- বইয়ের নামঃ ব্লু-প্রিন্ট
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃগোয়েন্দা কাহিনী
০১. নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের
নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের উপর যবনিকাপাত করবার পর দুটো দিনও কিরীটী একটু হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে পারে না। আবার দিল্লীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দপ্তরের সেক্রেটারী মিঃ সিংয়ের কাছ থেকে জরুরী ট্রাঙ্ক-কল এলো।
মিঃ রায়—
স্পিকিং। মিঃ রামস্বামীর সেক্রেটারী আমি–সিং।
নমস্তে, নমস্তে—বলিয়ে সিং সাব–
আমাদের সেই ব্যাপারটার মিঃ রামস্বামী আপনাকে তাগিদ দিতে বললেন—কবে আসছেন বলুন-কাল-পরশু-প্লেনেই চলে আসুন।
কিরীটী বললে, আপনাদের তো এখন পার্লামেন্টের সেসন চলছে। সেবারেই প্লেনের টিকিট পেতে আমায় গলদঘর্ম হতে হয়েছিল; তাছাড়া–
বলিয়ে?
এবারে আর প্লেনে যাবে না ভাবছি।
কেন, প্লেনেই তো আসা ভাল—
না, পরে বলবো—আমি ট্রেনেই যাবো।
কিন্তু–
ভয় নেই আপনার মিঃ সিং, আমি দুতিন দিনের মধ্যেই ওখানে হাজির হবো বলবেন আপনার মিনিস্টার সাহেবকে—হয়ত অন্য নামে—অন্য পরিচয়েও যেতে পারি—
বাট হোয়াই।
কিরীটী হেসে বললে, পরে জানতে পারবেন। আচ্ছা তাহলে ঐ কথাই রইলো।
কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
কৃষ্ণা পাশের সোফায় বসে একটা বই পড়ছিল, শুধাল, কার ফোন গো?
দিল্লীর স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারী মিঃ সিংয়ের। দিল্লী যাবার জন্য জরুরী পরোয়ানা।
সেই দলিলের ব্যাপারটা?
কিরীটীর সিগার কেস থেকে একটা সিগার তুলে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, মন্ত্রীমশাই খুব বেকায়দায় পড়েছেন।
কিন্তু মন্ত্রীমশাইয়ের অফিসের প্রাইভেট নিজস্ব চেম্বারের আয়রন সেফ থেকে গোপনীয় ডকুমেন্টস-এর ব্লু-প্রিন্ট চুরি যায়ই বা কি করে?
শুধু কি চুরি—একেবারে বিদেশে পাচার!
সত্যি সত্যিই পাচার হয়েছে নাকি?
নিঃসন্দেহে।
যায়ই বা কি করে?
বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা থাকলেই হয়। মীরজাফর-জগৎ শেঠ-উমিচাঁদদের বংশধরেরা তো একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি! তারা এখনো বহাল তবিয়তে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে।
কি জঘন্য মনোবৃত্তি—নিজের দেশের এত বড় শত্রুতা—
বিবেক বা দেশপ্রেম বলে কোন কিছুর বালাই ওদের আছে নাকি?
কবে যাবে?
দেখি কাল না হয় পরশু যেদিন টিকিট পাওয়া যায়।
তা ট্রেনে যাচ্ছো কেন, প্লেনেই তো–
না। প্লেনে যাওয়া মানে সকলের নজরে পড়া।
বাইরে শীতের রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। দিনকয়েক আগে দুদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় শীতটা যেন বেশ জাঁকিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে কনকনে হাড়-কাঁপানো হাওয়া সর্বক্ষণ।
কৃষ্ণা বই থেকে মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে, এখানেই এত শীত, দিল্লীতে যে কি শীত পড়েছে, সেটা বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারছি। কতদিন থাকবে দিল্লীতে?
কেন বল তো? কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাল।
ভাল লাগে না তুমি না থাকলে।
বেশ তো চল না তুমি কটা দিনের জন্য আমার সঙ্গে ঘুরে আসবে।
না।
না কেন? ভাবছি এবারে দেবেশের ওখানে গিয়েই উঠবো।
সরকারী গেস্ট হয়ে যাচ্ছো, হয়ত তারা তোমার থাকবার অন্য ব্যবস্থা করবে-কোন হোটলে বা কোন এম. পি. পাড়ার কোন কোয়ার্টারে তাছাড়া তুমি ব্যস্ত থাকবে।
তা করলেই বা। আমি যদি দেবেশের ওখানে থাকি, ওদের কি আপত্তি থাকতে পারে। চল, যাবে?
না, এবার থাক—তুমি বরং সুব্রতকে নিয়ে যাও।
তাকে তো নিয়ে যাবোই–একা যাচ্ছে কে? কে জানে কতদিন থাকতে হবে সেখানে। কারণ জালটা বহুদূর বিস্তৃত বলেই আমার মনে হচ্ছে।
কি করে বুঝলে?
সেবারে মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সেই রকমই মনে হয়েছিল।
দিন-দুই পরেই একটা ফোর বার্থ কম্পার্টমেন্টে দুটো বার্থ পাওয়া গেল দিল্লী কালকা মেলে।
কৃষ্ণা হাওড়া স্টেশনে এসে ওদের ট্রেনে তুলে দিল। ট্রেন ছাড়ার আগে সুব্রত বললে, তুমিও আমাদের সঙ্গে গেলে পারতে কৃষ্ণা।
হ্যাঁ-হয়ত দিবারাত্র এখানে ওখানে ছোটাছুটি করবে, না হয় মুখ গোমড়া করে পাইপ টানবে আর ঘরের মধ্যে পায়চারি করবে—ওকে তো জানি।
কিরীটী হেসে ফেলে।
হাসছো কি, মাথায় যখন তোমার রহস্যের ভূত চাপে, আয়নায় নিজের মুখের চেহারাটা তো আর কখনো দেখনি। দেখলে বুঝতে-কৃষ্ণা বলে।
কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, কি রকম দেখায় বল তো! সুকুমার রায়ের হুঁকোমুখখা হ্যাংলার মত?
সাবধান কৃষ্ণা, সুব্রত বলে ওঠে, কথাটা ওর অগণিত ভক্তদের কানে গেলে তুমি ওর অর্ধাঙ্গিনী বলেও রেয়াৎ করবে না।
কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলে, না করে করুক, তাই বলে যা সত্যি তা বলবো না?
বুঝলি সুব্রত, একেই বলে পেঁয়ো যোগীর ভিখ মেলে না।
থাক থাক হয়েছে, আমাকে কিন্তু রোজ একবার করে ট্রাঙ্ক-কল করবে।
যথা আজ্ঞা দেবী!
গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা পড়লো।
সুব্রত বলে, কি ব্যাপার—আমাদের কামরায় আর দুজন সহযাত্রীর এখনো দেখা নেই!
কিরীটী বললে, বোধ হয় ক্যানসেল করেছে তাদের প্রোগ্রাম।
দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়লো ঐ সময়—
কৃষ্ণা নেমে পড়—সুব্রত বললে।
কৃষ্ণা নেমে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে কিরীটীর দিকে তাকাল।
কিরীটী বলে ওঠে, কি হলো, চোখ ছলছল করছে কেন?
ইয়ার্কি করতে হবে না—কিরীটীর দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে কৃষ্ণা কামরা থেকে বের হয়ে যায়—ওরাও উঠে করিডোর দিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গে এগোয়।
কৃষ্ণা নেমে গেল।
ওরা দুজনে জানালা-পথে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে তখন
ক্রমে জনকোলাহল মুখরিত আলোকিত প্ল্যাটফর্মটা একটু একটু করে মিলিয়ে গেল। নানা কণ্ঠের নানা ভাষার মিশ্র একটানা গুঞ্জনটা এতক্ষণ যা কানের উপর এসে আছড়ে পড়ছিল, তাও ধীরে ধীরে শ্রুতির চৌকাঠটা পার হয়ে গেল।
এখন কেবল বিসর্পিল ইস্পাতের লাইনগুলো ইয়ার্ডের উজ্জ্বল আলোয় চিক চিক করছে—এক-আধটা ট্রেন এদিক ওদিক যাতায়াত করছে—চাকার শব্দ-ইঞ্জিনের শব্দ।
দূরে দূরে ইয়ার্ডের লাইটগুলো আলো ছড়াচ্ছে।
ওরা আবার একসময় করিডোর দিয়ে নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হলো। দরজাটা টেনে দিয়ে গিয়েছিল সুব্রত; এখন দেখলে দরজাটা খোলা আর নীচের একটা বার্থে বসে আছে দুজন।
অতি আধুনিকা একটি তরুণী। রূপ যত না থাক, রূপের জৌলুসকে বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রসাধন ও পোশাকের পারিপাট্যটা সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
পরনে দামী সিল্কের শাড়ি-ডিম মেরুন কালারের অনুরূপ জামা গায়ে-বগল পর্যন্ত কাটা হাতা। হাতে ছগাছি করে সোনার চুড়ি আর রিস্টওয়াচ। বয়স তিরিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। কপালে একটা সিঁদুরের বা কুমকুমের টিপ থাকলেও সিঁথিতে এয়োতির কোন চিহ্ন নেই অথচ দেখলে বাঙালি বলে মনে হয়। হাতে ধরা একটা ইংরাজী ফিল্ম ম্যাগাজিনে দৃষ্টিপাতে নিবদ্ধ। পাশে একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে আছে। ম্যানিকিওর করা আঙুলের দীর্ঘ নখগুলো। পাশে সামান্য ব্যবধানে বসে যে ভদ্রলোকটি পরনে তার দামী গরম স্যুট। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। বেশ হৃষ্টপুষ্ট লম্বা চেহারা। চোখে চশমা।
মুখটা গোলগাল। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যেই বলে মনে হয়। পায়ের নীচে গোটা-দুই সুটকেস। একটা বড় ফ্লাস্ক ও ছোট একটা বাস্কেট।
ওদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে মহিলাটি তাকালেনও না কিন্তু পাশের ভদ্রলোকটি চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালেন এবং হিন্দিতেই বললেন, আপলোগ এহি কামরামে যা রহে হেঁ?
সুব্রত বললে, জী!
আমার নাম রঞ্জিৎ কাপুর-কানপুর যাচ্ছি—আপনারা কতদূর? পুনরায় প্রশ্ন করলো।
কিরীটী এবারেও কোন কথা বললে না—পাশে একটা বই ছিল, সেটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণ।
সুব্রতই আবার বললে, জী দিল্লী
রঞ্জিৎ কাপুর আবার বললেন, আমার কানপুরে ট্যানারীর বিজনেস আছে— আপনারা দিল্লীতে কি বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি?
সুব্রত বললে, হ্যাঁ।
রঞ্জিৎ কাপুর বললেন, কিন্তু এখন তো ওদিকে ভীষণ ঠাণ্ডা।
তা তো হবেই–
তা দিল্লীই যাবেন–না আরো দূরে?
দেখি—এখনো কিছু ঠিক নেই। বেড়াতে বের হয়েছি।
আর উনি? কিরীটীর দিকে ইঙ্গিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন রঞ্জিৎ কাপুর।
উনিও আমার সঙ্গে চলেছেন।
পার্শ্বে উপবিষ্টা মহিলা কিন্তু একবারও তাকালেন না ওদের দিকে। আপনমনে বই পড়েই চলেছেন, যেন ওদের কথাবার্তা তার কানে প্রবেশই করছে না।
সুব্রতই আবার জিজ্ঞাসা করে, উনি?
উনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন না—তবে আমার পরমাত্মীয়া অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বহিন।
কিরীটী ঐ সময় সুব্রতর আলাপে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে ডাকল, এই সু—
কি রে?
একটু চলে আয় না। এই যে—
সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে উপরের বাঙ্ক থেকে বাস্কেটটা নামিয়ে তার থেকে দুটো গ্লাস, সোডার বোতল ও ওল্ড স্মাগলারের শিশিটা বের করল।
দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সোডা মিশিয়ে একটা গ্লাস কিরীটীকে দিল, অন্যটা নিজে নিল। তারপর হঠাৎ কি ভেবে কাপুরের দিকে তাকিয়ে বললে, মিঃ কাপুর–লাইক টু হ্যাভ সাম ড্রিঙ্ক!
অফ কোর্স।
সুব্রত আর একটা গ্লাস বের করছিল কিন্তু মিঃ কাপুর নিজেই তার বাস্কেটটা টেনে খুলে একটা গ্লাস ও ভ্যাট ৬৯-এর বোতল বের করলেন, তারপর গ্লাসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিলেন।
সুব্রত কাপুরের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে গ্লাসটা কাপুরের দিকে তুলে শুধালে, দিস্ মাচ!
ইয়েস।
হাউ মাচ সোডা?
একটু বেশী দেবেন।
সুব্রত গ্লাসে সোডা মিশিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে কাপুরের দিকে।
০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন
কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন, তারপর নিজে একটা সিগারেট নিয়ে কেসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরলেন, সিগ্রেট–
নো, থ্যাংকস।
হোয়াট অ্যাবাউট ইউ? কাপুর কেসটা এবারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরলেন।
নো, থ্যাংকস।
আপনার চলে না?
চলে, তবে সিগার—বলে কিরীটী পকেট থেকে একটা চামড়ার সিগার কেস বের করে তা থেকে একটা সিগার নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে উদ্যত হলো। তখন সে তার গ্লাসে ওষ্ঠ স্পর্শ করেনি।
ভদ্রমহিলা কিন্তু একই ভাবে তার হাতের ম্যাগাজিনটা পড়ে চলেছিলেন। এতক্ষণ ওদের দিকে তাকানওনি।
হঠাৎ কিরীটী ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, আমরা আপনার কোন অসুবিধা করছি না তো?
ভদ্রমহিলা চোখ তুললেন—চোখে-মুখে একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন। না, না–ক্যারি অন!
পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরাজী ও বাংলা উচ্চারণ।
বাংলা শুনেই কিরীটীর মনে হলো ভদ্রমহিলা বাঙালী।
তাছাড়া ওসবে আমি খুবই অভ্যস্ত—আবার হাসলেন ভদ্রমহিলা।
হঠাৎ সুব্রতর কি হলো, বললে, কিন্তু কেমন যেন বিশ্রী লাগছে–
না, না তাতে কি হয়েছে? আপনাদের কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই—আমাদের ঐ কাপুর সাহেবটির জন্য আমরা ও-ব্যাপারে রীতিমত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি—স্মিতকণ্ঠে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা; কিন্তু চোখে-মুখে তার সেই চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছিল।
ইয়েস—শকুন্তলা ইজ কোয়ায়েট হ্যাভিচুয়েটেড! কোন উন্নাসিকতা নেই-হাজার হলেও এ যুগের তরুণী তো। হাসতে হাসতে বললেন মিঃ কাপুর।
একটু কটাক্ষ হেনে শকুন্তলা বললেন, এ যুগের তরুণীদের যেন একেবারে সব আদিঅন্ত জেনে ফেলেছেন মশাই
পরিষ্কার বাংলা পরিষ্কার উচ্চারণ শকুন্তলার।
কিরীটী বললে সকৌতুকে, আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন।
মানে! বাংলা বলবো না কেন? আমি তো বাঙালী—
হ্যাঁ মশাই—মিঃ কাপুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, একেবারে সেন্ট পারসেন্ট বাঙালী–
আপনি—
হ্যাঁ, ওর ভগ্নীটিও তাই—বাঙালী মেয়েই বিয়ে করেছি।
তাই বলুন! কিরীটী বলে।
কিরীটী মৃদুহেসে বলে, তাহলেও খারাপ লাগছে মিঃ কাপুর, আমরা ড্রিঙ্ক করছি আর উনি চুপচাপ বসে আছেন—-মিস–
আমার নাম শকুন্তলা চ্যাটার্জী। শকুন্তলা বললেন, আমার ফ্লাক্সে গরম কফি আছে, আমি বরং কফি খাচ্ছি—বলতে বলতে শকুন্তলা ফ্লাক্সটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন।
ক্রমশ চারজনের মধ্যে বেশ গল্প জমে ওঠে।
হঠাৎ একসময় শকুন্তলা কথার মধ্যে বলে উঠলেন, আচ্ছা ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিঃ রায়—আপনি কি এসময় সত্যি সত্যিই স্রেফ বেড়াতেই যাচ্ছেন দিল্লীতে?
কেন বলুন তো? একটু কৌতুকের দৃষ্টিতেই যেন তাকাল প্রশ্নটা করে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে।
কারণটা ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না কেন?
আপনার মত লোক বিনা প্রয়োজনে এই প্রচণ্ড শীতে দিল্লীতে চলেছেন–
আমার মত লোক? আপনি আমাকে চেনেন নাকি? কিরীটী তাকাল কথাটা বলে শকুন্তলার মুখের দিকে। তার দুচোখে শাণিত দৃষ্টি–
আপনাকে কে চেনে না বলুন—কিরীটী রায়কে চেনে না—তারপরই একটু থেমে মৃদু হেসে শকুন্তলা বললেন, দেখেই আপনাকে আমি চিনেছিলাম—
কিরীটী প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো।
কিন্তু সত্যি বলুন না কেন এসময় দিল্লী যাচ্ছেন?
অনুমান করুন না।
কেমন করে অনুমান করবো?
কেন, পারেন না?
হঠাৎ যেন একটু থতমত খেয়েই শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে মুহূর্তের জন্য তাকালেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, পারছি না।
থট-রিডিং করুন।
ও বিদ্যে আমার জানা নেই, আপনার আছে নাকি? সকৌতুকে তাকালেন শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে। তার দুই চোখে সেই চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন ঝিলিক হানছে। বলুন তো আমি এই মুহূর্তে কি ভাবছি? শকুন্তলা প্রশ্ন করেন।
আপনি ভাবছেন—
বলুন! বলুন না? গলায় শকুন্তলার আবদারের সুর যেন একটা।
সুব্রত ও রঞ্জিত কাপুর কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আছে তাদের আলোচনা ভুলে। কাপুর না বুঝতে পারলেও সুব্রত যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কিরীটীর দুচোখের তারায় কেবল কৌতুকই নেই—সেই কৌতুকের পিছনে ঝিলিক দিচ্ছে আরো একটা কিছু।
আপনি ঠিক এই মুহূর্তে ভাবছেন—
ইয়েস! বলুন!
যে কাজের জন্য আপনি চলেছেন তা খুব সহজ হবে না—তাই নয় কি?
খিলখিল করে হেসে উঠলেন শকুন্তলা কামরার মধ্যে যেন হাসিটা মিষ্টি জলতরঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ল। শকুন্তলা বললেন, ভুল–
ভুল!
হ্যাঁ, কারণ কোন কাজের জন্যই আমি—
তবে এ সময় আপনি দিল্লী চলেছেন কেন?
দিল্লী? কে বললে? আমি তো কানপুর চলেছি।
যাচ্ছিলেন দিল্লী, তবে আপাতত ভাবছেন কানপুরেই ব্রেক-জার্নি করবেন।
ব্রেক-জার্নী করবো কানপুরে?
হ্যাঁ।
শকুন্তলা আবার পূর্বের মত হেসে উঠলেন। বললেন, কানপুরেই যাচ্ছি—আমার দিল্লী যাবার আপাতত কোন প্রোগ্রামই নেই।
মোস্ট ডিপ্লোমেটিক—
কি বললেন?
কিছু না—তবে এটা জানি—
কি জানেন? দিল্লীতে আবার আমাদের দেখা হবে।
তা যদি হয় মিঃ রায় সত্যিই খুব খুশী হব।
আমিও। কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
ট্রেনের গতি বাইরে মন্দীভূত হয়ে আসছিল ইতিমধ্যে।
সহসা কিরীটী প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। বললে, সুব্রত, বোধ হয় বর্ধমানে এসে গেল গাড়ি!
সত্যি বর্ধমান। স্টেশন ইয়ার্ডের আলো চলমান গাড়ির জানলা-পথে সকলের চোখে পড়ে। গাড়ির গতি আরো মন্দীভূত হয়ে আসছে।
কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চল্ সুব্রত–
কাপুর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় চললেন মিঃ রায়?
ডাইনিং সেলুনে যাচ্ছি-যাবেন নাকি?
হ্যাঁ, যাবো বৈকি—আপনারা এখোন আমরা আসছি।
গাড়ি ধীরে ধীরে আলোকিত প্ল্যাটফরমে ইন করছে।
কিরীটী আর সুব্রত কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
ডাইনিং সেলুনে বেজায় ভিড়।
টেবিলে টেবিলে যাত্রীরা সব বসে কেউ খাচ্ছে, কারো খাওয়া শেষ, এবারে উঠবে। কাঁটা-চামচের ঠুংঠাং শব্দ-বহু কষ্ঠের মৃদু গুঞ্জন আর সিগারেটের ধোঁয়া। অনেকেই হাওড়া থেকে ডাইনিং সেলুনে উঠেছিল–তারা উঠে পড়ে।
কোণের একটা টেবিলে দুজনে গিয়ে বসল।
বসতে বসতে সুব্রত বলে, কৃষ্ণাও টিফিন-ক্যারিয়ারে প্রচুর খাবার দিয়ে দিয়েছে। তবে আবার এখানে এলি কেন?
কিরীটী যেন কি ভাবছিল, সুব্রতর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।
খাবারগুলো—
নষ্ট হবে না, কাল খাওয়া যাবে। কিরীটী বললে।
বেয়ারা এসে দাঁড়াল অর্ডার নেবার জন্য।
সুব্রত বললে, কি অর্ডার দেবো বল?
যা খুশি দে না–
সুব্রতই তখন মেনু দেখে খানার অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে গেল। কিরীটী কাঁচের জানলাপথে বাইরের আলোকিত প্ল্যাটফর্মের দিকে চেয়ে থাকে।
তুই যেন কিছু ভাবছিস মনে হচ্ছে কিরীটী।
তোকে একটা কাজ করতে হবে সুব্রত—
কি, বল্।
কানপুরে তোকে ব্রেক-জার্নি করতে হবে।
সুব্রত চমকে যেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
ওরা কোথায় যায়, কোথায় ওঠে তোকে জানতে হবে, তারপর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়—পরের ট্রেনেই হয়ত ওরা দিল্লী যাবে—ওদের তুই ফলো করবি।
করবো—কিন্তু—
দিল্লীতে গিয়েও তুই ওদের ফলো করে ওরা কোথায় ওঠে জানবি, তারপর–
তোর সঙ্গে কোথায় কনটাক্ট করব?
দেবেশের ওখানে—ওকে আমি বলে রাখবো।
ঠিক আছে।
কিন্তু খুব সাবধান, মীনাক্ষী অত্যন্ত ধূর্ত ও সজাগ।
মীনাক্ষী!
ওর আসল নাম শকুন্তলা নয়, মীনাক্ষী—
কি করে জানলি?
ওর হাতের মীনা করা আংটিটা বাঁ হাতের অনামিকায় লক্ষ্য করলে দেখতে পেতিস।
সুব্রত কোন কথা বলে না।
কিরীটী একটু হেসে বলে, ও বুঝতে পারেনি কিন্তু আমি ওকে গাড়ির কামরায় দেখেই চিনেছিলাম–আই মেট হার বিফোর।
কোথায়?
দিল্লীতে।
দিল্লীতে!
হ্যাঁ, মিঃ সিংয়ের সঙ্গে গতবার যখন দিল্লীতে যাই–আমেরিকান কনসুলেটে একটা ককটেইল পার্টিতে ওকে দেখেছি?
সত্যি? হ্যাঁ, তাছাড়া—
কিন্তু কিরীটীর আর কথা বলা হলো না। বেয়ারা ঐ সময় খানা নিয়ে এলো।
ট্রেন ততক্ষণে আবার চলতে শুরু করেছে।
০৩. রাত প্রায় পৌনে দশটা
রাত প্রায় পৌনে দশটা।
ডাইনিং সেলুন প্রায় খালি হয়ে এসেছে তখন। কয়েকটা টেবিলে সামান্য কয়জন যাত্রী এদিক ওদিক ছড়িয়ে তাদের রাতের খানা শেষ করে কফির পেয়ালা নিয়ে বসেছে। কারো কারো সেই সঙ্গে চলেছে ধূমপান।
দ্রুত ধাবমান মেল ট্রেনের কাঁচের জানালা-পথে শীতের স্তব্ধ রাত্রির চতুর্দশীর চঁাদের আলো যেন অলসভাবে গা এলিয়ে পড়ে আছে।
মধ্যে মধ্যে এক-একটা স্টেশন মেল গাড়িটা অতিক্রম করে চলেছে। স্টেশনের আলো চকিতে যেন দেখা দিয়ে আবার দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যাচ্ছে।
ওরা দুজনেও ইতিমধ্যে খানা শেষ করে কফি নিয়ে বসেছিল। বেয়ারারা একে একে টেবিল পরিষ্কার করে ডিশ-প্লেট, কাঁটা-চামচ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেবল তারই মৃদু শব্দ মধ্যে মধ্যে শোনা যায়।
যে সময়ের কথা বলছি তখনো করিডোর ট্রেনের প্রচলন হয়নি।
কাজেই খানা শেষ হয়ে গেলেও গাড়ি আসানসোল না পৌঁছানো পর্যন্ত ওদের ডাইনিংকারেই থাকতে হবে।
কিরীটী!
উঁ—
ঐ রঞ্জিত কাপুর লোকটা—ওকে দেখেছিস আগে? মীনাক্ষীর ভগ্নীপতি?
না। তবে যে সম্পর্কটার কথা ওদের পরস্পরের বললে সেটাও আমার সত্য বলে। মনে হয় না।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।
কি? তোর ব্যাপারটা ওদের জানা?
নিঃসন্দেহে। যেভাবেই হোক, প্রতিপক্ষ টের পেয়েছে যে আমি দিল্লী কেন্যাচ্ছি এবং কবে, কখন যাচ্ছি।
তোর অনুমান যদি সত্য হয় তো তাই দেখতে পাচ্ছি।
যে কারণে প্লেনে না গিয়ে ট্রেনে চলেছি, সেটা দেখছি মাঠেই মারা গেল।
আমার মনে হয় গতবার যখনু তুই দিল্লী গিয়েছিলি তখনই ওরা জানতে পেয়েছিল কোনমতে—
কিরীটী কোন জবাব দিল না।
সে যেন কি ভাবছিল।
সুব্রত আবার বললে, ওদের অজ্ঞাতে ব্যাপারটা থাকলে তুই হয়ত কাজের কিছুটা সুবিধা পেতিস।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনো কোন অসুবিধা হবে না। যতটা সতর্ক থাকতাম তার চাইতে বেশীই থাকব কিন্তু গাড়ি বোধ হয় আসানসোল এলো—ইয়ার্ডের আলো দেখা যাচ্ছে।
একজন বেয়ারা কফির শূন্য কাপগুলো তুলে নিতে এসেছিল, তাকেই সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, আসানসোল আর কেতনা দূর?
আসানসোল গাড়ি আগয়ি সাব—
মিনিট দশেকের মধ্যে সত্যিই গাড়ির গতি হ্রাস পায়—বাইরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়।
বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা উঠে পড়ল।
গাড়ি থামতেই ওরা ডাইনিং-কার থেকে নামল।
কনকনে শীত বাইরে।
তবু তারই মধ্যে দেখা যায় প্ল্যাটফর্মে যাত্রীর ভিড়, ভেন্ডারদের চিৎকার—গরম চায়-গরম পুরি—পান সিগ্রেট–
ওরা এসে যখন কামরায় ঢুকলো—কাপুর উপরের একটা বার্থে আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। বোধ হয় ঘুমিয়েও পড়েছে। শকুন্তলা কিন্তু তখনো শোয়নি, নীচের বার্থে একটা কালো রংয়ের গরম রাত্রিবাস গায়েবার্থের উপর বিস্তৃত শয্যায় বসে একটা কি বই পড়ছে।
ওদের ঢুকতে দেখে বললে, খাওয়া হলো রায় সাহেব।
হ্যাঁ। কাপুর সাহেব দেখছি শুয়ে পড়েছেন।
হ্যাঁ। ওর নেশাটা বোধ হয় একটু বেশীই হয়েছিল, খানা খেয়েই শুয়ে পড়েছে। ওর তো এতক্ষে মধ্যরাত্রি।
সুব্রত বললে, আপনি যে শোননি?
ট্রেনে চট করে আমার ঘুম আসে না।
সুব্রত তার সুটকেস খুলে রাত্রিবাসটা বের করে কামরা থেকে বের হয়ে গেল।
ল্যাভেটরিতে গিয়ে রাত্রিবাস গায়ে চাপিয়ে সুব্রত মিনিট পনেরো বাদে যখন কামরায় ফিরে এলো, কিরীটী উঠে দাঁড়াল হাতে রাত্রিবাসটা নিয়ে।
কিরীটীর রাত্রে স্নান করা অভ্যাস, তা সে কি গ্রীষ্ম কি শীত। স্নান না করলে রাত্রে তার ঘুমই হয় না।
ফিরে এসে দেখলো কিরীটী, সুব্রত শুয়ে পড়েছে আগাগোড়া কম্বলটা মুড়ি দিয়ে। শকুন্তলাও শুয়ে পড়েছে।
রাতও অনেক হয়েছে।
কিরীটী বার্থে উঠে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গায়ে কম্বলটা টেনে দিল।
চলন্ত ট্রেনে কিরীটীরও তেমন বড় একটা ভাল ঘুম কোনদিনই হয় না। তবু সে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল কিরীটী।
যখন ঘুম ভাঙল চারিদিকে বেশ আলো ফুটে উঠেছে।
কামরার বন্ধ কঁচের শার্সি ভেদ করে কামরার মধ্যে আলো এসে পড়েছে-তবে সেটা খুব স্পষ্ট নয়। ঝাপসা ঝাপসা।
বালিশের উপর থেকে মাথাটা সামান্য তুলে নীচের দিকে তাকাল। ট্রেনের গতি তখন ক্রমশ হ্রাস হয়ে আসছে।
ট্রেন বোধ করি মোগলসরাই এলো।
গরম ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়িয়ে কিরীটী উপরের বার্থ থেকে নীচে নামল। নীচের দুটো বার্থে শকুন্তলা আর সুব্রত ঘুমোচ্ছ।
উপরের বার্থে ঘুমোচ্ছে কাপুর।
স্টেশন ইয়ার্ডে অনেক আলো দেখা যাচ্ছে।
কিরীটী চায়ের পিপাসা বোধ করে। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে কামরার মধ্যে যখন কিরীটী ফিরে এলো—দেখলো কামরার মধ্যে একমাত্র সুব্রত ছাড়া অন্য দুজন নেই।
মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেন থেমেছে।
কিরীটী বাইরে গিয়ে দুজনের মতো চায়ের অর্ডার দিয়ে যখন কামরার মধ্যে ফিরে এলো-দেখলো কাপুর আর শকুন্তলা বসে চা পান করছে।
সুব্রত তখনো ঘুমোচ্ছে।
শকুন্তলা আর রঞ্জিত কাপুর দুজনাই বললে, গুডমর্নিং, মিঃ রায়।
গুড মর্নিং।
চা চলবে নাকি? শকুন্তলা শুধায়।
আপনারা খান—আমি চায়ের কথা বলে এসেছি।
সুব্রত কম্বলের তলা থেকেই কথা বলে ওঠে, বলেছিস?
হুঁ। তোর ঘুম ভাঙল? কিরীটী প্রশ্ন করে।
সুব্রত বললে, অনেকক্ষণ!
বেলা দুটো নাগাদ ট্রেন কানপুরে এসে পৌঁছায়।
কথা ছিল শকুন্তলা একাই কানপুরে নেমে যাবে কিন্তু রঞ্জিত কাপুরও নেমে গেল।
সুব্রত প্রস্তুত হয়েই ছিল। ওরা গাড়ি থেকে নামার কিছু পরেই সুব্রতও সুটকেসটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
কিরীটী একাই গাড়ির কামরায়—আর কোন যাত্রী ছিল না।
ট্রেন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ কিরীটী চলন্ত গাড়ির জানালা-পথে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে-তারপর সকালে এলাহবাদে স্টেশনে কেনা সংবাদপত্রটা টেনে নেয় আবার নতুন করে চোখ বুলাবার জন্য।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা ওল্টাতেই হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের হয়ে পড়লো। একটু। কৌতূহলের বশেই ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ধরতেই কিরীটী যেন একটা চমক অনুভব করে।
ভাঁজ করা কাগজ মাত্র নয়, একটা চিঠি।
সংক্ষিপ্ত ইংরাজীতে লেখা। বেশ পরিষ্কার করে গোটা গোটা ইংরাজীতে লেখা। লেখাগুলো সামান্য যেন কেঁপে কেঁপে গিয়েছে।
মিঃ রায়,
যারা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তারা যেমন আলেয়ার পিছনে ছুটছেন— আপনাকেও ঠিক তেমনি ছুটে মরতে হবে। আপনার ক্ষমতা আছে আমরা জানি, কিন্তু পেনিট্রেশন করার চেষ্টা করলে বিপদকেই ডেকে আনা হবে জানবেন। আর তাছাড়া যে কাজের জন্য আপনি যাচ্ছেন সেটা এখন সকলেরই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।
–এক্স
কিরীটী বার দু-তিন আগাগোড়া চিঠিটা পড়লো।
হাতের লেখা থেকে ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না—হাতের লেখাটা মেয়ের না পুরুষের; খানিকটা মেয়েলী ধাঁচের লেখা বটে আবার পুরোপুরি মেয়েলীও নয়—পুরুষের হাতের লেখা হওয়াও আশ্চর্য নয়।
বেশ তাড়াতাড়ি লেখা হয়েছে।
কিন্তু লেখাটা কখন কাগজের মধ্যে এলো?
চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল কিরীটী।
এখন আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সত্যিই খুব সহজ নয়। দপ্তর থেকে যে গোপনীয় দলিলটা চুরি গিয়েছে সেটার মূল্য বা গুরুত্ব সম্পর্কে এখনো বিশেষ কিছু জানে না কিরীটী। তবে দলিলটার যে বিশেষ একটা মূল্য আছে সেটা সে বুঝেছিল, নচেৎ অন্তত সে-ব্যাপারে দিল্লীতে তার ডাক পড়তো না এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরও অতখানি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো না।
বিশেষ কোন আলোচনারই সুযোগ পায়নি গতবারে কিরীটী।
এবং এটাও সে বুঝতে পারছে, দলিলটা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে সরকার-পক্ষ যে তার সাহায্যের জন্য তাকে আহ্বান জানিয়েছেন সেটা অন্তত প্রতিপক্ষের অজানা নেই আর।
অতএব তাকে এবার খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হবে।
সকালের দিকে কিরীটী দিল্লী স্টেশনে অবতরণ করল।
তাকে নিয়ে যাবার জন্য হয়ত গাড়ি এবং তোক এসেছিল, কিন্তু কিরীটী সে সম্পর্কে কোন খোঁজখবরই নিল না—স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, সোজা রায়সিনহা রোডে যেতে।
মনে মনে স্থির করেছিল সে, সোজা গিয়ে আপাতত তার বন্ধু দেবেশের ওখানেই উঠবে।
তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
০৪. কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল
কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল দেবেশ তখনো অফিসে বের হয়নি। নিজের বাংলোতে তার অফিস-ঘরে বসে কাজ করছিল।
গেটের ভিতর দিয়ে ট্যাক্সি ঢোকার শব্দে দেবেশ বের হয়ে আসে।
কিরীটীকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে দেবেশ রীতিমত বিস্মিতই হয়।
কিরীটী তুই!
আমি এলাম বেড়াতে, কটা দিনের জন্য। চল্ ভিতরে যাওয়া যাক।
বলতে বলতে দুজন এসে দেবেশের অফিস-ঘরে ঢুকল।
তারপর কি ব্যাপার? এই শীতের সময় হঠাৎ রাজধানীতে!
চেয়ারে বসতে বসতে কিরীটী বললে, কেন, শীতের সময় তোদের রাজধানীতে আসা বারণ নাকি
তা নয়—তবে—
কি?
সত্যি বল্ তো ব্যাপারটা কি? তুই সত্যি সত্যি বেড়াতে এসেছিস?
বিশ্বাস করতে পারছিস না?
ঠিক তাই।
এসেছি কেন নিশ্চয়ই তুই জানবি তার আগে একটু চায়ের ব্যবস্থা কর—তোর গিন্নী কোথায়?
সে তো এখানে নেই।
নেই!
না, মাসখানেকের জন্য কলকাতা গিয়েছে। বলতে বলতে দেবেশ কলিংবেল বাজাল। বেয়ারা রামলাল এসে ঘরে ঢুকল।
রামলাল!
জী সাব—
চা নিয়ে আয়—
রামলাল চলে গেল।
দু-একদিন থাকবি, না আজই চলে যাবি? দেবেশ শুধায়।
দিন দশ-বারো হয়ত থাকবে।
সঙ্গে মালপত্র কিছু নেই?
একটা সুটকেস আর একটা হোলডল।
একটু পরে রামলাল চা নিয়ে এলো।
দুই বন্ধুতে চা-পান করতে করতে আবার কথা কয়। এবং তখুনি কিরীটী সংক্ষেপে তার দিল্লী আগমনের কারণটা দেবেশকে খুলে বলে।
কিন্তু ব্যাপারটা টপ সিক্রেট
ভয় নেই তোর, এখান থেকে তোর সিক্রেট বের হবে না। হাসতে হাসতে দেবেশ। বললে।
জানি। শোন্ তোকে একটা কাজ করতে হবে।
কি বল্?
প্রতাপ সিংকে তুই জানিস নিশ্চয়ই!
একজন প্রতাপ সিংকে জানি, প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারী–কিন্তু কেন বল্ তো? লোকটা কিন্তু বিশেষ সুবিধার নয়।
আর কোন প্রতাপ সিং কেউ কোন দপ্তরে সেক্রেটারী আছে নাকি!
আর একজন সিং আছে তবে সে প্রতাপ সিং নয়।
প্রতাপ সিং রামস্বামীর সেক্রেটারী তো?
হ্যাঁ, তিনিই বটে।
তাকে একবার এখন ফোনে পাওয়া যাবে?
তা হয়ত যেতে পারে।
দেখ তো, কানেকশন পাস কিনা।
প্রতাপ সিংকে বাড়িতে নয়, তার দপ্তরেই পাওয়া গেল।
ফোনটা দেবেশ কিরীটীর হাতে তুলে দিল।
মিঃ সিং—গুড মর্নিং—আমি রায়!
মিঃ রায়? কখন এলেন—কোন্ ট্রেনে, না প্লেনে এলেন?
সকালের ট্রেনেই এসেছি।
আমার লোক আর গাড়ি ফিরে এলো–তারা বললে আপনাকে খুঁজে পেলো না।
ইচ্ছে করেই ধরা দিইনি।
বুঝেছি–তা এখন কোথা থেকে কথা বলছেন? কোথায় উঠেছেন?
সাক্ষাতে সব জানাব-আপনার সঙ্গে কখন কোথায় দেখা হতে পারে বলুন, মিঃ সিং।
বলেন তো এই মুহূর্তেই হতে পারে, গাড়ি পাঠাতে পারি—আপনি তো জানেন, হাউ উই আর অ্যাঙসাস টু মিট ইউ!
ঠিক আছে, এখন বেলা পৌনে দশটা; এগারোটায় আপনার অফিসে মিঃ গুলজার সিং নামে একজন যাবে
হু ইজ গুলজার সিং?
সাক্ষাতেই তার পরিচয় পাবেন। কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
বেলা ঠিক এগারোটায় মিঃ সিংয়ের বেয়ারা এসে সেলাম দিল, তার হাতে একটা চিরকুট—চিরকুটে লেখা ইংরেজীতে গুলজার সিং।
প্রতাপ সিং সেকেলে একজন পুঁদে আই. সি. এস. অফিসার—বয়েস পঞ্চাশের কিছু ঊর্ধ্বেই হবে। তবে চেহারা থেকে বয়েসটা ঠিক ধরা যায় না।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা—ছয় ফুটের কাছাকাছি প্রায় লম্বা। পাঞ্জাবী শিখ হলেও দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরনে দামী গরম সুট। মাথার চুল ব্যাক-ব্রাশ করা—রগের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে।
প্রতাপ সিং টেবিলের উপর একটা ফাইল খুলে কি সব দেখছিলেন, বেয়ারাকে বললেন, গুলজার সিংকে ঘরে পাঠিয়ে দিতে।
মে আই কাম ইন?
ইয়েস, কাম ইন।
কিরীটী এসে ঘরে ঢুকল। ডোর-ক্লোজার লাগানো দরজা নিঃশব্দে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে এক কোণে ইলেকট্রিক হিটার বসানো! ঘরের বাতাস বেশ উষঃ—আরামপ্রদ।
কিরীটীর পরনে দামী সুটি। মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, চোখে কালো কাঁচের চশমা।
প্রতাপ সিং কিন্তু চিনতে পারেন না কিরীটীকে, কারণ গতবারের বেশভূষা ছিল অন্যরকম কিরীটীর।
বৈঠিয়ে সাব।
কিরীটী বসলো মুখোমুখি একটি চেয়ারে।
আপনি মিঃ রায়ের কাছ থেকে আসছেন?
হ্যাঁ, মিঃ সিং—
ইয়েস–
আমিই রায়—
গুড হেভেনস।
হাশ! আস্তে—এখানে যে কদিন থাকবো এইটাই হবে আমার পরিচয়।
বাট হোয়াই?
প্রয়োজন আছে-যাক এখন কাজের কথায় আসা যাক—কেউ এখন এখানে আসবে না তো?
না।
তাহলে কাজের কথাতেই আসা যাক। সে দলিলটা সম্পর্কে আর কোন সংবাদ পাননি?
দলিলটা পাওয়া গিয়েছে।
গিয়েছে? হাউ? কোথায় পেলেন?
যে আয়রন সেফ থেকে খোয়া গিয়েছিল তার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।
বলেন কি? কবে পেলেন?
দিন দুই হলো।
কিন্তু আপনি তো আমাকে ফোনে সেকথা জানাননি।
না, জানাইনি–তার কারণ—
কি বলুন তো? কারণ যারা সেটা চুরি করেছিল তারা সম্ভবত তার একটা ব্লু-প্রিন্ট করে নিয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, তবে–
তবে কি?
সেবারে আপনাকে বলেছিলাম সেটা হয়ত বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমরা ভাল করে সংবাদ পেয়েছি এখনো সেটা পাচার করতে পারেনি।
আর ইউ শিয়োর?
নচেৎ বলবো কেন?
মন্ত্রীমশাই আছেন এখন অফিসে?
আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, তাকে আপনার কথা জানিয়েছি।
তাহলে একবার চলুন তার ঘরে যাওয়া যাক।
এখুনি যাবেন?
হ্যাঁ, চলুন—
দুজনে অতঃপর সিংয়ের ঘর থেকে বের হয়ে একটা লম্বা করিডোর অতিক্রম করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দপ্তরের সামনে এসে দাঁড়াল।
দরজার গায়ে লাল বাতি জ্বলছে। এনগেজড।
দরজার সামনে টুলের উপরে যে বেয়ারা বসেছিল সে সিংকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দেয়।
ঘরে কে আছে ব্রিজনাথ?
সাহেবের পার্সোন্যাল স্টেনোসাহেব কি সব যেন ডিকটেশন দিচ্ছেন।
আপনি একটু দাঁড়ান, আমি দেখি—প্রতাপ সিং দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট দুয়েক বাদে একটি অতি-আধুনিকা তরুণী হাতে কতকগুলো কাগজপত্র নিয়ে বের হয়ে কিরীটীর পাশ দিয়ে।
কিরীটী যেন তরুণীটিকে দেখেও দেখে না–সে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
প্রতাপ সিং দরজা খুলে কিরীটীকে ভিতরে আসতে আহ্বান জানাল।
কিরীটী ভেতরে প্রবেশ করল।
চমৎকার ভাবে সাজানো-গোছানো ঘরটি। ঘরটি কিরীটীর অপরিচিত নয়-ইতিপূর্বে দিল্লীতে এলে, ওই ঘরের মধ্যে মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনা হয়েছিল।
প্রতাপ সিং বোধ হয় আগেই কিরীটীর ব্যাপারটা রামস্বামীকে জানিয়ে দিয়েছিল? রামস্বামী তাকে সাদর আহ্বান জানালেন, বি সিটেড প্লিজ মিঃ রায়।
কিরীটী সামনের চেয়ারটায় বসে।
আচ্ছা মিঃ সিং, তুমি তাহলে সেই জরুরী ফাইলটা আজই যাতে আমাদের প্রধান মন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করো—আমি ততক্ষণে ওঁর সঙ্গে কথাটা সেরে নিই।
ও, কে-স্যার।
প্রতাপ সিং ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আপনি এসে গেছেন মিঃ রায়, আমি যেন বেঁচেছি। কি অসহ্য উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যে দিনরাত কাটছে।
০৫. আপনার সেক্রেটারীর মুখে শুনলাম
আপনার সেক্রেটারীর মুখে শুনলাম আসল ডকুমেন্টটা পেয়ে গিয়েছেন—কিরীটী বললে।
তাতেই তো আরো আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে, রামস্বামী বললেন।
ঠিক যেখানে ছিল আয়নার সে-এ, ঠিক সেখানেই পেয়েছেন কি ডকুমেন্টটা?
আঁ, হ্যাঁ তাই—একজাক্টলি হোয়ার ইট ওয়াজ! আরো নুতন করে গোলমাল দেখা। দিয়েছে ঐ দলিলটা আবার ফিরে পাওয়াতেই।
কেন?
প্রধান মন্ত্রীর ধারণা—
কি?
বুঝতে পারছেন না, যদিও রাদার ফ্যান্টাস্টিক—তাহলেও তার ধারণা, যারা হাতসাফাই করেছিল তারা নিশ্চয়ই তার একটা ব্লু-প্রিন্ট করে নিয়েছে।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তার ধারণা মিথ্যা নাও হতে পারে। হয়ত সত্যিই সেটার একটা ব্লু-প্রিন্ট করে নিয়ে দলিলটা আবার যথাস্থানে রেখে গিয়েছে—কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ যেন কিরীটী থেমে গেল।
মনে হলো তার মাথার মধ্যে হঠাৎ যেন কোন একটা চিন্তা এসে উঁকি দিয়েছে।
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
কিছু না—আচ্ছা মিঃ রামস্বামী—
বলুন।
দলিলটা যে চুরি গিয়েছিল, ব্যাপারটা কে কে জেনেছিল বলুন তো?
ব্যাপারটা প্রথম থেকেই, বুঝতেই তো পারছেন, সিক্রেট ও কনফিডেনশিয়াল রাখা হয়েছে–
তবু কে কে জানত?
প্রধানমন্ত্রী, আমি আর আমার চীফ সেক্রেটারী প্রতাপ সিং ছাড়া কেউ জানে না।
প্রতাপ সিংকে নিশ্চয়ই আপনি খুব বিশ্বাস করেন?
ওঃ, শিয়োর। হি ইজ অ্যাবভ অল সাসপিসান।
হুঁ। তা বলছিলাম—
বলুন।
দলিলটা যখন পেয়ে গিয়েছেন, তখন কি আর আমার কোন প্রয়োজন আছে?
কি বলছেন মিঃ রায়, দলিলের কপি যখন করে নিয়েছে—সেটা পাচার হবেই।
আর একটা কথা
বলুন!
আমি যাবো আপনার পার্টিতে কিন্তু আমার পরিচয়টা যেন যথাসাধ্য গোপন থাকে।
আপনি যেমন বলবেন মিঃ রায় তেমনিই হবে—তারপরেই একটু থেমে মন্ত্রী মশাই বললেন, আপনার ব্যক্তিগত সিকিউরিটির জন্য যদি কোন প্রহরার প্রয়োজন বোধ করেন তো আমাকে জানাতে কোনরকম দ্বিধাবোেধ করবেন না মিঃ রায়।
না, সেরকম কিছু আপাতত আমার প্রয়োজন নেই।
গাড়ি চাই না আপনার?
না।
কোথায় উঠেছেন।
রায়সিনহা রোডে।
আপনার থাকার তো আমি ভাল ব্যবস্থা করেছিলাম।
তার প্রয়োজন নেই।
ঠিক আছে, কিছু দরকার হলে সিংকে বলবেন।
জানাবো। এখন তাহলে আমি উঠবো—
কিরীটী মন্ত্রীমশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
বিকেলের দিকে সুব্রত এলো।
দেবেশ খনো অফিস থেকে ফেরেনি। শীতের বেলা ইতিমধ্যেই ম্লান হয়ে এসেছিল। দেবেশের বসবার ঘরে চা-পান করতে করতে দুজনার মধ্যে কথাবার্তা হয়।
তারপর তোর কি খবর বল্ সুব্রত?
খবর বিশেষ কিছু নেই—স্টেশন থেকে বেরুনো পর্যন্ত ওদের আমি ফলো করেছিলাম।
তারপর?
কিন্তু স্টেশনের বাইরে একটা গাড়ি ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল—সে গাড়িতে চেপে হাওয়া হয়ে গেল।
ওদের অনুসরণ করতে পারলি না?
বিরাট সুপার লাকসারী কার—গাড়িটার নম্বর ছিল দিল্লীর।
হুঁ। তাহলে তারা সোজা দিল্লীতেই এসেছে-কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা বললে কিরীটী।
ঐ সময় বেয়ারা রামলাল এসে বললে, সাহেব অফিস থেকে ফোন করছেন।
কাকে?
রায় সাহেবকে ডাকছেন।
কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল।
কে, কিরীটী?
হ্যাঁ, কি ব্যাপার?
গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, চলে আয়।
কোথায়?
আয় না। কিরীটীর মনে হলো দেবেশ যেন কোনমতে কথা কটা বলেই ফোনের কানেকশনটা কেটে দিল।
০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়
ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়, দেবেশবাবু ফোন করেছিলেন কেন?
বুঝলাম না ঠিক। বললে গাড়ি পাঠাচ্ছে, কোথায় যেন যেতে হবে।
কোথায়?
তা তো কিছু বললো না।
দেবেশবাবু জানেন কেন তুই এখানে এসেছিস?
হ্যাঁ, বলেছি।
কিরীটীর পরনে একটা গরম পায়জামা, পাঞ্জাবি ও গায়ে শাল ছিল; সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে প্রস্তুত হয়ে নিল।
একটু পরেই গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকছে হেড-লাইট জ্বালিয়ে দেখা গেল। গাড়ির আলোটা জানালার বদ্ধ কঁচের শার্সির উপর দিয়ে ঘুরে গেল।
ঐ, গাড়ি বোধ হয় এসে গেল। চলি।
একজন নেপালী ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। কালো রঙের ঝকঝকে একটা নিউ মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি।
কিরীটী গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়িটা দেবেশের নয়, একবার মনেও হয়েছিল কথাটা; দেবেশ তার নিজের গাড়ি না পাঠিয়ে অন্য গাড়ি পাঠাল কেন? এ কার গাড়ি?
কিরীটী তখন অপরিচিত বাঁধানো মেটাল পথ ধরে নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে।
কিরীটী মনে হয় একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় সে যাচ্ছে? কিন্তু কি ভেবে কোন প্রশ্নই করল না।
প্রায় মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে কুতুবের কাছাকাছি নতুন যে পল্লী গড়ে উঠেছে, এখানে ওখানে সব নতুন বাড়ি হচ্ছে, সেই পল্লীর মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াল।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দরজাটা খুলে দিল।
কিরীটী গাড়ি থেকে নামল।
নীচের তলায় আলো জ্বলছে।
এই কোঠি?
জী সাব—অন্দর যাইয়ে—
কিরীটী দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছাকাছি যেতেই দরজাটা খুলে গেল।
খোলা দরজার সামনে দামী সুট পরিহিত চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে। যুবক তাকে অভ্যর্থনা জানাল : মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
আসুন ভিতরে।
ঘরের মধ্যে পা দিল কিরীটী। আলোকিত কক্ষ—মূল্যবান রুচিসম্মত সোফা কাউচে ঘরটি চমৎকার করে সাজানো।
কেঝা যায় কোন ধনীর গৃহ।
মিঃ দাশ কোথায়?
উপরে চলুন।
কিরীটী যুবককে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে একটা ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল।
ভিতরে যান মিঃ রায়, মিঃ দাশ ভিতরেই আছেন।
একটু যেন কেমন ইতস্তত করে কিরীটী, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। কেন যেন মনে হয় কিরীটীর, হঠাৎ এভাবে দেবেশের একটা ফোন কল পেয়ে সোজা না এলেই ভাল হতো। কিন্তু চিন্তা করবারও আর তখন সময় নেই। কিরীটী দরজা ঠেলে ভিতরে পা দিল।
আলোকিত ঘরটা।
মাঝারি সাইজের এবং সে ঘরের মধ্যেও সব মূল্যবান আসবাবপত্র। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে কিরীটী কাউকে দেখতে পেল না।
ঘরটা খালি।
একটু যেন বিস্মিত হয়েই কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে।
আসুন মিঃ রায়–গুড ইভনিং।
ঘরের দক্ষিণ কোণ থেকে একটা ভারী পুরুষ-কণ্ঠ ভেসে এলো। এবং কিরীটীর মনে হলো কণ্ঠস্বরটা যেন তার পরিচিত। কিন্তু বক্তাকে ঘরের মধ্যে কোথাও দেখতে পেল না।
কিরীটী এদিক ওদিক তাকায়।
দক্ষিণ কোণে কেবল একটা ভারী পর্দা ঝুলছে। সেই পর্দা ঠেলেই এবারে যে লোকটি কক্ষের মধ্যে আবির্ভূত হলো তাকে দেখেই কিরীটী চিনতে পারে।
ট্রেনের সেই পরিচিত রঞ্জিৎ কাপুর।
গুড ইভনিং মিঃ রায়—চিনতে পারছেন?
কিরীটী প্রথমটায়—একটু হকচকিয়ে গেলেও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। পরিস্থিতির সঙ্গে। মৃদু হেসে বললে, পারছি বৈকি!
নিশ্চয়ই, চিনতে পারবেন বৈকি। আপনি গুণী লোক। কিন্তু বসুন-দাঁড়িয়ে কেন?
বসতে হবে না—
সে কি! বসবেন না?
না। যে জন্য এভাবে ধরে নিয়ে এলেন আমাকে সেটা বরং তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।
বলবো বলেই তো ডেকেছি। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর কথাবার্তা হতে পারে। আর সেটা শোভনও হবে না।
ইউ নীড নট ওরি, মিঃ কাপুর। আপনার কি বক্তব্য আছে বলে ফেলুন।
শুনবেন বৈকি এসেছেন যখন আপনাকে কৌশলে এখানে আমরা নিয়ে এসেছি বলবার জন্যেই তো—যা আমাদের
কথা বলে কি খুব কিছু একটা লাভ হবে মিঃ কাপুর, আপনাদের নেটওয়ার্কটা যখন আমি জানতে পেরেছি।
জেনে ফেলেছেন?
জেনেছি বৈকি। তাই বলছিলাম আপনার মত একজন কাট আউট অর্থাৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে কি আমার কিছু লাভ হবে। আপনি বরং আপনার বড় কর্তা স্টেশন চীফকে ডাকুন।
স্টেশন চীফকে ডাকবো?
হ্যাঁ, তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কি! যদি কিছু ডিল-এ আসতে হয় তা হলে স্বয়ং খোদ কর্তা বা স্টেশন চীফের সঙ্গেই কথাবার্তা বলা ভাল। তার সামান্য একজন এজেন্ট বা ইনফরমারের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ কি? আমারও সময়ের মূল্য আছে।
আপনি আমার সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।
রঞ্জিৎ কাপুরের গলার স্বরটা বেশ যেন গম্ভীর শোনাল।
বলতে পারি বলছেন?
হ্যাঁ।
বেশ, তবে বলুন আপনিই, আপনার কি বক্তব্য আছে?
আমার বক্তব্যটা তো আপনার অজানা নয়, মিঃ রায়।
আমাকে ভয় দেখিয়ে যে খুব একটা সুবিধা হবে না আশা করি সেটা অন্তত মিঃ কাপুর বুঝতে পেরেছেন?
রঞ্জিৎ কাপুর স্থিরদৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত চেয়ে রইল কিরীটীর মুখের দিকে, তারপর বললে, বেশ, তাহলে ডিলেই আসা যাক। কত টাকা পেলে আপনি এ রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াবেন?
আপনাদের অফারটা শুনি?
দশ হাজার।
মাত্র!
পনেরো হাজার।
পনেরো হাজার!
বেশ, পঁচিশ হাজার। কেমন, ডিল ক্লোজড!
তার আগে আমি জানতে চাই, আমার বন্ধু দেবেশ দাশ কোথায়?
যে গাড়িতে আপনি এসেছেন এখানে সেই গাড়িতেই তাকে তার বাংলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণে হয়ত তিনি বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছেন।
কেমন করে বিশ্বাস করবো আপনার কথা?
ঘরের কোণে ঐ যে ফোন আছে, ফোন করে দেখুন।
দ্যাট ইজ নট এ ব্যাড আইডিয়া! কিরীটী ফোনটার সামনে দাঁড়াল এবং দেবেশের নাম্বারের ডায়েল করল।
হ্যালো, কে।
দেবেশের বেয়ারা রামলালের গলা।
রামলাল, আমি কিরীটী—সাহেব বাড়িতে পৌঁছেছে?
এইমাত্র এলো একটা গাড়ি, দেখি বোধ হয় সাহেবেরই–
রঞ্জিৎ কাপুর ইতিমধ্যে যে কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কিরীটী তা বুঝতে পারেনি-সহসা রঞ্জিৎ কাপুর হাত দিয়ে টিপে ফোন কনেকশনটা অফ করে দিল এবং শান্তগলায় বললে, উহু, নো মোর মিঃ রায় বাজে কথা বাড়িতে ফিরে বলবেন। নাউ লেট আস ফিনিশ আওয়ার ডিল! টাকাটা আপনার একশত টাকার নোটে হলে চলবে তো?
টাকা তো আমি এখানে নেবো না মিঃ কাপুর—কিরীটী শান্তগলায় বললে।
এখানে নেবেন না! তবে কোথায়?
বুঝতেই পারছেন অতগুলো নগদ টাকা—
তবে কিভাবে কোথায় পেমেন্টটা করতে হবে বলুন?
কলকাতায়।
কিন্তু তা তো সম্ভব নয় সহসা ঘরের মধ্যে এক নারী কণ্ঠস্বর কিরীটীর কানে প্রবেশ করতেই কিরীটী ফিরে তাকাল–
একজন ভদ্রমহিলা।
বয়স চল্লিশের নীচে নয়।
দামী জর্জেটের শাড়ি পরিধানে—চোখে-মুখে উগ্র প্রসাধনের চিহ্ন। হাতে একটা কালো রংয়ের অ্যাট্যাচি কেস।
মিসেস খান্না?
রঞ্জিৎ কাপুরের প্রশ্নে মিসেস খান্না ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাপুর, ইফ হি ইজ এগ্রিড টু আওয়ার টার্মস, এই কেসে টাকা আছে, ওঁকে গুনে নিতে বললা—আর কাল ভোরের প্লেনে ওঁর টিকিটও রেডি আছে কাশ্মীরে যাবার–
কাশ্মীর! কথাটা বললে কিরীটীই।
হ্যাঁ, কাশ্মীরে এখন সোজা যাবেন। দশদিন পর সেখান থেকে ফিরবেন। হোটেলে আপনার ঘর ঠিক করা আছে।
নট ব্যাড! কিন্তু এই ঠাণ্ডায় কাশ্মীর-অন্য কোথাও গেলে হতো না ম্যাডাম?
কিরীটীর ঐভাবে হঠাৎ ফোন-কল পেয়ে চলে যাওয়াটা সুব্রতর ঠিক ভাল লাগেনি। কিন্তু কিরীটীকে সেকথা বললে সে শুনবে না তাই তাকে বাধা দেয়নি। কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে সেও বাইরে এসেছিল।
কিন্তু পোর্টিকোর আলোতে যখন দেখলো অপরিচিত ড্রাইভার ও অপরিচিত গাড়ি, সে কিরীটীকে বাধা দেবে ঠিক করেছিল কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিতে কিরীটী গাড়িতে উঠে বসে, ড্রাইভার গাড়িটা ছেড়ে দেয়।
সুব্রতর মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগে-কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে সে আর কালবিলম্ব না করে ঘরে ঢুকে সুটকেস থেকে লোডেড পিস্তলটা পকেটে পুরে সোজা গেট দিয়ে বের হয়ে পড়ে।
ভাগ্য ভাল বলতে হবে, বেরুতেই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে গেল।
সুবৰ্তর ট্যাক্সিতে উঠে সামনের দিকে চালাতে বলে ড্রাইভারকে। কিরীটীর গাড়ির নম্বরটা আগেই সে দেখে নিয়েছিল।
কিছুদূর যেতেই অগ্রবর্তী গাড়িটা সুব্রতর নজরে পড়ল।
ড্রাইভারকে সুব্রত অগ্রবর্তী গাড়িটাকে ফলো করতে বললে।
০৭. অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে
অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। হাত পনেরো-কুড়ির ব্যবধানে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে সুব্রতও ট্যাক্সি থেকে নামল।
ইধার ঠারিয়ে, আভি হাম আতে হে—
সুব্রত ইতিমধ্যে ড্রাইভারকে বলেছিল সে পুলিসের একজন অফিসার।
ড্রাইভার সুব্রতর প্রস্তাবে কোন আপত্তি জানায় না।
দূর থেকেই দেখতে পেল সুব্রত-বাড়ির দরজা খুলে গেল, একজন সুটপরা লোক কিরীটীকে ভিতরে ডেকে নিল, দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটা পিছনের দিকে চলে গেল।
সুব্রত আবার এগিয়ে যায়। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু দরজার গায়ে ঠেলা দিয়ে বুঝতে পারে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
যেমন করে হোক সুব্রতকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই হবে কিন্তু কেমন করে ঢুকবে বুঝতে পারে না। বাড়িটার চারপাশে একবার ঘুরে দেখা যাক—অন্য কোন প্রবেশপথ পাওয়া যায় কিনা। সুব্রত বাড়ির পিছনদিকে এগুলো।
বাড়িটা বোধ হয় মাত্র কিছুদিন হলো শেষ হয়েছে। চারিদিকে এখনো রাবিশ, ভাঙা ইটের টুকরো, লোহার রড, স্টোন-চিপস ছড়ানো। অন্ধকার রাত, ভাল কিছু দেখাও যায় না।
সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এগোয় সুব্রত।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
হাত-দশেক দূরে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে—খোলা একটা দরজা-পথে বাইরে আলো এসে পড়ছে খানিকটা।
গাড়ির সামনে বোধ হয় ড্রাইভারটা দাঁড়িয়ে। কি এখন করা যায় ভাবছে সুব্রত, এমন সময় হঠাৎ ওর নজরে পড়লো দুজন লোক দুপাশ থেকে একজন সুট পরিহিত
ভদ্রলোককে ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে এলো।
লোকটি মনে হয় ঠিক সুস্থ নয়, কেমন যেন টলছে!
পাশেই গ্যারেজ-মত একটা ঘর-সুব্রত এগিয়ে গেল—নিঃশব্দে গ্যারেজের পিছনে।
ড্রাইভার ও অন্য দুজন তোক সেই লোকটিকে গাড়ির মধ্যে তুলতে ব্যস্ত—এই সুযোগে সুব্রত চকিতে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজা-পথে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। সামনে সরু একটা প্যাসেজ-মত—তারপরই পাশাপাশি দুটো ঘর—দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ।
আরো একটু এগিয়ে দোতলায় উঠবার সিঁড়িটা ওর নজরে পড়ল। সিঁড়ির নীচে। জমাট অন্ধকার।
কাদের যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
ওরা হয়ত ফিরে এলো। সুব্রত চট করে সিঁড়ির নীচে আত্মগোপন করল। দুজনের পায়ের শব্দ।
সুব্রত বুঝতে পারে কাজ শেষ করে ওরা ফিরে এলো। ক্রমে পায়ের শব্দ সরু। প্যাসেজের অন্য প্রান্তে মিলিয়ে গেল।
শব্দ মিলিয়ে যাবার পরও মিনিট পাঁচ-সাত সুব্রত সিঁড়ির নীচে অন্ধকারের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কোনদিকে কোন আর শব্দ নেই।
সুব্রত সিঁড়ির নীচ থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে উপরে উঠে যায়। শেষ। ধাপে সবে পা ফেলেছে নজরে পড়ল ওর, একটা ঘরের ভেজানো দ্বারপথে ঈষৎ আলোর আভাস।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুব্রত এগিয়ে যায়।
কিরীটীর গলা ওর কানে আসে—আপনাদের অফারটাই শুনি।
কে যেন বললে, দশ হাজার—
কিরীটীর জবাব—মাত্র!
সুব্রতর বুঝতে আর বাকী থাকে না, কিরীটী শত্রুর ফাঁদে পা দিয়েছে।
দরজার গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ায় সুব্রত–প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ললাডেড পিস্তলটার ট্রিগারটা চেপে ধরে। ভাগ্যে সে পিস্তলটা সঙ্গে এনেছিল!!
কিরীটীর গলার স্বরটা কানে আসে, নট ব্যাড়, কিন্তু এই ঠাণ্ডায় কাশ্মীরে, অন্য কোথাও গেলে হতো না ম্যাডাম?
রঞ্জিৎ কাপুরের গলার স্বর, শুনুন মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে জোক করবার মত প্রচুর সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা আমাদের অফার আপনাকে দিয়েছি—নাউ ইউ ডিসাইড
দড়াম করে ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে গেল।
চকিতে সেই শব্দে রঞ্জিৎ কাপুর, সেই ভদ্রমহিলা ও কিরীটী ফিরে তাকাল দরজার দিকে।
দরজার উপরে দাঁড়িয়ে সুব্রত—হাতে ধরা তার পিস্তল।
ডোন্ট ট্রাই টু মুভ মিঃ কাপুর—এটার ছটা চেম্বারই ভর্তি!
ঘটনার আকস্মিকতায় সেই মহিলা ও রঞ্জিৎ কাপুর দুজনাই বিমূঢ় বিহুল—বোবা যেন।
কিরীটী ওদের বডি সার্চ করে দেখ, কোন আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা।
রঞ্জিৎ কাপুরের পকেটে পিস্তল পাওয়া গেল।
আগে সুব্রত বের হয়ে এলো, পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে চকিতে ঘরের দরজা বাইরে থেকে টেনে লক করে দেয়—ইয়েল লক সিস্টেম, চাবিটা পকেটে ফেলে দেয় দরজা থেকে খুলে।
তারপর দুজনে ছুটে নীচে এসে ট্যাক্সিতে চেপে বসতে পাঁচ মিনিটও লাগালো না।
রায়সিনহা রোডে যখন ওরা ফিরে এলো রাত তখন পৌনে এগারোটা।
দেবেশকে বাইরের ঘরেই পাওয়া গেল।
একটা সোফার উপরে সে শুয়ে-পাশে একজন ডাক্তার। রামলালও সেখানে। উপস্থিত।
আপনারা? ডাক্তার প্রশ্ন করেন।
রামলাল বলে, সাহেবের দোস্ত—
আই সী!
কি ব্যাপার, ডাক্তার?
মিঃ দাশকে কোন ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল বা ইনজেক্ট করা হয়েছিল রামলালের টেলিফোন পেয়ে যখন এলাম দেখি হি ওয়াজ ইন এ সেমিকনসাস স্টেজ। পা খুব ফিবল।
এখন কেমন আছেন?
এখন অনেকটা ভাল—আপাতত এখানেই থাকুন, আরো কিছুক্ষণ পরে নিয়ে গিয়ে বেডরুমে শুইয়ে দেবেন। আর এক কাপ গরম দুধ দেবেন।
পরের দিন দেবেশের মুখ থেকেই ওরা সব শুনলোলা।
অফিস থেকে সোয়া পাঁচটা নাগাদ সে বেরুতে যাবে, এমন সময় মিনিস্টারের জরুরী ফোন আসে তার বাড়ি থেকে।
তারপর?
বাইরে থেকে দেখি আমার গাড়িটা নেই। কি করি, জরুরী কল, তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ঐ দিকে আসতে দেখি, আসতে দেখে তাতেই উঠে বসি।
অ্যান্ড ইউ অয়ার ইন দি ট্র্যাপ দেবেশ, কিরীটী বললে।
একজাক্টলি! ট্যাক্সিতে উঠতেই একজন অ্যাট দি পয়েন্ট অফ এ গান আমাকে চুপচাপ থাকতে বলে। এবং আমাকে নিয়ে একটা বাড়িতে গিয়ে তোলে। সেখানে আবার দুজন লোক ছিল, তারা অ্যাট দি পয়েন্ট অফ এ গান আমাকে দিয়ে তোকে ফোন করায়। কিন্তু তুই গেলে যে সেখানে বিপদে পড়বি, কথাটা বলতে পারলাম না বুঝতেই পারছিস আমার তখন কি অবস্থা! তুই গিয়েছিলি নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে।
ভদ্রমহিলা!
হ্যাঁ, ম্যাডাম–
তারপর?
তারপর আর কি মোটা টাকার অফার—
বলিস কি?
ডকুমেন্টটা যে রীতিমত মূল্যবান ছিল, সেটা ভুলে যাস কেন? পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছিল, হয়ত পঞ্চাশেও রাজী হতো–তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি।
কি?
ডকুমেন্টটার রুপ্রিন্টটা এখনো পাচার করতে পারেনি ওরা ভারতবর্ষ থেকে।
কি করে বুঝলি?
নচেৎ অত টাকা কি অফার করে, না আমাকেই ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে?
কিরীটী?
কি?
আমার একটা কথা শুনবি?
কি কথা!
এ কেসটা ছেড়ে দে।
পাগল নাকি!
ওসব গ্যাঙ বড় সাংঘাতিক।
হতে পারে, তবে ওরাও জানে কিরীটীকে। ভয় নেই বন্ধু, চল্ আজ একবার তোর গাড়ি নিয়ে গতরাত্রের পাড়াটা ঘুরে আসি।
০৮. দুপুরে কিরীটী, সুব্রত ও দেবেশ বের হলো
দুপুরে কিরীটী, সুব্রত ও দেবেশ বের হলো গাড়ি নিয়ে—কিন্তু সেই পাড়ায় গিয়ে গতরাত্রের বাড়িটা ওরা কিছুতেই স্পট-আউট করতে পারল না। অনেক বাড়ি হচ্ছে, অনেকগুলো তৈরীও হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সবই প্রায় এক প্যাটার্নের যেন।
অনেকক্ষণ ধরে ঐ তল্লাটে গাড়িতে ঘুরে ঘুরে আবার ওরা ফিরে এলো।
সন্ধ্যায় মন্ত্রীর গৃহে ককটেল-পার্টি।
দুপুরে একবার কিরীটী বের হয়েছিল রামস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর অফিস চেম্বারে বসেই অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা হলো।
মন্ত্রীর ওখান থেকে ফিরতে কিরীটীর বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে হয়ে গেল। দেবেশ ঐদিন অফিস যায়নি।
ক্রমে দিনের আলো নিভে এলো। ছোট শীতের বেলা ফুরিয়ে এলো।
মন্ত্রী মশাই বলেছিলেন, তিনি তাঁর গাড়ি পাঠাবেন কিন্তু কিরীটী বলেছিল তার কোন প্রয়োজন নেই।
কটায় আসছেন মিঃ রায়?
ঠিক সময়েই যাবো।
রাত নটা নাগাদ কিরীটী আর সুব্রত বের হলো বেশভূষা করে।
দুজনারই মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, পরনে দামী সুট।
গুলজার সিং–হরবন্স সিং।
দেবেশের গাড়িতে করে বের হয়ে গেল। কনট প্লেসে এসে ওরা গাড়ি ছেড়ে দিল। ড্রাইভারকে বলে দিল, রাত দশটার পর যেন সে গাড়ি নিয়ে রামস্বামীর গৃহের সামনে গিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করে
ওখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিল ওরা।
মন্ত্রী মশাইয়ের গৃহের সামনে যখন ওরা এসে পৌঁছাল রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।
বাংলোর সামনে প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে।
দোতলার হলঘরে পার্টির ব্যবস্থা হয়েছিল।
ওরা যখন ঘরে গিয়ে ঢুকল, মদের তখন যেন ফোয়ারা বয়ে চলেছে। প্রায় জনাত্রিশেক নানা বয়েসী পুরুষ ও নারী।
সব দেশের ডিপ্লোম্যাটরাই সেখানে ভিড় করেছে। ইউ. কে, আমেরিকা, ফরাসী, জার্মানী, যুগোশ্লাভিয়া, কানাডা, জাপান সব ফরেন অফিসের ডিপ্লোম্যাটরা এসেছে এবং সস্ত্রীক।
গুনগুন একটা গুঞ্জন চলেছে ঘরের মধ্যে।
সিগারেটের ধোঁয়ায় যেন একটা কুয়াশা জমেছে।
পূর্ব-পরিকল্পনা মত কিরীটী ও সুব্রত হলঘরের মধ্যে ঢুকে দুজনে দুদিকে ছড়িয়ে যায়।
রামস্বামীর দৃষ্টি সজাগ ছিল।
কিরীটীকে দেখতে পেয়ে রামস্বামী এগিয়ে এলেন, গুড ইভনিং মিঃ সিং!
গুড ইভনিং।
একজন বেয়ারা ট্রেতে করে হুইস্কি নিয়ে এলো।
কিরীটী একটা গ্লাস তুলে নিল!
আমার দিকে আপনি নজর দেবেন না মিঃ রামস্বামী–ইউ লুক আফটার ইয়োর গেস্ট।
রামস্বামী সরে গেলেন।
কিরীটী চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। এবং সে চমকে উঠলো ভিড়ের মধ্যে শকুন্তলা অর্থাৎ মীনাক্ষীকে দেখে। শকুন্তলার পরিধানে আজ দামী সিফন, চোখে-মুখে উগ্র প্রসাধনের প্রলেপ।
সারা দেহে যৌবন যেন উপচে পড়ছে। রঞ্জিৎ কাপুরকে কিন্তু তাদের মধ্যে কোথাও দেখতে পেল না কিরীটী।
কিরীটী শকুন্তলার উপরে দৃষ্টি রাখে।
এক হাতে মদের গ্লাস, অন্য হাতে সিগারেট। বেশ স্বচ্ছন্দেই যেন ধূমপান করছে। শকুন্তলা।
হঠাৎ শকুন্তলার পাশে এসে দাঁড়াল রামস্বামীর সেক্রেটারী মিঃ সিং।
দুজনে কথা বলতে বলতে ঘরের এক কোণে এগুতে থাকে।
কিরীটী ওদের কাছাকাছি থাকবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ কিরীটীর কানে এলো মিঃ সিং বলছেন শকুন্তলাকে, মিস খাতুন, কালই তাহলে আপনি চললেন হংকং?
ও ইয়েস!
মিস খাতুন।
মিস খাতুন! তাহলে ভদ্রমহিলা হিন্দু নন-মুসলিম।
কিরীটী কান খাড়া করে রাখে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ হলে এসে ঢুকলো রঞ্জিৎ কাপুর ও গতরাত্রের সেই মহিলা অর্থাৎ ম্যাডাম।
রামস্বামীর সেক্রেটারী মিঃ সিং ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানায়।
ভদ্রমহিলার এক হাতে একটা বড় ঘড়ি।
ঘড়িটা যেন সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
একটু পরে কিরীটী দেখে সেই মহিলা ও শকুন্তলা ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে ফিসফিস করে কি যেন কথা বলছে।
পার্টি ভাঙলো প্রায় রাত দুটো নাগাদ।
একে একে গেস্টরা বিদায় নিতে থাকে।
কিরীটী একসময় রামস্বামীর সামনে এসে ফিসফিস করে বললে, একবার পাশের ঘরে চলুন মিঃ রামস্বামী, কয়েকটা কথা আছে।
রামস্বামী কিরীটীকে নিয়ে তার বেডরুমে গিয়ে ঢুকলেন।
কি কথা বলুন তো?
মিস খাতুনকে আপনি চেনেন?
ঐ মীনাক্ষী খাতুন! হ্যাঁ চিনি। কেন বলুন তো?
কতদিন থেকে ওঁকে চেনেন?
তা বছর দুই হবে।
কোথায় থাকেন উনি–কি করেন?
কি করেন ঠিক জানি না, তবে সব এমব্যাসিতেই ওঁর যাতায়াত আছে।
উনি কাল হংকং যাচ্ছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনাকে একটা সংবাদ নিতে হবে। কাল সকালে যেসব ইন্টারন্যাশানাল প্লেন ছাড়ছে তার মধ্যে কো-কোটা হংকং টাচ করবে!
ঠিক আছে।
যদি পারেন তো আজ রাত্রে সংবাদটা আমাকে জানাবেন।
জানাবো।
ভোর চারটে নাগাদ টেলিফোন বেজে উঠলো।
কিরীটী জেগেই ছিল। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো।
রামস্বামী স্পিকিং। মিঃ রায়!
হ্যাঁ আমিই—বলুন।
একটা থাই প্লেন কাল সকাল সাড়ে নটায় ছাড়ছে, সেট হংকং টাচ করবে।
আর কোন প্লেন?
না।
ঠিক আছে। আপনার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসারকে বলবেন, তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ পালাম এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকেন।
চতুর্বেদীকে তো আপনি চেনেন।
হ্যাঁ।
তাঁকেই বলবো থাকতে।
০৯. পালাম এয়ারপোর্ট
পালাম এয়ারপোর্ট।
বেলা আটটার আগেই কিরীটী এসে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হলো সুব্রতকে নিয়ে। তার বেশভূষা আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম।
মরক্কো দেশীয় এক সুলতানের মত। চোগা চাপকান, মাথায় হ্যাট, তার উপরে কালো মোটা কর্ড পাচানো-চোখে কালো চশমা।
চতুর্বেদীকে দেখা গেল সে ইন্টারন্যাশানাল কাউন্টারের কাছেই রয়েছে। আটটা পঁচিশ।
দেখা গেল শকুন্তলাকে এয়ারপোর্টে এসে একটা দামী গাড়ি থেকে নামতে। তার হাতে একটা হ্যান্ডব্যাগ।
টিকিট চেকিংয়ের পর শকুন্তলাকে দেখা গেল ঘন ঘন এদিক ওদিক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে শকুন্তলা।
কিরীটী দূর থেকে লক্ষ্য রাখে।
নটা বাজতে মিনিট দশেক আগে একটি বিশিষ্ট এমব্যাসীর গাড়ি এসে দাঁড়াল এয়ারপোর্টের সামনে। সেই গাড়ি থেকে নামল একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। পরনে দামী সুট।
ভদ্রলোক লাউঞ্জে এসে ঢুকতেই শকুন্তলা এগিয়ে গেল তার কাছে।
চতুর্বেদীর সঙ্গে কিরীটীর চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। চতুর্বেদী প্লেন ড্রেসেই ছিল। ওদের কাছাকাছি এগিয়ে যায়।
মিঃ আলাম, আমার ঘড়িটা এনেছেন?
হ্যাঁ, এই যে—
মিঃ আলাম পকেট থেকে একটা হাতঘড়ি বের করে দিল শকুন্তলাকে।
থ্যাংকস।
তাহলে আমি চলি!
আসুন।
আলাম দুপা এগিয়েছে, চতুর্বেদী এসে শকুন্তলার সামনে দাঁড়াল—কিরীটীও এগিয়ে আসে।
গুড মর্নিং মিস খাতুন।
কে?
চমকে ফিরে তাকায় শকুন্তলা।
আমি ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের লোক। আপনাকে একবার আমার সঙ্গে আমাদের হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে।
বাট হাউ দ্যাট ইজ পসিবল অফিসার, আমার প্লেন এখুনি ছাড়বে!
সে তো আমি জানি না—আমার ওপর যা অর্ডার আছে—
বাট হোয়াই? কেন?
এবারে কিরীটী এগিয়ে এলো, চোখের কালো চশমাটা খুলে ফেলল, চিনতে পারছেন আমাকে মিস মীনাক্ষী খাতুন?
কে আপনি?
সে কি! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন সারারাত ট্রেনে একসঙ্গে মাত্র দুদিন আগে এলাম–
মিঃ রায়।
হ্যাঁ, কিরীটী রায়। বুঝতেই পারছেন আপত্তি জানিয়ে লাভ হবে না—অফিসারের সঙ্গে ওদের হেডকোয়ার্টারে চলুন—ইফ ইউ ডোন্ট লাইক টু ক্রিয়েট এ সিন হিয়ার, অ্যাট দিস এয়ারপোর্ট! ইয়োর গেম ইজ আপ!
কি বলছেন যা-তা পাগলের মত?
চলুন হেডকোয়ার্টারে, সেখানেই সব জানতে পারবেন—-চলুন—
শকুন্তলা আর আপত্তি জানায় না।
মাইকে তখন অ্যানাউন্স শুরু হয়েছে–প্যাসেঞ্জার প্রসিডিং টুওয়ার্ডস হংকং ম্যানিলা আর রিকোয়েস্টেড
ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের হেডকোয়ার্টারে মীনাক্ষী খাতুনকে নিয়ে ওরা এলো।
মীনাক্ষী বলে, নাউ টেল——অফিসার, এসবের মানে কি আমাকে ধরে নিয়ে এলেন। কেন এয়ারপোর্ট থেকে?
কথা বললে কিরীটীই, মিস খাতুন, এবারে ডকুমেন্টটা বের করে দিন—
ডকুমেন্ট! কিসের ডকুমেন্ট? কি বলছেন পাগলের মত?
পাগল যে আমি নই, আপনি তা ভাল করেই জানেন। এখন বের করুন সেই ডকুমেন্ট—যেটা ভায়া হংকং একটি পররাষ্ট্রে পাচার করছিলেন—প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটা জরুরী ডকুমেন্টের ব্লু-প্রিন্ট।
আমি একটা ইমপরটেন্ট ডকুমেন্টের ব্লু-প্রিন্ট নিয়ে যাচ্ছিলাম পাচার করতে, কে বললে আপনাকে?
অস্বীকার করার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না মিস খাতুন।
বেশ তো, আমার হ্যান্ডব্যাগ সার্চ করে দেখুন। তারপর তির্যক দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে মীনাক্ষী, চান তো আমার বডিও সার্চ করতে পারেন।
চতুর্বেদী বললেন, একজন মহিলাকে ডাকবো স্যার? ঊর্ধ্বতন অফিসার কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিরীটী মৃদু শান্ত গলায় বললে, তার আর প্রয়োজন হবে না, মিস খাতুন, আপনার হাতঘড়িটা খুলে দিন।
হাতঘড়িটা! হেসে ফেললে মীনাক্ষী খাতুন, তাহলে এতক্ষণে আপনার ধারণা হলো মিঃ রায়, আপনাদের বহু মূল্যবান ব্লু-প্রিন্টটা আমার হাতঘড়ির মধ্যেই আছে।
ঘড়িটা খুলে দিন—
এবারে কিন্তু মিস খাতুনের মুখখানা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
কি হলো, দিন।
দিচ্ছি—বলতে বলতে মিস খাতুন তার হ্যান্ডব্যাগটা খুলে কি একটা বের করে চট করে মুখে পুরে দিলো।
এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে কিছু বুঝবার আগেই মীনাক্ষী খাতুনের দেহটা সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল।
কি হলো?
কিরীটী তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে মীনাক্ষীর পাল্স দেখে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, শি ইজ ডেড!
ডেড?
বিস্ময়-বিহুল কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করেন চতুর্বেদী।
কিরীটী সে কথায় যেন কোন কান দিল না। মৃত মীনাক্ষীর হাত থেকে দামী রিস্টওয়াচটা খুলে নিল।
রিস্টওয়াচটা দেখতে দেখতে বললে, কারো কাছে একটা ছুরি হবে?
চতুর্বেদী একটা ছুরি এনে দিলেন।
সেই ছুরির সাহায্যেই ঘড়ির পিছনের ডালাটা খুলে ফেলতেই একটা মাইক্রো ফিল্ম রোল বের হলো।
হিয়ার ইউ আর মিঃ চতুর্বেদী—এই ফিল্মের মধ্যেই ব্লু-প্রিন্টের ফটো আছে।
কিরীটী বলতে বলতে ফিল্মটা চতুর্বেদীর হাতে তুলে দিল।
ম্যাগনিফাইং প্রজেক্টারের সাহায্যে বোঝা গেল কিরীটীর অনুমান ভুল নয়—ফিল্মের মধ্যেই বু-প্রিন্ট রয়েছে।
ঐদিনই দুপুরের দিকে মন্ত্রীমশাইয়ের ঘরে।
রামস্বামী জিজ্ঞাসা করেন, ধরলেন কি করে মিঃ রায়?
আপনাদের দলিলটা আবার যথাস্থানে ফিরে আসতেই বুঝেছিলাম, দলিলটার একটা রু-প্রিন্ট ওরা সংগ্রহ করে নিয়েছে এবং সেটাই পাচার করবে।
তারপর?
তারপর আমাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে টাকার অফার দিল, বুঝতে পারলাম ব্লু-প্রিন্টটা এখনো পাচার করতে পারেনি—এ দেশেই আছে!
কিন্তু একটা মাইক্রো ফিল্মের মধ্যে—
ভেবে দেখুন সেটাই সবচাইতে সেফ—তাই সেটার সম্ভাবনার কথাই সর্বাগ্রে আমার মনে হয়েছিল।
উঃ, আপনি আমার যে কি উপকার করলেন মিঃ রায়।
আমি তত বেশী কিছু করিনি মিঃ রামস্বামী। একজন নাগরিক হিসাবে আমার জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যটুকুই করেছি মাত্র—তবে একটা কথা—
কি?
ওরা যে একটা মাইক্রো ফিল্মই তৈরী করেছিল তা নাও হতে পারে সেফটির জন্য হয়ত আরো কপি করেছিল কটা দিন স্পেশাল ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে একটু সাবধানে থাকতে বলবেন—চারিদিকে নজর রাখতে বলবেন। আচ্ছা আজ আমি তাহলে উঠি।
প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন না?
আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার তাঁকে জানাবেন—আজই সন্ধ্যার প্লেনে আমাকে ফিরে যেতে হবে কলকাতা।
আজই যাবেন?
হ্যাঁ।
টিকিট পেয়েছেন?
পাওয়া গিয়েছে বোধ হয়। আচ্ছা উঠি, নমস্কার।
কিরীটী রামস্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।