বিচারা তাতিয়ানা! নিশ্চয়ই বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছে। কেন বন্ড তার মানসিক উদ্বেগ আর উত্তেজনার কথা ভাবেনি ন্যাশ ছিল বলে রক্ষে।
বিল চুকিয়ে, ভারি ব্যাগটা নিয়ে বন্ড তাড়াতাড়ি তাদের কামরার দিকে চলল।
৭নম্বর কামরায় বন্ড টোকা দিল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ন্যাশ বেরিয়ে বলল, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল এখন ঠিক আছে। ওপরের বিছানায় সে এখন ঘুমুছে। মেয়েটির পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে মনে হয় ওল্ডম্যান।
বন্ড কামরায় ঢুকে দেখল ফারের কোটের ভিতর থেকে হাতটা ঝুলে পড়েছে সে সন্তর্পণে হাতটা কোটের পকেটে দিতে গিয়ে দেখল হাতটা বেজায় ঠাণ্ডা। এখন ওর ঘুমোনোই ভাল তাই সে বেরিয়ে এল।
ন্যাশ বলল, এখন রাতের ব্যবস্থা করা যাক। আমার বই আছে। War and Peace প্রথমে আপনি ঘুমিয়ে নিন ওল্ডম্যান। আপনার চেহারাটা বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। যখন আর চোখ খুলে থাকতে পারব না তখন আপনাকে জাগিয়ে দেব। ৯ নম্বর কামরার দিকে সে ইঙ্গিত করল। এখনো বেরোয়নি। কোন রকম মতলব থাকলে বেরুবে মনে হয়। আপনার কাছে পিস্তল আছে, ওল্ডম্যান?
হ্যাঁ, তোমার নেই?
না, নেই। বাড়িতে একটা লুগার আছে কিন্তু এ ধরনের কাজের পক্ষে সেটা বেজায় ভারি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ড বলল, তাহলে, আমারটাই তোমার কাছে রাখ, চল, ভেতরে যাই।
তারা ভিতরে এল, বন্ড দরজা বন্ধ করে তার বেরেটা বার করে ন্যাশকে দিল, আটটা গুলি আছে, সেমি অটোমেটিক। সেফটি ক্যাচ বন্ধ আছে। পিস্তলটা নিয়ে পেশাদারের মত হাত রেখে সেটার ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল ন্যাশ। ক্লিক ক্লিক করে বার কয়েক সেফটি ক্যাচটা সে খুলল আর বন্ধ করল।
কেউ তার পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করে–এটা বন্ড বরদাস্ত করতে পারে না। পিস্তলটা কাছে না থাকলে নিজেকে তার বিবস্ত্র বলে মনে হয়। রুক্ষগলায় সে বলল, একটু হালকা। কিন্তু ঠিক ঠিক জায়গায় গুলি চালালে এটা নির্ভুলভাবে খুন করবে।
ন্যাশ মাথা নেড়ে জানালার পাশে নিচের বাঙ্কের এক কোণে বসে ভাবল, এই কোণে বসলাম এখানে থেকে গুলি চালানো সহজ।
কোট আর টাই খুলে বন্ড বালিশে হেলান দিয়ে সেই ব্যাগটার ওপর পা রাখল। এ্যামেবলার পত্রিকাটি তুলে সে পড়বার চেষ্টা করল কিন্তু তার ভারি ক্লান্ত মনে হল। বইটা কোলে রেখে চোখ বুজল সে। কিন্তু তার ঘুমনো কি উচিত। আর কোন সর্তকতামূলক ব্যবস্থা কি করতে পারে।
হ্যাঁ, সেই গোঁজগুলো। নিজের কোটের পকেট থেকে সেগুলো বার করে বাঙ্ক থেকে নেমে দুটো দরজার নিজে বন্ড সেগুলো ভাল করে আটকে দিল। তারপর আবার বাঙ্কে গিয়ে মাথার পেছনকার পড়ার আলোটা নিভিয়ে দিল।
রাতের বেগুনী আলোটা টিমটিম করে জ্বলল। থ্যাঙ্কস, ওল্ডম্যান, মৃদুস্বরে ন্যাশ বলল।
ট্রেনটা আর্তনাদ করে সশব্দে ঢুকল একটা টানেলের মধ্যে।
.
মারাত্মক বোতল
পায়ের গাটে মৃদু চাপ পড়তে বন্ডের ঘুম ভাঙল। সে নড়ল না। জন্তুর মত জেগে উঠল তার সমস্ত অনুভূতি।
কিছুই বদলায়নি। ট্রেনের সেই নানা শব্দ। কাঠের ফ্রেমের মৃদু কিছুকিছু, ওয়াশবেসিনের ওপরকার ছোট আলমারি থেকে মৃদু টুং টাংসেখানে হোল্ডারের মধ্যে নকল দাঁত ভেজাবার ছোট গ্লাসটা আলগা হয়ে গেছে।
কে তাকে জাগাল? বন্ড দেখল ন্যাশ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার বেগুনী আভা চোখ দুটোর তীক্ষ্ণতা অনুভব করল বউ। তার কালো ঠোঁট সামান্য ফাঁক, দাঁতগুলো চকচক করছে।
বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত, ওল্ডম্যান। আমি এখন কথা বলার মেজাজে আছি।
তার স্বরের মধ্যে নতুন কি রয়েছে। নিঃশব্দে বন্ড পা নামাল। তৃতীয় ব্যক্তির মত বিপদ এই ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
খুব ভাল কথা, বন্ড বলল। ন্যাশের ঐ কথায় কি ছিল যাতে তার শিরদাঁড়া সিরসিরিয়ে উঠছে। সেটা কি কর্তৃত্বের স্বর। সম্ভবত বিপদ নয়। ঘরের মধ্যে একটা উন্মত্ততার আভাস পাচ্ছে সে। এই লোকটা সম্বন্ধে তার সহজাত ধারণাটাই তা হলে ঠিক। পরের স্টেশনে লোকটাকে বিয়ে দিতে হবে। কোথায় তারা পৌঁচেছে। সীমান্ত কখন আসবে?
সময় দেখার জন্য বন্ড তার কব্জিটা তুলল। ন্যাশর-এর দিক থেকে শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ ক্লিক শব্দ। বন্ডের কব্জিতে সাংঘাতিক জোরে একটা আঘাত লাগল, কাঁচের টুকরোগুলো ছিটকে পড়ল তার মুখে। দরজায় সজোরে আছড়ে পড়ল তার হাতটা। কব্জিটা কি ভেঙে পড়ল?–বন্ড ভাবল, হাতটা ঝুলিয়ে আঙুলগুলো নেড়ে দেখল ঠিক আছে।
বইটা তখনো ন্যাশের কোলে খোলা। কিন্তু এখন সেটার পুটের ওপরকার ফুটো দিয়ে সামান্য বোয়া বেরুচ্ছে। ঘরে বারুদের অস্পষ্ট গন্ধ।
বন্ডের বুকের ভেতরা শুকিয়ে গেল।
তাহলে আগাগোড়াই একটা জালপাতা ছিল। মস্কো থেকে ক্যাপটেন ন্যাশকে তার কাছে পাঠানো হয়েছে। M তাকে পাঠায়নি। ৯ নম্বর কামরায় আমেরিকান পাসপোর্টের MGB এজেন্টের কথাটা একেবারেই বানানো। তারপর বন্ড ন্যাশকে তার পিস্তলটা দিয়েছে। এমন কি দরজায় তলাক্ত শক্ত করে দেয়া গোজগুলো। ফলে ন্যাশ এখন নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করছে।
বন্ড শিউরে উঠল–ভয়ে নয়, বিতৃষ্ণায়।
ন্যাশ কথা বলতে শুরু করল জোরালো দৃঢ় গলায়। যা দেখলাম তাতে অনেক আজেবাজে কথা বলার দরকার হবে না। ওরা মনে করে এই বই-এর মত যন্ত্রটা আমার হাতে ভাল খেলে। এটার মধ্যে দশটা বুলেট আছে–২৫ দমদম। একটা ইলেকট্রিক ব্যাটারি দিয়ে ছোঁড়া যায়। তোমাকে মানতেই হবে এ ধরনের যন্ত্র বানানোর ব্যাপারে রুশীরা। সিদ্ধহস্ত। তোমার বইটা শুধুই পড়বার জন্য। ভারি দুঃখের কথা, ওল্ডম্যান।