- বইয়ের নামঃ অবিশ্বাস্য
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. মধুগঞ্জ মহকুমা শহর
০১.
মধুগঞ্জ মহকুমা শহর বলে তাকে অবহেলা করা যায় না।
মধুগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য নগণ্য, মধুগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে কুড়ি মাইল দূরে, মধুগঞ্জে জলের কল, ইলেকট্রিক নেই, তবু মানুষ মধুগঞ্জে বদলি হবার জন্য সরকারের কাছে ধন্যে দিত। কারণ এসব অসুবিধাগুলো যে রকম এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে শাপ, অন্যদিক দিয়ে আবার ঠিক সেইগুলোই বর। মাছের সের দু আনা, দুধের সের ছ পয়সা, ঘিয়ের সের বারো আনা এবং সেই অনুপাতে আণ্ডা মুরগী সবই সস্তা। আর সবচেয়ে বড় কথা, কাচ্চাবাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য মধুগঞ্জ পুব-বাঙলা-আসামের অক্সফোর্ড বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না; ওয়েলশ মিশনারিদের কৃপায় মধুগঞ্জে একটি হাইস্কুল আর দুটো প্রাইমারি স্কুল যে পদ্ধতিতে চলত তা দেখে বাইরের লোক মধুগঞ্জে এসে অবাক মানত। স্কুল হস্টেলে সীটের জন্য পুব বাঙলা-আসামে একমাত্র মধুগঞ্জেই আরাই-গজী ওয়েটিং লিস্ট অফিসের দেয়ালে টাঙানো থাকত। হস্টেলের খাই-খরচা মাসে সাড়ে চার টাকা, আর সীট রেন্ট চার আনা।
মধুগঞ্জের আরেকটি সদ্গুণের উল্লেখ করতে লেখকমাত্রই ঈষৎ কুণ্ঠিত হবেন। লেখকমাত্রই সাহিত্যিক, কাজেই মধুগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের হৃদয়ে আকৃষ্ট করবে এ তো জানা কথা। কিন্তু সাহিত্যিকেরা এ তত্ত্বও বিলক্ষণ জানেন যে, এ সংসারে আর পাঁচজন শহরের দোষগুণ নির্ণয় করার সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জিনিসটাকে জমা-খরচের কোনো খাতেই ফেলার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ, এ তত্ত্ব তো অতিশয় সত্য যে, নিছক প্রকৃতির মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ চাকরিতে বদলি খোঁজে না, কিংবা ব্যবসা ফাঁদে না।
এ সত্য জানা সত্ত্বেও যে দু-একজন সাহিত্যিক বরযাত্রীরূপে কিংবা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করতে এসেছেন তারাই মধুগঞ্জের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গিয়েছেন। তাই দেখে খাস মধুগঞ্জীয় কাঁচা সাহিত্যিকরাও মধুগঞ্জের আর পাঁচটা সুখ সুবিধের সঙ্গে তার প্রাকৃতিক দৃশ্যেরও প্রশস্তি গেয়েছেন।
পশ্চিম বাঙলা যেখানে সত্যই সুন্দর সেখানেই দেখি তার উঁচু-নিচু খোয়াইডাঙা আর দূরদুরান্তের নীলা পাহাড়। উঁচু-নিচুর ঢেউ খেলানো মাঠের এখানে ওখানে কখনো বা দীর্ঘ তালগাছের সারি, আর কখনো একা দাঁড়িয়ে একটিমাত্র তালগাছ। এই তালগাছগুলো মানুষের মনে যে অন্তহীন দূরত্বের মায়া রচে দিতে পারে তা সমুদ্রও দিতে পারে না। সমুদ্রপাড়ে বসে মনে হয়, এই আধামাইল দুরেই বুঝি সমুদ্র থেমে গিয়েছে–আকাশে নেমে গিয়ে নিরেট দেয়ালের মত হয়ে সমুদ্রের অগ্রগতি বন্ধ করে দিয়েছে।
পশ্চিম বাঙলার খোয়াইডাঙা তাই তার শালতাল দিয়ে, দূর না হয়েও যে দূরত্বের মরীচিকা সৃষ্টি করে সে মায়াদিগন্ত মানুষের মনকে এক গম্ভীর মুক্তির আনন্দে ভরে দেয়। জানি, মন স্বাধীন; সে কল্পনার পক্ষিরাজ চড়ে এক মুহূর্তেই চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে সৃষ্টির ওপার পানে ধাওয়া দিতে পারে, কিন্তু সে স্বপ্ন প্রয়াণে তো আমার রক্তমাংসের শরীরকে বাদ দিয়ে চলতে হয়–আমাকে এক নিমিষে নিয়ে যায় দূর হতে দূরে যেখানকার শেষ নীল পাহাড় বলে, আরো আছে, আরো দুরের দূর আছে; সে যেন ডাক দিয়ে বলে, তুমি মুক্ত মানুষ, তুমি ওখানে বসে আছ কী করতে চলে এসো আমার দিকে।
এ মুক্তি ধারণা নিছক কবি-কল্পনা নয়। বহ্বার দেখা গিয়েছে সন্ধ্যার সময় পশ্চিমপানে তাকাতে তাকাতে সাঁওতাল ছেলে হঠাৎ দাওয়া ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে রওয়ানা দিল। তারপর সে আর ফিরল না। মড়া পাওয়া গেল পরের দিন খোয়াইয়ের মাঝখানে বাড়ি হতে অনেক দূরে। বুড়ো মাঝিরা বলে, ভূত তাকে ডেকেছিল, তারপর অন্ধকারে পথ হারিয়ে কী দেখেছে, কী ভয় পেয়ে মরেছে, কে জানে?
পুব বাঙলার সৌন্দর্য দুরত্বে নয়, পুব বাঙলার মাঠের শেষে মাঠ, মাঠের শেষে, সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে নয়, সেখানে মাঠের শেষেই ঘন সবুজ গ্রাম আর গ্রামখানির উপর পাহারা দিচ্ছে সবুজের উপর সাদা ডোরা কেটে কেটে সুদীর্ঘ সুপারি গাছ। আর সে সবুজ কত না আভা, কত না আভাস ধরতে জানে। কচি ধানের কাঁচা-সবুজ, কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার কালো সবুজ। পানার সবুজ, শ্যাওলার সবুজ, হলদে-সবুজ থেকে আরম্ভ করে আম জাম কাঠালের ঘন সবুজ, কচি বাশের সবুজ, ঘনবেতের সবুজ আর ঝরে পড়া সবুজ পাতার রস খেয়ে খেয়ে পুব বাঙলার মাটি হয়ে গেছে গাঢ় সবুজ–কৃশ্যাম। তাই তার মেয়ের গায়ের রঙে কেমন যেন সবুজের আমেজ লেগে আছে। সে শ্যামশ্রী দেশ-বিদেশে আর কে পেয়েছে, আর কে দেখেছে?
কিন্তু মধুগঞ্জের সৌন্দর্য এও নয়, ওও নয়। মধুগঞ্জ পুব বাঙলার মত ফ্ল্যাট নয়, আবার পশ্চিম বাঙলার মত ঢেউখেলানোও নয়। ভগবান যেন মধুগঞ্জে এক তিসরা খেলা খেলার জন্য নয়া এক ক্যানভাস নিয়ে বসে গেছেন। ক্যানভাসখানা বিরাট আর তাতে আছে মোটামুটি তিনটি বড় রঙের পোচ–সামনের কাজলধারা, নদীর কাকচক্ষু কালো জল, নদী পেরিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত, সর্বশেষে এক আকাশছোঁয়া বিরাট নিরেট নীল পাথরের খাড়া পাহাড়। এখানে পশ্চিম বাঙলার মত মাঠ ঢেউ খেলতে খেলতে পাহাড়ে বিলীন হয়নি-পাহাড় এখানে দাঁড়িয়ে আছে পালিশ সবুজ মাঠের শেষে সোজা খাড়া পাঁচিলের মত। তার গায়ে কিছু কিছু খাজ আছে কিন্তু এ খাজ আঁকড়ে ধরে ধরে উপরে চড়া অসম্ভব।