লোকটার অবস্থা চিন্তা করে বেশ দুঃখই হলো রানার। কে ভাবতে পারবে, এমন একটা ডাকসেটে পুলিস অফিসারের অপরাধী ধরে ধরে জেলে। পোরা ছাড়া আরও কোন ব্যক্তিগত গোপন দুঃখ বা সমস্যা থাকতে পারে? বিশেষ করে এই ধরনের সমস্যা। সহানুভূতি বা সান্তনা ওর তেমন ভাল আসে না, তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল, এই যে নেশা–কবে এর খপ্পরে পড়ল?
আল্লাই মালুম। বহু বছর আগে। আমার ভাই যখন টের পেল তারও, বেশ কয়েক বছর আগে।
কয়েকটা দাগ দেখলাম নতুন?
উইথড্রয়াল ট্রিটমেন্ট চলছে ওর। ঝট করে বন্ধ করে দিলে মারাই যাবে। বেচারী। কিন্তু আসল সমস্যা সেটা নয়–প্রায়ই কারা যেন ওকে ফুল-ডোজ দিয়ে যায় গোপনে। বাজপাখির মত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে ওর ওপর মারগ্রিয়েট। রোজ সকালে ভন্ডেল পার্কে নিয়ে যায়-ওখানে পাখিদের বুট খাওয়াতে খুব ভালবাসে ইরিন। দুপুরে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে আমি প্রায়ই থাকি না, মারগ্রিয়েটও হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেই ফাঁকে কাজ হাসিল করে চলে যায়। ওরা।
ওকে ওয়াচ করবার ব্যবস্থা করেননি?
বহুবার। কিভাবে ওর কাছে সাপ্লাই পৌঁছায় কেউ ধরতে পারেনি।
আপনাকে বাগে আনবার জন্যে ওর ওপর ওষুধ প্রয়োগ করছে ওরা?
এছাড়া আর কি হতে পারে? আমার ওপুর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। টাকা দিয়ে কেনে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত; টাকা নেই ইরিনের। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই হেরোইন সাপ্লাই দিচ্ছে ওরা ইরিনকে। ওরা জানে না, চোখের সামনে মরে যেতে দেখব ইরিনকে, তব কম্প্রোমাইজ করব না আমি কিছুতেই। যত ভাবে যত চেষ্টাই করুক, নোয়াতে পারবে না ওরা আমার। মাথা। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করছে না তাই বলে।
চব্বিশ ঘণ্টা গার্ডের ব্যবস্থা করা যায় না?
সেটা করতে গেলে খাতিরে হবে না, ব্যাপারটাকে অফিশিয়াল করতে। হবে। এই ধরনের অফিশিয়াল অনুরোধ হেলথ অথোরিটির কানে যেতে বাধ্য। তারপর?
মাথা ঝাঁকাল রানা। পাগলা গারদে পুরে দেয়া হবে ওকে। কোনদিন। ফিরে আসবে না আর।
কোনদিন না। চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল মাগেনথেলারের। মাথা নাড়ল সে এপাশ-ওপাশ।
আর কি বলা যায় বুঝতে না পেরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল রানা ড্রইংরূম থেকে।
.
০৬.
সারাটা দুপুর হোটেল কামরায় বসে কর্নেলের দেয়া ক্রস-ইনডেক্স করা ফাইল ঘটল রানা। ফাইলে গত তিনটে বছর অ্যামস্টার্ডামে ডাগ সংক্রান্ত যত রকমের যত কেস হয়েছে তার বিবরণ সাজানো আছে। প্রত্যেকটাই। দুঃখেরকোনটা মৃত্যু, কোনটা আত্মহত্যা, কোনটা বা পারিবারিক ভাঙন আর সাংসারিক অশান্তির কাহিনী।
নানান ভাবে চোখ বুলাল রানা ওগুলোর ওপর, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্রস ইনডেক্সগুলোকে নানান ভাবে সাজাবার চেষ্টা করল; কিন্তু সবই বৃথা। কোন প্যাটার্ন পাওয়া গেল না। ঘণ্টা দুয়েক ফাইলটা নাড়াচাড়া করে প্রবোধ দিল। সে নিজের মনকে কর্নেল ডি গোল্ড আর ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের মত ঘুঘু অফিসার যদি এসব ধৈর্যের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা করে কোন প্যাটার্ন। বের না করতে পেরে থাকে, তাহলে সে কোন ছার? ফাইল ঘাটা কোনদিনই ভাল লাগে না ওর, কাজেই এসব ঘেটে আশ্চর্য কিছু আবিষ্কারের আশা করা বৃথা। নেহায়েত বোকামি। কোন লাভ হবে না ধরে নিয়ে ফাইল বন্ধ করে। ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠল সে শেষ বিকেলে।
ঘুম থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠে স্নান সেরে নিল সে গরম পানিতে। ঘন ছাই রঙের একটা স্যুট গায়ে চড়িয়ে নেমে এল নিচে। রিসিপশন ডেস্কে চাবিটা। বাড়িয়ে দিতেই হাসিমুখে এগিয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আজকের হাসিতে আগেকার সেই অতি স্মার্টনেস দেখা গেল না, রীতিমত একটা সমীহ ভাব টের পেল রানা ওর ব্যবহারে। বুঝল, রানাকে হালকাভাবে গ্রহণ করতে বারণ করা হয়েছে ওকে।
গুড ইভনিং, গুড ইভনিং, মিস্টার রানা। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করল সে। কাল হয়তো একটু খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছিলাম কিন্তু সেই সময়…
আরে না, না। ও কিছু না। ভদ্রতার দিক থেকে রানাই বা কম যাবে। কেন? কিছু মনে করিনি আমি। ওই রকম একটা অবস্থায় কার সাথে কে কি ব্যবহার করছে সেসব দেখলে কি চলে? দেখাই যাচ্ছিল, খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন আপনি সেটাই স্বাভাবিক। কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে চাইল রানা। ট্যুরিস্ট গাইডে কিন্তু এই বৃষ্টির উল্লেখ নেই মোটেই।
যেন কথাটার মধ্যে মস্ত কিছু রসিকতা রয়েছে এমনি ভাবে হেসে উঠল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যেন হাজার টুরিস্টের মুখে হাজার বার শোনেনি। সে-রানার মুখেই প্রথম শুনছে এই রকম একটা কথা। তারপর জিজ্ঞেস করল, বেরোচ্ছেন বুঝি?
হ্যাঁ। য্যানডামের দিকে চলোম। যা মাথায় এল যা খুশি একটা নাম বলে দিল রানা।
য্যানডাম? হুঁ, য্যানডাম! বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অপেরায়?
ঠিক ধরেছেন, বলেই বেরিয়ে পড়ল রানা সদর দরজা দিয়ে। ডোরম্যানকে ইঙ্গিত করতেই পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে একটা ট্যাক্সি এসে হাজির। হয়ে গেল গেটের কাছে। উঠে বসল রানা পেছনের সীটে, ডোরম্যানকে শুনিয়ে ড্রাইভারকে বলল, শিফল এয়ারপোর্ট।
রওনা হলো ট্যাক্সি। রানা লক্ষ করল, আরেকটা ট্যাক্সিও রওনা হলো। পিছন পিছন। সামনের ট্রাফিক লাইটে গাড়িটা থামতে পেছন ফিরে ভাল করে। দেখে নিল রানা হলুদ স্ট্রাইপ আঁকা মার্সিডিজ ট্যাক্সিটা–আরোহী নেই, ড্রাইভার একা। ট্রাফিক লাইট সবুজ হতেই ভিযেলস্ট্রাট ধরে এগোল ট্যাক্সি, পিছনেরটাও চলল সেই একই দিকে।