহ্ তা’য়ালা করেছেন। আমীরে আফ্রিকা আপনি কি চিন্তে করছেন? স্পেনের দরজা আমার হাতে আমি তা খুলে দেব।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, স্পেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা জুলিয়ন এমন চিত্তাকর্ষণ শব্দ ও ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন যে মুসা ইবনে নুসাইরের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু তিনি দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের যাদুময়ী কথা ও চিত্তহরী বক্তৃতার ধোকা সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন। তিনি ইশারা করলেন, সবাইকে বাহিরে চলে যাবার জন্যে। কামরার মাঝে মুসা জুলিয়ন ও দুভাষী রয়ে গেল।
মূসা : জুলিয়ন! তুমি আমার জন্যে খুব সুন্দর জাল বিস্তার করছো। তুমি আকলের উপর এত পরিমাণ নির্ভরশীল যে এটা চিন্তে করার কাবেল তুমি নও যে, যার কাছে যাদুময়ী বক্তৃতা দিচ্ছ সে অনেক ময়দানের খেলোয়াড়, তার চোখের তীক্ষ্ণতা মাটির নিচ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুতে পারে।
জুলিয়ন : বেশক আমীরে মুসা! আমি এসব কিছু চিন্তে করেই এসেছি। আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি আমাকে ছোট ভাই মনে করে “তুমি” বলে সম্বোধন করেছেন। অনুমতি দিন আমিও আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করি। সে হাত দুটো মুসার দিকে প্রসারিত করে বলল, “আমার অন্তরের বন্ধুত্ব গ্রহণ করুন এবং আমার দিলে যা লুকিয়ে আছে তাও শ্রবণ করুন।”
মুসা ইবনে নুসাইর তার প্রসারিত হস্তদ্বয় জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পর জুলিয়ন তার হাত মুসার হাত থেকে বের করে উঠে দাঁড়ান। তিনি অত্যন্ত ক্ষীপ্ততার সাথে তলোয়ার কোষমুক্ত করেন। তার চেয়ে আরো বেশী দ্রুত মুসার হাত তার কুরসীর সাথে রাখা তলোয়ারে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু জুলিয়ন তলোয়ার দু’হাতের তালুর ওপর নিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে মুসার সামনে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার মুসার কদমের কাছে রেখে দিয়ে পিছনে কিছুদূর সরে এসে দাঁড়ালেন।
জুলিয়ন অত্যন্ত স্পৃহা ও তেজস্বীভাবে বললেন, আমীরে মুসা! এটা এমন তলোয়ার যা কখনো নত হয়নি। সে দুশমনের উঁচু ও উন্নত গর্দান ওয়ার করেছে। বেয়াদবী মনে করবে না-মুসা! তাকাববরী ও অহংকার ভাববে না, এটা ঐ তলোয়ার যাকে তুমিও নত করতে পারনি। তোমার বর্বর ফৌজও তার ঝলকানী দেখে সিওয়াস্তার কেল্লার পিছু হটে ছিল। আজ সে তলোয়ার তোমার পদযুগলের নিচে পড়ে রয়েছে। কোন বাদশাহ্, কোন সেনাপতি এত সহজে তার তলোয়ার নিজের দুশমনের কদমের নিচে রাখে না কিন্তু তুমি আমার দুশমন নও। এখন আমারা ভাই ভাই একে অপরের দোস্ত। আজকে এক বন্ধু তার দুঃখ অপর বন্ধুর হৃদয়ে ঢালার জন্যে এসেছে… তা কি গ্রহণ করবে মুসা!
মুসা ইবনে নুসাইর নিচু হয়ে পায়ের নিচ থেকে জুলিয়নের শমসের উঠিয়ে নিজ হাতে জুলিয়নকে অর্পন করলেন।
মুসা : তুমি আমাকে দোস্ত ও ভাই বলেছ এটা শুনে খুশী হলাম। আমি তোমার তলোয়ারের কদর করি। মুসা নিজ তলোয়ার কোষবদ্ধ করে বললেন, এখন কি আমার দোস্ত তার অন্তরের ব্যথার কথা আমাকে বলবে?
জুলিয়ন : হ্যাঁ। যা শোনানোর জন্যে এসেছি তা শুনিয়ে যাব। যদি আমীরে মুসার বেটীকে কেউ বেআব্রু করে তাহলে মুসা তাকে কি শাস্তিদেবে?
প্রতি উত্তরে মুসা বললেন, অভিযোগ প্রমাণিত হবার পর অপরাধীকে প্রস্তরাঘাতে খতম করে দেয়া হবে।
জুলিয়ন : অপরাধী যদি কোন মুলুকের বাদশাহ্ হয়?
মুসা : তাহলে মুসা তার শাহী তখতের ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে আর সে বাদশাহর খানদানের তামাম আওরতকে দাসী বানিয়ে নিয়ে আসবে।
জুলিয়ন : আর সে মাজলুম বেটি যদি তোমার দুশমনের হয়?
মুসা; সে মাজলুম বেটী এবং তার বাপ যদি ফরিয়াদী হয়ে আসে তাহলে মুসা তারও প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হবে যে তার নিজের সালতানাত কোন খতরার মাঝে পড়ে কি না!
জুলিয়ন : না মুসা! তোমার সালতানাত ও প্রসাদ কোন খতরায় পড়বেনা। বরং তোমার সালাতানাত আরো প্রশস্ত হবে… এখন শোন মূসা! সে মাজলুম পিতা, আমি, নির্যাতিতা আমার বেটী।
মুসা : তারপরও তোমার তলোয়ার কেন কোষবদ্ধ? এবং তোমার তলোয়ার কেন আমার পদযুগলে পড়ল?
জুলিয়ন : এজন্যে যে অপরাধী আমার চেয়ে বেশী তকতওয়ালা আর সে হলো স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক।
মুসা : রডারিকের শাহী মহলে তোমার বেটী কিভাবে গেল?
জুলিয়ন : আমীরে মুসা! বেশক আমি বাদশাহ্ রডারিকের জায়গীরদার, কিন্তু আমার সম্পর্ক স্পেনের শাহী খান্দারের সাথে। কোন এক সময় আমার এ রাজ্য স্বাধীন ছিল, সময়ের প্রেক্ষিতে সিওয়াস্তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব স্পেনের বাদশাহ্ নিয়ে নেন এবং সিওয়াস্তা স্পেনের অংশে পরিণত হয়। আমি বাদশাহ্ থেকে হলাম গভর্নর। শাহী খান্দানের রেওয়াজ রয়েছে যে, যার মেয়ে পনের-ষোল বছরে পদার্পন করে তখন তার বেটীকে স্পেনের শাহী মহলের আদব-কায়দা, শিষ্টাচার শেখানোর জন্যে শাহী মহলে পাঠিয়ে দেয়। শাহী পরিবারের লোকরা অনেক সময় তার দশ বার বছরের মেয়েকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়…….
সে দস্তুর মুতাবেক আমি আমার বেটী ফ্লোরিডাকে বাদশাহ্ রডারিকের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। তার বয়স সতেরর দোড় গোড়ায় পৌঁছেছে। যেহেতু মেয়েদের আদব-তরবিয়ত শিক্ষা দেয়া হয় এ কারণে তাদেরকে শাহী মহলে আওরতের নেগরানীতে রাখা হয়। পুরুষের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকে না। আমার বেটী খবর পাঠিয়েছে, বাদশাহ্ রডারিক থোকা দিয়ে তার ইযযত হরন করেছে।
মুসা : তোমার বেটী এখন কোথায়?
জুলিয়ন : আমি তাকে টলেডো হতে নিয়ে এসেছি, তুমি হয়তো জানো টলেডো স্পেনের রাজধানী। এখন আমার বেটী সিওয়াস্তাতে। ইচ্ছে করলে আমার বেটীকে এখানে তলব করে জিজ্ঞেস করতে পার।
মুসা ইবনে নুসাইর! আমার বেইযতির প্রতিশোধ আমি রডারিক থেকে নিতে চাই। তার এক তরীকা তো এই যে, তাকে আমি কতল করে ফেলব। কিন্তু এটা সম্ভব বলে মনে হয় না। সে বহুত কম বাহিরে বের হয়। যদি বের হয় তাহলে তার চতুর পার্শ্বে মুহাফিজের ভিড় জমে থাকে।
দ্বিতীয় তরীকা যার কথা চিন্তে করে তোমার কাছে আমি এসেছি তাহলে তুমি স্পেন আক্রমণ কর আমি তোমাকে পূর্ণ মদদ করব। তবে আমি সামনে আসব না। বেশক স্পেনে ফৌজ বেশুমার। সংখ্যার দিকে যদি লক্ষ্য কর তাহলে তুমি হামলা করতে পারবেনা তবে যে উদ্দীপনা ও নিয়মতান্ত্রিকতা তোমার ফৌজের মাঝে রয়েছে তা রডারিকের সৈন্যের মাঝে নেই এর তাফসীল আমি পরে করব। আমি ইয়াকীনের সাথে বলছি তোমার ফৌজ স্পেনের ফৌজকে শেকান্ত দিবে। আমার প্রতিশোধ কেবল রডারিকের হত্যার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না বরং তার বাদশাহীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাই। আমার এই ইরাদা কেবল তুমিই পূর্ণ করতে পারো। তবে এর পরিপূর্ণ ফায়দা তোমার হবে। আমি কেবল এ আবেদন করব যে তুমি সিওয়াস্তাকে আযাদ রাখবে।
***
এটা একটা মাশহুর ওয়াকিয়া যা ঐতিহাসিকরা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, জুলিয়নের দুই বেটী ছিল। একজনের নাম ছিল ফ্লোরিডা অপরজনের নাম ছিল মেরী। ফ্লোরিডা যত বড় হচ্ছিল তত তার সৌন্দর্য মাধুর্য রূপলাবণ্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
তারা বলতেন, আমার বেটী যে সুন্দর হয়ে গড়ে উঠছে তার জন্যে তো ঐ রকম সুন্দর শাহজাদা পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে। তার মা জানতেন যে, তার বেটী চৌদ্দ বছর বয়সেই এক শাহজাদাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যাকে বেছে নিয়েছে প্রকৃত অর্থে সে শাহজাদা নয়। সে শাহী আস্তাবলের এক শাহ সোয়ারের বেটা। এই শাহ্ সোয়ার শাহী খান্দানের ও ফৌজী অফিসারদের আওলাদেরকে ঘোড় সোয়ারী ও নেজাবাজী প্রশিক্ষণ দেন। শাহী খান্দান ও ফৌজের উঁচু পর্যায়ে তার, বেশ মর্যাদা, কদর রয়েছে।
হিজী তার নওজোয়ান বেটা। ফ্লোরিডার বয়স যখন তের/চৌদ্দ বছর, হিজীর বয়স তখন সতের/আটার বছর। হিজীকে তার পিতা শৈশবেই শাহ সোয়ার বানিয়েছিলেন। নেজা বাজীতে সে পারদর্শী ছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্লোরিডার বাপ জুলিয়ন তার মেয়েকে ঘোড় সোয়ার বানানোর জন্যে হিজীর বাবাকে হুকুম করেছিলেন। ফ্লোরিডা সকাল-সাঁঝে ঘোড় সোয়ারের জন্যে যেত।
জুলিয়ন হিজীর বাপকে হিদায়াত দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আমার বেটীকে বেটী মনে করবে না। তুমি জান আমার কোন লাড়কা নেই। সম্ভবত এ কারনেই আমার এ লাড়কী লাড়কা হতে যাচ্ছে। সে আমার ছেলের অভাবপূরণ করবে। তাকে মর্দ মনে করে শাহ্ সোয়ার বানাবে এবং তাকে নেজা বাজী শেখানোর সাথে সাথে দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার ও কুঠার চালানোর তরবিয়াত দেবে।
দেড়-দুই মাহিনায় ফ্লোরিডা ঘোড় সোয়ারীতেএত পুখতা হয়ে গেল যে সে ঘোড়ায় সোয়ার অবস্থায় তার ঘোড়া বড় উপত্যকা ও উঁচু প্রাচীর লাফ দিয়ে অতিক্রম করতে লাগল। তার উস্তাদ তাকে একাকী দূরে যেতে দিতেন না। কিন্তু ফ্লোরিডা ছিল শাহজাদী, সে তার উস্তাদের ওপর হুকুমজারী করে ঘোড় নিয়ে চলে যেত।
উস্তাদ আশংকা করছিলেন, এ লাড়কী একাকী জঙ্গলে ঘোড়া নিয়ে গিয়ে কোন বাধার সম্মুখীন হয়ে যদি ঘোড়া হতে পড়ে যায় বা ঘোড়া যদি পড়ে যায় আর সে যদি ঘোড়ার নিচে পড়ে তাহলে তা উস্তাদের জন্যে বড়ই দুভাগ্য ডেকে আনবে। তাই উস্তাদ তার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ফ্লোরিডা যখন ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যেত তখন উস্তাদ তার ছেলে হিজীকে ঘোড়া দিয়ে তার পিছনে পাঠিয়ে দিতেন।
হিজীকে আপনার পিছনে বা সাথে দেখে ফ্লোরিডা কোন প্রশ্ন করেনি। একদিন সে পথিমধ্যে ঘোড়া দাঁড় করাল, হিজী তার কাছে গিয়ে তার নিজের ঘোড়াও, থামাল। ফ্লোরিডা তাকে দেখে মুচকি হাসি দিল। হিজীর মাঝে ছিল পৌরুষের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের ছবি। তার শরীরের অব কাঠামো দেখে পরিষ্কার বুঝে আসছিল মর্দে ময়দান। তার মাঝে ছিল পুরুষকে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ারের মাধ্যমে ব্যাকুল ও অস্থির করার ক্ষমতা আর মজলিসে রমণী পাগলপারা করার মোহ ও আকর্ষণ।
ফ্লোরিডা : হিজী! আমাকে ঘোড়া হতে নামিয়ে দাওতো। এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে একা নামতে পারছিনে।
এটা শাহজাদীর হুকুম ছিল। তাই হিজী তৎক্ষণাৎ নিজ ঘোড়া হতে নেমে শাহজাদীর ঘোড়ার কাছে গিয়ে তার রেকাবের ওপর হাত রেখে দাঁড়াল। কিন্তু শাহজাদী দু’হাত প্রসারিত করে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে ক্ষণিকের মাঝে হিজীর বাহুবন্ধনে চলে এলো। হিজী তাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে পিছে হটছিল কিন্তু শাহজাদীর নরম-মাংসল বাহু যুগল হতে সে বেরুতে পারল না।
ফ্লোরিডা : ভয় পেওনা হিজি! তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে… খুব… ভাল লাগে।
“আমি তোমাদের এক গোলামের বেটা শাহজাদী!” হিজী কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।
“গভর্নর জুলিয়ন যদি জানতে পারেন তাহলে….।”
ফ্লোরিডা : ভুল বুঝো না হিজি! আমি লাড়কী তো বটে তবে বৈশিষ্ট্য লাড়কীর নয়। আমি সেরেফ তোমার শরীর চাই না। তুমি কি সে মহব্বত সম্পর্কে ওয়াকিফ নও যার জন্ম হৃদয়ে এবং হৃদয়ের গভীরেই বাসা বেধে থাকে?
হিজি : না! শাহজাদী না!
ফ্লোরিডা : আমাকে শাহজাদী বলবে না। আমাকে মহব্বত করার নির্দেশ আমি তোমাকে দিচ্ছিনে… আমাকে ফ্লোরা বলবে।
***
হিজি ফ্লোরা বলতে লাগল। শাহজাদী শাহী প্রাচীর ও আঙ্গিনা ডিঙ্গিয়ে এলো। লোক সম্মুখে হিজি ছিল তার নওকর কিন্তু কেল্লার বাহিরে খোলা প্রান্তরে ছিল তার প্রিয়জন ও হৃদয় সুজন। প্রথম দিন ফ্লোরিডা তাকে বলে ছিল আমি কেবল তোমার শরীর চাই না, তা সে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিল। তার মহব্বত দিল হতে জন্ম নিয়ে অন্তরের গভীরতম প্রদেশে ঠাঁই করে নিয়েছিল।
হিজি তাকে শাহ্ সোয়ার বানিয়ে নেজাবাজী ও তলোয়ার চালনেও মাহের বানিয়ে দিল। ফ্লোরিডার বাবা-মা বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারলানা যে, তাদের বেটী নি জিন্দেগীর সাথী ইন্তেখাব করে নিয়েছে। ফ্লোরিডা ও হিজি কখনো চিন্তা করেনি যে তাদের শাদী আদৌ হবে না। জুলিয়ন মখমলের নকশা চটের থলীতে করবেন না। তারা তো প্রেমের সাগরে ডুবদিয়ে নিজেদের অবস্থার কথাই কেবল ভুলেনি বরং তামাম দুনিয়াকেই ভুলে গিয়েছিল।
সময়ের ঘড়ি অতিক্রম করে দু’ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন মা ফ্লোরিডাকে বললেন তার বাবা তাকে টলেডো নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাকে কমছে কম একবছর স্পেনের বাদশাহ রডারিকের শাহী মহলে অতিবাহিত করতে হবে।
ফ্লোরিডা : কেন?
মা : তুমি কি জান না, শাহী খান্দানের লাড়কীরা সেখানে শাহী আদব-আখলাক ও বাদশাহী চাল-চলন শিখতে যায়?
ফ্লোরিডা : আমি মূর্খ-গ্রাম্য? আমি শাহী তরীকা সম্পর্কে ওয়াকিফ নই? আমার কিসের কমতি পরিলক্ষিত হচ্ছে?… আমি যাব না, আমিঐ শাহী খান্দান সম্পর্কে অনেক কথা-বার্তা শুনেছি। শাহী মহলে যে আদব-আখলাক প্রচলিত রয়েছে তার কয়েকটা ঘটনা আমি শ্রবণ করেছি।
ফ্লোরিডার মা তাকে অনেক বুঝালেন কিন্তু তার কোন কথা শ্রবণ করল না, সে এক কথায় বলতে লাগল ঐসব বাদশাদের কাছে কোন আখলাক, ভদ্রতা, শিষ্টাচার কিছুই নেই। কিন্তু তার বাবা যখন হুকুমের স্বরে তাকে স্পেনে যেতে বললেন তখন আর সে অস্বীকার করার সাহস পেল না। সে জানত তার বাবা কি পরিমাণ স্বেচ্ছাচারী।
জুলিয়ন ও তার বিবি ফ্লোরিডাকে সাথে নিয়ে রেখে আসলেন স্পেনের রাজধানী টলেডোতে বাদশাহ্ রডারিকের শাহী মহলে। তারা ফ্লোরিডাকে রডারিকের সম্মুখে উপস্থিত করেছিলেন।
রডারিক ফ্লোরিডার রূপ লাবণ্য ও নব যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “আহ্! এত সুন্দরী! জুলিয়ন! এ লাড়কীকে নামকাওয়াস্তে কোন শাহজাদার সাথে শাদী দিয়ে বিনষ্ট করবে না।
জুলিয়ন সহাস্যে উত্তর দিয়েছিলেন, এ বেটী নয় এ আমার বেটা।
ফ্লোরিডার বাবা-মা যখন সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলেন দু’নয়ন আঁসুতে ভরে উঠেছিল।
***
আট-দশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হিজির বাপ জুলিয়নকে বললেন, তার ছেলে লাপাত্তা হয়ে গেছে। জুলিয়নের নির্দেশে তাকে সর্বত্র তালাশ করা হলো, মাঠে-ময়দানে, জঙ্গলে ঘোড় সোয়ার পাঠান হলো কিন্তু কোথাও হিজির নাম নিশানা পাওয়া গেলে না।
ওখানে সে থাকলে না পাওয়া যাবে। সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে টলেডো পৌঁছে ছিল। সে ফ্লোরিডার বিরহ সহ্য করতে পারেনি। সেখানে পৌঁছে সোজা শাহী আস্তাবলে গিয়ে জিম্মাদার অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করে নওকরীর দরখাস্ত করেছিল। আস্তাবলের অফিসার তার ইমতেহান নেয়ার জন্যে বা তার সাথে মজাক করার জন্যে একটা অত্যন্ত অবাধ্য ও দুষ্ট অশ্বের দিকে ইশারা করে বলেছিল, এ অশ্বকে সোয়ারী বানিয়ে দেখাও।
ঐ ঘোড়া খুব কম লোকের বাগে আসত। হিজি সে ঘোড়ার ওপর জিন লাগিয়ে। সোয়ার হয়ে গেল। আস্তাবলের তাবৎ কর্মচারীরা হিজির ঘোড়ার পীঠ হতে পতিত হওয়ার দৃশ্য দেখার জন্যে একত্রিত হয়ে গেল। ঘোড়া তার অবাধ্যতা দেখান শুরু করল। সোয়ারীর কোন ইশারা-ইঙ্গিতই সে পাত্তা দিল না কিন্তু হিজি অল্প কিছুক্ষণ পরেই তাকেবাগে এনে ফেলল। অত্যন্ত দ্রুত দৌড়াল, সব ধরনের চাল-চালনা করল এবং ঘোড় দৌড়ের ময়দানে যে বাধা ছিল তা নির্দিধায় অতিক্রম করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল।
নেজাবাজী ও তলোয়ার চালনার অমূল্য কৌশল দেখাল যার ফলে ভাল পদে তার নওকরী হয়ে গেল। তার মাকসাদ কেবল নওকরী ছিল না, সে তো ফ্লোরিডার সাথে মিলন চাচ্ছিল। কিছু দিনের মাঝে সে জেনে গেল ফ্লোরিডা কোথায় থাকে, কিন্তু তাকে ফ্লোরিডার কাছে যাওয়ার জন্যে চেষ্টা করতে হলো না। একদিন পাঁচ ছয়জন শাহজাদী ঘোড় সোয়ারের জন্যে এলো। তাদের মাঝে ফ্লোরিডাও ছিল। এসব শাহজাদীরা ফ্লোরিডার মত অন্যান্য শহর হতে তালীম তরবিয়তের জন্যে এসেছে। তাদের তরবিয়তের মাঝে ঘোড় সোয়ারও শামিল ছিল।
ফ্লোরিডা হিজিকে দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ল। সে যেহেতু শাহজাদী ছিল এ কারণে যে কোন নওকরের সাথে তার কথা বলার অধিকার ছিল। সে সোজা হিজীর কাছে গিয়ে উচ্চ স্বরে কথা বলতে লাগল যাতে কারো কোন সন্দেহ না হয়।
ফ্লোরিডা : তোমার নাম কি?
আগস্টস। হিজি তার নাম ভুল বলল, অন্যদের কাছেও সে এনামই বলেছে।
ফ্লোরিডা : তোমাকে মনে হচ্ছে ইতিপূর্বে কোথাও দেখেছি।
হিজি : হয়তো দেখতে পারেন শাহজাদী! আমি বেশ অনেক জায়গায় অবস্থান করেছি।
অন্যান্য শাহজাদীরাও তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বেশ হাসি খুশীতেই এসেছিল।
ফ্লোরিডা : আস্তাবলে তোমার কি কাজ?
আস্তাবলে অফিসার যিনি পাশেই দাঁড়ান ছিলেন, বললেন, সে খুব ভাল শাহ্ সোয়ার শাহ্জাদী!
ফ্লোরিডা : শাহ্ সোয়ার! আজই তাহলে তাকে আমাদের সাথে পাঠাও দেখব কত বড় শাহ্ সোয়ার।
ঐ দিনই হিজিকে শাহজাদীদের সাথে পাঠান হলো। কেল্লার বাহিরে গিয়ে ফ্লোরিডা তার সাথী শাহ্জাদীদের বলল, সে এই শাহ্ সোয়ারের সাথে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেখবে এ ঘোড় সোয়ার কতটুকু মাহের।
কিছুক্ষণ পরেই ফ্লোরিডা ও হিজির ঘোড়া সমন্তরালে চলতে লাগল, তারা ঘোড়া দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের সবুজ-শ্যামল চুড়াতে গিয়ে পৌঁছুল, বেশ কিছুক্ষণ পর তারা পাহাড় হতে বের হলো, এর মাঝে তারা তাদের অন্তরে জমে থাকা কথা সেরে নিয়েছিল। হিজি ফ্লোরিডাকে বলেছিল সে কাউকে কিছু না বলেই সিওয়াস্তা থেকে চলে এসেছে।
ফ্লোরিডা : তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। আমার বাবা যদি জানতে পারেন যে, তুমি এখানে তাহলে প্রথমে এ শক হবে যে তুমি আমার জন্যে এখানে চলে এসেছ। সিওয়াস্তার শাহী নওকরী ছেড়ে এখানে নওকরী করতে আসার এ ছাড়া আর কোন কারণ নেই। থাকলেও তুমি কাউকে বুঝাতে পারবে না।
হিজি : ফ্লোরিডা! আর কিছু দিন থাকতে দাও। দু’ একদিন আরো মুলাকাতের মওকা দাও তাহলে আমি চলে যাব। আমার বাবাকে বলব, সিওয়াস্তাতে থাকতে থাকতে এক ঘেয়েমী হয়ে উঠেছিলাম তাই কিছুদিন স্পেন ঘুরে এলাম।
শাহী মহলের চতুর্পাশ্বে ঘন গাছ পালা ও পত্র পল্লবে ঘেরা বাগিচা ছিল, তার কোন এলাকা ঘন গাছ-গাছালি ও লতা-গুল্মে একেবারে ঢেকে নিয়েছিল, ফ্লোরিডা হিজিকে এমনই একটা কোনের কথা বলে রাস্তা বাতিয়ে দিল এবং অর্ধেক রাতের পরে যাওয়ার হেদায়েত দিল। কারণ এর পূর্বে বা দিনের বেলা গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
***
বিপদ আশংকা পিছে ফেলে হিজি দ্বিতীয়বার রাতের আঁধারে বাগানের নিঝুম কোণে ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাৎ করল। ফ্লোরিডারও বিপদের শংকা ছিল। বাহিরে থেকে যে সব শাহজাদীরা এসেছিল তাদের প্রতি কড়া নজর রাখা হতো। তারপরও ফ্লোরিডা দু’রাত্র তার কামরা হতে খালী পায়ে বেরিয়ে চোরের মত বাগানে পৌঁছে ছিল। দ্বিতীয় মুলাকাতে ফ্লোরিডা হিজিকে তিন রাত পরে আসতে বলেছিল।
যে দিন রাত্রে হিজির বাগানে যাবার কথা ছিল, সেদিন বাদশাহ রডারিক চার পাঁচ দিনের গায়ের হাজিরীর পর ফিরে এসেছিল। স্পেনের কিছু এলাকাতে বিদ্রোহীয়া মাথা উঁচু করেছিল। বাদশাহ্ রডারিক নিজে সেখানে গিয়ে বিদ্রোহীদের তিন সর্দারের শিরোচ্ছেদ করে এসেছেন। সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুলেন, তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত আবার খুশী কারণ বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার পূর্বেই তা খতম করে দিয়েছে।
বাদশাহ্ ম্লান করে শরাব পানে বসলেন, তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল তিনি খুশীতে ফেটে পড়ছেন এবং তিনি স্থির করতে পারছেন না, খুশী তিনি কিভাবে উদযাপন করবেন। বাদশাহের মনে আনন্দ আনার জন্যে খুশী উদযাপনের জন্যে সাধারণতঃ দুটো জিনিস প্রাধান্য পায়, রমণী ও শরাব। বাদশাহ্ রডারিকের দরবারেও এ দু’জিনিসের কোন কমতি ছিল না। বাদশাহর দরবারে দু’তিন জন হাকীমও তার সাথে পনিরত ছিল।
মায়াবী, নবযৌবনা যে সব লাড়কীরা শরাব পান করাচ্ছিল তাদের দিকে দেখে বাদশাহ্ রডারিক বললেন, “কোন নতুন ফুল আছে? নাক ছিটকিয়ে নিজেই বললেন, নেই… কলি চাই, অর্ধ ফুটিত কলি।”
একজন হাকিম আদবের সাথে মুচকি হেসে বলল,এরাইতো ফুল, যারা স্পেনের বাদশাহর স্বপ্নিল নিলাভ ভূবনে খোশবু ছড়াচ্ছে।
বাদশাহ্ মাতালের সুরে বললেন, না! না! কলি চাই…। হাতে তুড়ি দিয়ে বললেন, ফ্লোরিডা… জুলিয়নের বেটী…।
বাদশাহর এক মুশির বলল, শাহান শাহে উন্দুলুস! বহিরাগত শাহজাদীরা আমাদের কাছে আমানত। তারা আদব-আখলাক শিখতেএসেছে। এখানে আগত শাহজাদীদের সাথে এ নাগাদ মামুলী কৌতুক-উপহাস পর্যন্ত করা হয়নি। এ সুনাম ক্ষুণ্ণ না করাই ভাল।
নিশাতে ঢুলতে ঢুলতে বাদশাহ্ বললেন, হাম উসে উন্দুলুস কা মালেকা বানায়েনগে। তুম সব চল যাও আওর ফ্লোরিডাকো ইহা ভেজ দো।
মুশির বলল, শাহান শাহে মোয়াজ্জম! বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করা এবং মুসিবত থেকে আপনাকে বাঁচান আমার নৈতিক দায়িত্ব। যদিও এ দায়িত্ব আদায় করতে গিয়ে আমাকে প্রাণ দিতে হয়। হতে পারে ক্রোধান্বিত হয়ে আপনারই তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে আমার মাথা বদন থেকে জুদাহ করে দেবে, কিন্তু এতে আমার আত্মা শান্তি পাবে যে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
শাহ্ রডারিক বললেন, কিসের বিপদ? জুলিয়নের পক্ষ হতে আমার ওপর আবার কি মুসীবত আসবে? প্রথমত হতে পারে তার বেটী ফ্লোরিডা আমার স্বপ্নীল ভূবনে রাত্রি যাপনকে বড় সম্মানজনক মনে করবে,দ্বিতীয়তঃ তা যদি না হয় তাহলে সে তার বাপকে বলবে, তারপর জুলিয়ন আমার কি করতে পারবে? দু ইঞ্চি জমিনের মালিক আমাদের বিশটা সোয়ারীর মুকাবেলা করার কাবেল নয়। তার তাকত তো আমি। যদিও সে আরবি ও বর্বরদেরকে সিওয়াস্তাতে বাধা দিয়ে স্পেনের দিকে আসতে দিচ্ছে না তার কারণ তো এটাই যে তার পিঠের ওপর আমার হস্ত রয়েছে। যদি আমার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেই তাহলে আরব ও বর্বর মুসলমানরা তার কেল্লার প্রতিটি ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তার দুই বেটীকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে। আমি যদি তার বেটীকে কিছু সময়ের জন্যে আমার খাবগাহতে অবস্থান করাই তাহলে তার খোশ হওয়া উচিৎ। হতে পারে আমি তার বেটীকে আমার রাণী বানাব।
মুশীর : শাহানশাহে মোয়াজ্জম! আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের তো শুধু দোস্ত পয়দা করা উচিৎ। দোস্তকে দুশমন বানানো উচিৎ নয়।
বাদশাহ্ রডারিক শাহী প্রতাপে বললেন, “তুমি কিছুই বুঝ না, যাও তাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।”
শাহী প্রতাপ ও শরাবের নেশা, দুটো একত্রিত হয়ে রডারিকের মস্তিস্কের ওপর পর্দা ঢেলে দিয়েছিল। ছোট বাচ্চাকে বাবা ডাকলে যেমন খুশী ভরে দৌড়ে আসে ঠিক তেমনিভাবে আনন্দচিত্তে ফ্লোরিডা বাদশাহর খাবমহলে প্রবেশ করল। স্পেনের বাদশাহের আহ্বানকে সে হয়তো নিজের জন্যে মর্যাদাকর মনে করেছিল। কিন্তু সে কামরাতে প্রবেশ করার সাথে সাথে রডারিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
ফ্লোরিডা বের হবার জন্যে বহুত চেষ্টা কোশেশ করল, ক্রন্দন করল, কিন্তু সেতো ছিল এক হিংস্র শক্তিশালী ক্ষুধাতুর হায়েনার থাবাতে। রডারিক কোনদিনও কল্পনা করতে পারেনি যে কোন মেয়ে তাকে এভাবে ভর্ৎসনা করতে পারে যে ভাবে ফ্লোরিডা ঘৃণা ভরে তাকে ভর্ৎসনা করছিল। রডারিক তাকে রাণী বানানোর লোভ দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু ইযযত-আব্রু বিলিয়ে দিয়ে সে রানী হতে রাজী হয়নি।
রডারিক তাকে এ হুমকি দিয়ে ছিল যে, তিনি সিওয়াস্তার ওপর আক্রমণ করে তার বাবাসহ পুরো খান্দানকে টলেডোর অলি-গলিতে ভিক্ষা করতে বাধ্য করবে। ফ্লোরিডা বলেছিল, আসমান-জমিন সর্বত্র যদি আগুন লাগিয়ে দাও তবুও আমি আমার কুমারিত্ব খতম করতে পারব না।
স্পেনের ইতিহাসবেত্তারা সকলে এ ব্যাপারে ঐকমত্য যে ফ্লোরিডা কোন লোভে পড়েনি এমনিভাবে বাদশাহর কোন হুমকি-ধমকিকেও পাত্তা দেয়নি। সে তার কুমারিত্ব ও অনুঢ়ত্বের দোহায় দিচ্ছিল। কিন্তু শাহী প্রতাপ ও শরাব রডারিককে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছিল। ফলে ষোল বছরের লাড়কী তার সতীত্ব ও কুমারিত্বকে হেফাজত করতে পারল না।
***
এটা ছিল রাতের প্রথম পহরের ঘটনা। অর্ধ রজনী অতিবাহিত হতেই হিজি বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শাহী বাগিচার ঐ আঁধার প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল যেখানে সে ইতিপূর্বে দু’বার গিয়েছিল। বাগানের প্রান্ত দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে ঐ জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে পূর্বে ফ্লোরিডার সাথে তার মিলন ঘটেছিল। ফ্লোরিডা তখনও আসেনি। তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা ছায়া মূর্তি ক্রমে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কাছে আসতে আসতে তা এক রমণীল রূপ ধারণ করল। হিজি পূর্বের ন্যায় দু’তিন কদম তার দিকে অগ্রসর হলো কিন্তু ফ্লোরিডার চাল-চলনে বিন্দুমাত্র আবেগ ও আনন্দের ছোঁয়া ছিল না। প্রতিটি মিলন মুহূর্তের ন্যায় এবারও হিজি তার দু’হস্ত প্রসারিতকরে দিল কিন্তু ফ্লোরিডা তার বুকে যাওয়ার পরিবর্তে তা সজোরে সরিয়ে দিয়ে মুছা যাবার ন্যায় ঘাসের ওপর বসে পড়ল।
কি হয়েছে ফ্লোরা! হিজি ঘাবড়িয়ে ভয়ার্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে তার কাছে গিয়ে বসল। নয়ন যুগল অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে ফ্লোরিডা বলল, আমার কাছ থেকে দূরে থাক হিজি! আমার অপবিত্র কায়া স্পর্শ কর না, আমি তোমার উপযুক্ত নই। আমি আমার আত্মসম্মানী বাহাদুর বাবাকেও মুখ দেখানোর আর কাবেল নই। আমি আমার নিজেকেই ভর্ৎসনা করছি।
হিজি কম্পমান স্বরে বলল, কি হয়েছে তা খুলে বলতো ফ্লোরা!
ফ্লোরিডা তাকে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল।
ফ্লোরিডা ফুপাতে ফুপাতে বলল, আমার সতীত্ব-অনুঢ়ত্ব আমার সম্পদ ছিল। আমি নিজেকে কখনো শাহজাদী মনে করিনি। আমার যদি সম্রাজ্ঞী হবার অভিপ্রায় থাকতো তাহলে আমি আমার বাপের চারকের বেটার প্রেম সাগরে অবগাহন করতাম না।
ফ্লোরা! … হিজি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের নিচ থেকে খঞ্জর বের করে বললো, আমি বাদশাহর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব। তাকে হত্যা করে এখান থেকে চলে যাবার কোশেশ করব। যদি ধরাও পড়ি তবুও কোন পরওয়া নেই। তোমার। ইযযতের ওপর আনন্দে জীবন বিলিয়ে দেব।
ফ্লোরিডা তার সম্মুখে দু’হাত সম্প্রসারিত করে বলল, না হিজি! তুমি তার কাছে পৌঁছুতে পারবে না, তার পূর্বেই পাকড়াও হয়ে যাবে। আমি তোমাকে উদ্দেশ্যহীন মৃত্যু গহ্বরে যেতে দেবনা। তুমি এক কাজ কর, কোন বাহানায় সবচেয়ে ভাল অশ্ব নিয়ে প্রত্যূষে শহরের ফটক খুলতেই তুমি বেরিয়ে যাবে। যত দ্রুত যেতে পার যাবে এবং সিওয়াস্তা পৌঁছে আমার বাবাকে এ ঘটনা শুনাবে। তাকে বলবে তিনি এসে যেকোন বাহানায় যেন আমাকে নিয়ে যান। শাহ্ রডারিকের কাছে এমন কিছু যেন প্রকাশ না পায় যাতে সে বুঝতে পারে যে বাবা এ ঘটনা জানে। বাবা যদি রডারিকের সামনে সামান্যতমও গোস্বা প্রকাশ করেন তাহলে এ হতভাগা দুস্কৃতকারী বাদশাহ্ তাকে কতল করে ফেলবে। আর আমাকে আজীবনের জন্যে তার মহলে বন্দি করবে। রডারিক আমাকে গুরুতর হুমকি দিয়েছে। বাবাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে বলবে তা না হলে চিরতরে সিওয়াস্তা হারাতে হবে অধিকন্তু আমাদের খান্দানের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
***
প্রথম দিন যে অবাধ্য ঘোড়া দ্বারা হিজির ইমতেহান নেয়া হয়েছিল, অতি প্রত্যূষে সে ঐ ঘোড়ার ওপরে জিন লাগাল। হিজি তাকে বাহিরে দৌড়ানোর বাহানায় নিয়ে গেল। কেল্লার ফটক খুলাছিল। কেল্লা থেকে বের হয়েই সে ঘোড়াকে পদাঘাত করল, ঘোড়া হাওয়ার তালে ছুটে চলল, তার সামনে টলেডো থেকে সমুদ্র পর্যন্ত (যেখানে জাবালুত ত্বারে অবস্থিত) পাঁচশত মাইলের রাস্তা। এত পরিমাণ রাস্তা দৌড়ে অতিক্রম করা ঘোড়ার জন্যে অতীব কষ্ট সাধ্য। তারপরও গোয়েন্দার হাত থেকে বাঁচার জন্যে হিজি পূর্ণ দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ছিল।
অনেক দূর যাবার পর এক নদীর কুলে ঘোড়া থামিয়ে ঘোড়াকে পানি পান করাল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করার পর হিজি সাধারণ গতিতে ঘোড়া ছুটাল। রাতেও সে অবিরাম গতিতে সফর করছিল। যৎ সামান্য আরাম করা ছাড়া সারাক্ষণ, সফর করার ফলে দীর্ঘ পাঁচশত মাইল রাস্তা মাত্র চার দিনে অতিক্রম করল।
সম্মুখে সমুদ্র। সিওয়াস্তা যাবার জন্যে কোন কিশতী তৈরী নয়। দু’তিন দিনের মধ্যে কোন কিশতী সে দিকে যাবার ছিল না। এক পাল তোলা নৌকার মাঝিরা হিজিকে একা নিয়ে যাবার জন্যে এত পরিমাণ পয়সা দাবি করল যা তার কাছে ছিল না।
হিজি নৌকার মাল্লাদের উদ্দেশ্যে বলল, এ ঘোড়া তোমাদের কিশতীর চেয়ে অনেক কিমতী। এটা তোমরা রেখে দিয়ে আমাকে সিওয়াস্তার সীমানায় পৌঁছে দাও।
মাল্লা : আমরা মাঝি-মাল্লা। আমরা ঘোড়া কি করব। আমাদের নিজের ও ছেলে-পুলের পেটের অন্ন যুগাতেই আমরা অক্ষম। ঘোড়াকে খিলাব কোথা থেকে?
হিজিঃ এটা বিক্রি করে তোমরা তোমাদের পয়সা নিয়ে নিবে।
মাল্লা : আমরা ঘোড়ার সওদাগীরি সম্পর্কে ওয়াকিফ নই।
হিজি : তাহলে আমাকে বিশ্বাস কর। আমাকে নিয়ে চল, ওপার গিয়ে কেরায়ার পয়সাও দেব সাথে ইনয়ামও পাবে।
মাঝিরা তার সেকেল-ছুরত, শরীরের কাঠাম, পোষাক-পরিচ্ছেদ ও ঘোড়া দেখে তাকে অফিসার মনে করল ফলে ঘোড়াসহ তাকে কিশতিতে তুলে নৌকার পাল তুলে দিল।
সমুদ্র সফর ছিল বার মাইল। সূর্য মনি রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় হিজির কিশতী সিওয়াস্তার তীরে গিয়ে ভীড়ল। হিজি মাল্লাদেরকে সাথে নিয়ে সোজা জুলিয়নের মহলে পৌঁছে ফটকের সিপাহীকে বলল, গভর্নর জুলিয়নকে অতি দ্রুত গিয়ে বল, আমি টলেড়ো হতে শাহ্জাদী ফ্লোরিডার জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছি।
জুলিয়ন তাকে তাৎক্ষণিক আহ্বান করল, কারণ সে তার বেটীর খবরের জন্যে বেকারার ছিল।
***
জুলিয়ন তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল তুমি ফৌরইয়ারকের বেটা না?
হিজি : হ্যাঁ গভর্নর! আমি তার বেটা।
জুলিয়ন : তুমি কি টলেডো থেকে এসেছ? তোমার বাবাকে না বলে চলে গিয়েছিলে?
হিজি : জি হ্যাঁ। এখানে একঘেঁয়েমী লাগছিল তাই স্পেন সফরে বেরিয়ে ছিলাম। তবে মুহতারাম গভর্নর! আমার গায়েব হয়ে যাওয়া বা ফিরে আসা এটা আপনার জন্যে কোন জরুরী বিষয় নয়। আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি সেটা খুবই জরুরী। আগে একটা আবেদন শুনুন। আমি যে কিশতীতে এসেছি তার কেরায়া দিতে পারিনি, মাল্লা সাথে এসেছে, তাকে কেরায়া দিতে হবে।
জুলিয়ন কেরায়া ও ইনয়াম দেয়ার হুকুম দিয়ে হিজিকে জিজ্ঞেস করল, তার বেটী কি পয়গাম পাঠিয়েছে।
হিজি পয়গাম শুনানোর সাথে সাথে জুলিয়ন উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তার সারা শরীরের খুন যেন চেহারা ও চোখে জমা হয়ে গেল। সে ক্রোধ ও ক্ষোভে কামরার মাঝে দ্রুত পায়চারী করতে লাগল।
হিজি : শাহ্জাদীর সাথে ইত্তেফাঁকান আমার মুলাকাত হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে এ ঘটনা শুনানোর পর আমি বাদশাহ্ রডারিককে হত্যার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু শাহ্জাদী আমাকে এই বলে বাধা দিল যে, আমি তার কাছে পৌঁছতে পারব না গ্রেফতার হয়ে যাব। আমি সেখানের শাহী আস্তাবলের ঘোড়া চুরি করে এ নাগাদ এসেছি।
জুলিয়ন : শাহজাদী ঠিক বলেছিল, এ বাদশাহকে হত্যা করা মুশকিল নয়। আমি তার প্রতিশোধ নেব, তুমি যাও।
জুলিয়ন তার এলাকার বাদশাহ ছিল যদিও তার এলাকা ছোট ছিল এবং সে স্পেনের বাদশাহ্ রডারিকের জায়গীরদার ছিল তবুও তার অবস্থান বাদশাহর মত ছিল। ফলে সে একজন চাকরের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা-পর্যালোচনা সমীচীন মনে করছিল না। সে হিজির জন্যে কিছু ইনয়াম পেশ করল।
হিজি : না জনাব! ইনয়াম কোন কৃতিত্বের জন্যে? আমাকে অনুমতি দিন আমি স্পেন গিয়ে বাদশাহ রডারিকের হত্যার মওকা তালাশ করব। আমার খান্দান আপনার নিমক খেয়েছে। আমি সে নিমক হালাল করতে চাই। আপনার ইযযত আমাদের ইযযত।
জুলিয়ন : হিজি! তুমি যাও। আগে আমাকে চিন্তা করতে দাও। তুমি চিন্তা ফিকির না করে এবং আমাকে কিছু না বলে কিছুই করবে না।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, জুলিয়নের মত জায়গীরদাররা রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহকে খুশী করার জন্যে স্বীয় ললনাদের দিয়ে দিত কিন্তু জুলিয়ন আত্মমর্যাদাশীল ছিল ফলে তার বেটীর সতীত্ব হরণ তাকে পাগল বানিয়ে দিল। সে সাথে সাথে টলেডো থেকে নিজ কন্যা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল।
সকল ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মুতাবেক জুলিয়ন কিছু তুহফা নিয়ে টলেডোতে গিয়ে বাদশাহ রডারিকের সাথে এমন নিষ্ঠা ও প্রীতির সাথে সাক্ষাৎ করল, যেন সে তার মেয়ের ইযযত হরণের ব্যাপারে কিছুই জ্ঞাত নয়। সে তার আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তা এমনভাবে পেশ করল যে বাদশাহর মঙ্গলকামী হয়ে তার হাল অবস্থা জানার জন্যে সাক্ষাৎ করতে এসেছে।
বাদশাহ্ রডারিক যখন বুঝতে পারলেন, জুলিয়ন তার মেয়ের ব্যাপারে কিছুই অবগত নয় তখন সে জুলিয়নের মত ছোট ছোট জায়গীরদারদের সাথে যে ব্যবহার ও সম্মান করে তার চেয়ে অনেক বেশী সম্মান ও ইযযত জুলিয়নকে করলেন, তার সম্মানে বাদশাহ্ (অনেক বড়) বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন যাতে নৃত্য ও সংগীতের ব্যবস্থা ছিল। সে অনুষ্ঠানে ফ্লোরিডা তার বাবার সাথে বসে রডারিক তার সাথে কি আচরণ করেছেন এবং তাকে হুমকি দিয়েছেন তা বর্ণনা করল।
জুলিয়ন : আমাদের আস্তাবলের হাকীম ফৌরইয়াডরকের বেটা হিজি তোমার ঘটনা বিস্তারিতভাবে আমার কাছে বর্ণনা করেছে। রডারিকের সামনে আমি নাজানার ভান করেছি। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি তার পর এমন প্রতিশোধ নেব যাতে তার শাহী মসনদ মাটির সাথে মিশে যাবে।
পরের দিন বাদশাহ রডারিক জুলিয়ন তার দরবারে আসার দরুন তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করলেন এবং নিয়ান্তার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করলেন।
রডারিক জুলিয়নকে জিজ্ঞেস করলেন, মুসলমানরা পরে মনে হয় সিওয়াস্তার ওপর হামলার হিম্মত করেনি?
জুলিয়ন : না। সিওয়স্তার কেল্লার মজবুত দেয়ালে মাথা টুকে টুকে মস্তকচূর্ণ করে ফেলেছে। তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে সিওয়াস্তার ওপর স্পেনের মহারাজের অপাজেয় যুদ্ধ শক্তির ছায়া রয়েছে। এখন তারা সিওয়াস্তার দিকে ফিরে তাকাতেও সাহস পায় না।
রডারিক : তোমার বেটী ফ্লোরিডা কেবল খুবসুরতই নয় দানেশমন্দ ও বাহাদুরও বটে। তাকে কোন সাধারণ ব্যক্তির কাছে অর্পণ করো না। আমি তার তরবিয়তে খুবই মুগ্ধ।
এটা আমার বড়ই সৌভাগ্য। জুলিয়ন গোলামের মত বলল, কিছু দিনের জন্যে ফ্লোরিডাকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
রডারিক : না নিয়ে যাওয়াই ভাল।
জুলিয়ন মিথ্যে বলল, তার মা ভীষণ বিমার হয়ে পড়েছে। সেই আমাকে পাঠিয়েছে। বলছিল, দু’তিন দিনের জন্যে ফ্লোরিডাকে নিয়ে আস, মায়ের স্নেহ মহব্বত আমি লুকিয়ে রাখতে পারছিনে। দু’তিন পরে আবার বেটীকে পাঠিয়ে দেব।
রডারিক শান্তনার শ্বাস নিয়ে বললেন, পাঠিয়ে দেবে! তাহলে নিয়ে যাও।
স্বয়ং ফ্লোরিডা বলছিল সে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চায়। জুলিয়ন আবার মিথ্যে বলল।
রডারিক : তোমার বেটী অবশ্যই ফিরে আসতে চাবে।
ঐতিহাসিকরা জুলিয়ন ও রডারিকের এক মজাদার আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন।
রডারিক : আচ্ছা জুলিয়ন! তোমাদের এলাকায়তত ভাল বাজ পাখি পাওয়া যায়, শিকারের জন্যে আমার বাজ পাখী দরকার।
জুলিয়ন : হ্যাঁ শাহানশাহে উন্দুলুস! আমি আপনার জন্যে এমন বাজ পাঠাব যা ইতিপূর্বে আপনি দেখেননি। তা শিকারের প্রতি এমনভাবে ধাবিত হয় যে তাকে বাঁচার কোন অবকাশ দেয় না।
জুলিয়নের একথা যে ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা বলেন, এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে জুলিয়ন সে সময়ই স্থির করেছিল যে, রডারিকের প্রতিশোধের জন্যে স্পেনের উপর হামলার ব্যাপারে মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে।
জুলিয়ন ফ্লোরিড়াকে সিওয়াস্তাতে নিয়ে এলো এবং পরের দিনই মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে সাক্ষাতের জন্যে বেরিয়ে পড়ল।
***
মুসা ইবনে নুসাইর সতর্কতা অবলম্বনকে খুব জরুরী মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, এক খ্রীষ্টান বাদশাহ্ অপর খ্রীষ্টান বাদশাহর ওপর মুসলমান দ্বারা আক্রমণ করাবে। তিনি ভাবছিলেন, এটা কোন ফন্দি হতে পারে। এ কারণে তিনি জুলিয়নকে কোন শান্তনা দায়ক জওয়াব দিচ্ছিলেন না।
জুলিয়ন : আপনি বিশ্বাস না করেন তাহলে আমার বেটী ফ্লোরিডাকে উপস্থিত করব, আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন।
মুসা : আমি হিজি নামের ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে চাই, তাকে আমার কাসেদ নিয়ে আসবে। আসার আগ পর্যন্ত তুমি তোমার সাথে আগত অফিসারসহ আমার মেহমান হিসেবে থাকবে।
সে মুহূর্তেই একজন কাসেদ হিজিকে আনার জন্যে সিওয়াস্তা পাঠিয়ে দেয়া হলো। সে সময় জুলিয়ন মুসা ইবনে নুসাইরকে স্পেন ও রডারিক সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিল, যা আজও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
জুলিয়ন : মুসা! রডারিকের ব্যাপারে দুশমনি আমার অন্তরে আজ নতুন সৃষ্টি হয়নি। এ দুশমনি অনেক পুরাতন। তুমি হয়তো জান স্পেনে গোথাদের রাজত্ব ছিল। রডারিক ছিল স্পেন ফৌজের সিপাহসালার। ডেজা নামের এক গোথা ছিল স্পেনের বাদশাহ্। সে সৃষ্টিগতভাবে নেক ইনসান ছিল। পাদ্রীরা ধর্মের আড়ালে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ জমা করে বিলাস বহুল জীবন যাপন করছিল। গীর্জা পরিণত হয়েছিল পাপের আড্ডা খানায়…
আর মূসা! পোপদের নির্দেশে সবকিছু হতো। পাদ্রীরা নিজ ইচ্ছেমত চলা ফেরা করত। যেহেতু তারা ধর্মগুরু ছিল এ কারণে সাধারণ ফৌজ ও জনগণ তাদেরকে সম্মান করত। বাদশাহও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতেন। জীবন ব্যবস্থা এমন ছিল যে ধনী দিন বদিন ধনের পাহাড় গড়ে তুলছিল আর দরিদ্র ক্রমে হচ্ছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। প্রজারা মূলতঃ ছিল শাহী খান্দানের গোলাম। শ্রমিকদেরকে বেগার খাটান হতো বা একেবারে যৎসামান্য পারিশ্রমিক দেয়া হতো। জনসাধারণের জন্যে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত ছিল যা সামান্যতম অপরাধেই প্রয়োগ করা হতো। জনগণের ওপর এত পরিমাণ কর আরোপ করা হয়েছিল যুদ্বরুণ তারা ক্ষুধার্ত দিন গুজরাত, অপর দিকে জনতার পয়সায় শাহী খাজানা ভরে উঠত। সে সম্পদ শাহী খান্দানের বিলাসীতা ও আরাম-আয়েশের পিছনে হতো ব্যয়।
ডেজা তখত নাসীন হলেন, আমার বিবি তারই বেটী। ডেজার অন্তরে ধর্মের ইহতেরাম ও আওয়ামের মহব্বত ছিল। তিনি তখত নাসীন হয়েই গীর্জা ও পাদ্রীদের প্রতি দৃষ্টি দিলেন। গীর্জাকে পাপের আড্ডা থেকে মুক্ত করলেন। তারপর তিনি নজর দিলেন ঐ সকল রাঘব বোয়ালদের দিকে যারা আওয়ামকে ভুখা-নাংগা রেখে তাবৎ সম্পদ জমা করত নিজ উদরে। তিনি সাধারণ জনতার ওপর থেকে কর উঠিয়ে তা আরোপ করলেন ধনীদের ওপর। তিনি সম্পদশালীদের সম্পদের পুংখানুপুংখ হিসেব-নিকেস করে নতুনভাবে তার উপর ট্যাক্স আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করে ছিলেন। এভাবে ক্রমে সাধারণ জনগণের মাঝে শান্তি ফিরে আসছিল।…..
ধর্মগুরু, আমীর ওমারা, জায়গীরদার যে সম্পদ আম জনতাকে শোষণ করে জমা করেছে তা আবার তাদের হাতে ফিরে যাবে এটা মেনে নেয়া তাদের জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল, তাই পাদ্রীরা এক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে ফৌজের মাঝে এ প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলল যে বাদশাহ্ ডেজা ধর্মের ব্যাপারে নাক গলিয়ে ধর্মগুরুদেরকে স্বীয় গোলাম বানানোর চেষ্টা করছে। ফৌজ বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল, আর সে বিদ্রোহীদের নেতা ছিল রডারিক। ডেজার ওফাদার ফৌজ খুব স্বল্পই রইল, যারা রইল তারা বিদ্রোহীদের সাথে বেশীক্ষণ যুদ্ধ করতে পারল না। বিদ্রোহীরা বিজয়ার্জন করল। পাদ্রীরা রডারিককে শাহী মসনদে সমাসীন করল। সে মসনদে বসেই ডেজাকে কতল করার নির্দেশ দিল। সুতরাং তাকে কতল করা হল। তারপর আমীর ওমারা, শাহী খান্দান ও জায়গীরদার আবার বিলাসীতায় ডুবে গেল……
মুসা! আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি তুমি যদি স্পেন আক্রমণ কর তাহলে সেখানে সাধারণ জনগণ তাদের বিলাসী ও জালেম বাদশাহ্ এবং জেনারেলদেরকে ত্যাগ করবে। হতে পারে ফৌজও হয়তো রডারিকের ডাকে সাড়া দিবে না। তোমার ফৌজ যদি স্পৃহা-উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করে তাহলে স্পেন সৈন্য অতিদ্রুত ময়দান হতে পলায়নপদ হবে।
এ নাগাদ মুসা ইবনে নুসাইর তাকে কোন ফায়সালা শুনাননি।
***
চার-পাঁচদিন পর হিজি মুসার কাসেদের সাথে এসে পৌঁছল। সম্মানিত মেহমানের ন্যায় তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে মুসার কাছে পৌঁছে দেয়া হল। ফ্লোরিডার সাথে যে হিজির পাগলপারা প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে সে কথা হিজি ফ্লোরিডার বাবাকে বলেনি। ফ্লোরিডার বিরহে সে যে উম্মাদ হয়ে চুপিসারে সংগোপনে টলেডো গিয়েছিল সে কথাও প্রকাশ করেনি। সে জুলিয়নকে বলেছিল সিওয়াস্তার পরিবেশ এক ঘেয়েমী হয়ে উঠেছিল তাই সে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। ফ্লোরিডার সাথে তার প্রেম, মুলাকাত, তার বিরহে অস্থির হয়ে টলেডো গমন, সেখানে ফ্লোরিডার সাথে একান্তে মিলন এবং ফ্লোরিডার প্রতি রডারিকের বাড়াবাড়ি, তাবৎ দাস্তান হিজি মুসার কাছে বর্ণনা দিল। যার বর্ণনা পূর্বে দেয়া হয়েছে।
মুসা হিজিকে নানা বিষয়ে সওয়াল করলেন, হিজি হার সওয়ালের জওয়াব দিল। সওয়াল-জওয়াবের মাধ্যমে মুসা তার সকল শক-সুবাহ্ দূর করে হিজিকে মেহমান খানায় পাঠিয়ে দিয়ে জুলিয়নকে তলব করলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর; মেরে ভাই জুলিয়ন! আমি তোমার প্রতিটি কথা ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার আবেদনের প্রতি গভীরভাবে চিন্তা-ফিকির করেছি। সালার, হাকীম ও মুসিরদের সাথে সলাপরামর্শ করেছি। তোমাকে পূর্ণ মাত্রায় বিশ্বাস করছি তবে এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফায়সালা গ্রহণের ব্যাপারে আমি স্বক্ৰীয় নই। স্পেন কোন ছোট-খাটো মুলুক নয় তেমনিভাবে তার ফৌজও কোন মামুলী ফৌজ নয়। আমি খলীফার থেকে ইয়াজত তলব করব, আজই খলীফার কাছে পয়গাম দিয়ে কাসেদ দামেস্কে পাঠাব। তোমাকে খলীফার জওয়াবের ইনতেজার করতে হবে। কাসেদ, অত্যন্ত দ্রুত গতি সম্পন্ন হবে আর যে দীর্ঘ সফর….. এক মাস তো। লাগবেই….. কাসেদ হয়তো দু’চার দিন আগেও ফিরে আসতে পারে। তুমি এখন ফিরে যাও, পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন পরে এসো বা আমিই তোমাকে খবর দিয়ে তলব করব।
মুসা জুলিয়নকে রসুত করে কাতেবকে ডেকে খলীফার কাছে এক দীর্ঘ পয়গাম লেখালেন। জুলিয়নের অভিপ্রায়ের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন। সে সময় খেলাফতের মসনদে সমাসীন ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক যিনি যথার্থ অর্থে ছিলেন একজন মর্দে মুমিন। ইসলামের মায়াবী বাণী সমুদ্রের ওপারে পৌঁছানোর জন্যে তিনি ছিলেন পাগল পারা। সে সময়ই তিনি মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থান পাঠিয়ে ছিলেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিলেন তার ডান হস্ত।
মুসা জুলিয়নের তামাম কথা উল্লেখ করার পর লেখলেন,
জুলিয়ন তো ঘটনাক্রমে আমাদের থলীতে এসেছে, আমি আমার অন্তরের কথা বলছি, আমার নয়নযুগল আজ দীর্ঘদিন স্পেনের প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে। ইসলামের পয়গাম মিসর ও আফ্রিকার সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কয়েকবার সীমান্তে দাঁড়িয়ে স্পেনের দিকে লক্ষ্য করেছি এবং সমুদ্রের বুকচিরে তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছি…..।
ইদানিং এক খ্রীষ্টান গভর্নর সাহায্যের প্রস্তাব করেছে ফলে আপনি সবদিক বিবেচনা করে আমাকে স্পেন অভিমুখে অগ্রসর হবার অনুমতি দিবেন। আরেকটা বিষয়ে আপনি ফিকির করবেন, তাহলে আমার কাছে যে ফৌজ রয়েছে তারা। সকলেই প্রায় বর্বর। বর্বররা খুনখার কওম। তাদের ফৌজকে আমি নিয়ম-শৃংখলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছি কিন্তু তারা স্থিরভাবে বসার লোক নয়। তাদেরকে বেশীদিন নিয়ম-শৃংখলার রশিতে বেধে রাখা যায় না। তাদেরকে যদি বেশীদিন বেকার রাখা হয় তারা পরস্পরে লড়াই শুরু করবে অথবা নিয়ম কানুনের ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এমনকি ইসলামের ব্যাপারেও বিদ্রোহ করতে পারে।
খলীফাতুল মুসলিমীন! আমি তাদেরকে সিওয়াস্তার ওপর হামলা, অবরোধ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত রেখেছিলাম কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো তাও বন্ধ। এখন জরুরী তাদেরকে কোন একটা যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাওয়া যাতে তারা যুদ্ধ বিগ্রহের নেশা মিটাতে পারে। তাছাড়া আরেকটা কারণ রয়েছে, তাদের পূর্ণ মুমিন ও মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে বড় প্রয়োজন স্পেন অভিমুখে রওনা করা, যাতে তারা কুফরস্থানে গিয়ে বিজয় অর্জন করে ইসলামের চির সুন্দর মহিমা প্রচার। প্রসার করবে, ফলে ক্রমে ইসলাম তাদের শিরা-উপশিরা ও অন্তরের গভীরতম প্রদেশে স্থান করে নিবে।
***
কাসেদ অনেকদিন পর খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের জওয়াব নিয়ে ফিরে এলো। জওয়াব ইতিবাচক ছিল। তবে খলীফা খুব তাগিদ দিয়ে লেখেছেন সতর্কতাবলম্বন খুবই জরুরী। যেসব লোক ইসলামের গন্ডির বাইরে তাদের ওপর পূর্ণ ভরসা ও বিশ্বাস করা শংকা মুক্ত নয়। সতর্কতার ব্যাপারে খলীফা লৈখেছেন, জুলিয়নকে ভালভাবে ইমতেহান করার জন্যে, যদি সে ইমতেহানে কামিয়াব হয় তাহলে দামেস্কে খবর দিবে এখান থেকে প্রয়োজনীয় ফৌজ ও সামানাদি পাঠান হবে।
মুসা ইবনে নুসাইর খলীফার জওয়াব পরামর্শ সভাতে পড়ে শুনিয়ে সকলের থেকে মশওরা তলব করলেন। আরবদের মেধা-ধীশক্তি সর্বজন স্বীকৃত। কিছুক্ষণ আলোচনা-পর্যালোচনার পর জুলিয়নকে পরীক্ষা করার একটা পদ্ধতি তারা করলেন। জুলিয়নকে আসার পয়গাম দেয়ার জন্যে একজন দূত সিওয়াস্তা পাঠিয়ে দেয়া হল।
জুলিয়নতো এ পয়গামের অপেক্ষাতেই ছিল। পয়গাম পাওয়া মাত্র রওয়ানার জন্যে প্রস্তুত হল। সিওয়াস্তাতে অবস্থানরত ডেজার ভাই আওপাসকে সাথে নিল। তাদের সাথে সৈন্যবাহিনীর এক বড় অফিসার ও একশত জনের এক নিরাপত্তা বাহিনী ছিল।
এ শাহী কাফেলা সফর শেষে মুসার রাজধানী কায়রোতে পৌঁছার পর জুলিয়ন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মুসার সাথে সাক্ষাৎ করে। ইতিহাস প্রমাণ করে ঐ মুলাকাতে ডেজার ভাই আওপাস ও জুলিয়নের সৈন্য বাহিনীর সিনিয়র অফিসারও ছিল। এটা। একটা ঐতিহাসিক মুলাকাত ছিল। এ মুলাকাতের মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্যে স্পেনের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
মুসা ইবনে নুসাইর : মেরে ভাই জুলিয়ন! দামেস্ক থেকে ইযাজত এসেছে তবে এ শর্তে যে, তোমাকে এটা প্রমাণ করতে হবে, বাদশাহ্ রডারিকের সাথে তোমার এমন দুশমনি রয়েছে, পরিবেশ যতই অনুকূলে আসুক সে দুশমনি খতম করে তাকে তুমি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না।
জুলিয়ন : তা প্রমাণ করার জন্যে কোন তরীকা তুমিই বলে দাও। আমি তো প্রহর গুনছি। ঐ হতভাগা রডারিক থেকে আমার বেইযতির প্রতিশোধ কবে গ্রহণ করব।
আওপাস : আমীরে মুহতারাম! আমার ঐ ভাইয়ের রূহ আমাকে রাত্রে ঘুমাতে দেয় না যার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করে তার বাদশাহী মসনদ তছনছ করে নিজে শাহী তখতে বসেছে আর আমার ভাইকে করিয়েছে হত্যা। এখন সে আবার আমাদের খান্দানের ওপর কালিমা লেপন করেছে। আমাদের পরিস্থিতির স্বীকার যদি আপনি হতেন তাহলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে একদিন অপেক্ষা করাও আপনার। পক্ষে সম্ভব হতো না। আর যদি আপনার মত বিপুল সংখ্যক ফৌজ আমাদের থাকত তাহলে মদদের ভিখ মাগার জন্যে আপনার দ্বারে আসতাম না।
মুসা : আর ইন্তেজার করব না। জুলিয়ন! এক কাজ কর, তোমার সৈন্য সামন্ত্র নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে রাতের আঁধারে স্পেনের সীমান্তবর্তী কোন এলাকা আক্রমণ কর এবং স্পেনের ফৌজী বাহিনী আসার পূর্বেই ফিরে আস। এটা একটা প্রমাণ হবে যদ্বারা আমি বুঝতে পারব, সত্যিই তুমি রডারিককে দুশমন জ্ঞান কর। আমি তোমার প্রতিশোধ স্পৃহা দেখতে চাই।
জুলিয়ন : আর সেখানে যদি তাদের বিপুল সংখ্যক ফৌজের সাথে মুকাবালা হয় বা আমার ফৌজ যদি কোন বিপদে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি কি হবে?
মুসা : তোমাকে বিপদের সম্মুখীন হতে দেব না, আমার ফৌজী বাহিনী সমুদ্র। পাড়ে অবস্থান করবে। আমি পয়গাম পৌঁছার এমন ইন্তেজাম করব যদি তোমার সৈন্য কোন বিপদের সম্মুখীন হয় তাহলে ফাওরান আমি সংবাদ পাব ফলে আমার ফৌজ তোমার মদদে পৌঁছে যাবে।
জুলিয়ন ও আওপাস ফাওরান রেজামন্দি জহের করল এবং মুসার সাথে পরামর্শ করে স্পেনের এক সীমান্তবর্তী এলাকার ওপর হামলার প্লান তৈরি করে তারা দুজন তখনই সিওয়াস্তা অভিমুখে রওনা হয়ে গেল।
মুসা ইবনে নুসাইর জেনারেল আবু জুরয়া তুরাইফ ইবনে মালেক আল-মুয়াফিরী এর নেতৃত্বে একদল ফৌজকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, তারা যেন সিওয়াস্তার উপকণ্ঠে গিয়ে তাবু ফেলে অবস্থান করতে থাকে। তার পর জুলিয়ন যখন তার ফৌজ, স্পেনের দিকে প্রেরণ করবে তখন আবু তুরাইফ তার ফৌজ প্রস্তুত করে সিওয়াস্তার সীমানা পাড়ে গিয়ে পৌঁছুবে।
সালার তুরাইফ যখন তার ফৌজ সহ সিওয়াস্তার নিকটে পৌঁছুলেন তখন জুলিয়ন কেল্লা হতে বেরিয়ে এসে তাকে শাহী ইস্তেকবাল করে নিবেদন করল তিনি যেন কেল্লার অভ্যন্তরে তার কামরাতে একা অবস্থান করেন।
সালার তুরাইফ : নওয়াব জুলিয়ন! আমাদের একজন জেনারেল সে নিজেকে তার একজন মামুলী ফৌজের চেয়ে বেশি মর্যাদাবান মনে করেনা, তাই তার পৃথক কামরাতে অবস্থান করার কোন প্রয়োজন নেই। যুদ্ধের ময়দানে সালার আর সিপাহী সমান। আমাদের ধর্ম উঁচু-নিচু মানে না। আপনি যদি আমাদেরকে নামাজ পড়তে দেখেন তাহলে নির্ণয় করতে পারবেন না, কাতার বন্দিভাবে দাঁড়ান সে মুসলমানদের মাঝে কে সেনাপতি আর কে সিপাহী। এমনও হয় যে আমাদের সিপাহীরা আগে আর আমরা থাকি পিছনে। তবে ইমামতি করার সৌভাগ্য লাভ করে সেনাপতি।
জুলিয়ন অত্যন্ত আবেগের সাথে বলল, আপনি স্পেন বিজয় করবেন, আপনি যা বর্ণনা করলেন সেটাই ইসলামের মৌল শক্তি। আমাদের সেনাপতি সিপাহীকে নিজের গোলাম মনে করে….. তারপরও আমার মহলের দরজা আপনার জন্যে উন্মুক্ত।
অতঃপর একদিন সে রজনী সমাগত হলো যে রজনীতে জুলিয়নের ফৌজ সিওয়াস্তার সমুদ্র তীর হতে পাল তোলা কাশতীতে সোয়ার হচ্ছিল অপর দিকে সালার তুরাইফের সৈন্যদল সমুদ্রকুলে পৌঁছে গিয়ে ছিল।
***
সমুদ্র সফর মাত্র বার মাইল ছিল। জুলিয়নের যুদ্ধ নৌকার মাল্লারা ছিল অত্যন্ত অভিজ্ঞ। সমুদ্র পূর্ণ শান্ত, বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল অনুকূলে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই জুলিয়নের সৈন্যবাহিনী স্পেন তীরে পৌঁছে গিয়ে ছিল। কামান ছিল আওপাসের হাতে।
জুলিয়ন ছিল সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে। তার সাথে ছিল বিবি ও দুই বেটী ফ্লোরিডা ও মেরী। ফৌজ রওনা হওয়া পর্যন্ত ফ্লোরিডা বাবার কাছে একটা বিষয় বারবার উত্থাপন করছিল। সে পুরুষের লেবাস পরে ফৌজের সাথে স্পেন যাবার জন্যে জিদ ধরেছিল। সে তার বাবার লেবাস বের করে এনেছিল। ঢাল-তলোয়ার নিয়ে পূর্ণ। প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ন তাকে যাবার অনুমতি দিচ্ছিল না, মা-ও বাধা দিচ্ছিলেন।
ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলছিল, “আমি কি শাহ্ সোয়ার নই? বর্শা-তলোয়ার আমি কি চালাতে পারি না? আমার নিক্ষিপ্ত তীর কি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়?”
বাবা-মা তাকে বলছিলেন, তুমি সবকিছু ঠিকমত জান কিন্তু দুশমন যখন তলোয়ার-বর্শা নিয়ে সম্মুখে আসে তখন নিজের তলোয়ার বর্শা ঠিকমত চালনা করা মুশকিল হয়ে যায় এবং নিক্ষিপ্ত তীর তখন লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে থাকে। লড়না আওর মরনা এ দু’ননা মর্দোকা কাম হায়।
ফ্লোরিডা : বেআব্রু আমি হয়েছি, তাই স্পেনের ওপর প্রথম আক্রমণে অন্তত আমাকে শরীক হতে দিন।
বাবা তাকে এ ওয়াদা দিয়ে বিরত রাখলেন যে, মুসলমানরা স্পেন আক্রমণ করে যখন রডারিককে পরাজিত করবে তখন সে মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে আবেদন করবেন রডারিককে জীবিত গ্রেফতার করে ফ্লোরিডার কাছে ন্যাস্ত করার জন্যে যাতে সে তাকে হত্যা করতে পারে।
ফ্লোরিডা শান্ত হয়েছিল এবং ফৌজকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্যে বাবার। সাথে সমুদ্র কুলে পৌঁছে ছিল, যেখানে সে মুসলমান সালার আবু জুরয়া তুরাইফকে দেখতে পেল। বাবা তাকে সে সালারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারপর, ফ্লোরিডা তুরাইফের পিছনে লাগল সে যেন তার বাবার থেকে ফৌজের সাথে যাবার অনুমতি নিয়ে দেন।
সালার তুরাইফ : তোমার বাবা যদিও তোমাকে যাবার ইযাজত দেন কিন্তু আমি তোমাকে ইযাজত দেব না। আমরা আওরতের ইযযত-আব্রুর হেফাজতের, জন্যে জীবন উৎসর্গ করি সেখানে আওরতকে কিভাবে দুশমনের সামনে ময়দানে পাঠাই?
***
অর্ধ রাত্র অতিবাহিত হয়ে গেছে। স্পেনের দক্ষিণ তীরে মিদান পল্লীর লোক গভীর ঘুমে অচেতন। তীরে ফৌজি চৌকীর ফৌজরাও নিদ্রাপুরীতে বিচরণ করছে। যে সকল সান্ত্রীদের পাহারা তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। তাদের কোন আশংকা ছিল না। তারা জানত, সিওয়াস্তা স্পেনের প্রবেশ দ্বার আর সেখানে রয়েছে মজবুত কেল্লা ও জুলিয়নের ফৌজ।
আশংকা মুসলমানদের ছিল। তারা সিওয়াস্তার রাস্তা ছেড়ে কোন দূরবর্তী তীর ঘেষে আসতে পারত কিন্তু আরবদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল তারা নৌযান সম্পর্কে ও সমুদ্র যুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়। প্রকৃত ঘটনাও, এমনই ছিল। কারণ সে সময় ইসলামের প্রাথমিক যুগ। ৯২ হিজরী সন। সে সময় নাগাদ আরবরা সমুদ্র যুদ্ধের মওকা পায়নি।
স্পেনের সমুদ্রতীরবর্তী ফৌজ বেফিকির ছিল। জুলিয়নের কিশতীগুলো মিদান পল্লী থেকে কিছুটা দূরে আসল। হুকুম মুতাবেক ফৌজ অতি খামুশীর সাথে কিশতী থেকে অবতরন করল। তাদের কমান্ডার আওপাস জানত কোথায় কোথায় চৌকি রয়েছে। তিনি তার ফৌজকে বিভিন্ন দলে বিভিক্ত করে দ্রুত হামলার হুকুম দিলেন।
প্রহরীরা বুঝতে পারল তাদের দিকে ছায়া মুর্তি আসছে কিন্তু কারা আসছে তা বুঝে উঠার পূর্বেই মহাপ্রলয় তাদেরকে গ্রাস করল। চৌকিতে শায়িত ফৌজ নিদ্রা থেকে উঠার কোন মহলত পেল না, পরপারে পাড়ি জমাল। অনেকদূর পর্যন্ত চৌকি বিস্তৃত ছিল প্রভাত রবি উঁকি দেবার পূর্বেই তা বিলকুল সাফ করে ফেলা হল। তাদের একজনও পলায়ন করে খবর দেয়ার অবকাশ পেল না যে, তাদের ওপর হামলা হয়েছে।
সকাল হতে না হতেই জুলিয়নের ফৌজ দুতিনটি বস্তিতে ঢুকে পড়ল। হুকুম মুতাবেক ফৌজ লুটতরাজ শুরু করে দিল। জুলিয়ন নির্দেশ দিয়ে ছিলেন কোন গির্জা যেন দাঁড়িয়ে না থাকে। তার ফৌজরা কিছু গির্জাতে করল অগ্নি সংযোজন আর কিছু করল ভেঙ্গে চুরমার। বিকেল নাগাদ সিপাহীরা পুরোদমে লুটতরাজের কাজ চালিয়ে গেল। কোন সুন্দরী যুবতী রমণী চোখে পড়লে তাকেও তারা রেহায় দিল না এবং যেভাবে তারা কিশতীতে গিয়ে ছিল ঠিক তেমনি আবার কিশতীতেই নিরাপদে ফিরে এলো।
জুলিয়ন নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন এলান করে দেয়া হয় তারা সিওয়াস্তার ফৌজ, তাই ফৌজরা লুটতরাজের ফাঁকে ফাঁকে এ এলান করছিল। ফৌজ যখন ফিরে এলো তখন জুলিয়ন মুসা ইবনে নুসাইরের সালার তুরাইফকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে রডারিককে দুশমন মনে করি এখন একীন এসেছে কিনা।
জুলিয়ন : আপনি সালার, বলুন দেখি, রডারিক এখন সিওয়াস্তার ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা করবে এ আশংকা কি আমি সৃষ্টি করিনি?
সেনাপতি তুরাইফ : সে তো হামলা করতেই পারে, সে কিভাবে সহ্য করে নিবে, তার এক জায়গীরদার তার মুলুকে গিয়ে আক্রমণ করে ব্যাপকভাবে ফৌজ হত্যা ও বাড়ী-ঘর লুট করে ফিরে আসে। এটা সহ্য করে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে নওয়াব জুলিয়ন আমরা আপনাকে ছাড়ব না। আমার এ সেনাদল এখানেই থাকবে এবং তারা সদা সমুদ্র তীরে থাকবে চৌকস। আপনি দ্রুত গিয়ে আমাদের আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে মিত্রতার চুক্তি পূর্ণ মাত্রায় সম্পাদন করুন এবং এ সংবাদ স্পেনে রডারিককে পৌঁছে দিন।
***
মিত্রতার চুক্তি হয়ে গেল।
মুসার বিশ্বাস হয়ে ছিল জুলিয়ন তার সাথে প্রতারণা করছে না কিন্তু এ বিশ্বাস কে মুসা পরিপূর্ণভাবে পুজা করতে চাচ্ছিলেন। এজন্যে তিনি স্পেন সমুদ্র তীর হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত “অগেসীরাস” নামে এক দ্বীপ নির্ধারণ করে তাতে হামলা করার প্লান তৈরি করলেন। এতে তিনি নিজস্ব ফৌজের সাথে জুলিয়নের ফৌজও শামিল করলেন। জুলিয়নের ফৌজ কি পরিমাণ নির্ভরযোগ্য এবং স্পেনের ফৌজ যুদ্ধে পারদর্শি কেমন আর তার কমান্ডারইবা কেমন যোগ্য এ যৌথ অভিজানের মাধ্যমে তা তিনি যাচায় করতে চাচ্ছিলেন।
এ যৌথ ফৌজী অভিযানের কামান মুসা দিয়েছিলেন সেনাপতি আবু জুরয়া তুরাইফ ইবনে মালেকের হাতে। সেনাপতি আবু তুরাইফকে আখিরী হিদায়েত দিয়ে মুসা বললেন,
ইবনে মালেক! তুমি নিজে তো লক্ষ্য রাখবেই তোমার নায়েবদেরকেও লক্ষ্য রাখতে বলরে জুলিয়নের কমান্ডাররা আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছেকিনা। এটাও লক্ষ্য রাখবে তারা লড়ায়ে বাহাদুর না বুজদিল।
জুলিয়ন তার কমান্ডারদেরকে লক্ষ্য করে বলছিলেন, আবারও তোমাদেরকে বলছি, মুসলমানরা যেন বলতে না পারে জুলিয়নের ফৌজ বুঝদিল এবং এমন কোন কাজ করবে না যাতে তাদের সন্দেহ হয় আমরা তাদেরকে ধোকা দিচ্ছি। মুসলমানদের আমীর এখনো আমাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন নি। স্মরণ রাখবে! নিজের মান সম্মানের ওপর জীবন বিলিয়ে দেয় যে বাহাদুর সে কখনো থোকা দিতে পারে না। তোমরা এক ধোকাবাজ থেকে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছ। সে ধধাকাবাজ স্পেনের বাদশাহ রডারিক। প্রথমেই তোমাদেরকে বলেছি রডারিক আমাদের দুশমন। তার ওপর তোমরা একবার আক্রমণ চালিয়েছ।….. আমি একটা কথা বার বার জোর দিয়ে বলছি মুসলমানরা যেন সামান্যও অনুভব না করতে পারে। তোমরা বুজদিল ও ধোকাবাজ।
৭১০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এক প্রভাত রজনীর আলো আঁধারীতে মুসা ইবনে নুসাইরের ও জুলিয়নের ফৌজ বিশাল জঙ্গী কিশতীতে সোয়ার হয়েছিল। জুলিয়নের ফৌজ সংখ্যা ইতিহাসে উল্লেখ নেই। মুসলমান ফৌজ সংখ্যা ছিল চারশত পায়দল আর একশত ঘোড় সোয়ার।
অগেসীরাস তেমন বড় কোন দ্বীপ ছিল না আবার একেবারে ছোটও ছিল না। পূর্বেই গোয়ান্দা মাধ্যমে জেনে নেয়া হয়েছিল সেখানে স্পেনের ফৌজ কি পরিমাণ আছে এবং কোথায় কোথায় আছে। কিশতী এমন জায়গাতে ভিড়ান হলো যেখানে ঘন গাছ-পালা ও সবুজ শ্যামলীতে ঢাকা উঁচু টিলা ছিল। এ টিলা দ্বীপের ফৌজের চোখের অন্তরালে ছিল। কোন ফৌজ আসছে কিনা তা দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কিন্তু সালার তুরাইফ ও জুলিয়নের ফৌজ দুশমনের চোখের আড়ালে থাকতে পারল না। তাদের কিশতী যখন সমুদ্র পার হয়ে দ্বীপের দিকে যাচ্ছিল তখন। দ্বীপবাসী দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছিল।
কিশতী কিনারে ভিড়ল। ফৌজ সবে মাত্র জমিনে অবতরন করেছে এখনও ঘোড় সোয়ার ঘোড়ায় আরোহন করেনি পায়দল ফৌজি সম্মুখে অগ্রসর হবার জন্যে শৃংখলাবদ্ধ হয়নি এরি মাঝে হঠাৎ করে টিলা থেকে তাদের ওপর তীরের বান বয়ে গেল। তীর আন্দাজরা ঘন গাছ-পালা, লতা গুলোর মাঝে লুকিয়েছিল। স্পেনের এক উপকূল এলাকায় জুলিয়নের ফৌজরা হামলা করার পর থেকে সীমান্তবর্তী উপকূল এলাকাও দ্বীপে ফৌজরা খুব চৌকান্না ও প্রস্তুত ছিল।
ঘোড় সোয়াররা তীরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে এদিক সেদিক ছুটছিল, সেনাপতি তুরাইফ তাদেরকে নির্দেশ দিলেন তীরের নাগালের বাইরে গিয়ে চতুর দিক থেকে টিলাকে ঘিরে ফেলার জন্যে। পায়দল সৈন্যরা পূর্বেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিছু সমুদ্রের মাঝে আর কিছু কিশতিতে আশ্রয় নিয়েছিল। সম্মুখে কেবল আহতরাছিল।
জুলিয়নের সৈন্য বাহিনীর কমান্ডার ছিল আওপাস তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার সিপাহীদেরকে একত্রিত করে হুকুম দিলেন টিলার পিছন দিক থেকে ওপরে যাওয়ার জন্যে, সিপাহীরা বিদ্যুৎ গতীতে ছুটে চলল। তীর আন্দাজরা সম্মুখে তথা সমুদ্রের দিকে তীর নিক্ষেপ করছিল। আওপাসের সিপাহীরা ডানবাম ও পিছন দিক থেকে টিলার ওপরে ঘন গাছ-পালা পত্র পল্লব ও ঘাসের মাঝে প্রবেশ করছিল ফলে তীর আন্দাজদের নিশানা পরিবর্তন হয়ে গেল। আওপাস স্বীয় সিপাহীদেরকে চিৎকার করে আহ্বান করছিল আর সিপাহীরা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে তীরবানকে উপেক্ষা করে টিলার ওপর আরোহণ করছিল।
সেনাপতি তুরাইফ যখন আওপাসের সিপাহীদের এ সাহসীকতা লক্ষ্য করলেন তখন তিনি তার তীর আন্দাজ সৈন্যদেরকে টিলার নিচের বৃক্ষে উঠে দুশমনের তীর আন্দাজকে নিশানা বানানার নির্দেশ দিলেন। মুসলমান তীর আন্দাজরা গাছে উঠার সময় দুশমনের তীরের আঘাতে জখম হয়ে কয়েকজন ভূলণ্ঠিত হলো। বাকি তীর আন্দাজরা বৃক্ষে আরোহণ করে অবিরাম গতিতে টিলার ওপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগল।
দ্বীপের তীর আন্দাজরা পলায়ন পদ হতে লাগলো কিন্তু টিলা ঘোড়সোয়ারীদের বেষ্টনীতে ছিল ফলে তারা কেউ পলায়ন করতে পারলনা। দ্বীপের বাকী ফৌজরা আক্রমণকারীদের মুকাবালা করার জন্যে আসছিল। সেনাপতি তুরাইফ তার ঘোড় সোয়ারদেরকে টিলার নিচে লুকিয়ে রেখে কমান্ডাদেরকে কৌশল বাতিয়ে দিয়েছিলেন।
উভয় পক্ষের ফৌজ এর মাঝে সংঘর্ষ বেধে গেল। স্পেন ফৌজ দ্রুত পিছু হটতে লাগলো, সেনাপতি তুরাইফ তার লুক্কায়িত ফৌজদেরকে বেরিয়ে আসার জন্যে ইশারা করলেন। ঘোড় সোয়াররা অতি দ্রুত গতিতে টিলার পাদদেশ থেকে বেরিয়ে হাওয়ার তালে ঘোড়া ছুটিয়ে দুশমনের পিছনে চলে গেল। দুশমনের জন্যে এ কৌশল আশাতীত ছিল। ঘোড় সোয়াররা পিছন দিক থেকে অতর্কিত হামলা চালাল, ফলে দ্বীপের ফৌজরা ব্যাপক হারে কতল হতে লাগল।
স্বল্পসময়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। এ দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে জাজীরাতুল খাজরা (সবুজ শ্যামল দ্বীপ) নাম রাখা হলো।
***
সালার তুরাইফ ফিরে এসে মুসা ইবনে নুসাইরকে বললেন, জুলিয়ন প্রতারণা করছেনা। আর তার ফৌজ জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছে। তিনি আরো বললেন, স্পেনের ফৌজের মাঝে যুদ্ধের স্পৃহা ক্ষীণ। তাদের পরিচালনার মাঝেও এমন কোন কৌশল নেই যা আমাদেরকে পেরেশান করতে পারে।
মুসা ইবনে নুসাইর স্পেনের ওপর হামলার প্রান তৈরি করতে লাগলেন। জুলিয়ন মুগীছে রূমী নামক এক নও মুসলিমকে সাথে নিয়ে মুসার কাছে আসলেন। মুগীছে রূমী গোথা ছিল। জুলিয়ন মুসলমান ফৌজদের সাথে স্পেন যাবার ইরাদায় এসে ছিলেন। তিনি মুগীছকে সাথে নিতে চাচ্ছিলেন। মুসা ইবনে নুসাইর ইতস্তত করতে লাগলেন।
জুলিয়ন কিছুটা অভিযোগ ও গোর স্বরে বললেন, মুসা! এখনও কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?….. আমার এমনই কিছুটা আশংকা ছিল। আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আরো পুখতা করার জন্যে আরো একটা পদ্ধতি সাথে নিয়ে এসেছি।
জুলিয়ন মুসার কাছ থেকে উঠে বাহিরে গেল। সিওয়াস্তা থেকে তার সাথে বেশ বড় কাফেলা এসেছিল। যার মাঝে তার চাকর-নওকর মুহাফেজ, মুশীর এবং মহিলারাও ছিল।
পরে জুলিয়ন যখন মুসার কামরায় প্রবেশ করলেন তখন তার সাথে দু’জন খুব সুরত লাড়কী ছিল। তাদের সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ। শরীরের কাঠামো যাদুময়ী, মনোহরী, চিত্তাকর্ষক।
জুলিয়ন বললেন,এরা আমার বেটী। এই হলো ফ্লোরিডা আর ও হলো তার বোন মেরী। আমি এদেরকে জামানত হিসেবে তোমার কাছে অর্পণ করছি। এরা আমার ইযযত ও আব্রু। ফ্লোরিডা আমার সেই বেটী যার জন্যে আমি আমার এক শক্তিধর ও পুরাতন দোস্তকে দুশমন আর পুরাতন দুশমনকে দোস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছি। নিশ্চয় তুমি লক্ষ্য করেছ আমি আমার আত্মসম্মানে উম্মাদ হয়ে এত বড় বিপদাশংকা সৃষ্টি করেছি এবং ক্ষমতাধর বাদশাহর মুলুকের ওপর হামলা করেছি তারপর তোমার ফৌজের সাথে আমার ফৌজ দ্বীপ কবজ করার জন্যে পাঠিয়েছি।….. মুসা ইবনে নুসাইর! আজ আমার এ ইযযত সম্মান তোমার হাতে সমর্পণ করছি। আমিরে মুগীছ তোমার ফৌজকে সামান্যতমও থোকা যদি দেই তাহলে আমার বেটীদেরকে দাসীতে পরিণত করবে বা হিংস্র বর্বরদের কাছে অর্পণ করবে।
জুলিয়নের এ আবেদন মুসা গ্রহণ করে ছিলেন কিনা বা তাদের মাঝে আরো কোন আলোচনা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে কোন ঐতিহাসিকই বিস্তারিত তেমন কিছু লেখেননি। ইতিহাসে শুধু এতটুকু পাওয়া যায় যে জুলিয়ন তার দু’বেটীকে জামানত রেখে ছিলেন।
জুলিয়ন দ্বিতীয় আবেদন পেশ করেছিলেন তার তামাম ফৌজ মুসার ফৌজের সাথে স্পেন পাঠাবেন। মুসা এ আবেদন দুটো আপত্তিজনক শব্দে নাকচ করে দিয়ে ছিলেন। তবে এতটুকু মদদ ও সহয়েগিতা চেয়েছিলেন যে, সিওয়াস্তা হবে মুসলমান ফৌজের জন্যে রসদগাহ্ আর সময় সময় মুজাহিদরা স্পেন যাওয়া আসার পথে সিওয়াস্তার কেল্লায় খানা-পিনা, আরাম-আয়েশ ও অন্যান্য জরুরত মিটাবে।
স্পেন উপকূল পর্যন্ত পৌঁছার কিশতী ও সমুদ্র জাহাজ যেন জুলিয়ন দেন এ মদদ তার কাছে মাগা হয়েছিল।
জুলিয়ন সর্বোপরি সাহায্যের অঙ্গিকার করলেন এবং এটাও বললেন যে, তার ফৌজ ময়দানে মদদের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকবে।
সে দিনই মুসা ইবনে নুসাইর একটা পয়গাম কাসেদের মাধ্যমে খলীফার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্পেনের ওপর হামলার ইজত তো খলীফা পূর্বেই দিয়েছিলেন, কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি অন্যান্য বিষয় ছাড়াও খলীফার কাছে লেখেছিলেন,
……স্পেনে ফৌজী অভিযান চালানোর ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ইজত তলব করে সময় নষ্ট করা আমার কাছে মুনাসিব মনে হলো না, তবে আপনি হিন্দুস্থানে যে লস্কর পাঠিয়েছেন, তার জরুরত এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে যাতে আমি স্পেন অভিযান মুলতবী করতে বাধ্য হতে পারি। একই সাথে দু’টো অভিযান আপনার জন্যে কষ্টসাধ্য বা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যাতে দু’টো অভিযানই বা কোন একটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
খলীফা ওলীদ নেহায়েত আশাব্যঞ্জক জওয়াব দিয়ে ছিলেন, তিনি লেখেছিলেন, আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তাবৃৎ প্রস্তুতি নিয়ে লস্কর রওনা করে দাও। সেনাপতি ইন্তেখাব খুব চিন্তা-ফিকির করে করবে।
***
সালার ইন্তেখাব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কোন একটা অজুহাতে মুসা সালার তুরাইফকে সালারে আলা বানাতে চাচ্ছিলেন না। একটা কারণ তো ফৌজের প্রায় শতভাগই ছিল বর্বর। মুসা চাচ্ছিলেন, সালারে আলা বর্বর হবে আর আরবী সালার হবে তার অধিনে। সে সময় বর্বরদের মাঝে এমন কিছু ব্যক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যাদের যুদ্ধ পরিচালনা করার যোগ্যতাছিল। তারা ফৌজের কমান্ডার পদার্জন করে ছিল।
তাদের মাঝে একজন ছিলেন তারেক ইবনে যিয়াদ। মুসা অতীতের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। যখন বর্বরদের অধিকাংশ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং আরবদের মুকাবালায় যুদ্ধ জিহাদে ছিল ব্যস্ত। মুসা সে সময় সেখানে অনেক যুদ্ধ করেছেন। এবং পেয়ার-মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব সুলভ আচরণও করেছেন। সে সময় অনেক বর্বর গ্রেফতার হয়েছিল তাদেরকে উপবোস্থ কর্মকর্তারা নওকর বা গোলাম বানিয়ে রেখেছিলেন। মুসার কাছে এক বর্বর যুবক এতো ভাল লেগেছিল তাকে তিনি নিজের কাছে রেখে ছিলেন। সে তার কাছে গোলামের মতই ছিল। মুসা তার কথা বার্তা শুনে ও কাজকর্ম দেখে অনুভব করতে পারলেন এ নওজোয়ান কোন সাধারণ। বংশের নয়। সে ছিল স্বর্ণকেশী আর চেহারা ছিল যেন সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। একদিন মুসা তাকে তার বাপ-দাদার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে প্রতি উত্তরে সে বলেছিল ডেন্ডাল বংশে তার জন্ম। বর্বরদের অন্যান্য কবিলার চেয়ে ডেভাল কবিলা সর্বেদিক থেকে উত্তম ও সম্ভ্রান্ত ছিল।
মুসার এ গোলাম চিন্তা-চেতনার দিক থেকে উঁচু মানসিকতার ছিল আর তার মনযোগ ছিল যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে। ঘোড় সোয়ারীতে ছিল মাহের আর তীর আন্দাজ ও তলোয়ার চালনে ছিল পূর্ণ পারদর্শী। বর্বরদের বিদ্রোহী কবিলাকে দমানোর জন্যে মুসা যখন ফৌজী অভিযান চালাতেন তখন এ গোলামও তার সাথে থাকত। সিওয়াস্তা অবরোধেও সে মুসার সাথে গিয়েছিল। মুসা লক্ষ্য করলেন এ গোলাম কেবল খেদমতগারই নয় সে অনেক সময় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাকে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে পরামর্শও দান করে। সে আরবী জবান মাতৃভাষার ন্যায় আয়ত্ত করে নিয়েছিল।
মুসা তাকে ফৌজের মাঝে একটা পদে আসীন করার পর দেখলেন সুন্দর পরিচালনা দক্ষতা ও দলকে বিজয়ী বেশে সম্মুখে অগ্রসর করার যোগ্যতা তার মাঝে বিদ্যমান। মুসা তাকে যুদ্ধ ময়দানে ইমতেহান নিয়ে এক দলের কমান্ডার বানিয়ে দিলেন। তারপর কিছুদিন পরেই সে তার যোগ্যতা বলে নায়েবে সালারের পদে আসনাসীন হয়। ইতিপূর্বেই সে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল তখন মুসা ইবনে নুসাইর তার নাম তারেক আর বাবার নাম রেখে ছিলেন যিয়াদ।
স্পেন অভিযান পরিচালনার বিষয় সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে মুসা ইবনে নুসাইরের দৃষ্টি বার বার তারেকের প্রতি যাচ্ছিল। মুসার দৃষ্টিতে তারেকের মাঝে সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাগলপারা, সে চায় সম্মুখে অগ্রসর হতে, পিছু হটতে যেন সে জানেই না।
মুসা তাকে ডেকে বললেন, স্পেন অভিযানে তাকে সিপাহ্ সালার নির্বাচন করা হয়েছে এই হলো স্পেনের নকশা। তার পরীক্ষা নেয়ার জন্যে মুসা সম্মুখে নকশা রেখে দিলেন। কিভাবে তুমি স্পেন মুলুকে হামলা করবে? ধরে রাখ তোমার লস্কর সংখ্যা বেশী হলে উধ্বে সাত হাজার হতে পারে তবে এর কমও হতে পারে কিন্তু বেশী হবে না। তারেক ইবনে যিয়াদ নকশা ভাঁজ করে রেখে দিলেন।
তারেক; আমীরে মুহতারাম! আমিএমন উসূল ও নিয়মে স্পেন উপকূলে সৈন্য অবতরণ করব যে লস্কর সম্মুখ পানেই কেবল অগ্রসর হবে পিছু ফিরার কেউ চিন্তেই করবে না…..। হয়তো বিজয় নয়তো মৃত্যু!
মুসার চেহারায় মৃদ হাসির রেখা ফুটে উঠল।
কায়রো ছিল মিশর ও আফ্রিকার দারুল হুকুমত। সিপাহ্ সালার মুন্তাখাব হবার। সাথে সাথে কায়রো শহরে তীর-বর্শা ও অন্যান্য হাতিয়ার তৈরী হতে লাগল। তীরও নিক্ষেপের জন্যে বর্শা অধিক হারে তৈরি হচ্ছিল। মুসা ইবনে নুসাইর তীর ও বর্শা বানানোর ব্যাপারে বলেছিলেন এত পরিমাণ বানাবে যাতে স্পেন থেকে খবর না আসে যে তা খতম হয়ে গেছে। মাঝখানে সাগর ছিল প্রতিবন্ধক। দুশমন কর্তৃক। রসদের রাস্তা অবরুদ্ধ হবার আশংকা ছিল।
যে সকল ফৌজ স্পেন রওনা হবে, তারেক ইবনে যিয়াদ তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। স্পেনের যে এলাকায় লড়াই হবে সে এলাকা সম্পর্কে তিনি জুলিয়নকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন। জুলিয়ন তাকে বিস্তারিত বাতিয়ে দিয়ে ছিলেন। স্পেন প্রাকৃতিক দিক থেকে উত্তর আফ্রিকার চেয়ে ভিন্ন। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা, পাহাড় পর্বত, নদী-নালা ইত্যাকার দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ। তারেক ইবনে যিয়াদ। সেখানের সর্বোপরি বিষয় সামনে রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
অবশেষে রওনার দিন এসে হাজির হলো। তারেককে যে ফৌজ দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। এর মাঝে কয়েকশ সোয়ারীও ছিল।. তাবৎ ফৌজ ছিল বর্বর। জুলিয়ন তাদেরকে চারটি যুদ্ধ জাহাজ, নিজের মাঝি-মাল্লা ও নাবিক দিয়েছিলেন। জাহাজগুলো এত বড়ছিল যে তাতে সাত হাজার ফৌজ, অশ্ব ও অন্যান্য আসবাবপত্র খুব সুন্দরভাবে সংকুলান হয়েছিল।
বিদায়ের প্রাক্কালে তারেক ইবনে যিয়াদ মুসার সাথে করমর্দন করে বলেছিলেন, আমীরে মুহতারাম! এখন থেকে কেবল বিজয় সংবাদ শুনতে পাবেন।
মুসা : একথা ভুলে যেওনা ইবনে যিয়াদ! দুশমন সংখ্যা এক লাখের বেশী হতে পারে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : প্রতিটি লড়াইতেই দুশমন সংখ্যা আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী থাকে। আমি আপনাকে একটা বাশারত শুনাতে চাচ্ছি। গতরাতে আমি রাসূল (স)-কে খাবাবে দেখলাম, তিনি আমাকে বাশারত দিলেন, হিম্মত ও সবরের আঁচল মজবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, বিজয় তোমাদেরই হবে।
তারেকের এ খাব ঈসায়ী ঐতিহাসিকরাও তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, এ দ্বারা বুঝা যায় এ খাব কোন মুসলমান ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক প্রসূত নয়।
যখন জাহাজ নঙ্গোর তুলে নিল তখন তীরে সমবেত হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু-কিশোর দু’হাত ওপরে তুলে তাদের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করছিল, তারপর তাদের সে হাত বিদায় সম্ভাষণের জন্যে আরো উপরে উঠেছিল। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর ক্রমে তা দূরে চলে যেতে লাগল। রমণীদের নয়নযুগলে আঁসুর বান বয়ে গেল। এ সাত হাজার ফৌজের অধিকাংশের ভাগ্যেই ছিল স্পেনে দাফন। তারা আল্লাহর পয়গাম সমুদ্রের অপর পারে পৌঁছানোর জন্যে চিরতরে বিদায় হয়ে যাচ্ছিল। সে ঐতিহাসিক তারিখটি ছিল, ৭১১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই।
উপকূলে যেখানে জাহাজ ভিড়েছিল তার নাম ছিল কিলপী, পরবর্তিতে জাবালুত তারেক নামে অভিহিত হয়। এনামই এ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
তামাম লস্কর জাহাজ থেকে নামার পর তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজ দাঁড় করিয়ে দিলেন, মাঝি-মাল্লাদেরকে দাঁড় করালেন পৃথকভাবে। তারেক নিজে ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তারেক মাল্লাদেরকে নির্দেশ দিলেন, “চারটি জাহাজেই আগুন লাগিয়ে দাও।”
মাল্লারা পেরেশান ও হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল।
তারেক : জাহাজ থেকে তাবৎ সৈন্য নেমে গেছে মাল-সামান নামিয়ে নেয়া হয়েছে, জাহাজে আগুন লাগিয়ে দাও।
এ নির্দেশ তো কেবল সে সিপাহ্ সালার করতে পারে যার মেধা-বুদ্ধি বিকৃতি ঘটেছে।
তারেক বর্বর ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, বর্বর ভাইরা! জাহাজে অগ্নি সংযোজন কর, আমরা জীবিত ফিরে যাবার জন্যে আসিনি।
বর্বররা সব গুলো জাহাজে আগুন লাগিয়ে ছিল।….
আগুন জাহাজের বাদাম, মাস্তুল, পাঠাতন সর্ব কিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছিল। দাউ দাউ করে জ্বলছিল। ধুম্রজালে স্পেনের গগন ছেয়ে যাচ্ছিল।
তারেকের গর্জন শুনাগেল। তাবৎ ফৌজ তার দিকে মনোনিবেশ করল, তার আওয়াজ ছিল দৃঢ় ও তেজস্বী। তিনি বর্বর ছিলেন তামাম লসকরও ছিল বর্বর কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদ লসকরকে লক্ষ্য করে বর্বর জবানের পরিবর্তে আরবি জবানে ভাষণ দিলেন। তার সে ভাষণ আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং কিয়ামত তক থাকবে,
“হে বাহাদুর যুবক ভায়েরা! এখন পিছু হটবার ও পলায়ন পদ হবার কোন সুযোগ নেই। তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পশ্চাতে সমুদ্র। না পিছনে পলায়ন করতে পারবে না সামনে। সুতরাং এখন ধৈৰ্য্য, হিম্মত ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে কাজ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। স্মরণ রেখ! এই মুলুকে তোমাদের দৃষ্টান্ত বখিলের দস্তরখানে এতিম যেমন। তোমাদের সামান্যতম বুজদেলী তোমাদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিবে। তোমাদের দুশমনের কাছে লস্বর বহুত যিয়াদা হাতিয়ারও বহুত। দুশমনের কাছে রসদ পৌঁছবার মাধ্যম অনেক তোমাদের কাছে তার কিছুই নেই। যদি তোমরা বাহাদুরীর সাথে কাজ না কর তাহলে তোমাদের ইযযত মাটির সাথে মিশে যাবে। তোমাদের সম্মান হবে ভূলণ্ঠিত। অতএব নিজের ইযযত সম্মান রক্ষা কর আর দুশমনকে সংকুচিত হতে মজবুর কর। তাদের শক্তিকে খতম করে দাও। আমি তোমাদেরকে এমন কোন জিনিস হতে ভীতি প্রদর্শন করছিনা যার সম্মুখে আমি উপনীত হবো না। আমি তোমাদেরকে এমন জায়গাতে যুদ্ধ করতে বলছিনা যেখানে আমি নিজে যুদ্ধ করবো না। আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি যদি তোমরা দৃঢ় পদ থাক তাহলে এই মুলুকের দৌলত সম্মান তোমাদের পদ চুম্বন করবে। তোমরা যদি কষ্ট স্বীকার কর তাহলে এই মুলুকের তাবৎ জিনিসের মালিক তোমরাই হবে। আমীরুল মু’মিনীন ওলীদ ইবনে আব্দুল মালেক এই কাজের জন্যে তোমাদের মত বাহাদুরকে মুনতাখাব করেছেন যে তোমরা হবে এখানের শাহী মহলের জামাতা আর হবে এথাকার খুবসুরত আওরাতের খাবে। তোমরা যদি এই মুলুকের শাহ সোয়ারদের মোকাবেলা করে তাদেরকের, পরাজিত করতে পার তাহলে এখানে আল্লাহর দীন এবং রাসূল (স)-এর আহকাম মকবুল হবে এবং তার ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটবে। অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখ আমি তোমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছি যে পথে সে পথের যাত্রী সর্বপ্রথম আমিই হবো। লড়াইয়ের মাঝে সর্বপ্রথম আমার তুলোয়ারই কোষ মুক্ত হবে। আমি যদি নিহত হই তাহলে তোমরা তো বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন, অন্য কাউকে সিপাহসালার বানিয়ে নেবে কিন্তু আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গে বিমুখ হবে না এবং এ মুলুক স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত প্রশান্তির শ্বাস ফেলবেনা।
৩. বিশাল চারটি জাহাজ
“আমাদেরকে অশ্বপদ তলে পৃষ্ঠ কর, এক মজবুর লাড়কীর চিফাটা আত্মচিৎকার শুনে নাও, তোমার শাহী মসনদও ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হবে, তোমার নাম নিশানাও যাবে চিরতরে মুছে।”
যার মাঝে সাত হাজার সৈন্য, রসদ পত্র ও ঘোড়া সংকুলান হয় এমন বিশাল বিশাল চারটি জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বলছে আর তার লেলিহান শিখা দূর দূরান্ত থেকে দেখা যাবে না এমনটি হতে পারে না। তারেক ইবনে যিয়াদের নির্দেশে জাহাজ চারটিতে অগ্নি সংযোগ করার সাথে সাথে লেলিহান শিখা ক্রমেই বুলন্দ হচ্ছিল। ধোয়া মেঘের ন্যায় আসমানে পৌঁছুতে ছিল। কাছেই জেলে ও মাল্লাদের বস্তি ছিল।
বস্তিবাসীরা একে অপরকে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঐ দেখো, কোন তাজেরের জাহাজে আগুন লেগে গেছে।
“মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রে আগুন লেগেছে, এক বৃদ্ধ জেলে বলল,
একজন জওয়ান মাল্লা বলল, তাড়াতাড়ি চল, বাহিরের কোন তাজেরের মাল জ্বলছে, চল আমরাও কিছু মাল হয়তো সংগ্রহ করতে পারব।
বস্তির-মর্দ, আওরত, বাচ্ছা সকলেই সাগর তীর অভিমুখে ছুটল।
সে সময় তারেক ইবনে যিয়াদ ফৌজের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। মানুষ কাছে এসে ফৌজ দেখে থমকে দাঁড়াল। বস্তিবাসীদের সাথে আগুন দেখে আরো কিছু লোকও এসেছিল। যেদিক থেকে লোক তামাশা দেখার জন্যে, আসছিল সেদিকে মুগীছে রূমী ছিলেন। মুগীছ তার অধিনস্থ ঘোড় সোয়ারদেরকে নির্দেশ দিলেন আগত জনতা দলকে ঘিরে ফেলোর জন্যে যাতে একটা বাচ্চাও পলায়ন করতে না পারে।
হুকুম দেয়ার সাথে সাথে ঘোড় সোয়াররা হুকুম তামিল করল। আগত জনতার মাঝে নওজোয়ান লাড়কী ও জওয়ান আওরতও ছিল। তারা চিৎকার করে পলাতে উদ্যত হল। পুরুষরা রমণী ও বাচ্চাদের বেষ্টনীতে রাখল অপর ঘোড় সোয়ার ফৌজরা তাদের সকলকে ঘিরে রাখল। তারপর তাদের সকলকে হাঁকিয়ে এক পাশে নিয়ে যাওয়া হল।
ততক্ষণে তারেক ইবনে যিয়াদের ভাষণ সমাপ্ত হয়ে ছিল। মুগীছে রূমী ঘোড়া দোঁড়িয়ে এসে তারেকের সামনে থামলেন।
তারেক : তুমি কেন তাদেরকে রুখেছ তা আমি জানি। তাদেরকে ছেড়ে দিলে তাদের মাধ্যমে স্পেনে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে যেত। আমরা তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা করতে চাই। তাদেরকে এখানেই রুখে রাখ আমরা সামনে চলে যাবার পর, তাদেরকে ছাড়বে…..
আর মুগীছ! বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখবে, আওরতের সাথে যেন কোন রকম অসৌজন্যমূলক আচরণ না হয়।
মুগীছ : হা ইবনে যিয়াদ! আমিএ হত দরিদ্র লোকদের অন্তর হতে এখনি ভয় দূর করে দিচ্ছি। তুমি হয়তো জান,এরা হলো স্পেনের মাজলুম মাখলুক। আমি তাদের সাথে এমন আচরণ করব যে তারা আমাদের মদদগার হয়ে যাবে। আমি তাদের থেকে জেনে নেব এখানের ফৌজ কোথায় রয়েছে।
মুগীছে রূমী ছিলেন গোথা কওমের ইহুদী পরিবারের সন্তান। কিছুদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তার মাঝে ইহুদীর কোন বৈশিষ্ট্য ছিল না। ইহুদী মানেই ফেত্নাবাজ, চক্রান্তকারী, শয়তান। মুগীছে রূমীর অন্তর ইহুদীদের সিফত গ্রহণ, করেনি হয়তো একারণেই তিনি ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন। তিনি মুসা ইবনে নুসাইরের জামানার পূর্বেই মুসলমানদের ফৌজে শামিল হয়েছিলেন। তার মাঝে পরিচালনার যোগ্যতা ছিল। যার ফলে খুব তাড়াতাড়ি ফৌজের উচ্চপদ এবং কিছুদিন পরেই সেনাপতি পদে আসীন হয়ে ছিলেন।
উত্তর আফ্রিকাতে বর্বরদের সাথে সর্বশেষ যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে মুগীছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ইতিহাসু সে বিজয়ের মুকুট মুগীছের মাথাতেই রাখে। মুগীছ স্পেনের অধিবাসী ছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়।
মুগীছ অবরুদ্ধ জনতা দলের কাছে গেলেন।
একজন বৃদ্ধ মাল্লা বলল, হে ফৌজের সর্দার! তোমরা যারাই হও এবং যেখান থেকেই আসনাকেন, বল তোমরাও কি গরীবের ইযযতকে এতো তুচ্ছ মনে কর? আমার মনে হচ্ছে তুমি এখনই আদেশ দেবে আমাদেরকে গ্রেফতার করার আর যুবতী রমণীদেরকে পৃথক করার জন্যে। তুমি কি আমাদের ব্যাপারে এ নির্দেশ দেবে? আমরা তোমাদের কাছে এ জন্যে এসেছিলাম যে তোমাদের একটা জাহাজে আগুন লেগেছে বাকী জাহাজে আগুন না লাগে এ জন্যে তোমাদের সাহায্য করতে পারব।
মুগীছ : আমাদের ব্যাপারে তোমাদের কোন ভয় নাই। আমাদের জাহাজে আমরা নিজেরাই অগ্নি সংযোজন করেছি।
বুড়ো মাঝি : তাহলে তো তোমাদের ব্যাপারে আমাদের ভয় আরো বেশী, তোমরা দস্যু। অন্যের জাহাজ ছিনতাই করে এনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছ, নিজের জাহাজে কেউ কি আগুন লাগায়।
মুগীছ : তুমি আমাদের দস্যু বল বা আরো কিছু বল না কেন, তবে জেনে রাখ তোমাদের কোন লাড়কী ও কোন আওরতকে আমাদের কেউ স্পর্শ করবে না।
বুড়ো মাল্লা : আচ্ছা মেনে নিলাম। তবে একটা কথা তোমাকে বলি হয়তো তা শুনে আমাদের ওপর তোমাদের দয়ার উদ্রেগ হবে, এখানের ফৌজরা আমাদের ইযযতের উপর সবচেয়ে বড় হামলাকারী। আমাদের ফৌজরা যখন এদিকে আসে তখন তারা জোরপূর্বক দু’তিন জওয়ান লাড়কীকে নিয়ে যায় তারপর পরের দিন তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়।
মুগীছ : এখন তোমাদের ইযযত নিরাপদ হয়ে গেল।
মাল্লা : তাহলে আমাদেরকে ঘোড় সোয়ার দ্বারা বেষ্টনী দিয়ে রেখেছ কেন?
মুগীছ : যাতে তোমরা আগেই আমাদের আগমন বার্তা তোমাদের ফৌজের কাছে পৌঁছাতে না পার এ জন্যে। আমরা এখান থেকে চলে গেলে তোমরা নিজ ঘরে ফিরে যাবে। তোমাদের ফৌজকি এখানে আশে-পাশেই কোথাও রয়েছে?
ঐ বুড়োর কাছে আরো কয়েকজন জেলে ও মাঝি এসে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মাঝে থেকে একজন বয়স্ক সামনে অগস্রর হয়ে বলল,
তোমাকে এ ফৌজের সর্দার বলে মনে হচ্ছে….. তুমি যেহেতু আমাদের ইযতের জামানত দিয়েছ, সেহেতু আমরাও তোমাদেরকে এখানের ফৌজের হাত থেকে বাঁচানোর জামানত দিচ্ছি। আমাদের ফৌজ এখান থেকে বেশী দূরে নয়।
বুড়ো মাল্লা মুগীছে রুমিকে বলল, এ এলাকাতে কয়েক জায়গায় ফৌজী চৌকি রয়েছে। সবচেয়ে কাছে চৌকি রয়েছে ছয় মাইল দূরে আর তা এ এলাকার জেনারেলের হেড কোয়ার্টার। এ সকল চৌকিতে যে ফৌজ রয়েছে তার সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার।
জেনারেলের নাম ছিল তিতুমীর, ইতিহাসে যাকে প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ জেনারেল হিসেবে অবহিত করা হয়েছে।
***
তারেক ইবনে যিয়াদ ধারণা করেছিলেন, অতর্কিতভাবে উপকূলীয় ফৌজের ওপর আক্রমণ করে তাদেরকে পাকড়াও করবেন, তার এ ধারণা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। যে সময় মুগীছে রূমী মাল্লা ও জেলেদেরকে শান্তনা দিচ্ছিলেন সে সময় স্পেনের ফৌজের এক সদস্য তাদের জেনারেলকে বহিরাগত ফৌজের আগমন সংবাদ শুনাচ্ছিল। ঐ ব্যক্তি জাবালুত্ তারেকে উপস্থিত ছিল।
সে ফৌজ তার জেনারেলকে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলছিল, আমি চারটি জাহাজ সিওয়াস্তার দিক থেকে আসতে দেখলাম, তারপর তারা সে জাহাজের তাবৎ মাল-সামানা নামিয়ে নিয়ে তাতে অগ্নি সংযোজন করেছে।
জেনারেল আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে?
ফৌজ : আমি নিজ চোখে জাহাজ জ্বলতে দেখে এসেছি। যে ফৌজ এসেছে তা দশ হাজারের কম হবে বলে মনে হলো না।
জেনারেল : তারা যদি ফৌজ হয় তাহলে কোন বিপদ জনক ফৌজ বলে মনে হচ্ছে। তারা নিশ্চয় উম্মাদ ফৌজ কারণ উম্মাদরাই কেবল নিজেদের জাহাজে অগ্নি সংযোজন করতে পারে।
জেনারেল তিতুমীর ঘোড় সোয়ার-পায়দল তাবৎ ফৌজ যেন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি : নিয়ে অতিসত্তর জেনারেলের চৌকির কাছে এসে জমা হয় এ ফরমান দিয়ে সব চৌকিতে কাসেদ পাঠিয়ে দিল।
তার কাছে তাৎক্ষণিক ভাবে যে ফৌজ একত্রিত হল তার পরিমাণ ছিল বার হাজার। তার মাঝে এক হাজার ছিল ঘোড় সোয়ার। আসবাব-পত্র ও অস্ত্র-শস্ত্রের দিক থেকে তারা তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। তাদের সবচেয়ে বড় যে ফায়দা ছিল তা হলো তারা তাদের নিজ দেশে ছিল। সেখানে তাদের অতিসত্তর রসদ ও সাহায্য পাবার সম্ভাবনা ছিল। তারা ছিল বর্ম পরিহিত।
তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজের সংখ্যা ছিল সাত হাজার তার মাঝে মাত্র তিনশত ছিল ঘোড় সোয়ার। বর্ম পরিহিত একজনও ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় কমজোরী তারা ছিল অপরিচিত স্থানে ও বিদেশে, যেখানের আকাশ-বাতাস, মাটি, আগুন-পানি তাবৎ কিছু ছিল তাদের দুশমন। তাদের সাহায্য ও রসদ-পত্র আসার পথও ছিল অনেক দূরবর্তী। আর মাঝখানে ছিল প্রাচীর হিসেবে বার মাইলের এক বিশাল সমুদ্র।
জাহাজ চারটি জ্বলেই যাচ্ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদের সাথে আওপাস, জুলিয়নও এসেছিলেন। এরা দু’জন ছিলেন রাহুবর; তারা স্পেনের সর্ব বিষয়ে ওয়াকিফ ছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তাদেরকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, স্পেনের কোথায় কি রয়েছে, কেল্লা বন্দ শহর কোথায় এবং তার দূরত্ব কতদূর ইত্যাদি। আওপাস ও জুলিয়ন সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছিলেন।
জুলিয়ন : আমাদের প্রথমে মুকাবালা হবে উপকূলবর্তী ফৌজের সাথে। সময়ের পূর্বেই যদি সব ফৌজ একত্রি হয়ে যায় তাহলে আমাদের জন্যে মুশকিল হবে। তাদের এ ফৌজের সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি অধিকন্তু তাদের হাতিয়ারও বেশ উমদা, কিন্তু তারা আমাদের আগমন সংবাদ পায়নি, আমরা এদেরকে পৃথক পৃথকভাবে খতম করব।
মুসলমান ফৌজ জাহাজ থেকে নেমে সামান পত্র গুছিয়ে সামনে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিয়ে ছিলেন এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা হবে তবে তার স্থাপন করা হবে না।
এক ঘোড়া সোয়ার অত্যন্ত দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে তারেক ইবনে যিয়াদ, জুলিয়ন ও আওপাসের কাছে থেমে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হও। স্পেন ফৌজ আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে গেছে, তাবৎ চৌকির ফৌজ একত্রিত হয়েছে। তারা বেশী দূরে নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই এসে যাবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এ ব্যক্তি কে? বর্বর নয়তো?
জুলিয়ন : সে আমাদের লোক। তার নাম হিজি। জুলিয়ন হিজিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কিভাবে এলে?
হিজি : ঘোড়া ও ফৌজ যখন জাহাজে সোয়ার হচ্ছিল তখন আমি মুসলমানদের পোশাক পরে এসে ঘোড়ার হাজাজে সোয়ার হয়ে গেলাম। এখানে এসে দেখলাম ফৌজ জাহাজ থেকে অবতরণ করে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু এখানের ফৌজ যে আমাদের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে বা তারা কোথায় আছে তার দিকে কারো কোন লক্ষ্য নেই। আমিএ এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিফ তাই আগে চলে গেলাম। তারপর ঘোড়া পিছে রেখে চুপি-চুপি সামনে অগ্রসর হয়ে এখানের ফৌজ দেখতে পেলাম। এখানের ফৌজ আমাদের আগমন খবর জানে কিনা এটা জানার জন্যেই আমি গিয়ে ছিলাম।
তারেক ইবনে যিয়াদের মত একজন বিচক্ষণ সিপাহ্ সালার এ বিষয়টা ভুলে যাবেন এটা অসম্ভব ছিল কিন্তু তিনি সমেমাত্র প্রতিরক্ষা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন আর সেখানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হচ্ছিলেন তাই সম্মুখে নজর দেয়ার ফুরসত তার হয়নি।
তারেক ইবনে যিয়াদ প্রাণ খুলে হিজিকে মুবারকবাদ জানালেন। এ হলো সেই হিজি যাকে ফ্লোরিডা প্রাণ দিয়ে ভালবাসত এবং নিজের কাছে পাবার জন্যে ছিল পাগল পারা। ফ্লোরিডার বিরহে উম্মাদ হয়ে তার পিছে পিছে টলেডোতে গিয়ে পৌঁছেছিল। শাহ্ রডারিক ফ্লোরিডাকে বে আব্রু করলে হিজি শাহী আস্তাবল থেকে ঘোড়া চুরি করে পালিয়ে সিওয়াস্তা পৌঁছে ফ্লোরিডার বাবাকে অবহিত করেছিল।
কিছুদিন পূর্বে মুসা ইবনে নুসাইরের আস্থাভাজন হবার জন্যে জুলিয়ন যখন স্পেনের তীরবর্তী এলাকাতে হামলা করেছিলেন তখন ফ্লোরিডা তাদের সাথে যাবার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে রওনা দিয়েছিল কিন্তু তার বাবা জুলিয়ন তাকে যেতে দেননি।
তারপর তারেক ইবনে যিয়াদের ফৌজ যখন রওনা হচ্ছিল তখন জুলিয়ন ও আওপাস তাদের সাথে ছিলেন। ফ্লোরিড়া ভাল করে জানত তার বাবা তাকে যেতে দেবে না তাই সে হিজিকে বলেছিল, সে মুসলমান ফৌজের সাথে যেতে চাই। হিজিকে এ ফৌজের সাথে নেয়া হচ্ছিল না। মুসলমান ফৌজের সাথে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। যদি জুলিয়নের সিপাহী বাহিনী যেত তাহলে হিজি যেতে পারত কারণ তার বাপ ছিল শাহী আস্তাবলের বড় অফিসার।
“তুমি আমাকে মুসলমান ফৌজের লেবাস এনে দাও, তা পরে আমি জাহাজে সোয়ার হয়ে যাব। আমি আমার নিজের হাতে রডারিক থেকে প্রতিশোধ নেব” ফ্লোরিডা হিজিকে লক্ষ্য করে বলেছিল।
হিজি বুঝাচ্ছিল কিন্তু সে উম্মাদের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল, হিজি আশংকা করছিল এ লাড়কী যা বলছে তা হয়তো করেই দেখাবে।
হিজি : ফ্লোরা! আমি তোমার যন্ত্রণা অনুভব করছি কিন্তু তুমি কি একটা বিষয় ভেবে দেখেছ, রডারিক পর্যন্ত পৌঁছে, তাকে যে তুমি হত্যা করতে পারবে তার কি নিশ্চয়তা রয়েছে?
ফ্লোরিডা : আমি মুসলমানদের পুরুষের লেবাসে আসব।
হিজি : আবেগে নয়, গভীরভাবে চিন্তে কর ফ্লোরা! তুমি জখম হতে পার, কতলও হতে পার….. আর যদি তুমি জিন্দা ধরা পড় তাহলে তুমি নিজেই চিন্তে করে দেখ রডারিকের ফৌজরা তোমার সাথে কিরূপ আচরণ করবে? হয়তো তুমি এমন পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হবে। তখন তুমি কিভাবে কার থেকে তোমার ইযযত হরনের প্রতিশোধ নেবে?
ফ্লোরিডা নিশ্চুপ হয়ে গেল, যেন সে কথা অনুধাবন করতে পেরেছে।
ফ্লোরিডা : তাহলে এটা কর হিজি! তুমি যাও এবং নিজ হাতে পাপিষ্ঠ রডারিককে হত্যা কর। আমি তোমার আমানত ছিলাম, সে তার মাঝে খেয়ানত করেছে। আমার ইযযত, আমার অন্তরের মালিক তুমি। ঐ শয়তান রডারিক অন্তর মন পর্যন্ত অপবিত্র করে দিয়েছে….. বল হিজি! আমার অন্তরে যে আগুন লেগেছে তা কি তুমি পারবে নির্বাপন করতে?
হিজি : হ্যাঁ পারব। আমি তোমার বে আব্রুর প্রতিশোধ নেব। হিজি ফ্লোরিডার নরম-মাংসল হস্ত যুগল নিজ হস্তে নিয়ে চুম্বন করে বুকের ওপর রেখে বলল, তোমার ভালবাসার কসম! তোমার প্রীতি মহব্বতের শপথ! রডারিক আমার হাতেই মরবে।
ফ্লোরিডা হিজির হাত ধরে বলল, তুমি আরো একটা ওয়াদা কর হিজি! রডারিকের মাথা কেটে তুমি নিয়ে আসবে, আমি তার মাথা রাস্তার কুকুরকে দিয়ে খাওয়াব।
হিজি : আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ফ্লোরা। তার মাথা তোমার কাছে, উপস্থিত করব।
হিজি ফ্লোরিডাকে পরম আবেগে বুকে জুড়িয়ে ধরে ফ্লোরিডার যৌবন সুরায় ভরা ওষ্ঠ ধরে ঠোঁট মিলিয়ে নিল। ফ্লোরিডার মসৃণ কপোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু হিজির হাতে পড়ল। হিজিরও নয়ন যুগল আঁসুতে ভরে উঠল।
সুন্দরী-সৌষ্ঠব নওজোয়ান ফ্লোরিডা স্পেনের মত এত বড় মুলকের বাদশাহকে প্রত্যাখান করে শাহী আস্তাবলের এক সামান্য, নওকরকে তার সবকিছু সমর্পণ করেছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদের সৈন্য রওনা হয়ে যাবার পর থেকে প্রতিদিন সকাল সাঁঝে ফ্লোরিডা ইবাদত খানাতে গিয়ে ইবাদত করে কেবল দুটো প্রার্থনা করত। এক. মুসলমানদের যেন বিজয় হয় দুই, হিজি যেন পাপিষ্ঠের মাথা নিয়ে জীবিত ফিরে আসে।
স্পেন ফৌজ একত্রিত হয়েছে এ সংবাদ পাবার সাথে সাথে তারেক ইবনে যিয়াদ তার নিজ ফৌজকে প্রস্তুত হবার হুকুম দিলেন আর তিনি দ্রুতগতিতে জাবালুত তারেকে গিয়ে আরোহন করে চতুর্দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তার সাথে মুগীছে রূমী ছাড়াও সেনাপতি তুরাইফ ইবনে মালেক ছিলেন। তিনি আগেই পছন্দ মত ময়দান যুদ্ধের জন্যে নির্বাচন করে রেখেছিলেন। তিনি এমন এলাকার দিকে ইশারা করলেন যা ছিল সবুজ-শ্যামল বৃক্ষ লতাতে ঢাকা উঁচু টিলা।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে বললেন, তামাম সোয়ারীকে ঐ টিলার উপর পাটিয়ে দাও, আর কমান্ডারদেরকে বল তারা যেন প্রতিটি সোয়ারীকে অশ্বে। প্রস্তুত রাখে এবং নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
তারেক ইবনে যিয়াদ সালারদেরকে ফৌজের নিয়ম শৃংখলা বুঝিয়ে হিদায়াত দিলেন তারপর পর্বত হতে অবতরণ করলেন। যেসব জেলে ও মাল্লাকে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে বলা হলো তারা যেন ঘর থেকে না বের হয়। তীর আন্দাজ কমান্ডারদেরকে বিশেষ হুকুম দিলেন। এরি মাঝে খবর এলো স্পেন ফৌজ চলে এসেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সাথে কিছু সেনাদল নিয়ে সম্মুখে চলে গেলেন। অপর দিক থেকে তিতুমীর সম্মুখে এলো, সে হিফাজত রক্ষীর বেষ্টনীতে ছিল। রক্ষীরা উমদা জংগী ঘোড়ায় সোয়ার ছিল।
তিতুমীর উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কি জন্যে এসেছ?
তারেক জিজ্ঞেস করলেন, সে কি বলছে?
তিতুমীরের কথার তর্জমা করে তারেককে বুঝান হল।
জুরিয়ন : দাঁড়াও ইবনে যিয়াদ! তাকে জওয়াব আমি দিচ্ছি।
জুলিয়ন সামনে অগ্রসর হয়ে তিতুমীরের জবাবে উচ্চস্বরে বললেন, জিজ্ঞেস করছ আমরা কি নিতে এসেছি। আমরা স্পেন নিতে এসেছি।
তিতুমীর রোষে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলল, হে নিমক হারাম! তুই আমাদের জায়গীরদার আর তুই এসেছিস আমাদের মুলুকের উপর হামলা করতে কাদেরকে সাথে নিয়ে এসেছিস? এতে তার নিজস্ব ফৌজ নয়। তুই ইতিপূর্বে এখান থেকে লুটতরাজ করে নিয়ে গেছিস এজন্য তুই মনে করেছিস এখনো সহী সালামতে জিন্দা অপেই যাবি। পরিণাম চিন্তা করে এই বর্বর লসকরকে ফিরিয়ে নিয়ে যা, আমার ফৌজের প্রতি লক্ষ্য কর, তোর ফৌজের চেয়ে দ্বিগুণ। তোর কাছে তো ঘোড় সোয়ার নেই।
জুলিয়ন ও তিতুমীরের মাঝে কি কথা বার্তা হল তা তারেক ইবনে যিয়াদকে, তার ভাষায় বুঝিয়ে বলা হল, তারেক ইবনে যিয়াদ যুদ্ধের দামামা বাজাবার হুকুম দিলেন। দামামা বেজে উঠল, তারেক তার সৈন্যদেরকে হামলা করতে ইশারা করলেন।
তিতুমীরের কাছে রয়েছে মুসলমানদের দ্বিগুণ ফৌজ এবং এক হাজার ঘোড় সোয়ার। এতে সে ছিল আত্বম্ভরী। পায়দল মুসলমান ফৌজ তাকবীর ধ্বনি দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল। তিতুমীর তার মুহাফিজদের সাথে পশ্চাতে চলে গেল। তার নিজে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। বিজয়ের ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস ছিল। অপরদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ স্বীয় হামলাকারী সৈন্যদলের অগ্রভাগে ছিলেন। তিতুমীর তার এক হাজার ঘোড় সোয়ারকে পায়দল বাহিনীর পিছনে রেখেছিল।
উভয় পক্ষের মাঝে মুকাবিলা শুরু হল। মুসলমানদের ভাল করেই জানা ছিল এটা তাদের জীবন মরনের বিষয়। ফিরে আসার কোন মাধ্যম ছিল না। জাহাজ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের ভাষণে তারা নতুন জীবন লাভ করেছিল। তারেক বিপক্ষের সম্মুখ সৈন্যদলের ওপর বীরবিক্রমে আক্রমণ চালিয়ে পিছু হটছিলেন। তার অধিনস্থ কমান্ডাররা পশ্চাদপদ হচ্ছিল। প্রলয়ংকরী যুদ্ধের মাঝে তিতুমীর চিৎকার করে বলছিল, তাদেরকে জিন্দা ফিরে যেতে দিবে না। তারা পলায়ন করছে, পলায়ন করতে যেন না পারে। সবাইকে খতম করে দাও….. তাদের পশ্চাদধাবন কর।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে আরও দ্রুত পিছু হটতে লাগলেন আর দুশমন সৈন্যদল তাদের পিছু পিছু আসল। তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রেখে ছিলেন। মধ্যেবর্তী দলকে তিনি তার নিজের কমান্ডে রেখে ছিলেন। এদের দ্বারাই তিনি হামলা চালিয়ে পিছু হটে আসছিলেন। তাকবীরধ্বনি থেমে গেল এবং মুসলমানরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছল যেখানে ঘনগাছ পালা এবং একদিকে লম্বাটিলা।
স্পেন সৈন্য যখন ঐ গাছের নিচে আসল তখন গাছের প্রতিটি শাখা থেকে তাদের উপর অবিরাম তীর বন্যা বয়ে গেল। মুসলমান তীর আন্দাজরা টিলার উপর লুকিয়ে ছিল তারাও দুশমনের ওপর তীর বর্ষণ শুরু করল। তীর আন্দাজ খুবই কাছে থেকে তীর নিক্ষেপ করছিল এজন্য একটা তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে দুশমন সৈন্যের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছিল।
এই বিশেষ হিদায়েতই স্পেন ফৌজ আসার পূর্বে তারেক ইবনে যিয়াদ তীর আন্দাজ কমান্ডারদেরকে দিয়েছিলেন। দুশমন আসার পূর্বেই তীর আন্দাজদেরকে বৃক্ষে এবং টিলার ওপর প্রস্তুত রাখা হয়েছিল আর তারেক ইবনে যিয়াদের পিছু হটার মাকছাদ এটাই ছিল যে যাতে দুশমনকে তীর আন্দাজদের জালে ফেলা যায়। তার এ কৌশল সফল হয়েছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, “এলান করে দাও দুশমনের ঘোড়া যেন জখম না হয়, আমাদের ঘোড়ার প্রয়োজন রয়েছে, তবে দুশমনের কোন সোয়ার যেন জিন্দা যেতে না পারে।
তার এ নির্দেশ সমস্বরে এলান হতে লাগল।
তিতুমীর তার ফৌজের অবস্থা লক্ষ্য করছিল। তার কাছে তখনও অনেক ফৌজ মওজুদ ছিল। অপর দিকে মুসলমানদের ফৌজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল ডানে অপর দল বামে অবস্থান করছিল। তিতুমীর একই সাথে দু’দলের ওপর হামলা চালাবার হুকুম দিল। তারেকের দেয়া হিদায়াত মুতাবেক উভয় দল আরো বেশী ডানে-বামে সরে গেল যাতে দুশমনের ফৌজ আরো বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
বর্বর মুসলমানরা খুবই খুন পিয়াসু যুদ্ধবাজ ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ হত্যাযজ্ঞ করাই ছিল তাদের পেশা। ইসলাম তাদেরকে যুদ্ধের নব উদ্দীপনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছিল। ফলে তাদের যুদ্ধের ধরণ পালটিয়ে গিয়ে ছিল। তারা প্রথমে নিজেরা পরস্পরে লড়াই করত। স্বয়ং ঈসায়ী ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধের যে স্পৃহা ছিল স্পেন ফৌজের মাঝে তা ছিল না। স্পেন ফৌজ নিজেদেরকে বাদশাহর নওকর মনে করতো আর তারা বেতন-ভাতার জন্যে লড়াই করতো এবং তার জন্যেই জীবিত থাকতে চায়তো। পাদ্রীরাও শাহী খান্দান ও আমীর উজীরদের মত বিলাসী জীবন যাপন করত। স্পেনে বেশ অনেক সংখ্যক ইহুদী বাসিন্দা ছিল কিন্তু খৃস্টানরা তাদেরকে নিজেদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। ইহুদী ললনাদের আরও হেফাজত ছিল না। কোন সুন্দরী-মায়াবী, যুবতী ইহুদী লাড়কী দেখলেই পাদ্রীর হুকুমে তাকে গির্জার সম্পদে পরিণত করা হত। পাদ্রীরা বলত তাকে গির্জা বাসিনী বানান হবে কিন্তু পাদ্রীরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুদের এ কীর্তি ফৌজদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তাই মাল্লা ও জেলেরা মুগীছে রূমীকে বলেছিল সৈন্যরা কোন নজওয়ান খুব সুরত লাড়কী দেখলে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়।
মুসলমানরা স্পেন লস্করের হামলা, অত্যন্ত দৃঢ়তা, সাহষীকতার সাথে প্রতিহত করল। তারা সংখ্যায় কমছিল কিন্তু যুদ্ধ স্পৃহায় ছিল পাগল পারা। তিতুমীরের ধারণা ছিল তার এত বড় বিশাল বাহিনী ক্ষণিকের মাঝে মুসলমানদের এ স্বল্প সৈন্যকে পরাস্ত করে হত্যা করবে। তারেকের দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় তার আশার গুড়ে বালি পড়ল।
তারেক ইবনে যিয়াদ দুশমনের পাশে যে টিলা ছিল তার মাঝে পূর্বেই ঘোড় সোয়ারদেরকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি যে দল নিয়ে হামলা করে পিছু হটে আসলেন সে দলকে কৌশলে ঘোড় সোয়ারদের কাছে নিয়ে গেলেন, তারপর তিনি পায়দল ও ঘোড় সোয়ারদের নির্দেশ দিলেন তারা টিলার আড়াল দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে যেন স্পেন ফৌজের পশ্চাদ হতে আক্রমণ করে বসে।
তারেকের এ কৌশল তিতুমীরের জন্যে অপ্রত্যাশিত ছিল। তার ধারণা ছিল তাদের পশ্চাদ দিক নিরাপদ রয়েছে। পশ্চাদে হামলার নেতৃত্বে তারেক স্বয়ং ছিলেন, আর তার দুই সেনাপতি মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ সম্মুখ হতে অবিরাম গতিতে তীর-বর্শার আক্রমণ করছিলেন।
তারেক তিনশত ঘোড় সোয়ার ও দু’হাজার শার্দুল পায়দল নিয়ে পশ্চাদ দিক থেকে স্পেন ফৌজের ওপর বীরবিক্রমে হামলা করার পর তিতুমীর বুঝতে পারল পিছন দিক হতে তাদের ওপর বিপদ ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মাঝে তার দুহাজার ফৌজ খতম হয়ে গেল আর যারা জীবিত ছিল তারা ভয়াবহ আত্মচিৎকারে নিজেদের অন্যান্য ফৌজের মাঝে গ্রাস সৃষ্টি করছিল। স্পেন ফৌজের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। তারেকের পূর্ব পরিকল্পনা, মুতাবেক মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ তাদের ফৌজ নিয়ে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী স্পৃহা ও বীরত্বে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্পেন সোয়ারীদের ঘোড়া তাদের ফৌজের জন্যে চরম বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারেক নির্দেশ দিয়েছিলেন দুশমনের ঘোড়া জখম না করে সহীহ সালামতে ধরার জন্যে। ঘোড় সোয়ারী জখম হয়ে হয়ে নিচে পড়ছিল আর ঘোড়া লাগামহীন হয়ে দিগবিদিক উম্মাদের ন্যায় ছুটছিল এবং ফৌজকে পায়ের তলে পৃষ্ঠ করছিল। তারেকের তীর আন্দাজরা স্পেন ফৌজের জন্যে আরো বড় মসীবত ডেকে আনছিল। তারা গাছের ওপর হতে অবিরাম তীর নিক্ষেপ করে দুশমনের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছিল।
তিতুমীর তার সারিবদ্ধ ফৌজের মধ্যখানে ছিল। সৈন্য পূর্ণ বিশৃংখল হয়ে গিয়ে ছিল। তার হুকুম কেউ শুনছিল না। তার ফৌজের প্রতিটি সদস্য যার যার মত একাকী পলায়ন করছিল। অর্ধেক সৈন্য খতম হয়ে গিয়েছিল। কোন জখমী সৈন্য পড়লে পায়দল ও ঘোড়ার পদতলে সেও পৃষ্ঠ হয়ে খতম হচ্ছিল।
জুলিয়ন মুগীছে রূমীকে লক্ষ্য করে বললেন, মুগীছ! কয়েকজন জানবাজ ফৌজ পাঠাও, তারা তিতুমীরকে গ্রেফতার করে আনবে।
মুগীছ : যুদ্ধের যে অবস্থা এ পরিস্থিতিতে তার কাছে পৌঁছা যাবে না।
আওপাস : আমাকে চার-পাঁচজন বর্বর দাও, আমি তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে যাচ্ছি।
মুগীছ : আমি আমার হেফাজত রক্ষীর চারজন তোমাকে দিচ্ছি।
আওপাস চারজন ঘোড় সোয়ারী নিয়ে বীর বিক্রমে ছুটে চলল, ঐদিকে তিতুমীরের এক নায়েব তাকে বলল, তিতুমীর! আপনি কি দুশমনের হাতে আত্মাহুতি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? আমাদের তো কিছুই বাকী নেই। সব খতম হয়ে গেছে।
তিতুমীর : তুমি কি এখান থেকে পলায়নের মশওয়ারা দিচ্ছ।
নায়েবঃ ঝান্ডা গুটিয়ে ফেলে গ্রুত পলায়ন করুন। অর্ধেক ফৌজ খতম হয়ে গেছে বাকীরা পলায়নপদ।
তিতুমীর সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিল। মুসলমানদের শক্তিম, স্পৃহা ও লক্ষ্য করছিল। মুসলমানরা তাদের দ্বিগুণ ফৌজকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তাদেরকে হত্যা শুরু করেছে। খোদ তিতুমীরের মাঝেও ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল। এ অবস্থায় তার বাঁচার জন্যে পলায়ন ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সে পলায়নের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল এবং পতাকা বহনকারীকে গুটিয়ে ফেলার জন্যে নির্দেশ দিল।
ঝান্ডা অদৃশ্য হবার সাথে সাথে মুহূর্তের মাঝে ময়দান খালী হয়ে গেল। পড়ে রইল কেবল লাশ আর লাশ। কিছু জখমী ফৌজ পড়ে ছিল তারা উঠার চেষ্টা করছিল কিন্তু লাগামহীন স্পেন ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে তারাও চিরতরে খতম হয়ে গেল।
তারেক ইবনে যিয়াদ : ঘোড়ার বাগডোর হাতে নেও আর মালে গণিমত জমা কর। দুশমনের জেনারেল পলায়ন করেছে।
***
কিছুদিন পর স্পেন বাদশাহ্ রডারিক জেনারেল তিতুমীরের পয়গাম পড়ে গোয় ফেটে পড়ছিলেন। সে সময় তিনি দারুল হুকুমত টলেডোতে ছিলেন না। টলেডো হতে কয়েক দিনের দূরত্ব পামপিলুনা নামক এক শহরে অবস্থান করছিলেন। সেথায় জার্মানের কিছু লোক বসবাস করত। তারা স্পেনের স্থানীয় লোকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহ করিয়ে দিয়ে ছিল। ইতিহাস যেমনিভাবে রডারিককে বিলাস প্রিয় ও অন্যায় প্রবণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ঠিক তেমনিভাবে যুদ্ধের ময়দানে শক্তিশালী দুশমনের জন্যেও বাজ পাখি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার শাহী মর্যাদার ওপর সামান্যতম আঘাতও তার জন্যে ছিল অসহনীয়। বিদ্রোহীদের জন্যে তিনি ছিলেন মালাকুল মওত। পামপিলুনা এলাকাতে বিদ্রোহের খবর পেয়ে কোন জেনারেল না পঠিয়ে নিজে ফৌজ নিয়ে সেথা উপনীত হয়েছেন।
বিদ্রোহীরা মুকাবালা করল কিন্তু রডারিকের রোষ ও আক্রোশ তারা বর্দাশত করতে পারল না। ঐ যুদ্ধে রডারিক জীবিতদেরকে পলায়ন করার সুযোগ দিলেন না। বহিরাগত বিদ্রোহী সর্দারদেরকেও গ্রেফতার করলেন তাদের আরো কয়েকজন সাথীও ধৃত হল। তাদের ওপরই নয় তাদের আওরতদের উপরও চলল নির্যাতনের স্টীম রোলার। বিদ্রোহীদেরকে এমন অমানবিক শাস্তি দেয়া হতো যাতে তারা জীবিতও থাকতে পারত না আবার মৃত্যু বরণ করত না। রডারিক তাদেরকে মৃত প্রায় করে আবার জীবিত করার চেষ্টা করত। যখন তারা বেহুশ হয়ে যেত তখন তাদেরকে এক ময়দানে নিক্ষেপ করে শহরের লোকদেরকে একত্রিত করে একজনকে-এলান করার নির্দেশ দেয়া হত।
“এরা বিদ্রোহী, এরা গাদ্দার, এরা শাহান শাহে উন্দুলুসের ক্রোধ সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিল না। প্রতিদিন এসে তার অবস্থা দেখে শিক্ষা গ্রহণ কর আর শাহানশাহর রোষানলকে ভয় কর।……এরা বিদ্রোহী….. এরা গাদ্দার…..।”
তাদের আওরতদের সাথে আরো ঘূণ্য আচরণ করা হত। রাতে তাদেরকে বিবস্ত্র করে রডারিকের আম দরবারে নাচতে বাধ্য করা হত। এর সাথে সাথে তাদেরকে করা হত বেত্রাঘাত। সে মজলিসে বাদশাহ, ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও ফৌজী অফিসাররা উপস্থিত থাকত। তারা এসব রমণীদের সাথে লজ্জা জনক আচরণ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত। পরিশেষে শরাব পান করে উম্মাদ হয়ে তারা। আওরাতদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেত।
সন্ধ্যেবেলা, দরবারে লোক থৈ থৈ করছে। বিদ্রোহীদের আওরতদেরকে উলঙ্গ করে নাচান হচ্ছে। পনের বছরের এক কিশোরীকে রডারিক তার উরুর ওপর বসিয়ে রেখেছেন, শরাব পানির মত প্রবাহিত হচ্ছে, এরি মাঝে রডারিককে খবর দেয়া হলো টলেডো হতে তিতুমীরের কাসেদ এসেছে সত্তর মুলাকাত করতে চায়।
রডারিকের নির্দেশে কাসেদ অন্দর মহলে গিয়ে বাদশাহর কাছে লিখিত পয়গাম পেশ করল। বাদশাহ সে পয়গাম তার এক মুশিরকে পড়ে শুনানোর জন্যে বললেন এবং তালি বাজালেন সকলে মুহূর্তের মাঝে নিশ্চুপ হয়ে গেল, পরিবেশ হয়ে গেল নিরব-নিস্তব্ধ।
মুশীর উচ্চস্বরে পয়গাম পাঠ করতে লাগল,
শাহান শাহে উন্দুলুসের খেদমতে সালাম ও আদাব। শাহানশাহর এ গোলাম শাহী খান্দানের ইজ্জত ও মুলুকের মর্যাদা রক্ষার্থে সব সময় জীবনবাজী রেখে লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছে। যেখানেই বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সেখানে শাহী খান্দানের এ গোলাম মৃত্যুদূত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে এবং বিদ্ৰোইদেরকে মৃত্যুপথের যাত্রী বানিয়েছে, কেউ বলতে পারবেনা তিতুমীর কোন ময়দানে পরাজয় বরণ করেছে। কিন্তু এরা কোন জিন-ভূত যারা আমার অর্ধেক ফৌজ খতম করে দিয়েছে আর বাকী অর্ধেক হয়েছে পলায়নপদ।
রডারিক তার উরুর ওপর বসা কিশোরীকে সরিয়ে দিয়ে ইতস্ততঃ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঠিকভাবে দেখে পড়ছ তো? নিহত হয়েছে আর বাকীরা পালিয়েছে। কোথায়…..? জিন-ভূত-ছিল মানে? তাড়াতাড়ি পাঠ কর।
মুশীর পাঠ করতে লাগল, তারা চারটি জাহাজে এসেছে এবং জাহাজ থেকে অবতরণ করে জাহাজগুলোতে অগ্নি সংযোগ করেছে। আমি সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তাবৎ ফৌজ নিয়ে পৌঁছে ছিলাম। তাদের সংখ্যা আমার ফৌজের অর্ধেক ছিল। তাদেরকে চিরতরে খতম করার জন্যে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু তারা এমনভাবে লড়াই করল যার ফলে আমার ফৌজের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি হল। বৃক্ষ হতে তীর, টিলা হতে তীর আর আশ্চর্যের বিষয় হলো কোন তীরই লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল না। তাদের কোন ঘোড় সোয়ার দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু না জানি আমাদের পশ্চাদ দিক থেকে কোথা হতে এসে পড়ল। তাদের সোয়াররা আমার ফৌজের ওপর এমন
হামলা করল যে তা শামাল দিয়ে পিছনে ফিরার সুযোগই দিল না।
ঐ পয়গামে তিতুমীর যুদ্ধ ও তার ফৌজের করুণ অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করে ছিল তারপর সে যা লেখেছিল তা আজও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত।
তারা কারা এবং কোথা থেকে আসল তা বুঝা গেল না। তবে যারাই হোক এবং যেখান থেকেই আসুক তারা যে অত্যন্ত যুদ্ধবাজ ও ভয়ঙ্কর এতে কোন সন্দেহ নেই। হতে পারে তারা দম্য দল, লুটতরাজ করে ফিরে যাবে তবে তাদেরকে সেখানে খতম করা জরুরী। আমার ফৌজ পনের হাজার আর তাদের ফৌজ ছিল এর অর্ধেক এখন আমার এর চেয়ে আরো বেশী ফৌজের প্রয়োজন। সর্বশেষ এবং জরুরী কথা হলো তাদের সাথে আমাদের জায়গীরদার জুলিয়ন এবং ডেজার ভাই আওপাসও রয়েছে।
রডারিক পেরেশাসন ও আশ্চর্য হয়ে বললেন, জুলিয়ন? আওপাস! তাদেরকে মৃত্যু এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। আমি বুঝেছি। তিতুমীর বুজদিল প্রমাণিতহয়েছে, আমি তাকে জীবিত থাকার সাধ মিটিয়ে দেব। হামলা করেছে কারা,এতটুকু দেখার সুযোগ সে পায়নি…..
জুলিয়ন-আওপাস আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে এসেছে। তার নিজস্ব ফৌজের সাথে বর্বরদের হয়তো নিয়ে এসেছে। তিতুমীরকে ফৌজ দেব না, আমি নিজেই যাব। জুলিয়নের বেটী ফ্লোরিডাকে আমার মহলে নিয়ে আসব। ঐ বদবখতদের জানা নেই আমি গাদ্দারীর কি শাস্তি দেই।
রডারিক হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন এবং বিদ্রোহীদের বিবস্ত্র আওরাতদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা এখন চলে যাও, তারপর সিপাহীদেরকে রডারিক নির্দেশ দিলেন, কাল সকালে বিদ্রোহীদেরকে ময়দানে নিয়ে ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ করে হত্যা করবে আর তাদের আওরতদেরকে রেখে দিয়ে এখানের গির্জার পাদ্রীদের কাছে সমর্পণ করবে।
মহিলারা বুক ফাটা চিৎকার শুরু করল, দুতিন জন বাদশাহর পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল, একজন মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আপনি আমাদেরকে অনেক শাস্তি দিয়েছেন আর শাস্তি দিয়েন না মাফ করেদেন।
এক কিশোরী বলল, বাদশাহ সালামত! আমার বাবার অপরাধের শাস্তি কেন আমাকে দিচ্ছেন? আমি তো কিছুই জানি না আমার বাবা পর্দার আড়ালে কি করেছে। অন্য আরেকজন মহিলা বলল, আমাকে ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ করেন; আমার ভাইকে ছেড়েদিন।
রডারিক ধাক্কা দিয়ে তিনজনকেই সরিয়ে দিল।
সর্বকনিষ্ট কিশোরী বলল, শাহে উলুস! যত পার আমাদের ওপর জুলুম কর, আমাদের অশ্বতলে পৃষ্ঠ কর, একজন নির্যাতিত, নিপীড়িত অসহায় লাড়কীর চিত্ত ফাটা আহ্….. শুনে রাখ। তোমার বাদশাহী মসনদ ও ঘোড়ার পদাঘাতে চুর্মার হবে, মিটে যাবে চির তরে তোমার নাম নিশানা, তোমার ও তোমার বাদশাহীর দিন ঘনিয়ে এসেছে।
রডারিক তিরস্কারের হাসি হেসে বলল, সাবাস! আমি তোমার সাহসীকতার তারীফ করছি, তুমি এত বড় মুলুকের বাদশাহকে ভয় করনি….. এখানে এসো লাড়কী! আমি তোমাকে ইনয়াম দেব।
লাড়কি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রডারিক : সবার দিকে ফিরে দাঁড়াও। সকলে দেখ এ লাড়কী কত বড় সাহসীনী বীরঙ্গনা। লাড়কী রডারিকের দিকে পশ্চাদ ফিরে দাঁড়াল। দরবারীরা তাকে দেখতে লাগল। রডারিকের তলোয়ার তার শাহী কুরসীর সাথে রাখা ছিল। বাদশাহ ক্ষীপ্ততার সাথে দ্রুত বেগে তলোয়ার কোষমুক্ত করে পশ্চাদ দিক হতে কিশোরীর মস্তকে এমন জোরে আঘাত হানল, এক কোপে মাথা শরীর থেকে পৃথক হয়ে গেল এবং সে কিছুক্ষণ ছটফট করে চিরতরে নিথর হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে বিদ্রোহীদেরকে এক ময়দানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। অপর প্রান্তে পঞ্চাশ-ষাটজন ঘোড় সোয়ারী অত্যন্ত দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা বিদ্রোহীদের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বিদ্রোহীরা তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এদিক-সেদিক ছুটতে লাগল, সোয়ারীরা ঘোড়া ছুটিয়ে অশ্ব পদতলে তাদেরকে চিরতরে খতম করে দিল।
***
এদিকে উত্তর আফ্রিকার দারুল ইমারত কায়রোতে আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের পয়গাম পড়ে আহাম ব্যক্তিদেরকে শুনাচ্ছিলেন।
…. আল-হামুদুলিল্লাহ্, আমরা আমাদের দ্বিগুণ দুশমনের ওপর বিজয়ার্জন করেছি। আমাদের তিনশত ঘোড় সোয়ারের মুকাবালায় এক হাজার ঘেড়. সোয়ার ছিল। স্পেনের প্রতিটি সৈন্যের ছিল লৌহ শিরোস্ত্রান। তাদের হাতিয়ার ছিল আমাদের হাতিয়ারের চেয়ে অনেকগুণ ভাল। আল্লাহ্ তায়ালা ফাতাহ্ হাসিলের তরিকা আমাকে বাতলিয়েছেন। আল্লাহর পক্ষ হতে আমি মদুদ প্রাপ্ত হয়েছি। তীরন্দাজদেরকে বৃক্ষে আর ঘোড় সোয়ার দেরকে টিলার পাশে লুকিয়ে রেখে ছিলাম। তারপর পশ্চাদে হটার থোকা দিয়ে তাদেরকে সম্মুখে অগ্রসর করেছি, তারা এগুতে এগুতে আমার তীর আন্দাজের নাগালে এলে তারা বৃক্ষ হতে দুশমনের ওপর অবিরাম তীর বর্ষণ শুরু করলে তারা পেরেশান হয়ে পড়ে এরি মাঝে পশ্চাদ হতে আমার ঘোড় সোয়ার তাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। এভাবে সাত হাজার আল্লাহর পথের মুজাহিদ পনের হাজার কাফেরের ওপর বিজয়ার্জন করে।
আমি পয়গাম লেখাচ্ছি আর যে দৃশ্য দেখছি সে দৃশ্য আমীরে মুহতারাম ও খলীফাতুল মুসলিমীনেরও প্রত্যক্ষ করার মত। দুশমনের লাশ এত বেশী যে শেষ হচ্ছে না। জংগী কয়েদীর দ্বারা লাশ সরাচ্ছি। যত গর্ত ছিল তাতে লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে, গত শেষ হয়ে গেছে কিন্তু লাশ শেষ হয়নি। বাকি শবদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ছয়শত অশ্ব হস্তগত হয়েছে। মৃত দুশমনের হাতিয়ারের স্তূপ জমেছে।
এখন অতিরিক্ত ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন। খবর পেয়েছি, স্পেন ফৌজ অনেক বেশী এবং সম্মুখে কেল্লাবন্দি শহর। আমি অতিরিক্ত ফৌজের জন্যে ইন্তেজার করে সম্মুখে অগ্রসর হব। আমাদের কামিয়াবীর জন্যে দোয়া করবেন। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আর ফিরে আসব না, কারণ ফিরে আসার কোন রাস্তাই নেই। আমরা যে চারটি জাহাজে এসেছিলাম তা অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করা হয়েছে।”
মুসা ইবনে নুসাইর হর্ষফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, সাবাশ! তোমাকে কোন শক্তি পরাজিত করতে পারবে না।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের বিজয় খবর ও তার জন্যে সাহায্যের আবেদন করে তখনই খলীফা ওয়ালীদ ইবনে মালেকের নামে একটা পয়গাম লিখিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
***
পামপিলুনাতে রডারিক হুকুম জারি করলেন, এখান থেকে টলেডো পর্যন্ত যেন এ ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয় যে, স্পেনে বহিরাগত কওম অনুপ্রবেশ করেছে যারা এত শক্তিশালী ও রক্তপিপাসু যে, তাদের চেয়ে দ্বিগুণ ফৌজকে তারা খতম করে দিয়েছে। রডারিক তার ফরমানে একথাও বলে ছিল যে আক্রমণকারীদের ব্যাপারে যেন মানুষকে ভয় দেখান হয় এবং বলা হয়, তারা দস্যুদল, তারা-তোমাদের ধন সম্পদ ও আওরতদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে আর তোমাদের মুলকে লাগাবে আগুন, তোমাদেরকে করবে হত্যা।
সরকারী কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। তারা প্রত্যেক গ্রাম মহল্লার কর্মচারীর কাছে এ পয়গাম পৌঁছিয়ে টলেডোতে গিয়ে পৌঁছল তারপর প্রত্যেক বস্তি ও গির্জাতে এলান হতে লাগল,
“সমুদ্রের দিক থেকে এক অজ্ঞাত মুলকের এক বড় দস্যুদল ও লুটেরা আমাদের মুলকে প্রবেশ করেছে। তারা আমাদের অনেক বড় ফৌজী দলকে হালাক করে দিয়ে তুফানের মত সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। তারা বাড়ীতে হানা দিয়ে নগদ টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ কবজা করছে আর জওয়ান আওরতদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে তারপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঘরে অগ্নি সংযোগ করছে। তাদের এ ধ্বংসলীলা হতে ইবাদতগাহও রক্ষা পাচ্ছে না। নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চাদেরকে বর্শার আঘাতে হত্যা করছে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।
শাহান শাহেউন্দুলুস, তার ফৌজ নিয়ে ঐ ভয়ানক লস্করের মুকাবালায় বেরুচ্ছেন, বাদশাহ্ রডারিক নির্দেশ দিয়েছেন, যে সকল লোক তীর আন্দাজী, তলোয়ার পরিচালনা করতে পারে তারা যেন ফৌজে শামিল হয়। যারা ফৌজে শামিল হবে তারা ভাতা পাবে অধিকন্তু দস্যু দল থেকে যা করতলগত হবে তারও একটা অংশ থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে তোমাদের জান-মাল, তোমাদের ঘর-বাড়ীও লাড়কীরা নিরাপত্তা পাবে…..।
লোক সকল প্রস্তুত হয়ে যাও। হাতিয়ার ও ঘোড়ায় মোয়র হয়ে নিজের ইজ্জত ও ধন-সম্পদ লুট থেকে বাঁচাও আর তা যদি না কর তাহলে আজই বাল-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে চলে যাও এবং কমজোর বুজদিল হয়ে জানোয়ারের মত দিন গুজরান কর। তারপর যখন ফিরে আসবে তখন নিজেদের ঘর-বাড়ীর আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না।
জওয়ান ও অর্ধ বয়সী লোকেরা অত্যন্ত স্পৃহা ও উদ্দীপনার সাথে গায়ের মুলকী লঙ্করকের মুকাবালার জন্যে তৈরী হতে লাগল। তাদেরকে বলা হলো বাদশাহ্ রডারিক অমুক রাস্তা দিয়ে টলেডো যাবেন; ফৌজে শামিল হতে ইচ্ছুক সে যেন রাস্তায় অপেক্ষমান থাকে।
***
কিছু ইবাদত খানায় এ এলান হচ্ছিল না, সেগুলো ছিল ইহুদীদের ইবাদত খানা। তাদের সংখ্যা বেশী ছিল না। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে স্পেনে ইহুদীরা ছিল অত্যন্ত মাজলুম। কারীগরি, প্রকৌশলী, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ইহুদীদের হাতে কিন্তু তাদের পয়সা ছিল না। তাদের থেকে এত পরিমাণ কর আদায় করা হত যার ফলে তাদের কাছে দু’মুটো খাবারের পয়সা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। তাদের নিম্ন শ্রেণীকে অস্পর্শ মনে করা হত।
স্পেনের শাহী মসনদ যখন ডেজার হাতে আসল তখন সে খ্রীষ্টানদের মত ইহুদীদেরকে পদ মর্যাদা দিয়ে টেক্স কমিয়ে দিল। ইহুদীদের খুব সুরত লাড়কীদেরকে জোরপূর্বক গির্জার অধীনে অর্পন করা হত, ডেজা এ নিপীড়নের পথও বন্ধ করে দিল। কেবল ইহুদীদেরই নয় বরং সর্বসাধারণের জীবন মানও সে উন্নত করল আর এটাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। রডারিক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়ে নিজে শাহী মসনদে বসল। স্পেনের শাহী মুকুট নিজের মাথায় পরেই সে ডেজাকে হত্যা করল।
বহিরাগত শত্রুর মুকাবালায় লোক ফৌজে শামিল হবার ব্যাপারে যখন গির্জায়, শহরের চৌকিতে, গ্রামে-গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে এলান হচ্ছিল তখন ইহুদীদের ইবাদত খানায় অন্যদিক নিয়ে গোপন আলোচনা চলছিল।
ইহুদীদেরকে ফৌজে শামিল হওয়া থেকে কিভাবে বাধা দেয়া যায় এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে একদিন পাঁচ-ছয়জন ইহুদী সর্দার এক ইবাদত খানাতে একত্রিত হলো। তারা কোন অবস্থাতেই রডারিককে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না।
ইহুদীদের এক ধর্মগুরু বলল, রডারিকের ফৌজে শামিল হবার বিষয়টাই। কেবল নয় বরং তাকে কিভাবে ক্ষতি করা যায় সে ব্যাপারেও আমাদের চিন্তে-ভাবনা করতে হবে।
অন্য আরেকজন ধর্মগুরু বলল, আগে থেকেই ফৌজে কিছু ইহুদী শামিল রয়েছে, তাদেরকে কিভাবে বের করে আনা যায় সে ব্যাপারে ভাবার দরকার।
অন্য আরেকজন বলল, আমি অন্যদিক চিন্তে করছি। যারা ফৌজে রয়েছে তাদেরকে ফৌজে রেখে রডারিকের ফৌজের বিরুদ্ধে তাদেরকে লাগানো যেতে পারে।
একজন প্রশ্ন করল, তাদের বিরুদ্ধাচরণের কথা যদি কেউ জেনে যায়?
জবাবে অপর জন, কেউ জানতে পারবে না।
অন্যজন বলল, যদি এটা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমি এর চেয়ে আরো বড় ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে পারব।
সৃষ্টিগতভাবেই ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী। মাটির নিচ থেকে গোড়া কাটার ব্যাপারে তারা যেমন পারদর্শী অন্যকোন কওম এমনটি নয়। তাদের ধর্মগুরু এ ব্যাপারে ফায়সালা করল যে, প্রতিটি ইহুদীর ঘরে এ খবর পৌঁছে দিতে হবে যেন কেউ রডারিকের ফৌজে শামিল না হয়।
***
অর্ধবয়সী এক আওরত। নাম তার মেরীনা। যৌবন ডলে গিয়েছিল কিন্তু লম্বা দেহলতা ও ছন্দময়ী চেহারাতে প্রেমের আবেদন ও আকর্ষণ পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তার প্রতি যারা লক্ষ্য করত তাদেরকে তার যাদুময়ী আঁখি যুগল পাগল করে ফেলত। সে কোন সাধারণ ও মামুলী আওরত ছিল না। তাকে শাহী মহলের বেগমদের মাঝে গণ্য করা হত। সে রডারিকের রক্ষিতা ছিল এবং একমাত্র সেই কেবল যৌবন ঢলে যাবার পরও শাহী মহলে বহাল তবীয়তে বিদ্যমান ছিল। মহলের কোন রমণী ত্রিশ বছরে উপনীত হলেই তাকে গায়েব করে দেয়া হত বা ইনয়াম হিসেবে ফৌজের কোন আলা-অফিসারকে দিয়ে দেয়া হত।
মেরীনা ইহুদী ছিল। ইহুদীদের স্বভাব মুতাবেক সেও ষড়যন্ত্রকারীনি ছিল। একেতো সে ছিল রমণী দ্বিতীয়ত: ছিল অত্যন্ত সুন্দরী ও মায়াবী। অধিকন্তু চক্রান্তকারী সুচতুর ইহুদীর মেধা। এ সকল সিফত ও বৈশিষ্ট্য বলে সে মহলে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। সেজে ছিল শাহী হেরেমের রাণী। তার কৃষ্ণকালো আঁখি যুগল ও বচন ভংগিতে ছিল যাদু পরশ ও সম্মোহনী প্রবল আকর্ষণ। যার হাত থেকে রডারিকও পারেনি বাঁচতে।
সে সময় স্পেনের রাজধানী টলেডোর শাহী মহল হতে এক দেড় মাইল দূরে সবুজ শ্যামলে ঘেরা একটা ঝিল ছিল, সে ঝিলের এক পাশে ছিল গাছ-পালা লতা গুল্মে ঢাকা একটা উঁচু টিলা। সে ঝিলের কাছে কোন পুরুষের যাবার অনুমতি ছিল না কারণ তা শাহী মহলের আওরতদের জন্যে খাছ করে দেয়া হয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে সেথায় আওরতরা সন্তরন, নৃত্য, গান-বাজনা ও আমোদ-প্রমোদের জন্যে যেত।
বিকাল বেলা। সূর্য বিদায়ের জন্যে পশ্চিম দিগন্তে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। ঝিল পাড়ে পঁচিশ-ত্রিশজন রমণী গল্প-গুজব, খেলা-ধুলা, হাসি-তামাশায় মেতেউঠেছে। তাদের মাঝে কিশোরী ও পূর্ণযৌবনা ললনারাও রয়েছে। প্রতিদিনই তারা এ ঝিল পাড়ে এ ধরনের কর্মে লিপ্ত হত। তাদেরকে নেগরানী করত মেরিনা। সে বিকেলেও মেরীনা তাদের নেগরানী করছিল।
ঝিল অদূরে গাছের আড়ালে ললনাদের অশ্ব গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল যার কোচওয়ান ছিল পুরুষ। কোচওয়ানদের একজন দেখতে পেল এক ব্যক্তি ঐ সীমানার ভিতরে এসে গেছে যার কাছে কাউকে আসার অনুমতি দেয়া হয় না। কোচওয়ানরা তাকে ফিরে যাবার জন্যে ইশারা করল কিন্তু সে তার প্রতি লক্ষ্য না করে সম্মুখে অগ্রসর হয়েই চলল, কোচওয়ানরা তাকে বাধা দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালে সে রাস্তা পরিবর্তন করে অগ্রসর হতে লাগল, তাকে বাধা দিতে দিতে সে ঝিল পাড়ে গিয়ে উপনীত হলো। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করল, সে কেবল চোখ দুটো খোলা রেখে মাথা ও মুখমণ্ডল পুরো চাদরে ঢেকে রেখেছিল। সে পা পর্যন্ত লম্বাচোগা পরিহিত ছিল। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করলে সে চিৎকার শুরু করল। ঝিল পাড়ে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত আওরতরা সে আওয়াজ শুনে মনে করল কোন জানোয়ারের আওয়াজ। তারা তার প্রতি তেমন লক্ষ্য করল না। কেবল মেরীনা তার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করল কারণ ইতিপূর্বে কিছু মানুষের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। সে যেহেতু নেগরান ছিল তাই কাপড় পরিধান করে যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল সেদিকে রওনা হল। মেরীনা সামনে অগ্রসর হয়ে দেখল, কোচওয়ানরা পাগলের ন্যায় এক ব্যক্তিকে ধরে টানা-হেঁছড়া করছে আর সে আশ্চর্যজনকভারে চিৎকার করছে। কেবল কোন পাগলের পক্ষেই সম্ভব ছিল সে নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করা। সে মেরীনাকে দেখেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, ঐ যে রানী এসে গেছে। এ কথা বলেই মেরীনার দিকে দৌড় দিল। কোচওয়ানরা তাকে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু দ্রুত দৌড়াচ্ছিল তাই তারা ধরতে পারল না ফলে সে মেরীনার কাছে গিয়ে পৌঁছুল। মেরীনার পদতলে লুটিয়ে পড়ল। মেরীনা কিছুটা পিছে সরে গেল।
সে মাথা তুলে বলল, মেরীনা! আমি আওপাস, তোমার মিলনে এসেছি। কোচওয়ান এসে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে চাইল।
মেরীনা : ছেড়ে দাও। বেচারা পাগল, কারো কোন ক্ষতি করবে না। তোমরা চলে যাও।
আওপাস দুঃখ ভরা স্বরে বলল,আমি পাগল নই মেরীন! পাগল নই! আমি ফরীয়াদি, আমি মাজলুম।
সে ডেজার ভাই আওপাস ছিল, যে ডেজার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করিয়ে তাকে হত্যা করে নিজে শাহী মসনদ দখল করেছে। সে সময় আওপাসের বয়স ছিল সতের-আঠার বছর। আওপাস ছিল গোথা বংশীয়। ডেজা ছিল সর্বশেষ গোথা বাদশাহ্। মেরীনা এক ইহুদী ব্যবসায়ীর বেটী। ডেজার হুকুমতের সময় তার ওমর ছিল ষোল-সতের বছর। আওপাস মেরীনাকে প্রথম দেখাতে ভালবেসে ফেলেছিল কিন্তু মেরীনা তার সে ভালবাসাকে গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছি।
মেরীনা আওপাসকে বলেছিল, এই মরিচিকাকে কেন ভালবাসা বলছ? আমি ইহুদী বেটী হবার পরও এখনও কেন যে শাহী খান্দানের থাবা থেকে বেঁচে আছি তা জানি না। তুমি তোমার গোলামদেরকে হুকুম দাও তারা আমাকে জোর পূর্বক তোমাদের বিলাস বহুল স্বপ্নীল মহলে পৌঁছে দেবে। তুমিতো শাহ্জাদা। বাদশাহর ভাই।
আওপাস : তুমি কি জান না কেন তুমি শাহী খান্দানের হাত থেকে বেঁছে আছ? তোমার কি জানা নেই যে, আমার ভাই মসনদে বসার পর ফরমান জারী করেছেন, কোন ইহুদী লাড়কীকে জোর পূর্বক কোন গির্জায় বা শাহী খান্দানের কারো কাছে সোপর্দ করা গুরুতর অপরাধ। এর বিরুদ্ধাচরণকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। হবে।
আমি বাদশাহর ভাই আর তুমি প্রজা এ কারণে তোমাকে আমি শাহী মহলে নিয়ে যাব না। যেদিন আমি তোমাকে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ করব সেদিন তোমাকে মহলে নিয়ে যাব।….. মেরীনা! আমি তোমাকে পেয়ার করি। মহল থেকে দূরে কোথাও তোমার সাথে আমি সাক্ষাৎ করব।
মেরীনার অন্তরেও আওপাসের মহব্বত জায়গা করে নিয়ে ছিল। তারপর থেকে তারা মহলের বাহিরে কোথাও একত্রে মধুর মিলনে লিপ্ত হতে থাকে। একদিন তাদের মুলাকাতের খবর আপাসের ভাই ডেজার কাছে পৌঁছে।
ডেজা : তুমি যে শাহী খান্দানের সন্তান এ অনুভূতি কি হারিয়ে ফেলেছ? ঐ লাড়কী কে? যার সাথে তুমি মেলা-মেশা কর।
আওপাস : ইহুদী, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক শারীরিক নয় আর আমি তার সাথে বাদশাহর ভাই হিসেবে সাক্ষাৎ করি না।
ডেজা : তুমি কেবল সেই লাড়কীর সাথেই মিলতে পারবে যার সাথে তোমার শাদী দেব। আর সে লাড়কী কে তুমি তো জানই।
আওপাস : আপনি যার সাথে আমার শাদী দেবেন তার সাথে আমি মিলব না। আমি তো ঐ ইহুদী লাড়কীকেই শাদী করব।
ডেজা : তাহলে তুমি এ মুলকের মসনদ ও তাজ থেকে বঞ্চিত হবে। তুমি হয়তো ভুলে গেছ আমার পর এ মসনদে তুমি বসবে। তোমার রাণী গোখা খান্দানের হবে। সে সাধারণ প্রজা ও ইহুদী হবেনা।
আওপাসঃ মসনদ ও মুকুট থেকে বঞ্চিত হব তবুও মেরীনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
বড় ভাই এর সাথে আওপাসের বাদানুবাদ হলো। ডেজা একদিকে বড় ভাই অপরদিকে বাদশাহ। সে এ দু অধিকারে মেরীনার সাথে সাক্ষাৎ না করার নির্দেশ দিল।
যদি সাক্ষাৎ করে তাহলে তাকে কয়েদ খানায় পাঠান হবে। আওপাস এ ধমকীকেও ভয় করল না এবং ভাইকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিল, সে মেরীনার সাথে বেওফায়ী করতে পারবে না।
কিছু দিন পর এক সাক্ষাতে মেরীনা আওপাসকে বলল, ডেজার এক রাজদূত তার বাবাকে বলেছে, সে যেন তার বেটীকে শাহী খান্দানের কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে না দেয় আর মেরীনাকে যেন তাড়াতাড়ি শাদী দিয়ে দেয়।
ডেজা যেহেতু বাদশাহ ছিল তাই মেরীনা নামক ঐ ইহুদী লাড়কীকে ইচ্ছে করলে সরিয়ে দিতে পারত কিন্তু সে ছিল দয়াপ্রবণ ও জনগণের অধিকার সচেতন এ কারণে সে তা করা ভাল মনে করেনি। মেরীনাকে তার বাবা গৃহবন্দি করে রেখেছিল কিন্তু আওপাস রাতের আঁধারে তার সাথে সাক্ষাৎ করত। মেরীনার বাবা তার শাদী ঠিক করেছিল কিন্তু মেরীনা তাতে সম্মত হয়নি।
ডেজা মেরীনাকে তো কোন শাস্তি দেয়নি এমনিভাবে তার বাবাকে কোন প্রকার হুমকি-ধমকি দেয়নি তবে আওপাসকে দিয়েছে কঠিন শাস্তি তারপরও সে মেরীনার সাথে মিলন বন্ধ করেনি, তাইতো বলে প্রেম মানে না কোন বাধা। একদা রাতের আঁধারে তারা পলায়ন করছিল কিন্তু পখিমাঝেই ধরা পড়ে যায়। তারপর থেকে ডেজা আওপাসকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল।
আওপাস তার বাদশাহ ভাই এর জন্যে আর মেরীনা তার বাবার জন্যে এক বড় মসীবত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের প্রেম সাগরে ডুব দেয়া দু’বছর অতি বাহিত হয়েছিল। তাদের প্রেম কাহিনী টলেডো শহরে মানুষের মুখে মুখে অনুরিত হচ্ছিল। এরি মাঝে একদিন হঠাৎ করে শাহী মহলে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। খবর এলো ফৌজ বিদ্রোহ করেছে আর এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে ফৌজী কমান্ডার রডারিক। ডেজা তার দেহরক্ষী দল ও টলেডোতে আরো যে ফৌজ ছিল তাদেরকে নিয়ে বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ দমনের জন্যে রওনা হলো। সে ধারণা করেছিল গিয়েই বিদ্রোহীদেরকে খতম করে ফেলবে কিন্তু বাস্তব অবস্থা ছিল এর বিপরীত। তার জানা ছিল না তার বিরুদ্ধে ফৌজী বাহিনী ও গির্জায় প্রোপাগান্ডা ছড়ান হয়েছিল যে সে নিজ মুলুকের ওফাদার নয় বরং অন্যদেশের বাদশাহর সাথে নিজ মুলুকের ব্যাপারে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
পূর্বেই বলা হয়েছে ডেজা ছিল একজন মানব প্রেমিক বাদশাহ্ আর সে ইহুদীদেরকে স্বসম্মানে বসবাসের ব্যবস্থা করে ছিল এ কারণে ফৌজী অফিসার, জায়গীরদার, আমীর ওমারারা হয়েছিল তার প্রতি অখুশী। পাদ্রীরা তো তার প্রতি হয়েছিল চরম ক্ষীপ্ত। তারা ভোগের জন্যে বেছে নিত ইহুদের নব যৌবনা সুন্দরী ললনা। ডেজা এ রাস্তা করে দিয়েছিল বন্ধ। জায়গীরদার ও ধর্মগুরুরা তার বিরোধী হয়ে যায় ফলে ক্ষমতার মসনদে থাকা হয়ে যায় দুস্কর। ডেজার অবস্থাও এমনটিই হয়েছিল। ডেজা যে ফৌজ টলেডো হতে নিয়ে গিয়েছিল তার দরুন নিজের প্রতি বিশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু ময়দানে গিয়ে সে তার ভুল বুঝতে পারলতাবৎ ফৌজ তার পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সাথে মিলে গেল।
ডেজা রডারিকের হাতে ধৃত হয়ে নিহত হলে তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য পলায়ন করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সিওস্তাতে গিয়ে উঠলে জুলিয়ন তাদেরকে আশ্রয় দিল কারণ জুলিয়ন ছিল ডেজার জামাতা। তা নাহলে সেও তাদেরকে আশ্রয় দিত না। কারণ সে ছিল স্পেনের জায়গীরদার।
***
অন্তত বিশ বছর পর তাদের মিলন ঘটল। মেরীনার নির্দেশ মুতাবেক কোচ ওয়ানরা তাদের গাড়ীর কাছে চলে গেল আর মেরীনা আওপাসকে নিয়ে টিলার ওঁতে গেল। তাদের মিলন ছিল অত্যন্ত আবেগঘণ। দীর্ঘক্ষণ তারা উভয়ে চোখের আঁসুতে আপন আপন হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করছিল। একে যেন অপরের ভেতর প্রবেশ করেছিল।
মেরীনা : তুমি কিভাবে জানতে পারলে আমি টলেডোতে রয়েছি।
আওপাস : এ খবর তো আমি কয়েক বছর আগে থেকেই জানি। জুলিয়নের লোকজন সব সময়ই এখানে আসা যাওয়া করত। তাদের কে যেন আমাকে বলেছিল, যে মেরীনার জন্যে তুমি তোমার ভাইকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলে এবং সিংহাসন হতে বিমুখ হয়ে পড়েছিলে সে মেরীনা রডারিকের হেরেমে রয়েছে। এরপরও তোমার খবরা খবর আমার কাছে পৌঁছত। মেরীনা! এখানে বেশী কথা বর্ণা আমাদের জন্যে সমীচীন নয়, উভয়ের জন্যেই খতা রয়েছে।
মেরীনা : ঠিক বলেছ আওপাস! তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। তুমি অত্যন্ত বিজ্ঞ গোয়েন্দা বলে মালুম হচ্ছে। এখন আমি ঝিলপাড়ে থাকব এটাও তুমি জেনে গেছ।
আওপাস : আমি গোয়েন্দা নই বরং এখানে আমি অভিজ্ঞ গোয়েন্দার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আমাদের গোথা গোত্রের দুজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারা আমাকে প্রথমতঃ বলেছিল যে তুমি এখনও বাদশাহর মহলে রয়েছ। দ্বিতীয়ত: তারা বলেছিল পড়ন্ত বিকেলে মহলের অন্যান্য আওতদের সাথে ঝিলপাড়ে আসা তোমার মামুল। আমি গত পরশুদিন হতে এই বেশে তোমার খোঁজে বনের মাঝে উভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজকে আমাকে গোয়েন্দা খবর দিল তুমি আওরতদের সাথে ঝিল পাড়ে আছ…..। মেরীনা! প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসেছে। রডারিকের থেকে আমি যে প্রতিশোধ নেব তাতো তুমিজান, তোমারও তার থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিৎ। তোমার যৌবনে সে তোমাকে তার উপপত্নী বানিয়ে তোমার জীবন নাশ করেছে। আমিতো বিয়ে শাদী করেছি। বিবি বাচ্চাও রয়েছে।
মেরীনা অত্যন্ত দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলল, ঠিকই বলেছ আওপাস! আমার প্রতিশোধ নেয়া প্রয়োজন। আমি যখন তোমার হতে পারিনি তখন অন্য কারো আর বিবি হতে পারিনি। মাতাও হতে পারিনি। তার পরিবর্তে আমি শয়তানে পরিণত হয়েছি। আমার মাঝে শয়তানের বদঅভ্যাস সৃষ্টি হয়েছে। আর আমি পুরুষদেরকে এবং হেরেমের আওরাতদেরকে আংগুলের ইশারায় নাচান শুরু করেছি। মহলের অফিসার আমীর-ওমারা, উজির-নাজীর আমাকে মুকুট বিহীন ম্রাজ্ঞী বলতে শুরু করেছে।
আওপাস : কথা অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে মেরীনা! তোমার মত আমিও আবেগে ডুবে যাচ্ছি। বিশ বছর পূর্বের সে সব স্মৃতি চারণ করতে ইচ্ছে করছে। কাংখা হচ্ছে জামানা যদি বিশ বছর পিছিয়ে যেত।
মেরীনা : তোমার বিরহের পরে তোমার বিচ্ছেদ বেদনা যে স্বপ্ন আমাকে দেখাচ্ছিল সে কথা আমি তোমাকে বলব, তোমাকে দেখে আমার হৃদয়, সাগরে আবেগের বাধ-ভাংগা ঢেউ উঠেছে।
আওপাস : আপাতত: এখন আবেগ দমিয়ে রাখ মেরীনা! প্রতিশোধের সময় এসেছে।
মেরীনা : আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আক্রমণকারীদের সাথে এসেছ। আক্রমণ কারীরা কারা?
আওপাস : বর্বর। বর্বর মুসলমান। তারপর আওপাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিল জুলিয়ন মুসলশানদেরকে আক্রমণের জন্যে কিভাবে তৈরি করল। আওপাস বলল, মেরীনা। স্পেন ফৌজী বাহিনীতে গোথা ফৌজ যেমনি রয়েছে তেমনিভাবে ইহুদীও রয়েছে। তুমি কি এমন কৌশল অবলম্বন করতে পার, যখন রডারিক ও মুসলমান ফৌজ সামনাসামনি হবে তখন গোথা ও ইহুদীরা মুসলমানদের সাথে গিয়ে মিলে যাবে।
মেরীনা এমনটি আমি করতে পারি এবং বাস্তব এমনই হবে। এ ব্যাপারে বেশী কথা বলার প্রয়োজন নেই।
আওপাস : আর কোন খবর দিতে পার?
মেরীনা : হ্যাঁ। রডারিক পামপিলুনাতে রয়েছে এবং সৈন্য একত্রিত করছে। সাধারণ জনসাধারণকে ফৌজে শামিল হবার জন্যে বলা হচ্ছে। মুসলমান ফৌজ সংখ্যা কত।
আওপাস : সাত হাজার। তবে এখন কিছু কম রয়েছে কারণ প্রথম লড়াই-এ কিছু মারা গেছে।
মেরীনা! আহা! তারা তো সংখ্যায় খুবই কম। মুসলমানতে সব খতম হয়ে যাবে।
আওপাস মৃদু হেসে বলল, তোমাদের জেনারেল তিতুমীরকে জিজ্ঞেস কর। তুমি যদি মুসলমানদের যুদ্ধ করতে দেখ তাহলে পেরেশান হয়ে যাবে। তারা কুফরের বিরুদ্ধে লড়াই করা জিহাদ বলে। যার অর্থ হচ্ছে পবিত্র যুদ্ধ। মুসলমানরা জিহাদকে ইবাদত মনে করে। আর সে ইবাদতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে তারা আত্মতৃপ্তি হাসিল করে তবে তারা অহেতুক জীবন দান করে না। যেহেতু তাদের মনে বিন্দুমাত্র মৃত্যুর ভয় থাকে না তাই তারা দুশমনের ফৌজী দলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুশমনের জন্যে মৃত্যুদূত হয়ে উঠে। তাদের সেনাপতি এমন কৌশল জানে দুশমনের কোমর ভাঙ্গার পরে তারা তার সে কৌশল বুঝতে পারে। আমার চোখের সামনে মুসলমানদের সাত হাজার ফৌজ তিতুমীরের পনের হাজার ফৌজের যে দুর্দশা করেছে সে সম্পর্কে তুমি তো শুনেছই।
মেরীনা : ভাল করে শুনে রাখ আওপাস! রডারিক যে ফৌজ সংগ্রহ করছে তা এক লাখের কম হবে না।
আওপাস : সে ব্যাপারে তুমি আমাদেরকে ভাবতে দাও। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবেসে থাক এবং সে ভালবাসা যদি এখনও তোমার হৃদয়ে থেকে থাকে তাহলে আমি তোমাকে যে কাজ করতে বলেছি তা কর।
মেরীনা : তা অবশ্যই হবে, তুমি চিন্তে করনা। পাগল বেশে তুমি এখান থেকে চলে যাও।
আওপাস : আমি কয়েক দিনের মাঝেই তোমার কাছে আসছি। একথা বলে আওপাস সেখান থেকে চলে গেল।
***
স্পেনের ইতিহাস বেত্তারা এমন কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেছে যা আশ্চর্যজনকই কেবল নয় অবিশ্বাস্যও বটে কিন্তু যখন দেখি, সে সব বর্ণনা ইউরোপের ঐতিহাসিকরা তৎকালীন লেখকদের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন তখন বিশ্বাস করতে হয়। খ্রীস্টান ঐতিহাসিকদের জন্যে মুসলমানদের বিপক্ষে লেখার দরকার ছিল কারণ স্পেনের বিজয় খ্রীস্টান নয় বরং গোটা খ্রীস্টবাদের ছিল পরাজয়।
তিনজন নির্ভরযোগ্য খ্রীস্টান ঐতিহাসিক তারেক ইবনে যিয়াদ ও রডারিকের ব্যাপারে কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন। স্পেন ফৌজী বাহিনীর জেনারেল তিতুমীরকে পরাজিত করার কয়েক দিন পর তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে যেদিকে যাবেন সেদিকে যাচ্ছিলেন। কেন্দ্র থেকে সাহায্য আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রথম যুদ্ধ ময়দানের কাছেই তাবু স্থাপন করে ছিলেন। যুদ্ধ ময়দান হতে মরদেহ তো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল কিন্তু জমাট বাঁধা রক্তের পাহাড় জমে ছিল ফলে রাতদিন সর্বদা নানা ধরনের জানোয়ার ও সরিসৃপ রক্তপানে ভীড় জমিয়ে ছিল। সাপ-বিচ্ছুতে পুরো এলাকা ভরে গিয়েছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ সম্মুখ এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়ে ছিলেন। পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিলেন জুলিয়ন। তার সাথে মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফও ছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আওপাস কবে নাগাদ ফিরে আসবে? ধরা পড়ে যাবে নাতো?
জুলিয়ন : সে তো এমন আনাড়ী নয় যে ধরা পড়বে। অবশ্যই কিছু একটা করে আসবে। এমন ছদ্দবেশে গেছে কেউ তাকে চিনতে পারবেনা ফলে তার গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তাছাড়া কয়েদীদের থেকে আপনিতো শুনতে পেয়েছেন রডারিক টলেডোতে নেই। তামাম আমীর-ওমারা, উজীর-নাজীররাও তার সাথে গিয়েছে এ অবস্থায় আওপাসের জন্যে কাজ করা সহজ হবে।
তারা কথা-বার্তায়, আলাপ-আলোচনার মাঝ দিয়ে জেলে ও মাল্লাদের বস্তি অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদকে বলা হয়েছিল। বহুদূর পর্যন্ত কোন শহর, পল্লী নেই এ কারণে এখানে ফৌজও নেই। তারা আরো অগ্রসর হলো। চতুর্দিক সবুজ শ্যামলে ঘেরা সৌন্দর্য মণ্ডিত পরিবেশ। কুদরতের সে সৌন্দর্যের লীলাতে ছোট একটা বস্তি ছিল যার আশে-পাশে লোক ঘোরা-ফেরা করছিল। তারেক তার সাথীদের সাথে যখন ঐ ব্যক্তির কাছে পৌঁছল তখন লোকগুলো তাদের নিজ নিজ বাড়ীতে চলে গেল।
তারেক : জুলিয়ন! তারা হয়তো জেনে গেছে যে, আমরা তাদের ফৌজ বাহিনীকে পরাস্ত করেছি। তাদেরকে বুঝাবে যে আমরা ঐ বিজয়ী বাদশাহদের মত নই যারা বিজয়ার্জন করার পর তাদের ফৌজরা মানুষের বাড়ী-ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট করে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং লাড়কীদেরকে বে আক্র করে।
জুলিয়ন : ইবনে যিয়াদ! তাদের বুঝানোর প্রয়োজন কি? তোমাদের পক্ষ থেকে এমন কোন কান্ড না ঘটলে তারা এমনিতেই বুঝে যাবে।
তারা এ ধরনের আলাপ-আলোচনা করছিল এরি মাঝে এক বুড়ি আাত বস্তি থেকে বেরিয়ে এসে তারেকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। তারেক তার ঘোড়ী থামালেন সাথীদের ঘোড়াও দাঁড়িয়ে গেল।
বুড়ি : আমাদের ফৌজ বাহিনীকে যে ফৌজ শেকান্ত দিয়েছে সে ফৌজের কমান্ডার কি তোমাদের মাঝে রয়েছে?
জুলিয়নঃ হ্যাঁ বুড়ি মা! ইনি হলেন সে ফৌজী বাহিনীর কমান্ডার। জুলিয়ন তারেকের দিকে ইশারা করে বুড়ির ভাষায় কথাগুলো বলল।
বুড়ি কোন প্রকার ভয়-ভীতি ছাড়াই তারেককে বলল, ঘোড়া থেকে নেমে তোমার মাথা উম্মুক্ত কর।
মুগীছে রূমী স্পেনের ভাষা বুঝতেন, তিনি তারেককে বুঝিয়ে বললেন, বুড়ি কি বলছে।
তারেক অশ্ব হতে অবতরণ করে মাথা আবরণ মুক্ত করলেন।
বুড়ি তারেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সাবাস! তুমি এসেগেছ…..। আমার স্বামী গণক ছিল, তার ভবিষ্যৎ বাণী দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে মরে গেছে। আমাকে বহুবার বলেছে, বাহিরে থেকে একটা কওম আসবে, স্পেন জয় করে তারা দেশ শাসন করবে। তাদের কামান্ডারের আলামত হবে তার মাথা-দাড়ির কেশ হবে স্বর্ণালী আর তার ললাট হবে প্রশস্ত সে ব্যক্তিই হলে তুমি। স্বর্ণকেশী এবং তোমার কপালও চওড়া। আরও একটা নিশানা রয়েছে তোমার কাঁধ আবরণ মুক্ত কর, সেখানে একটা বড় তিলক এবং তার আশে-পাশে কেশ থাকবে।
মুগীছে রূমী তাকে বুঝিয়ে দিলেন বুড়ি কি বলছে তারপর তাকে স্কহ্মদ্বয় উন্মুক্ত করার জন্যে বললেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার কাঁধ আবরণ মুক্ত করতে করতে বললেন, বুড়ি ঠিকই বলেছে, আমার বাম স্কন্ধে তিলক রয়েছে।
তারেক ইবনে যিয়াদের তিলক ও তার আশপাশের কেশ দেখে বুড়ি বলল, স্পেনকে তুমিই জয় করবে। তুমিই হলে সে ব্যক্তি যে এদেশের জনসাধারণকে বাদশাহ্ ও তার কর্মচারীদের নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করবে।
এ ঘটনা তিনজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক লেখেছেন।
তারেক ইবনে যেয়াদ তার সাথীদেরকে বললেন, বন্ধুগণ! আমি তোমাদেরকে এবং পুরো সৈন্যবাহিনীকে আমার স্বপ্নের কথা বলেছি, যার মাঝে রাসূল (স) আমাকে বিজয়ের বাসারত দিয়েছেন। এখন এ বুড়ি সুসংবাদ শুনাল স্পেন বিজেতা আমিই হব। তবে স্মরণ রেখ! আমাদেরকে কিন্তু জীবন বাজী রেখে লড়তে হবে।
***
ঐ রাতেই আওপাস ফিরে এলো। সে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছিল। সে প্রথমে জুলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করল। জুলিয়ন তাকে তারেক ইবনে যিয়াদের তাবুতে নিয়ে গেল সেখানে অন্যান্য সালাররাও ছিলেন। আওপাস তার পুরো কার্যকর্মের কথা বর্ণনা করল। মেরীনার সাথে মুলাকাত ও তার সাথে যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তাও নাল।
তারেক : তুমি কি বিশ্বাস কর যে, ঐ আওরত এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেবে?
আওপাস : তার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। যদি মেরীনা এ কাজ না করে তাহলে অন্যরা করবে। গোথা কওমের কয়েকজন সর্দার সেখানে মওজুদ ছিল তাদের সাথে আমি সাক্ষাৎ করে এসেছি।… তবে ইবনে যিয়াদ ভাল করে একথাটা শুনে নাও যে, রডারিক কমছে কম এক লাখ ফৌজ সাথে নিয়ে আসবে। পিমপুলনা থেকে টলেডো পর্যন্ত সকল লোক ফৌজে যোগ দিচ্ছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এটা তো আমার জন্যে সুসংবাদ। যদি সাধারণ জনগণ ফৌজে শামিল হয় তাহলে তারা ভিড় বাড়িয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ করবে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ ফৌজের মত লড়াই করতে পারবেনা। তারা যুদ্ধ নিয়ম-কানুন ও শৃংখলার ব্যাপারে অজ্ঞ হবে।
আবু জুরয়া তুরাইফ : তারপরও খুশী হয়ে অসচেতন থাকা আদৌ সমীচীন হবে না। আমাদের ফৌজ সংখ্যা কখনও তাদের সমপরিমাণ হবে না। আমাদের জন্যে যদি সাহায্য আসে তাহলে সে সৈন্য সংখ্যাও সাত হাজারের বেশী হবে না।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আমি তোমাদের সকলকে একথা বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থা করছেন, আওপাস টলেডোতে যা করে এসেছে তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতি হাতে করেছেন।
***
আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর খলীফা ওয়ালীদকে তারেক ইবনে যিয়াদের প্রথম বিজয়ের সংবাদ পাঠিয়ে যে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, তার জবাবে খলীফা সাহায্যের জন্যে পাঁচ হাজার ফৌজ পাঠিয়ে ছিলেন। সে পাঁচ হাজার ফৌজের মাঝে সোয়ারী কতজন ছিল আর পায়দল কত ছিল তার সংখ্যা কোন ইতিহাসেই বিস্তারিত পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়টা সকলেরই সামনে ছিল যে প্রয়োজনের তাগীদে ফৌজ সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। তারেকের কাছে সাত হাজার ফৌজ ছিল যার মাঝে প্রথম যুদ্ধে কিছু শহীদ হয়েছিল। পরবর্তী সাহায্যের জন্যে প্রেরিত ফৌজ মিলিয়ে মোট ফৌজ হয় বার হাজার।
এদিকে রডারিকের এলান অনুপাতে মানুষ অত্যন্ত স্পৃহা-আগ্রহ নিয়ে দলে দলে ফৌজী বাহিনীতে শামিল হচ্ছিল। কয়েক দিনের মাঝেই রডারিকের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে ছিল আর এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুশিররা (পরামর্শ দাতাগণ) বলেছিল, আক্রমণকারীদের সংখ্যা মাত্র সাত হাজার এত কম সংখ্যক ফৌজের মুকাবালায় এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য জমা করার কোন প্রয়োজন নেই। এতে একে তো সময় নষ্ট হচ্ছে অপর দিকে খরচ বাড়ছে।
রডারিক শাহী হুংকার দিয়ে বলল, তিতুমীর আক্রমণকারীদেরকে জিন-ভূত হিসেবে অবহিত করেছে, আমি লাখের বেশি ফৌজ নিয়ে যাব যাতে দুনিয়ার অন্য কওমও জানতে পারে যে, স্পেনের বাদশাহ্ কত শক্তিশালী। পরে তাদের দেমাগ থেকে স্পেনের ওপর আক্রমণের ভূত বেরিয়ে যাবে। আমি অসংখ্য ফৌজের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের সাত হাজার ফৌজকে পদতলে পৃষ্ঠ করে মারব। বিশ পঁচিশ হাজার অশ্বারোহী তাদের ওপর দৌড়িয়ে আমি তাদের শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে কিমা বানাব। আমি জিন ভূতকে ভয় পাই না।
রডারিক যে একজন নির্ভীক বীর বাহাদূর লড়াকু ছিল ইতিহাস এ বাস্তবতা স্বীকার করে এবং সে যে জিন-ভূতকে ভয় পেতনী তাও প্রমাণ করে। তার নির্ভীকতা ও বীরত্ব এমন রূপ কথা জন্ম দিয়েছে যা ইতিহাসের একটা অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার এক ঐতিহাসিক ডাশনকশন আওরং তার বই “স্পেনের বিজয়” এর মাঝে এ ঘটনা বিস্তারিত ভাবে লেখেছেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক লেইন পোল এ ঘটনা ড্রশনকশন ছাড়া পূর্বেকার দলীল দস্তাবেজ এর উদ্ধৃতি দিয়ে তার গ্রন্থ “মূর স্পেনে উল্লেখ করেছেন। (ইউরোপের ঐতিহাসিকরা বর্বর মুসলমানদেরকে মুর লেখেছেন)।
আরেকটি ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, “তারেক ইবনে যিয়াদ’ স্পেন আক্রমণ করার কিছুদিন পূর্বে বাদশাহ্ রডারিক টলেডোতে তার দরবারে মসনদে বসে আছে, এমন সময় দু’জন সম্মানিত বৃদ্ধ দরবারে প্রবেশ করল। তারা পুরাতন যুগের আবা কাবা পরিহিত ছিল। তাদেরকে দেখে ধর্মগুরু বলে মনে হচ্ছিল। তাদের শুভ্র দাড়ি ও চাল-চলনে বলছিল তারা উঁচু পর্যায়ের গণক বা পাদ্রী। তারা তাদের কাপড় কোমরবন্দ দ্বারা কোমরের সাথে বেঁধে রেখে ছিল আর তাদের কোমর বন্দের সাথে ছিল চাবির বড় গোছা। রডারিকের মত দাম্ভিক বাদশাহও তাদের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মাঝ থেকে একজন হাতের ইশারায় রডারিককে বসার জন্যে ইশারা করলে রডারিক বসে পড়ল।
এক বৃদ্ধ বলল, হে শাহে উন্দুলুস! আমরা তোমাকে একটা গোপন কথা বলার জন্যে এসেছি। প্রত্যেক নতুন বাদশাহর জন্যেই জরুরী সে গোপন বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া। তুমি নতুন আসনাসীন হয়েছে এবং তোমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
রডারিক : এ গোপন বিষয় সম্পর্কে আমি অবহিত হতে চাই না। আশা করি আর কোন ভূমিকার প্রয়োজন নেই।
বৃদ্ধ : বেশী অস্থির হয়ো না বাদশাহ্! গোপন বিষয় অবগত হবার পরেও ধৈর্য হারা হবে না। তা নাহলে পরে আফসোস করতে হবে। … যখন এ মূলকে হিরাক্লিয়াসের বাদশাহী ছিল তখন সে স্পেন প্রজন্মের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তারপর সে এ টলেডো শহরের বাহিরে একটা বুরুজ নির্মাণ করিয়ে ছিল। তার মাঝে সে কোন যাদু মন্ত্র রেখেছিল। ঐ বুরুজের একটাই লোহার দরজা যা অত্যন্ত শক্তিশালী মজবুত। দুরজাতে সে নিজ হাতে তালা লাগিয়ে ছিল। সে বলেছিল স্পেনের প্রত্যেক নব বাদশাহর জন্যে অপরিহার্য সে শাহী মসনদে বসার কিছু দিন পর এ দরজায় একটা তালা লাগিয়ে তার চাবি আমাদের কাছে অর্পণ করবে। বৃদ্ধ চাবির গোছা দেখিয়ে বলল,এগুলো ঐ তালার চাবি যা হিরাক্লিয়াসের পরেএবং তোমার পূর্বের বাদশাহরা লাগিয়ে ছিল। এবার তোমার পালা। দরজায় তালা লাগিয়ে দাও; আমরা একদিন এসে চাবি নিয়ে যাব।
রডারিক : আমি ঐ বুরুজ দেখেছি। আমি তাকে কোন পুরাতন ইমারত মনে করছিলাম। তোমরা দু’জন কি ঐ বুরুজেই বাস কর?
বৃদ্ধ বলল, না হে শাহে আন্দুলুস! আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। এ চাবি আমাদের বাপ-দাদারা দিয়েছে। এ বুরুজের হেফাজত করা আমাদের খান্দানের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব আমাদের খান্দানের আগত প্রজন্ম পালন করবে।
রডারিক : তোমাদের সে দায়িত্ব আমি এখানেই শেষ করে দেব।
অপর বৃদ্ধ : হে শাহান শাহ! আমাদেরকে তুমি তোমার প্রজা জ্ঞান কর না। বুরুজ খোলার ইরাদা যদি তোমার থেকে থাকে তাহলে তুমি ভাল করে শুনে নাও, পরিণামে তুমি অনুশোচনায় আগুনে পুড়বে। অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণামের শিকার হবে।
ইতিপূর্বে যে সব বাদশাহরা সে দরজা খুলেছে তাদের পরিণাম কি পরিমাণ ভয়াবহ হয়েছিল তা তুমি কোন বিজ্ঞ ইতিহাসবিদকে ডেকে জিজ্ঞেস কর। জুলিয়াস সিজারের চেয়ে জালেম আর শক্তিশালী বাদশাহ্ কে ছিল? সেও ঐ দরজা খোলার চেষ্টা করেনি…। আমরা চলে যাচ্ছি। সাবধান বাদশাহ! আমরা বাস্তব বিষয় বর্ণনা করেছি। তুমি ঐ বুরুজের দরজায় যে তালা লাগাবে কিছুদিন পর আমরা তার চাবি নেয়ার জন্যে আসব।
বৃদ্ধ দু’জন চলে গেল।
***
বৃদ্ধ দু’জন চলে যাবার পর রডারিক ঘোষণা দিল, “রডারিক যদিএ মুলকের বাদশাহ হয়ে থাকে তাহলে এ মুলকের কোন বিষয় গোপন থাকবে না। আমি ঐ বুরুজে তালা তো লাগাবই না বরং তামাম তালা ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখব ভেতরে– কি আছে।
একজন পরামর্শ দাতা বলল, গোস্তাগী মাফ করবেন বাদশাহ নামদার। আমাদের মাঝে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বাদশাহ্ নামদারের সাহসীকতা, বীরত্ব দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শাহান শাহূকে বিপদের হাত থেকে বাঁচান আমাদের একান্ত কর্তব্য। বৃদ্ধ রাহেব বলে গেল বুরুজে হিরাক্লিয়াস কোন যাদুমন্ত্র বন্ধ করে রেখেছে। কোন মানুষ যাদুর মুকাবালা করতে পারে না। আমি শাহান শাহের দরবারে নিবেদন করছি তিনি যেন বুরুজের সিংহদ্বারে তালা লাগিয়ে দেন এবং এ বিষয় যেন ভুলে যান।
রডারিক : এ পরামর্শ যদি তুমি আমাকে দাও তাহলে আমাকে শাহানশাহ বলা ছেড়ে দাও। এ মুলুকের জমিন আমার; এর প্রতিটি রহস্য ভেদ আমার দরকার। ইতিপূর্বে আমি ঐ বুরুজের দিকে কখনো দৃষ্টিপাত করি নাই। এখন যেন মনে হচ্ছে পুরো বুরুজ আমার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পুরোহিত বললেন, শাহান শাহে রডারিক! স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানের পাহাড় শাহ্ রডারিকের নাম শুনে কেঁপে উঠে কিন্তু কিছু অলৌকিক ক্ষমতা এমন রয়েছে যার সামনে মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। শাহান শাহ্ যদি আমাকে নিজ ধর্ম গুরু মানেন তাহলে আবেদন করব, শাহান শাহ্ যেন ঐ বুরুজের দরজা না খোলেন।
রডারিক : হিরাক্লিয়াস আমার মতই একজন বাদশাহ ছিল। সে যদি কোন অলৌকিক ক্ষমতা ঐ বুরুজে বন্ধ করে থাকে তাহলে সে ক্ষমতা তার কজাতে ছিল এখন তা আমি আমার কজাতে আনতে পারি। বাদশাহু মুচকি হেসে দরবারে উপস্থিত সকলের প্রতি নয়ন ফিরিয়ে দাম্ভিকতার স্বরে বলল, হে ভীতুর দল! ঐ বুরুজে রোমীয়রা ধনভান্ডার লুকিয়ে রেখেছিল। সেখানে নিশ্চয় অমূল্যবান হিরা মতি পান্না রয়েছে। তাতে ভয় কেবল এটাই যে হয়তো সেখানে বড় ভয়ংকর বিষধর সাপ লুকিয়ে রয়েছে। তোমাদের মাঝে কে কে আছে যারা ঐ বুরুজের গোপন রহস্য উৎঘাটনে আমার সাথে থাকবো।
রডারিক একথা বলে জেনারেলদের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, যেসব জেনারেলরা বাহাদুর হিসেবে খ্যাত ছিল, তারা বাদশাহর নজরে ভীতু বুজদিল হতে চায় না। তারা সকলে একে একে উঠে বলল, আমি শাহানশাহর সাথে আছি। আমি শাহান শাহর সাথে আছি।
যেসব ইতিহাসবিদরা এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন তারা লেখেছেন, পরামর্শ দাতাগণ, বড় পাদ্রীরা এবং তার পরিবারের লোকরা রডারিককে বাধা দিল। কিন্তু সে কারো বাধা মানল না এবং চার-পাঁচ দিন পরে যুদ্ধ সাজে সেজে বুরুজে (দুর্গে) গিয়ে পৌঁছল। তার সাথে এমন দুতিনজন জেনারেল ছিল যারা বেশ কয়েকটা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব-সাহসীকতা দেখিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। তাদের সাথে বিশেষ ঘোড় সোয়ার দল ও তালা ভাঙ্গার জন্যে মিন্ত্রী ছিল।
বুরুজ একটা প্রশস্ত টিলার ওপর ছিল। তার চতুর্দিকে ছিল উঁচু টিলা। বুরুজ মর্মর পাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সৌন্দর্যের জন্যে জায়গায় জায়গায় রোপা খচিত যা আলোতে ঝলমল করে উঠত। ভেতরে যারার জন্যে টিলা কেটে সুড়ংগ রাস্তা বানান হয়েছিল। সে রাস্তা এত প্রশস্ত ও উঁচু ছিল যে ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে অতিক্রম করা যেত। তার প্রবেশদ্বারে লোহার মজবুত দরজা ছিল যাতে বহু তালা লাগান ছিল। এসব তালা হিরাক্লিয়াস থেকে ডেজা পর্যন্ত সকল বাদশাহদের লাগান।
যে দু’জন বৃদ্ধ পাদ্রী রডারিকের দরবারে গিয়েছিল তারা সেখানে বিদ্যমান ছিল। একজন বৃদ্ধ বলল, আমরা তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি।
রডারিক; ওদের থেকে কুঞ্জীগুলো ছিনিয়ে নাও এবং তামাম তালা খুলে ফেল। রডারিকের শক্তিশালী বাহিনীর সাথে বৃদ্ধরা জবরদস্তি করতে পারল না, তাদের থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয়া হলো।
তালা ছিল অসংখ্য, মরিচা ধরা তালাও ছিল। তাছাড়া এটাও জানাছিল না কোন চাবি কোন তালার। সারাদিন তালা খোলার চেষ্টা-তদবীর চলল। সূর্য ডুবার কিছুক্ষণ পূর্বে তামাম তালা খোলে সদর দরজা উন্মুক্ত করা হলো। রডারিক ভেতরে প্রবেশ করল তার সাথে কয়েকজন জেনারেল ও মুহাফেজ গেল। একটু সামনেই বড় প্রশস্ত হল রূম ছিল। তার একটা দরজা ছিল যদ্বারা এক কামরাতে যাওয়া যেত।
ঐ দরজার সম্মুখে কাঁসার নির্মিত মানুষের এক বৃহৎ আকারের মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। তার এক হাতে লোহার মুগোর ছিল আশ্চর্যের বিষয় হলো মূর্তি ঐ মুগোর দ্বারা জমিনের ওপর আঘাত হানছিল। মূর্তির বুকে স্পেনী ভাষায় লেখাছিল, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।”
রডারিক মূর্তিকে লক্ষ্য করে বলল,আমি কোন খারাপ অভিসন্ধিতে আসিনি, কোন জিনিসে হাত লাগাব না। এখানের গোপন রহস্য জানার জন্যে কেবল এসেছি। তারপর যেমনি এসেছি অমনটি চলে যাব, আমাকে বিশ্বাস কর এবং রাস্তা ছেড়ে দাও।
মূর্তির মুগোর মারা বন্ধ হয়ে গেল। যে হাত ওপরে উঠেছিল তা উপরেই রয়ে গেল আর রডারিক সে হাতের নিচ দিয়ে অন্য কামরাতে চলে গেল তার সাথে তার সঙ্গীরাও গেল।
তারা যে কামরায় প্রবেশ করল তা অত্যন্ত খুব সুরত ছিল। রডারিকের মুহাফেজরা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার আলোতে দেয়ালে মূল্যবান, হিরা, মতি, তারার মত ঝলমল করছিল। কামরার মধ্যখানে টেবিলে একটা সিন্ধুক রাখা ছিল তাতে লেখা ছিল,
“এ সিন্ধুকের মাঝে এ দুর্গের গোপন রহস্য সংরক্ষিত রয়েছে কোন বাদশাহ্ ছাড়া কেউ এ সিন্ধুক খুলতে পারবে না তবে বাদশাহূর্কে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, তার কাছে বিস্ময়কর বিষয়ের দ্বার উন্মোচিত হবে, সে বিস্ময়কর বিষয় যে ঘটনা বিপর্যয় হিসেবে বাদশাহর বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটবে।
রডারিক নির্ভীকনে সিন্দুকের ঢাকনা খুলে ভেতরে দৃষ্টিপাত করল, তাতে এক ফুট লম্বা একফুট চওড়া একটা চামড়ার কাগজ পড়েছিল। তামার একটা প্লেট ঐ চামড়ার নিচে আরেকটি প্লেট ছিল তার ওপরে। রডারিক চামড়া টুকরা হাতে নিয়ে দেখল তাতে ঘোড় সোয়ার যুদ্ধাদের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। তারা তীর, কামান ও বর্শাতে সজ্জিত। তাদের চেহারা ভয়ঙ্কর আর তাদের প্রতিচ্ছবির ওপর লেখা রয়েছে, “লক্ষ্য কর হে অবাধ্য ইনসান! এরা এমন সোয়ারী যারা তোমাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তোমার বাদশাহী ভূলণ্ঠিত করবে।”
রডারিক প্রতিচ্ছবির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল তার জেনারেলদের নজরও তার প্রতি নিবিষ্ট ছিল। তারা এমন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল যেন অদূরেই দু’দল ফৌজ লড়ায়ে লিপ্ত হয়েছে।
অশ্ব দৌড়, শব্দ, ফৌজদের চিৎকার ধ্বনি ভেসে আসছিল। কোন বহিরাগত ফৌজ তার মুলুকে হামলা করেছে এবং তারা টলেডোতে পৌঁছে গেছে এটা ভেবে রডারিক ঘাবড়ে গেল কিন্তু তার হতচকিত ক্ষণিকের মাঝেই শেষ হয়ে গেল কারণ সে যুদ্ধ পরিষ্কার তার সম্মুখে দেখছিল।
তারা যুদ্ধ এভাবে প্রত্যক্ষ করছিল যে, কামরার দেয়াল অদৃশ্য হয়ে তার স্থলে মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল। আর সে মেঘের মাঝে অত্যন্ত প্রশস্ত যুদ্ধ ময়দান দেখা যাচ্ছিল। দু’দল ফৌজ সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। একদল ফৌজ ঈসায়ী অপরদল উত্তর আফ্রিকার মুসলমানরা। উভয় দল ফৌজ একে অপরের খুনের দরিয়া বয়ে দিচ্ছে। তলোয়ার তলোয়ারে ও যুদ্ধ হাতিয়ার হাতিয়ারে টক্কর খাচ্ছিল। যুদ্ধের দামামা বাজছিল। পায়দল ও সোয়ারী জখম হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ছিল আর পলায়ন পদ দ্রুতগামী ঘোড়া তাদেরকে জমিনের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিল। এ ভয়াবহ যুদ্ধের ময়দানে তীর-বর্শা উড়ে এসে মানুষের শরীর জখম করছিল। বেদনাদায়ক আর্তনাদে আসমান থরথর করে কাঁপছিল। পায়দল ও ঘোড়ার পদাঘাতে জমিন টলছিল।
অতি ভয়াবহ ঐ হাঙ্গামার মাঝে বারবার এ আহ্বান শোনা যাচ্ছিল, হে আল্লাহর রাসূলের প্রেমিকগণ! কাফেরদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দাও।
“আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন।”
“হে মুসলমানগণ! পশ্চাতে রয়েছে সমুদ্র, পারাপারের মাধ্যম জাহাজ হয়েছে। ভস্মিভূত।”
“আল্লাহর রাসূল বিজয়ের বাশারত দিয়েছেন।”
রডারিক, তার জেনারেলরা ও মুহাফিজগণ এ রক্তঝরা যুদ্ধের মাঞ্জার প্রত্যক্ষ করছিল। নারা, আহ্বান, শোর-গোল ও আত্ম চিৎকার শ্রবণ করছিল। এ দৃশ্যের ওপর-নিচ, ভান-বাম চতুর্দিকে সফেদ বাদল ছেয়ে ছিল। এ ভয়াবহ দৃশ্য ছিল কাল্পনিক কিন্তু বস্তুত বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল। রডারিকের চেহার রং দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। তার জেনারেল ও মুহাফিজদের চেহারায় ভয় ও আতংকের চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তাদের সাথে যদি বাদশাহ্ না থাকত তাহলে তারা পলায়ন করত।
খ্রীস্টান ফৌজের ঝান্ডা যা পতপত করে উড়ছিল একে একে সব ভূলণ্ঠিত হতে লাগল। মুসলমানদের পতাকা উড়ছিল। পরিশেষে কাফেরদের ঐ ঝান্ডা যার ওপর ক্রস চিহ্ন ছিল তাও পড়ে গেল, সে ঝান্ডা মাটিতে পড়তেই কাফেরদের মাঝে হা হুতাশ ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। মুসলমানরা তাদেরকে খতম করতে লাগল।
রডারিক খ্রীস্টানদের মাঝে একজন যোদ্ধা দেখতে পেল। সফেদ ঘোড়ার ওপর সোয়ার হয়ে রডারিকের দিকে পিঠ ফিরিয়েছিল। তার মাথায় সে সিরস্ত্রান ছিল তা হুবহু রডারিকের শিরস্ত্রানের ন্যায় ছিল। এমনিভাবে তার যুদ্ধ পোষাকও রডারিকের মত। তার সফেদ ঘোড়াও রডারিকের ঘোড়ার ন্যায়। বিন্দুমাত্রও পার্থক্য ছিল না। ইতিহাস বর্ণনা করে রডারিকের ঘোড়ার নাম ছিল ইলইয়া।
যুদ্ধ দৃশ্যে বাদশাহ্ বেশে রডারিক যে সোয়ারীকে দেখছিল সে হঠাৎ করে অশ্ব থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সফেদ অশ্ব সোয়ারীহীন দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে লাগল।
হঠাৎ রডারিক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং পিছে ফিরে দ্রুত পলায়ন পদ হলো। যে’কামরার সামনে কাঁসার মূর্তি মুগর হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিল সেথায় এসে দেখল মূর্তি নেই। রডারিক ও তার সাথীরা আরো ভীত হয়ে পড়ল। তারা দ্রুত– পদে সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। বাহিরে এসে তারা দেখল ঔ দু’জন বৃদ্ধ পাদ্রী যারা প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিল এবং রডারিককে ভেতরে যেতে নিষেধ করছিল তারা মরে পড়ে আছে। রডারিক সেখান থেকে দূরে চলে গিয়ে পিছে ফিরে দেখল দুর্গ যে বাদলে ঢাকা ছিল তা লেলিহান শিখায় পরিণত হয়েছে আর দুর্গের মর্মর পাথর পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলছে। চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। বাতাস তীব্রবেগে প্রবাহিত হতে লাগল। দুর্গের লেলিহান শিখার স্ফুলিঙ্গ ওপরে উঠে জমিনে পড়তে লাগল। এ ঘটনা বর্ণনাকারী ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, দুর্গের আগুন জমিনে যেখানে পড়ছিল তা রক্তে পরিণত হচ্ছিল।
রডারিক তার জেনারেল ও মুহাফিজদের সাথে সেখান থেকে দ্রুত বেগে পলায়ন করল।
***
তারপর রডারিক ধর্মগুরু, পন্ডিত ও জায়গীরদারকে জিজ্ঞেস করতে লাগল ঐ দুর্গের রহস্য কি এবং যে যুদ্ধের দৃশ্য দেখা গেল তার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কি। কেউ তাকে যথাযথ জবাব দিতে পারল না। কেউ তাকে তার বীরত্ব ও বাহাদুরীর তারীফ করল কেউ আবার দুশমনের বিপক্ষে বিজয়ের সুসংবাদ গুনাল। কেবল একজন জাদুকর তাকে কিছু সাফ জওয়াব দিল।
জাদুকর : শাহানশাহর সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। এটা তো কেউ বলতে পারে না যে হিরাক্লিয়াস সে দুর্গ কেন নির্মাণ করেছিলেন। হয়তো হতে পারে তাতে শয়তানের কোন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দুর্গ না খোলাটাই আপনার জন্যে সমীচীন ছিল। লড়ায়ের যে ইশারা আপনি পেয়েছেন তা ভাল ইঙ্গিত বহন করছে না।
রডারিক : আমরা কি সে অশুভ পরিণামের হাত থেকে বাঁচতে পারি না?
জাদুকর : তা একটা তরীকাতেই সম্ভব। তাহলে আপনি যখন কোন যুদ্ধে যাবেন তখন এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য সংখ্যা সাথে নিয়ে যাবেন যাতে দুশমন দেখেই পলায়ন করে, বা যুদ্ধ করা ব্যতিরেকেই আত্মসমর্পণ করে।
এ ঘটনার পর পামপিলুনা এলাকাতে বিদ্রোহ হয়। রডারিক বিশাল ফৌজী বাহিনী নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করে বিদ্রোহীদেরকে চিরতরে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং সেখানেই খবর পায় আফ্রিকা স্পেনের উপর হামলা করেছে। তিতুমীর তাকে সংবাদ দিয়েছিল হামলাকারীদের সংখ্যা সাত/আট হাজার। রডারিক বিপুল সংখ্যাক ফৌজ সংগ্রহের ইন্তেজাম করে সেথা হতে দারুল হুকুমত টলেডোর দিকে রওনা হলো।
সে যখন টলেডোতে পৌঁছুল তখন তার ফৌজ সংখ্যা একলাখে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মাঝে হাজার হাজার ছিল অশ্বারোহী। রডারিক টলেডোতে কালক্ষেপণ না করে তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে রওনা হলো যেখানে তিতুমীর পরাজিত হয়েছে।
এদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ সাহায্যকারী ফৌজ হিসেবে মাত্র পাঁচ হাজার ফৌজ পেলেন। এতে তার মোট ফৌজ সংখ্যা বার হাজারে উন্নীত হলো।
রডারিকের এক লক্ষ্য ফৌজ মুসলমানদের বার হাজার সৈন্যকে ছিন্ন ভিন্ন করার উম্মাদনায় বাঁধ ভাঙ্গা বানের ন্যায় ধেয়ে আসছিল।
***
পাঁচ হাজার ফৌজ তারেক ইবনে যিয়াদের মদদে এসে উপনীত হলো। এতে ইবনে যিয়াদ আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। সাহায্য আসার পূর্বে তার অপেক্ষায় তিনি এমন পাগলপারা ছিলেন যে রাতে হঠাৎ কোন সময় ঘুম ভেঙ্গে গেলে মুহাফিজ দলের কামান্ডারকে তলব করে বলতেন এখনই দু’জন সোয়ারী সমুদ্র পাড়ে পাঠিয়ে দাও সাহায্যের জন্যে ফৌজ আসছে কিনা তারা যেন সংবাদ নিয়ে আসে।
দিনের বেলা তিনি সমুদ্র তীরে গিয়ে জাবালুত তারেকের চূড়াতে উঠে উঁচু হয়ে বারবার সমুদ্র বক্ষে গভীরভাবে নয়ন বুলাতেন পরিশেষে যখন ফৌজ আসার কোন আলামত তিনি দেখতেন না তখন তার প্রতিটি কথা ও কাজে গোস্বার ঝলক দেখা দিত। তার সালাররা তাকে শান্তনা দিয়ে বলতেন সাহায্য বাহিনী অনেক দূর হতে। আসবে তো। তাই কিছুদিন দেরী হওয়াটা স্বাভাবিক।
তারেক কয়েকবার একথা বললেন, আমি জানি তাড়াতাড়ি কেন সাহায্য আসছে না। সম্ভবতঃ আমীরে আফ্রিকা কাসেদকে দামেস্কে পাঠিয়ে খলীফার দরবারে সাহায্যের আবেদন করেছেন। দামেস্ক থেকে ফৌজী সাহায্য আসতে আসতে কয়েকটি নতুন চাঁদ উদিত হবে। বুড়া আর জওয়ানের মাঝে এটাইতো পার্থক্য। একদা তারেক বললেন, মুসা ইবনে নুসাইর বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে ফলে হার কাম এখন আরামের সাথে করতে চায়। তার এ কথা তো স্মরণ রাখা দরকার ছিল যে আমি জওয়ান এবং ধৈর্য হারা। সিরিয়া ও আরব থেকে সাহায্য তলব করার কি প্রয়োজন ছিল এবং তার মাঝে কি বুদ্ধিমত্তা লুকিয়ে রয়েছে? বর্বররা তো মরে যায়নি! কেবল শুধু এলান করে দিলেই হতো যে, সমুদ্র পাড়ে ইবনে যিয়াদের সাহায্য প্রয়োজন তাহলে একদিনের মাঝেই হাজার হাজার বর্বর মুসার দরবারে উপস্থিত হতো।
ফৌজী সাহায্যের অপেক্ষায় তারেক দাঁতের উপর দাঁত পিষছিলেন তারপরও সৈন্যের ট্রেনিং পূর্ণদমে চালু রেখেছিলেন। ঘোড় সোয়ারীদের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন। কারণ তিতুমীরের সাথে যুদ্ধের সময় অসংখ্য ঘোড়া হাতে এসেছিল! তারেক পায়দলদের মাঝ থেকে বেছে বেছে অশ্ব দিয়ে বিশেষভাবে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ বেকার বসে থাকার আদমী ছিলেন না। তাছাড়া তাকে এ বিষয়টাও পেরেশান করে তুলেছিল যে, স্পেনের জেনারেল তিতুমীর পরাজিত হয়ে বসে নাই, সে তারেক ইবনে যিয়াদের ইন্তেজার করবে না বরং পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করার মানসে এবং হামলাকারীদেরকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ এ খবর পেয়েছিলেন যে, স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক রাজধানী হতে বেশ অনেক দূরে রয়েছে। সে বিদ্রোহ দমনে গেছে। তার অবর্তমানে তারেক ইবনে যিয়াদ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খতম করে। আরো কিছু এলাকা দখল করে কিছু ফৌজও হালাক করতে পারতেন।
পরিশেষে সাহায্যের ফৌজ এসে পৌঁছল। তারেক নবাগত পাঁচ হাজার ফৌজকে মাত্র এক রাত্র বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে সকালেই সম্মুখে অগ্রসর হলেন। তিনি জুলিয়নের কাছে জেনে নিয়ে ছিলেন সামনে কোথায় কি রয়েছে। তাছাড়া তিনি ভাল গোয়েন্দা হিসেবে হিজিকে পেয়েছিলেন যে হিজি ফ্লোরিডার কাছে রডারিকের মাথা কেটে আনার ওয়াদা করেছিল। তারেক তাকে দু’জন আদমী দিয়ে ছিলেন তারা দুশমনের এলাকাতে গিয়ে দেখে আসত দুশমন কোথায় আছে এবং তাদের সংখ্যা কত। যদি কেল্লা থাকে তাহলে তা কেমন মজবুত।
সম্মুখে একটা মজবুত কেল্লা ছিল। তিতুমীর ফৌজের কিছু ফৌজ পলায়ন করে সেখানে আশ্রয় নিয়ে কেল্লাবাসীর সংখ্যাধিক্য করেছিল ফলে কেল্লাবাসী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল এবং খুসী হয়েছিল কিন্তু তিতুমের ফৌজরা কেল্লাবাসীদের যুদ্ধের স্পৃহা কমিয়ে দিয়েছিল। বর্বররা তাদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করে দিয়েছিল। পরাজিত সৈন্যরা একথা কখনও বলত না যে তারা নিজেরা বুজদিল কিন্তু হামলাকারীরা যে অত্যন্ত শক্তিশালী তা প্রচার করত। তিতুমিরের ফৌজরা কেল্লাতে প্রবেশ করতেই আওয়াজ তুলে দিয়ে ছিল,
হামলাকারীরা মানবরূপী জিন, ভূত বৈ কিছু নয়। নিজেদের জীবনের বিন্দুমাত্র পরওয়া করে না। আমরা স্বচোখে দেখলাম তাদের কাছে একটাও ঘোড়া নেই, তারপর জানিনা কোথা থেকে যেন বিপুল সংখ্যক ঘোড় সোয়ার আমাদের পশ্চাৎ হতে এসে উপস্থিত হল। আসমান থেকে আমাদের ওপর তীর বর্ষিত হতে লাগল। একেকটা তীর আমাদের একেকজন আদমীকে হালাক করে দিল।
তারা সংখ্যায় আমাদের অর্ধেকও ছিল না।
আর তাদের ধ্বনী! … যেন বজ্রপাত হচ্ছিল।
এ ভীতি কেল্লা অতিক্রম করে শহরের মানুষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। শহরে প্রার্থনা হতে লাগল ঐ জালেম হামলাকারীরা যেন এদিকে না আসে। এটা এমন বাস্তব বিষয় যে খোদ খ্রীস্টান ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেছেন যেমন লেইনপোল লেখেছেন, “মুসলমানরা সংখ্যায় খুবই কম ছিল কিন্তু তারা অসাধারণ বীর বাহাদুর, সাহসী ও জীবন উৎস্বর্গকারী ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ এমন এক সিপাহসালারের হাতে ছিল যাকে ইতিহাস নির্দ্বিধায় ‘হিরো’ হিসেবে অবহিত করে। যুদ্ধ শক্তি, ভাল অস্ত্র শস্ত্র, সংখ্যার বিপুলতা তো স্পেনের ফৌজদেরও ছিল কিন্তু যে স্পৃহায় মুসলমানরা সজ্জিত ছিল তা স্পেন ফৌজের কাছে ছিল না।”
মুসলমানরা আল্লাহর হুকুমে আর স্পেনবাসীরা বাদশাহর হুকুমে যুদ্ধ করছিল। মুসলমানরা তাকবীর দিচ্ছিল আল্লাহু আকবার, আল্লাহ্ সবচেয়ে বড়। এ ধ্বনী তাদের অন্তরে গভীরতম প্রদেশ থেকে বেরুচ্ছিল। এ ধ্বনীর মাঝে যে ভীতি ছিল তা ছিল আল্লাহর নামের। স্পেনীদের কোন ধ্বনী ছিল না। আর থাকলেও তা ছিল শাহান শাহে উন্দুলুস জিন্দাবাদ। এটা একটা প্রাণহীন ধ্বনী। এটা একটি প্রথাগত তাকবীর, এতে উদ্দীপনা স্পৃহা কিছুই নেই।
***
সবুজ-শ্যামলে ঘেরা। চতুর্দিক কুদরতের সৌন্দর্যের শোভায় সুশোভিত। এখনো প্রভাত আলো পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়নি এমন সময় কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে এক সেপাহী চিৎকার করে বলে উঠল “তারা এসে গেছে” তারপর এ আওয়াজে কয়েকজন সেপাহী একসাথে চিৎকার করে উঠল এ শব্দ আপনা আপনিই পুরো পল্লীতে ছড়িয়ে পড়ল।
কেল্লার জিম্মাদার দৌড়ে গিয়ে প্রাচীরে চড়ে মুসলমান লস্কর আসতে দেখল। সে তিতুমীরের মত বিজ্ঞ জেনারলেকে এ লস্করের কাছে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে দেখেছে। কিছুদিন তিতুমীর এ কেল্লাতে অবস্থান করেছিল এবং এমন আঙ্গিকে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছিল তাতে কেল্লার জিম্মাদারের ভেতর ভীতির সঞ্চার হয়ে ছিল। সে ভীতি সঞ্চারক জীন-ভূতের লস্কর এখন তার সম্মুখে উপস্থিত। কেল্লার জিম্মাদার প্রাচীরের ওপর থেকে হুকুম দিল, কেল্লার দরজা ভালকরে বন্ধ করে দাও এবং প্রতিটি দরজার সামনে পূর্ণ প্রস্তুত থাক। ..
তীর আন্দাজ ও বর্শাওয়ালারা প্রাচীরের ওপর পৌঁছে গেল। দরজা ভেতর থেকে আরো ভাল করে বন্ধ করে প্রতিটি দ্বারে বিপুল সংখ্যক ফৌজ অবস্থান নিল।
মুসলমানরা অতিদ্রুত এসে কেলার চারপাশে অবস্থান নিয়ে কেল্লা ঘিরে ফেলল। তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেনী জবানে এলান করালেন, কেল্লার দরজা খুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ কর। যদি আমাদের একজন ফৌজও মারা যায় আর আমরা যদি দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি তাহলে তোমাদের অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর যদি স্বেচ্ছায় দ্বার খুলে দাও তাহলে সদ্ব্যবহার করা হবে। আমরা অবরোধ লম্বা করব না। আজকের সূর্য অস্ত যাবার পূর্বেই আমরা কেল্লাতে প্রবেশ করব।
কেল্লার দরজা হতে আওয়াজ এলো, তোমাদের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে, পারলে হিম্মত করে নিজেরা দরজা খুলো।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার ঘোষণা পূণরায় দেয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না, “তিনি তার নিজের ব্যাপারে ঠিকই বলেছিলেন, “আমি ধৈর্য হারা যুবা।”
তারেক : কেল্লা ভেঙ্গে ফেল।
কেল্লা কিভাবে ভাঙতে হয় মুসলমানরা তা ভাল করে জানত। সাথে সাথে কুড়াল ও হাতুড়ী নিয়ে সদর দরজার কাছে তারা উপস্থিত হলো। ওপর হতে তাদের উপর বর্শা ও তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ হলো কিন্তু বর্বররা তীর-বর্শাকে ভয় করত না। মুসলমানদের তীরন্দাজরা যারা দরজা ভাঙতে ছিল তাদের পশ্চাতে ছিল। তাদের কামান ছিল খুব শক্তিশালী ফলে তীর অনেক দূর পর্যন্ত যেত। তারা দুশমনের তীব্র আন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারীদের ওপর অবিরামগতিতে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। দু’তিনজন দুশমনের তীর আন্দাজ প্রাচীর থেকে নিচে পড়ে গেল। বাকীরা লুকিয়ে পড়ল।
কেল্লার দরজা ছিল চারটি। প্রতিটি দরজাতেই বর্বররা উম্মাদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তীর বর্শার কোন পরওয়া ছিল না। দরজাতে কুড়াল-হাতুড়ী দ্বারা আঘাত হানছিল প্রবল বেগে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসীকতার কাজ ছিল। কোন সিপাহসালার তার ফৌজকে এত ঝুঁকিপূর্ণ ও আশংকাজনক অবস্থার সম্মুখীন করত না কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদের মূলনীতি হলো “স্বয়ং নিজে ভীতি প্রদ হয়ে যাও তাহলে সব ভীতি ও খত্রা দূর হয়ে যাবে।”
তারেকের মূল শক্তি হলো তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাম অন্তরে নিয়ে কাফেরের মুকাবালায় বেরিয়ে ছিলেন। এ দুটো পবিত্র নাম তার অন্তরের মনিকোঠায় দানা বেধে ছিল। একারণেই স্বপ্নে রাসূল (স) তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন “বিজয় তোমাদের জন্যে অপেক্ষমান তবে তা তোমরা পাবে শর্ত হলো আল্লাহর রশি শক্তভাবে ধরে থাকবে।”
এটা তো স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার প্রতিশ্রুতি… যদি তোমরা দৃঢ়পদ থাক তাহলে তোমাদের বিশজন, কাফেরদের দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে আর তোমরা যদি একশত দৃঢ় থাক তাহলে তোমরা এক হাজার কাফেরের বিপক্ষে বিজয়ার্জন করবে। (সূরা আনফাল)
তারেক ইবনে যিয়াদ ঐ সকল অটল-অবিচল ও স্থিতিশীলদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে রাসূলে খোদা ছাড়া কুরআনে কারীমও বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছে।
তারা কেল্লা কজা করে ফেলল। দরজা একটা ভাঙ্গার সাথে সাথে বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যার ন্যায় মুসলমানরা ভেতরে প্রবেশ করল। কেল্লার ফৌজরা মুকাবালা তো করল ঠিকই কিন্তু তাতে উদ্দীপনা ও প্রাণ ছিল না। কেল্লার জিম্মাদার দ্রুত আত্মসমর্পণ করে ভয়াবহ খুন-খারাবীর হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ প্রথমে এলান করার জন্যে হুকুম দিলেন, কেউ যেন পলায়ন না করে। সকলে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে। তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের পূর্ণ হিফাজত করা হবে।
মানুষ ভীত হয়ে পলায়নের রাস্তা খুঁজছিল। লাড়কীদের বাবা-মা তাদেরকে গোপন করছিল। আর যাদের ঘরে ধন-দৌলত ছিল তারা তো সাথে নিয়ে পলায়নের চিন্তা-ভাবনা করছিল। তারেকের হুকুম তাদের পালাবার দ্বাররুদ্ধ করে দিল। তারেকের দ্বিতীয় নির্দেশ ছিল কেল্লার তাবৎ ফৌজকে পৃথক করে আলাদা করে দাঁড় করানোর জন্যে।
তারেক আরো নির্দেশ দিলেন, “আর শহরবাসীকে সতর্ক করে দাও, কেউ যেন কোন ফৌজকে তার ঘরে লুকিয়ে রাখার মত ভুল না করে। কারো ঘর থেকে যদি কোন স্পেনী ফৌজ বের হয় তাহলে সে বাড়ীর পুরো সদস্যকে যুদ্ধ কয়েদী আর তার ঘরের তাবৎ ধন-সম্পদ মালে গণিমত হিসেবে ধার্য হবে।
তামাম ফৌজকে জঙ্গী কয়েদী বানিয়ে তাদেরকে ঐ কেল্লাতেই রাখা হলো।
***
কেল্লা বেষ্টিত শহর হাতে আসাতে এক বড় প্রশস্ত উপত্যাকা তারেক ইবনে যিয়াদের অধিকারে আসল। সবুজ-শ্যামল বনানীতে ঘেরা এলাকা তার অদূরেই। সমুদ্র। তারেক ইবনে যিয়াদ কেল্লাতে অবস্থান করে সমুদ্র পাড়ে তাবু স্থাপন করে ফৌজকে সদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলেন।
বিজিত কেল্লা হতে এত বিপুল পরিমাণ তীর-বর্শা, ঢাল সংগ্রহ হয়েছিল যা বড় ও দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের জন্যে যথেস্ট ছিল। সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় যা হস্তগত হয়েছিল তা হলো দু’হাজার অশ্ব। এ দু’হাজার ঘোড়া তাদেরকে দিলেন, যারা ছিল শাহ্ সোয়ারা।
তারেক ইবনে যিয়াদ এখন সদা ব্যস্ত। তার কাছে রয়েছে মাত্র বার হাজার লস্কর যার মাধ্যমে এক লাখ ফৌজকে পরাজিত করতে হবে। এক লাখ সৈন্য তো এত বেশী ছিল যে বার হাজার ফৌজকে পদতলে পৃষ্ট করে মারতে পারত। এতবিশাল বাহিনীকে সেকি পরাজিত করতে পারবে? এ প্রশ্ন তারেককে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল।
একদিন তারেক ইবনে যিয়াদের চেহারাতে চিন্তার ছাপ দেখে জুলিয়ন বলল,–
ইবনে যিয়াদ! তোমাকে তোমাদের রাসূল বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাছাড়া স্পেনবাসীদের পক্ষ হতে যে দোয়া পাচ্ছ তাও খোদার দরবারে পৌঁছেছে। তুমি আবার এমনটি বলনা যে যারা মুসলমান নয় তাদের দোয়া-আহ্বান খোদা শুনেন না। খোদা তার অপর বান্দা কর্তৃক নির্যাতিত বান্দার দোয়া (আহ্বান) অবশ্যই শ্রবণ করেন।
জুলিয়নের এ বক্তব্য তারেক ইবনে যিয়াদের এ নির্দেশের ব্যাপারে ছিল যে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন, যাতে জঙ্গী কয়েদীদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হয় আর তার চেয়ে সে বেশী সদ্ব্যবহার করা হয় শহরবাসীদের সাথে এবং নিজেদের কর্ম দ্বারা যেন তাদেরকে আশ্বস্ত করান যায় যে, মুসলমানরা তাদের ইজ্জত-আব্রুর মুহাফিজ এবং প্রত্যেককে তার যোগ্যতানুসারে প্রাপ্য প্রদান করা হবে। তারা যা উপার্জন করবে তা তাদের থাকবে তবে তাদের মান মুতাবেক তাদের থেকে কর উসুল করা হবে।
যে এলাকা তারেক ইবনে যিয়াদ করতলগত করে ছিলেন তাতে কার্ডিজ ছাড়া ও আরো বেশ কিছু ছোট বড় বসতি ছিল। তার মাঝে দু’তিনটি বসতি হামলাকারীদের ভয়ে বিরান হয়ে গিয়েছিল। তারা মনে করে ছিল হামলাকারীরা রডারিকের মত কোন জালেম বাদশাহ্। তাদের ফৌজরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, লুটতরাজ করে জওয়ান লাড়কীদেরকে নিজেদের দাসী-বাঁদীতে পরিণত করবে এবং তামাম গবাদী পশু ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তাই তারা তাদের বাল-বাচ্চা ও গৃহপালিত পশু সাথে নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল। কিন্তু হামলাকারী ফৌজ তাদের ঘর বাড়ীর দিকে ফিরেও তাকাইনি।
জুলিয়ন : এসব লোক সকলেই তোমার সাথে রয়েছে ইবনে যিয়াদ! তারা তোমার বিজয় কামনা করছে। তারা আসমানের দিকে হাত তুলে ফরিয়াদ করছে, যাতে রডারিকের বাদশাহী বরবাদ হয়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ : বিজিত লোকদের সাথে মানবতা দেখান ও সদ্ব্যবহার করা এটা আমার নির্দেশ নয় বরং স্বয়ং আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল (স)-এর হুকুম।
***
বাদশাহ্ রডারিক রাজধানী টলেডোতে অবস্থান না করে এক লাখ ফৌজ নিয়ে সরাসরি অগ্রসর হচ্ছিল। সে প্রথমে বার্তা পাঠিয়ে ছিল টলেডোতে তার আপন মহলে যাবে না, শহরের বাহিরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রওনা হবে। সে যখন টলেডোর উপকণ্ঠে উপনীত হলো তখন বিপুল সংখ্যক সরকারী কর্মচারী ও শুভাকাঙ্খী তার ইন্তেজারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মাঝে তার পরাজিত জেনারেল তিতুমীরও ছিল।
রডারিক : তুমি কি তোমার চেহারা আমাকে দেখানোর উপযুক্ত মনে কর? তোমার চেয়ে অর্ধেক ফৌজের হাতে পরাজিত হয়ে আমার এস্তেকবালে দাঁড়িয়েছ, ধিক তোমাকে!
তিতুমীর : শাহান শাহে মুয়াজ্জম! জেনারেল একাকী যুদ্ধ করে না। আমি আমার ফৌজের আগে পলায়ন করিনি। ফৌজরা প্রথমে পলায়ন পদ হয়েছে। আমার অপরাধ শুধু এতটুকু যে, সেখানে মৃত্যু বা জঙ্গী কয়েদী হবার জন্যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকিনি।
রডারিক তার কথায় আরো গর্জে উঠল এবং তাকে তিরস্কার করল। তিতুমীর কোন সাধারণ জেনারেল ছিল না। স্বয়ং রডারিক তার অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সাহসীকতার তারীফ করত। আর তিতুমীর রডারিকের দুর্বলতার ব্যাপারে ভাল জানত।
তিতুমীর : বাদশাহ নামদার! আপনি মহলে গিয়ে আরাম করুন, এক লাখ ফৌজ আমাকে সোপর্দ করুন। আমি একদিনের মাঝে আক্রমণকারীদের পদতলে পৃষ্ট করে সমুদ্রপাড়ে পৌঁছে যাবো এবং এ হামলাকারীরা যেথা হতে এসেছে সেথায় আপনার পতাকা উড্ডীন করব। আমাকে তিরস্কার করার পূর্বে শাহান শাহ্ আমার কাছে যে পরিমাণ ফৌজ ছিল সে পরিমাণ ফৌজ নিয়ে যান, তাহলে দেখা যাবে বীরত্ব। এক লাখ ফৌজ কোন অযোগ্য-বুজদিল জেনারেলের কাছেও যদি থাকে তাহলে সেও হুংকার ছাড়তে পারে।
তিতুমীরের কাছে হয়তো রডারিক কোন বিষয়ে দুর্বল ছিল তা নাহলে তার এ উদ্ধ্যতোর জন্যে রডারিক জালেম বাদশাহ্ অবশ্যই তাকে শাস্তি দিত। রডারিক চুপ, করে থেকে তিতুমীরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। দেখতে পেল তার শাহী মহলে খুব সুরত আওরত মেরীনা তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রডারিক মেরীনার দিকে লক্ষ্য করতেই সে বাদশাহর সামনে কুর্নিশ করল।
মেরীনা : শাহানশাহ! আমার জন্যে কি নির্দেশ রয়েছে।
রডারিক : তুমি জানো তোমার প্রতি কি নির্দেশ রয়েছে। নতুন কিছু আছে কি?
মেরীনা : হ্যাঁ শাহান শাহ্! কম বয়সী, খুব সুরত অর্ধফোঁটা এক কলি রয়েছে … আমি আপনার সাথে যাব?
রডারিক : ঐ কলি সাথে নিয়ে এসো, তাছাড়া যদি আরো থাকে তাকেও নিয়ে এসো। আওরতদের গাড়ী পিছনে রয়েছে।
মেরীনা শাহ্ রডারিককে গভীর ভাবে লক্ষ্য করে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তাবুর ক্যানভাসযুক্ত দেয়াল দাঁড় করিয়ে তার ওপর শামিয়ানা টাঙিয়ে দেয়া হলো এবং তার মাঝে মখমল বিছিয়ে শাহী কুরসী রাখা হলো যা ছিল তখতে তাউছের ন্যায়। এভাবে অল্প ক্ষণের মাঝে শামিয়ানার নিচে বাদশাহ্ রডারিকের দরবার তৈরী করা হলো। রডারিক অশ্ব হতে অবতরণ করে কাপড়ের জাকজমক পূর্ণ সে দরবারে উপস্থিত হলো। চলতে চলতে রডারিক তার পিছনের এক ব্যক্তির কানে কানে কি যেন বলল!
“সে উপস্থিত রয়েছে শাহান শাহে আলী মাকাম। ঐ ব্যক্তি একথা বলে পিছনে এক ব্যক্তির কাছে চলে গেল।”
রডারিক যার কথা জিজ্ঞেস করেছিল সে সত্তর ঊর্ধ্ব এক জাদুকর। তার দাড়ি লম্বা, দুধের মত সফেদ। কাঁদ হতে টাকনু পর্যন্ত লম্বা চোগাপরিহিত। মাথায় গোল টুপি, গলায় ও হাতে মুর্তির মালা, আরেক হাতে বাদামী রং-এর বড় লাঠি।
ঐ ব্যক্তি ধীরে ধীরে এসে রডারিকের কাছে পৌঁছল। জাদুকরের পোষাক আশাক, বয়স ও চেহারা দেখে সম্মানী মনে হচ্ছিল। কিন্তু রডারিক তার পাশের কুরসীতে বসতে পর্যন্ত তাকে বল না। তাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল।
রডারিক : হে গণক! তুমি কি ভবিষ্যৎ এর ব্যাপারে ভয়াবহ কোন কিছু দেখতে পাচ্ছ?
গণক : হ্যাঁ। বাদশাহ নামদার! দেখছি। অস্পষ্ট মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা দেখতে পাই তা কখনো খুব গাঢ় হয় আবার কখনো তাতে অন্য কিছু দেখতে পাই।
রডারিক : যা দেখতে পাও তা কি?
গণক : বাদশাহ্ নামদার যে দৃশ্য দুর্গের মাঝে দেখেছিলেন, সে দৃশ্য দেখতে পাই।
রডারিক : তোমাকে যে দৃশ্যের কথা বলেছিলাম তা কি তোমার পূর্ণ মাত্রায় স্মরণ আছে?
গণক : তা আমার পূর্ণ মাত্রায় স্মরণ রয়েছে। আপনার এ গোলামের স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত প্রবল।
রডারিক শাহী প্রতাপে বলল, তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছি কেবল তার জবাব দাও। ফালতু কথা শুনার সময় আমার নেই। তোমাকে যা শুনিয়ে ছিলাম যদি স্মরণ থেকে থাকে তাহলে বল, তা বাস্তব রূপ নিবে না তো?
গণক : এক লাখ ফৌজের সামনে কোন হাকীকত টিকবে না। এরা তো সমুদ্রের তরঙ্গ মালার ন্যায় কোন বাধা মানে না।
রডারিক : আরেকটি কথা বল তাহলো এক নওজোয়ান লাড়কীকে আমি খাবে দেখি।
গণক : তাকে কি অবস্থায় দেখেন শাহান শাহ্!
রডারিক : মস্তকহীন অবস্থায় সে এসে আমার সামনে দন্ডায়মান হয়। তারপর পলক ফেলতেই দেখা যায় তার শরীরে মাথা রয়েছে। মিট মিট করে আমাকে দেখতে থাকে। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি… তার কিছুক্ষণ পরে লাড়কীর আওয়াজ শুনতে পাই… “তোমার রাজত্বের ওপরও ঘোড়া দৌড়ান হবে। তোমার নাম নিশানা .জে পাওয়া যাবে না।“ লাকীর ঠোঁট নড়ে না কিন্তু আওয়াজ শুনা যায়।
গণক : শাহানশাহ্ ঐ লাড়কীকে চিনেন কি? এমন কোন লাড়কী আপনার সান্নিধ্যে এসেছে কি?
রডারিক : হ্যাঁ, পামপিলুনাতে আমার সান্নিধ্যে এসেছিল। সে বিদ্রোহী সর্দারের কম বয়সী বেটী ছিল। আমি তাকে কাছে রেখে ছিলাম তারপর একরাতে একটা গোস্তাখী করার দরুন তলোয়ারের এক কোবে তার শিরোচ্ছেদ ঘটিয়েছি।
রডারিকঃ এটা কোন খারাপ ফাল কি না? আর একটা কথা বলি, আমি কাউকে ভয় পাইনা কিন্তু খাবের মাঝে ঐ লাড়কীকে দেখার সাথে সাথে ভয় পেয়ে যাই।
গণক : শাহান শাহ! ফাল ভাল নয়। শিশু-কিশোরদের বদ দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়। ঐ সত্তা যিনি সবাইকেপয়দা করেছেন সবার ইনসাফ করেন।
রডারিক : আমি জানি তোমার হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে যে তুমি সে বদ ফলকে প্রতিহত করতে পারবে। এটা তো ঐ জাদুর প্রভাব যার স্রষ্টা ইহুদীরা আর তুমি কেবল ইহুদীদের গুরুই নও, গণকও বটে। আমি তোমাকে মহলে যে মর্যাদা দান করেছি তার উপযুক্ত কোন ইহুদীকে আমি মনে করি না। তুমি কেবল একক ইহুদী ব্যক্তিত্ব যাকে আমি এত সম্মান দান করেছি।
গণক : এ গোলাম কি এ সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত নয়? এতটুকু ইজ্জত কি তার হক নয়?
রডারিক : নিশ্চয় রয়েছে। আমি তোমাকে এর চেয়েও বেশী ইনয়াম দেব… তুমি ফাওরান এক কাম করে দাও। এমন তদবীর কর যাতে ঐ লাড়কী স্বপ্নে যেন আমার কাছে না আসে, আর আমার অন্তর হতে যেন তার ভয় বিদূরিত হয়, এমন যেন না হয়, যে আমি হামলাকারীদের মুকাবালায় গেলাম আর আমার অন্তরে ভীতি সঞ্চার হলো।
এ ঘটনা যে ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন তারা লেখেন, রডারিক একজন অত্যন্ত সাহসী বাদশাহ ছিল। যুদ্ধের ময়দানে ছিল বীরবাহাদুর। কিন্তু ঐ কিশোরীকে হত্যা করার পর হতে তার মাঝে ভয় বাসা বেঁধে ছিল আর সে হয়ে পড়েছিল ভীতুর ডিম। ঐগণক জাদুতে পারদর্শী ছিল তাছাড়া ভবিষ্যৎ সম্পকে যে খবর দিত এ কারণে রডারিক তাকে মহলে রেখেছিল।
ইহুদীগণক রডারিকের মাথা হতে মুকুট উঠিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখল এবং তার মাথাকে দুহাতে ধরে একটু উঁচু করে বাদশাহর চোখে চোখ রাখল তার পর তার হাতের দুটো আঙ্গুটি বাদশাহর মাথায় বুলাতে লাগল। এ রূপ কয়েক মিনিট করে রডারিকের মাথা ছেড়ে দিল। বাদশাহ্ ডানে-বামে ফিরে দেখল।
রডারিক : আমি বিশেষ একটা কিছু অনুভব করছিলাম।
গণক : আমি জানি শাহানশাহ্! আপনি তা করবেন। এখন আর ঐ লাড়কী বাদশাহ্ নামদারের খাবে আসবে না, চিন্তা-চেতনাতেও না, আর দিল থেকে তার ভয় বিদূরিত হবে।
রডারিক : বাকী কাজ? তুমি বলেছিলে এ ফাল ভাল নয় তার প্রতিকার কিভাবে করবে?
গণক : বাদশাহ নামদার! আপনি কি আমাকে নব যৌবনা লাড়কী ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?
রডারিক : একজন নয় একশ জন দিতে পারব। বল বয়স কত হতে হবে?
বৃদ্ধ গণক : একুশ বছরের কম বয়স হতে হবে। আর ঐ লাড়কী আমার জন্যে নয়। তাকে জীবিত রাখা যাবে না। আজ রাত হবে তার জীবনের শেষ রাত। তার কলিজাসহ শরীর হতে আরো কিছু বের করে তার ওপর জাদুর আমল করব।
রডারিক তাৎক্ষণিকভাবে মেরীনাকে আহ্বান করল।
রডারিক : তুমিএক, লাড়কীর কথা বলেছিলে, বলেছিলে তার বয়স কম অর্ধ ফোঁটা কলি,তার বয়স কত?
মেরীনা : মোল-সতের বছর শাহানশাহ!
রডারিক : তাকে আজ রাতে এ গণকের কাছে অর্পণ করবে।
মেরীনা : আমাকে বাদশাহ্ নামদার তার সাথে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
রডারিক : আমার সাথে তোমার যাবার প্রয়োজন নেই। গণকের নির্দেশ মুতাবেক রাত্রি বেলা ঐ লাড়কীকে নিয়ে উপস্থিত হবে। তারপর রডারিক বৃদ্ধ গণককে লক্ষ্য করে বলল ঐ লাড়কীকে সাথে নিয়ে যাও তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবে সে কি করবে।
মেরীনা বৃদ্ধ ইহুদীর অনুগামী হলো।
***
রাতের প্রথম প্রহর কিছুটা অতিবাহিত হয়ে গেছে। মেরীনা এক খুব সুরত লাড়কীকে নিয়ে বৃদ্ধ ইহুদীর কামরায় প্রবেশ করল। মেরীনা রডারিকের নির্দেশ মুতাবেক যখন ঐ বৃদ্ধ ইহুদীর সাথে মহলে এসেছিল তখন সে বৃদ্ধকে বলেছিল বাদশাহ আপনাকে অত্যন্ত মূল্যবান ইনয়াম দিয়েছে। এ লাড়কীকে তো সে শাহানশাহর জন্যে নির্ধারণ করেছিল আর বাদশাহর সাথে তাকে যাবার কথা ছিল।
বৃদ্ধ গণক : তুমি কি কখনো কোন আওরতকে আমার কামরায় যাতায়াত করতে দেখছো? আমিএ বয়সে নওজোয়ান লাড়কী কি করব। এ লাড়কীকে আমার অন্য কাজে প্রয়োজন। তা রাতে বলল, তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে কারো কাছে তা ফাস করা যাবে না। এ গোপন খবরের মূল্য তোমার জীবন। নিশ্চয় তুমি তোমার জীবন খতম করতে চায়বে না।
ঐ লাড়কী যখন মেরীনার সাথে জাদুকর ইহুদীর কামরাতে প্রবেশ করল তখন ভয়ে চমকে উঠে মেরীনাকে জড়িয়ে ধরল। সম্মুখে একটা টেবিলে তিনটি মাথার খুলি পড়ে ছিল। আর দেয়ালে ছিল মানুষের কংকাল ঝুলান। বৃদ্ধ ইহুদী একটা বাক্সের ঢাকনা খুললে তার মাঝে দুটো সাপ ফনা পেতে উঠলে কিশোরী চিৎকার দিয়ে উঠল।
কামরার মাঝে লাশ পচা দূর্গন্ধ। তবে সেখানে কোন লাশ ছিল না। এ দুর্গন্ধ রসায়নিক দ্রব্যাদির ছিল। সে কামরাতে নানা ধরনের জিনিস পত্র পুড়ান হতো। কামরার সার্বিক অবস্থা ছিল ভীতিকর। মেঝেতে কিছু পুটলা এলোমলো ভাবে পড়েছিল। এ কামরার বৃদ্ধই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বাহিরে বের হয়। সে এ কামরাতে প্রবেশ করা মাত্র তার রূপ পাল্টে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে হিংস্র রূপ ধারণ করল।
বৃদ্ধ ইহুদী আরো একটা কামরা খুলে দিয়ে মেরীনাকে বলল, ঐ লাড়কীকে এ কামরাতে বসিয়ে তুমি চলে এসো। মেরীনা কিশোরীকে ঐ কামরাতে নিয়ে গেল। কামরাটা তুলনামূলক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। একটা পালং, তাতে মূল্যবান ও অত্যন্ত সুন্দর বিছানা বিছান। ফ্লোরে মূল্যবান কার্পেট পাতা। ছাদের সাথে রওশন ফানুস লাগান। তবে অন্য কামরার দূর্গন্ধ এ কামরাতেও রয়েছে।
কিশোরী মেরীনাকে বলল, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে? ইনিই কি শাহানশাহ্ রডারিক? এভো ফৌজের ঐ জেনারেলও নয় যার জন্যে তুমি আমাকে নিয়ে ছিলে। সে তো ফৌজের সাথে চলে গেছে।
মেরীনা : তোমার দ্বারা যে খেলা করাতে চেয়েছিলাম তা বাদশাহর নির্দেশে সম্পূন্ন ভেস্তে গেছে। তোমার সাথে আমিও বাদশাহর সাথে যেতাম কিন্তু যেতে দেয়া হয়নি।
কিশোরী : কেন যেতে দেয়া হয়নি? আমিএ দূর্গন্ধময় কামরাতে এ বুড়ার সাথে থাকব না। তুমি আমার বাবাকে যে টাকা দিয়েছ তা ফিরিয়ে নিবে।
পাশের কামরা থেকে বুড়ো ইহুদী বলল, দ্রুত এসো মেরীনা, তাকে ওখানেই রেখে এসো।
মেরীনা কিশোরীর কানে কানে বলল, ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে এখান থেকে বের করার কৌশেশ করব।
মেরীনা পাশের কামরাতে বৃদ্ধের কাছে চলে গেল।
***
জাদুকর ইহুদী : আমি জানি তুমি ইহুদী; আর তুমিও হয়তো জান আমিও ইহুদী। তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। বাদশাহর বিজয়ের জন্যে আমিএমন কাজ করব যাতে তুমি ঘাবড়ে যাবে কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না।
মেরীনা : বাদশাহ্ যে পরিমাণ ফৌজ নিয়ে গেছে তাতে তিনি এমনিতেই বিজয়ী হবেন তার জন্যে কোন ইহুদীর কিছু করতে হবে না।
বৃদ্ধ ইহুদী ধমকের স্বরে বলল, আমার কাজে বাধা দেবে না। শাহান শাহ্র জন্যে দুটো বদফাল রয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া খতম করা জরুরী।
মেরীনা : মৃদু হেসে বলল, শুনেছি আক্রমণকারীদের মোট সংখ্যা এগার/বার হাজার। আর বাদশাহর ফৌজ এক লাখ তার মাঝে সোয়ারীই হবে বার হাজারের বেশী। তাই বিজয় আমাদের বাদশাহ নামদারের হবে। ফলে এমনিতেই আপনি ইনয়াম পাবেন।
বৃদ্ধ ইহুদী : আমি যা জানি তুমি তা জান না। যা বলছি তাই কর…।
ঐ লাড়কীর শরীর হতে আমাকে কলিজা বের করতে হবে। শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করার সাথে আমি তার কলিজা বের করব তার পেট হতে আরো দুটো জিনিস বের করতে হবে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। যখন কাজ হয়ে যাবে তখন লাড়কীর লাশ গুম করার দায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকে আর এটা কোন কঠিন কাজ। নয়। এ কামরা হতে এভাবে লাশ গুম হতে থাকে।
বৃদ্ধের কথা শুনে ভয়ে মেরীনা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হলো কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।
বৃদ্ধ : তাকে খুব পিয়ার করে যত্নসহ এখানে নিয়ে এসো, সে যেন কিছু অনুভব করতে না পারে।
মেরীনা অন্য কামড়ায় প্রবেশ করে এদিক-সেদিক দেখতে লাগল সে যা তালাশ করছিল তা পেয়ে গেল তা তুলে নিয়ে কিশোরীকে তার সাথে যাবার জন্যে বলল।
কিশোরী : এখন আমার কি হবে? ঐ দুর্গন্ধময় বুড়োর কাছে রেখে তুমি চলে যাবে?
মেরীনা : আমি কিছু একটা করব। তুমি ভয় পাবে না। আমাকে সাহায্য করবে। দুজনই বৃদ্ধ জাদুকরের কামরায় প্রবেশ করল।
জাদুকর : এসো বেটী! এ টেবিলের উপর একটু বস… আমাকে তোমার বাবার মত মনে কর।
কিশোরী মেরীনার দিকে তাকাল, মেরীনা তাকে ইশারায় টেবিলে বসতে বলল। বৃদ্ধ কিশোরীর কাছে পৌঁছল। সে তাকে উঁকিয়ে শেষ করার চিন্তা-ভাবনা করেছিল। বৃদ্ধ মেরীনার দিকে পিঠ দিয়ে ছিল। মেরীনা অপর কামরা হতে একটা লোহার ডান্ডা লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে ডান্ডা দ্বারা অত্যন্ত স্ববেগে বৃদ্ধের মাথায় আঘাত হানল এমনিভাবে আরেকটি আঘাত হানলে বৃদ্ধ বেহুশ হয়ে পড়ে গেল।
মেরীনা বৃদ্ধকে চিৎ করে তার বুকের ওপর বসে পূর্ণ শক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরল। অল্পক্ষনের মাঝে বুড়ো শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করল। অপর একটি কামরায় কাঠের বিরাট বড় একটা বাক্স ছিল। মেরীনা কিশোরীকে সাথে করে বৃদ্ধের লাশ ঐ কামরায় নিয়ে গেল। বাক্স খুলে তার ভেতর যা কিছু ছিল তা বের করে দু’জন মিলে বাক্সের ভেতর লাশ ভরে তার দরজা বন্ধ করে দিল।
মেরীনা : এখন তার রডারিক বাদশাহ্ বিজয় অর্জন করে ফিরে আসবে। চল্ লাড়কী তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে পড়।
কিশোরী : আমার ভীষণ ভয় লাগছে। এসবের কিছুই তো বুঝলাম না।
মেরীনা : এ বুড়ো যদি না মরত তাহলে তুমি মরতে, ভয় পেওনা, আগামীকাল সকালে তোমাকে আমি অন্যত্র নিয়ে যাব। কারো কাছে খবরদার এসব কিছু বলবে না।
তারা দু’জন সেখান থেকে চলে আসল। মেরীনা কিশোরীকে তার নিজ কামরাতে নিয়ে গেল। মেরীনা তার নিজের জন্যে বড় আশংকা সৃষ্টি করেছিল। রডারিকের বিজয়ের ব্যাপারে সকলে পূর্ণদ্যমে আস্বস্ত ছিল। কারণ তার এ বিশাল ফৌজের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না। রডারিকের বিজয় হলে মেরীনার। বাঁচা সহজ ছিল কারণ রডারিক মনে করত বৃদ্ধ ইহুদী তার বদফাল দূর করে দিয়েছে পরে হয়তো কারো হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু পরাজিত হয়ে আসলে কিয়ামত দাঁড় করিয়ে দিত।
মেরীনা পলায়নের ইরাদা করল। পরের দিন ঐ কিশোরীর সুরত পরিবর্তন করে তাকে তার নিজ বাড়ীতে পাঠিয়ে দিল। আর সে নিজে অন্য এক জায়গায় চলে গেল।
একটা বড় আলীশান প্রাসাদ। সেখানে এক গোথা খান্দানবাস করে। মেরীনা তাদেরকে ইহুদী হত্যাসহ তাবৎ ঘটনা বর্ণনা করল। এক ব্যক্তি বলল, তুমি খুব ভাল করেছ, এক নিষ্পাপ বাচ্চাকে বাঁচিয়েছ তার পর এখন যা হয় তাতে দেখতেই পাবে।
মেরীনা : বর্বরদের সংখ্যা খুবই সীমিত তাই রডারিক যে জীবিত ফিরে আসবে না এ উমিদ করা ঠিক হবে না।
অপর ব্যক্তি বলল, সে ধর জীবিতই ফিরে আসবে তাতে তোমার পেরেশান হবার কিছু নেই, যখন ফিরে আসবে তখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে। তোমাকে সুস্থ-সুন্দরভাবে সিওয়াস্তা পৌঁছে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। তুমি দোয়া কর আওপাস যেন জীবিত থাকে আমরা তোমাকে তার কাছে পৌঁছে দেব।
একদিকে রডারিক জাদু-মন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছিল যেন একলাখ ফৌজের ওপর তার কোন ভরসা নাই। অপর দিকে মুসলমানদের ক্যাম্পে কেবল মাত্র আল্লাহ্ আল্লাহ্ রব ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে বলেছিলেন তাদের মুকাবালায় তাদের চেয়ে আটগুণ বেশী ফৌজ আসছে। একজন মুজাহিদকে আটজনের সাথে মুকাবালা করতে হবে। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর এবং জুময়ার খুৎবাতে যেমনি তার সে স্বপ্ন শুনাতেন যাতে রাসূল (স) বিজয়ের বাশারত দিয়েছিলেন তেমনি কুরআনের ঐ সকল আয়াত পাঠ করে শ্রবণ করাতেন যার মাঝে আল্লাহ্ তায়ালা মুমিনদেরকে বিজয় ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
“বহুবার ছোটদল বড় দলের ওপর বিজয় অর্জন করেছে।” এ আয়াত পাঠ করে তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজদেরকে বুঝাতেন, ছোট দলে ফৌজ সদস্যও তার আমীরের মাঝে কিরূপ গুণাবলী ও কি পরিমাণ ঈমানী শক্তি পয়দা করলে আল্লাহ তায়ালা বড় দলের ওপর বিজয় দান করেন।
“স্মরণ কর! সে সময়ের কথা যখন তোমাদের জন্যে করলাম সাগরকে দ্বিধা বিভক্ত ও তোমাদেরকে দিলাম পরিত্রাণ আর ফেরাউন সম্প্রদায়কে করলাম নিমজ্জিত।”,
তারেক ইবনে যিয়াদ এ আয়াত বারংবার পাঠ করে তার ফৌজী বাহিনীকে শ্রবণ করাতেন। তিনি তার ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বলতেন, এ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা সম্বোধন করেছেন বনী ইসরাঈলদেরকে। ফেরআউনের জাদুর চ্যালেঞ্জে মুসা (আ.) এমন মুজেজা দেখিয়ে ছিলেন যার ফলে ছামেরীর ভেলকীবাজী হয়েছিল খতম আর ফেরআউন হয়েছিল হতভম্ব। যখন বনী ইসরাঈল মিশর হতে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের সম্মুখে নিল নদ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে বিশাল নদী পশ্চাদে ফেরআউন ও তার ফৌজ। এহেন পরিস্থিতে মুসা (আ) তাঁর লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত হানলে তা দ্বিভক্ত হয়ে রাস্তায় পরিণত হয়। সে রাস্তা দিয়ে মুসা তার বাহিনী নিয়ে সুন্দরভাবে নদী অতিক্রম করে চলে যান কিন্তু সে রাস্তায় ফেরআউন তার বাহিনী নিয়ে অবতরণ করার সাথে সাথে উভয় দিকের পানি একত্রিত হয়ে ফেরআউনও তার গোটা ফৌজ বাহিনী নিমজ্জিত হয়ে চিরতরে খতম হয়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিয়ে বললেন, “কিন্তু মুহাজিদ ভাইরা! আল্লাহ্ তায়ালা হযরত মুসা (আ)-কে চল্লিশ দিনের জন্যে আহ্বান করেছিলেন। সে আহ্বানে তিনি সাড়া দিলে তার অবর্তমানে ইসরাঈলরা গো বৎসের পূজা শুরু করেছিল যার পরিণাম তাদের বিপর্যয় ডেকেআনে। মুজাহিদ ভাইরা আমার! পরিবেশ-পরিস্থিতি যতই তোমাদের প্রতিকুল হোকনা কেন সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবতে রত থাকবে। এ ধরনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করে তিনি মুজাহিদদেরকে ঈমানী বলে বলিয়ান করে তাদের মাঝে জিহাদের স্পৃহা উদ্দীপনা বৃদ্ধি করছিলেন। তিনি যুদ্ধের জন্যে যে জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন, দিনের বেলা মুজাহিদ বাহিনীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন।
এদিকে রডারিকের বিশাল ফৌজী বাহিনী বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার ন্যায় প্রবল বেগে ধেয়ে আসছিল, তার গতিরোধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না।
***
মেরীনা যে প্রাসাদে গিয়ে উঠেছিল ইতিপূর্বে কয়েক বার সে সেখানে গিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বার তার বেশ-ভূশা পরিবর্তন করে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। টলেডোতে এ ধরনের আরো কিছু প্রাসাদ ছিল, যা দেখে লোকেরা বলতএখানে। সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর লোকরা বাস করে। এসব প্রাসাদে এমনকার্যক্রম শুরু হয়েছিল যা পরবর্তীতে ইউরোপের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। আওপাস যেদিন ঝিল পাড়ে মেরীনার সাথে মিলিত হয়েছিল সেদিন থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। আওপাস সেদিন মেরীনাকে বলেছিল, এখন সময় এসেছে যদ্বারা গোথা ও ইহুদীরা ফায়দা হাসিল করে রডারিককে সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে পারে। আর তার একমাত্র উপায় হলো গোথা ও ইহুদী যেসব ফৌজ রয়েছে চূড়ান্ত লড়াই এর সময় তারা মুসলমানদের সাথে মিলে রডারিকের বিরুদ্ধাচরণ করবে।
মেরীনা ইহুদী ছিল একারণে তার মাথাতে জন্মগতভাবে ষড়যন্ত্রের বীজ ছিল। অধিকন্তু তার অন্তরে রডারিকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন দাউ দাউ করে জুলছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে রডারিক তার প্রেমের ছন্দময় জীবন নস্যাৎ করে ছিল। সে আওপাসের প্রেমে ছিল বিভোর। বিশ বছর পর যখন আওপাসের সাথে মিলন ঘটল তখন তার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের জ্বালা শতগুণে বেড়ে গেল। আওপাসের কথা শুনে সে বলেছিল রডারিকের বুকে খঞ্জর বিদ্ধ করে চিরতরে খতম করবে।
মেরীনা রডারিক থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা শুরু করল। তার কাছে এক অত্যন্ত সুন্দরী লাড়কী ছিল। বাদশাহর খাছ মহলে ছিল তার যাতায়াত। মহলে দু’চার জন ইহুদী ও গোথা কওমের লোক বেশ উপরস্থ পদে সমাসীন ছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে স্পেনে সবচেয়ে মাজলুম ছিল ইহুদী সম্প্রদায়। তাদের অধিকাংশ ছিল গরীব। মেরীনা যে প্রাসাদে গিয়েছিল সেখানে অধিকাংশ লোকছিল গোথা কওমের অধিকন্তু তারা ছিল ডেজার অত্যন্ত ভক্ত। তাদের মাঝে এক ব্যক্তির নাম ছিল জেওয়াজ। সে ছিল ডেজার বাল্য বন্ধু। মেরীনা তার সাথে সাক্ষাৎ করে আওপাসের মুলাকাতের কথাও সে যে আলোচনা করেছে তা বিস্তারিত বলল। জেওয়াজ কোন প্রকার চিন্তা-ফিকির ছাড়াই মেরীনার প্রস্তাব মেনে নিল। সে মেরীনাকে তার বাবা ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে আওপাস মেরীনাকে যা বলেছে তার বিবরণ দিল।
জেওয়াজের বাবা বললেন, প্রস্তাবতো ভাল কিন্তু অত্যন্ত আশংকা জনক। কারণ কেউ এটা মেনে নেবে না যে এত স্বল্প সংখ্যক হামলাকারীরা স্পেনের একলাখ ফৌজকে পরাজিত করতে পারবে… এটা নামুমকিন। ইহুদী ও গোথারা যদি গাদ্দারীও করে তবুও তাদের সংখ্যা কতইবা হবে। পনের-বিশ হাজার না হয় হবে। এরা হামলাকারীদের সাথে মিলে কিইবা করবে? বিজয় হবে রডারিকের। তারপর জানই তো পরিণাম কি হবে? রডারিক একজন গাদ্দারকেও জীবিত রাখবে না আর গোথা ও ইহুদীদের ওপর যে নিপীড়ন চালান হবে তা হবে অতীব ভয়াবহ।
মেরীনা : আওপাসের ধারণা ভিন্ন। সে বলছিল, মুসলমানরা খুবই সাহসী ও বীরবাহাদুর এবং অভিজ্ঞ। তাদের চেয়ে দ্বিগুণ ফৌজ ছিল তিতুমীরের কিন্তু খুব কম সময়ের মাঝে তাদেরকে পরাস্ত করে অর্ধেকের বেশী ফৌজকে করল হালাক আর স্বল্প সংখ্যক ছাড়া বাকীরা হলো মুসলমানদের কয়েদী। আপনারা সলা-পরামর্শ করেন, আওপাস আরেকবার আসবে। আমি তাকে আপনাদের কাছে পৌঁছে দেব।
জেওয়াজের বাবা বললেন, তুমি ইহুদী নেতাদের সাথেও আলোচনা কর।
***
মেরীনা : ইহুদী ধর্মগুরু ও নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ আলোচনার মাঝে দিন রাত কাটাতে লাগল। এক রাতে তিন-চারজন ইহুদী জেওয়াজের প্রাসাদে বসা ছিল। তাদের সাথে তিন-চারজন গোথাও ছিল। তারা সকলেই এ ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করছিল, মেরীনা চুপি চুপি তাদের আলোচনা শ্রবণ করছিল।
এক বৃদ্ধ ইহুদী বলল, আমরা শুধু একটা বিষয় বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই, তাহলে আজ আমরা রডারিকের নির্যাতন-নিপীড়নের স্বীকার এবং পশুর ন্যায় জীবন যাপন করছি। রডারিকের হাত থেকে মুক্তি পাবার প্রত্যাশায় হামলাকারীদেরকে সাহায্য করব। তারপর তারা যদি বিজয় অর্জন করে তাহলে তারা রডারিকের জায়গায় আমাদের ওপর শাসনকর্তা হয়ে বসবে। তারা হলো মুসলমান আমরা হলাম ইহুদী। তখন আমরা তাদের নির্যাতন নিপীড়নের বস্তুতে পরিণত হব। আমাদের অবস্থান, এমন হওয়া দরকার যে, আমরা মুসলমানদেরকে সাহায্য করব যাতে রডারিক পরাজয় বরণ করে তারপর সাথে সাথে মুসলমানদের ওপর অতর্কিতভাবে এমন আক্রমণ করা হবে যাতে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারপর ইহুদী ও গোথারা যৌথভাবে স্পেন শাসন করবে।
আওপাসের তাবৎ পরিকল্পনা নস্যাৎ হচ্ছে বলে মেরীনা অনুমান করতে পারল। সে ঝিল পাড়ে আওপাসের কাছে নিজের ব্যাপারে বলেছিল,
“আমি কারো বিবি হতে পারলাম না, হতে পারলাম না মা, আমি শয়তান হয়ে গেছি। আমার মাঝে শয়তানের স্বভাব চরিত্র দানা বেঁধেছে।” সে ঠিকই বলেছিল।
বৃদ্ধ ইহুদীর কথা তার কানে আসার সাথে সাথে তার মাথায় একটা মিথ্যে ভাবনা উদয় হলো,
মেরীনা বলল, মুসলমানরা এখানে বাদশাহী করবার জন্যে আসেনি। আওপাস আমাকে বলেছিল তারা লুটতরাজ করার জন্যে এসেছে। তাদের ঝুড়িভরে গেলে তারা ফিরে যাবে। আওপাস আমাকে বলেছে সে এবং জুলিয়ন রডারিকের সিংহাসন ভূলণ্ঠিত করার জন্যে তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে এসেছে, তারা মুসলমানদেরকে বলেছে স্পেনের শাহী খাজানাতে এত পরিমাণ ধন-দৌলত সোনা দানা রয়েছে যা হবে বিপুল সংখ্যক উটের বোঝ। আপনারা তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন তারা কোন মুলুকের ফৌজ নয় বরং তারা দস্যুদল।
বৃদ্ধ ইহুদী : তাহলে বলব,তুমি মুসলমানদের ব্যাপারে অবহিত নও। তারা যেখানে যায় স্বল্প সংখ্যক গিয়ে বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেদের অধিনত করে ফেলে। তারা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের মত বিশাল রাজ্যকে খতম করে দিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখ অল্প দিনের মাঝে ইসলামী সালতানাতের কি পরিমাণ বিস্তরণ ঘটেছে। মুসলমানরা অমুসলিম কওমের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে ধর্মীয় দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে।
বৃদ্ধ ইহুদী মুসলমানদের বীরত্ব, বিজয়ের ইতিহাস বর্ণনা করে চলছিল, মেরীনা তাকে থামিয়ে দিল।
মেরীনা : কাবেলে ইহতেরাম বুজুর্গ! আপনি আরবের মুসলমানদের কথা বলছিলেন, স্পেনে যারা এসেছে তারা বর্বর। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হত্যা-লণ্ঠন করাই হলো তাদের পেশা। তাদের সিপাহ্ সালারও বর্বর। এরা যুদ্ধবাজ কওমের মাঝেই বড় হয়েছে। তারা তাদের মুলকে কোন্ বাদশাহী কায়েম করেছে যে তারা আমাদের দেশে বাদশাহী কায়েম করবে?
মেরীনা : তার ছলচাতুরীকে পূর্ণ দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত করে বৃদ্ধ ইহুদীদেরকে নিজের ধারনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলো।
***
দু’তিন দিন পর আওপাস দুনিয়া বিরাগী সন্নাসীর বেশে টলেডোতে মেরীনার সাথে সাক্ষাতের মওকা তৈরী করে নেয়। মেরীনা তাকে ঐ ইহুদী ও গোথা সর্দারদের কাছে পাঠিয়ে দিল। এক ইহুদী পণ্ডিত কি যুক্তি পেশ করেছিল তার জবাবে মেরীনা কি বলেছে তা সে আওপাসের কাছে বর্ণনা দিল।
আওপাস পৌঁছার পর রাত্রে মেরীনাও সেখানে হাজির হলো। গোথা ও ইহুদীদের সর্দাররা সমেবেত হয়েছিল। আওপাস ছিল গোথা আর রডারিক যেহেতু গোথাদের বাদশাহী ভূলণ্ঠিত করেছে তাই আওপাস সহজেই গোথা সর্দারদেরকে আপন করে নিতে পারল। ইহুদিদের বৃদ্ধ ব্যক্তি কেবল নিজেদের ফায়দার কথা বারংবার বলতে লাগল।
আওপাস ইহুদী নেতাদেরকে সম্বোধন করে বলল, গোথারা তাদের রাজত্বকালে ইহুদীদেরকে সম্মান দান করেছিল এং তাদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আপনারা কি তা ভুলে গেছেন? এটা ভুলার কথা নয়। কারণ বেশী দিন আগের কথা নয়। গোথাদের সমমর্যাদা ইহুদেরকে দান করার দরুণই তো আমার ভাই ডেজাকে নির্মমভবে হত্যা করে তার প্রতিদান দেওয়া হয়েছে। আপনারা আমাদের সাথে থাকেন, ইহুদীরা আবার সে রূপ মান-মর্যাদা পাবে। আর বর্বররা লুঠতরাজ করে ধন-সম্পদ গুছিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
পরিশেষে ঐ রাত্রেই পরিকল্পনা করে কাজ শুরু হয়ে গেল। একজন গোথা জেনারেল রাজী হচ্ছিল না। সে রডারিকের অপেক্ষায় অপেক্ষমান ছিল। জেনারেল মূলত বাদশাহর চাটুকার ছিল। মেরীনা জাদু প্রয়োগ করল। সে তাকে এক নব যৌবনা খুব সুরত ললনার ঝলক দেখাল। জেনারেল কাবু হয়ে গেল এবং ঐ ললনীকে তার সাথে যুদ্ধে নিয়ে যেতে চাইল।
মেরীনা : বাদশাহ্ আপনার জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এত সুন্দর লাড়কী সে আপনার কাছে রাখতে দেবে না। বরং আমি লাড়কীকে বাদশাহর কাছে পৌঁছে দেব বাদশাহ সাথে করে নিয়ে যাবে তারপর লাড়কীকে আমি ঠিকমত বুঝিয়ে দেব সে পরে আপনার কাছে চলে আসবে। বাকী আমি আপনাকে যা বললাম তা করার জন্যে প্রস্তুত হোন। রডারিক যদি নিহত হয় তাহলে নতুন বাদশাহকে বলে আপনাকে বিশাল জায়গীরের অধিকারী বানিয়ে দেব।
মেরীনা ঐ ইহুদী তরুণীকে বলেদিল ঐ জেনারেলের প্রতি কোন ভরসা নেই। সে প্রতারণা করতে পারে। মেরীনা ঐ তরুণীর হাতে সুফুফ (চূর্ণ ঔষধ) দিয়ে বলল, রাত্রে জেনারেল কে যখন শরাব পান করাবে তখন শরাবের মাঝে এ সুফ মিশিয়ে দেবে। সুফুফের প্রতিক্রিয়াতে সে মেধাগত ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধের সময় জেনারেলকে অকেজো করে রাখা।
এ সুফুফ যদি রডারিককে পান করান যেত তাহলে ইহুদী ও গোথাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব ছিল না। কেননা সে কোন কিছু পানাহার করার পূর্বে দু’জন ব্যক্তিকে পানাহার করিয়ে তা পরীক্ষা করে নিত। তার একান্ত লোকেরা তার খানা-পিনার ইন্তেজাম করত। ঐতিহাসিকরা লেখেন, সে যে অত্যন্ত জুলুমবাজ ও নির্যাতনকারী ছিল তা জানত। তাই সর্বদা মাজলুমদের প্রতিশোধের আশংকায় থাকত।
***
গোথা ও ইহুদী সর্দাররা আওপাসের সাথে পরামর্শ করে যে পরিকল্পনা করেছিল সে অনুপাতে প্রায় দেড়শত নওজোয়ান তৈরী করা হলো। রডারিক টলেডোতে পৌঁছার পর নওজোয়ানদেরকে তার সামনে পেশ করা হলো যে এরা স্বেচ্ছায় ফৌজে শামিল হতে চায়। এরা সাধারণ ফৌজ নয় জানবাজ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। রডারিককে আরো বলা হলো এরা রাতের যুদ্ধা, রাতের আঁধারে হামলাকারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করবে।
রডারিক যেদিন টলেডোতে পৌঁছুল তার আগের দিন আওপাস ফিরে গিয়েছিল। সেদিন রাতেই গোথা গোত্রের সাথে সম্পর্ক যুক্ত কমান্ডাররা গোপনে বৈঠকে মিলিত হয় তার মাঝে ইহুদীরাও ছিল। তারা নির্জনে সলা-পরামর্শ করে সবাই যার যার মত ফিরে যায়।
পরের দিন রডারিক যখন একলাখ ফৌজীবাহিনী (যার মাঝে কয়েক হাজার ছিল ঘোড় সোয়ার) নিয়ে হামলাকারীদেরকে স্পৈন হতে বিতাড়নের মানসে তুফানের বেগে ছুটছিল তখন সিপাহীরা হামলাকারীদের ব্যাপারে একে অপরের থেকে নানান ধরনের আশ্চর্যজনক কথা-বার্তা শুনছিল।
“তিতুমীরের মত বাহাদুর জেনারেল তাদেরকে দেখেই পলায়ন করেছিল।”
“শোনা যায় তারা মাত্র কয়েক হাজার কিন্তু এক লাখের চেয়ে বেশী শক্তিশালী।”।
“তাদের কোন তীর ব্যর্থ হয় না। বাতাসে তীর ছেড়ে দেয় তারপর তীর নিজেই একজনের বুকে এসে বিদ্ধ হয়।”
“তাদের একজন পায়দল, চারজন-ছয়জন সোয়ারীর মুকাবালা করে এবং একে একে সবাইকে ওয়ার করে ফেলে।”
“স্বয়ং তিতুমীর বাদশাহকে বলেছে তারা আদমী নয়, জিন-ভূত।”
“শোনা যায় তারা কিন্তীতে আসেনি, এত বড় সমুদ্র সাঁতার কেটে এসেছে।”
“আমি তো এমনও শুনেছি যে তারা সাঁতার কাটেনা বরং পানির উপর হেঁটে চলে।”
রডারিকের ফৌজ রওনা হবার পর হতে তাদের মাঝে এ ধরনের নানা কথা আলোচনা হচ্ছিল। একজন একথা শুনে তার সাথে আরো তিন কথা যোগ করে অন্যের কাছে বর্ণনা করত। ফলে ক্রমেই ফৌজের মাঝে ভয়-ভীতি বাড়ছিল। তবে আরো একটা কথা তাদের মাঝে চর্চা হচ্ছিল তা হলো, তারা যেমনিভাবে চরম জালেম ঠিক তেমনিভাবে অত্যন্ত দয়ালু।
ইহুদী ও গোথারা যে পরিকল্পনা করেছিল সে মুতাবেক ফৌজের মাঝে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছিল। আর এসব কথা ফৌজের মাঝে চর্চা করছিল ঐ দেড়শত লোক যাদেরকে বিশেষ যুদ্ধবাজ হিসেবে ফৌজে শামিল করা হয়েছিল। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সৈন্যদের মাঝে এসব কথা আলোচনা করে প্রচার করছিল।
এক ইংরেজ ঐতিহাসিক তার গ্রন্থ “মুসলমানদের ইতিকথা”-তে লেখেছেন, স্পেনের ফৌজের ওপর এটা একটা মানসিক যুদ্ধ ছিল যা তারেক ইবনে যিয়াদ সৃষ্টি করেছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ আওপাসকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন সে যেন স্পেন ফৌজের মাঝে এমন কিছু লোক শামিল করে দেয় যারা মুসলমানদের ব্যাপারে ত্রাস সৃষ্টি করবে। আওপাস ইহুদী ও গোথা সর্দারদের কাছে এ প্রস্তাব পেশ করলে তারা তার বন্দোবস্ত করে দেড়শত লোক রডারিকের ফৌজে শামিল করেছিল।
***
একদিকে মুসলমানদের তাবুতে বিজয়ের জন্যে দোয়া হচ্ছিল অপরদিকে ইহুদী। ও গোথাদের ইবাদতগাহে রডারিকের পরাজয়ের জন্যে প্রার্থনা হচ্ছিল। ইহুদী ও গোথা সম্প্রদায় পরস্পরে আলোচনা করচিল রডারিক যদি নিহত হয় বা পরাজিত হয়, তাহলে রাজত্ব তাদের। কারণ হামলাকারীরা লুটতরাজ করে ফিরে যাবে।
রডারিকের ফৌজ সমুদ্র তীরে পৌঁছে গিয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ খবর পেয়ে ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে একটা পাহাড়ে গিয়ে চড়লেন, সমুদ্র তীরে বহুদূর পর্যন্ত। তিনি মানুষ আর ঘোড়া দেখতে পেলেন। এত পরিমাণ ফৌজ তিনি ইতিপূর্বে আর কোনদিন দেখেননি। তারেককে পূর্বেই বলা হয়েছিল রডারিকের সৈন্য সংখ্যা এক লাখের মত হবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ আসমানের দিকে দু’হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আল্লাহ্! ওগো আমার আল্লাহ! তোমার নামের সম্মান রক্ষা কর। আমরা তোমার নামে কুফুরীর বিপক্ষে লড়াই করতে এসেছি এবং তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি।
তারেক তার ফৌজ, দরিয়া হতে প্রায় এক মাইল পিছে রেখে ছিলেন। আর রডারিকের ফৌজকে সমুদ্রের তীরে আনতে চাচ্ছিলেন। যাতে তাদের পশ্চাদে থাকে সমুদ্র। তারেক তার সৈন্যবাহিনীর মাত্র কয়েক দল সম্মুখে রেখে বাকী সকল সৈন্য রেখেছিলেন পাহাড়ের ভেতর। তারেক লক্ষ্য করলেন রডারিকের ফৌজরা অতিদ্রুত নৌকা দিয়ে পুল তৈরী করছে।
“এদেরকে তো অত্যন্ত চঞ্চল মনে হচ্ছে।” তারেক ইবনে যিয়াদ আওয়াজ শুনতে পেলেন, ফিরে দেখলেন তার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ।
তারেক : আমরা এ ফৌজকে খুব তাড়াতাড়ি বিতাড়িত করব।
তারা যদি যুদ্ধের ক্ষেত্রেও এমন তেজী হয় তাহলে……। আবু জুরয়া বলতে বলতে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
তারেকঃ তোমরা কি দেখছনা তাদের চঞ্চলতা ও তেজীর কারণ কি? লক্ষ্য কর, তাদেরকে কিভাবে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। তারা স্বেচ্ছায় ও উদ্দীপনায় কাজ করছে না বরং তাদের সালারের দোররা তাদেরকে করাচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানেও তাদের সালার দোররা মেরে লড়াই করাবে?
তারেক ইবনে যিয়াদের দুই সালার গভীরভাবে লক্ষ্য করল, তারা দেখতে পেল তাদের জেনারেল বেত নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে কেউ একটু অলসতা করলে তার পিঠে পড়ছে সপাং সপাং বেতের বাড়ি।
তারেক : যুদ্ধ হয় স্পৃহা-উদ্দীপনায়, বেত্রাঘাতে নয়। যে কওমের কর্তারা তাদের অধিনতদেরকে গোলাম মনে করে আর বাদশাহ হয়ে যায় প্রজাদের জন্যে ফেরাউন সে কওমের ধ্বংস অনিবার্য। উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ কওমকে বিনাশ করে দেয়। আমাদের সিপাহীদের মাঝে প্রেরণা রয়েছে। জেনারেল, সিপাহী সকলের অন্তরে এক আল্লাহএক রাসূল। আমাদের মাঝে সমতার এটাই কারণ। কারো আল্লাহ বড় কারো ছোট এমন নয়, প্রাসাদ হোক ঝুপড়ী, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্ এক, আর বড়ত্ব একমাত্র আল্লাহরই।
আবু জুরয়া তুরাইফ : কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ফৌজ?
তারেক : তোমরা নিজ নিজ জায়গায় চলে যাও। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে বিজয়ের এমন উপকরণ দান করেছেন যার বিন্দুমাত্রও আশা ছিল না। রাসূল (স) এর বাসারত মিথ্যে হতে পারে না, কিন্তু আমি শুধু খাব দেখার আদমী নই। যে আল্লাহকে তালাশ করে সেই আল্লাহকে পায়। আর আল্লাহ্ তাকেই সাহায্য করেন যে প্রচেষ্টা করে। এখন তোমরা নিজেদের অবস্থানে অটল-অবিচল থাক।
সারা রাত রডারিকের সৈন্য একত্রিত হলো। সকাল হবার সাথে সাথে দেখা গেল দরিয়ার তীরে প্রশস্ত ময়দানে একলাখ ফৌজ লড়াই এর প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লেনপোল লেখেন, তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড়ায় আরোহন করে তার ফৌজের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত উঁচু ও দৃঢ় স্বরে বললেন,
“ইসলামের মুজাহিদ ভাইয়েরা! তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পিছনে সমুদ্র। পলায়নের কোন রাস্তা তোমাদের জন্যে ভোলা নেই। তোমাদের সম্মুখে একটাই রাস্তা তাহলো বাহাদুরী ও বিজয়। দুশমনের সংখ্যাধিক্যে ভয় পেওনা। ভয় কর ঐ পরাজয়কে যা তোমাদের জন্যে লাঞ্ছনা-গুঞ্জনা বয়ে আনবে।”
ইউরোপীয়ান একজন ইতিহাসবিদ লেখেন, মুসলমান ফৌজরা বজ্রের মত গর্জে উঠে শ্লোগানে মাতোয়ারা করে তুলল,
“আমরা তোমার সাথে রয়েছি তারেক! আমরা তোমার সাথে রয়েছি।”
স্পেন ফৌজের পক্ষ হতে এলান হলো, “তোমরা যারাই হও ফিরে যাও। স্পেনের শাহানশাহর বাদশাহী এক সমুদ্র হতে অপর সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। তার তলোয়ারের ভয়ে পুরো ইউরোপ প্রকম্পিত হয়। তোমাদের প্রতি তিনি অনুগ্রহ করছেন তোমরা ফিরে যাও তাহলে তার তলোয়ার কোষবদ্ধ থাকবে তা নাহলে তোমরা নিজদের পরিণাম চিন্তে কর।”
তারেক ইবনে যিয়াদকে বুঝিয়ে দেয়া হলো তারা কি ঘোষণা করছে, তারেক ইবনে যিয়াদ তার জবাব বাতলিয়ে দিয়ে বললেন স্পেনী ভাষায় তা এলান করার জন্যে। এলানের জওয়াব দেওয়ার জন্যে আওপাস ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উঁচু স্বরে বলল,
“স্পেনের শাহানশাহকে তারেক ইবনে যিয়াদের সালাম। শাহান শাহে মুয়াজ্জম! আমরা ফিরে যেতে পারি না, আমরা আমাদের তাবৎ জাহাজ-কিস্তি জ্বালিয়ে দিয়েছি। আমরা শাহানশাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যে তিনি আমাদের জন্যে সমুদ্রে নৌকার পুল তৈরী করে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর নির্দেশে এসেছি, এখন স্পেনের বাদশাহর হুকুমে ফিরে যেতে পারি না।”
অপর প্রান্ত হতে বর্বর ভাষায় এলান হলো,
শাহান শাহে রডারিকের মুকাবালার জন্যে সম্মুখে অগ্রসর হলে আল্লাহ তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। তোমরা হলে দস্যু কওম, আমরা তোমাদেরকে শেষবারের মত……
কথা শেষ না হতেই মুসলমানদের কামান হতে তিনটি তীর গিয়ে এলানকারী জেনারেলের বুকে বিদ্ধ হলো। সে ঘোড়া হতে নিচে পড়ে গেলে স্পেনের এক ঘোড় সোয়ার তরিঘড়ি করে মুমূর্ষ জেনারেলকে নিজের ঘোড়ায় উটিয়ে নিয়ে গেল।
***
রডারিক সৈন্য বাহিনীর সম্মুখে ছিল না, তার পতাকা পিছনে দেখা যাচ্ছিল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার ছিল। সে যখন জানতে পারল, মুসলমানরা তার এক জেনারেলকে হত্যা করেছে তখন সে আক্রমণ করার নির্দেশ দিল। যুদ্ধের নিয়ম নীতি ও পরিচালনার ব্যাপারে তার অত্যন্ত সুনাম ছিল। সে যে প্লান বানিয়েছিল তার জেনারেলরা তা পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করে নিয়েছিল।
রডারিক তার জেনারেলদেরকে বলেছিল, দু’তিন দল মিলে আক্রমণ করা হবে। এক সাথে বেশী ভীড় করলে তোমাদের নিজেদের তীরে জখম হয়ে ও নিজেদের ঘোড়ার পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে তোমরা নিজেরাই মারা যাবে। ভীড়ের মাঝে সিপাহীরা ঠিকমত তীর চালাতে পারবেনা। তাই প্রত্যেক বার হামলা হবে দুতিন দলের মাধ্যমে এবং তাহবে নতুন নতুন দল। দুশমনের সংখ্যা খুবই স্বল্প। তাদেরকে পর্যায়ক্রমে যুদ্ধ করাতে হবে যাতে তারা বিশ্রামের সুযোগ না পায়। যুদ্ধের ক্ষণ দীর্ঘ করতে হবে যাতে দুশমনরা আমাদের তলোয়ারে কিছু খতম হয় আর বাকীরা যেন এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, কোথাও এক জায়গায় জমে লড়াই করা যাবে না। আঘাত হেনেই কেটে পড়বে। কেটে পড়ার সময় এলোমেলো হয়ে যাবে, যাতে করে তোমাদের পিছু পিছু যে দুশমনরা আসবে তারাও যেন এলো-মেলো হয়ে যায়। দুশমনদেরকে পাহাড়ের আড়ালে আনবে তাহলে তাদেরকে তীরন্দাজরা আঘাত হানতে পারবে।
তারেকের প্লান ছিল গেরিলা যুদ্ধের। কারণ এত স্বল্প সংখ্যক বাহিনী নিয়ে রডারিকের বৃহৎ বাহিনীর সাথে এক জায়গাতে স্থির থেকে সামনা-সামনি যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু গেরীলা যুদ্ধ কোন সহজ যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ কেবল বিজ্ঞ জেনারেলই পরিচালনা করতে পারে।
রডারিক হামলার নির্দেশ দিয়ে দিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তিন-চার দলকে সম্মুখে অগ্রসর করলেন, তারা এমনভাবে লড়াই করতে লাগল যেন তারা পলায়নের জন্যে ব্যস্ত। তারা এমনভাবে আস্তে আস্তে পিছু হতে লাগল যে, স্পেন ফৌজ তা বুঝতেও পারলনা। মুসলমানরা একটা পাহাড়ের আড়ালে এসে-ডানে বামে চলে গেল। এরি মাঝে পাহাড়ের চূড়া হতে স্পেনী ফৌজের ওপর বর্শা ও তীর, বৃষ্টির ন্যায় অবিরাম বর্ষণ হতে লাগল। এসকল তীর-বর্শা তিতুমীরের ফৌজ হতে হাসিল হয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ ওঁত হতে তীর-বর্শা নিক্ষেপের কৌশল শিক্ষা দিয়ে ছিলেন।
তারেকের যেসব সৈন্য ডানে-বামে এলো-মেলো হয়ে চলে গিয়েছিল তারা কিছুদূর গিয়ে একত্রিত হয়েগেল। দুশমনরা তীরের আঘাতে যখন পিছু হটতে লাগল তখন ডান-বাম হতে মুসলমানরা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করল। দুশমনরা দিশেহারা হয়ে, এলো-মেলোভাবে পলায়ন করতে লাগল। প্রতিরক্ষার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা অসহায়ভাবে নিহত হতে লাগল।
যুদ্ধ বিশারদ ঐতিহাসিকরা লেখেন, এর দ্বারা মুসলমানদের সিপাহ্ সালারের যুদ্ধ কৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু মুসলমান ফৌজের ব্যাপারে স্পেনী ফৌজের মাঝে যে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল তা তাদের যুদ্ধ মনোবল দুর্বল করে দিয়েছিল।
এদিন রডারিক আরো কয়েকটি দলের মাধ্যমে আক্রমণ করাল এবং ভালভাবে সৈন্যবাহিনীকে বলে দিল মুসলমানরা পিছু হটলে তাদের পিছু পিছু যেন তারা না যায়। এখন মুসলমানদের পিছু হটার প্রয়োজন ছিল না। তাদের ওপর যখন আক্রমণ হলো তখন তারা টিলার মাঝে আশ্রয় নিল এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। স্পেন ফৌজও তাদের মত এলো-মেলো হয়ে গেল। তারপর মুসলমানরা টিলার ওপর থেকে তাদের ওপর এমন আক্রমণ করল যে তাদের অপ্রত্যাশিতভাবে প্রচুর জীবন নাশ হয়ে গেল। মুসলমানরা পিছু হটার কৌশলে তাদের প্রতি আক্রমণ করতে লাগল। তারপর হঠাৎ করে মুসলমানরা সব একত্রিত হয়ে বেষ্টনি দিয়ে স্পেন ফৌজকে ঘিরে ফেলে সম্মুখে বীর বিক্রমে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে এমনভাবে সংকুচিত করে ফেলল যে তারা তলোয়ার চালানোরও সুযোগ পেল না। মুসলমানরা তাদেরকে কচু কাটা করল। সূর্য অস্তমিত হলো। ময়দানে রডারিকের ফৌজের লাশের স্তূপ পড়ে রইল তা দেখে তারা আঁতকে উঠল।
অর্ধ রাত্রি। রডারিকের ফৌজ গভীর নিদ্রায় অচেতন। পাহারাদার ঘুরাফেরা করছে। হঠাৎ এক পাহারাদের বুকে খঞ্জর বিদ্ধ হলো। এভাবে আরো কয়েকজন পাহারাদারের অবস্থা এমন হলো। একদিক পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ হয়ে গেল। ফৌজ তাবু ছাড়া ছিল। ঘোড়া ফৌজের কাছেই বাঁধা ছিল।
পাহারাদার নিহত হবার পর ছয়জন মুসলমান ধীরপদে অত্যন্ত সতর্কার সাথে ঘোড়ার কাছে পৌঁছে ঘোড়ার রশি কেটে দিয়ে খঞ্জর মেরে জখম করে ছেড়ে দিল। প্রায় দেড়শত ঘোড়া তারা এমন করল। ঘোড়া আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে. লাগল এবং মাটিতে যে সব ফৌজ শুয়েছিল তাদেরকে পিষে ফেলল। এভাবে আঘাত প্রাপ্ত ঘোড়া অসংখ্যক সৈন্যকে পদতলে পৃষ্ঠ করে খতম করে দিল।
এ কর্ম সমাপ্ত করে জানবাজ মুজাহিদরা সেখান তেকে অত্যন্ত সুস্থ সুন্দরভাবে ফিরে এলো। তারা যখন তাদের ক্যাম্পে পৌঁছল তখন সেখানে পর্যন্ত রডারিকের ফৌজের শোর-গোল শুনা যাচ্ছিল। তখনও ঘোড়া ছুটাছুটি করছিল। কোন সাধারণ ঘোড়া ছিল না তা ছিল যুদ্ধ ঘোড়া, তাই তাদের সহজে আয়ত্বে আনা সম্ভব ছিল না। রডারিকসহ তামাম ফৌজ জেগে উঠেছিল।
মশাল জ্বালান হলো। একটা ঘোড়াকে খুব কষ্ট করে ধরা হলো। ঘোড়ার পিঠ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। রডারিক পেরেশান হয়ে পড়ল। এ ঘোড়া জখম হলো কি করে। আরো কিছু ঘোড়া ধরে আনা হলো সবগুলোর বদন হতে প্রবল বেগে রক্ত বেরুচ্ছিল।
রডারিক : এটা দুশমনের রাতের কাণ্ড। রাতে যারা পাহারায় ছিল তাদেরকে অশ্বের পিছু বেঁধে টেনে-হেঁছড়ে চামড়া ছুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ কর।
পাহারাদারদের তালাশ শুরু হলো। অনেকক্ষণ পরে তিন জনের লাশ পাওয়া গেল।
***
রাত্রি শেষে যখন দিনের আলো প্রকাশ পেল তখন ময়দানের ভয়াবহতা চোখে পড়ল। ময়দানে কেবল লাশ আর লাশ। ময়দান হতে লাশ না উঠিয়ে রডারিক বড় ভুল করেছিল। আগে থেকে ফৌজের মাঝে আতংক বিরাজ করছিল, ময়দানে বিপুল পরিমাণ মৃতদেহ দেখে সে আতংক তুফান আরো বেড়ে গেল। রডারিকের উচিৎ ছিল রাতেই লাশ উঠিয়ে সমুদ্রে ফেলার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সে হয়তো একথা ভেবে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলমানরা এক রাতে এত পরিমাণ ফৌজ খতম করল কিভাবে। তার ধারনা ছিল, মাত্র কয়েকটি দল আক্রমণ করলেই এ স্বল্প সংখ্যক মুসলমান পলায়ন পদ হবে কিন্তু প্রথম দিনের যুদ্ধে তার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রডারিক তার জেনারেলদেরকে ডেকে বলল, ময়দানে তোমাদের ফৌজের যে পরিমাণ লাশ দেখছ এ পরিমাণ মুসলমানদের লাশ আজকে আমি চাই। তোমাদেরকে আজ অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে।
একজন জেনারেল বলল, আজ আমরা বিপুল সৈন্য নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করব।
তিতুমীর বলল, পাহাড়ের অভ্যন্তরে গিয়ে আমরা তাদেরকে খতম করব। তিতুমীরের উদ্দেশ্যে রডারিক বলল, তোমার মাথায় যদিএতটুকু বুদ্ধিই থাকত তাহলে তুমি তাদের হাতে মার খেয়ে পলায়ন করতে না। তুমি যদি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ কর তাহলে না তুমি জীবিত ফিরে আসবে না তোমার সিপাহী। অন্য জেনালেরকে লক্ষ্য করে বলল, আর তুমি বলছ, বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করবে। তুমি কি কালকে দেখনি? তারা প্রথমে তোমাদেরকে এলোমেলো করেছে তারপর একজায়গায় একত্রিত করে ভিড় সৃষ্টি করে সবাইকে খতম করে দিয়েছে… তুমি কি জানো যে দুশমনের সামনে ভীড় করা লোকসান?
আজ স্বল্প সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করবে, একজন মুকাবালা করবে একজনের। নিজেদের মাঝে এতটুকু দূরত্ব রাখবে যাতে আরামে তলোয়ার চালান যায়। আজকের হামলাতে অর্ধেক সোয়ারী অর্ধেক পায়দল থাকবে।
এদিকে তারেক ইবনে যিয়াদ কয়েকজন পায়দল সৈন্যদল নিয়ে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি প্রথমে আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন না। প্রথমে দুশমনকে আক্রমণের সুযোগ দিতেন যাতে তাদের কৌশল ও যুদ্ধের প্রক্রিয়া বুঝা যায়।
রডারিকের পরিকল্পনা মুতাবেক তার ফৌজ গতকালের মত দ্রুত বেগে সম্মুখে অগ্রসর হলো না বরং মধ্যম গতিতে সামনে বাড়তে লাগল। তারা সামনে-পিছনে তিন সারিতে সারিবদ্ধ ছিল। প্রথম সারিতে ছিল ঘোড় সোয়ার। তারা মুসলমানদেরকে দেখামাত্র দ্রুত বেগে ধেয়ে আসল। মুসলমান পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল। তারা সকলেই পায়দল ছিল। একজন সোয়ারীও দেখা যাচ্ছিল না। মুসলমানদের পক্ষ হতে যুদ্ধের নাকারা বেজে উঠল। স্পেনী ঘোড় সোয়াররা পূর্ব হতেই বর্শা প্রস্তুত করে রেখেছিল। কিন্তু তারা যখন মুসলমানদের কাছে পৌঁছল তখন মুসলমানরা তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিল। তারা সকলেই হঠাৎ করে বসে পড়ল ইতিমধ্যে তেজবেগে ঘোড়া তাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেল। ঘোড়া থামাতে পারল না। যখন তারা ঘোড়া থামিয়ে পিছে ফিরে আসছিল ততক্ষণে মুসলমানরা দুশমনের পায়দলবাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে পূর্ণদমে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ঘোড় সোয়াররা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারল না কারণ তাদের নিজেদের পায়দল সৈন্যও তাদের সম্মুখে পড়ছিল। ঘোড় সোয়ার যখন আরো সম্মুখে গিয়ে পিছে ফিরে আসছিল তখন একটা বড় টিলার পশ্চাৎ হতে হঠাৎ মুসলমানদের ঘোড় সোয়ার বেরিয়ে রডারিকের সোয়ারীদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করে বসল। আক্রমণ রডারিক বাহিনীর কাছে অকল্পনীয় ছিল। তারা বুঝে ওঠার পূর্বেই মুসলমানদের তলোয়ারে কচু কাটা হলো।
স্পেনীদের অন্য আরেকদল ঘোড় সোয়ার যখন মুসলমান ঘোড় সোয়ারদের দিকে যাচ্ছিল তখন তারা দ্রুত বেগে ঘোড়া ফিরিয়ে যে পাহাড় এবং টিলা হতে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।
স্পেনী জবানে বার বার আহ্বান হতে লাগল ফিরে এসো! ফিরে এসো। পাহাড়ের মাঝে খবরদার যেওনা।
স্পেনী সোয়ার যখন ফিরে আসতে লাগল তখন মুসলমান সোয়ারীরা পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করে তাদেরকে খতম করতে লাগল এবং আক্রমণ করেই তারা দ্রুতপদে পালিয়ে যেতে লাগল।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, উভয় পক্ষের সৈন্যরা বীরত্ব প্রদর্শন করতে ছিল কিন্তু মুসলমানদের মাঝে যে স্পৃহা ছিল স্পেনীদের মাঝে তা ছিল না। মুসলমানরা ছিল বর্বর আর বর্বররা যুদ্ধ-বিগ্রহে ছিল আগ্ৰহী অধিকন্তু ছিল দক্ষ। তাদের হত্যাযজ্ঞের কথা ছিল মাশহুর। ইসলাম গ্রহণের পর কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল, যার ফলে তাদের যুদ্ধ স্পৃহা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
স্পেন ফৌজ মুসলমানদের মুকাবালায় টিকে থাকতে পারল না, তারা পিছু হটতে লাগল। স্পেন সোয়ারীদেরকে মুসলমান সোয়ারীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেরেশান করে তুলেছিল। স্পেনীরা এলো-মেলো হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা একাই কয়েকজন সোয়ারকে খতম করছিল কিছু সোয়ারীকে তো তারা ঘোড়াসহ জীবিত ধরে নিয়ে এসেছিল। মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনীতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল, ক্রমেই যুদ্ধে দামামা-নাকারার আওয়াজ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যুদ্ধের ময়দানের জন্যে বর্বরদের বিশেষ নাকারা ছিল যা তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাজান জরুরী মনে করত।
রডারিকের ফৌজের মাঝে পূর্ব হতেই যে আতংক বিরাজ করছিল তা যুদ্ধের ময়দানের স্পৃহা তাদের খতম করে দিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল।
***
রডারিকের নির্দেশে রাত্রে ক্যাম্পের চতুর্দিকে পাহারা জোরদার করা হলো। তারপরও কিছু জানবাজ মুজাহিদ ক্যাম্পে পৌঁছে বহু সৈন্য হত্যা করে ঘোড়ার ওপর তীর চালিয়ে তা বেকার করে দিয়ে আসল।
সকালে অগ্নিশর্মা হয়ে রডারিক বলল,আজকে হবে শেষ লড়াই। আজ আমি স্বয়ং নিজে অগ্রভাবে থাকব। এক গোথা জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল, গোখা সিপাহীদেরকে আমি এখনো অগ্রে পাঠাইনি, তুমি তোমার গোথা জানবাজদেরকে বলে দাও আমি এখন বিজয়ের একমাত্র ভরসা তোমাদের ওপর করছি। আমার। কওমের বাহিনীরা আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।
এ জেনারেলের সাথেই মেরীনা কথা বলে তার পক্ষে আনতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সে সক্ষম হয়নি পরিশেষে এক সুন্দরী লাড়কীর লোভ দেখিয়ে ছিল। তার সে প্ল্যানও বাস্তবায়ন হয়নি, ইহুদী জাদুকর তাকে জবাই করার জন্যে নিয়ে গেলে তা ভেস্তে গেছে।
যুদ্ধের তৃতীয় দিন গোথারা যুদ্ধের জন্যে সম্মুখে আসল। তাদের পিছনে ছিল অন্য কওমের সৈন্য বাহিনী। পিছনের বাহিনীর সাথে রডারিকও ছিল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার ছিল। মাথার ওপর পতাকা উড়ছিল। চতুরপার্শ্বে ছিল তার মুহাফেজ বাহিনী।
তারেক ইবনে যিয়াদ রডারিকের পতাকা দেখে তার ঘোড়া ছুটিয়ে তার সৈন্য বাহিনীর সম্মুখে চলে গেলেন। তারেকের পিছনে তার রক্ষী বাহিনী গেলে তিনি তাদেরকে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। আর মুগীছে রূমীকে কাছে ডেকে তার কানে কানে কিছু বললেন। মুগীছে রূমী স্পেনী ভাষা বুঝত এবং বলতে পারত। সে তারেক ইবনে যিয়াদের কথা শুনে সম্মুখে চলে গেল।
মুগীছে রূমী এলান করল, “আমরা শাহান শাহে উন্দুলুসকে স্বাগতম জানাচ্ছি, আমাদের সিপাহ্ সালার তারেক ইবনে যিয়াদ বলছেন, বাদশাহ্ রডারিক যদি যুদ্ধের জন্যে এসে থাকেন তাহলে তিনি যেন আমাদের মত রক্ষী বাহিনী ছাড়া একাকি সম্মুখে আসেন।”
রডারিক ঘোষণা করাল, আমার মত কোন বাদশাহ যদি তোমাদের মাঝে থাকত তাহলে আমি তোমাদের সম্মুখে যেতাম। দস্যু সর্দারের সামনে যাওটা বাদশাহ্র মর্যাদাহানী। তোমাদের বাদশাহকে সাথে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ এলান করালেন, “আমরা তোমাকে অচিরেই আমাদের বাদশাহ্র কাছে পৌঁছে দেব। আমাদের বাদশাহ্ আল্লাহ্, আমরা কোন মানুষকে বাদশাহ্ বানাইনা। আমাদের সকলের বাদশাহ্ আল্লাহ এ পয়গাম ও তোমাদের বাদশাহী, চিরতরে খতম করার জন্যে এসেছি।’
গোথা জেনারেলের নাম ধরে আহ্বান করে রডারিক বলল, সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দাও।
গোথা জেনারেল উচ্চধ্বনি দিতে বলল, প্রবল বেগে আগ্রমণ কর হে আহলে গোথা! একথা বলেই সে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিল।
তার নিজস্ব সোয়ারীদের মধ্য হতে এক সোয়ারী পিছন দিক হতে এসে তার পিঠে প্রবল বেগে বর্শার আঘাত হানল। তারপর পিঠ হতে বর্শা বের করে পূনঃবার মারল। জেনারেল ঘোড়া হতে পড়ে গেল। গোথা কওমের সৈন্যরা তলোয়ার কোষবন্ধ করে মুসলমানদের সাথে গিয়ে মিলে গেল। তাদের মাঝে সোয়ারী ও পায়দল উভয়দল ছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ তো আগে থেকেই জানতেন যে গোথা ও ইহুদীরা তাদের সাথে মিলে যাবে কিন্তু তারেকের ফৌজরা ছিল পেরেশান, এ আবার কেমন হামলাকারী যে তারা তলোয়ার কোষবদ্ধ করে রেখেছে।
তারেক ঘোষণা দিলেন, তাদেরকে ইস্তেকবাল কর, তারা তোমাদের দোস্ত, এখন থেকে তারা তোমাদের সাথী।
অপরদিকে রডারিক হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছিল একি? তারা কোথায় যাচ্ছে? তারা তাদের জেনারেলকে হত্যা করল?
তার এসব প্রশ্নের জওয়াব দেয়ার কেউ ছিল না। এটা ছিল মেরীনা ও আওপাসের গোপন পরিকল্পনার ফসল। গোখাদের সংখ্যার ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা দ্বিমত পোষণ করেছেন, কেউ বলেছেন, বিশ হাজার কেউ পঁচিশ বলে জ্ঞান। করেছেন। আবার কেউ পনের-বিশ হাজার বলে ধারণা করেছেন।
রডারিকের প্রশ্নের জওয়াব দেয়ার জন্যে এক গোথা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উচ্চস্বরে বলল,
আমরা আমাদের বাদশাহ্ ডেজার প্রতিশোধ নেব। স্পেনের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী গোথা কওম। রডারিক! তুমি গোথাদের রাজত্ব খতম করে নিজে ক্ষমতার মসনদে হয়েছ আসীন, এবার দেখবে আমরা আমাদের অধিকার কিভাবে আদায় করি।”
***
লড়াই ছাড়াই যুদ্ধের রূপ পাল্টে গেল। আগের দিন রডারিক প্রবলবেগে আক্রমণ করিয়ে ছিল, কিন্তু প্রতিটি আক্রমণই ব্যর্থ হয়েছে। মুসলমানদের সংখ্যা এক সাথে বিশ হাজার বৃদ্ধি পেল। আর এ সংখ্যা কেবল নামকা ওয়াস্তে ছিল না বরং তাদের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলছিল প্রতিশোধের অনির্বাণ শিখা।
সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে তারেক ইবনে যিয়াদ যুদ্ধ পলিসি পরিবর্তন করলেন এবং গোথাদের মাঝ থেকে একজনকে জেনারেল নিয়োগ করলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সালারদেরকে সম্বোধন করে বললেন,
“কে বলবে যে, আমার রাসূলুল্লাহর (স) ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিতহবে না…। আল্লাহর সাহায্য যখন আসে তখন তার বান্দার তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে যায়। আল্লাহ্ তায়ালা অবশ্যই তার মাহবুবের সুসংবাদ বাস্তবায়ন করবেন। তোমরা সকল ফৌজুকে বলে দাও তারা যেন আল্লাহর দরবারে মাথা নত রাখে আর দিলে কেবল যেন আল্লাহর নাম স্মরণ করে।
অপরদিকে সমুদ্র তীরে এক জাঁকজমকপূর্ণ তাবুতে রাগে-দুঃখে বাদশাহ রডারিক দাঁতে দাঁত পিষছিল। কখনো সে বসছিল কখনো আবার লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে তাবুর মাঝে পায়চারী করছিল। আবার কখনো মাথা-বুক থাপড়াচ্ছিল। দু’জন জেনারেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। পরিশেষে একজন বয়স্ক জেনারেল, রডারিক যাকে অত্যন্ত সম্মান করত, সে কামরায় প্রবেশ করে বলল,
বাদশাহ নামদার! আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। গোখারা প্রতারণা করেছে তাতে কোন অসুবিধা হবে না। আমরা তাদের বংশ নিপাত করে দেব।
মাটিতে স্বজোরে পদাঘাত করে গর্জে উঠে রডারিক বলল, আমাদের বংশই নিপাত হবার পথে। যা বলছ তার কাবেল যদি তোমরা হতে তাহলে প্রথমদিনই এ, লড়াই খতম হয়ে যেত। তোমরা দুশমনের কি ক্ষতি করতে পেরেছ? যারা সংখ্যার দিক থেকে মানুষের পায়ের নিচে পিপড়ার ন্যায়। কিন্তু এ পিপড়া এখন আমাদের অস্তিত্ব বিনাশের পথে। দুশমন কমজোর হবার চেয়ে দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠল।… আমার সম্মুখ থেকে বেরিয়ে যাও।
জেনারেল চলে না গিয়ে শুরাতে শরাব ঢালল।
জেনারেল পিয়ালা রডারিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমরা শাহানশাহ্ কে এ অবস্থায় দেখতে চাই না। এ পিয়ালা পান করে নিজেকে সামলে নেন।
রডারিক পিয়ালা নিয়ে স্বজোরে ছুঁড়ে ফেলে তা ভেঙ্গে খানখান করে ফেলল।
রডারিক : তোমরা আমার বুদ্ধিমত্তা খতম করতে চাও, তোমরা আমাকে বাস্তবতা ভুলে যেতে বলছ।
জেনারেল রডারিকের খিমা থেকে বেরিয়ে আওরতদের খিমার দিকে গিয়ে একজন নওজোয়ান সুন্দরী লাড়কীকে সাথে করে নিয়ে এলো যে রডারিকের কাছে খুবই প্রিয় ছিল। সে লাড়কীকে খিমাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই লাড়কী খিমা হতে বেরিয়ে এলো। রডারিক লাড়কীকে খুব তীব্রভাবে ধাক্কা দিয়ে ছিল ফলে লাড়কী বের হয়ে আওরতদের খিমার দিকে চলে গেল।
***
রডারিক বুড়ো জেনারেলকে আহ্বান করল। জেনারেল দৌড়ে রডারিকের খিমাতে পৌঁছল।
হতাশভাবে রডারিক জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলল, সম্ভবত ঐ ইহুদী গণক ব্যর্থ হয়েছে। সে বলেছিল, একজন নওজোয়ান লাড়কীকে জবেহ করলে আমার মন্দ পরিণাম (বদফালী) দূরিভূত হবে। আমি তাকে লাড়কী দিয়েছি। সে হয়তো তাকে জবেহ করেছে… কিন্তু… বেকার হয়ে গেছে…। ইহুদী আমাকে ধোকা দেয়নি তো?
জেনারেল : আমি এখনই এক সোয়ারীকে টলেডো প্রেরণ করছি, সে সংবাদ নিয়ে আসবে।
পরাস্ত আহত সৈনিকের মত হতাশার স্বরে রডারিক বলল, সে কবে পৌঁছবে। আর কবে বা ফিরে আসবে!
হিরাক্লিয়াসের দুর্গ খোলা আমার ঠিক হয়নি। দুর্গের রক্ষক দুজন পাদ্রী আমাকে বাধা দিয়েছিল। তুমি আমার সাথে ছিলে তুমিও আমাকে বুঝিয়ে নিষেধ করেছিলে।
জেনারেল : শাহানশাহ্! পিছনের কথা ভুলে যান এবং সন্দেহ মন থেকে বের করে দেন।
রডারিক : সন্দেহ ও হতাশার হাত থেকে আমি কিভাবে মুক্তি পাব? তুমি কি লক্ষ্য করছে না, দুর্গে আমরা যুদ্ধের যে দৃশ্য দেখেছিলাম তা প্রতিদিন এখানে প্রত্যক্ষ করছি। মুসলমানদের যে ধ্বনি শুনে ছিলাম তাই শুনছি। আমরা ফৌজকে দুর্গের দৃশ্যের পিছু হটতে দেখছি। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। আমি দেখেছিলাম আমার ঘোড়া আমাকে ফেলে পালিয়ে চলে যাচ্ছে। আর যে লাড়কীকে পামপিলুনাতে হত্যা করেছিলাম সে লাড়কী আবার আমার স্বপ্নরাজ্যে এসে ভীড় করছে।
ঐতিহাসিক লেইনপোল তৎকালের স্পেন ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেছেন, “দুর্গ ও হত্যাকৃত কিশোরী” রডারিকের ওপর প্রেতাত্মার ন্যায় সোয়ার হয়েছিল। যে ইহুদীগণক এর হাত থেকে মুক্তি দেয়ার কথা বলেছিল মেরিনা তাকে হত্যা করেছিল। বিশ-পঁচিশ হাজার গোথা ফৌজ কেবল রডারিকের পক্ষই ত্যাগ করেনি বরং তার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তারপরও তার কাছে বেশ অনেক সৈন্য ছিল কিন্তু সে সব সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। যুদ্ধ ময়দানের কর্তৃত্ব পুরোদমে তারেকের দখলে ছিল। তারেক কোন সন্দেহ ও দুষ্ট আত্মার হাতে গ্রেফতার ছিল না। তার মনে পাপের অনুশোচনা ছিল না; তার দৃঢ় বিশ্বাস তার মনোবলকে আরো বাড়িয়ে ছিল। পক্ষান্তরে রডারিকের অন্তর-মন পাপের প্রায়শ্চিত্তের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। হিসেব-নিকেসের দিন তার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল।
***
যুদ্ধের আঠারতম দিনের সূর্য উদিত হলো। রডারিক তার তামাম ফৌজকে অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে ময়দানে দাঁড় করাল। সে তার সফেদ ঘোড়ায় সোয়ার। ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে ফৌজের মাঝে এলান করতে লাগল, আজকে যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছাবে। তোমরা যদি দুশমনকে পরাজিত করতে পার তাহলে এত বিপুল পরিমাণ ইনয়াম তোমাদেরকে দেব তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও শাহান শাহ্ রডারিককে স্মরণ করবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : হে গোথা সম্প্রদায় তোমরা যদি আজ পরাজিত হও তাহলে, স্পেন হতে তোমাদের বংশ নির্মূল করা হবে। তোমাদের কোন আওরত ও কোন বাচ্চা রডারিক জীবিত রাখবেনা। আর হে বর্বর কওম! তোমরা কখনো কোন দিন কারো কাছে পরাজিত হয়েছ। তোমরা যদি পরাজিত হও, তাহলে কোথায় যাবে? তোমরা এই প্রথম অন্যদেশে এসেছ। আরবী মুসলমানরা কয়েকটি মূলককে ইসলামী সালতানাতে শামিল করতে সক্ষম হয়েছে। তোমাদের আরবী ভাইরা বলবে যে, বর্বররা অন্যদেশে গিয়ে যুদ্ধ করার কাবেলই ছিল না, এটা তোমরা পছন্দ কর?
বর্বর লস্কর হতে বুলন্দ আওয়াজ উঠল, নেহী তারেক! নেহী! আমরা তোমার সাথে আছি এবং তোমার সাথেই থাকব।
রডারিক : আক্রমণকারীদের ধ্বনীতে ভয় পেওনা। এরা কোন বাদশাহর ফৌজ নয়, এরা দস্যু, ডাকাতের দল।
ফৌজদের স্পৃহা, উদ্দীপনা বাড়াবার উদ্দেশ্যে তারেক বলছিলেন, হে আহলে ইসলাম! বিজয় তোমাদেরই, তোমরা দুশমনের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করতে পেরেছ। আর এটা ভুলে যেওনা যে, এ হাজার হাজার গোথারা তাদের জালেম ও উৎপীড়ক বাদশাহর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে এসেছে। আল্লাহর হুকুম কোন অসহায় বস্তির ওপর জুলুম হলে সেখানে তোমরা সহায়ের হাত বাড়াও। তোমাদের গোথা ভাইদেরকে এ জালেম বাদশাহর হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দাও।
বর্বরদের পক্ষ হতে ধ্বনী উঠল, আমরা জান কুরবানী করেদেব তারেক! আমরা জীবন উৎসর্গ করে দেব।
***
রডারিক হামলা করার নির্দেশ দেয়া মাত্র তার সোয়ারীরা উম্মাদের ন্যায় ছুটে এলো। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সোয়ারীদলকে সামনের কাতারে রেখেছিলেন। যখন দুশমনের সোয়ারী কাছে চলে এলো তখন হঠাৎ করে পায়দল তীর আন্দাজদল সম্মুখ ভাগে চলে গেলো। তারা খুব দ্রুততার সাথে স্পেনীদের ওপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। বর্বরদের কামান ছিল খুব শক্তিশালী। তা হতে নিক্ষিপ্ত তীর খুব দ্রুততার সাথে অনেক দূরে যেত।
বেশ কিছু স্পেনী ফৌজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কিন্তু ঘোড়ার তেজ কমল না। যখন তারা একেবারে কাছে চলে এলো তখন পায়দল তীর আন্দাজ নিজেদের সোয়ারীর পিছনে চলে গেল। মুসলমান সোয়ারী পূর্ব হতেই তৈরী ছিল। উভয় পক্ষের মাঝে মুকাবালা শুরু হয়ে গেল। যখন সোয়ারীরা এলোমলো হয়ে গেল তখন তারেকের ইশারায় পার্শ্বদেশ হতে গোথা দল বেরিয়ে স্পেনীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে বসল।
রডারিক এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখছিল কিন্তু সে আর স্থির থাকতে পারল না। সে পায়দল বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিল।
তারেক এবার বিশেষ পলিসি চালতে লাগলেন। তিনি গোথাদেরকে সামনাসামনি যুদ্ধ করতে বললেন। আর মুসলমান ফৌজকে ডানে-বামে পাঠিয়ে দিলেন। একদিকে মুগীছে রূমী আর অপরদিকে গেলেন আবু জুরয়া তুরাইফ। তারা বহুদূর ঘুরে নিজ নিজ জায়গায় পৌঁছে গেল।
রডারিক পূর্ণ দমে আক্রমনের জন্যে অগ্রসর হচ্ছিল। রডারিকের চতুরপার্শ্বে যে সৈন্য বাহিনী ছিল, মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ তাদের ওপর বীর বীক্রমে আক্রমণ করে বসল। এ হামলাতে স্পেনী ফৌজ পুরোদমে ঘাবড়ে গেল। ব্যাপারটা রডারিক নিজেও বুঝে উঠতে পারল না।
তার সৈন্যরা এ হামলার মুকাবালা করা তো দূরের কথা তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। যারা আত্মসমর্পণ করল তারাই কেবল মুজাহিদদের হাত থেকে রেহায় পেল।..
ইতিহাসবিদরা লেখেন, ঐতিহাসিক যুদ্ধসমূহের মাঝে এটা একটা অন্যতম। এ যুদ্ধে যেমন বীরত্ব প্রদর্শিত হয়েছে তেমনিভাবে মুসলমানদের পক্ষ হতে যে যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে অন্য কোন যুদ্ধে তা খুব কমই পরিলক্ষিত হয়েছে।
এ ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝেও এক ব্যক্তি উম্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে যেন কাউকে তালাশ করছে এমনভাবে ঘুরছিল। এ বাদামী রং এর যুবক সাগর তীর পর্যন্ত এভাবে পৌঁছে ছিল। এভাবে ঘুরে ফিরে যাকে তালাশ করছে তাকে যেন পাচ্ছে না। এ যুবকই হলো হিজি যে রডারিকের মস্তক কর্তন করে আনার ব্যাপারে ফ্লোরিডার কাছে প্রতিশ্রুত বদ্ধ হয়েছিল। রডারিককে তালাশ করছিল।
রডারিকের ঝান্ডা দেখা যাচ্ছিল না। অনেক পূর্বেই ঝান্ডা পতিত হয়েছিল। স্পেনীরা হাল ছেড়ে দেয়ার এটাও একটা কারণ ছিল যে তাদের শাহী ঝান্ডা পড়ে গিয়েছিল, এর অর্থ হলো হয়তো বাদশাহ্ নিহত হয়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে। হিজি সাগর পাড়ে রডারিকের ঘোড়া দণ্ডায়মান দেখতে পেল কিন্তু তাতে রডারিক সোয়ার ছিল না। ঘোড়র কাছেএকটি তলোয়ার পড়েছিল। যার হাতলে মূল্যবান মনি-মুক্তা খচিত। এটা যে রডারিকের তলোয়ার তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে রডারিকের পাদুকাও তলোয়ারের কাছে পড়ে ছিল।
হিজি মহিলাদের তাবুতে চলে গেল। সেখানে রডারিকের হেরেমের রমণীরা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছিল। হিজি তাদেরকে ধমক দিয়ে রডারিকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। তারা সকলে এক জবাব দিল যে তারা কেউ তার ব্যপারে কিছু জানে না।
হিজি দ্রুত এসে রডারিকের তলোয়ার ও জুতা উঠিয়ে তার ঘোড়াতে আরোহন করে দ্রুত বেগে তা হাঁকিয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে লাগল রডারিক নিহত হয়েছে। রডারিক নিহত হয়েছে। এ এলান করতে করতে সে তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছে ঘোড়া ও পাদুকা পাওয়ার ঘটনা বর্ণনা কর।
আঠার দিনের যুদ্ধ শেষ হলো। লেইনপোল লেখেন, আঠার দিনের লড়াই আটশত বছরের স্পেনের রাজত্ব মুসলশানদেরকে প্রদান করে। এছাড়াও আরো কিছু যুদ্ধ মুসলমানদের করতে হয়েছিল। কিন্তু মৌলিক ভাবে যুদ্ধছিল এটাই। যা গালীদের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ।
সকল ঐতিহাসিকই একমত হয়ে লেখেছেন যে, রডারিকের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার সফেদ ঘোড়া, অলংকৃত তলোয়ার ও পাদুকা সাগরের পাড়ে পাওয়া গিয়েছিল। কেউ কেউ মত ব্যক্ত করেছেন, সে সাগরে সলীল সমাধীত হয়ে আত্মহুতি দিয়েছিল। তবে অধিকাংশরা লেখেছেন, সে পলায়ন করার মানসে সাগর পাড়ি দিচ্ছিল, কিন্তু সাগরের উত্তাল তরঙ্গ তাকে অপর পাড়ে পৌঁছাতে দেয়নি।
ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, খ্রীস্টানদের মাঝে পূর্ণমাত্রায় এ বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে, রডারিক নিহত হয়নি বরং সে রূপ-আকৃতি পরিবর্তন করে খ্রীস্টবাদের প্রচারক ও রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে স্পেন অধিবাসীদের মাঝে বদ্ধমূল ছিল। এ যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার স্পেনী ফৌজ হালাক হয়েছিল যার মাঝে উল্লেখযোগ্য জেনারেল ও স্পেনের নওয়াব ও আমীররা ছিল। আর ত্রিশ হাজার হয়েছিল কয়েদী। রন্ডারিকের ফৌজরা মুসলমানদেরকে কয়েদী হিসেবে বেঁধে নেয়ার জন্যে সাথে বড় রশী এনেছিল কিন্তু পরিণামে মুসলমানরা সে রশী দ্বারা রডারিকের ত্রিশ হাজার সৈন্য কয়েদী করেছিল।
৪. রডারিকের পরাজিত ফৌজ
“নিজেদের ধর্মীয় বিধানকে তোমরা পদদলিত করছ। আমি তোমাদের এ অপরাধ ক্ষমা করতে পারিনা। কুমারী রাহেবাদেরকে তোমরা উপ পত্মী হিসেবে গ্রহণ করতে পার এমন বিধান কি হযরত ঈসা (আ)-এর ধর্মে রয়েছে…না… তোমরা হত্যার উপযুক্ত।”
রডারিকের পরাজিত ফৌজের ত্রিশ হাজার কয়েদীকে একত্রিত করে বাঁধার পূর্বের দৃশ্যছিল এক হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত দীর্ঘ প্রশস্ত ময়দান, ময়দানে হাশরে পরিনত হয়েছিল। লাশের স্তূপ রক্তগঙ্গায় হাডুডুবু খাচ্ছিল। হাজার হাজার আহতরা কাতরাচ্ছিল। অনেকে উঠে দাঁড়াবার কোশেশ করছিল। অনেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছিল। আহতদের আত্ম চিল্কারে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যাদের শরীরে তীর বিদ্ধ ছিল তারা সবচেয়ে বেশী চিৎকার করছিল। অশ্ব ও পায়দল সৈন্যদের পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলী কনা বাতাসে ভর করে স্পেনের রাজধানী টলেডোতে গিয়ে পৌঁছেছিল। একজন ইতিহাসবেত্তা লেখেন, এটা কোন বিস্ময়কর নয় যে তারেক ইবনে যিয়াদ জালেম বাদশাহ্ রডারিকের পরাজয় আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যক্ষ করছিলেন। ইতিহাস আজ পর্যন্ত পেরেশান যে বার হাজার সৈন্য কিভাবে এক লাখ বাহিনীকে পরাস্ত করে নাম নিশানা মিটিয়ে দিল।
রডারিকের আত্মম্ভরিতা যখন যুদ্ধের ময়দানে ভূলণ্ঠিত, তারেক ইবনে যিয়াদ তখন অশ্বপিঠে সোয়ার হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন। তার বিজয়ী মুজাহিদরা আহতদেরকে ও শহীদ সাথীদের শব পূর্ণ ইহতেরামের সাথে একত্রিত করছিল। কিছু মুজাহিদ ঐ সকল স্পেনীদেরকে পাকড়াও করছিল যারা উঁচু ঘাস ও গাছ-পালার মাঝে লুকাবার কোশেশ করতে ছিল। কেউ কেউ তাদের সাথীদের লাশের নিচে আত্মগোপনের ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। মুসলমানরা তাদের হত্যা করবে হয়তো তাদের মনে এ ভয় বিরাজ করছিল। নৌকা দ্বারা তাদের তৈরীকৃত পুল পূর্ণ মাত্রায় সহী সালামতে ছিল। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে সে পুল অতিক্রম করছিল। একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে পিছে ফেলে আগে যাবার চেষ্টা করছিল। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই তার নিজ সাথীর দ্বারা সাগরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। ইতমেনান ও শান্তিতে সেই ছিল যে, হাতিয়ার সমর্পণ করে মুসলমানদের হাতে নিজেকে সোপর্দ, করেছিল।
যে সব স্পেনী কিস্তির পুল দিয়ে অতিক্রম করছিল তাদেরকে ফিরিয়ে আনার হুকুম কে দিয়েছিল তা জানা নেই। বহু তীরন্দাজ মুসলমান সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কয়েকজন কয়েদী দ্বারা ঘোষণা করাল তারা যেন সকলে ফিরে আসে তা নাহলে তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করা হবে। স্পেনীরা ফিরে আসার পরিবর্তে আরো দ্রুত অগ্রসর হবার প্রতিযোগিতা শুরু করল। এরিমাঝে কামান হতে তীর গিয়ে কয়েকজন স্পেনীকে ফেলে দিল। এ অবস্থায় তাদের মাঝে আতংক আরো বেড়ে গেল অনেকে পিছে ফিরে এলো কিন্তু যারা অপর প্রান্তের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তারা প্রত্যাবর্তন করল না। এদের সংখ্যাও একেবারে কমছিল না।
তারেক ইবনে যিয়াদ দেখতে পেলেন, তার দু’তিনজন মুজাহিদ বিশ-পঁচিশ জন যুবতাঁকে হাঁকিয়ে নিয়ে আসছে। এরা ছিল রডারিকের হেরেমের। তারেক ইবনে যিয়াদ চূড়া থেকে নেমে এলে যুবতীদেরকে তার সামনে আনা হলো, তাদের মাঝে একজন কেবল মাঝ বয়সী বাকী সকলেই কিশোরী ও যুবতী, একে অপরের চেয়ে সুন্দরী।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এরা কি শাহী খান্দানের?
জুলিয়ন : না ইবনে যিয়াদ! এরা প্রজাদের বিভিন্ন খান্দানের লাড়কী। এরা। রডারিকের আমোদ-ফুর্তির উপকরণ। বিশ-পঁচিশজন উপ-পত্মীই যদি না থাকল তাহলে কিসের বাদশাহী।
তারেক : তাদেরকে জিজ্ঞস কর, তাদের মাঝে এমন কেউ আছে কি যে বাদশাহর হেরেমে স্বেচ্ছায় ছিল না।
তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা সকলেই বলল, তাদেরকে জোরপূর্বক বাদশাহর কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল। তাদের মাঝে খ্রীষ্টানও ছিল তবে অধিকাংশ ছিল ইহুদী।
বাদশাহ্ কোথায়?
“এ প্রশ্নের জবাব কোন লাড়কী দিতে পারবে না।” হেরেমের প্রধান রমণী জবাব দিল। চার রাত ধরে বাদশাহ তার খিমাতে কাউকে আহ্বান করেনি। প্রতিরাতে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু সে আমাকে ধমক দিয়ে বের করে দিত। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন থেকে সে গোস্বায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। রাতে সে প্রচুর পরিমাণ শরাব পান করত, একদিন রাতে তাকে বেঁহুশ অবস্থায় উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। দারোয়ানকে ডেকে তাকে বিছানাতে শয়ন করিয়ে ছিলাম।
স্পেনের শাহানশাহ্র ফৌজকে যে মুসলমানরা পরাজিত করেছিল তাদের সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের শিরে ছিল আল্লাহ্ তায়ালার কুদরতের হাত। আর অন্তরে ছিল রাসূলে খোদা (স)-এর ইশক ও মহব্বত। রাসূল (স) তাকে বাসারত দিয়ে ছিলেন। এ বাশারত প্রকৃত অর্থে তাঁর ফরমান ছিল, “তারেক! তুমি যদি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হও তাহলে পরাজিত হবে না। আল্লাহ তোমার সাথে রয়েছেন।”
তারেক রাসূল (স)-এর ফরমান তামীল করেছিলেন।’
স্পেনের বাদশাহ্ রডারিককে তার পাপ পরাজিত করেছিল। তার পরাজয় হয়েছিল শিক্ষনীয়। না জানে কত কুমারীর হৃদয়কে সে ভেঙ্গে করেছে খান খান। সে বিদ্রোহীদের ইস্তুরিয়া নাম্নী এক কিশোরীর অন্তর করেছিল চুরমার। তার ওপর তলোয়ার চালানোর পূর্বে বলেছিল তোমার বাদশাহীর ওপর ঘোড়া দৌড়ান হবে। তোমার সিংহাসন হবে চিরতরে ভূলণ্ঠিত।
রমণীদেরকে যখন তারেকের সম্মুখে উপস্থিত করা হলো তখন তিনি উম্মুক্ত ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেসব কয়েদীরা লুকিয়েছিল তাদেরকে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। তিন-চারজন কয়েদী তারেকের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তাদের মাঝে একজন পোশাক-আষাক, চলা-ফেরা অন্য কয়েদীদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। সে তারেকের সামনে রমণীদেরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
এক মুসলিম মুজাহিদ তাকে ধমক দিয়ে বলল, এখানে না দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হও।
কয়েদী : এ মেয়েদের মাঝে আমার ছোট বোন রয়েছে। তার সাথে একটু সাক্ষাৎ করতে দাও, আবার কবে দেখা হবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। উক্ত মুজাহিদ ছিল বর্বর, দয়া-মায়া কাকে বলে সে তা জানত না। তাই তাকে দু’হাতে। ধাক্কা দিয়ে সম্মুখে যাবার জন্যে বলল।
‘এ হলেন আমার বড় ভাই।” এক সুন্দরী যুবতী তারেক ও জুলিয়নকে বলল, আমার সামনে কিছুক্ষণের জন্যে তাকে আসার অনুমতি কি আপনারা তাকে দেবেন?
তারেক মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তাকে আসতে দাও। তার ভগ্নির সাথে শেষ মুলাকাত করে নিক।
কয়েদী মহিলাদের সীমানায় এসে আস্তে আস্তে তার বোনের দিকেঅগ্রসর হতে। লাগল। তার সাথে মুজাহিদ ছিল যাতে সিপাহ্ সালারের সামনে যেন কোন বেয়াদবী না করতে পারে। মুজাহিদদের হাতে ছোট ছোট বর্শা ছিল যা দুশমনের প্রতি নিক্ষেপ করা হতো। কয়েদীর বোন অতি দ্রুততার সাথে মুজাহিদের হাত থেকে একটি বর্শা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত বেগে তার ভায়ের বুকে বিদ্ধ করে দেয়। বর্শা বের করে আবার দ্বিতীয় বার আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হলে এক মুজাহিদ তাকে বাধা দিয়ে তার হাত থেকে বর্শা কেড়ে নেয়। কিন্তু বর্শার এক আঘাতেই কয়েদী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিস্ক্রীয় হয়ে যায়।
জুলিয়ন স্পেনী ভাষায় যুবতাঁকে বলল, তুমি তোমার ভাইকে হত্যা করলে? সে হাতিয়ার অর্পন করে আত্মসপৰ্মণ করেছে এজন্যে হয়তো তাকে হত্যা করলে?
যুবতী : না, সে কারণে নয়। অনেক আগেই তাকে হত্যা করতাম কিন্তু তার কোন সুযোগ পাইনি। আপনারা যদিএর শাস্তি দিতে যান তাহলে দিতে পারেন। আপনাদের হাতে তলোয়ার রয়েছে, রয়েছে বর্শা তার মাধ্যমে আমাকে টুকরো টুকরো করতে পারেন।
যুবতীর কথা তারেককে বুঝিয়ে বলা হলো।
তারেক : তাকে বল, আমরা তাকে কোন শাস্তি দেব না। তাকে জিজ্ঞেস কর, তার ভাইকে হত্যা করল কেন?
যুবতী : আমার ভাই ফৌজে ভর্তি হয়েছিল সে পদোন্নতি চাচ্ছিল। সে লালসায় একদিন আমাকে ধোকা দিয়ে শাহী মহলে নিয়ে এসে হেরেমের রমণীদের সাথে সাক্ষাৎ করালে রমণীরা হেরেম পরিদর্শনের কথা বলে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে। বুড়ো বাদশাহ আমাকে ক্রীড়নকে পরিণত করে। আজ দু’বছর ধরে আমি হেরেমে রয়েছি। হেরেমের রমণীদের কে আমি বার বার আমার ভাইএর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার কথা বলেছি কিন্তু তারা বলেছে, হেরেমের কোন আওরত বাহিরের কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না। তারা আমাকে বলেছিল তোমার ভাই পদমর্যাদা হাসিলের জন্যে তোমাকে হেরেমে পাঠিয়েছে।… আজ দু’বছর পর তার সাথে আমার হিসাব-নিকাশের মওকা মিলেছে।
সালার মুগীছে রূমী : যে ফৌজের মাঝে এমন ভাই থাকে তার পরিণাম এমনই হয়।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এ যুবতীরা যদি নিজ বাড়ী যেতে চায় তাহলে কয়েদী বানিও না। এদের সকলকে তোমাদের সাথে রাখ। যেন কোন প্রকার কষ্ট না পায়। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হব। যখন কোন লাড়কীর বাড়ী পাওয়া যাবে তখন তাকে তার আপনজনদের কাছে সোপর্দ করে আসবে।
***
দ্বিতীয়দিন তারেক ইবনে যিয়াদ তার আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে একটি পয়গাম লেখান তাতে তিনি রডারিকের সাথে যুদ্ধের পূর্ণ বিবরণ দেন। তার শেষে লেখেন,
“এখন পর্যন্ত কোন শহর বিজয় করতে পারিনি তাই বিশেষ কোন তুহফাহ্ পাঠাতে পারলাম না। ত্রিশ হাজার জঙ্গী কয়েদী রয়েছে। আমার ধারণা আমীরুল মু’মিনীন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক এ তুহফা খুবই পছন্দ করবেন। এ কয়েদীরা সর্বদা আপনার কাছেই থাকবে কারণ তাদের বাদশাহ্ সলীল সমাধিত হয়েছে ফলে তাদেরকে পণ দিয়ে মুক্ত করার বা অন্য কোন শর্তে ছাড়াবার কেউ নেই। আমাদের কোন কয়েদী স্পেনীদের হাতে নেই যার মুকাবালায় তাদেরকে মুক্ত করতে হবে এমনও নয়। আমীরে মুহতারাম! আরেকটি তুহফা আপনার দরবারে পেশ করছি তাহলে স্পেন বাদশাহ্র মাহবুব (প্রিয়) ঘোড়া “ইলয়া” আর তার সুসজ্জিত তলোয়ার। আমি এখন সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছি, আমার কামিয়াবীর জন্যে মসজিদে মসজিদে দোয়া করাবেন।”
কয়েদী এবং বেকার ঘোড়া পাঠাবার জন্যে সমুদ্র জাহাজের প্রয়োজন ছিল। জুলিয়নের চারটি বিশাল জাহাজ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মুসলমানদের কাছে বিকল্প আর বড় কোন জাহাজ ছিল না। ফলে কয়েদীদেরকে পাঠাবার জন্যে স্পেনীদের বড় কিশতী নেয়া হলো। কয়েদী আর বেকার ঘোড়ার সংখ্যা কম ছিল না। তিনদিন তিনরাত একাধারে পারাপারের কাজ অব্যাহত ছিল।
উত্তর আফ্রিকার বর্বর গোত্রের লোকেরা বেকারার ও পেরেশান হয়ে উঠেছিল, তারা যুদ্ধের খবরের জন্যে সমুদ্র তীরে অপেক্ষমান ছিল। পরিশেষে কয়েদীদের প্রথম কিশতী তীরে ভিড়ল। বর্বররা খবর নেয়ার জন্যে মাল্লাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েদীদের সাথে বর্বর সৈন্যরা ছিল। তারা যুদ্ধের খবর তাদেরকে বললে অপেক্ষমান বর্বররা দ্রুতবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে নিজ নিজ কবিলাতে গিয়ে পৌঁছল। যেখানে যেখানে তারেক ইবনে যিয়াদের বিজয় আর স্পেনীদের পরাজয়ের সংবাদ পৌঁছল সেথায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নারী-পুরুষ শিশু-কিশোররা উম্মাদের ন্যায় নাচতে লাগল।
তারেকের কাছে বর্বর ফৌজ খুবই কম।”
“সম্মুখে গিয়ে কোথাও আবার শক্রর হাতে আটকা না পড়ে।”
“তারেক ইবনে যিয়াদের সাহায্যের জন্যে প্রস্তুত হও।”
এ ধরনের নানা কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এর ফলশ্রুতিতে বর্বররা কিসতী জোগাড় করে জোয়ান-নওজোয়ান, মাঝবয়সী বর্বর মুসলমানরা তারেক ইবনে যিয়াদের মদদের জন্যে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে একত্রিত হয়ে স্পেনে পৌঁছতে লাগল।
এদিকে হিজি একটা নৌকা থেকে নেমে জুলিয়নের মহলের দিকে দ্রুত বেগে ছুটে চলল। এ হলো সেই হিজি যে রডারিকের মাথা কেটে এনে জুলিয়নের বেটী ফ্লোরিডার পায়ের কাছে রাখার ওয়াদা করেছিল। হিজি যখন সিওয়াস্তাতে পৌঁছল তখন পর্যন্ত সেখানে স্পেনের যুদ্ধের কোন খবর পৌঁছেনি। সে যখন নৌকা থেকে নেমে ছুটতে লাগল তখন তার পিছু পিছু তিন-চারজন বর্বর ছুটতে লাগল।
তুমি কি স্পেন থেকে এসেছ? দৌড়াতে দৌড়াতে হিজি এক বর্বরের আওয়াজ শুনতে পেল।
না দাঁড়িয়েই হিজি জবাব দিল। যা, আমি জানি তুমি কি জানতে চাচ্ছ… বর্বররা বিজয় অর্জন করেছে।
বর্বর : একটু দাঁড়াও ভাই! ভালভাবে বলে যাও!
হিজি দ্রুত চলতে চলতে সংক্ষেপে যুদ্ধের ঘটনা, রডারিকের মৃত্যু ও তার ফৌজ হালাকীর খবর শুনিয়ে দিল।
হিজি : কায়রোতে যাও সেখানে স্পেনের হাজার হাজার কয়েদীকে অবতরণ করান হবে।
বর্বর মুসলমানরা বিজয়ের খুশী প্রকাশ করে ধ্বনী দিতে দিতে ফিরে গেল। আর হিজি মহলের দিকে গ্রুত বেগে হেঁটে চলল। মহল ছিল কেল্লার ভেতর আর তা ছিল নিকটেই। ফ্লোরিডা কেল্লার প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নিষ্পলক * চেয়ে ছিল। সে প্রতিদিন এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ কয়েকবার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সাগর বক্ষে নির্নিমিষ দৃষ্টে চেয়ে থাকত। কোন কিশতী দেখলে অপলক নেত্রে তা প্রত্যক্ষ করত, কিন্তী চলে গেলে তার চেহারায় নৈরাশ্যতার ছাপ ফুটে উঠত। এভাবে সে দিনের পর দিন প্রহর গুনছিল। পরিশেষে সে যার প্রতীক্ষায় ছিল তাকে দেখতে পেল। সে দূর থেকেই দেখতে পেল কিশতী হতে যে অবতরণ করল সে হিজি।
ফ্লোরিডা কেল্লার প্রাচীর হতে দৌড়ে নামল। হিজি মহলের সদর দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। দিনের বেলা, তাই দরজা খোলা। হিজি কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করল। তাকে সকলেই চিনত একারণে কেউ বাধা দিল না। মহলের যেখানে ফুল বাগান, উঁচু গাছ-পালা ও পত্র-পল্লবে ঘেরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। বহিরাগত কারো সেখানে যাবার অনুমতি ছিল না। অনেক বড় বিস্ময়কর খবর নিয়ে এসেছিল তাই হিজি বড় পেরেশান ছিল। ফলে সে কোন কানুনের পরওয়া করেনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে একটু ঝিরিয়ে নিচ্ছিল।
হিজি : হিজি পশ্চাতে মেয়েলি কণ্ঠ ও পদধ্বনি শুনতে পেল। পিছনে ফিরতে ফ্লোরিডা তীব্র আবেগে তাকে বুঝে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পরেই ফ্লোরিডা হিজিকে ছেড়ে দিয়ে হালকা ধাক্কা মেরে পিছু হটে গেল। তার চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ভেসে উঠল।
ফ্লোরিডা : তুমি রিক্ত হাতে এসেছ, তোমার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ কর, রডারিকের মাথা কোথায়?
হিজি ফ্লোরিডার কথা শুনে মৃদু হাসল।
ফ্লোরিডা হিজির কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বলল হিজি! বল, মুসলমানরা রডারিকের কাছে পরাজিত হয়েছে আর তুমি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছ? আমার বাবা কি গ্রেফতার হয়েছে না নিহত হয়েছে?
হিজি: না ফ্লোরা! গভর্নর জীবিত রয়েছেন, রডারিক নিহত হয়েছে।
তার মাথা কেন নিয়ে আসনি?
হিজি : সে সলিল সমাহিত হয়েছে। মাটি থেকে শাহী পাদুকা তুলে ফ্লোরিডার দিকে তুলে ধরে বলল, তার এ জুতা হস্তগত হয়েছে। তার সফেদ ঘোড়া দরিয়ার কিনরায় দাঁড়িয়ে ছিল। ঘোড়ার কাছে পড়েছিল তার এ পাদুকা ও তলোয়ার। এ জিনিস আমার হাতে এমনিতেই আসেনি। আমি তলোয়ার নিয়ে রডারিকের ফৌজের মাঝে প্রবেশ করেছিলাম। রডারিকের পতাকা দেখতে না পেয়ে সমুদ্র পাড় পর্যন্ত পৌঁছে ছিলাম। রডারিকের ফৌজ মুসলমানদের হাতে নিহত হচ্ছিল। আমি রডারিকের সফেদ ঘোড়া দেখতে পেলাম কিন্তু তাতে রডারিক সোয়ার ছিল না। তার পাদুকা ও তলোয়ার উঠিয়ে তার ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে গিয়ে খবর দিলাম রডারিক সলিল সমাহিত হয়েছে। ঘোড়া ও মুক্তা খচিত তলোয়ার তারেক তার কাছে রেখে দিলেন। পাদুকা আমার কাছে রাখার জন্যে আবেদন করলাম। তিনি অনুমতি দিলেন। আমি তা তোমার জন্যে। নিয়ে এসেছি। ফ্লোরিডার চেহারা চমকে উঠল। তার প্রতিশোধ পূর্ণ হলো।
***
দু’জন ঐতিহাসিক প্রফেসর দুজি এবং গিয়ানগুজ লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে তারেক ইবনে যিয়াদের পয়গাম পৌঁছলে তিনি তা তড়িঘরি করে পড়লেন। আবেগে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আট দিন যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তারেক ইবনে যিয়াদ দিয়েছিলেন কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর তাতে পূর্ণ শান্ত হলেন না,
“তুমি তোমার ভাষায় শুনাও” বার্তা বাহককে মুসা বললেন। “আট দিন যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দাও, তুমি যা নিজ চোখে দেখেছ তা বল।”
ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইব আবেগে উদ্বেলিত হয়ে গিয়েছিলেন। চুলে ঢুলে যুদ্ধের বর্ণনা শ্রবণ করছিলেন। বর্ণনা শ্রবণের পর খলীফার কাছে বিস্তারিত পত্র লেখেছিলেন তার শেষাংশে লেখেছিলেন,
“এ যুদ্ধ কোন সাধারণ যুদ্ধের মত ছিল না। কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। পূর্ণ হাশরের ময়দান ছিল। আমি মৌখিক যে বর্ণনা শুনেছি তাতে আমার শরীর শিহরে উঠেছিল। আমাদে বিজয় ছিল সন্দেহজনক। বার হাজার সৈন্য এক লাখের মুকাবালায় অর্ধদিনও টিকতে পারে না। এটা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে জীবন উৎসর্গকারীদের কারিশমা। আমরা তাদেরকে কেবল মুবারকবাদ জানাতে পারি, প্রতিদান তো স্বয়ং আল্লাহ পাক দেবেন।
মুসা ইবনে নুসাইর রডারিকের ঘোড়া ও তরবারী পয়গামের সাথে খলীফার দরবারে দামেস্কে পাঠিয়ে দেন। এর সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদীও পাঠান। ইবনে মানসুর নামক এক আরব লেখক সে দৃশ্যকে এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন,
“সে ত্রিশ হাজার সৈন্য দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে,ইসলামের মুকাবালায় কুফর কতটা অসহায়। কয়েদী দলকে ভীতির চাদর ঢেকে নিয়ে ছিল। এতদিন তারা বাতিল আকীদা-বিশ্বাসে বন্দী ছিল। ছিল তাদের বাদশাহর গোলাম। আর এখন তারা যুদ্ধ বন্দী হয়ে হেঁটে চলেছে। তাদেরকে এ খবর তখনো দেওয়া হয়নি যে, তোমরা ঘোর হতাশা হতে বেরিয়ে আলোর পথে যাচ্ছো, বাতিল হতে হকের দিকে যাচ্ছ। তাদেরকে খবর দেওয়া হয়নি যে, ইসলামের বাদশাহ জালেম নয়, নির্যাতনকারী ও নিপীড়ক নয়। ইসলামে মুনিব-গোলাম একই মর্যাদা রাখে।
একজন ইউরোপিয়ান কবি রডারিকের পরাজয়ের বিবরণ এভাবে দিয়েছেন, “যখন রডারিকের সৈন্য পরাজিত হলো তখন সে একটা উঁচু টিলার ওপর গিয়ে পরিস্থিতি দেখতে লাগল, সে দেখতে পেল, গতকালও যে শাহী পতাকা পতপত করে উড়ছিল আজ তা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে রক্তমাখা মাটিতে পড়ে আছে। সে মুসলমানদের বিজয় ধ্বনি শুনতে পেল। তার পরাজিত-নিরাশ বিস্ফোরিত আঁখিযুগল তার জেনারেল ও ক্যাপ্টেনদেরকে তালাশ করতে লাগল। কিন্তু দেখল যারা নিহত হয়েছে তারা ছাড়া বাকীরা পলায়ন করেছে।
রডারিক আহ্! ধ্বনী উচ্চারণ করে নিজেকে সম্বোধন করে বলল, আমার ফৌজের লাশের গণনা কেউ করতে পারবে না, কে করতে পারে এত বিপুল পরিমান শব দেহের গণনা?… এত বিস্তৃত ময়দান রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। খুন দেখে তার নয়নযুগল বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল যেন কোন আহত সিপাহীর গর্দান হতে শেষ রক্ত বিন্দু প্রবাহিত হচ্ছে।
“রডারিক নিজেকে লক্ষ্য করে বলল, গতকল্য পর্যন্ত আমি স্পেনের বাদশাহ ছিলাম। আজ কিছুই নই। আলিশান কেল্লার দরজা আমার সৈন্যদেরকে দূর থেকে দেখেই খুলে যেত। এখন এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি শান্তিভরে একটু বসতে পারি। আমার জন্যে দুনিয়ার তাবৎ দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।… হে বদনসীব! তুমি মনে করেছিলে পৃথিবীর সারা তাকৎ তোমার হাতে…। হ্যাঁ আমি হতভাগা। আজকে আমি শেষবারের মত সূর্যকে অস্তমিত হতে দেখছি। হে মৃত্যু! তুমি এত ধীর পদে আসছো কেন? আমাকে ছুঁ মেরে তুলে নিতে ভয় পাচ্ছ কেন? এসো… দূত এসো।”
***
তারেক ইবনে যিয়াদ তার সকল জেনারেলদেরকে ডাকলেন, জুলিয়ন ও আওপাস তার সাথে ছিল।
তারেক : আমরা এখানে আর বেশীক্ষণ অবস্থান করতে পারছি না। এ ময়দান থেকে যেসব স্পেনীরা পলায়ন করেছে তাদের স্থির থাকতে দেয়া যাবে না। তাদের পিছু ধাওয়া করতে হবে তাই রওনা হবার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
জুলিয়ন ও আওপাসের তত্ত্বাবধানে ফৌজ রওনা হবার প্রস্তুগ্রিহণ করছিল এরি মাঝে তারেক জানতে পারলেন বিপুল পরিমাণ বর্বর মুসলমান ফৌজে যোগদানের জন্যে এসেছে। যে সকল বর্বর গোত্রে বিজয়ের খবর পৌঁছেছে সেখান থেকেই মুসলমানরা স্পেনে পৌঁছা শুরু করেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ তাদেরকে ফৌজে শামিল করে নেয়ার নির্দেশ দিলেন আর বললেন, তাদেরকে যেন জানিয়ে দেয়া হয়, তারা যুদ্ধের জন্যে এখানে এসেছে লুটতরাজের চিন্তা যেন কেউ না করে।
সম্মুখে সাধনা নামেএকটা কেল্লা ছিল। মুসলমানদেরকে দূর থেকে আসতে দেখে কেল্লাতে যত সৈন্য ছিল তারা সবাই পালিয়ে গেল। শহরের সাধারণ জনগও চলে যাচ্ছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড় সোয়ার বাহিনীর প্রধানকে বলল, কয়েকজন সোয়ারী দ্রুত পাঠিয়ে দেয়া হোক তারা গিয়ে শহরীদেরকে যেন আশ্বস্ত করে যে, তাদের ধন-সম্পদ, ইজ্জত-আব্রুর পূর্ণ হিফাজত করা হবে।
ঘোড় সোয়ারী গিয়ে তাদেরকে যার যার বাড়ীতে ফিরিয়ে পাঠাল। আর শহরবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে আসল। প্রতিনিধি দলের মাঝে যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক সে বলল, আমরা দুর্বল, কমজোর। দুর্বলদের এমন কোন অধিকার থাকে না যে তারা শক্তিশালীদের ওপর কোন শর্ত আরোপ করবে। এ অধিকার বাদশাহদের রয়েছে যে তারা সৈন্যদের শক্তি বলে দুর্বল দেশে আক্রমণ করে দখল করে নিয়ে মানুষের ঘর-বাড়ী লুটতরাজ ও রমণীদের ইজ্জত হরনের হুকুম দেবে। আপনিও এমন কিছুই করবেন। এ পল্লীতে আপনাকে কেউ বাধা দেবে এমন কেউ নেই। আমাদেরকে যাবার অনুমতি দিন। সকলের ধন-সম্পদ নিয়ে নেন। আমরা আমাদের জোয়ান লাড়কী ছাড়া সাথে কিছুই নিচ্ছি না। আপনি বস্তিতে প্রবেশ করুন, আমরা আপনাকে ইস্তেকবাল জানাব। বৃদ্ধের বক্তব্য তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হলো।
তারেক বললেন, তাদের সকলকে ভালভাবে বুঝিয়ে দাও, আমরা এমন ধর্ম নিয়ে এসেছি যা দুর্বলকে সবলের হাত থেকে রক্ষা করে। আর যাকে তাকে বাদশাহ হবার অনুমতি প্রদান করে না। আমাদের ধর্মে লুটতরাজের কোন অনুমতি নেই। কোন রমণীর ইজ্জত হরনের শাস্তি হলে তাকে প্রস্তারাঘাতে নিহত করা। তাদেরকে বলে দাও, আমরা এদেশ কবজা করতে আসিনি। এসেছি এখানের মানুষের হৃদয় জয় করতে, তবে জোরপূর্বক নয় পেয়ার ও মহব্বতের মাধ্যমে। নিজ নিজ ঘরে যাও, মূল্যবান জিনিস পত্র লুকানোর কোন প্রয়োজন নেই যার কাছে যা আছে তা তারই।
প্রতিনিধি দলকে যখন তারেক ইবনে যিয়াদের বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়া হলো তখন তাদের চেহারায় নৈরাশ্যতা ও অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। তারা আর কিছু না বলে তারেকের ঘোড়ার পিছু পিছু হেঁটে চলল। তাদের পিছনে মুজাহিদ দলও অগ্রসর হলো, এভাবে সাধনা কেল্লাবন্দি পল্লী কোন প্রকার হতাহত ছাড়াই হাতে এসে গেল।
শহরের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে প্রধান কর্মকর্তা মুসলমান আর বাকীরা গোথা ও খ্রীষ্টান নিয়োগ করলেন। শহরবাসীদের প্রতি কেউ চোখ তুলে তাকাল না। ফলে শহরের সকলের মন হতে সন্দেহ ও আশংকা দূরীভূত হলো।
সমুখে কারমুনা নামেএকটি ছোট শহর রয়েছে। আট দশ দিন তারেক এ শহরেই অতিবাহিত করলেন। ইতোমধ্যে উত্তর আফ্রিকা থেকে বর্বর গোত্রের মুসলমানরা আসতে লাগল। কোন কোন ঐতিহাসিক তাদের সংখ্যা বার হাজার আবার কেউ পঞ্চাশ হাজার বর্ণনা করেছেন, তবে তাদের সংখ্যা বিশ-পঁচিশ হাজারের মাঝে ছিল। শৃংখলাবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার কৌশল তাদেরকে শিখিয়ে দেয়ার জন্যে তারেক তার জেনারেলদের নির্দেশ দিলেন।
তারেক যখন তার ফৌজ নিয়ে কারমুনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন শহরের দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোক এলো। তাদের মাঝ থেকে একজন বলল,
প্রথম দিন আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আপনি বাস্তব প্রমাণ করেছেন, আপনার ধর্ম মানুষকে মানুষের মর্যাদা দান করে আর সাধারণ জনগণকে নির্যাতনের অনুমতি দেয় না। এ বস্তির আবাল-বৃদ্ধ সকলেই আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরা আপনার অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে সম্মুখের বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া কর্তব্য মনে করি।…
এ পল্লী যত সহজে আপনার হাতে এসেছে সামনে আর কোন শহর এত সহজে আপনার করতলগত হবে না। এখান থেকে যে সব ফৌজ পলায়ন করেছে তারা আপনাদের ভয়ে পলায়ন করেনি। তাদের কমান্ডার প্রথমে শহরবাসীকে বলেছিল তারাও যেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং কেল্লা যেন মুসলমানরা জয় করতে নাপারে। আমরা দু’জন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমরা বলেছিলাম ফৌজ সংখ্যা অল্প আর শহরবাসী যুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়।
একজন ফৌজি অফিসার বলেছিল, এখানে যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়ারই দরকার নেই। বরং এ শহর আক্রমণকারীদের ছেড়ে দিয়ে আমরা সম্মুখে গিয়ে সকলে একত্রিত হয়ে শক্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। রডারিকের বোকামী ও গোথাদের গাদ্দারীর দরুন আমাদের পরাজয় হয়েছে। পরিশেষে সকলেই তার কথা মত একমত হলো যে, মুসলমানদেরকে আসতে দেখলেই তারা পালিয়ে যাবে এবং সম্মুখে গিয়ে সম্মিলিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
তারেক : তোমাদের ফৌজরা কি ভয় পায়নি?
শহরবাসী; যারা রডারিকের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। কিন্তু কেল্লার অন্যান্য ফৌজরা ও শহরবাসীরা তাদেরকে এত পরিমাণ ভর্ৎসনা দিয়েছে যে, তারাও প্রতিশোধের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। তাদের অন্তরে এখন ভয় নেই। আছে প্রতিশোধ স্পৃহা। আমরা আপনাকে সতর্ক করার জন্যে এসেছি যে, সম্মুখে মুকাবালা খুব কঠিন হবে।
***
তারেক ইবনে যিয়াদ কারমুনা পৌঁছে কেল্লা অবরোধ করার পর বুঝতে পারলেন, সহজে এ কেলা কজা করা যাবে না। অবরোধ দীর্ঘ হবে। প্রাচীরের ওপর তীরন্দাজ ও বর্শা নিক্ষেপকারীরা প্রস্তুত হয়েছিল। তারেক দেয়ালের চতুর্দিক ঘুরে ফিরে দেখলেন কোথাও তা ভাঙ্গার ব্যবস্থা আছে কিনা কিন্তু দেয়াল ছিল অত্যন্ত মজবুত। দরজা খোলার চেষ্টা করা হলে ওপর থেকে তীর ও বর্শার আঘাতে কয়েকজন মুসলমান আহত ও কয়েকজন শহীদ হয়ে গেল। চার-পাঁচ দিন এভাবে চেষ্টা করা হলো কিন্তু ওপর থেকে অবিরাম তীর-বর্শা বৃষ্টি নিক্ষেপ হবার সাথে সাথে ধিক্কার আসতে লাগল,
“এটা সাধনা নয়! বর্বররা! এটা হলো কারমুনা।
“অসভ্যরা আমাদের হাতে কেন মরার জন্যে এসেছ? বাঁচতে চাইলে ফিরে যাও।”
“ডাকাত-দস্যুর দল! কিছু সোনা-চান্দী নিক্ষেপ করছি তা নিয়ে চলে যাও।”
হে হতভাগারা! পরাজিত রডারিক নিহত হয়েছে। কিন্তু আমরা জীবিত রয়েছি।
অবরোধ বেশ দীর্ঘ হয়েছিল। কোন ঐতিহাসিক এক মাস আর কেউ দু’মাসের কথা উল্লেখ করেছেন।
এক রাতে অবরোধ তুলে নেয়া হলো। প্রাচীরের ওপর স্পেন ফৌজরা নৃত্য করতে লাগল। শহরবাসীও প্রাচীরের ওপর একত্রিত হলো। মশালের আলোতে রাত দিনে পরিণত হলো। সারা শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
অর্ধ রাত্র পর শহরবাসী প্রাচীর হতে নেমে নিজ নিজ বাড়ীতে চলে গেল। দীর্ঘ দিনের অবরোধে ক্লান্ত সিপাহীরাও ঘুমিয়ে পড়ল। প্রাচীরের বুরুজে ও দরজার সম্মুখে কয়েকজন পাহারাদার জেগে রইল। দু’শ, আড়াইশ ব্যক্তি দরজার সম্মুখে এসে স্পেনী ভাষায় পাহারাদারদেরকে ডাকতে লাগল।
এক বুরুজ হতে পাহারাদারদের কমান্ডার জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা?” বাহির থেকে আওয়াজ দেয়া হলো, “আমি সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়ন। মশাল নিয়ে এসে আমাকে বাঁচাও।”
গভর্নর জুলিয়ন সম্পর্কে তাদের জানা ছিল এবং ইতোপূর্বে তারা এনাম শুনেছে।
কামান্ডার : তুমি কোথা কেথে এলে?
জুলিয়ন : দরজা খুলে আমাকে রক্ষা কর। সাথে যারা রয়েছে তারা আমার রক্ষীবাহিনী। প্রায় সাত-আটশ সিপাহী হালাক হয়ে গেছে। আমরা রডারিকের সাথে প্রধান যুদ্ধে শরীক ছিলাম এবং কোন মতে জানে বেঁচে পালিয়ে এখানে এসেছি। কেল্লা অবরোধ ছিল একারণে আমরা লুকিয়ে ছিলাম। আজ অবরোধ উঠতেই আমরা তোমাদের কাছে এসেছি। আমি আহত। আমার সৈন্যদের মাঝেও বিশ পঁচিশজন আহত। আমরা বড় ক্লান্ত-শ্রান্ত। ক্ষুধা-তুষ্টে আমাদের জীবন উষ্ঠাগত। তাড়াতাড়ি দরজা খোল।”
জুলিয়নের পোষাক-আশাক ও তার চেহারার অবস্থা সাক্ষী দিচ্ছিল যে অনেক মুসীবত ভোগ করেছে। তার সাথে যে দু’শ আড়াইশ ফৌজ ছিল তারে অবস্থাও চিল অত্যন্ত করুণ।
ওপর থেকে একাধিক মশালের আলোতে দেখা হলো, প্রকৃত অর্থেই সে জুলিয়ন।
অধরাত্রের পরের সময়। কেল্লার জিম্মাদারকে জাগানোর প্রয়োজন না মনে করে দরজা খুলে দেয়া হলো।
দু’শ আড়াইশ ফৌজসহ জুলিয়ন ভেতরে প্রবেশ করে সৈন্যদের ইশারা করতেই তারা পাহারাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকল দরজা খুলে দেয়া হলো। কেল্লার ফৌজ অবরোধ উঠে যাবার আনন্দে শরাব পান করে বিভোর ঘুমাচ্ছিল! মুসলমান অবরোধ তুলে নিয়ে বেশী দূরে যায়নি। তারা জুলিয়নের ইশারার অপেক্ষায় অদূরেই কোথাও লুকিয়ে ছিল। রাতের চাদর তাদেরকে ঢেকে নিয়ে ছিল।
এটা ছিল জুলিয়নের কৌশল যা সে তারেকের সাথে পরামর্শ করে তৈরী করে ছিল।
ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, জুরিয়নের সাথে যে দু’শ আড়াইশ ফৌজ ছিল তারা সকলে ছিল ইউনানী ও জুলিয়নের নিজস্ব ফৌজ। কিন্তু অন্য ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা সকলেই ছিল মুসলমান। তারা তাদের লেবাস পরিবর্তন করে নিয়ে ছিল। এটাই সঠিক বলে মনে হয় কারণ জুলিয়নের সাথে তার নিজস্ব ফৌজ ছিল না।
পাহারাদারদেরকে হত্যা করে দরজা খুলে মশাল হাতে নিজে জুলিয়ন প্রাচীরের ওপর গেল। মশাল উঁচু করে ডানে-বামে ঘুরাতে লাগল। তারেক ইবনে যিয়াদ এরই অপেক্ষায় ছিলেন। তার ফৌজ পূর্ব হতেই প্রস্তুত ছিল। তারেক ঘোড়া দৌড়ানোর সাথে সাথে তার ফৌজরা প্লাবনের ন্যায় কেল্লার দিকে ছুটে চলল এবং খোলা দ্বার দিয়ে সোজা কেল্লার ভেতর চলে গেল। কেল্লাভ্যন্তরে হৈ-হুঁল্লোড় শুরু। হয়ে গেল। কেল্লার ফৌজ জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল তারা কয়েদী।
মুজাহিদদের ফৌজ কেল্লায় প্রবেশ করার পর কেল্লার কিছু ফৌজ ও অফিসার পলায়ন করার সুযোগ পেয়েছিল। বিশ-পঁচিশ মাইল সামনে একটা কেল্লা বন্দী শহর ছিল এবং ঐ শহর ছিল খ্রিস্টানদের ধর্মের কেন্দ্র। সেখানে ছিল একটা বড় গির্জা তার সাথেই ছিল পাঠশালা। এছাড়াও সেখানে আরো বেশ কয়েকটা ছোটগির্জা ও খানকা ছিল।
এটা সে সময়ের কথা যখন পাদ্রীরা আদর্শচ্যুত হয়ে শাহানশাহী জীবন যাপন করছিল এবং ধর্মের মাঝে নিজেদের পক্ষ হতে কমবেশ করছিল। ধর্মের ব্যাপারে তারা চরমভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। তাদেরকে বাধা দেয়ার ব্যাপারে স্বয়ং বাদশাহও সাহস করতেন না। তারা সাধারণ জনগণের কাছে নিজেদেরকে বাহ্যত ভাবে পূত-পবিত্র প্রমাণিত করে রেখেছিল। তারা জনগণকে অধীনতার রশীতে। এমনভাবে বেঁধে রেখেছিল যেভাবে এখন বর্তমানে পাকিস্তানে ভন্ডপীররা তাদের মুরীদদের রেখেছে। স্বয়ং খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, পাদ্রীরা গির্জা ও খানকার মত ইবাদত খানাকে তারা ভোগ-বিলাসের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। সেথায় গোত্রপ্রীতি ও শরাব পানের আড্ডা খানা ছিল। তারপরও সে শহরকে পবিত্র স্থান মনে করা হতো।
***
তারেক ইবনে যিয়াদের এখন লক্ষ্য সম্মুখস্থ শহর ইসাজা। জুলিয়ন ও আওপাস তাকে আগেই জানিয়ে দিয়ে ছিলেন, ইসাজা খ্রিস্টানদের অত্যন্ত পবিত্র নগরী ফলে তা সহজে হস্তগত করা যাবে না। শহরের নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ সকলে জান প্রাণ দিয়ে লড়াই করবে।
জুলিয়ন তারেককে মৌখিকভাবে যা বলছিল তা কার্যতঃ ইসাজা শহরে হচ্ছিল। রডারিকের সাথে যুদ্ধে যেসব সৈন্য পালিয়ে এসে সাধনা ও কারমুনাতে আশ্রয় নিয়েছিল। এ দু কেল্লা মুসলমানরা দখল করার পর তারা পলায়ন করে ইসাজায় পৌঁছে ছিল। সে শহরে খবর পৌঁছে ছিল মুসলমানরা একেরপর এক বিজয়ার্জন করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের মাঝে ভয় সৃষ্টি হয়েছিল ঠিক কিন্তু যুদ্ধের স্পৃহাও পয়দা হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল তাদের মুলকে কোন রাজা বাদশাহর ফৌজ হামলা করেনি বরং এমন ধর্মের দস্যু দল হামলা করেছে যারা খ্রীস্টান ধর্মের মত সত্য ধর্মকে খতম করে দিবে। পিছনের শহরের ফৌজরা যখন পলায়ন করে ইসাজাতে পৌঁছতে ছিল তখন সেথাকার লোকরা তাদেরকে ভর্ৎসনাবানে বিদ্ধ করছিল, তাদের তিরস্কারের ভাষা ছিল এরূপ :
“এসব বুজদিলদেরকে শহর থেকে বের করে দাও।”
“বেহায়া ও নির্লজ্জের দল! সাধনা ও কারমুনার বেটীদেরকে দুশমনের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে।”
“আমাদের বেটীদেরকে আমরা নিজেরাই হেফাজত করব। এ বুজদিলদেরকে জীবিত রেখে কোন লাভ নেই।”
“তাদের পুরুষের পোশাক খুলে রমনীদের কাপড় পরিয়ে দাও।”
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নারীরা বলছিল, ইসাজার নারীরা লড়াই করবে, এসব নালায়েকদেরকে কেউ এক ঢোঁক পানি দেবে না। তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরুক। তাদেরকে প্রস্তারাঘাতে নিহত কর।
এ ধরনের হাজারো অভিসম্পাদ তীরের ন্যায় তাদের প্রতি নিক্ষেপ হচ্ছিল। তারা এখানে আশ্রয় তালাশ করতে এসেছিল কিন্তু তাদের জন্যে ছিল না কোন আশ্রয়। সেখানে যারা ফৌজ ছিল তারাও তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করছিল না, যত যায় হোক তারা যেহেতু ফৌজ ছিল তাদের দ্বারা যুদ্ধ করাতে হবে তাই তাদের জন্যে খানা-পিনার ব্যবস্থা করা হলো। সেখানকার অফিসার আক্রমণকারীদের ব্যাপারে জানতে চাইল।
কিন্তু সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারল না। দু’একজন মুখ খুলে কেবল এ কথা বলল, কিছুই বুঝে এলো না মাত্ৰকয়েক হাজার লোক এক লাখের চেয়ে বেশী ফৌজকে কিভাবে খতম করে ফেলল। শাহান শাহ্ রডারিকও তাদের চাল না বুঝতে পেরে মারা গেল।
সন্ধ্যার পর বড় পাত্রী সাধারণ সভা আহ্বান করল। তাতে পালিয়ে আসা ও শহরী ফৌজ, সকলকে আহ্বান করা হলো। ক্রমে শহরের জন সাধারণ ও ফৌজরা সভাস্থলে সমবেত হলো। পাদ্রী প্রথমে ওয়াজের ভংগিতে বক্তব্য শুরু করল, তাতে মানুষের মাঝে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি মহব্বত-ভালবাসা শত গুণ বেড়ে গেল। তারপর সে তার আসল কথায় এলো,
… এ হামলা তোমাদের মুলকের ওপর নয় বরং এ হামলা তোমাদের ধর্মের ওপর। এ আক্রমণ তোমাদের মান-সম্মান ও ইজ্জতের ওপর। এ শহরের পবিত্রতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে তোমরা ভাল করেই জ্ঞাত। তোমা যদি এ শহর দুশমনের হাতে তুলে দাও তাহলে মনে করবে তোমরা কুমারী মরিয়মকে দুশমনের কাছে অর্পণ করলে। যেন তোমরা ক্রস দুশমনের পদতলে নিক্ষেপ করলে। ঈসা মসীর রাজত্ব চিরতরে মুলোৎপাটন করলে। আর তোমাদের যুবতী মেয়েদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের হাতে তুলে দিলে। হামলাকারীরা দস্যু-ডাকাত, ইজ্জতহরণকারী, তারা তোমাদের বেটীদের সাথে তোমাদেরকেও নিয়ে যাবে। গোলামের মত তোমাদেরকে ধনীদের কাছে বিক্রি করবে। তোমাদের গির্জা-ইবাদত খানা ও খানকাকে তারা আস্তাবলে পরিণত করবে। বল, তোমরা কি এমনটি চাও?
“না ফাদার না! আমরা এ শহরের জন্যে জীবন বিলিয়ে দেব।” সমবেত জনসাধারণ জবাব দিল।
পাদ্রী : এখন আমি ফৌজদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলল,এরা যুদ্ধ ময়দান হতে পালিয়ে এসেছে। তোমরা তাদের বহু তিরস্কার করেছ, তারাও লজ্জিত হয়েছে। লড়াইয়ের ময়দান থেকে পলায়ন করা পাপ কাজ। এখন যদি তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে দুশমনকে পরাজিত করে, তাহলে তাদের পূর্বের পাপ মোচন হয়ে যাবে, আর যে এ শহর রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে সে স্বর্গে প্রবেশ করবে।
ফৌজদের মাঝে যুদ্ধ-স্পৃহা ফিরিয়ে আনার জন্যে পাদ্রী অত্যন্ত জোরাল বক্তৃতা পেশ করল। শ্রোতারা তাকবীর ধ্বনী দিয়ে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানাল এবং আমজনতা ও ফৌজ সকলেই জীবন বাজী রেখে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলো।
তারপর পাত্রী ঐ সকল রমণীদের ঘরে গেল যারা নিজেদের জীবন-যৌবন ধর্মের জন্যে ওয়াকফ করে ছিল। ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা এত সুন্দরী ছিল যে তাদের সৌন্দর্যের চর্চা দূর দূরান্ত পর্যন্ত হতো। তারা সকলে চির কুমারী ছিল। তাদের সাথে পাদ্রীরা থাকত। তারা সারা জীবন বিবাহ-শাদীতে আবদ্ধ হতো না।
বড় পাদ্রী সকল নারীকে হলে একত্রিত করে সাধারণ জলসায় যে বক্তব্য রেখেছিল সে বক্তব্যই নারীদেরকে শুনান। মুসলমানদেরকে দস্যু-ডাকাত, হামলাকারী ও জঙ্গলি জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করল।
পাদ্রী : তোমাদের মত সুন্দরী যুবতীদেরকে মখমল ও রেশমে জড়িয়ে রাখবে না। হয়তো জানে মেরে ফেলবে বা আধমরা করে সাথে নিয়ে গিয়ে অমানবিক আচরণ করবে। আমাদের এ শহরের কোন আশংকা নেই। আমাদের আশংকা তোমাদের ব্যাপারে। তোমরা যদি তাদের হাতে চলে যাও তাহলে পরিণাম খুবই খারাপ হবে।
এক যুবতী বলল, তাহলে আমরা কি কর্ডোভা বা টলেডো চলে যাব ফাদার?
পাদ্রী : না, তোমাদের জন্যে কোন জায়গা নিরাপদ নয়। তবে একটা তরীকা রয়েছে যদ্বারা এ বিপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে বা বিপদ হালকা হবে তার জন্যে প্রয়োজন চার-পাঁচ সাহসী লাড়কী।
একজন যুবতী জিজ্ঞেস করল, কি কাজ করতে হবে?
পাদ্রী : মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কমান্ডার যার নাম তারেক। তাকে হত্যা করতে হবে এবং তার সাথে যে দু’তিনজন বড় জেনারেল রয়েছে তাদেরকেও।
সকলকে নিরবতা ছেয়ে নিল। যেন হলে কেউ নেই।
পাদ্রী : কাজ তেমন কঠিন নয়। তারা আসছে, এসেই এ শহর দখল করে তোমাদেরকে তাদের সাথে রাখা শুরু করবে। তোমরা ভাল করে জেনে নাও, তোমরা একজন তাদের একজনের কাছে থাকবে এমনটি আদৌ হবে না। তোমাদের অবস্থা তো এমন হবে যেমন একটা বকরী নেঘড়ে বাঘের পালের মাঝে পড়লে যেমন হয়। এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার পূর্বেই তোমরা তাদেরকে রাস্তার মাঝে কেন হত্যা করবে না? তোমাদের মাঝে একজন যুবতীও কি এমন নেই?
মুসলমানদের ফৌজ কারমুনা থেকে রওনা হয়ে রাস্তার মাঝে এক জায়গায় তাবু ফেলবে। যারা যেতে চাও তাদেরকে সেথায় পৌঁছে দেয়া হবে। তারা সেখানে। গিয়ে বলবে আমরা তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে যেতে চাই, তাদেরকে কেউ বাধা দেবে না। প্রত্যেক লাড়কীর কাপড়ের মাঝে খঞ্জর লুক্কায়িত থাকবে। তারেক ইবনে যিয়াদ একজন যুবতাঁকে নিজের তাবুতে রাখবে আর বাকীদেরকে তার জেনারেলরা। নিয়ে যাবে।
তারপর তোমরা তো নিজেরাই বুঝো খঞ্জর কিভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ কাজের জন্যে পাঁচ-ছয়জন লাড়কীর প্রয়োজন… কে কে তৈরী আছো?
রমণীরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণপর একজন উঠে দাঁড়াল, তার পর আরেক যুবতী উঠল। তারা দুজন এ বিপদ জনক মিশনে যাবার জন্যে তৈরী বলে জানাল। তাদের দু’জনের পীড়াপিড়ীতে আরেকজন রাজি হলো।
পাদ্রী : তিনজনই যথেষ্ট, তোমরা আমার সাথে এসো।
পাদ্রী তাদেরকে কেল্লার যিম্মাদারের কাছে নিয়ে গেল, যিম্মাদার একজন অভিজ্ঞ জেনারেল ছিল। সে রমণীদেরকে কোন্ মিশনে পাঠান হবে এবং তারা সে কাজ কিভাবে সম্পাদন করবে তা ভাল করে বুঝিয়ে দেবে।
***
ফৌজের সাথে তারেক ইবনে যিয়াদ কারমুনা হতে ইসাজার দিকে রওনা হলেন। পঁচিশ-ত্রিশ মাইল রাস্তা মুসলমানরা একদিনে অতিক্রম করত। মুসলমানদের দ্রুত পায়দল চলার কথা তৎকালে মাশহুর ছিল। পৃথিবীর যেখানেই তারা যুদ্ধ করেছে পায়ে হেঁটে সেখানে তারা দুশমনকে বিস্মিত করে দিয়েছে। সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী ও সুলতান মাহমুদ গজনবীর পায়দল অগ্রসরতাকে ইউরোপের ঐতিহাসিকরা প্রাণ খুলে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তার সৈন্যবাহিনীকে একদিনে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল অতিক্রম করাতেন কিন্তু ইসাজাতে পৌঁছেই যেহেতু শহর অবরোধ করে অতিদ্রুত শহর কজা করতে হবে তাই সৈন্যদের একরাত আরামের বড় প্রয়োজন ছিল ফলে তিনি পথিমাঝে তাবু স্থাপন করেছিলেন।
তাবু স্থাপন করা হয়েছে। রাতের আঁধার গাঢ় হয়ে আসছে। তারেক তার তাবুতে। এরি মাঝে সংবাদ দেয়া হলো এক স্পেনী বৃদ্ধ তার সাথে তিনজন যুবতী লাড়ীকও রয়েছে তারা সিপাহ্ সালারের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়।
তারেক তাদের সকলকে ভেতরে আহ্বান করে দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন দু’ভাষী পাঠানোর জন্যে।
দারোয়ান বেরিয়ে গেলে তারেক রমণীদের দিকে নজর তুলে তাকালেন। তারপর তার চেহারাতে এমন ছাপ ফুটে উঠল যেন তিনি ইতিপূর্বে এত সুন্দরী লাড়কী আর কোনদিন দেখেননি। রমণীরা গভীরভাবে তারেককে দেখছিল আর মুচকি হাসছিল।
দুভাষী আসলে তারেক ইবনে যিয়াদ তাকে বললেন, এদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা এখানে কেন এসেছে?
বৃদ্ধ কারণ বর্ণনা করার পর রমণীরাও একে একে কিছু বলল।
দুভাষী তারেক ইবনে যিয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন,এরা ইসাজা হতে কারমুনা যাচ্ছিল। এ মেয়েদের মাঝে একজন হলো ফুফু আর দু’জন তার ভাতিজী। তাদেরকে বলা হয়েছে, কারমুনাতে শান্তি ফিরে এসেছে এখন ইসাজার ওপর হামলা হবে। হামলাকারীরা মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করবে। এ ভয়ে তারা কারমুনা যাচ্ছিল।
তারেক; তারা আমার কাছে এসেছে কেন?
দুভাষী :বৃদ্ধ বলছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাদেরকে আপনার দরবারে নিয়ে এসেছে। তারা ফৌজদের কাছে খানা-পানি চায়তে পারত কিন্তু তারা লাড়কীদের উত্ত্যক্ত করবে এ কারণে তারা আপনার দরবারে আসাটা ভাল মনে করেছে। আর এ রমণীরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ও প্রশংসা করছে।
তারেক দারোয়ানকে ডেকে বললেন, “এদের চারজনের জন্যে তাবু তৈরী কর, বিছানা বিছাও, খানা তৈরী কর।”
দুভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন, এদেরকে তাবুতে নিয়ে যাও আর বলে দাও, রমণীরা এখানে পূর্ণ হেফাজতে থাকবে।
দারোয়ান ও দুভাষী তাদেরকে তারেকের খিমা হতে বাহিরে নিয়ে গেল, কিন্তু এক জন মেয়ে পুনরায় তারেকের খিমাতে ফিরে এসে একেবারে তারেকের কাছে বসে পড়ল। সে ইশারাতে তারেককে বলছিল সে আজরাত এ খিমাতে কাটাবে। তারেক দুভাষীকে ডেকে মেয়েটি কি বলতে চায় তা জিজ্ঞেস করার জন্যে বলল, দুভাষী জিজ্ঞেস করলে সে তারেকের খিমাতে কিছু সময় অতিবাহিত করতে চায় বলে জানাল।
তারেকঃ তাকে বুঝিয়ে বল, আমরা এমন ধর্মের অনুসারী যা কোন বেগানা রমণীর সাথে একাকী থাকার অনুমতি প্রদান করে না। তাকে বুঝানোর চেষ্টা কর আমি কেবল এ ফৌজের সিপাহ্ সালার নই বরং এদের ইমামও বটে। ফলে আমি এমন কোন কর্ম করতে পারি না যদ্বরুণ অন্যরা সুযোগ পায় ভুল পথে চলার।
মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে তারেকের মুখপানে চেয়ে রইল। সে তারেকের সাথে অনেক কথা বলতে চায়, কিন্তু সে তারেকের জবান বুঝেনা আর তারেকও বুঝেনা তার জবান। তবে সে এতটুকু তো অবশ্যই বুঝে যে পাপের কোন ভাষা নেই। তিনি মাঝখানে আরেকজনকে তরজমাকারীর জন্যে কেন দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
দুভাষী এ কথা মেয়েটিকে বুঝাবার চেষ্টা করল যে, সিপাহসালার তার উপস্থিতি একেবারে পছন্দ করছেন না। কিন্তু মেয়েটি তার মতে অটল।
তারেক রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, তাকে বল, সে যেন এখান থেকে বেরিয়ে যায় ভানাহলে তাদের সকলকেই এ এলাকা হতে বের করে দেয়া হবে।
তরজুমান মেয়েটিকে বলল, সিপাহ সালার অত্যন্ত গোস্বান্বিত। এখান থেকে চলে যাও, না হলে সকলকে বের করে দেয়া হবে।
মেয়েটি আরো বেশী আশ্চর্য হয়ে তারেক ইবনে যিয়াদের মুখ পানে চাইল। সে ধীরে ধীরে তারেকের দিকে অগ্রসর হলো। একেবারে তারেকের কাছে গিয়ে সে তার ফ্রোকের তলদেশ হতে একটা খঞ্জর বের করে তারেকের পদতলে খঞ্জর রেখে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারেক কিছুটা বিস্মিত হয়ে দুভাষীর দিকে তাকালেন।.দুভাষী মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কি?
মেয়েটি : আমি যা শুনেছিলাম তা ভুল প্রমাণিত হলো। আজ আমি সর্ব প্রথম এমন ব্যক্তি দেখলাম যে আমার মত সুন্দরী যুবতী ললনাকে ফিরিয়ে দিল। আমি সিপাহসালারকে হত্যা করতে এসেছিলাম। আমার সাথে যে দু’জন লাড়কী এসেছে। তারাও একই উদ্দেশ্যে এসেছে আর ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তি যে আমাদের সাথে এসেছে, সে আমাদের কোন আত্মীয় নয়। তাকে আমাদের বড় পাত্রী ও কেল্লাদার পাঠিয়েছে। তারা আমাদেরকে বলেছিল, তোমরা এভাবে মুসলমানদের প্রধান সেনাপতির কাছে পৌঁছবে। তারপর সে তোমাদের সৌন্দর্য মাধুরী ও যৌবন সুরা দেখে খাছ কামরাতে তোমাদেরকে স্থান দেবে, আর তোমরা সুযোগ বুঝে, তার বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবে, তারপর মুখ চেপে ধরে গর্দান কেটে ফেলবে। অতঃপর কামরা হতে চুপিসারে নিরাপদে বেরিয়ে আসবে। এমনিভাবে বাকী দু’জন মেয়েরও দু’জন সালারকে কতলের প্লান ছিল। তুমি তোমার সিপাহসালারকে বল, তিনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত রয়েছি।
তারেক : তাদেরকে কোন শাস্তি দেব না। তারা স্বেচ্ছায় আসেনি তাদেরকে পাঠান হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি তাদেরকে নিয়ে এসেছে তাকে সকালে ফজর নামাজের পর কতল করা হবে।
মেয়েটি যখন অরেক ইবনে যিয়াদের ফায়সালা শুনল, তখন বলল, সে আরো কিছু কথা বলতে চায়। তারপর সে বলতে লাগল,
“সিপাহ্ সালার হয়তো আশ্চর্যবোধ করছেন, এ মেয়ে কতবড় বীরাঙ্গনা দুঃস্বাসহী যে, একজন বিজয়ী সিপাহসালারকে কতল করতে এসেছে। আমি এত বড় বীরঙ্গনা নই তবে আমাদেরকে জোরপূর্বক যে জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে তাতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাদের ধর্মের লোক আমাকে এবং আমার সাথীদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে কারণ আমরা ধর্ম যাজিকা আর আমাদের দিবা রজনী অতিবাহিত হয় ইবাদতখানায়। আমাদেরকে কুমারী মনে করা হয় এবং একজন যাজিকা ও যাজক আজীবন অবিবাহিতই থাকে কিন্তু বস্তুতঃ যাজক-যাজিকা কেউই কুমার থাকে না। আমাদের ইবাদত খানার সাথেই আমাদের আরামগাহ্। তাতে দিন-রাত সর্বদা চলে অপকর্ম, পাপাচার। ফৌজের বড় বড় অফিসাররাও সেথায় আসে, শরাব পান করে উন্মাদ হয়ে আমাদের সাথে রাত যাপন করে কিন্তু দিনের আলোতে গির্জা ও ইবাদত খানাতে নসীহত ও প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষকে খোদার ভয় দেখান হয়। তাদেরকে এ ধারনা দেয়া হয় যে পাদ্রী ও যাজিকারা আসমান থেকে অবতারিত নিষ্পাপ ফেরেশতা। এ ধর্ম গুরুরা টলেডোর শাহী মহলকে নিজেদের করতলগত করে রেখেছে। রডারিকের মত জালেম বাদশাহও তাদেরকে ভয় পেত।
তারেক ইবনে যিয়াদ : ভয় পেতনা, বরং ধর্ম গুরুদের সামনে মাথা নত এ কারণে করত যাতে তারা আকর্ষণীয়, সুন্দরী যুবতী যাজিকা তার দরবারে পেশ করে।
তারেক তরজুমানকে বললেন, এ মেয়ের কথা বেশ অর্থবহ তাকে বল, সে যেন আরো কিছু কথা আমাদেরকে শুনায়।
মেয়ে : ইসাজা খ্রীস্টানদের একটি পবিত্র শহর। কিন্তু প্রার্থনালয়ে যেসব যাজিকারা রয়েছে তারা অধিকাংশ ইহুদীদের কন্যা। আমিও ইহুদী। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমার বয়স যখন তের/চৌদ্দ বছর তখন আমাকে জোরপূর্বক এক গির্জাতে নিয়ে গিয়ে বৈরাগীনি বানানো হয়। আপন বাবা, মা, ভাই, বোন বাড়ী ঘর তো আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়ে ছিলোই অধিকন্তু পাদ্রীরা আমার সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিস ছিনিয়ে নিয়েছে তা হলো আমার কুমারীত্ব। তবে মানুষ আমাকে কুমারী যাজিকা বলে সম্মান করত। আমি যে কাহিনী বর্ণনা করলাম তা প্রত্যেক বৈরাগিনীর জীবন বৃত্তান্ত।… আমি সিপাহসালারের কাছে আবেদন পেশ করছি খ্রিস্টানরা যে শহরকে পবিত্র মনে করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পারাশীতে নিমজ্জিত শহরের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেন।
মুসলমানদের প্রধান সেনাপতিকে আমার এ শরীর ছাড়া আর কিছু ইনয়াম হিসেবে পেশ করতে পারি না। আমার একান্ত ইচ্ছে আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি আর তিনি আমাকে শাদী করুন, কিন্তু আমার এ বাসনা পূর্ণ হতে দেব না। কারণ আমিএকজন অপবিত্র মেয়ে আর সিপাহসালার খোদা প্রিয় ও অনেক বড় সম্মানী ব্যক্তি। আমি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলছি বিজয় তোমাদের অবশ্যম্ভাবী। পরাজয় ঐ সকল ধোকাবাজদের হয় যারা ধর্মের নেবাস পরিধান করে অগোচরে পাপের সাগরে হাবুডুবু খায়।
তারেক ইবনে যিয়াদ তরজমানকে লক্ষ্য করে বললেন, “এ লাড়কীকে ঐ লাড়কীদের কামরাতে নিয়ে যাও আর এদের সাথে যে আদমী এসেছে তাকে এখানে নিয়ে এসো।”
মেয়েটি চলে গেল। মেয়েদের সাথে যে বৃদ্ধ এসেছিল সে তারেকের কামরাতে প্রবেশ করল। যে খঞ্জর মেয়েটি তারেকের পদতলে রেখেছিল তা তারেক ইবনে যিয়াদের হাতে ছিল।
“তুমি কি এ খঞ্জর দ্বারা আমাকে হত্যা করতে চাও? তাকের খঞ্জর দেখিয়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন।”
বৃদ্ধ ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। তার চোখগুলো হয়ে ছিল এত বড় বড় যেন মনি বেরিয়ে আসবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ দুভাষীর মাধ্যমে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে বললেন, যে ব্যক্তি মহিলাদেরকে ময়দানে অবতরণ করায় তার এ অবস্থাই হয় যা তোমার হচ্ছে। আমরা অসৎ ও বাতিলের মুলোৎপাটনে এসেছি। আমরা আল্লাহ তায়ালার এ জমিনকে পাপমুক্ত করতে এসেছি আর তোমাদের ধর্মগুরু ও ফৌজের সালাররা সে পাপের আশ্রয় নিয়ে হকের রাস্তায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে। আমি যুদ্ধের ময়দানে তীর বা তলোয়ারের দ্বারা মৃত্যু বরণ করব। আমি যে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এ কুফরী রাজ্যে এসেছি সে আল্লাহ আমাকে গোনাহর কাজে লিপ্ত রেখে এক আওরতের হাতে মারবেন না। তুমি আমাকে বল, ইসাজাতে সৈন্য সংখ্যা কত, কেল্লার প্রাচীর কেমন এবং এমন কোন রাস্তা আছে কি যা দিয়ে কেল্লার ভেতর আমরা প্রবেশ করতে পারব?
বৃদ্ধ : কেল্লা বহুত মজবুত। প্রাচীর এত শক্ত যে আপনি কোথাও তা ভাঙতে পারবেন না। আপনার সিপাহীরা প্রাচীরের কাছেই যেতে পারবে না কারণ শহরের আবালবৃদ্ধ বণিতা, নারী-পুরুষ সকলে তীর বর্শা নিয়ে প্রাচীরের ওপর সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকবে। বড় পাদ্রী শহরবাসী ও ফৌজদেরকে পূর্ণদ্যমে তৈরী করে রেখেছে। যে সকল ফৌজ প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে তারা জীবনবাজী রেখে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে।
তারেক : তুমি কে?
বৃদ্ধ :আমি পাদ্রী।
তারেক : তুমি আমাকে এবং আমার দু’সালারকে ঐ মেয়েদের মাধ্যমে হত্যা করার মানসে এসেছিলে না কি?
বৃদ্ধ : হ্যাঁ সিপাহ সালার! আমিঐ ইরাদাতেই এসেছিলাম তবে এখন অন্তর থেকে সে ইরাদা ত্যাগ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।
তারেক খঞ্জর হাতে আস্তে আস্তে বৃদ্ধের কাছে এসে পূর্ণ শক্তি দিয়ে বৃদ্ধের বুকের ওপর আঘাত হানলেন।
খঞ্জর বৃদ্ধের বুক হতে বের করতে করতে বললেন,সাপ কখনো দংশনের ইচ্ছে পরিত্যাগ করতে পারে না।
বৃদ্ধ হস্তদ্বয় বুকের ওপর রেখে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ল। তারেক দারোয়ানকে ডেকে বললেন, “আমাদের অবস্থান থেকে দূরে এ লাশ ফেলে আসবে। আর তিন ললনার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন তাদেরকে যেন পৃথক পৃথকভাবে হেফাজতে রাখা হয়। তারপর তিনি জুলিয়ন, আওপাস ও অন্যান্য সালারদেরকে ডেকে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পেশ করলেন।
ফজরের পরই কালো ইসাজার দিকে রওনা হলো। সে সময় নিয়ম ছিল প্রধান সেনাপতি ইমামতি করতেন সে অনুপাতে তারেক ইবনে যিয়াদ নামাজের ইমামতি করে ফৌজদের উদ্দেশ্যে বললেন, সম্মুখের শহর একেবারে সহজে করতলগত হবে না বরং বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে এবং বেগ পেতে হতে পারে। এভাবে তিনি বেশ তেজদ্বীপ্ত ভাষণ দিলেন।
ইসাজার বড় রাহেব এবং কয়েকটা লড়াই এর অভিজ্ঞ কেল্লাদার এ খবরের অপেক্ষায় ছিল যে, মুসলমানদের সিপাহসালারসহ আরো দু’জন সালার হত্যা হয়েছে ফলে তার সৈন্যরা অভিযান মূলতবী করেছে। সে সাত সকালেই কেল্লার প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে কারমুনার দিকে নিষপলক চেয়েছিল। তার আশা ছিল তিন লাড়কীর ঘোড়া গাড়ী দেখতে পাবে, সূর্য ক্রমে ওপরে উঠছিল কিন্তু ঘোড়ার গাড়ী নজরে আসছিল না।
দূর আকাশে সে ধূলি উড়তে দেখতে পেল। কিন্তু এত ধূলীকণা ছোট কাফেলার দরুন উড়বে না। সে ধূলিধূসর দিগন্তে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেল অশ্বপ্রতিচ্ছবি।
“দুশমন আসছে” কেল্লাদার প্রাচীর হতে উচ্চস্বরে আওয়াজ দিল।
কেল্লার ফৌজ পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ফৌজের কমান্ডাররা বিগত রাতে ফায়সালা করে ছিল, কেল্লার মাঝে বন্দি হয়ে পড়ার চেয়ে খোলা ময়দানে আক্রমণকারীদের মুকাবালা করা হবে। তাদের ধারণা ছিল যেহেতু মুসলমানদের প্রধান সেনাপতিসহ আরো দু’জন সেনাপতি নিহত হবে তাই মুসলমান সম্মুখে অগ্রসর হবে না তারপরও তারা নিজেদের ফৌজ তৈরী রেখে ছিল। আর মনে মনে খুশী হচ্ছিল মুসলমানরা যদি তাদের সিপাহসালার ছাড়া হামলা করে তাহলে তারা তাড়াতাড়ি মারা যাবে। তারা এটা কখনো ধারণা করতে পারেনি যে, মুসলমানদের সিপাহসালার এত সুন্দরী ললনাকে প্রত্যাখ্যান করবে আর সে তাদের কতলের হাত থেকে বেঁচে যাবে।
দুর্গপতির ঘোষণায় শহরের তামাম দরজা খুলে গেল আর সিপাহীরা অত্যন্ত দ্রুতবেগে কেল্প ছেড়ে বাহিরে চলে এলো। দামামা বেজে উঠল, ফৌজের মাঝে যুদ্ধ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হলো।
তারেক ইবনে যিয়াদের বাহিনী ক্ৰমে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে চলল। সম্মুখ দলের কমান্ডার দেখল কেল্প হতে সৈন্যরা বের হয়ে ময়দানে কাতার বন্দি হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে সে তার দলকে দাঁড় করিয়ে অশ্ব হাঁকিয়ে তারেক ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছে ঘটনা বর্ণনা করল।
তারেক তার সৈন্য বাহিনীকে তিন ভাগেভাগ করলেন। এক ভাগের দায়িত্ব মুগীছে রূমী আরেক ভাগের দায়িত্ব যায়েদ ইবনে কাসাদাকে দিলেন আর এক দলের দায়িত্ব নিজে রাখলেন। দায়িত্বশীলদেরকে তৎক্ষণাৎ দিক নির্দেশনা দিলেন। মুগীছে রূমীকে তিনি শহরের এক প্রান্তে পাঠিয়ে দিলেন উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে শহরের পশ্চাতে রাখা।
যায়েদ ইবনে কাসাদাকে বামদিকে প্রেরণ করলেন সাথে নির্দেশ দিলেন দুশমনের নজর এড়িয়ে যথা সম্ভব তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আর হুকুম না দেয়া পর্যন্ত হামলা করবে না। তারেক নিজে দুশমন যে দিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে গেলেন। তিনি দুশমনের কাছে পৌঁছা মাত্রই তারা আক্রমণ করে, বসল।
ঐতিহাসিক লেইনপোল লেখেছেন, ইসাজার ফৌজের সে হামলা একেবারে মামুলী ছিল না। বরং অত্যন্ত শক্তছিল এবং আক্রমণের অবস্থা দেখে প্রতীয়মান হয়, তাদের লড়াই এর স্পৃহা ছিল আর সে শহর হেফাজতে তারা হয়েছিল দৃঢ় প্রতিক্ষ। প্রফেসর দুজি লেখেছেন, খ্রীস্টান ফৌজরা এত শক্ত আক্রমণ করেছিল যে তা সামাল দেয়া তারেকের জন্যে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তারেকের সৌভাগ্য যে কয়েক হাজার নতুন বর্বর ফৌজ এসে তার ফৌজে যোগ দিয়ে ছিল তানাহলে ইসাজার ফৌজরা তার পরাজয় ডেকে আনত। বর্বর কওম জন্মগত ভাবেই লড়াকু-যুদ্ধবাজ তাই সহজে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া তাদের জন্যে অসম্ভব ছিল ফলে তারা জীবনবাজী রেখে লড়ছিল কিন্তু তাদের অনেক ফৌজ মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েছিল।
ঈসায়ী ফৌজের জেনারেল মুসলমানদের পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করার জন্যে তার বাম পার্শ্বের দলকে বামদিকে পাঠিয়ে দিল। সৈন্যদল পেছনে যেতে লাগল কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে সেদিকে মুসলমানদের একটি দল রয়েছে। মুসলমান সৈন্যদলের কমান্ডার খ্রীস্টান ফৌজ আসতে দেখে তার সৈন্য বাহিনীকে আরো পিছনে নিয়ে গেলেন যাতে খ্রীস্টানরা তাদেরকে দেখতে না পায়।
খ্রীস্টান বাহিনী আরো কিছুটা সম্মুখে গিয়ে ডানদিকে ফিরে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল এরি মাঝে যায়েদ ইবনে কাসাদা তার বাহিনী নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুশমনরা প্রস্তুতি নেয়ারই সুযোগ পেল না। এতে তারেক ইবনে যিয়াদের পশ্চাৎ একেবারে নিরাপদ হয়ে গেল।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল। শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সাধারণ জনতা এ ভয়াবহ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিল। তারা মুগীছে রূমীর বাহিনী দেখতে পেল। তারা বাম দিকে শহর হতে কিছুটা দূরে তারেক ইবনে যিয়াদের হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। একজন শহরী দ্রুত গিয়ে মুগীছে রূমীর সংবাদ তাদের জেনারেলকে দিলে, জেনারেল তার ডান দিকের বাহিনীকে মুগীছের দিকে পাঠিয়ে দিল।
মুগীছে রূমী ছিলেন অত্যন্ত চৌকস ও সচেতন। তিনি তার কয়েকজন সৈন্যকে খবর নেয়ার জন্যে সম্মুখে পাঠিয়ে ছিলেন তারা দৌড়ে এসে তাকে সংবাদ দিল যে দুশমনের কিছু ফৌজ এদিকে আসছে। মুগীছ তারেক ইবনে যিয়াদের নির্দেশের অপেক্ষা না করে তার বাহিনীকে সম্মুখে অগ্রসর হবার হুকুম দিলেন। তার কাছে বেশ যথেষ্ট পরিমাণ অশ্বারোহী ছিল।
মুগীছে রূমী সামনা-সামনি না লড়ে তার সৈন্য বানিীকে আরো সম্মুখে নিয়ে দুশমনের পার্শ্ব থেকে হামলা করলেন। তাদের আক্রমণ এত কঠিন ছিল যে, দুশমন পিছু হঠতে লাগল। তাদের পিছনে ছিল শহরের প্রাচীর। তারা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছিল কিন্তু মুগীছের বাহিনী তাদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করল যে তারা পিছু হটতে হটতে তাদের পিঠ দেয়ালে লেগে গেল। তারা সম্মুখে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করল কিন্তু মুসলমানরা তাদের সে চেষ্টা সফল হতে দিল না। বর্বর মুসলমানরা একান্তভাবে জীবনবাজী রেখে লড়ে গেল। যুদ্ধ তিনভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তারেক ইবনে যিয়াদ সবচেয়ে বিপদে ছিলেন। তার দু’পাশের সৈন্যরা পৃথক পৃথকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কোন কৌশল অবলম্বনেরও কোন রাস্তা ছিল না। তার প্রতিটি সৈন্য নিজে নিজে লড়াই করছিল। তার কোন রিজার্ভ বাহিনী ছিল না। তারেক নিজে একজন মামুলী সৈনিকের মত লড়ছিলেন। তার ফৌজের ক্ষতি হচ্ছিল ব্যাপকভাবে।
যায়েদ ইবনে কাসাদা যেহেতু দুশমনের পশ্চাৎ হতে আক্রমণ করেছিলেন এ কারণে দুশমনের লোকসান বেশি হয়েছিল। যায়েদ ইবনে কাসাদা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ সালার। তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন তারেক ইবনে যিয়াদ বেশ বিপদে আছেন তাই তিনি তার সৈন্যের এক চতুর্থাংশ তারেকের সাহায্যে পাঠিয়ে দিলেন এতে তারেকের বিপদ কিছুটা হালকা হলো। কিন্তু খ্রীস্টান ফৌজরা তাদের পবিত্র নগরী রক্ষার্থে জীবনবাজী রেখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করছিল।
মুগীছে রূমী ঈসায়ী ফৌজকে যে ফাঁদে ফেলেছিলেন এতে তাদের বেশ লোকসান হচ্ছিল। তারা প্রতিপক্ষের ঘোড় ও প্রাচীরের মাঝে বন্দী হয়ে পড়েছিল। তারা অনেকেই ঘোড়ার পিট হতে পড়ে পদতলে পৃষ্ট হচ্ছিল। অশ্বারোহীরা এমন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, তীর-তরবারী চালানো একেবারে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা পরস্পরে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছিল।
দুশমনের ঘোড়া অক্ষত রাখার ব্যাপারে তারেকের বিশেষ নির্দেশ ছিল যাতে ঐ ঘোড়া প্রয়োজনে নিজেদের কাজে আসে কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মুগীছে রূমী ঘোড়ার পরওয়া করলেন না। দুশমনের ঘোড়া জখম করার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশের ফলে বর্বর মুসলমানরা আরোহীর সাথে সাথে ঘোড়ার শরীরও তীর বর্শা দিয়ে আঘাত হানতে লাগল। এতে করে যে ঘোড়া আহত হলো সে তার আরোহীর বাগ মানলা না। কিছু অশ্ব ও আরোহী অন্য অশ্বের পদ তলে পৃষ্ট হলা।
দুশমনরা পালাতে লাগল। কিন্তু খুব কম সংখ্যই পালাতে পারল। মুগীছ তার কিছু ফৌজ তারেকের মদদে পাঠিয়ে দিলেন। এতে তারেকের বিপদ আরো হালকা হয়ে গেল এবং যুদ্ধের হাল যা খ্রীষ্টানদের পক্ষে যাচ্ছিল তা ঘুরে গেল।
ইতিহাস খ্রীষ্টান ফৌজকে জানায় সাধুবাদ; কারণ তারা যে সাহসীকতা ও …দৃঢ়তার সাথে লড়ে মুসলমানদের যে পরিমাণ ক্ষতি করেছিল তা বেশ ব্যাপক ছিল। মুসলমানরা এত পরিমাণ ক্ষতির জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তারা প্রথমপর্যায়ে বিজয়ের খুশীতে ছিল। সাঁঝ নাগাদ খ্রীস্টানরা পরাজিত ঠিকই হলো কিন্তু মুসলমানদের মাথা থেকে এ বিষয়টা বের করেদিল যে তারা যেদিকেই যাক বিজয় তাদের অতি সহজে, পদচুম্বন করবে না।
একদিকে দিবসের সূর্য ডুবছিল অপরদিকে খ্রীস্টানদের বাহাদুরীর সূর্য হলো অস্তমিত। তাদের দুর্গপতি, তামাম জেনারেল নিহত হলো। সিপাহীদের মাঝে খুব স্বল্প সংখ্যক জীবিত রইল। তারেকের সৈন্য বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব যখন তাকে দেয়া হলো তখন তিনি একেবারে ‘খ’ মেরে গেলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত যে, তার শরীরের গ্রন্থিগুলো খুলে গেছে। পুরো দিন একজন মামুলী সৈনিকের মত লড়াই করেছেন।
খ্রীস্টান ফৌজদের মাঝে যারা জীবিত ছিল তারা চলা-ফেরা করার কাবেল ছিল না। যে যেখানে ছিল সে সেখানেই বসে পড়েছিল। এখন তারা কয়েদী। তাদের মাঝে যারা পলায়নের চেষ্টা করছিল তাদেরকে পাকড়াও করে আনা হচ্ছিল। শহরে এলান করে দেয়া হলো, কেউ যদি কোন ফৌজকে আশ্রয় দেয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলেন আহতদেরকে মুসলমানরা ময়দান থেকে নিয়ে আসবে আর শহরবাসী তাদের সেবা-শশ্রুষা করবে। আহত ব্যক্তি মুসলমান হোক বা স্পেনী সবার সাথে এক রকম ব্যবহার করতে হবে কেউ এর বিপরীত করলে তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
তারেক ইবনে যিয়াদকে যে তিন রমণী হত্যা করতে এসেছিল তাদের তলব করলেন, তারপর তাদেরকে যে বড় পাদ্রী পাঠিয়ে ছিল তারেক আহ্বান করে রমণীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তিই কি তোমাদেরকে পাঠিয়েছে।
রমণীদের মাঝ থেকে একজন জবাব দিল, হা সিপাহ সালার সেই আমাদেরকে পাঠিয়েছে এবং হত্যার পন্থা সেই বাতলিয়ে দিয়েছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ পাদ্রীকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার ফৌজের একজন আদমীও তোমাদের কোন ইবাদত খানার বারান্দাতেও যাবে না। ইবাদত খানা যে ধর্মেরই হোকনা কেন আমাদের জন্যে তার সম্মান রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আমরা কোন ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবনা। প্রত্যেক ধর্মের লোক নিজ ইবাদত ও ধর্মের কর্ম সম্পাদনে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। কিন্তু যেভাবে তোমরা তোমাদের ধর্মীয় বিধানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে আমি তোমাদের এ গোস্তাখী মাফ করব না। কুমারী রমণীদেরকে তোমরা উপ-পত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো, এমন কোন বিধান কি হ্যরত ঈসা (আ)-এর ধর্মে রয়েছে। না… এমন বিধান নেই, ফলে তুমি হত্যাযযাগ্য।
পাদ্রী থর থর করে কাঁপতে লাগল এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্যে অনেক কিছু বলল। কিন্তু তারেক তার কথার প্রতি কর্ণপাত না করে তাকে বন্দী করে আগামীকাল প্রভাতে হত্যার নির্দেশ দিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ অন্যান্য পাদ্রীদেরকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন যুবতী রমণীদেরকে তাদের নিজ নিজ বস্তিতে পাঠিয়ে তাদের পিতা-মাতার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেনী ফৌজদের সেবা-যত্নের জন্যে শহরবাসীদের ওপর চাদা নির্ধারণ করলেন আর তারা যেহেতু ফৌজের সাথে মিলে যুদ্ধ করে ছিল, তাই তাদের ওপর কর নির্ধারণ করলেন।
একজন খ্রীস্টান ঐতিহাসিক নাম তার এইচ. পি. সিকাড, তিনি লেখেছেন, তারেক ইবনে যিয়াদ যখন ইসাজার বিজয়ার্জন করলেন তখন পাদ্রীরা পরম্পরে বলাবলি করতে লাগল, মুসলমানরা হিংস্র জাতি, তোমাদের সাথে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করবে। যুবতী বৈরাগিনীরা তাদের ভয়ে নিজেদের চেহারা বিকৃত করে ফেলেছিল তারপরও তাদের প্রতি মুসলমানরা বিন্দুমাত্র দয়া করেনি, তাদেরকে হত্যা করেছে।
কিন্তু এইচ. পি. সিকাডের এ বক্তব্যকে তার স্বজাতি ঐতিহাসিকরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা লেখেছেন, পাদ্রীরা মুসলমানদের আচার ব্যবহারে এত মুগ্ধ হয়েছিল যে, তাদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আর যুবতী যাজিকারা মুসলমান ফৌজের সাথে পরিনয়ে আবদ্ধ হয়েছিল।
একজন ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক লেখেছেন, মুসলমানরা যে, অমুসলিমদের ইবাদতখানা নষ্ট করেছে ইতিহাসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারেক ইবনে যিয়াদ শহরের দায় দায়িত্ব খ্রীষ্টান অফিসারদের হাতে সোপর্দ করে ছিলেন কিন্তু তাদের ওপররাস্ত কর্মকর্তা ছিল মুসলমান।
***
পরের দিন সকালে শহীদদের লাশ পাঁচ কাতারে সারিবদ্ধ করে তারেক ইবনে যিয়াদ যখন জানাযার নামাজ পড়াচ্ছিলেন, তখন এক হৃদয়বিদারক বেদনা বিধুর অবস্থার অবতারণা ঘটেছিল। শহীদের কাফন শহরবাসীরা ব্যবস্থা করেছিল। শহরবাসীরা শহীদদের জানাযা ও দাফনের দৃশ্য প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল।
কিছুক্ষণের মাঝে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বিশাল গণ কবরে পরিণত হলো। কবর স্থান ঐসব মুজাহিদদের সমাধিস্থল যারা সর্ব প্রথম ইউরোপ পর্যন্ত আল্লাহ্ তায়ালার একত্ববাদের ও রাসূল (স)-এর রেসালতের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন।
মুজাহিদরা আল্লাহ আকবার ধ্বনি দিচ্ছিলেন, তারেক ইবনে যিয়াদের নয়ন যুগল অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। শহীদদের দাফন সম্পর্ণ করে তারেক ফাতেহা পাঠ করে অশ্রুসজল চোখে কবরস্থান হতে বেরুচ্ছিলেন এরি মাঝে তাকে খবর দেয়া হলো কায়রো থেকে আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরের কাসেদ এসেছে। তারেক কাসেদ থেকে পয়গাম নিয়ে পড়তে লাগলেন। পয়গাম পড়তে পড়তে তার চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল। তার কাছে জুলিয়ন ও অন্যান্য সালাররা ছিলেন।
“তোমাদের কেউ কি বলতে পারো এ নির্দেশের মাঝে কি দানেশমন্দী রয়েছে?” অস্বাভাবিক অবস্থায় তারেক তার সালারদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর মুসা ইবনে নুসাইরের পয়গাম পড়ে তাদেরকে শুনাতে লাগলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেককে লক্ষ্য করে লেখেছিলেন,
বিবেকের দাবী হলো তুমি যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করবে। তানাহলে বিজয়ের উল্লাসে সম্মুখে অগ্রসর হতে হতে হঠাৎ পরাজয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। সম্মুখে অগ্রসর হবে না, যতক্ষণ দ্বিতীয় পয়গাম না পাঠাই বা আমি নিজে আরো ফৌজ নিয়ে উপস্থিত না হই।
কোন ঐতিহাসিকই মুসা ইবনে নুসাইরের পয়গামের পূর্ণ বিবরণ পেশ করেনি। তারা কেবল এতটুকু উল্লেখ করেছে যে, মুসা তারেককে কেবল হুকুমই দেননি বরং তাকে বাধ্য করেছিলেন তিনি যেন সম্মুখে অগ্রসর না হতে পারেন। খ্রীস্টান ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইর লক্ষ্য করলেন, তারেক যে তার গোলাম ছিল এখন সে স্পেনের মত এত বড় বিশাল রাজ্যের বিজয়ী হতে যাচ্ছে। সে মাত্র বার হাজার সৈন্যের মাধ্যমে রডারিকের এক লাখের চেয়ে বেশী ফৌজকে কেবল পরাজিত করেনি বরং তাদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিয়েছেন। ফলে ইসলামী সালতানাতেও খলীফার কাছে সে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতে যাচ্ছে। এতে মুসার অন্তরে বিদ্বেষ জন্ম নিল। তারেককে এ নির্দেশ দেয়ার পিছনে তার এ বিদ্বেষ কাজ করেছে। তারেক কে বাধা দিয়ে নিজে বিজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিল।
কিন্তু যারা সঠিক ঐতিহাসিক বিশেষ করে মুসলমান ইতিহাসবিদরা লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইরের সে নির্দেশ যথাযথ ছিল। কারণ তিনি চিন্তা করেছিলেন তারেক ইবনে যিয়াদ তরুণ যুবক ফলে তিনি আবেগের বশীভূত হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে আটকে না পড়েন এবং যে এলাকা বিজয় হয়েছে তা যেন হাত ছাড়া না হয়ে যায়।
মুসা ইবনে নুসাইরের নির্দেশ সঠিক ছিল কিনা এ বিতর্কে আমরা না গিয়ে সে নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক ও তার সেনাপতিরা কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছিলেন তা আমরা তুলে ধরছি যার বিবরণ নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদরা লিপিবদ্ধ করেছেন।
তারেক কবরস্থান থেকে বেরিয়ে তার সালারদেরকে আহ্বান করে ছিলেন সালারদের সাথে তিনি জুলিয়নকেও রেখেছিলেন। কারণ জুরিয়ন ছিলেন বয়স্ক, অভিজ্ঞ অধিকন্তু তিনি খ্রীস্টান হওয়া সত্ত্বেও তার স্বজাতির বিরুদ্ধে তারেকের সাথে পূর্ণ বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে কৃতিত্ব দেখিয়ে ছিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ : হে আমার বন্ধুবর! তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। আমি বুঝতে পারছি না আমীরের এ হুকুমের মাঝে কি হিকমত লুক্কায়িত রয়েছে। একদিকে ইসলামের বিধান, আমীরের অনুসরণ কর, তার বিরুদ্ধাচরণ কর না, অপর দিকে আমরা যদি সামনে অগ্রসর না হয়ে এখানে স্থির বসে থাকি তাহলে স্পেনীরা মনে করবে যে আমাদের বিপুল পরিমাণ সৈন্য শহীদ হয়েছে তাই আমরা সামনে অগ্রসর হতে ভয় পাচ্ছি।
মুগীছে রূমী : ইবনে যিয়াদ! স্পেনীরা যা মনে করার তা করুক। কিন্তু আমাদের দেখার বিষয় হলো যে, আমরা স্পেনীদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছি। এখন আমরা যদি তা হতে অবতরণ করি তাহলে স্পেনীরা বিক্ষিপ্ত শক্তিকে একত্রিত করে আমাদের জন্যে বিপদের কারণ হতেপারে। আমরা দুশমনের ওপর ভীতির চাদর বিছিয়ে দিয়েছি। আমি এর মাঝে কোন হিকমত খুঁজে পাচ্ছিনে যে আমরা দুশমনকে একত্রিত হবার সুযোগ দেব।
জুলিয়ন : লক্ষ্য কর তারেক! আমীরের হুকুম তামীলের ব্যাপারে তোমাদের ধর্মের যে নির্দেশ সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না, আমাদের ধর্মের নির্দেশ তোমাদের মতই তবে আমীর যদি এমন নির্দেশ দেয় যদ্বরুণ ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের ক্ষতি হয়, এমন হুকুম পালন করাকে আমি পাপ মনে করি। তুমি চিন্তে কর তারেক! তুমি কয়েকটা যুদ্ধে বিজয়ার্জন করলে। বিশেষ করে রডারিকের যুদ্ধে রডারিকের সাথে বড় বড় আমীর ওমারা ও অভিজ্ঞ সেনাপতিদেরকে হত্যা করেছ। স্পেন ফৌজের আসল বুহ্যকে তুমি চুরমার করে দিয়েছ। যারা পলায়ন করেছে তাদের অন্তরে রয়েছে তোমাদের ভয়। এ অবস্থায় তুমি কি তাদের একত্রিত হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর সুযোগ দিবে, না তাদের পিছু ধাওয়া করবে যাতে তারা স্বস্তির খাস না নিতে পারে?
যায়েদ ইবনে কাসাদা : আমীরে মুসা এখান থেকে অনেক দূরে। ফলে এখানকার বাস্তব চিত্র ও স্পেনী ফৌজদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন।
জুলিয়ন : তাছাড়া এ ইসাজা শহরের ব্যাপারে তুমি লক্ষ্য কর। এটা স্পেনের চৌরাস্তা, এখান থেকে একটা রাস্তা কর্ডোভা, আরেকটা গ্রানাডা, তৃতীয় আরেকটা রাস্তা সালাগা আর চতুর্থ রাস্তা গেছে স্পেনের রাজধানী শাহী মহল টলেডোর দিকে। তুমি যদি এ চারটি শহর দখলে আনতে পারো তাহলে মনে কর যে পুরো স্পেন তোমার দখলে এসে গেল। তুমি সম্মুখে অগ্রসর হও, আমীর যদি নারাজ হন তাহলে আমি তার সাথে কথা বলব।
তারেক : আমি নিজেও তার সাথে আলাপ করতে পারি কিন্তু আলাপ আলোচনা পরে হবে। এখন আমরা সম্মুখে অগ্রসর হবো।
***
আমীরের হুকুমএড়িয়ে অন্য শহরের দিকে অগ্রসর হবার ফায়সালা তারেক গ্রহণ করলেন। তার ফৌজকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করে এক ভাগের সেনাপতি যায়েদ ইবনে কাসাদাকে নিয়োগ করে তার নেতৃত্বে মালকুন শহরের দিকে ফৌজ পাঠালেন। অপরভাগের নেতৃত্ব তারেক নিজের হাতে রেখে কর্ডোভার দিকে অগ্রসর হলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ কর্ডোভা অবরোধ করলেন, কিন্তু প্রথম দিনই অনুধাবন করতে পারলেন শহরে প্রবেশ করা বড় কঠিন। প্রাচীর ও দরজার কাছে যাওয়া আত্মহত্যার নামান্তর। কেল্লার চতুরপার্শ্বে ছিল পরিখা। তারেক সর্বোপরি চেষ্টা করলেন, কেবল একটা চেষ্ঠার বাকী ছিল তা হলো অবরোধ সময় বৃদ্ধি করা। নয়দিন অতিবাহিত হয়ে গেল।
তারেক : মুগীছ! তুমি এখানেই থাক, আমি চললাম। আমরা তো আমীরের হুকুম উপেক্ষা এ কারণে করলাম যেন স্পেনী ফৌজ একত্রিত না হতে পারে এবং তারা যেন স্বস্তি না পায়। এখানে যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে কয়েক মাস লেগে যাবে। এখানে অবরোধ করে বসে থাকলে চলবে না। আমি রাজধানী টলেভোর দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এখানে যে সৈন্য আছে তা দু’ভাগে ভাগ করছি।
মুগীছে রূমী : অধিকাংশ ফৌজ তোমার সাথে রাখ ইবনে যিয়াদ। আমাকে মাত্র সাতশত সৈন্য দাও।
সেরেফ সাত শত! মাত্র সাতশত ফৌজের দ্বারা তুমি এ কেল্লা কজা করতে পারবে? আশ্চর্য হয়ে তারেক মুগী কে জিজ্ঞেস করলেন।
জুলিয়ন : মুগীছ সাত শত ফৌজ নিয়ে এ কেল্লা করতলগত করতে পারবে কিনা তা জানি না তবে তারেক! তুমি স্বল্প ফৌজ দ্বারা টলেডো জয় করতে পারবে না। টলেডো হলো রাজধানী, স্পেনের প্রাণ কেন্দ্র তাই সহজে তা কব্জা করা যাবে না। ফলে অধিকাংশ ফৌজ তুমি তোমার সাথে নিয়ে সেদিকে রওনা হও।
মুগীছ : আল্লাহর মদদই আমার জন্যে যথেষ্ট। এ শহরে আমি প্রবেশ করবই, ইনশাআল্লাহ।
তারেক : মুগীছ! কল্পনা ও স্বপ্নজগতের কথা বল না। আল্লাহ তায়ালা তো তাকে মদদ করেন যে, বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রেখে চেষ্টা করে।
মুগীছ : আমি যে সাতশত ফৌজ নির্বাচন করব, তা তুমি রেখে বাকীগুলো নিয়ে রওনা হয়ে যাও। রাসূল (স) আমাদেরকে বিজয় সুসংবাদ দিয়েছেন ফলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থাও করে দিবেন। আমরা এ পরিখার পাশে কেবল বসে থাকব না।
মুগীছে রুমীর পছন্দমত সাতশত সৈন্য রেখে বাকী ফৌজ সাথে নিয়ে তারেক টলেডোর দিকে রওনা হলেন। তার সাথে জুলিয়ন ও আওপাসও গেলেন।
***
কর্ডোভার দেয়ালের ওপর তীর-কামিন, বর্শা হাতে মানুষের যে প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছিল তা খুশীতে ফেটে গেল আর তার মাঝ থেকে ভেসে এলো বিজয় উল্লাস।
“তারা চলে গেল- তারা চলে গেল।”
“এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছ মুসলমানরা।”
“আমাদের মেহমানরা চলে যাচ্ছে।”
“দাঁড়াও আমরা দরজা খুলে দিচ্ছি।”
তীর-ধনুক, বর্শা হাতে নেচে নেচে খ্রীষ্টানরা বিজয় ধ্বনী দিচ্ছিল। ফেটে পড়ছিল তারা অট্টহাসিতে। তারেক তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, মুগীছে রূমী তার সাতশত ফৌজ খন্দক হতে দূরে পশ্চাতে নিয়ে গেলেন। মুসলমানরা নিরাশ হয়ে অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছে এ খুশীতে খ্রীস্টানরা আত্মহারা।
রাত্রে শহরে হচ্ছিল আনন্দ উৎসব। গির্জাতে যাজক-যাজিকারা খুশীতে মেতে উঠেছিল। ইসাজা যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে শহরবাসী শুনে ছিল, মুসলমান ফৌজ চলে যেতে দেখে তারা মনে করল এ মুসীবত তাদের ওপর থেকে চলে গেল। তাই এ খুশীতে তারা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিল।
কর্ডোভা শহরের অদূরে লতা-গুল্মে ঘেরা এক সবুজ-শ্যামল বনানীতে, মুগীছে রূমী তার ফৌজ থেকে পৃথক হয়ে একাকী নিবিষ্ট চিত্তে নফল নামাজ পড়ে, আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
“হে আল্লাহ! তুমি একক সত্ত্বা, তোমার কোন শরীক নেই। হে পরওয়ার দেগার! তুমি যাকে ইচ্ছে তাকে ইজ্জত দান কর, যাকে ইচ্ছে তাকে বেইজ্জতি কর, তুমি তাবৎ কিছুর ক্ষমতাবান। আমি তোমার ওপর ভরসা করে মাত্র সাতশত সৈন্য দ্বারা এ শহর জয় করার ওয়াদা করেছি। আমি এ শহরের বাদশাহ হতে চাই না। বরং তোমার বাদশাহী এ শহরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
ওগো দয়াময়! তুমি আমাকে সাহস ও হিম্মতদান কর যাতে আমি তোমার একত্ববাদ ও মুহাম্মদ (স)-এর রিসালতের বানী নিয়ে এ কেল্লাতে প্রবেশ করতে পারি এবং বাতিলের ঘোর তমাশায় যেন হকের প্রদীপ প্রোজ্জ্বল করতে পারি। আমাকে তোমার দরবারে ও আমার সাথীদের কাছে লজ্জিত করোনা দয়াময়।
দোয়া শেষ করে চোখের পানি মুছে ফৌজদের কাছে গিয়ে বসে পড়লেন, সকল সোয়ারী তার পাশে এসে জমা হলো।
উচ্চস্বরে মুগীছে রূমী বলতে লাগলেন,
হে আমার প্রিয় সাথীরা! আমি সিপাহ্ সালারকে বলেছিলাম, আমাকে কেবল সাতশত সোয়ারী দিন আমি আপনাকে এ শহর উপহার দেব। আমি আমার দাবী ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্যে তোমাদেরকে নির্বাচন করেছি। এ প্রতিশ্রুতি আমি সিপাহ সালারের কাছে করিনি বরং স্বয়ং আল্লাহর কাছে করেছি আর এ ওয়াদা তোমাদের বীরত্বের ওপর ভরসা করে করেছি। আল্লাহর কাছে অঙ্গিকার কর আমরা হয়তো এ শহরের প্রাচীর ভেঙ্গে তাতে প্রবেশ করব তানাহলে সকলে মৃত্যুর শুরা পান করব। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন, তোমরাও আল্লাহর সাথে থেকো।
স্বমস্বরে জবাব এলো,
“আমরা তোমার সাথে আছি, আমরা অঙ্গিকারাবদ্ধ হচ্ছি আমরা হয়তো এ শহর দখলে নেব তা নাহলে জীবন দিবো।”
সকাল বেলা। মুগীছে রূমী একাকী বেরুলেন কেল্লা ও শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর দেখার মানসে। হয়তো প্রাচীরের ওপর উঠার বা তা ভাঙ্গার উপযুক্ত কোন জায়গা পাওয়া যেতেও পারে। একজন রাখাল ভেড়া-বকরী নিয়ে আসছিল। সে মুগীছকে দেখে সালাম করে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাদশাহকে যারা পরাজিত করেছে আপনি কি সে ফৌজের একজন মুগীছ স্পেনী জবান জানতেন, তাই জবাব দিলেন, হা দোস্ত! তুমি আমাকে তোমার দুশমন মনে করছ?
রাখাল : আমরা খুবই গরীব। কাউকে দুশমন ভাবার ক্ষমতা আমাদের নেই।
মুগীছ রাখালের সাথে বন্ধুসূলভ আলাপ করতে করতে তার সাথে যেতে লাগলেন।
রাখাল : দাঁড়াও। তোমরা যদি এ শহরের ভেতর প্রবেশ করতে চাও তাহলে পিছন দিকে চলে যাও। সেদিকে দরিয়াও আছে খন্দকও আছে। এক জায়গায় প্রাচীর একটু ভাঙ্গা আছে। সে জায়গার আলামত হলো সেখানে একটা বৃক্ষ আছে। যার ডাল প্রাচীরের ওপর গিয়ে পড়েছে। সেথা হতে তোমরা প্রাচীর ভাঙ্গতে পারো। নিজে গিয়ে দেখে এসো, একাজ তোমরা করতে পারবে কিনা।
মুগীছে রূমী ছদ্দবেশে অনেক দূর ঘুরে সমুদ্র পাড়ে গেলেন। দেয়ালের ভাঙ্গা স্থান তিনি খুঁজে পেলেন, কিন্তু যে পরিমাণ ভাঙ্গা তা দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আরো ভাঙ্গা লাগবে। প্রাচীরের ওপর পাহারাদার ছিল। মুগীছ চুপি চুপি ফিরে এসে চার-পাঁচজন ফৌজকে সে স্থান দেখে আসার জন্যে পাঠালেন।
প্রাচীরে ভাঙ্গা স্থানের চেয়ে তার কাছে যে গাছ রয়েছে তা দ্বারা উপকার বেশী হবে কারণ তার ডাল বয়ে প্রাচীরের ওপর যাওয়া যাবে। কিন্তু পাহারাদাররা বড় ভয়ের কারণ।
ঐতিহাসিক লেইনপোল লেখেন, মুসলমানরা যুদ্ধ বিদ্যা ও বীরত্বে নজীর বিহীন ছিল। তাদের বিজয়ের কারণ মূলত: এটাই ছিল। তাছাড়া ঐশী শক্তিও তাদের পক্ষে হামেশা ছিল। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো যা তাদের পক্ষে যেত। মুগীছে রূমী দেয়াল ভাঙ্গা ও প্রাচীরের কাছে গাছ পেয়ে ছিলেন কিন্তু তা কাজে লাগান কঠিন ছিল।
সূর্য অস্তমিত হলো, আঁধারের চাদর ঢেকে নিল কর্ডোভা নগরীকে। কিছুক্ষণ পর প্রবল বেগে শুরু হলো ঝড়-বৃষ্টি। বাতাসের তীব্রতায় গোটা নগরী থরথর করে কাঁপছিল। বৃষ্টি এত প্রবল হচ্ছিল যেন প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। গাছ-পালা উপড়ে পড়ার উপক্ষম। এ ভয়াবহ তুফানের হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিলনা মুগীছ ও তার সাথীদের জন্যে। তাদের কোন তাবু ছিল না আর যদি থাকতও তবুও তা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঘোড়া চিৎকার করে ছটফট করছিল। টিলার পাদদেশে গিয়ে কোন মতে জীবন রক্ষা করছিল।
মুগীছে রূমী উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, এখন উপযুক্ত সময়,এ তুফান আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত। ঘোড়াতে জিন লাগিয়ে দ্রুত প্রাচীরের কাছে চল, এখন প্রাচীরের ওপর কোন পাহারাদার নেই। কোদাল সাথে নিও।
এ প্রবল বৃষ্টি ও ঝঞ্ঝা বায়ুর মাঝে সাতশত সৈন্য নিয়ে মুগীছে রূমী রওয়ানা হলেন। বিজলীর উৎকট চমক আর বজ্রের প্রকট ধ্বনিতে ঘোড়া বাগ না মেনে এদিকে সেদিকে ছটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আরোহীরা তাদের দক্ষতা বলে ঘোড়াকে বাগে রেখেছিল।
কর্ডোভার অদূর দিয়ে সাগর অতিবাহিত হয়েছে। ঘোড় সোয়ারদেরকে যেহেতু প্রাচীর হতে দূরে রাখা দরকার ছিল তাই সাগরের মাঝে হাঁটু পানিতে তাদেরকে রাখা হয়েছিল। সাগরের প্রবল স্রোত তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল।
পাহারাদাররা বুরুজের মাঝে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
মুগীছে রূমী তার চারজন সহযোগীসহ প্রাচীরের কাছে গাছ-পালা ও লতা গুলোর মাঝে অবস্থান নিলেন।
আবু আতীক : সালার! প্রাচীর ভাঙ্গার প্রয়োজন নেই। আমি রশী সাথে নিয়ে এসেছি, আমাকে গাছে উঠার অনুমতি দিন।
আবু আতীক রশী নিয়ে গাছে উঠে প্রাচীরের দিকে যে ডাল ছিল তাতে গেল। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। বৃষ্টিতে ডাল পিছলে হয়ে গিয়েছিল ফলে পা পিছলে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। তবুও সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়ালের ওপর পৌঁছে প্রাচীরের খুঁটির সাথে রশী বেঁধে বাকী অংশ রশী নিচে নামিয়ে দিলে সাত-আটজন ফৌজ রশী ধরে প্রাচীরের ওপর উঠে গেল। তারা তলোয়ার উন্মুক্ত করে পাহারাদারের একটা বুরুজে পৌঁছে সে বুরুজের চারজন পাহারাদারকে অতর্কিতভাবে হত্যা করে। অনুরূপভাবে আরো কয়েক বুরুজের পাহারাদারদেরকে হত্যা করে তারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দরজার কাছে এসে সেখানে যে পাহারাদার ছিল তাদেরকে হত্যা করে দরজা খুলে দিল। তারপর আবু আতিক বাহিরে গিয়ে মশাল জ্বালিয়ে সংকেত দেয়ার সাথে সাথে মুসলিম সোয়ারীরা তুফানের মত প্রবল বেগে কেল্লার মাঝে প্রবেশ করল।
দু’তিনজন স্পেনী ফৌজকে রাহবর বানিয়ে মশালের আলোতে মুসলিম ফৌজ কেল্লার আনাচে-কানাচে পৌঁছতে ছিল। স্পেনী ফৌজ ঘুমিয়ে ছিল তাদেরকে চিরতরে নিদ্রাপুরে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যারা আত্মসমর্পণ করে স্বেচ্ছায় ধরা দিল তারাই কেবল কতলের হাত থেকে রেহায় পেল। শহরীরা কোন মুকাবালাই করতে পারল না।
সকাল বেলা। ঝড়-বৃষ্টি খতম হয়েছে। কেল্লা ছিল মুসলমানদের হাতে, কিন্তু কেল্লার ভেতর ছিল আরেকটা কেল্লা যা মুসলমানদের দখলে আসেনি। সেটা ছিল খ্রীস্টান পাদ্রীদের ও যাজিকাদের আবাসস্থল ও দরসগাহ। তার প্রাচীর ছিল অতি উঁচু আর দরজা ছিল লোহার।
কর্ডোভার গভর্নর রাতের আঁধারে কিছু সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সেখানে পালিয়ে গিয়েছিল। মুগীছ এলান করলেন, আত্মসমর্পণ কর তাহলে রক্ষা পাবে আর মুকাবালা করলে পাবে শাস্তি।
গভর্নর প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে জওয়াব দিল, পাদ্রীদের কাছে এসে দেখ শান্তি কে পায় তখন বুঝবে। বাঁচতে চায়লে এ শহর হতে চলে যাও।
এ সুরক্ষিত স্থানে প্রবেশের জন্যে মুগীছ বহু চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পেলেন না। তাকে বলা হলো তার ভেতরে ফলমুলের এত পরিমাণ গাছ পালা আছে যে কয়েক মাসেও তা খতম হবে না।
প্রায় এক মাস পর মুগীছ জানতে পারলেন, শহরের ভেতরে যে নালা রয়েছে তার পানি দুর্গের ভেতরে যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্গের লোকরা এ পানিই পান করছে। মুগীছ নালার মুখ বাঁধ দিয়ে ভেতরে পানি যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, তারপর তিন-চারদিন পরেই দরজা খুলে গেল।
মুগীছ প্রথমে গভর্নরের গর্দান উড়িয়ে দিলেন। তারপর তার মাঝে যেসব ফৌজি অফিসার ছিল তাদেরকে হত্যা করলেন। তীরন্দাজদেরকে করলেন বন্দী আর যাজিকাদের করে দিলেন মুক্ত।
উত্তর আফ্রিকার রাজধানীতে আমীর মুসা ইবনে নুসাইর আঠার হাজার ফৌজ একত্রিত করলেন। তিনি পূর্বেই স্পেন যুদ্ধে শরীক হবার অনুমতি খলীফা ওয়ালীদ থেকে নিয়ে রেখেছিলেন। তার ধারণা ছিল তারেক ইবনে যিয়াদ তার নির্দেশ মুতাবেক যুদ্ধ বন্ধ করে তার জন্যে অপেক্ষা করছেন, তিনি গিয়ে বিজয়াভিজানে শামিল হবেন।
কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদ ও তার সালাররা যে আমীরে মুসার নির্দেশ অমান্য করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন তা স্পেনের আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করছিল।
***
যায়েদ ইবনে কাসাদাকে তারেক ইবনে যিয়াদ যেদিকে প্রেরণ করেছিলেন, সেদিকে ছিল স্পেনের বড় শহর গ্রানাডা। স্পেনের নামকরা জেনারেল তিতুমীর যে তারেকের সাথে সর্ব প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিল সে গ্রানাডাতে অবস্থান করছিল। সে মুসলমানদের বিজয় খবর শুনতে পাচ্ছিল তাই গ্রানাডা রক্ষার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল।
কেল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও শহরের প্রাচীরের কোন ত্রুটি ছিল না। ফৌজের কোন অভাব ছিল না এতদ্বসত্ত্বেও ফৌজের মাঝে যুদ্ধের কোন স্পৃহা ছিল না তারা হয়ে পড়েছিল হতদ্দম। এ বিষয়টা তিতুমীরকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
রডারিকের মৃত্যু সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। রডারিককে মানুষ বড় বাহাদুর ও যুদ্ধবাজ মনে করত। তার ব্যাপারে মাশহুর ছিল, সে মহলে জালিম বাদশাহ্ আর যুদ্ধ ময়দানে মহাবীর। তাকে পরাজিত করার ক্ষমতা অন্য কোন বাদশাহর নেই। এ কারণে মানুষের ধারণা ছিল সে মরে নাই বরং জীবিত আছে এবং এক সময় ফিরে আসবে। আবার অনেকে মনে করত যদি মরেও যায় তবুও তার প্রত্যাবর্তন ঘটবে। কিন্তু এ বিশ্বাস সকলের ছিল না অনেকে আবার একথাও বলত, মুসলমানরা যে যুদ্ধবাজ তারা রডারিককে কেবল পরাজিতই করেনি বরং একেবারে দুনিয়া হতে চির বিদায় দিয়েছে।
তিতুমীরের ফৌজের মানসিক এ অবস্থা তার জন্যে বড় ভয়াবহ ছিল। সে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছিল। তার পরাজয়কে সে বিজয়ে পরিনত করার স্বপ্ন দেখছিল। তাছাড়া সে স্পেনের বাদশাহ হবারও খাব দেখছিল। তার অধিনস্থ– অফিসারদেরকে সে এ লোভই দেখিয়েছিল। তার অফিসারদেরকে বলেছিল,
“এখন দেশে কারো হুকুমত নেই। যে বিজয়ার্জন করবে সেই হবে রাজত্বের অধিকারী। আফ্রিকার বর্বররা লুটতরাজের জন্যে এসেছে। তারা এক জায়গায় পরাজিত হলেই পলায়ন পদ হবে তারপর রাজ্যের অধিকারী হবো আমরা। তোমরা বসবে আমার জায়গায় আর আমি বসবো রডারিকের স্থানে। তবে তার জন্যে আগে প্রয়োজন হামলাকারীদেরকে বিতাড়িত করা।”
ফৌজি অফিসারদের জন্যে এতটুকু ইশারাই যথেষ্ট ছিল। তারা বড় পদের প্রত্যাশায় হামলাকারীদেরকে পরাস্ত করার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল।
তিতুমীর বলল, তোমরা সকলেই শুনেছ তারা গ্রানাডার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কমজোরী পয়দা করেছে। তাদের একটি দল গ্রানাডার দিকে আসবে, তাদেরকে সমুলে ধ্বংস করতে হবে। যদি আমরা এ দলকে খতম করতে পারি তাহলে কর্ডোভার দিকে তাদের যে দল গিয়েছে তাদের ওপর আগ্রমণ করতে পারব। তারপর আমরা টলেডোর দিকে যে দল গিয়েছে তাদেরকে খতম করতে পারব। আর তাদেরকে পরাস্ত করার একটা পদ্ধতি হলো গ্রানাডার দিকে যে দল অগ্রসর হচ্ছে তাদেরকে পথিমধ্যে জায়গায়-জায়গায় আক্রমণ করা হবে যাতে তারা গ্রানাডা নাগাদ না পৌঁছতে পারে। আর যদি পৌঁছেও তাহলে তারা যেন ক্লান্ত শ্রান্ত থাকে এবং তাদের ফৌজ যেন অবশিষ্ট থাকে কম। তাহলে আমরা তাদেরকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করাতে পারব।
একজন উপরস্থ অফিসার বলল, আপনার পরিকল্পনা খুবই ভাল। আমরা মুসলমানদেরকে গ্রানাডা অবরোধ করার সুযোগই দেব না। শহর থেকে দূরে, ফাঁকা ময়দানে তাদের সাথে যুদ্ধ হবে। আপনি রডারিকের আসনে আসীন হবার কথা বলছিলেন, আপনি কি ভুলে গেছেন যে, রডারিকের এক বেটা রয়েছে। তার বর্তমানে আপনি স্পেনের মুকুট কিভাবে পরিধান করবেন?
তিতুমীর জবাব দিল, সে তো পাগল।
অফিসার তার মাতা তো পাগল নয়। তাছাড়া ইউগুবীলজি, সেও আপনার মত জেনারেল। সবসময় টলেডোতে থেকেছে। রডারিকের বিবি তাকে খুব পেয়ার করে আর ফৌজদের মাঝেও তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে ফলে সে ফৌজকে আপনার বিরুদ্ধে রানীর পক্ষে উসকে দেবে। আপনি যদি তার বিরুদ্ধে যান তাহলে সে আপনাকে হত্যা করবে বা আপনাদের পরস্পরে লড়াই শুরু হবে এতে করে দুশমন পুরো মূলক পূর্ণ মাত্রায় বিজয় করার সুযোগ পাবে।
তিতুমীর তার একথা শুনে এমনভাবে হাসতে লাগল যেন তার অফিসার একেবারে পাগলপনা কথা বলেছে। সে এর কোন জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।
তিতুমীর বলল, এটা পরের বিষয় আগে এসো, ফৌজ ভাগ করেনি। কোথায় কত ফৌজ পাঠান যায় তা ভেবে দেখি।
গ্রানাডাতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল, তিতুমীর সে জায়গাগুলোর প্রত্যেকটিতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করল এবং ফৌজদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রত্যেক জায়গাতে একই ভাষণ পেশ করল,
“ঐ শাহেন শাহ্ রডারিক মৃত্যু বরণ করেছে যে, স্পেনকে নিজের পৈত্রিক সম্পদ ও তোমাদেরকে তার গোলাম বানিয়ে রেখেছিলেন। স্পেনের জমিতে উৎপাদিত প্রতিটি শস্যকণার হকদার তোমরা। তোমরা তোমাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের প্রতিটি পয়সার মালিকও তোমরা। এখন থেকে তোমাদের জমির উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক আর কেউ জোর করে নিয়ে যাবে না। তোমাদের নিজ হাতে উপার্জিত প্রতিটি জিনিসের মালিক তোমরাই হবে। তোমরা যারা ফৌজে আছ তাদের বাপ-ভাই থেকে কোন প্রকার কর আদায় করা হবে না। কোন ফৌজ যদি লড়াই এ আহত হয় তাহলে তাকে তার নির্ধারিত বেতন-ভাতা সর্বদা প্রদান করা হবে। আর কেউ যদি নিহত হয় তাহলে তার উত্তরাধিকারীদেরকে এক সাথে পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হবে।”
তিতুমীরের ভাষণ এ পর্যন্ত আসতে ফৌজরা ধ্বনী শুরু করেদিল।– “তিতুমীর জিন্দাবাদ, স্পেন জিন্দাবাদ।” তাদের ধ্বনী শেষ হলে তিতুমীর তার ভাষণ আবার শুরু করলেন,
“আফ্রিকার এ বর্বর মুসলমানরা তোমাদের মুলুক ও তোমাদের ঘর-বাড়ী লুট করবার জন্যে এসেছে। তারা তোমাদের মেয়ে-বোন ও নওজোয়ান স্ত্রীদেরকে ধরে নিয়ে যাবে এবং তাদেরকে তোমাদের সামনে বেআব্রু করবে। এ ডাকাতরা দশ বার বছরের বাচ্চাদেরকেও ধরে নিয়ে যায়। যদি তাদের হাত থেকে ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত বাঁচাতে চাও তাহলে জীবন বাজী রেখে লড়াই কর। দুশমনের ভয় অন্তর থেকে বের করে দাও। তারা এত বড় বাহাদুর নয় যা তোমরা শুনেছ। যেসব ফৌজ পরাস্ত হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা বলবে মুসলমানরা মানুষ নয় তারা জিন ভূত। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, তারা তোমাদের মতই মানুষ। পৃথিবীতে যদি কেউ বাহাদুর থেকে থাকে তাহলে তা রয়েছ তোমরা।”
তিতুমীর যাদের সম্মুখে ভাষণ দিচ্ছিল তারা জানত না যে, সে প্রথমে মুসলমানদের সাথে লড়াই করে পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে এসেছে, আর এখন বড় বড় কথা বলে ভাষণ দিচ্ছে। সেই প্রথম মুসলমানদেরকে জিন-ভূত হিসেবে অবহিত করেছিল।
***
তিতুমীর গ্রানাডাতে পৌঁছার পূর্বেই যায়েদ ইবনে কাসাদা গ্রানাডার অদূরে কেল্লা বন্দী শহর নাগাদ পৌঁছে তা অবরোধ করে ফেললেন। প্রাচীরের ওপর তীরন্দাজ ও বর্শাধারী ফৌজ মওজুদ ছিল। তারা তীর, বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। কিন্তু মুসলমানদের কামান ছিল বেশ শক্তিশালী, তারা দূর হতে তীর নিক্ষেপ করতে পারত। তাই প্রাচীরের ওপর থেকে যে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছিল তা মুসলমানদের কাছে এসে পৌঁছছিল না। কিন্তু মুসলমানরা যা নিক্ষেপ করছিল তা জায়গায় পৌঁছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছিল।
মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনী স্পেনীদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করছিল। মুসলমানরা অবিরাম তীর বর্ষণ করার দরুন প্রাচীরের ওপর যে ফৌজ ছিল তা মাথা তুলে দাঁড়াবার অবকাশ পেল না। মুসলমানরা চেষ্টা করছিল দেয়ালের ওপর চড়ার বা প্রাচীর ভাঙ্গার। কিছু মুজাহিদ দরজার কাছে পৌঁছে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল।
মুসলমানরা এমন স্পৃহা ও বীরত্বের সাথে লড়াই করছিল যেন তারা পুরো কেল্লা প্রাচীরসহ উপড়ে ফেলে দেবে। মুসলমানদের ব্যাপারে স্পেনীদের মনে যে আতংক ছিল তা পূর্ণ মাত্রায় জেগে উঠল। মুসলমানরা যে তীর নিক্ষেপ করছিল তা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পল্লীর ভেতর পড়ছিল। এতে শরীদের মাঝে ত্রাস আরো বেড়ে গেল ফৌজরা বিলকুল ভেঙে পড়ল। বেগতিক দেখে কেল্লাদার দরজা খুলে দেয়ার হুকুম দিল।
মুসলমানরা কেল্লার ভেতর প্রবেশ করল। তেমন ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই তা মুসলমানদের করতলগত হলো।
***
একটু সম্মুখে আরো দুটো বড় নগরী। মালাকা ও মুরশিয়া। মালাকার ফৌজরা বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে কেল্লার বাহিরে কাতার বন্দি হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। তাদের এ বীরত্ব প্রদর্শন তিতুমীরের ভাষণের কারণে ছিল। কিন্তু তাদের জানাছিল না তাদের লড়াই এমন মুসলমানের সাথে যারা যুদ্ধের মাঝে খুঁজে পায় সুখ। জন্মের পরেই যাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয় যুদ্ধলড়াই।
জেনারেল যায়েদ তারেক ইবনে যিয়াদের শেখান বিশেষ কৌশল বলে স্পেনীদেরকে এমনভাবে পিছনে নিয়ে গেলেন যে তাদের পিঠ প্রাচীরে ঠেকে গেল। ঘোড়া পায়দলদেরকে পৃষ্ঠ করছিল। আর মুসলমানরা তাদেরকে চিরতরে খতম করছিল। জেনারেল যায়েদ দুশমনকে যুদ্ধে লিপ্ত করে তার কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদকে পাঠিয়ে দিলেন দরজা ভাঙ্গার জন্যে।
স্পেনীরা কেল্লা হতে বেরিয়ে সাহসীকতা ও বীরত্বের পরিচয় ঠিকই দিল কিন্তু তারা কেল্লা হেফাজতের কথা ভুলে গিয়েছিল। কেল্লার বাহিরে তারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করছিল অপর দিকে মুসলমানদের জানবাজ ফৌজরা কেল্লার দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। পরিশেষে স্পেনীরা হাতিয়ার ছেড়ে দিল। তিতুমীরের জ্বালাময়ী ভাষণ কোন কাজে আসল না। যেখানে তীর-তলোয়ার চলতে থাকে সেখানে শব্দবান বাতাসে হারিয়ে যায়।
এখন যায়েদের সম্মুখে স্পেনের অন্যতম নগরী গ্রনাডা। জেনারেল তিতুমীর কেল্লা বন্দি এ নগরীতে রয়েছে। প্রথম পরাজয়ের প্রতিশোধ ও স্পেন রাজ্যের সম্রাট হবার প্রত্যাশায় লড়াইয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখে ছিল। সেও অবরুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করা ভাল মনে করল না। তার ফৌজকে শহর হতে বের করে কিছু দূরে কাতার বন্দি করল।
যায়েদ ইবনে কাসাদার সৈন্য সংখ্যা তিতুমীরের সৈন্যের চেয়ে কম ছিল এতটুকু উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া কার সৈন্য সংখ্যা কত ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কোন ঐতিহাসিকই উল্লেখ করেননি। স্পেনী ফৌজের সাথে শহরীরাও যোগ দিয়েছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় কম হওয়া ছাড়াও তাদের আরেকটা দুর্বলতা ছিল যে তারা ছিল ক্লান্ত শ্রান্ত। একেতো এসেছে বহুদূর সফর করে তাছাড়া যুদ্ধ তো পর্যায়ক্রমে লেগেই রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু সম্মুখে দুশমনকে কাতার বন্দি দেখে তারা ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে বিশ্রামের কথা ভুলে গিয়ে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরী হয়ে গেল।
সম্মুখে দুশমন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, যায়েদ ইবনে কাসাদা তার বাহিনীকে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড় করিয়ে, দুশমনের সৈন্য সংখ্যা ও তাদের কি ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে তা লক্ষ্য করতে লাগলেন।
তিতুমীরের জানাছিল যে, মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনী স্পেনী সৈন্যদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তাই সে আগেই তার সৈন্যদেরকে ধ্বনী দেয়ার জন্যে হুকুম দিল। সাথে সাথে তারা যুদ্ধ শুরু করার জন্যে উস্কাতে লাগল। দুশমনের উদ্দীপনা স্পৃহা দেখে যায়েদ বুঝতে পারলেন তারা জীবন বাজী রেখে লড়ার জন্যে প্রস্তুত। মুসলমান ফৌজরা ক্লান্ত একথা ভেবে যায়েদ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন কিন্তু এ পরিস্থিতিতে পিছু তো আর হটা যায় না তাই তিনি যেখানে ছিলেন সেখান থেকেই। ফৌজকে প্রস্তুতি নিয়ে তাকবীর দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ফৌজের স্পৃহা-উদ্দীপনা বাড়াবার জন্যে বলতে লাগলেন,
“বর্বর ভাইরা আমার! তোমাদের স্পৃহা ও ঈমানী শক্তি যাচাই করার সময় এসেছে। আমি আরবী। আজ তোমাদের প্রমাণ করতে হবে যুদ্ধের ময়দানে আরবীদের চেয়ে বর্বররা বেশী ত্যাগী ও জানবাজ। স্মরণ রেখ! তোমাদের অন্য সাথীরা অন্য শহরের দিকে গেছে। তাদের কাছ থেকে তোমাদের তিরস্কার শুনতে না হয় যে, গ্রানাডার দিকে যারা গেছে তারা বুজদিল ও বেঈমান ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমরা যদি পরাজিত হও তাহলে আল্লাহর সামনে তোমরা কি জবাব দেবে।”
এতটুকু বলার পরেই বর্বররা উচ্চস্বরে শ্লোগান দিয়ে উঠল, “আমরা তোমার সাথে আছি যায়েদ! আমরা তোমার সম্মুখে থাকব, আমরা আদৌ পলায়ন পদ হবো না।”
ঐ যুদ্ধের বিবরণদানকারী ঐতিহাসিক প্রফেসর ডিজি লেখেন, যায়েদ ইবনে কাসাদা ঘোড়ায় সোয়ার ছিলেন, তিনি ঘোড়াকে কেবলামুখী করে মাথা নত করে দোয়ার জন্যে হাত উঠালেন। তার ঠোঁট নড়ছিল, নাজানি কি বলে তিনি আল্লাহর কাছে বিজয় কামনা করছিলেন। ক্রমে তার মাথা ও হাত আসমানের দিকে উঁচু হতে লাগল। মুনাজাত শেষ না করেই তিনি বলতে লাগলেন, “হে ইসলামের রক্ষকরা! আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছেন।”
তারপর প্রায় একশত জানবাজ মুজাহিদকে পৃথক করে তাদেরকে কিছু হিদায়াত দিলেন, সে মুতাবেক তারা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সে রাস্তায় চলে গেল। কিছু দূর যাবার পর তারা মোড় ঘুরে উঁচু-নিচু টিলার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিতুমীর মুসলমানদের সাথে আরেক বার যুদ্ধ করেছে। তারেক ইবনে যিয়াদ কি কৌশল অবলম্বন করে তাদেরকে কচুকাটা করেছিল সে তসবীর তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাই সে তার কমান্ডার ও ফৌজদেরকে বলে দিল মুসলমানরা হামলা করার পর যদি পিছনে সরে যায় তাহলে তাদের পিছু না গিয়ে বরং তারা যেন আরো নিজেদের পিছনের দিকে চলে আসে।
এদিকে যায়েদ তার সৈন্যদেরকে বললেন, তোমরা যে ক্লান্ত-শ্রান্ত এটা যেন দুশমনের কাছে প্রকাশ না পায়। দুশমনের যে সৈন্য এখানে রয়েছে তার অধিকাংশ অন্য যুদ্ধ হতে পলায়ন করে এসেছে। তাই তাদের দিলে বর্বরদের ভয় রয়েছে ফলে এমনভাবে লড়তে হবে যাতে তাদের সে ভয় যেন আরো বেড়ে যায়। উল্টো আমাদের মাঝে যেন ভীতির সঞ্চার না হয়।
তিতুমীর তার ফৌজকে এমন জায়গায় কাতার বন্দি করেছিলেন যে তার ডানে ও বামে উঁচু টিলা থাকার দরুন সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ ছিল। যায়েদ তার সৈন্যকে তিনভাগে ভাগ করলেন। তিনি মধ্যভাগকে সম্মুখে পাঠালেন আর নিজে পিছনে থাকলেন। অপর দিকে গ্রানাডার দ্বিগুণ সৈন্য সামনে অগ্রসর হলো, তাদের পিছনে রইল তিতুমীর নিজে।
মুসলমানরা তাকবীর দিতে দিতে দ্রুত সম্মুখে অগ্রসর হলে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল। স্পেনী ফৌজ বুঝতে পারল না যে, মুসলমানরা ক্রমে পিছু হঠছে। তারা সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল। তিতুমীর পিছু দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সামনে এগুতে নিষেধ করছিল।– হঠাৎ করে টিলার দু’ পাশ থেকে তিতুমীরের ফৌজের ওপর তীর-বর্শা বৃষ্টি শুরু হলো। এরি মাঝে টিলার পাদদেশ হতে বর্বর ঘোড় সোয়াররা দ্রুত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে স্পেনী ফৌজের পশ্চাতে চলে গেল। সেদিক থেকে তারা জীবন বাজী রেখে বীরত্বের সাথে আক্রমণ করল। তীর-বর্শার আঘাতে স্পেনী ফৌজ এলোমেলো হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল।
ঐতিহাসিক নেইলপোল লেখেন, স্পেনী ফৌজের মাঝে আগে থেকেই মুসলমানদের ব্যাপারে যে ত্রাস ছিল তা তীর-বর্শার চেয়ে বেশী কাজে লাগল। ইতিপূর্বে যেসব সৈন্য অন্য যুদ্ধ হতে পালিয়ে এসে ছিল তারা এমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল যে মুহূর্তের মাঝে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।
যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেই যায়েদ ইবনে কাসাদা একশ জানবাজ ফৌজকে পৃথক করে শহরের পিছনে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন। তিনি তাদেরকে বলেছিলেন তারা দূর দিয়ে শহরের পিছনে গিয়ে কেল্লার দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করবে কারণ স্পেনের তাবৎ সৈন্য কেল্লার বাহিরে চলে এসেছে সম্ভবতঃ কেল্লার পাহারাতে কেউ নেই বা থাকলেও খুব কম সংখ্যক রয়েছে।
জানাবাজদের এ দল শহরের পিছনে পৌঁছে গেল। প্রাচীরের ওপর একজন দাঁড়ান ছিল সে মুসলমানদেরকে আসতে দেখে, দ্রুত ঘোড়ায় মোয়র হয়ে তিতুমীরের কাছে গিয়ে খবর পৌঁছাল যে, কিছু সংখ্যক মুসলমান পশ্চাৎ’ হতে শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিতুমীর প্রায় তিনশর মত অশ্বারোহীকে শহরের পশ্চাতে পাঠিয়ে দিল আর যেসব সৈন্য এখনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি তাদেরকে হুকুম দিল তারা যেন শহরের ভেতর চলে যায়।
স্পেনী ফৌজ শহরের দিকে যাবার জন্যে পিছু ফিরতেই যায়েদ ইবনে কাসাদা তার সাথে রক্ষিত ফৌজ নিয়ে পশ্চাদ হতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হামলা যেহেতু পশ্চাৎ দিক থেকে ছিল তাই স্পেনীদের বেশ ক্ষতি হলো।
নেইলপোল লেখেন, অন্য কোন যুদ্ধে এত পরিমাণ মানুষ আর মরেনি। তিতুমীর যে তিনশ ফৌজ শহরের পশ্চাতে পাঠিয়ে ছিল বর্বররা তাদেরকে একেবারে কচুকাটা করেছিল। কোন ফৌজ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার সুযোগ পেয়ে ছিল তাহলে সে শহরের দিকে যায়নি, জ্ঞানশূন্য হয়ে অন্য দিকে ছুটে আত্মগোপন করেছিল।
তিতুমীরকে যুদ্ধ ময়দানে পাওয়া গেল না। স্পেনী ফৌজদের পতাকা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ শেষ হয়েছিল কিন্তু যায়েদ ইবনে কাসাদার নির্দেশ ছিল কোন দুশমনকে যেন জিন্দা না রাখা হয়।
যুদ্ধ ময়দান হতে গ্রানাডা বেশ একটু দূর ছিল। দুশমন বাহিনী পুরো সাফ করে সালার যায়েদ গ্রানাডার দিকে রওনা হলেন। তিনি তার ফৌজদেরকে সুসংবাদ দিলেন যে আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। এখন কাজ হলো কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা, সম্ভবতঃ শহরে কেউ আর প্রতিরোধ করবার নেই। যায়েদ ইবনে কাসাদা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কেল্লার দিকে দৃষ্টিপাত করে থ’ মেরে গেলেন। কেল্লার প্রাচীরের ওপর মানুষের দরুন আরেকটি প্রাচীর তৈরী হয়েছে। অবরোধের সময় সব কেল্লার ওপরে সিপাহী থাকে কিন্তু এত পরিমাণ মানুষ তিনি ইতিপূর্বে আর কোথাও দেখেননি। প্রাচীরের ওপর যারা রয়েছে তাদের সকলের হাতে তীর-বর্শা, গায়ে বর্ম ও মাথায় লৌহ শিরস্ত্রান।
যায়েদ তার সহকারী সালারকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা মনে করেছিলাম যে, গ্রানাডার তাবৎ সৈন্য খতম করে দিয়েছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তো দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত। ময়দানে যে সৈন্য ছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী সৈন্য দেখা যাচ্ছে শহরের হেফাজতে রয়েছে তাই এখন সম্মুখে অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না।
পড়ন্ত বিকেল। দিবাকর হারিয়ে যাবার জন্যে উঁকি মারছে। যায়েদ ইবনে কাসাদা কেল্লা অবরোধ করলেন। মুসলমান বহু ফৌজ শহীদ হয়ে ছিলেন, অনেকে হয়েছিলেন আহত। বাকীরা পূর্ণ মাত্রায় ক্লান্ত-শ্রান্ত তারপরও সালার যায়েদ প্রাচীরের কাছে গিয়ে ঘোষণা করলেন, হে কেল্লাবাসী! তোমরা তোমাদের ফৌজের পরিমাণ লক্ষ্য কর। তোমরা যদি যুদ্ধ ব্যতীত শহরের দরজা খুলে দাও তাহলে সকলে পাবে নিরাপত্তা তানা হলে সকলকে করা হবে হত্যা।
কোন কেল্লা অবরোধ করে এমন ঘোষণা দিলে সাধারণতঃ ভেতর থেকে দাম্ভিকতাপূর্ণ জবাব আসে কিন্তু যায়েদ ইবনে কাসাদার ঘোষণার কোন জবাব এলো না।
অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ কেল্লার দরজা খুলে গেল। আর তিতুমীর সফেদ পতাকা হাতে বেরিয়ে এলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো তিতুমীর সন্ধির পতাকা নিয়ে কেবল মাত্র একজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে চলে এসেছে। তার সাথে কোন দেহ রক্ষী, সৈন্য সামন্ত কিছুই নেই। যায়েদ ইবনে কাসাদা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তিতুমীরকে ইস্তেকবাল জানালেন। তারপর দু’জন পরস্পরের মুখোমুখি হলেন।
তিতুমীর : এখানের যে বড় কমান্ডার তার নির্দেশে আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনি আপনার কাছে পয়গাম পাঠিয়েছেন যে আপনি যদি অবরোধ করেন। তাহলে এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাবে তবুও কিছু করতে পারবেন না। প্রাচীরের দিকে তাকালেই আপনি অনুধাবন করতে পারবেন যে শহরের অভ্যন্তরে কি পরিমাণ। ফৌজ মওজুদ রয়েছে।
যায়েদ ইবনে কাসালা দুভাষীর মাধ্যমে জবাব দিলেন, এত পরিমাণ সৈন্য থাকার পরেও তুমি সন্ধির জন্যে কেন এসেছ? আমার ফৌজ তো তুমি দেখছেই। আগের তুলনায় এখন আরো কমে গেছে।
তিতুমীর : আমাদের জেনারেল খুব রহম দিল ইনসান। তিনি দেখেছেন লড়াই এর দরুন তার বিপুল পরিমাণ ফৌজ হালাক হয়েছে, আপনার ফৌজের লুকসান হয়েছে। এখন আবার যদি লড়াই হয় তাহলে উভয়ের লুকসান হবে, তিনি এটা। চাচ্ছেন না। আর যদি সন্ধি না করেন তাহলে আপনাকে তো বলছিই যে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সামন্ত রয়েছে, আপনি কেল্লা কজা করতে পারবেন না।
যায়েদ ইবনে কাসাদ। ধোকার আশংকা করতে ছিলেন। তারপরও তিতুমীর যেভাবে প্রস্তাব পেশ করেছে তার কথা বিশ্বাস করে সন্ধি প্রস্তাবে তিনি সম্মত হলেন।
তিতুমীর বলল, তবে হ্যাঁ, সন্ধির শর্ত কিন্তু আমরা পেশ করব। আর সবচেয়ে বড় শর্ত হলো, শহরবাসীর জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করার দায়িত্ব থাকবে আপনার ওপর। আপনার কোন ফৌজ কোন শহরবাসীর ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো ভান্ডারে যে টাকা-পয়সা আছে তা আমরা স্বেচ্ছায়। আপনার সমীপে পেশ করব। তৃতীয় শর্ত থাকবে আপনি আমাদেরকে যুদ্ধ বন্ধি বানাবেন না। আর আমি আপনার পক্ষ হতে এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হব। আপনার সকল বিধি-বিধান মেনে নিয়ে পূর্ণ মাত্রায় আপনার অনুগত থাকব।
সন্ধির এ শর্তাবলী লিপিবদ্ধ করে যায়েদ ইবনে কাসাদা তাতে স্বাক্ষর করে নিজের সীল মোহর লাগিয়ে দিলেন।
যায়েদ ইবনে কাসাদার এক সহকারী কমান্ডার একটু গোস্বার স্বরে বলল, ইবনে কাসাদা! আপনি আমাদের সকলের মৃত্যুর পরওয়ানার ওপর স্বাক্ষর করে সীল লাগিয়েছেন।
আরেকজন কমান্ডার বলল, ঠিকই ইবনে কাসাদা! মনে হচ্ছে আপনি খুব ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন তাই আপনার বুদ্ধিতে কাজ করছে না।
যায়েদ ইবনে কাসাদা : আল্লাহর ওপর আমার পূর্ণ ভরসা রয়েছে। তোমরা কি আশংকা করছ যে, তিতুমীর আমাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছেআমরা ভেতরে গেলে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের নাম নিশানা মিটিয়ে ফেলবে।
কমান্ডাররা বলল, ঘটনা হয়তো এমনই ঘটবে।
যায়েদ ইবনে কাসাদা : তোমাদের বুদ্ধির অভাব আছে। কোন কেল্লাদার দুশমনের সামান্যতম ফৌজকেও ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। আমাদের তো ফৌজ রয়েছে তাদের প্রবেশের জন্যে সে সকাল বেলা দরজা খুলে দেবে। তারা। হয়তো বুঝতে পেরেছে, বর্বর মুসলমান সংখ্যায় কম হলেও তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
যায়েদ ইবনে কাসাদা সারা রাত ঘুমোতে পারলেন না। তিনি চিন্তা করতে ছিলেন না জানি তাকে কোন ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে কিনা। তিনি তার কমান্ডারদেরকে রাতে বিদ্রি থেকে চৌকস থাকার জন্যে এবং প্রভাতে কেল্লাতে প্রবেশ করার সময় চতুর্দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করার নির্দেশ দিলেন।
প্রভাত হলো। এক মুজাহিদ ফজরের আযান দিলে তাবৎ লস্কর যায়েদ ইবনে কাসাদার পিছনে নামাজ পড়ল। যায়েদ তার অধিনত কমান্ডারদেরকে বললেন, কেল্লার ভেতর প্রবেশ করার সময় সবাই যেন সতর্ক থাকে।
সকাল বেলা। সূর্য উঠার পূর্বেই কেল্লার ভেতর হতে একজন এসে যায়েদ ইবনে কাসাদাকে বলল, জেনারেল তিতুমীর আপনার জন্যে ইন্তেজার করছে। যায়েদ তার সৈন্য বাহিনীকে তার পিছু পিছু আসার নির্দেশ দিয়ে আগন্তুকের সাথে রওনা হলেন।
ফৌজ পূর্ব হতেই তৈরী ছিল। যায়েদ নির্দেশ দেওয়া মাত্র তারা রওনা হয়ে গেল। ধারণা ছিল হয়তো প্রাচীরের ওপর পূর্বের ন্যায় ফৌজ থাকবে কিন্তু দেখা গেল প্রাচীরে কেউ নাই।
তিতুমীর ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়েদের ইন্তেজারে ছিল। যায়েদ পৌঁছলে তাকে এস্তেকবাল করে ভেতরে নিয়ে গেল।
যায়েদ : আমার ফৌজরাও কি ভেতরে আসতে পারবে?
তিতুমীর : হ্যাঁ, তা তো বটেই। আমি কি সন্ধি পত্রে উল্লেখ করিনি যে কেল্লা আপনাকে সোপর্দ করব?
যায়েদ ইশারা করামাত্র তামাম ফৌজ কেল্লাভ্যন্তরে প্রবেশ করল এবং পূর্ব নির্দেশ মুতাবেক পূর্ণ সতর্ক রইল। কেল্লার ভেতর কোন ফৌজ চোখে পড়ল না। ঘরের ছাদে আওরাত ও বাচ্চাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিছু কিছু বৃদ্ধ মানুষও ছিল। এতে যায়েদের সন্দেহ আরো প্রবল হলে মনে হয় নিশ্চয় কোন ফাঁদ পাতা হয়েছে।
যায়েদ : আপনার ফৌজ ও কেল্লাদার কোথায়?
তিতুমীর : এখানে কোন ফৌজ নেই। এখানে আপনি ফৌজের একটা সদস্যও পাবেন না। আমি আপনার কাছে মিথ্যে বলেছিলাম। আমার দেহরক্ষীও নেই। যে একজন ব্যক্তি দেখেছেন সে আমার ব্যক্তিগত কর্মচারী, আমাকে ছেড়ে যেতে সে রাজী হয়নি।
যায়েদ : আমি তোমার একথা কি বিশ্বাস করব?
তিতুমীর: ফৌজ এমন কোন ছোট জিনিস নয়-যে তা লুকিয়ে রাখব। এ সারা শহর আপনাকে সোপর্দ করেছি। আপনার কাছে ফৌজ আছে। শহর তল্লাশী করে দেখতে পারেন। আমাকে ছাড়া এখানে আপনি কোন সৈন্য দেখতে পাবেন না। আমার তাবৎ ফৌজ আপনার হাতে কতল হয়েছে আর যারা জীবিত আছে তারা। পালিয়ে গেছে।
যায়েদ : তুমি মিথ্যে বলছ। দেয়ালের ওপর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে ফৌজ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে সৈন্য আমি দেখতে চাই।
আবাল-বৃদ্ধ জনতার দিকে ইশারা করে হেসে তিতুমীর বলল, এরা হলো সে ফৌজ যাদেরকে আপনি প্রাচীরে দেখেছিলেন, আপনি যদি দেখতে চান তাহলে তা আমি আবার দেখাতে পারি। আমি ধোকা দিয়ে সন্ধি পত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছি। আমার কাছে কোন ফৌজ নাই। তাই পলায়ন করার পরিবর্তে এ পদ্ধতি অবলম্বন। করেছি। যাতে আপনি মনে করেন কেল্লা অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ সৈন্যের সমাবেশ রয়েছে।
যায়েদ : এ প্রতারণার কি দরকার ছিল? তুমি কি এ বৃদ্ধ বনিতাকে আমাদের হাতে কতল করাতে চাচ্ছিলে? আমি যদি কেল্লা আক্রমণের ইচ্ছে করতাম তাহলে এ নিষ্পাপ শিশু-কিশোররা তো আমাদের তীর বর্শার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতো। আর তুমি মনে করোনা যে আমি তোমার ফৌজ দেখে ভীতু হয়ে সন্ধি করেছি।
তিতুমীর : আমি জানি আপনাকে ভীতি প্রদর্শন সম্ভব নয়। আর আমি আপনাকে ভয়ও দেখাই নাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল আপনি এমন পদ্ধতি গ্রহণ করেন যাতে দ্বিতীয় বার যেন আর রক্তপাত না ঘটে। আমি আপনাকে পূর্ণ মাত্রায় আশ্বস্তঃ করছি যে, আপনার সাথে আমি যে অঙ্গিকারাবদ্ধ হয়েছি তা কোন চালবাজী নয় প্রকৃত অর্থেই আমি আপনার আনুগত্য স্বীকার করেছি। আমি আমার নিজস্ব কোন ফৌজ তৈরী করব না বরং পরিপূর্ণভাবে আপনার অধীনত থাকব।
ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেন তিতুমীরের বুদ্ধিমত্তা দেখে যায়েদ এত পরিমাণ প্রভাবান্নিত হন যে প্রধান সেনাপতি তারেক ইবনে যিয়াদের অনুমতি ছাড়াই তিনি তিতুমীরকে গ্রানাডার গভর্নর নিযুক্ত করেন তবে তাকে এক আরবী শাসনকর্তার অধীনে রাখেন।
গ্রানাডার অধিবাসীদের মাঝে ইহুদীদের সংখ্যাধিক্য ছিল। তারা রডারিকের শাসনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল তাই তারা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। গ্রানাডার সরকার পরিচালনার জন্যে যায়েদ মুসলমানদের সাথে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকেও নিয়োগ করেছিলেন। প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার মত লোক বেশ অভাব ছিল মুসলমানদের মাঝে। এ অভাব মিটানোর জন্যে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে এসব কাজে নিযুক্ত করতে হতো। পরিণামে ঐ ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বিদ্রোহ করেছে এবং ইসলামী সালতানাতানের ক্ষতি সাধনের জন্যে সর্বোপরি চেষ্টা করেছে।
যে সময় মুগীছে রূমী ও যায়েদ ইবনে কাসাদা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আপন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সে সময় তারেক ইবনে যিয়াদও টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। টলেডো যেহেতু রাজধানী ছিল এজন্যে জুলিয়ন ও আওপাস তারেকের সাথে ছিল। টলেডো শহর কেবল দরিয়ার পাড়েই ছিল না বরং দরিয়া দ্বারা তা বেষ্টিত ছিল। দরিয়ার কিনারাতেই একটি ঝিল ছিল যাতে দরিয়ার পানি এসে জমা হতো। এ ঝিলের পাড়েই মেরীনার সাথে আওপাসের সাক্ষাৎ হয়েছিল।
টলেডো শহর একদিকে তো সাগর বেষ্টিত অপর দিকে কেল্লা বন্দি এ শহর বেশ উঁচুতে ছিল। কেল্লা ও শহরের প্রাচীর খুব ভারী ও বড় মজবুত পাথর দ্বারা তৈরী করা, হয়েছিল। শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের আশে-পাশে ছিল গভীর ও প্রশস্ত পরিখা। যারাই সিংহাসনে বসেছে তারাই শহরের প্রতি রক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করেছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ ময়দানে-পাহাড়ে সামনা-সামনি লড়াই করেছেন। বার হাজার সৈন্য দ্বারা এক লাখ সৈন্য পরাস্ত করেছেন। কিন্তু কেল্লা কবজা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তার কৌশল-পদ্ধতিও আলাদা। তারপর টলেডোর মত শক্তিশালী ও মজবুত হলে তো কোন কথাই নেই। আল্লাহর ওপর ভসরা করে তারেক সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
টলেডোতে বাদশাহ রডারিকের মাতম চলছিল। কেবল শাহী মহল নয় বরং গোটা শহর বিষণ্ণতার চাদর ডেকে নিয়ে ছিল। রডারিকের এক লাখ ফৌজের কিছু পলায়নকৃত ফৌজ টলেডোতে পৌঁছেছিল এ ছাড়া অন্যান্য যুদ্ধ থেকেও পলায়ন পদ সৈন্যরাও সেখানে একত্রিত হয়েছিল। তারা সেখানে পৌঁছে মুসলমানদের ব্যাপারে মানুষের মাঝে এমন প্রচারণা চালিয়ে ছিল যে মুসলমানরা যেন এমন হিংস্র বাঘ সিংহ যে যাকে সামনে পায় তাকে মুহূর্তের মাঝে খতম করে দেয়।
রডারিক যখন ভূমধ্য সাগরের যুদ্ধের জন্যে স্বেচ্ছালোক সংগ্রহ করছিল তখনও টলেডোতে মুসলমানদের ব্যাপারে নানা ধরনের প্রচারনা চলছিল। যেমন একে অপরে বলাবলি করছিল,
“তারা মুসলমান বা অন্য যাই হোকনা কেন তারা মানুষ নয়। অন্য কোন মাখলুক।”
“তারা নেকড়ে বাঘ, অজগর, সম্মুখে যা পায় তা গ্রাস করে চলে যায়।”
“বাদশাহ্-রডারিকের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”
“তারা আমাদের বাদৃশাহকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে।”
“এটা তাদের অভ্যাস, তারা যাকে পরাজিত করে তার গোস্ত তারা ভক্ষণ করে।”
তারা এদিকে আসছে, লুটতরাজের কোন সীমা থাকবে না।” : এ ধরনের নানা প্রচারনা টলেডোর মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে চলছিল।
মানুষের ঘরে ধন-দৌলত, যুবতী ললনা ছিল কিন্তু কেউ তার কোন চিন্তা করছিল না সকলেই নিজের জীবনের চিন্তে করছিল। ধনী-গরীব সকলে নিজের জান বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।
তৎকালে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, বিজয়ীরা লুটতরাজ ও মানুষের ইজ্জত আব্র হরণ করতো। যার ফলে মানুষ পলায়ন করে চলে যেত। সুতরাং মুসলমানদের ব্যাপারে এসব-প্রচারণা মানুষের কাছে কোন আশ্চর্যজনক কিছু মনে হলো না। তাই টলেডো ছেড়ে জনসাধারণ পলায়ন করতে লাগল ফলে কিছু দিনের মাঝেই পুরো শহর জনশূন্য হলো। কেবল সেনা সদস্যরা রয়ে গেল, তারাও ছিল একেবারে ভীত-সন্ত্রস্ত।
ফৌজ ছাড়া শহরে আর যেসব লোকছিল তারা হলো ইহুদী ও গোথা সম্প্রদায়ের লোক। তারা মুসলমানদের পক্ষে ছিল। মুসলমানদের ব্যাপারে উদ্ভট প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এরাই মানুষের মাঝে বেশী ত্রাস সৃষ্টি করেছিল।
***
টলেডোতে বেশ অনেকগুলো গির্জা ছিল তার মাঝে একটা ছিল বড় গির্জা। গির্জাতে ছিল যাজিকা ও বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ। পূর্বেই বলা হয়েছে গির্জার পাদ্রীরা নিজেদেরকে খোদা প্রেরিত ফেরেশতা ও দুনিয়া ত্যাগী বলে দাবী করত, বস্তুত তারা ছিল ভোগবিলাসী, দুনিয়াদার ও প্রবৃত্তি-পূজারী। বাদশাহদের কাছ থেকে তারা জায়গীর নিয়েছিল। জায়গীরের অর্থ সম্পদ ছাড়াও গির্জার নামে তারা মানুষের কাছে পয়সা নিয়ে সম্পদের বিশাল ভান্ডার গড়ে তুলেছিল। সকল পাদ্রী বড় পাদ্রীর কাছে গিয়ে বলল, এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ সোনা-দানা, টাকা-পয়সা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়?
বড় পাদ্রী বলল, অবশ্যই কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার। এত পরিমাণ সম্পদ সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাথে যদি নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে নিজেদের লোকরাই তা লুট করে নিবে। সুতরাং তাবৎ ধন-সম্পদ, মনি-মুক্তা, টাকা-পয়সা একত্রিত করে আন্ডার গ্রাউন্ডে গর্ত করে সবকিছু মাটিতে পুঁতে রাখ।
রাতে সম্পদের বাক্স প্রধান গির্জার আন্ডার গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেল। আন্ডার গ্রাউন্ডে ফ্লোর খুঁড়ে তাবৎ খাজানা মাটি চাপা দিয়ে রাখা হলো। পাশে রয়ে গেল প্রায় ছয় ফুট লম্বা ও তিনফুট চওড়া একটা গর্ত। খননকারী ছিল তিনজন, তাদের কাজ প্রায় শেষের পথে এরি মাঝে বড় পাদ্রীর ইশারায় আরো তিনজন ব্যক্তি খোলা তলোয়ার হাতে সেখানে প্রবেশ করল।
বড় পাদ্রী খননকারীদেরকে নির্দেশ দিল গর্তের মাঝে যে অবশিষ্ট মাটি রয়েছে তা তুলে ফেল। নির্দেশ মুতাবেক তারা মাটি উঠানোর জন্যে ঝুঁকার সাথেসাথে তলোয়ার ধারীরা তিন খনন কারীর গর্দান উড়িয়ে দিল। তারপর খালী গর্তে তাদের লাশ রেখে মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হলো। বড় পাত্রী বলল, এখন এ তাবৎ সম্পদ পূর্ণ মাত্রায় নিরাপদ হয়ে গেল, আর কেউ ছিন্তাই বা নষ্ট করতে পারবে না।
তারপর প্রধান পাদ্রী আন্ডার গ্রাউন্ডের ঢাকনা ফেলে দিয়ে তার ওপর ফরশ বিছিয়ে একটা টেবিল রেখে দিল আর সে টেবিলের ওপর ক্রসবিদ্ধ অবস্থায় হযরত ঈসা (আ)-এর মূর্তি রেখেদিল।
প্রধান পাদ্রী বলল,এখন আমাদের এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। নতুন বিজয়ীরা আসুক। তারপর পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা ফিরে আসব। আমাদের সম্পদাদি হেফাজতে থাকবে। আর একটা কথা ভাল করে শুনে নাও, একজন যুবতী যাজিকাও যেন এখানে না থাকে তাহলে মুসলমানরা তাদেরকে দাসীতে পরিণত করবে।
***
সূর্য দেবী সবেমাত্র অস্তমিত হয়েছে। তারেক ইবনে যিয়াদ টলেডো থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরত্বে রয়েছেন। ফৌজ রয়েছে তাবুতে। তিনি জানেন না তার সাথী মুগীছে রূমী ও যায়েদ ইবনে কাসাদা কি অবস্থায় আছে।
টলোডা হতে বার/তের মাইল দূরে দু’শ আড়াই শ নারী-পুরুষ, শিশু কিশোরের আরেকটি কাফেলা অবস্থান করছে তবে সে কাফেলা কোন ফৌজের নয়। স্বয়ং প্রধান পাদ্রী সে কাফেলাতে আরো দু’চারজন পাদ্রীসহ রয়েছে। কাফেলা খোলা আসমানের নিচে গভীর ঘুমে অচেতন। তাদের সোয়ারী গুলো পাশেই বাঁধা রয়েছে।
রাত্রি দ্বিপ্রহর। কাফেলার অদূরে একটি গাছের ওঁতে আয়না মেরী নাম্নী এক যুবতী ললনা নিষপলক নেত্রে চেয়ে আছে কাফেলার দিকে। তের-চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে গির্জায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন তার বয়স বাইশ-তেইশ বছর। বাহ্যিকভাবে তো তাকে ধর্ম যাজিকা বানানো হয়ে ছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাকে, পাদ্রীরা বানিয়ে ছিল উপ-পত্নি। আর এরূপ পত্নী বানানকে পাদ্রীরা অধিকার বলে মনে করত।
নিদ্রিত কাফেলার কাছ থেকে একটি ছায়া মূর্তি ধীরে ধীরে আয়না মেরির কাছে গিয়ে পৌঁছল।
আয়না মেরী : সেই কখন থেকে তোমার প্রতিক্ষায় আছি। তুমি এভাবে খালি হাতে কেন এলে জিমি? ঘোড়া কোথায়? দ্রুত ঘোড়া নিয়ে এসো, এখান থেকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।
জিমি : কি হয়েছে সব কিছু খুলে বল মেরী! তুমি কেবল এ গাছের দিকে ইশারা করে রাত্রি দ্বিপ্রহরে দু’টো ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলে।
মেরী যে গির্জায় যাজিকা ছিল সেখানে নওকর ছিল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সুদর্শন যুবা জিমি। তার শয়ন স্থল গির্জার ভেতরেই ছিল। মেরী তাকে দেখা মাত্র তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সে গির্জাতে আরো চার-পাঁচ জন যাজিকা ছিল কিন্তু মেরীর বদকিসমত সে ছিল তাদের সকলের চেয়ে কম বয়সী ও সবচেয়ে সুন্দরী। মাঝ বয়সী পাদ্রীরা তাকে ভোগ্য বস্তু বানিয়ে রেখেছিল।
জিমির সাথে প্রথম সাক্ষাতে মেরী অনুভব করতে পেরেছিল যেমনিভাবে তার হৃদয় গভীরে জিমির প্রেম-ভালবাসা আসন গেড়ে বসেছে ঠিক তেমনিভাবে জিমিও তার জন্যে বেকারার হয়ে উঠেছে। প্রথম মুলাকাতেই মেরী তার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় খুলে দিয়েছিল। বলেছিল তার শত-সহস্র বেদনার কথা। সে বলেছিল তাকে তের চৌদ্দ বছর বয়সে কিভাবে জোর পূর্বক গির্জাতে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তাকে বুঝানো হয়েছিল খোদা তাকে তার বন্দেগীর জন্যে নির্বাচন করেছেন ফলে দুনিয়ার সাথে এখন তার তাবৎ সম্পর্ক চুকে গেছে।
প্রথম মুলাকাতেই মেরী কান্না মাখা গলায় জিমিকে বলেছিল,
“কিন্তু পাদ্রীরা আমার সাথে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ও যে আচরণ করেছে তাতে তারা আমাকে ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তুলেছে। ঈসা মসীকে একবার গুলিতে চড়ান হয়েছিল। আর আমি প্রতিদিন, প্রতিটি রাত্রে শুলিতে চড়ি। ঈসা মসীকে হাতে-পায়ে কিলক বিদ্ধ করা হয়েছিল। আর আমার হৃদয় অন্তরে কিলক মারা হয়। প্রতি রাত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে আমি ধুকে ধুকে মরি। আমি তো একজন পতির স্বপ্ন দেখতেছিলাম। আমি খোদার মহব্বত চাই না। আমি চাই এক ইনসানের ভালবাসা-মহব্বত। কিন্তু আমাকে কে ভালবাসবে? কে আমাকে তার হৃদয় গভীরে স্থান দেবে? আমি নিজেই আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ পাই, আমার নিজেকে ঘৃনা হয়। তুমিও কি আমাকে ঘৃণা করবে জিমি?
জিমিঃ তোমার শরীরের প্রতি আমার কোন মোহ নেই, নেই কোন কাংখা। আমার লক্ষ্য, আমার চাওয়া-পাওয়া কেবল মাত্র তোমার হৃদয়-মন।
যে মায়া-মমতা, প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক হৃদয়-মনের সাথে, শরীরের সাথে নয় জিমি প্রথম সাক্ষাতে মেরীকে সে ভালবাসা ও প্রেমের কথা বলেছিল। মেরি এতদিন আর কাংখায় ছিল কাতর তা সে পেয়েছিল। তারা দু’জন সেথা হতে পলায়নের অঙ্গিকার করেছিল। কিন্তু গীর্জা থেকে কোন যাজিকা পালিয়ে যাবে এটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। প্রতিটি গীর্জার যুবতীরা কয়েদীর মত বসবাস করত। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ এমন স্বতন্ত্রধর্মী ছিল যে কোন যাজিকা পালিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার জন্যে ছিল একেবারেই অসম্ভব। জিমির ঘরও ছিল দূরে। টলেডোতে তার এমন কেউ ছিল না যে, সেখানে মেরীকে লুকিয়ে রেখে পরে সময় মত পালিয়ে যাবে। তার পরও তারা প্রতিক্ষা করে ছিল পালিয়ে যাবার জন্যে।
ছ’ মাসে তাদের প্রেম-ভালবাসা এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে তাদের বিচ্ছেদের কথা চিন্তা করাই ছিল অবান্তর। তারা একে অপরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করাকে, মামুলী জ্ঞান করত। ২. তারপর টলেডোতে মুসলমানদের ভয়-ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। কিছু দিনের মাঝেই মানুষ শহর ছেড়ে চলে যেত লাগল।
একদিন জিমি মেরীকে বলল, মেরী! এখন সুযোগ এসেছে, শহরের দরজা সর্বদা খোলা। মানুষ দলে দলে পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমরাও আমাদের পোষাক বদলিয়ে পালিয়ে যেতে পারি।
মেরী : এখন তারা আমার প্রতি আরো বেশী নজর রাখছে। আমি সামান্যতম একটু এদিক-সেদিক গেলে তারা পাগলের মত তালাশ করতে থাকে।
জিমিঃ প্রধান পাদ্রীর কামরাতে তোমার পরিবর্তে অন্য কোন যাজিকাকে পাঠিয়ে দাও।
মেরী : আমাকে ছাড়া সে অন্য কোন নারীর প্রতি ঘুরেও তাকায় না। আমাকে ছাড়া তার অবস্থা এমন হয়, যেমন তোমাকে ছাড়া আমার অবস্থা আর আমাকে ছাড়া তোমার অবস্থা হয়।
জিমি : তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তাকে হত্যা করতে পারি, তারপর দু’জন নিরাপদে শহর থেকে বেরিয়ে যাব।
মেরী : না জিমি! না, তুমি ধরা পড়ে যাবে। আমি নিজের জন্যে কোন চিন্তা করি না, আমিতো মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে চাই। তবে তোমার জন্যে আমার চিন্তে হয়।
আরো বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। জিমি বারবার কেবল পাদ্রীকে হত্যার কথা বলতো। স্পেনের রাজধানী টলেডোতেও কোন শাসনকর্তা ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে কেউ রাজ কার্য সম্পাদনও করছিল না।
সাত সকালে শহরের ফটক খুলে দেয়া হতো আর গভীর রজনী নাগাদ তা ঐভাবে উম্মুক্ত থাকতো।
টলেডোর এ অবস্থা সম্পর্কে তারেক ইবনে যিয়াদ অবগত ছিলেন না। জুলিয়ন ও আওপাস তাকে বলেছিল, টলেডোতে প্রবেশ করা বড়ই কঠিন হবে। রডারিকের উত্তসূরীরা জীবনবাজী রেখে শহর হিফাজতের জন্যে লড়ে যাবে ফলে অবরোধ বেশ লম্বা হবার সম্ভাবনা।
***
মেরী জিমিকে লক্ষ্য করে বলল, দিনের বেলা তোমাকে আমি সব কথা বলতে পারিনি। আমাদের পাদ্রী প্রধান গীর্জাতে ধন-সম্পদ লুকিয়ে এসেছে। সে আমাকে এত মুহব্বত করে যে তার পূর্ণ বিবরণ আমাকে সে দিয়েছে।
জিমি : সে সম্পদের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?
মেরী : সে সম্পদ্ধ আমাদের হস্তগত করতে হবে।
জিমি : তোমার দেমাগ ঠিক নেই। আমরা সম্পদ আরোহণ করে কি করব? সে সম্পদ বা কোথায় রাখব?
মেরী : তাবৎ সম্পদ আমরা উঠাব না; বরং আমাদের প্রয়োজন মত আরোহণ করব। শহরে আমাদের বাড়ীতে থাকব। আমাদের বাড়ী খালী পড়ে রয়েছে। বাড়ীর সবাই চলে গেছে।
জিমি : মুসলমানরা আসলে পরে কি করবে?
মেরী : আমরা মুসলমান হয়ে যাব। শুনেছি ইসলাম গ্রহণ করলে মুসলমানরা খুব ভাল ব্যবহার করে।
জিমি তো আর ফেরেশতা নয় যে তার সম্পদের লালসা ছিল না। তাছাড়া মেরীর প্রেম তো ছিলই তাই সে টলেডো প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রস্তুত হলো।
কাফেলা গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত। জিমি ধীর পদে তার ঘোড়ার কাছে গিয়ে তা নিয়ে ফিরে এলো মেরীর কাছে। তারপর মেরীকে সম্মুখে বসিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিল। কাফেলার কোন সদস্য বিন্দুমাত্র খবরও পেলনা যে এক অশ্ব দু’সোয়ারী নিয়ে তাদের ছেড়ে চলে গেল।
পূর্ব দিগন্তে আলোর ঝলক উঠতেই কাফেলা রওনা হবার জন্যে তৈরী হলো। মেরী ও জিমিকে না পেয়ে প্রধান পাদ্রী ঘোষণা করে দিল। “সে লাড়কী তার বিবি, বেটী কিছুই না, সে চলে গেছে তাতে এতো হৈ চৈ করার কি আছে; এ ধরনের আরো নানা কথা বলে অন্য পাদ্রীরা তামাশা করতে লাগল। তার পছন্দ হয়েছে চলে গেছে এতে ভাল হয়েছে, সফরে এত সুন্দর ললনা না থাকাই ভাল। আমাদের সাথে আরো মেয়ে আছে তারাও যদি পালিয়ে যায় তাহলে কোন অসুবিধা নেই বরং আরো ভাল। এসব কথা শুনে প্রধান পাদ্রী নিশ্চুপ হয়ে গেল। কাফেলা রওনা শুরু করল। তারা রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। রোমে ছিল তাবৎ গীর্জার মারকাজ ও পোপের হেড কোয়ার্টার।
সকাল হতে না হতেই মেরী ও জিমি টলেডোতে পৌঁছে গেল। তারা শহরের প্রধান ফটক খোলার অপেক্ষায় রইল। ফটক খোলার সাথে সাথে তারা শহরে প্রবেশ করল। মেরী জিমিকে নিয়ে তার নিজ আবাসস্থলে ফিরে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল ঘরের আসবাব পত্র সব ঠিক ঠাক পড়ে আছে যেন ঘরের মানুষ কিছুক্ষণের জন্যে বাহিরে গেছে এখনই ফিরে আসবে।
গভীর রজনী। দু’জন পায়দল হেঁটে চলল প্রধান গীর্জার দিকে। তাদের ধারণা ছিল গীর্জার গেইটে তালা লাগান থাকবে কিন্তু তারা গেইট উম্মুক্ত পেল। গীর্জার ভেতর নিবিড় অন্ধকার। এর চেয়ে আরো বেশী আঁধার হলেও জিমি-মেরী গীর্জায় প্রবেশ করতে পারবে, কারণ গীর্জার প্রতিটি আনাচে-কানাচ সম্পর্কে তারা পূর্ণ ওয়াকিফ।
মশাল, খঞ্জর ও কোদাল হাতে তারা আন্ডার গাউন্ডের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছে গেল। তারপর মশাল জ্বালিয়ে নিচে চলে গেল। মেরী বলল, দেখলে আমরা কত সহজে এখানে পৌঁছে গেলাম।
জিমি : এখানে যে বিপুল পরিমান মাল-সম্পদ রয়েছে তা সবতো আমরা উঠাতে পারব না।
মেরী : যতটুকু পারি ততটুকু নিয়ে যাব।
জিমি : এখানে আমি কিছুই রেখে যাব না। যা পারি তা নিয়ে তোমাদের ঘরে রেখে এসে পুনরায় আবার আসব। সমস্ত ধন-সম্পদ তোমাদের ঘরে পুঁতে রাখব। মুসলমানরা যদি আসে তাহলে আমরা বাহ্যত মুসলমান হয়ে যাব ফলে তারা আমাদের বাড়ীতে আক্রমণ করবে না। বাড়ীর অভ্যন্তরে আমরা ঈসায়ী ধর্ম পালন করব।
মেরী : ধর্মের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। কেউ মুসলমান হোক বা খ্রীস্টান তা আমার কাছে সমান সমান। তুমি খনন কাজ শুরুকর। খনন করার প্রয়োজন ছিল না। মাটি সরানোর প্রয়োজন ছিল। জিমি অতি দ্রুত মাটি সরাতে লাগল। এক স্কুপের মাটি প্রায় শেষ হয়ে গেছে অল্প কিছু বাকী। আরো কিছু মাটি সরাতেই জিমি লাফ দিয়ে পিছু হটে এলো, যেন ফনাদার সর্প বের হয়ে হঠাৎ তার ওপর হামলা করেছে।
মেরী : কি হলো, অমন করছ কেন?
জিমি : সামনে এসে তুমিও দেখ কেমন খাজানা।
মেরী : মশাল হাতে গর্তের কাছে গিয়েই চিৎকার মেরে উঠল। গর্তে তিনটি লাশ পড়ে আছে। লাশের সাথে কোন মাথা নেই, কেবল ধড় পড়ে আছে। মেরী কাঁপতে কাঁপতে জিমিকে জড়িয়ে ধরল।
জিমি : লাশের গায়ের রক্ত এখনো শুকোয়নি। মনে হচ্ছে যেন সবেমাত্র কেউ তাদেরকে হত্যা করে দাফন করে গেছে।
মেরী : তাদেরকে কতল করা হয়েছে কেন?
জিমি : এরা হয়তো খাজানার খবর জানত। তাই তারা খানাজা নিতে এসেছিল আর পাদ্রী মনে হয় কিছু পাহারাদার রেখে গেছে তারা এদেরকে হত্যা করে অথবা এরা বেশী সংখ্যক লোক এসেছিল এদের বাকী সাথীরা শরীক কমানোর জন্যে এদেরকে হত্যা করেছে।
মেরী : তাহলে তো খাজানা আর নেই।
জিমিঃ তুমি সরে যাও আমি আরেক স্তূপের মাটি সরিয়ে দেখছি। জিমি দ্বিতীয় স্তূপের মাটি সবে সরানো শুরু করেছে হঠাৎ এক ব্যক্তি তলোয়ার হাতে দৌড়ে এসে জিমির ওপর আক্রমণ করে বলতে লাগল, এ খাজানা আমার। এর কারণে আমি একাকী এখানে রয়ে গেছি।
তলোয়ারের আঘাতে জিমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হামলাকারী মেরীর প্রতি আক্রমণের জন্যে উদ্যত হতেই মেরী তার হাতের জ্বলন্ত মশাল তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। মশালের আগুনে তার চেহারা পুড়ে গেল। তলোয়ার হাত থেকে পড়ে গেল। সে বেহুঁশ হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
মেরী মশাল তুলে নিয়ে দ্বিতীয়বার আবার তার চেহারার ওপর ছুঁড়ে মারল। চেহারা আরো ঝলসে গেল। তারপর সে মাটিতে পড়ে গেলে মেরী তার খঞ্জর বের করে আক্রমণকারীর বুকে আঘাত হানল।
জিমি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে বলল, মেরী! দ্রুত এখান থেকে পালিয়ে যাও।
মেরী : না, তোমাকে এখানে রেখে আমি আদৌ যাব না। মেরী জিমির কাছে গিয়ে তার মাথা কোলে নিতেই জিমি নিঃশ্বেস ত্যাগ করে চিরতরে বিদায় নিলো। আক্রমণকারী আগেই মারা গেছে।
মশাল গালিচার ওপর পড়ে জ্বলছে। খাজানার স্তূপের উপর দুটো লাশ পড়ে আছে। তাদের শরীর হতে রক্ত বেয়ে পড়ছে।
মেরী ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। হঠাৎ তার মনে হলো আরো কেউ আসতে পারে। হয়তো গির্জাতেই কেউ আছে। সে মশাল ফেলে রেখেই আন্ডার গ্রাউন্ড হতে ওপরে উঠে এলো। নিচের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। নিকষ কালো আঁধার। সে যদি গীর্জা সম্পর্কে ওয়াকিফ না হত তাহলে কোন কিছুর সাথে ঠোকর খেয়ে পড়ে থাকত। গীর্জা হতে বেরিয়েই সে দৌড়াতে লাগল।
স্পেনের রাজধানীতে নিথর নিস্তব্ধ ভীতিকর রজনী। শহরের অধিকাংশ বাড়ী শূন্য পুরীতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা একজন যুবতী রমণীর জন্যে বড়ই ভয়ংকর। সে নিজেকে আরো সাহসী করে রওনা হয়ে এক সময় নিজ বাড়ীতে পৌঁছে গেল। বাড়ীতে পৌঁছে ঘরের ভেতর হতে দরজা বন্ধ করে দিল।
৭১২ খ্রীস্টাব্দের পড়ন্ত বিকেল। আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর ১৮ হাজার লস্কর নিয়ে স্পেনের দক্ষিণ সীমান্তে অবতরণ করলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের সাহায্যে স্পেনে পৌঁছননি। স্পেন বিজয় নায়ক তারেক ইবনে যিয়াদকে অবহিত করা হচ্ছিল। তারেকের বিজয় সংবাদ খলীফা ওয়ালীদের কাছে পৌঁছেছিল। স্বয়ং খলীফা তারেকের কাছে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তারেক ছিলেন মুসার আজাদকৃত গোলাম। তার আজাদকৃত গোলামকে স্পেন বিজেতা বলা হবে এটা হয়তো মুসা ইবনে নুসাইর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, সে সময় মুসা ইবনে নুসাইরের বয়স হয়েছিল আশি বছর। বুদ্ধির প্রখরতা কমে এসেছিল। তাই তার অধীনত ও মুশীরদের পরামর্শে তিনি সাধারনতঃ কাজ করতেন। এসব পরামর্শ দাতারাই তাকে বুঝিয়ে ছিল যে, স্পেনের মত বিশাল সাম্রাজ্যের বিজয় নেতা হিসেবে আপনার একজন সাধারণ কৃতদাসকে অভিহিত করা হবে এটা সমীচীন নয়। আপনার জন্যে অসম্মানও বটে। তাছাড়া তারেক ছিলেন অনারব বর্বর মুসলমান। আর মুসা ছিলেন আরব। আর অনারবদের প্রতি আরবদের হেয় দৃষ্টি সব সময় ছিল এবং এখনও আছে। তাই মুসা ইবনে নুসাইর হয়তো বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি। ফলে তিনি নিজে বিশাল সৈন্য সামন্ত নিয়ে রওনা হয়েছিলেন স্পেন পানে।
তারেক ইবনে যিয়াদ যেসব এলাকা জয় করে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছিলেন তার মাঝে দুটো প্রসিদ্ধ এলাকা মেদুনা-শেদুনা ও কারমুনা ছিল। মুসা ইবনে নুসাইরের গোয়েন্দারা তাকে খবর দিয়েছিল যে, তারেক ইবনে যিয়াদ দুই শহরে রাজকার্য। পরিচালনার জন্যে খ্রিস্টানদের নিয়োগ করেছেন। তারেকের এটাও কমতি ছিল যে, রাজকার্য পরিচালনার মত উপযুক্ত লোক তার ফৌজে ছিল না। মুসা ইবনে নুসাইর অবগত হলেন ঐ দুই শহরে খ্রিস্টানরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মুসা ইবনে নুসাইর হঠাৎ করে ঐ দুই শহরে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হাজির হয়ে শহর নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আরবী গভর্নর নিয়োগ করলেন। মুসা ইবনে নুসাইরের কৃতিত্ব তো এতটুকুই ছিল যে, দুটো শহরে হয়তো বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতেছিল তিনি তা নিভিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দামেস্কে খলীফার দরবারে খবর পাঠান হলো তিনি ঐ দু’শহর জয় করেছেন।
মুসা ইবনে নুসাইর যখন ইসাবেলা শহরের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি যুদ্ধের সম্মুখিন হলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ এসব ছোট খাটো শহর ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ তার কৌশল ছিল টলেড়ো হলো রাজধানী এমনিভাবে কর্ডোভা ও গ্রানাডা স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর এ তিনটা শহর হাতে এলে বাকীগুলো এমনিতেই এসে যাবে। তখন দুশমনরা মনোবল হারিয়ে ফেলে রনে ভঙ্গ দেবে। যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারেকের এটা বিরাট বড় বিচক্ষণতা ছিল।
মুসা ইবনে নুসাইর ধারনা করেছিলেন, অতি সহজেই তিনি ইসাবেলা হস্তগত করতে পারবেন কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন শহর অবরোধ করলেন তখন বুঝতে পারলেন তার ধারণা ঠিক নয় এবং এত সহজে শহর কজা করা যাবে না।
শহরবাসী প্রতিরোধের ব্যবস্থা এরূপ করল যে, সকাল বেলা হঠাৎ করে শহরের ফটক খুলে যেত আর ঘোড় সোয়াররা বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মত এসে মুসলমানদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে শহরে ফিরে যেত। তারা কখন কোন দিন আসবে তা কিছুই জানা যেত না।
মুসা ইবনে নুসাইর এ অবস্থা মুকাবালার অনেক কোশেশ করলেন, কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পেলেন না, অবরোধ দীর্ঘায়ীত হতে লাগল। মুসা অভিজ্ঞ সালার ছিলেন, তিনি নিজে যুদ্ধের ময়দানে মামুলী ফৌজের মত লড়াই করেছেন কিন্তু এখন তিনি উপনীত হয়েছেন বার্ধক্যে, আগের মত তকত আর নেই।
ঈসায়ী ফৌজ হররোজ তার ফৌজের লোকসান করতে লাগল, তিনি খুঁজে পেলেন না কি করবেন। পরিশেষে তার দু’ ছেলে আব্দুল্লাহ্ ও মারওয়ান বীরত্ব প্রদর্শন করলেন। তারা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন, ঈসায়ী ফৌজ যখন বাহিরে এসে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে তখন তারা দু’জন তাদের ঘোড় সোয়ার দ্রুত হাঁকিয়ে একদম প্রাচীরের কাছে গিয়ে দুশমনের পিছনে অবস্থান করে তাদের শহরে ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিল তারপর তাদের ওপর পশ্চাৎ-সম্মুখ হতে. আক্রমণ করে হালাক করা হলো। এভাবে কয়েকবার করে ঈসায়ী ফৌজের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হলে, তাদের ফৌজ সংখ্যা কমে গেল। পরিশেষে দেড় মাস পর কেল্লা বিজয় হলো।
তারেক ইবনে যিয়াদ টলেডোর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি এখন যে পরিমাণ চিন্তিত এত চিন্তিত ইতিপূর্বে আর কখনও হননি। টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাকে পেরেশান করে তুলেছিল। প্রয়োজনে কয়েকবার মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে সৈন্য সামন্তের আবেদন করার পর তিনি তা পাঠান নি। এ দুঃখের কথা কয়েকবার তিনি তার সাথীদের কাছে প্রকাশ করেছেন। তার সৌভাগ্য কয়েক হাজার বর্বর মুসলমান স্বেচ্ছায় তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। তানাহলে এত কম সংখ্যাক ফৌজ দিয়ে তিনি এত বড় সফলতার্জন করতে পারতেন না।
টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতি মজবুত তা তারেক ইবনে যিয়াদ জানতে পেরেছিলেন কিন্তু টলেডোর আভ্যন্তরীণ অবস্থা কি সে ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন না।
বাদশাহী তখত খালী। সে তখতে কে বসবে তা নিয়ে টলেডোর শাহী মহলে চলছে জোর হাঙ্গামা রডারিকের যেসব সন্তান ছিল তাদের মাঝে কেবল রজমান্ড নামে একজন ছেলে ছিল তার বৈধ সন্তান। তার বয়স ছিল আঠার-উনিশ বছর। নিয়মানুপাতে সেই ছিল তখত আসীন হবার অধিকারী কিন্তু এ বয়সেই সে এত বিলাস প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাবার সালতানাতের প্রতি তাকে বারবার মনোযোগী, করে তোলার চেষ্টা করেও কোন কাজ হয়নি। সে ছিল শিকারী প্রেমী আর কোন সুন্দরী যুবতী দেখলেই তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসতো আবার কিছুদিন পর তাকে বাদ দিয়ে আরেক জন নিয়ে আসতো।
রডারিক ছিল স্পেনের শাহেন শাহ। তার যখন যা ইচ্ছে তাই সে করত। স্পেনই নয় আশে-পাশের দেশ থেকে সে সুন্দরী রমণীদের কে তার হেরেমে এনে রাখত। কিছুদিন পর তাদেরকে বিদায় করে দিয়ে নতুনদের আয়োজন হতো। তার বৈধ স্ত্রী ছিল একজন,এ ছাড়া আরো দু’জনকে সে হেরেমে স্থায়ীত্ব দান করেছিল এবং তাদের সাথে সে বৈধ স্ত্রীর আচরণ করতো। এ সকল রমণীদের ছেলে সন্তান ও হয়েছিল। তারা সকলেই ছিল অবৈধ। রডারিকের মৃত্যুর পর এ সকল মহিলারাও উঠে পড়ে লাগল তাদের সন্তানদেরকে রডারিকের স্থলাভিষিক্ত করার জন্যে। কিন্তু রডারিকের বৈধ সন্তান রজমান্ডের বর্তমানে অন্য কেউ শাহী আসনে আসীন হতে পারছিল না।
টলেডোতে ফৌজের জেনারেল ইউগোবেলজী ছিল। সে ছিল রডারিকের ডান হাত-বাম হাত। সে সব সময় টলেডোতেই শাহী মহলে থাকত। আসলে সে ছিল রানীর প্রিয়জন। যার ফলে সে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল।
রডারিকের বেটা রজমান্ড ঐ সকল যুবতীদেরকে তার শয্যাসঙ্গী বানাত যারা; রডারিকের উপ-পত্নির গর্ভজাত ছিল আর রডারিক ছিল তাদের পিতা। তাদের মাঝে লিজা নামে এক যুবতীও ছিল। বয়স ছিল বিশ-পঁচিশ বছর। তার এক ভাই ছিল। মহলে তার বেশ ভাল প্রভাবও ছিল।
ইউগোবেলজীও ছিল রডারিকের মত বিলাস প্রিয়। রডারিকের পরে সে হয়ে ছিল মহলে অঘোষিত সম্রাট। সে লিজার প্রেমে পড়ে লিজাকে কাছে পাবার জন্যে পাগল পারা হয়ে উঠে। কিন্তু লিজা তাকে এড়িয়ে চলছিল। পরিশেষে জেনারেল তাকে শাদীর প্রস্তাব দিল তবুও সে তাতে