- বইয়ের নামঃ বিষকুম্ভ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. তাসের ঘর
সেই তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম একপাটি চকচকে তাস নিয়ে কিরীটী তার বসবার ঘরে, শিথিল অলস ভঙ্গিতে সোফাটার উপরে বসে, সামনের নিচু গোল টেবিলটার ওপরে নানা কায়দায় একটার পর একটা তাস বসিয়ে, তাসের একটা ঘর তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই কিছুটা গড়ে উঠবার পর ভেঙেচুরে তাসগুলো টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং আমি নিঃশব্দে বারংবার সেই প্রচেষ্টার একই পুনরাবৃত্তি দেখছিলাম তারই উল্টোদিকে অন্য একটা সোফার ওপরে বসে।
প্রতিবারের ভেঙেপড়া তাসের ঘরের পুনর্গঠনের মধ্যে নিজে ব্যস্ত থাকলেও কিরীটীর সমস্ত মনটাই যে কোন একটি বিশেষ চিন্তার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই পাক খেয়ে ফিরছিল সেটা আমি জানতাম বলেই তার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে বসেছিলাম কোনোরূপ সাড়াশব্দ না করে।
নিস্তব্ধ ঘরটার মধ্যে দেওয়াল-ঘড়ির মেটাল পেণ্ডুলামটা কেবল একঘেয়ে বিরামহীন একটা টকটক শব্দ তুলছিল।
ফাল্গুনের ঝিমিয়ে-আসা শেষ বেলা।
কলকাতা শহরে এবারে শীতটা যেমন একটু বেশ দেরিতেই এসেছিল তেমনি এখনো যাই যাই করেও যেন যাচ্ছে না।
একটা মৃদু মোলায়েম শীত-শীত ভাব যেন শেষ-হয়ে-যাওয়া গানের মিষ্টি সুরের রেশের মতই দেহ ও মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অবিশ্যি তিন-চার দফা চা পান উভয়েরই হয়ে গিয়েছে। এবং কিরীটীর শেষবারের চায়ের কাপটার অর্ধনিঃশেষিত চাটুকু তারই সামনে টেবিলের উপরে তখনো ঠাণ্ডা হচ্ছে।
প্রায় ঘণ্টাদেড়েক হবে এসেছি কিন্তু কিরীটী আমার পদশব্দে চোখ না তুলেই সেই যে, আয় সুব্রত বস, বলে তাসের ঘর তৈরিতে মেতে আছে তো আছেই। আর আমিও সেই থেকে আসা অবধি বোবা হয়ে বসে আছি তো আছিই।
ঘড়ির পেণ্ডুলামটা তেমনিই টকটক শব্দ করে চলেছে। নিচের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল হর্ণ বাজিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে।
শেষ পর্যন্ত বসে বসে একসময় কখন যেন কিরীটীর তাসের ঘর তৈরি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গিয়েছি নিজেই তা জানি না।
দেখছিলাম তাসের পর তাস সাজিয়ে ঘরটা এবারে কিরীটী অনেকটা গড়ে তুলেছে। হঠাৎ সব আবার ভেঙে টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এল, যাঃ! আবার ভেঙে গেল!
সম্পূর্ণভাবে সোফার গায়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, জানি তাসের ঘর এমনি করেই ভেঙে যায়। বৃথা চেষ্টা।
আমিও প্রশ্ন করলাম, কি হল?
পাচ্ছি না। দাঁড়াবার মত কিছুতেই যেন একটা শক্ত ভিত পাচ্ছি না।
কেন?
কেন আর কি! টুকরো টুকরো সূত্রগুলো এমন এলোমেলো যে, একটার সঙ্গে অন্যটা কিছুতেই জোড় দিতে পাচ্ছি না।
তাসগুলো টেবিলের উপরে তেমনিই ছড়িয়ে রয়েছে।
দিনান্তের শেষ আলোটুকুও মিলিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে কখন জানি ধূসর আবছা অন্ধকার একটু একটু করে চাপ বেঁধে উঠেছে।
বাঁ-দিকে উপবিষ্ট সোফার হাতলের উপর থেকে রক্ষিত চামড়ার সিগারকেস ও দেশলাইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে, তা থেকে একটা সিগার বের করে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে সিগারে অগ্নিসংযোগ করে নিল কিরীটী। ওষ্ঠধৃত জ্বলন্ত সিগারটায় কয়েকটা মৃদু সুখটান দিয়ে ধূমোদগীরণ করেকিরীটী আবার কথা বললে, ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেমন লাগল আজ সুব্রত?
ভুজঙ্গ ডাক্তার। ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)।
মনে পড়ল মাত্র আজই সকালে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।
কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আজকের সকালের সমস্ত দৃশ্যটাই যেন মুহূর্তে মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
নামে ব্যবহারে চেহারায় কারও মধ্যে এতটা সামঞ্জস্য, আবার সেই অনুপাতে অসামঞ্জস্যও থাকতে পারে ইতিপূর্বে যেন আমার সত্যিই ধারণারও অতীত ছিল।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বার থেকে তার সঙ্গে আলাপ করে ফিরবার পথে ঐ কথাটাই বার বার আমার যে মনে হয়েছিল সেও মনে পড়ে ঐ সঙ্গেই।
সামঞ্জস্যটা ওর চেহারা ও নামের মধ্যে। মনে হয়েছিল শিশুকালে যিনিই ওই ভুজঙ্গ নামকরণ করে থাকুন না কেন, দূরদর্শী ছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে। কারণ আর যাই করুক
কেন কানা ছেলের নাম পদ্মপলাশলোচন রাখেননি এটা ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়বে না। এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে নজরে আসবে এবং বলাই বাহুল্য চোখ ফিরিয়ে নিতে হবেই। না নিয়ে উপায় নেই। সমস্ত মনটা ঘিন ঘিন করে উঠবে এবং সেই সঙ্গে মনে হবে লোকটার ঐ ভুজঙ্গ নাম ছাড়া দ্বিতীয় কোন আর নাম বুঝি হতেই পারত না।
গায়ের রঙ লোকটির সত্যিকারের কাঞ্চনবর্ণ বলতে শুদ্ধ ভাষায় যা বোঝায় ঠিক তেমনি। চোখ যেন একেবারে ঠিকরে যায়। কিন্তু মানুষের গায়ের রঙটাই তো তার রূপের সবটুকু নয়। মুখখানা চৌকো। অনেকটা ভারী চোয়ালওয়ালা দ্রাবিড়িয়ান টাইপের মূখ। টানা দীর্ঘায়ত রোমশ যুগল। তার মধ্যে দু-একটা জ্বকেশ এত দীর্ঘ যে বিস্ময়ের চিহ্নের মত যেন উঁচিয়ে আছে। তারই নীচে ক্ষুদ্র গোলাকার পিঙ্গল দুটি চক্ষুতারকা। শাণিত ছোরার ফলার মতোই সে-দুটি চোখের দৃষ্টিতে যেন অদ্ভুত একটা বুদ্ধির প্রাথর্য। শুধু কি খই, আরও কি যেন আছে সেই দুটি পিঙ্গল চক্ষুতারকার দৃষ্টির মধ্যে। এবং যেটা সে-দৃষ্টির দিকে তাকালেই তবে অনুভূত হয়, অদ্ভুত এক আকর্ষণ।
চোখের নিচেই নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো যেন একটু বেঁকে রয়েছে সামনের দিকে।
গালের দু-পাশে হনু দুটি একটু বেশিমাত্রায় সজাগ, অনেকটা ব-দ্বীপের মত। অতিরিক্ত মাত্রায় ধূমপানের ফলে পুরু ওষ্ঠ দুটিতে একটা পোড়া তামাটে রঙ ধরেছে, আর তারই মধ্যে
মধ্যে কলঙ্কের মত ছোট ছোট খেতচিহ্ন। চিবুকটা একটু ভোঁতা এবং ঠিক মধ্যিখানে পড়েছে একটা খাঁজ।
আরও একটা বিশেষত্ব আছে মুখটার মধ্যে। প্রশস্ত কপালের ডানদিকে একেবারে প্রান্ত ছুঁয়ে আধ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা একটা রক্তজড়ুল চিহ্ন। সেই জড়ুলের উপরেও দুটি দীর্ঘ কেশ।
মাথায় অত্যন্ত ঘন কর্কশ কুঞ্চিত কেশ অনেকটা নিগ্রোদের মত, ব্যাকব্রাস করা।
লম্বা হাড়গিলে প্যাটার্ণের ডিগডিগে চেহারা। সরু লম্বা গলা। কণ্ঠা ও চিবুকের মধ্যবর্তী গলনলীর উপরে অ্যাডমস্আপেলটা যেন একটু বেশী প্রকট। ইংরাজীতে যাকে বলে প্রমিনেন্ট।
নিখুঁতভাবে দাড়িগোঁফ কামানো। মধ্যে মধ্যে লোকটির সূচাগ্র জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়া যেন একটা বদভ্যাস। সব কিছু জড়িয়ে মনে হয় যেন একটা বিষধর সরীসৃপ ফণা বিস্তার করে হেলে আছে। এই বুঝি ছোবল দেবে। ভুজঙ্গ নামটা সার্থক সেদিক দিয়ে। এবং চেহারায় সরীসৃপ-সাদৃশ্যটা যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চাপা নিঃশব্দ হাসির মধ্যে। ডাক্তারের সদাসর্বদা জিহ্বার অগ্রভাগটা বের করা আর টেনে নেওয়ার মত আর একটি অভ্যাস যা প্রথম দৃষ্টিতেই আমার নজরে পড়েছিল, সেটা হচ্ছে তাঁর হাসি। বলতে গেলে কথায় কথায় যেন তিনি হাসেন এবং হাসির সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিচের শ্বেতিচিহুিত পুরু তাম্রাভ ওষ্ঠটা নিচের দিকে নেমে আসে উল্টে আর উপরের ওষ্ঠটি সামান্য একটু উপরের দিকে কুঁচকে ওঠে। আর বিভক্ত সেই ওযুগলের ফাঁকে সজারুর মত ছোট ছোট তীক্ষ্ণ দুসারি অদ্ভুত রকমের সাদা সাদা দাঁত একঝাঁক তীরের ফলার মত যেন মুহূর্তের জন্য সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝিকিয়ে ওঠে। এবং অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে নিকোটিননিষিক্ত মাড়িটা যেন ঠেলে ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। ঐ সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হয়েছিল, যে লোক অতবেশী ধূমপান করে তার মাড়ির সঙ্গে দাঁতেও নিকোটিনের কালচে দাগ থাকা উচিত ছিল, কিন্তু দাঁতগুলো যেন মুক্তার মতই ঝকঝক করছিল।
যাহোক, বলছিলাম ভুজঙ্গ ডাক্তারের হাসির কথা। ভুজঙ্গ ডাক্তার হাসলে এবং সেই সময় তার দিকে চেয়ে থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সে মুখের উপর থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিতে হবেই। ঘিনঘিন করে উঠবে সমস্ত মনটা। হঠাৎ গায়ে একটা টিকটিকি পড়লে যেমন অজান্তেই সর্বাঙ্গ সিসিরিয়ে ঘিনঘিন করে ওঠে, ঠিক তেমনি। কিন্তু আশ্চর্য! পরক্ষণেই ডাক্তারের কণ্ঠস্বর কানে গেলেই পুনরায় তার দিকে চোখ ফিরিয়ে না তাকিয়ে উপায় নেই। পুরুষোচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু যেমন সুরেলা তেমনি মিষ্টি। মনে হবে কথা তো নয় যেন গান গাইছে লোকটা। আর কথা বলার ভঙ্গিটিও এমন চমৎকার! শুধু কি কথাই? ব্যবহারটুকুও যেমনি মিষ্টি মোলায়েম তেমনি দরদেরও যেন অন্ত নেই।
শিক্ষায় দীক্ষায় রুচিতে ব্যবহারে কথায়বাতায় সৌজন্যতায় এমন কি আগাগোড়া পরিচ্ছন্ন রুচিসম্মত বেশভূষায় পর্যন্ত যেন একটা অদ্ভুত ঝকঝকে শালীনতা ও আভিজাত্য সুস্পষ্ট। তাই বলছিলাম নাম ও চেহারার সামঞ্জস্যের মধ্যে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য।
সামান্য আলাপেই যেন লোকটির একেবারে নিঃস্ব পর একান্ত অপরিচিতকেও মুহূর্তে আকর্ষণ করে আপনার করে নেবার আশ্চর্য রকমের একটা ক্ষমতা আছে।
চোখের উপরে যেন এখনও ভাসছে লোকটার চেহারাটা।
পরিধানে দামী পাতলা ট্রপিক্যাল অ্যাস কলারের ক্রীজ করা সুট। গলায় সাদা কলারের সঙ্গে কালোর উপরে লাল স্পটেড বো, পায়ে দামী গ্লেসকীডের চকচকে ক্রেপসোলের জুতো।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. বি. এফ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)। কলকাতা শহরে বছর দশেক হবে প্র্যাকটিস করছেন। সরকারী হা তালের সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যেই শহরের অগ্রগণ্য চিকিৎসকদের তালিকার মধ্যে অন্য কজন বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন।
প্রতিপত্তি ও পসারে বেশ কায়েমী ভাবেহ ২..ছেন সুপ্রতিষ্ঠিত। লোকেরা বলে ভুজঙ্গ ডাক্তার মরা মানুষকেও নাকি বাঁচিয়ে তুলতে পারে এমনই পারঙ্গম চিকিৎসাশাস্ত্রে।
সাজারী প্র্যাকটিস করেন ভুজঙ্গ ডাক্তার। সর্বরোগের চিকিৎসক নন। সাজারীর যে-কোন কঠিন রোগীর ঘরে ভুজঙ্গ ডাক্তার পা দিলেই নাকি লোকেরা বলাবলি করে, তার অর্ধেক রোগ সেরে যায়। এমনি অচল বিশ্বাস ও আস্থা সকলের ভুজঙ্গ ডাক্তারের উপরে বর্তমান।
পার্কসাকাস অঞ্চলে তিনতলা একটা বিরাট ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার চারঘরওলা একটা সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট নিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তারের কনসালটিং চেম্বার ও নার্সিংহোম। একজন জুনিয়ার ডাক্তার অ্যাসিস্টেন্ট ও চারজন শিক্ষিতা ট্রেণ্ড নার্স। দুজন ইউরোপীয়ান, একজন অ্যাংলো-চায়নীজ, একজন বাঙালী। চেম্বারের সঙ্গে সংলগ্ন চার-বেডের নার্সিংহোমটির সঙ্গেই লাগোয়া একটি অপারেশন থিয়েটারও আছে।
চেম্বারের কনসালটিং আওয়ার প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা। আবার সন্ধ্যায় পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা।
প্রচুর পসার।
চেম্বারের ঐ নির্দিষ্ট টাইমটা ছাড়াও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে হাসপাতাল ও প্রাইভেট কল অ্যাটে করবার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার ভুজঙ্গ ডাক্তার সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত যে রাত নটার পর বাড়িতে একবার ঢুকলে, তখন হাজার টাকা অফার করলেও তাঁকে দিয়ে কোন রোগী দেখানো তো যাবেই না, এমন কি তিনটা থেকে পরদিন ভোর ছটার আগে পর্যন্ত তিনি নিজে কোন ফোন-কলও অ্যাটেণ্ড করবেন না। ঐ সময়ের মধ্যে যদি কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে বা করতে হয় তো বাড়ির অন্য লোক মারফৎ করতে হবে।
আশ্চর্য! গত পাঁচ বৎসর ধরেই শোনা যায়, প্রতিদিন রাত্রি নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত, ঐ আট ঘণ্টা সময় তিনি নাকি সমস্ত দায়িত্ব ও কাজকর্ম থেকে নিজেকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিজের শয়নঘর ও তৎসংলগ্ন লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে রাখেন।
বলতে গেলে বাইরের জগতে তো নয়ই, এমন কি তাঁর গৃহেও ঐ আট ঘণ্টা সময় তো তিনি সকলের কাছ থেকেই দূরে বিচ্ছিন্ন ও একক হয়ে থাকেন।
শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের বয়স নাকি প্রায় বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। অকৃতদার। এবং নারী জাতি সম্পর্কেও আজ পর্যন্ত তাঁর কোনরূপ দুর্বলতার কথা কেউ কখনও শোনেনি।
সংসারে আপনার জন বলতে বিকলাঙ্গ, অর্থাৎ ডান পা-টি খোঁড়া, বেকার একটি সহদর ভাই আছে। বয়সে ভাইটি ডাক্তারের থেকে আট বৎসরের ছোট। নাম ত্রিভঙ্গ। তাই ত্রিভঙ্গ চৌধুরীও মৃখ নয়। বি. এ. পাস। ত্রিভঙ্গ বিবাহিত। ভুজঙ্গ ডাক্তারই ত্রিভঙ্গের বিবাহ দিয়েছেন। অপূর্ব সুন্দরী বি. এ. পাস একটি গরীব মেয়ের সঙ্গে। সেও বছর ছয়েক হবে। নাম মৃদুলা। আর আছে বছর সাড়ে চারের মৃদুলা ও ত্রিভঙ্গর একমাত্র পুত্রসন্তান অগ্নিবান।
ভাইপোটি শোনা যায় ভুজঙ্গ ডাক্তারের অত্যন্ত প্রিয়। বাড়িতে আর লোকজনের মধ্যে ভুজঙ্গের অনেক দিনের খাসভৃত্য, রামচন্দ্র বা রাম। সে একমাত্র ভুজঙ্গেরই কাজকর্ম করে। দ্বিতীয় ভৃত্য হচ্ছে ভূষণ। একটি ঝি রাতদিনের, সুরবালা, রাঁধুনী বামুন কৈলাস, সোফার হরিচরণ ও নেপালী দারোয়ান রাণা।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের ইদানীং পসার খুব বৃদ্ধি হলেও ফিজ পূর্বের মতই রেখেছেন, বাড়ান নি। চেম্বারে ষোল ও বাড়িতে বত্রিশ। শোনা যায় ফিজ সম্পর্কে ভুজঙ্গ ডাক্তারের নাকি অপূর্ব একটা নীতি ছিল সেই প্র্যাকটিসের শুরু থেকেই।
ফরেন ডিগ্রী নিয়ে দুশ বৎসর পূর্বে যেদিন তিনি পার্কসাকাস ট্রাম-ডিপোর কাছাকাছি বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরেই পঞ্চাশ টাকা মাসিক ভাড়ায় ছোট একখানা ত্রিকোণাকার ঘর নিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেন, সেই দিন থেকেই তাঁর ফিজ তিনি চেম্বারে মোল ও গৃহে বত্রিশ ধার্য করেন।
এবং সে-সময় নতুন সদ্য-বিলাতফেরত ডাক্তারদের যা অবস্থা হয়ে থাকে, দিনের পর দিন রোগীর প্রত্যাশায় বারনারীর মতোই আপনাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে, রাস্তার চলমান পদধ্বনির দিকে কান পেতে, নিজের প্রকোষ্ঠেরই কড়িকাঠ গণনা করতে হত, সে-সময়ও কচিং কখনও কোন রোগী তাঁর চেম্বারে এলে সর্বাগ্রে তাকে বলতেন, জানেন তো আমার ফিজ! এখানে ষোল, বাড়িতে হলে বত্রিশ। ফ্রি কনসালটেশন আমি করি না।
ফলে যা হবার তাই হত।
ভাগ্যে সপ্তাহে একটি রোগী জুটত কিনা সন্দেহ।
বন্ধুবান্ধবেরা যদি কখনও বলত, গোড়াতে ফিজটা কমাও ভুজঙ্গ। পরে যখন পসার বাড়বে ফিজ ক্রমে বাড়িয়ে যাবে।
ভুজঙ্গ নাকি হেসে জবাব দিতেন, উহুঁ। Start ও finish আমার একই থাকবে, শুরুতে যা ধরেছি শেষেও তাই রাখব।
উপোস করে মরবে যে!
মরবে না ভুজঙ্গ চৌধুরী। প্রতিভার যাচাই অত সহজেই হয় না হে। কয়লাখনির মধ্যে যে হীরা থাকে তাকে খুঁজে বের করতে হলেও সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষা তাদেরও দিতে হবে বৈকি। আর আমাকেও সেটা সহ্য করতে হবে।
এত বিশ্বাস!
ঐ বিশ্বাসের উপরেই তো দাঁড়িয়ে আছি হে।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের প্রতিভা যে সত্যিই ছিল এবং সে যে মিথ্যা দম্ভ প্রকাশ করেনি, ক্রমে সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছিল। লোকে একদিন তাকে চিনতে পারলে। সেই সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারও বদল হল। বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ হল।
এবারে ঐ অঞ্চলেরই একেবারে ট্রাম-রাস্তার উপরে বিরাট একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় সম্পূর্ণ একটা ফ্ল্যাট নিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে ভুজঙ্গ নতুন চেম্বার ও নার্সিংহোম করলেন।
তারপর দেখতে দেখতে গত পাঁচ বৎসরে যেন হু-হু করে ভুজঙ্গ ডাক্তারের পসার ও খ্যাতি শহর ও শহরের আশেপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ফিজ কিন্তু তাঁর মোল-বত্রিশের উপরে গেল না। কথা তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। এক কথায় সকলকেই তিনি তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই।
প্রতিভা থাকে অবিশ্যি অনেকেরই কিন্তু সেই প্রতিভার বিকাশের ও স্বীকৃতিলাভের সৌভাগ্য কজনের হয় সত্যিকারের! সেই দিক দিয়ে ভুজঙ্গ ডাক্তার নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।
চেম্বারে প্রত্যহ রোগীর ভিড় এত থাকে যে, সব রোগীকে তিনি প্রত্যহ পূর্ব অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া সত্ত্বেও দেখে উঠতে পারেন না। ক্ষুন্ন মনে অনেককেই পরের দিনের আশায় ফিরে যেতে হয়। কারণ যাকে তিনি পরীক্ষা করেন সময় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপেই পরীক্ষা করে থাকেন।
এনগেজমেন্টের খাতায় পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত রোগী সব বুক হয়ে থাকে চেম্বারে।
এত পসার ও খ্যাতি লোকটার তবু নাকি ব্যবহারে তাঁর এতটুকু চাল বা অহঙ্কার নেই। পূর্বে যারা তাঁকে চিনত, তারা বলে, ভুজঙ্গ ডাক্তার আগের মতোই ঠিক আছে। কোন বদল হয়নি।
তাঁর সম্পর্কে গুজবের অন্ত নেই। বিশেষ করে তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স সম্পর্কে। এখনও কিন্তু তিনি নিজের বাড়িও একটা করেননি।
০২. ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে
ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে পূর্বে সাক্ষাৎ-পরিচয় না থাকলেও জনরব ও জনশ্রুতিতে লোকটি আমাদের একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। সাক্ষাৎভাবে পরিচয়-সৌভাগ্য হল মাত্র আজই সকালে।
রবিবার। হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ। হাসপাতালে সকালেই বেরুবার তাগাদা নেই। তাছাড়া রবিবার চেম্বারেও সকালে স্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যতীত তিনি রোগী দেখেন না। তাই ভুজঙ্গ ডাক্তার সকাল সাড়ে আটটায় কিরীটীর সঙ্গে সাক্ষাতের টাইম দিয়েছিলেন। সাক্ষাতের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল সাড়ে আটটায় ঠিক।
আমরা পাঁচ মিনিট আগেই ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছেছিলাম। বেয়ারার হাতে পূর্বেই কিরীটীর কার্ড প্রেরিত হয়েছিল। ওয়েটিং রুমটি চমৎকার ভাবে সাজানো। একেবারে খাস ইউরোপীয়ান স্টাইলে।
মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট। সোফা কাউচ। গোলাকার একটি টেবিল ঘরের মধ্যস্থলে। চকচকে সব ফার্নিচারেরই চোখ ঝলসানো পালিশ। সাদা নিরাবরণ দুধধবল চুনকাম করা দেওয়ালে কিছু ফ্রেসকোর সূক্ষ্ম কাজ। কোন ছবি বা ক্যালেণ্ডার নেই। এক কোণে একটি বিরাট ঘড়ি স্ট্যাণ্ডের উপর বসানো।
ঘরের জানলা ও দরজার পর্দায় ফিকে নীল সূক্ষ্ম বিলিতি নেটের সব পদা ঝোলানো।
ঢং করে সময়-সংকেত ঘরের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে কোথায় যেন অদৃশ্য ইলেকট্রিক সাংকেতিক একটা শব্দ শোনা গেল, কঁ কঁ…. সঙ্গে সঙ্গে বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকে বললে, আসুন।
বেয়ারার পিছনে পিছনে করিডোর পার হয়ে আমরা এসে সম্পূর্ণ-বন্ধ একটি কপাটের সামনে দাঁড়ালাম।
কপটটা ঠেলতেই লিং অ্যাকশানে সরে গেল, বেয়ারা বললে, ভিতরে যান।
প্রথমে কিরীটী ও তার পশ্চাতে আমি একটি প্রশস্ত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ওয়েটিং রুমটির মতই এই ঘরটিও অনুরূপ রুচিসম্মতভাবে সাজানো-গোছানো। দিনের বেলাতেও জানালায় ভারী মোটা ফিকেনীল স্ক্রিন টানা।
চার-পাঁচটা বড় বড় ডোমের অন্তরালে অদৃশ্য শক্তিশালী বিদ্যুৎ-বাতির আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে, বাইরের সূর্যালোক ভিতরে না আসা সত্ত্বেও।
ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের অদ্ভুত সুরেলা মিষ্টি কণ্ঠের আহ্বান কানে এল, আসুন। Be seated please Mr. Roy! এক মিনিট।
কণ্ঠস্বরে সামনের দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল সাদা ধবধবে অ্যাপ্রন গায়ে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অর দেওয়ালের কাছে ঘূর্ণমান একটা লিকুইড সোপর কাঁচের আধার থেকে সোপ নিয়ে ওয়াশিং বেসিনের ট্যাপে হাত ধুচ্ছেন।
ঘরের ঠিক মধ্যখানে এক একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিল। পুরু কাঁচের প্লেট তার উপরে। একটি ডোমে ঢাকা ফ্লেকসিবিল টেবিল-ল্যাম্প।
টেবিলের উপরে বিশেষ কিছুই নেই। একটি স্টেথোসকোপ, একটি প্রেসক্রিপসন প্যাড, এটি মুখখোলা পার্কার ফিফটিওয়ান, একটি কাঁচের গোলাকার পেপারওয়েট। একটি ঝিনুকের সুদৃশ্য অ্যাসট্রে। একটি ৯৯৯য়ের সিগারেট টিন ও একটি ম্যাচ।
বড় টেবিলের পাশেই কাঁচের প্লেট বসানো একটি স্ট্যাণ্ডের উপরে সাদা এনামেলের ট্রেতে কিছু ডাক্তারী পরীক্ষার আবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি। তারই পাশে বসবার ঘোরানো একটি গদি-আঁটা গোল টুল। এবং তারই সামনে ডাক্তারের বসবার জন্যই বোধ হয় গদি আঁটা একটি রিভলবিং চেয়ার। টেবিলের অন্যদিকে গদি আটা সুদৃশ্য আরও দুটি চেয়ারও নজরে পড়ল। কনসালটিংয়ের সময় ঐ চেয়ারই বোধ হয় নির্দিষ্ট রোগী ও তার সঙ্গের অ্যাটেনডেন্টের জন্য। এক পাশে অন্য একটি দরজা দেখা যাচ্ছে, ভিতরে বোধ হয় সংলগ্ন আর একটি পরীক্ষা-ঘর আছে। ঘরে মেঝেতে ফিকে সবুজ বর্ণের রবার-কার্পেট বিছানো।
নিঃশব্দ পায়ে আমরা দুজনে এগিয়ে গিয়ে সেই দুটি চেয়ারই অধিকার করে বসলাম। ডাক্তার হাত ধুতে লাগলেন।
ওয়েটিং রুমের মত কনসালটিং রুমের দেওয়ালও সম্পূর্ণ সাদা এবং দেওয়ালে কোন ছবি বা ক্যালেণ্ডার নেই। একটি মাত্র গোলাকার ইলেকট্রিক ক্লক ছাড়া। মিনিটে মিনিটে বড় কাঁটাটা সরে যাচ্ছে এক এক ঘর।
হাতধোয়া শেষ করে ডাক্তার আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। দুই ওষ্ঠের বন্ধনীতে আলগাভাবে ধরা অর্ধদগ্ধ একটি সিগারেট। টাওয়েলের সাহায্যে হাতটা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, সাক্ষাৎ পরিচয় আপনার সঙ্গে না থাকলেও আপনার নামটা আমার অপরিচিত নয় মিঃ রায়। বলতে বলতে টাওয়েলটা স্ট্যান্ডের উপরে রেখে রিভলবিং চেয়ারটার উপরে এসে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
তাকিয়েছিলাম আমি ডাক্তারের মুখের দিকেই। হাসির সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন বিশ্রী লাগল। চোখটা ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।
ডাক্তার বলছিলেন তখন, বুঝতেই পারেন, ডাক্তার মানুষ, বড্ড un-social, নচেৎ আপনার সঙ্গে আলাপ এক-আধবার হওয়ার নিশ্চয়ই সুযোগ ঘটত।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে এবারে জবাব দিল, সাক্ষাৎ-পরিচয়ের সৌভাগ্য না হলেও আপনিও আমার একেবারে অপরিচিত নন ডক্টর চৌধুরী।
মুহূর্তে ডাক্তার চৌধুরীর পিঙ্গল চোখের তারায় যেন একটা হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। এবং সেই সঙ্গে মুখেও তাঁর হাসি ফুটে ওঠে।
আবার আমি আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম। একটা ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল অনুভূতি যেন আমার সর্বদেহে ছড়িয়ে গেল।
ডাক্তার তখন আবার বলছিলেন, বলেন কি মিঃ রায়! ডাক্তারদের তো শুনি লোকে যতটা পারে এড়িয়েই চলে। নেহাৎ বিপদে বা বেকায়দায় না পড়লে তাদের সামনাসামনি কেউ বড় একটা আসে বলে তো জানি না।
ডাক্তারদের ডাক্তারিটাই তো একমাত্র পরিচয় নয় ডক্টর চৌধুরী! বলে কিরীটী।
কিরীটীর জবাবে মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর চৌধুরী, তারপর মৃদু হেসে বললেন, কথাটা হয়ত আপনার মিথ্যা নয় মিঃ রায়। কিন্তু লোকে তো সেটা ভুলেই যায়। আমরাও যেন ভুলতে বসেছি।
সেটা কিন্তু বলব আপনাদেরই নিজেদের সেম প্রফেশনের লোকেদের উপরে একটা বিশেষ পক্ষপাতিত্ব। আর সেই কারণেই বোধহয় চট করে বড় একটা কেউ আপনাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না।
সত্যি, আপনারও তাই মনে হয় নাকি! বলতে বলতে নিঃশেষিত-প্রায় জ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশটুকুর সাহায্যেই টিন থেকে একটা নতুন সিগারেট টেনে অগ্নিসংযোগ করে টিনটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, চলে নিশ্চয়ই?
ধন্যবাদ। চলে। তবে আমি সিগার আর পাইপই লাইক করি। বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে চামড়ার সিগারকেসটা বের করে একটা সিগার নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
What about you Subrata baboo? বলে ডাক্তার আমার দিকে টিনটা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাসলেন।
No! Thanks! বলে সঙ্গে সঙ্গেই আমি আবার দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম।
ওঃ, বলেন কি মশাই! ধূমপান করেন না।
না। দু-একবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু রপ্ত করতে পারলাম না। বলে হাসলাম। আমিও একসময় সিগার চেষ্টা করেছিলাম মিঃ রায়, কিরীটীর দিকে তাকিয়ে এবারে ডাক্তার বলতে লাগলেন, কিন্তু গন্ধটা এমন উগ্র যে সুব্রতবাবুর মতই রপ্ত করতে পারলাম না। এবং কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলের গায়ে সংযুক্ত কোন অদৃশ্য প্রেসবটম টিপতেই কঁ কঁ করে একটা শব্দ হল ও তার পরমুহূর্তেই ঘরের মধ্যকার তৃতীয় দ্বারটি খুলে একটি মধ্যবয়সী নার্স ঘরে ঢুকে ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়াল, আদেশের অপেক্ষায়।
টি প্লিজ, নার্সকে কথাটা বলেই ডাক্তার ফিরে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে এবং প্রশ্ন করলেন, চা চলবে তত মিঃ রায়?
আপত্তি নেই।
সুব্রতবাবু আপনি—
হেসে বললাম, আপত্তি নেই।
নার্স চলে গেল ঘর থেকে পূর্ব দ্বার-পথে।
আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাঃ চৌধুরী কথা বললেন, মিঃ রায়, আপনার ও সুব্রতবাবুর চেহারা সংবাদপত্র মারফৎ এতবার দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে যে, দেখামাত্রই আজ আপনাদের আমার সেইজন্যই চিনে নিতে কষ্ট হয়নি।
কিরীটী ধূমপান করতে করতে নিঃশব্দে হাসল মাত্র, কোন জবাব দিল না।
একটু পরেই বেয়ারা ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। এবং ট্রেটা ডাক্তারের সামনে নামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দেই আবার চলে গেল।
ডাক্তারই উঠে নিজহাতে চিনির পরিমাণ জেনে নিয়ে তিন কাপ চা তৈরী করে দু কাপ আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে তৃতীয় ও অবশিষ্ট কাপটি তুলে নিলেন।
চা পানের সঙ্গে সঙ্গেই গল্প চলতে লাগল।
একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম ডাক্তার যাকে বলে একেবারে চেইন স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছেন। আবার মনে হল লোকটা এত বেশী ধূমপান করে, অথচ ওর দাঁতগুলো অমন ঝকঝক করছে কি করে! কোন দাঁতে কোথাও এতটুকু নিকোটিনের ছোপ মাত্রও নেই!
রবিবারে এভাবে দেখা করতে এসে আপনাকে বিব্রত করলাম না তো ডক্টর চৌধুরী। কিরীটী বলে।
না, না—বিব্রত কেন করবেন। রবিবারে অবিশ্যি পূর্ব হতে কোনোস্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে গাড়িটা নিয়ে একা একাই বের হয়ে পড়ি। সমস্তটা দিন কলকাতার বাইরে এই ইট-কাঠ-পাথরের প্রাণান্তকর সভ্যতার হৈ-হট্টগোলের সীমানা পার হয়ে, কোথাও কোনো খোলা জায়গায় গিয়ে কাটিয়ে আসি। ঐ ভাবে একটা কোনও নির্জন জায়গায় ঘণ্টাকয়েক কাটানোর মধ্যে যে কত বড় একটা রিলিফ পাই—সে জানি একমাত্র আমিই। কিন্তু পরশু আপনার ফোন না পেয়ে এবং এ রবিবার সকালে কোনোস্পেশাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকায় আপনাদের আমি আসতে বলেছিলাম আজ। তাছাড়া আপনি আমার সঙ্গে নিজে থেকে দেখা করে আলাপ করতে আসছেন, সে লোভটাও তো কম নয় মিঃ রায়। সুযোগটাকে তাই সাদরে আহ্বান জানাতে এতটুকু কিন্তু দ্বিধা করিনি। কিন্তু থাক সে কথা। আপনার মত একজন লোক যে কেবল আমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যই এসেছেন কথাটা কেমন যেন শুধু তাই মনে হচ্ছে না মিঃ রায়, নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণও কিছু একটা আছে। বলে ডক্টর চৌধুরী তাকালেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে।
হাসল কিরীটী। বললে, একেবারে আপনার অনুমানটা যে মিথ্যে তা নয় ডক্টর চৌধুরী। সত্যিই কতকটা নিজের তাগিদেই আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি।
না, না—সে কি কথা! বলুন না কি প্রয়োজন আপনার? কৌতূহলে ডাক্তারের পিঙ্গল দুটো চোখের তারা যেন বারেকের জন্য ঝিকিয়ে উঠল।
কিরীটী চুরুটের অগ্রভাগটা সামনের টেবিলের উপর রক্ষিত অ্যাশট্রের মধ্যে ঠুকতে ঠুকতে মৃদুকণ্ঠে বললে, ডক্টর চৌধুরী, তাহলে আমার কাজের কথাটাও সেরে ফেলি, কি বলেন?
নিশ্চয়ই। আচ্ছা, বলছিলাম আপনি ব্যারিস্টার অশোক রায়কে বোধ হয় চেনেন? কিরীটীর প্রশ্নে দ্বিতীয়বার স্পষ্ট দেখতে পেলাম ডাক্তারের চোখের তারা দুটো মুহূর্তের জন্য যেন ঝিকিয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই শান্ত গলায় জবাব দিলেন, হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
চেনেন তাহলে? কতদিন চেনেন?
তা বছরখানেক তো হবেই।
বছরখানেক!
হ্যাঁ।
যদি কিছু মনে না করেন তো ঐ অশোক রায় সম্পর্কেই, মানে—কিরীটী একটু ইতস্তত করে।
না না-বলুন না কি বলছেন?
আচ্ছা, আপনার সঙ্গে তাঁর কি সূত্রে ঠিক পরিচয়টা হয়েছিল যদি বলেন—
ডাক্তারের সঙ্গে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যা হয়।
অর্থাৎ রোগী হিসাবেই তো। তা তিনি
হুঁ। কিন্তু মিঃ রায়, আর বেশি প্রশ্ন করতে পারবেন না। জানেন তো ডাক্তার ও তাঁর রোগীর মধ্যে পরস্পরের সম্পর্কটা। বলে মৃদু হাসলেন ডাঃ চৌধুরী।
বলা বাহুল্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিতে যেন বাধ্য হলাম।
থাক। আর বলতে হবে না, বুঝেছি। কিরীটী বললে।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন সবিস্ময়ে তাকালেন ডাঃ চৌধুরী কিরীটীর মুখের দিকে।
কেবল একটা কথার আর জবাব চাই। অশোক রায় প্রায়ই এখানে, মানে আপনার কাছে আসতেন, তাই না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
প্রায়ই বলতে অবিশ্যি আপনি ঠিক কি মীন করছেন জানি না মিঃ রায়, তবে মধ্যে মধ্যে এক-আধবার আসেন। কথাটা শেষ করে হঠাৎ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ডাঃ চৌধুরী এবারে বললেন, কেবল ঐ সংবাদটুকু জানবার জন্যই নিশ্চয়ই এত কষ্ট করে আজ এখানে আসেননি মিঃ রায় আপনি?
বিশ্বাস করুন ডক্টর চৌধুরী। সত্যি, ঐটুকুই আমার জানবার ছিল আপনার কাছে। বাকিটা
বাকিটা?
মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দিল, সেটা জানা হয়ে গিয়েছে।
অতঃপর দুজনেই যেন কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে। তারপর ডাঃ চৌধুরীই আবার স্তব্ধতা ভঙ্গ করেন, অবশ্য আপনি যদি কিছু মনে না করেন তো একটা প্রশ্ন ছিল আমার মিঃ রায়।
বলুন।
আমি যতদুর জানি অশোক রায় ব্যারিস্টার is a perfect gentleman!
নিশ্চয়ই। তাতে কোন সন্দেহই নেই আমারও।
কিন্তু সন্দেহ যে আপনিই মনে এনে দিচ্ছেন মিঃ রায়।
আমি?
কতকটা তাই তো। এ দেশে একটা প্রবাদ আছে নিশ্চয়ই জানেন, পুলিসে ছুঁলে আঠার ঘা। তা আপনি আবার তাদেরও পিতৃস্থানীয় বলে নিজের রসিকতায় নিজেই আবার মৃদু হাসলেন।
না না—সে সব কিছুই নয়। কিরীটী বোধ হয় আশ্বাস দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের দিকে চোখ ছিল আমার। স্পষ্ট বুঝলাম আশ্বাস হলেও সে আশ্বাসবাক্য ডাক্তারের মনে কোনরূপ দাগই কাটতে সক্ষম হয়নি। তথাপি মুখ ফুটেও আর কিছু তিনি বললেন না। কিরীটীর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন।
কিরীটীই আবার কথা বললে, আচ্ছা, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে ঢোকবার সময় লক্ষ্য করলাম, একবারে লাগোয়া, বলতে গেলে পাশাপাশি একই রকমের দুটো গেট।
তাই। দোতলায়ও এ-বাড়ির ঠিক আমারই মত পাশাপাশি চারটে ফ্ল্যাট। আমারটা ও আমার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে ওঠবার সিঁড়িটা কমন। তার পাশের ডাইনের দুটো ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে ওঠবার গেট হচ্ছে দ্বিতীয় গেটটা এবং সেটারও একটাই সিঁড়ি।
আপনার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়াটে আছে তো?
হ্যাঁ। একজন ইণ্ডিয়ান ক্রিশচান। মিঃ গ্রিফিথ। তার স্ত্রী মিসেস্ গ্রিফিথ ও তাদের একমাত্র তরুণী কন্যা—মিস নেলী গ্রিফিথ।
ওঃ! পাশের দুটো ফ্ল্যাটে?
ও দুটোতে একটায় আছে শুনেছি একটি ইহুদী পরিবার। অন্যটায় আর একটি ক্রিশ্চান ফ্যামিলি।
ভাল কথা। আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী, রাত্রে আপনার চেম্বারে কেউ থাকে না?
হ্যাঁ, থাকে বৈকি। চেম্বারের সঙ্গে আমার নিজস্ব একটা চার বেডের নার্সিংহোম আছে যে। রোগী থাকলে তারা থাকে আর থাকে নার্স ও কুক মাযোলাল ও দারোয়ান বা কেয়ারটেকার গুলজার সিং। কিন্তু এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন, ব্যাপার কি বলুন তো? আমার চেম্বার ও নার্সিংহোমে কোন রহস্যের গন্ধ পেলেন নাকি? বলে মৃদু হাসলেন আবার ডাক্তার চৌধুরী।
না না—সে-সব কিছু নয়।
দেখবেন মিঃ রায়, ডাক্তারের চেম্বারে কোন রহস্য উদঘাটিত হলে চেম্বারটিতে তো আমার তালা পড়বেই—সেই সঙ্গে এত কষ্টে এতদিনের গড়ে তোলা বেচারী আমার প্র্যাকটিসেরও গয়া হবে।
না না—এমনি একটা ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে একটু সাহায্য নিতে এসেছিলাম। কথায় কথায় আপনার ফ্ল্যাটের কথাটা উঠে পড়ল। আচ্ছা আর আপনাকে বিরক্ত করব না, এবারে তাহলে উঠি। ওঁঠ সুব্রত বলতে বলতে কিরীটী ও সেই সঙ্গে এতক্ষণের নীরব শ্রোতা আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
ডাক্তার চৌধুরী আমাদের তাঁর ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আচ্ছা নমস্কার। কিরীটী বললে। নমস্কার। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিরীটীর গাড়িতে এসে বসলাম।
হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।
ছুটির দিনের শহর। তবু লোক-চলাচল ও কর্মব্যস্ততার যেন অন্ত নেই।
কিরীটী গাড়িতে উঠে ব্যাক-সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। তাকালাম একবার তার মুখের দিকে। বুঝলাম কোন একটা বিশেষ চিন্তা তার মস্তিষ্কের গ্রে সেলগুলোতে আবর্ত রচনা করে চলেছে।
গত পরশুদিন দুপুরে হঠাৎ আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল ব্যাপারটা যে, সে ডাঃ চৌধুরীর সঙ্গে রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে দেখা করবার জন্য এবং আমাকেও সঙ্গী হিসাবে চায়।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হঠাৎ ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করতে চাস কেন?
কিরীটী বলেছিল, দোষ কি! তাছাড়া মানুষ-জনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় থাকাটা তো খারাপ নয়। বিশেষ করে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মত একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের সঙ্গে।
বুঝলাম, কিন্তু—
এর মধ্যে আবার কিন্তু কি?
অন্য কেউ হলে কি আর কিন্তু উঠত, এ কিরীটী রায় কিনা! হেসে জবাব দিয়েছিলাম। মোটকথা আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম, এই হঠাৎ আলাপের ব্যাপারটা একেবারে এমনই নয়, এর পশ্চাতে একটা বিশেষ কারণ আছেই। কিরীটীর চরিত্র তো আমার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সেদিনও যেমন সে কিছু ভেঙে স্পষ্ট করে জানায়নি, আজও জানাবে না এমন ভেবেই আর কোন প্রশ্ন না করে বসে রইলাম।
গাড়ি চলেছে মধ্যগতিতে।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, বাড়ি যাবি নাকি?
তা যেতে হবে বৈকি।
হীরা সিং, সুব্ৰতর বাড়ি হয়ে চল।
হীরা সিং নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল গাড়ি চালাতে চালাতেই।
.
বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল বটে কিরীটী কিন্তু মনটা সুস্থির হল না। কেবলই ঘুরেফিরে কিরীটীর ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে সকালের আলাপের কথাটা মনে পড়তে লাগল। আর সেই সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে উঠতে লাগল, ভুজঙ্গ ডাক্তারের সেই চেহারাটা। খাওয়া-দাওয়ার পরই গাড়ি নিয়ে কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম।
এসে দেখি কিরীটী একা একা তার বাইরের ঘরে সোফার উপরে বসে এক প্যাকেট তাস নিয়ে তাসের ঘর তৈরির মধ্যে ড়ুবে আছে। পায়ের শব্দে চোখ না তুলেই বলল, আয় সুব্রত, বস্।
কিরীটীর কথায় হঠাৎ যেন নতুন করে চোখের উপর স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল ভুজঙ্গ চৌধুরীর সরীসৃপসদৃশ চেহারাটা ও সেই সঙ্গে তার সেই কুৎসিত হাসির কথাটা। ব্যাপারটা স্মরণ হতেই গা-টা যেন কি এক ক্লেদাক্ত অনুভূতিতে ঘিনঘিন করে উঠল।
বললাম, তোর কেমন লাগল কিরীটী লোকটাকে?
কিরীটী চোখ বুজে ছিল সোফার গায়ে হেলান দিয়ে। সেই অবস্থাতেই বলল, আমার?
ছোটবেলায় টুনটুনির গল্পের বইয়ে পড়া সেই সাক্ষী শেয়ালের কথা মনে পড়ছিল লোকটাকে দেখে। মনে আছে তোর গল্পটা?
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল গল্পটা, বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি ব্যাপারটা কি বল তো?
কিসের ব্যাপার?
বলছি হঠাৎ ভুজঙ্গ-ভবনে আজ হানা দিয়েছিলি কেন?
কেন হানা দিয়েছিলাম?
হুঁ।
অবশ্যই একটা উদ্দেশ্য ছিল।
কথাটা বলে কিরীটী এতক্ষণে মুখ খুলল।
০৩. বর্তমান কাহিনীর আদিপর্ব
অতঃপর কিরীটীর মুখেই শোনা বর্তমান কাহিনীর আদিপর্বটা হচ্ছে:
বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়, যার মাসিক আয় কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার টাকা, তাঁরই একমাত্র মাতৃহারা পুত্র নব্য ব্যারিস্টার, বাপেরই জুনিয়ার অশোক রায়। এবং কিরীটীর বর্ণিত কাহিনীটা তাঁরই সম্পর্কে।
বছর তিনেক হবে মাত্র অশোক রায় বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসে বাপের জুনিয়র হিসেবেই আদালতে যাতায়াত শুরু করেছেন।
এবং বাপের তদ্বিরে ও চেষ্টায় আয়ও হতে শুরু করেছে।
বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট এবং অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির ছেলেটি। দেখতে-শুনতেও সুপুরুষ। এখনও বিবাহ করেননি। তবে গুজব শোনা যাচ্ছে হাই-সোসাইটি-গার্ল, বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট স্বর্গীয় ডাঃ অমল সেনের সুন্দরী তরুণী কন্যা মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি কিছুদিন যাবৎ একটা ঘনিষ্ঠতা দেখা দিয়েছে অশোক রায়ের।
সেই সূত্র ধরেই অভিজাত মহলে এমন কথাও কানাকানি চলেছে যে, এতকাল পরে সত্যি সত্যি নাকি বোহেমিয়ান মিত্রা সেন ঘব বাঁধবেন কিনা সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেছেন।
মিত্রার বাবা ডাঃ অমল সেন, ডি.এ.সি. একদা ইণ্ডিয়ান এড়ুকেশন সার্ভিসে ছিলেন, রিটায়ার করে আবার সরকারী বিশেষ একটি দপ্তরেই আরও বেশি মাহিনায় নতুন পোস্টে দিল্লীতে জয়েন করেছিলেন কিন্তু বেশিদিন তাঁর সে চাকরি করবার সুযোগ হয়নি। গত বৎসর মারা গিয়েছেন হঠাৎ রক্তচাপের ব্যাধিতে স্ট্রোক হয়ে।
এবং মৃত্যুকালে তিনি বেশ একটামোটা টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও কলকাতার উপরে বালিগঞ্জ অঞ্চলে চমৎকার একখানা বাড়ি রেখে গিয়েছেন।
তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে ঐ মিত্রা।
মিত্রাই সবার কনিষ্ঠ।
ডাঃ সেনের দুই ছেলেই অর্থাৎ মিত্রার দুই দাদা একজন নামকরা অধ্যাপক ও একজন ইনজিনীয়র বড় চাকুরে। বাপের সঞ্চিত অর্থ তো ছিলই, নিজেরাও বেশ ভালই অথোপার্জন করেন দুই ভাইই। কাজেই সংসারে সচ্ছলতার অভাব নেই। মিত্রার আট বৎসর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বর্তমানে মিত্রার বয়স ত্রিশ হলেও প্রায় কাছাকাছি, যদি কেউই সে সংবাদটি জানে না। কারণ দেখলেও বোঝবার উপায় নেই। মিত্রা এম. এ. পাস। দেকতে বা তার গাত্রবর্ণ যাই হোক না কেন, চোখেমুখে চলনে-বলনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে তার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিপছিপে মেয়েটি হাই-সোসাইটির মধ্যমণি হিসাবে বিরাজ করছে অনেক দিন ধরে। বৌদিরাও মিত্রাকে ভালবাসে এবং তার দাদারাও মিতা বলতে অজ্ঞান। স্নেহে একেবারে অন্ধ। বালিগঞ্জে লেক টেরেসে বৈকালী সাঞ্জ ক্লাবের সঙ্ঘমিত্রা মিত্রা সেন। তাছাড়া কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকাও। বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবের মেম্বার হচ্ছে অভিজাত ধনী সম্প্রদায়ের ছেলে ও মেয়েরা।
সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রবেশ সেখানে অসম্ভব, কারণ চাঁদের হার প্রতি মাসে একশতর নিচে নয়।
তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায় ঐ বৈকালী সঙ্ঘের একজন নিয়মিত সত্য। কোর্ট হতে ফিরে সন্ধ্যার পর নিজের গাড়ি নিয়ে সে বের হয়ে যায়, ফেরে কোন রাতেই সাড়ে এগারোটার আগে নয়। অশোক রায় সম্পর্কে খোঁজ করতে করতেই সব জানা গিয়েছে।
অশোক রায় ঘটিত ব্যাপারটা অবশ্য কিরীটীর মুখেই আমার শোনা এবং বলাই বাহুল্য বিচিত্রও। বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের সঙ্গে বছর চারেক আগে কিরীটীর একটা জাল দলিলের মামলার ব্যাপারে আলাপ-পরিচয় হয় এবং ক্রমে সেই আলাপ-পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। পূর্বেই বলেছি ঘটনার আদিপর্বটা কিরীটীর মুখ থেকেই শোনা, তাই কিরীটীর জবানিতেই বলছি:
সন্ধ্যার দিকে একদিন রাধেশ রায় আমাকে ফেন করলেন: রহস্যভেদী, কাল সন্ধ্যার পর এই ধরুণ গোটা আট-নয়ের সবয় আপনি ফ্রি আছেন কি?
কেন বলুন তো? আসুন না। অনেককাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে আর গল্পসল্পও করা যাবে।
ব্যারিস্টার রাধেশ রায় যে কি ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তাঁর চেম্বারে মক্কেলের ভিড় থাকে আর রাত্রেও বারোটা-একটা পর্যন্ত লাইব্রেরি ঘরে বসে তিনি নিয়মিত পড়াশুনা করেন।
তাই হাসতে হাসতে বললুম, ব্যাপার কি বলুন তো? ভূতের মুখে রাম-নাম!
না, না, আসুন না—সত্যিই just a social call! ফোনেই বললেন রাধেশ রায়। কিন্তু বিশ্বাস হল না সম্পূর্ণরূপে ব্যারিস্টারের কথাটা।
যা হোক পরের দিন ঠিক রাত নটায় বালিগঞ্জ প্লেসে রাধেশ রায়ের বিরাট ভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম।
চেম্বারে প্রবেশ করে দেখি সব চেয়ার খালি, আশ্চ! কেবল আবেশ রায়ের পাসোন্যাল টাইপিস্ট হিমাংশু একা আপন মনে বসে খটখট করে কি সব টাইপ করে চলেছে মেশিনে।
হিমাংশুঁকেই প্রশ্ন করলাম; ব্যারিস্টার সাহেব কোথায়?
হিমাংশু টাইপ করা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনিই কি মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
বসুন—পরক্ষণে সে ভিতরে গিয়ে কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে একজন উর্দিপরা বেহারা এসে দাঁড়াল।
হিমাংশু তাকে আমার আসবার সংবাদ সাহেবকে দিতে বলল।
মিনিট পাঁচেক বাদে ব্যারিস্টার সাহেবের খাস ভৃত্য কানু এসে বললে, সাহেব আপনাকে উপরে যেতে বললেন, চলুন।
চল।
কানুকে অনুসরণ করে পুরু কার্পেট মোড়া সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় টানা বারান্দার শেষ ও দক্ষিণ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিপূর্বেও বাড়িতে গেলে ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসেই গল্পসল্প হত। উপরে উঠলাম এই প্রথম।
দরজার পর্দা তুলে কানু আহ্বান জানাল, আসুন।
ব্যারিস্টার সাহেবের শয়নকক্ষ। মেঝেতে পুরু নরম কার্পেট এবং ঘরে বহু মূল্যবান সব আসবাবপত্র, রুচি ও আভিজাত্যের চমৎকার সমম্বয় সর্বত্র।
ঘরের সংলগ্ন একটি চারিদিকে খোলা ছাদের মত জায়গা। মাথার উপরে অবশ্য খানিকটা আচ্ছাদন আছে। চারিদিকে ফুলের, পাতাবাহারের ও পামট্রির টব বসান। ছোটখাটো একটা নাশারী বললেও চলে।
একধারে একটি সুদৃশ্য গোল টেবিল, তার পাশে দুটি গদি-আঁটা চেয়ার। এখামা মাত্র খালি এবং অন্য একটিতে বসে আছেন ব্যারিস্টার সাহেব স্বয়ং।
টেবিলের উপরে সাদা দুধের মত ডোমে ঢাকা একটি বৈদ্যুতিক টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। মধ্যিখানে একটি ২৩ অংশ পূর্ণ ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট স্কচ হুইস্কির কালো রঙের বোতল, সোডা সাইফন, একটি খালি পেগ গ্লাস ও পূর্ণ একটি পেগ গ্লাস।
পদশব্দে ব্যারিস্টার মুখ তুলে তাকালেন, আসুন রহস্যভেদী, বসুন।
তারপরেই কানুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, কানু, বাইরের দরজায় বসে থাক। যতক্ষণ না ডাকি তোকে, এদিকে আসবার দরকার নেই।
আচ্ছা। কানু জবাব দেয়।
হ্যাঁ, কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে ফোন এলে হিমাংশুই ধরবে—সে আমার লাইব্রেরি ঘরে আছে।
কানু চলে গেল।
মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে ব্যারিস্টার সাহেবের দিকে তাকালাম।
পরিধানে সাদা ফ্লানেলের পায়জামা ও ডিপ কালো রঙের কিমনো।
শোনা যায় প্রথম যৌবনে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন নাকি রাধেশ রায়। এখনও অবশ্যি বয়স হলেও সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। উজ্জ্বল গৌর গাত্র-বর্ণ। প্রশস্ত কপাল। মাথার দুপাশে একটু টাক পড়েছে। রগের দু-একটা চুলে পাক ধরেছে। খড়ের মত উন্নত নাসা। দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ। কঠিন ধারালো চিবুক।
মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো, চোখেসোনার ফ্রেমে প্যাঁসনে।
আমাকে কিছু না বললেও তাঁর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকতেই বুঝতে কষ্ট হল না সমগ্র সেই মুখখানা ব্যেপে পড়েছে যেন কিসের একটা চিন্তার সুস্পষ্ট ছায়া।
Have a peg-রাধেশ রায় বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে।
দিন তবে ছোট একটা, জবাব দিলাম।
রাধেশ রায় নিজেই শূন্য পেগ গ্লাসটিতে লিকার ঢেলে সোডা সাইফনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
সোডা আমিই মিশিয়ে নিলাম।
Best of luck!
পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে দুজনেই আমরা গ্লাসে চুমুক দিলাম। মিনিট পাঁচ-সাত তারপর নিঃশব্দেই কেটে গেল।
মাঘের মাঝামাঝি হলেও শীতের তীব্রতা তেমন অনুভূত হয় না। ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মিশে আছে বায়ুতরঙ্গে মিষ্টি ফুলের নাম-না-জানা একটা পাতলা গন্ধ।
টেবিল-ল্যাম্পের আলো উপবিষ্ট ব্যারিস্টারের চোখে মুখে কপালে এসে পড়েছে। হাতদুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা।
বসবার ভঙ্গিটা যেন কেমন শিথিল অসহায় বলে মনে হয়।
বুঝতে পারছিলাম, রাধেশ রায় আজ রাত্রে বিশেষ কিছু বলবার জন্যই এভাবে আমায় ডেকে এনেছেন। কিন্তু যে কারণেই হোক সংকোচ বোধ করছেন। চেষ্টা করেও যেন সংকোচ বা দ্বিধাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। আমিও তাঁকে সময় দিতে লাগলাম। যা বলবার উনি নিজে থেকেই বলুন। সংকোচ ওঁর কেটে যাক। বলতেই যখন চান। ওদিকে তাঁর গ্লাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, আবার গ্লাস ভর্তি করে নিলেন।
দ্বিতীয় গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে এবারে আমার দিকে তাকালেন, তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, রহস্যভেদী, আপনার তীক্ষ্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুভূতির উপরে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। বুঝতে পারছি না ঠিক তবে মনে হচ্ছে something somewhere wrong! To tell you frankly, I want your help!
কি ব্যাপার? মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
You know my son অশোক! Recently I dont know why but I feel much worried about him!
একটু বেশ আশ্চর্য হয়েই রাধেশ রায়ের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর একটু থেমে মৃদুকণ্ঠে বললাম, কি ব্যাপার বলুন তো? আমি তো যতদূর শুনেছি আজকাল অশোকবাবু বেশ promising in the Bar—কতকটা যেন আশা দেবারই চেষ্টা করি।
হ্যাঁ হ্যাঁ—তা জানি। কিন্তু সব কথা বলবার আগে একটা কথা আপনাকে আমি বলতে চাই মিঃ রায় বিশেষ করে শেষের দিকে একটু যেন থেমেই কথাগুলো বললেন ব্যারিস্টার।
বলুন? ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করি।
সব কথা বলবার আগে যে কথা বিশেষ করে বলতে চাই মিঃ রায়, অশোক যেন এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু না জানতে পারে। আশা করি বুঝতেই পারছেন, সে আমার একমাত্র ছেলে। মা নেই, বড় অভিমানী।
সংকোচটা যেন ব্যারিস্টার সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
নিশ্চিন্ত থাকুন। আশ্বাস দিই ব্যারিস্টারকে।
অবশ্য সেটা আমি জানি বলে আপনাকেই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য ডেকে এনেছি মিঃ রায়।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
কেবল ব্যারিস্টার সাহেব মধ্যে মধ্যে পেগ-গ্লাসটা তুলে চুমুক দিতে লাগলেন নিঃশব্দে। মুখ দেখে বোঝা যায় অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি কি ভাবছেন। মনে মনে নিজেকেই নিজে যেন যাচাই করে চলেছেন।
অশোক কয়েক মাস ধরে দেখছি যেন একটু বেশি খরচ করছে! হঠাৎ আবার ব্যারিস্টার সাহেব কথা বললেন।
তা অল্প বয়েস; বিয়ে-থা করেননি, যথেষ্ট ইনকাম করেন, কোনো liabilities-ও নেই—তাছাড়া এই তো খরচ করবার সময়। হাসতে হাসতে জবাব দিই।
বাধা দিলেন ব্যারিস্টার, না না—ঠিক তা নয় মিঃ রায়। যতই খরচ করুক সে, তিন-চার হাজার টাকা একজনের মাসে pocket expense—একটু কি বেশিই বলে মনে হয় না আপনার?
তিন-চার হাজার! এবারে সত্যি বিস্ময়ের পালা আমার।
হ্যাঁ। না হলে আর বলছি কি? আমার আর অশোকের অ্যাকাউন্ট অবশ্য আলাদা। জীবনে স্বাবলম্বনের চিরদিন আমি বিশেষ পক্ষপাতী তাই তার নামে বিলেত থেকে সে ফিরবার পরই হাজার পঞ্চাশ টাকা দিয়ে starting একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। তার কাছ থেকে কোনদিনই কোন কিছু আমি আশা ও করি না এবং তার রোজগার ও খরচ সম্পর্কেও কোনদিন খোঁজ-খবর নেবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কিন্তু মাত্র দিন আষ্টেক আগে হঠাৎ ভুল করে, just by mistake, তার ব্যাঙ্কের একখানা চিঠি আমি খুলতেই ব্যাপারটা আমার নজরে পড়ল।
কি রকম?
তাই তো বলছি।
আমি আবার ব্যারিস্টার সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম।
রাধেশ রায় আবার বলতে শুরু করলেন যেন একটু থেমেই, একসঙ্গে গত তিন মাসের statement of account এসেছে
অশোকই মনে হয় চেয়ে পাঠিয়েছিল ব্যাংকে। এবং just out of curiosity সেই statement of account-টা দেখতে গিয়েই নজরে পড়ে গেল আমার প্রত্যেক মাসে সে প্রায় তিন-চার হাজার করে টাকা ড্র করেছে। এবং গত প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে একটা করে আড়াই হাজার টাকার self-draw আছে। আমি তো চমকে গেলাম। প্রত্যেক মাসে তার এত অর্থের কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আর প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে ঐ আড়াই হাজার টাকাই বা draw করা হচ্ছে কেন? ব্যারিস্টার বলতে বলতে থামলেন বোধ হয়। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার জন্যই।
কোনো heavy insure বা payment-ও তো থাকতে পারে। বললাম আমি।
Nothing of that kind! ওর কোন insure-ই নেই। যা হোক—কেমন মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিঃ ওয়াটসন আমার বিশেষ বন্ধু ও অনেক দিনের পরিচিত। Irang him up। সে যা বললে, তাতে বিস্ময় যেন আরও বাড়ল। সে বললে, গত এক বৎসর ধরেই নাকি অশোক প্রতি মাসের দশ তারিখে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঐ আড়াই হাজার টাকা self-cash করে নিয়ে আসে।
হুঁ।
বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কি রকম delicate! যা হোক আমি দুটো দিন ব্যাপারটা নিজে নিজেই ভাববার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো conclusion-এই পৌঁছতে পারলাম না। যতই আমার সন্দেহ বাড়তে লাগল, সেই সঙ্গে ঔৎসুক্যও বাড়তে লাগল। যদিও ব্যাপারটা বিশ্রী, তবু তলে তলে গোপনে আমি তার উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না রেখে থাকতে পারিনি।
ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর বক্তব্য শেষ করে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, মিঃ রায়, বুঝতে পারলেন কিছু?
সাগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম আবার।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ কেটে গেল। তারপরই আমি এবারে প্রশ্ন করলাম, এমনও তো হতে পারে তাঁর কোনো প্রাইভেট লোক বা কাউকে তিনি ঐ টাকাটা দিয়ে থাকেন, মানে বলছিলাম কি কোনো সৎ প্রতিষ্ঠানে হয়ত বা সাহায্য করে থাকেন।
ব্যারিস্টার আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। সম্মুখে টেবিলের উপরে রক্ষিত এবং ক্ষণপূর্বে নিঃশেষিত পেগ-গ্লাসটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন শুধু স্তব্ধ হয়ে।
কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধভাবে কেটে গেল।
ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করলেন ব্যারিস্টার, সে রকম কিছুই না। বলে একটু চুপ করে থেকে পুনরায় শুরু করলেন, কয়েকটা ব্যাপারকে জীবনে আমি নিরতিশয় ঘৃণা করে এসেছি মিঃ রায়। অন্যের চিঠি লুকিয়ে পড়া, অন্যের গতিবিধির উপরে আড়াল থেকে গোপনে গোপনে নজর রাখা ও অন্যের ব্যাপারে অকারণ মাথা ঘামানো। পর তো কথাই নেই, এমন কি নিজের স্ত্রী-পুত্রের বেলাতেও না। কিন্তু এমনই দুর্দৈব যে, অশোক, আমার নিজের সন্তানের বেলায় তাই আমাকে করতে হল। এ যে আমার পক্ষে কত বড় লজ্জা ও দুঃখের কারণ হয়েছে মিঃ রায়, তা আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।
বেদনায় ও গ্লানিতে মনে হল ব্যারিস্টারের কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন বুজে আসছে। আর কেউ না হলেও আমি বুঝেছিলাম সমস্ত ব্যাপারটা ব্যারিস্টার রায়ের পক্ষে কতখানি বেদনার কারণ হয়েছে। এবং শুধু বেদনাই নয়, তাঁকে কতখানি সেই সঙ্গে বিচলিতও করেছে।
শূন্য পেগ-গ্লাসটায় কিছুটা আবার লিকার ঢেলে এবং তাতে সোড়া মিশিয়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে, এ মাসের দশ তারিখে আর নিজের কৌতূহলকে চেপে রাখতে পারলাম না। আমার এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, রুচি ও নীতি-বোধকে একপাশে ঠেলে রেখেই বেলা দশটা বাজবার কিছু আগে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক দশটায় দেখলাম অশোকের গাড়ি এসে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে দাঁড়াল।
অশোক নিজেই ড্রাইভ করছিল। আর তার পাশে উপবিষ্ট দেখলাম একটি নারী।
নারী!
অর্ধস্ফুট ভাবে আপনা হতেই যেন কথাটা আমার কণ্ঠ হতে বের হয়ে এল।
হ্যাঁ। কিন্তু তার মুখ দেখতে পেলাম না। মাথায় অল্প ঘোমটা টানা। কেবল একখানা চুড়ি-পরা হাত গাড়ির দরজার উপরে ন্যস্ত দেখতে পেলাম দূর থেকে। অশোক গাড়িটা এমন ভাবে পার্ক করে রেখেছিল আর আমার ট্যাক্সি এমন জায়গায় ছিল যে সেখান থেকে গাড়ির সামনের দিকটায় নজর পড়ে না। কেবল একটা সাইড দেখা যায় মাত্র। লজ্জায় ও সংকোচে গাড়ি থেকে নামতে পারলাম না। ভূতগ্রস্তের মতই গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম আমি। মিনিট কুড়ি বাদে ব্যাঙ্ক থেকে অশোক বের হয়ে এল এবং গাড়িতে উঠে, স্পষ্ট দেখলাম, পার্শ্বে উপবিষ্ট সেই মেয়েটির হাতে নোটের বাণ্ডিলগুলো তুলে দিল। তারপর উটো পথে গাড়িটা বের হয়ে গেল।
গাড়িটা ফলো করলেন না কেন?
না, তা করিনি। ঘটনাটা আমাকে এমন বিল ও বিমূঢ় করে ফেলেছিল যে ঠিক ঐ সময়টাতে, যখন খেয়াল হল অশোকের গাড়ি আশেপাশে কোথায়ও নেই। তারপর দুটো দিন কেবল ভাবতে লাগলাম। আমার কেস-পত্র সব কোথায় পড়ে রইল। তৃতীয় দিনে অশোক যখন সন্ধ্যার পর চেম্বারে কেস সেরে রাত সাড়ে আটটায় বের হল তাকে ফলো করলাম ট্যাক্সি নিয়ে। কানুকে দিয়ে আগেই ডাকিয়ে এনে তার মধ্যে বসে অপেক্ষা করছিলাম গেটের অদূরে। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবটা সম্পর্কে কিছু জানেন মিঃ রায়, মানে নাম শুনেছেন ক্লাবটার কখনও?
জানি, শুনেছি। লেক টেরেসে তো?
হ্যাঁ। সেখানে গিয়ে ঢুকল অশোক। রাত সাড়ে এগারোটায় বের হল ক্লাব থেকে। আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম এত রাত্রে ক্লাব থেকে বের হয়ে বাড়ি না ফিরে সে চলেছে পার্ক সার্কাসের দিকে।
পার্ক সার্কাসের দিকে? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই।
হ্যাঁ। এবারে তার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে।
অত রাত্রে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারে?
হ্যাঁ। তবে বাইরের দরজা তো বন্ধ ছিল; দোতলায় চেম্বারের ঘরেওকোনো আলোজ্বলছিল। সব অন্ধকার।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সঙ্গে শুনেছি নার্সিং হোমও আছে, এমনও তো হতে পারে যে, অশোকবাবুর কোনো জানাশুনা রোগী নার্সিং হোমে ছিল, তাকেই তিনি দেখতে গিয়েছিলেন!
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? হতে পারে নার্সিং হোম, তাই বলে ওটা তো আর দেখা করতে যাবার সময় নয় ঐ মাঝরাত্রে! তাছাড়া সব দিক এই কদিন ধরে ভেবেচিন্তেই শেষ পর্যন্ত আপনার পরামর্শ নেওয়া স্থির করেই আপনাকে ডেকেছি মিঃ রায়। যাক শুনুন, অশোক গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে কলিং বেলের বোতাম টিপতেই কে যেন এসে দরজা খুলে দিল। অশোক ভেতরে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর?
আধ ঘণ্টা বাদে অশোক চেম্বার থেকে বের হয়ে এল। তারপর অবিশ্যি সে বাড়ির দিকেই গাড়ি চালাল। তারপর তিন রাত অশোককে আমি গোপনে ফলো করেছি এবং প্রত্যেক বারেই দেখেছি সে বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাব থেকে বের হয়ে সোজা পার্ক সাকাসে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারেই যায়। শুধু এই নয়, আজ ছ-সাত মাস থেকেই লক্ষ্য করছি অশোকের কথায়বাতায়, তার চালচলনে, ব্যবহারে, এমন কি চেহারাতেও যেন একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। অমন চমৎকার, উজ্জ্বল চেহারা ছিল ওর; যেন একটা কালো ছায়া পড়েছে তার ওপরে। সমস্ত দিন কেমন ঝিম মেরে থাকেমনে হয় যেন খুব ক্লান্ত। চিরদিন যে হাসিখুশী হৈ-হুল্লা করে চলত, সে যেন হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। অথচ রাত্রে ফেরবার পর যতক্ষণ
ঘুমোয় পাশের ঘর থেকে শুনি কখনও গুনগুন করে গান গাইছে বা শিস দিচ্ছে। একেবারে অন্য প্রকৃতির। কতবার ভেবেছে ওকে ডেকে খোলাখুলি সব জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু লজ্জা ও সংকোচ এসে বাধা দিয়েছে। ভেবে ভেবে যখন কোনো আর কূল-কিনারা পাচ্ছি না, হঠাৎ মনে পড়ল আপনার কথা। I am sure মিঃ রায়, এর পেছনে কোন একটা গোলমাল আছে। Somewhere something wrong! অশোক my only son। একমাত্র ছেলে ওই আমার। যেমন করে যে উপায়েই হোক এই দুশ্চিন্তা থেকে আপনি আমায় বাঁচান, মিঃ রায়। বলতে বলতে ব্যারিস্টার কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরলেন। আবেগে ও উত্তেজনায় তাঁর ধৃত মুষ্টিটা যেন কাঁপছে থরথর করে তখন। চোখের কোলে অশ্রু।
ব্যস্ত হবেন না ব্যারিস্টার। কয়েক দিন সময় দিন; আর আমাকে একটু ভাবতে দিন।
কিন্তু একটা কথা, ও যেন ঘুণাক্ষরেও না কিছু সন্দেহ করে।
ভয় নেই আপনার। নিশ্চিন্ত থাকুন। দু-পাঁচ দিনের মধ্যেই আপনার সঙ্গে আমি দেখা করব।
০৪. সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে
সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে ডিনার শেষ করে তো ফিরে এলাম। কিন্তু তারপর পর পর চার-পাঁচদিন সর্বদা দিনে রাত্রে অশোক রায়কে ছায়ার মত অনুসরণ করেও মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিরীটী বলতে লাগল, এদিকে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম শুধু গত বৎসরখানেক ধরে মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি অশোক রায়ের একটু বিশেষ করে ঘনিষ্ঠতা চলেছে এবং বৈকালীতে মিত্রা সেনই অশোকের আসল আকর্ষণ। যতক্ষণ বৈকালীতে ও থাকে মিত্রা ও অশোক কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু রাত এগারোটা বাজবার পর থেকেই অশোক যেন কেমন চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে। চোখেমুখে একটা উত্তেজনা ফুটে ওঠে। রাত এগারোটায় ঠিক মিত্রা সেন চলে যায়। এবং মিত্রা সেন চলে যাবার পর থেকেই অশোকের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখা দেয়। অথচ মজা এই, ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকালেও রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার আগে কখনও সে বৈকালী থেকে বের হয় না। এবং রাত সাড়ে এগারোটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগেই ঠিক বের হয়ে পড়ে—এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। এই তো গেল অশোকের ব্যাপার। তারপরই নজর দিলাম ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর ওপরে। তাঁর চেম্বারের attendance একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে আটটা; দেড় ঘণ্টা চেম্বারে বসেই চলে যান হাসপাতালে। বেলা গোটা বারো নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে বাইরের কলগুলো সেরে বেলা দেড়টায় ঠিক বাড়ি পৌঁছন। বিকেলে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা চেম্বার অ্যাটেনডেন্স। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় চেম্বার থেকে বের হয়ে এসেন গাড়িতে চাপেন এবং সোজা চলে আসেন আমির আলী অ্যাভিতে নিজের বাড়িতে। বাড়িতে একবার রাত্রে পৌঁছানোর পর সকলেই জানে হাজার টাকা দিলেও এবং যত সিরিয়াস সেই হোক না কেন রাত্রে কখনও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেউ বাড়ির বাইরে আনতে পারবে না। এবং, নানা ভাবে খবর নিয়ে দেখেছি, কথাটা মিথ্যে বা অত্যুক্তি নয়। রাত্রে চেম্বার থেকে ফেরবার পর সত্যিই আর তিনি বাইরে যান না। এদিকে ভুজঙ্গ ডাক্তার চেম্বার থেকে চলে যাবার পরই তাঁর একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার ও একজন নার্স বাদে আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাকি আর সব চেম্বার থেকে চলে যায়, চেম্বারের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঐ চেম্বার ও নার্সিং হোমে থাকে একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার একজন নার্স ও প্রহরায় থাকে একজন শিখ দারোয়ান গুলজার সিং ও কুক মাধোলাল। কিন্তু মজা আছে ঐখানেই। রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকে রাত প্রায় একটা দেড়টা পর্যন্ত মধ্যে মধ্যে এক-একখানা প্রাইভেট গাড়ি এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়—কখনও কোন পুরুষ, আবার কখনও কোনো মহিলা গাড়ি থেকে নেমে দরজার কলিংবেলের বোতামটা গিয়ে টেপেন। নি:শব্দে দরজা খুলে যায়। তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং পনের মিনিট থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার চেম্বার থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে চেপে চলে যান। প্রতি রাত্রে এই একই ব্যাপার ঘটছে।
কিরীটীর কথায় বাধা না দিয়ে পারি না, বলি, এ যে রীতিমতো সিনেমা-কাহিনী হে!
তাই বটে। শোন, শেষ হয়নি এখনও। আমার next step হল যে যে গাড়ি রাত্রে চেম্বারে আসে তাদের নাম্বারগুলো টুকে অনুসন্ধান করে তাদের মালিকদের খুঁজে বের করা। শুরু করে দিলাম। এবং এইখানে এসেই ব্যাপারটা যেন আরও বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে গেল।
কি রকম? প্রশ্ন করলাম।
শোন হে সুব্রতচন্দ্র! কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গলায় বেশ একটু আমেজ এনে বললে, চমকে উঠো না যেন এবারে নামগুলো শুনে। অশোক রায় ছাড়াও এক নম্বর সুচরিতা দেবী আর একসেলেন্সী মহারাণী অফ সোনাপুর স্টেট। দু নম্বর বিখ্যাত আর্টিস্ট বর্তমানে নব্য চিত্রকরদের মধ্যমণি সোমেশ্বর রাহা। তিন নম্বর বিখ্যাত পাল অ্যাণ্ড কোংএর তরুণ প্রোপাইটার শ্ৰীমন্ত পাল। চার নম্বর—স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী। পাঁচ নম্বর বর্তমানের শ্রেষ্ঠ চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক। ছ নম্বর-উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ। আর চাই?
বিস্ময়ে আমি সত্যিই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটী একে একে যে সব নামগুলো করে গেল তাদের মধ্যে যে কেবল শহরের বর্তমান নামকরা ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ই আছে তাই নয়, এমন নামও করলে যাদের নাম। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
এরাই রাত্রির বিভিন্ন যামে নিয়মিত ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে হানা দেয়।
কিন্তু কেন?
.
কিরীটীর কাহিনী শেষ হবার পর দুজনে চুপচাপ বসেছিলাম। ঘরের মধ্যে যেন হঠাৎ একটা স্তব্ধতার গুরুভার জমাট বেঁধে উঠেছে।
এবং এতক্ষণে যেন বুঝতে পারছি আজ সকালে কিরীটীর ভুজঙ্গ চৌধুরী দর্শনে গমনটা আকস্মিক বা সামান্য খেয়ালের বশে নয়। সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী হয়েছিল।
সদ্য কিরীটীর মুখে শোনা বিচিত্র নামগুলো ও সেই সঙ্গে সেই লোকগুলোর চেহারা ও এতদিনকার তাদের সকলের আমাদের জানিত বাইরের পরিচয়টা মনের মধ্যে বিচিত্র এক চিন্তার সৃষ্টি করেছিল।
অশোক রায়, মহারাণী সুচরিতা দেবী, আটিষ্ট সোমেশ্বর রাহা, পাল এ্যাণ্ড কোং-এর শ্ৰীমন্ত পাল, অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী, অভিনেতা চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক, উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ–সমাজ বা সোসাইটিতে সকলেই এমন বিশেষ পরিচিত যে নাম করলেই সকলকে চেনা যায়।
সেই একটা দিক এবং দ্বিতীয় দিকটা হচ্ছে প্রত্যেকের অবস্থা, অর্থাৎ আর্থিক অবস্থা সচ্ছল। সকলেরই যাতায়াত আছে ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে। এবং যাতায়াতটা দিনের আলোয় প্রকাশ্যে নয়, রাত্রির অন্ধকারে,বলতে গেলে এক প্রকার গোপনেই এবং ভুজঙ্গ ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু কেন?
কেন ওরা সকলেই ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে রাত্রে যাতায়াত করে? বিশেষ করে চেম্বার যখন বন্ধ থাকে এবং তিনি যখন সেখানে থাকেন না!
হঠাৎ কিরীটীর কথায় আবার চমক ভাঙল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস সুব্রত?
কি?
সকলেই ভুজঙ্গ ডাক্তারের ওখানে যায় এবং রাত্রি এগারটার পর!
হ্যাঁ।
শুধু তাই নয়, সে সময় সাধারণত ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ তো থাকেই এবং সে সময়টা ডাক্তার চৌধুরী তাঁর বাড়ি থেকে কখনও বের হন না। এর থেকে একটা কথা কি স্বতঃই মনে হয় না যে,ডাক্তারের এ সময়টায় চেম্বারে অনুপস্থিতি ও ওদের সেই সময়ে গমনাগমন, কোথায় যেন একটা রহস্য রয়েছে! হয়ত এমন কোন আকর্ষণ সেখানে আছে যার টানে–
কিন্তু তাই যদি থাকে তো সেটা কি হতে পারে? তোর কি মনে হয়?
মনে তো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু মনে হলেই তো হয় না। ভুললে চলবে কেন আমাদের, ডাঃ চৌধুরী এবং অন্যান্য সকলেরই সোসাইটিতে আজকের দিনে একটা পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে।
তা অবিশ্যি আছে। শুধু তাই নয়, আর একটি ব্যাপার হচ্ছে ঐ বৈকালী সঙ্ঘ।
হ্যাঁ, খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমি, ঐ সব ব্যক্তিবিশেষের বৈকালী সঙ্ঘেও নিয়মিতযাতায়াত আছে এবং তারা প্রত্যেকেই সেখানকার মেম্বার।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। কিন্তু আরও একটু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে, বিশেষ ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী কখনও আজ পর্যন্ত বৈকান্ধী সঙ্ঘে পা তো দেনইনি, এমন কি সঙ্ঘের ওপরেও নাকি তিনি মর্মান্তিক ভাবে চটা। সঙ্ঘের নাম পর্যন্ত নাকি তিনি শুনতে পারেন না।
কেন?
তাঁর ধারণা বৈকালী সঙ্ঘটা নাকি আসলে একটা যৌন ব্যভিচারের গোপন কেন্দ্র। যত সব তথাকথিত অ্যারিস্টোক্রেটিক পয়সাওয়ালা তরুণ-তরুণীরা ঐখানে সেই উদ্দেশ্যেই মিলিত হন। আর ঠিক সেই কারণেই আমি fill up the blank পূর্ণ করতে পারছি না কদিন ধরে ভেবেও। অথচ আমাদের ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের পুত্র তরুণ ব্যারিস্টার শ্রীমান অশোকের যাতায়াত নিয়মিত দু জায়গাতেই। সে যাক গে, তুই একটা কাজ করতে পারবি?
কি?
মিত্রা সেনের গতিবিধি সম্পর্কে একটা রিপোর্ট আমাকে এনে দিতে পারবি?
সে কি আর ঠাকুরপোর দ্বারা সম্ভব হবে? বরং আমি—
চমকে দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখি বক্তা আমাদের কিরীটী-গৃহিণী শ্রীমতি কৃষ্ণা বৌদি। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনার ফাঁকে চায়ের ট্রে হাতে কখন যে নিঃশব্দে কৃষ্ণা বৌদির সেই ঘরে আবির্ভাব ঘটেছে দুজনের একজনও সেটা টের পাইনি। এবং বুঝতে পারা গেল শুধুআবিভাবই নয়, আমাদের শেষের আলোচনার অংশটুকুর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে।
কিরীটীই বলে, কৃষ্ণা!
হাতের ট্রেটা সামনের ছোট টেবিলটার উপরে রাখতে রাখতে কৃষ্ণা বৌদি বললে, হ্যাঁ কৃষ্ণাই। সর্বাগ্রে চা-সুধার দ্বারা গলদেশ ভিজাইয়া লওয়া হউক, তারপর যাহা আমার বক্তব্য, পেশ করিতেছি।
দুজনেই আমরা হাসতে হাসতে ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিলাম হাতে।
কৃষ্ণা বৌদিও একটি কাপ হাতে নিয়ে কিরীটীর পাশের সোফায় বসল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে চেয়ে শুধাল, কি বলছিলে কৃষ্ণা?
বলছিলাম তোমার মিত্রা সেনের সংবাদটা ঠাকুরপোর দ্বারা ঠিক সুবিধে হবে না, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
তুমি!
হ্যাঁ। নারীর মনোলোকের সংবাদ নারীই ঠিক যোগাড় করতে পারে।
কিন্তু—
ভাবছ চিনে ফেলবে! না, মা-ভৈষী! একটা রাত একটু আমাকে ভাবতে দাও, তারপর আমি কাজে নামব।
কৃষ্ণা জবাব দিল।
০৫. দিন দুই পরে কিরীটী
দিন দুই পরে কিরীটী আবার আমাকে ডেকে বলল, কৃষ্ণার কথা শুনে কিন্তু তুই চুপ করে বসে থাকিস না সুব্রত। মিত্রা সেনের সমস্ত সংবাদটা আমার চাই।
বললাম, তথাস্তু।
কিন্তু বললাম তো তথাস্তু। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব! শ্রীমতী মিত্রা সেন সম্পর্কে যতটুকু জানি বা জানবার সৌভাগ্য হয়েছে, তিনি গভীর জলের মৎস্যকন্যা! এমন একটা পরিবেশের মধ্যে তাঁর বিহার যে সেখানে আমার মত একজন নগণ্য অসামাজিক রসকষহীন ব্যক্তির পক্ষে মাথা গলানো শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব। তিনি থাকেন অভিজাত পল্লীর প্রাসাদোপম পিতৃ-নিবাসের তিনতলার একটি নির্জন কক্ষে। সিঙ্গল করা মাথার চুল, কপাল কপোল ও ওষ্ঠ থেকে শুরু করে পদাঙ্গুলির নখাগ্র পর্যন্ত এমন সুচারুভাবে এনামেলিং করা যে, ত্রিশোত্তীর্ণ হয়েও আজ তিনি চিত্তবিমোহিনী, স্থিরযৌবনা, মনোলোভা।
অতএব দুদিন ধরে কেবল ভাবলামই। তারপর বিদ্যুৎ-চমকের মতই হঠাৎ যেন ভাবতে ভাবতে মানসপটে একখানি মুখ ভেসে উঠল।
সুধীরঞ্জন মিত্র।
হ্যাঁ, ঠিক। সুধীর ওখানে গিয়ে হানা দিতে হবে। সে হয়তো একটা পথ বাতলে দিতে পারবে। কলকাতা শহরে সত্যিকারের পুরাতন এক বনেদী ঘরের ছেলে সুধী। ওদেরই এক পূর্বপুরুষ হেস্টিংসের আমলে বেনিয়ানগিরি করে মা লক্ষ্মীকে এনে গৃহে তুলেছিলেন। তারপর দুই পুরুষ ধরে নর্তকী ও সুরার বিলাসিতায় সেই লক্ষ্মীর রস শোষণ করেও যা বাকি ছিল সুধীর জীবনে, ইচ্ছে করলে সুধী তার একটা জীবন হেসেখেলে পায়ের উপরে পা দিয়েই কাটিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সুধী তার পূর্বপুরুদেরও যেন নারী ও সুরার ব্যাপারে ডিঙিয়ে গেল। এবং পিতার মৃত্যুর পর দশটা বছর যেতে না যেতেই হাটখোলার শেষ বসতবাটিটুকুও বন্ধক দিয়ে সে আজও নাকি পূর্বের মত না হলেও মেজাজেই দিন কাটাচ্ছে।
সুধীর আরও দুইটি বিশেষ গুণ ছিল যেটা তার বাপ-পিতামহ বা তস্য পিতা কোনদিনই আয়ত্ত করতে পারেননি। সুধী ইংরাজী সাহিত্যে এম.এ পাস করেছিল এবং সর্বাপেক্ষা বেশী নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থানটি অধিকার করে। পড়াশুনার বাতিকও তার ছিল প্রচণ্ড। আর বেহালা বাজানোয় সে ছিল অদ্বিতীয়। এবং সেই বিশেষ গুণটির জন্যই তথাকথিত ইউরোপীয় ভাবধারায় সমৃদ্ধ নতুন দিনের কালচার্ড সোসাইটির মধ্যেও সে পেয়েছিল অনায়াস প্রবেশাধিকার। এবং আজও সে অবিবাহিত। সুধীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর চারেক আগে এক পাটিতে।
সুধীরঞ্জনের কথা মনে হতেই পরদিন সকাল-সকালই বের হয়ে পড়লাম তার গৃহের উদ্দেশে।
সুধীর কথাই ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।
পার্টিতে সে-রাত্রে সুধীর বেহালা বাজানো শুনে মুগ্ধই হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তারপর পরিচয় হয়ে তার পড়াশুনা ও জ্ঞান দেখে আরও বেশী করে মুগ্ধ হই। বেশ কিছুদিনে আলাপও জমে উঠেছিল। তারপরই তার নারী ও সুরাপ্রীতির সন্ধান পেয়ে কি জানি কেন হঠাৎ তার প্রতি মনটা আমার বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে এক সময় তার কাছ থেকে সরে এসেছিলাম।
তারপর অবিশ্যি কালে-ভদ্রে কচিৎ কখনও যে দেখা হয়নি সুধীরঞ্জনের সঙ্গে তা নয়। তবে পূর্বের মত আর ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। সে-ও চায়নি হতে।
বিরাট সেকেলে প্যাটার্নের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। অন্দরমহলে বহু ভাড়াটে এসে বসবাস করছে। বহির্মহলেরই চারখানা ঘর নিয়ে সুধী থাকে। এখনো অবিশ্যি তার চাকর ঠাকুর দারোয়ান সোফার আছে। আর আছে আপনার জন বলতে সুধীর এক বিধবা সত্তর বৎসরের পিসী মৃন্ময়ী। ঘুম থেকে উঠে সুধী চা-পান কবতে বসেছিল, এমন সময় ভৃত্যের মুখে আমার আসার সংবাদ পেয়ে আমাকে সোজা একেবারে তার শয়নঘরেই ডেকে পাঠাল।
একটা চেয়ারের উপর বসে সুধী চা-পান করছিল। আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললে,এস, এস সুব্রত। হঠাৎ কি মনে করে? পথ ভুলে নাকি?
না। মনে করেই এসেছি।
বটে! কি সৌভাগ্য! বলেই ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিল।
সামনেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
একটু পরেই ভৃত্য চা নিয়ে এল। চা-পান করতে করতে ভাবছিলাম কি ভাবে বক্তব্যটা আমার শুরু করা যায়।
সুধীই প্রথমে কথা বললে, তারপর হঠাৎ উদয় কেন বল তো?
তোমার কাছে একজনের কিছু সংবাদ পাই যদি সেই আশায়—
সংবাদ! আমি ভাই সংবাদ দিতে পারি নারীমহলের, অন্য মহলের সংবাদ—
একজন নারী সম্পর্কেই জানতে চাই।
বল কি! ভূতের মুখে রামনাম! কি ব্যাপার বল তো হেঁয়ালি রেখে?
হেঁয়ালি নয়, সত্যিই কোন এক বিশেষ নারী সম্পর্কেই—
সত্যি বলছ? Are you serious?
নিশ্চয়ই।
হুঁ। বল শোনা যাক।
মিত্রা সেনকে চেনো?
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চমকে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণকাল নিষ্পলক হয়ে রইল।
কি? চেনো নাকি?
এককালে চিনতাম।
এখন?
দেখাশুনা হয় এইমাত্র। কিন্তু বন্ধু, সাবধান! ও হচ্ছে বহ্নি-পতঙ্গ। ও পতঙ্গের দিকে হাত বাড়ালে হাতই পুড়বে, পতঙ্গ ধরা দেবে না।
সুধীরঞ্জনের কণ্ঠস্বরে শেষের দিকে কেমন যেন একটা চাপা বেদনার আভাস পেলাম বলে মনে হল। চমকে তাকালাম ওর মুখের দিকে। মেঘে ঢাকা আলোর মত কি একটা বিষণ্ণতা যেন ওর চোখে-মুখে ক্ষণেকের জন্য ছায়া ফেলে গেল।
এখন দেখাশুনা হয় বললে তো, সেটা কিরকম?
বৈকালী সঙ্ঘের নাম শুনেছ?
চমকে উঠলাম আবার সুধীরের কথায়। বললাম, হ্যাঁ, সেইখানেই নাকি?
হ্যাঁ। বলতে পার বৈকালী সঙ্ঘের তিনিই মক্ষীরাণী!
.
সুধীরঞ্জনের শেষের কথায় বেশ যেন একটু ঔৎসুক্যই অনুভব করি। নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার তাহলে বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত আছে বল?
এককালে খুবই ছিল। তবে এখন কখনও-সখনও গিয়ে থাকি।
শেষ কবে গিয়েছিলে?
এই তো গত পরশুই গিয়েছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা ব্যারিস্টার অশোক রায়ের নাম—
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবারে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ব্যাপারটা সত্যি করে কি বল তো সুব্রত? প্রথমেই করলে মিত্রা সেনের নাম, তারপরই করছ অশোক রায়ের নাম! রহস্যের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছি!
ব্যাপারটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি সুধী। আমি বিশেষ করে ঐ দুজনের সম্পর্কে ও বৈকালী সংঘ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আর তোমার কাছে সে ব্যাপারেই কিছু সাহায্য চাই।
তাই তো সুব্রত! তুমি যে আমায় চিন্তায় ফেললে!
কেন?
কারণ বৈকালী সঙ্ঘ হচ্ছে এমন একটি সঙ্ঘ সেখানে একমাত্র সেই সঙ্ঘের মেম্বার ছাড়া প্রবেশ একেবারে strictly prohibited। একেবারে দুঃসাধ্য।
কিন্তু তার কি কোন পথ নেই?
সে আরও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
কি রকম?
তিনজন সঙ্ঘের মেম্বারের রেকমেণ্ডেশন না পেলে কারও মেম্বারশিপ সেখানে গ্রাহ্যই করা হয় না।
তুমি তো একজন আছ। আর দুজনের রেকমেণ্ডেশন তুমি যোগাড় করে দিতে পারবে না?
কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।
দেখাদেখি নয় ভাই। যে করে থোক তোমাকে করে দিতেই হবে।
কিন্তু ভাই তোমার বেলায় আরও একটা যে মুশকিল আছে।
কেন?
এককালে তুমি পুলিসের চাকরি করতে। শুধু তাই নয়, তুমি আবার কিরীটী রায়ের সাক্ষাৎ দক্ষিণহস্ত–দুনিয়া-সমেত সকলেই জানে। তোমায় কমিটি নিতে চাইবে কিনা সেও একটা ভাববার কথা।
কিন্তু কেন নেবে না? যতদূর শুনেছি, বৈকালী সঙ্ঘ তো অভিজাত ধনিক সম্প্রদায়ের একটি মিলন-কেন্দ্র, তাহলে আমাদের যদি বর্তমানে বা অতীতে কখনও পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ থাকেই, সেখানে প্রবেশাধিকার পাব না কেন? তবে কি তুমি বলতে চাও সেখানে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে থাকে যাতে ঐ দিক থেকে তাদের ভয়ের বা আশঙ্কার কারণ আছে?
সুধীরঞ্জন প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তা জানি না ভাই, তবে পুলিস বা পুলিস-সংক্রান্ত লোকেদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
হেতু?
হেতু আর কি! ওরা এমন কি যেখানে যাবে, সেখানেই একটা না একটা মামলা বাধা চাই। শোনা যায় স্ত্রীর সঙ্গেও নাকি মন খুলে কথা বলে না!
তাহলে উপায়? উপায় নেই?
তাই তো বলছিলাম—
আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?
বল?
এই কথা—আসল নামে আমি যাব না। ছদ্মনাম নেব। ধর কোন জমিদারনন্দনের পরিচয়ে! কিন্তু তোমার ওই চেহারাটির সঙ্গে যে অনেকেরই পরিচয়-সৌভাগ্য আছে ভাই।
ভয় নেই। একেবারে অন্য চেহারায় ও বেশে—
বল কি! যদি ধরা পড়?
ধরা পড়ব। হুঁ! আরে তুমিই দেখে চিনতে পারবে না তো অন্যে পরে কা কথা।
সুধীরঞ্জন অতঃপর কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর বললে, বেশ, দিন পাঁচেক বাদে এস। আজ কি নাম নেবে সেইটেই শুধু বলে যাও। একবার চেষ্টা করে দেখব।
তুমিই বল না, কি নাম নেওয়া যায়?
ছদ্মবেশ ও নাম তুমি নেবে, আর বলব আমি!
আচ্ছা নাম বলছি। মুহূর্তকাল ভাবলাম। বললাম, সত্যসিন্ধু রায়। চক্রধরপুর কোল মাই-এর মালিক।
বেশ। নাম ও পরিচয়টা জোরালো দিয়েছ বটে।
সেদিনকার মত বিদায় নিয়ে সুধীরঞ্জনের ওখান থেকে বের হয়ে এলাম।
সুধীর কাছে গিয়ে এতটা যে সুবিধা হবে যাত্রার পূর্বমুহূর্তেও ভাবিনি।
.
সুধীরঞ্জনের চেষ্টাতেই সত্যসিন্ধু রায় বৈকালী সঙ্ঘে প্রবেশাধিকার পেল। এবং যথাসময়ে একটি গোলাকার সাদা আইভরি ডিস্কের উপরে বৈকালী সঙ্ঘের সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশপত্রও হাতে এসে পৌঁছল।
তারও দিন-পাঁচেকবাদে একদিন রাত্রি নটায় প্রথম বৈকালী সঙ্ঘের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গেটের দারোয়ান দেখলাম অত্যন্ত সজাগ ও চতুর।
আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলে, পাস দেখলাইয়ে।
বৈকালী সঙ্ঘের প্রবেশপত্র হিসাবে যেটি আমার হস্তগত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র টাকার আকৃতির একটিগোলাকার আইভরিডিস্ক। তারমধ্যে একটি লাল বৃত্তের মধ্যে অঙ্কিত অপূর্বসুন্দর একখানি নারীমুখ ও অন্য দিকে লেখা বৈকালি কথাটি। আইভরি ডিস্কটি পকেট থেকে বের করে প্রহরীর সামনে ধরলাম।
সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী এক দীর্ঘ সেলাম দিয়ে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে বললে, যাইয়ে সাব। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম আমি। সামনেই সরু করিডোর। অল্পদূর এগিয়েই সামনে পড়ল চকচকে আলো-পিছলে-যাওয়া বম টিকের ফ্রেমে ওপেইক গ্লাস বসানো ভারি মজবুত দরজা। দরজার গায়ে একটি সাদা কাঁচের নব ও তার নীচে একটা সাদা চাকতিতে কালো ইংরাজী অক্ষরে লেখা: PULL। মুহূর্তকাল ইতস্তত করে দরজার নষ্টা ধরে টানতেই নিঃশব্দে একপাল্লাওয়ালা দরজার কপাটটা সরে এল। পাইরিথ্রাম মেনথল-ইউক্যালিপটাস-মিশ্রিত মৃদু গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিল সঙ্গে সঙ্গে। প্রবেশ করলাম একটা হলঘরে। মেঝেতে পুরু রবার কার্পেট বিছানা। সমস্ত হলঘরটা মৃদু একটা নীলাভ আলোয় যেন থমথম করছে। সামনেই কার্পেট-মোড়া একটা সিঁড়ি। বুঝলাম দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি সেটা।
হলঘরে প্রবেশ করতেই সাদা উর্দি পরিহিত একজন বেয়ারা সামনে এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। এবং মুহূর্তকাল আমার মুখের ও চেহারার দিকে তাকিয়ে বললে, কার্ড?
বুঝলাম সতর্ক প্রহরার এটি দ্বিতীয় ঘাঁটি। অপরিচিতকে এখানেও পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে। যথারীতি আমাকে সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশ-চাকতিটি বের করে আবার দেখাতে হল।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেলাম।
Upstairs please! এবারের নির্দেশ ইংরাজীতেই।
সামনেই সিঁড়ি। এগিয়ে গেলাম। কার্পেটে মোড়া সিঁড়িটা আধাআধি উঠে ডানদিকে একটু কার্ড নিয়ে আবার উপরে উঠে গিয়েছে। সিঁড়ির পথেও নীলাভ আলো।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার সামনেই আবার দরজা। এ দরজাটিও একটি পাল্লার এবং কাটগ্লাসের। পূর্ব দরজার মত এ দরজার গ্লাসেও নির্দেশ লেখা: PUSH।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিরাট একটি হলঘর। নীচের হলঘরের প্রায় দিগুণ এবং মিশ্রিত হাসি ও মৃদু আলোকের একটা গুঞ্জরণের সঙ্গে সঙ্গে নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করল মৃদু একটা ল্যাভেণ্ডারের মিষ্টি গন্ধ। দেওয়ালের গায়ে গায়ে অদৃশ্য আলো থেকে আলোকিত ঘরটি। এবং সে আলো নীলাভ হলেও বেশী স্পষ্ট। ঘরের মধ্যে টেবিল-চেয়ার, সোফা-কাউচ পাতা। সেইসব সোফা-কাউচে বসে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে অনেককে দেখলাম। বিভিন্ন বয়সের দশ-পনের জন নরনারী। বিভিন্ন দামী বেশভূষা গায়ে। প্রত্যেকেই তাদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে হাসি-গল্প করছে। আমি ঘরে সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত ব্যক্তি। হঠাৎ প্রবেশ করা সত্ত্বেও কে আমার দিকে বারেকের জন্যও ফিরে তাকাল না। বুঝলাম তারা নিজেদের সম্পর্কে সেখানে কত নিশ্চিন্ত যে, আচমকা কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করলেও তারা জানে সে এমন একজন কেউ যে তাদের দ্বারাই সেখানে প্রবেশধিকার পেয়েছে।
মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে আমি ঘরের চারপাশটা তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে একবার দেখে নিলাম যথাসম্ভব আড়চোখে।
হলঘরটা দৈর্ঘ্যে যতটা প্রস্থে তার অর্ধেকের কিছু বেশিই হবে। যে দরজা-পথে ঘরে প্রবেশ করেছিলাম সে দরজা ছাড়াও দুদিকে আরও চারটি অনুরূপ কাটগ্লাসেরই এক পাল্লাওয়ালা দরজা চোখে পড়ল। এবং দরজাগুলোর মাথায় ইংরাজী অক্ষরে দেখলাম লেখা আছে 1,2,3,4; ঘরের ঐ দরজা ছাড়া আরও চারটি জানালা চোখে পড়ল কিন্তু সেগুলো একটু বেশ উঁচুতেই এবং প্রত্যেক জানালায় ভারি নীল রঙের পর্দা টাঙানো। তার উপরে চারদিকে চারটি ভেনটিলেটার। এ ছাড়াও ঘরে চারটি ফ্যান আছে। তবে সেগুলি বন্ধই ছিল, মাত্র একটি ছাড়া। দেওয়ালের চারিদিকেই আলো, তবে সেগুলো অদৃশ্য। নীলাভ কাঁচের আবরণে ঢাকা। ঘরের দেওয়াল একেবারে দুধ-সাদা। সম্পূর্ণ নিরাবরণ। কোথাও একটি ক্যালেণ্ডার বা ছবি পর্যন্ত নেই।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত নর-নারীরা সকলেই যে গল্প করছিল তা নয় —দুটো টেবিলে জনাপাঁচেক বসে তাসও খেলছিল। আরও একটি জিনিস নজরে পড়ল, ঘরে একটি বিলিয়ার্ড টেবিল। কিন্তু কাউকেও বিলিয়ার্ড খেলতে দেখলাম না। সকলেই যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কি করব ভাবছি, হঠাৎ এমন সময় আমার ডাইনে 2 নম্বর দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল ও দীর্ঘকায় এক বৃদ্ধ, পরিধানে দামী নেভি-ব্লু ট্রপিক্যাল স্যুট-ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। এবং আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর চাপা কণ্ঠে বললেন, আসুন সত্যসিন্ধুবাবু! নমস্কার।
আমার নামটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম একসঙ্গে উপস্থিত ঘরের সকলেরই অনুসন্ধানী দৃষ্টি যেন একঝাঁক তীরের মতই আমার সর্বাঙ্গে এসে বিদ্ধ করল।
আগন্তুক তখন ঘরে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে বললেন-Ladies and gentlemen! আসুন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের বৈকালী সঙ্ঘের নতুন সভ্য শ্রীযুক্ত সত্যসিন্ধু রায়ের সঙ্গে। ইনি চক্রধরপুরের একজন বিখ্যাত কোল মার্চেন্ট।
অতঃপর প্রত্যেকের সঙ্গে নাম করে করে আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন আগন্তুক: ইনি সলিসিটার সানু ভৌমিক, ইনি অ্যাডভোকেট নীলাম্বর মিত্র, ইনি মার্চেন্ট শ্ৰীমন্ত পাল, ইনি ব্যারিস্টার অশোক রায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিবারেই আগন্তুকের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দীর্ঘকায়, বয়স মনে হয় পঞ্চাশোত্তীর্ণ, ষাটের কাছাকাছিই হবে। মাথার চুল কোঁকড়ানো, ব্যাকব্রাশ করা এবং একেবারে সাদা। চোখে একটি কালো কাঁচের চশমা। পুরু ওষ্ঠ এবং উপরের পাটির দাঁতের সামনের দুটো দাঁত যেন একটু বেশী বড়। গাল সামান্য তোবড়ানো, বোঝা যায় মাড়ির দাঁত নেই। মুখে সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সামান্য একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়ান। গলাটা ভারী এবং গম্ভীর হলেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত মিষ্টত্ব আছে কণ্ঠস্বরে।
আচ্ছা, তাহলে আমি চললাম। Make yourself comfortable Mr. Roy। বলেই বললেন, আশ্চর্য, দেখুন সবার পরিচয় দিলাম অথচ নিজের পরিচয়টাই আপনাকে দিলাম না! আমার নাম রাজেশ্বর চক্রবর্তী।
ওঃ, আপনিই তাহলে এখানকার প্রেসিডেন্ট! বললাম এবার আমিই।
তাই। আচ্ছা চলি।
রাজেশ্বর চক্রবর্তী অতঃপর যে দ্বারপথে প্রবেশ করেছিলেন সেই দ্বারপথেই প্রস্থান করলেন।
এক নম্বর দরজাটি এবারে খুলে গেল এবং একজন ওয়েটার হলঘরে প্রবেশ করল। দৃষ্টি পড়বার মত লোকটা। দৈর্ঘে ছ ফুটেরও বেশী হবে। যে অনুপাতে ঢ্যাঙা লোকটা সে অনুপাতে কিন্তু শরীর নয়। অনেকটা তাই হাড়গিলে প্যাটার্নের মনে হয়।
লোকটার পরিধানে ছিল সাদা লংস ও গলা-বন্ধ সাদা কোট। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট দেওয়া। ছোট কপাল। বাঁশির মত ধারালো নাক। নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফ।
লোকটা ঘরে ঢুকতেই একজন বললেন, মীরজুমলা, একটা বড় জিন অ্যাণ্ড লাইম দাও। অন্য একজন বললে, একটা হুইস্কি ছোটা পেগ। আর একজন বললে, একটা রাম অ্যাণ্ড লাইম।
সকলের নির্দেশেই মীরজুমলা মৃদু হেসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
এমন সময় হঠাৎ একটা মিহি নারী কন্ঠের আওয়াজে চমকে সেই দিকে তাকালাম। তিন নম্বর দরজাটার পাল্লাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার গোড়ায়ই দাঁড়িয়ে অপরূপ সুন্দরী একনারীমূর্তি। তিনি মীরজুমলার দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরজুমলা, কোল্ডলিমন-জুস।
শুধু আমিই নয়, হলঘরে সেই নারীমূর্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত সকলেরই কর্ণে সে কণ্ঠস্বর প্রবেশ করায় সকলেই একসঙ্গে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে সাদর আহ্বান জানালেন তাকে এবং Hail beautious stranger of the grove বলে তাঁদের মধ্যে শ্রীমন্ত পাল এগিয়ে আসেন।
আর একটি সুবেশ প্রৌঢ় ব্যারিস্টার অমিতাভ মৈত্রও এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, Good evening Miss Sen!
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল, আশ্চর্য! এ তো সেই মুখ। কত কাগজে দেখেছি। মিস মিত্রা সেন!
বৈকালী সঙ্ঘের সুধীরঞ্চন-বর্ণিত মক্ষীরানী।
০৬. অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে
অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে প্রথম দর্শনেই শ্রীমতী মিত্রা সেনকে দেখে চোখ ঝলসে গিয়েছিল সে-রাত্রে আমার। সত্যিই কালো জমিনের উপরে সাদা জরির পাড় দেওয়া বহুমূল্য ইটালীয়ান সিফন শাড়িটি যেন সে বরঅঙ্গে লেপ্টে ছিল। হাতে একগাছি হীরা-বসানো জড়োয়ার চুড়ি। কানে নীলার দুল। হীরা ও নীলার উপরে বিদ্যুতের আলো পড়ে যেন ঝিলিক দিচ্ছিল। আর অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না। কিন্তু ঐবেশভূষাতেই যেন মনে হচ্ছিল তাকে বিশ্ব-বিজয়িনী। লম্বায় পাঁচ ফুট দু-এক ইঞ্চির বেশী হবে না। রোগাটে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। কিন্তু প্রসাধনের রঙে সেটা বোঝবার উপায় ছিল না।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মিত্রা সেনকে সাদর আহ্বান জানালেও এবং সকলেইসোৎসুক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মিত্রা সেন কিন্তু সকলকেই উপেক্ষা করে তাকাল তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায়ের দিকে। মধুর হাসিতে দু-গালে তার টোল খেয়ে গেল। মৃদু কণ্ঠে অশোকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বললে, অশোক, আমার আসতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল!
দরদে ও আব্দারে মেশানো সে কণ্ঠের সুর।
অশোক রায়ের ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটুখানি হাসি জেগে ওঠে।
তারপরেই অশোকের কাছে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে এসে বললে, পূবের চাইতে যেন আর একটু চাপা কণ্ঠেই, রাগ করনি তো?
অন্য কেউ না শুনলেও কথাটা আমি শুনতে পেলাম।
দেরি হল যে! মৃদু কণ্ঠে অশোক রায় এবার প্রশ্ন করে।
বল কেন, বৌদি কোথায় এক পার্টিতে যাবে শাড়ি পছন্দ করে দিতে দিতে—
তা তুমি যে গেলে না?
ভুলে গেলে নাকি, শনিবার আর বুধবার রাত্রে যেখানেই যাই না কেন, রাত দশটায় এখানে আসিই!
ঐ সময় ওয়েটার মীরজুমলা এসে হলঘরের মধ্যে ঢুকল সুদৃশ্য একটা প্লাসটিকের ট্রের উপরে পিপাসীদের বিভিন্ন সব পানীয় গ্লাসে গ্লাসে ভরে। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে সে ট্রে-টা ধরতে লাগল। এক এক করে যে যার নির্দিষ্ট পানীয় মীরজুমলার ইঙ্গিতে তুলে নিতে লাগল ট্রে-র উপর থেকে। মিত্রা সেনকে লিমন-জুসের গ্লাসটা দিয়ে শূন্য ট্রে-টা হাতে এবার এগিয়ে এল মীরজুমলা আমার দিকে এবং আমার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
আমিও তাকালাম লোকটার মুখের দিকে।
তারপরই সুস্পষ্টোচারিত নির্ভুল ইংরাজীতে প্রশ্ন করল, Any drink, Sir?
একজন ওয়েটারের মুখে অমন সুস্পষ্টোচ্চারিত নির্ভুল ইংরাজী শুনে আমিও নিজের অজ্ঞাতেই মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, Yes, Gin and bitter please?
মীরজুমলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে স্থানত্যাগ করল। এবারে স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, চলার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ও গতি আছে লোকটার।
আমি আবার হলের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলাম।
হঠাৎ ছোট একটা কথা কানে এল।
লাকি গ্যায়!
কথাটা বলেছিল বিখ্যাত আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহা তার সামনেই দণ্ডায়মান শ্ৰীমন্ত পালকে।
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সোমেশ্বর একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অল্প দূরেই ঘনিষ্ঠভাবে পাশাপাশি দণ্ডায়মান মিত্রা সেন ও অশোক রায়ের দিকে।
সোমেশ্বরের দু-চোখের তারায় মনে হচ্ছিল যেন একটা কুটিল হিংসা ও সঙ্গে আরও একটা কিছু মিশে আছে।
নিজের অজ্ঞাতেই যেন দৃষ্টিটা আমার সোমেশ্বরের মুখের উপর স্থির হয়ে ছিল। সোমেশ্বরকে ইতিপূর্বে চাক্ষুষ কখনও না দেখলেও ওর আঁকা ছবি দেখেছি। এবং বহু সাময়িক কাগজে ওর অনন্যসাধারণ প্রতিভার সমালোচনা পড়েছি। সেই থেকেই লোকটাকে না দেখলেও মনের মধ্যে ওর প্রতি আমার একটা প্রশংসা ও শ্রদ্ধার ভাব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনও ভাবতে পারিনি লোকটার চেহারা এত কুৎসিত। বেঁটে কালো দেখতে। ছোট কপাল, রোমশ জোড়া জ। নাকটা একটু চাপা। গোল গোল চোখ। একমাত্র হাতের মোটা মোটা কুৎসিত রোমশ আঙুলগুলি ছাড়া দেহের আর সমুদয় অংশ সযত্ন পরিধেয় পোশাকে আবৃত থাকলেও বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটার শরীরে লোমের একটু আধিক্যই আছে।
ভাবছিলাম ঐ লোমশ কুৎসিতদর্শন মোটা মোটা আঙুলগুলো কি করে অমন সাদা কাগজের বুকে সূক্ষ্ম শিল্প রচনা করে! লোকটার চেহারা, চোখের দৃষ্টি ও হাতের আঙুল দেখলেই স্বতই মনে হয় লোকটা নিশ্চয় একটা নৃশংস খুনী। অতবড় উঁচুদরের একজন শিল্পী কোনমতেই নয়।
বিধাতার সৃষ্টি সত্যই আশ্চর্য। নইলে এমন চেহারা ও কাজে এমন বৈচিত্র্য আসে কোথা থেকে আর কোন যুক্তিতেই বা! নিজের চিন্তায় বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম চার নম্বর দরজা-পথে কেউ ক্ষণপূর্বে নিশ্চয়ই প্রস্থান করেছে, দরজার কবাটটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তারপরেই এদিক-ওদিক তাকাতে নজরে পড়ল ঘরের মধ্যে দুটি প্রাণী নেই। অশোক রায় ও মিত্রা সেন। এবং নিজের অজ্ঞাতেই আবার আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ঘুরে গিয়ে পড়ল আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহার মুখের উপরে। দেখলাম সোমেশ্বরের দু-চোখের স্থিরদৃষ্টি সেই চার নম্বরের বন্ধ কবাটের গায়ে যেন পিন দিয়ে কে এঁটে দিয়েছে।
ক্ষণকাল সেই বন্ধ কটের দিকে তাকিয়ে থেকে সোমেশ্বর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চার নম্বর দরজাটা খুলে প্রস্থান করল।
ঘড়িতে ঠিক তখন সাড়ে দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাক।
দুর্নিবার এক আকর্ষণে সেই চার নম্বর দরজাটা আমায় টানছিল এবং নিজের অজ্ঞাতেই একসময় পায়ে পায়ে সেদিকে যে এলিয়েও গিয়েছি টের পাইনি। দরজার কাছাকাছি প্রায় যখন গিয়েছি হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল, মীরজুমলা ট্রে-তে করে আমার পানীয় নিয়ে হলঘরে এসে প্রবেশ করল।
Your drink, Sir!
ট্রে থেকে গ্লাসটা তুলে নিতে নিতে আড়চোখে তাকালাম মীরজুমলার মুখের দিকে। মুখখানা যেন তার পাথরে কোঁদা, কিন্তু চোখের কোণে স্পষ্ট যেন মনে হল একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ-চমক।
মীরজুমলা তিন নম্বর দরজা-পথে বের হয়ে গেল ট্রে-টা হাতে নিয়ে। হলঘরের চারিদিকে আবার দৃষ্টিপাত করলাম। কেউ আমার দিকে চেয়ে আছে কি! কিন্তু না, সকলেই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে কারও যেন হৃক্ষেপও নেই। আমি যে একজন নবাগত তাদের সঙ্ঘে আজ রাত্রে, সে ব্যাপারে কারো মনেই যেন বিন্দুমাত্রও কৌতূহলের উদ্রেক করেনি।
কিন্তু নিজের কাছেই নিজের আমার যেন কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। কেমন যেন একটু বিব্রত বোধ করছিলাম।
প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কেউ আমার কাছে এগিয়ে এল না।
আর আলাপ করবার চেষ্টাও করল না।
এখানকার নিয়ম-কানুন রীতি-নীতিও আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। গায়ে পড়ে এখানে হয়ত কেউ কারও সঙ্গে আলাপ করে না।
কিন্তু কিসের টানেই বা প্রতি রাত্রে এখানে এতগুলো বিভিন্ন চরিত্রের লোক এসে জড়ো হয়? সামান্য একটু তাস খেলা বিলিয়ার্ড খেলা বা সামান্য একটু ড্রিঙ্কের জন্যই কি? মন কিন্তু কথাটা মেনে নিতে চাইল না অত সহজে।
কিরীটী যে বলেছিল এবং সুধীরঞ্জনের কথাবার্তাতেও প্রকাশ পেয়েছিল,এ সঙ্ঘটা হচ্ছে আসলে নর-নারীদের একটা যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে পরস্পরের একটা মিলনকেন্দ্র, কই সেরকমও তো এতক্ষণের মধ্যে তেমন কিছু আমার চোখে পড়ল না। বরং রুচি ও সংযমের পরিচ্ছন্নতাই সকলের মধ্যে লক্ষ্য করছি এযাবৎ।
তাছাড়া পুলিস বা তৎ-সংক্রান্ত লোকেদের এড়িয়ে চলবার মত কিছুও তো এখনও পর্যন্ত আমার নজরে পড়ল না।
ভুলেই গিয়েছিলাম যে গ্লাসটা হাতে করেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটি সিপ-ও দিইনি পানীয়ে।
হঠাৎ পাশ থেকে একটি মিষ্ট মৃদু-উচ্চারিত নারীকণ্ঠে চমকে ফিরে তাকালাম।
কি নাম আপনার?
সুবেশা মধ্যবয়সী এক নারী ইতিমধ্যে কখন আমার পশ্চাতে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি। আমি যখন এ ঘরে প্রবেশ করি তখন ওঁকে দেখিনি। নিশ্চয়ই পরে কোন এক সময় এসেছেন।
আগন্তুক মহিলা খুব সুন্দরী না হলেও প্রসাধন-নৈপুণ্যে সুন্দরীই মনে হচ্ছিল। মৃদুকণ্ঠে আমার ছদ্মনামটা উচ্চারণ করলাম, সত্যসিন্ধু রায়।
আমার নাম বিশাখা চৌধুরী। আপনাকে আগে কখনও দেখিনি তো বৈকালী সঙ্ঘে?
না। আজই প্রথম এসেছি।
কারও সঙ্গে বুঝি এখনও আলাপ হয়নি?
নামেমাত্র কারও কারও সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে, তার বেশি হয়নি।
তা এখানে এই ঘরের মধ্যে রয়েছেন কেন? আমার তো বদ্ধ ঘরে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।
উপায় কি? কোথায় আর যাব?
কেন, গার্ডেনে চলুন না! Its a lovely place!
গার্ডেন!
হ্যাঁ। ও, আপনি তো নতুন! এ বাড়ির কিছুই জানেন না! চলুন গার্ডেনে যাওয়া যাক।
বেশ তো, চলুন।
বিশাখা চৌধুরীকে অনুসরণ করে তিন নম্বর দরজার দিকে এগিয়ে চললাম। দরজা ঠেলে প্রথমে তিনি বের হলেন, তাঁর পিছনে আমিও হলঘর থেকে বের হলাম। সরু একটা প্যাসেজ। স্বল্পশক্তির একটামাত্র বিদ্যুৎবাতির আলো প্যাসেজে। এবং সেই স্বল্পালোকে নির্জন প্যাসেজটা যেন কেমন থমথমে মনে হয়। প্যাসেজের দু-পাশে গোটা দুই বন্ধ দরজা আর একটা জানলা পার হয়ে দ্বিতীয় জানলার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চমকে উঠলাম। খোলা জানলার পথে স্বল্প আলো-আঁধারিতে মনে হল যেন একখানা মুখ চট করে সরে গেল। এবং শুধু মুখই নয়, একজোড়া চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
যে মুখখানা ক্ষণেকের জন্য আমার দৃষ্টিপথে পড়েছিল, পলকমাত্রেই সে মুখখানা কিন্তু চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। ওয়েটার মীরজুমলার মুখ।
চোখের তারায় সেই সরীসৃপ চাউনি। বুঝলাম নতুন আগন্তুক আমি এ গৃহে এবং আমাকে তিনজন মেম্বারের সুপারিশে এখানে প্রবেশাধিকার দিলেও প্রখর দৃষ্টিই আছে আমার উপরে।
এমনি নিছক কৌতূহলেই সেই প্রখর দৃষ্টি আমার উপর পতিত হয়েছে, না আমাকে সন্দেহ করেই এরা আমার প্রতি দৃষ্টি রেখেছে সেটাই বুঝতে পারলাম না। সে যাই হোক, বুঝলাম সাবধানের মার নেই, আমাকে এখানে সতর্ক ও সজাগ হয়ে চলতে হবে।
প্যাসেজটা শেষ হয়েছে একটা দরজায়। সে দরজাটা খুলতেই বিদ্যুতালোকে আমার চোখে পড়ল একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নীচে নেমে গিয়েছে।
আসুন! বিশাখা সিঁড়ির ধাপে পা দিলেন।
আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই চোখে পড়ল একটি উদ্যান। নানা আকারের গাছপালাই নজরে পড়ল। আরও নজরে পড়ল উদ্যানের মধ্যে স্বল্পশক্তির নীল বিদ্যুবাতি জ্বলছে মধ্যে মধ্যে। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো ছোট ছোট ঝোপের মতও আছে। আর আছে একটা ঘর উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে। লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে নেমে বিশাখার সঙ্গে উদ্যানে এসে দাঁড়ালাম।
ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে যেন একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ দিয়ে গেল। সরু সরু সিমেন্ট-বাঁধানো রাস্তা উদ্যানের মধ্যস্থলে একটি গোলাকার বাঁধানো জায়গা থেকে যেন চারিদিকে হাত বাড়িয়েছে। বাঁধানো রাস্তার পরেই ঘাসের কোমল সবুজ কার্পেট যেন চারিদিকে বিছানো। তার মধ্যে মধ্যে সযত্ন-বর্ধিত নানা আকারের গাছপালা ও ঝোপ। সব কিছুর ভিতরেই যেন একটা সুপরিকল্পিত প্ল্যানের নির্দেশ আছে বলে মনে হয়।
উদ্যানটি যে কতখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত সঠিক বোঝবার উপায় নেই। কারণ সীমানা সেই স্বল্প নীলাভ আলোয় রাত্রে চোখে পড়ল না।
আবছা আলো-ছায়ার মধ্যে দিয়ে সরু বাঁধানো পথ ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়েই ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছিলাম। আমার সঙ্গিনীর মনে তখন কি চিন্তা ছিল জানি না, কিন্তু আমার মনের সবটা জুড়েই সরু প্যাসেজ দিয়ে আসবার সময় ক্ষণেকের জন্য দেখা জানলা-পথে মীরজুমলার সেই পাথরে-খোদাইকরা মুখ ও সরীসৃপের মত দুটি চোখের দৃষ্টিভেসে বেড়াচ্ছিল। আমার সমস্ত চিন্তা যেন তাতেই নিবদ্ধ ছিল।
হঠাৎ বিশাখার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, কেমন লাগছে এ জায়গাটা, সত্যসিন্ধুবাবু?
অ্যাঁ!
কি ভাবছিলেন বলুন তো?
কই, কিছু না।
একটা কথা বলব, মিঃ রায়?
বলুন না।
সত্যসিন্ধু! আপনার নামটা যেন কেমন!
কেন বলুন তো?
সে জানি না, তবে ও নামে আমি কিন্তু আপনাকে ডাকতে পারব না।
সে কি! তবে কি নামে ডাকবেন?
কেন? ঐ পোশাকী নামটা ছাড়া আপনার কি আর অন্য কোন নাম নেই? মানুষের তো কত সময় ডাকনামও দু-একটা থাকে!
ডাকনাম?
হ্যাঁ। এই ধরুন না, যেমন আমার ডাকনাম শিলু। এখন অবিশ্যি ও নামে ডাকবার আর কেউ নেই। তবে ছোটবেলায় ঐ নামটা ধরেই সকলে আমাকে ডাকত। বলুন না, আপনার ডাকনামটা কি?
ঐ নামটি ছাড়া তো আমার আর দ্বিতীয় কোন নাম নেই বিশাখা দেবী। তবে ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে সত্যবাবু বলেও ডাকতে পারেন।
কারা যেন এদিকে আসছে!
সত্যিই চেয়ে দেখি একটি পুরুষ ও একটি নারী-মূর্তি পরস্পর গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে মন্থর পদে হাঁটতে হাঁটতে এই দিকেই আসছে।
অস্পষ্ট আলোয় তাদের মুখ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
চলুন ঐ ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চ আছে, সেখানে গিয়ে আমরা বসি।
রেডিয়াম ডায়েল দেওয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। বললাম, এবারে যাব ভাবছি!
কোথায়?
বাড়িতে।
বাড়িতে বুঝি রাত জেগে বসে আছেন মিসেস?
মৃদু হাসলাম বিশাখার কথায়।
হাসলেন যে? প্রশ্ন করলেন বিশাখা।
আপনার কথায়।
কেন?
তার কারণ বিয়েই করিনি তো মিসেসের ভাগ্য আসবে কোথা থেকে?
সে কি! বাঙালীর ছেলে, এত উপার্জন, এখনও বিয়ে করেননি?
না।
আশ্চর্য! কেন বলুন তো?
কেন আর কি! সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
বিয়ে করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি?
না। তাছাড়া শুধু সুযোগই তো নয়, মনের একটা তাগিদও তত থাকা দরকার বিয়ের ব্যাপারে।
ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে আমরা দুজনে এসে বিশাখা-বর্ণিত ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চের উপরে পাশাপাশি বসেছিলাম।
বাড়িতে মিসেসের তাগিদই যখন নেই তখন বাড়ি ফেরবার জন্য এত তাড়াই বা কিসের?
রাত হল।
নিজের ছোট্ট হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিয়ে বিশাখা এবারে বললেন, মাত্র তো এগারটা! রাতের তো এখনও সবটাই বাকি!
হঠাৎ এমন সময় কানে এল মৃদু ভায়োলিন বাজনার শব্দ।
আশেপাশে কে যেন ভায়োলিন বাজাচ্ছে মনে হচ্ছে? প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ।
কে বাজাচ্ছে বলুন তো?
সুধী বাজাচ্ছে।
সুধী!
মানে সুধীরঞ্জন?
হ্যাঁ। চেনে নাকি তাকে?
হ্যাঁ। আপনাদের এখানকার সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে ঐ একজনের সঙ্গেই যা একটু-আধটু পূর্ব-পরিচয় আছে।
সিনিক!
কে?
কে আবার, আপনার ঐ সুধীরঞ্জন!
কেন?
কিন্তু আমার কেনর জবাব দিলেন না বিশাখা। চুপ করে রইলেন। সেরাত্রে বুঝতে পারলেও পরে বুঝছিলাম সুধীরঞ্জনকে কেন বিশাখা চৌধুরী সেরাত্রে সিনিক বলেছিলেন! যাহোক বিশাখার আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অনিচ্ছাটা বুঝতে পেরে আমিও অন্য প্রশ্ন তুললাম। বললাম, এখানে এসে সুধী কারও সঙ্গে বুঝি মেশে না? আপনার মনে একা একা বেহালা বাজায়? তা বেহালা বাজাবার জন্য এখানেই বা ওকে আসতে হবে কেন তাও তো বুঝতে পারছি না!
কে বললে সুধী এখানে বেহালা বাজাতে আসে? ও বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে!
বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে? এই অন্ধকার বাগানের মধ্যে?
মনের মানুষকে বেহালা বাজানো শেখাবার জন্যে আলো বা আঁধারের ঘর বা বাগানের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে নাকি?
মনের মানুষ!
হ্যাঁ। শনিবার রাত্রে ও আসে মৃদুলোকে বেহালা শেখাবার জন্যে।
আর কৌতূহল প্রকাশ করা হয়ত উচিত হবে না। তাই চুপ করে গেলাম। মৃদু শব্দে বেহালা বাজালেও এমন চমৎকার সুরের একটা আকৃতি সে বাজনার মধ্যে ছিল যা আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্বভাবতই সেইদিন আকর্ষণ করছিল।
রাত হয়ে যাচ্ছে, তবু যাবার কথাও যেন ভুলে গেলাম।
সুধী এত চমৎকার বেহালা বাজায়, কই আগে তো কখনও জানতে পারিনি!
হঠাৎ আবার চমক ভাঙল বিশাখার কণ্ঠস্বর, চলুন সত্যসিন্ধুবাবু, উঠুন।
উঠব?
হ্যাঁ। এই যে বলছিলেন রাত হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি যাবেন? যাবেন না?
হ্যাঁ চলুন।
উঠে দাঁড়ালাম।
.
আরও তিন রাত্রি বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত করবার পর বিশাখা চৌধুরীর পরিচয় আর একটু পেলাম।
ফিলসফির বিখ্যাত প্রফেসর স্বর্গীয় ডক্টর প্রতুল চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী হচ্ছেন বিশাখা চৌধুরী। বয়স পঁয়তাল্লিশোত্তীর্ণ।
দুটি মেয়ে, তাদের দুজনেরই বিবাহ হয়ে গিয়েছে। তারা শশুর-গৃহে। ডক্টর চৌধুরী নেহাত কিছু কম রেখে যাননি তাঁর বিধবা স্ত্রীর জন্য। কলকাতার উপর একখানা বাড়ি ও মোটামুটি কিছু ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও শেয়ারের কাগজ।
ইচ্ছা করলে বিশাখা চৌধুরী তাঁর বাকি জীবনটা আরামেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু গত-যৌবনা, দুটি সন্তানের জননী বিশাখার মনে কামনার আগুন তখনও নিঃশেষে নির্বাপিত হয়নি। তাই তাঁকে ছুটে আসতে হয়েছিল ঘরের বাইরে, বৈকালী সঙ্ঘের রাতের আসরে। প্রতি রাতে বৈকালী সঙ্ঘে তিনি আসতেন সেই অতৃপ্ত কামনার তাগিদেই। এবং সামনে যাকে পেতেন তাকেই আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করতেন। তিন রাত্রের আলাপেই সেটা আমার আর জানতে বাকি ছিল না। কিন্তু সে কথা জানতে পারা সত্ত্বেও আমি তাঁকে নিরুৎসাহ করিনি, কারণ তখন তাঁকে ঘিরে অন্য একটা চিন্তা আমার মনের মধ্যে উদয় হয়েছে। ওঁকে হাতে রাখতে পারলে এখানে আমি কতকটা নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়েই আসা-যাওয়া করতে যে পারব তা বুঝেছিলাম।
পঞ্চম রাত্রে হঠাৎ চমকে উঠলাম আর এক নবাগতার মুখের দিকে তাকিয়ে। পঞ্চম রাত্রি অবিশ্যি আমার পর পর আসা নয়। বৈকালী সঙ্ঘে আমার পঞ্চম রাত্রি আসা গত কুড়িদিনে। আজ আবার দ্বিতীয়বার রাজেশ্বর চক্রবর্তীকে দেখলাম বৈকালী সঙ্ঘে।
ইতিমধ্যে আর তাঁকে দেখতে পাইনি।
নিয়মানুযায়ী আজও প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীই এক নবাগতাকে সঙ্ঘের অন্যান্য মেম্বারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
কুমারী মীনা রায়।
আমি চমকে উঠেছিলাম কুমারী মীনা রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এইজন্য যে প্রথম দৃষ্টিতেই একটু ভাল করে লক্ষ্য করতেই তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কৃষ্ণা বৌদি। কিরীটী-মহিষী।
এমনিতেই চোখ-ঝলসানো রূপ আর চেহারা কৃষ্ণার। তার উপরে আজ তার বেশ ও প্রসাধনে একটা অভূতপূর্ব চাকচিক্য ছিল, যাতে করে পুরুষ তো ছার মেয়েদেরও মনে আকর্ষণ জাগায়। এবং সেই কারণেই বোধ হয় সেরাত্রে আমার আবির্ভাবে কেউ আমার দিকে ফিরে না তাকালেও, আজ ঘরের মধ্যে উপস্থিত পনেরজন বিভিন্ন বয়েসী নরনারীর ত্রিশজোড়া কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি যেন একঝাঁক ধারালো তীরের মতই কৃষ্ণাকে গিয়ে তার সর্বাঙ্গে বিদ্ধ করল। এবং তাকিয়েই রইল সকলে।
মনে হচ্ছিল আজ রাত্রে বৈকালী সঙ্ঘের মক্ষীরানী শ্রীমতী মিত্রা সেন এসে তার পাশে দাঁড়ালেও বুঝি ম্লান হয়ে যেতেন। কিন্তু মিত্রা সেন সে-সময়ে এসে তখনও পৌঁছাননি। যদিও সেটা শনিবারই ছিল।
প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীতাঁর কর্তব্য-কাজটুকু সম্পাদন করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
এবং নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত কৃষ্ণার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
০৭. নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত
নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্তর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলাম। হায় অবোধ, জান না তো ও বহ্নিশিখা মিথ্যা, শুধু মরীচিকা, মায়া মাত্র! ও তোমাদের বুকে তৃষ্ণার আগুন জ্বালিয়ে পালিয়েই যাবে। কোনদিনই ওর নাগাল পাবে না।
হঠাৎ এমন সময় বেহালার বাক্স হাতে সুধীরঞ্জন এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এবং সুধীকে দেখেই জাস্টিস মল্লিকের মেয়ে মিস রমা মল্লিক মধুর কন্ঠে সুধীকে সম্বোধন করে বলে উঠলেন, আসুন সুধীবাবু! অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম। কিন্তু ভায়োলিনের বাক্স আপনার হাতে, ব্যাপার কি?
জবাব দিলেন বিশাখা আমার পাশ থেকে, হ্যাঁ, ওটা ভায়োলিনই। মৃদুলা দেবীকে উনি যে আজকাল ভায়োলিন শেখান। কিন্তু সরি সুধীবাবু, আজ মৃদুলা অ্যাবসেন্ট। আর রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল যখন, আজ আর কি আসবেন!
জবাব দিলেন রমা মল্লিক, নাই বা এল মৃদুলা! আজ সুধীবাবুর বাজনা আমরা শুনব। সুধীবাবু, please–একটা বাজিয়ে শোনান!
সোমশ্বর রাহাও মিস্ মল্লিকের অনুরোধে সায় দিলেন।
সুধী হাসতে হাসতে বললে, আমি রাজী আছি, একটি শর্তে; আপনাদের মধ্যে কেউ must accompany me with your voice!
জবাব দিলেন এবারে মিস্ মল্লিক, কিন্তু কে গলা দেবে বলুন তো? মিত্রাদি absent যে! এখনও এসেই পোঁছোননি!
কেন? মিস্ সেন নেই বলে কি আর কেউ আমাকে আপনাদের মধ্যে একটু সঙ্গ দিতে পারেন না?
এবারে বললাম আমিই, মিস্ মীনা দেবী, আপনার মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি অন্তত আমাদের নিরাশ করবেন না!
কৃষ্ণা সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি?
হ্যাঁ, আপনি। আমার ধারণা নিশ্চয় আপনি গান জানেন।
সামান্য একটু-আধটু: কিন্তু আপনাদের কি তা ভাল লাগবে? বেশ গাইছি, পরে কিন্তু শুনে নিন্দে করতে পারবেন না।
সুধীরঞ্জন বেহালাটা বাক্স থেকে বের করে সুর বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললে, ধরুন,…
কি গাইব? কৃষ্ণা শুধায়।
যা খুশি। সুধী বলে।
কৃষ্ণা তখন গান ধরল। রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর সুধী মেলাল সেই সুরে তার বেহালা।
নির্বাক। স্তব্ধ সমস্ত হলঘর!
সকলের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে বিস্ময় ও শ্রদ্ধা। বুঝলাম কৃষ্ণা দেবী তাঁর প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই বৈকালী সঙ্ঘকে জয় করলেন তাঁর রূপ ও কণ্ঠ দিয়ে। গানের শেষ লাইনে এসে সবে পৌঁছেছে কৃষ্ণা, হলঘরে আবিভাব ঘটল মিতা সেনের।
ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণার কণ্ঠের সংগীত শুনে মিত্রা সেন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
এবং তার সে দাঁড়াবার মধ্যে যতটা কৌতূহল তার চাইতেও বেশি বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, আর কেউ ঘরের মধ্যে সেটা বুঝতে না পারলেও আমার সতর্ক দৃষ্টিতে কিন্তু সেটা এড়ায়নি।
এবং তার সে বিস্ময় আরও বৃদ্ধি পেল যখন কৃষ্ণার গানের শেষে ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সকলের কণ্ঠ হতে অকুণ্ঠ প্রশংসাধ্বনি উচ্ছ্বসিত হয়ে কৃষ্ণাকে অভিনন্দন জানাল।
সুপার্ব! একসেলেন্ট! চমৎকার! প্রভৃতি অভিনন্দন চারিদিক হতে শোনা গেল।
ঐ সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি মিত্রা সেনের উপরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু আজ আর বিশেষ কারও কণ্ঠ হতে পূর্ব পূর্ব রাত্রের মত তার আবির্ভাবে স্বাগত সম্ভাষণ উচ্চারিত হল না।
মৃদু কণ্ঠে দু-একজন মাত্র বললে, গুড ইভনিং মিস্ সেন।
অকস্মাৎ যেন এক মর্মান্তিক আঘাতে মিত্রা সেনের ঐ সঙ্গে এতদিনকার সুনির্দিষ্ট আসন ভেঙে পড়ছে। মিত্রা সেন তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবাগতা কৃষ্ণার দিকে। তার দুচোখের দৃষ্টিতে শুধু যে বিস্ময় তাই নয়, সেই সঙ্গে একটা চাপা বিরক্তি ও তাচ্ছিল্যও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমি মিত্রা সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম এত বড় আঘাত কোন নারীর পক্ষে সহ্য করা সত্যই অসম্ভব। বিশেষ করে মিত্রা সেনের মত নারী, যে এতকাল এখানকার সকলের হৃদয়ে বিজয়িনীর আসন অধিকার করে এসেছে এবং কখনও অনুকম্পা, কখনও সামান্য একটু সহানুভূতি বা একটুখানি প্রশ্রয়ের কৃপা-দৃষ্টি বর্ষণ করে এখানকার অনেকেরই হৃদয় নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলে এসেছে, তার পক্ষে তো আরও দুঃসাধ্য। কিন্তু দেখলাম মিত্রা সেন শুধু এতকাল এতগুলো লোককে রাতের পর রাত রূপের কাজল দিয়েই মোহগ্রস্ত করে রাখেনি, বুদ্ধিও যথেষ্টই রাখে সে। মুহূর্তের মধ্যেই নিজের পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করে নিয়ে ওষ্ঠপ্রান্তে তার চিরাচরিত স্বভাবসিদ্ধ বিজয়িনীর হাসি ফুটিয়ে অকুণ্ঠ চরণে কৃষ্ণার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললে, নমস্কার! আপনি বোধ হয় কুমারী মীনা রায়—বৈকালী সঙ্ঘের নতুন মেম্বার!
হ্যাঁ।
আচ্ছা চলি, আজ একটু কাজ আছে। এবার থেকে আসা-যাওয়া যখন করবেন তখন পরিচয় আরও হবে। বলে সোজা দুনম্বর দরজা-পথে এগিয়ে গেল মিত্রা সেন।
কিন্তু সবে সে দরজা বরাবর গিয়েছে কৃষ্ণা অর্থাৎ মীনা তাকে বাধা দিয়ে বললে, কিন্তু আপনার নামটা তো জানা হল না!
মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াল মিত্রা সেন। মরালের মত হীরার কষ্ঠী পরা গ্রীবা বেঁকিয়ে তাকাল কৃষ্ণার দিকে। মৃদু কণ্ঠে শুধাল, আমার নাম?
হ্যাঁ। কৃষ্ণা জবাব দেয়। মিত্রা সেন। বলেই আর দাঁড়াল না, ওষ্ঠপ্রান্তে চকিত হাসির একটা বিদ্যুৎ জাগিয়ে দরজা ঠেলে হলঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল পরমুহূর্তেই।
সংগীতের আনন্দধ্বনির মাঝখানে মিত্রা সেনের আঁকস্মিক আবিভাবটা হলঘরের মধ্যে হঠাৎ যেন একটা থমথমে ভাবের সৃষ্টি করেছিল, মিত্রা সেনের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সেটা তখন কেটে গেল। সকলের কণ্ঠ হতে কৃষ্ণাকে আর একটি গান শোনানোর জন্য মিলিত অনুরোধ উচ্চারিত হল।
মীনা দেবী, আর একটি প্লিজ! কৃষ্ণা সবার অলক্ষ্যে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। বুঝলাম আমার ছদ্মবেশে আমাকে চিনতে না পারলেও কণ্ঠস্বরে ধরতে পেরেছে সে আমাকে। চোখের ইঙ্গিতে জানালাম—গাও।
আবার একটি গান ধরল কৃষ্ণা। সুধীও তার বেহালা ধরল সেই গানের সুরে সুর মিলিয়ে।
এই সুযোগ।
সকলেরই দৃষ্টি কৃষ্ণার উপরে।
আমি সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে দুনম্বর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল, আমি হলঘর থেকে বের হলাম।
দরজা ঠেলে হলঘর থেকে যেখানে গিয়ে প্রবেশ করলাম সেটা একটি ছোট আকারের ঘর। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। এদিন-ওদিক গোটা দুই সোফা-সেটি রাখা।
কিন্তু ঘরের চারদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম। একটি দরজা বা জানালা আমার নজরে পড়ল না।
নজরে যা পড়ল তা হচ্ছে ঘরের চার দেওয়ালে চারদিকে আঁকা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মানুষপ্রমাণ সাইজের বিভিন্ন বেশভূষার চারটি ওরিয়েন্টাল নারীমূর্তি।
ক্ষণপূর্বে হলঘর থেকে মিত্রা সেন এই ঘরেই ঢুকেছে। তবে সে গেল কোথায়! এই ঘরে সে নেই তো! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, তবে কি এ ঘরে কোন গুপ্ত দ্বারপথ আছে, যে দ্বারপথে মিত্রা সেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে!
নিশ্চয়ই তাই। নইলে সে যাবে কোথায়?
কিন্তু কোথায় সে গুপ্ত দ্বারপথ এই ঘরে, যদি থেকে থাকেই?
এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে আবার আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি চার দেওয়ালে অঙ্কিত চারটি নারীমূর্তির প্রতি নিবদ্ধ হল।
সেই ছবিগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চকিতে একটা কথা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল। এই ছবিগুলোর মধ্যেই কোন গুপ্ত দ্বারপথে সংকেত লুক্কায়িত নেই তো! ভাবতে ভাবতে আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিগুলো দেখতে শুরু করলাম, একটার পর একটা।
তৃতীয় ছবিখানির সামনে এসে দেখতে দেখতে হঠাৎ ছবিটার মধ্যে একটা জিনিস.আমার নজরে পড়ল। অপরূপ নৃত্যভঙ্গিতে লীলায়িত নারীদেহের দক্ষিণ হস্তে একটি পদ্মকুঁড়ি ধরা। এবং পদ্মকুঁড়িটি মনে হল ছবির অন্যান্য অংশের মত আঁকা নয়। যেন ডাইসের সাহায্যে গড়ে তোলা। হাত বাড়িয়ে পদ্মকুঁড়িটা দেখতে দেখতে একসময় চমকে উঠলাম সম্পূর্ণ ছবিটাই ধীরে ধীরে ঘুরে গেল যেন একটা পিভেটের উপরে। আর আমার সামনে প্রকাশ পেল অ-প্রশস্ত একটি মৃদু আলোকিত প্যাসেজ।
মুহূর্তকাল মাত্র দ্বিধা করে সেই প্যাসেজের মধ্যে পা দিলাম। কয়েক পদ এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে প্যাসেজটা। আর মোড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্মুখে আমার চোখে পড়ল একটি ভেজানো ঈষৎ-উন্মুক্ত কাঁচের দরজা।
দরজার উপরে বাইরে ঝুলছে দু-পাশে ভারী ভেলভেটের পদা।
পর্দার আড়ালে গিয়ে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিতে যাব—মিত্রা সেনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম।
মিত্রা সেন যেন কাকে বলছে, তা যেন হল, কিন্তু ঐ কুমারী মীনা রায়ের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়টা কি?
তুমি তো জান মিত্রা, স্পষ্ট পুরুষকণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল, এ সঙ্ঘের নিয়ম, তিনজন মেম্বার যখন কাউকে মেম্বারশিপের জন্য রেকমেন্ড করে দলভুক্ত হবার পারমিশন দেয় তখন আর তার সম্পর্কে কোন কৌতূহলই কারও প্রকাশ করা চলবে না।
হ্যাঁ, তা জানি বৈকি। কিন্তু ইদানীং দেখছি বৈকালী সঙ্ঘের নিত্যনতুন মেম্বার হচ্ছে।
পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন হল, কি বলতে চাও তুমি?
কি আমি বলতে চাই, প্রেসিডেন্টের নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
মিস্ সেন কি প্রেসিডেন্টের কাছে কৈফিয়ত তলব করছেন? তাহলে আবার আপনাকে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই স্মরণ করতে বলব এখানকার এগার নম্বর আইনটি। আচ্ছা মিস্ সেন, এবারে তাহলে আপনি যেতে পারেন।
বুঝলাম মিস্ সেন এবারে এখুনি ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। আমি চকিতে দরজার পদার আড়ালে নিজেকে যথাসম্ভব গোপন করলাম, কেননা তখন সেখান থেকে আর পালাবার সময় ছিল না। এবং অনুমান আমার মিথ্যা নয়, পরমুহূর্তেই জুতোর খটখট শব্দ তুলে ঘর থেকে বের হয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা প্যাসেজে অদৃশ্য হয়ে গেল মিত্রা সেন।
ভাবছি আমিও এবারে স্থানত্যাগ করব, কিন্তু হঠাৎ একটা বিচিত্র কঁ-কঁ শব্দে চমকে উঠলাম।
তারপরই ঘরের সেই পূর্ব-পুরুষকণ্ঠ আবার শোনা গেল: মীরজুমলা, কি খবর! অ্যাঁ? হ্যাঁ– হ্যাঁ, ঠিক আছে। O.K.
আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিবেচনার কাজ হবে না। নিঃশব্দে পায়ে আমি যে পথে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই পূর্বেকার ঘরে প্রবেশ করলাম। সেখান থেকে আবার হলঘরে গিয়ে প্রবেশ করতেই বিশাখা এগিয়ে এল আমার দিকে। প্রশ্ন করল, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে যে হঠাৎ?
বুঝলাম প্রেসিডেন্টের অবস্থানটা এখানকার মেম্বারদের কাছে কোনকিছু একটা গোপন ব্যাপার নয়। দুনম্বর দরজা দিয়ে যে প্রেসিডেন্টের ঘবে যাওয়া যায় তা এদের অজ্ঞাত নয়।
এমনি একটু দরকার ছিল। তুমি কতক্ষণ?
বলাই বাহুল্য, আমাদের উভয়ের মধ্যে আপনি পর্বটা ঘুচিয়ে দিয়ে উভয়ে আমরা পরস্পর পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতে শুরু করেছিলাম ইতিমধ্যে।
তোমার কিছুক্ষণ আগে মিস সেন প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে বের হয়ে এল দেখলাম। দুজনেই একসঙ্গেই গিয়েছিলে নাকি প্রেসিডেন্টের ঘরে?
না, উনি আগে গিয়েছিলেন, পরে আমি গিয়েছি।
কিন্তু দরকারটা হঠাৎ কি পড়ল তাঁর কাছে তোমার? ও-ঘরে তো বড় একটা কেউ পা-ই দেয় না এখানকার!
তাই নাকি?
হুঁ। তিন বছর এখানে যাতায়াত করছি, একদিন মাত্র ওঁর ঘরে গিয়েছিলাম। বাবাঃ,যা গম্ভীর লোকটা! কথা বলতেই ভয় করে।
কেন?
কেন আবার কি? মুখগোমড়া লোকদের দুচক্ষে আমি দেখতে পারি না। সে যাক। তুমি এ কদিন আসনি যে বড়?
কলকাতায় ছিলাম না।
আর আমার যে এ কদিন কি ভাবে কেটেছে! কণ্ঠে বিশাখার একটা চাপা অভিমানের সুর যেন জেগে ওঠে।
মনে মনে একটু শঙ্কিত হয়ে উঠি। শেষ পর্যন্ত এই বয়েসে কি সত্যিসত্যিই বিগত-যৌবনা, প্রেমপাগল এক বিধবা নারীর মনের মানুষ হয়ে উঠলাম নাকি!
নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য নেহাৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই কৌতুকভরে বিশাখাকে প্রশয় দিতে গিয়ে অন্য এক ভয়াবহ কৌতুকের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছি না তো!
বিশাখার মুখের দিকে তাকালাম একবার আড়চোখে। সুস্পষ্ট অনুরাগমাখা অভিমানের চিহ্ন দেখলাম সে মুখে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই মুহূর্তে।
বেচারী বিশাখা চৌধুরী! পলাতকা যৌবনা-স্বপ্নের পিছনে পিছনে কি আশা নিয়েই না সে ছুটে বেড়াচ্ছে! হাসির চাইতে যেন দুঃখই হল। কারণ আমার নিজের দিকটা নিজের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। সেখানে কোথাও একটুকু কুয়াশাও নেই। এবং যেদিন ও স্পষ্ট করে জানতে পারবে সেই সত্যটি, সেদিনকার সে দুঃখটা বেচারী সইবে কেমন করে?
কিন্তু যাক গে সে কথা। যে কারণে আমার এখানে আসা সেদিক দিয়ে আমি যে এখনও এতটুকু অগ্রসর হতে পারিনি।
এখানকার সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও আমার কাছে ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট।
বিশাখার কথায় হঠাৎ আবার চকম ভাঙল, চল সত্য, নীচে যাওয়া যাক।
চল!
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে
পরের দিন সকালে কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে তার বসবার ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।
বৈকালী সঙ্ঘে. আমার কয়েক রাত্রির অভিজ্ঞতার কথা কিরীটীকে বলছিলাম এবং সে গভীর মনযোগের সঙ্গে শুনছিল। সব শুনে বললে, আমিও এ কদিন চুপ করে ছিলাম না। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর রাজেন সিকদারকে দিয়ে বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কে যতটা খোঁজ নেবার নিয়েছিলাম কিন্তু কোনরকম সন্দেহের ব্যাপারই তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিসের রিপোর্ট হচ্ছে বৈকালী সঙ্ঘটি তথাকথিত ধনী এবং উচ্চশ্রেণীর অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল নর-নারীর সম্পূর্ণ নির্দোষ মিলন-কেন্দ্র। একটু-আধটু নাচ-গান, ফ্ল্যাশ, বিলিয়ার্ড ও ড্রিঙ্ক চলে সেখানে যেমন আর দশটি ঐ ধরনের নৈশ-ক্লাবে চলে থাকে। এবং নর-নারীর অবাধ মেলামেশার ফলে যতটুকু প্রেমঘটিত আদিরসাত্মক ব্যাপার ঘটতে পারে তার বেশী কিছুই নয়। অর্থাৎ পুলিসের গোপন কালোখাতায় বৈকালী সঙ্ঘ নৈশ-ক্লাবটির নাম নেই।
কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি কিরীটী, ঠিক যতটুকু বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে সেটাই সব নয়। একেবারে নিদোষ নিরামিষ ব্যাপার সবটাই নয়।
অর্থাৎ তুই বলতে চাস,পুলিসের সতর্ক দৃষ্টির অলক্ষ্যে আরও একটা গোপন ব্যাপার সেখানে ঘটে যার আকর্ষণে বিশেষ একদল নরনারী সেখানে রাতের পর রাত ছুটে যায়!
হ্যাঁ। আর সেটা যে ঠিক কী হতে পারে সেটাই এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না। তোর মতের সঙ্গে যে আমার খুব একটা অমিল আছে তা নয় সুব্রত, কিন্তু তুই ও কৃষ্ণা যে পথে চলেছিস সে পথে গেলে কোনদিনই তোরা ঠিক জায়গাটিতে পৌঁছতে পারবি না।
মানে?
অর্থাৎ মাতালের আড্ডায় গেলে তোকেও তাদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে মদ খেয়ে ঢলাঢলি করতে হবে। নচেৎ কোনদিনই তাদের আপনার জন বলে তারা তোকে ভাববে না। মাঝখান থেকে শুধু খানিকটা পণ্ডশ্রমই হবে। অত দূর থেকে নয়, সত্যি করে প্রেম করতে হবে বিশাখা চৌধুরীর সঙ্গে তোর।
তার মানে?
মানে আবার কি! ওরকম প্রেমের অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি প্রেমে পড়তে হবে তোকে।
ওরে বাবা! ঐ বিশাখা চৌধুরীর সঙ্গে! ওটা তো একটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মেয়েমানুষ!
কিরীটী আমার কথায় মৃদু হাসে।
হাসছিস! বিশাখা চৌধুরীর পাল্লায় পড়লে বুঝতে পারতিস!
বিশাখার বয়স হয়ে গিয়েছে একটু বেশী, এই তো? আরও বছর পনের তার বয়স কম হলে, নিশ্চয়ই এমনি আপত্তিটা তোর করে অভিনয় করতিস না প্রেমের?
কখনও না।
নিশ্চয় তাই। আরে ভুলে যাস কেন, প্রেমের ব্যাপারটাই তো একটা হিস্টিরিয়া।
মানি না তোর কথা।
মানবি রে মানবি। আগে সত্যিকারের কারও প্রেমে পড়, তখন বুঝবি।
থাক, হয়েছে। এখন একটা কাজের কথা বল তো। বৈকালী সঙ্ঘের যাদের সম্পর্কে তোকে আমি বলেছি, তাদের সম্পর্কে তোর মতামতটা কি?
সকলেই তো দেখা যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
মুশকিল তো সেখানেই হয়েছে। তবু তোকে আমি স্পষ্ট বলছি ওদের মধ্যে তিনজন সম্পর্কে আমার মনে যথেষ্ট দ্বিধা আছে।
কোন্ তিনজন?
এক নম্বর হচ্ছে প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তী, দু নম্বর ওয়েটার মীরজুমলা ও তিন নম্বর মক্ষীরানী শ্রীমতী মিত্রা সেন।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে প্রশ্ন করল, আর কারও ওপর তাহলে তোর সন্দেহ নেই?
না।
কিন্তু আমি হলে যতটুকু তোর মুখে শুনলাম তা থেকে আরও একজনের সম্পর্কে বেশ একটু বেশী রকমই চিন্তিত হতাম, সজাগ থাকতাম!
কে? কার কথা বলছিস?
একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবি, কার কথা আমি বলতে চাই।
কিন্তু—
কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, আমাকে বলে দিতে হবে না—চোখ মেলে রাখ, নিজেই দেখতে পাবি।
বাইরে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। সতর্ক পদশব্দ।
কে?
সমীরণ!
এস সমীরণ, ভেতরে এস।
কিরীটীর আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবয়েসী ভৃত্যশ্রেণীর একজন লোক ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। কিন্তু ভৃত্যশ্রেণীর হলেও বেশভূষায় ও চেহারায় একটা ধনীগৃহের ভৃত্যের ছাপ আছে। পরিষ্কার একটি ধুতি পরিধানে, গায়ে তদ্রপ একটি ফতুয়া ও পায়ে একটা চপ্পল। মাথার চুল কাঁচা-পাকায় মেশানো, দাড়িগোঁফ কামানো। কপালের উপরে ঠিক দক্ষিণ জ্বর উপরে একটা বড় আব আছে।
বোসো। আগন্তুককে কিরীটী তার সামনেই একটা সোফার উপরে বসবার জন্য নির্দেশ জানাল।
প্রথমত ভূত্যের নাম সমীরণ ব্যাপারটা আমার মনে কেমন একটু খটকা লাগিয়েছিল, তারপর তাকে কিরীটীর সাদর আহ্বান আমাকে বিশেষ কৌতূহলী করে তোলে।
লোকটা সোফার উপরে সবে একটিবার মাত্র আড়চোখে আমার দিকে তাকাতেই দুজনের আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল এবং মুহূর্তের তার সেই চোখের দৃষ্টিতেই যেন একটা সন্দেহের বিদ্যুতের ইশারা পেলাম।
সুব্রতকে তুমি চেন না সমীরণ? দেখনি ওকে কোনদিন?
সুব্রতবাবু! নমস্কার! বলে সমীরণ এবারে পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবারে। বলে, নাম শুনেছি ওঁর তবে দেখা-সাক্ষাৎ হবার সৌভাগ্য হয়নি।
কিরীটী এবারে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সমীরণ সরকার ইউ পির স্পেশাল ব্রাঞ্চে ছিল, মাসখানেক হল বাংলা দেশে বদলি হয়ে এসেছে।
আমি প্রতিনমস্কার জানালাম।
পরে জেনেছিলাম জ্বর উপরে ঐ আবটি দেহের পোশাক ও মাথার চুলের মতই অবিশ্যি ছদ্মবেশের উপকরণ।
বয়েসেও আমাদের চাইতে ছোট বলে সমীরণের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, কিন্তু এভাবে দিনের বেলায় আমার এখানে আসাটা কিন্তু তোমার উচিত হয়নি সমীরণ।
কিরীটী পরিচয় দেবার পর আমি প্রশংসমান দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলাম সমীরণ সরকারের দিকে। নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়েছেন বটে ভদ্রলোক।
উপায় কি? সমীরণ প্রত্যুত্তরে তখন কিরীটীকে বলছিলেন, এই সময়টাই হচ্ছে বেস্ট সময়। ডাক বা খোঁজ পড়বে না। আর তিনি বাড়িতেও থাকেন না এ সময়টা।
না, তাহলেও অন্যায় হয়েছে। তুমি তাকে চেন না সমীরণ। অত্যন্ত প্রখর দৃষ্টি লোকটার।
সে অবিশ্যি আমিও যে লক্ষ্য করিনি তা নয়। অতি সাধারণ গতিবিধির মধ্যেও কোথায় যেন একটা নিঃশব্দ সজাগ ও সতর্ক আসা-যাওয়া আছে যা চট করে কারোরই নজরে পড়বে না।
যাক। এখন এ কদিনের অবজারভেশনে কি জানতে পারলে বল?
সমীরণ সরকার তখন বলতে শুরু করে।
আপনি ঠিকই সংবাদ পেয়েছিলেন মিঃ রায়। বাড়িতে নিজেদের বলতে ডাক্তার, তাঁর বিকলাঙ্গ ভাই ত্রিভঙ্গ, ত্রিভঙ্গের স্ত্রী মৃদুলা—
নামগুলো শুনেই চমকে উঠলাম। ত্রিভঙ্গ মানে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর বিকলাঙ্গ ভাই নয় তো?
কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। বললে, ভুজঙ্গ ডাক্তারের একজন ভৃত্যের প্রয়োজন ছিল, ব্যাপারটা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরে ডাক্তারের এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সুপারিশে সমীরণকে সেখানে ভৃত্যের চাকরিটি করিয়ে দিয়েছি। কিরীটী আবার সমীরণের দিকে তাকিয়ে বললে, তারপর কি বলছিলে বল, সমীরণ!
বলছিলাম ঐ মৃদুলা দেবীর কথাই। সমীরণ তার বক্তব্য আবার শুরু করে, ভদ্রমহিলার বয়স আমার কিন্তু মনে হয় তার স্বামী ত্রিভঙ্গের চাইতে এক-আধ বছর বেশী না হলেও সমবয়সীই হবে প্রায়। এবং ডাক্তারের গৃহের সর্বময় কর্তৃত্ব তারই হাতে। কিন্তু বয়স তার যাই হোক, যৌবন তার দেহে এখনও অটুট আছে। দেখতে কালো এবং রোগাটে বটে তবে সে কালোর মধ্যে আছে একটা আশ্চর্য রকমের যৌবনদীপ্ত শ্ৰী। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য তার চোখ দুটি। বুদ্ধির একটা অদ্ভুত জ্যোতিও সে চোখের তারায়।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ত্রিভঙ্গ লোকটি অত্যন্ত শান্তশিষ্ট। গোবেচারী টাইপের। দোতলার একটা ঘরে সর্বদাই বই নিয়ে পড়ে আছে। বাড়ি থেকে তো দূরের কথা, সেই ঘরে থেকেই বড় একটা বের। হয় না। নিজের দাদার সঙ্গে তো নয়ই, স্ত্রীর সঙ্গেও বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
ত্রিভঙ্গের স্ত্রী মৃদুলা আলাদা ঘরে থাকে, না একই ঘরে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
স্বামী স্ত্রী আলাদা আলাদা ঘরে থাকে। বাড়িটা তিনতলা হলেও বাড়ির মধ্যে ঘর সর্বসমেত আটটি। অবশ্য রান্নাঘর, স্টোররুম বাদ দিয়ে। একতলা ও দোতলায় তিনখানি করে ছয়খানি ঘর; তিনতলায় দুখানি ঘর। তিনতলায় দুখানা ঘর নিয়ে থাকেন ডাঃ চৌধুরী, ডাঃ চৌধুরী যখন থাকেন না সে দুটি ঘরে তালা দেওয়াই থাকে দেখেছি।
বাইরে থেকে আলাদা তালা দেওয়া থাকে নাকি?
আলাদা কোন তালা নয়, দরজার সঙ্গেই ইয়েল-লকের সিস্টেম আছে, তাতেই চাবি দেওয়া থাকে। আর ডাঃ চৌধুরী বাড়িতে যতক্ষণ থাকেন তখনও একমাত্র ডাঃ চৌধুরীর খাস ভৃত্য রাম ব্যতীত দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির তাঁর ঘরে প্রবেশের হুকুম নেই। কেউ যায়ও না।
শুনেছিলাম ত্রিভঙ্গের নাকি একটি ছেলে আছে, যে ছেলেটাকে ডাঃ চৌধুরী অত্যন্ত ভালোবাসেন?
হ্যাঁ, অগ্নিবাণ। তার ব্যাপারটা যেন ও বাড়িতে একটু স্বতন্ত্র।
কি রকম?
দিনের বেলা একটা-দেড়টার পর ডাঃ চৌধুরী যখন হাসপাতাল থেকে ফেরেন, ভাইপোটিকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে যান। অগ্নিবাণ দুপুরে তাঁর সঙ্গেই খায়। সারাটা দ্বিপ্রহর সে তার জ্যাঠার কাছেই থাকে। বিকেলে চেম্বারে যাওয়ার আগে যখন ডাক্তার তিনতলা থেকে নেমে আসেন, অগ্নিবাণকে সঙ্গে করে দোতলায় দিয়ে যান। আবার রাত্রে সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে যখন বাড়ি ফিরে আসেন, অগ্নিবাণকে সঙ্গে করে উপরে নিয়ে যান। সে তার জ্যাঠার সঙ্গেই রাত্রে যা খাবার খায়, তারপর রাম তাকে তার মার কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়। অগ্নিবাণকে ডাঃ চৌধুরী শুধু ভালবাসেন যে তা নয়, তার উপরে ডাক্তারের একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে বলেই মনে হয় আমার।
মৃদুলা দেবীর সঙ্গে ডাক্তারের সম্পর্ক কি রকম?
বিশেষ বোঝবার উপায় নেই। দুজনেই অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির ও স্বল্পবাক।
পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না?
হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে দুজনের কথাবার্তা হয় দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ডাঃ চৌধুরী, তাঁর ভাই ত্রিভঙ্গ, তাঁর স্ত্রী মৃদুলা দেবী যেন যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। একই বাড়িতে সকলে থাকেন বটে তবে কারো সঙ্গে কারো হৃদয়ের বড় একটা যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকেই যেন যে যার একটা স্বতন্ত্র জগতে বাস করছে। কখনও কোন চেঁচামেচি বা গোলমাল শুনবেন না। অদ্ভুত শান্ত যেন বাড়িটা। ও বাড়িতে অগ্নিবাণ যদি না থাকত তো বাড়িতে মানুষ-জন আছে বলেই মনে হত না। কেমন যেন একটা চাপা আশঙ্কার থমথমানি বাড়িটার সর্বত্র।
বাড়িটা ঠিক রাস্তার ওপরে, নয়?
না। বড় বড় দুটো চারতলা ফ্ল্যাট-বাড়ির মাঝখান দিয়ে সরু একটা প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলে তবে বাড়িটা। প্যাসেজটা অবশ্য সরু হলেও তার মধ্যে দিয়ে বড় গাড়ি অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারে। প্রায় দশ-বারো কাঠা জায়গা নিয়ে বাড়িটা। কাঠা তিনেক জায়গার ওপরে বাড়িটা। পিছনের দিকে একটা বাগান আছে। বাগানের চারপাশে প্রায় মানুষপ্রমাণ উঁচু প্রাচীর বাড়ির সীমানাটাকে ঘিরে রেখেছে।
পিছনে বাগানের ওপাশে কোন রাস্তা আছে,লক্ষ্য করেছ?
হ্যাঁ, একটা ব্লাইণ্ড লেন আছে। তার ওপাশে একটা বস্তি।
বাগান থেকে সেই ব্লাইন্ড লেনে যাতায়াত করবার কোন দরজা আছে?
আছে। তবে সেটা সর্বদা তালা লাগানোই থাকে দেখেছি।
বাড়ির ভেতর থেকে পিছনের বাগানে যাবার দরজা কোনখানে?
দুটো দরজা আছে। একটা অন্দরে, অন্যটা বাইরে দিয়ে। সেই পথ দিয়েই মেথর যাতায়াত করে। বাড়ির পিছন দিকে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি আছে—মেথরদের দোতলার ও তিনতলার বাথরুমে যাবার জন্য।
ডাঃ চৌধুরী শুনেছি রাত্রি নটার পর বাড়ি ফিরে আর কোথায়ও বার হন না?
তাই।
কখনও বের হন না?
না, আমি খুব মাইনিউটলি লক্ষ্য করে দেখেছি গত পনেরো দিন। সত্যিই তিনি কোথায়ও আর বের হন না।
গাড়িও বের হয় না?
না, সোফার হরিচরণ রাত্রে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই গ্যারেজে গাড়ি তুলে রেখে দেয় আর গাড়ি বের করে আবার পরের দিন সকালে। গত পনেরো দিন ঐ নিয়মের কোন ব্যতিক্রমই দেখিনি।
ডাক্তারকে নিজে কখনও গাড়ি চালাতে দেখেছ?
না। হরিচরণের মুখেই একদিন শুনেছি ডাক্তার গাড়ি চালাতে জানেন না।
ঠিক আছে। এবারে তুমি যাও সমীরণ। আর ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে কনট্রাক্ট করতে হলে একটা কার্ড ড্রপ করো আমার নামে; খুব যদি জরুরী হয় তো ভুজঙ্গ ডাক্তারের বাড়ির কাছে বড় রাস্তার ওপর যে ড্রাগ হাউস নামে ডিসপেনসারিটা আছে, তার মালিক ভবতারণবাবুকে আমি বলে রেখে দেব, সেখানে ফোন আছে, সেখান থেকে আমাকে ফোন করতে পারবে। আর একটা কথা, ডাক্তারের বাড়িতে যে ফোন আছে সেটা কোথায়, কোন্ ঘরে?
তিনতলায়–বারান্দার দেওয়ালের গায়ে ব্র্যাকেটের উপরে বসানো। ঠিক ডাক্তার চৌধুরীর শোবার ঘরের দরজার মুখে।
০৯. সমীরণ সরকার বিদায়
সমীরণ সরকার বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।
স্পষ্ট বুঝলাম ঘরে বসে থাকলেও কিরীটী চারিদিকে সতর্ক নজর রেখেছে। এবং ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের একমাত্র পুত্র তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায়ের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিরীটীর চিন্তাধারা যে যে দিকে বিস্তৃত হয়েছিল সেই সব দিকগুলো এখনও তার মন জুড়ে রয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস যা আমাকে বিস্মিত করেছিল, অশোক রায়ের ব্যাপারে কিরীটীর এবারকার নিষ্ক্রিয়তা। কখনও কোন রহস্যের সম্মুখীন হলে ইতিপূর্বে কিরীটীকে কখনও এমনি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় হয়ে বড় একটা বসে থাকতে দেখিনি।
তাই প্রশ্ন না করে পারলাম না, সোজাসুজি কথাটা পাড়লাম।
অশোক রায়ের ব্যাপারটা আর কিছু ভেবেছিস কিরীটী?
কিরীটী বোধ হয় নিজের চিন্তার মধ্যে তন্ময় হয়ে ছিল। হঠাৎ আমার প্রশ্নে চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল।
বললে, কি বলছিলি সুব্রত?
বলছিলাম অশোক রায়ের কথা–
না। সেদিন তোকে তার সম্পর্কে যতটুকু বলেছিলাম তার বেশী আর বিশেষ কিছুই এখনও জানতে পারিনি।
তোর কি মনে হয় অশোক রায়ের ব্যাপারে আমাদের ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর সত্যি কোন যোগাযোগ আছে?
তোর কি মনে হয়? কিরীটী আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল।
আমার তো মনে হয়, অশোক রায়ের যদি কোন মিস্ট্রি থাকে তা ঐ বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যেই, মিত্রা সেনের সঙ্গেই। ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে বৈকালী সঙ্ঘের তো কোন যোগাযোগই আজ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না।
এবং তাতে করে তো সুস্পষ্টভাবে এটা প্রমাণ হয় না যে, ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে অশোক রায়ের কোন গোপন যোগাযোগ নেই, ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক বাদেও। বরং আমার তো মনে হয় বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বারদের অনেকরই যখন গভীর রাত্রে গোপন অভিসার আছে ডাক্তারের চেম্বারে, তখন দুয়ে দুয়ে চারের মত সব কিছুর ভেতরে একটা গোপন যোগসূত্রও। আছে। কিরীটী বলে।
তাহলে তুই বলতে চাস ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীরও অলক্ষে যোগাযোগ আছে বৈকালী সঙ্ঘের সঙ্গে?
বলতে চাইলেই বা সেটা বলতে পারছি কোথায়! ডাক্তার তো শুনলাম ভুলেও কোনদিন রাত নটার পর বাড়ি থেকে বের হন না। আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে কখনও বৈকালী সঙ্ঘের ধারেকাছেও যেতে দেখেনি। তাছাড়া সম্মানিত, খ্যাতিসম্পন্ন একজন নামকরা চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সমাজে সর্বত্র পরিচয়। এবং শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কেও কোন খারাপ রিপোর্ট পুলিস সংগ্রহ করতে পারেনি। আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছিস বোধহয়!
পারছি। মৃদু কণ্ঠে বললাম।
আর একটা কথা, এ মাসের তিন তারিখে দূর থেকে অশোক রায়ের গাড়ি ফললা করে ব্যাঙ্ক পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
তারপর?
যথারীতি এবারেও সে আড়াই হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে তার সঙ্গিনী এক নারীর হাতে—যিনি গাড়িতেই উপবিষ্টা ছিলেন—তুলে দিতে দেখেছি।
সঙিনী সেই নারীকে দেখলি?
দেখলাম, কিন্তু দুঃখিত, তিনি তোমার মিত্রা সেন নন।
তবে?
মিত্রা সেন নন এই পর্যন্ত বলতে পারি। তবে বয়সে দূর থেকে তাঁকে তরুণী বলেই মনে হল। এবং দেখতেও সুন্দর।
তারপরেও তাদের নিশ্চয়ই ফলো করেছিলি?
করেছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেক সমস্ত ডালহৌসি স্কোয়ার, ধর্মতলা ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটটা চক্কর দেবার পর থিয়েটার রোড ধরে যেতে যেতে হঠাৎ একসময় দেখলাম শ্রীযুক্ত অশোক রায়ের বদলে গাড়ি চালাচ্ছেন তাঁর সেই সঙ্গিনীটি এবং অশোক রায় গাড়িতে নেই কোথায়ও।
বলিস কি?
তাই। তবে বার চার-পাঁচ ট্রাফিকের জন্য গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল চার-পাঁচ জায়গায়। এবং এর পরে বুঝেছিলাম সেই সময়েই এক ফাঁকে অশোক রায় গাড়ি থেকে নেমে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে। তবে এর মধ্যেও একটা কথা আছে যা ভাবছি–
কি?
প্রতিবারই ব্যাঙ্ক থেকে ফেরবার পথে সেদিনকার মত ঐরকম অনির্দিষ্টভাবে গাড়িটা রাস্তায় রাস্তায় চক্কর দিয়ে একসময় অশোক রায়কে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, অন্যের দৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য, না সেদিন আমি তাদের ফলো করছি জেনেই ঐ পন্থা ধরেছিল?
নিশ্চয় না। তুই যে সেদিন তাদের ফলো করবি তা তারা জানবেই বা কি করে?
তোর কথাই যদি মেনে নিই তো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে—
অর্থাৎ?
অর্থাৎ সেদিন না হলেও কোন একদিন কেউ তাদের ফলো করবে ভেবেই যদি তারা প্রতিবারই ঐ ধরনের সাবধানতা নিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে প্রথমত ব্যাপারটা খুব ক্লিয়ার নয়। দ্বিতীয়ত এর পশ্চাতে যে ব্রেন আছে তা রীতিমত তীক্ষ্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। আচ্ছা গাড়িটা কার?
অশোক রায়েরই নিজস্ব গাড়ি, মরিস টেন লেটেস্ট মডেলের। কিন্তু তারপর আরও আছে বন্ধু! ঘটনাটির ঐখানেই পূর্ণচ্ছেদ নয়।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে আবার।
কিরীটী বলতে লাগল, ফলো করতে করতে গাড়িটা এসে একসময় দাঁড়াল হল অ্যাণ্ড অ্যাণ্ডার্সনের বাড়ির সামনে। আরোহিণী গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। আমি অপর ফুটপাতে আমার ভাড়াটে ট্যাক্সিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম দরজার দিকে তাকিয়ে তীর্থের কাকের মত।
তারপর?
মিনিট দশেক বাদে এবারে যিনি দোকান থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলেন, তিনি কিন্তু সেই মহিলাটি নন, যিনি এতক্ষণ গাড়ি চালাচ্ছিলেন!
তবে আবার কে?
কে বলে মনে হয়? নামটা শুনে জানি চমকে উঠবি, তবু শোন, স্বয়ং অশোক রায়।
বলিস কি!
হ্যাঁ। এবং সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা এবারে ব্যারিস্টার সাহেব হাইকোর্টের দিকেই চললেন।
আর সেই তরুণীটি?
মিথ্যা সে মরীচিকার পিছনে আর ছুটে লাভ নেই বলে আমিও সুবোধ বালকের মত গৃহে পুনরাগমন করলাম। তাহলেই বুঝতে পারছ লেনদেনের ব্যাপারটা একটু জটিল।
তবে মিত্রা সেনের সঙ্গে অশোক রায়ের ব্যাপারটা কি? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই: সেটাও কি তবে নিছক প্রেম নয়? অন্য কিছু?
অতদূর অবিশ্যি এখনও পপছিতে পারিনি। তবে আজ রাত্রে একটা ব্যাপারে অনেস্ট অ্যাটেম্পট নেব ভাবছি।
কিসে?
ইচ্ছে করলে তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পার।
কোথাও যাবে নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
পার্ক সার্কাসেডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার-কাম নার্সিং হোমে।
রাত্রে মানে কখন? কটার সময়?
রাত ঠিক বারোটায়।
কিন্তু তোকে অত রাত্রে সেখানে ঢুকতে দেবে কেন?
যাতে দেয় সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। রাত্রে নটার পর আসিস। এলেই যথাসময়ে সব জানতে পারবি।
কিরীটীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম বটে কিন্তু কিরীটীর মুখে শোনা অশোক রায়ের ব্যাপারটাই মনের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগল। কে সে তরুণী, যাকে প্রতি মাসে এমনি করে গত আট-নয় মাস যাবৎ ঠিক নিয়মিত মাসের প্রথমেই আড়াই হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিয়ে যাচ্ছে সে! আর কেনই বা মাসে মাসে ঐ টাকা দিচ্ছে? মিত্রা সেনের সঙ্গেই বা তাহলে অশোক রায়ের সম্পর্কটা কি! তা ছাড়া কিরীটী ইঙ্গিতে যে কথা বললে, বৈকালী সঙ্ঘের সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের একটা অলক্ষ্য যোগাযোগ আছে, সেটাই বা আসলে কি ধরনের যোগাযোগ! ভুজঙ্গ ডাক্তারকে তো গত পনের-কুড়ি দিনে কখনও দেখি নি বৈকালী সঙ্ঘে যেতে। অবশ্য লোকটার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যেও যেন কেমন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। ঠিক একেবারে নরম্যাল নয়।
.
কিরীটী বলছিল রাত্রি নটার পর তার ওখানে যেতে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত বিলম্ব যেন আর সইছিল না। সাড়ে সাতটার পরই বের হয়ে পড়লাম কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিরীটী তার বাইরের ঘরেই বসে একটা কাগজের গায়ে পেনসিলের সাহায্যে কিসের যেন নকশা আঁকছিল। আমার পদশব্দে মুখ না তুলেই বললে, আয় সুব্রত! এত তাড়াতাড়ি এলি, খেয়ে আসিসনি নিশ্চয়!
না।
ঠিক আছে, একসঙ্গে খাওয়া যাবেখন।
কিরীটীর পাশে বসে তার সামনে অঙ্কিত নকশাটার দিকে তাকালাম, কিসের নকশা রে ওটা?
ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার ও নার্সিং হোম যে ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে আছে সেই বাড়ির নকশা। বাড়িটার মালিক এককালে ছিলেন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী আলি ব্রাদার্সের ছোট ভাই মহম্মদ আলি।
একদিন ছিল মানে? এখন আর নেই নাকি?
না। নকশাটার উপরে পেনসিলের আঁচড় কাটতে কাটতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল কিরীটী।
তবে বর্তমান মালিক কে?
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
কথাটা শুনে যেন আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কিরীটী বলে কি! বর্তমানে বাড়িটার মূল্য ন্যূনপক্ষে হলেও দেড় লক্ষ টাকার কম নয়! বললাম, সত্যি বলছিস?
১০. আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুর
আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুরটা কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়াতে পারেনি পরমুহূর্তে বুঝলাম, কারণ সে হাতের নকশাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এবং আমার দিকে না তাকিয়েই পূর্ববৎ শান্তকণ্ঠে বললে, বিস্ময়ের এতে কি আছে! বর্ণচোরা আমের ধর্মই যে ওই। বাইরে থেকে অত সহজে বোঝবার উপায় নেই। মাস ছয়েক হল আলি ম্যানশনটি ডাঃ চৌধুরীর নামে রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বাড়িটার দাম দেড় লক্ষ টাকার তত কম হবে বলে আমার মনে হয় না!
তাই। তবে ক্রেতা মাত্র আশি হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। কিন্তু এর চাইতেও একটা বেশি ইনটারেস্টিং সংবাদ তোকে দিতে পারি যা তোর জানা নেই।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। ও কিন্তু তখনও হাতের আঁকা নকশাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। এবং এবারেও আমার দিকে না তাকিয়েই বললে, সংবাদটা অবিশ্যি শুভ। প্রজাপতি-ঘটিত সংবাদ।
প্রজাপতি-ঘটিত সংবাদ!
হ্যাঁ। শ্রীমান অশোক রায় শীঘ্রই বিবাহ করছেন।
কাকে?
শ্ৰীমতী মিত্রা সেনকে।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ। অশোক রায় তাঁর বাপকে গতকাল রাত্রে জানিয়েছেন এবং কিছুক্ষণ আগে রাধেশ রায় সে সংবাদটি ফোনে আমাকে জানিয়েছেন।
কিন্তু অশোক রায়ের চাইতে যে মিত্রা সেন বয়সে বড়!
তাতে কি? এ হচ্ছে বিশুদ্ধ প্রেমের ব্যাপার! পঞ্চশরের কৌতুক!
তা রাধেশ রায় আর কি বলবেন? ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুশী হতে পারেননি সংবাদটা শুনে?
তা অবশ্য হননি। কিন্তু বাপ হয়ে উপযুক্ত পুত্রের একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাঁর করারই বা কি আছে! বড়জোর তিনি বলতে পারতেন,ব্যাপারটা তিনি খুশীমনে নিতে পারছেন না। জবাবে হয়তো ছেলে বলে বসত, বিবাহটা যখন সে-ই করবে তখন পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে তার পছন্দ বা মতামতটাই সবাগ্রগণ্য।
তা বটে, তবে বিয়েটা হচ্ছে কবে? তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছে নাকি?
হ্যাঁ, আগামী মাসের ছ তারিখে মঙ্গলবার অর্থাৎ হাতে আর দিন দশ মাত্র সময় আছে।
আজ তো আর যাওয়া হল না। আগামী কাল বৈকালী সঙ্ঘে গেলেই হয়ত সেখানে সংবাদটা পেতাম।
সম্ভব না। কারণ এতদিনেও যখন কেউ সেখানকার ব্যাপারটা জানতে পারেনি, বিবাহের পূর্বে কেউ জানতে পারবে বলে মনে হয় না। বিবাহের ব্যাপারটা তাঁরা দুজনের একজনও জানাজানি করতে চায় না বলেই আমার ধারণা।
যাই বল, মুখরোচক এই সংবাদটা জানাজানি হয়ে গেলে ওদের সোসাইটিতে একটা চাঞ্চল্য দেখা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। এতকাল ধরে বহু হতভাগ্য পতঙ্গকে পুড়িয়ে মিত্রা সেন রূপিণীবহ্নিশিখাশেষ পর্যন্ত যৌবনের প্রান্তসীমায় এসে মালাবদল করছেন, একটা সেনসেশনের ব্যাপারই বটে!
জংলি এসে ঢুকল। বললে, মা জিজ্ঞাসা করলেন, খানা টেবিলে এখন দেওয়া হবে কিনা?
হ্যাঁ, দিতে বল্।
.
খাবার টেবিল থেকে আমরা বাইরের ঘরে এসে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা বাজে প্রায়।
কিরীটী সোফাটার উপরে বেশ আরাম করে গা এলিয়ে দিয়ে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল। বুঝলাম আমাদের নৈশ অভিযানের এখনও দেরি আছে। মাথার মধ্যে তখনও আমার কিরীটীর কাছ থেকে শোনা সংবাদ দুটিই ঘোরাফেরা করছিল। বিশেষ করে অশোক রায় ও মিত্রা সেনের বিবাহের ব্যাপারটা। দীর্ঘদিন ধরে একান্তভাবে বোহিমিয়ান জীবন কাটিয়ে আজ হঠাৎ মিত্রা সেন ঘর বাঁধবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল কেন! এতদিনে কি তবে সে বুঝতে পেরেছে জীবনে ঘর বাঁধবার প্রয়োজনীয়তা! কিন্তু তাও তো বিশ্বাস করতে মন চায় না। এখনও তার হাবভাব, চালচলন ও ব্যবহারের মধ্যে এমন একটা ভোগের উজ্জ্বলতা রয়েছে এবং সেই উচ্ছঙ্খলতা দীর্ঘদিন ধরে রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছে, সেটাকে সে অস্বীকার করতে কি এত সহজেই পারবে এবং তার মত একজন তীক্ষ্ণধী মেয়ের পক্ষে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে তার প্রতি অশোক রায়ের আকর্ষণটাকে আর যাই বলা যাক,প্রেম নয়। বরং বলা চলে ক্ষণিকের একটা মোহ। তাই যদি হয়, সেই মোহটা যখন কেটে যাবে তখনকার পরিস্থিতিটা কি ও ভাবছে না একবারের জন্যও? না ওসবের কোন বালাই-ই নেই ওদের এই বিবাহ ব্যাপারে কোনও একটা বিশেষ কারণেই এই যোগাযোগটা ঘটছে!
বুঝতে পারিনি কিরীটীর চিন্তাধারাটাও আমার মত একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। তার প্রশ্নে যেন তাই হঠাৎ পরক্ষণেই চমকে উঠলাম।
অশোক রায় ও মিত্রা সেনের বিয়ের ব্যাপারটা তোর কি মনে হয় সুব্রত? কিরীটী সহসা প্রশ্ন করল।
মানে? কি ঠিক তুই বলতে চাইছিস?
বলছি, বিয়েটা ওদের সত্যি সত্যিই শেষ পর্যন্ত হবে বলে তোর মনে হয়?
সে আবার কি! এই তো বললি অশোক রায় তার বাপকে বিয়ের তারিখটা পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছে!
তা অবশ্য দিয়েছে। কিন্তু মক্ষীরানীর বিয়ে হয়ে গেলে বৈকালী সঙ্ঘের কি হবে?
কি আবার হবে, সিংহাসন শূন্য নাহি রবে। তাছাড়া বিয়ে করলেই যে মিত্রা সেন সঙ্ঘ ছেড়ে দেবে তারও তো কোনো মানে নেই!
তা অবশ্য নেই। তবে চিরযৌবনা কুমারী মক্ষীরানীকে সকলে যে চোখে দেখত অশোক রায়ের স্ত্রী হলে কি আর তারাই সে চোখে তাকে দেখবে, না অশোক রায়ই সেটা তখন পছন্দ করবে?
অশোক রায় তো জেনেশুনেই বিয়ে করছে। আর এতদিনের অভ্যাস মিত্রা সেনের ছাড়াতে। চাইলেই কি ছাড়তে সে পারবে নাকি! যেমন গর্ধবচন্দ্র তেমন তার ফল ভোগ করাই উচিত। সারাদেশে যেন তার মিত্রা সেন ছাড়া পাত্রী ছিল না!
হঠাৎ ঐ সময় আমাদের কথার মাঝখানে ঘরের ফোন ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। কিরীটী সোফা থেকে উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো! কে? হ্যাঁ, আমিই কথা
বলছি, বলুন। ব্যবস্থামত নার্সিং হোম থেকে কল এসেছে। যাচ্ছি। হ্যাঁ—এক্ষুণি যাচ্ছি। মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই আপনার ওখানে পৌঁছে যাব।
কিরীটী রিসিভারটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ডাক এসে গিয়েছে। মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই আমি প্রস্তুত হয়ে আসছি। এক্ষুণি আমরা বেরুব, তুই একটু বোস্।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
বসে বসে একটা পিকটোরিয়াল ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম, পদশব্দে মুখ তুলে তাকাতেই যেন হঠাৎ চমকে উঠলাম। দীর্ঘকায় এক পাঠান আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরিধানে সালোয়ার পাঞ্জাবি, মাথায় পাঠানী পাগড়ি। মুখে চাপদাড়ি,পাকানো পুরুষ্টু গোঁফ।
গলাটা একটু ভারী ভারী করে কিরীটী কথা বলল, আদাবস্ সাব…
কি ব্যাপার? হঠাৎ এ বেশে কেন? মৃদু হেসে প্রশ্ন করলাম।
বানু বেগমের ভাই পীর খাঁ। এ বেশে না গেলে চলবে কেন?
তা যেন হল, কিন্তু পাঠান পীর খাঁর সঙ্গে আমাকে বাঙালী দেখলে লোকের সন্দেহ হবে না?
হওয়াই স্বাভাবিক। আর এক প্রস্থ সাজসজ্জা তোর জন্যেই ঘরে রেডি করে এসেছি। বি কুইক! ভোল পাল্টে আয়।
কিরীটীর ল্যাবরেটারি ঘরের সংলগ্ন ছোট একটি অ্যান্টিরুমের মত আছে, তার মধ্যে ছদ্মবেশ ধারণের সব রকম ব্যবস্থাই থাকে আমি জানতাম। বিনা বাক্যব্যয়ে আমি উঠে সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। একটা টেবিলের উপরে পাঠান-বেশনেবার সবই প্রস্তুত ছিল। তাড়াতাড়ি শুরু করে দিলাম কাজ।
মিনিট আষ্টেকের মধ্যে যখন প্রস্তুত হয়ে কিরীটীর সামনে এসে দাঁড়ালাম, ক্ষণেকের জন্যে আমার আপাদমস্তকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে সে বললে, ঠিক আছে। তোর নাম হবে, আয়ুব খাঁ। পীর খাঁর বোন বানু বেগমের স্বামী।…
সর্বনাশ! বলিস কি? শেষ পর্যন্ত অপরিচিত এক ভদ্রমহিলার স্বামীর প্রক্সি দিতে হবে নাকি! না ভাই, স্বামী সেজে কাজ নেই, পাঠানী খানদানী ব্যাপার, ওরা কথায় কথায় ছোরা চালায়।
ভয় নেই রে, ভয় নেই। বানু বেগম ও পীর খাঁ, ভাই ও বোনের দুজনের সম্মতিক্রমেই আজকের এ নৈশ অভিসার আমাদের arranged হয়েছে। তাছাড়া বানু বেগমের স্বামী আয়ুব খাঁ এখন বহু পথ দূরেপেশোয়ারে। চল চল—আর দেরিনয়, বানুবেগমের অবস্থা আশঙ্কাজনক, সে তার স্বামী ও ভাইকে দেখবার জন্য তার আত্মীয়ের বাড়িতে জরুরী টেলিফোন করেছিল কিছুক্ষণ আগে এবং সৌভাগ্যক্রমে দুজনেই আজ দুপুরে কলকাতায় এসে গিয়েছে। একজন লাহোর থেকে, অন্যজন পেশোয়ার থেকে। আর তার আত্মীয় নার্সিং হোমে টেলিফোনে। সেই সংবাদ দিয়ে বলেছেন, পীর খাঁ ও আয়ুব খাঁ দুজনেই নার্সিং হোমে যাচ্ছেন এখুনি।
এতক্ষণে ব্যাপারটা যেন কিঞ্চিৎ বোধগম্য হয় আমার।
রাত্রে ডাঃ চৌধুরীর নার্সিং হোমে হানা দেবার জন্য কিরীটী চমৎকার একটি প্ল্যান দাঁড় করিয়েছে।
.
গাড়িতে উঠে বসে বললাম, এখন কোথায়?
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে কিরীটী বললে, সোজা রসা রোডে আল্লাবক্সের গৃহে। তারপর তাঁরই গাড়িতে আমরা যাব ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর নার্সিং হোমে।
রাত ঠিক এগারোটা বেজে দশ মিনিটে আল্লাবক্সের গাড়িতে চেপে আমরা তিনজন পার্ক সাকাসের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর নার্সিং হোমের সামনে এসে নামলাম।
আল্লাবক্সই এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে যে ইলেকট্রিক বেল তার বোতামটা টিপল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল, সামনে দাঁড়িয়ে: বিরাটকায় গুলজার সিং।
আল্লাবক্স ও গুলজার সিংয়ের মধ্যে কি কথাবার্তা হল উর্দুতে। আমাদের সকলকে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে পুনরায় গুলজার সিং ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
গুলজার সিংকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে আমরা তিনজনে দোতলায় উঠলাম। ডাক্তারের চেম্বারের দরজা অতিক্রম করে আমরা প্যাসেজটা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সুসজ্জিত ঘরটি ওয়েটিং রুম বলেই মনে হল।
গুলজার সিং আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রস্থান করল। আমরা তিনজন তিনটি চেয়ারে বসলাম এবং বসবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে এসে প্রবেশ করল একজন স্যুট পরিহিত তরুণ। আগন্তুক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাবক্স উঠে দাঁড়িয়ে ইংরাজীতে প্রশ্ন করলেন, বানু বেগম কেমন আছে ডাঃ মিত্র?
সেই রকমই। খুব restless। ডাঃ মিত্র বললেন।
অতঃপর আল্লাবক্স আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ডাক্তারের সঙ্গে।
ডাঃ মিত্র আমাদের নমস্কার জানিয়ে বললেন, আসুন আপনারা। চার নম্বর কেবিনেপেসেন্ট আছে।
ঘরের মধ্যস্থিত দুটি দ্বারপথের একটি দ্বার দিয়ে প্রথমে এগিয়ে গেলেন ডাঃ মিত্র, তাঁর পশ্চাতে আমরা তিনজন অগ্রসর হলাম তাঁকে অনুসরণ করে।
সরু একটা প্যাসেজ, ডান দিকে পর পর অনুরূপ চারটি দরজা এবং প্রত্যেক দরজার মাথায় পর পর ইংরাজীতে এক দুই তিন চার ক্রমিক নম্বর লেখা।
পরে বুঝেছিলাম একটা হলঘরকেই সম্পূর্ণ সিলিং পর্যন্ত পার্টিশন তুলে পর পর চারটি কিউবসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এবং সেই কিউবসগুলোই এক-একটি কেবিন। প্রত্যেকটি কেবিনের সঙ্গেই একটি করে ছোট্ট অ্যাটাচড় বাথরুম। চার নম্বর অর্থাৎ সর্বশেষ কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাঃ মিত্র বললেন, যান আপনারা ভিতরে কিন্তু রোগিণীর কণ্ডিশন ভাল নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টা করবেন। জানেন তো—আল্লাবক্সের দিকে তাকিয়ে এবারে ডাঃ মিত্র বললেন, রাত্রে আমরা নার্সিংহোমে কখনও কোনও ভিজিটার্সকে আসতে দিই না। ডক্টর চৌধুরীর কড়া আদেশ আছে। সম্পূর্ণ আমার নিজের রিস্কে আসতে দিয়েছি আপনাদের, কেবলমাত্র রোগিণীর কথা ভেবেই।
জবাব দিল আল্লাবক্স, আপনার এ উপকারের কথা আমরাও ভুলব না ডাঃ মিত্র।
মৃদু হেসে ডাঃ মিত্র যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই আবার প্রস্থান করলেন। আমরা তিনে চার নম্বর কেবিনের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে আল্লাবক্স কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বেডে শুয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে এক রোগিণীকে আমরা ককাতে শুনলাম রোগযন্ত্রণায়।
আল্লাবক্স বেডের কাছে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন, বানু—
ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রোগিণী আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন। অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। রোগশীর্ণ মুখখানি, তবু তাতে যেন লেগে রয়েছে কষ্টসাধ্য একটুখানি হাসি।
ভাইজান—
কোনখান থেকে শুনেছিলে তুমি পরশু রাত্রে মানুষের গলার আওয়াজ?
বাথরুমের মধ্যে যাও। ঢুকতে ডান দিককার দেওয়ালের গায়ে দেখবে একটা কাঁচের চৌকো বক্সের মধ্যে আলোটা বসানো আছে। সেই কাঁচের বাক্সটার সামনে দাঁড়াতেই সে রাত্রে মানুষের গলা শুনেছিলাম।
অতঃপর আর সময়ক্ষেপ না করে প্রথমে কিরীটী ও সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাতে আমি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।
বাথরুমের আলোর সুইচটা ঘরে ঢুকবার মুখেই কিরীটী অন্ করে দিয়েছিল। বাথরুমটা ছোট্ট। একটা স্নানের টব একপাশে ও দেওয়ালে বসানো একটা সিঙ্ক ও কমোড।
ঘরে ঢুকতেই আমাদের নজরে পড়ল, ডান দিককার দেওয়ালের গায়ে গাঁথা চৌকো একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে একটি বাল্ব জ্বলছে।
ঘষা কাঁচের তৈরি আলোর বাক্সটি। হাত দিয়ে একবার পরখ করে কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল, তারপর পকেট থেকে ছুরি বার করল। ছুরির ইস্পাতের তৈরি শক্ত ফলাটা বাক্সটার এক জায়গায় বসিয়ে সামান্য একটু চাড় দিতেই ডালাটা খুলে গেল, হাত ঢুকিয়ে। কিরীটী বাল্বটা খুলে নিতেই ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল ও সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল একটি নারীর কণ্ঠস্বর। অত্যন্ত স্পষ্ট।
হ্যাঁ, স্পষ্ট কথাটাই তোমাকে আমি বলতে এসেছি। আজ এবারে আমি মুক্তি চাই।
জবাব শোনা গেল গম্ভীর পুরুষ-কণ্ঠে,তোমাকে আমি বেঁধে রাখিনি, ইচ্ছে করলেই তো তুমি যখন খুশি চলে যেতে পার। কিন্তু আমার কথা যদি শোন তো বলি এভাবে ছেলেমানুষি করে লাভটাই বা কি?
ছেলেমানুষি!
তাছাড়া আর একে কি বলব?
তাই বটে! অদৃশ্য নাগপাশে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে—
সেও তোমার ভুল ধারণা। বাঁধনই যদি মনে কর তো সেটা তোমার নিজেরই সৃষ্টি।
আমার সৃষ্টি?
তাই নয় তো কি?
তা তো বলবেই! আজ ওর চাইতে বেশি প্রাপ্য আর আমার কি থাকতে পারে!
শোন, আবোল-তাবোল কল্পনার দ্বারা নিজেকে মিথ্যা পীড়িত করো না। বাড়ি যাও। কয়েকদিন তোমার ভাল করে বিশ্রাম ও সুনিদ্রার দরকার। এই নাও। এই শিশি থেকে একটা ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ো, দেখবে খুব সাউণ্ড স্লিপ হবে।
ধন্যবাদ। ঘুমের ওষুধের দরকার যদি আমার হয় তো তোমার কাছে হাত পাততে হবে না।
তারপরই সব স্তব্ধ।
বাথরুমের আলোটা আবার জ্বলে উঠল।
দেখলাম ইতিমধ্যে কখন একসময় কিরীটী বাল্বটা হোলডারে লাগিয়ে দিয়ে কাঁচের পাল্লাটা আটকে দিচ্ছে।
আমরা দুজনে বাথরুম থেকে আবার ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।
আল্লাবক্স ও বানু বেগম নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের মধ্যে যেন কি কথাবার্তা বলছিল, আমাদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে আমাদের মুখের দিকে তাকাল দুজনেই।
কিরীটী আল্লাবক্সকে চোখের ইঙ্গিতে কি যেন নির্দেশ দিল দেখলাম। আল্লাবক্স এগিয়ে গিয়ে একটা ইলেকট্রিক বোম টিপে দিল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘরের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল, ঘরে এসে প্রবেশ করলেন আমাদের পূর্ব পরিচিত ডাঃ মিত্র।
ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম।
ডাক্তার মিত্র আমাদের সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে মাঝামাঝি নেমেছি হঠাৎ নিচে থেকে জুতোর শব্দ কানে এল।
তারপরই চোখে পড়ল স্যুট-পরিহিত এক পুরুষ-মূর্তি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। আমি হঠাৎ গায়ে কিরীটীর নিঃশব্দ অঙ্গুলি-সংকেত স্পর্শ পেয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম সিঁড়ির ধাপের উপরেই। আগন্তুক ধীরে ধীরে উঠে নিঃশব্দে আমাদের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেল।
আগন্তুক কিন্তু আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং পাশ দিয়ে উঠে যাবার সময় যেন মনে হল পাছে আমাদের পরস্পরের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে যায়, সেজন্য বিশেষ একটু সতর্কতা অবলম্বন করেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু মুখটা ঘুরিয়ে নিলেও আগন্তুককে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। বিখ্যাত কয়লা-ব্যবসায়ী শ্ৰীমন্ত পাল, বৈকালী সঙ্ঘের অন্যতম মেম্বার।
বাকি সিঁড়ি কটা অতিক্রম করে নিচে নেমে আসতেই প্রহরারত গুলজার সিংয়ের সঙ্গে দেখা হল।
গুলজার সিং নিঃশব্দে আমাদের মুখের দিকে তাকাল এবং নিঃশব্দ সে দৃষ্টির মধ্যে আর কিছু না থাকলেও খানিকটা সন্দেহ যে উঁকি দিচ্ছিল সেটা বুঝতে কিন্তু কষ্ট হল না। কিন্তু কোনরূপ বাক্যব্যয় না করে সে যেমন দরজা খুলে দিল, আমরাও তেমনি বিনা-বাক্যব্যয়ে নার্সিং হোম থেকে বের হয়ে এলাম।
আমাদের পশ্চাতে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
১১. হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত
হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত গাড়িটা খানিকটা দূরেই পার্ক করে রেখেছিল। আমরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, শ্ৰীমন্ত পালের চকচকে ফোর্ড কনসাল গাড়িটা নার্সিং হোমের সামনেই পার্ক করা আছে। অদূরে রাস্তার লাইটপোস্টের আলোয় দেখলাম, গাড়ির মধ্যে কোন ড্রাইভার নেই। শূন্য গাড়িটা পার্ক করা আছে মাত্র। গাড়ি ও গাড়ির নাম্বার দুটোই আমার যথেষ্ট পরিচত। হীরা সিং সজাগই ছিল।
আমারা এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে ঘাড় ফিরিয়ে হীরা সিং প্রশ্ন করল, কিধার যায়গা সাব?
কোঠি চল। কিরীটী বললে।
প্রথম থেকেই অর্থাৎ সেই বাথরুম থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন চুপ করে গিয়েছিল। একটি কথাও বলেনি। বুঝতে পারছিলাম কিরীটীর মনের মধ্যে বিশেষ কোন একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই আমিও কথা বলা নিরর্থকভেবে চুপ করেই গিয়েছিলাম।
গাড়ি ছুটে চলেছে নিঃশব্দ গতিতে রাত্রির জনহীন পথ দিয়ে। দু-পাশের বাড়িগুলো যেন ফ্রেমে আঁকা ছবির মত মনে হয়।
রাস্তার দু-পাশে লাইটপোস্টের আলো ও রাত্রির অন্ধকার মেশামেশি হয়ে যেন আলোছায়ার একটা রহস্য গড়ে তুলেছে। সেই আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে জাগরণ-ক্লান্ত চোখ দুটো আমার যেন কেমন জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ কিরীটীর কথায় চমকে ওর মুখের দিকে ফিরে তাকালাম।
আমাদের নামবার সময় সিঁড়ি দিয়ে যে লোকটা উঠে গেল তাকে চিনতে পেরেছিস সুব্রত?
হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল।
কিন্তু আমি যদি বলি সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়!
তার মানে? বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শ্ৰীমন্ত পাল নয়। কিরীটী আবার বললে।
কি বলছিস কিরীটী?
ঠিকই বলছি। যদিও সামনাসামনি একদিন মাত্র ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলাম, তবুও বলতে পারি সিঁড়িতে যার সঙ্গে একটু আগে আমাদের দেখা হয়েছে সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়। হুবহু শ্ৰীমন্ত পালেরই ছদ্মবেশে অন্য কেউ। তবে এও বলব, সে যেই হোক তার অদ্ভুত একটা দক্ষতা আছে ছদ্মবেশ ধারণের। কিরীটীর কথাগুলো যতখানি বিস্ময় ঠিক ততখানি কৌতূহলের উদ্রেক করে আমার মনে। এবং আমি কোন কথা বলবার পূর্বেই কিরীটী আবার বলে, আচ্ছা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ডাক্তারের চেম্বারের দূরত্ব কতটা হতে পারে?
মনে মনে একটা হিসাব করে বললাম, মাইল তিন কি সাড়ে তিনের বেশি হবে বলে তো মনে হয় না।
তাহলে অ্যাভারেজ স্পীডে গাড়ি চালালে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে কত সময় লাগতে পারে?
তা রাস্তা খালি থাকল পনের-মোল মিনিটের বেশি নিশ্চয় নয়।
অর্থাৎ খুব বেশি লাগলে কুড়ি মিনিটের বেশি নয়।
তাই।
হঠাৎ এরপর কিরীটী সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।
বললে, কাল যাচ্ছিস তো বৈকালী সঙ্ঘে?
হ্যাঁ, যাব। দু-তিন দিন যাইনি।
হ্যাঁ যাস। আর চেষ্টা করে দেখিস যদি বিশাখা চৌধুরীর কাছ থেকে মিত্রা-অশোক সংবাদ কিছু সংগ্রহ করতে পারিস?
বৌদিও কাল যাচ্ছে নাকি?
না। তার সেখানে যাবার যেটুকু প্রয়োজন ছিল তা মিটে গিয়েছে।
কি রকম!
বারুদস্তুপে অগ্নিসংযোগ করবার জন্য সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন ছিল— শ্ৰীমতী সেটা দিয়ে এসেছেন।
ও। তাহলে বৌদির বৈকালী সঙ্ঘে যাবার ব্যাপারে তোর সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল, বল?
তা ছিল।
বুঝতে কণ্ঠ হল না, কৃষ্ণা বৌদির বৈকালী সঙ্ঘে যাবার ব্যাপারে একটি পূর্ব পরিকল্পনা ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে আবার গত কুড়ি-বাইশ দিনের সমস্ত ব্যাপারগুলো পর পর ভাববার চেষ্টা করি।
কোথায় কোন ঘটনা কোন্ সূত্রে কার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে,নতুন করে আবার ভাববার চেষ্টা করি।
পরের দিন রাত্রে সাড়ে দশটা নাগাদ যখন বৈকালী সঙ্ঘে গিয়ে হাজির হলাম তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, ঘটনার গতি কত দ্রুত বিশেষ একটি পরিণতির কেন্দ্রে এগিয়ে এসেছে।
পূর্ব পূর্ব রাতের মত আজও হলঘরে নরনারীদের ভিড় ছিল। ভিড়ের মধ্যে কোথাও বিশাখা চৌধুরীকে দেখতে পেলাম না। এবং দ্রুত অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা চারিদিকে সঞ্চালন করেও ঘরের মধ্যে আর কোথাও আরও দুটি পরিচিত মুখও নজরে পড়ল মা। একটি অশোক রায়, দ্বিতীয়টি মিত্রা সেন। বিশেষ করে যাদের সম্পর্কে গতকাল কিরীটীর মুখ থেকে মুখরোচক সংবাদটি পেয়েছিলাম—এবং যে সংবাদটি পাওয়া অবধি মনের মধ্যে একটা কৌতূহল আমাকে কেবলই চঞ্চল করে তুলছিল—মিত্রা সেনকে অবিশ্যি ঐ সময় প্রতি রাত্রে দেখিনি, সে একটু দেরি করেই আসত, কিন্তু অশোক রায় ঠিকই উপস্থিত থাকত। মিত্রা সেন এলে তবে সে হলঘর থেকে যেত।
হঠাৎ এমন সময় এক নম্বর দরজাপথে বিশাখা চৌধুরী হলঘরে প্রবেশ করে আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি আমার কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।
দুদিন আসনি যে বড়?
একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।
লক্ষ্য করলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিশাখা যেন হাঁপাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চোখের মণি দুটো যেন তার কি এক উত্তেজনায় চকচক করছে। রক্তচাপে মুখখানাও যেন থমথম করছে।
কোথা থেকে আসছ? জিজ্ঞাসা করলাম।
ভীষণ পিপাসা পেয়েছিল, বারে গিয়েছিলাম। চল না,যাবে? কিছু ড্রিঙ্ক করবে?
না। ড্রিঙ্ক আমি করি না, জান তো।
তা হোক, চল। আমার অনুরোধে না হয় একটু অরেঞ্জ বা লিমনই ড্রিঙ্ক করলে।
কেন? Any special occassion!
যদি বলি হ্যাঁ—তারপরই মৃদু হেসে বললে, না, না—সে রকম কিছুনা। চলই না,–বলতে বলতে আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে বিশাখা আমার হাতটা ধরতেই অ্যালকহলের তীব্র একটা গন্ধ তার গায়ের দামী প্যারিস সেন্টের গন্ধকেও যেন ছাপিয়ে এসে আমার নাসারন্ধ্রে ঝাপটা দিল।
থমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
দুচোখের তারায় বিশাখার নেশাগ্রস্ত বিলোল দৃষ্টি। এতক্ষণে বুঝলাম বিশাখা ড্রিঙ্ক করেছে। একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। গত পনের-কুড়ি রাত্রির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে কখনও তাকে আজ পর্যন্ত ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি। বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই তাকিয়েছিলাম বিশাখার মুখের দিকে।
মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নোচ্চারিত হল, কি দেখছ অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যসিন্ধু?
সহসা এমন সময় ভয়ার্ত চাপা নারী-কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আতশব্দে চমকে সামনের দিকে তাকালাম।
সোনপুর স্টেটের মহারানী সুচরিতা দেবীর কণ্ঠস্বর।
Horrible! How Horrible!
কি! কি! ব্যাপার কি মহারানী!
কি ব্যাপার সুচরিতা দেবী!
কি হল মহারানী!
একসঙ্গে আট-দশটি বিভিন্ন পুরুষ ও নারী কন্ঠোচ্চারিত প্রশ্ন মহারানীকে উদ্দেশ করে যেন বর্ষিত হল। আমি আর বিশাখাও এগিয়ে গিয়েছিলাম।
প্রৌঢ়া মহারানীর সুন্দর মুখখানা যেন নিদারুণ একটা ভীতিতে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে কাগজের মত। সমস্ত দেহটা তাঁর তখনও কাঁপছে মৃদু মৃদু।
শ্ৰীমন্ত পাল ও মনোজ দত্ত মহারানীর আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কি মহারানী? কী?
মিত্রা—মিত্রা সেন—
কি? কি হয়েছে মিত্রা সেনের?
She is dead! Stone-dead! একটা আর্ত অস্ফুট চাপা আর্তনাদের মতই যেন ভয়াবহ ঐ কথা দুটি কোনমতে উচ্চারণ করে দুহাতে মুখ ঢেকে একটা সোফার উপরে বসে পড়লেন মহারানী কাঁপতে কাঁপতে।
বন্দুকের ব্যারেল থেকে যেন একটা বুলেট বের হয়ে এসেছে। এবং শুধু একজনের নয়, একসঙ্গে সেই ঘরের মধ্যে তখন উপস্থিত সকলেরই বক্ষ যেন ভেদ করেছে সেই একটিমাত্র বুলেট একসঙ্গে।
মহারানী তখনও কম্পিতকণ্ঠে বলে চলেছে, Oh God! কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!……
মিত্রা সেন মারা গিয়েছে? সে কি! প্রথমেই কথাটা উচ্চারণ করলেন জমাট স্তব্ধতার মধ্যে তরুণ ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত।
হ্যাঁ, আমি স্বচক্ষে এইমাত্র বাগানে দেখে এলাম। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম বুঝি ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বার বার ডেকেও সাড়া না পেয়ে, এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই, বলতে বলতে হঠাৎ শিউরে উঠলেন মহারানী।
এবার এগিয়ে গিয়ে আমি কথা বললাম, আপনিস্থির-নিশ্চিতত মহারানী! সত্যিসত্যিই মিত্রা সেন মারা গেছেন?
কি বলছেন আপনি সত্যসিন্ধুবাবু! I am sure, she is dead, stone-dead!
কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে একবার দেখা দরকার এখুনি!
আমার কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের যেন এতক্ষণে খেয়াল হয়। সকলেই একসঙ্গে আমার প্রস্তাবে সায় দেয়, নিশ্চয় নিশ্চয়, চলুন চলুন সত্যসিন্ধুবাবু।
চলুন তো মহারানী! কোথায়?
আমি মহারানীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন মহারানী, না, না—আমি আর সেখানে যেতে পারব না। Dont request me, যান—আপনারা যান।
ঘরের মধ্যে তখন উপস্থিত ছিলেন শ্রীমন্ত পাল, মনোজ দত্ত, মহারানী অফ সোনপুর সুচরিতা দেবী, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, আমি ও বিশাখা চৌধুরী।
১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর
মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর হলঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য তখন একটা মৃত্যুর মতই কঠিন পীড়াদায়ক স্তব্ধতা নেমে আসে।
সকলেই যেন একটা আকস্মিক আঘাতে যোবা হয়ে গিয়েছি। কারও মুখে কোন কথা নেই।
এবং সুকঠিন সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্বপ্রথম কথা বললেন শ্ৰীমন্ত পাল।
শ্ৰীমন্ত পালই জিজ্ঞাসা করেন, কোথায়? কোথায় আপনি দেখেছেন মহারানী মিত্রা সেনকে?
কামিনী ঝোপের সামনে যে বেঞ্চটা আছে, সেই বেঞ্চে—
আমিই এবার শ্ৰীমন্ত পালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, জানেন আপনি জায়গাটা মিঃ পাল?
হ্যাঁ, আসুন।
শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই অতঃপর সকলে আমরা হলঘরের এক নম্বর দরজা দিয়ে বের হয়ে লোহার সেই ঘোরানো সিঁড়িপথে উদ্যানে এসে নামলাম।
আকাশের পঞ্চমীর চাঁদ। মৃদু চন্দ্রালোকে উদ্যানটার মধ্যে একটা আলোছায়ার রহস্য যেন গড়ে তুলেছে। অদ্ভুত স্তব্ধ চারধার।
শ্ৰীমন্ত পালকে অনুসরণ করেই সকলে আমরা অগ্রসর হলাম। উদ্যানের একেবারে পূর্ব কোণে গোটা দুই কামিনী ফুলের গাছ পাশাপাশি ডালপালা ছড়িয়ে একটা ঝোপ সৃষ্টি করেছে। সেই ঝোপটা ঘুরে সামনে এগিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম।
মৃদু চন্দ্রালোকে যে দৃশ্য আমার চোখে পড়ল আজও আমার যেন তা স্পষ্ট মনে আছে।
লোহার ব্যাকওয়ালা একটা বেঞ্চ। তারই একধারে উপবিষ্ট ভঙ্গীতে দেখলাম মিত্রা সেনকে।
মাথাটা বুকের সামনে ঝুলে পড়েছে। হাত দুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা। পরিধানের সাদা জর্জেটের জরি ও চুমকি বসানো আঁচলটা বুকের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে। চাঁদের আলোয় সেই আঁচলার জরির কাজ ও চুমকিগুলো যেন চিকচিক করে জ্বলছে!
আশেপাশে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
স্তিমিত চন্দ্রালোকে সমস্ত দৃশ্যটা এমনি করুণ যে, কয়েক মুহূর্ত কারও কণ্ঠ থেকে যেন স্বরটুকু পর্যন্ত বের হয় না। মৃত্যুর হাতে কি মর্মান্তিক করুণ আত্মসমর্পণ! মিত্রা সেনের সমস্ত দম্ভ, আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্য যেন নিঃশেষে তার শেষ করুণ ভঙ্গিটির মধ্যে নিবিড় এক আত্মসমর্পণে ধ্যানস্থ হয়ে আছে।
নির্বাক চিত্রার্পিতের মত মৃতের চারিপাশে সব দাঁড়িয়ে।
ধীরে ধীরে আমিই শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম উপবিষ্ট মৃতদেহের সামনে সর্বপ্রথম। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার ভাল করে তাকালাম মৃতার দিকে।
তারপর একসময় আবার ঘুরে গিয়ে দাঁড়ালাম মৃতের পশ্চাতের দিকে। এবং হঠাৎ সেই সময় নজরে পড়ল সেই মৃদু চন্দ্রালোকে মাটিতে কি একটা বস্তু চকচক করছে। কৌতূহলভরে নিচু হয়ে দেখতে যেতেই বুঝলাম সেটা একটা ছোট কাঁচের পেগ গ্লাস।
সন্তর্পণে মাটি থেকে পেগ গ্লাসটা তুলে নিলাম।
আমার হাতে পেগ গ্লাসটা দেখে অস্ফুটকণ্ঠে ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত বললেন, পেগ গ্লাস না?
হ্যাঁ।
গ্লাসটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই একটা আলতো অ্যালকহলের গন্ধ আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল।
মনোজ দত্তই আবার কথা বললেন, মিস সেন তো কখনও ড্রিঙ্ক করতেন না! পেগ গ্লাস এখানে এল তবে কি করে?
মনোজ দত্তর কথায় মনে পড়ল, সত্যিই মিত্রা সেনকে আজ পর্যন্ত কখনও ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি এবং বিশাখার মুখেই শুনেছি তিনি ড্রিঙ্ক করেন না কখনও। এবং বৈকালী সঙ্ঘের সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা আদপেই নাকি পছন্দ করতেন না। এমন কি তিনি দু-একবার এমন প্রস্তাবও নাকি তুলেছিলেন যে, বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ড্রিঙ্কের ব্যাপারটা একেবারে তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু অন্যান্য সভ্য ও সভ্যাদের প্রতিবাদের জন্যই সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি আজও।
সেই মিত্রা সেনের রহস্যপূর্ণ আকস্মিক হত্যার অকুস্থানে পেগ গ্লাস তাহলে এল কি করে!
আর শুধু তাই নয়, পেগ গ্লাসটার মধ্যে এখনও সদ্য অ্যালকোহলের গন্ধ জড়িয়ে আছে।
পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সেই রুমালের মধ্যে অত্যন্ত সন্তর্পণে পেগ গ্লাসটা জড়িয়ে পকেটের মধ্যে আবার রেখে দিলাম।
মনোজ দত্ত ও আমার মধ্যে হঠাৎ দু-একটা কথাবার্তার শব্দের পরই যেন অকস্মাৎ সব আবার নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।
মৃদু চালোকে একবার আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান নির্বক নিশ্চল নরনারীদের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হল কেউ যেন তারা জীবিত নয়। কতকগুলো পটে আঁকা ছবি মাত্র আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
পকেট থেকে এবারে সরু পেনসিল-টচটা বের করে মৃতার আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে ডান হাতে টর্চটা জ্বেলে বাঁ হাত দিয়ে মিত্রা সেনের চিবুকটা স্পর্শ করতেই একটা বরফ-শীতল বিদ্যুৎ-স্পর্শে যেন হাতের আঙ্গুলগুলো আমার শিহরিত হল।
মৃতের ঝুলন্ত শিথিল মুখখানি ঈষৎ উত্তোলিত হল আমার হাতের মধ্যে। বুঝলাম মৃত্যু বেশিক্ষণ ঘটেনি। এখনও মৃতদেহে রাইগার মর্টিস্ সেট ইন্ করেনি। আমার হস্তপ্ত টর্চের আলোয়, সেই মুহূর্তে উত্তোলিত মুখখানির মধ্যে যেটা আমার দুচোখের প্রখর দৃষ্টির সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, সেটা হচ্ছে মিত্রা সেনের প্রসাধন-চিহ্নিত সমগ্র মুখখানি জুড়ে নীলাভ একটি ছায়া। আর বিস্ফারিত দুটি চক্ষু, ঈষৎ বিভক্ত দুটি ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে একটি লালা ও রক্তমিশ্রিত কালচে ধারা নেমে এসেছে।
সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের অজ্ঞাতেই যেন মনের ভেতর থেকে কে আমায় বলে উঠল, বিষ! কোন তীব্র বিষেই তার মৃত্যু ঘটেছে!
তীব্র কোন বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু।
মনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতটা বোধ হয় অকস্মাৎ মুখ দিয়েই আমার অজ্ঞাতে অস্ফুটে শব্দায়িত হয়ে উঠেছিল : বিষ!
সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজনের কণ্ঠ হতে প্রতিশব্দের মতই যেন দু-অক্ষরের কথাটি উচ্চারিত হয় : বিষ!
হ্যাঁ, বিষেই মৃত্যু হয়েছে। ক্ষীণ অথচ স্পষ্টকণ্ঠে বললাম আমি।
কথা বললে এবারে বিশাখা, আত্মহত্যা! সুইসাইড!
সুইসাইডও হতে পারে, হোমিসাইডও হতে পারে! কথা হচ্ছে, বিষ যখন মৃত্যুর কারণ এবং মৃত্যু যখন সকলেরই আমাদের অজান্তে আকস্মিকভাবে ঘটেছে, এখুনি সর্বাগ্রে আমাদের একটা পুলিসে সংবাদ দেওয়া কর্তব্য।
আমার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রার চার-পাঁচটি কণ্ঠ হতে যুগপৎ অস্ফুটে উচ্চারিত হল : পুলিস!
হ্যাঁ, পুলিসে এখুনি একটা সংবাদ দিতে হবে বৈকি।
বিশাখা চৌধুরী বললে, পুলিস! পুলিস কেন?
বললাম তো, সাসপিসাস্ ডেস্! আপনারা একজন কেউ যান, পুলিসে একটা ফোন করে দিন। নিকটবর্তী থানা যেটা সেখানে ফোন করলেই হবে।
সকলের মুখের দিকে তাকিয়েই কথাটা আমি বললাম। কিন্তু কারোর মধ্যেই যেন সাড়া পেলাম না।
পরস্পর তারা বারেকের জন্য পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যেন সকলে নিশ্চল পূর্ববং দাঁড়িয়েই রইল।
বুঝলাম কেউ এগুবে না।
তখন আমিই শ্ৰীমন্ত পালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, চলুন শ্ৰীমন্তবাবু, ফোনটা কোনখানে আমাকে দেখিয়ে দেবেন চলুন।
চলুন, বারে ফোন আছে। শ্ৰীমন্ত পাল মৃদুকণ্ঠে যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই কথাটা উচ্চারণ করলেন।
স্থানত্যাগের পূর্বে আমি সকলকে সম্বোধন করে বললাম, একটা কথা বলা প্রয়োজন, পুলিস না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ তাদের বিনানুমতিতে যেন এখান থেকে বাইরে কেউ যাবেন না।
বাইরে যাব না! অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী প্রশ্ন করলেন আমাকে।
না। এ অবস্থায় পুলিস এসে এখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত, বুঝতেই তো পারছেন, এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে রিস্ক আছে। যদি শেষ পর্যন্ত মিত্রা সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা সুইসাইড না হয়ে হোমিসাইড প্রমাণ হয়, হয়তো আপনাদের প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা ভাবে পুলিসের জবানবন্দির সম্মুখীন হতে হবে। আপনারা তাহলে অপেক্ষা করুন। আমি একটা ফোন করে দিয়ে আসি। আর একটা কথা, মৃতদেহের আশেপাশে কেউ যেন যাবেন না, মৃতদেহ স্পর্শও যেন কেউ করবেন না।
কিন্তু আপনি সত্যসিন্ধুবাবু এত কথা জানলেন কি করে? হঠাৎ মনোজ দত্ত আমাকে প্রশ্ন করলেন।
আমি?
হ্যাঁ—these are all law points! আমি পূর্বে কিছুদিন লালবাজারে স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি করেছিলাম।
C. I. D.? অস্ফুট কণ্ঠে বললেন মনোজ দত্ত।
আর নিজের আত্মপরিচয় গোপন রাখা বৃথাই, তাই এবারে স্পষ্টকণ্ঠে জবাব দিলাম, হ্যাঁ মিঃ দত্ত, তবে সরকারী নয়, বে-সরকারী শখের সত্যসন্ধানী আমি। কিরীটী রায়ের নাম শুনেছেন?
কিরীটী রায়! একসঙ্গে সকলের কণ্ঠ হতেই নামটা উচ্চারিত হল।
হ্যাঁ, কিরীটী রায়ের সহকারী আমি সুব্রত রায়।
সে কি! অস্ফুট আর্তকণ্ঠে বললে এবারে বিশাখা চৌধুরী।
তাই বিশাখা দেবী। সত্যসিন্ধু আমার ছদ্মনাম, ছদ্মপরিচয়। আমি সুব্রত রায়। বলেই শ্ৰীমন্ত পালের দিকে এবারে তাকিয়ে বললাম, চলুন মিঃ পাল, we must inform the police!
একটা আকস্মিক বজ্রপাতের মতই যেন আমার সত্যকার পরিচয়টা সমস্ত পরিস্থিতিটাকে বিমূঢ় বিস্ময়ে একেবারে বরফের মতই জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছিল।
বিমূঢ় নিশ্চল মানুষগুলোর মুখের দিকে আর না তাকিয়েই এবারে আমি শ্ৰীমন্ত পালকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
১৩. বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী
বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী টেবিলের সামনে বসে ড্রিঙ্ক করছিল। একপাশে একটা ঘেরা কাঁচের পার্টিশন ভোলা জায়গায় ফোন ছিল। পার্টিশনের মধ্যে ঢুকে সর্বাগ্রে নিকটবর্তী থানায় পরিচিত থানা অফিসার রজত লাহিড়ীকে দুঃসংবাদটা দিয়ে কিরীটীকে ফোনে ডাকলাম।
হ্যালো! কিরীটী রায় কথা বলছি। তারে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
আমি সুব্রত, বৈকালী সঙ্ঘ থেকে বলছি রে।
কি ব্যাপার?
মিত্রা সেন খুব সম্ভবত murdered!
সংবাদটা শুনে কিন্তু অপর পক্ষের কণ্ঠে কোনরূপ বিস্ময় প্রকাশ পেল না। শান্ত প্রত্যুত্তর শোনা গেল : শেষ পর্যন্ত murdered! কিন্তু এতটা ঠিক তো আশা করিনি? নিজের পরিচয় দিয়েছিস নাকি?
হ্যাঁ, এইমাত্র দিলাম।
এত তাড়াতাড়ি! আর একটু পরে দিলেই হত। যাকগে, থানায় সংবাদ দিয়েছিস?
হ্যাঁ, রজত লাহিড়ীকে জানিয়েছি। তিনি এক্ষুনি আসছেন।
অশোক রায় ঐখানেই আছে তো?
অশোক রায়! কই না, তাকে তো এখনো পর্যন্ত দেখিনি!
খোঁজ নে, আমি আসছি। হ্যাঁ ভাল কথা, ক্লাবের প্রেসিডেন্টের খবর কি?
এখনও খবর নিতে পারিনি।
কেউ যেন না সটকাতে পারে। Keep an eye!
হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা করেছি।
যাচ্ছি আমি।
ফোন রেখে বের হয়ে এলাম। শ্ৰীমন্ত পাল পার্টিশনের সুইং-ডোরের অল্প দূরেই দাঁড়িয়েছিলেন। এবং ঘরের মধ্যে যাঁরা টেবিলে বসে ড্রিঙ্ক করছিলেন তাঁরা দেখলাম পূর্ববৎ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বুঝলাম এ-ঘরের নরনারীদের মধ্যে এখনও দুঃস্বপ্নের ধাক্কাটা এসে পৌঁছয়নি।
কিন্তু সত্যিই অশোক রায়কে তো এতক্ষণ পর্যন্ত আজ এখানে আসা অবধি একবারও দেখিনি। মিত্রা সেন এসেছিল অথচ জোড়ের অন্যটি অশোক রায় আসেননি এ তত হতে পারে না— বিশেষ করে আজ শনিবার। মিত্রা সেনের অনিবার্য উপস্থিতির রাত যখন, তখন অশোক রায়ের আসাটাও অনিবার্য।
বিশেষ করে ঐ সঙ্গে আরও একট কথা মনে পড়ল। মাত্র আগের দিনেই কিরীটীর মুখে শুনেছি মিত্রা ও অশোকের বিবাহের ব্যাপারটা স্থির হয়ে গিয়েছে। সে অবস্থায় আজকের রাত্রে মিত্রা সেন এসেছে অথচ অশোক রায় আসেননি এবং শুধু আসাই নয়, মিত্রা সেন বিষপ্রয়োগে নিহত অথচ অশোক রায় অনুপস্থিত। কথাটা ভাবতে ভাবতেই শ্ৰীমন্ত পালের দিকে এগিয়ে গেলাম।
চলুন মিঃ পাল, প্রেসিডেন্টের ঘরে একবার যাওয়া যাক।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে শ্ৰীমন্ত পাল বললেন, চলুন।
ঘর থেকে বের হয়ে অপরিসর প্যাসেজটা দিয়ে পাশাপশি যেতে যেতে আমিই আবার প্রশ্ন করলাম, অশোক রায়কে দেখছি না, তিনি কি আজ আসেননি নাকি?
কই, আমি তো তাঁকে আজ দেখিনি একবারও।
কখন আপনি এসেছেন আজ?
রাত সাড়ে নটার পর।
আপনি যখন হলঘরে এসে ঢোকেন কাকে কাকে দেখেছিলেন সেখানে, মনে আছে?
হ্যাঁ।
মিত্রা সেন তাদের মধ্যে ছিলেন কি?
না। তাকেও দেখিনি।
তবে কে কে ছিলেন তখন হলঘরে?
মহারানী,সুধীরঞ্জন, সুমিত্রা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, মনোজ দত্ত, সোমেশ্বর আর রমা মল্লিক ছিল।
বিশাখা ছিলেন না?
না, কই! তাকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!
ভাল করে মনে করে দেখুন, আর কাউকে হলঘরের মধ্যে দেখেননি?
আমার বেশ মনে আছে। আর কাউকে তখন হলঘরের মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। পাশাপাশি চলতে চলতেই বললেন শ্ৰীমন্ত পাল।
চলুন একবার প্রেসিডেন্টের ঘরে যাওয়া যাক, বললাম আমি।
চলুন।
সরু প্যাসেজটা ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। ডান দিকে ঘুরতেই সামনে একটা দরজা আমার চোখে পড়ল।
দরজার গায়ে একটা সাদা বেকালাইটের প্রেস বাটন আছে দেখলাম।
শ্ৰীমন্ত পালই এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে প্রেস বাটনটা টিপলেন।
ধীরে নিঃশব্দে আমাদের চোখের সামনে দরজাটা খুলে গেল।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে আহ্বান শোনা গেল, আসুন।
প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীর গলা।
প্রেসিডেন্টের ঘরের যে দ্বারপথটি সেদিন আমার নজরে পড়েছিল, সেটা ছাড়াও এটি তাহলে ঘরে যাবার অন্য আর একটি দ্বার।
এ ধরনের আরও দ্বারপথ আছে কিনা তাই বা কে জানে!
শ্ৰীমন্ত পালের সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রেসিডেন্টের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে পিছন ফিরে টেবিলের সামনে বসে একতাড়া ভাউচার সই করতে ব্যস্ত ছিলেন।
একটা ব্যাপার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ্য করেছিলাম। পশ্চাতের দ্বারের পাল্লাটি বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একেবারে দেওয়ালের গায়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বাইরের থেকে প্রবেশদ্বারটি বোঝা গেলেও আকৃতি ও দ্বারের বৈশিষ্ট্য থেকে ভিতর থেকে সেটা বোঝবারও উপায় নেই। সমস্ত দ্বারপথটি জুড়ে দেওয়ালের গায়ে আঁকা রয়েছে একটি নৃত্যরতা চৈনিক সুন্দরীর নিখুঁত প্রতিকৃতি। বুঝলাম বাইরে থেকে জানা গেলেও ঘরের ভিতর থেকে দ্বারপথটি বোঝবার কোনও উপায় বা চিহ্ন নেই। তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে ঐটি একটি গোপন দ্বারপথ।
ভাউচারগুলি সই করতে করতেই পূর্ববৎ চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থায় প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বললেন,কি খবর শ্রীমন্তবাবু?
শ্ৰীমন্ত পালের দিকে না তাকিয়েই বুঝলাম প্রেসিডেন্ট তাঁকে চিনতে পেরেছেন তা সে যে ভাবেই হোক।
সত্যসিন্ধুবাবু মানে সুব্রতবাবু—
শ্ৰীমন্ত পালের কথা শেষ হবার পূর্বেই চকিতে মুখ তুলে তাকালেন প্রেসিডেন্ট আমাদের দিকে। কালো চশমার অন্তরালে সেই মুহূর্তে তাঁর চোখের দৃষ্টির মধ্যে কি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল না টের পেলেও তাঁর চকিত শিরোত্তোলন ও তাকাবার ভঙ্গী থেকেই বুঝেছিলাম, আমার নামটা তাঁর কানে আকস্মিক ভাবেই প্রবেশ করেছে।
সুব্রতবাবু! সত্যসিন্ধুবাবুর সঙ্গে সুব্রতবাবুর কি সম্পর্ক?
সেই শুভ্রকেশ শান্ত চেহারা।
কথা বললাম এবারে আমিই, আমার নাম ও পরিচয়ের ব্যাপারে আমি গোপনতার আশ্রয় নিয়েছিলাম, মিঃ প্রেসিডেন্ট। তার জন্য আমি দুঃখিত–
গোপনতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তার জন্য আপনি দুঃখিত মিঃ সুব্রত রায়! কিন্তু কেন বলুন তো? একটা সুতীক্ষ্ণ শব্দভেদী বাণের মতই যেন প্রেসিডেন্টের শান্ত কণ্ঠ হতে উচ্চারিত প্রশ্নটা আমাকে এসে বিদ্ধ করল।
আপনার সে প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আপনাকে একটা দুঃসংবাদ জানাতে চাই মিঃ চক্রবর্তী।
কিন্তু আমার কথার ধার দিয়েও যেন গেলেন না রাজেশ্বর চক্রবর্তী। আপন মনেই বললেন, অজ্ঞাতকুলশীল!! সুধীরঞ্জন is responsible বলতে বলতে টেবিলের গায়ে একটা অদৃশ্য বোম বোধ হয় টিপলেন।
মুহূর্ত পরেই সম্মুখের দ্বারপথে মীরজুমলাকে দেখা গেল।
মীরজুমলা, সুধীরঞ্জন—
মীরজুমলা আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারপথে ক্ষণপূর্বে যেমন আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তেমনি করেই অন্তর্হিত হল।
আমরা দুজনেই এতক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট আবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, আপনার সত্যকার পরিচয় তাহলে সুব্রত রায় আপনি! লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রাক্তন সি.আই.ডি.!
তা যা বলেন।
হ্যাঁ। তা বেশ। কিন্তু কি যেন দুঃসংবাদের কথা বলছিলেন একটুক্ষণ আগে?
মিত্রা সেন মারা গেছেন।
কি? কি বললেন? অত্যন্ত চমকিত বিস্ময়ে প্রশ্নটা করলেন তিনি।
মিত্রা সেন মারা গেছেন এবং কোনও তীব্র বিষই তাঁর মৃত্যুর কারণ। তাঁর মৃতদেহ বাগানের বেঞ্চিতে–
মানে, এখানে?
হ্যাঁ।
Are you mad Mr. Roy! কি সব আবোল-তাবোল বকছেন?
নিজেই স্বচক্ষে বাগানে দেখবেন চলুন না। আপনার একবার দেখা দরকার। থানায় অবিশ্যি আমি এইমাত্র ফোন করে দিয়েছি।
কিন্তু কে–কে আপনাকে গায়ে পড়ে সর্দারি করতে বলেছে মিঃ সুব্রত রায়, জানতে পারি কি?
আমার কর্তব্য বলে মনে করেই থানায় আমি ফোন করেছি মিঃ চক্রবর্তী।
All right? আপনি এখন যেতে পারেন এ ঘর থেকে। আর একটা কথা জেনে যান, এই মুহূর্ত থেকে আর আপনি বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বার থাকলেন না।
ধন্যবাদ! আমারও ঘর ছেড়ে যাবার পূর্বে একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার, পুলিস আসা পর্যন্ত এ বাড়ি ছেড়ে আপনি যেন কোথাও যাবার চেষ্টা না করেন।
ধন্যবাদ!
আমারই ক্ষণপূর্বের ধন্যবাদটা যেন ব্যঙ্গোক্তির মধ্যে ফিরিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট আমাকে।
আমি ঘর থেকে দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে সোজা হলঘরে চলে এলাম।
হলঘরে ঢুকতেই কানে এল ভায়োলিনের করুণ মিষ্টি সুর।
চেয়ে দেখি নির্জন হলঘরের মধ্যে একাকী এক কোণে একটা চেয়ারে বসে সুধীরঞ্জন আপন মনে ভায়োলিন বাজাচ্ছেন।
সুধীরঞ্জন কি তবে প্রেসিডেন্টের পরোয়ানা এখনও পায়নি। মীরজুমলা কি এ ঘরে আসেনি!
এগিয়ে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম, সুধীরঞ্জন!
প্রথম ডাকটা শুনতে পেল না। দ্বিতীয়বার ডাকতেই মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভায়োলিন বাজানো বন্ধ করে বলল, কি?
প্রেসিডেন্ট যে তোমাকে ডাকছেন, শোননি?
না।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
এসেই একটু বাইরে গিয়েছিলাম, এই মিনিট কয়েক হল ফিরে হলঘরে কাউকে না দেখতে পেয়ে একা একা কি করি, তাই একটু ভায়োলিন বাজাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কি ব্যাপার? আজ যে আসর ফাঁকা? সব গেল কোথায়?
একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাই তো একদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে দুর্ঘটনা! ওর মধ্যে নতুনত্ব তো কিছু নেই!
না, না—সত্যিই–
আমি কি বলছি মিথ্যে—
খুব সম্ভব মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন!
What! কি বললে?
মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন, বিষপ্রয়োগে।
এ যে সত্যিই Arabian Night-এর গল্প শোনাচ্ছ হে! কিন্তু সংবাদটা দিল কে?
মহরানী অফ সোনপুরই প্রথম মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন বাগানে।
তার মানে, এইখানে?
হ্যাঁ।
হঠাৎ এমন সময় পশ্চাতে মীরজুমলার কণ্ঠস্বর শোনা গেলঃ স্যার! আপনাকে প্রেসিডেন্ট তাঁর ঘরে ডাকছেন।
সুধীই প্রশ্ন করে মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়ে, কাকে?
তোমাকে। বললাম আমি।
আমাকে?
হ্যাঁ, আমার সম্পর্কে আলোচনার জন্যই বোধ হয় তলব পড়েছে তোমার।
তোমার সম্পর্কে? হঠাৎ–
সত্যকার পরিচয়টা যে এইমাত্র তাঁকে দিয়ে এলাম।
সর্বনাশ করেছ! তারপর?
মীরজুমলা আবার ঐ সময় বলল, চলুন স্যার।
সময় নেই যাবার এখন, প্রেসিডেন্টকে গিয়ে বলমীরজুমলা। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল সুধীরঞ্জন।
কিন্তু স্যার–
যা বললাম তাই বলগে–যাও!
ঠিক সেই মুহূর্তে হলঘরের প্রধান দরজা খুলে গেল এবং হলঘরে এসে প্রবেশ করল প্রথমে দারোয়ান, তার পশ্চাতে থানা অফিসার রজত লাহিড়ী এবং সর্বশেষে কিরীটী ও দুজন ইউনিফর্ম-পরিহিত পুলিস। পুলিস দুজনের দিকে তাকিয়ে রজত লাহিড়ী বললেন, তোম দোনো এই দরওয়াজা পর খাড়া রহে। বিনা হুকুমসে কোই বাহার না যায়। আউর বাহারসে ভি কোই নেই অন্দার ঘুষে।
কিরীটী ততক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বলা বাহুল্য আমার ছদ্মবেশই ছিল। তথাপি কিরীটী মুহূর্তকাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললে, মেক-আপটা বেশ জুতসই নিয়েছিস তো সুব্রত!
হেসে ফেললাম আমি।
চল্, কোথায় ডেড বডি আছে?
বাগানে।
এস হে রজত! কিরীটী রজত লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে আহ্বান জানাল।
হঠাৎ ঐ সময় লক্ষ্য করলাম হলঘরের মধ্যে কোথাও মীরজুমলা নেই।
নিঃশব্দে ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন সে সবার অলক্ষ্যেঅন্তর্হিত হয়েছে।
সুধীরঞ্জনও আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল।
দোতলার সরু প্যাসেজটা দিয়ে কিরীটী ও লাহিড়ীকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাবার সময় কিরীটী প্রশ্ন করল, অশোক রায় কোথায়?
এখনও পর্যন্ত তার কোনও হদিস পাইনি।
সে আজ এসেছিল, না মোটে আসেইনি?
তাও বলতে পারি না। এখনও বিশেষ কারও সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। তবে আমার ধারণা সে নিশ্চয় এসেছিল।
কিসে বুঝলি?
আজ শনিবার। বিশেষ করে তোকে তো বলেছিলাম বৃহস্পতি ও শনিবার মিত্রা সেন এখানে আসবেই, এ তো অশোক জানে।
আমার কথার প্রত্যুরে কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না অতঃপর আমরা লোহার ঘোরানো সিঁড়িপথে নেমে এসে একের পর এক নীচে বাগানে পা দিলাম। ইতিমধ্যে চাঁদ আকাশের পশ্চিম প্রান্তে অনেক হেলে পড়ায় তার আলোও ঝিমিয়ে এসেছিল।
দেখলাম যে কজন নরনারীকে প্রায় মিনিট কুঠি-পঁচিশ পূর্বে বাগানের মধ্যে সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে চিত্রার্পিতের মত দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখে গিয়েছিলাম, তাঁরা তখনও সেইখানেই যে যার দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তেমনি। এবং মনোজ দত্তও ইতিমধ্যে কখন একসময় যেন আবার বাগানের মধেফিরে এসেছেন প্রেসিডেন্টের ঘর থেকে। আমাদের পদশব্দেওঁরা সকলেই একবার মুখ তুলে তাকালেন। কিরীটীও দেখলাম সেই মৃদু চন্দ্রালোকে সকলের মুখের দিকে পর পর একবার তাকিয়ে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি দিল।
কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কিরীটী লাহিড়ীকে সম্বোধন করে নিম্নকণ্ঠে কি যেন বলল।
লাহিড়ী দণ্ডায়মান নরনারীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যান, সকলে হলঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমরা আসছি। আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমাদের কিছু কথা আছে।
এতক্ষণ তাঁরা যেন সকলে ঐ বিশেষ নির্দেশটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সকলেই একে একে স্থানত্যাগ করলেন।
ধীরে ধীরে অনেকগুলো পদশব্দ বাগানের অপর প্রান্তে আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল।
অদ্ভুত স্তব্ধ চারিদিক। মধ্যে মধ্যে কেবল মৃদু পত্রমর্মর ও একটানা একটা ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।
মৃতদেহ ঠিক পূর্ববৎ বেঞ্চের উপরে উপবিষ্ট রয়েছে।
পকেট থেকে পেনসিল-টচটা বের করে টর্চের আলো ফেলে পায়ে পায়ে কিরীটী মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।
মৃতার চিবুক স্পর্শ করে, মুখে টর্চের আলো ফেলে ক্ষণকাল সেই মৃত্যুনীল মুখখানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, সত্যিই বিষ সুব্রত।
শুধু বিষই নয়। এই যে বিষ-পাত্রও পেয়েছি! বলতে বলতে পকেট থেকে পেগ গ্লাসটা বের করে কিরীটীর সামনে এগিয়ে ধরলাম।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে বার দুই ঘুরিয়ে দেখে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী বললে, এ যে দেখছি সুরাপাত্র! মিত্রা সেনের কি সুরাসক্তি ছিল নাকি?
না, আমি কখনও দেখিনি এবং সকলে তাই বললেনও এখানে।
তাই তো মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সুইসাইড নয় তো?
অসম্ভব বলে স্ত্রী-চরিত্রে কোন কিছুই নেই। তাই সে সম্ভাবনাটাও আমাদের চিন্তা থেকে বাদ দিতে পারব না। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে জীবনে যার মধুযামিনী এমনি করের আসন্ন হয়ে উঠেছিল, কোন্ দুঃখে সে আত্মহত্যা করতে যাবে। তাছাড়া এ বিবাহে যখন দুজনেই মন দেওয়া-নেওয়ার পর্বটা সমাপ্ত করে অগ্রসর হয়েছিল তখন আচমকা এমনি করে আত্মহত্যাই বা একজন করতে যাবে কেন?
কিরীটীর কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয়।
কিরীটী আবার বললে,সে যাই হোক, এখানে মৃতদেহের কাছেই পেগ গ্লাসটা যখন পাওয়া গিয়েছে অবশ্যই তার একটা তাৎপর্য আছে। তা সে মিত্রা সেন কোনদিন ড্রিঙ্কে অভ্যস্ত থাকুন বা নাই থাকুন। তাছাড়া আরও একটা কথা এর মধ্যে ভাববার আছে। মিত্রা সেনের মত মেয়ে যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তো এই বিশেষ স্থানটি ও সময় বেছে নিলেন কেন? তাঁর চরিত্রের ভ্যানিটির কথাটাও আমাদের ভুললে চলবে না।
কথাগুলো বলে কিরীটী চারপাশে আলো ফেলে ফেলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর আবার ক্ষীণকণ্ঠে বললে, মৃতের চোখেমুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন সুস্পষ্ট আছে বটে। তবে মৃতদেহের সহজ পশ্চার দেখে মনে হয় মৃত্যুর কারণ যে বিষই হোক না কেন, সেটা অত্যন্ত তীব্র ও দ্রুত কার্যকরী ছিল। আর খুব সম্ভবত ব্যাপারটা যা মনে হচ্ছে, যদি হত্যাই হয়ে থাকে, নিশ্চিন্ত বিশ্বাসেমিত্রা সেন হত্যাকারীর হাত থেকে বিষ গ্রহণ করে পান করেছিলেন। তারপর ভাববারও আর সময় পাননি, অবধারিত মৃত্যুকে বরণ করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে হয় হত্যাকারী পূর্ব হতেই জানত আজ রাত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিত্রা সেন এখানে আসবেন বা থাকবেন, না হয় তাঁরই পূর্ব পরিকল্পনা বা প্ল্যান মত মিত্রা সেনকে এখানে কোন এক সময় আজ রাত্রে আসতে হয়েছিল। পরের ব্যাপারটাই যদি সত্যি হয় তো বলতে হবে হত্যাকারী পূর্ব থেকেই বিষ নিয়ে প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু একটা কথা কিরীটী–বাধা দিলাম আমি।
কি?
ধরেই যদি নেওয়া যায় যে, ঐ পেগ গ্লাসেই মিত্রা সেনকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, তাহলে মদ ভিন্ন কি এমন পানীয় যা মিত্রা সেনকে বিষ মিশ্রিত করে হত্যাকারী তার হাতে তুলে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, কথাটা অবিশ্যি ভাববার। তবে তারও পক্ষে তোর একমাত্র যুক্তি তো যে, মিত্রা সেনের ড্রিঙ্ক করার হ্যাবিট ছিল না, এই তো? কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবনে কখনও যে তিনি ড্রিঙ্ক করেননি বা করতে পারেন না, তারও তো কোন মানে নেই। দৈব কার্যকারণ বলে একটা কথা আছে, মানিস তো?
তা মানি। তাই যদি হবে তো সে এমন কেউ হওয়া দরকার যার দ্বারা সেটা হওয়া সম্ভব!
সে তো এখানেই কেউ হতে পারে।
মানে?
মানে এখানে সকলের সঙ্গেই তো তার ভাব ছিল, হৃদ্যতা—অর্থাৎ তোমার অশোক রায় থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরী বা স্বয়ং মহারানী অফ সোনপুরও তো হতে পারেন। বলেই কিরীটী হেসে ফেললে, কিন্তু থাক সে কথা, স্বেচ্ছাকৃত বিষগ্রহণ যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই সে সময় দ্বিতীয় কোনোনরনারীর সুনিশ্চিত এখানে আবির্ভাব ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, ঐ সঙ্গে একটি কথা ভুললে চলবে না সুব্রত, মিত্রা সেনের বিবাহের দিন অসন্ন হয়ে এসেছিল এবং বর্তমানের অতি আধুনিক ইঙ্গ-বঙ্গ সোসাইটির সে ছিল অন্যতম। কিন্তু আর এখানে নয়। রাত অনেক হল, এবারে এখানকার ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়গণকে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। পুলিসের হুমকি দিয়ে অনেক্ষণ তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। কি বলেন মিঃ লাহিড়ী?
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে যেন নির্বাক দর্শকের মতই একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিঃ লাহিড়ী। একটি কথা বা একটি মন্তব্যও করেননি। কিরীটীর প্রশ্নোত্তরে মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, রাত অনেক হয়েছে, প্রায় সাড়ে এগারোটা।
চল্ চল্ সুব্রত। হলঘরে একবার যাওয়া যাক।
১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে
হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখেই কানে এসেছিল বহু কণ্ঠের মিশ্রিত চাপা একটি গুঞ্জন। আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেইযেন সেটা সহসা থেমে গেল। ভাষাহীন একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন সহসা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠল।
কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও হলঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম।
বুঝতে পারলাম, ইতিমধ্যেই বাকি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যেও দুঃসংবাদটা প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। কারণ হলঘরের মধ্যে সকলেই উপস্থিত ছিলেন। দেখতে পেলাম না কেবল সকলের মধ্যে বিশেষ দুটি প্রাণীকে। একজন হচ্ছেন বৈকালী সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তী, দ্বিতীয় অশোক রায়। আরও একটা ব্যাপার যা আমার দৃষ্টিকে এড়ায় নি, সেটা হচ্ছে ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীর চোখেমুখেই যেন একটা চাপা ভয় ও আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেরই মনের উদ্বেগ যেন প্রত্যেকের নীরবতার মধ্যেও চাপা থাকেনি।
ঘরের মধ্যে সে সময় উপস্থিত ছিলেন মহারানী অফ সোনপুর স্টেট সুচরিতা দেবী,ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত, শ্ৰীমন্ত পাল, সুধীরঞ্জন, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, বিশাখা চৌধুরী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক, সোমশ্বর রাহা আর দুজন ভদ্রলোক, যাঁদের মধ্যে মধ্যে দেখলেও নাম জানতাম না, পরে ঐ রাত্রেই জবানবন্দি নেবার সময় জেনেছিলাম,রঞ্জন রক্ষিত ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী। এঁদের মধ্যে রঞ্জন রক্ষিত শেয়ার মার্কেটের একজন চাঁই, বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী একজন ফিল্মজগতের প্রোডিউসার-ডাইরেকটার।
.
কিরীটীর পরামর্শমতই বার-রুমে রজত লাহিড়ীকে সামনে রেখে কিরীটী তার জেরা শুরু করল—প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে সেই ঘরে একের পর এক ডেকে এনে।
প্রথমেই ডাক পাঠানো হল মীরজুমলার সাহায্যে প্রেসিডেন্টকে। তিনি তাঁর নিজস্ব ঘরের মধ্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
ডান পা-টি একটু টেনে টেনে একটা মোটা লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট এসে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।
বসুন মিঃ চক্রবর্তী, আপনিই এখানকার প্রেসিডেন্ট? প্রশ্ন করলেন রজত লাহিড়ী।
নিদিষ্ট চেয়ারটা টেনে একটু যেন কষ্ট করেই বসতে বসতে প্রেসিডেন্ট মৃদুকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।
আপনার ডান পায়ে কি কোন দোষ আছে নাকি মিঃ চক্রবর্তী? হঠাৎ প্রশ্ন করে এবার কিরীটী।
কিরীটীর দিকে না তাকিয়েই মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন প্রেসিডেন্ট, আর বলেন কেন, old age-এর বায়নাক্কা কি একটা! রিউম্যাটিজ, এনলার্জ প্রস্টেট, তার উপরে আবার ক্রনিক ব্রংকাইটিস। বলার সঙ্গে সঙ্গেই বারকয়েক খুকখুক করে কাশলেন রাজেশ্বর চক্রবর্তী। নেহাৎ এরা ছাড়ে না, নাহলে এ বয়সে আর এইসব ঝামেলা পোষায় বলে যেন কথাটা শেষ করলেন কোনমতে!
চোখেও তো দেখছি আবার কালো চশমা ব্যবহার করছেন! চোখেও কোন দোষ আছে। নাকি মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী আবার শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। সে তো আজ নয়, বহুদিন থেকেই ভুগছি, হাইপার মেট্রোপিয়া না কি ডাক্তারেরা বলেন। জবাব দিলেন রাজেশ্বর।
হুঁ। তা শুনেছেন বোধ হয় দুঃসংবাদটা?
হ্যাঁ, সত্যসিন্ধুবাবু—আপনাদের ঐ সুব্রতবাবু একটু আগে মিঃ পালের সঙ্গে আমার অফিসঘরে গিয়ে সুসংবাদটা দয়া করে শুনিয়ে এসেছেন। চমৎকার ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন বটে সুব্রতবাবু। সত্যসিন্ধু! সত্যের একেবারে সাক্ষাৎ মূর্তি! বলেই আবার বার কয়েক কেশে নিলেন।
কিরীটী যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে রাজেশ্বর চক্রবর্তী বলে উঠলেন, তা দেখুন—ভাল কথা, আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি শেষ করলেন কথাটা।
জবাব দিলাম আমিই, ওর নামটা শোনেননি? কিরীটী রায়।
কিরীটী রায়? মানে সেই শখের গোয়েন্দা–
হ্যাঁ।
সুখী হলাম মিঃ রায় আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তা দেখুন মিঃ রায়, আমি বলছিলাম নামেই এখানকার প্রেসিডেন্ট আমি। কাজকর্মের মধ্যে কেবল হিসাব-নিকাশটাই রাখতে হয় বৈকালী সঙ্ঘের। অবিশ্যি ঐ সঙ্গে এখানকার ডিসিপ্লিন রাখবারও দায়িত্ব একটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে। কিন্তু এখানকার মেম্বারদের পার্সোনাল ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই।
কথাটা একটু স্পষ্ট করে যদি বলেন মিঃ চক্রবর্তী? প্রশ্ন করলেন লাহিড়ীই এবার।
বলছিলাম এরা যদি কেউ পরস্পরের প্রেমে পড়ে বা আত্মহত্যা করে, সে ব্যাপারে আমি আপনাদের কি সাহায্য করতে পারি বলুন? আপনাদের ঐ সত্যসিন্ধুবাবুকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, কিছুদিন তো এখানে উনি যাতায়াত করেছেন, এখানকার হালচালও নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছেন। আমার সঙ্গে এই সঙ্ঘের ঐ প্রেসিডেন্টের পদটি ছাড়া আর বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। নতুন মেম্বার এলে তার পরিচয়টা করিয়ে দিই একবার হলঘরে এসে, নচেৎ হলঘরেই বলুন, বারই বলুন বা এ বাড়ির অন্য কোন জায়গাই বলুন, কখনও আমি পা বাড়াই না। বলে আবার বার দুই কাশলেন।
কিন্তু একটা কথা যে আপনার আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করে আবার।
বলুন?
এখানকার ডিসিপ্লিনের ব্যাপারটা যখন এঁরা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন
তা দিয়েছেন বটে। তবে সেটা একান্ত অফিস-সংক্রান্তই। কারোর ব্যক্তিগত গণ্ডি পর্যন্ত সেটা যেমন কখনও এক্রোচ করিনি এবং করার আমি প্রয়োজনও বোধ করিনি কোনদিন। এখানকার যারা মেম্বার, তারা সকলেই সম্ভ্রান্তবংশীয়, সমাজ বা সোসাইটিতে তাদের যথেষ্ট পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে। ভল-মন্দ বোঝবার তাদের নিজেদের বয়সও হয়েছে।
কিন্তু এ কথাটা কি সত্যি নয় মিঃ চক্রবর্তী যে, এ সঙ্ঘ গড়বার পিছনে নিশ্চয়ই কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে? প্রশ্ন করে আবার লাহিড়ীই।
উদ্দেশ্য আর কি! দশজনের কোন একটা জায়গায় মেলামেশার মধ্যে দিয়ে খানিকটা নির্দোষ আনন্দ লাভ করা!
শুধুমাত্র নিদোষ খানিকটা আনন্দই? আর কিছু নয়? জিজ্ঞাসা করে কিরীটী।
না। আমি যতদূর জানি তাই।
কিন্তু এখানে ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, ফ্ল্যাশও চলে শুনেছি? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
তা চলে একটু-আধটু।
একটু আধটু নয়। পুরোপুরি নাইট ক্লাবই এটা একটা।
নাইট ক্লাব বলে আপনি ঠিক কি মীন করতে চাইছেন জানি না মিঃ রায়, তবে আপনাদের তথাকথিত আইনভঙ্গের কোন ব্যাপারই এখানে ঘটে না। সেটা ভাল করে খোঁজ নিলেই একটু জানতে পারবেন। বলে আবার একটা কাশির ধমক যেন সামলে নিলেন মিঃ চক্রবর্তী।
নাইট ক্লাব বলতে ঠিক যা মীন করে, আমিও ঠিক তাই মীন করেছি মিঃ চক্রবর্তী। কিন্তু যাক সে কথা। আপনার এখানকার কাজটা কি পেইড? না অনারারী?
সম্পূর্ণ অনারারী, মিঃ রায়।
তাহলে এ সঙ্ঘের ওপর আপনারও একটা অন্তরের টান আছে বলুন! নইলে প্রতি রাত্রে এই বয়সে, বিশেষ করে আপনার এ নানাবিধ বোগজর্জর দেহ নিয়ে সাড়ে নটা থেকে রাত বারোটা একটা পর্যন্ত এখানে চেয়ারে বসে থাকেন কি করে?
আর একটা কাশির দমক সামলে নিয়ে মিঃ চক্রবর্তী বললেন, তা যে একেবারে নেই, বললে মিথ্যাই বলা হবে মিঃ রায়। কথাটা তাহলে খুলেই বলি। বিয়ে-থা করিনি, বাপ-পিতামহ জমিদারি করে বেশ কিছু অর্থও রেখে গিয়েছিল, একমাত্র বংশধর তাদের আমি। চিরকাল হেসে খেলে স্ফুর্তি করেই কাটিয়ে বছর সাতেক আগে গাঁয়ের বসবাস তুলে দিয়ে কলকাতায় যখন চলে আসি, সময় কাটছিল না, সেই সময়ই এখানকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সুখময়বাবুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এখানে এসে ঢুকি।
হুঁ, তারপর?
পরে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হওয়ায় এরা সকলে মিলে আমাকে ধরে বসল, প্রেসিডেন্টের পদটা আমাকে নেবার জন্য। ভাবলাম মন্দ কি, এমনিতেই তো এ বয়সে ঘুম কম। সময়টা কাটানো যাবে।
তা বেশ করেছেন। সময় ভালোই কাটাচ্ছেন, কি বলেন? প্রশ্ন করলেন আবার রজত লাহিড়ী।
আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ যদি শেষ হয়ে থাকে–
হ্যাঁ, আপাতত আপনি যেতে পারেন। বললে কিরীটী। কেবল একটা প্রশ্ন, সামনের শনিবার অশোক রায়ের সঙ্গে মিত্রা দেবীর বিবাহের সব স্থির হয়েছিল, জানেন কিছু?
না।
.
এবার এলেন মহারানী সুচরিতা দেবী।
বসুন মহারানী ঐ চেয়ারটায়। রজত লাহিড়ী বললেন।
মহারানী চেয়ারে বসবার পর কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনিই প্রথমে মিত্রা সেনের মৃতদেহ দেখতে পান, তাই না?
আমিই প্রথমে সকলকে হলঘরে এসে জানাই।
লক্ষ্য করলাম প্রশ্নটার জবাব একটু ঘুরিয়ে দিলেন মহারানী।
আজ রাত্রে কখন আপনি এখানে আসেন?
রাত পৌনে নটা হবে বোধ হয় তখন।
আপনি যখন হলঘরে এসে ঢোকেন আর কেউ সে ঘরে ছিলেন?
ছিল।
মনে আছে আপনার, কে কে ছিলেন তখন হলঘরে?
হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল, সুমিতা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক আর সুপ্রিয় গাঙ্গুলী।
আর কেউ ছিল না?
না।
তারপর আপনি হলঘর থেকে কখন বেরিয়ে যান?
মিনিট পনেরো বাদেই। মানে সওয়া নটা নাগাদ বলুন?
ঐ রকমই হবে।
কোথায় যান হলঘর থেকে বের হয়ে?
বার-রুমে।
সেখানে কতক্ষণ ছিলেন?
মিনিট পনের-কুড়ি হবে। মাথাটা সন্ধ্যা থেকেই ধরেছিল, তাই বার-রুমে গিয়ে একটা রাম ও লাইম খেয়েও যখন মাথাটা ছাড়ল না, বাগানে গিয়েছিলাম একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে।
সঙ্গে সে সময় আপনার কেউ ছিল, না একাই গিয়েছিলেন বাগানে?
একাই গিয়েছিলাম।
বার-রুমে যখন আপনি যান, সে সময় সে ঘরে আর কেউ ছিল?
ছিল।
কে?
রঞ্জিত রক্ষিত আর বিশাখা চৌধুরী।
আর কেউ ছিল না?
না।
অশোকরায় বামিত্রাসেনকে তাহলে আপনি হলঘর বাবার-রুমেকোথাও আজ দেখেননি?
না।
বেশ। তারপর বলুন বাগানে গিয়ে আপনি কি করলেন?
বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ এলোমোলো ভাবে ঘুরে বেড়াই, তারপর দক্ষিণ দিকের ঐ কুঞ্জের কাছাকাছি যেতেই মনে হল–
কি, থামলেন কেন? বলুন? কিরীটী তাড়া দিল মহারানীকে।
মনে হল একটা যেন দ্রুত পদশব্দ বাঁ দিককার বড় ঝোপটা বরাবর মিলিয়ে গেল। কিন্তু সে সময় অতটা খেয়াল হয়নি।
কেন?
কারণ বাগানে তো অনেকেই যেত, তাই ভেবেছিলাম হয়ত কেউ—
তারপর বলুন।
আর একটু এগুতেই আবছা চাঁদের আলোয় হঠাৎ নজরে পড়ল, বেঞ্চের ওপর একাকী বসে আছে যেন কে! প্রথমটায় চিনতে পারিনি। তাছাড়া যে বসেছিল তার সামনাসামনি যাবারও আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না। ফিরে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন মনটার মধ্যে কিছু বোধ হওয়ায় যে বসেছিল তার বসবার বিশেষ ভঙ্গীটি দেখে এগিয়ে গেলাম আরও একটু কাছে। এবারে মনের কিছুটা যেন আরও স্পষ্ট হল। যে বসে আছে, তার মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে যেন কি এক অসহায় ভঙ্গীতে। কাছে এগিয়ে যেতে এবারে চিনতে পেরেছিলাম, সে আর কেউ নয়, মিত্রা সেন। কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম
তার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে। সাড়া দেবার জন্য গলা-খাঁকারি দিলাম। কিন্তু অপরপক্ষ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। এবারে কেমন একটু যেন বিস্মিতই হলাম। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিস সেন! কোনো সাড়া নেই তবু। এই পর্যন্ত বলে মহারানী থামলেন।
বলুন, তারপর? আবার কিরীটী তাগিদ দিল।
আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে এবারে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন্! তবু সাড়া নেই। যেমন তিনি বুকের কাছে মাথা ঝুলিয়ে বসেছিলেন তেমনই রইলেন।
ঘুমিয়ে পড়েননি তোভেবে হাত বাড়িয়ে তাঁর গায়ে হাত দিয়ে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন! না, তবু সাড়া নেই। এবারে কেন জানি না হঠাৎ গা-টা যেন আমার কেমন ছমছম করে উঠল। চারদিকে একবার তাকালাম। আশেপাশে কেউ নেই। কেবল চাঁদের আলো ও অন্ধকারে আবছা একটা আলোছায়ার থমথমানি। ঠিক সেই মুহূর্তে কী আমার মনে হয়েছিল জানি না, পরক্ষণেই আঙুল দিয়ে তার কপাল স্পর্শ করতেই যেন মনে হল, কোনও মানুষের জীবন্ত শরীর নয়, অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রাণহীন কি একটা স্পর্শ লাগল আমার আঙুলের ডগায়। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল আমার। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নিজের অজ্ঞাতেই আবার শিউরে উঠে মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠে বললেন, that uncanny sensation! I will never forget and I cant explain you even what it was!
হঠাৎ চুপ করে গেলেন মহারানী।
সকলেই আমরা মহারানীর ভয়-বিহ্বল মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। স্তব্ধ ঘরটার মধ্যে কেবল ওয়াল-ক্লকের পেণ্ডুলামটার একঘেয়ে টকটক শব্দ হয়ে চলেছে।
কয়েকটি মুহূর্ত স্তব্ধতার মধ্যেই কেটে গেল।
বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তারপর আবার মহারানী বলতে শুরু করলেন, এবং যখন সম্বিৎ ফিরে এল হঠাৎ যেন মনে হল, মিস সেন বেঁচে নেই। সে মৃত। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্ধশ্বাসে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে আসি। সোজা একেবারে হলঘরে এসে ঢুকি। Now I find. she is really dead! সত্যিই সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু এখনও যেন আমি ভাবতে পারছি না মিঃ রায়, কী করে এ দুর্ঘটনাটা ঘটল আর কেনই বা ঘটল? কেন সে আত্মহত্যা করল?
কিন্তু আত্মহত্যা তো নয় মহারানী! বললে কিরীটী।
চমকে তাকালেন মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে। প্রশ্ন করলেন, আত্মহত্যা নয়? তবে—
নিষ্ঠুর হত্যা। Cold-blooded murder!
মার্ডার! She has been murdered! এ আপনি কী বলছেন, মিঃ রায়! How impossible!
আমার ধারণা আমি ঠিকই বলেছি। মিস্ সেনকে হত্যাই করা হয়েছে মহারানী।
কিন্তু কে তাকে হত্যা করবে, আর কেনই বা করবে? She was so nice! So Charming! সকলেই তাকে ভালবাসত।
আপনি হয়ত জানে না মহারানী, বুকভরা ভালবাসার অমৃত থেকেই অনেক সময় বিষের ফেনা গেঁজিয়ে ওঠে। তাছাড়া এখানে আপনারা যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁদের কার মনে কোন্ গোপন ভালবাসা, ব্যর্থতা, ক্রোধ, হিংসা বা বিদ্বেষ জমা হয়ে আছে তা জানবেন কি করে?
কিন্তু–
না, মহারানী! তা যদি না হত তো এমনি নিষ্ঠুর হত্যা তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে প্রকাশ পেত না। কিন্তু থাক সে কথা। আজ এই মুহূর্তে না হলেও, জানতে আমরা পারবই। আর একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করব।
বলুন।
জানতেন কি, অশোক রায় ও মিত্রা সেনের মধ্যে বিবাহের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গিয়েছিল?
Absured, impossible! বিশ্বাস করি না আমি।
সত্যিই হয়ে গিয়েছিল, রেজেস্ট্রি অফিসে পদের নাম পর্যন্ত রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছিল।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। একবর্ণও মিথ্যে নয়, যা আমি বললাম।
আশ্চর্য তো!
মাত্র একটি শব্দই নির্গত হল মহারাণীর কণ্ঠ হতে।
মহারানীর চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত আশ্চর্য শব্দটি ও সেই মুহূর্তের তাঁর চোখ ও মুখের চেহারা স্পষ্টই যেন আমার কাছে ব্যক্ত করল—বিস্ময়ই নয়, আরও একটা কিছু সেই সঙ্গে। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী যেন বুঝে উঠতে পারলাম না।
পরমুহূর্তে আবার কিরীটী প্রশ্ন করল মহারানীকে, তা এতে আশ্চর্য হবার কি আছেমহারানী? এত দিন পরে হয়ত মিস্ সেন তাঁর জীবনের যোগ্য সাথী খুঁজে পেয়েছিলেন, তাই তাঁরা বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন।
আজ যখন মিত্রা বেঁচে নেই তখন আসল কথাটা বলতে আর আমার দ্বিধা নেই মিঃ রায়। মিত্রাকে আমি দীর্ঘদিন থেকে জানি। এক সময় she was my classmate! সেই থেকে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার সুযোগ হয়। পুরুষ জাতটার প্রতিই she had a peculiar complex
কি রকম?
সে বলতো পুরুষের জন্মই নাকি মেয়েদের মন যোগানোর জন্য এবং যে কোনো পুরুষের চোখের সামনেই দেহের প্রলোম তুলে তাকে নাচানো যেতে পারে। আর সেইটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র নিষ্ঠুরতম খেলা বা সেই নিষ্ঠুরতম খেলার মধ্যে দিয়ে সে আনন্দলাভ করাটাই একমাত্র নেশা! স্ত্রীলোক হয়ে জন্মেও সে যে কত বড় হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল, আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম। আর সেই নিষ্ঠুর খেলায় শুধু অশোক রায় কেন, তার আগে অসীম বোস, সুধীর মিত্র প্রভৃতি কতজনার যে সে সর্বনাশ করেছে সে তো আমার অজানা নয়!
কথাগুলো বলতে বলতে একটা অবিমিশ্র ঘৃণা যেন মহারানীর কণ্ঠ হতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। আমরা সকলেই নিঃশব্দে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। কয়েকটা মুহূর্ত থেমে আবার মহারানী বলতে লাগলেন, তাই বলছিলাম অশোক রায় মিত্রার মৃত্যুর কথা জানতে পারলে, আজ দুঃখ পেলেও, পরে একদিন বুঝতে পারবে মিত্রার মৃত্যু was a blessing to him in disguise!
১৫. মহারানীর জবানবন্দির পর
মহারানীর জবানবন্দির পর ঘরে এসে ঢুকলেন শ্ৰীমন্ত পাল কিরীটীরই নির্দেশে।
শ্ৰীমন্ত পালকে চেয়ারে বসতে বলে সোজাসুজিই কিরীটী তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি আজ এখানে কখন এসেছেন মিঃ পাল?
আজ অন্যান্য দিনের চাইতে একটু তাড়াতাড়িই এসেছিলাম। বোধ হয় তখন রাত সাড়ে আটটা কি আটটা চল্লিশ হবে।
অন্যান্য দিন আরও দেরিতে আসেন?
হ্যাঁ, অফিসের কাজকর্ম সেরে আসতে আসতে প্রায় নটা দশটা বেজে যায়।
আচ্ছা আজ যখন আসেন তখন কাকে কাকে হলঘরে দেখেছিলেন, মনে আছে?
হলঘরে তখন তিনজন ছিল। সুমিতা চ্যাটার্জী ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী, আর ছিল ওয়েটার মীরজুমলা।
ওঁরা দুজন বুঝি গল্প করছিলেন?
হ্যাঁ, সুপ্রিয়র next production-এর নায়িকার রোলে অভিনয় করবার জন্য কনট্রাক্ট করেছে সুমিতা, সেই সম্পর্কেই ওঁরা আলোচনা করছিলেন।
আর মীরজুমলা তখন হলঘরে কি করছিল?
ওদের কোল্ড ড্রিঙ্ক দিতে এসেছিল। দিয়ে চলে গেল।
তারপর কতক্ষণ আপনি ঐ হলঘরে ছিলেন?
তা ঘণ্টা দুই হবে। সুব্রতবাবু আসা পর্যন্ত।
ঐ সময়ের মধ্যে একবারও আপনি হলঘর ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি?
না।
ঠিক মনে আছে আপনার?
হ্যাঁ।
মহারানী সুচরিতা দেবী কখন হলঘরে আসেন, মনে করে বলতে পারেন?
বোধহয় তখন রাত নটা আন্দাজ হবে। সঠিক আমার মনে নেই।
আচ্ছা বাইরে থেকে কি তিনি হলঘরে এসে ঢোকেন?
না। মনে হচ্ছে দুনম্বর দরজা দিয়েই যেন হলঘরে এসে ঢুকতে তাঁকে আমি দেখেছিলাম।
সঠিক আপনার মনে আছে? ভেবে আর একবার ভাল করে বলুন মিঃ পাল।
মুহূর্তকাল ভেবে নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে মিঃ পাল এবারে বললেন, হ্যাঁ, আমার মনে আছে। দু নম্বর দরজা দিয়েই তিনি হলঘরে ঢুকেছিলেন।
হুঁ। একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে, তারপর কতক্ষণ তিনি হলঘরে ছিলেন, মনে আছে?
তা মিনিট দশ-পনেরোর বেশী হবে বলে মনে হয় না।
আচ্ছা সুব্রত হলঘরে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত আর কাকে কাকে তাহলে আপনি এখানে আসতে দেখেছেন মিঃ পাল?
এক এক করে সকলেই এসেছেন তারপর, রমা মল্লিক, মনোজ, সুধীরঞ্জন, নিখিল ভৌমিক–
আর কাউকে আসতে দেখেননি? মিত্রা সেন, অশোক রায় বা বিশাখা চৌধুরীকে?
অশোক রায় বা মিত্রা সেনকে দেখিনি, তবে বিশাখা চৌধুরী বোধ হয় আমারও আগেই এসেছিলেন মহারানীর মতই। কারণ মনে পড়ছে, তাঁকেও মহারানীর আগেই দুনম্বর দরজা দিয়ে হলঘরে ঢুকতে দেখেছিলাম।
আচ্ছা, ওদের দুজনের মধ্যে কে আগে হলঘরে ঢুকেছিল দুনম্বর দরজা দিয়ে মিঃ পাল, মহারানী না বিশাখা চৌধুরী?
আগে বিশাখা, তার মিনিট কয়েক পরেই মহারানী ঢোকেন হলঘরে।
আচ্ছা মিঃ পাল, আপনি কতদিন এই সঙ্ঘে যাতায়াত করছেন?
তা বছর তিনেক তো হবেই।
তাহলে তো দেখছি আপনি এই বৈকালী সঙ্ঘের একজন পুরাতন মেম্বার?
তা বলতে পারেন এক দিক দিয়ে। তবে আমার চাইতে পুরাতন মেম্বার এখানে আরো আছেন।
আপনার চাইতেও পুরাতন মেম্বার এখানে আর কে কে আছেন মিঃ পাল?
প্রথমেই ধরুন মহারানী। বলতে গেলে She is the oldest! তাঁর সমসাময়িক ছিলেন মিত্রা সেন। শুনেছি দু-চার মাস এদিক-ওদিক এখানে এসেছেন তাঁরা। তারপর শুনেছি মীরা চৌধুরী, তিনিও আমার আগেই এসেছেন এখানে।
মীরা চৌধুরী? তাঁকে কখনও এখানে আজ পর্যন্ত দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না মিঃ পাল! কথাটা এবার বললাম আমিই।
আমার দিকে ফিরে তাকালেন শ্ৰীমন্ত পাল। তারপর মৃদু হেসে বললেন, না সুব্রতবাবু, দেখেননি। কারণ তিনি মাস দুই হবে এখানে আর আসছেন না।
কেন? এ সঙ্ঘ কি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন? প্রশ্নটা করলেন কিরীটী।
তা ঠিক বলতে পারি না, মিঃ রায়। আপনার এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবেন আমাদের প্রেসিডেন্ট।
কি রকম? কাউকে এখান থেকে সরাতে হলে কি আপনাদের প্রেসিডেন্টই final authority?
সেই রকমই তো আমার মনে হয়। কিরীটীর প্রশ্নের জবাবে শ্ৰীমন্ত পাল বললেন।
কেন?
কারণ এখানকার ভাল-মন্দ শুভাশুভের জন্য আমাদের প্রেসিডেন্ট যতখানি দায়ী আর কেউ ততখানি দায়ী বলে তো আমার মনে হয় না।
আর একটা কথা মিঃ পাল, এই বাড়িতে প্রবেশের মেইন গেট ছাড়া অন্য কোন দ্বারপথ আছে বলে আপনি জানেন?
যতদূর জানি প্রবেশ ও নির্গমের এ বাড়িতে একটিমাত্র দ্বার ছাড়া দ্বিতীয় কোন দ্বারপথ নেই মিঃ রায়।
তারপর আবার কয়েকটা মুহূর্ত নিস্তব্ধতার মধ্যেই কেটে যায়।
উপস্থিত ঘরের মধ্যে সকলেই যেন অত্যন্ত চুপচাপ।
হঠাৎ আবার সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটীই কথা বলে।
বললে, হ্যাঁ, ভাল কথা মিঃ পাল, আপনি জানতেন কি মিত্রা সেন ও অশোক রায়ের বিবাহের সব স্থির হয়ে গিয়েছিল?
সে কি! কই না! রীতিমত একটা বিস্ময়ের সুরই যেন প্রকাশ পায় মিঃ পালের কণ্ঠস্বরে।
জানতেন না? শোনেননি?
না। এই প্রথম শুনছি। আর শুনলেও বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন বলুন তো?
মিত্রা সেন কাউকে কোনোদিন বিবাহ করতে পারতেন এ আমি ভাবতেও পারি না মিঃ রায়।
ভাবতেও পারেন না! কিন্তু কেন বলুন তো মিঃ পাল?
কারণ তিনি ছিলেন আমার মতে এমন এক জাতীয় মেয়েমানুষ যাঁরা ঠিক অনেকটা হংসের মত, সর্বক্ষণ জলে থাকলেও গায়ে জলবিন্দুটিও বসে না। পুরুষ জাতটার সব কিছুই তাঁর কাছে ছিল ঐ জলেরই মত।
হুঁ, আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন মিঃ পাল। হ্যাঁ, দয়া করে নীচের তলায় যে বেয়ারাটি থাকে তাকে যদি একবার পাঠিয়ে দেন! কি যেন তার নামটা?
আপনি শশীর কথা বলছেন? আচ্ছা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
নীচের রিসেপশন রুমের বেয়ারা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
কি নাম তোমার?
আজ্ঞে স্যার, শশী হাজরা।
তোমার ডিউটি নীচের রিসেপশন ঘরে বুঝি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ স্যার।
কতক্ষণ থাকতে হয় তোমার সেখানে?
রাত আটটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
প্রতি রাত্রেই তুমি থাক?
হ্যাঁ।
তোমার কোনরকম অসুখ-বিসুখ করলে?
আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি স্যার।
এখানে তুমি কতদিন কাজ করছ শশী?
সাত বছর স্যার।
সাত বছর! মিঃ চক্রবর্তী শুনেছি এখানকার প্রেসিডেন্ট গত সাত বছর ধরে। তুমি আর তিনি কি তাহলে একসঙ্গেই এখানে আস? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, কতকটা তাই বটে। প্রেসিডেন্টই আমাকে আর মীরজুমলাকে এখানে কাজ দেন স্যার। তোমাদের দুজনকে বুঝি তিনি আগে থাকতেই চিনতেন?
হঠাৎ এবারে কিরীটীর প্রশ্নে শশী যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললে, আজ্ঞে না, ঠিক তা নয়, এখানকার দারোয়ানের মুখে এখানে লোকের প্রয়োজন শুনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করি, তিনি তখন কাজ দেন।
দেখা করার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার এখানে কাজ হয়ে গেল, সঙ্গে কারও জোরালো সার্টিফিকেট ছিল বুঝি তোমার শশী?
সাটিফিকেট?
হ্যাঁ?
কই না!
তবে এমন একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠানে চাওয়া মাত্রই কাজ পেয়ে গেলে? আগে কোথায় কাজ করতে?
আগে আর কোথায়ও কখনও কাজ করিনি।
এইখানেই প্রথম?
হ্যাঁ।
ভাগ্যবান তুমি শশী! এই চাকরির অভাবের বাজারে চাওয়া মাত্রই কাজ পেয়ে গেলে! তা মাইনে কত পাও?
ষাট টাকা।
তুমি দেখছি ডবল ভাগ্যবান! তা থাক কোথায়? কোথাকার লোক তুমি? এর আগে কলকাতাতেই বরাবর ছিলে নাকি?
পর পর কিরীটীর প্রশ্নগুলো যেন শশী হাজরাকে বেশ একটু বিচলিত করে তোলে। কিন্তু লোকটা দেখলাম বেশ চালাক-চতুর। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ভাগ্যবান যদি বলেন তো স্যার, তাও আপনাদেরই শ্রীচরণেরই দয়া। আপনারা শ্রীচরণে আশ্রয় না দিলে কে আমাদের মত গরিব-দুঃখীকে দেখবে বলুন? প্রেসিডেন্ট সাহেব এখানকার বিচক্ষণ ও মহৎ। মানুষ চেনেন তিনি। চাকরির আগে অবিশ্যি থাকতাম বেলেঘাটায় এক বস্তিতে। তারপর এখানে চাকরি হবার মাস দুই পর থেকে এখানেই থাকবার হুকুম পেয়েছি। এখন এখানেই থাকি। বাড়ি আমার মেদিনীপুর জেলায়, পাঁশকুড়া থানা।
হুঁ। আর মীরজুমলা? সেও এখানেই থাকে?
হ্যাঁ। নীচের ঘরে আমি, দারোয়ান, মীলজুমলা—তিনজনে থাকি।
আচ্ছা শশী, বলতে পার আজ কে কে এখানে এসেছিলেন রাত্রে? এবং পর পর কে কখন এসেছেন?
ঠিক তো স্মরণ নেই স্যার! কে কখন এসেছেন—
যতটা পার স্মরণ করেই বল।
শশী হাজরা অতঃপর মনে মনে কী যেন ভেব নিল। তারপর মৃদুকণ্ঠে থেমে থেমে বলতে শুরু বলতে–
সর্বপ্রথমে আসেন মিস সেন। তারপর—
মানে মিত্রা সেন?
হ্যাঁ।
তারপর?
তারপর বিশাখা চৌধুরী, তারপর বোধ হয় অশোকবাবু। তারপর—
অশোকবাবু তাহলে আজ রাত্রেও এসেছিলেন? বাধা দিল কিরীটী।
হ্যাঁ স্যার।
কখন তিনি আবার তাহলে চলে গিয়েছেন?
তা রাত তখন পৌনে নটা হবে বোধ হয়।
আচ্ছা মনে করে বলতে পার তিনি কখন এসেছিলেন আজ এখানে?
রাত আটটার দু-পাঁচ মিনিট পরেই হবে স্যার।
কি করে বুঝলে?
তারই কিছু আগে নীচের ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত আটটা বাজতে শুনেছিলাম। তাতেই মনে আছে স্যার সময়টা।
হ্যাঁ, আর মিত্রা সেন?
তার মিনিট দশেক পরে।
আর বিশাখা চৌধুরী?
তার দু-পাঁচ মিনিট পরেই।
মহারানী কখন এসেছেন?
ঐ বিশাখা চৌধুরীর কয়েক মিনিট বাদেই স্যার।
তোমাদের প্রেসিডেন্ট?
রাত দশটায়।
সাধারণত রাত কটা নাগাদ তোমাদের প্রেসিডেন্ট এখানে আসেন শশী?
তার কোন ঠিক নেই। তবে পৌনে দশটা থেকে দশটার মধ্যেই আসেন বরাবর দেখছি।
আচ্ছা শশী, বলতে পার, এখানে যাঁরা আসেন সাধারণত তাঁদের ভেতরে ঢুকতে হলে কি ওপরের হলঘরের মধ্যে দিয়েই ঢুকতে হয়?
না। তা কেন হবে? হলঘরের দরজার মুখেই ডান দিকে যে ঘরটা আছে, তার মধ্যে দিয়েও ঢুকে প্যাসেজ দিয়ে আর একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে চার নম্বর দরজা দিয়েও তো ইচ্ছে করলে হলঘরে ঢুকতে পারা যায় স্যার। প্রেসিডেন্টের ঘর থেকেও তিন নম্বর বা চার নম্বর দরজা দিয়েও হলঘরে ঢোকা যায়। আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব তো কখনও হলঘর দিয়ে ঢোকেনই না স্যার। ঐ প্যাসেজ দিয়ে সোজা তাঁর ঘরে চলে যান আবার সেই রাস্তা দিয়েই বের হয়ে আসেন।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার, মীরজুমলাকে এবারে পাঠিয়ে দাও।
সেলাম জানিয়ে শশী বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
শশী ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই পকেট থেকে কাগজের উপরে আঁকা ঐ বাড়িটার একটা নকশা বের করে আমি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, এই নে কিরীটী, আমি এ বাড়ির একটা নকশা গতকাল বসে বসে এঁকেছিলাম। এ বাড়ির সব কিছু সন্ধান এর মধ্যেই পাবি।
কিরীটী আমার হাত থেকে নকশাটা নিয়ে আলোর সামনে মেলে ধরল। থানার ও. সি. আলোর সামনে মেলে ধরল। থানার। রজত লাহিড়ীও নকশার উপর ঝুঁকে পড়লেন।
পদশব্দ শোনা গেল আবার দরজার ওপাশে। মকশার উপর চোখ রেখেই কিরীটী বলে, মীলজুমলাকে আসতে বল সুব্রত ঘরে।
আমিই মীরজুমলাকে ঘরে ডাকলাম।
১৬. মীরজুমলা
তোমার নাম মীরজুমলা? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
জী
দেশ কোথায়?
ঢাকা জিলা।
বাঙালী তুমি?
হ্যাঁ।
তুমি আর শশী এখানে সাত বছর কাজ করছ, তাই না?
শশী বলেছে বুঝি?
যেই বলুক, কথাটা সত্যি কিনা?
একটু ইতস্তত করে মীরজুমলা বললে, হ্যাঁ।
তবে একটু আগে ও কথা বললে কেন মীলজুমলা?
আজ্ঞে মানে লোক বড় মিথ্যাবাদী কিনা তাই—
হুঁ, আচ্ছা আজ রাত্রে এখানে অশোক রায় এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
মিস সেনের আগে না পরে?
কয়েক মিনিট পরেই বোধ হয়।
তারপর অশোক রায় কখন চলে যান জান কিছু?
না। দেখিনি।
অশোক রায় ও মিত্রা সেনকে তুমি কোথায় দেখ?
মিস সেন এসেই নীচে বাগানে চলে যান, আমি তখন হলঘরে। যাবার সময় বলে যান আমাকে, অশোকবাবু এলে তাঁকে বাগানে পাঠিয়ে দেবার জন্য।
অশোক রায় এলে তুমি বলেছিলে তাঁকে সে কথা?
হ্যাঁ। বলেছি বৈকি।
তুমিই তো এখানে সকলকে ড্রিঙ্ক সরবরাহ কর মীরজুমলা?
হ্যাঁ।
মিত্রা সেন ড্রিঙ্ক করতেন?
না।
কখনো ড্রিঙ্ক করেননি?
না।
অশোক রায়?
করতেন মধ্যে মধ্যে।
মহারানী?
করতেন প্রত্যহ।
বিশাখা চৌধুরী?
প্রত্যহ করতেন।
আজ ওঁরা কেউ ড্রিঙ্ক করেছিলেন?
বিশাখা চৌধুরী ও মহারানী করেছেন।
তুমি দেখেছিলে আজ মহারানী ও বিশাখা চৌধুরীকে আসতে?
মহারানীকে দেখেছি, কিন্তু বিশাখা চৌধুরীকে দেখিনি।
কেন? তুমি তখন কোথায় ছিলে?
বারে।
আচ্ছা আপাতত তুমি যেতে পার। রঞ্জনবাবুকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও।
যে আজ্ঞে।
মীরজুমলা চলে গেল।
মীরজুমলা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, লাহিড়ী সাহেব, প্রত্যেককে আমি আমার যা জিজ্ঞাসা করবার জিজ্ঞাসা করছি বলে আপনার কাউকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে কিন্তু চুপ করে থাকবেন না।
না, না—আপনিই জিজ্ঞাসা করুন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে নোট করে যাচ্ছি প্রত্যেকের জবানবন্দি। সেরকম কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু আপনি যেখানে জিজ্ঞাসা করছেন সেখানে কোন প্রশ্ন তোলার কোনরকম প্রয়োজন থাকতে পারে বলে তো
আমার মনে হয় না। মৃদু হেসে কথাটা শেষ করেন লাহিড়ী।
তাই বলে সব দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে চাপাবেন নাকি?
এতবড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি! হাসতে হাসতে জবাব দেন লাহিড়ী আবার।
আসুন রঞ্জনবাবু!
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে যে ব্যক্তি প্রবেশ করলেন তাঁকে আহ্বান জানাল কিরীটী।
রোগাটে চেহারার ভদ্রলোক, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দু-তিন ইঞ্চির বেশী হবে না। পরিধানে দামী স্যুট। বেশভূষা ও চেহারার মধ্যে একট সযত্নরক্ষিত পরিচ্ছন্নতা। বয়স চল্লিশের কোঠা প্রায় পার হতে চলেছে বলেই মনে হয়৷
মাঝখানে সিঁথি করে চুল ব্যাকব্রাশ করা। ছোট কপাল, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় দৃষ্টি বেশ তীক্ষ্ণ ও সজাগ। নাকটা একটু চাপা।
রঞ্জন রক্ষিত ঘরে ঢুকেই বললে, হলঘরে ওঁরা সব অস্থির হয়ে উঠেছেন। কতক্ষণ আর তাঁদের এভাবে আপনারা আটকে রাখতে চান, ওঁরা জানতে চাইছেন।
জবাব দিল কিরীটীই, সুব্রত, ওঘরে গিয়ে বলে আয় যাঁদের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে তাঁরা আপাতত যেতে পারেন বটে যে যার বাড়ি কিন্তু পুলিশ কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে আপাতত তাঁরা কেউ কলকাতা ছেড়ে যেতে পারবেন না। কি বলেন লাহিড়ী সাহেব?
হ্যাঁ, তাই বলে আসুন সুব্রতবাবু। আর অসুবিধা না হলে প্রত্রেকের বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে নেবেন ওঁরা যাবার আগে।
বললাম, প্রত্যেকের ঠিকানা তো প্রেসিডেন্টের খাতা থেকেই পাওয়া যেতে পারে!
তবে তো কথাই নেই, they can go now। যেতে পারেন তাঁরা।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে পাশের হলঘরে গিয়ে ঢুকলাম কিরীটী তথা লাহিড়ী সাহেবের নির্দেশটা জানিয়ে দেবার জন্য।
ঘরের মধ্যে ছত্রাকার ভাবে বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বাররা সকলে এদিক-ওদিক বসে ফিসফিস করে কি যেন সব আলোচনা করছিলেন পরস্পর নিজেদের মধ্যে, আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই অকস্মাৎ তাঁদের আলোচনার গুঞ্জনটার মধ্যে যেন একটা ছেদ পড়ল।বুঝলাম পরস্পরের মধ্যে আলোচনারত প্রত্যেকেরই মনটা পড়েছিল এক নম্বর দরজার দিকেই। যুগপৎ অনেকগুলো চোখের সপ্রশ্ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন এসে সর্বাঙ্গে ছুঁচের মত বিদ্ধ হল।
আমি গম্ভীর হয়ে মৃদুকণ্ঠে রজত লাহিড়ী তথা কিরীটীর নির্দেশটা জানিয়ে দিয়েই সকলের মুখের উপর দিয়েই দ্রুত দৃষ্টি একবার বুলিয়ে নিলাম।
আমার কথার কেউ কোন জবাব না দিলেও, অনেকের মুখেই যে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল সেটা আমার দৃষ্টিতে এড়াল না।
নিঃশব্দে যেমন আমি হলঘরে প্রবেশ করেছিলাম তেমনিই নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে এসে পূর্বোক্ত বার-রুমে ঢুকলাম।
১৭. ঘরে ঢুকে শুনি রঞ্জন রক্ষিত
ঘরে ঢুকে শুনি রঞ্জন রক্ষিত কিরীটীর কোন একটা প্রশ্নের জবাবে তখন বলছেন, সে আপনি যাই বলুন না মিঃ রায়, আমি তবু বলব রীতিমত এটা একটা টরচার। বিশেষ করে এখানে যাঁরা মহিলারা উপস্থিত আছেন, just think of them, ভেবে দেখুন তাঁদের কথা।
কিন্তু এভাবে প্রশ্ন না করা ছাড়া আমাদের উপায়ই বা কি বলুন মিঃ রক্ষিত! কিরীটী বলে।
কেন, আপনারা কি মনে করেন এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন তাঁদের মধ্যে কেউই মিস সেনকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়ে তাঁর হাতে বিষের পাত্র তুলে দিয়েছিলেন? তাই যদি ভেবে থাকেন তো বলব, এটা যেমন অ্যাবসার্ড তেমনি হাস্যকর। ভুলে যাবেন না মিঃ রায়, এখানে যাঁরা আসেন বা আজ রাত্রে উপস্থিত আছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা বংশপরিচয়, সমাজ ও শিক্ষা, কৃষ্টির ঐতিহ্য আছে। প্রত্যেকেই তাঁরা কালচার্ড সোসাইটি থেকে এসেছেন।
কথাটা আমি আপনার নিশ্চয় অবিশ্বাস করছি না মিঃ রক্ষিত। কারণ প্রথমত যে দুর্ঘটনার সঙ্গে আপনারা সকলে সাক্ষাৎ বা পরোক্ষ ভাবেই বলুন জড়িত হয়ে পড়েছেন, আজ এখানে সেটা আইনের চোখে অপরাধমূলক বলেই এ ধরনের জবানবন্দি পুলিসের কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে আপনারা বাধ্য, তা সে আপনাদের ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক। অবশ্য ইচ্ছে করলে আপনারা চুপ করে থাকতে পারেন, যেটা বলব সম্পূর্ণ যে যাঁর আপনাদের নিজ নিজ রিস্কে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা সমাজ বা পরিচয়ের যে নজির আপনি তুলেছেন তার জবাবে এইটুকুই আমি বলতে পারি, পাপকে কি আজও আমরা শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজ-পরিচয়ের দিক থেকে গণ্ডী দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছি? কিন্তু যাক সে কথা, আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব পেলে সুখী হব!
সে আপনি চাইবেন না কেন মিঃ রায়, আমি কিন্তু তবু বলব, মানুষের নার্ভের ওপরে এ আপনাদের নিছক একটা জুলুম।
জুলুম!
নিশ্চয়ই।
জুলুম যদি হয়ও মিঃ রক্ষিত, আমার প্রশ্নগুলোর জবাব আপনাদের কাছ থেকে আমার পাবার চেষ্টা করতেই হবে। এখন কথা হচ্ছে আপনি আমার সেই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে রাজী আছেন কিনা?
মুহূর্তকাল গম্ভীর হয়ে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে মিঃ রক্ষিত নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, বেশ বলুন, কি জানতে চান আপনারা আমার কাছ থেকে?
কিরীটী প্রত্যুত্তরে এবারে মৃদু হেসে তার প্রশ্ন করল। বললে, আজ রাত্রে আপনি কখন এখানে এসেছেন?
আমি এখানে মশাই নিয়মিত যাকে বলে আসি না। মধ্যে মধ্যে আসি।
সে প্রশ্ন তো আপনাকে আমি করিনি, আমি জিজ্ঞাসা করেছি আজ রাত্রে কখন আপনি এসেছেন?
তা ঠিক সময়টা আমার মনে নেই।
আন্দাজ করেই না হয় বলুন। দু-চার মিনিট এদিক-ওদিক হলেই বা।
মুশকিলে ফেললেন মশাই। এমনি করে আজ সময়ের জবাবদিহি করতে হবে জানলে কারেক্ট টাইমটাই দেখে রাখতাম।
বেশ আপনাকেই আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি মিঃ রক্ষিত, একটা ব্যাপার আজকের রাত্রের, তা থেকে হয়ত আজ রাত্রে এখানে কখন এসেছেন টাইমটা আপনার মনে পড়তে পারে। রাত নটা নাগাদ আজ আপনি ও বিশাখা চৌধুরী বার-রুমে ছিলেন, মনে পড়ছে?
দাঁড়ান দাঁড়ানমশাই, আমার আজরাত্রেরমুভমেন্টের অনেক ডিটেলসইতোদেখছি আপনারা ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে বসে আছেন! ভাল। তা ছিলাম। বিশাখার সঙ্গে বসে দুটো পেগ ড্রিঙ্ক করেছি বটে এখানে এসে। কিন্তু সেটা যে ঠিক রাত নটার সময়ই তা হলফ করে বলি কি করে বলুন?
বেশ। সে যাক। বার-রুমে যাবার কতক্ষণ আগে আপনি আজ এখানে আসেন—পনের-বিশ মিনিট, আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা?
তা বোধ হয় রাত সাড়ে আটটা হবে। দু-চার মিনিট আগে বা পরেও হতে পারে।
আপনি সোজা হলঘরে এসেই ঢোকেন তো?
হ্যাঁ, সেটা আমার মনে আছে।
সে সময় হলঘরে কে কে ছিল আপনার মনে আছে মিঃ রক্ষিত?
বিশাখা চৌধুরী আর অশোক রায় ছিল হলঘরে।
অশোক রায় ছিলেন হলঘরে সে সময়?
তাই আমার মনে হয়। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দেখেছিলাম তাকে দুনম্বর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তার পিছনটা আমি দেখেছিলাম।
তাহলে আপনি সিওর নন যে, তিনিই অশোক রায় কিনা?
বা রে! অশোক রায়কে আমি চিনি না? অশোক রায়ই। তার হাঁটবার ভঙ্গীটুকু পর্যন্ত যে আমার পরিচিত।
অশোক রায়ের সঙ্গে তাহলে কি আপনার এই সঙ্ঘ ছাড়াও অন্যরকম ভাবে জানাশোনা ছিল?
ছিল বৈকি। শেয়ার মার্কেটে যাদের যাওয়া-আসা আছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার বিশেষ পরিচয় আছে।
সত্যি আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আপনি শেয়ার মার্কেটের একজন বিশেষ পরিচিত। আপনার বুঝি অফিস আছে কোনো?
হ্যামডেন অ্যাণ্ড রক্ষিত কোম্পানির আমিই তো মেজর শেয়ারহোল্ডার।
হুঁ, আচ্ছা মিঃ রক্ষিত, আপনার তো শেয়ার মার্কেটের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় আছে। এখানে যাঁরা আসা-যাওয়া করেন, মানে আপনাদের এখানকার এই মেম্বারদের মধ্যেকার কার কার শেয়ার মার্কেটে যাতায়াত আছে বা শেয়ার সম্পর্কে কারা ইনটারেসটেড-নামগুলো যদি বলেন?
এখানকার অনেকেই তো শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে ইনটারেসটেড-অশোক রায়,মনোজ দত্ত, মহারানী, সুধীরঞ্জন, নিখিল ভৌমিক!
আপনাদের প্রেসিডেন্ট?
Dont talk about him, a hopeless fellow! ও জানে শুধু টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাব করতে আর নিজের ঘরের মধ্যে গুম হয়ে নিজের ধার-করা vanity নিয়ে বসে থাকতে!
কিরীটী রঞ্জন রক্ষিতের কথায় মৃদু হাসে। তারপর আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা আপনার অফিসে যাতায়াত আছেবাইরের এমন দু-চারজনইনফ্লুয়েনসিয়াললোকেরনাম করতে পারেন?
কেন পারব না! অনেক মহাত্মাই তো শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে ইনটারেসটেড!
যথা?
এই ধরুন না ব্যারিস্টার ব্রজেন সোম, সলিসিটার আর. এন. মিত্র, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
হঠাৎ রঞ্জন রক্ষিতের মুখে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর নামটা শুনে চমকে ওঠে যেন কিরীটী, কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবটা সামলে নেয়।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীকে আপনি তাহলে চেনেন?
খুব ভাল ভাবেই চিনি। চমৎকার লোক।
কিন্তু তিনি তো শুনেছি অত্যন্ত busy ডাক্তার। তা তিনি এসবের সময় পান?
হুঁ, জানেন নাতো শেয়ার মার্কেটের একজন পোকা বললেও চলে লোকটাকে! তিনটে-চারটে নাগাদ প্রত্যহ একবার যানই আমার অফিসে। নেহাৎ না যেতে পারলে টেলিফোন করেন।
যাক সে কথা। আপনি যে একটু আগে বলছিলেন হলঘরে ঢুকে আজ আপনি বিশাখা চৌধুরীকে দেখেছিলেন, তিনি তখন হলঘরে কি করছিলেন?
একটা সোফার ওপরে বসে ছিলেন চুপটি করে। আমার যাবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন মিঃ রক্ষিত, I was waiting for you! বললাম, সে কি? তার জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যা থেকেই কেমন যেন একটু dull লাগছে, কিছু ভাল লাগছে না। চলুন একটু ড্রিঙ্ক করা যাক। যদি আপনার আপত্তি না থাকে। অগত্যা কি আর করি বলুন? একজন ভদ্রমহিলা ড্রিঙ্ক অফার করছেন! দুজনে গিয়ে ঢুকলাম বারে।
তারপর?
তারপর বোধ হয় আধঘণ্টা সেই ঘরেই বসে দুজনে ড্রিঙ্ক করেছি।
আপনারা যে-সময় বারে বসে ড্রিঙ্ক করছিলেন তখন মহারানী সে ঘরে এসেছিলেন?
কে, মহারানী?
হ্যাঁ!
মনে হচ্ছে যেন একবার এসেছিলেন।
কতক্ষণ সেখানে ছিলেন মহারানী?
তা ঠিক মনে নেই।
বিশাখা চৌধুরী আপনার সঙ্গে বার-রুমে কতক্ষণ ছিলেন?
মাঝখানে মনে পড়ছে ড্রিঙ্ক করতে করতে মিনিট পনেরো-কুড়ির জন্য বোধ হয় একবার উঠে যান বার থেকে। তারপর আবার এসে বসেন।
অশোক রায় বা মিত্রা সেনকে সামনাসামনি আপনি আজ রাত্রে একবারও দেখেছেন?
না।
আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন। দয়া করে বিশাখা চৌধুরীকে একবার এ ঘরে যদি পাঠিয়ে দেন!
দিচ্ছি।
রঞ্জন রক্ষিত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
এবারে ঘরে এলেন বিশাখা চৌধুরী।
কিরীটী তাঁকে আহ্বান জানাল, আসুন মিসেস চৌধুরী, বসুন।
নির্দিষ্ট চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বিশাখা চৌধুরী একবার তেরছা ভাবে তীব্ৰদৃষ্টিতে যেন আমার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে সে-সময় আমার প্রতি আর যাই থাক ভালবাসা যে বিন্দুমাত্রও ছিল না সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। এবং কেন জানি না, তাঁর দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টি মিলতেই চোখটা আমি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম।
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে আবার চমকে ফিরে তাকালাম।
কিরীটী বিশাখা চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বলছে, সুব্রতর ওপরে যেন আপনি অবিচার করবেন মিসেস চৌধুরী। আপনাকে আমি এ-কথা হলপ করে বলতে পারি, আপনার প্রতি ওর গত কদিনের ব্যবহারের মধ্যে আর যাই থাক, এতটুকু প্রতারণাও ছিল না। আর ছদ্মবেশে ওর এখানে আসাটা ওর নিজের ইচ্ছায় ঘটেনি, আমরাই পরামর্শ মত!
থাক, ওঁর কথা আর বলবেন না। একটা যেন অতর্কিত থাবা দিয়েই কিরীটীর বক্তব্যটা অর্ধপথে থামিয়ে দিলেন বিশাখা চৌধুরী। তারপরই বললেন, আপনাদের সমস্ত ব্যাপারটা তাহলে pre-arranged! আগে থেকেই সব প্ল্যান করা ছিল!
সত্যি কথা বলতে গেলে, কতকটা হ্যাঁ-ও বটে, আবার কতকটা না-ও বটে। যাক সে কথা। আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেন।
সাধ্য হলে দেব।
অবিশ্যি আপনার সাধ্যের বাইরে কোন প্রশ্ন আমি করব না।
দেখুন মিঃ রায়, আমার ঘণ্টাখানেক ধরে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, যা আপনার জিজ্ঞাস্য আছে একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে আমাকে ছেড়ে দিলে বিশেষ বাধিত হব।
মিসেস চৌধুরী—
প্লিজ। আমাকে বিশাখা চৌধুরী বলে ডাকলেই বাধিত হব।
স্যরি। আচ্ছা আপনি আজ কখন এখানে আসেন?
সোয়া আটটা কি আটটা বিশ হবে।
সোজা আপনি হলঘরে এসেই ঢোকেন তো?
হ্যাঁ।
হলঘরে তখন আর কেউ ছিল?
ছিল, অশোক রায়।
আর মিত্রা সেন?
না, তাকে দেখিনি।
মিত্রা সেনকে আজ একবারও দেখেননি?
না।
মহারানীকে দেখেছিলেন কখন প্রথম?
ঠিক মনে করে বলতে পারছি না। দুঃখিত।
মহারানীকে হলঘরে এসে মিত্রা সেনের মৃত্যুসংবাদ দেবার আগে একবারও দেখেছেন কিনা আপনার মনে পড়ছে না?
না।
আচ্ছা মিঃ রক্ষিতের সঙ্গে এই ঘরে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে আপনি নাকি উঠে বাইরে কোথায় মিনিট পনের-কুড়ির জন্য গিয়েছিলেন, তারপর আবার এই ঘরে ফিরে আসেন, কথাটা কি সত্যি?
Funny! কে আপনাকে এ কথা বলেছে মিঃ রায়? আমি এ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর আর তো এ ঘরে ফিরে আসিনি? আমি এ ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে হলঘরেই ছিলাম।
এ ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার আপনি এ ঘরে ফিরে আসেননি তাহলে?
Certainly not!
কিন্তু যদি বলি আজ রাত্রে মিত্রা সেনের মৃতদেহ বাগানের মধ্যে আবিষ্কৃত হবার পূর্বেই একবার আপনি কোন এক সময় নিচের বাগানে গিয়েছিলেন?
তাহলে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হব যে, আপনার অনুমানটা বা জানাটা সম্পূর্ণ ভুল!
বিশাখা চৌধুরীর সদম্ভ উক্তির সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মুখখানা যে সহসা কঠিন হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে চাপা মৃদু কণ্ঠে এবারে সে বলে, ভুল!
হ্যাঁ।
তারপর কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই যেন এগিয়ে গেল দুপা উপবিষ্টা বিশাখা চৌধুরীর দিকে এবং হাত বাড়িয়ে তাঁর মাথার কেশ থেকে ছোট পাতা সমেত কামিনীগাছের একটা ভাঙা শাখা টেনে বের করে বলল, মিত্রা সেন যেখানে বেঞ্চের ওপর মৃত অবস্থায় ছিলেন তার পিছন দিকে একটা কামিনী গাছের বোপ আছে, আপনার নিশ্চয়ই অজানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর আপনারা যখন সকলে মিলে বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, সে-সময় কেমন করে এই বস্তুটি আপনার চুলের সঙ্গে আটকে থাকতে পারে বলতে পারেন। যদি সত্যি আপনার কথাই মেনে নেওয়া যায় যে, সেই সময়ই প্রথম আপনি আজ নীচের বাগানে গিয়েছিলেন।
বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মুখের কোথায়ও যেন বিন্দুমাত্র রক্ত আর নেই। সমস্ত রক্ত যেন তাঁর মুখ থেকে কে ব্লটিং পেপারে শুষে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, কিরীটীর মুখের দিকে স্থাপিত তাঁর দু-চোখের বোবাদৃষ্টির মধ্যে সেই মুহূর্তে যে অসহায় করুণ একটা ভাব ফুটে উঠেছিল তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, তিনি যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছেন যেন।
ন যযৌ ন তস্থৌ।
কী, জবাব দিন?
বিশাখা চৌধুরীর এতক্ষণের সমস্ত দৃঢ়তা যেন কিরীটীর শেষ প্রশ্নের নির্মম আঘাতে গুঁড়িয়ে একেবারে চুরমার হয়ে গেল।
হঠাৎ দুহাতের মধ্যে মুখ ঢেকে চাপা আর্ত করুণ কণ্ঠে বলে উঠলেন এবারে বিশাখা, বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি-আমি মিত্রার মৃত্যুসম্পর্কে কিছু জানি না, কিছু জানি না।
কিন্তু নিষ্ঠুর কিরীটী।
পূর্ববৎ কঠিন কণ্ঠেই এবারে সে বললে, আপনি তাহলে মিসেস চৌধুরী স্বীকার করছেন এখন যে, আগে আর একবার আপনি আজ রাত্রে একসময় নীচের বাগানে গিয়েছিলেন?
মৃদু ক্ষীণকণ্ঠে এবার প্রত্মর এল ছোট একটিমাত্র শব্দে, হ্যাঁ।
হুঁ। তাহলে এই ঘরে বসে যখন রঞ্জনের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করছিলেন, তার আগেই অর্থাৎ মিঃ রক্ষিতের সঙ্গে দেখা হবার আগেই আপনি একবার বাগানে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি কিছু জানি না। মিত্রার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
সত্যই যদি তাই হয় তো আপনাকে আমি এইটুকুই আশ্বাস দিতে পারি যে আপনার শঙ্কিত হবারও কোন কারণ নেই। তবে আমি যা-যা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি তার মধ্যে যেন কোন কিন্তু রাখবেন না। সত্য জবাবই দেবেন যা জানেন।
বলুন।
আপনি এখানে এসে সোজা তাহলে বাগানেই যান?
একটু ইতস্তত করে বিশাখা জবাব দেন, হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? এসেই সোজা বাগানে গেলেন কেন?
অশোককে যেতে দেখেছিলাম।
তার মানে আপনি তাঁকে ফলো করেছিলেন, তাই কি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন ফলো করছিলেন তাঁকে?
প্রত্যুত্তরে এবারে চুপ করে রইলেন মাথাটা নীচু করে বিশাখা চৌধুরী।
কই, জবাব দিন?
একজন আমাকে অশোক ও মিত্রার ওপরে নজর রাখতে বলেছিল।
হুঁ। কে—সে লোকটি কে?
ক্ষমা করবেন আমাকে মিঃ রায়, আমি তার নাম করতে পারব না।
পারবেন না?
না।
কেন? শুনুন আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এটুকু বিশ্বাস আমাকে করতে পারেন, আপনার কাছ থেকে যে নামটা আমি জেনেছি এ কথা কাউকেই আমি জানাব না। ইচ্ছে করলে আপনি নামটা একটুকরো কাগজে লিখে আমাকে জানাতে পারেন।
ক্ষমা করবেন। তবু পারবো না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাহলে এই আমি বুঝব যে আপনি বলবেন না ইচ্ছে করেই!
বললাম তো আপনাকে আমার কথা। আপনি এখন যা বোঝেন।
মুহূর্তকাল প্রত্যুত্তরে কিরীটী চুপ করে রইল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, নামটা যখন বলবেনই
বলে আপনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ, মিথ্যে পীড়াপীড়ি আর আপনাকে আমি করব না। তবে এটা ঠিকই জানবেন বিশাখা দেবী, এই মুহূর্তে না হলেও, তার নাম জানতে খুব বেশী দেরি আমার হবে না। নাম তার আমি জানবই। যাক সে কথা, আপনি নীচে গিয়ে কী করছিলেন আর কখনই বা ফিরে আসেন?
১৮. আমি যখন নীচের বাগানে যাই
আমি যখন নীচের বাগানে যাই, বলতে লাগলেন বিশাখা চৌধুরী, প্রথমটায় অশোককে কোথায়ও দেখতে পাইনি। তাই ইতস্তত তার সন্ধান করতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে শেষে সেই কামিনী ঝোপের পশ্চাতে গিয়ে উপস্থিত হতেই একটি চাপা সতর্ক নারীকণ্ঠস্বর আমার কানে এল।
নারীকণ্ঠ।
হ্যাঁ।
চিনতে পেরেছিলেন সে নারীকণ্ঠ?
না। কারণ ইতিপূর্বে সে কণ্ঠস্বর কখনও আমি শুনেছি বলে মনে হয় না।
হুঁ। তারপর বলে যান–
শুনতে পেলাম সতর্ক নারীকন্ঠে কে যেন বলছে, এক মুহূর্ত আর এখানে থেকো না। যত তাড়াতাড়ি পার এখান থেকে চলে যাও। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে এবং অন্যান্য মেম্বাররা সব এসে পড়লে তখন মুশকিলে পড়বে। সেই নারীকণ্ঠের প্রত্যুত্তরে শুনলাম কে যেন বললে, কিন্তু হাত-পা আমার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। পারব না, আমি পালাতে পারব না। তার জবাবে সেই পূর্ব নারীকণ্ঠস্বর এবারে বললে, ছি, তুমি না পুরুষমানুষ! এত ভীতু তুমি! এইটুকু সাহস তোমার নেই? যাও শিগগির পালাও এখান থেকে। এরপর পালাবার আর পথ পাবে না। জবাবে এবার পুরুষ বললে, কিন্তু পালালে কি সকলের সন্দেহ আমার ওপরেই পড়বে না? পূর্ব নারী এবারে জবাব দিল, সে পরের কথা পরে। এখনও পালাও। তাছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছকেন, সকলেইতোমার সঙ্গে ওর ইদানীংকার ঘনিষ্ঠতার কথা জানে। এমনিতেও তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না, অমনিতেও না। এই পর্যন্ত বলে বিশাখা চৌধুরী থামলেন।
বলুন, তারপর?
তারপরই একটা দ্রুত পদশব্দ পেলাম, সেটা যেন দূরে চলে গেল ক্রমে ক্রমে।
বলতে বলতে বিশাখা চৌধুরী আবার থামলেন। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
তারপরই আবার কিরীটী বললে, থামলেন কেন, বলুন যা বলছিলেন মিসেস চৌধুরী।
মিসেস চৌধুরী আবার বলতে শুরু করলেন, তারপর কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন স্তব্ধ অনড় হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
এবং কতকটা তারপর ধাতস্ত হবার পর, অতি সন্তর্পণে সেই কামিনী ঝোপের মধ্যে ঢুকে আরও একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম, পিছন ফিরে কে যেন বেঞ্চের ওপর বসে আছে। আর আশেপাশে দ্বিতীয় জনপ্রাণী নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর ঝোপ থেকে সন্তর্পণে বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াতেই, মৃদু চাঁদের আলোয় বেঞ্চের ওপরে উপবিষ্টা মিত্রাকে দেখে যেন চমকে উঠলাম। প্রথমটায় অতটা খেয়াল হয়নি। তারপরই হঠাৎ মনে হল অমন নিঝুম হয়ে মিত্রা বেঞ্চের ওপর বসে আছে কেন? মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে! মনটার মধ্যে কেমন যেন ছাঁত করে উঠল। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। সন্দেহটা এবারে যেন আরও দৃঢ় হল। ভয়টা আরও চেপে বসল। আবার ডাকলাম, মিত্রা! মিত্রা! না, তবু কোন সাড়া-শব্দ এল না মিত্রার দিক থেকে। এবারে সত্যি সত্যিই ভয়ে ও আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা যেন কেমন আমার কেঁপে উঠল। এগিয়ে গিয়ে ওর মাথা স্পর্শ করতেই সভয়ে দুপা পিছেয়ে এলাম। সেই মুহূর্তেই আশঙ্কা আমার দৃঢ় হল, মিত্রা মরে গিয়েছে। এবং মারা গেছে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে সঠিকভাবে আরও চার-পাঁচ মিনিট চলে গেল। হাত পা সবঙ্গ তখন আমার কাঁপছে। হঠাৎ এমন সময় ফিরে আসবার জন্য পা বাড়াতেই আমার পায়ে যেন কী ঠেকল। তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিতেই দেখি একটা রেকর্ড সিরিঞ্জ, যা ডাক্তাররা সাধারণত ইনজেকশনের জন্য ব্যবহার করে।
ইনজেকশনের সিরিঞ্জ!
হ্যাঁ, এই যে দেখুন। বলতে বলতে বিশাখা তাঁর হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি কাঁচের রেকর্ড টু সি-সি সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতের উপর তুলে দিলেন।
কিরীটী সিরিঞ্জটা হাতের উপর নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, আমিও তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। টু সি-সি কাঁচের রেকর্ড সিরিঞ্জ একটা এবং ছোট অত্যন্ত সরু একটা হাইপোডারমিক নীডল তখনও তাতে পরানো আছে। তবে নীডলটা একটু বেঁকে গিয়েছে।
ধীরে ধীরে সিরিঞ্জটা দেখা হয়ে গেলে সামনের টেবিলে রেখে কিরীটী পুনরায় বিশাখা চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল। বললে, তারপর বলুন?
সিরিঞ্জটা ব্যাগের মধ্যে পুরে সোজা আর মুহূর্তকাল দেরি না করে উপরে বার-রুমে চলে এলাম। মাথার মধ্যে তখনও আমার যেন কেমন করছে। মীরজুমলার কাছ থেকে একটা স্টিফ পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে হলঘরে ঢুকে সোফার ওপরে বসে পড়লাম। তারই দু-তিন মিনিট বাদে রঞ্জিত রক্ষিত এসে হলঘরে ঢুকল। সেখান থেকে দু-এক মিনিট বাদেই আমরা আবার এসে এই ঘরে ঢুকি।
তাহলে রঞ্জনবাবুর সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে আবার আপনি বাইরে গিয়েছিলেন কেন?
প্রেসিডেন্টকে সংবাদটা দিতে।
দিয়েছিলেন তাঁকে সংবাদটা?
না। কারণ তখনও তিনি তাঁর ঘরে এসে পৌঁছাননি। তাই এ ঘরেই আবার আমি ফিরে আসি। এবং তারই দু-এক মিনিট বাদে মহারানী এসে এই ঘরে ঢোকেন।
একটা কথা বিশাখা দেবী, কিরীটী প্রশ্ন করে, বাগানের সেই পুরুষকণ্ঠটি চিনতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
কার কণ্ঠস্বর সেটা?
অশোকের।
আর নারীকণ্ঠস্বরটি?
বললাম তো, চিনতে পারিনি।
এখানকার মেম্বারদের কারও গলার সঙ্গেই মেলে না?
না।
আর একবার ভাল করে ভেবে বলুন।
না। কারণ এখানকার কারও কণ্ঠস্বরই আমার অপরিচিত নয় মিঃ রায়।
হুঁ। আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন।
বিশাখা চৌধুরী অতঃপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এরপর বাকি সকলকে একের পর এক ডেকে দু-চারটি প্রশ্ন করে কিরীটী তাঁদের ছেড়ে দিতে লাগল।
জবানবন্দি নেবার পালা যখন শেষ হল রাত তখন আড়াইটে বেজে গিয়েছে।
একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, এবারে চল, ওঠা যাক লাহিড়ী। আপাতত উপরের তলার সমস্ত ঘরগুলোতে তালা দিয়ে দুজন কনস্টেবলকে প্রহরায় রেখে দাও। কাল সকালে তোমার থানায় আমি আসছি। পরবর্তী কাজের প্ল্যান সেখানেই আমরা চক-আউট করব।
সেইমতই ব্যবস্থা করে মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে, আমরা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে বের হয়ে এলাম এবং রজত লাহিড়ীকে থানায় নামিয়ে দিয়ে কিরীটীর সঙ্গে তার গাড়িতে তারই বাসায় এসে উঠলাম।
১৯. কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম
কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম রাত্রির শেষ প্রহর উত্তীর্ণ প্রায়।
কিরীটী একটা সোফার উপরে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
বুঝলাম বাকি রাতটুকু কিরীটীর মাথার মধ্যে এখন মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারের জটিল ও দুরূহ চিন্তাটাই পাক খেয়ে খেয়ে ফিরবে। এখন আর ওকে ডাকলে সাড়া মিলবে না। অতএব বড় সোফাটার ওপরে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে চোখ বুজলাম।
সারাটা রাত্রির ক্লান্তি। তাই বোধ হয় চুপ করে সোফার উপরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাও মনে নেই।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল পাশের ঘরের ক্যাজেল ঘড়ির সুমধুর পাঁচটা বাজবার সংকেত-ধ্বনিতে।
চেয়ে দেখি কিরীটী ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে হাত দুটি পশ্চাতে মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করছে যেন আপন মনেই। সামনেই টেবিলের ওপরে দেখি সোজা করে পাতা আছে বৈকালী সঙ্ঘের বাড়িটার আমারই দেওয়া তাকে কাগজে আঁকা প্ল্যানটা ও একটা কাগজ একটা পেপার-ওয়েট দিয়ে চাপা। ভাল করে চেয়ে দেখি সেই কাগজে কতকগুলো নাম ও তার পাশে পাশে সময় বসানো। আর তারই পাশে রয়েছে কিরীটীর প্রিয় মুখখোলা কালো রঙের সেফার্স কলমটা।
বুঝলাম বাকি রাতটুকু কিরীটী চোখের পাতা এক তো করেইনি, এবং মস্তিষ্কের সংখ্যাতীত কোষগুলিতে চিন্তার যে ঘৃণাবর্ত এতক্ষণ ধরে বয়ে গিয়েছে তারও সমাপ্তি এখনও ঘটেনি।
কিরীটীকে ডেকে তার ধ্যান ভাঙাব কি ভাঙাব না ভাবছি, ঐ সময় চায়ের ট্রে হাতে কৃষ্ণা বৌদি এসে ঘরে প্রবেশ করল। খুব ভোরেই স্নান সেরে নিয়েছে বোঝা গেল। সিক্ত কুন্তলরাশি পৃষ্ঠদেশ ব্যেপে রয়েছে। পরিধানে সাদা-কালো চওড়াপাড় তাঁতের শাড়ি ও গায়ে লাল ভেলভেটের ব্লাউজ।
একটু যেন ইচ্ছে করেই সামনের ত্রিপয়ের উপরে চায়ের ট্রে-টা রাখতে রাখতে কৃষ্ণা তার স্বামীকে সম্বোধন করে বলল, মুনিবর! এবারে ধ্যান ভঙ্গ করুন। চা রেডি।
কিরীটী মৃদু হেসে স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকাল, তারপর সোফার উপরে বসে একটি ধূমায়িত চা-ভর্তি কাপ তুলে নিল হাতে নিঃশব্দে।
আমিও একটা কাপ তুলে নিলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, কৃষ্ণা, গতরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে কিছুটা দায়ী কিন্তু তুমিই।
কৃষ্ণা বৌদি তখন সবেমাত্র কিরীটীর পাশেই সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। চকিতে কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, মানে?
মানে আর কী! তোমাদের নারীচরিত্রের পরস্পরের প্রতি সহজাত চিরন্তন ঈর্ষা এবং তুমিই অকস্মাৎ তোমার রূপ-বহ্নি নিয়ে বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত হয়ে সেই ঈর্ষায় ইন্ধন যুগিয়েছিলে অন্য এক নারীর মনে।
হুঁ। তার পর?
তারপর আর কী! যার ফলে গতরাত্রের দুর্ঘটনা ঘটে গেল। নারী তোমার অনুতপ্ত হওয়া উচিত।
কিছুতেই না। বিশ্বাস করি না তোমার কথা। প্রতিবাদ জানায় কৃষ্ণা বৌদি।
বিশ্বাস কর না কর কিন্তু আমি নাচার। যাক সে কথা, গতরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, মোটামুটি তাঁদের একটা গতিবিধির টাইম-টেবল তৈরি করেছি। কাগজটা পড়ে দেখ তো সুব্রত, কোথায়ও ভুল রইল কিনা। বলে এবার কিরীটী আমার দিকে তাকাল।
জানি এসব ব্যাপারে কিরীটীর কোন দিনও ভুল হয় না এবং হতেও দেখিনি। তবুকাগজটা তুলে চোখের সামনে ধরলাম।
দেখলাম কিরীটী গতরাত্রে যারা বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত ছিল তাদের কয়েকজনকে বাদ দিয়ে বাকি সকলকে নিয়ে একটা তাদের গতিবিধির টাইম-টেবিল তৈরি করেছে।
প্রথমেই দেখলাম মিত্রা সেনের নাম। তার পাশে লেখা আছে:
মিত্রা সেন বৈকালী সঙ্ঘে গতরাত্রে এসেছিল, আটটা বাজতে দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে। এবং সম্ভবত সোজা সে নীচের বাগানে চলে যায়। কিন্তু কেন? বাগানে (?) ৭-৫০ মিঃ—পূর্ব পরিকল্পনামত কারও না কারও নির্দেশক্রমে ৭-৪৫ মিঃ বা নিজের ইচ্ছাতেই বা নিজের প্ল্যানমত কারও সঙ্গে দেখা করতে। যদি তাই হয় তো কার সঙ্গে দেখা করতে। সম্ভবত হত্যাকারীই ঐ সময় মিত্রা সেনকে বাগানে আসতে বলেছিল, যাতে করে নির্বিঘ্নে সে তার কাজ হাসিল করতে পারে। হত্যার জন্য বাগানের ঐ স্থানটি সে বেছে নিয়েছিল, কারণ মৃত্যুসময়ে কোনরূপ কাতর শব্দ মিত্রা সেনের কণ্ঠ হতে নির্গত হলেও কারও কানে সেটা পৌঁছবে না এবং নিশ্চিন্তে সে কার্য সমাধা করতে পারবে। সমস্ত কিছু প্যালোচনা করে মনে হয় মিত্রা সেনকে রাত আটটা থেকে আটটা দশের মধ্যেই কোনো এক সময় তীক্ষ্ণ মারাত্মক কোনো বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
অশোক রায়—সকলের জবানবন্দি থেকে বোঝা যাচ্ছে অশোক রায় বৈকালী সঙ্ঘে গতরাত্রে মিত্রা সেনের ঠিক পরে-পরেই এসেছিল রাত আটটা থেকে আটটা দশ মিনিটের মধ্যে কোনো এক সময়ে। সে ৮-১০ মিঃ মধ্যে কিন্তু সোজা বাগানে যায়নি। হলঘরে বোধ হয় ৮-২০ মিঃ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু কেন? কার জন্য অপেক্ষা করছিল? মিত্রা সেনের জন্যই কি? বিশাখা চৌধুরী ৮-৩৫ মিঃ নাগাদ অশোক রায়কে হলঘরে বসে থাকতে দেখেছিল। এবং বৈকালী সঙ্ঘে সেরাত্রে উপস্থিত মেম্বারদের মধ্যে একমাত্র বিশাখা চৌধুরী ব্যতীত অন্য কেউই অশোক রায়কে সে রাত্রে ওখানে দেখেনি। তার কারণ হয়তো অশোক রায় হলঘরে কিছুক্ষণ থেকেই বাগানে চলে যায়,নীচে অন্যান্য মেম্বারদের পৌঁছবার পূর্বেই। বিশাখার স্টেটমেন্ট যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে অশোক রায় বাগানে গিয়েছিল। শশী হাজরার স্টেটমেন্ট থেকে বোঝা (৮-৪৫ মিঃ) যাচ্ছে অশোক রায় রাত পৌনে নটা নাগাদ আবার বৈকালী সঙ্ঘ থেকে চলে যায়। অর্থাৎ ৮-৮১০ মিঃ-এ এসে ৮-৪৫ মিঃ-এ চলে যায়। আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অশোক রায় তাহলে সেখানে ছিল। হলঘরে যদি অশোক রায় কিছুক্ষণ বসে থেকে থাকে, তাহলে ২৫ মিঃ থেকে আধ ঘণ্টা সময় নিশ্চয়ই সে বাগানে ছিল। এখন কথা হচ্ছে, ঐ সময়ের আগে না ঐ সময়ের মধ্যেই মিত্রা সেন নিহত হয়েছে? শুধু তাই নয়, বিশাখা চৌধুরীর স্টেটমেন্ট থেকে আরও একটা ব্যাপার যা আমরা জেনেছি, সেটা হচ্ছে অশোক রায় বৈকালী সঙ্ঘে আসার মিনিট দশেক পরেই বিশাখা চৌধুরী আসেন এবং তারই দু-চার মিনিট বাদে যদি অশোক রায় হলঘর থেকে বের হয়ে বাগানে গিয়ে থাকে, তাহলে সে বাগানে গিয়েছিল সম্ভবত আটটা বেজে দশ মিনিট থেকে আটটা কুড়ি মিনিটের মধ্যেই; এবং বিশাখা তাকে একপ্রকার অনুসরণ করে গিয়েই যদি তার কণ্ঠস্বর ঝোপের পাশ থেকে শুনে থাকে তো তখন সেটা হবে আটটা বেজে পঁচিশ থেকে সাড়ে আটটা। আর তাই যদি হয় তো তাহলে শশী হাজরার স্টেটমেন্ট সত্যি বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ অশোক রায় রাত পৌনে নটা নাগাদ চলে যেতে পারে। এবং সত্যি যদি তাই হয়ে থাকে তো অশোক রায় বাগানে ছিল সে। রাত্রে আটটা কুড়ি মিঃ থেকে আটটা পঁয়ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত। অর্থাৎ মাত্র পনের মিনিট সময়। ব্যাপারটি অত্যন্ত গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। বিশাখা চৌধুরীর কথা থেকে আরও একটা ব্যাপার জানা যাচ্ছে, সেরাত্রে ঐ সময় বাগানে দ্বিতীয় কোন এক নারী ছিল। কে সে? গতরাত্রে যে কজন নারী বৈকালী সঙ্ঘে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে কি কেউ? কিন্তু বিশাখা চৌধুরী বলেছে ইতিপূর্বে সে কণ্ঠস্বর নাকি সে শোনেনি সঙ্ঘে, তার অপরিচিত। তবে যে-ই থাকুক এটা ঠিক সে আটটার আগেই ঐ রাত্রে সঙ্ঘে এসেছিল। অথচ শশী হাজরার কথা থেকে জানা যায়, মিত্রা সেনই সর্বপ্রথম গতরাত্রে সঙ্ঘে এসেছে। স্বতই এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে, শশী হাজরার ও বিশাখার স্টেটমেন্ট সম্পূর্ণ ঠিক বা correct কিনা! যদি correct হয় তো সে আর কেউ নয়, স্বয়ং (?) এবং সে-ই তাহলে হত্যাকারী কি?
মহারানী সুচরিতা দেবী—নিজে তিনি বলেছেন, তিনি নাকি গতরাত্রে পৌনে নটা অর্থাৎ ৮-৪৫ মিঃ নাগাদ সঙ্ঘে আসেন। তারপর তিনি হলঘরে এসে দেখতে পান ৮-৪৫ মিঃ নাগাদ শ্ৰীমন্ত পাল, সুমিতা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলীকে। হলঘরে তিনি রাত ৯টা পর্যন্ত ছিলেন। সেখান থেকে যান বার-রুমে। সেখানে ৮-৩০ মিঃ–এ দেখতে পান, রঞ্জন রক্ষিত ও বিশাখা চৌধুরীকে। সেখান থেকে ৯-৫মিঃ থেকে ৯-১০মিঃ-এর মধ্যে যান নীচের বাগানে। তাঁর স্টেটমেন্ট যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে নিশ্চয়ই অশোক রায় বাগান ছেড়ে চলে যাবার পর তিনি সেখানে গিয়েছেন। তিনি একটি পদশব্দও শুনেছিলেন নাকি। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। শশী হাজরার স্টেটমেন্ট। তার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী মহারানী গতরাত্রে সঙ্ঘে এসেছেন মিত্রা সেন, অশোক রায় ও বিশাখার ঠিক পরে-পরেই ২৫ মিনিটের মধ্যে। অর্থাৎ রাত ৮-২০ মিঃ থেকে ৮-২২ মিঃ-এরমধ্যে যদি বিশাখা এসে থাকে, তাহলে রাত ৮-২৫ মিঃ থেকে৮-৩০মিঃ–এর মধ্যেই মহারানী গতরাত্রে সঙ্ঘে এসে পৌঁছেছিলেন। এবং তাতে করে পনের মিঃ সময়ের হেরফের হচ্ছে, যে সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটা বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে মহারানী ও মিত্রা সেন এককালে ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন পরস্পর পরস্পরের।
বিশাখা চৌধুরী—মিত্রা সেন ও অশোক রায়ের পরই গতরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে আসেন বিশাখা চৌধুরী। অর্থাৎ রাত ৮-১০ মিঃ থেকে ৮-২০ মিনিটের মধ্যে। অবশ্য যদি ৮-১০ মিঃ—শশী হাজরার স্টেটমেন্ট সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। ৮-২০ মিঃ বিশাখা চৌধুরী নিজে বলেছেন, তিনি এসেছেন ৮-১৫ মিঃ থেকে ৮-২০ মিঃ-এর মধ্যে। অর্থাৎ শশী হাজরার ৮-২০ মিঃ স্টেটমেন্টের সঙ্গে প্রায় মিলই আছে। বিশেষ গরমিল নেই। হলঘরে ঢুকে তিনি একমাত্র অশোক রায়কে দেখতে পান। এবং প্রকৃতপক্ষে হলঘরে এসে গোঁজার পরই অশোক রায় হলঘর থেকে বার হয়ে যায় নীচের বাগানের দিকে। হলঘরে সেই সময় তৃতীয় আর কেউ নাকি উপস্থিত ছিলেন না। সেক্ষেত্রে বিশাখার সঙ্গে অশোকের কোন কথাবার্তা হয়েছিল কিনা তাও জানবার উপায় নেই। সম্ভবত হয়নি এবং বিশাখা যে তাকে বাগানে follow করছিল তাও অশোক জানে না বা টের পায়নি। এখন এই স্টেটমেন্ট থেকে একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে যে, অশোক বাগানে গিয়েছিল ৮-২৫ মিঃ থেকে ৮-৩০ মিঃ-এর মধ্যে খুব সম্ভবত। এবং বিশাখা বাগানে পৌঁছেছিল সম্ভবত ৮-৩০ মিঃ থেকে ৮-৩২।৩৩ মিঃ-এর মধ্যে, বড় জোর ৮-৩৫ মিঃ-এর মধ্যে। তাই যদি হয়ে থাকে,তাহলে শশী হাজরার টেটমেন্ট যোব হয় মিথ্যে নয় যে, অশোক ৮-৪৫ মিঃ নাগাদ সঙ্ঘ থেকে বের হয়ে যায়। বিশাখা চৌধু বাগানে আত্মগোপন করে থাকাকালীন সময়ে যে কোন এক নারীর কণ্ঠস্বর শুনেলিসে কে? আবার সে প্রশ্নটি মনে আসছে। কারণ তার স্টেটমেন্ট থেকে জানা যাচ্ছে সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বর নারীর সঙ্গে অশোকই কথা বলছিল। অশোক তাহলে নিশ্চয়ই চেনে সে নারীকে।
শ্ৰীমন্ত পাল—তাঁর নিজস্ব স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায় তিনি এসেছিলেন সঙ্ঘে ঐদিন রাত্রে, রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। এবং তাঁর কথা যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়, ৮-৩০ মিঃ-এ তিনি আসবার পর অশোক রায় সেখান থেকে চলে যায়। তিনিও সোজা এসে হলঘরে প্রবেশ করেন। এবং হলঘরে প্রবেশ করে সেখানে দেখতে পান সুপ্রিয় গাঙ্গুলী, সুমিত্রা চ্যাটার্জী ও মীরজুমলাকে। অর্থাৎ ৮-৩০ মিঃ-এর সময় বার-রুমে মীরজুমলা ছিল না। সেখানে ছিল বিশাখা চৌধুরী ও রঞ্জন রক্ষিত। ৮-৩০ মিঃ থেকে ৮-৩৫ মিঃ-এর মধ্যে হলঘরে ঢেকে রমা, মনোজ দত্ত ও নিখিল ভৌমিক। এবং তার পরে দুনম্বর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেন মহারানী ও বিশাখাকে রাত ৯টা নাগাদ। মহারানী আবার ৯-১৫ মিনিটের সময় ঘর থেকে বের হয়ে যান।
রঞ্জন রক্ষিত-রঞ্জন রক্ষিত বলেছেন, তিনি এসেছেন গতরাত্রে সঙ্ঘে রাত ৮-৩০ মিঃ নাগাদ। কিন্তু সম্ভবত কথাটা ঠিক নয়। কারণ শ্ৰীমন্ত পাল যখন ৮-৩০ মিনিটে এসে ৮-৩০ মিঃ-এ হলঘরে প্রবেশ করেন সে সময় রঞ্জন রক্ষিত হলঘরে ছিলেন না। ছিলেন বার-রুমে। তাতে করেমনেহয় তিনি আগেই এসেছিলেন। এবং বিশাখাচৌধুরীর পরে-পরেই। সম্ভবত ৭-২০ মিঃ থেকে ৮-২৫ মিঃ-এর মধ্যে কোনো এক সময়। এবং তিনি যে বলেছেন সে সময় বিশাখা চৌধুরী ও অশোক রায় ঘরে ছিল, কথাটা সম্ভবত সত্য। এবং বিশাখা বা অশোক রায় সে কথা জানতে পারেনি। এবং তিনি যে অশোক রায়কে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিলেন ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই—কথাটা মিথ্যা নাও হতে পারে। তারপর তিনি বিশাখা চৌধুরী সম্পর্কে যে কথাটা বলেছেন সেটাও হয়তো সত্যই।
এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। সে দেখি সোফায় হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে আপন মনে ধূমপান করছে। এবার আমি কাগজের অপর পৃষ্টা ওল্টালাম। সেখানে শুধু একটি কথাই লেখা আছে:
মিত্রা সেনের মৃত্যু ঘটেছে সম্ভবত সন্ধ্যা ৭-৫৫ থেকে রাত্রি ৮টার মধ্যে কোনো এক সময় এবং নীচের বাগানেই তীব্র বিষের ক্রিয়ায়।
কাগজটা হাতে করে বসে নিজের মনেই কথাটা ভাবছিলাম। হঠাৎ কিরীটীর ডাকে চমকে তার মুখের দিকে তাকালাম।
কি রে, আমার বিশ্লেষণের মধ্যে কিছু ভুল আছে সুব্রত?
আর একটু বিশদ করে বললে সুখী হতাম।
২০. কিরীটী মৃদু হেসে বললে
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, গতরাত্রে আমাদের বিশেষ আলোচ্য সময়টি হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা—ঐ একটি ঘণ্টা অর্থাৎ সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা ঐ একঘণ্টা সময়ের মধ্যে ওখানে যারা যারা উপস্থিত ছিল বা আসা-যাওয়া করেছে, তাদের মুভমেন্টস্-এর ওপরই আমাদের মিত্রা সেনের হত্যা-ব্যাপারে যাবতীয় রহস্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে—এই কথাটা ধরে নিতে হবে। কিন্তু প্রত্যেকের আলাদা আলাদা statement থেকে যতটা আমরা আপাতত সংগ্রহ করতে পেরেছি তার মধ্যে দুটি প্রাণী ব্যতীত অন্য কাউকেই
ঐ সময়ের জালে আটকাতে পারছি না। তাদের মধ্যে আবার একজন নিহত। দ্বিতীয়জন। আপাতত পলাতক। নাগালের বাইরে। অর্থাৎ মিত্রা সেন ও অশোক রায়। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই তুই লক্ষ্য করেছিস, বিশাখার statement যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রথমত অশোক রায় কিছুতেই হত্যাকারী হতে পারে না। এবং দ্বিতীয়ত যে নারী-কণ্ঠস্বরকে বিশাখা অশোকের সঙ্গে কথা বলতে গতরাত্রে শুনেছিল সে কার কণ্ঠস্বর?
তোর মতে তা হলে বুঝতে পারছি সেই অদৃশ্য নারী-কণ্ঠস্বরের অধিকারিনীই মিত্রা সেনের হত্যাকারিণী। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মিত্রা সেনকে হত্যা করেছে কোন এক নারীই, পুরুষ নয়—তাই কি?
হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা। মৃদুকণ্ঠে কিরীটা বললে, এবং শুধু তাই নয়, সেই হত্যাকারিণী নারী আগে থাকতেই অকুস্থানে উপস্থিত ছিল এও আমার স্থির বিশ্বাস।
কিন্তু কে সে নারী?
আপাতত অন্তরালে থাকলেও খুঁজে তাকে বের করবই।
কিন্তু গতকাল বৈকালী সঙ্ঘে এমন কোনো অপরিচিতা নারীর উপস্থিতির কথাই তো জানা যায়নি কারও জবানবন্দি থেকেই!
তা অবিশ্যি জানা যায়নি সত্যি!
তবে শশী হাজরার স্টেটমেন্টকে যদি নির্ভুল বলে ধরে নেওয়া যায় এবং বাইরের কোনো অপরিচিতা নারী না হয়ে যদি সঙ্ঘেরই কোন মেম্বার নারী হয় তো সে মিত্রা সেনই।
কেন?
কারণ শশী হাজরার স্টেটমেন্ট থেকে জেনেছি মিত্রা সেনই গতরাত্রে প্রথম আসে।
না। সত্যি কথা সে বলেনি। আর সেই জন্যই লাহিড়ীকে বলে এসেছি তাকে এ্যারেস্ট করে তার ওপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবার জন্য। বুঝলাম, কিন্তু তারপর?
এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে অশোক রায়ের সন্ধান করা। তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে হয়ত হত্যাকারিণীকে ধরতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না, কারণ সে-ই একমাত্র হত্যাকারিণীকে দেখেছিল।
আর কোনো প্রোগ্রাম নেই?
আছে। দু-জায়গা নিঃশব্দে আজই রাত্রে রেইড করতে হবে।
একটা তো বুঝতে পারছি ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার ও নার্সিং হোম। দ্বিতীয়টি?
তাঁর আবাসগৃহ।
বলিস কি?
হ্যাঁ।
ঐদিনই বিকেলের দিকে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গেল কিরীটীর অনুমান মিথ্যে নয়। তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই মিত্রা সেনের মৃত্যু ঘটেছে-Curara (রারা) বিষের ক্রিয়ায়। এবং তার পাকস্থলীতে যা পাওয়া গিয়েছেসেটার মধ্যে আর যাই থাক অ্যালকোহলের নামগন্ধও নেই। শুধু তাই নয়,যে পেগ গ্লাসটি অকুস্থানে মৃতদেহের সন্নিকটে পাওয়া গিয়েছিল সেটা কেমিকেল অ্যানালিসিস করেও কিছু পাওয়া যায়নি, তবে সিরিঞ্জ অ্যানালিসিস করে Curara বিষ পাওয়া গিয়েছে। এমন কি অ্যালকোহলও না। বিশেষ একটি ব্যাপার যা পুলিস সার্জেন জানিয়েছেন কিরীটীকে সেটা হচ্ছে, মৃতদেহের পৃষ্ঠদেশে একটি নীডল পাংচারের দাগ পাওয়া গিয়েছে, সম্ভবত সেইখানেই ঐ বিষ সিরিঞ্জের সাহায্যে মিত্রা সেনের দেহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
যাক নিঃসন্দেহ হওয়া গেল একটা ব্যাপারে যে, মিত্রা সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাই—আত্মহত্যা নয়।
বিকেলের শেষ রৌদ্রালোকটুকুও যেন যাই-যাই করছিল।
কিরীটীর ঘরের মধ্যে বসে আমি ও কিরীটী ময়নাতদন্ত-রিপোর্টও কেমিকেল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
জংলী এসে ঐসময় ঘরে ঢুকল। বললে ব্যারিস্টার সাহেব রাধেশ রায় এসেছেন, দেখা করতে চান।
কিরীটী বললে, হ্যাঁ, এই ঘরেই নিয়ে আয়।
একটু পরেই প্রৌঢ় ব্যারিস্টার রাধেশ রায় এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাতেই যেটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে আমার চোখে ধরা পড়ল সেটা হচ্ছে, গভীর একটা ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তার ছায়া যেন তাঁর সমগ্র মুখখানির উপর ফুটে উঠেছে।
বসুন মিঃ রায়। কিরীটীই রাধেশ রায়কে আহ্বান জানাল।
রাধেশ রায় সামনের দামী সোফাটার উপরে বসে বারেকমাত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলেন, তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, না মিঃ রায়, তার কোন সন্ধানই করতে পারলাম না। রাত সাড়ে নটার কিছু পরে শুনলাম সে নাকি একবার বাড়িতে এসেছিল। তারপরেই একটা সুটকেস হাতে সে বের হয়ে যায় মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই। চাকরটা জিজ্ঞাসা করেছিল কোথায় সে যাচ্ছে কিন্তু সে কোনো জবাব দেয়নি। বলেনি কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি কি আপনার মনে হয় মিঃ রায়, তারই এ কাজ?
কিরীটী কোনো জবাব দেয় না, চুপ করে থাকে।
রাধেশ রায় আবার বলতে লাগলেন, অশোকের টেম্পারামেণ্ট আমার শুধু ভাল করে জানা বলেই নয়, এ ধরনের ক্রাইম,—আইন-আদালত নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেও বলতে পারি সে এ কাজ করেনি মিঃ রায়। তার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়।
সেটা তো পরের কথা মিঃ রায়, কিরীটী বলে, কিন্তু এভাবে আকস্মিক তাঁর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে করে পুলিসের চোখে কেমন করে নিজেকে তিনি
পরিষ্কার করবেন, যতক্ষণ না তিনি সামনাসামনি এসে দাঁড়াচ্ছেন ও তাদের সমস্ত প্রকার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন!
কিন্তু আমি কি করতে পারি বলুন? আজ পর্যন্ত কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কখনও সে যায়নি। তবু আমি অবিশ্যি পাটনায় আমার ভাইয়ের কাছে, দিল্লীতে তার মেশোর কাছে তার করে দিয়েছি। যথাসম্ভব এখানেও পরিচিত-অপরিচিত সকলের কাছে সন্ধান নিয়েছি।
পরিচিত কোন জায়গায় সে যায়নি। তাছাড়া কাল রাত্রে যে সময় সে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছে, দুরপাল্লার কোনো ট্রেনই তখন আর ছিল না প্রথমত এবং দ্বিতীয়ত ট্রেনে গেলে সেখানে এত তাড়াতাড়ি সে পৌঁছতে পারত না। সে তার নিজের গাড়ি নিয়েই গিয়েছে।
না না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়! তার গাড়ি তো গ্যারেজেই রয়েছে। কিরীটী এবারে প্রত্যুত্তরেমুহূর্তকাল নীরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাধেশ রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, গ্যারেজে আছে সে গাড়ি এবং কাল রাত্রে ছিল না। সে গাড়ি গ্যারেজে ফিরে এসেছে আজ সকাল আটটায়।
কে—কে বলল আপনাকে এ কথা?
মিঃ রায়, আপনি যে আপনার একমাত্র পুত্রস্নেহে অন্ধ সেকথা তো আমার অজানা নয়। শুনুন রাধেশবাবু, আজ সকালে যে পাঞ্জাবী ড্রাইভার অশোকবাবুর গাড়িটা নিয়ে এসে গ্যারেজে গাড়ি রেখে সোজা আপনার বাড়ির অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করেছিল আমি তার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এই যে টেলিফোন আছে ওখানে। ফোনে তাকে এখুনি একবার এখানে ডেকে আনবেন কি?
কিরীটীর কথায় দিশেহারা বিবশ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত রাধেশ রায় তাকিয়ে থাকেন তার মুখের দিকে নিঃশব্দে। তারপর মৃদু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন, পাঞ্জাবী ড্রাইভার!
হ্যাঁ। আপনি জানেন না রাধেশবাবু, গতরাত থেকেই প্লেন ড্রেসে আমার লোক আপনার বাড়ির প্রহরায় ছিল। এবং এখনও আছে। তারা আপনার গৃহের প্রতিটি খুঁটিনাটির ওপর নজর রেখেছে। তারাই যথাসময়ে রিপোর্ট দিয়েছে।
কিন্তু আমার বাড়িতে তো কোন পাঞ্জাবী ড্রাইভার নেই। একজন মাত্র ড্রাইভার,বাঙালী,
সেও আমারই গাড়ি চালায়। অশোক বরাবর তার নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করত। তার তো কোন ড্রাইভারই আজ পর্যন্ত নেই।
তাও আমার অজানা নয়। তাই তো আমি জিজ্ঞাসা করছি, পাঞ্জাবীর ছদ্মবেশে তাহলে সে ব্যক্তিটি কে, যে আজ সকালে আপনার ছেলের গাড়িটা গ্যারেজে এনে তুলে আপনার বাড়ির ভেতরই অদৃশ্য হয়ে গেল?
আপনি যে কি বলছেন মিঃ রায়, বুঝতেই পারছি না! ব্যাপারটা আগাগোড়া আমার কাছে যে গল্পের মতই মনে হচ্ছে!
গল্প নয় রাধেশবাবু, নিষ্ঠুর সত্য–বলতে বলতে হঠাৎ পকেট থেকে একখানা ফটোগ্রাফ চকিতে বের করে আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, আলোটা জ্বেলে দে সুব্রত।
নিঃশব্দে উঠে আমি ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলাম সুইচ টিপে, কেননা ইতিমধ্যেই ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ চাপ বেঁধে উঠেছিল।
হাতের ফটোটা নিঃশব্দে সম্মুখে উপবিষ্ট রাধেশ রায়ের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কিরীটী পূর্ববৎ শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললে, এই ফটোটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখুন রাধেশবাবু। সেই ড্রাইভারটি যখন গ্যারেজে গাড়ি রেখে অন্দরে প্রবেশ করছিল, সেই সময়ই আমার লোক দূর থেকে তার এই ফটোটা তুলে নিয়েছে। ঘণ্টা তিনেক আগেই মাত্র এটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা, এই লম্বা লোকটি, মাথায় পাগড়ি—এ কে?
নির্বাক বিহ্বল বোবা দৃষ্টিতে রাধেশ রায় কিরীটীর দেওয়া ফটোটা হাতে নিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সুট পরিহিত দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি, মাথায় পাঞ্জাবীদের মতন পাগড়ি, অন্দরের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে উদ্যত, ঐ সময়ই স্ন্যাপটা নেওয়া হয়েছে।
ঘরের মধ্যে একটশ অদ্ভুত স্তব্ধতা। কেবল দেওয়ালঘড়ির পেণ্ডুলামটা একঘেয়ে টকটক শব্দ জানিয়ে চলেছে।
কি, জবাব দিন রাধেশবাবু! এ লোকটিকে এখন পর্যন্ত আপনার বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়নি। কে এ লোকটি?
রাধেশ রায় তথাপি নির্বাক।
এ হয়তো আপনার ছেলের খবর জানে। আমি এর সঙ্গে কথা বলতে চাই। দয়া করে ফোনে এখানে লোকটিকে একবার ডাকবেন কি! আবার কিরীটী বলে।
রাধেশ রায় পূর্ববৎ নিশ্চুপ।
শুনুন রাধেশবাবু, মাসখানেক আগে একদিন আপনি ব্যাকুল হয়ে এবং আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তিত হয়েই সাহায্যের জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এবং আজ বলতে বাধা নেই, আপনার মুখে সেদিনকার সেই কাহিনী শুনেই সেদিন তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকখানিই এগুতে হয়েছিল আমাকে পরে। যার ফলে আমাকে ঘটনাচক্রে শেষ পর্যন্ত এমন একটা ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যার পশ্চাতে আমি অনুসন্ধানের দ্বারা জানতে পেরেছিলাম যে, একটা বিরাট ব্ল্যাক মেইলিংয়ের প্ল্যান রয়েছে। এবং শুধু আপনার ছেলে অশোকবাবুই নন, আরও অনেকেই সে প্ল্যানের মধ্যে, পরে জানতে পারি যে, অলক্ষ্যে জড়িয়ে পড়ে শোষিত হয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এবং সেই রহস্য উদঘাটনের জন্য এগুতে এগুতে হঠাৎ এক বিষধর সর্প গতরাত্রে গরল উদগীরণ করে সমগ্র ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলেছে আরও। মন বলছে আমার সেই ব্ল্যাক মেইলিংয়ের সঙ্গে মিত্রা সেনের হত্যার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছি না এখনো পর্যন্ত কিভাবে সেই যোগাযোগটা ঘটেছে। এবং যতক্ষণ না সেটা আরও স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি, আসল ব্যাপারে আর অগ্রসর হবারও যেন পথ করতে পারছি না। আর সেই কারণেই আপনার ছেলে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আমার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্লিজ, আপনি আমাকে সাহায্য করুন। ঐভাবে চুপ করে থেকে আমাকে নিরর্থক দেরি করাবেন না।
ক্ষমা করবেন মিঃ রায়। যে লোকটি সম্পর্কে আপনি জানতে চাইছেন সে লোকটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
ফটোর ঐ লোকটি—ওকেও চেনেন না?
না।
কিন্তু আমি যদি বলি রাধেশবাবু, আপনি সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন?
এড়িয়ে যাচ্ছি!
হ্যাঁ। কার ফটো আপনি তা না স্বীকার করলেও আমি জানি ঐ ফটোর খায্যে যে ধরা পড়েছে সে কে, কি তার পরিচয়?
কে? ভীত-বিহ্বল কণ্ঠে অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করে রাধেশ রায় তাকালেন কিরীটীয় মুখের দিকে।
আপনার ছেলে আশোক রায়। শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে কিরীটী শেষ কথাটা উচ্চারণ করল।
এবং কিরীটীর কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাধেশ রায়ের বিষণ্ণ মুখখানি যেন আরও বিষণ্ণ—একেবারে কালো হয়ে গেল মুহূর্তে।
বোবার মতই তাকিয়ে থাকেন রাধেশ রায় কিরীটীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে অতঃপর।
২১. টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে
কিরীটী এবারে বলে, যান উঠুন টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে এখানে এখুনি একবার আসতে বলুন, যদি এখনও আপনার ছেলের মঙ্গল চান!
কিরীটীর কতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারপ্রান্তে অকস্মাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠস্বরে যুগপৎ আমরা সকলেই ফিরে তাকালাম।
ডাকতে হবে না মিঃ রায়, আমি নিজেই এসেছি।
এবং অশোক রায়ের কণ্ঠস্বর শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত সংযম যেন রাধেশ রায়ের মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তিনি স্থান-কাল-পাত্র এমন কি নিজেকে পর্যন্ত ভুলে গিয়ে যেন আর্ত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অস্ফুট একটা চিৎকার করে উঠলেন, অশোক!
ধীর প্রশান্ত পদে আশোক রায় ততক্ষণে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে পূর্ববৎ শাঠেই কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি আপনার জিজ্ঞাস্য আছে আমাকে করুন মিঃ রায়। I am ready!
না, না—অশোক-আশোক, বাধা দিয়ে আবার চিৎকার করে উঠলেন হতভাগ্য পিতা।
না, বাবা। আমাকে বাধা দিও না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে দাও কি উনি জিজ্ঞাসা করবেন? আমি জবাব দেব।
কিন্তু অশোক–অশোক–
না, বাবা। এই আত্মগোপনের পিছনে যে সন্দেহের কালো ছায়া সর্বক্ষণ আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে আর আমি সহ্য করতে পারছি না।এর চাইতে নিশ্চিন্ত মনে জেলের অন্ধকার ঘরে বাস করাও সহজ। মিঃ রায়, বলুন কি আপনি জানতে চান আমার কাছ থেকে?
বসুন অশোকবাবু। এতক্ষণে কিরীটী কথা বলল।
অশোক রায় কিরীটীর নির্দেশে সামনের খালি সোফাটার উপর বসলেন।
কিরীটী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বুঝতে পারছিলাম অশোক রায়ের ঐ সময় তারই গৃহে অকস্মাৎ আবির্ভাবের ব্যাপারটা সে-ও চিন্তা করতে পারেনি ক্ষণপূর্বেও। তাই সেও বোধ হয় একটু বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এবং সেই কারণেই নিজের মধ্যে সে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
আপনি গতকাল রাত্রে বৈকলী সঙ্ঘে গিয়েছিলেন অশোকবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
গিয়েছিলাম।
ঠিক কখন গিয়েছিলেন সময়টা মনে আছে?
হ্যাঁ, রাত আটটা বাজতে মিনিট দু-পাঁচ আগেই হবে।
কিন্তু সাধারণত শুনেছি আপনি তো অত আগে কখনও সঙ্ঘে যেতেন না! তাই নয় কি?
হ্যাঁ। কিন্তু কাল একটু আগেই গিয়েছিলাম।
বিশেষ কোন কারণ ছিল কি?
একটু ইতস্তত করে অশোক রায় বললেন, মিত্রা যেতে বলেছিল।
কেন?
তার নাকি বিশেষ কি কথা বলবার ছিল!
কি কথা তা কোনো আভাস তিনি দেননি?
না। তবে বলেছিল বিশেষ জরুরী, প্রয়োজনীয়।
কখন তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন?
গতকাল দুপুরের দিকে টেলিফোনে।
কি বলেছিলেন?
বলেছিল ঠিক রাত আটটায় সঙ্ঘের পিছনের বাগানে বকুলবীথির সামনে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবল। তারপর মৃদুকণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা অশোকবাবু, আপনি স্থিরনিশ্চিত যে টেলিফোনে গতকাল দুপুরে ঠিক মিত্রা দেবীর কণ্ঠস্বরই শুনেছিলেন?
তাহলে আপনাকে কথাটা বলি, গলাটা যেন কেমন ভাঙা-ভাঙা ও একটু চাপা শুনেছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম সে সম্পর্কে, মিত্রা বলেছিল তার নাকি সর্দি হয়েছে হঠাৎ।
তাহলে আপনি সন্দেহ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
বেশ। সোজা আপনি গিয়ে হলঘরেই তো প্রবেশ করেন?
হ্যাঁ।
কেউ তখন সেই হলঘরে ছিল?
ছিল।
কে?
তাকে আমি চিনি না। কখনও ইতিপূর্বে দেখিনি।
পুরুষ না নারী?
নারী।
কত বয়স হবে তার?
পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশী হবে বলে মনে হয় না।
দেখতে কেমন?
চকিতে এক লহমার জন্য দেখেছিলাম, আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তিনি তিন নম্বর দরজার পথে হলঘর থেকে বের হয়ে যান। তাই একটু অবাক হয়েই বোধ হয় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, এমন সময় বিশাখা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?
না।
কোনো কথাই হয়নি?
না। ইদানীং কিছুদিন থেকে তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ ছিল।
কেন?
সে একান্তই আমার personal ব্যাপার। তবে এইটুকু জেনে রাখুন, I hate her!
আপনি তাহলে বিশাখা চৌধুরীর হলঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বাগানের দিকে যান?
তাই।
বাগানে গিয়ে মিত্রা সেনের সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?
না। She– She was then already dead! সে আর তখন বেঁচে নেই—বলতে বলতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম অশোক রায়ের কণ্ঠস্বরটা যেন জড়িয়ে এল।
কি করে বুঝলেন যে সে বেঁচে নেই?
ডেকে সাড়া না পেয়ে দুবারেও, গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতেও যখন নড়ল না বা সাড়া দিল না তখন চমকে উঠি। তারপর ভাল করে দেখতে গিয়ে বুঝি যে—সে তখন মৃত। কিন্তু তখনও তার গা গরম ছিল মিঃ রায়। বোধ হয় আমি সেখানে পৌঁছবার অল্পক্ষণ
আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল।
You are right, অশোকবাবু! That was the fact! আমার ধারণা সাড়ে সাতটা থেকে সাতটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বলেই কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, মিত্রা সেনের ব্যাপারে শশী হাজরার statement correct নয় সুব্রত। ৭-৪৫ মিঃ থেকে ৭-৫০ মিঃ নয়। সন্ধ্যা সাতটা কুড়ি থেকে সাতটা পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই মিত্রা সেন গতকাল সঙ্ঘে এসেছিলেন এবং সোজা গিয়ে বাগানে পৌঁছতে তাঁর যদি ৫৬ মিনিট সময় লেগে থাকে তাহলে ৭-৩০ মিঃ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আর তাই যদি হয়ে থাকে তো হত্যাকারী গতকাল যে কোনো সময় সাতটা কুড়ি থেকে সাতটা পঁচিশ মিনিটের পূর্বেই সেখানে গিয়েছিল এবং উপস্থিত ছিল ঐ বৈকালী সঙ্ঘে।
বাধা দিলাম এবারে আমি। তাই যদি হয় তাহলে বুঝতে পেরেছি, তুই কি বলতে চাস! প্রথমত বৈকালী সঙ্ঘের বাড়িতে ঢোকবার একটিমাত্র দ্বারপথ ছাড়া আর দ্বিতীয় দ্বারপথ নেই বলেই আমরা শুনেছি এবং মিত্রা সেনের পূর্বে কেউ আর এসেছিল বলেও শশী হাজরা বলেনি। তাহলে এক্ষেত্রে দুটি কথাই ভাবতে হবে। এক—হয় এই মেইন ডোর ছাড়াও সঙ্ঘের বাড়িতে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো দ্বারপথ আছে নিশ্চয়ই, যে ব্যাপারটা হয়তো মেম্বাদের কাছেও গোপন ছিল। দ্বিতীয় শশী হাজরা সত্য statement দেয়নি। শুধু তাই নয়, আরও একটা ভাববার কথা আছে। অশোকবাবুবৈকালী সঙ্ঘের একজন পুরাতন influential মেম্বার। এবং সঙ্ঘে একমাত্র মেম্বারদের ছাড়া যখন বাইরের কারোরই প্রবেশের কোনোরকম অধিকারই ছিল না, সেক্ষেত্রে এমন কে নারী গত সন্ধ্যায় হলঘরে উপস্থিত ছিলেন যিনি অশোকবাবু ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই তিন নম্বর দ্বারপথ দিয়ে হলঘর থেকে বের হয়ে যান এবং অশোকবাবুও যাঁকে চিনতে পারলেন না! যাক তাহলে আপাতত আমরা একটা ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি যে, মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন গতরাত্রে সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিট থেকে সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই।
তাহলে তো অশোকের উপরে কোন সন্দেহই পড়তে পারে না মিঃ রায়!
এতক্ষণে যেন হালকা হয়ে রাধেশ রায় কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন।
না, প্রথম থেকেই আমি স্থিরনিশ্চিত ছিলাম যে অশোকবাবু হত্যা করেননি মিত্রা সেনকে। এবং সেটা সম্পর্কে ডবল করে নিশ্চয় হয়েছি ওঁর একটি মাত্র কথা শুনেই একটু আগে।
কথাটা যে কি, অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মিত্রা সেনের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে একটু আগে যে অশোক রায়ের গলা ধরে এসেছিল, কিরীটীর নিশ্চয়তার পিছনে তারই ইঙ্গিত ছিল।
কিরীটী অতঃপর তার প্রশ্ন শুরু করেছে তখন।
অশোকবাবু, মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর আপনি যখন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তখন কি কেউ আপনাকে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিল?
মৃদুকণ্ঠে অশোক রায় প্রত্যুত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
কে সেই নারী?
মহারানী সুচরিতা দেবী বলেই আমার মনে হয়।
মহারানী?
হ্যাঁ। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট তাঁকে দেখতে পাইনি। তাছাড়া মনের অবস্থাও তখন আমার এমন ছিল না যে তাঁর সম্পর্কে ভাবি। তবে মনে হয় তিনিই।
না অশোকবাবু, মহারানী নন।
তবে? তবে কে তিনি?
এ সেই নারী সম্ভবত যাকে আপনি গতকাল হলঘরে ঢুকেই দেখতে পেয়েছিলেন মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু–
আমার মন বলছে তাই। কিন্তু যাক সে কথা। আপনি হঠাৎ আত্মগোপন করেছিলেন কেন?
কারণ তিনিই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আত্মগোপন না করলে মিত্রার হত্যাকারী বলে আমাকেই লোকে ভাববে। আর সেই কথা শুনে আমারও যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল, আমি তাড়াতাড়ি পালালাম।
আপনি যাবার সময় নিশ্চয়ই হলঘর দিয়ে যাননি?
না। প্রেসিডেন্টের ঘরের পাশ দিয়ে যে প্যাসেজ, সেই প্যাসেজ দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিলাম।
কেউ আপনাকে বের হয়ে যাবার সময় দেখেছিল বলে আপনি জানেন?
অত লক্ষ্য করে দেখিনি।
স্বাভাবিক। বলে একটু থামল কিরীটী। মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবল, তারপর মৃদুকণ্ঠে আবার বললে, অশোকবাবুকে এবারে আমার যা জিজ্ঞাস্য, সেটা আমি রাধেশবাবু আপনার অনুপস্থিতিতেই করতে চাই।
বেশ আমি যাচ্ছি। আমি গাড়িতেই অপেক্ষা করছি। রাধেশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু অশোক রায় বাধা দিলেন, না বাবা, তুমি বাড়ি চলে যাও আমি পরে যাচ্ছি।
রাধেশ রায় ইতস্তত করেন। কিরীটী ব্যাপারটা বুঝে বলে, আপনি যান রাধেশবাবু, উনি পরেই যাবেনখন।
রাধেশ রায় আর দ্বিরুক্তি করলেন না। ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।
২২. সোফার উপরে নিঝুম হয়ে
অশোকবাবু!
সোফার উপরে নিঝুম হয়ে মাথা নীচু করে বসেছিলেন অশোক রায়।
কিরীটীর ডাকে মুখ তুলে তাকালেন, বলুন!
গত প্রায় বৎসরখানেক ধরে প্রতি মাসের প্রথমদিকে আপনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিতেন। যদি আমাকে সে সম্পর্কে একটু enlighten করেন!
ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে থেকে ধীরে ধীরে একসময় অশোক রায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবই যখন আপনাকে বলছি মিঃ রায়, সে কথাও বলব আপনাকে।
হ্যাঁ, বলুন–
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। একটা কুৎসিত জঘন্য চক্রান্তের মধ্যে কৌশলে আমাকে ফেলে দীর্ঘদিন ধরে আমাকে ব্ল্যাকমেইলিং করা হচ্ছে। বলে একটু থেমে পুনরায় শুরু করলেন অশোক রায়, বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যে মধ্যে বাগান-পার্টি হয়, কলকাতার বাইরে ব্যারাকপুরের এক বাগানবাড়িতে।
একটা কথা, সেই বাগানবাড়িটা কার,জানেন কিছু?
না।
বেশ, বলুন তারপর?
বৎসর দুই আগে সেই রকমই এক পার্টিতে মনীষা দেবী নামে এক অত্যাশ্চর্য নারীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। বলতে আপনাকে দ্বিধা নেই মিঃ রায়, অমন অদ্ভুত intelligent নারী ইতিপূর্বে বড় একটা আমার চোখে পড়েনি। মনীষা দেবীর এমন কিছু একটা বিস্ময়কর আকর্ষণ ছিল যা মুহূর্তমাত্রে যে কোনো পুরুষকেই আকর্ষণ করতে পারে। কোনো সংকোচ না করেই বলছি, আমিও আকর্ষিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল জীবনে তার দেখা না পেলে বোধ হয় জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যেত। And what a fool I was! যাক যা বলছিলাম। সেই পার্টির দিন রাত্রেই, সন্ধ্যার পর থেকেই কি ঝড়বৃষ্টি সেদিন! পাটির সকলেই প্রায় চলে গিয়েছিল তখন, কেবল সে বাড়িতে ছিলাম আমি ও মনীষা দেবী। দোতলার নিভৃত যে ঘরটিতে বসে আলাপ করছিলাম তার আলো নিবিয়ে দেওয়া হয় হঠাৎ। এবং হঠাৎ আলো নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আচম্বিতে মনীষা দেবী আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেন ও সেই মুহূর্তেই অন্ধকারে ক্যামেরার ফ্লাশবাল্ব জ্বলে ওঠে। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে ওঠবার আগেই আবার আলো জ্বলে উঠল ও সঙ্গে সঙ্গে মনীষা help! help! বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তার চিৎকারে সকলে ঘরে এসে প্রবেশ করল। তার মধ্যে এক বৃদ্ধ ছিলেন যাঁকে ইতিপূর্বে সেদিন পার্টিতে দেখিনি। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মনীষা তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললে, আমি নাকি তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করতেই ঐ ঘরে এসেছিলাম। বুঝতেই পারছেন তখন আমার অবস্থা। সেই ঘটনারই খেসারত দিয়ে চলেছি মাসে মাসে এখনও মিঃ রায়।
সেই বৃদ্ধকে আপনি চিনতে পারেননি অশোকবাবু?
না।
কখনও দেখেননি পূর্বে?
না।
আপনার মত আর কেউ বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বার ঐ ধরনের খেসারত দিচ্ছেন বা দিয়েছেন। বলে জানেন?
আগে জানতাম না। পরে মিত্রা কয়েক দিন আগে আমাকে বলেছিল, বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যে আমার মত নাকি আরও অনেক victim ছিল।
হুঁ। আমি সেটাই আশা করেছিলাম। ভাল কথা, তাঁদের কারও নাম জানেন?
জানি। দু-তিনজনের—শ্ৰীমন্ত পাল, মনোজ দত্ত, সুপ্রিয়।
তাঁরাও তাহলে প্রতি মাসে টাকা দিতেন?
তাই তো শুনেছি।
কার হাতে টাকাটা আপনি দিতেন তুলে প্রতি মাসে?
বিশাখার হাতে, সে-ই আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যেত ছদ্মবেশে।
হুঁ।
অশোক রায় বর্ণিত কাহিনী যেন এক অবিশ্বাস্য রহস্যের দ্বারোদঘাটন করে চলেছে।
ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে যে রাত্রির প্রহরও গড়িয়ে প্রায় সাড়ে নটা বাজতে চলেছে, সেদিকে কারও যেন তখন খেয়াল নেই।
উপবিষ্ট অশোক রায়ের চোখে-মুখে একটা বিষণ্ণ ক্লান্তি। কিরীটী কেবল ঘরের মধ্যে
তখন উঠে পায়চারি করে চলেছে নিঃশব্দে।
প্রবল উত্তেজনায় যে তার দেহটা কাঁপছে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম।
কয়েকটা মুহূর্ত আবার স্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল।
হঠাৎ আবার কিরীটীই অশোক রায়ের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, এখন বুঝতে পারছি অশোকবাবু, এতকাল পরে এক উজ্জ্বঙ্খল নারীর মধ্যে আপনি সত্যিসত্যিই চিরন্তন স্নেহময়ী, প্রেমলিন্দু নারীত্বকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। সত্যিই সে আপনার প্রেমের স্পর্শে বিস্মরণ থেকে জেগে উঠেছিল।
বুঝতে পেরেছি আপনি মিত্রার কথা বলছেন, বলতে বলতে অশোক রায়ের চোখের কোণ দুটো অশ্রুতে ছলছল করে ওঠে। তারপর একটু থেমে বিষণ্ণ করুণ কণ্ঠে বলে, আমি সেটা জানতে পেরেছিলাম বলেই তার অতীতের সমস্ত দোষ-ক্রটি সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম মিঃ রায়। কিন্তু কোথা থেকে হঠাৎ কি হয়ে গেল! অশোক রায়ের কণ্ঠস্বর যেন শেষটায় আর শোনা গেল না, কান্নায় বুজে এল।
কথা বললে আবার কিরীটী, আর ঠিক সেই জন্যই তাঁকে এমনি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হল অশোকবাবু। এতকাল যে শয়তান সেই নারীর মন ও দেহকে নিয়ে নিষ্ঠুর ব্যবসা খুলে বসেছিল সে সেটা সহ্য করতে পারল না এবং ভবিষ্যতে যাতে আরও রহস্য তার দ্বারা বাইরে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, সেই কারণেই আপনার ও মিত্রা দেবীর মিলনের মুহূর্তে সে মিত্রা দেবীকে সংহার করল নিজের সেফটির নিরাপত্তার জন্য। এমনিই হয় অশোকবাবু। পাপের পথ দুষ্কৃতির পথ,বড় পিছল, বড় ভয়াবহ। একবার সে পথে পড়লে ফেরা বড় কঠিন। এবং ফিরতে গেলেও এমনি করেই তাকে মূল্য দিতে হয়। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে আর একটি প্রশ্ন আমার আপনাকে জিজ্ঞাস্য আছে।
নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালেন অশোক রায়।
ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীকে আপনি চিনতেন?
হ্যাঁ।
তাঁর চেম্বারে ও নার্সিং হোম সম্পর্কে আপনি কিছু আমাকে বলতে পারেন?
খুব বেশী আমি জানি না মিঃ রায়, তবে বৈকালী সঙ্ঘের অনেক মেম্বারই মধ্যে মধ্যে রাত এগারোটার পর সেখানে যাতায়াত করতেন।
কেন তাঁরা যাতায়াত করতেন বলতে পারেন?
না।
আপনিও তো মধ্যে মধ্যে সেখানে যেতেন?
হ্যাঁ গিয়েছি।
কেন?
জবাবে কেন জানি এবারে অশোক রায় চুপ করে রইলেন মাথা নিচু করে।
বুঝতে পারছি অশোকবাবু, কোনো কিছুর একটা আকর্ষণ আপনারও সেখানে ছিল। বুলতে আপনি দ্বিধা করছেন। বেশ, কথাটা আরও স্পষ্ট করেই তাহলে বলি, কোনো মাদক দ্রব্যের বা ঐ জাতীয় কোনো কিছুর বেচা-কেনার ব্যাপার কি সেখানে আছে?
এবারে যেন সত্যিই চমকে ওঠেন অশোক রায়। বিহ্বল জড়িত কণ্ঠে বলেন, কিন্তু আপনি—আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
যদি বলি, নিছক সেটা আমার একটা অনুমান মাত্র?
অনুমান!
হ্যাঁ।
মাদক দ্রব্য কিনা জানি না মিঃ রায়, তবে এক ধরনের স্পেশাল-ব্র্যাণ্ড ইজিপ্সীয়ান সিগারেট কেনবার জন্য কেউ কেউ আমরা সেখানে যেতাম।
সিগারেট?
হ্যাঁ।
যাক আর আমার কিছু আপনাকে জিজ্ঞাস্য নেই। আপনি এবারে যেতে পারেন। কেবল একটা অনুরোধ, এই মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি কলকাতা ছেড়ে কোথায়ও যাবেন না দয়া করে।
বেশ তাই হবে।
২৩. অশোক রায় বিদায় নিলেন
অতঃপর অশোক রায় বিদায় নিলেন।
ঐদিন রাত বারোটার পর কিরীটীর পূর্ব পরিকল্পনামত আমরা ছোট একদল সশস্ত্র পুলিস-বাহিনী নিয়ে ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর আমীর আলী অ্যাভির আবাসস্থলে গিয়ে ঘেরাও করলাম।
এবং আমি, কিরীটী ও লাহিড়ী তিনজনে মিলে সদর দরজায় উপস্থিত হয়ে, কিরীটীর নির্দেশে আমিই দরজার গায়ে কলিং বেলের বোতামটা টিপলাম।
বলা বাহুল্য আমরা তো সাধারণ বেশে ছিলামই, লাহিড়ীও ছিলেন সাধারণ বেশে।
কিছুক্ষণ বাদেই দরজা খুলে দিল ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর খাসভৃত্য রাম।
কে আপনারা, কি চান?
কিরীটী জবাব দিল, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
রাত্রে তো তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
করবেন। তুমি তাঁকে গিয়ে বল কিরীটী রায় এসেছেন, দেখা করতে চান। জরুরী।
মিথ্যে আপনি বলছেন বাবু। স্বয়ং মহারাজা এলেও রাত্রে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
ইতিমধ্যে কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত তার নিযুক্ত লোকটি ডাক্তারের বাড়ির ছদ্মবেশী ভৃত্য রামের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং আচমকা পিছন দিক থেকে রামকে আক্রমণ করতেই কিরীটীও তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে গেল লাফিয়ে। রাম কোনরূপ শব্দ করবার পূর্বেই তাকে হাত-মুখ বেঁধে বন্দী করা হল। এবং সেই ছদ্মবেশী ভৃত্যই তখন রামের কোমর থেকে চাবির গোছা ছিনিয়ে নিল।
ঐ চাবির গোছাটা হাতাবার জন্যই এত আয়োজন পরে জেনেছিলাম।
চাবির সাহায্যে তারপর সিঁড়ির কোলাপসিবল গেট খুলে আমরা নিঃশব্দ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।
দোতলা ও তিনতলার মধ্যে সিঁড়িতে আর একটি কোলাপসিবল গেট ছিল, সেটাও ঐ রিঙের একটি চাবির সাহায্যে খুলে আমরা তিনতলায় পা দিলাম।
দুটি ঘর পাশাপাশি।
দুটোরই দ্বার বন্ধ।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় দ্বারে আঘাত করল পর পর চারটি টুক-টুক শব্দে।
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দরজাটা খুলে গেল।
কি রে রাম–কথাটা বলতে গিয়ে শেষ না করেই সহসা ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী আমাদের তিনজনকে দরজার সামনে দেখে বিস্ময়ে যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
নমস্কার ডাঃ চৌধুরী। এত রাত্রে নিজের শয়নকক্ষের দোরগোড়ায় আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন!
মুহূর্তকাল স্তব্ধ থেকেই ভুজঙ্গ চৌধুরী যেন নিজেকে সামলে নিলেন এবং মৃদু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, তা একটু হয়েছি বৈকি।
ভাবছেন নিশ্চয়ই কি করে এখানে এত রাত্রে প্রবেশ করলাম!
না। কিন্তু বাইরে কেন, ভিতরে আসুন। কষ্ট করে এসেছেনই যখন।
ভুজঙ্গ চৌধুরীর পরিধানে তখন ছিল গ্রে রঙের ট্রপিক্যাল সুট। পায়ে রবারসোল দেওয়া জুতো।
সেই দিকেই তাকিয়ে কিরীচী বললে, এই ফিরছেন, না কোথাও বেরুচ্ছিলেন?
অনধিকার চর্চা ওটা আপনার মিঃ রায়। কিন্তু কেন এ গরীবের কুটিরে বে-আইনী ভাবে জুলুম করে এই অসময়ে আপনার মত মহাত্মার শুভাগমন, জানতে পারি কি?
জানাব বলেই তো আসা। শুনবেন বৈকি। তার আগে এই মিঃ লাহিড়ীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আবার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
ওঁকে আমি চিনি। পরিচয়ের কোন প্রয়োজন নেই। আপনার বক্তব্যটা তাড়াতাড়ি শেষ করলে বাধিত হব।
কথা বললেন এবার রজত লাহিড়ীই। বললেন, বৈকালী সঙ্ঘ ও আপনার চেম্বারে বিনা লাইসেন্সে হ্যাহিস্ নামক মাদক দ্রব্যের চোরাকারবার করবার জন্য আপনাকে আমি arrest করতে এসেছি ডাঃ চৌধুরী।
I see! তা এ মূল্যবান সংবাদটি কোথায় পেলেন? মিঃ কিরীটী রায়ই দিয়েছেন বোধ হয়?
সে জেনে আপনার কোনো লাভ নেই ডাঃ চৌধুরী। আপনি সরে আসুন, আপনার ঘরটা একবার সার্চ করতে চাই।
করতে পারেন, কিন্তু consequence-টাও মনে রাখবেন। অযথা একজন ভদ্রলোককে এভাবে বিব্রত করা আপনাদের আইনও নিশ্চয়ই সম্মতি দেয় না!
সে সম্পর্কে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। লাহিড়ী জবাব দিলেন।
আবার কিরীটী কথা বললে, তার আগে দয়া করে আপনি আপনার ছোট ভাই ত্রিভঙ্গবাবু ও তাঁর স্ত্রী মৃদুলা দেবীকে যদি একবার এখানে ডাকেন—
মিঃ রায়, অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছেন না কি! জবাবে বলেন ভুজঙ্গ চৌধুরী।
চোখরাঙানিতে বিশেষ কোনো ফল হবে না আর ডাক্তার সাহেব। যা বলছি তাই করুন। নচেৎ বাধ্য হয়ে আমাদেরই সে ব্যবস্থা করতে হবে জানবেন। আপনার মত একজন শয়তানী বুদ্ধিতে পরিপক্ক ব্যক্তির বোঝা উচিত যে প্রস্তুত হয়েই এখানে আজ আমরা এসেছি সব রকমে। মিথ্যে আর দেরি করে কোনো লাভ হবে না। যা বললাম করুন। কেন মিথ্যে চাকর-বাকরদের সামনে একটা scene create করবেন!
অতঃপর মুহূর্তকাল ডাঃ চৌধুরী কি ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু তাদের ডাকতে হলেও তো নীচে আমাকে যেতেই হবে।
নীচে যাবেন কেন? ঘরের মধ্যে কোনো কলিং বেল নেই আপনার?
কলিং বেল!
নিশ্চয়ই। দেখুন না একটু দয়া করে মনে করে। উপর-নীচ করাটাও আপনার বিশেষ অভ্যাস নেই বলেই আমি শুনেছি ডাক্তার সাহেব। চলুন, ঘরে ঢুকে ওঁদের আহ্বান করুন।
সে রকম কোনো ব্যবস্থাই আমার ঘরে নেই।
তবে দয়া করে সরুন। আমাকেই দেখতে দিন।
মুহূর্তকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ডাঃ চৌধুরী।
আপনিও ভেতরে চলুন। আমরা ভেতরে যাব আর আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, সেটা কি ভাল দেখাবে? চলুন! বলতে বলতে কিরীটী মৃদু হাসল।
সকলে মিলে আমরা যেন কতকটা ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীকে ঘিরেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
একটা ব্যাপার আজ প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, কিরীটীর চোখ ও কান যেন অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে আছে। তার দেহের প্রতিটি রোমকূপ যেন চক্ষু মেলে রয়েছে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে ঢুকে চকিতে সিলিং থেকে শুরু করে দেওয়াল ও মেঝে পর্যন্ত কক্ষের সর্বত্র তার তীক্ষ্ণ অতিমাত্রায় সজাগ দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিল বারকয়েক।
অত্যন্ত সাধারণ ও স্বল্প আসবাবপত্রে কক্ষটি যেন একেবারে ছিমছাম।
একপাশে একটি সিঙ্গল বেডিং। একটি স্টীলের আলমারি, একটি আরামকেদারা, একটি বিরাট আয়না দেওয়ালে টাঙানো ও বেডিংয়ের কাছে একটি ত্রিপত্রের ওপরে অদ্ভুত একটি বৃদ্ধের কাষ্ঠমূর্তি ও একটি কাঁচের জলভর্তি পাত্র। মূর্তিটি বিরাট উদরবিশিষ্ট এক বৃদ্ধের। উদরের দু পাশে দুটো হাত। দন্তপাটি বিকশিত। পা ভাঁজ করে বসে আছে। মাথায় একটি টুপি।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখলাম ঘরের সর্বত্র ঘুরে গিয়ে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত সেই কাষ্ঠনির্মিত বিচিত্র বৃদ্ধের মূর্তির উপরে স্থির হল।
কয়েক সেকেণ্ড মৃর্তিটার দিকে কিরীটী তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ত্রিপয়টার সামনে। দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে হাত রাখল মূর্তিটার গায়ে।
আমরা সকলে স্তব্ধ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল, পিকিউলিয়ার! A nice curio! মূর্তিটা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন ডাক্তার সাহেব? বলতে বলতে তাকাল কিরীটী ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মুখের দিকে।
নির্বাক ডাঃ চৌধুরী।
শুধু তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির ফলার মত দৃষ্টি নিস্পলক কিরীটীর দৃষ্টির প্রতি নিবদ্ধ।
ঘরের মধ্যে যেন একটা বিশ্রী অস্বস্তিকর থমথমে ভাব।
কিরীটী স্থির অপলক দৃষ্টিতে ডাঃ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু দেখতে পেলাম তার ডান হাতটির আঙুলগুলো নিঃশব্দে মূর্তিটার মাথায় বুলিয়ে চলেছে।
স্তব্ধতা।
বরফের মতই জমাট বাঁধানো স্তব্ধতা।
চারজোড়া চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি পরস্পর পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ।
দুখানা তীক্ষ্ণ তরবারির ফলা যেন পরস্পরকে স্পর্শ করে আছে একে অন্যের মুহূর্তের অসর্তকতায় চরম আঘাত হানবার প্রতীক্ষ্ণয়।
সহসা একটা মৃদু পদশব্দ যেন মনে হল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। পদশব্দটা ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এসে খোলা দরজার গোড়ায় থামল। তারপরই দেখা গেল খোলা দরজার পথে এক অধাবগুষ্ঠিতা নারীমূর্তি।
আজও মনে আছে আমার, সে যেন একটা আবিভাব! মধ্যরাত্রি যেন মূর্তিমতী হয়ে স্বপ্নের পথ বেয়ে সেদিন আমার দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা এক স্বপ্নচারিণী নারীমূর্তি যেন।
গাত্রবর্ণ খুব পরিষ্কার না হলেও চোখে মুখে ও দেহে সেই নারীর রূপের যেন অবধি ছিল না।
মনোমোহিনী সেই নারীমূর্তি খোলা দরজার পথে কমধ্যে প্রবেশ করেই মুহূর্তমধ্যে যেন থমকে দাঁড়াল। এবং মুখে ফুটে উঠল একটা তার চাপা আশঙ্কা।
আসুন মৃদুলা দেবী!
ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটী মৃদু অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর।
কিন্তু কিরীটীর আহ্বানে কোন সাড়াই যেন জাগল না সেই প্রস্তরীভূত নারীমূর্তির মধ্যে।
আবার কিরীটী বললে, বসুন!
তথাপি নির্বাক সেই নারীমূর্তি।
এবারে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, নীচের গাড়ি থেকে অশোকবাবুকে ডেকে নিয়ে আয় তো সুব্রত!
আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম একটু যেন বিস্মিত হয়েই।
কিন্তু নীচে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই কখন একসময় অশোক রায় নিজের গাড়ি নিয়ে এসে তার মধ্যে বসে আছেন চুপটি করে।
বললাম, কিরীটী আপনাকে ওপরে ডাকছে, চলুন অশোকবাবু!
ঘরের মধ্যে আমি ও অশোকবাবু প্রবেশ করতেই কিরীটী বললে, আসুন অশোকবাবু। দেখুন তো, ঐ উনিই আপনার সেই মনীষা দেবী কিনা!
কিরীটীর কথায় অশোকবাবু এবার চোখ তুলে তাকালেন, ঘরের মধ্যেই একপাশে পাথরের মত নিঃশব্দে দণ্ডায়মান মৃদুলা দেবীর মুখের দিকে চেয়ে।
মৃদুলা দেবীও যেন কেমন বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন অশোক রায়ের মুখের দিকে। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
স্তব্ধ কয়েকটা মুহূর্ত। কেবল ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটার একঘেয়ে পেণ্ডুলামের টকটক শব্দ।
কি, চিনতে পারছেন না অশোকবাবু?
ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এবার মাথা নাড়ালেন অশোক রায়।
চিনেছেন?
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে বললেন, হ্যাঁ, উনিই। আমার মনে পড়েছে এখন, উনিই মিত্রার মৃত্যুর দিন বৈকালী সঙ্ঘে—
হ্যাঁ অশোকবাবু, কথাটা এবার কিরীটীই শেষ করে, ওঁকেই আপনি হলঘরে সেরাত্রে ঢুকতে দেখেছিলেন। আর শুধু তাই নয়, বাগানে সে রাত্রে মিত্রা সেনের dead body-র সামনে থেকে উনিই চক্রান্ত করে ভয় দেখিয়ে আপনাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি, যাতে করে আপনাকেই সকলেই মিত্রা সেনের হত্যাকারী বলে সহজেই মনে করতে পারেন!
তবে কি,–অর্ধস্ফুট আর্তকণ্ঠে কথাটা বলতে গিয়েও যেন শেষ করতে পারলেন না অশোক রায়।
হ্যাঁ, উনিই মিত্রা দেবীর হত্যাকারিণী। মৃদুলা দেবী এবং মীরা চৌধুরী একমেবাদ্বিতীয়ম্। কিন্তু উনি দুর্ভাগ্যক্রমে মিত্রা দেবীকে হত্যা করার অপরাধে আজ দণ্ড নিতে বাধ্য হলেও, আসল হত্যার পরিকল্পনাটা ওঁর নয়, হত্যার ব্যাপারে উনি instrument মাত্র ছিলেন। আসল পরিকল্পনাকারী বা হত্যাপরাধে অপরাধী হলেন উনি–আমাদের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
কিরীটী ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল একবার এবং তাঁকেই সম্বোধন করে বললে, কিন্তু এ আপনি কি করলে ডাঃ চৌধুরী! মানুষের সেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের নীচে ড়ুবে গেলেন!
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী নির্বাক।
২৪. বিস্মিত হতবাক সকলে
বিস্মিত হতবাক সকলে।
কিরীটী বলতে লাগল, হ্যাঁ, উনি! মৃদুলা দেবীরই সাহায্যে আমাদের ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী তাঁর লাভের ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। হতভাগ্য রূপমুগ্ধ পুরুষদের ওঁরই সাহায্যে ব্ল্যাক-মেইলিং করতেন এবং নার্সিংহোমে ওঁরই হাত দিয়ে সরবরাহ করতেন হ্যাহিসিগারেট নেশাগ্রস্তদের। তারপর মিত্রা সেনকে হাতে পেয়ে বৈকালী সঙ্ঘের ব্যপারটা তাঁরই হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে গেল মিত্রা দেবী অশোকবাবুকে ভালোবাসায়। ভালোবাসার সুধারসে নতুন করে জেগে উঠলেন মিত্রা দেবী আর সেইটাই হল তাঁর কাল। পাছে তাঁর মুখ থেকে সব অতীতের সত্য কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে ভুজঙ্গ চৌধুরী মৃত্যুবাণ হানলেন মিত্রার বুকে। কৌশলে তাঁকে বৈকালী সঙ্ঘে আনিয়ে মৃদুলা দেবীর সাহায্যে বিষপ্রয়োগ করালেন। পূর্বেই বলেছি, অশোক রায় সে রাত্রে হলঘরে ঢুকে মনীষা দেবীকেই দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু মনীষা দেবী বা মৃদুলা দেবী ছদ্মবেশে থাকায় এবং অশোক রায় ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই মনীষা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ায় অশোক রায় সেরাত্রে তাঁকে চিনতে পারেননি।
.
শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি মৃদুলাই স্বীকৃতি দিলেন আদালতে।
সে স্বীকৃতি যেমন করুণ তেমনি মর্মস্পর্শী।
প্রথম যৌবনে একদা মৃদুলা ভালোবেসেছিল ভুজঙ্গ ডাক্তারকে। কিন্তু অর্থপিশাচ ভুজঙ্গর মনে আর যাই থাক, নারীর প্রতি কোন দুর্বলতা কোনোদিনই ছিল না। অথচ সে বুঝতে পেরেছিল অসাধারণ বুদ্ধিমতী মৃদুলাকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখতে পারলে সে ভবিষ্যতে অনেক কাজ কুরতে পারবে, তাই সে কৌশল করে পঙ্গু ভাই ত্রিভঙ্গের সঙ্গে গরিবের মেয়ে মৃদুলার বিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে আসে, তার অর্থাৎ মৃদুলার অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
আর তার পর থেকেই মৃদুলার সেই প্রেমের সুযোগ নিয়ে দিনের পর দিন যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে ভুজঙ্গ ডাক্তার হতভাগিনী মৃদুলাকে।
ভুজঙ্গের প্রতি ভালবাসা ছাড়াও, কিছুটা অবিশ্যি বিকৃত মনোবৃত্তি ছিল মৃদুলারও। তা হলে তাকে দিকে সব কাজ হয়তো ভুজঙ্গ ডাক্তারেরও করা অসাধ্য হত।
এবং শেষ পর্যন্ত মিত্রা সেন অশোক রায়কে ভাল না বাসলেও হয়তো ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ঐভাবে অত দ্রুত ঘটত কিনা সন্দেহ।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীই রাত্রে ছদ্মবেশে বৈকালী সঙ্ঘে গিয়ে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসত।
সে কথাও জানা গেল মৃদুলার জবানবন্দি থেকেই।
মৃদুলা পূর্ব হতেই উপস্থিত ছিল সেরাত্রে বৈকালী সঙ্ঘে এবং শশী হাজরা যেটা তার জবানবন্দিতে গোপন করে গিয়েছিল, পরে তাও স্বীকার করে। মৃদুলাই অতর্কিতে তীব্র ক্রিয়ার বিষ মিত্রার দেহে ইনজেক্ট করেছিল ভুজঙ্গের পূর্ব পরামর্শমত।