এর সঙ্গে সে-যুগে লম্বা কুর্তা পরা হত। ইনি পরেছেন কঞ্চুলিকা বা চোলি। আমি মাত্র একবার সেদিকে তাকিয়েছিলুম।
মোগল বাদশা মারা গেলে যে ছেলে রাজা হত সে অন্যদের চোখ চোখেরই সুরমা পরার শলা দিয়ে কানা করিয়ে দিত। আমার দুটি চোখই যেন কানা হয়ে গেল। ওরকম কিংখাব আমি দেশ-বিদেশের কোনও জাদুঘরেও দেখিনি। সোনা-রুপোর জরি দিয়ে সে কিংখাবে এমনই কারুকার্য করা হয়েছে যে কিংখাবের একটি টানাপড়েনের রেশমি সুতোও দেখা যাচ্ছে না।
ঘাঘরাটি ছিল যেন শীতল ঝরনা; এ যেন সাক্ষাৎ অগ্নিকুণ্ড।
চোলির হেথাহোথা দু একটি মুক্তো গাঁথা। যেমন বহ্নি নির্বাপিত করার জন্য ক্ষুদ্র হিমিকার নিষ্ফল প্রয়াস।
দু কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে বুলবুল-চশম্ ওড়না।
সেই ছেলেবেলায় দাদিমাকে বুলবুল-চশম শাড়ি পরতে দেখেছি। আর আজ তার-ই ওড়না অতি সূক্ষ্ম মসলিনের এখানে-ওখানে দুটি দুটি করে বুলবুলের চোখের (চশম) মতো ফুটো করে সে দুটি অতি ফাইন মুগা সিল্ক দিয়ে বোতামের ফুটোর মতো কাজ করা হয়। এ রমণীর রুচি আছে। ক্ল্যাসিস্ পড়ে। বুলবুল-চশম্ কালিদাসের যুগের, তার মূল্য ইনি জানেন।
আশ্চর্য! এলো খোঁপা! গামেটল রঙের কৃষ্ণনীল চুলের খোঁপাটি কাঁধে শুয়ে আছে যেন কৃষ্ণকরবীর স্তবক শুভ্র ফুলদানিতে ঘুমিয়ে আছে।
***
হঠাৎ দেখি এক চোখ-ঝলসানো সুন্দরী, বিধবার থান পরে! ইনি বিয়ের পরবে কেন? আমাদের দেশে তো কড়া বারণ। তখন আবার দেখি তার হাতে ফেনা-ভর্তি শ্যাম্পেনের গেলাস। নাহ, ইনি সদ্য স্টুডিয়ো থেকে শুটিঙ অর্ধসমাপ্ত রেখে এসেছেন।
আরও অনেকেই ছিলেন। বেবাক বর্ণনা দিতে হলে তামাম পুজো সংখ্যাটা আমাকেই লিখতে হয়। খর্চায় পুষবে না– সম্পাদক জানেন।
ইতোমধ্যে কৃষ্ণলাল জভেরি এসে আমাকে নিয়ে চললেন সেই তারকা যজ্ঞশালার প্রান্তদেশে অনাদৃতা ঊর্মিলার অবস্থা থেকে টেনেহিঁচড়ে অন্য প্রান্তে। কী ব্যাপার? জভেরি উত্তেজনার মধ্যিখানে ইংরেজি ভুলে গিয়ে গুজরাটিতে কী যেন ‘সুঁ সুঁ’ করলে। কে যেন আমাকে ইন্টারভু দেবে। আমি বেকার। বিধি তবে দক্ষিণ। অদ্য প্রভাতের সবিতা প্রসন্নোদয় হয়েছেন। আম্মো ইস্টার হব।
শমশাদ বানু লায়লা মৃদু হাস্য করলেন। ফিল্মস্টারের ধবধবে সাদা দাঁত নয়। গোলাপির চেয়েও গোলাপি রঙের অতি ক্ষীণ একটি ফিল-স্টারের দাঁতের উপর। কী সুন্দর! তাই বুঝি কালিদাস তাঁর নায়িকার দাঁতের সঙ্গে রাঙা অশোকের তুলনা দিয়েছেন– শুভ্র বন-মল্লিকার সঙ্গে দেননি। আগেই বলেছি, ইনি ক্ল্যাসিকস্। পানের রস গ্রহণ করতে জানেন। অন্য পান কিন্তু জানেন না। হাতে লেমন-স্কোয়াশ।
শুধালেন, ‘আপনি দার্শনিক?’
আমি জভেরিকে ধমক দিয়ে বললুম, ‘জভেরি!’
জভেরি ভীরু। বলল, ‘আমি কিছু বলিনি।’
আমি বিবি সাহেবাকে চালাকি করে শুধালুম, ‘আমাকে কি এতই বিজ্ঞ মনে হয়?’
‘বুদ্দু মনে হয়। বিজ্ঞ মনে হয় ফিল্মস্টারকে, ব্যাঙ্কারকে, পোকার খেলাড়িকে।’
বাধ্য হয়ে বললুম, ‘না। আমি দার্শনিক নই। আমি দর্শনের শত্রু, ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করি।’
শমশাদ বানুর মুখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটল।
এতদিনে আমার নীরস শাস্ত্রচর্চা ধন্য হল।
বললেন, ‘সে তো আরও ভালো। আমি তাই খুঁজছিলাম। আচ্ছা বলুন তো–’ বলে তিনি যেই একটু থেমেছেন, আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘বিবি সাহেবা, এই জায়গা কি ধর্ম-চর্চার পক্ষে প্রশস্ত?’
অবহেলার সঙ্গে বললেন, ‘নয় কেন? পাপীরাই তো ধর্মচর্চা করবে। ধার্মিকদের তো ওসব হয়ে গিয়েছে। তেলো মাথায় ব্রিলেন্টাইন? সেকথা থাক। আমি শুধোতে চাই, কেউ যদি মরে যায় (আমার মনে হল শমশাদ কেমন যেন একটু শিউরে উঠলেন) তবে আমি মরে গেলে তাঁকে দেখতে পাব কি?’
আমি শুধালুম, ‘কোন্ ধর্মমতে?’
‘সে আবার কী?’
‘আমি “তুলনাত্মক ধর্মশাস্ত্র” চর্চা করি।’
‘তার মানে?’
‘এই মানে ধরুন পৃথিবীতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান মেলা ধর্ম আছে। আমি প্রত্যেক ধর্মের জন্ম, যৌবন, বর্তমান অবস্থা,– কে কী বলে তাই পড়ি। যেমন প্রত্যেক দেশের ইতিহাস হয়, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেরও ইতিহাস হয়।’
একটু অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, ‘আমি অতশত বুঝি না। আমি ফিলমে কাজ করি আমি পণ্ডিত নই। আমি জানতে চাই, এতসব ধর্ম পড়ার পর এ বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত, পার্সনাল মতটা কী?’
মহা ফাঁপরে পড়লুম। বললুম, ‘আমি কখনও ভেবে দেখিনি। মুসলমান ধর্ম বলে– ’
বাধা দিয়ে বললেন, ‘থাক। আপনি তা হলে একটি আস্ত চিনির বলদ। ধর্ম বয়ে বেড়াচ্ছেন– কখনও কাজে লাগাননি।’
আমি বললুম, ‘ধর্ম কি মসলা বাটার জিনিস! নামাজের কার্পেট দিয়ে কি মানুষ বিছানা বাঁধে?’
অতি শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘না। কিন্তু নামাজের কার্পেটে মানুষ নামাজ পড়ে; ওটা শিকেয় তুলে রাখে না।’
আমি বললুম, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়াতে ফিলম-স্টারদের সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল। আপনি নিশ্চয়ই বিস্তর লেখাপড়া করেছেন।’
‘কী আশ্চর্য! এ তো কম-সেসের কথা। এটা না থাকলে প্রসার, ডিরেক্টর, এডমায়ারার, লাভারের দল আমাকে কুটিকুটি করে ফেলত না! ওসব কথা থাক্। আপনি আমার কথার উত্তর বেশ চিন্তা করে দিন।’
তার পর জভেরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহে জভেরি, ওঁকে একটা শ্যাম্পেন দাও না?’
আমি মাথা নেড়ে বললুম, ‘থাক্। আপনার পাল্লায় পড়ে আমার বিশ বছরের নেশা কপ্পুর হয়ে গেছে। আড়াই ফোঁটাতে আর কী হবে, লায়লীবানু!’