ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদ্দৌল্লাকে প্রতারিত করার আরেকটি সুযোগ তাদের হাতে এসে যায়। এটা দিয়ে তারা নবাবকে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পেল। তারা ৯ বা ১০ মে নাগাদ মারাঠা পেশোয়া বালাজি রাও-এর কাছ থেকে মারাঠাদের সঙ্গে তাদের আঁতাতের প্রস্তাব নিয়ে একটি চিঠি পেল। বালাজি রাও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, এক লক্ষ কুড়ি, হাজার মারাঠি অশ্বারোহী সৈন্য নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবে এবং কলকাতায় ইংরেজদের যা ক্ষতি হয়েছে তার দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ তাদের দেওয়া হবে। ক্লাইভ প্রথমে ভাবলেন চিঠিটা জাল এবং এটা লিখে নবাব ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য যাচাই করতে চাইছেন। স্ক্র্যাফ্টন অবশ্য বলেছেন যে ক্লাইভ পত্রবাহকের সঙ্গে গোপনে একটা বৈঠক করেছিলেন।৪৯ শেষপর্যন্ত ক্লাইভ এই চিঠিকে দুটো কাজে লাগাতে চাইলেন—প্রথম, ওয়াটসকে বললেন, মীরজাফরকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানাতে। তা হলে হয়তো মারাঠা আক্রমণের ভয়ে মীরজাফরও বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে স্ক্র্যাফ্টনের মারফত চিঠিটা সিরাজদৌল্লাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাতে নবাব ইংরেজদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন।৫০ মারাঠাদের চিঠিটি নিয়ে সিলেক্ট কমিটি যে সিদ্ধান্ত করল তা থেকে ইংরেজদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে-কোনও উপায়ে সিরাজকে হঠাতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত: ৫১
কমিটির সদস্যরা সবাই একমত যে মারাঠা শাসন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য এবং সম্ভব হলে আমরা তা কখনও হতে দেব না। সেজন্যই আমরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা সমর্থন করি, যদি তা কার্যে পরিণত করা যায়। কিন্তু এমনও হতে পারে যে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে এবং নবাবের সঙ্গে আবার আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে মারাঠাদের সাহায্য দেশের [বাংলার] বিভিন্ন অঞ্চলে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারবে তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক হবে। তাই ঠিক করা হল যে বাজিরাও’র সঙ্গে বন্ধুতাপূর্ণ যোগাযোগ রেখে চলাই শ্রেয়। সুতরাং তাঁর প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান বা তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ কোনওটাই করা হবে না।
লিউক স্ক্র্যাফ্টন বাজিরাও-এর চিঠি নিয়ে সিরাজদৌল্লার কাছে গেলেন। চিঠিটি সম্বন্ধে নবাবের প্রথমে সন্দেহ হয় কিন্তু স্ক্র্যাফ্টন বেশ চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর সন্দেহ ভঞ্জন করতে সক্ষম হন। ফলে ইংরেজদের চালাকি বেশ সফল হল৷ সিরাজদৌল্লা ক্লাইভের ‘প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফেটে পড়লেন,’ এবং এমনকী ঘোষণা করলেন যে তিনি পলাশি থেকে তাঁর সেনাপতিদের—রায়দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মর্দান— ফিরে আসার নির্দেশ দেবেন। নবাব অবশ্য প্রথমে বলেছিলেন যে শুধু মীরজাফরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তাতে কিন্তু চক্রান্তকারীরা খুব বিপদে পড়ে যেত। তাই ওয়াটস ভাবছিলেন মীরজাফর যাতে পলাশি থেকে এক পা না নড়েন সে-সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার কথা। ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদৌল্লা অচিরেই তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং তিন সেনাপতিকেই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন।৫২ মীরজাফর ৩০ মে মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন।
ততদিনে ষড়যন্ত্রের কথা লোকে বলাবলি করতে শুরু করে দিয়েছে। সিরাজদৌল্লাও হয়তো কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরকে সরিয়ে খাজা আব্দুল হাদি খানকে বক্সির পদে নিযুক্ত করেন। মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি মন্তব্য করেছেন যে ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজকে জানানো সত্ত্বেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে ‘ইন্দ্রিয় সুখের ভোগে’ লিপ্ত থাকলেন। তাঁর বিশ্বাসভাজন ও বিশেষ অনুগত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মীর মর্দান ও আব্দুল হাদি খান, তাঁর এহেন নিষ্ক্রিয়তায় অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।৫৩ এটা কিন্তু সঠিক বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে এবং ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজদৌল্লা বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই হয়তো নবাব, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে সন্দেহ করছিলেন, তাদেরও সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তাঁর তখনও আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সে-কারণে তিনি তাড়াতাড়ি মীরজাফর ও খাদিম হোসেন খানকে তাঁদের পুরনো পদে পুনর্বহাল করে তাঁদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শপথ নিলেন যে নবাবের প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত থাকবেন।৫৪
মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা যে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুতপক্ষে সিরাজের প্রতি অনুগত সেনাপতিরা মীরজাফরদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেবার জন্য তাঁকে বারংবার অনুরোধ করেছিল। খাজা আব্দুল হাদি খান ও মীর মর্দান নাকি তাঁকে এই বলে সাবধান করেছিলেন যে, ‘ইংরেজদের কার্যকলাপ সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা এদেশ জয় করতে বদ্ধপরিকর….মীর মহম্মদ জাফর খান বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে এই নবাবের বংশকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। সুতরাং প্রথমেই তাঁকে খতম করা উচিত। তা হলে পরে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে।’৫৫