বাঙলা আর্যভূমি, কিন্তু এ ভূমির আর্যগণ উত্তর ভারতের অন্যান্য আর্যের মতো নন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার স্থান এখানে নয়। তাই মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১. বাঙলা দেশকে যখনই বাইরের কোনও শক্তি শাসন করতে চেষ্টা করেছে তখন বাঙালি বিদ্রোহ করেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপন স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাঠান যুগে বাঙলা অতি অল্পকাল পরাধীন ছিল এবং মোগল যুগেও মোটামুটি মাত্র জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত বাঙলা দিল্লির শাসন মেনেছে।
২. অন্যান্য আর্যদের তুলনায় বাঙালি কিছুমাত্র কম সংস্কৃতচর্চা করেনি, কিন্তু সে চৰ্চা সে করেছে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। আদিশূর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলের বহু চেষ্টাতেও বাঙালি উত্তর ভারতের সঙ্গে স্ট্রিমলাইনৃড় হয়ে সংস্কৃত পদ্ধতিতে সংস্কৃত বর্ণমালার উচ্চারণ করেনি এবং বাঙলাতে সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করার সময় তো কথাই নেই।
৩. বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে। এ সাহিত্যের প্রাণ এবং দেহ উভয়ই খাঁটি বাঙালি। এ সাহিত্যে শুধু যে মহাভারত্নে শ্রীকৃষ্ণ বাঙলায় খাঁটি কানুরূপ ধারণ করেছেন তাই নয়, শ্রীমতী শ্রীরাধাও যে একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুর্শিদিয়ার আশিক ও পদাবলির শ্রীরাধা একই চরিত্র একই রূপে প্রকাশ পেয়েছেন।
বাঙালির চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান। তার অর্থ এই যে, কি রাজনীতি, কি ধর্ম, কি সাহিত্য যখনই যেখানে সে সত্য শিব সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই সেটা গ্রহণ করতে চেয়েছে; এবং তখন কেউ ‘গতানুগতিক পন্থা’ ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’-র দোহাই দিয়ে সে প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এবং তার চেয়েও বড় কথা,– যখন সে বিদ্রোহ উচ্ছলতায় পরিণত হতে চেয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করেছে।
এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি মুসলমানও এ কর্মে পরম তৎপর। ধর্ম বদলালেই জাতির চরিত্র বদলায় না।
***
পাঠান আমলে বাঙলা দেশে আরবি-ফারসির চর্চা ব্যাপকভাবে হয়নি। সে যুগে বাঙলাতে লিখিত সরকারি দলিলপত্রে পর্যন্ত আরবি-ফারসি টেকনিকল শব্দ প্রায় নেই। মহাপ্রভু এবং তাঁর শিষ্যদের কেউ কেউ মুসলমান ধর্মের সঙ্গে সুপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সে যুগের বাঙলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ অতি অল্প।
খাস পাঠান যুগে তো কথাই নেই, মোগল যুগের প্রারম্ভেও কবি আলাওল যে কাব্য রচনা করেছেন তাতে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্যই লক্ষণীয়—
উপনীত হৈল আসি যৌবনের কাল।
কিঞ্চিৎ ভুরুর-ভঙ্গে যৌবন রসাল ॥
আড় আঁখি বঙ্ক-দৃষ্টি ক্রমে ক্রমে হয়।
ক্ষণে ক্ষণে লাজে তনু যেন শিহরয় ॥
সম্বরয় গিম-হার, কটির বসন।
চঞ্চল হইল আঁখি, ধৈরয-গমন ॥
চোররূপে অনঙ্গ অঙ্গেতে আসে যায়।
বিরহ বেদনা ক্ষণে ক্ষণে মনে ভায় ॥
এ ধরনের কাব্য তখন মুসলমানদের ভিতর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তার বর্ণনা পাই অন্য এক কবির কাছ থেকে। সৈয়দ সুলতান বলেন,
আপনা দীনের বোল্ একা না বুঝিল।
পরস্তব-সকল লৈয়া সব রহিল ৷
(দীন = ধর্ম; পরস্তব = পরধর্ম কীর্তন। এর পূর্বেই মুসলমানরা পদাবলী কীর্তন রচনা আরম্ভ করেছেন এবং কাজী ফয়জউল্লার ‘গোরক্ষ বিজয়’ মুসলমানদের ভিতর লোকপ্রিয় হয়ে গিয়েছে।)
মুসলমানরা আপন ধর্মচর্চা না করে ‘হিন্দুয়ানি’ কাব্য নিয়ে মেতে আছে দেখে মুসলমান মোল্লা-মৌলবিগণ তারস্বরে আপন প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং আরবি-ফারসিতে ধর্মচর্চা করবার জন্য বারবার কড়া ফতোয়া জারি করেছেন।
তখন সৈয়দ সুলতান বললেন, ‘আমরা বাঙলা ছাড়ব না; কিন্তু মুসলমান শাস্ত্রচর্চাও করব। তাই বাঙলাতেই মুসলমান শাস্ত্রচর্চা হবে।’
আরবি-ফারসি ভাষে কিতাব বহুত।
আলিমানে বুঝে, না বুঝে মূর্খসুত।
যে সবে আপন বুলি না পারে বুঝিতে।
পাঁচালী রচিলাম করি আছয়ে দৃষিতে ॥
আল্লায় বলিছে, ‘মুই যে-দেশে যে-ভাষ,
সে-দেশে সে-ভাষে কইলুম রসুল প্রকাশ।’
(আলিমান = আলিমগণ = পণ্ডিতগণ; রসূল আল্লার প্রেরিত পুরুষ, পয়গম্বর।)
অতি মোক্ষম জবাব। সৈয়দ সুলতান কুরানের বচন উদ্ধৃত করে সপ্রমাণ করলেন, বাঙলাতেই বাঙালি মুসলমানের শাস্ত্রচর্চা করা ফরজ– অবশ্য করণীয়।
সৈয়দ সুলতান কিন্তু আটঘাট বেঁধে পয়গম্বর সাহেবের বাণী বাঙলাতে প্রকাশ করেছেন। নিতান্ত যে কটি আরবি শব্দ ব্যবহার না করলেই নয়, তিনি মাত্র সেগুলোই ব্যবহার করেছেন এবং প্রচলিত হিন্দু ধর্মের মাধ্যমেই ইসলাম প্রকাশ করেছেন।
তোমার সবের মুই জানো হিতকারী।
ইমান-ইসলামের কথা দিলাম প্রচারি ॥
যেরূপে সৃজন হইল সুরাসুরগণ।
যেরূপে সৃজন হইল এ তিন ভুবন ॥
যেরূপে আদম ইবা সৃজন হইল।
যেরূপে যতেক পয়গম্বর উপজিল ॥
বঙ্গেতে এসব কথা কেহ না জানিল।
নবী-বংশ পাঁচালীতে সকল শুনিল।
এস্থলে দ্রষ্টব্য, হিন্দু-মুসলমান উভয়কে মুসলমান ধর্ম বোঝাতে গিয়ে কবি এমন সব বস্তুর উল্লেখ করেছেন, যা মুসলমান ধর্মে নেই। ‘সুর’ ‘অসুর’ কল্পনা ইসলামে নেই। ‘তিন ভুবন’ ইসলামে নেই, আছে ‘দুই ভুবন’। তাঁর পুস্তকের নাম ‘নবীবংশ’ ও হিন্দু ‘হরিবংশের’ অনুকরণ– আরবিতে এই ধরনের নাম নেই।