- বইয়ের নামঃ মদনভস্ম
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম
মদনভস্ম
উৎসর্গ-
কল্যাণীয়া করবী গুপ্ত (সীপু)
আশীর্বাদক বাবা
.
এই পুস্তকে বর্ণিত কোনও চরিত্রের সঙ্গে জীবিত বা মৃত কোন চরিত্রের কোন সম্পর্ক নাই এবং কোনও ঘটনা বা স্থানের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নাই।
-লেখক।
.
০১.
জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম। বিষণ্ণ ম্লান মুখখানির দিকে তাকালে মনে হবে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বুঝি তার উপর দিয়ে। একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। অসহায় চোখের দৃষ্টি যেন যে-কোন একটা অবলম্বন খুঁজছিল।
অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ। আর মুখোমুখিই প্রায় একটা চেয়ারে বসে থানা-অফিসার সাধন দত্ত একটির পর একটি প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।
কতদিনের পরিচয় ছিল আপনাদের?
অনেক দিনের। মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে পার্শ্বেই দণ্ডায়মান হরপ্রসাদের দিকে একবার তাকাল সুসীম।
হরপ্রসাদও সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন, হ্যাঁ, অনেক দিনের পরিচয় ওদের।
তবু কত দিনের?
তা ধরুন বারো বছর তো হবেই। কি বল সুসীম! হরপ্রসাদ সুসীমকেই যেন পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, তা হবে।
বারো বছর অনেক দিন বলুন!
হ্যাঁ, অনেক দিনের আলাপ ছিল ওদের পরস্পরের। কতকটা যেন পুনরাবৃত্তির মতই কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
হুঁ।
মনে হলো সাধন দত্ত যেন কি ভাবতে লাগলেন আপন মনেই।
মিঃ দত্ত!
সুসীমের মৃদুকণ্ঠের ডাকে মুখ তুলে তাকালেন সাধন দত্ত।
আমি এবারে বাইরে যেতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবেন বৈকি, যান না।
সুসীম ঘর থেকে বের হয়ে আসবার জন্য পা বাড়াতেই সাধন দত্ত বললেন, সুসীমবাবু, আপনার স্ত্রীকে যদি এ ঘরে একবার পাঠিয়ে দেন!
সুসীম কিছু বলবার আগেই হরপ্রসাদ বললেন, নিশ্চয়ই, আমি ডেকে আনছি শ্রাবণীকে।
সুসীম আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরে একাকী শ্রাবণী বসেছিল।
পরিধানে বৌভাতের দামী সবুজ বেনারসী শাড়ি। গলায় জড়োয়ার হীরা ও মুক্তা বসানো হার, হাতে হীরা বসানো বালা, কানে হীরার কর্ণাভরণ। লাল শাঁখা, লোহা, রুলিও ছিল হাতে। কপাল জুড়ে সযত্ন-অঙ্কিত চন্দন-তিলক।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে।
খোলা জানালাপথে বাইরের সেই তরল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল শ্রাবণী।
সুসীমের নববধূ শ্রাবণী।
হরপ্রসাদ এসে ঘরে ঢুকলেন।
হরপ্রসাদের পদশব্দে ফিরে তাকাল শ্রাবণী।
শ্রাবণী, মিঃ দত্ত তোমাকে আর একবার ডাকছেন।
কেন?
তা তো ঠিক জানি না। চল একবার।
জামাইবাবু?
বল?
কিছু জানতে পারা গেল?
কি?
কে—মানে বলছিলাম, কে তাঁকে হত্যা করলো?
না।
এখনো জানতে পারা গেল না?
না।
জানতে নিশ্চয়ই পারা যাবে না—
তা জানতে হবে বৈকি।
কিন্তু-–
কিছু বলছিলে?
না, কিছু না—চলুন।
হরপ্রসাদের পিছনে পিছনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো শ্রাবণী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে উপরের যে ঘরে সাধন দত্ত বসেছিলেন, হরপ্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সেই ঘরে এসে ঢুকল শ্রাবণী।
আসুন মিসেস্নাগ। আবার আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত। বসুন–
যন্ত্রচালিত একটা পুতুলের মতই যেন শ্রাবণী এগিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট খালি চেয়ারটায় সাধন দত্তর মুখোমুখি বসল।
আচ্ছা মিসেস্ নাগ, সে-সময় একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না আমার—
চোখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল শ্রাবণী সাধন দত্তর মুখের দিকে নিঃশব্দে।
আপনি আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে আপনার পূর্বে পরিচয় ছিল–
হ্যাঁ।
কি সূত্রে আপনাদের পরিচয়?
কিছুদিন এক কলেজে পড়েছিলাম—
কিছুদিন মানে কতদিন হবে?
তা তিন বছর হবে।
ঘনিষ্ঠতা ছিল কি আপনাদের মধ্যে?
না। তাকে—তাকে আমার কোনদিনই ভাল লাগে নি।
ভাল লাগে নি! কেন?
তা-তা আমি বলতে পারবো না। তবে—তবে তাকে কখনো আমার ভাল লাগে নি। তবু–তবু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ দত্ত, আমি কখনো চাই নি তার এভাবে মৃত্যু হোক।
হুঁ। আচ্ছা মিসেস, নাগ, আপনাদের বিবাহের পূর্বে আপনার স্বামীর সঙ্গে যে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পূর্ব-পরিচয় ছিল, আপনি কি তা জানতেন?
জানতাম।
খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল নাকি ওদের শুনলাম!
আমিও তাই জানতাম।
আর একটা কথা, আপনি ঠিক জানেন—আপনাদের আজকের এই উৎসবে আপনার স্বামী তাকে প্রথমে নিমন্ত্রণ করেন নি?
জানি করে নি—
তারপর যেচে সে যে নিজে থেকে নিমন্ত্রণ নিয়েছিল—এ কথাটা কি আপনি শুনেছিলেন?
শুনেছি। আমার স্বামীই কাল রাত্রে আমাকে বলেছিল।
আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, যেচে হঠাৎ অমন করে কেন সে নিমন্ত্রণ নিতে গেল?
কি করে বলবো!
আজ এখানে আসবার পর আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছিল?
হয়েছিল।
কথাবার্তাও হয়েছিল নিশ্চয়ই?
হয়েছিল।
ও সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কোন কথা হয় নি?
না।
আপনি নিশ্চয়ই তার ঐভাবে যেচে নিমন্ত্রণ নিয়ে এখানে আসায় খুশি হতে পারেন নি!
সেটাই তো স্বাভাবিক।
তা বটে। আর একটা কথা—
বলুন।
এ ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
না।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
শ্রাবণী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দোতলার বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে শ্রাবণী লক্ষ্য করল, তার স্বামী সুসীম রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু কি জানি কেন, স্বামীকে যেন দেখেও দেখলোনা শ্রাবণী। নিজের ঘরের দিকেই সে চলে গেল।
সুসীমও শ্রাবণীকে দেখে যেন ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারল না।
চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো।
.
মৃত্যু মানুষের জীবনে একান্তই স্বাভাবিক ঘটনা নিঃসন্দেহে।
কিন্তু তবু সেই মৃত্যুকেই মনে হয় অস্বাভাবিক, যখন অকস্মাৎ বিনা নোটিশে এসে হাজির হয়। শুধু অস্বাভাবিকই নয়, যেন একেবারে অকস্মাৎ বিমূঢ় করে ফেলে।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক মৃত্যুটাও ঠিক তেমনি করেই বাড়ির মধ্যে অতগুলো লোককে যেন একেবারে অভিভূত, বিমূঢ় করে দিয়েছিল মুহূর্তে। কিছুক্ষণের জন্য সকলে যেন একবারে বোকা বনে গিয়েছিল।
লর্ড বায়রনের সেই বিখ্যাত কবিতার ঘটনা–ভিসন অফ ব্যালসেজারের মতোই সুনন্দার মৃত্যুটা অমোঘ নিষ্ঠুর এক অদৃশ্য হাতে যেন লেখা হয়ে গেল!
সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
ঐ যে বিরাট হলঘরটার এক কোণে দামী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে এখনো বসে আছে সুনন্দা চ্যাটার্জী, শুধু মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে করুণ অসহায় এক ভঙ্গিতে—
ঐ সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত। মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বেই অমোঘ নিষ্ঠুর সত্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে–সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
পরিধানে দামী সাদা ইটালীয়ান সিফনের শাড়ি, গায়ে ডি রেড় ভেলভেটের ব্লাউজ, কনুই পর্যন্ত হাতা। চোখেমুখে সূক্ষ্ম একটা প্রসাধনের প্রলেপ। তার জামাকাপড় সর্বাঙ্গ থেকে এখনো ঘরের বাতাসে ভাসছে তার প্রিয় সেন্ট কালিফোর্নিয়ান পপির মৃদু মিগ্ধ সুবাসটা। মাথার খোঁপাটা ভেঙে ঘাড়ের পাশে লুটিয়ে পড়েছে। এক হাত নিরাভরণ, অন্য হাতের সুডৌল মোমের মত মসৃণ মণিবন্ধে দামী সোনার ওমেগা রিওয়াটা এখনো টিটি করে চলছে। সব ঠিক তেমনিই আছে, শুধু সুনন্দার ঐ দেহের মধ্যে প্রাণটুকুই নেই।
সুনন্দা মৃত।
একটু আগেও নাকি বিশাখা হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুনন্দার উচ্ছ্বসিত হাসি শুনেছিল। মৃত সুনন্দা চ্যাটার্জী—তবু এখনো তার সেই যৌবন-ঢলঢল-দেহ ঠিক তেমনিই আছে।
মৃত্যু কখন এসেছিল এবং নিঃশব্দে এসে কখন বাড়িভর্তি এতগুলো আমন্ত্রিত লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুনন্দার মোমের মতো নরম এবং শঙ্খের মতো ধবল গ্রীবায় সরু সাদা ঐ সিল্ক কর্ডের ফসটি লাগিয়ে যে তাকে চিরতরে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখে গিয়েছে সেটাই কেউ জানতে পারে নি।
শুধু আশ্চর্যই নয়, বিস্ময়কর। তবু সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত।
একদা প্রথম যৌবনে যাকে ঘিরে কত হতভাগ্য যুবক আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনার জাল বুনেছে এবং তাদের সে আশা-আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনাকে নির্মম নিষ্ঠুর ব্যঙ্গোক্তিতে রূঢ় প্রত্যাখ্যান জানালেও মরীচিকার মত যার পিছনে পিছনে তারা ঘুরেছে আর ঘুরেছে—এই সেই সুনন্দা চ্যাটার্জী। শোনা যায় তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কোন পুরুষ তাকে স্পর্শ করা দূরে থাক নির্দিষ্ট একটা ব্যবধান ছাড়া কাছে গিয়ে দাঁড়াবারও সাহস পায় নি। তেত্রিশটি বসন্ত তার রুদ্ধ দ্বারে ব্যর্থ আঘাত হেনে ফিরে গেলেও সুনন্দার দিকে চাইলে মনে হবে-যৌবন বুঝি ওর দেহে অষ্টাদশীর মতোই অটুট। দীর্ঘদিন ধরেই সে দেহচর্চার সঙ্গে লাঠি ছোরা আর যুযুৎসু বিদ্যায়ও পারদর্শিনী হয়ে উঠেছিলো, তাই ছেলেরা বরাবরই বলে এসেছে—ও মেয়ে নয়, আগুনের শিখা।
সেই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে কিনা অমনি করে সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে হলো!
এর চাইতে অভাবিত, বিস্ময়কর আর কি ঘটতে পারে?
কিন্তু অভাবিতই হোক আর বিস্ময়করই হোক, সুনন্দা মৃত।
রাতও বেশি নয়—মাত্র সাড়ে এগারটা। তাও গ্রীষ্মের রাত্রি সাড়ে এগারটা। উৎসবের বাড়িতে রাত সাড়ে এগারটা তো রাতই নয়। তখনো আমন্ত্রিতদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পৌঁছায় নি বলেই সুসীম নিচের করিডোরে নিজেই অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। উৎসবটা তারই বৌভাতের।
এ-কান ও-কান হতে হতে তার কানে গিয়ে সংবাদটা পৌঁছাতেই দ্রুতপদে সুসীম উপরে উঠে আসে।
এবং হলঘরটার মধ্যে ঐ সময় যারা মূক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরই মধ্যে বান্ধবী বিশাখাকে সামনে দেখে তাকেই প্রশ্ন করে, কি–কি ব্যাপার?
বিশাখা ততক্ষণে বোধ হয় নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিল কিছুটা। সে বলে অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে, যেন একপ্রকার ফিসফিস করেই, সুনন্দা ইজ ডেড!
ডেড!
যেন ভূত দেখার মতই হঠাৎ চমকে ওঠে কথাটা বলে সুসীম।
সি হ্যাজ বিন ব্রুটালি মার্ডারড!
সত্যি-সত্যি–
এবারে বিশাখা চোখের ইঙ্গিতে অদূরে সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে বসা সুনন্দার মৃতদেহটা দেখিয়ে দিল।
সেই দিকে তাকিয়ে যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় সুসীম।
কয়েক মুহূর্ত সেই নিপ্রাণ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে সোফাটার সামনে এগিয়ে যন্ত্রণাকাতর রুদ্ধকণ্ঠে বলে, হাউ অ্যাবসার্ড! নো, নো–দ্যাট কান্ট বি–কান্ট বি—
বিরাট হলঘরটি ফুলে আর লতাপাতায় এবং অত্যুজ্জ্বল সব ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঝলমল করছে। মেঝেতে দামী কার্পেট বিছানো। চারপাশে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ মূক সব সুসজ্জিত আমন্ত্রিত নরনারীর দল।
সুসীম যেন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার চোখ তুলে তাকালো। সুনন্দা যে তার গৃহে আজ অভ্যাগতা—অতিথি!
বলতে গেলে সবার আগে সেই বিকেলেই এসেছে সুনন্দা!
মাত্র মাসখানেক পূর্বের সেই ব্যাপারের পরও সুনন্দা যে একপ্রকার নিজে থেকে যেচেই নিমন্ত্রণ নিয়ে তার বিবাহের উৎসবে আসবে, সুসীম তা বিশ্বাস কেন—ভাবতেও বুঝি পারে নি।
আর ভাবতে পারে নি বলেই নিজে তো সুনন্দার কাছে যায়ই নি, নিমন্ত্রণের একটা চিঠি পাঠাবার কথাটা পর্যন্ত ভাবতে পারে নি, সাহস পর্যন্ত হয় নি।
কারণ সুসীমের চাইতে কে আর বেশী করে চিনত সুনন্দাকে!
মনশ্চক্ষে যেন সুসীম স্পষ্ট দেখেছিল সেই ধনুকের মতো ভ্রূ ঈষৎ উত্তোলিত করে সামনের উপরের পাটির দাঁত দুটো দিয়ে নীচের ওষ্ঠটা কামড়িয়ে ধরে ক্ষণকাল মুখের দিকে চেয়ে থেকে সুনন্দা জবাব দিচ্ছে তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে ও কণ্ঠস্বরে, সুসীম বুঝি ভেবেছিলে দেশাচার আছে বলেই নিমন্ত্রণ করবার অধিকারটাও সকলেরই সকলকে আছে!
আজ সুসীমও ঐ কথার পর সহসা পরমুহূর্তেই কোন জবাব জুগিয়ে উঠতে পারত না নিজের ওষ্ঠে। আর সুনন্দাও তাকে কেবল এটুকু বলেই নিষ্কৃতি দিত না।
পরমুহূর্তেই বলতো, তা এসেছে যখন–সামাজিকতা আমারও করা কর্তব্য, কি বল? আমার ড্রাইভার মহীন তো তোমার বাড়ি চেনে, সেই যাবেখন লৌকিকতাটুকু সেরে আসতে। হ্যাঁ দেখো, ভুলে যেও না যেন আবার ওকে দুটো খাইয়ে দিতে!
তারপর কি আর দাঁড়াতে পারত সীম?
সেদিনকার মতোই হয়তো অসহ্য অপমানে আর হিংস্র একটা আক্রোশে—ঠিক যাকে বলে একেবারে ফেটে পড়তে সে এবং সেদিনকার মতোই ইতর বলে বের হয়ে আসা ছাড়া উপায়ই বা শেষ পর্যন্ত কি আর থাকত তার! তাই তো সে যায় নি। অথচ রীতিমত পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত সকলকেই সুসীম নিমন্ত্রণ করেছিল তার বিবাহহাৎসবে, করেছিল অবিশ্যি দুটো কারণে।
প্রথমতঃ সে পুরুষ। সৌভাগ্যবান্ কৃতী পুরুষ। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অর্থে, বিদ্যায়, স্বাস্থ্যে, পরিচিতিতে—কিসে নয়?
সব দিক দিয়েই সে যখন প্রতিষ্ঠিত, তখন বয়সটা আটচল্লিশ বছর হয়েছে বলেই যে তার ভাগ্যে মনের মতো এবং দশজনকে দেখাবার মতো বৌ জুটবে না, এ কথাটা যে কত বড় মিথ্যে সেটা প্রমাণিত করার এই একটা মস্ত সুযোগ এবং দ্বিতীয়তঃ সুনন্দাকেও বুঝিয়ে দেওয়া যে সুসীমের মত স্বামী-সৌভাগ্য সুনন্দার ছিল না!
কিন্তু সত্যিই কি তাই? এ বিয়েতে কি সে মনের মধ্যে সত্যিকারের তৃপ্তি পেয়েছে? নিশ্চয়ই পায় নি। আর যাকেই ফাকি দেওয়া যাক না, নিজের মনকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না! নইলে শ্রাবণীর মতো মেয়েকে বধূরূপে পাচ্ছে জেনেও বিয়ের আগের রাত্রে কেন নিদ্রাহীন রাত্রি কেটেছিল তার?
বাসরঘরের নির্জনতার মধ্যেও কেন সে শ্রাবণীর মুখের দিকে সহজভাবে তাকাতে পারে নি? নিজের মনকে বার বার কেন বোঝাতে হয়েছে নিজেকে, আমি ঠকি নি—আমি ঠকি নি!
বধূসহ গৃহে প্রত্যাগমন করেও কেন সে ঝিম মেরে ছিল?
কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিল না!
.
কাল বৌভাতের উৎসব বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা গমগম করছিল। রাত বোধ করি তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছিল সুসীম নিজেকে। শুতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
ঘরে সে-সময় কেউ ছিল না, নইলে সুসীম নিশ্চয়ই ফোনটা ধরত না। ভাগ্যে কেউ ঐ সময় ঘরে ছিল না!
একান্ত অনিচ্ছায় শিথিল হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়েছিল সে, হ্যালো! সসীম?
সুসীম?
পরিচিত-অত্যন্ত পরিচিত সেই নারী কণ্ঠস্বর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বইয়ে দেয় সুসীমের শিরায় শিরায়।
সোজা হয়ে বসে সুসীম, কে সুনন্দা?
আশ্চর্য তো, তুমিই ঠিক ফোনটা ধরলে! সুনন্দার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর পুনরায় শোনা গেল।
হ্যাঁ, আমিই।
খুব ব্যস্ত বুঝি?
না না, ব্যস্ত কি–
আজ তো তোমার কালরাত্রি, তাই না?
কালরাত্রি কথাটা প্রথমটায় ঠিক যেন বুঝতে না পেরে পুনরাবৃত্তি করে সুসীম, কালরাত্রি!
তাই তো বলে আজকের রাতটাকে?
এতক্ষণে কথাটা বুঝতে পেরে সুসীম বলে, ও হ্যাঁ!
বেহুলার স্বামীকে কালনাগিনী দংশেছিল এই রাত্রে, তাই এই রাতটাকে বলে কালরাত্রি। তা কই—আমাকে তো নিমন্ত্রণও করলে না!
তুমি—কথাটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারে না সুসীম।
যাই বা না যাই, চিঠিও তো একটা দিতে পারতে ডাকে—প্রজাপতি-মার্কা! বুকপোস্টে দুপয়সার ডাকটিকিটের বেশী তো কিছু আর খরচ হতো না!
সুসীম চুপ করে থাকে।
অন্য পক্ষ আবার বলে, কি, চুপ করে রইলে যে?
তারপর একটু থেমে আবার সুনন্দা বলে, বুঝতে পেরেছি—
কী?
কেন তুমি আমাকে নিমন্ত্রণ করো নি।
কেন?
আমার উপস্থিতিতে তোমার শ্রাবণী যদি সবার চোখে ছোট হয়ে যায় সেই ভয়ে। কারণ তুমি তো জানই, আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হবে না!
তার মানে?
তুমি যে—
কি?
না, থাক।
কেন, শুনিই না?
সত্যি বল তো সুসীম, তুমি যে শ্রাবণীর জীবনে চতুর্থ পুরুষ, সে কথাটা কি সত্যিই তুমি জান না?
শ্রাবণীর আমার পূর্বে আর কোন স্বামী ছিল বলে তো শুনি নি!
কি একটা কথা বললে বল তো সুসীম! বিয়ে করার পর পুরুষ নাকি বোকা হয়ে যায় শুনেছি, কিন্তু তুমি যে দেখছি বিয়ের পর এক রাত্রি বৌয়ের সঙ্গে বাস করেই বোকা হয়ে গেলে!
তাই মনে হচ্ছে বুঝি?
নিশ্চয়ই। নইলে অন্তত তুমি কি করে ভাবলে আজকের দিনে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে তার স্বামীই একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ!
ও, এই কথা! কিন্তু যারা আমার বিশেষ পরিচিত তারা যে তোমার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় তাই বা ভাবছো কি করে?
মানে? গলার স্বরটা তীক্ষ্ণ ধারালো শোনালো সুনন্দার।
চমকে উঠলে যেন মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি-সত্যিই এতে চমকাবার কি আছে? তুমি তো একটু আগেই বললে কোন কুমারী মেয়ের জীবনে, বিশেষ করে তেত্রিশ বছর বয়স পর্যন্তও যারা কুমারী, তাদের যদি কখনো বিয়ে হয়ই, সেই স্বামীই তার জীবনে প্রথম বা একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ হতে পারে না!
ও, এই কথা! মৃদু হাসির সঙ্গে সুনন্দার কণ্ঠ থেকে কথাটা উচ্চারিত হয়। যাক, ওসব কথা যেতে দাও। সসীম পরক্ষণেই বলে, কাল আমার বৌভাতের উৎসবে যদি আসো তো সত্যই জেনো খুশী হব।
সত্যি বলছো খুশী হবে?
সত্যি।
সত্যি?
সত্যি, সত্যি, সত্যি। আসবে কিনা বল এখন!
যাবো।
কথা দিলে?
দিলাম।
.
০২.
মাথাটার মধ্যে তখনো যেন কেমন ঝিঁঝিম্ করছিল সুসীমের। এমন সময় সুসীমের ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ সামনে এসে দাঁড়ালেন, সুসীম!
কে? ও আপনি!
পুলিসে ফোন করে এলাম।
পুলিস!
হ্যাঁ। উই মাস্ট ইনফরম দি পুলিস! সর্বাগ্রে পুলিসকেই একটা সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন।
হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ঘরের চারিদিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো সুসীম, ইতিমধ্যে অত বড় হলঘরটা কখন যেন একেবারে খালি হয়ে গিয়েছে।
ঘরের মধ্যে সে ও হরপ্রসাদ ব্যতীত ঐ মুহূর্তে তৃতীয় আর কোন প্রাণীই নেই। এবং সোফার উপরে উপবিষ্ট ভঙ্গিতে রয়েছে সুনন্দার মৃতদেহটা। সুনন্দা মৃত! নতুন করে যেন আবার মনে পড়লো সুসীমের, সুনন্দা মৃত! সরু সাদা একটা সিল্ক কর্ডের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
.
নিকটবর্তী থানা-অফিসার সাধন দত্ত যখন এসে সুসীমের গৃহে পৌঁছলেন সংবাদটা পেয়ে, রাত তখন প্রায় দেড়টা।
সমস্ত বাড়িটা তেমনি সুসজ্জিত। ঘরে ঘরে তেমনি অত্যুজ্জ্বল সব আলো জ্বলছে। প্রায়। দেড়শত আমন্ত্রিত নানা বয়েসী নারী-পুরুষে তখনো বাড়িটা ভর্তি।
শুধু থেমে গিয়েছে সানাই। আর থেমে গিয়েছে অকস্মাৎ কোন যাদুমন্ত্রবলে যেন উৎসবগৃহের সমস্ত কলহাসি, গুঞ্জন। প্রায় দেড়শ নরনারী মূক, যেন একেবারে বোবা হয়ে একতলায়। সব ভিড় করে রয়েছে। দোতলা থেকে সবাই নীচে নেমে এসেছে।
এমন কি সুসীমের সব আত্মীয়স্বজন ও নববধূ শ্রাবণী পর্যন্ত নীচে চলে এসেছে। সকলের চলচ্ছক্তি তো বটেই, জিহ্বাও যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আর সুসীম—সে যেন কেমন অসহায়ের মতো নীচের হলঘরের পাশের লাইব্রেরী ঘরটার মধ্যে একাকী একটা সোফার উপরে বসে চোখ বুজে পড়ে আছে।
হরপ্রসাদই করিডোরে থানা-অফিসারের আগমন-প্রতীক্ষ্ণয় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিসের কালো রংয়ের ভ্যানটা এসে করিডোরের সামনে দাঁড়াতেই তিনি এগিয়ে গেলেন।
সাধন দত্ত ভ্যান থেকে নেমে হরপ্রসাদকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁকেই প্রশ্ন করলেন, এটাই তো সুসীম নাগের বাড়ি?
হ্যাঁ, আসুন।
কি ব্যাপার বলুন তো?
সুসীম আমার শ্যালক, আজ তার বৌভাতের উৎসব ছিল এই বাড়িতে। তার এক পরিচিতা মহিলা সুনন্দা চ্যাটার্জী আজ এখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। তিনিই নিহত হয়েছেন।
ডেড বডি কোথায়?
উপরের হলঘরে—চলুন।
হরপ্রসাদই সাধন দত্তকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন আগে আগে। সাধন দত্ত তার পিছনে পিছনে সিঁড়ি অতিক্রম করে চললেন।
তা নিহত হয়েছে বলছেন?
হ্যাঁ, গলায় সরু একটা সিল্ক কর্ডের ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ভদ্রমহিলাকে হত্যা করা হয়েছে।
বলেন কি? ফাঁস!
হ্যাঁ।
কোন ডাক্তারকে ডেকেছিলেন?
ডাক্তার একজন এখানে উপস্থিত আছেন।
দুজন এসে উপরের হলঘরে ঢুকলেন।
মৃতদেহ পরীক্ষা করে সাধন দত্ত অস্ফুট কণ্ঠে কেবল বললেন, হাউ হরি? সত্যিই যে ফাঁস লাগিয়েই মারা হয়েছে দেখছি! কিন্তু বাড়ি-ভর্তি এত লোকের মাঝখানে এঁকে এমনি ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হলো, আর কেউ আপনারা ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না?
তাই তো দেখছি—অসহায় ভঙ্গিতে যেন আমতা আমতা করে কথাটা বললেন হরপ্রসাদ।
নট ওনলি মিস্টিরিয়াস—আবিলিভে টু! কিন্ত কে প্রথমে ব্যাপারটা আবিষ্কার করলেন?
তা—তা তো ঠিক জানি না। এখানে আজ যারা উপস্থিত, সম্ভবতঃ তাদেরই মধ্যে কেউ।
আজকের উৎসবে আপনাদের এ বাড়িতে এসেছিলেন হয়তো বহু লোক এবং তাদের মধ্যে সকলে নিশ্চয়ই নেই?
প্রশ্নটা করে সাধন দত্ত হরপ্রসাদের মুখের দিকে তাকালেন।
না। কারণ যাঁদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই চলে গিয়েছেন। যারা এখনো আছেন তারা এক-চতুর্থাংশ হবেন—
অনেকেরই তাহলে এখনো খাওয়া-দাওয়া হয় নি?
না। এই ব্যাপারের পর—
হুঁ স্বাভাবিক। তাহলে বলতে পারছেন না—কে প্রথম ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন?
না।
তা আপনার শ্যালক—এ বাড়ির মালিক সুসীমবাবু কোথায়?
নীচে আছে। বেচারা এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে—
হবারই তো কথা। তাকে একবারটি এ ঘরে ডেকে আনবেন?
নিশ্চয়ই। আমি এখুনি ডেকে নিয়ে আসছি।
হরপ্রসাদ কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
সাধন দত্ত হরপ্রসাদের অনুপস্থিতিতে ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন।
হলঘরের যেদিকটায় সোফার উপরে মৃতদেহ ছিল, সেদিকটায় চারটে প্রমাণ-সাইজের স্টীলের গডরেজের আলমারি সামান্য সামান্য ব্যবধানে পাশাপাশি দাঁড় করানো ছিল। এবং সেই আলমারিগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই আরো একটা ব্যাপার সাধন দত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আলমারির পিছনেই একটি সংলগ্ন বাথরুম এবং বাথরুমের দরজাটা তখনো খোলাই রয়েছে। বাথরুমটা কিন্তু অন্ধকার।
মুহূর্তকাল যেন সাধন দত্ত কি ভাবলেন, তারপরই পকেট থেকে টর্চ বের করে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করতে যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে বাথরুমের আলোর সুইচটা তার নজরে পড়লো। হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপলেন, কিন্তু খুট করে একটা শব্দ হলো মাত্র, আলোটা জুললো না বাথরুমের।
হাতের টর্চটা জ্বেলেই সাধন দত্ত তখন বাথরুমের ভিতরটা দেখতে লাগলেন। ঝঝকে তক্তকে বড়লোকের বাড়ির বাথরুম। দুটো দরজা বাথরুমের, একটা ঐ হলঘরের সংলগ্ন—যে। দরজাপথে এইমাত্র সাধন দত্ত প্রবেশ করেছেন, আর দ্বিতীয় দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। হাত ধোবার বেসিন, মিরার, দেওয়ালের গায়ে ইউরিন্যাল, কমোড সবই আছে। এমন কি সোপকেসে সাবান ও টাওয়েলও আছে।
কিন্তু বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই খুব মৃদু হলেও একটা কেমন মিষ্টি বিজাতীয় গন্ধ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল সাধন দত্তর। নাক দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে টেনে গন্ধটা কিসের অনুভব করবার চেষ্টা করতে করতে আলো ফেলে ফেলে এদিক ওদিক ভাল করে তাকাতে তাকাতে অকস্মাৎ কমোডটার পাশেই সাদা মতো কি একটা সাধন দত্তর নজরে পড়লো।
কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে নীচু জিনিসটা তুলে নিতেই বুঝলেন সেটা একটা রুমাল। রুমালটা হাতে তুলে নিতেই বুঝতে পারলেন ঐ রুমালটা থেকেই সেই গন্ধটা আসছিল। মিষ্টি গন্ধ—গন্ধটা এবারে কিসের বুঝতে দেরী হলো না.সাধন দত্তর। ক্লোরোফরমের মিষ্টি গন্ধ।
রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে আরো কিছুক্ষণ বাথরুমটার চারিদিক ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন সাধন দত্ত।
হলঘরে পুনরায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ওদিককার দরজাপথে হরপ্রসাদের সঙ্গে সুসীম এসে ঘরে ঢুকলো।
আপনিই এ বাড়ির মালিক সসীম নাগ? প্রশ্ন করেন সাধন দত্ত।
হ্যাঁ।
আপনারই বৌভাতের উৎসব আজ এ বাড়িতে ছিল?
হ্যাঁ।
কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন!
সুসীম বসলো।
সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন শুরু করলেন।
উনি অর্থাৎ যিনি নিহত হয়েছেন তিনিও শুনলাম, হরপ্রসাদবাবুর কাছে, আজকের আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন!
হ্যাঁ।
ওঁর নাম শুনলাম সুনন্দা চ্যাটার্জী, তাই না?
হ্যাঁ।
কোথায় থাকেন উনি? এই কলকাতায়ই কি?
হ্যাঁ। তিলজলায় থাকে।
বিবাহিতা না অবিবাহিতা?
কুমারী?
হ্যাঁ।
কি করতেন উনি?
ক্যালকাটা গার্লস কলেজের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন।
আচ্ছা উনি যে মারা গিয়েছেন, সেটা সর্বপ্রথম কে টের পায়?
প্রথমে—প্রথমে বোধ হয় জানতে পারে মৃণাল—
মৃণাল!
আমার বন্ধু। সেও আজ এখানে উপস্থিত আছে।
হরপ্রসাদবাবু, মৃণালবাবুকে একটিবার এ ঘরে ডেকে আনতে পারেন?
মৃণাল আমাদের সঙ্গেই এসেছিল, বাইরে সে দাঁড়িয়ে আছে।
ও, তাই নাকি! হরপ্রসাদবাবু, তাঁকে ডাকুন তো ঘরে।
হরপ্রসাদ বললেন, ডাকছি। কথাটা বলেই হরপ্রসাদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একটু পরেই মৃণালকে নিয়ে হরপ্রসাদ পুনরায় ঐ ঘরে ঢুকলেন।
ডাঃ মৃণাল সেন।
লম্বা-চওড়া রীতিমত বলিষ্ঠ চেহারা মৃণাল সেনের। এবং গায়ের রং শ্যাম হলেও চেহারায় ও চোখে-মুখে অপূর্ব একটা শ্ৰী আছে। পরিধানে শান্তিপুরী ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। চোখে কালোমোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
আপনার নাম মৃণাল সেন?
হ্যাঁ।
কি করেন আপনি?
ও ডাক্তার। জবাবটা দিল সুধীমই।
ডাক্তার! ভ্রূ-দুটো যেন মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হলে সাধন দত্তর।
আপনি শুনলাম ডাক্তার সেন সুসীমবাবুর বন্ধু!
হ্যাঁ, অনেকদিনের বন্ধু আমরা। স্পষ্ট সহজ কণ্ঠে জবাব দেয় মৃণাল।
সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনারও পরিচয় ছিল, ডাক্তার সেন?
ছিল।
শুনলাম আপনিই নাকি প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?
আমি! কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মৃণাল বলে, হ্যাঁ, আমিই–
ব্যাপারটা আমাকে ডিটেইলস্ বলবেন, ডাক্তার সেন?
অতঃপর মৃণাল যা বললো তা হচ্ছে?
নিমন্ত্রিতদের লাস্ট ব্যাচ তখন তেতলার ছাদে খেতে বসেছে। পাতে লুচি তরকারি পড়েছে, কিন্তু তখনও কেউ খেতে শুরু করে নি। কারণ যারা যারা সেই ব্যাচে বসবে, তাদের মধ্যে সকলে এসে পৌঁছায় নি আসরে।
মৃণালও ঐ লাস্ট ব্যাচে বসবে বলে ছাতে উঠে এসেছিল। এবং সুসীমই ঠেলেঠুলে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তুই হ্যাঁ, বসে পড় মৃণাল, আমি একবার নীচে যাই। সুসীম বলেছিল।
কেন, তুইও চল না—এই সঙ্গে বসে যাবি!
না রে, এখনো দেখছি কেউ কেউ আসেন নি—
তুইও যেমন! রাত কত হয়েছে জানিস? আর কেউ আসবে না, চল!
না। তুই হ্যাঁ, আমি আরো আধঘণ্টা দেখি।
মৃণাল অতঃপর উপরে চলে যায়। এবং ছাতে যেখানে খাওয়ার জায়গা হয়েছিল সেখানে পৌঁছে হঠাৎ এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুনন্দার কথা মনে পড়ে।
সুনন্দা তো কই তখনো খায় নি!
মৃণাল নীচে নেমে আসে সুনন্দাকে খোঁজবার জন্য। কারণ মৃণালকে সুনন্দা বলেছিল ফিরবার পথে যেন সুনন্দাকে সে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। কারণ সুনন্দার নিজের গাড়িটা সেদিন কারখানায় দেওয়ায় তাকে নাকি ট্যাক্সিতে আসতে হয়েছিল।
মনে পড়ে সুনন্দাকে সে ঘণ্টাখানেক আগে হলঘরের আলমারিগুলোর সামনে একটা সোফার উপরে বসে থাকতে দেখে শুধিয়েছিল, কি ব্যাপার, এখানে যে এভাবে দল ছেড়ে চুপচাপ বসে!
সুনন্দা জবাব দিয়েছিল, এমনি।
মনটা কেমন করছে বুঝি?
কেন?
মৃদু হেসে মৃণাল বলেছিল, না এমনিই বলছি—
আশ্চর্য তোমরা মৃণাল পুরুষরা, সত্যি—
কি রকম?
নিজেদের তোমরা এমন একটা উঁচু আসনে বসাতে অভ্যস্ত–
না না—আজকে ঝগড়া নয়, খালি পিস্-সন্ধি—
সুনন্দা হেসে ফেলে।
চল, ওঠো।
কোথায়?
চল বর্মা থেকে আমাদের এক কমন ফ্রেণ্ড এসেছে, নীচে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
না তুমি যাও, অন্য এক সময় বরং আলাপ করা যাবে। তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।
বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মৃণাল, অপেক্ষা করছে! কার জন্য?
কাল বলবো, আজ নয়।
বেশ। কালই তবে শুনবো।
মৃণাল আর দাঁড়ায় নি।
কিন্তু খাওয়ার পর ছাত থেকে হলঘরে এসে যখন সে ঢুকলো তখন হলঘর একেবারে খালি, কেবল সেই সোফাটার উপরে তেমনি তখনো একাকী বসে আছে সুনন্দা।
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা।
সুনন্দা!বলে ডেকে কাছে এগিয়ে গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে যায় মৃণাল।
অস্বাভাবিক—অস্বাভাবিক মনে হয় সুনন্দাকে। আর একটু কাছে গিয়েই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে দেরি হয় না মৃণালের। এবং তারপর গায়ে হাত দিতেই সে সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কে স্থিরনিশ্চিত হয়।
তারপর? সাধন দত্ত শুধালেন।
ঠিক সেই সময় বিশাখা এসে হলঘরে ঢোকে।
বিশাখা তখনো ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি।
সে তাই কৌতুক করতে করতে এগিয়ে আসে, কি ব্যাপার, নিভৃতে দুজনে মুখোমুখি!
ফিরে তাকায় মৃণাল বিশাখার মুখের দিকে। মৃণালের সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে রক্তশূন্য। চোখের দৃষ্টি অসহায় বিহূল।
চমকে ওঠে বিশাখা, বলে, কি ব্যাপার, মৃণাল?
মৃণাল কোন কথা না বলে নিঃশব্দে শুধু ইঙ্গিতে সুনন্দাকে দেখায়।
বিশাখা সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বোকার মতোই তখনো ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করে, কি হয়েছে সুনন্দার?
সি ইজ ডেড!
ডেড?
একটা আর্ত অস্ফুট চীৎকার যেন বের হয়ে আসে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
তারপরই বিশাখা ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এবং ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যে সকলের গোচরীভূত হয়ে যায়।
.
০৩.
অতঃপর সাধন দত্ত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে যাঁরা ঐ সময় সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন একে একে তাদের সকলকেই ডেকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে আর কেউ কিছু জানেন কিনা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
কিন্তু কারো কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, কেউই বড় একটা সুনন্দাকে লক্ষ্য করেন নি।
মাত্র দুজন ছাড়া।
বিষ্ণু দে আর বিশাখা চৌধুরী।
বিষ্ণু দে ওদের মানে সুসীমদেরই এক বন্ধু। তিনিও সুনন্দাকে চিনতেন। আর বিশাখা চৌধুরী শ্রাবণী, সুসীম ও মৃণালের বান্ধবী। বিশাখাও চিনতো সুনন্দাকে তবে কোন ঘনিষ্ঠ পরিচয় তার সুনন্দার সঙ্গে ছিল না নাকি।
প্রশ্ন করে জানা গেল, বিশাখা চৌধুরী নাকি দুর্ঘটনা জানাজানি হবার প্রায় আধ ঘণ্টাটাক আগে ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সুনন্দাকে ঐ সোফায় বসে থাকতে দেখেছিল এবং সে তখন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল।
আরো একটা ব্যাপার জানা গেল ঐ সঙ্গে যে ঠিক ঐ সময়টাতেই নাকি আমন্ত্রিতদের মধ্যে কে একজন ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীদের নানা ধরনের চমৎকার তাসের খেলা দেখিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন।
পাশেই বসেছিল সুসীম ও মৃণাল। সুসীমই হঠাৎ প্রশ্ন করে, তাসের খেলা!
হ্যাঁ।
কে আবার আজ দেখাচ্ছিলেন তাসের খেলা?
বিশাখা জবাব দেয়, তা তো জানি না। তাকে চিনিও না, কখনো আগে দেখি নি। ভদ্রলোককে।
মৃণাল এবারে শুধায়, কেমন দেখতে ভদ্রলোক ছিলেন মনে আছে তোমার?
মনে আছে বৈকি। বিশাখা জবাব দেয়, ভদ্রলোককে দেখতে অনেকটা ঠিক তোমারই মতো। আমার মতো?
মৃণাল যেন বিশাখার কথায় বিস্ময়ে কেমন একপ্রকার অভিভূত হয়েই তার মুখের দিকে তাকায়।
বিশাখার কথা তখনো শেষ হয়নি। এবং মৃণাল ও উপস্থিত সকলের বিস্ময়ের আরো কিছু বাকী ছিল।
বিশাখা বলল, শুধু অনেকটা সেই ভদ্রলোক তোমার মতোই বা দেখতে বলছি কেন, তার গলার স্বরটাও মনে পড়ছে এখন যেন তোমারই মতো শুনেছিলাম।
সত্যি বলছো বিশাখা! কেমন যেন প্রায় নিশ্চুপ কণ্ঠে প্রশ্নটা করলো মৃণাল।
সত্যিই বলছি, বিশ্বাস কর। তবে পার্থক্যও কিছু ছিল বৈকি। বেশভূষাটা পর্যন্ত তোমারই মতো হলেও, তাঁর ছিল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও চোখে কালো কাচের চশমা।
বিশাখার জবানবন্দীটা যেন সকলকে সত্যিই কেমন বিমূঢ় করে দেয়। ম্যাজিক দেখানোর কথাটা আরো দশ-বারোজন নিমন্ত্রিতও সমর্থন করলেন। কিন্তু সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য যে সুসীম ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও জানে না। কারণ ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তার নিমন্ত্রিতদের লিস্টে নাকি আজ ছিল না।
মৃণালও তাই বললে।
আর বিষ্ণু দে—তিনি বললেন, দুর্ঘটনাটা আবিষ্কৃত হবার বোধ হয় মাত্র মিনিট দশ-পনের আগে কি একটা কাজে ঐ হলঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি নাকি ঠিক ঐখানে ঐ সোফার উপরে সুনন্দাকে বসে থাকতে দেখেছিলেন অন্য এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। এবং সেই ভদ্রলোকের চেহারা নাকি বিশাখা বর্ণিত সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতোই ছিল।
অর্থাৎ যতদূর জানা যাচ্ছে ঐ বিষ্ণু দে ভদ্রলোকই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ জীবিত দেখেন যে সময় সুনন্দা তার পার্শ্বে উপবিষ্ট একই সোফায় অনেকটা যাকে প্রায় সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের মতই দেখতে তারই সঙ্গে কথা বলছিল।
সাধন দত্ত প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোকের চেহারাটা আপনার ঠিক মনে পড়ছে, মিঃ দে?
হ্যাঁ, বললাম তো, বিশাখা দেবী এইমাত্র যে চেহারার কথা বললেন সেই ভদ্রলোকের চেহারাটাও ঠিক তেমনি ছিল।
বিস্ময়ের ব্যাপার সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন ব্যক্তির জবানবন্দী থেকে যা দাঁড়াচ্ছে তাতে করে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে যে, বিশাখা দেবী ও অন্যান্য অনেকেরই বিবৃত চেহারার কোন এক ভদ্রলোক ঐ দিন ঐ উৎসবে সুসীমের গৃহে উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু কে সে ভদ্রলোক?
সুসীমবাবু বলছেন, অমন চেহারার কেউই তাঁর গৃহে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন না।
তবে ভদ্রলোকটি কোথা থেকে এলেন আর কোথায়ই বা গেলেন?
তবে কি সে-ই সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যাকারী?
সত্যি সত্যি সে হত্যাকারী হলেও, ব্যাপারটা যেন কেমন দুর্বোধ্য। কারণ সেই লোকই যদি সুনন্দাকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে থাকে তো সুসীমের অপরিচিত হয়েও কোন্ দুঃসাহসে সে এখানে প্রবেশ করেছিল আজ রাত্রে?
আর কেমন করেই বা এত লোকের মাঝখানে, বলতে গেলে এতগুলো লোকের এক রকম চোখের উপরেই সুনন্দাকে হত্যা করে গেল লোকটা?
ইতিমধ্যে রাত্রি শেষ হয়ে এসেছিল। নিমন্ত্রিতরা সকলেই যে যার গৃহে ফিরে গিয়েছেন। সাধন দত্তও মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আপাততঃ সুসীমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে
উঠে আবার বসে পড়ে প্রশ্ন শুরু করলেন।
.
০৪.
সবাই চলে গিয়েছে।
কেবল সুসীম, শ্রাবণী, ভগ্নীপতি হরপ্রসাদ, সুসীমের বোন সুধা উপরের লাইব্রেরী-ঘরে যেন তখনো বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে বসে ছিল।
এ কি অপূর্ব, অকল্পিত বিভ্রাট! হরপ্রসাদ লোকটি যেমন স্থির ধীর, তেমনি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন এবং রীতিমত রসিক প্রকৃতির। সুদীর্ঘকাল দুই পুরুষ ধরে ওঁদের পরিবার পাটনা শহরে আছে। হরপ্রসাদ পাটনা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসাবে প্র্যাকটিস্ করেন এবং একজন নামকরা ব্যারিস্টার। বয়সে দুএক বছরের বড়ই হবেন হরপ্রসাদ সুসীম থেকে। কিন্তু তা হলেও উভয়ের মধ্যে অর্থাৎ হরপ্রসাদ ও সুসীমের মধ্যে একটা রসের এবং মধুর প্রীতির সম্পর্ক বরাবরই ছিল। সুনন্দা যে একসময় দীর্ঘদিন ধরে শ্যালক সুসীমের মনোহারিণী ছিল, ব্যাপারটা হরপ্রসাদের বা তার স্ত্রী সুধার অজানা ছিল না।
তাই মধ্যে মধ্যে সুসীমকে একটু রসিকতার সুরেই বলতেন হরপ্রসাদ, দেখ ভায়া, তোমার বান্ধবীটি যখন তোমার মন হরণ করেছেন তখন যে তিনি সত্যি সত্যিই মনোহারিণী সন্দেহ নেই, কিন্তু কি জান ভায়া—
কি?
ঐ মন হারানো ও মন পাওয়া পর্বের মধ্যে একটা মাধুর্য আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তুমি ব্যাপারটা যেভাবে টেনে টেনে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলছে তাতে করে তোমার ওপরে তাঁর আস্থাটা শেষ পর্যন্ত যদি মিইয়েই যায় তাতে করে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে সুসীম, না, সে ভয় নেই।
নেই তো?
না।
একটু বেশী স্যাংগুইন-ই যেন তুমি বলে মনে হচ্ছে ভায়া!
তা একটু বৈকি। পুনরায় হাসির সঙ্গেই জবাব দিয়েছে সুসীম তার ভগ্নীপতিকে। কিন্তু তারপর হঠাৎ যখন তাঁর বিবাহের আট বছর বাদে হরপ্রসাদ শ্যালকের কাছ থেকে চিঠি পেলেন, সুসীমের বিবাহের দিন স্থির, তিনি যেন অবিলম্বে সুধাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন—তখনো কিন্তু হরপ্রসাদ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে পাত্রী সুনন্দা চ্যাটার্জী নয়, শ্রাবণী চৌধুরী।
যাই হোক, স্ত্রী-সহ হরপ্রসাদ অবিলম্বে মানে বিয়ের সাতদিন আগেই কলকাতায় এসে পৌঁছালেন এবং গাড়ি থেকে নেমেই শ্যালককে কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করলেন, মন-জানাজানির পর্ব তাহলে এতদিনে শেষ হলো ভায়া!
যদিও আলাপ ছিল, তবুও সেভাবে জানবার বা বুঝবার চেষ্টাই করি নি কখনো। আর সময় পেলাম কোথায়?
মানে?
মানে পনের দিন আগে পর্যন্তও তো ব্যাপারটা ভাবতে পারি নি।
ভাবতে পারো নি—সময় পেলে না মানে? বারোটা বছর যে একটা যুগ হে–তোমাদের উভয়ের জানাজানি–
ও, তুমি সুনন্দার কথা বলছে বুঝি? কিন্তু সে তো নয়! হরপ্রসাদকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বলে সুসীম।
বিস্ময়ের যেন সত্যিই অবধি থাকে না হরপ্রসাদের। বলেন, সে কি হে? তুমি কি তবে সুনন্দাকে বিয়ে করছো না?
না।
সত্যি বলছো?
সত্যিই।
হরপ্রসাদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। এবারে সোফাটায় বসে পড়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও-তুমি যে ভায়া সত্যি-সত্যিই আমাকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছ! রসিকতা করছে না তো?
রসিকতা কেন হবে! হাসতে হাসতে সুসীম বলে, বিয়ে করছি আমি অন্য একটি মেয়েকে-শ্রাবণী চৌধুরী তার নাম।
ও। তা–তাহলে সুনন্দা–
পূর্ববৎ হাসতে হাসতেই সুসীম বলেছিল, সুনন্দা নামটা শুনেই তো বোঝা উচিত ছিল হরপ্রসাদ—সে হচ্ছে দশের নন্দিতা! কোন ব্যক্তিবিশেষের নন্দিতা হতে সে রাজী হবে কেন?
বল কি!
তাই।
কিন্তু–
না হে, তা ছাড়া—
তা ছাড়া?
প্রেম আর বিয়ে ও দুটো বস্তু তো এক নয় হে। একটা হচ্ছে সযতনে ব্যবহার করবার মতো পোশাকী দামী সিফন শাড়ী, অন্যটা আটপৌরে শাড়ি—একান্ত সাংসারিক ঘরোয়া ব্যাপার।
কিন্তু তাহলে তোমার ও সুনন্দার মধ্যে এতদিনকার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! একেবারে ছাড়াছাড়ি নয় তো?
ছাড়াছাড়ি হবে কেন?
তাই তো ভায়া, ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে!
গোলমেলে কেন হতে যাবে?
হ্যাঁ, গোলমালের বৈকি—
না, গোলমেলে কিছু নেই।
বলছো?
হুঁ।
কিন্তু শ্রাবণীকে কি ব্যাপারটা বলেছো?
বলবার প্রয়োজন হয় নি–
প্রয়োজন হয় নি!
না। সে জানে।
জানে মানে?
একটু আগেই তো বললাম, সেও অপরিচিতা ছিল না। সুনন্দার কথা সে সবই জানত।
.
এ কথাটাও পরে শুনেছিলেন হরপ্রসাদ, সুসীম শেষ পর্যন্ত সুনন্দাকে তার বিবাহে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত করে নি।
তাই সেই সুনন্দা যখন বৌভাতের দিন সেজেগুজে এসে হাজির হলো উৎসব-বাড়িতে, হরপ্রসাদ একটু অবাকই হয়েছিলেন। তারপর সুসীম সুনন্দাকে যেভাবে রিসিভ করেছিল— যেন বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েই সে এসেছে, ব্যাপারটা হরপ্রসাদকে যেন আরো একটু বেশী অবাক করে।
।আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে হরপ্রসাদ কথাটা সুসীমকে না শুধিয়ে পারেন নি, তবে যে বলেছিলে ভায়া সুনন্দাকে তুমি নিমন্ত্রণ জানাও মি!
মৃদু হেসে সুসীম বলেছিল, কাল রাত্রে নিমন্ত্রণ করেছিলাম–
সত্যি?
সত্যি।
হরপ্রসাদ অতঃপর চুপ করেই গিয়েছিলেন।
কিন্তু সুসীমের বোন সুধা সুনন্দাকে আসতে দেখে খুশী হয় নি। আসলে একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতাটা কোনদিনই প্রীতির চোখে দেখে নি সুধা। কি জানি কেন, সুনন্দাকে আদপেই যেন তার ভাল লাগতো না কোনদিন। সুনন্দার চালচলন বেশভূষা প্রসাধন কথাবার্তা কোনটাই সুধার কোনদিন ভাল লাগে নি।
সুনন্দার সঙ্গে সুধারও আলাপ-পরিচয় ছিল, যেহেতু সুধাও একসময় সুনন্দার সহপাঠিনী ছিল। এবং অতীতে সেই সূত্রেই সুসীমদের বাড়িতে সুনন্দার যাতায়াত শুরু হয়েছিল। সেই সময়ই সুসীমের আলাপ প্রথম সুনন্দার সঙ্গে। এবং ক্রমশ শ্রাবণী, বিশাখা চৌধুরী প্রভৃতির সঙ্গেও তখনই আলাপ হয়।
সুধার তারপর অবিশ্যি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সে স্বামীর ঘর করতে চলে যায় পাটনা।
প্রথম যেদিন সুধা লক্ষ্য করেছিল, সুনন্দা তাদের গৃহে তার কাছে এলেও তার আকর্ষণটার মূল হচ্ছে সুসীম এবং সুধাদের বাড়িতে এলে বেশীর ভাগ সময় সে সুসীমের ঘরে তার বন্ধুদের সঙ্গেই কাটায়, তখন থেকেই সুধার যেন কেমন ব্যাপারটা ভাল লাগত না।
মুখে কিছু না বললেও, সেই থেকেই সে সুনন্দাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এবং ক্রমশ তার মনে যেন সুনন্দার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জমে উঠতে থাকে।
তবে কোনদিনই সে সুনন্দা সম্পর্কে কোন অসন্তোষ প্রকাশ করে নি। কারণ সে জানতো সুসীমের সঙ্গে সুনন্দার একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিয়ের ব্যাপারে তাই সে আসতেও চায় নি প্রথমটায়। কিন্তু হরপ্রসাদ বলেছিলেন স্ত্রীকে, ছিঃ সুধা, এ সময় তোমার মনে যাই থাক না কেন, না যাওয়াটা হবে একটা অমার্জনীয় অপরাধ। তা ছাড়া সে যখন পছন্দ করে বিয়ে করছে, তখন তোমার আমার কি বলবার থাকতে পারে!
একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই আসতে হয়েছিল সুধাকে। কিন্তু এসে যখন শুনলে সুনন্দা নয়—অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সুসীমের বিয়ে হচ্ছে, তখন সুধা সত্যিই খুশী হয়েছিল। ভারী মনটা তার হালকা হয়ে গিয়েছিল। নতুন উৎসাহে সে বিয়ের ব্যাপারে কোমর বেঁধেছিল।
কিন্তু বৌভাতের উৎসবে সুনন্দাকে আসতে দেখে আবার সুধা যেন একটু ক্ষুন্নই হয়েছিল, যদিও সে জানতো না শেষ পর্যন্ত কেন সুসীম সুনন্দাকে না বিয়ে করে শ্রাবণীকে বিয়ে করলো!
সুনন্দা নিহত হওয়ায় হরপ্রসাদ ও সুধা এই কথাগুলি ভাবছিল।
হরপ্রসাদ ও সুধা দুজনের মনের মধ্যেই নানা প্রশ্ন উদিত হতে থাকে, কিন্তু কেউই সুসীমকে মুখ ফুটে কোন প্রশ্ন করতে পারে না।
সুধা কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারে না, ঘরের পাষাণ-স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কতকটা যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করবার মতো কথাটা উচ্চারণ করে, কিন্তু কে হত্যা করলো ওকে অমন করে?
সুধার কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সহসা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে চম্কে সুধার মুখের দিকে তাকালো।
কে!
সুধার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত কথাগুলোর মধ্যে কে নিষ্ঠুর এই শব্দটা যেন একটা বিষাক্ত ছুঁচের মতো সকলের চেতনাকে বিদ্ধ করে।
সুসীম ভাবে কে, হরপ্রসাদ ভাবে কে, সুধা ভাবছে কে, শ্রাবণীও ভাবে কে?
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত অতিবাহিত হবার পর হরপ্রসাদ কথা বলেন, তার চাইতেও বড় কথা, এই বাড়িতেই বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটলো!
সুধা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তার জন্য কি আমরা দায়ী?
দায়ী—আমরা দায়ী কেমন করে? অসহায় কণ্ঠে কথাটা বলে সুসীম সকলের মুখের দিকে তাকায়।
মনে হলো সত্যিই যেন সুসীম একটা অবলম্বন খুঁজছে।
দায়ী আমরা নিশ্চয়ই হয়তো নয়—হরপ্রসাদ বলেন।
হয়তো মানে! কি কি আপনি বলতে চান হরপ্রসাদবাবু? শ্রাবণী প্রশ্নটা করে।
ণা না—তাই তো বলছিলাম। আমরা—আমরা দায়ী হবো কেন? কিন্তু পুলিস—
হরপ্রসাদের কথাটা শেষ হলো না, সুধা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, পুলিস কি?
এ বাড়িতে ব্যাপারটা যখন ঘটেছে, তখন আমাদের তারা—মানে ঐ পুলিস খুব সহজে নিষ্কৃতি দেবে কি?
নিষ্কৃতি দেবে না মানে! এ কি জুলুম নাকি? সুধা যেন তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে।
জুলুমের কথা নয় সুধা, কথাটা হচ্ছে আইনের। অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে যেন কথাটার প্রত্যুত্তর দিলেন হরপ্রসাদ।
আইন!
হ্যাঁ, আইন, আইনই জুলুম করবে।
রেখে দাও তোমার আইন, জুলুম করলেই অমনি হলো! প্রতিবাদ জানায় সুধা পুনরায় তীক্ষ্ণকণ্ঠে।
এবারে আর হরপ্রসাদ কোন জবাব দিলেন না। মৃদু হাসলেন মাত্র।
.
০৫.
সুনন্দা চ্যাটার্জীর নিহত হওয়ার ব্যাপারটা আর যার মনেই যেটুকু রেখাপাত করুক বা না করুক—স্বামী-স্ত্রী সুসীম ও শ্রাবণীর মনের মধ্যে কিন্তু কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম চিড় ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আনন্দের আকাশে কোথায় যেন একটা কালির বিন্দুর মত মেঘ দেখা দিল। বিবাহের পূর্বে শ্রাবণীর সঙ্গে সুসীমের যে পরিচয়টা ছিল, তার মধ্যে আর যাই হোক ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় সেরকম সত্যই কিছু ছিল না সুসীমের দিক থেকে।
কিন্তু সুসীম যেটা কোনদিনই বুঝতে পারে নি বা বুঝবার কোন অবকাশ পায় নি সেটা হচ্ছে শ্রাবণীর একটা দুর্বলতা ছিল তার প্রতি।
আর শ্রাবণীও সেটা কোনদিন সুসীমকে বুঝতে দেয় নি।
কারণ সুনন্দার প্রতি সুসীমের মনোভাবটা শ্রাবণীর অজ্ঞাত ছিল না।
সেদিন মাত্র দিন-পনের আগে হঠাৎ যখন সুসীম গিয়ে শ্রাবণীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব করেছিল, তখন শ্রাবণী একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। কয়েকটা মুহূর্ত সে জবাব দিতেও পারে নি।
আমি বুঝতে পারছি প্রস্তাবটা তোমার কাছে খুবই আকস্মিক মনে হচ্ছে শ্রাবণী, তাই এখুনি এই মুহূর্তেই কোন জবাব তোমার কাছে আমি চাই না। তুমি বরং ভেবে দেখো—কালপরশু না-হয় আবার আমি আসব!
যাবার জন্য সুসীম পা বাড়ায়।
শোন!
হঠাৎ সেই সময় শ্রাবণী ডাকে।
একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কি?
আমার কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু কারোরই তো এতদিন জানতে বাকী ছিল না যে তুমি সুনন্দাকেই বিয়ে করবে!
প্রত্যুত্তরে হাসে সুসীম।
হাসছো যে?
কথাটা এতদিন লোকে জানত বটে, মিথ্যাও তুমি বল নি, কিন্তু—
থামলে কেন, বল?
ভুল বোঝা বলে মানুষের একটা ব্যাপারও তো থাকতে পারে!
ভুল?
হ্যাঁ, সবটাই হয়তো একটা ভুলের ওপরই এতদিন দাঁড়িয়ে ছিল—
এই বারো বছর ধরে ভুল?
সারাজীবনেও তো মানুষের কোন কোন ভুল শোধরায় না–তা এ তো বারোটা বছর!
তবু একটু বেশী সময়ই নয় কি?
তাই তো তোমাকে সময় দিয়ে যাচ্ছি। জবাব তো আজই এই মুহূর্তেই আমি চাইছি না।
শ্রাবণী অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কোন কথাই বলে না। সুসীমও চুপ করেই থাকে।
তারপর শ্রাবণী এক সময় বলে, এ রকমটা যে একদিন হবে আমি তা জানতাম।
তুমি জানতে! বিস্ময়ে তাকায় সুসীম শ্রাবণীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, জানতাম। আর তুমি চোখ বুজে না থাকলে এতদিনে সেটা জানতে পারতে।
কি কি জানতে পারতাম?
জানতে পারতে সে তোমাকে সত্যিই ভালবাসে না। শুধু তোমাকেই বা বলি কেন, কোন পুরুষকে ভালবাসার মতো নারীমনই ওর নেই।
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, নারীর যে মন পুরুষকে ভালবাসে, সে মনই যে ওর নারী হয়েও নেই। যাক সে কথা, আমার কথা আমি বলছি না, তুমি বরং আরো কিছুদিন ভেবে দেখ।
ভেবেই আমি তোমার কাছে আজ এসেছিলাম শ্রাবণী।
সত্যি বলছো?
হ্যাঁ।
বেশ, তাহলে তুমি ব্যবস্থা করতে পারো।
আনন্দে সুসীম শ্রাবণীর একটা হাত ধরে ফেলে বলে, সত্যি–সত্যি শ্রাবণী!
সত্যি।
আঃ! তুমি-তুমি আমাকে বাঁচালে। কি নিশ্চিন্ত যে তুমি আমাকে করলে। কিন্তু একটা কথা শ্রাবণী–
বল?
আজ-কালের মধ্যেই কিন্তু চাকরিতে তোমাকে তাহলে ইস্তফা দিতে হবে—
না।
সে কি! বিয়ের পরেও চাকরি করবে?
না, বিয়ের পরে আর করবো না। তবে রেজিগনেশান দেবো বিয়ের পর–এখন নয়।
কি ভেবে এবারে সুসীম বলে, বেশ।
আর একটা কথা—
কি?
বিয়েটা কিন্তু আমাদের রেজিস্ট্রী করে হবে, রাজী তো?
বেশ। আমার আপত্তি নেই।
.
ঘটনাচক্রে মধুরাত্রি ওদের যাপন করা হয়ই নি।
তাই সুধা পরের দিন রাত্রে নতুন উৎসাহে আবার ঘর সাজিয়েছিল। এবং স্বামীকে বলে এক রাত্রির জন্য এমন কি সানাইয়ের পর্যন্ত ব্যবস্থা করেছিল। সুসীম অনেক বাধা দিয়েছিল, কিন্তু কান দেয় নি তার কথায় সুধা। রাত্রে নিজের হাতে শ্রাবণীকে সাজিয়ে পাঠিয়েছিল সেই ঘরে।
সুসীম ঘরের কোণে একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে ছিল। শ্রাবণী এসে ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শ্রাবণী স্বামীর সঙ্গে কোন কথাই বললো না। ঘরের সংলগ্ন যে ব্যালকনি ছিল সেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
সারাদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখাও হয় নি—কথাও হয় নি।
শ্রাবণী ঘরে ঢুকেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতে সুসীম যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে যায়। অতঃপর কিছুক্ষণ সে ঘরের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর কি ভেবে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকেই অগ্রসর হয়।
অন্ধকারে শ্রাবণী ব্যালকনির রেলিং ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাইরে সানাই তখনো বাজছে।
সুসীম এসে পিছনে দাঁড়াতেও কিন্তু শ্রাবণী ফিরে তাকাল না বা কোন কথা বললো না। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সুসীম। কিন্তু শ্রাবণী যখন সাড়া দিলই না, তখন মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শ্রাবণী!
শ্রাবণী নিরুত্তর।
সুসীম আবার ডাকল, শ্রাবণী!
তথাপি শ্রাবণী কোন সাড়া দেয় না।
সাড়া দিচ্ছ না কেন শ্রাবণী? তুমি কি কথা বলবে না?
আমি কিছুদিনের জন্য শিলং যেতে চাই—এবং কালই যেতে চাই।
মৃদুকণ্ঠে শ্রাবণী এবারে কথাগুলো বলে।
শিলং!
হ্যাঁ।
ও। তা কালই তুমি যেতে চাও!
হ্যাঁ, এখানে—এ বাড়িতে যেন এক মুহূর্তও আর আমি টিকতে পারছি না।
বেশ। কিন্তু সেখানে—
সেখানে ছোট মাসী আছে আমার, কিছুদিন সেখানে গিয়ে আমি থাকবো।
বেশ। তবে আমি ভাবছিলাম, আমাদের কথা হয়েছিল বিয়ের পর মাসখানেক আমরা মুসৌরী গিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবো–
না না–ওসব এখন থাক!
বেশ তাই হবে, কিন্তু একটা কথা—
কি?
সত্যিই যদি আমাকে কিছু তোমার বলবার থাকে তো বলতে পার।
বলবার! তোমাকে?
হ্যাঁ।
মুহূর্তকাল নিঃশব্দে অন্ধকারে যেন স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে রইলো শ্রাবণী।
তারপর বললো, কিছু বলবার নেই আজ আর তোমাকে–কিছু বলবার আর নেই—
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, বলবার যা সেদিনই তো আমি বলেছিলাম তোমাকে, যেদিন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গিয়ে তুমি দাঁড়িয়েছিলে। কিন্তু কেন—কেন সেদিন সত্য কথাটা গোপন করেছিলে বলতে পার?
সত্য কথা গোপন করেছি!
করো নি? সুনন্দাকে যে তুমি ভুলতে পারো নি, কোনদিন পারো না—কথাটা কেন গোপন করেছিলে আমার কাছে সেদিন?
শ্রাবণী, শোন—
কি আর শুনবো—কি আর তুমি বলবে? কিন্তু কেন এমনটা করলে তুমি আমার সঙ্গে? আমি তো কোনদিন তোমার কোন ক্ষতি করি নি, তবে তুমি আমার এতবড় ক্ষতিটা কেন করলে?
শ্রাবণী, বিশ্বাস করো, কোন ক্ষতি তোমার আমি করি নি—
এখনো তাই বলবে?
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো—
বিশ্বাস! আচ্ছা বলতে পারো, সুনন্দাকে যে শেষ পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করেছিলে—কথাটা কেন আমার কাছে গোপন করেছিলে?
বলতাম নিশ্চয়ই, কিন্তু বলবার সময় পেলাম কোথায়?
বলবার সময় পাও নি, না? কিন্তু পরশু রাত্রে সুনন্দার সঙ্গে ফোনে কথা বলবার পর যখন সুধার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল তাকেও তো কথাটা বলো নি! জামাইবাবুকেও বলল নি! ইচ্ছা করেই তুমি বলো নি! কিন্তু–
কি বল, থামলে কেন?
না থাক, ভুল যখন আমারই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্তও করতে তো হবে আমাকেই। তুমি শুধু কাল আমার শিলং যাবার ব্যবস্থা করে দাও।
কিন্তু ভেবে দেখ একটু শ্রাবণী, কালই যদি তুমি শিলং চলে যাও, ব্যাপারটা কি সকলের চোখেই বিশ্রী ঠেকবে না?
বিশ্রী ঠেকুক আর না-ই ঠেকুক, আমি যাবোই।
যেও তুমি, আমি বাধা দেব না। তবে জামাইবাবু আর সুধা চলে যাক, তারপর যেও। শুধু আমার এই অনুরোধটুকু তুমি রাখো শ্রাবণী। এখন শোবে চল
না, তুমি যাও।
শুতে যাবে না?
না।
সুসীম আর অনুরোধ জানাল না। ঘরের মধ্যে চলে গেল।
আর শ্রাবণী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো অন্ধকারে।
০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ
তিনদিন পরে।
বিচিত্র একটা সংবাদ যেন সুসীমকে একেবারে বিমুঢ় করে দেয়।
সকালের দিকে সুসীম নীচে তার বসবার ঘরে একটা চেয়ারে বসে সেদিনকার দৈনিকটার উপর চোখ বুলাচ্ছিল, এমন সময় থানা-অফিসার সাধন দত্ত এসে ঘরে ঢুকলেন।
বসুন, মিঃ দত্ত! কোন খবর আছে নাকি?
আছে।
কি?
একটা বিশেষ ব্যাপারে আলোকসম্পাতের জন্যে আপনার কাছে আসতে হলো আমাকে সুসীমবাবু! সাধন দত্ত বললেন।
কি বলুন তো?
দুদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে যা জানতে পারলাম—
কি?
সুনন্দা দেবীর সঙ্গে গত বারো বছর ধরে তিনজন খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আপনারা–
তিনজন!
হ্যাঁ, প্রথম হচ্ছেন আপনি—
আমি? হ্যাঁ, তা আমি—মানে আমার সঙ্গে সুনন্দার—
কথাগুলো যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায় সুসীমের।
সাধন দত্ত বলেন, হ্যাঁ আপনি, ডাঃ মৃণাল সেন আর—
কিন্তু–
শুনুন, আরো একজন ছিল—
কে?
নীরেন সেন।
বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে যায় সুসীম, সাধন দত্তর মুখ থেকে নামটা উচ্চারিত হতেই।
.
সে, মৃণাল ও নীরেন একই বছরে বি. এস-সি. পাস করে। একই কলেজে পড়েছে তারা। তারপর মৃণাল গিয়ে ভর্তি হলো কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে। সে এক বছর এম. এসসি পড়ে পড়া ছেড়ে বাপের কোলিয়ারীর বিজনেস দেখাশোনা করতে শুরু করে। কারণ হঠাৎ সেই সময় তার বাপের মৃত্যু হয়।
আর বর্ষায় এক ধনী টিম্বার-মার্চেন্ট কাকা ছিলেন নীরেনের—তার কাছেই সে চলে যায় ভাগ্যান্বেষণে ঐ সময়ই। সেও আজ প্রায় দশ বছর হতে চললো বৈকি। মনে পড়ে সুসীমের, গত দশ বছরে অবশ্য অনেকবার এসেছে নীরেন কলকাতায় এবং কখনো এক মাস, কখনো বা দুমাস থেকে গিয়েছে।
সেই নীরেনের সঙ্গে যে সুনন্দার কোন দিন কোন সূত্রে আলাপ ছিল, স্বপ্নেও তা জানতে পারে নি সুসীম। আর সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের যদি আলাপই ছিল তো সেকথা কোন দিন তাদের ঘুণাক্ষরে জানতেই বা দেয় নি কেন সে? ব্যাপারটা রীতিমতো বিস্ময়েরই।
এ আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত, নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার পরিচয় ছিল? কথাটা শেষ পর্যন্ত সুসীম না বলে পারে না।
মৃদু রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে সুসীমের দিকে তাকিয়ে সাধন দত্ত বললেন, কেন, আপনি তো উভয়েরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি ব্যাপারটা জানতেন না বলতে চান?
বিশ্বাস হয়তো করবেন না আপনি, তবে ব্যাপারটা আমি জানতাম না সত্যিই। আর মৃণালও যে জানে না, তাও আমি জোর করে বলতে পারি।
আপনার এখানে আসার আগে আমি ডাঃ সেনের ওখান হয়েই এসেছি। তিনিও আপনার মতই বললেন, তিনিও জানতেন না কিছু। তাতেই কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে একটু দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে–
কিন্তু কথাটা আপনি জানলেন কি করে?
কতকগুলো চিঠি দেখে।
চিঠি!
হ্যাঁ। চিঠিগুলো গতকাল সুনন্দা দেবীর তিলজলার বাড়ির শোবার ঘর সার্চ করতে গিয়ে পেয়েছি। চিঠিগুলো অবিশ্যি সবই প্রেমপত্র বলা চলতে পারে।
প্রেমপত্র!
হ্যাঁ। চিঠিগুলো লিখেছেন ডাঃ সেন, আপনি ও নীরেনবাবু। তবে বেশীর ভাগ চিঠিই নীরেনবাবুর লেখা।
নীরেনের লেখা!
হ্যাঁ, বর্মার পোম থেকে লেখা চিঠি। আর সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের সবার চিঠিগুলো পড়ে নীরেনবাবুর চিঠিগুলোর মধ্যেই যেন বেশী ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত পেয়েছি।
চিঠিগুলো দেখতে পারি?
একজিবিট হিসাবে চিঠিগুলো আপাততঃ থানায় রয়েছে। মামলার সময় দেখতে পাবেন বৈকি, অবশ্য দেখতে চাইলে! কিন্তু যেজন্যে আমি বিশেষ করে এসেছি সেটা হচ্ছে, সুনন্দা চ্যাটার্জী যেদিন নিহত হয় তার ঠিক আগের দিনই কোন এক সময় সুনন্দা চ্যাটার্জীকে নীরেনবাবু একটা চিঠি লেখেন–
কি চিঠি?
সে চিঠিটার কপি আমার কাছে আছে। বলে পকেট থেকে একটা লেখা কাগজ বের করে সুসীমের হাতে তুলে দিলেন সাধন দত্ত।—দেখুন!
সংক্ষিপ্ত চিঠি।
সোনা,
কালকের ব্যাপারের জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বিশ্বাস কর, আমি ছাড়া তুমি এ দুনিয়ার আর কারো হবে এ আমার পক্ষে ভাবাও দুঃসাধ্য। আমি টেম্পার লুজ করেছিলাম একমাত্র সেই কারণেই। যাই হোক, তুমি যখন চেয়েছে তখন সেটা নিশ্চয়ই আমি ফিরিয়ে দেবো। কাল তো তুমি সুসীমের ওখানে আসছেই, কালই সেখানে দিয়ে দেবো। তোমার বাড়িতে গিয়েই দিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু তা পিরবো না—কারণ তোমার বাড়ির দরজায় আর কখনো এ জীবনে আমি পা দেবো না, আর আমার বাড়ির দরজাও তোমাকে মাড়াতে দেবো না।
ইতি তোমার—নী
চিঠিটা পড়তে পড়তে সুসীমের মনের মধ্যে একটা কথা উঁকি দেয়, তবে কি সেই কারণেই যেচে নিজে আমন্ত্রণ নিয়ে সুনন্দা তার বৌভাতের উৎসবে এসেছিল?
কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুসীম।
মিঃ নাগ!
যা! সাধন দত্তর ডাকে চমকে সুসীম তার দিকে তাকালো। চিঠিটা আপনার বন্ধু নীরেনবাবুর হাতের লেখা কিনা সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে তার অন্যান্য চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে আমার তো ধারণা হয়েছে, একই হাতের লেখা—যদিচ হুবহু একেবারে মেলে নি। কিন্তু হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিল হোক বা না-ই হোক, এ চিঠি যে নীরেনবাবুরই লেখা তার অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমি অন্যভাবেও পেয়েছি।
কি প্রমাণ?
প্রমাণ পেয়েছি, যেদিন চিঠিটা লেখেন নীরেনবাবু তার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি সুনন্দা চ্যাটার্জীর বাড়িতে গিয়েছিলেন।
তাতে কি হলো?
শুনুন, এখনো সব কথা শেষ হয় নি আমার। সেদিন দুজনার মধ্যে কোন কারণে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়, মিস্ চ্যাটার্জীর ঝি মনোরমা শুনেছে—
ঝগড়া হয়েছিল?
হ্যাঁ, আর সেই সময় ঝগড়া করে বের হয়ে আসবার মুখে নাকি নীরেনবাবু তাকে শাসিয়ে এসেছিলেন, সুনন্দা দেবীকে তিনি হত্যা করবেন!
সত্যি–সত্যি বলছেন?
সত্যিই বলছি—মনোরমা বলেছে।
হঠাৎ ঐ সময় সাধন দত্তর শেষ কথাটা যেন একটা অন্য উপলব্ধি জাগায় সুসীমের মনে। সে চমকে ওঠে এবং ব্যগ্রকণ্ঠে শুধায়, হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং এট মিঃ দত্ত!
এখনো বুঝতে পারছেন না? নীরেনবাবুই হত্যা করেছেন সেরাত্রে মিস চ্যাটার্জীকে!
না—দ্যাট কাণ্ট বি! ইপসিবল! ফ্যানাটিক!
না, ইপসিবল বা ফ্যানাটিক নয় সুসীমবাবু। গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে রুমালটা সুসীমের সামনে মেলে ধরেন সাধন দত্ত, আরো প্রমাণ আছে—এই রুমালটা দেখুন, এই রুমালের কোণে সুতো দিয়ে লেখা N অর্থাৎ নীরেনের আদ্যাক্ষর–
কিন্তু—
এই রুমালটা আমি কোথায় পেয়েছি জানেন?
কোথায়?
সেরাত্রে আপনারই এই বাড়িতে। যে হলঘরে মিস্ চ্যাটার্জী নিহত হন, সেই হলঘরেরই সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে। আর–
আর?
রুমালটার মধ্যে ক্লোরোফরমের গন্ধ ছিল!
না না—এসব আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত! আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে যেন কথাগুলো বলতে গিয়ে সুসীম ভেঙে পড়ে।
যা বলছি, মিথ্যা একটি বর্ণও তার মধ্যে নেই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সেক্ষেত্রে নীরেনবাবুই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন।
কি বলছেন আপনি? তাহলে কি আপনি নীরেনকে অ্যারেস্ট করছেন?
আপনি যদি আমি হতেন, তাই কি করতেন না! আচ্ছা আমি তাহলে আজকে উঠবো।
সাধন দত্ত উঠে দাঁড়ান।
মিঃ দত্ত!
সাধন দত্ত যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, সুসীমের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
আপনি কি সত্যিই তাহলে বিশ্বাস করেন যে নীরেনই সুনন্দাকে হত্যা করেছে?
প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলেন সাধন দত্ত শুধু।
কিন্তু–কিন্তু আপনার ভুলও তো হতে পারে মিঃ দত্ত!
ভুল?
হ্যাঁ–
না, ভুল আমার হয় নি। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন সাধন দত্ত।
.
০৭.
কি যেন সেই কবিতাটা?
কিরীটীর প্রশ্নে কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার মুখের দিকে, কবিতা!
হ্যাঁ, সেই যে—
In the same hour and hall
The fingers of a hand
Came forth against the wall,
And wrote as if on sand :
The fingers of a man;–
A solitary hand.
এ যেন ঠিক সেই ব্যালসেজারস্ ফিস্টের সলিটারি হ্যাণ্ডের মতোই সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুলিপি লেখা হয়ে গেল!
কথাগুলো বলে কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে লাগলো।
মৃণাল সেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে।
নীরেনের গ্রেপ্তারের সংবাদটা সে জানতো না। সুসীম টেলিফোনে তাকে জানিয়েছিল এবং সেই সঙ্গে জানিয়েছিল নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতার কথা, যদিচ সে আগেই কথাটা সাধন দত্তর মুখে শুনেছিল। সংবাদটা শুনে অবধি মৃণালও কম আশ্চর্য হয় নি। কারণ সেও সুসীমের মতোই প্রথম শুনলো যে সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা ছিল!
নীরেন তাদের উভয়েরই বন্ধু, অথচ তারা এতদিন ঘুণাক্ষরেও দুজনের একজনও জানতে পারেনি যে সুনন্দার সঙ্গে তার এতটা ঘনিষ্ঠতা কখন কি ভাবে গড়ে উঠেছিল। ব্যাপারটা জানবার পর মৃণালের যেটা স্বভাবতই মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, নীরেন তাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা গোপন করেছে।
কিন্তু কেন? ব্যাপারটা তাদের কাছে গোপন করবার মতো কি এমন কারণ থাকতে পারে নীরেনের?
সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা যদি তারা জানতই, তাতে এমন কি এসে যেত! বিশেষ করে তাদের দুজনেরই সঙ্গে যখন সুনন্দার পরিচয় ছিল!
সে কি ভেবেছিল, সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানতে পারলে তারা খুশি হবে না? এই পর্যন্ত চিন্তা করেই মৃণাল নিজের কাছেই নিজে কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
নীরেনকে সামনাসামনি পেলে হয়তো মৃণাল তাকে কথাটা স্পষ্টাস্পষ্টিই জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু সে অবকাশ সে পায় নি। তার কারণ সংবাদটা যখন সে সুসীমের কাছ থেকে জানতে। পারলো, তার আগেই নীরেনকে সাধন দত্ত গ্রেপ্তার করেছেন।
নাগালের বাইরে সে—হাজতে।
তবু চেষ্টা করেছিল মৃণাল সাধন দত্তর সঙ্গে দেখা করে নীরেনের সঙ্গে হাজতে দেখা করবার একটা অনুমতি পাওয়ার।
কিন্তু সাধন দত্ত রাজী হন নি।
অথচ সাধন দত্তর যুক্তি যাই হোক না কেন এবং সুনন্দাকে যে নীরেনই হত্যা করেছে সেসম্পর্কে যতই তিনি স্থিরনিশ্চিত হোন না কেন, মৃণাল কোনমতেই যেন মন থেকে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি—সাধন দত্তর যুক্তিটাকে গ্রহণ করতে পারে নি।
তা ছাড়া বন্ধু হিসাবেও নীরেনের এই দুর্দিনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো তার কর্তব্য। এই কথাটা ভেবে মৃণাল যখন কোন দিক দিয়ে কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন হঠাৎ তার কিরীটীর কথা মনে পড়ে যায়।
কিরীটী রায়! একসময় তার সঙ্গে মৃণালের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লোকটার। সে হয়তো তাকে এ সময় কোন একটা পথ দেখিয়ে দিতে পারে। শুধু কি পথ, কিরীটীর কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা কথা মৃণালের মনে হয়, নীরেনের এই দুর্দিনে তাকে একমাত্র হয়ত ঐ কিরীটী রায়ই সাহায্য করতে পারে।
পুলিসের অসাধ্য কিছুই নেই।
একবার যখন তারা নীরেনকে সুনন্দার হত্যা-ব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে, তখন সহজে তারা তাকে নিষ্কৃতি দেবে না।
বরং আপ্রাণ চেষ্টাই করবে তাকেই হত্যাকারী প্রমাণিত করতে।
আর তারা নীরেনের বন্ধু হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবে!
না, তা উচিত নয়—কর্তব্যও নয়।
০
পরের দিনই সকালের দিকে মৃণাল কিরীটীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো।
কি ব্যাপার ডাক্তার? কিরীটী শুধায়।
বিশ্রী একটা বিপদে পড়ে এসেছি তোমার শরণাপন্ন হয়ে।
কি হলো?
সংক্ষেপে ঘটনা বিবৃত করে মৃণাল তখন।
কিরীটী সমস্ত ব্যাপারটা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর এক সময় সোফা থেকে উঠে পায়চারি শুরু করে।
.
০৮.
সাধন দত্ত যাই বলুন না কেন কিরীটী, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না নীরেন সুনন্দাকে সেরাত্রে হত্যা করেছে!
কিন্তু তোমার বন্ধুর বিরুদ্ধে যে প্রমাণগুলো সাধন দত্ত হস্তগত করেছেন একটু আগেই তুমি বললে, সেগুলো তো একেবারে কিছু নয় বলে অস্বীকার করতে পারা যাচ্ছে না ডাক্তার–
কি এমন প্রমাণ? সেই চিঠি আর সুসীমের ঘরের বাথরুম থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক কোণে লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তো! কিন্তু ঐ এন লেখা রুমালটা যে নীরেনেরই, তার প্রমাণ কি? সুসীমের বাড়িতে সেদিন নিমন্ত্রিত বহু লোকের সমাগম হয়েছিল, তাদের অনেকের নামেরই আদ্যাক্ষর খুঁজলে দেখা যাবে হয়ত এন!
শান্তকণ্ঠে কিরীটী পূর্ববৎ পায়চারি করতে করতেই বাধা দিয়ে বলে, তোমার যুক্তির যে সারবত্তা নেই তাও আমি বলছি না ডাক্তার–
তবে?
তুমি যেমন বলছে সেই লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর না হয়ে অন্য যাঁরা সে রাত্রে ওখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরও কারো হতে পারে, তেমনি অবিসংবাদিভাবে যে এটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর নয় তারও কোন অকাট্য প্রমাণ তো তুমি দিতে পারছে না ডাক্তার!
না, তা পারছি না—তবে সে তো নীরেনকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যেতে পারে!
এ যে ছেলেমানুষের মত কথা বলছো!
মানে? ধর যদি নীরেনবাবু সত্যি কথা না বলেন—
বাঃ, কেন সে মিথ্যে না বলতে যাবে?
কেন যাবে, তাই না? যাবে, হয়ত কোন স্বার্থ থাকলে–
না, না—সত্যি বলছি কিঃটিী, নীরেন তাকে কিছুতেই হত্যা করতে পারে না—
আহা, সে তো পরের কথা! আপাততঃ রুমালটার কথাটাই ভাবা যাক না!
রুমালটার কথা আবার কি ভাববো?
কেন, তুমিই তো একটু আগে বললে, সাধনবাবু বলেছেন, রুমালটায় ক্লোরোফর্মের গন্ধ ছিল।
তা তো ছিল। কিন্তু–
কথা হচ্ছে, তাহলে কি ভাবে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করা হয়েছে? ক্লোরোফর্ম দেবার পরে ফাঁস লাগিয়ে, না ক্লোরোফর্মের সাহায্য হত্যাকারী আদপেই নেয় নি? কেবলমাত্র কোন ব্যক্তিবিশেষের ওপর সুনন্দা দেবীর হত্যার সন্দেহটা আরোপ করবার জন্য ক্লোরোফর্ম মাখিয়ে হত্যাকারী ঐ রুমালটি বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়েছিল–
মৃণালের মনে হয়, লোকটা কি আবোল-তাবোল বকছে! কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না।
কিন্তু যাক সে কথা, একটা কথার জবাব দিতে পারো ডাক্তার?
কি?
তোমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও নীরেনবাবু সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা তোমাদের দুবন্ধুর কাউকেই কেন এতদিন জানতে দেয় নি?
বললাম তো একটু আগে, ব্যাপারটা আমাদেরও কম আশ্চর্য, অভিভূত করে নি! কেন যে সে কথাটা গোপন করেছিল–
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে—
কি?
তুমি ও সুসীমবাবু দুজনেই সুনন্দা দেবীকে ভালবাসতে—তাই তোমাদের বন্ধু হলেও সুনন্দার ব্যাপারটা তিনি তোমাদের কাছ থেকে গোপন করে গিয়েছেন?
মৃণাল চুপ করে থাকে।
জান তো, ভালবাসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বন্ধুত্বের কোন মূল্য নেই! তা ছাড়া আরো একটা কথা–
কি?
সুনন্দা দেবীকে লেখা সেই অদ্ভুত চিঠিটা! বিশেষ করে সাধন দত্ত যখন জোর গলায় বলছেন, সে চিঠি নীরেবাবুরই হাতের লেখা!
হ্যাঁ বলেছেন বটে, তবে—
উঁহু, বেশ জটিল—আর আমার কি মনে হচ্ছে জান?
কি?
এর পশ্চাতে রয়েছে মদনের ফুলশর—
মদনের ফুলশর!
হুঁ। মনে করো কবির সেই অক্ষয় পংক্তি—পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছো এ কি সন্ন্যাসী!
তাহলে–
Love is jealous, love is selfish! অবিশ্যি এ-ও আমি সাধন দত্তর মত হলফ করে বলছি না যে তোমার বন্ধু নীরেনবাবুই তোমাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী–
দেখো কিরীটী, ওসব আমি কিছু বুঝি না। আমি আবারও হলফ করে তোমাকে বলছি যে নীরেন নির্দোষ। আর সেটা তোমাকেই প্রমাণ করে দিতে হবে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বেশ বেশ, তাই হবে—
কথা দিচ্ছ তুমি?
কথা! বেশ, কথা দিলাম।
মৃণাল অতঃপর যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিন্তু একটা কথা ডাক্তার—
কি?
তোমার বন্ধু সুসীমবাবু, তাঁর—তারও কি বিশ্বাস নীরেনবাবু সত্যিই নির্দোষ?
নিশ্চয়ই।
বেশ। তবে কাল একবার তোমার বন্ধুর বাড়িটা আমি ঘুরে আসতে চাই।
বেশ তো, ইচ্ছা করলে তুমি অবিশ্যি আজ—এখুনি যেতে পারো। এখুনি তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারি–
না, আজ নয়! কাল-কাল বেলা আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ তুমি এসো।
মৃণাল অতঃপর বিদায় নিল।
মৃণাল ঘর থেকে বের হয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনে সাধন দত্তকে ডাকল কিরীটী। কিরীটী।
কে?
সাধনবাবু, আমি কিরীটী রায়।
কি সৌভাগ্য! নমস্কার। কি খবর?
কি করছেন এখন? খুব ব্যস্ত নাকি?
না, না–বসে আড্ডা দিচ্ছি।
তাহলে একবার আসুন না গরীবের গৃহে। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মার্ডার কেসটায় আমি একটু ইনটারেস্ট ছিলাম—
এখুনি—এখুনি আসছি!
.
আরো ঘণ্টাখানেক পরে। কিরীটীর ঘরেই সাধন দত্তও সে মুখোমুখি দুজনে বসে সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছিল। সাধন দত্তর সঙ্গে বছর পাঁচেক পূর্বে ঘটনাচক্রে কিরীটীর আলাপ হয়। এবং সে ঘটনাটা হচ্ছে একটি জাল উইলের ব্যাপার। সেই সময়ই সাধন দত্তর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কিরীটী।
তাই মৃণালের মুখে সাধন দত্ত নীরেন সেনকে সুনন্দার হত্যাব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছেন শুনে ব্যাপারটাকে আদৌ লঘুভাবে নিতে পারে নি সে। এবং এ-ও বুঝতে পেরেছিল কিরীটী, বিশেষ কোনো কারণ আছে বলেই সাধন দত্ত নীরেন সেনকে গ্রেপ্তার করেছেন।
সাধন দত্তর মুখে ই আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাটা শোনবার পর কিরীটী বলে, কেবলমাত্র ঐ রুমাল ও চিঠিটার উপর নির্ভর করে যে আপনি নীরেনবাবুকে গ্রেপ্তার করেন নি, তা আমি জানি সাধনবাবু। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম—
না মিঃ রায়, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুসীমবাবুকে বা মৃণালবাবুকে আমি বলি নি সব কিছু স্পষ্ট করে। একটু আগে আপনাকে যে মহিলাটির কথা বললাম, বিশাখা, মানে বিশাখা চৌধুরী, সেই মহিলাটি তার জবানবন্দীতে একটা কথা বলেছিলেন। অবিশ্যি সে রাত্রে নয়, পরের দিন সন্ধ্যায় তার ওখানে যখন গিয়েছিলাম—
কি বলেছিলেন তিনি?
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। যে বাথরুমের মধ্যে আমি সে-রাত্রে রুমালটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, সেই বাথরুমে প্রবেশ করবার আর একটা দরজা ছিল পিছনের বারান্দা দিয়ে। সেই দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ফিরে আসেন বিশাখা চৌধুরী, বাথরুমে ঐ সময় নীরেন সেনকে পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
কিন্তু–
শুনুন, আরো আছে। নীরেন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ঐ সময় তার হাতে একটা শিশি দেখতে পেয়েছিলেন বিশাখা।
কিন্তু কথাটা তিনি তাঁর প্রথম দিনের জবানবন্দীতে আপনাকে প্রকাশ করেন নি কেন?
সে সময় ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব খুঁজে পান নি বলেই সে রাত্রে আমাকে এ সম্পর্কে। কিছু বলতে নাকি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
আচ্ছা সে-সময়, মানে যখন তিনি নীরেন সেনকে দেখতে পান তখন বাথরুমে কি আলো জ্বলছিল?
না, বাথরুম অন্ধকার ছিল। তবে—
কি?
হলঘরের আলোর খানিকটা অংশ বাথরুমের মধ্যে গিয়ে পড়ায় বাথরুমটার মধ্যে অস্পষ্ট একটা আলোছায়া ছিল। তারপর যা বলছিলাম, নীরেন সেন বাথরুম থেকে চলে যাবার পর বিশাখা গিয়ে বাথরুমে ঢুকেই নাকি ক্লোরোফর্মের গন্ধ পেয়েছিলেন।
হুঁ। আচ্ছা ঠিক রাত্রি কটায় যেন সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত আবিষ্কৃত হয়?
সোয়া এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে।
বিশাখা চৌধুরী কি নীরেন সেনের পূর্বপরিচিত ছিলেন?
না।
ডাঃ সেন, সুসীম নাগ ও সুনন্দার সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় ছিল তার?
সুসীমের সঙ্গে ছিল, তবে এক কলেজে কাজ করলেও সুনন্দার সঙ্গে শুনেছি বিশাখার তেমন হৃদ্যতা বা ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
বিশাখা চৌধুরীর বয়স কত হবে?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে।
বিয়ে করেছেন?
না।
কি করেন ভদ্রমহিলা?
সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে একই কলেজে অধ্যাপকের কাজ করেন এই তো বললাম।
তা বিয়ে এখনো করেন নি কেন ভদ্রমহিলা? তিনিও কি ঐ তিনজনের একজনকে ভালোবাসতেন?
সে রকম কোন কিছু তো এখনো জানা যায় নি।
জানা কিন্তু উচিত ছিল। যাক্ বাথরুমের মধ্যে সেরাত্রে পিছন ফিরে স্বল্প আলোআঁধারিতে যে ব্যক্তি শিশি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি যে নীরেন সেনই, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই তো আপনার বিশাখা চৌধুরীর?
না।
দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর বলতে হবে ভদ্রমহিলার। কিন্তু আমি ভাবছি—দৃষ্টিশক্তি যার এত প্রখর, তিনি ব্যাপারটা জেনেও সেরাত্রে আপনাকে বলেন কি কেন?
বললাম তো, ব্যাপারটায় প্রথমে উনি তত গুরুত্ব নাকি দেন নি।
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে বিচার করতে গেলে তো দেওয়া উচিতই ছিল, তাই নয় কি মিঃ দত্ত?
তা অবিশ্যি ছিল।
চুরোটটা নিভে গিয়েছিল, সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে বার-দুই টান দিয়ে কিরীটী ইতিমধ্যে পায়চারি থামিয়ে যে চেয়ারটার উপর উপবেশন করেছিল সেটারই পিছনে হেলান দিয়ে যেন আরাম করে বসল গা ঢেলে দিয়ে।
সাধনবাবু, সকলের কথাই আপনি বললেন, কিন্তু সুসীম নাগের ভগ্নী সুধা দেবী ও সেদিন নিমন্ত্রিত হয়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটির কথা তো তেমন বিশেষ কিছু বললেন না!
কিরীটীর প্রশ্নে কতকটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই তাকান সাধন দত্ত তার মুখের দিকে।
কিন্তু কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো না সাধন দত্তর। কারণ কিরীটী তখন হাত বাড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে সম্মুখের ছোট গোল টেবিলটার উপরে রক্ষিত কাচের ছাইদানিটায় হাতের
অগ্নিদগ্ধ চুরোটের অগ্রভাগটা ঝাড়ছিল।
সুধা দেবী আর বিষ্ণু দে!
হ্যাঁ, হরপ্রসাদবাবু তার জবানবন্দীতে কি বলেন নি যে তার স্ত্রী সুধা দেবী তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা কোন দিনই তেমন প্রীতির চোখে দেখেন নি?
হ্যাঁ, তাই বলেছিলেন বটে।
তাহলে স্বভাবতই কি আমরা ধরে নিতে পারি না যে আমন্ত্রণ না করা সত্ত্বেও রবাহূতভাবে সুনন্দা চ্যাটার্জীর সেরাত্রের উৎসবে সুসীম নাগের বাড়িতে উপস্থিতিটা সুধা দেবীর কাছে প্রীতির ব্যাপার হয় নি? এবং সুধা দেবী একজন নারী–
কিন্তু–
কি জানেন সাধনবাবু, ঐদিনকার ব্যাপারে সুধা দেবী অবহেলার যোগ্য নন! আর বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটি এবং তার জবানবন্দীও অবহেলার বস্তু নয়!
কিন্তু বিষ্ণু দে–
বিশাখা তার জবানবন্দীতে বলেছেন, সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হবার আধঘণ্টাটাক আগে তিনি নাকি ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সোফায় সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে একজন ভদ্রলোককে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন এবং সেই সময় ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন।
এবং বিষ্ণু দে-ও তার মিনিট পনেরো পরে হলঘরে এসে তাই দেখেছিলেন। অর্থাৎ তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, বিষ্ণু দে ও বিশাখা চৌধুরী দুজনে ব্যাপারটা দেখেছেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু বিশাখা তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, সেই ম্যাজিসিয়ানের বেশভূষা, এমন কি তার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত নাকি মৃণাল সেনের মতো!
তা তো বলেছেনই।
কিন্তু সেকথা কি বিষ্ণু দে বলেছেন?
না।
অথচ তার কাছ থেকেও ঐ একই ব্যাপারটা কি আমরা আশা করি না?
তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ম্যাজিসিয়ানের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন নি।
মিথ্যে কথা।
কি বলছেন মিঃ রায়?
বললাম তো মিথ্যে কথা। A deliberate and intentional lie! বিষ্ণু, মৃণাল ও। সুসীমবাবু তিনজনেই মিথ্যা বলেছেন।
কিন্তু–
এর মধ্যে কোন কিন্তুই নেই, মিঃ দত্ত। নিমন্ত্রণ-বাড়িতে অত লোক তার ম্যাজিক দেখলো, তিনি প্রকাশ্যে সকলের চোখের সামনে হলঘরের মধ্যে ম্যাজিক দেখালেন, অথচ সুসীমবাবু আর মৃণাল তাঁকে দেখলেন না—আপনি কি আমাকে কথাটা বিশ্বাস করতে বলেন?
অবিশ্যি আপনি যা বলছেন—
যুক্তি ছাড়া কিরীটী রায় কথা বলে না।
তাহলে কি আপনার ধারণা নীরেন সেন হত্যাকারী নয়?
ধারণা আমার কিছুই নয়, আর কিছুই এই মুহূর্তে আমি বলছি না। It is too early to say anything! তবে এইটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত–
কি?
জবানবন্দীতে সেরাত্রে তিনজন মিথ্যা কথা বলেছে—
তিনজন!
হ্যাঁ।
কে কে?
সুসীম নাগ, ডাঃ মৃণাল সেন—
আর?
শ্ৰীমতী বিশাখা চৌধুরী।
.
০৯.
পরের দিন বেলা নটা নাগাদ কিরীটী ডাঃ মৃণাল সেনের সঙ্গে সুসীমের গৃহে উপস্থিত হলো।
সুসীম ঐ সময় তার নীচের হলঘরে বসে দরজা বন্ধ করে কতকগুলো পুরাতন চিঠি দেশলাই জ্বেলে একটার পর একটা পোড়াচ্ছিল একাকী।
ভৃত্য এসে দরজায় ধাক্কা দিতে সুসীম শুধায়, কে?
আজ্ঞে দাদাবাবু, আমি দীনু। মৃণালবাবু আর এক ভদ্রলোক এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন মৃণালবাবু।
যা, এই ঘরে পাঠিয়ে দে।
যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সুসীম পোড়া চিঠির ছাইগুলো একত্র করে বাইরে বাগানের মধ্যে ফেলে দেয় জানালাপথে। এবং তখনো যে চিঠিগুলো পোড়ানো বাকি ছিল, সেগুলো একটা বইয়ের আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দেয়।
চিঠিগুলো সুনন্দার।
দীর্ঘ বারো বৎসরের আলাপে অনেক চিঠিই লিখেছিল তাকে সুনন্দা। একটি চিঠিও সুনন্দার নষ্ট করে নি সুসীম এতদিন। সযত্নে বাণ্ডিল বেঁধে এতদিন রেখে দিয়েছিল সব চিঠি। কিন্তু আজ সকালে উঠেই কেন যেন মনে হয়েছিল সুসীমের, ওগুলোর প্রয়োজন আজ তার জীবনে ফুরিয়েছে। সুনন্দার স্মৃতি মন থেকে আজ তার মুছে ফেলাই উচিত। সুনন্দা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক আজ তার জীবন থেকে।
আজ থাক শুধু শ্রাবণী।
দরজায় ধাক্কা পড়লো।
সুসীম! মৃণালের গলা শোনা যায়।
সুসীম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
পরিচয় করিয়ে দিই—আমার বন্ধু সুসীম নাগ, আর সুসীম তুমি এঁকে কখনো না দেখলেও আমার মুখে এঁর কথা বহু শুনেছে—কিরীটী রায়!
দুজনে দুজনকে নমস্কার জানায়।
কিন্তু কিরীটীর নামটা শুনে সুসীমের ভ্রূ-দুটো যেন ঈষৎ কুঞ্চিত হয়।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সুসীম যেন মুখে একটা খুশির ভান এনে সাদর অভ্যর্থনা জানায়, বসুন, বসুন মিঃ রায়।
ঘরে ঢুকতেই কাগজ পোড়ার গন্ধটা কিরীটীর নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। সে বলে, ঘরে একটা কাগজ পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি যেন, মিঃ নাগ!
কাগজ পোড়ার?
হ্যাঁ। বলতে বলতে সহসা নীচু হয়ে ঘরের মেঝে থেকে একটুকরো পোড়া কালো কাগজ তুলে নেয় হাতে কিরীটী, কিছু পোড়াচ্ছিলেন নাকি?
হ্যাঁ-হ্যাঁ, কতকগুলো পুরাতন কাগজপত্র—
হুঁ, জঞ্জাল রেখে তো লাভ নেই!
মৃদুকণ্ঠে যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাগুলো বলে কিরীটী।
কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?
না, কিন্তু আপনার লাইব্রেরীতে বেশ ভাল কালেকশন আছে বলেই মনে হচ্ছে মিঃ নাগ!
হ্যাঁ, বাবার লাইব্রেরী এটা। বই পড়ার একটা নেশা ছিল বাবার।
সুসীম মৃদুকণ্ঠে বলে।
আচ্ছা মিঃ নাগ—
বলুন!
নীরেনবাবু মানে আপনাদের বন্ধু নীরেন সেন আপনাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছে বলে কি আপনার মনে হয়?
স্বাভাবিকভাবে মনে হয় না, তবে–
তবে?
নীরেন আমাদের সহপাঠী বন্ধু বটে, তবে তার সবটুকুই কি আমরা জানি, না সেটা সম্ভব!
তা তো বটেই।
মৃণালকেও আমি তাই বলছিলাম—
চলুন মিঃ নাগ, আপনার সেই হলঘর ও বাথরুমটা একবার আমি দেখতে চাই।
নিশ্চয়ই, চলুন!
.
প্রথমেই ওরা দোতলার সেই হলঘরে যায়।
হলঘরটির চারপাশে একবার দৃষ্টিপাত করে প্রথমেই প্রশ্ন করে কিরীটী, ঐ যে আলমারিগুলো দেখছি, সেরাত্রে কি ঐভাবেই আলমারিগুলো ছিল মিঃ নাগ?
হ্যাঁ।
ঐভাবেই বরাবর রয়েছে?
না, উৎসবের জন্য আলমারিগুলোকে ঘরের একধারে place করা হয়েছিল জায়গার জন্যে–
আলমারিগুলোর মধ্যে কি আছে?
অফিসের ফাইল, কাগজপত্র।
এটা তাহলে আপনার অফিস-ঘর হিসাবেই সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয় বলুন।
হ্যাঁ।
কিরীটী লক্ষ্য করে দেখলো আলমারিগুলো স্টীলের।
কিরীটী অতঃপর আলমারিগুলোর পিছনে গিয়ে দেখলো, সেগুলো একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো নয়, আলমারি ও দেওয়ালের মাঝখানে বেশ কিছুটা জায়গার ব্যবধান আছে।
সেদিন এই হলঘরেই বোধ হয় নিমন্ত্রিতদের বসবার জায়গা হয়েছিল?
হ্যাঁ, কিছু সোফা আর চেয়ার পেতে বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সেগুলো সরিয়ে ফেলেছেন মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ, নীচের অফিস-ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুসীম জবাব দেয়।
অতঃপর কিরীটী গিয়ে ইয়েল-লক চাবি দিয়ে দরজা খুলে হলঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে ঢুকলো। বাথরুমের ও ঘরের মধ্যবর্তী দরজার উপরার্ধে মোটা কাচ বসান।
সুসীম ও মৃণাল কিরীটীকে অনুসরণ করে।
বাথরুমটা নেহাৎ ছোট নয়। বেশ বড় সাইজের বাথরুম। কিরীটী লক্ষ্য করে, বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ঠিক ওপরেই দেওয়ালে যে আয়নাটা রয়েছে সেটা একেবারে দরজাটার মুখোমুখি বসানো।
কিছুক্ষণ সেই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরীটী। তারপর বাথরুমের দরজা দুটো পরীক্ষা করে। দুটো দরজাতেই ইয়েল-লক লাগানো।
মিঃ নাগ!
বলুন।
সেরাত্রে বাথরুমের দুটো দরজাই খোলা ছিল বোধ হয়?
হ্যাঁ, যদি কারো প্রয়োজন হয়—
তা তো বটেই। আচ্ছা মিঃ নাগ, আপনার বান্ধবী বিশাখা দেবী আপনার এ বাড়িতে পূর্বে কখন এসেছেন?
বহুবার।
আচ্ছা মনে পড়ে আপনার, বাথরুমটা কখনো তিনি ব্যবহার করেছেন কিনা?
তা বোধ হয় করেছে।
সুনন্দা চ্যাটার্জী?
সেও এসেছে এবং বাথরুমও সে ব্যবহার করেছে।
তাহলে দেখছি, এ বাথরুমটা কারোরই অপরিচিত ছিল না!
না, তা ছিল না।
কথা বলতে বলতে কিরীটী বাথরুমটার চারিদিকে ইতস্তত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
আবার একসময় কিরীটী বলে, মিঃ নাগ, সেরাত্রের পর এ কদিন এই বাথরুমটা কি ব্যবহৃত হয়েছে?
না মিঃ রায়, সেই দুর্ঘটনার পর এই হলঘরের দিকে কেউ আসে নি।
কিন্তু এই বাথরুমটাও কি ব্যবহৃত হয় নি?
না, বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। তা ছাড়া–
সুসীমের শেষের কথায় কিরীটী যেন একটু আগ্রহ সহকারেই ফিরে তাকালো সুসীমের দিকে।
সুসীম এবারে যেন ইতস্তত করেই বলে, সেই দুর্ঘটনার রাত্রের পর থেকে এদিকটায় বড় একটা কেউই আসে নি–
কেন?
আমি অবিশ্যি শুনি নি, তবে অনেকেই নাকি এদিকটায় রাত্রে কিসের শব্দ শুনেছে—
সহসা ঐ সময় কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ঘরের কোণে মেঝে থেকে একটা কর্কশূন্য এক ড্রাম সাইজের হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শিশি পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সেই রুমালটা দিয়ে সন্তর্পণে চেপে ধরে তুলে নিল।
মৃণাল এগিয়ে আসে, বলে, কি?
একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শিশি। গায়ে দেখছি লেবেল আঁটা আছে—থুজা টু হাড়ে! শিশিটা দেখছি ফেটে গিয়েছে। এ বাড়িতে রিসেন্টলি কেউ থুজা ব্যবহার করেছিল বলে জানেন নাকি মিঃ নাগ?
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তো এ বাড়িতে কেউ ব্যবহার করে না মিঃ রায়!
তবে শিশিটা আপনার বাড়ির বাথরুমের মধ্যে এলো কি করে?
কি জানি! বলতে পারছি না তো!
কিরীটী এবারে মৃণালের মুখের দিকে ফিরে তাকালো, ডাক্তার, তোমার হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কে কোন জ্ঞান আছে?
শুনে শুনে কিছু জানি। মৃণাল জবাব দেয়।
হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে থুজার ইনডিকেশন কি জান? Undesirable and unwanted growth নাকি রিমুভ করা হয় থুজার সাহায্যে! মৃদু হেসে শিশিটা রুমাল সমেতই জড়িয়ে পকেটে রাখতে রাখতে কথাটা বলে কিরীটী।
তারপর পুনরায় কিরীটী সুসীমের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, এই বাথরুমের চাবি কার কাছে সেরাত্রে ছিল?
বললাম তো এইমাত্র আপনাকে মিঃ রায়, চাবি সেরাত্রে খুলেই রাখা হয়েছিল। তবে পাশেই ক্লোক্রমের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে চাবিটা রেখে দিয়েছিলাম।
চাবিটা একবার নিয়ে আসুন তো!
এখুনি নিয়ে আসছি—সুসীম বাথরুমের অন্য দ্বারপথে বের হয়ে গেল।
সুসীম বাথরুম থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী পার্শ্বেই দণ্ডায়মান মৃণালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ডাক্তার, তুমি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ কর?
মৃণাল একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই একটু চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, কোন্ ব্যাপারে?
তোমাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীর হত্যার ব্যাপারে?
কাকে সন্দেহ করবো!
কাকে করবে তা বলি কি করে? তবে করো কিনা সেইটাই শুধু জিজ্ঞাসা করছি!
না।
অর্থাৎ সন্দেহ করতে পারো এমন কোন নাম মনে পড়ছে না, এই তো! বেশ আমি কয়েকটা নাম করি-ধর বিশাখা দেবী, শ্রাবণী দেবী, সুসীম, নীরেন–
কি বলছো কিরীটী, এরা—after all এরা কেন সুনন্দাকে হত্যা করতে যাবে!
তারপরেই যেন দুম্ করে কিরীটী বললে, কিন্তু তুমি?
আমি!
বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে তাকায় মৃণাল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ তুমি—তুমিও তো পার তাকে হত্যা করতে!
কথাটা বেশ স্পষ্ট ও সহজকণ্ঠে কিরীটী বললেও, কৌতুকে যেন তার চোখের পাতা দুটো নাচছিল তখন।
আমি হত্যা করবো সুনন্দাকে!
কেন, অসম্ভব কি?
কি বলছো কিরীটী?
স্বাভাবিক হ্যাঁ, তাই বলছি!
স্বাভাবিক?
কিরীটী বলে, কি জান ডাক্তার, মানুষের অবচেতন মনের অন্ধকার গলিখুঁজিতে কখন যে কোন্ লিঙ্গা নখর বিস্তার করে, তা সে নিজেও টের পায় না। এই ধর না আমার কাছে তোমার আসাটা! কেন তুমি এসেছো আমার কাছে?
কেন—
এসেছো তুমি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেছে বলেই—
তার মানে?
মানে কি তুমি জান না?
কি বলতে চাও?
বলতে চাই—
কিন্তু কিরীটীর মুখের কথাটা শেষ হলো না, সুসীম এসে ঘরে ঢুকলো।
কি হলো মিঃ নাগ, চাবিটা পেলেন? কিরীটী শুধায়।
আশ্চর্য! চাবিটা তো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে পেলাম না মিঃ রায়!
পেলেন না?
না।
সেটা তাহলে বোধহয় খুনীর পকেটেই রয়ে গিয়েছে!
সুসীম বা মৃণাল কিরীটীর কথার কোন জবাবই যেন খুঁজে পায় না। কেবল দুজনে দুজনের মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকায়।
কিন্তু এখানে আর নয় সুসীমবাবু, চলুন আপনার এই বাথরুমের পাশের ক্লোরুমটা একবার দেখবো।
চলুন।
.
ক্লোকরুমটাও নেহাৎ আকারে একেবারে ছোট নয়। তবে একটু লম্বা প্যাটার্নের। ক্লোমটার মধ্যে অবিশ্যি বেশী কিছু জিনিসপত্র ছিল না। একটা বড় সাইজের ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি ও গোটাকয়েক স্টীলের কালো রংয়ের ট্রাঙ্ক এবং একটা আলনা।
ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কিরীটী শুধায়, এ ক্লোব্রুমটা যেন মনে হচ্ছে আজকাল আর ব্যবহার হচ্ছে না মিঃ নাগ!
না, বছর দুয়েক ধরে ওপরের হলঘরটায় অফিস করায় এটা আর ব্যবহার হয় না।
চাবি দেওয়াই থাকতো, না খোলাই থাকতো ঘরটা?
খোলাই থাকে।
খোলা থাকলেও ঘরটা নিয়মিত ঝাড়পোঁছ হয় বলে তো মনে হচ্ছে না?
তা বোধ হয় হয় না।
কিরীটী এবারে ড্রেসিং টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল এবং তার দুপাশের দুটো টানা টেনে একের পর এক খুললো।
দুটো টানাই একেবারে খালি। টানার হ্যাণ্ডেলে ধুলো জমে ছিল, হাতে সেই ধুলো লাগে কিরীটীর। হাতের ধুলোটা অন্য পকেট থেকে আর একটা রুমাল বের করে মুছতে মুছতে কিরীটী বলে, এ ঘরটা আপনার অনেকদিন মনে হচ্ছে ঝাড়পোঁছ হয় না মিঃ নাগ!
এ ঘরটা তো ব্যবহার হয় না। তাই হয়তো চাকররা—
মনোযোগ দেয় না এ ঘরটায়। স্বাভাবিক। ঠিক আছে, চলুন এবারে বাইরে যাওয়া যাক।
.
কিরীটীকে নিয়ে সুসীম তার নীচের পারলারে বসালো।
একটু পরে হরপ্রসাদ ও তার স্ত্রী সুধাও এলেন।
দুচারটে মামুলি কথাবার্তার পর একসময় কিরীটী সকলকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো।
প্রথমেই সুধা।
সুধাকে বলে, আচ্ছা সুধা দেবী, আপনার তো সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে পরিচয় ছিল?
হ্যাঁ।
কি ধরনের মেয়ে ছিল সে?
নসিয়েটিং! কখনো তাকে আমি স্ট্যাণ্ড করতে পারি নি।
কেন বলুন তো? তার স্বভাব-চরিত্র কি তেমন সুবিধার ছিল না?
তা জানি না, তবে এটা জানি, পুরুষকে নাচানোই ছিল তার স্বভাব। তার কোন–ইংরেজীতে যাকে বলে—প্রিন্সিপল চরিত্রে ছিল না।
আচ্ছা সুধা দেবী, সেরাত্রে কে একজন আমন্ত্রিতদের মধ্যে নানা ধরনের তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন, আপনি তাঁকে দেখেছিলেন?
না।
আর একটা কথা, আপনার দাদার বন্ধু ডাঃ সেন, নীরেন সেন আর বিষ্ণু দে—এঁদের সকলের সঙ্গেই বোধ হয় আপনার পরিচয় ছিল?
ছিল। তবে বেশী আলাপ যদি বলেন তো একমাত্র ডাঃ সেনের সঙ্গেই—
এঁদের তিনজনের মধ্যে কেউ তাসের ম্যাজিক জানেন কি?
কখনো শুনি নি তো!
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন। সুসীমবাবু—আপনার দাদাকে এ ঘরে পাঠিয়ে দেন যদি!
দিচ্ছি।
সুধা বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
.
সুসীম নাগ।
দেখুন সুসীমবাবু, কিরীটী বলে, আপনার ও মিস্ সুনন্দা চ্যাটার্জী সম্পর্কে সব কথাই শুনেছি ডাঃ সেনের কাছ থেকে। তাই সে-সব কথা নয়—অন্য কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করবো। আচ্ছা আপনার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে কি আপনি সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহ করেন?
না।
নীরেনবাবুকে?
না।
আচ্ছা সেই ম্যাজিসিয়ান সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে রহস্যপূর্ণ।
কিন্তু there was somebody—এটা তো আপনি স্বীকার করবেনই।
অনেকেই যখন দেখেছে—
হুঁ। আচ্ছা সেরাত্রে শেষ কখন আপনার সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
রাত পৌনে এগারটা হবে বোধ হয়।
কোথায় দেখা হয়েছিল?
হলঘরের সামনের বারান্দায়।
একস্যাক্টলি কোথায়?
ঐ দোতলার ক্লোরুমটার সামনে একা রেলিংয়ে হাত রেখে সে দাঁড়িয়ে ছিল।
কোন কথা হয়েছিল সে-সময় তার সঙ্গে আপনার?
হয়েছিল।
কি কথা?
বলেছিল ঘরের মধ্যে স্টাফি বোধ হওয়ায় সে ঐখানে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে—
আর কোন কথা নয়?
না, তারপরই আমি নীচে চলে যাই।
যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম—
করুন!
সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ পর্যন্ত কেন আপনি বিয়ে করলেন না?
মুহূর্তকাল চুপ করে থাকে সুসীম, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আজ আর সে কথা আপনাকে বলতে আমার কোন বাধা নেই মিঃ রায়। দেহেই সে শুধু নারী ছিল, মনে ছিল সে এক বিচিত্র জীব। না নারী, না পুরুষ। অন্ধের মত আমি ছুটে বেড়িয়েছি তার পিছনে পিছনে—একটাআধটা দিন নয়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর—তবু জানতে পারি নি তার আসল পরিচয়টা—চিনতে পারি নি তার আসল চেহারাটা। তবু-তবু আজ অস্বীকার করবো না আপনার কাছে মিঃ রায়, তাকে আমি ভালবাসতাম। জীবনে কাউকে আমি অমন করে বুঝি ভালবাসি নি–
শেষের দিকে গলাটা ধরে আসে সুসীমের। চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে। মানুষের জীবনটা সত্যিই কি বিচিত্র মিঃ রায়, সুসীম বলতে থাকে, নইলে দেখুন বারোটা বছর তো অপেক্ষা করেছিলাম ওকে নিয়েই ঘর বাঁধবো বলে–
আপনি তাকে ভুল বোঝেন নি তো মিঃ নাগ! কিরীটী বলে।
ভুল! না মিঃ রায়, ভুল বুঝি নি। আর ভুল বুঝি নি বলেই শ্রাবণীকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছি। তার পরিচিতজনেরা সবাই জানতে এবং বলেছেও চিরদিন, ওর চোখে নাকি একটিমাত্র দৃষ্টিই আছে—ব্যঙ্গের দৃষ্টি। ও নাকি শুধু জানে ব্যঙ্গ করতেই। কিন্তু আমি জানি তা নয়, সেটা ওর বাইরের একটা খোলস ছিল মাত্র। আসলে ও ছিল ক্লীবনা পুরুষ, না নারী—আর সেইটাই যে মুহূর্তে জানতে পারলাম, সেই রাত্রেই সোজা ওর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম শ্রাবণীর কাছে—তাকে প্রস্তাব জানিয়েছিলাম। তাই তো নীরেনের ব্যাপার যখন শুনলাম, প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল নীরেন এত বড় ভুলটা করলো কি করে!
আচ্ছা মিঃ নাগ—
বলুন?
নীরেনবাবুর সঙ্গে সুনন্দা দেবীর ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা কি সত্যিই আপনি জানতেন না?
না।
কোন কারণে আপনার কোনরকম সন্দেহও হয় নি?
না। আচ্ছা আর একটা কথা, নীরেনবাবুকে তো আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহ করেন না—কিন্তু আর কারো ওপরে কি আপনার সন্দেহ হয়?
না।
ডাঃ সেনকে?
য়্যাঁ! মৃণালকে? না।
আপনি তো নিশ্চয়ই চান যে সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী ধরা পড়ুক!
চাই বৈকি।
আচ্ছা এবারে তাহলে আমি উঠবো মিঃ নাগ আজকের মতো—তবে আবার হয়তো। আমি আসবো—আবার হয়তো বিরক্ত করবো আপনাদের।
না, না—বিরক্তির কি আছে! যখনই প্রয়োজন হবে আসবেন—
ধন্যবাদ।
কিরীটী উঠে দাঁড়ালো।
.
১০.
গাড়িতে উঠে কিরীটী মৃণালকে সম্বোধন করে বলে, বিশাখা দেবী কোথায় থাকেন মৃণাল?
শ্যামবাজারে।
এখন গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?
তা হয়তো হতে পারে, কারণ এখন তো তার গ্রীষ্মের ছুটি চলেছে!
কিরীটী হীরা সিংকে নির্দেশ দেয় শ্যামবাজারের দিকে গাড়ি চালাতে।
শ্যামবাজারে রামধন মিত্রের লেনে বিশাখা থাকে। মৃণালই হীরা সিংকে নির্দেশ দিয়ে নিয়ে এল বিশাখার বাড়িতে।
.
একটা দোতলা বাড়ির দোতলার তিনখানা ঘর নিয়ে বিশাখা থাকে।
ছোট সংসার। বিশাখা, তার বিধবা মা ও একটি বেকার জুয়াড়ী ভাই জগদীন্দ্র। বিশাখার চাকরির আয় থেকেই সংসার চলে।
বিশাখার সব কিছু পরিচয়ই কিরীটী মৃণালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে গাড়িতেই জেনে নেয়। বিশেষ করে যেটা সাধন দত্তও তাকে জানাতে পারেন নি।
ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই শোনা যায় বিশাখা নাকি কোন একজনকে রেজেস্ট্রী করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ে করলেও প্রকাশ্যে সেই স্বামীকে নিয়ে বিশাখা ঘর করে নি।
কিরীটী শুধিয়েছিল, কেন?
বিশাখার জীবনে সে এক চরম দুঃখের কাহিনী কিরীটী। কেবল দুঃখের কেন লজ্জারও। ব্যাপারটা একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জানে না অনাত্মীয়ের মধ্যে। আর আপনার জনেদের মধ্যে একমাত্র জানেন ওর মা।
কিন্তু দুঃখের কাহিনী বলছো কেন ডাক্তার?
বিশাখার মুখেই শুনেছি, লোকটা শুধু পাষণ্ডই নয়, হৃদয়হীন নিষ্ঠুরও। আমি অবিশ্যি আলফ্রেডকে চোখে কখনো দেখি নি, নামটা শুনেছি।
লোকটার নাম আলফ্রেড বলছে–
হ্যাঁ, ক্রিশ্চান। শুনেছি, মাত্র একটা বছর নাকি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বিশাখার।
তারপর বুঝি ডিভোর্স হয়ে গেল?
না, ডিভোর্স আজ পর্যন্ত হয় নি।
কেন?
সেও এক দুর্বোধ্য ব্যাপার। কারণ জিজ্ঞাসা করেও জবাব পাই নি বিশাখার কাছ থেকে। যাই হোক, আলফ্রেডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর বিশাখা ক্রমে এম. এ. পাস করে, তারপর অধ্যাপিকার চাকরি নেয়।
বিশাখা দেবীর বিবাহের ব্যাপারটা মিস্ চ্যাটার্জী জানতেন না?
যতদূর জানি জানতো না।
সুসীমবাবু—তোমার বন্ধুও না?
না।
.
মৃণালের অনুমান মিথ্যে হয় নি। বিশাখা বাড়িতেই ছিল।
মৃণালের মুখে কিরীটীর পরিচয় পেয়ে বিশাখা তাকে সমাদরে অভ্যর্থনা করে বসতে দিল। ছোটখাটো দেখতে এবং রোগা চেহারার শ্যামলা মেয়েটি প্রথম দর্শনেই যেন কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি। বয়েস বিশাখার যাই হোক না কেন, কুড়ি-বাইশের বেশী বলে মনে হয় না। যে ঘরে কিরীটী ও মৃণালকে বিশাখা বসতে দিয়েছিল সে ঘরটিতে সামান্য আসবাবের মধ্যে যেন একটা পরিচ্ছন্ন রুচির বিকাশ।
বিশাখা বলে, চা নিয়ে আসি?
কিরীটী বাধা দেয়, না বিশাখা দেবী, এ সময় চায়ের জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, বসুন। ডাক্তার সেন আমার পরিচয়টা আপনাকে দিল বটে, তবে এ সময় আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করলো না।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালো।
১১-১৫. কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে
কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে, ঠিক কি ভাবে কেমন করে তার বক্তব্যটা সদ্যপরিচিতা এক ভদ্রমহিলার কাছে ব্যক্ত করবে!
কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরীর কাছে যেটুকু জানবার জেনে নেবে!
দেখুন বিশাখা দেবী, ডাক্তার সেন আপনার পরিচিত এবং আমারও পরিচিত। সেই সূত্রেই অবিশ্যি এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম—
বিশাখা সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কথার জবাব দেয় না।
নিঃশব্দে কেবল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অবিশ্যি আজ এই সময় না হলেও কাল বা পরশু যখনই হোক আপনার কাছে আমাকে আসতে হতো, কারণ–
মৃদুকণ্ঠে বাধা দিয়ে বিশাখা বললে, আপনি অত কিন্তু করছেন কেন মিঃ রায়, আপনি কেন এসেছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি–
পেরেছেন?
তা পেরেছি বৈকি। সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কেই বোধ হয় কিছু জিজ্ঞাস্য আছে আমার কাছে আপনার!
ঠিক তাই। তবে–
অবিশ্যি সত্যি কথাই বলছি, আপনি যখন এসেছেন এবং আপনি যখন ডাঃ সেনের বন্ধু, তখন অনুমানই করে নিয়েছি সুনন্দার মৃত্যুর রহস্যের সন্ধানের ভারটা আপনার বন্ধুর অনুরোধেই হয়ত আপনি হাতে নিয়েছেন। তাই নয় কি?
কিরীটী বিশাখার শেষ কথাতেই বুঝতে পারে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, অনুমান আপনার মিথ্যে নয় বিশাখা দেবী। সেনের অনুরোধেই যেমন এ ব্যাপারে আমি হাত দিয়েছি, তেমনি সেই ব্যাপারেই এ সময়ে আপনার এখানে আমার আসা। কিন্তু আপনিও কি চান না বিশাখা দেবী–
কি?
সে রাত্রে অমন নৃশংসভাবে যে আপনাদের পরিচিত সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছে সে ধরা পড়ক!
চাই বৈকি। কিন্তু আমি ঠিক আপনাকে যে সে ব্যাপারে কিভাবে সাহায্য করতে পারি, সেটাই এখনো বুঝে উঠতে পারছি না!
সে-রাত্রে সুনন্দা দেবীর হত্যার ব্যাপারটা রহস্যে আবৃত হয়ে আছে নিঃসন্দেহে। আর সাহায্যের কথা বলছেন! কার কাছে যে কিভাবে সাহায্য পাবো, কে কতটুকু সূত্র আমার হাতে তুলে দেবেন তাও আগে থাকতে বলা দুষ্কর। তবু আপনারা সে-রাত্রে যাঁরা অকুস্থানে উপস্থিত ছিলেন—
উপস্থিত শুধু আমরা কজনাই তো নয় মিঃ রায়, নিমন্ত্রণ-বাড়িতে সে রাত্রে প্রায় পাঁচশ জন উপস্থিত ছিলেন।
তা অবিশ্যি ছিলেন কিন্তু সুনন্দা চ্যাটার্জীর পরিচিত আপনারা যে কজন ছিলেন, আপাততঃ তাঁদের যা বলবার তা জানতে পারলেই মনে হচ্ছে হয়তো আমার কাজটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
আপনি সত্যিই কি তাই মনে করেন মিঃ রায়?
প্রশ্নটা করে সোজাসুজি স্পষ্ট দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীর সে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কিসের একটা চাপা উত্তেজনা যেন সেই দুই চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তাই আমার মনে হয় বিশাখা দেবী!
চোখে চোখ রেখেই স্পষ্ট কণ্ঠে কিরীটী জবাবটা দিল।
অবিশ্যি আমি অস্বীকার করবো না মিঃ রায়, আপনি কেসটা হাতে নিয়েছেন জেনে আমি আনন্দিতই হয়েছি–
সত্যি আনন্দিত হয়েছেন?
নিশ্চয়ই, কারণ—বলতে বলতে থেমে যায় বিশাখা।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে তাগিদ দেয়, কই, বললেন না কারণটা কি?
কারণ আমার ধারণা, পুলিসের সাধ্যও নেই ঐ দুর্বোধ্য ব্যাপারের কোন মীমাংসাতেই পোঁছানো!
কেন?
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের কর্মদক্ষতা তো জানতে আর কারো বাকী নেই!
না, না—এ আপনি কি বলছেন বিশাখা দেবী? সাধনবাবু খুব কপিটেন্ট লোক—
তা হবেন হয়তো—
হবেন নয়, সত্যিই দেখবেন এ রহস্যের মীমাংসা তিনি করবেনই।
তাই বুঝি সর্বাগ্রে নীরেনবাবুকে অ্যারেস্ট করে বসে আছেন!
কান্নার স্বরে একটা যেন স্পষ্ট ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
অ্যারেস্ট করবার কারণ আছে বলেই হয়ত তাঁকে অ্যারেস্ট করেছেন—
কি এমন অকাট্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে পেয়েছেন তিনি বলুন তো?
তা কেমন করে বলবো বলুন, তবে পেয়েছেন বৈকি নিশ্চয়ই কিছু!
কিছু পান নি। রামের অপরাধে শ্যামকে ধরতেই ওরা অভ্যস্ত।
বিশাখা দেবী, আমি দেখছি পুলিসের ওপরে আপনার তেমন আস্থা নেই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, এর চাইতেও অনেক জটিল ও দুর্বোধ্য ব্যাপারেরও তারা মীমাংসা করতে পারে ও করেছে, এমন নজিরের অভাব নেই! সে কথা যাক, অসময়ে এসে আপনাকে বেশী আটকে রেখে বিব্রত করবো না। গোটা তিন-চার প্রশ্নের জবাব কেবল আপনার কাছ থেকে চাই–
বলুন, সাধ্যমত আমি আপনাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করবো।
বিশাখা দেবী, আপনি দুর্ঘটনার রাত্রে আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন, দুর্ঘটনাটা প্রকাশ হওয়ার আধ ঘণ্টাটাক আগে আপনি নাকি হলঘরে কাকে ডাকতে এসে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে একটা সোফার ওপরে পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলতে দেখেছিলেন—
দেখেছিলাম।
কে সে ভদ্রলোক? তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন?
না। তাকে আমি পূর্বে কখনো দেখি নি।
কি রকম দেখতে?
রোগা, লম্বা এবং পরিধানে ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল। আর–
আর? চোখে কালো কাচের চশমা ছিল।
হুঁ। আর একটা কথা, সে-রাত্রে হলের মধ্যে যিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন, তাঁকে আপনি ও বিষ্ণুবাবু দুজনেই দেখেছিলেন—
বিষ্ণুবাবু দেখেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমি দেখেছি!
যাক সে কথা, আপনি বলেছেন তার গলার স্বরটা নাকি অবিকল আমাদের ডাক্তারের গলার স্বরের মতো বলেই সে-রাত্রে আপনার মনে হয়েছিল!
মুহূর্তের জন্য কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট মৃণালের দিকে তাকিয়ে বিশাখা বলে, হ্যাঁ বলেছিলাম।
যা বলেছেন আপনি, সে-সম্পর্কে আপনার কোনরকম মতদ্বৈধ নেই—You are sure!
তাই মনে হয়েছিল সে-সময়—
কিন্তু ভদ্রলোক দেখতে কি ডাক্তারের মতো ছিলেন?
সেই রকমই।
অতঃপর কয়েকটা মুহূর্তের জন্য একটা স্তব্ধতা।
বিশাখা দেবী, শুনেছি আপনি নিহত মিস্ চ্যাটার্জীর সঙ্গে একই কলেজে অধ্যাপনার কাজ করতেন—কথাটা কি সত্যি?
সত্যি।
কতদিন একত্রে একই কলেজে অধ্যাপনার কাজ করছেন আপনারা?
তা বছর চার হবে।
A prety long time—কি বলুন!
তাই।
আপনাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল নিশ্চয়ই?
না। তীক্ষ্ণকণ্ঠে জবাব দেয় বিশাখা।
ঘনিষ্ঠতা ছিল না, অথচ বলছেন একই কলেজে দুজনে আপনারা দীর্ঘ চার বছর ধরে—
তা করলেই বা!
না, তাই বলছিলাম—একই কলেজে দীর্ঘ চার বছর ধরে কাজ করেও আপনাদের পরস্পরের মধ্যে কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না-rather strange!
কেন, এতে strange হবার কি থাকতে পারে?
তা একটু মনে হয় বৈকি! কিরীটী বলে।
মনে হবার তো কোন কারণ নেই।
কিন্তু বিশাখা দেবী–
বিশাখা কিরীটীকে কথা শেষ করতে দিল না, সে বললে, আমি তাকে ঘৃণা করতাম—সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতাম।
কণ্ঠস্বরে বিশাখার যেন একটা তিক্ত ঘৃণা আর অবরুদ্ধ আক্রোশ ঝরে পড়লো।
ঘৃণাই যে শুধু আপনি তাকে করতেন বিশাখা দেবী তাই নয়, মনে হচ্ছে আক্রোশও ছিল তার প্রতি আপনার একটা!
বিচিত্র নয়। যদি জানবার আপনার সৌভাগ্য হতো মিঃ রায়, কি নীচ মন আর কুৎসিত চরিত্র তার ছিল—she was not only a vamp, a filthy snake too! স্বাভাবিক ভাবে একজন মানুষ আর একজন মানুষের ঐ ধরণের বীভৎস মৃত্যুতে দুঃখ পায়, আমিও পেয়েছি তবু বলবো, she deserved it! Rather I should say, she has been rightly served!
কথাগুলো একটানা বলে অন্যদিকে মুখ ফেরালো বিশাখা।
মৃণাল বোধ হয় সহ্য করতে পারে না আর, কি যেন বলবার চেষ্টা করে, কিন্তু বিশাখা—তুমি–
একটা থাবা দিয়ে যেন সঙ্গে সঙ্গে মৃণালের বক্তব্য থামিয়ে দিল বিশাখা।
বললে, থাম থাম মৃণাল—তোমাদের ক বন্ধুর কাছে সে demi-goddess ছিল জানি। পুরুষ তোমরা, তাই তার সত্যিকারের বীভৎস চেহারাটা কখনো তোমাদের চোখে পড়ে নি—পড়লে বুঝতে how obscene and how filthy she was!
অকস্মাৎ ঐ সময় কিরীটী ধীর শান্ত কণ্ঠে কথা বলে ওঠে, বিশাখা দেবী, সুনন্দা চ্যাটার্জীর নিহত হওয়ার ব্যাপারে আপনি কি তাহলে কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ!
হ্যাঁ।
সন্দেহের কথা যদি বলেন মিঃ রায় তো বলবো, সকলকেই আমি করি—এমন কি নিজেকে পর্যন্ত আমি সন্দেহ করি!
নিজেকেও আপনি সন্দেহ করেন?
নিশ্চয়ই। কারণ many a time I sincerely wished that I could kill her! কত সময় মনে হয়েছে তাকে আমি হত্যা করি—strangle her to death!
অবরুদ্ধ একটা উত্তেজনায় যেন হাঁপাতে থাকে বিশাখা।
সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী আর কোন প্রশ্ন করে না বিশাখাকে। একটু সময় দেয় যেন।
.
বিশাখা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল।
বেশ কিছুক্ষণ একটা স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হবার পর একসময় আবার মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে, বিশাখা দেবী, আজ আর আপনাকে বিরক্ত করবো না বেশী। একটি মাত্র প্রশ্ন আপনাকে আমার আর করবার আছে।
বিশাখা ফিরে তাকালো কিরীটীর মুখের দিকে।
একটু আগে আপনি ডাক্তারকে বললেন, তোমাদের কবন্ধু বন্ধু বলতে কাকে কাকে আপনি exactly mean করছেন?
কেন, ওরা বিশেষ তিনজন—যারা ওদের বন্ধুমহলে Three Musketeers বলে পরিচিত।
Three Musketeers!
হ্যাঁ–মৃণাল, সুসীম আর নীরেন!
নীরেনবাবুকে তাহলে আপনি চিনতেন?
চিনতাম বৈকি।
Excuse me, আর একটি কথা—নীরেনবাবুর সঙ্গে যে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পরিচয় ছিল, আপনি কি তা জানতেন?
কেন জানব না, খুব জানতাম!
তুমি জানতে বিশাখা? মৃণাল বিশাখার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে।
জানতাম বৈকি। কেন, তুমি জানতে না?
না।
আশ্চর্য! সে বর্মা থেকে এলে তো তার বেশীর ভাগ সময় ওর বাড়িতেই কাটত। দুনিয়াসুদ্ধ সবাই ব্যাপারটা জানত, আর বলতে চাও তুমিই জানতে না—nonsense!
সত্যিই আমি জানতাম না, মৃণাল বলে, আর সুসীমও জানত না।
Another hypocrite-কাজে এক-মুখে আর!
কি বলছো বিশাখা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—another hypocrite হচ্ছে তোমাদের ঐ সুসীম নাগ!
চল হে ডাক্তার, এবারে ওঠা যাক। ওঁকে অনেকক্ষণ বিরক্ত করেছি। বলতে বলতে কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
.
১২.
ঐদিনই সন্ধ্যাবেলা।
কিরীটীর বাড়িতে তার দোতলার বসবার ঘরে সাধন দত্ত আর কিরীটী দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যা-ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলেন।
সাধন দত্ত বলছিলেন, সেদিন উৎসবের রাত্রের সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের ব্যাপারটার কিছুতেই কোন সলুশনে যেন আমি আসতে পারছি না মিঃ রায়! ব্যাপারটা so mysterious–
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, মিস্টিরিয়াস!
নয়? একঘর নিমন্ত্রিতের মধ্যে লোকটা ম্যাজিক দেখিয়ে গেল, আর ব্যাপারটা বাড়ির লোকেদের কারোরই নজরে পড়ল না—এমন কি ডাঃ সেনেরও নয়!
নজরের কথা ছেড়ে দিন মিঃ দত্ত, তবে আপনি ব্যাপারটার মধ্যে যতখানি গুরুত্ব আরোপ করছেন, আমার মনে হয় তার কিছুই নয়—
তার মানে? কি আপনি বলতে চান মিঃ রায়?
আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা নিছক একটা joke-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়।
কি বললেন, joke-কৌতুক!
হ্যাঁ, joke-বাংলা ভাষায় যাকে কৌতুক বলে।
তার মানে?
মানেটা খুবই সহজ। আমি বলতে চাই, there was no intention behind! সেদিনকার উৎসবের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যেই হয়ত কেউ ম্যাজিসিয়ান সেজে খানিকটা কৌতুক-বলতে পারেন নিছক খানিকটা আনন্দ সৃষ্টি করবারই চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। যদিচ ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে ঘোরালো হয়ে ওঠায় বেচারী ম্যাজিসিয়ান হয়তো শেষ পর্যন্ত আত্মগোপন করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু–
তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা নিতান্তই যাকে বলে কাকতালীয়। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর সঙ্গে সত্যিই আমার মনে হয় কোন যোগ নেই। কিন্তু সে কথা যাক, আপাততঃ সব কিছু শুনে সকলের সঙ্গে কথা বলে ও অকুস্থান ঘুরে যে কথাগুলো আপনাকে আমি বলতে চাই–
কি, বলুন?
বিশাখা বিবাহিত, সে কথাটা আপনি বোধ হয় জানেন না।
সে কি? তার তো জানি বিয়েই হয় নি?
না, সে বিবাহিত। তার স্বামী হচ্ছে একজন ভারতীয় ক্রিশ্চান—আলফ্রেড ঘোষ। ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করে—গার্ড।
সত্যি বলছেন!
তাই তো শুনলাম।
বিবাহিত—তবু নিজেকে কুমারী বলে চালাচ্ছে। এ যে রীতিমত জটিল বলে মনে হচ্ছে!
সেই জটিলতার কারণটাই তো খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে মিঃ দত্ত!
কিন্তু কেমন করে?
সে খুব শক্ত হবে না। আগে আপনি একটা খোঁজ নিন তো!
কিসের খোঁজ নেবো?
রেলওয়ে গার্ড মিঃ আলফ্রে ঘোষ সম্পর্কে details খবরাখবরটা যোগাড় করুন তো।
বেশ।
দ্বিতীয়তঃ, প্রোমে নীরেন সেন সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদ আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
করবো। আর কিছু?
না, আপাততঃ আর কিছু নয়। ঐ সংবাদগুলো আমাকে আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন। সংগ্রহ করে দিন।
বেশ, দেবো।
হ্যাঁ, আর আগে যা বলেছি—যাবার পথেই কিন্তু সে কাজটা সেরে যাবেন মিঃ দত্ত!
.
সাধন দত্ত বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছেন প্রায় ঘণ্টা-দুই পূর্বে।
কিরীটী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল। ঘরের আলোটা সাধন দত্ত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিভিয়ে দিয়েছিল কিরীটী। জংলী এসে অন্ধকার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো, কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকায় ইতস্তত করে—ডাকবে কি ডাকবে না!
কিন্তু জংলীর পদশব্দ কিরীটীর শ্রুতিগোচর হয়েছিল, সে প্রশ্ন করে, কি রে জংলী?
একজন মেয়েছেলে দেখা করতে চায়।
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবলো; তারপরে মৃদুকণ্ঠে বললে, ঘরের আলোটা জ্বেলে দিয়ে এ-ঘরেই পাঠিয়ে দে তাকে।
ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দিয়ে জংলী নীচে চলে গেল।
একটু পরেই পদশব্দ শোনা গেল ঘরের দরজার সামনে।
আসুন বিশাখা দেবী!
সত্যি, বিশাখাই ঘরে প্রবেশ করলো।
সর্বাঙ্গে একটা চাদর জড়ানো ছিল বিশাখার এবং সেই চাদরের সাহায্যেই মাথায় ঈষৎ অবগুণ্ঠন ভোলা ছিল।
বসুন বিশাখা দেবী!
বিশাখা কিরীটীর মুখোমুখি ছোট সোফাটার উপরে উপবেশন করলো।
জানতাম আপনি আসবেন, আপনার আগমন প্রতীক্ষ্ণই করছিলাম আমি এতক্ষণ।
আমি আসবো আপনি জানতেন!
জানতাম।
কথাটা বলে হঠাৎ যেন কিরীটী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।
বিশাখাও স্তব্ধ, কিরীটীও স্তব্ধ।
উভয়ের মধ্যখানে যেন একটা স্তব্ধতার পাষাণভার।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বিশাখাই প্রথমে কথা বলে, কিরীটীবাবু!
বলুন?
এইমাত্র আপনি যা বললেন তা কি সত্যি?
কি সত্যি বিশাখা দেবী?
আমি যে এ-সময় আসবো আপনি জানতেন!
সত্যিই জানতাম বিশাখা দেবী। আর আপনি কেন এসেছেন তাও জানি।
জানেন?
জানি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বলে, থানা-অফিসার মিঃ দত্ত আপনার কাছে গিয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু আশ্চর্য-আপনি জানলেন কি করে!
কারণ আমিই তাকে যেতে বলেছিলাম।
আপনি যেতে বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
সে কথা যাক, আপনি বরং যা বলতে এসেছেন বলুন।
জবাবে বিশাখা অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করেই থাকে।
কেবল নিঃশব্দে শাড়ির আঁচলের পাড়ের একটা অংশ টেনে টেনে সোজা করতে থাকে।
কই, বললেন না?
মিঃ রায়!
বলুন?
আচ্ছা সত্যিই কি আপনি মনে করেন—
কি?
মানে বলছিলাম, নীরেনের ফাঁসি হবে!
কাউকে কেউ হত্যা করলে, প্রচলিত আইনে সেই শাস্তিই তো তার প্রাপ্য—to be hanged by neck till death!
সহসা যেন আর্তকণ্ঠে একটা চাপা উদ্বেগ প্রকাশ পায়, না, না—তা হতে পারে না! আমি বলছি নীরেন নির্দোষ—সে হত্যা করে নি! আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়—
নির্দোষিতা তো তার এমনি প্রমাণিত হবে না বিশাখা দেবী, তার জন্য রীতিমত প্রমাণ চাই।
অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে। উদ্বেগ আর আশঙ্কায় বিশাখার সমস্ত মুখখানা কেমন যেন করুণ মনে হয়।
বিহ্বল কণ্ঠে বিশাখা বলে, প্রমাণ!
হ্যাঁ, প্রমাণ। বিশাখা দেবী, নীরেনবাবুর যদি ফঁসিই হয়, তাতে আপনার কি? তিনি তো আপনার কেউই নন?
বিশাখার চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে।
উপরের পাটির দাঁত দিয়ে সে তার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে।
কেউ নয়—সত্যিই তো, সে আমার কে? কেউ তো নয়! কথাগুলো যেন কতকটা আত্মগতভাবে বলে বিশাখা এবং দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
তারপরই হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সোফা থেকে বিশাখা, বলে, আমি যাই–
কিন্তু যেজন্য এসেছিলেন বিশাখা দেবী, কই সে-সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না!
কিছু না মিঃ রায়, আমি—আমি যাই–
পা বাড়ায় বিশাখা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে।
দাঁড়ান বিশাখা দেবী, শুনুন!
ঘুরে দাঁড়ালো বিশাখা কিরীটীর সে-ডাকে।
নীরেনবাবু সম্পর্কে আপনি আমাকে যা বলতে এসেছিলেন, নির্ভয়ে এবং নিঃসঙ্কোচেই আপনি আমাকে তা বলে যেতে পারেন।
বিশাখা কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
বসুন-বসুন ঐ সোফাটায়। বিশাখা বসে পড়লো।
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, সব কথা যদি আপনি আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেন তো নিশ্চয়ই তাকে আমি–
মিঃ রায়!
হ্যাঁ কথা দিচ্ছি, আমি তাকে নিশ্চয়ই ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবো।
পারবেন—সত্যি বলছেন পারবেন?
পারবো। কিন্তু তার আগে সব কথা আপনাকে আমার কাছে স্বীকার করতে হবে।
অকস্মাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে যেন কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ে বিশাখা, জানি না—আমি কিছু জানি না–কিছু জানি না–
অতঃপর মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, কিছু জানেন না?
না, না, না—
বেশ, আমার কয়েকটা প্রশ্নের সত্য জবাব দিন অন্তত! সেরাত্রে কাকে আপনি দেখেছিলেন সুসীমবাবুর বাড়ির হলঘরে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে কথা বলতে? বলুন, জবাব দিন?
জানি না, জানি না—চিনতে পারি নি—তাকে আমি চিনতে পারি নি—
কিন্তু আমি বলছি আপনি জানেন এবং চিনতে পেরেছিলেন তাকে। বলুন সত্যি কিনা?
না, না—
নীরেনবাবু, তাই না!
না, না—
হ্যাঁ, তিনি নীরেনবাবুই। বলুন সত্যি কিনা?
অশ্রুভেজা চোখ তুলে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
আর একটা কথা, আপনার স্বামী আলফ্রেড ঘোষ এখন কোথায়?
জানি না—
জানেন। বলুন তিনি কোথায়? সে রাত্রে তিনি কলকাতায় ছিলেন, তাই না?
মাথা নিচু করলো বিশাখা।
আলফ্রেড ঘোষের সঙ্গে তো আপনার কোন সম্পর্কই নেই, সত্যি কিনা?
সত্যি।
কতদিন হলো আপনাদের separation হয়েছে?
ছবছর। তা এখনো ডিভোর্স হয় নি কেন? কারণটা কি?
কারণ কিছুই নেই—
নিশ্চয়ই আছে। কি কারণ বলুন?
বলতে পারবো না—আমি বলতে পারবো না! বলতে বলতে আবার দুহাতে মুখ ঢাকলো বিশাখা।
একটু থেমে কিরীটী বললে, আপনি না বললেও আমি তা ঠিক জানতে পারবো বিশাখা দেবী—
আমি—আমি যাই—
আসুন।
বিশাখা অতঃপর সোফা থেকে উঠে টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
একটু পরেই পাশের ঘর থেকে সাধন দত্ত এসে ঐ ঘরে ঢুকলেন।
আশ্চর্য দাওয়াই বাতলেছিলেন তো মিঃ রায়! দত্ত বলেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আশ্চর্যের কিছুই নেই এতে মিঃ দত্ত—
আশ্চর্য নয়! কি বলেন, একেবারে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে!
আসবেই তো—
আপনি জানতেন ও আসবে?
জানতাম। এ যে যাকে বলে প্রাণের টান! একটু চোখ খোলা থাকলে আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন মিঃ দত্ত।
কি বলছেন!
হ্যাঁ তাই, আজ সকালে ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে মুহূর্তে ওর হাতের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়েছিল—
আংটি!
হ্যাঁ, ওর ডান হাতের অনামিকায় যে নাম মিনা করা আছে—সে নামটা হচ্ছে নীরেন।
আশ্চর্য, আপনি তাও দেখেছেন?
ভাল করে চোখ মেলে সব না দেখলে বুঝবো কি করে?
কথাটা বলে উঠে গিয়ে কিরীটী ঘরের কোণে ফোন ডায়েল করতে শুরু করে এবং নিম্নকণ্ঠে কার সঙ্গে যেন ফোনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে কিরীটী পুনরায় এসে নিজের জায়গায় বসতেই সাধন দত্ত বলেন, বিশাখা দেবীর কথাবার্তা শুনে এবারে তো আপনি মানবেন নিশ্চয়ই যে, নীরেনবাবুই সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন গলায় সিল্ককর্ডের ফাঁস দিয়ে!
তা যদি বলেন তো বিশাখাই বা হত্যাকারিণী নয় কেন?
কি বললেন?
বলছিলাম বিশাখাও তো হত্যা করে থাকতে পারে সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে। কেবল বিশাখাই বা বলি কেন, সুসীমবাবু এবং আমাদের ডাঃ সেনও সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করে। থাকতে পারে।
কিরীটীর শেষের কথায় কেমন যেন বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল্ করে চেয়ে থাকেন সাধন দত্ত ওর মুখের দিকে।
সুনন্দার মৃত্যুটা অত্যন্ত জটিল মিঃ দত্ত এবং হত্যাটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকারী অত্যন্ত কৌশলে সেরাত্রে হত্যা করলেও হত্যা করবার জন্য সে পূর্ব হতেই প্রস্তুত করেছিল নিজেকে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, না মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সুনন্দাকে হত্যার উদ্দেশ্যটা যে সেরাত্রে হত্যাকারীর কি ছিল, সেটাই এখনো আমার কাছে স্পষ্ট হয় নি। যদি একটা ব্যাপারে কারো সাহায্য পেতাম—
কি?
সুনন্দার অতীত জীবনটা যদি জানতে পারতাম! কিন্তু মৃণাল সুসীমবাবু বা নীরেনবাবু–কেউই কিছু বলবে না আমি জানি!
কথাগুলো বলতে বলতে সহসা যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়, স্পষ্ট ও দৃঢ়কণ্ঠে সে বলে, কিন্তু বলতে তাদের হবেই একদিন-সব কথা বলতে তাদের হবেই!
আবার যেন সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঝিমিয়ে আসে, কতকটা যেন আপন মনেই বলে, কিন্তু কেমন করে—কেমন করে–
ঢং ঢং ঢং। ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি এগারটা ঘোষিত হলো।
সাধন দত্ত বলেন, রাত এগারটা, আমি উঠলাম।
সাধন দত্ত উঠে পড়লেন।
কিরীটী তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল।
সেরাত্রে দুর্ঘটনার স্থানে উপস্থিত যারা ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষ দুটি লোকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো এখনও তার বাকী আছে।
বিষ্ণু দে আর আলফ্রেড ঘোষ। ট্রাফিক্ সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ এলিসকে একটু আগে সে আলফ্রেড-এর বিষয়ে কাল তাকে জানাবার জন্য ফোন করে দিয়েছে।
আর বিষ্ণু দে—সে বর্তমানে কলকাতায় নেই।
দুর্ঘটনার পরের দিনই সে ইন্সুরেন্স কোম্পানির একটা জরুরী কাজে দিল্লীতে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, সে নাকি পরশু-তরশু ফিরছে।
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকলো।
কি হলো, আজ সারাটা রাত্রি পায়চারি করেই কাটাবে নাকি?
সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারে একটা মীমাংসা আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না কৃষ্ণা!
মেয়েদের মন—ও যদি এত সহজেই তুমি বুঝতে! চল, রাত দুটো বাজে—শোবে চল।
চমকে ওঠে কিরীটী স্ত্রীর কথায়, বলে, কি-কি বললে? মেয়েদের মন!
হ্যাঁ, হ্যাঁ–চল।
কিন্তু কৃষ্ণা, সুসীমবাবুর সেদিনকার সব কথাও তত তোমাকে আমি বলেছি সুনন্দা চ্যাটার্জী সম্পর্কে–
তোমার সুসীমবাবুর কথা আর বলল না, আস্ত একটি গর্দভ! নইলে এত বড় ভুলটা সে কি করে করলো?
ভুল!
নয়? সুনন্দা তাকেই জেনো ভালবাসত—
তাই যদি হবে তো—
তাকে বিয়ে করলো না কেন, এই তো? কিন্তু—
কিন্তু কি কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে, কিন্তু এখন থাক! চল তো শোবে। ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে–চল!
.
১৩.
আরো দুদিন পরে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা পুরাতন ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে এসে সাধন দত্ত আর কিরীটী তার গাড়ি থেকে নামলো।
রাত তখন প্রায় সোয়া এগারটা হবে। পাড়াটা ইতিমধ্যেই যেন নিঝুম হয়ে গিয়েছে।
পুরাতন চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। একতলায় সব দোকান। দোকানের দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উপরে দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় সর্বসমেত বারোটি ফ্ল্যাট।
ছোট ছোট ফ্ল্যাট। বেডরুম ও সিটিংরুম নিয়ে মাঝারি সাইজের দুখানা করে ঘর, বাথরুম, কিচেন আর সামনে এক চিলতে করে ব্যালকনি। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে বরাবর একতলা থেকে চারতলা শেষ হয়ে সেই চারতলার ছাত পর্যন্ত। নানা ধরনের ভাড়াটে এসে ভিড় করেছে ফ্ল্যাটগুলোতে। তবে বেশীর ভাগই সব ভারতীয় ক্রিশ্চান ও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান।
রাত সোয়া এগারোটা হলেও সব ফ্ল্যাটের তখনো আলো নিভে যায় নি। হাসি গান ও বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে কোন কোন ফ্ল্যাটে। অনেক দিনের পুরাতন বাড়ি, তার উপরে বোধ হয় অনেক বছর কোন সংস্কারও হয় নি।
বহু জায়গায় সিঁড়ির সিমেন্ট চটে ইট বের হয়ে পড়েছে। কাঠের রেলিংটায় যে কত ময়লা আর ধুলো, তেল আর ঘাম জমে জমে বিচিত্র এক রূপ নিয়েছে তা বলা দুঃসাধ্য! দেওয়ালের চুনকামের অবস্থাও তাই। বাড়িটার মধ্যে আলো বাতাস খুব বেশী খেলে বলেও মনে হয় না। একটা ভ্যাপসা সোঁদা সোঁদা গন্ধ সর্বত্র।
গেট খোলাই ছিল। কেবল এক পাশে একজন মুসলমান দারোয়ান খাটিয়ার উপর বসেছিল।
ওদের দেখে, বিশেষ করে সাধন দত্তর গায়ে পুলিসের ইউনিফর্ম তাকে যেন তটস্থ করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
আলফ্রেড ঘোষ এই বাড়িতে থাকে? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ সাব, যাইয়ে না—তিনতল্লামে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট।
সাব হ্যায়?
জী।
কিরীটী আর সাধন দত্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।
উঠেই সোজা বাঁদিকে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট। দরজার গায়ে কলিং বেল ছিল। কলিং বেলের বোতামটা টেপেন সাধন দত্ত।
একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়—অর্ধেক খোলা দরজার ফাঁকে একটা কুৎসিত পুরুষের মুখ উঁকি দিল, হুস দ্যাট!
ভারী কর্কশ কণ্ঠস্বর।
মিঃ আলফ্রেড ঘোষ? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
ইয়েস!
মে আই কাম্ ইন্?
কিন্তু কি দরকার তোমার এত রাত্রে একজন ভদ্রলোকের কাছে, জানতে পারি কি অফিসার?
দরকার একটা আছে বৈকি মিঃ ঘোষ!
কয়েকটা মুহূর্ত ভ্ৰ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সাধন দত্তর মুখের দিকে আলফ্রেড।
সিঁড়ির স্বল্প আলো-আঁধারে পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত সাধন দত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় আলফ্রে কিছু ভাবে।
তার ঘরের দরজায় পুলিস সাধন দত্তর ঐ মুহূর্তে এসে আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটা অভূতপূর্ব তো বটেই, আকস্মিকও!
এবং তাকে যে খানিকটা ধূর্ত শিকারী বিড়ালের মত সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে, কিরীটী ঐ মুহূর্তে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথাটা বেশ বুঝতে পারে।
তবু ওরা দুজনেই অপেক্ষা করে।
কিরীটী আর সাধন দত্ত। কারণ কিরীটী বার বার করে আসবার সময় সাধন দত্তকে বলেছিল, আলফ্রেকে যেন কোনরকম হুমকি দিয়ে বা জোরজবরদস্তি করে আগে থাকতেই ভয় দেখানো না হয়।
যাই হোক, আলফ্রেড ব্যাপারটা কোন রকম অনুমান করতে পারুক আর নাই পারুক, ওদের ঘরে ঢুকতে না দেওয়া অসমীচীন ও যুক্তিযুক্ত হবে না বুঝতে পেরেই হয়ত দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দরজা থেকে এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং মৃদু কণ্ঠে চাপা বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই
অনিচ্ছাকৃত আহ্বান জানাল, কাম!
আগে সাধন দত্ত ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করলো।
সমস্ত ঘরটা যেন অগোছাল, অপরিচ্ছন্ন।
একধারে গোটাচারেক বহু পুরাতন জীর্ণ সোফা ও সামনে তার একটা গোল টেবিল, অন্যদিকে একটা পুরাতন হ্যাট-র্যাক ও একটা বহুকালের রংচটা অর্গান বোধ হয়।
দেওয়ালে খানকতক কুৎসিত ভঙ্গির ছবিওয়ালা ক্যালেণ্ডার ঝুলছে। ঘরের মধ্যে সর্বসমেত গোটা-দুই মাত্র জানালা। মলিন জীর্ণ নেটের পর্দা দেওয়া। দুটি দরজার একটি সদর, অন্যটি বোধহয় ওপাশের ঘরে প্রবেশের মধ্যবর্তী দরজা।
একটি জীর্ণ মলিন পিংক কালারের পর্দা ঝুলছে সেই দ্বারপথে। মেঝেতে জীর্ণ মলিন একটা কার্পেট বিস্তৃত।
সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা যেন ঘিঘিনে ভাব।
ঘর শুধু নয়, কিরীটী দেখছিল আলফ্রেড লোকটাও যেন অনুরূপ দেখতে।
বেঁটে গুণ্ডা প্যাটার্নের চেহারা লোকটার। মাথার চুল রুক্ষ, কাঁচায়-পাকায় মেশানো। মুখময় ছোট ছোট দাড়ি। বোধ হয় দিন-দুই ক্ষৌরি হয় নি লোকটার। তোবড়ানো গাল। টিয়াপাখীর ঠোঁটের মতো নাকটা যেন বেঁকে সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। রোমশ ভ্র। পরিধানে একটা স্ট্রাইপ দেওয়া স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে জীর্ণ মলিন একটা ঝলঝলে অনুরূপ রাত্রিবাস।
বসতে পারি? সাধন দত্তই ইংরাজীতে শুধান।
বসুন।
পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিল আলফ্রেড।
তুমি এখানে বুঝি একাই থাক মিঃ ঘোষ? সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন করলেন।
সে খবরে তোমার কোন দরকার আছে কি অফিসার? এই আনআর্থলি আওয়ারে একজন নিরীহ ভদ্রলোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো কেন সেইটুকুই সর্বাগ্রে জানালে বাধিত হবো।
নিশ্চয়ই। আমরা এসেছি একটা মার্ডার কেসের তদন্তের ব্যাপারে।
হোয়াট? কি বললে?
বললাম তো, একটা হত্যার তদন্তের ব্যাপারে—
কিন্তু–
দিন-দশেক পূর্বে ভবানীপুর অঞ্চলে একটা মার্ডার হয়, তুমি বোধ হয় সংবাদপত্রে পড়ে থাকবে মিঃ ঘোষ–
সংবাদপত্র আমি পড়ি না।
পড় না!
না।
কখনো পড়ো না?
না। যত সব মিথ্যা খবর—আর ট্রাস্ খবর!
ও। তা ভবানীপুরে দিন-দশেক আগে অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জী নামে এক মহিলা নিহত হন, তাঁরই অর্থাৎ সেই কেসেরই তদন্তের ব্যাপারে এসেছি আমরা।
কয়েক মুহূর্ত অতঃপর ঘোষ যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তুমি বলছো ভবানীপুর না কোথায় দিন দশেক আগে কে একজন মার্ডারড হয়েছে, তার জন্যে আমার কাছে আসবার তোমার কি প্রয়োজন হলো বুঝতে পারছি না তো!
তুমি অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জীকে চিনতে না?
নো, নেভার! নেভার হার্ড দি নেম ইভেন্!
নামও শোন নি কখনো তার? প্রশ্ন করলো এবারে কিরীটীই।
সিওরলি নট! হু ইজ সী?
পরিচয় তো দিলাম একটু আগে! আবার কিরীটী বললে।
আমিও তো বললাম, জীবনে তার নামই আমি কখনো শুনি নি।
অথচ আমরা জানি, যেরাত্রে বকুলবাগান রোডে সুসীম নাগের বাড়িতে সুনন্দা চ্যাটার্জী নিহত হন, তুমি সেরাত্রে সেখানে উপস্থিত ছিলে!
আর ইউ ম্যাড? আই নেভার ইভেন্ হার্ড অফ দেম্! তাছাড়া কবে বললে, দশ দিন আগে?
হ্যাঁ, গত মোলই জুন—কিরীটী বলে।
লেট মি রিকলেক্ট! ইয়েস্ ইয়েস্, আই ওয়াজ অন ডিউটি দ্যাট নাইট!
ডিউটিতে ছিলে?
অফ্ কোর্স! ইয়েস—আই নাউ ডিসটিংকট্রলি রিমেম্বার—আই ওয়াজ অন্ ডিউটি দ্যাট নাইট!
কিন্তু আমি বলছি, ইউ ওয়্যার প্রেজেন্ট দেয়ার দ্যাট নাইট! গম্ভীর কণ্ঠে যেন কিরীটী প্রতিবাদ জানাল।
ননসেন্স! এনিথিং মোর হ্যাভ ইউ গট টু সে? ই নট, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম! বাজ অফ—
শোন মিঃ আলফ্রেড ঘোষ, উপযুক্ত প্রমাণ আছে আমাদের কাছে যে সে রাত্রে তুমি সে বাড়িতে উপস্থিত ছিলে।
ড্যাম রট!
নো মিঃ ঘোষ, তোমার বৌ সাক্ষী দেবে—
হোয়াট? মাই ওয়াই?
কথাটা হঠাৎ শোনামাত্রই ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতই চমকে ওঠে বলে মনে হয় আলফ্রেড ঘোষ।
হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী—বিশাখা ঘোষ।
হঠাৎ যেন কিরীটীর শেষের কথায় জোঁকের মুখে নুন পড়লো।
বিশাখা নামটা কিরীটীর মুখ থেকে উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আলফ্রেডের মুখের চেহারাটা একেবারে সত্যি-সত্যিই কেমন যেন মুহূর্তে বদলে গেল।
কয়েকটা মুহূর্ত সে কোন কথাই অতঃপর বলতে পারে না।
তারপর একসময় আমতা আমতা করে বলে, বিশাখা!
হ্যাঁ বিশাখা ঘোষ, তোমার স্ত্রী। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু ততক্ষণে আলফ্রেড নিজেকে সামলে নিয়েছে, হঠাৎ হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠে।
আমার ওয়াইফ! বিশাখা! ইয়েস, ওয়ান্স আপন এ টাইম দ্যাট বীচ্ ওয়াজ মাই ওয়াইফ– কিন্তু অনেক কাল আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে—
না। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়, তোমাদের ডিভোর্স এখনও হয় নি।
কিরীটীর কথার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় দপ্ করে যেন হাসির শেষ রেশটুকুও নিভে গেল আলফ্রেডের মুখের উপর থেকে।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো মিঃ আলফ্রেড,ঘোষ, সব কিছু সংবাদ নিয়েই আমরা এসেছি তোমার কাছে!
হ্যাঁ, না—হয় নি বটে আজো ডিভোর্স, কিন্তু কিন্তু, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই, তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দিয়েছি।
মুক্তিই যদি দিয়ে থাক তো ডিভোর্স আজো তোমাদের হয় নি কেন?
হয় নি মানে হয় নি—এমনিই হয় নি!
তাই কি? না অন্য কোন গুরুতর কারণ আছে?
কারণ! কি কারণ?
যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে যে হত্যা করা যায় না!
কি বললে?
বলছিলাম যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে কি হত্যা করা যায়? মিঃ ঘোষ, মাইনে তো তুমি পাও তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ সব মিলিয়ে, তাই না?
হ্যাঁ। তাহলে লয়েডস্ ব্যাঙ্কে তোমার অ্যাকাউন্টে গত তিন বছরে চোদ্দ হাজার টাকা কোথা থেকে এলো?
সে—সে আমি, মানে—আই হ্যাভ আরনড দ্যাট মানি!
আরনড! বাট হাউ? কাম-কনফেস্ এভরিথিং! গোপন করার চেষ্টা করলে জেনো বিপদই ডেকে আনবে—
আমাকে—আমাকে, মানে-হ্যাঁ, আমাকে একজন টাকাটা দিয়েছে—
কে দিয়েছে? তোমার স্ত্রী নিশ্চয়?
হ্যাঁ।
ঠিক সেই সময় সাধন দত্ত বললেন, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট মিঃ ঘোষ!
অ্যারেস্ট! বা হোয়াট্ ফর?
যথাসময়েই জানতে পারবে।
.
১৪.
আলফ্রেড ঘোষকে গ্রেপ্তার করবার পরের দিনের ঘটনা।
বিষ্ণু দে কলকাতায় ফিরে এলো।
মৃণাল সমস্ত ব্যাপারটাই জানত, তার মুখ থেকেই বিষ্ণু দে সব শুনলো। এবং এও সে শুনলো মৃণালের মুখেই যে, সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারে কিরীটী তাদের সকলকেই নাকি সন্দেহ করেছে। এবং মৃণালকে কিরীটী বলে রেখেছে, বিষ্ণু দে কলকাতায় ফিরে এলেই তার সঙ্গে কিরীটী একবার দেখা করতে চায়।
বিষ্ণু দে বললে, কিন্তু আমি-আমি তার সঙ্গে দেখা করে কি করবো?
দেখা করা তোমার কর্তব্য। মৃণাল বলে।
কর্তব্য বলছো! শুধায় বিষ্ণু দে।
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
কারণ সেই দুর্ঘটনার রাত্রে আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম—
কিন্তু আমরা ছাড়াও তো সে রাত্রে সেখানে আরো অনেকেই উপস্থিত ছিল।
তা অবিশ্যি ছিল, তবে আমরা তার অর্থাৎ সুনন্দার বিশেষ পরিচিত ছিলাম।
তাতে কি এমন অপরাধ হলো?
অপরাধ কিছু নয়—
তবে?
হয়তো আমাদের মত তোমাকেও তার কিছু জিজ্ঞাস্য থাকতে পারে। চলই না, একবার দেখা করে আসবে।
বলছো চল, কিন্তু সত্যি বলছি মৃণাল, ব্যাপারটা আমার কেন যেন আদপেই ভাল লাগছে!
স্পষ্ট একটা বিরক্তিই যেন বিষ্ণু দের কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।
ভাল লাগালাগির প্রশ্ন তো এখানে নয়, দেখা করাটা তোমার কর্তব্য।
বেশ, তাহলে সুসীমকেও ডেকে পাঠাও।
সুসীম!
হ্যাঁ, যেতে হয় একসঙ্গে তিনজনই যাবো–
মৃণাল উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে সুসীমের নম্বরে ডায়েল করতে যাবে, এমন সময় দরজার গোড়ায় সুসীমকে দেখা গেল।
এই যে মৃণাল, বিষ্ণু তোমরা দুজনেই আছে—এদিকে কাল রাত্রে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার–
আবার সাংঘাতিক ব্যাপার কি হলো? মৃণাল শুধায়।
কাল রাত্রে বিশাখার life-এর ওপরে নাকি একটা attemept হয়েছিল–
সে কি!
দুজনেই সুসীমের কথায় চমকে ওঠে।
হ্যাঁ। But thank God, she has narrowly escaped! একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে—
কিন্তু ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলবে? অধীর কণ্ঠে মৃণালই প্রশ্ন করে।
ঘুমন্ত অবস্থায় তার গলাতে ফাঁস দিয়ে—
ফাঁস! অর্ধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে যেন বিষ্ণু দে।
হ্যাঁ, ফাঁস পরানো হয়েছিল। তবে হঠাৎ বিশাখার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আততায়ীকে ধাক্কা দিয়ে সে ফেলে দেয়—
বল কি সুসীম, how horrible! যা বলছে সত্যি? বিষ্ণু শুধায়।
সত্যি।
তারপর? মৃণাল শুধায়।
তারপর আর কি, হত্যাকারী উধাও হয়ে যায়!
দেখেছিল—মানে দেখতে পেয়েছিল বিশাখা হত্যাকারীকে?
না। ঘরের আলো নেভানো ছিল—
মৃণালই এতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিল। বিস্ময়ে হতভম্ব বিষ্ণু নিঃশব্দে শুনছিল, এবারে বিষ্ণু প্রশ্ন করলো, কিন্তু তুমি—তুমি সে কথা জানলে কি করে সুসীম?
আমি?
হ্যাঁ।
আমি বিশাখার বাড়িতে গিয়েছিলাম আজ সকালে, দেখি বেচারা আকস্মিক ঘটনায় আর ভয়ে একেবারে যেন সিঁটিয়ে রয়েছে।
তা তো হবারই কথা। মৃণাল সহানুভূতির সঙ্গে জবাব দেয়।
কিন্তু আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মৃণাল, বিশাখার উপরে আবার হত্যার attempt হলো কেন!
মৃণাল সহসা যেন কোন জবাব দিতে পারে না। সুসীম, মৃণাল ও বিষ্ণু অতঃপর তিনজনই যেন কেমন মুহ্যমানের মত বসে থাকে।
একটু আগে যে মৃণাল ও বিষ্ণু কিরীটীর ওখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, ঐ মুহূর্তে যেন সে কথাটাও তারা বিস্মৃত হয়।
একে তো সুনন্দার সেরাত্রে আকস্মিক হত্যার ব্যাপারটাই সকলকে কেমন স্তম্ভিত বিমূঢ় করে দিয়েছে, তার ওপর এই নতুন দুঃসংবাদ। ভেবে পায় না যেন ওরা, হঠাৎ বিশাখার ওপরই বা আবার কেন অটেমপ্ট নেওয়া হলো!
আর কেই বা নিল? তবে কি এও সুনন্দার হত্যাকারীরই কাজ? কিন্তু কেন?
সুনন্দাকেই বা কেন হত্যা করা হলো, আবার বিশাখার উপরেই বা গতরাত্রে হত্যার প্রচেষ্টা হলো কেন?
ঘটনাপ্রবাহ কোথায় চলেছে?
.
সত্যি, ব্যাপারটা শুধু আকস্মিকই নয়—রীতিমত একটা চিন্তারও বৈকি।
পনের দিনও হয় নি, মৃত্যু তাদের একজনকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে, এবং সেই দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কা এখনো যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো তাদের ঘিরে রয়েছে। ইতিমধ্যেই আবার মৃত্যুর কালো ছায়া তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কেন–কেন এ মৃত্যুর পদসঞ্চার!
বিষ্ণু দে আর মৃণাল সেন দুজনকেই যেন স্তব্ধ বিমূঢ় করে দিয়েছে সুসীমের দেওয়া সংবাদটা। হত্যাকারী তাদের মধ্যে থেকে একজনকে হত্যা করে নিশ্চিন্ত হয় নি, আবার সে তার মৃত্যুস হাতে রাত্রির অন্ধকারে অলক্ষ্যে আর একজনের পশ্চাতে এসে গতরাত্রে দাঁড়িয়েছিল!
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সুসীমই আবার কথা বলে, শ্রাবণী ভয়ানক ভয় পেয়ে গিয়েছে সংবাদটা শুনে। সে আর এক মুহূর্ত কলকাতায় থাকতে চায় না। শিলং-এ তার এক মাসী আছেন, ভাবছি কালই তাকে পাঠিয়ে দেবো সেখানে। যাক্, কিছুদিন সেখানে গিয়েই না হয় থেকে আসুক।
মৃণাল বলে, সেই ভাল, তাকে সেখানেই পাঠিয়ে দাও সুসীম।
সেই ব্যবস্থাই করছি।
কিন্তু কিরীটী রায়কে সর্বাগ্রে গতরাত্রের সংবাদটা দেওয়া প্রয়োজন। মৃণাল বলে।
ঠিক বলেছো মৃণাল।
এক কাজ করলে হয় না! মৃণাল সুসীমের মুখের দিকে চেয়ে শুধায়।
কি?
ফোন করে এখানেই একবার কিরীটী রায়কে আসতে বললে হয় না!
সেই ভালো, তাই বরং ফোন করে দাও। সুসীম সায় দেয়।
মৃণাল উঠে পড়লো কিরীটীকে ফোন করতে।
.
১৫.
বিষ্ণু দের মনটা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে উৎসবের সেই রাতটার কথাই বার বার যেন ভেসে উঠছিল।
উৎসবের আনন্দের মধ্যে সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুটা এবং সমস্ত ঘটনার নাটকীয় বীভৎসতাটা আজো সে যেন ভুলতে পারছে না।
দিল্লীতে তার যাবার কথা ছিল আরো কয়েকদিন পরে, কিন্তু এক মুহূর্তও সে যেন আর টিকতে পারছিল না কলকাতা শহরে।
পরের দিনই তাই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু দিল্লীতে গিয়েও স্বস্তি পায় নি এক মুহূর্ত বিষ্ণু।
সর্বক্ষণ যেন সেই দুঃস্বপ্নটা জাগরণে ও নিদ্রায় তাকে তাড়া করে নিয়ে ফিরেছে। সুনন্দার সঙ্গে পরিচয় ছিল বটে বিষ্ণুর, কিন্তু সসীম বা মৃণালের মতো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। নিঃসন্দেহে ভাল লাগতো সুনন্দাকে বিষ্ণুর, কারণ সুনন্দার ছিল একটা বিচিত্র আকর্ষণ। যে আকর্ষণকে বিষ্ণু দে কেন, অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সে-ও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সুনন্দাকে মনে মনে হয়তো কিছুটা ভালবেসেছিল বিষ্ণু—তাই সে সুনন্দার নিষ্ঠুর মৃত্যুতে আঘাত পেয়েছিল মনে।
দিল্লীতে বসে কয়েকদিন ধরে বিষ্ণু অনেক ভেবেছে, কে সুনন্দাকে অমন করে হত্যা করলো! কিন্তু ভেবে-ভেবেও কোন কূলকিনারা পায় নি ব্যাপারটার।
মৃণাল ঘরে ফিরে এসে বললে, কিরীটী এখুনি আসছে।
তার পরের আধঘণ্টা সময় যেন ওদের একটা বিচিত্র স্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হয়।
সকলের মধ্যেই একটা বিশেষ উত্তেজনা যেন পরিলক্ষিত হয়, অথচ কেউ কিছু বলছে না। মধ্যে মধ্যে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে তিনজনই।
প্রত্যেকেই যেন ভাবছে তখন।
.
মৃণালও ভাবছিল সুনন্দার কথাটাই। এবং গত কদিন ধরে সর্বক্ষণই প্রায় সে ভাবছিল বুঝি সুনন্দার কথাটা।
সুনন্দার মৃত্যুর ব্যাপারটা সত্যিই তাকে যেন বিস্ময়াবিভূত করে দিয়েছে।
কিরীটী স্পষ্টাস্পষ্টি তাকে মুখে কিছু না বললেও তার হাবভাব কথাবার্তা সব কিছুর মধ্যেই যেন মৃণালের মনে হয়েছে, কিরীটী তাদের কবন্ধুকে কেমন একটু সন্দিগ্ধভাবেই দেখতে শুরু করেছে।
সত্যিই তো–সন্দেহ হবারই তো কথা!
তাদের সকলের সঙ্গেই যখন ছিল সুনন্দার এতদিনকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও পরিচয়, তখন কতকটা স্বাভাবিকভাবেই তো তাদের উপরে সন্দেহ এসে পড়তে পারে।
তারপর নীরেনের ব্যাপারটা।
নীরেন তাদের এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, অথচ তারা কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি কখন ইতিমধ্যে তার ও সুনন্দার মধ্যে পরিচয় ঘটলো এবং সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলো। এবং সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, সুনন্দার ঘরের টেবিলের টানার মধ্যে নীরেনের চিঠিগুলো ঐভাবে আবিষ্কৃত না হলে হয়তো ব্যাপারটা আজও ওরা জানতে পারতো কিনা সন্দেহ।
বিশাখা অবিশ্যি ওদের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানত, কিন্তু কই বিশাখাও তো এতদিন ওদের কিছু জানতে দেয় নি! বিশাখারই বা ব্যাপারটা গোপন করার কি কারণ থাকতে পারে? যতদূর মনে হয়, বিশাখা হয়তো ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছে!
কিন্তু কেন? বিশেষ করে বিশাখা যখন অমন তীব্রভাবে সুনন্দাকে ঘৃণা করতো!
আশ্চর্য বিশাখার সুনন্দার প্রতি এতটা ঘৃণার ব্যাপারটাও এতদিন জানত না মৃণাল!
কখন কোন প্রসঙ্গেই কথাটা সে ইতিপূর্বে প্রকাশ করে নি!
সেদিন বিশাখার মুখে আচমকা কথাগুলো শুনে মৃণালের তাই বুঝি বিস্ময়ের অবধি ছিল। সে যেন চমকে উঠেছিল বিশাখার মুখে কথাগুলো শুনে। কিন্তু কেন যে এই তীব্র ঘৃণা, সেটাই এখন পর্যন্ত ভেবে কিছু পায় নি মৃণাল।
কি এমন কারণ থাকতে পারে বিশাখার সুনন্দার প্রতি ঐ তীব্র ঘৃণার? তবে কি বিশাখাও মনে মনে নীরেনকেই ভালবাসত?
ব্যাপারটা যেন সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে তোলে।
এতদিন জেনে এসেছে সুনন্দার মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত সুনন্দা সুসীমকেই সর্বাপেক্ষা বেশী ভালবাসত, অথচ এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়।
সুনন্দা ভালবাসত সব চাইতে বেশী নীরেনকেই। আবার এতদিন মনে হয়েছে মৃণালের, বিশাখা বুঝি এসব ভালবাসাবাসির মধ্যে আদৌ ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা নয়, বিশাখাও বোধ হয় নীরেনকেই ভালবাসত।
কিন্তু নীরেন–নীরেন কি সে কথা জানত? চকিতে ঐ সময় একটা চিন্তা মৃণালের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়। তবে কি সুনন্দার ঐ নিষ্ঠুর হত্যার মূলে ছিল ভয়াবহ একটা কুটিল হিংসা!
শিউরে ওঠে যেন মৃণাল কথাটা মনে হতেই।
তবে—তবে কি বিশাখাই হত্যা করেছে সুনন্দাকে?
সুসীমের মনের মধ্যেও বিচিত্র চিন্তা তরঙ্গ তুলে যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল তার, এর চাইতে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
শ্রাবণীকে বিয়ে করে সুনন্দাকে সে জব্দ করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুনন্দা মরে এখন মনে হচ্ছে সে-ই বেশী জব্দ হয়েছে। জীবনটাকে যেন আরো বিষময় করে তুলেছে তার স্ত্রী শ্রাবণী।
সে-রাত্রি থেকে শ্রাবণীর যেন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে। গতরাত্রে তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত রীতিমত একটা ঝগড়াই হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণীর নাকি সারাটা রাত ঘুম হয় না। সর্বক্ষণ মনে হয় এক অশরীরী নারী যেন তার আশেপাশে ঘুরছে।
শ্রাবণী বলে, পারছি না—এখানে আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। আমাকে তুমি এখান থেকে যেতে দাও, নচেৎ নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাবো!
শ্রাবণীর ঈদৃশ আচরণে শেষ পর্যন্ত সুসীমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল।
সুসীম বেশ একটু কড়াভাবেই বলেছিল, এটা তোমার সত্যিই কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না শ্রাবণী।
কি বলতে চাও তুমি? স্পষ্ট তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্নটা করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েছিল শ্রাবণী।
তা নয় তো কি! এতগুলো লোক আমরা এ বাড়িতে রয়েছি, একা তুমিই কেবল টিকতে পারছো না! কিন্তু কেন বলতে পারো? আর এ সময় হঠাৎ দুম করে তুমি চলে গেলে লোকেই বা ভাববে কি?
এর মধ্যে লোকের ভাবাভাবির কি থাকতে পারে শুনি?
থাকতে পারে বৈকি। তাছাড়া আমি বলেছিই তো, দুটো দিন সবুর কর, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে শিলং-এ রেখে আসবো।
না, আমাকে তুমি ছেড়ে দাও।
দুটো দিনও তুমি অপেক্ষা করতে পারবে না?
না, না—
সত্যি আমি আশ্চর্য হচ্ছি শ্রাবণী, আমার মনের এই অবস্থা—
মনের এ অবস্থা যে তোমার হবে সে তো তুমি জানতেই।
কি বললে?
ঠিকই বলছি। ভুলতে যদি তাকে পারবেই না জানতে, তবে কেন আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে গিয়েছিলে বলতে পার?
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, হ্যাঁ– কার কাছে তুমি কি ঢাকা দিতে চাইছো? এ নাটক সৃষ্টি করবার আমাকে নিয়ে তো কোন প্রয়োজনই ছিল না!
তুমি থামবে শ্রাবণী?
তিক্ত একটা চাপা তিরস্কারের মতই যেন কথাটা বলে ওঠে সুসীম।
কি, চোখ রাঙাচ্ছ—কিন্তু সে সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। শোন, কালই আমি চলে যাচ্ছি–
ঠিক আছে, যেও।
রাগ করেই অতঃপর সুসীম ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। এবং বাকী রাতটা সে পথে পথেই ঘুরে বেড়িয়েছে উদ্ভ্রান্তের মত।
.
সকালে গৃহে ফিরেই টের পেয়েছে সুসীম, আজই চলে যাবে শ্রাবণী। সব কিছুর তোড়জোড় সে দেখে এসেছে। ওকে গৃহে ফিরতে দেখে ওর বোন সুধা ঘরে এসে ঢুকল। মাথার চুল রুক্ষ, ক্লান্ত বিপর্যস্ত চেহারা সুসীমের।
দাদা!
কি?
সারারাত কাল কোথায় ছিলে?
সুসীম কোন জবাব দেয় না বোনের প্রশ্নের।
তোমরা কি শুরু করেছে জানি না! এদিকে বৌদি দেখছি সব গোছগাছ করে ফেলেছে আজই রাত্রে সে নাকি শিলং-এ তার মাসীর ওখানে যাচ্ছে!
ভুল হয়ে গিয়েছে সুধা, জীবনে বোধ হয় এত বড় ভুল আর হয় নি আমার। আর ভুল যখন হয়েছেই, তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে বৈকি।
বৌদি আর ফিরবে না শুনলাম দাদা!
আমি জানি—
তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুধা। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
তারপর এক সময় মৃদুকণ্ঠে আবার ডাকে, দাদা!
কি?
কি হয়েছে আমাকে বলবে?
আমাকে বিরক্ত করিস না সুধা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।
সুধা বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
কিন্তু সুসীমও ঘরে থাকতে পারে না। সে-ও বের হয়ে পড়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
১৬-১৮. পঞ্চশরের কীর্তি
কিরীটী এসে ঘরে ঢুকলো।
সুসীমের সঙ্গে কিরীটীর পূর্বেই পরিচয় হয়েছে, বিষ্ণু দের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় করিয়ে দিল মৃণালই।
কিরীটী বললে, ভালই হয়েছে ডাক্তার, তুমি আমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছো। আমিও চাইছিলাম তোমাদের তিনজনকে একসঙ্গে মিট করতে।
ফোনে আমি সে-সময় সব কথা তোমাকে বলি নি কিরীটী। কাল রাত্রে আর একটা দুর্ঘটনা প্রায় ঘটে গিয়েছিল আর কি–
জানি। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।
জানো! সবিস্ময়ে তাকায় মৃণাল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, জানি। বিশাখা দেবীর ওপরে কাল রাত্রে অ্যাটেম্পট হয়েছিল, এই তো?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি—
বিশাখা দেবী সকালেই আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন। অবিশ্যি ঐ ধরনের একটা কিছু যে শীঘ্রই ঘটবে, বিশেষ করে আলফ্রেডের গ্রেপ্তারের পর, সেটা আমি কতকটা অনুমান করেছিলাম।
তুমি অনুমান করেছিলে?
হ্যাঁ। শুধু তিনি কেন, আমি অনুমান করেছিলাম তোমাদের যে কোন একজনের ওপরেও হয়তো হত্যাকারী অ্যাটেম্পট নিতে পারে। কিন্তু যাক সে কথা, তুমি জানলে কি করে? তোমাকেও বুঝি বিশাখা দেবী ফোন করেছিলেন?
না, না—সুসীমই তো এসে একটু আগে বললে!
সুসীমবাবু?
বিস্ময়ে কিরীটী সুসীমের মুখের দিকে তাকাল।
সুসীমও তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।
Is it true, সুসীমবাবু?
কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, আমি সকালে ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম, গিয়ে শুনি সব। সসীম বললে।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, ও, তাই বলুন। আপনি তাহলে গিয়েছিলেন আজ সকালেই বিশাখা দেবীর বাড়ি!
হ্যাঁ।
যাক সেকথা। অ্যাটেম্পটু হয়েছিল—শেষ পর্যন্ত কিছু তো ঘটে নি!
কিরীটী একটু যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই কথাটা বলে।
সুসীম বলে, কিন্তু কি বলছেন আপনি মিঃ রায়, কিছু ঘটে নি বটে, তবে ঘটতে তো পারত!
তা হয়তো পারত, তবে ঘটে নি যখন–
তুমি যাই বল কিরীটী, আমার কিন্তু ব্যাপার দেখে কেমন হাত-পা পেটে সেঁধুবার যোগাড় হয়েছে!
ভয় নেই। মৃদু হেসে কিরীটী বোধ করি মৃণালকে সান্ত্বনাই দেয়।
ভয় নেই?
না।
আবার একসময় কিরীটী বলে, সেরাত্রের আপনাদের সকলের বক্তব্যই অবিশ্যি কিছু সাধন দত্তর কাছ থেকে এবং কিছু আপনাদের মুখ থেকেও শুনেছি, তবু আরো কিছু আমার আপনাদের সকলকেই জিজ্ঞাস্য আছে।
কিরীটীর মুখের দিকে তিনজনেই প্রায় একই সঙ্গে তাকালো।
কিরীটীও নিঃশব্দে সকলের মুখের উপরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললে, আপনারা হয়তো জানেন না এখনো, সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার জানা গিয়েছে
কি—কি জানা গিয়েছে? মৃণালই প্রশ্ন করে।
যদিও তার গলায় সরু সিল্ক-কর্ডের ফাঁস ছিল এবং মৃত্যুর কারণও যদিচ শেষ পর্যন্ত ফঁসের দ্বারা স্ট্র্যাংগল করে শ্বাসরোধ করেই, তথাপি আরও কিছু আছে, ফাস দেবার পূর্বে she was given morphine–
সে কি! চমকে প্রশ্ন করে মৃণাল।
হ্যাঁ ডাক্তার। মরফিনের সাহায্যে তাকে কিছুটা আধো ঘুমন্ত আধো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে
এনে পরে তার গলায় হত্যাকারী ফাঁস লাগিয়েছে। ফাঁস দেবার মুহূর্তে অবিশ্যি হত্যাকারী আরো কিছুটা কসাস হয়েছিল একটা ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে।
সকলেই স্তব্ধ হয়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিরীটী বলতে থাকে, হত্যাকারী যে শুধু কসাই ছিল তাই নয়, রসিকও বটে!
রসিক!
হ্যাঁ ডাক্তার, রসিকজন। হোমিওপ্যাথরা শুনেছি থুজা ঔষধের সাহায্যে unwanted, undesirable growthকে ধ্বংস করেন, এক্ষেত্রে হত্যাকারী থুজার শিশিতে ক্লোরোফরম এনে বোধ হয় সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিল। তোমরা হয়তো হত্যাকারীর রসিকতাটা ধরতে পারো নি মৃণাল, কিন্তু তার জন্য আক্ষেপের কারণ নেই, কারণ সে রসের সন্ধানটা যখন আমি অন্তত পেয়েছি, সে-সব কথা—যাক কারণ যথাসময়েই সব কিছুর ব্যাখ্যা আমি সকলের কাছে করবো, এখন যে জিজ্ঞাস্যগুলো আপনাদের কাছে আমার আছে সুসীমবাবু, সেগুলোই শেষ করে নেওয়া যাক।
পূর্ববৎ কিরীটীর মুখের দিকেই সকলে তখনো চেয়ে আছে যেন বোবা দৃষ্টিতে।
কিরীটী বলে, ময়নাতদন্ত থেকে জানা গিয়েছে সম্ভবত রাত এগারটা থেকে সোয়া এগারটার মধ্যেই সুনন্দা চ্যাটার্জী নিহত হয়েছিলেন। ডাক্তার তুমিই প্রথম বল, ঠিক ঐ সময়টাতে তুমি সেরাত্রে কোথায় ছিলে এবং কি করছিলে?
আমি!
হ্যাঁ, মনে করে বল। মানে সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হবার আধঘণ্টা পূর্বে–
আমি তখন ওপরের ছাতে নিমন্ত্রিতদের খাওয়ার তদারক করছিলাম।
কেউ তার সাক্ষী আছে?
সাক্ষী!
হ্যাঁ, witness—কারণ তা না-হলে তুমি যে সত্য কথা বলছো তার প্রমাণ হবে কি করে?
কেন সুসীম—সুসীমই তো জানে। সে-সময় সে একবার ছাতে গিয়েছিল।
কথাটা কি সত্য সুসীমবাবু? সুসীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে কিরীটী।
সত্যি। মৃদুকণ্ঠে সুসীম বলে।
তারপরই বোধ হয় ডাক্তার তুমি নেমে এসেছিলে নীচের হলঘরে তোমার বান্ধবীকে ডাকতে!
হ্যাঁ।
আচ্ছা রাত দশটা থেকে পৌনে এগারটার মধ্যে তুমি কোথায় ছিলে?
সে সময় আমি—আমি বোধ হয় হলঘরেই ছিলাম—
হলঘরে সে-সময় কাকে কাকে তুমি দেখেছো?
অনেকেই ছিল। তার মধ্যে বিষ্ণুকেও আমি দেখি—
বিষ্ণুবাবুকে তুমি দেখেছিলে?
হ্যাঁ, বিষ্ণু তখন সোফায় উপবিষ্ট সুনন্দার সঙ্গে দাঁড়িয়ে বোধ হয় কথা বলছিল—তাই না বিষ্ণু?.
বিষ্ণুর মুখটা যেন সহসা ঐ কথায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সে আমতা আমতা করে বলে, আমি—কই আমি তো–
বাঃ, মনে নেই তোমার! তারই কিছুক্ষণ পরে তো তুমি হরপ্রসাদবাবুকে হলঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছিলে, তোমার মাথাটার মধ্যে যেন কেমন করছে—
হ্যাঁ, হ্যাঁ—মনে পড়েছে বটে, ঠিক কেমন যেন আমার তখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বোধ হয় ভিড়ে আর গরমে—
গরমে নয় বিষ্ণুবাবু, তখন অন্য কারণে আপনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল!
সকলেই কিরীটীর কথায় চমকে যেন তার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু কিরীটী যেন খেয়ালই করে না ব্যাপারটা। সে পুনরায় বিষ্ণু দে-কেই প্রশ্ন করে, মিঃ দে, বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
তা বছর চার-পাঁচ হবে—
আর সুনন্দা দেবীর সঙ্গে?
ঐ রকমই হবে।
সুসীমবাবু, আপনার বিশাখা দেবীর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
বছর বারো-তেরো হবে। তারা একসময় আমাদের প্রতিবেশী ছিল।
তাহলে সুনন্দা দেবীর আগেই বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ নাগ, বিশাখা দেবী ও আলফ্রেড ঘোষের বিবাহ-বিচ্ছেদ আজও হয় নি কেন বলতে পারেন?
না।
যাকগে ওদের কথা, এবারে যে নির্দিষ্ট সময়টা সম্পর্কে একটু আগে ডাক্তার সেনকে প্রশ্ন করলাম, তখন আপনি কোথায় ছিলেন–কি করছিলেন?
আমি তো কখনো বেশীক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকি নি। একবার ওপরে, একবার নীচে—সারা বাড়িময় আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তাই আপনি যা প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর এখন ঠিকভাবে বলা আমার পক্ষে তো সম্ভব নয় মিঃ রায়! সুসীম জবাব দেয়।
তা তো ঠিকই। আপনি যখন সে-রাত্রের উৎসবের ছিলেন হোস্ট। আচ্ছা রাত ঠিক দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে আপনি সেরাত্রে কোথায় ছিলেন মনে করে বলতে পারেন?
মৃদু হেসে সুসীম এবারেও বলে, না।
কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ যেন কেমন গুম হয়ে বসে থাকে।
তারপরই হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমি চললাম। কিন্তু একটা কথা যাবার আগে বলে যেতে বাধ্য হচ্ছি ডাক্তার, তোমরা কেউ আমার প্রশ্নের জবাবে সত্য যা তা বললে না!
কি বলছো কিরীটী? মৃণাল বলে।
ঠিকই বলছি, সত্য বলে নি। কারণ তোমাদের সকলের মনেই পাপ আছে।
পাপ!
হ্যাঁ, পাপ। কিন্তু সে পাপের হাত থেকে নিষ্কৃতিও পাবে না কেউ জেনো। গরল যেমন মানুষের সমস্ত দেহ জুড়ে একদিন ফুটে ওঠে বীভৎস ভয়ঙ্কর হয়ে—পাপও ঠিক তেমনি চাপা থাকে না—চাপা দেওয়া যায় না।
কথাগুলো বলে কিরীটী আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
১৭.
পরের দিন রাত্রি প্রায় তখন এগারোটা।
আগের দিনই দ্বিপ্রহরে শ্রাবণী শিলং রওনা হয়ে গিয়েছে। হরপ্রসাদ ও সুধা দেবীও পাটনা রওনা হয়ে গিয়েছেন ঐদিন। অত বড় বাড়িটায় একা ছিল সুসীম। বাড়িটা যেন একেবারে নিঝুম।
এতকলার লাইব্রেরী ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল সুসীম।
ঘরের দরজাটা ভেজানোই ছিল। সহসা একটা মৃদু শব্দ কানে আসতেই দরজাটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সুসীম।
ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা দুটো খুলে যাচ্ছে।
কে-কে ওখানে?
দরজাটা একেবারে খুলে গেল, মৃণাল এসে এদিক-ওদিক ভীত শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে ঘরের মধ্যে ঢুকলো। এবং ঢুকেই দরজাটা ভিতর থেকে ভেজিয়ে দিল।
কি ব্যাপার মৃণাল, এত রাত্রে?
ওষ্ঠের উপর আঙুলের সঙ্কেতের ইশারা জানিয়ে নিম্নকণ্ঠে মৃণাল বললে, চুপ!
কি হয়েছে কি?
আমি—আমি ভুল করেছি সুসীম—
ভুল!
হ্যাঁ, ভুল–কিরীটীকে এই ঘটনার মধ্যে টেনে নিয়ে এসে।
কিন্তু–
আজ দুপুরে সে আমার ওখানে এসেছিল। তার কথাবার্তায় বুঝলাম—
কি–কি বুঝলে? উৎকণ্ঠায় যেন ভেঙে পড়ে সুসীমের গলার স্বর।
সুনন্দার হত্যার ব্যাপারে সে আমাকেই সন্দেহ করছে। কিন্তু তুমি তুমি তো জান। সুসীম—
আমি—আমি কি জানি?
সুনন্দাকে আমি ভালবাসতাম সত্যি এবং আমার চাইতেও সে তোমাকে ভালবাসে জেনে আজ আর অস্বীকার করবো না, আক্রোশও হয়েছিল আমার প্রচণ্ড তার ওপরে, হত্যাই তাকে আমি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুনন্দার ঘরে যে চিঠি পাওয়া গিয়েছে, সে চিঠি আমি লিখি নি—
কে বলেছে সে চিঠি তুমি লিখেছো?
কিরীটী।
ননসেন্স! ওটা একটা হামবাগ! বোস বোস তুমি।
ঠিক সেই মুহূর্তে ভেজানো দরজাটা পুনরায় খুলে গেল। এবং ঘরে প্রবেশ করলো বিষ্ণু দে।
এ কি! বিষ্ণু, তুমি এত রাত্রে? সুসীম প্রশ্ন করে।
কেন, তুমিই তো রাত এগারটায় কি জরুরী ব্যাপারে আমাকে এখানে আসতে বলেছে সুসীম!
আমি তোমাকে আসতে বলেছি! কই না তো!
বাঃ রে, তুমি ফোনে বললে, তুমি জান সুনন্দাকে কে হত্যা করেছে–কিন্তু তুমি বিশ্বাস করা সুসীম, আমি তাকে হত্যা করি নি। তবে–
কি? বিষ্ণুর মুখের দিকে তাকায় সুসীম।
রাত ঠিক দশটায় সে-রাত্রে আমি সুনন্দাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা সরবৎ এনে দিয়েছিলাম—
সরবৎ এনে দিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিষ্ণু বলতে থাকে, সে সরবৎটা শেষ করে আমাকে বলেছিল, আমার সঙ্গে নাকি তার কি কথা আছে। কিন্তু গ্লাসটা রেখে ফিরে আসতে আমার কয়েক মিনিট দেরি হয়েছিল, এসে দেখি সে হলঘরে নেই—
তুমি-তুমি তাকে সে-রাত্রে সরবৎ খাইয়েছিল বিষু? মৃণাল শুধায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ—কিন্তু সে সরবতের মধ্যে কিছু ছিল না, আমি হলফ করে বলতে পারি।
তোমার কথাটা কিরীটী রায় বিশ্বাস করবে ভাবো
মৃণালের কথা শেষ হলো না। দরজা ঠেলে এসে ঘরে ঢুকলো বিশাখা, এই যে বিষ্ণু তুমি-তুমি কিরীটী রায়কে বলেছে যে আমি সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করেছি!
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হয়েছে সহসা।
একটা পাষাণভার স্তব্ধতা।
আমি বলেছি! বিষ্ণু কোনমতে শুধায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ—তুমি—
বিশাখার কথা শেষ হলো না, হঠাৎ ঘরের মধ্যে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি নারী-কণ্ঠস্বর যেন কোন অদৃশ্য অলক্ষ্য থেকে ভেসে এলো, হ্যাঁ তুমি—তুমিই হত্যা করেছে সুনন্দাকে বিশাখা!
কে? কে? কে?
একসঙ্গে সকলেই চিৎকার করে ওঠে।
কে–কে ও কথা বললে?
কিন্তু কোথায় কে, কেউই তো নেই ঘরে!
অকস্মাৎ সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা ভয়ের অনুভূতি সকলের মেরুদণ্ড দিয়ে শির শির করে বয়ে যায়।
সকলেই ওরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায় কি এক অসহায় আতঙ্ক-বিহ্বল দৃষ্টিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার যেন অলক্ষ্য থেকে সেই অচেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো স্পষ্ট, সুসীম, মৃণাল, বিষ্ণু, বিশাখা—এত তাড়াতাড়ি আমাকে তোমরা ভুলে গেলে! আমি কে, তাই না? আমি সুনন্দা-সুনন্দা–
কথাগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সুমিষ্ট হাসির লহরী যেন ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো।
আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায় আবার। ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে।
টুক…টুক…টুক…
ঘরের ভেজানো দরজার গায়ে মৃদু নক পড়লো।
এবং ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি সুসীমবাবু?
বাকশক্তি ওদের সকলের তখন যেন একেবারে এতটুকুও অবশিষ্ট নেই।
কেউ সাড়া দেয় না। সবাই যেন বোবা।
ধীরে ধীরে কিরীটী ও সাধন দত্ত ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
নমস্কার। এই যে আপনারা সকলেই দেখছি এখানেই জমায়েত হয়েছেন! ভালোই হলো–we can have a frank discussion amongst ourselves!
বাধা দিয়ে কিরীটীকে সাধন দত্ত বললেন, কিন্তু কর্তব্যটা চুকিয়ে নিলে হতো না আগে মিঃ রায়?
একটু অপেক্ষা করুন মিঃ দত্ত। তারপরই মৃণালের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, মিঃ দত্ত এসেছেন সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে–
সুনন্দার হত্যাকারী!
হ্যাঁ, ডাক্তার। এভাবে আজ এই রাত্রে এইখানে তোমাদের সকলকে এই ঘরে একত্রিত করার মূলেও ছিল ওঁর কৌশল। It is not an accident! কারণ উনি চেয়েছিলেন সকলের সামনে থেকেই হত্যাকারীর মুখোশ খুলে দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেন আজ এখান থেকে–
আমাদের মধ্যে থেকে! সুসীমই এবারে প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ সুসীমবাবু, প্রমাণিত হয়েছে যে এই মুহূর্তে এখানে আপনারা যে চারজন উপস্থিত আছেন, তারই মধ্যে একজন সেরাত্রে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছেন।
আমাদের মধ্যেই একজন?
কথাটা বলে সুসীম যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, আপনাদের মধ্যেই একজন–
সুসীম, বিশাখা, মৃণাল ও বিষ্ণু পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। সকলের চোখেই যেন একই প্রশ্ন, কে—কে? কে হত্যা করেছে সেরাত্রে সুনন্দাকে?
কে? কে?
হঠাৎ বিষ্ণু দে চিৎকার করে ওঠে, না, না—এ torture! Unbearable torture! এ অসহ্য—অসহ্য—
থাম বিষ্ণু! তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় সুসীম, মিঃ রায় যা বলছেন তাই যদি সত্যি হয় তো কেন আমরা স্বীকার করছি না কে আমাদের মধ্যে সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করেছি? Come, speak out! মৃণাল, বিষ্ণু–-চুপ করে থেকো না, দোহাই তোমাদের—এর চেয়ে জঘন্য, এর চেয়ে কলঙ্কের ব্যাপার হতে পারে না। আমরাই আমাদের একজন প্রিয় বান্ধবীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি–কিন্তু কেন, কেন হত্যা করেছি–
হত্যা করা হয়েছে তাকে এইজন্য যে–because she knew something!
কী জানতে পেরেছিল সে?
কিন্তু সেটা তো হত্যার উদ্দেশ্য। কি ভাবে সেরাত্রে হত্যাকারী সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছিল, সেই আলোচনাতেই আগে আসা যাক। কিরীটী বললে।
পাথরের মতোই যেন সবাই ঘরের মধ্যে বসে থাকে। শ্বাসরোধকারী একটা স্তব্ধতা।
কিরীটী বলতে লাগলো, হত্যাকারী দুঃসাহসী নিঃসন্দেহে। প্রচণ্ড risk-ও নিয়েছিল সে এবং successfulও হয়েছিল। তবু—তবু সে দুজনার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে নি। ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বে।
ছদ্মবেশ! মৃণাল প্রশ্ন করে।
হা ছদ্মবেশ। সব কিছুই আমি explain করবো। রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে সেরাত্রে সরবতের সঙ্গে মরফিন প্রয়োগ করে নেশাগ্রস্ত সুনন্দাকে কৌশলে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে, ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে দিয়েছিল হত্যাকারী।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মৃণালই পুনরায় প্রশ্ন করে।
বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাও। ফাস দেওয়ার পরে তাকে বাথরুম থেকে বের করে এনে সোফার ওপরে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসে হত্যাকারী ফাঁসটা টাইট করে দেয়। ঘুমে। তখন মরফিনের ও ক্লোরোফরমের ক্রিয়ায় ঢলে পড়েছে সুনন্দা–প্রতিবাদ জানাবার বা চিৎকার করবারও বেচারীর তখন আর কোন ক্ষমতা ছিল না।
তবে কি—
হ্যাঁ মৃণাল, বিষ্ণু দে ও বিশাখা দেবী সেরাত্রে সুনন্দার পাশে বসে যে ব্যক্তিটিকে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন—সে-ই সুনন্দার হত্যাকারী। এবং সুনন্দা was dead at that time–
না, না—তা কেমন করে হবে! আমি যে তার পরেও তার সঙ্গে কথা বলেছি কিরীটী! মৃণাল বলে।
না, তুমি কথা বললেও তার কোন জবাব পাও নি। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী বলে, it was a deliberate lie-মিথ্যা, সে তখন already মৃত—নিহত! তাই আমি বলেছিলাম সেদিন, সবাই তোমরা তোমাদের জবানবন্দীতে মিথ্যা কথা বলছো!
সবাই স্তব্ধ, নির্বাক।
কিরীটী আবার বলে, তুমি, বিষ্ণুবাবু, বিশাখা দেবী–বলুন, বলুন বিষ্ণুবাবু চিনতে পারেন নি সেদিন আপনি সুনন্দা দেবীর পার্শ্বে উপবিষ্ট ব্যক্তিটিকে? বিশাখা দেবী, আপনি চিনতে পারেন নি?
বিশাখা যেন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগিণীর মতো চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে, না, না, না–পারি নি—পারি নি–
পেরেছেন! You did!
না–না—না—
হ্যাঁ পেরেছেন, বলুন–বলুন সে কে? বলতে আপনাকে হবেই বিশাখা দেবী। আর সেরাত্রে বাথরুমের মধ্যেও যাকে দেখেছিলেন, তাকেও আপনি চিনেছিলেন। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি, আপনি সেরাত্রে তাকে চিনতে পেরেছিলেন বলেই গতরাত্রে আপনাকে হত্যাকারী আক্রমণ করেছিল–
না, না, না—তবু চেঁচাতে থাকে বিশাখা।
কঠিন ঋজুকণ্ঠে এবারে কিরীটী বলে, চিনতে পারেন নি–সুসীমবাবুকে আপনি চিনতে পারেন নি এখনো বলছেন?
সুসীম!
মৃণালের কণ্ঠ থেকে যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে এলো।
হ্যাঁ, সুসীমবাবুই।
কথাটা বলেই কিরীটী পুনরায় বিষ্ণু দের দিকে ফিরে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে, বিষ্ণুবাবু, সেরাত্রে কার কাছ থেকে আপনি সুনন্দা দেবীর জন্য সরবৎ চেয়ে এনেছিলেন?
আমি!
হ্যাঁ।
বিশাখা দিয়েছিলো—
বিশাখা দেবী, কথাটা কি সত্যি?
বিশাখা জবাব দেয় না।
তার মাথাটা তখন প্রায় বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে।
.
১৮.
হ্যাঁ, সুসীমবাবুই।
পরের দিন মৃণালের বাসায় বসেই বলছিল কিরীটী, সুসীমবাবুই যে সেরাত্রে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছেন, সেটা আমার মনই বলেছিল। কারণ তার মতো সুনন্দা দেবীকে হত্যা করার সুযোগ সেদিন ঐ উৎসবের বাড়িতে আর কারো ছিল না। কিন্তু হত্যা করবার কারণ বা উদ্দেশ্যটা তখনো আমি খুঁজে পাই নি। এবং উদ্দেশ্যটা যে মুহূর্তে আমি খুঁজে পেলাম, সেই মুহূর্তেই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু উদ্দেশ্যটা কি? সুনন্দাকে তার মতো কেউ তো ভালবাসত না! মৃণাল বললে।
কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি জানতে পেরেছিলেন, সুনন্দা তাঁকে নিয়ে শুধু খেলাই করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে সেই হতাশা আর পরাজয়ের অপমান তাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।
খেলাই করে এসেছে সুনন্দা তাকে নিয়ে!
হ্যাঁ ডাক্তার–নির্মম খেলা। কারণ সুনন্দা ভালবাসত সত্যিকারের—
কাকে?
নীরেন সেনকে। আর নীরেনের সঙ্গে তার বিবাহও হয়ে গিয়েছিল এক বছর পূর্বে।
সে কি!
রেজিস্টারার্স অফিসে খোঁজ নিলেই ব্যাপারটা তুমি জানতে পারবে ডাক্তার—
কিন্তু এটা তো বুঝতে পারছি না কিরীটী, সে-কথাটা কেন তবে তারা গোপন করে রেখেছিল!
দুটি কারণে। এক হচ্ছে—সুনন্দা ব্রাহ্ম, নীরেনের কাকা—যিনি অবিবাহিত এবং প্রচুর সম্পত্তির মালিক, তিনি নীরেনের বিবাহটা মেনে নিতেন না এবং বিবাহ করলে নীরেনকে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে তিনি বঞ্চিত করতেন। নীরেনের পক্ষে ঐ বিরাট fortuneকে অস্বীকার করার ক্ষমতা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, বিশাখা আর তার স্বামী আলফ্রেডের ভয়ে–
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো মিঃ রায়!
আলফ্রেড, বিশাখা, সুসীম আর নীরেনের একটা চোরাই মাদক দ্রব্যের ব্যবসা ছিল। বর্মার ভিতর দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষের মধ্যে চোরাই আফিমের কারবার চালাচ্ছিল ওরা। বেচারী সুনন্দা সে কথাটা জানতো না–
বলো কি!
হ্যাঁ। পরে অবিশ্যি কিছুদিন আগে জানতে পেরে ও চুপ করে ছিল। এদিকে সুসীম নীরেন ও সুনন্দার সম্পর্কটা জানতো না। শ্রাবণীকে বিয়ে করার কিছুদিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরে সুনন্দাকে যখন সে বলে তার মুখোশ সে খুলে দেবে, সুনন্দা তখন মরীয়া হয়ে সুসীমকে বলে, তাহলে সে-ও সুসীমের চোরাকারবারের ব্যাপারটা প্রকাশ করে দেবে। ওদের দুজনের মধ্যে যেদিন কথা-কাটাকাটি হয়, ঠিক সেইদিনই ঘটনাচক্রে আলফ্রেড সুনন্দার বাড়িতে তার পাশের ঘরে উপস্থিত ছিল। সে-ই তার জবানবন্দীতে সব কথা বলেছে—প্রকাশ করে দিয়েছে। আর তার মুখ থেকে সব কথা শোনবার পরই সুনন্দাকে হত্যার উদ্দেশ্যটাও আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। একে তো নীরেনের ব্যাপার নিয়ে সুনন্দার প্রতি আক্রোশ ছিলই সুসীমের, তার উপরে ঐ চোরাকারবার—কাজেই তখন সুনন্দাকে এ পৃথিবী থেকে অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা ছাড়া অন্য পথ আর ছিল না সুসীমের।
কিন্তু সুনন্দাকে যে সুসীমই হত্যা করেছে তার প্রমাণ?
মোক্ষম দুটি প্রমাণ আছে।
কি প্রমাণ?
প্রথমতঃ, থুজার শিশিতে সুসীমের finger-print পাওয়া গিয়েছে, আর রুমালটা—
কোন্ রুমাল?
যেটা সুসীমবাবুর বাথরুমে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন মিঃ দত্ত। সুসীমের দুটো নাম ছিল তুমি বোধ হয় জান—
দুটো নাম!
হ্যাঁ, দুটো নাম। একটা ডাকনাম, অন্যটা পোশাকী নাম। ডাকনামটা হচ্ছে নাড়ু আর পোশাকী নামটা হচ্ছে সুসীম। আর সেই নাড়ুরই আদ্যক্ষর ইংরেজী এন রুমালের কোণে লেখা! সুসীমের পরিধেয় বস্ত্র ও রুমাল ইত্যাদিতে ঐ এনই ব্যবহার করতে সে অনেকদিন ধরে। সুধা দেবীর মুখ থেকেই পরশু আমি সংবাদটা পেয়েছিলাম। সুসীম চমৎকার ভাবে সমস্ত ব্যাপারটা সাজিয়েছিল—যাতে করে নীরেনকেই পুলিস সন্দেহ করে এবং তার পক্ষেও এক ঢিলে দুই পাখী মারা হয়! অবিশ্যি আলফ্রেডের স্বীকারোক্তি না পেলে এবং সুসীম সেরাত্রে বিশাখাকে হত্যার চেষ্টা না করলে এত দ্রুত আমার মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভবপর হতো না। অবিশ্যি আরো একজন সুসীমকে সন্দেহ করেছিল—
কে?
সুসীমের নব-বিবাহিত স্ত্রী—
শ্রাবণী!
হ্যাঁ।
আশ্চর্য!
এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই ডাক্তার। নারীর ব্যাপারে নারীর মনই সর্বাগ্রে সন্দিগ্ধ হয়। শ্রাবণীও ঠিক সেই কারণেই অর্থাৎ সন্দেহ হওয়ায় কলকাতা থেকে সরে যায়।
সবশেষে কিরীটী বলছিল, বিচিত্র দুটি চরিত্র তোমাদের ঐ সুসীম আর বিশাখা! বলতে ইচ্ছা করে—যেমন দেবা তেমনি দেবী! আলফ্রেডের টাকার প্রয়োজন ছিল, কারণ সে ছিল নেশার দাস আর জুয়াড়ী—সে টাকা যোগাত সুসীম, বিনিময়ে বিশাখাকে তুলে দিয়েছিল আলফ্রেড সুসীমের হাতে।
সত্যি বলছো!
হ্যাঁ। কিন্তু বিশাখা ভালবাসত নীরেনকে—
Is it!
তাই সুনন্দার জন্য বিশাখার পক্ষে নীরেনকে পাওয়া সম্ভবপর ছিল না বলেই সুনন্দার প্রতি বিশাখার একটা আক্রোশ ছিল। সেই কারণেই ছদ্মবেশে সুসীমকে চিনতে পেরেও বিশাখা সেরাত্রে মুখ খোলে নি।
কিন্তু বিষ্ণু-বিষ্ণু কেন মুখ খোলে নি? সে কেন সব প্রকাশ করে নি?
ভয়ে। আসলে লোকটা প্রচণ্ড ভীরু—
একটা কথা, নীরেনের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল কেন সুনন্দার দুর্ঘটনার আগের রাত্রে?
কারণ এ তো সোজা কথা! সুনন্দা নীরেনদের চোরাই কারবারের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল বলে–
কি করে?
বিশাখার একখানা চিঠিতে। আক্রোশের বশে নীরেনের প্রতি সুনন্দার মনটা বিগড়ে দেবার জন্যে মরীয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত সে সুনন্দাকে একটা চিঠি দিয়েছিল–
তারপর?
দুজনের ঝগড়া হতে সুনন্দা বলেছিল, নীরেনের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক আর নেই। সে-ও যেন নীরেনকে লেখা তার চিঠিগুলো ফেরত দেয় এবং সেও ফিরিয়ে দেবে তাকে লেখা নীরেনের চিঠিগুলো। তারপর তাদের গোপনে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। কিন্তু নীরেন চিঠি দিয়ে জানায়, সেগুলো সে ফেরত দেবে, তবে সে বিশাখার চিঠিটাও চায়। কিন্তু–
কি?
বেচারী সুনন্দা সত্যিই ভালবাসত নীরেনকে। তাই সে চেয়েছিল সুসীমের বাড়িতে এসে সুসীমের সামনেই সব কিছুর একটা মুখোমুখি মীমাংসা করে নেবে। তাই যেচে সে নিমন্ত্রণ নিয়েছিল সুসীমের। বেচারী তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি, সুসীমের বাড়িতে সেরাত্রে যাওয়া মানেই মৃত্যুর ফাঁসে গলা এগিয়ে দেওয়া। কারণ সুসীমকে ফোন করার পরই সে তার plan স্থির করে ফেলে মনে মনে। অবিশ্যি সুসীম গোড়াতেই একটা মারাত্মক ভুল করেছিল
ভুল!
হ্যাঁ।
কি ভুল?
শ্রাবণীকে ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ বিয়ে করে—
সত্যিই আশ্চর্য! মৃণাল বলে।
প্রেম আর ঈর্ষা এমন দুটি বস্তু ডাক্তার, যার মধ্যে আশ্চর্য বলে কিছু নেই। কারণ যা কিছু ঘটেছে সেরাত্রে, সব কিছুর মূলেই ছিল ঐ প্রেম আর ঈর্ষা। সবটাই সেই পঞ্চশরের কীর্তি।