ফ্যাকাসে, কোঁচকানো আঙুলের ফাঁক দিয়ে উন্মাদিনীর দৃষ্টিতে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে, শিরশির করে উঠল গা। পাগল মানুষ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির হয়। কেউ এদের করুণা করে, কেউ ভয় পায়। আমি বিড়বিড় করে বললাম, আ-আমি যাই।
উত্তপ্ত ফুটপাত দিয়ে দ্রুত পা চালালাম। কিন্তু পা জোড়া ভয়ানক ভারি আর অসাড় মনে হলো, যেন দুঃস্বপ্নের মাঝ দিয়ে হাঁটছি। সূর্য প্রচন্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে মাথার উপরে। কিন্তু টের পাচ্ছি না যেন। সময় এবং স্থান জ্ঞান হারিয়ে ছুটছি আমি।
হঠাৎ একটা শব্দ কানে যেতে রক্ত হিম হয়ে এল আমার। ঘড়িতে দেখলাম তিনটা বাজে। তিনটার সময় আমার স্কুল গেটে থাকার কথা, ক্রিস্টিনের জন্য। আমি এখন কোথায়? এখান থেকে স্কুল কত দূরে? রাস্তায় কোন বাস বা ট্যাক্সিও নেই। বাস কোথায় পাব? পথচারীদের পাগলের মত এসব প্রশ্ন করতে লাগলাম। তারা আমার দিকে ভীত চোখে দেখছে, যেন ওই বুড়ির মত চেহারা আমার। ওরা নিশ্চয় আমাকে পাগল ঠাউরেছে। অবশেষে সঠিক বাসটি পেয়ে গেলাম।
ধুলো আর গরমে অস্থির আমি বুকে দারুণ ভয় নিয়ে অবশেষে স্কুলে। পৌঁছালাম। এক দৌড়ে পার হলাম খেলার মাঠ। ক্লাসরুমে সাদা স্কার্ট পরা সেই তরুণী শিক্ষিকা বইপত্র গোছাচ্ছে।
ক্রিস্টিন জেমসকে নিতে এসেছি। আমি ওর মা। দুঃখিত, দেরি হয়ে গেছে। কোথায়?
ক্রিস্টিন জেমস? –কোঁচকাল তরুণী, তারপর কলকল করে বলল, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। লাল চুলের ছোট্ট, সুন্দর মেয়েটি। ওর ভাই এসেছিল ওকে নিতে, মিসেস জেমস। দুজনের চেহারায় অদ্ভুত মিল দেখলাম। তবে বোনকে সে যে খুব ভালবাসে তা তার আচরণ দেখেই বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা আপনার স্বামীরও কি তার বাচ্চাদের মতো লাল চুল?
ওর ভাই- কী বলল? অস্পষ্ট গলায় জানতে চাইলাম।
কিছুই বলেনি। প্রশ্ন করলেও শুধু হেসেছে। এতক্ষণে ওরা বোধহয় বাড়ি পৌঁছে গেছে। আপনি ঠিক আছেন তো?
হ্যাঁ। ধন্যবাদ। আমি গেলাম।
পা পুড়ে যাওয়া উত্তপ্ত রাস্তার পুরোটাই দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম আমি।
ক্রিস্টিন! কোথায় তুমি? ক্রিস! ক্রিস্টিন! মাঝে মাঝে এখনও শুনতে পাই আমার সেই আর্তনাদ ঠাণ্ডা বাড়িটির দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে। ক্রিস্টিন! ক্রিস্টিন! কোথায় তুমি? জবাব দাও! ক্রিস্টিন! তারপর, হ্যারি! ওকে নিয়ে যেয়ো না! ফিরে এসো! হ্যারি! হ্যারি!
উন্মত্তের মতো বাগানে ছুটলাম আমি। প্রখর রোদ ধারাল ফলার মতো আঘাত হানল। ধবধবে সাদা গোলাপগুলো ভীষণভাবে জ্বলজ্বল করছে। স্থির বাতাস। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমি বুঝি ক্রিস্টিনের খুব কাছে চলে এসেছি। যদিও ওকে দেখতে পেলাম না। তারপর আমার চোখের সামনে নাচতে শুরু করল গোলাপগুলো, রঙ বদলে হয়ে উঠল লাল। রক্ত লাল। বৃষ্টিস্নাত লাল। মনে হলো আমি লালের মাঝ দিয়ে কালোর মাঝে ঢুকে পড়েছি, তারপর শুধুই শূন্যতা–প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি।
.
মারাত্মক হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি। বেশ কয়েক দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হলো আমাকে। ওই সময় জিম আর পুলিশ মিলে বেহুদাই খুঁজেছে ক্রিস্টিনকে। ব্যর্থ এ প্রচেষ্টা চলল মাস কয়েক ধরে। মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যাবার ঘটনা নিয়ে স্থানীয় খবরের কাগজে নানান গল্প ছাপা হলো। তারপর এক সময় থিতু হয়ে এল উত্তেজনা। পুলিশ ফাইলে আরেকটি অমীমাংসিত রহস্য জমা হলো।
শুধু দুজন মানুষের জানা থাকল আসল ঘটনা। পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে বাস করা এক পাগলি বুড়ি আর আমি। বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আজও ভয়টা গেঁথে আছে আমার মনে।
ছোট্ট ছোট্ট জিনিস আমাকে ভীত করে তোলে। রোদ। ঘাসের ওপর গাঢ় ছায়া। সাদা গোলাপ। কোঁকড়ানো লাল চুলের শিশু। আর একটা নাম হ্যারি। কত সাধারণ একটা নাম!
–রোজমেরি টিম্পারলি