কিন্তু এসব তো অলীক কল্পনা৷ ইম্যাজিনারি৷ মোহনলালের ভাষায় ‘রুট ওভার মাইনাস ওয়ান’৷
‘পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান হল, আপনার ওয়াইফ রীতিমতো সুন্দরী, ইয়ং—তার ওপর ওঁর যৌবন দারুণ ভাইটাল—মানে, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স…৷’
মোহনলালের কথাগুলো একটু মোটা দাগের শোনালেও তথ্যগুলো সত্যি৷ তবে স্বর্ণমালা ফ্রিজিড—মানে, কামশীতল—ছিল৷ এই তথ্যটা মোহনলাল পাল জানেন না৷ শুধু উনি কেন, আমি ছাড়া আর কেউই জানে না৷ কিন্তু ফ্রিজিড বলে স্বর্ণাকে আমি কিছু কম ভালোবাসতাম না৷ ওকে আমি এখনও প্রতি মুহূর্তে মিস করি৷ স্বর্ণা! আই লাভ ইউ!
‘বিয়ের পর পাঁচটা বছর কাটতে না কাটতেই আপনার ওয়াইফ এরকমভাবে ব্রুটালি মার্ডার হয়ে গেলেন৷ খুব স্যাড৷
‘আচ্ছা, শুরু থেকেই ব্যাপারটা রিকনস্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করা যাক…৷’
আবার! আমি ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিলাম৷ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের খাঁচা থেকে৷ কতবার যে পুলিশকে এসব কথা বলেছি৷ মোহনলালও বোধহয় কম করে সাড়ে চোদ্দোবার আমার বক্তব্য শুনেছেন৷ কিন্তু উপায় নেই৷ ওঁদের তদন্তের স্বার্থে পুরোনো রেকর্ড বাজাতে হবে৷ তা ছাড়া মোহনলাল তো খোলাখুলি বলেই দিয়েছেন, আমাকে তিনি নাইনটি ফোর পয়েন্ট থ্রি পারসেন্ট সন্দেহ করেন৷ পরিসংখ্যান সে-কথাই বলছে৷ নাকি এই একমাসে শতকরা হিসেবের সংখ্যাটা আরও বেড়ে গেছে?
পেটে কয়েকবার হাত বোলালেন ডিটেকটিভ৷ তারপর বডিটাকে কাত করে যথেষ্ট কসরত করে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডায়েরি আর বলপয়েন্ট পেন বের করলেন৷ ভুরু কুঁচকে ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগলেন৷ পাতা ওলটানোর সুবিধের জন্যে তিনি বারবার জিভে আঙুল ঠেকাচ্ছিলেন৷
ওঁর পুরু কালচে ঠোঁট, দাঁত হলদেটে৷ তার ওপরে এই জঘন্য হ্যাবিট—আমার গা ঘিনঘিন করছিল৷
‘আপনার ওয়াইফের ফোনটা যখন আপনি রিসিভ করেন তখন টাইম কত ছিল?’ ডায়েরির পৃষ্ঠাতে চোখ রেখেই প্রশ্নটা করলেন৷
ঢিলে গলায় জবাব দিলাম, ‘দুটো বাজতে পাঁচ—৷’
‘কারেক্ট৷ আগে নানান সময়ে সাতবার আপনি এই একই টাইম বলেছেন…৷’
‘তা ছাড়া আপনারা তো আমার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ডসও চেক করেছেন—’ বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করলাম৷
কিন্তু মোহনলাল পাল আমার বিরক্তি গায়ে মাখলেন না৷ ডায়েরির পাতা ওলটাতে-ওলটাতেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘ইয়েস—তা চেক করেছি৷ আপনার ওয়াইফের মোবাইল ফোনটা তো থেঁতলে ভজহরি হয়ে গিয়েছিল—তাই সেটা চেক-টেক আর করা যায়নি৷ তবে সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে আমরা কল রেকর্ডস-এর রিপোর্ট নিয়েছি৷ সত্যিই স্বর্ণমালা ম্যাডাম আপনাকে সেসময় ফোন করেছিলেন৷ আপনি সত্যি কথাই বলছেন৷’ একটু চুপ করে থাকার পরঃ ‘তখন আপনি অফিসে কার চেম্বারে যেন ছিলেন?’
‘এইচ. আর. ম্যানেজার তুষার পারেখের চেম্বারে৷ ওকে জিগ্যেস করলেই ও আমার কথা করোবোরেট করবে৷ আসক হিম…৷’
হাসলেন মোহনলাল, বললেন, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ৷ সে তো জিগ্যেস করেইছি৷ উনি করোবোরেট করেছেন…৷’
‘তবে আবার আমাকে জিগ্যেস করছেন কেন?’
‘মিস্টার মজুমদার, বিরক্ত না হওয়াটা একটা আর্ট৷ আপনি বিরক্ত হলেও আমি বিরক্ত হতে পারি না৷ আমরা একই কথা বারবার জিগ্যেস করি৷ অ্যাকশন রিপ্লে, রিপ্লে, রিপ্লে, অ্যান্ড রিপ্লে৷ দেখবেন, এইসব রিপ্লের ফাঁকফোকর থেকে হঠাৎ-হঠাৎ পিকিউলিয়ার সব ক্লু বেরিয়ে আসে৷ কেঁচোর বদলে সাপ…৷’ শব্দ করে হাসলেন ডিটেকটিভ৷ তারপর আচমকা: ‘তুষার পারেখের চেম্বারে আপনি নিজে থেকে গিয়েছিলেন, নাকি উনি আপনাকে ডেকেছিলেন?’
এ-প্রশ্নটা নতুন৷ আগে শুনিনি৷
আমি একটু চিন্তা করে জবাব দিলাম, ‘আমি নিজে থেকে গিয়েছিলাম৷ একটা ইন্টারভিউ অ্যারেঞ্জ করার ব্যাপারে…৷’
ডায়েরিতে কী যেন লিখে নিলেন মোহনলাল৷ ওঁর মামুলি শার্ট থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছিল৷
ডায়েরির লেখার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়েছিলেন ডিটেকটিভ৷ সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আগেই তো আপনাকে বলেছি, আপনি আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট৷ আপনাকে সন্দেহ করাটাই আমাদের ব্রত৷ অন্তত থিয়োরি তাই বলছে৷ সুতরাং, আমাদের কাজ হল আপনাকে খুনি ঠাউরে মোটিভ খুঁজে বের করা, খুনটা আপনি কী করে করলেন সেটা গেস করা—তারপর তার সাপোর্টে প্রমাণ-টমান খুঁজে বের করা৷
‘ইয়ং স্বামী বা স্ত্রী খুন হলে আমরা প্রথমেই একটা লাভ ট্র্যাঙ্গেল-এর কথা ভাবি৷ মানে, ত্রিকোণ প্রেম৷ এইরকম প্রেমের একটা কোণ হচ্ছেন স্বর্ণমালা ম্যাডাম, সেকেন্ড কোণটা আপনি৷ আর আমি—মানে, পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে তিন নম্বর কোণটা৷ কোথায় সেই কোণ? কে সেই কোণ?
‘তো আপনার ওয়াইফের মার্ডার কেসটাকেও আমরা লাভ ট্র্যাঙ্গেল-এর অ্যাঙ্গেল থেকে ছানবিন করতে চাইছি…’ কাশলেন মোহনলাল৷ কাশিতে কফের ঘড়ঘড়ে শব্দ হল৷ তারপরঃ ‘তুষার পারেখের চেম্বারে আপনি তা হলে নিজে থেকে গিয়েছিলেন?’
‘বললাম তো, হ্যাঁ—৷’
‘হুঁ—৷’ ডায়েরির পাতা থেকে চোখ তুলে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকালেনঃ ‘এমনটা তো হতেও পারে রীতেশবাবু, আপনি জানতেন ওই স্পেশাল ফোনটা আসবে—তাই একজন উইটনেস রাখতে চেয়েছিলেন৷’
আমি হাঁ করে শজারুর গোঁফওয়ালা ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ লোকটা বলে কী! আমি আগে থেকে জানতাম, স্বর্ণমালা ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ টাইপের কিছু একটা বলে আমাকে ফোন করবে! তার মানে তো আমি আগে থেকেই জানতাম যে, স্বর্ণা খুন হবে!