বসন্ত সেনের উচ্চারিত প্রতিটি কথা যেন নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের ছুঁচ বিধিয়ে দেয় দারোগা লক্ষ্মীকান্তর সর্বদেহে।
লজ্জায় অপমানে আক্রোশে তিনি যেন ফুলতে লাগলেন। রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে। মুখ দিয়ে তাঁর কোন বাক্যও সরে না।
হাতকড়াও দেবে নাকি! না এমনিই গেলে চলবে দারোগাবাবু? আবার প্রশ্ন করলেন বসন্ত সেন।
না, এমনি চলুন আমার সঙ্গে
কিন্তু যদি রাস্তায় তোমাকে একটা থাপড় কষিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাই, ধরে থাকতে পারবে তো? ঐ তো তোমার চেহারা! আমার শক্তির খবর জান তো! বৃদ্ধ হলেও এখনও লাঠি হাতে নিয়ে যদি দাঁড়াই, তুমি তোমার থানার সমস্ত চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়েও সামনে আমার দাঁড়াতে পারবে না।
লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের কথার কোন জবাবই দেন না।
এবারে মৃদু হেসে বসন্ত সেন বললেন, না, ভয় নেই চল। দেখেই আসা যাক তোমার আইনের দৌড়টা কত দূর!
অগ্রে অগ্রে বসন্ত সেন ও পশ্চাতে লক্ষ্মীকান্ত সাহা কক্ষের বদ্ধ দরজাটার দিকে অগ্রসর হলেন। দরজার কাছবরাবর গিয়ে হঠাৎ বসন্ত সেন ঘরে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে সম্বোধন করে বললেন, চললাম কিরীটীবাবু, মৃত্যুঞ্জয়ের সলিসিটার রায় অ্যাণ্ড বোসের অতীনলাল কাল-পরশুর মধ্যে হয়ত এসে পড়বেন। তাঁকে আসতে লিখেছিলাম। মৃত্যুঞ্জয়ের উইলের ব্যাপারে মিঃ বোস আসছেন, সান্যাল মশাই রইলেন, সত্যজিৎ রইলো, সকলের সামনে যেন উইলটা পড়া হয়। সম্পত্তির প্রবেট নিতে হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে সিন্দুকে নগদ টাকা আছে। চাবিটা আমি সবি মার হাতে গতকালই দিয়ে দিয়েছি।
কিরীটী এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। নির্বাক শ্রোতা হয়েই সমগ্র দৃশ্যটা আগাগোড়া উপভোগ করছিল। এখনও চুপ করেই রইল।
হঠাৎ অতঃপর লক্ষীকান্তের দিকে ঘরে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, এক মিনিট দারোগা সাহেব। তুমি একটু বাইরে যাও, আমি কিরীটীবাবুর সঙ্গে কথা বলে এক্ষুনি আসছি।
নিঃশব্দে লক্ষ্মীকান্ত দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে দরজাটা খুলে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
নিঃশব্দে বসন্ত সেন দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
কিরীটীবাবু!
বলুন।
আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
বলুন!
এ ব্যাপারে আর আপনি থাকবেন না। এখান থেকে চলে যান। আপনার পুরো ফিসই আমি দেবো। সবিতা আর সত্যজিৎ ওরা বুঝতে পারবে না—
কিন্তু
তাছাড়া ভেবে দেখুন, কি হবে আর মিথ্যা কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করে
আপনি কি তাই মনে করেন? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কথা কয়টি বলে কিরীটী তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তাই মনে করি। এটকু অন্ততঃ বুঝবার আমার শক্তি আছে কিরীটীবাবু, এবং পেরেছিও। আপনি লক্ষ্মীকান্ত নন, তাই আবার অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি ফিরে যান। বরং আপনার প্রাপ্যের চাইতে বেশীই কিছু—
ভুল করছেন আপনি সেন মশাই। বুঝতেই যখন কিছুটা আপনি আমাকে পেরেছেন, এটকুও আপনার বোঝা উচিত ছিল, টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে আপনি নিরস্ত করতে পারবেন না। তাছাড়া আরো একটা কথা, আমাকে এ কেসে নিযুক্ত করেছেন আপনি নন-সবিতা দেবী। তিনি যদি এখন আমাকে যেতে বলেন আমি সানন্দে এই মুহূর্তে চলে যাবো, অন্যথায়—
তাহলে আপনি স্থিরপ্রতিজ্ঞই?
কথা যখন দিয়েছি, একটা মীমাংসা না করা পর্যন্ত আমার যাবার উপায় নেই সেন মশাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। সত্য-সন্ধানী আমি—সত্য-বন্ধ!
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বসন্ত সেন কিরীটীর চোখের প্রতি চোখ রেখে।
শাণিত তরবারির মতই দুজোড়া চোখের দৃষ্টি পরস্পর যেন পরস্পরের প্রতি নিবন্ধ হয়ে আছে।
বেশ তবে তাই হোক। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বসন্ত সেন জবাব দিলেন।
একটা কথার জবাব আপনার কাছে পেতে পারি কি সেন মশাই? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে।
কি?
এমন কোন স্ত্রীলোককে আপনি কি জানেন, যিনি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিশেষ পরিচিতাই হয়ত ছিলেন, যার নামের আদ্যাক্ষর হয়ত ছিল ল—
কিরীটীর কথা শুনে চকিতের জন্যই যেন বসন্ত সেনের চোখের তারা দুটো জ্বলে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন বসন্ত সেন, না—
হুঁ। আর একটি কথা বলুন! বৌরাণীর বিলে নৌবিহারের জন্য এদের কোন নৌকা বা বোট ছিল কি?
না। জবাবটা বসন্ত সেন এবারে যেন একটু ইতস্তত করে দেন।
আপনার ঠিক স্মরণ আছে?
আছে বৈকি।
হ্যাঁ, একটা কথা গতকাল আপনাকে বলা হয়নি, কানাইয়ের মার ঘরের মেঝেতে কতকগুলো অস্পষ্ট ক্লেপ-সোলের জুতোর ছাপ দেখেছিলাম। এবং ঠিক অনুরূপ জুতোর ছাপ নন্দনকাননের মধ্যস্থিত বিরাম-কুটীরের ঘরের মেঝেতেও দেখেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর ছাপগুলো বুঝি সত্যজিৎবাবুরই, পরে বুঝেছি তা নয়
আমি তো ক্রেপসোল দেওয়া জুতো পরি না রায় মশাই! শান্তকণ্ঠে জবাব দেন বসন্ত সেন।
জানি। কিরীটীর ওপ্রান্তে বঙ্কিম হাসির একটা রেখা জেগে ওঠে এবং ধীরকণ্ঠে বলে, আচ্ছা নমস্কার। প্রয়োজন হলে আমাকে সংবাদ দিতে পারেন সেন মশাই। কারণ—
কিরীটীর কথাটা নায়েব বসত সেন শেষ করতে দিলেন না, প্রশান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, তার প্রয়োজন হবে না। ধন্যবাদ। নমস্কার।
অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে অতঃপর ঘাড় উঁচু করে দরজাটা খুলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে বসন্ত সেন কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।