সুতরাং নতুন ব্লক দুটো নিয়ে এবার মেতে উঠল বুয়ান৷ পরের দিনই তৈরি হয়ে গেল দুটো জিনিস: তৃণভোজী ডাইনোসর আর চাঁদ৷ মা আর বাপি আশেপাশে না থাকলেই নতুন ব্লক নিয়ে জুনোর সঙ্গে ওর গল্প চলতে লাগল৷
অ্যাপাটোসরাসটা মাপে ইঞ্চিসাতেক একটা মডেল হলেও দেখতে একেবারে জীবন্ত৷ ঠিক ওর টিরানোসরাস রেক্সের মতন৷
চাঁদটাও ঠিক যেন তাই৷ মাপে দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটবলের মতো হলেও দেখতে হুবহু আসল চাঁদের মতো৷ ক্ষতচিহ্নের মতো দেখতে উল্কাপাতের বড়-বড় গর্ত, সাদা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপরে কালো-কালো শিরা-উপশিরা—পরিভাষায় যাকে বলে ‘লুনার মারিয়া’৷ এ ছাড়া ‘ইমপ্যাক্ট বেসিন’, ‘ক্রেটার’—বইয়ে যা-যা পড়েছে বুয়ান তার সবকিছুরই ইশারা রয়েছে চাঁদের এই খুদে মডেলে৷
আরও একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল বুয়ান৷ অন্ধকারে চাঁদের মডেলটা থেকে হালকা আলোর আভা বেরোয়৷ হয়তো চাঁদ তৈরির ছোট-ছোট ব্লকগুলো ফ্লুওরেসেন্ট পলিমার দিয়ে তৈরি৷
একদিন সন্ধের পর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে জুনোর সঙ্গে খেলতে শুরু করল৷ খেলার সরঞ্জাম হিসেবে হাতের কাছে রয়েছে একজোড়া ডাইনোসর আর চাঁদ৷
বুয়ান আর জুনো নিজেদের মধ্যে নানান কথা বলছিল৷ তারই মধ্যে বুয়ান হঠাৎ বলে উঠল, ‘জুনো, চলো, আমরা চাঁদে যাই—৷’
‘যাব বললেই যাওয়া যায়! একটা স্পেসশিপ লাগবে, আর তোমার জন্যে লাগবে স্পেস-স্যুট—নইলে তুমি চাঁদে নামবে কী করে!’
‘আর তুমি? তোমার স্পেস-স্যুট লাগবে না?’
‘না৷ বিকজ আমি তো রোবট—স্পেশাল প্লাস্টিক আর মেটাল দিয়ে তৈরি…৷’
বুয়ান বুঝতে পারল, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওর সঙ্গে মজা করছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও স্পেসশিপ আর স্পেস-স্যুটের ব্যাপারটা ওর মাথায় গেঁথে গেল৷ ব্লকের দোকানে ও এই ব্লকগুলো বিক্রি হতে দেখেছে৷ সুতরাং সেগুলোর না হয় ব্যবস্থা হল৷ কিন্তু…৷
‘কিন্তু জুনো, চাঁদ তো মহাকাশে ভেসে থাকে! আমার এই চাঁদটা, তুমি তো জানো, মেঝেতে থাকে—গড়ায়…৷’
‘সব জানি৷ চিন্তা কোরো না—ধীরে-ধীরে সব হবে৷ চাঁদের অ্যাটমসফিয়ার তৈরি করতে হবে, চাঁদের গ্র্যাভিটি তৈরি করতে হবে, ওটাকে শূন্যে ভাসাতে হবে—তবেই না ব্লকের মডেলটা আসলের মতো হবে!’
জুনোর কথায় বুয়ানের হাসি পেয়ে গেল৷ কী যে আজেবাজে বকছে রোবটটা! বুয়ান জানে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ছ’ভাগের একভাগ৷ সেইজন্যই চাঁদে বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা—প্রায় নেই বললেই চলে৷
কিন্তু কী করে এসব তৈরি করবে জুনো?
সে যাই হোক, সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্পেসশিপ আর স্পেস-স্যুটের ব্লক চলে এল বাড়িতে এবং দু-দিনের মধ্যে মডেল দুটো তৈরিও হয়ে গেল৷
তারপর চাঁদে যাওয়া নিয়ে দু-বন্ধুর চর্চা চলতে লাগল দিনের পর দিন৷
চাঁদ সম্পর্কে বুয়ান অনেক কথা জানে৷ কিন্তু জুনোর কথায় ও বুঝতে পারল, চাঁদ সম্পর্কে জুনোর জ্ঞান বুয়ানের অন্তত একশো গুণ৷ ও জানে, চাঁদের ব্যাস ১৭৩৮ কিলোমিটার, চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে পাক খাওয়ার সময় চাঁদের একটা পিঠ সবসময় পৃথিবীর দিকে ‘মুখ’ করে থাকে, চাঁদের কালচে এলাকাগুলোর নাম ‘মারিয়া’, আর আলোকিত অঞ্চলগুলো ‘লুনার হাইল্যান্ডস’৷ এও জানে, পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩৮৪৪০০ কিলোমিটার৷
বুয়ান বলল, ‘জানো, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন? ওঁর সঙ্গী ছিলেন এডুইন অলড্রিন?’
‘জানি৷’ বলল জুনো, ‘ওঁদের আর-এক সঙ্গী মাইকেল কলিন্স লুনার মডিউলের ভেতরে বসেছিলেন…চাঁদে নামেননি…৷’
চাঁদে যাওয়ার জন্য বুয়ানের আর তর সইছিল না৷ ও তাগাদা করে-করে জুনোকে একেবারে পাগল করে দিচ্ছিল৷ তাতে বেস্ট ফ্রেন্ড সবসময় বলে, ‘একটু সবুর করো৷ ঠিক সময় এলেই আমরা স্টার্ট দেব…৷’ একটু থেমে জুনো আবার বলেছে, ‘জানো তো, চাঁদের টেম্পারেচার ওর নানান জায়গায় নানান রকম৷ -১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে +১১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠা-নামা করে৷ আমরা ওর এমন জায়গায় গিয়ে ল্যান্ড করব যেখানে টেম্পারেচার আটাশ কি তিরিশ ডিগ্রি—মানে, আমাদের পক্ষে খুব কমফোর্টেবল, বুঝলে?’
বুয়ান শোনে, কিন্তু ওর মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যে, মনভোলানো কথা৷ কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই মনে হয়, জুনো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড৷ বেস্ট ফ্রেন্ড কখনও মিথ্যে কথা বলবে না!
চারদিন পরেই এসে গেল সেই দিন৷
রাত আটটার সময় পড়ার ঘরের দরজা ভেজিয়ে জুনোর কাছে এসে বসল বুয়ান৷ হাতের কাছেই রাখা আছে স্পেস-স্যুট, স্পেসশিপ আর চাঁদ৷ এইবার জুনো শুরু করবে ওদের চাঁদে পাড়ি দেওয়ার তোড়জোড়৷
এবং শুরু হয়েও গেল৷
জুনো বলল, ‘বুয়ান, এখন আমি যা-যা করব সেটাকে তুমি মোটেই ম্যাজিক বলে ভেবো না৷ কারণ, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যখন অনেকটা এগিয়ে যায় তখন সেটাকে সবাই ম্যাজিক ভেবে ভুল করে৷ এসো, লেট আস স্টার্ট…ওয়ান, টু, থ্রি…৷’
ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে খুলতেই যে-দৃশ্য শ্রেয়সীর চোখে পড়ল সেরকম দৃশ্য বুঝি শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়৷
বুয়ানকে ডাকতে এসেছিলেন শ্রেয়সী৷ কিন্তু দরজা খুলতেই পাথর হয়ে গেলেন৷
কোথায় বুয়ান!
তার বদলে চোখের সামনে এক ম্যাজিক-দৃশ্য৷
ঘরটা অন্ধকার৷ তবে একটা হালকা আলোর নীল আভা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরে৷ ঘরটা এত ঠান্ডা যেন মনে হচ্ছে ঘোর শীতকাল৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে শূন্যে ভেসে রয়েছে একটা সাদা গোলক—ব্লক দিয়ে তৈরি বুয়ানের চাঁদ৷ সেই চাঁদের গায়ে আসল চাঁদের মতো কলঙ্কের দাগ চোখে পড়ছে৷