ঘূর্ণিঝড়ের মতোই নিমেষে উধাও হয়ে গেল ক্ষণিকের অতিথি। স্তম্ভিত করে গেল ঘরশুদ্ধ সবাইকে। তারপরেই অবশ্য উচ্চনিনাদী সোরগোলে ফেটে পড়ল ছোট কামরা-খানা। দপ দপ করে জ্বলে উঠল সব কটা মোমবাতি। আমি যখন নিঃসীম আতঙ্কে জবুথবু হয়ে বসে ওরা তখন তল্লাসি চালিয়ে যাচ্ছে আমার কোটের বা আস্তিনের ভেতরের আস্তরে। সেখানকার চোরা পকেট থেকে বের করে ফেলেছে নকল তাস। আলোয়ানের ফুলের কারুকাজের গায়ে গায়ে লুকানো খুপরিগুলো থেকেও বেরিয়েছে জুয়াচোরের জন্য বিশেষ ধরনের তৈরি সব কটা তাস।
নিঃশব্দ সেই ধিক্কারের চাইতে বুঝি গালিগালাজ অনেক সহনীয় ছিল।
হেঁট হয়ে নিজের পায়ের কাছ থেকে অত্যন্ত মূল্যবান পশুর লোমের আলখাল্লাটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন গৃহস্বামী মিস্টার প্রেসটন মি. উইলসন, আপনার এই সম্পত্তিটাও নিয়ে যান– জানি না এর ভেতরে আরও কটা খুপরি বানিয়ে রেখেছেন। দয়া করে আপনি অক্সফোর্ড ত্যাগ করবেন কালকেই, এবং তার আগে, এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন এই ঘর থেকে।
কাঁটছাঁট কথায় এই ভাবে গলাধাক্কা দেওয়ার জবাবটা আমি মুখের ওপরেই ছুঁড়ে দিতাম, যদি না আর একটা অতি অদ্ভুত ব্যাপার আমার নজরে আসত। মিস্টার প্রেসটন যে-আলখাল্লাটা কুড়িয়ে নিয়েছেন ওঁর পায়ের কাছ থেকে, ঠিক ওরকম একটা আলখাল্লা তো আমার হাতেই রয়েছে। হুবহু এক! আমি যে অত্যন্ত খরুচে আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের, তা নিশ্চয় এই কাহিনী পড়ে বোঝা যাচ্ছে। আমার মগজখানাও তত উর্বর কল্পনা আর বিচিত্র খামখেয়ালিপনার একটা মস্ত কারখানা। অতিশয় দুপ্রাপ্য পশুর লোম থেকে তৈরি আশ্চর্য ডিজাইনের এই আলখাল্লা তৈরি হয়েছিল শুধু আমারই ফরমাশ অনুযায়ী। বলাবাহুল্য এ-জিনিসের কপি আর কোথাও থাকতে পারে না। অথচ রাতের আগন্তুক যেখানে এসে দাঁড়িয়ে বচনসুধা শুনিয়ে গেল –ঠিক সেইখান থেকেই অবিকল সেইরকম একটা আলখাল্লা। তুলে বাড়িয়ে ধরেছেন মিঃ প্রেসটন।
পরপর এতগুলো হাড়-হিম করা কান্ড ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও উপস্থিত বুদ্ধি হারাইনি আমি। ঘরের কাউকে দেখতেও দিলাম না যে ঠিক ওইরকম আলখাল্লা ইতিপূর্বেই অন্যমনস্কভাবে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছি আমি। নীরবে দু-নম্বর আলখাল্লাটা মিঃ প্রেসটনের হাত থেকে টেনে নিয়ে চাপা দিলাম আমার নিজের আলখাল্লাটাকে এবং মুচকি হেসে বেপরোয়া ভঙ্গিমায় গটগট করে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। পরের দিনই ভোরের আলো ফোটবার আগেই অক্সফোর্ড ত্যাগ করলাম চিরতরে এবং বেরিয়ে পড়লাম মহাদেশ সফরে।
পালালাম কিন্তু বৃথাই। বিভীষিকার উল্কি-আঁকা আমার হৃদয় সেইদিন থেকে ভয়-তরাসে হয়ে থেকেছে প্রতিটি পল-অনুপল-বিপল। যেখানেই গেছি, সেখানেই ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি রূপে হাজির হয়েছে এই উইলিয়াম উইলসন। প্রতিবারেই নাক গলিয়েছে আমার ব্যাপারে –নাটকীয়ভাবে বানচাল করে দিয়েছে আমার সমস্ত পরিকল্পনা। রহস্যময় এই সত্তা আমারই প্রতিচ্ছায়া হয়ে ঘুরছে আমার পেছন পেছন এবং কাজ হাসিলের ঠিক মুহূর্তটিতে উল্কাবেগে উপস্থিত হয়ে চুনকালি দিয়ে গেছে আমার মুখে। আমার অপকর্ম নিয়ে যত মাথাব্যথা যেন শুধু ওরই। প্যারিসে পা দিতে না দিতেই হাড় জ্বালিয়েছে।
একটার পর একটা বছর গেছে, কিন্তু নিদারুণ বিরক্তিজনক উইলিয়াম উইলসন নিস্কৃতি দেয়নি আমাকে। সীমা পরিসীমা নেই তার শয়তানির, তার নিরন্তর ধূর্ততার। পালিয়ে গেছি রোমে– সেখানেও সে রেহাই দেয়নি আমাকে। কুটিল ইচ্ছাপূরণের ঠিক মুহূর্তটিতে বিনা নোটিসে আচমকা আবির্ভূত হয়ে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে আমার পরিকল্পনা! জাল পেতেছি বার্লিনে–ছিঁড়ে খুঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছে শয়তান শিরোমণি এই উইলিয়াম উইলসন।
ঠিক একই ভাবে আমার সাজানো খুঁটি বাঁচিয়ে দিয়েছে মস্কোতে। এ হেন পিশাচকে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ থেকে ঘৃণা করেছি, ভয়ও পেয়েছি। জঘন্য পোকামাকড়কেও মানুষ বুঝি এত ঘেন্না এত ভয় করে না। কখন কোন্ মুহূর্তে করাল সেই অপচ্ছায়া দেখা দেবে এই ভয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে পালিয়েছি কিন্তু বৃথা-বৃথা-বৃথা! সে আমার পেছন ছাড়েনি!
মনকে শুধিয়েছি বহুবার কে এই উইলিয়াম উইলসন? কোথায় তার প্রকৃত নিবাস? কি উদ্দেশ্য নিয়ে মুহূর্মুহূ হানা দিয়ে যাচ্ছে আমার প্রতিটি কুকর্মে? কোনো জবাবই পাইনি। খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছি আমার ওপর তার খবরদারির অভিনব পদ্ধতিগুলোকে। লক্ষ্য করেছি যখনই আমি ভয়ানক ভাবে ফেঁসে যাওয়ার মতো খারাপ কাজ করে চলছি ঠিক তখনই সে না বাগড়া দিলে কিন্তু কুখ্যাতির অতলে তলিয়ে যেতাম নির্ঘাৎ।
এটাও লক্ষ্য করেছি– খুব ভালভাবেই লক্ষ্য করেছি– হুবহু আমার মতনই জামাকাপড় পড়ে এলেও কোনোবারেই সে আমাকে তার মুখ দেখায়নি। হতে পারে, আলো পড়েনি তার মুখে। কিন্তু প্রতিবারেই কী কৌশলে তার মুখাবয়ব ঢেকে রেখে দিয়েছিল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে সেটাও তো একটা অতলান্ত প্রহেলিকা। :
ইটনে তর্জনী তুলে শাসিয়ে গেছে কিন্তু মুখ দেখায়নি; অক্সফোর্ডে আমার মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেছে সেখানেও তার অতর্কিত আর্বিভাবের পূর্ব মুহূর্তে নিভে গেছে সব কটা মোমবাতি যেন এক দানবিক ফুকারে; রোমে সে যেন স্বয়ং বস্ত্র হয়ে নেমে এসে ধ্বংস করে গেছে আমার উচ্চকাঙ্ক্ষা, প্যারিসে নিতে দেয়নি প্রতিশোধ, নেপলসে ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমার কপট প্রেমের খেলা, মিশরে টেনে ধরেছে আমার লালসার লাগাম। কিন্তু কোনোবারেই সে তাকে চেনবার সুযোগ দেয়নি। এত বড় ধুরন্ধর প্রতিভাটা যে আমার স্কুল জীবনের পরম প্রতিদ্বন্দ্বী উইলিয়াম উইলসন স্বয়ং একবারও সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার ক্ষীণতম সুযোগও সে আমাকে দেয়নি।