যন্ত্রণায় মেজরের সারা শরীর যেন ফালা ফালা হয়ে যেতে লাগল। শরীরটা বাঁকতে শুরু করল। পেট আর হাতের ভেতর থেকে, পায়ের ভেতর থেকে একটা আগুনের হল্কা সারা শরীরটাকে পুড়িয়ে দিতে লাগল। মনে হল ঠোঁট দুটোতে কেউ যেন ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে। ঘাড়ের কাছে, বালির ওপর কি একটা ধড়ফড় করে উঠতেই স্কর্পিয়ন ফিশটার কথা মনে পড়ে গেল তার। হঠাৎ তার চেতনাটা একটু পরিষ্কার হয়ে উঠল যেন! তাই তো! সেই পরীক্ষাটা! যে করেই। হোক, যে কোন উপায়েই হোক, অক্টোপাসের কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে, তাকে খাবার দিতে হবে যে!
উঠে বসতে গিয়ে তার সারা শরীর ঝনঝনিয়ে উঠল। কোন রকমে বা হাতে তলপেটটা চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন বালির ঢাল বেয়ে, পানিতে গিয়ে পড়লেন। তার সমস্ত দেহটা যন্ত্রণায় এদিক-ওদিক দুলছে, টলমল করে উঠছে। প্রবাল করে অক্টোপাসের বাসাটা পঞ্চাশ গজ দূরে, পানির নিচে। মেজর অতি কষ্টে কোন রকমে সেখানে হাজির। হলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে খাড়া রেখে হেঁট হয়ে মুখোশসমেত মাথাটা পানিতে চুবিয়ে দিলেন। অক্টোপাসের বাসার ভেতর যখন তাকিয়ে দেখলেন তখন ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। দেখতে পেলেন রক্তের সরু সরু কয়েকটা ধারা সুতোর মত এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে নেমে চলেছে পানির ভেতর। তিনি কোচের ডগার বেশ কাছাকাছি পাকড়ে ধরে মাছটাকে বাড়িয়ে দিলেন গর্তের দিকে। বিষের এই টোপ একমাত্র অক্টোপাসকেই ঘায়েল করতে পারে না। তিনটে গঁড় চঞ্চল হয়ে উঠে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল। স্কর্পিয়ন ফিশটার গা ঘেঁষে নড়ে বেড়াতে লাগল।
মেজরের চোখের সামনে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারলেন এটা জ্ঞান হারাবার আগের অবস্থা। মাথা নাড়া দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই শুড়গুলো চাবুকের মত সপাটে খাড়া হয়ে উঠল মেজরের হাতের দিকে। ক্ষতবিক্ষত ঠোঁট দুটো প্রসন্ন হাসিতে দু ফাঁক হয়ে গেল মুখোশের ভিতর।
অক্টোপাসটা, মেজরের আদরের অক্টোপাস নির্মম নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। একটা মারাত্মক সম্ভাবনার কথা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি। শুড়গুলো পাক খেয়ে তার হাত বেয়ে আরও ওপরে উঠে গেল। নিচের টানটা আরও বেশি হল।
একটা আর্ত চিৎকার ধীরে ধীরে জনহীন সেই উপসাগরের নিস্তব্ধ বিস্তারের শূন্যতায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ল। মেজরের মাথাটা পানির নিচে তলিয়ে গেল। শুধু কয়েকটা বুদ্বুদ্ উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পানির বুকে।
কিছুক্ষণ পরে স্মিথের পা দুটো ঠেলে উঠলো পানির বাইরে, আরও ছোট ছোট ঢেউয়ের ছোঁয়ায় দেহটা এদিক ওদিক দুলতে লাগল। অক্টোপাসটা তখন শুড়ের নরম মাংস-ঘেরা চাকা চাকা গর্ত দিয়ে তার ডান হাতখানা চেখে চেখে দেখছে।
দু জন জামাইকান ছোকরা মাছ ধরতে গিয়ে মেজর স্মিথের দেহটা দেখতে পায়। মেজরের কোচটা দিয়েই অক্টোপাসটাকে গেঁথে, চিৎকারে উল্টে ফেলে মাথাটা কুপিয়ে কেটে শেষ করে দেয়, তারপর তিনটে মৃত দেহকে ডাঙ্গায় টেনে তোলে, মেজরের দেহটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়, স্কর্পিয়ন ফিশ আর অক্টোপাসটাকে বাড়ি নিয়ে যায় বেঁধে খাবে বলে।
জেল গ্রীনার পত্রিকার স্থানীয় সংবাদ দাতা খবর পাঠায় যে, মেজর স্মিথকে অক্টোপাসে মেরেছে, কিন্তু বহিরাগত ট্যুরিস্টরা যাতে ঘাবড়ে যান, সেই ভয়ে খবরটা কাগজে ছাপা হল এই ভাবে যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
জেমস্ বন্ড খবরটা পেয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে ধরে নিয়ে এই মন্তব্য লিখলেন যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে। রিপোর্টের শেষ পাতায়, সে দিনের তারিখ দিল, তারপর ফাইলটা তুলে রাখল।
ডাক্তার গ্রীভস, ময়না তদন্ত করেছিলেন, তাঁর রিপোর্ট থেকেই সিক্রেট সার্ভিসের একদা দক্ষ অফিসারের অদ্ভুত শোচনীয় মৃত্যুকাহিনীর একটা পরিশিষ্ট দাঁড় করানো সম্ভবপর হয়েছিল।
.
নিলামী ইনাম
জুন মাসের প্রথম দিক। গরমটা খুব বেশি। বন্ড কাগজপত্র দেখছিল। ০০ বিভাগে যে সব ফাইল-পত্র আসে, দেখে শুনে নেবার পর তাতে পেঁড়া দিতে হয় ঘোর ছাই রঙা চক পেন্সিল দিয়ে। পেন্সিলটা এতক্ষণ হাতে ধরা ছিল, এবার নামিয়ে রাখল, কোটটা খুলে ফেলল। তার সেক্রেটারি মেরি গুডনাইট নিজের পয়সায় যে হ্যাঁঙ্গারটা টাঙিয়ে দিয়েছে, কোটটা পরিপাট করে তাতে ঝুলিয়ে রেখে আসা যেত, কিন্তু তা না করে ঝপ করে মেঝেয় জড়ো করে ফেলে দিল।
পৃথিবীতে কোথাও যেন কিছু ঘটছে না, সব শান্ত, সব স্বচ্ছন্দ। কয়েক সপ্তাহ ধরেই আসা আর যাওয়ার ছকে বাঁধা পড়ে আছে। টপ সিক্রেট এর ফাইল, এমন কি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত যেন একই অবস্থায় পড়ে আছে। এই ধরনের নিরালম্ব ফাঁকার আকারগুলো অসহ্য ঠেকে বন্ডের কাছে। সায়ান্টিফিক রিসার্চ ব্যুরোর একটা দাঁত ভাঙা নিবন্ধের পাতা ওল্টাচ্ছে বটে, কিন্তু চোখ বা মন তার ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষছে না।
রাশিয়ানরা কিভাবে সায়ানাইড গ্যাসকে অভিনব উপায়ে কাজে লাগাচ্ছে, তারই বিবরণ; খেলনা পিস্তলের পিছন দিকে ফোলা জায়গাটা টিপে ধরলে যেমন পিচকিরির মত পানি ছিটকায়, তেমনি একটা অতি সাধারণ আর সস্তার খেলনা পিস্তলের হাতিয়ার দিয়েই না কি মানুষ খুন করা যায়। সায়ানাইডের ধোয়া ছিটকে এসে মুখে লাগলেই, সঙ্গে সঙ্গে খতম। ঢালু জায়গায় পঁচিশ বছরের বেশি বয়সের লোকের ওপর প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের বিফলতাই মৃত্যুর কারণ বলে মেনে নেওয়া ছাড়া সম্ভবত কোন গতি থাকবে না।