- বইয়ের নামঃ বৌরাণীর বিল
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা
প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা।
কলকাতা শহরে বর্ষাটা এবারে বেশ দেরি করেই নেমেছে। তাপদগ্ধ ধরিত্রী যেন জলস্নান করে জুড়িয়ে গিয়েছে। মেঘলা ভিজে আকাশে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার যেন ঘন হয়ে চাপ বেধে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কিরীটী আর সত্যজিৎ মুখোমুখি দুজনে দুটো সোফার ওপরে বসে। সত্যজিৎ তার বক্তব্য শেষ করে এনেছে তখন; দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে দুটো হত্যা। প্রথমটি স্ত্রী, উনিশ বৎসর পরে তার স্বামী। এবং দুটি হত্যারই অকুস্থান বৌরাণীর বিলের মধ্যে সেই দ্বীপ। দ্বীপটির মধ্যে আছে একটি বিরাম কুটির—তার চারপাশে ফুলের বাগান। দ্বীপটিকে ওখানকার লোকেরা ‘নন্দন কানন’ বলে।
আরো আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়! নন্দন কাননের মধ্যে একটি শাখাপ্রশাখা বকুল বৃক্ষ আছে, সেই বকুল বৃক্ষের তলাতেই দুটি মৃতদেহ পাওয়া যায়।
কিরীটী মৃদু স্বরে বলে, Queer coincidence!
তাই। জবাব দেয় সত্যজিৎ।
কিরীটী ঘরের মধ্যে জমাট বেধে ওঠা আবছা আলো-আঁধারের দিকে তাকিয়ে আর একবার সত্যজিতের বর্ণিত কাহিনীটা প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করে।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর ইহজগতে নেই। তিনি নিহত।
পিতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর নিহত হওয়ার সংবাদটা কন্যা সবিতাকে যেন একেবারে কয়েক মুহূর্তের জন্য অসাড় ও পঙ্গু করে দিল। ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারবার্তাটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে হস্টেলের কমনরুমের বারান্দায় অসহায় স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে থাকে সবিতা।
আজই মাত্র কলেজের গ্রীষ্মের ছুটির বন্ধ হলো।
কাল রাত্রের ট্রেনে সবিতা বাড়ি যাবে, দুপুরে সে বাবাকে একটা তারও করে দিয়েছে তার যাত্রার সংবাদ দিয়ে। কয়েকটা আবশ্যকীয় জিনিসপত্র কিনবার জন্য মার্কেটে গিয়েছিল সবিতা, হস্টেলে ফিরে আসতেই হস্টেলের দারোয়ান তারটা তার হাতে দিল। একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল সবিতা হঠাৎ এসময় একটি তার পেয়ে। হঠাৎ তার এলো কেন? ভয়ে ও সংশয়ে তারটা খুলে পড়তেই মূহর্তে যেন সবিতা একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছে।
তারটা করেছেন নায়েব কাকা বসন্ত সেন। মর্মঘাতী তার।
Baboomahashaya Killed! Come Sharp!
Naeb-Kaka-Basanta
নায়েব কাকা যে ওকে তার করেছেন ওর তারটা যাওয়ার আগেই, তার প্রেরণের সময়টা দেখেই সবিতা সেটা বুঝতে পারে।
বিমূঢ় হতচকিত ভাবটা কতকটা সামলে নিয়ে সবিতা তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল; সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন সবেমাত্র। ইচ্ছা করলে এবং কিছু ক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারলেই তো অনায়াসেই সে আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ধরতে পারে। ট্রেন তো সেই রাত সাড়ে নটায়। এখনো পুরো দুটো ঘণ্টা সময় ওর হাতে আছে। হ্যাঁ, যেমন করেই হোক আজকের রাত্রের ট্রেনটাই ওকে ধরতে হবে। সবিতা সহসা যেন জোর করেই মনের ও দেহের অসহায়, বিমূঢ় পঙ্গু অবস্থাটাকে ঝেড়ে ফেলে, আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে বারান্দাটা পার হয়ে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এবং সিঁড়ি অতিক্রম করে সোজা একেবারে এসে দোতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট মিসেস ব্যানার্জীর ভেজানো দ্বারের সামনে এসে দরজার গায়ে মৃদু আঘাত করল।
মিসেস ব্যানার্জী ঘরের মধ্যেই ছিলেন, মৃদুকণ্ঠে আহ্বান জানালেন, কে, ভিতরে এসো।
সবিতা দরজা ঠেলে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।
সবিতার চোখমুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস ব্যানার্জী যেন বেশ একটু বিস্মিত হন, ব্যাপার কি সবিতা! কি হয়েছে? অসুখ করেনি তো?
নিঃশব্দে কোন কথা না বলে সবিতা ক্ষণপূর্বে পাওয়া তারটা মিসেস ব্যানার্জীর দিকে এগিয়ে দিল।
বিস্মিতা মিসেস ব্যানার্জী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে তারটা পড়ে সবিতার মুখের দিকে তাকালেন, কখন পেলে এ তার?
এই কিছুক্ষণ আগে দারোয়ান দিল–
হুঁ!
আমি আজকের রাত্রের গাড়িতেই যেতে চাই মিসেস ব্যানার্জী!
আজ রাত্রের গাড়িতেই যাবে, কটায় গাড়ি জান কিছু?
হ্যাঁ, জানি।
বেশ, পার তো যাও।
সবিতা আর দ্বিরুক্তি না করে সুপারিনটেনডেন্টের ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কোনমতে একটা সুটকেসের মধ্যে কিছু জামা-কাপড় নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে সবিতা ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বললে, শিয়ালদহ স্টেশন!
একটা সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কেটে সবিতা যখন ট্রেনের একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় এসে উঠে বসল, গাড়ি ছাড়তে তখন আর মাত্র মিনিট সাতেক বাকি।
গাড়িতে সে ছাড়াও আরো চারজন যাত্রী ছিল। একটা বার্থ খালি।
একটু পরে সে বাথটাও একজন অল্পবয়সী যুবক গাড়ি ছাড়বার ঠিক মিনিট চারেক আগে এসে অধিকার করল।
গাড়ি ছাড়ল।
একটা গুমোট গরমে এতক্ষণ কামরাটা যেন ঝলসে যাচ্ছিল, গাড়ি ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে চলমান গাড়ির খোলা জানালা-পথে একটা তৃপ্তির পরশ দিয়ে গেল।
স্টেশন ইয়ার্ডের আলোগুলো ক্ৰমে একটা দুটো করে গাড়ির ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে।
হারিয়ে যাচ্ছে আলোগুলো পশ্চাতের অন্ধকারে একটি দুটি করে।
জ্যৈষ্ঠের একেবারে গোড়ার দিক। এবারে একদিনের জন্যও কালবৈশাখী এখনও দেখা দেয়নি কে জানে কেন!
সেই সন্ধ্যা থেকেই আকাশে মেঘ করে আছে, একটা থমথমে ভাব।
সবিতা গাড়ির খোলা জানলা-পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ যেন শ্বাস নেবার অবকাশ পায়।
ভাল করে একবার ভেবে দেখবার চেষ্টা করে সমগ্র ব্যাপারটা আগাগোড়া।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী– তার বাবা। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আশ্রয়স্থল আর ইহজগতে নেই।
বাড়ি গিয়ে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই দেউড়ি পার হয়েই কাছারী বাড়ির দালানে তাঁর সেই সৌম্য প্রশান্ত চেহারাটা আর চোখে পড়বে না।
সস্নেহ মধুর সেই হাসি দিয়ে কেউ আর অভ্যর্থনা জানাবে না, পথে কোন কষ্ট হয়নি তো মা! গাড়ি ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছেছিল?
প্রত্যেকবার ছুটিতে যাবার পর প্রথম দর্শনে কেউ আর বলবে না, তুই হাতমুখ ধুয়ে চা খা, আমি এখনি আসছি সবু!
ও আর কাউকে প্রত্যুত্তরে আব্দার-ভরা কণ্ঠে বলবে না, দেরি করো না বাবা, এখুনি এসো কিন্তু। তুমি এলে তবে দুজনে একসঙ্গে বসে চা খাবো। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে কিন্তু–
না রে না। আসছি, তুই যা—
এগিয়ে যেতে পিছন থেকে আর ও শুনতে পাবে না বাবার গলা, বসন্ত, আজ আমাকে ছুটি দাও। নকাইচকাই এসেছে, আজ ওর অনারে আমার ছুটি।
ওকে আদর করে বাবা নকাইচকাই বলে ডাকেন।
নকাইচকাই ওঁর আদরের ডাক।
ওর চার বছর বয়সে মা মারা গিয়েছেন। বাবার কাছেই ও মানুষ। মাকে ওর কিছুই মনে নেই।
বাবার শোবার ঘরে শিয়রের ধারে মায়ের এনলার্জড ফটোটার দিকে কতবার ও অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু কিছুই মনে করতে পারেনি। মা! মায়ের স্মৃতিটা এমন অস্পষ্ট!
মা-বাপ বলতে ঐ একজনকেই চিরদিন জেনে এসেছে। কি শান্ত চরিত্রের মানুষ ওর বাবা! লোকে বলত অজাতশত্রু।
অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির জমিদার হলেও কাউকে একটা চড়া বা উঁচু, কথা বলেননি। উদার শিশুর মত প্রকৃতি তার বাপের। কে শত্রুতা করে হত্যা করলে, নায়েব কাকা বসন্তবাবু তার বিশেষ কিছুই জানাননি, কেবল টেলিগ্রামে লিখেছেনঃ
Baboo Mahashaya killed! Come sharp!
Killed! নিহত!
কে-ই বা তাঁকে হত্যা করলে এবং কেনই বা তাঁকে হত্যা করলে!
ব্যাপারটা আগাগোড়া কিছুই যেন এখনো সবিতা বুঝে উঠতে পারছে না।
মেল ট্রেন।
এখন বেশ জোরেই চলেছে। লোহার চাকার একঘেয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দটা শ্রবণকে পীড়িত করে তোলে।
আকাশে ইতিমধ্যে একসময় কখন মেঘটা বেশ চাপ বেঁধে ঘন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কয়েকটা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ওর চোখেমুখে এসে পড়তেই ওর চমক ভাঙল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের সোনালী আলোয় মেঘাবৃত আকাশটা যেন ঝলকিয়ে উঠছে।
সবিতা ঘরে বসে গাড়ির কামরার মধ্যে দৃষ্টিপাত করল।
উপরের দুটো বার্থ ও নিচের দুটো বার্থ অধিকার করে ইতিমধ্যে কখন একসময় চারজন যাত্রী নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।
দুজন তারা এখনো কেবল জেগে।
সে ও সর্বশেষের আগন্তুক যাত্রী সেই তরুণ যুবকটি। যুবকটির সঙ্গে কেবলমাত্র একটি মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস ও হোল্ডলে বাঁধা একটি বেডিং।
বেডিংটা এখনো সে খোলেনি। তারই গায়ে হেলান দিয়ে সুটকেসটার উপরে জুতোসমেত পা দুটো তুলে দিয়ে কামরার আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে কি একটা মোটা ইংরাজী বই পড়ছে।
সবিতা কতকটা অন্যমনস্কভাবেই তার ঠিক সামনেয় মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট, পাঠরত একমাত্র জাগ্রত তরুণ সহযাত্রীটির দিকে তাকাল।
বছর সাতাশ-আটাশ হয়ত বয়স হবে ওর। দোহারা লম্বা গড়ন।
চোখেমুখে অর্থাৎ মুখের গঠনে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা যেন ফুটে বের হয়।
তৈলহীন রুক্ষ লম্বা চুলগুলো কামরার মধ্যস্থিত ফ্যানের হাওয়ায় কপালের উপর এসে থেকে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাঁ গালের উপরে একটা দীর্ঘ গভীর ক্ষতচিহ্ন।
হঠাৎ ভদ্রলোকের বার্থের উপরে রক্ষিত চামড়ার সুটকেসটার উপরে নজর পড়ল সবিতার।
সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।
বাংলায় লেখা সত্যজিৎ রায়, রেঙ্গুন।
রেগুন! সত্যজিৎ রায়! কথা দুটির মধ্যে কোথায় যেন একটা পরিচয়ের ইঙ্গিত রয়েছে।
খুব বেশী দিনের কথা নয়। মাত্র বৎসরখানেক আগের কথা।
বাবার মুখে ইদানীং অনেকবার রেঙ্গুনে অবস্থিত ঐ নামটির উল্লেখ ও শুনেছে।
বাবার ছোটবেলার বন্ধ, সত্যভূষণ রায়ের একমাত্র ছেলে, সত্যজিৎ রায়। বিলেত-ফেরত ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনীয়ার। সঙ্গে সঙ্গে আবার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা নিহত হয়েছেন। বাবা নিহত হয়েছেন কেবল এই কথাটাই ও নায়েব কাকার তারবার্তায় জেনেছে, তার চাইতে বেশী কিছু ও জানতে পারেনি এখনো পর্যন্ত।
নিজের চিন্তার মধ্যেই সবিতা আবার তলিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠের সম্বোধনে চমকে মুখ তুলে তাকাল।
রাত বারোটা বাজে, ঘুমোবেন না? প্রশ্নকারী সম্মুখের মধ্যকার বার্থে উপবিষ্ট যুবক।
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় সবিতা।
কিন্তু আপনার তো দেখছি সঙ্গে কোন বেডিং পর্যন্ত নেই! যুবক স্মিতভাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।
সত্যি! এতক্ষণে সবিতার খেয়াল হয়। তাড়াতাড়িতে বেডিংটা পর্যন্ত সঙ্গে আনেনি সবিতা।
অবিশ্যি আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে যা বেডিং আছে সেটা শেয়ার করে নিতে পারি।
না, তার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি—
আপনি হয়ত ভাবছেন আমাকে আপনি বিব্রত করবেন! কিন্তু মোটেই তা নয় মিস।
আমার নাম সবিতা চৌধুরী।
কতদূর যাবেন আপনি মিস চৌধুরী?
সবিতা তার গন্তব্যস্থানের কথা বলতেই যুবক সবিস্ময়ে বলে ওঠে, আশ্চর্য! আমিও তো একই জায়গার যাত্রী। আপনি কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর–
হ্যাঁ। আমি তাঁর মেয়ে, বলতে বলতে সহসা এতক্ষণে সবিতার দুচোখের দৃষ্টি অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে আসে নিজের অজ্ঞাতেই।
নিরুদ্ধ অন্তর-বেদনায় এতক্ষণ সবিতা ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছিল। সেই সন্ধ্যায় পিতার নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া থেকে এই পর্যন্ত একফোঁটা অশ্রুও তার চোখ দিয়ে পড়েনি।
সহসা সত্যজিৎ রায়ের প্রশ্নে সে যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরই কন্যা এই পরিচয় দিতে গিয়ে তার চোখের পাতা দুটো অশ্রুজলে ভিজে গেল।
সত্যজিৎ অবাক বিস্ময়ে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
পিতার পরিচয় দিতে গিয়ে হঠাৎ তার দুচোখের পাতা অশ্রুভারে টলমল করে উঠলো কেন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
আমার নামটা আপনি শুনেছেন কিনা মিস চৌধুরী জানি না, আমার বাবা সত্যভূষণ রায় আপনার বাবা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বাল্যবন্ধু। আপনার বাবার আমন্ত্রণ পেয়েই আমি বর্মা থেকে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি।
সবিতা কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। নিঃশব্দে সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ একপক্ষে ভালই হলো। গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের কাল প্রায় দ্বিপ্রহর হবে। দীর্ঘ পথে আপনাকে সঙ্গী পেয়ে মন্দ হলো না। পথের। একঘেয়েমিটা অনেকটা সহ্য হবে। সত্যি, কি আশ্চর্য যোগাযোগ দেখুন! বলতে বলতে মৃদু হাসে সত্যজিৎ।
সহসা একসময় সত্যজিৎ লক্ষ্য করে, তার এতগুলো কথার জবাবে একটি কথাও বলেনি এতক্ষণ সবিতা। একতরফা সে-ই কেবল এতক্ষণ বকবক করে চলেছে।
এবং শুধু তাই নয়, যদি দেখবার তার না ভুল হয়ে থাকে তো সবিতার চোখে সুস্পষ্ট অশ্রুর আভাসও লক্ষ্য করেছে।
নিজের কৌতুহলকে আর দমন করতে পারে না সত্যজিৎ। এবং কোন প্রকার ইতস্তত না করে সোজাসুজিই প্রশ্ন করলে, মাফ করবেন মিসু চৌধুরী, একটা কথা না বলে আর থাকতে পারছি না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ রকম চিন্তিত ও অন্যমনস্ক আপনি। পরস্পরের পরিচয় থেকে যখন জানা গেছে এতদিন আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও পরিচয়ের দাবী একটা উভয়েই আমরা উভয়ের কাছে করতে পারি, সেই পরিচয়ের দাবীতেই জিজ্ঞাসা করছি কথাটা। আশা করি মনে কিছু করবেন না।
না। আপনি হয়ত জানেন না মিঃ রায়, অতি বড় একটা দুঃসংবাদ পেয়েই আমি এই ট্রেনে দেশের বাড়িতে যাচ্ছি–
দুঃসংবাদ! বিস্মিত কণ্ঠে সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। আমার বাবা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, হঠাৎ নিহত হয়েছেন।
নিহত হয়েছেন! মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষে সত্যজিৎ তাকিয়ে থাকে সবিতার মুখের দিকে।
হ্যাঁ।
আর একটু স্পষ্ট করে বলুন মিস চৌধুরী, আমি যে আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
এর চাইতে বেশী আমিও কিছুই জানি না মিঃ রায়। বসন্ত কাকা তার করে কেবলমাত্র ঐটকুই আমায় জানিয়ে যেতে লিখেছেন।
কিন্তু
আমি নিজেও এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, কেমন করে এত বড় দুর্ঘটনাটা সম্ভব হলো! আমার অজাতশত্রু বাপকে কে হত্যা করতে পারে!
বাইরে থেকে একজন মানুষকে সব সময় সম্পূর্ণভাবে বিচার করা চলে না সবিতা দেবী। তাছাড়া আপনার বাবার মত অত বড় একটা জমিদারী চালাতে গেলে নিজের অজ্ঞাতেই দুএকজন শত্রু সষ্টি করা এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু সে-সব কথা পরে ভাবলেও চলতে পারে। সব চাইতে বড় কথা হচ্ছে এখন তিনি নিহত হয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে আমি বা আপনি সে ব্যাপারে কতদূর কি করতে পারি
আমরা আর কি করতে পারি বা পারবো! কতকটা যেন হতাশাই সবিতার কণ্ঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই। আমাদের দুজনেরই অনেক কিছুই করণীয় আছে। আপনার পিতা এবং আমার পিতা বাল্যবন্ধু। আগে চলুন সেখানে পৌঁছই, তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিয়ে যেমন করেই হোক এ হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবারও তো অন্তত একটা চেষ্টা করতে পারি।
সত্যজিতের কথাটা সবিতা যেন ঠিক হদয়ঙ্গম করে উঠতে পারে না।
ও বুঝে উঠতে পারে না, ওরা দুজনে ওখানে গিয়ে পৌঁছেই বা কি করে তার পিতার হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করতে পারে।
কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তার পিতার মৃত্যু-রহস্যের মীমাংসা হোক বা না হোক, পথের মাঝখানে সত্যজিতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তার সরস মধুর কথাবার্তায় পিতার হত্যা-সংবাদে যে অসহনীয় দুঃখ তাকে একেবারে বিমূঢ় ও অসহায় করে ফেলেছিল তা থেকে ও যেন কতকটা সান্ত্বনা পায়।
অন্তত তার দুঃখের ভাগীদার যে নিঃসম্পর্কীয় হলেও একজন আছে, এ কথাটা জেনেও যেন ও মনের মধ্যে অনেকটা সান্ত্বনা পায়। অনেকটা নিশ্চিত হয়।
০২. নায়েব বসন্তবাবু
নায়েব বসন্তবাবু, নিজেই স্টেশনে এসেছিলেন সবিতা তার পেয়েই রওনা হবে এই আশা করে।
বসন্তবাবুর বয়স ষাটের কোঠা প্রায় পার হতে চললেও বার্ধক্য এখনো তাঁকে খুব বেশী কাবু করতে পারেনি।
চুলগুলো পেকে একেবারে সাদা হয়ে গেলেও শরীরের গঠন ও কার্যক্ষমতার মধ্যে কোথায়ও এতটুকু বার্ধক্যের ছায়া পড়েনি এখনো। তাঁর পেশল উঁচু লম্বা দেহের গঠন দেখলে মনে হয় দেহে এখনও তাঁর প্রচুর ক্ষমতা। এখনো তিনি দশ-পনের মাইল পথ অনায়াসে হেঁটে চলে যেতে পারেন।
লাঠি হাতে পেলে এখনো দুজন লোকের মহড়া অনায়াসেই নিতে পারেন।
বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে চাকরিতে তিনি এসে ঢুকেছিলেন, আজ দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর এই জমিদারীতে তিনি চাকরি করছেন।
এই চৌধুরী-বাড়িতে তাঁর একটা যুগ কেটে গেল।
জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বয়সে তাঁর চাইতে বছর তিনেক মাত্র বড় ছিলেন।
একটু বেশী বয়সেই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বিবাহ করেছিলেন এবং বিবাহের প্রায় বছর দশেক বাদে সবিতার জন্ম হয়।
সবিতার যখন চার বছর বয়স তখন সবিতার মা হেমপ্রভা মারা যান। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আর বিবাহ করেননি।
বসন্তবাবু, অকৃতদার। এবং যতদূর তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, ত্রিসংসারে তাঁর সত্যিকারের আপনার বলতে কেউ নেই এবং কোনদিন কেউ তাঁর আত্মীয়স্বজন আছে বলেও তিনি স্বীকার করেন না।
দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের মধ্যে মাত্র বারচারেক তিনি তীর্থভ্রমণের নাম করে মাস-দুই করে ছুটি নিয়ে বাইরে গিয়েছেন।
ঐ চারবার ছাড়া কেউ তাঁকে কোনদিন ঐ জায়গা ছেড়ে একটা দিনের জন্যও বাইরে যেতে দেখেনি।
যত বড় বিপদই হোক—বিপদে ভেঙে পড়া বা বিমূঢ় হয়ে পড়ার মত লোক নন বসন্তবাবু।
সবিতা ও সত্যজিৎকে পাশাপাশি ট্রেন থেকে নেমে আসতে দেখে বসন্তবাবু, আর অগ্রসর না হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে ছিলেন সত্যজিতের দিকে।
সত্যজিৎ কিন্তু নিজেই এগিয়ে এসে নিজের পরিচয়টা দিল, আমি রেঙ্গুনের সত্যভূষণবাবুর ছেলে সত্যজিৎ।
সত্যজিৎ সম্পকে সকল ব্যাপার জানা থাকলেও ইতিপূর্বে বসন্তবাবু, সত্যজিৎকে দেখেননি।
নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, এসো। তোমার আসবার কথা ছিল আমি বাবুর মুখেই শুনেছিলাম।
অতঃপর সবিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন, চলো মা, বাইরে টমটম দাঁড়িয়ে আছে।
মালপত্র সামান্য যা সঙ্গে ছিল সহিস লছমনের সাহায্যে টমটমের পিছনে তুলে দিয়ে তিনজন পাশাপাশি টমটমে উঠে বসলেন।
বসন্তবাবু নিজেই টমটম হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছেন।
জায়গাটা আধা শহর আধা গ্রামের মত।
বেলা প্রায় পড়ে এলো।
আজ গাড়িটা প্রায় ঘণ্টা আড়াই লেট ছিল।
নিঃশেষিত দ্বিপ্রহরের ম্লান বিধুর আলোয় উঁচু কাঁচা মাটির সড়কের দুপাশের গাছপালা, গৃহস্থের ক্ষেতখামার, ঘরবাড়িগুলো কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
সারাটা দিনের অসহ্য গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপে সব কিছু যেন ঝলসে গিয়েছে বলে মনে হয়। বসন্তবাবু একধারে বসে নিঃশব্দে টমটম চালাচ্ছেন, অন্য পাশে ওরা সবিতা ও সত্যজিৎ নিঃশব্দে বসে আছে গা ঘেষে পাশাপাশি।
তিনজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। স্টেশন থেকে বর্তমান জমিদারবাড়ি প্রায় দীর্ঘ পাঁচ মাইল পথ হবে।
স্টেশন থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে ছোট শহরটি গড়ে উঠেছে হাজার দশেক লোকজন নিয়ে, জমিদারের বর্তমান বাসভবন শহর থেকেও প্রায় তিন মাইল দূরে নির্জন একটা বিলের ধারে।
বর্তমান জমিদারদের বাসভবনের আশেপাশে কোন বসতবাটিই নেই।
প্রথম দিকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী বাপের আমলের পুরাতন যে জমিদার বাটি একটা ছিল তাতেই বাস করতেন।
প্রমোদভবনে এসে বসবাস করছিলেন তাও আজ দীর্ঘ উনিশ বৎসর হয়ে গেল।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পূর্বপুরুষেরা বছরের কিছুটা সময় এই দূরবর্তী নিরালা প্রমোদভবনে এসে আনন্দ ও স্ফুর্তি করে কাটিয়ে যেতেন মাত্র।
প্রমোদভবনের ব্যবহারটা ক্রমে কমে আসতে থাকে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিতার আমল থেকেই।
দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর প্রমোদভবন অব্যবহার্য হয়ে পড়ে থাকবার পর আবার একদা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী প্রমোদভবনের সংস্কার সাধন করে পুরাতন পৈতৃক আমলের জমিদার-বাটি থেকে অসুস্থ স্ত্রী হেমপ্রভা ও একমাত্র চার বৎসরের কন্যা সবিতাকে নিয়ে কিছুকাল বাস করবেন বলে এসেছিলেন। কিন্তু প্রমোদভবনে আসবার চারদিনের মধ্যেই হেমপ্রভা অকস্মাৎ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় অসুস্থা স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেলেন এবং ফিরে এসে পুরাতন জমিদার-ভবনে গিয়ে উঠলেও একটা বেলাও সেখানে কাটাতে পারলেন না।
হেমপ্রভার সহস্র স্মৃতিবিজড়িত বিরাট প্রাসাদের কক্ষগুলো দিবারাত্রি যেন মৃত্যুঞ্জয়কে পীড়িত ও ব্যথিত করে তুলতে লাগল। সন্ধ্যার দিকেই আবার পালিয়ে এলেন ঐ দিনই তিনি পুরাতন জমিদার-ভবন ত্যাগ করে প্রমোদ ভবনেই।
সবিতার বাল্য ও শৈশব ঐ প্রমোদভবনে কেটেছে।
জমিদারী আর মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর চাল ও পাটের ব্যবসা ছিল। পরিত্যক্ত বিরাট প্রাসাদটা জুড়ে মৃত্যুঞ্জয় তাঁর কাছারী করলেন।
প্রত্যহ টমটমে চড়ে দ্বিপ্রহরের আহারাদির পর মৃত্যুঞ্জয় পুরাতন প্রাসাদে আসতেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে সমস্ত কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করে, ব্যবস্থাপত্র করে রাত্রে একেবারে ফিরতেন।
ঘোড়ার গলার ঘন্টিটা ঠুং ঠুং করে সায়াহ্নবেলার মন্থর বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বৈশাখের করুণ রিক্ততা।
আজও আকাশের পশ্চিম প্রান্তে মেঘের ইশারা দেখা দিয়েছে। গতকালের মত এবং আজও হয়ত কালবৈশাখী দেখা দিতে পারে।
ক্রমে আদালত, স্কুলবাড়ি, বাজার ছাড়িয়ে টমটম শহরকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলে।
এর পর মাঝখানে সরু কাঁচামাটির অপ্রশস্থ সড়ক এবং দুপাশে চষা ভূমি।
শহর ছাড়িয়ে প্রায় মাইল দুই গেলে বৌরাণীর বিল।
বৌরাণীর বিলের ধার দিয়ে প্রায় সোয়া ক্রোশটাক পথ এগিয়ে গেলে রাস্তাটা যেন বিলের জলের মধ্যে গিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হঠাৎ।
বিলের মধ্যেই দোতলা পাকা ইটের গাঁথুনি বাড়িটাই প্রমোদভবন, বর্তমান জমিদারের বসতবাটি।
প্রমোদভবনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
সহিসের হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে বসন্তবাবু, টমটম থেকে নেমে ওদের দুজনকেও নামতে বললেন।
সামনেই একটা টানা প্রকাণ্ড বারান্দা রেলিং দিয়ে ঘেরা।
বারান্দার ঝোলানো বাতিটা জেলে দেওয়া হয়েছে। বাইরে বাতাস ছেড়েছে, বাতিটা দুলছে বাতাসে।
সবিতা প্রমোদভবনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।
সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে সমগ্র প্রমোদভবনের উপরে যেন একটা বিষাদের করুণ ছায়া নেমে এসেছে।
ক্রমেই বাতাসের বেগ বাড়ছে।
সকলে এসে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।
তোমরা হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করো মা—আমি ততক্ষণ হাতে-মুখে একটু জল দিয়ে আহ্নিকটা সেরেই আসছি।
সারাটা পথ একেবারে কঠিন মৌনব্রত অবলম্বন করে থেকে এই সর্বপ্রথম বসন্তবাবু ওদের সঙ্গে কথা বললেন।
এবং ওদের জবাবের কোনরূপ প্রতীক্ষা মাত্রও না করে সোজা তাঁর মহলের দিকে চলে গেলেন।
বনমালী ও কানাইয়ের মা।
বনমালী চৌধুরী-বাড়ির বহুদিনকার পুরাতন ভৃত্য।
আর দাসী কানাইয়ের মাও চৌধুরী-বাড়িতে আছে—তাও আজ পঁচিশ বছর হবে বৈকি।
কানাইয়ের মা-ই কোলে-পিঠে করে সবিতাকে মানুষ করেছে।
বনমালী আর কানাইয়ের মা দুজনেই একসঙ্গে এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
বনমালীর হাতে একটা লণ্ঠন।
কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে ঢুকেই সবিতাকে লক্ষ্য করে বোধ হয় কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু সহসা সবিতার পাশে সত্যজিৎকে দেখে সে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল।
বনমালীর চোখেও জল আসছিল, সেও কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সবিতাকেই সম্বোধন করে ভাঙা গলায় বললে, ভিতরে চল দিদিমণি।
হ্যাঁ, আপনি যান সবিতা দেবী, হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন গে। আমি এই ঘরেই বসছি ততক্ষণ–
আপনিও আসুন সত্যজিৎবাবু। বলে কানাইয়ের মার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, কানাইয়ের মা, দোতলায় আমার পাশের ঘরটাতেই এই বাবুর থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। বনমালী, তুমিও যাও—ঘরটা কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি একটু গুছিয়ে দাও গে।
সত্যজিৎ বাধা দেয়, আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন সবিতা দেবী। ওসব হবেখন।
বাবা থাকলে কোন কিছুর জন্যেই অবিশ্যি আমাকে ভাবতে হতো না সত্যজিৎবাবু! বলতে বলতে সবিতার চোখের কোল দুটো জলে চকচক করে ওঠে।
রাত বোধ করি দশটা হবে। কিছুক্ষণ আগে কালবৈশাখীর একপশলা ঝড়জল হয়ে গিয়েছে। খোলা জানালা-পথে ঝিরঝির করে জলে ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরের মধ্যে।
সবিতার কক্ষের মধ্যেই বসন্তবাবু, সত্যজিৎ ও সবিতা তিনজনে বসে কথা হচ্ছিল।
ঘরের এক কোণে কাঠের একটা ত্ৰিপয়ের উপরে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া কেরোসিনের টেবিল-বাতিটা কমানো, মৃদুভাবে জ্বলছে। বাতির শিখাটা ইচ্ছে করে কমিয়ে রাখা হয়েছে। মৃদু আলোয় কক্ষের মধ্যে একটা আলোছায়ার স্বপ্ন যেন গড়ে উঠেছে।
বসন্তবাবু, বলছিলেনঃ
ব্যাপারটা শুধু, আশ্চর্যই নয়, রহস্যময়! পরশুদিন সকালে বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দনকাননে বকুল গাছটার তলায় চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহটা যখন আবিস্কৃত হলো–
সত্যজিৎ বাধা দিল, মৃতদেহ প্রথম কে আবিষ্কার করে?
আমি। আমিই প্রথমে মৃতদেহ দেখতে পাই। সাধারণত চৌধুরী মশাইয়ের ইদানীং মাসখানেক ধরে শরীর একটু খারাপ যাওয়ায় বেলা করেই ঘুম থেকে উঠছিলেন।
তাহলেও সাতটার মধ্যেই তিনি শয্যাত্যাগ করতেন। পরশু সকালে আটটা বেলা পর্যন্তও যখন চৌধুরী মশাই শয়নঘর থেকে বের হলেন না, বনমালীই চৌধুরী মশাইকে ডাকতে গিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে ঘর খালি। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। বনমালী এদিক ওদিক বাড়ির মধ্যে খোঁজাখুজি করে আমাকে সংবাদ দেয়। আমি তো আশ্চর্যই হলাম বনমালীর কথা শুনে। কারণ এত সকালবেলা বেড়ানো বা বাড়ি থেকে কোথাও বের হওয়া তো তাঁর কোন দিনই অভ্যাস নেই। যাহোক সমস্ত বাড়িটা খুঁজেপেতেও যখন তাঁকে পেলাম না তখন বাড়ির চারপাশে খোঁজাখুজি শুরু করলাম। তারপর আমিই খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মৃতদেহ বৌরাণীর বিলের মধ্যে নন্দন কাননে গিয়ে দেখতে পেলাম।
কি অবস্থায় দেখলেন? সত্যজিৎ প্রশ্ন করল আবার।
দেখলাম বকুল গাছতলায় দেহটা লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে। পরিধানে সেই আগের দিনেরই ধুতিটা, খালি গায়ে একটা মুগার চাদর জড়ানো। এক পায়ে চটিটা আছে, অন্য পায়ের চটিটা একটু দূরে পড়ে আছে।
মৃতদেহে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল? সত্যজিৎ আবার প্রশ্ন করে।
না, তেমন কোন বিশেষ আঘাতের চিহ্নই দেহের কোথায়ও ছিল না, তবে নাকে ও মুখে রক্তমিশ্রিত ফেনা জমে ছিল।
আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ বোধ হয় throttle–শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। তাই কি?
সত্যজিতের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকালেন বসন্তবাবু, এবং বললেন, এখানকার সরকারী ডাক্তারের তাই অভিমত। মৃতদেহ ময়না-তদন্তের ফলে নাকি তাঁকে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে, এইটাই প্রমাণ হয়।
সত্যজিৎ তাকাল বসন্তবাবুর মুখের দিকে। সবিতা নিজের অজ্ঞাতেই একটা অর্ধস্ফুট আর্তকাতর শব্দ করে ওঠে।
বসন্তবাবুর বুকখানা কাঁপিয়েও একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
বললেন, মৃতদেহ কালই প্রত্যুষে সৎকার করা হবে।
কথাটা যেন কোনমতে জানিয়ে দিয়ে নিজের দায় থেকে মুক্তি পেলেন বসন্তবাবু।
পাষাণের ভারের মত যে ব্যথাটা এ দুদিন তাঁর বুকের মধ্যে জমাট বেধে ছিল, সবিতার কাছে সব খুলে বলবার পর থেকে যেন কতকটা লাঘব বোধ করলেন।
আচ্ছা নায়েব মশাই, এই মৃত্যুরহস্য তদন্ত করে কোন কিছুই কি আপনারা জানতে পারেননি?
না। কিছুই আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। দারোগা সাহেব এ বাড়ির চাকর-বাকর ঝি দারোয়ান সহিস সকলকেই যতদূর সম্ভব জেরা করেছেন, কিন্তু
বনমালী ও কানাইয়ের মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কারা আছে?
আমি, সরকার রামলোচন, দারোয়ান ঝোটন সিং, সহিস লছমন, ঠাকুর শিবদাস
এরা কেউ কিছু বলতে পারলে না?
না।
এরা সকলেই বিশ্বাসযোগ্য?
হ্যাঁ, তা বৈকি। অনেকদিন ধরেই তো ওরা এ বাড়িতে কাজ করছে। তাছাড়া চৌধুরী মশাইকে গলা টিপে হত্যা করে এদের কারই বা কি লাভ হতে পারে!
লাভালাভের কথাটা কি অত সহজেই বিচার করা চলে নায়েবমশাই। মানুষের লাভক্ষতির তুলাদণ্ডটি এত সূক্ষ্ণ ভারবৈষম্যেই এদিক-ওদিক হয় যে ভাবতে গেলে যেন অনেক সময় বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। অবশ্য আপনি আমার চাইতে অনেক বেশী প্রবীণ ও বিচক্ষণ, শেষের দিকের কথা কটা সত্যজিৎ যেন কতকটা ইচ্ছে করেই যোগ করে দেয় নিজের বক্তব্যের সঙ্গে; কারণ সত্যজিৎ কথা বলতে বলতেই লক্ষ্য করেছিল ওঁর শেষের কথাগুলি শুনে, বসন্তবাবুর মুখের রেখায় একটা চাপা বিরক্তি ভাব যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সত্যজিতের শেষের কথাগুলোতেও কিতু বসন্তবাবুর মুখের বিরক্তি ভাবটা গেল না। এবং সত্যজিতের কথার উত্তরে তিনি যখন কথা বললেন, তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা বিরক্তির আভাস স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিল, তোমার কথাটা যে মিথ্যে তা আমি বলছি না সত্যজিৎ। তবে এ বাড়িতে যারা আজ ৮/১০ বছর ধরে কাজ করছে তাদের সম্পকে আর যে যাই ধারণা করুক না কেন, আমি জানি অন্ততঃ তারা সকল প্রকার সন্দেহেরই অতীত।
নিশ্চয়ই তো। কিন্তু এটাও আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে probabilityর বা সম্ভাবনার দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে এক্ষেত্রে একটা কথা আমরা না ভেবে পারছি না যে, চৌধুরী মশাইয়ের হত্যার ব্যাপারে সব কিছু বিবেচনা করে দেখতে গেলে একটা কথা আমাদের স্বতই মনে হবে এ বাড়িতে ঐ সময় যে বা যারা ছিল তাদের মধ্যে কেউই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যায় না বা যেতে পারে না।
সহসা বসন্তবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সত্যজিতের কথার জবাব মাত্রও না দিয়ে এবং সোজা একেবারে সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাত অনেক হয়েছে মা, কাল সারা রাত ট্রেনে জেগে এসেছো, এবারে শুয়ে পড়। আমিও অত্যন্ত পরিশ্রান্ত—আমি শুতে চললাম।
বসন্তবাবু, সোজা ঘর থেকে চলে গেলেন।
ক্রমে তাঁর পায়ের চটিজুতোর শব্দটা সিঁড়ি-পথে মিলিয়ে গেল।
০৩. অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে
অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই হঠাৎ কথার মধ্যে একপ্রকার জোর করেই যেন পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে বসন্তবাবু ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ায় সত্যজিৎ যেন নিজেই অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।
এ বাড়ির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি সে। তাছাড়া বসন্তবাবু এই পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট তো বটেই, এ পরিবারের একজন পরম হিতৈষীও বটে। বলতে গেলে একদিক থেকে এ পরিবারের আত্মীয়েরও অধিক বসন্তবাবু। এবং সেদিক দিয়ে সবিতার পিতার হত্যার ব্যাপার নিয়ে এরূপ স্পষ্টভাবে মতামত প্রকাশ করাটা হয়ত তার উচিত হয়নি।
বসন্তবাবুর চটির শব্দটা ক্রমে মিলিয়ে যাওয়ার পরও সত্যজিৎ ও সবিতা কেউই কোন কথা বললে না কিছুক্ষণ ধরে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
সত্যজিৎ মনে মনে ভাবছিল হয়ত সবিতাও তার কথায়বার্তায় অসন্তুষ্ট হয়েছে।
তাই সে ভাবছিল কিভাবে সমস্ত পরিস্থিতিটাকে সহজ করে আনা যেতে পারে।
হঠাৎ এমন সময় সবিতার ডাকে সত্যজিৎ মুখ তুলে তাকাল।
সত্যজিৎবাবু!
বলুন? সাগ্রহে সত্যজিৎ সবিতার মুখের দিকে তাকাল।
একটা কথা আপনাকে আমি বলে রাখি। যে বা যারা আমার দেবতার মত বাপকে এমন নিঠুরভাবে হত্যা করেছে তাকে বা তাদের আমি কোনমতেই ক্ষমা করব না এবং এই নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের মীমাংসার জন্য যতপ্রকার চেষ্টা সম্ভব সবই আমি করব। তার জন্য বাবার জমিদারীর শেষ কপর্দকটি পর্যন্তও যদি আমাকে ব্যয় করতে হয় তাতেও আমি পশ্চাৎপদ হবো না।
ঠিক এমনিটিই আমি আশা করেছিলাম সবিতা দেবী আপনার কাছ থেকে। দেখুন আপনার বুঝবার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যে স্নেহময় পিতাকে আপনি হারিয়েছেন, হাজারবার চোখের জল ফেলে বুক চাপড়ে কাঁদলে বা হা-হুতাশ করলেও আর তাঁকে জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে না। এবং এও আমরা সকলেই জানি মা বাপ কারো চিরদিন বেঁচে থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে ব্যক্তিকে মেনে নিয়েও চুপ করে থাকতে আমরা পারব না, কারণ তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণেই যেমন করে যে উপায় হোক এই হত্যা-রহস্য আপনাকে উৎঘাটন করতেই হবে। আমি নিশ্চিত যে এর মধ্যে কোন foul play রয়েছে।
সবিতার মনের মধ্যেও একটা প্রতিজ্ঞা সত্যজিতের কথায় ক্রমে ক্রমে দানা বেধে উঠছিল। বাপকে সে আর ফিরে পাবে না ঠিকই। কিন্তু সেও সহজে নিশ্চিত হবে না। পিতার হত্যাকারীকে সে খুঁজে বের করবেই। কিন্তু কোন পথ ধরে সে এই রহস্যের মীমাংসায় অগ্রসর হবে?
হঠাৎ সে সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সত্যজিৎবাবু আপনার কি সত্যি-সত্যিই মনে হয় এ বাড়িতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যেই কেউ
কথাটা যেন কেন সবিতা শেষ করতে পারে না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে।
চারিদিক ভেবে দেখতে গেলে ওদের কাউকেই তো আমরা সন্দেহের তালিকা থেকে বর্তমানে বাদ দিতে পারছি না সবিতা দেবী! কথাটা আপনিই চিন্তা করে দেখুন না!
কিন্তু
অবশ্য এও ঠিক যে, এ কথা ধরে নিচ্ছি বলেই যে তাঁদের মধ্যেই কেউ একজন এক্ষেত্রে হত্যাকারী সুনিশ্চিতভাবে তাও তো নয়। কিন্তু যাক সে কথা, এদিকে রাত অনেক হল। আজকের মত আপনি বিশ্রাম নিন গিয়ে। কাল এদিককার কাজ মিটে গেলে আমি এখানকার থানার দারোগার সঙ্গে একটিবার দেখা করব। তাঁর কাছে হয়ত আরো অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব সবিতা দেবী
কিন্তু তিনি যদি আপনাকে সাহায্য না করেন?
সেও আমি ভেবে দেখেছি; পুলিসের লোকদের আমি জানি তো। পথ আমাদেরও আছে সেক্ষেত্রে—
কি? সবিতা তাকায় সত্যজিতের মুখের দিকে।
কলকাতার সি. ডির সুব্রত রায়কে আমার এক বন্ধু চেনে। শুধু চেনে নয়, সুব্রতবাবু তার বিশেষ বন্ধুও বটে। কাল সকালেই তাঁকে সব কথা জানিয়ে চিঠি দিতে আমি চাই। অবিশ্যি এতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে—
আপত্তি! কেন আপত্তি থাকবে? নিশ্চয়ই তাঁকে আপনি চিঠি লিখবেন।
বেশ, তবে সেই কথাই রইল।
এরপর পরস্পর পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে সত্যজিৎ সবিতার কক্ষ হতে বের হয়ে এল।
রাত্রি প্রায় দেড়টা। সত্যজিতের চোখে ঘুম আসছিল না।
ঘরের মধ্যে গরমও খুব বেশী। দরজা খুলে ঘরের সংলগ্ন ছাতে এসে দাঁড়াল সত্যজিৎ। সন্ধ্যার কালবৈশাখীর ছায়ামাত্রও আর এখন আকাশের কোথাও অবশিষ্ট নেই। তৃতীয়ার ক্ষীণ চাঁদও আকাশে অস্তমিতপ্রায়। রাত্রির কালো আকাশটা তারায় যেন ছেয়ে আছে। ছাতটা বেশ ঠাণ্ডা। অস্তমিতপ্রায় চাঁদের ক্ষীণ আলো সমস্ত প্রকৃত জুড়ে যেন পাতলা একটা পর্দার মত থিরথির করে কাঁপছে।
ছাতের চারিপাশে প্রায় বুক-সমান উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের গা ঘেষে দাঁড়াল সত্যজিৎ। প্রমোদভবনের তিন দিক বৌরাণীর বিল বেষ্টন করে রেখেছে। খুব প্রশস্ত বিল, এপার-ওপার নজর চলে না।
স্তিমিত চন্দ্রালোকে বিলের কালো জলে যেন অদ্ভুত একটা চাপা রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে। বিলের এপারে ঝাউগাছের সারি। ঝাউয়ের সরু চিকন পাতাগুলো হাওয়ায় দলে দলে যেন একটা চাপা কান্না কাঁদছে।
জনমানবের বসতি থেকে অনেক দূরে নির্জন এই বৌরাণীর বিলের ধারে এই জমিদারের কোন পূর্বপুরুষ যিনি এই প্রমোদভবন তৈরী করেছিলেন, কালের অদৃশ্য কালো হাত তাঁকে নিশ্চিহ্নভাবে গ্রাস করতে পারেনি—অতীতের সাক্ষী হয়ে আজও সে দাঁড়িয়ে আছে।
কত রজনীর প্রমোদ-বিলাসের কত কাহিনী না জানি এই প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে অশ্রুত আনন্দ বেদনায় গমরে উঠেছে।
যারা একদা এই ভবনের কক্ষে কক্ষে বিলাস আনন্দ করে গিয়েছে তারা কি এখানকার স্মৃতি ভুলতে পেরেছে? অদেহী অশীরীর দল আজও হয়ত প্রতি রাত্রে এখানে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় পাশাপাশি হাত-ধরাধরি করে।
আসর জমায়। কান্না-হাসির দোল দোলানো অতীত স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো উল্টে যায় হয়ত।
কালো আকাশের বুকে চাঁদ হারিয়ে গিয়েছে।
সত্যজিৎ কক্ষের দিকে এগিয়ে চলল। ঘরের ভেজানো দরজাটার সামনে এসে কিন্তু সত্যজিৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল! ঘরের মধ্যে স্পষ্ট পদশব্দ।
সত্যজিৎ কান পেতে শোনবার চেষ্টা করে।
শুধু পদশব্দ কি! সেই সঙ্গে যেন আসছে একটা মিষ্টি নূপুরের আওয়াজ।
অত্যন্ত মৃদু পদবিক্ষেপে কে যেন হাঁটছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ রুণু-ঝুনু রুণু-ঝুনু। ধীরে অতি সন্তর্পণে দরজার কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক করতেই সঙ্গে সঙ্গে যেন পদশব্দ ও নূপুরের ধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে গেল, হারিয়ে গেল মুহর্তে।
ঘরের আলোটা কমানোই ছিল। অদ্ভুত একটা আলো-আঁধারিতে ঘরটা রহস্যময়।
কিন্তু কোথায় কে! ঘর শূন্য, কেউ নেই।
ভারী আশ্চর্য তো! সত্যজিৎ যেন বেশ বিস্মিতই হয়। ঘরের ওপাশের অন্য দরজাটা হা হা করছে খোলা।
বিস্মিত সত্যজিৎ খোলা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল, সামনেই একটা ছোট অলিন্দ মত, তারপরই নেমে গেছে অন্ধকার সিঁড়ি নিচের দিকে।
কোথায় গিয়েছে এই সিঁড়ি?
কোন ঘন অন্ধকারের রহস্যের মধ্যে এই সিঁড়িপথ গিয়ে মিশেছে কে জানে?
একটু পূর্বে এই ঘরের মধ্যে যে পদশব্দ, যে নূপুরের ধ্বনি শোনা গিয়েছিল সেই কি এই সিঁড়ি-পথ দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল?
সত্যজিৎ মুহূর্তের জন্য সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবল, তারপর ঘরের মধ্যে আবার প্রবেশ করে সুটকেস থেকে টর্চটা নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে দাঁড়াল সিঁড়ির মাথায়।
প্রথম সিঁড়ির উপর পা দিতেই সত্যজিৎ তার সমস্ত শরীরে যেন একটা অহেতুক শিহরণ অনুভব করে।
কে যেন তার কানে কানে অশ্রুত সাবধান-বাণী উচ্চারণ করে : কোথায় চলেছ সত্যজিৎ?
নাগিনীর মায়ায় ভুলো না।
নাগিনী!
তা হোক, তবু সত্যজিৎ এগিয়ে যাবে।
সত্যজিৎ এগিয়ে চলল।
ধাপের পর ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে সত্যজিৎ নেমে চলল।
সিঁড়ির প্রায় শেষ ধাপে এসে পৌচেছে, সহসা আবার কানে এসে বাজল যেন সেই মিষ্টি নূপুরের ধ্বনি।
অন্ধকারে কে যেন পায়ের নূপুর রুণু-ঝুনু বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে।
অদৃশ্য অশরীরী কোন মায়াবিনী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে নূপুরসংকেতে সম্মুখের ঐ নিচ্ছিদ্র রহস্যময় অন্ধকার থেকে।
নিজের অজ্ঞাতেই সত্যজিৎ সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এ কি সত্যি কোন মায়াবিনীর মায়া, না তারই শোনবার ভুল!
সবিতার চোখেও ঘুম আসছিল না। চোখ দুটো যেন জ্বালা করছে।
সবিতা তার শিয়রের কাছের জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল, হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিল জানালার কবাট দুটো।
অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল অন্ধকার আকাশের দিকে।
দীর্ঘ ছমাস পরে সে বাড়িতে এল অথচ যার স্নেহসিক্ত মধুর ডাকটি শোনবার জন্যে তার বিদেশে সমস্ত অন্তর তৃষিত হয়ে থাকে সেই স্নেহময় পিতা আজ তার কোথায়?
আর কেউ আদর করে ডাকবে না সাবি মা আমার। বিদেশ যাত্রাকালে আর কেউ তার মাথায় হাতটি রেখে স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বলবে না, গিয়েই কিন্তু চিঠি দিস মা। ভুলিস না যেন তোর বুড়ো বাপ আবার ছুটি হলে একদিন তুই ফিরে আসবি সেই দিনটির আশায় দিন গুনছে এখানে বসে একলাটি।
ওর নাকি যখন চার বছর বয়স তখন মা মারা যান।
ভাল করে সঠিকভাবে জানে না বটে তবে কানাঘুষোয় শুনেছিল একদিন ওর মার মৃত্যুর সঙ্গেও যেন কি একটা রহস্য জড়িয়ে আছে।
অবশ্য সে সম্পর্কে কোন দিনই তার মনে কখনো অকারণ কৌতূহল দেখা দেয়নি।
বাবাও তার মার সম্পর্কে কখনো কোন কথা বলেননি এবং তারও কোন দিন বাবাকে মার কথা জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি।
সাত বছর বয়সের সময় ও দেশ ছেড়ে কলকাতার বোর্ডিংয়ে গিয়ে থেকে পড়াশনা শুরু করেছে।
আজ পনের বৎসর সে কলকাতাতেই আছে। কেবল বৎসরে দুবার ছুটিতে মাসখানেকের জন্য এখানে এসে থেকে গিয়েছে, তাও প্রতি ছুটিতেই যে এসেছে তা নয়।
মধ্যে মধ্যে ছুটিতে এদিক-ওদিক বেড়াতেও গিয়েছে। দুখানা ঘরের পরের ঘরটাতেই বাবা শতেন।
কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ ওকে যেন সেই ঘরটার দিকেই টানতে থাকে।
নিজের ঘর থেকে বের হয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে চলল সবিতা সেই ঘরটার দিকে।
ঘরের দরজা ভেজানোই ছিল। বাঁ হাতে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল।
ঘরটা আজ শূন্য। কিন্তু ঘরের মধ্যে বাবার ব্যবহৃত প্রত্যেকটি জিনিস যেখানকারটি যেমন তেমনই আছে।
একধারে ঘরের প্রকাণ্ড সেই কারুকার্যমণ্ডিত মেহগনি কাঠের পালঙ্কের উপর এখনও তেমনি শয্যাটি বিস্তৃত।
মাথার ধারে চৌকির উপরে দেওয়ালে সেই লোহার সিন্দুকটি তেমনই আছে বসানো।
শয্যার ঠিক শিয়রে মাথার উপরে দেওয়ালে টাঙানো মায়ের এনলার্জড তৈলচিত্রটি। ঘরের দক্ষিণ কোণে আয়নাবসানো কাঠের আলমারিটা। তারই পাশে কাপড়ের আলনা।
আলনায় এখনো বাবার ব্যবহৃত ধুতি, চাদর ও জামা রাখা রয়েছে।
পূর্ব কোণে লিখবার টেবিলটি ও বসবার চেয়ারটি। এবং তারই পাশে বেতের আরাম কেদারাটা ও তার পাশে বাবার নিত্যব্যবহার্য গড়গড়াটা।
অনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীনভবে ঘরের এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ সবিতার নজরে পড়ল, তার ও বাবার ফটোটা দেওয়ালে পাশাপাশি টাঙানো।
হাতের মোমবাতিটা উঁচু করে তুলে ধরে মোমবাতির আলোয় বাবার ফটোটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সবিতা।
চিরদিনের বাবার সেই সুন্দর হাসিটি ওষ্ঠপ্রান্তে যেন সজীব বলেই ছবির মধ্যেও মনে হয় এখনো।
সহসা চোখের কোল দুটি জলে ছলছল করে ওঠে।
বাবা! সত্যি কি তুমি আর নেই! আর কি সত্যিই এ জীবনে কোন দিনও তোমার ডাক শুনতে পাব না!
কোথায় গেলে তুমি এমনি করে আমায় না জানিয়ে?
সত্যিই কি কেউ তোমাকে হত্যা করল?
বলে দাও বাবা! তাই যদি হয়, আমি তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেব।
প্রতিজ্ঞা করছি আমি, যে তোমাকে হত্যা করেছে কোনোমতেই তাকে আমি নিষ্কৃতি দেব না।
প্রতিশোধ আমি নেব! নেব! নেব!
সত্যজিৎ হাতের টর্চের বোতামটা টিপে আলোটা জ্বালল। সম্মুখের অন্ধকারে হস্তধৃত টর্চের আলোর রশ্মিটা ছড়িয়ে গেল। একটা অপ্রশস্ত সরু গলিপথ সম্মুখে। সত্যজিৎ হাতের টর্চের আলো ফেলে ফেলে দেখল পথটা বেশ লম্বা। এগিয়ে গেল সত্যজিৎ আলো ফেলতে ফেলতে সেই অপ্রশস্ত গলিপথে।
আশ্চর্য! চারিদিকেই ঘেরা দেওয়াল পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে, কোথাও কোন নির্গমনের পথই নেই।
অন্ধ গলিপথ।
তার ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কেউ যে এই গলির মধ্যে এসে অন্য কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাবে তারও কোন রাস্তা নেই। তবে?
সবই কি তাহলে তার ভ্রম!
কেউ তার ঘরে যায়নি বা কেউ নূপুর পায়ে হেঁটে যায়নি!
কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যজিৎ কোনোমতেই যেন বুঝে উঠতে পারে না, যদি এই গলিপথ দিয়ে অন্য কোথাও নিষ্ক্রমণের কোনও রাস্তা নাই থাকে তবে ঐ গোপন সিঁড়ি-পথ ও এই গলি-পথের তাৎপর্য কি?
অনাবশ্যক নিশ্চয়ই এ গলির পথ তৈরী করা হয়নি।
নিশ্চয়ই এই গলি-পথ থেকে অন্য কোন ঘরে বা বাইরে যাবার কোন পথ বা দ্বার আছে যেটা নজরে পড়ছে না।
কোন গুপ্ত-পথ বা গুপ্ত-দ্বার!
সত্যজিৎ আবার আলো ফেলে ফেলে চারিদিককার দেওয়ালে অনুসন্ধান করতে লাগল।
দেওয়ালের গায়ে ঠুকে ঠুকে দেখতে লাগল।
কিন্তু আশ্চর্য! কোন কিছুরই হদিস ও পেল না। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পূর্বশ্রুত সেই নূপুরের শব্দও আর কই ও শুনতে পেল না।
কতকটা যেন বিফলমনোরথ হয়েই সত্যজিৎ তার ঘরে আবার ফিরে এল এবং সিঁড়িপথের সঙ্গে সংযুক্ত দরজা বন্ধ করে দিল শিকল তুলে।
০৪. পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল
পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায় সবিতার ডাকে।
সত্যজিৎবাবু উঠুন! নায়েব কাকা নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, দারোগাবাবু, নাকি এসেছেন!
লজ্জিত সত্যজিৎ চোখ রগড়াতে রগড়াতে শয্যা হতে উঠে নেমে দাঁড়াল। খোলা জানালা-পথে প্রভাতী রৌদ্র এসে সমস্ত কক্ষটা আলোয় ঝলমল করছে।
সবিতার পরিধানে একটা সাধারণ মিলের কালোপাড় শাড়ি। রুক্ষ তৈলহীন চুলের রাশ বুকে পিঠে ছড়িয়ে আছে।
যেন একখানি পরিপূর্ণ বিষাদের সকরুণ প্রতিচ্ছবি।
কানাইয়ের মাকে এই ঘরে আপনার চা দিতে বলেছি। দোতলার বাথরুমেই জল আছে, হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
পায়ে জুতোটা গলাতে গলাতে সত্যজিৎ বললে, আপনি চা খাবেন না!
না।
কেন, আপনার কি চা খাওয়া অভ্যাস নেই?
আছে। তবে—
সকরুণ বিষণ্ণ হাসি সবিতার ওঠপ্রান্তে জেগে ওঠে।
সহসা সত্যজিতের মনে পড়ে যায়, তিনদিন পিতার মৃত্যুতে সবিতাকে নিয়মপালন করতে হবে।
গত প্রত্যুষেও ট্রেনে চা-পান করেনি।
লজ্জিত সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি বাইরে বাথরুমের দিকে চলে যায়—যেন ঘটনাটাকে কতকটা সহজ করে দেবার জন্যই।
নায়েব বসন্তবাবু ওদের অপেক্ষাতেই বাইরের ঘরে একটা চেয়ারের ওপর বসে অন্য একটি চেয়ারের পাশ্বে উপবিষ্ট থানার দারোগা লক্ষ্মীকান্তবাবুর সঙ্গে নিম্নস্বরে কি সব কথাবার্তা বলছিলেন।
দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহার বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে নয়; বয়স যাই হোক মাথার সবটুকু জুড়ে বিস্তীর্ণ একটি টাক। কেবল পশ্চাতে ঘাড়ের দিকে সামান্য যা চুল আছে তার মধ্যে বেশীর ভাগই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।
নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। মুখখানা বর্তুলাকার, ছড়ানো নাসিকা, ওপরের ওষ্ঠটি স্বাভাবিক রকমের পুরু।
লক্ষ্মীকান্তর মস্তকের চুলের অপ্রতুলতার সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করবার জন্যই হয়ত সর্বাঙ্গে লোমের প্রাচুর্য।
লক্ষ্মীকান্ত দারোগা সবিতার একেবারে অপরিচিত নয়, কারণ ইতিপূর্বে দু-একবার এই বাড়িতেই চৌধুরী মশাই বেঁচে থাকতে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে।
সবিতা ও সত্যজিৎকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে বসন্তবাবুই সর্বপ্রথমে সবিতাকে আহ্বান জানালেন, এস মা। ঐ চেয়ারটায় বস। লক্ষ্মীকান্তবাবু অনেকক্ষণ তোমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছেন—তিনদিন হয়ে গেল, আর তো বাসি মড়া এমনি করে রাখা যায় না—
কথাটা শেষ করলেন লক্ষ্মীকান্ত দারোগা, হ্যাঁ সবিতা দেবী, কেবল আপনি যাতে আপনার পিতাঠাকুরকে একটিবার শেষবারের মত—
তার আর কোন প্রয়োজন নেই নায়েব কাকা। মৃতদেহ সৎকারের আয়োজন করুন।
কিন্তু তুমি একবার
সে সৎকারের সময়েই হবে। আপনি আর দেরি করবেন না।
সবিতার কণ্ঠস্বর ক্লান্ত ও নিস্তেজ হলেও যেন একটা দৃঢ়তায় সুস্পষ্ট মনে হয়।
বেশ। তাহলে আমি সব ওদিককার যোগাড়যন্ত্র করি গে। আচ্ছা লক্ষ্মীকান্তবাবু, আমি তাহলে –
হ্যাঁ আসুন। সবিতা দেবীর সঙ্গে আমার গোটাকতক কথা আছে, সেগুলো ইতিমধ্যে সেরে নিই।
বসন্তবাবু আর অপেক্ষা করলেন না, কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
বসন্তবাবু কক্ষ হতে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ধরে যেন ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।
লক্ষ্মীকান্তবাবু, সবিতা ও সত্যজিৎ কারো মুখেই কোন কথা নেই।
ঠিক কি ভাবে বক্তব্যটা শুরু করলে নেহাত অশোভন বা পীড়াদায়ক হবে না সেই কথাটাই লক্ষ্মীকান্ত চিন্তা করতে থাকেন বোধ হয়।
এমন সময় সবিতাই শুরু করে, ইনি সত্যজিৎ রায়, বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে। আমাদের আত্মীয়ের মতই। বাবাই ওঁকে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এর উপস্থিতিতে আমরা সকল প্রকার আলোচনাই করতে পারি লক্ষ্মীকান্তবাবু।
ও। মৃদুভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন লক্ষ্মীকান্ত।
হ্যাঁ, এবারে আপনি আপনার আমাকে যে প্রশ্ন তা করতে পরেন।
একসকিউজ মি ফর এ মিনিট লক্ষ্মীকান্তবাবু ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, সহসা কথার মাঝখানে লক্ষ্মীকান্তকে কোন কথা বলবার অবকাশ না দিয়েই সত্যজিৎ বলে ওঠে, আপনাকে আমি দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
নিশ্চয়ই। বলুন কি জিজ্ঞাসা করতে চান?
লক্ষ্মীকান্ত পূর্ণ দৃষ্টিতে সকৌতুকে তাকালেন প্রশ্নকারী সত্যজিতের মুখের দিকে।
আপনাদের ধারণাও বটে এবং শুনলাম ময়না তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে, চৌধুরী মশাইকে কেউ না কেউ হত্যাই করেছে, তাই না?
হ্যাঁ। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
আচ্ছা যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তার আশেপাশে বা চৌধুরী মশায়ের দেহে ও জামাকাপড়ে এমন কোন চিহ্ন কি পাওয়া গিয়েছে—অবশ্য একমাত্র ময়না-তদন্তের ফলাফল ছাড়া যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে তাঁকে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে?
লক্ষ্মীকান্ত দারোগা এই সব খুন-জখমের তদন্ত কুড়ি বছর ধরে করছেন।
বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ও কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু সত্যজিৎ যেভাবে তাঁকে প্রশ্নটা করল ঠিক এই ধরণের প্রশ্ন যে ঐরকম জায়গা থেকে শুনতে পাবেন এ যেন তাঁর স্বপ্নেরও অতীত ছিল।
বিস্মিত লক্ষ্মীকান্ত কিছুক্ষণ প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি ঠিক কি জানতে চান সত্যজিৎবাবু?
জানতে চাই কি কি কারণে আপনারা এক্ষেত্রে যে চৌধুরী মশাইকে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে বলে স্থিরসিদ্ধান্ত হয়েছেন, অবশ্য ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়া
ময়না-তদন্তে যখন শ্বাসরোধ করা হয়েছে বলেই প্রমাণিত হয়েছে, তখন আবার কি প্রয়োজন বলুন?
তা বটে! আচ্ছা চৌধুরী মশাইয়ের গলায় কোন দাগ বা চিহ্ন কি ছিল যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে তাঁকে
না, এমন কোন চিহ্নই তাঁর গলায় ছিল না।
মৃতদেহের গায়ে কোন জামা ছিল না শুনেছি
না, একটা চাদর জড়ানো ছিল মাত্র।
কোন struggle বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন তাঁর গায়ে পরিধেয় বস্ত্রে ছিল না?
না।
যেখানে মৃতদেহ পাওয়া যায় সেই আশেপাশের জমিতে কোন চিহ্ন বা
না, তাও ছিল না।
কোন পদচিহ্ন?
না।
আচ্ছা শুনেছি একপাটি জুতো মৃতদেহের পায়েই ছিল, আর অন্য পাটি জুতো কিছুদূরে ঘাসের উপরে পড়েছিল?
তাই।
হুঁ। আচ্ছা মনে করনে শ্বাসরোধ করেই যদি তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকে তাহলে সেই শ্বাসরোধের ব্যাপারটা কোথায় সংঘটিত হয়েছিল? মানে সেইখানেই যেখানে মৃতদেহ পাওয়া যায়, না অন্য কোথায়ও বলে আপনাদের ধারণা?
এ তো সহজেই অনুমান করা যায়, নিশ্চয়ই সেই নন্দনকাননেই!
কেন বলুন তো?
লক্ষীকান্ত এবারে যেন সত্যজিতের প্রশ্নে বেশ একটু বিরক্তই হয়েছেন তাঁর কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল, তা ছাড়া আর কি! নইলে কি আপনার ধারণা। শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করে, হত্যাকারী শেষে মৃতদেহটা ঐ দীর্ঘ পথ বহন করে নিয়ে গিয়েছে বোকার মত!
সম্ভবত সেটা হয়ত হত্যাকারী করেনি, কারণ সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে আপনাদের রিপোর্ট শুনে মনে হচ্ছে সেই নন্দনকাননেই যে চৌধুরী মশাইকে হত্যা করা হয়েছে সেটাও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।
কেন বলুন তো? একটা ব্যঙ্গ ও তাচ্ছিল্য-মিশ্রিত কৌতূহলের সঙ্গেই যেন লক্ষ্মীকান্ত সত্যজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন।
কারণটা হয়ত চট করে আপনাকে এখনি বুঝিয়ে বলতে পারছি না লক্ষ্মীকান্তবাবু, তবে সাধারণ বুদ্ধি যাকে আমরা common sense বলি তা থেকে মনে হয় মৃতদেহ ও তার আশপাশের যে বর্ণনা আপনারা দিচ্ছেন তাতে করে বরং উল্টোটাই মনে হয়—হত্যা করবার পর মৃতদেহ সেখানে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে।
এবারে লক্ষ্মীকান্ত হেসে ফেললেন, চমৎকার যুক্তি আপনার মশাই! কে এমন আহাম্মক আছে বলুন যে হত্যা করবার পর মৃতদেহটাকে অতখানি risk নিয়ে ঐ নন্দনকাননের মধ্যে গিয়ে ফেলে রেখে আসবে? কাজ হাসিল করবার পর অকুস্থান থেকে খুনী যত তাড়াতাড়ি গা-ঢাকা দিয়ে সরে যেতে পারে তাই সে যায় এবং সেটাই এযাবৎকাল স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছি মশাই। এ লাইনে একটা জীবনই তো কেটে গেল।
আপনার ও-কথার মধ্যে যুক্তি আছে বৈকি লক্ষ্মীকান্তবাবু, তবে কি জানেন, আপনিও হয়ত শুনে থাকবেন, এমনও বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যে ধরনের risk-এর কথা আপনি বলছেন সেই ধরনের প্রচার risk থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কোন উদ্দেশ্যেরই বশবর্তী হয়ে অনেক সময় হত্যাকারী হত্যা করবার পর অকুস্থান হতে মৃতদেহ টেনে বা বহন করে নিয়ে গিয়ে দূরবর্তী কোন স্থানে ফেলে রেখে এসেছে।
দেখুন মশাই, আপনার সঙ্গে অত চুলচেরা তর্ক-বিচার করবার মত পর্যাপ্ত সময় আমার হাতে বর্তমানে নেই। আমি case-এর investigation-এর জন্য সবিতা দেবীকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই একটু private-এ
সুস্পষ্ট বিরক্তি ও কতকটা তাচ্ছিল্যই যেন ঝরে পড়ল লক্ষ্মীকান্তর কণ্ঠস্বরে এবারে।
কিন্তু সত্যজিৎ কোন জবাব দেবার পূর্বেই সবিতা বলে উঠল, আমাকে যা আপনি জিজ্ঞাসা করতে চান লক্ষ্মীকান্তবাবু ওঁর সামনেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনাকে তো একটু আগেই আমি বলেছি উনি বাবার বন্ধুপুত্র ও আমাদের আত্মীয়েরই মত।
না না—তার কোন প্রয়োজন নেই সবিতা দেবী। বেশ তো, উনি যখন বিশেষ করে private-এ আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান, আমি না হয় পাশের ঘরেই কিছুক্ষণের জন্য
সত্যজিৎ উঠে দাঁড়াল।
কিন্তু সবিতার দৃঢ় সংযত কণ্ঠস্বরে সহসা ও ফিরে দাঁড়াল, না, আপনি যাবেন না মিঃ রায়। এই ঘরেই থাকুন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে দিন আপনার উপস্থিতিতেই উনি কি জানতে চান—
সত্যজিৎ ও লক্ষ্মীকান্তবাবু, দুজনেই যেন বেশ একটু সবিতার আচরণে ও কণ্ঠস্বরে বিস্মিত হয়ে একই সময়ে যুগপৎ সবিতার মুখের দিকে তাকায়।
সবিতা তার অর্ধসমাপ্ত কথাটা শেষ করে বলে, হ্যাঁ, যেহেতু বাবার এই হত্যা-রহস্যের মীমাংসার জন্য ওঁর সাহায্য ও সহানুভূতিও যেমন আমার প্রয়োজন তেমনি আপনার সাহায্য ও সহানুভূতিও আমার প্রয়োজন এবং সেই কারণেই আমি চাই গোড়া থেকেই যেন আমাদের তিনজনের মধ্যে একটা সহজ বোঝাপড়া থাকে।
ওঃ! তা বেশ। সত্যজিৎবাবু, আপনিও তাহলে বসুন।
পূর্বের মতই বিরক্তি-মিশ্রিত কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্ত বলে ওঠেন।
সত্যজিৎ আবার পূর্বের আসনটিতে বসে পড়ল।
শুনুন লক্ষ্মীকান্তবাবু, আপনি জানেন আমার টাকার অভাব নেই। বাবার এই হত্যা-রহস্যের মীমাংসার জন্য আপনাদের ব্রাঞ্চের কোন বিশেষ অভিজ্ঞ ও নামকরা ব্যক্তিকেও যদি চান আনতে পারেন, তার যাবতীয় খরচও আমি দেব।
বেশ তো। আনন্দের কথা। তবে এক্ষেত্রে তাতেও কোন সুরাহা হবে বলে তো আমার মনে হয় না!
কেন বলুন তো? প্রশ্নটা করে সত্যজিৎ।
আমারও তো মশাই বিশ বছরের অভিজ্ঞতা এ লাইনে। খুনীর ধরাছোঁয়াও পাবেন না।
ধরা-ছোঁয়াও পাব না?
পাবেন কি করে! আমার যতদূর মনে হয় খুনী এক্ষেত্রে কোন বাইরের লোক। এ বাড়ির তো কেউ নয়ই, এ শহরেরও কেউ নয়। এ বিষয়ে আমি একেবারে স্থির সিদ্ধান্ত
কেন বলুন তো?
কারণ আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা পর্যালোচনা করে যাবতীয় সকলের জবানবন্দি নিয়ে এটা অন্ততঃ বুঝতে পেরেছি, হত্যাকারী এখানকার কেউ নয়।
আপনি তাহলে বলতে চান বাইরের কেউ প্রশ্ন করে সত্যজিৎ।
নিশ্চয়ই।
কিন্তু উদ্দেশ্য?
তা উদ্দেশ্যও একটা আছে বৈকি। গম্ভীর স্বরে প্রত্যুত্তর দেন লক্ষীকান্তবাবু।
আপনি ধরতে পেরেছেন নাকি কিছু?
সেটা অবশ্য ভেবে দেখতে হবে।
বিশ বছরের অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে লক্ষ্মীকান্তর অকাট্য যুক্তির বহুর শুনে সত্যজিৎ মনে মনে কৌতুক অনুভব না করে পারে না। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সকৌতুকে চেয়ে থাকে লক্ষীকান্তর মুখের দিকে।
অতঃপর লক্ষ্মীকান্ত সবিতাকে জিজ্ঞাস্য প্রশ্নগুলি করতে লাগলেন।
আচ্ছা সবিতা দেবী, আপনি বলতে পারেন, আপনার পিতার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন কেউ আছে কিনা যার সঙ্গে আপনার বাবার শত্রুতা ছিল?
না।
কেন বলুন তো
কারণ বাবার পিতৃবংশের দিক থেকে তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল বলে জানি না। বাবা ঠাকুর্দার একমাত্র ছেলে।
আপনার পিতার একটি ভগ্নী ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা—
পিসিমা আমার জন্মের পূর্বেই মারা যান শুনেছি। তাঁর একমাত্র পুত্র শুনেছি বর্মা না মালয় কোথায় ডাক্তারী করেন। তাঁকে জীবনে দেখিওনি কখনো, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হবারও কোন সৌভাগ্য হয়নি। আর বাবার মাতৃবংশে শুনেছি বাবার দুই মামা বাবার চাইতে বয়সে ছোট, এখনও বেঁচে আছেন, বিক্রমপুরের ওদিকে কোথায় জমিদার। তাঁদের সঙ্গেও আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
হুঁ। আচ্ছা দেখুন, জমিদারী ও ব্যবসা চালাতে গেলে বহু, লোকের সঙ্গে শত্রুতা ইচ্ছা না থাকলেও হয়ে যায় জানি তো—এখন ব্যক্তিবিশেষের কথা
না, সেরকম শত্রুও বাবার কেউ কোন দিন ছিল বলে জানি না।
ভাল করে ভেবে বলুন সবিতা দেবী, এমনও হতে পারে আপনি জানেন না!
আমার বাবাকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম।
কিন্তু আমি তো শুনেছি আপনি আপনার সাত বছর বয়স থেকেই বিদেশে। কেবল মধ্যে মধ্যে ছুটিতে যা এখানে আসতেন।
তাহলেও আমি তাঁকে খুব ভাল করেই জানতাম।
ও! তাহলে এবারে আমি উঠব।
আসুন।
লক্ষ্মীকান্ত বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
০৫. শ্মশান হতে ফিরে
শ্মশান হতে ফিরে সবিতা স্নান সেরে তার নিজের ঘরে শয্যার উপরে গা এলিয়ে পড়েছিল। সমস্ত শরীরে একটা ক্লান্ত অবসন্নতা।
কানাইয়ের মা এক গ্লাস সরবৎ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
দিদিমণি, এই সরবটুকু খেয়ে নাও দেখি—
ওই টেবিলের উপর রেখে যা কানাইয়ের মা।
না। এই সরবটুকু তুমি খেয়ে নাও।
বিরক্ত করিস না। যা বলছি তাই শোন। সত্যজিৎবাবুকে চা-জলখাবার দিয়েছিস?
হ্যাঁ, তৈরী হয়ে গেছে, এবার দেব।
তোদের দিয়ে কোন কাজ হয় না। আগে কোথায় তাঁকে চা-জলখাবার। দিবি, তা নয় আমার জন্য সরবৎ নিয়ে এসেছিস!
লজ্জিত কানাইয়ের মা সরবতের গ্লাসটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে সত্যজিৎকে চা-জলখাবার দেবার জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সত্যজিৎ তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসেছিল।
বনমালী ঘরের মধ্যে সেজ বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে বটে তবে আলোর শিখাটা কমানো।
খাবারের প্লেট ও চায়ের কাপ হাতে কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল, বাবু!
কে?
চা এনেছি বাবু।
তোমার দিদিমণিকে কিছু খেতে দিয়েছিলে কানাইয়ের মা?
হ্যাঁ, সরবৎ দিয়ে এসেছি।
খাবারের প্লেটটা ও চায়ের কাপ পাশের একটা চৌকির উপরে নামিয়ে রেখে কানাইয়ের মা ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য উদ্যত হল।
সত্যজিৎ ডাকল, কানাইয়ের মা!
সত্যজিতের ডাকে কানাইয়ের মা ফিরে দাঁড়াল।
ওইখানে এসে বসো কানাইয়ের মা। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সত্যজিতের আহবানে কানাইয়ের মা তার সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
ওইখানে বসো।
কানাইয়ের মা মাটিতেই বসল।
চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললে, তুমি তো এ বাড়িতে অনেক দিন আছ শুনলাম, পুরনো লোক—
দিদিমণির এককুড়ি তিন বছর বয়স হল। তা ধর না গো—তারও দুবছর আগে থেকে এ বাড়িতে আমি আছি বাবু। পুরনো নোক বইকি।
অর দিদিমণিও তো শুনেছি তোমারই কোলেপিঠে মানুষ।
তা ছাড়া আর কার? আমারই কোলেপিঠে দিদিমণি মানুষ হল তো!
আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমাদের দিদিমণির বাবা মানে কর্তাবাবু, তুমি তো জান তাকে কেউ খুন করেছে—
আহা! আর বোলোনি গো বাবু, মেয়েটার কি দুঃখের কপাল! ওর মা আহা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-ঠাকরুণ ছিলেন গো—স্বগগের দেবী, মেয়েটার চার বছর বয়সের সময় অঘোরে মারা গেল এই হতচ্ছাড়া বাড়িতেই। কত্তাবাবুও এই বাড়িতেই মারা গেল অঘোরে। এই বাড়িটাই অলুক্ষুণে বাবু
তোমার দিদিমণির মাও এই বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন নাকি?
তাছাড়া আর কি! এই বাড়িতেই তো!
কি হয়ে মারা যান তিনি?
কাউকে বোলোনি বাবু। কেউ জানে না। কত্তাবাবুর মানা ছিল, এতদিন কাউকে বলিনি
তোমার দিদিমণিও জানে না?
না। এক কত্তাবাবু জানতেন—আর জানতাম আমি
সত্যজিৎ কৌতূহলে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সবিতার মার মৃত্যুর মধ্যেও তাহলে একটা রহস্য রয়ে গিয়েছে। কেবল জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরই রহস্যময় মৃত্যু ঘটেনি, উনিশ বছর আগে সবিতার মার মৃত্যুর ব্যাপারেও এমনি কোন রহস্য ছিল। এবং শুধু তাই নয়, উভয়েরই মৃত্যু একই বাড়িতে ঘটেছে।
কানাইয়ের মা অনেক কথা জানে। হয়ত সেসব কথা জানতে পারলে বর্তমান রহস্যের উপরে অনেকখানি আলোকসম্পাত হবে।
সব গুছিয়ে কৌশলে কানাইয়ের মার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
কানাইয়ের মার কয়েকটি কথাতেই সত্যজিৎ বুঝেছিল, মেয়েমানুষ হয়েও এতকাল একমাত্র জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ভয়েই হয়ত কানাইয়ের মা যেসব গোপন কথা এতকাল কারো কাছে মন খোলসা করে বলতে সাহস পায়নি, অথচ ভিতরে ভিতরে যে কথাগুলো তার স্বাভাবিক নারীমনের বৃত্তিতে কারো কাছে উগরে দেবার জন্য ছটফট করেছে—সত্যজিতের কাছে তারই কিছু হয়ত হঠাৎ বলে ফেলেছে।
সত্যজিতের ধারণা যে মিথ্যে নয় সেটা সে পরমুহূর্তে বুঝতে পারে কানাইয়ের মায়ের পরবর্তী কথায়, অনেক কথা বলে ফেননু বাবু। কাউকে আবার যেন বলোনি। কত্তাবাবু, আজ আর বেঁচে নেই বটে তবে ধর্মের ভয় তো আছে গো।
তা তো নিশ্চয়ই। তোমার কোন ভয় নেই কানাইয়ের মা। আমি সব শুনেছি, তুমি এদের কত বড় আপনার লোক। দিদিমণির তুমি মায়ের সমান। দিদিমণিই বলছিল তুমি তো তার মায়ের মতই
তা বইকি বাবু! আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে কানাইয়ের মা। হাজার হলেও নারীর মন তো। সত্যজিতের কথাগুলো তার নারীচিত্তের ঠিক জায়গাটিতেই গিয়ে ঘা দিয়েছে।
আমিও তো তাই বলি কানাইয়ের মা। পেটে ধরলেই কি কেবল মা হয়! দেখো তোমরা যাই বল, অপঘাতে বাবুর মৃত্যু হয়েছে, আমার কিন্তু ধারণা এ কোন দুষ্ট লোকের কাজ—
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা, সত্যজিতের মুখের দিকে।
হ্যাঁ। সব তোমাকে আমি বলব কিন্তু তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার কতকগুলো কথা জানা দরকার।
আমি কি জানি বাবু
আজ রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর একবার আসতে পার কানাইয়ের মা এ ঘরে? আমি আর তোমার দিদিমণি থাকব। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
তা আর পারবোনি কেন, আসবোখন।
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা; কুণ্ঠে গেলি
মুখপোড়া বনমালী মিনষে আবার চেঁচাতে নেগেছে, যাই বাবু
বলি অ কানাইয়ের মা, কানের মাথাটি খেয়ে বসে আছিস নাকি! রা-টি কাড়ছিসনি কেন রে বুড়ী
বলতে বলতে ঘরের মধ্যে বনমালীর আবির্ভাব, এই যে তু ইখানটিতে বসে। ঠাকুর যে উদিকে চেচায়ে মরছে। রান্নাবান্না হবে, না হবেকনি—
যাচ্ছি, যাচ্ছি—চল।
কানাইয়ের মা বনমালীকে সঙ্গে করে নিয়েই ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সবিতা এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল, সত্যজিৎবাবু
আসুন সবিতা দেবী।
কানাইয়ের মা বুঝি বকরবকর করে আপনাকে বিরক্ত করছিল?
সত্যজিৎ সবিতার কথায় মৃদু হাসল, না, বরং আমিই তাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিলাম।
অমন কাজটিও করবেন না। একবার বকতে শুরু করলে ও আর থামতে চায় না।
বসুন মিস চৌধুরী।
সবিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সত্যজিতের মুখোমুখি উপবেশন করল।
আপনি হয়ত জানেন না মিস চৌধুরী, অনেক সময় অবান্তর বাজে কথার মধ্যে থেকেই কাজের ও প্রয়োজনীয় কথা খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু ওর যে ষোল আনার মধ্যে সাড়ে পনের আনা কথাই অবান্তর!
তা হোক, বুড়ী লোকটি ভাল।
কি করে বুঝলেন?
শুনন মিস চৌধুরী, ওকে আজ রাত্রে এ ঘরে আসতে বলেছি। আরো বলেছি, আমি ও আপনি এ ঘরে থাকব।
কেন বলুন তো?
আচ্ছা আপনি আপনার মায়ের মৃত্যু-ব্যাপার সম্পর্কে কিছু জানেন?
বিস্ময়ের সঙ্গে সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে তাকায়, কেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন হঠাৎ? কানাইয়ের মা কিছু সে সম্পর্কে বলছিল নাকি?
না, কিছু বলেনি বটে তবে আমার মনে হয় কানাইয়ের মা হয়ত কিছু জানে।
সবিতা প্রথমটায় একটু ইতস্তত করে, তারপর বলে, হ্যাঁ। আমিও একবার ছোটবেলায় কানাঘুষোয় মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে কি একটা রহস্য জড়িয়ে আছে শুনেছিলাম বটে, তবে details কিছুই জানি না। কিন্তু কানাইয়ের মা সে কথা জানবে কি করে
সত্যজিৎ তখন একটু পূর্বে কানাইয়ের মার সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সব বিশদভাবে খুলে বললে।
সবিতা নিঃশব্দে সব শুনে গেল।
তাই আমি ঠিক করেছি, যতটা পারি প্রশ্ন করে ওর কাছ থেকে আমাদের জেনে নিতে হবে। আরো একটা কথা, আপনার মাও নাকি এই বাড়িতেই মারা যান!
কই, সে কথা তো আমি শুনিনি?
শুনলেও হয়ত আপনার মনে নেই। একেবারে ছোট্টটিই তো ছিলেন আপনি তখন।
আপনার কি মনে হয় সত্যজিৎবাবু, এ রহস্যের আপনি মীমাংসা করতে পারবেন?
আমার কি ধারণা জানেন মিস চৌধুরী? মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। মানুষই যদি হত্যা করে থাকে তাঁকে তবে মানুষই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারে। মানুষই problem তৈরী করে, আবার মানুষই সেটা solve করে।
দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে কানাইয়ের মা যে কথাগুলো একমাত্র চৌধুরী মশায়ের ভয়ে বুকের মধ্যে জমা রেখে দিয়েছিল, সেগুলো সত্যজিৎ ও সবিতার কাছে বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দীর্ঘ উনিশ বছর আগেকার কাহিনী।
সবিতার মা হেমজার শরীরটা কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না।
তাই স্ত্রী হেমপ্রভা, ছোট চার বছরের মেয়ে সবিতা ও কানাইয়ের মাকে নিয়ে প্রমোদভবনে এক মাসের জন্যে বিশ্রাম নিতে এলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
চারদিকে খোলা-মেলা বিলের হাওয়া, নির্জনতা স্ত্রীর মন ও শরীরের উপরে একটা পরিবর্তন ঘটাবে এইটাই ভেবেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
শহর থেকে দূরে নির্জন এই বিলের ধারে যেন অবারিত মুক্তির একটা কোমল স্পর্শ।
প্রমোদভবনের তিন দিক ঘিরে দেড়মানুষ সমান উঁচু, প্রাচীর।
বায়ুর তাড়নায় বিলের জল প্রাচীরের গায়ে ছলছলাৎ করে আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
প্রমোদভবনের পশ্চাতের দ্বার খুললেই চোখে পড়ে প্রায় শদুই গজ দূরে একটা ছোট দ্বীপের মত। প্রমোদভবন থেকে সেই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সেগুন, শালকাঠ ও পাথর বিলের জলের মধ্যে ফেলে একটা রাস্তা তৈরী করা হয়েছে।
রাস্তাটা অপ্রশস্ত—তিনজনের বেশী লোক একত্রে পাশাপাশি হাঁটতে পারে না।
দ্বীপটা ত্রিভুজাকার। দ্বীপের মধ্যে ছোট বড় নানাজাতীয় বৃক্ষ যেন একটা অরণ্যস্ততা এনেছে। দ্বীপের ঠিক মধ্যস্থলে একটি চমৎকার পাথরের তৈরী একতলা ছোট বাড়ি। বাড়ির মধ্যে খানতিনেক ঘর মাঝারি আকারের। বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে দেশী-বিদেশী নানাজাতীয় ফলের গাছ।
বহুদিনের অযত্ন-বর্ধিত হয়ে এখন সম্পূর্ণ বাগানটি একটা যেন ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
আপন মনেই এখন ফুল ফোটে, ফল ঝরে, আগাছা বেড়ে চলে।
দীর্ঘকালের অযত্নে বাড়িটার ঘরের জানালা-কবাটগুলো জীর্ণ ও ধংসপ্রায়।
দিবারাত্র বাতাসে মচমচ, খটখট শব্দ করে।
জমিদার বাটি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ছিল এক দিগন্তপ্রসারী বিল। এই বিলের যোগাযোগ ছিল একেবারে পদ্মার সঙ্গে।
চারপুরুষ আগে করালীপ্রসন্ন চৌধুরী তাঁর প্রিয়তমা মহিষী রাণী কাঞ্চনমালার জন্যে ঐ বিলের মধ্যে পাথর ফেলে এক প্রমোদভবন গড়ে তোলেন। এবং বিলের মধ্যেই পাথর ফেলে মাটি ঢেলে তৈরী করেন এক নকল দ্বীপ। ফুলফলের গাছগাছড়া লাগিয়ে দ্বীপের প্রাণসঞ্চার করেন।
নির্মাণ করেন দ্বীপের মধ্যস্থলে একটি সুরম্য ছোট বিশ্রামভবন। তার চারপাশে দিগদেশ হতে নানাবিধ, আকার, গন্ধ ও বর্ণ-বৈচিত্র্যের ফুলের গাছ এনে রচনা করেন এক উদ্যান; তারই নাম দেন নন্দনকানন।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যখন তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভাকে নিয়ে প্রমোদভবনে এলেন, বহুদিনের অবহেলায় ও অব্যবহার্যে এবং কালের নিষ্ঠুর আঘাতে আঘাতে প্রমোদভবন জীর্ণ ভগ্নপ্রায় এবং দ্বীপের মধ্যে নন্দনকানন জঙ্গলাকীর্ণ ও ভীষণ কালনাগের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে।
প্রমোদভবনকে যথাসাধ্য মেরামত ও সংস্কার করে নিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
অল্পদিনের মধ্যেই হেমপ্রভার স্বাস্থ্যেরও উন্নতি দেখা গেল। কিন্তু নিষ্ঠুর ভবিতব্য যা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর জন্যে অলক্ষ্যে অপেক্ষা করছিল, জীবনের সুধার পূর্ণ পাত্রটিকে সহসা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
দাসী কানাইয়ের মা ও সবিতাকে নিয়ে রুগ্না হেমপ্রভা একটি কক্ষে শুতেন। পাশের ঘরেই শয়ন করতেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মার নিদ্রারোগটা চিরদিনই বেশী। একদিন সকালে কানাইয়ের মার ডাকাডাকি ও চেঁচামেচিতে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘুম ভেঙে জানলেন হেমপ্রভাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হন্তদন্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন, শয্যার উপরে তখনও চার বছরের শিশুকন্যা সবিতা অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।
মাকে যে তার পাওয়া যাচ্ছে না, কিছুই তার সে জানে না। বাড়ির অন্যান্য ভৃত্যরা—তখনও সকলে ঘুম ভেঙে ওঠেনি।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যেন পাগলের মত হয়ে গেলেন।
কোথায় গেল হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে! তাঁদের দীর্ঘ দশ বৎসরের বিবাহিত জীবনের প্রতিটি দিনরাত্রির ইতিহাসকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী হেমপ্রভার আকস্মিক অন্তধানের কোন কারণ বা মীমাংসা খুঁজে পেলেন না।
কোনদিনের জন্যও তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতটকু ভুল বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্যের কারণ ঘটেনি যাতে করে সহসা এমনিভাবে হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে গৃহত্যাগ (?) করতে পারে।
হেমপ্রভাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, একমাত্র কানাইয়ের মা ও তিনি নিজে ছাড়া তৃতীয় আর কেউ জানে না।
কানাইয়ের মাকে নিজের ঘরে ডেকে এনে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘরের দরজায় খিল তুলে দিলেন।
শোন কানাইয়ের মা, তোর মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না একথা যেন কেউ জানতে পারে। একমাত্র তুই ও আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ জানে না। ঘুর্ণাক্ষরেও একথা কেউ কোনদিন যদি জানতে পারে তবে তোকে জ্যান্ত নন্দনকাননে মাটির তলায় কবর দেব।
কানাইয়ের মা থরথর করে কাঁপছিল। গলাটা তার শুকিয়ে গিয়েছে, কোনমতে একটা ঢোক গিলে শুষ্ক নিম্নকণ্ঠে বললে, মরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না বাবু
মনে থাকে যেন। হ্যাঁ দেখ, আজই রাতে আমি সবিতাকে নিয়ে কাশী যাব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি। নিচের ঠাকুর চাকর কেউ যেন ওপরে না আসে। বলবি তোর মার কাল রাত থেকে অসুখের খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে। যা–
বাড়ির সকলেই জানল গত রাত থেকে হেমপ্রভা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন খুব খারাপ অবস্থা চলছে। আজ রাত্রেই জমিদারবাবু অসুস্থা স্ত্রী, কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাচ্ছেন।
স্ত্রীর অসুখের সংবাদ দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী রাত এগারোটায় স্টেশনে যাবার জন্যে দুখানা পাল্কির ব্যবস্থা করতে বললেন নায়েবকে। রাত দুটোর গাড়িতে তিনি সস্ত্রীক কলকাতায় যাবেন।
নায়েব বসন্ত সেনকে আদেশ দিয়েই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আবার দোতলায় চলে গেলেন।
সমস্ত দিন বাড়িটা অসহ্য নিস্তবতায় থমথম করতে লাগল। যেন একটা ভয়াবহ সতর্কবাণী বাড়ির লোকজনদের বিভীষিকার মত ঘিরে রইল।
সমস্ত বাড়িটার মধ্যে কোথাও এতটুকু কোন শব্দ নেই, এমন কি ছোট মেয়ে সবিতার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত একবারের জন্যে শোনা গেল না।
নিচের তলায় ঠাকুর চাকর দাসীর দল কেবল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
রাত এগারোটার সময় একখানা পাল্কি বেহারারা উপরে নিয়ে গেল এবং আধ ঘণ্টা বাদে কাহার-বাহিত কবাট-বন্ধ করা পাল্কির পিছনে পিছনে ঘুমন্ত সবিতাকে বুকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নেমে এলেন এবং তাঁর পশ্চাতে নেমে এল কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা সবিতাকে নিয়ে অন্য খালি পাল্কিটায় গিয়ে উঠে বসল। ঘোড়ায় জিন দেওয়া ছিল।
নিঃশব্দে রাত্রির অন্ধকারে পাল্কি দুটো প্রমোদভবনের গেট দিয়ে বের হয়ে গেল।
পশ্চাতে ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে পাল্কি দুটোকে অনুসরণ করলেন জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
মাথার উপরে নক্ষত্রখচিত রাতের কালো আকাশ কেমন বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আর বৌরাণীর বিলের ধারে ধারে ঝাউগাছগুলো নিঃশব্দে অন্ধকারে সকরুণ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন সেই বোবা আকাশের গায়ে ছড়িয়ে দিতে লাগল।
চারদিন বাদে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আবার কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এবং এসে উঠলেন আবার প্রমোদভবনেই।
লোকে জানল কলকাতাতেই হেমপ্রভার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ঐ চারদিনের মধ্যেই অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর। তাঁর মাথার অর্ধেকের বেশী চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে, আর তাঁর দুচোখের কোলে পড়েছে গাঢ় কালো একটা রেখা।
সারাটা রাত মৃত্যুঞ্জয় ঘুমাল না।
নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে ভূতের মত প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে ছাতে ও বারান্দার অলিন্দে ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
দিন দুই বাদে কি খেয়াল হতে ভোররাতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নন্দনকাননের দিকে চললেন প্রমোদভবনের খিড়কির দরজাটা খুলে।
বহুদিন মানুষের পায়ের ছাপ এখানে পড়েনি।
জঙ্গলে আকীর্ণ চারিদিক। পা ফেলা যায় না।
হঠাৎ সেই নন্দনকাননের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে প্রকাণ্ড একটা বকুল গাছের তলায় এসে হঠাৎ ভূত দেখার মতই যেন চমকে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঠিক সামনেই বকুল গাছটার তলায় ঘাসের উপরে পড়ে আছে হেমপ্রভার মৃতদেহটা।
ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে দেহটা। এই সাতদিনে পচে দেহটা একটু ফুলেও উঠেছে।
পরিধানে এখনো সেই সাতদিন আগেকার চওড়া লালপাড় শাড়িটা। চিরদিন চওড়া লালপাড় শাড়ি পরতেই হেমপ্রভা ভালবাসতেন।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে মৃত্যুঞ্জয় কতক্ষণ যে ঐখানে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর শবদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মনে নেই।
শোক দুঃখ বেদনা সকল অনুভূতি যেন বুকের মধ্যে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে।
সহসা একটা খসখস শব্দে চমকে ফিরে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়। ঠিক পশ্চাতে হাত-চারেকের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা তুই এখানে? কঠিন একটা উষ্মার ভাব মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ে।
কানাইয়ের মা কোন জবাব দিতে পারে না।
নিঃশব্দে মাথা নিচু করে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে থাকে।
কানাইয়ের মাও হেমপ্রভার মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিল।
সত্যই কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত।
হেমপ্রভাই তাঁর বাপের বাড়ি থেকে অল্পবয়সী বিধবা সদ্যপুত্রহারা কানাইয়ের মাকে খাস দাসী করে নিয়ে এসেছিলেন।
কলকাতা থেকে ফিরে রাত্রে যখন অত বড় বাড়িটার মধ্যে নিঃশব্দে একা একা ছায়ার মত মৃত্যুঞ্জয় ঘুরে বেড়াতেন, অলক্ষ্যে থেকে সদাসতর্ক দৃষ্টি দিয়ে কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উপরে নজর রাখছিল। মৃত্যুঞ্জয় যে তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভাকে কত গভীরভাবে ভালবাসতেন কানাইয়ের মা তা জানত। এবং সেই কারণেই হেমপ্রভার এই আকস্মিকভাবে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা মৃত্যুঞ্জয়ের মনের মধ্যে যে কত নিদারুণ আঘাত হেনেছে তাও সে বুঝেছিল।
স্ত্রীর শোকে মনের ঝোঁকে মৃত্যুঞ্জয় হঠাৎ আত্মহত্যা বা ঐ ধরনের কিছু করে ফেলেন এই ভয়েই কানাইয়ের মা সদা-সতর্ক দৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয়কে দিবারাত্র
অলক্ষ্যে থেকে ছায়ার মত অনুসরণ করছিল।
এবং ঐভাবে অনুসরণ করতে করতে ভোররাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিছু পিছু নন্দনকাননে এসেছিল সে।
হেমপ্রভার মৃতদেহ ঐভাবে নন্দনকাননের বকুলতলায় দেখে সেও কম বিস্মিত হয়নি।
বল, কেন তুই এখানে এসেছিস?
আবার রুক্ষকঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
কানাইয়ের মা তখন অকপটে প্রভুর কাছে সব কথা খুলে বললে।
মৃত্যুঞ্জয় এর পর আর কিছু বলতে পারলেন না কানাইয়ের মকে। কানাইয়ের মা যে তাঁর প্রতি গভীর মমতাবশেই ঐখানে ঐভাবে তাঁকে অনুসরণ করে এসেছে জানতে পেরে কেন যেন তাঁর অন্তরটা স্নিগ্ধ হয়ে এল।
ঐদিনই গভীর রাত্রে নিজ হাতে বকুলতলাতেই মাটি খুড়ে কানাইয়ের মার সাহায্যে মৃতা স্ত্রীর শেষকৃত্যটকু পালন করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মা ভিন্ন আর দ্বিতীয় কোন প্রাণীই ঐ ব্যাপারটা জানতে পারল না।
এবং সেই দিন থেকেই মৃত্যুঞ্জয় সবিতার সমস্ত ভার কানাইয়ের মার হাতেই তুলে দিলেন।
আর কানাইয়ের মাকে বিশেষ করে সাবধান করে দিলেন লোকে যেমন জেনেছে যে হেমপ্রভার কলকাতাতেই রোগের মৃত্যু হয়েছে তাই যেন জানে, এর বেশী কেউ যেন কিছু না জানতে পারে।
মৃত্যুঞ্জয় জমিদার-ভবনে আর ফিরে গেলেন না।
প্রমোদভবনকেই আরো ভাল করে সংস্কার করে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দিলেন।
আর কেউ না জানলেও কানাইয়ের মা জানত, প্রায়ই গভীর রাত্রে জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নন্দনকাননে গিয়ে অন্ধকারে বকুলতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
প্রিয়তমা স্ত্রীকে যেখানকার মাটিতে শেষ শয়ানে শুইয়ে রেখেছিলেন, সেখানকার মাটিই যেন তাঁকে অন্ধকার নিঝুম রাতে হাতছানি দিয়ে ডাকত।
এ খবর আর কেউ জানে না বাবু একমাত্র আমি ছাড়া। বলে চুপ করল কানাইয়ের মা।
সবিতার চোখের কোল দুটো ছলছল করছিল জলে ভরে গিয়ে।
তার মায়ের মৃত্যুর সকরুণ কাহিনী তাকে যেন নির্বাক করে দিয়েছে।
এদিকে রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে খোলা জানলা-পথে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করছিল।
কানাইয়ের মার কণ্ঠনিঃসৃত বেদনাক্লিষ্ট কাহিনী যেন সমগ্র কক্ষটা জুড়ে জমাট বেধে আছে এখনো!
অন্তত বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপা একটা মস্ত বড় রহস্য!
০৬. সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে
সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহও ঐ বকুলতলাতেই পাওয়া গেছে, তাই না?
হ্যাঁ।
এবং মৃতদেহ প্রথমে দেখতে পান বসন্তবাবুই না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমার মার মৃত্যু ও তোমার বাবার মৃত্যু এ দুটো ব্যাপার তোমার কি বলে মনে হয়?
আজ্ঞে দাদাবাবু, আমি তো বলেছিই আমার মনে হয় এ দুটোই কোন অপদেবতার কাজ।
কেন বল তো?
কানাইয়ের মা অতঃপর কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
কি যেন বলতে চায়, অথচ ঠিক বলতে সাহস পাচ্ছে না। সঙ্কোচ বোধ করছে।
বল না কি বলতে চাও? কেন তোমার মনে হয় এ অপদেবতার কাজ?
দেখুন দাদাবাবু, এ বাড়িটাই ভাল না!
বাড়িটা ভাল না?
আজ্ঞে। আমি অনেকদিন টের পেয়েছি এ বাড়িটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অপদেবতা ভর করে আছে।
অপদেবতা ভর করে আছে? কি পাগলের মত যা-তা বকছ কানাইয়ের মা!
হ্যাঁ বাবু, ঠিকই বলছি। নানা রকমের শব্দ রাত্রে অনেক সময় এ বাড়িতে শোনা যায়। অনেক রাত্রে ঘুঙুরের শব্দও শুনেছি।
চকিতে সত্যজিতের প্রথম রাত্রির কথা মনে পড়ে যায়।
সেই মিষ্টি নূপুরের আওয়াজ! সেই নূপুরের আওয়াজকে অনুসরণ করে তার সিঁড়িপথে নিচে নেমে যাওয়া!
সেও তো জাগ্রত অবস্থাতেই সুস্পষ্ট সেই নূপুরের আওয়াজ শুনেছিল!
সে কাউকে দেখতে পায়নি বটে তবে স্পষ্ট কি সে শোনেনি কে যেন নূপুর পায়ে তার ঘরের মধ্যে চলে বেড়াচ্ছিল!
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, মিলিয়ে গেল একটু একটু করে সেই নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ।
তাছাড়া তার ঘরের ওপাশের দরজাটাও তো খোলা দেখতে পেয়েছিল।
তবে কি কানাইয়ের মা যা বলছে তাই ঠিক? সত্যি এ বাড়িতে কোন অপদেবতা আছে?
রাত্রের অন্ধকারে চারিদিক নিঝুম হয়ে এলে, সবাই গাঢ় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলে অশরীরী কেউ এ বাড়ির কক্ষে কক্ষে অলিন্দে প্রাঙ্গণে সিঁড়িপথে নূপুর পায়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়!
কানাইয়ের মা আবার বলে, লোকে বলে আজও নাকি বৌরাণীর প্রেতাত্মা এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি! সে-ই নাকি আজও নিষুতি রাতে ঘুঙুর পায়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়!
বৌরাণী! বৌরাণী আবার কে? কথাটা বলে বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সত্যজিৎ কানাইয়ের মার দিকে।
তাও জাননি! বৌরাণীর নামেই তো এই এত বড় বাড়ি তৈরী হয়েছিল গো। ঐ বিলের জলেই তো বৌরাণী ড়ুবে মরেছিল গো। তাই তো লোকে ঐ বিলকে আজও বলে বৌরাণীর বিল!
এবারে সত্যজিৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সবিতার দিকে।
সবিতাই এবারে অনুচ্চারিত প্রশ্নের যেন জবাব দেয়, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি বটে। তবে আমি কখনো কোন আওয়াজ বা শব্দ নিজের কানে শুনিনি।
আপনার বাবার কাছে কোনদিন কিছু এ সম্পর্কে শুনেছেন মিস চৌধুরী?
না। বাবা আমাকে কখনো কোনদিন আমাদের বংশের কোন কথা বা গল্প বলেননি। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, বাবা যেন ওসব ব্যাপারে অদ্ভুত একটা সংযম রক্ষা করে চলতেন। বহুদিন মনে পড়ে, বাবাকে দেওয়ালে টাঙানো মার এনলার্জড ফটোটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু একটা দিনের জন্যেও বাবা আমার সঙ্গে মার কোন কথাই আলোচনা করেননি। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি কেন তা করেননি।
রাত্রি শেষ হয়ে পূর্ব দিগন্তে প্রথম আলোর রক্তিম ইশারা যেন দেখা দিয়েছে।
খোলা জানলা-পথে সেই রক্তিম আলোর আভাস যেন ওদের অন্তরকে পর্যন্ত এসে স্পর্শ করে গেল।
কানাইয়ের মাকে বিদায় দিয়ে সত্যজিৎ সবিতাকেও যেন একপ্রকার ঠেলেই তার ঘরে পাঠিয়ে দিলে, অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে।
সারাটা রাত্রি জাগরণের পর সত্যজিতের নিজের চোখ দুটোও জ্বালা করছিল। সে ছাদে এসে দাঁড়াল।
চাপা লালচে আলোয় সমস্ত প্রকৃতি যেন সারা রাত্রির অন্ধকারকে অতিক্রম করে রক্তিম চক্ষু মেলে সবে তাকাচ্ছে।
প্রভাতী বায়ুতরঙ্গে বিলের বুকে ক্ষুদ্র ঢেউগুলো ছন্দের আলপনা বুনে চলেছে।
দূরে নজরে পড়ল সেই দ্বীপটা।
দূর থেকে দ্বীপের গাছপালাগুলো তখনও খুব স্পষ্ট মনে হয় না। যেন একটা অস্পষ্টতার কুয়াশায় ঘোমটা টেনে রহস্যে ঘনীভূত হয়ে আছে।
ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদিন রহস্যজনকভাবে সবিতার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল, আবার দীর্ঘ উনিশ বছর বাদে ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদা প্রত্যুষে পাওয়া গেল সবিতার পিতা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহ।
উনিশ বছর পূর্বে যে হত্যাকাণ্ড (?) সংঘটিত হয়েছিল এবং উনিশ বছর পরে মাত্র কয়েকদিন আগে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল, আছে কি তার মধ্যে কোন যোগাযোগ! দুটি হত্যাকাণ্ডই কি একই সূত্রে গাঁথা, না একের সঙ্গে অন্যের কোন সম্পর্ক নেই!
ক্ষণপূর্বে কানাইয়ের মার বর্ণিত অতীতের সুদীর্ঘ কাহিনী হতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে একটা মস্ত বড় রহস্য জড়িয়ে আছে এবং যে রহস্যের মূলটা হয়ত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিন্তু কে করবে সেই অতীতের যবনিকাকে উত্তোলন?
কেমন করে উদঘাটিত হবে সত্যিই কোন অতীত রহস্য যদি এই হত্যাকাণ্ডের মূলে থাকেই, সেই অবশ্য প্রয়োজনীয় সত্যটুকু!
অতীতের কথা কানাইয়ের মা যতটুকু জানত বলেছে।
আর এ বাড়িতে বহুদিনকার পুরাতন লোক কে আছে? বনমালী। আর আছেন এদের নায়েব বসন্ত সেন।
কিন্তু বসন্ত সেনের মুখ থেকে কি কোন কথা বের করা যাবে?
বিশেষ করে পরশু রাত্রের আলোচনার ব্যাপারে তিনি যেন একটু তার উপরে অসন্তুষ্টই হয়েছেন বলে ওর ধারণা।
এক্ষেত্রে কোন কথাই হয়ত তিনি বলবেন না।
কিন্তু কেনই বা বলবেন না, পরক্ষণেই মনে হয় কথাটা সত্যজিতের, তার উপরে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তো কি!
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে তাঁরও তো কম interest থাকবার কথা নয়! আর কেবল interestই বা কেন, কর্তব্যও তো একটা আছে। এবং সব কিছুর উপরে নায়েব বসন্ত সেনের এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা!
আত্মীয় বন্ধু বা অভিভাবক বলতে সবিতা দেবীর একমাত্র উনিই—বসন্ত সেন।
নিকটতম আত্মীয়ের পর্যায়েই আজ উনি সবিতা দেবীর পড়েছেন।
হ্যাঁ, তাঁকেই আরো ভাল করে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে অতীতের কোন কথা যা হয়ত একমাত্র উনি ব্যতীত আর কেউই জানেন না।
তাছাড়া একবার ঘুরে দেখে আসতে হবে বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটি।
ঐ দ্বীপই হচ্ছে অকুস্থান।
মনের মধ্যে সহসা কেমন যেন একটা অদ্ভুত প্রেরণা ঐ মুহূর্তেই অনুভব করে সত্যজিৎ। বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটা যেন অদ্ভুত ভাবেই ওর মনকে আকর্ষণ করতে থাকে।
সত্যজিৎ আর দেরী করে না।
মস্ত বড় একটা প্রাঙ্গণ পার হয়ে একটা সরু অন্ধকার অলিন্দ মত, সেই অলিন্দেরই শেষপ্রান্তে যে দরজাটা সেটা খুলতেই সত্যজিতের চোখে পড়ল, বিলের জলে বড় বড় পাথর ফেলে, মাটি ও কাঁকর বিছিয়ে পায়ে চলা রাস্তাটা বরাবর দ্বীপের সঙে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে।
এটি যেন প্রমোদভবন ও দ্বীপের সংযুক্ত একটি সেতু।
রাস্তাটি জল থেকে মাত্র হাতখানেক উঁচু।
বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো, দুদিকটা ক্রমশঃ ঢালু হয়ে জলের মধ্যে নেমে গিয়েছে।
দীর্ঘ কয় বৎসরের জলের স্পর্শে পাথরগুলোর বুকে সবুজ শ্যাওলার একটা আস্তরণ পড়েছে। যেন সবুজ মখমলের একখানা কাপেটকে কে বিছিয়ে দিয়েছে রাস্তাটার দুধারে।
এই জায়গাটায় বিলের জল খুব গভীর বলে মনে হয় না। কাকচক্ষুর মত পরিষ্কার জল যেন টলটল করছে।
রাস্তাটার দু পাশে বড় বড় বুনো ঘাস গজিয়েছে, আর তার মধ্যে মধ্যে একপ্রকার জলজ কাঁটালতা।
ছোট্ট ছোট্ট লাল ফল সেই কাঁটা লতায় ফুটে আছে। ঘন সবুজের মধ্যে সেই লাল ফুলগুলো যেন রক্তপ্রবালের মত জ্বলছে।
সত্যজিৎ পথ অতিক্রম করে দ্বীপে এসে উঠল। ত্রিভুজাকার দ্বীপটি।
পথটা এসে যেখানে দ্বীপটায় শেষ হয়েছে, সেই মুখেই একটা আমলকী গাছ, ভোরের আলো আমলকী গাছের চিকণ পাতার উপরে বড়ে যেন পিছলিয়ে যাচ্ছে।
একটা দোয়েল আমলকী গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে।
সামনেই ডানহাতে একটা বাঁশঝাড়। বাতাসে বাঁশঝাড়টা আন্দোলিত হয়ে কটকট শব্দ তুলছে।
দ্বীপের মধ্যে পায়ে-চলা একটা পথ ছিল বটে এককালে, তবে এখন বহুদিনের যত্ন ও সংস্কারের অভাবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘন আগাছায় সে পাথর আর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না।
চারিদিকে ঘন সন্নিবেশিত গাছপালা অদ্ভুত একটা আলোছায়ার রহস্য দিয়ে ঘেরা। মধ্যে মধ্যে বায়ুর তাড়নায় বৃক্ষের পত্র ডালপালা আন্দোলিত হয়ে রহস্যময় এক শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করছে।
মনে হয় কারা যেন চাপা গলায় ফিসফিস করে কি বলতে চায়।
অদ্ভুত একটা শিহরণ সর্বাঙ্গে অনুভব করে সত্যজিৎ।
অস্পষ্ট অনুচ্চারিত কার সাবধানবাণী যেন বলছে, এগিয়ো না! এগিয়ে না! ওখানে মৃত্যু! ওখানে বিভীষিকা!
তবু এগিয়ে চলে সত্যজিৎ।
আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে নজরে পড়ে দ্বীপের মধ্যস্থিত বিরাম কুটীর।
কুটীরের ঠিক পশ্চাতেই একটা প্রকাণ্ড বকুল বৃক্ষের তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সত্যজিৎ।
এই সেই বকুল বৃক্ষ।
এরই তলায় উনিশ বছর আগে একদিন নিরুদ্দিষ্টা হেমপ্রভার গলিত মৃতদেহটা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে।
আর দীর্ঘ উনিশ বছর পরে মাত্র সাতদিন আগে এই বকুল বৃক্ষের তলাতেই নায়েব বসন্ত সেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনিও কি বিস্ময়ে নির্বাক হয়েছিলেন?
আশ্চর্য! উনিশ বছরের হলেও এই একই বৃক্ষতলে স্বামী ও স্ত্রীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর নির্মম পরিহাস!
ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর শ্বাসরোধ করে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।
পরিষ্কার সহজ কথায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
কে হত্যা করল এমন করে স্বামী ও স্ত্রী–মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও হেমপ্রভাকে।
একই লোকের হাতে কি স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিহত হয়েছেন!
কিন্তু এই বা কেমন? একই দিনে তো সেই সময় দুজনকেই হত্যা করা চলতে পারত?
একজনকে হত্যা করবার পর দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে আর একজনকে হত্যা করবার কারণটা কি! প্রয়োজন কি ছিল এই দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে প্রতীক্ষা করবার!
তবে কি একই হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেনি? দুজন হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেছে? হত্যাকারী দুজন!
হত্যার কারণ উভয় ক্ষেত্রেই কি এক, না বিভিন্ন! বিভিন্ন কারণ হলেও অকুস্থান সেই বকুল বৃক্ষতল হল কেন?
একটার পর একটা চিন্তা সত্যজিতের মাথার মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে লাগল।
দুটি হত্যাই একই সূত্রে গাঁথা, না একটির সঙ্গে অন্যটির আদৌ কোন সম্পর্ক নেই! সম্পূর্ণ বিভিন্ন! কেবল ঘটনাচক্রে দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটা অদ্ভুত পারম্পর্য এসে গিয়েছে মাত্র!
জট পাকিয়ে গিয়েছে দুটি হত্যা-রহস্য একত্র।
হত্যা-রহস্য দুটি যতই পাক খেয়ে খেয়ে জট পাকিয়ে তোলে, সত্যজিতের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা জিদ চেপে যায়।
মীমাংসা যতই সুদূরপরাহত বলে মনে হয়, মনের মধ্যে ততই যেন আরো তীব্র করে ও একটা রহস্যের হাতছানি অনুভব করে।
কানাইয়ের মা যে বলতে চায় এর মধ্যে কোন অপদেবতার কাণ্ডকারখানা আছে, তা ও বিশ্বাস করে না এবং যুক্তি দিয়েও মানতে পারে না।
অশিক্ষিতা কানাইয়ের মার কাছে যেটা সম্ভবপর বলে মনে হয়েছে, সত্যজিতের কাছে সেটা একেবারে সম্ভবপর বলে মনে হয় না।
মনে হয় একটিবার কলকাতায় যেতে পারলে বোধ হয় ভাল হতো। সেখানে গিয়ে কোন ভাল ডিটেকটিভের সন্ধান করে তাকে যদি এই কাজে নিযুক্ত করা যেত, হয়ত সহজেই এই রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছনো যেত।
ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ দ্বীপের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। দ্বীপের মধ্যে যে বিরাম কুটীর, সেটা একটা একতলা পাকা বাড়ি।
রৌদ্র বৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটাকে পুড়িয়েছে ও ভিজিয়েছে। বাড়িটার আসল রং কবে পড়ে ঝলসে ধুয়ে মুছে গিয়েছে।
দেওয়ালের গায়ে ছাদের কার্নিশে ধরেছে ফাটল আর সেই ফাটলের মধ্যে নির্বিবাদে বেড়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থের গাছগুলো।
জানলার কবাটগুলো কোনটা কবজার সঙ্গে ঝুলছে, কোনটার একটা পাল্লা বন্ধ করা, কোনটার দুটো পাল্লাই হা-হা-করছে খোলা। মধ্যে মধ্যে হাওয়ার মরিচা-ধরা কবজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা যায়। রং চটে গিয়েছে।
চারিদিকেই একটা হতশ্রী অযত্ন অবহেলার ছবি।
বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে এককালে যে চমৎকার একটি ফুলের বাগান ছিল, বিগত দিনের সেই সৌন্দর্য-সৃষ্টির ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন আজও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, দৈন্য অবহেলায় বুনো আগাছায় সমাকীর্ণ হয়ে।
সেই গোলাপ, গন্ধরাজ, যুঁই, চামেলীর সমারোহ কাঁটালতা ও বুনো ফুলের পর্যাপ্ততায় লজ্জায় যেন মুখ ঢেকেছে।
এই হয়ত সেই চৌধুরীদের নন্দনকানন। চৌধুরীবাড়ির আদরিণী বিলাসিনী বধুদের অলক্তরাগরঞ্জিত চরণের নূপুরনিক্বণে অতীতে হয়ত একদিন এই নন্দনকানন শব্দমুখরিত হয়ে উঠত।
অন্তঃপুরের সলজ্জ বধূটি হয়ত এখানে আপন খেয়াল-খুশিতে অবাধ স্বচ্ছন্দ গতিতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কখনো হয়ত কোন ফুলগাছের সামনে দাঁড়িয়ে ডাল থেকে ফুলটি ছিড়ে আপন কবরীতে লীলাভরে গুঁজে দিয়েছে।
আজ তারা কোথায়?
এই ভগ্ন বিরাম কুটীরের কক্ষের বায়ুতরঙ্গে কি তাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়?
সম্মুখে ছোট অপরিসর একটি বারান্দা এবং বারান্দার সামনেই পর পর তিনখানা ঘর।
পর পর তিনটি ঘরের মধ্যেই গিয়ে প্রবেশ করল সত্যজিৎ। ঘরের মেঝেতে একপর্দা ধুলো জমে আছে। কতদিন এখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি কে জানে!
০৭. কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই
কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই সকালবেলায় চা-পান করতে করতে সবিতার কাছে বললে, আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে মিস চৌধুরী, তাহলে কলকাতায় একজন ভাল ডিটেকটিভকে এনগেজ করে আসি এ ব্যাপারে!
আমিও গত রাত থেকে ঐ কথাই ভাবছিলাম সত্যজিৎবাবু। কিন্তু নায়েবকাকাকে কি একটিবার জিজ্ঞাসা করে তাঁর মতামত নেওয়া উচিত নয়?
সত্যজিৎ সবিতার প্রশ্নের জবাবে বলতে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই। তাঁকে অবশ্যই একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে বৈকি, কিন্তু তার পূর্বেই ঘরের দরজার উপরে নায়েবমশাইয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিসের মতামত মা সবি?
উভয়েই চমকে ফিরে তাকাল।
পায়ে হরিণের চামড়ার চটিজুতো থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নায়েব বসন্ত সেন একেবারে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন
এবং ওদের পরস্পরের আলোচনার শেষ কথাগুলো শুনতে পেয়েছেন, এরা। টেরও পায়নি।
এই যে নায়েবকাকা, আসুন! সবিতাই আহ্বান জানাল।
কর্তার শ্রাদ্ধের যোগাড় তো এবারে দেখতে হয়, সেই ব্যাপারেই একটা পরামর্শ করবার জন্য তোমার কাছে আসছিলাম মা। কিন্তু একটু আগে কি যেন মতামতের কথা বলছিলে মা!
সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে একবার পলকের জন্য দৃষ্টিপাত করে।
তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বলে, বলছিলাম নায়েবকাকা, বাবার এই মৃত্যুর কথাটা একটু ইতস্ততঃ করে সবিতা আবার বলে, ব্যাপারটাকে আমরা এত সহজে ভুলে যাব কেন?
কিন্তু মা এক্ষেত্রে আমাদের আর করবারই বা কি আছে? দারোগাবাবুর সঙ্গে তুমি এখানে এসে পৌঁছবার পূর্বেও অনেক পরামর্শ করেছি। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা অস্পষ্ট ধোঁয়ার মত মনে হয়। কোন দিক দিয়ে কোন সূত্রেরই সন্ধান আমরা পাচ্ছি না, অন্তত যার সাহায্যে একটা অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
সূত্র হয়ত আমরা আপাততঃ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু এসব ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তিও তো আছেন। তাঁরা চেষ্টা করলে
সবিতার কথায় বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন নায়েব বসন্ত সেন ওর মুখের দিকে।
হ্যাঁ নায়েবকাকা, ভাবছি কলকাতা থেকে একজন সুদক্ষ ডিটেকটিভ এনে
ডিটেকটিভ।
হ্যাঁ, ডিটেকটিভ। আপনি কি বলেন?
সবিতার প্রস্তাবে বসন্ত সেনের চোখেমুখে একটা সুস্পষ্ট বিরক্তির রেখা যেন দেখা দিয়ে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
একবার আড়চোখে বসন্ত সেন সত্যজিতের দিকেও তাকালেন।
বেশ তো মা। তোমার যদি তাই ইচ্ছা হয়—
তাহলে সত্যজিৎবাবু, আপনি আজই কলকাতায় চলে যান। একজন ভাল দেখে ডিটেকটিভ একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
নায়েব বসন্ত সেন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ যেন গাঝাড়া দিয়ে গলাটা খাকারি দিয়ে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, ভাল কথা মা, তোমার মামাবাবু, নিত্যানন্দ সান্যাল মশাই এখানে আসছেন দুচার দিনের মধ্যেই। আমাকেও একটা চিঠি দিয়েছেন, আর এই নাও তোমারও একটা চিঠি আছে।
বসন্ত সেন একটা খাম এগিয়ে দিলেন সবিতার দিকে!
মামাবাবু! মামাবাবু আসছেন? সবিতার মনে পড়ে নিত্যানন্দ সান্যালকে। মধ্যে মধ্যে কলকাতায় এসে ওর হস্টেলে ওর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং এখানেও এসেছেন। তার মা হেমপ্রভার দুরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। আপন মায়ের পেটের ভাই নয়। ওর মায়ের মৃত্যুর আগে মধ্যে মধ্যে এ বাড়িতে আসতেন। কানাইয়ের মার মুখেই শোন, তার মা নাকি ঐ সান্যাল-বাড়িতেই মানুষ। ছোটবেলায় মা-বাপ মারা যাওয়ায় ঐ মামাবাবুর মার কাছেই নাকি মা মানুষ হয়েছে এবং ঐ সান্যাল-বাড়ি থেকেই মার বিবাহ হয়।
পরবর্তীকালে নিত্যানন্দ সান্যাল চাকরিব্যাপদেশে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
তবে দূর পাঞ্জাবে চলে গেলেও মামাবাবুর সঙ্গে ওদের সম্পর্ক বা যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি, এমন কি তার মায়ের মৃত্যুর পরও। কারণ বলতে গেলে তার মায়ের দিক দিয়ে একমাত্র আত্মীয় ঐ নিত্যানন্দ সান্যালই ছিলেন বেঁচে। দূরসম্পর্কীয় ভাই বোন হলেও সেই শিশুকাল হতে একই গৃহে পাশাপাশি মানুষ হওয়ার দরুন ও মায়ের ইহজগতে আর আপনার জন বলতে দ্বিতীয় কেউ না থাকায় নিত্যানন্দ সান্যাল অর্থাৎ তার ঐ মামাবাবুর মায়ের পরমাত্মীয়ই
লোকটিও চমৎকার। বাঙালীর মধ্যে সচরাচর অমন চমৎকার দেহসৌষ্ঠব বড় একটা চোখে পড়ে না। টকটকে উজ্জল গায়ের বর্ণ। খড়গের মত নাসিকা। চোখ দুটো কি হাস্যময়! একমুখ দাড়ি।
ইদানীং চুল দাড়ি সব প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। কারণে অকারণে হা-হা করে প্রাণ খুলে হাসেন।
একমাত্র মাথায় শ্বেতশুভ্র কেশ ও দাড়ি ছাড়া বুঝবার উপায় নেই লোকটার বয়স হয়েছে।
বয়সে তাঁর বাবার মতই।
দিন কুড়ি আগেও কলকাতায় কি একটা কাজে হঠাৎ এসেছিলেন একদিনের জন্য, তবু, ওর সঙ্গে দেখা করতে ভোলেননি।
বলেছিলেন এবারে পরীক্ষা হয়ে গেলে ওর বাবাকে বলে কিছুদিনের জন্য ওঁর কর্মস্থল লুধিয়ানায় ওকে নিয়ে যাবেন। সেখানে ওরই প্রায় সমবয়সী ওঁর একটি মেয়ে আছে—নাম তার কল্যাণী। অবশ্য কল্যাণীকে আজ পর্যন্ত সে দেখেনি।
বসন্ত সেন বললেন, তাহলে আমি উঠি মা। সত্যজিতের যাবার ব্যবস্থা দেখি গে।
সবিতা নিজের চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বললে, হ্যাঁ, তাই যান নায়েব কাকা।
বসন্ত সেন বিদায় নিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
সবিতা নিত্যানন্দ সান্যালের চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। নিত্যানন্দ সান্যালের চিঠিটা সংক্ষিপ্ত।
কল্যাণীয়া মা সবিতা,
সংবাদপত্র মারফৎ তোমার পিতার আকস্মিক মৃত্যু-সংবাদে বিস্মিত ও মর্মাহত হইয়াছি। একাকিনী নিশ্চয়ই তুমি বিশেষ বিপদে ও অসুবিধায় পড়িয়াছ। তোমার বর্তমান অবস্থা আমি সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। শ্রীশ্রী দয়াময় দীনবন্ধু তোমাকে সহসা এইভাবে কেন যে বিপদগ্রস্ত করলেন বুঝিতে পারিতেছি না। প্রভুর লীলা বোঝা সত্যই ভার। যাহা হউক চিন্তা করিও না, এদিককার যা হয় একটা ব্যবস্থা করিয়া শীঘ্রই দুচার দিনের মধ্যে আমি রাজবাটি পৌঁছিব।
পুঃ। কল্যাণীকেও সঙ্গে লইয়া যাইতেছি।
ইতি
আঃ তোমার মামাবাবু
পত্রখানা পড়ে সবিতা নিজেও যেন কতকটা স্বস্তি ও শান্তি বোধ করে।
অনেকক্ষণ পরে সত্যজিৎ কথা বলে, যাক এ একপক্ষে আপনার ভালই হলো, আপনার মামা আসছেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু এত বড় একটা দুঃসংবাদ, তাঁকেই তো সর্বাগ্রে সংবাদ দিয়ে এখানে আনানো উচিত ছিল। বলতে গেলে এখনও তো দেখতে পাচ্ছি উনিই আপনার একমাত্র আত্মীয়।
সবিতা এবার সংক্ষেপে মামার পরিচয়টা দেয় সত্যজিতের কাছে, ইনি অবিশ্যি আমার নিজের আপন মামা নন। তবে আপনার জনের চাইতেও বেশী। মার দুরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। এবং মা ঐ মামাদের বাড়িতেই মানুষ এবং শুনেছি ওখান থেকেই মার বিবাহও হয়েছিল।
তা যাই হোক, উনি এলে আপনি অনেকটা বল-ভরসা পাবেন তো বটেই, তাছাড়া ওঁর মেয়েও যখন ওর সঙ্গেই আসছেন—একজন সঙ্গী পাবেন, নিঃসঙ্গতাও অনেকটা আপনার লাঘব হবে।
মামার মেয়ে কল্যাণীকে কখনো আমি দেখিনি তবে শুনেছি সে আমারই সমবয়েসী।
তাহলে তো খুবই ভাল হবে।
***
ঐদিন রাত্রের গাড়িতে সত্যজিৎ কলকাতায় চলে গেল।
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ
কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ, সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।
সত্যজিৎ তার এক বন্ধু অমিয়র চিঠি নিয়ে প্রথমে সুব্রতর সঙ্গে দেখা করে এবং সুব্রত সত্যজিৎকে সঙ্গে নিয়ে কিরীটীর ওখানে আসে।
কিরীটী হাসতে হাসতে একসময় বললে কিন্তু একটা কথা যদি আমাকে খুলে বলেন সত্যজিৎবাবু, তাহলে বড়ই সুখী হই।
বলুন কি জানতে চান!
আপনি তো সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, but why you are so much interested?
কিরীটীর প্রশ্নে সত্যজিতের মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে।
সেটুকু কিরীটীর দৃষ্টি এড়ায় না। মৃদু হেসে সে বলে, বুঝেছি। আর বলতে হবে না। আচ্ছা আপনাদের মধ্যে কোন পূর্ব-পরিচয় বা সাক্ষাৎ আলাপ ছিল?
সত্যজিৎ এতক্ষণে লজ্জা ও সঙ্কোচটা কাটিয়ে উঠেছে, স্মিতকণ্ঠে বললে, তাহলে আপনাকে কথাটা খুলেই বলি কিরীটীবাবু। আপনাকে বলেছি, আমার বাবা ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী গ্রামে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। আমাদের বাড়ি রাজবাড়িরই পাশের গ্রামে মহেশডাঙায়। মাঝে থাকে একটা খাল। মহেশডাঙা থেকে প্রত্যহ খাল পার হয়ে বাবা পাশের গ্রামের স্কুলে পড়তে আসতেন। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী জমিদারবাড়ির ছেলে; এন্ট্রান্স পাস দেবার পর আর তিনি লেখাপড়া করেননি। বাবারও লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি অর্থাভাবে। এবং পাস দেবার কিছুদিন পরেই বাবা একবস্ত্রে কোনমতে ভাগ্যান্বেষণে পালিয়ে যান সুদূর বর্মায়। ক্ৰমে বাবা সেখানে গিয়ে কাঠের ব্যবসা করে নিজের অবস্থা ফেরান। দুই বন্ধুর মধ্যে ভাগ্যক্রমে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি কখনও। নিয়মিত পত্ৰমারফৎ পরস্পর পরস্পরকে সকল সংবাদ দেওয়ানেওয়া করতেন। আমার চাইতে সবিতা বছর ছয়েকের ছোট। দুই বন্ধুর মধ্যে পত্র মারফৎই কথা হয়েছিল, আমার সঙ্গে বাবা সবিতার বিবাহ দেবেন। অবশ্য এসব কথা কিছুই আমি জানতাম না। পরে মাস পাঁচেক আগে বিলেত থেকে ফিরে আসার পর বাবা একদিন আমাকে ঘরে ডেকে বললেন সব কথা। এবং তাঁর ইচ্ছাটুকুও জানালেন। কিন্তু আমি রাজী হলাম না। যাকে কোনদিন দেখিনি, যার সম্পর্কে কিছুই জানি না বলতে গেলে, তাকে হঠাৎ বিবাহ করে ঘরে আনব, কেন যেন মনের থেকে এ ব্যাপারে কিছুতেই সাড়া পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বাবা বার বার আমাকে বলতে লাগলেন তাঁর বাল্যবন্ধুকে তিনি কথা দিয়েছেন, অন্যথায় তিনি দত্তাপহারক হবেন। অবশেষে বাবার পীড়াপীড়িতে কতকটা বাধ্য হয়েই আমি বললাম, বেশ, এখানে এসে সেই মেয়েকে দেখে যদি আমার পছন্দ হয় তাহলে আমি এ বিবাহে রাজী আছি। বাবা তাঁর বন্ধুকে পত্র মারফৎ সব কথা জানালেন। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীও এ বিষয়ে দেখলাম অত্যন্ত। আধুনিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি পত্রোত্তরে জানালেন, তাই হবে, আমি যদি গিয়ে তাঁর মেয়েকে দেখে পছন্দ করি তাহলে এ বিবাহ হবে। আর তাছাড়া এও তিনি জানালেন, আজ পর্যন্ত তাঁর মেয়েকে এ বিবাহ সম্পর্কে কোন কথাই জানাননি যখন তখন আমার গিয়ে তাঁর মেয়েকে দেখার মধ্যে কোন অসুবিধাই থাকতে পারে না। সেই অনুসারেই সামনের গ্রীষ্মের বন্ধে সবিতা বাড়ি যাবে, আমাকেও ঐ সময়েই যেতে লিখলেন।
আপনি তাহলে সেই ব্যবস্থা অনুযায়ীই এসেছেন বাংলাদেশে?
হ্যাঁ।
আচ্ছা পরে আপনার সঙ্গে ও সবিতা দেবীর সঙ্গে ও-সম্পর্কে কোন কথাবার্তা হয়েছে
না।
ভাল কথা, নায়েব বসন্ত সেন যখন চৌধুরী-বাড়িতে বহুদিন আছেন, এ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু জানেন?
জানাটাই তো স্বাভাবিক। এবং আমার মনে হয় জানেনও, কারণ আমি যে আসছি সে কথাটা যখন তিনি চৌধুরী মশাইয়ের কাছে শুনেছিলেন তখন ও কথাটা কি আর শোনেননি?
তা বটে। তবে আপনার সঙ্গে ঐ সম্পর্কে কোন কথা হয়েছে কি?
না।
আপনার বাবাকে তাঁর বন্ধুর নিহত হবার সংবাদটা নিশ্চয়ই আপনি দিয়েছেন?
দিয়েছি।
আর বিবাহ সম্পর্কে আপনার মতামতটা? কিরীটীর চোখের কোণে কৌতুকের চাপা হাসি।
সত্যজিৎ চাপা হাসির সঙ্গে জবাব দেয়, শুধু আমার মতামত হলেই তো এক্ষেত্রে চলবে না মিঃ রায়। সবিতা দেবীরও এখন বয়স হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছেন, তাঁর নিজস্ব একটা মতামতও তো আছে এ ব্যাপারে।
হ্যাঁ, তা একটা আছে বৈকি। তবে তাঁকে না দেখে এবং তাঁর সঙ্গে আলাপপরিচয় না করেই তাঁর সম্পর্কে আপনার মুখ থেকে যতটুকু জেনেছি, আপনার যখন এ বিবাহে অমত নেই তখন তাঁর দিক থেকে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
কেন বলুন তো? একজনের সঙ্গে আলাপ করে অন্যের thoughtreadingও আপনি করতে পারেন নাকি দুর থেকেই?
তা একটু-আধটু পারি বৈকি। নহলে এত সহজে এ ব্যাপারে আমি রাজী হতাম না। বিশেষ করে যখন জানতে পারছি এ ব্যাপারের শেষটুকু মধুরেণ সমাপ্ত হবে; এর আগের অধ্যায়ে যত দুঃখই থাকুক না কেন, সেটাই মনকে আমার inspiration যুগিয়েছে। নইলে সত্য কথা বলতে কি আপনাকে, আজকাল তথাকথিত হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যেন কোন interestই পাই না। সেই অর্থ, সেই লালসা, সেই প্রেম, সেই প্রতিহিংসা প্রত্যেকটি হত্যার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত শেষ দৃশ্যে হয় হাতকড়া বা ফাঁসির দড়ি দিয়ে এমন একটা করুণ রসের সৃষ্টি করে যে, নিজের উপরও যেন ধিক্কার এসে যায়।
কিন্তু সত্যিকারের culprit বা দোষীকে ধরিয়ে দেওয়াও তো নাগরিক হিসাবে আপনার একটা মহৎ কাজ বা কর্তব্য।
তা ঠিক আমার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত নয় সত্যজিৎবাবু। এককালে একটা মোহ ও vanity বশেই এ lineয়ে হাত দিয়েছিলাম। বুদ্ধির খেলায় একজনকে ধরাশায়ী করতে একটা অপূর্ব পুলক অনুভব করতাম। ক্রমে সেটা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন নেশাটা এসেছে থিতিয়ে।
কেন?
তার কারণ দেখতে পাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তথাকথিত ঐ সব ভিলেনের দল অপরাধই করে বটে, তবে অপরাধের artটাকে জানে না।
অপরাধের আর্ট?
হ্যাঁ। আর্ট বলতে অবশ্য এক্ষেত্রে আমি এখানে ভিলেনের চাতুরীটাকেই mean করেছি। বলাই বাহুল্য আপনার ব্যাপারটা সে পর্যায়ে পড়ে না, কারণ আপনার কাছ হতে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা শুনে আমার যতদূর মনে হচ্ছে, হেমপ্রভা চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপার দুটো একসূত্রে তো গাঁথা নয়ই, হত্যাকারীও এক নয়।
সত্যজিৎ যেন একটু বিস্মিত হয়েই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় এবং বলে, কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে দুটো মৃতদেহ একই জায়গায় পাওয়া গেল কেন? Why peculiar coincidence!
ঘটনার পারম্পর্য বা সামঞ্জস্য এক এক সময় এরকম অদ্ভুত ঘটতে দেখা যায় সত্যজিৎবাবু, কিন্তু দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে একই হত্যাকারী প্রথম হত্যার পর দ্বিতীয়বার হত্যা করবে এটা আদপেই স্বাভাবিক নয়।
কিন্তু
সত্যজিৎবাবু, time factor is a very important factor! আমাদের দেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে, হত্যাকারী একটা ক্ষণিক উত্তেজনার মুহূর্তেই হত্যা করে বসে। পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে সব situationকে closely watch করে হত্যা করে না। অবশ্য একেবারেই যে হয় না তা আমি বলতে চাই না, কারণ নজিরের অভাব নেই। যেমন ধরুন পাকুড় মার্ডার কেস, ভাওয়ালের মধ্যম কুমারকে হত্যার প্রচেষ্টা প্ল্যান করেই এবং সময় নিয়ে ঐ সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু ভেবে দেখলেই এবং সমগ্র ঘটনাকে ভালভাবে পর্যালোচনা করে দেখলে বুঝতে পারবেন সেরকম কিছু নয়। প্রথমটা দ্বিতীয়টাকে follow করেনি, তবে দ্বিতীয় হত্যাটা প্রথম হত্যাটার cause বা কারণ হতে পারে। সে যাক। এ ধরনের মতামত প্রকাশ করবার আগে আমাদের অনেক কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য এ ব্যাপারে জানা প্রয়োজন। এবং আরো অনেক কিছু বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন। অর্থাৎ যাকে আমরা তদন্তের ব্যাপারে findings বলি—সব এখনও আমাদের হাতে তো আসেনি।
তাহলে কবে আমরা রওনা হচ্ছি মিঃ রায়?
শুভস্য শীঘ্রং! আজই রাত্রের গাড়িতে হলেই বা ক্ষতি কি?
বেশ তো, তবে সেই রকম ব্যবস্থাই করি।
করুন।
অতঃপর সত্যজিৎ তখনকার মত কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাত্ৰোত্থান করে।
০৯. কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ
কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ রাজবাটিতে পৌঁছবার পরের দিনই সন্ধ্যার দিকে নিত্যানন্দ সান্যাল মশাই তাঁর কন্যা কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে এসে পৌঁছলেন।
স্টেশনে জমিদারবাড়ির টমটমই সান্যালমশাইকে আনতে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার অন্ধকার সবে তখন চারিদিকে ঘন হয়ে এসেছে। প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে বাতি জলে উঠেছে।
সত্যজিতের ঘরেই কিরীটী তার থাকবার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল।
সত্যজিৎ পাশের ঘরে সবিতার সঙ্গে কথা বলছিল, আর কিরীটী একা ঘরের মধ্যে একটা আরামকেদারার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে একটা চুরোটে অগ্নিসংযোগ করে মধ্যে মধ্যে ধূমোদগিরণ করছিল।
সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল এবং সেই সঙ্গে শোনা গেল গম্ভীর মোটা গলার ডাক, সবি! আমার সবি মা কই!
কণ্ঠস্বর শ্রুতিপটে প্রবেশ করা মাত্রই কিরীটী সহসা যেন নিজের অজ্ঞাতেই আরামকেদারাটার উপরে সোজা হয়ে উঠে বসে।
পায়ের শব্দ ক্রমেই সিঁড়ি-পথে উপরের দিকে উঠে আসছে।
সবিতাও বোধ হয় সে কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল এবং ঘর থেকে বাইরে বারান্দায় বের হয়ে এসেছিল।
কিরীটীও উঠে এগিয়ে যায় খোলা দরজাটার দিকে।
এবং নিজের অস্তিত্বকে গোপন রেখেই ইচ্ছা করে দরজার খোলা কবাট দুটো ভেজিয়ে দিয়ে ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের বারান্দায় দৃষ্টিপাত করে।
সিঁড়ির মাথাতেই আগন্তুক নিত্যানন্দ সান্যালের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল এবং সবিতা নীচু হয়ে নিত্যানন্দর পায়ের ধুলো নিতে যেতেই নিত্যানন্দ পরম স্নেহে প্রসারিত দুই বাহুর সাহায্যে সবিতাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মধুসিক্ত করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, থাক মা থাক, হয়েছে—হয়েছে।
কণ্ঠস্বরটা সান্যালমশাইয়ের অশ্রুতে যেন বুজে আসে, চোখের কোলেও দুফোঁটা জল চকচক করে ওঠে বোধ হয়।
সবিতার মাথাটা সান্যালমশাই নিজের প্রশস্ত বক্ষের উপর ন্যস্ত করে ধীরে ধীরে ওর মাথার চলে সস্নেহে অঙ্গুলি-সঞ্চালন করতে থাকেন।
বারান্দার যেটুকু আলো সান্যালমশাইয়ের চোখে-মুখে পড়েছিল, সেই আলোতেই কিরীটী দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে, অন্তরের রুদ্ধ শোকাবেগটা সামলাবার জন্য সান্যালমশাই যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সান্যালমশাইয়ের মেয়ে কল্যাণীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কল্যাণী সবিতার চাইতে বছর চারেকের ছোট হবে বলেই মনে হয়। মেয়েটি কালো দেখতে হলেও সে কালো রূপের মধ্যে অপূর্ব একটা শ্ৰী আছে। মেয়েটির মুখখানির যেন এক কথায় তুলনা হয় না। ছোট কপাল, কপালের উপর কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল এসে পড়েছে; দুচোখের দৃষ্টিতে অপূর্ব একটা বুদ্ধির দীপ্তি যেন ঝকঝক করছে।
সবিতা নিজেকে সামলে নিয়ে সান্যাল মশাইয়ের স্নেহের বাহুবন্ধন হতে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ধীরকণ্ঠে বলে, চলুন মামাবাবু, ঘরে চলুন।
চল মা।
কল্যাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে সবিতা তাকেও আহ্বান জানায়, এসো কল্যাণী।
প্রভু হে, দয়াময়! সবই তোমার ইচ্ছা! বলতে বলতে সান্যালমশাই সবিতা ও কল্যাণীকে অনুসরণ করে সবিতার ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই সবিতার ঘরের দ্বারপথে সত্যজিৎ এসে দাঁড়াল।
সহসা খোলা দ্বারপথে সত্যজিৎকে এসে দাঁড়াতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন সান্যালমশাই, এবং একবার সত্যজিতের দিকে তাকিয়ে নিমেষেই তার আপাদমস্তক এক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সবিতার দিকে ফিরে তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
সবিতা কোন প্রকার ইতস্তত মাত্র না করে সান্যালমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বাবার বন্ধুর ছেলে সত্যজিৎবাবু, বর্মা থেকে এসেছেন।
ও, তুমিই সত্যজিৎ-মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুপুত্র! মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে তোমার সম্পর্কে আমি সব কথাই শুনেছি। তা বেশ বেশ, কথাটা বলে এবারে সত্যজিতের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন, তা বাবাজীর এখানে কবে আসা হলো?
সবিতা দেবীর সঙ্গে একই ট্রেনে এখানে এসেছি। জবাব দিল সত্যজিৎ।
একই ট্রেনে আসা হয়েছে! তা বেশ বেশ! মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধুপুত্র তুমি, এ বাড়ির পরমাত্মীয় বইকি। হ্যাঁ মা সবি, এর এখানে থাকতে কোন কষ্ট বা অসুবিধা হচ্ছে না তো?
না, না, আপনি ব্যস্ত হবেন না মামাবাবু। প্রত্যুত্তর দেয় সত্যজিৎ।
সকলে এসে সবিতার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।
সত্যজিৎ একটা খালি চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে সান্যালমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন মামাবাবু।
সান্যালমশাই চেয়ারটার উপর উপবেশন করে একবার ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।
বসন্তর সঙ্গে দেখা হলো না—সে কি নেই? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন নিত্যানন্দ সবিতার মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বসন্তকাকা আছেন তো। সবিতা জবাব দেয়।
কই, নিচে তাকে দেখলাম না তো।
দুপুরের দিকে কাছারীতে গিয়েছেন, এখনো বোধ হয় ফেরেননি।
এমন সময় নীচে একটা উচ্চকণ্ঠের গোলমাল শোনা গেল। গোলমালের শব্দ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই কানে এসেছিল এবং সকলেই প্রায় উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।
ব্যাপার কি! নিচে এত গোলমাল কিসের? নিত্যনন্দই কতকটা যেন স্বগতভাবেই প্রশ্ন করলেন।
আমি দেখছি। সত্যজিৎ এগিয়ে যায়।
সবিতাও সত্যজিৎকে অনুসরণ করে।
নিচে বাইরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সত্যজিৎ ও সবিতা থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
অত্যন্ত দীর্ঘকায় মিলিটারী লংস ও বুসকোট পরিধান এক ভদ্রলোক উচ্চকণ্ঠে নায়েব বসন্তবাবুর সঙ্গে তর্ক করছেন। ঠাকুর, বনমালী, গোবিন্দ প্রভৃতি ভৃত্যের দল চারিদিকে দাঁড়িয়ে ভিড় করে।
আগন্তুকের দীর্ঘ বলিষ্ঠ গঠন প্রথমেই সকলের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। মুখখানা চৌকো। ছড়ানো চোয়াল।
মুখখানা দেখলেই মনে হয় যেন অত্যন্ত দৃঢ়বদ্ধ কঠিন ও কর্কশ। চোখ দুটো ছোট ছোট গোলাকার।
লোকটার সামনেই পায়ের কাছে একটা হোন্ডঅল স্ট্রাপ দিয়ে বাঁধা, একটা চামড়ার মাঝারি আকারের সুটকেস ও একটা এ্যাটাচী কেস।
আগন্তুক বসন্তবাবুকেই প্রশ্ন করছিল—আমার চিঠি পাননি মানে কি! এডেন থেকে পর পর দুদুখানা চিঠি দিয়েছি। এতদূর পথ এই বোঝা নিজের কাঁধে করে নিয়ে আসতে হয়েছে।
না, আপনার কোন চিঠিই পাইনি।
বেশ, চিঠি না পেয়েছেন না পেয়েছেন। চিঠিটা পেলে আর এমনি ঝামেলাটা আমাকে সহ্য করতে হতো না।
কিন্তু আপনার পরিচয় সম্পর্কে যখন আমি এতটুকুও জ্ঞাত নই, তখন এ বাড়িতে আপনাকে আমি উঠতে দিতে পারি না। নায়েব বসন্ত সেন বললেন।
বটে! উঠতে দিতে পারেন না। আমার পরিচয়টা পাবার পরও নয়?
না। দঢ়কণ্ঠে বসন্তবাবু, প্রত্যুত্তর দেন।
তাহলে আপনি বলতে চান যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আমার কাকা ছিলেন না? অর্থাৎ সোজা কথায় আমি তাঁর ভাইপো নই? কিন্তু এ কথাটাও কি কখনও আপনি শোনেননি কাকার মুখে যে, তাঁর এক বড় জাঠতুতো ভাই ছিল শশাঙ্কশেখর চৌধুরী এবং ১৮ ১৯ বৎসর বয়সের সময় তিনি ভাগ্যাণ্বেষণে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান? আপনি তো শুনি বহুকাল এ-বাড়িতে আছেন। এ কথাটা কখনো কাকার মুখে শোনেননি?
শুনেছি। শুনেছি তাঁর এক জাঠতুতো ভাই ছিল কিন্তু
তবে আবার এর মধ্যে কিন্তুটা কি?
কিন্তুটা যথেষ্ট আছে বৈকি। গম্ভীর দৃঢ় সংযত কণ্ঠে বসন্তবাবু, এবারে বললেন, আপনি সন্তোষ চৌধুরী যে সেই গৃহত্যাগী শশাঙ্কশেখর চৌধুরীরই একমাত্র পুত্র তার তো কোন প্রমাণ দেননি, একমাত্র আপনার কথা ছাড়া।
What do you mean! আমার কথা ছাড়া মানে কি? আমার কথার কি কোন মূল্যই নেই? আপনি তাহলে বলতে চান I am an imposter– প্রতারক!
মিথ্যে আপনি চেচাচ্ছেন মশাই। গলাবাজি করে এ প্রশ্নের মীমাংসা হতে পারে না। আপনার কাছে কোন লিখিত-পড়িত প্রমাণ আছে কি, যার সাহায্যে আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে আপনিই সেই শশাঙ্কবাবুর পুত্র সন্তোষ চৌধুরী, এই চৌধুরী বংশেরই একজন।
তাও আছে বৈকি! প্রয়োজন হলে আদালতেই সেটা আমি পেশ করবো, আপনাকে নয় অবশ্যি, ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিল সন্তোষ চৌধুরী।
সবিতা এতক্ষণ নিঃশব্দ বিস্ময়ে ওদের পরস্পরের কথা-কাটাকাটি শুনছিল। কিন্তু চুপ করে থাকতে পারল না, একটু এগিয়ে এসে বললে, কে এই ভদ্রলোক কাকাবাবু?
সন্তোষ চৌধুরী সবিতার কথায় তার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তুমিই বোধ হয় সবিতা, কাকার মেয়ে? আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমার জাঠতুতো ভাই। এডেন থেকে আসছি, আমার নাম সন্তোষ চৌধুরী।
এডেন থেকে আসছেন?
হ্যাঁ। Its a long journey! সব বলবো, আগে একটু চা চাই বোন। তৃষ্ণায় গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। এমন হতচ্ছাড়া জায়গা যে স্টেশনে একটা চায়ের স্টল পর্যন্ত নেই। পরক্ষণেই সবিতার জবাবের অপেক্ষা মাত্রও না করে অদূরে দণ্ডায়মান ভৃত্যের দিকে তাকিয়ে বললে, এই বেটারা, হাঁ করে ভূতের মত দাঁড়িয়ে দেখছিস কি! জিনিসগুলো উপরে নিয়ে চল না। I want some rest, ভীষণ tired!
কিন্তু তার কথায় কেউ কোন আগ্রহ জানায় না। যে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে থাকে।
সন্তোষবাবুর জিনিসপত্র নিচের মহলে আমার পাশের খালি ঘরটার রাখ। গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে বসন্তবাবু, বললেন।
নিচের মহলে থাকতে হবে মানে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সন্তোষ চৌধুরী বসন্তবাবুর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, নিচের ঘরেই আপনাকে থাকতে হবে যতক্ষণ না আপনার identity আমি সঠিকভাবে পাচ্ছি।
কঠিন স্বরে নায়েব বসন্তবাবু বলে ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন আর দ্বিতীয় কোন বাক্যব্যয় মাত্রও না করে।
বসন্তবাবুর খড়মের শব্দটা খটখট করে ঘরের বাইরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে যারা আর সকলে উপস্থিত ছিল, স্থাণুর মত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো।
শেষ নির্দেশ যেন জারী হয়ে গিয়েছে। এবং বসন্তবাবুর মুখনিঃসৃত সে নির্দেশের বিরুদ্ধে এ কক্ষের মধ্যে উপস্থিত কারো যেন এতটুকু ক্ষীণ প্রতিবাদ করবারও ক্ষমতা বা দুঃসাহস নেই, সেটকু বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না।
কক্ষের জমাট স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে প্রথমেই কথা বলল সন্তোষ চৌধুরী, তাহলে আমাকে নিচের ঘরে থাকতে হবে সবিতা? কথাটা বলে সন্তোষ সবিতার মুখের দিকে তাকাল।
ঘটনার পরিস্থিতিতে সত্যজিৎ নিজেকে যেন একটু বিব্রত বোধ করে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় সে।
সত্যিই যদি এই লোকটি একটু আগে যা বলল ঠিক হয় এবং এই চৌধুরীদের আত্মীয়ই হয়, তাহলে একে নিচের একটা ঘরে স্থান দিয়ে নিজের তার উপরের একখানা ঘর দখল করে থাকাটা নিশ্চয়ই শোভনীয় হবে না, ও সমীচীনও হবে না।
সত্যজিৎ এবারে কথা বললে, আমিই কেন নিচের একটা ঘরে এসে থাকি না
মিস চৌধুরী? উনি বরং
আপনি! বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সন্তোষ চৌধুরী এতক্ষণে সত্যজিতের মুখের দিকে।
আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না সন্তোষবাবু। আপনি এসেছেন এডেন থেকে আর আমি আসছি বর্মামুলুক—রেঙ্গুন থেকে।
এদের কোন আত্মীয় রেঙ্গুনে ছিলেন বলে তো কই জানি না! সন্তোষ চৌধুরী কথাটা বললে।
ঠিকই। আমি এদের আত্মীয় নই—
তবে?
মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বন্ধুপুত্র। এদের গৃহে সামান্য কয়েকটা দিনের জন্য অতিথি মাত্র। শীঘ্রই চলে যাবো।
অঃ, একান্ত নিরাসক্ত ভাবেই সন্তোষ চৌধুরী শব্দটা উচ্চারণ করল।
আপাততঃ তো ওপরের কোন ঘর খালি নেই সন্তোষদা, আপনি বরং দুটো দিন কাকা যে ব্যবস্থা করে গেলেন নিচের ঘরেই থাকুন।
সবিতার কথায় যুগপৎ সকলেই যেন একটু বিস্মিত ভাবেই ওর মুখের দিকে তাকাল। গোবিন্দ, বাবুর জিনিসপত্রগুলো নায়েবকাকার পাশে যে ঘরটা খালি আছে, সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করে দাও। সবিতা এবারে কতকটা দৃঢ়কণ্ঠেই যেন তার বক্তব্যটা জানিয়ে দিল।
গোবিন্দ এগিয়ে এসে সন্তোষ চৌধুরীর মালপত্রগুলো মাটি থেকে তুলে নিতে নিতে বললে, চলেন বাবু
চল। সন্তোষের কণ্ঠস্বর ও মুখের চেহারাটা কেমন যেন অদ্ভুত শান্ত ও নিরাসক্ত শোনায়।
গোবিন্দ মালপত্রগুলো মাথায় তুলে নিয়ে ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়াল এবং সন্তোষ চৌধুরী তাকে অনুসরণ করল।
বসন্তবাবুর পাশের ঘরটা খালিই পড়েছিল।
ঘরটা স্বল্পপরিসর হলেও আলো-হাওয়ার প্রচুর ব্যবস্থাই আছে। জিনিসপত্রগুলো মেঝেতে নামিয়ে রেখে গোবিন্দ সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন বাবু, আগে একটা আলো জ্বেলে নিয়ে আসি।
গোবিন্দ ঘর হতে বের হয়ে গেল।
অন্ধকার ঘরটার মধ্যে একাকী সন্তোষ চৌধুরী দাঁড়িয়ে রইলো।
১০. পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী
পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরটা থেকে বের হয়ে বাইরের বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।
সন্ধ্যা থেকেই সারা আকাশটা জুড়ে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। শুরু হলো এতক্ষণে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবল হাওয়া।
মধ্যে মধ্যে কালো আকাশটার এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের নীল আলো যেন চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। গুরু গুরু মেঘের ডাক থেকে থেকে আকাশটাকে যেন কাঁপিয়ে তুলছে।
বারান্দাটা অতিক্রম করে কিরীটী বাইরের মহলের দিকে অগ্রসর হলো। ইতিমধ্যে বারান্দার ঝোলানো বাতি জেলে দেওয়া হয়েছে। প্রবল বায়ুর ঝাপটায় বাতিটা দুলছে। কাঁপছে বাতির শিখাটা। দেওয়লের গায়ে প্রতিফলিত আলোটাও সেই সঙ্গে কাঁপছে এধার থেকে ওধারে মৃদুমন্দ।
জলের ঝাপটা বারান্দাতেও আসছে—বেশিক্ষণ এই খোলা বারান্দায় থাকলে সর্বাঙ্গ ভিজে যাবে। সামনেই একটা ঘরের খোলা দ্বার দেখতে পেয়ে কিরীটী সেই ঘরের মধ্যেই গিয়ে ঢুকে পড়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ভারী গলায় প্রশ্ন এলো, কে?
কণ্ঠস্বরটা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল নায়েব বসন্তবাবুর।
এইমাত্র বোধ হয় সন্ধ্যা-আহ্নিক সমাপ্ত করে বসন্তবাবু, শুধু একটা ধুতি পরিধানে খালিগায়ে ঘরের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালের গায়ে একটা দেওয়ালবাতি জ্বলছে। তারই আলোয় কিরীটী পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত বাবুর মুখের দিকে।
বসন্তবাবুর দুচোখের তারায় যেন একটা কঠিন প্রশ্ন ছুরির মত ঝিকিয়ে উঠছে।
নায়েব বসন্ত সেনের দুই চক্ষুর ছুরির ফলার মত ধারালো শাণিত দৃষ্টি যেন কয়েকটি মুহূর্ত কিরীটীর দুই চক্ষুর দৃষ্টির সঙ্গে উদ্ধত স্পর্ধায় মিলিত হয়ে স্থির হয়ে থাকে। পলকহীন, অকম্পিত।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই, পরক্ষণেই বসন্ত সেনের চক্ষুর দৃষ্টি ও মুখের একটু আগে কঠিন হয়ে ওঠা সমস্ত রেখাগুলো সহজ ও কোমল হয়ে এলো। বিনীত হাস্যে চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।
কিরীটীবাবু, যে! হঠাৎ কি মনে করে? বসন্তবাবুই প্রথমে প্রশ্ন। করলেন।
কিরীটী স্মিতকণ্ঠে বললে, একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম। বসতে পারি সেনমশাই?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বসুন। অভ্যর্থনা জানালেন নায়েব বসন্ত সেন। এবং সমস্ত আবহাওয়াটাকে সহজ ও লঘু করে সম্মুখের একটা খালি চেয়ার চোখের নির্দেশে দেখিয়ে দিলেন বসন্তবাবু কিরীটীকে।
আপনার সময় নষ্ট করছি না তো সেনমশাই? চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে কিরীটী কথাগুলো নায়েবমশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই উচ্চারণ করলে।
না, না—সন্ধ্যার পর আমি বিশেষ কোন কাজই করি না। এই সময়টা রাত্রে আহারের আগে পর্যন্ত আমার সম্পূর্ণ বিশ্রামের সময়।
কিরীটী চেয়ারটার উপর নড়েচড়ে একটু আরাম করে বসল এবং পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে কেস থেকে একটা সিগার নিয়ে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।
নায়েব বসন্ত সেনও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন করলেন। পরিধেয় ধুতিটার কোছাটা খুলে গায়ের উপর জড়িয়ে নিলেন।
খোলা জানলা-পথে জলসিক্ত ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আসছে, বেশ শীতশীত করে।
বৃষ্টিও যেন নেমেছে একেবারে আকাশ ভেঙে।
কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দে অতিবাহিত হয়, দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। বাইরে শুধু, একটা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। টেবিলের উপরে একটা সাদা চিমনি দেওয়া কেরোসিনের টেবিল বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় ঘরটা বেশ আলোকিতই হয়ে উঠেছে।
সহসা এক সময় নায়েব বসন্তবাবুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, তার মৃত্যুর সমস্ত ব্যাপারটাই তো আপনি সত্যজিৎ ও সবিতার মুখে শুনেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
এ সম্পর্কে সত্যজিতের যা ধারণা তাও নিশ্চয়ই শুনেছেন?
শুনেছি। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
কিন্তু ব্যাপারটা আপনার কি মনে হয় মিঃ রায়?
দেখুন ঘটনা সম্পর্কে যতটা শুনেছি তাতে অবশ্য আমার মনে হয় এর পিছনে একটা বিশ্রী চক্রান্ত আছে—
চক্রান্ত! কথাটা উচ্চারণ করে নায়েব বসন্ত সেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে বিস্ময়-দৃষ্টিতে।
হ্যাঁ। এবং এও ঠিক, মৃত্যুঞ্জয়বাবুর হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে হলে আমাদের দীর্ঘ উনিশ বৎসর আগে তাঁর স্ত্রীর হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুকে সর্বাগ্রে মীমাংসা করতে হবে—
হেমপ্রভার মৃত্যু! সে তো উনিশ বছর আগে ঘটেছে। তাছাড়া হেমপ্রভার মৃত্যুও তো যতদূর জানি স্বাভাবিক ব্যাপার। রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী বসন্ত সেনের মুখের দিকে। কানাইয়ের মার মুখ থেকে শোনা সত্যজিৎ-বর্ণিত হেমপ্রভার সে মৃত্যু-কাহিনী কি তবে বসন্ত সেনের অজ্ঞাত! সত্যই কি বসন্ত সেন সে ব্যাপারের কিছুই জানেন না? না তিনি স্বীকার করতে চাইছেন না? কিন্তু সত্য হোক মিথ্যা হোক, বেশ ভাল করে যাচাই না করে কিরীটী বসন্ত সেনকে মুক্তি দেবে না। সেই কারণেই ব্যাপারটা যেন আজও বসন্ত সেনের অজ্ঞাতই এইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী, কেন, আপনি কিছুই জানেন না—হেমপ্রভা দেবীর সত্যিকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা?
কই না! হেমপ্রভার মৃত্যুর মধ্যেও কোন একটা ব্যাপার ছিল, এ তো কই আমার এতদিন জানা ছিল না! তিনি হঠাৎ একদিন সকালে অসুস্থ অবস্থাতেই বেশী রকম অসুস্থ হয়ে পড়ায় কর্তা রত্রেই তাঁকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
না, তা বোধ হয় ঠিক নয়। গভীর কণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
কী আপনি বলছেন মিঃ রায়! আমি যে তখন এ বাড়িতেই ছিলাম। আমার চোখের সামনে দিয়ে অসুস্থ হেমপ্রভাকে পাল্কিতে চাপিয়ে কর্তা কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান!
হ্যাঁ, পাল্কি যেতে দেখেছেন বটে তবে তার মধ্যে একটা পাল্কিতে কেউ ছিল না—ছিল খালি। এবং তার আগেই হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু ঘটেছিল।
যত সব আজগুবী ব্যাপার। কে বলেছে আপনাকে এসব কথা শুনি?
আমাকে কেউ বলেনি। বলেছে কানাইয়ের মা সবিতা ও সত্যজিৎবাবুকে।
কানাইয়ের মা বলেছে! দাঁড়ান তো দেখি, হারামজাদীকে একবার ডাকি—
বসন্ত সেন চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটী তাঁকে বাধা দিল, ব্যস্ত হবেন না বসন্তবাবু, বসুন। আমার কথাটা শেষ করতে দিন আগে। এখনও আমার শেষ হয়নি।
কিন্তু এ যা আপনি বলছেন এ তো একেবারে সম্পূর্ণ আরব্য উপন্যাস। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!
উপন্যাসের চেয়েও অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা অনেক সময়েই আমাদের জীবনে ঘটে নায়েব মশাই। অবশ্য আমার ধারণা ছিল ব্যাপারটা আপনার অজ্ঞাত নয়।
না মিঃ রায়, আপনি হয়ত জানেন না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর আমি মাইনেকরা ভৃত্য হলেও তাঁর সঙ্গে কোনদিন আমার প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক ছিল না। বন্ধু এবং ভায়ের মতই আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছে ছিলাম। তাঁর জীবনের কোন ঘটনাই আমার অজ্ঞাত ছিল না কোন দিন। সেক্ষেত্রে এতবড় একটা ঘটনা তিনি আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছেন এ কথা আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য।
হয়ত এমনও হতে পারে সর্বদা তিনি সব কথা আপনার কাছে বললেও ঐ ব্যাপারটা কোন বিশেষ কারণেই আপনার কাছ থেকে গোপন করেছিলেন
কারণ বলছেন, কি তার এমন কারণ থাকতে পারে! আর সত্যিই যদি আপনি যা বলছেন তাই হয়ে থাকে, তাহলে তো এত বড় একটা ঘটনা তিনি নিঃশব্দে চাপা দিয়ে যাবেন, তাই বা কেমন করে সম্ভব বা বিশ্বাসযোগ্য বলুন? তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি জানেন না মিঃ রায়, কিন্তু আমি জানি, হেমপ্রভাকে তিনি জীবনাধিক ভালবাসতেন। তাঁর পায়ে কাঁটাটি ফুটলেও তিনি বুক পেতে দিতে পারতেন। আর অমনি একটা ব্যাপারকে তিনি নীরবে সহ্য করে যাবেন!
নায়েব মশাই, আপনি অবিবাহিত। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর প্রেম ও ভালবাসার রাস্তাটা এমন জটিল যে তার অনেক সময় হদিসই পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আমাদের এই বাংলাদেশে কোন কোন স্বামী-স্ত্রী জীবনব্যাপী গরমিল অসামঞ্জস্যকে এমনভাবে সহিষ্ণুতা ও সামাজিক নিয়মকানুনের চাপে পড়ে কাটিয়ে দিয়ে যায় যে, জীবিতকালে তো নয়ই মৃত্যুর পরেও সেটার কোন আভাসমাত্রও হয়ত পাওয়া যায় না। অবশ্য আপনি মনে করবেন না যে আমি এমন কিছু বলতে চাইছি স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী সম্পর্কে। এবং এক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথাও আপাতত নয়। আমি যেটা সম্পকে স্থিরনিশ্চিত হতে চাই সেটা হচ্ছে, সত্যি সত্যি হেমপ্রভা দেবীরও এইখানেই মৃত্যু হয়েছিল কিনা এবং তাঁর মৃতদেহ নন্দনকাননের বকুলবৃক্ষের তলেই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কলকাতা হতে প্রত্যাবর্তনের পর সাতদিন বাদে তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন কিনা।
এসব আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? হেমপ্রভার মৃতদেহও সেই বকুল বৃক্ষতলেই কর্তা কলকাতা হতে ফিরে এসে আবিষ্কার করেছিলেন?
হ্যাঁ, তাই। অন্ততঃ কানাইয়ের মার বর্ণিত কাহিনী সেই কথাই বলে।
মিঃ রায়, কানাইয়ের মাকে এ সম্পর্কে ভাল করে জিজ্ঞাসাবাদ করা আমার একান্তই প্রয়োজন।
সে বললাম তো, পরে করলেও আপনার চলবে। তবে আমাকে যদি আপনি বিশ্বাস করেন তবে এইটুকু আপনাকে আমি বলতে পারি, ও সম্পর্কে আমি নিজেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম এবং আমার ধারণা সে মিথ্যা কিছুই বলেনি। উনিশ বৎসর পূর্বে ঠিক যেমনটি ঘটেছিল এবং যেমনটি সে দেখেছিল ঠিক তেমনটিই সে বলেছে, তার মধ্যে কোন কিছু অত্যুক্তি বা অবোধ্য কিছুই নেই।
কিন্তু তাই যদি হবে কানাইয়ের মার কথা যদি সত্যিই ধরে নেওয়া যায়, তাহলে একটা ব্যাপার আমি আদতেই বুঝে উঠতে পারছি না যে, হেমপ্রভার মৃত্যুর ব্যাপারটা এভাবে গোপন করবার মৃত্যুঞ্জয়ের কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
আমার জিজ্ঞাস্যও তাই সেন মশাই। তিনি তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ঐভাবে আগাগোড়া গোপন করে গেলেন কেন সকলের কাছ থেকে, এমন কি আপনার মত সুহৃদের কাছেও কেন গোপন করে গেলেন? অবশ্য ঘটনা হতে যতটুকু জানা যায়, কানাইয়ের মা একান্তভাবেই দৈবক্রমে ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিল বলেই আজ আমরা এতদিন পরে সমস্ত ব্যাপারটা জানতে পেরেছি, নচেৎ সেটা হয়ত কেউ জানতে পারত না। আমি যতদূর শুনেছি এবং এইমাত্র আপনার মুখ থেকেও যতটা জানতে পারলাম, আপনার সঙ্গে স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর একটা নিকট যোগাযোগ ছিল মনের দিক দিয়ে; তাই জিজ্ঞাসা করছি এমন কোন অতীত কাহিনী বা ঘটনার কথা তাঁর জীবনের আপনি জানেন কি, যার দ্বারা আমরা তাঁর স্ত্রীর রহস্যময় মতুর উপরে কোন অলোকসম্পাত করতে পারি।
কিরীটীর সোজা সরল প্রশ্নে নায়েব বসন্ত সেন কিছুক্ষণের জন্য যেন মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নায়েব বসন্ত সেনের দিকে তাকিয়ে বললে, শুনন নায়েবমশাই, এক বিষয়ে আমি অন্ততঃ স্থিরনিশ্চিত যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে নিঠুরভাবে হত্যা করাই হয়েছে। অবশ্য ঘটনার অনেক পরে আমি অকুস্থানে এসেছি, তাহলেও এ মৃত্যু-রহস্যের মীমাংসা করাটা খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার হবে না; কেবল কিছু সময় নেবে। কিন্তু আপনাদের সকলের সাহায্য যদি পাই তাহলে মীমাংসার ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসে।
আমি তো আপনাকে প্রথম দিনই বলেছি কিরীটীবাবু, আমার যতটুকু সম্ভব সাহায্য আপনাকে আমি করতে প্রস্তুত। এবং একথাও আপনাকে আমি প্রথম দিনই বলেছি, মৃত্যুঞ্জয়ের মত নির্মল ও সৎ চরিত্রের লোক আমি জীবনে বড় একটা দেখিনি। কোন কলঙ্কই তাঁকে স্পর্শ করেনি। অত্যন্ত দৃঢ় নায়েব বসন্ত সেনের কণ্ঠস্বর।
কিরীটী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চুপ করে বসে রইল এবং মধ্যে মধ্যে হস্তধৃত চুরুটটায় মৃদু মৃদু টান দিয়ে ধুমোদগীরণ করতে লাগল।
ইতিমধ্যে বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কেবল বর্ষণ-ক্লান্ত রাত্রির কালো আকাশটার গায়ে বিদ্যুতের চমকানি থেকে থেকে নীল আলোর সঙ্কেত জানিয়ে যাচ্ছে।
কিরীটী আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী মারা যান সেই বিকালে বা সন্ধ্যায় শেষ আপনার সঙ্গে কখন দেখা হয়েছিল সেন মশাই?
রাত দশটায় তিনি আহার করেন, তার আগে পর্যন্ত তাঁর শোবার ঘরেই আমরা দুজনে বসে কথাবার্তা বলছিলাম।
কি ধরনের কথাবাতা সে-রাত্রে আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?
সবিতা সম্পর্কেই বিশেষ যা কথাবার্তা হয়েছিল। সত্যজিৎকে তিনি রেঙ্গুন থেকে আসতে লিখেছেন এবং সে এলে উভয়ের যদি উভয়কে পছন্দ হয় তাহলে এই সামনের আষাঢ়েই ওদের বিবাহ দেবেন—এই সবই বলছিলেন।
আর কোন কথা হয়নি আপনাদের মধ্যে, যাতে করে তাঁর অত্যাসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনরুপ ধারণা করা যেতে পারে?
না।
হুঁ। আচ্ছা ইদানীং তাঁর মনের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল বলতে পারেন? কোন প্রকার দুশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা
না।
জমিদারীর অবস্থা ও আর্থিক অবস্থা ইদানীং তাঁর ভালই ছিল নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ। ব্যাঙ্কে প্রায় লাখ তিনেক টাকা মজুত আছে, কলকাতায় একখানা বাড়ি এবং এখানকার জমিদারী ও কারবারের অবস্থা আশাতীত ভালই বলতে হবে।
তিনি কোন উইল লিখে রেখে গিয়েছেন বলে জানেন কি?
বছর পাঁচেক আগে একটা উইল করেছিলেন। ইদানীং অবশ্য একবার কিছুদিন আগে বলেছিলেন, পূর্বের সেই উইলটার একটু সামান্য অদলবদল করবেন, কিন্তু সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি।
সে উইলে কি লেখা আছে জানেন? তাঁর যাবতীয় সম্পত্তিই তাঁর একমাত্র মেয়ে সবিতাই পাবে, কেবল–
কেবল?
হাজার পঞ্চাশ টাকা তিনি আমার নামে দিয়ে গিয়েছেন, প্রয়োজনমত সেটা আমি এবং আমার একান্ত ইচ্ছামত যে কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবো।
আর তাঁর কোন নিকট বা দূর-আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবকে কিছুই দিয়ে যাননি?
না। তবে, বসন্তবাবু, একটু ইতস্ততঃ করতে থাকেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কি যেন ভেবে বললেন, ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর নামে উইলের মধ্যে একটা নির্দেশ আছে—
কিরীটী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে, যিনি আজ সন্ধ্যাবেলা এডেন না কোথা থেকে এলেন, উনিই কি সেই দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতুপত্র সন্তোষ চৌধুরী?
বলতে পারি না উনিই সেই মৃত্যুঞ্জয়ের বর্ণিত সন্তোষ চৌধুরী কিনা, যদিও সেই পরিচয় নিয়েই উনি এসে আজ হাজির হয়েছেন
ভদ্রলোককে তাহলে ইতিপূর্বে কখনো আপনি দেখেননি এবং চেনেনও না?
না।
উইলে ওঁর সম্পর্কে কি নির্দেশ আছে বলছিলেন?
ভ্রাতুষ্পত্র সন্তোষ চৌধুরী যদি কোন দিন ফিরে এসে তাঁর পিতৃ-সম্পত্তির দাবী জানান, তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ১/৪ অংশ সে পাবে। বাকী ৩/৪ অংশ পাবে কন্যা সবিতা। সবিতা যদি বিবাহ না করে তাহলে অর্ধেক সম্পত্তি ঐ সন্তোষ চৌধুরী পাবেন অথবা সবিতার মৃত্যুর পর যদি তার কোন সন্তানসন্ততি না থাকে তাহলে ঐ সন্তোষ চৌধুরী বা তাঁর বংশধরেরা যদি জীবিত থাকে তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ৩/৪ অংশ তারা পাবে এবং বাকী অংশ সবিতার স্বামী পাবে।
সবিতা দেবী তো ঐ সন্তোষ চৌধুরী সম্পর্কে পূর্বে কিছুই জানতেন না, অন্ততঃ গতকালও তাই বলেছেন।
না, সে জানত না। একমাত্র আমিই জানতাম। মৃত্যুঞ্জয় আমাকে উইল করবার সময় একবার মাত্র বলেছিলেন।
ঐ সন্তোষ চৌধুরী কোথায় থাকেন ইত্যাদি বা সে সম্পর্কে কিছুই কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আপনাকে বলেননি?
হ্যাঁ বলেছিলেন, এডেন না কি কোথায় থাকেন
এডেনের ঠিকানাটা বলেননি?
না।
আজ যে ভদ্রলোক সন্ধ্যাবেলা সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয়ে এলেন, একে কি আপনার আসল লোক নয় বলে কোনরূপ সন্দেহ হচ্ছে?
যতক্ষণ না সঠিকভাবে জানতে পারছি ততক্ষণ মেনে নিই বা কেমন করে? যার কেবলমাত্র নামই শুনেছি, অথচ পূর্বে কখনো যাকে চাক্ষুষ দেখিনি তাকে এত সহজে স্বীকার করে নিতে তো পারি না।
উনিই যে আসল সন্তোষ চৌধুরী তার কোন প্রমাণ এখনও দেখেন নি?
না।
আপনি জানতে চাননি?
চেয়েছিলাম, বলেছেন প্রয়োজন হলে সে-সব প্রমাণ নাকি আদালতেই পেশ করবেন। আমাকে কোন প্রমাণ দিতে রাজী নন তিনি।
দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করল।
আহারের সময় উপস্থিত—ভৃত্য এসে সংবাদ দিল। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
১১. আকাশের বুকে ভোরের আলো
ভাল করে আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ফুটে ওঠেনি। অত্যাসন্ন প্রত্যূষের চাপা রক্তাভায় পূবের আকাশটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, খোলা জানলা-পথে জলো হাওয়া কেমন শীত-শীত বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে গেল। কিরীটী শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল। আলনা থেকে জামাটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে কিরীটী ঘরের দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় বের হয়ে এল। এ বাড়ির কারোরই এখনও নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। সিঁড়ি-পথ অতিক্রম করে কিরীটী সোজা বাইরে চলে এল সদর দরজা খোলা দেখে। প্রমোদভবন থেকে সোজা যে রাস্তাটা দুপাশের ঝাউবিথীর মধ্যখান দিয়ে সামনের সড়কে গিয়ে মিশেছে কিরীটী সেই রাস্তাটা ধরেই এগিয়ে চলল। হাওয়ায় ঝাউগাছের চিকন পাতাগুলি এক প্রকার সোঁ সোঁ শব্দ তুলেছে। এত সকালে প্রমোদভবনের সদর দরজাটা খোলা দেখে কিরীটী ভেবেছিল হয়ত চাকরবাকরদের মধ্যেই কেউ ইতিমধ্যে উঠেছে, কিন্তু ঝাউবীথির মাঝখান দিয়ে পথটা ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই তার সে ভুলটা ভেঙে গেল। অল্পদুরে একটি নারীমূর্তি ধীরপদে এগিয়ে চলেছে। এত সকালে এই পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে কে! সবিতা দেবী নাকি? কিন্তু নারীমূর্তিটির চলবার ভঙ্গী দেখে কিরীটী বুঝতে পারে সে সবিতা নয়। তবে কে? কিরীটী একটু দ্রুতই পা চালিয়ে চলে। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় অগ্রগামী নারীমূর্তিকে কিরীটী অনুসরণ করতে করতেই দেখে পরিধানে তার আকাশ-নীল রংয়ের একটা শাড়ি এবং মাথার চুল লম্বা বেণীর আকারে পৃষ্ঠোপরি দোদুল্যমান। পায়ে বোধ হয় চপ্পল সু, চলার ভঙ্গী ও চাল-চলন দেখে মনে হয় সেও তারই মত প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে হয়ত।
অনেকটা কাছাকাছি হতে এবং দুজনের মধ্যে ব্যবধান কমে আসতেই তাকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো।
কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, অগ্রগামিনী আর কেউ নয়, সবিতার গত সন্ধ্যায় বিদেশাগত মামার মেয়ে কল্যাণী।
কল্যাণী একটু বিস্মিত দৃষ্টিতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটীও তাকিয়ে ছিল কল্যাণীর মুখের দিকেই।
পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি এখনো এবং কল্যাণী ইতিপূর্বে কিরীটীকে না দেখলেও কিরীটী গত সন্ধ্যাতেই দরজার ফাঁক দিয়ে কল্যাণীকে দেখেছিল, তাতেই তার কল্যাণীকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কিরীটীই প্রথমে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলে, সুপ্রভাত, আপনিই বোধ হয় কল্যাণী দেবী!
কল্যাণী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত কিরীটীর মুখে তার নিজের নামোচ্চারণ শুনে কতকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না ঠিক!
আমার নাম কিরীটী রায়। কিরীটী স্মিতকণ্ঠে জবাব দেয়।
ও, আপনিই কিরীটীবাবু! সবিতাদি কাল রাত্রে আপনার কথা বলছিল বটে। নমস্কার।
বেড়াতে বের হয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ। নতুন জায়গায় আমার তেমন ঘুম হয় না। সারাটা রাত বিছানার উপরে ছটফট করে ভেরের দিকে আর শুয়ে থাকতে ভাল লাগলো না। তাই বের হয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবের রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত, বাংলাদেশের এই শ্যামল রূপটি ভারী ভাল লাগছে।
দুজনেই আবার তখন পাশাপাশি চলতে শুরু করেছে সামনের দিকে। চলতে চলতেই কিরীটী কল্যাণীর কথার প্রত্যুত্তর দেয়, হ্যাঁ, এমন দেশটি আর কোথাও গেলে পাবেন না। বলতে গেলে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই আমি পর্যটন করেছি, কিন্তু বাংলার মাটিতে ও আকাশে যে মিষ্ট শ্যামল একটি অখণ্ড পরিপূর্ণতার সন্ধান পাই এমনটি আর কই চোখে তো আমার পড়ল না।
হয়ত আপনার কথাই সত্যি মিঃ রায়। বাংলাদেশের মেয়ে হলেও জন্ম আমার পাঞ্জাবে এবং বলতে গেলে এই আমার বাংলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
যত দিন যাবে দেখবেন এ দেশকে আপনার আরো বেশী করে ভাল লাগবে। ঋতুতে ঋতুতে আকাশে ও মাটিতে এর পরিবর্তন রংয়ের খেলা যেমন অপূর্ব তেমনি সুন্দর। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। যাকে নিত্য দেখেও আশ মেটে না।
পুব আকাশে একটু করে দিনের আলো যেন পাপড়ির মত দল মেলেছে।
রাস্তাটা নির্জন। ছোট ছোট লাল কাঁকর ছড়ানো রাস্তাটায়। জমিদারেরই তৈরী রাস্তাটা। গতরাত্রের বৃষ্টিতে রাস্তাটা এখনো ভিজে আছে। রাস্তার দুপাশে খোলা মাঠ—যেন সবুজ দুখানা চাদর দুদিকে বিছানো। ক্রমে একথা সেকথার মধ্যে দিয়ে দুজনার মধ্যে আলাপটা আরো বেশ জমে ওঠে। কিরীটীর কল্যাণীকে বেশ লাগে। মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বাংলার বাইরে পাঞ্জাবে মানুষ বলেই হয়ত কল্যাণীর স্বভাবে, কথাবার্তায় ও চালচলনে একটা সাবলীল গতি রয়েছে। বাংলাদেশের ঐ বয়েসী মেয়েদের মত লজ্জা বা আড়ষ্টতা এর চরিত্রের মধ্যে কোথাও নেই। কল্যাণীর চরিত্রে ও কথায়বার্তায় যে একটা সহজ সরলতা তাই নয়, তার দৈহিক গঠন ও স্বাস্থ্যের মধ্যেও একটা সুস্থ ও সহজ সৌন্দর্য আছে। রূপ বলতে যা বোঝায় কল্যাণীর তা না থাকলেও চেহারায় একটা সৌন্দর্য আছে—গায়ের রং কালোই কিন্তু তথাপি সেই কালোর মধ্যে এমন একটা স্নিগ্ধকর শ্যামল লাবণ্য আছে যেটা অতি সহজেই যেন অন্যের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চোখমুখের গঠনটিও কল্যাণীর ভারী চমৎকার। বাঁকানো ধনুকের মত ভ্রূ, ঘন আঁখিপল্লব, সজল স্নিগ্ধ দুটি চোখের তারা। পাতলা দুটি ওষ্ঠ। বাম গালের উপরে একটি তিল মুখের সৌন্দর্যকে যেন অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। কথায় কথায় চমৎকার হাসে কল্যাণী। এবং সেই হাসিটি যেন সমস্ত চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মেয়েটির কথাবার্তার মধ্যেও যেন একটা কৌতুকপ্রিয়তা বিদ্যমান।
সবিদি ও সত্যজিৎবাবুর মুখেই শুনেছিলাম আপনি নাকি একজন সাংঘাতিক বাঘা ডিটেকটিভ মিঃ রায়!
বাঘা ডিটেকটিভ! আর কি শুনেছেন বলুন তো মিস সান্যাল? হাসতে হাসতেই কিরীটী কল্যাণীকে প্রশ্ন করে।
আরো কত কি! সব কি ছাই মনে আছে? বলতে বলতে হঠাৎ কল্যাণী প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ রায়, সত্যিই কি আপনার মনে হয় আপনি পিসেমশাইয়ের হত্যাকারীকে ধরতে পারবেন?
রাস্তার একপাশে একটা বড় আকারের পাথর পড়েছিল। কিরীটী পাথরটার দিকে এগুতে এগুতে কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, আসুন মিস সান্যাল, ঐ পাথরটার উপরে কিছুক্ষণ বসা যাক।
বেশ তো! দু
জনে পাথরটার উপরে গিয়ে বসল।
পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগার সেটা থেকে টেনে নিতে নিতে কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে প্রশ্ন করে, ধুমপান করতে পারি? আপত্তি নেই আপনার?
Oh Surely, not at all!-মৃদু হাস্য-তরল কণ্ঠে কল্যাণী জবাব দিল।
সিগারটার দেয়াশলাই জালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে গোটা দুইতিন টান দিল কিরীটী। কল্যাণী পাথরটার সামনে থেকে একটা ঘাসের শীষ টেনে ছিড়ে দাঁত দিয়ে কাটতে লাগল অন্যমনস্ক ভাবে।
হঠাৎ কিরীটী আবার কথা শুরু করে, হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন আপনি মিস সান্যাল! হত্যাকারীকে ধরতে পারবো কিনা, তাই না?
হ্যাঁ, জানেন আমি একজন ডিটেকটিভ বইয়ের খুব ভক্ত! ঐসব তদন্তের ব্যাপারে আমার ভারী interest লাগে, ছোটখাটো সব অদ্ভুত সুত্র ধরে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা ভারী শক্ত কাজ, না?
তা একটু শক্ত বইকি। চোখ থাকলে এবং ইংরাজীতে যাকে আমরা সাধারণতঃ common sense বলি একটু প্রখর থাকলেই যে কোন রহস্যের solution-এ আসতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
তবে সকলে পারে না কেন?
কিরীটী কল্যাণীর কথায় এবারে হেসে ফেলল এবং হাসতে হাসতে বলে, আসল ব্যাপারটা কি জানেন? ধরুন আপনাকে একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। বলুন তো সবিতা দেবীর বাড়িতে একতলা থেকে দোতলায় উঠতে কটা সিঁড়ি আছে?
কটা সিঁড়ি! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল কল্যাণী কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বলুন না। আপনি কতবার ঐ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেছেন কাল থেকে?
তা কাল রাত্রে বারচারেক এবং আজ সকালে একবার।
পাঁচবার। তাহলে বলুন ঐ সিঁড়ি দিয়ে আপনি ওঠা-নামা করেছেন এবং দেখেছেনও সিঁড়িগুলো কেমন, না?
হ্যাঁ।
তাহলে বলুন কটা সিঁড়ি আছে?
এই পঁচিশ-ত্রিশটা হবে বোধ হয়।
উহু, একত্রিশটা সিঁড়ি আছে। তবেই দেখুন একই সিঁড়ির পথে আপনি ও আমি দুজনাই ওঠা-নামা করেছি। আমি সিঁড়ি-পথ দিয়ে আপনার মত কেবল ওঠা-নামাই করিনি, প্রথমবারেই ওঠবার সময় চারিদিকে ভাল করে সিঁড়িগুলোর অবস্থা দেখে মোট কতগুলো সিঁড়ির ধাপ আছে তাও গুনে নিয়েছি! এই হয়। আপনারা, কেবল সাধারণ লোকেরা দেখেনই, you only see but I observe! এইখানেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে তফাৎ। আমি বাড়িটার উপরতলার যাবতীয় খুটিনাটি সব বলতে পারি। চলুন রোদ চড়ে উঠেছে। এবারে ফেরা যাক।
চলুন।
দুজনে উঠে আবার প্রমোদভবনের দিকে চলতে শুরু করে।
কিরীটী এক সময় আবার পথ চলতে চলতেই কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, কথা হচ্ছিল আমাদের হত্যাকারীকে ধরতে পারবো কিনা? ধরতে পারবোই তবে বর্তমানে এখন আমার কেবল চারিদিক দেখবার ও কান পেতে শোনবার পালাই চলেছে। এরপর যা দেখবো শুনবো সব কিছু তার ভাবতে হবে এবং ভাবতে ভাবতেই আমার চোখের সামনে ক্রমে সব রহস্যের কুয়াশা ভেদ করে আলো ফুটে উঠবে যখন, তখনই আপনাকে আমি বলতে পারবো কবে ঠিক হত্যাকারীর কিনারা আমি করতে পারবো। তার আগে নয়।
আমাকে আপনার এই রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপারে সহকারিণী করে নেবেন মিঃ রায়?
বেশ তো। সহকারী যদি সত্যিকারের সহকারী হয় তাহলে কাজ করবার মধ্যেও যে একটা আনন্দ আছে।
কিরীটী হাসতে হাসতেই জবাব দেয়।
কিন্তু আমার সাহচর্য যদি আপনার কাজে বিঘ্ন ঘটায়?
বিঘ্ন ঘটাবে কেন? আপনার মনে যদি আমাকে আমার কাজে সত্যিকারের সাহায্য করবার ইচ্ছা থাকে তাহলে কি আর আপনি বিঘ্ন ঘটাবেন?
চলতে চলতে দুজনে প্রায় তখন প্রমোদভবনের মধ্যে এসে গিয়েছে। দুর থেকে দেখা গেল নায়েব গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পাশে লক্ষ্মীকান্ত দারোগা।
দুজনেরই দৃষ্টি একই সঙ্গে অদূরে গেটের সামনে দণ্ডায়মান লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও নায়েবের উপরে পতিত হল।
নায়েবের পাশে ঐ ভদ্রলোকটি কে মিঃ রায়? কল্যাণী কিরীটীকে প্রশ্ন করে।
চিনতে পারা তো কষ্ট নয় ভদ্রলোকটিকে মিস সান্যাল! কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
আপনি চেনেন না নাকি ওঁকে?
না, তবে ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে অনায়াসেই একটা অনুমান করে নিতে পারা যায় চেয়ে দেখুন। ভদ্রলোকের পরিধানে খাকি প্যান্ট ও খাকি হাফসাট।
তার থেকে কি প্রমাণ হলো?
প্রমাণ হচ্ছে এই যে, ভদ্রলোক বোধ হয় এখানকার থানা অফিসার, পুলিসের লোক।
বেশ তো আপনার যুক্তি! খাকি জামাকাপড় পরলেই পুলিসের লোক হবে নাকি? মিলিটারীর কোন লোকও তো হতে পারে?
এক্ষেত্রে তা নয় তার কারণ দুটো, এক নম্বর হচ্ছে মিলিটারী ড্রেস ঠিক অমনটি হয় না, দ্বিতীয়তঃ এই রকম জামায় ঐ পোশাক কেউ পরলে সে পুলিসের লোক হওয়ারই বেশী সম্ভাবনা
কথা বলতে বলতে ওরা দুজনে প্রায় লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও নায়েবের একেবারে কাছাকাছি ততক্ষণে এসে পড়েছে। নায়েব কথা বললেন কিরীটীকে সম্বোধন করে, এই যে মিঃ রায়, আসুন। বেড়াতে বের হয়েছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ।
আপনার জন্যেই ইনি অপেক্ষা করছেন। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি এখানকার থানা ইনচার্জ লক্ষ্মীকান্ত সাহা। আর এর কথা আপনাকে গতকাল আমি জানিয়েছিলাম চিঠি দিয়ে, ইনিই শ্রীযুক্ত কিরীটী রায়।
নমস্কার। লক্ষ্মীকান্ত কিরীটীকে নমস্কার জানায়।
নমস্কার। কিরীটী প্রতিনমস্কার জানাতে জানতে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তেরচাভাবে কল্যাণীর দিকে সকৌতুকে তাকায়।
কাল বসন্তবাবুর চিঠিতে আপনার এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আপনার সঙ্গে আলাপ করার লোভটা সম্বরণ করতে পারলাম না, মিঃ রায়। ছুটে এসেছি।
ধন্যবাদ। মৃদু নম্র কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
ওঁর মুখেই শুনলাম চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে নাকি তাঁর বাপের হত্যারহস্যের কিনারা করতে আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন?
না, এই তো সরে দিন দুই মাত্র এখানে এসেছি, এখনও তো সব চারিদিক ভাল করে দেখাশোনা করার সুযোগ পাইনি।
দেখাশোনা আর কি করবেন! লাশও তো সৎকার করে ফেলা হয়েছে। লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন।
তা তো ফেলতেই হবে, বাসি মড়া ঘরের মধ্যে রেখে আর লাভ কি বলুন? মিথ্যে কেবল দুর্গন্ধ ছড়াবে বই তো নয়! কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে আর দেখবেন কি?
যে কোন হত্যার ব্যাপারেই মৃতদেহটা তো শেষ পরিচ্ছেদ মাত্র লক্ষ্মীকান্তবাবু। প্রশ্নের অঙ্কের উত্তরমালা ছাপার অক্ষরে একটা সংখ্যাত্তর মাত্র। কিন্তু উত্তরটা জানলেই তো আর অঙ্কটা কষা যায় না। কি বলেন? হাসতে হাসতে কিরীটী কথাটা বলে।
কিরীটীর হেয়ালি ভরা কথাগুলোর সঠিক অর্থ একেবারেই লক্ষ্মীকান্তর হৃদয়ঙ্গম হয় না। তথাপি সে জবাব দিতে পশ্চাৎপদ হয় না।
তা যা বলছেন, তবে কি জানেন মিঃ রায়, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে বেশ একটু জটিলই।
কেন বলুন তো?
কারণ এখানকার কোন স্থানীয় লোকই চৌধুরী মশাইকে হত্যা করেনি
তাই বুঝি!
নিশ্চয়ই, সে সম্পর্কে কোন ভুলই নেই। Some outsiders—আর আপনি কি মনে করেন খুন করার পর আর সে বেটা এ সহরের চতুঃসীমানায় আছে? সঙ্গে সঙ্গেই পগারপার হয়েছে।
হ্যাঁ।
তা হলেই বুঝুন। নচেৎ আমিই কি এত সহজে হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম নাকি! এতক্ষণে বেটাকে নিয়ে হাজতে পরতাম না!
চলুন না, ভিতরের ঘরে বসেই কথাবার্তা হবেখন। কথাটা বললেন নায়েব।
তাই চলুন। লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন।
নায়েব বসন্ত সেনেরই আহ্বানে অতঃপর সকলে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে নায়েবের কক্ষমধ্যেই এসে চকূলেন।
বসুন দারোগা সাহেব, কিরীটীবাবু, বসুন। মা-লক্ষী, তুমিও বোস। সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে বসন্ত সেন সকলকেই বসবার জন্য আহ্বান জানালেন।
সকলে উপবেশন করে।
একটু চা হবে তো দারোগা সাহেব? লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন প্রশ্ন করলেন।
চা! তা না হয় আনান!
বসন্ত সেন বোধ হয় চায়ের যোগাড় দেখতেই অন্দরের দিকে চলে গেলেন।
কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে এবার লক্ষ্মীকান্তই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না? আপনি?
কল্যাণী বোধ করি নিজের পরিচয়টা নিজেই দিতে যাচ্ছিল, কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, উনিও এখানে নবাগতা, মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছেন। সবিতা দেবীর মামাতো বোন। কল্যাণী সান্যাল।
মামাতো বোন! কই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কোন শ্যালক আছেন বলে তো সেদিন সবিতা দেবী কিছু বললেন না?
এবার জবাব দিল কল্যাণী নিজেই, মামাতো বোনই বটে, তবে তাঁর সঙ্গে ঠিক রক্তের কোন জোরাল সম্পর্ক নেই। আমার বাবা নিত্যানন্দ সান্যাল পিসিমার দূরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। এবং শুনেছি আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুরমার কাছেই নাকি তিনি মানুষ। আমাদের বাড়ি থেকেই পিসিমার বিবাহ হয়েছিল।
বেশ সহজ পরিষ্কার কণ্ঠে কল্যাণী লক্ষ্মীকান্তকে কথাগুলো বলে গেল। কল্যাণীর জবাব দেবার ভঙ্গী ও কথার চমৎকার বাঁধুনি কিরীটীকে কল্যাণীর প্রতি শ্রদ্ধান্বিতই করে তোলে। সংক্ষেপে সে লক্ষ্মীকান্তর যাবতীয় প্রশ্নেরই তখন উত্তর দিল।
লক্ষীকান্ত দারোগাও কল্যাণীর জবাবে তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না।
এমন সময় দেওয়ান বসন্তবাবু, আবার ঘরের মধ্যে ফিরে এলেন।
নায়েবকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে লক্ষ্মীকান্ত তাঁকেই এবারে প্রশ্ন করলেন, সেই ছোকরাটি, সত্যজিৎ না কি নাম, চৌধুরী মশাইয়ের বন্ধুপুত্র— চলে গিয়েছেন নাকি?
না, তিনি এখনো এখানেই আছেন। তাঁকে ডাকবো নাকি?
না, ডাকতে হবে না। হ্যাঁ ভাল কথা কিরীটীবাবু, আপনার পরিচয় হয়নি সেই ছেলেটির সঙ্গে?
কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়, হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি। কেন বলুন তো!
না, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম, ছেলেটিকে আপনার কেমন বলে মনে হয়?
চমৎকার! A perfect gentleman!
ভৃত্য একটা ট্রেতে করে চার পেয়ালা চা নিয়ে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।
তিনিই বোধ হয় সবিতা দেবীকে পরামর্শ দিয়ে আপনাকে এখানে আনিয়েছেন।
কিরীটী এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারে, হঠাৎ তার সত্যজিৎ সম্পর্কে ঐ ধরনের প্রশ্নটা করবার উদ্দেশ্য কি। লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে দুএকটি কথা বলবার পরই কিরীটী লক্ষ্মীকান্ত-চরিত্র সম্পর্কে কতকটা আন্দাজ করে নিতে পেরেছিল এবং এটাও সে বুঝতে পারছিল, স্পষ্টাস্পষ্টি ভাবে না জানালেও লক্ষ্মীকান্ত তার এখানে আগমনটা বিশেষ সুনজরের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। এ জগতে একশ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেদের অধিকারের সীমানা বা চৌহদ্দির মধ্যে তৃতীয় কোন ব্যক্তির মাথা গলানোটা আদপেই ভাল দৃষ্টিতে বা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কিরীটী মনে মনে একটু হাসে এবং অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্তর প্রশ্নের জবাব দেয়।
কতকটা তাই বটে, আবার সম্পূর্ণ সেটা না-ও বটে। কারণ সবিতা দেবীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেই বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, কারো কথা চট করে যে মাথা পেতে মেনে নেবেন ঠিক সে শ্রেণীর মেয়ে তিনি নন।
লোকচরিত্র সম্পর্কেও তো দেখছি বেশ আপনার অভিজ্ঞতা আছে কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ, লোকচরিত্র নিয়েই যখন কারবার করতে হয়, সে সম্পর্কে একটুআধটু জ্ঞান না থাকলে কি করে চলে বলুন? কিন্তু সেকথা যাক, লক্ষ্মীকান্তবাবু। আপনি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এতে যে কি আনন্দিত হলাম! আপনিই এলেন, নচেৎ গতকালই ভাবছিলাম আপনার সঙ্গেই যে সর্বাগ্রে আমার একবার দেখা করা প্রয়োজন–
কেন বলুন তো?
বলতে গেলে আপনিই তো এই শহরের দণ্ডমুখের খোদ মালিক। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে যা কিছু investigation তো আপনার দ্বারাই হয়েছে। কাজেই এর রহস্যের তদন্তে নামতে হলে আপনার সাহায্য ও উপদেশটাই তো সবপ্রথম কথা।
কিরীটীর কথা বলবার ভঙ্গিতে কল্যাণী এমন কি বসন্ত সেন পর্ন্তত ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারে না। কিরীটীর গণনায় ভুল হয়নি। সাপের মুখে ধুলো পড়ার মতই কাজ হলো, লক্ষ্মীকান্তর চক্ৰ গুটিয়ে এলো। বিনয় বিগলিত কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্ত জবাব দিলেন, হেঁ! হেঁ! কি যে বলেন আপনি কিরীটীবাবু? তবে হ্যাঁ, কেসটা জটিল হলেও আমার দিক থেকে যথাসম্ভব সাহায্য আপনি পাবেন।
পাবো বলেই তো আশা করে আছি। নচেৎ কোন দুঃসাহসে এ কেসটা আমি হাতে নিয়েছি বলুন তো?
কিন্তু দারোগা সাহেব, এদিকে চা যে জুড়িয়ে গেল! কথাটা বললে কল্যাণী।
ওঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক ঠিক। লক্ষ্মীকান্ত হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে একটা কাপ নিতে নিতে বললেন, এ কি, তিন কাপ চা যে!
কথাটার জবাব দেয় কিরীটীই, একটা কাপ ঐ সঙ্গে হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে নিতে, নায়েব মশাইয়ের বোধ হয় চা তেমন চলে না!
এবারে জবাব দিলেন নায়েবই, হ্যাঁ। এ-যুগের লোকদের মত চা-টা তেমন আমার ঠিক সহ্য হয় না। কিরীটীবাবু, ঠিকই বলেছেন।
চা খান না! আশ্চর্য তো! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত।
না। সকালে বিকালে চায়ের বদলে আমি এক লাস করে দুধ পান করি।
হ্যাঁ, ওঁর আমাদের মত বোধ হয় অসার বস্তুতে তেমন পক্ষপাতিত্ব নেই। উনি একেবারে খাঁটি ও সার বস্তুরই প্রিয়। হাসতে হাসতেই কিরীটী কথাটা উচ্চারণ করে এবং হাসতে হাসতেই কথাটা বললেও, আড়চোখে বসন্ত সেনের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে কিরীটী ভোলে না। নায়েবের চোখের তারা দুটো যেন বারেকের জন্য একবার ঝিকিয়ে উঠে আবার স্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেল, সেটুকুও তার নজর এড়ায় না।
বাইরে এমন সময় চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল। এবং সেই সঙ্গে গলাও শোনা গেল, বসন্ত ভায়া, কোথায় হে?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি যুগপৎ খোলা-পথের দিকে পতিত হয়।
এই যে সান্যাল মশাই আসুন। আসুন-আমি এই ঘরেই আছি। উদার কণ্ঠে আহ্বান জানালেন বসন্ত সেন।
১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল
কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন পরক্ষণেই। পরিধানে একটা সাদা ধুতি, গায়ে একটা মের্জাই। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।
আসুন সান্যাল মশাই। এদের সঙ্গে আপনার পরিচয়টা করিয়ে দিই। ইনি শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীকান্ত সাহা, এখানকার থানার বড়বাবু। ইনি মিঃ কিরীটী রায় রহস্যভেদী—আর ইনি—
নমস্কার, আসুন। আপনার পরিচয় আগেই আপনার কন্যা দিয়েছেন। লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের বক্তব্যে বাধা দিয়ে কথাটা বললেন।
বটে! বটে! মা কালই বুঝি আগেই আমার পরিচয় দিয়েছে? কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে বাপের পরিচয়—সেটা তো ঠিক পরিচয় পাওয়া হলো না দারোগা সাহেব! কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন সান্যাল।
কেন বলুন তো? প্রশ্ন করলেন লক্ষীকান্ত।
কেন আবার! অতিশয়োক্তিতে সে পরিচয় যে অনিবার্য ভাবেই দুষ্ট হবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকালে উঠে কোথায় গিয়েছিলে মা-জননী? আমার এখনো উপাসনা সমাপন হয়নি। প্রভাত-উপাসনার ব্যবস্থাটা করে দাও তো গিয়ে মা
এখনি যাচ্ছি বাবা। সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। কতকটা যেন লজ্জিত ভাবেই কথা কটি বলে কল্যাণী কক্ষ হতে একটু দ্রুতই নিক্রান্ত হয়ে গেল।
আপনি কালই এখানে এসে পৌচেছেন শুনলাম! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ। সংবাদপত্রে সব জানা মাত্রই চলে আসতে হলো। আপনার বলতে আজ আমি ছাড়া মেয়েটার আর কেউই তো নেই। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। ছেলেবয়সে মাকে হারাল, ত্রিসংসারে একমাত্র ছিল ঐ বাপ, তাকেও হারাল। খেদপূর্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সান্যাল মশাই।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের একজনও কেউই সান্যাল মশাইয়ের কথার কোন জবাব দিল না।
সকলেই নিঃশব্দে বসে রইল।
নিত্যানন্দই আবার কথা বললেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো দারোগা সাহেব! এ যে একেবারে অসম্ভব, অবিশ্বাস্য! এই অজ শহর, এখানেও এসব ঘটে! কিরীটীবাবু, কথা বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর দিকে ঘরে তাকিয়ে সান্যাল তাঁর বক্তব্যের শেষটুকু কিরীটীর উদ্দেশ্যেই যেন ব্যক্ত করলেন, আপনি তো শুনলাম একজন নামকরা বিচক্ষণ গোয়েন্দা, আপনিই বলুন না?
অসম্ভব হলেও ব্যাপারটা এইখানেই তো ঘটেছে মিঃ সান্যাল! জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
কিন্তু কে হত্যা করলো? আর তাকে হত্যা করেই বা কি লাভ?
দ্বিতীয় প্রশ্নটার আপনার জবাব পেলেই তো আপনার প্রথম প্রশ্নটার জবাবটাও আমরা পেয়ে যাই সান্যাল মশাই! এবারে জবাব দিল কিরীটীই, এবং সেটাই তো এক্ষেত্রে আমাদের তদন্তের মূল ব্যাপার!
কি জানি কিরীটীবাবু, ঘটনাটা সংবাদপত্র মারফৎ পড়া অবধিই যেন আমি একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন—
আমি চৌধুরীকে তো বেশ ভাল করেই জানতাম, অমন চরিত্রবান সহৃদয় লোক হয় না আজকালকার দিনে বড় একটা। তারপর কতকটা যেন স্বগত ভাবেই বললেন, দয়াময়, সবই তোমার লীলা প্রভু!
আমাদেরও তাই বক্তব্য সান্যাল মশাই। কিরীটী আবার কথা বলে, এ দুর্ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে এবং সেটা থাকতেই হবে। বিনা উদ্দেশ্যে বা বিনা কারণে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনো সংঘটিত হয় না। হতে পারে না। আপনি, বসন্তবাবু, আপনার দীর্ঘদিন ধরে নিহত মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে জানতেন। তাঁর সম্পর্কে আপনারা আমাদের যত সংবাদ দিতে পারবেন আর কারো পক্ষেই সেটা সম্ভবপর হবে না। এবং এ-ও সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে থেকেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বা মলবান সত্রের সন্ধান পাই যার সাহায্যে এই ধরনের তদন্ত-ব্যাপারে মীমাংসাটা সহজ ও সরল হয়ে আসে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কিরীটীবাবু, সান্যাল বলতে লাগলেন, এমন কোন ঘটনাই কই চৌধুরী সম্পর্কে আমার মনে পড়ছে না যেটা আপনাদের বললে আপনারা এ ব্যাপারে আলোর সন্ধান পাবেন, যে ঘটনাকে তার এইভাবে নিহত হবার সামান্যতম কারণ বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলেও আপনার যদি আমাকে বলেন ঠিক কি আপনারা জানতে চান চৌধুরী সম্পর্কে, তাহলে জানা থাকলে বলতে পারি কারণ সে যে আমার কতখানি আপনার ছিল সে একমাত্র আমিই জানি। আমার কোন মার পেটের বোন ছিল না কিরীটীবাবু। হেম আমার দূর-সম্পর্কীয় মামাতো বোন হলেও সহোদরারও অধিক ছিল। একই মায়ের স্নেহের অঞ্চলে সে ও আমি বর্ধিত হয়েছি। সে যে আমার কত খানি ছিল, বলতে বলতে প্রৌঢ় সান্যালের গলার স্বরটা রুদ্ধ হয়ে আসে— দুই চক্ষুর দৃষ্টি অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে ওঠে।
সান্যালের শেষের কথাগুলোতে কক্ষের আবহাওয়াটা যেন কেমন করুণ হয়ে ওঠে।
সান্যাল তাঁর ধুতির প্রান্ত দিয়ে উদগত অশ্রুকে মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, উনিশ বৎসর পূর্বে হঠাৎ একদিন কলকাতা থেকে চৌধুরীর চিঠিতে যখন জানলাম হেমের মৃত্যু হয়েছে, সে আর ইহজগতে নেই, সেদিনের কথা আমি ভুলবো না কিরীটীবাবু। হেমের অসুখের সংবাদ পূর্বেই চৌধুরীর চিঠিতে পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু সে যে অত শীঘ্র আমাদের মায়া কাটিয়ে তার এত সাধের সাজানো ঘর ফেলে ঐ বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে এ যেন সত্যিই আমার স্বপ্নাতীত ছিল। হেমের মৃত্যুর পর দুবার মাত্র এখানে আমি এসেছি। —এ বাড়িতে পা দিলেই যেন হেমের শত সহস্র স্মৃতি আমার কণ্ঠ টিপে ধরেছে, তাই হাজার ইচ্ছা হলেও এদিকে আর পা বাড়াইনি। আর পা দিয়েই বা কি হবে বলুন! যার সঙ্গে সম্পর্ক সে-ই যখন রইল না! আর চৌধুরীর কথাই বা কি বলবো, কি যে ভালবাসত ও হেমকে! হেমের অসময়ে মৃত্যুতে ও যেন একেবারে হঠাৎ অল্প বয়সেই দেহ ও মনে স্থবির হয়ে পড়েছিল। বাইরে থেকে অবশ্য বুঝবার উপায় ছিল না, ভিতরে ভিতরে একেবারে শুকিয়ে। যেন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটী ও বসন্ত সেনের মধ্যে একবার দৃষ্টি-বিনিময় হয় চকিতে, যখন সান্যাল হেমপ্রভার মৃত্যুর কথা বলছিলেন। কিন্তু কিরীটী বা বসন্ত সেন দুজনার কেউই সান্যালের কথার মধ্যে কথা বলে তাঁকে বাধা দিল না। সান্যালের বক্তব্য শেষ হতেই সহসা কিরীটী বলে ওঠে, একটা কথা সান্যাল মশাই, একটু আগে আপনার ভগ্নী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যে কথাটা বললেন, মানে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, তাই কি?
বিস্মিত সান্যাল কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
কিন্তু কানাইয়ের মার মুখে হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে সেটা কিন্তু, কিরীটী শেষটুকু বলতে বোধ হয় ইতস্ততই করে।
সান্যাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, কি শুনেছেন?
হেমপ্রভা দেবীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি এবং সকলে যা জানে কলকাতায়ও তাঁর মৃত্যু ঘটেনি।
সে কি! একই সঙ্গে বলতে গেলে প্রায় কথাটা উচ্চারণ করলেন সান্যাল ও দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
নিষ্ঠুর সত্যকে এবার অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবেই যাচাই করার প্রয়োজন। এতকাল যা ঘন রহস্যের অন্তরালে সকলের অজ্ঞাত ছিল আর তা থাকবে না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য অতীতের আর এক রহস্যকে লোকচক্ষুর সম্মুখে উন্মোচিত করল যেন অতর্কিতেই।
কালের বিধান।
কালস্রোতে যা নিশ্চিহ্ন হয়ে ধুয়ে-মুছে একবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলেই সকলে ভেবেছিল, আজ আবার কানাইয়ের মা তাকে বর্তমানের মধ্যে এনে উপস্থিত করেছে।
ক্ষণপূর্বে উচ্চারিত কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
কারো কণ্ঠ হতে এতটুকু স্বরও নির্গত হয় না।
বারেকের জন্য চকিত দ্রুত দৃষ্টি সঞ্চালনে কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল।
হ্যাঁ, গতকাল সেন মশাইয়ের সঙ্গেও ঐ কথারই আলোচনা আমরা করেছিলাম—কিরীটী আবার বলে।
এ কথা কি সত্য বসন্ত? এবারে প্রশ্ন করলেন সান্যাল বসন্ত সেনকে।
না, সত্য নয়। কঠোর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নায়েব প্রত্যুত্তর দিলেন।
নায়েব মশাই, কোন কিছু আপনার অজ্ঞাত বলেই তাকে একমাত্র সেই যুক্তিতেই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না। কালও আপনাকে এটুকুই বলবার চেষ্টা করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, কানাইয়ের মা মিথ্য বলেনি।
ডাক তো বসত ভায়া একবার ঐ ঝি কানাইয়ের মাকে। কথাটা বললেন সান্যালই এবারে।
হ্যাঁ, তাই ডাকুন, সত্যিই যদি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর ব্যাপারে কোন রহস্য থেকেই থাকে সেটাকে অতি অবশ্য যাচাই করা প্রয়োজন। লক্ষ্মীকান্ত যেন অতি উৎসাহের সঙ্গে কথাটা বললেন।
গোবিন্দ এই গোবিন্দ! বসন্তবাবু দরজার বাইরে গিয়ে ভৃত্য গোবিন্দকে ডাকলেন।
একটু পরেই গোবিন্দ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো, বাবু!
কানাইয়ের মাকে একবার ডেকে দে তো। যা শীগগির পাঠিয়ে দে এ ঘরে। গোবিন্দ আদেশ পালনের জন্য চলে গেল।
কিন্তু কানাইয়ের মার কথার সত্যতা যাচাই করার চাইতেও ঢের বিস্ময় সকলের জন্য অপেক্ষা করছিল, যখন গোবিন্দ এসে সংবাদ দিল সকাল থেকে কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আবার কিরে! ভাল করে। খোঁজ নিয়ে দেখ। কোথায় যাবে বুড়ী!
তীক্ষ্ণ রাগত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন বসন্ত সেন।
আজ্ঞে ভাল করেই দেখেছি। ঠাকুর আর বনমালীও বললে, সকাল থেকে অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি—
ঠিক এমনি সময় প্রথমে সবিতা ও তার পশ্চাতে সত্যজিৎ কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করলে।
সবিতার চোখমুখে একটা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সবিতা সকলকে সেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত দেখে, এমন কি দারোগা লক্ষীকান্ত সাহাকেও সেই ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট দেখে প্রথমটায় যেন একটু ইতস্ততই করে কিন্তু পরক্ষণেই সে সঙ্কোচটুকু কাটিয়ে উঠে ব্যগ্র কণ্ঠে বসন্ত সেনের দিকে তাকিয়েই বলে, নায়েব কাকা, সকাল থেকে এ বাড়ির মধ্যে কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
একটা জলজ্যান্ত মানুষ রাতারাতি কোথায় উধাও হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই কৈাথাও না কোথাও আছে। আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখতে বলছি মা গোবিন্দকে। জবাব দিলেন বসত সেন।
এতক্ষণ কিরীটী একটা কথাও বলেনি। একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে কথা বললে, কানাইয়ের মা কোন ঘরে শুতো?
নীচের তলায় চাকরদের ঘরের পাশের একটা ঘরে। জবাব দিল সবিতা।
চলুন তো, একবার ঘরটা ঘুরে দেখে আসি। কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টিতে তাকে অনুসরণ করতে বলে খোলা দরজার দিকে সর্বপ্রথম এগিয়ে গেল। এবং দরজার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে লক্ষী কান্তকে সম্বোধন করে বললে, আসুন লক্ষ্মীকান্তবাবু, চলুন আপনিও এক বার দেখবেন না ঘরটা?
হ্যাঁ চলুন। লক্ষ্মীকান্তও অতঃপর তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন।
বসন্ত সেনও অনুসরণ করলেন ওদের।
বারান্দাটা অতিক্রম করে প্রশস্ত একটা বাঁধানো আঙ্গিনা। আঙ্গিনার দক্ষিণ প্রান্তে পর পর তিনটে ঘর। তারই একটা ঘরে কানাইয়ের মা সবিতারা এখানে আসবার পর থেকে রাত্রে শুচ্ছিল। ওদের এখানে আসবার পূর্বে অবশ্য কানাইয়ের মার জিনিসপত্র ঐ ঘরের মধ্যে থাকলেও, উপরের তলার একটা ঘরেই শুতো সে। পাশের দুখানা ঘরের একটায় থাকে বনমালী, অন্যটায় গোবিন্দ ও ঠাকুর!
নাতিপ্রশস্ত ঘরখানি। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। সবিতাই ঘরের সামনে এসে ঘরটা দেখিয়ে দিতে সর্বাগ্রে কিরীটীই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র বিশেষ কিছু তেমন নেই! একধারে একটা টিনের পুরাতন রং-চটা ট্রাঙ্ক, ছোট একটা মিলারের চ্যাপ্টা তালা লাগানো। তারই পাশে একটা মাটির কলসী ও তার উপরে পরিষ্কার কাঁসার লাস উবড় করা।
দেওয়ালের গায়ে গায়ে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টানিয়ে খানকয়েক সাদাকাপড় পরিষ্কার শাড়ি ঝোলানো আছে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একবার চারিদিকে তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে পর পর যে দুটি বদ্ধ জানালা ছিল সে দুটি খুলে দিল।
এক ঝলক হাওয়া ও আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। জানালা দুটো বিলের দিকে। জানালা খুললেই দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিলের জল চোখে পড়ে।
কিরীটী শয্যাটার দিকে এগিয়ে গেল। শয্যার মলিন চাদরটা জায়গায় জায়গায় কুচকে আছে এবং মাথার বালিশটা বিছানার একধারে পড়ে আছে।
অতঃপর কিরীটী ঘরের মেঝেটা তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে এক জায়গায় বসে পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেটার সাহায্যে কি যেন দেখতে লাগল।
অন্যান্য সকলে কৌতুহলী হয়ে কিরীটীর পশ্চাতে এসে দাঁড়ায়।
মিনিট দেড়েক বাদে কিরীটী আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সবিতার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, কানাইয়ের মা তো বিশেষ করে আপনার কাজ-কর্মই দেখাশোনা করত, তাই না?
হ্যাঁ। ইদানীং বয়স হওয়ায় তাকে বিশেষ কাজকর্ম তো করতে দেওয়া হতো না। নিজের খুশিমত যা টুকটাক কাজ একটু-আধটু করত।
কাল রাত্রে শেষবারের মত তাকে কখন আপনি দেখেন?
রাত এগারটার কিছু পরে সে আমার কাছ থেকে চলে আসে।
আজ সকালে কখন সর্বপ্রথম জানতে পারেন যে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না?
এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। রোজ সকালে সে আমার জন্য চা নিয়ে যেত, আজ যায়নি দেখে খোঁজ করতেই তো বনমালী এসে আমাকে বললে কানাইয়ের মাকে পাওয়া যাচ্ছে না খুঁজে।
বনমালী কোথায়?
বনমালীকে ডেকে আনা হল ঘরের মধ্যে।
এই যে বনমালী, তুমি কোন্ ঘরে গতকাল রাত্রে শুয়েছিলে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
এই ডানদিককার পাশের ঘরটাতে বাবু।
আজ সকালে তোমার দিদিমণি খোঁজ করবার আগে কানাইয়ের মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, জানতে না?
আজ্ঞে না। খুজতে এসেই তো দেখলাম এ ঘরে সে নেই।
কাল রাত্রে শেষ কখন তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?
খাওয়ার সময় রাত্রে, তখন সাড়ে দশটা হবে—
তারপর?
আজ্ঞে তারপর আমি ঘুমোতে চলে আসি ঘরে, আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি কাল রাত্রে।
রাত্রে কোন রকম শব্দ শুনেছিলে এ ঘরে?
না।
খুব ঘমিয়েছিলে বুঝি?
আজ্ঞে। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল—
ঠাকুর কোথায়? তাকে একবার ডেকে আন তো! বনমালী গিয়ে রন্ধনশালা হতে ঠাকুরকে পাঠিয়ে দিল।
বছর ত্রিশ-পয়ত্রিশ বয়সে হবে লোকটার। ঢ্যাঙা রোগা চেহারা। গায়ের। রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। গালের হনু দুটো বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। পুরু কালো ঠোঁট। উপরের পাটির দাঁত বিকশিত হয়েই আছে। লোকটার স্বভাব বোধ হয় বেশ পরিচ্ছন্ন। পরিষ্কার একটা খাটো ধুতি পরিধানে। গলায় লম্ববান ধবধবে একগুচ্ছ পৈতা।
তুমিই এ বাড়িতে রান্না কর? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আইজ্ঞা কর্তা।
কি নাম তোমার?
আইজ্ঞা অধীনের নাম যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাঢ়ী শ্রেণী।
বাড়ি কোথায়?
আইজ্ঞা সোনারাং।
কত দিন আছ এ বাড়িতে?
তা আপনাগোর আশীর্বাদে ধরেন গিয়া এক বৎসর তো হইবই।
তুমি এই পাশের ঘরেই শোও তো?
আইজ্ঞা।
কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কাল রাত থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জান?
আইজ্ঞা কি কইলেন? কানাইয়ের মায়েরে খুইজা পাওয়া যাইতেছে না। কন কি! যাইবো কনে? এহানেই কোথায় হয়ত হইবো। খুইজা দেখুম?
১৩. সকলে আবার নায়েবের ঘরে
সকলে আবার নায়েবের ঘরে ফিরে এলো।
কানাইয়ের মার অতর্কিত অন্তর্ধানের ব্যাপারটা যেন সকলকেই একেবারে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিয়েছে।
রাতারাতি কোথায় যেতে পারে কানাইয়ের মা?
শহর এখান থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে। সে যদি নিজের ইচ্ছাতেই চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এই পাঁচ মাইল পথ রাত এগারটার পর কোন এক সময় এখান থেকে বের হয়ে অতিক্রম করে গিয়েছে।
কালকের সেই বৃষ্টি-বাদলের অন্ধকার রাত্রে যদি সে স্বেচ্ছায় গিয়েও থাকে, তাহলেও খুব বেশী দূর এখনও যেতে পারেনি নিশ্চয়ই।
আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহলে!
অত্যন্ত দ্রুত কিরীটী আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে একবার চিন্তা করে বিশ্লেষণ করে নেয় বোধ হয়।
এ কথা অবশ্য ঠিকই, হয় কানাইয়ের মা স্বেচ্ছায় এ-বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে, নচেৎ হয়ত যেতে হয়েছে। অথবা এবাড়ি থেকে তাকে কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
চলে গিয়েই যদি থাকে সে এ-বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায়! কিন্তু কেন যাবে? কি এমন কারণ থাকতে পারে তার যাবার?
যদি যেতে বাধ্য হয়ে থাকে! হয়ত সেটা অসম্ভব নয়।
আর যদি তাকে এখান থেকে সরানো হয়ে থাকে! সেটাও অসম্ভব নয়। কারণ এ বাড়ির সে বহুদিনকার পুরাতন দাসী। এ পরিবারের সঙ্গে সে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। তার পক্ষে অনেক অতীত ঘটনার সাক্ষী হওয়া মোটেই তো অস্বাভাবিক নয়। এবং সেটা সকলের পক্ষে বাঞ্ছনীয় তো নয়ই, অভিপ্রেত বা সুখকরও নয়।
ধরেই যদি নেওয়া যায় তাকে সরিয়েই ফেলা হয়েছে কোন বিশেষ কারণে, তাহলে কত দূরে কোথায় তাকে সরানো হল?
রাতারাতি কত দূরে তাকে সরিয়ে ফেলা সম্ভবপর?
কিরীটী সহসা লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় দারোগাবাবু, কানাইয়ের মার ব্যাপারটা?
মাগী নিশ্চয়ই কোথাও চলে গিয়েছে।
চলে গিয়েছে কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, খুঁজে আর দেখতে হবে না। অনেক খোঁজা হয়েছে, তাকে পাওয়া যায়নি।
খোঁজেন খোঁজেন—ভাল কইরা খুজিয়া দেখেন, পাইবেনখন। যাইবো কনে! যাওনের জায়গা থাকলি তো যাইবো! পোড়াকপাইলা বুড়ীর চালচুলো কোথাও কি আছে নাকি! বেবাক গিইলা বইসা আছে না মাগী! ওই যা, ওদিকে ডাল বসাইয়া আইছি! সব বোধ হয় পুইড়া ছাই হইয়া গেল! নির্বিকার যোগেশ বোধ হয় রন্ধনশালার দিকে যাবার জন্যই দরজার দিকে পা বাড়ায়।
এই হারামজাদা, যাচ্ছিস কোথায়, দাঁড়া! সহসা যেন অতর্কিতে বাঘের মতই গজিয়ে ওঠেন লক্ষ্মীকান্ত দারোগা।
থমকে দাঁড়িয়ে যায় যোগেশ। এবং ফ্যালফ্যাল করে লক্ষমীকান্তর মুখের দিকে তাকায়।
যাচ্ছিস কোথায়? বাবু, যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দে!
যোগেশ কিন্তু লক্ষ্মীকান্তর কথার কোন জবাব দেয় না, কেবল তাকিয়ে থাকে নিশ্চপ হয়ে তাঁর মুখের দিকে।
শালার চোখমুখের চেহারা দেখেছেন কিরীটীবাবু? পাক্কা শয়তান! লক্ষ্মীকান্ত কথাটা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে।
গালিগালাজ দেন ক্যান? কি করছি আমি? যোগেশ দারোগা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
না, গালাগালি দোব না, তোমায় পাদ্যার্ঘ্য দেব!
কি কইলেন? যোগেশ আবার প্রশ্ন করে।
যোগেশ, তুমি তো পাশের ঘরেই কাল রাত্রে শুয়েছিলে? এ ঘরে কাল রাত্রে কোন শব্দ শুনেছ? প্রশ্ন করে এবারে কিরীটী।
আইজ্ঞা শব্দ শুনুম ক্যামনে? ক্ষেন্তীর মায় কয়, আমি একবার নিদ্রা গেলে নাকি ঢাকের বাদ্যিও কানে আমার যায় না! তা আপনাগোর ছিচরণের আশীর্বাদে নিদ্রাটা আমার একটু গাঢ়ই।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও।
যোগেশকে অতঃপর বিদায় দেওয়া হল।
এখন আমার কি মনে হচ্ছে জানেন কিরীটীবাবু?
কি?
বুড়ী নিশ্চয়ই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে জড়িত ছিল। কোন কারণে বেগতিক দেখে পালিয়েছে; কিন্তু আমিও আপনাকে বলে রাখছি কিরীটীবাবু, আমারও নাম লক্ষ্মীকান্ত সাহা, চোদ্দ বছর দারোগাগিরি করছি। —ও হাঁ করলেই বুঝতে পারি। থানায় ফিরে গিয়েই চারিদিকে আমি লোক পাঠাবো। বেটী পালাবে কোথায়, হাতে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে এনে হাজতে ভরবো না! দেখুন না
কানাইয়ের মাকে ধরতে পারলে অবশ্য মন্দ হত না, তবে তাকে এত সহজে ধরা যাবে বলে মনে হচ্ছে না মিঃ সাহা!
এটা আমার এলাকা কিরীটীবাবু—আপনি নিশ্চিত থাকুন।
সহসা এমন সময় পাশের ঘর থেকে উগ্র কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল, গোবিন্দ! এই গোবিন্দ গোবিন্দ! এখনো চা দেবার সময় হল না বেটা তোদের?
লক্ষ্মীকান্ত নায়েবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে?
সন্তোষ চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় এডেন থেকে এসেছে। জবাব দিলেন। বসন্ত সেন।
লোকটা কে? আবার জিজ্ঞাসা করেন লক্ষ্মীকান্ত।
পরিচয় দিচ্ছে কর্তার জাঠতুত ভাইয়ের ছেলে—ভাইপো।
ভাইপো! কই, এর সম্পর্কে কোন কথা তো সেদিন আপনার মুখে বা সবিতা দেবীর মুখে শুনিনি।
আপনিও ওর আসবার পূর্বে ওর সম্পর্কে কোন কথাই শোনেননি? এবারে প্রশ্ন করে লক্ষ্মীকান্তই সবিতাকে।
না।
আপনার বাবা কোন দিন যে তাঁর জাঠতুত ভাই এডেনে থাকেন সে সম্পর্কে কোন কথাই আপনাকে বলেননি মিস চৌধুরী? প্রশ্ন করল এবারে কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে।
না। সবিতা এবারেও ঐ একই ছোট্ট সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়।
নায়েব মশাই, আপনি? আপনিও কোনদিন তাঁর মুখে শোনেননি তাঁর কোন জাঠতুত ভাই আছেন এডেনে, এ কথা? কিরীটী বসন্ত সেনের মুখের দিকে তাকিয়েই আবার প্রশ্ন করল।
শুনেছিলাম একবার কয়েক বছর আগে। কথায় কথায় একদিন তিনি বলেছিলেন, তাঁর এক জাঠতুত ভাই বিবাহের পর হঠাৎ বাপের সঙ্গে নাকি কি নিয়ে গোলমাল বাধায় কাউকে কিছু না জানিয়েই রাতারাতি বৌকে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান।
তারপর?
তারপর নাকি আর তাঁদের কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। চৌধুরীরাও তখন জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিলেন। রামশঙ্কর চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর পিতা পরষ্পর সহোদর ভাই ছিলেন। রামশঙ্করও তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র ছিলেন এবং মৃত্যুঞ্জয়ও ছিলেন তাঁর পিতার একমাত্র পুত্র। রামশঙ্করের গৃহত্যাগের পর দীর্ঘ এগার বৎসরেও যখন গৃহত্যাগী নিরুদিষ্ট পুত্র আর গৃহে ফিরে এলো না এবং হাজার চেষ্টা করেও বহু অর্থব্যয় করেও তাঁর বা তাঁর স্ত্রীর কোন সংবাদই পাওয়া গেল না তখন তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ভাগের সম্পত্তি স্বেচ্ছায় তাঁর একমাত্র ভ্রাতুষ্পত্র মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকেই দান করে যান কেবল একটি শর্তে যদি কোনদিন তাঁর গৃহত্যাগী পুত্র বা তাঁর বংশের কেউ ফিরে আসে, তাহলে তাঁর ভাগের সম্পত্তি তাকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেও আজ দীর্ঘ চৌত্রিশ বৎসর আগেকার ঘটনা।
এই ভদ্রলোক বলছেন তিনি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠভ্রাতার পুত্র? লক্ষ্মীকান্ত প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
কিন্তু তার প্রমাণ কিছু দিয়েছেন?
প্রমাণের কথা জিজ্ঞেস করায় বললে, প্রয়োজন হলে সে সব প্রমাণই কোর্টে দাখিল করবে। আমাকে সে কিছুই দেখাতে রাজী নয়। বসন্ত সেন লক্ষমীকান্তর প্রশ্নের জবাব দিলেন।
হুঁ। ডাকুন তো একবার ভদ্রলোকটিকে?
লক্ষ্মীকান্তর নির্দেশে নায়েব বসত সেন কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। এবং সোজা গিয়ে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন। নিদ্রাভঙ্গের পর সন্তোষ চৌধুরী শয্যার উপরে বসে আপন মনে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে মধ্যে মধ্যে সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ধূমোদগীরণ করছিল; নায়েবের পদশব্দে ভৃত্য বোধ হয় চা এনেছে ভেবে বললে, কই, চা এনেছিস?
কিন্তু কথাটা বলে সামনের দিকে তাকিয়ে ভৃত্যর বদলে স্বয়ং নায়েবকে দেখে ভ্ৰকুঞ্চিত করে বললে, এই যে, নায়েব মশাই যে! ব্যাপার কি বলুন তো, সত্যিই আমাকে এ বাড়ি থেকে তাড়াবার মতলব নাকি আপনার? সকালবেলা যে ভদ্রলোককে এক কাপ চা দিতে হয়, তাও কি এ বাড়িতে চাকররা জানে না?
ঠিক এমনি সময় কল্যাণী হাতে এক কাপ ধুমায়িত চা নিয়ে কক্ষের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
কল্যাণীকে সহসা চায়ের কাপ হাতে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখে উভয়েই কম বিস্মিত হয় না।
এ কি! আপনি চা নিয়ে এলেন কেন? চাকররা কোথায়? প্রশ্নটা করল সন্তোষই।
কল্যাণী মৃদু হেসে জবাব দিল, আপনার মেজাজের ভয়ে গোবিন্দ চা নিয়ে আসতে সাহস পেল না, তাই আমিই নিয়ে এলাম আপনার চা।
কল্যাণীর হাত হতে চায়ের কাপটা নিতে নিতে সন্তোষ যেন একটু লজ্জিতভাবেই বলে, হ্যাঁ, সকালবেলা চা না পেলে মেজাজটা আমার যেন কেমন বিগড়ে যায়।
কল্যাণী কিন্তু সন্তোষের কথায় আর কোন জবাব না দিয়ে অতঃপর ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল।
এইবারে নায়েব বসন্ত সেন বললেন, একটু তাড়াতাড়ি চা-টা শেষ করে নিন সন্তোষবাবু। আপনাকে ওঁরা পাশের ঘরে ডাকছেন।
কে ডাকছেন?
এখানকার থানার বড় দারোগা সাহেব।
দারোগা সাহেব! কিন্তু তাঁর সঙ্গে কি প্রয়োজন?
তা তো জানি না, তবে এখনি একবার আপনাকে ডেকেছেন।
আমি ডাকাতও নই, খুনীও নই। I have got no. business with any দারোগা সাহেব!
আপনার কোন বিজনেস না থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে। সহসা খোলা দ্বারপথে লক্ষ্মীকান্তর কণ্ঠস্বর শোনা গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ বসন্ত সেন ও সন্তোষ সামনের দ্বারপথের দিকে তাকাল।
শুধু একা লক্ষ্মীকান্ত সাহাই নয়, কিরীটী সবিতা ও সত্যজিৎও সঙ্গে আছে।
লক্ষ্মীকান্ত কথা বলতে বলতে সোজা একেবারে ঘরের মাঝখানে সন্তোষের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।
সন্তোষ রুক্ষ বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল আগন্তুক লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কর্কশকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কে আপনি? ভদ্রলোকের ঘরে সাড়া দিয়ে পারমিশান নিয়ে ঢুকতে হয়, এইটুকু জানেন না?
জানি কিনা সে পরে বিবেচনা করা যাবে মশাই। আপাততঃ আপনাকে আমার সঙ্গে এখুনি একবার থানায় যেতে হবে। বেশ সতেজ নির্দেশপূর্ণ কণ্ঠ লক্ষ্মীকান্তর।
থানায় যেতে হবে কেন? বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় সন্তোষ লক্ষ্মীকান্তর মুখের দিকে।
কারণ আপনি আমার এলাকায় বিদেশী, আমাকে না জানিয়ে প্রবেশ করেছেন।
তাই নাকি? বাংলাদেশের মধ্যেও গ্রামে ও ছোটখাটো শহরে পাসপোর্ট সিস্টেমের প্রচলন হয়েছে এ কথা তো কই শুনিনি?
দেখুন সন্তোষবাবু, কার সঙ্গে রসিকতা করছেন একটু ভেবে করবেন। আপনি আমার সঙ্গে এখনি থানায় যেতে রাজী কিনা বলুন?
যদি না যাই?
কেমন করে যাওয়াতে হয় আমি তা জানি। থানা থেকে কনেস্টেবল পাঠিয়ে দেব কি?
সন্তোষ গুম হয়ে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন কোথায় যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখবেন দারোগা সাহেব, এ অপমান আমিও এত সহজে হজম করে নেব না।
এখন তো চলুন, তারপর যা করবার করবেন। বলতে বলতে কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্মীকান্ত বললেন, কিরীটীবাবু, আপনিও আসুন। আপনার সঙ্গে আমার অনেক পরামর্শ আছে।
আমি ভাবছিলাম সন্ধ্যার দিকে আপনার ওখানে যাব। কিরীটী জবাব দেয়।
বেশ, তাই না হয় আসবেন। চলুন সন্তোষবাবু।
সন্তোষকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন।
১৪. লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা
লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা সন্তোষ চৌধুরীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে যেন একটা নাটকীয় সংঘাতের সষ্টি করে গেলেন।
ক্রমে দুজনের জুতোর শব্দ ঘরের বাইরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ সকলেই ঘরের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পর পর দুটি ঘটনা যেন অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই ঘটে গেল। প্রথমতঃ কানাইয়ের মার নিরুদ্দিষ্ট হওয়া, দ্বিতীয়তঃ লক্ষ্মীকান্তর কতকটা জোর করেই সন্তোষ চৌধুরীকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে যাওয়া।
ঘটনার পরিস্থিতিতে সকলেই যেন অল্পবিস্তর হকচকিয়ে গিয়েছে।
সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটীকে প্রশ্ন করল, লক্ষ্মীকান্তবাবু, কি সন্তোষবাবুকে arrest করে নিয়ে গেলেন নাকি মিঃ রায়?
না, না—তা কেন হবে, বোধ হয় ওঁকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে চান। সন্তোষবাবুর কাছ থেকে সহজে কোন কথা বের করা যাবে না বলেই বোধ হয় সঙ্গে করে থানায় নিয়ে গেলেন।
নায়েব বসন্ত সেন একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন অত্যন্ত যেন আকস্মিক ভাবেই। বসন্ত সেনের এভাবে অকস্মাৎ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়াটা সকলের কাছেই বেশ যেন একটু রূঢ় ও অপ্রত্যাশিত বলেই মনে হল এবং ঘটনার রূঢ়তাটুকু সবিতাকেই যেন লজ্জিত করে তোলে বিশেষ করে, কারণ বসন্ত সেনের কিরীটীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর ব্যাপার সবিতার দৃষ্টিকেও এড়ায়নি।
লজ্জিত ও সঙ্কুচিত সবিতার মনের অবস্থাটা কিরীটী তার মুখের ওপরে পলকমাত্র দৃষ্টিপাত করেই উপলব্ধি করতে পেরে স্মিত কণ্ঠে বলে, চলুন সবিতা দেবী, উপরে আপনার বাবা যে ঘরে শুতেন সে ঘরটা একবার ভাল করে দেখতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?
না, না—নিশ্চয়ই না, চলুন না। কিন্তু কানাইয়ের মার ব্যাপারটা যে কিছুই বুঝে উঠতে পরছি না মিঃ রায়। কোথায় গেল সে? সবিতার কণ্ঠ স্বরে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
সবিতার প্রশ্নে কিরীটী বারেকের জন্য মুখের দিকে তাকাল, তারপর অত্যন্ত শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, ভুল আমারই হয়েছে মিস চৌধুরী। পূর্বাহ্নেই আমার কানাইয়ের মার সম্পর্কে সাবধান হওয়া উচিত ছিল। সত্যিই আমি দুঃখিত।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী সবিতা কিরীটীর কথার তাৎপর্যটা বোধ হয় অতি সহজেই অনুমান করে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, কিরীটীবাবু, তবে কী
হ্যাঁ, হঠাৎ যদি হতভাগিনী কানাইয়ের মার মৃতদেহটা এই প্রমোদভবনের আশেপাশে কোথাও আবিষ্কৃত হয়ে যায় আশ্চর্য হব না এতটুকুও, তবে
কিরীটীর অসমাপ্ত কথার কতকটা জের টেনেই সবিতা প্রশ্ন করে, তবে মিঃ রায়?
না, থাক। মানুষের মন কিনা তাই খারাপটাই মনের মধ্যে সর্বাগ্রে এসে উঁকি দেয়। আপনার মা হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর ব্যাপারেও যে একটা রহস্য জড়িয়ে আছে, কথাটা এত তাড়াতাড়ি বোধ হয় আমাদের প্রকাশ করা উচিত হয়নি।
মিঃ রায়, তবে কি, কতকটা যেন আর্তকণ্ঠেই সবিতা কিরীটীকে কি একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে সহসা চুপ করে ব্যাকুল দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
সবিতা দেবী, অসংযত রসনা বড় মারাত্মক জিনিস। তাছাড়া আপনার হয়ত জানা নেই ইট-সিমেন্ট-সুরকির তৈরী ঘরের দেওয়ালেরও কান আছে। মানুষের মত তারাও শুনতে পায়। শুধু যে শুনতে পায় তাই নয়, কথাও অনেক সময় বলতে পারে। চলুন উপরে যাওয়া যাক। কিরীটী যেন বক্তব্যটা জোর করেই একপ্রকার শেষ করে দিয়েই অর্ধপথে খোলা দরজার দিকে পা বাড়ালে।
দরজার ঠিক মুখেই কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললে, বাবা, তোমার প্রভাতী উপাসনার যে সময় চলে গেল। কতক্ষণ তোমার উপাসনার সব ব্যবস্থা করে বসে আছি। উপাসনায় বসবে না?
সান্যাল ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, হ্যাঁ মা, চল যাই। দয়াময় প্রভু! বলতে বলতে সান্যাল অন্যান্য সকলকে অতিক্রম করে বেশ একটু দ্রুত পদবিক্ষেপেই এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন।
কল্যাণীও তার পিতাকে অনুসরণ করল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, একটা শাবল আর একটা কোদালের প্রয়োজন আমার মিস চৌধুরী। পাওয়া যাবে এখানে?
বিস্মিতা সবিতা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কোদাল আর শাবল! কি হবে তা দিয়ে?
কিরীটী হাসতে হাসতে জবাব দেয়, অতীতকে খুঁড়ে দেখবো!
অতীতকে খুড়ে দেখবেন?
হ্যাঁ। কে জানে হয়ত তক্ষশিলার মত অত্যাশ্চর্য ধংসাবশেষের সন্ধানও মিলতে পারে। কিন্তু জিনিস দুটো পাওয়া যাবে কি?
কেন যাবে না? গোবিন্দকে বললেই সে দেবেখন। কখন চাই আপনার ও দুটো।
আমার ঘরে রেখে দিতে বলবেন, সময়মত কাজে লাগাবো। কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
ইতিমধ্যে সিঁড়ি অতিক্রম করে সকলে প্রায় দোতলায় এসে পৌচেছে। সবিতা সকলের আগে, কিরীটী ও সত্যজিৎ পাশাপাশি অগ্রবর্তিনী সবিতাকে অনুসরণ করে।
চলতে চলতে চাপা নিম্নকণ্ঠে সত্যজিৎকে সম্বোধন করে কিরীটী বলে, কাল দুপুরের দিকে আপনাকে আমার একটু প্রয়োজন সত্যজিৎবাবু। সময় হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে।
বেশ।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর শয়নকক্ষ।
দরজায় তালা দেওয়া ছিল, সবিতা তার ঘর থেকে চাবিটা এনে তালা খুলে ঘরটা খুলে দিল। সবিতার এবারে এখানে আসা অবধি ঐ ঘরটায় সর্বদা তালা দেওয়াই থাকে, কেবল সন্ধ্যার কিছু আগে একবার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কানাইয়ের মাকে দিয়ে ঘরটা ঝাড়পোঁছ করে বাবার ফটোর নিচে একটা ধূপদানিতে ধূপ রেখে আসত।
মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরের মধ্যে যে জিনিসটি যেমন ভাবে সজ্জিত ছিল, এখনো অবিকল ঠিক তেমনটিই আছে। কোন কিছুই নাড়াচাড়া করা হয়নি বা ছোঁয়া হয়নি।
প্রথমে সবিতা কক্ষমধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল, তার পশ্চাতে কিরীটী ও সত্যজিৎ।
কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে বারেকের জন্য কিরীটী তার চিরাচরিত তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে চতুপার্শ্বস্থিত ঘরের যাবতীয় কিছু দেখে নিল নিঃশব্দে।
ঘরে ঢুকতেই সামনে দেওয়ালে যে এনলার্জড ছবিটি টাঙানো আছে— মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর শিশু বালিকা কন্যা সবিতা—অনুমানেই বুঝে নেয় কিরীটী।
ঠিক মুখোমুখি না হলেও ঘরের অন্য দিককার দেওয়ালে একটা সেকালের ভারী মেহগনী কাঠের পালিশ-করা দেরাজ। দেরাজ পুরাতন হলেও পালিশ যেন এখনো চক চক করছে। দেরাজের ঠিক উপরে একখানা এনলার্জ করা ছবি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো। ছবিটা বাঁধানো সোনালী রংয়ের সূক্ষ্ম কারকার্যমণ্ডিত মোটা চওড়া ফ্রেমে। ছবির মধ্যে দেখা যাচ্ছে বছর ২৪/২৫-এর এক নারীকে। চিনতে কষ্ট হয় না কিরীটীর এবারেও অনমানে, ঐ হেমপ্রভার প্রতিকৃতি—সবিতার জননী। ঠিক অবিকল যেন সবিতাই ছবির মধ্যে। মায়ের চেহারার, এমন কি চোখ-মুখ-কপালের হবহু আদলটি পর্যন্ত পেয়েছে। সবিতা তার জননীর।
ঘরের দক্ষিণ কোণে একটা ভারী কাঠের চৌকির উপরে বসানো একটা লোহার সিন্দুক।
সবিতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই চারটে জানালার কবাটই খুলে দিয়েছিল। ঘরটি এমন ভাবে তৈরী যে, প্রচুর আলো-হাওয়ার অবাধ গতিবিধি আছে।
বিলের দিকে দুটো জানালা ঘেষে একেবারে একটি উঁচু পালঙ্কের উপরে নিভাঁজ একটি শয্যা সবুজ বর্ণের বেডকভার দিয়ে ঢাকা।
একপাশে আলনায় খানকয়েক ধুতি জামা গোছানো। এবং আলনার নিচে দুই জোড়া জুতো।
ঘরের অন্যদিকে একটা ছোট সেক্রটারিয়েট টেবিল। টেবিলের উপরে কিছু কাগজপত্র ও খানকয়েক পুস্তক।
সামনেই একটা চেয়ার ছাড়াও একটা দেওয়াল-আলমারি, একটা দামী আরামকেদারা ও একটা জলচৌকি আছে ঘরে।
ঘরের দুটো দরজা—একটা প্রবেশের ও নির্গমনের, অন্য দরজাটা সামনে দিকে ছাদে যাতায়াতের জন্য।
ঐ দেওয়াল-আলমারি, সিন্দুক ও ড্রয়ারের চাবি আপনাব কাছেই তো সবিতা দেবী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। সবিতা একটা চাবির রিং কিরীটীর হাতে তুলে দিল, এই চাবির রিংয়েই সব চাবি পাবেন।
আচ্ছা মিস চৌধুরী, আপনার পিতা রাত্রে যখন নিদ্রা যেতেন, জানালাদরজা শুনেছি খোলাই থাকত! ছাদের ঐ দরজাটা, ওটাও কি ভোলাই থাকত, জানেন? কিরীটী সহসা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। যতদূর জানি, ঐ দরজাটাও রাত্রে তিনি খুলেই শুতেন। সবিতা জবাব দেয়।
সাধারণতঃ রাত কটা পর্যন্ত জেগে তিনি পড়াশুনা ও জমিদারী সংক্রান্ত কাজকর্ম করতেন?
শুতে প্রায়ই তাঁর বারোটা সাড়ে-বারোটা হয়ে যেত। সকালের দিকে তাই বোধ হয় তিনি একটু দেরিতেই উঠতেন।
কিরীটী প্রথমেই কথা বলতে বলতে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, সাধারণতঃ এই টেবিলে বসেই তো তিনি কাজকর্ম করতেন?
হ্যাঁ।
কিরীটী লক্ষ্য করে দেখে, টেবিলটার উপরে সূক্ষ্ম একটা ধুলোর পর্দা পড়ে আছে।
টেবিলটা ইদানীং কতদিন ঝাড়-পোঁছ করা হয়নি?
কানাইয়ের মাকে ও টেবিলটা ছুতে বারণ করে দিয়েছিলাম। এখানে আসবার পর আমি একদিন মাত্র টেবিলটা পরিষ্কার করেছিলাম।
কিরীটী নিঃশব্দে তাকিয়ে টেবিলটার উপরে যাবতীয় কিছু খুটিয়ে দেখছিল, সহসা তার নজরে পড়ল একটা লম্বা চুল টেবিলের কাঠের জোড়ের মুখে আটকে আছে।
চুলটা কৌতূহলভরে টেনে বের করল কিরীটী। লম্বা কোঁকড়ানো চুল। কোন নারীর কেশ একগাছি।
কিরীটী লম্বা কোঁকড়ানো কেশগাছি দুই হাতের আঙুলে ধরে টেনে টেনে দেখতে লাগল এবং মধ্যে মধ্যে সবিতার দিকে তাকাতে লাগল। কৌতুহলী সবিতা ও সত্যজিৎ একই সঙ্গে প্রশ্ন করে, কি কিরীটীবাবু?
একগাছি কেশ! বলতে বলতে পকেট হতে একটা কাগজ বের করে কেশগাছি সেই কাগজের মধ্যে রেখে সযতনে কাগজটা ভাঁজ করে পকেটের মধ্যে রাখতে রাখতে বললে, কই, এর মধ্যে বলুন তো কোন চাবিটা ড্রয়ারগুলোর?
চাবির রিংটা সবিতার হাতে দিতে দিতে সবিতা একটা লম্বা মোটা চাবি ড্রয়ারের গায়ে ঢুকিয়ে ড্রয়ারটা খুলে দিল।
এক এক করে সবিতার সাহায্যে কিরীটী দুই দিককার ছটা ড্রয়ারই খুলে তার ভিতরকার কাগজপত্র সব পরীক্ষা করতে লাগল। এবং কাগজপত্রগুলো দেখতে দেখতে একসময় একটা মোটা বোর্ডে বাঁধাই সুদৃশ্য অ্যালবাম টেনে বের করল। অ্যালবামটার মধ্যে অনেক ফটো আঁটা রয়েছে।
কিরীটী বিশেষ কৌতূহলের সঙ্গেই অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখে যেতে লাগল।
ফটোগুলো তোলা বোধ হয় অনেকদিন আগেকার। একটু লালচে রং ধরেছে প্রায় প্রত্যেক ফটোতেই এবং ফটোগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগই নানা জায়গার ফটো। ঘরবাড়ি, পুরাতন মন্দির, ফোর্ট, জলাশয়, রাস্তাঘাট, বাগানবাগিচা, কবর ইত্যাদির।
বেশীর ভাগই রাজপুতানার ফটো দেখছি! অ্যালবামটা কার সবিতা দেবী।
অ্যালবামটা এর আগে কখনও আমি দেখিনি; বোধ হয় বাবারই
আপনার বাবার ফটো তুলবার শখ ছিল বুঝি একসময়?
বলতে পারি না ঠিক। কখনও বাবাকে ফটো তুলতে আমি দেখিনি।
এককালে হয়ত তিনি খুব দেশভ্রমণ করেছেন। আপনার বাবার মুখে। কখনও দেশ ভ্রমণের গল্প শোনেননি মিস চৌধুরী?
না।
সাধারণতঃ আপনার বাবার সঙ্গে আপনার কি ধরনের কথাবার্তা হত?
এই আমার লেখাপড়া, আমার কলেজের কথা এই সবই আলোচনা করতাম আমরা। সবিতা জবাব দেয়।
হুঁ। অ্যালবামটা আমার কাছে আমি রাখতে পারি আপাততঃ?
বেশ তো, রাখুন না।
কিরীটী অতঃপর কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। কাগজগুলো দেখতে দেখতে একটা খামের মধ্যে খানকতক পুরাতন চিঠি যত্নের সঙ্গে লাল সুতো দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পেল।
চিঠিগুলো খুলে পরীক্ষা করতে গিয়ে কিরীটী একটু আশ্চর্যই হয়, চিঠিগুলো অনেকদিন আগেকার এবং হিন্দী ভাষায় লেখা।
হিন্দী ভাষায় দেবনাগরী অক্ষরে লেখা চিঠি!
খান-চার-পাঁচ চিঠি। চিঠিগুলো কিরীটী অ্যালবামটার মধ্যেই খাম সমেত রেখে দিল। সহসা একসময়ে কিরীটী শূন্য শয্যাটির দিকে তাকিয়ে সবিতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললে, যে রাত্রে আপনার বাবা নিহত হন, সে রাত্রে শয্যার উপর যে চাদর ও বেডকভার বিছানো ছিল সেগুলো কি বদল করা হয়েছে মিস চৌধুরী?
না। কেবল ঐ বেডকভারটা বিছানার উপর ছিল না, ওটা পরে আমি পেতে বিছানাটা ঢেকে রেখেছি।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বিছানার উপর থেকে বেডকভারটা টেনে তুলে ফেলে বিছানার চাদরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল।
একটা কথা সবিতা দেবী, যে রাত্রে আপনার বাবা নিহত হন, পরের দিন সকালে ঐ ছাদের দিকের দরজাটা কি খোলা দেখা গিয়েছিল?
তা তো বলতে পারি না! বনমালী হয়ত বলতে পারবে।
ঐদিন দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর কিরীটী একাকী তার ঘরের মধ্যে বসে একটা চেয়ারের উপরে সকালবেলা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে আনা ফটোর অ্যালবামটা আবার একবার উল্টেপাল্টে দেখছিল।
একটা পাতায় এসে দৃষ্টি যেন মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থির হয়ে থাকে।
একটি মন্দিরের চত্বরে দাঁড়িয়ে পূজারিণীর বেশে একটি অপরুপ সুন্দরী ১৯।২০ বৎসর বয়স্কা রাজপুতানী মেয়ে। ফটোটা অনেকদিনের পুরাতন হলেও এবং ফটোর বর্ণ অনেকটা ফিকে হয়ে এলেও মেয়েটির অপরুপ দেহশ্রী ও সৌন্দর্য এখনও একেবারে চাপা পড়ে যায়নি।
মেয়েটি হাসছে। পরিধানে ঘাগরা ও গায়ে ওড়না। বুকের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে দুটি বেণী।
সহসা বাইরে পদশব্দ শোনা গেল।
চমকে উঠে তাড়াতাড়ি হাতের অ্যালবামটা বন্ধ করে বিছানার তলায় রেখে দিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা অবশ্য ভেজানোই ছিল।
দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত শোনা গেল, আসতে পারি? কে, কল্যাণী দেবী! আসুন, আসুন। কিরীটী মৃদু আহ্বান জানাল। কল্যাণী এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
অপূর্ব সাজ পরেছে সে। পাঞ্জাবী মেয়েদের মত ঢিলা পায়জামা, পাঞ্জাবি ও রেশমী একটা উড়নী গলায় ভাঁজ করা।
বাঃ! চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু আপনাকে এই বেশে মিস সান্যাল! কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।
নিজেকে অত্যন্ত free মনে হয় এই পোশাকে।
তা তো হবেই। ওই বেশেই যে আপনি অভ্যস্ত। কিরীটী জবাব দেয়।
বোধ হয় তাই। কিন্তু একা একা ঘরের মধ্যে বসে আপনি করছিলেন কি?
বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? কিরীটী কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে বললে।
১৫. তাহলে বসেই পড়া যাক
তাহলে বসেই পড়া যাক, কি বলেন? সম্মুখের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে, হাস্যদীপ্ত কণ্ঠে কল্যাণী বললে।
হ্যাঁ বসুন।
ঘরের কোণে একটা শাবল ও ছোট কোদালের উপরে হঠাৎ নজর পড়ে কল্যাণীর। বিস্মিত দৃষ্টিতে বস্তু দুটির দিকে তাকিয়ে কল্যাণী প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কি? কোদাল আর শাবল দিয়ে কি হবে মিঃ রায়?
মাটি খুড়বো। হাসতে হাসতেই জবাব দেয় কিরীটী।
মাটি খুড়বেন! হঠাৎ মাটি খুড়বার কি প্রয়োজন হলো আবার?
জানেন না, মাটি খুঁড়তে খুড়তেই কত বিরাট বিস্ময়ের আমরা সন্ধান পেয়েছি! কত শত বৎসরের ঘুমন্ত অতীতকে মাটির কবর-শয্যা হতে চোখের সামনে খুঁজে পেয়েছি! তক্ষশীলা, মহেঞ্জোদড়ো, হরোপ্পা।
তা যেন হল, কিন্তু এখানেও সে সব আছে নাকি?
নেই যে তাই বা কে বলতে পারে? কবির বচন জানেন না যতন করহ লাভ হইবে রতন!
সত্যি মিঃ রায়, আপনি হেয়ালি করেও কথা বলতে পারেন!
সে কথা যাক। আপনাকে একটা কাজের ভার দিতে চাই, পারবেন?
নিশ্চয়ই। বলুন কি কাজ? উৎসাহিত হয়ে ওঠে কল্যাণী।
সন্তোষবাবুর উপরে আপনাকে একটু নজর রাখতে হবে।
সন্তোষবাবু! তাকে তো সকালবেলা থানার দারোগা arrest করে নিয়ে গেল—কিন্তু কেন বলুন তো, হঠাৎ ভদ্রলোককে arrest করল কেন?
আমার যতদূর মনে হয়, সন্তোষবাবুকে arrest করবার মত উপযুক্ত evidence লক্ষ্মীকান্ত সাহার ঝুলিতে নেই। হয়ত কয়েকটা জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
কিন্তু এও তো ভারী অন্যায়। এমনি করে হুট করে একজন ভদ্রলোককে arrest করে নিয়ে যাওয়া!
অন্যায় বৈকি। কিন্তু ঘটনাচক্রে এমন বিশ্রী সময়ে ও এমন বিশ্রী পরিস্থিতির মধ্যে তিনি এসে পড়েছেন যে, এ রকমটা হওয়া বিশেষ কিছুই আশ্চর্য নয়। দশচক্রে ভগবান ভূত বলে একটা প্রবাদ আছে না আমাদের দেশে, এক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে মিস সান্যাল।
কিরীটীবাবু?
কল্যাণীর গলার স্বরে কিরীটী যেন বেশ একটু বিস্মিত হয়েই ওর মুখের দিকে তাকাল, বলুন?
একটা অনুরোধ আমার—দাবীও বলতে পারেন। আপনি অবশ্য কথাটা মানবেন কিনা জানি না, তবে আমার কি মনে হয় জানেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কয়েক ঘণ্টার আলাপ-পরিচয়েই কেউ কেউ পরস্পরের কাছে এত ঘনিষ্ঠ ও এত সহজ হয়ে আসে যে ভাবতেও অনেক সময় বিস্ময় লাগে। এই ধরুন আপনার কথাই। কতক্ষণেরই বা আলাপ আপনার সঙ্গে, অথচ মনে হচ্ছে যেন আপনার সঙ্গে বুঝি কতদিনেরই না পরিচয়! হয়ত আপনি মনে মনে হাসছেন, কিন্তু
কেন, হাসবো কেন? কিরীটী হাস্যোদীপ্ত কণ্ঠেই বাধা দিয়ে বলে ওঠে।
সে যাই হোক, সেই দাবীতেই অনুরোধটা জানাচ্ছি, আপনি আমাকে আপনি বা মিস সান্যাল না বলে শুধু কল্যাণী বলে ডাকলে কিন্তু ভারী খুশী হবে এবং সেই সঙ্গে যদি আপনির দুরত্বটা তুলে দিয়ে তুমি বলে সম্বোধন করেন, তাহলে খুশীর সত্যিই বলছি অন্ত থাকবে না। তাছাড়া বয়সেও তো আমি আপনার চাইতে অনেক ছোটই হব, সেদিক দিয়েও তো অনায়াসেই আমাকে আপনি তুমি বলে ডাকতে পারেন।
বেশ তো। তুমি বলে ডাকলেই যদি তুমি খুশী হও কল্যাণী তাই হবে। কিরীটী স্নিগ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয়।
আঃ, বাঁচলাম। এবারে নিশ্চিন্ত মনে বলি, খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে পিসেমশাইয়ের হত্যার ব্যাপারটাই ভাবছিলাম। একটা ব্যাপারে কেমন যেন খটকা লাগছে।
কি বলুন তো
আবার বলুন?
ও ভুল হয়ে গিয়েছে, বল!
আচ্ছা এই পিসিমার হত্যার ব্যাপারটা—নায়েব বলেছেন তিনি ও সম্পর্কে কিছুই জানেন না, এও কখনো হতে পারে?
কৌতুকে কিরীটী প্রশ্ন করে, কেন?
না, অনেক দিনকার পুরাতন লোক উনি এ বাড়ির, শুধু তাই নয়। পিসেমশাইয়ের একদিক থেকে যতদূর শুনলাম নাকি বন্ধুর মতই ছিলেন উনি। আমার তো মনে হয়, বিশেষ কারণেই কথাটা তিনি অস্বীকার করছেন এখন।
তুমি হয়ত ঠিকই ধরেছ কল্যাণী, তাহলেও এত তাড়াতাড়ি কোন বিষয়েই চট করে মতামত প্রকাশ করা উচিত নয়।
তারপর কানাইয়ের মার অন্তর্ধানের ব্যাপারটা!
কি মনে হয় তোমার?
এর পিছনেও কোন রহস্য আছে।
কি রকম?
পাছে কানাইয়ের মা উপস্থিত থাকলে পিসিমার ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়, তাই হয়ত তাকে সরানো হয়েছে কৌশলে।
স্বাভাবিক।
কিন্তু বেচারীকে খুন করে কেউ ঐ বৌরাণীর বিলের জলে ড়ুবিয়ে দেয়নি তো?
তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই কল্যাণী।
বলেন কি?
ঠিক তাই। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে যেমন সেই সঙ্গে দশটা মিথ্যার আমদানি করতে হয়, তেমনি বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একটা হত্যার ব্যাপারকে চাপা দেওয়ার জন্য আরো দুএকটা আনুষঙ্গিক হত্যা এসে পড়ে। অথচ হত্যাকারী বোঝে না যে সে নিজে যত ধূর্ত ও ক্ষিপ্রই হোক না কেন, হত্যা তার পথ-রেখা বা চিহ্ন সর্ব ক্ষেত্রেই রেখে যাবেই পশ্চাতে। এবং সেই পথরেখা ধরে এগিয়ে চললে তাকে ধরা দিতে হবেই, সুব্রতকেও আমি বহুবার বলেছি এ কথা। কেবল একটা ছকে ফেলা—
কিন্তু সেই ছকে ফেলা
হ্যাঁ, সেজন্য কিছু সূত্রের (clue) আবশ্যক। Detection-এর মূল কথাটাই তো তাই। সুত্রকে খুঁজে বের করতে হবে
How interesting!
Interesting সন্দেহ নেই, তবে সমগ্র ব্যাপারটাকে interesting করে তুলবার জন্য স্থির বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনা-শক্তি ও সতর্ক তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন প্রতি মুহূর্তে। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা বুদ্ধির অঙ্ক।
বুদ্ধির অঙ্ক?
হ্যাঁ। তোমাকে যখন বর্তমান এই detection ব্যাপারে সহকর্মী হিসাবেই নিয়েছি, কয়েকটা প্রশ্ন তোমাকে ভাববার জন্য দিচ্ছি। ভেবে জবাব দিও।
প্রশ্ন? বলুন?
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে—মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভার মৃত্যুর মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে কিনা? ২নং প্রশ্ন হচ্ছে—যদি থেকেই থাকে তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় মৃত্যুর মধ্যে দীর্ঘ এই উনিশ বৎসরের ব্যবধান কেন হলো? ৩নং প্রশ্ন—ঐ উনিশ বৎসরের ব্যবধানে একই হত্যাকারীর পক্ষে একই কারণে দুজনকেই হত্যা করা সম্ভবপর কিনা? বুঝতে পারছো বোধ হয়, তৃতীয় প্রশ্নের যদি জবাবটা খুঁজে পাও, ঐ সঙ্গেই প্রথম প্রশ্নের জবাবটাও সহজ হয়ে আসবে।
হুঁ।
৪নং প্রশ্ন—দুটি মৃতদেহই ঐ একই জায়গায় বকুলবৃক্ষতলে পাওয়া গেল কেন? দুবারই হত্যার স্থান ঐ বকুলবৃক্ষতলই বেছে নেওয়া হয়েছিল, না দ্বিতীয় হত্যার পর মৃতদেহ ঐ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? নিয়ে যাওয়াই যদি হয়ে থাকে, কি তার উদ্দেশ্য ছিল? শুধু তাই নয়, যদি ধরে নেওয়া যায়। ঐখানেই মৃতদেহ বহন করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, স্বভাবতই একটা প্রশ্ন। জাগবে মনে, হত্যাকারী দেহে প্রচুর শক্তি ধরে। ঐ সঙ্গে একথাও মনে হবে, তাহলে কোথায় হত্যা করা হয়েছিল?
আচ্ছা একটা কথা মিঃ রায়, আপনি কি তাহলে ধরেই নিচ্ছেন কানাইয়ের মা পিসিমার মৃত্যু সম্পকে যে কাহিনী বলেছে তা সত্য?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু তার প্রমাণ কি?
Yes, it is an intelligent question! প্রমাণ? এক্ষেত্রে প্রমাণের চাইতে probability উপরেই আমি বেশী জোর দিয়েছি,
কিন্তু কেন?
প্রথমত কানাইয়ের মার মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে এ ধরনের একটা চমৎকার কাহিনী গড়ে তুলে বলবার যেমন কোন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে না, তেমনি তার মত একজন অশিক্ষিত দাসীর পক্ষে সম্পূর্ণ পারম্পর্য ও যুক্তি বজায় রেখে এমন একটা সুষ্ঠ কাহিনী রচনা করে তুলবার ক্ষমতা থাকতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ অনেকদিনকার পুরোনো দাসী এ বাড়ির সে এবং হেমপ্রভা দেবীর বাপের বাড়ি থেকেই সে এসেছে। খাস দাসী ছিল সে হেমপ্রভা দেবীর। এবং তার প্রতি একটা প্রগাঢ় স্নেহ ও ভালবাসা গড়ে ওঠা কানাইয়ের মার পক্ষে অসম্ভব তে নয়ই—অস্বাভাবিকও নয়। সেদিক দিয়েও যদি বিচার করে দেখি তাহলে দেখা যাবে হেমপ্রভা দেবীর কোনরুপ কলঙ্ক রটে বা তাঁর চরিত্রের প্রতি কোনরুপ বাঁকা ইঙ্গিত আসতে পারে, কানাইয়ের মার দ্বারা সেটাও খুব স্বাভাবিক নয়। তৃতীয়তঃ কনাইয়ের মার মত একজন স্ত্রীলোকের ঐভাবে তারই মনিব-পত্নীর সম্পর্কে একটা কল্পিত কাহিনী গড়ে তুলে বলবারই বা কি স্বার্থ থাকতে পারে! চতুর্থতঃ ঘটনাটা আপনি প্রকাশ না করবার যে হেতু কানাইয়ের মা দর্শিয়েছে, সেটাও আমার চোখে খুবই স্বাভাবিক লেগেছে। এবং শেষ ও পঞ্চম, আচমকা এইভাবে কানাইয়ের মা নিরুদ্দিষ্টা হওয়ায় তার বর্ণিত কাহিনী যে মিথ্যা নয়—কথাটা আরো বেশী করেই আমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর একমাত্র সেই কারণেই আজ সকাল থেকে কানাইয়ের মার নিরুদিষ্টা হবার পর থেকে বর্তমান রহস্যের চিন্তাধারাটা আমি একটা নির্দিষ্ট পথে চালনা করতে সক্ষম হয়েছি।
মুগ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গেই কল্যাণী কিরীটীর যুক্তিপর্ণ আলোচনা শুনছিল। সামান্য একটা ব্যাপারকে সে কত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তি দিয়ে বিচার করে ভাবলেও চমৎকৃত হতে হয়।
কিরীটীর কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, রাজহাঁস যেমন দুধ ও জলের মধ্যে থেকে কেবল দুধটাকেই ছেকে টেনে বের করে নেয়, রহস্যের তদন্তের ব্যাপারেও আমাদের তেমনি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘটনার মধ্য হতে নির্জলা প্রয়োজনীয় সত্যটকু ছেকে নিতে হবে। তবেই না সমস্ত রহস্যটা সহজ হয়ে আসবে! তারপর সহসা কিরীটী নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, কিন্তু এবারে আমাকে একবার থানার দিকে যেতে হবে যে কল্যাণী!
এখন থানায় যাবেন?
হ্যাঁ, বেলা প্রায় আড়াইটে হল, দেখে আসি সন্তোষ-পর্ব কতদূর গড়াল! মৃদু হাস্য সহকারে কথাটা বলতে বলতে কিরীটী চেয়ারটা হতে গাত্রোত্থান করল।
কখন ফিরবেন মিঃ রায়?
বেশী দেরি হবে না। সন্ধ্যার আগেই হয়ত ফিরতে পারবো।
কল্যাণী কক্ষ হতে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী সর্বপ্রথমে ঘরের দরজাটায় খিল তুলে দিল। সত্যজিৎ এখন সবিতার ঘরেই আছে, চট করে এ ঘরে আসবে না। মাত্র কয়েক দিন আগেকার তার ভবিষ্যৎ বাণীটা মনে পড়ে যায়, বর্তমান এই কেসেরই কথাপ্রসঙ্গে তার কলকাতার বাড়িতে বসে সত্যজিৎকে যে আশ্বাসটুকু সে দিয়েছিল সবিতা সম্পর্কে, মনের দিক দিয়ে তাদের যে অপূর্ব একটা মিল গড়ে উঠেছে এই কদিনের সান্নিধ্যেই—সেটা আর কারো চোখে না পড়লেও কিরীটীর প্রখর ও সজাগ দৃষ্টিকে এড়াতে পারেনি। দুজনের মিলেছে ভাল। এবং সামান্য এই কদিনের আলাপ-পরিচয়ে কিরীটী বুঝতে পেরেছিল বেশ বলিষ্ঠ চরিত্রের ছেলেটি। বেশীর ভাগ সময়ে সবিতা ও সত্যজিৎ প্রায় একই সঙ্গে থাকে। সত্যজিতের নিরবসর সাহচর্যে পিতার আকস্মিক মৃত্যু শোকটাও সবিতার কাছে অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে। একটিবার নন্দনকাননটা ঘুরে দেখে আসতে হবে, সেই কারণেই কিরীটী কাজের দোহাই দিয়েই আপাততঃ কল্যাণীকে বিদায় দিয়েছে ঘর থকে। থানায় যাবার জন্য লক্ষ্মীকান্ত আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেও আপাততঃ তার যাবার ইচ্ছা নেই। অতএব এই হচ্ছে উপযুক্ত অবসর। নায়েব বসন্তবাবু কাছারি বাড়িতে গিয়েছেন টমটম নিয়ে। সবিতা ও সত্যজিৎ উপরে সবিতার ঘরে বিশ্রম্ভালাপে রত। নিত্যানন্দ সান্যাল এখন, দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। বাড়ির দাসদাসীরাও এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। কিরীটী একটা জামা গায়ে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে দোতলার শুন্য বারান্দাটার উপরে এসে দাঁড়াল। দ্বিপ্রহরের নির্জনতায় সমস্ত প্রমোদভবন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কোথায়ও এতটুকু সাড়াশব্দ পর্যন্ত যেন নেই। কার্নিশের ওপরে কবুতরগুলিও নিস্তব্ধ। তথাপি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারিদিকে এক বার তাকিয়ে নিয়ে কিরীটী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো জামার পকেটে খুরপীর মত একটা ছোট্ট অস্ত্র নিয়ে। নিচের অনুরুপ বারান্দাটা অতিক্রম করে কিরীটী বাঁধানো আঙ্গিনাটার উপরে এসে দাঁড়াল। মাথার উপরে সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে, তথাপি আষাঢ়ের তীব্র রৌদ্রদাহ চারিদিক যেন ঝলসে দিচ্ছে। আঙ্গিনা অতিক্রম করে শেষপ্রান্তের একটা খালি অব্যবহার্য ঘরের মধ্যে এসে সে ঢুকল। গতকালই দ্বিপ্রহরের দিকে কিরীটী গোটা বাড়িটাই একবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল। ঐ ঘরের মধ্যে একটা দরজা আছে। আঙ্গিনার দরজাটি ছাড়াও যে দরজাপথে প্রমোদভবনের বাইরে নন্দনকাননে যাবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাঁধানো পথটার উপরে গিয়ে পড়া যায়। দরজাটা খুলে কিরীটী সেই পথের উপরে এসে দাঁড়াল। ঐ পথ দিয়ে নন্দনকানন যেতে মিনিট পাঁচেকের বেশী লাগে না। নন্দনকাননে পৌঁছে কিরীটী জঙ্গলাকীর্ণ বাগানটার মধ্যে অন্যমনস্ক ভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং ঘুরতে ঘুরতেই একসময় কিরীটী পূর্ববর্ণিত সেই পুরাতন পত্রবহুল বকুল বৃক্ষটির নিচে ছায়ায় এসে দাঁড়াল।
এই বকুলবৃক্ষতলই হচ্ছে অকুস্থান।
একটি মৃতদেহ এই বৃক্ষতলে দীর্ঘ উনিশ বৎসর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল, দ্বিতীয় মৃতদেহটি মাত্র কয়দিন আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। সহসা একটা কথা কিরীটীর মনে হয়। এই নন্দনকানন দীর্ঘকাল অব্যবহার্যই পড়ে ছিল। বহুদিন মানুষের পদচিহ্ন এখানে পড়েনি। প্রমোদভবন হতে নন্দনকাননে আসবার যে দুটি দ্বারপথ—তার চেহারা ও অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন সে দ্বার দুটি ব্যবহার করা হয় নি। খোলা হয় নি ঐ দ্বার দুটি। মানুষের বর্জন ও অবহেলায় ক্রমে এই নন্দনকানন আগাছা ও জঙ্গলে পরিকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। এসব সত্ত্বেও নায়েব বসন্ত সেন এইখানেই বা কেন তার প্রভুর অন্বেষণে এসেছিল? তবে কি এখানে মধ্যে মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আসতেন? এবং সে সংবাদ কি বসন্ত সেনের অগোচর ছিল না? যদি ধরে নেওয়া যায় আসতেনই, তাহলে সে কথাটা জানা বসন্ত সেনের পক্ষে অন্ততঃ অসম্ভব ছিল? কিন্তু কেনই বা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী এই নন্দনকাননে আসতেন? তাঁর মৃতা স্ত্রীর কথা স্মরণ করেই কি? দীর্ঘ উনিশ বৎসর ধরে কারো স্মৃতি এমনি করে বহুন করা সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলেও মৃত্যুঞ্জয়-চরিত্রে সেটা সম্ভব ছিল কিনা? মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রীকে অবশ্যই ভালবাসতেন, নচেৎ আর দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহই বা করলেন না কেন? সংযমী ও মিতবাক পুরুষ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় এবং চরিত্রের তাঁর ঐ দিকটা অবশ্য সবিতার কথা হতেই জানা গিয়েছে। স্ত্রীকে ভালবাসলেও তিনি কদাপি ভুলেও একমাত্র কন্যা সবিতার সঙ্গেও মৃতা স্ত্রীর সম্পর্কে আলোচনা করতেন না। কিন্তু কেন? এও কি স্ত্রীর প্রতি গভীর প্রেমেরই একটা লক্ষণ? না তার কোন নিগূঢ় কারণ ছিল? কোন কারণেই তিনি স্ত্রীর সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা সযত্নে ইচ্ছাপূর্বকই এড়িয়ে চলতেন, এমন কি একমাত্র কন্যার নিকটে পর্যন্ত। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর আরো একটা কথা মনে হয়, উনিশ বৎসর পরে একদা প্রভাতে অসুস্থ স্ত্রীকে সহসা তাঁর ঘরে শয্যায় না দেখতে পেয়ে কি কারণেই বা স্ত্রী সম্পর্কে তিনি অমন সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন? স্ত্রীকে ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না, সেজন্য তাঁর অমন লুকোচুরি করারই বা কি এমন প্রয়োজন ছিল? খোলাখুলি ভাবে ব্যাপারটা সকলের সঙ্গে আলোচনা না করে অমন রহস্যজনক ভাবে রাতারাতি অসুস্থা স্ত্রীকে চিকিৎসার দোহাই দিয়ে কলকাতায় নিয়ে চলে যাবারই বা কি প্রয়োজন ছিল? কেন সমগ্র ঘটনাকে অমনভাবে সাজানো হলো? লোকে যদি জানতই যে তাঁর স্ত্রীকে বাড়ির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না, তাতে একটা দুর্নামের বা কলঙ্কের কথা ওঠা হয়ত স্বাভবিকই ছিল কিন্তু তার চাইতেও কি বেশী কিছু সন্দেহ মৃত্যুঞ্জয়ের মনের মধ্যে ছিল?
অতীত!
অতীতকেই সর্বাগ্রে জানতে হবে এ রহস্যের মীমাংসা করতে হলে। চিন্তিত কিরীটী নন্দনকাননের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং ঘুরতে ঘুরতেই একসময় কিরীটী একেবারে জলের ধার ঘেষে এসে দাঁড়ায়।
সহসা পাড়ের একটা জায়গা ওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। সেখানকার মাটিতে যে লম্বা লম্বা ঘাসগুলো আছে সেগুলো যেন মাটির বুকে একেবারে লেপটে আছে। একটু নিস্তেজ ও শুকনোও যেন। নিঃশব্দে কৌতুহলে এগিয়ে গিয়ে কিরীটী সেখানকার মাটির ঘাসগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। নিয়মিত ভাবেই দীর্ঘদিন ধরে কোন ভারী বস্তুবিশেষের চাপে যেন সেখানকার মাটি আর ঘাস থেতলে গিয়েছে। কোন ভারী বস্তুর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে জায়গাটা যেন চিহ্নিত হয়ে আছে আশপাশের পাড়ের অন্যান্য অংশ হতে।
কিরীটী তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চারিদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। পাড়ের অন্যান্য অংশের চাইতে গাছপালাগুলোও এখানে যেন একটু ঘন সন্নিবেশিত, একটু ছায়াবহুল, একটু অন্ধকার, একটু নির্জন। বড় বড় শাখাপ্রশাখা ও পত্রবহুল দুটো পলাশবৃক্ষ। একটি পলাশবৃক্ষের তলে মস্ত বড় একটা পাথরের মত আছে। আরো একটু এগিয়ে কিরীটী পাথরটার সামনে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্যই লাগে কিরীটীর। পাথরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। এই জঙ্গলাকীর্ণ মানুষের অগম্য স্থানে অমনি একটি পরিষ্কার পাথর কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। চিন্তিত মনেই কিরীটী পাথরটার উপর এগিয়ে গিয়ে উপবেশন করল।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। প্রখর রৌদ্রের তেজ অত্যন্ত স্তিমিত অবসন্ন। চারিদিকে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে একটা স্নিগ্ধ ছায়া। নিস্তরঙ্গ বিলের জল। সামনের দিকে তাকাল কিরীটী। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এক দিকে তার পশ্চাতে নন্দনকানন, অন্য দিকে যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল জল আর জল। দক্ষিণদিকে অস্পষ্ট পাড়ের রেখা দেখা যায়। বৈকালের ম্রিয়মাণ আলোয় দেখা যায় কেবল একটা ধূসর রেখা। বোঝা যায় ঐদিকটার পাড়ে গাছপালা আছে। এই দ্বীপ থেকে দক্ষিণের ঐ পাড়ের দুরত্ব কতটা হবে? খুব বড়জোর আধমাইলটাক হবে হয়ত।
আরো কিছুক্ষণ বাদে কিরীটী উঠে দাঁড়াতে যাবে, সহসা ওর নজরে পড়ল দিনশেষের ম্লান আলোয় ঠিক ওর পায়ের নিচেই ঘাসের উপরে কি যেন একটা চিকঠিক করছে। কৌতূহলভরে কিরীটী ঝুঁকে নিচু হয়ে ঘাসের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বস্তুটা তুলে নিল।
স্বর্ণ-অঙ্গুরীয় একটি।
হাতের পাতার উপরে স্বর্ণ-অঙ্গরীয়টি রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল কিরীটী। ওর নজর পড়ল অঙ্গরীয়ের উপরে একটি নামের আদ্যাক্ষর লেখা, দেবনাগরী অক্ষরে অক্ষরটা হচ্ছে ল। কিরীটী অঙ্গরীয়টা বুকপকেটের মধ্যে রেখে দিল।
স্থানত্যাগ করে এবারে কিরীটী নন্দনকাননের মধ্যস্থিত বিরাম-কুটীরের দিকে অগ্রসর হলো।
আকাশের আলো যেন আরো ম্লান হয়ে এসেছে। একটা বিষণ্ণ করুণ স্তব্ধতা চারিদিকে যেন জমাট বেধে উঠছে ক্ৰমে ক্ৰমে। অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা, কেবল মধ্যে মধ্যে চারিপাশ্বের বৃক্ষাদি হতে এক-আধটা পাতা খসে খসে পড়ছে নিঃশব্দে। সহসা কতকগুলো বিচিত্র পাখীর শব্দে চারিদিক মর্মায়িত হয়ে উঠলো। সন্ধ্যায় নীড়াগতা পাখীর দল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বিরাম-কুটীরের বারান্দায় উঠলো এবং কয়েক পা অগ্রসর হতেই অস্পষ্ট আলোয় ওর নজরে পড়ল বারান্দার ধুলায় অস্পষ্ট কতকগুলো ছোট ছোট পদচিহ্ন।
ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য কিরীটী পকেট হতে শক্তিশালী টর্চবাতিটা বের করে বোতাম টিপে টর্চের আলোয় সেই পদচিহ্নগুলি দেখতে লাগল।
ক্ষীণ অষ্পষ্ট পদচিহ্ন! স্বভাবতঃ চট করে কারো দৃষ্টিতে পড়বে না। ভিজে কাদামাখা পায়ে কেউ কোনদিন হেঁটে গিয়েছিল। হয়ত তারই অস্পষ্ট চিহ্ন—আজও সামান্য যা বোঝা যাচ্ছে। এবং আরো নজরে পড়ল সেই পদচিহ্নগলোর আশেপাশেই ধুলোর ওপর জুতোর সোলের কতকগুলো ছাপ। ছাপগুলো প্রথম পায়ের ছাপ হতে অনেক স্পষ্ট। বোধ হয় অল্প কিছুদিন আগে মাত্র জুতো পায়ে কেউ এখানে এসেছিল। ক্রেপ সোল দেওয়া জুতোর ছাপ। প্রমোদভবনে কে কি রকম জুতো পায়ে দেয়? কিরীটীর মনে পড়ল, লক্ষ্য করেছে সে একমাত্র সত্যজিৎই ভারী ক্রেপ সোলের জুতো পায়ে দেয়। সত্যজিৎই এসেছিল হয়ত এখানে। মনে মনে হাসে কিরীটী। অনুসন্ধিৎসা আছে ছেলেটির, দেখেশুনে শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেয়েই তার দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু পাশের ঐ অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলো কার? পদচিহ্নের গঠন ও আকার দেখে মনে হয় কোন স্ত্রীলোকেরই পদচিহ্ন ওগলো। তবে কি সবিতাও এসেছিল সত্যজিতের সঙ্গে এখানে? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? যতদূর মনে পড়ে ও লক্ষ্য করেছে, সবিতা তো কদাপি খালি পায়ে চলাফেরা করে না। এমন কি বাড়ির মধ্যে কক্ষেও না। এতদূর সে খালি পায়ে নিশ্চয়ই আসেনি? তবে কার পদচিহ্ন?
ক্রমে এক এক করে কিরীটী বিরাম-কুটীরের সমস্ত কক্ষগুলোই পরীক্ষা করে দেখল। অনুরূপ পদচিহ্ন আর কোথাও সে দেখতে পেল না।
দিনের বেলা আর একবার এসে বিরাম-কুটীরটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
বাইরে সন্ধ্যার কালো ছায়া একটু একটু করে ক্রমে যেন চারিদিক ছেয়ে ফেলছে। ধূসর আলোয় আশেপাশের গাছপালাগুলো অস্পষ্ট ছায়ার মত মনে হয়।
নির্দিষ্ট নিজের কক্ষের দ্বার ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই কিরীটী চমকে উঠল। ইতিমধ্যে এক সময় ভৃত্য এসে কক্ষের আলোটা জেলে দিয়ে গেলেও আলোর শিখাটা কমানো। মৃদু আলোয় কিরীটীর চোখ পড়ল কক্ষের মধ্যে একটা চেয়ার অধিকার করে বসে আছে সন্তোষ চৌধুরী।
কিরীটীর পদশব্দে সন্তোষ ততক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
সন্তোষবাবু?
হ্যাঁ আমি—আপনার অপেক্ষাতেই বসে আছি মিঃ রায়। মৃদু কণ্ঠে সন্তোষ চৌধুরী প্রত্যুত্তর দিল।
কি ব্যাপার? থানা থেকে কখন ফিরলেন? বসুন। বসুন।
সন্তোষ আবার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। কিরীটীও অন্য একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি হয়ে বসল।
এই মিনিট কুড়ি হবে—
তারপর কি খবর বলুন? হঠাৎ আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন দারোগা সাহেব?
১৬. আর বলেন কেন
আর বলেন কেন? মিথ্যে খানিকটা হয়রান করলে কেবল। আমার নামও সান্টা চৌধুরী—কেমন দারোগা বুঝিয়ে দেবো!
প্রমাণটা যখন আপনার কাছেই আছে, সেটা সকালে এখানে দেখিয়ে দিলেই তো পারতেন, সকলের সন্দেহভঞ্জন হয়ে যেত। মিথ্যে তাহলে আর এমনি করে হয়রান হতে হতো না আপনার!
প্রমাণ আর প্রমাণ! এ কি জুলুম মিঃ রায়? এই বাড়িরই ছেলে আমি? সবিতা আর আমার দেহে একই রক্তের ধারা বইছে। আমার কথাই কি প্রমাণ নয়? সবিতার বাবা ও আমার বাবা আপন জাঠতুত খুড়তুত ভাই ছিলেন।
নিশ্চয়ই সেটাই প্রমাণ বৈকি। তবে কি জানেন সন্তোষবাবু, বলতে গেলে একটা যুগ এ বাড়ির সঙ্গে আপনাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। আপনার পিতাঠাকুর আপনার জন্মের পূর্বেই এ গৃহ ছেড়ে চলে যান। তারপর দীর্ঘকাল ধরে যতদূর শুনেছি কোন পত্র দেওয়া-নেওয়াও হতো না। এক্ষেত্রে যদি এদের মনে সন্দেহ জেগেই থাকে তাতে করে এদের খুব বেশী দোষ দেওয়া যায় কি আপনিই বলুন না? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নটা করে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ও বুড়ো শয়তানটার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু সবিতা? সেও আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারছে না?
আপনি তো বুঝতেই পারছেন সন্তোষবাবু, বসন্তবাবুই এখন একদিক দিয়ে সবিতা দেবীর গার্জেন।
গার্জেন! I can tell you Mr. Roy that old শকুনি—ঐ যত অনর্থের মূল। কাকামণির হত্যার আসল ব্যাপারটা আমি কিছুই জানতাম না। আজই থানায় গিয়ে সব শুনলাম
বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে কিরীটী তাকাল সন্তোষ চৌধুরীর দিকে,
আপনি জানতেন না? কি জানতেন না? মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যে নিহত হয়েছেন, জানতেন না?
তা নয়, তবে কাকার মৃত্যুর আগাগোড়া ব্যাপারটা জানতাম না। জানতাম না যে সত্যসত্যই তাঁকে হত্যা করেছে কেউ।
কিরীটী কিছুক্ষণ সম্মুখে উপবিষ্ট সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে ঈষৎ কুঞ্চন দেখা দেয়।
সন্তোষ চৌধুরী ইতিমধ্যে যেন তার পুর্বোক্ত কথার জের টেনেই বলতে থাকে, আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না মিঃ রায়, সংবাদটা যে কত বড় একটা শক দিয়েছে আমাকে! মাত্র বছর দুই আগে বাবা মারা গিয়েছেন। মা মারা গেছেন বছর বারো আগে। লেখাপড়াও বিশেষ কিছু করিনি। বাবার এডেনের স্টীমার পয়েন্টের কাছে মস্ত বড় একটা স্টেশনারী দোকান ছিল ওখানকারই একজন আফ্রিকান মুসলমান পার্টনারের সঙ্গে। প্রচুর লাভ হতো দোকানটা থেকে। আমিও ঐ দোকানটাতেই কাজ করতাম। হঠাৎ মাস চারেক আগে ঐ পার্টনার আমাকে জানাল দোকানে নাকি আমার কোন শেয়ার নেই। আমি ওখানকার একজন মাইনে-করা কর্মচারী মাত্র। বাবা নাকি মৃত্যুর কিছু দিন আগেই তাঁর দোকানের অর্ধেক শেয়ার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
তা আপনি তো বললেন আপনার বাবা বছর দুই হলো মারা গেছেন—এত দিন সে কথা সে জানায়নি কেন?
বললে পাছে আমি মনে আঘাত পাই সেকারণেই কোন কথা আমাকে নাকি জানায়নি।
তাহলে এতদিন পরেই বা হঠাৎ জানাল কেন?
দোকানের একটা ব্যাপারে গোলমাল হওয়ায় আমার সঙ্গে তখন সব কথা খুলে আমায় সে বলে।
তারপর?
অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন ফলই হলো না। দীর্ঘ উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যাপার। কোন দলিলপত্রও খুঁজে পেলাম না। অবশেষে বাধ্য হয়েই একপ্রকার বিরক্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম ভারতবর্ষে।
যদি কিছু মনে না করেন মিঃ চৌধুরী, একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাই।
নিশ্চয়ই। বলুন না শুনি?
আপনার কাকা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যে মারা গিয়েছেন এ সংবাদটা আপনি কোত্থেকে পেলেন?
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরীটীর প্রশ্নটা সে সন্তোষ চৌধুরীকে বেশ একটু বিব্রত করে তুলেছে তার চোখে-মুখেই সেটা যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলা সংবাদপত্রে সংবাদটা বের হয়েছিল। তাতেই আমি জানতে পারি। একটু যেন ইতস্তত করেই কথাগুলো বলে সন্তোষ চৌধুরী।
বাংলা সংবাদপত্রে! এডেনে কি বাংলা সংবাদপত্র যায় নাকি?
হ্যাঁ। মর্মবাণী, বাংলার অর্ধ-সাপ্তাহিক কাগজটা আমাদের বাসায় নিয়মিত যেত। তাতেই সংবাদটা পাই, এখানে রওনা হবার দিন দুই আগে।
সংবাদটায় কি লেখা ছিল? .
এই যে দেখুন না কাগজের কাটিংটা, এখনো আমার ব্যাগেই আছে। I kept it. বলতে বলতে সন্তোষ চৌধুরী তার জামার পকেট হতে সুদৃশ্য একটা চামড়ার পাস বের করে পার্স থেকে সংবাদপত্রের ছোট একটা কাটিং কিরীটীর হাতে তুলে দিল।
কিরীটী ঘরের আলোয় কাটিংটা পড়তে লাগল। স্থানীয় সংবাদদাতা প্রেরিত সংবাদ!—স্থানীয় জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর প্রাণহীন দেহ গতকল্য বৌরাণীর বিলের মধ্যস্থিত যে দ্বীপটি—যাহাকে স্থানীয় লোকেরা নন্দনকানন বলিয়া জানে সেখানেই পাওয়া গিয়াছে। জমিদারের মৃত্যুর কারণ জানা যায় নাই। রহস্যজনক বলিয়াই মনে হয়। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী অত্যন্ত অমায়িক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার জমিদারীর উন্নয়নকল্পে এযাবৎকাল তিনি বহু অর্থ ব্যয় করিয়াছিলেন। ইত্যাদি।
গভীর মনোযোগের সঙ্গে এক নিঃশবাসে লেখাটা পড়ে কিরীটী কাগজটা সন্তোষ চৌধুরীকে ফেরত দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, চৌধুরী মশাইয়ের যে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে সে তো এই সংবাদেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি সন্তোষবাবু!
কথাগুলো বলতে বলতেই কিরীটী সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
এবার প্রত্যুত্তরে কতকটা যেন ইতস্তত করেই সন্তোষ চৌধুরী জবাব দেয়, হ্যাঁ। তবে তাঁর মৃত্যুটা রহস্যজনক বলতে যে ব্যাপারটা এতটা ঘোরাল হত্যা এটাই বুঝে উঠতে পারিনি দারোগাবাবুর সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে সব জানতে পারবার পূর্ব পর্যন্ত।
অতঃপর কিরীটী ক্ষণকাল চুপ করেই থাকে। তারপর একসময় মুখ তুলে মৃদুকণ্ঠে বলে, দারোগাবাবুর সঙ্গে আপনার কি কথা হলো?
ভদ্রলোকটিকে বিশেষ সুবিধাজনক বলে মনে হল না মিঃ রায়। কথাবার্তা আমাদের মধ্যে যা কিছু হয়েছে কাকার হত্যা সম্পর্কেই। তাঁর ধারণা হত্যাকারী বাইরেরই কোন লোক। কিন্তু আমিও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি
কি বুঝিয়ে দিয়েছেন? আদপেই সেটা সম্ভবপর নয়!
সম্ভবপর নয় কেন?
কেন আবার কি! এ বাড়িরই কেউ না কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।
আপনার কি তাই মনে হয় মিঃ চৌধুরী?
নিশ্চয়ই। এ বিষয়ে কোন ভুল নেই। এই গোবিন্দপুরে কে তাঁকে বাইরে থেকে হত্যা করতে আসবে? আর কেনই বা আসবে?
সন্তোষ চৌধুরীর কথায় কিরীটী মৃদু হাস্য করে, কোন জবাব দেয় না।
হাসছেন যে? আপনিই বলুন না, তাঁর সঙ্গে বাইরের লোকের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
ভুলে যাচ্ছেন কেন মিঃ চৌধুরী, তিনি এখানকার জমিদার ছিলেন এবং শুধু তাই নয় তাঁর ব্যবসা ছিল ও বন্ধকী কারবারও কিছু কিছু করতেন। তাঁর পক্ষে বাইরের শত্রু থাকা কিছুই বিচিত্র নয়। বরং স্বাভাবিকই বলতে পারেন।
কিন্তু আপনি যাই বলুন মিঃ রায়, আমার স্থির বিশ্বাস বাইরের কেউ নয়। এ বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল সেরাত্রে তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ কাকাকে হত্যা করেছে। তাছাড়া এ বাড়ির পুরাতন ঝি কানাইয়ের মা, নিশ্চয়ই সে মারাত্মক কিছু জানত যার জন্য তাকেও রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হতে হয়েছে এ বাড়ি থেকে গতরাত্রে। আমাদের প্রত্যেকেরই কি এখন কর্তব্য জানেন?
কি? কৌতুকভরা দৃষ্টিতে কিরীটী সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
নিরুদ্দিষ্টা কানাইয়ের মাকে যেমন করে যে উপায়ে হোক এখন সর্বাগ্রে খুঁজে বের করা।
সন্তোষ চৌধুরীর কথার কোনো জবাব দেয় না কিরীটী। নিঃশব্দে ঠোঁটের মধ্যে পাইপটা চেপে ধরে ধূমপান করতে থাকে। কিছুক্ষণ একটা স্তব্ধতার মধ্যেই অতিবাহিত হয়ে যায়।
একসময় কিরীটী পীড়াদায়ক স্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে সন্তোষ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কিন্তু আমাকে আপনার কি বলবার ছিল বলুন তো? যেজন্য এখানে আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন?
হ্যাঁ, থানা থেকে আসতে আসতে আমার কি মনে হচ্ছিল জানেন
কি?
এ হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা করা প্রয়োজন। এবং আপনি যখন এ কাজে হাত দিয়েছেন তখন আমাদের প্রত্যেকেরই আপনাকে আমাদের সাধ্যমত সাহায্য করা কর্তব্য। আমি তা করবো সেই কথাটা বলবার জন্য আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।
ধন্যবাদ। আপনাদের সকলেরই সাহায্যের আমার প্রয়োজন। মৃদুভাবে কিরীটী জবাব দেয়।
***
ঐ রাত্রেই। রাত তখন গোটা এগার হবে। অল্পক্ষণ আগে মাত্র সকলের আহারাদি শেষ হয়েছে। অনুজ্জল টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় দ্বিপ্রহরে কিরীটী যে এ্যালবামটা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের ড্রয়ার থেকে এনেছিল তারই পাতাগুলো পুনরায় অন্যমনস্ক ভাবে ওল্টাচ্ছিল। সহসা এমন সময় অতর্কিতে দরজার বাইরে একটা দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কিরীটী ক্ষিপ্রহস্তে অ্যালবামটা বাজিয়ে তার শয্যার নিচে একেবারে চালান করে দিল। এবং বিস্মিত দৃষ্টি ভেজানো দরজার দিকে তুলে ধরল।
পরমুহূর্তেই ভেজানো দরজা ঠেলে কমধ্যে এসে প্রবেশ করল কল্যাণী।
কল্যাণী দেবী! কি সংবাদ? এত রাত্রে?
কল্যাণীর চোখেমুখে একটা সুস্পষ্ট উত্তেজনার আভাস।
লক্ষ্মীকান্ত সাহা! অস্ফুট কণ্ঠে কল্যাণী উচ্চারণ করল।
বসো। বসো। ঐ চেয়ারটায় বসো। কিরীটী পাশেরই শুন্য চেয়ারটা দেখিয়ে কল্যাণীকে শান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাল।
কল্যাণী কিন্তু বসে না। চেয়ারের একটা হাতলের উপরে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে মনের উত্তেজনাটা সামলে নেবার চেষ্টা করে মুহূর্তের জন্য। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, নায়েব মশাইয়ের ঘরে লক্ষ্মীকান্ত সাহা গোপনে বোধ হয় কোন পরামর্শ করছে আর সেই ঘরের বন্ধ দরজার গায়ে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে শুনছেন সন্তোষবাবু।
কিরীটী কল্যাণী-প্রদত্ত সংবাদটায় কোন গুরুত্বই আরোপ না করে মৃদু হাস্য তরল কণ্ঠে বলে, তাতে হয়েছে কি?
বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় কল্যাণী কিরীটীর মুখের দিকে।
কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা কি জানালে হতো না মিঃ রায়? কল্যাণীর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগটা অস্পষ্ট থাকে না।
বসো। আজকের রাতে যে সভা বসেছে তার সমস্ত রহস্যই হয়ত আর দুচার দিনের মধ্যেই সর্বসমক্ষে উঘাটিত হয়ে যাবে। এখন তাড়াহুঁড়ো করতে গেলে হয়ত সব কেচে যাবে।
কিরীটীর কথাগুলো কল্যাণী যে ঠিক স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি সেটা কিন্তু কিরীটীর আদপেই বুঝতে কষ্ট হয় না কল্যাণীর চোখমুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার কথাটা হয়ত ঠিক বুঝতে পারনি কল্যাণী। খুব সম্ভবত ঘটনাচক্রে নিজের ব্যর্থতায় লক্ষ্মীকান্ত সাহা সাদা কথায় যাকে বলে একেবারে মরীয়া হয়ে উঠেছে। কাজেই যে কোন একটা কাজের দ্বারা নিজের ক্ষমতা জাহির করবে হয়ত সে দুচার দিনের মধ্যেই। এ হয়ত তারই প্রস্তুতি চলেছে।
বারান্দার দামী ওয়াল-ক্লকটা এমন সময় ঢং করে রাত্রি সাড়ে এগারটা ঘোষণা করল। রাত অনেক হলো কল্যাণী, এবারে তুমি শুতে যাও। আমারও ঘুম পেয়েছে। বলতে বলতে নিদ্রাকাতর হয়েই যেন সে একটা হাই তুলল। এবং কথাটা শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
কল্যাণীকে ঘর ত্যাগ করবার জন্য সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। কল্যাণীও আর দ্বিরুক্তি না করে ঘর হতে বের হয়ে গেল। কিন্তু তার কৌতূহলী মন কিরীটীর কথায় নিবৃত্ত হয় না। পায়ে পায়ে সে নিচের সিঁড়ি বেয়ে একতলার দিকে অগ্রসর হয়।
আহারাদির পর নিদ্রা আসছিল না দেখে কল্যাণী প্রমোদভবনের সামনে দক্ষিণাংশে যে ফুলের ছোটখাটো একটা বাগান আছে সেখানে আপন মনে অন্ধকারেই একটা পাথরের বেদীর উপরে বসেছিল। দুপুর থেকেই একটা অসহ্য গুমোট গরমে প্রকৃতি যেন থমথম করছে। বাতাসের লেশমাত্রও নেই। বিকালের দিকে আকাশের এক প্রান্তে একটু মেঘ উঠেছিল কিন্তু সেটাও ঘন চাপ বেধে উঠতে পারেনি, অন্ধকার রাত্রির আকাশপটে তারাগুলো কেবল মিটিমিটি জ্বলছে। কল্যাণী আপন মনে বসে বসে কিরীটীর সঙ্গে দ্বিপ্রহরে যে আলোচনা হয়েছিল তাই ভাবছিল। কে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে হত্যা করেছে? আর কেনই বা করেছে? কিরীটীর কথায় মনে হয় স্বার্থটা অর্থ-সম্পর্কিত। অর্থই এ অনর্থের মূল। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিরাট সম্পত্তির প্রকৃতপক্ষে মালিক এখন ঐ সবিতাই। তবে সন্তোষ চৌধুরী তার যে পরিচয় দিয়েছে তা যদি সত্য হয়, তাহলে এ সম্পত্তির একটা অংশ তারও প্রাপ্য। নায়েব বসন্ত সেন সন্তোষ চৌধুরী তার পরিচয়ের উপযুক্ত প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে স্বীকার করে নিতে রাজী নন। স্পষ্টই সেকথা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন এখানে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। সন্তোষ চৌধুরীও জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছে উপযুক্ত প্রমাণ তার কাছে আছে এবং প্রয়োজন হলে সে প্রমাণ করবেও যে সে এই বংশেরই সন্তান। সত্য হোক মিথ্যা হোক প্রমাণ তার হাতে নিশ্চয়ই আছে, নচেৎ এভাবে জোর গলায় সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করত না। তা ছাড়া সে কি বোঝে না প্রতারক প্রমাণিত হলে আইনের হাতে কিভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে। শুধু তাই নয়, শাস্তিও তাকে পেতে হবে এবং নায়েব বসন্ত সেন সহজে তাকে নিষ্কৃতি দেবে না। সহসা এমন সময় সাইকেলের ঘণ্টি শুনে সচকিত হয়ে কল্যাণী অদূরে গেটের দিকে তাকাল, গেটের আলোয় সাইকেলআরোহীকে দেখে চিনতে ওর কষ্ট হলো না। দারোগা লক্ষীকান্ত সাহা। লক্ষ্মীকান্ত দারোগা এত রাত্রে এখানে! সকালেই তো ভদ্রলোক এখানে এসেছিলেন এবং যাবার সময় সঙ্গে করে সন্তোষ চৌধুরীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার কিছু আগে সন্তোষ চৌধুরী ফিরে এসেছে ও দেখেছে। এও জানে কল্যাণী, রাত্রের আহার্য সবিতাই বনমালীকে বলে সন্তোষের ঘরে প্রেরণ করেছিল। কৌতুহলী হয়ে কল্যাণী দূর থেকেই লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকে অনুসরণ করে। লক্ষ্মীকান্ত সাইকেলটা গেটের একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা ভিতরে প্রবেশ করে নায়েব বসন্ত সেনের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে কল্যাণী লক্ষ্মীকান্তকে লক্ষ্য করতে লাগল। নায়েবের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই অল্প পরে দরজা খুলে খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালেন বসন্ত সেন।
কি দারোগা সাহেব! এত রাত্রে?
বসন্ত সেনের প্রশ্নে বদ্ধ ওষ্ঠের উপরে ডান হাতের তর্জনী তুলে চাপা গলায় লক্ষ্মীকান্ত বললেন, আস্তে। কথা আছে, উপরে চলুন।
উভয়ের ঘরের মধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর হতে পুনরায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কল্যাণী একটু অবাকই হয়েছিল। প্রথমতঃ এত রাত্রে লক্ষনীকান্তের আবির্ভাব এবং তাঁর আগমনের ব্যাপারে ঐভাবে সতর্কতা অবলম্বন। কল্যাণী চিন্তা করবারও অবকাশ পেল না, অতর্কিতে একটা অস্পষ্ট শব্দ ওর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই ও ফিরে তাকাল। পাশের ঘরের দরজা খুলে সন্তোষ চৌধুরী পা টিপে টিপে বের হয়ে এলো। কল্যাণী থামের আড়ালে আত্মগোপন করেই লক্ষ্য করতে লাগল সন্তোষ চৌধুরীর গতিবিধি।
সন্তর্পণে পা ফেলে সন্তোষ এগিয়ে এসে দাঁড়াল বসন্ত সেনের ঘরের বন্ধ দরজার গায়ে একেবারে যেন ঘেষে। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ সন্তোষ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দার ঝোলানো বাতির আলো সন্তোষের চোখেমুখে এসে পড়েছে। কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।
কল্যাণী বুঝতে পারে সন্তোষ আড়ি পেতে ঘরের ভিতরকার বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্তর কথাবার্তা শোনবার চেষ্টা করছে। সহসা কল্যাণীর মনে হয় এ সংবাদটা কিরীটীকে এক্ষনি দেওয়া প্রয়োজন।
এত রাত্রে লক্ষ্মীকান্তর আবির্ভাব ও সন্তোষ চৌধুরীর আড়ি পেতে ওদের কথা শোনবার চেষ্টাব্যাপার দুটোই যেন কেমন একটা সন্দেহের উদ্রেক করে। আজ সকাল হতেই পরের পর ঘটনাগুলো কানাইয়ের মা গত রাত থেকে সহসা নিরুদিষ্টা হয়ে গেল। লক্ষ্মীকান্ত সাহা এসে সন্তোষ চৌধুরীকে থানায় ধরে নিয়ে গেলেন। ফিরে এলো সে সন্ধ্যার মুখে। তারপর রাত প্রায় এই এগারোটায় সহসা লক্ষ্মীকান্তর এখানে আবির্ভাব। সন্তোষ চৌধুরীর ঐ ধরনের সন্দেহজনক গতিবিধি। কল্যাণী আর দেরি করে না। থামের আড়াল থেকে সরে গিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
সমস্ত বাড়িটা জুড়ে একটা স্তব্ধতা।
কল্যাণী পা টিপে টিপে সিঁড়ি অতিক্রম করে নিচে নামছে। সিঁড়ির আলোটা অপর্যাপ্ত হওয়ায় সমগ্র সিঁড়ি-পথটা তেমন স্পষ্টভাবে আলোকিত করতে পারছে না। আধো-আলো আধো-ছায়ায় যেন একটা আলোছায়ার রহস্য ঘন হয়ে উঠেছে। নিচে নেমে এসে সোজা কল্যাণী থামের আড়ালে আড়ালে বারান্দা দিয়ে বসন্ত সেনের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু সেখানেও সন্তোষকে দেখতে পেল না। বসন্ত সেনের ঘরের দরজা পূর্বের মতই এখনো বন্ধ।
কে?
মুহূর্তে অন্ধকারেও গলাটা চিনতে কল্যাণীর কষ্ট হয় না। সন্তোষ চৌধুরী।
কে?
আমি কল্যাণী। মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় কল্যাণী।
কল্যাণী দেবী! লাগেনি তো?
না।
এত রাত্রে নিচে যে আপনি? শুতে যাননি এখনো? সন্তোষ প্রশ্ন করে।
না। শুইনি যে এখনো দেখতেই তো পাচ্ছেন। আপনিও তো শোননি এখনো দেখছি? পাল্টা প্রশ্ন করে কল্যাণী।
না। ঘুম আসছিল না তাই অন্ধকার বারান্দায় ঘুরে বেড়াছিলাম।
আমিও তাই। মৃদু হাস্য-তরল কণ্ঠে কল্যাণী প্রত্যুত্তর দিল।
কল্যাণীর কণ্ঠস্বরের মধ্যে যে একটা হাসির চাপা আভাস আছে সন্তোষের কিন্তু বুঝতে সেটা কষ্ট হয় না। অজ্ঞাতেই বোধ হয় ভ্রূ দুটো তার একটু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
অতর্কিতেই সন্তোষ বলে ওঠে, হাসছেন যে?
হাসছি! কই না তো!
সন্তোষ কোন জবাব দেয় না কল্যাণীর কথায়। চুপ করেই থাকে।
ক্ষণপরে সন্তোষ আবার প্রশ্ন করে, আপনি তো সবিতার মামাতো বোন, তাই না?
হ্যাঁ। রক্তের সম্পর্ক না হলেও আত্মীয়তার সম্পর্কে।
তার মানে?
তার মানে আর কি! রক্তের কোন সম্পর্ক নেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে। সবিদির মা আমার বাবার পাতানো বোন ছিলেন, এই আর কি!
ওঃ। একটা স্বস্তির সঙ্গে যেন ও শব্দটি সন্তোষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো।
নিশ্চিন্ত হয়েছেন বোধ হয় মিঃ চৌধুরী, আমি সম্পত্তির একজন দাবীদার নই বলে? ক্ষণপূর্বের সেই হাস্য-তরল কণ্ঠস্বর অন্ধকারে ধ্বনিত হয়ে উঠলো।
আপনি একজন ভাগীদার হলেই বা অসন্তোষের আমার কি কারণ থাকতে পারতো বলুন? সবিতার সম্পত্তির দাবী নিয়ে তো এখানে আমি আসিনি।
কিন্তু সকলের ধারণা তো তাই।
সকলের ধারণাই যে তাহলে ভুল, এইটুকুই আমি বলতে পারি। আমি এসেছি আমার নিজের দেশের বাড়িতে ফিরে, আমার সাত পুরুষের ভিটাতে। সম্পত্তির ওপরে বা কোন টাকা-পয়সার ওপরে আমার কোন লোভই নেই। এদের কারো সঙ্গে আমার কোন বিবাদও নেই, কেবল আমি আমার ন্যায্য অধিকারে এখানে থাকতে চাই। কিন্তু আশ্চর্য, দেখুন তাও এরা দিতে রাজী নয়!
কল্যাণী সন্তোষের কথার কোন জবাবই দেয় না। জবাব দেবার মত তার কি-ই বা আছে।
সন্তোষ আবার বলতে শুরু করে, এ বাড়ির উপরের তলায় পর্যন্ত নায়েব বসন্ত সেন আমাকে প্রবেশাধিকার দেয়নি। অথচ শুনলেন তো আজ সকালে, বসন্ত সেন নিজের মুখেই স্বীকার করল কাকার উইলে স্পষ্ট লেখা আছে আমি ফিরে এলে আমি আমার ভাগের সম্পত্তি পাবো।
আমাকে এসব কথা বলছেন কেন? এতক্ষণে কোনমতে কল্যাণী কথা কয়টি বলে।
না, না-রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সবিতার তো আপনি আত্মীয়ের মতই। অতঃপর সহসা যেন আলোচনার মধ্যে একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে সন্তোষ বলে ওঠে, আচ্ছা চলি। রাত অনেক হলো। বলতে বলতে সন্তোষ তার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে কল্যাণী থমকে দাঁড়াল। পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল হাত দুটি পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ করে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে নিঃশব্দে কক্ষমধ্যে পায়চারি করছেন।
কল্যাণীর পদশব্দে নিত্যানন্দ কন্যার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকালেন। মুখখানা থম থম করছে—চোখের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অসন্তোষ। গম্ভীর ঘরে প্রশ্ন করলেন নিত্যানন্দ, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?
নিচে বাগানে বেড়াচ্ছিলাম।
এই মাঝরাত্রে নিচের অন্ধকার বাগানে বেড়াচ্ছিলে! বেড়াবার চমৎকার সময়! কন্ঠে শ্লেষ।
কল্যাণী পিতার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
এ সেই নিত্যানন্দ সান্যাল নন, যিনি সর্ব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত নির্বিকার। যিনি শান্ত সহিষ্ণু, অমায়িক।
দুই চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশ ঝকঝক করছে। ক্ষণকাল সেই আক্রোশ-ঝরা দৃষ্টিতে কন্যার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সহসা যেন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বিষোদ্গার করলেন, মিথ্যুক! লজ্জা করলো না তোমার মিথ্যা কথা বলতে! নিচের বারান্দায় থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঐ বখাটে ছোকরার সঙ্গে গল্প করছিলে না?
কল্যাণী নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কথার জবাব দিতেও তার ঘৃণা হয়। সমস্ত মন সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে।
এত রাত্রে ঐ ছোকরাটার সঙ্গে কি তোমার এমন কথা হচ্ছিল শুনি?
তথাপি কল্যাণী নিরুত্তর। এতটুকু স্বরও ওর কণ্ঠ হতে বের হয় না।
আক্রোশে ও জ্বালায় নিত্যানন্দ চাপা কণ্ঠে আবার তর্জন করে ওঠেন,
কি? চুপ কেন? জবাব দাও?
নিরুত্তর। কল্যাণী এখনো নিরুত্তর।
কল্যাণী! কটু তিক্ত কণ্ঠে আবার তর্জন করে উঠলেন নিত্যানন্দ।
কিছুই আমার বলবার নেই। এতক্ষণে ধীরে সংযত কণ্ঠে কল্যাণী জবাব দেয়।
কিছুই তোমার বলবার নেই?
না।
বেশ। কালই তোমাকে আমি লুধিয়ানায় পাঠিয়ে দেবো। গ্রীষ্মের ছুটিটা তুমি হস্টেলেই থাকবে।
বলতে বলতে নিত্যানন্দ কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন।
আর নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত কল্যাণী দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মধ্যে। প্রচণ্ড একটা অগ্ন্যুৎপাতের মত তখন তার সমস্ত অন্তরটা জলে পড়ে যেন একেবারে খাক হয়ে যাচ্ছে।
১৭. সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ
সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ হলো।
কিরীটী চোখ মেলে দেখল শয্যার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে সবিতা। তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট উদ্বেগ।
কি হয়েছে সবিতা দেবী?
আপনি শীগগির একবার নিচে চলুন। লক্ষ্মীকান্তবাবু এসেছেন। নায়েব কাকাকে arrest করে নিয়ে যাচ্ছেন—এ সব কি মিঃ রায়! নায়েব কাকাকে arrest করছেন কেন?
কিরীটী শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে জামাটা গায়ে দিতে দিতে বলে, কেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা নায়েব মশাইকে arrest করেছেন আমি কেমন করে তা বলবো বলুন? তা তিনি কিছু বলেননি কেন ওঁকে তিনি arrest করছেন?
না। কেবল বললেন—এ সব পুলিসের সিক্রেট ব্যাপার, সকলের কাছে বলতে তিনি রাজী নন।
এক্ষেত্রে আমিই বা তাহলে কি করতে পারি বলুন? নির্লিপ্তভাবে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু আমাদের তো একটা প্রতিবাদ করা উচিত।
পূর্বের মতই পরম নির্বিকার ও শান্তভাবে জামার বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে কিরীটী বলল, পুলিসের কোন কাজে প্রতিবাদ করলে তো তারা আপনাকে সমর্থন করবে না সবিতা দেবী!
তাই বলে অন্যায় জুলুম! সবিতার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।
অন্যায় জুলুমই যে তাই বা কি করে আপনি বুঝলেন? চলুন দেখি!
কিরীটী প্রস্তুত হয়ে নিতে নিতে বললে। উভয়ে নিচে বসন্ত সেনের ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে দুখানা চেয়ারে মুখোমুখি নিঃশব্দে বসে আছেন বসন্ত সেন, থানার দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহা আর একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ।
ওদের পদশব্দে বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্ত দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
নমস্কার লক্ষ্মীকান্তবাবু। ব্যাপার কি! এত সক্কালেই? প্রশ্ন করে হাসিমুখে কিরীটী আর একটু এগিয়ে যায় ঘরের মধ্যে।
লক্ষ্মীকান্তর মুখখানা অত্যন্ত গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠেই প্রতিনমস্কার জানিয়ে লক্ষ্মীকান্ত বললেন, মিঃ রায় এসেছেন ভালই হলো। সবিতা দেবী, সত্যজিতবাবু আপনারা অনুগ্রহ করে একটু যদি পাশের ঘরে যান! মিঃ রায়ের সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা ছিল।
কিরীটীই নিঃশব্দে চোখের ইঙ্গিতে সত্যজিৎ ও সবিতাকে কক্ষ ত্যাগ করে যেতে ক্ষণেকের জন্য অনুরোধ জানায়।
দুজনেই নিঃশব্দে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে।
দরজাটা এবারে ভেজিয়ে দিন মিঃ রায়। পূর্ববৎ গম্ভীর কণ্ঠেই লক্ষয়ীকান্ত বললেন।
মৃদু হেসে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল।
বসন্তবাবুকে গতরাত্রেই এসে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম মিঃ রায়। কিন্তু উনি বলছেন আমার সে-সব প্রশ্নের কোন জবাব দিতেই উনি নাকি বাধ্য নন। তাই এক্ষেত্রে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে আইনের প্রয়োগ করতে হচ্ছে।
মিথ্যে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই লক্ষ্মীকান্তবাবু। আমি প্রস্তুত, আপনি চলুন। শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে সহসা কথা বললেন বসন্ত সেন।
কাল আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন, কিন্তু পরের দিক থেকেই শরীরটা কেমন ভাল লাগছিল না তাই
গেলে ভালই করতেন মিঃ রায়। অনেক interesting কথা শুনতে পারতেন।
তাই নাকি? কি রকম? কাল রাত্রে যখন আপনি এসেছিলেন টের পেয়েছিলাম কিন্তু ভাবলাম বসন্তবাবুর সঙ্গে হয়ত কোন গোপনীয় জরুরী। কথা আছে তাই আর বিরক্ত করিনি আপনাকে।
হ্যাঁ, আপনি হয়ত শুনে সুখীই হবেন, কাল সন্তোষবাবুকে থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় অনেক রহস্যই উৎঘাটিত হয়েছে যার ফলে সম্পূর্ণ কেসটাই একটা definite shape নিয়েছে। প্রথমে অবশ্য ভদ্রলোক মুখ খুলতে চাননি কিন্তু জানেন তো মুখ খুলবার দাওয়াই আমাদের জানা আছে—চাপে পড়ে সব প্রশ্নের জবাব শেষ পর্যন্ত দিয়েছেন।
বটে! কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী লক্ষ্মীকান্তর সাফল্যে গদগদ মুখের দিকে।
সহসা এমন সময় বসন্ত সেন তাঁর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললেন, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, সন্তোষবাবু যে সব চিঠি আপনাকে দেখিয়েছেন। একটাও তার সত্য নয়; কারণ গত চব্বিশ বৎসর একখানা চিঠিও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী কাউকে লেখেননি। এমন কি তাঁর মেয়েকেও তিনি নিজহাতে চিঠি কোনদিন লেখেননি। চিঠি যা লেখা হতো তাঁরই জবানীতে আমার হাত দিয়েই।
প্রশ্ন করল এবারে কিরীটীই, কেন তিনি নিজহাতে চিঠি লিখতেন না তার কোন কারণ ছিল কি?
হ্যাঁ ছিল।
সেই কারণটাই তো আপনার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম। লক্ষ্মীকান্ত বলে ওঠেন, কিন্তু উনি বলতে রাজী নন।
রাজী নন কেন? প্রশ্নটা কিরীটীই করে।
না, রাজী নই। আপনাদের বর্তমান তদন্তের ব্যাপারের সঙ্গে আমার ও প্রশ্নের জবাবের কোন সংস্পর্শ আছে বলেই আমি মনে করি না। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয়ের হাতের লেখা আমার যথেষ্ট পরিচিত, চিঠিগুলো আমাকে দেখালেই আমি দপ্তরের খাতাপত্রে তাঁর হাতের যে সব লেখা আছে তার সঙ্গে মিলিয়ে সত্য মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারবো, কিন্তু দারোগা সাহেব চিঠিগুলো আমাকে দেখাতেই রাজী নন!
কিরীটী বসন্ত সেনের কথায় লক্ষ্মীকান্ত সাহার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল এবং বললে, সে চিঠিগুলো আপনার কাছেই আছে বুঝি মিঃ সাহা?
হ্যাঁ। আসবেন আপনি থানায়, দেখাবোখন।
চিঠিগুলো সেন মশাইকে দেখাতে আপনার সত্যিই আপত্তি আছে নাকি?
বর্তমানে আছে, কারণ আপনি চিঠিগুলো পড়লেই জানতে পারবেন।
হুঁ। শুধু, এই জন্যই কি আপনি ওঁকে arrest করেছেন?
না, আরো দুটো কারণ আছে।
আরো দুটো কারণ আছে?
হুঁ, যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নিহত হন সে রাত্রে উনি এখানে উপস্থিত ছিলেন না, ওঁর জবানবন্দীতে বলেছিলেন উনি
না, ছিলাম না তাই বলেছি। মহাল দেখতে গিয়েছিলাম, রাত প্রায় গোটা তিনেকের সময় ফিরি। জবাবটা দিলেন বসন্ত সেন।
কিন্তু সত্যি কথা তো তা নয়। আপনি সেদিন আদপেই এ বাড়ি হতে বের হননি। নিজের ঘরের মধ্যেই ছিলেন।
কথাটা এবারে বলেছিল কিরীটী।
কিরীটীর কথায় যুগপৎ চমকে দুজনেই বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্ত সাহা ওর মুখের দিকে বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায়।
সে কি! তবে যে আপনি গতরাত্রে বলছিলেন জমিদারী সংক্রান্ত কোন একটা বিশেষ গোপনীয় ব্যাপারেই কোন একটা মহালে আপনাকে যেতে হয়েছিল এবং গোপনীয় বলেই মহালের নামটা আপনি বলবেন না? তীক্ষ্ণকণ্ঠে এবারে বসন্ত সেনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা শেষ করলেন সাহা, হুঁ! আসলে আপনি তাহলে এ বাড়ী ছেড়ে সেদিন কোথায়ও যাননি!
কিরীটীর কথায় ও লক্ষ্মীকান্ত সাহার চ্যালেঞ্জে নায়েব বসন্ত সেন যেন একেবারে পাথরের মতই স্তব্ধ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মুখখানাও যেন ঐ মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছিল একেবারে পাথরেই গড়া ভাবলেশহীন। ক্রোধ, বিরক্তি, হতাশা, ব্যথা, লজ্জা, অপমান কোন কিছুই যেন প্রকাশ পাচ্ছে না মুখের স্থির অচঞ্চল রেখাগুলোতে।
নায়েব মশাই, এ কথা তাহলে সত্যি? পুনরায় প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
জানি না। আপনাদের কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে রাজী নই লক্ষমীকান্তবাবু। আপনি আমাকে arrest করতে এসেছেন করুন। কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে চান, চলুন আমি প্রস্তুত। নিরতিশয় একটা তাচ্ছিল্যের সুরই যেন নায়েব বসন্ত সেনের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ল।
আপনি তাহলে জবাব দেবেন না। আবার প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত।
না।
এখন মনে হচ্ছে কানাইয়ের মার অন্তর্ধানের ব্যাপারেও আপনি লিপ্ত আছেন। লক্ষীকান্ত বললেন।
যেমন আপনার অভিরুচি ভাবতে পারেন। মিথ্যে আপনি সময় নষ্ট করছেন দারোগা সাহেব। আমার মুখ থেকে আপনি একটি প্রশ্নেরও জবাব পাবেন না।
লগুড়াহত জানোয়ারের মতই এবারে যেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তীক্ষ্ণ কর্কশ কণ্ঠে বলেন, কিন্তু আমিও লক্ষ্মীকান্ত সাহা। আপনাদের মত বহু নায়েবকেই আমার দেখা আছে। চলুন আগে থানায়, তারপর দেখা যাবে আপনাদের মত ঘুঘু চরিত্রের লোককে
দারোগা লক্ষ্মীকান্তর কথাটা শেষ হল না, মুহূর্তে বাঘের মতই থাবা মেরে রুদ্রার্জুন বসন্ত কেন লক্ষ্মীকান্তর বক্তব্যটা অর্ধপথে থামিয়ে দিলেন লক্ষ্মীকান্ত! ভুলো না এটা বসন্ত সেনের এলাকা। এখনি যদি তোমাকে জ্যান্ত হাত পা বেধে সামনের ঐ বৌরাণীর বিলের জলের ঠাণ্ডা পাঁকের নিচে পুঁতে ফেলি তোমার ফিরিঙ্গি বাপঠাকুদ্দার সাধ্যও হবে না তোমার লাশ খুঁজে বের করে! এ তোমার থানার চৌহদ্দী নয়—ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখনি এখনো।
ঠাণ্ডা বাররু-স্তূপ যেন সহসা একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে দাবানলের মতই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
শান্ত ভদ্র বসন্ত সেনের মধ্যে যে এমন একটি রুদ্র ভয়ঙ্কর রূপ ভস্মাচ্ছাদিত হয়ে চাপা পড়েছিল ভাবতেও যেন বিস্ময় লাগে।
বসন্ত সেনের এ যেন এক অভিনব রূপ।
বৃদ্ধের সমস্ত শরীরটা যেন একটা নিষ্কাশিত তীক্ষ্ণ ধারালো অসির মত ঋজু হয়ে উঠেছে। ক্ষণপূর্বের পাথরের মতই স্থির অচঞ্চল মুখখানি যেন মুহর্তে রুদ্রাগ্নির মতই ধকধক করে জ্বলে উঠেছে।
এককালে জমিদারের নায়েবদের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপের কথা শোনা যেত এ যেন সেই পুরাতন দিনেরই নায়েব। সরকারী কোন আইন বা নীতির এরা ধার ধারে না, এদের আইন এদের কাছে। অশিষ্ট অবাধ্য প্রজাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে এদেরই পূর্ব-পুরুষেরা হয়ত একদা অন্ধকার স্যাঁতসেতে গুপ্তকক্ষে জীবন্ত কবর দিত। রাতারাতি খুন করে লাশ মাটির নীচে পুতে ফেলত, নয়তো পুষ্করিণীর তলায় গলায় পাথর বেধে ড়ুবিয়ে দিত। অথবা জ্যান্ত দেওয়ালের সঙ্গে ইট দিয়ে রাতারাতি গেথে ফেলত।
লক্ষ্মীকান্ত নিজেও বোধ হয় এতটা আশা করেননি। মুহূর্তের জন্য তাই বোধ হয় তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মতই নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং হিংস্র জানোয়ারকে নিয়ে ঘাঁটানো আর বিবেচনার কাজ হবে না ভেবেই নিজের রূপ এবারে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাপরাধের সন্দেহে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করছি। বসন্তবাবু
লক্ষ্মীকান্তর মুখের কথা শেষ হতেই সহসা যেন বাজের মত তীক্ষ্ণ উচ্চকণ্ঠে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন বসন্ত সেন।
কিরীটী লক্ষ্মীকান্ত দুজনেই চমকে ওঁর প্রচণ্ড হাসির শব্দে ওর মুখের দিকে তাকায়। বসন্ত সেন হাসছেন, হাঃ! হাঃ! হাঃ!
কেউই ওঁর হাসিতে বাধা দেয় না।
হাসি থামিয়ে বসন্ত সেন ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, এই বিদ্যা আর বুদ্ধিরই এত দন্ড! তুমি বের করবে মৃত্যুঞ্জয়ের হত্যাকারীকে! এর চাইতে সে আত্মহত্যা করে মরেছে বা অদৃশ্য কোন আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে, যে রিপোর্ট দিয়েছিলে সেই যে ছিল ভাল। মিথ্যা তোমার কাদা ঘেটে নোংরা হওয়াই সার হবে লক্ষ্মীকান্তবাবু। কিন্তু বড় গলায় তো আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলেছ, শেষ পর্যন্ত তোমার আইন দিয়ে আমাকে বেধে রাখতে পারবে তো দারোগাবাবু! যাগগে। মরুক গে। চল কোথায় যেতে হবে—
বসন্ত সেনের উচ্চারিত প্রতিটি কথা যেন নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের ছুঁচ বিধিয়ে দেয় দারোগা লক্ষ্মীকান্তর সর্বদেহে।
লজ্জায় অপমানে আক্রোশে তিনি যেন ফুলতে লাগলেন। রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে। মুখ দিয়ে তাঁর কোন বাক্যও সরে না।
হাতকড়াও দেবে নাকি! না এমনিই গেলে চলবে দারোগাবাবু? আবার প্রশ্ন করলেন বসন্ত সেন।
না, এমনি চলুন আমার সঙ্গে
কিন্তু যদি রাস্তায় তোমাকে একটা থাপড় কষিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাই, ধরে থাকতে পারবে তো? ঐ তো তোমার চেহারা! আমার শক্তির খবর জান তো! বৃদ্ধ হলেও এখনও লাঠি হাতে নিয়ে যদি দাঁড়াই, তুমি তোমার থানার সমস্ত চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়েও সামনে আমার দাঁড়াতে পারবে না।
লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের কথার কোন জবাবই দেন না।
এবারে মৃদু হেসে বসন্ত সেন বললেন, না, ভয় নেই চল। দেখেই আসা যাক তোমার আইনের দৌড়টা কত দূর!
অগ্রে অগ্রে বসন্ত সেন ও পশ্চাতে লক্ষ্মীকান্ত সাহা কক্ষের বদ্ধ দরজাটার দিকে অগ্রসর হলেন। দরজার কাছবরাবর গিয়ে হঠাৎ বসন্ত সেন ঘরে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে সম্বোধন করে বললেন, চললাম কিরীটীবাবু, মৃত্যুঞ্জয়ের সলিসিটার রায় অ্যাণ্ড বোসের অতীনলাল কাল-পরশুর মধ্যে হয়ত এসে পড়বেন। তাঁকে আসতে লিখেছিলাম। মৃত্যুঞ্জয়ের উইলের ব্যাপারে মিঃ বোস আসছেন, সান্যাল মশাই রইলেন, সত্যজিৎ রইলো, সকলের সামনে যেন উইলটা পড়া হয়। সম্পত্তির প্রবেট নিতে হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে সিন্দুকে নগদ টাকা আছে। চাবিটা আমি সবি মার হাতে গতকালই দিয়ে দিয়েছি।
কিরীটী এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। নির্বাক শ্রোতা হয়েই সমগ্র দৃশ্যটা আগাগোড়া উপভোগ করছিল। এখনও চুপ করেই রইল।
হঠাৎ অতঃপর লক্ষীকান্তের দিকে ঘরে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, এক মিনিট দারোগা সাহেব। তুমি একটু বাইরে যাও, আমি কিরীটীবাবুর সঙ্গে কথা বলে এক্ষুনি আসছি।
নিঃশব্দে লক্ষ্মীকান্ত দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে দরজাটা খুলে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
নিঃশব্দে বসন্ত সেন দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
কিরীটীবাবু!
বলুন।
আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
বলুন!
এ ব্যাপারে আর আপনি থাকবেন না। এখান থেকে চলে যান। আপনার পুরো ফিসই আমি দেবো। সবিতা আর সত্যজিৎ ওরা বুঝতে পারবে না—
কিন্তু
তাছাড়া ভেবে দেখুন, কি হবে আর মিথ্যা কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করে
আপনি কি তাই মনে করেন? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কথা কয়টি বলে কিরীটী তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তাই মনে করি। এটকু অন্ততঃ বুঝবার আমার শক্তি আছে কিরীটীবাবু, এবং পেরেছিও। আপনি লক্ষ্মীকান্ত নন, তাই আবার অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি ফিরে যান। বরং আপনার প্রাপ্যের চাইতে বেশীই কিছু—
ভুল করছেন আপনি সেন মশাই। বুঝতেই যখন কিছুটা আপনি আমাকে পেরেছেন, এটকুও আপনার বোঝা উচিত ছিল, টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে আপনি নিরস্ত করতে পারবেন না। তাছাড়া আরো একটা কথা, আমাকে এ কেসে নিযুক্ত করেছেন আপনি নন-সবিতা দেবী। তিনি যদি এখন আমাকে যেতে বলেন আমি সানন্দে এই মুহূর্তে চলে যাবো, অন্যথায়—
তাহলে আপনি স্থিরপ্রতিজ্ঞই?
কথা যখন দিয়েছি, একটা মীমাংসা না করা পর্যন্ত আমার যাবার উপায় নেই সেন মশাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। সত্য-সন্ধানী আমি—সত্য-বন্ধ!
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বসন্ত সেন কিরীটীর চোখের প্রতি চোখ রেখে।
শাণিত তরবারির মতই দুজোড়া চোখের দৃষ্টি পরস্পর যেন পরস্পরের প্রতি নিবন্ধ হয়ে আছে।
বেশ তবে তাই হোক। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বসন্ত সেন জবাব দিলেন।
একটা কথার জবাব আপনার কাছে পেতে পারি কি সেন মশাই? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে।
কি?
এমন কোন স্ত্রীলোককে আপনি কি জানেন, যিনি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিশেষ পরিচিতাই হয়ত ছিলেন, যার নামের আদ্যাক্ষর হয়ত ছিল ল—
কিরীটীর কথা শুনে চকিতের জন্যই যেন বসন্ত সেনের চোখের তারা দুটো জ্বলে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন বসন্ত সেন, না—
হুঁ। আর একটি কথা বলুন! বৌরাণীর বিলে নৌবিহারের জন্য এদের কোন নৌকা বা বোট ছিল কি?
না। জবাবটা বসন্ত সেন এবারে যেন একটু ইতস্তত করে দেন।
আপনার ঠিক স্মরণ আছে?
আছে বৈকি।
হ্যাঁ, একটা কথা গতকাল আপনাকে বলা হয়নি, কানাইয়ের মার ঘরের মেঝেতে কতকগুলো অস্পষ্ট ক্লেপ-সোলের জুতোর ছাপ দেখেছিলাম। এবং ঠিক অনুরূপ জুতোর ছাপ নন্দনকাননের মধ্যস্থিত বিরাম-কুটীরের ঘরের মেঝেতেও দেখেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর ছাপগুলো বুঝি সত্যজিৎবাবুরই, পরে বুঝেছি তা নয়
আমি তো ক্রেপসোল দেওয়া জুতো পরি না রায় মশাই! শান্তকণ্ঠে জবাব দেন বসন্ত সেন।
জানি। কিরীটীর ওপ্রান্তে বঙ্কিম হাসির একটা রেখা জেগে ওঠে এবং ধীরকণ্ঠে বলে, আচ্ছা নমস্কার। প্রয়োজন হলে আমাকে সংবাদ দিতে পারেন সেন মশাই। কারণ—
কিরীটীর কথাটা নায়েব বসত সেন শেষ করতে দিলেন না, প্রশান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, তার প্রয়োজন হবে না। ধন্যবাদ। নমস্কার।
অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে অতঃপর ঘাড় উঁচু করে দরজাটা খুলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে বসন্ত সেন কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিরীটী নির্নিমেষে বসন্ত সেনের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল। ওষ্ঠপ্রাতে আবার তার সেই ক্ষণপূর্বের বঙ্কিম হাসি জেগে ওঠে।
১৮. পর পর দুটি প্রভাত
পর পর দুটি প্রভাত দুটি আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে প্রমোদভবনের উপরে যেন প্রচণ্ড আঘাত হেনে গেল।
কানাইয়ের মার অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্টা হওয়া, নায়েব বসন্ত সেনের লক্ষ্মীকান্ত কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়া।
বসন্ত সেন কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করার ব্যাপারটা আদৌ একটা গুরুতর ঘটনা বলে ধরেননি। ঘর হতে বের হয়ে বারান্দায় দণ্ডায়মান সত্যজিৎ ও সবিতার ব্যাকুল সপ্রশ্ন দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো।
সত্যজিৎ সবিতা দুজনেই যেন একটু বিস্মিত হয়। বসন্ত সেনের মুখের কোথাও উদ্বেগের বা চাঞ্চেল্যের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই যেন। প্রশান্ত মুখ এবং ওষ্ঠপ্রান্তে নিশ্চিন্ত একটি হাসির স্পষ্ট আভাস। কোন বাক্যবিনিময়ই হলো না পরষ্পরের মধ্যে, কেবল নির্বাক দৃষ্টির মধ্যে দিয়েই যেন বসন্ত সেন বুঝিয়ে দিলেন চিন্তার উদ্বেগের কোন কারণ নেই।
অন্দর অতিক্রম করে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বসন্ত সেন হাঁক দিয়ে দারোয়ানকে ডাকলেন।
ভোজপুরী দারোয়ান সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়াল, জি!
লছমনকে বোলনা টমটম তৈয়ার করকে তুরন্ত ইধার আনেকে লিয়ে! নায়েবের হকুমে দারোয়ান সহিস লছমনকে সংবাদ দিতে চলে গেল।
অদূরে গেটের পাশে দারোগার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেদিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, আপনার সঙ্গে ঘোড়া আছে দেখছি দারোগাবাবু-আপনি বরং তাহলে এগোন, আমি টমটমে থানায় আসছি।
আমিও আপনার সঙ্গেই টমটমে যাবোখন—
কিন্তু আপনার ঘোড়া?
সে থানায় গিয়ে একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
দারোগার কথায় বসন্ত সেন মুচকি একটু হাসলেন। বুঝতে পারছিলেন, অতঃপর লক্ষ্মীকান্ত সাহার আর সাহসে কুলোচ্ছে না তাঁকে একলা ছেড়ে যেতে।
বস্তুতঃ কতকটা তাই বটে। বসন্ত সেনকে ঘাঁটাবারও এখানে এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে যেমন আর তাঁর সাহস ছিল না তেমনি তাঁকে এখানে একা ছেড়ে থানায় ফিরে যেতেও ভরসা পাচ্ছিলেন না। যেমন করে হোক যত শীঘ্র সম্ভব এখন বসন্ত সেনকে নিয়ে থানায় নিজের এলাকার মধ্যে গিয়ে তুলবার জন্য মনে মনে সত্যিই তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।
ক্ষণপূর্বে কক্ষের মধ্যে বসন্ত সেনের উচ্চারিত তাঁর সদম্ভোক্তিগুলো লজ্জায় অপমানে আক্রোশে যেন তাঁর ভিতরটা পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল, কিন্তু এখানে একাকী অসহায়ভাবে তাঁরই চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড়িয়ে হুমকি ছাড়বার মত দুঃসাহস আর তাঁর ছিল না।
কিন্তু তার কোন প্রয়োজন নেই দারোগাবাবু! স্বেচ্ছায় যখন আপনার হাতে নিজেকে ধরা দিতে চলেছিই, আর যাই হোক বসন্ত সেন কথার খেলাপ করবে না। বেশ, তাহলে না হয় একটু অপেক্ষাই করুন—টমটমটা আসুক।
বারান্দার উপরেই দুজনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লছমন টমটম জুতে নিয়ে এল।
বসন্ত সেন এগিয়ে যেতেই লছমন নায়েবের হাতে লাগামটা তুলে দিল সসম্ভ্রমে।
বসন্ত সেন বরাবরই টমটম নিজেই চালান।
পাদানীর উপরে পা দিয়ে টমটমে উঠে বসে লাগামটা জুত করে ধরে চাবুকটা হাতে নিচ্ছেন বসন্ত সেন, লক্ষ্মীকান্ত এগিয়ে এলেন পাদানীর দিকে টমটমে উঠে বসবার জন্য। কিন্তু ঠিক সেই মুহর্তে যেন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। চকিতে ঘোড়াটার লাগামটা টেনে উদ্ধত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে লক্ষ্মীকান্তকে সম্বোধন করে বসন্ত সেন বললেন, উহ! এ টমটমে নয়, এ ঘোড়াটা নতুন, বড় তেজী। কখন কি বিপদ ঘটায় বলা যায় না, আপনি আপনার ঘোড়ায় চেপেই বরং আমার পিছনে পিছনে আসুন-বলতে বলতে হাতের মুঠোয় ধরা চাবুকটা শূন্যে আন্দোলিত হয়ে হুস করে একটা শব্দ তুলতেই শিক্ষিত তেজী ঘোড়া নক্ষত্রবেগে ছুটে যেন টমটমটাকে টেনে নিয়ে সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হতভম্ব লক্ষ্মীকান্ত স্তব্ধ হয়ে গেটের সামনে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সমস্ত অন্তরটা তখন যেন একটা ভীষণ অগ্নুৎপাতের মত জলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল তাঁর।
দাঁতে দাঁত চেপে অদূরে গাছের সঙ্গে বাঁধা রোগ-জীর্ণ ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে সমস্ত শরীর যেন তাঁর কাঁপছে, পা টলছে।
ঘোড়াটার উপরে উঠতে গিয়ে দুদুবার উঠতে পারলেন না লক্ষ্মীকান্ত! এখনো অশ্ব ব্যাপারে লক্ষ্মীকান্ত খুব বেশী রপ্ত হননি।
তিনবারের বার উঠে বসলেন তিনি ঘোড়ার পিঠে।
ধীরে ধীরে দুলকি চালে ঘোড়া চলতে লাগল। রাস্তায় পড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেবল একটা ধুলোর চক্র সম্মুখের পথটাকে ধুম্রজালের মত আচ্ছন্ন করে আছে—টমটমের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
***
কক্ষের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিরীটী। ক্ষণপূর্বের হাসির যে বঙ্কিম রেখাটি ওষ্ঠপ্রান্তে তার দেখা দিয়েছিল সেটা একসময় মিলিয়ে গিয়েছে, কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ পদশব্দে চোখ তুলে তাকাতেই নজরে পড়ল কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছে সত্যজিৎ ও সবিতা।
আসুন সত্যজিৎবাবু, সবিতা দেবী! ওরা চলে গেলেন?
হ্যাঁ, নায়েব টমটমে গেলেন আগে-পিছনে গেলেন দারোগাবাবু। জবাব দিল সত্যজিৎ।
তাই নাকি! কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে আবার সেই বিচিত্র হাসি জেগে ওঠে, বেশ শক্ত পাল্লায় পড়েছেন এবারে আমাদের সাহা মশাই!
কিন্তু এ অত্যন্ত অন্যায় জুলুম আপনাকে আমি বলতে পারি কিরীটীবাবু! কখনই হতে পারে না, নায়েব কাকা বাবার কোনপ্রকার অনিষ্ট চিন্তা।করতেই পারেন না। কেউ বললেও আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আবেগে উত্তেজনায় সবিতার কণ্ঠস্বরটা কাঁপছিল।
আপনি ব্যস্ত হবেন না সবিতা দেবী। স্নিগ্ধ আশ্বাস-ভরা কণ্ঠে কিরীটী বলে, বসন্তবাবু, দোষী কি নিদোষী সে বিচার করতে যাওয়া এখন হয়ত আমাদের কারো পক্ষেই বিবেচনার কাজ হবে না, আইনের জোর দেখিয়ে যে লক্ষীকান্ত ওঁকে ধরে নিয়ে গেলেন সেটার মীমাংসার অবশ্য অন্য পথও ছিল। একেবারে সটান হাজতে নিয়ে গিয়ে না পরলেও চলতো।
কিন্তু কারণটা কি মিঃ রায়? প্রশ্ন করলো এবারে সত্যজিৎ।
বসন্তবাবু, তাঁর জবানবন্দীতে বলেছিলেন যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হন সেদিন সকালের দিকেই নাকি একটা মহাঁল পরিদর্শনে গিয়ে ফিরেছিলেন তিনি ঐদিন রাত দুটোর পরে। কিন্তু
কিন্তু
কিন্তু আদপেই তিনি ঐদিন কোন মহালে যাননি। নিজের ঘরেই ছিলেন। কথাটা বললে কিরীটী।
সে কি!
হ্যাঁ, তবে দারোগাবাবুও সে-কথা জানতেন না এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত। তিনি মানে আমাদের দারোগাবাবু, ওঁকে পীড়াপীড়ি করছিলেন জানবার জন্য কোন মহাল পরিদর্শনে উনি গিয়েছিলেন, কিন্তু বসন্তবাবু, সেকথা বলতে রাজী নন। পরে অবশ্য আমার কথায় ব্যাপারটা যেন আরো ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল।
কিন্তু আপনার কথাই কি সত্যি মিঃ রায়? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলে এবারে সবিতা।
হ্যাঁ সবিতা দেবী।
সে কথা আপনি জানলেন কি করে মিঃ রায়?
কানাইয়ের মার মুখে
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হলো।
কানাইয়ের মার মুখে? প্রশ্ন করলে সত্যজিৎ।
হ্যাঁ।
কিন্তু আপনার সঙ্গে তার কথা হলো কখন? আবার সত্যজিৎ প্রশ্ন করে।
যে রাত্রে সে নিরুদ্দিষ্টা হয়, মানে পরশু রাত্রে শুতে যাবার আগে সিঁড়িতে কানাইয়ের মার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে এনে কয়েকটা প্রশ্ন করি। তখনই ওই কথাটা নায়েব সম্পর্কে জানতে পারি। প্রথমটায় সে বলতে রাজী হয়নি, পরে চাপ দিয়ে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে সত্য কথাটা বের করে নিয়েছিলাম।
তবে কি সত্যিই কানাইয়ের মা ওঁর, সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, বাবার মৃত্যুর আসল ঘটনাটা জানত নাকি?
না।
ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, কানাইয়ের মার অতর্কিতে পরশু রাত্রে নিরুর্দিষ্টা হবার ব্যাপারটা আপনাকে যেন নাড়া দিতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে তার evidenceগুলোও অন্ততঃ বিশেষ ভাববার ছিল না কি?
নিশ্চয়ই। তাতে কোন ভুল নেই সত্যজিতবাবু। তবে এই ব্যাপারে কানাইয়ের মা যতটুকু part play করতে পারতো, she already played it এবং তার নিকট হতে যতটকু information আমাদের পাওয়ার ছিল আমরা পেয়েও গিয়েছি, তাই বর্তমানে সে অবান্তর। হত্যাকারী তাকে spot থেকে সরিয়ে ফেলে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে বলে তো আমার মনে হয় না! বরং সে একটু দেরিই করে ফেলেছে আমার মতে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা ভুল সে কি করেছে জানেন? শেষ পর্যন্ত ঐ কানাইয়ের মার ব্যাপারে তৎপর হতে গিয়েই। বেচারা বুঝতে পারেনি, হঠাৎ আচমকা এই case-এর evidence কতকগুলো নষ্ট করবার ইচ্ছায় কানাইয়ের মাকে না সরালে তার কাছে পৌঁছবার একটা নির্দিষ্ট পথ আমরা পেয়ে যাব। তবে এইটুকুই বলতে পারি সত্যজিতবাবু, কানাইয়ের মাকে হত্যা সে করেনি আর সেই কারণেই আমি কানাইয়ের মার নিরুদ্দেশ হওয়া সম্পর্কে খুব বেশী আকর্ষিত হইনি।
কিন্তু কি করে আপনার ধারণা হলো যে কানাইয়ের মাকে সত্যি সত্যিই হত্যা করা হয়নি?
যুক্তি দিয়ে এখনি আপনাকে আমি বলতে পারছি না সত্যজিৎবাবু তবে বলতে পারেন এটা আমার মনের একটা intuition, আমার মনের অনুভূতিই আমাকে তাই বলছে।
কিন্তু নায়েব কাকা সম্পর্কে কি করা যায় কিরীটীবাবু? এতক্ষণে সবিত্য কথা বললে।
একটু আগেই তো আপনাকে আমি বললাম সবিতা দেবী, লক্ষ্মীকান্তবাবু কতকটা জিদের বশেই বসন্তবাবুকে arrest করে নিয়ে গেলেন। আমি হলে arrest করতাম না। শেষের কথাটা কিরীটী যেন কতকটা অস্পষ্ট কণ্ঠে আত্মগতভাবেই উচ্চারণ করল।
সবিতা বা সত্যজিৎ দুজনের একজনও কিরীটীর কথার শেষটুকু তার উচ্চারণের অস্পষ্টতার দরুন শুনতে পায়নি, তাই সবিতাই প্রশ্ন করে, অ্যাঁ, কি বললেন মিঃ রায়?
না, ও কিছু না।
কিন্তু সে যাই হোক, যেমন করেই পারেন বসন্ত কাকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আপনাকে আসতেই হবে মিঃ রায়।
দেখি।
না, দেখি নয় মিঃ রায়, মনে হয় একমাত্র হয়ত দারোগাবাবু, আপনার কথাই শুনলেও শুনতে পারেন। বলবেন না হয়, ওঁর জন্য জামিন হতে হলে আমিই হব। যা টাকার জামিন চান উনি, প্রস্তুত আছি।
কিরীটী সবিতার মুখের দিকে তাকাল, বুঝলাম, কিন্তু দারোগা সাহেব arrest করেই নিয়ে গেছেন। Arrest একবার কাউকে এইভাবে করবার পর, বিশেষ করে খুনের সন্দেহে, এখন জিলার ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া তো আর কেউই তাঁকে জামিন দেবার অধিকারী নন। তাহলে আপনাকে জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই গিয়ে প্রার্থনা জানাতে হয়।
সত্যজিৎ এতক্ষণ চুপ করেই ছিল, এবারে সে মুখ খুললে, মিথ্যে কেন ব্যস্ত হচ্ছে সবিতা। ওঁর উপরে আমরা যখন সব কিছুতে নির্ভর করছি, যা ভাল বোঝেন উনি করবেন।
কি বলছো তুমি জিত! জান না উনি আমাদের কতখানি! বাবা যে ওঁকে কতখানি স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন আর কেউ তা না জানলেও আমি তো জানি। আর উনিও বাবাকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন তেমনই ভালবাসতেন।
সবিতার কথাটা শেষ হল না, ঘরের বাইরে চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল না অথচ নিত্যানন্দ সান্যাল ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখেমুখে উদ্বেগের একটা কালো ছায়া যেন ঘনিয়ে আছে। ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, এই যে তোমরা সব দেখছি এই ঘরেই আছো, এত সক্কালে দারোগাবাবুই বা এসেছিলেন কেন আর টমটম করে বসন্তই বা অত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল?
নিত্যানন্দ সান্যালের প্রশ্নে সবিতার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, রুদ্ধকণ্ঠে সে-ই জবাব দিল, নায়েব কাকাকে দারোগা লক্ষ্মীকান্ত arrest করে নিয়ে গেলেন।
Arrest করে নিয়ে গেলেন? বসন্তকে? মানে, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন সান্যাল।
বাবার হত্যার ব্যাপারে, কথাটা সবিতা শেষ করতে পারল না।
দয়াময়! প্রভু! বসন্ত শেষ পর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয়কে, উহু না—না! তা হতে পারে না—নিঃশব্দে আপন মনেই মাথা দোলাতে লাগলেন সান্যাল, বিচিত্র বিচিত্র! বসন্ত কিনা মৃত্যুঞ্জয়কে
কিরীটী আর দাঁড়ায় না, একসময় নিঃশব্দেই পাশ কাটিয়ে ঘর হতে বের হয়ে আসে।
কিরীটীকে ঘর ত্যাগ করে যেতে দেখে সান্যাল সবিতাকে সম্বোধন করে বলেন, উহু এ তো ভাল কথা নয় মা সবি! এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।
আমিও তাই কিরীটীবাবুকে একটু আগে বলছিলাম।
কিরীটীবাবু তো চলে গেলেন দেখছি। তা উনি কি বললেন?
এখন ওঁকে জামিনে খালাস করতে হলেও নাকি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাদের যেতে হবে।
বেশ তো। সত্যজিৎবাবু, তুমিই হয় একটিবার তাহলে আজ সুদূরে চলে যাও—আমি চিঠি দিয়ে দেবোখন। কিন্তু তা যেন হলো, এদিকে এদিককার জমিদারীর ব্যাপারই বা কে সব দেখাশোনা করবে? কাছারীতে গিয়েও তো একজনের বসা দরকার? সাকসেশন সার্টিফিকেট উইলের প্রাবেট এসবও তো কিছু এখনও নেওয়া হয়নি!
কাকাবাবু, ফিরে না আসা পর্যন্ত কাছারী বন্ধই থাক মামাবাবু! সবিতা জবাব দিল।
পাগলী মেয়ে! তাই কি হয় রে! এত বড় জমিদারী, এত বড় ব্যবসা। মাথার উপরে একজন শক্ত হাতে লাগাম না ধরে থাকলে কর্মচারীরা চুরিডাকাতি করেই যে সব দুদিনে ফাঁক করে দেবে।
তাহলে কাকাবাবু, যতদিন না ফিরে আসেন আপনিই না হয় সব দেখাশোনা করুন মামাবাবু।
না, না—মা। এই বৃদ্ধ বয়সে ওসবের মধ্যে আর আমাকে জড়িয়ে ফেলবে কেন মা!
কিন্তু মামাবাবু, আপনি ছাড়া এসব আর তাহলে দেখবেই বা কে? আমি তো ওসবের কিছুই জানি না, বুঝিও না!
তাই তো! তুমি যে আমাকে বড় বিপদে ফেললে মা! অগত্যা চোখের উপরে আমি বেঁচে থাকতে হেমের একটিমাত্র সন্তানের সব ভেসে যাবে তা তো আর দেখতে পারবো না। যাই তাহলে, আমিই না হয় কাছারীতে যাই। তারপরই উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিলেন, বনমালী! এই বনমালী!
ডাক শুনে বনমালী এসে হাজির হল। সে বোধ হয় ঘরের আশপাশেই কোথাও ছিল।
আমায় ডাকছিলেন মামাবাবু?
হ্যাঁ, এই যে বাবা বনমালী! যাও তো বাবা, টমটমটাকে জুততে বল তো! কাছারী যেতে হবে।
টমটম, তো নায়েবজী নিয়ে বাইরে গেছেন, এখনও ফেরেননি।
ও হ্যাঁ। দেখেছো কি ভুলো মন আমার! সত্যিই তো, টমটমটা তো বসন্ত ভায়াই নিয়ে গেছেন—তা ঘোড়া আছে তো?
তা আছে।
তা ঘোড়াতেই জিন করিয়ে আনতে বলগে।
যে আজ্ঞে।
বনমালী চলে গেল। সান্যালও বোধ হয় কাছারিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হতেই চলে গেলেন।
ঘরের মধ্যে কেবল সবিতা ও সত্যজিৎ।
সবিতা? সত্যজিৎ ডাকে।
বল? সত্যজিতের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকলি সবিতা।
মনে হচ্ছে আজকের ব্যাপারে তুমি যেন অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছো?
কালকের ও আজকের ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশঙ্কা জাগছে জিৎ। আমার সত্যি বলছি কেমন যেন ভয়-ভয় করছে।
কিন্তু এখন তো বুঝতে পারছো সবিতা, তোমার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই প্রকাণ্ড একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ক্রমে ক্রমে এখন সব একটু একটু করে জানা যাচ্ছে অনুসন্ধান করতে গিয়ে।
সবিতা সত্যজিতের যুক্তিকে খণ্ডনও যেমন করতে পারে না তেমন ও সম্পর্কে কোন কথাও যেন বলবার স্পৃহা পর্যন্ত বোধ করে না।
কি শান্তিই ছিল তাদের এই বাপ ও মেয়ের সংসারে। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার আবির্ভাব কেন? কেন এ কালো মেঘ?
সত্যিই জিৎ, আমার কি মনে হচ্ছে জান? এই বাড়ি-ঘর দুয়ার সমস্ত সম্পত্তি ফেলে রেখে কলকাতার হস্টেলেই আবার ফিরে যাই।
তাতেই এই সঙ্কটকে কি তুমি এড়াতে পারবে সবি?
কিন্তু এখানকার হাওয়াই যেন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। আমার যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।
আর কটা দিন অপেক্ষা করো, কিরীটীবাবু, তোমার বাবার হত্যা-রহস্যের একটা মীমাংসা করতে পারেন ভালো, নচেৎ আমি তো
সত্যি কথা বলতে কি তোমায় জিৎ, তাতেও যেন আর আমার খুব বেশী উৎসাহ বা রুচি নেই।
সে কি! এ তুমি কি বলছে সবি?
হ্যাঁ। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানবার পর থেকে, বাবার ও মৃত্যুর ব্যাপারে কোথায় যেন একটা পারিবারিক জটিলতাই জড়িয়ে আছে, যেটা এতদিন হয়ত কালের অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল সকলে ভুলেও গিয়েছিল, এখন আবার এই মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে হয়ত সেই সব অতীতের কাহিনী মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।
ও কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় সবিতা কিন্তু অতীতে ধরেই যদি নিই একটা পারিবারিক কলঙ্ক থেকেই থাকে এবং সেই জন্যই শুধু, তুমি তোমার জন্মদাতা অমন স্নেহময় পিতার হত্যাকারীকে এমনি করে নিষ্কৃতি দাও তাহলে তুমিই কি মনে শান্তি পাবে? পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে কোন দিন?
কিন্তু তুমি— সবিতা আর নিজেকে রোধ করে রাখতে পারে না। গত কয়েক দিন ধরে যে প্রশ্নের কাঁটাটা নিরন্তর তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছিল, তার মা ও বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয়ই একটা অতীতের পারিবারিক কলঙ্ক কোথায়ও আছে এবং সেটা একদিন যখন সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়বে দিনের আলোর মত সেদিন তখন সত্যজিৎ কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে?
এত বড় শোক ও দুঃখের মধ্যেও যে সদ্যজাত প্রেম তার সমগ্র হৃদয়কে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, শেষ পর্যন্ত যদি তারই পারিবারিক একটা অতীত কলঙ্কের জন্য তাকে আবার ভুলে যেতে হয়, সে ব্যথাকেই বা সে ভুলবে কেমন করে কি সানায়!
সত্যজিৎ! সত্যজিৎ! না, না—তাকে আজ আর সে হারাতে পারে না! কিন্তু পিতার প্রতি কন্যার কর্তব্য
আজ দুদিন ধরে ঐ দ্বন্দ্বেই সে অহর্নিশি পীড়িত হচ্ছে।
১৯. লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে রুদ্ধ আক্রোশে ফুলতে ফুলতে লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন। থানার দুজন চৌকিদার এসে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরল।
ঘন ঘন চাবুকের ঘায়ে জর্জরিত করে ও দুই পা দিয়ে পেটে ক্রমাগত লাথি মেরেও অশ্বের গতি তিনি বাড়াতে পারেননি। ঘোড়াটার মুখ দিয়ে ফেনী গড়াচ্ছিল। আশেপাশে চেয়ে দেখলেন লক্ষ্মীকান্ত, কিন্তু টমটম বা বসন্ত সেন কাউকেই নজরে পড়ল না। ঘোড়া হতে নেমে ঘর্মাক্ত কলেবরে থানার বারান্দায় এসে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত। সেখানেও বসন্ত সেন নেই।
থানার বারান্দায় এ. এস. আই. পাণ্ডে দুজন চাষীর এজাহার নিচ্ছিলেন। চাষী দুটো সানুনাসিক কণ্ঠে পাণ্ডেকে কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল, সহসা ওদের দিকে নজর পড়ায় যেন বোমার মতই ফেটে পড়লেন লক্ষ্মীকান্ত, হাজতঘরে নিয়ে শুয়েরিকা বাচ্চাদের বেশ করে ঘাতক দাও, তবেই সব স্বীকার করতে পথ পাবে। যেমন কুকুর তার তেমনি মগের চাই।
অকস্মাৎ বড়বাবুকে আক্রোশে ফেটে পড়তে দেখে বিস্মিত পাণ্ডে মুখ তুলে তাকাল তার দিকে।
চাষী দুজন অপরাধী নয়, একটা চুরির ব্যাপারে থানা থেকেই সাক্ষী হিসাবে ওদের এজাহার নেওয়া হচ্ছিল। অকারণে ওদের হাজতঘরে পরে ঠ্যাঙাবার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
নায়েব বসত সেন এসেছিল পাণ্ডে? প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত।
কে, নায়েববাবু! হ্যাঁ, তিনি তো প্রায় মিনিট পনেরো আগে এসেছিলেন টমটমে করে। একখানা জরুরী চিঠি আপনার নামে লিখে রেখে গেছেন। বলে গেলেন আপনি এলেই আপনাকে দিতে।
কি বললে? সে চিঠি লিখে রেখে চলে গেছে? কর্কশ কণ্ঠে শুধোলেন লক্ষ্মীকান্ত সহকারী পাণ্ডেকে।
হ্যাঁ—এই যে চিঠি স্যার!
বলতে বলতে একটা ভাঁজকরা চিঠি এগিয়ে দিলেন পাণ্ডে বড়বাবুর দিকে।
চিঠি! কে চায় সে বদমায়েশের চিঠি! যেন একেবারে খেকিয়ে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত, সে বেটাকে আমি গ্রেপ্তার করেছিলাম। আর সে বেটা কিনা দিব্যি তোমাকে একটা চিঠি গছিয়ে দিয়ে ভেগে গেল! আহাম্মক! গদভ কোথাকার! কি করো? ঘাস খাও? যত সব অপদার্থ অকর্মার দল!
ব্যাপারটা যেন এতটুকুও বোধগম্য হয়নি এমনি হাঁ করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে পাণ্ডে লক্ষ্মীকান্তর দিকে কিছুক্ষণ, তারপর ঢোক গিলে বলে, গ্রেপ্তার! নায়েবজীকে গ্রেপ্তার করেছেন স্যার?
হ্যাঁ। ঐ বেটা ঘুঘুই তো জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে হত্যা করেছে।
বলেন কি!
চিঠিটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন লক্ষ্মীকান্ত!
সংক্ষিপ্ত চিঠি।
লক্ষ্মীকান্ত,
ভয় নেই আমি পালাচ্ছি না। দুচার দিনের মধ্যেই আমি আবার ফিরে আসছি, বিশ্বাস
করতে পারো আমার কথায়। কতকগুলো জরুরী কাজ আছে আমার হাতে, সেগুলো শেষ না করা
পর্যন্ত কিছুতেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমার কথায় যদি বিশ্বাস করো তাহলে আমার
জামিন আমি রইলাম। আর একটা কথা, এ নিয়ে আবার সবিতাদের উপর কোন হামলা করো না।
কথাটা বলতে হলো এই জন্যে যে তোমার পক্ষে বিচিত্র কিছুই নেই। বুদ্ধিটা আবার তোমার একটু
বেশী মাত্রায় প্রখর কিনা। সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, যেন প্রমোদভবনের কারো উপরে
এতটুকুও কোন জুলুম না হয়, তাহলে ফিরে এসে তোমাকে জীবন্ত রাখবো না।
নায়েব বসন্ত সেন।
আক্রোশে হতাশায় অপমানে যেন লক্ষ্মীকান্তর সমস্ত অন্তরটা অগ্ন্যুৎপাতের মত দাউ দাউ করে জ্বলছে। পঠিত চিঠিটা আক্রোশে হাতের মুঠোর মধ্যে দুমড়াতে দমড়াতে রোষকষায়িত লোচনে পাণ্ডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দিকে গেছে সে?
মনে হল স্টেশনের দিকেই যেন গেলেন স্যার!
এই মুহূর্তে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়ুন—যেমন করে হোক তাকে গ্রেপ্তার করে আনা চাই বা তার সংবাদ আনা চাই। যান।
যাচ্ছি স্যার। তাড়াতাড়ি পাণ্ডে উঠে দাঁড়ালেন। লক্ষ্মীকান্ত চীৎকার করে উঠলেন, সমশের-ইসমাইল!
থানার দুই জাঁদরেল ষণ্ডামাকা সেপাই। থানার যত অপকর্ম ওদের দিয়েই করানো হয়। হতদন্ত হয়ে তারা বড়বাবুর ডাক শুনে ছুটে এলো, হোজুর
ছোটবাবু স্টেশনে যাচ্ছেন সাইকেল চেপে। তোমরাও যাও। নায়েব বসন্ত সেনকে ধরে আনতে হবে।
সমশের আর ইসমাইল।
লক্ষ্মীকান্তর দুটি যমদুত-সদৃশ সাকরেদ। এ সব ব্যাপারে এক পায়ে তো ওরা দাঁড়িয়েই আছে সর্বদা।
সমশের ও ইসমাইল দুজনের আবার নায়েব বসন্ত সেনের উপরে রাগও ছিল।
জমি সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে মাস দুই আগে ওরা একটা চাষী জোতদারকে সায়েস্তা করতে গিয়েছিল, আচমকা পূর্বাহ্নেই সংবাদ পেয়ে তীরের মত ঘোড়া ছুটিয়ে নায়েব বসন্ত সেন অকুস্থানে এসে হাজির হয়।
বসন্ত সেনের হাতে ঘোড়া হাঁকাবার সময় বিনুনী-কর চামড়ার একটা চাবুক ধরা থাকত। চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই বসন্ত সেন ঘোড়া থেকে ঘর্মাক্ত কলেবরে লাফিয়ে ভূমিতে এসে দাঁড়াল, কি ব্যাপার সেপাই?
চাষী জোতবার পরাণ মণ্ডল নায়েবকে দেখে কেদে পড়ল, দেখেন কত্তা, সেপাইদের অত্যাচারটা একবার দেখেন। মিথ্যে মিথ্যে ওরা আমায় থানায় নিয়ে যেতে চায়।
বসন্ত সেন বললেন, সেপাই, তোমরা থানায় যাও। আমি দারোগা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যাবোখন। বলো সাহেবকে ওর জামিন আমি রইলাম।
সমশের আর ইসমাইল দুজনেই খিঁচিয়ে উঠেছিল কটুকণ্ঠে, সরে যান নায়েব মশাই! এ সব থানা-পুলিসের ব্যাপারে আপনি মোড়লি করতে এসেছেন কেন?
বাঘের মতই অকস্মাৎ গর্জে উঠেছিলেন বসন্ত সেন, এই শুয়ারকি বাচ্চা! জানিস কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস? চাবকে একেবারে পিঠের চামড়া তোদের তুলে নেবো।
ইতিমধ্যে গোলমাল ও চেঁচামেচিতে প্রায় শখানেক চাষী সেখানে চারপাশে এসে ভিড় করেছে। লোহার মত কঠিন শক্ত দেহের বাঁধনি তাদের।
রাগে গর্জাতে গর্জাতে সমশের আর ইসমাইলকে থানায় ফিরে আসতে হয়েছিল।
সেযাত্রায় অবশ্য থানার দারোগাকে বসন্ত সেন শপাঁচেক টাকার নোট গুজে দিয়ে তার রোষবহ্নি হতে পরাণ মণ্ডলকে বাঁচিয়েছিল।
সমশের আর ইসমাইলকে দারোগা সাহেব চোখ রাঙিয়েই বলেছিল, জমিদারের এলাকায় বাস করতে হলে একটু সাবধান হয়ে বুঝে-সুঝে কাজ করতে হয়।
কিন্তু রৌপ্য চাকতির একটি ভগ্নাংশও তাদের পকেটে যায়নি, অতএব তাদের রাগটা বসন্ত সেনের উপরে প্রশমিত হবার সুযোগ পায়নি। তারা এতদিন সুযোগের অন্বেষণেই ফিরছে। আজ মিলেছে সুযোগ। মহা উল্লাসে তারা বসন্ত সেনের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী সাইকেলবাহী পাণ্ডের পশ্চাতে পশ্চাতেই বের হয়ে পড়তে দেরি করে না এতটুকুও।
আর ঠিক ঐ সময়ে প্রমোদভবনের মধ্যে কোথাও একটা সাইকেল পাওয়া যায় কিনা অনুসন্ধান করে ফিরছিল কিরীটী।
বনমালী বললে, কাছারীর পাইক রামশুরণের একটা ভাঙা সাইকেল আছে। বেচারা ঘোড়ায় চড়তে জানে না বলে কর্তাবাবু তাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, জরুরী সংবাদ কখনো দেওয়া-নেওয়া করতে হলে রামশরণকে দ্রুত যাওয়া-আসার জন্য। মাস দুই হলো রামশরণ ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। নিচের যে ঘরে সে থাকত সে ঘরেই সাইকেলটা আছে। আনবো সেটা?
কিরীটীর আদেশে রামশুরণের সাইকেলটা এনে দিল বনমালী। কিরীটী সাইকেলটা চেপে বের হয়ে পড়ল।
বৌরাণীর বিলটার ধার দিয়ে যতদূত বাঁধানো সড়ক ছিল চালিয়ে শেষে কাঁচা রাস্তায় এসে পড়ল কিরীটী। কাঁচা সড়কে গত দুদিনের বৃষ্টির ফলে কাদা জমে আছে। কোনমতে তার মধ্যে দিয়েই সাইকেল চালিয়ে সন্তর্পণে এগুতে লাগল কিরীটী।
বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিক ওটা। জনহীন, মানুষের বসতি বড় একটা নেই এদিকে। বেশীর ভাগই জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে কেবল দুএকটা চালাঘর এদিকটায় চোখে পড়ে।
এই জঙ্গলই অস্পষ্ট রেখায় গত সন্ধ্যায় নন্দনকানন হতে দেখা গিয়েছিল। মাথার উপরে বৈশাখের জলন্ত সূর্য। পিপাসায় কণ্ঠতালু কাঠ হয়ে উঠেছে। কোথাও একটু তৃষ্ণার জল পাওয়া যায় কিনা এদিক ওদিক তাকাতে লাগল কিরীটী।
সহসা নজরে পড়ে ছোট একটা বাড়ি। চালাঘর বললে ভুলই হবে। মেঝে ও দেওয়ালের পাকা গাঁথুনির উপরে খড়ের ছাউনি। আশেপাশের খানিকটা স্থানও পরিচ্ছন্ন। তবে সংস্কারের অভাবে ও অযত্নে জঙ্গলাকীর্ণই হয়ে আছে।
এমন নির্জনে একেবারে জঙ্গলের প্রান্তে এমন একটা বাড়ি দেখে একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল সে।
বাড়িটায় কোন লোকজন আছে বলেও মনে হয় না। কোথাও কোন পত্রান্তরালে বসে একটা ঘুঘু কূজন করছিল।
কিরীটী সাইকেল হতে নেমে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। সহসা এমন সময় বাড়ির পশ্চাৎ দিক হতে একটি প্রৌঢ় বাড়ির সামনে এসে কিরীটীকে অদূরে সাইকেলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।
লোকটার সাজ-পোশাকে ও চেহারায় এ দেশীয় বলে মনে হয় না।
উঁচু লম্বা চেহারা। মুখে সাদা-পাকা চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি রঙিন কাপড়ের। পরিধানে রাজপুতদের ধরনের পায়জামা, গায়ে একটা রঙিন পাতলা পাঞ্জাবি, পায়ে নাগরা।
মনে হয় লোকটা কোন রাজপুত-বংশীয়ই হবে। কিরীটী হাতের ইশারায় লোকটিকে ডাকল।
প্রৌঢ় ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করে বোধ হয় কি ভাবলে, তারপর ধীরে মন্থর পায়ে নাগরা জুতোর মচমচ শব্দ তুলে কিরীটীর সামনে এগিয়ে এল এবং অত্যন্ত রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, কেয়া? কেয়া মাংতেছে আপ ইধার?
নমস্তে জী, অপিকো দেখনেসে মালুম হোতা হ্যায় কি আপ ইধার বাঙ্গলকা আদমী নেহি হো।
বেশখ বাবাজী, ম্যায় রাজপুত হু। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর মোলায়েম হয়ে আসে।
রাজপুত! বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে, আপ রাজপুতনাকে রহনেওয়ালে?
হ্যাঁ। রাজপুতনার এক গাঁয়ে আমার বাড়ি।
এখানে কতদিন আপনি আছেন? আপনার নাম কি?
আমার নাম সূরযমল সিং, জাতিতে আমরা রাজপুত চৌহান। মাস দেড়েক হলো এখানে এসেছি। কিন্তু কেন বলুন তো?
না, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।
সূরযমল অতঃপর চুপ করেই থাকে।
এখানে কোন কাজ ছিল বুঝি আপনার সিংজী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
কিরীটীর প্রশ্নে সুরযমল একটু যেন থমকে গিয়ে ইতস্ততঃ করে, তারপর মৃদু হাস্যের সঙ্গে মোলায়েম কণ্ঠে জবাব দেয়, কাজ না থাকলে কি সাধ করে নিজের মুলক ছেড়ে এত দূর দেশে কেউ আসে বাবাজী! তা বাবাজী, আপনাকে তো এদিকে কখনও দেখিনি!
না, আমিও মাত্র কয়েকদিন হল এদিকে এসেছি, এখানকার লোক আমি নই। জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। বড় পিপাসা পেয়ে গেল, হঠাৎ এই বাড়িটা চোখে পড়ায়—
পিপাসা লেগেছে বাবুজী আপনার, দাঁড়ান, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সূরযমল চীৎকার করে ডাকল, আরে এ চন্দ্রা, চন্দ্রা বিটিয়া হো?
মিহি মেয়েলী কণ্ঠে জবাব এল, যাইলোটামে থোড়া পানি আউর থোড়ি মিঠাই তো লাও বিটিয়া
না, মিঠাই নয় সূরযমলজী, শুধু পানি। কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।
এ কি কোন একটা বাত হলো বাবাজী। মেহমান, আপনি আমার কুটীরে। প্রৌঢ় হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
অপূর্ব!
মুহূর্তে যেন কিরীটীর দুটি চোখের তারা বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।
কিরীটী সম্মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
কোন একটি শান্ত রাগিণী যেন মূর্তিময়ী হয়ে নিঃশব্দে সঙ্গীতের মত চারিদিক মর্মায়িত করে এগিয়ে আসছে। কি অপুর্ব সুঠাম দেহবল্লরী। চপলা চঞ্চলা।
একটু লম্বাটে ধরনের মুখখানি।
হাতের মুঠির মধ্যে যেন ধরা যায় সরু কটিদেশ। পেলব সুকোমল দুটি বাহু।
পরিধানে যদিও রক্তিম পশমের ঘাঘরা ও আঁটসাট কাঁচলি, তথাপি যেন প্রস্ফুটিত কমলের মতই সৌন্দর্য ঢলঢল করছে কমনীয়তায় মাধুর্যে। এক হাতে লৈটা ও আর এক হাতে রেকাবিতে দুটো নাড়ু নিয়ে এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল তরুণী।
হরিণের মত সরল দুটি চোখের চাউনি তুলে তাকাল তরুণী।
চোখের নিচে কাজলের সক্ষম কালো রেখা। মাথার চুলে বেণী সংবদ্ধ।
খালি পা দুটিতে অলক্তরাগ চিহ্ন।
এই আমার নাতনী চন্দ্রলেখা বাবাজী। আমার ভাইয়ের বিটির বিটি।
ওর মা?
ওর মা! আমাদের বিটি প্রৌঢ়ের চোখের কোল দুটি ছলছল করে এল।
অনুমানেই বুঝতে পারে কিরীটী, প্রৌঢ়ের মেয়েটি আর ইহজগতে নেই।
কিরীটী চন্দ্রলেখার প্রসারিত হাত হতে মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা নিল। নাড়ু ঠিক নয়, লাড্ডু। এবং ওদের দেশীয় প্রথায়ই তৈরী। কোনমতে একটা লাড্ডু গলাধঃকরুণ করে কিরীটী এক লোটা পানিই ঢকঢক করে পান করে নিল।
চন্দ্রলেখা কিরীটীর হাত হতে লোটা আর পাত্রটি নেবার জন্য এবার এগিয়ে আসতেই কিরীটীর স্মৃতির পৃষ্ঠায় একটা বিদ্যুৎচমক খেলে যায় যেন।
অবিকল ঠিক এমনি না হলেও এই মুখখানিরই আদলটা যেন ওর চেনা চেনা।
তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে একবার তাকাল কিরীটী চন্দ্রলেখার মুখের প্রতি।
কোথায় কবে যেন অমনি একখানি মুখে সে দেখেছে। কিন্তু কোথায়!
মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা কিরীটীর হাত থেকে নিয়ে চলে গেল চন্দ্রলেখা অন্দরের দিকে।
কিরীটী তাকিয়ে থাকে মেয়েটির ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহের দিকে। কি দেখছেন বাবাজী?
কিরীটী মৃদু হেসে প্রৌঢ় সূরযমলের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, আপনার নাতনীর ঠিক রাজরাণীর মতই রূপ সিংজী!
রাজরাণী! সবই ওর কপালের লিখন, প্রৌঢ় সূরযমলের বুকখানা কাঁপিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন বের হয়ে আসে।
কথাগুলো অস্পষ্ট আত্মগতভাবে উচ্চারণ করেছিল সূরযমল। কিরীটী সঠিক বুঝতে পারে না।
কিন্তু বললে না তো সিংজী, এ দেশে কেন তুমি এসেছো?
ঐ যে বল্লাম বাবুজী, ভাগ্যের লিখন! ভাগ্যই টেনে এনেছেন আমাদের এই দেশে-নইলে, কথাটা সরযমল আর শেষ করে না। হঠাৎ যেন কথার মোড়টা ফিরিয়ে দিয়ে সূরযমল বলে, এই ধূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন বাবাজী, চল ওপাশের আমবাগানের বিলের ধারে চমৎকার একটা জায়গা আছে।
চল।
সত্যিই অপূর্ব জায়গাটা।
নিবিড় আম্রকানন। সম্মুখেই দিগন্তপ্রসারী বিলের জল। বৌরাণীর বিল।
দ্বিপ্রহরের খর সূর্যালোকে বিলের বুকে মন্থর বায়ুর তাড়নে জেগে-ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউগুলো যেন হীরার কুচির মতই জলজল করছে।
পত্রান্তরাল হতে একটা হরিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে শিস দিয়ে উঠছে একটা বুলবুলি।
কিরীটী ভাবছিল এমন নিরিবিলি জায়গাটিতে এমন একখানা বাড়ি কে তৈরী করল!
প্রশ্নটা সরযমলকে জিজ্ঞাসা না করে পারে না সে।
লোকালয়ের বাইরে এই নির্জন জায়গায় এই বাড়িটার খোঁজ তোমাকে কে দিল সিংজী?
যে বাবুজী আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি এই বাড়িতে এনে তুলেছেন আমাদের।
বাবুজী! কি নাম তার?
উহ; বাবু, শুধাবেন না দয়া করে। ঐ কথাটি বললে বেইমানি করা হবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি—
হ্যাঁ
কিরীটী মনের মধ্যে একটা জাল বুনে চলে।
একটা কাহিনীর ছিন্নসূত্র। কিছুতেই এ কয়দিন ধরে যার কোন হদিসই সে মনের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিল না, সেই ছিন্ন সূত্রটিই যেন সহসা মনের মধ্যে এসে উকিঝুকি দিচ্ছে।
চিন্তার জাল নীহারিকার মত এখনও দ্রুত ঘুর্ণমান আকারহীন। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে।
তাছাড়া বাবাজীর বোধ হয় ইচ্ছাও ছিল না কারো সঙ্গে এ দেশে আমি আলাপ-পরিচয় করি বা কথা বলি। কিন্তু দেড় মাস একটা লোকের মুখে দেখি না। এই প্রথম এখানে বাইরের লোক তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি
তোমার খাওয়াদাওয়া, বাজার-হাট করতে হয় না?
না। বাবুজীর লোক হপ্তায় দিন করে সব পৌঁছে দিয়ে যায়।
প্রৌঢ় সূরযমল ও তার অপূর্ব সুন্দরী তরুণী নাতনীর এখানে বাস করা হতে সব কিছুই যেন একটা ঘন রহস্যের জালে ঘেরা।
কিন্তু অদৃশ্য পরিচয় দানে অনিচ্ছুক সব ব্যাপারে সদা সতক প্রৌঢ়বর্ণিত বাবু-জীটি কে?
কি সম্পর্ক সেই বাবুজীর এই প্রৌঢ় রাজপুত ও তার তরুণী সুন্দরী নাতনীটির সঙ্গে? কেনই বা সে এদের সদর রাজপুতানা হতে এই নির্জন স্থানটিতে এনে লুকিয়ে রেখেছে? কি উদ্দেশ্যে?
কথায় বোঝা গেল, প্রৌঢ়ের নিকট হতে তার বাবুজীর কোন সংবাদই পাওয়া যাবে না। কিন্তু সংগ্রহ করতে হবে সংবাদটি।
কেন হঠাৎ দেড় মাস যাবৎকাল রাজপুতানা হতে ঐ প্রৌঢ় সরমল সিং ও তার তরুণী নাতনী চন্দ্রলেখা বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ প্রান্তে এই নির্জন কুটিরে বাসা বেধেছে?
বিলের অপর প্রান্তে প্রমোদভবনের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই তো?
এ বাড়িটা কার জানো সিংজী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না বাবুজী।
কিরীটী যখন প্রমোদভবনে এসে পৌঁছল সূর্য তখন ঠিক মধ্যগগনে। তাম্রপাত্রের মত সমস্ত আকাশটা প্রখর তাপে যেন গনগন করছে। প্রচণ্ডঅগ্ন্যুত্তাপ যেন মাথার উপরে আকাশ হতে ঝরে পড়ছে।
বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবিতা ও কল্যাণী। কল্যাণীর হাতের মধ্যে ধরা একটা চিঠির কাগজ। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে নীল কোর্তা গায়ে কুলী শ্রেণীর একটা লোক। লোকটা বোধ হয় স্টেশনের কুলীই হবে।
সাইকেলটা বারান্দার এক পাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বারান্দার উপরে উঠে এলো কিরীটী।
সবিতার সমস্ত মুখখানা যেন উদ্বেগে থমথম করছে। কল্যাণীর চোখমুখেও চিন্তার ছায়া।
ব্যাপার কি মিস সান্যাল? কিরীটীই ওদের দিকে অগ্রসর হতে হতে প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে।
এই দেখুন, কল্যাণী হাতের কাগজটা কিরীটীর সামনে এগিয়ে দেয়।
কি এটা? কাগজটা কিরীটী তার কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে তুলে ধরল। চিঠি। সংক্ষিপ্ত চিঠি একখানা। লিখেছেন নায়েব বসন্ত সেন। কৌতুহলভরেই চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে কিরীটী।
সুচরিতাসু মা সবিতা,
কয়েকটা বিষয়ে জরুরী কাজে একান্ত বাধ্য হইয়াই আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাইতে হইতেছে। এবং সেই কারণেই আপাততঃ লক্ষ্মীকান্ত দারোগার কথা অগ্রাহ্য করিয়া যাইতে হইল। তুমি কোনরুপ চিন্তা করিও না। পার তো এবং সর্বদিকে মঙ্গল চাও তো কিরীটীবাবুকে বিদায় দিও তাহার যথাযোগ্য প্রাপ্য মিটাইয়া। বৃদ্ধ চিরমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তোমার কাকাবাবুর এই অনুরোধটি রাখিও মা। এটা আমার একান্ত অনুরোধ। তোমার পিতাঠাকুর আজ মৃত। সেই মহাত্মার প্রতি যদি তোমার এতটুকুও সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য থাকে তাহা হইলে তাহার মৃত্যুরহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত হও। লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকেও পৃথক পত্ৰ দিয়া গেলাম। টমটমটা স্টেশন-মাস্টারমশাইয়ের জিম্মায় রহিল, সেটা লইয়া যাইবার ব্যবস্থা করিবে।
চিরআশীর্বাদক তোমার নায়েব কাকা
বসন্ত সেন।
কিরীটীই কুলীটার দিকে চেয়ে বললে, তুই যা। মাস্টারবাবুকে বলিস গাড়িটা বিকেলে লোক গিয়ে নিয়ে আসবে। বলতে বলতে পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে কিরীটী লোকটাকে বকশিশ দিল।
কুলীটা হাসিমুখে সেলাম জানিয়ে চলে গেল।
বসন্তবাবু এভাবে চলে গেলেন, এটা কি ভাল হলো মিঃ রায়? কথাটা বললে কল্যাণী।
বিশেষ কোন কারণেই তাঁকে যেতে হয়েছে, চিঠিতেই তো তিনি জানিয়েছেন কল্যাণী। এ ব্যাপারে এত চিন্তার কি আছে?
কিতু লক্ষ্মীকান্ত দারোগা!
কল্যাণীর মুখের কথা শেষ হল না দেখা গেল ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে এক অশ্বারোহী প্রমোদভ্রমণের দিকে আসছে।
দ্রুতধাবমান অশ্বের লৌহক্ষুরের খট খট শব্দ ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে।
কিরীটী সবিতা ও কল্যাণী তিনজনেই সোৎসুক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে অশ্বারোহীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কে অশ্বারোহী! বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ক্ৰমে অশ্বারোহী স্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং তাকে চেনাও গেল।
ঝড়ের গতিতেই অশ্বারোহী সোজা একেবারে প্রমোদভবনের গেটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে অভ্যস্ত দক্ষ অশ্বচালকের মতই মুহূর্তে অশ্বের বল্গা টেনে এক লহমায় যেন অশ্বের সমস্ত গতিকে রোধ করে জিনের পা-দানে পা দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়ালেন।
অশ্বের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত ও মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে।
অশ্বারোহীও ঘর্মাক্তকলেবর। বৃদ্ধ বয়সে পরিশ্রমে তখনও তিনি হাঁপাচ্ছেন। নিত্যানন্দ সান্যাল।
২০. নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে
নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে বারান্দায় এসে উঠে দাঁড়ালেন।
সবি মা তুমি আছ, কিরীটীবাবু, আপনি আছেন—ব্যাপার বড় সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসন্ত ভায়া থানায় ধরা না দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। দারোগাতো একেবারে অগ্নিশর্মা। কাছারীতে কাজ করছিলাম, একেবারে মারমূর্তিতে গিয়ে হাজির
সংবাদ আমরাও পেয়েছি। ধীরকণ্ঠে কেবল কিরীটী কথাগুলো বলে।
পেয়েছেন? শুনেছেন সব?
হ্যাঁ, বসন্তবাবু সবিতা দেবীকেও স্টেশন থেকে একটা চিঠি দিয়েছেন সব ব্যাপার জানিয়ে।
চিঠি? হ্যাঁ, এই দেখুন। কিরীটী চিঠিটা সান্যালের হাতে তুলে দিল।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সান্যাল চিঠিটা পড়লেন।
কিন্তু বুঝতে পারছি না এরকম আহাম্মকের মত কাজ ওঁর মত একজন স্থির বিবেচক লোক করতে গেলেন কেন? পুলিশ তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না, আর লক্ষ্মীকান্ত দারোগা অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের লোক, সে তো কোনমতেই বিশ্বাস করবে না।
কেন?
এই সাধারণ সহজ কথাটা বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়। পুলিশ বিশ্বাস করবেন না এ ব্যাপারে আমাদের কোন হাত বা যোগসাজস নেই। তাদের ধারণা আমরাই বসন্ত ভায়াকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছি। সে কোথাও যায়নি।
কিন্তু বাবা, লক্ষ্মীকান্ত দারোগাকেও নায়েবমশায় আলাদা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন, লিখেছেন, কথাটা বললে কল্যাণী।
চিঠি লিখে রেখে গিয়েছে– পুলিশের জাতও এমনি, ওসব চিঠির কথা বিশ্বাস করবে মনেও স্থান দিও না। সন্দিগ্ধ মন ওদের সবেতেই ওরা সন্দেহ করে। স্টেশন পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। সেখানে স্টেশন মাস্টার পর্যন্ত নাকি বলেছে কলকাতাগামী ঐ সময় একটা ট্রেন ছিল কিন্তু ট্রেনটার স্টেশনে stoppage পর্যন্ত নেই, প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জার এবং বিশেষ জরুরী প্রয়োজন বলিয়ে স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে আগের জংশনে ফোন করিয়ে গাড়ি থামিয়ে সেই গাড়িতে নাকি বসন্ত সেন চলে গেছেন। লক্ষ্মীকান্ত সাহা স্টেশন মাস্টারের কথা পর্যন্ত বিশ্বাস করেনি, ছুটে ঐখান থেকেই কাছারীতে গিয়ে হাজির হয়েছে। কাছারীতে সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
হুঁ। তাহলে দারোগা সাহেবের ধারণা বসন্তবাবুর কলকাতায় যাওয়ার জন্য ট্রেনে চাপাটাও চোখে ধূলো দেবার জন্যই? কথাটা যেন আবার বলে কল্যাণীই।
তা না হলে আর বলছি কি! এখানেও সে আসবে না ভাব! এলো বলে!
তা সেজন্য এত চিন্তারই বা কি আছে সান্যালমশাই। আসুন না তিনি। স্বচক্ষে এসে দেখেই যান না হয়। মনের মধ্যে সন্দেহ একটা পুষে রাখার চাইতে সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়াই তো ভাল। জবাব দেয় কিরীটী মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে।
এদিকে আরো একটা মুস্কিল হয়ে গিয়েছে যে মা সবিতা! এবারে সান্যাল এতক্ষণ নির্বাক স্থাণুর মত দণ্ডায়মান সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছারীতে গিয়ে আমি সব কাজকর্ম দেখতে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন সব শুরু হল। বাধ্য হয়েই কতকটা তাই আমাকে প্রকাশ করতে হল, বসন্তকে থানায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছে। যেই না ওই কথা আমার মুখ থেকে শোনা, সঙ্গে সঙ্গে অমনি চারিদিক থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। কেন, কি বৃত্তান্ত, সাত-সতের। দয়াময় এ বৃদ্ধ বয়সে কি যে ঝামেলার মধ্যে এনে আমাকে ফেললেন! জীবনে মিথ্যার আশ্রয় আজ পর্যন্ত নিইনি। মিথ্যা বলি কি করে! বাধ্য হয়েই সব খুলে বলতে হল। আর কি বলবো, শুরু হয়ে গেল কর্মচারীদের মধ্যে যত কল্পনা আর জল্পনা। নানা ধরনের প্রশ্ন, মিথ্যা কথা তো বলতে পারবো না, পালিয়ে এলাম। কি করি এখন বল তো মা?
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন সান্যাল সবিতার মুখের দিকে।
সবিতার কানে কিন্তু সান্যালের অত বড় দীর্ঘ বক্তৃতার কিছুই প্রবেশ করেনি।
সে তখন হতে বসন্ত সেনের পত্রটা পাওয়া অবধি পত্ৰমধ্যে বসন্ত সেন লিখিত কথাগুলোই ভাবছিল। মনের মধ্যে তার তোলপাড় করে ফিরছিল চিঠির কথাগুলোই।
কিরীটীকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানাতে বিশেষ করে লিখেছেন বসন্ত কাকা। লিখেছেন তিনি, সেই মহাত্মার প্রতি যদি তার এতটুকু সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য থাকে তাহলে যেন তাঁর পিতার মৃত্যু-রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপার হতে সে নিবৃত্ত হয়। কয়েকদিন ধরে তার মনের মধ্যে যে একটা সন্দেহের বিশ্রী কাঁটা খচখচ করছে, তারপর পারিবারিক ইতিহাসে কোথায় যেন একটা জটিলতা জড়িয়ে আছে সেটা স্বভাবতই একদিন সকলে ভুলে গিয়েছিল, অতীতের অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এইভাবে খোঁচাখুচি করতে গেলে হয়ত অতীতের সেই বিস্মৃতিপ্রায় জটিল কাহিনী দিনের আলোয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। কেচো খুড়তে গিয়ে হয়ত গোখরো সাপ ফণা তুলে বের হয়ে আসবে—হানবে মৃত্যু ছোবল।
তবে কি সে কিরীটীকে বিদায় দেবে?
কিন্তু কেমন করে? কেমন করে এখন সে বলবে কিরীটীবাবুকে যে আপনি ফিরে যান মিঃ রায়?
কিন্তু কিরীটীবাবু এখন ফিরে গেলেই কি সব চাপা যাবে? সবাই সব কথা যাবে ভুলে? না, তা আর তো হবে না। কেউ কোনদিন ভুলবে না, ভুলতে পারে না। মুখে না বললেও ইঙ্গিতে হাবেভাবে প্রকাশ করবে। প্রকাশ না হলেও আড়ালে মুখ টিপে হাসাহাসি করবে, তার চাইতে সত্য যা প্রকাশ হোক। সংশয়ের এ পীড়ন থেকে মুক্তি হোক। সত্যিই যদি পারিবারিক কোনও কলঙ্ক তাদের থেকেই থাকে জানুক সকলে। ধনী জমিদারদের বংশে অমন কত কলঙ্ক থাকে। অপমানের ভয়ে লজ্জার ভয়ে আজ তাকে এড়িয়ে গেলেই তা থেকে মুক্তি মিলবে না। পাপের, অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত যে করতেই হবে পূর্বপুরুষদের পরবর্তী বংশধরদের। হ্যাঁ, যদি কোন পাপ থেকেই থাকে তার পিতার, কন্যা সে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে। ভয় পাবে না সে। সত্যকে সে অস্বীকার করবে না। বংশের কোন অজ্ঞাত পাপ যদি তাকে স্পর্শ করেই থাকে, ফলভোগ তাকে করতে হবে বৈকি। কিন্তু সত্যজিৎ, সত্যজিৎকে যদি হারাতে হয়? হারাতে হয় হারাবে। সত্যের জন্য কর্তব্যের জন্য দিতে যদি হয়ই, যদি হয়ই আবশ্যক, দেবে সে তার প্রেমকে বলিদান। কঠিন প্রতিজ্ঞায়। সবিতা নিজেকে দৃঢ় করে তোলে। এবং এতক্ষণে কতকটা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সান্যালের দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি বলছিলেন মামাবাবু?
বলছিলাম বসন্তের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কাছারী ও অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে বিশ্রী একটা সন্দেহ জেগেছে। মৃদুকণ্ঠে বললেন সান্যাল।
সেটা তো খুব স্বাভাবিক মামাবাবু। এ ধরনের ব্যাপারে ওরকম একটুআধটু গোলমাল হৈচৈ হয়েই থাকে। এজন্য বিচলিত হলে তো আমাদের চলবে না। কালকে আপনার সঙ্গে আমিও একবার কাছারী ও অফিসে যাবো।
তুমি? তুমি যাবে? না, না—তার কোন প্রয়োজন হবে না। শক্ত হতে আমিও জানি। আমি দেখছিলাম কেবল আজ ব্যাটাদের দৌড়। বিকেলের দিকে গিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছি। মুহূর্তে নিত্যানন্দের কথার ধাঁচ পর্যন্ত পাটে গেল। কণ্ঠের সুর গেল বদলে।
ইতিমধ্যে সকলের পশ্চাতে সন্তোষ চৌধুরী যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে এবং ওদের সকল আলাপ-আলোচনাও শুনেছে ধৈর্যের সঙ্গে নিঃশব্দে, ওরা কেউ টেরই পায় নি, এমন কি ওর উপস্থিতিটা পর্যন্ত। এতক্ষণে সন্তোষ চৌধুরী কথা বললে, সবিতা, তোমার যদি আপত্তি না থাকে—তুমি যদি আমার সম্পর্কটা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা না করো—
উপস্থিত সকলেই বক্তা সন্তোষ চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকাল। সন্তোষ চৌধুরীর কথা তখনও শেষ হয় নি, সে বলছিল, আমিও নায়েব ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত থেকে সব দেখাশোনা করতে পারি।
না, না—তোমার মানে আপনার এখন এসব ব্যাপারে না যাওয়াই ভাল সন্তোষবাবু। প্রতিবাদটা জানালেন নিত্যানন্দ সান্যাল।
কেন? ক্ষতি কি তাতে? ভ্রূকুটি-কুটিল দৃষ্টিতে তাকায় সন্তোষ চৌধুরী সান্যালের দিকে।
বুঝলেন না এটা? এখনও তো এ বাড়ির সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্কই প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এতে করে আরো হয়ত ব্যাপারটা জটিল হয়েই উঠবে।
আমি এই বাড়িরই ছেলে। এখন আমিই বলতে গেলে সবিতার সব চাইতে নিকটতম আত্মীয়-ঝামেলার কোন কথাই তো এতে উঠতে পারে না।
আহা, আপনি ঠিক বুঝছেন না! আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
বক্তব্যের শেষাংশটুকু সান্যাল পার্শ্বেই দণ্ডায়মান কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।
আপনাদের ঘরোয়া পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে আমার মতামত দেওয়াটা ঠিক শোভন হবে না সান্যাল মশাই। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কারোরই কিছু করতে হবে না মামাবাবু। নায়েব কাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত—যতদিন না সব গোলমাল মেটে, দেখাশোনা সব আমিই, হ্যাঁ-আমিই করবো। দৃঢ় সতেজ কণ্ঠে সবিতা বলে।
তুমি দেখবে! পাগলী! এসব ব্যবসা জমিদারীর ব্যাপার কি তুমি বুঝবে? কিছু তোমায় ভাবতে হবে না মা। আমি যখন এসে উপস্থিত হয়েছিই
না মামাবাবু, আপনাকে আর কষ্ট দেব না। বুড়ো মানুষ আপনি কটা দিন এখানে থাকলেই মনে বল-ভরসা পাব। যা দেখবার আজ থেকে আমি দেখবো। বলে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিল, বনমালী-বনমালী!
সবিতার ডাকে সাড়া দিয়ে বনমালী এসে হাজির হল, আমাকে ডাকছিলেন দিদিমণি?
হ্যাঁ, লছমনকে স্টেশনে পাঠিয়ে দে, টমটমটা নিয়ে আসুক। বিকেলে আমি কাছারীতে যাবো–
বনমালী চলে গেল।
এবার সবিতা কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, মিঃ রায়, দয়া করে যদি আপনি এখন আমার ঘরে একবার আসেন উপরে। আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা ছিল।
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে অতঃপর দৃঢ় সংযত পদবিক্ষেপে রাজেন্দ্রণীর মতই অন্দরের দিকে এগিয়ে গেল। সকলে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবিতার গমনপথের দিকে।
আড়চোখে এবার তাকাল কিরীটী সান্যালের মুখের দিকে, প্রশান্ত মুখমণ্ডল প্রসন্ন হাসিতে যেন ঝলমল করছে।
কোথায়ও মুখের মধ্যে এতটুকু বিরাগ বা আক্রোশের চিহ্নমাত্রও নেই। কিরীটী অগ্রসর হলো ভিতরে যাবার জন্য।
প্রভু! তোমার লীলা দয়াময়। মা কল্যাণী, উপাসনার একটু আয়োজন করে দেবে চল তো মা জননী! নিরাকার পরম ব্রহ্ম কোন পথে যে কখন আমাদের চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন তা তিনিই জানেন। ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম।
নিত্যানন্দ ভিতরের দিকে পা বাড়ালেন। কল্যাণী অনুসরণ করল পিতাকে।
কেবল স্তব্ধ নির্বাক সন্তোষ একাকী পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সবিতা তার নিজের ঘরে একটা আরামকেদারার উপরে হেলান দিয়ে। অর্ধশায়িত ভাবে চোখ বুজে নিঃশব্দে পড়েছিল, কিরীটীর পদশব্দ দোরগোড়া পর্যন্ত এলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল না। টের পায় না সে।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, সবিতা দেবী!
চোখ মেলে তাকাল সবিতা, ওঃ মিঃ রায়, আসুন ভিতরে আসুন— বলতে বলতে সবিতা কেদারাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই সবিতা ভিতর থেকে ঘরের দরজাটায় খিল তুলে বন্ধ করে দিল।
বসুন মিঃ রায়। দুজনেই উপবেশন করে মুখোমুখি দুটো কেদারায়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা।
কিরীটী পকেট হতে একটা সিগার বের করে অগ্নিসংযোগ করল।
নায়েব কাকার চিঠিটা পড়লেন তো মিঃ রায়?
কিরীটী সবিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললে, হ্যাঁ। শুধু, চিঠিতেই আপনাকে বসন্তবাবু, আমাকে এ ব্যাপারে নিবৃত্ত করতে বলেননি, আজ সকালে যাবার সময় নিজেও আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ফিরে যাবার জন্য।
হুঁ। আপনি—আপনি তাতে কি জবাব দিয়েছেন?
বলেছি আপনি আমাকে নিযুক্ত করেছেন, আপনি বললেই আমি চলে যেতে পারি। এখন আমার থাকা না-থাকাটা অবশ্য আপনার উপরেই নির্ভর করছে। তা আপনি কি বলেন?
আমি!
হ্যাঁ।
শুনুন মিঃ রায়, যত বড় দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপারই হোক না কেন, এর শেষ আমি দেখতে চাই। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বেশ।
কিন্তু একটা কথা মিঃ রায়—
বলুন?
সত্যিই কি আপনি মনে করেন এ রহস্য আপনি উঘাটন করতে পারবেন?
আমি আপনার এখানে এসেছি দিন পাঁচেক মাত্র। আর পাঁচটা দিন আমাকে সময় দিন সবিতা দেবী।
আর পাঁচ দিনের মধ্যেই? বিস্মিতা সবিতা তাকাল কিরীটীর মুখের প্রতি।
হ্যাঁ। পাঁচদিন বলছি, হয়ত তা নাও লাগতে পারে। তবে তার বেশী প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। ভাল কথা, সত্যজিৎবাবুকে দেখছি না যে?
সদরে তিনি ম্যাজিস্টেটের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।
আপনার একটু আগেকার দৃঢ়তায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি সতি দেবী। এবং আপনি জানেন না, অজ্ঞাতেই সম্পূর্ণভাবে আপনি সমস্ত পরিস্থিতিরই একটা আকস্মিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তারপর কতকটা যেন অস্ফুট আত্মগতভাবে বলে, I wanted this! I wanted_now I am to see and wait!
কি বললেন?
না, কিছু না। আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি। কিরীটী ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। এবং সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অস্ফুটভাবেই পূর্বের মত বলতে থাকে, I hear the foot-steps! আসবে—এবারে সে আসবে।
স্বপ্লেখিতের মতই যেন অকস্মাৎ কিরীটীর সমস্ত চেতনা, অনুভূতি সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চিন্তার ঘন কুজ্ঝটিকা-জাল একটু একটু করে মুক্তির আলোকসম্পাতে দূরীভূত হতে শুরু করেছে।
আর দেরি নেই।
রাত্রি কত হবে? হাত-ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল কিরীটী, পৌনে এগারটা।
অত্যন্ত ক্ষিপ্তহস্তে কিরীটী সুইমিং কস্টিউমটা পরে নিয়ে তার উপরে ধুতিটা মালকোঁচা দিয়ে পরিধান করে নিল।
মাথায় এঁটে নিয়েছে সাঁতার দেবার একটা কালো রঙের রবারের তৈরি সুইমিং ক্যাপ। পায়ে রবার-সু।
ঘরের আলোটা কমিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে কক্ষ হতে বের হয়ে এলো কিরীটী দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে।
সত্যজিৎ সদর হতে ফেরে নি। ঘরের মধ্যে সে তাই একাই ছিল।
এর মধ্যেই সমগ্র প্রমোদভবন যেন ঘুমের নিঃসীম অতলে তলিয়ে গিয়েছে। পা টিপে টিপে সিঁড়ি-পথ অতিক্রম করে ভিতরের আঙ্গিনা পার হয়ে পূর্বদিনের ঘরের মধ্যেকার সেই পথ দিয়েই নন্দনকাননে যাবার পথে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
মাথার উপরে রাত্রির আকাশে শুক্লাত্রয়োদশীর চাঁদ। ক্ষীণ চন্দ্রালোকে অদূরে নন্দনকানন, দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিল কেমন যেন স্বপ্ন-বিহ্বল।
দ্রুতপদে কিরীটী নন্দনকাননে এসে পৌঁছল। পুবদিনের সেই স্থানটি চিনে নিতে কিরীটীর কষ্ট হয় না। তারপর ধীরে ধীরে জলের মধ্যে গিয়ে নামল।
গ্রীষ্মের রাত, বেশ গরম বোধ হচ্ছিল, বিলের শীতল জলে আকণ্ঠ ড়ুবিয়ে শরীর যেন জড়িয়ে গেল। কিরীটী সন্মুখদিকে দৃষ্টি রেখে দ্রুত হস্ত-সঞ্চালনে জল কেটে সাঁতরে চলল।
ক্ষীণ চন্দ্রকিরণস্নাত বিলের জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কিরীটীর মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা জাগে। মনে পড়ে বঙ্কিমের চন্দ্রশেখরের প্রতাপ ও শৈবলিনীর চন্দ্রালোকিত রাত্রে গঙ্গার বুকে সাঁতার দেবার কথা।
কিরীটী এগিয়ে চলে।
স্বপ্নের চাইতেও বর্তমানে যে চিন্তা তাকে এই রাত্রে বৌরাণীর বিলের জলে এনে ফেলেছে, ঐ অস্পষ্ট দূরবর্তী অন্ধকার বৃক্ষ-সমাকুল তটরেখা—সেই দিকে লক্ষ্য রেখে কিরীটী সাঁতরে চলে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে।
অনেকটা পথ চলে এসেছে কিরীটী।
সহসা তার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল অষ্পষ্ট ক্ষীণ সঙ্গীতের সুরে। উৎকর্ণ হয়ে ওঠে কিরীটী সন্তরণ দিতে দিতেই। জলের মধ্যে গানের সুর! হ্যাঁ, সত্যি কে যেন গান গাইছে অল্প দূরে কোথাও। গানের সুরকে অনুসরণ করে কিরীটী আরও খানিকটা দ্রুত নিঃশব্দে সাঁতরিয়ে এগিয়ে যায়।
ক্ৰমে স্পষ্ট—আরো স্পষ্ট শোনা যায় এবার গানের সুরলহরী।
কি মধুর! কিবা অপরূপ কন্ঠ! চন্দ্রালোকিত এই নিশীথ রাত্রি যেন বীণাবাদন করছে। গানের সুর-মুর্ছনায় যেন আকাশ বাতাস দিগন্ত প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে।
আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর সহসা এতক্ষণে কিরীটীর নজরে পড়ে তীরের সন্নিকটে একটি ছোট ভাসমান নৌকা জলের মধ্যে। ভাসমান সেই নৌকার উপরে বসেই ধীরে ধীরে বৈঠা দিয়ে জল কাটতে কাটতে আপন মনে সম্বিৎহারা হয়ে কে যেন গান গেয়ে চলেছে।
আরো একটু এগিয়ে গেল কিরীটী সন্তর্পণে।
চন্দ্রালোকে এবারে গায়িকা নৌকার উপরে উপবিষ্টা চন্দ্রলেখাকে চিনতে কিরীটীর কষ্ট হয় না।
গায়ে একটা পাতলা জরির ওড়না চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। বৃক্ষের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে পাকানো মত দুটি বেণী।
আশ্চর্যই হয়ে যায় কিরীটী এত রাত্রে নৌকায় বসে চন্দ্রলেখাকে গান গাইতে শুনে।
কে জানে ওর দাদু হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে! সেই ফাঁকে চন্দ্রা নৌকা নিয়ে বিলের জলে ভেসে পড়েছে এই রাত্রে।
কি একটা উর্দু গান গাইছে চন্দ্রা। গানের ভাষা না বুঝলেও ভারি মিষ্টি কিন্তু লাগে কিরীটীর গানের ভাব।
কিরীটী এবারে একটু অন্ধকার দেখে তীরের এক অংশে সাঁতরে গিয়ে ওঠে এবং উঠে ভিজে কষ্টিউমটা গা হতে খুলে ধুতিটা পরে নিল।
চন্দ্রা তখনও আপন মনে গান গাইছে। কিরীটী আলোছায়া-খচিত পথ দিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল।
দিনের বেলায় আজ যখন প্রৌঢ় সূরযমলের সঙ্গে এই দিকে এসেছিল তখনি বেশ ভাল করে চারিদিক দেখে রেখেছিল। বাড়ির পশ্চাৎভাগে পৌছাতে তার কষ্ট হয় না।
এদিককার দরজাটা ভেজানো ছিল মাত্র। বোধ হয় চন্দ্রলেখাই ভেজিয়ে রেখে গিয়েছে।
সন্তর্পণে ভেজানো দরজাটা ঠেলে ফাঁক করে কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল, সামনেই অপ্রশস্ত একটি আঙ্গিনা।
অস্তগামী চন্দ্রালোকে চারিদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখে নেয় কিরীটী।
ঘরের প্লিন্ত মাটি হতে প্রায় হাতখানেক উঁচু। তারপরেই একটা বারান্দা মত। বারান্দার উপরে এসে উঠলো কিরীটী।
পর পর তিনটি ঘর। দুটি ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। একখানা ঘরের ঈষদুন্মক্ত দ্বারপথে আসছে মৃদু আলোর একটুখানি আভাস।
পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল কিরীটী প্রথমেই সেই কক্ষের দিকে।
আলগোছে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপরে ভর করে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়েই ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেষে মাটির প্রদীপাধারের উপরে একটি মৃৎপ্রদীপ জ্বলছে মিটমিট করে।
প্রদীপের সেই ক্ষীণালোকেই তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কিরীটী কক্ষের চতুঃপার্শ্ব দেখে নিল। শুন্য কক্ষ।
এক কোণে একটা খাটিয়ার উপরে শুন্য শয্যা। তারই পাশে একটা মাটির কলসী, একটা গ্লাস। দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে খানকতক শাড়িকাপড় ঝোলানো।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না এই ঘরেই শোয় চন্দ্রলেখা। এটা তারই শয়নকক্ষ নিশ্চয়ই।
এইটা যদি চন্দ্রলেখার শয়নকক্ষ হয় তো ওর দাদু সুরযমলের ঘর কোনটা? কোন ঘরে তাহলে সূরযমল থাকে?
বাকী দুটো ঘর তো দেখছে ও তালাবদ্ধ। তবে কি সুরযমল এই দুটো ঘরেরই কোন একটাতে থাকে। এখন নেই, কোথায় গিয়েছে! কিন্তু এত রাত্রে সে কোথায়ই বা যাবে বা যেতে পারে তার বয়সের তরুণী নাতনীকে একাকিনী এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একা বাড়িতে রেখে?
তবে রাজপুত এরা, এদেশের লোকদের মত ভীতু তো নয়। তাছাড়া রাজপুতের মেয়ে আত্মরক্ষা করতেও হয়ত জানে।
সহসা এমন সময় অস্ফুটকাতর একটা শব্দে ও যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই থমকে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠে। শিকারী বিড়ালের মতই সজাগ হয়ে ওঠে।
অস্ফুট কাতরোক্তি। স্পষ্ট ও শুনেছে।
উৎকর্ণ হয়ে আছে কিরীটী, অসম্ভব কিছুর একটা প্রতীক্ষায় ওর সমস্ত দেহটা যেন কঠিন ঋজু হয়ে উঠেছে।
আঙ্গিনার উপরে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। কোথায় অন্ধকারে একটা তক্ষক টক টক করে শব্দ করে উঠলো, নিস্তব্ধ রজনী যেন ককিয়ে উঠলো। কুৎসিত শব্দটা যেন নিস্তব্ধ রজনীর বুকে একটা ভয়াবহু ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোন আশু অশুভ অমঙ্গলের। আবার শোনা গেল অস্পষ্ট কাতরোক্তি। ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠের যন্ত্রণাকাতর শব্দ যেন। মনে হয় বুঝি একটা বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস নিশতি রাতের স্তব্ধতায় মর্মায়িত হয়ে উঠেছে।
কাতর শব্দটা আবার কানে ভেসে এলো। এবারে কিরীটীর মনে হলো যেন পাশেরই কোন ঘর থেকে শব্দটা অস্পষ্টভাবেই ভেসে আসছে।
সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী আধো আলো আধো ছায়া ঘেরা বারান্দার চারদিকে।
কোথা হতে আসছে শব্দটা শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে বোঝবার চেষ্টা করে।
ঐ তালাবন্ধ দুটো ঘরের একটা ঘর হতে কি? পায়ে পায়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যায় কিরীটী প্রথম ঘরটার দিকে।
আবার সেই অস্পষ্ট কাতরোক্তি।
সহসা আবার কিরীটী থমকে দাঁড়াল। বহুদূর হতে যেন ভেসে আসছে দ্রুত ধাবমান অশ্বক্ষুরধ্বনি।
খট খটখট খটখট– ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোন অশ্বারোহী হয়ত এই দিকেই আসছে।
ঘরের দিকে আর যাওয়া হল না। অষ্পষ্ট কাতরোক্তি ক্ষণপূর্বে কোথা হতে আসছে তার আর সন্ধান করা হল না কিরীটীর। মুহর্তে সে নিজের সংকটময় পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করে কর্মপন্থা স্থির করে ফেলে। অত্যন্ত দ্রুত ক্ষিপ্রপদে কিরীটী আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে বাড়িটার সম্মুখভাগে এসে দাঁড়াল। সকালবেলাতেই ঐদিন কিরীটী লক্ষ্য করেছিল একটা বড় শিমুল গাছ ও তেতুল গাছ পাশাপাশি একটা জায়গায় বাড়িটার সামনে দক্ষিণ দিকে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া বিস্তার করে।
কিরীটী দ্রুতপদে সেই দুটি বৃক্ষের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।
অশ্বক্ষুরধ্বনি এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে এই দিকেই অশ্ব ছুটিয়ে আসছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অশ্বারোহী বাড়ির সামনে এসে বেগবান অশ্বের রাশ টেনে অশ্বের গতি রোধ করল। অষ্পষ্ট চাঁদের আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিরীটী দেখল দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি অশ্ব হতে অবতরণ করল।
কিন্তু অশ্বারোহীকে চিনবার উপায় নেই। সর্বাঙ্গ একটা কালো মুখমলের আংরাখায় আবৃত। মুখাবয়বেরও প্রায় সবটাই কালো একটা রুমালে টাকা।
অশ্বারোহী ধীর মন্থর পদে চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।
দৃঢ় বলিষ্ঠ পদবিক্ষেপ। চলার মধ্যে কোন সঙ্কোচ বা দ্বিধামাত্রও যেন নেই।
স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো দ্রুত কিরীটী উল্টে যায়, মনে করবার চেষ্টা করে আগন্তুকের চলার ভঙ্গীটা—কোন পরিচিতজনের চলার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে কিনা।
কিরীটী কিন্তু বৃক্ষের আড়াল হতে বের হয়ে আসে না বা আগন্তুককে অনুসরণ করবার চেষ্টা করে না। নিশ্চেষ্ট হয়েই অপেক্ষা করে।
সে স্পষ্ট দেখতে পেল এক সময় আগন্তুক বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বৃক্ষের আড়াল থেকে বের হয়ে আবার বাড়ির দিকে অগ্রসর হবে কিনা ভাবছে এমন সময় অতর্কিতেই কিরীটী যেন চমকে ওঠে আবার পদশব্দে।
শুকনো ঝড়া পাতা গড়িয়ে যাচ্ছে মচমচ করে, কে যেন ধীর মন্থর পদে পশ্চাতের গাছপালার দিক থেকে হেঁটে আসছে।
চকিতে কিরীটী আধো আলো আধো অন্ধকারে পশ্চাতের দিকে তাকিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াল। একটা অস্পষ্ট আবছা মূর্তি এগিয়ে আসছে। পদভারে তার শুকনো ঝরা পাতাগুলো মচমচ শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে।
মূর্তি ক্রমে আরো এগিয়ে আসে। অষ্পষ্ট আলোছায়াতেও কিরীটীর এবারে চিনতে কিন্তু কষ্ট হয় না।
সূরযমল সিং
সূরযমল এগিয়ে বাড়ির মধ্যেই গিয়ে প্রবেশ করল। কিরীটী তথাপি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে।
অপেক্ষাই করবে সে।
বোধ হয় মিনিট পনের বাদে আকাশে চাঁদের সামান্য অবশিষ্ট আলোকটুকুও যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
চাঁদ অস্তমিত।
চারিদিক একটা অস্পষ্ট ধূসর আবহাওয়ায় যেন রহস্যঘন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কিরীটী সচকিত হয়ে উঠল। পূর্বের সেই আগন্তুক ও সূরযমল প্রায় পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে বাড়ির ভিতর হতে বের হয়ে এলো।
নিম্নকণ্ঠে দুজনে তখনও যেন কি কথা বলছে পরস্পরের মধ্যে হিন্দী ভাষাতেই। প্রথমটায় ওদের কারো কোন কথাই কিরীটী বুঝতে পারে না। ক্রমে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে যখন কিরীটী যেখানে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল আত্মগোপন করে তার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে, ওদের দুএকটা শব্দ খাপছাড়া অসংলগ্ন ভাবে ওর কানে এলেও সঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
এগিয়ে যেতে যেতে একসময় দুজনেই কিরীটী যে গাছ দুটোর আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তার হাত দেড়েক তফাতে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
এবারে ওদের কথাও স্পষ্ট শুনতে পেল কিরীটী।
সূরযমল বলছিল, তোমাকে তো বললাম বাবুজী, আর এভাবে এখানে আমি দেশ মুলক ছেড়ে থাকতে পারব না।
চাপা ভারী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এলো, শোন সূরযমল, তোমারই ভালর জন্য এ ব্যবস্থা করেছি আমি।
কিন্তু
আর বেশীদিন থাকতে হবে না। কাজ শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।
ঝুটমুট তুমি এখানে আমাকে ধরে রেখেছ বাবুজী। এতদিন তো হয়ে গেল তোমার কথায় কথায়—
সুরযমল, ছেলেমানুষী করো না।
বাবুজী, অর নয়। সামনের শনিবারই চলে যাবো।
পাগলা, তা হতে পারে না।
আমি যাবোই। মিথ্যেই তুমি আমাকে অনুরোধ করছে।
সুরযমল শোন, আমার বিনা হকুমে এখান হতে যদি এক পা-ও নড়, তাহলে
বাবুজী, ভুলে যাচ্ছো সূরযমল রাজপুতের বাচ্ছা। ও চোখরাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে।
দ্বিতীয় বক্তার কণ্ঠস্বর সহসা এর পর যেন একেবারে খাদে নেমে এলো, এতদূর এগিয়ে এসে এভাবে সব নষ্ট করো না সূরযমল। তোমারই ভালর জন্য বলছি আমি। আর একটা সপ্তাহ তুমি অপেক্ষা কর। এতদিনই তো অপেক্ষা করলে।
সুরযমল কোন প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করেই থাকে।
কাল আবার দেখা হবে। আর মনে থাকে যেন যা বলে গেলাম। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে গিয়েছে এইভাবে জামার ভিতর হাত চালিয়ে একমুঠো নোট বের করে সূরযমলের দিকে এগিয়ে দিল, এই নাও, এই টাকাগুলো রাখো। আমি চললাম।
সূরযমল হাত বাড়িয়ে নোটগুলো নিল।
অতঃপর আগন্তুক এগিয়ে অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহী হয়ে নিমেষে অশ্বকে ছুটিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। দুর হতে বিলীয়মান অশ্বক্ষুরধ্বনি ভেসে আসে খট খট খট। ক্রমে মিলিয়ে যায়। সূরযমল আরো কিছুক্ষণ স্থাণর মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
২১. বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে
পুনর্বার বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে যখন পৌঁছল কিরীটী, রাত তখন প্রায় তিনটে হরে। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর অবসন্ন।
প্রমোদভবনটা মনে হচ্ছে যেন ঘুমে একেবারে পাথর হয়ে আছে।
বাতাসে ঝাউগাছের সর সর চিকন পাতাগুলো সোঁ সোঁ করুণ একটা শব্দে নিশীথের স্তব্ধতাকে একঘেয়ে ভাবে বিদীর্ণ করে চলেছে।
আর কোন শব্দ শোনা যায় না।
পূর্বের পথেই কিরীটী প্রমোদভবনে প্রবেশ করে আঙ্গিনা অতিক্রম করে। ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল।
সিঁড়ি-পথের দেওয়ালে আলোটা টিমটিম করে জ্বলছে। ঘোলাটে আলোয় সমস্ত সিঁড়ির পথটা যেন কেমন ছমছম করছে।
সিঁড়ির মাঝামাঝি উঠেছে কিরীটী, নিচের বারান্দায় যেন কার পদশব্দ পাওয়া গেল। সিঁড়ির দিকেই কেউ এগিয়ে আসছে।
মুহূর্তে যেন কিরীটী সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিঃশব্দ অথচ অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে বাকী সিঁড়িগুলো কতকটা লাফ দিয়ে দিয়েই অতিক্রম করে কিরীটী দোতলার বারান্দায় উঠে সোজা একেবারে নিজের ঘরের দরজাটা ঠেলে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল। ঘরের আলোটা তেমনি কমানো, পিট পিট করে জ্বলছে। শয্যার দিকে তাকিয়ে দেখলো পাশাপাশি দুটি শয্যা তার ও সত্যজিতের, দুটিই শূন্য।
কিন্তু অত ভাববারও সময় নেই কিরীটীর। চকিতে ফু দিয়ে চিমনির উপর ঘরের একটিমাত্র আলো নির্বাপিত করে দিল সে।
নিমেষে নিচ্ছিদ্র আঁধার যেন সমস্ত কক্ষটি গ্রাস করে নিল। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দ। কেবল শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি সজাগ। উৎকর্ণ। চোখের দৃষ্টিতে ঘরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ক্রমে সহ্য হয়ে আসে।
সতর্ক নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে অতঃপর কিরীটী এগিয়ে গেল কক্ষের ভেজানো দরজাটার দিকে।
কবাট দুটো ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দায় দৃষ্টিপাত করলে কিরীটী। শুনতে ভুল করেনি। পদশব্দই। কে যেন সিঁড়ি-পথে উপরেই উঠে আসছে।
পদশব্দ ক্রমেই উপরের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু একজোড়া তো নয়, জোড়া পায়ের শব্দ যে শুনেছে কিরীটী!
আশ্চর্য! এত রাত্রে কারা উপরে আসছে?
আরো আশ্চর্য হলো কিরীটী যখন দেখলো শুনতে তার ভুল হয়নি দুজনই!
সত্যজিৎ ও কল্যাণী। এবং পরস্পর ওরা হাত-ধরাধরি করে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে।
কল্যাণী ও সত্যজিৎ! এত রাত্রে দুজনে নিচে ওরা কোথায় ছিল?
সবিতা দেবী! সবিতা দেবী কোথায়?
তুমি ঠিক দেখেছ তো কল্যাণী, তুমি যখন বিছানা ছেড়ে উঠে আস সবিতা ঘুমিয়েই ছিল? কল্যাণীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে সত্যজিৎ।
হ্যাঁ। মৃদু চপল হাসি কল্যাণীর ওষ্ঠপ্রান্তে, নাক ডাকাচ্ছিল।
এর মধ্যে যদি সে উঠে থাকে বা ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে?
দিন চারেক তো শুচ্ছি ওর সঙ্গে। গাঢ় ঘুম—এক ঘুমে রাত কাবার করে। কিন্তু কিরীটীবাবু
এতক্ষণে তিনিও হয়ত নাক ডাকাচ্ছেন। চাপা হাসির সঙ্গে জবাব দেয় সত্যজিৎ।
বারান্দার ওয়াল-ক্লকটা এমন সময় ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করল। রাত্রি চারটে। শেষ হয়ে এলো রাত। উঃ রাত চারটে, চলি! ত্বরিতপদে কল্যাণী তার ঘরের দিকে চলে গেল।
কিরীটীও আর মুহূর্ত মাত্র দেরি করে না। সোজা ক্ষিপ্রপদ অন্ধকারেই গিয়ে শয্যার উপরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
চোখ বুজেই পড়ে থাকে অন্ধকারে কিরীটী কান দুটো সজাগ রেখে। একটু পরেই ভেজানো কপাট খুলে গেল। নিঃশব্দে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল সত্যজিৎ। ওর পায়ের শব্দেই কিরীটী টের পায়।
কিরীটী যে অবস্থায় ছিল ঠিক সেই অবস্থায়ই শয্যায় শুয়ে পড়েছে। ভাল করে জলও মোছবার অবকাশ পায়নি, বেশটাও বদলাতে পারেনি।
সত্যজিৎ পকেট হতে টর্চ বের করে বোতাম টিপল। টর্চের আলোয় ঘরের চারিদিক একেবার দেখে নিল। শায়িত কিরীটীর মুদ্রিত চোখের পাতায় টর্চের তীব্র আলোর রশ্মিটা মুহূর্তের জন্য এসে পড়ে, কিরীটী বুঝতে পারে।
কিরীটীকে ঐ অবস্থায় শুয়ে ঘুমোতে দেখে সত্যজিৎ একটু অবাকই হয়।
এগিয়ে গেল সত্যজিৎ টেবিলের উপরে রক্ষিত আলোটা ফিরে আবার জ্বালাবার জন্য। টেবিলের উপরেই দিয়াশলাইটা ছিল।
দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠি জালিয়ে হাত বাড়িয়ে আলো হতে চিমনিটা খুলে হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তপ্ত কাঁচের চিমনির স্পর্শে উঃ করে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সত্যজিতের হাত হতে চিমনিটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
যেন হঠাৎ চিমনি ভাঙার শব্দেই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে, ধড়ফড় করে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি নিয়ে কিরীটী অন্ধকারেই শয্যার উপরে উঠে বসে প্রশ্ন করল, কে কি হলো?
অপ্রতিভ সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, আমি। কিরীটীবাবু, আমি। আলো জালতে গিয়ে হাত হতে হঠাৎ চিমনিটা পড়ে ভেঙে গেল।
দাঁড়ান, নড়বেন না। ভাঙা কাঁচের টুকরোতে পা কাটবেন। আমার একটা ছোট হ্যারিকেন আছে, জালাচ্ছি। কিরীটী শয্যা হতে নেমে ঘরের কোণে রক্ষিত একপাশে তার সঙ্গে আনা ছোট দামী লণ্ঠনটি তুলে নিয়ে বললে, দিয়াশলাই আছে—দিন তো দিয়াশলাইটা! ছুড়ে দিন এদিকে।
হাত বাড়িয়ে অন্ধকারেই টেবিলের উপর থেকে দিয়াশলাইটা খুঁজে নিয়ে কিরীটীর দিকে অন্ধকারে ছুড়ে দিল সত্যজিৎ, অল্প চেষ্টাতেই কিরীটী আলোটা জালল।
ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল উজ্জ্বল আলোয়।
বাতিটা ছোট হলেও প্রচুর আলো হয়।
হাতের বাতিটা টেৰিলের উপরে নামিয়ে রেখে এতক্ষণে কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সম্মুখে স্থির দণ্ডায়মান সত্যজিতের দিকে।
বাইরের দেওয়ালে ওয়াল-ক্লকটা বাজতে শুরু করে—ঢং-ঢং- এক দুই তিন চার পাঁচ
রাত শেষ হয়ে এলো, এই ফিরছেন বুঝি? ফিরতে এত দেরি হলো যে সত্যজিৎবাবু।
কিরীটীর প্রশ্নে বারেকের জন্য মুখ তুলে তাকাল সত্যজিৎ কিরীটীর দিকে, কিন্তু ওর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর হতে সিগারকেসটা তুলে নিয়ে তা থেকে একটা সিগার বের করে সিগারটায় অগ্নিসংযোগ করল।
জলন্ত সিগারটায় গোটাকয়েক টান দিয়ে কিরীটী আবার সত্যজিতের দিকে তাকাল।
সত্যজিৎ তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির নির্বাক।
বসুন সত্যজিৎবাবু। আপনার সঙ্গে কয়েকটা আমার কথা আছে।
সত্যজিৎ তথাপি নির্বাক।
বসুন!
এবার সত্যজিৎ চেয়ারটার ওপরে উপবেশন করল।
শুনেন সত্যজিৎবাবু, সবিতা দেবীর ব্যাপারে এখানে আমি এলেও এখানে আমার আসবার যে যোগাযোগ সেটা আপনার দ্বারাই হয়েছে। বলতে গেলে আপনিই সেদিন আমাকে এখানে এনেছেন।
সত্যজিৎ কিরীটীর দিকে চোখ তুলে তাকাল।
এখানে আসবার পর এই কদিনের অনুসন্ধানে—কিরীটী মৃদুভাবে বলতে লাগল, যতটকু আমি জেনেছি বা বুঝেছি, সবিতা দেবীর পিতা মৃতুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারটা অতীতের একটা অত্যন্ত জটিল কাহিনীর সঙ্গে জড়িত আছে এটা স্পষ্টই বোঝা গেছে এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তাহলে দুচার দিনের মধ্যেই আর একটা বড় রকমের দুর্ঘটনাও যে ঘটবে সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। অবশ্য আমি যাতে এই অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনাটা না ঘটে সে চেষ্টাই করছি। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আমি বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছি, যে অবস্থায় সবিতা দেবীকে বাদ দিয়ে আমি আশা করছিলাম। অন্ততঃ আপনার সাহায্য আমি পাবই, এই জটিল রহস্যের পাক খাওয়া সূত্ৰগুলোর
কিরীটীর কথা শেষ হলো না, সত্যজিৎ কথা বললে, আমি তো সর্বদাই প্রথম হতে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত মিঃ রায়।
তাই যদি হবে তাহলে গত কদিন হতেই লক্ষ্য করছিলাম আমি, আপনি আমাকে avoid করেই চলেছেন। এবং শুধু তাই নয়, সব কথাও আপনি আমাকে খুলে বলছেন না!
কে বললে? যা যা এখানে এসে আমি জেনেছি সবই তো খুলে আপনাকে আমি বলেছি।
না, বলেননি। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন হঠাৎ কেমন কঠিন মনে হয়।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়?
ঠিকই বলছি। এই কদিনেই আপনি যে কল্যাণী দেবীর সঙ্গে সবিতা দেবীর অজ্ঞাতেই এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, কই এই কথাটা তো
মিঃ রায়!
আমি ঘুমোইনি-জেগেই ছিলাম সত্যজিৎবাবু, এতক্ষণ!
আপনি জেগে ছিলেন?
হ্যাঁ। এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ এত রাত্রে সিঁড়িতে পদশব্দ পেয়ে কৌতূহলের বশেই এগিয়ে গিয়েছিলাম কে এত রাত্রে উপরে আসছে দেখবার জন্য। আপনাকে ও কল্যাণী দেবীকে একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে হাত-ধরাধরি করে উঠে আসতে দেখে একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম; কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি সত্যজিৎবাবু, তার চাইতেও বিস্মিত হয়েছি আমার ভুল ভেঙে যাওয়াতে।
আপনার ভুল ভেঙে যাওয়ায়! কি ভুল?
সবিতা দেবী ও আপনার মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে বলে আমি অনুমান করেছিলাম, এখন দেখছি সেটা ভুল!
না, ভুল নয় কিরীটীবাবু।
ভুল নয়? বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে কিরীটী সত্যজিতের মুখের দিকে তাকাল।
না। এবং সবিতা সব জানে।
সবিতা দেবী সব জানেন! আপনার ও কল্যাণীর
হ্যাঁ, সে জানে।
কি বলছেন আপনি সত্যজিৎবাবু?
সব জেনেশুনে সবিতা দেবী
হ্যাঁ, কারণ তার ও আমার সম্পর্কটা পূর্বের মতই অটুট আছে। কোন প্রকার সন্দেহ বা গোলমাল হবার অবকাশ এখনও ঘটেনি আমাদের পরস্পরের মধ্যে।
কিরীটীও যেন সত্যিই কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে। কণ্ঠে তার স্বর ফোটে না। কিছুক্ষণ সে স্তব্ধ হয়েই বসে থাকে।
সহসা বিদ্যৎ-চমকের মত একটা কথা তার মনের মধ্যে উদয় হওয়ায় সত্যজিতের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে সেরাত্রে আপনিই কি কানাইয়ের মার শোবার ঘরে যে ঘর হতে সে নিরুদ্দিষ্টা হয়, সেই ঘরে গিয়েছিলেন?
এবারে সত্যজিতের চমকাবার পালা। চমকে সে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, আপনি সে কথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
সে কথা পরে হবে, তার আগে আমি জানতে চাই, তাহলে আপনি last person এ বাড়ির মধ্যে যিনি শেষবারের মত কানাইয়ের মাকে সেরাত্রে এ বাড়ি হতে নিরুদ্দিষ্টা হবার পূর্বে দেখেছিলেন—and not I! But at what time! রাত তখন কটা মনে আছে কি আপনার?
কানাইয়ের মার ঘর হতে আসি রাত বোধ করি তখন পৌনে একটা হবে। গোপন না করে এবারে সত্যজিৎ বলে।
কিরীটী কিছুক্ষণ অতঃপর নিজের মনেই কি যেন চিন্তা করে এবং পরে মৃদুকণ্ঠে বলে, হুঁ! তাহলে রাত একটার পর কোন এক সময়ে she was removed!
আপনার কি ধারণা মিঃ রায়, তাহলে তাকে কেউ জোর করেই
সত্যজিতের কথা শেষ হয় না, কিরীটীই আবার পাল্টা প্রশ্ন করে, অবশ্যই এবং তাকে আমার যতদূর অনুমান কতকটা বাধ্য করা হয়েছিল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্য। কিন্তু আপনার কি অন্য রকম কিছু বলে মনে হয় সত্যজিৎবাবু? কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সত্যজিতের মুখের দিকে।
আমার মনে, সত্যজিৎ যেন কেমন ইতস্তত করতে থাকে।
বলুন! বলুন! কি বলতে চান বলুন সত্যজিৎবাবু? বলুন সে রাত্রে হঠাৎ কেন আপনি নিচের মহলে কানাইয়ের মার ঘরে গিয়েছিলেন? কেন? কি কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে? কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন একটু অনুনয়, ব্যগ্রতা ঝরে পড়ে।
আপনার অনুমানই বোধ হয় ঠিক মিঃ রায়। আমি গিয়ে দেখি, কানাইয়ের মা already যেন যাবার জন্য তৈরি। ছোটমত একটা পুটলিতে খানকয়েক কাপড় ও টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেধে একপ্রকার প্রস্তুত হয়েই আছে—কিন্তু আপনি সেটা অনুমান করলেন কি করে, আমি তো কারো কাছেই ও-কথা বলিনি। এমন কি
এমন কি সবিতা দেবীর কাছেও বলেননি! বেশ করেছেন। আমি জানতে পেরেছি কি করে, আপনি জিজ্ঞাসা করছিলেন না? আপনার নস্যি নেওয়ার অভ্যাস আছে একমাত্র এ বাড়িতে, তাই না? সে নস্যি কিছু পড়ে আছে আমি ঘরের মেঝেতে পরের দিন সকালে দেখতে পেয়েছিলাম। তাছাড়াও ঐদিন সকালে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পর আপনার মুখের দিকে তাকিয়েও স্পষ্টই আমি বুঝলাম you have something under your sleeve! কিন্তু আপনি গোপন করেছেন এবং সেটা অবশ্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়ে ছিল, কিছুক্ষণ পরেই কানাইয়ের মার ঘরে গিয়ে মেঝেতে নস্যির গুঁড়ো পড়ে থাকতে দেখে। কিন্তু কেন? কেন আপনি কানাইয়ের মার সঙ্গে অত রাত্রে দেখা করতে গিয়েছিলেন? কিরীটী যেন আবার তার পূর্বের প্রশ্নেই ফিরে এলো।
কারণ আমি তাকে সন্দেহ করেছিলাম। আরো অনেক কিছুই এ ব্যাপারের সে জানে। এ-বাড়ির বহুদিনের পুরাতন দাসী সে—আমার ধারণা হয়েছিল। নিশ্চয়ই সে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর জীবনের এমন কোন রহস্যময় গোপন ব্যাপার জানে—
ঠিক তাই। সে জানত—আপনার ধারণা নির্ভুল। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর জীবনের কোন জটিল গোপনীয় ঘটনা সে জানত এবং সেই কারণেই তাকে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে।
তবে কি নায়েব বসন্ত সেনই? উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করে সত্যজিৎ।
না, বসন্ত সেন হত্যাকারী নন। তবে
তবে?
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাকারীকে হয় তিনি জানেন, না হয় হত্যার কারণ তিনি জানেন।
বলেন কি! তা সত্ত্বেও তিনি সব কথা এভাবে গোপন করেছেন?
হ্যাঁ করেছেন। তারও কারণ হয়ত, আর কোন উপায় ছিল না।
তাই যদি হবে তাহলে এভাবে ধরা না দিয়ে নায়েব বসন্ত সেন mysteriously গা-ঢাকা দিলেন কেন?
ঐ একই কারণেই হয়ত, কিরীটী আবার বলে।
কিন্তু এতে করে কি লাভ হল?
তাঁর লাভ হোক আর নাই হোক, অন্ততঃ আমার লাভ হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়ে তাঁর একান্ত অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতেই তিনি আমাকে এই হত্যা-রহস্যের তদন্তের ব্যাপারে কিছু সময় দিয়েছেন যেটার প্রয়োজন আমার একান্ত ভাবেই হয়েছিল। কিন্তু আর একটা কথা সত্যজিৎবাবু
বলুন?
আপনার ও কল্যাণী দেবী সম্পর্কে
আজ নয়। আর একটা দিন আপনার কাছে সময় চাই মিঃ রায়। কাল আগামী কাল সব কথা কল্যাণী সম্পর্কে আপনাকে খুলে বলব।
হয়ত তার আর কোন প্রয়োজন হবে না। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়। কিরীটী চেয়ার হতে উঠে এগিয়ে গিয়ে বিলের দিককার জানলার কবাট দুটো আরো ভাল করে খুলে দেয়।
রাতের আকাশ অত্যাসন্ন প্রভাতের প্রথম আলোর স্পর্শে ক্রমে ক্রমে লালচে হয়ে উঠছে।
ভোর হয়ে এলো।
মৃদুমন্দ রাত্রি-শেষের স্নিগ্ধ বায়ু কিরীটীর জাগরণ-ক্লান্ত চোখে একটা ঝাপটা দিয়ে গেল।
সত্যজিৎ এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো এক এক করে মেঝের উপর থেকে কুড়িয়ে একটা কাগজের উপরে তুলতে লাগল।
দিগন্তপ্রসারী বৌরাণী বিলের বুকের উপর হতে রাত্রিশেষের ঘোলাটে পর্দাটা একটু একটু করে কে যেন টেনে তুলে নিচ্ছে।
অদূরে নন্দনকাননে গাছপালাগুলোও ক্রমে দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো কাগজের মধ্যে জড়ো করে সত্যজিৎ ঘরের বাইরে চলে গেল।
থানায় গিয়ে একবার দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহার সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন।
কিরীটী আশা করেছিল, গত সন্ধ্যায়ই লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের ব্যাপারে হয়ত প্রমোদভবনে আসবে, কিন্তু আসেনি।
কিরীটী একটু যেন আশ্চর্যই হয়েছে লক্ষ্মীকান্ত আসেনি দেখে।
সন্তোষ চৌধুরীকে থানায় নিয়ে যাবার পর কি এমন সে লক্ষ্মীকান্তকে বলেছে যাতে করে সেই রাত্রেই লক্ষ্মীকান্তকে বসন্ত সেনের সঙ্গে দেখা করতে আসতে হয়েছিল?
অবশ্য লক্ষ্মীকান্ত গতকাল সকালে বলেছিল সে থানায় গেলে নাকি অনেক interesting ব্যাপার জানতে পারত।
লক্ষ্মীকান্তর কথায় কিরীটী বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি এই কারণেই যে সে অনুমান করেছিল নিশ্চয়ই সে সব সন্তোষের কাছে শোনা কোন ঘটনা বা তার কাছে প্রাপ্ত চিঠিপত্রের মধ্যে কোন সংবাদ পেয়েছে, যাতে করে লক্ষ্মীকান্ত উত্তেজিত হয়ে এখানে ছুটে এসেছিল।
লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে এখন একবার দেখা করা প্রয়োজন।
প্রথম ভোরের আলো খোলা জানলাপথে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।
হঠাৎ কিরীটীর খেয়াল হয়, ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো ফেলবার অছিলায় সেই যে কিছুক্ষণ পূর্বে সত্যজিৎ এ ঘর হতে বের হয়ে গেল আর ফিরে আসেনি।
সহসা একটা কথা কিরীটীর মনে পড়ে যায়, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ড্রয়ারের মধ্যে প্রাপ্ত দেবনাগরী অক্ষরে লেখা চিঠির বাণ্ডিলটা।
চিঠিগুলো সব পড়া হয়নি।
ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে কিরীটী চিঠির ফিতে বাঁধা বাণ্ডিলটা সুটকেসের ভিতর হতে টেনে বের করল।
চেয়ারে বসে চিঠির বাণ্ডিলটা খুলল কিরীটী।
বহুদিন আগেকার লেখা। কাগজগুলো লালচে হয়ে গিয়েছে। কালিও যেন অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
প্রত্যেকটি চিঠির শুরুতে সম্বোধন করেছে বাবুজী বলে এবং চিঠির শেষে নাম দস্তখত করেছে কোন এক লক্ষণ।
আটখানা চিঠি। হাতের বাঁকা লেখা ও নাম দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না প্রত্যেকটি চিঠির লেখক একই ব্যক্তি এবং চিঠিগুলো দুএক মাস তো বটেই, কোন কোন চিঠি আবার ছ মাস বা এক বৎসরের ব্যবধানে লেখা হয়েছে।
একটা চিঠিতে লেখা–
সে মরেছে। আমিও মরবো। কিন্তু মরতে পারছি না কেবল একজনের মুখ চেয়ে। ওর যাহোক একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত মরতে পারছি না। তাছাড়া চেৎ সিং, সেও তোমাকে নিষ্কৃতি দেবে না।
কে এই চেৎ সিং! আর একখানা চিঠিঃ
চেৎ সিং তোমাকে একদিন খুঁজে পাবেই, কারণ আমার স্থির ধারণা চেৎ সিং তোমারই খোঁজে মুলক ছেড়েছে। চেৎ সিংয়ের বুকের পাঁজরা তুমি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ। হায়, কেন সেদিন তোমায় বিশ্বাস করেছিলাম! লোভের উপযুক্ত শাস্তিই আমার মিলেছে।
আরো পরের একখানা চিঠি এবং সর্বশেষ চিঠিই বোধ হয়–
এইবার আমি নিশ্চিন্ত। চেৎ সিং আমায় জানিয়েছে সে তোমার সংবাদ পেয়েছে, কিন্তু এই দুঃখ আমার থেকে গেল—তোমার সংবাদটা শোনা পর্যন্ত আর হয়ত আমার বাঁচা হবে না।
বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল, মিঃ রায়!
কিরীটী চমকে ওঠে, কে?
দরজাটা খুলন মিঃ রায়। আপনার চা এনেছি। কল্যাণীর গলা।
ক্ষিপ্রহস্তে চিঠিগুলো কোনমতে গুছিয়ে কিরীটী বাণ্ডিলটা সুটকেসের মধ্যে ভরে ফেলে।
দরজাটা খুলতেই দেখা গেল ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে প্রসন্ন হাস্যমুখে দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে কল্যাণী।
ঘুমোচ্ছিলেন নাকি এখনো? প্রশ্ন করে কল্যাণী চায়ের কাপ হাতে ঘরে প্রবেশ করতে করতে।
না। আসুন, সুপ্রভাত!
চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে কল্যাণী বলে, কাল রাত্রে আমাদের ঘরে কেউ বোধ হয় এসেছিল মিঃ রায়!
চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে কিরীটী সবেমাত্র চুমুক দিয়েছিল, কল্যাণীর কথায় চকিতে ওর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই এবং বোধ হয় বিশ্বাস করতে চাইছেন না আমার কথা?
দুটোর একটাও নয় কল্যাণী দেবী। কিন্তু কিসে বুঝলেন আপনি?
কল্যাণী বোধ হয় লক্ষ্য করলে না যে কিরীটী তাকে তুমির বদলে আবার আপনি বলে কথা বলছে।
ঘুম ভেঙেছে প্রথমে আমারই উঠেই দেখি ঘরে কতগুলো জুতোর অস্পষ্ট ছাপ।
ঘুম ভেঙেছে! কতটুকু সময় তাহলে ঘুমিয়েছিলেন?
মানে? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল কল্যাণী কিরীটীর প্রশ্নভরা দুই চোখের দিকে।
আমার চাইতে সে কথাটা কি আপনি ভাল জানেন না কল্যাণী দেবী!
কল্যাণী কিন্তু নিরুত্তর। তার কণ্ঠে কোন ভাষাই যোগায় না যেন।
ঘরে তো গেলেন ভোর পাঁচটায়। ঘুমোবার সময় পেলেন কখন?
এবারে কিরীটী লক্ষ্য করে, কল্যাণীর সমস্ত মুখখানা যেন একটা চাপা রক্তিমাভা ধারণ করেছে।
কল্যাণী দেবী! মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবার ডাকে।
কল্যাণী তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে। ঠিক এমনি সময় সবিতা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল,
মিঃ রায়!
আসুন সবিতা দেবী। সুপ্রভাত। রাত্রে নিশ্চয়ই কাল খুব গভীর নিদ্রা দিয়েছিলেন!
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সবিতা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
যাক, আপনার সৌভাগ্য বলতে হবে, গতরাত্রে আপনার কোন ক্ষতি হয়নি!
আপনি
হ্যাঁ। এইমাত্র কল্যাণী দেবীর মূখেই শুনলাম আপনার শয়নঘরের দরজা খোলা পেয়ে সেই সুযোগে কে নাকি আপনার শয়নঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন। এবং এও বোঝাই যাচ্ছে যিনিই গতরাত্রে আপনার শয়নঘরে প্রবেশ করে থাকুন না কেন, সুযোগের অভাবে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি।
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, কেউ যে গতরাত্রে কোন এক সময় আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল সন্দেহ নেই সত্যি, কিন্তু কি করে সেটা আদৌ সম্ভব হলো? আমি ও কল্যাণী শোবার আগে, নিজে হাতে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম ঘরের, সবিতা বিহ্বলভাবে কথাগুলো বললে।
কিরীটী কৌতুকোজ্জল দৃষ্টিতে বারেকের জন্য কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে সবিতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, বন্ধ থাকলেই বা! কারো খুলতে তো সেটা কষ্ট হতে পারে না!
কিন্তু আমি বা কল্যাণী কেউই তো রাত্রে আমরা উঠিনি! সবিতা আবার বলে।
আপনি ওঠেননি এটা ঠিকই, কিন্তু কল্যাণী দেবী? কিরীটী প্রশ্ন করল।
না, কলিও ওঠেনি। আমাদের দুজনের ঘুম প্রায় একই সঙ্গে ভেঙেছে। সবিতা জবাব দেয়।
সে প্রশ্নের মীমাংসা পরে করলেও চলবে। আগে একবার চলুন দেখি, দেখে আসি আপনার ঘরটা। কল্যাণী দেবী বলছিলেন আপনার শয়নঘরের মেঝেতে নাকি কার জুতোর অস্পষ্ট ছাপ রয়েছে!
আলোচনাটা যেন কতকটা ইচ্ছে করেই বন্ধ করে দিয়ে কিরীটী চেয়ার হতে উঠে সবিতাকে নিয়ে অগ্রসর হল তার ঘরের দিকে।
শ্লথ মন্থর পায়ে কল্যাণীও ওদের অনুসরণ করল।
অষ্পষ্ট জুতোর ছাপই বটে।
এবং সেই পূর্বের ক্রেপসোল দেওয়া জুতোরই ছাপ কয়েকটা ঘরের মেঝেতে তখনও রয়েছে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ছাপগুলো পরীক্ষা করে দেখে আর একবার ঘরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল।
সবিতার নিদ্রিত অবস্থায় যে সময়টা কল্যাণী ঘরে ছিল না এবং ঘরের দরজা খোলা ছিল সেই সুযোগেই কেউ এসেছিল এই ঘরে সুনিশ্চিত।
কিন্তু কেন? কি উদ্দেশ্যে এসেছিল সে?
নিশ্চয়ই একেবারে বিনা উদ্দেশ্যে কেউ গতরাত্রে কল্যাণীর অবর্তমান ঘরে আসেনি এবং সম্ভবতঃ রাত্রে ঠিক এ সময় কল্যাণী যে ঘরে থাকবে না এবং দরজা খোলাই থাকবে তাও তো নিশীথ আগন্তুক জানত না!
কিন্তু
পরক্ষণেই যেন কিরীটীর সন্দিগ্ধ মন প্রশ্নে আবর্তিত হয়ে ওঠে।
অপাঙ্গে একবার অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান কল্যাণীর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারে না কিরীটী।
আবার কিরীটী মেঝের উপরে জুতোর ছাপগুলোর দিকে তাকাল। সবিতার পালঙ্কের একেবারে কাছবরাবর ঘেষে জুতোর ছাপগুলো।
ঘরের দক্ষিণ দিক ঘেষে দুটো শয্যা, একটা সবিতার দামী পালঙ্কের উপরে, অন্যটা হাত দুই ব্যবধানে কল্যাণীর, ছোট একটা তক্তপোশের উপরে।
দুটি খাটের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় মেঝেতেই জুতোর ছাপগুলো রয়েছে।
সহসা কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনাদের মধ্যে কে প্রথম ঐ ছাপগুলো দেখতে পান মিস চৌধুরী?
কল্যাণী। ওই আমাকে পরে দেখায়।
দরজার বাইরে এমন সময় ভৃত্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দিদিমণি?
কে রে?
কলকাতা থেকে উকীলবাবু এসেছেন। মামাবাবু, আপনাকে একবার এখনি নিচে ডেকে দিতে বললেন।
যান মিস্ চৌধুরী। বোধ হয় কলকাতা থেকে আপনাদের সলিসিটার অতীনলাল বোস এসেছেন। কিরীটীই এবারে সবিতার দিকে তাকিয়ে বললে।
মিঃ বোস সলিসিটার! তাঁর আসবার কথা ছিল কই
হ্যাঁ, নায়েব বসন্তবাবুই তাঁকে আসতে লিখেছিলেন আপনার বাবার উইল সংক্রান্ত ব্যাপারেই। কিরীটী জবাব দিল।
বাবার উইলের ব্যাপারে?
হ্যাঁ। যদিও সাধারণভাবে বিচার করে দেখতে গেলে আপনিই আপনার পিতার যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী, তাহলেও সকলের অজ্ঞাতে যদি উইলের মধ্যে অন্য কোন ব্যবস্থা বা এমন কোন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে গিয়ে থাকেন যেটা জানা দরকার, সেদিক দিয়েও তো উইলের মধ্যে কি লেখা আছে বা না আছে আপনার জানা দরকার সবিতা দেবী। যান নিচে যান।
আপনিও আসুন মিঃ রায়!
কিন্তু আমার সেখানে থাকাটা কি উচিত হবে সবিতা দেবী? আমি তো আপনাদের ফ্যামিলির কেউ নই, সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি!
তা হোক, আপনি চলুন। সত্যজিৎবাবু কোথায়?
তিনি তো অনেকক্ষণ ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন, জানি না তো! কিরীটী জবাব দেয়।
তুমি দেখ তো কল্যাণী, সত্যজিৎবাবু, কোথায়? কল্যাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে সবিতা কথাটা বললে।
সকাল থেকে কই সত্যজিতের সঙ্গে তো আমার দেখাও হয়নি!
কিরীটী চকিতে একবার কল্যাণীর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললে, চলুন দেখা যাক, নিচেও হয়ত তিনি থাকতে পারেন।
নিচে বাইরের ঘরেই সত্যজিতের দেখা পাওয়া গেল।
নিত্যানন্দ সান্যাল একজন সাহেবী পোশাক পরিহিত সুশ্রী গৌরবর্ণ হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল সত্যজিৎ রায়।
ওদের সকলকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে নিত্যানন্দ সান্যালই আহ্বান জানালেন, এই যে সবি মা, এসো! ইনি অতীনলাল বোস তোমাদের সলিসিটার। এবং উপবিষ্ট মিঃ বোসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, মিঃ বোস এই সবিতা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে।
নমস্কার মিস চৌধুরী বসুন। বসন্তবাবুরই জরুরী চিঠি পেয়ে আমি আসছি, কিন্তু এখানে এসে ওঁর মুখে বসন্তবাবু সম্পর্কে সব কথা শুনে তো
বিরক্তি ও ভ্রূকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে সবিতা সম্মুখেই উপবিষ্ট নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকাল এবং পরক্ষণেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অতীনলালের দিকে তাকিয়ে বললে, কি আপনি শুনেছেন নায়েবকাকার সম্পর্কে মিঃ বোস আমি জানি না—তবে আমি বলতে পারি, ব্যাপারটা সম্পূর্ণই একটা misunderstanding বা দারোগা লক্ষ্মীকান্তবাবুর misjudgement! যাক, সে আলোচনা বর্তমানে আমাদের না করলেও চলবে। আর আমার ইচ্ছাও নয়। আপাতত ঐ বিষয় নিয়ে আর আলোচনা করবার। আপনি বোধ হয় বাবার উইল এনেছেন?
সবিতার অদ্ভুত সংযত কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত কথাগুলি কিরীটীকে বিস্মিত করে। গতকাল দ্বিপ্রহরের দিকে জমিদারী দেখাশোনার ব্যাপারে সবিতার যে অদ্ভুত দৃঢ়তা ও সংযমের পরিচয় পেয়েছিল, আজও সবিতার কণ্ঠে যেন ঠিক সেই সুরটিই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে।
অকস্মাৎ কক্ষের মধ্যে যেন একটা অপ্রিয় পরিস্থিতি ঘনিয়ে ওঠে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কিছু ক্ষণের জন্য একটা স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে বিরাজ করে।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সলিসিটার অতীনলালই আবার কথা বললেন, হ্যাঁ, উইলটা আমি সঙ্গেই এনেছি বসন্তবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী। পূর্বের অপ্রিয় আলোচনাটা যেন কতকটা ইচ্ছা করেই সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, একেবারে অন্য ধারায় বক্তব্য শুরু করলেন, তা সে যাই হোক, তিনি উপস্থিত যখন নেই-ই, আপনাদের সকলের সামনে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উইলটা পড়তে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু উইল পড়বার আগে সবিতা দেবী আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন আছে এবং যে প্রশ্নের উপরে উইল এখন আর পড়া না-পড়াটা সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছে। অতীনলাল সবিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন।
বিস্মিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবিতা তাকায় অতীনলালের দিকে, প্রশ্ন?
হ্যাঁ। যে শিলমোহর-করা খামটা আপনার নামে তাঁর আয়রন-সেফে ছিল। সেটা খুলে আপনি আপনার বাবার শেষ চিঠিটা পড়েছেন কি?
অতীনলালের প্রশ্নে মনে হল সবিতা যেন অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়েছে এবং বিস্ময়সন্দিগ্ধভরা কণ্ঠে কোনমতে বললে, বাবার আয়রন-সেফে আমার নামে শিলমোহর করা খামের মধ্যে তাঁর শেষ চিঠি?
হ্যাঁ, কেন পাননি আপনি সে চিঠি? আমার প্রতি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর শেষ নির্দেশ ছিল, যে নির্দেশ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে জরুরী রেজিস্টার্ড একটা চিঠির মারফৎ পাই যে, এ চিঠি যেটা তিনি তাঁর সেফে রেখে গেলেন, আপনি খুলে না পড়া পর্যন্ত উইল যেন সর্বসমক্ষে তো নয়ই আপনাকে পর্যন্তও যেন পড়ে না শোনানো হয়।
কিন্তু বাবার আয়রন-সেফ এবং যে টেবিলে বসে তিনি সাধারণতঃ লেখাপড়া করতেন, সব আমি বসন্তকাকার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে এখানে আসবার পরদিনই তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখেছি যদি কোন চিঠি বা এ ধরণের কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় যাতে করে বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন হদিস পাওয়া যায়, কিন্তু কিছুই তো পাইনি!
সবিতার কথায় অতীনলাল কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে কি যেন ভাবলেন। অতঃপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, এ অবস্থায় তাহলে নায়েববাবু, ফিরে না আসা পর্যন্ত বা তাঁর কাছ হতে ঐ চিঠি সম্পর্কে সব না জানা পর্যন্ত তো উইলটা আমি পড়তে পারবো না সবিতা দেবী!
নিত্যানন্দ সান্যাল এবারে কথা বললেন, একটা কথা মিঃ বোস ক্ষমা করবেন, অবশ্য না বলে এক্ষেত্রে আমি পারছি না। ধরুন যদি সে লেফাপাটার কোন হদিসই না পাওয়া যায়, তাহলে সবি মা কি তার উইলটা সম্পর্কেও জানতে পারবে না?
পারবেন। তবে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
অপেক্ষা করতে হবে মাত্র ঐ সামান্য একটা কারণে?
কারণটা যে সামান্য, সে কথা আপনি জানলেন কি করে, মিঃ সান্যাল? ঐ চিঠির বিষয়বস্তুর সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উইলেরও এমন একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে যে, যাতে করে ঐ চিঠিটা পূর্বে না পড়া থাকলে উইলের বিষয়বস্তু সঠিকভাবে উপলব্ধিই করতে পারবেন না অন্ততঃ সবিতা দেবী।
তার মানে?
ক্ষমা করবেন মিঃ সান্যাল। বর্তমানে এর বেশী কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ যেটুকু আমি বলেছি ঐটুকুই চিঠিতে মৃত্যুর আগে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আমাকে জানিয়েছিলেন। ঐ শিলমোহর করা লেফাপার মধ্যে চিঠিতে তিনি তাঁর মেয়েকে কি লিখেছিলেন বা না লিখেছিলেন, সে সম্পর্কে আমিও কিছু জানি না বিশ্বাস করুন।
দেখ মা, সবিতাকে লক্ষ্য করে নিত্যানন্দ সান্যালই আবার কথা বললেন। এবং সকলেই নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকায়।
নিত্যানন্দ বললেন, তুমি মনে হয়ত দুঃখ পাবে মা আমার কথাটা শুনে, কিন্তু কথাটা আমি না বলেও পারছি না। জীবনে কোন দিন মিথ্যার আশ্রয় নিইনি-চিরদিন সত্যকেই জীবনের লক্ষ্য করে এসেছি এবং অপ্রিয় হলেও সত্য যখন মনে হচ্ছে, বলতে বাধ্য হচ্ছি কথাটা—আমারও এখন স্থিরবিশ্বাস হচ্ছে, এ কাজ বসন্ত ভায়ারই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবিতা তাকাল নিত্যানন্দ সান্যালের দিকে,
না, না, না—
স্থিরভাবে বিবেচনা করে দেখো, সে ছাড়া আর কারো পক্ষেই
মামাবাবু?
মা রে! চুলে পাক ধরেছে, বয়সও আমার অনেক হলো। এ বয়সে দেখলামও অনেক, অবশ্য বসন্ত ভায়াও আমার বহুদিনের এবং যথেষ্ট পরিচিত। এ কাজ তার দ্বারা সম্পন্ন হয়নি প্রমাণ হলে আমার চাইতে এ জগতে আর কেউ বেশী সুখী ও আনন্দিত হবে না হয়ত, তবু চক্ষুলজ্জার খাতিরে অপ্রিয় ও কষ্টকর বলে সত্যকে যদি আমরা অস্বীকার করি, তার চাইতে দুঃখ ও গ্লানি আর বেশী কিছু থাকবে না মা। তাই বলছিলাম, আমার মনে হয় এ কাজ তারই। ভেবে দেখো মা, তোমার পিতার আকস্মিক অপঘাতে মৃত্যুর পর একমাত্র এ বাড়িতে সে-ই তো এ কটা দিন ছিল। এবং তার হাতেই চাবি ছিল। বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে দেখতে গেলেও স্বভাবতই কি মনে হবে না যে, লেফাপাটা সরানো তার পক্ষে যতটা সহজ ও সুবিধা ছিল তেমন আর কারো পক্ষেই সুবিধা ছিল না। শুধু, সেই নয় মা, আরো একটা কথা আমাদের এক্ষেত্রে ভাবতে হবে, মিঃ বোস যখন বলছেন মৃত্যুঞ্জয়ের মতুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ওঁকে ঐ লেফাপার সংবাদ দিয়ে একটা জরুরী পত্র দিয়েছিলেন, তখন নিশ্চয় তাঁর Iron-safe-এ লেফাটা ছিল। এবং ছিলই যখন, তখন সেটা গেল কোথায়? চাবিবদ্ধ Iron-safeএর ভিতর থেকে পাখা মেলে তো কিছু আর লোপাটা উধাও হয়ে যেতে পারে না!
উপস্থিত নিত্যানন্দ সান্যালের যুক্তিকে কেউ যেন অস্বীকার করতে পারে না, করবার উপায়ও নেই।
অতীনলালই বলেন, মিঃ সান্যাল ঠিকই বলেছেন সবিতা দেবী। কথাটা ভেবে দেখবার মত।
ভাবতে আর হবে না মিঃ বোস। অতর্কিত কণ্ঠস্বরে সকলেই একসঙ্গে চমকে বক্তার দিকে ফিরে তাকায় ঘরের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন। বক্তা সন্তোষ চৌধুরী।
কেউই ঘরের মধ্যে উপস্থিত ইতিমধ্যে টের পায়নি কখন একসময় সন্তোষ চৌধুরী সবার পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার উপস্থিতিটা না জানলেও ক্ষণপূর্বে ঘরের মধ্যে যে আলোচনাটা চলছিল সেটা সে শুনছে।
সন্তোষ চৌধুরী বক্তব্যটা শেষ করে, সেই শয়তানের কাজ! এখন সময় বুঝে ধরা পড়ে কৌশলে গাঢাকা দিয়েছে।
আপনি! আপনাকে তো চিনতে পারছি না? কথাটা বললেন মিঃ অতীনলাল সন্তোষকে লক্ষ্য করে।
আমি। আমার নাম সন্তোষ চৌধুরী, সবিতার জাঠতুতো ভাই আমি। ওর বাবা ও আমার বাবা আপন জাঠতুতো ভাই ছিলেন। দিন তিনেক হলো আমি এডেন থেকে এসে পৌঁছেছি।
অতীনলাল সন্তোষ চৌধুরীর কথা শুনে তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটি কথাও বললেন না।
এতক্ষণ পর্যন্ত কিরীটী একটিও কথা উচ্চারণ করেনি। একান্ত নির্লিপ্তভাবেই চক্ষু কর্ণকে সজাগ রেখে এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে সকলের কথা শুনছিল এবং এখনও কোন কথাই বলল না—কেবল অতীনলালের সন্তোষ চৌধুরীর মুখের প্রতি নিবন্ধ স্থিরসন্ধানী দৃষ্টিটাই তাকে যেন বিশেষভাবেই কৌতুহলী করে তুলল।
স্পষ্টই বুঝতে পারছিল কিরীটী, এবারে অতীনলাল কিছু একটা বলবেন। প্রতীক্ষায় উদগ্রীব হয়ে ওঠে কিরীটী।
আপনি সন্তোষ চৌধুরী? এডেন থেকে এসেছেন? ধীরকণ্ঠে অতীনলাল সন্তোষের মুখের দিকে স্থির-নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলেন।
হ্যাঁ।
অদ্ভুত যোগাযোগ তো! এত আস্তে অতীনলালের কণ্ঠে কথাটা উচ্চারিত হল যে, একমাত্র কিরীটীর অতিমাত্র সজাগ শ্রবণেন্দ্রিয় ব্যতীত ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্য কারোরই শ্রবণে কথাটা প্রবেশ করল না। এমন কি সন্তোষ চৌধুরীও কথাটা শুনতে পেল না।
কি বললেন মিঃ বোস?
না, কিছু না! অতীনলাল শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন।
তাহলে উইলটা পড়বার কি হবে মিঃ বোস? প্রশ্নটা এবারে নিত্যলাল সান্যালই করলেন।
উইল! আরো দুটো দিন বসন্তবাবুর জন্য আমি অপেক্ষা করবো এখানে। পরশু সকালে উইল পড়ে শোনাব সকলকে। জবাব দিলেন অতীনলাল।
তুমি কি বল মা সবি? প্রশ্ন করলেন সান্যাল সবিতাকে।
ক্ষতি কি, তাই হবে। আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
কালকের দিনটা তো মধ্যে, তাই হবে না হয়। কিরীটী জবাব দিল।
প্রভু হে, দয়াময়! মা কলি, আমার উপাসনার আয়োজন করে দেবে চল মা বহুক্ষণ সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
নিত্যানন্দ সান্যাল অতঃপর কক্ষত্যাগ করবার জন্যই বোধ হয় চেয়ার হতে গাত্রোখান করে, দুয়ারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে মিঃ অতীনলালের থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও মা। পথশ্রমে উনি ক্লান্ত চায়ের ব্যবস্থা করো।
প্রশান্ত পদক্ষেপে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন সান্যাল। পশ্চাতে পশ্চাতে তাঁকে অনুসরণ করে কল্যাণী।
চাকর বেটারাই বা সব গেল কোথায়? ভদ্রলোককে যে এক কাপ চা দিতে হয়, সে হুঁশও কি বেটাদের নেই? এই বনমালী! বলতে বলতে সন্তোষ চৌধুরীও কক্ষ ত্যাগ করলেন।
সত্যজিৎ এরপর ইঙ্গিতে সবিতাকে ডেকে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল।
২২. কিরীটী ও অতীনলাল সলিসিটার
ঘরের মধ্যে এখন দুজন।
কিরীটী ও অতীনলাল সলিসিটার।
কিরীটীবাবু! এতক্ষণে সর্বপ্রথম অতীনলাল কিরীটীর দিকে তাকিয়ে সম্বোধন করলেন ওকে। দুজনেরই পূর্ব-পরিচয় ছিল, কিন্তু এতক্ষণ কেউ সেটা প্রকাশ করেননি।
গতকাল নায়েব বসন্ত সেনের মুখে অতীনলাল বোস সলিসিটারের নাম শোনা অবধিই কিরীটী ভাবছিল এ কোন অতীনলাল এবং আজ সলিসিটারের আসার সংবাদ পেয়ে এই ঘরে প্রবেশ করেই অতীনলালকে দেখে বুঝতে পেরেছিল ইনি তার পরিচিতই।
বলুন?
ব্যাপারটা যেন একটু ঘোরালই মনে হচ্ছে!
একটু নয়, বেশই ঘোরাল মিঃ বোস। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
উইলটা পড়া সম্পর্কে কি করা যায় বলুন তো?
উইলের বিষয়বস্তু আপনার জানা আছে তো?
না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর এটা নতুন উইল। মাস দেড়েক আগে পূর্বের উইলটা বদলে তিনি এই নতুন উইলটা করেছিলেন। এ উইলটা যখন লেখা হয় আমি উপস্থিত ছিলাম না। ফেডারেল কোর্টে একটা মামলায় আমাকে দিল্লী যেতে হয়েছিল—আমার সিনিয়ার পার্টনার উইলটা করে দেন। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে উইলটা নিয়ে আসতে হয়েছে।
হ। আচ্ছা একটু আগে যে বলছিলেন—মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হবার দিন আষ্টেক আগে যে জরুরী চিঠিটা লিখেছিলেন, সে চিঠিটা কি সঙ্গে এনেছেন?
হ্যাঁ। দেখতে পারি কি চিঠিটা?
এই যে, অতীনলাল তাঁর পোর্টফোলিওটা খুলে একটা লেফাপা বের করে তার ভিতর হতে একটা মুখ-কাটা রেজিস্ট্রী খাম বের করে দিলেন।
কিরীটী চিঠিটা খাম থেকে টেনে বার করল। চিঠিটা বোসের সিনিয়র পার্টনারকেই লেখা। এবং তারিখ দেখেই বোঝা যায় নিহত হবার ঠিক নদিন পূর্বে চিঠিটা মৃত্যুঞ্জয় লিখেছিলেন।
চিঠিটা অবশ্য সংক্ষিপ্ত। চিঠিতে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, তিনি একটা শিলমোহর করে চিঠি তাঁর মেয়ের নামে লেফাপার মধ্যে রেখে গেলেন; সেই চিঠিটা তাঁর মেয়ে না পড়ার আগে যেন কোনমতেই উইল পড়ে শোনানো না হয় তাকে।
যাই হোক মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী লিখিত এই চিঠি ও লেফাপার মধ্যে শিলমোহল করে যে গোপন চিঠি তিনি লিখে গিয়েছেন এবং মাত্র মাস দেড়েক আগে আবার নতুন করে উইল করার ব্যাপারে পূর্বের উইল বদল করে এ সব কিছু হতে একটা কথা কিরীটীর মনে স্বতই উদয় হয়, গত মাস-দুয়ের মধ্যে এমন কোন ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছিল যা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল।
এবং যে কারণে তাঁকে উইল পর্যন্ত বদলাতে হয়েছিল। চিঠিটা পড়ে কিরীটী সেটা অতীনলালের হাতে আবার ফেরত দেয়।
পূর্বের উইলে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী কিভাবে তাঁর সম্পত্তির ব্যবস্থা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপনার মনে আছে কি মিঃ বোস?
আছে, তবে details তো মনে নেই।
তবু বলুন তো, শুনি?
দুই ভাগে সম্পত্তি ভাগ করা হয়েছিল—এক অংশ তাঁর মেয়ে সবিতা দেবী পাবেন। বাকী অর্ধেকের অর্ধাংশ যদি তার জাঠতুত ভাই রামশঙ্কর চৌধুরীর ছেলে সন্তোষ চৌধুরী ফিরে আসেন তো তিনি পাবেন, এবং অবশিষ্ট পাবেন সৌদামিনী দেবী বা তস্য পুত্র ধনঞ্জয়।
সৌদামিনী ও তস্য পুত্র ধনঞ্জয়—এরা কে?
তা ঠিক বলতে পারি না।
পূর্বের উইলে ওঁদের সম্পর্কে তাঁর কোন নির্দেশ বা পরিচিতি তো ছিল না?
আপনাকে বা আপনার সিনিয়র পার্টনারকেও ওঁদের পরিচয় দেননি?
আমি বা আমার পার্টনার কেউই জানি না, তবে বলেছিলেন মিঃ চৌধুরী যে সময়মত সে সব ব্যবস্থাই তিনি করে যাবেন।
কিরীটী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কি যেন ভাবে এবং সহসা একটা কথা মনে পড়ায় আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ বোস বলতে পারেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যে তাঁর পূর্বেকার উইল বদল করে আবার নতুন উইল তৈরী করেছিলেন, এ সংবাদ বসন্তবাবু জানতেন কিনা?
মনে হয় জানতেন, কারণ প্রথমবারের উইলে বসন্তবাবু, একজন সাক্ষী ছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়বারের উইলে শুনেছি আমার সিনিয়রের মুখেই, বসন্তবাবু, সাক্ষী হিসাবে নামসই করেননি। তবে মৃত্যুঞ্জয়বাবু যদি বসন্তবাবুকে বলে থাকেন পরে এক সময়ে সেটা অবশ্য বলতে পারি না।
দ্বিতীয়বারের ঐ নতুন উইল সম্পর্কে আপনার কোন idea নেই তাহলে?
না।
ও সম্পর্কে কোন কথা আপনার সিনিয়রও কোন দিন আপনাকে বলেননি?
না।
কখনও সামান্য discussion-আলোচনাও হয়নি?
না।
ভৃত্য প্লেটে করে চা-জলখাবার নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঐদিনই দ্বিপ্রহরে কিরীটী তার ঘরে সবিতাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। প্রয়োজনীয় কিছু আলোচনা ছিল সবিতার সঙ্গে ওর।
আজ রাত্রে আপনি যে ঘরে ও যে শয্যায় শোন, সে ঘরে ও সেই শয্যায় আপনার শোয়া চলবে না সবিতা দেবী। কিরীটী বলে।
কেন?
এখন কোন প্রশ্নই আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে করবেন না সবিতা দেবী ও সম্পর্কে। সময়ে সবই আপনি জানতে পারবেন।
কিন্তু
এইটুকু শুধু বলতে পারি, যে ব্যবস্থা আমি করছি সব কিছু বিবেচনা করেই আমাকে করতে হচ্ছে, এবং এর চাইতে বেশী কিছু খুলে বলা বর্তমানে আমার পক্ষে সম্ভব নয় সবিতা দেবী।
বেশ, তাই হবে। কিন্তু কোন ঘরে শোব রাত্রে?
আপনার বাবার ঘরে। আর এ কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে, এমন কি কল্যণী দেবী বা সত্যজিৎবাবুও না।
কিন্তু বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, একই বাড়িতে ওদের সকলের সঙ্গে থেকে সকলের অজ্ঞাতে অন্য ঘরে শোওয়া কেমন করে আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে!
কোন কৌশলে বুদ্ধি খাটিয়ে সামান্য কাজ সম্পন্ন করতে আপনি পারবেন না সবিতা দেবী?
সবিতার মুখের দিকে তাকিয়েই কিরীটী বুঝতে পারে, সবিতা ওর প্রস্তাবে সত্যিই একটু বিহ্বল হয়ে পড়েছে।
শুনুন সবিতা দেবী, যেমন usual আপনি ঘরে শুতে যান শুতে যাবেন নিজের ঘরে, তারপর রাত্রে কোন এক সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে ছাদের দরজা খুলে ছাদ দিয়েই পাশের আপনার বাবার ঘরে গিয়ে শোবেন। বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাই?
হ্যাঁ। মৃদু নিরুৎসুক কণ্ঠে জবাব দেয় সবিতা।
আর একটা কথা সবিতা দেবী
বলুন।
সৌদামিনী ও তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়—এদের আপনি চেনেন?
কই, ও নাম দুটো কখনও শুনেছি বলেও তো আমার মনে পড়ছে না!
মনে করে দেখুন তো! আপনার কোন দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় বা
না, ও নাম দুটো জীবনে কখনও শুনিনি।
কখনও আপনার বাবার মুখে কোন আলোচনার মধ্যে?
না।
ভাল করে আর একবার ভেবে দেখুন সবিতা দেবী!
না, কখনও ও দুটো নাম শুনিনি কারো মুখেই।
কানাইয়ের মার মুখেও নয়?
না। কিন্তু কেন বলুন তো?
ওই দুটি নামের পরিচয় আমার জানা একান্ত আবশ্যক সবিতা দেবী। আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন সবিতা দেবী। হ্যাঁ ভাল কথা, দুটো দিন অন্তত আপনি বাড়ি থেকে কোথাও বের হবেন না। এটিও আমার একটা বিশেষ অনুরোধ।
বেশ।
সবিতাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী চটপট প্রস্তুত হয়ে নিল, এখনি একবার থানায় যেতে হবে। লক্ষ্মীকান্তর সঙ্গে কথা আছে।
কিরীটী থানায় গিয়ে পৌঁছাল যখন, বেলা তখন প্রায় তিনটে।
লক্ষ্মীকান্ত বাইরে অফিস ঘরেই ছিলেন, কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, আসুন কিরীটীবাবু, বসুন।
কিরীটী নিঃশব্দে উপবেশন করল। বললে, বসন্তবাবুর কোন খোঁজ পেলেন মিঃ সাহা?
না। তবে কলকাতায় ঘটনার বিবরণী ও বসন্ত সেনের full description দিয়ে special branch-এ জরুরী তার করে দিয়েছি। যে কোন মুহূর্তেই সংবাদ একটা কিছু আশা করছি।
আমার মনে হয় দু-চার দিনের মধ্যে হয়ত বসন্তবাবু, নিজেই ফিরে এসে ধরা দেবেন মিঃ সাহা!
হুঁ! আপনি তাই মনে করেন কিরীটীবাবু? আপনি জানেন না তাহলে ঐসব চরিত্রের লোকদের they are dangerous! প্রথম হতেই ব্যাপারটা আমি লঘু করে নিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি এত জটিলতা আছে ভিতরে। আফসোস হয় আমার—প্রথমেই ও লোকটাকে সন্দেহ করিনি কেন? প্রথমেই ওকে গ্রেপ্তার করলে হয়ত এতদিনে সব সুরাহা একটা হয়ে যেত
ভাববেন না, সে যাবে কোথায় পালিয়ে, ধরা পড়বেই!
সে আমিও জানি। তবে
আপনি পরশু বলছিলেন, সন্তোষ চৌধুরীর নিকট অনেক কিছুই নাকি জানতে পেরেছেন!
হ্যাঁ সন্তোষ চৌধুরী দুখানা চিঠি দেখাল মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর লেখা রামশঙ্করের কাছে।
সে চিঠি দুটোতে কি লেখা ছিল আপনার মনে আছে কি মিঃ সাহা।
সংসারের নানা কথা।
সে চিঠির মধ্যে টাকা বা সম্পত্তির কোন কথা ছিল কি?
না, সে ধরনের কোন কথাই ছিল বলে তো মনে পড়ছে না!
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
আবার প্রশ্ন করে, কানাইয়ের মার কোন সংবাদ পেলেন মিঃ সাহা?
না। চারিদিকে লোক তো পাঠিয়েছিলাম, কেউই কোন সংবাদ আনতে পারেনি।
আপনার লোকদের বিলের চৌহদ্দিটা একবার ভাল করে খুঁজে দেখতে বলবেন তো!
কেন বলুন তো?
দেখুন না খোঁজ করে, কানাইয়ের মার সন্ধান না পেলেও, আর কারো সংবাদও তো পেতে পারেন!
বেশ তো, এখনি লোক পাঠাচ্ছি। কিন্তু আপনার অনুসন্ধান কতদূর এগলো?
কিরীটী তখন নিচুকণ্ঠে কতকগুলো কথা লক্ষ্মীকান্তকে বললে। কিরীটীর কথা শুনতে শুনতে লক্ষ্মীকান্ত বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং বলেন, আশ্চর্য! তাহলে তো আমার মনে হয়
সন্তর্পণে এবারে আমাদের এগুতে হবে। He is desperate now! মরীয়া হয়ে এবারে হত্যাকারী তার শেষ attempt নেবেই—এবং সেই চরম মুহূর্তে আমরা red-hand ধরবো তাকে। আপনি প্রস্তুত থাকবেন। বিশেষ করে এই কথা বলবার জন্যই আমার এখানে আসা।
ধন্যবাদ। আমি প্রস্তুত থাকবো।
প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ কিরীটী সাইকেলে চেপেই আবার প্রমোদভবনে ফিরে এলো।
সন্ধ্যা একসময় উত্তীর্ণ হয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার রাত্রি চারিদিকে ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে।
ক্রমে রাত্রি বেড়ে চলে, নিস্তব্ধ হয়ে আসে চারিদিক।
প্রমোদভবনের সকলের চোখে নেমে আসে ঘুমের ঢুলুনি। একটা কিছু ঘটনার প্রতীক্ষায় রাত্রির নিস্তব্ধ প্রহরগুলো কেটে যেতে থাকে কিরীটীর। কিন্তু কোন কিছুই ঘটলো না, ব্যর্থ প্রতীক্ষার ব্যাকুলতায় নিশি প্রভাত হলো।
একটা অস্বাভাবিক গুমোট ভাব যেন সমস্ত প্রমোদভবনকে গ্রাস করেছে। চলাফেরা করে সব নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। কারো মুখেই কোন কথা নেই।
এমনি করেই কেটে গেল সমস্ত দিন সূর্য গেল অস্তাচলে, সন্ধ্যার তরল ছায়া নেমে এল চারিদিকে, রাত্রিও আসন্ন।
রাত্রি!
রহস্যময়ী রাত্রি আসে তার কালো ওড়না মেলে ধরণীর বুকে শ্লথ মন্থর পদসঞ্চারে। রহস্যঘন আশঙ্কার পূর্বাভাস যেন রাত্রির ঘনিয়ে ওঠা স্তব্দতায়।
গেটের পাশে ঝাউগাছগুলো বাস টানছে যেন থেকে থেকে কোন ক্লান্ত প্রেতাত্মার মতই। বৌরাণীর বিলের অথৈ কালো জল অন্ধকারে যেন ঘন জমাট বেধে আছে। কালো রহস্যঘন আকাশে তারাগুলো মিটিমিটি তাকাচ্ছে ভয়ে ভয়ে বুঝি।
ঢং..ঢং…ঢং। রাত্রি তিনটে ঘোষিত হলো দেওয়াল-ঘড়িটায়।
একটা চাপা পদশব্দ অন্ধকারে যেন মর্মরিত হয়ে উঠলো। কিরীটী প্রস্তুতই ছিল সত্যজিৎকে নিয়ে। চকিতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যেও অন্ধকার। আলোটা আগেই নিবিয়ে রাখা হয়েছে।
পা টিপে টিপে কিরীটী এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে কিরীটী বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দার দিকে দৃষ্টিপাত করল।
শুনতে সে ভুল করে নি।
কালো আংরাখায় আবৃত সেই দীর্ঘ মূর্তি, মুখের নিম্নাংশে কালো একটা রুমাল বাঁধা। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের দিকেই।
কিরীটী আর মুহূর্তও বিলম্ব করে না। ক্ষিপ্র ত্বরিৎপদে ছাদের দরজা দিয়ে বের হয়ে ছাদ দিয়েই সবিতার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। সবিতার ঘর ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে যেমন সে হাতের টর্চের আলো ফেলেছে ঘরের মধ্যে এবং চাপা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছে, হাত তোল বন্ধু your game is up. আংরাখা-আবৃত মূর্তি শয্যাটার উপরে সবে ঘুমন্ত সবিতার উপরে দুই হাত প্রসারিত করে ঝুঁকেছিল, চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একলাফে দক্ষিণ দিকে সরে গেল এবং বিদ্যুৎগতিতেই যেন পরমুহূর্তে আর এক লাফে ছাদের দরজা দিয়ে বাইরে অদৃশ্য হলো।
কিরীটী ও সত্যজিৎও লাফ দিয়ে মূর্তিকে অনুসরণ করে ছাদের দরজার দিকে ছুটে যায়। ছাদে এসে কিরীটী দেখলে মূর্তি ছাদের প্রাচীরের উপরে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং চক্ষের পলকে নীচে লাফিয়ে পড়ল।
দুজনেই ছুটে প্রাচীরের কাছে এল এবং প্রাচীরের উপরে উঠে নীচে ঝুঁকে দেখতে পেল, আবছা ছায়ার মত মূর্তিটা তখন নন্দনকাননের পথ ধরে ছুটছে।
কিরীটী ও সত্যজিৎ কালবিলম্ব না করে পর পর দুজনেই নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আশ্চর্য, পায়ে তাদের এতটুকু লাগলো না, যেখানে তারা লাফিয়ে পড়েছে সেখানকার মাটি ঝরঝরে নরম ধুলোর মত।
এ ব্যবস্থা তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে পূর্বাহ্নেই করা ছিল।
কিরীটী আগে আগে এবং পশ্চাতে ছুটলো সত্যজিৎ নন্দনকাননের দিকে। হঠাৎ মনে হলো যেন ঝপ করে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বার অস্পষ্ট একটা শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা কিরীটীর সতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়াল না।
কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল। পশ্চাতে সত্যজিৎও।
কেউ যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো বলে মনে হল না? সত্যজিৎই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। কিন্তু চুপ! আস্তে! কিরীটী সত্যজিৎকে সতর্ক করে দেয় চাপা কণ্ঠে, চেয়ে দেখুন ঐ
সত্যি! সত্যজিৎ কিরীটীর চাপাকণ্ঠের সতর্ক নির্দেশে সামনের অন্ধকারে জলের দিকে তাকিয়ে দেখল, নিঃশব্দ সাঁতারে কেউ একটা কালো সর্পিল রেখার মত এগিয়ে চলেছে প্রমোদভবনের প্রাচীরের দিকে।
ওদিকে যাচ্ছে যে নিশ্চয়ই ওদিকে কোন গুপ্ত দ্বারপথ আছে—wait and see!
অনুমান মিথ্যা নয়। দেখা গেল কে একজন প্রাচীর ঘেষে উঠে দাঁড়িয়েছে অন্ধকারেই ছায়ার মত জল থেকে।
পরমুহর্তেই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল যেন প্রাচীরের মধ্যে আশ্চর্য মন্ত্রবলে!
Now quick, follow me! বলেই কিরীটী জলে নামল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে দুজনে সাঁতরিয়ে প্রাচীরের সামনে এসে পৌঁছল। এবং ঐখানে জলের গভীরতা বুঝবার জন্য নিচে পা দিতেই জলের নিচে মাটি পায়ে অনুভব করে। এক কোমরও জল নয় ওখানে।
সামনেই একটা ছোট দ্বারপথ-কপাটটা এখনও উন্মুক্ত আছে।
সিক্ত অবস্থাতেই আগে আগে কিরীটী ও পশ্চাতে সত্যজিৎ সেই ছোট দ্বারপথ দিয়ে নিচু হয়ে কতকটা হামাগুড়ি দেবার মত করেই ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলে সরু একটি অপ্রশস্ত গলিপথ সামনে—অন্ধকার।
বদ্ধ বায়ুর ভ্যাপসা গরমে গলি-পথটা যেন কালো মুখব্যাদান করে আছে।
কোথায় গেছে এই গুপ্ত গলি-পথ! প্রমোদভবনের কোন অংশের সঙ্গে নিশ্চিত যোগাযোগ আছে এই গোপন গলি-পথের!
সতর্ক পদসঞ্চারে দুজনে অগ্রসর হয়।
কিছুটা অগ্রসর হবার পরই ক্ষীণ একটা আলোর শিখা অন্ধকারে যেন অনিশ্চিতের মধ্যে আশার হাতছানি জানায়।
আরো অধিক সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলে কিরীটী।
অগ্রসর হয় দুজনে। একটা কটু অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধ যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে আসছে। নাক জালা করে।
অশ্বের হ্রেষাধনি শোনা গেল। তবে কি ওরা আস্তাবলের দিকেই এগিয়ে চলেছে?
হ্যাঁ, কয়েক পদ আর অগ্রসর হতেই দুজনে—প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে সত্যজিৎ প্রমোদভবনের আস্তাবলের মধ্যে এসেই প্রবেশ করল।
সামনেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অদূরে সেই মূর্তি। এক কোণে একটা আলো জ্বলছে। মূর্তি তার গা হতে ভিজে জামা-কাপড়গুলো খুলতে ব্যস্ত।
চোখের ইশারায় কিরীটী সত্যজিৎকে বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে ডান দিকে এগিয়ে যায়।
হঠাৎ অসতর্ক সত্যজিতের পায়ের নিচে ঘরের মেঝেতে ইতস্তত ছড়ানো ঘোড়ার আহার্য চানার দানা পিষ্ট হবার মচমচ শব্দে চকিতে মূর্তি ফিরে ঘুরে দাঁড়ায়।
গায়ের জামাটা খুলেছে মাত্র, মুখের রুমালটা এখনো খোলা হয়নি।
ধকধক করে হিংস্র বাঘদের মতই লোকটার চোখের তারা দুটো জলে ওঠে একটা নিষ্ঠুর ক্রোধে।– আকস্মিক পরিস্থিতিটা কিরীটী মুহূর্তে উপলব্ধি করে নেয় এবং আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হবার পূর্বেই লোকটা চকিতে পা বাড়িয়ে ঠিক তার পায়ের নাগালের মধ্যেই অশ্বটায় প্রচণ্ড একটা লাথি মারে। ঝনঝন করে আলোর চিমনিটা ভেঙে গড়িয়ে যায়, মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে অবলুপ্ত হয়ে যায়।
কিরীটী মুহূর্তের জন্য যেন বিহবল হয়ে পড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই অন্ধকারে আন্দাজ করে সম্মুখের দিকে লাফিয়ে পড়ে।
অন্ধকারেও কিরীটীর লক্ষ্য ব্যর্থ হয় না। লোকটাকে জাপটে ধরে।
জড়াজড়ি করেই কিরীটী লোকটাকে নিয়ে মেঝেতে পড়েই চেচিয়ে ওঠে, সত্যজিৎবাবু, টর্চটা জালান!
হতভম্ব সত্যজিৎ বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে।
কিরীটীর আদেশে যেন সব্বিৎ ফিরে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কোমরে ঝোলানো টর্চটার বোতাম টিপে আলো জলে।
কিরীটীর বুঝতে বিলম্ব হয় না, যাকে আক্রমণ করেছে তার গায়ে শক্তি প্রচুর। যত করে মাটিতে চেপে ধরে তার বুকের ওপর উঠে বসবার চেষ্টা করে কিরীটী, কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে না প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী বলে।
সহসা সত্যজিতের নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটা মোটা মত হাত দেড়েক কাঠের টুকরো। এগিয়ে গিয়ে কাঠটা তুলে নিয়ে সত্যজিৎ
সুযোগ বুঝে লোকটার মাথায় একটা সজোর আঘাত হানে।
একটা অস্পষ্ট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে এবারে প্রতিপক্ষ এলিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে। হাত-পা এলিয়ে দেয়।
বুঝতে পারে কিরীটী, মাথায় আঘাত পেয়ে ক্ষণেকের জন্য সংজ্ঞালোপ হয়েছে প্রতিপক্ষের।
ঘরের কোণ হতে একটা মোটা দড়ি এনে অতঃপর ভূতলশায়ী সংজ্ঞাহীন লোকটার হাত বেধে তাকে বন্দী করতে ওদের বেগ পেতে হয় না।
প্রতিপক্ষকে বন্দী করে কিরীটী যখন উঠে দাঁড়াল, গুরু পরিশ্রমে তখন সে হাঁপাচ্ছে।
কে লোকটা!
রহস্যের মেঘনাদ—মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাকারী ক্লিষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয় কিরীটী সত্যজিতের প্রশ্নের।
সত্যজিৎ বলে, সত্যি?
হ্যাঁ।
কৌতুহলভরে সত্যজিৎ এগিয়ে গিয়ে বন্দী সংজ্ঞাহীন ভূপতিত ব্যক্তির মুখ হতে কালো রুমালটা খুলে নিয়ে যেন ভূত দেখবার মত চমকে উঠে, এ কি,
এ যে সহিস লছমন!
হ্যাঁ, লছমনই বটে। তবে আসলে ও লছমন নামধারী মাত্র–ছদ্মনাম ওর ওটা।
ছদ্মনাম?
হ্যাঁ। কিন্তু লোকটাকে তো মনে হতো বড়ো অকর্মণ্য!
সে-ও ওর ভেক ধারণ করা মাত্র। দেখতেই তো পেলেন ওর শক্তির বহর। কিন্তু এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক। বাগানে দলবল নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত অপেক্ষা করছেন। এ নাটকের শেষ দৃশ্যের এখনও বাকী।
কিরীটী ও সত্যজিৎ বাগান অতিক্রম করে বারান্দার দিকেই অগ্রসর হতেই অন্ধকার হতে লক্ষ্মীকান্ত সামনে এসে দাঁড়ালেন, কিরীটীবাবু?
মিঃ সাহা! কি ব্যাপার?
চুপ, আস্তে, কানাইয়ের মা
কানাইয়ের মা! এসেছে তাহলে? কিন্তু কোথায়?
সন্তোষ চৌধুরীর ঘরে ঢুকেছে।
২৩. ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে
ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
দরজার ফাঁক দিয়ে ওরা দেখলো ঘরের মধ্যে সন্তোষ চৌধুরী ও কানাইয়ের মা।
তুই আবার ফিরে এলি কেন? রুক্ষ সন্তোষের কণ্ঠস্বর।
তুই বলেছিলি আসবি—আসিসনি বলে—চল, এবার তোকে সঙ্গে করে নিয়ে তবে আমি যাব।
আমার যাবার এখনও সময় হয়নি, তুই যা।
না, তোকে না নিয়ে যাবো না।
যা বলছি হারামজাদী! এখনো ফিরে যা, নইলে তোকে খুন করবো বলছি!
তাই কর, তাই কর। তবু, সবুর অমঙ্গল আমি করতে দেব না।
রাক্ষসী শয়তানী! সবু তোর কে যে তার জন্যই তুই হেদিয়ে মরছিস?
তোর সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। তুই যাবি কিনা বল?
না-না-না। তুই যা।
তুই তাহলে যাবি না? কানাইয়ের মা দৃঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করে
না।
যাবি না?
না।
এক্ষনি তবে আমি চেচিয়ে সকলকে ডেকে তোর আসল পরিচয় দেবো!
খুন-খুন করে ফেলবো তবে তোকে রাক্ষসী। হিংস্র রাগে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি সন্তোষ কানাইয়ের মার গলা টিপে ধরে।
সেই মুহূর্তেই কিরীটীর ইঙ্গিতে লক্ষ্মীকান্ত দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেচিয়ে ওঠেন, দরজা খোল! দরজা খোল!
কিন্তু ভিতর হতে কোন সাড়া নেই।
দরজা খোল! না হলে দরজা ভেঙে ঢুকবো!
তথাপি কোন সাড়া নেই।
ভাঙুন দরজা। কিরীটীই বলে।
তিনজনে মিলে একত্রে ধাক্কা দিতেই ভিতর হতে মড়াৎ করে দরজার খিল ভেঙে গেল। তিনজনেই হড়মড় করে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
সন্তোষবাবু, you are under arrest! লক্ষ্মীকান্ত গর্জন করে ওঠেন।
হতচকিত বিহ্বল সন্তোষ ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই আবক্ষ অবগুণ্ঠন টেনে নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।
কি, ব্যাপার কি! কি ব্যাপার? খোলা দ্বারপথে ঠিক ঐ সময় সান্যালের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
এই যে সান্যাল মশাই! আসুন আসুন—ঠিক সময়েই আপনি এসেছেন। সহসা অত্যন্ত উচ্ছসিত কণ্ঠে যেন সাদর আহ্বান জানাল কিরীটী দ্বারপ্রান্তে উপনীত নিত্যানন্দ সান্যালকে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই চমকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে। এবং সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ-চমকের মতই অবগুণ্ঠনবতী কানাইয়ের মা তার দীর্ঘ অবগুণ্ঠন সহসা মাথার উপরে তুলে দিয়ে তাকাল সান্যালের মুখের দিকে।
এ কি, সেই কানাইয়ের মা না? আকস্মিক উত্তেজনায় অসতর্ক কণ্ঠ হতে নিত্যানন্দের উচ্চারিত হলো কথাগুলো।
হ্যাঁ, আমি। ফিরে আসতে হলো আমাকে।
ব্যাপারটা যেন আদৌ কিছুই নয় এমনি একটা উদাসীন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিত্যানন্দ বললেন, হঠাৎ তুই কাউকে না বলে চলেই বা গেলি কেন, আবার ফিরেই বা এলি কেন? এদিকে তোর জন্য সকলে আমরা ভেবে মরি!
কানাইয়ের মা নিত্যানন্দ সান্যালের কথার কোন জবাব দিল না, কেবল তার ওষ্ঠপ্রাতে অদ্ভুত হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠলো মাত্র।
বিস্মিত নির্বাক কিরীটী কানাইয়ের মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এ তার পূর্ব-পরিচিতা এ বাড়ির পুরাতন দাসী কানাইয়ের মা নয় যেন। ভীরু সঙ্কোচে দৈন্যবিলুণ্ঠিতা কানাইয়ের মাও নয়।
দাঁড়াবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত যেন পাল্টে গিয়েছে। মাথার উপরে অবগুণ্ঠন স্খলিত। মাথার সম্মুখের দিকে কাঁচা-পাকায় মিশানো চুলগুলো। ছোট ললাট। ধোপদুরস্ত একটা সাদা থানকাপড় পরিহিতা। গায়ে একটা সাদা খদ্দরের মোটা চাদর।
ওর সর্বাঙ্গ দিয়ে, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীতে পর্যন্ত যেন একটা আভিজাত্য ফুটে বের হচ্ছে।
সেই চিরপরিচিত কানাইয়ের মা যেন দাসীর পদ হতে অভিজাত বংশের এক নারী-পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছে হঠাৎ। গৌতম-অভিশাপে পাষাণী অহল্যা যেন অকস্মাৎ রাঘবের রতুল চরণস্পর্শে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।
আর কেন, এবার ক্ষান্ত হও দাদা। মাথার উপরে ভগবান আছেন, এত পাপ তিনি সহ্য করবেন না। অবিচলিত শান্ত কণ্ঠ হতে কানাইয়ের মার কথাগলো বজ্রের মতই উচ্চারিত হল।
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ কানাইয়ের মার নিত্যানন্দ সান্যালকে সম্বোধিত কথাগুলো উচ্চারিত হল।
নিত্যানন্দ সান্যালের সমস্ত মুখে যেন কে একপোঁচ কালি বুলিয়ে দিয়েছে। কালো মুখখানা থমথম করছে একটা হিংস্র উত্তেজনায়।
কিন্তু মুহূর্তে সামলে নিলেন নিত্যানন্দ সান্যাল নিজেকে, কানাইয়ের মা! অনেক দিনের চাকরানী তুই আমাদের বাড়ির। বালবিধবা হেম তোকে বড় স্নেহ করত। হেম আমাকে দাদা বলে ডাকত, তুইও তার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দাদা বলে ডাকতিস। দাসী হলেও তোকে আমি চিরদিন ছোট বোনের মতই দেখেছি। বুঝতে পারছি, কোন কারণে তুই মনে বড় ব্যথা পেয়েছিস। তাই বোধ হয় মাথারও ঠিক নেই তোর। চল, পাশের ঘরে চল, বুঝতে পারছি তোর বিশ্রামের প্রয়োজন—আর, বলে নিজেই সান্যাল ঘর ছেড়ে যাবার জন্য পা বাড়ান।
কানাইয়ের মা কোন কথা বলার পূর্বেই কিরীটী গমনোদ্যত নিত্যানন্দ সান্যালকে বাধা দিল, দাঁড়ান সান্যাল মশাই! ঘর ছেড়ে যাবেননা!
নিঃশব্দে ফিরে দাঁড়ালেন সান্যাল এবং চোখ তুলে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীও তাকিয়ে আছে সান্যালের মুখের দিকে।
যুধ্যমান দুটো শাণিত তরবারি যেন পরস্পরের প্রতি উদ্যত।
সহসা কানাইয়ের মার কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, মাথা আমার ঠিকই আছে দাদা। দেখছি গোলযোগ ঘটেছে আপনারই, নইলে মায়ের পেটের বোনকে চিনতে পারছেন না।
তবে রে হারামজাদী ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই যেন অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে কানাইয়ের মার কণ্ঠদেশ টিপে ধরলেন সান্যাল।
মুখোশটা খুলে গেল সান্যালের।
ঘটনাটা এত দ্রুত ও আকস্মিক ভাবে ঘটে গেল যে, ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে পড়ে।
নিষ্ঠুর পেষণে কানাইয়ের মার গলা দিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ কেবল বের হচ্ছে।
তোকে খুনেই করে ফেলবো হারামজাদী, গর্জাতে থাকে ক্রোধান্ধ সান্যাল, আর পেষণ আরো কঠিন করেন হাতের মুষ্টির।
কিরীটী সর্বাগ্রে এগিয়ে বলিষ্ঠ দুই বাহুতে সান্যালের কাঁধ টিপে ধরে প্রবল এক ঝাঁকুনি দেয়, ছাড়ন, ছাড়ুন!
কিন্তু মরীয়া হয়ে উঠেছেন সান্যাল। চীৎকার করে ওঠেন, না না—খুনখুন করবো ওকে আমি। বাধ্য হয়ে কিরীটী তখন যুযুৎসর প্যাঁচে সান্যালের কঠিন মুস্টি শিথিল করে কানাইয়ের মাকে মুক্তি দেয়।
কানাইয়ের মা ঢলে পড়ে যাচ্ছিল, সত্যজিৎ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলে। এলিয়ে পড়ে কানাইয়ের মা চেয়ারটার উপরেই।
বাইরে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। সকলেই সোৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় খোলা দরজার দিকে। ঘরে প্রবেশ করলেন নায়েব বসন্ত সেন।
হ্যাঁ, আমি। কিন্তু এসব কি ব্যাপার লক্ষ্মীকান্ত?
জবাব দিল কিরীটী, আসুন নায়েব মশাই। আজকের ঘটনার you were the missing link,হারানো সূত্র!
কিরীটী তখনও নিত্যানন্দ সান্যালকে দুই হাতে ধরে আছে। নিত্যানন্দকে অতঃপর অন্য একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, সুবোধ বালকের মত এবারে বসুন তো সান্যাল মশাই! Dont try to play any more dirty tricks! আপনার খেলা শেষ হয়েছে।
চোখের জলের মধ্যে দিয়েই কানাইয়ের মা—হতভাগিনী সৌদামিনী তার জীবনের কলঙ্ক-মাখা ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো একের পর এক মেলে ধরতে লাগল।
নির্বাক সকলে বসে ঘরের মধ্যে। কিরীটী, সত্যজিৎ, নিত্যানন্দ সান্যাল, সন্তোষ চৌধুরী, বসন্ত সেন, কল্যাণী, সবিতা, সৌদামিনী দেবী, লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও অতীনলাল।
রাত শেষ হয়েছে। ভোরের প্রথম আলো পূর্বাকাশ রাঙিয়ে তুলছে।
.
সৌদামিনীর কথা
হতভাগিনী কলঙ্কিনী সৌদামিনীর কথা কি আর নতুন করে শুনবেন কিরীটীবাবু! বাংলাদেশের ঘরে ঘরেই তো এমনি কত ইতিহাস আছে, কিন্তু কজনা তার খোঁজ রাখে! তিলতিল করে কত হতভাগিনীর জীবন-প্রদীপ যে নিভে যায়—তুষানলে ধিকিধিকি জলে নিঃশেষ হয়ে যায় কত সৌদামিনী, সে সংবাদই বা কজনে এ সংসারে পায়!
তের বৎসর বয়সের সময় বিবাহ হল আমার। স্বামী কেমন চিনলামই না। খেলাঘরের মতই স্বামীর ঘর আমার নিষ্ঠুর পদাঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে গেল। হাতের নোয়া, সিথির সিদূর মুছে এক বৎসরের মধ্যেই ফিরে এলাম বাপের ঘরে; রাক্ষসী পোড়াকপালী আমি।
হেম আমার তিন বৎসরের ছোট হলেও আমার খেলার সাথী সে ছিল। সে-ই ছিল আমার সঙ্গী। ফিরে এসে আবার হেমের সঙ্গেই খেলাঘর পাতলাম। তিনটি বছর কেটে গেল, হঠাৎ একদিন শিউরে উঠলাম নিজের দিকেই তাকিয়ে। দেহের দুকূল ভেঙে নেমেছে কখন জোয়ারের জলোচ্ছাস। টেরও পায়নি। অসংবৃত দেহকে যেন কোনমতেই আর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে পারি না। এমন সময় হেমের হল বিয়ে।
হেমের স্বামী মৃত্যুঞ্জয় বিবাহের পর একটা বছর ঘন ঘন আমাদের ওখানে আসত। প্রথম প্রথম মৃত্যুঞ্জয়কে এড়িয়েই চলতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদের ওপরে একাকী দাঁড়িয়ে আছি, সহসা কার পদশব্দে ফিরে তাকালাম। যাকে দেখলে আমার এত ভয়, যার চোখের দিকে তাকাতে বুকে কেঁপে ওঠে, নিজেকে যেন আর কোনমতেই ধরে রাখতে পারি না—সেই মৃত্যুঞ্জয়! আমার দেবতা! আমার সব!
***
ভয় পেলে সৌদামিনী?
না, সৌদামিনীর বুক তখন কাঁপছে দুরু দুরু। তুমি আমাকে এড়িয়ে চল কেন মিনি? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? কেন তুমি আমায় ভয় কর বল তো?
কই, না তো! ভয় করি কে বললে? মনে মনে বলে সে, ওগো দেবতা, আমার ভয় নয় গো, ভয় নয়—আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই।
চাও তো দেখি আমার চোখের দিকে? কই, চাও? সহসা হাত বাড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয় সৌদামিনীর একটা হাত ধরে ফেলেন।
না, ছাড় কেউ এসে যাবে এখুনি লক্ষীটি!
এত ভয় তোমার সৌদামিনী?
না না! ছিঃ!
সমস্ত যৌবন সৌদামিনীর তৃষিত হয়ে উঠেছিল কিন্তু সে তৃষ্ণা তার মিটল না। বরং দিনকে দিন যে বেড়েই চলে। শেষ পর্যন্ত যেদিন তার খেয়াল হল, সারা দেহ ছাপিয়ে এসেছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব সেদিন ভয়ে সে নীল হয়ে গেল।
নীলকণ্ঠ সারা বিশ্বের গরল ধারণ করে যেখানে কলকল্লোলকান্তি জাহ্নবীবেষ্টিত হয়ে অন্নপূর্ণার দুয়ারে ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়েছেন, সৌদামিনী সেখানে ছুটে এলো তার কলঙ্কিত দেহের যৌবনমথিত গরলটুকু নিয়ে; সেই গরলে নীলকণ্ঠ দেবাদিদেবের চরণেরই আশ্রয়ে।
ধনঞ্জয় সেখানেই জন্ম নিল এক সেবাশ্রমে।
সৌদামিনী যেদিন সেবাশ্রম হতে দুই মাসের শিশুপুত্রকে বুকে করে ফিরে এলো, নিত্যানন্দ তখন দুয়ার রোধ করে দাঁড়ালেন, যাও, এখানে নয়।
কলঙ্কিনী! লজ্জা করে না তোর! দূর হ!
কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? অনন্যোপায় সৌদামিনী আবার কাশীতেই ফিরে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে এক পত্র দিল।
মৃত্যুঞ্জয় পত্র পেয়ে কাশীতে এলেন এবং বললেন, এখানে এভাবে তোমার সন্তানকে তুমি, মানুষ করতে পারবে না মিনি। তার চাইতে ওকে কোন অনাথ আশ্রমে দাও, আমি সব ব্যয়ভার বহন করবো, আর তুমি আমার ওখানেই চলো।
কি জানি কেন, সৌদামিনী তাতেই রাজী হলো। ধনঞ্জয়কে এক আশ্রমে রেখে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের গৃহেই এসে উঠলো।
কিন্তু পরিচয় দিল তার সৌদামিনী নয়-দাসী কানাইয়ের মা বলে।
কানাইয়ের মা পরিচয়েই সৌদামিনি চৌধুরী-গৃহে থেকে গেল। সৌদামিনী মরেছে।
হেমপ্রভার ব্যাপারটা আদৌ মনঃপুত না হলেও, মুখে সে কিছু বললে না বটে তবে দুঃখ পেল স্বামীর ব্যবহারে।
সৌদামিনীর মাতৃত্বের সংবাদ না পেলেও সৌদামিনীর সম্পর্কে তার স্বামীর দুর্বলতার কথাটা তার অবিদিত ছিল না।
কিন্তু ক্রমে সৌদামিনীকে হেমপ্রভার সহ্য হয়ে গিয়েছিল, যখন সে দেখলে সৌদামিনী তার গৃহে এলেও সত্যি-সত্যিই দাসীর মতই সে দিন কাটাচ্ছে। সে তার অধিকারের সীমাকে কোন অজুহাতেই লঙ্ঘন করে না বা করবার চেষ্টাও করে না। সবিতা এলো হেমপ্রভার গর্ভে এবং ঐ সময় হতেই হেমপ্রভা স্বামীর ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগল। স্বামী যেন তার সদাই গম্ভীর, চিন্তাকুল।
আরো দেখলে, প্রতি মাসে স্বামী তার দাদা নিত্যানন্দকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ইনসিওর করে পাঠায়।
একদিন প্রশ্ন না করে আর পারে না, কিন্তু স্বামীর কাছে কোন জবাবই পায় না।
কথাটা একদিন সৌদামিনীর কাছে কিন্তু প্রকাশ হয়ে গেল।
সৌদামিনী ঐ বাড়িতে থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর কোন ব্যাপারেই থাকত না।
কিন্তু হেমের মুখের দিকে চেয়েই একদিন রাত্রে সৌদামিনী মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে এসে প্রবেশ করল, ওখানে আসবার দীর্ঘ আট মাস পরে।
দীর্ঘদিন পরে সৌদামিনীকে নিজের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় প্রশ্ন করেন, সৌদামিনী, তাহলে তুমি আজও বেঁচে আছো?
সৌদামিনী তো অনেকদিন আগেই মরে গেছে চৌধুরী মশাই-এ কানাইয়ের মা সৌদামিনীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে, যে পাপ সে তার নিজের কাছে করেছিল। কিন্তু সে কথা যাক, আমি একটা কথা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম চৌধুরী মশাই!
বল?
প্রতি মাসে আপনি লুধিয়ানায় দাদাকে টাকা পাঠান, এ কথা কি সত্য?
সৌদামিনীর প্রশ্নে মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ সত্য। কিন্তু একান্তই শুনতে চাও কি কেন?
হ্যাঁ বলুন।
হেমও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে অনেকবার, কিন্তু বলতে পারিনি। দুঃখের ও লজ্জারই কথা, তোমাকে বলছি তবু হেমকে বলতে পারিনি, এবং কেন পারিনি হেম না বুঝতে পারলেও তুমি বুঝবে। হেমকে বিবাহ করবার মাস আষ্টেক আগে একবার দেশভ্রমণে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে উজ্জয়িনীতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চৌহান রাজপুতের মেয়ে কাঞ্চনমালার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করি।
চৌধুরী মশাই! একটা আর্ত চীৎকার যেন সৌদামিনীর কণ্ঠ চিরে বের হয়ে আসে।
ভাবছো আমি মহাপাষণ্ড, না! তাই। আমারও পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়েছে। মুক্তি পাইনি। কিন্তু যা শুনতে চাইছিলে শোন। বিবাহের পর মাস তিনেক কেটে গেল, ভাবছি বাবাকে সব লিখে জানাব এবং বৌকে নিয়ে দেশে আসব, এমন সময় কাঞ্চনের এক বন্ধু ছিল রাজপুত যুবক চেৎ সিৎ, তারই সঙ্গে একদিন রাত্রে বাগানে কাঞ্চনকে দেখে হিংসায় বুক আমার জ্বলে গেল। ওদের উপর নজর রাখতে লাগলাম। বুঝলাম কাঞ্চন চেং সিং কে ভালবাসে। মাঝখানে আমি এসে না পড়লে ওদের বিবাহও হত একদিন। হিংসায় ক্রোধে অন্ধ হয়ে কাঞ্চনকে ফেলে এক রাত্রে চুপে চুপে পালিয়ে এলাম। ওরা আমার ঠিকানাও জানত না। পরে ফিরে এসে মাস আষ্টেক বাদে হেমকে বিবাহ করি। ওদের আর খোঁজ নিইনি। মাস পাঁচেক পূর্বে তোমার দাদা নিত্যানন্দর চিঠিতে জানতে পারি, যখন চলে আসি কাঞ্চন তখন নাকি অন্তঃসত্বা ছিল। এবং একটি মেয়ের জন্মদান করেই সে মারা গিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় চুপ করলেন।
তারপর?
তারপর তোমার দাদা নিত্যানন্দ উজ্জয়িনীতে গিয়েছিল বেড়াতে। কেমন করে জানি না কাঞ্চনের বাপ লক্ষণ সিংয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং বোধ হয় সে সব কথা জানতে পারে এবং বুঝতে পারে আমিই সেই।
কেমন করে বুঝতে পারলেন তিনি?
কাঞ্চনের কাছে আমার একটা ফটো ছিল সেই ফটোটা দেখে। ফটোটাই এখন তার সম্পত্তি এবং তারই জোরে গত কয়েক মাস ধরে সে আমাকে শোষণ করছে। মাথা নীচু করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
দাদার এতদূর অধঃপতন হয়েছে।
মাঝে মাঝে ভাবি কি জান সৌদামিনী, কলঙ্কসাগরে তো ডুবেছিই। কাঞ্চনের মেয়ে সে তো আমারই, তাকে এখানে নিয়ে আসি।
আপনি কি পাগল হলেন? ও চিন্তাও মনে স্থান দেবেন না। একবারটি ভাবুন তো, এ সংবাদ হেম জানতে পারলে সে কত বড় দুঃখ পাবে? কিন্তু আমার একটা কথা শুনবেন?
বল? দাদাকে এখানে একবার আসতে লিখুন, আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।
তাতে কি কোন ফল হবে সৌদামিনী, বরং টাকা যেমন সে নিচ্ছে নিক। এতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে তো
সন্তুষ্ট! জানেন না চৌধুরী মশাই, লোভ বেড়েই চলে ক্রমে, ওর হাঁ সামলাতে আপনাকে সর্বস্বান্ত হতে হবে। তার চাইতে লিখে দিন দাদাকে এখানে আসতে।
বেশ।
মাসখানেক বাদে নিত্যানন্দ এলেন। সৌদামিনী ভুল করেছিল। নিজের মায়ের পেটের ভাই হলেও নিতানন্দ-চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারেনি। যাবার আগে বরং সে শাসিয়েই গেল উল্টে সৌদামিনীকে।
নিত্যানন্দ চলে গেল বটে, তবে মনে মনে যাবার আগে সে নতুন এক ফন্দী মাথায় নিয়ে ফিরে গেল এবং তারপর দেখা গেল, ঘন ঘন সে কাঞ্চনপুরে যাতায়াত শুরু করেছে। হেমপ্রভার প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসা যেন উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন।
বৎসর দুই এইভাবে নিয়মিত মৃত্যুঞ্জয়ের ওখানে আসা-যাওয়া করে করে এবারে সে আর এক মর্মঘাতী তীর নিক্ষেপ করল মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে।
দুর্বলচিত্ত সন্দিগ্ধ-চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় সহজেই সেই নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে কাবু হয়ে পড়লেন, হেমপ্রভা মধ্যে মধ্যে একমাত্র নিত্যানন্দকেই পত্র দিত। হঠাৎ একবার দুদিনের জন্য এসে নিত্যানন্দ হেমপ্রভা ও তার শিশুকন্যাকে সঙ্গে করে লুধিয়ানায় নিয়ে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের অবর্তমানেই। সেই সময় কিছুদিন ধরে হেমপ্রভার সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের মন-কষাকষিটা একটু বেশীই চলছিল। বাড়ী ফিরে মৃত্যুঞ্জয় হেমপ্রভাকে না দেখতে পেয়ে মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। স্ত্রীকে চিঠিও দিলেন না। হেমপ্রভাও অভিমানভরে একখানি চিঠিও স্বামীকে লিখল না। সৌদামিনী এসবের কিছুই জানত না। দীর্ঘ ছয় মাস পরে হেমপ্রভা আবার ফিরে এল স্বামীর গৃহে এবং শরীর তার তখন খুবই খারাপ। মনে যার ঘুণ ধরে, দেহ তার ভাঙ্গতে দেরি হয় না। হেমপ্রভারও হয়েছিল তাই। হেমপ্রভা ফিরবার দিন পাঁচেক বাদেই মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রমোদভবনে উঠে এলেন এবং ওখানে আসবার দিন চারেক বাদে এক রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রচণ্ড বচসা হয়ে গেল। নিত্যানন্দকে নিয়ে হেমপ্রভার চরিত্রে সন্দেহ করে স্পষ্টাস্পষ্টিই মৃত্যুঞ্জয় অভিযোগ জানালেন এবং বললেন, নিত্যানন্দ নিজে নাকি চিঠিতে অনেক দিন আগেই তাকে ও সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল। ঘৃণায় লজ্জায় হেমপ্রভা একেবারে পাথর হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জা! এর চেয়ে যে মৃত্যুও ছিল ভাল।
এবারে কিরীটী বললে, এবং সেই দুঃখ ও অপমানেই তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন নিশ্চয়ই! কেউ তাঁকে হত্যা করেনি!
সৌদামিনী বললে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
আপনার বর্ণিত কাহিনী প্রথমে সত্যজিৎবাবুর ও পরে আপনার মুখে শুনেই বুঝেছিলাম, আসল ও সত্যি কথাটা আপনি গোপন করেছেন। আপনার বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে অনেকটা ফাঁক ছিল। তাছাড়া যে মুহর্তে বুঝেছিলাম দীর্ঘ উনিশ বৎসরের ব্যবধানে দুটো মৃত্যুর কারণ এক নয় এবং শেষেরটা যখন অবিসংবাদিত ভাবেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল সত্য বলে, তখনই বুঝেছিলাম আগের ব্যাপারটা আত্মহত্যা ভিন্ন আর কিছুই হতে পারে না। অবশ্য এরূপ ভাববার আমার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত হেমপ্রভা দেবীকে একমাত্র হত্যা করা সম্ভব ছিল তাঁর স্বামীর পক্ষেই, কিন্তু তা তিনি যে করেননি সেটা বুঝেছিলাম সাত দিন বাদে কলকাতা হতে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীর মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারেই। তিনি প্রথম হতেই সন্দেহ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী গৃহত্যাগ করেছে এবং গেছে নিত্যানন্দবাবুর ওখানেই। তাই তিনি অসুস্থা স্ত্রীর একটা কল্পিত চিকিৎসার ভান করে মেয়ে ও আপনাকে নিয়ে কলকাতায় যান, কিন্তু আসলে কলকাতা থেকে নিত্যানন্দবাবুর ওখানে গিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল—
ঠিক তাই। চৌধুরীমশাই লুধিয়ানাতেই দাদার ওখানে হেমের খোঁজে গিয়েছিলেন। জবাব দেয় সৌদামিনী।
কিন্তু সেখানে স্ত্রীর খোঁজ না পেয়ে গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে জন্মের মত ত্যাগ করবেন এই মনস্থ করে ও নিজের বংশমর্যাদা ও সম্মান বাঁচাতে রটনা করে দিলেন তার মৃত্যুর কথা। ফিরে এলেন তিনি এখানে। কিন্তু চরম দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি তিনি যতই সন্দিহান হন আসলে হয়তো স্ত্রীকে সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই স্ত্রীকে অমন করে চলে যেতে দেখে মর্মান্তিক যাতনায় ছটফট করে বেরিয়েছিলেন, এমন সময় মতো স্ত্রীর দেহ আবিষ্কৃত হল নন্দনকাননে। তার পরের ব্যাপারটাও স্বাভাবিক গতিই নিয়েছে। এ ছাড়া হেমপ্রভা যে নিহত হয়নি কারো দ্বারা সন্দেহ করেছিলাম দ্বিতীয় অন্য একটি কারণে হেমপ্রভা দেবীকে যদি তাঁর স্বামী না হত্যা করে থাকেন আর কারো পক্ষে যেমন তাঁকে হত্যা করবার কোন কারণই থাকতে পারে না, তেমনি নিহত হলে অন্তত কানাইয়ের মা অর্থাৎ আপনি সর্বদা যখন তাঁর পাশের ঘরে শুতেন ও সর্বদা প্রাণ দিয়ে তাঁর দেখাশুনা করতেন, আপনি নিশ্চয় সেটা জানতে পারতেন। আপনার কাছে সে ধরা পড়তই এবং সেক্ষেত্রে অন্তত আপনি এতদিন পরে বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর পরে আর সে কথা গোপন করে রাখতেন না।
সৌদামিনী চুপ করে রইলেন।
কিরীটী আবার তার বক্তব্য শুরু করে, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুরহস্যটা আমার কাছে খোলসা হয়ে যায়, যে রাত্রে সৌদামিনী দেবী এখান হতে চলে যান সেই রাত্রে ওঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আলোচনা করবার পরই। এবং যে মুহূর্তে বুঝলাম হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুর সাক্ষাৎ কোন যোগাযোগ নেই, পরোক্ষে থাকলেও তখনই ভাবতে লাগলাম এতকাল পরে তাহলে মৃত্যুঞ্জয়বাবু নিহত হলেন কেন? এইখানে একটা ব্যাপার প্রথমটায় সত্যিই আমাকে বিশেষভাবে delimma-র মধ্যে ফেলেছিল—অকুস্থানটি। একই স্থানে বকুলবৃক্ষতলে দুটি মৃতদেহ কেন আবিষ্কৃত হল! পরে অনেক ভেবে দেখেছি এবং সৌদামিনী দেবীর মুখে একটা কথা শুনে বুঝেছি, তাঁরও সম্ভবত, মানে হেমপ্রভা দেবীর বকুলতলে আত্মহত্যা করবার দুটি কারণ ছিল। ১নং সৌদামিনী দেবী বলেছিলেন প্রমোদভবনে আসা অবধি তো বটেই, তারও পূর্বে দুএকবার হেমপ্রভা দেবী নাকি প্রমোদভবনে বেড়াতে এসেও ঐ বৃক্ষতলটিতে গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। স্থানটি নাকি তাঁর বড় প্রিয় ছিল, শুনেছি বৌরাণীর বিল বলা হত ঐ বিলটিকে—এই চৌধুরী বংশেরই নাকি কোন বৌরাণীর ইচ্ছাতেই বিলের মধ্যে ঐ বিরাম-কুটিরটি তৈরী হয়েছিল বলে এবং পরে ঐ বিলের জলে সেই বৌরাণী সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে যান আর ওঠেন না। সেই হতেই বিলটিকে লোকে বৌরাণীর বিল নাকি বলত। এবং সেই হতেই চৌধুরীবংশে একটা প্রবাদের মতই শেষে দাঁড়িয়েছিল ঐ বিল এ বাড়ির বৌদের পক্ষে নাকি অভিশপ্ত। যাক যা বলছিলাম, ২নং কারণ হয়ত হেমপ্রভা দেবীর ইচ্ছা ছিল ঐখানে গিয়েই আত্মহত্যা করবার, নিজের মৃতদেহটা যাতে আদরিণী একমাত্র কন্যার চোখে না পড়ে। অবশ্য সবই আমার অনুমান। সে যাই হোক, হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু রহস্যটা মীমাংসিত হবার পরই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মৃত্যুরহস্যে আমি মন দিই। একটা ব্যাপার অবশ্য—গোড়া হতেই সব ইতিহাস শুনে বুঝেছিলাম, চৌধুরী মশাইয়ের নিহত হবার পশ্চাতে কোন একটা পারিবারিক জটিল কাহিনী আছে এবং আর অকুস্থান যে রাজপুতানায়—তাও বুঝতে পারি, তাঁর ড্রয়ার হতে যে অ্যালবামটি উদ্ধার করি তারই ফটোগুলো দেখে। সেই ফটোগুলোর মধ্যে একটা ফটো ছিল এক নবযৌবনা অপরুপ সৌন্দর্যময়ী এক নারীর। বুঝলাম মিঃ চৌধুরীর জীবনের কয়েকটি ছিন্ন পৃষ্ঠা সুদূর ঐ রাজপুতানাতেই ছড়িয়ে রয়েছে যার সাক্ষ্য দিচ্ছে আজও তাঁরই সযত্নরক্ষিত অ্যালবামটি। কিন্তু কে ঐ তরুণী? কেন তার ফটো অ্যালবামের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত? তার পরই কুড়িয়ে পেলাম নন্দনকাননে একটি স্বর্ণঅঙ্গুরীয়। যার উপরে খোদাই করা ছিল একটি দেবনাগরী অক্ষর ল। কার অঙ্গুরীয়? অঙ্গরীয়টি দেখেই বুঝেছিলাম সদ্য না হলেও দুদশ দিনের মধ্যে কোন এক সময় কারো হাত হতে ঐ অঙ্গুরীয়টি ওখানে খসে পড়েছে। আর একটা জিনিস ঐ জায়গায় জলের ধার ঘেষে পাড়ে ঘাসের অবস্থা দেখে বুঝেছিলাম নিয়মিত কিছুদিন ধরে ওখানে নৌকা বা বোট জাতীয় কিছু এসে ভিড়বার জন্যেই ঘাসগুলো যেন নিস্তেজ হয়ে আছে। বুঝলাম এখানে বোটে চেপে কারো যাতায়াত ছিল। তারও প্রমাণ পেলাম বিরাম-কুটিরের ঘরে ধুলোর ওপরে জুতোর সোলের ও খালি পায়ের ছাপ দেখে। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল মন। খোঁজ নিতে গিয়ে সরমল সিং ও তার নাতনী চন্দ্র লেখার সন্ধান পেলাম। সরমলের সঙ্গে সামান্য আলাপ করতেই বুঝলাম তারা রাজপুত। এবং চন্দ্রলেখার মুখের আদলটি হবহু, একেবারে মিলে গেল অ্যালবামের ফটোর সেই রাজপুতানী মেয়েটির মুখের সঙ্গে। ছিন্নসূত্র জোড়া লাগল।
হ্যাঁ, ঐ চন্দ্রলেখাই চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে কাঞ্চনমালার বা লছমীর (কাঞ্চনের ডাকনাম) গর্ভজাত কন্যা এবং সবিতার চাইতে বছরখানেকের বড়। সূরযমল লক্ষণের ছোট ভাই লছমীর কাকা। জবাব দিল সৌদামিনী।
তাহলে ওই আংটিটা বোধ হয় চন্দ্রার মায়েরই! কিরীটী বলে।
লক্ষ্মীকান্ত তখন হঠাৎ বলেন, কিন্তু ক্রেপসোল দেওয়া কোন জুতো সেখানে পাইনি মিঃ রায়!
প্রমোদভবনের আস্তাবল খুজলেই পাবেন। সেটা লছমনের সম্পত্তি।
লছমনের?
হ্যাঁ, কারণ সে-ই যে সেটা ব্যবহার করতো! জবাব দেয় কিরীটী। কিন্তু
ভয় নেই। মোক্ষম বন্ধনে বাঁধা রয়েছেন শ্রীমান। পালাবার উপায় নেই।
মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়, এ বাড়ির নূপুর-রহস্যের মেঘনাদ ঐ লছমনই। আসলে লছমন ওর ছদ্মনাম মাত্র।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে কিরীটীর দিকে তাকায়।
বসন্ত সেন বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? লছমন যে অনেক দিনকার পুরাতন সহিস এ বাড়ির!
সে পুরাতন সহিস আসল লছমন এতদিন বন্দী হয়ে বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিকের বাড়িতে সুরযলের হেপাজতে ছিল। তাই না মিঃ সাহা?
হ্যাঁ, তাকে মুক্তি দিয়ে থানায় রেখে এসেছি। জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত।
বৃদ্ধ লছমনকে গায়েব করে তার ছম্মবেশ ধারণ করে চেৎ সিং, একদা যে প্রথম যৌবনে কাঞ্চনমালার পাণিপ্রার্থী ছিলেন। তাঁর এখানে এসে সকলের চোখে ধুলো দিতে কষ্ট হয়নি। প্রথমে নানারূপ ভয় দেখিয়ে নুপুরের শব্দ শুনিয়ে চৌধুরী মশাইকে চেৎ সিং সন্দিগ্ধ করে তোলে। এবং খুব সম্ভবত হয়ত কৌতুহলী হয়ে অদৃশ্য নূপুরের শব্দ অনুসরণ করতে করতে কোন এক রাত্রে ঘটনাচকে যখন হতভাগ্য চৌধুরী মশাই নন্দনকানন পর্যন্ত চলে যান, সেই সময় সুযোগ পেয়ে চেৎ সিং তাকে আক্রমণ করে কৌশলে অজ্ঞান করে, পরে গলা টিপে হত্যা করে। ঐ কারণেই হয়ত চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহ বকুলবৃক্ষতলে পাওয়া যায়। সব ব্যাপারটাই আকস্মিক এবং নিষ্ঠুর নিয়তি চালিত।
সৌদামিনী আবার বলে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে হতেই প্রায় চৌধুরী মশাই আমাকে বলতেন হেম নাকি প্রত্যহ রাত্রে তাঁকে ডাকে। তার পায়ের নূপুরে তিনি স্পষ্ট শুনেছেন। হেম নূপুর পরতে খুব ভালবাসত।
তাহলেই দেখুন, অনুমান আমার মিথ্যা নয়। এবারে আসা যাক আসল পরিকল্পনাকারীর রহস্যে। নিত্যানন্দ সান্যাল সমস্ত ঘটনাটির তিনিই ছিলেন মূল। প্রথমে তিনি কাঞ্চনমালার ব্যাপার নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেল করেছেন, পরে নিজেকে হেমপ্রভার প্রেমিক প্রতিপন্ন করে সন্দিগ্ধ চৌধুরীর মনে সংশয় এনে দিয়ে further blackmail করেছেন। শেষ পর্যন্ত যখন চৌধুরী মশাই সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌচেছেন, তখন তিনিই সূরযমল প্রভৃতিকে এখানে আনিয়ে চেৎ সিংকে চৌধুরীর সংবাদ দিয়ে তার নৃশংস প্রতিশোধস্পৃহার অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে তাকে দিয়েই হত্যা করিয়েছেন চৌধুরীকে। উনি যখন বুঝেছিলেন, লেবু তেতো হয়ে গিয়েছে টিপতে টিপতে, গাই আর দুধ দেবে না, তখন ওদের দিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে সমস্ত সম্পত্তিটা বাগাবার চেষ্টায় ছিলেন। প্রত্যক্ষ না থেকে পরোক্ষে বসে কলকাঠি ঘুরিয়েছেন। আর ঐ হতভাগ্য ধনঞ্জয়—আমাদের সন্তোষবাবু, সৌদামিনী দেবীর বখে যাওয়া-পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয় এখানে এসেছিল সম্পত্তির লোভে। কিন্তু সন্তোষবাবু তো আজ দুবছর মৃত, তবে পরিকল্পনাটি উনি পেলেন কোথায়? সন্তোষের সংবাদ জানলেনই বা কেমন করে? বলুন ধনঞ্জয়বাবু, অন্যথায় আপনি কিন্তু প্রতারণার চার্জে পড়বেন।
সন্তোষ নিত্যানন্দের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেচিয়ে উঠলো, ঐ—ঐ নিত্যানন্দই প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে এখানে এনেছে। আমার-আমার কোন দোষ নেই। আমি কিছু জানি না।
কিরীটী মৃদু হাসে, চমৎকার! একেবারে আটঘাট বেধেই নেমেছিলেন সান্যাল মশাই। এবং এত করেও শেষ বজায় রাখতে পারলেন না। ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে। Really I pity you!
উঃ, কি শয়তান উনি! আপনি জানেন না মিঃ রায়, ওঁর আরো কীর্তি আছে। সত্যজিৎ বলে।
কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে জবাব দেয়, জানি। শেষ পর্যন্ত মেয়ে কল্যাণীকে আপনার পিছনে লাগিয়েছিলেন, force করে আপনার ও সবিতা দেবীর মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে, তাই না?
কিন্তু আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
জানাটাই যে আমার কাজ সত্যজিৎবাবু! কিরীটী জবাব দেয়। কল্যাণীর মাথাটা লজ্জায় নুয়ে আসে।
লক্ষ্মীকান্তবাবু, আমার যা বলবার ছিল বললাম। কেবল একটা কথা বসন্তবাবুকে জিজ্ঞাস্য আছে—সেই শীলমোহর করা লোফাপাটা, আয়রণ সেফে যেটা ছিল, কিরীটী বসন্তবাবুর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, আমিই সেটা সরিয়ে ফেলেছিলাম, সবিতার নামে লেখা আছে দেখে এবং কৌতূহলের বশে খুলে পড়তে গিয়েই চৌধুরীর অতীত জীবনের ইতিহাস আমি সব জানতে পারি। আমার ইচ্ছা ছিল না সবিতা আর ওসব জানতে পারে, তাই আমি আপনাকে ফিরে যেতে বলেছিলাম। সবিতাকেও নিবৃত্ত হতে বলেছিলাম। শেষকালে যখন বুঝলাম, আমরা কত অসহায় নিয়তির হাতে তখনই বাধ্য হয়ে লক্ষ্মীকান্তর হাতে না ধরা দিয়ে উজ্জয়িনীতে ছুটেছিলাম ব্যাপারটার শেষ জানতে, কিন্তু গিয়ে তাদের সন্ধান পেলাম না। তখনও বুঝিনি সান্যাল মশাই এমন জঘন্য খেলায় নেমেছেন।
সে চিঠি কোথায় কাকা? সবিতা প্রশ্ন করে।
সে চিঠি ছিড়ে আমি বৌরাণীর বিলেই ভাসিয়ে দিয়েছি। বাপ যত অপরাধীই হোন না কেন, তাঁর পদস্খলনের কথা সন্তানের শোনা বা জানাও মহাপাপ মা। ভুলে যাও সে কথা। বসন্ত সেন বললেন।
তাহলে এবারে আমার উইলটা পড়তে আর আপত্তি নেই, বলে অতীনলাল খাম ছিড়ে উইল পাঠ করলেন। নতুন উইলে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সন্তোষ মৃত জেনে সমান তিন অংশে ভাগ করে দিয়েছেন তাঁর তিন পুত্র-কন্যাদের মধ্যে। সবিতা, চন্দ্রলেখা ও ধনঞ্জয় সম্পত্তির সকলেই সমান অংশীদার।
সবিতা সকলের নিকট হইতে দূরে এসে খোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। পূব আকাশকে রাঙা করে সূর্যোদয় হচ্ছে। দিগন্তপ্রসারী বৌরাণী বিলের জলে কে যেন মুঠো মুঠো রাঙা আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। চৌধুরীবংশের সমস্ত পাপ স্খলিত করে সর্বপাপঘ্ন দিবাকর যেন উদয়াচল থেকে শান্তির মন্ত্র আকাশে মাটিতে জলে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন দিক হতে দিগন্তে।
সবিতার দু চোখের কোলে জল।
মৃত পিতাকে স্মরণ করে দুটি হাত একত্র করে সে প্রণাম জানায়, তার পিতার আত্মা যেন শান্তি পায়। হে সর্বপাপঘ্ন সবিতা—সবিতাকেও ক্ষমা করো।