- বইয়ের নামঃ নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ
- লেখকের নামঃসুশীল চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. প্রথম অধ্যায় – ভূমিকা
আমার ছোটভাই
অকালপ্রয়াত সলিলকান্তি চৌধুরীর
স্মৃতির উদ্দেশে
.
ঋণ স্বীকার
এই বই লেখার ব্যাপারে আমার স্ত্রী, মহাশ্বেতা, আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া এটা লেখা সম্ভব হত না। বহরমপুরের ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত অনেকগুলি ছবি দিয়ে কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। এ বইয়ের জন্য ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালের কর্তৃপক্ষ কিছু ছবি ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়ে বাধিত করেছেন। শ্রীমতী সুস্মিতা দুধোরিয়া কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে আমাকে সাহায্য করায় উপকৃত হয়েছি। এই বইয়ের ব্যাপারে শ্রী শ্রীরাম সিং এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে আমার অনেক উপকার করেছেন। আনন্দ পাবলিশার্স অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বইটি প্রকাশনার ব্যবস্থা করায় আমি কৃতজ্ঞ।
.
সংকেত সূচি
BPC | Bengal Public Consultations |
Beng. Letters Recd. | Bengal Letters Received |
C & B Abstr. | Coast and Bay Abstracts |
DB | Despatch Books |
Fact. Record | Factory Records |
FWIHC | Fort William-India House Correspondence |
HB | Hughli to Batavia |
Home Misc. | Home Miscellaneous |
HR | Hoge Regering van Batavia |
OC | Original Correspondence |
Orme Mss. | Orme Manuscripts |
Mss. Eur. | European Manuscripts |
NAI | National Archives of India |
VOC | Verenigde Oost-Indische Compagnie |
Journals | |
BPP | Bengal Past and Present |
CHJ | Calcutta Historical Journal |
IESHR | Indian Economic and Social History Review |
IHR | Indian Historical Review |
JAS | Journal of Asian Studies |
J. As. S | Journal of Asiatic Society |
JEH | Journal of Economic History |
JESHO | Journal of the Economic and Social History of the Orient |
MAS | Modern Asian Studies |
প্রথম অধ্যায় – ভূমিকা
এ বছর, ২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদ তিনশ’ বছরে পদার্পণ করল। ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খান মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তন করেন। সে অনুযায়ী এ বছরই মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছর। এ উপলক্ষেই এই গ্রন্থের অবতারণা। সাধারণভাবে একটি শহর বা নগরের কোনও প্রতিষ্ঠাতা থাকে না, স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শহর বা নগরের উৎপত্তি হয়। এর ব্যতিক্রম হাতে গোনা যায়। যেমন সেন্ট পিটারের প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর। মুর্শিদাবাদও এই ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ে। এতদিন আমরা জানতাম, জোব চার্ণকই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৬৯০-র ২৪ আগস্ট তিনিই এই শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। তাই বহুদিন ধরে এই দিনটি কলকাতার জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। ১৯৯০ সালে বেশ সাড়ম্বরে কলকাতার তিনশ’ বছর পূর্তি উৎসবও হয়ে গেল। কিন্তু অতি সম্প্রতি মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট দ্বারা নিযুক্ত পাঁচজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সহমত হয়ে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, জোব চার্ণককে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না, ২৪ আগস্টও কলকাতার জন্মদিন নয়। তবে মুর্শিদাবাদ প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার কোনও অবকাশ নেই কারণ মুর্শিদকুলি খান যে ১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তন করেন সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়।
মুর্শিদাবাদ ও এই অঞ্চল নিয়ে অনেক বইই লেখা হয়েছে। তবে তার মধ্যে বেশ কিছু ভাল বই প্রায় একশ’ বছর বা তারও আগে লেখা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: নিখিলনাথ রায় মুর্শিদাবাদ কাহিনী (১৮৯৭), মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (১৯০২), জগৎশেঠ (১৯০৫); J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District (1902); P. C. Majumdar, The Musnud of Murshidabad (1905); A. C. Campbell, Glimpses of Bengal (1907) ইত্যাদি। গত কয়েক দশকেও মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে: B. N. Banerjee, Begams of Bengal; K. K. Datta, Alivardi and His Times; Abdul Karim, Murshid Quli and His Times; J. H. Little, The House of Jagat Seths; K. M. Mohsin, A Bengal District in Transition: Murshidabad; প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, মুর্শিদাবাদ চর্চা; সোমেন্দ্র চন্দ্র নন্দী, বন্দর কাশিমবাজার, The Life and Times of Kanto Babu ইত্যাদি। তা ছাড়াও Philip Calkins, গৌতম ভদ্র প্রমুখ মুর্শিদাবাদ নিয়ে সুচিন্তিত কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু এ সবগুলিতেই মুর্শিদাবাদের শুধু খণ্ড খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদের একটি সামগ্রিক চিত্র কোথাও ঠিক নেই।
তাই মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছর উপলক্ষে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের প্রতি, বিশেষ করে স্বাধীন নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রসঙ্গে, নতুন করে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন আছে। গত প্রায় চার দশক ধরে সমুদ্র বাণিজ্যের ইতিহাস, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলায় ব্যবসা-বাণিজের গতিপ্রকৃতি, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বাংলার ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভসে, বিশেষ করে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি (British Library, India Office Records) এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভস (Algemeen Rijksarchief), যেসব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি তার ভিত্তিতে মুর্শিদাবাদের সার্বিক ইতিহাস রচনা করার তাগিদ অনুভব করেছি। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এই গ্রন্থের অবতারণা। আর মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছরে পদার্পণই এই গ্রন্থ রচনার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আশা করি তা মনে রাখলে এই গ্রন্থ রচনার ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক বলে বিবেচিত হবে। এখানে নবাবি আমল বলতে আমাদের আলোচনা স্বাধীন নবাবি আমলেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। অর্থাৎ মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা এবং পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত, মোটামুটি ১৭০৪ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল। তারপরেও মুর্শিদাবাদের নবাবরা ছিলেন বটে তবে মীরজাফর থেকে আরম্ভ করে সবাই ইংরেজদের ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া মুর্শিদাবাদের যা কিছু গৌরব এবং শ্রীবৃদ্ধি, সবটাই স্বাধীন নবাবি আমলে। তারপর ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে আস্তে আস্তে মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে, কলকাতাই সব কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। পলাশির পর থেকেই মুর্শিদাবাদের এই অবনমনের সূত্রপাত। তাই এই বইতে শুধু মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগের কথাই তুলে ধরা হয়েছে।
মোট দশটি অধ্যায়ে আমার বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই ‘ভূমিকা’-তে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের পত্তনের ইতিবৃত্ত। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে এবং কেন মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে দেওয়ানি কার্যালয় মখসুদাবাদে নিয়ে আসেন এবং তাঁর নিজের নাম অনুযায়ী নতুন নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। বিভিন্ন তথ্যের সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে ১৭০৪ সালেই যে মুর্শিদাবাদের পত্তন তাও এখানে প্রতিষ্ঠিত। পরের অধ্যায়ে মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন নবাবরা কীভাবে মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন তার সম্যক বিশ্লেষণ। বস্তুতপক্ষে, নবাবি আমলই মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। বহু তথ্যের সমাবেশে এখানে তাই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে বণিকরাজাদের (merchant princes) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার তিন বণিকরাজা— জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ— মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। নবাবদের সঙ্গে এঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নবাবদের আনুকূল্যেই এঁরা বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতির প্রায় সবটাই কুক্ষিগত করে নেন। শুধু তাই নয়, বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতেও এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
পঞ্চম অধ্যায়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। পলাশি বাদ দিয়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না। বিশেষ করে এতদিন পর্যন্ত পলাশির যে ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা দিয়ে এসেছেন— কেন এই ষড়যন্ত্র, কে বা কারা এর মূল নায়ক, এতে ইংরেজদের ভূমিকা কী, ইত্যাদি— তা সত্যি যুক্তিগ্রাহ্য কিনা তা নতুন করে বিচার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ এর মধ্যে অনেক নতুন তথ্য, বিবরণগত শুধু নয় পরিসংখ্যানগতও বটে, আমরা ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে আবিষ্কার করতে পেরেছি যার ভিত্তিতে এতদিনের বক্তব্যগুলি অসার বলে প্রমাণ করা যায়। সংক্ষেপে এ বক্তব্যগুলি হল— পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না, তাদের বাংলা বিজয় নেহাতই ‘আকস্মিক ঘটনা’, প্রায় ‘অনিচ্ছাকৃত’। বাংলার ‘অভ্যন্তরীণ সংকটই’ ইংরেজদের বাংলায় ডেকে আনে, পলাশি ‘ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র’, ইত্যাদি। এখানে আমরা এই সব বক্তব্যগুলি খণ্ডন করে দেখিয়েছি যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছাড়া পলাশি সম্ভব হত না। তারাই একদিকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে প্রায় কাকুতিমিনতি করে নবাবের দরবারের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীকে তাদের ‘বিপ্লবে’র পরিকল্পনায় সামিল করিয়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন, ইংরেজদের পক্ষে বঙ্গবিজয় এত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল কেন এবং যে প্রশ্নের কোনও উত্তর এতদিন কেউ দিতে পারেননি, আমরা তা এখানে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৭৩০-র দশক থেকে ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা চলছিল। এরা এই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত। কিন্তু ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৫০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায়। তার কারণ ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলি থেকে দেশীয় বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও তাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের বেগমদের বৃত্তান্ত। এঁদের চারিত্রিক বৈপরীত্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কেউ কেউ স্বামীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন শুধু নয়, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্যও পরিচালনা করেছেন। স্বামীর বিপদের সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও উচ্চাকাঙক্ষা চরিতার্থ করার জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেননি। জিন্নতউন্নেসা, শরফুন্নেসা, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, লুৎফুন্নেসা, মুন্নি বেগম প্রমুখের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করে তাই এখানে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের শিল্পবাণিজ্যের বিশ্লেষণ। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল বাংলায় কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ভারতবর্ষ ও এশিয়া ছাড়াও ইউরোপে এই দুটি পণ্যের বিরাট চাহিদা ছিল। ফলে নবাবি আমলে এই দুটি পণ্যের উৎপাদন এবং বাণিজ্যের দ্রুত অগ্রগতি হয়। এশীয়/ভারতীয় বণিক এবং ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে এই পণ্য দুটি রফতানি করত। এতদিন ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে এই রফতানি বাণিজ্যে মুখ্য ভূমিকা ছিল ইউরোপীয়দের, তারাই এই দুটি পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি করত। কিন্তু আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে এখানে দেখিয়েছি যে এতে এশীয়/ভারতীয়দের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই দুটি পণ্য রফতানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। বস্তুতপক্ষে, কাঁচা রেশমের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এশীয়/ভারতীয়দের রফতানির পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানি মিলে যে মোট রফতানি তার চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।
মুর্শিদাবাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির আলোচনা অষ্টম অধ্যায়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজকর্ম উপলক্ষে বহু জাতি, বর্ণ ও ধর্মের লোকরা এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করত। তারপর পরস্পরের পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হত স্বাভাবিকভাবেই। ফলে মুর্শিদাবাদে একটি ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের অর্থনীতিও বেশ উন্নত ছিল। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দিল্লি-আগ্রা থেকে আগত মনসবদার ও অভিজাতবর্গ বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ করত, মুর্শিদকুলির আমল থেকে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলার ধনসম্পদ বাংলাতে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদেই, সঞ্চিত হত। ১৭৪০-র দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত নবাবরা দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠাতেন। তা সত্ত্বেও এঁদের কোষাগারে যে পরিমাণ ধনরত্ন সঞ্চিত হয়েছিল তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মারাঠা আক্রমণে এ সময় বাংলার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা মোটামুটি বেশ ভালই ছিল বলে ফারসি ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন। জৈন কবি নিহাল সিংহও এটা সমর্থন করেছেন।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য—হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনওভাবেই ব্যাহত হয়নি। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কোনও ঘটনা এসময় ঘটেনি। বরং এই দুই ধর্ম-সংস্কৃতির যে সমন্বয় প্রক্রিয়া তা ওই সময়েই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। এ মিলন প্রক্রিয়া থেকেই ‘সত্যপীরের’ মতো নতুন ‘দেবতা’র উদ্ভব, যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। এ সময় হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে বা মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরা মহা আড়ম্বরে হোলি, দেওয়ালি প্রভৃতি হিন্দু উৎসব পালন করতেন, তাতে কোনও প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও এই দুই ধর্মসংস্কৃতির মিলন প্রক্রিয়ার প্রতিফলন একদিকে মুসলমান কবি ফৈজুল্লা ও অন্যদিকে হিন্দু কবি ভারতচন্দ্রের ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তিতে।
নবম অধ্যায়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের বর্ণনা। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। নবাবদের আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য এক নতুন মাত্রা পায়। মুঘল শৈলীর সঙ্গে বাংলার স্থানীয় শৈলীর সংমিশ্রণ হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত সব নবাবেরই প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ, সমাধিভবন, ইত্যাদি নির্মাণ করা প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। একদিকে নবাবদের এই মানসিকতা, অন্যদিকে তাঁদের হাতে অফুরন্ত ধনরত্ন থাকায় মুর্শিদাবাদে একের পর এক নতুন নতুন প্রাসাদ, মসজিদ, উদ্যানবাটিকা প্রভৃতি নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুর্শিদকুলির কাটরা মসজিদ ও খোশবাগের সমাধিক্ষেত্র, সুজাউদ্দিনের ফৰ্হাবাগ, নওয়াজিস মহম্মদের মোতিঝিল প্রাসাদ, সিরাজদ্দৌল্লার হিরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ, ইমামবারা ও মদিনা, মুন্নি বেগমের চৌক মসজিদ ইত্যাদি। পরিতাপের বিষয়, এগুলির মধ্যে বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শেষ অধ্যায়ে উপসংহার— এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার।
০২. মুর্শিদাবাদ নগরীর পত্তন
অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা।
দিল্লির তখ্তে তখন মুঘল সম্রাট ঔরংজেব। কিন্তু ১৬৮০ থেকেই তিনি দাক্ষিণাত্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। কুড়ি বছর ধরে তিনি মূলত দাক্ষিণাত্যেই অবস্থান করছিলেন। রাজধানী দিল্লি থেকে তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগে বিস্তৃত সাম্রাজ্যের বহু অংশেই অরাজকতা দেখা দিয়েছে, শান্তিশৃঙ্খলা ও শাসনব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এককালের পরাক্রান্ত সাম্রাজ্যের পতন প্রায় আসন্ন। কেন্দ্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল থেকেই মুঘল সম্রাটের কাছে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠেছে। সম্রাট ঔরংজেবের চরম দুরবস্থা। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে নিদারুণ অর্থকষ্ট ও যুদ্ধের ধকল— সব মিলে বৃদ্ধ সম্রাট শুধু ক্লান্ত নন, প্রায় বিধ্বস্তও।
অবশ্য তাঁর এই দুর্দশার জন্য ঔরংজেব প্রধানত নিজেই দায়ী। বছরের পর বছর দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সৈন্যবলের অপচয়, তার কোনও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অনেকটা জেদের বশেই তিনি এই অর্থহীন ও অন্তহীন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হয়ে তিনি দাক্ষিণাত্যের দুই স্বাধীন শিয়া রাজ্যের— বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা— অস্তিত্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। এই দুই রাজ্যকে শায়েস্তা করতে তিনি কুড়ি বছর ধরে দাক্ষিণাত্যে পড়ে রইলেন। আর ওদিকে রাজধানী দিল্লির তথা সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। ঔরংজেবের দাক্ষিণাত্য যুদ্ধ যে তাঁর অপরিণামদর্শিতার পরিচায়ক, এ-বিষয়ে প্রায় সব বিশিষ্ট ঐতিহাসিকই সহমত।১
মুঘল সাম্রাজ্যের ও সম্রাটের যখন এই দুরবস্থা তখন একমাত্র ভরসা ছিল সুবে বাংলা। সাম্রাজ্যের চারদিকে যখন অরাজকতা, অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, সম্রাটকে রাজস্ব পাঠাতে চরম অনীহা এবং কার্যত বন্ধ, তখন বাংলাই একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বস্তুতপক্ষে, সপ্তদশ শতক ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সুবা (প্রদেশ) হিসেবে গণ্য হত। বাংলার উর্বর জমি, বিভিন্ন রকমের ও অপর্যাপ্ত কৃষিজ পণ্য এবং সস্তা অথচ উৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব মিলে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অত্যন্ত মূল্যবান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাংলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর বাংলা যেহেতু সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বাংলায় একমাত্র সোনা-রুপো ছাড়া অন্য কিছুর বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে বাংলা থেকে যারা পণ্য রফতানি করত, তাদের সবাইকে— সে ইউরোপীয় বা এশীয় বণিক যেই হোক না কেন— এ সব পণ্য কেনার জন্য বাংলায় সোনা-রুপো বা নগদ টাকা পয়সা নিয়ে আসতে হত।২
বস্তুতপক্ষে, সপ্তদশ শতকে বাংলার প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। সমসাময়িক বিদেশি পর্যটক ও ফারসি ঐতিহাসিকরা এ নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন। রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন সলিম বাংলাকে জিন্নৎ-অল-বিলাদ বা ‘প্রদেশসমূহের মধ্যে স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেছেন।৩ মুঘল সম্রাট ঔরংজেব নাকি বাংলাকে বলতেন ‘জাতীয় স্বর্গ।’৪ সব মুঘল ফরমান, পরওয়ানা বা সরকারি নথিপত্রে বাংলাকে ‘ভারতবর্ষের স্বর্গ’ বলে উল্লেখ করা হত। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law) লিখেছেন ওটাই বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান।৫ বাংলার সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে এবং এখান থেকে ধনরত্ন আহরণ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন দেশ থেকে বহু লোকের সমাগম হত বাংলায়। ধনরত্নের লোভ ছেড়ে তারা সহজে বাংলা থেকে বিদায় নিতে পারত না। ১৬৬০-এর দশকে ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) মন্তব্য করেছেন:৬
… the rich exuberance of the country… has given rise to a proverb… that the kingdom of Bengal has a hundred gates open for entrance, but not a single one for departure.
স্বাভাবিকভাবে, এই বাংলাই ছিল বাদশাহ ঔরংজেবের একমাত্র আশাভরসা— যেখান থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় হবে এবং তা দিয়ে দাক্ষিণাত্যে তাঁর যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেবে। কিন্তু তাঁর সে প্রত্যাশা পুরোপুরি সফল হল না। শাহজাদা মহম্মদ আজিমুদ্দিন তখন বাংলার সুবাদার। তিনি বাংলায় আসেন ১৬৯০ সালে। তিনি ঔরংজেবের তখন জীবিত জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথম বাহাদুর শাহের পুত্র— অর্থাৎ ঔরংজেবের পৌত্র। ইতিহাসে তিনি আজিম-উস-শান নামেই সমধিক পরিচিত। আজিম-উস-শান রাজস্ব আদায়ে তেমন তৎপর ছিলেন না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল— বাংলা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ধন আহরণ করা— যা দিয়ে তিনি ঔরংজেবের আসন্ন মৃত্যুর পর দিল্লির মসনদ দখল করার লড়াইয়ে যোগ দিতে পারবেন।৭ ফলে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় ও সম্রাটকে দাক্ষিণাত্যে অর্থজোগান দেবার ব্যাপারে আজিম-উস-শানের তেমন উৎসাহ ছিল না। তাই সম্রাট খোঁজ করছিলেন এমন একজন দক্ষ ও বিশ্বাসী ব্যক্তির যিনি বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারবেন এবং তাঁকে দাক্ষিণাত্যে নিয়মিত অর্থ পাঠাবেন। ভাগ্যক্রমে তিনি এমন একজনের সন্ধানও পেয়ে গেলেন, যাঁর তখন নাম ছিল মহম্মদ হাদি।
কে এই মহম্মদ হাদি?
ঔরংজেব যখন মহম্মদ হাদিকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন, তখন তিনি হায়দরাবাদের দেওয়ান ও ইয়েলকোণ্ডালের ফৌজদার। এ কাজে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন ও সম্রাটের নজরে পড়েন। ঔরংজেব মহম্মদ হাদিকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করে তাঁকে করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে ১৭০০ সালের নভেম্বরে বাংলায় পাঠান। করতলব বাংলায় আসেন ওই বছরের ডিসেম্বরে। বাংলার দেওয়ান পদের সঙ্গে তিনি মখসুদাবাদের ফৌজদার পদেও নিযুক্ত হন।৮
এই করতলব খাঁ ওরফে মহম্মদ হাদি জন্মসূত্রে কী ছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন, তিনি জন্মলগ্নে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং খুব সম্ভবত দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ।৯ তবে তিনি যে ব্রাহ্মণ ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ফারসি ইতিহাস মাসির-উল-উমারাতে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন বলে উল্লেখ আছে।১০ খুব অল্প বয়সেই তাঁকে কিনে নেন হাজি শফি ইস্পাহানি নামে এক পারসিক অভিজাত ব্যক্তি। হাজি সাহেব তাঁকে নিজের পুত্রের মতো বড় করে তোলেন এবং তাঁকে মহম্মদ হাদি নাম দেন। হাজি শফি বিভিন্ন সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ছিলেন, যেমন দেওয়ান-ই-তান (তান মানে তলব বা মাইনে), বাংলার দেওয়ান ও দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান ইত্যাদি।১১
হাজি শফি সম্ভবত ১৬৯০ সালে মুঘল রাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে পারস্য দেশে ফিরে যান। মহম্মদ হাদিও তাঁর মনিবের সঙ্গে ওদেশে চলে যান। কিন্তু হাজির মৃত্যুর পর তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং বেরার প্রদেশের দেওয়ান আবদুল্লা খুরাসানির অধীনে কার্যভার গ্রহণ করেন।১২ যেহেতু হাজি শফি এবং আবদুল্লা খুরাসানি দু’জনেই দেওয়ান ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করে মহম্মদ হাদি কিছুদিনের মধ্যেই রাজস্ব ব্যাপারে অত্যন্ত অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং হায়দরাবাদের দেওয়ান হিসেবে যথেষ্ট কৃতকার্য হন। তাই অতি সহজেই তিনি মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের নজরে পড়েন এবং সম্রাট তাঁকে বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না।
বাংলার দেওয়ানপদে করতলব খাঁর নিযুক্তি তৎকালীন সুবাদার শাহজাদা আজিম-উসশানের মোটেই মনঃপূত হয়নি। এতদিন তিনি নিজেই বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন— দেওয়ানির দেখাশোনাও তিনিই করতেন। এখন হঠাৎ করতলব খাঁ উড়ে এসে জুড়ে বসায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট কিন্তু যেহেতু করতলবকে স্বয়ং সম্রাট ঔরংজেব নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন, শাহজাদা আজিম মুঘল বাদশাহের পৌত্র হওয়া সত্ত্বেও করার কিছু ছিল না। এখানে মনে রাখা দরকার মুঘল শাসনব্যবস্থায় সুবাদার ও দেওয়ান দু’জনেই সম্রাটের দ্বারা নিযুক্ত হতেন এবং স্বাধীনভাবে নিজের নিজের শাসন পরিচালনা করতেন। সুবাদার ছিলেন সাধারণ শাসনব্যবস্থা ও সৈন্যবাহিনীর প্রধান, দেওয়ান ছিলেন রাজস্ববিভাগের দায়িত্বে। তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল রাজস্ব সংগ্রহ। তিনি কিন্তু সুবাদারের অধীন ছিলেন না, সোজা মুঘল সম্রাটের কাছেই ছিল তাঁর দায়বদ্ধতা। এহেন অবস্থায় দেওয়ান করতলব খাঁর আগমনে শাহজাদা আজিম খুবই মুশকিলে পড়ে যান কারণ রাজস্ব বিভাগের ওপর তার আর কোনও কর্তৃত্বই থাকল না। ফলে দিল্লির বাদশাহি মসনদের জন্য আসন্ন গৃহযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য বাংলা থেকে প্রয়োজনীয় অর্থভাণ্ডার সংগ্রহ করার পথে করতলব খাঁ প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠবে— এটা শাহজাদা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তাই প্রথম থেকেই তিনি করতলব খাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন।
করতলব বাংলায় এসেই সোজা রাজধানী জাহাঙ্গিরনগরে (ঢাকা) চলে গেলেন এবং সুবাদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে দেখা করলেন। তারপরই তিনি দেওয়ানি কাজে মনোনিবেশ করলেন। প্রথমেই তিনি রাজস্ব বিভাগের সব কর্মচারীকে তাঁর অধীনে এবং সুবাদার শাহজাদা আজিমের আওতার বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর তিনি রাজস্ব বিভাগে বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন, যাতে রাজস্ব বৃদ্ধি পায় এবং রাজস্বের অপচয় বন্ধ হয়। এ কাজে তিনি খুবই সাফল্য লাভ করেন যার ফলে প্রথম বছরেই তিনি মুঘল সম্রাট ঔরংজেবকে দাক্ষিণাত্যে এক কোটি টাকা পাঠাতে সমর্থ হন।১৩
এতে আজিম-উস-শান আরও ক্ষেপে গেলেন এবং করতলব খাঁকে একেবারে সরিয়ে দেবার জন্য মতলব ভাঁজতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নগদি সৈন্যদের (ভাড়াটে সৈন্য যারা নগদ টাকার বিনিময়ে সৈন্যবাহিনীতে কাজ করে) সর্দার আবদুল ওয়াহিদকে বশ করে করতলব খাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত করেন। নগদি সৈন্যরা বেশ কিছুদিন তাদের বেতন পায়নি বলে ক্ষুব্ধ ছিল। রাজস্ব বিভাগ থেকেই এই বেতন দেওয়া হত। তাই এজন্য করতলব খাঁকেই দায়ী করা হল এবং চক্রান্তে ঠিক করা হল যে মাইনে আদায় করার ভান করে নগদি সৈন্যরা করতলব খাঁকে রাস্তায় ধরবে এবং হইচই লাগিয়ে দেবে। ওই গণ্ডগোলের মধ্যে সুযোগ বুঝে করতলবকে হত্যা করা হবে।১৪
করতলব খাঁ রোজই সকালে সুবাদারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, কিন্তু তিনি খুব সতর্ক থাকতেন, কখনও একা যেতেন না— সব সময় সশস্ত্র হয়ে কিছু বিশ্বাসী ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতেন। একদিন সকালবেলা তিনি যথারীতি সুবাদারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় হঠাৎ আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে নগদি সৈন্যরা করতলবকে ঘিরে ফেলে তাদের বেতন দাবি করতে লাগল এবং প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু করে দিল। করতলব কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না, তিনি নগদি সৈন্যদের নিয়ে সোজা সুবাদারের কাছে চলে গেলেন। তিনি জানতেন এ চক্রান্ত সুবাদারেরই। তাই তিনি সোজা গিয়ে সুবাদারকে বললেন: ‘আপনিই আমাকে হত্যা করার জন্য এ চক্রান্ত করেছেন। মনে রাখবেন সম্রাট আলমগির খুব দূরে নন [তিনি সবই জানতে পারবেন]। এ রকম জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকুন, কারণ এতে সম্রাটের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। সাবধান! আমার প্রাণহানি করলে আপনিও প্রাণে বাঁচবেন না।’১৫
শাহজাদা আজিম-উস-শান করতলবের সাহস দেখে ও ঔরংজেবের শাস্তির ভয়ে খুব ঘাবড়ে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একদিকে আবদুল ওয়াহিদ ও তাঁর সৈন্যদের ডেকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন এবং তাদের কৃতকার্যের জন্য শাস্তি প্রদানের ভয় দেখালেন। অন্যদিকে ভালমানুষের মতো এ ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না বলে করতলবের কাছে সাফাই গাইলেন এবং ভবিষ্যতে করতলবের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেন। করতলব ফিরে এসে সব নথিপত্র তলব করলেন এবং নগদি সৈন্যদের সব প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে তাদের বরখাস্ত করে দিলেন। অন্যদিকে ওয়াকিয়ানবিশকে দিয়ে সব ঘটনার বিবরণ বাদশাহের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, নিজেও সমস্ত ঘটনার কথা লিখে সম্রাটকে জানান। সব খবর পেয়ে ঔরংজেব সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদা আজিমকে কড়া ভাষায় লিখে পাঠান: ‘করতলব খাঁ সম্রাটের একজন পদস্থ কর্মচারী। ওর শরীরের বা সম্পত্তির যদি বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়, তা হলে মনে রাখবে আমি তার শোধ তোমার ওপরই তুলব।’১৬
আসলে করতলব খাঁর ওপর ঔরংজেবের ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। যেহেতু একমাত্র করতলবই তাঁকে নিয়মিত অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই তিনি তাঁর ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এসব কারণে সুবাদার আজিম-উস-শান তাঁর পৌত্র হলেও, তিনি করতলবের ওপর আজিমের কোনও আঘাত বা বিদ্বেষ সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। এ সত্যটা করতলব খাঁও উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাই সুবাদার আজিমকে উপেক্ষা করতে কোনওরকমের দ্বিধা বোধ করেননি। বাংলায় আসার অল্প কিছুদিন পরেই, বিশেষ করে তাঁর প্রতি আজিম-উস-শানের বিরূপতা দেখে, করতলব ঔরংজেবকে জানান, যে তিনি বাংলায় আসাতে কিছু লোক খুবই অসন্তুষ্ট এবং তারা নানাভাবে সম্রাটকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার চেষ্টা করছে। সেজন্য তিনি ঔরংজেবকে অনুরোধ জানান তিনি যেন তাঁর জায়গায় অন্য লোক নিয়োগ করেন। বোঝাই যাচ্ছে, এ বিষয়ে সম্রাট কিছু না করলে তিনি পদত্যাগ করতে চান। ঔরংজেব সঙ্গে সঙ্গে লিখে পাঠালেন:১৭
আপনার বক্তব্য আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। দেওয়ান ও ফৌজদার হিসেবে আপনার পুরোপুরি ক্ষমতা— তাতে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। আপনার বিরুদ্ধে কারও কোনও অভিযোগই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনার ওপর আমার যে আস্থা এবং বিশ্বাস সে বিষয়ে আপনি সন্দেহ করছেন কেন? কোনও শয়তানের অভিসন্ধিই সফল হবে না। আল্লা আমাদের এইসব শয়তানের হাত থেকে নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন।… আপনার প্রতি আমার আস্থার কথা মনে রাখবেন, আমার নির্দেশগুলি খেয়াল রাখবেন, মনে কোনও শঙ্কা রাখবেন না। আরও বেশি মন দিয়ে রাজস্ব আদায় করে যান।
ঔরংজেব সত্যিই করতলব খাঁর ওপর খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন, বিশেষ করে তাঁর যোগ্যতা ও সততা দেখে ১৭০৪ সালে তিনি তাঁকে লেখেন: ‘একই ব্যক্তি হয়ে আপনি বাংলা ও বিহারের দেওয়ান, ওড়িষ্যার নাজিম ও দেওয়ান। আপনার পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও-সব অঞ্চলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এত কাজ করতে পারতাম না। একমাত্র আল্লার প্রসাদধন্য কোনও ব্যক্তিই এত যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে।’১৮
সে যাই হোক, করতলব খাঁ কিন্তু আজিম-উস-শান সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না। তাঁর ভয় হল শাহজাদা সুযোগ পেলেই আবার তাঁর প্রাণহানির চেষ্টা করতে পারেন। তাই তিনি সুবাদার থেকে দূরে কোথাও তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় সরিয়ে নিতে মনস্থ করলেন। এজন্য তিনি গঙ্গা (ভাগীরথী) তীরবর্তী মখসুদাবাদকে বেছে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তেই তিনি মখসুদাবাদকে দেওয়ানির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বলে সিদ্ধান্ত করেন।১৯ ওটা বাংলার প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে ওখান থেকে বাংলার প্রায় সব অংশের ওপর সুষ্ঠুভাবে নজর রাখা যাবে। সেদিক থেকে ঢাকার চেয়ে মখসুদাবাদের অবস্থান অনেক বেশি উপযোগী। তা ছাড়া, করতলব যেহেতু মখসুদাবাদের ফৌজদারও ছিলেন, সেজন্য তিনি ঢাকার চেয়েও ওখানে অনেক বেশি নিরাপদ ছিলেন। ওখানে তিনিই কর্ণধার, মুঘল অমাত্যদের মধ্যে ঢাকাতে তার স্থান ছিল দ্বিতীয়, সুবাদারের ঠিক পরে। মখসুদাবাদে তিনিই প্রধান। এখানে দেওয়ানি কার্যালয় সরিয়ে নেবার স্বপক্ষে তিনি হয়তো এটাও ভেবেছিলেন যে ওখান থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর নজরদারি করাও অনেকটা সুবিধেজনক হবে। এ সময় কোম্পানিগুলি গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল।২০
স্থানটি নির্বাচন করে সুবাদার শাহজাদা আজিম-উস-শানের অনুমতি না নিয়েই, দেওয়ানি কার্যালয়ের সব আমলা-কর্মচারীদের নিয়ে করতলব খাঁ মখসুদাবাদে চলে এলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে তিনি ঢাকা থেকে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কারদের তাঁর সঙ্গে করে মখসুদাবাদ নিয়ে এলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন বাংলায় জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদও।২১ ওখানে কাছারি ও অন্যান্য যাবতীয় বিভাগের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করে তিনি ওখান থেকেই দেওয়ানির কাজকর্ম পরিচালনা করতে শুরু করে দিলেন। এখানে লক্ষ করার বিষয়, তিনি সুবাদারকে না বলে, এমনকী তাঁর অনুমতি না নিয়েই, মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন তাঁর ওপর সম্রাট ঔরংজেবের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। শাহজাদা তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে নালিশ করলেও কোনও ফল হবে না।
করতলব খাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কিছুদিন পরেই ঔরংজেব আজিম-উস-শানকে বাংলা ছেড়ে বিহারে চলে যাবার নির্দেশ দেন। পুত্র ফারুখশিয়রকে ঢাকায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে শাহজাদা আজিম সপরিবারে পাটনায় আশ্রয় নেন এবং সেখানে থাকাই স্থির করেন। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে তিনি নিজের নামানুসারে পাটনার নতুন নামকরণ করেন আজিমাবাদ। অনুমান, তিনি ঢাকা ছেড়ে পাটনা যান ১৭০৩ সালে।২২ এর ফলে ঢাকায় সুবাদারের উপস্থিতি আর থাকল না, মখসুদাবাদই সুবার সব কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠল। এ ভাবে মখসুদাবাদে প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় স্থাপিত হল এবং পরে এটাই সুবার প্রাদেশিক সরকারের কেন্দ্র হয়ে উঠল।
এখানে স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল জাগতে পারে, করতলব খাঁ মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করার আগে জায়গাটা কেমন ছিল? গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস-সলাতিন থেকে জানা যায়, মখসুস খান নামে এক ব্যবসায়ী প্রথম জায়গাটির উন্নতিসাধন করেন। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে একজন মখসুস খানের নাম পাওয়া যায়, যিনি একজন মুঘল অমাত্য হিসেবে ষোড়শ শতকের শেষদিকে বাংলা ও বিহারে রাজকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। মুখসুস খান ওখানে একটি সরাই নির্মাণ করেন এবং স্থানটি তাঁর নামানুসারে মখসুদাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।২৩ ডাচ পর্যটক ভ্যালেন্টাইনের (Valentijn, ১৬৫৮-৬৪) ম্যাপে মখসুদাবাদকে গঙ্গার দুই শাখার মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ হিসেবে দেখানো হয়েছে।২৪ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন যে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবাদ আছে যে সুলতান হোসেন শাহের সময় মুখসূদন দাস নামে এক নানকপন্থী সন্ন্যাসী তাঁকে অসুখ থেকে সুস্থ করে তোলায় তিনি তাঁকে ওই স্থান দান করেন এবং ওই সন্ন্যাসীর নামানুসারে ওই স্থানটির নাম হয় মুখসুদাবাদ বা মখসুদাবাদ।২৫ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে কাশিমবাজারের মতো মখসুদাবাদও কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এবং সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেটা আরও বাড়তে থাকে। ফলে এখানে শাসনবিভাগের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়, যেটার উল্লেখ পাওয়া যায় ইংরেজ কোম্পানির এজেন্ট স্ট্রেনশ্যাম মাস্টার (Streynsham Master) ও উইলিয়াম হেজেসের (William Hedges) লেখায়।২৬
মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করে করতলব খাঁ রাজস্ববিভাগের সংস্কার ও রাজস্ববৃদ্ধিতে মনোযোগ দেন। সব ঠিকঠাক করে বাংলার রাজস্ব নিয়ে তিনি দাক্ষিণাত্যে সম্রাট ঔরংজেবের কাছে যাবেন স্থির করলেন। কিন্তু রাজস্বের হিসেব দাখিল করার জন্য প্রধান কানুনগো দর্পনারায়ণের সই দরকার ছিল। তিনি তাঁর প্রাপ্য তিনলক্ষ টাকা না দিলে সই করতে অস্বীকার করলেন। করতলব খাঁ এক লক্ষ টাকা দিতে রাজি হলেন। বাকিটা দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন কিন্তু দর্পনারায়ণ তাতে রাজি হলেন না। করতলব খাঁ অগত্যা দ্বিতীয় কানুনগো জয়নারায়ণকে দিয়ে সইসাবুদ করিয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে রওনা হলেন। বাদশাহি দরবারে পৌঁছে তিনি সম্রাট ঔরংজেব ও তাঁর মন্ত্রীদের প্রচুর পরিমাণ নগদ টাকা ও বাংলা থেকে আনা নানা দুর্লভ সামগ্রী উপহার দিলেন। আর রাজস্বের সব হিসাবপত্র বাদশাহের প্রধান দেওয়ানের কাছে পেশ করলেন।২৭
বাদশাহের দেওয়ান হিসাবপত্র পরীক্ষা করে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং করতলব খাঁর কাজকর্মের, বিশেষ করে রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য, ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্রাট ঔরংজেব করতলব খাঁর ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বহুমূল্য পোশাক, পতাকা, নাগরা ও তরবারি উপহার দিলেন। সর্বোপরি তিনি তাঁকে মুর্শিদকুলি খান উপাধিতে ভূষিত করলেন এবং তাঁর উপাধি অনুসারে মখসুদাবাদের নাম মুর্শিদাবাদ করার অনুমতি দিলেন। মুর্শিদকুলি মুখসুদাবাদে এসে নতুন নাম মুর্শিদাবাদ চালু করলেন এবং সেখানে একটি বাদশাহি টাঁকশালও স্থাপন করেন।২৮
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুর্শিদকুলি ঠিক কবে মখসুদাবাদ থেকে মুর্শিদাবাদ নাম চালু করলেন অর্থাৎ ঠিক কবে থেকে মুর্শিদাবাদের পত্তন হল? স্যার যদুনাথ সরকার এক জায়গায় বলছেন ১৭০২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সম্রাটের কাছ থেকে করতলব খাঁ মুর্শিদকুলি উপাধি পান।২৯ তা যদি হয়, তা হলে দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসে তিনি মখসুদাবাদের নতুন নাম মুর্শিদাবাদ চালু করেছিলেন ১৭০৩ সালের আগে নয় কারণ দাক্ষিণাত্য থেকে মখসুদাবাদ ফিরতে তো দু’-তিন মাস সময় অবশ্যই লেগেছিল। অন্যত্র স্যার যদুনাথ লিখেছেন (একই প্রবন্ধে) যে করতলব খাঁ মখসুদাবাদে তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করার অনেক বছর পরে মুঘল সম্রাটের অনুমতি নিয়ে তিনি মখসুদাবাদের নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ।৩০ কিন্তু তিনি নির্দিষ্টভাবে কোন সালের কথা বলেননি। তারিখ-ই-বংগালা ও রিয়াজ-উস-সলাতিনের বিবরণ অনুযায়ী যে মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠা ১৭০৪ সালে। আধুনিক গবেষক আবদুল করিমও মনে করেন যে মুর্শিদাবাদের পত্তন হয় ১৭০৪ সালেই। মনে হয় এটাই ঠিক কারণ মুর্শিদকুলি যখন দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরছেন তখন ইংরেজ কোম্পানির কটকের ভারতীয় প্রতিনিধি (ভকিল—vakil) তাঁর সঙ্গে কটকে দেখা করেন এবং সেটা ১৭০৪ সালের গোড়ার দিকেই। তা ছাড়া মুর্শিদাবাদের টাঁকশালে প্রথম যে মুদ্রা তৈরি হয় তাতেও ১৭০৪ সালই লেখা ছিল। সুতরাং সব দিক থেকে বিবেচনা করে মনে হয় মুর্শিদাবাদের পত্তন হয়েছিল ১৭০৪ সালেই।৩১
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. J. N. Sarkar, A Short History of Aurangzeb; Satish Chandra, Mughal India.
২. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, Sushil Chaudhury, From Prosperity to Decline— Eighteenth Century Bengal, পৃ. 2-৪।
৩. রিয়াজ-উস-সলাতিন, পৃ. ৪।
৪. ঐ।
৫. S. C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. III, p. 160.
৬. Bermier, Travels, p. 440.
৭. J. N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, pp. 402-403.
৮. Abdul Karim, Murshid Quli Khan and His Times, p. 16; J. N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, p. 400.
৯. J. N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, p. 400.
১০. Maasir-ul-Umara, vol. III, p. 751.
১১. Maasir-i-Alamgiri, quoted in Abdul Karim, Murshid Quli, p. 15.
১২. রিয়াজ, পৃ. ২৫৪, টীকা, ৫৫; J.N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, p. 400; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 15-16.
১৩. Abdul Karim, Marshid Quali, pp. 16-14; রিয়াজ, পৃ. ২৪৮, History of Bengal, vol. II, p. 401.
১৪. রিয়াজ, পৃ. ২৪৯; J. N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, pp. 403-4; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 19-20.
১৫. J. N. Sarkar (ed.), History of Bengal, vol. II, pp. 403-4; Abdul Karim, Murshid Quli. pp. 20; তারিখই-ই-বংগালা, পৃ. ২৮.
১৬. রিয়াজ, পৃ. ২০৫।
১৭. ইনায়েৎউল্লা, আহকাম-ই-আলমগিরি, পৃ. ২১৮, History of Bengal, vol. II, p. 401-তে উদ্ধৃত।
১৮. আহকাম-ই-আলমগিরি, পৃ. ১৯৮, History of Bengal, vol. II, p. 402-তে উদ্ধৃত।
১৯. Abdul Karim, Murshid Quli, p. 21; History of Bengal, vol. II, p. 404.
২০. K.M. Mohsin, A Bengal District in Transition: Murshidabad, 1765-93, pp. 5- 6; Abdul Karim, Murshid Quali, pp. 21; History of Bengal, vol II, p. 404; রিয়াজ, পৃ. ২৫১-৫২।
২১. K. M. Mohsin, Murshidabad, p. 6; Abdul Karim, Murshid Quli, p.98.
২২. তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ২৯; রিয়াজ, পৃ. ২৫০; Abdul Karim, Murshid Quli, p. 22.
২৩. রিয়াজ, পৃ. ২৮; Mohsin, Murshidabad, p. 4.
২৪. ঐ, পৃ. ৪।
২৫. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৩৩৮-৩৯।
২৬. Mohsin, Murshidabad, p. 4, f.n. 5.
২৭. রিয়াজ, পৃ. ২৫২-৫৩; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৩৩৮।
২৮. History of Bengal, vol. II, p. 404; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 22-23.
২৯. History of Bengal, vol. II, p. 399.
৩০. ঐ, পৃ. ৪০৪।
৩১. Abdul Karim, Murshid Quli, p. 23 and f.n. 2 same page.
০৩. মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ – নবাবি আমল
নবাবি আমলেই মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ, এ কথা সর্বতোভাবে স্বীকার্য। নবাবি আমল বলতে অবশ্য আমরা স্বাধীন নবাবি আমলের কথাই বলছি অর্থাৎ মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত, তার মানে পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত। তারপর মুর্শিদাবাদে কিছুদিন নবাব অধিষ্ঠিত ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সে নবাবরা ইংরেজদের হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। ফলে মুর্শিদাবাদের গৌরবময় দিনের অবসান সিরাজদ্দৌলার পর থেকেই। পলাশির পর ইংরেজরা পর্যায়ক্রমে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয় এবং মুর্শিদাবাদের পরিবর্তে কলকাতা হয়ে ওঠে বাংলার প্রাণকেন্দ্র। ফলে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদকুলি খান
মুর্শিদকুলি শুধু মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তনই করেননি, এর উন্নতিকল্পে তাঁর অবদান অনেকখানি। অবশ্য এখানে বলা প্রয়োজন, তখনকার বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও মুর্শিদকুলির সহায়ক হয়েছিল যার ফলে তিনি মুর্শিদাবাদকে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি যে মুর্শিদকুলি একই সঙ্গে মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের বিশেষ বিশ্বাসভাজন ও প্রীতিভাজন হয়ে উঠেছিলেন যার ফলে স্বয়ং সম্রাটের পৌত্র ও বাংলার সুবাদার শাহজাদা আজিম-উস-শানকে উপেক্ষা করেই তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, ঔরংজেব যখন আজিম-উস-শানের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে (মুর্শিদকুলির প্রতি বিরূপতা ও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য) তাঁকে বাংলা ছেড়ে পাটনা চলে যাবার নির্দেশ দিলেন, তখন শাহজাদা আজিম তাঁর পুত্র ফারুখশিয়রকে বাংলায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে পাটনা চলে গেলেন। কিন্তু সম্রাট ঔরংজেব ফারুখশিয়রকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন মুর্শিদকুলির পরামর্শমতো রাজকার্য চালান।১ ফলে কার্যত মুর্শিদকুলিই বাংলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদও বাংলায় প্রাদেশিক সরকারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদেরও গুরুত্বও অনেক বেড়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদ শহরের বিস্তৃতি ও প্রতিপত্তি সমান তালে বৃদ্ধি পেতে লাগল।
বস্তুতপক্ষে ১৭০৭ সালে সম্রাট ঔরংজেবের মৃত্যু পর্যন্ত মুর্শিদকুলিই ছিলেন বাংলার সর্বেসর্বা। ঔরংজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট হলেন প্রথম বাহাদুর শাহ। তিনি পুত্র আজিম-উস-শানকে আবার বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিন্ত আজিম দিল্লিতে তাঁর পিতার কাছেই থাকতে লাগলেন এবং তাঁর পুত্র ফারুখশিয়রকে নায়েব সুবাদার করে বাংলার শাসনভার তাঁর ওপরই ন্যস্ত করলেন। প্রথম বাহাদুর শাহের রাজত্বের প্রথমদিকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মুর্শিদকুলিকে বাংলার ‘ডেপুটি গভর্নর’(সুবাদার) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আজিম-উস- শান তাঁর বহুদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু মুর্শিদকুলির ওপর বদলা নেবার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাঁর বৃদ্ধ ও দুর্বল পিতা সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের ওপর তাঁর প্রভাব খাটিয়ে মুর্শিদকুলিকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করলেন। মুর্শিদকুলিকে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান করে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফলে পুরো দু’বছর, ১৭০৮ থেকে ১৭০৯, তাঁকে বাংলার বাইরে কাটাতে হল।২
কিন্তু ১৭১০ সালে আবার মুর্শিদকুলিকে বাংলার দেওয়ান করে ফিরিয়ে আনা হল। এর প্রধান কারণ শাহজাদা আজিম-উস-শান বুঝতে পেরেছিলেন যে দিল্লির মসনদের জন্য যে লড়াই আসন্ন, এবং যাতে তিনি নিজে একজন প্রধান অংশগ্রহণকারী হবেন, তাতে যত বেশি সংখ্যক মুঘল মনসবদার ও অমাত্যদের সমর্থন লাভ করতে পারবেন, ততই তাঁর শক্তিবৃদ্ধি হবে। সেজন্য তিনি মুর্শিদকুলির সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলে তাঁকে নিজের দলে আনার চেষ্টা করলেন। এর ফলেই মুর্শিদকুলি বাংলার দেওয়ান পদে পুনরায় নিযুক্ত হতে পারলেন। আর কাগজে কলমে তখনও বাংলার সুবাদার রইলেন আজিম-উস-শান।৩
তারপর দিল্লিতে চলল রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা। সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর (১৭১২) যে গৃহযুদ্ধ শুরু হল, তাতে আজিম-উস-শান নিহত হলেন এবং সম্রাট হলেন জাহান্দার শাহ।৪ তাঁর পরে সম্রাট হলেন ফারুখশিয়র (১৭১৩)। তিনি তাঁর শিশুপুত্র ফরখুন্দা শিয়রকে কাগজে কলমে বাংলার সুবাদার পদে নিযুক্ত করেন এবং মুর্শিদকুলি হলেন বাংলার ডেপুটি সুবাদার। শেষ পর্যন্ত সম্রাট ফারুখশিয়র ১৭১৬/১৭ সালে মুর্শিদকুলিকে জাফরখান নাসিরি উপাধি দিয়ে বাংলার সুবাদার পদে অভিষিক্ত করেন। ১৭২৭ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মুর্শিদকুলি একাদিক্রমে বাংলার সুবাদার ও দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এভাবে তিনি ১০ বছরের বেশি বাংলার সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেরে শাসন করে গেছেন। এটা সাধারণ মুঘল শাসনব্যবস্থার যে রীতিনীতি ছিল তার সম্পূর্ণ এবং একমাত্র ব্যতিক্রম। একমাত্র মুর্শিদকুলিই সুবাদার ও দেওয়ান এ দুটি পদের অধিকারী হতে পেরেছিলেন।৪ স্যার যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে মুর্শিদকুলি ১৭১৭ সালে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন কিন্তু আব্দুল করিম তাঁর গবেষণায় দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে সালটা আসলে ১৭১৬, ১৭১৭ নয়। মনে হয় আব্দুল করিমের বক্তব্যই সঠিক।৫
সে যাই হোক, একাধারে বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার পদে মুর্শিদকুলির নিযুক্তি মুর্শিদাবাদের ইতিহাসেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ঢাকার বদলে মুর্শিদাবাদই এখন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদ হয়ে উঠল বাংলার প্রাণকেন্দ্র, রাজতন্ত্র ও শাসনযন্ত্রের সব ক্রিয়াকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এ অবস্থা চলল সিরাজদ্দৌলা পর্যন্ত, অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধ অবধি। তারপরই বাংলায় স্বাধীন নবাবি আমলের পরিসমাপ্তি। তারপরের নবাবরা মূলত ইংরেজদের ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। ইংরেজরাও ধীরে ধীরে কলকাতাকে সব ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল করে তুলল। ফলে মুর্শিদাবাদ স্বাধীন নবাবি আমলের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
মুর্শিদকুলিই বাংলায় নিজামত বা নবাবির প্রতিষ্ঠাতা। দিল্লির মুঘল বাদশাহদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল, তিনি শুধু নিয়মিত বাংলার রাজস্ব দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতেন। দিল্লিতে তখন ডামাডোল, একের পর একজন দিল্লির মসনদ দখল করছেন, মুর্শিদকুলি কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। দিল্লিতে যিনিই বাদশাহ হচ্ছেন, মুর্শিদকুলি তাঁকেই রাজস্ব পাঠাচ্ছেন, কোনওরকমের ভেদাভেদ না করে। তিনি জানেন, বাংলার রাজস্ব ছাড়া দিল্লির কোনও বাদশাহেরই চলবে না। তাই তাঁরা কেউই মুর্শিদকুলিকে ঘাঁটাতে যাবেন না, বাংলায় তিনি যা করতে চাইবেন, তাই করতে পারবেন। এভাবেই তিনি বাংলায় নিজামত এবং স্বাধীন নবাবি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পর বাংলার অন্য নবাবরাও তাঁর নীতি অনুসরণ করে বাংলা থেকে নিয়মিত রাজস্ব পাঠিয়েছেন, দিল্লিও বাংলা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। নবাব আলিবর্দি খানের রাজত্বের প্রথম কয়েক বছর অবধি নিয়মিত এ রাজস্ব পাঠানো হয়েছিল। মনে হয় ১৭৪০-এর দশকের প্রথম কয়েক বছরের পর, সম্ভবত মারাঠা আক্রমণের জন্য, এ রাজস্ব পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।৬
১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করার পর থেকেই একদিকে যেমন সেখানে লোক সমাগম বেড়ে যায় তেমনই অন্যদিকে শাসনকার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন দফতরের জন্য নির্মাণকার্যও শুরু হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমিদারদের আমলারা, দেওয়ানি কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সব কানুনগো ও অন্যান্য কর্মচারীরা সবাই ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসে। তা ছাড়া বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার-মহাজনও, যাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান জগৎশেঠ পরিবার, নতুন সুযোগের সন্ধানে ঢাকা থেকে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন।৭ এ ছাড়াও, মুর্শিদকুলির রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের ফলে যে নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী শ্রেণির আবির্ভাব হয় মুর্শিদাবাদ তাদেরও প্রধান আস্তানা হয়ে ওঠে।৮ শুধু তাই নয়, মুর্শিদাবাদ প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় ও পরে রাজধানী হওয়ার ফলে তার গুরুত্ব এতই বেড়ে যায় যে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে, কাশিমবাজারে, তাদের কুঠিগুলিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে, যদিও অবশ্য তাদের কাছে কাশিমবাজার কুঠিগুলির প্রয়োজনীয়তা কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহের জন্য।
দেওয়ানির পরে যখন মুর্শিদকুলিকে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত করা হল, তখন মুর্শিদাবাদই বাংলার রাজধানীতে পরিণত হল। ফলে সেখানে শুধু রাজকর্মচারী নয়, ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার থেকে শুরু করে নানারকম অসংখ্য লোকের আনাগোনাও শুরু হয়ে গেল এবং এদের মধ্যে অনেকেই নতুন রাজধানীতে তাদের আস্তানা পাতল। এভাবে মুর্শিদাবাদ বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম শহর হয়ে উঠল। শুধু ভারতীয় বা এশীয় বণিকরা নয়, অনেক বিদেশি বণিকরাও মুর্শিদাবাদে ঠাঁই করে নিল। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আর্মানিরা। মুর্শিদাবাদের পার্শ্ববর্তী সৈয়দাবাদে তারা নিজেদের একটি বসতি স্থাপন করে সেখানে একটি গির্জাও প্রতিষ্ঠা করল।৯ ফরাসিরাও এখানে একটি কুঠি তৈরি করে।১০ তা ছাড়া মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজার বাংলার বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানে এশিয়া ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ী, সওদাগর, ব্যাঙ্কার-মহাজনদের শুধু নয়, প্রায় সব প্রধান ইউরোপীয় কোম্পানিরও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।১১ এসব কারণে মুর্শিদাবাদের গুরুত্বও অনেক বেড়ে যায়।
মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি কার্যালয় নিয়ে আসার পরে স্বাভাবিক কারণেই মুর্শিদকুলি বিভিন্ন দফতরের জন্য নির্মাণকার্য শুরু করে দেন। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিম জানাচ্ছেন, দুঘরিয়ার ঊষর ও নির্জন প্রান্তরে মুর্শিদকুলি একটা প্রাসাদ, দেওয়ানখানা (Board of Revenue), খালসা খাজাঞ্চিখানা (Court of Exchequer) প্রভৃতি তৈরি করেন।১২ তা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের সুবিধের জন্য তিনি একটি সরাইখানা তৈরি করেন, তার মধ্যে একটি মসজিদও। তিনি যখন বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন এবং মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়, তখন সেখানকার নির্মাণকার্য স্বভাবতই অনেক বেড়ে যায়। তিনি মুর্শিদাবাদে একটি টাঁকশালও স্থাপন করেন এবং সেখানে যে মুদ্রা তৈরি হত তাতে লেখা থাকত ‘মুর্শিদাবাদ টাঁকশালে তৈরি’।১৩ তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদের পূর্ব প্রান্তে তাঁর খাস তালুকে তিনি একটি খাজাঞ্চিখানা, একটি কাটরা ও মসজিদ এবং বিরাট একটি জলাশয় নির্মাণ করেন। ওই মসজিদের সিঁড়ির তলায় তিনি নিজের সমাধিক্ষেত্রও বানিয়ে নেন। মৃত্যুর পর তাঁকে ঐখানে সমাধিস্থ করা হয়।১৪ এটি ‘জাফর খানের কাটরা’ নামে পরিচিত।
মুর্শিদকুলির সময় মুর্শিদাবাদের নানারকমের উৎসব ও জাকজমক ছিল দেখবার মতো। তার মধ্যে একটি ছিল পুণ্যাহ, চৈত্র মাসের শেষে জমির রাজস্ব আদায় শেষ হওয়ার পর বৈশাখের প্রথমদিকে হত পূণ্যাহ। ওইদিন মুর্শিদাবাদে সব জমিদাররা বা তাদের প্রতিনিধিরা হাজির হত। মহাসমারোহে চলত পুণ্যাহের উৎসব।১৫ বাংলা থেকে দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর ব্যাপারটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রত্যেক বছরই মুর্শিদকুলি রাজস্ব বাবদ নগদ ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা করে পাঠাতেন। তা ছাড়াও খালসা জমি থেকে প্রাপ্ত আয় এবং বাংলা থেকে বহুবিধ চিত্তাকর্ষক জিনিসপত্র রাজস্বের সঙ্গে যেত। এ সবই দু’শোটি শকটে বোঝাই করে ছ’শো অশ্বারোহী ও পাঁচশো পদাতিক সৈন্যের পাহারায় মুর্শিদকুলি নিজে মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। তবে সবচেয়ে বড় জাঁকজমক দেখা যেত হজরত মহম্মদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে। এটা হত রবি-উল-আওয়াল মাসের পয়লা তারিখ থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত। এ ক’দিন নবাব মুর্শিদাবাদ ও নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে জ্ঞানীগুণী, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধুসন্ত, ফকির, শেখ, সৈয়দ, ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে মজলিসে নেমন্তন্ন করে সবাইকে পানাহারে আপ্যায়িত করতেন। শুধু তাই নয়, ওই ক’দিন ভাগীরথীর দক্ষিণে লালবাগ থেকে পশ্চিম তীরের উত্তরে শাহিনগর পর্যন্ত নদীর দু’ধারেই হাজার হাজার চিরাগবাতি দিয়ে সাজানো হত। ওই সব চিরাগের আলোতে মসজিদ, মিনার, গাছপালায় কোরানের শ্লোক ও নানাবিধ কবিতা ফুটে উঠে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হত। মুর্শিদকুলির নির্দেশে নাজির আহমেদ চিরাগের আলো জ্বালাবার জন্য প্রায় এক লক্ষ লোক নিয়োগ করতেন। সন্ধের সময় একবার তোপধ্বনি করে আলো জ্বালাবার সংকেত দেওয়া হত এবং সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার চিরাগবাতি জ্বলে উঠে এক অপূর্ব সুন্দর বাতাবরণের সৃষ্টি করত। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিমের ভাষায় ‘producing an illusion as if a sheet of light had been unrolled, or as if the earth had become a sky studded with stars’.
মুঘলধারা অনুসরণ করে মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারও শুরু করেন। বলা বাহুল্য এ দরবারে রাজ্যের অমাত্যরা শুরু করে ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী, বিদেশি পর্যটক, ইউরোপীয় কোম্পানিরগুলির প্রতিনিধিরা নিয়মিত উপস্থিত হতেন। মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনবিভাগের সংস্কারের ফলে বাংলায় শুধু নতুন এক ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার-মহাজন শ্রেণির আবির্ভাব হয়নি, নতুন এক বড় বড় জমিদার শ্রেণি ও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও উদ্ভব হয়। এদের মধ্যে অনেকেরই নবাবি দরবারে যাতায়াত ছিল। এ দরবারের জাঁকজমক পরবর্তী নবাবদের সময় অনেক বেড়ে যায়। যেহেতু মুর্শিদকুলি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, সেজন্য ধর্মের প্রতিপালনেও তিনি যথেষ্ট নজর দিতেন, যেটা তাঁর পরে বাংলার নবাবদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। রোজ কোরানপাঠ ও মালাজপ করার জন্য তিনি আড়াই হাজার কোরানে পারদর্শী ব্যক্তি ও তসবি (মালাজপক) নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর নিজের রসুইখানা থেকে রোজ দু’বেলা এদের খাবার পরিবেশন করা হত।১৬
যতদূর জানা যায়, তাতে মনে হয় মুর্শিদকুলির সময় মুর্শিদাবাদের সাধারণ লোকদের অবস্থা বেশ ভালই ছিল। এখানে প্রথমে দেওয়ানি ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে নানারকমের নির্মাণকার্য এবং ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী, জমিদার, অমাত্য এ সবের আনাগোনার ফলে কাজকর্মের এবং আয়ের পথও বেশ সুগম হয়। তা ছাড়া মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদ থেকে (সারা বাংলা থেকেও বটে) বাইরে চাল রফতানি একদম বন্ধ করে দেন। অথচ বহুদিন থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে, এমন কী লোহিত সাগর ও পারস্য সাগর অঞ্চলেও, বাংলা থেকে চাল রফতানি হত।১৭ যাই হোক, মুর্শিদকুলি চাল রফতানি বন্ধ করার ফলেই সম্ভবত তাঁর সময় মুর্শিদাবাদে চালের দাম ছিল, গোলাম হোসেন সলিমের তথ্য অনুযায়ী, টাকায় ৫ থেকে ৬ মণ, যদিও সলিমুল্লা বলছেন, টাকায় ৪ মণ। সে অনুপাতে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ছিল সস্তা। ফলে রিয়াজের লেখক বলছেন, মুর্শিদাবাদের লোকেরা তখন মাসে এক টাকা খরচ করলেই পোলাও, কালিয়া খেতে পারত। এটা হয়তো অত্যুক্তি, যদিও এ থেকে অনুমান করা যায় সাধারণ লোকদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছলই ছিল।১৮
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুর্শিদকুলির আমলে বাঙালি হিন্দুদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়। মুসলমান রাজত্ব হলেও তিনি বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগে বাঙালি হিন্দুদেরই শুধু নিযুক্ত করেছিলেন। তার অন্যতম কারণ অবশ্য বাঙালি হিন্দুরা যেমন ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিল, তেমনি রাজস্বের ব্যাপারেও তাদের বেশ দক্ষতা ছিল। তা ছাড়া মুর্শিদকুলির ধারণা ছিল হিন্দুরা রাজস্বের হিসেবে গরমিল করলে বা তা আত্মসাৎ করলে তিনি তাদের কড়া শাস্তি দিতে পারবেন, যেটা মুসলমান কর্মচারী হলে তাঁর পক্ষে করা অসুবিধেজনক ছিল। শাস্তির ভয়ে হিন্দুরা তহবিল তছরূপ বা রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে কোনওরকমের অবহেলা করবে না। তারিখ-ই-বংগালার লেখক সলিমুল্লা লিখছেন:১৯
Murshed Kuli Khan employed none but Bengally Hindoos in the collection of revenues, because they are most easily compelled by punishment to discover their malpractices, and nothing is to be apprehended from their pusillanimity.
বলা বাহুল্য, মুর্শিদাবাদে সদর দেওয়ানি কার্যালয় অবস্থিত হওয়ার ফলে উক্ত কর্মচারীদের মধ্যে, বিশেষ করে যারা উচ্চপদস্থ, তাদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদেই বসবাস করতে শুরু করে। তাতে মনে হয় মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যায় সাম্প্রদায়িক অনুপাতে অনেকটা ভারসাম্য দেখা যায়। রিয়াজের লেখক বলছেন এ সময় মুর্শিদাবাদের জনসাধারণ নবাবদের কল্যাণে দিল্লি তথা উত্তর ভারতের লোকদের সঙ্গে মেলামেশা ও কথাবার্তা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেদের চালচলন, কথাবার্তা ও ব্যবহারে দিল্লি ও উত্তর ভারতের লোকদের মতো অনেকটা পরিশীলিত হয়ে ওঠে, যেটা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না।২০
সুজাউদ্দিন
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর (১৭২৭) পর তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খান বাংলার মসনদে বসেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ পিতা সুজাউদ্দিন খান, যিনি তখন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর বা ছোট নবাব ছিলেন, মুর্শিদকুলির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মসনদের লোভে মুর্শিদাবাদের দিকে ছুটে আসেন এবং মুর্শিদকুলির প্রাসাদ চেহেল সুতুনে (‘palace of forty pillars’—চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদ— মুর্শিদকুলির তৈরি) নিজেকে বাংলার সুবাদার বা নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন। সরফরাজ কিন্তু এটা মোটেই মেনে নিতে চাননি এবং সুজাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁর চরিত্রের যতই দোষ থাক, তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। তাঁর মা, সুজাউদ্দিনের পত্নী, জিন্নতউন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও গুণবতী মহিলা। তাই স্বামী সুজাউদ্দিনের উচ্ছৃঙ্খল চরিত্র ও নারী সম্ভোগে চরম আসক্তি দেখে তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বামীকে ছেড়ে তাঁর পিতার কাছে চলে আসেন। কিন্তু সরফরাজ যখন তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইলেন, তখন তাঁর দিদিমা, মুর্শিদপত্নী নাসিরা বানু বেগম, ও মা জিন্নতউন্নেসা তাঁকে তা থেকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন যে সুজাউদ্দিন বৃদ্ধ হয়েছেন, বেশিদিন রাজত্ব করতে পারবেন না। তাই কিছুদিনের মধ্যে সরফরাজ নবাব হতে পারবেন— সুতরাং শুধু শুধু রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন নেই। সরফরাজ দিদিমা ও মায়ের কথা মেনে নিয়ে, পিতা সুজাউদ্দিনকে নবাব/সুবাদার হিসেবে স্বীকার করে নিলেন।২১
মসনদে বসার কিছুদিনের মধ্যেই সুজাউদ্দিন শুধু ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিলেন না, সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ দরবারকে নতুন করে সাজিয়ে জাঁকজমক পূর্ণ করে তুলতে লেগে গেলেন। বয়স হয়ে গেলেও তিনি জীবনের আনন্দসম্ভোগ ছেড়ে দিতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। বরং নবাব হওয়ার পর ক্ষমতা ও অর্থের অধিকারী হয়ে তাতে আরও ডুবে গেলেন। তাঁর আনুষঙ্গিক হিসেবে তিনি মুর্শিদাবাদকে ঢেলে সাজাতে চাইলেন। মুর্শিদকুলির তৈরি প্রাসাদ ও অন্যান্য ইমারত ছোট ছোট বলে তাঁর একেবারে পছন্দ ছিল না। তাই তিনি মুর্শিদকুলির প্রাসাদ ভেঙে একটি প্রশস্ত প্রান্তরে বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তা ছাড়াও তিনি একটি অস্ত্রাগার, একটি অত্যুচ্চ তোরণ, একটি দেওয়ানখানা (revenue court), চল্লিশটি স্তম্ভের ওপর চেহেল-সুতুন নামে একটি প্রাসাদ (palace of forty pillars), একটি ব্যক্তিগত দফতর (private office– খিলওয়াত খানা), একটি জুলুসখানা (reception hall) ও একটি খালিসা কাছারি (court of exchequer— ফরমানবাড়ি) নির্মাণ করেন। শুধু তাই নয়, মুর্শিদকুলির সময়কার রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী নাজির আহমেদকে ফাঁসিতে ঝোলাবার পর মুর্শিদাবাদের অদূরে ভাগীরথী তীরে তিনি যে মসজিদ ও উদ্যান নির্মাণ শুরু করেছিলেন, সুজাউদ্দিন সেটা সম্পূর্ণ করেন। সেখানেও তিনি প্রাসাদ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন এবং তাঁর নাম দেন ফরাহবাগ বা ফর্হাবাগ। সেখানে তিনি সারা বছর পিকনিক ও নানারকমের আনন্দ উৎসব করতেন। আর বছরে একবার তাঁর দরবারের উচ্চপদস্থ ও শিক্ষিত কর্মচারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করতেন।২২
সরফরাজ
নবাব সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর (১৭৩৯) সরফরাজ নবাব হলেন। যদিও সমসাময়িক কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেছেন যে তিনি তাঁর পিতার মতোই নারীসম্ভোগ ও বিলাসব্যসনে লিপ্ত ছিলেন,২৩ তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি খান কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা লিখছেন। ইউসুফ আলির ভাষ্য অনুযায়ী সরফরাজের ভোগবিলাসের প্রতি কোনও আসক্তি ছিল না, তিনি নিয়মিত দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন।২৪ সে যাই হোক, তাঁর সময় মুর্শিদাবাদ দরবারে বিশেষ জাঁকজমকের ব্যবস্থা তেমন দেখা যায় না। তাঁর পিতার মতো প্রাসাদ, ইমারত ইত্যাদি নির্মাণও তাঁর রাজত্বে চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ অবশ্য তিনি মাত্র বছরখানেকই রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। তিনি মসনদে বসার পরই সুজাউদ্দিনের দরবারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী তিন অমাত্য/পারিষদ, যাঁদের ‘ত্রয়ী’ বলা হয়— দেওয়ান আলমচাঁদ, ব্যাঙ্কার জগৎশেঠ ফতেচাঁদ ও সৈয়দ আহমেদ— এবং যাঁদের হাতে নবাব সুজাউদ্দিনের সময় বাংলার শাসনক্ষমতাই চলে গেছল, তাঁরা সরফরাজকে সরিয়ে আলিবর্দিকে বাংলার নবাব করার ষড়যন্ত্র করেন। আলিবর্দি, যাঁকে সুজাউদ্দিন বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন, গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০ সালে) সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদ দখল করে নেন।
আলিবর্দি খান
আলিবর্দির শাসনকালে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ওপর দিয়ে বিরাট ঝড় বয়ে যায়। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত মারাঠারা প্রায় প্রত্যেক বছরই বাংলায় লুঠতরাজ চালায়। তাই আলিবর্দি মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করতে তাঁর রাজত্বের অনেকটা সময়ই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া, এ সময় তাঁকে বিহারে আফগান বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হতে হয়। ফলে তাঁর সময় মুর্শিদাবাদ দরবারের জাঁকজমক তেমন চোখে পড়ে না। মারাঠা আক্রমণের ঢেউ মুর্শিদাবাদেও আছড়ে পড়ে। যেহেতু মারাঠাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল টাকাকড়ি ও ধনসম্পত্তি সংগ্রহ করা এবং যেহেতু রাজধানী মুর্শিদাবাদে নবাব ও তাঁর ধনী অমাত্যরা ছাড়াও বহু বড় বড় ধনী ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ীদের আবাস, তাই মারাঠাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুর্শিদাবাদ। ফলে এ সময় মুর্শিদাবাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ব্যাহত হয়, কারণ মারাঠাদের লুঠতরাজের ভয়ে বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন-ব্যবসায়ী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যেত এবং এ কারণে মুর্শিদাবাদে নগদ টাকা ও ধার জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। দু’-একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।
১৭৪২ সালের ৭ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতায় জানাচ্ছে যে মারাঠা আক্রমণের ভয়ে জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে গেছেন, তাই কোনও শরাফ বা মহাজনই মুর্শিদাবাদে থাকা নিরাপদ মনে করছে না। একমাত্র জগৎশেঠরা ফিরে এলে তারা নিশ্চিন্ত বোধ করবে। ফলে মুর্শিদাবাদের বাজারে নগদ টাকার যথেষ্ট অভাব দেখা দিয়েছে, ধার পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাই নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।২৫ ১৪ জুন কাশিমবাজার থেকে কুঠিয়ালরা জানাচ্ছে, জগৎশেঠ ফিরে এসেছেন, তা দেখে অন্য ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারও, তাই বাজারে টাকার আর কোনও অভাব নেই।২৬ আবার ১৭৪৩ সালে মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কায় জগৎশেঠরা যখন মুর্শিদাবাদ থেকে পালালেন, তখন ওই বছর জুন মাসে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি থেকে জানাচ্ছে যে ‘এখানে কোনও ধার পাওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়েছে কারণ জগৎশেঠরা শহর ত্যাগ করার ফলে বাজারে নগদ টাকার নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে।’২৭ আবার ২ জুলাই তারা লিখছে, ‘জগৎশেঠ ফতেচাঁদ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন এবং কাশিমবাজারে এখন টাকার প্রাচুর্য, ধার পাওয়াও অনেক সহজ।’২৮ ১৭৪২ সালে মীর হাবিবের প্ররোচনায় মারাঠারা মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে লুঠতরাজ চালায়, জগৎশেঠের বাড়ি থেকে তারা মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়াও নগদ ২ কোটি টাকা লুঠ করে নিয়ে যায় (মুজাফফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী ৩ লক্ষ)।২৯
তবে মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের অর্থনীতি ও শিল্পবাণিজ্যে এক বিরাট বিপর্যয় দেখা দেয় বলে অনেক ঐতিহাসিকের যে অভিমত, তা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত।৩০ মারাঠা আক্রমণ ও লুঠতরাজ কিছুটা বিপর্যয় ঘটিয়েছিল সন্দেহ নেই, তবে সেটা সাময়িক এবং কোনও কোনও অঞ্চলেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিল। মারাঠারা বাংলা ও মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়— বর্ষা শুরু হবার আগেই তারা বাংলা থেকে ফিরে যেত এবং বর্ষা শেষ হবার পর আবার ফিরে আসত। ফলে বাংলার কৃষক কারিগররা মারাঠারা চলে যাবার পর তাড়াতাড়ি তাদের কাজকর্ম শুরু করে দিত আবার মারাঠারা ফিরে আসার আগে ফসল তুলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেত। তা ছাড়া মারাঠারা মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট পথ ধরেই আক্রমণ করতে আসত এবং সে পথের দু’ধারেই শুধু লুঠতরাজ চালাত।৩১ ফলে মারাঠা আক্রমণ মুর্শিদাবাদ তথা বাংলায় দীর্ঘস্থায়ী কোনও বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি।৩২
১৭৫১ সালে মারাঠাদের সঙ্গে আলিবর্দির চুক্তি হয়ে যাবার পর বাংলা তথা মুর্শিদাবাদে মারাঠা আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আলিবর্দি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলেন এবং দরবারের জাঁকজমকের দিকে নজর দিলেন। এ সময়কার একটি পুণ্যাহের বিবরণ দিয়েছেন তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি। সেদিন চারশোর বেশি ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে জমিদার, অমাত্য, রাজকর্মচারী সবাই ছিল, আলিবর্দি তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী খেলাত বা সম্মান পোশাক প্রদান করেন। তারপর সবাইকে ভুরিভোজে অ্যাপ্যায়িত করা হয়। ওইদিন নবাব তাঁর প্রাসাদে সোনা দিয়ে মোড়া খুঁটির ওপর লাগানো, সোনার সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা সামিয়ানার তলায় স্বর্ণখচিত সিংহাসনে বসে জমিদারদের কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব গ্রহণ করেন।৩৩
মারাঠা আক্রমণ সত্ত্বেও আলিবর্দির সময় যে মুর্শিদাবাদের যথেষ্ট উন্নতি ও বিস্তার হয়েছিল, তার প্রমাণ মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। করম আলি লিখেছেন:৩৪
The city of Bengal [i.e. Murshidabad] in his reign extended over 12 kos [24 miles] in length and 7 kos [14 miles] in breadth; in addition to this, many rich men had built pleasure-houses outside the city. Twelve persons were entitled to play the naubat morning and evening. Many kinds of people, high and low, and all classes of artisans and men of all skill and letters were assembled in this city.
বস্তুতপক্ষে প্রায়-সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস থেকে জানা যায় যে মারাঠাদের বছরে ১২ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তি কিনে নেবার পর আলিবর্দি বাংলা থেকে মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন মুছে দেবার প্রতি খুবই যত্নবান হয়ে পড়েন। জনৈক ফারসি ঐতিহাসিকের মন্তব্য, আলিবর্দি এ কাজ করেছেন ‘with judgement and alacrity and to the repose and security of his subjects, and never after-wards deviated in the smallest degree from those principles’.৩৫
সিরাজদ্দৌল্লার পনেরো মাসের স্বল্প রাজত্বেও মুর্শিদাবাদে জাঁকজমক ও বৈভবের কোনও ঘাটতি ছিল না। নবাবদের প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের জন্য মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এ প্রাসাদ হীরাঝিলের প্রাসাদ নামে পরিচিত হয়। আলিবর্দির সময়কার মতো তাঁর সময়েও মুর্শিদাবাদ দরবারে এবং রাজপ্রাসাদে মহাসমারোহে হোলি ও অন্যান্য উৎসব পালিত হত। তাঁর কাছে হোলি উৎসবের এমনই আকর্ষণ ছিল যে ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) করেই তিনি তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ এসে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে হোলিতে মেতে ওঠেন।৩৬
মুর্শিদাবাদের নবাব ও বণিকরাজাদের (merchant princes) সঞ্চিত ধনসম্পদ প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। মুর্শিদকুলির সময় থেকে আলিবর্দির রাজত্বের প্রথম দিক অর্থাৎ ১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত দিল্লিতে মুঘল বাদশাহের কাছে রাজস্ব বাবদ বছরে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পাঠিয়েও নবাবের কোষাগারে প্রচুর অর্থ সঞ্চিত হত। শুধু নবাব নন, তাঁর আত্মীয় পরিজন ও অমাত্যরাও বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিল। মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী আলিবর্দি-কন্যা ও ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদের পত্নী ঘসেটি বেগমের মোতিঝিল প্রাসাদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে বিতাড়িত করার পর সেখান থেকে হিরে জহরত বাদ দিয়েই নগদ ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এক কোটি টাকা মূল্যের সোনা-রুপোর নানা বাসনও মোতিঝিল থেকে সিরাজ কবজা করেছিলেন।৩৭ এতে অত্যুক্তি থাকলেও অনেকটাই সত্য আছে বলে মনে হয়।
পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগারে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিল যে ওখানে শুধুমাত্র সোনা-রুপো মিলে ২ কোটি টাকা সঞ্চিত ছিল। তা ছাড়াও, তারিখ-ই-মনসুরীর লেখকের মতে, নবাবের হারেমে লুকোনো যে ধনসম্পদ ছিল, সোনা, রুপো, হিরে, জহরত মিলে তার মূল্য কম করে ৮ কোটি টাকা।৩৮ মুর্শিদাবাদের বণিকরাজা জগৎশেঠদের ব্যবসার মূলধনই ছিল আনুমানিক ৭ কোটি (William Bolts)৩৯ থেকে ১৪ কোটি টাকার (N. K. Sinha)৪০ মতো আর তাদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকা।৪১ পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ দেখে প্রায় হতবাক। তিনি লিখেছেন:৪২
The city of Murshidabad is as extensive, populous and rich, as the city of London, with this difference that there are individuals in the first possessing infinitely greater property than any of the last city.
একটি অনুমান অনুযায়ী ১৭৬০-এর দশকে লন্ডনের জনসংখ্যা ছিল ৭৫০,০০০-এর মতো।৪৩ ক্লাইভের বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তা হলে তখন মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যাও ওরকমই ছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৭৭২ সালে লন্ডনে একটি পার্লামেন্টারি কমিটিতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ক্লাইভ বলেছিলেন:৪৪
Consider the situation in which the victory at Plassey had placed me! A great prince was dependent on my pleasure; an opulent city lay at my mercy; its richest bankers bid against each other for my smiles; I walked through vaults which were thrown open to me alone, piled on either hand with gold and jewels! Mr. Chairman, at this moment I stand astonished at my moderation.
এ থেকে স্পষ্ট যে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ নবাবদের কোষাগারে সঞ্চিত ধনসম্পদ দেখে একেবারে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. আহকম-ই-আলমগিরি, পৃ, ১০৬ক, Abdul Karim, Murshid Quali and His Times-এ উদ্ধৃত, পৃ. ২৫।
২. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, Vol. II, p. 405; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 28-29.
৩. Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 30-31; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, Vol. II, pp. 405-406.
৪. মাসির-উল-উমারা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৭৫২; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৩৯ক, Abdul Karim, Murshid Quli-তে উদ্ধৃত, পৃ. ৫৪; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, p. 406.
৫. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p.407; Abdul Karim, Murshid Quli, pp. 54-55.
৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 11, 18.
৭. রিয়াজ, পৃ. ২৮; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ২৯ক, Abdul Karim, Murshid Quli, p. 21-এ উদ্ধৃত।
৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 17-18; K. M. Mohsin, Murshidabad, p. 6.
৯. S. Chaudhury and M. Morineau, ed., Merchants, Companies and Trade, p. 75. P. C. Majumdar, Musnud, p. 233
১০. K. M. Mohsin, Murshidabad, p. 6.
১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 208-209.
১২. রিয়াজ, পৃ. ২৮; Abdul Karim, Murshid Quli, p. 4.
১৩. রিয়াজ, পৃ. ২৮; Abdul Karim, Murshid Quli, p. 23, যদিও আব্দুল করিম মনে করেন যে ১৭০৪ সালে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করার পরই মুর্শিদাবাদে টাকশালটি স্থাপিত হয়, অন্য মতে মুর্শিদকুলি সুবাদার হওয়ার পরে ১৭১৬/১৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৪. রিয়াজ, পৃ. ২৮৪; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭০; A. H. Dani, Muslim Architecture, pp. 275-76,
১৫. রিয়াজ, পৃ. ২৭৯-৮০; তারিখ-ই-বংগলা, পৃ. ৬৭; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৪৭১।
১৬. রিয়াজ, পৃ. ২৮০, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৬৪; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৪৭১। রিয়াজের লেখক বলছেন আড়াই হাজার আর সলিমুল্লা ও নিখিলনাথ রায়ের লেখায় দু’হাজার।
১৭. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization in Bengal, pp. 4-5, 242- 43; S. Chaudhury and M. Morineau, ed., Merchants, Companies and Trade, p. 5.
১৮. রিয়াজ, পৃ. ২৮০-৮১; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৬৫; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৪৭২।
১৯. সলিমুল্লা, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৩৬-৩৭।
২০. রিয়াজ, পৃ. ২৭।
২১. J. N. Sarkar, ed., Histrory of Bengal, vol. 2, pp. 422-23; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 2-3; স্যার যদুনাথ সরকার অবশ্য বলছেন যে অন্যান্যদের মধ্যে সরফরাজ তাঁর মাতামহী, মুর্শিদপত্নীর, কথাতেই প্রধানত নিজের পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত্ত হন। রিয়াজের লেখকও অবশ্য বলছেন যে মুর্শিদকুলির পত্নী, নাসিরা বানু বেগম, যিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ এবং যিনি সরফরাজকে প্রাণাধিক ভালবাসতেন, তিনিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে সরফরাজকে তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত্ত করলেন (রিয়াজ, পৃ. ২৮৮)। অন্যদিকে সলিমুল্লার ভাষ্য অনুযায়ী সরফরাজের দিদিমা ও মা দু’জনেই এটা করেছিলেন (সলিমুল্লা, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭২)।
২২. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৫।
২৩. K.K.Datta, Alivardi, pp. 16-18; রিয়াজ, পৃ. ২৮৮;সলিমুল্লা, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৩।
২৪. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ৯-১০।
২৫. Factroy Records, Kasimbazar, Vol. 6, 7 June 1742; BPC, vol. 6, 14 June 1742.
২৬. ঐ, vol. 15, f, 194vo, 21 June 1742; Factory Records, Kasimbazar, vol. 6, 14 June 1742.
২৭. BPC, vol. 16, f. 181vo, 10 June 1743; Factory Records, Kasimbazar, vol. 6,6 June 1743.
২৮. BPC, vol. 6, 2 July 1743.
২৯. J. H. Little, Jagatseth, p. 120; করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ২৯।
৩০. K. K. Datta, Alivardi; P. J. Marshall, East Indian Fortunes; Bengal—the British Bridgehead; K. N. Chaudhuri, Trading World of Asia.
৩১. Richard Becher’s letter to Governor Verelst, 24 May 1769, quoted in W. K. Firminger, Fifth Report, pp. 183-84.
৩২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 300-302, “Was there an eco- nomic crisis in mid-eighteenth century Bengal?” in Richard B. Barnett, ed, Rethinking Early Modern India, pp. 219-52.
৩৩. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী পৃ. ১১৬; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 154-55.
৩৪. মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 58.
৩৫. Calendar of Persian Correspondence, vol. II, pp. 191, 197, quoted in K. K. Datta, Alivardi, p. 140.
৩৬. মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 72.
৩৭. ঐ, পৃ .৬২।
৩৮. তারিখ-ই-মনসুরী, trans, H. Blochmann, JAS, no. 2, 1867, pp. 95-96.
৩৯. William Bolts, Considerations, p. 158.
৪০. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, Vol. II, p. 134.
৪১. Luke Scrafton to Colonel Clive, 17 Dec. 1757, Orme Mss. India, XVIII, f. 5043; Eur. G 23, Box 37.এ প্রসঙ্গে আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ.১১৪-১৫ দ্রষ্টব্য।
৪২. J. H. Little, The House of Jagatseth, p. 2-তে উদ্ধৃত।
৪৩. K. M. Mohsin, Murshidabad, p. 227 and p. 227, fn. 1 দ্রষ্টব্য।
৪৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126 উদ্ধৃত।
০৪. বণিকরাজা
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের যে সমৃদ্ধি তাতে ওখানকার বণিকরাজাদের (mer-chant princes) অবদান অনস্বীকার্য। এই বণিকরাজারা একাধারে সওদাগর, ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, মহাজন-—সব কাজই এঁরা করতেন। এঁরা শুধু প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন না, বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি ও মুর্শিদাবাদ দরবারে এঁদের প্রভাব ছিল প্রবল। এঁদের রাজকীয় আচার আচরণ ও জীবনযাত্রা দেখে অনেক ইউরোপীয় পর্যটক এঁদের ‘বণিকরাজা’ হিসেবেই গণ্য করতেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতি এবং সে জন্যই কিছুটা বাংলার সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসেও এঁদের গুরুত্ব অনেকখানি। আবার অন্যদিকে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে এঁদের ভূমিকাও নিতান্ত নগণ্য নয়। এই বণিকরাজাদের মধ্যে জগৎশেঠদের মূল আস্তানা ছিল মুর্শিদাবাদে; অন্য দু’জনের মধ্যে উমিচাঁদের কলকাতা আর আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের হুগলি। তবে যেহেতু এই বণিকরাজাদের মুর্শিদাবাদের দরবারে নিত্য আনাগোনা ছিল, সেজন্য এই তিনজন বণিকরাজাকেই মুর্শিদাবাদের লোক বলে গণ্য করা যেতে পারে।
বণিকরাজাদের মধ্যে জগৎশেঠরা অষ্টাদশ শতকের প্রায় গোড়া থেকেই বাংলার অর্থনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে শুরু করেছিলেন, উমিচাঁদ ১৭৩০-র দশক থেকে আর খোজা ওয়াজিদ ১৭৪০-র দশক থেকে। বাংলার বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রশাসনে এই তিন বণিকরাজারা মিলে একাধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। বাংলার টাকার বাজার ছিল এঁদেরই হাতে এবং এঁরাই একদিকে শিল্পবাণিজ্য ও অন্যদিকে নবাব সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবদের আনুকূল্যে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসা ও অন্যান্য বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা করায়ত্ত করে এঁরা বাংলার শিল্পবাণিজ্যে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গেও ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কোম্পানিগুলি এঁদের মাধ্যমে শুধু যে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করত তা নয়। তারা এঁদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা ধার করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাত। এঁদের কাছেই তারা ইউরোপ থেকে পাঠানো সোনা রুপো বিক্রি করে নগদ টাকা জোগাড় করত। তবে এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই বণিকরাজাদের উত্থান, প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রধান সোপান ছিল মুর্শিদাবাদ নবাবদের দাক্ষিণ্য। নবাবদের আনুকূল্যেই এঁরা এতটা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
এই বণিকরাজাদের মধ্যে সবদিক থেকে অগ্রগণ্য ছিলেন জগৎশেঠরা। এঁদের বলা হয় ‘Rothchilds of the East’। রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে এঁদের পূর্বপুরুষ হীরানন্দ শাহু ভাগ্যান্বেষণে ১৬৫২ সালে পাটনা চলে আসেন। তাঁর সাত পুত্রের জ্যেষ্ঠ মানিকচাঁদ তখনকার বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে মহাজনি ব্যবসা শুরু করেন। এঁরা ছিলেন শ্বেতাম্বর জৈন।১
ঢাকায় মানিকচাঁদের সঙ্গে নবাগত দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মুর্শিদকুলি যখন বাংলার তৎকালীন সুবাদার আজিম-উস-শানের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ১৭০৪ সালে দেওয়ানি দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন, তখন তার সঙ্গে মানিকচাঁদও ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। তখন থেকেই মুর্শিদকুলির আনুকূল্যে জগৎশেঠদের উন্নতির শুরু—তাঁদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁদের রমরমা এই মানিকচাঁদ ও তার উত্তরসূরী ফতোচাঁদের সময়। ১৭১৪ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হওয়ার পর তাঁর ভাগ্নে ফতেচাঁদ গদিতে বসেন। ফতেচাঁদের সময়ই জগৎশেঠরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। সম্ভবত মুর্শিদকুলির অনুরোধে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে ‘জগৎশেঠ’ (Banker of the World) উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি বংশানুক্রমিক।
প্রায় তিরিশ বছর ধরে বাংলার বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ ১৭৪৪ সালে মারা যান। তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁর দুই পৌত্র জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ। ১৭৬৩ সালে মীরকাসিমের আদেশে গঙ্গাবক্ষে তাঁদের সলিল সমাধি হয়।২ বাংলায় জগৎশেঠদের বিপুল আয়, প্রচও ক্ষমতা ও বিশেষ মর্যাদার কতগুলো উৎস ছিল। সেগুলি হল: মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, বাংলার রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেওয়ার অনুমোদন, মুদ্রা বিনিময়ের হার ধার্য করার ক্ষমতা ও সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসা। বাংলার সুবাদার মুর্শিদকুলির প্রচ্ছন্ন সমর্থনে জগৎশেঠরা ১৭২০ সাল নাগাদ টাঁকশালের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তার প্রমাণ মেলে ১৭২১ সালে লেখা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি: ‘…Futtichund having the entire use of the mint, no other shroff dare buy an ounce of silver’৩.
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ কিছুদিন ধরেই টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির অনুমতি পাওয়ার চেষ্টা করছিল। এই মর্মে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিকে কোম্পানি অনেকবার নির্দেশ পাঠায় তারা যেন নবাবের কাছ থেকে এ জন্য অনুমতি জোগাড় করার চেষ্টা করে। কাশিমবাজার কাউন্সিল নবাবের দরবারের গণ্যমান্য অমাত্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করে। কিন্তু ওটা যে হওয়ার নয় তা বুঝতে পেরে তারা ফোর্ট উইলিয়ামকে জানাল যে: “We are informed that while Futtichund is so great with the Nabab, they [the English] can have no hopes of that Grant, he alone having the sole use of the mint nor dare any other shroff or mer- chant buy or coin a rupee’s worth of silver.’৪
টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার জগৎশেঠদের আয়ের একটি বড় উৎস ছিল। তার ফলে তাঁরা সে অধিকারে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিতে কোনওমতেই রাজি ছিলেন না। যে কোনও মূল্যেই তাঁরা এটা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এমনকী, ১৭৪৩ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা লিখছে যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ যতদিন জীবিত আছেন, ততদিন ইংরেজদের অন্য কারও পক্ষে টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর এমনই প্রভাব যে তিনি যা চাইবেন তার অন্যথা হবে না।৫ ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির খুবই মুশকিল হত। তারা বাংলার রফতানি পণ্য কেনার জন্য ইউরোপ থেকে যেসব সোনা-রুপো নিয়ে আসত (প্রায় সবটাই রুপো) সেগুলোর বেশিরভাগই জগৎশেঠদের কাছে বিক্রি করতে হত কারণ এগুলোর বিনিময়ে তাদের স্থানীয় মুদ্রা সংগ্রহ করতে হত এবং তা দিয়েই রফতানি পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হত। আর যেহেতু জগৎশেঠদের হাতেই টাঁকশালের কর্তৃত্ব, তাদের আমদানি করা রুপো জগৎশেঠদের কাছে বিক্রি করা ছাড়া কোনও উপায় তাদের ছিল না। শুধু তাই নয়, জগৎশেঠরা যে দাম দিতেন, সেটাই তাদের নিতে হত। বলা বাহুল্য সে দাম বাজারের দামের চেয়ে কমই হত। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির পক্ষে এ ব্যবস্থা মেনে নিতেই হত কারণ তারা এ দেশে পণ্য কেনার জন্য যে রুপো নিয়ে আসত, জগৎশেঠদের ছলচাতুরির জন্য তারা সেগুলি দিয়ে টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করতে পারত না। অথচ দাদনি বণিকদের মাধ্যমে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের নগদ টাকার খুবই প্রয়োজন হত।৬
জগৎশেঠদের প্রভূত আয়ের আরেকটি বড় উৎস ছিল বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময়ের হার বা বাট্টা ধার্য করার অধিকার। বাংলার নবাবদের সঙ্গে শেঠদের এমনই ঘনিষ্ঠতা এবং তাঁদের ওপর ও বাংলার টাকার বাজারে এঁদের এমনই প্রভাব ছিল যে (যার অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁরা নবাবদের প্রয়োজনে বরাবরই অর্থ সাহায্য করে গেছেন) তাঁরা নবাবদের দিয়ে তাদের সুবিধামতো বিনিময়ের হার ধার্য করাতে পারতেন। তখনকার বহু নথিপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।৭ তা ছাড়া এ সময় বাংলায় নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্নরকমের মুদ্রা আসত, বাংলায়ও ছিল নানা রকমের মুদ্রা। বাজারে কিন্তু এসব চলত না। সব রকমের মুদ্রাকেই সিক্কা টাকায় পরিবর্তিত করতে হত—এ জন্য দিতে হত বাট্টা। এ বাট্টার হার ঠিক করত জগৎশেঠরা, তাঁদের লাভের অঙ্ক মাথায় রেখে। ফলে বাট্টা থেকেও তাঁদের প্রচুর লাভ হত। জগৎশেঠরা পুরনো বা অন্য প্রান্ত থেকে আসা সব মুদ্রা টাঁকশালে পাঠিয়ে নতুন চলতি মুদ্রায় (সিক্কা) পরিবর্তিত করতেন আর এই মুদ্রা পরিবর্তন করার জন্য তাঁরা বাট্টা নিতেন। সেটা থেকে তাঁদের আয় হত প্রচুর। লিউক স্ক্র্যাফ্টনের (Luke Scrafton) অনুমান অনুযায়ী (১৭৫৭ সাল) জগৎশেঠরা বছরে ৫৮ লক্ষ টাকার মতো মুদ্রা তৈরি করত এবং এ বাবদ তাদের বার্ষিক আয় হত ৩-১/২ লক্ষ টাকা।৮ এ ছাড়াও দেশি ও বিদেশি মুদ্রা বাংলায় চলতি সিক্কা টাকায় বিনিময় করে দেওয়ার জন্য শেঠদের প্রচুর আয় হত। তাঁরা নবাবের প্রাপ্য রাজস্বও জমা নিতেন। জমিদার ও আমিলরা তাঁদের কাছে ভূমি রাজস্ব জমা দিত। তা ছাড়াও যারা রাজস্ব আদায়ের নিলাম কিনত, শেঠরা তাদের জামিনও হতেন, অবশ্যই লাভের বিনিময়ে।
জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের আরেকটি সোজা রাস্তা ছিল চড়া সুদের মহাজনি ব্যবসা। তারা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে বার্ষিক শতকরা ১২ টাকা হারে টাকা ধার দিতেন। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য এসব কোম্পানিরা ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে আসত ঠিকই। কিন্তু ইউরোপ থেকে জাহাজ আসতে অনেক সময় দেরি হত। আবার এসব রুপো সোজাসুজি টাঁকশালে নিয়ে গিয়ে সেগুলি থেকে মুদ্রা তৈরি করা সম্ভব হত না কারণ টাঁকশাল ছিল জগৎশেঠদের কর্তৃত্বে। বাজারে বা জগৎশেঠদের কাছে এসব রুপো বিক্রি করে নগদ টাকা জোগাড় করতে সময় লাগত অনেক। এদিকে রফতানি পণ্য জোগাড় করতে টাকার খুব প্রয়োজন হত কারণ ঠিক সময় এসব পণ্য সরবরাহ করার জন্য দাদনি বণিকদের আগাম টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করতে না পারলে পরে অনেক বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হত। আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো পাঠালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে কোম্পানিগুলির প্রায় সবসময় নগদ টাকার ঘাটতি হত। সে জন্য বাজার থেকে তারা টাকা ধার করতে বাধ্য হত এবং মূলত তারা জগৎশেঠদের কুঠি থেকেই এই টাকা ধার করত, যদিও তারা কলকাতার দাদনি বণিক বা কাশিমবাজারের কাটমা পরিবারের কাছ থেকেও টাকা ধার করত।৯
জগৎশেঠদের কাছ থেকে সহজে টাকা ধার করা গেলেও শতকরা ১২ টাকা সুদ কোম্পানিরা খুব বেশি বলেই মনে করত এবং কোনও উপায় নেই বলেই এত চড়া সুদ দিতে বাধ্য হত। কোম্পানিগুলির কর্ণধাররা ইউরোপ থেকে বার বার লিখে পাঠাত যে সুদের হার ‘exorbitant’ এবং তাই ‘rank poison to our commerce’। তাই তারা বাংলায় ধার করাটা একেবারেই চাইত না কারণ ‘the interest…eats deep and insensibly’১০। কিন্তু বাংলায় টাকা ধার না করে তাদের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল না। ১৭৩০-র দশক ও ১৭৪০-র দশকের প্রথম দিকে বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ডুপ্লে (Dupleix) জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে ‘greatest of Jews’ এবং ‘our chopping-block’ বলে বর্ণনা করলেও টাকার জন্য তাঁর কাছেই হাত পাততে বাধ্য হতেন বারবার।১১ ১৭১৮ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানি মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠদের কাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার মতো ধার করেছিল।১২ আর ১৭৫৫ থেকে ১৭৫৭, এই তিন বছরে জগৎশেঠদের কাছ থেকে ডাচ কোম্পানি ২৪ লক্ষ টাকা ধার করেছিল।১৩ ১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজদের কাছে চন্দননগরের পতন হল, তখন শেঠদের কাছে ফরাসিদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা।১৪
সুদের হার কমানোর কোনও উপায় নেই দেখে কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের কাছে এ জন্য অনুনয় বিনয় করত। তাতে আগে কোন ফল হয়নি। ১৭৪০ নাগাদ শেঠদের বোধহয় মনটা একটু নরম হল। ১৭৪০-র ১১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতায় জানাল যে কোম্পানি যদি জগৎশেঠদের কাছে সুদের হার কমাবার জন্য আবেদন করে, তা হলে তা হয়তো মঞ্জুর হয়ে যাবে।১৫ সে অনুযায়ী কলকাতা কাউন্সিল সেদিন জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখে। ইংরেজদের প্রার্থনা অনুযায়ী জগৎশেঠরা সুদের হার কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করে দিলেন। ১৭৪০-র ২১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা জগৎশেঠের কুঠি থেকে শতকরা ৯ টাকা হারে ৬০,০০০ টাকা ধার করল।১৬ তখন থেকে ইউরোপীয়রা কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ ও জগৎশেঠদের অন্যান্য কুঠি থেকে ওই হারে টাকা ধার করতে লাগল। ১৭৪২ সালের ২৯ মার্চ একদিনে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতায় জগৎশেঠদের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা ধার করে।১৭ ইংরেজদের মতো ডাচ, ফরাসি ও অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের বিভিন্ন কুঠি থেকে প্রয়োজন মতো ঋণ নিত, একই সুদের হারে। জগৎশেঠরা যে একদিনের মধ্যেই সুদের হার কমিয়ে দিতে পারল তা থেকে বাংলা তথা উত্তর ভারতের টাকার বাজারে তাঁদের একাধিপত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে জগৎশেঠরা একটি প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠে। বাংলার অন্য সব ব্যাঙ্কার, সওদাগর-ব্যবসায়ী, শরাফ প্রভৃতি সব ব্যাপারেই জগৎশেঠদের অনুকরণ করে চলত। মারাঠা আক্রমণের জন্য জগৎশেঠ যখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান, তখন কাশিমবাজারের ইংরেজ কাউন্সিল কলকাতায় লিখেছিল (৭ জুন ১৭৪২) যে যতদিন না জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে আসছেন, ততদিন সেখানকার কোনও সওদাগর, মহাজন বা শরাফ নিজেদের নিরাপদ ভাববে না। তাই নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠকে অনুনয় জানালেন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন কারণ ‘his presence being as necessary to the Nabub as to the merchants’ এবং ‘his conduct being the general guide to all of them’।১৮ ক’দিন পর (১৪ জুন ১৭৪২) কাশিমবাজার থেকে কুঠিয়ালরা জানাল যে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন এবং সে খবর পেয়ে অন্যান্য মহাজন ও ব্যবসায়ীরাও শহরে ফিরে এসেছে।১৯ আবার ফতোচাঁদ যখন পরের বছর (১৭৪৩ সাল) মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কায় মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে গেলেন তখন কাশিমবাজার কাউন্সিল ফোর্ট উইলিয়ামে লিখছে যে ফতেচাদ চলে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদে টাকা ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে—বাজারে টাকার এত অভাব জগৎশেঠের মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাওয়ার জন্য।২০ তারা আবার ২ জুলাই লিখেছে যে ফতেচাঁদ ফিরে এসেছেন, ফলে বাজারে এখন টাকার কোনও অভাব নেই।২১
জগৎশেঠরা অষ্টাদশ শতকের প্রায় প্রথম থেকেই মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। বাংলার নবাব ও তাঁদের শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর জগৎশেঠদের যে বিরাট প্রভাব ছিল তা অভূতপূর্ব—বাংলার ইতিহাসে এমনটি আর কখনও দেখা যায়নি। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পালাবদলে শেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।২২ বাদশাহি দরবারে তাঁদের যে কতটা প্রভাব ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁরা মুঘল দরবার থেকে বাংলার নবাবদের স্বীকৃতি ও অনুমোদন জানিয়ে ফরমান আনিয়ে দিতেন। এভাবে জগৎশেঠ ফতোচাঁদ মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর নবাব সজাউদ্দিনের জন্য দিল্লিতে দরবার করে তাঁর জন্য অনুমোদন জোগাড় করেন। তাই সুজাউদ্দিন ফতোচাঁদের প্রতি মুর্শিদকুলির চেয়েও অনেক বেশি উদার ছিলেন এবং শেঠদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নানা রকমের সুবিধা দিয়েছিলেন। ১৭৩০ সালে কাশিমবাজারে শেঠদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঝামেলা হয়—কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির ভারতীয় গোমস্তাকে নিয়ে। ইংরেজরা তখন নবাবের অন্যতম দুই প্রধান অমাত্য, হাজি আহমেদ ও দেওয়ান আলমচাঁদকে দিয়ে শেঠদের বিরুদ্ধে সুজাউদ্দিনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু’জনেই তাদের পরামর্শ দিলেন, ফতোচাঁদকে নবাব খুবই শ্রদ্ধা এবং সমীহ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোন কথাই নবাব শুনবেন না। তাই শেঠদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নিলেই ইংরেজরা ভাল করবে, কোনও অমাত্যেরই জগৎশেঠের বিরুদ্ধে নবাবকে কোনওভাবেই প্রভাবিত করার সাধ্য নেই।২৩ হাজি আহমেদ কাশিমবাজার কাউন্সিলকে জানান যে ‘Futtichund’s Estate was esteemed as the King’s treasure and the Nabob was resloved to see him satisfied.২৪
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব রাষ্ট্রবিপ্লবেই জগৎশেঠদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ হাত ছিল। তাঁদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদলই সম্ভব ছিল না। সমসাময়িক প্রায় সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও ফারসি ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। পলাশির যড়যন্ত্র ও বিপ্লবে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নেন, যদিও এ চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা ছিল ইংরেজরা। তারা উমিচাঁদের মাধ্যমে প্রথমে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা করে। লতিফ সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে নবাব হওয়ার বাসনা জানিয়েছিল এবং তিনি যে জগৎশেঠদের সমর্থন পাবেন তা জানাতেও ভোলেনি। পরে যখন মীরজাফরকে পাওয়া গেল তখন ইংরেজরা তাড়াতাড়ি ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরকেই নবাব করার ষড়যন্ত্র করল। তার কারণ শুধু এই নয় যে ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাশালী অমাত্য (তিনি নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ), তার চেয়েও বড় কারণ তিনি জগৎশেঠদের অনেক বেশি কাছের লোক।২৫ কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘It is this family [of Jagat Seth] who conducted all his (Alivardi’s) business and it may be said that it had long been the chief cause of all the revolutions in Bengal.:২৬
বাংলায় জগৎশেঠদের যে প্রবল ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল তা দেখে বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষরা সবাই তাদের উত্তরসূরিদের জন্য লেখা ‘মেমোরি’তে (mem- orie—যাতে বাংলার শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সওদাগর-মহাজন সবকিছু সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ ও পরামর্শ থাকত) জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ওপর বিশেষ জোর দিতেন। ১৭৪৪-এ বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান সিকটারম্যান (Sichtermann) তাঁর ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার (‘greatest banker of Hindosthan’ বা ‘voornaamsten wis- selaar van geheel Hindosthan’)। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনি কারবার ভারতবর্ষের সর্বত্র বিস্তৃত। তিনি যদিও ব্যক্তিগতভাবে শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তা হলেও পুরো ব্যাপারটাতেই তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। সে জন্য তাকে সবসময় খুশি রাখা এবং তাঁর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখা খুবই দরকার। এটা করার সবচেয়ে ভাল উপায় তাঁকে নিয়মিত বিরল প্রজাতির ছোট পাখি, ভাল মশলা ও ছোটখাট এবং দুষ্প্রাপ্য জিনিস উপহার দেওয়া।২৭
সিকটারম্যানের পরবর্তী ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস (Jan Huijghens) ১৭৫০ সালে তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে কোম্পানির পক্ষে হুগলিতে জগৎশেঠের গোমস্তা বৈজনাথের (Baijnath) সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার কারণ তা হলে তিনি তাঁর মনিব জগৎশেঠদের দিয়ে মুর্শিদাবাদ দরবার থেকে তাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধে আদায় করতে পারবেন।২৮ তাঁর উত্তরসূরি ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ১৭৫০ সালে তার ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের দুই উত্তরাধিকারী, জগৎশেঠ মহতাব রাই ও মহারাজা স্বরূপ চাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে ও বিস্তৃত হচ্ছে। কারণ তাঁরা নবাবকে সবসময় নবাবের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। তাই কারসেবুম জোর দিয়েছেন যাতে কোম্পানি জগৎশেঠদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখে।২৯
কারসেবুমের উত্তরসূরি লুই টেইলেফারটও (Louis Taillefert) তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে জগৎশেঠরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার। তিনি জানাচ্ছেন ডাচরা বাংলা থেকে চিঠিপত্রে এতদিন ধরে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের কথা লিখেছে যে হল্যান্ডে কোম্পানির কর্মকর্তাদের সন্দেহ হতে পারে এমন নামের কোনও ব্যক্তি আদৌ ছিল কি না। আসলে বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রে জগৎশেঠদের কুঠিগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। হুগলিতে তাঁদের কুঠির নাম ছিল শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ আনন্দচাঁদজী, ঢাকায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও জগৎশেঠ ফতেচাঁদজী, পাটনায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ দয়ানন্দজী।৩০ আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ ও মহাচাঁদ জগৎশেঠ ফতেচাঁদের তিন ছেলে। ফতেচাঁদ বেঁচে থাকতেই প্রথম জনের মৃত্যু হয়। আমরা আগেই দেখেছি জগৎশেঠ মহতাবচাঁদ ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ ফতেচাঁদের পৌত্র ও তাঁর উত্তরসূরী।৩১ এখানে উল্লেখযোগ্য যে জগৎশেঠদের এমনই প্রতিপত্তি ও প্রভাব ছিল যে বাংলা ও বিহারের সব ব্যাঙ্কার-মহাজন, শরাফ তাঁদের তাঁবে থেকেই নিজেদের কাজকারবার করত। কেউ তার অন্যথা করলে তার রক্ষা ছিল না—জগৎশেঠরা তাকে শেষ করে ছাড়তেন।৩২
ইউরোপে যেমন কিছু কিছু পরিবার রাষ্ট্রের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করতেন, জগৎশেঠরাও তেমনি কার্যত বাংলার নবাবের ব্যাঙ্কার ছিলেন। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এন. কে. সিনহা মন্তব্য করেছেন: ‘The Jagat Seth house was to the Bengal Nawabs what the Fugger of Augsburg were to the Emperor Charles V of Germany and the Medicis of Florence were to the Papacy in the Middle Ages’.৩৩
শেঠদের ধনসম্পদের পরিমাণ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করা খুবই কঠিন। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন খান লিখেছেন:
…their riches were so great that no such bankers were ever seen in Hindustan or Deccan…. nor was there any banker or merchant that could stand comparison with them all over India…. Their wealth was such that there is no mentioning it without seeming to exaggerate and to deal in extravagant fables.৩৪
এক বাঙালি কবি বলেছেন গঙ্গা যেমন শতমুখে জলরাশি এনে সমুদ্রে ফেলে, তেমনি ধনরত্ন এসে জমা হত জগৎশেঠদের কোষাগারে।৩৫ ১৭৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) অনুমান করেন যে শেঠদের ব্যবসার মূলধন ছিল ৭ কোটি টাকার মতো।৩৬ অন্যদিকে এন. কে. সিনহার ধারণা, জগৎশেঠদের সমৃদ্ধির যুগে তাঁরা অন্তত ১৪ কোটি টাকার মালিক ছিলেন।৩৭ লিউক স্ক্র্যাফ্টনের হিসেব অনুযায়ী ১৭৫৭ সালে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মতো।৩৮
সারণি ১
জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়, ১৭৫৭
(টাকায়)
রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেওয়া বাবদ ১০% হারে ১০,৬০,০০০
জমিদারদের কাছ থেকে সুদ বাবদ ২০% হারে ১৩,৫০,০০০
বছরে ৫০ লক্ষ টাকা টাঁকশালে
নতুন মুদ্রায় পরিবর্তন করার জন্য ৭% ৩,৫০,০০০
৪০ লক্ষ টাকার ওপর সুদ, ৩৭-১/২% হারে ১৫,০০,০০০
বাট্টা বা বিনিময়ের সুদ বাবদ, ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা ৭,০০,০০০
মোট ৪৯,৬০,০০০
(সূত্র: ক্লাইভকে লেখা স্ক্র্যাফ্টনের চিঠি, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৫৭)
জগৎশেঠদের কী পরিমাণ টাকা ছিল তার একটা আন্দাজ করা যেতে পারে মারাঠারা যখন ১৭৪২ সালে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে, তখন মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়ি লুঠ করে নগদ ২ কোটি টাকা (সিয়রের লেখক গোলাম হোসেনের মতে, যদিও মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি বলেছেন তিন লক্ষ টাকা) নিয়ে চলে যায়। সিয়রের অনুবাদক হাজি মুস্তাফা লিখেছেন, এই বিশাল পরিমাণ টাকা লুঠ হয়ে গেলে ইউরোপের যে কোনও রাজাই বিচলিত হয়ে পড়তেন কিন্তু জগৎশেঠ ফতেচাঁদের হাবভাবে বিশেষ কোনও তারতম্য হল না, ‘he continued to give govern-ment bills of exchange at sight of full one crore at a time’৩৯
জগৎশেঠদের খ্যাতি এতই ব্যাপক ছিল যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যত বিশিষ্ট ইউরোপীয় কর্মচারী ছিল, তাদের সবাই শেঠদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছে। ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম (Robert Orme) কিছুকাল বাংলায় ছিলেন। তিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিকে লিখেছেন যে সারা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ শরাফ ও ব্যাঙ্কার।৪০ ক্যাপ্টেন ফেন্উইক (Captain Fenwick) নামে এক ইংরেজ স্বাধীন বণিক (Free Merchant), যিনি কলকাতায় থাকতেন, বলেছেন যে জগৎশেঠ মহতাব রাই নবাবের খুবই প্রিয়পাত্র এবং লন্ডনে ব্যাঙ্কারদের কেন্দ্র লম্বার্ড স্ট্রিটের সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও তাঁর মতো ব্যাঙ্কার হবে না।৪১ ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী ও পলাশি চক্রান্তের মূল নায়কদের অন্যতম লিউক স্ক্র্যাফ্টন (Luke Scrafton) জগৎশেঠ সম্বন্ধে ১৭৫৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে ক্লাইভকে লেখেন: ৪২
Jugget Seat is in a manner the government’s banker; about two thirds of the revenues are paid into his house, and the government give the draught (draft) on him in the same Manner as a Merchant on the Bank.
কোম্পানির আরেক কর্মচারী ও পলাশি ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক, কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের মতে জগৎশেঠ ছিলেন ‘the greatest Banker in the Empire of Indostan and the Second in Power in Bengal.’৪৩ আর ফরাসি কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল’ (Jean Law) লিখেছেন যে, জগৎশেঠরা হচ্ছেন ‘bankers of the Mogul, the richest and the most powerful who have ever lived’.৪৪
আমরা আগেই বলেছি জগৎশেঠরা ছাড়া মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আরও দু’জন বণিকরাজা, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কথা বলা দরকার, যদিও মুর্শিদাবাদে তথা বাংলায় জগৎশেঠদের মতো অতটা প্রভাব বা প্রতিপত্তি এঁদের ছিল না। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে এই তিন বণিকরাজা মিলে মধ্য-অষ্টাদশ শতকের মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতি থেকে রাজনীতি সবকিছুকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলেন। জগৎশেঠদের মতো অন্য দুই বণিকরাজার স্থায়ী নিবাস মুর্শিদাবাদে না হলেও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই নবাব ও নবাবের দরবারের অনুগ্রহলাভের জন্য মুর্শিদাবাদে তাদের আস্তানা করতে হয়েছিল এবং মুর্শিদাবাদই হয়ে উঠেছিল তাঁদের অন্যতম কর্মস্থল।
এই দুই বণিকরাজার মধ্যে একজন উমিচাঁদ বা আমিরচাঁদ। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশক ধরে বিশেষ করে, তিনি বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। উত্তর ভারত, সম্ভবত আগ্রা থেকে৪৫ তিনি বাংলায় আসেন ১৭২০-র দশকে এবং কলকাতার বিশিষ্ট দাদনি বণিক ও ইংরেজ কোম্পানির ‘ব্রোকার’ বিষ্ণুদাস শেঠের৪৬ অধীনে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেন।৪৭ ১৭৩০-র দশকের প্রায় প্রথম দিক থেকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন গণ্যমান্য ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের দুই প্রধান ক্ষেত্র ছিল কলকাতা ও পাটনা। তার কাজকারবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কলকাতায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে, বিশেষ করে ইংরেজ কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহ, মহাজনি কারবার এবং অন্তর্বাণিজ্য আর বিহারে সোরা ও আফিং-এর ব্যবসা। ১৭৩০-র দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দির প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। ১৭৪১ সালে তিনি এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পাটনা টাঁকশালের নিলাম কেনেন।৪৮ তাঁর ভাই দীপাচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের (Saran) ফৌজদারি চালাতেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন উমিচাঁদ। তিনি ও তাঁর ভাই দীপাচাঁদ মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার একচেটিয়া ব্যবসা প্রায় কুক্ষিগত করেছিলেন।৪৯
সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে অবশ্য উমিচাঁদের খুব একটা সুনাম ছিল না। ইংরেজ কোম্পানি কয়েকবারই তাঁর বিরুদ্ধে অসৎ উপায় অবলম্বন করার অভিযোগ করেছিল। কিন্তু কোম্পানি তাকে তাদের দাদন বণিকের কাজ থেকে বরখাস্ত করতে সাহস পায়নি, এই ভয়ে যে তা হলে তিনি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি বা অন্য কোন ইউরোপীয় কোম্পানির পণ্য সরবরাহের কাজ নিয়ে নিতে পারেন। আসলে উমিচাঁদের ব্যবসায়ী বুদ্ধি, দক্ষতা ও অর্থবল সম্বন্ধে ইরেজদের এতই আস্থা ছিল যে তাঁকে তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। এমনকী ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের এক সদস্য জন ফরস্টার (John Forster) লিখেছেন: ৫০
his [Umichand] natural and acquired capacity for business, his extra-ordinary knowledge of the inland trade and his greater command of money all which qualities I think render him a prosper person to deal with.
তবে উমিচাঁদের প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল বাংলার শাসকগোষ্ঠীর, বিশেষ করে বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদ দরবারের, সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ১৭৩৫ সালে যখন ইংরেজ কোম্পানি তাদের দাদনি বণিকদের তালিকা থেকে উমিচাঁদের নাম কেটে দিল, তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী অমাত্য, হাজী আহমেদ, কোম্পানিকে জানান যে উমিচাঁদকে যেন আবার দাদনি বণিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়—তিনি নিজে উমিচাঁদের জন্য জামিন হতে প্রস্তুত।৫১ এ থেকে স্পষ্ট যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে উমিচাঁদ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তার সোরা ও আফিং-এর প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা মুর্শিদাবাদ নবাবের দাক্ষিণ্যেই সম্ভব হয়েছিল। নবাব আলিবর্দিকে ছোটখাট বিদেশি ও দুষ্প্রাপ্য জিনিস উপহার দিয়ে তিনি তাঁর প্রশ্রয় পেয়েছিলেন।৫২ শুধু তাই নয়, নবাব সিরাজদ্দৌল্লারও তিনি প্রিয়পাত্র এবং বিশ্বস্ত সভাসদ হয়ে ওঠেন।
উমিচাঁদ যে একজন ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। কোন অগ্রিম বা দাদনি না নিয়েই তিনি ইংরেজ কোম্পানির জন্য ১০ লক্ষ টাকার পণ্য সরবরাহ করতে পারতেন। ১৭৫০ সালে কোম্পানির কাছে তাঁর পাওনা ছিল ১৬ লক্ষ টাকা।৫৩ পাটনাতে তাঁর ভাই দীপচাঁদের বার্ষিক আয় ছিল এক লক্ষ টাকা, এ থেকে উমিচাঁদের,—যাঁর বাণিজ্যিক পরিধি আরও অনেক ব্যাপক ছিল—আয়ের কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।৫৪ তিনি কলকাতার সবচেয়ে বড় ও ভাল অনেকগুলি বাড়ির মালিক ছিলেন। তাঁর সশস্ত্র কর্মচারী ও পিওনের সংখ্যা ছিল তিনশো।৫৫ ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম ১৭৫০-র দশকের প্রথমদিকে কলকাতায় ছিলেন এবং উমিচাঁদকে ভাল করেই জানতেন। তিনি উমিচাঁদ সম্বন্ধে লিখেছেন:৫৬
Among the Gentoo merchants established in Calcutta, was one named Omichand, a man of great sagacity and understanding, which he had employed for forty years with unceasing diligence to increase his for- tune…he was become the most opulent inhabitant of the colony [Calcutta]. The extent of his habitation, divided into various parts, the number of his servants continually employed in various occupations and a retinue of armed men in constant pay, resembled more the state of a prince than the condition of a merchant.
কলকাতায় উমিচাঁদের আস্তানা হলেও ১৭৪০র দশক থেকে তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন মুর্শিদাবাদে যাতে নবাব ও তাঁর দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা সুদৃঢ় হয়। কারণ চতুর ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি জানতেন তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের জন্য নবাব ও তাঁর দরবারের দাক্ষিণ্য একান্ত প্রয়োজনীয়। পলাশি চক্রান্তের সময় দেখা যাচ্ছে তিনি প্রায় সর্বদাই মুর্শিদাবাদে। আমরা পরে দেখব, তাঁর মাধ্যমেই ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে ইয়ার লতিফ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারপর থেকে পলাশির যুদ্ধের মাত্র ক’দিন আগে পর্যন্ত তিনি মুর্শিদাবাদেই ছিলেন। তাই তাঁকে বাদ দিলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের আরেক বণিকরাজা ছিলেন আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদ। সপ্তদশ শতক থেকেই আর্মানিরা বাংলায় বিদেশি বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম। তারা যে-সব পণ্য নিয়ে বাণিজ্য করত, তার মধ্যে অন্যতম বস্ত্র ও কাঁচা রেশম। তাই কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি অন্তত মধ্য-সপ্তদশ শতক থেকেই। মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে এদের প্রধান ঘাঁটি ছিল কারণ এরাও জানত যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের জন্য মুর্শিদাবাদ দরবারের আনুকূল্য একান্তভাবে প্রয়োজন। সৈয়দাবাদে প্রথম আর্মানি গির্জা স্থাপিত হয় ১৬৬৫ সালে— তার ধ্বংসাবশেষের পাশে ১৭৫৮ সালে তাদের নতুন গির্জা তৈরি হয়।৫৭
বাংলায় আর্মানি বণিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খোজা ওয়াজিদ। বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী হুগলি ছিল ওয়াজিদের প্রধান কর্মস্থল, সেখান থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য চালাতেন। একদিকে ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি, অন্য দিকে উমিচাঁদের মাধ্যমে তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে তাদের রফতানি পণ্য সরবরাহ করতেন তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যানধারণা ছিল তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য—যে কোনও মূল্যেই তিনি সেটার শ্রীবৃদ্ধি করতে প্রস্তুত ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দির দাক্ষিণ্যেই তিনি বিহার অর্থনীতির অনেকটাই কুক্ষিগত করতে সমর্থ হন—বিহারে দু’টি প্রধান রফতানি পণ্য, সোরা ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসা তিনি নিজের করায়ত্ত করেন ১৭৪০-র শেষ দিক থেকে।৫৮ ১৭৫৩ সালে তিনি আলিবর্দির কাছ থেকে বিহারে সোরার একচেটিয়া ব্যবসা করার ইজারা পান।৫৯ তার আগের বছর তিনি নবাবকে ২৫ বা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লবণের ব্যবসার ইজারাও নেন।৬০
অন্য বণিকরাজাদের মতো খোজা ওয়াজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি সমুদ্র বাণিজ্যেও লিপ্ত ছিলেন। মনে হয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তিনি বর্হিবাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে (যদিও সেগুলি অসম্পূর্ণ, মাঝেমধ্যেই ফাঁক আছে) জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে ওয়াজিদের অন্তত ৬টি বাণিজ্যতরী ছিল।৬১ এগুলির মাধ্যমে তিনি তখনকার বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দর হুগলির সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর জাহাজগুলি হুগলি থেকে বিভিন্ন পণ্যসম্ভার নিয়ে জেড্ডা (Jedda), মোখা (Mokha), বসরা (Basra), সুরাট, মসুলিপট্টনম প্রভৃতি বন্দরে বাণিজ্য করতে যেত। জাহাজগুলির নাম—‘সালামত রেসান’, ‘মোবারক’, ‘গেনজামের(?)’, ‘মদিনা বক্স’, ‘সালামত মঞ্জিল’ ও ‘মুবারক মঞ্জিল’। ডাচ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুম ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের লেখা থেকে জানা যায় যে সুরাটে ওয়াজিদের একটি বাণিজ্য কুঠিও ছিল।৬২
মুর্শিদাবাদ দরবারে ওয়াজিদের যে প্রবল প্রভাব ও প্রতিপত্তি, তা শুধু জগৎশেঠদেরই ছিল। নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ, নবাব তাঁকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি, বিশেষ করে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে, দৌত্যে নিযুক্ত করতেন। ইংরেজরাও তাঁর সঙ্গে নবাবের ঘনিষ্ঠতার কথা ভাল করে জানত। তারা তাঁকে মুর্শিদাবাদ দরবারের একজন অমাত্য বা দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশীল ব্যক্তি বলেই মনে করত।৬৩ রবার্ট ওরম তাঁকে বাংলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।৬৪ আর কাশিমবাজার ইংরেজ কুঠির উইলিয়াম ওয়াটস ও ম্যাথু কোলেট (Mathew Collet) লিখেছেন যে তিনি সুবে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সওদাগর এবং নবাবের ওপর তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল।৬৫ ফারসি ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খানও জানাচ্ছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দির এক ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় বন্ধু। ব্যবসা-বাণিজ্য করে তিনি প্রচুর ধনোপার্জন করেন এবং লোকে তাঁকে ‘ফখর-উৎ-তুজ্জার’ (সওদাগরদের গর্ব—pride of merchants) নামে জানত।৬৬
বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে ১৭৪০-র শেষদিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন তা ডাচ রেকর্ডস থেকে স্পষ্ট। ১৭৫০ সালে বাংলায় ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে ডাচদের উচিত ওয়াজিদের সঙ্গে হৃদ্যতা রেখে চলা কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তিনি খুবই ‘সম্মানিত ব্যক্তি’।৬৭ পঞ্চাশের দশকে যে তিনি নবাবের দরবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি, তা বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষ ইয়ান কারসেবুমের ১৭৫৫-র লেখা থেকে পরিষ্কার। কারসেবুম লিখেছেন:৬৮
While mentioning those persons whose friendship would be very useful to your Honour I cannot neglect Coja Mahmet Wazit, recently honoured with the title of Faqqur Tousjaar meaning supporter of the treasure because he is truly the maintainer of the riches of the rulers. He gives them a lot willingly rather than under compulsion.
বলা বাহুল্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথম কয়েকবছর, পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত, ওয়াজিদ মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন এবং স্বভাবতই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন মুর্শিদাবাদেই। আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হবেন এটা ধরে নিয়ে তিনি ১৭৫২ সাল থেকেই সিরাজের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। ধুরন্ধর এই আর্মানি বণিক খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নবাব ও দরবারের আনুকূল্য অত্যন্ত জরুরি। সে জন্য তিনি প্রথমে নবাব আলিবর্দির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিলেন, পরে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গেও। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকেই ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’-ও মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।৬৯
ওয়াজিদ ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূলভাবাপন্ন ছিলেন। ক্লাইভ তাঁকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।৭০ আসলে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল’-র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।৭১ এর কারণ, তাঁর কাছে তাঁর নিজের ব্যবসার স্বার্থই ছিল সবচেয়ে বড়। তিনি ভাল করেই বুঝেছিলেন যে ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সেরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিংয়ের বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্র-বাণিজ্য, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে এসবের কোনওটাতেও বিশেষ কিছু লাভ হবে না।
ওয়াজিদ যেহেতু মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম, তাই পলাশির ষড়যন্ত্রে তাঁর একটা ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তবে তিনি ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত, এবং অনেকটা ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের সমর্থক। তাই প্রথম দিকে তিনি পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রে তিনি সামিল হন একেবারে শেষ মুহূর্তে। কিন্তু কেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (জানুয়ারি ১৭৫৭) পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য পরামর্শ দেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে ফরাসি চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদ্দৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হতে পারবে না।৭২ এটা থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতকেই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:৭৩
আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব [ওয়াজিদ] ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকম অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছেন…সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে সবসময় আমাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন…শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের খতম করে দেন।
সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন যখন তিনি বুঝলেন যে নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি জানতেন তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক আনুকূল্যের খুবই প্রয়োজন। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল’র বিতাড়নের (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার সিরাজদ্দৌল্লাকে দেওয়া তাঁর পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজ তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং নবাব তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমনই শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে’র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন: ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে [কাশিমবাজারে] লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’৭৪
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহূর্তে পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি কিছুটা আগে-পরে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।৭৫ এটা সঠিক বলে মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন, ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭-তে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ওসব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি।’৭৬ ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-এ।
ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে, জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল। ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা ভাঙতে না পারে।’৭৭ ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।৭৮
উপরোক্ত তিন বণিকরাজা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, মহাজনও ছিল। কারণ এই অঞ্চল ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র। শুধু বাংলা থেকে নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকী ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও বহু এশীয় বণিকরা কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য এই অঞ্চলে আসত। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম ব্যবসায়ী। এরা মহাজনি কারবারেও লিপ্ত ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি এদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা ধার করত। ১৭২৪-র সেপ্টেম্বর মাসে কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ডাচ কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিল কাটমা পরিবারের।৭৯ ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ ডুপ্লের (Dupleix) সময় তারা কাশিমবাজারের কাটমাদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল।৮০
এই কাটমা পরিবার থেকে ইংরেজ কোম্পানি কাশিমবাজারে তাদের ‘ব্রোকার’ বা প্রধান সওদাগর নিয়োগ করত। ১৭৩০ সালে তারা হাতু (Hathu) কাটমাকে এই পদে নিযুক্ত করেছিল। কারণ তিনি ছিলেন ‘a man of unquestionable credit and the properest person for the post of a broker’, এবং ‘a man of considerable estate.’৮১ কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে বিবাদের ফলে ১৭৩৭ সালে তিনি পদচ্যুত হন এবং তার জায়গায় ‘ব্রোকার’ হলেন কাটমা পরিবারেরই অন্যতম সদস্য, বলাই বা বলরাম কাটমা (রেকর্ডসে Bally)। তাঁকে নিয়োগ করার কারণ তাঁর ছিল ব্যবসায়ী হিসেবে বহুদিনের অভিজ্ঞতা এবং তিনি ছিলেন খুব ধনী পরিবারের লোক।৮২ ১৭৪১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন—সে বছর ওই পদটি তুলে দেওয়া হয়।
মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার থেকে পণ্য, বিশেষ করে কাঁচা রেশম, সংগ্রহ করার জন্য ওখানে গুজরাট, লাহোর, মুলতান, দিল্লি, আগ্রা, বেনারস, গোরখপুর, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু সওদাগর ভিড় জমাত।৮৩ তা ছাড়া ছিল আর্মানিরা—মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে তাদের বড় ঘাঁটি ছিল। তবে কাঁচা রেশমের বাজারে সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল গুজরাটিরা—দামের কোনও তোয়াক্কা না করে তারাই সবচেয়ে ভাল রেশম কিনত, যার জন্য সবথেকে উৎকৃষ্ট রেশমের নামই হয়ে যায় ‘গুজরাটি সিল্ক’। অবশ্য বাজারে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীও ছিল, যাদের সাধারণত পাইকার বলা হত। এরা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশমের জোগান দিত। এ সব ব্যপারীদের মধ্যে বাঙালি ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অবাঙালি এবং আর্মানিরাও ছিল। ১৭৫৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে ৪২ জন ব্যাপারীর সঙ্গে চুক্তি করে তার মধ্যে অন্তত ১০/১২ জন ছিল গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের ব্যবসায়ী। বাঙালিদের মধ্যে উঁচু নিচু সব জাতের লোকই ছিল—ব্রাহ্মণ, বৈদ্য থেকে তেলি পর্যন্ত।৮৪
এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জাতির, গোষ্ঠীর হলেও তাদের মধ্যে একটা জোটবদ্ধতা ছিল যার ফলে কলকাতার দাদনি বণিকদের চেয়েও তারা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তারা অনেক সময়ই এরকম ‘জোট’ (ring) তৈরি করে ইউরোপীয় কোম্পানি বা বড় বড় এশীয় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত এবং নিজেদের দাবিতে অটল থাকতে পারত। ১৭৪১ সালে ইংরেজ কোম্পানির এসব দাদনি বণিকরা চুক্তিমতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করার চেষ্টা করা হলে তারা জোটবদ্ধভাবে তা দিতে অস্বীকার করল কারণ এরকম জরিমানা তাদের কোনওদিন দিতে হয়নি। তাই এখনও তারা তা দেবে না। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি কলকাতা কাউন্সিলকে জানাল, কোম্পানির দাদনি বণিকরা জোটবদ্ধ হয়ে এমনই দৃঢ়তার সঙ্গে জরিমানা দিতে অস্বীকার করছে যে ইংরেজদের ক্ষমতা নেই তাদের বাধ্য করে।৮৫
এসব ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে থাকায় তাদের ওপর জোরজুলুম করার প্রচেষ্টাকে তারা অনেকাংশেই প্রতিহত করতে পারত। সাধারণভাবে কোম্পানিগুলি ব্যবসায়ীদের যে অগ্রিম (দাদনি) দিত, তার জন্য তাদের কাছ থেকে জামিন নিত। কিন্তু মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী এরকম কোনও জামিন দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল। এরা যে কত স্বাধীনভাবে কাজ কারবার করত তা কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট: (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৪২)৮৬
…as to giving security as demanded of them [the merchants] is what they would not do on any account that some of them did business for Guzzeraters, Multaners, Armenians and other merchants and for greater amounts than with us and yet no such thing was ever demanded of them…besides there were none among them but what were esteemed men of credit and many of them substantial men….In short that none of them would submit to the reproaches/as they call it/ of giving security.
কোনওমতেই এ ব্যবসায়ীদের জামিন দিতে রাজি করাতে না পেরে কোম্পানি তাদের শর্ত মেনে নিয়েই তাদের সঙ্গে কাঁচা রেশম সরবরাহের চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৭
আসলে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী অগ্রিমের জন্য জামিন দিতে এত অনিচ্ছুক ছিল কারণ তারা অনেকেই বিশিষ্ট সওদাগর এবং তারা বড় বড় ভারতীয় ও এশীয় ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ করত। তাদের আশঙ্কা ছিল, একবার যদি তাদের জামিন দেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে তা হলে বাজারে তাদের যে সুনাম আছে তা নষ্ট হয়ে যাবে এবং সবাই ভাববে যে তারা তেমন নির্ভরযোগ্য নয়।৮৮ ১৭৪৪ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি থেকে কলকাতায় জানাচ্ছে যে তাদের যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সরবরাহ করতে বলা হয়েছে, তা ওখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য তাদের মুর্শিদাবাদ-সৈয়দাবাদ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এদের মধ্যে অনেকে বেশ ধনী এবং বাজারে এদের খুব সুনাম, বিশেষ করে রাম সিং, গোঁসাইরাম, রামনাথ ইচ্ছানাথ প্রভৃতি। এদের সাহায্য ছাড়া ওই পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এরাই প্রধানত এই পণ্যের ব্যবসায়ী এবং এরা সবচেয়ে ভাল মানের জিনিস সরবরাহ করে—অন্যান্য ব্যবসায়ীরা এই পণ্য সরবরাহ করতে একেবারে চাইত না। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীরা অগ্রিমের জন্য কিছুতেই জামিন দিতে নারাজ। আর যদি এদের সঙ্গে রেশমিবস্ত্রের জোগান দেওয়ার জন্য ইংরেজরা চুক্তি না করে, তাহলে ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে এদের লুফে নেবে। তাই শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি জামিন ছাড়াই এদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৯
সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সুরাটে যেমন বণিকদের ‘মহাজন’ বা ‘গিল্ড’ গোছের জিনিস ছিল,৯০ তেমনি মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের ব্যবসায়ীদেরও পঞ্চায়েত ছিল (রেকর্ডে ‘punch or whole body’)। পঞ্চায়েত যা ঠিক করত, সব ব্যবসায়ী তা মেনে নিত। ১৭৫৫ সালের কাশিমবাজার কুঠির লেখা থেকে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ও বিধান সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে:৯১
Our merchants having entered into and signed a punch or agreement whereby they are bound not to allow of our taking the 10 percent penalty for the short delivery of goods in the year 1752, and that in case of our discharging any of them from our Employ, the whole body should quit our Business, and that any one or more, should for private ends violate these agreements, he or they should be liable to pay a penalty both to the merchants dismissed and to the Government with several other restrictions.
এটা থেকে বোঝা যায়, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের পঞ্চায়েত বেশ শক্তিশালী ও কার্যকরী সংগঠনই ছিল।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. J.H. T. Walsh, Murshidabad, pp. 254-58; J. H. Little, ed., N K. Sinha, Jagat Seth, p. VI.
২. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 7, 3 Jan. 1745; BPC, vol. 17, f. 437, 4 Jan. 1745; C & B Abstr., vol. 5, f. 28, para 49, 9 Jan. 1745.
৩. BPC, vol. 4, f. 462, vo.4, Nov. 1721.
৪. ঐ. vol. 4, f. 438 vo, 28 Aug. 1721. জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ টাঁকশালের ওপর প্রায় পুরোপুরি কর্তৃত্ব করতেন বলে আমার যে বক্তব্য, তা ওম প্রকাশ মানতে রাজি নন। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (‘On Coinage in Mughal India’, IESHR, 25, 4 (1988), p. 487) তিনি এটা বলেছেন। এখানে আমি যেসব তথ্য দিয়েছি এবং আমার বই From Prosperity to Decline, Chapter IV,এ যে-বিশদ আলোচনা আছে তা থেকে বলা যায় যে ওম প্রকাশের বক্তব্য সঠিক বলে মনে হয় না। অবশ্য এটা ঠিক যে বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির অধিকার সবারই ছিল কিন্তু জগৎশেঠরা নবাবের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে টাঁকশালের কাজকর্ম নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। ফলে কাগজে কলমে যাই থাকুক না কেন, টাঁকশালের পুরো কর্তৃত্ব ছিল জগৎশেঠদের হাতে।
৫. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 16 March 1743.
৬. S. Chaudhury. From Prosperity to Decline, pp. 77-87, 111-112.
৭. BPC, vol. 11, f. 349, 8 Nov. 1736; vol. 12, f. 17, 13 Dec. 1736; Bengal Letters Recd., vol. 21, f. 507, 13 Jan. 1750; BPC, vol. 25, f, 43, 3 Feb. 1752.
৮. ক্লাইভকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্টনের চিঠি, Orme Mss., India, XVIII, f, 5043, 17 Dec 1737.
৯. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 67-55.
১০. D. B., vol. 95, f, 519, 18 Jan. 1705.
১১. Indrani Ray, ‘Some Aspects of French Presence in Bengal, 1731-40’. CHJ. vol. 1, no. 1, July 1976, pp. 99-101.
১২. J. H. Little, ed., N. K. Sinha, Jagatseth, p. x, See also, Kantu Papers, BPC, vol. 8, f, 256, Annex. to Consult., 29 June 1730.
১৩. VOC, 2874 থেকে তথ্যের ভিত্তিতে।
১৪. J. H. Little, ed., N. K. Sinha, Jagatseth, p. XI; ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick) বলেছেন, ১৭৪৭-৪৮ সালে জগৎশেঠদের কাছে ফরাসি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লক্ষ টাকা আর ১৭৫৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম ওয়াটস একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখেছেন যে শেঠদের কাছে ফরাসিদের ১৩ লক্ষ টাকা ধার আছে। Orme Mss. India, VI, f. 1525; ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, Bengal, vol. II, p. 229-এ উদ্ধৃত।
১৫. BPC, vol. 14, f. 317-17vo, 11 Dec. 1740.
১৬. ঐ, vol. 14, f. 337, 26 Dec. 1740.
১৭. ঐ, vol. 15, f. 84vo, 29 March 1742.
১৮. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 7 June 1742; BPC, vol. 15, f. 188, 10 June 1742.
১৯. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 14 June 1742; BPC, vol. 15, f. 194vo, 21 June 1742.
২০. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 6 June 1743; BPC, vol. 16, f. 181vo, 10 June 1743.
২১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 2 July 1743.
২২. W.W. Hunter, Statistical Account of Bengal, vol. IX, p. 254.
২৩. BPC, vol. 8, f. 260, 13 July 1730.
২৪. ঐ, vol. 8, f. 234vo, 2 June 1730.
২৫. বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমার বই পলাশির অজানা কাহিনী, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757 ও এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
২৬. S.C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 77.
২৭. Sichtermann’s ‘Memorie’, VOC, 2629, f. 967, 14 March 1744.
২৮. Jan Huijghens’ ‘Memorie’, VOC, 2763, f. 467, 20 March 1750.
২৯. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, VOC, 2849, ff. 128-128vo, 14 Feb. 1755.
৩০. Louis Taillefert’s ‘Memorie’, VOC, 2849, ff. 247vo-248vo, 27 Oct. 1755.
৩১. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৩৮
৩২. Louis Taillefert’s ‘Memorie’, VOC, 2849, f. 248-248vo, 27 Oct. 1755.
৩৩. J.H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. IV.
৩৪. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৮।
৩৫. J.H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. 3.
৩৬. William Bolts, Considerations, p. 158.
৩৭. J. H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. XVII.
৩৮. Luke Scrafton to Colonel Clive, 17 Dec. 1747, Orme Mss., India, XVIII, f. 5043; Eur. G 23, Box 37.
৩৯. Quoted in J. H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. 125; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 29.
৪০. Orme Mss., India VI, f. 1455.
৪১. ঐ, f. 1525.
৪২. Orme Mss., India XVIII, f. 5041.
৪৩. Law’s Memoir, Hill, III, p. 185.
৪৪. Watts’ Memoirs, p. 28.
৪৫. ইংরেজ কোম্পানির পাটনা কুঠির নথিপত্রে উমিচাঁদ ও তাঁর ভাই দীপচাঁদকে (উপাধি ‘আগ্রাওয়ালা’) ১৭৪৭ সালে আজিমাবাদের (পাটনার তখনকার নাম) বাসিন্দা বলে বর্ণনা করা হয়েছে, Fact. Records, Patna, vol. 2, 3 April 1742. অন্য একটি সূত্রে উমিচাঁদকে ‘আগ্রার পূর্বতন বাসিন্দা’ বলা হয়েছে, BPC, vol. 17, f. 276vo.
৪৬. কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার—যাদের অনেকেই দাদনি বণিক ছিলেন, জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। এই পরিবারের কয়েকজন ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর বা ‘ব্রোকার’ হিসেবে কাজ করেছে।
৪৭. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p.6.
৪৮. C & B Abstr., vol. 4, f. 376, 11 Dec. 1741.
৪৯. Home Misc. Series, vol. 192, f. 64; BPC, vol. 17, f. 769, 16 Dec. 1744.
৫০. BPC, vol. 20, f, 109-9 vo, 15 Aug 1747.
৫১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 5, 21 Jan. 1736.
৫২. Hill, vol. II, pp. 63-64.
৫৩. BPC, vol. 23, f. 186, 1 July 1750.
৫৪. ঐ, vol. 17, f. 372 vo, 1 Dec. 1744.
৫৫. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 60, 128.
৫৬. ঐ, vol. II, Sec. I, pp. 60, 128.
৫৭. P. C. Majumdar, Musnud, p. 233.
৫৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 120.
৫৯. BPC, vol. 26, f. 110, 2 April 1753; Beng. Letters Recd., vol. 22, para 18, f. 410.
৬০. Orme Mss., O.V. 134, f. 13; Mss. Eur. D. 283, f. 22; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 120-21.
৬১. এসব তথ্য ডাচ রেকর্ডস থেকে সংগৃহীত। VOC 2661, 2689. 2862.
৬২. VOC 2849; Hill, II, p. 87.
৬৩. BPC, vol. 26, f. 132vo, 3 May 1758; C & Abst., col. 5, f. 424; Beng. Letters Recd., vol. 22, f, 412.
৬৪. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 58.
৬৫. Records of Fort St. George, Diary and Consultation Book, 1756, vol. 86, p. 32; Orme Mss., O.V. 19, p. 104.
৬৬. Yusuf Ali Khan, Zamia-i-Tadhkira-i-Yusufi, p. 17.
৬৭. ‘Memorie’ of Jan Huijghens, VOC 2763, f. 458, 20 March 1750.
৬৮. ‘Memorie’ of Jan Kerseboom, VOC 2849, f. 128 vo, 14 Feb. 1755.
৬৯. Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 187.
৭০. ওয়াটসকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss. India, X, f. 112 vo.
৭১. Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 190.
৭২. সিলেক্ট কমিটিকে ওয়াটস, Select Committee Consults., Orme Mss., India V, f. 1210; O.V. 170, f. 215.
৭৩. ক্লাইভের ওয়াটস, ৩ মে ১৭৫৭ Hill, II, pp. 374-75.
৭৪. ক্লাইভের ওয়াটস, ৯-১৩ মে ১৭৬৭, Hill, II, pp. 379.
৭৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190, f. n. 1.
৭৬. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss., India X, f. 112 vo.
৭৭. মীরণকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ নভেম্বর ১৭৫৯, Clive Mss., 269 No. 982.
৭৮. Mss. Eur. G 37, Box 22.ওয়াজিদ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার প্রবন্ধ “Trading Networks in a Traditional Diaspora. Armenians in India, c. 1600-1800’, paper presented at the XIIIth International Economic History Congress, Buenos Aires, July 2002.
৭৯. VOC 2030, ff. 156-58, 16 March 1725.
৮০. Indrani Ray, ‘Some Aspects of French Presence in Bengal, 1731-40’, CHJ, vol. 1, No. 1, July 1976, pp. 99-101.
৮১. BPC, vol. 8, f. 321, 7 Dec. 1730.
৮২. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 5. Consult. 5 Feb: 21 Feb; 19 March 1737; C & B.Abstr. vol.4, f.210. para 4, 15 Feb. 1737; BPC, vol. 12, f.162, 16 April 1737.
৮৩. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 233.
৮৪. ঐ, p.241, fn. 82.
৮৫. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 25 Dec. 1741.
৮৬. ঐ, vol. 6, 26 Frb. 1742.
৮৭. ঐ.
৮৮. ঐ. vol. 6, 27 Jan. 1744.
৮৯. BFC, vol. 17, f. 66, 23 April 1744; Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 19 April 1744.
৯০. S. Chaudhury, The Surat Crisis of 1669—A Case Study of Mercantile Protest in Medieval India’, CHJ, vol. V, no. 2, Jan-June 1981, pp. 129-46.
৯১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 12, 21 Oct. 1754.
০৫. পলাশি
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের সম্যক বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। তা না করলে এই ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মুর্শিদাবাদেই এ ষড়যন্ত্রের উদ্ভব, বিকাশ ও রূপায়ণ। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে পলাশি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশিতে ইংরেজদের বাংলা বিজয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করে। বাংলা থেকেই এবং বাংলার অর্থভাণ্ডার দিয়েই ইংরেজরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা। সেজন্য তারা কেন এবং কী ভাবে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলা জয় করে, তার আলোচনা করা প্রয়োজন।
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, এস. সি. হিল (১৯০৫) থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল (১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭), রজতকান্ত রায় (১৯৯৪) প্রমুখের গ্রন্থেও১ সিরাজদ্দৌল্লা এবং পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে কতগুলি বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দেখা যায়। সাধারণভাবে এ বক্তব্যগুলি হল—পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না; সিরাজদ্দৌল্লা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি ‘আকস্মিক’ ঘটনামাত্র, এর পেছনে তাদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ (মার্শালের ভাষায় ‘no calculated plottings’) ছিল না। মুর্শিদাবাদ দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তারা মাঠে নেমে পড়ে এবং নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় সামিল হয়।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা হয় হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে বিবাদ ও সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলার মসনদও হারালেন, তার জন্য মূলত দায়ী তিনিই। আবার পলাশির ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখান হয়ে থাকে যে সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী অমাত্যবর্গকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। ইদানীং এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘সংকটও’ [বিশেষ করে কে. এন. চৌধুরী (১৯৭৮), পিটার মার্শাল (১৯৮০, ’৮৭)] দেখা দিয়েছিল এবং এই ‘উভয় সংকট’ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই যেন ইংরেজরা ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বাংলা জয় করে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক আবার ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে প্রাক-পলাশি বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় যত্নবান। এঁদের বক্তব্য, পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম নবাবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলি কতটা সঠিক এবং তথ্য ও যুক্তিনির্ভর, তার সূক্ষ্ম এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। গত দু’দশকেরও বেশি ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (India Office Records, British Library, London) রক্ষিত ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও ‘প্রাইভেট পেপারস’ এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভসে (Algemeen Rijksarchief, The Hague) সংরক্ষিত ডাচ কোম্পানির দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে (যেগুলি এর আগে পলাশির প্রেক্ষিতে কেউ দেখেননি বা ব্যবহার করেননি) যেসব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি এবং তার পাশাপাশি আগের নানা তথ্য ও সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে আমরা ওপরের বক্তব্যগুলি খণ্ডন করেছি।
আমাদের মূল বক্তব্য, পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই একাজ সম্পন্ন করে এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয়, পলাশির যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে। তবে এটাকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষ স্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। নবাবের দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা অংশ সিরাজদ্দৌল্লার ওপর বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, একথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে বক্তব্যের ওপর জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই চক্রান্ত পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না।
বিচার্য বিষয়
আলোচনার সুবিধের জন্য বিষয়গুলি আর একটু বিশদভাবে বলা প্রয়োজন। প্রথম, ঐতিহাসিকরা (এবং বেশিরভাগ সমসাময়িক লেখকরাও বটে) সহমত যে নবাব হওয়ার আগে সিরাজদ্দৌল্লা এতই নির্মম, নিষ্ঠুর এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই আলিবর্দির পরে সিরাজের নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সিরাজের এই ‘কদর্য’ চরিত্র অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রায় সবাইকে শুধু নয়, সাধারণ মানুষকেও তাঁর প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল। কাশিমবাজারের তদানীন্তন ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘Before the death of Alivardi Khan, the character of Siraj- uddaula was reputed to be worst ever known. In fact he had distinguished himself not only by all sorts of debaucheries but by a revolting cruelty’২. দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের যে বিবাদ ও সংঘর্ষ হয়েছিল তার জন্য সিরাজদ্দৌল্লাই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। এ সংঘর্ষের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে এস. সি. হিল নবাবের উদ্দেশ্য বা কারণ এবং নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন। হিলের মতে এ সংঘর্ষের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হল সিরাজদ্দৌল্লার ‘দম্ভ’ এবং ‘অর্থলিপ্সা’। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যেসব অভিযোগ— ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যকরণের প্রচেষ্টা, দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বেআইনি অপব্যবহার এবং নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান— সেগুলিকে হিল সাহেব ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।৩
তৃতীয়ত, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বক্তব্য, পলাশি ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র (ক্রিস বেইলির ভাষায় ‘Indian-born conspiracy’)। এর পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না। প্রথমদিকে ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল ‘খুবই সীমিত’ কিন্তু তারা যখন উপলব্ধি করল যে মুর্শিদাবাদ দরবারে একটি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে উৎসুক, তখন তাদের লক্ষ্য আস্তে আস্তে প্রসারিত হল।৪ সাধারণভাবে পলাশির ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত মীরজাফরকেই দায়ী করা হয়। মীরজাফরই বিশ্বাসঘাতক—নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে বাংলার মসনদ অধিকার করার মতলবে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে পলাশি চক্রান্তে যোগ দেন— এ মত বহুল প্রচারিত। বাংলায় মীরজাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। এখনও ওই নাম বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ।
চতুর্থত, প্রাক্-পলাশি বাংলায় অভ্যন্তরীণ ‘সংকটের’ কথাও বলা হয়ে থাকে। আগে এই ‘সংকটকে’ শুধু রাজনৈতিক ‘সংকট’ হিসেবে দেখা হত। কিন্তু ইদানীং এর সঙ্গে অন্য একটি মাত্রাও যোগ করার চেষ্টা হয়েছে—বলা হচ্ছে এটা অর্থনৈতিক ‘সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণি, জমিদার ও অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে শ্রেণিগত জোটবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। আর অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে— অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্পবাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণির আর্থিক দুরবস্থা, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ সবগুলিকে ১৭৪০-র দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তাঁর ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।৫
আবার অধুনা বলা হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাঙ্কিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতেই পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা করা সমুচিত। হিল সাহেব অবশ্য অনেকদিন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে তাদের সঙ্গে উপরোক্ত শ্রেণির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।৬ কিছুদিন আগে ব্রিজেন গুপ্ত দেখাবার চেষ্টা করেছেন, বাংলার সঙ্গে ইউরোপীয় সমদ্র বাণিজ্যের ফলে হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশেষ শ্রেণিই বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহায়কের (‘catalytic agent’) কাজ করেছিল।’৭ আর এখন পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলি প্রমুখ ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর জোর দিচ্ছেন— বলছেন, তাঁর ফলে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে কারণেই হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়।৮ অর্থাৎ সেই ‘কোলাবোরেশন থিসিসের’ ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে বাংলায় হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের, বিশেষ করে ইংরেজদের, স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় এবং সেজন্যই এরা ইংরেজদের সঙ্গে পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। বিশদভাবে বলতে গেলে এ বক্তব্য মোটামুটি এরকম: অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যেরই বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি বাণিজ্য করছিল এবং ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ (রুপো, টাকাকড়ি) আমদানি করত। আর এই বাণিজ্যের ফলে হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ লাভবান হতে থাকে এবং সে কারণেই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্রিস বেইলি এমন কথাও বলছেন যে বাংলায় ‘ব্যবসায়ী-ভূস্বামীদের স্বার্থ ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছিল যে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তারা সহ্য করতে পারছিল না এবং সেজন্যই পলাশির ঘটনা ঘটল’।৯
সবশেষে এবং একদিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রাক-পলাশি বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত চিত্র। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, পলাশি যুদ্ধের প্রাক্কলে বাংলার সমাজ হিন্দু এবং মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত ছিল। মুসলমান নবাবের অত্যাচারে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমান শাসন থেকে মুক্তি চাইছিল, তাই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাতে উৎসুক ছিল। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তাও এস. সি. হিল। ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার যে সংঘর্ষ বাধে, হিলের মতে তাঁর অন্যতম ‘সাধারণ’ কারণ মুসলমান শাসকদের প্রতি হিন্দুদের অসন্তোষ। স্যার যদুনাথ সরকার সোজাসুজি এ ধরনের কথা না বললেও উদ্ধৃতি দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, মূলত হিন্দুরাই মুসলমান শাসনের অবসান চাইছিল। ব্রিজেন গুপ্ত বাংলার দ্বিধাবিভক্ত এই সমাজের কথা বলতে গিয়ে প্রায় হুবহু হিলের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন।১০
.
সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্র
ইতিহাসের গল্পকথায় শুধু নয়, মননশীল লেখকদের ভাষ্যেও সিরাজদ্দৌল্লা দুশ্চরিত্র, নির্মম, নিষ্ঠুর ও লম্পট। সন্দেহ নেই, সমসাময়িক বিদেশি পর্যবেক্ষক ও ফারসি ইতিহাসেও এমন বর্ণনাই আছে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সংঘর্ষের কারণ খুঁজতে গিয়ে বা পলাশি চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটনে নবাব হওয়ার আগে সিরাজ চরিত্রের এই ‘অন্ধকার’ দিকটা খুঁটিয়ে দেখার খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবু তর্কের খাতিরে ওটা প্রয়োজনীয় বলে যদি ধরেও নেওয়া যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে বাংলার প্রায় সব নবাবই একই চরিত্রদোষে দোষী—দুশ্চরিত্র আর নিষ্ঠুর কেউ কম ছিলেন না। তা হলে শুধু সিরাজদ্দৌল্লাকেই ‘দুশ্চরিত্রের’ জন্য দোষী করার প্রচেষ্টা কেন? মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার সব নবাবই নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ দু’জনেই দুশ্চরিত্র ছিলেন। সেক্ষেত্রে সিরাজদ্দৌল্লার প্রতিই কেন শুধু এ অপবাদ? এটাকে পলাশির ষড়যন্ত্র ও ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রচার বলে সন্দেহ করা কি খুবই অমূলক?
আমাদের এ বক্তব্যকে কিন্তু সিরাজ চরিত্রের দোষস্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ভুল বোঝার অবকাশ নেই। নবাব হওয়ার আগে দুশ্চরিত্রের অপবাদ সিরাজকে দেওয়া যায় না বা নবাব হিসেবে সিরাজ খুব মহান ছিলেন এটা মোটেই আমাদের বক্তব্য নয়। আমাদের যুক্তি অন্যত্র। আমাদের প্রশ্ন— নবাব হওয়ার পরেও কি সিরাজ আগের সেই চরিত্রের লোক ছিলেন? তার মধ্যে কি কোনও পরিবর্তন এসেছিল বা তার কি চৈতন্যোদয় হয়েছিল? নবাব হওয়ার পরেও কি তিনি আগের মতো উদ্ধত, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর আর নির্মম ছিলেন? ইতিহাসে এর সোজাসুজি সাক্ষ্যপ্রমাণ তেমন কিছু নেই। তবু এখানে ওখানে ছোটখাট কিছু তথ্য, কিছু ইঙ্গিত থেকে একটা ধারণা আমরা করতে পারি। তা ছাড়া নবাব হিসেবে (যদিও স্বল্প সময়ের জন্য—পনেরো মাসেরও কম) সিরাজদ্দৌল্লার আচরণ ও কাজকর্ম বিশ্লেষণ করেও আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি। এখানে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের মনে রাখতে হবে। সিরাজ চরিত্রের যে কদর্য দিকটার দিকে সবাই অঙ্গুলি সংকেত করছেন, তা কিন্তু মুখ্যত সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার আগের চরিত্র (জাঁ ল’ স্পষ্ট বলেছেন ‘Before the death of Alivardi Khan’)। নবাব হওয়ার পরে সিরাজ চরিত্রের এ ‘অন্ধকার’ দিকটার সোজাসুজি কোনও তথ্য বা প্রমাণ কিন্তু অপ্রতুল। এর কারণ সম্ভবত নবাব হওয়ার পরে সিরাজদ্দৌল্লার স্বভাব এবং আচরণের পরিবর্তন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সাম্প্রতিক লেখাতেও সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘জেদী’, ‘একরোখা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তাঁর ‘মেজাজি রাগিস্বভাবের’ ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।১১ লব্ধপ্রতিষ্ঠ এক ঐতিহাসিক আবার সিরাজদ্দৌল্লার ‘নিষ্ঠুরতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও উন্মাদ স্বভাবের’ গল্পকে ‘পরাজিতের মরণোত্তর পুরস্কার’ বলে উল্লেখ করেও সত্য ঘটনা কী তা এড়িয়ে বলছেন ‘সত্য যাই হোক না কেন, সিরাজদ্দৌল্লা মোটেই আলিবর্দির যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন না।’১২ নবাব হওয়ার পরে সিরাজের চরিত্রে যে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছিল তা আমরা ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টনের (Luke Scrafton) লেখা থেকে জানতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় সিরাজ কোরান ছুঁয়ে শপথ করেন যে তিনি জীবনে আর কোনওদিন মদ্যস্পর্শ করবেন না, সে শপথ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।’১৩ অথচ এই স্ক্র্যাফ্টনই আগে সিরাজকে ‘অতিরিক্ত পানাসক্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। সিরাজ-চরিত্রে এ পরিবর্তন খুবই অর্থবহ কারণ যে যুবক অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত তিনি যে এত সহজে দীর্ঘদিনের বদভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারলেন এবং মৃত্যুপথযাত্রী মাতামহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজীবন রক্ষা করেছেন, তাঁর পক্ষে ইচ্ছে করলে নিজের স্বভাবচরিত্র সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। ওই কারণে মনে হয় নবাব হওয়ার আগে সিরাজের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।
এমন পরিবর্তন যে অসম্ভব নয় (যদিও নাটকীয় হতে পারে) এবং তার যে সম্ভাবনাও ছিল সেটা আমাদের জানাচ্ছেন জাঁ ল’, যিনি-ই প্রধানত সিরাজচরিত্রের কদর্য রূপটি তুলে ধরেছেন। তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ: ‘People have flattered themselves that when he (Siraj] became Nawab he would be more humane.’ তিনি নিজেও অবশ্য আশা করেছিলেন যে হয়তো “সিরাজ একদিন [নবাব হওয়ার পরে?] সজ্জনে পরিণত হতে পারেন।’ তাঁর ওরকম বিশ্বাসের কারণও ছিল যার জন্য তিনি লিখেছেন, ‘[ঢাকার] তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান১৪ সিরাজের চেয়ে কম দুশ্চরিত্র ও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না কিন্তু পরে তিনি সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন’।১৫
এবার নবাব হওয়ার পর সিরাজদ্দৌল্লার আচরণ বিশ্লেষণ করা যাক। জাঁ ল’র লেখা থেকেই স্পষ্ট যে তিনি ফরাসিদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন। ফরাসিদের প্রতি কোনও নিষ্ঠুরতা বা উদগ্র রাগ তিনি দেখাননি। তাঁর দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মসনদের দাবিদার, ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের প্রতি তিনি কেমন আচরণ করেছিলেন? নবাব হওয়ার আগে তাঁর যে চরিত্র আমরা দেখেছি, তার সঙ্গে মিলে যায় এমন হঠকারিতা বা অবিবেচনাপ্রসূত কিছু কি তিনি করেছিলেন? এর উত্তর কিন্তু একদম ‘না’। তিনি তাঁর প্রথম শত্রু ঘসেটি বেগমকে (যিনি সিরাজকে নবাব হিসেবে একেবারে চাননি এবং সিরাজ যাতে নবাব হতে না পারেন তাঁর জন্য যথাসাধ্য চক্রান্ত করছিলেন) যেভাবে ‘বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্তির সঙ্গে বাগ মানিয়েছিলেন’ তা তারিখ-ই-বংগালা-ই-মবহতজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি খানও তারিফ না করে পারেননি। তিনি লিখছেন যে বহুলোক, যারা আগে ঘসেটি বেগমকে সমর্থন করছিল, তারা সিরাজের ‘আপোষমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায়’ সন্তুষ্ট হয়ে বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। শওকত জঙ্গ অবশ্য আরও অনেক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজের তখ্ত বজায় রাখতে সিরাজ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হন ও তাঁকে পর্যুদস্ত করেন।
ইংরেজদের সঙ্গেও কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লা প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। পরে একদিকে দৌত্যের মাধ্যমে ও অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করে একটা মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। একুশ বাইশ বছরের তরুণ এক নবাবের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি জ্ঞানবুদ্ধি আর কী আশা করা যেতে পারে? কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ উইলিয়াম ওয়াটস, যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখতেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ক্ষমতা এবং ধনসম্পত্তির প্রাচুর্যে কিঞ্চিৎ বেসামাল’, বলে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা হয়তো সত্যের অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু পনেরো মাসের স্বল্প রাজত্বকালে সিরাজ কোনও পাগলামি, অর্বাচীনতা বা নিষ্ঠুরতার পরিচয় যে দেননি, ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ থেকে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায়। পাশাপাশি এটাও সত্য যে সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হিসেবে, দেশের শাসক হিসেবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। এদেশে ব্যবসা করতে এসে নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার মতো কোনও ঔদ্ধত্যকে তিনি সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। ওয়াটসের মতে সিরাজদ্দৌল্লা বিদেশি বণিকগোষ্ঠীর কাছে প্রত্যাশা করেছিলেন যে তারা নবাবের আদেশ বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে। কিন্তু তা বলে সিরাজ সর্বক্ষণ ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব দেখিয়েছেন, এমন কথা ঠিক নয়। যে তরুণ যুবা ‘উগ্র মেজাজ’ এবং ‘নির্মম নিষ্ঠুরতার’ জন্য কুখ্যাত, তিনি কিন্তু নবাব হওয়ার পরে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অবরোধ ও আত্মসমর্পণের পরে পরাজিত ইংরেজদের প্রতি ‘উদার মানবিকতার’ সঙ্গে ব্যবহার করেছেন১৭— এ তথ্য কাশিমবাজার কুঠির এক ইংরেজ কর্মচারীরই। কাশিমবাজারের ইংরেজ বিষয়-সম্পত্তির ওপর সিরাজ হাত পর্যন্ত দেননি, শুধু সেখানকার অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। ইংরেজদের সম্পূর্ণ অসহায় পেয়েও কোন লুঠতরাজ, হত্যা বা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় কিন্তু সিরাজ নেননি। সিরাজ চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াটসের মন্তব্য: ‘….in his own nature [Siraj was] timid to the last degree.’ স্ত্রী লুৎফুন্নেসার প্রতি সিরাজের গভীর ভালবাসা ও মদ্যপান না করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার মধ্যে কিন্তু বদ্ চরিত্রের লক্ষণ কিছু পাওয়া পাওয়া যায় না।
.
সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ
নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজদের মধ্যে যেসব বিশেষ ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে বিরোধ এবং যার ফলে শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, সেগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে এ সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সিরাজ নবাব হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ও ইংরেজদের পারস্পরিক স্বার্থের সংঘাতের ফলে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আসলে আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে সিরাজ ইংরেজ কোম্পানির বেশ কিছু কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ এগুলির মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় এবং আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদ নিয়ে বিরোধ অবধারিত ভেবে ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই প্রায় প্রকাশ্যে তাদের দুর্গগুলির সংস্কার ও সংহত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলিবর্দির গুরুতর অসুস্থতা এবং অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য অভিযান করতে পারেন এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সিরাজ আপাতত ইংরেজ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৮
ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হওয়ার সিরাজদ্দৌল্লার আরও গভীর কারণ ছিল। তিনি নবাব হওয়ার পর ইংরেজরা তাকে কোন উপঢৌকন বা নজরানা পাঠাননি বলে তাঁর ক্ষোভ হয়েছিল বলে যে বক্তব্য, তা মোটেই ঠিক নয়।১৯ প্রথম থেকেই তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে ইংরেজরা তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির বিরোধিতা করতে পারে এবং তারা মসনদের দাবিদার, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিচ্ছে। এ সন্দেহ কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। বস্তুত ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল সিরাজের পক্ষে নবাব হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ রেনল্ট বা কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’র লেখা এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইউরোপীয় তথ্য থেকেও জানা যায় যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে একটা মতলব ভাঁজছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রেনল্ট স্পষ্ট জানাচ্ছেন: ‘ঘসেটি বেগমের দলকে মসনদ দখলের দৌড়ে কেউ আটকাতে পারবে না এবং সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য, এই স্থির বিশ্বাসে ইংরেজরা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে [সিরাজের বিরুদ্ধে] চক্রান্ত শুরু করে।’২০ জাঁ ল’ও লিখেছেন যে অন্য অনেকের মতো ইংরেজরাও ভেবেছিল, ‘সিরাজদ্দৌল্লা কখনও নবাব হতে পারবেন না এবং তাই তারা কোনও কাজে তাঁর দ্বারস্থ হত না’।২১ তা ছাড়া মসনদের জন্য সিরাজের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গেও ইংরেজদের যোগাযোগ ছিল।২২ এসব দেখেই মনে হয় কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার বলেছেন যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের ওপর রেগে যাওয়ার যথেষ্ট ইন্ধন যুগিয়েছিল।২৩
সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য তাঁর আত্মম্ভরিতা ও অর্থলিপ্সাই দায়ী বলে যে বক্তব্য তা কিন্তু মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তিনি যদি সত্যিই দাম্ভিক হতেন এবং তাঁর দাম্ভিকতাই যদি বিরোধের অন্যতম কারণ হত তা হলে তাঁর দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গকে পরাভূত করার পরই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থলিপ্সার অভিযোগও ভিত্তিহীন।২৪ আসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের তিনটি নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। আমাদের কাছে যেসব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে সহজেই প্রমাণ করা যাবে যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত এবং মোটেই ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য সিরাজের ‘মিথ্যা ওজর’ নয়। সিরাজের অভিযোগগুলি হল—(১) নবাবের বিনা অনুমতিতে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টা। (২) দস্তকের বেআইনি ও যথেচ্ছ অপব্যবহার। (৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান। খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর একটি চিঠিতে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ তিনটি অভিযোগের কথা স্পষ্ট করে জানান।২৫
.
কেল্লার সংস্কার
উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ ও সংঘাত, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখা দরকার। কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকে স্পষ্ট যে, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৭৪০-র দশকে মারাঠা আক্রমণের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারদিকে গড়খাই (ditch) খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি ১৭৫২) যে ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।২৬ অবশ্য ওই পরিচালক সমিতি ১৭৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামকে জানাচ্ছে, নবাবকে যেন বোঝানো হয় কেল্লা সুসংহত করার ‘মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।’২৭ কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য বলছেন২৮ ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করছিল, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল লন্ডনে লিখেছিল যে এর মূল উদ্দেশ্য ‘দেশীয় শত্রুদের [অবশ্যই নবাব] আক্রমণ প্রতিহত করা’।২৯ সুতরাং সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজদের এ প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:৩০
নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just pol-icy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে।… এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।
এখানে এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা শুধু ইংরেজদের নয়, ফরাসিদেরও আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যেসব নির্মাণকার্য করেছিল, সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু নির্মাণ করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেল। কিন্তু ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ, নবাবের কথায় তারা কর্ণপাতও করল না।৩১ হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে ইংরেজরা তাদের ‘অধিকারের সীমা লঙ্ঘন’ করেছিল এবং ‘নবাবের অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কেল্লা সুসংহত করেছিল।৩২ সুতরাং এটা অবশ্যই বলা যায় যে এ-ব্যাপারে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করা যায় না।
.
দস্তকের অপব্যবহার
দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বে-আইনি অপব্যবহার সম্বন্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তকের সাহায্যে তারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে বাণিজ্যশুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী এ দস্তক তারা এশীয় বণিকদের কাছেও বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্য কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্য প্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে’।৩৩ এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্বহানি হচ্ছিল সিরাজ স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা লেখক জানাচ্ছেন:৩৪
সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্য দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
এমনকী এস. সি. হিলও স্বীকার করেছেন যে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যেসব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা বলতেই হবে যে ইংরেজরা যেভাবে দস্তকের ব্যবহার করেছে, তা [ফারুখশিয়রের] ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।৩৫ সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে তাঁর ‘মিথ্যা অজুহাত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
.
নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান
নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দি খানও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।৩৬ কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। কৃষ্ণদাস রাজবল্লভের পুত্র আর রাজবল্লভ ছিলেন ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারী এবং সে সুবাদে ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত। রাজবল্লভের বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ ছিল এবং সেটা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। রাজবল্লভ ভয় পেয়ে ওয়াটসকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য । ওয়াটসের ধারণা হয়েছিল ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্য লাভ করবে। তাই তিনি কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেককে (Roger Drake) লেখেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দিতে কারণ ‘রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে’।৩৭ কৃষ্ণদাস সপরিবারে ৫৩ লক্ষ টাকার ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন আলিবর্দির মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে।৩৮ এরপরে কিন্তু ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই এবং ড্রেককে লেখেন যে কৃষ্ণদাসকে এ অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন নয়। ড্রেক তাতে কর্ণপাতও করেননি।৩৯ কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, মসনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিরাজের যে বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যে অভিযোগ তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।
সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের (জুন ১৭৫৬) আগের যে ঘটনাবলি তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে কলকাতার ইংরেজদের কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ সংঘর্ষকে অপরিহার্য করে তোলে। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। এ সংঘর্ষ বাধার তিনদিন আগে পর্যন্ত সিরাজ কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাঠানো দূত নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিস্ফল হল মূলত গভর্নর ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করেন। ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করার পর নবাব কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন।৪০ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ করে নবাবের দূত নারায়ণ সিংকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে, কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:৪১
Could it be ever imagined any Prince would suffer a set of merchants to protect from him any of his subjects, much less a man who had enjoyed a considerable post under the government or would tamely put up with the insult to his messenger? …turning the messenger away will be construed an insult by the whole world.
.
অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’
প্রাক্-পলাশি বাংলায় অভ্যন্তরীণ সংকট প্রসঙ্গে যে বক্তব্য তাঁর আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমে রাজনৈতিক সংকট। সত্যিই কি এমন কোনও সংকট দেখা দিয়েছিল? আমাদের উত্তর, মোটেই না। সাধারণভাবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণি, ভূস্বামী ও অভিজাতবর্গের যে নতুন শ্রেণিবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার পরে একেবারে ভেঙে পড়ে কারণ তিনি তাঁর ব্যবহারে ওইসব শ্রেণির লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর ফলেই রাজনৈতিক সংকট। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসংঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এটা মনে রাখা দরকার যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণিনির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেবার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব, তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়— এটা মুর্শিদকুলির শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্বনীতির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। তা ছাড়া, এই তথাকথিত জোটবন্ধন একেবারেই শ্রেণিভিত্তিক নয়— ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। আবার এ শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিশ্ছিদ্র কোনও সংগঠনও নয়। বারে বারে তার মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। তাই সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর ‘নতুন শ্রেণিগত জোটবদ্ধতা’ ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়— এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।৪২
ঠিক এমনি ভাবেই দেখানো যায় যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় কোনও অর্থনৈতিক সংকটও ছিল না। এ সময় বাংলার শিল্পবাণিজ্যে যে অবক্ষয়ের কথা বলা হয় তা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকরা যে বিপুল পরিমাণ পণ্য রফতানি করেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিল্পবাণিজ্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তাঁর দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। এটা ঠিকই, ১৭৪০-র দশকের শেষদিকে ও ৫০-র দশকের প্রথমদিকে ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্য কিছুটা কমে যায়। তবে সেটা বাংলার শিল্পবাণিজ্যে সংকটের জন্য নয়, কোম্পানির নিজস্ব সমস্যার জন্য। এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, এতদিন বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের কোনও ধারণা আমাদের ছিল না, ফলে এটাকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। ইদানীং আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পেরেছি যে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, ইউরোপীয়দের সম্মিলিত বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি।৪৩ তাই যে সময় বাংলা থেকে এশীয় ও ইউরোপীয়রা এত বিশাল পরিমাণ পণ্য রফতানি করছে, সে সময় শিল্পবাণিজ্যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, এ কথা মানা যায় না।
তা ছাড়া পলাশির প্রাক্কালে বাংলার ব্যাঙ্কিং-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর্থিক দূরবস্থার মধ্যে পড়ে বলে যে বক্তব্য তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আমরা দেখিয়েছি যে এ-সময় ওই গোষ্ঠীর বেশ শ্রীবৃদ্ধিই হয়েছিল। বাংলার তিন বণিকরাজার—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও আর্মানি খোজা ওয়াজিদ— আর্থিক সমৃদ্ধি তখন তুঙ্গে। তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে একদিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে চলেছিলেন, অন্যদিকে বাংলার বস্ত্র ও রেশমশিল্পে লিপ্ত ব্যবসায়ীদের অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের মহাজনি ব্যবসার তখন রমরমা। সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করার জন্য নগদ টাকার অভাব মেটাতে বণিকরাজা ও অন্য মহাজনদের কাছে নিয়মিত টাকা ধার করত।৪৪ এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় ব্যাঙ্কার ব্যবসায়ীদের আর্থিক দুর্গতির কথা মেনে নেওয়া কঠিন।
আবার মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল বলে যে ধারণার ওপর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছি যে প্রাক-পলাশি বাংলায় মূল্যস্তর এমন কিছু বাড়েনি যাতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এটা বলা যায়। প্রায় কুড়ি বছরের কাপড়ের দামের যথাযথ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি যে ১৭৩০ থেকে ১৭৫০-র প্রথমদিক পর্যন্ত বেশির ভাগ কাপড়ের দামই তেমন কিছু বাড়েনি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম কমেছে। কাঁচা রেশমের দামে যদিও ওঠা-পড়া লক্ষ করা গেছে, ক্রমাগত ও নিয়মিত দাম বেড়েছে, এমন কথা কোনওমতেই বলা যায় না। চালের দামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে— বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে দাম কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে কিন্তু সাধারণভাবে চালের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে চলেছে এমন কিছু কিন্তু চোখে পড়ে না। তাই পলাশির আগে বাংলায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার।৪৫
‘কোলাবোরেশন থিসিসও’ কিন্তু অচল। এটা যুক্তিগ্রাহ্য হত যদি দেখানো যেত যে মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী-মহাজনদের সমৃদ্ধি ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। আমরা অন্যত্র৪৬ দেখিয়েছি যে ওই সময় ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করেছিল এবং তাই তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করেছিল, এ বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ইউরোপীয়দের তুলনায় এশীয়/ভারতীয় বণিকদের বাংলা থেকে পণ্য রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, ফলে তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ আমদানি করেছিল, ইউরোপীয়রা নয়। সুতরাং বলা যেতে পারে যে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের সমৃদ্ধি বহুলাংশেই নির্ভর করত এশীয়দের বাণিজ্যের ওপরেই, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ওপর নয়। তাই বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিকদের স্বার্থ ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল এটা কিছুতে বলা যায় না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হবে। বাংলার অন্যতম প্রধান বণিকরাজা জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকার মতো। তার মধ্যে খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ লক্ষ টাকার মতো আয় হত ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে। অর্থাৎ শতকরা ৩৩ ভাগের মতো। বাকিটা অবশ্যই এশীয় বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্তির ফলে।৪৭ তাই ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসের মূল যে প্রতিপাদ্য— বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিক-মহাজন, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাতবর্গের ভাগ্যের সঙ্গে ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের, ভাগ্য ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেবেন এই ভয়ে ওরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব ঘটাতে বাধ্য হয়— তা ধোপে টেঁকে না।
পরিশেষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজ। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত।৪৮ সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে ব্যগ্র হয়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ প্রেক্ষিতে প্রাক-পলাশি সময়ে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে যেটা মনে রাখা প্রয়োজন তা হল, পলাশি শুধু হিন্দুদের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়— হিন্দুরাই শুধু মুসলমান নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেনি। হিন্দু-মুসলমান-জৈন-আর্মানি সব সম্প্রদায়ের লোকই এতে লিপ্ত হয়েছিল। তবে পলাশি বিপ্লব মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণির একটি শক্তিশালী অংশকে— যার মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও— সামিল করতে পেরেছিল। বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল— ১৭২৭ এবং ১৭৩৯/৪০ সালে, যখন শাসকগোষ্ঠীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং এ দুটি বিপ্লবের সময় যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬/৫৭ সালেও সে প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।
পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হত, তা হলে সমসাময়িক সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাস গ্রন্থে তা অবশ্যই প্রতিফলিত হত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তখনকার সাহিত্য বা ইতিহাসবেত্তার লেখায় দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয় থাকতে পারে, শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়। তার মূল শ্রেণিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলে আসছিল, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তার পরিপূর্ণ রূপ দেখা যায়। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে— এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র সৃষ্টি- যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের ‘সত্যপীর’ কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।৪৯ এডওয়ার্ড সি ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষের’ পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।৫০ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কবি ফৈজুল্লার ‘সত্যপীর’ কবিতা, যেখানে ‘যে রাম সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।৫১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।
তা ছাড়া এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রাক্-পলাশি বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কথা বলা হয়। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের হেগ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক পলাশির আগে বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমি পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরম-এর তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুদের দখলে, একমাত্র মুসলমান বক্সি হল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু।৫২ দ্বিতীয় তালিকাটি বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom)। সেই তালিকাতেও নায়েব দেওয়ান রায় রায়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের একচ্ছত্র প্রাধান্য।৫৩ ১৭৫৪/৫৫ সালের এই যে চিত্র, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা আরও স্পষ্ট হয়। তরুণ নবাবের ডানহাত ও সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসভাজন ছিলেন মোহনলাল। বস্তুতপক্ষে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দুপ্রাধান্য এত বেশি ছিল যে তা দেখে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেন:৫৪
The Gentoo (Hindu) connection became the most opulent influence in his [Alivardi’s] government of which it pervaded every department with such efficacy that nothing of moment could move without their participation or knowledge.
ওপরের সব তথ্য বিচার করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সোজাসুজি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।
.
পলাশি কার চক্রান্ত?
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক কে বা কারা? মীরজাফরই শুধু বিশ্বাসঘাতক বলে জনমানসে এখনও যে ধারণা বহুল প্রচারিত, তা ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য? পলাশি কি শুধু ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র, এতে ইংরেজদের কি কোনও ভূমিকা ছিল না? এখানে অবশ্য বলে নেওয়া প্রয়োজন যে মীরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ শেষ পর্যন্ত পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন এবং নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের হাতে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই দরবারের চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের দিন পর্যন্ত তারা স্থানীয় ষড়যন্ত্রীদের নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যাতে দরবারের ওইসব অভিজাতবর্গ শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমরা সেটা পরে দেখাব— তা থেকে স্পষ্ট হবে কী ভাবে ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে সমস্ত ব্যাপারটা সংগঠিত করেছিল।
পলাশির ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মীরজাফর ও জগৎশেঠ, যদিও উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখও এতে জড়িত ছিলেন। তাই মীরজাফরই একমাত্র ‘বিশ্বাসঘাতক’, এটা সত্য নয়। জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা প্রথমে সিরাজদ্দৌল্লার জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law), যিনি দরবারের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতেন, পরিষ্কার লিখেছেন যে ‘ইংরেজরা যা করেছে [পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব] তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া তারা করতে কখনও ভরসা পেত না’।৫৫ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকার দায় শুধু মীরজাফরের নয়— জগৎশেঠদের দায় মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয়।
আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পেছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদেরই হাতে। জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘অনেকদিন ধরে বাংলায় যেসব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিলেন তাঁরাই [জগৎশেঠরা]।’৫৬ ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র পড়েও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে পলাশি চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদত পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।৫৭ তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ‘মোহনলাল যদি সুস্থ থাকতেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা-রহিত না হতেন, তা হলে জগৎশেঠদের চক্রান্ত অত সহজে সফল হত না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, মোহনলাল কিছুদিন ধরে এবং বিশেষ করে চরম বিপদের এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন’। ল’ মনে করতেন যে মোহনলাল জগৎশেঠদের পরম শত্রু এবং তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারার মতো একমাত্র ব্যক্তি।৫৮ মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির সন্দেহ, মোহনলালকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।৫৯
.
কেন এই চক্রান্ত?
যদিও ইংরেজরা পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, যে প্রশ্ন আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং যা এখনও পর্যন্ত কেউ করেননি৬০ তা হল এ চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে এত জরুরি হয়ে পড়েছিল কেন? তার প্রধান কারণ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা। সমসাময়িক নথিপত্র ও দলিলদস্তাবেজ পরীক্ষা করে দেখলে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাবে। এসব কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে— ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি প্রচুর ধনোপার্জন করে দেশে ফিরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। বাংলায় কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০-র দশক ও ’৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপরে ৪০-র দশকের শেষদিক থেকে ৫০-র দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর কারণ একদিকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে এসময় অভাবনীয় উন্নতি এবং অন্যদিকে হুগলির আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার। ফরাসিদের সঙ্গে আবার ওয়াজিদের বোঝাপড়া থাকার ফলে ইংরেজরা খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে যায় এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই বাংলা বিজয় করতে চেয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
১৭৫০-র দশকের প্রথমদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা যে নিদারুণ সংকটে পড়ে তা কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম৬০, কলকাতার এক ইংরেজ বাসিন্দা ক্যাপ্টেন ফেনউকের৬১ লেখা ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আলাপ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা ছাড়াও ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় আসা-যাওয়া করা জাহাজের যে তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে আমাদের বক্তব্যের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে। ১৭৫৪ সালে যেসব ইংরেজ জাহাজ বাংলার বন্দরে এসেছিল তাঁর মোট সংখ্যা ২০। এর মধ্যে ১২টি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র ৮টি যারা ব্যক্তিগত ব্যবসা করত তাদের। অন্যদিকে ওই বছরই বাংলায় ফরাসি জাহাজ এসেছিল ২৭টি— তাঁর মধ্যে ২২টিই ব্যক্তিগত ব্যবসাতে লিপ্ত, আর মাত্র ৫টি ফরাসি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন, এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।৬২ এই পরিসংখ্যান থেকেও এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পরে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা আরও বেশি সংকটের মুখে পড়ে কারণ এই প্রথম তরুণ নবাব ইংরেজদের দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি এই বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কর্মচারীরা তাদের এই লাভজনক ব্যবসা ছাড়তে একেবারেই নারাজ ছিল। তাই তারা তাদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও অন্যদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা করে। এজন্য রাজ্য জয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। তাতে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট দূর করা সম্ভব হবে তা শুধু নয়— উৎপাদনক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, ব্যবসায়ী-সওদাগর, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। একথা শুধু যে পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hindsight) ধরা পড়েছে তা নয়। কোম্পানির লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের (Colonel Scott) বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা (১৭৫২), ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের (Frankland and Manningham) ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির পণ্য সরবরাহে দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন (১৭৫৩), নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখো মনোভাব—এসবই ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তার নির্দেশক। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা কলকাতার সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার (Richard Becher) জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলিতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যাপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল’।৬৩ এসব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না।
.
পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা
পলাশি-প্রাক্কালের ঘটনাবলি এবং আমাদের কাছে এখন যেসব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে দেখানো যাবে যে ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা দখল করে (জুন ১৭৫৬) ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠায়। কাউন্সিল তাঁদের যে নির্দেশ দেয় (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। এ নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং নবাবের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়ই’ শুধু অভিযাত্রী দলের উদ্দিষ্ট হবে না। তাদের চেষ্টা করতে হবে ‘to effect a junction with any powers in the province of Bengal that might be dissatisfied with the violence of the nawab’s gov-ernment or that might have pretensions to the nawabship’.৬৪ শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর দরবারের মধ্যে যে অসন্তোষ ছিল তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ’ করেছিল৬৫ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।
নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে ঠিকই কিন্তু ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সেজন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। অংশত তার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি (৩১ জানুয়ারি) থেকে তা সুস্পষ্ট।৬৬ ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।৬৭ ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে (John Walsh) লেখা স্ক্র্যাফ্টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। তিনি লিখছেন:৬৮
ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে…· মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন…·. এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি [my old favourite scheme] সফল হতে পারে।
স্ক্র্যাফ্টন আবার ১৮ এপ্রিল ওয়ালসকে লিখছেন, ইয়ার লতিফ খানকে নতুন নবাব হিসেবে বসাবার প্রস্তাব দিয়ে, যেটা ওয়াটস ও উমিচাঁদ মিলে চেষ্টা করছিলেন।৬৯ ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখা ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে এ পরিকল্পনা সমর্থন করলেন। এদিকে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হল। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ জানালেন, স্ক্র্যাফ্টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারেন তাঁর অনুমতি দেবার জন্য কারণ ওখানে স্ক্র্যাফ্টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে হবে।৭০ এ কাজটা ‘যে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ তা অনুমান করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নিল, ক্লাইভ যেন ‘দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নবাবের প্রতি মনোভাব এবং এ নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোককে নিয়োগ করেন’।৭১ সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্রাফ্টন ‘ইংরেজদের পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যবর্গের সমর্থন লাভের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন।
ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম লিখেছেন যে নবাবের দরবারে অভিজাতবর্গের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের পরিমাপ করতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর পরই উমিচাঁদ নবাবের উচ্চপদস্থ অমাত্যদের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে দেন।৭২ ফলে ২৩ এপ্রিল ইয়ার লতিফ খান ওয়াটসের সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওয়াটস তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে উমিচাঁদকে নবাবের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে পাঠান। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে তাঁর নবাব হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন এবং জানান যে রায়দুর্লভ ও জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেন এবং ক্লাইভকে জানিয়ে দেন। ক্লাইভও তাঁর সম্মতি জানিয়ে দিলেন। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে লতিফ সম্বন্ধে ক্লাইভের কোনও ধারণাই ছিল না। তাঁর সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না, ইয়ার লতিফ হিন্দু না মুসলমান তা পর্যন্ত নয়। তাই এর ঠিক দু’দিন পরে (২৮ এপ্রিল) তিনি ওয়াটসকে লিখলেন: ‘লতিফ কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’৭৩ এ থেকে স্পষ্ট যে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য এতই ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল যে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই সিরাজের জায়গায় নবাব করতে চেয়েছিল। তিনি কেমন ব্যক্তি, ভাল কি মন্দ, তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি।
এমনি সময় মসনদের জন্য আরেকজন প্রার্থী, মীরজাফর, রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হন। যদিও রবার্ট ওর ম বলছেন যে মীরজাফর কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেক্রসের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাব ইংরেজদের কাছে পাঠান, ওয়াটস নিজে তাঁর পিতাকে পরে লিখেছিলেন যে তিনি ‘নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ’ করেন। তিনি এটাও জানান যে মীরজাফর ‘খুব আগ্রহভরে আমার প্রস্তাবে সায় দেন এবং আমাদের সহায়তায় নবাব হওয়ার বিনিময়ে যে কোনও যুক্তিসঙ্গত শর্তাবলিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হন’।৭৪ খুব সম্ভবত ইংরেজরা হয়তো বুঝতে পেরেছিল, শুধু ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের ‘কঠিন কার্যোদ্ধার’ করতে পারবে না। তাই তারা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ মীরজাফর শুধু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সৈন্যাধ্যক্ষই নন, তাঁর পেছনে রয়েছে জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন।৭৫ কলকাতায় সিলেক্ট কমিটিও মীরজাফরকে নতুন নবাব করার সিদ্ধান্ত নিল এবং ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দিল।
কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্গুরাবস্থা এবং ইংরেজরা মীরজাফরের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিল না। মীরজাফরও তখন পর্যন্ত যড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’৭৬ এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে:
আমাদের পরিকল্পনাকে কী ভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাকে ভাল করে বোঝাতে… এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাকে নিশ্চিন্ত করতে।৭৭
এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করছিল। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই তিনি ২২ মে ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’৭৮ পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।৭৯ অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।
এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়াতে ওয়াটস প্রায় ক্ষেপে যান। মীরজাফর পলাশি থেকে ফিরে ৩০ মে থেকে মুর্শিদাবাদে ছিলেন। তা সত্ত্বেও ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি সম্পাদন করতে পারেননি। অনুমান, তার জন্য মীরজাফরের কিছুটা অনীহা। তাই অত্যন্ত বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ওয়াটস ৩ জুন লিখছেন: ‘এসব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদলোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’৮০ ব্যাপারটা নিয়ে লোকে বলাবলি করছে দেখে ক্লাইভও চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে ওয়াটস ৫ জুন মীরজাফকে দিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তি সই করাতে সক্ষম হলেন। লাল কাগজের চুক্তিটি, যাতে নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য বলে বলা হল সেটি নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। এতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সই ক্লাইভের জ্ঞাতসারেই জাল করা হয়েছিল বলে যে সন্দেহ করা হয়, তা খুব অমূলক নয়।৮১ নবাব পদে উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী ইয়ার লতিফকে বাদ দেওয়ার ফলে উমিচাঁদ নবাবের সম্পত্তির যে ভাগ চেয়েছিলেন, তা ফাঁকি দেওয়ার জন্যই ক্লাইভের এই চাতুরি। এদিকে রায়দুর্লভ সাদা কাগজের চুক্তি সম্বন্ধেও আপত্তি জানালেন এই বলে যে চুক্তির চাহিদা মেটাবার মতো অর্থ নবাবের কোষাগারে নেই। নবাবের সম্পদের পাঁচ শতাংশ তাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করা হল।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেও কিন্তু সিলেক্ট কমিটি তাদের বিপ্লবের পরিকল্পনা তাড়াতাড়ি রূপায়ণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তাই কমিটি ১১ জুন বিস্তারিত আলোচনা করল, ‘তখনই সোজা মুর্শিদাবাদ অভিযান করা সমচিত হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত খবর এবং কার্যোদ্ধারে কী ভাবে অগ্রসর হবে তার একটা খসড়া পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে’। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নিল যে ‘মীরজাফরকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা সেটা সম্পন্ন করার জন্য এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না’। কারণ আর দেরি করলেই সিরাজদ্দৌল্লা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি জেনে ফেলতে পারেন। তখন মীরজাফরকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং ফলে ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে’। ইংরেজদের তখন ‘দেশের সংঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে’ আর তা হলে ইংরেজদের পরাজয় অনিবার্য।৮২ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্লাইভ ১৩ জুন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন।
ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করেন তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ১৮ জুন তিনি কাটোয়া দখল করলেন। সেখানে ‘দারুণ অস্বস্তির মধ্যে’ দু’দিন কাটান। তিনি সিলেক্ট কমিটিকে জানালেন যে মীরজাফরের কাছ থেকে স্পষ্ট সংকেত না পেয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন’। তিনি আরও লিখলেন যে, মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও যেভাবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চাইছেন তাতে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যাবার আশঙ্কা। এটাও তিনি জানালেন যে, মীরজাফর তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি নদী পেরোবেন না। বর্ষা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে প্রয়োজন হলে মারাঠারা বা বীরভূমের রাজা বা এমন কী দিল্লির উজির গাজিউদ্দিন খান, কারও না কারও সঙ্গে সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার করা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে লিখছেন যে, তাঁর ইচ্ছা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোনো যাতে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর কোনও বড় রকমের ক্ষতি না হয়। কারণ এ ফৌজ অক্ষত থাকলে আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা সফল না হলেও ভবিষ্যতে যে কোনও সময় বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি আমাদের বজায় থাকবে।’৮৩
এ থেকে পরিষ্কার, মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠাতে ইংরেজদের শেষ পর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও, ইংরেজরা অন্য কারও সহায়তায় এ কাজ সম্পন্ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হত না এবং সেই অন্য কেউ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যরাই যে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংরেজদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কেউ হলেই চলত। আসলে তখনও পর্যন্ত ক্লাইভ মীরজাফর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন, যদি মীরজাফর সাহায্য করতে এগিয়ে না আসেন তা হলে কী করা যাবে? তবে বিপ্লব ঘটাতে তিনি এতই উদ্গ্রীব ছিলেন যে মীরজাফরের ওপর আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি এবং তাকে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যোগ দিতে বারবার প্ররোচিত করতে লাগলেন। কাটোয়া থেকে ১৯ জুনও তিনি মীরজাফরকে লিখলেন:৮৪
আপনার পক্ষে বিশেষ করে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আপনি খুব একটা গা করছেন না দেখে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এ ক’দিনের মধ্যে আমি যখন ফৌজ নিয়ে অভিযান করছি তখন আমি ঠিক কী করব বা কী ব্যবস্থা নেব সে সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত বা নির্দেশ পাইনি। আপনার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব, আর এগুবো না। আমার মনে হয় অতি সত্বর আমার ফৌজের সঙ্গে আপনার যোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ক্লাইভ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও অস্থির হয়ে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সভা ডাকলেন ২১ জুন— উদ্দেশ্য, নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না ইংরেজরা যেখানে আছে সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর নবাবের বিরুদ্ধে মারাঠাদের ‘আমাদের সঙ্গে’ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।৮৫ এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশি যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার, সিরাজকে হঠাবার যে চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (project)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত— মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না। এদিকে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তখনই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইল, যদিও ক্লাইভ ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করলেন এবং পরের দিনই পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে স্থির করলেন। তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে কোনও ইতিবাচক নির্দেশ বা সংকেত এসে পৌঁছয়নি।৮৬ এতেই স্পষ্ট যে বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই, সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে, ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:৮৭
যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারি…· আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এটার ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই [বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার [নবাব] হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হোন। আমাদের কিন্তু [পরে] বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।
মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন এবং অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তাঁর উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌছল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।
এদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অবস্থা বেশ কাহিল। অস্থিরচিত্ত ও বিপদের সময় বিহ্বল হয়ে পড়াটা তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত, তাঁর অন্যতম দুর্বলতা। অবশ্য এটা মনে না রাখলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে যে তখন কতগুলি ঘটনা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল। এসময় তাঁর দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের কতগুলি কারণও ছিল। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই আহমদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে বাংলায় আফগান আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক করে হোক বা ভুল করে হোক, তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজদের চাইতে আফগানরাই তখন বড় বিপদ। তাই তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ অংশকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে বিহার সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে তাঁর দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ও ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই সম্ভবত তিনি যারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বলে সন্দেহ করছিলেন তাদের সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তখনও তাঁর আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লা মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্যান্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে বিরাট ভুল করেছিলেন। এটা লিউক স্ক্র্যাফ্টন৮৮ এবং জাঁ ল’ও৮৯ স্পষ্ট ভাষাতে জানিয়েছেন। অথচ সিরাজের অনুগত সেনাপতিরা, বিশেষ করে মীরমর্দান, আব্দুল হাদি খান প্রমুখ তাঁকে বারংবার অনুরোধ ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা নিলে ইংরেজরা আক্রমণ করতে কোনওমতেই সাহস করবে না।৯০ কিন্তু নবাব তাতে কর্ণপাতও করলেন না, তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশিতে ইংরেজদের মুখোমুখি হলেন ২৩ জুন।
পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায়দুর্লভ রাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিতান্ত দর্শক হয়ে, যেন মজা দেখতেই যুদ্ধে আসা।৯১ আর রিয়াজের লেখক বলছেন, মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাকে বারবার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তিনি একবিন্দু নড়লেন না।৯২ তা সত্ত্বেও কিন্তু পলাশির তথাকথিত যুদ্ধের হারজিত আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি। ২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন হতবাক—’they made a most pompous and favourable appearance…. their disposition, as well as their regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them’.৯৩
পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন। সকাল ৮টা নাগাদ (ক্লাইভের ভাষ্য অনুযায়ী ৬টায়) যুদ্ধ শুরু হল। ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত ও দক্ষ সেনাপতি মোহনলাল, মীরমর্দান, খাজা আবদুল হাদি খান, নবসিং হাজারি প্রমুখের নেতৃত্বে ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর সাঁ ফ্রে’র অধীনে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা ক্লাইভের কাছে খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে, তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের সৈন্যরা এবং সেনাপতিরা তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ, তাই তারা ইংরেজদের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তো তিনি দেখছেন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।৯৪ পলাশির যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জন উড (John Wood) নামে এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়।৯৫ ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’৯৬
যুদ্ধ চলতে লাগল। নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত সেনাপতিদের নেতৃত্বে অসম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজ ফৌজের দিকে এগুতে লাগল। বেলা তখন প্রায় তিনটে। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছিল।৯৭ ঠিক এসময় দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমর্দান গুরুতর আহত হয়ে পড়েন, তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীরমর্দান নিহত হন’।৯৮ মীরমর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদ্দৌল্লা দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীরমর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেনাপতিদের সকলেই প্রথমে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন— এই যুক্তিতে যে ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। কিন্তু সিরাজের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।৯৯ ইউসুফ আলি লিখেছেন, ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।১০০
সিরাজদ্দৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল ৫টার মধ্যেই পলাশির তথাকথিত যুদ্ধ শেষ। পলাশি যুদ্ধের সাক্ষী ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে কোনওরকমের মুখোমুখি যুদ্ধ বা আক্রমণ ছাড়াই এমন একটি ‘great and decisive’ যুদ্ধের নিষ্পত্তি এবং তাঁর সঙ্গে একটি রাজ্যজয়ও হয়ে গেল।১০১ সন্ধ্যা ৬টায় ক্লাইভ মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন— ‘আপনার পরিকল্পনা সফল হওয়ায় অভিনন্দন গ্রহণ করুন’।১০২ এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত দাউদপুর থেকে মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘এ জয় আপনার। আমার নয়। অতি সত্বর আমার সঙ্গে মিলিত হলে খুশি হব। আপনাকে নিয়ে কালই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব বলে ঘোষণা করার সম্মান আমি পাব।’১০৩ ক্লাইভই মুর্শিদাবাদে মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় নবাবের মুকুট পরিয়ে দেন।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. S. C. Hill, Bengal in 1756-57, 3 vols; P. J. Marshall, Bengal — the British Bridgehead; C. A. Bayly, Indian Society and the Making of the British Empire; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, IHR: পলাশীর ষড়যন্ত্র।
২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 162.
৩. Hill, Vol. I, Introduction, p. liii.
৪. P.J. Marshall, Bengal, p. 91; C. A. Bayly, Indian Society, p. 50: Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 11, 12; পলাশী, পৃ. ১২, ১৬।
৫. আমার প্রবন্ধ, ‘Was there a crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’, presented in the “Workshop on the Eighteenth Century”. University of Virginia, Charlottesville. Now published in Richard B. Barnett, ed., Rethinking Early Modern India, pp. 129-52.
৬. Hill, Vol. 1, p. XXIII.
৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32.
৮. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50
৯. ঐ, pp. 49-50.
১০. S. C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 120; Bengal in 1756-57, vol. I, Introduction, pp. xxiii, lii; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p.41.
১১. রজতকান্ত রায়, পলাশী।
১২. P.J. Marshall, Bengal.
১৩. Luke Scrafton, Reflections, p. 55.
১৪. নওয়াজিস মহম্মদ খান ছিলেন নবাব আলিবর্দির ভাই সৈয়দ আহমেদের পুত্র, আলিবর্দির কন্যা ঘসেটি বেগমের স্বামী ও ঢাকার শাসনকর্তা বা ছোট নবাব।
১৫. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.
১৬. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮.
১৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 57.
১৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 41.
১৯. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৩৮-৪১।
২০. ডুপ্লেকে লেখা রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 204.
২১. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.
২২. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৪১।
২৩. ড্রেককে লেখা বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd, vol. 23,f. 460.
২৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 47-48.
২৫. ওয়াজিদকে সিরাজদ্দৌল্লা, ১ জুন ১৭৫৬, Hill, III, p. 152.
২৬. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের (লন্ডন) চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.
২৭. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. I, p. 68.
২৮. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.
২৯. C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31; Watts to Drake and Fort William Council, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.
৩০. Mss. Eur, D. 283, f. 26; প্রায় একই রকমের বক্তব্য হলওয়েলের, Holwell to Court of Directiors, 30 Nov, 1756, Hill, II, p. 18; জোরটা আমার দেওয়া।
৩১. Law’s Mentoir, Hill, III, pp. 164-65.
৩২. Hill, I, pp. liv-lv.
৩৩. Mss. Eur. D. 283, ff, 15, 25.
৩৪. ঐ, পৃ. ২৫।
৩৫. Hill, I, p. lv.
৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.
৩৭. কোর্টকে ওয়াটস, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd. vol. 23, f. 378.
৩৮. S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 43 and fn. 30.
৩৯. Hill, III, pp. 332-33; II, pp. 4-5.
৪০. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৫২-৫৪; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 43-46, 58-61.
৪১. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f, 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে বেচার, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.
৪২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 13-16; Prelude to Empire, pp 73-76.
৪৩. ঐ, পৃ. ২০২-১১, ২৪৯-৫৯।
৪৪. ঐ, পৃ. ১০৯-৩১ এ বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
৪৫. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, ‘Was there a Crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’ in Richard B. Barnett, ed., Rethinking Early Modern India, pp. 129-52.
৪৬. S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 70-73.
৪৭. Luke Scrafton to Robert Clive, 17 Dec. 1757, Orme Mss., India, XVIII, f. 5043.
৪৮. বিস্তারিত তথ্যের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36; Orme to Clive, 25 Aug. 1752, Orme Mss., O.V. 19, ff. 1-2.
৪৯. ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা; D. C. Sen, History of Bengali Language and Literature, PP. 288, 793.
৫০. Edward C. Dimmock, Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, p. 2.
৫১. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।
৫২. Orme Mss., India VI, ff. 1500-1502.
৫৩. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb. 1755, VOC 2849, ff. 125-26.
৫৪. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 52-53.
৫৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.
৫৬. ঐ।
৫৭. ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368: ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.
৫৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.
৫৯. করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯.
৬০. মি. রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, Orme Mss., O.V. 12,f. 83.
৬১. BPC, Range l, vol. 15, f. 327,7 Oct. 1752; Orme Mss., O. V., 12, f. 83; Eur. G 37, Box 21, 1 Sept. 1753; Orime Mss., India, VI, f. 111vo.
৬২. পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে উদ্ধার করে টানেজের হিসেব করা হয়েছে, Relevant volumes in VOC.
৬৩. Beng. Letters Recd., vol. 24, f. 236, 20 May 1757.
৬৪. Orme Mss., vol. 170, f. 99; Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.
৬৫. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 442.
৬৬. সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 205.
৬৭. ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Orme Mss., India, V, f. 1275; Orme Mss.. O.V. 170, f. 397,
৬৮. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.
৬৯. স্ক্র্যাফ্টনের চিঠি, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.
৭০. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, f. 1212; O.V. 170, f.222.
৭১. ক্লাইভকে সিলেক্ট কমিটি, ২৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, 368; Select Committee Consults., 28 April 1757, Orme Mss., India, f. 1214.
৭২. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec I. p. 148.
৭৩. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.
৭৪. তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.
৭৫. Watts’ Memoirs, p. 82.
৭৬. ক্লাইভ ওয়াটসকে, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 373.
৭৭. Orme Mss., India V,f. 1228; O. V. 170, f. 265.
৭৮. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.
৭৯. ঐ, ১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.
৮০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
৮১. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ১৮ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 387; পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ওয়ালসের সাক্ষ্য, Hill, III, p. 318; জন কুকের [John Cooke] সাক্ষ্য, Hill, III, p. 120.
৮২. Select Committee Proceedings, 11 June 1757, Orme Mss., India V, ff. 1232-33; O. V. 170, ff. 256-57; জোরটা আমি দিয়েছি।
৮৩. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 417-18.
৮৪. মীরজাফরকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419. জোরটা আমি দিয়েছি।
৮৫. Journal of Eyre Coote, Orme Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p. 54.
৮৬. S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 145.
৮৭. Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.1), Hill, II, pp. 420-21, Recd., 22 June at 3 p.m., Hill, II, p. 420; Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.2), despatched at 6 p.m., Hill, II, p. 421; জোরটা আমার দেওয়া।
৮৮. Scrafton, Reflections, pp. 91-92.
৮৯. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.
৯০. করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫।
৯১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
৯২. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
৯৩. Scrafton, Reflections, pp. 93-94.
৯৪. ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts, Memoirs, p. 110.
৯৫. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 178.
৯৬. Watts’ Memoirs, p. 110.
৯৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
৯৮. Scrafton, Reflections, p. 110.
৯৯. তারিখ-ই-বংগলা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।
১০০. তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবংজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।
১০১. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.
১০২. ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭। (ক্লাইভ পেলেন সন্ধ্যা ৬টায়), Orme Mss., India, XI, f.2814,
১০৩. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, VI, p. 2815.
০৬. বেগম বৃত্তান্ত
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে নবাব-বেগমদের কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিত্বসম্পন্না, বুদ্ধিমতী, বিজ্ঞ মহিলা—তাঁদের স্বামীদের প্রয়োজনমতো রাজকার্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংকটের সময় যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন কুটিল, কুচক্রী ও স্বার্থান্বেষী। শুধু তাই নয়, কারও কারও ব্যক্তিগত চরিত্রও খুব একটা নিষ্কলঙ্ক ছিল না। নিজেদের অভীষ্ট সিদ্ধ করার জন্য এঁরা অনেকটা নীচে নামতেও দ্বিধা করতেন না। তাই বলা যায় যে মুর্শিদাবাদ বেগমদের মধ্যে একদিকে খুব উঁচু আদর্শের মহিলাকে যেমন দেখা যায়, তেমনি সাক্ষাৎ মেলে একেবারে বিপরীত চরিত্রের নারীর। এখানে আমরা এই দুই বিপরীত মেরুর কয়েকজন বেগমদের বৃত্তান্ত আলোচনা করব।
জিন্নতউন্নেসা
জিন্নতউন্নেসা ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর একমাত্র কন্যা এবং পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিনের পত্নী। সিয়রের লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর আরেকটি নাম ছিল, নাফিসা। কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতিনে নাফিসাকে সরফরাজের ভগিনী বলেই বলা হয়েছে।১ সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাস থেকেই জানা যায় যে মুর্শিদকুলির অন্য কোনও স্ত্রী বা রক্ষিতা ছিল না। বাংলার পরবর্তী কিছু নবাবের মতো তাঁর কোনও হারেমও ছিল না। মুর্শিদকুলি তাঁর একমাত্র পত্নীর প্রতিই বিশ্বস্ত ছিলেন। সে যাই হোক, তিনি যখন দাক্ষিণাত্যে ছোট রাজকর্মচারী ছিলেন, তখনই তিনি তাঁর কন্যার সঙ্গে সুজাউদ্দিনের বিবাহ দেন। সুজা তাঁর শ্বশুরবাড়িতে পরিবারের সদস্য হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করেন। এর কিছুদিন পরে মুর্শিদকুলি বাংলার দেওয়ান ও পরে বাংলার সুবাদার পদেও অধিষ্ঠিত হলেন। তখন তিনি জামাতা সুজাউদ্দিনকে উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর বা ছোট নবাব হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই শ্বশুর-জামাতার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল। দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে সুজাউদ্দিন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে উড়িষ্যা চলে গেলেন।
শাসক হিসেবে সুজাউদ্দিন জনপ্রিয় ছিলেন, বেশ দয়ালু এবং উদার স্বভাবেরও। কিন্তু নারীর প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব দুর্বলতা, নারী সম্ভোগে তাঁর আসক্তি ছিল প্রবল। জিন্নতউন্নেসা ধর্মভীরু ও উদারচেতা ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তেজস্বীও। তাই স্বামীর এমন চরিত্রস্খলন তিনি মেনে নিতে পারেননি। তা ছাড়া তাঁর পিতার প্রতি স্বামীর বিরূপ মনোভাবও তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাই স্বামী সুজাউদ্দিনকে ছেড়ে তিনি পুত্র সরফরাজকে নিয়ে পিতার কাছে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। সেখানে তিনি ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে জীবন কাটাতে থাকেন।
মুর্শিদকুলির কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। জামাতা সুজাউদ্দিনের ওপর তিনি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে তিনি তাঁর দৌহিত্র, কন্যা জিন্নতউন্নেসার পুত্র, সরফরাজকে মসনদে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করবেন স্থির করে দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে অনুমোদন আনার চেষ্টা করলেন। এদিকে সুজাউদ্দিন এখবর পেয়ে তাঁর পরামর্শদাতা দুই ভ্রাতা হাজি আহমেদ ও আলিবর্দি খানের সঙ্গে আলোচনা করে দিল্লিতে বাদশাহের কাছে দূত পাঠালেন বাংলার দেওয়ানি ও নিজামতে তাকে অধিষ্ঠিত হওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তারপর যেই তিনি খবর পেলেন যে মুর্শিদকুলি মৃত্যুশয্যায়, তখনই তিনি আলিবর্দি খান ও সৈন্যসামন্তদের নিয়ে কটক থেকে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যেই তিনি মুর্শিদকুলির মৃত্যু সংবাদ২ পান এবং মুর্শিদাবাদ পৌঁছবার আগেই বাদশাহের অনুমতিও এসে যায়। মুর্শিদাবাদ এসে তিনি সোজা মুর্শিদকুলির প্রাসাদ চেহেল সুতুনে ওঠেন এবং নিজেকে বাংলার নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন।৩
এ খবর পেয়ে সরফরাজ তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু তাঁর মা জিন্নতউন্নেসা ও দিদিমা, মুর্শিদকুলির বেগম নাসিরা, দু’জনেই সরফরাজকে তা থেকে বিরত করার চেষ্টা করলেন। সরফরাজ এ দু’জনেরই নয়নের মণি ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন:৪
Your father is old; after him, the subadari as well as the country with its treasure would devolve on you. To fight against one’s own father is cause of loss in this world and in the next as well as ignominy. It is meet that till the lifetime of your father, you should remain con-tented with the Diwani of Bengal.
সরফরাজ যেহেতু কোনওদিনই এঁদের মতামত অগ্রাহ্য করেননি এবং সবসময় এঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছেন, তাই তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে এঁদের কথা মেনে নিলেন এবং সুজাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেন। তিনি তাঁর পিতাকে বাংলার নবাব হিসেবে মেনে নিলেন। এ ঘটনা থেকে মুর্শিদ-বেগম নাসিরা বানু ও সরফরাজের মা, সুজাউদ্দিনের বেগম, জিন্নতউন্নেসার বিচক্ষণতা ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়।
এরপর সুজাউদ্দিন জিন্নতউন্নেসার কাছে গিয়ে তাঁর পূর্বকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন এবং বেগমের ক্ষমা ভিক্ষা করেন। বেগম জিন্নতউন্নেসা তাঁকে ক্ষমা করে দেন। নবাব হয়ে সুজাউদ্দিন সরফরাজ বা তাঁর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র টাকি খানকে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু জিন্নতউন্নেসা তাঁর একমাত্র পুত্রকে কাছ ছাড়া করতে রাজি হলেন না। আবার টাকি খানকেও ওই পদে নিযুক্ত করতে তিনি আপত্তি জানালেন। বাধ্য হয়ে সুজাউদ্দিন বেগমের ইচ্ছা মেনে নিলেন। এ থেকে বোঝা যায় সুজাউদ্দিনের ওপর জিন্নতউন্নেসার কতটা প্রভাব ছিল।
যা হোক শেষ পর্যন্ত, মনে হয় অনেকটা জিন্নতউন্নেসার ইচ্ছেতেই, আলিবর্দি খানকে বিহারের ডেপুটি গভর্নর করে পাঠানো হবে স্থির হল। বেগম মনে করতেন তিনিই মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত নিজামতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং সুজাউদ্দিন তাঁর অধীনেই রাজ্যশাসন করার অধিকার পেয়েছেন। তাই তিনিই প্রথমে আলিবর্দিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে খেলাত দিয়ে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করলেন। তাঁর পর সুজাউদ্দিন আলিবর্দিকে খেলাত প্রদান করে বিহারের ছোট নবাব বলে ঘোষণা করলেন।৫ এ ঘটনা থেকেও স্পষ্ট, জিন্নতউন্নেসা কতটা বিজ্ঞা, বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না ছিলেন, এবং তিনি রাজ্যশাসনেও কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
এর পরের ঘটনাবলী জিন্নতউন্নেসার পক্ষে খুবই নিদারুণ হয়েছিল। আলিবর্দি সুজাউদ্দিনের সময়কার শক্তিশালী ত্রয়ীর (triumverate)—হাজি আহমেদ, আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ, যাঁরা সুজাউদ্দিনের বকলমে বাংলা শাসন করতেন—সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর বেগম জিন্নতউন্নেসার পুত্র নবাব সরফরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০) সরফরাজ আলিবর্দির বাহিনীর মুখোমুখি হন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতেই তিনি প্রাণ বিসর্জন দেন।৬ এভাবে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু জিন্নতউন্নেসার কাছে কতটা মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক হয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
যুদ্ধ জেতার দু’দিন পরে আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ শহরে পদার্পণ করলেন এবং মসনদে বসার আগেই জিন্নতউন্নেসার কাছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বেগমকে তিনি জানালেন যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেবেন এবং যথাসাধ্য তাঁর আজ্ঞা বহন করে চলবেন। জিন্নতউন্নেসা পুত্রশোকে এতই কাতর ছিলেন যে তিনি উত্তরে আলিবর্দিকে কোনও কথাই বললেন না।৭ নবাব হয়ে আলিবর্দি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার স্বামী নওয়াজিস মহম্মদকে ঢাকার ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করেন। নওয়াজিস জিন্নতউন্নেসাকে তাঁর প্রাসাদ ছেড়ে ঢাকায় তাঁর কাছে তাঁর পালিতা মা হিসেবে এসে থাকতে রাজি করালেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর ঘরসংসারের সব দায়িত্বও জিন্নতউন্নেসার হাতে দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। বেগম নওয়াজিসকে জিজ্ঞেস না করে বা তাঁর অনুমতি না নিয়েও নিজের পছন্দমতো সব কাজ করার অধিকারও পেলেন। তবে নিজের সম্মান ও আভিজাত্য বজায় রেখে তিনি সবসময় পর্দার অন্তরাল থেকেই নওয়াজিসের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন।৮
বেগম জিন্নতউন্নেসার উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায় আরও একটি ঘটনা থেকে। তিনি সরফরাজের এক রক্ষিতার গর্ভজাত পুত্র আগা বা আকা বাবাকে দত্তক নেন। সরফরাজ যেদিন গিরিয়ার যুদ্ধে নিহত হন, সেদিনই আগা বাবার জন্ম হয়। হয়তো এজন্যই শোকাতুরা বেগমের আগার প্রতি করুণার উদ্রেক হয় এবং তিনি তাঁকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। আগা বেগমের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন, বেগমের বার্ধক্যে একমাত্র সান্ত্বনা। আগার সঙ্গে তিনি নওয়াজিস মহম্মদের ভাই সৈয়দ আহমেদের এক কন্যার বিবাহ দিতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। সৈয়দ আহমেদ প্রথমে এ প্রস্তাবে রাজি হননি কিন্তু শেষ পর্যন্ত নওয়াজিস মহম্মদ ও তাঁর স্ত্রী ঘসেটি বেগমের পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন, কিন্তু নবাব পরিবারের নানা দুর্ঘটনার জন্য এই বিবাহ সম্পন্ন হয়নি বলেই মনে হয়।৯
ঘসেটি ও নওয়াজিস দু’জনেই জিন্নতউন্নেসাকে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। মুর্শিদকুলির খাসতালুক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি তিনি একাই ভোগ করেছেন। নওয়াজিস মহম্মদ বা আলিবর্দি কখনও তাতে হাত দেননি। শুধু তাই নয়, আলিবর্দি এবং নওয়াজিস তাকে এতই সমীহ এবং সম্মান করতেন যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁর সামনে তারা নতজানু হয়ে অভিবাদন জানাতেন এবং তিনি বলার পরই শুধু তারা তাঁর সামনে আসন গ্রহণ করতেন।১০
জিন্নতউন্নেসা কতদিন জীবিত ছিলেন, কবে তাঁর মৃত্যু হয়, সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের আধ মাইলের মতো উত্তরে আজিমনগরে তিনি যে মসজিদ নির্মাণ করেন, তাঁর ধ্বংসাবশেষ অনেক দিন দেখা গেছে। কথিত আছে, এ ধ্বংসাবশেষের পাশেই তাঁর মৃত্যুর পর তাকে সমাধিস্থ করা হয়।১১
দুরদানা বেগম
মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যে ব্যক্তিত্বসম্পন্না, সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ দুরদানা বেগম। তিনি ছিলেন নবাব সরফরাজ খানের সহোদরা এবং উড়িষ্যার ছোট নবাব (ডেপুটি গভর্নর) দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের পত্নী। কথিত আছে যে উড়িষ্যাতে তাঁর স্বামীর চাইতেও তাঁর সম্মান ও মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। আলিবর্দি খান সরফরাজ খানকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদে বসার পর সরফরাজের ভগ্নীপতি উড়িষ্যার ছোট নবাব দ্বিতীয় মুর্শিদকুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। আলিবর্দির বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো কোনওরকমের সহায়সম্বল তাঁর ছিল না। সে রকম মনোবলও নয়। তাই তিনি আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে একেবারে ভরসা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁর পত্নী দুরদানা বেগম তাকে আলিবর্দির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন কারণ তিনি এভাবে তাঁর সহোদর সরফরাজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তাতে বিশেষ কোনও ফল না হওয়ায় এবং যুদ্ধ করতে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলির প্রচণ্ড অনীহা দেখে দুরদানা বেগম শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামীকে এই বলে ভয় দেখালেন যে আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না গেলে তিনি তাকে পরিত্যাগ করবেন। তাঁর সব বিষয়সম্পত্তি ও উড়িষ্যার ছোট নবাবের পদ সব কিছু তাঁর জামাই মীরজা বকীর খানকে দিয়ে দেবেন। এতেই কাজ হল এবং মুর্শিদকুলি আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বালেশ্বরের এই যুদ্ধে তিনি আলিবর্দির কাছে পরাজিত হন। এরপর মুর্শিদকুলি ও দুরদানা বেগম দাক্ষিণাত্যে নিজাম-উল-মুলক আসফ ঝা’র দরবারে আশ্রয় নেন।১২
শরফুন্নেসা
মুর্শিদাবাদের রাজনীতি ও শাসন প্রক্রিয়ায় বেগমদের কারও কারও প্রভাব যে বেশ মঙ্গলদায়ক ও ইতিবাচক হয়েছিল তা আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে শুধু অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁর স্বামীর পাশে থেকেছেন তা নয়, আলিবর্দি যখন মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতেন, রাজধানী থেকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনি তখন রাজকার্য পরিচালনা করতেন। আলিবর্দি যখন বালেশ্বরে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, তখন শরফুন্নেসাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আবার তিনি যখন ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করতে বর্ধমানের কাছে মারাঠাদের সম্মুখীন হন, তখন বেগম শরফুন্নেসা স্বামীর সহযোগী হন।১৩ ওই যুদ্ধে মারাঠারা লণ্ডা নামের যে হাতির পিঠে বসে বেগম যুদ্ধ করছিলেন, সেটাকে ঘিরে ফেলে এবং তাকে প্রায় ধরে ফেলে। ভাগ্যক্রমে নবাবের সেনাপতি ওমর খানের পুত্র মুসাহিব খানের অসীম বীরত্বে শরফুন্নেসা মারাঠাদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে বেঁচে যান।১৪
অনেক সময় দেখা গেছে যে শরফুন্নেসা তাঁর স্বামী নবাব আলিবর্দিকে তাঁর বিপদ ও দুশ্চিন্তার সময় সাহস, ভরসা ও বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শ দিয়েছেন। এমন একটি পরিস্থিতির কথা সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন লিখে গেছেন। একদিন তিনি যখন বেগমের অন্দরমহলে বসেছিলেন, তখন উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নবাব এসে হাজির হন। আলিবর্দির মুখ দেখেই শরফুন্নেসা বুঝতে পারেন যে নবাব বেশ চিন্তাগ্রস্ত। স্বামীর কাছে কী হয়েছে তা তিনি জানতে চান। তাঁর অনুরোধে আলিবর্দি জানান যে তাঁর আফগান সেনাপতিদের, বিশেষ করে শামসের খানের, মতিগতি সুবিধের নয়, তিনি হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করে মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন। এ ভাবনায় আলিবর্দি খুবই উদ্বিগ্ন। শরফুন্নেসা তক্ষুনি দু’জন বিশ্বস্ত অনুচরকে মারাঠা বাহিনীর প্রধান রঘুজি ভোঁসলের কাছে পাঠালেন এই বার্তা নিয়ে যে তাঁরা বেগমের কাছ থেকে আসছেন এবং একটা মিটমাট করে মারাঠারা যেন বাংলা ছেড়ে চলে যান। রঘুজির খুব আপত্তি ছিল না। কিন্তু মীর হাবিব তা হতে দিলেন না। মীর হাবিবের প্ররোচনায় তিনি মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন কিন্তু কাটোয়ার যুদ্ধে তিনি আলিবর্দির হাতে পরাজিত হন।১৫
রাজকার্যের ব্যাপারে শরফুন্নেসা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে আলিবর্দিকে সাহায্য করতেন। মারাঠাদের পরাস্ত করার পর তিনি মারাঠাদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগে তাঁর আফগান সেনাপতিদের বরখাস্ত করেন। তারা আলিবর্দির জামাতা ও বিহারের ছোট নবাব জৈনুদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে এবং আলিবর্দির কন্যা ও জৈনুদ্দিনের পত্নী, আমিনা বেগমকে বন্দি করে রেখে প্রতিশোধ নিল। কিন্তু আলিবর্দি যুদ্ধ করে আফগানদের পরাস্ত করেন ও কন্যা আমিনাকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করে আনেন। বিহার শাসন করার জন্য তিনি তাঁর দাদা হাজি আহমেদের পুত্র ও তাঁর মধ্যম জামাতা সৈয়দ আহমেদকে ছোট নবাব করে পাটনা পাঠালেন। এই ব্যবস্থা বেগম শরফুন্নেসার একেবারে মনঃপূত হল না। তিনি বুঝতে পারেন যে বিহার সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওখান দিয়েই বাইরের শত্রু ও আক্রমণকারীরা বাংলায় ঢুকতে পারে। তাই বিহারের শাসনকর্তার গুরুত্বপূর্ণ পদে সৈয়দ আহমেদ একেবারে অনুপযুক্ত। আলিবর্দিকে তিনি বিষয়টার গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। তিনি জানতেন নবাব তাঁর কথার ও মতামতের যথেষ্ট দাম দেন। তবু সৈয়দ আহমেদকে বিহারের ছোট নবাবের পদ থেকে হঠাবার জন্য তিনি আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। আলিবর্দির, এবং অবশ্য তাঁর বেগমেরও, ইচ্ছে যে সিরাজউদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করবেন। বেগম সিরাজের মাথায় ঢোকালেন যে সৈয়দ আহমেদ বিহারের ছোট নবাব থাকলে সিরাজের পক্ষে আলিবর্দির পর মসনদে বসা সম্ভব হবে না। সিরাজ আলিবর্দির কাছে বায়না ধরলেন, সৈয়দ আহমেদকে বিহার থেকে সরাতে হবে। বৃদ্ধ আলিবর্দি প্রিয় নাতির কথা কোনওদিন ফেলতে পারেননি। এবারও পারলেন না। সৈয়দ আহমেদকে সরিয়ে সিরাজকেই বিহারের ডেপুটি গভর্নর করা হল।১৬ এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বেগম শরফুন্নেসা কতটা বিজ্ঞ, বুদ্ধিমতী ও কৌশলী ছিলেন।
মুর্শিদকুলির মতো আলিবর্দিও একমাত্র পত্নীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর অন্য কোনও পত্নী বা রক্ষিতা ছিল না। বেগম শরফুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও সচ্চরিত্রা। তাঁর নৈতিক মূল্যবোধও ছিল প্রখর। তাই তিনি তাঁর কন্যাদের, ঘসেটি ও আমিনা বেগমের, চারিত্রিক স্খলন কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেননি। ঘসেটি তাঁর স্বামী ঢাকার ছোট নবাব নওয়াজিস মহম্মদের অধস্তন কর্মচারী ও প্রিয়পাত্র হোসেন কুলি খানের সঙ্গে অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বদান্যতায় হোসেন কুলি বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর অনেক কুকর্মও ঢাকা পড়ে যায়।১৭ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হোসেন কুলি ঘসেটির বোন, জৈনুদ্দিন আহমদের স্ত্রী ও সিরাজদ্দৌল্লার মা, আমিনা বেগমের প্রেমে পড়েন। এ সব ঘটনায় শরফুন্নেসা খুবই অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি তাঁর দুই কন্যাকে সুপথে আনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তিনি সফল হতে পারলেন না। তখন তিনি স্থির করলেন সব নষ্টের গোড়া হোসেন কুলি খানকে একেবারে সরিয়ে দিতে হবে। এজন্য তিনি আলিবর্দির কাছে দরবার করেন। এর উত্তরে আলিবর্দি জানালেন যে যেহেতু হোসেন কুলি নওয়াজিস মহম্মদের কর্মচারী ও তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ, তাঁর অনুমোদন ছাড়া এ কাজ করা ঠিক হবে না। বেগম শুরফুন্নেসা নওয়াজিসের অনুমতি আদায় করলেন এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে এ কাজের ভার দিলেন। সিরাজ লোক দিয়ে সেটা সম্পন্ন করেন বলে কথিত আছে।১৮
শরফুন্নেসা অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। হলওয়েল জানাচ্ছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা দখল করার পর হলওয়েল ও অন্য কয়েকজন ইংরেজকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। শরফুন্নেসার অনুরোধে সিরাজ হলওয়েল ও অন্যান্যদের মুক্তি দেন।১৯ সে যাই হোক, হলওয়েল শরফুন্নেসার গুণমুগ্ধ ছিলেন বলে তাঁর প্রশংসা করতে ভোলেননি :২০
a woman whose wisdom, magnanimity, benevolence and every ami-able quality, reflected high honour on her sex and station. She much influenced the Usurper’s [Alivardi’s] councils, and was ever consult-ed by him in every material movement in the state, except when san-guinary and treacherous measures were judged necessary, which he knew she would oppose as she ever condemned them when perpe-trated, however successful.
শরফুন্নেসার শেষ জীবন কেটেছিল দুঃখদুর্দশা ও যন্ত্রণার মধ্যে। পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর মীরজাফর মসনদ দখল করলে তাঁর পুত্র মীরণ শরফুন্নেসা, তাঁর দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগম এবং সিরাজপত্নী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে বন্দি করে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ঘসেটি ও আমিনাকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। বাকিরা কোনওরকমে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের হস্তক্ষেপে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে পারলেন। কিন্তু তাদের যে মাসোহারার ব্যবস্থা হল, তাতে জীবন নির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরফুন্নেসাকে ইংরেজ গভর্নরের কাছে তাঁর ভাতা বৃদ্ধির জন্য আর্জি পাঠাতে দেখা যায়।২১ বাংলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ নবাব আলিবর্দি খানের বেগমের কী নিদারুণ পরিণতি!
ঘসেটি—মোতিঝিলের বেগম
ঘসেটি বেগম নবাব আলিবর্দির জ্যেষ্ঠা কন্যা। প্রথমে তাঁর নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। পরে তিনি ঘসেটি বলেই পরিচিত হন। তবে অনেকেই তাঁকে ছোট বেগম হিসেবেই জানত কারণ তাঁর স্বামী নওয়াজিস মহম্মদ ছিলেন ঢাকার ছোট নবাব। মুর্শিদাবাদের জনমানসে তাঁর পরিচয় ছিল মোতিঝিলের বেগম বলে কারণ তাঁর স্বামীর তৈরি মুর্শিদাবাদের অদূরে মোতিঝিল প্রাসাদেই তিনি বসবাস করতেন।২২ আলিবর্দি ঘসেটির বিবাহ দেন তাঁর দাদা হাজি আহমেদের জ্যেষ্ঠ পুত্র নওয়াজিস মহম্মদের সঙ্গে। বাংলার মসনদ দখল করার পর তিনি নওয়াজিসকে ঢাকার ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত করেন। নওয়াজিস প্রথম যৌবনে তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতা, নিষ্ঠুরতা ও বদচরিত্রের জন্য কুখ্যাত ছিলেন কিন্তু পরে তাঁর চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন আসে। শাসক হিসেবে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সুখ্যাতি অর্জন করেন।২৩ তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ভগ্নস্বাস্থ্য ও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার অভাবের জন্য তিনি ঢাকার শাসনভার তুলে দিয়েছিলেন পত্নী ঘসেটি বেগম ও তাঁর প্রিয়পাত্র হোসেন কুলি খানের ওপর।২৪
ঘসেটি বেগম ও নওয়াজিস মহম্মদের কোনও সন্তান ছিল না। তাই তাঁরা সিরাজদ্দৌল্লার ছোট ভাই এক্রামুদ্দৌল্লাকে দত্তক নিলেন। এক্ৰাম নওয়াজিসের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন এবং তাঁর জীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস। এদিকে আলিবর্দি খান ১৭৫২ সালে তাঁর দুই জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র, নওয়াজিস মহম্মদ ও পূর্ণিয়ার নবাব সৈয়দ আহমেদকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।২৫ এতে মনে হয় নওয়াজিস খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং তখন থেকে তিনি তাঁর বেগম ঘসেটিকে নিয়ে প্রধানত মুর্শিদাবাদে তাঁর মোতিঝিলের প্রাসাদে বাস করতে থাকেন। এর কিছুদিন পরেই ১৭৫৪ সালে তাঁর দত্তক পুত্র ও প্রাণাধিক প্রিয় এক্রামুদ্দৌল্লা বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নওয়াজিস এ নিদারুণ শোক সহ্য করতে পারলেন না। ১৭৫৫ সালের ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। মোতিঝিলের প্রাসাদে এক্রামুদ্দৌল্লার পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।২৬
নওয়াজিসের মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগম ঢাকার শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি হোসেন কুলির হাতেই দিয়ে দেন। আমরা আগেই বলেছি, ঘসেটির সঙ্গে হোসেন কুলির অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং কথিত আছে যে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা কৌশল করে সিরাজদ্দৌলাকে দিয়ে হোসেন কুলিকে হত্যা করান। এরপর ঢাকার শাসনভার চলে যায় নওয়াজিস পত্নী ঘসেটির আরেক প্রিয়পাত্র ও ঘনিষ্ঠ রাজবল্লভের হাতে। নওয়াজিস অত্যন্ত ধনী ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বেগম ঘসেটিই সবকিছুর মালিক হন। ঘসেটি প্রথম থেকেই সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ ছিলেন। প্রথমত তাঁর আশঙ্কা ছিল সিরাজ নবাব হয়েই তাঁর সব ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবেন। তা ছাড়া তিনি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নিজের জন্য মসনদ দখল করতে চেয়েছিলেন। আলিবর্দি তাঁর জীবিতাবস্থায় দু’জনের মধ্যে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হতে পারেননি। বৃদ্ধ নবাব ৮০ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালের ৯/১০ এপ্রিল মারা যান। খোশবাগে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।২৭
নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌল্লা ১০ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। প্রথমেই তিনি মসনদের জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাইলেন। স্বামী নওয়াজিসের দৌলতে ঘসেটি প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তা ছাড়া হোসেন কুলির মৃত্যুর পর ঢাকার শাসনভার যাঁর হাতে ছিল, সেই রাজবল্লভও ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত হয়ে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে বেশ শক্তিশালী চক্র গড়ে তোলেন। এদিকে সিরাজও সন্দেহ করেছিলেন যে ঘসেটি ও রাজবল্লভ ইংরেজদেরও তাদের দলে সামিল করার চেষ্টা করছিলেন। এ সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়।২৮ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রেকর্ড থেকে এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ রেনল্ট (Renault) লিখেছেন যে, ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল যে ঘসেটি বেগমের দলকে কেউ রুখতে পারবে না, ঘসেটিই মসনদ দখল করবেন। সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য। তাই তারা বেগমের সঙ্গে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়।২৯ আবার কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ও বলেছেন যে ইংরেজরা ভেবেছিল সিরাজদ্দৌল্লা কখনওই নবাব হতে পারবেন না। এ অভিমত অন্য একটি ফরাসি তথ্যেও পাওয়া যায়।৩০ ইংরেজদের মধ্যে অনেকের লেখা থেকেও এটা স্পষ্ট। হলওয়েলের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের সাফল্য সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকী কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেকেরও (Roger Drake) ধারণা ছিল ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে সিরাজের সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।৩১
এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘসেটি বেগমকে শায়েস্তা করা ছাড়া সিরাজদ্দৌল্লার কোনও গত্যন্তর ছিল না। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন যে ঘসেটি বেগমের ধনসম্পদ হস্তগত করাই ছিল সিরাজের প্রধান উদ্দেশ্য। এটা মনে হয় সর্বাংশে সত্য নয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে সিরাজ ভাবতেই পারেন যে ঘসেটি বেগমের হাতে যে প্রভূত অর্থ আছে, তা তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নানাভাবে কাজে লাগাতে পারেন। সেজন্য তাঁর কাছ থেকে ওই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা অত্যন্ত জরুরি। ঘসেটি বেগম যে তাঁর ঐশ্বর্য ছড়িয়ে নানা শ্রেণীর লোককে তাঁর দলে টানছিলেন তা ফারসি ইতিহাসেও আছে।
তবে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে প্রথমে কোনও জোরজবরদস্তি করেননি। তিনি আপস-মীমাংসার চেষ্টাই করেছিলেন। এজন্য তিনি আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা ও বণিকরাজা জগৎশেঠকে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠান যাতে বেগম মোতিঝিলের প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সমঝোতা করতে সিরাজ যে এই কুটনৈতিক চালের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারিখ-ই-বংগালা-ই মহবৎজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলিও তাঁর তারিফ না করে পারেননি। উক্ত লেখক এই মর্মে লিখেছেন যে, বহুলোক যারা আগে বেগমকে সমর্থন করত, তারা সিরাজের আপসমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।৩২ এদিকে হোসেন কুলির মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগমের আরেক প্রণয়ী, মীরজা নজর আলি, মোতিঝিলের রক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। কোনও কোনও ফারসি ঐতিহাসিকের মতে সিরাজদ্দৌল্লা মোতিঝিল আক্রমণ করেন। নজর আলি পালিয়ে যান এবং সিরাজ বেগমকে বন্দি করে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে নিয়ে আসেন। মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী এই সম্পদের মধ্যে হিরে, জহরত ছাড়াই নগদ চার কোটি টাকা, চল্লিশ লক্ষ মোহর এবং এক কোটি টাকা মূল্যের সোনা, রুপোর বাসন ছিল।৩৩ এটা অত্যুক্তি বলেই মনে হয়।
ঘসেটি বেগমের জীবন করুণ পরিণতির মধ্যেই শেষ হয়। আমরা আগেই দেখেছি, পলাশি যুদ্ধের পরে মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা, তাঁর দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগম, সিরাজ-পত্নী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে বন্দি করা হয় এবং কিছুদিন পরে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আগস্ট ১৭৫৮-তে। মীরণ এঁদের সবাইকে মসনদের দাবিদার ভেবে তাঁর শত্রু মনে করতেন। তিনি ঢাকার ডেপুটি গভর্নর যশরত খানকে এঁদের সবাইকে মেরে ফেলতে নির্দেশ পাঠান। যশরত তাতে রাজি না হওয়ায় মীরণ এ কাজ সম্পন্ন করতে তাঁর এক অনুচরকে পাঠান। সে অনুচরের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে পেরে ঘসেটি বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। কথিত আছে যে, এসময় আমিনা ও ঘসেটি বেগম এই বলে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেন যে তাঁরা নিজেরাই অনেক পাপ করেছেন, তাই মর্মান্তিক মৃত্যুই তাদের প্রাপ্য। তবে তাঁরা ভাগ্যবান যে এভাবে মৃত্যু হলে তাঁদের পাপের ভার মীরণের ওপর পড়বে। তাদের দু’জনকে একটি নৌকো করে ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই নৌকো মাঝনদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে দুই বোন ঘসেটি ও আমিনা বেগমের সলিল সমাধি হয়। জনশ্রুতি আছে যে দুই বোন মীরণকে এই বলে অভিশাপ দেন যে বজ্রাঘাতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। তাই নাকি হয়েছিল, যদিও এর সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ আছে।৩৪
আমিনা বেগম
আমিনা বেগম নবাব আলিবর্দির কনিষ্ঠা কন্যা ও সিরাজদ্দৌল্লার জননী। তাঁর বিয়ে হয় আলিবর্দির ভ্রাতুষ্পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদ খানের সঙ্গে। পরে আলিবর্দি জৈনুদ্দিনকে বিহারের ডেপুটি গভর্নর করে পাঠান। আমিনাও তাঁর সঙ্গে পাটনা যান। কিন্তু আমিনা বেগমের কপালে খুব বেশিদিন সুখভোগ করা ছিল না। বিহারের বিদ্রোহী আফগানরা আলিবর্দির ওপর প্রতিশোধ নিতে জৈনুদ্দিন ও তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করে। আমিনা কোনওরকমে বেঁচে যান। আফগানরা তাঁকে বন্দি করে রাখে। শোনা যায় যে আফগানরা বেআব্রু করে খোলা গাড়িতে আমিনাকে পাটনায় প্রদক্ষিণ করায় এবং এতে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অত্যন্ত ব্যথা পায়। পরে আলিবর্দি পাটনা অভিযান করে আফগানদের শায়েস্তা করেন এবং আমিনাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এরপর আমিনা বেগম মুর্শিদাবাদে এসে আশ্রয় নেন।৩৫ সেখানে তিনি দিদি ঘসেটি বেগমের মতো অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সেটা ভেবেই হয়তো সিয়রের অনুবাদক নোটা মানুস (Nota Manus) ওরফে হাজি মুস্তাফা মন্তব্য করেন যে ‘She [Amina] became famous in Murshidabad by her amours and gallantry’.৩৬ দিদির প্রণয়ী হোসেন কুলির সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্ক হয় এবং আমরা দেখেছি বেগম শরফুন্নেসার উদ্যোগে কীভাবে হোসেন কুলিকে হত্যা করা হয়। এই ত্রিকোণ প্রেম মুর্শিদাবাদের জনমানসে যে কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা সিয়রের লেখক ও আলিবর্দির আত্মীয় গোলাম হোসেনের লেখা থেকে স্পষ্ট।৩৭
In the zenith of the conqueror’s (Alivardi’s) power, such infamies and lewdness came to be practised by some females and other persons of his family, as cannot be mentioned with decency, but effectually dishonoured his family for ever. All his daughters as well as his beloved Siraj-ud-daulla, lapsed into such a flagitious conduct, and they were guilty of such a variety of shameful excesses, as would have disgraced totally any person whatever, still more, persons of their elevated rank and sublime station.
এখানে অবশ্য বলা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা সম্বন্ধে গোলাম হোসেনের যে বক্তব্য তা আমরা পুরোপুরি মেনে নিতে পারি না—এটা অনেকটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত, যা আমরা অন্যত্র বিশদ তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি।৩৮
আমিনা সম্বন্ধে অবশ্য বলা যায় যে তিনি নাকি উদার এবং কোমল বৃত্তিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করার পর সিরাজ যখন উইলিয়াম ওয়াটস ও তাঁর স্ত্রী পরিবারকে তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা যেতে বাধ্য করেন এবং পরে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান, তখন নাকি আমিনা বেগমের অনুনয়ে সিরাজদ্দৌল্লা তাদের মুক্তি দেন। এটা বোধ হয় সঠিক নয়, কারণ সিরাজ ওয়াটসের পরিবারকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান এমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য কিন্তু পাওয়া যায় না। বরঞ্চ দেখা যায় যে, কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজ ইংরেজ কুঠির অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া কিছুতে হাত দেননি। ইংরেজ মহিলা, শিশুদের এমনকী ওয়াটস সমেত কোনও কর্মচারীকে বন্দিও করেননি। শুধু ওয়াটস ও বেটসনকে তাঁর সঙ্গে কলকাতা অভিমুখে যাত্রার সঙ্গী করে নেন, খুব সম্ভবত সিরাজের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার জন্য কলকাতার গভর্নর ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য।৩৯
আমিনা বেগমের জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ মুহূর্ত দেখা দেয় পলাশির যুদ্ধের ক’দিন পরে। পলাশির যুদ্ধে পরাজিত নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে নতুন নবাব মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে হত্যা করা হয়। তারপর সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে মুর্শিদাবাদ শহরে ঘোরানো হয়। মৃতদেহ নিয়ে হাতিটি আমিনার প্রাসাদের কাছে এসে পৌঁছয়। আমিনা খবর পেয়ে তখন বেআব্রু অবস্থায় পাগলের মতো বেরিয়ে আসেন এবং প্রিয়পুত্রের মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করতে থাকেন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে মুর্শিদাবাদের মানুষ অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এমন অবস্থা দেখে মীরজাফরের ভাগ্নে ও নানা বদ অভ্যেস ও বদকাজে তাঁর সহযোগী খাদিম হোসেন খান তাঁর ভৃত্যদের আমিনা বেগম ও অন্য মহিলাদের জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। এরপর যখন সিরাজের মৃতদেহ মুর্শিদাবাদের বাজারে এনে ফেলে দেওয়া হল, এবং কেউ মৃতদেহকে স্নান করিয়ে সমাধিস্থ করতে এগিয়ে এল না, তখন নবাব পরিবারের কাছে ঋণী এক বৃদ্ধ, মীর্জা জয়নাল আবেদিন বাকাওয়াল, সিরাজের মৃতদেহকে স্নান করিয়ে শবাধারে রেখে খোশবাগে আলিবর্দির সমাধির পাশে সমাধিস্থ করেন।৪০ এরপর আমিনার জীবনে যে দুঃসময় নেমে আসে এবং তাঁর যে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তা আমরা আগেই বলেছি।
লুৎফুন্নেসা—সিরাজ-বেগম
লুৎফুন্নেসার নামে বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে এখনও বিষাদের সুর বেজে ওঠে। সত্য-মিথ্যা কল্পনা মিশে লুৎফুন্নেসা এখনও বাঙালির জনমানসে প্রেম, ভালবাসা, ত্যাগ, তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক। আর বলা বাহুল্য, মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে লুৎফুন্নেসার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁর শৈশবের পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কথিত আছে যে তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন। নাম ছিল রাজ কনওয়ার। তিনি সিরাজ-জননীর ক্রীতদাসী ছিলেন এবং সিরাজের তাঁকে খুব পছন্দ হওয়ায় তিনি তাকে সিরাজের হাতে তুলে দেন। সিরাজ তাঁর রূপ ও গুণে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে হারেমে রাখেন এবং তাঁর নতুন নামকরণ করেন লুৎফুন্নেসা। তাদের একটি কন্যা সন্তানও জন্মায়।৪১ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৭৪৬ সালে আলিবর্দি তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে মহম্মদ ইরাজ খানের কন্যা উমদাতুন্নেসা ওরফে বানু বেগমের খুব ধুমধাম করে বিবাহ দেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাঁর ভক্তি, ভালবাসা, সেবাযত্ন ও গভীর অনুরাগে তাঁর স্বামীকে এমনই আপন করে নিলেন যে সিরাজ তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী বানু বেগমের চেয়েও লুৎফুন্নেসার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং কার্যত তাকেই প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন।
লুৎফুন্নেসাও অবশ্য এই মর্যাদার যথাযোগ্য সম্মান রেখেছিলেন। মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় এক শতাব্দীরও আগে লুৎফুন্নেসা সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তা যদিও খুবই ভাবাবেগপূর্ণ, তবুও অনেকাংশে সত্য।৪২
লুৎফ উন্নেসা মানবী হয়েও দেবী। তাঁর এই পবিত্র দেবভাবে হতভাগ্য সিরাজ নিজের অপদগ্ধ জীবনে কিছুটা শান্তি লাভ করতে পেরেছিলেন। লুৎফ উন্নেসা ছায়ার মতো সিরাজের সঙ্গ দিতেন। কি বিপদে, কি সম্পদে, লুৎফ উন্নেসা কখনও সিরাজকে পরিত্যাগ করেননি। যখন সিরাজ বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার যুবরাজ হয়ে আমোদ তরঙ্গে গা ঢেলে দিতেন, তখনও লুৎফু উন্নেসা তাঁর সহচরী। আবার যখন রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে তেজোহীন—আভাহীন—কক্ষচ্যুত গ্রহের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, তখনও লুৎফ উন্নেসা তাঁরই অনুবর্তিনী। যখন… [পলাশি যুদ্ধের পর] তাঁর আকুল আহ্বানে ও মর্মভেদী অনুনয়ে কেউই তাঁর অনুসরণ করতে ইচ্ছে করেনি, কেবল লুৎফ উন্নেসা নিজের জীবনকে অকিঞ্চিৎকর মনে করে শত বিপদ মাথায় নিয়ে সিরাজের পেছনে পেছনে চলেছেন। স্বামীর দেহত্যাগের পরও তাঁর জীবন তাঁরই পরকালের কল্যাণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত হয়।
অবশ্য অনেকে বলেন যে লুৎফুন্নেসার প্রতি সিরাজের ভালবাসা এবং আনুগত্যের আরও একটি কারণ ছিল। সিরাজ ফৈজি ফরজান নামে দিল্লির এক অপূর্ব সুন্দরী নর্তকীর মোহে পড়েন এবং তাকে এনে তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে তোলেন। কিছুদিন পর ফৈজি সিরাজের ভগ্নীপতি সৈয়দ মহম্মদ খানের শারীরিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন এবং লুকিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেন। এটা টের পেয়ে সিরাজ ফৈজিকে প্রাসাদের একটি ঘরে বন্দি করে চারদিক থেকে ঘরটি বন্ধ করে দেন। তাতে ফৈজির নির্মম মৃত্যু হয়।৪৩ ফৈজির বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ খুবই আঘাত পান এবং ফলে লুৎফুন্নেসার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজদ্দৌল্লা যখন মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসেন। তখন তাঁর এত বড় বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য বিশেষ কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকী তাঁর শ্বশুর ইরাজ খানও সাহায্যের হাত বাড়াননি। বাধ্য হয়ে সিরাজ ২৫ জুন রাত্রির অন্ধকারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করলেন—সঙ্গে লুৎফুন্নেসা, তিন বছরের শিশুকন্যা ও দু’একজন দাসদাসী। সিরাজদ্দৌল্লা নাকি লুৎফুন্নেসাকে এ অবস্থায় তাঁর সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাতে কর্ণপাতও করেননি—এ দুর্দিনে তিনি স্বামীকে একা একা যেতে দিতে কিছুতেই রাজি হননি। তিনদিন তিনরাত অনাহারে পথ চলার পর রাজমহলের কাছে নৌকো থেকে নেমে সিরাজ দানশাহ নামে এক ফকিরের কাছে খাবার চাইতে গেলেন। সিরাজকে চিনতে পেরে দানাশাহ তাঁকে মীরজাফরের জামাই মীরকাশিমের হাতে তুলে দেন। এরপর তাকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মীরজাফরের পুত্র মীরণের গুপ্তঘাতক মহম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করেন। এসব ঘটনা মোটামুটিভাবে সবার জানা। তাই বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই।৪৪
স্বামীর মৃত্যুর পর লুৎফুন্নেসার জীবন নিদারুণ দুঃখদুর্দশা ও দারিদ্রের মধ্যে কাটে। নতুন নবাব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মীরণ লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা উম্মত জহুরাকে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা, দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগমের সঙ্গে ১৭৫৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় নির্বাসিত করেন। সেখানে কীভাবে মীরণের নির্দেশে ঘসেটি ও আমিনা বেগমকে নৌকো থেকে নদীগর্ভে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় তা আগেই বলা হয়েছে। শরফুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও বন্দি অবস্থায় তাদের দুঃখদুর্দশার সীমা ছিল না। তাঁদের জন্য যে সামান্য মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল তাও তারা নিয়মিত পেতেন না। পরে মহম্মদ রেজা খান যখন ঢাকার শাসক হয়ে আসেন তখন তাঁদের নিয়মিত মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। আর ভাগ্যের এমনই পরিহাস, যে ক্লাইভ তাঁর স্বামীর ভাগ্য বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁরই কৃপায় ঢাকায় সাত বছর বন্দিজীবন যাপন করার পর লুৎফুন্নেসাদের মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানো হয়।৪৫
মুর্শিদাবাদে আসার পর শরফুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা কোম্পানি সরকারের কাছে তাঁদের জীবিকার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করতে আবেদন করেন। আবেদনপত্রে তিনজনেরই স্বাক্ষর ছিল।৪৬ লুৎফুন্নেসাকে খোশবাগে আলিবর্দি ও সিরাজদ্দৌল্লার সমাধির তত্ত্বাবধান করার ভার দেওয়া হয়। এজন্য তিনি মাসে ৩০৫ টাকা করে পেতেন। তা ছাড়া মাসে ১০০ টাকা করে তিনি মাসোহারা পেতেন। কিছুদিন পর তাঁর একমাত্র কন্যা উম্মত জহুরার স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি খুবই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৭৭৪ সালে উম্মত জহুরার মৃত্যু হয়। জহুরার চারটি অল্প বয়স্কা কন্যা ছিল—শরফুন্নেসা, আসমতুন্নেসা, সাকিনা, আমাতুলমাদি। কোম্পানি এঁদের ভরণপোষণের জন্য মাসে ৫০০ টাকা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে।৪৭ কিন্তু তারা যখন বড় হয়ে উঠল, তখন ওই টাকায় তাদের খরচপত্র চালানো লুৎফুন্নেসার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তিনি ১৭৮৭ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসকে তাঁর অবস্থার কথা জানিয়ে এবং তাঁদের মাসোহারা বাড়াবার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি দেন। তাতে তিনি এটা জানান যে জহুরার দুটি মেয়ের তিনি বিয়ে দিয়েছেন, এতে তাঁর প্রচুর খরচ হয়েছে। আরও দুটি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, যা ব্যয় সাপেক্ষ এসব যেন বিবেচনা করা হয়।৪৮ কিন্তু কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। লুৎফুন্নেসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লার সমাধির দেখাশোনা করেছেন এবং রোজই সমাধিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়েছেন। ১৭৯৫ সালের নভেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়।
সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর অনেকেই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি কারও প্রস্তাবে রাজি হননি। মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি লিখেছেন যে এরকম এক ব্যক্তি লুৎফুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে লুৎফুন্নেসা উত্তর দিয়েছিলেন যে ‘আমি হাতির পিঠে চড়তে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন গদর্ভের পিঠে চড়ব কী করে’?৪৯ এটা থেকে লুৎফুন্নেসার চরিত্রের দৃঢ়তা ও তেজস্বিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মুন্নি বেগম
যদিও এ গ্রন্থে স্বাধীন নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিবৃত্ত আমাদের আলোচ্য বিষয়, তাই মীরজাফর বা তাঁর বেগম মুন্নি আমাদের আওতায় ঠিক পড়ে না। তবু মুর্শিদাবাদের বেগম বৃত্তান্ত আলোচনা করতে গিয়ে মুন্নি বেগমকে বাদ দিলে তাতে কিছুটা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। কারণ মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে মুন্নি বেগমের জীবনই বোধ হয় সবচেয়ে বর্ণময় ও রোমাঞ্চকর। মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি চতুর, কৌশলী, বুদ্ধিমতী, স্বার্থান্বেষী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্না ছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরের বিবাহিতা স্ত্রী না হয়েও তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী শা’ খানমকে ম্লান করে দিয়ে মীরজাফরের প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন।৫০
মুন্নি বেগমের জীবন অনেকটাই সরদানার প্রখ্যাত রানী সমরুর মতো। গরিবের ঘরে জন্ম, দারিদ্রের মধ্যে শিশুকাল আর পরবর্তী জীবনে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের চূড়ায়— যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছেন। সিকান্দ্রার কাছে বলকুণ্ডা নামের এক অখ্যাত গ্রামের এক গরিব বিধবার সন্তান তিনি। দারিদ্রের জন্য বিধবা মা ছোটবেলাতেই তাঁকে একজন আমিরের বিশু নামে এক ক্রীতদাসীর কাছে বিক্রি করে দেন। বিশু পাঁচ বছর দিল্লিতে ছিলেন এবং সেখানে মুন্নিকে নাচগানে তালিম দেন। কিছুদিনের মধ্যে মুন্নির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক ১৭৪৬ সালের আগস্ট মাসে নওয়াজিস মহম্মদ খান তাঁর দত্তকপুত্র এক্রামুদ্দৌল্লার বিয়ে উপলক্ষে মুন্নিসহ বিশুর নর্তকীর দলকে দশ হাজার টাকা দিয়ে মুজরো করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। এরপর মুন্নি ও বিশুর দল ওখানেই থেকে যায় এবং আমির ওমরাহদের মনোরঞ্জন করতে থাকে। মীরজাফর মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে দলটিকে নিজের দরবারের জন্য নিয়োগ করলেন। কিন্তু নিজে মুন্নির রূপ ও গানে এতই মোহিত হয়ে পড়লেন যে তাঁকে নিজের হারেমে নিয়ে এলেন। আর মুন্নি সুকৌশলে মীরজাফরকে বশীভূত করে তাঁর প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন, যার ফলে মীরজাফর পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ থেকে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ আত্মসাৎ করেছিলেন, তাঁর পুরোটারই অধিকারী হতে পেরেছিলেন।
১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী বব্বু বেগমের মুবারকউদ্দৌল্লা নামে এক পুত্র ও মুন্নি বেগমের দুই পুত্র ছিল—নজমউদ্দৌল্লা ও সইফউদ্দৌল্লা। মুন্নি বেগম কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের প্রচুর পরিমাণ ঘুষ দিয়ে নিজের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে মসনদে বসবার ব্যবস্থা করলেন। কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল মীরজাফর পুত্র মীরণের একমাত্র বৈধ পুত্রের নবাব হওয়ার ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করে মুন্নি বেগমের ১৫ বছরের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে নবাব করে দিল। কিন্তু নজমউদ্দৌল্লা জ্বর হয়ে ১৭৬৬ সালের ৮ মে মারা যান। এরপর তাঁর ছোটভাই নবাব হলেন। ১৭৭০ সালের মার্চ মাসে তারও অকাল মৃত্যু হয়। ফলে বন্ধু বেগমের ১২ বছরের পুত্র মুবারকউদ্দৌল্লা মসনদে বসেন। বলা বাহুল্য, তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই পুত্র নবাব থাকাকালীন মুন্নি বেগমের হাতেই ছিল সব ক্ষমতা, তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। বব্বু বেগম একেবারে অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হলেন।
কিন্তু মুবারকউদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর মুন্নি বেগমের ক্ষমতার অবসান হল। ক্ষমতায় থাকাকালীন মুন্নি বেগম নায়েব দেওয়ান ও ডেপুটি গভর্নর মহম্মদ রেজা খানকে বেশ অবজ্ঞা করেই চলতেন। এখন সুযোগ বুঝে রেজা খান তাঁর প্রতিশোধ নিলেন। কিছুটা তাঁরই প্ররোচনায় গভর্নর কার্টিয়ার আদেশ দিলেন যে এখন যেহেতু মুবারকউদ্দৌল্লাই নবাব, তাঁর মা বব্বু বেগমের হাতেই মুন্নি বেগমকে সব ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে— তাঁকে এখন বব্বু বেগমকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলে মানতে হবে। কিন্তু তাতে মুন্নি বেগম বিশেষ হতাশ হননি কারণ সুচতুর এই মহিলা জানতেন, একদিন না একদিন সুযোগ আসবেই, ধৈর্য ধরে শুধু অপেক্ষা করতে হবে। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন এসময়ের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন :
…whose [Munni Begam’s] extent of understanding nothing can be compared to, but the immense stock which is known to be possessed of in jewels and money, thought proper to take no notice of such an alteration; and although deeply wounded by such underhand deal ings, she thought it beneath her dignity to descend to an explanation; and she passed the whole over with a disdainful silence.
কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানির কর্মচারীদের রদবদল হল। ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে কার্টিয়ারের জায়গায় গভর্নর হিসেবে যোগ দিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি কলকাতায় এসে লন্ডনের নির্দেশমতো নিজামতের তহবিল আত্মসাৎ ও তছরুপ করার অভিযোগে রেজা খানকে বন্দি করলেন। আর ওদিকে নবাবের নিজের মা বব্বু বেগমের হাত থেকে নিজামতের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা আবার মুন্নি বেগমকে দেওয়া হল। মুন্নি বেগমের বয়স তখন ৫০। তাঁর সাম্মানিক ধার্য হল বছরে ১,৪০,০০০ টাকা আর তাঁর সাহায্যকারী মহারাজ নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাসের বেতন বছরে ১,০০,০০০ টাকা। শোনা যায় যে মুন্নি বেগম হেস্টিংসকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে এ কাজ করিয়েছিলেন। এর মধ্যে হয়তো কিছুটা সত্য আছে কিন্তু এর পেছনে হেস্টিংসের অন্য মতলবও ছিল। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সিক্রেট কমিটিকে তাঁর লেখা একটা চিঠিতে সেটা পরিষ্কার :
The Begam as a woman, is incapable of passing the bounds assigned her; her ambition cannot aspire in higher dignity. She has no children to provide for, or mislead her fidelity; her actual authority rests on the Nawab’s life, and therefore cannot endanger it. It must cease with his minority, when she must depend absolutely on the Company for sup-port against her ward and pupil, who will then become her master. Of course her interest must lead her to concur with all the designs of the Company and to solicit their patronage.
কিন্তু মুন্নি বেগমের এই সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হল না। দু’বছর পরে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হলেন বটে কিন্তু যে নতুন কাউন্সিল হল, তাতে তিনজন সদস্যই হেস্টিংস-বিরোধী। তারা মুন্নি বেগমকে অপসারণ করে আবার বব্বু বেগমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এতে হেস্টিংস খুবই মর্মাহত হন। মুন্নি অবশ্য বরাবরই হেস্টিংসের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর বিপদে আপদে সবসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হেস্টিংসও অবশ্য তাঁর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী ১৭৮৩ সালে ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে তিনি লন্ডনের পরিচালক সমিতির কাছে মুন্নি বেগমের প্রশংসা করে এবং বৃদ্ধ বয়সে তিনি যেন একটু আরামে থাকতে পারেন তাঁর জন্য ওঁর ভাতা যেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সে অনুরোধ জানান। মুন্নি বেগমের একটি আর্জিও এ চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়। তাতে অবশ্য খুব একটা ফল হয়নি—মুন্নি বেগমের মাসিক ভাতা ঠিক হল ১২,০০০ টাকা। সেটা এবং নিজের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার দিয়ে সত্যিকারের বেগম ও রানির মতোই তিনি মুর্শিদাবাদে জীবন কাটাতে লাগলেন। তাঁকে কেউ ভালবাসত না কিন্তু নবাব থেকে সবাই তাঁকে ভয় করত।
মুন্নি বেগম আনুমানিক ৯৭ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোট মূল্য ছিল ১৫ লক্ষ টাকার ওপর। জাফরাগঞ্জে মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়। মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের দক্ষিণপূর্বে চক মসজিদ মুন্নি বেগম তৈরি করিয়েছিলেন। এটাই মুর্শিদাবাদের বৃহত্তম মসজিদ। নবাব সুজাউদ্দিনের প্রাসাদ চেহেল সুতুনের ধ্বংসাবশেষের ওপর এটি তৈরি হয় ১৭৬৭ সালে। মুন্নি বেগমকে কোম্পানির জননী আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর স্বামী নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তিনি যখন শোকে মুহ্যমান তখন লর্ড ক্লাইভ নাকি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, ‘আমি মৃত নবাবকে বাঁচিয়ে তুলতে পারব না কিন্তু আপনাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি যে আমি এবং এখানকার আমার ইংরেজ সহকর্মীরা আমাদের আপনার সন্তান বলেই মনে করি, আপনাকে আমরা আমাদের জননী বলে জানি।’ বস্তুতপক্ষে ক্লাইভ এবং হেস্টিংস দুজনেই মুন্নি বেগমকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন এবং তাঁর প্রতি যথেষ্ট সদয় ছিলেন। সত্যি বলতে গেলে মুন্নি বেগমের জীবনের মতো বারবার এমন উত্থানপতন, এমন বৈচিত্র্যে ভরা বর্ণময় জীবন মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাই আজও তাঁর স্মৃতি অমলিন।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫; রিয়াজ-উস-সলাতিন, পৃ. ৩২২।
২. Abdul Karim, Murshid Quli, p. 59
৩. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 2-3. ফারসি ইতিহাস সিয়র বা রিয়াজ-উস-সলাতিনে আগে থেকে বাদশাহের অনুমোদন নেওয়ার উল্লেখ কিছুই নেই। আসলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে দিল্লির বাদশাহ শুধু নামেমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন কিন্তু কার্যত তাঁর কোনও ক্ষমতাই ছিল না। ফলে বাংলার নবাবরা দিল্লিতে যিনিই মসনদে বসতেন, তাঁকেই রাজস্ব পাঠাতেন। দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠালেই বাদশাহ সন্তুষ্ট থাকতেন, তাঁদের আর ঘাঁটাতেন না।
৪. রিয়াজ-উস-সলাতিন, পৃ. ২৮৮. রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিম অবশ্য বলছেন যে সরফরাজকে নিবৃত্ত করেন তাঁর মাতামহী মুর্শিদপত্নী নাসিরা বানু বেগম, রিয়াজ, পৃ. ২৮৮। স্যার যদুনাথ সরকারের বক্তব্যও মোটামুটি তাই, History of Bengal, vol. 2, p.423. অন্যদিকে ব্রজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি লিখেছেন যে জিন্নতউন্নেসাই সরফরাজকে তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন, B. N. Banerjee, Beganas of Bengal, p. 2. অবশ্য তারিখ-ই বংগালার লেখক সলিমুল্লা জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে নাসিরা বানু ও জিন্নতউন্নেসা দু’জনেই সরফরাজকে নিবৃত্ত করেন, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭২।
৫. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ৮-৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 3-4; সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮২।
৬. রিয়াজ, পৃ. ৩১০-৩২১, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ২০-২৩; J. N. Sarkar, History of Bengal, vol. II, pp. 440-42; K. K. Datta, Alivardi and His Times, p. 248.
৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪০; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 5.
৮. B.N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 6
৯. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬; J, N. Sarkar, Bengal Nawabs, Pp. 50, 147-48; 152-53.
১০. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬।
১১. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 6.
১২. সিয়র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৪৮-৫০, ৩৫৩-৫৫; রিয়াজ, পৃ. ৩২৭-২৮, ৩৩০।
১৩. রিয়াজ, পৃ. ৩২৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 8.
১৪. রিয়াজ, ৩৩৮-৩৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 7; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৭৯-৮০।
১৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১-১৪।
১৬. ঐ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৫-৬৬।
১৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২২।
১৮. B, N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 11; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৮৪-৮৫।
১৯. Holwell to William Davis, 28 Feb. 1757, Hill, 111, pp. 151-52.
২০. Holwell, Interesting Historical Events, pt. I, Chap. II, pp. 170-71.
২১. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 12.
২২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৯; J. N. Sarkar History of Bengal, vol II, p. 469; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 14.
২৩. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 34 35.
২৪. J. N. Sarkar, History of Bengal, vol. II, p. 470.
২৫. K. K. Datta, Sirajuddaullah, pp. 1-2.
২৬. মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 56-57; আওয়াল-ই-মহবৎজঙ্গী, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 152-53; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 446; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৭।
২৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৬২; মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p.58; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৯-১১; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p.447.
২৮. S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 41-42.
২৯. ডুপ্লেকে রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 207.
৩০. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64; Hill, III, p. 219.
৩১. কোর্ট অফ্ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 349; Drake’s Narrative, 19 July 1756, Hill, I, pp. 122-23.
৩২. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩; তারিখ-ই-বংগালা-ই-মজবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮।
৩৩. মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৬১-৬২; রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৫-৮৬, Hill, II, P. 2; III, pp. 217-18.
৩৪. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮১, ৩৬৮-৭০; রিয়াজ, ৩৮৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 21-23.
৩৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩-৪৪, ৫৬।
৩৬. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮২ পাদটীকা; ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৪ পাদটীকা।
৩৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২১।
৩৮. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ১৯-২৩।
৩৯. Hyde, Parochial Annals of Bengal, p. 158 quoted in B.N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 25; Hill, I, p. lx; 176; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 46-47, fn. 46, p. 47,
৪০. মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৭-৭৮; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৬; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ, ২৪২-৪৩, J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 496.
৪১. Letter of the Board of Revenue to the Court of Directors, 29 Dec. 1794. Para 40, quoted in B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 31, fn; সিয়রেও তাঁকে ক্রীতদাসী বলে বর্ণনা করা হয়েছে, সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮২; বেভারিজ অবশ্য বলেছেন যে লুৎফুন্নেসা মোহনলালের সহোদরা ছিলেন কিন্তু এটা বোধ হয় ঠিক নয়, Beveridge, ‘Old Places in Murshidabad’, Calcutta Review, 1892.
৪২. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১১৩।
৪৩. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬১৪-১৫ এবং পাদটীকা; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১১৫-১৮। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ফৈজির ঘটনাটা কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতিন, মুজাফ্ফরনামা বা তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গীতে পাওয়া যায় না।
৪৪. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৪-৭৬; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৭-৭৮; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪০-৪২; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২২-২৩; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 32-34.
৪৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮১; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 35; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২৪।
৪৬. Calender of Persian Correspondence, vol. 1, p. 452, Letter no. 2761, 10 Dec. 1756, quoted in B.N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 35-36.
৪৭. B. N. Banerjee, Begamas of Bengal, p. 36: নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২২-২৩।
৪৮. Original Receipts, 1787, no. 176, quoted in B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 36-37.
৪৯. মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৮।
৫০. এর পরের অংশটি মূলত B. N. Banerjee, Begams of Bengal এবং সিয়র অবলম্বনে লেখা। তাই সূত্রনির্দেশ ও টীকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
০৭. শিল্পবাণিজ্য
এই গ্রন্থে আমাদের আলোচ্য বিষয় মূলত নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহরের ইতিহাস হলেও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের শিল্প বাণিজ্যের কথা স্বভাবতই এসে পড়ে কারণ নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের যে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি দেখা গেছে তার একটি প্রধান কারণ মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের শিল্পবাণিজ্যে বিরাট অগ্রগতি— যা এর আগে বা পরে কখনও দেখা যায়নি। এই শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বড় বড় সব ব্যবসায়ী, সওদাগর, মহাজন, প্রভৃতি মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারেই তাদের আস্তানা করেছিল এবং সেখান থেকেই তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। এসব ব্যবসায়ী, সওদাগরদের মধ্যে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের লোক তো ছিলই, এমনকী ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও এখানে তাদের কুঠি তৈরি করেছিল। এরা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের প্রধান দু’টি শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল— এ দু’টি হল, কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র।
কাঁচা রেশম(Raw Silk)
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বিভিন্ন এশীয়/ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ইউরোপীয় কোম্পানিরা বাংলা থেকে যে-সব পণ্য রফতানি করত, তার অন্যতম প্রধান ছিল কাঁচা রেশম। পণ্য রফতানির মোট যে মূল্য, সেদিক থেকে বস্ত্র রফতানির পরেই রেশমের স্থান। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বহু দিন ধরেই বাংলা থেকে রেশম রফতানি করছিল, ইউরোপীয়রা এ ব্যবসা শুরু করে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। তার আগে ইংরেজ ও ডাচরা পারস্যদেশ ও চিন থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করত।১ কিন্তু যখন তারা দেখল যে বাংলা থেকে রেশম রফতানি করতে পারলে অনেক লাভজনক হবে, তখন তারা এদিকে নজর দিল। ইংরেজ কোম্পানি ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করে বাংলা থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করার ওপর জোর দিল।২ ১৬৭০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ইংরেজদের রেশম বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে এবং মাঝেমধ্যে কিছুটা ওঠানামা করলেও এ বাণিজ্য ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই দশকেই সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছয়। তার পরের দুই দশকে— ১৭৪০ ও ১৭৫০— অবশ্য তাতে ভাঁটা পড়ে যায়। ডাচ কোম্পানিও সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রেশম রফতানি শুরু করে। তবে ইংরেজদের সঙ্গে তফাত, ডাচরা বাংলার রেশম শুধু ইউরোপে নয়, জাপানেও তারা তা রফতানি করত। বস্তুতপক্ষে জাপানে রেশম রফতানি তাদের আন্তঃএশীয় বাণিজ্যের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল। ১৬৭০-র দশক পর্যন্ত ডাচরা হল্যান্ডে বেশির ভাগ পারস্যদেশের রেশমই রফতানি করত, আর বাংলা ও চিনদেশের রেশম প্রধানত জাপানে। কিন্তু ওই শতকের শেষ দুই দশকে এই প্যাটার্ন সম্পূর্ণ পালটে যায়। একদিকে জাপানের বাণিজ্যে এ সময় ভাটা পড়ে এবং অন্যদিকে বাংলার রেশম চিন বা পারস্যদেশের রেশমের চাইতে একটু নিম্নমানের হলেও, অনেক সস্তা তাই তারা এখন শুধু বাংলার রেশম হল্যান্ডে রফতানি করতে শুরু করল।৩
ইউরোপের রেশমশিল্পে সাধারণত ইতালির রেশমই ব্যবহার করা হত। কিন্তু ওই রেশমের মূল্য ছিল অত্যধিক। কিন্তু যখন দেখা গেল যে বাংলার রেশম ইতালির রেশমের বদলে ইউরোপের রেশমশিল্পে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে এবং তাতে খরচ অনেক কম পড়বে, তখন ইউরোপে বাংলার রেশমের চাহিদা বেশ বেড়ে গেল এবং কোম্পানিগুলিও বাংলা থেকে রেশম রফতানি করে প্রচুর মুনাফা করতে লাগল। দু’-একটি উদাহরণ থেকে এই লাভের পরিমাণ আন্দাজ করা যেতে পারে। ১৬৫৩-৫৪ সালে ডাচরা বাংলা থেকে রেশম রফতানি করে শতকরা প্রায় দু’শো শতাংশ লাভ করে। ইংরেজ কোম্পানির ক্ষেত্রেও লাভের পরিমাণ ছিল ওরকমই। ১৬৯৫-৯৬ সালে মার্থা নামের জাহাজ বাংলা থেকে যে রেশম ইংল্যান্ডে রফতানি করে, তাতে কোম্পানির মোট মুনাফা হয় শতকরা আড়াইশো ভাগ। তবে এই লাভের পরিমাণ সব সময় এক রকম হত না, কখনও বেশি, কখনও কম হত।৪ সে জন্য অন্যান্য দেশের রেশমের তুলনায় কিছুটা নিম্নমানের হলেও, বাংলার রেশমের ইউরোপে বেশ চাহিদা ছিল। এ প্রসঙ্গে ফরাসি পর্যটক বার্ণিয়ে’র মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে:৫
The (Bengal) silks are not certainly so fine as those of Persia, Syria, Sayd and Barut, but they are of a much lower price; and I know from indisputable authority that, if they were well selected and wrought with care, they might be manufactured into most beautiful stuffs.
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, শুধু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি নয়, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সওদাগর ব্যবসায়ীরা বাংলার রেশমের উৎপাদন কেন্দ্র ও বাজারগুলিতে ভিড় জমাত। বস্তুত কোম্পানিগুলি ভারতবর্ষে আসার অনেক আগে থেকেই এসব ব্যবসায়ীরা বাংলা থেকে স্থলপথে ভারতবর্ষের ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রেশম রফতানি করত। এদের মধ্যে গুজরাটিরাই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী। তা ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে ছিল মধ্য এশিয়া, মুলতান, লাহোর, আগ্রা, বেনারস, হায়দরাবাদ, গোরখপুর প্রভৃতি অঞ্চলের সওদাগর গোষ্ঠী। এরা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ রেশম রফতানি করেছে, পলাশির আগে পর্যন্ত বাংলার রেশমের বাজারে এদেরই অনেক বেশি প্রাধান্য ছিল, ইউরোপীয়দের নয়। পলাশির পরে চিত্রটা সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে এশীয়/ভারতীয় বণিকরা বাংলার রেশমের বাজার থেকে প্রায় উৎখাত হয়ে যায়। তাদের রেশম রফতানির পরিমাণও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকে।৬
রেশমের উৎপাদন ও রেশমশিল্পের সংগঠন
এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে বাংলায় রেশম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল। ১৬৭৬ সালে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির অধ্যক্ষ স্ট্রেনশ্যাম মাস্টার (Streynsham Master) লিখেছেন যে ওই অঞ্চলের প্রায় পুরোটাতেই তুঁত গাছের চাষ হত। এই তুঁতের পাতাই রেশম পোকার প্রধান খাদ্য।৭ তুঁত গাছের চাষই ছিল তখন মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের সবচেয়ে পরিচিত চিত্র। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনে রেশমের উৎপাদন ও বাণিজ্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় এখানকার একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্যে— ‘তুঁতের চাষ নিজের পুত্রসন্তানের চাইতেও অনেক বেশি সম্পদ ও সুখের আকর’।৮ বলা বাহুল্য, রেশম উৎপাদন, রেশমশিল্পের সংগঠন ও বাণিজ্য এ অঞ্চলের বহু মানুষেরই রুজি রোজগারের উপায় করে দিয়েছিল। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অন্য কিছু কিছু অঞ্চলেও, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের রংপুরে, নদীয়ার কুমারখালি ইত্যাদি জায়গায় রেশমের উৎপাদন হত। তবে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলই ছিল রেশমের সর্বপ্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, গুণগত মানের দিক থেকেও ওই অঞ্চলের রেশমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট।
রেশমের মোট বার্ষিক উৎপাদন সম্বন্ধে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া দুষ্কর। ফরাসি পর্যটক টাভার্নিয়ে জানিয়েছেন যে ১৬৬০ ও ১৬৭০-এর দশকে বাংলার রেশম উৎপাদনের মোট পরিমাণ ছিল ২২,০০০ গাঁট, প্রত্যেক গাঁটরিতে ১০০ পাউন্ড করে রেশম। এ পরিসংখ্যান নিয়ে অবশ্য ইদানীং সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ টাভার্নিয়ে বলছেন, এ সময় ডাচরা বাংলা থেকে বছরে ৬০০০-৭০০০ গাঁটরি রেশম রফতানি করত। তা ঠিক নয়। আসলে তারা বছরে এর চেয়ে অনেক কম পরিমাণ রেশম রফতানি করেছে। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে এটা সুস্পষ্ট।৯ কিন্তু আমরা যদি বাংলা থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রেশম রফতানির হিসেব দেখি, তা হলে টাভার্নিয়ের দেওয়া বাংলায় রেশম উৎপাদনের পরিমাণে কিছুটা অত্যুক্তি থাকলেও তা সম্পূর্ণ অবাস্তব নয়। ১৭৫১ সালে যখন মারাঠা আক্রমণে বাংলার রেশমশিল্পের উৎপাদন বেশ কিছুটা ব্যাহত হয়, তখনও এশীয়/ভারতীয় বণিকদের বাংলা থেকে রেশম রফতানির পরিমাণ ছিল ২৪,০০০ মণের মতো।১০ সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলায়, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে, বিপুল পরিমাণ রেশমের উৎপাদন হত।
রেশম শিল্পকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—কাঁচা রেশমের উৎপাদনের জন্য তুঁতের চাষ এবং তারপর রেশম তৈরির প্রণালী। তাই এ শিল্প আংশিক কৃষিভিত্তিক, আংশিকভাবে পারিবারিক কুটিরশিল্প। কৃষকরা অন্যান্য শস্যের সঙ্গে তুঁতের চাষও করত। এই তুঁতগাছের গাছের পাতা খাইয়ে চাষির বাড়িতে গুটিপোকার লালনপালন করা হত। সাধারণত চাষিবাড়ির পুরুষরা মাঠে তুঁতগাছের চাষ করত আর বাড়ির মেয়েরা রেশম গুটিপোকার লালনপালন করত। এ গুটিপোকার লালনপালনের জন্য আলাদা ও বিশেষ রকমের ঘর তৈরি করতে হত। এরকম ঘরের দৈর্ঘ্য হত ২৪ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট, উচ্চতা ৯ ফুট, এবং তাতে ৩ ফুট উঁচু একটি মাচা থাকত। মাটির মোটা দেয়াল করতে হত আর দেয়ালের ওপরের দিকে দুটো জানলা, খড়ের পুরু ছাদ। ওরকম ঘরে ২০০ কাহন বা মোট ২,৫৬,০০০ গুটিপোকা গোবর দিয়ে ভাল করে লেপা ডালাতে করে মাচার ওপরে রাখা যেত। পোকামাকড় যাতে ডালায় আসতে না পারে তার জন্য মাটির রেকাবিতে জল দিয়ে তাঁর ওপর বাঁশের খুঁটির ওপর মাচাটা রাখা হত। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে দরকার হত সুতো কাটার জন্য মাদুর, ছুরি, তুঁতের পাতা নিয়ে আসার জন্য ঝুড়ি, গুটিপোকা রোদে দেওয়ার জন্য কয়েকটি চটের ব্যাগ আর মাটির রেকাবিগুলি মাঝেমাঝেই জলভরতি করে রাখার জন্য কয়েকটি কলসি। এই সবগুলি জিনিস করতে উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে খরচ পড়ত ৫০ থেকে ৬০ টাকার মতো।১১ মধ্য অষ্টাদশ শতকে মনে হয় আরও কম খরচে সবটাই হয়ে যেত।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রেশম উৎপাদন সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে, তাঁর আগে নয়। তবে অষ্টাদশ শতকের ক্ষেত্রেও এসব তথ্য প্রযোজ্য কারণ তাঁর মধ্যে উৎপাদন পদ্ধতিতে বিশেষ হেরফের হয়নি। উৎপাদনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে গুটিগুলিকে দিনে দু’বার তুতের পাতা খেতে দিতে হত এবং পরের দু’পর্যায়ে ৬ বা ৮ ঘণ্টা অন্তর এটা করতে হত। গুটিপোকা থেকে যখন রেশমের সুতো কাটার সময় হত তখন ‘they turn from a greenish-cream to a mellow light orange colour… with a transparent streak down the back, passing, as it is observed, the emission from tail to head, which forms the silk’.১২ তারপর গুটি পোকাগুলিকে মাদুরে রেখে রোদে ও হাওয়ায় দেওয়া হয় আর রাত্রে ঢাকা দিয়ে রাখা হত। গুটিপোকাগুলি প্রায় ৫৬ ঘণ্টা ধরে রেশমের সুতো বার করতে থাকত। চার পাঁচদিন পর পোকাগুলি তাঁর থেকে কাটিম দিয়ে সুতো বার করার জন্য উপযোগী হত। তখন গৃহস্থ চাষি সেগুলিকে পাইকার বা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত কিংবা নিজের বাড়িতে পোকাগুলি সেদ্ধ করে রেশমের সুতো তৈরি করত।১৩
রেশমসুতোর কাটনিরা গুটিপোকা থেকে যে সুতো তৈরি করত তার নাম পাটানি (pattaney) বা পাটনি (putney)। এতে মিহি এবং মোটা দু’রকমের সুতোই মেশানো থাকত। সুতো কাটার ব্যাপারে মেয়েরাই অগ্রবর্তী ভূমিকা নিত এবং এ ব্যাপারে তাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ১৭৫০-র দশকে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেছেন যে:১৪
The women wind off raw silk from the pod of the worm. A single pod of raw silk is divided into twenty different degrecs of fineness, and so exquisite is the feeling of these women, that whilst thread is running through their fingers so swiftly that their eyes can be of no assistance, they will break it off exactly as the assortments change, at once from the first to the twentieth, from nineteenth to the second.
১৮০৭ সাল নাগাদ বুকাননও (Buchanan) রেশমের সুতো কাটার ব্যাপারে মেয়েদের দক্ষতা ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।১৫
রেশমের বাজার
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, বাংলার রেশমের বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। এর কারণ, শুধু ভারতবর্ষ নয়, এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে ব্যবসায়ীরা রেশম কিনতে বাংলায়, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আসত। তা ছাড়াও ক্রেতাদের মধ্যে ছিল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, ভারতীয়/এশীয় ব্যবসায়ীরাই বাংলার রেশমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, ইউরোপীয়রা নয়। আবার দেশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুজরাটিরাই ছিল সবচেয়ে বড় ক্রেতা। উৎকৃষ্ট মানের রেশম হলে দামের তোয়াক্কা না করেই তারা সেই রেশম কিনে নিত। বাংলার রেশমের বাজারে তাদের এমনই প্রভাব এবং প্রতিপত্তি ছিল যে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে দামি যে রেশম তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘গুজরাটি সিল্ক’।১৬ উত্তর ভারতের অর্থনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের সিল্কের বাজার। এটা ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী জন কেনের (John Kenn) লেখা থেকে স্পষ্ট। ১৬৬১ সালে তিনি জানাচ্ছেন:১৭
According as this silk sells in Agra, so the price of silk in Kasimbazar riseth and falleth. The exchange of money from Kasimbazar to Patna and Agra riseth and falleth as the said silk findeth a vent in Patna and Agra.
মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের কাঁচা রেশমের বাজারে এশীয়/ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এমনই দাপট ছিল যে অনেকটা তাদের কেনাকাটার ওপরেই বাজারে দাম ওঠানামা করত, ইউরোপীয়রা এ বাজারে প্রায় নীরব দর্শক হয়েই থাকত। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৭৩৩ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি জানায় যে কাঁচা রেশমের দাম নির্ভর করছে বাজারের এশীয়/ভারতীয়দের চাহিদা অনুযায়ী, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের ক্ষমতায় কুলোবে না। এটা সম্পূর্ণ তাদের আয়ত্তের বাইরে।১৮ এর এগারো বছর পরেও (১৭৪৪) অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কোম্পানির কাশিমবাজার কাউন্সিল কলকাতায় লিখছে যে কাঁচা রেশমের দাম অনেক বেড়ে গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অসহায় কারণ কাঁচা রেশমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা তাদের ক্ষমতার বাইরে।১৯ অবশ্য এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে বাজারে কাঁচা রেশমের দাম এশীয়/ভারতীয় সওদাগরদের চাহিদা ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণে ওঠানামা করত। যেমন প্রাকৃতিক কারণ। বেশি বৃষ্টিতে বা খরার জন্য রেশমের উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হত এবং তাতে বাজারে কাঁচা রেশমের দামও বেড়ে যেত। তা ছাড়া মারাঠা আক্রমণের জন্যও (১৭৪২-৫১) রেশম উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোম্পানির নথিপত্রে তাঁর প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিকরা মারাঠা আক্রমণের নেতিবাচক ফলাফলের ওপর বড় বেশি জোর দিয়েছেন বলে মনে হয়।২০ যদিও এটা অস্বীকার করা যায় না যে মারাঠা আক্রমণ রেশমের উৎপাদনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়েছিল, কিন্তু বাংলা থেকে এ সময়কার রেশম রফতানির পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে যে মারাঠা আক্রমণে রেশমশিল্প বা বাণিজ্যে খুব বেশি একটা প্রভাব পড়েনি। তাঁর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে প্রায় দশ বছর ধরে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ১৭৫১ সালে এশীয় বণিকরা বাংলা থেকে ২৪,০০০ মণের মতো কাঁচা রেশম রফতানি করেছে।২১ মারাঠা আক্রমণের ফলে যদি রেশমশিল্প ও বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে থাকত, তা হলে এত বিশাল পরিমাণ কাঁচা রেশম রফতানি করা কোনওমতেই সম্ভব হত না।
এশীয়/ভারতীয় বণিকরা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে তাদের প্রয়োজনমতো রফতানির জন্য কাঁচা রেশম কিনত। মাঝে মাঝে অবশ্য তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বা পাইকারদের মাধ্যমেও রেশম সংগ্রহ করত। বলা বাহুল্য, এইসব বণিকদের অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে নিজেদের আস্তানা করেছিল। কিন্তু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি প্রধানত কাঁচা রেশম সংগ্রহের জন্য ওই অঞ্চলে নিজেদের কুঠি স্থাপন করলেও, ভাষাগত অসুবিধের জন্য তারা উৎপাদকদের কাছ থেকে বা বাজার থেকে সরাসরি রেশম কিনতে পারত না। তার জন্য স্থানীয় রেশম ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হত। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে অবশ্য এরকম সওদাগরের কোনও অভাব ছিল না। এদের মধ্যে স্থানীয় বাঙালি ব্যবসায়ী যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সওদাগর ব্যবসায়ী। এরা মূলত রেশম ও রেশমিবস্ত্র ব্যবসায়েই লিপ্ত ছিল।
১৭৫৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে ৪২ জন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁর মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন ছিল বাংলার বাইরের— প্রধানত গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারতের লোক। আবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ থেকে শুরু করে তেলি পর্যন্ত সব জাতের মানুষ ছিল।২২
কোম্পানিগুলি সাধারণত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে রেশম সরবরাহের জন্য দাদনি বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করে নিত কারণ এ সময়েই সবচেয়ে ভাল পাটনি বাজারে আসত। অনেক দর কষাকষির পর রেশমের দাম ও কত পরিমাণ রেশম সরবরাহ করতে হবে তা ঠিক হত। কোম্পানি তখন বণিকদের মোট দামের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ টাকা অগ্রিম বা দাদন বাবদ দিত। এ টাকার জন্য কোম্পানি বণিকদের কাছ থেকে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে চেষ্টা সফল হত না। কারণ মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকরা বেশ জোটবদ্ধই ছিল। তাদের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তারা প্রায়শই কোম্পানির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত এবং কোম্পানির নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে সমর্থ হত। এটা আমরা আগের একটি অধ্যায়ে বিশদভাবে দেখিয়েছি।২৩
তবে চুক্তির সময় কীরকম দামে বণিকরা রেশম সরবরাহ করবে তা ঠিক হয়ে গেলেও মাঝে মধ্যে তারা দাম নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে বাক্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ত। সমসাময়িক নথিপত্র থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ১৭৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ইংরেজ কোম্পানির দাদনি বণিকেরা একটি নির্দিষ্ট হারে রেশম সরবরাহ করবে বলে চুক্তি করে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে তারা কোম্পানিকে জানিয়ে দেয় যে রেশমের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে পূর্বনির্ধারিত দামে রেশম সরবরাহ করা কোনও মতেই সম্ভব হবে না, রেশমের দাম বাড়াতেই হবে। কাশিমবাজার কাউন্সিল বণিকগোষ্ঠীর (‘assembly of merchants’) সঙ্গে বৈঠক করে তাদের বাগে আনার বিফল চেষ্টা করল। বৈঠকের পর কাউন্সিল যা লিখেছে তা থেকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের রেশম বাণিজ্য সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। কাউন্সিল বলছে:২৪
We told them (merchants) the price being already agreed, it was not in our power to alter it, and if they would not undertake the invest-ment we must look out for other merchants that would, to which they replied we might do as we pleased, but they were sure no merchants could contract cheaper than themselves, who had been bred up in silk business from their childhood, but they could not give us their labour without some profit of which they saw no prospect at the price we kept.
এ থেকে স্পষ্ট যে কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদের বণিকগোষ্ঠীর একটি বিশেষত্ব ছিল যে তারা সাধারণত কোনও একটি নির্দিষ্ট পণ্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ (specialist) ব্যবসায়ী, ছোটবেলা থেকে তারা এ পণ্যের কাজ কারবারেই অভিজ্ঞতা অর্জন করে এ পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যেই লিপ্ত হত। এ অঞ্চলের বণিকরা সাধারণত রেশম এবং রেশমিবস্ত্রের ব্যবসাতেই নিযুক্ত থাকত। এদের মধ্যে অনেকে শুধু রেশমের ব্যবসা করত, আবার অনেকে শুধু রেশমিবস্ত্রের। কেউ কেউ অবশ্য দু’টো পণ্যের বাণিজ্যই করত। এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, এরা মোটামুটি ভাল মুনাফা না হলে কাউকে পণ্য সরবরাহ করতে আগ্রহী হত না এবং এদের পঞ্চায়েত বেশ শক্তিশালী ছিল।
ইংরেজ কোম্পানি মুর্শিদাবাদ কাশিমবাজার থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভর করত কাশিমবাজারের কাটমা পরিবারের ওপর। অষ্টাদশ শতকের তিরিশের দশকে এ পরিবারের কয়েকজনই কোম্পানির ‘প্রধান বণিক’ (chief merchant) হিসেবে কাজ করেছে। এদেরই একজন বলাই বা বলরাম কাটমা, কোম্পানির ‘প্রধান বণিক’ নিযুক্ত হয় ১৭৩৭ সালে। ১৭৪০-এ যখন কোনও একটি কারণে নবাব তাঁকে বন্দি করে রাখেন, তখন কোম্পানি চোখে অন্ধকার দেখে কারণ ‘if some of that family [Katma] will not assit us on this occasion, we find it on several Tryalls impossible to get any of our other merchants to agree for more silk or piece-goods.’২৫
কোম্পানিগুলি বাংলা থেকে ইউরোপে যে কাঁচা রেশম পাঠাত, অনেক সময় সে রেশম ইউরোপের তাতে ব্যবহার করা মুশকিল হত। কারণ এগুলো গোটানো বা কুণ্ডলী করা থাকত না। এসব অসুবিধে দূর করার জন্য কোম্পানিগুলি, বিশেষ করে ডাচরা, কাশিমবাজারে কারখানা (karkhana) স্থাপন করে এ কাজের জন্য উপযুক্ত কারিগর নিযুক্ত করত। বাংলার শিল্প জগতে একদিক থেকে এটি একটি অভিনব সংযোজন। এর আগে কোনও ব্যক্তিগত বা বেসরকারি মালিকানার প্রতিষ্ঠানে এরকম নতুনত্ব দেখা যায়নি। অবশ্য মুঘল যুগের কারখানার কথা আমরা জানি। তবে এসব কারখানা মূলত বাদশাহি প্রতিষ্ঠান। এখানে বাদশাহ ও আমির ওমরাহদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই শুধু তৈরি হত, সাধারণ মানুষের বা বাজারের জন্য নয়। নবাবি আমলে ঢাকায় এরকম কারখানা ছিল, যেখানে সবচেয়ে বিলাসবহুল, উৎকৃষ্ট ও দামি মসলিন তৈরি হত।২৬ সে যাই হোক, ডাচ কোম্পানিই প্রথম ইউরোপের তাঁতগুলোর উপযুক্ত করে রেশমিসুতো কাটাবার ও ভাল করে গুটিয়ে রফতানি করার জন্য ১৬৫৩ সালে কাশিমবাজারে একটি কারখানা স্থাপন করে। তার জন্য কোম্পানি একটি চালা (shed) তৈরি করে, যাতে ৩,০০০ কারিগর কাজ করতে পারত। এদের পুরো কাজে লাগালে বছরে ১,৫০০ গাঁটরি উৎকৃষ্ট মানের রেশম তৈরি করা যেত। কিন্তু কোম্পানি তা সব সময় করে উঠতে পারত না। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ইউরোপে রেশমের চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ায় ডাচ কোম্পানি ১৭১৫ সালে চালাটি আরও বাড়ায় যাতে ৪,০০০ কারিগর একসঙ্গে কাজ করতে পারে।২৭ ইংরেজ কোম্পানিও এরকম কারখানা তৈরি করে কিন্তু সেখানে ৩০০-র বেশি লোক একসঙ্গে কাজ করতে পারত না, তাই কাশিমবাজার কাউন্সিল ১৭৫৫ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখে কারখানাটি বড় করা দরকার, তাই চালাটা আরও বাড়াতে হবে এবং তাঁর জন্য অর্থ মঞ্জুর করতে। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে রাজি না হওয়ায় কারখানার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি।২৮
রেশমিবস্ত্র
কাঁচা রেশম ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ সিল্কের কাপড় তৈরি হত এবং তাঁর অধিকাংশই ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে শুধু নয়, ইউরোপেও রফতানি হত। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার যেহেতু বাংলায় রেশম উৎপাদনের সবেচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল, সেজন্য স্বাভাবিক ভাবেই উৎকৃষ্ট সিল্পের কাপড়ও এখানেই তৈরি হত। সঙ্গে সঙ্গে সিল্ক-সুতি মেশানো কাপড়ও। এই দু’রকম কাপড়েরই প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল। ঐতিহাসিকরা বলেন:
The neighbourhood of Murshidabad is the chief seat of manufacture of wove silk: taffeta, both plain and flowered, and many other sorts of inland commerce and for exportation, are made there abundantly, than at any other places where silk is wove.
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিল্ক কাপড়ের কাজ-কারবার যারা করত, তারা ওতেই বিশেষজ্ঞ ব্যবসায়ী। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত এরকম কাপড় কেনাবেচা করত না। কোম্পানির নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৭৪৪ সালে কাশিমবাজার থেকে যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়, তা করতে হলে এখানকার কুঠিয়ালরা জানায়, মুর্শিদাবাদ-সৈয়দাবাদে যে সব অভিজ্ঞ ও বড় বড় ব্যবসায়ী এই পণ্যই শুধু সরবরাহ করে, তাদের সাহায্য একান্ত দরকার। এদের মধ্যে আছে গোঁসাইরাম, রাম সিং, রামনাথ ইচ্ছানাথের মতো ধনী ও এ পণ্যে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। তারাই প্রধানত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের সিল্কের কাপড় সরবরাহ করতে পারে। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত এই পণ্যে কাজ-কারবার করতে চায়না। কোম্পানি গোঁসাইরাম প্রমুখ ব্যবসায়ীর সঙ্গে রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য চুক্তি করতে চায় কিন্তু ওই সব ব্যবসায়ীরা অগ্রিমের জন্য জামিন দিতে অস্বীকার করে। তারা বলে যে এতে বাজারে তাদের সুনাম নষ্ট হবে। কাশিমবাজার কাউন্সিল কলকাতায় লেখে যে এরা খুবই ধনী এবং সিল্কের কাপড়ে বিশেষ ব্যবসায়ী। সিল্কের কাপড় সরবরাহ করার জন্য ওদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি না করলে এরা হাতছাড়া হয়ে যাবে, ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি এদের লুফে নেবে। ফলে ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে ইংল্যান্ড থেকে যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র পাঠানোর জন্য নির্দেশ এসেছে, তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। অবশেষে কোম্পানি জামিন ছাড়াই ওই সব রেশমিবস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৩০
সিল্ক কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ‘টাফেটার’ (tafettas বা taffaties) আর এটা প্রধানত কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলেই বেশি তৈরি হত। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ইউরোপে যে রেশমিবস্ত্র রফতানি করত, তার একটা বড় অংশই টাফেটা। ডাচরা আবার এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও জাপানে রফতানি করত। শুধু ইউরোপীয়রা নয়, এশীয় বণিকরাও মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বেশ ভাল পরিমাণ ‘টাফেটা’ রফতানি করত। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে বাংলা থেকে ইউরোপীয়রা নয়, এশীয় বণিকরাই সবচেয়ে বেশি রেশমিবস্ত্র রফতানি করত, যার মধ্যে টাফেটা অন্যতম। নীচে প্রদত্ত সারণি থেকে এটা পরিষ্কার।
সারণি ৭.১
এশীয় বণিক ও ইউরোপীয়দের রেশমিবস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড়
১৭৫০/৫১-১৭৫৪/৫৫
এশীয়রা ইউরোপীয় কোম্পানি
বছর (সংখ্যা) ডাচরা ইংরেজরা মোট ইউরোপীয়
(সংখ্যা) (সংখ্যা) (সংখ্যা)
১৭৫০/৫১ ১২৪,৬৭৫ ১২,৮৯০ ১২,৭৬০ ২৫,৬৫০
১৭৫১/৫২ ৯২,৪৭৫ ৩৯,৬২৮ ২০,০৪১ ৫৯,৬৬৯
১৭৫২/৫৩ ৮৯,৯৭৮ ২৭,৭৭৭ ৩২,৬১৫ ৬০,৩৯২
১৭৫৩/৫৪ ৭৮,৯৭৮ ২৯,০২৯ ২৪,৬৬৩ ৫৩,৬৯২
১৭৫৪/৫৫ ৭৫,০৬২ ৪০,৮৮৩ ৩৪,১৬০ ৭৫,০৪৩
মোট সংখ্যা ৪৫৭,১৬৮ ১৫০,২০৭ ১২৪,২৩৯ ২৭৪,৪৪৬
বার্ষিক গড় ৯১,৪৩৪ ৩০,০৪১ ২৪,৮৪৮ ৫৪,৮৮৯
[সূত্র: এশীয় বণিকদের রফতানি, BPC, vol. 44, Consult. 19 June 1769; ডাচ রফতানি হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানা (Algemeen Rijksarchief) থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে হিসেব করে বার করা হয়েছে; ইংরেজ কোম্পানির রফতানি K. N. Chaudhuri-র বই (Trading World) থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।]
এই পরিসংখ্যানে অবশ্য ফরাসিদের রফতানির পরিমাণ ধরা হয়নি কারণ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। তবে P.J. Marshall এর বক্তব্য অনুসরণ করে, যে ফরাসিদের রফতানির পরিমাণ ডাচ বা ইংরেজদের রফতানির অর্ধেক হওয়ারই সম্ভাবনা,৩১ আমরা অনুমান করতে পারি যে, ডাচ ও ইংরেজদের রফতানির বার্ষিক গড় যখন যথাক্রমে ৩০,০৪১ ও ২৪,৮৪৮ তখন ফরাসিদের বার্ষিক গড় রফতানি ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০-এর বেশি হতে পারে না। তা যদি হয়, তা হলে ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রেশম রফতানির মোট বার্ষিক গড় ৬৭,০০০ থেকে ৭০,০০০-এর বেশি হতে পারে না (ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে ডাচ ও ইংরেজদের রফতানির বার্ষিক গড় ৫৪,৮৮৯)। অথচ ওপরের সারণি থেকে আমরা দেখছি যে এশীয় বণিকদের রেশমিবস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড় ৯১,৪৩৪। সুতরাং কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে রেশমিবস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশীয় বণিকরাই অনেক বেশি এগিয়ে ছিল।৩২
কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে কাঁচা রেশম উৎপাদন ও এই শিল্পের সঙ্গে অনেক কৃষক/কারিগর যেমন যুক্ত ছিল, তেমন রেশমিবস্ত্র তৈরি করার জন্যও অনেক তাঁতি ও কারিগরের প্রয়োজন ছিল। সমসাময়িক নথিপত্র থেকে জানা যে এ অঞ্চলে এমন তাঁতি ও কারিগরের কোনও অভাব ছিল না। এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে বাজারে যখন সিল্কের কাপড়ের প্রচুর চাহিদা ছিল, কাঁচা মালেরও খুব একটা অভাব যখন চোখে পড়ে না, তখন আন্দাজ করা যেতে পারে যে এদের অবস্থাও খুব একটা খারাপ ছিল না। তাঁতিরা সাধারণত তিনটে রঙের ‘টাফেটা’ বুনত— পাকা সবুজ, হালকা সবুজ ও নীল। এই তিন রকম কাপড় বুনতে কোন খাতে কত খরচ হত, তাঁতি কত পেত এবং বিশেষ করে পুরো খরচের শতকরা কত তাঁতির লাভ থাকত সে সম্বন্ধে একটি তালিকা আমি পেয়েছি। পরের পাতায় সেটি উদ্ধৃত করা হল।
আমরা আগেই বলেছি বাংলা থেকে যে বিপুল পরিমাণ কাঁচা রেশম রফতানি হত, তাঁর অধিকাংশই কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে, এবং ইউরোপীয় কোম্পানি তথা ভারতীয়/এশীয় বণিকরা সবাই এতে লিপ্ত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ রেশম রফতানিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কাদের— ইউরোপীয়দের না ভারতীয়/এশীয় বণিকদের? এতদিন ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়দেরই মুখ্য ভূমিকা— তারাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করত। তা যদি হয়, তা হলে কাঁচা রেশমের রফতানিতেও তারা ছিল অগ্রগণ্য, কারণ বাংলা থেকে যে দু’টি প্রধান রফতানি পণ্য (মোট মূল্য এবং পরিমাণগতভাবে), তা হল বস্ত্র ও কাঁচা রেশম। সুতরাং ওপরের বক্তব্য অনুযায়ী কাঁচা রেশমের রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দেরই প্রধান ভূমিকা। অন্তত কে, এন, চৌধুরী (১৯৭৮), ওম প্রকাশ (১৯৮৫, ১৯৯৮), পিটার মার্শাল (১৯৭৮, ১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭) প্রমুখের গবেষণা গ্রন্থ থেকে এ ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।৩৩
তবে প্রশ্ন, এ ধারণা কি সঠিক? আমরা অস্বীকার করছি না যে বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যে ইউরোপীয়রা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু তা বলে একথা বলা যায় না যে বাংলার সামগ্রিক বহির্বাণিজ্যে তারা এশীয় বণিকদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল কারণ এতে সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে স্থলপথে বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারটাও থাকছে। অনেকদিন ধরেই বাংলা থেকে স্থলপথে বহিবাণিজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে (বিশেষ করে নীলস স্টিনসগার্ড (Niels Steensgaard), অশীন দাশগুপ্ত প্রমুখের লেখায়),৩৪ মুঘল, পারসিক ও অটোমান (Ottoman) এই তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের পর এবং তাঁর ফলে সুরাটের মতো আন্তর্জাতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের পতন হওয়ায় স্থলপথে বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায়। এরকম চিন্তাধারার অন্যতম কারণ, ভারতবর্ষ/বাংলা থেকে স্থলপথে বাণিজ্য সম্বন্ধে কোনও তথ্য পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর, যেখানে ইউরোপীয় বাণিজ্য সম্বন্ধে বেশ সহজেই পরিসংখ্যানগত তথ্য ইউরোপের মহাফেজখানাগুলি থেকে সংগ্রহ করা যায়। অবশ্য এর সঙ্গে ও-সব ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইউরোপ কেন্দিক (Eurocentric) মানসিকতাও হয়তো কিছুটা কাজ করেছে।
সারণি ৭.২
কাশিমবাজারে টাফেটা তৈরীর খরচ, ১৭৫৬
[টাকা, আনা, পাই]
Taffeta Cost of Silk Winding Cost Twisting Cost Patash
& Straw agent Blue & other Other Dyes Tying Broken Threads Weaving Total Cost Weaver’s Profit in Percentage of Total Cost
Pucca Green 6.10 0.4.6 0.4.0 0.2.0 0.10.6 3.12.6 0.1.0 1.4.0 13.0.6 9.6
Pale Greem 6.10 0.4.6 0.4.0 0.2.0 0.10.6 3.11.0 0.1.0 1.4.0 9.15.0 12.5
Blue 6.10 0.4.6 0.4.0 0.2.0 0.10.6 0.1.0 1.4.0 9.4.0 13.5
[সূত্র: Fact. Records, Kasimbazar, vol 12, 15 Jan. 1756; BPC, vol. 28,f. 386. 22 Jan. 1756]
আমরা কিন্তু এখন বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারছি যে কাঁচা রেশম রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়রা ইউরোপীয়দের চাইতে, বলতে গেলে, বেশ কয়েক যোজনই এগিয়ে ছিল। এজন্য প্রথমে দেখা যাক, বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি মধ্য-অষ্টাদশ শতক নাগাদ বাংলা থেকে কী পরিমাণ রেশম রফতানি করত। ইংরেজ কোম্পানির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ১৭৪৫-৪৬ থেকে ১৭৪৯-৫০, এই পাঁচ বছরে তাদের রেশম রফতানির বার্ষিক গড় ১,২০০ মণ আর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৭৫০-৫১ থেকে ১৭৫৪-৫৫ পর্যন্ত বার্ষিক গড় ১,১৪৬ মণ। আর ডাচ কোম্পানির ক্ষেত্রে ১৭৪০-৪১ থেকে ১৭৪৪-৪৫-এ পাঁচ বছরে বার্ষিক গড় ছিল ৮৯৭ মণ আর ১৭৫০-৫১ থেকে ১৭৫৪-৫৫ পর্যন্ত তা ছিল ৯৬৯ মণ।৩৫ ফরাসিদের রফতানি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি তবে পিটার মার্শালের অভিমত অনুসারে তাদের রফতানির পরিমাণ ইংরেজ ও ডাচদের রফতানির অর্ধেক মতো হবে (যদিও তা আরও কম হওয়ার সম্ভাবনা) ধরে নিলে, তার বার্ষিক গড় পরিমাণ হবে ৫০০ মণের মতো। অর্থাৎ ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসিদের সম্মিলিত রফতানির বার্ষিক গড় পরিমাণ দাঁড়ায় (ইংরেজদের ১,৫০০ মণ, ডাচদের ১,০০০ মণ, ফরাসিদের ৫০০ মণ ধরে) খুব বেশি হলে ৩,৫০০ মণ।৩৬ তা যদি হয়, এ সময় এশীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ কতটা ছিল তা দেখতে হবে।
আমার সৌভাগ্য যে আমি কাশিমবাজার থেকে ১৭৪৯-১৭৬৭, এই দীর্ঘ উনিশ বছরের এশীয় বণিকদের রেশম রফতানির সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান উদ্ধার করতে পেরেছি। এই তালিকাটি ১৭৬৯ সালে কাশিমবাজারের ‘কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট’ অলডারসে (W. Aldersey) মুর্শিদাবাদের বাদশাহি শুল্কবিভাগের (seir customs house) রসিদপত্র থেকে তৈরি করেছিলেন।৩৭ যেহেতু এশীয় বণিকদের রেশম রফতানির জন্য মুর্শিদাবাদের শুল্কবিভাগে শুল্ক জমা দিতে হত, সেজন্য এই তালিকায় এশীয় বণিকরা কী পরিমাণ রেশম রফতানি করছে, তার পরিমাণ, মূল্য এবং কত শুল্ক দিচ্ছে সবই আছে। এতে স্পষ্ট করে বলা আছে যে এই তালিকায় শুধু এশীয় বণিকদের রফতানিই ধরা হয়েছে, অন্য কারও নয়। আমরা এখানে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত এশীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ ও তার মূল্য তুলে ধরেছি। তারপর কয়েকবছরের যে হিসেব তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই কারণ তখন রফতানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
সারণি ৭.৩
কাশিমবাজার থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাঁচা রেশম রফতানি, ১৭৪৯-৫৮ মোট পরিমাণ ও মূল্য
বছর পরিমাণ(মণ) মূল্য (টাকা)
১৭৪৯ ২০,০৩৭ ৫৬,১০,৪২৩
১৭৫০ ১৯,৫৭১ ৫৪,৭৯,৭৮৬
১৭৫১ ২৩,৭৪০ ৬৬,৪৭,০৯৫
১৭৫২ ১৭,৬১৫ ৪৯,৩২,২২১
১৭৫৩ ১৮,০৫৩ ৫০,৫৪,৮৪০
১৭৫৪ ১৫,২৪৯ ৪২,৬৯,৫৯৪
১৭৫৫ ১২,২৬৯ ৩৪,৩৫,৩১০
১৭৫৬ ৭,৬৩৫ ২১,৩৭,৭৬২
১৭৫৭ ২১,৩৪৭ ৫৯,৭৭,০৪৫
১৭৫৮ ১৮,১৯২ ৫০,৯৩,৬৩৪
এই তালিকার তলায় সংকলক অলভারসে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন:
The above account indicates only the Trade on which Duties were really paid to the pachotra daroga [Royal Customs House] but besides this there was formerly carried on a very considerable trade in these articles by Juggutseats House and others who had interests with the Nizamat for these goods to pass Duty free…. The above is the trade of Natives only on which duties have been paid.
[সূত্র: Bengal Public Consultations, Range 1, vol. 44, 19 June 1769]
ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৮, এ দশ বছরে এশীয়/ভারতীয় বণিকরা মোট ১,৭৩,৭০৮ মণ কাঁচা রেশম রফতানি করেছে অর্থাৎ এসময় তাদের রফতানির বার্ষিক গড় ছিল ১৭,৩৭১ মণ। আর ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মোট রফতানির বার্ষিক গড় ৩,৫০০ মণের বেশি নয়। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সিল্ক রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চাইতে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল— অন্ততপক্ষে চার পাঁচগুণ বেশি। আর তাই যদি হয়, তা হলে এশীয়/ভারতীয় বণিকরাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো/টাকাপয়সা আমদানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। কারণ বাংলায় পণ্য কিনতে গেলে সব ব্যবসায়ী-সওদাগরকেই নগদ টাকা বা সোনা-রুপো নিয়ে আসতে হত। বাংলায় তা ছাড়া অন্য কোনও জিনিসের চাহিদা ছিল না। মধ্য অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বারবার একথা বলেছেন। এরকম এক কর্মচারী, উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts), লিখেছেন যে বাংলার পণ্য কেনার জন্য অসংখ্য ব্যবসায়ী বাংলায় আসত, ‘with little else than money or bills [of exchange]’৩৭ এবং সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যে ‘the inland importation into Bengal always far exceeded the whole importation by sea from Europe and the gulfs of Arabia and Persia.’৩৮ আরেকজন কর্মচারী যিনি পরে বাংলার গভর্নরও হয়েছিলেন, হ্যারি ভেরেলষ্ট (Harry Verelst) বলেছেন যে ‘the whole amount of the trade of the Provinces [of Bengal] was a clear gain to them by an exchange of their produce for bullion’ এবং ‘there flowed every year an increase of specie equal to the Amount of the export of the Country’.৩৯ অন্য আরেক কর্মচারী, লিউক স্ক্র্যাফ্টন (Luke Scrafton), জানিয়েছেন যে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য সওদাগর ‘used to resort to Bengal with little else than ready money or bills to purchase the produce of the Provinces’.৪০
বাংলা থেকে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল থেকে, কাঁচা রেশম রফতানির ক্ষেত্রে ভারতীয়/এশীয় বণিকদের যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ছিল সেটা সমসাময়িক বহু তথ্য থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত। সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি কাশিমবাজারের এক গুজরাটি সিল্ক ব্যবসায়ীর গোমস্তা ছিলেন এবং তিনি নিজেও তিরিশ বছর ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৭৫০-র দশকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মুর্শিদাবাদে তখন দশ জন সওদাগর ছিল যারা বছরে ১৩,০০০ থেকে ২০,০০০ মণ পর্যন্ত সিল্ক রফতানি করত।৪১ বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষ লুই টেইলেফারট (Louis Taillefert) ১৭৬৩ সালে লিখেছেন যে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক থেকে লাহোর ও মুলতান অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের গোমস্তারা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার থেকে সিন্ধ কেনার পরিমাণ অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।৪২ তা ছাড়া উইলিয়াম বোল্টস, হ্যারি ভেরেলস্ট, লিউক স্ক্র্যাফ্টন প্রমুখ জোর দিয়ে বলেছেন যে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের অসংখ্য ‘ক্যারাভ্যান’ (caravan) বাংলায় পণ্য, বিশেষ করে বস্ত্র ও রেশম, কেনার জন্য নিত্য আসা যাওয়া করত। কিন্তু উত্তর পলাশি পর্বে এ চিত্র সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে ভারতীয়/এশীয় বণিকরা পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের স্থলপথের বাণিজ্যে ভাঁটা পড়তে থাকে এবং ক্রমশ তা প্রায় বিলীন হয়ে যায়।
রেশম শিল্পের পাশাপাশি আরও কিছু ছোটখাটো শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হাতির দাঁতের কারুশিল্প (ivory carving)। এই শিল্পের উৎপত্তি নবাবি আমলে। তার আগে এর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় না। এর উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি গল্প বহুল প্রচলিত। মুর্শিদাবাদের এক নবাব একটি কান-খুঁচুনি (ear-pick) তৈরি করতে বলেন এবং সে অনুযায়ী ঘাসের তৈরি একটি কান-খুঁচুনি বানানো হলে সেটা তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। কারণ একমাত্র হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসই নবাবের মর্যাদার উপযোগী। তখন এ কাজের জন্য দিল্লি থেকে এক ওস্তাদ কারিগরকে আনা হল। তিনি যখন এ কাজ করছিলেন তখন এক হিন্দু ভাস্কর বা খোদাইকার দেয়ালের একটি ফুটো দিয়ে জিনিসটা কীভাবে করা হচ্ছে সেটা দেখে নেয় এবং কীভাবে এটা করতে হয় সে কৌশল শিখে ফেলে। এই ভাস্কর তার ছেলে তুলসীকে কৌশলটি শিখিয়ে দেয়। তুলসী খাটেম্বের (Khatember) এ কাজে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং নবাব তাকে পনেরো টাকা মাস মাইনেতে দরবারে নিযুক্ত করেন। নবাব ও দরবারের জন্য তুলসী হাতির দাঁতের নানারকম জিনিসপত্র তৈরি করত। অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম ভারতবর্ষের অন্য যে কোনও অঞ্চলের চাইতে অনেক বেশি সুনাম অর্জন করেছিল। দিল্লি, বেনারস প্রভৃতি অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের এই শিল্পের অনুকরণে জিনিসপত্র তৈরি হত।৪৩
হাতির দাঁতের কারুশিল্পে প্রধানত জীবজন্তুর মূর্তি— হাতি, ঘোড়া, উট, ইত্যাদি; নৌকা, পালকি, গোরুর গাড়ি, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, বিয়ের মিছিল, শিকারের চিত্র, চিরুনি, লাঠি, খেলনা, ছুরির বাঁট, কলমদান, দোয়াতদান, আয়নার ‘ফ্রেম’ (কাঠামো), এসব ছিল উল্লেখযোগ্য। মীরজাফরের বেগম বিধবা মুন্নি বেগম ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রীকে হাতির দাঁতের তৈরি একটা চেয়ার ও ছোট টেবিল উপহার দিয়েছিলেন। এ দু’টি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মূল্যবান বস্তু হয়ে উঠেছিল। মুর্শিদাবাদ থেকে হাতির দাঁতের কারুশিল্প ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও রফতানি হত। দেশের ভেতরে এই শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবরা, তাঁদের অমাত্য ও অন্যান্য অভিজাতবর্গ এবং ধনী শ্রেষ্ঠীরা। নবাব এবং দরবারের রমরমা যখন অস্তমিত, তখন কিছুদিন কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারীরা এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কিন্তু রেশম শিল্প ও বাণিজ্যের অবনতির ফলে কোম্পানিগুলির এজেন্টরা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ায় হাতির দাঁতের কারুশিল্পেও দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। হাতির দাঁতের কারুশিল্পের জন্য হাতির দাঁত আসত শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম থেকে, যেখানে তখন হাতি শিকার করা হত। তা ছাড়া বোম্বাই থেকে কলকাতা হয়ে আফ্রিকার হাতির দাঁতও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আসত।৪৪
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. Glamann, Dutch-Asiatic Trade, pp. 112-113; K.N. Chaudhuri, Trading World, pp. 343-47; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 178-80; Om Prakash, Dutch Company, pp. 208-09.
২. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, p. 179.
৩. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 119-200.
৪. Glamann, Dutch-Asiatic Trade, p. 122; Om Prakash, Dutch Company, pp. 187, 196, 199; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, p. 181.
৫. Bernier, Travels, p. 439.
৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 220-21.
৭. Streynsham Master, The Diaries of…, vol. 2. p. 28.
৮. H.R. Ghosal, Economic Transition, p. 57, f.n. 126-এ উদ্ধৃত।
৯. Tavernier, Travels, vol. II, p. 2; K. N. Chaudhuri, Trading World, p. 354; Om Prakash, Dutch Company, p. 57.
১০. BPC, Range 1, vol. 44, Annex. to Consult., 19 June 1769,
১১. J. Geoghegan, Silk in India, pp. 15-16; D. H. W. Speed, ‘Notes on the Culture of Silk in Bengal’, in Transactions of Agricultural and Horticultural Society of India, vol. III. 1837, pp. 14-15. ১২৮০ টি গুটিপোকায় এক কাহন (kahan) বা ১৬ পণ। গোবর দিয়ে লেপে নিলে ডালাগুলি অনেক বেশি টিঁকত এবং গোবরের গন্ধে পোকামাকড়ও কম আসত।
১২. D. H. W. Speed, ‘Notes on the Culture of Silk’, pp. 22-23.
১৩. J. Geoghegan, Silk in India, pp. 6-7, 15-16.
১৪. Robert Orme, Historical Fragments, p. 412.
১৫. F. Buchanan, Bhagalpur, p. 613.
১৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 225.
১৭. B. M. Addl. Mss. 34,123; Wilson, Early Annals, vol. 1. p. 376.
১৮. C & B. Abstr., vol. 3, f. 337, para. 36, 26 Dec. 1733.
১৯. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, Consult. 23 Jan. 1744.
২০. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 299-303.
২১. BPC, Range 1, vol. 44, Annex. to Consult., 19 June 1769.
২২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 241, f.n. 82.
২৩. এ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়।
২৪. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 7, Consults., 19 Jan., 28 Feb. 1745.
২৫. Ibid, vol. 6, Consults., 10 March 1742; S. Chaudhury From Prosperity to Decline, p. 239.
২৬. John Taylor, ‘Dhaka Cloth Production’, Home Misc., 456F; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 145-46.
২৭. Om Prakash, European Commercial Enterprise, p. 174; Dutch Company, p. 217.
২৮. Factory Records, Kasimbazar, vol. 12, Consults, 7 Aug. 27 Aug. 1755.
২৯. Colebrook and Lambert, Remarks on Husbandry, p. 170.
৩০. BPC, Range 1, vol. 17, f. 66, 23 April 1744; Factory Records, Kasimbazar, vol. 6, 19 April 1744.
৩১. P. J. Marshall, Bengal, p. 66.
৩২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 208-210.
৩৩. K. N. Chaudhuri, Trading World; Om Prakash, Dutch Company: European Commercial Enterprise; P. J. Marshall, East Indian Fortunes; Bengal; C. A. Bayly, Indian Society.
৩৪. Niels Steensgaard, Asian Trade Revolution; Ashin Das Gupta, Indian Merchants and the Decline of Surat.
৩৫. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Table 8.2 and Table 8.3, pp. 251-52.
৩৬. Ibid, pp. 251-253; f. n. 114, p. 253.
৩৭. BPC, Range 1, vol. 44, Consults., 19 June 1769.
৩৮. William Bolts, Considerations, p. 200.
৩৯. Harry Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC, Range 1, vol. 24, f. 324.
৪০. Luke Scrafton, Reflections, p. 20.
৪১. Proceedings of the Board of Trade, 13 March 1791, quoted in N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, pp. 111-12.
৪২. Taillefert’s ‘Memorie’, HR. 246, f. 141, 17 Nov. 1763.
৪৩. O’Malley, Murshidabad District Gazetteer, p. 140; K. M. Mohsin, A Bengal District in Transition, pp. 74-75.
৪৪. Ibid., pp. 75-76.
০৮. সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে ওই অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কথা এসে পড়বে। এই সব দিকগুলির সম্যক বিশ্লেষণ প্রয়োজন কারণ আমরা দেখতে পাব, এই সব দিক থেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল বেশ কিছু বিশেষত্ব ও নতুনত্বের দাবি করতে পারে এবং সে দাবি খুবই যৌক্তিক। সপ্তদশ শতকে যে সব বৈশিষ্ট্য মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের তথা বাংলার ইতিহাসে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তাতে অনেক পরিবর্তন আসে। সেগুলি সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে প্রতিফলিত।
সমাজ
নবাবি যুগে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, বহু জাতি ও বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের সমাবেশ। এরকম ঠিক এর আগে কখনও দেখা যায়নি। মুর্শিদকুলি যখন ১৭০৪ সালে দেওয়ানি কার্যালয় ঢাকা থেকে সরিয়ে মখসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদে) নিয়ে আসেন তখন ওই দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মচারী মুর্শিদাবাদে চলে আসে, সঙ্গে আসে বেশ কিছু ব্যাঙ্কার-মহাজন ও সওদাগর—এদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ। তারপর যখন মুর্শিদকুলি ১৭১৬/১৭ সালে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হলেন এবং মুর্শিদাবাদই বাংলার নতুন রাজধানী হল, তখন ঢাকা থেকে সব রাজকর্মচারী এবং অমাত্য ও অভিজাতবর্গও মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস শুরু করল। এদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষ ছিল। তা ছাড়া নতুন সুযোগের সন্ধানে বহু ব্যবসায়ী-সওদাগর-মহাজনও ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মুর্শিদাবাদে আস্তানা করল। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আর্মানি বণিকগোষ্ঠী। এমন কী তারা মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে নিজেদের একটি উপনিবেশও (কলোনি) স্থাপন করে। মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনসংক্রান্ত সংস্কারের ফলে একদিকে যে নতুন এক বাণিজ্যিক শ্রেণি এবং অন্যদিকে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, তাদের অধিকাংশের আবাসস্থলও ছিল মুর্শিদাবাদ। তাছাড়া তখন বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রও ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে। তাই নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সমাজকে ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) বললে অত্যুক্তি হবে না।
বলা বাহুল্য, সামাজিক স্তরবিন্যাসে মুর্শিদাবাদের সমাজে সর্বোচ্চ ছিল অভিজাত শ্রেণি। মুর্শিদাবাদ সুবে বাংলার রাজধানী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদ অভিজাতবর্গ ও তাদের আশ্রিত ব্যক্তিদের বাসস্থল হয়ে ওঠে। রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নবাবদের নীতি ছিল দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিজাতদের আমন্ত্রণ করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা।১ তার সঙ্গে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যায়নের জন্য যে প্রচেষ্টা হয়েছিল, তাতে প্রায় সব নবাবই যুক্ত ছিলেন। ফলে অনেক অভিজাত ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে পদার্পণ করেন। এ সব নানা কারণে মুর্শিদাবাদে অভিজাত শ্রেণির বহু মানুষের সমাবেশ হয়। এই অভিজাতরা সাধারণত দুই সম্প্রদায়ের, হিন্দু ও মুসলমান। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়। বস্তুতপক্ষে, মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের মধ্যে শিয়াদেরই ছিল প্রাধান্য। ফারসি ইতিহাস তারিখ-ই-মনসুরীর লেখক মন্তব্য করেছেন: ‘in Murshidabad the Shias, are, by the blessing of God, the reigning sect’.২ অন্যদিকে মুর্শিদকুলি বাঙালি হিন্দু ছাড়া আর কাউকে রাজস্ববিভাগে নিযুক্ত করতেন না, ফলে প্রচুর হিন্দু রাজকর্মচারী মুর্শিদাবাদে বাস করত।৩ এ প্রসঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, মুর্শিদকুলির সংস্কারের ফলে যে নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় তাদের অধিকাংশই হিন্দু। তাই মুর্শিদাবাদের দরবারে হিন্দুদের যে বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।
মুর্শিদাবাদের সমাজে ও শ্রেণিবিন্যাসে অভিজাত শ্রেণির পরই ছিল ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার ও বাণিজ্যিক শ্রেণির স্থান। এদের অনেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে মুর্শিদাবাদের সমাজে জায়গা করে নিয়েছিল। ১৭৩০-এর দশকে নবাব সুজাউদ্দিনের সময় জৈন কবি নিহাল সিংহ মুর্শিদাবাদে আসেন এবং তাঁর ‘বংগাল দেশ কী গজল’ কবিতায় গঙ্গাতীরবর্তী রাজধানীর ও ব্যবসায়কেন্দ্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী-বাণিজ্যিক শ্রেণির পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন:৪
বসতী কাসমবাজার, সৈদাবাদ খাগড়া সার।
রহতে লোক গুজরাতীক, টোপীবাল জেতী জাতীক।
আরব আরমনী আংগরেজ, হবসী হুরমজী উলাংদেজ।
সীদী ফরাসীস আলেমান সৌদাগর মুর্গল পাঠান।।
শেঠী কুংপনী কী জোর দমকে লাগে লাখ কিরোর।
অর্থাৎ কবি নিহাল কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ ও খাগড়ায় বিভিন্ন বণিকগোষ্ঠীর উপস্থিতির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন কারণ এটা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। আর এই বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে হরেক দেশ ও জাতির লোক—গুজরাটি, আরব, আর্মানি, ইংরেজ, হাবসি, হুরমজি অর্থাৎ পার্সি, ওলন্দাজ (ডাচ), সিদ্দি, ফরাসি ও পাঠান-মোগল।
শুধু তাই নয়, সমসাময়িক ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও ফরাসি নথিপত্রেও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে বিভিন্ন প্রান্তের বহু সওদাগরগোষ্ঠীর কার্যকলাপের কথা সবিস্তারে বলা হয়েছে। ফরাসি সূত্র থেকে জানা যায় যে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে গুজরাটি, আর্মানি, মিরজাপুরি, গোরখপুরি প্রমুখ বণিকগোষ্ঠী খুবই সক্রিয় ছিল।৫ মুর্শিদাবাদের ‘পাচোত্রা’ দারোগার দপ্তরে শুল্ক জমার হিসেব থেকে দেখা যায়, লাহোর এবং মুলতান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা পণ্য রফতানি বাবদ শুল্ক জমা দিত।৬ ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস লিখেছেন:৭
A variety of merchants of different nations and religions, such as Cashmeerians, Multanys, Patans, Sheikhs, Sunniasys, Paggayahs, Betteas and many others used to resort to Bengal.
এই সব সওদাগরদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে তাদের বসতি স্থাপন করেছিল এবং স্থায়ীভাবেই এখানে বসবাস করত। বিশেষ করে যে সব সওদাগর পরিবার রাজস্থান, গুজরাট বা উত্তর ভারত থেকে আসত। তারা মুর্শিদাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত অনেক মারওয়ারি পরিবার। জগৎশেঠরা এসেছিল মারওয়ারের নাগর থেকে অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। মুর্শিদকুলির সঙ্গে এই পরিবারের মানিকচাঁদ মুর্শিদাবাদে আসেন এবং তারপর থেকে এঁরা মুর্শিদাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তেমনি দুধোরিয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হুজুরীমল কাপড়ের ব্যবসা করতে রাজস্থানের বিকানির থেকে এসে মুর্শিদাবাদে স্থায়ী আস্তানা করেন।৮ এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
এ সব বড় বড় সওদাগর ছাড়াও মুর্শিদাবাদে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব ছিল, যারা নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত। এরকম একটা গোষ্ঠী ‘সন্ন্যাসীরা’। এরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক। সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য অনুযায়ী (খুব সম্ভবত পলাশির সময়কার অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে) কয়েকশো সন্ন্যাসী মুর্শিদাবাদ থেকে মিরজাপুরে কাঁচা রেশম রফতানি করত এবং বছরে ওই রফতানির পরিমাণ ছিল এক হাজার মণ।৯ এর পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে অন্য একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দেখা মেলে— তারা হচ্ছে খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ী। মুর্শিদাবাদ একটি শহর, তাই তার বাসিন্দাদের জন্য প্রচুর খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হত। ১৭৮৩-৮৪ সালের একটি আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে রোজ ৫,০০০ হাজার মণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন ছিল।১০ তা যদি হয়, মধ্য অষ্টাদশ শতকে শস্যের চাহিদা আরও বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক কারণ ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের পর এবং কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ও কলকাতায় প্রায় সব অফিস-কাছারি নিয়ে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যা ১৭৮৩-৮৪ সালে বেশ কমে যায়। যা হোক, আমাদের আলোচ্য সময়ে দৈনিক ৫,০০০ মণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হত ধরে নিলেও এই বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত বিশেষ একটি গোষ্ঠী—যারা খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল। সে হিসেবে মুর্শিদাবাদে এদের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল।
এই খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে নীচে উদ্ধৃত একটি বর্ণনা পাওয়া যায়:১০
All the grain business is carried on by four tribes, the Cuyar, Buccali, Ujinea and Moorcha. They are managed by a few of the most rich and opulent of each tribe and no instance will ever occur of their underselling each other or ever deviating from the plans of combination
ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির নাম দেখে অনুমান করা যায় যে এরা মূলত রাজস্থানের বাসিন্দা ছিল। ‘মুরচা’ ও ‘কুয়ার’রা সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম রাজস্থানের শৈখাবতীর লোক, ‘উজিনিয়ারা’ উজ্জয়নের ব্রাহ্মণ। ওপরের উদ্ধৃতি থেকে খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলি হল, এদের গোষ্ঠীগত সংহতি এবং গোষ্ঠীগুলির ওপর দলপতি বা সর্দারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা। এরা খাদ্যশস্য মজুত করত ভগবানগোলাতে—সেখানে তাদের অনেকগুলি গোলা ছিল। বলা বাহুল্য, সুযোগ বুঝে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিলে, ব্যবসায়ীরা শস্যের দাম বাড়িয়ে দিত এবং প্রচুর মুনাফা করে নিত।১১
মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ীরা একটি মিশ্র বা ‘হেটেরোজেনাস’ গোষ্ঠী—এদের মধ্যে একদিকে বড় বড় সওদাগর, ব্যাঙ্কার, অন্যদিকে ছোটখাট ব্যবসায়ী, যাদের মধ্যে খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ী, সন্ন্যাসী ও ছোট ছোট ব্যাপারী (peddlers) সবাই ছিল। ব্যাঙ্কার মহাজনদের মধ্যে বাঙালি, অবাঙালি সবাই অন্তর্ভুক্ত। অবাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে গোষ্ঠী, জ্ঞাতি এবং জাতপাতের প্রশ্ন বড় করে দেখা যেত। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল ওসওয়াল (Oswal) সম্প্রদায়ের জৈন। এদের কাজ কারবার দেখার জন্য এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর লোকদেরই নিযুক্ত করত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জগৎশেঠরা। শেঠদের গোমস্তারা সবাই তাঁদের নিজেদের আত্মীয়, জ্ঞাতি বা সম্প্রদায়ের লোক।১২ এটা অবশ্য আর্মানিদের ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে প্রযোজ্য। তারা নিজেদের আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোক ছাড়া কাউকেই প্রায় গোমস্তা বা এজেন্ট নিযুক্ত করত না। বাংলায় আর্মানিদের কাজকর্মের বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।১৩ সামাজিক দিক থেকে এ সব ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করত। এদের বিয়ে, সাদি, সামাজিক মেলামেশাও নিজেদের গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, ধর্মীয় ব্যাপারে তো বটেই। সবাই প্রায় নিজেদের মহল্লাতেই বসবাস করত।
অভিজাত শ্রেণি, ব্যবসায়ী-সওদাগর ছাড়া মুর্শিদাবাদের অন্য যারা বাসিন্দা, তাদের মধ্যে অন্যতম, যারা বৃত্তিমূলক (professional) কাজে নিযুক্ত ছিল। আবার এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শাসন, রাজস্ব ও আইন বিভাগে মাঝারি ও নীচের দিকের কর্মচারী। মুর্শিদাবাদ নিজামতে, দেওয়ানিতে, সদর দেওয়ানি আদালতে, ফৌজদারি আদালতে এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরে মাঝারি ও নিম্নস্তরে বহু কর্মচারী নানা পদে অধিষ্ঠিত ছিল। সাধারণভাবে বেশির ভাগ দপ্তরেরই প্রধান পদে মুসলমান কর্মচারী, বাকি সব পদে বেশিরভাগই হিন্দু কর্মচারী থাকত। কবি ভারতচন্দ্র নবাব ও রাজাদের দরবারের নিচুতলার কর্মচারী ও বিভিন্ন বৃত্তিধারী লোকজনের তালিকা দিয়েছেন। তাতে বৈদ্য, হস্তগণনাকারী, লেখক, খাজাঞ্চি, উকিল, ‘বাজে জমি’ দপ্তরের প্রধান, সময়রক্ষক, নাকিব, এমন সব বৃত্তিমূলক ব্যক্তির নাম আছে। এদের স্ত্রীরা এদের সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে এদের বেশির ভাগই হিন্দু।১— এই তালিকা থেকে অনুমান করা যায় যে পেশাদারি লোকদের আয় ও তাদের সামাজিক মর্যাদায় বেশ তারতম্য ছিল।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত বহু লোকের আবাস ছিল মুর্শিদাবাদে। এদের মধ্যে বৈদ্য ও কবিরাজরা সমাজে বেশ মর্যাদা ভোগ করত। উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারীদের কাছে এদের খুব কদর ছিল এবং মুসলমান হেকিমের চেয়ে এদের চিকিৎসার ওপর তাদের ভরসা ছিল অনেক বেশি।১৫ এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের সমাজে হিন্দু পুরোহিত, মুসলমান মোল্লা, মৌলভি ও অন্যান্য ধর্মগুরুরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন খান লিখেছেন যে মুর্শিদাবাদের নবাবরা এদের মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস করার জন্য আহ্বান জানাতেন এবং তাদের নানারকম উপহার ও সুযোগ সুবিধা দিতেন।১৬ ভারতচন্দ্র তার সময়কার বাদশাহি/রাজকীয় নগরীর অধিবাসীদের পেশাগত যে বর্ণনা দিয়েছেন, মুর্শিদাবাদ সম্বন্ধে তা প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন:১৭
কায়স্থ বিবিধ জাতি দেখে রোজগারি।
বেনে মণি গন্ধসোনা কাঁসারি শাঁখারি।।
গোয়ালা তামুলী তিলি তাঁতী মালাকার।
নাপিত বারুই কুরী কামার কুমার।।
আগরি প্রভৃতি আর নাগরী যতেক।
যুগি চাষা ধোবা চাষা কৈবৰ্ত্ত অনেক।।
সেকরা ছুতার নুড়ী ধোবা জেলে গুঁড়ী।
চাঁড়াল বাগদী হাড়ী ডোম মুচী শুঁড়ী।।
কুরমী কোরঙ্গা পোদ কপালি তিয়র।
কোল কলু ব্যাধ বেদে মালী বাজিকর।।
এ ছাড়া অবশ্য দিনমজুর ও অন্য খেটেখাওয়া মানুষও ছিল মুর্শিদাবাদে। মনে হয় কাজকর্মের সন্ধানে এরা আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকেই আসত। নবাবের সৈন্যবাহিনীতে প্রচুর সাধারণ সৈন্যও ছিল। নবাবি আমলে অনেক স্থানীয় ব্যক্তিকেও সৈন্যবাহিনীতে নেওয়া হত। রিয়াজের লেখক জানিয়েছেন যে আলিবর্দির যে সব সৈন্যের মুর্শিদাবাদে বাড়ি তারা ঘরে ফেরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকত। সুতরাং আমরা বলতে পারি মুর্শিদাবাদের সমাজে অভিজাত থেকে শুরু করে সাধারণ স্তরের মানুষও পাশাপাশি বাস করত এবং সমাজ ছিল বহু জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বীর এক সংমিশ্রণ।
অর্থনীতি
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ উন্নত ছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সপ্তদশ শতকে, বিশেষ করে এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বাংলা থেকে দিল্লি, আগ্রা ও উত্তর ভারতের অন্যত্র যে ধন নিষ্ক্রমণ হত, তা নবাবি আমলে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। মুর্শিদকুলি আসার আগে পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, সবাই মুঘল বাদশাহি পরিবারের লোক বা মুঘল দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বলেই ওই পদে নিযুক্ত হতেন। সুবাদার শাহ সুজা (১৬৩৯-৬০) ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র। আরেক সুবাদার, শায়েস্তা খান (দুবার, ১৬৬৪-৭৮ এবং ১৬৭৯-৮৮) ছিলেন সম্রাট ঔরংজেবের পিতৃব্য এবং অন্য এক সুবাদার আজিম-উস-শান (১৬৯৭-১৭১২) ছিলেন ঔরংজেবের পৌত্র। অন্য সুবাদাররাও অনেকেই মুঘল দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এঁরা, বিশেষ করে মুঘল পরিবারের সদস্যরা, বাংলা ছাড়তে চাইতেন না কারণ এখানে ধনসম্পদ আহরণের অফুরন্ত সুযোগ। তাই মুঘলনীতির ব্যতিক্রম করে তাঁরা তিন বছরের অনেক বেশি সময় বাংলায় সুবাদার হিসেবে থেকে গেছেন। এঁরা বাংলা থেকে যে ধনসম্পদ আহরণ করতেন তার সবটাই প্রায় বাংলার বাইরে দিল্লি, আগ্রা ও উত্তর ভারতে নিয়ে যেতেন। ফলে বাংলা থেকে এই ধন নিষ্ক্রমণের ধারা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই সব সুবাদার, মনসবদাররা কী পরিমাণ ধন আহরণ করে বাংলার বাইরে নিয়ে যেতেন তার একটা ধারণা করা যেতে পারে কয়েকজনের দৃষ্টান্ত থেকে। শায়েস্তা খান ১০ বছরে ৯ কোটি টাকা, খান জাহান বাহাদুর খান এক বছরে ২ কোটি এবং আজিম-উস-শান ৯ বছরে ৮ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন।১৮
নবাবি আমলে বাংলা, অবশ্যই মুর্শিদাবাদ থেকে, এই বিপুল ধন নিষ্ক্রমণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর সুবাদাররা দিল্লি থেকে নিযুক্ত মনসবদার নন, মুর্শিদকুলি বাংলায় প্রায় স্বাধীন নিজামত প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিল্লি থেকে বাংলায় মুঘল মনসবদার বা অন্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠানও এখন বন্ধ হয়ে গেল। স্থানীয় বাসিন্দারাই এখন নিজামতের সব পদে নিযুক্ত হল। ফলে বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের প্রশ্নই রইল না। নবাবরা বা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা বাংলায় ধন আহরণ করা বন্ধ করে দিলেন ঠিক তা নয়। যা ধনসম্পদই তাঁরা আহরণ করে থাকুন না কেন, তা বাংলাতেই থেকে গেল, তাতে বাংলার ধনসম্পদই বৃদ্ধি পেল। ১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত নবাবরা বাংলা থেকে প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার মতো রাজস্ব দিল্লিতে পাঠাতেন। তা ছাড়া বাংলার প্রায় সব নবাবই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে মুর্শিদাবাদে নানা প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধিভবন প্রভৃতি নির্মাণ করেন। এ সবকিছু করেও নবাবরা যে পরিমাণ ধনসম্পদ সঞ্চয় করেছিলেন, তা দেখে অবাক হতে হয়।
পলাশিতে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাভূত করে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদের কোষাগারে গিয়ে নবাবের সঞ্চিত ধনসম্পদ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র সোনা-রুপো নিয়ে ওখানে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টাকা। ক্লাইভ লিখেছেন যে নবাবের কোষাগারে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখলেন, সোনা ও হিরে-জহরত দুধারে স্তূপীকৃত হয়ে আছে।১৯ আমরা আগেই বলেছি, তারিখ-ই-মনসুরীর লেখক জানিয়েছেন যে নবাবের হারেমে লুকোনো যে ধনসম্পদ ছিল, সোনা, রূপো, হিরে, জহরত মিলে তার মূল্য কম করে ৮ কোটি টাকা।২০ আর মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুসারে, সিরাজদ্দৌলা ঘসেটি বেগমকে মোতিঝিল প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করে সেখান থেকে হীরে জহরত বাদ দিয়েই নগদ ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১ কোটি টাকা মূল্যের সোনা, রুপোর নানা বাসনপত্রও সিরাজ মোতিঝিল থেকে উদ্ধার করেছিলেন।২১ এসব তথ্যে হয়তো কিছুটা অত্যুক্তি আছে কিন্তু তা হলেও এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
নবাব, মনসবদার বা অন্যান্য অভিজাতবর্গ শুধু নয়, নবাবি আমলে ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগর প্রভৃতি শ্রেণি প্রচুর ধনসম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় করেছিল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে তাঁরা ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠেন। তাঁদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা, আর ব্যবসার মূলধনই ছিল কম করে ৭ কোটি টাকা, কারও কারও মতে ১৪ কোটি টাকা।২২ জগৎশেঠরা ছাড়াও মুর্শিদাবাদে তখন আরও দু’জন বণিকরাজা ছিলেন, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ। এঁদের সম্পদের বা সঞ্চিত অর্থের কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তা যে বেশ ভাল পরিমাণের হবে সেটা অনুমান করা যায়। কারণ উমিচাঁদ সোরা, আফিং-এর প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করতেন। তা ছাড়াও ছিল তাঁর টাকা লেনদেনের ব্যবসা। খোজা ওয়াজিদ বিহারের অর্থনীতি প্রায় কব্জা করে নিয়েছিলেন, সোরা এবং আফিং-এর ব্যবসাও ছিল তাঁর কুক্ষিগত। এ ছাড়া তিনি সমুদ্রবাণিজ্যেও লিপ্ত ছিলেন, তাঁর কমপক্ষে ৬টি বাণিজ্যতরী ছিল। এ সব তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে মুর্শিদাবাদের বণিকরাজারা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন।
বণিকরাজারা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে বহু ব্যাঙ্কার-মহাজন, সওদাগর এসে ভিড় জমিয়েছিল। নবাবি আমলে এখানকার কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তুঙ্গে। এ সব পণ্যের চাহিদা শুধু ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে নয়, ইউরোপেও ছিল প্রচুর। ফলে শিল্পবাণিজ্যের তখন রমরমা। জৈন কবি নিহাল সিংহ লিখেছেন, বালুচরে কাঁসার হাট বসে, সেখানে অনেক রকম ভাল ভাল বাসন বিক্রি হয়। বহু ঘর তাঁতিরও বাস সেখানে, তারা নানারকমের কাপড় বোনে। কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ ও খাগড়ায় অনেক লোকের বাস, বিভিন্ন দেশের, জাতির ও ধর্মের। রেশমের ও রেশমি বস্ত্রের কারবার জমজমাট। দিল্লির সঙ্গেই যেন মুর্শিদাবাদ টেক্কা দেয়—‘জৈসা দিল্লিকা বাজার, তৈসা চৌক গুলজার’।২৩ বাজারে টাকার অঢেল আমদানি, ধারের কোনও অসুবিধেই নেই। বাজারে যে টাকার অভাব নেই, টাকার আমদানি যে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা ১৭৪০ সালের একটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি তাদের রফতানি পণ্য কেনার জন্য বাংলার টাকার বাজার থেকে প্রায়ই টাকা ধার করতে বাধ্য হত এবং তারা ধার করত প্রধানত জগৎশেঠদের কাছ থেকে। সুদের হার ছিল শতকরা ১২ টাকা। এ হার কমাবার জন্য কোম্পানিগুলি অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিফল হয়। ১৭৪০ সালে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠদের কুঠিতে গিয়ে সুদের হার কমাবার জন্য আবার অনুনয় বিনয় করে। জগৎশেঠ সেটা মঞ্জুর করেন এবং পরের দিন থেকে সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে নেমে শতকরা ৯ টাকা হয়ে যায়। এটা টাকার বাজারে জগৎশেঠদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ সন্দেহ নেই। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয় তখন বোধ হয় বাজারে টাকার আমদানি ছিল প্রচুর, ধার সহজলভ্য। তাই হয়তো জগৎশেঠরা এক কথায় সুদের হার কমিয়ে দেন।২৪
এ প্রসঙ্গে নবাব আলিবর্দির সময়, ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত, প্রায় প্রতি বছর যে মারাঠা আক্রমণ হয়েছে, মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতিতে তার কতটা প্রভাব পড়েছিল তা আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা আগেই বলেছি, মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল এমন বক্তব্য সঠিক বলে মনে হয় না। অর্থনীতি যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা সাময়িক এবং কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ। এর কোনও দীর্ঘকালীন প্রভাব মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতিতে পড়েনি। মারাঠারা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়, মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট পথেই বাংলায় লুঠতরাজ করতে আসত। ওই সব অঞ্চলের কৃষক-তাঁতি-কারিগর প্রমুখ বর্ষার আগে, মারাঠারা চলে গেলে, নিজেদের কাজকর্ম শুরু করে দিত আবার শীতকালে, মারাঠারা আসার আগে, তাদের ফসল/উৎপাদন সব গুছিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেত। মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় মারাঠা আক্রমণের ভয়ে জগৎশেঠ ও অন্যান্য ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগররা কিছুদিন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতেন এবং মারাঠাদের মুর্শিদাবাদ আক্রমণের সম্ভাবনা চলে গেলে আবার তাঁরা মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতেন। মাঝে মাঝে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বাজারে টাকার অভাব দেখা দিত কিন্তু সেটা একেবারেই সাময়িক। জগৎশেঠ এবং অন্যান্যরা মুর্শিদাবাদে ফিরে এলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার রমরমা দেখা দিত, বাজারে টাকারও কোনও অভাব থাকত না। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে মারাঠা আক্রমণের ফলে যে কোনও অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়নি তার প্রমাণ, এ সময়েও ওই অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচা রেশম ও রেশমি কাপড় রপ্তানি হয়েছিল। যে অর্থনীতিতে ওই পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হতে পারে, তা মারাঠা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছিল এ কথা বলা যায় না।২৫
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সাধারণ লোকের অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল মনে হয়। প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায়, এবং মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে কাঁচা রেশম ও রেশমি কাপড়ের ব্যবসার জন্য ওই অঞ্চলে কাজকর্ম এবং আয়ের পথও বেশ সুগম হয়। তা ছাড়াও নবাবদের নানা স্থাপত্যকর্মের ফলে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়। আসলে মুর্শিদকুলি অভিজাতবর্গ, দেশি সওদাগর, বিদেশি বণিক, হিন্দু কর্মচারী ও জবরদস্ত জমিদারদের সামলে ও তাদের নিয়ে বাংলায় নিজামতের যে কাঠামোটি তৈরি করেন এবং পরে অন্য নবাবরা যেটা বজায় রেখেছিলেন তাতে সলিমুল্লা, গোলাম হোসেন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা সুবে বাংলাকে ‘দার-উল-আমন’ বলতে দ্বিধা করেননি। আর এই ‘দার-উল-আমনে’র রাজধানী হিল মুর্শিদাবাদ। হয়তো সাধারণ লোকের কথা ভেবেই মুর্শিদকুলি বাংলা থেকে চাল রফতানি বন্ধ করে দেন এবং সে কারণেই সম্ভবত চালের দাম অনেক কমে যায় ও তাতে সাধারণ মানুষের খুব সুবিধা হয়। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন বলেছেন এ সময় মুর্শিদাবাদে চালের দাম ছিল টাকায় ৫ থেকে ৬ মণ, যদিও সলিমুল্লা লিখেছেন, টাকায় ৪ মণ। সে অনুপাতে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ছিল সস্তা। ফলে, গোলাম হোসেন সলিম জানাচ্ছেন, তখন মাসে এক টাকা খরচ করলেই লোকে পোলাও, কালিয়া খেতে পারত। এটা হয়তো অত্যুক্তি, যদিও এ থেকে অনুমান করা যায় যে সাধারণ লোকের অবস্থা বেশ স্বচ্ছলই ছিল।২৬
নবাব সুজাউদ্দিনের সময়েও মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নতই ছিল। সিয়রের লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন খান সুজাউদ্দিনের শাসনকাল সম্বন্ধে লিখেছেন যে বাংলা তখন ‘came to enjoy so much prosperity as to exhibit everywhere an air of plenty and happiness’.২৭ ১৭৮৯ সালে ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ববিভাগের কর্মচারী, জন শোর (John Shore), মন্তব্য করেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষ কয়েকবছর বাদ দিয়ে মুর্শিদকুলি থেকে মীরকাশিমের রাজত্বকালের মধ্যে, একমাত্র সুজাউদ্দিনের সময়েই দেশের উন্নতিসাধন করাটা মুর্শিদাবাদের নিজামতের প্রধান লক্ষ্য ছিল।২৮ কবি নিহাল সিংহ এই সময় মুর্শিদাবাদে আসেন এবং সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে পৌরাণিক রাম রাজ্যের লক্ষণ দেখতে পান: ‘নাহি জোর অর জুলম্যাঁন, নাঁহি বাটমৈ বটপার, নাঁহি চোর চেটকবার।’ তাই সকল প্ৰজাই সুখী। দুঃখীর দেখা পাওয়াও ভার হয়ে ওঠে। ‘ইহবিধ রহৈ রেয়ত সুখী, দেখা কোউ নাঁহি দুঃখী’।২৯
নবাব আলিবর্দি খানের আমলে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিছুটা ব্যাহত হয়েছিল সন্দেহ নেই তবে সেটা সাময়িক। ১৭৫১ সালে মারাঠাদের কাছ থেকে শান্তি কেনার পর আলিবর্দি সর্বশক্তি ও মনপ্রাণ দিয়ে রাজ্যের উন্নতিসাধনে উঠে পড়ে লাগেন। তিনি যে এ কাজে যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে মুর্শিদাবাদ শহরের বিস্তৃতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে দেখা যায়। মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি লিখেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষদিকে মুর্শিদাবাদ শহর প্রচুর বিস্তার লাভ করে— দৈর্ঘ্যে ২৪ মাইল, প্রস্থে ১৪ মাইল তখন শহরের আয়তন। তা ছাড়াও অনেক ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার শহরের প্রান্তে তাদের বাগানবাড়ি তৈরি করে।৩০ নগরায়ণের এই যে চিত্র, তা থেকে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পলাশির পর রবার্ট ক্লাইভ প্রথম মুর্শিদাবাদ দেখে বিস্ময়ে হতবাক। তিনি মন্তব্য করেছেন যে মুর্শিদাবাদ লন্ডনের মতোই বিরাট, প্রচুর লোকবসতি এবং লন্ডনের মতোই ধনী শহর। তফাত শুধু এই যে লন্ডনের চেয়ে মুর্শিদাবাদে অনেক বেশি ধনী লোক যাদের ধনসম্পদ লন্ডনের যে কোনও ধনী বাসিন্দার চাইতে অনেক অনেক বেশি।৩১
সংস্কৃতি ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদকে বহু জাতি, বিভিন্ন র্ধম ও বর্ণের মানুষের মিলনক্ষেত্র বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। মুর্শিদাবাদে প্রথম দেওয়ানি ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ মুর্শিদাবাদে এসে ঠাঁই নেয়। আবার মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ায় বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের সওদাগর-ব্যাঙ্কার-মহাজন এসে ভিড় জমায় এখানে। এদের মধ্যে একদিকে যেমন ছিল হিন্দু-জৈন ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগর, অন্যদিকে তেমনই দেখা যায় তার সঙ্গে ছিল শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়। এরকম একটি জায়গায় বহু জাতি, বহুবর্ণ ও বহু ধর্মাবলম্বীর সমাবেশ ইতিহাসে খুবই বিরল। এর জন্য অবশ্য মূলত মুর্শিদাবাদের নবাবদের উদারনীতিই অনেকটা দায়ী। সব ধর্ম ও জাতি সম্পর্কে সহনশীলতা ও উদারতা মুর্শিদাবাদের নবাবদের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। ফলে মুর্শিদাবাদে নবাবদের আমলে যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দেখা যায়, তা যে কোনও শহরের পক্ষেই গর্বের বিষয়।
আসলে মুর্শিদকুলির সময় থেকে মুর্শিদাবাদের নবাবরা উদারতা ও সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেন। হয়তো তাঁদের ধারণা ছিল এতেই রাষ্ট্রের মঙ্গল ও উন্নতি হবে। তাই নিজেরা শিয়া মুসলমান হয়েও সুন্নি মুসলমান, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তাঁরা কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করেননি। মুর্শিদকুলির সময় থেকেই হুগলি ও মুর্শিদাবাদ শিয়াদের বড় উপনিবেশ হয়ে ওঠে। বাংলায় জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদ জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও মুর্শিদকুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। মূলত তাঁরই আকর্ষণে মানিকচাঁদ তাঁর সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। পলাশির আগে পর্যন্ত এই জগৎশেঠ পরিবারই মুর্শিদাবাদ নিজামতের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও হিতাকাঙক্ষী বলে পরিচিত ছিল। আবার মুসলমান হয়েও মুর্শিদকুলি শাসনবিভাগের প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে রাজস্ববিভাগে, হিন্দুদেরই নিয়োগ করেছিলেন। এর পেছনে হয়তো তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের স্বার্থ—রাজস্ব আদায়ে যাতে কোনও রকমের গাফিলতি না হয়। কিন্তু তা হলেও এর ফলে নবাবি আমলে একটি ধারার (tradition) সৃষ্টি হয়— হিন্দুরা শুধু সাধারণ কর্মচারী নয়, অনেক উচ্চপদেও নিযুক্ত হয়। বলতে গেলে নবাবি আমলে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রে হিন্দুদেরই ছিল প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য।
তা বলে মুর্শিদাবাদে শুধু শিয়া, সুন্নি বা হিন্দুদের বাস ছিল তা নয়। ছিল আরও অনেক জাতি ও ধর্মের মানুষের। আমরা আগেই বলেছি, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আরব, আর্মানি, ইংরেজ, হাবসি, পার্সি, ওলন্দাজ, সিদ্দি, ফরাসি, পাঠান, মোগল, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, লাহোরি, মুলতানি— সবাই এসে জড়ো হত নানা কাজে, ব্যবসায় কেনাবেচা করতে, বিশেষ করে রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করতে। ফলে এত বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লোক পাশাপাশি থাকার ফলে পরস্পরের মেলামেশা ও আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটি ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) সংস্কৃতির উদ্ভব হয় মুর্শিদাবাদে। একদিকে হিন্দু ও জৈন মন্দির, মুসলমান মসজিদ অন্যদিকে আর্মানি ও খ্রিস্টানদের গির্জা—সবকিছুর সহাবস্থান। কবি নিহাল সিংহ লিখেছেন, মুর্শিদাবাদে ভাল ভাল দেবমন্দির ও ধর্মশালা আছে, তার গা ঘেঁষেই উঠেছে সুন্দর সব মসজিদ ও মিনার। অসংখ্য যতী, যোগী, ভক্ত, প্রভৃতি নানা বেশে এখানে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।৩২
আছ দেহরে পোষাল, সিবকৈ ধাম অরু ধ্রুমশাল,
মসজিদ মুনারে মকাম, ক্যা ক্যা বনৈ হৈ কমঠান,
জোগী জতী নাথ অলেখ, জংগম ভকত নানা ভেখ?
এদিকে ধর্মনিষ্ঠ নবাব মুর্শিদকুলি শহরে মাদ্রাসা ও বাজার বা কাটরা পাশাপাশি খুলে দেন। নবাবি মুর্শিদাবাদে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আরাধনা একসঙ্গে শুরু হয়। উৎসবের দিনে মাহিনগর, লালবাগ প্রভৃতি এলাকায় প্রজানির্বিশেষে খাওয়ানো, দান খয়রাত চলত, এলাকাগুলিও জমজমাট হয়ে পড়ত। আরেকদিকে নবাব সাহেব নিজের হাতে কোরান নকল করতেন আর সেই কোরান বিলি করা হত নামজাদা জায়গায়—মক্কা, মদিনা ও কারবালায়, এবং বাংলার পাণ্ডুয়ায়, গাজিসাহেবের আস্তানায়। নিজে শিয়া হয়েও মুর্শিদকুলি সুন্নি আলিমদের সঙ্গে ‘বহস’ করতে ভালবাসতেন। সব মিলে মুর্শিদাবাদ সব ধর্ম ও সংস্কৃতির এক মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এ ধারা পলাশি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের নানা পালাপর্বণ, উৎসব, সমারোহে বিভিন্ন ধর্ম সংস্কৃতির সমন্বয় চোখে পড়ে। মহরমের সময় ভাটিয়ালি গায়করা শোকগাথা গাইত।৩৩ শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা একই মসজিদে পাশাপাশি নমাজ পড়ত। হিন্দুদের হোলি উৎসবে মুসলমানরাও যোগ দিত। শুধু সাধারণ প্রজা নয়, নবাবরাও হোলি উদযাপন করতেন। নবাব শহমৎ জঙ্গ (ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান) শওকত জঙ্গের (তিনি তখন পাটনা থেকে এসেছিলেন) সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেন। এমন কী সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) সম্পাদন করেই তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে তাঁর প্রাসাদ হীরাঝিলে হোলির উৎসবে মেতে ওঠেন।৩৪ শুধু তাই নয়, নবাবরা প্রচুর অর্থব্যয় করে হিন্দুদের দেওয়ালি উৎসবও পালন করতেন।৩৫ মুর্শিদাবাদে মারাঠাদের তৈরি মন্দিরের পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল আলিবর্দির মসজিদ। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বরানগরের মন্দিরচত্বর এবং মাস্তিরাম আওলিয়ার আখড়া সামনাসামনি অবস্থান করছিল। এই এলাকাতেই রানি ভবানী শ্যাম রায়ের মন্দির তৈরি করেন। বেরাভাষা বলে মুর্শিদাবাদের শিয়াদের একটি প্রাচীন উৎসব আসলে হিন্দুদের গঙ্গাপূজার মুসলিম সংস্করণ।৩৬
হিন্দু মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেও মুর্শিদাবাদে সম্প্রীতি বজায় ছিল। নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদে এদের মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। এই দুই সম্প্রদায় বাংলায় বহুদিন ধরে সৌহার্দ্যের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। এডওয়ার্ড সি. ডিমক [Edward C. Dimmock, Jr.] একটি মননশীল প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষে’র পরিচয় পাওয়া যায় না।৩৭ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এ সময় মুসলমানরা হিন্দুমন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে সিন্নি দিচ্ছে— এটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম আর সংস্কৃতির মিলন প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র জন্ম— যে ‘দেবতা’ হিন্দু মুসলমান উভয়েরই উপাস্য। কবি ভারতচন্দ্রের ‘সত্যপীর’ কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।৩৮ মুর্শিদকুলির সমসাময়িক রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘সত্যনারায়ণ’ কাব্যে ‘এরপর আমি রহিম এবং রাম দুজনের উপাসনাই করব। রাম এবং রহিম ঈশ্বরের দুই নাম—মক্কাতে তিনি রহিম আর অযোধ্যায় রাম’৩৯ এমন কথা আছে। এরকম অভিব্যক্তিই দেখা যায় মধ্য-অষ্টাদশ শতকের মুসলিম কবি ফৈজুল্লা’র সত্যপীর কবিতায়— ‘যে রাম, সেই রহিম’।৪০ ভারতচন্দ্রেও প্রায় তারই অনুরণন: ‘পুরানের মত ছাড়া কোরাণএ কি আছে। ভাবি দেখ আগে হিন্দু মুসলমান পাছে।’৪১ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মুর্শিদাবাদের নাগরিক জীবনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. রিয়াজ-উস-সলাতিন, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations in the Town of Murshidabad’, Indian Historical Review, 1976, p. 313.
২. তারিখ-ই-মনসুরী, Journal of the Asiatic Society of Bengal, pt. 1, (1869), p. 100.
৩. সলিমুল্লা, তারিখ-ই-বংগালা, f. 36-37, quoted in Abdul Karim, Murshid Quli, p. 68.
৪. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩১০৷
৫. L’Achney to Chevalier, 27 May 1768, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 315.
৬. Ibid., p. 315.
৭. William Bolts, Considerations, p. 200
৮. J. H. T. Walsh, History of Murshidabad, p. 246.
৯. সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবৃতি, Board of Trade—Commercial, 13 March 1789, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 323.
১০. Pott’s letter to Governor General, 12 Feb., 15 Feb., Board of Revenue, quoted in Gautam Bhadra, Ibid., p. 323. পট এরকম বর্ণনা লেখেন ১৭৮৮ সালে কিন্তু এটা তিন চার দশক আগের অবস্থা সম্বন্ধেও সমান প্রযোজ্য কারণ এইটুকু সময়ের ব্যবধানে অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়েছিল বলে মনে হয় না।
১১. Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 324.
১২. জগৎশেঠদের জন্য দেখুন, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 109-116.
১৩. আর্মানিদের জন্য, S. Chaudhury, ‘Trading Network of a Traditional Diaspora— Armenians in Bengal Trade, c. 1600-1800’, paper presented at the XIIIth International Economic History Congress, Buenos Aires, July 2002.
১৪. ভারতচন্দ্র, গ্রন্থাবলী, পৃ. ২৮৮-৯২।
১৫. Tapan Raychaudhuri, Bengal under Akbar and Jahangir, p. 198.
১৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭০
১৭. ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, পৃ. ২২৯।
১৮. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 413; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 210, 239, 247.
১৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126-এ উদ্ধৃত।
২০. তারিখ-ই-মনসুরী, trans. H. Blockmann, JAS, no. 2, 1867, pp. 95-96.
২১. মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 72.
২২. Willam Bolts, Considerations, p. 158; J. H. Little, Jagatseth, p. XVII.
২৩. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩১০।
২৪. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 112.
২৫. Ibid, pp. 112-13; 299-302.
২৬. রিয়াজ, পৃ. ২৮০-৮১
২৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ ২৮০।
২৮. Minute of Sir John Shore, W. K. Firminger, ed., Fifth Report, vol. II p. 9.
২৯. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩০৭।
৩০. মুজাফ্ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 58.
৩১. J. H. little, House of Jagatseth, p. 2.
৩২. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬, ৩০৯।
৩৩. তারিখ-ই-মনসুরী, Journal of the Asiatic Society of Bengal, pt. 1 (1869), pp. 100-111.
৩৪. Karam Ali, Mazaffarnamah, ff. 86a-86b; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 49, 72.
৩৫. সিয়র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৪, Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’ p. 335-এ উদ্ধৃত।
৩৬. তারিখ-ই-মনসুরী, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 335.
৩৭. Edward C. Dimmock, K, Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, p. 2.
৩৮. D. C. Sen, Bengali Language, pp. 396-97; ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা।
৩৯. রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য, সত্যনারায়ণ, এন. এন. গুপ্ত সম্পাদিত, পৃ. ১১।
৪০. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।
৪১. ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, পৃ. ৪০২।
০৯. স্থাপত্য
বাংলার স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুর্শিদকুলি যখন ঢাকা থেকে মখসুদাবাদে তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করেন ও মখসুদাবাদের নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ, তখনও সেটা ছিল প্রায় অজ গ্রাম। কিন্তু বিভিন্ন শাসন দপ্তরের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘরবাড়ি, অফিস কাছারি নির্মাণ শুরু হয়ে যায় প্রথম থেকেই। তারপর মুর্শিদাবাদ যখন বাংলার রাজধানী হল তখন এসব নির্মাণ কার্য আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মুর্শিদাবাদের সব নবাবই নানারকমের ইমারত, প্রাসাদ, মসজিদ তৈরি করতে ভালবাসতেন এবং এটা তাদের প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। তাই মুর্শিদকুলি থেকে আরম্ভ করে সুজাউদ্দিন, আলিবর্দি, এমন কী সিরাজদ্দৌল্লাকে নানারকমের স্থাপত্যকর্ম নির্মাণ করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, এই ধারা মীরজাফর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল যার প্রমাণ মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগমের তৈরি স্থাপত্যগুলি। পরের নবাবদের মধ্যেও কেউ কেউ এটা বজায় রেখেছিলেন। এ সব নির্মাণ কার্যে নবাবদের মানসিকতাই শুধু সাহায্য করেনি, তাঁদের যে অফুরন্ত ধনসম্পদ ছিল তা এসব কাজের খুবই সহায়ক হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরা শুধু নতুন নতুন ভবন ও উদ্যান তৈরি করে মুর্শিদাবাদকে সুন্দর করার চেষ্টা করেননি। নিজামতের কর্মচারী, শ্রেষ্ঠী ও অমাত্যবর্গও প্রাসাদ, ভবন, বাগানবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, প্রভৃতি নির্মাণ করে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তাই এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের মতে মুর্শিদাবাদ কখনও কখনও ভারতের রাজধানী দিল্লিকেও হার মানাত।১ কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নবাবি আমলের স্থাপত্যগুলি আজ বেশিরভাগই প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
মুঘল যুগে বাদশাহি স্থাপত্যের শিল্পশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট নির্দশন দেখা যায় ঢাকায়। কিন্তু এই শিল্পরীতি যানবাহন ও যাতায়াতের অসুবিধের জন্য, এবং স্থাপত্যকর্মীর অভাবে বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করেনি। তাই বাংলার বেশির ভাগ অঞ্চলেই প্রাক-মুঘল যুগের স্থাপত্যশৈলীই অনুসৃত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে কিছু কিছু অঞ্চলে, যেখানে মুঘল শাসন বেশ কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মুঘল শৈলী অনুসরণ করে প্রাসাদ ও ভবন নির্মাণ করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে মুঘল শৈলীর সঙ্গে স্থানীয় শৈলী ও শিল্পরীতির সংমিশ্রণও হয়েছে। কিছু কিছু স্থাপত্যে প্রাক-মুঘল যুগের ইটের দেওয়ালে খচিত শৈলীর নিদর্শনের পাশাপাশি মুঘল শৈলীর নিদর্শন— যেমন গম্বুজও, দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যশিল্পে এই সংমিশ্রণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এখানে আমরা নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট স্থাপত্যগুলির পর্যালোচনা করব।
কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যকর্মের অন্যতম নিদর্শন কাটরা মসজিদ। নবাব মুর্শিদকুলি খান ১৭২৩ সালে এটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং শরীর ভেঙে গেছে বুঝতে পেরে তিনি নিজের সমাধি নির্মাণ করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তাতে একটি মসজিদ ও কাটরা বা বাজারও থাকবে। এই কাটরা বা বাজার থেকেই ‘কাটরা মসজিদ’ নাম। সমাধি, মসজিদ ও কাটরা স্থাপনের জন্য শহরের পূর্বদিকে খাস তালুকের কাছের একটি স্থান বেছে নেওয়া হয়। মোরাদ ফরাস নামে একজন সাধারণ অথচ বিশ্বস্ত কর্মচারী এই কাজের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হন। প্রচলিত ভাষ্য অনুযায়ী মোরাদ কাছাকাছি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সে সব উপকরণ দিয়ে সমাধি ভবন তৈরি করেন। সলিমুল্লার তারিখ-ই-বংগালা গ্রন্থে হিন্দু মন্দির ভাঙার কথা থাকলেও গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস-সলাতিনে কিন্তু এটা নেই। মন্দির ভেঙে সেসব জিনিস দিয়ে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি বিখ্যাত রাধামাধবের হিন্দু মন্দির ও অন্য কয়েকটি মন্দিরের খরচপত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এ ছাড়া কাটরা মসজিদের নির্মাণে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলি সব একই রকমের। বিভিন্ন মন্দির ভেঙে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা হলে তাতে এরকম মিল বা সঙ্গতি থাকত না।২
কাটরা মসজিদ একটি চতুর্ভুজাকৃতি উঁচু প্রাঙ্গণে অবস্থিত। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৪০ ফুট, প্রস্থ ২৫ ফুট আর এতে ৫টি গম্বুজ ছিল। মুর্শিদকুলির নির্দেশমতো মসজিদের দরজায় সিঁড়ির নীচে একটি ছোট ঘর তৈরি করা হয়। এখানেই মুর্শিদকুলিকে সমাধিস্থ করা হয়। মসজিদের দরজায় যেতে গেলে চৌদ্দটি বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয়। দরজা পার হয়ে প্রায় ১২০ ফুট দূরে মসজিদ। গম্বুজগুলি ধাতু দিয়ে তৈরি। মসজিদের দরজায় খুব বড় কালো পাথরের তৈরি চৌকাঠ। ভেতরের দিকে একটি বৃহৎ কক্ষ। তার দেওয়ালের চারদিকে ধনুকাকৃতি খিলান (arch) তির্যকভাবে অবস্থিত। মসজিদ এবং চত্বরের চতুর্দিকে দোতলায় অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষ যেখানে মুর্শিদকুলির সময় সাতশো’ ‘করি’ বা কোরান পাঠক কোরান পাঠ করত। মসজিদের সঙ্গে মিনার, চৌবাচ্চা এবং ইঁদারাও তৈরি করা হয়।
অনেকে মনে করেন যে কাটরার মসজিদ ঢাকায় তৈরি মুর্শিদকুলির মসজিদের, যা ‘করতলব খানের মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত, অনুকরণ।৩ আবার কেউ কেউ বলেন যে এটি মক্কার মসজিদের অনুকরণে তৈরি।৪ আবার মসজিদের ভেতরের বৃহৎ কক্ষের দেওয়ালে তির্যকভাবে তৈরি যে সব ধনুকাকৃতি খিলান (arch), এই শৈলী দক্ষিণ ভারতীয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তবে এটা হয়তো ঠিক নয় কারণ এই বিশেষ শৈলী মুঘল যুগের বাংলায় খুবই প্রচলিত ছিল।৫
কাটরা মসজিদের সঙ্গে জাহানকোষা নামক কামানের নাম যুক্ত হয়ে আছে। কাটরার পূর্বদিকে একটি অশ্বত্থ গাছের দুটি কাণ্ডের মাঝখানে এই কামান রক্ষিত বলে বোধহয়। এখানেই মুর্শিদকুলির কামানগুলিও রাখা হয় বলে জানা যায়। সে জন্য এ জায়গাটিকে আজও সাধারণ লোকেরা তোপখানা বলে। জাহানকোষা কামানটি লম্বায় প্রায় ১২ হাত, বেড় তিন হাতেরও বেশি। এর মুখের বেড়টি ১ হাতের ওপর। আগুন লাগার ফুটোটির ব্যাস দেড় ইঞ্চি। কামানটি মুঘল সম্রাট শাজাহানের রাজত্বকালে ইসলাম খাঁর সুবাদারির সময় জাহাঙ্গিরনগরের (ঢাকা) দারোগা শের মহম্মদের নির্দেশে ও হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দন কর্মকার নামক শিল্পী নির্মাণ করেন। এটির ওজন ২১২ মণ, এতে বারুদ লাগে ২৮ কিলো।৬
মুবারক মঞ্জিল
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন দক্ষ কিন্তু আয়েসি ও শৌখিন লোক। শহর মুর্শিদাবাদের রাজসিক বোলবোলাও তাঁর আমলেই বাড়ে। নিত্যনতুন প্রাসাদ নির্মাণ করা তাঁর হবি ছিল। কুচ করে যেখানে তিনি আসতেন, সেখানে মহল তৈরি করতেন, নাম দেওয়া হত মুবারক মঞ্জিল। মুর্শিদকুলির তৈরি ‘চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদ’ বা চেহেল সুতুনে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে নারাজ ছিলেন। ঘরগুলো বাড়িয়ে তিনি এই প্রাসাদের রদবদল করেন। সরকারি নানা বিভাগের জন্য বাড়িঘর তৈরি হয়— দিওয়ানখানা, খিলাতখানা, ফরমান বাড়ি, খালসা কাছারি, আরও কত কী! শুধু তাই নয়, মুর্শিদকুলির আমলের রাজস্ববিভাগের নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী নাজির আহমেদ মুর্শিদাবাদের অদূরে ভাগীরথীর তীরে দাহাপাড়াতে যে মসজিদ ও উদ্যান নির্মাণ শুরু করেছিলেন, সুজাউদ্দিন তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাবার পর অসমাপ্ত মসজিদ ও উদ্যানের কাজ সম্পূর্ণ করেন। সেখানেও তিনি প্রাসাদ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন এবং তার নাম দেন ফর্হাবাগ বা ফররাজবাগ (আনন্দ-উদ্যান)। এখানে তিনি সারা বছর পিকনিক ও নানা রকমের আনন্দ উৎসব করতেন আর বছরে একবার তাঁর দরবারের উচ্চপদস্থ ও শিক্ষিত কর্মচারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করতেন।৭
মোতিঝিল
মোতিঝিলের বিখ্যাত প্রাসাদের নির্মাতা নবাব আলিবর্দি খানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিস মহম্মদ খান ওরফে শহমত জঙ্গ, আলিবর্দির দুহিতা ঘসেটি বেগমের স্বামী। মোতিঝিল অর্থাৎ Lake of Pearls— মুক্তোর ঝিল। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের প্রাসাদের দেড় মাইল দক্ষিণ পূর্বে এই সুন্দর জায়গাটির অবস্থান দেখে এবং অশ্বপদাকৃতি ঝিল এর তিনদিক ঘিরে থাকায় নওয়াজিস মহম্মদ এখানে তাঁর নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তিনি ঢাকার শাসনকর্তা বা ছোট নবাব পদে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আলিবর্দি খান যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকতেন তখন মুর্শিদাবাদ রক্ষা করার ভার তাঁর বেগম ও নওয়াজিসের ওপরই থাকত। তাই তিনি বেশির ভাগ সময়েই মুর্শিদাবাদে থাকতেন। তাঁর বিশ্বস্ত সহকারী হোসেন কুলি খানের ওপর ঢাকার শাসনভার ন্যস্ত থাকত। নওয়াজিস অত্যন্ত বিলাসী ও আমোদপ্রিয় লোক ছিলেন। মুর্শিদাবাদের মধ্যে নিজের বাসভবনে সব সময় থাকতে তাঁর ভাল লাগত না। তাই ১৭৪৩ সালে তিনি মোতিঝিলের প্রাসাদ নির্মাণ করেন।৮ পরে প্রাসাদের পশ্চিম দিকে তোরণদ্বার নির্মাণ করে তাকে সুরক্ষিত করেন। তারই কাছে ১৭৫০/৫১ সালে একটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও অতিথিশালাও নির্মিত হয়। মসজিদ ও অতিথিশালার জন্য নওয়াজিস প্রচুর অর্থব্যয় করতেন।৯
বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের বহু ভগ্নস্তূপ থেকে মার্বেল ও অন্যান্য জিনিসপত্র এনে মোতিঝিলের প্রাসাদ তৈরি করা হয়। প্রাসাদটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত, ভাগগুলি (চত্বর) পরস্পরের অল্প ব্যবধানে। প্রত্যেকটি ভাগ দুটি বৃহৎ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রাচীরগুলি প্রত্যেক দিকেই ঝিলের জল স্পর্শ করত। নওয়াজিস মোতিঝিলের প্রাসাদেই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। গান, বাজনা, নানা বিলাসবহুল প্রমোদ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। নানা নর্তকী ও বাইজি এনে এখানে তিনি মজলিস বসাতেন এবং আত্মীয়পরিজন নিয়ে এখানে থাকতেই তিনি ভালবাসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ঘসেটি বেগম সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে মোতিঝিলেই বাস করতে থাকেন। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে ঘসেটি বেগমকে বিতাড়িত করে মোতিঝিল দখল করেন এবং সব ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন।১০
মোতিঝিল প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা জড়িয়ে আছে।১১ ১৭৫৭ সালে সিরাজদ্দৌল্লা মোতিঝিল থেকেই পলাশি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন বলে যে অভিমত, তা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ তখন তিনি নিজের প্রাসাদ হীরাঝিলেই থাকতেন। ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলার দেওয়ানি হস্তান্তর করার জন্য নবাবের সঙ্গে আলোচনা করতে এসে মোতিঝিলে ছ’দিন কাটিয়েছিলেন। আবার কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার পর ১৭৬৬ সালের এপ্রিল মাসে ক্লাইভ এখানে এসেছিলেন এবং এ প্রাসাদেই কোম্পানি প্রথম পুণ্যাহ করে। এ উৎসবে নবাব নজমদৌল্লা যথোচিত পোশাক পরিচ্ছদ পরে মসনদে বসেছিলেন, পাশে দেওয়ানের (কোম্পানির) প্রতিনিধি রূপে ক্লাইভ। উপস্থিত ছিলেন জগৎশেঠ, রেজা খান ও মুর্শিদাবাদের অমাত্য ও অভিজাতবর্গ। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন নবাব নাজিমের দরবারে কোম্পানির রাজনৈতিক এজেন্ট ছিলেন (১৭৭১-৭৩), তখন তিনি মোতিঝিলের প্রাসাদেই থাকতেন। মোতিঝিলে শেষ পুণ্যাহ হয় ১৭৭২ সালে। তারপরেই রাজস্ব বিভাগ কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। মোতিঝিল কোম্পানি বাগ নামেও পরিচিত কারণ এটা বেশ কিছুদিন কোম্পানির দখলে ছিল। ১৮৭৬ সালে এটা আবার নবাবকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।১২
হীরাঝিল
হীরাঝিলের প্রাসাদ নির্মাণ করেন সিরাজদ্দৌল্লা। তখনও তিনি যুবরাজ, নবাব হননি। ফর্হাবাগ থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে মাইল খানেক দূরে, জাফরাগঞ্জের উল্টোদিকে এই প্রাসাদ। মুঘল সম্রাট শাজাহানের মতো সিরাজদ্দৌল্লারও সৌন্দর্যপ্রীতি ছিল এবং সেজন্যই তিনি এই প্রাসাদ তৈরি করেন বলে মনে করা হয়। প্রাসাদের সঙ্গে তিনি একটি কৃত্রিম ঝিলও তৈরি করেন, ঝিলের নাম হীরাঝিল (Lake of Diamonds)। ঝিলের নাম অনুসারে প্রাসাদের নাম হয় হীরাঝিল প্রাসাদ। ঝিলের দু’দিক পাথর দিয়ে বাঁধানো। গৌড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে নানা রকম পাথর এনে এই ভবন তৈরি হয়। এটি প্রধানত ইঁট দিয়ে তৈরি কিন্তু জায়গায় জায়গায় পাথর বসিয়ে সিরাজ এর সৌন্দর্যবৃদ্ধির চেষ্টা করেন। প্রাসাদের একটি অংশ এমতাজ মহল। এটা এত বিশাল ছিল যে এতে তিনজন ইউরোপীয় ‘নরপতি’ থাকতে পারতেন বলে অনেকের ধারণা।১৩
কথিত আছে যে সিরাজদ্দৌল্লা যখন প্রাসাদটি তৈরি করছিলেন তখন একদিন নবাব আলিবর্দি সপারিষদ এটি দেখতে আসেন। তিনি যখন বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন তখন সিরাজ তাঁকে একটি প্রকোষ্ঠে বন্ধ করে রাখেন এবং নবাবকে জানান যে তিনি মুক্তি পেতে পারেন যদি হীরাঝিল প্রাসাদের নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে ও তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেন। বৃদ্ধ নবাব বরাবরই সিরাজকে আস্কারা দিয়ে এসেছেন, এবারও তাকে বিমুখ করলেন না। তিনি এ-বাবদ সিরাজকে হীরাঝিলের কাছেই একটি বাজার বা গঞ্জ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিলেন। গঞ্জ থেকে বার্ষিক আয় হত ৫ লক্ষ টাকার ওপর। সিরাজের নাম মনসুর-উল-মুলক থেকে এ গঞ্জের নাম হয় মনসুরগঞ্জ। হীরাঝিলের প্রাসাদকেও অনেকে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ বলে উল্লেখ করে থাকেন।১৪
হীরাঝিলের প্রাসাদ তৈরি হওয়ার পর সিরাজদ্দৌল্লা সেখানেই বাস করতে থাকেন। নবাব হওয়ার পরেও তিনি কেল্লায় না থেকে হীরাঝিল থেকেই রাজকার্য চালাতেন। এই প্রাসাদের সঙ্গে বহু স্মৃতি বিজড়িত। এখানেই তিনি বিখ্যাত সুন্দরী ও নর্তকী ফৈজিকে এনে আমোদপ্রমোদে মত্ত হন। পরে ফৈজির বিশ্বাসঘাতকতায় নিদারুণ আঘাত পেয়ে তাঁকে প্রাসাদের একটি কক্ষে বন্ধ করে রাখেন, সেখানে তাঁর মর্মন্তুদ মৃত্যু হয়। আবার এই প্রাসাদেই সিরাজ তাঁর প্রিয়তমা পত্নী লুৎফুন্নেসার সঙ্গে বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি পলাশি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন আবার পলাশিতে পর্যুদস্ত হয়ে এখানেই ফিরে এসে লুৎফুন্নেসা ও শিশুকন্যাকে নিয়ে রাত্রের অন্ধকারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। সিরাজের পালানোর খর পেয়ে মীরজাফর হীরাঝিলের প্রাসাদ দখল করেন। এদিকে ক্লাইভ এসে মোরাদবাগে আস্তানা নেন। তারপর হীরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদেই মীরজাফরের রাজ্যাভিষেক হয়। প্রাসাদের বিশাল হলে ক্লাইভ মীরজাফরের হাত ধরে এনে মুর্শিদাবাদের তখ্ত মোবারকে বসালেন। মসনদে বসিয়ে ক্লাইভ তাঁকে এক পাত্র মোহর নজরানা দিলেন। তারপর দরবারের অমাত্য ও অভিজাতবর্গ নতুন নবাবকে নজরানা দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
হীরাঝিল প্রাসাদের ধনাগারে সিরাজদ্দৌল্লার কী পরিমাণ ধনরত্ন সঞ্চিত ছিল তার একটা ধারণা করা যেতে পারে মীরজাফর, ক্লাইভ প্রমুখ যখন সেই ধনাগার লুণ্ঠন করেন, তা থেকে। লুণ্ঠনের সময় মীরজাফর, ক্লাইভ ছাড়াও ওয়ালস, ওয়াটস, লাশিংটন, দেওয়ান রামচাঁদ এবং মুন্সি নবকৃষ্ণ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, সিরাজের এই কোষাগারে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা, ৩২ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্দুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স অলঙ্কারের ব্যবহারোপযোগী হিরে, জহরত ও ২ বাক্স অখচিত চুনী, পান্না প্রভৃতি দামি পাথর ছিল। এ অনুমান হয়তো অত্যুক্তি কিন্তু কিছুটা যে সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ ছাড়াও কেউ কেউ বলেন যে হীরাঝিল প্রাসাদের অন্তঃপুরে আরেকটি লুকোনো ধনাগার ছিল এবং তাতে ৮ কোটি টাকার মতো ধনরত্ন সঞ্চিত ছিল। এর খবর ইংরেজরা পায়নি। এই ধন মীরজাফর, তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী আমির বেগ খান, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এটাও নেহাৎ আজগুবি গল্প নয়। কারণ যে রামচাঁদ পলাশি যুদ্ধের সময় মাসিক ৬০ টাকা বেতনে কাজ করতেন, দশ বছর পরে তিনি মারা যাওয়ার সময় তাঁর নগদ ও হুণ্ডিতে ৭২ লক্ষ টাকা, ৪০০টি বড় বড় সোনার ও রুপোর কলসি থাকার উল্লেখ দেখা যায়। তার মধ্যে ৮০টি সোনার, বাকি রুপোর। তা ছাড়াও তাঁর ১৮ লক্ষ টাকার জমিদারি ও ২০ লক্ষ টাকার জহরতও ছিল। নবকৃষ্ণ সে সময় মাসিক ৬০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন কিন্তু তিনি নাকি তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগমও খুব সম্ভবত এই লুঠের টাকাতেই অগাধ সম্পদের মালিক হন। তাঁর যাবতীয় হিরে, জহরত এই লুণ্ঠন থেকেই পাওয়া।১৫ নবাব হয়ে মীরজাফর প্রথমে হীরাঝিল প্রাসাদেই থাকতেন। কিছুদিন পর তিনি ভাগীরথীর পূর্ব তীরে কেল্লার মধ্যে আলিবর্দির ভবনে চলে আসেন।
ইমামবারা-মদিনা
মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত স্থাপত্য ইমামবারা নির্মাণ করেছিলেন সিরাজদ্দৌল্লা। মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের কাছেই উত্তরদিকে সিরাজ ইমামবারার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কথিত আছে যে তিনি নিজের মাথায়/হাতে করে ইট, পাথর বয়ে এনে ইমামবারার কাজ শুরু করেন। কারও কারও মতে নির্মাণকার্যে শুধু মুসলমান কারিগর ও শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়েছিল, হিন্দুদের নয়। ইমামবারার মাঝখানে ‘মদিনা’। মদিনার জন্য ৬ ফুটের মতো জমি খুঁড়ে তাতে মক্কা (কারও কারও মতে কারবালা) থেকে আনা মাটি দিয়ে ভর্তি করা হয়। তার ওপরে ছোট চতুষ্কোণ একটি ভবন তৈরি করা হয়। তাতে একটি গম্বুজ ও চারটি ছোট মিনার। মহরমের সময় সারা দিন রাতই মদিনাতে কোরান পাঠ করা হত। উত্তর ও দক্ষিণের ঘরগুলো গুদাম ঘর ও কর্মশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত। মহরমের সময় কয়েকশো লোক রাত্রে ইমামবারা ও মদিনাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত থাকত। ওই সময় প্রত্যেকটি কক্ষেই ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়াল বাতি প্রভৃতি জ্বালানো হত, এবং তাতে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হত। সিরাজদ্দৌল্লা বহুমূল্য বস্ত্রাদি দিয়ে ইমামবারা ও মদিনা সাজিয়েছিলেন। পরে নবাব মীরকাসিম নগদ টাকার জন্য সব বিক্রি করে দেন। সিরাজের সাধের ইমামবারাটি ১৮৪২ সালে বাজি পোড়ানোর সময় পুড়ে যায়। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও ১৮৪৬ সালে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। রক্ষা পায় শুধু মদিনা।১৬
রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন সলিম ইমামবারা দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন:১৭
Its praise is beyond description; its equal is not to be found in the whole of Hindustan. Although at present one-tenth of it does not exist, yet a remnant of it is a fair specimen of the original edifice.
মুর্শিদাবাদের বর্তমান ইমামবারাটি ১৮৪৮ সালে তখনকার নিজামতের দেওয়ান সৈয়দ সাদিক আলি খানের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়। এটি আগের ইমামবারার সামান্য উত্তর দিকে। পুরনো মদিনা যথাস্থানেই রাখা হয়। নতুন ইমামবারাতে একটি নতুন মদিনা তৈরি করা হয়। নতুন ইমামবারা তৈরি করতে ৬ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হয়। এটি লম্বায় ৬৮০ ফুট, প্রস্থে নানা জায়গায় বিভিন্ন মাপের হলেও মাঝখানে ৩০০ ফুট। এটি তৈরি করতে ১১ মাস মাত্র সময় লেগেছিল। সাদিক আলি খান পেশায় ইঞ্জিনিয়ার না হলেও পুরো নির্মাণ কার্যের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। সব কারিগর ও শ্রমিকদের মজুরি ছাড়াও খাবার দেওয়া হত যাতে তারা দিনরাত কাজ করতে পারে। ইমামবারা তৈরি হওয়ার পর সব কর্মীকেই শাল, দোশালা প্রভৃতি পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। ফলে একেক সময় মুর্শিদাবাদের অলিতে গলিতে এসব বহুমূল্য পোষাক পরা লোকদের খুবই দেখা যেত।১৮
খোশবাগ
ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে লালবাগের কাছে দক্ষিণ দিকে যে উদ্যান বাটিকা তার নাম খোশবাগ অর্থাৎ সুখস্বর্গ (garden of happiness)। এই উদ্যান আসলে একটি সমাধি ক্ষেত্র। এই সমাধিক্ষেত্রে আলিবর্দি, সিরাজদ্দৌল্লা, লুৎফুন্নেসা বেগম এবং সম্ভবত আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার সমাধিও অবস্থিত। নবাব আলিবর্দি তাঁর জননীকে সমাধিস্থ করার জন্য এই উদ্যান তৈরি করেন। খোশবাগের সমাধিভবনে প্রধানত দুটি চত্বর— প্রথমটি প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু, দ্বিতীয়টি প্রথমটির পশ্চিম দিকে। এই দ্বিতীয় চত্বরে প্রবেশ করার জন্য আরও একটি প্রবেশদ্বার। প্রাচীর বেষ্টিত এই সমাধি স্থানটির উত্তর দিকে একটি উঁচু স্থানে ১৭টি সমাধি আছে। মূল সমাধি গৃহের মধ্যস্থলে সাদা ও কালো পাথরের তৈরি যে সমাধি, সেটি নবাব আলিবর্দির। তার পূর্বদিকে সিরাজদ্দৌল্লার সমাধি। পলাশির যুদ্ধে পরাভূত সিরাজকে হত্যা করে তার ছিন্নভিন্ন দেহ হাতির পিঠে মুর্শিদাবাদ প্রদক্ষিণ করাবার পর এখানে এনে সমাধিস্থ করা হয়। সিরাজের সমাধির দক্ষিণে তাঁর পায়ের নীচে তাঁর প্রিয়তমা বেগম লুৎফুন্নেসার সমাধি।
আলিবর্দি তাঁর জননীর মৃত্যুর পর এই সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করে এই উদ্যানবাটিকার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভাণ্ডারদহ ও নবাবগঞ্জ নামক দুটি গ্রামের থেকে প্রাপ্য রাজস্ব বরাদ্দ করেন। এর পরিমাণ ছিল মাসিক ৩০৫ টাকা। সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর অন্যান্য বেগমদের সঙ্গে লুৎফুন্নেসাকেও ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়। সেখানে ৭ বছর কাটাবার পর অনেকটা ক্লাইভের বদান্যতায় তাঁকে মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানো হয় এবং কিছুদিনের মধ্যে খোশবাগের সমাধি ক্ষেত্র তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। এর জন্য তিনি মাসিক ৩০৫ টাকা করে পেতেন। লুৎফুন্নেসার জীবিতাবস্থাতেই তাঁর কন্যা উম্মত জহুরার মৃত্যু হয়। সেজন্য লুৎফুন্নেসার মৃত্যুর পর উম্মত জহুরার কন্যা খোশবাগ সমাধিক্ষেত্রের তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব তাঁদের ওপর দেওয়ার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে আর্জি পাঠান। হেস্টিংস তা মঞ্জুর করেন। তাঁদের মৃত্যুর পর সেই বংশের লোকরা খোশবাগের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায়।১৯
ফর্হাবাগ, রোশনিবাগ
নবাব সুজাউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন, বিলাসপ্রিয় ও সৌন্দর্যের ভক্ত। তাই মুর্শিদকুলির তৈরি প্রাসাদ চেহেল সেতুন বা অন্যান্য স্থাপত্যে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। নিজের পছন্দমতো বহু স্থাপত্য, উদ্যান ইত্যাদি তৈরি করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি বোধ হয় ফর্হাবাগ বা সুখকানন। এটি মুর্শিদাবাদের দাহাপাড়াতেই, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে, রোশনিবাগের কিছুটা উত্তরে। এই বাগানটি ও তাতে একটি মসজিদ প্রথম তৈরি করতে শুরু করেন মুর্শিদকুলির নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী এক কর্মচারী—নাজির আহমেদ। সুজাউদ্দিন নবাব হয়ে নাজিরের মৃত্যুদণ্ড দেন কিন্তু ওই বাগান ও মসজিদের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন। ফর্হাবাগের সৌন্দর্যকরণে সুজা কোনওরকম কার্পণ্য করেননি। মসজিদ ছাড়াও এখানে নানা সুন্দর প্রমোদ অট্টালিকাও তিনি তৈরি করেন। বাগানে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হয়। অসংখ্য ফোয়ারা এ বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।২০
ফর্হাবাগের কাছেই রোশনিবাগ বা আলোর উদ্যান (garden of light)। এটি নবাব সুজাউদ্দিনের সমাধি। রোশনিবাগ উদ্যানের সামনে নবাবরা আলোকোৎসব করতেন বলে এর নাম রোশনিবাগ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। রোশনিবাগের বর্তমান সমাধিভবনের উত্তরদিকে এর প্রবেশদ্বার। সেটি অতিক্রম করে কয়েক পা গেলে সুজাউদ্দিনের সমাধি। প্রায় ৩ হাত উঁচু একটি বিশাল ভিতের ওপর সমাধিটি। পুরনো সমাধিটি ধ্বংস হয়ে গেলে নতুন সমাধিটি তৈরি হয়। সমাধিভবনটির দৈর্ঘ্য ১৪ হাত, প্রস্থ ১৩ হাত। মুর্শিদাবাদে এত বড় সমাধি আর একটিও নেই।২১
জাফরাগঞ্জ
জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ ভাগীরথীর তীরে, মুর্শিদাবাদ কেল্লা থেকে আধ মাইল উত্তরে অবস্থিত। মীরজাফর মসনদে বসার আগে এখানেই থাকতেন। তাই এটি মীরজাফরের প্রাসাদ হিসেবেও পরিচিত। সম্ভবত তাঁর নাম অনুসারেই এর নাম জাফরাগঞ্জ। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে এর নামকরণ হয় মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলি জাফর খানের নাম অনুসারে। সে যাই হোক, মীরজাফর নবাব হওয়ার পর মনসুরগঞ্জে সিরাজদ্দৌল্লার হীরাঝিল প্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র মীরণকে জাফরাগঞ্জের ভবন দিয়ে দেন। এই জাফরাগঞ্জেই সিরাজকে হত্যা করা হয়, এটিই সিরাজের বধ্যভূমি। তাই যে ভবনে সিরাজের নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়, তাকে মুর্শিদাবাদবাসীরা ‘নেমকহারামের দেউরি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এই প্রাসাদেই ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফর ও মীরণের গুপ্তসন্ধি হয় এবং ওয়াটস বোরখা পরে লুকিয়ে পাল্কি করে এখানে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে আসেন। জাফরাগঞ্জেই মীরজাফর, মীরণ ও মীরজাফরের বংশধরদের সমাধি। মীরজাফর পত্নী মুন্নি বেগমের সমাধিও এখানে।২২
জগৎশেঠের প্রাসাদ
জগৎশেঠদের প্রাসাদ ছিল মহিমাপুরে। এখন তার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অথচ জগৎশেঠদের এই প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ইতিহাসের বহু স্মরণীয় ঘটনা বিজড়িত। এই প্রাসাদে বসেই বাংলায় দু-তিনটে রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিকল্পনা করা হয়েছিল কারণ শেঠরা ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব ছিল না। পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজদের পক্ষে ওয়াটস ও ওয়ালস চুক্তির শর্তানুযায়ী কী ভাবে টাকাপয়সার লেনদেন হবে তা নিয়ে মীরজাফর ও দুর্লভরামের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় বসেন এই প্রাসাদেই। কয়েকদিন পরে আবার ক্লাইভ, ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্টন, মীরণ, দুর্লভরাম মীরজাফরকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসেন এবং জগৎশেঠের সামনে লেনদেন সম্পর্কে কথাবার্তা পাকা করেন। উমিচাঁদ তাঁর অংশ প্রাপ্তির আশায় ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। সভা শেষ হলে ক্লাইভ স্ক্র্যাফ্টনকে জানালেন যে এবার উমিচাঁদকে প্রতারণার কথা ফাঁস করা যেতে পারে। স্ক্র্যাফ্টন বাইরে এসে উমিচাঁদকে দেশীয় ভাষায় জানান যে লাল কাগজের চুক্তিটি জাল, তিনি নবাবের ধনসম্পদের কিছুই পাচ্ছেন না। এতে নাকি উমিচাঁদ মুর্ছা যান এবং তিনি পাগল হয়ে যান। তবে আমরা দেখিয়েছি যে এটা মোটেই সঠিক নয়।২৩
এ ছাড়া, মুর্শিদাবাদে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন। চকবাজারে এটি তৈরি করা হয় বলে একে চক মসজিদ বা মুন্নি বেগমের মসজিদও বলা হয়। সৈয়দাবাদের আর্মানিরা ১৭৫৮ সালে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। তখনই এটি তৈরি করতে খরচ হয় ২ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা। এর পূর্বদিকে আরেকটি গির্জা তৈরি হয়েছিল ১৬৬৫ সালে। সেটি নষ্ট হয়ে গেলে নতুন গির্জাটি তৈরি হয়। হীরাঝিলের কাছে ছিল মোরাদবাগ প্রাসাদ। পলাশির যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে এসে ক্লাইভ এখানে অবস্থান করেন এবং মীরণ এসে তাঁকে মনসুরগঞ্জ বা হীরাঝিলের প্রাসাদে মীরজাফরের কাছে নিয়ে যান। ওয়ারেন হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ দরবারে ইংরেজ প্রতিনিধি হয়ে আসার পর মোরাদবাগের প্রাসাদেই থাকতেন। বাংলার ইংরেজ গভর্নর ভ্যানসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে মীরকাশিমকে নবাব করবার জন্য যখন মুর্শিদাবাদে আসেন, তিনিও তখন এই প্রাসাদে ওঠেন।২৪
সবশেষে, হাজারদুয়ারি। এই ইমারতটি অবশ্য স্বাধীন নবাবি আমলের নয়। তা হলেও মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের কথা বলতে গেলে হাজারদুয়ারির কথা বাদ দেওয়া যায় না। এটিই মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইমারত। তাই খুব সংক্ষেপে এটির একটু বিবরণ দিচ্ছি। ভাগীরথীর তীরে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের এই বিশাল প্রাসাদ। ইতালীয় ভাস্কর্যের অনুকরণে এটির নকশা করেন ‘বেঙ্গল কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর জেনারেল ডানকান ম্যাকলিয়ড (Duncan Mcleod)। তাঁর তত্ত্বাবধানে এটির নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। ১৮২৯ সালে এর ভিত্তি স্থাপন হয় এবং নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয় ১৮৩৭ সালে। এটি ত্রিতল ইমারত, শীর্ষে একটি গম্বুজ দিয়ে পরিবৃত। এর হাজারটি দরজা বলে নাম হাজারদুয়ারি। যে চত্বরে এটি অবস্থিত তার নাম নিজামত কিল্লা। এর মধ্যে প্রাসাদ ছাড়াও ইমামবারা, মদিনা, ঘড়িঘর, তিনটি মসজিদ এবং অনেকগুলি কক্ষ।২৫
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৮
২. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 172-73.
৩. Ibid., p. 172.
৪. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 276.
৫. Ibid.
৬. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ২৩।
৭. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৩।
৮. O’ Malley, Bengal Distict Gazetteers, Murshidabad, pp. 209-10.
৯. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৬-৯৭।
১০. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 186-87; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৫-৯৯।
১১. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 188.
১২. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০০; P. C. Majumdar, Musnad of Murshidabad, pp. 188-89;
১৩. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 206; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০৫.
১৪. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, pp. 277-78.
১৫. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০৭-১০৮; P. C. Majumdar, Musnud, pp. 207-208; A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, pp. 277-78.
১৬. A. C. Campbell, Glimpses of Bengal, pp. 333-34; J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District, pp. 44-45; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 118-19.
১৭. রিয়াজ, পৃ. ২৮-২৯।
১৮. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 120-21.
১৯. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৪৩-৫০; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 198-99; A. H. Dani, Muslim Architecture in Begal, p. 277.
২০. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৫-৭৬।
২১. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 199; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ২৫-২৮।
২২. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 277; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৫৩-৫৪।
২৩. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 153: S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 119-20.
২৪. J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District, p. 75; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 208, 233.
২৫. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 273.
১০. উপসংহার / নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
স্বাধীন নবাবি আমল মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কী ঐশ্বর্যে, আঁকজমকে, রাজনৈতিক স্থিরতায়, শিল্পবাণিজ্যের অগ্রগতিতে, শান্তিশৃঙ্খলায়, সাংস্কৃতিক বিকাশে মুর্শিদাবাদ এইসময় উন্নতির চরম শীর্ষে পৌঁছেছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে যখন অস্তমান মুঘল সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চলই রাজনৈতিক অরাজকতা ও অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ে বিপর্যস্ত, তখন কিন্তু এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাংলা তথা রাজধানী মুর্শিদাবাদ। এই সময় বাংলার নবাবদের পরিচালনায় একটি সুস্থ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল এবং সব নবাবই— মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত সবাই— সেটি যথাযথভাবে রূপায়িত করেন। ফলে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল, কোনও অস্থিরতা ছিল না, অরাজকতাও নয়। মুর্শিদাবাদের নবাবরা এমন রাজনৈতিক ও আর্থিক নীতি অনুসরণ করেন যাতে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়, রাজনৈতিক স্থিরতা বজায় থাকে ও আর্থিক অগ্রগতি হয়। এই উন্নতিতে অবশ্য মুর্শিদাবাদের নবাবদের সঙ্গে হাত মেলায় শাসক শ্রেণির ওপরতলার একটি গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে নবাবদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। বস্তুতপক্ষে বাংলার পূর্বতন রাজধানী ঢাকা বা এমনকী প্রাচীন রাজধানী গৌড়েও বোধহয় নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদের মতো সব স্তরে এতটা শ্রীবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়াতেই মুঘল সম্রাট ঔরংজেব মহম্মদ হাদি নামক তাঁর এক বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মচারীকে, যিনি তখন হায়দরাবাদের দেওয়ান ছিলেন, দেওয়ান করে ও করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে বাংলায় পাঠান। উদ্দেশ্য, করতলব বাংলার রাজস্ব বিভাগকে সুবিন্যস্ত করে বাংলা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করবেন এবং তা নিয়মিত ঔরংজেবকে দাক্ষিণাত্যে পাঠাবেন। বৃদ্ধ সম্রাট তখন দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে কুড়ি বছর ধরে জর্জরিত ও আর্থিক অনটনে ব্যতিব্যস্ত। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই তাঁকে রাজস্ব পাঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অসহায় ঔরংজেবের একমাত্র ভরসা করতলব খাঁ ও বাংলার রাজস্ব। করতলব সম্রাটকে নিরাশ করেননি। তিনি বাংলার রাজস্ব বিভাগের সম্পূর্ণ সংস্কার করে মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত রাজস্ব পাঠিয়ে গেছেন। কিন্তু করতলব রাজধানী ঢাকায় এসে দেখলেন, তখনকার সুবাদার ঔরংজেবের পৌত্র শাহজাদা আজিম-উস-শান নতুন দেওয়ানের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট নন কারণ এতদিন তিনি একচ্ছত্রভাবে বাংলার ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভোগ করছিলেন। করতলব এসে তাতে বাধার সৃষ্টি করবে। করতলবের প্রতি তাঁর অনীহা প্রায় শত্রুতায় পর্যবসিত হয়। এমনকী তিনি করতলবের প্রাণনাশের চেষ্টাও করেন যদিও তা ব্যর্থ হয়।
করতলব বুঝতে পারেন যে ঢাকায় তিনি নিরাপদ নন। সর্বোপরি, ঢাকায় সুবাদার আজিম-উস-শানের উপস্থিতিতে তিনি তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবেন না, স্বাধীনভাবে কাজ করা তো দূরের কথা। তাই তিনি দেওয়ানি কার্যালয় ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত করলেন মখসুদাবাদে। এজন্য তিনি আজিম-উস-শানের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি কারণ তিনি জানতেন সম্রাট ঔরংজেব তাঁর ওপর খুবই সন্তুষ্ট, বিশেষ করে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্কার করে তিনি সম্রাটকে নিয়মিত অর্থ পাঠাতেন, এজন্য। করতলবের পক্ষে মখসুদাবাদকে বেছে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এটিকে তাঁর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান মনে করার কারণ এটি বাংলার প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ফলে এখান থেকে বাংলার প্রায় সব অংশের ওপরই সুষ্ঠুভাবে নজর রাখা যাবে, যা জাহাঙ্গিরনগর (ঢাকা) থেকে সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া যেহেতু তিনি মখসুদাবাদের ফৌজদারের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেজন্য তিনি ওখানে অনেক বেশি নিরাপদ। তিনি হয়তো এটাও ভেবেছিলেন যে গঙ্গা তীরবর্তী মখসুদাবাদ থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর ভালভাবে নজরদারি করা যাবে কারণ এই সময় তারা গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল। ১৭০৪ সালে মখসুদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করে তিনি দাক্ষিণাত্যে সম্রাট ঔরংজেবের কাছে বাংলার রাজস্ব ও নজরানা নিয়ে হাজির হলেন। সম্রাট সানন্দে এতে অনুমতি দিলেন। তাঁকে মুর্শিদকুলি খান উপাধি দিয়ে তাঁর নামানুসারে মখসুদাবাদের নতুন নামকরণ, মুর্শিদাবাদ, করতে দিতে সাগ্রহে রাজি হলেন। এভাবেই মুর্শিদাবাদের উৎপত্তি।
১৭০৭ সালে ঔরংজেবের মৃত্যুর সময়ই মুর্শিদকুলি বাংলার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ঔরংজেবের মৃত্যুর পরও তিনি দিল্লির মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত বাংলার রাজস্ব পাঠাতে ভোলেননি। দিল্লির বাদশাহি মসনদে যিনিই বসুন না কেন, মুর্শিদকুলির নীতিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। মুঘল বাদশাহরাও নিয়মিত অর্থ পেয়ে খুশি, বাংলা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বা সামর্থ্য কোনওটাই তাঁদের ছিল না। ফলে মুর্শিদকুলি নিজের ইচ্ছেমতো বাংলার শাসন চালাতে পেরেছিলেন, দিল্লি থেকে কোনওরকমের হস্তক্ষেপ বা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্ন ওঠেনি। মুঘল শাসনকাঠামোর রীতি ভেঙে ১৭১৬/১৭ সালে মুর্শিদকুলিকে দেওয়ানের সঙ্গে সুবাদারের পদেও নিযুক্ত করা হল। ফলে এতদিন ধরে যে রীতি চলে আসছিল—সব উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও মনসবদারদের দিল্লি থেকেই বাংলায় পাঠান হত— তার এখন সম্পূর্ণ অবসান হল। মুর্শিদকুলি এখন নিজের পছন্দমতো লোককে রাজকার্যে নিযুক্ত করতে লাগলেন— তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় লোকদেরই প্রাধান্য দিলেন। তাতে এতদিন বাইরে থেকে আগত মনসবদার ও অন্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ করত, তা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে বাংলা থেকে আহরিত ধনসম্পদ বাংলাতেই থেকে গেল এবং বাংলার ধনভাণ্ডার বৃদ্ধির সহায়ক হল।
তা ছাড়াও মুর্শিদকুলির শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন মধ্যবিত্ত, ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্রেণি ও বড় বড় জমিদার সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হল। এরা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এদের বেশিরভাগেরই মুখ্য কর্মস্থল মুর্শিদাবাদ হওয়াতে, তার উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে এদের যথেষ্ট অবদান ছিল। নবাব হিসেবে মুর্শিদকুলিও তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিছুটা শাসনবিভাগের প্রয়োজনে, কিছুটা মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তিনি অনেক প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ ও ঘরবাড়ি তৈরি করেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ প্রায় অজ পাড়াগাঁ থেকে প্রাণবন্ত একটি শহরে পরিণত হল। শুধু তাই নয়, নতুন রাজধানীর নবাবি দরবারে নানারকম জাঁকজমকেরও ব্যবস্থা করেন মুর্শিদকুলি। এই দরবারে একদিকে যেমন বড় বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অভিজাতবর্গ অন্যদিকে অনেক বিদেশি, বিশেষ করে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির প্রতিনিধির, নিত্য আনাগোনা ছিল। নানা ধর্মীয় উৎসবে মুর্শিদকুলি সাধুসন্ত, ফকির, শেখ, সৈয়দ প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের লোকদের আপ্যায়িত করতেন এবং মুর্শিদাবাদকে হাজার হাজার আলোকমালায় সাজিয়ে তুলতেন।
পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিন রাজ্যশাসনের ভার—জগৎশেঠ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও হাজি আহমেদ—এই ত্রয়ীর ওপর ছেড়ে দিলেও নিজে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যায়নে যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন। শৌখিন, বিলাসপ্রিয় এই নবাবের মুর্শিদকুলির নির্মিত প্রাসাদ ও ইমারতগুলি ছোট বলে মোটেই পছন্দ হয়নি। তাই তিনি নতুন নতুন প্রাসাদ, ভবন, উদ্যানবাটিকা নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন থেকে শুরু করে ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ব অধিকর্তা স্যার জন শোর পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন যে সুজাউদ্দিনের সময় বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। এরপর নবাব সরফরাজ মাত্র কিছুদিন রাজত্ব করেছিলেন— আলিবর্দির হাতে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মারাঠা আক্রমণ সত্ত্বেও আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের প্রভূত উন্নতি হয়। মারাঠাদের কাছ থেকে শান্তি কিনে নেবার পর তিনি মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন মুছে দিতে বদ্ধপরিকর হন এবং তাতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন। তার প্রমাণ হিসেবে মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলি জানিয়েছেন যে ওই সময় মুর্শিদাবাদ শহর অনেক বিস্তার লাভ করে। আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারের জাঁকজমক ছিল দেখবার মতো। তখন পুণ্যাহের দিনে যে মহোৎসব হত, তা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। সিরাজদ্দৌল্লার পনেরো মাসের রাজত্বেও মুর্শিদাবাদের বৈভব ও জাঁকজমকে কোনওরকমের ঘাটতি ছিল না। আলিবর্দির নবাবি প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও তিনি মনসুরগঞ্জে নিজের পছন্দমতো বিশাল হীরাঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
মুর্শিদাবাদের নবাবদের ধনভাণ্ডারে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ সঞ্চিত ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এ সম্পদ কিন্তু তাঁরা সঞ্চয় করেছিলেন দিল্লিতে প্রত্যেক বছর (১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত) ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাবার পর। পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের কোষাগারে সঞ্চিত ধনরত্ন দেখে হতবাক হয়ে যান। এই ধনাগারে সোনা রুপো মিলে ২ কোটি টাকার মতো সঞ্চিত ছিল। তা ছাড়া বলা হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার হারেমে যে ধনসম্পদ লুকোনো ছিল তার পরিমাণ কম করে ৮ কোটি টাকার মতো। শুধু তাই নয়, মুর্শিদাবাদের অভিজাতবর্গের যা সঞ্চয় ছিল তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আলিবর্দির কন্যা ও ঢাকার ছোট নবাব নওয়াজিস মহম্মদের পত্নী ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লা নাকি ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগরদের সম্পদের পরিমাণও কিংবদন্তি হয়ে আছে। জগৎশেঠদের ব্যবসার মূলধন ছিল ৭ কোটি টাকা এবং ধনসম্পদ ১৪ কোটি টাকার মতো। মুর্শিদাবাদ দেখে ক্লাইভ মন্তব্য করেছিলেন যে শহরটি লন্ডনের মতোই জনবহুল— লন্ডনের সঙ্গে তফাত শুধু এই যে মুর্শিদাবাদে এমন কিছু লোক আছে যারা লন্ডনের যে কোনও বাসিন্দার চাইতে অনেক অনেক বেশি ধনী।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের শ্রীবৃদ্ধিতে শ্ৰেষ্ঠী-মহাজন-ব্যাঙ্কার-সওদাগরদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। মুর্শিদাবাদ একদিকে সুবে বাংলার রাজধানী, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র। ফলে শুধু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও ধর্মের ব্যবসায়ী-সওদাগর-মহাজনরা এখানে এসে জমায়েত হত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিন বণিকরাজা—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও আর্মানি খোজা ওয়াজিদ। এঁদের বণিকরাজা বলা হয় এই কারণে যে এঁরা সওদাগর-ব্যাঙ্কার হলেও এঁদের জীবনযাত্রা ও ধরনধারণ ছিল রাজাদের মতো। এঁদের মধ্যে জগৎশেঠদের স্থায়ী আস্তানা ছিল মুর্শিদাবাদে, বাকিদের নয়। কিন্তু যেহেতু এঁরা তিনজনই মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং যেহেতু এঁদের রমরমা মুর্শিদাবাদের নবাব ও তাঁর দরবারের আনুকূল্যেই, এঁদের বেশির ভাগ সময়ই কাটত মুর্শিদাবাদে। তাই মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে এই বণিকরাজাদের কথা এসে পড়বেই।
বাংলায় জগৎশেঠদের আদিপুরুষ মানিকচাঁদ মুর্শিদকুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শদাতা ছিলেন। মুর্শিদকুলি যখন ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে দেওয়ানি স্থানান্তরিত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে মানিকচাঁদও ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। তারপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নবাবের দাক্ষিণ্যে জগৎশেঠরা উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যান। মানিকচাঁদের উত্তরাধিকারী ফতেচাঁদ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় জগৎশেঠ (সারা দুনিয়ার ব্যাঙ্কার) উপাধি পান। সিরাজদ্দৌল্লার আগে পর্যন্ত সব নবাবদের সঙ্গেই জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আস্তে আস্তে বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচ্ছত্র অধিকার প্রায় কুক্ষিগত করে নেয়। নবাবি আমলে রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেবার অধিকারও ছিল তাঁদের। এ ছাড়া বাট্টার হার নির্ধারণ করা থেকে ঋণের জন্য সুদের হার নির্ণয় করা পর্যন্ত সবকিছুই তাঁদের করায়ত্ত ছিল। শুধু বাংলা বা মুর্শিদাবাদ নয়, সমগ্র উত্তর ভারতে টাকার বাজারে তাঁদের এমনই প্রতিপত্তি ছিল যে ইংরেজ কোম্পানির অনুরোধে তাঁরা একদিনেই সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করে দিয়েছিলেন। তাঁদের এই ফতোয়া সমগ্র উত্তর ভারতেই কার্যকরী হয়েছিল। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম থেকে শুরু করে বাংলায় ডাচ কোম্পানির সব ডাইরেক্টরা লিখেছেন যে জগৎশেঠরা তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার ছিলেন। শেঠদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মতো। সিয়রের লেখক মন্তব্য করেছেন যে তাঁদের ধনসম্পদের কথা বলতে গেলে মনে হবে রূপকথা। আর এক বাঙালি কবি লিখেছেন, গঙ্গা যেমন শতমুখে জলরাশি এনে সমুদ্রে ফেলে তেমনি করে অজস্র ধনরত্ন এসে জমা হয় শেঠদের কোষাগারে।
শেঠদের মতো অন্য দুই বণিকরাজার— উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ— ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার উৎসও ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের আনুকূল্য। উমিচাঁদ ও তাঁর ভাই দীপচাঁদ পাটনার দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে বিহারের সেরা ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার প্রায় কুক্ষিগত করে নেন। তা ছাড়া উমিচাঁদ খাদ্যশস্য ও আফিংয়ের ব্যবসাও একচেটিয়া করার চেষ্টা করেন। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদ বিহারের প্রায় সমগ্র অর্থনীতিকেই নিজের একচেটিয়া করে নেন। বিহারের সোরা ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসা এবং সুবে বাংলায় লবণ-এর ব্যবসায় একচ্ছত্র অধিকার ছিল তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ। তার যে বিরাট প্রভাব ও প্রতিপত্তি, এবং তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের যে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি তার অন্যতম কারণ মুর্শিদাবাদের নবাবদের এবং দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নবাবকে তাঁর প্রয়োজনে ওয়াজিদ সাগ্রহেই অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন, কখনও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। আলিবর্দি তাঁকে ফখর-উৎ-তুজ্জার (বণিকদের গর্ব) উপাধি দিয়েছিলেন।
বণিক রাজাদের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনায় বেগমদের কথাও এসে যায়। এই বেগমদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই নানাভাবে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলেছিলেন, কখনও ভাল, কখনও বা মন্দ। এঁদের কেউ কেউ ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্না, উদারচেতা ও সাহসী। আবার কেউ কেউ চাতুর্য, শঠতা ও খলচরিত্রের মূর্ত প্রতীক। মুর্শিদকন্যা ও সুজাউদ্দিনের বেগম জিন্নতউন্নেসা প্রথম দলের। স্বামী উড়িষ্যার ছোট নবাব সুজাউদ্দিনের নারীসম্ভোগে প্রচণ্ড রকমের আসক্তি দেখে তিনি তাঁকে ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। আবার এই সুজাউদ্দিনই যখন মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর মসনদ দখল করার জন্য সসৈন্যে মুর্শিদাবাদে হাজির হন এবং যখন মুর্শিদকুলির ইচ্ছানুযায়ী নবাব পদে অভিসিক্ত, জিন্নতউন্নেসা ও সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত, তখন এই জিন্নতউন্নেসাই পুত্র সরফরাজকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করেন। সুজার শাসনকালে অবশ্য জিন্নতউন্নেসার অভিপ্রায় অনুযায়ীই অনেক সিদ্ধান্ত কার্যকরী হত।
আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার প্রভাব যে মুর্শিদাবাদের রাজনীতি ও শাসনপ্রক্রিয়ায় বেশ মঙ্গলদায়ক ও ইতিবাচক হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি যে শুধু নিজের জীবন ও সম্মান বিপন্ন করে যুদ্ধক্ষেত্রেও স্বামী আলিবর্দির পাশে থেকেছেন তা নয়, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্যও পরিচালনা করতেন। হতাশা ও প্রয়োজনের সময় তিনি স্বামীকে সাহস দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু তাঁর দুই কন্যা—ঘসেটি ও আমিনা বেগম—ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের। ঘসেটি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, চক্রী ও শ্লথ চরিত্রের। নিজে মসনদ দখল করার জন্য তিনি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করেছিলেন। সঙ্গে দোসর তাঁর গুপ্ত প্রণয়ী ও তাঁর মৃত স্বামী নওয়াজিস মহম্মদের বিশ্বস্ত সহকারি হোসেন কুলি খান। আবার তাঁর ছোট বোন আমিনা বেগমের সঙ্গে যখন হোসেন কুলি অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন, তখন ঘসেটি আমিনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ভাগ্যের পরিহাস, মীরণের নির্দেশে দু’জনকেই গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। এই দু’জনের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সিরাজ-পত্নী লুৎফুন্নেসা। পলাশির পরে শত্রুদের হাত থেকে পলায়মান স্বামীকে তিনি একা ছাড়েননি, সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়ে শিশুকন্যার হাত ধরে তিনি স্বামীর অনুগামিনী হয়েছেন। পরে আমৃত্যু স্বামীর সমাধির পরিচর্যা করেছিলেন। অন্যদিকে মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম ছিলেন মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে সবচেয়ে ধুরন্ধর। স্বামীর মৃত্যুর পরও বহুদিন ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো ইংরেজদের সঙ্গে ভাব করে তিনি বকলমে মুর্শিদাবাদের নবাবি চালিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ পলাশি। পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে এতদিনের যে বক্তব্য—পলাশির পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না’, এটা একটা প্রায় ‘আকস্মিক ঘটনা’, ইংরেজরা প্রায় ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বাংলা বিজয় করতে বাধ্য হয়’, বাংলার ‘অভ্যন্তরীণ সংকটই’ ইংরেজদের ডেকে আনে, ইত্যাদি— মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছাড়া পলাশির ষড়যন্ত্র বা বিপ্লব কোনওভাবেই সম্ভব হত না। তারাই দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি গোষ্ঠীকে একদিকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে কাকুতি-মিনতি করে তাদের (ইংরেজদের) চতুর ‘পরিকল্পনায়’ সামিল করিয়েছিল। আসলে ওই সময় ইংরেজদের পক্ষে বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল কারণ তখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য, যেটা ১৭৩০-র দশক ও ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রমরমিয়ে চলছিল, এক তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলি থেকে দেশীয়দের সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে ইংরেজ বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে। সেই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার ও তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে বাংলা বিজয় ছাড়া ইংরেজদের আর কোনও পথ খোলা ছিল না।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজে নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদে শুধু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে স্থায়ী আস্তানা করে নেয়। এভাবে বহু জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের সমাবেশের ফলে ওখানে একটি ‘কসমোপলিটন’ সমাজ গড়ে ওঠে। জৈন কবি নিহাল সিংহ সুন্দরভাবে এ সমাজের বর্ণনা দিয়েছেন। সামাজিক স্তরবিন্যাসে এখানে ওপরের তলায় ছিল অভিজাত ও অমাত্যবর্গ, বড় বড় ব্যাঙ্কার-মহাজন ও শ্রেষ্ঠীরা। মাঝখানে নানারকমের পেশা ও বৃত্তিতে নিযুক্ত এক ধরনের মধ্যবিত্ত ও ছোটখাট ব্যবসায়ী আর তলার দিকে কারিগর, দিনমজুর ইত্যাদি নিম্নবিত্তের মানুষ। অর্থনীতির দিকে থেকে নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে যে শ্রীবৃদ্ধি দেখা গেছে, তা এর আগে অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। এ অঞ্চলের রেশম ও রেশমিবস্ত্রের শিল্প ও বাণিজ্যে নবাবি আমলেই সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছিল। মারাঠা আক্রমণের ফলে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতি খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে অভিমত তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অর্থনীতিতে মারাঠা আক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল তবে তা সাময়িক এবং কোনও কোনও অঞ্চলেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিল, তার কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। মারাঠা আক্রমণের বছরগুলোতেও এশীয় ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে যে বিশাল পরিমাণ কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র রফতানি করেছে তাই তার প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে এতদিনের যে বক্তব্য— ইউরোপীয়রাই সবচেয়ে বেশি পণ্য (কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সমেত) রফতানি করত এবং ফলে তারাই সবচেয়ে বেশি টাকাপয়সা, সোনা-রুপো আমদানি করত— তা যথার্থ নয়। নবাবি আমলে এশীয়/ভারতীয় বণিকরাই সবচেয়ে বড় রফতানিকারক ছিল, ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি টাকাপয়সা, সোনা-রুপো আনত, ইউরোপীয়রা নয়।
সংস্কৃতির দিক থেকেও নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ খুবই উন্নত ছিল। বহু জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ পাশাপাশি বাস করত এখানে। ফলে পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হত। মুর্শিদাবাদ হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিয়া, সুন্নি, আর্মানি ও ইউরোপীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। তার ফলে মুর্শিদাবাদে একটি উদার ও মিশ্র সংস্কৃতির (composite culture) আবির্ভাব হয়। এই সময় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বজায় ছিল, কোথাও কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। শিয়া, সুন্নিরাও পাশাপাশি শান্তিতে বাস করত। মুর্শিদাবাদের নবাবরা মুসলমান হলেও রাজকার্যে হিন্দুদেরই ছিল প্রাধান্য। এতে নবাবদের উদার মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই নবাবরা হিন্দু উৎসব হোলি এবং দেওয়ালি সাড়ম্বরে পালন করতেন। হিন্দুদের মুসলমানদের দরগায় সিন্নি দেওয়া বা মুসলমানদের হিন্দু মন্দিরে পুজো দেওয়া প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুত অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এই মিলনপ্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো ‘দেবতা’র জন্ম— যে ‘দেবতা’ হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নতুন নতুন প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ, উদ্যানবাটিকা প্রভৃতি নির্মাণ করা নবাবদের প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। একদিকে এঁদের মানসিকতা ও সৌন্দর্যপ্রীতি, অন্যদিকে কোষাগারে প্রচুর ধনসম্পদ নতুন নতুন স্থাপত্য নির্মাণের সহায়ক হয়েছিল। মুর্শিদকুলির তৈরি কাটরা মসজিদ মুর্শিদাবাদের অন্যতম আকর্ষণ। মোটামুটি এই সময় থেকেই মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যশিল্পে মুঘল শৈলীর সঙ্গে স্থানীয় শৈলী ও শিল্পরীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। শৌখিন ও বিলাসপ্রিয় নবাব সুজাউদ্দিনের মুর্শিদকুলির প্রাসাদ ‘চেহেল সুতুন’ ছোট বলে পছন্দ হয়নি। তাই তিনি নিজের পছন্দমতো প্রাসাদ, ইমারত, উদ্যানবাটিক নির্মাণ করেন। তাঁর তৈরি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি—ফর্হাবাগ বা সুখকানন। আলিবর্দি খানের জামাতা ও ঘসেটি বেগমের স্বামী, নওয়াজিস মহম্মদ, মোতিঝিলের বিখ্যাত প্রাসাদ তৈরি করেন। ওদিকে সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার আগেই হীরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ নির্মাণ করে সেখানে বাস করতে থাকেন। ইমামবারাও তাঁর তৈরি। নবাবরা আবার তাঁদের সমাধিস্থলও তৈরি করে রাখতেন। আলিবর্দি, সিরাজদ্দৌল্লা, লুৎফুন্নেসা সবার সমাধিই খোশবাগে। মীরজাফর থাকতেন জাফরাগঞ্জের প্রাসাদে। এখানেই তাঁর, মীরণ ও তাঁদের বংশধরদের সমাধি। দুঃখের বিষয়, মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যকর্মগুলির বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত, খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
পলাশির পর থেকেই মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব কমতে থাকে। সিরাজদ্দৌল্লার পর মীরজাফর নতুন নবাব হলেও ইংরেজদের হাতের পুতুলমাত্র। ১৭৬০ সালে মীরকাশিম নবাব হয়ে মুঙ্গেরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ১৭৬৩-তে মীরজাফর আবার নবাব হন। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দেওয়ানি পেল। ১৭৬৬ সালে ক্লাইভ দেওয়ান হয়ে মুর্শিদাবাদে পুণ্যাহ করলেন। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ইংরেজদের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য দেওয়ানি ও খালসার সব বিভাগগুলি কলকাতা নিয়ে গেলেন। ফলে মুর্শিদাবাদ থেকে বহু কর্মচারী কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হল। রাজধানী হিসেবে মুর্শিদাবাদের যেটুকু গুরুত্ব ছিল, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট (Regulating Act) পাশ হওয়ার পর কলকাতা ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের সদর দফতর হওয়ায় তাও নষ্ট হয়ে গেল। মুর্শিদাবাদের টাঁকশাল ১৭৯৯ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে বাংলার রাজধানী থেকে মুর্শিদাবাদ শুধুমাত্র একটি জেলাশহরে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে মধ্য-অষ্টাদশ শতকে যে মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যা ছিল আনুমানিক দশ লক্ষ, তা ওই শতকের শেষদিকে অনেকটাই কমে যায়। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষও অবশ্য তার একটি অন্যতম কারণ।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
ORIGINAL SOURCES (মূল সূত্র)
A. MANUSCRIPT SOURCES (পাণ্ডুলিপি)
1. India Office Records, British Library, London
Bengal Public Consultations
Bengal Letters Received
Bengal Secret and Military Consultations
Coast and Bay Abstracts
Despatch Books
European Manuscripts
Factory Records
Home Miscellaneous Series
Mayor Court’s Records, Calcutta
Original Correspondence
Orme Manuscripts
2. ALGEMEEN RIJKSARCHIEF, THE HAGUE, NETHERLANDS
Verenigde Oostindische Compagnie (VOC)
Overgekomen brieven en papiers and Inkomend briefbook, 1720-57 (Select Volumes)
Hoge Rgering van Batavia, 246 (Taillefert’s ‘Memorie’, 17 Nov. 1763)
3. Stadsarchief Antwerpen, Antwerp, Belgium
General Indische Compagnie (The Ostend Company), 5768
B. PRINTED SOURCES (মুদ্রিত আকরগ্রন্থ)
1. PERSIAN WORKS (ফারসি গ্রন্থ)
Gholam Hossein Khan, Seir Mutaqherin, vol. II, trans. Haji Mustafa, Second Reprint, Lahore, 1975.
Gulam Husain Salim, Riyaz-us-Salatin, trans. Maulavi Abdus Salam, Calcutta, 1904.
Inayat Allah, Ahkam-i-Alamgiri.
Karam Ali, Muzaffarnamah, in J. N. Sarkar, Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.
Salimullah, Tarikh-i-Bangala, trans. Gladwin, Calcutta, 1788.
Shah Nawaz Khan, Maasir-ul-Umara, trans., H. Beveridge, Calcutta, 1952.
Tarikh-i-Mansuri, trans., H. Blochmann, Journal of the Asiatic Society. no. 2, 1867.
Yusuf Ali Khan, Tarikh-i-Bangala-i-Mahabatjangi, trans. Abdus Subhan, Calcutta, 1982.
2. WORKS IN EUROPEAN LANGUAGES (ইউরোপীয় ভাষায় লেখা গ্রন্থ)
(A) Published sources
Datta, K. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. I (1748-56), Delhi, 1956.
Firminger, W. K., ed., The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons of the Affairs of the East India Company, 1812, 3 vols., Calcutta, 1917-18.
—, Historical Introduction to the Fifth Report, Calcutta, 1917.
Hill, S. C., Bengal in 1756-57, 3 vols., London, 1905.
Martin, Francois, Memories de Francois Martin, 1665-1696, ed., A. Martineau, Paris, 1931.
Records of Fort St. George: Diary and Military Consultations, Madras, 1912-25.
Sinha, N. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. V (1767-9), Calcutta, 1959.
Wilson, C. R., ed., The Early Annals of the English in Bengal, 3 vols., London, 1895-1917.
Yule, H., ed., The Diary of William Hedges, 3 vols., London, 1887-9.
Van Dam, Pieter, Beschrijvinge vande Oost-Indische Compagnie, ed., F.W. Stapel & others, 4 books in 7 parts, The Hague, 1927-54.
(B) Travellers’ Account, Memoirss. etc. (পর্য্যটকদের বিবরণ, স্মৃতিকথা ইত্যাদি)
Bernier, F., Travels in the Mogul Empire, 1656-1658, ed. A. Constable, Oxford, 1934.
Bolts, William, Considerations on Indian Affairs, London, 1772.
Bowrey, Thomas, A Geographical Account of Countries Round the Bay of Bengal, 1669-1679, ed., R. C. Temple, Cambridge, 1905.
Dow, Alexander, History of Hindostan, vol. III, London, 1770.
Orme, Robert, Historical Fragments of the Mogul Empire, London, 1805.
—, History of the Military Transactions of the British Nation in Indostan, 3 vols., London, 1803.
Scrafton, Luke, Reflections on the Government of Indostan, London, 1763.
Stavorinus, J. S., Voyage in the East Indies, trans. S. H. Wilcoke, 3 vols., London, 1798.
Tavernier, Jean-Baptiste, Travels in India, 1640-1667, trans. V. Ball, London, 1889.
Vansittart, H., A Narrative of the Transactions in Bengal from 1760-1764, London, 1766.
Verelst, H., A View of the Rise, Progress and Present State of the English Government in Bengal, London, 1772.
Watts, William, Memoirs of the Revolution in Bengal, London, 1760.
(C) Secondary works (প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ)
(১) বাংলা
অনিরুদ্ধ রায়, মধ্যযুগের ভারতীয় শহর, কলকাতা, ১৯৯৯
আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, ঢাকা, ১৯৭৭।
অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, কলিকাতা, ১৮৯৮।
কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি, ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৩৮০।
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়, পলাশীর যুদ্ধ, কলিকাতা, ১৯৫৩।
নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, কলিকাতা, ১৯০২।
—, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, কলিকাতা, ১৯০৩।
—, জগৎশেঠ, কলিকাতা, ১৯১২।
প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, মুর্শিদাবাদ চর্চা, কলিকাতা, ১৩৮০।
রজতকান্ত রায়, পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, কলকাতা, ১৯৯৪।
ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা, ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী, কলিকাতা, ১৯৬৩।
সোমেন্দ্রলাল রায়, মুর্শিদাবাদের কথা ও কাহিনী, কলিকাতা, ১৯৬০৷
শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সিরাজদ্দৌল্লা, কলিকাতা, ১৯৪২।
শ্রীপারাবাত, মুর্শিদকুলী খাঁ, কলিকাতা, ১৯৯০।
(২) ইংরেজি
Arasaratnam, S., Merchants, Companies and Commerce on the Coromandel Coast, 1650-1740, New Delhi, 1986.
—, ‘The Indian Merchants and their Trading Methods’, Indian Economic and Social History Review, 3 (1966), 85-95.
Bagchi, A. K., The Political Economy of Underdevelopment, Cambridge, 1982.
—, ‘Reflections on Patterns of Regional Growth in India during the Period of British Rule’, Bengal Past and Present, XCV, 1976.
Banerjee, B. N. The Begams of Bengal, Calcutta, 1945.
Bayly, C. A., The Imperial Meridian: The British Empire and the World, 1780-1830, London, 1988.
—, Indian Society and the Making of the British Empire, Cambridge, 1987.
Bandyopadhyay, Sekhar, From Plassey to Partition, Orient Longman, 2004.
Bayly, C.A., and Sanjay Subrahmanyam, ‘Portfolio Capitalists and the Political Economy of Early Modern India’, Indian Economic and Social History Review, 25, 4 (1988), 403-24.
Bence-Jones, M., Clive of India, London, 1974.
Bhadra, Gautam, ‘The Role of Pykars in the Silk Industry of Bengal, 1765-1830’, Studies in History, 3, no. 2 (1987), 137-85; 4, nos. 1 & 2 (1988), 1-35.
—‘Social Groups and Relations in the Town of Murshidabad, 1765-1793’ Indian Historical Reveiw, pp. 312-38, 1976.
Bhattacharya, Bhaswati, ‘Between Fact and Fiction: Khoja Gregory Alias Gurgin Khan’, in Circumbulations in South Asian History, Essays in Honour of D. H. A. Kolff, Leiden, 2003, pp. 134-158.
Bhattacharya, S., The East India Company and the Economy of Bengal from 1704 to 1740, London, 1954.
Boxer, C. R., The Dutch Seaborne Empire, New York, 1965.
Bruijn, J. R., F.S. Gaastra and I. Schoffer, Dutch-Asiatic Shipping, 3 vols., The Hague, 1979-87.
Calkins, P. B. ‘The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740’, Journal of Asian Studies, vol. XXIX, no. 4 (August 1970), 799-806.
—, ‘The Role of Murshidabad as a Regional and Sub-Regional Centre in Bengal’, in R. L. Park, ed., Urban Bengal, East Lansing, 1969.
Campbell, Glimpses of Bengal, Calcutta, 1907.
Chandra, Satish, ed., The Indian Ocean: Explorations in History, Commerce and Politics, New Delhi, 1985.
Chatterjee, Kumkum, Merchants, Politics and Society in Early Modern India, Bihar: 1733-1820, Leiden, 1996.
—, ‘Trade and Durbar Politics in the Bengal Subah, 1733-1757’, Modern Asian Studies, 26 (1992), 233-73.
Chatterjee, Tapan Mohan, The Road to Plassey, Bombay, 1960.
Chaudhuri, K. N., Asia before Europe, Cambridge, 1990.
—, Trade and Civilization in the Indian Ocean: An Economic History from the Rise of Islam to 1750, Cambridge, 1985.
—, The Trading World of Asia and the English East India Company, Cambridge, 1978.
—, ‘India’s International Economy in the Nineteenth Century’, Modern Asian Studies, II (1968).
—, ‘The Structure of the Indian Textile Industry in the Seventeenth and Eighteenth Centuries’, Indian Economic and Social History Review, XI (June-Sept. 1974), 127-82.
Chaudhury, Sushil, and Michel Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade: Europe and Asia in Early Modern Era, Cambridge, 1999.
Chaudhury, Sushil, ‘Trading Networks of a Traditional Diaspora, Armenians in Indian Trade’, paper presented at the XIII International Economic History Congress, Buones Aires, Argentina, July 2002 and now being published.
—, ‘Armenians in Bengal Trade, circa. mid-Eighteenth Century’, paper presented at the International Seminar on ‘Armenians in Asian Trade, 16th-18th Century’, Paris, October 1998. Now being published by MSH, Paris.
—, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, c. 1650-1757’, paper presented at the XIIth International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1808’, and now published in Global Connections and Monetary History, ed., Flynn, et al, Ashgate, 2003.
—, ‘Was there a Crisis in Mid-Eighteenth Century Bengal?‘, in Rethinking Early Modern India, ed., Richard B. Barnett, New Delhi, 2002.
—, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000.
—, From Prosperity to Decline: Bengal in the Eighteenth Century, New Delhi, 1995.
—, ‘International Trade in Bengal Silk and the Comparative Role of Asians and Europeans, circa. 1700-1757’, Modern Asian Studies, 29, 2, (1995), 373-86.
—, ‘European Companies and Bengal Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993), 321-40.
—, ‘Sirajuddaula and the Battle of Plassey’, History of Bangladesh, vol. 1, Dhaka, 1992, 93-130.
—, ‘Trade, Conquest and Bullion: Bengal in the mid-Eighteenth Century’, Itinerario, vol. 15, no. 2 (1991), 21-32.
—, ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics,’ Indian Historical Review, vol. XVI. nos. 1-2, 137-48.
—, ‘The Imperatives of Empire—Private Trade, Sub-Imperialism and the British Attack on Chandernagore, March 1757’, Studies in History, vol. VIII, no. 1 (Jan.-June 1992), 1-12.
—, ‘General Economic Conditions in Nawabi Bengal, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 30-66.
—, ‘European Trading Companies and Bengal’s Export Trade, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 183-224.
—, ‘Continuity or Change in the Eighteenth Century? Price Trends in Bengal, circa. 1720-1757’, Calcutta Historical Journal, vol. XV., nos. 1-2 (July 1990-June 1991), 1-27.
—, ‘Sirajuddaullah, English Company and the Plassey Conspiracy—A Reappraisal’, Indian Historical Review, vol. XXIII, nos. 1-2 (July 1986-Jan. 1987), 111-34.
—, ‘Merchants, Companies and Rulers: Bengal in the Eighteenth Century’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, vol. XXXI (Feb. 1988), 74-109.
—, Trade and Commercial Organization in Bengal, 1650-1720, Calcutta, 1975.
—, ‘The Rise and Decline of Hughli—A Port in Medieval Bengal’, Bengal Past & Present, (Jan.-June 1967), 33-67.
Chicherov, A. I. India: Economic Development, Moscow, 1971.
Colebrook, H. T., Remarks on the Husbandry and Commerce of Bengal, Calcutta, 1804.
Curley, David, ‘Fair Grain Markets and Mughal Famine Policy in Eighteenth Century Bengal,’ Calcutta Historical Journal, 2 (1977), 1-26.
Dani, A.H., Muslim Architecture in Bengal, Dacca, 1961.
Das Gupta, Ashin, Merchants of Maritime India, Varorium, 1994.
—, Indian Merchants and the Decline of Surat, c. 1700-1750, Wiesbaden, 1979.
—, ‘Trade and Politics in 18th Century India’, in D. S. Richards, ed., Islam and the Trade of Asia, Oxford, 1967.
—, and M.N. Pearson, eds., India and the Indian Ocean, 1500-1800, Calcutta, 1987.
Datta, K.K., Alivardi and His Times, 2nd edn., Calcutta, 1963.
—, Survey of India’s Social Life and Economic Conditions in the Eighteenth Century, 1707-1813, Calcutta, 1961.
—, Studies in the History of Bengal Suba, 1740-1760, Calcutta, 1936.
Dimock, Edward C. Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, Honolulu, 1975.
Eaton, Richard M., The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, Delhi, 1994.
Edwardes, Michael, The Battle of Plassey and the Conquest of Bengal, London, 1963.
—, Plassey: The Founding of an Empire, London, 1969.
Feldbaeck, Ole, ‘Cloth Production and Trade in Late Eighteenth Century Bengal’, Bengal Past & Present, vol. LXXXVI (July-Dec. 1967), 124-41.
Foster, William, ‘Gabriel Boughton and the Trading Privileges in Bengal’, Indian Antiquary, 40 (1911).
Furber, Holden, Rival Empires of Trade in the Orient, 1600-1800, Minneapolis and Oxford, 1976.
—, ‘Asia and West as Partners before “Empire” and After’, Journal of Asian Studies, 28 (1969).
—, John Company at Work, Cambridge, 1961.
—, Bombay Presidency in the mid-Eighteenth Century, Bombay, 1965.
Furber, Holden, and Kristof Glamann, ‘Plassey: A New Account from the Danish Archives’, Journal of Asian Studies, vol. XIX, no. 2 (February 1960).
Gaastra, F. S., “The Dutch East India Company and its Intra-Asian Trade in Precious Metals’, in W. Fischer, R.M. McInnis and J. Schneider, eds., The Emergence of a World Economy, pt. I, 1500-1800, Wiesbaden, 1986, 97-112.
Ghoshal, H. R., Economic Transition in the Bengal Presidency, 1793-1833, Patna, 1950.
Glamann, Kristof, Dutch Asiatic Trade, 1620-1740, Copenhagen, The Hague, 1958.
—, ‘Bengal and the World Trade about 1700’, Bengal Past & Present, vol. LXXVI, no. 142 (1957), 30-9.
Gupta, Brijen K., Sirajuddaullah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962.
Habib, Irfan, ‘Merchant Communities in Pre-Colonial India,’ in J. D. Tracy, ed., The Rise of Merchant Empires: Long Distance Trade in the Early Modern Period, 1350-1750, Cambridge, 1990, 371-99.
—, ‘Studying a Colonial Economy—Without Perceiving Colonialism’, Modern Asian Studies, 19, 3 (1985), 355-81.
—, ‘The Technology and Economy of Mughal India’, Indian Economic and Social History Review, vol. XXVII, no. 1 (Jan.-March 1980), 1-34.
—, ‘Changes in Technology in Mughal India’, Studies in History, II, 1, 15-39.
—, Potentialities of Capitalistic Development in the Economy of Mughal India’, Journal of Economic History, 29 (March 1969).
—, The Agrarian System of Mughal India, Bombay, 1963.
Hill, S. C., Three Frenchmen in Bengal, London, 1905.
Hossain, Hameeda, The Company Weavers of Bengal, Delhi, 1988.
Irwin, J. and P. R. Schwartz, Studies in Indo-European Textile History, Ahmedabad, 1966.
Karim, Abdul, Murshid Quli and His Times, Dacca, 1963.
Khan, A. M., The Transition in Bengal, Cambridge, 1969.
Krishna, Bal, Commercial Relations between India and England, London, 1924.
Kumar, Dharma, ed., The Cambridge Economic History of India, vol. 2.
Little, J. H., The House of Jagat Seths, Calcutta, 1956.
Marshall, P. J., Bengal—The British Bridgehead, Cambridge, 1987.
—, East Indian Fortunes, Oxford, 1976.
—, ‘Private British Investment in Eighteenth Century Bengal, Bengal Past & Present, 86 (1967), 52-67.
Majumdar, P. C., The Musnud of Murshidabad, Murshidabad, 1905
Mclane, John, R., Land and Local Kingship in Eighteenth Century Bengal, Cambridge, 1993.
Meilink-Roelofz, M. A. P., Asian Trade Revolution and European Influence in the Indonesian Archipelago between 1500 to about 1630, The Hague, 1962.
Mitra, D. B., The Cotton Weavers of Bengal, Calcutta, 1978.
Mohsin, K. M., A Bengal District in Transition: Murshidabad, Dacca, 1973.
Moosvi, Shireen, The Economy of Mughal Empire, Delhi, 1987.
—, ‘The Silver Influx, Money Supply, Prices and Revenue Extraction in Mughal India’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, XXX (1988), 47-94.
Nichol, J. D., ‘The British in India, 1740-63: A Study of Imperial Expansion into Bengal’, unpublished Ph. D. thesis, University of Cambridge, 1976.
Pearson, M. N., Merchants and Rulers in Gujarat, Berkeley and Los Angeles, 1976.
Perlin, Frank, ‘Proto-Industrialization and Pre-Colonial South Asia’, Past and Present, 98 (1983), 30-95.
—, ‘Pre-Colonial South Asia and Western Penetration in the Seventeenthto Nineteenth centuries: A Problem of Epistemological Status’, Review, 4(1980).
Prakash, Om, The European Commercial Enterprise in Pre-Colonial India, Cambridge, 1998.
—, ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry—A Reply’, Modern Asian Studies, 27, 2 (1993), 341-56.
—, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, Princeton, 1985.
—, ‘Asian Trade and European Impact: A Study of the Trade from Bengal, 1630-1729’, in Blair Kling and M. N. Pearson, eds., The Age of Partnership: Europeans in Asia before Dominion, Honolulu, 1979.
—, ‘Bullion for Goods: International Trade in the Economy of Early Eighteenth Century Bengal’, Indian Economic and Social History Review, XIII (1976), 159-87.
Ray, Aniruddha, The Marchant and the State: The French in India, 2 vols., New Delhi, 2004.
Ray, Indrani, ‘Dupleix’s Private Trade in Chandernagore’, Indian Historical Review, I (1974), 279-94.
—, ‘The French Company and the Merchants of Bengal, 1680-1730’, Indian Economic and Social History Review, 7 (1970).
Ray, Rajat Kanta, ‘Colonial Penetration and Initial Resistance: The Mughal Ruling Class, the English East India Company and the Struggle for Bengal’, Indian Historical Review, 12 (July 1985-Jan. 1986). 1-105.
Raychaudhuri, T. and Irfan Habib, eds., The Cambridge Economic History of India, vol. 1, Cambridge, 1982.
Richards, J. F., Precious Metals in Late Medieval and Early Modern Worlds, Durham, 1983.
—, ‘Mughal State Finance and the Pre-Modern World Economy’, Comparative Studies in Society and History, 23 (1981).
Sarkar, J. N., ed., History of Bengal, vol. II, Dhaka, 1948.
—, trans. and ed., Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.
Saxe, Elizabeth Lee, ‘Fortune’s Tangled Web: Trading Networks of English Enterprises in Eastern India, 1657-1717’, unpublished Ph.D. Dissertation, Yale University, 1979.
Seth, M. J., Armenians in India from Earliest Times to the Present Day, Reprint, Calcutta, 1973.
Sinha, N. K., The Economic History of Bengal, 3 vols., Calcutta, 1958-65.
—, ed., History of Bengal, 1757-1905, Calcutta, 1967.
Steensgaard, Niels, ‘Asian Trade and World Economy from the 15th to the 18th Centuries’, in T. R. de Souza, ed., Indo-Portuguese History, New Delhi, 1984.
—, The Asian Trade Revolution of the Seventeenth Century, Chicago, 1974.
Subrahmanyam, Sanjay, The Portugese Empire in Asia, London, 1992.
—, The Political Economy of Commerce: Southern India, 1500-1650, Cambridge, 1990.
Taylor, J., A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta, 1840.
Thompson, Virginia M., Dupleix and His Letters, 1742-54, New York, 1933.
Tracy, J. D., ed., The Rise of Merchant Empires, Cambridge, 1990.
Van Leur, J. C., Indonesian Trade and Society, The Hague, 1955.
Van Santen, H. W., De Verenigde Oost-Indische Compagnie in Gujarat en Hindusthan, 1620-60, Leiden, 1982.
Walsh, J. H. T., A History of Murshidabad District, Calcutta, 1902.
Wallerstein, Immanuel, The Modern World System, II: Mercantilism and the Consolidation of the World Economy, 1600-1750, New York, London, 1980.
Wink. Andre, ‘Al-Hind: India and Indonesia in the Islamic World-Economy, c. 700-1800’, in Itinerario, Special Issue, The Ancient Regime in India and Indonesia, 1988, 33-72.