কিরীটী আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী মারা যান সেই বিকালে বা সন্ধ্যায় শেষ আপনার সঙ্গে কখন দেখা হয়েছিল সেন মশাই?
রাত দশটায় তিনি আহার করেন, তার আগে পর্যন্ত তাঁর শোবার ঘরেই আমরা দুজনে বসে কথাবার্তা বলছিলাম।
কি ধরনের কথাবাতা সে-রাত্রে আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?
সবিতা সম্পর্কেই বিশেষ যা কথাবার্তা হয়েছিল। সত্যজিৎকে তিনি রেঙ্গুন থেকে আসতে লিখেছেন এবং সে এলে উভয়ের যদি উভয়কে পছন্দ হয় তাহলে এই সামনের আষাঢ়েই ওদের বিবাহ দেবেন—এই সবই বলছিলেন।
আর কোন কথা হয়নি আপনাদের মধ্যে, যাতে করে তাঁর অত্যাসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনরুপ ধারণা করা যেতে পারে?
না।
হুঁ। আচ্ছা ইদানীং তাঁর মনের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল বলতে পারেন? কোন প্রকার দুশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা
না।
জমিদারীর অবস্থা ও আর্থিক অবস্থা ইদানীং তাঁর ভালই ছিল নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ। ব্যাঙ্কে প্রায় লাখ তিনেক টাকা মজুত আছে, কলকাতায় একখানা বাড়ি এবং এখানকার জমিদারী ও কারবারের অবস্থা আশাতীত ভালই বলতে হবে।
তিনি কোন উইল লিখে রেখে গিয়েছেন বলে জানেন কি?
বছর পাঁচেক আগে একটা উইল করেছিলেন। ইদানীং অবশ্য একবার কিছুদিন আগে বলেছিলেন, পূর্বের সেই উইলটার একটু সামান্য অদলবদল করবেন, কিন্তু সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি।
সে উইলে কি লেখা আছে জানেন? তাঁর যাবতীয় সম্পত্তিই তাঁর একমাত্র মেয়ে সবিতাই পাবে, কেবল–
কেবল?
হাজার পঞ্চাশ টাকা তিনি আমার নামে দিয়ে গিয়েছেন, প্রয়োজনমত সেটা আমি এবং আমার একান্ত ইচ্ছামত যে কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবো।
আর তাঁর কোন নিকট বা দূর-আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবকে কিছুই দিয়ে যাননি?
না। তবে, বসন্তবাবু, একটু ইতস্ততঃ করতে থাকেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কি যেন ভেবে বললেন, ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর নামে উইলের মধ্যে একটা নির্দেশ আছে—
কিরীটী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে, যিনি আজ সন্ধ্যাবেলা এডেন না কোথা থেকে এলেন, উনিই কি সেই দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতুপত্র সন্তোষ চৌধুরী?
বলতে পারি না উনিই সেই মৃত্যুঞ্জয়ের বর্ণিত সন্তোষ চৌধুরী কিনা, যদিও সেই পরিচয় নিয়েই উনি এসে আজ হাজির হয়েছেন
ভদ্রলোককে তাহলে ইতিপূর্বে কখনো আপনি দেখেননি এবং চেনেনও না?
না।
উইলে ওঁর সম্পর্কে কি নির্দেশ আছে বলছিলেন?
ভ্রাতুষ্পত্র সন্তোষ চৌধুরী যদি কোন দিন ফিরে এসে তাঁর পিতৃ-সম্পত্তির দাবী জানান, তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ১/৪ অংশ সে পাবে। বাকী ৩/৪ অংশ পাবে কন্যা সবিতা। সবিতা যদি বিবাহ না করে তাহলে অর্ধেক সম্পত্তি ঐ সন্তোষ চৌধুরী পাবেন অথবা সবিতার মৃত্যুর পর যদি তার কোন সন্তানসন্ততি না থাকে তাহলে ঐ সন্তোষ চৌধুরী বা তাঁর বংশধরেরা যদি জীবিত থাকে তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ৩/৪ অংশ তারা পাবে এবং বাকী অংশ সবিতার স্বামী পাবে।
সবিতা দেবী তো ঐ সন্তোষ চৌধুরী সম্পর্কে পূর্বে কিছুই জানতেন না, অন্ততঃ গতকালও তাই বলেছেন।
না, সে জানত না। একমাত্র আমিই জানতাম। মৃত্যুঞ্জয় আমাকে উইল করবার সময় একবার মাত্র বলেছিলেন।
ঐ সন্তোষ চৌধুরী কোথায় থাকেন ইত্যাদি বা সে সম্পর্কে কিছুই কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আপনাকে বলেননি?
হ্যাঁ বলেছিলেন, এডেন না কি কোথায় থাকেন
এডেনের ঠিকানাটা বলেননি?
না।
আজ যে ভদ্রলোক সন্ধ্যাবেলা সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয়ে এলেন, একে কি আপনার আসল লোক নয় বলে কোনরূপ সন্দেহ হচ্ছে?
যতক্ষণ না সঠিকভাবে জানতে পারছি ততক্ষণ মেনে নিই বা কেমন করে? যার কেবলমাত্র নামই শুনেছি, অথচ পূর্বে কখনো যাকে চাক্ষুষ দেখিনি তাকে এত সহজে স্বীকার করে নিতে তো পারি না।
উনিই যে আসল সন্তোষ চৌধুরী তার কোন প্রমাণ এখনও দেখেন নি?
না।
আপনি জানতে চাননি?
চেয়েছিলাম, বলেছেন প্রয়োজন হলে সে-সব প্রমাণ নাকি আদালতেই পেশ করবেন। আমাকে কোন প্রমাণ দিতে রাজী নন তিনি।
দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করল।
আহারের সময় উপস্থিত—ভৃত্য এসে সংবাদ দিল। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
১১. আকাশের বুকে ভোরের আলো
ভাল করে আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ফুটে ওঠেনি। অত্যাসন্ন প্রত্যূষের চাপা রক্তাভায় পূবের আকাশটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, খোলা জানলা-পথে জলো হাওয়া কেমন শীত-শীত বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে গেল। কিরীটী শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল। আলনা থেকে জামাটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে কিরীটী ঘরের দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় বের হয়ে এল। এ বাড়ির কারোরই এখনও নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। সিঁড়ি-পথ অতিক্রম করে কিরীটী সোজা বাইরে চলে এল সদর দরজা খোলা দেখে। প্রমোদভবন থেকে সোজা যে রাস্তাটা দুপাশের ঝাউবিথীর মধ্যখান দিয়ে সামনের সড়কে গিয়ে মিশেছে কিরীটী সেই রাস্তাটা ধরেই এগিয়ে চলল। হাওয়ায় ঝাউগাছের চিকন পাতাগুলি এক প্রকার সোঁ সোঁ শব্দ তুলেছে। এত সকালে প্রমোদভবনের সদর দরজাটা খোলা দেখে কিরীটী ভেবেছিল হয়ত চাকরবাকরদের মধ্যেই কেউ ইতিমধ্যে উঠেছে, কিন্তু ঝাউবীথির মাঝখান দিয়ে পথটা ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই তার সে ভুলটা ভেঙে গেল। অল্পদুরে একটি নারীমূর্তি ধীরপদে এগিয়ে চলেছে। এত সকালে এই পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে কে! সবিতা দেবী নাকি? কিন্তু নারীমূর্তিটির চলবার ভঙ্গী দেখে কিরীটী বুঝতে পারে সে সবিতা নয়। তবে কে? কিরীটী একটু দ্রুতই পা চালিয়ে চলে। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় অগ্রগামী নারীমূর্তিকে কিরীটী অনুসরণ করতে করতেই দেখে পরিধানে তার আকাশ-নীল রংয়ের একটা শাড়ি এবং মাথার চুল লম্বা বেণীর আকারে পৃষ্ঠোপরি দোদুল্যমান। পায়ে বোধ হয় চপ্পল সু, চলার ভঙ্গী ও চাল-চলন দেখে মনে হয় সেও তারই মত প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে হয়ত।